মুসলিম জাতীয়তাবাদ ও মুসলিম সংস্কৃতি
১৯৪০ সালের লাহোর প্রস্তাবের[১] ভিত্তিতেই ভারতীয় উপমহাদেশের মুসলমানদের জাতীয় আন্দোলন এক বিশেষ রূপ পরিগ্রহ করে। কাজেই পাকিস্তান আন্দোলনের যথার্থ চরিত্রকে বোঝার জন্য এই প্রস্তাবের তাৎপর্যকে উলব্ধি করা দরকার। লাহোর প্রস্তাবের মধ্যে যে জিনিসটি সব থেকে উল্লেখযোগ্য সেটি হচ্ছে সাম্প্রদায়িক ভিত্তিতে দেশকে বিভক্ত করার প্রস্তাব। এখানে আদর্শভিত্তিক রাষ্ট্র অথবা ইসলামের কোন উল্লেখ নেই। এর মধ্যে যে অভিযোগের ইঙ্গিত ও দাবীর ঘোষণ আছে সে ইঙ্গিত এবং ঘোষণা আদর্শের নয়, সাম্প্রদায়িক স্বার্থরক্ষার।
এই দুইয়ের পার্থক্য সুস্পষ্ট। কারণ মুসলমানদের সাম্প্রদায়িক স্বার্থ এবং ইসলামী রাষ্ট্রের আদর্শ মোটেই এক জিনিস নয়। ইসলামী রাষ্ট্রে মুসলমান মধ্যবিত্ত, যাঁরা পাকিস্তান আন্দোলনের নেতৃস্থানে এবং পুরোভাগে ছিলেন, তাঁদের স্বার্থ যথাযথভাবে রক্ষিত হবে এমন কথা নেই। এবং মুসলমান মধ্যবিত্তের স্বার্থ এমন এক রাষ্ট্রব্যবস্থায় যথাযথভাবে রক্ষিত হওয়া সম্ভব যে ব্যবস্থার সাথে ইসলামী আদর্শের কোন যোগাযোগ নেই। লাহোর প্রস্তাবের এ দাবীকে তাই আদর্শভিত্তিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার দাবী বলা চলে না। এ দাবী ছিল ভারতের মুসলমান সংখ্যাগরিষ্ঠ এলাকার মুসলমানদের ঐহিক স্বার্থরক্ষার দাবী।
২
ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার সাথে সব থেকে নিকটবর্তী কথা যেটা মুসলিম লীগের নেতারা বলেছিলেন সেটা হচ্ছে সাংস্কৃতিক আত্মনিয়ন্ত্রণের কথা। তাঁদের মতে ভারতীয় হিন্দু এবং ভারতীয় মুসলমানদের সংস্কৃতি এক তো নয়ই উপরন্তু তাদের তফাৎ একেবারে মৌলিক। বিভিন্ন প্রদেশ এবং ভাষাভাষী অঞ্চলের হিন্দু মুসলমানের সাংস্কৃতিক জীবনের পার্থক্য তাঁদের চোখে পড়েনি। তাঁরা শুধু ধরে নিয়েছিলেন ভারতীয় হিন্দু সংস্কৃতি এক এবং মুসলমানদের সংস্কৃতি অন্য। কাজেই মুসলমানদের স্বতন্ত্র বিকাশের জন্য তাঁরা প্রয়োজন বোধ করেছিলেন স্বতন্ত্র রাষ্ট্র পাকিস্তানের। এ দাবী তাঁদের পক্ষে ছিল অত্যন্ত স্বাভাবিক কারণ সাম্প্রদায়িক স্বার্থ বলতে সাধারণতঃ আর্থিক স্বার্থ যেমন চাকুরী ব্যবসা-বাণিজ্য ইত্যাদি স্বার্থ) বোঝালেও সাম্প্রদায়িক স্বার্থের একটা সাংস্কৃতিক দিকও ছিল এবং পাকিস্তান আন্দোলনে সেই দিকটি রচনা করলো আন্দোলনের আবেগ অনুভূতির ভিত্তিভূমি।
কিন্তু তাই বলে সাম্প্রদায়িক সাংস্কৃতিক আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার এবং দাবীকে আদর্শ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার দাবী বলে ব্যাখ্যা করলে ঐতিহাসিকতার ক্ষেত্রে একটা গুরুতর ভুল করা হবে। যে কোন দেশের, সমাজের অথবা সম্প্রদায়ের ধর্মীয়, ভাষাগত, আবেগজাত এবং আধিমানসিক ঐতিহ্যের সাথে যোগসূত্র বিচ্ছিন্ন না করে মোটামুটিভাবে তার ভিত্তিতে সমসাময়িক আর্থিক জীবনের সাথে সামঞ্জস্য রক্ষা করে নিজেদের সংস্কৃতিকে রূপান্তরিত এবং নব নবভাবে গঠন করা। সাম্প্রদায়িক সাংস্কৃতিক আত্মনিয়ন্ত্রণের অর্থকে তাই কোনক্রমেই ধর্মীয় রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার সাথে এক করে দেখা চলে না। এ দুই ভিন্ন জিনিস | সাংস্কৃতিক আত্মনিয়ন্ত্রণ এবং ধর্মীয় রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার সমস্যাকে বোঝার জন্য এদেরকে তাই ভিন্ন করে দেখাই ভাল।
৩
কায়েদে আজম জিন্না তাঁর দ্বিজাতিতত্ত্বকে পাকিস্তান আন্দোলনের তাত্ত্বিক ভিত্তি হিসাবে বিবেচনা এবং বর্ণনা করেন। দ্বিজাতিতত্ত্বের ব্যাখ্যাকালে কায়েদে আজম সম্প্রদায় এবং জাতিকে তফাৎ করে দেখেননি।২ ভারতীয় হিন্দু এবং মুসলমান যে দুই ভিন্ন জাতি এর প্রমাণ স্বরূপ তিনি যে সমস্ত যুক্তির অবতারণা করেছিলেন এবং ভারতীয় সামাজিক, আর্থিক, রাজনৈতিক এবং সাংস্কৃতিক জীবনের থেকে তাঁর যুক্তির সপক্ষে যে সকল উদাহরণ উল্লেখ করেছিলেন তাঁর থেকেই তাঁর এই ধারণা নিঃসন্দেহে প্রমাণিত হয়। এজন্যই ভারতীয় রাজনীতির সর্ববৃহৎ সমস্যা হিসাবে তিনি দেখেছিলেন সাম্প্রদায়িকতাকে, ধর্মীয় রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার সমস্যাকে নয়।
ভারতবর্ষে সাম্রাজ্যবাদবিরোধী জাতীয়তাবাদী আন্দোলন যে পরিশেষে দ্বিধাবিভক্ত হয়ে সাম্প্রদায়িক জাতীয়তাবাদে রূপান্তরিত হয়েছিল এ বিষয়ে ঊনিশশো চল্লিশের দিকে কংগ্রেস লীগের নেতাদের মনে বিশেষ কোন সংশয় ছিল না। কংগ্রেস ও সমস্যাকে খোলাখুলিভাবে শেষ পর্যন্ত অস্বীকার করলেও তার বাস্তবতা সম্পর্কে কংগ্রেসী নেতাদের ধারণা ছিল সুস্পষ্ট এজন্য দেখা যায় যে, ১৯৪৪ সালে কায়েদে আজম এবং মহাত্মা গান্ধীর মধ্যে যে বিখ্যাত পত্রাবলী[৩] বিনিময় হয়েছিল তার মধ্যে মুখ্যতঃ আলোচিত হয়েছিল একটিমাত্র জিনিস: তৎকালীন রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে সাম্প্রদায়িক সমস্যা।
কেবিনেট মিশন প্রস্তাবে পকিস্তানের কোন উল্লেখই ছিল না। সেখানে প্রস্তাব ছিল সারা ভারতবর্ষকে ক, খ এবং গ এই তিনটি স্বায়ত্তশাসিত এলাকায় বিভক্ত করে ভারতবর্ষে একটি ফেডারেশন স্থাপন। এ প্রস্তাবের মধ্যে ভারতের সাম্প্রদায়িক সমস্যার সমাধানের সম্ভাবনা থাকায় বহু বিঘোষিত লাহোর প্রস্তাবকে উপেক্ষা করে কায়েদে আজম কেবিনেট মিশন প্রস্তাবে প্রায় সম্মত হয়েছিলেন। পরবর্তী আলোচনায় কংগ্রেস নেতাদের, বিশেষ করে নেহরুর সাথে, মতদ্বৈধ হওয়ায় তিনি এ প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেন। কিন্তু এ প্রত্যাখ্যান সত্ত্বেও একথা স্মরণ রাখা দরকার যে প্রথম দিকে তিনি এ প্রস্তাবে মোটামুটিভাবে সম্মত ছিলেন এবং সে সম্মতি যদি তিনি চূড়ান্তভাবে দান করতেন তা হলে ভারতের সাম্প্রদায়িক সমস্যার একটা সমাধান হলেও তাতে ইসলামী রাষ্ট্র অথবা পাকিস্তান প্রতিষ্ঠিত হতো না। পাকিস্তান আন্দোলনের চরিত্রকে বোঝার জন্য ভারতবর্ষের সাম্প্রদায়িক সমস্যার এই স্বরূপ যথার্থভাবে বোঝা দরকার। এ সমস্যা যে মুসলিম লীগের মূল রাজনৈতিক ভিত্তি ছিল তার প্রমাণ লাহোর প্রস্তাবের পূর্বেও পাওয়া যায়। ১৯৩৫ সালের সংবিধান অনুযায়ী নির্বাচনের পর কংগ্রেসে যে সকল প্রদেশে ক্ষমতা লাভ করে সেখানে মুসলমানদের উপর কীভাবে অবিচার অত্যাচার হয়েছিল সে বিষয়ে ওয়াকেফহাল হওয়ার জন্য সাা ভারত মুসলিম লীগের কাউন্সিল ১৯৩৮ সালে একটি কমিটি গঠন করে। পীরপুরের রাজা মোহাম্মদ মেহদী এ কমিটির সভাপতি ছিলেন। এজন্য এ কমিটির রিপোর্টকে ‘পীরপুর রিপোর্ট’ নামে অভিহিত করা হয়। রিপোর্টটির প্রথম দিকেই সাম্প্রদায়িক সমস্যার উপর একটি সংক্ষিপ্ত আলোচনা আছে। এ আলোচনায় ইসলাম অথবা কোন ধর্মীয় সমস্যা সম্পর্কে বিশেষ কোন উল্লেখযোগ্য আলোচনা নেই। সাম্প্রদায়িক সমস্যা যে জাতীয়তাবাদ থেকে স্বতন্ত্র নয়, উপরন্তু জাতীয়তাবাদেরই রূপান্তর এ জ্ঞান মুসলিম লীগের নেতাদের ছিল। কাজেই জাতীয়তাবাদের প্রশ্নের সাথে ধর্মীয় প্রশ্নের কিছু সম্পর্ক থাকলেও তার গুরুত্ব জাতীয়তাবাদের থেকে কোন অংশেই বেশী ছিল না।[৪] কংগ্রেস লীগের নেতারা দীর্ঘ আলোচনা সত্ত্বেও শেষ পর্যন্ত একমত হতে অক্ষম হওয়ায় ১৯৪৬ সালে সারা দেশে নেমে এলো সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা। ভারতবর্ষের একপ্রান্ত থেকে অন্য প্রান্ত পর্যন্ত প্রবহিত হলো হিন্দু-মুসলমানের মিলিত রক্তে। অদৃষ্টপূর্ব এই রক্তপাতের ফলে পরিশেষে ভারতের রাজনৈতিক জীবনে হিন্দু মুসলমানের সমঝোতার প্রয়োজন হলো নিতান্তই অপরিহার্য। দেশ বিভাগ ব্যতীত মুসলিম লীগ এবং কংগ্রেসের নেতারা অন্য কোন সর্বসম্মত পথ খুঁজে পেলেন না। দীর্ঘ দিনের দ্বন্দ্ব, কলহ এবং রক্তস্নানের পর ১৯৪৭ সালের ১৪ই আগষ্ট ভারতবর্ষের উত্তর পশ্চিম এবং পূর্ব সীমান্তের মুসলমান সংখ্যাগরিষ্ঠ এলাকাগুলি নিয়ে গঠিত হলো স্বাধীন রাষ্ট্র পাকিস্তান। কায়েদ আজম জিন্না ঘোষণা করলেন ভারতীয় উপমহাদেশে সাম্প্রদায়িক সমস্যার অবসানের কথা।
৪
স্বাধীনতার পর পাকিস্তানের সংবিধান সভার সভাপতিরূপে কায়েদে আজমের প্রথম বক্তৃতা অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। এই উদ্বোধনী ভাষণে তিনি ঘোষণা করেন নোতুন রাষ্ট্রের চারিত্রিক পরিচয়। এ প্রসঙ্গে তিনি বলে যে সেদিন থেকে পাকিস্তানে হিন্দু, মুসলমান, বৌদ্ধ, খৃষ্টানের মধ্যে কোন তফাৎ নেই। নোতুন রাষ্ট্রের বিভিন্ন কর্মক্ষেত্রে সকলে অংশগ্রহণ করবে ধর্মের ভিত্তিতে নয়, পাকিস্তানী জাতীয়তার ভিত্তিতে। এদেশের অধিবাসীদেরকে তাই আর হিন্দু, মুসলমান, বৌদ্ধ, খৃষ্টান ইত্যাদি হিসাবে না দেখে দেখতে হবে পাকিস্তানী রূপে। তারা সকলে পাকিস্তানী, এই হলো সেদিন থেকে তাদের মুখ্য এবং জাতীয় পরিচয়।[৫] কায়েদে আজমের এই বক্তৃতার মধ্যে দ্বিজাতিতত্ত্ব অথবা ধর্মীয় রাষ্ট্রের কোন উল্লেখ নেই।
যে কথা আছে সে কথা সে কোন বিচক্ষণ, প্রবীণ এবং অভিজ্ঞ রাজনীতিবিদদের কথা। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠানকে কায়েদে আজম ধরে নিয়েছিলেন সাম্প্রদায়িক সমস্যার নিশ্চিত সমাধান হিসাবে। কাজেই সে সমস্যার কোন পুনরুল্লেখ করা তিনি প্রয়োজন বোধ করেননি। এমন কি তার কোন ইঙ্গিতও তাঁর এই ঐতিহাসিক ভাষণের মধ্যে অনুপস্থিত। একদিকে এই ভাষণে এদেশের নোতুন জাতীয়তাবাদের ভিত্তি সম্পর্কে তাঁর গুরুত্বপূর্ণ ঘোষণা এবং অন্যদিকে দ্বিজাতিতত্ত্ব ও আদর্শ ভিত্তিক রাষ্ট্রের অনুল্লেখ দুইই বিশেষভাবে তাৎপর্যপূর্ণ। সাম্রাজ্যবাদী শাসন আমলের রাজনীতির বাস্তবতা এবং স্বাধীনতা উত্তরকালে পাকিস্তানী রাজনীতির বাস্তবতার মধ্যে পার্থক্য উপলব্ধি করতে কায়েদে আজম জিন্নার সময় লাগেনি। ভারতীয় মুসলমান সম্প্রদায়ের অবিসংবাদী নেতা হিসাবে তিনি দ্বিজাতিতত্ত্বের যে ঘোষণা করেছিলেন সে ঘোষণার পুনরুল্লেখ করা পাকিস্তানী রাষ্ট্রের প্রধান হিসাবে তাঁর পক্ষে সম্ভব হয়নি। কারণ দুই সম্প্রদায়ের আর্থিক ও রাজনৈতিক জীবনের প্রভেদ এবং সাংস্কৃতিক জীবনের পার্থক্যের উপর জোর দেওয়াতেই ভারতকে ভাগ করা সম্ভব হয়েছিল। পাকিস্তানে সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলমানেরা নোতুন রাষ্ট্রে যখন নিশ্চিন্তে প্রতিষ্ঠিত হলো এবং অন্য সম্প্রদায়ের পক্ষ থেকে যখন কোন বাধা-বিপত্তির সম্ভাবনা আর রইলো না, সে অবস্থায় দ্বিজাতিতত্ত্ব আর্থিক এবং রাজনৈতিক জীবনে হলো নিতান্তই নিষ্প্রয়োজনীয়। এ প্রয়োজনের অভাব কায়েদে আজম উপলব্ধি করেছিলেন পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পরদিনই।[৬] এজন্যই স্বাধীনতাপূর্ব ভারতবর্ষে যে কারণে হিন্দু মুসলমান কংগ্রেস নেতারা অখণ্ড ভারত এবং এক জাতিতত্ত্বের কথা বলেছিলেন, ঠিক সেজন্যই কায়েদে আজমও স্বাধীনতার পর এমনকি পূর্বেও[৭] বলেছিলেন পাকিস্তানের অখণ্ডতা এবং এক জাতিতত্ত্বের কথা। দুই বিভিন্ন অর্থনৈতিক অবস্থা এবং রাজনৈতিক পরিবেশে একই ব্যক্তির এই দ্বিবিধ মনোভাব আপাতদৃষ্টিতে অদ্ভুত মনে হলেও রাজনৈতিক বাস্তবতার দিক থেকে বিচার করলে সেটাকেই মনে হবে সব থেকে স্বাভাবিক এবং রাজনৈতিক বিবেচনা প্রসূত। এর পর অন্যান্য সভা-সমিতিতে এবং চিঠিপত্রে[৮] কায়েদে আজম দুই একবার ইসলামী নীতি অনুসারে রাষ্ট্র পরিচালনার কথা বললেও আপেক্ষিকভাবে সে সব উক্তি তাৎপর্যহীন। সংবিধান সভার সরকারী বক্তৃতার সাথে তাদের গুরুত্বের কোন তুলনা হয় না। তাঁর এ বক্তৃতা থেকে একথাও স্পষ্ট বোঝা যায় যে, কায়েদে আজম ধর্মীয় রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার স্বাপ্নিক ছিলেন না। তিনি মুখ্যত ছিলেন ভারতীয় মুসলমানদের স্বার্থসচেতন বিচক্ষণ রাজনীতিবিদ।
৭
পাকিস্তান প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল ভারতীয় উপমহাদেশের মুসলমানদের, বিশেষতঃ মধ্যবিত্ত মুসলমানদের স্বার্থরক্ষার তাগিদে। যে সাংস্কৃতিক আত্মনিয়ন্ত্রণের কথা এ প্রসঙ্গে উঠেছিল সে আত্মনিয়ন্ত্রণও মূলতঃ মুসলমান মধ্যবিত্তের। ১৯৪৭ সালের আগষ্ট মাসের পর থেকে আজ পর্যন্ত পাকিস্তানের ইতিহাস বিচার করলে দেখা যাবে যে পাকিস্তানের ১৯৫৬ সালের এবং বর্তমান সংবিধানে [অর্থাৎ ১৯৬২ সালের সংবিধান] পাকিস্তান ইসলামী প্রজাতন্ত্র ঘোষিত হলেও দেশের আর্থিক এবং সাংস্কৃতিক জীবনে, বিশেষত মধ্যবিত্তের ক্ষেত্রে, ইসলামের প্রভাব পূর্বাপেক্ষা বৃদ্ধিপ্রাপ্ত তো হয়ইনি উপরন্তু হ্রাস পেয়েছে বহুলাংশে।
যে কোন দেশে জাতীয় আন্দোলন মোটামুটি ভাবে পরিচলিত হয় মধ্যবিত্তের নেতৃত্বে এবং মধ্যবিত্তের স্বার্থ সংরক্ষণের প্রচেষ্টায়। পাকিস্তানের অর্থনৈতিক অগ্রগতি এবং রাজনৈতিক উত্থান-পতনের ইতিহাসকে বিচার করে দেখলে দেখা যাবে যে অন্যান্য জাতীয় রাষ্ট্রের সাথে পাকিস্তানের উল্লেখযোগ্য কোন তফাৎ নেই। পাকিস্তানকে যাঁরা ইসলামী রাষ্ট্রের আন্দোলন বলে অভিহিত করেন তাঁরা সাধারণতঃ রাজনৈতিক বক্তৃতা এবং প্রবন্ধ নিবন্ধের মাধ্যমে এ কথা বলেন যে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর ক্ষমতাসীন রাজনীতিবিদ, শিক্ষা বণিক শ্রেণী এবং নবউত্থিত বুদ্ধিজীবী সম্প্রদায় পাকিস্তানের আদর্শের প্রতি বিশ্বাসঘাতকতাপূর্বক নিজেদের স্বার্থরক্ষায় সচেষ্ট হওয়ায় এদেশ ইসলামী আদর্শ এবং ঐতিহ্য থেকে হয়েছে অনেকখানি বিচ্যুত ও বিচ্ছিন্ন। এক্ষেত্রে যে বিষয়টি বিশেষভাবে লক্ষণীয় সেটি হচ্ছে পাকিস্তানের বর্তমান মুসলমান সমাজের ইসলামী আদর্শ এবং ঐতিহ্য থেকে বিচ্যুত ও বিচ্ছিন্ন হওয়ার প্রশ্ন। পাকিস্তানের মুসলমানদের রাজনৈতিক, আর্থিক এবং সাংস্কৃতিক জীবন আজ য়ে ইসলামী আদর্শের উপর প্রতিষ্ঠিত এবং ইসলামী ঐতিহ্যের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত নয়, অন্ততঃ সন্তোষজনকভাবে, এ ব্যাপারে সকলেই একমত। এক্ষেত্রে এই মতৈক্যের গুরুত্ব এবং তাৎপর্য অনেক। কারণ এটাই আজ পাকিস্তানী মুসলমান জীবনের বাস্তবতা। আমাদের জীবন আজ যে পথ ধরে ক্রমশঃ রূপান্তরিত হচ্ছে সে পথ আর যাই হোক ইসলামী আদর্শ ঐতিহ্যের পথ নয়।
পাকিস্তানের বর্তমান ধর্মীয় জীবনের এ শৈথিল্যকে অনেকে রাজনৈতিক মূঢ়তা এবং বিশ্বাসঘাতকতার উৎপত্তি বলে ব্যাখ্যা করলেও কোন বিশেষ শ্রেণী, সম্প্রদায় অধবা গোষ্ঠীর বিশ্বাসঘাতকতার মধ্যে এ শৈথিল্য এবং ধর্মনিরপেক্ষতার সন্ধান পাওয়া সম্ভব নয়। এর সন্ধান মিলবে পাকিস্তান আন্দোলনের সত্যিকার চরিত্র বিশ্লেষণে এবং পাকিস্তানের ইতিহাসেবের সংস্কারমুক্ত আলোচনায়।
৬
ইংরেজ রাজত্বের সময় ভারতবর্ষকে শিল্পপ্রধান দেশ বলা চলতো না। তবু ভারতের কোন কোন প্রদেশে যেমন বোম্বাই, বিহার এবং বর্তমানে পশ্চিমবঙ্গে কিছু কিছু উল্লেখযোগ্য শিল্পের অস্তিত্ব ছিল। এ তুলনায় বর্তমানে পাকিস্তান অন্তর্ভুক্ত প্রদেশগুলিতে বিশেষ কোন উল্লেখযোগ্য শিল্পই ছিল না। ইংরেজদের সময় পূর্ব এবং পশ্চিম পাকিস্তানের বিভিন্ন অঞ্চলগুলিতে যাঁরা মানুষের আর্থিক ও রাজনৈতিক জীবনকে নিয়ন্ত্রিত করতেন তাঁদের ক্ষমতার উৎস প্রধানতঃ ছিল ভূমিস্বত্ব। পশ্চিম পাকিস্তানের মতো পূর্ব পাকিস্তানে সামন্ততান্ত্রিক প্রভাব এত প্রবল না হলেও এখানকার আর্থিক ও রাজনৈতিক জীবনও তাঁরাই নিয়ন্ত্রিত করতেন যাঁরা ছিলেন জমির মালিক। এঁদের মধ্যে অনেকে ব্যবসা-বাণিজ্য চাকরী ইত্যাদিতে নিযুক্ত থাকলেও এঁদের মুখ্য পরিচয় ছিল, জমির সাথে প্রত্যক্ষ অথবা পরোক্ষ যোগাযোগের মাধ্যমে। এজন্যই পূর্ব পাকিস্তানে সামন্ততন্ত্র পশ্চিম পাকিস্তানের মতো প্রভাবশালী না হলেও এদেশের সমাজকে ভূমিনির্ভর বলার কোন অসুবিধা নেই।
১৯৪৭ সালে আগষ্ট মাসে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর থেকে আজ পর্যন্ত এদেশের অর্থনৈতিক অগ্রগতিকে বিবেচনা করলে দেখা যাবে যে ধীর পদক্ষেপ হলেও অগ্রগতির মূল লক্ষ্য এদেশের মাটিতে শিল্প বাণিজ্যের প্রসারের মাধ্যমে ধনতন্ত্রের প্রতিষ্ঠা। ধনতন্ত্রের এ ক্রমবিকাশের ফলে এদেশের জীবনে যে পরিবর্তন পরিলক্ষিত হচ্ছে তা অত্যাশ্চর্য না হলেও উল্লেখযোগ্য। এ পরিবর্তনের ফলে একদিকে যেমন দেশের অর্থনৈতিক জীবন ক্রমশঃ রূপান্তরিত হয়ে চলেছে অন্যদিকে তেমনি রাজনৈতিক জীবনও এ রূপান্তরের দ্বারা হচ্ছে অধিকতর চিহ্নিত। পাকিস্তান এখনো মোটামুটিভাবে কৃষিপ্রধান দেশ হলেও শিল্প-বাণিজ্য ব্যবসাজীবী মধ্যবিত্তের প্রভাব শুধু এদেশের আর্থিক জীবনে নয়, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক জীবনেও সুপরিস্ফুট। এদেশের অর্থনীতি, রাজনীতি এবং সংস্কৃতিতে মধ্যবিত্তের যে প্রভাব আজ পরিলক্ষিত হচ্ছে সে প্রভাবের সাথে অন্যান্য ইউরোপীয় দেশের জীবনে মধ্যবিত্তের রাজনৈতিক, আর্থিত ও সাংস্কৃতিক প্রভাবের কোন চারিত্রিক গরমিল অথবা তফাৎ নেই। আমাদের দেশের অর্থনৈতিক উন্নতি এবং রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক জীবন আজ যে পথ ধরে প্রবাহিত, মোটামুটি সে পথ ধরেই অগ্রসর হয়েছিল ঊনিশ শতকের ইংলণ্ড হল্যাণ্ড ফ্রান্স এবং ইউরোপের অন্যান্য দেশের আর্থিক, রাজনৈতিক এবং সাংস্কৃতিক জীবন। অবশ্য এ জীবনযাত্রার মধ্যে পার্থক্যও আছে এবং সেটাই স্বাভাবিক। কিন্তু, তা সত্ত্বেও এ পার্থক্য তুলনায় এত গৌণ যে তাকে স্বীকার করে নিয়েও একথা নিঃসন্দেহে বলা চলে যে ধনতন্ত্রের বিকাশের যে ধারা অতীতে ইউরোপে আমরা প্রত্যক্ষ করেছি মোটামুটিভাবে সেই ধারাকেই অবলম্বন করে আজকের পাকিস্তানে ধনতন্ত্র মধ্যবিত্তের উন্নতি প্রবাহমান। খৃষ্টান ইউরোপ এবং মুসলিম পাকিস্তানের মধ্যে এদিক থেকে উল্লেখযোগ্য কোন পার্থক্য নেই।[৯]
৭
মুসলমান জাতীয়তাবাদের (যার মূল লক্ষ্য মুসলমানদের জন্য স্বতন্ত্র রাষ্ট্রপ্রতিষ্ঠা) ব্যাখ্যাকালে মুসলমানদের সাংস্কৃতিক বৈশিষ্ট্যের কথা অনেকে জোর দিয়ে বলেন এবং স্বভাবতঃই। কারণ জাতীয়তাবাদের সাথে জাতির সংস্কৃতির যোগাযোগ অবিচ্ছিন্ন। পাকিস্তান আন্দোলন কালেও ভারতীয় মুসলমানদের বৈশিষ্ট্যের উপর সাধারণভাবে অনেক গুরুত্ব আরোপ করা হয়।[১০] ভারতীয় মুসলমানদের সংস্কৃতি অন্যান্য ভারতীয় ধর্মীয় সম্প্রদায়ের, বিশেষতঃ হিন্দু সম্প্রদায়ের, সংস্কৃতি থেকে যে সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র্য মুসলিম লীগের নেতারা এ কথাটিকে বিশেষভাবে প্রচার করেছিলেন। এই প্রচারের মুখ্য উদ্দেশ্যে ছিল এ কথা প্রমাণ এবং প্রতিষ্ঠা করা যে, ভারতবর্ষের বিভিন্ন সম্প্রদায়ের সংস্কৃতির আসল ভিত্তি সাধারণ ভাষা, বাসভূমি, রাষ্ট্রীয় জীবন, সাহিত্য, সঙ্গীত, আর্থিক জীবন ইত্যাদি নয়। এ সংস্কৃতির ভিত্তিভূমি রচিত হয়েছে প্রায় সম্পূর্ণভাবে ধর্মের দ্বারা।[১১] কাজেই বৃহত্তর ভারতীয় জীবনে বিভিন্ন সম্প্রদায়ের সাংস্কৃতিক জীবনই পরস্পর থেকে বিচ্ছিন্ন এক একটি দ্বীপের মতো।
প্রথম দৃষ্টিতেই যে কোন মানব সমাজের সংস্কৃতি এবং সাংস্কৃতিক জীবন সম্পর্কে এ জাতীয় ধারণাকে বিভিন্ন কারণে মনে হয় নিতান্তই একদেশদর্শী। প্রত্যেক সমাজ জীবনের একটা বাস্তব ভিত্তি থাকে। কাজেই জীবনের এ বাস্তব ভিত্তি, অর্থাৎ আর্থিক জীবন, ভাষা, বাসভূমি ইত্যাদির মধ্যে যদি কোন উল্লেখযোগ্য পাথক্য না থাকে তাহলে হঠাৎ সমাজের সাংস্কৃতিক জীবনের মধ্যে এই দুস্তর ব্যবধান রীতিমতো আশ্চর্যজনক। এক এলাকাভুক্ত এবং এক ভাষাভাষী অঞ্চলের লোকের মধ্যে বেশভূষা, খাদ্যাভ্যাস এবং ধর্মীয় জীবনের খুঁটিনাটি বিষয়ে পার্থক্য থাকবেই এবং এটা সংস্কৃতিকেও অনেকাংশে করবে বৈচিত্রময়। কিন্তু তাই বলে এর পার্থক্যের গুরুত্ব যথাযথভাবে নির্ণয় এবং নিদের্শ না করে কতকগুলি গৌণ বিষয়কে লক্ষ্য করে দেখলে সে বিচারকে সংস্কৃতি বিচার বলা কঠিন।
৮
ভারতীয় হিন্দু-মুসলমানের সংস্কৃতি মূলগতভাবে ভিন্ন এ কথার দ্বারা আসলে কী বোঝায়? এ পার্থক্যকে যাঁরা গুরুত্বপূর্ণ ভাবেন তাঁদের মতে একদিকে এই দুই সম্প্রদায়ের বেশভূষা, খাদ্যাভাস, ভাষা, চলাফেরা, সাহিত্য-সঙ্গীত, ধর্মীয় আচার আচরণ ইত্যাদি যেগুলির মাধ্যমে মানুষের সাংস্কৃতিক জীবনের পরিচয় পাওয়া যায় সেগুলি একেবারে ভিন্ন। অন্যদিকে তাঁরা মনে করেন সাংস্কৃতিক জীবনের বিভিন্ন ক্ষেত্রে হিন্দু এবং মুসলমানের স্ব স্ব সম্প্রদায়ের মধ্যে এ বিষয়ে যথেষ্ট ঐক্য এবং মিল আছে। একটু লক্ষ্য করলেই দেখা যাবে যে সংস্কৃতির ক্ষেত্রে এ দাবী প্রতিষ্ঠা করা সহজ তো নয়ই, রীতিমতো অসম্ভব।
ভারতের যুক্ত প্রদেশের হিন্দু-মুসলমান উভয়েই যে বেশভূষা করে তার সাথে উত্তর- পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশের অথবা বাঙলাদেশের মুসলমানের মিল যেটুকু আছে গরমিল তার থেকে অনেক বেশী। ভাষার দিক থেকে এসব বিভিন্ন অঞ্চলের মুসলমানের মধ্যে তফাৎ অনেক। যুক্ত প্রদেশের হিন্দু এবং মুসলমানের ভাষাগত যে মিল আছে যুক্ত প্রদেশের মুসলমানের সাথে বাঙলাদেশের অথব সিন্ধু-পাঞ্জাবের মুসলমানের সে মিল কোথাও নেই। বাঙলাদেশের মুসলমানের খাদ্যের সাথে মাদ্রাজী, বিহারী, পাঞ্জাবী, পাঠান মুসলমানের খাদ্যের বিশেষ কোন মিল নেই। উপরন্তু এই সব অঞ্চলের হিন্দু-মুসলমানের খাদ্যাভাসের মধ্যে মিল অনেক বেশী। কিন্তু সাংস্কৃতিক ঐক্য অথবা পার্থক্যের আলোচনার এখানেই শেষ নয়। ধর্ম এবং ধর্মীয় আবেগানুভূতির দিক থেকেও বিভিন্ন অঞ্চলের হিন্দু মুসলমানের স্ব স্ব সম্প্রদায়গত ঐক্য কতখানি গভীর এবং সেটা তর্ক সাপেক্ষ। একজন পাঠান মুসলমানের কাছে ইসলামের যে অর্থ একজন গ্রাম্য বাঙালী মুসলমানের কাছে ধর্মের যে সেই একই অর্থ, একথা মনে করার কোন কারণ নেই। বাস্তব জীবনের ক্রিয়াকর্মের আলোকে বিচার করলে দেখা যাবে তার মধ্যে তফাৎ অনেক। মুসলমানদের ধর্মীয় জীবনের উৎসব আল-কোরান এবং হজরত মহম্মদ ও প্রথম চার খলিফার জীবন দৃষ্টান্ত ইত্যাদি হলেও তার উপলব্ধি এবং ব্যবহারের মধ্যে যে কোন পার্থক্য নেই এবং থাকলেও সে পার্থক্য যে গুরুত্বহীন একথা বলা চলে না, উপরন্তু এই পার্থক্যই রচনা করে বিভিন্ন এলাকার একই ধর্মাবলম্বীদের ধর্মীয় আবেগানুভূতির ভিত্তিভূমি। পূর্ব পাকিস্তানের মুর্শেদী মারফতী গান এদেশের গ্রাম্য মুসলমানের অন্তরকে নাড়া দেয়। কিন্তু এ সকল গাণের মধ্যে এমন অনেক জিনিস আছে যেগুলি বিশুদ্ধ কোরানীয় ধর্মতত্ত্বের বহির্ভূত এবং অনেক সময় তার বিরোধী। এখানকার মুসলমানদের ধর্মীয় ধারণা এবং সামাজিক রীতিনীতি অনেক কিছুর মধ্যেই হিন্দু পৌত্তলিকতা এবং হিন্দুদের সামাজিক রীতির প্রভাব সহজেই চোখে পড়ে। পীরপূজা, কবরপূজা, বিধবা মেয়েদের বিবাহ না দেওয়া, তাদের অলঙ্কার বর্জিত সাদা শাড়ী পরা ইত্যাদি প্রথা এ প্রসঙ্গে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। পাঠান মুসলমানেরা কিছু কিছু পীরপূজা ইত্যাদি করলেও তাদের ধর্মীয় আবেগানুভূতির ভিত্তি এর থেকে অনেক স্বতন্ত্র এবং সে স্বাতন্ত্র্যের কারণ দেশজ এবং ভৌগোলিক। কাজেই একজন গ্রাম্য পূর্ব পাকিস্তানী মুসলমান এবং একজন পাঠান অথবা মাদ্রাজী মুসলমানের ধর্মীয় জীবনের মধ্যে ঐক্যের থেকে ঐক্যের অভাবই চূড়ান্ত বিশ্লেষণে অধিকতর প্রত্যক্ষ। ভারতীয় হিন্দু-মুসলমানের সংস্কৃতির গরমিল এবং ভারতীয় মুসলমানদের সাম্প্রদায়িক সাংস্কৃতিক ঐক্যের যে কথা ঘোষণা করা হয় সে ঘোষণা নিতান্তই মৌখিক এবং প্রমাণহীন। এর বাস্তব ভিত্তি অত্যন্ত দুর্বল। ভারতীয় হিন্দুর সাংস্কৃতিক জীবন থেকে সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র ভারতীয় মুসলমানের সাধারণ সাংস্কৃতিক জীবনের ধারণাকে প্রমাণাভাবে অলীক কল্পনা বলেই মনে হয়। কিন্তু এই অলীক কল্পনা স্বাধীনতাপূর্ব ভারতবর্ষের রাজনৈতিক জীবনে এত প্রতাপশালী হলো কেমন করে? রাজনৈতিক সমাজতত্ত্বের এটা এক গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন। এবং এ প্রশ্নের মাধ্যমেই পাকিস্তান আন্দোলনের ধর্মীয় বৈশিষ্ট্যের চরিত্র যথাযথভাবে উদ্ঘাটিত হওয়া সম্ভব।
৯
ইসলামী ধর্মশাস্ত্রে ধর্ম এবং রাজনীতিকে খুব বেশী তফাৎ করে দেখা হয় না। অনেক সময় এ দুইকে ভিন্ন করে দেখার চেষ্টাকে গুরুতর নৈতিক অপরাধ হিসাবেও গণ্য করা হয়। কবি ইকবাল এই প্রেরণায় উদ্বুদ্ধ হয়ে ধর্ম থেকে রাজনীতিকে বিচ্ছিন্ন করার প্রচেষ্টা এবং প্রস্তাবকে চিঙ্গীজির সাথে তুলনা করেছিলেন। কিন্তু ধর্মশাস্ত্রের অনুশাসন এবং শাস্ত্রজ্ঞদের ধিক্কার সত্ত্বেও বাস্তবতঃ দুনিয়ার বিভিন্ন মুসলমান প্রধান দেশগুলিতে জাতীয় আন্দোলনের উত্থানের সাথে সাথে দেখা যায় ধর্ম ও রাজনীতির ক্রমবিচ্ছেদ। এসব ক্ষেত্রে ধর্ম ক্রমশঃ ব্যক্তি- জীবনের এবং রাজনীতি সমাজ জীবনের বিশিষ্ট সমস্যাগুলিকে অবলম্বন করে হতে থাকে গঠিত ও রূপান্তরিত। মধ্যপ্রাচ্য এবং দূরপ্রাচ্যের দেশগুলিতেও এ ধারা আজ সুস্পষ্টভাবে প্রত্যক্ষ। এদিক দিয়ে তুর্কি হল সর্বাগ্রগণ্য।
ভারতীয় মুসলমানদের রাজনীতিতে ধর্ম এবং ধর্মীয় সংস্কৃতির প্রভাবের ক্ষেত্রে ইসলামের শাস্ত্রীয় অনুশাসন তত্ত্বগতভাবে মুসলমানের চিন্তা-ভাবনাকে নিঃসন্দেহে অনেকখানি আচ্ছন্ন করেছিল। ভারতীয় রাজনীতিতে সাম্প্রদায়িকতার উত্থান না হলে এ প্রভাব কতদূর কার্যকরী এবং কতকাল স্থায়ী হতো সেটা তর্কসাপেক্ষ। কিন্তু সাম্প্রদায়িকতার আওতায় ভারতীয় মুসলমানদের রাজনৈতিক জীবনক্ষেত্রে ধর্ম ও রাজনীতির ক্রমবিচ্ছেদ হলোই না উপরন্তু রাজনৈতিক চিন্তাধারণা বাহ্যতঃ প্রায় সামগ্রিকভাবেই গঠিত হলো ধর্মকে অবলম্বন করে। এর প্রধান কারণ ভারতীয় রাজনীতিতে জাতীয়তাবাদের সাম্প্রদায়িকতায় রূপান্তর।
যে কোন দেশে জাতীয়তাবাদের উত্থানের সময় জাতির অতীত গৌরব এবং ঐতিহ্যের চেতনা জাতীয়তাবাদী মনোভাবের একটা বিশিষ্ট স্থান অধিকার করে। ভারতীয় হিন্দুদের ক্ষেত্রেও একথা খুবই সত্য। ঊনিশ শতকে ইউরোপীয় প্রাচ্যবিদদের আবিষ্কার, গবেষণা এবং অধ্যবসায়ের ফলে উদ্ঘাটিত হলো ভারতবর্ষের অতীত ইতিহাস, যে ইতিহাস ভারতবাসীর অন্তরে সঞ্চার করলো এক অভূতপূর্ব গৌরব চেতনা। বুদ্ধ-মহাবীর, অশোক- সমুদ্রগুপ্ত, বেদবেদান্ত-ষড়দর্শন, গঙ্গা-যমুনা-ভাগীরথী সব কিছুই একই ধারায় সম্মিলিত হয়ে বিস্ফারিত করলো ভারতবাসীর জাতীয় চেতনা। ঊনিশ শতকে এই ভারত আবিষ্কারের সময়েই অন্তর্নিহিত অর্থনৈতিক কারণে ধীরে ধীরে রচিত ও গঠিত হয়ে চলেছিল সাম্প্রদায়িকতার আর্থিক ও সমাজতাত্ত্বিক ভিত্তি। কাজেই সেকালের হিন্দু-মুসলমানের ইতিহাস চেতনার চরিত্রও এক ছিল না। এক দিকে হিন্দুরা বিশুদ্ধ ভারতীয় সব কিছুকে গ্রহণ করলো তাদের জাতীয় চেতনা ও সংস্কৃতির ভিত্তিভূমি হিসাবে। অন্যদিকে মুসলমানেরা ঊনিশ শতকের শেষের দিকে এবং বিশেষতঃ বিশ শতকে যা কিছু বিশুদ্ধ ভারতীয় তাকেই মনে করলো ইসলামবিরোধী এবং মুসলমান স্বার্থ পরিপন্থী।
জাতীয়তা ক্রমশঃ সাম্প্রদায়িকতায় রূপান্তরিত হওয়ায় ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির ক্ষেত্রে মুসলমানদের দৃষ্টি অনুসরণ করলো ধর্মীয় ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির পথ। এ পথ ধরে তাঁরা ভারতবর্ষের শ্যামল সমতল, বনভূমি, গিরিদরী, উপত্যকা পরিত্যাগ করে উপস্থিত হলে আরবের দুস্তর মরুভূমিতে, মিসর, ইরান, তুর্কির নদনদী পাহাড় খন্দকে। ভারতীয় প্রকৃতি পর্যন্ত ভারতীয় মুসলমানদের কাছে এজন্য হলো দোষদুষ্ট। কাব্য সাহিত্য তাই ভারতবর্ষের থেকে মধ্যপ্রচ্যের প্রাকৃতিক পরিবেশই তাদের হাতে পেলো অধিকতর প্রাধান্য। এ মনোবৃত্তির ফলে ভারতীয় মুসলমানদের কাছে বকুল, জবা ও শিউলীফুল এবং গঙ্গা, যমুনা, ভাগীরথী হলো বিজাতীয়। অজন্তা, ইলোরা, কোনারক হলো বিশুদ্ধ ইসলামী সংস্কৃতির পক্ষে বিপজ্জনক। অশোক সমুদ্রগুপ্ত হৰ্ষবৰ্দ্ধন হলেন হিন্দু সংস্কৃতির প্রচারক। আকবর শাহ হলেন জাতীয়তাবাদী মুসলমান এবং মাহমুদ গজনী, আলমগীর আওরঙ্গজেব হলেন মুসলিম লীগার। ভারতীয় মুসলমানদের সাংস্কৃতিক জীবনের এ অসুস্থতা বিশ্লেষণ কতে হলে ভারতীয় জীবনের মহাস্রোত থেকে বিচ্ছিন্নভাবে সেটা করা চলে না। এর সত্যকার পরিচয়ও তাই পাওয়া যাবে ভারতীয় জাতীয়তাবাদের সাম্প্রদায়িকতায় রূপান্তরে।
যা কিছু বিশুদ্ধ ভারতীয় হিন্দুদের ক্ষেত্রে সেটাই রচনা করলো হিন্দু সাম্প্রদায়িক আবেগ অনুভূতির ভিত্তি। অন্যদিকে মুসলমানদের ক্ষেত্রে যা কিছু বিশুদ্ধ ভারতীয় সেটাই হলো বর্জনীয়, পরিত্যাজ্য। সামগ্রিক ভারতীয় জীবনে এই সঙ্কট মুহূর্তে ধর্ম ধর্মীয় কারণে নয়, আর্থিক, রাজনৈতিক এবং সমাজতান্ত্রিক কারণেই সাধারণ ভারতীয় হিন্দু মুসলমানের চেতনা ও শুভবুদ্ধিকে করলো আচ্ছন্ন, অভিভূত এবং পক্ষাঘাতগ্রস্ত।
১০
পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর থেকে এদেশে আর্থিক ও রাজনৈতিক জীবনের মধ্যে পরিবর্তনের জন্য ধীরে ধীরে হলেও সাম্প্রদায়িকতার আর্থিক, রাজনৈতিক এবং সমাজতান্ত্রিক ভিত্তিভূমিও ক্রমশঃ পরিবর্তিত হচ্ছে। এ পরিবর্তনের ধারা পাকিস্তানের সাংস্কৃতিক জীবনকেও ক্রমশঃ নোতুনভাবে এবং নোতুন ধারায় করছে রূাপান্তরিত। এ রূপান্তরের ধারা আজও খুব স্পষ্ট নয়। তার মধ্যে জটিলতা, বিশৃঙ্খলা ও নৈরাজ্য সহজেই লক্ষণীয়। কিন্তু তা সত্ত্বেও পাকিস্তানের বিশেষ পূর্ব পাকিস্তানের, নোতুন সাংস্কৃতিক চেতনা একেবারে ধর্মনিরপেক্ষ না হলেও আগের মতো তা যে আর ধর্মনির্ভর নেই এ কথা সত্য। পাকিস্তানের সংস্কৃতি বিশুদ্ধ ইসলামী সংস্কৃতি হওয়া উচিত বলে যাঁরা মনে করেন তাঁরাও এই বাস্তব ঘটনা ও সত্যকে অস্বীকার করেন না। সমসাময়িক পত্রপত্রিকা এবং সংবাদপত্রের পৃষ্ঠাগুলিই এর সিদ্ধান্তমূলক প্রমাণ বহন করে।
পাকিস্তান আন্দোলনের সময় মুসলমানদের সংস্কৃতি চেতনা বহুলাংশে ধর্ম দ্বারা সমাচ্ছন্ন ছিল। যাঁরা বিশুদ্ধ ইসলামী রাষ্ট্র, সমাজ ও সংস্কৃতিতে বিশ্বাস করেন আজ তাঁরা কিন্তু বলেন না যে সমকালীন মুসলমানদের সংস্কৃতি চেতনা সত্য অর্থে ধর্মচেতনার দ্বার উদ্বুদ্ধ। তাঁরা শুধু বলেন যে পাকিস্তানের মুসলমানদের সংস্কৃতি চেতনা ধর্মচেতনার দ্বারা উদ্বুদ্ধ হওয়া উচিত।[১২] পাকিস্তান প্রতিষ্ঠাপূর্ব এবং উত্তরকালের চিন্তাধারার এই পার্থক্যের মধ্যেই সন্ধান পাওয়া যাবে সাংস্কৃতিক চেতনার নোতুন ধারার। এর মধ্যেই দেখা যাবে কোন্ অনুপ্রেরণার পাকিস্তানের সংস্কৃতি আজ রূপান্তরের পথে।
পাকিস্তানের অস্তিত্ব অতি অল্প দিনের। পাকিস্তানী জাতীয়তার সঠিক পরিচয় নির্ধারণও তাই আজ পর্যন্ত যথাযথভাবে হয়ে উঠেনি। স্বাধীনতা পূর্ব যুগের এদেশের ধর্মীয় চিন্তা, রাজনীতি ও সংস্কৃতি চিন্তা সব কিছুই ছিল একই চিন্তাধারায় মিশ্রিত ও প্রবাহিত। এ চিন্তাধারায় ধর্মীয় এবং সাম্প্রদায়িক প্রভাবই ছিল মুখ্য। রাজনীতি, সমাজনীতি, সংস্কৃতি ইত্যাদি সব কিছুই ছিল মোটামুটিভাবে তার দ্বারাই নিয়ন্ত্রিত। স্বাধীনতার পর থেকে আজ পর্যন্ত পাকিস্তানের বাস্তব জীবনক্ষেত্রে যা কিছু লক্ষ্যণীয় পরিবর্তন এসেছে তাদের কোনটিই কিন্তু ধর্ম চিন্তার ফল নয়। সরকার পক্ষ থেকে মাঝে মাঝে ধর্মকে নানাভাবে গুরুত্ব দেওয়ার প্রচেষ্টা সত্ত্বেও পাকিস্তানের রাষ্ট্রীয় জীবন বাস্তবতঃ ধর্মীয় নির্দেশে নিয়ন্ত্রিত হয়নি।[১৩] এদেশের মুখ্য রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক আন্দোলনসমূহ যেমন রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন, শাসনতান্ত্রিক আন্দোলন, বন্দীমুক্তি আন্দোলন, শিল্পোন্নয়ন ও সমতা রক্ষার আন্দোলন ইত্যাদি ধর্মীয় প্রেরণায় উদ্বুদ্ধ নয়। উপরন্তু অনেক ক্ষেত্রে এগুলির আবেদন প্রায় ধর্মবিরোধী।[১৪] ধর্মীয় আন্দোলনের প্রচেষ্টা যে ইদানীং কিছু কিছু হয়নি তা নয়। কিন্তু এ আন্দোলনের মধ্যে আগেকার সেই জৌলুষ এবং মোহমুগ্ধতা আর থাকেনি। জীবনের সাথে এ জাতীয় আন্দোলনের যোগাযোগ যেন আজ অনেকাংশে বিচ্ছিন্ন। এ কারণেই এদেশে ধর্মীয় বাধানিষেধ এবং নানা সংস্কার সত্ত্বেও নোতুন মধ্যবিত্ত শ্রেণী ও বুদ্ধিজীবী সম্প্রদায়ের কাছে ধর্মীয় চিন্তার সে পূর্ব আবেদন আর নেই।
***
১. From text of Resolution No I on future Constitution of India passed at the 27th Annual Session of the All India Muslim League held at Lahore on the 22nd, 23rd and 24th of March, 1940:
“3. Resolved that it is the considered view of this session of the All India Muslim League that no constitutional plan would be workable in this country or acceptable to Muslims unless it is designed on the following basic principle, viz that geographically contiguous units are demarcated into regions which should be so constituted, with such territorial readjustments as may be necessary, that the areas in which the Muslims are numerically in a majority as in the North-Western and Eastern Zones of India should be grouped to constitute, ‘Independent States’ in which the constituent units shall be autonomous and sovereign.
That adequate, effective and mandatory safeguards should be specifically provided in the constitution for minorities in these units and in these regions for the protection of their religious, cultural, economic, political, administrative and other rights and interests in consultation with them; and in other parts of India where the Musulmans are in minority adequate, effective and mandatory safeguards shall be specially provided in the constitution for them and other minorities for the protection of their religious, cultural, economic, political, administrative and other rights and interests in consultations with them.”
২. We have made it clear over and over again that we are organising our people and have no quarrel with the Hindus or any other community, large or small, in this sub-continent. We have repeatedly declared that cardinal principle and aim of the Muslim League is to safegurad the political rights and status of the Musalmans of India. The Muslims in India are a nation. They will not submit to any position other that of complete equality with the Hindu Community in this country.’ (Form the text of the presidential address delivered by Mr. Jinnah at the plenary session of the Bengal Provincial Muslim League Conference held at Sirajgonj on February 15th, 1942. [Speeches and Writings of Mr. Jinnah vol. I, Edited by Jamiluddin, P. 339 )
৩. Jinnah Gandhi Talks (September 1944). Text of correspondence and their relevant documents etc. Foreward by Nawabzada Liaquat Ali Khan, M L A Central office, All India Muslim League.
৪. Report of the Inquiry Committee appointed by the council of the All India Muslim League to inquire into Muslim grievances in congress provinces. (Novermber 15, 1938), P. 2-3
৫. ১৯৪৭ সালের ১১ই আগষ্ট করাচিতে পাকিস্তান সংবিধান সভায় কায়েদে আজম মহম্মদ আলী জিন্নার উদ্বোধনী বক্তৃতাঃ
All the same, in this division it was impossible to avoid the question of minorities being in one dominion or the other. Now that was unavoidable. There is no other solution. Now what shall we do? Now, if we want to make this great state of Pakistan happy and prosperous we should wholly and solely concentrate on the well-being of the people, and specially of the masses and the If you poor.
will work in co-operation, forgetting the past, burying the hatchet, you are bound to succeed. If you change your past and work together in a spirit that every one of you, no matter to what community he belongs, no matter what relations he had with you in the past, no matter what is his colour, caste or creed, is first second and last a citizen of this state with equal rights, privileges and obligation, there will be no end to the progress you will make.
I cannot emphasize this too much. We should begin to work spirit and in course of time all these angularities of the majority and minority communities the Hindu Community and Muslim Community – because even as regards Muslims you have Pathans, Punjabis, Shias, Sunnis and so on and among the Hindus you have Brahmins, Vaishnavas, Khartis, aslo Bengalis, Madrasis and so on – will vainsh. Indeed if you ask me this has been the biggest hindrance in the way of India to attain its freedom and independence and but for this we would have been free people long ago. No power can hold another nation, and specially a nation of 400 milion souls in subjection; nobody could have conquered you and even if it had happened, nobody could have continued its hold on you for any length of time but for this (Applause).
Therefore we must learn a lesson from this.” [বাঁকা চিহ্ন আমার নিজস্ব (ব.উ.)] You are free; you are free to go your temples, you are free to go to your mosques or to any other places of worship in this State of Pakistan. You may be belong to any religion or caste or creed – that had nothing to do with the business of the State (Hear, hear). As you know, history shows that in England condition sometime ago were much worse than those prevailing in India to-day. The Roman Catholics and the Protestants persecuted each other. Even now there are some states in existence where are discriminations made and bars imposed against a particular class. Thank God we are not starting in those days. We are starting in the days where there is no discrimination, no distinction between one community and another, no discrimination between one caste or creed and another. We are starting with this principle that we are all citizens and equal citizens of one state (Loud applause). The people of England in course of time had to face the realities of the situation and had to discharge the responsibility and burdens places upon them by the Government of their country and they went through that fire step by step. To-day you might say with justice that Roman Catholics and Protestants do no exist. What exists now is that every man is a citizen of Great Britain and they are all menbers of the nation, an equal citizen.
Now, I think we should keep that in front of us as ideal and you will find that in course of time Hindus would cease to be Hindus and Muslims would cease to be Muslims, not in the religious sense, because that the personal faith of each individual but in the political sense as citizens of the State.’ Quoted in the Report of the court of Inquiry constituted under Punjab Act. 11 of 1954 to enquire into the Punjab Disturbances of 1953. p. 201-2.
৬. There are repeated references in this speech to the bitterness of the past and an appeal to forget and change the past to bury the hatchet, the future subject of the state is to be a citizen with equal rights privileges and obligations, irrespcetive of colour, caste, creed or community. The word ‘nation’ is used more than once and religion is stated to have nothing to do with the business of the state and to be merely a matter of personal faith for the individual.’ পাঞ্জাব সাম্প্রাদয়িক গণ্ডগোল সম্পর্কিত মুনীর রিপোর্ট। পৃ ২০৩
৭. ৮ই এপ্রিল ১৯৪৬, দিল্লীতে বিভিন্ন প্রদেশের ও কেন্দ্রীয় বিধান সভার মুসলিম লীগ দলীয় সদস্যদের অধিবেশনে কায়েদে আজম জিন্নাহ এবং বঙ্গীয় প্রাদেশিক মুসলিম লীগের সাধারণ সম্পাদক আবুল হাশিমের দুই পাকিস্তান সম্পর্কে বিতর্ক। (Peoples Age, April 12, 1946)
৮. Quaid-i-Azam’s address before the Sind Bar Association on the occasion of the Prophet Day, Dawn, January 26, 1948. Quoted by L. Binder in Religion and Politics in Pakistan. p. 100.
৯. “বলা হইয়াছিল: আমাদের এমন একটি দেশ চাই, যেখানে আমরা মুসলমানদের ন্যায় জীবন যাপন করিতে পারিব, ইসলামকে পুনর্জীবিত ও জাগ্রত করিতে পারিব এবং ইসলামের বুনিয়াদে এক নূতন তাহজীব ও তামদ্দুনের প্রাসাদ গড়াইতে সমর্থ হইব। কিন্তু আল্লাহ যখন সেই দেশ আমাদের দান করিলেন তখন ওয়াদা পূরণ করা তো দূরের কথা ইসলামের নাম নিশানা যাহা কিছু আজ পর্যন্ত বাঁচিয়েছিল তাহাও নিশ্চিহ্ন করা হইতেছে এবং ইংরেজ এখানে যে সভ্যতা, নৈতিকতা এবং তামদ্দুনের ভিত্তি গড়িয়াছিল সেই ইমারতটিকেই এখন নানাভাবে রঙীন করিয়া পরিপূর্ণরূপে তৈয়ার করা হইতেছে।” [আমাদের আভ্যন্তরীণ ও বৈদেশিক সমস্যা, সাইয়েদ আবুল আলা মওদুদী, জামায়াতে ইসলাম পাবলিকেশন্স্। পৃ ২২]
১০. ‘Whereas the Hindus, extremists, moderates and missioneries, had all one aim and object, the Muslims had none. … Muslims, I reperat, had no ideal. Some of them were victim of fear and inertia, others out of sheer boredom turned nationalists. Some dream of Pan-Islamism, some despaired of life itself. Now all this has changed. The League has given a glorious ideal to the Musalmans. We can live for it, dream for it, and above all, die for it – die for it so that a rejuvenated, regenerated, renovated and triumphant Islam may once again raise its head in this land of ours and live an honourable and peaceful life. (Extract from an article by I. H. Qureshi in the Eastern Time, 9th August, 1940).
১১. “…Their (Muslim) idea of nationlity is not based on identity of race or community of economic interest or attachment to the geographical boundaries of a particular territory it rests on a definte life outlook and social policy territory it rests on a definite life outlook and social policy. … They are deeply conscious of their separate cultural characteristics which have developed for their adherence to an all-embracing creed and certain mmoral principles governing all aspects of life. It is this separate cultural characteristics which entitle them to claim for themselves the status of a separate nationlity. …
(Extract from an article “India one nation?” By Zamil-ud-Din Ahmed, Muslim University, Aligarh, published in India’s Problem of Her Future Constitution. Bombay, October, 1940. Publisher M. H. Saiyid.
১২. ইসলামকে দেশের শাসনতন্ত্রের ভিত্তিস্বরূপ গ্রহণ করিয়া সরকারীভাবে ঘোষণা ও প্রচার করিতেই তাহারা পাকিস্তানের প্রথম উনিশ মাস টালবাহানা করিয়া কাটাইয়াছে। কিন্তু তাহার পর দেশবাসী যখন চারিদিকে হইতে প্রচণ্ড দাবি উত্থাপন করিল তখন একান্তভাবে বাধ্য হইয়াই তাহারা ‘আদর্শ প্রস্তাব’ পাশ করিয়াছিল। কিন্তু তাহার পর দেশের শাসন ও শৃঙ্খলা ব্যবস্থা এবং সরকারী কর্মনীতিতে বিন্দুমাত্র পরিবর্তন সূচিত করা হয় নাই। কাজেই তাহারা যে ‘আদর্শ প্রস্তাব অনুযায়ী দেশকে গঠন করিতে বাস্তবিকই প্রস্তুত আছে, এ কথা মনে করিবার কোন কারণ নাই। [সাইয়েদ আবুল আলা মাওদুদী, আমাদের আভ্যন্তরীণ ও বৈদেশিক সমস্যা। জামাতে ইসলামী পাবলিকেশন্স্। প্রথম সংস্করণ ১৯৫২, পৃ ৫২]
১৩. The Quaid-i – Azam’s conception of a modern national state, it is alleged, became obsolete with the passing of Objectives Resolution, on. 12th March, 1941; but it has been freely admitted that this Resolution, though grandiloquent in words, phrases, clauses is nothing but a hoax* (গুরুত্ব নির্দেশ আমার নিজস্ব— ব.উ.) and that not only does it not contain even semblance of the embryo of an Islamic State but its provisions, particularly those relating to fundamental rights sre directly opposed to the principles of an ‘Islamic State”. মুনীর রিপোর্ট। পৃ ২০৩
১৪. শাসনতন্ত্র আন্দোলন সম্পর্কে একথা সব থেকে বেশী প্রযোজ্য। ইসলামী রাষ্ট্র, আল্লাহর সার্বভৌমত্ব ইত্যাদি প্রশ্নে এই আন্দোলনের ইসলাম বিরোধী ভূমিকা খুবই স্পষ্ট।