একটি সাম্প্রদায়িক সমালোচনার জবাবে
ডক্টর সৈয়দ সাজ্জাদ হোসায়েন[১] আমার সাম্প্রদায়িকতা নামক বইয়ের উপর যে আলোচনা করেছেন সেটা পড়ে মনে হয় তিনি একজন কাল্পনিক প্রতিপক্ষ খাড়া করে তার কতকগুলি উদ্ভট মতামত খণ্ডন করতে উদ্যত হয়েছেন। তিনি প্রথমেই মন্তব্য করেছেন যে, আমার প্রবন্ধগুলি পড়ে তাঁর মনে হয়েছে তিনি যেন তিরিশ বছর ‘আগেকার অতীতে ফিরে গেছেন। কিন্তু তাঁর এ আলোচনা পড়ে যে কোন সুবুদ্ধিসম্পন্ন পাঠকেরই মনে হবে যে আমরা প্রায় চৌদ্দশো বছর আগের পৃথিবীতে ফিরে গেছি। কাজেই এ নিয়ে আলোচনা নিষ্প্রয়োজন। বিশেষ করে সহজ হিসাবে চৌদ্দশোর কাছে তিরিশ বছর যখন নিতান্তই তুচ্ছ।
তাঁর এই প্রাথমিক মন্তব্যের পর তিনি আমার বইয়ের মূল বক্তব্যের একটা সার দেবার চেষ্টা করে কিছু কথা বলেছেন যেগুলিকে অস্বীকার না করলেও তাকে বইটির একটা বিশ্বস্ত সার বলে গ্রহণ করা চলে না। কিন্তু পরবর্তী আলোচনায় আমার বক্তব্যের নামে তিনি মাঝে মাঝে স্বরচিত কিছু বক্তব্য আমার উপর যেভাবে আরোপ করেছেন সেটা আমার বইয়ের যে কোন সাধারণ পাঠকের কাছেই অত্যন্ত আপত্তিকর মনে হবে। তাঁর এই সমস্ত কাল্পনিক বক্তব্যগুলি সম্পর্কেই এখানে কিছু আলোচনা প্রয়োজন।
সৈয়দ সাজ্জাদ হোসায়েন আলোচনাকালে নিশ্চিতভাবে ধরে নিয়েছেন যে বইটিতে আমি শুধু মুসলমান সাম্প্রদায়িকতার কথাই বলেছি, মুসলমানদেরকেই সবকিছু বিপর্যয়ের জন্য দায়ী করেছি। শুধু তাই নয়। আমার বক্তব্য তাঁর কাছে নাকি হিন্দু মহাসভার বক্তব্যের মতই মনে হয়েছে। কার মনে কখন কি কারণে কোন্ চিন্তা উদয় হয় সেটা মন্তস্তত্ত্ব এবং শিক্ষাতত্ত্বের বিচার্য বিষয়।
কিন্তু এক্ষেত্রে তাঁর এই ধারণার যে ভিত্তি নেই সেটা আমার বই-এর যে-কোন পৃষ্ঠায় নজর দিলেই ধরা পড়বে।
সৈয়দ সাজ্জাদ হোসায়েন বলেছেন, পাকিস্তানী জাতীয়তাবাদকে আমি সাম্প্রদায়িকতা আখ্যা দিয়েছি এবং কংগ্রেস ও হিন্দু মহাসভার ভারতীয় জাতীয়তাবাদকে অসাম্প্রদায়িক ইত্যাদি বলে বর্ণনা করে তার ওকালতী করেছি। তাঁর বক্তব্য যে কতখানি বিকৃত এবং তিনি যে কতখানি কল্পনাশ্রেয়ী সেটা নীচের উদ্ধৃতি থেকে বোঝা যাবে।
মধ্যবিত্তের শ্রেণীগত দুর্বলতার জন্য হিন্দু মধ্যবিত্ত নিজের স্বার্থ রক্ষা করতে গিয়ে মুসলমান মধ্যবিত্তের স্বার্থকে অনেকাংশ ক্ষুণ্ন করলো। ঠিক অনুরূপবাবে মধ্যবিত্তের শ্রেণীগত দুর্বলতার জন্য হিন্দু মধ্যবিত্ত নিজের স্বার্থ রক্ষা করতে গিয়ে মুসলমান মধ্যবিত্তের স্বার্থকে অনেকাংশে ক্ষুণ্ণ করলো। ঠিক অনুরূপভাবে মধ্যবিত্তের শ্রেণীগত দুর্বলতার কারণে মুসলমান মধ্যবিত্ত নিজের স্বার্থ সংরক্ষণের জন্য দুর্বলতর প্রতিযোগী হিসাবে হয়ে দাঁড়াল অধিকতর ধর্মাশ্রয়ী। হিন্দু সমাজও তাই একদিকে ইংরেজ এবং অন্যদিকে মুসলমান স্বার্থের বিরুদ্ধতায় তার মধ্যবর্তীকালীন আপেক্ষিক ধর্ম-নিরপেক্ষতাকে বহুতরভাবে শিথিল করে জাতীয় আন্দোলনের মধ্যে আবার নতুন করে আনল ধর্মীয় জটিলতা। হিন্দু মহাসভা ইত্যাদি সাম্প্রদায়িক সংগঠন, এমনকি কংগ্রেসের এক শক্তিশালী অংশ পর্যন্ত বিভোর হলো রামরাজত্বের স্বপ্নে। এ জটিলতার ফলে ভারতীয় জাতীয়তাবাদ আর সত্য অর্থে ধর্মনিরপেক্ষ রইলো না। বিকৃতরূপ ধারণ করে তা পরিণত হলো সাম্প্রদায়িকতায়।
সৈয়দ সাজ্জাদ হোসায়েন বলেছেন যেমন সাংস্কৃতিক আত্মনিয়ন্ত্রণের ভিত্তিতে মুসলিম লীগের যে দ্বিজাতিতত্ত্ব তাকে অস্বীকার করলেও জাতি বলতে কি বোঝায় সে সম্পর্কে আমি কিছুই বলিনি। তাঁর এ অভিযোগের যুক্তিসঙ্গত কারণ নেই। এ জন্য যে বইটিতে জাতিতত্ত্বের উপর দ্বিজাতিতত্ত্বকে দাঁড় করানোর চেষ্টা হয় তার সম্পর্কে বইটিতে ‘সাম্প্রদায়িকতা ও ধর্মীয় রাষ্ট্র’ এবং ‘মুসলিম জাতীয়তাবাদ ও মুসলিম সংস্কৃতি’ নামক প্রবন্ধে আলোচনা করা হয়েছে। মুসলমানদের মতো হিন্দুদের মধ্যেও ধর্মীয় প্রভাব যে প্রায় একই কারণে অনেক বিভ্রান্তির সৃষ্টি করেছিল সে কথাও মোটামুটিভাবে আলোচিত হয়েছে।
এই দুই পৃষ্ঠায় যা বলা হয়েছে তা থেকেই বোঝা যাবে যে কোন কুসংস্কার অথবা হিন্দু বা মুসলমান ধর্মের প্রতি পক্ষপাতদুষ্ট কোন দৃষ্টিভঙ্গী থেকে সাম্প্রদায়িক সমস্যায় আলোচনার প্রচেষ্টা বইটিতে করা হয়নি। কিন্তু সৈয়দ সাজ্জাদ হোসায়েন এর মধ্যেও হিন্দু মহাসভার দর্শন আবিষ্কার করেছেন। এতেও বিস্মিত হওয়ার কিছু নেই কারণ তাঁর আলোচনা থেকে মনে হয় মুসলমান সমাজের অগ্রগতির ইতিহাস পর্যালোচনাকালে মুসলমানেরা ভাল এবং হিন্দুরা খারাপ (যদিও ভাল মন্দের প্রশ্ন এ জাতীয় বিশ্লেষণের ক্ষেত্রে অবাস্তব) এই কথা দম্ভের সাথে ঘোষণা করলেই যে কোন লেখকের বক্তব্য ‘অন্ধ’, ‘কল্পনাশ্রয়ী’, হিন্দু মহাসভাপন্থী’ ইত্যাদি হতে বাধ্য। তাঁর এবং তাঁর সমর্থকদের এ মনোভাব এবং অনুভূতি যে একটি মনস্তাত্ত্বিক ঘটনা একথা অস্বীকার করেছি বলেও তিনি অভিযোগ করে বলেছেন, ‘এই স্বাতন্ত্র্যবোধ মুসলমানের মধ্যে যে ছিল এই ঐতিহাসিক সত্য অস্বীকার করার উপায় আছে কি?’ কিন্তু আমি কি বাস্তব সত্যকে সত্যিসত্যিই অস্বীকার করেছি? নিচে উদ্ধৃতি দিলাম:
তাঁরা শুধু ধরে নিয়েছিলেন ভারতীয় হিন্দুর সংস্কৃতি এক এবং মুসলমানের সংস্কৃতি এক এবং মুসলমানের সংস্কৃতি অন্য। কাজেই মুসলমানদের স্বতন্ত্র বিকাশের জন্য তারা প্রয়োজন বোধ করেছিলেন স্বতন্ত্র রাষ্ট্র পাকিস্তানের। এ দাবী তাঁদের পক্ষে ছিল অত্যন্ত স্বাভাবিক কারণ সাম্প্রদায়িক স্বার্থ বলতে সাধারণত আর্থিক স্বার্থ (যেমন চাকরী, ব্যবসা-বাণিজ্য ইত্যাদি স্বার্থ) বোঝালেও সাম্প্রদায়িক স্বার্থের একটা সাংস্কৃতিক দিকও ছিল এবং পাকিস্তান আন্দোলনে সেই দিকটিই রচনা করলো আন্দোলনের আবেগ অনুভূতির ভিত্তিভূমি।
সৈয়দ সাজ্জাদ হোসায়েন আমার জন্য বলেছেন : ‘আশা করি তিনি স্বীকার করবেন যে জাতীয়তাবাদ মূলত একটা অনুভূতি। ভাষা নৃতত্ত্ব এর কোনটা দিয়েই তার পরিমাপ করা চলে না।’ সমাজ-বিজ্ঞানসম্মত চিন্তার শাসনসীমা যাঁরা বিনা দ্বিধায় লঙ্ঘন করেন তাঁদের পক্ষে এ জাতীয় অনুভূতিবাদ প্রচার অস্বাভাবিক নয়। তাঁদের ধারণা মানুষের ইতিহাসের বিভিন্ন পর্যায়ে মানুষ যা কিছু চিন্তা এবং অনুভব করে তার কোন বাস্তব ভিত্তি নেই। তার সাথে আর্থিক, সামাজিক, শিক্ষাগত এবং অন্যান্য কোন কিছুর যোগ নেই। অনুভূতি শুধুই অনুভূতি, অন্য কিছুর সাথে তার কোন কার্যকরণ সম্পর্ক নেই। কাজেই মুসলমানেরা হঠাৎ মনে করলো তারা এক জাতি এবং মূলত সেই অনুভূতির মাহাত্ম্যেই তারা সৃষ্টি করলো নোতুন রাষ্ট্র পাকিস্তান। ইতিহাসের এমন চিত্তপ্রসারী ব্যাখ্যা রাষ্ট্রবিজ্ঞান এবং ইতিহাস-চর্চার ক্ষেত্রে অচল হলেও মহাকাব্য রচনা ক্ষেত্রে যে তা বিশেষ উপযোগী তাতে সন্দেহের অবকাশ নেই।
সৈয়দ সাজ্জাদ হোসায়েনের যুক্তি অনুসারে মসজিদের সামনে নামাজের সময় বাজনা বাজালে আসলে তার মধ্যে আপত্তিকর কিছু নেই। কারণ এর দ্বারা কিছু গোলমাল বাড়ায়, জীবন বিঘ্নিত হলেও সত্য অর্থে ইসলামের কোন অবমাননা হয় না। অর্থাৎ ইসলামের অবমাননা হবে কি না হবে সেটা নির্ভর করে কোন্ সম্প্রদায়ভুক্ত লোকে সেই কাজ করছে তার উপর এ মনোবৃত্তিকেই আমার বইয়ে আমি সাম্প্রদায়িকতা আখ্যা দিয়েছি, কারণ এ জাতীয় লোকের ধর্মের প্রতি কোন সত্যিকার আনুগত্য নেই। ধর্মের নামে পোলাও-কোর্মা-কোফতা – কালিয়া খাওয়া’ মুসলমানদের ঐহিক স্বার্থ রক্ষার জন্যই তাঁদের এত চিৎকার এবং গলাবাজি। এ জন্যই নামাজের সময় পর্যন্ত মুসলমানরাই ঢাকায় মসজিদের সামনে আজকাল বাজনা বাজালেও তাঁদের মনে ইসলাম সম্পর্কে ‘একটা নিরাপত্তার ভাব’ পরম নিশ্চিন্তে রাজত্ব করছে। একটু বিশ্লেষণ করলেই দেখা যাবে যে সৈয়দ সাজ্জাদ হোসায়েন অন্তরে যে নিরাপত্তা বোধ করেছেন সেটা ইসলাম সম্পর্কে নয়, নিরাপত্তা সর্বতোভাবে উচ্চ মধ্যবিত্ত পাকিস্তানী মুসলমানের সাম্প্রদায়িক স্বার্থের সম্পর্কে। এ জাতীয় মনোবৃত্তির প্রতি লক্ষ রেখেই আমি বলেছি:
ধর্মনিষ্ঠার সাথে সম্পর্ক আছে ধর্মীয় তত্ত্ব এবং আচার-বিচারের। সাম্প্রদায়িকতার যোগ হচ্ছে সম্প্রদায়ের সাথে। অর্থাৎ ধর্মনিষ্ঠার ক্ষেত্রে ব্যক্তির নিজের আচরণ এবং ধর্ম বিশ্বাসের গুরুত্ব বেশী। সাম্প্রদায়িকতার ক্ষেত্রে নিজের ধর্মীয় সম্প্রদায়ের প্রতি বিশেষ এক জাতীয় আনুগত্যের গুরুত্ব বেশী। এ ছাড়া সত্যিকার ধর্মনিষ্ঠা পরকালমুখী। পরকালেই তার সত্যিকার পুরষ্কারের আশা। সাম্প্রদায়িকতার মুনাফা ইহলোকে। ধর্মনিষ্ঠার জন্য অন্যের বিরুদ্ধাচরণের প্রয়োজন নেই। অন্যের বিরুদ্ধাচরণ এবং ক্ষতিসাধনের প্রচেষ্টার মধ্যেই সাম্প্রদায়িকতার বিকাশ এবং পরিণতি। ধর্মের সাথে তাই সাম্প্রদায়িকতার কোন প্রয়োজনীয় তত্ত্বগত সম্পর্ক নেই। ধর্মীয় তত্ত্ব এবং আচার-আচরণকে ভিত্তি করে যে সমাজ ও সম্প্রদায় গঠিত হয় সেই সম্প্রদায়ের ঐহিক স্বার্থ সাম্প্রদায়িকতার জনক। সাম্প্রদায়িকতা এ অর্থে পুরোপুরি ধর্মনিরপেক্ষ।
শিক্ষাক্ষেত্রে অনগ্রসরতাই মুসলিম সাম্প্রদায়িকতার প্রধান কারণ-আমার এই বক্তব্যকে সৈয়দ সাজ্জাদ হোসায়েন একটা আবিষ্কার বলে ব্যঙ্গ করেছেন। শিক্ষাক্ষেত্রে অনগ্রসরতা প্রধান কারণ, না অন্যতম প্রধান কারণ, না গৌণ কারণ এ নিয়ে অনেক বিতর্ক হতে পারে- এটা স্বীকার করতে আমার দ্বিধা নেই। কারণ যা লিখেছি সেগুলি সবই যে সম্পূর্ণ অভ্রান্ত এবং অপরিবর্তনীয় এ দাবী করার মতো জাগ্রত অনুভূতি আমার নেই। কিন্তু সৈয়দ সাজ্জাদ হোসায়েনের ব্যঙ্গোক্তি থেকে মনে হয় শিক্ষাক্ষেত্রে অনগ্রসরতাকে তিনি সাম্প্রদায়িকতা এবং মুসলমানদের রাজনৈতিক স্বাতন্ত্র্য বোধের অন্যতম কারণ হিসাবে বিবেচনা করতে সম্মত নন। তিনি যদি ঊনিশ শতকের ভারতবর্ষের শিক্ষা ব্যবস্থা এবং বিস্তারের সাথে পরিচিত হতেন তাহলে তাঁর জ্ঞানের শাসনেই তিনি এ ব্যঙ্গোক্তি থেকে বিরত থাকতেন। কিন্তু তিনি তো স্বাতন্ত্র্যের ‘অনুভূতি’ ব্যতীত অন্য কিছুকেই আমল দিতে নারাজ। কাজেই সে স্বাতন্ত্র্যবোধের কার্যকারণ অনুসন্ধানে তার প্রয়োজন কোথায়?
সৈয়দ সাজ্জাদ হোসায়েন এ প্রসঙ্গে আরও বলেছেন, ‘সমাজের কোন অংশ অনগ্রসর হয়ে থাকলে সমাজ দুর্বল হয়, কিন্তু তার ফলে সেই অনগ্রসর অংশের মধ্যে স্বাতন্ত্র্যবোধ জেগে ওঠে একথা বিশ্বাস করা বড় শক্ত। তফসিলভুক্ত হিন্দু সম্প্রদায়ের মধ্যে কোন স্বাতন্ত্র্যবোধ উদ্ভব হয় নি কেন? তার তো মুসলমানের চেয়েও বেশি অনুগ্রসর ছিল।’ এই হাস্যকর বক্তব্য এবং প্রশ্নের জবাবে বলতে বাধ্য হচ্ছি যে ভারতবর্ষে তফসিলীদের মধ্যে যথেষ্ট স্বাতন্ত্র্যবোধ ছিল; তারা ১৯৩৫ সালের ভারত-শাসন আইনে পৃথক নির্বাচন ব্যবস্থা লাভ করেছিল; ডক্টর আম্বেদকর তাদের অধিকার নিয়ে অনেক সংগ্রাম করেছেন; মুসলমানদের মতো তারাও যাতে শেষ পর্যন্ত সরে না পড়ে তার জন্য গান্ধীজী ‘হরিজন’ পত্রিকা এবং অন্যান্য প্রতিষ্ঠান ও সমাজসেবামূলক কাজের মাধ্যমে তাদেরকে সাথে রাখার জন্য আপ্রাণ চেষ্টা করেছিলেন; এবং তফসিলী ফেডারেশন নামে তাদের স্বতন্ত্র প্রতিষ্ঠান ছিল যার প্রতিনিধিরা পূর্ব পাকিস্তানের অনুপস্থিত ছিলেন না। এই প্রসঙ্গে সৈয়দ সাজ্জাদ হোসায়েন ভারতীয় নাগা, শিখ এবং দক্ষিণীদের কথাও ‘নিরাপদে’ স্মরণ করতে পারেন।
সাধারণতঃ মুসলমানেরা ধর্মীয় এবং সামন্ততান্ত্রিক বিভ্রান্তিবশতঃ মোগল সাম্রাজ্যকে নিজেদের সাম্রাজ্য বলে ধরে নিয়ে তার পতনকে নিজেদের পতন বলে ভুল করার কথা বলায় সৈয়দ সাজ্জাদ হোসায়েন আমাকে ‘নূতন আবিষ্কারের মোহে কল্পনাশ্রয়ী’ এবং আমার মতকে ‘ভারতীয়বাদ’ বলে ভূষিত করেছেন। আমার বক্তব্যকে ‘ভারতীয়বাদ’ বলে ধরে নিয়ে উত্তেজিত হওয়ার ফলে তিনি আমাকে কল্পনাশ্রয়ী ইত্যাদি বলে আরবী, ফারসী, কোরমা পোলাও নিয়ে অনেক আলোচনা করেছেন। কিন্তু আমার বক্তব্যের সাথে আসলে ভারতীয়বাদের কোন সম্পর্ক নেই। আমি মুসলমানদের ধর্মীয় এবং সামন্ততান্ত্রিক বিভ্রান্তির কথা মোগলরা ভারতীয় ছিল না এ কারণে বলিনি। বলেছি এ জন্য যে মোগল সাম্রাজ্যের দ্বারা যে মুসলমানেরা লাভবান হয়েছিল এবং তার পতনের পর যারা স্বভাবতঃই ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল তারা ছিল অন্যশ্রেণীর মানুষ – যারা কোর্মা-পোলাও খেত এবং আরবী ফারসীতে কথা বলত। ডাল, ভাত, মাছ খাওয়া এবং বাঙলায় কথা বলা সাধারণ মুসলমানের স্বার্থ, পাঠানযুগ ইংরেজযুগ সব সময়েই ছিল সম্পূর্ণ উপেক্ষিত। কাজেই সে সাম্রাজ্যের পতনকে নিজেদের পতন মনে করাটা ধর্মীয় এবং সামন্ততান্ত্রিক প্রভাবসৃষ্ট বিভ্রান্তি ছাড়া আর কিছুই নয়। ওয়াহাবী আন্দোলন, যার ভূমিকাকে সৈয়দ সাজ্জাদ হোসায়েন ‘সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী’ বলে বর্ণনা করেছেন, সে আন্দোলনের উৎপত্তি, বিকাশ এবং পরিণতির কারণ এবং ইতিহাসের সাথে ভালভাবে পরিচিত হলে তিনি সহজেই উপলব্ধি করতেন যে সে আন্দোলন আসলে সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী নয়, সামন্ততন্ত্রবিরোধী। এ জন্যেই ভারতবর্ষের উচ্চশ্রেণীর কোর্মাপোলাও খাওয়া মুসলমানদের আন্দোলন সেটা ছিল না। সে আন্দোলন ছিল ডাল, ভাত খাওয়া মুসলমানদের আন্দোলন, যেটা পরিশেষে অনেকখানি ইংরেজবিরোধী হয়েছিল ইংরেজদের সাথে কিছু কিছু সামন্ততান্ত্রিক শক্তির বোঝাপড়ার ফলে। এসবের সাথে ধর্মীয় প্রশ্ন অবশ্যই জড়িত ছিল এবং এটাই মূলতঃ তার প্রতিক্রিয়াশীল চরিত্রের জন্মদাতা। কারণ এই সাধারণ মুসলমানেরা ইংরেজ এবং সামন্ততান্ত্রিক শক্তিসমূহের অত্যাচারে জর্জরিত হয়ে স্বপ্ন দেখেছিল দারুল ইসলামের। সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী আন্দোলন বলতে যা বোঝায় তার কোন লক্ষণই ওয়াহাবী আন্দোলনের মধ্যে উপস্থিত ছিল না। কাজেই তার সেই ভূমিকাকে ‘বিলকুল চাপা দেওয়া’র প্রশ্ন ওঠে না।
পাকিস্তান আন্দোলন সম্পর্কে আমি যা কিছু বলেছি তার মধ্যে সৈয়দ সাজ্জাদ হোসায়েনের মতে সবচেয়ে বিভ্রান্তিমূলক হচ্ছে লাহোর প্রস্তাব সম্বন্ধে আমার মন্তব্য। তিনি বলেছেন যে প্রস্তাবে বহুবচনের ব্যবহার থাকলেও সে কথা কারও মনে ছিল না এবং সেটাকে কেউ কোন গুরুত্ব দেয়নি। কিন্তু সেই সঙ্গে তিনি আবার বলেছেন, ‘মুসলিম লীগের ইতিহাসে লাহোর Resolution শেষ কথা নয়। ঊনিশশো চল্লিশ সালে লাহোর প্রস্তাবের পর দিল্লীতে ১৯৪৩ সালে লীগ সদস্যদের কনভেনশনে এই Resolution পরিবর্তিত হয় এবং ভবিষ্যতে যাতে এ নিয়ে কোন বাকবিতণ্ডা না হতে পারে সেজন্য এক বছরে State কথাটাই ব্যবহার করা হয়।’ এখন প্রশ্ন হলো বহুবচন ব্যবহারের যদি কোন গুরুত্ব কেউ না দিয়ে থাকে এবং এসব নিয়ে কোথাও কোন আলোচনা না হয়ে থাকে তাহলে হঠাৎ সে প্রস্তাবকে ‘ভবিষ্যৎ বাকবিতণ্ডা’ থেকে মুক্ত রাখার জন্য পরিবর্তন করার প্রয়োজন দেখা দিল কেন? এ বিষয়ে অনেক কিছু বলা যেতে পারে। কিন্তু সৈয়দ সাজ্জাদ হোসায়েন তাঁর প্রশ্নের উত্তর এখানে নিজেই দিয়েছেন কাজেই এ নিয়ে কথা বাড়িয়ে লাভ নেই।
আমার প্রবন্ধগুলো পড়ে ডক্টর সৈয়দ সাজ্জাদ হোসায়েন খুবই নিরাশ হয়েছেন। এ জন্য আমি দুঃখিত। পরিশেষে তিনি যে কথা বলে আলোচনা শেষ করেছেন তাঁর সেই কথা উদ্ধৃত করেই আমি তাঁর সমালোচনা সম্পর্কে আলোচনা শেষ করব ‘পাকিস্তানের আদর্শ এবং ইতিহাস সম্বন্ধে আলোচনা হোক এটা আমরা আশা করি। তবে আলোচনা যেখানে তথ্যের উপর প্রতিষ্ঠিত নয় সেখানে এ ধরনের আলোচনা শুধু বিভ্রান্তির সৃষ্টি করতে পারে।
***
১. ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের প্রাক্তন অধ্যক্ষ এবং পরে রাজশাহী ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যায়ের উপাচার্য।
পরিশিষ্ট
সামাজিক পটভূমির উপর দৃষ্টি রেখে সাহিত্যকে বোঝার চেষ্টা করলে অনেক বিষয়ে আমাদের ধারণা পরিচ্ছন্ন হয়। ভারতবর্ষে সাম্প্রদায়িকতার উৎপত্তি এবং ইতিহাসকে বোঝার জন্য একথা বিশেষভাবে প্রযোজ্য। ঊনিশ শতকের সাহিত্যে সর্বক্ষেত্রেই ধর্মীয় প্রভাব অত্যন্ত স্পষ্টভাবে চোখে পড়ে। ধর্মকে বাদ দিয়ে সে সময়ে প্রকৃতপক্ষে কোন চিন্তাই সম্ভব ছিল না। ডিরোজীওর ব্যক্তিত্ব এবং ভাবাদর্শে অনুপ্রাণিত হয়ে ‘ইয়ং বেঙ্গল’ আন্দোলন যাঁরা গঠন করেছিলেন সংখ্যায় অল্প হলেও তাঁরা অবশ্য এদিক থেকে অনেকখানি ব্যতিক্রম। কিন্তু এই ‘ইয়ং বেঙ্গল’ দলের সকলেই ছিলেন হিন্দু সমাজের অন্তর্ভুক্ত। মুসলমানদের মধ্যে এ জাতীয় কোন আন্দোলন সে সময়ে গঠিত হয়নি। এর অন্যতম প্রধান কারণ ঊনিশ শতকে শিক্ষাক্ষেত্রে মুসলমানদের অনগ্রসরতা। এটাই একটা বড় কারণ যার জন্য মুসলমান সম্প্রদায়ের মধ্যে মধ্যবিত্তশ্রেণী গঠিত হতে হিন্দুদের তুলনায় সময় লেগেছে অনেক বেশী। ব্যবসা-বাণিজ্য, জমিদারী ইত্যাদির ক্ষেত্রে তাঁরা মুসলমান আমলেও হিন্দুদের থেকে অনেক পশ্চাতে ছিলেন। বাঙলাদেশের ক্ষেত্রে একথা বিশেষভাবে প্রযোজ্য। সে আমলের বাঙলায় মুসলমানেরা অধিক সংখ্যায় নিযুক্ত থাকতেন সামরিক বিভাগে, আইন আদালতে এবং অন্যান্য সরকারী দপ্তরে। এসব ক্ষেত্রে ইংরেজদের সময় তাঁদের অবস্থা পূর্বের তুলনায় ভালো তো হলোই না উপরন্তু শিক্ষাক্ষেত্রে পিছিয়ে থাকার ফলে তাঁরা আইন আদালত এবং বহুপ্রকার সরকারী চাকরী থেকেও ধীরে ধীরে অপসারিত হলেন। সামরিক বিভাগের উচ্চ পদ থেকে অবশ্য হিন্দু মুসলমান উভয়েই হলেন সম্পূর্ণভাবে বহিষ্কৃত।
এই বিষয়ে প্রায় সকলেই একমত যে ঊনিশ শতকে শিক্ষাক্ষেত্রে মুসলমানদের অনগ্রসরতাই মুসলমান মধ্যবিত্তের সংখ্যাল্পতা এবং অনগ্রসরতার জন্য দায়ী। শিক্ষাক্ষেত্রে মুসলমানদের এই অনগ্রসরতার সঠিক কারণ কি সেটা নির্ধারণ করার ঐতিহাসিক গুরুত্ব তাই খুব বেশী।
আনিসুজ্জামান তাঁর ‘মুসলিম মানস ও বাঙলা সাহিত্যে’[১] এর কারণ নির্ধারণের কিছুটা চেষ্টা করেছেন। এ বইটি বাঙলা সাহিত্যের উপর হলেও সাহিত্যক্ষেত্রে সামাজিক পটভূমির গুরুত্ব উপলব্ধি করে লেখক প্রথমদিকে আঠারো শতক থেকে মুসলমানদের সামাজিক অবস্থার একটা পর্যালোচনা করেছেন। সাহিত্যকে সমসাময়িক সমাজের পটভূমিকায় বিচার করার প্রচেষ্টা আমাদের সাহিত্য-সমালোচনায় অত্যন্ত বিরল। সেদিক থেকে আনিসুজ্জামানের প্রচেষ্টা খুবই উল্লেখযোগ্য।
বইটি সম্পর্কে দীর্ঘ আলোচনা এখানে সম্ভব নয়। তবে একটি জিনিষ এখানে সংক্ষেপে এবং সাধারণভাবে আলোচনা করা যেতে পারে। শিক্ষাক্ষেত্রে মুসলমানদের অনগ্রসরতার জন্য সাধারণতঃ তিনটি কারণ উল্লেখ করা হয়। যথা : মুসলমানদের আর্থিক অসঙ্গতি, ধর্মীয় এবং রাজনৈতিক কারণে তাদের ইংরেজী শিক্ষার বিরোধীতা এবং ইষ্ট ইণ্ডিয়া কোম্পানী ও বৃটিশ সরকারের শিক্ষানীতি। কোন লেখকই অবশ্য এগুলির উপর সমান গুরুত্ব আরোপ করেন না। আনিসুজ্জামানও সেটা করেননি। ‘ধর্মীয় গোঁড়ামি বা ইংরেজ শাসনের প্রতি ঘৃণাবশতঃ এদেশের মুসলমানেরা ইংরেজী শিক্ষা প্রত্যাখ্যান করেছিলেন বলে যে ধারণা প্রচলিত আছে, তার পুনর্বিচার’ করতে গিয়ে তিনি বলেছেন,
মিশনারী স্কুলে মুসলমানরাও পড়ত-তার প্রমাণ পাই চুঁচুড়া অঞ্চলে স্থাপিত রবার্ট মে’র স্কুলগুলোয় মুসলমান শিক্ষার্থীর সমাবেশে। ১৮১৭ সালে প্রতিষ্ঠিত কলকাতা স্কুল বুক সোসাইটিতে হিন্দু ও মুসলমান, উভয় সম্প্রদায়ের সদস্য ছিলেন। পরবর্তী বৎসরে প্রতিষ্ঠিত কলকাতা স্কুল বুক সোসাইটির দেশীয় সদস্যদের মধ্যে প্রথমে মুসলমান ছিলেন অধিক, পরে হিন্দু ও মুসলমান সদস্য সংখ্যা সমান করা হয়। সোসাইটি পরিচালিত স্কুলসমূহ মুসলমান ছাত্রেরা হিন্দুর তুলনায় সংখ্যাতে কম হলেও-পড়াশোনা করতো। এমনকি এ যুগে মুসলমান মেয়েদের শিক্ষালাভও অজ্ঞাত ছিল না। [পৃ ৩০-৩১]
তাঁর মতে বাঙলাদেশের মুসলমানদের আর্থিক দুর্গতির জন্যই শিক্ষাক্ষেত্রে তাঁরা এত অনগ্রসর ছিল। কিন্তু এ সত্ত্বেও তিনি যে এ ব্যাপারে নিশ্চিতভাবে তার মত স্থির হতে পেরেছেন সেটা মনে হয় না। একদিকে তাই তিনি বলছেন,
আর্থিক সঙ্গতির অভাবই বাঙালী মুসলমানের ইংরেজী শিক্ষা গ্রহণের পথে প্রধান বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে। আর এই সঙ্গতি ছিল বলেই যুক্ত প্রদেশের মুসলমানেরা এক্ষেত্রে অগ্রসর হতে পেরেছিলেন-ধর্মীয় গোঁড়ামী বা আত্মাভিমান বাঙালী মুসলমানদের চাইতে তাঁদের কম ছিল না। [পৃ ৩২]
আবার অন্যদিকে বলছেন,
ঊনবিংশ শতাব্দীতে বাঙলার নবজাগরণের সূচনা হয়েছিল রামমোহনের ধর্ম আন্দোলনে। বাঙলায় ও বাঙলার বাইরে মুসলমান সমাজেও ধর্ম আন্দোলন দেখা দিয়েছিল। কিন্তু সে আন্দোলন আধুনিক শিক্ষা ও সংস্কৃতির সঙ্গে তার যোগ ঘটায় নি — সে আন্দোলন তাকে নিয়ে গিয়েছিল রক্ষণশীলতার সুরক্ষিত দুর্গের অভ্যন্তরে। এই রক্ষণশীলতা থেকে আধুনিকতায় আসতে তার প্রয়োজন হয়েছিল অনেক সময়ের এবং আরো একটি ভাব আন্দোলনের। [পৃ ৩৬]
আর্থিক দুর্গতির জন্য মুসলমানেরা ইংরেজী শিক্ষা গ্রহণ করতে সক্ষম হয়নি একথা যেমন সত্য ইংরেজী শিক্ষা গ্রহণ না করায় যে তাদের আর্থিক দুর্গতির কারণ হয়েছিল একথাও ঠিক তেমনি সত্য। মুসলমান সমাজের পশ্চাদপদত্বের এই দ্বিবিধ কারণ আবার কতখানি বৃটিশ শিক্ষা নীতির উৎপত্তি সেটাও এ ক্ষেত্রেও বিশেষভাবে বিচার্য। আনিসুজ্জামানের মত কাজী আবদুল মান্নানও সাহিত্যে সামাজিক পটভূমির গুরুত্ব নির্ণয়ের প্রচেষ্টা করেছেন।[২] তাঁর মতে শিক্ষাক্ষেত্রে মুসলমানদের অনগ্রসরতার জন্য ইংরেজ সরকারের শিক্ষা নীতিই প্রধানতঃ দায়ী। কারণ হিন্দুদের শিক্ষার জন্য সরকার যে পরিমাণ অর্থ ব্যয় করেছিলেন তার তুলনায় মুসলমানদের জন্য তাঁরা তেমন কিছুই করেননি। এমনকি হাজী মহম্মদ মহসীন হুগলী মাদ্রাসার জন্য যে বিপুল পরিমাণ অর্থ দান করেন তার একটা খুব বড় অংশ ব্যয় করে সরকার হুগলীতে একটি ইংরেজী কলেজ পরিচালনা করতেন এবং একমাত্র হিন্দু ছেলেরাই উক্ত কলেজে পড়াশোনা করত। [পৃ ৫১-৫৩]
হুগলীতে ইংরেজী কলেজ স্থাপিত হওয়া সত্ত্বেও মুসলমানেরা ইংরেজী শিক্ষার সুযোগ কেন গ্রহণ করতে পারেনি সে সম্পর্কে কাজী মান্নান আবার মুসলমান ছাত্রদের আর্থিক দুর্গতির উল্লেখ করেছেন। তাঁর মতে হুগলী শহরে এসে পড়াশোনার খরচ চালান তাদের দ্বারা সম্ভব ছিল না। [পৃ ৫৫] এ ছাড়া তিনি আরও বলেছেন যে,
এতকাল তারা ফারসীর মাধ্যমে যে-শিক্ষা গ্রহণ করে আসছিল, ইংরেজ সরকার তার আর্থিক অবলম্বনগুলোকে আত্মসাৎ ক’রে যখন ইংরেজীর মাধ্যমে শিক্ষার নতুন ব্যবস্থা প্রবর্তন করলো, তখন তারা সরকারের উদ্দেশ্য সম্বন্ধেই সন্দিহান হয়ে উঠলো। এটাকে তারা মনে করলো তাদের ধর্মের ব্যাপারে বিদেশী জাতির হস্তক্ষেপ। [পৃ ৩৬]
ডাক্তার আজিজুর রহমান মল্লিক মুসলমানদের শিক্ষা সম্পর্কে বিশদ আলোচনা করেছেন। তিনি বলেছেন যে, প্রথম দিকে কোম্পানী ভারতীয়দেরকে শিক্ষা দেওয়ার ব্যবস্থা করেছিল কলকাতায় যেখানে ছিল হিন্দুদের প্রাধান্য। পূর্ব এবং উত্তর বঙ্গের মুসলমান প্রধান অঞ্চলগুলি এ ব্যাপারে সরকারের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিল অনেক পরে। ডাক্তার মল্লিক মুসলমানদের আর্থিক দুর্গতির কথাও এ প্রসঙ্গে আলোচনা করেছেন। ৩ কান্টওয়েল স্মিথের বক্তব্যেও অনেকটা এ ধরণের। বৃটিশদের অর্থনৈতিক ব্যবস্থা এ দেশের আর্থিক ক্রিয়াকর্মকে ক্ষতিগ্রস্ত করে পরিশেষে শুধু কৃষি ব্যতীত অন্য সব ক্ষেত্রে নিজেদেরকে প্রতিষ্ঠিত করেছিল। তাছাড়া নৌপথে ভারতবর্ষে আসার জন্য যে সব এলাকায় তাদের ব্যবসা-বাণিজ্য শিল্প ইত্যাদি প্রসার লাভ করেছিল সেগুলি ছিল মুসলমান কর্মকেন্দ্রগুলি থেকে অনেক দূরে- কলকাতা, মাদ্রাজ এবং বোম্বাইয়ে। তাঁর মতে মুসলমানদের আর্থিক উন্নতি এবং শিক্ষা দীক্ষা এ কারণেই অনেকাংশে বাধাপ্রাপ্ত ও ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল। ৪ কিন্তু এ কারণের গুরুত্ব সীমাবদ্ধ। বাঙলাদেশের থেকে যুক্ত প্রদেশের মুসলমানদের তুলনামূলক অগ্রসরতাকে আবার এর দ্বারা ব্যাখ্যা করা চলে না। তবে মুসলমান আমলে ক্ষমতার কেন্দ্রস্থল যুক্তপ্রদেশে অবস্থিত থাকার ফলে সেখানকার মুসলমানদের অবস্থা এমনিতেই বাঙলার মুসলমানদের তুলনায় অনেক ভাল ছিল।
কলকাতায় মুসলমানদের ইংরেজী শিক্ষার কোন ব্যবস্থাই প্রকৃতপক্ষে করা হয়নি। কলকাতা মাদ্রাসায় যে সামান্য প্রচেষ্টা হয়েছিল সেটাও সফল হয়নি। কারণ সেখানে যারা শিক্ষার জন্য যেতো তারা মোটামুটিভাবে ছিল অত্যন্ত রক্ষণশীল। ইংরেজী শিক্ষার প্রতি তারা বিরূপ ছিল। একথা সংস্কৃত কলেজ সম্পর্কেও প্রযোজ্য কারণ সেখানে ইংরেজী শিক্ষার যে প্রচেষ্টা করা হয় সেটাও সফল হয়নি। ফলে ১৮৩৫ খৃষ্টাব্দে সংস্কৃত কলেজ থেকে ইংরেজী শিক্ষা ব্যবস্থা একেবারে তুরে দেয়া হয়। রক্ষণশীল হিন্দুরা এই সিদ্ধান্তের জন্য সরকারকে অভিনন্দন জানান।[৫]
সংস্কৃত কলেজ থেকে ইংরাজী শিক্ষা তুলে দেওয়ায় কলকাতায় সাধারণভাবে হিন্দুদের ইংরেজী শিক্ষার কোন অসুবিধা ছিল না। কারণ হিন্দু কলেজেই তাঁরা সে সুযোগ লাভ করতেন। মুসলমানদের জন্য সে রকম কোন স্বতন্ত্র ব্যবস্থা না করায় সরকার কলকাতা মাদ্রাসায় ইংরেজী শিক্ষা প্রচেষ্টা সম্পূর্ণভাবে ব্যর্থ হলেও সেখানে ইংরেজী বিভাগ তুলে না দেওয়ার সিদ্ধান্ত করেন। ইংরেজী শিক্ষার ক্ষেত্রে মুসলমানেরা কতদূর পশ্চাদপদ ছিল তার উদাহরণ দিতে গিয়ে সালাহউদ্দীন আহমদ বলেছেন যে ১৮৩৫ খৃষ্টাব্দে কলকাতা মেডিকেল কলেজ স্থাপিত হলে দেখা গেল যে সেখানে আবেদকারীদের মধ্যে উপযুক্তমতো ইংরেজী শিক্ষিত এমন একজনও ছিল না, যাকে ভর্তি করা যেতে পারতো।[৬]
মুসলমানদের ইংরেজী শিক্ষাক্ষেত্রে পিছিয়ে থাকার ইতিহাসের সাথে পাকভারতীয় উপমহাদেশের সাম্প্রদায়িকতার ইতিহাস ওতপ্রোতভাবে জড়িত। এজন্যই এক্ষেত্রে আমাদের ধারণাকে পরিচ্ছন্ন করার প্রয়োজন অত্যন্ত বেশী।
**
১. আনিসুজ্জামান, মুসলিম মানস ও বাঙলা সাহিত্য, লেখক সঙ্ঘ প্রকাশনী, ১৯৬৪
২. কাজী আবদুল মান্নান, আধুনিক বাঙলা সাহিত্যে মুসলিম সাধনা, বাঙলা বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়।
৩. A. R. Mallik, British Policy and the Muslims of Bengal, p. 193
৪. W. C. Smith, Modern Islam in India, p. 164
৫. A. F. Salahuddin Ahmed, Social Ideas and Social Change in Bengal 1818-1835, p. 196
৬. Ibid, P. 147