ভারতবর্ষে বৃটিশের ক্ষমতা দখল ও হস্তান্তর
ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানী যখন ভারতবর্ষে বাণিজ্য শুরু করে তখন ইংলণ্ডে ধনতন্ত্রের বিকাশ ঘটেনি। কোম্পানী সে সময় নানাপ্রকার বস্ত্র ও ব্যবহার্য দ্রব্য ভারতবর্ষ থেকে নিয়ে গিয়ে ইংল্যান্ডের বাজারে হাজির করতো। এই বাণিজ্য উপলক্ষ্যে তারা ভারতের বিভিন্ন স্থানে কুঠি স্থাপন করে এবং সেই কুঠিগুলিকে কেন্দ্র করেই পরবর্তীকালে কোম্পানীর সামরিক শক্তি ধীরে ধীরে গঠিত ও সংহত হয়। আঠারো শতকের মাঝামাঝি কোম্পানীর আধিপত্য যথেষ্ট বৃদ্ধি লাভ করে এবং বাণিজ্যকর অসৎ ব্যবসা পদ্ধতি, রাজকার্যে হস্তক্ষেপ ইত্যাদি নিয়ে দেশীয় রাজশক্তির সাথে তাদের সংঘর্ষ ঘটতে থাকে। এই সংঘর্ষের ফলে অবশেষে দেশীয় রাজশক্তি পরাভূত হয় এবং ইংরেজের রাজদণ্ড এদেশে বিস্তার করে নিজেদের আধিপত্য। এই আধিপত্যের জন্য কোম্পানীর মুনাফা শুধু বাণিজ্যিক মুনাফার মধ্যে সীমাবদ্ধ না থেকে ভূমি-রাজস্ব থেকে প্রাপ্ত অর্থের দ্বারা তা বহুলাংশে স্ফীত হয়।
১৭৫৭ সালের পলাশীর যুদ্ধ থেকে শুরু করে ইষ্ট ইণ্ডিয়া কোম্পানী যে প্রয়োজনে একে একে বিভিন্ন দেশীয় রাজশক্তির বিরুদ্ধে অস্ত্র ধারণ করেছিল তার সাথে বৃটিশ শিল্পের অথবা শিল্পবণিকদের কোন যোগ ছিল না। এই যোগ না থাকার মূল কারণ তখনো পর্যন্ত শিল্প বিপ্লবের মাধ্যমে ইংল্যান্ডে শিল্পের বিকাশ এমন পর্যায়ে উপনীত হয়নি যার জন্য বিদেশে বৃটিশ উপনিবেশের কোন প্রয়োজন ছিল। উপরন্তু ইষ্ট ইণ্ডিয়া কোম্পানীর এই বহির্বাণিজ্য এই পর্যায়ে ছিল বৃটিশ শিল্প মালিকদের স্বার্থের খুবই পরিপন্থী। ইষ্ট ইণ্ডিয়া কোম্পানী ভারতবর্ষ থেকে নানা পণ্যদ্রব্য ইংল্যান্ডের বাজারে নিয়ে যাওয়ায় সেখানকার দেশীয় শিল্পের সাথে কোম্পানীর সংঘর্ষ বাধে এবং সতেরো শতকের দিকে তারা বৃটিশ পার্লামেন্টকে এ ব্যাপারে হস্তক্ষেপের জন্য উত্তরোত্তর চাপ দিতে থাকে। পার্লামেন্ট ইংল্যান্ডের দেশীয় শিল্প মালিকদের স্বার্থে শেষ পর্যন্ত চীন, ইরান ও ভারতবর্ষ থেকে আমদানী সিল্ক ও তুলাজাত বস্ত্র ব্যবহারের বিরুদ্ধে আইন পাশ করে; এবং সেই অনুসারে আইন ভঙ্গকারীদের উপর কঠিন জরিমানাও ধার্য হয়। এর ফলে আঠার শতকের দিকে ইষ্ট ইণ্ডিয়া কোম্পানীকে তুলাজাত এবং অন্যান্য দ্রব্যাদি ইংল্যান্ডে নিয়ে গিয়ে সেখানে বিক্রি না করে বাধ্য হয়ে সেগুলিকে ইউরোপের বাজারে চালান দিতে হতো।
কার্ল মার্কস ভারতবর্ষের উপর লিখিত তাঁর কয়েকটি প্রবন্ধে এ বিষয়ে আলোচনা করেছেন। ইষ্ট ইণ্ডিয়া কোম্পানীর বাণিজ্যের ধারা বিশ্লেষণ করে তিনি বলেছেন যে, ১৮১৩ সালের পূর্বে ভারতবর্ষ ছিল প্রধানত একটি রপ্তানিকারী দেশ। তুলাজাত এবং অন্যান্য পণ্যদ্রব্য সেখান থেকে প্রচুর পরিমাণে রপ্তানী হলেও সেই পরিমাণে বিদেশী পণ্য ভারতবর্ষে আমদানী হতো না। কাজেই সে সময়ে রপ্তানীর বিনিময়ে ভারতবর্ষের পাওনা মেটাতে হতো সোনা দিয়ে। কিন্তু ১৮১৩ সালের পর থেকেই সেই অবস্থার দ্রুত পরিবর্তন ঘটে এবং রপ্তানিকারী থেকে অতি সত্ত্বর ভারতবর্ষ পরিণত হয় একটি আমদানিকারী দেশে। এই পর্যায়ে হতেই ইষ্ট ইণ্ডিয়া কোম্পানীর বাণিজ্য ভারতের প্রাচীন শিল্প ব্যবস্থার মধ্যে এক নোতুন ও জটিল পরিস্থিতির সৃষ্টি করে।
বহুকাল হতে ভারতের বস্ত্রশিল্প এদেশীয় অর্থনীতিতে একটি গুরুত্বপূর্ণ স্থান অধিকার করেছিল। মাঞ্চেষ্টারের প্রতিযোগিতা এবং ইষ্ট ইণ্ডিয়া কোম্পানীর প্রত্যক্ষ প্রতিকূলতায় এই শিল্পের দ্রুত অবনতি ঘটে এবং বস্ত্র তৈরীর কাজে নিযুক্ত তাঁতীদের অবস্থাও হয় নানাভাবে বিপর্যস্ত। তারা যাতে তাঁতবস্ত্র তৈরী করতে না পারে তার জন্যে কোম্পানী থেকে বহু নিপীড়নমূলক ব্যবস্থা গৃহীত এবং এইভাবে ভারতের সর্বপ্রধান রপ্তানীযোগ্য পণ্যদ্রব্যের উৎপাদন দারুণভাবে কমে আসে। শুধু তুলাজাত দ্রব্যই নয়, সাধারণভাবে রপ্তানীর ক্ষেত্রে পূর্বে ভারতবর্ষের যে অবস্থা ছিল তা সম্পূর্ণভাবে পরিবর্তিত হয়ে সমগ্র দেশটিই ক্রমশঃ পরিণত হয় ইংল্যান্ডের শিল্পদ্রব্যের বিক্রয় ক্ষেত্রে।
পূর্বে ভারতবর্ষে ইষ্ট ইন্ডিয়া কোম্পানীর মুনাফার ভিত্তি ছিল বাণিজ্য এবং প্রত্যক্ষ শাসনক্ষমতা দখলের মাধ্যমে প্রাপ্ত ভূমি-রাজস্ব। ১৮১৩ থেকে ১৮৫৮ সালে মহারাণীর ঘোষণা পর্যন্ত সেই অবস্থা অপরিবর্তিত থাকলেও এই মধ্যবর্তী সময়ে ভারতীয় বাণিজ্যের সঙ্গে ইংল্যান্ডের নোতুন শিল্পমালিকদের স্বার্থ জড়িত হয়ে পড়ে। তার ফলে ভারতবর্ষের শাসনক্ষমতা কোম্পানীর কাছে হস্তান্তরিত করার জন্য তারা ক্রমাগতভাবে পার্লামেন্ট ও মন্ত্রীসভার উপর চাপ প্রয়োগ করতে থাকে। এ জাতীয় চাপ কোম্পানীর উপর বহু পূর্বেই ছিল কিন্তু ভারতের শাসনক্ষমতা নিজেদের হাতে রাখার জন্য তারা বৃটিশ সরকারকে বাৎসরিক চার লক্ষ পাউণ্ড কর দিয়ে সেই সম্ভাবনাকে ঠেকিয়ে রেখেছিল। ১৮৫৭ সালে বিপাহী অভ্যুত্থানের পর এই অবস্থাকে আর ঠেকিয়ে রাখা কোম্পানীর পক্ষে সম্ভব হলো না। এবং ১৮৫৮ সালে মহারাণী ভিক্টোরিয়ার ঘোষণা অনুসারে ভারতে কোম্পানীর সমগ্র এলাকা বৃটিশ সরকারের প্রত্যক্ষ শাসনাধীনে নিয়ে আসা হলো।
মহারাণীর এই ঘোষণা একদিকে যেমন ছিল ভারতবর্ষের সামন্তস্বার্থের বিরুদ্ধে ইংল্যান্ডের ধনতান্ত্রিক স্বার্থের জয়, অন্যদিকে তেমনি সেটা ছিল নোতুন বৃটিশ শিল্পস্বার্থের কাছে ইষ্ট ইণ্ডিয়া কোম্পানরি বাণিজ্যিক স্বার্থেরও নিশ্চিত পরাজয়।
২
১৭৯৩ সালে লর্ড কর্নওয়ালিসের আমলে কোম্পানী বাঙলাদেশে চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের মাধ্যমে রাজস্ব আদায়ের একটা স্থায়ী ব্যবস্থা করে। এছাড়াও ভারতের অন্যান্য স্থানে রাজস্ব আদায়ের বিবিধ ব্যবস্থার মাধ্যমে ইষ্ট ইণ্ডিয়া কোম্পানী গ্রামাঞ্চলে এমন এক শ্রেণীর কায়েমী স্বার্থ গড়ে তোলে যাদের স্থায়িত্ব এবং সমৃদ্ধি কোম্পানীর স্বার্থের সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িত হয়। এই ব্যবস্থার মাধ্যমে এদেশে নৃপতিদের সাথে এই পর্যায়ে স্বভাবতঃই ইংরেজদের কোন আপস সম্ভব ছিল না। উপরন্তু তাদের আধিপত্য খর্ব করার মাধ্যমেই কোম্পানী ভারতে নিজের প্রভাব ও রাজত্বকায়েম করতে সক্ষম হয়েছিল। সিপাহী বিদ্রোহ সাধারণ সৈনিক এবং কোন কোন ক্ষেত্রে কৃষকেরা অংশগ্রহণ করলেও তার সম্পূর্ণ নেতৃত্ব ছিল এই জাতীয় দেশীয় নৃপতি ও তাদের অনুচরদের হাতে। শুধু তাই নয়। সে বিদ্রোহের রাজনৈতিক লক্ষ্যও ছিল ভারতবর্ষের মোগল সাম্রাজ্যকে পুনরুজ্জীবিত করে বাহাদুর শাহকে দিল্লীর সিংহাসনে অধিষ্ঠিত করা। সিপাহী বিদ্রোহ তাই মূলত ছিল ভারতবর্ষে বৃটিশ ইষ্ট ইণ্ডিয়া কোম্পানীর আমদানীকৃত ধনতান্ত্রিক ব্যবস্থা ও বুর্জোয়া মূল্যবোধের বিরুদ্ধে দেশীয় সামন্ত নৃপতি এবং তাদের সহযোগীদের বিদ্রোহ। এই বিদ্রোহের অবসানে একদিকে ভারতীয় সামন্ত স্বার্থ পরাভূত হয় এবং অন্যদিকে ভারতবর্ষে ব্রিটিশের ধনতান্ত্রিক আর্থিক স্বার্থ সম্প্রসারণের সুযোগ বাড়ে। এই পর্যায় থেকেই এদেশীয় উচ্চ সামন্ত শক্তির সাথে শুরু হয় বৃটিশ সরকারের আঁতাতের শতাব্দীব্যাপী ইতিহাস।
৩
মার্কস বলেছেন যে, ভারতবর্ষে ইংরেজদের আগমন একদিকে যেমন এশীয় সমাজের মধ্যে অনেক বিপর্যয় সৃষ্টি করেছিল অন্যদিকে তা তেমনি সূচনা করেছিল এদেশের ইতিহাসের এক নোতুন অধ্যায়। সুতরাং একদিকে ধ্বংসাত্মক এবং অন্যদিকে গঠনমূলক কাজের মাধ্যমে ইংল্যাণ্ড ভারতবর্ষে এশীয় সমাজের ধ্বংস সাধন করে এখানে স্থাপন করে পাশ্চাত্য সমাজের ভিত্তিপ্রস্তর। এদিক দিয়ে ভারতবর্ষে ইংরেজদের আগমন পূর্ববর্তী বিদেশী আক্রমণকারীদের আগমন থেকে অনেক বেশি সুফলপ্রসূ হয়েছিলো।
ইংল্যান্ডে শিল্প বিপ্লবের ফলেই ইংরেজরা ভারতবর্ষে একটি নোতুন সামাজিক ব্যবস্থার গোড়াপত্তন করতে সক্ষম হয়। সামন্তবাদী ইংল্যান্ডের পক্ষে ভারতের সুপ্রাচীন সমাজ ব্যবস্থার মধ্যে কোন মৌলিক পরিবর্তনের সূত্রপাত সম্ভব ছিল না। যেমন সে ক্ষমতা ছিল না পূর্ববর্তী তুর্কী মোগল অথবা অন্য দখলকারীদের। ইষ্ট ইণ্ডিয়া কোম্পানীর মাধ্যমে ইংল্যান্ডের সাথে ভারতের যোগাযোগ স্থাপিত হয় সতেরো শতকের গোড়া থেকে। কিন্তু তারপর প্রায় দুশো বছর সেই যোগাযোগ অব্যাহত থাকা সত্ত্বেও ভারতীয় সমাজে কোনো মৌলিক পরিবর্তন সৃষ্টি তাদের দ্বারা সম্ভব হয়নি। তারা তুর্কী, মোগলদের মতোই সেদিক দিয়ে ছিল অক্ষম। এই অক্ষমতা ইংরেজরা কাটিয়ে উঠলো ঠিক তখন থেকে যখন ভারতের সাথে তাদের বাণিজ্যের ধারা হলো পরিবর্তিত। অর্থাৎ যে সময় ইংল্যাণ্ড একটি আমদানিকারী দেশ থেকে পরিণত হল রপ্তানিকারী দেশে। এই পরিবর্তন ইংল্যান্ডে শিল্পবিপ্লবের ফলেই সম্ভব হয়ছিল।
সিপাহী বিদ্রোহের পতনের পর সামন্ত স্বার্থের সাথে তাদের মূল দ্বন্দ্বের অবসান হলেও তৎকালীন ভারতবর্ষে ইংরেজরা যে নোতুন আর্থিক ও সামাজিক ব্যবস্থার প্রবর্তন করলো তার মধ্যেই সূত্রপাত হলো এক নোতুন দ্বন্দ্বের।
৪
নিজেদের শিল্পদ্রব্যের বাজার সম্প্রসারণ, সামরিক গতিশীলতা বৃদ্ধি এবং উন্নত প্রশাসনিক ব্যবস্থা গঠনের উদ্দেশ্যে ইংরেজরা এদেশে রেললাইন পাতলো, টেলিগ্রাফ বসালো, নোতুন শিক্ষাব্যবস্থার প্রবর্তন করলো এবং প্রতিষ্ঠা করলো ছাপাখানা ও সংবাদপত্র। এ সবের ফলে একদিকে যেমন ভারতবর্ষের গ্রাম্য স্বয়ংসম্পূর্ণতা ও বিচ্ছিন্নতার ভিত্তি ধ্বংস হয়ে বিভিন্ন এলাকায় ও প্রদেশের লোকের মধ্যে স্থাপিত হলো যোগাযোগ অন্যদিকে তেমনি উৎপত্তি হলো পাশ্চাত্য জ্ঞানবিজ্ঞানে সমৃদ্ধ এক নোতুন মধ্যবিত্ত শ্রেণীর। প্রশাসনিক ঐক্য, চলাচলের বিস্তৃত ব্যবস্থা, দেশীয় বাণিজ্য স্বার্থ, পাশ্চাত্য শিক্ষা ইত্যাদি এই মধ্যবিত্ত শ্রেণীর মধ্যে সর্বপ্রথম সৃষ্টি করলো এক নোতুন চেতনা যাকে মোটামুটিভাবে জাতীয় চেতনা বলে অভিহিত করা যেতে পারে।
ঊনিশ শতক থেকে বাঙলাদেশে যারা পাশ্চাত্য শিক্ষা গ্রহণ করে উকিল, মোক্তার, ডাক্তার, শিক্ষক ইত্যাদি হয়ে পেশাগত জীবন যাপন শুরু করেছিলেন তারা অধিকাংশই ছিল চিরস্থায়ী বন্দোবস্তপুষ্ট পরিবারভুক্ত। বাঙালী মধ্যবিত্তের সাথে তাই সামন্তবাদী ভূমিস্বার্থের সম্পর্ক বরাবরই ছিল খুব ঘনিষ্ঠ। বৃটিশ ইউরোপীয় বুর্জোয়াদের সাতে এদিক দিয়ে তার অনেকখানি পার্থক্য। বৃটিশ বুর্জোয়া শ্রেণীর মূল ভিত্তি রচিত হয়েছিল বাণিজ্য ও শিল্প স্বার্থের দ্বারা। শিল্প বিপ্লবই ছিল সেই শ্রেণীর স্রষ্টা। কিন্তু সারা ভারতবর্ষে দেশীয় শিল্পের তেমন কোন অস্তিত্ব না থাকায় ক্ষুদ্র ব্যবসায়িক এবং পশাগত স্বার্থের উপর তার প্রধান প্রতিষ্ঠার ফল ভারতীয় বুর্জোয়া ছিল মেরুদণ্ডহীন। এই জন্যেই ভারতীয় এবং বিশেষ করে বাঙালী মধ্যবিত্ত ইংরেজের উপর অনেকদিন পর্যন্ত আর্থিক ও রাজনীতিগতভাবে ছিল নির্ভরশীল। অর্থাৎ আমাদের রাজনৈতিক জীবনের উপর বৃটিশ সরকারের এত প্রভাব প্রতিপত্তির কারণ অনুসন্ধান করতে গেলে দেশীয় বুর্জোয়ার এই চরিত্র বিশ্লেষণের মাধ্যমেই তা করতে হবে।
৫
ইংরেজরা ভারতবর্ষের রাজনীতিকে একটি বিশেষ খাতে ঠেলে দেওয়ার জন্যেই ভারতীয় জাতীয় আন্দোলনের উদ্যোক্তা হিসাবে এগিয়ে এসেছিল। সেদিক দিয়ে তাদের সরকারবিরোধী উদারনৈতিক রাজনৈতিক এবং বৃটিশ ভারতীয় সরকারের চিন্তা ও কর্মের একটা সামঞ্জস্য ছিল। ইউরোপ ও ইংল্যান্ডের ইতিহাস থেকে তারাযে শিক্ষা লাভ করেছিল সেই শিক্ষাকে এক্ষেত্রে তারা উপযুক্তভাবে প্রয়োগ করতে চেষ্টার ত্রুটি করেনি। ইংল্যান্ডের গঠনতান্ত্রিক রাজনীতির ইতিহাস ইউরোপীয় রাজনীতির থেকে বহুলাংশে স্বতন্ত্ৰ। পার্লামেন্টের সঙ্গে ক্রমাগত সংঘর্ষের মাধ্যমে রাজারা সেখানে যেভাবে ধীরে ধীরে পার্লামেন্টের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করে এসেছিলেন ইউরোপে তেমনটি ঘটেনি। ইংল্যান্ডের তাই ফরাসী বিপ্লবের মতো কোন পরিস্থিতির উদ্ভব হয়নি। গঠনতান্ত্রিক পদ্ধতিতে প্রথমে সামন্তশক্তির এবং পরবর্তীকালে ধনতান্ত্রিক শক্তির সাথে রাজতন্ত্রের সংঘর্ষ ও আপসের মাধ্যমে ক্ষমতা সেখানে উত্তরোত্তরভাবে পার্লামেন্টের করতলগত হয়।
ইংল্যান্ডের এই আপসধর্মিতা সম্পর্কে যে কোন আলোচনা তার ভৌগোলিক অবস্থানকে বাদ দিয়ে সম্ভব নয়। ইউরোপীয় মহাদেশের মূল ভূখণ্ড থেকে বিচ্ছিন্ন থাকার ফলে দ্বীপটির দেশরক্ষা ব্যবস্থা বরাবরই ছিল ইউরোপীয় দেশগুলির রক্ষা ব্যবস্থা হতে সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র। প্রথম দিকে ভাইকিংদের আক্রমণ থেকে নিজেদের রক্ষা করার জন্য তাদেরকে নৌ প্রতিরক্ষার দিকে মনোযোগ দিতে হয়েছিল। এরপর স্পেন, ফ্রান্স এবং অন্যান্য ইউরোপীয় দেশগুলির আক্রমণের বিরুদ্ধেও তাদেরকে দ্বীপের অধিবাসী হিসাবে নৌবহর এবং নৌরক্ষা ব্যবস্থার উপরই স্বভাবত জোর দিতে হয়েছিল। এদিক থেকে ইউরোপের অন্যান্য দেশের সাথে তাদের রক্ষা ব্যবস্থার ছিল মৌলিক পার্থক্য।
ফ্রান্স, রাশিয়া, অস্ট্রিয়া, হাঙ্গেরী প্রভৃতি ইউরোপীয় দেশগুলি একই ভূমিখণ্ডে থাকার ফলে স্থলপথে পরস্পরের আক্রমণের বিরুদ্ধে রক্ষা ব্যবস্থাকে শক্তিশালী করার জন্য তাদেরকে বিশাল আকারে গড়ে তুলতে হয়েছিল নিয়মিত স্থলবাহিনী। এটাই ছিল তাদের দেশরক্ষার মূলসূত্র। কিন্তু ইংল্যান্ডের ক্ষেত্রে স্থলবাহিনীর পরিবর্তে নৌবাহিনীই ছিল তাদের রক্ষা ব্যবস্থার প্রধান ভিত্তি। রক্ষাব্যবস্থার এই পার্থক্য ইংল্যাণ্ড এবং মূল ইউরোপীয় ভূখণ্ডের দেশগুলির আভ্যন্তরীণ রাজনীতির উপর গভীর প্রভাব বিস্তার করে।
যে কোন দেশেই সামরিক বাহিনী, বিশেষত নিয়মিত স্থলবাহিনী দুটি মৌলিক ভূমিকা পালন করে। একদিকে তা প্রতিহত করে বৈদেশিক আক্রমণ অথবা অন্য দেশের উপর চালায় আক্রমণাত্মক হামলা। অন্য দিকে তা রাষ্ট্রযন্ত্রের ধারকদের শ্রেণীস্বার্থ রক্ষার জন্যে দমন করে আভ্যন্তরীণ প্রতিরোধ। এজন্যে যে কোন দেশেই রাষ্ট্র ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত শ্রেণী নিজের স্বার্থ রক্ষার্থে স্থলবাহিনীকে ব্যবহার করতে দ্বিধাবোধ করে না। এদিক দিয়ে নৌবাহিনীর গুরুত্ব অপেক্ষাকৃতভাবে অনেক কম।
ইউরোপীয় রাজচক্রবর্তীরাও নিয়মিত স্থলবাহিনীকে বরাবরই এভাবে ব্যবহার করে এসেছে। সেখানে, তাই নব উত্থিত বাণিজ্যিক ও শিল্প স্বার্থের হাতে আর্থিক ক্ষমতা কেন্দ্রীভূত হওয়া সত্ত্বেও সেখানকার রাজনৈতিক ক্ষমতা থেকে তারা ছিল প্রায় সম্পূর্ণভাবে বঞ্চিত। এই বঞ্চনার প্রতিকারের কোন গঠনতান্ত্রিক উপায় না থাকার ফলেই সম্ভব হয়েছিল ফরাসী বিপ্লব। বুরবোঁ রাজতন্ত্র আর্থিক দিক দিয়ে রিক্ত হয়ে পড়লেও রাজনৈতিক ক্ষমতা হস্তান্তরের কোন পরিকল্পনা অথবা প্রচেষ্টা তাদের ছিল না। অন্যদিকে নোতুন বুর্জোয়া শ্রেণীর হাতে আর্থিক ক্ষমতা কেন্দ্রীভূত হওয়ার ফলে নিজেদের হাতে রাজনৈতিক ক্ষমতা হস্তান্তর করতে তারা স্বাভাবতই ছিল আগ্রহশীল ও সচেষ্ট। আর্থিক ও রাজনৈতিক ক্ষমতার এই খণ্ডিত অবস্থার জন্য ফ্রান্সের সাধারণ জীবনযাত্রা এক চরম বিপর্যয়ের সম্মুখীন হয়েছিল। এই অবস্থায় বিপ্লব ব্যতীত বুর্জোয়া স্বার্থ এবং সামন্ত স্বার্থভিত্তিক রাজতন্ত্রের মৌলিক দ্বন্দ্বের অবসানের আর কোন পথ ছিল না। ফরাসী বিপ্লবের মাধ্যমে সেই দ্বন্দ্বেরই নিষ্পত্তি ঘটে। এই বিপ্লবের প্রভাব নেপোলিয়নের শাসনকালে ইউরোপের বিভিন্ন দেশে ছড়িয়ে গিয়ে সেখানেও বুর্জোয়া স্বার্থকে সামরিক শক্তির মাধ্যমেই, প্রতিষ্ঠিত করে। ইংল্যান্ডে কিন্তু এ জাতীয় কোন বিপ্লব সংঘটিত হয়নি। ১৬৮৮ র বিপ্লবের মাধ্যমে সেখানে যে পরিবর্তন সূচিত হয়েছিল তা ফরাসী বিপ্লবের মতো এত ব্যাপক ও রক্তাক্ত চরিত্র পরিগ্রহ করেনি। এ জন্যই এই পরিবর্তন গৌরবময় বিপ্লব নামে পরিচিত। ইংল্যান্ডে বুর্জোয়া স্বার্থ নিজেকে ক্রমশঃ প্রতিষ্ঠা করেছিল আপসের মধ্য দিয়ে সামন্ত স্বার্থের সাথে কোন সর্বব্যাপক সামরিক সংঘর্ষের মাধ্যমে নয়। এই আপসের ইতিহাস সুদূরপ্রসারী এবং ইংল্যান্ডে রাজতন্ত্রের আয়ত্তাধীন কোন বিশাল স্থলবাহিনীর অনুপস্থিতিই এই আপসকে বহুলাংশে সম্ভব করেছিল।
নৌবাহিনী গঠনের উদ্দেশ্যে দেশরক্ষা খাতে অধিকাংশ ব্যয় বরাদ্দের ফলে ইংল্যান্ডে বিশাল এক স্থলবাহিনী গঠন রাষ্ট্রের পক্ষে সম্ভব ছিল না। এজন্য আভ্যন্তরীণ বিদ্রোহ দমনের প্রয়োজন দেখা দিলে রাজাকে সব সময়েই তাঁর অধীনস্থ সামন্তদের মুখাপেক্ষী হতে হতো। কোন বৃহৎ সামরিক প্রস্তুতির জন্যে অর্থ এবং সৈন্যের প্রয়োজন হলে পার্লামেন্ট আহ্বান করে সেই প্রয়োজন মেটানোর জন্যে রাজাকে আনুষ্ঠানিকবাবে তাদের কাছে আবেদনও জানাতে হতো। এর ফলে ইংল্যান্ডের রাজা ফরাসী অস্ট্রিকম হাঙ্গেরিয়ান অথবা রুশ রাজাদের থেকে অধীনস্থ সামন্তদের ওপর থাকতেন বেশী নির্ভরশলি। এই নির্ভরশীলতার ফলে রাজাকে অনেক সময় বাধ্যতাবশত আপস করতে হতো এবং স্বাভাবিকভাবেই রাজকার্যে তাঁর অধীনস্থ সামন্তদের হস্তক্ষেপও রোধ করা যেত না। সেদিক থেকে তুলনামূলকবাবে তারা ইউরোপীয় সামন্তদের অপেক্ষা অনেকখানি বেশী স্বাধীনতা ভোগ করতো। রাজার সাথে এই সব সামন্ত স্বার্থের আপসের ইতিহাস ইংল্যান্ডে ১২১৫ সালের ম্যাগনাকার্টা স্বাক্ষর থেকেই শুরু। সেই থেকে ইংল্যান্ডের আভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে আপসের ভূমিকা খুব উল্লেখযোগ্য। তার মাধ্যমেই সেখানে রাজতন্ত্রের থেকে ক্ষমতা ক্রমশঃ হস্তান্তরিত হয় বুর্জোয়া পার্লামেন্টের হাতে আজ কেন্দ্রীভূত হয়েছে।
৬
নিজেদের রাজনৈতিক ইতিহাসের এই মূল শিক্ষাকে ইংরেজরা কোনদিন বিস্মৃত হয়নি। তাদের আপস মনোবৃত্তির ভিত্তি যাই হোক আপসের মাধ্যমে যে বিপ্লবকে রোধ অথবা বিলম্বিত করা যায় এ শিক্ষা থেকে তারা বিচ্যুত হয়নি বলেই ভারতবর্ষেও তারা জাতীয় আন্দোলনকে নিয়ন্ত্রণের ক্ষেত্রে একটা বিশেষ ভূমিকা গ্রহণে সমর্থ হয়েছিল।
ঊনিশ শতকের শেষের দিকে ভারতবর্ষে নানা আভ্যন্তরীণ পরিবর্তনের মধ্যে দিয়ে যে মধ্যবিত্ত শ্রেণীর উৎপত্তি হয়েছিল তার রাজনীতিকে আপসের মাধ্যমে আয়ত্তে আনার উদ্দেশ্যেই বৃটিশ সরকার ও বৃটিশ উদারনৈতিক মহল জাতীয় কংগ্রেসের প্রতিষ্ঠায় হস্তক্ষেপ করে। এদেশের স্বাধীনতা সংগ্রাম যাতে সশস্ত্র বিপ্লবের পথে না গিয়ে গণতান্ত্রিক রাজনীতির গণ্ডীতে আবদ্ধ থাকে তার জন্যেই সময় থাকতে তারা নিজেরাই সেই আন্দোলনের উদ্বোধন করে ভারতবাসীকে দিতে চেয়েছিল নিয়মতন্ত্রের দীক্ষা।
১৮৮৫ থেকে ভারতবাসীরা সংগঠিত রাজনৈতিক শক্তি হিসাবে ইংরেজদের কাছে যে সমস্ত দাবী উত্থাপন করেছে সেগুলিকে তারা সরাসরি অথবা সম্পূর্ণভাবে কোনদিনই অস্বীকার করেনি। দ্বিতীয়ত তারা সব সময় চেষ্টা করেছে ভারতীয়দের রাজনৈতিক দাবীদাওয়াগুলিকে এমনভাবে নিয়ন্ত্রণ করতে যাতে সেগুলির স্বীকৃতি জাতীয়তার সমস্যাকে সহজ না করে তাকে অধিকতর জটিল করে তোলে। পৃথক নির্বাচন ও প্রতিনিধিত্বের দাবী ইংরেজদের এই নীতিকেই জোরদার করে এবং এই দাবী বৃটিশ সরকারের কাছে উপস্থিত করানোর ক্ষেত্রে সরকারী গুপ্ত হন্তক্ষেপ ও কৃতিত্ব অনস্বীকার্য। আগা খান এবং নবাব মোহসীন-উল- মুক্-এর মতো প্রতিক্রিয়াশীল ও বশংবদ ব্যক্তিরাই এই ব্যাপারে ছিলেন ভারতীয় বৃটিশ সরকারের সক্রিয় সহযোগী।
ভারতীয় বুর্জোয়া চারিত্রিক দুর্বলতার জন্য তারা ব্যবসা-বাণিজ্য, চাকরী ইত্যাদির ক্ষেত্রে ইংরেজদের উপর নির্ভরশীল ছিল। এই নির্ভরশীলতার ফলেই অগ্রসর হিন্দু বুর্জোয়া এবং অনগ্রসর মুসলিম বুর্জোয়া উভয়েই অল্পবিস্তর ইংরেজ বিরোধী হলেও সেই বিরোধীতা ভারতবর্ষের স্বাধীনতা আন্দোলনের ক্ষেত্রে একটা সর্বাত্মক বিপ্লবী চরিত্র পরিগ্রহ করতে পারেনি। উপরন্তু হিন্দু-মুসলমান বুর্জোয়া আভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব রাজনীতি ক্ষেত্রে সাম্প্রদায়িকতা জন্মদান করে পরিস্থিতিকে আরও অনেক বেশী জটিল করে তুলেছিল।
সিপাহী বিদ্রোহের পতনের পূর্ব পর্যন্ত ভারতীয় সামন্ত নৃপতিদের সাথেই ছিল ইংরেজদের মূল দ্বন্দ্ব। বিদ্রোহের পতনের পর সে দ্বন্দ্বের অবসান হলেও ভারতীয় সমাজে বিকশিত হলো এক নোতুন দ্বন্দ্ব। ইংল্যান্ডের ঔপনিবেশিক দৌরাত্ম্য যত প্রখর হতে থাকলো এদেশের জনগণের সাথে তাদের দ্বন্দ্ব হয়ে উঠলো ততই তীব্র। এবং ভারতীয় বুর্জোয়ারাই অধিষ্ঠিত হলো ইংরেজদের বিরুদ্ধে এই জাতীয়তাবাদী সংগ্রামের নেতৃত্বে।
কিন্তু এই বুর্জোয়া শ্রেণীর মধ্যে ভাগ-বাঁটোয়ারা নিয়ে যে অন্তর্দ্বন্দ্ব দেখা গেলো সেটাও ইংরেজদের সক্রিয় সহযোগিতায় ক্রমশঃ দানা বাঁধতে থাকলো। বঙ্গভঙ্গ, গভর্ণর জেনারেলের কাছে পৃথক নির্বাচনের জন্য মুসলমান উচ্চ সামন্তগোষ্ঠীর আবেদন, মুসলিম লীগ ও হিন্দু মহাসভার প্রতিষ্ঠা, (এই দুই সাম্প্রদায়িক প্রতিষ্ঠানই ১৯০৬ সালে প্রতিষ্ঠিত) ১৯০৯ ও ১৯১৯-এর শাসনতান্ত্রিক ঘোষণায় সাম্প্রদায়িক নির্বাচনের স্বীকৃতি ইত্যাদির মাধ্যমে বুর্জোয়া অন্তর্দ্বন্দ্ব ধীরে ধীরে সুদৃঢ় সাম্প্রদায়িক চরিত্রের রূপ পরিগ্রহ করলো। এই সাম্প্রদায়িক রাজনীতির প্রভাব খেলাফত এবং অসহযোগ আন্দোলনের সময় কিছুটা কমে এলেও ভারতীয় বুর্জোয়ার মূলগত দুর্বলতার জন্যে সেই সব আন্দোলন কখনো সঠিক পরিণতি লাভ করেনি। তার পূর্বেই আপসধর্মী বুর্জোয়া নেতৃত্ব আন্দোলনকে প্রত্যাগার করে চেষ্টা করেছেন তাকে গঠনতান্ত্রিক রাজনীতির সংকীর্ণ গণ্ডীর মধ্যে আবার ফিরিয়ে আনতে। ভারতীয় জাতীয়তাবাদের নেতা মহাত্মা গান্ধীর এই ভূমিকা রাজনীতি ক্ষেত্রে ভারতীয় বুর্জোয়ার দ্বৈত চরিত্রকেই উদ্ঘাটন করে। একদিকে তাই দেখা যায় যে এই নেতৃত্ব বৃটিশের বিরুদ্ধে আন্দোলনের সূত্রপাত করছে কিন্তু অন্যদিকে তা আবার মধ্যপথে আন্দোলনকে প্রত্যাহার করে তাকে নামিয়ে আনছে, আপসের পথে।
কংগ্রেসী নেতৃত্ব এইভাবে মাঝে মাঝে বৃটিশবিরোধী ব্যাপক গণআন্দোলনের আহ্বান জানালেও মুসলিম লীগের কর্মসূচীতে তার কোন স্থান ছিল না। ১৯৩৫ সালের সাম্প্রদায়িক রোয়েদাদের পর মুসলমানদের রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান হিসাবে মুসলিম লীগের আধিপত্য ক্রমাগতভাবে বৃদ্ধি পায়। সেটাই ছিল স্বাভাবিক, কারণ গণতান্ত্রিক রাজনীতিক্ষেত্রে প্রত্যেককে তার ধর্মীয় পরিচয় অনুযায়ী ভোট প্রার্থনা করতে হতো। কাজেই মুসলমান মুসলমানদের উপর এবং হিন্দু হিন্দুর উপর এক্ষেত্রে হলো সর্বতোভাবে নির্ভরশীল। এই নির্ভরশীলতাই ভারতবর্ষকে গণতান্ত্রিক আন্দোলনের পথে থেকে বিচ্যুত করে তাকে চালনা করলো প্রতিক্রিয়াশীল রাজনীতির পথে। এবং তার ফলে হিন্দু মহাসভা এবং মুসলিম লীগের মধ্যে তো বটেই এমন কি কংগ্রেস মধ্যেও সাম্প্রদায়িক ও প্রতিক্রিয়াশীল প্রভাব উনশশো তিরিশের দিকে প্রবলতর হলো। এর প্রতিক্রিয়ার হিসাবে শুধু যে জাতীয়তাবাদী মুসলমানরাই অধিক সংখ্যায় কংগ্রেস ত্যাগ করে মুসলিম লীগে যোগদান করলো তাই নয়, কংগ্রেসের মধ্যে যে সমস্ত বামপন্থী দল এবং উপদলগুলি ছিল তারাও আনুষ্ঠানিকভাবে কংগ্রেসের সাথে নিজেদের সাংগঠনিক সম্পর্ক ছিন্ন করলো। জাতীয়তাবাদী প্রতিষ্ঠানের বাহ্যিক খোলস সত্ত্বেও কংগ্রেস হিন্দু সামন্ত-বুর্জোয়া স্বার্থের প্রতিভূতে পরিণত হওয়াই সম্প্রদায়গতভাবে মুসলমানদের এবং প্রগতিশীলদের কংগ্রেস পরিত্যাগের মূল কারণ। ভারতীয় বুর্জোয়ার অন্তর্নিহিত দুর্বলতা এবং এই সব অন্তর্দ্বন্দ্বের ফলে বৃটিশ সাম্রাজ্যবাদের সাথে ভারতীয় জনগণের দ্বন্দ্ব এ দেশে কোন বৈপ্লবিক আন্দোলনের জন্মদান করতে আর সক্ষম হলো না।
৭
ভারতীয় আন্দোলনের ক্ষেত্র সাম্প্রদায়িকতার উত্থান ভাষাভিত্তিক জাতীয়তাবাদের বিকাশকেও রুদ্ধ করেছিল। মুসলিম সামন্ত-বুর্জোয়া স্বার্থ হিন্দুদের প্রতিযোগিতা থেকে মুক্ত হয়ে নিজেদের শ্রেণীস্বার্থ প্রতিষ্ঠা ও প্রসারের জন্যে প্রথমে বিশেষ সুবিধা ও পরে একটি পৃথক আবাসভূমির দাবী তুলেছিল এবং দাবীকে তত্ত্বগত খোলস পরানোর জন্যে হাজির করেছিল দ্বিজাতিতত্ত্ব। হিন্দু সামন্ত-বুর্জোয়ারাও তেমনি নিজেদের শ্রেণীস্বার্থ উদ্ধারের উদ্দেশ্যে অধিকতর অগ্রসর সম্প্রদায় হিসাবে সমগ্র ভারতবর্ষকে নিজেদের আওতাধীনে রাখার জন্যে আওয়াজ তুলেছিল অখণ্ড ভারদের। এবং সেই দাবীকেও তত্ত্বগত খোলস পরানোর জন্যে তারা আবিষ্কার করেছিল একজাতিতত্ত্ব। হিন্দু-মুসলমান সামন্ত-বুর্জোয়া স্বার্থের এই সংঘাতের মধ্যে ভাষাভিত্তিক জাতীয় আন্দোলন ভারতবর্ষে আর দানা বাঁধতে পারেনি, যেমনটি সম্ভব হয়েছিল ইউরোপের ক্ষেত্রে।
শিল্প বিপ্লবের পরে ধনতন্ত্রের বিকাশের সাথে সাথে ইউরোপে ভাষাভিত্তিক জাতীয়তাবাদের গোড়পত্তন হয়। একই এলাকার অধিবাসী, একই ভাষাভাষী, মোটামুটিভাবে একই সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের অন্তর্গত এবং একই আর্থিক জীবনের অংশীদার হিসাবে বিভিন্ন ইউরোপীয় জনগোষ্ঠীরা জাতিগতভাবে সংগঠিত হয়। এইভাবে সংগঠিত হওয়ারকালে সামন্ত স্বার্থের সাথে গণতান্ত্রিক জাতীয়তাবাদী স্বার্থের দ্বন্দ্ব ক্রমশঃ ঘোরতর আকার ধারণ করতে থাকে। ইংল্যান্ডে এই দ্বন্দ্ব ধীরে ধীরে গঠনতান্ত্রিক ও সমঝোতার মাধ্যমে রূপান্তরিত হয়ে এলেও ইউরোপে তা সম্ভব হলো না। ফ্রান্সে ১৭৮৯ সালে ঘটলো সশস্ত্র বুর্জোয়া গণতান্ত্রিক বিপ্লব এবং সেই বিপ্লবের প্রতিক্রিয়া ইউরোপে সামন্তবাদের ভিত্তি ধ্বংসের কাজকে করলো ত্বরান্বিত। ঊনিশ শতকে ইউরোপীয় ধনতন্ত্রের বিকাশের সাথে তাই গণতান্ত্রিক জাতীয় রাষ্ট্রের উৎপত্তি এবং বিকাশও ছিল সমান্তরাল। ধনতন্ত্রের জাতীয় রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠা হয়েছিল এবং ১৭৮৯-র ফরাসী বিপ্লবী থেকে ১৮১৭-র প্যারিস কমিউন পর্যন্ত বিকাশের এই ধারা অব্যাহত ছিল।
ভারতবর্ষে কিন্তু ধনতন্ত্রের বিকাশের সাথে সাথে ভাষাভিত্তিক জাতীয়তাবাদ জোরদার হলো না। বুর্জোয়া শ্রেণীর সাম্প্রদায়িক অন্তর্দ্বন্দ্ব এই বিকাশকে রোধ করলো। ভারতীয় বুর্জোয়া পূর্ববর্ণিত দুর্বলতা এবং বৃটিশ সরকারের পৃষ্ঠপোষকতার উপর তাদের নির্ভরশীলতাই এর প্রধান কারণ। ইউরোপীয় বুর্জোয়ার মতো তারা যদি স্বাধীনভাবে শিল্প-বাণিজ্যকে কেন্দ্র করে গঠিত হতো তাহলে ভারতের ক্ষেত্রে সে সম্ভাবনা থাকতো। কিন্তু যে জাতীয়তাবাদী ভারতীয় বুর্জোয়া বৃটিশবিরোধী জাতয়িতাবাদী আন্দোলনের নেতৃত্বে ছিল তারা ইংরেজের সাথে বিরোধীতা সত্ত্বেও, তার উপর ছিল নির্ভরশলি। তার সাথে আবেদন নিবেদেনের পালা তাদের ১৯৪৭ পর্যন্ত শেষ হয়নি। এজন্যেই হিন্দু, মুসলমান, কংগ্রেস, লীগ প্রত্যেকে তাদের থেকে কিভাবে অধিক সুবিধা আদায় করতে পারে এই ছিল তাদের অন্যতম প্রধান তাগিদ। ভারতীয় স্বাধীনতা সংগ্রামের বৃহত্তম কাঠামোর মধ্যে ভাষাভিত্তিক জাতীয় আন্দোলনের সম্ভাবনা এই তাগিদের ফলেই ব্যাহত হয়েছিল।
হিন্দু মুসলমান সামন্ত-বুর্জোয়া স্বার্থের সংঘর্ষ যদি ভারতীয় স্বাধীনতা আন্দোলনকে দ্বিধাবিভক্ত না করতো তাহলে বাঙলা, অসমীয়া, হিন্দু, তামিল, তেলেগু, পাঞ্জাবী, সিন্ধী, পুশতু ইত্যাদি ভাষাভাষীর জনগোষ্ঠীর অনেকাংশে ফরাসী, জার্মান, বৃটিশ ইতালীয়ান ইত্যাদি ভাষাভাষীর জনগোষ্ঠীর মতোই হয়তো সংগঠিত হতো। কিন্তু একজাতিতত্ত্ব ও দ্বিজাতিতত্ত্বের প্রতাপে ভারতবর্ষে জাতীয় আন্দোলনের সে পরিণতি সম্ভব হলো না। সেটা হলো হিন্দু- মুসলমান নির্বিশেষে এক ভাষাভাষী অঞ্চলের লোকেরা একদিকে জাতিগতভাবে সংগঠিত হতো। এবং অন্যদিকে প্রয়োজনমতো একটি কেন্দ্রীয় ফেডারেল রাষ্ট্রও গঠন করতে পারতো। কিন্তু ভারতীয় রাজনীতি ব্যাপক ও বৈপ্লবিক গণ-আন্দোলনের পথে না যাওয়ায় গঠনতান্ত্রিক রাজনীতির সাম্প্রদায়িক সংকীর্ণতা সে সম্ভাবনাকে ব্যর্থ করলো।
৮
বাঙলাদেশের রাজনীতিতে একটা স্বাতন্ত্র্যবাদী চিন্তা বরাবরই ছিল। ঊনিশশো বিশের দিকে চিত্তরঞ্জন দাশের নেতৃত্বে বাঙলা কংগ্রেসের মাধ্যমে এই চিন্তা কিছুটা স্পষ্টতর রূপ নেয়। কিন্তু তা সত্ত্বেও বাঙালী জাতীয়তার ভিত্তিতে একটা সম্পূর্ণ পৃথক রাষ্ট্র স্থাপনের কথা তাঁরাও কোনদিন বলেননি। ভাষার ভিত্তিতে বাঙলাদেশে একটা পৃথক সার্বাভৌম রাষ্ট্র গঠনের আন্দোলন সর্বপ্রথম শুরু হয় ১৯৪৭-এর প্রথম দিকে। এই আন্দোলনকে বিশ্লেষণ করলে মুসলিম লীগ ও কংগ্রেসের সত্যিকার চরিত্র বিশ্লেষণের সুবিধা হবে এবং কংগ্রেসের ‘অসাম্প্রদায়িক’ ও মুসলিম লীগের ‘সাম্প্রদায়িক’ রাজনীতির মূলসূত্রও ভালভাবে উদ্ঘাটিত হবে। মুসলিম লীগের পাকিস্তান দাবীর তাত্ত্বিক ভিত্তি ছিল দ্বিজাতিতত্ত্ব। কংগ্রেসের অখণ্ড ভারতের তত্ত্বগত ভিত্তি ছিল ভারতীয় জাতীয়তা। বাঙলা ভাগের আন্দোলনের সময় বস্তুতপক্ষে কংগ্রেস লীগের এই দুই তত্ত্বই সামন্ত-বুর্জোয়া স্বার্থের অন্তর্নিহিত তাগিদে প্রায় সম্পূর্ণভাবে ভেঙ্গে পড়ে। ১৯৪৭-এর ‘স্বাধীন সার্বভৌম বাঙলা’ আন্দোলনের সূত্রপাত হয় মুসলিম লীগ নেতৃত্বের দ্বারা। পাকিস্তান আন্দোলনকালে বাঙলা ভাগের কথা পূর্বে তাঁরা চিন্তা করেননি। কিন্তু ভারত বিভাগ যখন অবধারিত হলো তখন ভারতীয় বৃটিশ সরকারের প্ররোচনায় শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জী আওয়াজ তুললেন বাঙলাদেশ ভাগ করার। এদিক দিয়ে তিনি নবাব সলিমুল্লারই উত্তরসূরী।
প্রথম দিকে কংগ্রেস নেতৃত্ব এ ব্যাপারে বেশী উৎসাহী না হলেও উৎসাহিত হতে তাঁরা বেশী সময়ও নিলেন না। শরৎচন্দ্র বসু ব্যতীত অন্যান্য কংগ্রেসী নেতারা সাম্প্রদায়িক ভিত্তিতে বাঙলাকে বিভক্ত করতে ব্যাকুল হয়ে উঠলেন। তাঁদের অসাম্প্রদায়িক জাতীয়াবাদের মুখোশ সাম্প্রদায়িক স্বার্থের তাগিদে খসে পড়লো। ‘ভারতমাতাকে’ দ্বিখণ্ডিত করতে যাঁরা নিতান্তই নারাজ ছিলেন ‘বঙ্গমাতাকে’ সাম্প্রদায়িক ভিত্তিতে দ্বিখণ্ডিত করতে তাঁরা দ্বিধা অথবা সঙ্কোচ বোধ করলেন না!
অন্যদিকে যে মুসলিম লীগের নেতারা এতদিন দ্বিজাতিতত্ত্বের সাম্প্রদায়িক বক্তব্যের ভিত্তিতে পাকিস্তান দাবী করে আসছিলেন তাঁরাই বাঙলা ভাগের আশঙ্কায় সে সম্ভাবনাকে রোধ করার জন্যে প্রস্তাব আনলেন বাঙালী সংস্কৃতির ভিত্তিতে স্বাধীন সার্বভৌম বাঙলার। স্বাধীন সার্বভৌম পূর্ব-পাকিস্তানের কথা আবুল হাশিম অবশ্য ইতিপূর্বেই উত্থাপন করেছিলেন। ১৯৪৬ সালের মুসলিম লীগ সাধারণ নির্বাচনে জয়লাভ করার পর কায়েদে আজম এপ্রিল মাসে দিল্লীতে মুসলিম লীগভুক্ত সংসদীয় সদস্যদের একটি সম্মেলন আহ্বান করেন। এই সম্মেলনের বিষয় নির্বাচনী কমিটিতে এ বিষয়ে কায়েদে আজমের সাথে আবুল হাশিমের এক বিতর্ক হয় এবং এই বিতর্কের মাধ্যমে তিনিই সর্বপ্রথম নিখিল ভারতীয় মুসলিম লীগ পর্যায়ে লাহোর প্রস্তাবের ভিত্তিতে দুই স্বাধীন সার্বভৌম পাকিস্তানের দাবী উত্থাপন করেন। (People’s Age, April ১২, ১৯৪৬) আবুল হাশিমের ক্ষেত্রে পরবর্তী স্বাধীন সার্বভৌমত্ব বাঙলার আন্দোলন অনেকাংশে ছিল সেই আন্দোলনেরই স্বাভাবিক পরিণতি। কিন্তু তবু প্রথম পর্যায়ে তিনি লাহোর প্রস্তাবের ভিত্তিতে যখন সার্বভৌম পূর্ব-পাকিস্তান (অর্থাৎ বাঙলাদেশ ও আসামের কিছু অংশ) দাবী করেছিলেন তখন তাঁর সে দাবীর প্রকৃত ভিত্তি ছিল সাম্প্রদায়িক। কিন্তু ১৯৪৭ সালের স্বাধীন সার্বভৌম বাঙলা দাবীর ভিত্তি সাম্প্রদায়িক ছিল না, সে ভিত্তি পরিবর্তিত হয়ে দাঁড়িয়েছিল বাঙালী জাতীয়তাবাদে। মুসলিম লীগের নেতৃবৃন্দ, বিশেষতঃ আবুল হাশিম এবং শহীদ সোহরাওয়ার্দী ধরে নিয়েছিলেন স্বাধীন সার্বভৌম বাঙলার অর্থ সংখ্যাগুরু মুসলমানদের আধিপত্য। সেই আধিপত্যকে স্থাপন করার জন্যে বাঙালী সংস্কৃতির কথা বলতে তাঁদের কোন অসুবিধা ছিল না। এমনকি এই প্রস্তাবে প্রথম দিকে কায়েদে আজম জিন্নাও কোন আপত্তি করেন নি। কারণ তিনিও ভেবেছিলেন যে সার্বভৌম বাঙলাদেশের অর্থই পাকিস্তান। সর্দার প্যাটেল, জওহরলাল এবং কংগ্রেসের দিকপালরাও তাই ভেবেছিলেন।
ভাষার ভিত্তিতে স্বাধীন সার্বভৌম বাঙলার পরিকল্পনা বৃটিশ সরকার সরাসরি প্রত্যাখ্যান করায় কায়েদে আজমও অবশেষে তাতে অসম্মতি জ্ঞাপন করেন। কিন্তু তা সত্ত্বেও বাঙলা ভাগের প্রশ্নে যখন ভোটাভুটির ব্যবস্থা হয় তখন বাঙলা ভাগের বিরুদ্ধে ভোট দিয়েছিলেন ‘বঙ্গমাতাকে’ দ্বিখণ্ডিত করার পক্ষে।
বৃটিশ সরকার ক্ষমতা হস্তান্তরের জন্য যে নীতিনির্ধারণ করেছিলেন সেই অনুসারে বাঙলাকে অখণ্ড রাখার প্রস্তাবে যদি পূর্ব ও পশ্চিম বাঙলার অর্থাৎ প্রধানত হিন্দু- মুসলমানদের ঐক্যমত না হয় তাহলে বাঙলাদেশকে ভাগ করার কথা ছিল। সে ঐক্যমত যে আর কিছুতেই সম্ভব নয় এ কথা ভালোভাবে জেনেই মাউন্টব্যাটেন সেই অব্যর্থ নীতিনির্ধারণ করেছিরেন। কাজেই তাঁদের পরিকল্পনা অনুসারে হিন্দু-মুসলমান সদস্যদের মধ্যে ঐক্যমত না হওয়ায় বাঙলাদেশ দুইভাগে বিভক্ত হয়ে গেল।
১৯৪৭ সালে বঙ্গভঙ্গ আন্দোলনের সময় কংগ্রেস সাম্প্রদায়িক ভিত্তিতে বাঙলা ভাগের দাবী তুলল এবং মুসলিম লীগ নেতৃত্বের এক শক্তিশালী অংশ বাঙালী সংস্কৃতির অসাম্প্রদায়িক ভিত্তির ওপর প্রতিষ্ঠা করতে চাইলো স্বাধীন সার্বভৌম বাঙলাদেশ। কংগ্রেস লীগের এই আকস্মিক ভূমিকা পরিবর্তনের কারণ হিন্দু-মুসলমান সামন্ত- বুর্জোয়ার সাম্প্রদায়িক স্বার্থ। কংগ্রেসী হিন্দুরা স্বাধীন সার্বভৌম বাঙলার সংখ্যালঘু হিসাবে নিজেদের নিরাপত্তাকে মনে করলেন বিপন্ন, যেমনটি মুসলিম লীগভুক্ত মুসলমানরা সারা ভারতে সংখ্যালঘু হিসাবে নিজেদের নিরাপত্তাকে মনে করতেন বিপন্ন ও বিঘ্নিত। এ জন্যেই মুসলমান সামন্ত-বুর্জোয়ার ভারত ভাগের এবং হিন্দু সামন্ত- বুর্জোয়ার বাঙলা ভাগের প্রস্তাব। ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের অসাম্প্রদায়িক রাজনীতি এবং মুসলিম লীগের মুসলিম সংস্কৃতি পরিচর্যার এই হলো বাস্তব ও সঠিক পরিচয়।
৯
কংগ্রেস-লীগের সামন্ত-বুর্জোয়া রাজনীতি বামপন্থী ও সমাজতান্ত্রিক রাজনীতিকে অনেকাংশে আপসপন্থী ও সংস্কারমুখী করে তুললেও তিরিশ চল্লিশের রাজনীতি বাস্তব অভিজ্ঞতার মধ্যে দিয়ে এদেশের শ্রমিক-কৃষক জনসাধারণ নিজেদের স্বার্থরক্ষার ক্ষেত্রে অনেকখানি সচেতন হয়ে ওঠে। শুধু তাই নয়, এতদিন কংগ্রেস-লীগের রাজনীতি যেমন বামপন্থী রাজনীতিকে প্রভাবিত করে এসেছিল তেমনি এখন শ্রমিক-কৃষকের এই নোতুন চেতনা এবং ট্রেড ইউনিয়ন ও কৃষক আন্দোলনের মাধ্যমে তাদের সংগঠিত রাজনীতি কংগ্রেস-লীগের সাধারণ কর্মীদের কিছুটা প্রভাবিত করতে শুরু করে। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধোত্তরকালে কৃষক-শ্রমিকের সাথে সামন্ত বুর্জোয়া শ্রেণীর দ্বন্দ্ব যত বেশি বৃদ্ধি পাচ্ছিল কংগ্রেস-লীগের নেতৃবৃন্দ ততই নিজেদের স্বার্থ রক্ষার সংগ্রামকে টিকিয়ে রাখার জন্য হচ্ছিলেন বদ্ধপরিকর। এই দ্বন্দ্ব ৫০ লক্ষ শ্রমিকের ধর্মঘট এবং ব্যাপক কৃষক আন্দোলনের মাধ্যমে বিকশিত হচ্ছিল নিত্য নোতুন রূপে।
১৯৪৬ এর দিকে সামন্ত বুর্জোয়া স্বার্থের সাথে শ্রমিক কৃষক স্বার্থের এই সংঘর্ষের মধ্যেই কংগ্রেস-লীগ রাজনীতির সংকট সীমাবদ্ধ ছিল না। সে সংকট পরিব্যাপ্ত হয়ে বৃটিশ- ভারতীয় নৌ, বিমান এবং স্থলবাহিনীকেও গ্রাস করতে উদ্যত হয়েছিল। ১৯৪৬ এর ২১ শে ফেব্রুয়ারী বৃটিশ-ভারতীয় নৌবাহিনীর মধ্যে যে ব্যাপক ও সর্বাত্মক বিদ্রোহের শুরু হয় সেটাই হয় এই সঙ্কটের বৃহত্তর উদাহরণ। সিপাহী বিদ্রোহের পর বৃটিশ বাহিনীতে এত বড় বিদ্রোহ আর কখনও সংঘটিত হয়নি। নৌ বিদ্রোহের প্রভাবে বৃটিশ-ভারতীয় বাহিনীর অন্যান্য অংশেও বিস্তৃত হওয়ার সম্ভাবনা দেখা দেয়। কিন্তু এই ‘বিপর্যয় শুধু বৃটিশ-ভারতীয় সরকারেরই বিপর্যয় ছিল না। কংগ্রেস-লীগের বুর্জোয়া নেতৃত্বই বিদ্রোহের যথার্থ তাৎপর্য উপলব্ধি করে তাকে খতম করতে হয়েছিল বদ্ধপরিকর। কংগ্রেস লীগের উচ্চতম নেতৃত্ব তাই বৃটিশবিরোধী এই বিদ্রোহকে দমন করার কাজে হাত মেলালেন বৃটিশ সরকারের সাথে। এর পর থেকে কৃষক, শ্রমিক, নিম্নমধ্যবিত্ত এবং বৃটিশ-ভারতীয় বাহিনীর মিলিত স্বাধীনতা সংগ্রামের সম্ভাবনার কথা চিন্তা করে বৃটিশ সরকারের সাথে কংগ্রেস-লীগ নেতৃত্ব ভারতীয় সমস্যার একটি ত্রিপক্ষীয় সমাধানের উপায় অন্বেষণে নিযুক্ত হলেন। ১৯৪৬-৪৭ সালে তাঁদের রাজনৈতিক কর্মতৎপরতার সেটাই হয়ে দাঁড়াল সর্বপ্রধান তাগিদ।
১০
বৃটিশ সরকার ভারতীয় পরিস্থিতির পর্যালোচনা করে উপলব্ধি করল যে, যে ভারত ত্যাগ করতে তারা যদি বিলম্ব করে তা হলে এদেশে যে বৈপ্লবিক রাজনৈতিক পরিস্থিতির উদ্ভব হবে তাকে আয়ত্তাধীন রাখা তাদের পক্ষে আর সম্ভব হবে না। পরিস্থিতি পরিবর্তনের সাথে সাথে কংগ্রেস লীগের প্রভাবও ক্রমশঃ ক্ষয়প্রাপ্ত হয়ে গঠনতান্ত্রিক রাজনীতির ভিত্তি বিনষ্ট হবে এবং সমাজতান্ত্রিক রাজনীতির উত্থানের ফলে ভারতবর্ষে বৃটিশ পুঁজির স্বার্থ সর্বতোভাবে বিপন্ন হয়ে পড়বে। কংগ্রেস-লীগ দেখলো যে তারা যদি অখণ্ড ভারত অথবা অখণ্ড পাঞ্জাব ও বাঙলা নিয়ে গঠিত পাকিস্তানের দাবীতে অবিচল থাকে তাহলে ভারতীয় রাজনীতিক্ষেত্রে তাদের শ্রেণীস্বার্থ ও নেতৃত্ব অদূর ভবিষ্যতে বিনষ্ট হওয়ার সম্ভাবনা। কাজেই এইসব বিবেচনার ফলে বৃটিশ সরকার এবং কংগ্রেস লীগ একটা পারস্পরিক আপস রফাকেই সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিলো। ভারতবর্ষ, পাঞ্জাব ও বাঙলাদেশকে বিভক্ত করার পরিকল্পনার মাধ্যমে বৃটিশরকার রক্ষা করতে চাইলো তার বিশাল পুঁজির স্বার্থকে এবং কংগ্রেস-লীগ সচেষ্ট হলো ব্যাপক শ্রমিক-কৃষক নিম্নমধ্যবিত্তের গণ উত্থানকে রোধ করে এদেশে সামন্ত- বুর্জোয়া স্বার্থ-সংরক্ষণ ও সম্প্রসারণ করতে।
বৃটিশ পার্লামেন্টে ভারতবর্ষে ক্ষমতা হস্তান্তরের সর্বশেষ তারিখ নির্ধারণ করেছিল ১৯৪৮- এর জুন মাস। কিন্তু ১৪৪৭ এর প্রথম থেকেই ভারতীয় রাজনীতিক্ষেত্রে বৈপ্লবিক পরিস্থিতির দ্রুত পরিবর্তনের ফলে তাদের আতঙ্ক স্বভাবতঃই অনেকাংশে বৃদ্ধি পায়। ফলে বৃটিশ সরকার নির্ধারিত তারিখের পূর্বেই ভারত ত্যাগের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। এর পর মাউন্টব্যাটেন তাঁর সরকারের ব্যাপক পরিকল্পনাকে দ্রুত আলোচনার আবর্তে নিক্ষেপ করে তাকে কার্যকরী করেন। এবং ১৪ই আগষ্ট ভারতবর্ষের সামন্ত-বুর্জোয়া নেতৃত্বের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করে নিজেদের কায়েমী স্বার্থ রক্ষণাবেক্ষণ এবং বৃহত্তর গণঅভ্যুত্থান ও বিপ্লবের সম্ভাবনাকে পিছিয়ে দেওয়ার ব্যবস্থা করেন। এভাবেই পাক- ভারতীয় উপমহাদেশে বৃটিশের ঔপনিবেশিক রাজত্বের পর এই ভূখণ্ডে স্থপিত হয় ইঙ্গ-মার্কিন নয়া উপনিবেশবাদের ভিত্তিপ্রস্তর।