“আমি আমার দুই বেটীকে তোমার কাছে পণ হিসেবে রাখছি, আমি অথবা মুগীছ যদি তোমার সৈন্যের সাথে ধোকাবাজী করি, তাহলে আমার দুই বেটীকে বর্বরদের কাছে সোপর্দ করে দেবে।”
বেশী দিন পূর্বের কথা নয়, তিন-চার বছর আগের ঘটনা। এক খ্রীষ্টান গভর্নরের আবেদনে মিসর ও আফ্রিকার আমীর মুসা ইবনে নুসাইর তারেক ইবনে যিয়াদকে আহ্বান করেছিলেন। দামেস্কের বন্দীশালায় বসে বিগত দিনের প্রতিটি ঘটনা মুসা ইবনে নুসাইরের, মনে পড়ছিল। তার চোখের সামনে অতীত জীবনের ছবি স্মৃতির ক্যানভাসে ভেসে উঠছিল। তিনি স্মরণ করতে চাচ্ছিলেন না তবুও স্মৃতির দলরা এসে ভিড় জমাচ্ছিল। অতীত দিনের কথা স্মৃতির পাতায় ভেসে উঠার দরুণ তার ব্যথিত হৃদয় আরো ব্যথিত হচ্ছিল। তিনি তো পরিত্যক্ত ও গযব নিপতিত জীবনের শেষ দিনগুলো অতিবাহিত করছিলেন। তার মনে কোন প্রকার দুঃখ, পরিতাপ ও আফসোস ছিল না। তিনি আল্লাহর নাম ও দীনের পয়গাম আটলান্টিক মহাসাগর পর্যন্ত পৌঁছে দিয়ে ছিলেন। নিরাপরাধী হওয়ার পরও তিনি শাস্তি ভোগ করছেন এ ব্যাপারে তিনি আল্লাহর কাছে কোন অভিযোগ করেন না। তিনি জানেন, আল্লাহ তার প্রতি অসন্তুষ্ট নন। তিনি দুনিয়ার সাথে সর্বোপরি সম্পর্ক ত্যাগ করেছিলেন। তিনি মনে মনে প্রস্তুত হয়ে গিয়ে ছিলেন যে, তাকে কয়েদ খানাতেই মৃত্যু বরণ করতে হবে এবং তাকে কোন এক অজ্ঞাত স্থানে দাফন করা হবে। হয়তো তার জানাযাও পড়া হবে না।
তিনি জানতেন না যে তাকে যেখানেই দাফন করা হোকনা কেন বা একেবারেই যদি দাফন নাও করা হয় বরং তার লাশ যদি সাগরে নিক্ষেপ করা হয় তবুও তার নাম ইসলামী ইতিহাসে আজীবন স্বর্ণাক্ষরে লিপিবদ্ধ থাকবে। যতদিন সূর্য তার আলোকরশ্মি দ্বারা পৃথিবীকে সতেজ রাখবে, চাঁদ-তারা রাতকে করবে আলোক উজ্জ্বল ততদিন মুসা ইবনে নুসাইরের নাম থাকবে অম্লান।
তারেক ইবনে যিয়াদ কোথায় আছেন? তার তা জানা ছিল না। খলীফা দুজনকেই দামেস্কে আহ্বান করেছিলেন। তারেকের ব্যাপারে তার ভীষণ চিন্তে হচ্ছিল যে, সে যুবক সিপাহসালার স্পেন বিজেতা তার সাথেও এরূপ ব্যবহার করা হচ্ছে এবং সেও হয়তো এ কয়েদখানারই কোন এক অন্ধকার কুঠিতে পড়ে মৃত্যুর। প্রহর গুনছে।
মুসা ইবনে নুসাইরকে কিরূপ নির্যাতন নিপীড়ন করা হচ্ছিল তা কিছু বর্ণনা করা হলো। এরূপ নিপীড়নের মাঝে তার ছেলের মাথা কেটে এনে তার সামনে রাখা। হয়েছিল।
চিন্তায় পরিক্ৰান্ত-পরিশ্রান্ত, বার্ধক্যে কাতর, লাঞ্ছনা ও কষ্টে অর্ধ মৃত মুসা ইবনে নুসাইরের ঐ দিনের কথা স্মরণ হলো যে দিন আফ্রিকার ছোট একটি রাজ্য সিওয়াস্তার (মরক্ক) গভর্নর জুলিয়ন তার কাছে এসেছিল। সে সময়ের তাবৎ দৃশ্য তার মানস পটে ভেসে উঠল। সেদিন মুসা উত্তর আফ্রিকার একটা শহর তানজেনিয়ায় ছিলেন। তখন মুসা মিশর ও উত্তর আফ্রিকার আমীর ছিলেন। তিনি মর্দে মুজাহিদ ও সিপাহ্ সালার এবং মানব জীবনোপকরণের সুষ্ঠু ব্যবস্থাপক ছিলেন। তিনি কখনো আরামে বসে থাকতেন না, শহরে-শহরে, পল্লীতে-পল্লীতে ঘুরে ঘুরে রাজ্যের অবস্থা পর্যবেক্ষণ করতেন।
বর্বরদের বিষয়টা তিনি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ মনে করতেন, অনেক সময় এ বিষয়টা নিয়ে পেরেশান হয়ে পড়তেন।
বর্বররা উত্তর আফ্রিকার বাসিন্দা ছিল। লড়াকু নির্ভীক এক জাতি। তাদের ইতিহাস যুদ্ধ-বিগ্রহ ও মারদাঙ্গার এর বিশাল উপাখ্যান। বিভিন্ন জাতি তাদের ওপর আক্রমণ করেছে কিন্তু পরিণামে তারা নিজেদের পুরো সৈন্য বাহিনী নিঃশেষ করে ফিরে গেছে, যদিও কেউ তাদের ওপর বিজয়ার্জন করেছে কিন্তু সে বিজয় খুব স্বল্প সময়ই ধরে রাখতে পেরেছে। বর্বরা বিদ্রোহ করে বিজয়ীদের চলে যেতে বাধ্য করেছে। রোম রাজ্যের মত বড় শক্তি তারা রক্ত সাগরে ভাসিয়ে দিয়েছে। হিসপাহানিকরা এসেছে তারাও রোমদের মত এমন পরাজিত হয়েছে আর কোনদিন বর্বরদের অভিমুখি হওয়ার কল্পনা করেনি।
বর্বরদেরকে যদি কেউ পরাজিত করে থাকে তাহলে আরবের মুসলমানরাই করেছে। কেবল পরাজিত করলেই সবশেষ হয় না, আসল কাজতো শুরু হয় পরাস্ত করার পর, তাহলো বিজীতদের ওপর কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করা। প্রথম পর্যায় বর্বরদের ওপর মুসলমানের যারা আমীর নিযুক্ত হয়েছিলেন তারা বর্বরদেরকে নিচু শ্রেণীর ও দাঙ্গাবাজ জাতি মনে করে তাদের সাথে ভাল ব্যবহার করেননি। বর্বররা অবাধ্য জাতি ছিল। তাদের পৃথক ধর্ম ও সংস্কৃতি ছিল। তারা মুসলমানদের ধর্মগ্রহণে অস্বীকৃতি জানিয়ে বিদ্রোহ করতে থাকে।
মুসা ইবনে নুসাইরের পূর্বে যিনি আমীর ছিলেন তিনি বর্বররা অধিনস্ত ও দাস, এ মনোভাব পরিহার করে তাদেরকে শহরের ব্যবস্থাপনা ও সৈন্য বাহিনীতে গুরুত্বের সাথে বিবেচনা করেন। তাদেরকে বড় বড় পদ মর্যাদা ও ক্ষমতা প্রদান। করে ইসলামী সমতা মূলনীতির আলোকে তাদেরকে আরবী সভ্যতা সংস্কৃতিকে অভ্যস্ত করে তোলেন। তবে সমস্যা হলো এ কারণে যে, বর্বররা আরবের গ্রাম্যদের মত গোত্রকে আঁকড়ে ধরে ছিল, প্রত্যেক গোত্রের পৃথক পৃথক সর্দার ছিল আর প্রতিটি গোত্রছিল স্বাধীন। এ কারণে তাদের সকলকে একটি জাতি হিসেবে একত্রিত করা যাচ্ছিল না। কিছু গোত্র আনুগত্য স্বীকার করলে বাকীরা হয়ে উঠত বিদ্রোহী। তাসত্ত্বেও আমীরের সদ্ব্যবহার ও তাবলীগে মুগ্ধ হয়ে বর্বররা ইসলাম গ্রহণ করতে ছিল।
তারপর মুসা ইবনে নুসাইর আমীর হিসেবে আগমন করেন। তিনি এসেই বর্বরদের একটা পৃথক ও নিয়মতান্ত্রিক সেনাবাহিনী গড়ে তোলেন। মুসা প্রতিটি গোত্রে স্বয়ং নিজে গিয়ে কার্যক্ষেত্রে ইসলামী শিক্ষা ও সভ্যতা সম্পর্কে অবহিত করেন। যেখানে শক্তি প্রয়োগ করা প্রয়োজন সেখানে শক্তি প্রয়োগ করেন তবে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই প্রেম-প্রীতি, ভালবাসা, ভ্রাতৃত্ব ও সৌহার্দ্যের অস্ত্র ব্যবহার করেন। স্বল্প কিছু দিনের মাঝে সকলে মুসলমান হয়ে যায়।
আমীরে মুসা ইবনে নুসাইর বর্বর ফৌজকেও আরবীদের ন্যায় শৃংখলাবদ্ধ করেন। বর্বররা লড়াকু তো ঠিকই ছিল কিন্তু যুদ্ধ বিদ্যা ও যুদ্ধ ময়দানের নিয়ম কানুন সম্পর্কে জ্ঞাত ছিল না। তারা হত্যা-লুণ্ঠন ও দুশমনদের বসতি ধ্বংস সাধনে, ছিল অভ্যস্ত। মুসা তাদেরকে ট্রেনিং দিয়ে যুদ্ধের নিয়ম শৃংখলা ও কমান্ডারের হুকুমে যুদ্ধ করার নীতিতে আবদ্ধ করেন।
এটা মুসা ইবনে নুসাইরের অবদান যে, তিনি সকল বর্বর গোত্রকে এক জাতিতে পরিণত করেছিলেন তবে প্রত্যেক গোত্রের সর্দারের সর্দারী বাকী রেখেছিলেন। ফলে তারা স্পৃহায় আরবদের সমপর্যায়ে পৌঁছে ছিল।
***
একদিন মুসা ইবনে নুসাইর উত্তর আফ্রিকার তানজানিয়া শহরে অবস্থান করছিলেন। তাকে খবর দেয়া হলো সিওয়াস্তার গভর্নর জুলিয়ন তার সাথে সাক্ষাৎ করার জন্যে এসছে। জুলিয়ন! অত্যন্ত আশ্চর্য হয়ে মুসা বললেন, সে খ্রীষ্টান গভর্নর, আমার সাথে কি উদ্দেশ্যে সাক্ষাৎ করতে চায়?
তার সাথে আরো কয়েকজন ব্যক্তি রয়েছে। খবর দাতা জবাব দিল, তাদেরকে শাহী মহলের লোক বা বড় কোন গভর্নর বলে মনে হচ্ছে, তারা কিছু উপঢৌকন নিয়ে এসেছে।
মুসা বললেন, খোদার কসম! আমি বিশ্বাস করতে পারছি না, আর কেউ কি এটা বিশ্বাস করতে পারে, যার সাথে আমাদের যুদ্ধ হয়েছে এবং যার সাথে আমাদের দুশমনি রয়েছে সে হঠাৎ করে আমাদের বন্ধুতে পরিণত হয়েছে? না,. এটা হতে পারে না, সম্ভবতঃ সে সন্ধির ফন্দি করতে এসেছে। আমি তার ফন্দির জালে পা দেব না।
মুসার এক গভর্নর বলল, আমীরে মুহতারাম! সে এত দূর হতে এসেছে, তাকে মুলাকাতের মওকা দিন।
সিওয়াস্তা একটা বড় শহর সমপরিমাণ রাজ্য যা জাবালুত তারেক (জিব্রালটাল)-এর বিপরীতে রোম সাগরের পাড়ে আফ্রিকার সীমান্তে অবস্থিত ছিল। তাকে ইউরোপের প্রবেশ দ্বার বলা হতো। সিওয়াস্তা রাজ্য ও জাবালুত্ ত্বারেকের মাঝে যে সাগর ছিল তার প্রসস্ত ছিল বার মাইল। সিওয়াস্তা স্পেনের বাদশাহ রডারিকের তত্ত্বাবধানে ছিল। রডারিক তার ফৌজ সিওয়াস্তার গভর্নর জুলিয়নকে দিয়ে ছিল অধিকন্তু জুলিয়নের নিজস্ব ফৌজও ছিল।
জুলিয়ন যেহেতু রডারিকের মত শক্তিধর বাদশাহর তত্ত্বাবধান ও মদদ পাচ্ছিল এ কারণে সে তার সৈন্যবাহিনী দ্বারা আশে-পাশের এলাকা কবজা করার কোশেসে রত ছিল। আমীরে আফ্রিকা মুসা তাকে শায়েস্তা করার জন্যে কয়েকবার সৈন্য প্রেরণ করেছেন ফলে মুসা ও জুলিয়নের মাঝে বেশ কয়েকবার লড়াই হয়েছে। দু’তিনবার মূসা পূর্ণ দমে হামলা করিয়েছেন, কিন্তু সিওয়াস্তার কেল্লা এত মজবুত ছিল যে তা দখলে আনা সম্ভব হয়নি। জুলিয়নের ফৌজকে কেল্লার মাঝে বন্দি করে রাখার জন্যে মুসা কেল্লার চতুষ্পর্শে বর্বর সৈন্য মুতায়েন করেছিলেন এবং এ এলান করেছিলেন যে জুলিয়নের ফেত্না চিরতরে খতম করার জন্যে তিনি পূর্ণদমে হামলা করবেন এবং অবরোধ দীর্ঘায়িত করে কেল্লার ফৌজ ও অন্যান্য লোকদেরকে ক্ষুধা পিপাসায় কতর বানিয়ে জুলিয়নকে মজবুর করবেন আত্মসমর্পণে। এ অবস্থায় রডারিকের সৈন্য বাহিনী যার সংখ্যা দুলাখেরও বেশি, জুলিয়নের মদদে এগিয়ে আসার আশংকা ছিল।
মুসা দু’বার দূত মারফত পয়গাম পাঠিয়ে ছিলেন জুলিয়নের কাছে যে, সে যেন শান্তিতে থাকে এবং অন্যকে শান্তিতে থাকতে দেয় তাহলে তাকে ভয়াবহ পরিণতির সম্মুখীন হতে হবে। জুলিয়ন উভয় পয়গামের জবাব দিয়ে ছিল কিন্তু তার মাঝে তুচ্ছ তাচ্ছিলভাব ছিল।
উভয় বার জওয়ারী পয়গামে জুলিয়ন বলেছিল, হে ইসলামী সালতানাতের আমীর! সিওয়াস্তাকে অবরোধ করার পূর্বে স্পেনের ফৌজের হিসেব করেন যাতে পরে পছতে না হয়।
এত বড় প্রকাশ্য দুশমন মুসার সাথে সাক্ষাৎ করতে এসেছে। মুসা তাকে অন্দরে আনার নির্দেশ দিলেন।
***
দু’তিন জন মুশির ও দু’জন সেনাপতিসহ মুসা যে কামরায় বসা ছিলেন জুলিয়ন শাহী লেবাছে বাদশাহী ঢং এ সে কামরাতে প্রবেশ করল। তাকে দেখে মুসা উঠে দাঁড়ালেন এবং হাসিমুখে মুসাফাহার জন্যে দু’হাত সামনে বাড়িয়ে দিলেন। জুলিয়ন তার ভাষায় কি যেন বলল, দু’ভাষী তার তরজমা করে দিল,
“আমি নিরাপদে এসেছি এবং নিরাপদে প্রস্থান করব। বন্ধুত্বের পয়গাম নিয়ে এসেছি এবং বন্ধুত্বের ভান্ডার নিয়ে ফিরে যাব।”
মুসা ইবনে নুসাইর জুলিয়নকে বুকে জড়িয়ে ধরে চেয়ারে বসতে বসতে বললেন, আমাদের ঘরে যদি কোন চরম দুশমনও আসে তাহলে তাকে আমরা দোস্ত মনে করি। আপনার দিলে যত বড়ই খারাপ ইরাদা থাকুক আমরা আপনাকে দোস্তই মনে করব।
তরজুমান উভয়ের কথাবার্তা বর্বর জবানে তরজমা করে শুনাচ্ছিল। জুলিয়নের সাথে চমকদ্বার পোশাক পরিহিত নেজাহ্ হাতে দুরক্ষি ছিল, তারা আধো বন্ধ আধো খোলা দরজার সামনে দাঁড়ান ছিল। জুলিয়ন তাদেরকে ইশারা করলে তারা রোবটের মত বুকে সালাম করে চলে গেল।
তারা চলে যাবার পর দু’জন কৃষ্ণকায় আদমী যাদের মাথায় সফেদ টুপি আর পরনে ঝলমলে তহবন্দ। তারা দু’জন একটা বাক্স নিয়ে এসে তা মুসা ইবনে নুসাইরের সামনে রেখে ঢাকনা খুলে দিয়ে তারা নতজানু হয়ে মুসার সামনে সিজদায় পড়ে গেল। তারা সিজদা থেকে উঠে নিচু হয়ে পিছন ফিরে চলে গেলে সাথে সাথে এরকম আরো দু’জন হাবশী গোলাম ঐ রকম বাক্স নিয়ে ঘরে প্রবেশ করল।
মুসা : আমীরে সিওয়াস্তা! আপনি এদেরকে বলেদেন এরা যেন আমার সামনে সিজদা না করে।
জুলিয়ন : আমীরে সালাতানাতে ইসলামীয়া! এরা গোলাম, শাহী খান্দানের আফরাদ নয় ফলে তাদেরকে সিজদা করতে বাধা দেবেন না।
মুসা : আমীর জুলিয়ন! আমরা সকলেই গোলাম। আমরা একজন বাদশাহের সামনে কেবল সিজদাবনত হই। মুসা শাহাদত আঙ্গুল আসমানের দিকে তুলে ইশারা করে বললেন, আর সে বাদশাহ হলেন আল্লাহ! এসব আদব-কায়দার পাবন্দী আপনি আপনার দরবারে করবেন, আমরা সকলে এখন আল্লাহর দরবারে বসে আছি। মুসা জিজ্ঞেস করলেন, আপনি কি কখনো মুসলমানদেরকে একত্রে নামাজ পড়তে দেখেননি।
জুলিয়ন : দেখে ছিলাম আমীরে আফ্রিকা! যখন আপনার সৈন্য বাহিনী সিওয়াস্তা অবরোধ করেছিল সে সময় একদিন সন্ধ্যায় কেল্লার প্রাচীরের উপর গিয়ে আপনার তামাম ফৌজকে এক ব্যক্তির পিছনে কাতার বন্দি হয়ে নামাজ পড়তে দেখেছিলাম।
মূসা : আপনি কি কিছু বুঝতে পেরে ছিলেন? সেনাপতি-সেপাহী, আলা আদনা, সফেদ সিয়া-রাজা-প্রজা সকলে একত্রে দাঁড়ান ছিল। সেখানে এমন কোন কানুন ছিলনা যে কর্মকর্তা সামনের কাতারে আর কর্মচারী পেছনে। ইসলামে মনিব ও গোলামের মাঝে কোন ইমতিয়াজ নেই। আল্লাহর দরবারে দাঁড়িয়ে সকলে সমান হয়ে যায়। মানুষ মানুষের সামনে নত হওয়া ও সিজদা করা ইসলামে বড় পাপের কাজ।
তিনটি বাক্স কামরার ভেতর আনা হলো। মুসা ইবনে নুসাইর নিষেধ করার পরও বাক্স আরোহনকারীরা নত হয়ে সিজদা করছিল আর জুলিয়ন তা দেখে মুচকি হাসছিল।
জুলিয়ন যা এনেছিল তা অত্যন্ত মূল্যবান হাদিয়া-তুহফা ছিল।
জুলিয়ন : আমীরে আফ্রিকা মুসা ইবনে নুসাইরের জন্যে একটি ঘোড়াও নিয়ে এসেছি। তা বাহিরে রয়েছে। শাহী আস্তাবলের ঘোড়া, এত দ্রুতগামী যেন উড়ে চলে। কেবল মাত্র শাহী লোককে তার পিঠে চড়তে দেয়। আবার লাগাম ধরার সাথে সাথে থেমে যায়। কয়েকটা ময়দানে যুদ্ধ করেছে। যেন শাহী আস্তাবলের বাদশাহ।
মুসা : আমি নিজের পক্ষ হতে এবং খলিফাতুল মুসলিমীনের পক্ষ হতে শুকরিয়া আদায় করছি। আপনি কি এখন আপনার তাশরীফ আনার মাকসাদ বলবেন?
***
তিনজন নির্ভরযোগ্য ঐতিহাসিক~ লেইন পোল, প্রফেসর দুর্জী ও স্যার মেক্যুয়েল, মুসা ইবনে নুসাইর ও জুলিয়নের যে আলাপ-আলোচনা হয়েছিল তা তারা বিস্তারিতভাবে উল্লেখ করেছেন।
জুলিয়ন : আমীরে আফ্রিকা ও মিশর! আমি আপনার জন্যে আরো একটি তুহফা নিয়ে এসেছি তবে সে তুহফা আপনাকে নিজে সম্মুখে অগ্রসর হয়ে গ্রহণ করতে হবে, আমি আপনার সাথে থাকব, পথিমাঝে কৃষ্ণসাগর বাধা হয়ে দাঁড়াবে। আমি আমার পথ প্রদর্শক প্রেরণ করব।
মুসা : আমাদের দিলের লুক্কায়িত বিষয় তো কেবল আল্লাহ জানেন। এক তো আপনার আগমনের বিষয়টাই আমার বোধ ক্ষমতার উর্ধ্বে তারপর আপনি তুহফার কথা বলছেন এবং যে আঙ্গিকে বলছেন তা অনুধাবনের শক্তিতো আমার একেবারেই নেই। আপনি আপনার শরীফের মাকসাদ ও মানশা এমনভাবে বর্ণনা করবেন না যা আমার মত কম আকলের লোকের অনুধাবন করতে কষ্ট হয়।
জুলিয়ন : সেই তুহফার নাম স্পেন। স্পেন একটা দেশ যে ব্যাপারে আপনি না ওয়াকিফ নন। আপনি ঐ মুলুককে ইসলামী সালতানাতের মাঝে শামিল করতে পারেন। সামনে ফ্রান্স। আপনি স্পেনে কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করে ফ্রান্সকেও অধীনে আনতে পারেন।
মুসা : সালতানাতে ইসলামীর সাথে আপনার কি সম্পর্ক? আর আপনার স্বজাতি, স্বগোত্রের বাদশাহ রডারিকের সাথেই বা আপনার কি দুশমনি?
জুলিয়ন : আপনি কি জানেন না যে আমি বাদশাহ রডারিকের জায়গীরদার? সে আমাকে আপনার রাস্তায় প্রতিবন্ধক বানিয়ে রেখেছে। সে সব সময় এ আশংকায় আছে যে, আরবের মুসলমান এত মক্তিশালী যোদ্ধায় পরিণত হয়েছে যে তারা পারস্য-রোম সম্রাটকে পর্যন্ত নিশ্চিহ্ন করে দিয়ে আজ তারা আফ্রিকার উত্তর সীমান্ত পর্যন্ত পৌঁছে গেছে। বর্বরজাতিকেও তারা ইসলামে দাখিল করে ফৌজি বাহিনীতে অন্তর্ভুক্ত করেছে ফলে সে ভয় পাচ্ছে, এখন মুসলমানরা স্পেন হয়ে ইউরোপে প্রবেশ করবে।
মুসা : আপনি কি স্পেন ও আমাদের মাঝে একটা আযাদমুলক হিসেবে থাকতে চাচ্ছেন?
জুলিয়ন : সে কথা পরে হবে, আগে আপনি আমার পূর্ণ কথা শ্রবণ করে আমার এক সওয়ালের জওয়াব দেন। আপনি কি স্পেনের ওপর হামলা করে সুন্দর ও শ্যামল রাজ্যকে আপনার বিশাল সালতানাতের মাঝে শামিল করবেন?
মূসা : না, আমার কাছে এত পরিমাণ সৈন্য নেই। কেন্দ্র থেকে সৈন্য সাহায্য পাবার আশা নেই, ফলে স্পেনের মত অত বড় ফৌজি বাহিনীর ওপর হামলা করার ক্ষমতা আমার নেই।
মুসা ইবনে নুসাইর অসত্য কথা বললেন, তিনি বহুবার স্পেনের ওপর হামলার ইরাদা করে পরিকল্পনা তৈরি করেছিলেন। তিনি তার সেনাপতিদের সাথে এ ব্যাপারে আলোচনা করে ছিলেন এবং তিনি এটা চাচ্ছিলেন যে খলীফা যেন তাকে স্পেন আক্রমণের অনুমতি দিয়ে দেন। সে সময় খলীফা ছিলেন ওয়ালীদ ইবনে আব্দুল মালেক, তিনি সব সময় যুদ্ধ করে অন্যান্য মূলুককে ইসলামী মুলুকে শামিল করার ফিকিরে থাকতেন। মুহাম্মদ ইবনে কাসেমকে তিনি সিন্দু আক্রমণে পাঠিয়ে ছিলেন। মুসা তার নিজের একটা কমজোরীর কথা চিন্তে করতেন তাহলে আরবরা তখন পর্যন্ত নৌ যুদ্ধে দক্ষ হয়ে উঠতে পেরে ছিল না। জাহাজ চালনায় তারা মাহের ছিল কিন্তু নৌ যুদ্ধের কিছু কলাকৌশল ছিল যে সম্পর্কে তখনও তারা নাওয়াকিফ ছিল। স্পেন ও আফ্রিকার মাঝে প্রাচীর হিসেবে ছিল সাগর, স্পেনে হামলার সময়ে স্পেনের জংগী জাহাজ তাদেরকে সমুদ্রের মাঝে বাধা দেয়ার সম্ভাবনা ছিল কিন্তু মুসলমানরা সাগরে যুদ্ধ সম্পর্কে জ্ঞাত ছিল না।
জুলিয়নকে মুসা জবাব দিলেন, স্পেনের ওপর হামলা করার কোন চিন্তাই তার নেই। তিনি সন্দেহ করেছিলেন, সে এ তথ্য নিতে এসেছে যে, স্পেনের ব্যাপারে মুসলমানদের চিন্তা-ফিকির কি। তিনি জুলিয়নের ব্যাপারে এ শুবাহও করেছিলেন যে সে মুসলমানদের অবস্থা পরীক্ষা-নিরীক্ষা করতে এসেছে। মুসলমানরা যদি হাত-পা গুটিয়ে বসে থাকে তাহলে তাদের ওপর হামলা করে তাদের আফ্রিকা ও মিসর হতে। বিতাড়িত করা হবে।
জুলিয়ন : আপনি হয়তো জানেন না যে, স্পেন কুতরতের এক ঈর্ষনীয় মুলুক। চারিদিকে সুবজ নয়নাভিরাম ক্ষেত, ঘন সন্নিবিশিষ্ট্য গাছ-পালা, পত্র-পল্লব, এত সৌন্দর্য মণ্ডিত যে যদি মৃত ব্যক্তিও দেখে তাহলে সে জীবিত হয়ে উঠবে। স্পেন সমুদ্র ও নদী প্রধান দেশ। তা সবুজ-শ্যামল পাহাড় ও মনোহরী উপত্যাকার মুলুক। সেথাকার মাটি সোনা, ফলায়। মাটির নিচে রত্নভান্ডার লুকিয়ে আছে। আপনি যদি সেখানে যান তাহলে আরবের বালুময় ও আফ্রিকার পাথুরী জমিনের দিকে ফিরে থাকাবেন না…
সেখানের মানুষ সৌন্দর্যের প্রতীক, সেখানের রমণীদের সৌন্দর্য যাদুর আবেশে মোহাবিষ্ট করে ফেলে। আপনি জান্নাতের কথা শুনেছেন যা মৃত্যুর পরে পাওয়া যাবে। কে পাবে কে পাবে না তা মালুম নেই। আপনি যদি স্পেনে যান তাহলে বলে উঠবেন এটাই সে জান্নাত যার ওয়াদা আল্লাহ্ তা’য়ালা করেছেন। আমীরে আফ্রিকা আপনি কি চিন্তে করছেন? স্পেনের দরজা আমার হাতে আমি তা খুলে দেব।
ঐতিহাসিকরা লেখেন, স্পেনের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য ও নয়নাভিরাম দৃশ্যের কথা জুলিয়ন এমন চিত্তাকর্ষণ শব্দ ও ভঙ্গিতে বর্ণনা করেন যে মুসা ইবনে নুসাইরের ওপর তার প্রভাব বিস্তার করে। কিন্তু তিনি দক্ষ এবং অভিজ্ঞ ব্যক্তি ছিলেন, তিনি খ্রীষ্টান ও ইহুদীদের যাদুময়ী কথা ও চিত্তহরী বক্তৃতার ধোকা সম্পর্কে ওয়াকিফ ছিলেন। তিনি ইশারা করলেন, সবাইকে বাহিরে চলে যাবার জন্যে। কামরার মাঝে মুসা জুলিয়ন ও দুভাষী রয়ে গেল।
মূসা : জুলিয়ন! তুমি আমার জন্যে খুব সুন্দর জাল বিস্তার করছো। তুমি আকলের উপর এত পরিমাণ নির্ভরশীল যে এটা চিন্তে করার কাবেল তুমি নও যে, যার কাছে যাদুময়ী বক্তৃতা দিচ্ছ সে অনেক ময়দানের খেলোয়াড়, তার চোখের তীক্ষ্ণতা মাটির নিচ পর্যন্ত গিয়ে পৌঁছুতে পারে।
জুলিয়ন : বেশক আমীরে মুসা! আমি এসব কিছু চিন্তে করেই এসেছি। আমি আপনার শুকরিয়া আদায় করছি যে, আপনি আমাকে ছোট ভাই মনে করে “তুমি” বলে সম্বোধন করেছেন। অনুমতি দিন আমিও আপনাকে তুমি বলে সম্বোধন করি। সে হাত দুটো মুসার দিকে প্রসারিত করে বলল, “আমার অন্তরের বন্ধুত্ব গ্রহণ করুন এবং আমার দিলে যা লুকিয়ে আছে তাও শ্রবণ করুন।”
মুসা ইবনে নুসাইর তার প্রসারিত হস্তদ্বয় জড়িয়ে ধরেন। কিছুক্ষণ পর জুলিয়ন তার হাত মুসার হাত থেকে বের করে উঠে দাঁড়ান। তিনি অত্যন্ত ক্ষীপ্ততার সাথে তলোয়ার কোষমুক্ত করেন। তার চেয়ে আরো বেশী দ্রুত মুসার হাত তার কুরসীর সাথে রাখা তলোয়ারে গিয়ে পৌঁছে। কিন্তু জুলিয়ন তলোয়ার দু’হাতের তালুর ওপর নিয়ে দাঁড়িয়ে সামনে অগ্রসর হয়ে মুসার সামনে ঝুঁকে পড়ে তলোয়ার মুসার কদমের কাছে রেখে দিয়ে পিছনে কিছুদূর সরে এসে দাঁড়ালেন।
জুলিয়ন অত্যন্ত স্পৃহা ও তেজস্বীভাবে বললেন, আমীরে মুসা! এটা এমন তলোয়ার যা কখনো নত হয়নি। সে দুশমনের উঁচু ও উন্নত গর্দান ওয়ার করেছে। বেয়াদবী মনে করবে না-মুসা! তাকাববরী ও অহংকার ভাববে না, এটা ঐ তলোয়ার যাকে তুমিও নত করতে পারনি। তোমার বর্বর ফৌজও তার ঝলকানী দেখে সিওয়াস্তার কেল্লার পিছু হটে ছিল। আজ সে তলোয়ার তোমার পদযুগলের নিচে পড়ে রয়েছে। কোন বাদশাহ্, কোন সেনাপতি এত সহজে তার তলোয়ার নিজের দুশমনের কদমের নিচে রাখে না কিন্তু তুমি আমার দুশমন নও। এখন আমারা ভাই ভাই একে অপরের দোস্ত। আজকে এক বন্ধু তার দুঃখ অপর বন্ধুর হৃদয়ে ঢালার জন্যে এসেছে… তা কি গ্রহণ করবে মুসা!
মুসা ইবনে নুসাইর নিচু হয়ে পায়ের নিচ থেকে জুলিয়নের শমসের উঠিয়ে নিজ হাতে জুলিয়নকে অর্পন করলেন।
মুসা : তুমি আমাকে দোস্ত ও ভাই বলেছ এটা শুনে খুশী হলাম। আমি তোমার তলোয়ারের কদর করি। মুসা নিজ তলোয়ার কোষবদ্ধ করে বললেন, এখন কি আমার দোস্ত তার অন্তরের ব্যথার কথা আমাকে বলবে?
জুলিয়ন : হ্যাঁ। যা শোনানোর জন্যে এসেছি তা শুনিয়ে যাব। যদি আমীরে মুসার বেটীকে কেউ বেআব্রু করে তাহলে মুসা তাকে কি শাস্তিদেবে?
প্রতি উত্তরে মুসা বললেন, অভিযোগ প্রমাণিত হবার পর অপরাধীকে প্রস্তরাঘাতে খতম করে দেয়া হবে।
জুলিয়ন : অপরাধী যদি কোন মুলুকের বাদশাহ্ হয়?
মুসা : তাহলে মুসা তার শাহী তখতের ইট চূর্ণ-বিচূর্ণ করে দেবে আর সে বাদশাহর খানদানের তামাম আওরতকে দাসী বানিয়ে নিয়ে আসবে।
জুলিয়ন : আর সে মাজলুম বেটি যদি তোমার দুশমনের হয়?
মুসা; সে মাজলুম বেটী এবং তার বাপ যদি ফরিয়াদী হয়ে আসে তাহলে মুসা তারও প্রতিশোধ নেবে। কিন্তু এটা বিশেষভাবে লক্ষ্যণীয় হবে যে তার নিজের সালতানাত কোন খতরার মাঝে পড়ে কি না!
জুলিয়ন : না মুসা! তোমার সালতানাত ও প্রসাদ কোন খতরায় পড়বেনা। বরং তোমার সালাতানাত আরো প্রশস্ত হবে… এখন শোন মূসা! সে মাজলুম পিতা, আমি, নির্যাতিতা আমার বেটী।
মুসা : তারপরও তোমার তলোয়ার কেন কোষবদ্ধ? এবং তোমার তলোয়ার কেন আমার পদযুগলে পড়ল?
জুলিয়ন : এজন্যে যে অপরাধী আমার চেয়ে বেশী তকতওয়ালা আর সে হলো স্পেনের বাদশাহ্ রডারিক।
মুসা : রডারিকের শাহী মহলে তোমার বেটী কিভাবে গেল?
জুলিয়ন : আমীরে মুসা! বেশক আমি বাদশাহ্ রডারিকের জায়গীরদার, কিন্তু আমার সম্পর্ক স্পেনের শাহী খান্দারের সাথে। কোন এক সময় আমার এ রাজ্য স্বাধীন ছিল, সময়ের প্রেক্ষিতে সিওয়াস্তার প্রতিরক্ষার দায়িত্ব স্পেনের বাদশাহ্ নিয়ে নেন এবং সিওয়াস্তা স্পেনের অংশে পরিণত হয়। আমি বাদশাহ্ থেকে হলাম গভর্নর। শাহী খান্দানের রেওয়াজ রয়েছে যে, যার মেয়ে পনের-ষোল বছরে পদার্পন করে তখন তার বেটীকে স্পেনের শাহী মহলের আদব-কায়দা, শিষ্টাচার শেখানোর জন্যে শাহী মহলে পাঠিয়ে দেয়। শাহী পরিবারের লোকরা অনেক সময় তার দশ বার বছরের মেয়েকে সেখানে পাঠিয়ে দেয়…….
সে দস্তুর মুতাবেক আমি আমার বেটী ফ্লোরিডাকে বাদশাহ্ রডারিকের কাছে পাঠিয়ে ছিলাম। তার বয়স সতেরর দোড় গোড়ায় পৌঁছেছে। যেহেতু মেয়েদের আদব-তরবিয়ত শিক্ষা দেয়া হয় এ কারণে তাদেরকে শাহী মহলে আওরতের নেগরানীতে রাখা হয়। পুরুষের সাথে তাদের কোন সম্পর্ক থাকে না। আমার বেটী খবর পাঠিয়েছে, বাদশাহ্ রডারিক থোকা দিয়ে তার ইযযত হরন করেছে।
মুসা : তোমার বেটী এখন কোথায়?
জুলিয়ন : আমি তাকে টলেডো হতে নিয়ে এসেছি, তুমি হয়তো জানো টলেডো স্পেনের রাজধানী। এখন আমার বেটী সিওয়াস্তাতে। ইচ্ছে করলে আমার বেটীকে এখানে তলব করে জিজ্ঞেস করতে পার।
মুসা ইবনে নুসাইর! আমার বেইযতির প্রতিশোধ আমি রডারিক থেকে নিতে চাই। তার এক তরীকা তো এই যে, তাকে আমি কতল করে ফেলব। কিন্তু এটা সম্ভব বলে মনে হয় না। সে বহুত কম বাহিরে বের হয়। যদি বের হয় তাহলে তার চতুর পার্শ্বে মুহাফিজের ভিড় জমে থাকে।
দ্বিতীয় তরীকা যার কথা চিন্তে করে তোমার কাছে আমি এসেছি তাহলে তুমি স্পেন আক্রমণ কর আমি তোমাকে পূর্ণ মদদ করব। তবে আমি সামনে আসব না। বেশক স্পেনে ফৌজ বেশুমার। সংখ্যার দিকে যদি লক্ষ্য কর তাহলে তুমি হামলা করতে পারবেনা তবে যে উদ্দীপনা ও নিয়মতান্ত্রিকতা তোমার ফৌজের মাঝে রয়েছে তা রডারিকের সৈন্যের মাঝে নেই এর তাফসীল আমি পরে করব। আমি ইয়াকীনের সাথে বলছি তোমার ফৌজ স্পেনের ফৌজকে শেকান্ত দিবে। আমার প্রতিশোধ কেবল রডারিকের হত্যার মাঝে সীমাবদ্ধ রাখতে চাই না বরং তার বাদশাহীকে মাটির সাথে মিশিয়ে দিতে চাই। আমার এই ইরাদা কেবল তুমিই পূর্ণ করতে পারো। তবে এর পরিপূর্ণ ফায়দা তোমার হবে। আমি কেবল এ আবেদন করব যে তুমি সিওয়াস্তাকে আযাদ রাখবে।
***
এটা একটা মাশহুর ওয়াকিয়া যা ঐতিহাসিকরা বিস্তারিতভাবে বর্ণনা করেছেন, জুলিয়নের দুই বেটী ছিল। একজনের নাম ছিল ফ্লোরিডা অপরজনের নাম ছিল মেরী। ফ্লোরিডা যত বড় হচ্ছিল তত তার সৌন্দর্য মাধুর্য রূপলাবণ্য বৃদ্ধি পাচ্ছিল।
তারা বলতেন, আমার বেটী যে সুন্দর হয়ে গড়ে উঠছে তার জন্যে তো ঐ রকম সুন্দর শাহজাদা পাওয়াই মুশকিল হয়ে যাবে। তার মা জানতেন যে, তার বেটী চৌদ্দ বছর বয়সেই এক শাহজাদাকে জীবন সঙ্গী হিসেবে বেছে নিয়েছে। যাকে বেছে নিয়েছে প্রকৃত অর্থে সে শাহজাদা নয়। সে শাহী আস্তাবলের এক শাহ সোয়ারের বেটা। এই শাহ্ সোয়ার শাহী খান্দানের ও ফৌজী অফিসারদের আওলাদেরকে ঘোড় সোয়ারী ও নেজাবাজী প্রশিক্ষণ দেন। শাহী খান্দান ও ফৌজের উঁচু পর্যায়ে তার, বেশ মর্যাদা, কদর রয়েছে।
হিজী তার নওজোয়ান বেটা। ফ্লোরিডার বয়স যখন তের/চৌদ্দ বছর, হিজীর বয়স তখন সতের/আটার বছর। হিজীকে তার পিতা শৈশবেই শাহ সোয়ার বানিয়েছিলেন। নেজা বাজীতে সে পারদর্শী ছিল। চৌদ্দ বছর বয়সে ফ্লোরিডার বাপ জুলিয়ন তার মেয়েকে ঘোড় সোয়ার বানানোর জন্যে হিজীর বাবাকে হুকুম করেছিলেন। ফ্লোরিডা সকাল-সাঁঝে ঘোড় সোয়ারের জন্যে যেত।
জুলিয়ন হিজীর বাপকে হিদায়াত দিতে গিয়ে বলেছিলেন, আমার বেটীকে বেটী মনে করবে না। তুমি জান আমার কোন লাড়কা নেই। সম্ভবত এ কারনেই আমার এ লাড়কী লাড়কা হতে যাচ্ছে। সে আমার ছেলের অভাবপূরণ করবে। তাকে মর্দ মনে করে শাহ্ সোয়ার বানাবে এবং তাকে নেজা বাজী শেখানোর সাথে সাথে দ্রুতগামী ঘোড়ার পিঠে চড়ে তলোয়ার ও কুঠার চালানোর তরবিয়াত দেবে।
দেড়-দুই মাহিনায় ফ্লোরিডা ঘোড় সোয়ারীতেএত পুখতা হয়ে গেল যে সে ঘোড়ায় সোয়ার অবস্থায় তার ঘোড়া বড় উপত্যকা ও উঁচু প্রাচীর লাফ দিয়ে অতিক্রম করতে লাগল। তার উস্তাদ তাকে একাকী দূরে যেতে দিতেন না। কিন্তু ফ্লোরিডা ছিল শাহজাদী, সে তার উস্তাদের ওপর হুকুমজারী করে ঘোড় নিয়ে চলে যেত।
উস্তাদ আশংকা করছিলেন, এ লাড়কী একাকী জঙ্গলে ঘোড়া নিয়ে গিয়ে কোন বাধার সম্মুখীন হয়ে যদি ঘোড়া হতে পড়ে যায় বা ঘোড়া যদি পড়ে যায় আর সে যদি ঘোড়ার নিচে পড়ে তাহলে তা উস্তাদের জন্যে বড়ই দুভাগ্য ডেকে আনবে। তাই উস্তাদ তার হাত থেকে বাঁচার জন্যে ফ্লোরিডা যখন ঘোড়া নিয়ে বেরিয়ে যেত তখন উস্তাদ তার ছেলে হিজীকে ঘোড়া দিয়ে তার পিছনে পাঠিয়ে দিতেন।
হিজীকে আপনার পিছনে বা সাথে দেখে ফ্লোরিডা কোন প্রশ্ন করেনি। একদিন সে পথিমধ্যে ঘোড়া দাঁড় করাল, হিজী তার কাছে গিয়ে তার নিজের ঘোড়াও, থামাল। ফ্লোরিডা তাকে দেখে মুচকি হাসি দিল। হিজীর মাঝে ছিল পৌরুষের সৌন্দর্য ও ব্যক্তিত্বের ছবি। তার শরীরের অব কাঠামো দেখে পরিষ্কার বুঝে আসছিল মর্দে ময়দান। তার মাঝে ছিল পুরুষকে যুদ্ধের ময়দানে তলোয়ারের মাধ্যমে ব্যাকুল ও অস্থির করার ক্ষমতা আর মজলিসে রমণী পাগলপারা করার মোহ ও আকর্ষণ।
ফ্লোরিডা : হিজী! আমাকে ঘোড়া হতে নামিয়ে দাওতো। এত ক্লান্ত হয়ে পড়েছি যে একা নামতে পারছিনে।
এটা শাহজাদীর হুকুম ছিল। তাই হিজী তৎক্ষণাৎ নিজ ঘোড়া হতে নেমে শাহজাদীর ঘোড়ার কাছে গিয়ে তার রেকাবের ওপর হাত রেখে দাঁড়াল। কিন্তু শাহজাদী দু’হাত প্রসারিত করে তার দিকে ঝুঁকে পড়ে ক্ষণিকের মাঝে হিজীর বাহুবন্ধনে চলে এলো। হিজী তাকে মাটিতে দাঁড় করিয়ে পিছে হটছিল কিন্তু শাহজাদীর নরম-মাংসল বাহু যুগল হতে সে বেরুতে পারল না।
ফ্লোরিডা : ভয় পেওনা হিজি! তোমাকে আমার খুব ভাল লাগে… খুব… ভাল লাগে।
“আমি তোমাদের এক গোলামের বেটা শাহজাদী!” হিজী কাঁপাকাঁপা গলায় বলল।
“গভর্নর জুলিয়ন যদি জানতে পারেন তাহলে….।”
ফ্লোরিডা : ভুল বুঝো না হিজি! আমি লাড়কী তো বটে তবে বৈশিষ্ট্য লাড়কীর নয়। আমি সেরেফ তোমার শরীর চাই না। তুমি কি সে মহব্বত সম্পর্কে ওয়াকিফ নও যার জন্ম হৃদয়ে এবং হৃদয়ের গভীরেই বাসা বেধে থাকে?
হিজি : না! শাহজাদী না!
ফ্লোরিডা : আমাকে শাহজাদী বলবে না। আমাকে মহব্বত করার নির্দেশ আমি তোমাকে দিচ্ছিনে… আমাকে ফ্লোরা বলবে।
***
হিজি ফ্লোরা বলতে লাগল। শাহজাদী শাহী প্রাচীর ও আঙ্গিনা ডিঙ্গিয়ে এলো। লোক সম্মুখে হিজি ছিল তার নওকর কিন্তু কেল্লার বাহিরে খোলা প্রান্তরে ছিল তার প্রিয়জন ও হৃদয় সুজন। প্রথম দিন ফ্লোরিডা তাকে বলে ছিল আমি কেবল তোমার শরীর চাই না, তা সে বাস্তবায়ন করে দেখিয়ে দিল। তার মহব্বত দিল হতে জন্ম নিয়ে অন্তরের গভীরতম প্রদেশে ঠাঁই করে নিয়েছিল।
হিজি তাকে শাহ্ সোয়ার বানিয়ে নেজাবাজী ও তলোয়ার চালনেও মাহের বানিয়ে দিল। ফ্লোরিডার বাবা-মা বিন্দুমাত্রও অনুভব করতে পারলানা যে, তাদের বেটী নি জিন্দেগীর সাথী ইন্তেখাব করে নিয়েছে। ফ্লোরিডা ও হিজি কখনো চিন্তা করেনি যে তাদের শাদী আদৌ হবে না। জুলিয়ন মখমলের নকশা চটের থলীতে করবেন না। তারা তো প্রেমের সাগরে ডুবদিয়ে নিজেদের অবস্থার কথাই কেবল ভুলেনি বরং তামাম দুনিয়াকেই ভুলে গিয়েছিল।
সময়ের ঘড়ি অতিক্রম করে দু’ বছর অতিবাহিত হয়ে গেল। একদিন মা ফ্লোরিডাকে বললেন তার বাবা তাকে টলেডো নিয়ে যাচ্ছেন সেখানে তাকে কমছে কম একবছর স্পেনের বাদশাহ রডারিকের শাহী মহলে অতিবাহিত করতে হবে।
ফ্লোরিডা : কেন?
মা : তুমি কি জান না, শাহী খান্দানের লাড়কীরা সেখানে শাহী আদব-আখলাক ও বাদশাহী চাল-চলন শিখতে যায়?
ফ্লোরিডা : আমি মূর্খ-গ্রাম্য? আমি শাহী তরীকা সম্পর্কে ওয়াকিফ নই? আমার কিসের কমতি পরিলক্ষিত হচ্ছে?… আমি যাব না, আমিঐ শাহী খান্দান সম্পর্কে অনেক কথা-বার্তা শুনেছি। শাহী মহলে যে আদব-আখলাক প্রচলিত রয়েছে তার কয়েকটা ঘটনা আমি শ্রবণ করেছি।
ফ্লোরিডার মা তাকে অনেক বুঝালেন কিন্তু তার কোন কথা শ্রবণ করল না, সে এক কথায় বলতে লাগল ঐসব বাদশাদের কাছে কোন আখলাক, ভদ্রতা, শিষ্টাচার কিছুই নেই। কিন্তু তার বাবা যখন হুকুমের স্বরে তাকে স্পেনে যেতে বললেন তখন আর সে অস্বীকার করার সাহস পেল না। সে জানত তার বাবা কি পরিমাণ স্বেচ্ছাচারী।
জুলিয়ন ও তার বিবি ফ্লোরিডাকে সাথে নিয়ে রেখে আসলেন স্পেনের রাজধানী টলেডোতে বাদশাহ্ রডারিকের শাহী মহলে। তারা ফ্লোরিডাকে রডারিকের সম্মুখে উপস্থিত করেছিলেন।
রডারিক ফ্লোরিডার রূপ লাবণ্য ও নব যৌবনে মুগ্ধ হয়ে বলেছিলেন, “আহ্! এত সুন্দরী! জুলিয়ন! এ লাড়কীকে নামকাওয়াস্তে কোন শাহজাদার সাথে শাদী দিয়ে বিনষ্ট করবে না।
জুলিয়ন সহাস্যে উত্তর দিয়েছিলেন, এ বেটী নয় এ আমার বেটা।
ফ্লোরিডার বাবা-মা যখন সেখান থেকে বিদায় নিয়ে চলে আসছিলেন দু’নয়ন আঁসুতে ভরে উঠেছিল।
***
আট-দশ দিন অতিবাহিত হওয়ার পর হিজির বাপ জুলিয়নকে বললেন, তার ছেলে লাপাত্তা হয়ে গেছে। জুলিয়নের নির্দেশে তাকে সর্বত্র তালাশ করা হলো, মাঠে-ময়দানে, জঙ্গলে ঘোড় সোয়ার পাঠান হলো কিন্তু কোথাও হিজির নাম নিশানা পাওয়া গেলে না।
ওখানে সে থাকলে না পাওয়া যাবে। সে সমুদ্র পাড়ি দিয়ে টলেডো পৌঁছে ছিল। সে ফ্লোরিডার বিরহ সহ্য করতে পারেনি। সেখানে পৌঁছে সোজা শাহী আস্তাবলে গিয়ে জিম্মাদার অফিসারের সাথে সাক্ষাৎ করে নওকরীর দরখাস্ত করেছিল। আস্তাবলের অফিসার তার ইমতেহান নেয়ার জন্যে বা তার সাথে মজাক করার জন্যে একটা অত্যন্ত অবাধ্য ও দুষ্ট অশ্বের দিকে ইশারা করে বলেছিল, এ অশ্বকে সোয়ারী বানিয়ে দেখাও।
ঐ ঘোড়া খুব কম লোকের বাগে আসত। হিজি সে ঘোড়ার ওপর জিন লাগিয়ে। সোয়ার হয়ে গেল। আস্তাবলের তাবৎ কর্মচারীরা হিজির ঘোড়ার পীঠ হতে পতিত হওয়ার দৃশ্য দেখার জন্যে একত্রিত হয়ে গেল। ঘোড়া তার অবাধ্যতা দেখান শুরু করল। সোয়ারীর কোন ইশারা-ইঙ্গিতই সে পাত্তা দিল না কিন্তু হিজি অল্প কিছুক্ষণ পরেই তাকেবাগে এনে ফেলল। অত্যন্ত দ্রুত দৌড়াল, সব ধরনের চাল-চালনা করল এবং ঘোড় দৌড়ের ময়দানে যে বাধা ছিল তা নির্দিধায় অতিক্রম করে সকলকে তাক লাগিয়ে দিল।
নেজাবাজী ও তলোয়ার চালনার অমূল্য কৌশল দেখাল যার ফলে ভাল পদে তার নওকরী হয়ে গেল। তার মাকসাদ কেবল নওকরী ছিল না, সে তো ফ্লোরিডার সাথে মিলন চাচ্ছিল। কিছু দিনের মাঝে সে জেনে গেল ফ্লোরিডা কোথায় থাকে, কিন্তু তাকে ফ্লোরিডার কাছে যাওয়ার জন্যে চেষ্টা করতে হলো না। একদিন পাঁচ ছয়জন শাহজাদী ঘোড় সোয়ারের জন্যে এলো। তাদের মাঝে ফ্লোরিডাও ছিল। এসব শাহজাদীরা ফ্লোরিডার মত অন্যান্য শহর হতে তালীম তরবিয়তের জন্যে এসেছে। তাদের তরবিয়তের মাঝে ঘোড় সোয়ারও শামিল ছিল।
ফ্লোরিডা হিজিকে দেখে বিস্ময়াভিভূত হয়ে পড়ল। সে যেহেতু শাহজাদী ছিল এ কারণে যে কোন নওকরের সাথে তার কথা বলার অধিকার ছিল। সে সোজা হিজীর কাছে গিয়ে উচ্চ স্বরে কথা বলতে লাগল যাতে কারো কোন সন্দেহ না হয়।
ফ্লোরিডা : তোমার নাম কি?
আগস্টস। হিজি তার নাম ভুল বলল, অন্যদের কাছেও সে এনামই বলেছে।
ফ্লোরিডা : তোমাকে মনে হচ্ছে ইতিপূর্বে কোথাও দেখেছি।
হিজি : হয়তো দেখতে পারেন শাহজাদী! আমি বেশ অনেক জায়গায় অবস্থান করেছি।
অন্যান্য শাহজাদীরাও তাদের কাছে এসে দাঁড়িয়ে ছিল, তারা বেশ হাসি খুশীতেই এসেছিল।
ফ্লোরিডা : আস্তাবলে তোমার কি কাজ?
আস্তাবলে অফিসার যিনি পাশেই দাঁড়ান ছিলেন, বললেন, সে খুব ভাল শাহ্ সোয়ার শাহ্জাদী!
ফ্লোরিডা : শাহ্ সোয়ার! আজই তাহলে তাকে আমাদের সাথে পাঠাও দেখব কত বড় শাহ্ সোয়ার।
ঐ দিনই হিজিকে শাহজাদীদের সাথে পাঠান হলো। কেল্লার বাহিরে গিয়ে ফ্লোরিডা তার সাথী শাহ্জাদীদের বলল, সে এই শাহ্ সোয়ারের সাথে ঘোড়া দৌড়িয়ে দেখবে এ ঘোড় সোয়ার কতটুকু মাহের।
কিছুক্ষণ পরেই ফ্লোরিডা ও হিজির ঘোড়া সমন্তরালে চলতে লাগল, তারা ঘোড়া দৌড়াতে দৌড়াতে পাহাড়ের সবুজ-শ্যামল চুড়াতে গিয়ে পৌঁছুল, বেশ কিছুক্ষণ পর তারা পাহাড় হতে বের হলো, এর মাঝে তারা তাদের অন্তরে জমে থাকা কথা সেরে নিয়েছিল। হিজি ফ্লোরিডাকে বলেছিল সে কাউকে কিছু না বলেই সিওয়াস্তা থেকে চলে এসেছে।
ফ্লোরিডা : তাড়াতাড়ি ফিরে যাও। আমার বাবা যদি জানতে পারেন যে, তুমি এখানে তাহলে প্রথমে এ শক হবে যে তুমি আমার জন্যে এখানে চলে এসেছ। সিওয়াস্তার শাহী নওকরী ছেড়ে এখানে নওকরী করতে আসার এ ছাড়া আর কোন কারণ নেই। থাকলেও তুমি কাউকে বুঝাতে পারবে না।
হিজি : ফ্লোরিডা! আর কিছু দিন থাকতে দাও। দু’ একদিন আরো মুলাকাতের মওকা দাও তাহলে আমি চলে যাব। আমার বাবাকে বলব, সিওয়াস্তাতে থাকতে থাকতে এক ঘেয়েমী হয়ে উঠেছিলাম তাই কিছুদিন স্পেন ঘুরে এলাম।
শাহী মহলের চতুর্পাশ্বে ঘন গাছ পালা ও পত্র পল্লবে ঘেরা বাগিচা ছিল, তার কোন এলাকা ঘন গাছ-গাছালি ও লতা-গুল্মে একেবারে ঢেকে নিয়েছিল, ফ্লোরিডা হিজিকে এমনই একটা কোনের কথা বলে রাস্তা বাতিয়ে দিল এবং অর্ধেক রাতের পরে যাওয়ার হেদায়েত দিল। কারণ এর পূর্বে বা দিনের বেলা গেলে ধরা পড়ার সম্ভাবনা ছিল।
***
বিপদ আশংকা পিছে ফেলে হিজি দ্বিতীয়বার রাতের আঁধারে বাগানের নিঝুম কোণে ফ্লোরিডার সাথে সাক্ষাৎ করল। ফ্লোরিডারও বিপদের শংকা ছিল। বাহিরে থেকে যে সব শাহজাদীরা এসেছিল তাদের প্রতি কড়া নজর রাখা হতো। তারপরও ফ্লোরিডা দু’রাত্র তার কামরা হতে খালী পায়ে বেরিয়ে চোরের মত বাগানে পৌঁছে ছিল। দ্বিতীয় মুলাকাতে ফ্লোরিডা হিজিকে তিন রাত পরে আসতে বলেছিল।
যে দিন রাত্রে হিজির বাগানে যাবার কথা ছিল, সেদিন বাদশাহ রডারিক চার পাঁচ দিনের গায়ের হাজিরীর পর ফিরে এসেছিল। স্পেনের কিছু এলাকাতে বিদ্রোহীয়া মাথা উঁচু করেছিল। বাদশাহ্ রডারিক নিজে সেখানে গিয়ে বিদ্রোহীদের তিন সর্দারের শিরোচ্ছেদ করে এসেছেন। সন্ধ্যায় এসে পৌঁছুলেন, তিনি ক্লান্ত-শ্রান্ত আবার খুশী কারণ বিদ্রোহীরা মাথা চাড়া দিয়ে ওঠার পূর্বেই তা খতম করে দিয়েছে।
বাদশাহ্ ম্লান করে শরাব পানে বসলেন, তার আচার-আচরণ ও কথাবার্তায় মনে হচ্ছিল তিনি খুশীতে ফেটে পড়ছেন এবং তিনি স্থির করতে পারছেন না, খুশী তিনি কিভাবে উদযাপন করবেন। বাদশাহের মনে আনন্দ আনার জন্যে খুশী উদযাপনের জন্যে সাধারণতঃ দুটো জিনিস প্রাধান্য পায়, রমণী ও শরাব। বাদশাহ্ রডারিকের দরবারেও এ দু’জিনিসের কোন কমতি ছিল না। বাদশাহর দরবারে দু’তিন জন হাকীমও তার সাথে পনিরত ছিল।
মায়াবী, নবযৌবনা যে সব লাড়কীরা শরাব পান করাচ্ছিল তাদের দিকে দেখে বাদশাহ্ রডারিক বললেন, “কোন নতুন ফুল আছে? নাক ছিটকিয়ে নিজেই বললেন, নেই… কলি চাই, অর্ধ ফুটিত কলি।”
একজন হাকিম আদবের সাথে মুচকি হেসে বলল,এরাইতো ফুল, যারা স্পেনের বাদশাহর স্বপ্নিল নিলাভ ভূবনে খোশবু ছড়াচ্ছে।
বাদশাহ্ মাতালের সুরে বললেন, না! না! কলি চাই…। হাতে তুড়ি দিয়ে বললেন, ফ্লোরিডা… জুলিয়নের বেটী…।
বাদশাহর এক মুশির বলল, শাহান শাহে উন্দুলুস! বহিরাগত শাহজাদীরা আমাদের কাছে আমানত। তারা আদব-আখলাক শিখতেএসেছে। এখানে আগত শাহজাদীদের সাথে এ নাগাদ মামুলী কৌতুক-উপহাস পর্যন্ত করা হয়নি। এ সুনাম ক্ষুণ্ণ না করাই ভাল।
নিশাতে ঢুলতে ঢুলতে বাদশাহ্ বললেন, হাম উসে উন্দুলুস কা মালেকা বানায়েনগে। তুম সব চল যাও আওর ফ্লোরিডাকো ইহা ভেজ দো।
মুশির বলল, শাহান শাহে মোয়াজ্জম! বিপদের ব্যাপারে সতর্ক করা এবং মুসিবত থেকে আপনাকে বাঁচান আমার নৈতিক দায়িত্ব। যদিও এ দায়িত্ব আদায় করতে গিয়ে আমাকে প্রাণ দিতে হয়। হতে পারে ক্রোধান্বিত হয়ে আপনারই তলোয়ার কোষমুক্ত হয়ে আমার মাথা বদন থেকে জুদাহ করে দেবে, কিন্তু এতে আমার আত্মা শান্তি পাবে যে আমি আমার দায়িত্ব পালন করতে পেরেছি।
শাহ্ রডারিক বললেন, কিসের বিপদ? জুলিয়নের পক্ষ হতে আমার ওপর আবার কি মুসীবত আসবে? প্রথমত হতে পারে তার বেটী ফ্লোরিডা আমার স্বপ্নীল ভূবনে রাত্রি যাপনকে বড় সম্মানজনক মনে করবে,দ্বিতীয়তঃ তা যদি না হয় তাহলে সে তার বাপকে বলবে, তারপর জুলিয়ন আমার কি করতে পারবে? দু ইঞ্চি জমিনের মালিক আমাদের বিশটা সোয়ারীর মুকাবেলা করার কাবেল নয়। তার তাকত তো আমি। যদিও সে আরবি ও বর্বরদেরকে সিওয়াস্তাতে বাধা দিয়ে স্পেনের দিকে আসতে দিচ্ছে না তার কারণ তো এটাই যে তার পিঠের ওপর আমার হস্ত রয়েছে। যদি আমার সাহায্যের হাত গুটিয়ে নেই তাহলে আরব ও বর্বর মুসলমানরা তার কেল্লার প্রতিটি ইট চূর্ণ-বিচূর্ণ করে তার দুই বেটীকে দাসী বানিয়ে নিয়ে যাবে। আমি যদি তার বেটীকে কিছু সময়ের জন্যে আমার খাবগাহতে অবস্থান করাই তাহলে তার খোশ হওয়া উচিৎ। হতে পারে আমি তার বেটীকে আমার রাণী বানাব।
মুশীর : শাহানশাহে মোয়াজ্জম! আমি শুধু এটা বলতে চাচ্ছি যে, আমাদের তো শুধু দোস্ত পয়দা করা উচিৎ। দোস্তকে দুশমন বানানো উচিৎ নয়।
বাদশাহ্ রডারিক শাহী প্রতাপে বললেন, “তুমি কিছুই বুঝ না, যাও তাকে এখানে পাঠিয়ে দাও।”
শাহী প্রতাপ ও শরাবের নেশা, দুটো একত্রিত হয়ে রডারিকের মস্তিস্কের ওপর পর্দা ঢেলে দিয়েছিল। ছোট বাচ্চাকে বাবা ডাকলে যেমন খুশী ভরে দৌড়ে আসে ঠিক তেমনিভাবে আনন্দচিত্তে ফ্লোরিডা বাদশাহর খাবমহলে প্রবেশ করল। স্পেনের বাদশাহের আহ্বানকে সে হয়তো নিজের জন্যে মর্যাদাকর মনে করেছিল। কিন্তু সে কামরাতে প্রবেশ করার সাথে সাথে রডারিক তাকে বুকে জড়িয়ে ধরলেন।
ফ্লোরিডা বের হবার জন্যে বহুত চেষ্টা কোশেশ করল, ক্রন্দন করল, কিন্তু সেতো ছিল এক হিংস্র শক্তিশালী ক্ষুধাতুর হায়েনার থাবাতে। রডারিক কোনদিনও কল্পনা করতে পারেনি যে কোন মেয়ে তাকে এভাবে ভর্ৎসনা করতে পারে যে ভাবে ফ্লোরিডা ঘৃণা ভরে তাকে ভর্ৎসনা করছিল। রডারিক তাকে রাণী বানানোর লোভ দেখিয়ে ছিলেন কিন্তু ইযযত-আব্রু বিলিয়ে দিয়ে সে রানী হতে রাজী হয়নি।
রডারিক তাকে এ হুমকি দিয়ে ছিল যে, তিনি সিওয়াস্তার ওপর আক্রমণ করে তার বাবাসহ পুরো খান্দানকে টলেডোর অলি-গলিতে ভিক্ষা করতে বাধ্য করবে। ফ্লোরিডা বলেছিল, আসমান-জমিন সর্বত্র যদি আগুন লাগিয়ে দাও তবুও আমি আমার কুমারিত্ব খতম করতে পারব না।
স্পেনের ইতিহাসবেত্তারা সকলে এ ব্যাপারে ঐকমত্য যে ফ্লোরিডা কোন লোভে পড়েনি এমনিভাবে বাদশাহর কোন হুমকি-ধমকিকেও পাত্তা দেয়নি। সে তার কুমারিত্ব ও অনুঢ়ত্বের দোহায় দিচ্ছিল। কিন্তু শাহী প্রতাপ ও শরাব রডারিককে হিংস্র পশুতে পরিণত করেছিল। ফলে ষোল বছরের লাড়কী তার সতীত্ব ও কুমারিত্বকে হেফাজত করতে পারল না।
***
এটা ছিল রাতের প্রথম পহরের ঘটনা। অর্ধ রজনী অতিবাহিত হতেই হিজি বাধা বিপত্তিকে উপেক্ষা করে শাহী বাগিচার ঐ আঁধার প্রান্তে গিয়ে পৌঁছুল যেখানে সে ইতিপূর্বে দু’বার গিয়েছিল। বাগানের প্রান্ত দিয়ে ঝুঁকে ঝুঁকে ঐ জায়গায় উপস্থিত হলো যেখানে পূর্বে ফ্লোরিডার সাথে তার মিলন ঘটেছিল। ফ্লোরিডা তখনও আসেনি। তাকে বেশীক্ষণ অপেক্ষা করতে হলো না। একটা ছায়া মূর্তি ক্রমে তার দিকে অগ্রসর হচ্ছিল। কাছে আসতে আসতে তা এক রমণীল রূপ ধারণ করল। হিজি পূর্বের ন্যায় দু’তিন কদম তার দিকে অগ্রসর হলো কিন্তু ফ্লোরিডার চাল-চলনে বিন্দুমাত্র আবেগ ও আনন্দের ছোঁয়া ছিল না। প্রতিটি মিলন মুহূর্তের ন্যায় এবারও হিজি তার দু’হস্ত প্রসারিতকরে দিল কিন্তু ফ্লোরিডা তার বুকে যাওয়ার পরিবর্তে তা সজোরে সরিয়ে দিয়ে মুছা যাবার ন্যায় ঘাসের ওপর বসে পড়ল।
কি হয়েছে ফ্লোরা! হিজি ঘাবড়িয়ে ভয়ার্ত হয়ে জিজ্ঞেস করে তার কাছে গিয়ে বসল। নয়ন যুগল অশ্রু সাগরে ভাসিয়ে ফ্লোরিডা বলল, আমার কাছ থেকে দূরে থাক হিজি! আমার অপবিত্র কায়া স্পর্শ কর না, আমি তোমার উপযুক্ত নই। আমি আমার আত্মসম্মানী বাহাদুর বাবাকেও মুখ দেখানোর আর কাবেল নই। আমি আমার নিজেকেই ভর্ৎসনা করছি।
হিজি কম্পমান স্বরে বলল, কি হয়েছে তা খুলে বলতো ফ্লোরা!
ফ্লোরিডা তাকে পূর্ণ ঘটনা বর্ণনা করল।
ফ্লোরিডা ফুপাতে ফুপাতে বলল, আমার সতীত্ব-অনুঢ়ত্ব আমার সম্পদ ছিল। আমি নিজেকে কখনো শাহজাদী মনে করিনি। আমার যদি সম্রাজ্ঞী হবার অভিপ্রায় থাকতো তাহলে আমি আমার বাপের চারকের বেটার প্রেম সাগরে অবগাহন করতাম না।
ফ্লোরা! … হিজি উঠে দাঁড়িয়ে কাপড়ের নিচ থেকে খঞ্জর বের করে বললো, আমি বাদশাহর থেকে প্রতিশোধ গ্রহণ করব। তাকে হত্যা করে এখান থেকে চলে যাবার কোশেশ করব। যদি ধরাও পড়ি তবুও কোন পরওয়া নেই। তোমার। ইযযতের ওপর আনন্দে জীবন বিলিয়ে দেব।
ফ্লোরিডা তার সম্মুখে দু’হাত সম্প্রসারিত করে বলল, না হিজি! তুমি তার কাছে পৌঁছুতে পারবে না, তার পূর্বেই পাকড়াও হয়ে যাবে। আমি তোমাকে উদ্দেশ্যহীন মৃত্যু গহ্বরে যেতে দেবনা। তুমি এক কাজ কর, কোন বাহানায় সবচেয়ে ভাল অশ্ব নিয়ে প্রত্যূষে শহরের ফটক খুলতেই তুমি বেরিয়ে যাবে। যত দ্রুত যেতে পার যাবে এবং সিওয়াস্তা পৌঁছে আমার বাবাকে এ ঘটনা শুনাবে। তাকে বলবে তিনি এসে যেকোন বাহানায় যেন আমাকে নিয়ে যান। শাহ্ রডারিকের কাছে এমন কিছু যেন প্রকাশ না পায় যাতে সে বুঝতে পারে যে বাবা এ ঘটনা জানে। বাবা যদি রডারিকের সামনে সামান্যতমও গোস্বা প্রকাশ করেন তাহলে এ হতভাগা দুস্কৃতকারী বাদশাহ্ তাকে কতল করে ফেলবে। আর আমাকে আজীবনের জন্যে তার মহলে বন্দি করবে। রডারিক আমাকে গুরুতর হুমকি দিয়েছে। বাবাকে খুব ভাল করে বুঝিয়ে বলবে তা না হলে চিরতরে সিওয়াস্তা হারাতে হবে অধিকন্তু আমাদের খান্দানের অবস্থা অত্যন্ত ভয়াবহ হবে।
***
প্রথম দিন যে অবাধ্য ঘোড়া দ্বারা হিজির ইমতেহান নেয়া হয়েছিল, অতি প্রত্যূষে সে ঐ ঘোড়ার ওপরে জিন লাগাল। হিজি তাকে বাহিরে দৌড়ানোর বাহানায় নিয়ে গেল। কেল্লার ফটক খুলাছিল। কেল্লা থেকে বের হয়েই সে ঘোড়াকে পদাঘাত করল, ঘোড়া হাওয়ার তালে ছুটে চলল, তার সামনে টলেডো থেকে সমুদ্র পর্যন্ত (যেখানে জাবালুত ত্বারে অবস্থিত) পাঁচশত মাইলের রাস্তা। এত পরিমাণ রাস্তা দৌড়ে অতিক্রম করা ঘোড়ার জন্যে অতীব কষ্ট সাধ্য। তারপরও গোয়েন্দার হাত থেকে বাঁচার জন্যে হিজি পূর্ণ দ্রুত গতিতে ঘোড়া ছুটিয়ে ছিল।
অনেক দূর যাবার পর এক নদীর কুলে ঘোড়া থামিয়ে ঘোড়াকে পানি পান করাল। কিছুক্ষণ বিশ্রাম গ্রহণ করার পর হিজি সাধারণ গতিতে ঘোড়া ছুটাল। রাতেও সে অবিরাম গতিতে সফর করছিল। যৎ সামান্য আরাম করা ছাড়া সারাক্ষণ, সফর করার ফলে দীর্ঘ পাঁচশত মাইল রাস্তা মাত্র চার দিনে অতিক্রম করল।
সম্মুখে সমুদ্র। সিওয়াস্তা যাবার জন্যে কোন কিশতী তৈরী নয়। দু’তিন দিনের মধ্যে কোন কিশতী সে দিকে যাবার ছিল না। এক পাল তোলা নৌকার মাঝিরা হিজিকে একা নিয়ে যাবার জন্যে এত পরিমাণ পয়সা দাবি করল যা তার কাছে ছিল না।
হিজি নৌকার মাল্লাদের উদ্দেশ্যে বলল, এ ঘোড়া তোমাদের কিশতীর চেয়ে অনেক কিমতী। এটা তোমরা রেখে দিয়ে আমাকে সিওয়াস্তার সীমানায় পৌঁছে দাও।
মাল্লা : আমরা মাঝি-মাল্লা। আমরা ঘোড়া কি করব। আমাদের নিজের ও ছেলে-পুলের পেটের অন্ন যুগাতেই আমরা অক্ষম। ঘোড়াকে খিলাব কোথা থেকে?
হিজিঃ এটা বিক্রি করে তোমরা তোমাদের পয়সা নিয়ে নিবে।
মাল্লা : আমরা ঘোড়ার সওদাগীরি সম্পর্কে ওয়াকিফ নই।
হিজি : তাহলে আমাকে বিশ্বাস কর। আমাকে নিয়ে চল, ওপার গিয়ে কেরায়ার পয়সাও দেব সাথে ইনয়ামও পাবে।
মাঝিরা তার সেকেল-ছুরত, শরীরের কাঠাম, পোষাক-পরিচ্ছেদ ও ঘোড়া দেখে তাকে অফিসার মনে করল ফলে ঘোড়াসহ তাকে কিশতিতে তুলে নৌকার পাল তুলে দিল।
সমুদ্র সফর ছিল বার মাইল। সূর্য মনি রক্তিম আভা ছড়িয়ে বিদায় নেয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছিল এমন সময় হিজির কিশতী সিওয়াস্তার তীরে গিয়ে ভীড়ল। হিজি মাল্লাদেরকে সাথে নিয়ে সোজা জুলিয়নের মহলে পৌঁছে ফটকের সিপাহীকে বলল, গভর্নর জুলিয়নকে অতি দ্রুত গিয়ে বল, আমি টলেড়ো হতে শাহ্জাদী ফ্লোরিডার জরুরী পয়গাম নিয়ে এসেছি।
জুলিয়ন তাকে তাৎক্ষণিক আহ্বান করল, কারণ সে তার বেটীর খবরের জন্যে বেকারার ছিল।
***
জুলিয়ন তাকে দেখেই জিজ্ঞেস করল তুমি ফৌরইয়ারকের বেটা না?
হিজি : হ্যাঁ গভর্নর! আমি তার বেটা।
জুলিয়ন : তুমি কি টলেডো থেকে এসেছ? তোমার বাবাকে না বলে চলে গিয়েছিলে?
হিজি : জি হ্যাঁ। এখানে একঘেঁয়েমী লাগছিল তাই স্পেন সফরে বেরিয়ে ছিলাম। তবে মুহতারাম গভর্নর! আমার গায়েব হয়ে যাওয়া বা ফিরে আসা এটা আপনার জন্যে কোন জরুরী বিষয় নয়। আমি যে পয়গাম নিয়ে এসেছি সেটা খুবই জরুরী। আগে একটা আবেদন শুনুন। আমি যে কিশতীতে এসেছি তার কেরায়া দিতে পারিনি, মাল্লা সাথে এসেছে, তাকে কেরায়া দিতে হবে।
জুলিয়ন কেরায়া ও ইনয়াম দেয়ার হুকুম দিয়ে হিজিকে জিজ্ঞেস করল, তার বেটী কি পয়গাম পাঠিয়েছে।
হিজি পয়গাম শুনানোর সাথে সাথে জুলিয়ন উঠে দাঁড়িয়ে গেল। তার সারা শরীরের খুন যেন চেহারা ও চোখে জমা হয়ে গেল। সে ক্রোধ ও ক্ষোভে কামরার মাঝে দ্রুত পায়চারী করতে লাগল।
হিজি : শাহ্জাদীর সাথে ইত্তেফাঁকান আমার মুলাকাত হয়ে গিয়েছিল। সে আমাকে এ ঘটনা শুনানোর পর আমি বাদশাহ্ রডারিককে হত্যার জন্যে প্রস্তুত হয়ে গিয়েছিলাম কিন্তু শাহ্জাদী আমাকে এই বলে বাধা দিল যে, আমি তার কাছে পৌঁছতে পারব না গ্রেফতার হয়ে যাব। আমি সেখানের শাহী আস্তাবলের ঘোড়া চুরি করে এ নাগাদ এসেছি।
জুলিয়ন : শাহজাদী ঠিক বলেছিল, এ বাদশাহকে হত্যা করা মুশকিল নয়। আমি তার প্রতিশোধ নেব, তুমি যাও।
জুলিয়ন তার এলাকার বাদশাহ ছিল যদিও তার এলাকা ছোট ছিল এবং সে স্পেনের বাদশাহ্ রডারিকের জায়গীরদার ছিল তবুও তার অবস্থান বাদশাহর মত ছিল। ফলে সে একজন চাকরের সাথে এ ব্যাপারে আলোচনা-পর্যালোচনা সমীচীন মনে করছিল না। সে হিজির জন্যে কিছু ইনয়াম পেশ করল।
হিজি : না জনাব! ইনয়াম কোন কৃতিত্বের জন্যে? আমাকে অনুমতি দিন আমি স্পেন গিয়ে বাদশাহ রডারিকের হত্যার মওকা তালাশ করব। আমার খান্দান আপনার নিমক খেয়েছে। আমি সে নিমক হালাল করতে চাই। আপনার ইযযত আমাদের ইযযত।
জুলিয়ন : হিজি! তুমি যাও। আগে আমাকে চিন্তা করতে দাও। তুমি চিন্তা ফিকির না করে এবং আমাকে কিছু না বলে কিছুই করবে না।
ঐতিহাসিকরা লেখেন, জুলিয়নের মত জায়গীরদাররা রডারিকের মত শক্তিধর বাদশাহকে খুশী করার জন্যে স্বীয় ললনাদের দিয়ে দিত কিন্তু জুলিয়ন আত্মমর্যাদাশীল ছিল ফলে তার বেটীর সতীত্ব হরণ তাকে পাগল বানিয়ে দিল। সে সাথে সাথে টলেডো থেকে নিজ কন্যা ফিরিয়ে আনার সিদ্ধান্ত নিল।
সকল ঐতিহাসিকদের বর্ণনা মুতাবেক জুলিয়ন কিছু তুহফা নিয়ে টলেডোতে গিয়ে বাদশাহ রডারিকের সাথে এমন নিষ্ঠা ও প্রীতির সাথে সাক্ষাৎ করল, যেন সে তার মেয়ের ইযযত হরণের ব্যাপারে কিছুই জ্ঞাত নয়। সে তার আচার-ব্যবহার ও কথাবার্তা এমনভাবে পেশ করল যে বাদশাহর মঙ্গলকামী হয়ে তার হাল অবস্থা জানার জন্যে সাক্ষাৎ করতে এসেছে।
বাদশাহ্ রডারিক যখন বুঝতে পারলেন, জুলিয়ন তার মেয়ের ব্যাপারে কিছুই অবগত নয় তখন সে জুলিয়নের মত ছোট ছোট জায়গীরদারদের সাথে যে ব্যবহার ও সম্মান করে তার চেয়ে অনেক বেশী সম্মান ও ইযযত জুলিয়নকে করলেন, তার সম্মানে বাদশাহ্ (অনেক বড়) বিশাল অনুষ্ঠানের আয়োজন করলেন যাতে নৃত্য ও সংগীতের ব্যবস্থা ছিল। সে অনুষ্ঠানে ফ্লোরিডা তার বাবার সাথে বসে রডারিক তার সাথে কি আচরণ করেছেন এবং তাকে হুমকি দিয়েছেন তা বর্ণনা করল।
জুলিয়ন : আমাদের আস্তাবলের হাকীম ফৌরইয়াডরকের বেটা হিজি তোমার ঘটনা বিস্তারিতভাবে আমার কাছে বর্ণনা করেছে। রডারিকের সামনে আমি নাজানার ভান করেছি। তোমাকে নিয়ে যাচ্ছি তার পর এমন প্রতিশোধ নেব যাতে তার শাহী মসনদ মাটির সাথে মিশে যাবে।
পরের দিন বাদশাহ রডারিক জুলিয়ন তার দরবারে আসার দরুন তাকে বিশেষ সম্মানে ভূষিত করলেন এবং নিয়ান্তার প্রতিরক্ষার ব্যাপারে আলোচনা করলেন।
রডারিক জুলিয়নকে জিজ্ঞেস করলেন, মুসলমানরা পরে মনে হয় সিওয়াস্তার ওপর হামলার হিম্মত করেনি?
জুলিয়ন : না। সিওয়স্তার কেল্লার মজবুত দেয়ালে মাথা টুকে টুকে মস্তকচূর্ণ করে ফেলেছে। তারা অনুধাবন করতে পেরেছে যে সিওয়াস্তার ওপর স্পেনের মহারাজের অপাজেয় যুদ্ধ শক্তির ছায়া রয়েছে। এখন তারা সিওয়াস্তার দিকে ফিরে তাকাতেও সাহস পায় না।
রডারিক : তোমার বেটী ফ্লোরিডা কেবল খুবসুরতই নয় দানেশমন্দ ও বাহাদুরও বটে। তাকে কোন সাধারণ ব্যক্তির কাছে অর্পণ করো না। আমি তার তরবিয়তে খুবই মুগ্ধ।
এটা আমার বড়ই সৌভাগ্য। জুলিয়ন গোলামের মত বলল, কিছু দিনের জন্যে ফ্লোরিডাকে আমার সাথে নিয়ে যাচ্ছি।
রডারিক : না নিয়ে যাওয়াই ভাল।
জুলিয়ন মিথ্যে বলল, তার মা ভীষণ বিমার হয়ে পড়েছে। সেই আমাকে পাঠিয়েছে। বলছিল, দু’তিন দিনের জন্যে ফ্লোরিডাকে নিয়ে আস, মায়ের স্নেহ মহব্বত আমি লুকিয়ে রাখতে পারছিনে। দু’তিন পরে আবার বেটীকে পাঠিয়ে দেব।
রডারিক শান্তনার শ্বাস নিয়ে বললেন, পাঠিয়ে দেবে! তাহলে নিয়ে যাও।
স্বয়ং ফ্লোরিডা বলছিল সে তাড়াতাড়ি ফিরে আসতে চায়। জুলিয়ন আবার মিথ্যে বলল।
রডারিক : তোমার বেটী অবশ্যই ফিরে আসতে চাবে।
ঐতিহাসিকরা জুলিয়ন ও রডারিকের এক মজাদার আলোচনার কথা উল্লেখ করেছেন।
রডারিক : আচ্ছা জুলিয়ন! তোমাদের এলাকায়তত ভাল বাজ পাখি পাওয়া যায়, শিকারের জন্যে আমার বাজ পাখী দরকার।
জুলিয়ন : হ্যাঁ শাহানশাহে উন্দুলুস! আমি আপনার জন্যে এমন বাজ পাঠাব যা ইতিপূর্বে আপনি দেখেননি। তা শিকারের প্রতি এমনভাবে ধাবিত হয় যে তাকে বাঁচার কোন অবকাশ দেয় না।
জুলিয়নের একথা যে ঐতিহাসিকরা লেখেছেন, তারা বলেন, এ দ্বারা প্রতীয়মান হয় যে জুলিয়ন সে সময়ই স্থির করেছিল যে, রডারিকের প্রতিশোধের জন্যে স্পেনের উপর হামলার ব্যাপারে মুসলমানদেরকে উদ্বুদ্ধ করবে।
জুলিয়ন ফ্লোরিড়াকে সিওয়াস্তাতে নিয়ে এলো এবং পরের দিনই মুসা ইবনে নুসাইরের সাথে সাক্ষাতের জন্যে বেরিয়ে পড়ল।
***
মুসা ইবনে নুসাইর সতর্কতা অবলম্বনকে খুব জরুরী মনে করতেন। তিনি বিশ্বাস করতে পারছিলেন না যে, এক খ্রীষ্টান বাদশাহ্ অপর খ্রীষ্টান বাদশাহর ওপর মুসলমান দ্বারা আক্রমণ করাবে। তিনি ভাবছিলেন, এটা কোন ফন্দি হতে পারে। এ কারণে তিনি জুলিয়নকে কোন শান্তনা দায়ক জওয়াব দিচ্ছিলেন না।
জুলিয়ন : আপনি বিশ্বাস না করেন তাহলে আমার বেটী ফ্লোরিডাকে উপস্থিত করব, আপনি তাকে জিজ্ঞেস করবেন।
মুসা : আমি হিজি নামের ঐ ব্যক্তির সাথে কথা বলতে চাই, তাকে আমার কাসেদ নিয়ে আসবে। আসার আগ পর্যন্ত তুমি তোমার সাথে আগত অফিসারসহ আমার মেহমান হিসেবে থাকবে।
সে মুহূর্তেই একজন কাসেদ হিজিকে আনার জন্যে সিওয়াস্তা পাঠিয়ে দেয়া হলো। সে সময় জুলিয়ন মুসা ইবনে নুসাইরকে স্পেন ও রডারিক সম্পর্কে অনেক কথা বলেছিল, যা আজও ইতিহাসের পাতায় লিপিবদ্ধ রয়েছে।
জুলিয়ন : মুসা! রডারিকের ব্যাপারে দুশমনি আমার অন্তরে আজ নতুন সৃষ্টি হয়নি। এ দুশমনি অনেক পুরাতন। তুমি হয়তো জান স্পেনে গোথাদের রাজত্ব ছিল। রডারিক ছিল স্পেন ফৌজের সিপাহসালার। ডেজা নামের এক গোথা ছিল স্পেনের বাদশাহ্। সে সৃষ্টিগতভাবে নেক ইনসান ছিল। পাদ্রীরা ধর্মের আড়ালে বিপুল পরিমাণ ধন-সম্পদ জমা করে বিলাস বহুল জীবন যাপন করছিল। গীর্জা পরিণত হয়েছিল পাপের আড্ডা খানায়…
আর মূসা! পোপদের নির্দেশে সবকিছু হতো। পাদ্রীরা নিজ ইচ্ছেমত চলা ফেরা করত। যেহেতু তারা ধর্মগুরু ছিল এ কারণে সাধারণ ফৌজ ও জনগণ তাদেরকে সম্মান করত। বাদশাহও তাদের বিরুদ্ধে কিছু বলতে ভয় পেতেন। জীবন ব্যবস্থা এমন ছিল যে ধনী দিন বদিন ধনের পাহাড় গড়ে তুলছিল আর দরিদ্র ক্রমে হচ্ছিল নিঃস্ব থেকে নিঃস্বতর। প্রজারা মূলতঃ ছিল শাহী খান্দানের গোলাম। শ্রমিকদেরকে বেগার খাটান হতো বা একেবারে যৎসামান্য পারিশ্রমিক দেয়া হতো। জনসাধারণের জন্যে কঠিন শাস্তি নির্ধারিত ছিল যা সামান্যতম অপরাধেই প্রয়োগ করা হতো। জনগণের ওপর এত পরিমাণ কর আরোপ করা হয়েছিল যুদ্বরুণ তারা ক্ষুধার্ত দিন গুজরাত, অপর দিকে জনতার পয়সায় শাহী খাজানা ভরে উঠত। সে সম্পদ শাহী খান্দানের বিলাসীতা ও আরাম-আয়েশের পিছনে হতো ব্যয়।
ডেজা তখত নাসীন হলেন, আমার বিবি তারই বেটী। ডেজার অন্তরে ধর্মের ইহতেরাম ও আওয়ামের মহব্বত ছিল। তিনি তখত নাসীন হয়েই গীর্জা ও পাদ্রীদের প্রতি দৃষ্টি দিলেন। গীর্জাকে পাপের আড্ডা থেকে মুক্ত করলেন। তারপর তিনি নজর দিলেন ঐ সকল রাঘব বোয়ালদের দিকে যারা আওয়ামকে ভুখা-নাংগা রেখে তাবৎ সম্পদ জমা করত নিজ উদরে। তিনি সাধারণ জনতার ওপর থেকে কর উঠিয়ে তা আরোপ করলেন ধনীদের ওপর। তিনি সম্পদশালীদের সম্পদের পুংখানুপুংখ হিসেব-নিকেস করে নতুনভাবে তার উপর ট্যাক্স আরোপ করে তা আদায়ে বাধ্য করে ছিলেন। এভাবে ক্রমে সাধারণ জনগণের মাঝে শান্তি ফিরে আসছিল।…..
ধর্মগুরু, আমীর ওমারা, জায়গীরদার যে সম্পদ আম জনতাকে শোষণ করে জমা করেছে তা আবার তাদের হাতে ফিরে যাবে এটা মেনে নেয়া তাদের জন্যে খুবই কষ্টসাধ্য বিষয় ছিল, তাই পাদ্রীরা এক্ষেত্রে ধর্মকে ব্যবহার করে ফৌজের মাঝে এ প্রোপাগাণ্ডা ছড়িয়ে তাদের ক্ষেপিয়ে তুলল যে বাদশাহ্ ডেজা ধর্মের ব্যাপারে নাক গলিয়ে ধর্মগুরুদেরকে স্বীয় গোলাম বানানোর চেষ্টা করছে। ফৌজ বাদশাহর বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে বসল, আর সে বিদ্রোহীদের নেতা ছিল রডারিক। ডেজার ওফাদার ফৌজ খুব স্বল্পই রইল, যারা রইল তারা বিদ্রোহীদের সাথে বেশীক্ষণ যুদ্ধ করতে পারল না। বিদ্রোহীরা বিজয়ার্জন করল। পাদ্রীরা রডারিককে শাহী মসনদে সমাসীন করল। সে মসনদে বসেই ডেজাকে কতল করার নির্দেশ দিল। সুতরাং তাকে কতল করা হল। তারপর আমীর ওমারা, শাহী খান্দান ও জায়গীরদার আবার বিলাসীতায় ডুবে গেল……
মুসা! আমি তোমাকে আশ্বাস দিচ্ছি তুমি যদি স্পেন আক্রমণ কর তাহলে সেখানে সাধারণ জনগণ তাদের বিলাসী ও জালেম বাদশাহ্ এবং জেনারেলদেরকে ত্যাগ করবে। হতে পারে ফৌজও হয়তো রডারিকের ডাকে সাড়া দিবে না। তোমার ফৌজ যদি স্পৃহা-উদ্দীপনা নিয়ে লড়াই করে তাহলে স্পেন সৈন্য অতিদ্রুত ময়দান হতে পলায়নপদ হবে।
এ নাগাদ মুসা ইবনে নুসাইর তাকে কোন ফায়সালা শুনাননি।
***
চার-পাঁচদিন পর হিজি মুসার কাসেদের সাথে এসে পৌঁছল। সম্মানিত মেহমানের ন্যায় তার প্রতি সম্মান প্রদর্শন করে তাকে মুসার কাছে পৌঁছে দেয়া হল। ফ্লোরিডার সাথে যে হিজির পাগলপারা প্রেমের সম্পর্ক রয়েছে সে কথা হিজি ফ্লোরিডার বাবাকে বলেনি। ফ্লোরিডার বিরহে সে যে উম্মাদ হয়ে চুপিসারে সংগোপনে টলেডো গিয়েছিল সে কথাও প্রকাশ করেনি। সে জুলিয়নকে বলেছিল সিওয়াস্তার পরিবেশ এক ঘেয়েমী হয়ে উঠেছিল তাই সে ভ্রমণে বেরিয়েছিল। ফ্লোরিডার সাথে তার প্রেম, মুলাকাত, তার বিরহে অস্থির হয়ে টলেডো গমন, সেখানে ফ্লোরিডার সাথে একান্তে মিলন এবং ফ্লোরিডার প্রতি রডারিকের বাড়াবাড়ি, তাবৎ দাস্তান হিজি মুসার কাছে বর্ণনা দিল। যার বর্ণনা পূর্বে দেয়া হয়েছে।
মুসা হিজিকে নানা বিষয়ে সওয়াল করলেন, হিজি হার সওয়ালের জওয়াব দিল। সওয়াল-জওয়াবের মাধ্যমে মুসা তার সকল শক-সুবাহ্ দূর করে হিজিকে মেহমান খানায় পাঠিয়ে দিয়ে জুলিয়নকে তলব করলেন।
মুসা ইবনে নুসাইর; মেরে ভাই জুলিয়ন! আমি তোমার প্রতিটি কথা ও প্রীতির সম্পর্ক গড়ে তোলার আবেদনের প্রতি গভীরভাবে চিন্তা-ফিকির করেছি। সালার, হাকীম ও মুসিরদের সাথে সলাপরামর্শ করেছি। তোমাকে পূর্ণ মাত্রায় বিশ্বাস করছি তবে এতবড় গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে ফায়সালা গ্রহণের ব্যাপারে আমি স্বক্ৰীয় নই। স্পেন কোন ছোট-খাটো মুলুক নয় তেমনিভাবে তার ফৌজও কোন মামুলী ফৌজ নয়। আমি খলীফার থেকে ইয়াজত তলব করব, আজই খলীফার কাছে পয়গাম দিয়ে কাসেদ দামেস্কে পাঠাব। তোমাকে খলীফার জওয়াবের ইনতেজার করতে হবে। কাসেদ, অত্যন্ত দ্রুত গতি সম্পন্ন হবে আর যে দীর্ঘ সফর….. এক মাস তো। লাগবেই….. কাসেদ হয়তো দু’চার দিন আগেও ফিরে আসতে পারে। তুমি এখন ফিরে যাও, পঁচিশ-ছাব্বিশ দিন পরে এসো বা আমিই তোমাকে খবর দিয়ে তলব করব।
মুসা জুলিয়নকে রসুত করে কাতেবকে ডেকে খলীফার কাছে এক দীর্ঘ পয়গাম লেখালেন। জুলিয়নের অভিপ্রায়ের কথা বিস্তারিতভাবে বর্ণনা করলেন। সে সময় খেলাফতের মসনদে সমাসীন ছিলেন ওয়ালীদ ইবনে আব্দুল মালেক যিনি যথার্থ অর্থে ছিলেন একজন মর্দে মুমিন। ইসলামের মায়াবী বাণী সমুদ্রের ওপারে পৌঁছানোর জন্যে তিনি ছিলেন পাগল পারা। সে সময়ই তিনি মুহাম্মদ ইবনে কাসেমকে হিন্দুস্থান পাঠিয়ে ছিলেন। হাজ্জাজ ইবনে ইউসুফ ছিলেন তার ডান হস্ত।
মুসা জুলিয়নের তামাম কথা উল্লেখ করার পর লেখলেন,
জুলিয়ন তো ঘটনাক্রমে আমাদের থলীতে এসেছে, আমি আমার অন্তরের কথা বলছি, আমার নয়নযুগল আজ দীর্ঘদিন স্পেনের প্রতি নিবদ্ধ রয়েছে। ইসলামের পয়গাম মিসর ও আফ্রিকার সীমান্তে এসে দাঁড়িয়ে গেছে। আমি কয়েকবার সীমান্তে দাঁড়িয়ে স্পেনের দিকে লক্ষ্য করেছি এবং সমুদ্রের বুকচিরে তার ওপর হামলার পরিকল্পনা করেছি…..।
ইদানিং এক খ্রীষ্টান গভর্নর সাহায্যের প্রস্তাব করেছে ফলে আপনি সবদিক বিবেচনা করে আমাকে স্পেন অভিমুখে অগ্রসর হবার অনুমতি দিবেন। আরেকটা বিষয়ে আপনি ফিকির করবেন, তাহলে আমার কাছে যে ফৌজ রয়েছে তারা। সকলেই প্রায় বর্বর। বর্বররা খুনখার কওম। তাদের ফৌজকে আমি নিয়ম-শৃংখলার বাধ্যবাধকতা আরোপ করেছি কিন্তু তারা স্থিরভাবে বসার লোক নয়। তাদেরকে বেশীদিন নিয়ম-শৃংখলার রশিতে বেধে রাখা যায় না। তাদেরকে যদি বেশীদিন বেকার রাখা হয় তারা পরস্পরে লড়াই শুরু করবে অথবা নিয়ম কানুনের ব্যাপারে বিদ্রোহী হয়ে উঠবে এমনকি ইসলামের ব্যাপারেও বিদ্রোহ করতে পারে।
খলীফাতুল মুসলিমীন! আমি তাদেরকে সিওয়াস্তার ওপর হামলা, অবরোধ ইত্যাদি কাজে নিয়োজিত রেখেছিলাম কিন্তু বেশ কিছুদিন হলো তাও বন্ধ। এখন জরুরী তাদেরকে কোন একটা যুদ্ধের ময়দানে নিয়ে যাওয়া যাতে তারা যুদ্ধ বিগ্রহের নেশা মিটাতে পারে। তাছাড়া আরেকটা কারণ রয়েছে, তাদের পূর্ণ মুমিন ও মুজাহিদ হিসেবে গড়ে তোলার জন্যে বড় প্রয়োজন স্পেন অভিমুখে রওনা করা, যাতে তারা কুফরস্থানে গিয়ে বিজয় অর্জন করে ইসলামের চির সুন্দর মহিমা প্রচার। প্রসার করবে, ফলে ক্রমে ইসলাম তাদের শিরা-উপশিরা ও অন্তরের গভীরতম প্রদেশে স্থান করে নিবে।
***
কাসেদ অনেকদিন পর খলীফা ওয়ালীদ ইবনে আব্দুল মালেকের জওয়াব নিয়ে ফিরে এলো। জওয়াব ইতিবাচক ছিল। তবে খলীফা খুব তাগিদ দিয়ে লেখেছেন সতর্কতাবলম্বন খুবই জরুরী। যেসব লোক ইসলামের গন্ডির বাইরে তাদের ওপর পূর্ণ ভরসা ও বিশ্বাস করা শংকা মুক্ত নয়। সতর্কতার ব্যাপারে খলীফা লৈখেছেন, জুলিয়নকে ভালভাবে ইমতেহান করার জন্যে, যদি সে ইমতেহানে কামিয়াব হয় তাহলে দামেস্কে খবর দিবে এখান থেকে প্রয়োজনীয় ফৌজ ও সামানাদি পাঠান হবে।
মুসা ইবনে নুসাইর খলীফার জওয়াব পরামর্শ সভাতে পড়ে শুনিয়ে সকলের থেকে মশওরা তলব করলেন। আরবদের মেধা-ধীশক্তি সর্বজন স্বীকৃত। কিছুক্ষণ আলোচনা-পর্যালোচনার পর জুলিয়নকে পরীক্ষা করার একটা পদ্ধতি তারা করলেন। জুলিয়নকে আসার পয়গাম দেয়ার জন্যে একজন দূত সিওয়াস্তা পাঠিয়ে দেয়া হল।
জুলিয়নতো এ পয়গামের অপেক্ষাতেই ছিল। পয়গাম পাওয়া মাত্র রওয়ানার জন্যে প্রস্তুত হল। সিওয়াস্তাতে অবস্থানরত ডেজার ভাই আওপাসকে সাথে নিল। তাদের সাথে সৈন্যবাহিনীর এক বড় অফিসার ও একশত জনের এক নিরাপত্তা বাহিনী ছিল।
এ শাহী কাফেলা সফর শেষে মুসার রাজধানী কায়রোতে পৌঁছার পর জুলিয়ন কিছুক্ষণ বিশ্রাম নিয়ে মুসার সাথে সাক্ষাৎ করে। ইতিহাস প্রমাণ করে ঐ মুলাকাতে ডেজার ভাই আওপাস ও জুলিয়নের সৈন্য বাহিনীর সিনিয়র অফিসারও ছিল। এটা। একটা ঐতিহাসিক মুলাকাত ছিল। এ মুলাকাতের মাধ্যমেই মুসলমানদের জন্যে স্পেনের দ্বার উন্মুক্ত হয়।
মুসা ইবনে নুসাইর : মেরে ভাই জুলিয়ন! দামেস্ক থেকে ইযাজত এসেছে তবে এ শর্তে যে, তোমাকে এটা প্রমাণ করতে হবে, বাদশাহ্ রডারিকের সাথে তোমার এমন দুশমনি রয়েছে, পরিবেশ যতই অনুকূলে আসুক সে দুশমনি খতম করে তাকে তুমি বন্ধু হিসেবে গ্রহণ করবে না।
জুলিয়ন : তা প্রমাণ করার জন্যে কোন তরীকা তুমিই বলে দাও। আমি তো প্রহর গুনছি। ঐ হতভাগা রডারিক থেকে আমার বেইযতির প্রতিশোধ কবে গ্রহণ করব।
আওপাস : আমীরে মুহতারাম! আমার ঐ ভাইয়ের রূহ আমাকে রাত্রে ঘুমাতে দেয় না যার বিরুদ্ধে রডারিক বিদ্রোহ করে তার বাদশাহী মসনদ তছনছ করে নিজে শাহী তখতে বসেছে আর আমার ভাইকে করিয়েছে হত্যা। এখন সে আবার আমাদের খান্দানের ওপর কালিমা লেপন করেছে। আমাদের পরিস্থিতির স্বীকার যদি আপনি হতেন তাহলে প্রতিশোধ নেয়ার জন্যে একদিন অপেক্ষা করাও আপনার। পক্ষে সম্ভব হতো না। আর যদি আপনার মত বিপুল সংখ্যক ফৌজ আমাদের থাকত তাহলে মদদের ভিখ মাগার জন্যে আপনার দ্বারে আসতাম না।
মুসা : আর ইন্তেজার করব না। জুলিয়ন! এক কাজ কর, তোমার সৈন্য সামন্ত্র নিয়ে সমুদ্র পার হয়ে রাতের আঁধারে স্পেনের সীমান্তবর্তী কোন এলাকা আক্রমণ কর এবং স্পেনের ফৌজী বাহিনী আসার পূর্বেই ফিরে আস। এটা একটা প্রমাণ হবে যদ্বারা আমি বুঝতে পারব, সত্যিই তুমি রডারিককে দুশমন জ্ঞান কর। আমি তোমার প্রতিশোধ স্পৃহা দেখতে চাই।
জুলিয়ন : আর সেখানে যদি তাদের বিপুল সংখ্যক ফৌজের সাথে মুকাবালা হয় বা আমার ফৌজ যদি কোন বিপদে পড়ে তাহলে পরিস্থিতি কি হবে?
মুসা : তোমাকে বিপদের সম্মুখীন হতে দেব না, আমার ফৌজী বাহিনী সমুদ্র। পাড়ে অবস্থান করবে। আমি পয়গাম পৌঁছার এমন ইন্তেজাম করব যদি তোমার সৈন্য কোন বিপদের সম্মুখীন হয় তাহলে ফাওরান আমি সংবাদ পাব ফলে আমার ফৌজ তোমার মদদে পৌঁছে যাবে।
জুলিয়ন ও আওপাস ফাওরান রেজামন্দি জহের করল এবং মুসার সাথে পরামর্শ করে স্পেনের এক সীমান্তবর্তী এলাকার ওপর হামলার প্লান তৈরি করে তারা দুজন তখনই সিওয়াস্তা অভিমুখে রওনা হয়ে গেল।
মুসা ইবনে নুসাইর জেনারেল আবু জুরয়া তুরাইফ ইবনে মালেক আল-মুয়াফিরী এর নেতৃত্বে একদল ফৌজকে এ নির্দেশ দিয়ে পাঠালেন যে, তারা যেন সিওয়াস্তার উপকণ্ঠে গিয়ে তাবু ফেলে অবস্থান করতে থাকে। তার পর জুলিয়ন যখন তার ফৌজ, স্পেনের দিকে প্রেরণ করবে তখন আবু তুরাইফ তার ফৌজ প্রস্তুত করে সিওয়াস্তার সীমানা পাড়ে গিয়ে পৌঁছুবে।
সালার তুরাইফ যখন তার ফৌজ সহ সিওয়াস্তার নিকটে পৌঁছুলেন তখন জুলিয়ন কেল্লা হতে বেরিয়ে এসে তাকে শাহী ইস্তেকবাল করে নিবেদন করল তিনি যেন কেল্লার অভ্যন্তরে তার কামরাতে একা অবস্থান করেন।
সালার তুরাইফ : নওয়াব জুলিয়ন! আমাদের একজন জেনারেল সে নিজেকে তার একজন মামুলী ফৌজের চেয়ে বেশি মর্যাদাবান মনে করেনা, তাই তার পৃথক কামরাতে অবস্থান করার কোন প্রয়োজন নেই। যুদ্ধের ময়দানে সালার আর সিপাহী সমান। আমাদের ধর্ম উঁচু-নিচু মানে না। আপনি যদি আমাদেরকে নামাজ পড়তে দেখেন তাহলে নির্ণয় করতে পারবেন না, কাতার বন্দিভাবে দাঁড়ান সে মুসলমানদের মাঝে কে সেনাপতি আর কে সিপাহী। এমনও হয় যে আমাদের সিপাহীরা আগে আর আমরা থাকি পিছনে। তবে ইমামতি করার সৌভাগ্য লাভ করে সেনাপতি।
জুলিয়ন অত্যন্ত আবেগের সাথে বলল, আপনি স্পেন বিজয় করবেন, আপনি যা বর্ণনা করলেন সেটাই ইসলামের মৌল শক্তি। আমাদের সেনাপতি সিপাহীকে নিজের গোলাম মনে করে….. তারপরও আমার মহলের দরজা আপনার জন্যে উন্মুক্ত।
অতঃপর একদিন সে রজনী সমাগত হলো যে রজনীতে জুলিয়নের ফৌজ সিওয়াস্তার সমুদ্র তীর হতে পাল তোলা কাশতীতে সোয়ার হচ্ছিল অপর দিকে সালার তুরাইফের সৈন্যদল সমুদ্রকুলে পৌঁছে গিয়ে ছিল।
***
সমুদ্র সফর মাত্র বার মাইল ছিল। জুলিয়নের যুদ্ধ নৌকার মাল্লারা ছিল অত্যন্ত অভিজ্ঞ। সমুদ্র পূর্ণ শান্ত, বাতাস প্রবাহিত হচ্ছিল অনুকূলে। নির্ধারিত সময়ের পূর্বেই জুলিয়নের সৈন্যবাহিনী স্পেন তীরে পৌঁছে গিয়ে ছিল। কামান ছিল আওপাসের হাতে।
জুলিয়ন ছিল সমুদ্র তীরে দাঁড়িয়ে। তার সাথে ছিল বিবি ও দুই বেটী ফ্লোরিডা ও মেরী। ফৌজ রওনা হওয়া পর্যন্ত ফ্লোরিডা বাবার কাছে একটা বিষয় বারবার উত্থাপন করছিল। সে পুরুষের লেবাস পরে ফৌজের সাথে স্পেন যাবার জন্যে জিদ ধরেছিল। সে তার বাবার লেবাস বের করে এনেছিল। ঢাল-তলোয়ার নিয়ে পূর্ণ। প্রস্তুত হয়েছিল। কিন্তু জুলিয়ন তাকে যাবার অনুমতি দিচ্ছিল না, মা-ও বাধা দিচ্ছিলেন।
ফ্লোরিডা চিৎকার করে বলছিল, “আমি কি শাহ্ সোয়ার নই? বর্শা-তলোয়ার আমি কি চালাতে পারি না? আমার নিক্ষিপ্ত তীর কি লক্ষ্য ভ্রষ্ট হয়?”
বাবা-মা তাকে বলছিলেন, তুমি সবকিছু ঠিকমত জান কিন্তু দুশমন যখন তলোয়ার-বর্শা নিয়ে সম্মুখে আসে তখন নিজের তলোয়ার বর্শা ঠিকমত চালনা করা মুশকিল হয়ে যায় এবং নিক্ষিপ্ত তীর তখন লক্ষ্যভ্রষ্ট হতে থাকে। লড়না আওর মরনা এ দু’ননা মর্দোকা কাম হায়।
ফ্লোরিডা : বেআব্রু আমি হয়েছি, তাই স্পেনের ওপর প্রথম আক্রমণে অন্তত আমাকে শরীক হতে দিন।
বাবা তাকে এ ওয়াদা দিয়ে বিরত রাখলেন যে, মুসলমানরা স্পেন আক্রমণ করে যখন রডারিককে পরাজিত করবে তখন সে মুসা ইবনে নুসাইরের কাছে আবেদন করবেন রডারিককে জীবিত গ্রেফতার করে ফ্লোরিডার কাছে ন্যাস্ত করার জন্যে যাতে সে তাকে হত্যা করতে পারে।
ফ্লোরিডা শান্ত হয়েছিল এবং ফৌজকে বিদায় সম্ভাষণ জানানোর জন্যে বাবার। সাথে সমুদ্র কুলে পৌঁছে ছিল, যেখানে সে মুসলমান সালার আবু জুরয়া তুরাইফকে দেখতে পেল। বাবা তাকে সে সালারের সাথে পরিচয় করিয়ে দিলেন তারপর, ফ্লোরিডা তুরাইফের পিছনে লাগল সে যেন তার বাবার থেকে ফৌজের সাথে যাবার অনুমতি নিয়ে দেন।
সালার তুরাইফ : তোমার বাবা যদিও তোমাকে যাবার ইযাজত দেন কিন্তু আমি তোমাকে ইযাজত দেব না। আমরা আওরতের ইযযত-আব্রুর হেফাজতের, জন্যে জীবন উৎসর্গ করি সেখানে আওরতকে কিভাবে দুশমনের সামনে ময়দানে পাঠাই?
***
অর্ধ রাত্র অতিবাহিত হয়ে গেছে। স্পেনের দক্ষিণ তীরে মিদান পল্লীর লোক গভীর ঘুমে অচেতন। তীরে ফৌজি চৌকীর ফৌজরাও নিদ্রাপুরীতে বিচরণ করছে। যে সকল সান্ত্রীদের পাহারা তারা তন্দ্রাচ্ছন্ন হয়ে কেউ বসে কেউ দাঁড়িয়ে। তাদের কোন আশংকা ছিল না। তারা জানত, সিওয়াস্তা স্পেনের প্রবেশ দ্বার আর সেখানে রয়েছে মজবুত কেল্লা ও জুলিয়নের ফৌজ।
আশংকা মুসলমানদের ছিল। তারা সিওয়াস্তার রাস্তা ছেড়ে কোন দূরবর্তী তীর ঘেষে আসতে পারত কিন্তু আরবদের ব্যাপারে প্রসিদ্ধ ছিল তারা নৌযান সম্পর্কে ও সমুদ্র যুদ্ধে অভিজ্ঞ নয়। প্রকৃত ঘটনাও, এমনই ছিল। কারণ সে সময় ইসলামের প্রাথমিক যুগ। ৯২ হিজরী সন। সে সময় নাগাদ আরবরা সমুদ্র যুদ্ধের মওকা পায়নি।
স্পেনের সমুদ্রতীরবর্তী ফৌজ বেফিকির ছিল। জুলিয়নের কিশতীগুলো মিদান পল্লী থেকে কিছুটা দূরে আসল। হুকুম মুতাবেক ফৌজ অতি খামুশীর সাথে কিশতী থেকে অবতরন করল। তাদের কমান্ডার আওপাস জানত কোথায় কোথায় চৌকি রয়েছে। তিনি তার ফৌজকে বিভিন্ন দলে বিভিক্ত করে দ্রুত হামলার হুকুম দিলেন।
প্রহরীরা বুঝতে পারল তাদের দিকে ছায়া মুর্তি আসছে কিন্তু কারা আসছে তা বুঝে উঠার পূর্বেই মহাপ্রলয় তাদেরকে গ্রাস করল। চৌকিতে শায়িত ফৌজ নিদ্রা থেকে উঠার কোন মহলত পেল না, পরপারে পাড়ি জমাল। অনেকদূর পর্যন্ত চৌকি বিস্তৃত ছিল প্রভাত রবি উঁকি দেবার পূর্বেই তা বিলকুল সাফ করে ফেলা হল। তাদের একজনও পলায়ন করে খবর দেয়ার অবকাশ পেল না যে, তাদের ওপর হামলা হয়েছে।
সকাল হতে না হতেই জুলিয়নের ফৌজ দুতিনটি বস্তিতে ঢুকে পড়ল। হুকুম মুতাবেক ফৌজ লুটতরাজ শুরু করে দিল। জুলিয়ন নির্দেশ দিয়ে ছিলেন কোন গির্জা যেন দাঁড়িয়ে না থাকে। তার ফৌজরা কিছু গির্জাতে করল অগ্নি সংযোজন আর কিছু করল ভেঙ্গে চুরমার। বিকেল নাগাদ সিপাহীরা পুরোদমে লুটতরাজের কাজ চালিয়ে গেল। কোন সুন্দরী যুবতী রমণী চোখে পড়লে তাকেও তারা রেহায় দিল না এবং যেভাবে তারা কিশতীতে গিয়ে ছিল ঠিক তেমনি আবার কিশতীতেই নিরাপদে ফিরে এলো।
জুলিয়ন নির্দেশ দিয়েছিলেন যেন এলান করে দেয়া হয় তারা সিওয়াস্তার ফৌজ, তাই ফৌজরা লুটতরাজের ফাঁকে ফাঁকে এ এলান করছিল। ফৌজ যখন ফিরে এলো তখন জুলিয়ন মুসা ইবনে নুসাইরের সালার তুরাইফকে জিজ্ঞেস করলেন, আমি যে রডারিককে দুশমন মনে করি এখন একীন এসেছে কিনা।
জুলিয়ন : আপনি সালার, বলুন দেখি, রডারিক এখন সিওয়াস্তার ওপর প্রতিশোধমূলক হামলা করবে এ আশংকা কি আমি সৃষ্টি করিনি?
সেনাপতি তুরাইফ : সে তো হামলা করতেই পারে, সে কিভাবে সহ্য করে নিবে, তার এক জায়গীরদার তার মুলুকে গিয়ে আক্রমণ করে ব্যাপকভাবে ফৌজ হত্যা ও বাড়ী-ঘর লুট করে ফিরে আসে। এটা সহ্য করে নেয়া তার পক্ষে সম্ভব নয়। তবে নওয়াব জুলিয়ন আমরা আপনাকে ছাড়ব না। আমার এ সেনাদল এখানেই থাকবে এবং তারা সদা সমুদ্র তীরে থাকবে চৌকস। আপনি দ্রুত গিয়ে আমাদের আমীর মুসা ইবনে নুসাইরের কাছে মিত্রতার চুক্তি পূর্ণ মাত্রায় সম্পাদন করুন এবং এ সংবাদ স্পেনে রডারিককে পৌঁছে দিন।
***
মিত্রতার চুক্তি হয়ে গেল।
মুসার বিশ্বাস হয়ে ছিল জুলিয়ন তার সাথে প্রতারণা করছে না কিন্তু এ বিশ্বাস কে মুসা পরিপূর্ণভাবে পুজা করতে চাচ্ছিলেন। এজন্যে তিনি স্পেন সমুদ্র তীর হতে কিছুটা দূরে অবস্থিত “অগেসীরাস” নামে এক দ্বীপ নির্ধারণ করে তাতে হামলা করার প্লান তৈরি করলেন। এতে তিনি নিজস্ব ফৌজের সাথে জুলিয়নের ফৌজও শামিল করলেন। জুলিয়নের ফৌজ কি পরিমাণ নির্ভরযোগ্য এবং স্পেনের ফৌজ যুদ্ধে পারদর্শি কেমন আর তার কমান্ডারইবা কেমন যোগ্য এ যৌথ অভিজানের মাধ্যমে তা তিনি যাচায় করতে চাচ্ছিলেন।
এ যৌথ ফৌজী অভিযানের কামান মুসা দিয়েছিলেন সেনাপতি আবু জুরয়া তুরাইফ ইবনে মালেকের হাতে। সেনাপতি আবু তুরাইফকে আখিরী হিদায়েত দিয়ে মুসা বললেন,
ইবনে মালেক! তুমি নিজে তো লক্ষ্য রাখবেই তোমার নায়েবদেরকেও লক্ষ্য রাখতে বলরে জুলিয়নের কমান্ডাররা আমাদেরকে ধোকা দিচ্ছেকিনা। এটাও লক্ষ্য রাখবে তারা লড়ায়ে বাহাদুর না বুজদিল।
জুলিয়ন তার কমান্ডারদেরকে লক্ষ্য করে বলছিলেন, আবারও তোমাদেরকে বলছি, মুসলমানরা যেন বলতে না পারে জুলিয়নের ফৌজ বুঝদিল এবং এমন কোন কাজ করবে না যাতে তাদের সন্দেহ হয় আমরা তাদেরকে ধোকা দিচ্ছি। মুসলমানদের আমীর এখনো আমাদের ওপর বিশ্বাস স্থাপন করতে পারেন নি। স্মরণ রাখবে! নিজের মান সম্মানের ওপর জীবন বিলিয়ে দেয় যে বাহাদুর সে কখনো থোকা দিতে পারে না। তোমরা এক ধোকাবাজ থেকে প্রতিশোধ নিতে যাচ্ছ। সে ধধাকাবাজ স্পেনের বাদশাহ রডারিক। প্রথমেই তোমাদেরকে বলেছি রডারিক আমাদের দুশমন। তার ওপর তোমরা একবার আক্রমণ চালিয়েছ।….. আমি একটা কথা বার বার জোর দিয়ে বলছি মুসলমানরা যেন সামান্যও অনুভব না করতে পারে। তোমরা বুজদিল ও ধোকাবাজ।
৭১০ খ্রিস্টাব্দের জুলাই মাসে এক প্রভাত রজনীর আলো আঁধারীতে মুসা ইবনে নুসাইরের ও জুলিয়নের ফৌজ বিশাল জঙ্গী কিশতীতে সোয়ার হয়েছিল। জুলিয়নের ফৌজ সংখ্যা ইতিহাসে উল্লেখ নেই। মুসলমান ফৌজ সংখ্যা ছিল চারশত পায়দল আর একশত ঘোড় সোয়ার।
অগেসীরাস তেমন বড় কোন দ্বীপ ছিল না আবার একেবারে ছোটও ছিল না। পূর্বেই গোয়ান্দা মাধ্যমে জেনে নেয়া হয়েছিল সেখানে স্পেনের ফৌজ কি পরিমাণ আছে এবং কোথায় কোথায় আছে। কিশতী এমন জায়গাতে ভিড়ান হলো যেখানে ঘন গাছ-পালা ও সবুজ শ্যামলীতে ঢাকা উঁচু টিলা ছিল। এ টিলা দ্বীপের ফৌজের চোখের অন্তরালে ছিল। কোন ফৌজ আসছে কিনা তা দেখা তাদের পক্ষে সম্ভব ছিল না কিন্তু সালার তুরাইফ ও জুলিয়নের ফৌজ দুশমনের চোখের আড়ালে থাকতে পারল না। তাদের কিশতী যখন সমুদ্র পার হয়ে দ্বীপের দিকে যাচ্ছিল তখন। দ্বীপবাসী দূর থেকে তা প্রত্যক্ষ করেছিল।
কিশতী কিনারে ভিড়ল। ফৌজ সবে মাত্র জমিনে অবতরন করেছে এখনও ঘোড় সোয়ার ঘোড়ায় আরোহন করেনি পায়দল ফৌজি সম্মুখে অগ্রসর হবার জন্যে শৃংখলাবদ্ধ হয়নি এরি মাঝে হঠাৎ করে টিলা থেকে তাদের ওপর তীরের বান বয়ে গেল। তীর আন্দাজরা ঘন গাছ-পালা, লতা গুলোর মাঝে লুকিয়েছিল। স্পেনের এক উপকূল এলাকায় জুলিয়নের ফৌজরা হামলা করার পর থেকে সীমান্তবর্তী উপকূল এলাকাও দ্বীপে ফৌজরা খুব চৌকান্না ও প্রস্তুত ছিল।
ঘোড় সোয়াররা তীরের আঘাত থেকে বাঁচার জন্যে এদিক সেদিক ছুটছিল, সেনাপতি তুরাইফ তাদেরকে নির্দেশ দিলেন তীরের নাগালের বাইরে গিয়ে চতুর দিক থেকে টিলাকে ঘিরে ফেলার জন্যে। পায়দল সৈন্যরা পূর্বেই এলোমেলো হয়ে গিয়েছিল। কিছু সমুদ্রের মাঝে আর কিছু কিশতিতে আশ্রয় নিয়েছিল। সম্মুখে কেবল আহতরাছিল।
জুলিয়নের সৈন্য বাহিনীর কমান্ডার ছিল আওপাস তিনি ব্যতিব্যস্ত হয়ে তার সিপাহীদেরকে একত্রিত করে হুকুম দিলেন টিলার পিছন দিক থেকে ওপরে যাওয়ার জন্যে, সিপাহীরা বিদ্যুৎ গতীতে ছুটে চলল। তীর আন্দাজরা সম্মুখে তথা সমুদ্রের দিকে তীর নিক্ষেপ করছিল। আওপাসের সিপাহীরা ডানবাম ও পিছন দিক থেকে টিলার ওপরে ঘন গাছ-পালা পত্র পল্লব ও ঘাসের মাঝে প্রবেশ করছিল ফলে তীর আন্দাজদের নিশানা পরিবর্তন হয়ে গেল। আওপাস স্বীয় সিপাহীদেরকে চিৎকার করে আহ্বান করছিল আর সিপাহীরা অত্যন্ত বীরত্বের সাথে তীরবানকে উপেক্ষা করে টিলার ওপর আরোহণ করছিল।
সেনাপতি তুরাইফ যখন আওপাসের সিপাহীদের এ সাহসীকতা লক্ষ্য করলেন তখন তিনি তার তীর আন্দাজ সৈন্যদেরকে টিলার নিচের বৃক্ষে উঠে দুশমনের তীর আন্দাজকে নিশানা বানানার নির্দেশ দিলেন। মুসলমান তীর আন্দাজরা গাছে উঠার সময় দুশমনের তীরের আঘাতে জখম হয়ে কয়েকজন ভূলণ্ঠিত হলো। বাকি তীর আন্দাজরা বৃক্ষে আরোহণ করে অবিরাম গতিতে টিলার ওপর তীর নিক্ষেপ করতে লাগল।
দ্বীপের তীর আন্দাজরা পলায়ন পদ হতে লাগলো কিন্তু টিলা ঘোড়সোয়ারীদের বেষ্টনীতে ছিল ফলে তারা কেউ পলায়ন করতে পারলনা। দ্বীপের বাকী ফৌজরা আক্রমণকারীদের মুকাবালা করার জন্যে আসছিল। সেনাপতি তুরাইফ তার ঘোড় সোয়ারদেরকে টিলার নিচে লুকিয়ে রেখে কমান্ডাদেরকে কৌশল বাতিয়ে দিয়েছিলেন।
উভয় পক্ষের ফৌজ এর মাঝে সংঘর্ষ বেধে গেল। স্পেন ফৌজ দ্রুত পিছু হটতে লাগলো, সেনাপতি তুরাইফ তার লুক্কায়িত ফৌজদেরকে বেরিয়ে আসার জন্যে ইশারা করলেন। ঘোড় সোয়াররা অতি দ্রুত গতিতে টিলার পাদদেশ থেকে বেরিয়ে হাওয়ার তালে ঘোড়া ছুটিয়ে দুশমনের পিছনে চলে গেল। দুশমনের জন্যে এ কৌশল আশাতীত ছিল। ঘোড় সোয়াররা পিছন দিক থেকে অতর্কিত হামলা চালাল, ফলে দ্বীপের ফৌজরা ব্যাপক হারে কতল হতে লাগল।
স্বল্পসময়ে যুদ্ধের পরিসমাপ্তি ঘটল। এ দ্বীপের নাম পরিবর্তন করে জাজীরাতুল খাজরা (সবুজ শ্যামল দ্বীপ) নাম রাখা হলো।
***
সালার তুরাইফ ফিরে এসে মুসা ইবনে নুসাইরকে বললেন, জুলিয়ন প্রতারণা করছেনা। আর তার ফৌজ জীবনবাজী রেখে লড়াই করেছে। তিনি আরো বললেন, স্পেনের ফৌজের মাঝে যুদ্ধের স্পৃহা ক্ষীণ। তাদের পরিচালনার মাঝেও এমন কোন কৌশল নেই যা আমাদেরকে পেরেশান করতে পারে।
মুসা ইবনে নুসাইর স্পেনের ওপর হামলার প্রান তৈরি করতে লাগলেন। জুলিয়ন মুগীছে রূমী নামক এক নও মুসলিমকে সাথে নিয়ে মুসার কাছে আসলেন। মুগীছে রূমী গোথা ছিল। জুলিয়ন মুসলমান ফৌজদের সাথে স্পেন যাবার ইরাদায় এসে ছিলেন। তিনি মুগীছকে সাথে নিতে চাচ্ছিলেন। মুসা ইবনে নুসাইর ইতস্তত করতে লাগলেন।
জুলিয়ন কিছুটা অভিযোগ ও গোর স্বরে বললেন, মুসা! এখনও কি তুমি আমাকে বিশ্বাস করতে পারছ না?….. আমার এমনই কিছুটা আশংকা ছিল। আমার প্রতি তোমার বিশ্বাস আরো পুখতা করার জন্যে আরো একটা পদ্ধতি সাথে নিয়ে এসেছি।
জুলিয়ন মুসার কাছ থেকে উঠে বাহিরে গেল। সিওয়াস্তা থেকে তার সাথে বেশ বড় কাফেলা এসেছিল। যার মাঝে তার চাকর-নওকর মুহাফেজ, মুশীর এবং মহিলারাও ছিল।
পরে জুলিয়ন যখন মুসার কামরায় প্রবেশ করলেন তখন তার সাথে দু’জন খুব সুরত লাড়কী ছিল। তাদের সৌন্দর্য ছিল অসাধারণ। শরীরের কাঠামো যাদুময়ী, মনোহরী, চিত্তাকর্ষক।
জুলিয়ন বললেন,এরা আমার বেটী। এই হলো ফ্লোরিডা আর ও হলো তার বোন মেরী। আমি এদেরকে জামানত হিসেবে তোমার কাছে অর্পণ করছি। এরা আমার ইযযত ও আব্রু। ফ্লোরিডা আমার সেই বেটী যার জন্যে আমি আমার এক শক্তিধর ও পুরাতন দোস্তকে দুশমন আর পুরাতন দুশমনকে দোস্ত হিসেবে গ্রহণ করেছি। নিশ্চয় তুমি লক্ষ্য করেছ আমি আমার আত্মসম্মানে উম্মাদ হয়ে এত বড় বিপদাশংকা সৃষ্টি করেছি এবং ক্ষমতাধর বাদশাহর মুলুকের ওপর হামলা করেছি তারপর তোমার ফৌজের সাথে আমার ফৌজ দ্বীপ কবজ করার জন্যে পাঠিয়েছি।….. মুসা ইবনে নুসাইর! আজ আমার এ ইযযত সম্মান তোমার হাতে সমর্পণ করছি। আমিরে মুগীছ তোমার ফৌজকে সামান্যতমও থোকা যদি দেই তাহলে আমার বেটীদেরকে দাসীতে পরিণত করবে বা হিংস্র বর্বরদের কাছে অর্পণ করবে।
জুলিয়নের এ আবেদন মুসা গ্রহণ করে ছিলেন কিনা বা তাদের মাঝে আরো কোন আলোচনা হয়েছিল কিনা এ ব্যাপারে কোন ঐতিহাসিকই বিস্তারিত তেমন কিছু লেখেননি। ইতিহাসে শুধু এতটুকু পাওয়া যায় যে জুলিয়ন তার দু’বেটীকে জামানত রেখে ছিলেন।
জুলিয়ন দ্বিতীয় আবেদন পেশ করেছিলেন তার তামাম ফৌজ মুসার ফৌজের সাথে স্পেন পাঠাবেন। মুসা এ আবেদন দুটো আপত্তিজনক শব্দে নাকচ করে দিয়ে ছিলেন। তবে এতটুকু মদদ ও সহয়েগিতা চেয়েছিলেন যে, সিওয়াস্তা হবে মুসলমান ফৌজের জন্যে রসদগাহ্ আর সময় সময় মুজাহিদরা স্পেন যাওয়া আসার পথে সিওয়াস্তার কেল্লায় খানা-পিনা, আরাম-আয়েশ ও অন্যান্য জরুরত মিটাবে।
স্পেন উপকূল পর্যন্ত পৌঁছার কিশতী ও সমুদ্র জাহাজ যেন জুলিয়ন দেন এ মদদ তার কাছে মাগা হয়েছিল।
জুলিয়ন সর্বোপরি সাহায্যের অঙ্গিকার করলেন এবং এটাও বললেন যে, তার ফৌজ ময়দানে মদদের জন্যে সদা প্রস্তুত থাকবে।
সে দিনই মুসা ইবনে নুসাইর একটা পয়গাম কাসেদের মাধ্যমে খলীফার কাছে পাঠিয়ে দিলেন। স্পেনের ওপর হামলার ইজত তো খলীফা পূর্বেই দিয়েছিলেন, কিন্তু মুসা ইবনে নুসাইর অত্যন্ত বিচক্ষণ ব্যক্তি ছিলেন তিনি অন্যান্য বিষয় ছাড়াও খলীফার কাছে লেখেছিলেন,
……স্পেনে ফৌজী অভিযান চালানোর ব্যাপারে দ্বিতীয়বার ইজত তলব করে সময় নষ্ট করা আমার কাছে মুনাসিব মনে হলো না, তবে আপনি হিন্দুস্থানে যে লস্কর পাঠিয়েছেন, তার জরুরত এমন অবস্থার সৃষ্টি করতে পারে যাতে আমি স্পেন অভিযান মুলতবী করতে বাধ্য হতে পারি। একই সাথে দু’টো অভিযান আপনার জন্যে কষ্টসাধ্য বা এমন পরিস্থিতি সৃষ্টি করতে পারে যাতে দু’টো অভিযানই বা কোন একটা দুর্বল হয়ে পড়তে পারে।
খলীফা ওলীদ নেহায়েত আশাব্যঞ্জক জওয়াব দিয়ে ছিলেন, তিনি লেখেছিলেন, আল্লাহকে স্মরণ কর এবং তাবৃৎ প্রস্তুতি নিয়ে লস্কর রওনা করে দাও। সেনাপতি ইন্তেখাব খুব চিন্তা-ফিকির করে করবে।
***
সালার ইন্তেখাব একটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয় ছিল। কোন একটা অজুহাতে মুসা সালার তুরাইফকে সালারে আলা বানাতে চাচ্ছিলেন না। একটা কারণ তো ফৌজের প্রায় শতভাগই ছিল বর্বর। মুসা চাচ্ছিলেন, সালারে আলা বর্বর হবে আর আরবী সালার হবে তার অধিনে। সে সময় বর্বরদের মাঝে এমন কিছু ব্যক্তি তৈরি হয়ে গিয়েছিল যাদের যুদ্ধ পরিচালনা করার যোগ্যতাছিল। তারা ফৌজের কমান্ডার পদার্জন করে ছিল।
তাদের মাঝে একজন ছিলেন তারেক ইবনে যিয়াদ। মুসা অতীতের পাতা উল্টাচ্ছিলেন। যখন বর্বরদের অধিকাংশ গোত্র ইসলাম গ্রহণ করেনি এবং আরবদের মুকাবালায় যুদ্ধ জিহাদে ছিল ব্যস্ত। মুসা সে সময় সেখানে অনেক যুদ্ধ করেছেন। এবং পেয়ার-মহব্বত ও ভ্রাতৃত্ব সুলভ আচরণও করেছেন। সে সময় অনেক বর্বর গ্রেফতার হয়েছিল তাদেরকে উপবোস্থ কর্মকর্তারা নওকর বা গোলাম বানিয়ে রেখেছিলেন। মুসার কাছে এক বর্বর যুবক এতো ভাল লেগেছিল তাকে তিনি নিজের কাছে রেখে ছিলেন। সে তার কাছে গোলামের মতই ছিল। মুসা তার কথা বার্তা শুনে ও কাজকর্ম দেখে অনুভব করতে পারলেন এ নওজোয়ান কোন সাধারণ। বংশের নয়। সে ছিল স্বর্ণকেশী আর চেহারা ছিল যেন সদ্য প্রস্ফুটিত গোলাপ। একদিন মুসা তাকে তার বাপ-দাদার ব্যাপারে জিজ্ঞেস করলে প্রতি উত্তরে সে বলেছিল ডেন্ডাল বংশে তার জন্ম। বর্বরদের অন্যান্য কবিলার চেয়ে ডেভাল কবিলা সর্বেদিক থেকে উত্তম ও সম্ভ্রান্ত ছিল।
মুসার এ গোলাম চিন্তা-চেতনার দিক থেকে উঁচু মানসিকতার ছিল আর তার মনযোগ ছিল যুদ্ধ সংক্রান্ত বিষয়ে। ঘোড় সোয়ারীতে ছিল মাহের আর তীর আন্দাজ ও তলোয়ার চালনে ছিল পূর্ণ পারদর্শী। বর্বরদের বিদ্রোহী কবিলাকে দমানোর জন্যে মুসা যখন ফৌজী অভিযান চালাতেন তখন এ গোলামও তার সাথে থাকত। সিওয়াস্তা অবরোধেও সে মুসার সাথে গিয়েছিল। মুসা লক্ষ্য করলেন এ গোলাম কেবল খেদমতগারই নয় সে অনেক সময় অত্যন্ত বিচক্ষণতার সাথে তাকে যুদ্ধের কৌশল সম্পর্কে পরামর্শও দান করে। সে আরবী জবান মাতৃভাষার ন্যায় আয়ত্ত করে নিয়েছিল।
মুসা তাকে ফৌজের মাঝে একটা পদে আসীন করার পর দেখলেন সুন্দর পরিচালনা দক্ষতা ও দলকে বিজয়ী বেশে সম্মুখে অগ্রসর করার যোগ্যতা তার মাঝে বিদ্যমান। মুসা তাকে যুদ্ধ ময়দানে ইমতেহান নিয়ে এক দলের কমান্ডার বানিয়ে দিলেন। তারপর কিছুদিন পরেই সে তার যোগ্যতা বলে নায়েবে সালারের পদে আসনাসীন হয়। ইতিপূর্বেই সে ইসলামে দীক্ষিত হয়েছিল তখন মুসা ইবনে নুসাইর তার নাম তারেক আর বাবার নাম রেখে ছিলেন যিয়াদ।
স্পেন অভিযান পরিচালনার বিষয় সম্মুখে উপস্থিত হওয়াতে মুসা ইবনে নুসাইরের দৃষ্টি বার বার তারেকের প্রতি যাচ্ছিল। মুসার দৃষ্টিতে তারেকের মাঝে সবচেয়ে বড় গুণ হলো সে বিজয় ছিনিয়ে আনতে পাগলপারা, সে চায় সম্মুখে অগ্রসর হতে, পিছু হটতে যেন সে জানেই না।
মুসা তাকে ডেকে বললেন, স্পেন অভিযানে তাকে সিপাহ্ সালার নির্বাচন করা হয়েছে এই হলো স্পেনের নকশা। তার পরীক্ষা নেয়ার জন্যে মুসা সম্মুখে নকশা রেখে দিলেন। কিভাবে তুমি স্পেন মুলুকে হামলা করবে? ধরে রাখ তোমার লস্কর সংখ্যা বেশী হলে উধ্বে সাত হাজার হতে পারে তবে এর কমও হতে পারে কিন্তু বেশী হবে না। তারেক ইবনে যিয়াদ নকশা ভাঁজ করে রেখে দিলেন।
তারেক; আমীরে মুহতারাম! আমিএমন উসূল ও নিয়মে স্পেন উপকূলে সৈন্য অবতরণ করব যে লস্কর সম্মুখ পানেই কেবল অগ্রসর হবে পিছু ফিরার কেউ চিন্তেই করবে না…..। হয়তো বিজয় নয়তো মৃত্যু!
মুসার চেহারায় মৃদ হাসির রেখা ফুটে উঠল।
কায়রো ছিল মিশর ও আফ্রিকার দারুল হুকুমত। সিপাহ্ সালার মুন্তাখাব হবার। সাথে সাথে কায়রো শহরে তীর-বর্শা ও অন্যান্য হাতিয়ার তৈরী হতে লাগল। তীরও নিক্ষেপের জন্যে বর্শা অধিক হারে তৈরি হচ্ছিল। মুসা ইবনে নুসাইর তীর ও বর্শা বানানোর ব্যাপারে বলেছিলেন এত পরিমাণ বানাবে যাতে স্পেন থেকে খবর না আসে যে তা খতম হয়ে গেছে। মাঝখানে সাগর ছিল প্রতিবন্ধক। দুশমন কর্তৃক। রসদের রাস্তা অবরুদ্ধ হবার আশংকা ছিল।
যে সকল ফৌজ স্পেন রওনা হবে, তারেক ইবনে যিয়াদ তাদের প্রশিক্ষণ শুরু করেছিলেন। স্পেনের যে এলাকায় লড়াই হবে সে এলাকা সম্পর্কে তিনি জুলিয়নকে জিজ্ঞেস করে ছিলেন। জুলিয়ন তাকে বিস্তারিত বাতিয়ে দিয়ে ছিলেন। স্পেন প্রাকৃতিক দিক থেকে উত্তর আফ্রিকার চেয়ে ভিন্ন। সবুজ-শ্যামলে ঘেরা, পাহাড় পর্বত, নদী-নালা ইত্যাকার দিক থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন এক দেশ। তারেক ইবনে যিয়াদ। সেখানের সর্বোপরি বিষয় সামনে রেখে প্রশিক্ষণ দিচ্ছিলেন।
অবশেষে রওনার দিন এসে হাজির হলো। তারেককে যে ফৌজ দেয়া হয়েছিল তার সংখ্যা ছিল সাত হাজার। এর মাঝে কয়েকশ সোয়ারীও ছিল।. তাবৎ ফৌজ ছিল বর্বর। জুলিয়ন তাদেরকে চারটি যুদ্ধ জাহাজ, নিজের মাঝি-মাল্লা ও নাবিক দিয়েছিলেন। জাহাজগুলো এত বড়ছিল যে তাতে সাত হাজার ফৌজ, অশ্ব ও অন্যান্য আসবাবপত্র খুব সুন্দরভাবে সংকুলান হয়েছিল।
বিদায়ের প্রাক্কালে তারেক ইবনে যিয়াদ মুসার সাথে করমর্দন করে বলেছিলেন, আমীরে মুহতারাম! এখন থেকে কেবল বিজয় সংবাদ শুনতে পাবেন।
মুসা : একথা ভুলে যেওনা ইবনে যিয়াদ! দুশমন সংখ্যা এক লাখের বেশী হতে পারে।
তারেক ইবনে যিয়াদ : প্রতিটি লড়াইতেই দুশমন সংখ্যা আমাদের চেয়ে কয়েকগুণ বেশী থাকে। আমি আপনাকে একটা বাশারত শুনাতে চাচ্ছি। গতরাতে আমি রাসূল (স)-কে খাবাবে দেখলাম, তিনি আমাকে বাশারত দিলেন, হিম্মত ও সবরের আঁচল মজবুতভাবে আঁকড়ে থাকবে, বিজয় তোমাদেরই হবে।
তারেকের এ খাব ঈসায়ী ঐতিহাসিকরাও তাদের কিতাবে উল্লেখ করেছেন, এ দ্বারা বুঝা যায় এ খাব কোন মুসলমান ঐতিহাসিকের মস্তিষ্ক প্রসূত নয়।
যখন জাহাজ নঙ্গোর তুলে নিল তখন তীরে সমবেত হাজার হাজার নর-নারী ও শিশু-কিশোর দু’হাত ওপরে তুলে তাদের জন্যে প্রাণ খুলে দোয়া করছিল, তারপর তাদের সে হাত বিদায় সম্ভাষণের জন্যে আরো উপরে উঠেছিল। জাহাজের পালে হাওয়া লাগার পর ক্রমে তা দূরে চলে যেতে লাগল। রমণীদের নয়নযুগলে আঁসুর বান বয়ে গেল। এ সাত হাজার ফৌজের অধিকাংশের ভাগ্যেই ছিল স্পেনে দাফন। তারা আল্লাহর পয়গাম সমুদ্রের অপর পারে পৌঁছানোর জন্যে চিরতরে বিদায় হয়ে যাচ্ছিল। সে ঐতিহাসিক তারিখটি ছিল, ৭১১ খ্রিস্টাব্দের ৯ জুলাই।
উপকূলে যেখানে জাহাজ ভিড়েছিল তার নাম ছিল কিলপী, পরবর্তিতে জাবালুত তারেক নামে অভিহিত হয়। এনামই এ পর্যন্ত বিদ্যমান রয়েছে।
তামাম লস্কর জাহাজ থেকে নামার পর তারেক ইবনে যিয়াদ তার ফৌজ দাঁড় করিয়ে দিলেন, মাঝি-মাল্লাদেরকে দাঁড় করালেন পৃথকভাবে। তারেক নিজে ঘোড়ায় চড়ে কিছুটা উঁচু জায়গায় দাঁড়িয়ে ছিলেন।
তারেক মাল্লাদেরকে নির্দেশ দিলেন, “চারটি জাহাজেই আগুন লাগিয়ে দাও।”
মাল্লারা পেরেশান ও হতভম্ব হয়ে তার মুখের দিকে চেয়ে ছিল।
তারেক : জাহাজ থেকে তাবৎ সৈন্য নেমে গেছে মাল-সামান নামিয়ে নেয়া হয়েছে, জাহাজে আগুন লাগিয়ে দাও।
এ নির্দেশ তো কেবল সে সিপাহ্ সালার করতে পারে যার মেধা-বুদ্ধি বিকৃতি ঘটেছে।
তারেক বর্বর ফৌজদেরকে লক্ষ্য করে বললেন, বর্বর ভাইরা! জাহাজে অগ্নি সংযোজন কর, আমরা জীবিত ফিরে যাবার জন্যে আসিনি।
বর্বররা সব গুলো জাহাজে আগুন লাগিয়ে ছিল।….
আগুন জাহাজের বাদাম, মাস্তুল, পাঠাতন সর্ব কিছু পুড়িয়ে ভস্ম করে দিচ্ছিল। দাউ দাউ করে জ্বলছিল। ধুম্রজালে স্পেনের গগন ছেয়ে যাচ্ছিল।
তারেকের গর্জন শুনাগেল। তাবৎ ফৌজ তার দিকে মনোনিবেশ করল, তার আওয়াজ ছিল দৃঢ় ও তেজস্বী। তিনি বর্বর ছিলেন তামাম লসকরও ছিল বর্বর কিন্তু তারেক ইবনে যিয়াদ লসকরকে লক্ষ্য করে বর্বর জবানের পরিবর্তে আরবি জবানে ভাষণ দিলেন। তার সে ভাষণ আজ পর্যন্ত ইতিহাসের পাতায় স্বর্ণাক্ষরে লিপিবদ্ধ রয়েছে এবং কিয়ামত তক থাকবে,
“হে বাহাদুর যুবক ভায়েরা! এখন পিছু হটবার ও পলায়ন পদ হবার কোন সুযোগ নেই। তোমাদের সম্মুখে দুশমন আর পশ্চাতে সমুদ্র। না পিছনে পলায়ন করতে পারবে না সামনে। সুতরাং এখন ধৈৰ্য্য, হিম্মত ও সহিষ্ণুতা অবলম্বন করে কাজ করা ছাড়া কোন উপায় নেই। স্মরণ রেখ! এই মুলুকে তোমাদের দৃষ্টান্ত বখিলের দস্তরখানে এতিম যেমন। তোমাদের সামান্যতম বুজদেলী তোমাদের নাম ও নিশানা মিটিয়ে দিবে। তোমাদের দুশমনের কাছে লস্বর বহুত যিয়াদা হাতিয়ারও বহুত। দুশমনের কাছে রসদ পৌঁছবার মাধ্যম অনেক তোমাদের কাছে তার কিছুই নেই। যদি তোমরা বাহাদুরীর সাথে কাজ না কর তাহলে তোমাদের ইযযত মাটির সাথে মিশে যাবে। তোমাদের সম্মান হবে ভূলণ্ঠিত। অতএব নিজের ইযযত সম্মান রক্ষা কর আর দুশমনকে সংকুচিত হতে মজবুর কর। তাদের শক্তিকে খতম করে দাও। আমি তোমাদেরকে এমন কোন জিনিস হতে ভীতি প্রদর্শন করছিনা যার সম্মুখে আমি উপনীত হবো না। আমি তোমাদেরকে এমন জায়গাতে যুদ্ধ করতে বলছিনা যেখানে আমি নিজে যুদ্ধ করবো না। আমি তোমাদের সাথেই রয়েছি যদি তোমরা দৃঢ় পদ থাক তাহলে এই মুলুকের দৌলত সম্মান তোমাদের পদ চুম্বন করবে। তোমরা যদি কষ্ট স্বীকার কর তাহলে এই মুলুকের তাবৎ জিনিসের মালিক তোমরাই হবে। আমীরুল মু’মিনীন ওলীদ ইবনে আব্দুল মালেক এই কাজের জন্যে তোমাদের মত বাহাদুরকে মুনতাখাব করেছেন যে তোমরা হবে এখানের শাহী মহলের জামাতা আর হবে এথাকার খুবসুরত আওরাতের খাবে। তোমরা যদি এই মুলুকের শাহ সোয়ারদের মোকাবেলা করে তাদেরকের, পরাজিত করতে পার তাহলে এখানে আল্লাহর দীন এবং রাসূল (স)-এর আহকাম মকবুল হবে এবং তার ব্যাপক প্রচার প্রসার ঘটবে। অন্তরে দৃঢ় বিশ্বাস রাখ আমি তোমাদেরকে নিয়ে যাচ্ছি যে পথে সে পথের যাত্রী সর্বপ্রথম আমিই হবো। লড়াইয়ের মাঝে সর্বপ্রথম আমার তুলোয়ারই কোষ মুক্ত হবে। আমি যদি নিহত হই তাহলে তোমরা তো বুদ্ধিমান ও ধীশক্তিসম্পন্ন, অন্য কাউকে সিপাহসালার বানিয়ে নেবে কিন্তু আল্লাহর রাহে জীবন উৎসর্গে বিমুখ হবে না এবং এ মুলুক স্বাধীন না হওয়া পর্যন্ত প্রশান্তির শ্বাস ফেলবেনা।