২. সাম্প্রদায়িকতা ও ধর্মীয় রাষ্ট্র

সাম্প্রদায়িকতা ও ধর্মীয় রাষ্ট্র

মধ্যবিত্তশ্রেণী ও জাতীয়তাবাদের উত্থান এবং বৃহত্তর সামাজিক জীবনক্ষেত্রে ধর্মীয় প্রভাবের হ্রাসপ্রাপ্তি যে কোন দেশের ইতিহাসে সমকালীন ঘটনা। দেশকালের ব্যবধানে মধ্যবিত্তের চরিত্র এবং জাতীয়তাবাদের গতি-প্রকৃতির মধ্যে অল্পবিস্তর পার্থক্য থাকলেও শ্রেণীগতভাবে ধর্মের প্রতি মধ্যবিত্তের কিছুটা ঔদাসীন্য মোটামুটি সবক্ষেত্রেই দেখা যায়। এর প্রধান কারণ প্রতিষ্ঠিত ধর্মসমূহের রীতিনীতি, আচার-আচরণ ইত্যাদি যে সামাজিক অবস্থার প্রতিফলন মধ্যবিত্তের সমাজ ও অর্থনৈতিক জীবন ব্যবস্থার সাথে তার কোন সামঞ্জস্য নেই। ধনতন্ত্রের বিকাশের পূর্বে ধর্মের প্রতি মানুষের যে গভীর আনুগত্য থাকে ধনতন্ত্রের ক্রমবিকাশ এবং মধ্যবিত্তের উত্থানের সাথে সে আনুগত্য ধীরে ধীরে শিথিল হয় এবং পরিশেষে ধর্মের স্থান বহুলাংশে অধিকার করে জাতীয়তাবাদ। ফ্রান্স ও ইউরোপের অন্যান্য দেশ এবং এশিয়া- আফ্রিকার বিভিন্ন দেশেও মধ্যবিত্তের উত্থানের সাথে ধর্মানুগত্যের শৈথিল্য অনেকখানি সরাসরিভাবে জড়িত।

সামন্ততান্ত্রিক এবং তার থেকেও নিম্নতর সমাজ-ব্যবস্থায় মানুষের আর্থিক এবং সামাজিক জীবনের মধ্যে গতির কোন চাঞ্চল্য থাকে না। সমস্ত কিছুই সেখানে মোটামুটি নির্দিষ্ট, অলঙ্ঘনীয়, অপরিবর্তনীয়। ধর্মীয় বিধিনিষেধ, রীতিনীতি এবং আচার-আচরণসমূহ এ ধরনের সমাজেরই প্রতিফলন। ধনতান্ত্রিক সমাজের সাথে এর কোন সামঞ্জস্য নেই। কারণ ধনতান্ত্রিক সমাজের মূলমন্ত্রই হলো প্রচলিত সর্বপ্রকার বিধিনিষেধ লঙ্ঘন করে বৃহত্তর আর্থিক জীবনের পরিপূর্ণ রূপান্তর। এজন্য প্রয়োজন সামন্ততান্ত্রিক, গোত্রীয় এবং অন্যান্য নিম্নতর সমাজ-ব্যবস্থার বহুতর আর্থিক, ধর্মীয়, সামাজিক এবং ঐতিহ্যিক বন্ধনকে শিথিল এবং অনেকাংশে নিশ্চিহ্ন করে মানুষের পারস্পরিক সম্পর্ককে এক নোতুন আর্থিক এবং সামাজিক ভিত্তির ওপর দাঁড় করানো। এ প্রয়োজনের তাগিদেই তাই পৃথিবীর সব দেশে মধ্যবিত্তের উত্থান চিহ্নিত করে বৃহত্তর সমাজ-জীবনে অন্যান্য বহু প্রভাবের সাথে ধর্মীয় প্রভাবেরও ক্রমশঃ হ্রাসপ্রাপ্তি। মধ্যবিত্তের জাতীয়তাবাদী আন্দোলন এ জন্যই যে শুধু ধর্মনিরপেক্ষ তা নয়, অনেক ক্ষেত্রে তা প্রবলভাবে ধর্মবিরোধী।

জাতীয়তাবাদের উপযুক্ত রাষ্ট্রীয় সংগঠন হলো জাতীয় রাষ্ট্র। ঠিক এজন্যই ইউরোপের ইতিহাসে দেখা যায় জাতীয়তাবাদের উত্থানের যুগে চার্চ এবং জাতীয় রাষ্ট্রের মধ্যে প্রচণ্ড বিরোধীতা। সামন্ততান্ত্রিক অর্থনৈতিক জীবনে চার্চের প্রভাব শুধু যে মানুষের ধর্মীয় এবং আধ্যাত্মিক জীবনকেই নিয়ন্ত্রিত করতো তাই নয়, সাধারণ জীবনযাত্রার উপরও তার প্রভাব থাকতো সর্বব্যাপী। ধনতান্ত্রিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থা ও সামাজিক পরিবেশ যে নোতুন শ্রেণীর জন্ম দিল সে শ্রেণীর কাঠামোর সাথে চার্চের সামাজিক কাঠামোর কোনো সামঞ্জস্য না থাকায় চার্চ ও রাষ্ট্রের পারস্পরিক বিরোধীতা ক্রমশ তীব্রতর হলো এবং এক সুদীর্ঘ সংগ্রামের শেষে মানুষের দৈনন্দিন আর্থিক এবং রাজনৈতিক জীবনক্ষেত্রে চার্চের পরিবর্তে রাষ্ট্রের প্রাধান্য হলো সুপ্রতিষ্ঠিত। তার অর্থ এই নয় যে, এর পর থেকে ইউরোপে ধর্মের প্রভাব মানুষের ব্যক্তিগত জীবনে সম্পূর্ণভাবে লোপ পেল। রাষ্ট্রীয় প্রাধান্য বলতে এ ক্ষেত্রে শুধু বোঝায় পূর্ববর্তী যুগে আর্থিক ও সামাজিক জীবনে ধর্মের যে সর্বব্যাপী প্রভাব ছিল সে প্রভাবের পরিবর্তে বিস্তীর্ণ আর্থিক জীবনে রাষ্ট্রীয় প্রভাবের প্রসার ও প্রতিষ্ঠা। অর্থাৎ এক কথায় রাষ্ট্রের ধর্মনিরপেক্ষতা।

ধর্মনিরপেক্ষতার এই তাড়না শুধু যে রাষ্ট্রকেই চালনা করলো তাই নয়, এ তাড়না মানুষের ব্যক্তিগত জীবনকেও ধর্মীয় আচার-আচরণের গণ্ডি থেকে বের করে তাকে অনেকাংশে করলো সংস্কারমুক্ত। এজন্য মধ্যবিত্ত এবং অন্যান্য শ্রেণীভুক্ত বহু লোক ব্যক্তিগতভাবে ধর্মাশ্রিত জীবন যাপন করলেও সাধারণভাবে ধর্মীয় প্রভাব লোক-জীবনে শিথিল হয়ে এলো। নোতুন যে আর্থিক শক্তিসমূহের তাগিদে ইতিহাসে মধ্যবিত্তের আবির্ভাব হলো সেই শক্তিসমূহের তাগিদেই মানুষের ধর্মীয় জীবনে দেখা দিল অদৃষ্টপূর্ব শৈথিল্য। ধর্মীয় প্রভাব এর পরও নানাভাবে এবং নানা পর্যায়ে সমাজের চিন্তাভাবনা ক্রিয়াকর্মকে নিয়ন্ত্রিত করলেও ধর্মের সে পূর্বগৌরব আর থাকলো না। রাষ্ট্রীয় ধর্মনিরপেক্ষতা সাধারণ জীবনযাত্রাকেও করলো অনেকাংশে ধর্মনিরপেক্ষ।

মধ্যবিত্তশ্রেণী ও জাতীয়তাবাদের উত্থানের সাথে ধর্মনিরপেক্ষতার উত্থান যে কোন দেশের ইতিহাসে সরাসরিভাবে জড়িত হলেও পাক-ভারতীয় মধ্যবিত্তশ্রেণী এবং জাতীয়তাবাদের ইতিহাসে এর ব্যতিক্রম ঘটলো কেন এটা এক গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন। পাক-ভারতীয় সাম্রাজ্যবাদবিরোধী জাতীয় আন্দোলন যে ধর্মের দ্বারা বিপুলভাবে প্রভাবিত ও নিয়ন্ত্রিত এ কথা সর্ববিদিত। এ নিয়ন্ত্রণ ভারতীয় ইতিহাসে সম্ভব হলো যে বিশেষ অবস্থার মাহাত্ম্যে তার সঠিক বিশ্লেষণ ও পর্যালোচনা করলে দেখা যাবে যে, আপাতদৃষ্টিতে এ নিয়ন্ত্রণকে ব্যতিক্রম মনে করলেও আসলে এটা সাধারণ নিয়মেরই অনুবর্তী এবং সে নিয়মের সুপরিচিত গণ্ডীর মধ্যেই পাক-ভারতীয় জাতীয়তাবাদও সম্পূর্ণভাবে আবদ্ধ।

ধর্মের প্রতি ভারতীয় হিন্দু-মুসলমান, বিশেষতঃ মুসলমান মধ্যবিত্তের অনুরাগের মূল কারণ ভারতীয় আন্দোলনে ধর্ম কতকগুলি বিশেষ অবস্থার মহিমায় রূপান্তরিত হলো মধ্যবিত্ত স্বার্থসিদ্ধির নিশ্চিত হাতিয়ারে। এক্ষেত্রে তাই ধর্মীয় প্রশ্ন স্বাধীনতা আন্দোলনের গতি ও চরিত্রকে অনেকখানি নির্দেশ ও গঠন করতে সক্ষম হলো এ কারণে নয় যে ভারতীয় হিন্দু-মুসলমান অন্যান্য দেশের লোকের তুলনায় অধিকতর ধর্মগতপ্রাণ। ঊনিশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধে এবং বিশ শতকের প্রথমার্ধে ভারতীয় হিন্দু-মুসলমানের ধর্মপ্রীতির আতিশয্যের উৎস আধ্যাত্মিকতাবাদ নয়। এর উৎসস্থল বৃহত্তর ভারতীয় আর্থিক ও রাজনৈতিক জীবনক্ষেত্র।

ঊনিশ শতকের প্রথমার্ধে ইউরোপীয় পণ্ডিতদের ভারতীয় শাস্ত্রসমূহের বিস্তৃত অনুশীলন এবং ভারতীয় ধনতন্ত্রের নবগঠিত ক্ষুদ্র মধ্যবিত্ত সমাজের একাংশের মনে সঞ্চার করলো প্রাচীন ঐতিহ্য এবং তার সাথে সনাতন ধর্মের প্রতি প্রগাঢ় অনুরাগ ও আনুগত্য এবং অন্যদিকে অন্য এক অংশকে বলিষ্ঠভাবে গঠিত করলো ইউরোপীয় উদারনৈতিক ঐতিহ্যে। এই দুইয়ের মধ্যবর্তী ছিলেন মধ্যবিত্ত শ্রেণীর এক প্রভাবশালী অংশ – যাঁরা ধর্মকে বর্জন না করে চেষ্টা করলেন নানাভাবে তার সংস্কার সাধন করতে। ঊনিশ শতকের প্রথম দিকে ধর্মসংস্কারের এই তাগিদেই রাজা রামমোহন ও দয়ামন্দ সরস্বতী প্রতিষ্ঠা করলেন ব্রাহ্ম ও আর্য সমাজের। ভারতীয় সাংস্কৃতিক ও সামাজিক জীবনে ধর্মবোধের এই নবজাগরণ ও সংস্কার প্রচেষ্টার ছাপ তৎকালীন শিক্ষাদীক্ষা এবং সাহিত্যকার্যের মধ্যে উপস্থিত থাকলেও তার কোন উল্লেখযোগ্য রাজনৈতিক গুরুত্ব ছিল না। রামমোহন তো বটেই এমন কি ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর পর্যন্ত হিন্দুধর্মের প্রতি বিন্দুমাত্র আনুগত্য না থাকা সত্ত্বেও ধর্মগ্রন্থ ও শাস্ত্রচর্চায় যে এতখানি আগ্রহশীল ছিলেন তার আসল কারণ তাঁরা ধর্মশাস্ত্রের বিশুদ্ধ অনুশীলন থেকে সমাজ সংস্কারের প্রয়োজনীয়তাকেই উপলব্ধি করেছিলেন অনেক বেশী করে। বিদ্যাসাগরের ধর্মগ্রন্থ চর্চার ক্ষেত্রে একথা বিশেষভাবে প্রযোজ্য। কারণ, বেদ-বেদান্ত- উপনিষদ ইত্যাদি উদাহরণের সাহায্যে বিধবাবিবাহের প্রচলনই ছিল তাঁর সংস্কার আন্দোলনের মুখ্য উদ্দেশ্য।

রাজনীতি সর্বপ্রথম সার্থকভাবে সাহিত্যের মাধ্যমে ধর্মের আশ্রয় গ্রহণ করলো বঙ্কিমচন্দ্রের উপন্যাস ও অন্যান্য লেখায়। তাঁর আনন্দমঠই ভারতীয় মধ্যবিত্তের রাজনৈতিক চেতনার মধ্যে সর্বপ্রথম নিয়ে এলো ধর্মীয় বিভ্রান্তি। ভারতীয় রাজনৈতিক জীবনক্ষেত্রের সূত্রপাত হলো উৎকট সাম্প্রাদায়িকতার।

হিন্দু সমাজের রাজনৈতিক চেতনায় সাম্প্রদায়িকতার প্রথম আবির্ভাবের কারণ সামাজিক ও রাজনৈতিক জীবনে মুসলমানের তুলনায় তাদের অপেক্ষাকৃত অগ্রসরতা। সিপাহী বিদ্রোহের কিছু পরে সৈয়দ আহমদ ইত্যাদির নেতৃত্বে মুসলমান মধ্যবিত্ত যখন নিজের স্বার্থসংরক্ষণে ব্যস্ত হলো সে সময় এই একই ধর্মীয় চেতনা তাদের রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গীকেও আচ্ছন্ন করলো অধিকতর উৎকটভাবে।

কিন্তু হিন্দু-মুসলমান মধ্যবিত্তের উত্থানের সাথে সাথে ধর্মীয় প্রভাব ক্রমশঃ বিলীয়মান না হয়ে বর্ধমান হলো কেন সে প্রশ্নের উত্তর লাভের জন্য প্রয়োজন ভারতীয় মধ্যবিত্তের চরিত্র এবং তার বৈশিষ্ট্যের পর্যালোচনা।

ভারতীয় এবং বিশেষ করে বাঙালী মধ্যবিত্তের চরিত্রের বিশদ ও বিস্তৃত আলোচনা এ প্রসঙ্গে প্রয়োজন না হলেও তার কতকগুলি বৈশিষ্ট্য এক্ষেত্রে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। সব ক্ষেত্রেই দেখা যায় যে, জাতীয় চেতনা মানুষকে তার ঐতিহ্য, ইতিহাস ও পূর্বগৌরব সম্পর্কে সচেতন করে। অন্যপক্ষে আবার ঐতিহ্য, ও ইতিহাসের চেতনা মানুষের মনে সৃষ্টি করে জাতীয়তাবোধ। ভারতীয় জাতীয় চেতনার মধ্যেও ঐতিহ্য ও পূর্বগৌরবের স্থান অন্যান্য দেশীয় জাতীয় চেতনার তুলনায় কোন অংশেই কম নয়। উপরন্তু এই ঐতিহ্য চেতনাই ভারতবর্ষের জাতীয় চেতনাকে সাম্প্রদায়িক চেতনায় রূপান্তরিত করার জন্য অনেকাংশে দায়ী।

ঊনিশ শতকের মাঝামাঝি হিন্দু মধ্যবিত্ত শ্রেণীর মধ্যে যে জাতীয় চেতনার সূত্রপাত হলো সে চেতনা ছিল প্রায় সামগ্রিকভাবেই ধর্মাচ্ছন্ন। বঙ্কিমচন্দ্র তাঁর আনন্দমঠ সন্ত্রাসবাদের যে আদর্শ চিত্রিত করেছিলেন তার মধ্যে হিন্দু ধর্মেরই ছিল নিঃসন্দেহে প্রাধান্য। রাজনারায়ণ বসু বৈপ্লবিক ভাবধারায় দীক্ষিত হলেও স্বাধীনতা অর্জন ও ধর্মের হৃত-গৌরব পুনরুদ্ধারকে পৃথক ও বিচ্ছিন্ন সমস্যা হিসাবে দেখার কোন ক্ষমতা তাঁর ছিল না। নবগোপাল মিত্র রাজনারায়ণ বসুর রাজনৈতিক চিন্তাধারাকে ‘হিন্দুমেলা’, ‘ন্যাশনাল সোসাইটি’ এবং হিন্দুমেলার মুখপত্র ‘ন্যাশনাল পেপার’-এর মাধ্যমে বাস্তব রূপদান করেন।[১] ন্যাশনাল সোসাইটির মূল উদ্দেশ্য ছিল হিন্দু সমাজের মধ্যে একতা ও জাতীয় চেতনার সঞ্চার। সোসাইটির এই সাম্প্রদায়িক উদ্দেশ্যের জন্য অনেকে একে ন্যাশনাল সোসাইটি নামে অভিহিত করায় আপত্তি জ্ঞাপন করলে ন্যাশনাল পেপারে নবগোপাল মিত্র লেখেন, ‘এই নামকরণে আপত্তি করার কি আছে সেটা আমার পক্ষে বোঝা শক্ত। হিন্দুরা যে একজাতিভূক্ত তাতে কোন সন্দেহ নেই এবং এজন্যই তাদের সংগঠন স্বাভাবিকভাবেই ন্যাশনাল সোসাইটি নামে পরিচিত হতে পারে।’ ঊনিশ শতকের নবগোপাল মিত্র বিশ শতকের কায়েদে আজম জিন্নারই যথার্থ পূর্বসূরি! হিন্দু সম্প্রদায়ের চেতনার মধ্যে এ জাতীয় বিভ্রান্তি লক্ষণ লক্ষ্য করেই ভূপেন্দ্রনাথ দত্ত লিখেছেন, ‘হিন্দুরা স্বদেশপ্রীতি ও স্বধর্মপ্রীতিকে তফাৎ করে দেখেনি এবং এই ধর্মীয় ও সাম্প্রদায়িক মনোভঙ্গীর ফলে পরবর্তীকলের জাতীয়তাবাদী আন্দোলনে ধর্মীয় প্রভাব দেশের বৃহত্তর স্বার্থের সমূহ ক্ষতিসাধন করবে।’[২]

মুসলমানদের জাতীয় চেতনার ক্ষেত্রে সেই একই কথা। হিন্দুরা ঊনিশ শতকের মধ্যভাগে স্বদেশপ্রীতি ও স্বধর্মপ্রীতিকে তফাৎ করে দেখেনি। মুসলমানরা কিন্তু আবার স্বদেশপ্রীতি ও স্বধর্মপ্রীতিকে এতবেশী তফাৎ করে দেখেছে যে, অবস্থার চাপে ধর্মপ্রীতির আতিশয্যে দেশকে তারা স্বদেশ বলে ভাবেনি। ভারতবর্ষের বাসিন্দা হয়েও ভারতের বৃহত্তর ঐতিহ্যকে অস্বীকার করে তারা নিজেদের ঐতিহ্যের সন্ধান করেছে শুধু আরব, পারস্য, তুরস্কে। ধর্মীয় প্রভাবে ভারতের হিন্দু-মুসলমান একই ঐতিহ্যের গৌরবের অংশগ্রহণ করতে অক্ষম হওয়ায় জাতীয় আন্দোলনের উত্থানের পূর্ব-মুহূর্তেই ভারতীয় মধ্যবিত্ত সমাজের সূত্রাপাত হলো সাম্প্রদায়িকতার ক্ষেত্র প্রস্তুতির।

হিন্দু-মুসলমানের মধ্যে ধর্মীয় ঐতিহ্যের চেতনা সৃষ্টি হলো দুই ভিন্ন কারণে। ভারতবর্ষের ঐতিহ্যকে পুনরুদ্ধার করার প্রশংসা সর্বাংশে ইউরোপীয় পণ্ডিতের প্রাপ্য। তাঁরাই পুনরুদ্ধার করলেন বেদ, উপনিষদ, ষড়দর্শন, বুদ্ধ, মহাবীর, অশোক এবং সমুদ্রগুপ্ত। এই পুনরুদ্ধারের ফলে হিন্দুদের বহু শতাব্দীর গৌরব প্রতিফলিত হলো ঊনিশ শতকের নব উত্থিত হিন্দু মধ্যবিত্তের চিন্তাভাবনা এবং বিস্তৃত ক্রিয়া-কর্মে ইংরেজ রাজত্বে হিন্দু মধ্যবিত্তের উন্নতির সূত্রপাত সে উন্নতি এই ঐতিহ্য-চেতনা দ্বারা অনেকখানি হলো দ্রুততর।

ভারতবর্ষের এই পূর্ব-গৌরবের কথা হিন্দু মানসকে যেভাবে আকৃষ্ট করলো ঠিক সেইভাবে মুসলমান মধ্যবিত্ত তার দ্বারা আকৃষ্ট হলো না। উপরন্তু আরব পারস্যের সংস্কৃতি ভারতীয় সংস্কৃতি দ্বারা আচ্ছন্ন হলো দেখে তারা স্বদেশের ঐতিহ্য থেকে নিজেদেরকে তফাৎ করলো আরও বেশী করে। মোগল সাম্রাজ্য, যাকে ধর্মীয় এবং সামন্ততান্ত্রিক বিভ্রান্তিবশতঃ সাধারণ মুসলমানেরাও নিজেদের সাম্রাজ্য বলেই মনে করতো, তার পতনের ঠিক পরবর্তীকালে মুসলমান এবং হিন্দুর ভারতীয় ঐতিহ্যের প্রতি এই বিভিন্ন মনোভাব দুর্বোধ্য তো নয়ই উপরন্তু অতি সহজবোধ্য। মোগল সাম্রাজ্য এবং নবাব রাজত্বের অবসানে উচ্চশ্রেণীর মুসলমান সমাজে যে ক্ষয়িষ্ণুতা এবং হতাশার সঞ্চার হলো তার প্রভাব থেকে মুসলমান সমাজ সামগ্রিকভাবে মুক্তি পেল না। এর ফলে ওহাবী আন্দোলনের মতো প্রতিক্রিয়াশীল আন্দোলন উত্তর ভারতের এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে বিস্তৃত হয়ে মুসলমান সমাজের শিক্ষাদীক্ষা, ব্যবসা-বাণিজ্য এবং উন্নতিকে করলো মারাত্মকভাবে ব্যাহত। হিন্দু সমাজ যে সময় দীক্ষিত হলো এগিয়ে চলার মন্ত্রে এ আন্দোলন ঠিক সেই সময় মুসলমান সমাজকে শেখাল পিছিয়ে থাকার মন্ত্র। এর ফলে হিন্দুরা যখন এক করে দেখলো স্বদেশ ও স্বধর্মকে মুসলমান সমাজের হাজার হাজার লোক তখন ধর্মপ্রীতির প্রাবল্যে ত্যাগ করতে প্রস্তুত হলো স্বদেশভূমি ভারতবর্ষ। ভারতীয় ইতিহাসে তাই ওহাবী আন্দোলনের প্রতিক্রিয়াশীলতার তুলনা নাই।

সামাজিক ও ধর্মীয় জীবনে হিন্দু মুসলমানের মধ্যে পার্থক্যের যে চেতনা বিদ্যমান ছিল সে চেতনা ভারতীয় ধনতন্ত্র এবং মধ্যবিত্তশ্রেণীর প্রসার ও অগ্রগতির সাথে ভারতীয় রাজনৈতিক জীবনক্ষেত্রে সৃষ্টি করলো এক কুৎসিত জটিলতা। এ জটিলতার নামই সাম্প্রদায়িকতা।

হিন্দু মধ্যবিত্ত যখন ব্যবসা-বাণিজ্য, চাকুরী ক্ষেত্রে অনেকখানি অগ্রসর হলো তখন বিদেশী ইংরেজদের সাথে সর্বক্ষেত্রেই শুরু হলো তাদের অল্পবিস্তর প্রতিযোগিতা। এ প্রতিযোগিতাই ধীরে ধীরে অবসান ঘটালো হিন্দু মধ্যবিত্তের একাংশের ইংরেজ-প্রীতির। শুধু তাই নয়। এর ফলে সূত্রপাত হলো ভারতীয় জাতীয় আন্দোলনের, যে আন্দোলনের পুরোভাগে থাকলো হিন্দু মধ্যবিত্ত। ঠিক এই সময়ে মুসলমান মধ্যবিত্তের সাথে ইংরেজদের প্রতিযোগিতার প্রশ্ন ওঠেনি। কারণ, তারা হিন্দুদের তুলনায় ব্যবসা-বাণিজ্য, শিক্ষা-দীক্ষায় ছিল অনেকখানি পশ্চাদপদ। এজন্য জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের প্রাথমিক পর্যায়ে মুসলমান সমাজে ইংরেজ বিরোধীতার তেমন প্রয়োজন ছিল না। সীমাবদ্ধ সুযোগ-সুবিধার ক্ষেত্রে মুসলমানদের প্রতিযোগিতা এ-সময় ছিল প্রধানতঃ হিন্দু মধ্যবিত্তের সাথে এবং সেই প্রতিযোগিতায় ফললাভের জন্য মুসলমান সমাজ ছিল ইংরেজের সাথে আপোষপন্থী। সামাজিক, অর্থনৈতিক এবং রাজনৈতিক ক্ষেত্রে হিন্দু-মুসলমানের এই বিভেদ ও রেষারেষিকে ইংরেজরা উপেক্ষা করলো না। উপরন্তু তাদের নিজেদের সাম্রাজ্যবাদী শাসনের হাতিয়ার হিসাবে এই রেষারেষিকে অবলম্বন করে তারা নির্ণয় করলো তাদের ভেদনীতি। ভারতীয় মধ্যবিত্তের অগ্রগতির সাথে ভারতীয় জাতীয় আন্দোলন শক্তিশালী হলেও তা সুস্থ পথে অগ্রসর হলো না। মধ্যবিত্তের শ্রেণীগত দুর্বলতার জন্য হিন্দু মধ্যবিত্ত নিজের স্বার্থ রক্ষা করতে গিয়ে মুসলমান মধ্যবিত্তের স্বার্থকে অনেকাংশে ক্ষুণ্ন করলো। ঠিক অনুরূপভাবে মধ্যবিত্তের শ্রেণীগত দুর্বলতার কারণে মুসলমান মধ্যবিত্ত নিজের স্বার্থসংরক্ষণের জন্য দুর্বলতর প্রতিযোগী হিসাবে হয়ে দাঁড়ালো অধিকতর ধর্মাশ্রয়ী। হিন্দু সমাজও তাই একদিকে ইংরেজ এবং অন্যদিকে মুসলমান স্বার্থের বিরুদ্ধতায় তার মধ্যবর্তীকালীন আপেক্ষিক ধর্মনিরপেক্ষতাকে বহুতরভাবে শিথিল করে জাতীয় আন্দোলনের মধ্যে আবার নোতুন করে আনলো ধর্মীয় জটিলতা। হিন্দু মহাসভা ইত্যাদি সাম্প্রদায়িক সংগঠন এমনকি কংগ্রেসের এক শক্তিশালী অংশ পর্যন্ত বিভোর হলো রাম রাজত্বের স্বপ্নে। এ জটিলতার ফলে ভারতীয় জাতীয়তাবাদ আর সত্য অর্থে ধর্মনিরপেক্ষ রইলো না। বিকৃত রূপ ধারণ করে তা পরিণত হলো সম্প্রদায়িকতায়।

সাম্প্রদায়িকতার মাহাত্ম্যে জাতীয় আন্দোলনের ক্ষেত্রে ধর্ম সম্প্রদায় পরিণত হলো জাতিতে এবং মুসলমানেরাই হলো এই জাতিতত্ত্বের প্রধান ব্যাখ্যাকার। এর কারণ হিন্দু মধ্যবিত্তের সাম্প্রদায়িক শ্রেণী-স্বার্থ উদ্ধারের জন্য অপেক্ষাকৃত অগ্রসর সংখ্যাগরিষ্ঠ সম্প্রদায় হিসাবে পৃথক রাষ্ট্রের প্রয়োজন ছিল না। কিন্তু মুসলমান মধ্যবিত্তের সে প্রয়োজন ছিল। কায়েদে আজম জিন্নাহ দ্বিজাতি তত্ত্বের এই হলো সুনিশ্চিত অর্থনৈতিক বুনিয়াদ। পাকিস্তানের স্বপ্ন সত্য অর্থে ধর্মগতপ্রাণ ভারতীয় মুসলমানদের ইসলামী জীবন যাপনের স্বপ্ন নয়। এ স্বপ্ন মূলতঃ মুসলমান মধ্যবিত্তের শ্রেণী-স্বার্থ প্রতিষ্ঠার।

ভারতীয় জাতীয় আন্দোলনের ক্ষেত্রে সাম্প্রদায়িকতা নিঃসন্দেহে জাতীয়তারই বিকৃতি। ধর্মীয়-রাষ্ট্রর মধ্যেই সেজন্য তার অনিবার্য পরিণতি। প্রত্যেক জাতীয় আন্দোলনই সৃষ্টি করতে চায় তার উপযোগী রাষ্ট্র-ব্যবস্থা অর্থাৎ জাতীয় রাষ্ট্র। এ রাষ্ট্র গঠিত হয় জাতিধর্মনির্বিশেষে দেশের সকল জনসাধারণকে নিয়ে। কিন্তু জাতীয় আন্দোলন সাম্প্রয়িকতায় পরিণত হলে সাধারণ অর্থে জাতীয় রাষ্ট্রের মধ্যে সে আন্দোলন পরিণতি লাভ করে না। তার জন্য প্রয়োজন হয় এমন এক রাষ্ট-ব্যবস্থা যেখানে শুধু শ্রেণী-স্বার্থ রক্ষার উপযোগী ব্যবস্থা থাকে। একদিকে সাম্প্রদায়িকতা যেমন জাতীয়তার বিকৃতি, অন্যদিকে ধর্মীয় রাষ্ট্রও তেমনি জাতীয় রাষ্ট্রের নির্ভুল বিকৃতি। মধ্যবিত্তের আর্থিক প্রয়োজনের তাগিদে জাতীয় রাষ্ট্রের মতো ধর্মীয় রাষ্ট্রেরও উৎপত্তি বলে অন্যান্য জাতীয় রাষ্ট্রের মতো ধর্মীয় রাষ্ট্রের মধ্যেও সাধারণ জীবনযাত্রা ধর্মনিরপেক্ষ হতে বাধ্য।

পাকিন্তান ইসলামী রাষ্ট্র হিসাবে ইসলাম ধর্মের বর্ধন করতে কতখানি সমর্থ হয়েছে সেটা তর্কসাপেক্ষ। কিন্তু ইসলামী রাষ্ট্র হিসাবে পাকিস্তান যে মুসলমান মধ্যবিত্তের শ্রেণী-স্বার্থ প্রতিষ্ঠায় অনেকখানি সফল হয়েছে সে বিষয়ে তর্কের কোন অবকাশ নেই। এদিক দিয়ে ইসলামী রাষ্ট্র পাকিস্তান অন্যান্য যে কোন জাতীয় রাষ্ট্রের মতই নিঃসন্দেহে ধর্মনিরপেক্ষ।

***

১. Majumdar, RC, Glimpses of Bangal in the Nineteenth Century, p. 75-6
২. ভূপেন দত্ত, সাহিত্য ও প্রগতি। পৃষ্ঠা ৪৩।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *