৭. অবনী যাবার পর

৩১.

অবনী অনেকক্ষণ হল চলে গেছে।

অবনী যাবার পর মালিনী এসেছিল খাবার নিয়ে; খাবার রেখে টুকটাক কয়েকটা কাজ সারল ঘরের, বাইরের দরজা জানলা বন্ধ করল, করে চলে গেল। যাবার সময়ও দেখল সুরেশ্বর চিঠিপত্র লিখছে। বাইরে থেকে দরজাটা নিঃশব্দে টেনে দিয়ে গেল। ভরতু ছুটি নিয়ে বাড়ি গিয়েছে, এই সময় তার দেশ বাড়িতে ক্ষেতির কিছু কাজ থাকে; ওর ফিরতে ফিরতে সপ্তাহ তিনেক। ভরতু না থাকায় এবং সুরেশ্বরের শরীর খারাপের পর থেকে মালিনীই মোটামুটি সুরেশ্বরের দেখাশোনা করছে। অন্য দিন মালিনী যখন খাবার দিতে আসে, এসে ছোটখাটো কাজকর্মগুলো সারে তখন সুরেশ্বর তার সঙ্গে দু-দশটা কথাবার্তা বলে। সস্নেহে ও সকৌতুকে কখনও আশ্রমের অন্তঃপুরের খবর কী রান্নাবান্না হল, কাকে কী খেতে দেওয়া হচ্ছে, ডাক্তারবাবুদের জন্যে কী ব্যবস্থা হল ইত্যাদি জিজ্ঞেস করে; কখনও বা রীতিমতো বিস্ময় প্রকাশ করে বলে–হ্যাঁ রে মালিনী, আমার ঘরের সামনে কুলগাছে এবারে একটাও কুল দেখলাম না, কী ব্যাপার বল তো? কখনও আবার হৈমন্তীর কথা শুধায়। …আজ খাবার রাখতে এসে মালিনী দেখল, দাদা কাজ করছেন। দু-একটা হু-হাঁ ছাড়া কিছুই বললেন না। মুখচোখ গম্ভীর মনে হল; ব্যস্ত দেখাল। আবার এক এক সময় খুবই অন্যমনস্ক মনে হল, যেন কত কী ভাবছেন। খাবার আনতে আজ খানিকটা দেরিও হয়েছিল। মালিনী হাতের কাজ সেরে চলে গেল।

মালিনী চলে যাবার সামান্য পরে সুরেশ্বর লেখা শেষ করে উঠল। রাত্রের দিকেই সাধারণত সুরেশ্বর চিঠিপত্র লেখার কাজটা সেরে রাখে। অবনীকে সামান্য এগিয়ে দিয়ে ফিরে এসে সুরেশ্বর কিছুক্ষণ চুপচাপ বসে ছিল। কিছু করতে ইচ্ছে করছিল না। মন চঞ্চল হয়েছিল। পরে যেন মনকে সংযত ও স্থির করার জন্যে প্রত্যহের নিয়মমতন প্রয়োজনীয় চিঠিপত্র লিখতে বসল। দুটো সাধারণ চিঠি এবং পাটনায় উমেশবাবুকে একটা চিঠি লিখল। তারপর উঠল। রাত হয়েছে। এসময় তার খাওয়া-দাওয়া সারা হয়ে যায়।

বাড়ির ভেতরের বারান্দায় হাত ধুতে এসে সুরেশ্বর দেখল, ভেতরে জ্যোৎস্না এসে পড়েছে, বাতাসে রাত্রের এবং শীতের স্পর্শও অনুভব করা যাচ্ছে, হয়তো রাত হয়ে আসায় হিম পড়ছে, চারপাশ নিস্তব্ধ, গাছের পাতায় কদাচিৎ দীর্ঘশ্বাসের মতন শব্দ উঠছে বাতাসের।

শোবার ঘরে এসে খেতে বসল সুরেশ্বর। মালিনী মাটিতে আসন পেতে, জল গড়িয়ে রেখেছে। জালতির গোল ঢাকনার তলায় খাবার; দুধের বাটিটাও গরম করে রেখে গেছে ঢাকা দিয়ে। খাবার বলতে খান-চারেক পাতলা পাতলা রুটি, বোধহয় মালিনী নিজের হাতেই সেঁকেছে, সেদ্ধ আলু-গোলমরিচের গুঁড়ো দিয়ে মাখানো, কড়াইশুটি আর টমেটো দিয়ে তৈরি একটা তরকারি।

খেতে বসে সুরেশ্বর আবার অবনীর কথা ভাবল। অবনীর সঙ্গে যেন আরও অনেক কথা হতে পারত, হয়নি। অল্প দু-চারটে কথা অবশ্য অবনী বলেছিল পরে। সেগুলো তেমন কিছু নয়, তাতে তাপ ছিল না, ব্যাকুলতা ছিল না। বোধহয় একেবারে অকল্পনীয় অবস্থার মুখোমুখি দাঁড়িয়ে সে বিহ্বল ও বিমূঢ় হয়ে পড়েছিল; কী বলবে না বলবে, কী বা ভাববে ঠিক করতে পারছিল না; মানুষের বদ্ধমূল ধারণা অপ্রত্যাশিতভাবে নাড়া খেলে যা হয়। অবনী যেন সহজে আর-কিছু ভেবে নিতে পারছিল না। একবার এমনও মনে হল, সে এসব বিশ্বাস করতে পারছে না, ভাবছে তাকে জব্দ করার জন্যে সুরেশ্বর মিথ্যে কথা বলেছে। অবিশ্বাস এবং ক্রোধ তার দৃষ্টিতে ফুটে উঠেছিল, কিন্তু তা সাময়িক। বিশ্বাস না করে তার উপায় ছিল না। অত্যন্ত নিরাশ হয়ে পড়ার মতন তখন অক্ষম হয়ে নিজের ওপরেই বিরক্ত হচ্ছিল। অবনীর আচরণকে আস্ফালন বলা যায় না, সুরেশ্বরের কাছে সে আস্ফালন দেখাচ্ছিল না–তবু, জীবন সম্পর্কে, জীবনের দুঃখ ও তিক্ততা সম্পর্কে অবনীর যেন কেমন একটা অহঙ্কারের ভাব ছিল, অবনী সেই অহঙ্কার নিয়ে বুঝি লড়তে এসেছিল, এসে দেখল তার অহঙ্কার অর্থহীন। নিজের ব্যর্থতার জন্যে সে বিব্রত, লজ্জিত ও আড়ষ্ট হয়ে গেল।

সুরেশ্বরের মনে হয়েছিল, যদি অবনী তখন অতটা বিমূঢ় ও বিক্ষুব্ধ না হত তা হলে হয়তো আরও কিছু বলত। বলার আবেগ তার দৃষ্টিতে ফুটে উঠেছিল, সে উত্তেজিত হয়েছিল। কিন্তু আঘাত এবং নৈরাশ্য অবনীকে বিপর্যস্ত ও নির্বাক করে ফেলল।

অবনীর চরিত্রে, সুরেশ্বর যতটা তাকে চিনেছে, এক ধরনের ক্রোধ ও বিরক্তি আছে যা অনেকটা আত্মগ্লানির মতন। এই আত্মগ্লানি তাকে মাঝে মাঝে নির্দয় করে, উত্তেজিত ও অসংযত করে। সুরেশ্বর বুঝতে পারল না, নিজের সম্পর্কে গোপনে অবনীর যে হীনমন্যতাবোধ তা থেকে এই মানসিক তিক্ততা সৃষ্টি হয়েছে কে না। হতে পারে এটা অন্যতম কারণ।

খাওয়া শেষ হয়েছিল সুরেশ্বরের; উঠে পড়ল। পাত্রগুলো এক পাশে সরিয়ে রাখল। রাখার সময় চোখে পড়ল, মালিনী কয়েক চামচ চিনিও রেখে দিয়েছিল, দুধের বাটির পাশে কাচের ছোট্ট পাত্রে চিনিটুকু পড়েই থাকল।

বাইরে গিয়েছিল, হাত-মুখ ধুয়ে ফিরল সুরেশ্বর; বসার ঘরের দরজা বন্ধ করেছিল আগেই ও-ঘরের চটের সিলিংয়ের ফাঁক-ফোকরে কটা চড়ুই বাসা বেঁধেছে, রাত্রে মাঝে মাঝে ফরফর করে ওঠে। সেই রকম একটা শব্দ হল। শোবার ঘরে একটি জানলা খোলা, বাতাস আসছিল। সুরেশ্বর মুখে দুটি লবঙ্গের দানা ফেলে জানলার কাছে এসে দাঁড়াল। মাঠে নরম জ্যোৎস্না ছড়ানো, অল্প অল্প হিম ঝরেছে রাত্রে, চারপাশ অসাড়, নিস্তব্ধ। দুরের দিকে তাকালে হিম-জ্যোৎস্না মাখানো মাঠটা জলাশয়ের মতন দেখাচ্ছিল। কাছাকাছি এবং তফাতের ফুল-পাতার ঝোপ, গাছগাছালি যেন নিদ্রিত।

দূরে মাঠের দিকে তাকিয়ে সুরেশ্বরের হঠাৎ মনে হল, যাবার সময় অবনী তেমন হুঁশের মধ্যে ছিল না, বোধহয় হেমের সঙ্গে দেখা করেও যায়নি। অস্থিরচিত্ত, বিমর্ষ, অন্যমনস্ক অবস্থায় অবনী যদি সোজা গাড়িতে গিয়ে বসে থাকে, তবে ওই অবস্থাতেই সে চলে গেছে। এত অস্থির মন নিয়ে ওই ফাঁকা দিয়ে মাঠঘাট পেরিয়ে অবনী চলে গেল ভেবে সুরেশ্বরের সামান্য দুশ্চিন্তা হচ্ছিল।

জানলা থেকে সরে এল সুরেশ্বর। ঘরের মধ্যে কয়েক পা হাঁটল। ঘড়ি না দেখেও বোঝা যায় রাত হয়েছে। মালিনী মশারি টাঙিয়ে পাশগুলো চালের ওপর তুলে রেখে গেছে। সুরেশ্বর মশারির কোণগুলো আরও একটু টেনে নিল, নিয়ে মশারি ফেলে বিছানার পাশে পাশে গুঁজে নিল। বাতি নিবিয়ে এসে শুয়ে পড়ল।

রাত্রে এখনও শীত আছে, র‍্যাগ গায়ে টেনে নিতে নিতে সামান্য যেন শীতধরার মতন লাগল, গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠল। শুয়ে শুয়ে এই শিহরনটুকু দমন করে নিল। খুব সম্ভব সর্দিজ্বরের পর তার শরীরের দুর্বলতাটুকু এখনও পুরোপুরি কাটেনি, সামান্যতেই শীত গায়ে লাগছে।

অন্ধকারে চোখের পাতা বন্ধ করে শুয়ে থাকতে থাকতে সর্বাঙ্গ কেমন অবশ হয়ে এল, স্নায়ুগুলিতে যেন সাড় থাকল না, বিছানার স্পর্শও গায়ে লাগছিল না, মনে হল তার চেতনা নিষ্ক্রিয় হয়ে গেছে। হঠাৎ, এই রকম মুহূর্তে, তন্দ্রার মধ্যে চকিতে সুরেশ্বর স্বপ্ন দেখল। স্বপ্ন দেখল: পালঙ্কের ওপর মার মৃতদেহ, পায়ের কাছে বিনুমাসি, মার পা জড়িয়ে ধরে কাঁদছে; মার মাথার কাছে নির্মলা চুপচাপ বসে, মার মুখের দিকে অপলকে তাকিয়ে আছে; আর পালঙ্কের মাঝামাঝি জায়গায় বাবা দাঁড়িয়ে। বাবার হাতে মস্ত বড় একটা রংমশাল–অনেকটা বাবার শখের কাশ্মীরি ছড়ির মতন; রংমশালটা জ্বলছে– তার মুখ থেকে রূপোলি ফুলকি, উজ্জ্বল আভা ঝরে পড়ছে। রংমশালের আলোয় মার সর্বাঙ্গ দেখা যাচ্ছিল; মুখ এবং গলা ছাড়া মার সবই আবৃত ছিল। গলায় নীল একটা চওড়া দাগ, কালসিটের চিক-হার পরে যেন মা ঘুমোচ্ছে।

স্বপ্নটা চকিতে দেখা দিয়েই যেন মিলিয়ে গেল। তন্দ্রাও কেটে গিয়েছিল। সুরেশ্বর অন্ধকারে চোখ চেয়ে আর কিছু দেখতে পেল না।

মার স্বপ্ন অনেক দিন দেখেনি সুরেশ্বর। আজ মাকে দেখতে পেয়ে তার খুব ভাল লাগছিল। যেন হঠাৎ সে বাল্যকালে ফিরে গিয়েছিল এবং বালকের মতন মার পালঙ্কের দিকে ছুটে যাচ্ছিল; কাছাকাছি এসে সুরেশ্বর বুঝতে পারল এবং দেখতে পেল, মা পালঙ্কে শুয়ে নেইমার মৃতদেহ শোয়ানো রয়েছে। সে আহত হল। পরে সুরেশ্বর একে একে নির্মলা, বিনুমাসি এবং বাবাকে দেখতে পেল। দেখার পর সে আর বালক থাকল না, আবার বয়স্কমানুষ হয়ে গেল।

স্বপ্নটা বিচিত্র। মার মৃত্যুর সময় বিনুমাসি বা নির্মলার থাকার কথা নয়। বিনুমাসি তখন তাদের কাছে ছিল না, মা তাকে অনেক আগেই ছুটি দিয়ে দিয়েছিল সংসার থেকে, তীর্থে পাঠিয়ে দিয়েছিল। এমনকী মার মৃত্যুর খবরও বিনুমাসি দেরিতে পাওয়ায় শ্রাদ্ধের সময় আসতে পারেনি। তবু স্বপ্নে মার মৃতদেহের সামনে বিনুমাসিকে কেমন যেন মানিয়ে গেল।

নির্মলার সঙ্গে মার কোনও রকম যোগাযোগ ঘটার কথাই ওঠে না। র কথা নির্মলা কিছু কিছু শুনেছিল মাত্র, সুরেশ্বরই বলেছিল। সেই নির্মলা যে কী করে মার মাথার সামনে এসে বসল, কে জানে? স্বপ্নে সবই সম্ভব। তবু নির্মলাকেও খুব বেমানান দেখাচ্ছিল না। সবচেয়ে যা অদ্ভুত এবং বেমানান তা হল বাবা। বাবা যে কী করে ছড়ির মতন লম্বা একটা রংমশাল জ্বালিয়ে মার পালঙ্কের সামনে দাঁড়িয়ে থাকল, কে জানে। বাবা কী দেখাতে চাইছিল?

সুরেশ্বর যেন ভাববার চেষ্টা করল, বাবা কী বেশে দাঁড়িয়েছিল। মনে করতে পারল না। কলকাতার কাজ সেরে যখন বাবা বাড়ি ফিরত বাবার পোশাকের কিছু অদলবদল ঘটত। দামি সিল্কের পাঞ্জাবি, ফরাসডাঙ্গার ধুতি, হাতে ছড়ি, পায়ে চকচকে পাম্পশু। একবার বাবা যখন কলকাতায় গিয়ে মাস খানেক পরে ফিরল, যেদিন ফিরল, পরের দিনই সকালে মাকে মার শোবার ঘর থেকে ফাঁস-খাওয়া অবস্থায় বের করে আনতে হয়েছিল। বাবা তখনও নিজের ঘরে বিছানায় শুয়ে, আকাশটা সেদিন মেঘে মেঘে কালো হয়ে ছিল সকাল থেকেই, বৃষ্টি পড়ছিল, থামছিল, পড়ছিল। ঝাঁপটা দিচ্ছিল। মেঘ ডাকছিল।

সুরেশ্বর মার মৃত্যু এবং আনুষঙ্গিক ঘটনাগুলো বিচ্ছিন্নভাবে মনে করছিল এবং ভাবছিল। দেশের বাড়িতে মার নিজের ঘরটি ছিল পুব মুখো, জানলা খুললে নদীর একটা দিক দেখা যেত, আর দেখা যেত আদিগন্ত ফসলের মাঠ-নদীর ওপারে। মার ঘরে ভারী ভারী সেকালের প্রচুর আসবাবপত্র ছিল। যখন মার মাথার গোলমাল শুরু হয়ে গেল তখন একে একে এবং নিজের খেয়ালে মা সব ঘর থেকে বের করে দিতে লাগল; বিলিতি একটা কাচের মস্ত আয়না, শোবার পালঙ্ক আর গহনার সিন্দুক ছাড়া মার ঘরে আর কিছু ছিল না শেষ পর্যন্ত। পানের বাটা আর সোনার দাঁতকাঠিও থাকত। মার রূপের অহঙ্কার ছিল না, তবু যখন খুব অপ্রকৃতিস্থ হয়ে পড়ত তখন আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজের সেই অসামান্য রূপ নিজেই দেখত, কোনও কোনও সময় কোনও লজ্জাও রাখত না। বাবাকে এ সময় ধারেকাছে কোথাও দেখা যেত না। অবশ্য বাবা দাম্পত্য সম্পর্ক মার সঙ্গে রাখেনি; সাংসারিক সম্পর্ক রেখেছিল। দিনের বেলায় বাবার খাবার সময় দিনান্তের মধ্যে একবার মাত্র মা বাবার সামনে এসে বসত এবং তখনই যা দেখা-শোনা কথাবার্তা হত স্বামী-স্ত্রীতে।

এ বিষয়ে কোনও সন্দেহ নেই, মা অপ্রকৃতিস্থ অবস্থায় আত্মহত্যা করেছিল। কিন্তু সুরেশ্বরের পরে সন্দেহ হয়েছিল, মা যেদিন আত্মহত্যা করে সেদিন বাবা কলকাতা থেকে ফিরে আসার পর রাত্রে মার ঘরে গিয়েছিল এবং মা ও বাবার মধ্যে কোনও রকম কলহ হয়েছিল। খুব সম্ভব মা সেদিন জানতে পেরেছিল কলকাতায় বাবার উপপত্নীর গর্ভজাত আর-একটি সন্তান আছে। মার অহঙ্কারে এবং সম্মানে, হয়তো আভিজাত্যে এটা লেগেছিল। যদিও বাবার ভোগসুখের বিষয়ে মা অবহেলা দেখিয়েছে, অন্য রমণীর সঙ্গে বাবাকে বসবাস করতে দিয়েছে, তবু মা বাবার এই দ্বিতীয় সন্তানকে সহ্য করতে পারেনি। বাবা মাকে কী বলেছিল, কী কলহ হয়েছিল তা সুরেশ্বর জানে না। এ সবই তার অনুমান। আত্মহত্যার পর মার ঘরের দরজা ভেতর থেকে খোলা ছিল, এবং বাবা যে মার ঘরে গিয়েছিল তার প্রমাণ হিসেবে বাবার সিগারেট-কেস মার ঘরে পড়ে ছিল। পরে শ্রাদ্ধান্তে বাবা যেদিন মার ছবির সামনে দাঁড়িয়ে অশ্রু বিসর্জন করেছিল–সেদিন বাবা নিজের অজ্ঞাতসারে যেন কলহের বিষয় কিছু বলে ফেলেছিল। সুরেশ্বর ছাড়া অন্য কারও তা জানার কথা নয়। সুরেশ্বরও তখন ভাল বোঝেনি।

বাবা যে কেন এরকম একটা অবস্থায় রংমশাল জ্বেলে দাঁড়িয়ে থাকল–সুরেশ্বর বুঝতে পারছিল না। মার মৃত্যু কি বাবার কাছে উৎসবের বিষয় হয়েছিল? ছেলেমানুষের মতন আহ্লাদ দেখিয়ে বাবা রংমশাল জ্বালাবে? বস্তুত মার মৃত্যুতে বাবার লাভ বা লোকসান কিছুই হয়নি। বেঁচে থেকেও মা বাবার বাধা ছিল না, মরে গিয়েও বাবার কোনও বাধা দূর করেনি। মার অবর্তমানে বাবা যে আর-একবার বিবাহ করেছে, বা কলকাতায় রাখা উপপত্নীকে পত্নীর মর্যাদা দিয়ে ঘরে এনেছে, তাও নয়। তা হলে এমন কী আনন্দের কারণ ঘটল যাতে বাবা রংমশাল জ্বালিয়ে মার মৃত্যুশয্যার পাশে দাঁড়িয়ে থাকবে!

স্বপ্নের অর্থ আবিষ্কারের জন্যে সুরেশ্বরের অস্থির বা ব্যাকুল হবার কোনও কারণ ছিল না। সে ব্যাকুল হচ্ছিল না। তবু এই অদ্ভুত বিসদৃশ ছবিটি তাকে খানিকটা অস্বস্তি দিচ্ছিল। আরও কিছুটা এলোমেলো ভাবনার পর তার মনে হল, বাবা যেন মার তরফের ছবিটা দেখাবার জন্যে রংমশাল হাতে দাঁড়িয়ে ছিল, হুস হুস করে রুপোলি ফুলকি ছড়িয়ে যে উজ্জ্বল আলো জ্বলছিল বাবা সেই আলো দিয়ে মাকে চেনাচ্ছিল: ওই তোমার মা, মূর্খ, অহঙ্কারী, পাগল; মরতে জানে, বাঁচতে জানে না। ওর সমস্ত জীবন ওইভাবে কেটেছে–পালঙ্কের ওপর চুল ছড়িয়ে শুয়ে, দাসীর হাতে আলতা পরে। তুমি ভেবো না বিনু কাঁদছে, বিনু তোমার মার পায়ে আলতা পরিয়ে দিচ্ছে।

চিন্তাটা সুরেশ্বরের যেন তেমন মনঃপূত হল না। সে অন্য কিছু ভাবতে গেল, ভাবতে গিয়ে দেখল, এই স্বপ্নের মধ্যে বাবা একটি পৃথক অংশ এবং মা, নির্মলা, বিনুমাসি অন্য অংশ; বাবা জীবনের সেই অংশ–যেখানে জীবনের অর্থ: ভোগ, ফুর্তি, সুখ, অপচয়, অসংযম, স্বার্থপরতা, নীচতা–এমনকী নিষ্ঠুরতা। মা, নির্মলা, বিনুমাসি–জীবনের অন্য অংশ; যেখানে মূর্খতা, অভিমান, অহঙ্কার, নৈরাশ্য, বেদনা, সহিষ্ণুতা, স্নেহ, প্রেম–এমন কী আত্মনিগ্রহ।

সুরেশ্বর এবার যেন অনেকটা সন্তুষ্ট হল। বাবা যে জীবনকে ভোগ্ন করেছিল, এবং ভোগ করতে বসে বিবেকে কোথাও বাধা পায়নি তাতে সন্দেহ নেই। দীর্ঘকাল বাবা বাঁচেনি; যতদিন বেঁচে ছিল নিজেকে রংমশালের মতন পুড়িয়ে ফেলেছে। তার জন্যে বাবার না অনুশোচনা, না দুঃখ। এমনকী বাবা তার উপপত্নীর এবং সেই সন্তানের জন্যেও কোনও মায়া-মমতা অনুভব করেনি, তাদের জন্যে কিছু রেখে যায়নি; ভোগের বিষয়, বস্তু ও তার পরিণতির মতন ওদের দেখেছে। …বাবার চরিত্রে নীচতা এবং নিষ্ঠুরতারও সীমা নেই।

মার মৃতদেহের পাশে নির্মলা এবং বিনুমাসি যে কেন বসে ছিল–এবার সুরেশ্বর বুঝতে পেরে আর অবাক হচ্ছিল না। মার পাশে ওদের মানায়, যদিও ওরা এক নয়। স্বতন্ত্র এবং পৃথক হলেও এই অংশে জীবনের বিষাদ এবং ব্যর্থতা, শোক ও ক্রন্দন রয়েছে। মার আত্মহত্যা, নির্মলার মৃত্যু–এরা একরকম নয়; মার ভাগ্য বিড়ম্বনা বা নির্মলার ভাগ্য এক নয়; মার মধ্যে নির্মলার সেই অদ্ভুত উদাসীনতা, নির্লিপ্ত সহিষ্ণুতা, ঈশ্বর-বিশ্বাস ছিল না। বিনুমাসি বেচারি একেবারে সাদামাটা, স্নেহ মমতা ছাড়া তার রূপ নেই চরিত্র নেই, সন্তানের মতন লালন-পালন করেছে সুরেশ্বেরকে; তবু বিনুমাসি দুঃখী; দুঃখী, কারণ বিনুমাসি সারা জীবনেও নিজের জন্যে কিছু পায়নি।

সহসা স্বপ্ন-বিষয়ক চিন্তাগুলি এলোমেলো হয়ে মন থেকে সরে গেল, গিয়ে অবনীর কথা মনে পড়ল সুরেশ্বরের। এবং কেমন যেন অজ্ঞাতসারেই সে অবনীকে স্বপ্নের ছবির মধ্যে দাঁড় করাতে গিয়ে দেখল অবনীর কোথাও স্থান হচ্ছে না। বাবার পাশে অবনীকে দাঁড় করানো যায় না–যদিও বাবার চরিত্রের একটা জিনিস অবনীর মধ্যে আছে: অপচয়–জীবনকে অপচয় করার কামনা। নির্মলা, মা এবং বিনুমাসির দিকেও অবনীকে রাখা যায় না, যদিও অবনীর কোথাও গভীর কোনও বেদনা ও নৈরাশ্য রয়েছে। অবনী ওদের মতন নয়, কোথাও যেন আলাদা।

সুরেশ্বরের হঠাৎ মনে হল, অবনী তার পিতার উপপত্নীর পুত্র হতে পারত, হলে অবাক হবার মতন কিছু ছিল নাঃ যদিও অবনী তা নয়, তার বাবার উপপত্নী থিয়েটারের অভিনেত্রী ছিল না। ভাগ্যের দিক থেকে উভয়ক্ষেত্রে একটা সাদৃশ্য রয়েছে এই মাত্র।

অবনী তাকে সংসার এবং জীবন চেনাতে এসেছিল। সুরেশ্বর যেন সামান্য বিহ্বল বোধ করল। কাতর হল। আমি জীবনের কিছু দেখিনি? বাল্যকাল থেকে যাদের দেখেছি তারা তো আমার জীবনের বাইরে ছিল না, তারা কেউই এই সংসারের বাইরেও নয়। আমার জন্যে কোনও আলাদা ব্যবস্থা হয়নি সংসারের, আমি ভাগ্যবন্ত ছিলুম না, সংসারের অনেক নোংরামি, কদর্যতা, হৃদয়হীনতার সঙ্গে আমার আজন্ম পরিচয়।

বালক বয়স থেকে আমি একা, আমার কোনও সঙ্গী ছিল না, আমি মার নজরে নজরে শিশুর মতন বেড়ে উঠেছিলাম। মার সব সময় ভয় ছিল আমি অপঘাতে মরব। জানি না কেন, মার মনে এই ধারণা জন্মেছিল। বাবাও আমার শত্রুতা করতে পারে-মা এরকমও ভাবত। ফলে বাবার সঙ্গে আমার পিতা-পুত্রের সম্পর্কটা কোনও কালেই আন্তরিক হয়নি। সেদিক থেকে আমাকে পিতৃহীন বা পিতার পালিত-পুত্রও বলা যায়। মাও আমার সঙ্গী ছিল না। আমার ওপর মার দৃষ্টি ছিল মাত্র, অন্তর ছিল না। একদিন মা শীতের দুপুরে রোদে চুল এলিয়ে বসে পানের বাটা পাশে রেখে বিন্তি খেলছিল, আমি কাছাকাছি জায়গায় খরগোসের খাঁচা নিয়ে বসে খেলছিলাম, খাঁচার মধ্যে থেকে খরগোসটা কী করে যেন বেরিয়ে এসে দালান বয়ে তরতর করে পালাল; আমি ছুটে তাকে ধরতে যাচ্ছিলাম; মা বলল, কোথায় যাচ্ছিস? বললাম, আমার খরগোসটা পালিয়েছে। মা বলল, থাক, পালাকগে যাক, তুই যাবি না। অন্য খরগোস আনিয়ে দেব। ..মা যতদিন বেঁচে ছিল কোনও দিনই আমার নিজের জিনিস নিজেকে ধরে রাখতে, বেছে নিতে দেয়নি। মার আঁচলের তলায় তলায় বেড়ে ওঠা ছাড়া আমার কোনও স্বাধীনতা ছিল না, মুক্তি ছিল না। আমি যে ছেলেবেলায় কিছুটা নির্জীব, সঙ্গীহীন, ভীতু ছিলাম তা মার জন্যে। মা মারা যাবার পর আমার আশেপাশে আর দেওয়াল থাকল না, বাবা আমায় অবাধ স্বাধীনতা দিয়েছিল, কারণ আমাদের মধ্যে কোনও গভীর ও আন্তরিক সম্পর্ক না থাকায় বাবার পক্ষে তখন আমায় স্বাধীনতা না দিয়ে উপায় ছিল না। আমি জীবনের সেদিকে যেতে পারলাম না–যেখানে অগণিত মানুষ স্নান্যাত্রায় চলেছে, যেখানের জল গন্ধক কূপের মতন টগবগ করে ফুটছে। সুযোগ এবং সামর্থ্য থাকা সত্ত্বেও আমি উল্লাসের দিক থেকে সরে থেকেছি।

ভাবনাগুলো এলোমেলো হয়ে গেল, সুরেশ্বর যেন হঠাৎ কেমন একটা ব্যবধানে সরে এল। কিছুক্ষণ আর তার উৎসাহ থাকল না, অনেকটা দূরে বসে উদাস হয়ে তাকিয়ে থাকার মতন সে অতীতের দিকে তাকিয়ে থাকল, বিশেষভাবে সে কিছু দেখল না। তাকিয়ে থাকতে থাকতে খাপছাড়া ভাবে সে এটা-সেটা মনে করতে এবং দু-চারজনকে যেন দেখতে পেল। কোথাও তার মন বসল না, শুধু পুরনো এক বন্ধু দিবাকরকে মনে পড়ল; মনে পড়ল দিবাকর বলত: আমি রোজ রাত্রে একবার করে লাইফের ব্যাটারিটা চার্জ করিয়ে নি,বুঝলি; সকালে একেবারে নিউ ব্যাটারি; শালাকম ছুটতে হবে…। সুরেশ্বর মনে করতে পারল, কলকাতায় হোস্টেলে থেকে বি-এ পড়ার সময় দিবাকর একদিন কোথায় পালিয়ে গেল, মাসখানেক পরে জানা গেল সে ভদ্রেশ্বরের দিকে রেলে কাটা পড়েছে। কী করে, কী কারণে এসব ঘটেছিল কেউ জানল না। কিন্তু দিবাকরের জীবনে দৌড়টা বেশিদিন টিকল না।

সুরেশ্বর তার যৌবনে দিবাকরের দলে ছিল না, কিন্তু সে দিবাকরের মতনই সরল, জীবন্ত ছিল, শিষ্ট ও নম্র ছিল। দিবাকর তাকে ভালবাসত, বলত: তুই বড় সাবধানী, ইউ আর এ ক্যাট…তোর শালা কখনও কিছু হবে না। ওরে সাবধানী পথিকবারেক পথ ভোলো5; পোয়েট বলেছে পথ ভুলতে, তুই শালা একেবারে সিধে সড়কে চলেছিস।

হয়তো দিবাকর ঠিকই বলেছিল, সুরেশ্বর সাবধানী ছিল। সাবধানী মানে এই নয় যে, সে জীবনের বাইরে বাইরে ছিল। তার কখনও মনে হয়নি, জীবন নিয়ে খেলা করে কিছু পাওয়া যেতে পারে। সে মধুর, সন্তুষ্ট, শিষ্ট থাকতে চেয়েছিল, এবং জীবনের প্রতি তার আবেগ ছিল সাধারণ মানুষের মতন। তার বন্ধুরা তাকে বরাবর ভালবাসত, মাস্টারমশাইরা স্নেহ করত, হেমদের বাড়িতে সকলেই তাকে পছন্দ করত।

এইভাবে যৌবনের প্রথমটা কাটল, তারপর আবার দেশবাড়িতে গিয়ে থাকতে হল, বাবা মারা গেল, সংসারে একেবারে একা, জমিজায়গা সম্পত্তি, কলকাতা থেকে বাবার উপপত্নীর সেই সম্পত্তি দাবি করে চিঠি, মামলা করার শাসানি। সুরেশ্বর কলকাতায় চলে এল আবার।

জীবনের এই পর্বটাও সুখে দুঃখে, কখনও ক্ষোভে, কখনও রোমাঞ্চে ভরা। সম্পত্তির সমস্যাটা মিটোতে হল বলে সুরেশ্বরের কখনও ক্ষোভ হয়নি, সে স্বেচ্ছায় যা দেবার দিয়েছিল। তারপর হেম…হেমের অসুখ…

সুরেশ্বর এখানে আবার যেন বাধা পেল এবং চিন্তাটা কিছুটা এলোমেলো হয়ে গেল। হেমের অসুখ, জীবন-মৃত্যুর সেই দ্বন্দ্ব, হেমের সেই অসহায়তা, তাদের সংসারের মাথার ওপর আকস্মিক সেই বজ্রপাত–এসব এখন অতি দুরের অস্পষ্ট ছবির মতন হয়ে গেছে। অস্বীকার করে লাভ নেই, তখন সেই বয়সে এবং অবস্থায় সুরেশ্বর হেমের প্রতি আকৃষ্ট হয়েছিল। যৌবনের সেই প্রেম তাকে উদ্বেল করেছিল, হেমের জন্যে তার দুশ্চিন্তার অবধি ছিল না। হেমের সাহচর্য, সঙ্গ, হেমের সুস্থতা তার একমাত্র কাম্য বিষয় ছিল। হেম যখন সুস্থ হয়ে উঠল তখন সুরেশ্বরের জীবনে এমন একটা স্বাদ এসেছিল যা আগে আর কখনও সে অনুভব করেনি। হেমের দেহমন যেন তার, হেমের নিশ্বাস যেন তার শ্বাসপ্রশ্বাসের সঙ্গে মিশ্রিত, হেমের হৃদয় যেন তার হৃদয়ের অন্তর্ভুক্ত।

এই সুখ, এই স্বাদ, এই আনন্দ মনে হয়নি কোনওদিন নৈরাশ্য আনবে। অথচ কী যেন হল, হেম আর তার আনন্দের কারণ হয়ে থাকল না। কী যেন নেই, কী যেন হারিয়ে গেছে, কোথায় যেন কিছু শূন্যতা থেকে যাচ্ছে–এরকম একটা ভাব ছিল মনে। অবসাদ লাগত। মনে হত, এই প্রেম কি আমায় সব দিতে পারে? কেন এরকম হতে শুরু হয়েছিল সুরেশ্বর জানে না। তার শুধু মনে হত কোথাও যেন একটা মিথ্যা আছে। হয় তার মনে, না হয় এই প্রেমে।

এমন সময় নির্মলার সঙ্গে তার পরিচয়। নির্মলা তার পরিণত যুবক বয়সের মনটিকে যেন কোথায় নিয়ে গিয়ে দাঁড় করিয়ে দিল। বিশ্বসংসারে এত দুঃখ, বেদনা, বঞ্চনা, অসুস্থতা, ব্যর্থতা আছে যার বুঝি পরিসীমা নেই; তবু মানুষ কী আশ্বাসে বাঁচবে? কেন বাঁচবে? নিরর্থক জীবনধারণে কোনও সান্ত্বনা আছে? নির্মলা বলত: আছে কিছু আছে; খুঁজে দেখো না কী পাও!

নির্মলার সংস্পর্শে এসে সুরেশ্বর তার চরিত্রের নকল সাজসজ্জাকে চিনতে পেরেছিল, অনুভব করতে পেরেছিল সে কত অকর্মণ্য, কোথায় তার স্বার্থ, কী ভীষণ তার অহঙ্কার, ভীরুতা, কত অবজ্ঞেয়, তার উদারতা। জীবনের সঙ্গে তার নিষ্ক্রিয় সম্পর্ককে আবিষ্কার করতে পেরে সুরেশ্বর তখন বেদনার্ত হয়েছিল।

অন্ধকারে কে যেন সহসা বলল, নির্মলা তোমায় কী দিয়েছিল?

সুরেশ্বর অন্ধকারের মধ্যে প্রায় নিশ্বাসের মতন সুরে এই প্রশ্নটি তার কানের কাছে শুনতে পেল। শুনে বিস্মিত হল না, বিভ্রান্ত হল না। নির্মলা তাকে কী দিয়েছিল এ কথা কি বলা যায়!

নির্মলা তোমায় সংসার থেকে, জীবন থেকে, ভালবাসা থেকে দূরে সরিয়ে দেয়নি?

সুরেশ্বরের এবার যেন হাসি পেল। নির্মলাই শেষ পর্যন্ত জীবনে যতটুকু দেবার সুরেশ্বরকে দিয়েছে।

সে আমায় এই বৃহৎ সংসারে অকস্মাৎ যেন ছুঁড়ে দিয়ে চলে গেল। আমি একা, আমি নিরাশ্রয়, আমার কোনও সান্ত্বনা নেই, সাহস নেই, বিশ্বাস নেই, উদ্দেশ্য নেই। কী মূল্য তবে এই জীবনের? কেন আমি বাঁচব? কী আমি পেতে পারি?

এই শূন্যতা এবং অবিশ্বাসের মধ্যে আমি আমার জীবনের অর্থ অন্বেষণ করতে চাইছিলাম। কলকাতা ছেড়ে আমি চলে গেলাম। সেই যে–ক্ষ্যাপা খুঁজে খুঁজে ফেরে পরশ-পাথর–সেই রকম। আমি সাধু সন্ন্যাসী, ফকির, বিদ্বান, বুদ্ধিমান, ধর্ম-প্রতিষ্ঠান নানা জায়গায় ঘুরেছি। আমার কোনও সান্ত্বনা জোটেনি। এমন কিছু পাইনি যাতে মনে হয় আমার হৃদয় জুড়োল। অথচ আমি অনুভব করতাম, নির্মলার দেওয়া সেই শেষ আবিরটুকু আমার কপালে দিব্য চুম্বনের মতন আঁকা আছে। কিছু আমায় পেতেই হবে।

অবশেষে একদিন আমার কাছে আমার জীবনের অর্থ ধরা দিল।

সেটা কী?

 সুরেশ্বর এবার হাসল যেন, বলল: আজ আমায় ঘুমোতে দাও।

সুরেশ্বরের চোখের পাতা বুজে এসেছিল।

.

৩২.

সকালের বাসেই হৈমন্তী চলে এসেছিল। আসার সময় গুরুডিয়া থেকে লাইটার মোড় পর্যন্ত হেঁটে এসে বাস ধরেছে। পথটুকু এবং সকালটি এত মনোরম ও স্নিগ্ধ লেগেছিল যে হাঁটার ক্লান্তি সে অনুভব করেনি, বরং আসার সময় চোখ চেয়ে চেয়ে দেখেছে এবং অনুভব করেছে শীত যেন পিছু ফিরে তাকাতে তাকাতে অনেকটা দূরে চলে গেছে, আর তাকে দেখা যাচ্ছে না; তার বদলে বসন্ত এসে গেছে। অস্পষ্ট একটি গুঞ্জন যেন অনুভব করা যাচ্ছিল বসন্তের।

স্টেশনে এসে হৈমন্তী:দেখল, সে আসবে বলে ওরা আজ অপেক্ষা করছে। বিজলীবাবুর বাড়িতেই গেল সরাসরি। -সরসীদি, বিজলীবাবুর ছোট বউ, পথ চেয়ে বসেছিলেন, সদরে এসে হাত ধরে টেনে নিয়ে গেলেন: আসুন ভাই, সকাল থেকে চাতক হয়ে বসে আছি। সঙ্গে সঙ্গে বিজলীবাবুর কাছে। পেন্সিলে লেখা চিরকুট গেল সরসীদির।

বাকি সকাল এবং দুপুরটুকু বিজলীবাবুর বাড়িতেই কাটল। আদর-আন্তরিকতার অভাব ঘটল না কোথাও। সরসীদি যা করলেন সারাক্ষণ মনে হল যেন দূর দেশ থেকে কোনও আত্মীয় এসেছে বাড়িতে, এসেছে হঠাৎ আবার চলেও যাবে কয়েক ঘণ্টার পর এই সময়টুকুতে যতটা পারি আদর-যত্ন করি। ওমা, সে কী কথা ভাই, অমন সিল্কের শাড়িটা সারাদিন পরে নষ্ট করবেন কেন, আমি শাড়ি বের করে রেখেছি, পরুন, আহা, আপনার যেমন কথা, চলুন না–আমি মাথা ঘষে দিচ্ছি, একটুও ঠাণ্ডা লাগবে না, দেখতে দেখতে চুল শুকিয়ে যাবে…কী সুন্দর চুল আপনার…। হৈমন্তী কোনও কিছুতেই বড় আপত্তি করতে পারল না। পারল না কারণ, অল্প হলেও সরসীদির সঙ্গে যতটুকু আলাপ, যে কদিন দেখাসাক্ষাৎ হয়েছে তাতে হৈমন্তী বুঝতে পেরেছিল মানুষটিকে না বলে দূরে সরিয়ে রাখা যায় না। গগন এসে সরসীদিকে আরও যেন নিকটজন করে দিয়ে গেছে। তা ছাড়া একটা সময় ছিল যখন হৈমন্তীর পরিচয় ছিল অন্ধ আশ্রমের ডাক্তার হিসেবে, পেশাদারি গাম্ভীর্যে এই পারিবারিক অন্তরঙ্গতা থেকে নিজেকে দূরে সরিয়ে রাখতে পারত, সে-গাম্ভীর্যও আর নেই, পরিচয়ের দূরত্বও না। সরসীদির আদর-যত্ন, অন্তরঙ্গতা হৈমন্তীর অপছন্দও হল না; বরং অনেক দিন পরে সে এই পারিবারিক জীবনের স্বাদ ও স্পর্শ পেয়ে খুশি হল; মন স্নিগ্ধ লাগল।

বিজলীবাবুর বড় বউকে দূরে দূরে সরে সরে থাকতেই হৈমন্তী দেখেছে আগে; শুনেছে, ঠাকুর ঘরেই তাঁর সময় কাটে। যদিও সংসারের তিনিই মাথা–তাঁর কথাতেই সংসারটা চলে, তবু সংসারে পড়ে থাকতে তাঁকে বড় দেখেনি। পরিচয় থাকলেও কখনও উনি হৈমন্তীর সঙ্গে বসে সরসীদির মতন গল্পসল্প করেননি, অল্প দু-চারটে কথা বলে নিজের কাজে চলে গেছেন। দেখা গেল, আজ তিনি পুজোপাঠ এবং সংসারের সময় থেকে দুদণ্ড বাঁচিয়ে হৈমন্তীর সঙ্গে কথাবার্তা বললেন।

হৈমন্তীর বরাবরই মনে মনে একটা কৌতূহল ছিল: ছোট-র সঙ্গে বড়র ওপর ওপর যে সম্ভাব, ভেতরেও কি সেই সদ্ভাব আছে? এই মেয়েলি কৌতূহল অনেক সময় হৈমন্তীকে ব্যর্থ করেছে, কিন্তু বোঝা বা অনুমান করার মতন সুযোগ কখনও ঘটেনি৷ মেলামেশা থাকলেও যে এটা সহজে বোঝা যেত তা নয়; তবু কৌতূহল ছিল হৈমন্তীর। আজ তার মনে হল, বড় অর্থাৎ সরসীদির দিদি স্বামীর দেখাশোনা দায়-দায়িত্বের ভারটা সবই বোনের হাতে তুলে দিয়েছেন যেমন বাড়িতে বউ এলে ছেলের ভার মা বউয়ের হাতেই তুলে দেয়। কথাটা ভাবতে হাসি পায় অবশ্য, মজাও লাগে; কিন্তু ব্যাপারটা অনেকটা সেইরকম। সরসীদির হাতে বিজলীবাবুকে গচ্ছিত করে উনি আড়ালে সরে গেছেন। তাঁর আলাদা ঘর; একা থাকেন। সে-ঘরে যতটুকু যা আছে সব যেন কোনও পুরনো স্মৃতির মতন রেখে দেওয়া, এখন আর যা ব্যবহার্য নয়। বিজলীবাবুর সদ্য-যুবক বয়সের ছবি, বিয়ের পর তোলা দুজনের ফটো, এমনকী কার্পেটের রাধাকৃষ্ণ–এসবই পুরনো সংগ্রহ; নতুন কিছু নেই। একার বিছানা, একটিমাত্র বালিশ। ঠাকুর-দেবতার ছবিতে দেওয়ালের অনেকখানি ভরা–বোধহয় এইগুলোই তাঁর নতুন, আর কিছু নয়। সরসীদির ঘরের চেহারা আলাদা, সেখানে আসবাবপত্র সাজসজ্জা স্বতন্ত্র, পালঙ্কজোড়া বিছানা, কাজ করা সুজনি, কাচের আলমারিতে নানা ধরনের টুকিটাকি, পুতুল, সরসীদির বড় ছবি, বিজলীবাবুর-এক সময়কার সংগ্রহ হরিণের শিং ইত্যাদি। ঘরে গদিমোড়া ইজিচেয়ার, আলনায় পাটপাট জামা কাপড় ধুতি শাড়ি গেঞ্জি ব্লাউজ মেশামেশি। দেরাজের মাথার ওপর ফুলদানি, শাঁখ, নিকেলের ফ্রেমে বাঁধানো বিজলীবাবুর ফটো। বোঝাই যায়, এ-ঘরের সর্বত্রই দাম্পত্য জীবনের স্পর্শ, ও-ঘরে দাম্পত্যের কিছু নেই। হৈমন্তীর মনে হল, বড় যিনি তিনি বড় হয়েই থেকে গেছেন, ছোট হননি; দুঃখ হোক, বেদনা হোক, তবু তিনি অশান্তি করেননি। সরসীদির মনে মনে যে দিদির ওপর কৃতজ্ঞতা কতটা তা বোঝা না গেলেও বেশ বোঝা গেল, দিদির যেদিকে আঙুল সরসীদির সেদিকে পা।

খাওয়া-দাওয়া শেষ হতে বেলা হল। অবনী এসেছিল; একেবারে ধুতি পাঞ্জাবি পরে। খাওয়া দাওয়া শেষ হলে সে চলে গেল; বলে গেল বাড়িতেই থাকবে। দুপুরে শুয়ে শুয়ে সরসীদির সঙ্গে অনেক গল্প হল, বাড়ির গল্প, মা মামা গগনের গল্প। সরসীদির কত কৌতূহল! একবার মজা করে বললে, আপনি কি ভাই এইভাবেই থাকবেন? শুধু চোখ দেখবেন, চোখে কাউকে পড়বে না? হৈমন্তী হেসে ফেলেছিল, দেখি! ..দুপুর ফুরিয়ে আসতেই হৈমন্তী উঠল, বলল, এবার যাব।

আসার সময় বড় বউ নিজের ঘরে এনে বসালেন দুদণ্ড, দু-পাঁচটা কথা বললেন। শেষে হঠাৎ বললেন, সরসীকে একবার কলকাতায় পাঠাব। তুমি সবচেয়ে ভাল ডাক্তার দেখিয়ে দেবে, পারবে না? …ওর তো এখনও বয়েস আছে।

হৈমন্তী প্রথমটায় না হলেও পরে বড়র চোখের দিকে তাকিয়ে অর্থটা বুঝল। মাথা কাত করল, হ্যাঁ–পারব। মনটা কিন্তু বিষণ্ণ হয়ে এল।

সদর পর্যন্ত এগিয়ে দিতে এসে সরসীদি একটু পাশে টেনে নিয়ে গিয়ে শুধোলেন, কানে কানে কী বললে ভাই, দিদি?

হৈমন্তী হেসে বলল, কিছু না তো?

 মিথ্যে বলে লাভ কি ভাই, সত্যি বলুন।

 সত্যি কিছু না। আপনি কলকাতায় যাবেন বেড়াতে..

কলকাতায় যাব আমি! সরসীদি চোখ কুঁচকে হৈমন্তীকে দেখতে দেখতে যেন সব রহস্য বুঝে। নিলেন। বললেন, বয়ে গেছে। ছাই যাচ্ছি! ..।

বিজলীবাবু খানিকটা পথ এগিয়ে দিলেন। বিকেলের দিকটায় তাঁকে বাস-অফিসে থাকতে হয়। কিছুটা পথ এগিয়ে দিয়ে তিনি বিদায় নিলেন। যাবার সময় বলে গেলেন, সন্ধে নাগাদ পারলে তিনি অবনীর বাড়িতে যাবেন।

সাইকেলে উঠে বিজলীবাবু চলে গেলেন। এখন সবে বিকেল, বেলা বেড়েছে, রোদ আছে–মরে আসা রোদ, বাতাস এলেমেলো, খানিকটা উষ্ণতা এবং তাপ এ-সময়ে আজকাল অনুভব করা যায়। হৈমন্তীর শুকনো শুকনো এবং গরম লাগছিল; অল্প ক্লান্তি; সারাটা দুপুর গল্পে গল্পে কেটেছে, আলস্য জমেছে যেন। হাই উঠল। সরসীদির মুখটা যেন মনের ওপর ভাসতে ভাসতে চলেছে, বিজলীবাবুর মতনই স্বভাব একেবারে, রঙ্গ রসিকতায় ভরা। গোলগাল মুখ, চোখ দুটি হাসিখুশি মাখানো, নাকে পুঁতির দানার মতন নাকছাবি, ঠোঁট দুটি সব সময় পানের রসে লাল হয়ে আছে, মাথার কাপড়টুকু সরে না কখনও। সরসীদির বয়েস হয়েছে, ওর চেয়ে কিছু বড়ই, শরীরও ভারি হয়ে গেছে, তবু সরসীদির মধ্যে এখনও যেন কম বয়সের চঞ্চলতা মরেনি। আর হয়তো কোনও দিন দেখা হবে না–তবু হৈমন্তীর মনে হল, সরসীদির মুখটি মাঝে মাঝে তার মনে পড়বে। আর, হৈমন্তী ভাবল, সত্যিই যদি সরসীদি কলকাতায় যান–তবে সে সাধ্যমতো ভাল ডাক্তার দেখিয়ে দেবে। বড় বউ-এর মুখটিও মনে পড়ল। সত্যি, সব থেকেও যেন এই সংসারে কিসের অভাব একটা চাপা বেদনার মতন থেকে গেছে। হৈমন্তী খানিকটা উদাস এবং বিষণ্ণ হল।

কাঁঠাল এবং নিমগাছের ঝোপ পেরিয়ে টালি-ছাওয়া ছোট মতন বাড়িটার পাশ দিয়ে যাবার সময় হৈমন্তীর হঠাৎ মনে হল; এই রাস্তায় আজই তার শেষবারের মতন আসা, আর কখনও এখানে আসবে না; রাস্তায় দাঁড়িয়ে পড়ে চোখ তুলে চারপাশ একবার দেখল, বটের পাতা ঝরছে, মস্ত একটা আমগাছ, ঘুঘু ডাকছিল কোথাও, শালিখ এসে মিষ্টির দোকানের সামনে পাতা খুঁটছে, সামান্য দূরে দেহাতি মিঠাইঅলার দোকান, কয়েকটা বোলতা উড়ছে, কুকুর শুয়ে আছে একপাশে, গোরুর গাড়ি আসছে হেলেদুলে চাকায় শব্দ তুলে। দেখতে দেখতে এই মুহূর্তে হৈমন্তীর হঠাৎ কেমন দীর্ঘশ্বাস পড়ল; এইসব ছেড়ে যাওয়ার দুঃখ।

সরু পথ ধরে এগিয়ে আবার বড় রাস্তায় পড়ল হৈমন্তী। তার পায়ের কাছে ছোট মতন একটা ঘূর্ণি উড়ছিল বাতাসের, নাকে মুখে ধুলোর ঝাঁপটা লাগল। তারপর রেল ফটক, দু দু-পাশে ফসল-তোলা শূন্য মাঠ, কাঁকর ছড়ানো উঁচু নিচু রাস্তা। আরও খানিকটা এগিয়ে আসতেই অবনীর বাড়ির কাছাকাছি এসে পড়ল।

ফটক খুলে ঢোকার সময় বারান্দায় কাউকে দেখতে পেল না হৈমন্তী। বাগানে নতুন নুড়ি পাথর ছড়ানো হয়েছে, শব্দ উঠছিল। অবনী কি ঘুমিয়ে আছে? এই অবেলায় তার ঘুমোবার কথা নয়।

বারান্দায় উঠতেই অবনী ঘর থেকে বেরিয়ে এল। আসুন। আমি ভাবলুম আপনি বোধহয় ওখানেই থেকে গেলেন। ঠাট্টা করেই বলল অবনী।

হৈমন্তী হেসে জবাব দিল, তা সত্যি, উঠতে চাইলেও কি উঠতে দেন ওঁরা।

বসার ঘরে এসে হাতের ব্যাগটা রাখল হৈমন্তী, বসতে বসতে বলল, জল খাব। আজ খুব তেষ্টা পাচ্ছে। বলে কী যেন ভেবে বলল, একটু গরম গরম লাগছে, না?

অবনী মহিন্দরকে জল এনে দেবার কথা বলতে গেল। হৈমন্তী গা এলিয়ে বসল। ক্লান্তি এবং আলস্য লাগছিল। এখন যেন তার মতন লাগছে, দুদণ্ড চোখ বুজে শুয়ে থাকতে ইচ্ছে করছিল। সারাটা দুপুর গল্পে গল্পে কেটেছে, খেয়ে উঠতেও বেলা হয়েছিল, তার ওপর এই গরম পড়ে-আসার মুখে শরীরে অবসাদ আসে এমনিতেই। বসে বসে হৈমন্তী হাই তুলল।

মহিন্দর জল দিয়ে গেল। হৈমন্তী জল খেয়ে বড় করে শ্বাস ফেলল স্বস্তির।

 অবনী এল। বসতে বসতে হেসে বলল,ফেয়ারওয়েল কেমন হল, বলুন?

 বেশ! …চমৎকার। হৈমন্তী হাসল।

কিছু পেলেন টেলেন? অবনী ঠাট্টা করে বলল, বলে সিগারেট ধরাল।

হৈমন্তী দুমুহূর্ত তাকিয়ে থাকল, চোখে স্নিগ্ধ হাসি; কী যেন ভাবল, বলল, হ্যাঁ পেয়েছি। বলে হাত বাড়িয়ে ব্যাগটা টেনে নিল। তারপর রুমাল বের করে কপাল গলা মুছল।

অবনী বলল, আপনি যেভাবে ওটা টেনে নিলেন মনে হল কিছু বুঝি বের করে দেখাবেন।

হৈমন্তী হেসে ফেলল। পরে বলল, ওঁরা মানুষ বড় ভাল। বলে একটু থেমে সামান্য উদাস গলায় বলল, কী জানি চলে যাচ্ছি বলেই কি না, সব কেমন মনে হচ্ছে। বোধহয় কোনও জায়গা ছেড়ে যাবার সময় এই রকম হয়। হয় না?

অবনী বলল, মন খারাপ?

তা মন খারাপই হবে হয়তো।

অবনী কিছু বলল না, সিগারেটের এক মুখ ধোঁয়া আস্তে আস্তে বাতাসে ছড়াতে লাগল।

 কলকাতায় গিয়ে এখন কিছুদিন এখানকার কথা খুব মনে পড়বে। …আমার আবার একটা খারাপ অভ্যেস আছে, কোথাও নতুন নতুন গেলে বার বার খালি ভুল হয়। সকালে ঘুম থেকে উঠবভাবব এখানে আছি, কতবার যে মালিনীকে ডেকে ফেলব… হৈমন্তী বলতে বলতে হেসে ফেলল।

মালিনীকেই দেখছি আপনার খুব মনে ধরেছে। অবনীও হেসে জবাব দিল।

না না, তা কেন! কাছে কাছে থাকত তো৷ অভ্যেস…। হৈমন্তী থেমে বড় করে হাই তুলল। হাই ওঠার সামান্য শব্দ হল। ঈষৎ লজ্জার চোখে হাসল, সারা দুপুর গল্প করেছি। সরসীদির গল্পের শেষ নেই। কী চমৎকার মানুষ।

আপনার একটা মস্ত গুণ দেখছি… অবনী পরিহাস করে বলল।

কী?

যাবার সময় মনে কোনও রকম কালি মেখে যেতে চান না। সবাইকে ভাল লেগে যায়।

হৈমন্তী কোনও কথা বলল না, হাসিমুখে শুনল, শুনতে শুনতে হয়তো অন্যমনস্ক হল সামান্য।

আরও কয়েকটা হালকা কথাবার্তা হল। বাইরে বিকেলের আলো আছে এখনও, রোদ চোখে পড়ছিল না, বেলা ফুরিয়ে এসেছে, পাখিদের স্বর ক্রমশই প্রবল হয়ে উঠছিল, হৈমন্তী আরও বার কয়েক হাই তুলল। তার চোখ সামান্য জ্বালা করছে, মুখ গলা গরম লাগছিল। অবসাদ এবং গরমের ভাবটুকু কাটাবার জন্যে চোখে মুখে জল দেওয়া দরকার, আবহাওয়াটা কেমন শুকিয়ে এসেছে।

হৈমন্তী বলল, চোখ মুখ কেমন জ্বালা করছে, একটু ঠাণ্ডা জল দিয়ে আসি।

 অবনী বলল, আসুন।

হৈমন্তী উঠে গেল। এ বাড়ির এখন সবই প্রায় তার চেনা।

.

হৈমন্তী ফিরে এলে বারান্দায় গিয়ে বসল ওরা। চোখ মুখ ধুয়ে এসে ঠাণ্ডায় হৈমন্তীর অবসাদ-ভাব অনেকটা কেটেছে। আগে একটা ক্লান্তির ভাব ছিল, এখন ভিজে মুখ সতেজ দেখাচ্ছে। কপাল এবং কানের পাশের চুলগুলি গুছোনো। মহিন্দর চা দিয়ে গেছে। চা ঢেলে শাড়ির আঁচলটা কোমরের কাছে টেনে নিয়ে চেয়ারের মধ্যে আরাম করে বসল হৈমন্তী। বিকেল ফুরিয়ে গেছে, আলো নেই, সামান্য অন্ধকার হয়ে এসেছে, বাতাস দিচ্ছিল, বাগানে তখনও পাখিদের গলা, স্টেশনের দিকে ট্রেনের শব্দ, বোধহয় আপ-প্যাসেঞ্জার গাড়িটা এসে গেল। চা খেতে খেতে বাকি অবসাদটুকুও যেন নষ্ট হয়ে আসছিল।

কলকাতায় যাবার কথা হচ্ছিল। অবনী আর-একবার জিনিসপত্র আনা, ট্রেনের কথা বুঝিয়ে বলে দিল। এখান থেকে একটা গাড়ি যাবে, বিছানা বাক্স এটা-সেটা বয়ে আনবে, এনে বাস-অফিসে রেখে দেবে, বিজলীবাবু মালপত্রের ঝামেলা সামলে সব ব্যবস্থা করে দেবেন। আর অবনী বিকেল নাগাদ যাবে গুরুডিয়ায়, গিয়ে হৈমন্তীকে নিয়ে আসবে। সন্ধের গাড়িটাতেই যাওয়ার ব্যবস্থা হয়েছে, একেবারে ভোরবেলায় হাওড়া। গাড়িটা অবশ্য ফাস্ট প্যাসেঞ্জার–কিন্তু সব দিক থেকেই সুবিধে, রিজারভেশান পাওয়া যাবে, ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে কলকাতা। তা ছাড়া ওই গাড়িতে চেনা লোক যাচ্ছে বিজলীবাবুর, দেখাশোনা করবে, খোঁজখবর নেবে। সকালের গাড়িটায় কিছু কিছু অসুবিধে ছিল, নয়তো দিনে দিনে যাওয়া যেত! অবনী কাল একটা টেলিগ্রাম করে দেবে গগনকে।

অবনী আরও একটু চা নিল। হৈমন্তী চিনি মিলিয়ে কাপটা অবনীর হাতে তুলে দিয়ে নিজের জন্যেও সামান্য নিল আবার। আর হাই উঠছিল না, শরীরের অবসাদটুকুও মরে গেছে। এখন ভাল লাগছিল। ঠাণ্ডা ফুরফুরে বাতাস বইছে, বাগানের গাছপালা এবং ফুলের মিশ্রিত একটা গন্ধ আসছিল। ক্রমে আঁধার জমে এল।

অবনী বলল, আপনার তাড়া নেই তো?

না, মাথা নাড়ল হৈমন্তী, তাড়া আর কিসের। এখন আমার সময় কাটানোই মুশকিল।

কলকাতায় ফিরে গিয়ে কী করবেন?

 দেখি।

 চাকরিবাকরি নেবেন নাকি কোথাও?

কিছু ভাবিনি। চুপচাপ বাড়িতে বসে থাকা আর-এক যন্ত্রণা। দেখি কী করি। চাকরি করতে ইচ্ছে করে না। পাচ্ছিই বা কোথায়। … বরং আমাদের চেনাশোনা দোকান-টোকান আছে সেখানে কোথাও বসব খানিক। শেষের কথাটা হৈমন্তী সামান্য হেসেই বলল।

নিজের বাড়িতেই একটা চেম্বার করে ফেলুন, অবনী হেসে বলল।

গেঁয়ো যোগী ভিখ পায় না জানেন! হৈমন্তী হেসে জবাব দিল, চোখও দেখতে হবে, পয়সাও পাব না; তার ওপর বদনাম।

বদনাম কেন?

ও হয়! মেয়েদের হাতে চোখ দেখালে লোকের বিশ্বাসই হবে না। হৈমন্তী মুখের সামনে থেকে পেয়ালাটা সরিয়ে নামিয়ে রাখল।

অবনী বলল, তা হলে তো দেখছি, এখানেই আপনার খাতির বেশি ছিল।

তা ছিল।

সিগারেট ধরাল অবনী। বারান্দা বেশ অন্ধকার হয়ে গেছে। বাতি জ্বালাবার জন্যে উঠতে ইচ্ছে করছিল না। তবু উঠল পাশের দিকের বাতিটা জ্বালাল, বারান্দায় সামান্য আলো হল।

ফিরে এসে চেয়ারে বসতে বসতে অবনী লঘু স্বরে বলল, এখানে যে আপনার খুব সুনাম হয়েছিল তাতে সন্দেহ নেই। সেদিন সুরেশ্বরবাবু আপনার খুব প্রশংসা করলেন।

হৈমন্তী তাকাল; কিছু বলল না।

অবনী কয়েক মুহূর্ত নীরব থেকে বলল, সুরেশ্বরবাবুর বাড়ির লোকের সঙ্গে আপনাদের মেলামেশা ছিল না?

না– হৈমন্তী মাথা নাড়ল আস্তে করে, মা এক-আধবার ওর মা বাবাকে দেখেছে, মার দূর সম্পর্কের বোন হতেন ওর মা। আমি দেখিনি। একবার মাত্র ওর বাবাকে কলকাতায় আমাদের বাড়িতে দেখেছিলাম। ছেলেবেলায়। ভুলে গিয়েছি।

অবনী স্থির চোখে তাকিয়ে ছিল, শুনছিল। অবনীর জানতে কৌতূহল হচ্ছিল; সুরেশ্বরের মা আত্মহত্যা করেছিলেন কেন? স্বামীর জন্যে? স্বামীর উপপত্নীর প্রতি ঈর্ষা ও বিদ্বেষবশে? আপনি কি ভদ্রলোকের বাবার পরিচয় জানেন? সেই ছেলের কথা শুনেছেন?

অবনী বলল, আমার ধারণা ছিল ভদ্রলোকের জীবনটা বেশ সুখে-স্বচ্ছন্দে কেটেছে; বোধহয় তা নয়। অবনী এমনভাবে বলল যাতে মনে হবে সে স্পষ্ট করে না হলেও অস্পষ্ট করে কিছু জিজ্ঞেস করছে।

হৈমন্তী অবনীর মুখের দিকে কয়েক পলক তাকিয়ে অন্য দিকে চোখ ফেরাল, তারপর বাগানের দিকে তাকিয়ে থাকল। ঘাড়ের পাশ দিয়ে শাড়ির আঁচলটা অন্যমনস্কভাবে গোছালো একটু, চেয়ারের দিকে পিঠ আরও হেলিয়ে দিল। তার মুখ দেখে কিছু বোঝা যাচ্ছিল না।

অবনী যেন অপেক্ষা করছিল, শেষে বলল, এই অন্ধ আশ্রম করার পেছনে ভদ্রলোকের কিছু যেন আছে! শখ করে করেছেন বলে আমার আর মনে হয় না। আপনার কী মনে হয়?

সঙ্গে সঙ্গে না হলেও হৈমন্তী পরে জবাব দিল, কী জানি, আমি জানি না।

অবনী কিছু ভাবছিল, বলল, তবু কী মনে হয় আপনার?

হৈমন্তীর এই প্রসঙ্গটা ভাল লাগছিল না। এখন সে আর এমন কিছু ভাবতে চায় না যাতে মন তিক্ত হয়। বলল, আমার কিছুই মনে হয় না। মানুষের নানারকম খেয়াল থাকে। কার কী খেয়াল হচ্ছে, কেন হচ্ছে আমার তা জেনে লাভ কী?

অবনী বুঝতে পারল হৈমন্তী বিরক্ত হচ্ছে। হেসে বলল, যাবার সময় আপনার মন একেবারে ধুয়ে মুছে পরিষ্কার, এখানেই বা ওই খুঁতটুকু কেন রাখছেন।

খুঁত?

রাগ-টাগ, বিরক্তি।

না– হৈমন্তী মাথা নাড়ল; বলল, ছেলেমানুষের মতন রাগ করব কেন! সেবয়েস আমার নেই। আমি রাগ নিয়ে যাচ্ছি না। তা বলে আমি ভক্তি নিয়েও যাচ্ছি না। …কিন্তু আপনি যেন সুরেশ-মহারাজের মস্ত ভক্ত হয়ে যাচ্ছেন। ব্যাপার কী?

অবনী হাসল। হাসতে হাসতে বলল, আমার মতন ভক্ত সুরেশ-মহারাজও পছন্দ করবেন না।

হৈমন্তী অবনীকে লক্ষ করে দেখছিল। দেখতে দেখতে বলল, আমার কিন্তু বেশ মনে হচ্ছে। আপনার মন ওদিকে টলেছে। বলে হৈমন্তী ঠোঁট টিপে হাসল।

সরল গলায় অবনী জবাব দিল, আমি তো আপনাকে আগেও বলেছি–কোনও কোনও ব্যাপার খারাপ লাগলেও মানুষটিকে আমার এমনিতে ভালই লাগে। …

হৈমন্তী যেন কেমন অপ্রস্তুত বোধ করল; যদিও অবনী তাকে কিছু জিজ্ঞেস করল না, তবু তার মনে হল অবনী যেন হৈমন্তীরও কোনওরকম মতামত চাইছে। অর্থাৎ বলতে চাইছে, মানুষটি যে ভাল একথা কি আপনি অস্বীকার করবেন? আজ যাবার সময় অবনীর কাছে সুরেশ্বর সম্পর্কে কোনও তিক্ততা প্রকাশ করে যাবার ইচ্ছে তার ছিল না। এখন পর্যন্ত সে এমন কিছু করেনি, বলেনি যাতে তার মনের পুঞ্জীভূত আক্রোশ, তার ঘৃণা, বিরক্তি, ব্যর্থতা, নৈরাশ্যের তীব্রতা ও গভীরতা অবনী জানতে পারে। অবনী যেটুকু জেনেছে সেটুকু গোপন করার মতন সংযম তার ছিল না, নেই। বাকি যা সবই চোখ চেয়ে দেখে অবনী অনুমান করেছে। তার অনুমান মিথ্যে নয় এইমাত্র।

হৈমন্তী অপ্রস্তুত ভাবটা কাটাবার জন্যে হেসে বলল, আপনাদের সুরেশ-মহারাজকে খারাপ বলবে কে! বলে একটু থেমে আবার বলল, দেবতুল্য ব্যক্তি..

ঠাট্টা করছেন?

 না না, সত্যি। …আপনারা নিঃস্বার্থে ভাল বলেন, আর আমাদের তো স্বার্থ ছিল।

স্বার্থ?

স্বার্থ– হৈমন্তী মাথা নোয়াল আস্তে করে, বলল, আমাদের স্বার্থ ছিল। এক সময়ে আমাদের জন্যে অনেকে করেছে।

অবনী নীরব থাকল। সে সুরেশ্বর সম্পর্কে কিছু জানতে চেয়েছিল মাত্র, তার বেশি নয়। অথচ যেন মনে হচ্ছে হৈমন্তীকে সে অপ্রসন্ন ও বিরক্ত করে তুলেছে। অপ্রীতিকর প্রসঙ্গটা চাপা দেবার জন্যে অবনী ব্যস্ত হল। ভুল করে বোকার মতন সুরেশ্বরের কথা সে কেন তুলল! বরং অবনী মনে মনে যে কথা বলার জন্যে আজ ব্যগ্র, উৎকণ্ঠিত, যা বলার জন্যে সে কাতর, সেই নিজের কথা কেন বলছে না! …তবে কি, অবনীর মুহূর্তের জন্যে সন্দেহ হল, হৈমন্তীকে সে পরীক্ষা করছে? সুরেশ্বর সম্পর্কে হৈমন্তীর কোথাও কোনও দুর্বলতা আছে কী না দেখছে? অবনী অস্বস্তি বোধ করল। যেন কিছুই নয়, কোনও গুরুতর বিষয়ে তারা কথা বলছে না–এইরকম ভঙ্গিতে প্রসঙ্গটা পালটাবার জন্যে অবনী হালকা করে বলল, যেতে দিন। তেমনভাবে দেখতে গেলে জগতে সবই স্বার্থ। আপনি যে এখানে এসেছিলেন, এটাও ওঁর স্বার্থ।

ওর স্বার্থ বই কি! আমার কিছু নয়, হৈমন্তী বলল। তবু, কোনওদিন, বলা তো যায় না–হয়তো আমাদের স্বার্থের কথাও জানতে পারবেন। তখন হয়তো মনে হবে আমরা–অন্তত আমি খুব অকৃতজ্ঞ।

অবনী হৈমন্তীর গলার স্বর শুনে বুঝতে পারছিল যে কোনও কারণেই হোক সে উত্তেজিত এবং অধৈর্য হয়ে উঠেছে। অবনী বাধা দেবার জন্যে কিছু বলতে যাচ্ছিল, বলতে পারল না, হৈমন্তী তার বাধায় কান দিল না।

হৈমন্তী বলল, আমাদের সমস্ত সংসার ওর কাছে কৃতজ্ঞ। …ওর দয়ায় আমি বেঁচেছি। হৈমন্তী ঝোঁকের মাথায় যেন হঠাৎ গোপনীয় কিছু প্রকাশ করছে, প্রকাশ করতে তার কুণ্ঠা নেই, দীনতা নেই; বলল, আমার তখন বয়স কম, সংসারের অবস্থাও তেমন ভাল না আমাদের, আমার অসুখ করল। তখন ও করেছে, ছুটোছুটি, ডাক্তার-হাসপাতাল; বাইরে টিবি হাসপাতালে পড়েছিলাম বছর দেড়েক। তারপরেও ওর যত্ন-উত্ন পেয়েছি। …আমার জন্যে টাকা পয়সা, সময় কম যায়নি ওর। এই দয়ার জন্যে আমরা আপনাদের সুরেশ-মহারাজের কাছে কৃতজ্ঞ।

অবনী কল্পনাও করেনি, সামান্য থেকে এতটা কিছু ঘটবে। ভুল করে নিবন্ত আগুনের টুকরো যেন পড়েছিল কোথাও তার থেকেই এমন কাণ্ডটা ঘটে গেল। বিহ্বল হল না অবনী, কিন্তু লজ্জায় সঙ্কোচে কেমন আড়ষ্ট হয়ে বসে থাকল। অসহ অস্বস্তির মধ্যে সে অনুভব করতে পারল, সুরেশ্বর এবং হৈমন্তীর জীবনের একটি অতি নিভৃত ও গোপনতম অংশ যেন প্রকাশ হয়ে পড়েছে। তার মনে হল, গগন একবার কথা প্রসঙ্গে ভাসাভাসা ভাবে অসুখের কথা বলেছিল, কিন্তু কিছুই বোঝা যায়নি, বুঝতেও দেয়নি গগন। সুরেশ্বর এবং হৈমন্তীর সম্পর্কের কি তবে ওটাই আদি? জীবন পেয়েছিল বলেই কি হৈমন্তী সুরেশ্বরকে তার সমস্ত কিছু দিতে চেয়েছিল। নাকি সুরেশ্বর জীবন দিয়েছিল বলেই হৈমন্তীকে নিজের কাজে পেতে চেয়েছিল? এটা প্রায় ঋণ শোধবোধের মতন। হয়তো তা নয়। হয়তো সুরেশ্বর অধিকার চায়নি, সঙ্গী চেয়েছিল; হয়তো হৈমন্তী সঙ্গ চেয়েছিল, সংসার চেয়েছিল; সুরেশ্বরের বৈরাগ্য চায়নি। কে জানে! অবনী কেন যেন আজ অদ্ভুত এক বেদনা বোধ করল, তার এই বেদনায় অংশীদার ওরা দুজনেই সুরেশ্বর এবং হৈমন্তী। সে বুঝতে পারল না, হৈমন্তী কোন আবেগবশে তার জীবনের এই গোপনীয়তাটুকু প্রকাশ করল। নিছক উত্তেজনায় নয়, হৈমন্তী অত্যন্ত চাপা স্বভাবের, সংযত, শিষ্ট, ধীর। উত্তেজনার বেশি আরও কিছু কি আছে!

হৈমন্তী নিঃসাড় হয়ে বসে ছিল, স্থির, বাগানের দিকে চোখ, একটা হাত গলার কাছে, গালে আঙুলের ডগা ছুঁয়ে রয়েছে। মুখটি এখনও যেন আঁচে ঝলসানো।

কিছু সময় এইভাবে কাটল, কেউ কোনও কথা বলল না। গুমট লাগছিল। অবনী আড়ষ্ট, বিব্রত; হৈমন্তী নীরব, স্থির, অসাড়। শেষ পর্যন্ত অবনী মৃদু গলায় বলল, আমারই দোষ; আমি আপনাকে অকারণে অসন্তুষ্ট করলাম। যাক গে, যেতে দিন…। বলে সামান্য থেমে, যেন হৈমন্তীর কোনও ক্ষোভ বা গ্লানি মুছে দেবার চেষ্টা করছে বলল, আমার ধারণা, আপনি আপনার সাধ্যমতো চেষ্টা করেছেন, এর বেশি করা যায় না। জগতে সবাইকে সুরেশ্বর হতে হবে এমন কথা নেই।

হৈমন্তী কথা বলল না, কিন্তু দীর্ঘ নিশ্বাসের শব্দ পাওয়া গেল। সামান্য নড়ল, গালের কাছ থেকে হাতটা নামাল।

অবনী অন্যমনস্কভাবে আবার সিগারেট ধরাল। বলল, আপনি কি এখনও রাগ করে আছেন? বলার মধ্যে যেন অনুশোচনার এবং সঙ্কোচের ভাব ছিল।

হৈমন্তী মাথা নাড়াল। না। আপনার ওপর রাগ করব কেন!

কথাটা আমার তোলা উচিত হয়নি।

তুলে ভালই করেছেন। হৈমন্তী যেন বুকের বোঝা হালকা করার মতন নিশ্বাস ফেলল, পিঠ একটু টান করে বসল, শেষে আবার বলল, আমার দিক থেকে আমি হালকা হলাম।

অবশেষে অবনী উঠল, বলল, চলুন, খানিকটা পায়চারি করা যাক বাগানে, বেশ বাতাস দিচ্ছে…

 হৈমন্তীও উঠল।

 বাগানে এসে সামান্য আগুপিছু হয়ে দুজনে পায়চারি করতে লাগল। সন্ধে হয়ে গেছে, বাতাস চঞ্চল ও স্নিগ্ধ। পাতার গন্ধ উঠছিল, বিকেলে বাগানে জল দিয়েছে মালি, মাটির একটা গন্ধ ছিল। জবাগাছের ডাল ছাঁটা হয়েছে সদ্য, লাল টিপফুলের গাছটা ফুলে ভরা, থোকা থোকা গাঁদা এক পাশে, কিছু শুকনো মুরশুমি ফুল।

এক সময় পাশাপাশি হয়ে হাঁটতে লাগল দুজনে মন্থর পায়ে।

 অবনী বলল, মানুষের মনের কিছু ঠিক নেই। কথাটা সে আচমকা বলল।

হৈমন্তী বুঝতে পারল না, ঘাড় ফিরিয়ে তাকাল।

অবনী হাসার চেষ্টা করে বলল, আপনি যতদিন এখানে থাকলেন ততদিন মনে হত, অকারণে কেন পড়ে আছেন; খারাপই লাগত। এখন চলে যাচ্ছেন বলে মনে হচ্ছে–বেশ তো ছিলেন।

হৈমন্তীর মন অনেকটা শান্ত হয়ে এসেছিল। ম্লান হেসে জবাব দিল, তাই নাকি! .এদিকে তো আমায় তাড়াবার জন্যে ব্যস্ত হয়ে পড়েছিলেন।

যাবার সময় এ-রকম একটা বদনাম রটিয়ে যাচ্ছেন! অবনী হাসল।

ছি ছি, বদনাম রটাব কেন! আপনার সুনামই করব। হৈমন্তীর গায়ের আঁচল আলগা করে দিল, হাসল, বাতাসে সিল্কের শাড়ির আঁচল কাঁপছিল। পরে বলল, আমাকে অকৃতজ্ঞ ভাবলে সত্যিই আমার কষ্ট হয়। আপনাদের কাছ থেকে আমি কমটা কী পেলাম! …সরসীদি আজ বলছিলেন, এখান থেকে চলে যেতে আমার খারাপ লাগছে না? বললাম, খুব খারাপ। সত্যি, আমার খারাপ লাগছে।

হৈমন্তীর গলায় বেদনা এবং দুঃখের কেমন এক গাঢ়তা ছিল। অবনী এই বেদনা অনুভব করছিল। বলল, আমরা বোধহয় প্রায়ই আপনার কথা বলব।

হৈমন্তী অন্যদিকে মুখ ফিরিয়ে নিল; স্টেশনের দিকে একটা মালগাড়ি আসছে বোধহয়–গুমগুম শব্দ উঠছে। শব্দটা বুকে লাগছিল হৈমন্তীর।

অল্প চুপচাপ থেকে অবনী বলল, মনে করে রাখার মতন সু-দিন আমাদের জীবনে বড় আসে না। অন্তত আমার জীবনে আসেনি। আপনি এসেছিলেন, আপনার সঙ্গে পরিচয় হয়েছিল, বন্ধুত্ব হয়েছিল এ আমার ভাগ্য। আমি মনে রাখব।

বাতাসে হৈমন্তীর এলো আঁচল উড়ে অবনীর হাতে লাগছিল। এখনও আকাশে চাঁদ ওঠেনি, উঠে আসছে, অন্ধকার ম্লান হয়ে এল, মালগাড়ির গুমগুম শব্দটা আরও স্পষ্ট, যেন স্টেশনের কাছাকাছি চলে এসেছে, ফুলগাছের মাটির সামান্য সোঁদা ভিজে ভিজে গন্ধ, কোনও ফুলের মৃদু সুবাস ভাসছে বাতাসে। হৈমন্তী দাঁড়াল।

অবনী সিগারেটের টুকরোটা দূরে ছুঁড়ে দিল। হৈমন্তীর ডিমের মতন মসৃণ গড়নের মুখ, টোল-তোলা নরম থুতনি, টানা টানা চোখের পাতা, সুন্দর গভীর নির্মল দুটি চোখ, মাথার পাতলা ঈষৎ রুক্ষ রেশমের মতন চুলের এবং তার স্থির, অল্প শিথিল, অবনত দেহের চারপাশে একটি অব্যক্ত মায়া যেন সৃষ্টি হয়েছিল। অবনীর মনে হল, তার জীবনে এ যেন এক অন্য মুহূর্ত, যা আগে কখনও আসেনি ভবিষ্যতেও আসবে না। সম্মোহিতের মতন হৃদয়ের কোনও আশ্চর্য তাড়নায় সে হৈমন্তীর দিকে নিষ্পলকে তাকিয়ে থাকল।

হৈমন্তী এক সময় মুখ তুলল, তুলে অবনীকে দেখল।

মনে রাখার মতন আমারও কিছু থাকল, হৈমন্তী অস্পষ্ট গলায় বলল।

কিছুক্ষণ আর কোনও কথা হল না, দুজনেই নীরব, মালগাড়িটা এসে চলে গেল, তবু তার কম্পন যেন এখানের মাটিতে। বুক কাঁপছিল হৈমন্তীর।

কোনও রকমে নিজেকে সংযত করে হৈমন্তী বলল, আপনি কবে কলকাতায় আসছেন?

 অবনী সামান্য সচেতন হল। আসছে মাসে।

 কেন যাচ্ছেন তা তো বললেন না? …

অবনী মুহূর্ত কয় ভাবল, বলল, বলব। …আপনাকে আমার বলা উচিত।

হৈমন্তী বুঝতে পারল না, তাকিয়ে থাকল।

অবনী ভেবে দেখেছিল তার যদি কোনও প্রত্যাশা থাকে, যদি প্রত্যাশা অপূর্ণও থাকে তবু কথাটা তার বলা দরকার। হৈমন্তী তাকে যতটুকু জানে, যেটুকু চিনেছে তার বেশি চেনা দরকার। গ্লানি এবং মনঃক্ষোভ, ভীতি এবং সঙ্কোচ রেখে লাভ নেই। হৈমন্তীর সামনে থেকে কোনওদিন নিজের লজ্জা বাঁচাবার জন্যে দুহাতে মুখ ঢেকে চলে যেতে তার ইচ্ছে হয় না। তার চেয়ে আমি যা তুমি আমায় সেই ভাবে দেখ। আমার কোনও গোপনতা আমি রাখব না, লজ্জা-গ্লানি লুকোতে গিয়ে ধিক্কারের পাত্র হতে আমার ইচ্ছে নেই। লুকোচুরি করে কী লাভ!

অবনী বলল, কলকাতায় গিয়ে আমাকে একবার উকিল-টুকিল, কোর্টকাছারি করতে হবে।

 হৈমন্তী বুঝল না, হেসে বলল, সম্পত্তিটম্পত্তি আছে নাকি আপনার?

না; সম্পত্তি নেই। …সম্পত্তি থাকার মতন সম্ভ্রান্ত আমি নই।

সম্পত্তি না থাকলে সম্ভ্রান্ত হয় না? হৈমন্তী অন্তরঙ্গ সুরে ঠাট্টা করল।

অবনী দুপলক যেন দেখল হৈমন্তীকে, তারপর বলল, না, আমি সম্ভ্রান্ত নই। রেসপেকটিবিলিটি আমার নেই। …যাক গে, সেটা পরের কথা, পরে শুনবেন। ..কলকাতায় আমার মেয়ে আছে। অবনী বলল, গলার স্বর কাঁপল না।

হৈমন্তী নির্বাক, নিশ্চল; ঘাড় ফিরিয়ে যেভাবে চোখ তুলে তাকিয়ে ছিল সেই ভাবেই তাকিয়ে থাকল, যেন নিশ্বাস নিচ্ছে না, বিস্ময় আছে কি না তাও বোঝা যায় না।

অবনীর মনে হল, তার বুকের মধ্যে থেকে কোনও যন্ত্রণা উঠে আসতে চাইছে, গলার কাছটায় কান্নার মতন লাগছে, জীবনের কোনও ব্যর্থতা বুঝি সিসের মতন ভার হয়ে আছে হৃদয়ে। মুখ হাঁ করে শ্বাস নিল অবনী, মাথার দুপাশে কপালের কাছে বরাবর জ্বালা করছিল। চোখে যেন কিছু স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছে না। বলল, আমার জীবনে অপছন্দ করার মতন অনেক কিছু আছে; সেসব হয়তো আপনার ভাল লাগবে না। …আমার স্ত্রী ছিল, তার সঙ্গে আমার কোনও সম্পর্ক নেই, থাকবে না। মেয়েটাকে আমি নিজের কাছে আনব। …কলকাতায় গিয়ে কিছু কাজ বাকি আছে। দেখি কী হয়…!

হৈমন্তী স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে থাকল। বাতাসে তার আলগা আঁচলের অনেকটা উড়ে অবনীর গায়ে লাগছিল। কখন যেন চাঁদের আলো ফুটে উঠেছিল।

এক সময় অবনী বলল, রাত হয়ে যাবে, আপনাকে পৌঁছে দিয়ে আসি। …একটু দাঁড়ান, আমি আসছি।

.

অবনী ফিরে এসে দেখল, হৈমন্তী কদম গাছের কাছে দাঁড়িয়ে আকাশ দেখছে। গাড়িটা কলাবাগানের দিকে দাঁড় করান ছিল। গাড়ি ঘুরিয়ে হৈমন্তীর সামনে এসে অবনী ডাকল, আসুন।

হৈমন্তী উঠে এল।

.

৩৩.

আপ প্ল্যাটফর্মে স্টেশনের অফিসঘরের কাছ থেকে গাড়ি আসার ঘন্টি বাজল, প্রথম ঘণ্টি; গাড়ি আসতে এখনও সামান্য দেরি।

ডাউন প্ল্যাটফর্মে যাত্রীদের ভিড় জমে উঠেছিল; এখনও লোক আসছে ওভারব্রিজ দিয়ে। শেডের তলায় ভিড়টা বেশি: টিনের সুটকেস, কাঠের বাক্স, বোঁচকা কুঁচকি, বস্তা, লাঠিসোঁটা আগলে দেহাতিরা বসে আছে; একপাশে কিছু নিত্যযাত্রীর জটলা; বিড়ির ধোঁয়া, কাশি, বিচিত্র এক গুঞ্জন ভাসছে। চাঅলা, পানঅলা হেঁকে যাচ্ছিল। গাড়ি আসার প্রথম ঘণ্টিতে চাঞ্চল্য জাগল।

ওভারব্রিজের নীচে, ফাঁকায়, হৈমন্তীর মালপত্র জড়ো করা। সামান্য তফাতে ব্রেকভ্যানে তোলার জন্যে রেলকুলিরা সবজির ঝুড়ি, আলুর বস্তা, এটা-ওটা জমা করছিল। বিজলীবাবু বাস-অফিসের কয়েকটা কুলিকে নিয়ে হৈমন্তীর মালপত্রের কাছে দাঁড়িয়ে চেনাশোনা লোকের সঙ্গে গল্প করছিলেন। অবনী কাছাকাছি জায়গায় পায়চারি করছিল।

সামান্য তফাতে কৃষ্ণচূড়া গাছের তলায় সিমেন্টের বেঞ্চিতে হৈমন্তী এতক্ষণ বসেছিল তারপর যেন অধৈর্য হয়ে বা বসে থাকতে থাকতে ক্লান্ত হয়ে উঠে দাঁড়িয়ে প্ল্যাটফর্মে পায়চারি করতে করতে শেষপ্রান্ত পর্যন্ত গিয়ে আবার ফিরছিল।

সুরেশ্বর ফাঁকায় দাঁড়িয়ে পরিচিত এক বয়স্ক ভদ্রলোকের সঙ্গে কথা বলছিল অনেকক্ষণ, গাড়ির প্রথম ঘণ্টি বেজে যাবার পর আলাপ চুকিয়ে এপাশে এল, এসে হৈমন্তীর কাছাকাছি দাঁড়াল।

আপ ডাউন প্ল্যাটফর্মের মধ্যে রেল লাইনে কোথাও মালগাড়ি দাঁড়িয়ে নেই। ওপারের আলো এপারে আসছিল, এপারে আলো কম। ওপাশটা ফাঁকা; টি-স্টলের কাছে দু-একজন দাঁড়িয়ে চা খাচ্ছে; মাল-গুদোমের দিক থেকে আলকাতরা আর চুনের গন্ধ ভেসে আসছিল মাঝে মাঝে, বাতাস এলোমেলো।

হৈমন্তীর কাছাকাছি এসে, পাশাপাশি হাঁটতে হাঁটতে সুরেশ্বর বলল, তোমার গাড়ি আজ মিনিট কুড়ি পঁচিশ দেরি করল। বলে কী ভেবে আবার বলল, যার সঙ্গে কথা বলছিলাম, উনি এখানকার স্টেশন মাস্টার। যেন স্টেশন মাস্টারের কাছ থেকেই গাড়ির খবরটা এনেছে সুরেশ্বর।

হৈমন্তী কোনও জবাব দিল না। গাড়ি আসতে দেরি করছে এটা সে জানে। যখন বসেছিল তখন অবনী এসে বলেছে, বিজলীবাবুও একবার বলে গেছেন। আজ, এখন, স্টেশনে আসার পর সে দেখছে তার বেশির ভাগ সময় একা একা কাটল, হয় একা একা, না হয় অতি তুচ্ছ কথায়। অবনী তার সামনে বা পাশে বেশিক্ষণ থাকছিল না; কখনও আসছিল, বসছিল একটু বা দাঁড়িয়ে থাকছিল, দু-চারটে সাধারণ কথা বলল, আবার চলে গেল ওপাশে; সুরেশ্বরও বার কয়েক কাছে এসেছিল, কথা বলেছিল, চেনাশোনা লোক দেখে উঠে গিয়েছিল আবার। ট্রেনে ওঠার পর হৈমন্তী একা, সারাটা পথ সে একা, এই শেষ সময়টুকু তার একা থাকতে ইচ্ছে ছিল না। অথচ অনেকটা সময় একা থাকতে হল।

হাঁটতে হাঁটতে ওভারব্রিজের কাছাকাছি পর্যন্ত এল, দাঁড়াল হৈমন্তী। অবনী মুখের সিগারেট থেকে অন্য একটা সিগারেট ধরাচ্ছে, বিজলীবাবু কুলিদের কী বুঝিয়ে বলছেন, শেডের তলায় যাত্রীরা ওঠাওঠি শুরু করেছে। কয়েক মুহূর্ত সেদিকে তাকিয়ে থেকে হৈমন্তী আবার মুখ ফেরাল, ফিরিয়ে আস্তে আস্তে হাঁটতে লাগল।

কয়েক-পা হেঁটে এসে হৈমন্তী দাঁড়াল। এখানটা আধো-অন্ধকার, পাশে প্ল্যাটফর্মের নীচে রেল লাইনের পাথরকুচি কোথাও কোথাও ছোট ছোট ঢিবির মতন পড়ে আছে। থোকা থোকা ছায়ার ফুল যেন। অন্ধকারে কৃষ্ণচূড়ার গাছটা বাতাসে কাঁপছিল। আজ এখনও চাঁদ ওঠেনি, ওঠার সময় হয়ে এল।

.

সুরেশ্বর বলল, একটা গরম কিছু নাওনি?

 হৈমন্তী অন্যদিকে তাকিয়ে মাথা হেলিয়ে বলল, নিয়েছি।

 গাড়িতে পরে নিয়ো; রাত্তিরে ঠাণ্ডা পড়বে।

 হৈমন্তী কোনও জবাব দিল না। এসব তুচ্ছ কথা তার ভাল লাগছিল না।

তোমার গাড়ি একেবারে ভোরে ভোরে হাওড়া পৌঁছে যাবে। গগনটা সময় মতন এসে পৌঁছতে পারলে হয়। …না হলে তোমার কোনও অসুবিধে হবে না, সঙ্গে লোক আছে, মালপত্র নামিয়ে একটু অপেক্ষা কোরো গগনের জন্যে।

হৈমন্তী দুরে তাকিয়ে থাকল: সিগন্যালের আলো দেখছিল যেন।

দেখতে দেখতে প্ল্যাটফর্মে চাঞ্চল্য বেড়ে একটা কলরব জেগেছে। বনের দিক থেকে রাত্রের বাতাস আসছে, ঠাণ্ডা, জঙ্গলের গন্ধ ভরা। স্টেশনের বাসস্ট্যান্ডের দিকে একটা গাড়ি ক্রমাগত হর্ন দিচ্ছে, কাউকে ডাকছে বোধ হয়; ওভারব্রিজের মাথায় কয়েকটা লোক ছুটছে। গাড়ি আসার দ্বিতীয় ঘণ্টি পড়ে গেল, সামনের একটা সিগন্যাল সবুজ হল।

গাড়ি এসে গেল। সুরেশ্বর বলল, চলো, গাড়ি আসছে।

হৈমন্তী ফিরতে লাগল। প্ল্যাটফর্মে কলরব বেড়ে গেছে, মালপত্র মাথায় ওঠাচ্ছে কুলিরা, সামান্য ছুটোছুটি। গাড়ি আসছে, হুইসল শোনা যাচ্ছে; ইঞ্জিনের শব্দ, হঠাৎ আলো এসে পড়ল, লাইনে শব্দ উঠছিল, চারপাশ প্রকম্পিত যেন।

সুরেশ্বর ওভারব্রিজের কাছে হঠাৎ বলল, আমি কলকাতায় চিঠি লিখে দিয়েছি, হেম। তোমায় কেউ কিছু জিজ্ঞেস করবে না। সুরেশ্বর থামল, তারপর কী ভেবে আবার বলল, মাসিমাকে আমি আর-একটা কথা লিখেছি, হেম; তুমি নিশ্চয় জানতে পারবে। …সংসারে তুমি যা চাও বেশির ভাগ মানুষই তা চায়; আমি তাতে দোষ দেখি না, অবজ্ঞাও করি না। …তুমি সুখী হও হেম; শান্তি পাও।

হৈমন্তী চোখ তুলে তাকাল। তার জানতে ইচ্ছে করছিল, কী লিখেছ তুমি মাকে? কোন কথা? জানতে ইচ্ছে করলেও হৈমন্তী কিছু জিজ্ঞেস করল না; মনে হল, কথাটা এখন স্পষ্ট করে জানলে হয়তো সে অস্বস্তির মধ্যে পড়বে। ইঞ্জিনের আলো প্ল্যাটফর্ম আলোকিত করে বেঁকে লাইনের ওপর পড়ল। কেবিন পেরিয়ে গাড়িটা প্ল্যাটফর্মে ঢুকে পড়েছে, প্ল্যাটফর্ম কাঁপছিল।

গাড়ি থামল। বিজলীবাবু যেখানে মালপত্র জড়ো করিয়ে রেখেছিলেন তার কয়েক হাত তফাতেই হৈমন্তীর কামরা। অবনী উঠে গিয়েছিল; কুলিরা মালপত্র তুলে দিল একে একে; কামরার অন্যদিকে এক অবাঙালি দম্পতি, একটি বাচ্চা; হৈমন্তীর মালপত্র গুছিয়ে রাখা হল, কিছু বুঝি লাগেজ ভ্যানে দিতে হয়েছে। বিজলীবাবু সব গোছগাছ করে দিয়ে নীচে নেমে দাঁড়ালেন; সঙ্গে যাচ্ছেন দাসবাবু, দেখাশোনা করে পাশের কোন কামরায় চলে গেলেন।

গাড়ি ছাড়তে এখনও সামান্য দেরি। পাতা বিছানায় হৈমন্তী এবার বসল, অবনী দাঁড়িয়ে ছিল এতক্ষণ, এবার নামল, নেমে বাইরে থেকে দরজাটা বন্ধ করে জানলার সামনে এসে দাঁড়াল।

হৈমন্তী বলল, ওরা চলে গেছে?

কারা?

 কুলিরা।

অবনী এপাশ ওপাশ দেখল। যায়নি। আছে। …কেন?

ওদের কটা টাকা দেব। হৈমন্তী ব্যাগ খুলে টাকা বের করতে লাগল।

অবনী একটা কুলিকে ডাকল। কুলিটা কাছে এলে হৈমন্তী তার হাতে একটা দশ টাকার নোট দিল, বলল, তোমরা সকলে ভাগ করে নিয়ো। কুলিটা হাত পেতে টাকা নিয়ে খুশি হয়ে চলে গেল, যাবার আগে কপালে হাত ঠেকাল।

অবনী এবার ঠাট্টাচ্ছলে বলল, আমার ভাগ্যেও কিছু বকশিশ আছে নাকি?

হৈমন্তী হাসবার চেষ্টা করল। পারল না।

সুরেশ্বর এগিয়ে আসছিল; বিজলীবাবুও আসছেন। গাড়ি ছাড়ার আর বুঝি দেরি নেই। অবনী ইঞ্জিনের দিকে তাকাল: সিগন্যাল সবুজ হয়েছে।

সুরেশ্বর জানলার কাছে এসে দাঁড়াল। কামরাটা দেখল একবার। ভালই হয়েছে, সঙ্গী পেয়ে গেছ। ওঁরা কতদূর যাবেন?

জানি না, হৈমন্তী বলল।

 বিজলীবাবু পাশে এসে গেছেন, ওরাও কলকাতা যাচ্ছে।

তবে তো ভালই, সুরেশ্বর বলল। আর খানিকটা পরে জানলাগুলো ফেলে দিও। রাতের ঠাণ্ডা খেয়ো না।

দরজাটা উনি ভেতর থেকে লক করে দেবেন–আমি বলেছি– বিজলীবাবু অবাঙালি ভদ্রলোককে ইঙ্গিতে দেখিয়ে সুরেশ্বরকে বললেন। আর কোনও ঝামেলা নেই। আপনি নিশ্চিন্তে ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে পৌঁছে যাবেন। শেষের কথাগুলো হৈমন্তীকে বলা।

গায়ে গরম কিছু একটা দিয়ে নিয়ো, সুরেশ্বর বলল।

হৈমন্তী মাথা নোয়াল, পরে দেব।

 গার্ডের সিটি বাজল।

আচ্ছা দিদি, গাড়ি ছাড়ল– বিজলীবাবু বিদায় জানিয়ে হাসলেন, আবার দেখা হবে– বলতে বলতে তিনি দুহাত কপালে ঠেকিয়ে নমস্কার জানালেন।

হৈমন্তী নমস্কার করল। সরসীদিকে নিয়ে আসবেন একবার কলকাতায়। তাঁকে আমার কথা বলবেন। দিদিকে নমস্কার দেবেন।

বিজলীবাবু হাসিমুখে দু পা পিছিয়ে এলেন।

 সুরেশ্বর গাঢ় মৃদু গলায় বলল, কলকাতায় পৌঁছে চিঠি দিয়ো…

হৈমন্তী আস্তে করে মাথা হেলাল। দেবে, চিঠি দেবে পৌঁছে। অনুচ্চ স্বরে বলল, তোমার ওখানে এখনও অসুখ-বিসুখ, সাবধানে থেকো।

ইঞ্জিনের হুইসল বাজল আচমকা, তারপর গাড়ি নড়ে উঠল। বিজলীবাবু খানিকটা পিছিয়ে গেলেন, সুরেশ্বর সরে দাঁড়াল। গাড়ি চলতে শুরু করেছে, অবনী পাশে পাশে হাঁটতে লাগল, হৈমন্তীর মাথা সামান্য ঝুঁকে পড়েছে, চুল এবং চিবুকের একপাশে আলো, প্ল্যাটফর্মের একটা আলো ডিঙিয়ে গেল কামরাটা, সামান্য অন্ধকার। অবনী অন্ধকারে হাঁটছে। হাঁটতে হাঁটতে জানলা ধরে ফেলল।

চলি…

খুব খারাপ লাগছে।

কী যে ছেলেমানুষি… হৈমন্তী হাসবার চেষ্টা করল। আবার তো দেখা হচ্ছে..

 কী জানি!

বাঃ! কী জানি কি! .. হৈমন্তী আরও ঝুঁকে পড়ল, তার বুক জানলায়, ডান হাতটা হঠাৎ অবনীর হাতের ওপর এসে পড়ল, যেন কোনও কান্না চাপার চেষ্টা করছে মুখ লুকিয়ে, অবনীর হাতের ওপর হাত রেখে বুক নুইয়ে মাথা নিচু করল। তার কপাল এবং চুল দেখা যাচ্ছিল। হৈমন্তী বলল, কলকাতায় আমাদের বাড়িতে উঠবে। উঠবে না?

অবনী বলল, উঠব।

তারপর আর কিছু না, হৈমন্তী মুখ ওঠাবার পর হাত সরিয়ে নিল, কামরাটা পলকে অনেকখানি এগিয়ে গেল। তারপর অন্ধকার, জানলায় ছায়ার মতন হৈমন্তী ছিল একটু, পর মুহূর্তে মিলিয়ে গেল। আর কিছু দেখা গেল না। রেল লাইনের চাকায় শব্দ, দু-এক ঝলক আলল, দেখতে দেখতে গাড়ি প্ল্যাটফর্ম ছাড়িয়ে গেল, গার্ডের গাড়ির পিছনের লাল আলো, ক্রমশ সেই আলো নিষ্প্রভ, ছোট ও শেষে বিন্দুবৎ হয়ে অদৃশ্য হল। অন্ধকারে চাঁদ উঠেছে, ঝাপসা চাঁদের আলোয় সামনের বন অসাড় ঘুমন্ত দেখাচ্ছিল, গাড়িটা তার মধ্যে কোথায় যেন হারিয়ে গেছে, অবনী আর দেখতে পেল না।

কয়েক মুহূর্ত বনের দিকে তাকিয়ে অবনী নিশ্বাস ফেলল, হৈমন্তীর উষ্ণ হাত ও বুকের স্পর্শ অনুভব করার জন্যে তার ডান হাতটা মুখের সামনে তুলে নিয়ে আস্তে আস্তে ফিরতে লাগল।

প্ল্যটফর্ম ফাঁকা হয়ে গিয়েছিল, দু-একজন রেলবাবু ছাড়া বড় কেউ ছিল না; সুরেশ্বর, বিজলীবাবু এবং অবনী ফিরছিল। ওভারব্রিজের সিঁড়ি ওঠার সময় বিজলীবাবু কী যেন বললেন, সুরেশ্বর সংক্ষেপে জবাব দিল। অবনী কিছু বলল না। কাঠের সিঁড়িতে পায়ের শব্দ ছাড়া আর কোনও শব্দও অনেকক্ষণ শোনা গেল না।

ওভারব্রিজ পেরিয়ে এসে সিঁড়ি দিয়ে নামতে নামতে বিজলীবাবু সুরেশ্বরকে বললেন, আজকের রাতটুকু এখানে কাটিয়ে গেলেও পারতেন, মহারাজ।

সুরেশ্বর মাথা নাড়ল। না, বিজলীবাবু।

তবে চলুন; লাস্ট বাসটা আপনাকে নামিয়ে দিয়ে যাবে।

অবনী এতক্ষণে যেন কথাটা খেয়াল করতে পারল। বলল, বাস কেন! আমি আপনাকে পৌঁছে দিয়ে আসব।

না, আবার আপনি কেন যাবেন? সুরেশ্বর আপত্তি জানাল।

 চলুন; রাস্তা সামান্য; আমার কোনও কষ্ট হবে না।

কবার আর যাবেন আসবেন? বিকেলে গিয়েছিলেন, এখন আবার…

 ও কিছু না। চার পাঁচ মাইল রাস্তা যেতে অসুবিধের কী আছে…

অবনীর গলার স্বর থেকে মনে হচ্ছিল তার পক্ষে যেন এখন এই যাওয়াটুকুর প্রয়োজন আছে। সুরেশ্বর অবনীকে লক্ষ করল। ওভারব্রিজের নীচে মোসাফিরখানার দিকে অবনীর জিপ দাঁড় করানো আছে। অবনী গাড়ির দিকে পা বাড়াল।

বিজলিবাবুর দিকে তাকাল সুরেশ্বর, যাবেন নাকি?

না, মহারাজ, আমার উপায় নেই। অফিসে ক্যাশ ফেলে এসেছি… বিজলীবাবু হেসে বললেন, ক্যাশ তুলতে হবে, কয়েকটা খুচরো কাজও আছে। মিত্তিরসাহেব আপনাকে বরং পৌঁছে দিয়ে আসুন।

সুরেশ্বর বলল, তা হলে আজ চলি, বিজলীবাবু।

আসুন। ..আমি একদিন যাচ্ছি। …মিত্তিরসাহেব, আমি এগোই।

বিজলীবাবু চলে গেলেন। সুরেশ্বর অবনীর পাশে পাশে হেঁটে গাড়ির কাছে এল। অবনী গাড়িতে ওঠার আগে একটা সিগারেট ধরাল।

কটা বাজল? সুরেশ্বর শুধোল।

অবনী ঘড়ি দেখল, প্রায় আট।

সুরেশ্বর পাশ দিয়ে উঠে বসল, অবনী উঠে পড়েছে।

গাড়িতে স্টার্ট দিল অবনী; হেডলাইট জ্বালল, তারপর সামনের দিকে সামান্য এগিয়ে বাঁ হাতে রাস্তা ধরল।

স্টেশনের এই দিকটার আলো, বাজার, মানুষজন, দোকানপসার, শিবমন্দির যেন কয়েক পলকের মধ্যে পেরিয়ে হঠাৎ গাড়িটাকে নির্জনতা ও অন্ধকারের মধ্যে এনে ফেলল অবনী; গাছগাছালির মধ্যে দিয়ে থানা এল, থানার পাশে বুঝি রামলীলা বসেছে, আলো জ্বলছে মাঠে, অল্প একটু শামিয়ানা, থানা ছাড়িয়ে একেবারে ফাঁকায় এসে পড়ল। লোকালয় বলে আর কিছু নেই, ফাঁকা নিস্তব্ধ মাঠ, ঝিঁঝির ডাক, জ্যোৎস্না ধরেছে মাঠেঘাটে, বসন্তের বাতাস দিচ্ছিল, বাতাসে শব্দ হচ্ছিল ঈষৎ।

অবনী এতক্ষণ কেমন একটা আচ্ছন্নতার মধ্যে ছিল। ফাঁকায়, নির্জনে এবং স্তব্ধতার মধ্যে এসে ক্রমশ যেন ঘুম ভেঙে জেগে ওঠার মতন তার সেই ঘোর কেটে আসছিল। চোখ চেয়ে অবনী পথঘাট মাঠ এবার যেন দেখতে পাচ্ছিল, সামান্য আগেও তার কোনও খেয়াল ছিল না, অভ্যাস এবং অনেকটা যেন যন্ত্রের মতন সে গাড়িটাকে চালিয়ে এনেছে। এতটা অন্যমনস্ক ভাবে গাড়ি চালানোর বিপদ হতে পারত। আশ্চর্য, হৈমন্তীর গাড়ি প্ল্যাটফর্ম ছেড়ে চলে যাবার পর সে এতক্ষণ কী করেছে, কী বলেছে কিছুই তার স্পষ্ট করে মনে পড়ছিল না–যেন যা ঘটেছে সবটাই কোনও ঘোরের মধ্যে, স্বাভাবিক কোনও চেতনা ছিল না। বিস্মৃত স্বপ্নের মতন তার সামান্য দাগ মাত্র লেগে আছে। অবনী দীর্ঘনিশ্বাস ফেলল; কিছুক্ষণ মনে মনে হৈমন্তীকে দেখল: ট্রেনের খোলা জানলায় মুখ রেখে অন্ধকারের দিকে তাকিয়ে বসে আছে, কয়লার গুঁড়ো জমছে মুখে।

সামনের রাস্তা থেকে লাফিয়ে এক ঝলক আলো উঠে এল। উলটো দিক থেকে গাড়ি আসছে। অবনী স্বাভাবিক দৃষ্টিতে পথঘাট লক্ষ করার চেষ্টা করল, সতর্ক হল। ঢালু থেকে উঁচুতে উঠেছিল, এবার মোটামুটি সমভূমি দিয়ে আসছে। কাছাকাছি এসে গেল। অবনী গাড়ির হেডলাইট নিবিয়ে পথের পাশে সরে গেল সামান্য, একটা মাল লরি, পাশ কাটিয়ে চলে গেল পলকে! হেডলাইট জ্বালিয়ে আবার মাঝরাস্তায় গাড়ি আনল অবনী।

এতক্ষণ সে প্রায় কোনও কথাই বলেনি, সুরেশ্বর এক-আধটা কথা কী যেন বলেছিল, অবনী জবাব দিয়েছে কী না তাও মনে পড়ল না। এবার অবনী বলল, উনি এখানে কত দিন থাকলেন?

আট-ন মাস, সুরেশ্বর জবাব দিল।

 অনেক বেশি বলে মনে হয়–। অবনীর গলার স্বর উদাস।

বর্ষার মুখে এসেছিল।

বসন্তের শুরুতে চলে গেল– অবনী হঠাৎ কেমন হালকা করে বলবার চেষ্টা করল। তারপর সামান্য চুপ করে থেকে বলল, আসার দিনের কথাটা আমার মনে আছে।

সুরেশ্বর সহজ গলায় বলল, হ্যাঁ..আপনি আমাদের লাটুঠার মোড় থেকে পৌঁছে দিয়েছিলেন।

অবনী চুপ করে থাকতে থাকতে যেন হেসে বলল, সেবার আপনার আশ্রমে, এবারে স্টেশনে।

সুরেশ্বরও যেন হাসল একটু।

গাড়িটা ধীর-গতি করে অবনী এবার স্বাভাবিকভাবে একটা সিগারেট ধরাল। কিছুক্ষণ আর কোনও কথা বলল না, দু-চার মুখ ধোঁয়া খেল। বলল, আপনাকে কয়েকটা কথা জিজ্ঞেস করতে ইচ্ছে করে যদি কিছু মনে না করেন…

মনে করার কী আছে!

না, তবু অবনী ইতস্তত করে বলল, হয়তো আপনার ব্যক্তিগত বলে মনে হতে পারে…

 আপনি কী জানতে চান আমি তো জানি না।

অবনী সরাসরি কিছু বলল না। ভাবছিল। সুরেশ্বর সম্পর্কে তার আগ্রহ এবং কৌতূহল নানা কারণে বেড়েছে; অবনী অনেক কিছুই জানতে আগ্রহ বোধ করে, যেমন সুরেশ্বরের মার কথা, কিংবা বাবার; জানতে ইচ্ছে করে সুরেশ্বরের এই জীবনের সঙ্গে তার কোনও সম্পর্ক আছে কিনা! হৈমন্তীর সঙ্গে সুরেশ্বরের সম্পর্কের কোথায় শুরু, আর কেনই বা শেষ–এও তার কৌতূহলের বিষয়। নির্বোধের মতন, অথবা ঝোঁকের মাথায় সুরেশ্বর হৈমন্তীকে নিজের মর্জি মতো চালাতে চেয়েছিল বলেও মনে হয় না। সুরেশ্বর কী চেয়েছিল? কী আশা করেছিল? কেন এনেছিল? মনে হয় না, এসবই একটা সাধারণ ভুল। অবনীর নানা প্রশ্ন ও সন্দেহ সত্ত্বেও সে এই ধরনের কথা তুলল না। তার মনে হল না, সুরেশ্বর তার ব্যক্তিগত ও নিজস্ব এইসব কথা পছন্দ করবে।

শেষ পর্যন্ত অবনী বলল, আজ আপনার আফশোস হচ্ছে না?

সুরেশ্বর সামান্য মুখ ফেরাল, অবনীকে দেখল। আফশোস! ..

অবনী বুঝল না সুরেশ্বর কথাটা এড়িয়ে যাবার চেষ্টা করবে কী না। বলল, আমি ভেবেছিলাম, মনে মনে আপনি আফশোস করবেন।

হেম ফিরে গেল বলে—

অবনী কিছু বলল না।

সুরেশ্বর সামান্য সময় নীরব থাকল, তারপর বলল, হেমকে আমি নিজের স্বার্থে এনেছিলাম, স্বার্থ ক্ষুণ্ণ হলে মানুষের লাগে।

আমি ঠিক স্বার্থের কথা বলছি না– অবনী বলল, স্বার্থ ছাড়াও কিছু থাকতে পারে। …হারাবার আফশোসও মানুষের থাকে।

সুরেশ্বর যেন কয়েক মুহূর্ত ভাবল, বলল, কী জানি, তেমন কোনও আফশোস আমার নেই। বলে সামান্য থেমে আবার বলল, হেমকে এখানে এনে আমি কিছুই দিতে পারলাম না সে-দুঃখ আমার থাকবে।

অবনী কথাটা কিছু বুঝল, কিছু বুঝল না। সুরেশ্বর বোধহয় মনে করে না হৈমন্তী তার প্রাপ্ত বস্তু ছিল, কিংবা প্রাপ্য বস্তু; হারাবার প্রশ্নটাও তাই তার কাছে অবান্তর।

অবনী কী ভেবে বলল, আপনি এরকম যে কেন করলেন আমি কিছুতেই বুঝে উঠতে পারি না। ওঁকে তো আপনি চিনতেন, জানতেন, বুঝতেন…। অবনীর গলার স্বরে আন্তরিকতা ও ঘনিষ্ঠতা ছিল। কিছু সময় আর কোনও কথা বলল না, পরে বলল, আপনি নিশ্চয় যা দিয়েছিলেন তা ফেরত চাননি।

হেমকে আমি কিছু দিইনি।

এক সময়ে ওঁর অসুখে যথেষ্ট করেছিলেন।

 সুরেশ্বর অবাক হল। কে বলল?

উনিই বলেছেন।

সুরেশ্বর যেন বিব্রত বোধ করল। তুচ্ছ কথাটা হেম কেন এমন করে মনে রেখেছে আমি জানি না।

 কৃতজ্ঞতা।

 সুরেশ্বর ব্যথিত হল। বলল, আমি কী সেজন্যে তাকে এখানে আনতে পারি!

আমারও মনে হয় না এসব হিসেব আপনি বোঝেন।

সুরেশ্বর অন্যমনস্ক, কিছু ভাবছিল। বলল, অসুখের সময় হেমের বয়স ছিল অল্প। সে ওই বয়সে সংসারের এমন জায়গায় গিয়ে পড়েছিল যেখানে শোক, দুঃখ, কষ্ট, অসহায়তা। আমার মনে হত, হেম দুঃখকে নিজের জীবন দিয়ে দিনে দিনে চিনে নিচ্ছে। ওর তখন কত মমতা দেখেছি, কত ভালবাসা দেখেছি। ভেবেছিলাম, ওর মধ্যে দুঃখের বোধ হয়েছে। ওর তা হয়নি। আমারও নয়। তারপর ও সুস্থ হল, ঘরে এসে বাইরের দুঃখু ভুলে গেল। …আমিও হয়তো ভুলে যেতাম, কিন্তু আর-একজন এল, যে আমায় ভুলতে দিল না; সে আমায় কোথায় যে হাত ধরে নিয়ে গেল…থাকল না..আমায় রেখে চলে গেল… সুরেশ্বরের গলা ভরে এসেছিল, যেন কণ্ঠ নয় তার হৃদয় কিছু বলছে।

অবনী মুখ ঘুরিয়ে সুরেশ্বরকে দেখছিল, দেখতে দেখতে সে অনুভব করল কোনও অদ্ভুত বিষণ্ণতা তাকে গ্রাস করছে। এ বিষণ্ণতা তার নয়, তবু কোনও আশ্চর্য যাদুমন্ত্রে যেন সে এই সম্মোহনের মধ্যে প্রবেশ করেছে। অন্যমনস্কভাবে অবনী গাড়ি প্রায় দাঁড় করিয়ে ফেলেছিল, এবং এত ধীরে ধীরে গাড়িটা যাচ্ছিল যেন এই নিস্তব্ধ প্রান্তরে কোনও পশুর মতন হাঁটছে, তার কোনও গন্তব্য নেই, আশ্রয় নেই।

গাড়িটা দাঁড় করাল অবনী। অন্যমনস্কতা এবং এই সম্মোহন সে নষ্ট করার চেষ্টা করল। চারপাশ তাকিয়ে তাকিয়ে দেখল। তারা অনেকটা পথ চলে এসেছে, ডান দিকে একটা বটগাছের তলায় ঢিবির মতন চুনকাম করা মন্দির, তার গা বেয়ে বাঁশের মাথায় লাল শালু উড়ছে, কোথাও জনমানব নেই, ওপাশে ঝোপে ঝোপে জোনাকি উড়ছে, পাশে বুঝি খালের নালা, জ্যোৎস্নাজোড়া প্রান্তরের বুকে নালাটি ক্ষতের দাগ হয়ে পড়ে আছে। মাঠে মাঠে বাতাস ছুটছিল, সি সি শব্দ হচ্ছিল।

অবনী নিশ্বাস ফেলল দীর্ঘ করে, কয়েক দণ্ড চুপচাপ, তারপর পকেট হাতড়ে সিগারেট বের করে ধরাল। হৈমন্তী এখন কতটা পথ চলে গেল, অবনী যেন মনে মনে ভাবল একবার।

গাড়ি আবার চলতে শুরু করলে অবনী বলল, বাইরের দুঃখই কি জীবনের সব?

সুরেশ্বর অন্যমনস্ক ছিল, শুনতে পায়নি। বলল, কিছু বললেন?

বলছিলাম বাইরের দুঃখই কি জীবনের সব?

 যার কাছে যেমন…হেমের কাছে তার নিজের দুঃখই বড়।

আপনার দুঃখের সঙ্গে তার মিল নেই।

না।

কিন্তু, মানুষ নিজের সুখ দুঃখই তো আগে বোঝে।

অনেক সময় সেটাই একমাত্র বোঝে; আগে যা বোঝে–পরেও তাই বোঝে। আমার বাবা তাঁর জীবনে শুধু নিজের সুখ বুঝেছিলেন, নিজের অভাবটাই তাঁর একমাত্র বোধ ছিল।

আপনার মা আত্মহত্যা করেছিলেন কেন?

 নিজের দুঃখে কোনও সান্ত্বনা পাননি বোধহয়।

অবনী আর কিছু বলল না। তার মনে হল না, বৃথা অন্য কোনও কথার প্রয়োজন আছে। সুরেশ্বর নিজের কথা ভুলতে চায়, তার নিজের সুখ দুঃখকে সে স্বীকার করে না, হৈমন্তীর সঙ্গে তার কোথাও মিল নেই, কোথাও নয়। কেন যে–অবনী বুঝতে পারল না–তার মার কথা মনে পড়ল; ললিতার কথা, এবং নিজের। মা শুধুমাত্র আত্মতৃপ্তি চেয়েছিল, সেই আত্মতৃপ্তির কী কুৎসিত পরিণতি! ললিতা কী চেয়েছিল, কী চায়? শুধু আত্মসুখ, সন্তুষ্টি, ভোগ। সে নিজেও ললিতার কাছে এর বেশি কিছু চায়নি। অবশ্য এ থেকে কিছু প্রমাণ করতে চাইছে না অবনী, তবু তার মনে পড়ছে। হয়তো সুরেশ্বরের কথায় কতটুকু সত্য সে দেখতে চাইছিল।

লাটঠার মোড়ের কাছাকাছি গাড়ি পৌঁছে গেল। ডান দিকে কয়েকটা খাপরাচালের ঘর দেখা যাচ্ছিল, ফাগুয়ার গান শুরু হয়েছে, বাতাসে একটা সুরেলা হল্লা ভাসছিল, খঞ্জনির শব্দ। ক্রমে লাটঠার মোড় এল। একটু আলো, ছোটখাট দু-একটা দোকান, দু-পাঁচজন মানুষ।

লাটঠার মোড় থেকে গাড়িটা কাঁচা রাস্তায় নামিয়ে নিল অবনী; তারপর মাঠ; আমলকী আর শালচারার ঝোপে লিটি পোকা টিপ টিপ করে জ্বলছিল, শুকনো মাটির গন্ধ। ধুধু প্রান্তরে এসে গাড়িটা উঁচু-নিচু পথে ঝাঁকুনি খেতে খেতে চলেছিল।

অবনী অনেকক্ষণ কোনও কথা বলেনি। এবার, নিশ্বাস ফেলে, আচমকা সুরেশ্বরকে ডাকল।

সুরেশ্বর সাড়া দিল।

অবনী বলল, আপনার সমস্ত জীবনটা আপনি এই জঙ্গলেই শেষ করে দিতে চান?

সুরেশ্বর কিছু বলল না, যেন বিনীত হাসি হাসার চেষ্টা করল, শব্দ হল সামান্য।

এখানে আপনি কী পেয়েছেন?

এত তাড়াতাড়ি! সুরেশ্বর এবার হাসল, শান্ত নির্মল ধ্বনি জাগল হাসির।

পাবার অপেক্ষায় আছেন? অবনীও পরিহাস করে হাসল।

 তা হয়তো আছি।

পাবেন?

কী জানি; হয়তো পাব না। …বসে থাকলেই কি পাওয়া যায়!

অবনী সুরেশ্বরের মুখ লক্ষ করল। বলল, আপনি কী ঈশ্বরদর্শনের আশায় বসে আছেন?

না, সুরেশর মাথা নাড়ল।

 অবনী অবাক হল। আপনি ঈশ্বর-বিশ্বাসী নন?

 কী রকম ঈশ্বর?

অবনী কেমন গোলমালের মধ্যে পড়ল। সে বুঝতে পারল না সুরেশ্বরের প্রশ্নের কী জবাব হতে পারে। কেমন ঈশ্বর? কেন, আস্তিক যাকে ঈশ্বর বলে তেমন ঈশ্বর। অবনী বলল, ঈশ্বরের আবার রকম থাকে নাকি? ..কী জানি আমি জানি না, মশাই।

সুরেশ্বর সঙ্গে সঙ্গে কোনও জবাব দিল না। পরে বলল, আমার ঈশ্বর আমার নিজের।

 বুঝলাম না…

বুঝোনোর মতন কিছু নেই। সুরেশ্বর সংযত গলায় বলল, আমার ঈশ্বর নিয়ে বড়-সড় তর্ক করা যায় না। …জগৎ আর জীবের বাইরে সে-ঈশ্বর থাকে না।

কিন্তু আমার ধারণা ছিল ঈশ্বর বস্তুটা এই দুইয়ের বাইরে–সাম থিং এলস..

 সে ঈশ্বরে আমার বিশ্বাস নেই। …আমার বেড়ার বাইরে যে ঈশ্বর তাকে নিয়ে আমি কী করব!

 অবনী বুঝতে পারল না। বলল, আপনার ঈশ্বর কী?

 কল্পনা।

সমস্ত ঈশ্বরই কল্পনা।

আমার ঈশ্বর মানুষের বোধবুদ্ধির অগম্য, অজ্ঞেয় অনুভব-হীন কল্পনা নয়। …মানুষের হৃদয় যা অনুভব করে আমার ঈশ্বরকে আমি তাই দিয়ে কল্পনা করেছি। মানুষ যা হতে চায়, অথচ পারে না, যা হতে পারলে সে ভাবে সে সার্থক হত, পূর্ণ হত, আমার ঈশ্বর তার বেশি নয়।

অবনী ইতস্তত করে বলল, তার দেবত্ব নেই?

না; সেভাবে নেই। সুরেশ্বর সংক্ষেপে বলল।

গাড়ি চলছে কী চলছে না বোঝা যায় না, শব্দটা কানের সঙ্গে মিশে আছে, ফাল্গুনের জ্যোৎস্নায় নিঃসাড় প্রান্তর কেমন অলৌকিক মগ্নতা পেয়েছে, ঝিঁঝির স্বরে এখানের শূন্যতা ভরে আছে।

সুরেশ্বর মৃদুস্বরে বলল, মানুষ তার সমস্ত অভাব, ব্যর্থতা, অপূর্ণতা, অক্ষমতার কথা নিজে যত জানে আকাশের ভগবান তত জানে না। ঈশ্বর আমার কাছে মানুষের কাম্য ও প্রার্থিত সমস্ত গুণের সমষ্টি। আমার ঈশ্বর নিগুণ নয়। সুরেশ্বর কয়েক মুহূর্তের জন্যে থামল, পরে বলল, মানুষ তার দয়া, মায়া, মমতা, প্রেম, শৌর্য, সৌন্দর্য-সমস্ত কিছুর চরম কল্পনা ঈশ্বরের ওপর আরোপ করেছে; তাই ঈশ্বরের চেয়ে মমতাময় প্রেমময় আর কিছুকে বলি না। অপূর্ণ মানুষের ধারণায় ঈশ্বরই তাই পূর্ণ। …এই দেবত্ব মানুষ শুধু ঈশ্বরকেই দিয়েছে, কারণ সে ভেবেছে এ-দেবত্ব বুঝি তার আয়ত্ত হবার নয়। বোধহয়, আমার ধারণা, এই দেবত্বের অভিজ্ঞতা তার হতে পারে। সংসারে যাঁরা মহৎ, যাঁরা সাধক, তাঁদের হয়তো হয়৷

অবনী বলল, আপনি কি দেবতা হয়ে উঠতে চান?

কতটা হতে পারি তার চেষ্টা করতে দোষ কোথায়! যদি ঈশ্বরের মমতা আমারই কল্পনা হয়, যদি বলি ঈশ্বরের চেয়ে সহিষ্ণু আর কিছু নয় তবে আমার পক্ষে আমার কল্পনার ঈশ্বরের মতো মমতাময়, সহিষ্ণু হবার চেষ্টা করতে আপত্তি কোথায়!

অবনী যেন কিছু ভাবল। বলল, আপনার ঈশ্বরে পাপ নেই?

না। পাপ কি মানুষের গুণ?

কিন্তু মানুষের মধ্যে আছে।

পবিত্রতা তাই আমাদের কল্পনা।

অবনী কিছু বলল না আর। সুরেশ্বরের ঈশ্বর যে কিছুটা এলোমেলো, সাদামাটা তাতে তার সন্দেহ হল না। বোধহয়, অবনীর মনে হল, ঈশ্বরকে রাখলে অপ্রয়োজনে রাখতে হয়, না হয় রাখতে নেই। সুরেশ্বর প্রয়োজনে ঈশ্বরকে রেখেছে। সে নির্বোধ। তবু অবনীর কোথাও যেন সুরেশ্বরের প্রতি সহানুভূতি ও মমতা হচ্ছিল।

গাড়ি অন্ধ আশ্রমের কাছাকাছি এসে পড়েছিল। আর অল্পক্ষণ পরেই আশ্রমে পৌঁছে যাবে। কেমন এক অবসাদ বোধ করছিল অবনী। অবসন্নভাবে সিগারেট ধরাল, গলা বুক ভরে ধোঁয়া নিল। কিছুক্ষণ আর কোনও কথা হল না। দুজনেই নীরব।

অবশেষে অবনী বলল, আপনি এই অন্ধ আশ্রম করতে এলেন কেন? সংসারে আরও অনেক কাজ ছিল।

সুরেশ্বর সামান্য ভেবে বলল, এই কাজটাই আমার ভাল লাগল।

 অন্ধ আতুর সেবা?

দুঃখীজনের সেবা। …আমিও তো অন্ধ। সুরেশ্বর সামান্য থামল, বলল, একবার আমি এক গেঁয়ো মেলায় গিয়েছিলাম। মেলাটা বসে মাঘ মাসের পূর্ণিমায় শোন নদীর ধারে। হরিদ্বারের গঙ্গায় যেমন লোকে সন্ধেবেলায় প্রদীপ ভাসায়–সেই রকম এই মেলাতেও অনেকে মাটির প্রদীপ ভাসাতে আসে। ভাবে এটা পুণ্য কাজ। সেবার একটা বুড়ো এসেছিল। প্রদীপ ভাসাতে গিয়ে কেমন করে যেন নদীতে পড়ে গেল। তাকে টেনেটুনে তুলল লোকে। বুড়ো অন্ধ। আমি বললাম, তুমি নিজে অন্ধ তবু এভাবে একলা একলা প্রদীপ ভাসাতে এলে কেন? জবাবে বুড়োটা বলল,-বেটা, আমি আজন্ম অন্ধ, আমি ছোট, তবু যখন এই একরত্তি মাটির পিদ্দিমে এক ফোঁটা আলো দিয়ে নদীতে ভাসিয়ে দি, তখন বুঝতে পারি আমার ছোট্ট পিদ্দিমটা হাজার মানুষের আলোর সঙ্গে নদীর ঘাট ভাসতে ভাসতে কোথায় যেন চলে গেল। জীবনকে এইভাবে যেতে দাও।

অবনী অনেকক্ষণ চুপ করে থেকে বলল, আপনি কি কোনও কিছু পাবেন? অন্ধ তো পথ পায় না।

 মানবজীবনের একটা দিক এই রকমই। দুঃখের জগতে, যন্ত্রণার জগতে আমরা জন্মেছি। তেমন করে দেখতে গেলে ব্যর্থতাই মানুষের নিয়তি। …তবু..

অবনী অপেক্ষা করে থাকল।

সুরেশ্বর বলল, তবুজগতের সঙ্গে জীবনের সঙ্গে কর্ম দিয়ে যে জড়িত তার সান্ত্বনা আছে। আমি নিষ্ক্রিয় হয়ে বাঁচতে পারি না। অবিশ্বাস করে, দূরে সরে থেকে, পালিয়ে যদি বাঁচা যেত আমি বাঁচতাম।

এই বেঁচে থাকায় কিছু কি আছে?

আমি ভাবি, আছে। মর্যাদা আছে, সান্ত্বনা আছে।

আশ্রমের সামনে এসে গাড়িটা লাফাল। গর্ত ছিল কোথাও। অবনী ব্রেক চাপল, তারপর আশ্রমের মধ্যে ঢুকে গেল। অন্য দিনের মতনই সে গাড়িটা হৈমন্তীর ঘরের কাছাকাছি মাঠে রাখল। তার খেয়াল ছিল না হয়তো, কিংবা অভ্যাসবশেই।

সুরেশ্বর নামল, অবনীও নেমে পড়ল।

 সুরেশ্বর বলল, নামলেন? বসবেন একটু?

 না। আপনাকে একটু এগিয়ে দিই। পা ছাড়িয়ে নিচ্ছি আর কি! অবনী হাসল।

মাঠ দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে সুরেশ্বরের ঘরের দিকে এগিয়ে যাচ্ছিল ওরা।

সুরেশ্বর বলল, অবনীবাবু

বলুন।

হেম আমার অনেক অহঙ্কার ভেঙেছে। তার কাছে আমি কৃতজ্ঞ। থামল, আবার বলল, সেই যে গান আছে: যতবার আলো জ্বালাতে চাই নিবে যায় বারে বারে আমারও তাই। নিজেকে জ্বালাতে চাই, তবু নিজেই কোথায় যেন নিবিয়ে ফেলি।

অবনী সুরেশ্বরকে দেখল। সুরেশ্বর শান্ত পায়ে সামনের দিকে চোখ রেখে হেঁটে চলেছে। তার শরীরের কোথাও অবনত ভাব নেই, দ্রুততা নেই পদক্ষেপে, অথচ, সে নম্র, বিনীত। মনে হয় সে কোনও কিছু লক্ষ করছে না, অথচ সে লক্ষ করছে।

ঘরের সামনে এসে সুরেশ্বর ডান দিক দিয়ে আরও একটু এগিয়ে গেল, গিয়ে হরীতকী গাছের তলায় সিমেন্টের ছোট একটি বেদির সামনে দাঁড়াল। বলল, বসব একটু। বসবেন?

না, আর বসব না। অবনী মাথা নাড়ল। সুরেশ্বর যে এখন একা নির্জনে নিস্তব্ধতার মধ্যে দুদণ্ড বসে থাকতে চায় অবনী অনুভব করতে পারছিল। আর অপেক্ষা করা যায় না। অবনী বলল, চলি, রাত হয়ে আসছে…।

আসুন। …আবার আসবেন।

আসব, অবনী অন্যমনস্কভাবে বলল, আচ্ছা চলি।

ফিরতে লাগল অবনী। সুরেশ্বরের ঘরের সামনে দিয়ে চলে এল। আরও কয়েক পা এগিয়ে দাঁড়াল: সুরেশ্বরকে দেখতে ইচ্ছে করছিল৷ পিছু ফিরে তাকাল: সিমেন্টের বেদির ওপর আসন করে সুরেশ্বর বসে আছে, পাশে হরীতকী গাছ, মনে হল সুরেশ্বরের মুখ আকাশের দিকে। ফাল্গুনের নিশীথ বাতাস ও কোমল জ্যোৎস্নার মধ্যে তাকে এখন বড় দূরের বলে মনে হচ্ছিল। দীর্ঘ নিশ্বাস ফেলে অবনী আবার ফিরতে লাগল।

মাঠ দিয়ে অন্যমনস্কভাবে অবনী হাঁটছিল: ঘাসে বুঝি সামান্য হিম পড়ে আর্দ্র হয়েছে, করবীঝোপ মাঝে মাঝে শিহরিত হচ্ছিল, কদাচিৎ কারও গলার স্বর ভেসে আসছে, দু-একটি আলো জ্বলছে কোথাও! অবনী কিছু লক্ষ করল না; সরাসরি এসে গাড়ির কাছে দাঁড়াল।

অন্যমনস্কভাবে অবনী গাড়িতে উঠল, উঠে অভ্যাসমতন গিয়ারে হাত দিল। স্টার্ট দেওয়ার পর যেন শব্দ এসে তাকে সচেতন করল। হেডলাইট জ্বালাল অবনী। আলোর ঢেউ যেন সামান্য ব্যবধানটুকু নিমেষে পেরিয়ে গেল, গিয়ে হৈমন্তীর ঘরের দিকে আছড়ে পড়ল। মুহূর্তের জন্যে কেমন বিভ্রম ঘটল, তারপর অবনীর মনে হল হৈমন্তী নেই, তার ঘর শূন্য পড়ে আছে। ফাঁকা, রিক্ত, নিঃস্ব মনে হল নিজেকে বুকের কোথাও যেন কিছু নেই–সব কেমন অসাড়, শূন্য। মুখ হাঁ করে গভীর শ্বাস ফেলল। তারপর গাড়ির মুখ ঘুরিয়ে নেবার জন্যে সামান্য পিছিয়ে এগিয়ে নিল গাড়িটা, নিয়ে বৃত্তাকারে ঘুরিয়ে আনল। ঘুরিয়ে নেবার সময় হেডলাইটের আলো প্রথমে অন্ধনিবাস, পরে রোগী-ঘর, তাঁত-ঘর এবং শেষে পেট্রম্যাক্স-জ্বালানতুন হাসপাতালের গায়ে গায়ে পড়ল, পড়ে ঘুরে এল। আর সহসা অবনীর মনে হল, এই আলো অতি তীব্র, ভীষণ; মনে হল এই আলোর কৌতূহল বড় বেশি; যেন শিকারের আগ্রহে সতর্ক হয়ে তন্ন তন্ন করে সব দেখতে চায়। নিষ্ঠুর, নির্দয়। আর কেন যেন অবনীর অদ্ভুত এক অস্বস্তি হল। সে আড়ষ্ট ও ভীত হল। গাড়ির আলো দুটিকে নিজের চক্ষু বলে মনে হচ্ছিল। হয়তো অবনী সুরেশ্বরের এই আশ্রমে ক্ষিপ্তের মতন, নির্বোধের মতন এবং নির্দয় হয়ে বেমানান, অপ্রয়োজনীয় আলো নিয়ে এখানকার সমস্ত কিছুকে অবজ্ঞা ও উপহাস করতে এসেছিল, হয়তো শিকার করতে।

অবনী আলো নিবিয়ে দিল। দিয়ে জ্যোৎস্নার আলোয় ধীরে ধীরে, অন্ধ আশ্রমের আর কোনও কিছুকে খণ্ডিত না করে অপরাধীর মতন মাঠ দিয়ে পথ ধরে ফটকের বাইরে জামতলায় চলে এল।

তারপর কাঁচা রাস্তায় আবার আলো জ্বালল অবনী। গাড়ি চলছিল।

যাবার পথে অবনী বুঝতে পারল না–পিছনে যে মানুষটি একপাশে কিছু অন্ধ, অন্য পাশে কয়েকটি মড়কের মানুষ নিয়ে পড়ে আছে, সে জীবনে কী পাবে। অবনী জানেনা এতে কিছু পাওয়া যায় কি না। তার বিশ্বাস হয় না। সুরেশ্বর নির্বোধের মতন সমস্ত প্রাপ্তিগুলোই একে একে ফেলে দিয়েছে। এখন, সে অন্য কিছুর অপেক্ষায় আছে। এই অপেক্ষায় সে কি কিছু পাবে? পাওয়া কি সম্ভব?

অবনীর বিশ্বাস করতে বাধছিল, এতে কিছু পাওয়া যায়। তবু কী এক বেদনায়,সহানুভূতি ও করুণায় অবনী প্রার্থনা করল: ওই মানুষটি যেন কিছু পায়। কিছু পায়।

অবনী সজল চোখে অসাড় জ্যোৎস্নাপ্লাবিত এই চরাচরে কিছু যেন অনুভব করার চেষ্টা করল।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *