৪. নীরবে কিছু সময়

১৬.

নীরবে কিছু সময় বসে থেকে সুরেশ্বর উঠল। তার মুখে না প্রসন্নতা, না অসন্তোষ বা বিরক্তি। স্মিত সরল হাসিও ছিল না; কেমন এক গাম্ভীর্য ঘন হয়ে উঠেছিল মুখে। এই গাম্ভীর্যে কোনও মানুষের ক্রোধ বা বিতৃষ্ণাও প্রকাশ করে না; মনে হয় অন্যমনস্কতাবশত এবং বেদনাজাত এক মালিন্য সৃষ্টি হয়েছে।

হৈমন্তীর ঘর থেকে শান্তভাবেই বিদায় নিয়ে সুরেশ্বর বাইরে চলে এল।

বাইরে শীত বেড়েছে। উত্তরের বাতাস এখনও তেমন করে বইতে শুরু করেনি। তবু আজ বাতাসে ধার ছিল, থেমে থেমে উত্তরের দমকা আসছিল। অগ্রহায়ণের শেষ, চারপাশে হিমের ধূসরতা জমছে, আকাশের তারাগুলি তেমন করে যেন জ্বলছে না। সুরেশ্বর ধীর পায়ে হাঁটতে লাগল, যেন শীতের মধ্যে একা একা পায়চারি করছে।

হৈমন্তীর আজকের ব্যবহারে সে দুঃখিত, হয়তো ক্ষুব্ধ। তবু সুরেশ্বর হৈমন্তীর স্বপক্ষে চিন্তা করছিল। অপরের প্রতি বিরক্ত হওয়ার মধ্যে কৃতিত্ব বা কষ্ট কিছুই নেই যেন এই ধরনের মনোভাবের বশবর্তী হয়ে সে হৈমন্তীর প্রতি সহৃদয় হচ্ছিল এবং ভেবে দেখার চেষ্টা করছিল হৈমন্তী এতটা রূঢ় হল কেন।

হেম যে অসঙ্গত কিছু বলেছে তা হয়তো নয়, সুরেশ্বর ভাবছিল, হাসপাতাল আর মেঠাইমণ্ডার দোকান কখনও এক হতে পারে না। কলকাতার হাসপাতালে হেমের যা শিক্ষা তাতে সে নিয়মের বাইরে যেতে চায় না, হয়তো পারে না। হাসপাতালের বাঁধা নিয়ম সে রাখতে চায়। এতে দোষের কিছু নেই, বা তার পক্ষে অন্যায় কিছু হয়নি। তা ছাড়া, সুরেশ্বর নিজেও মনে করে, হেমের শরীর স্বাস্থ্যের ওপর লক্ষ রাখা উচিত, অনিয়ম ও অত্যধিক পরিশ্রম তার পক্ষে ক্ষতিকর।

কিন্তু, সুরেশ্বর ভাবল, হেম সহৃদয়তার সঙ্গে বিষয়টা বিবেচনা করতে কেন রাজি হল না? এই অনিচ্ছুক আচরণ তার কেন? যদি সে অত্যধিক পরিশ্রমের কথা তোলে তবে তার বিবেচনা করা উচিত ছিল, এখানে তা নিত্য হয় না, প্রত্যহ একরাশ রোগী এখানে চোখ দেখাতে আসছে না। সকালের দিকে দু-চারজন, বেলায় আরও কয়েকজন। মোটামুটি হিসেব নিলে হয়তো দেখা যাবে, সারাদিনে সাধারণভাবে আট দশজনের বেশি রোগী আসে না। হাটের দিন কিছু বাড়ে। তেমনি আবার মাঝে মাঝে সারাদিনে একটি দুটি রোগীর বেশিও যে হয় না।

হেমের এসব কথা ভাবা উচিত ছিল; ভাবতে পারত, কোনও কোনওদিন যেমন তার অত্যধিক পরিশ্রম হয়, কোনও কোনওদিন আবার তেমন তার হাতে প্রচুর সময় থাকে, বিশ্রাম পায়। তা ছাড়া একথা ঠিকই, এটা কোনও শহরগঞ্জ নয়, এখানে চোখ দেখাতে আসব বললেই আসা যায় না। আসা-যাওয়ার এই অসুবিধে তার বিবেচনা করা উচিত ছিল। ইচ্ছে থাকলেও অনেকে যে উপায়হীন হয়ে দেরিতে আসে হেম কী তা বোঝে না? না কী তা বিবেচনা করা তার দায় নয়?

সুরেশ্বর মনে করে না, বিষয়টা বা সমস্যাটা গুরুতর কিছু ছিল। সামান্য ব্যাপার, হয়তো তুচ্ছ ব্যাপার। হেম হাসপাতালের নিয়ম রাখতে চাইছে, রাখুক, কিন্তু তার বাঁধাধরা সময়ের সামান্য এদিক-ওদিক করেই তা করা যেত। সুরেশ্বর ভেবেছিল, হেমকে বলবে: তুমি বরং সকালের দিকটা আরও একটু আগে হাসপাতাল থেকে চলে এসে, স্নান খাওয়া-দাওয়া বিশ্রাম সেরে দুপুরে আবার একবার যেয়ো, বিকেল পর্যন্ত থেকো।

সুরেশ্বরের ধারণা, মোটামুটি এই নিয়মটাতে কারও অসুবিধে হবার কারণ নেই। যেসব রোগীর আসতে বেশ বেলা বয়ে যায়, তারা, আর যারা দুপুরের দিকে আসে তাদের হেম দুপুর-বিকেলে দেখতে পারে। হাটের দিন ছুটকো এক-আধজন অসময়ে এসে পড়লেও হেম তাদের ব্যবস্থা করে নিতে পারবে।

শীতের মধ্যে অন্ধকারে হাঁটতে হাঁটতে সুরেশ্বর নিজের ঘরের কাছে চলে এল।

হেম বড় অবুঝ হয়ে উঠেছে। সে তার কাজ এবং অধিকার নিয়ে আজ যা বলল তাতে সুরেশ্বর ক্ষুণ্ণ হয়েছে। সুরেশ্বর বাস্তবিকই নিজের কোনও অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে যায়নি। হাসপাতালের ব্যাপারে নিজের মতামত চাপানোর কথাও সে ভাবেনি। তবু হেম ধরে নিল, সুরেশ্বর তার অধিকার দেখাতে এসেছে। …আমার আশ্রম, আমার হাসপাতাল, আমার কথা মতন কাজ হবে–ঠিক এই ধরনের মনোভাব কি সুরেশ্বর কোথাও প্রকাশ করেছে? জ্ঞানত করেনি, অজ্ঞানত যদি করে থাকে সে জানে না। হেমকে সুরেশ্বর ডেকে পর্যন্ত পাঠায়নি, নিজে এসেছিল, কোনও কৈফিয়ত চায়নি, রূঢ় কথা বলেনি। তবু হেম তাকে অন্যরকম ভাবল।

কিন্তু…, সুরেশ্বর এখন কোথাও যেন অদ্ভুত এক পীড়ন বোধ করল। অনুভব করল, হৈমন্তীর শেষ কথাটা তার অহঙ্কারে লেগেছে। এর আগে কখনও কেউ সুরেশ্বরকে এভাবে বলেনি, বা বোঝবার অবকাশ দেয়নি যে, সুরেশ্বর এই আশ্রমকে তার ব্যক্তিগত সম্পত্তি মনে করে। হেম ঘুরিয়ে সেকথা বোঝাবার চেষ্টা করেছে। বলতে চেয়েছে, তার অধিকারের সীমা সুরেশ্বর লঙ্ঘন করতে গিয়েছিল।

আশ্চর্য! আজ চার বছর তো সুরেশ্বরের একথা মনে হয়নি, আশ্রমের ওপর সে কর্তৃত্ব করার আনন্দ পেতে চায়। বা এমনও তার মনে হয়নি, এই আশ্রমের সঙ্গে তার অদ্ভুত এক অহঙ্কার জড়িয়ে আছে, এবং নিজের অধিকার সে যত্রতত্র প্রয়োগ করার অবাধ স্বাধীনতা ভোগ করছে। এই আশ্রম আমার, আমি এর মালিক, আমায় তোমাদের মান্য করা উচিত–এ-ধরনের নোংরা, বিশ্রী চিন্তা ও আত্মসন্তুষ্টির ভাব সুরেশ্বরের কোনওদিন কি হয়েছে।

মাথা নাড়ল সুরেশ্বর, না তার মনে এমন কোনও অহং-বোধ নেই। কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে সে কোথায় যেন কাতর হল এবং ভাবল, যদি এই বোধ আমার না থাকে তবে হেমের কথায় বিচলিত হলাম কেন? কেন আমার তখন মনে হয়েছিল, কী স্পর্ধা হেমের, কী স্পর্ধা! যদিও আমি তখন স্তম্ভিত নির্বাক ছিলাম, কিন্তু আমার মনের মধ্যে কে যেন হঠাৎ বিশ্রীভাবে আঁচড় বসিয়ে দিয়েছিল, জ্বালা করছিল; কেমন এক তপ্ত রোষ আমার চোখে ও মুখে এসে পড়েছিল। আমি সংযত থাকার চেষ্টা করেছি, হয়তো পারিনি, হেম আমার চোখ মুখের ভাব দেখতে পেয়েছে।

কেমন এমন হয়, কেন? সুরেশ্বর যেন গ্লানি অনুভব করছিল। মাথা মুখ নিচু করে সিঁড়ি দিয়ে বারান্দায় উঠল।

নিজের সমর্থনে তার যুক্তি নেই এমন নয়। হেমের সমস্ত ব্যবহারের মধ্যে অগ্রাহ্যের ভাব ছিল, নির্দয়তা ছিল; অবিবেচনা ও অন্যায়ের জন্যে হেমের ওপর তার বিরক্ত হওয়া স্বাভাবিক। সুরেশ্বর এই ধরনের রূঢ়তা প্রত্যাশা করেনি। তবু, সুরেশ্বরের মনে হল-সে হেমের কাছে তার কর্তৃত্ব প্রকাশ করে ফেলেছিল। সুরেশ্বর বলেছিল: হাসপাতালের কথা আমায় জানাবে না…? বাকিটা বলেনি, কিন্তু বোঝাই যায় সুরেশ্বর বলতে চেয়েছিল, আশ্রমের কোথায় কী হয়, কী হচ্ছে, কী হবে–সবই তাকে জানানো দরকার; তাকে না জানিয়ে তার মতামত না নিয়ে কিছু হতে পারে না। হেম সুরেশ্বরের এই প্রভুত্ব অথবা কর্তৃত্বের রূপটি ধরতে পেরেছে, পেরেছে বলেই সমান উদ্ধত হয়ে তার অধিকারের কথা তুলেছে।

ঘরে এসে বসল সুরেশ্বর। লণ্ঠনের আলো তেমন উজ্জ্বল নয়। ঘর প্রায় আবছা অন্ধকার হয়ে আছে, কনকন করছে ঠাণ্ডা, ভরতু একটা বই অন্য জানলা বন্ধ করেনি ঘরের, জানলা দিয়ে বাইরের অন্ধকার ছাড়া আর কিছু চোখে পড়ে না।

কেমন যেন অপরাধীর মতন বসে থাকল সুরেশ্বর; তার গ্লানি ও অনুশোচনা হচ্ছিল। এখন বেশ স্পষ্টই সে বুঝতে পারছিল, হেমের কাছে যতই সে বিনীত নম্র সরল হয়ে উপস্থিত হয়ে থাকুক তার মধ্যে কোথাও এই বিশ্রী অহঙ্কার ছিল। আশ্রমের ব্যাপারে তার কর্তৃত্ব ক্ষুণ্ণ করা তার সহ্য হয়নি, ভাল লাগেনি। সে অসন্তুষ্ট ও বিরক্ত হয়েছিল।

অনেকক্ষণ চুপচাপ বসে থেকে, সুরেশ্বর তার বিচলিত ভাব দমন করল। তার মনে হল, হেম যেমন খানিকটা বাড়াবাড়ি করেছে, সেও সেই রকম খানিকটা বাড়াবাড়ি করছে। এতটা কাতর হবার বা গ্লানি বোধ করার কিছু নেই। আশ্রমের ভালমন্দ, রোগীদের সুবিধে অসুবিধে দেখা তার কর্তব্য। হেম যদি অন্যায় করে, যদি তার কাজেকর্মে রোগীদের বা হাসপাতালের ক্ষতি হয় সুরেশ্বরের সে-বিষয়ে কথা বলার অধিকার আছে। যুগলবাবু কি শিবনন্দনজিও একথা বলতে পারতেন। যুগলবাবুও রোগী তাড়ানোর ব্যাপারে সন্তুষ্ট নন। শিবনন্দনজি–যাঁর সঙ্গে হাসপাতালের কোনও সম্পর্ক নেই, তিনিও কথাটা শুনে বলেছিলেন, কাজটা ভাল হয়নি।

মনের ক্ষুব্ধ ও কাতর ভাবটা কমে এলেও সুরেশ্বর কোথাও যেন একটা কাঁটা ফুটে আছে অনুভব করছিল। এই কাঁটা কী, ঠিক বোঝা যাচ্ছিল না। হতে পারে হৈমন্তীর কাছ থেকে অপ্রত্যাশিত আঘাত, হতে পারে নিজের কোনও দুর্বলতা আজ তার কাছে প্রকাশ হয়ে পড়েছে। অন্য কিছুও হতে পারে।

জীবনের যে সমস্ত মোটা তার সুরেশ্বর মোটামুটি একটা সঙ্গতির মধ্যে বেঁধে ফেলেছিল বা সে-চেষ্টা করে আসছিল তার মধ্যে কোনও একটা তার সুরেশ্বরের বাঁধাঘাট ছেড়ে হঠাৎ যেন ছিঁড়ে লাফিয়ে উঠল আজ। সেটা কী? অহঙ্কার?

অহঙ্কার সুরেশ্বরের মধ্যে বরাবরই ছিল, বাল্যকাল থেকেই। সম্ভবত মার চরিত্র থেকে এই অহঙ্কার-বোধ সে পেয়েছিল। বাবা যে ধরনের অহঙ্কারী ছিলেন তা সাধারণ অহঙ্কার, বিত্ত ও বংশমর্যাদার অহঙ্কার; কিন্তু মার অহঙ্কার ছিল অন্য রকম। রূপের জন্যে মার কোনও অহঙ্কার ছিল না, কেননা অসামান্য রূপ সত্ত্বেও মা সেই রূপের মধ্যে বাবাকে বেঁধে রাখতে পারেনি। হয়তো সেজন্যে রূপের ব্যাপারে মা হতাশ হয়ে পড়েছিল। মার অহঙ্কার ছিল অন্য জায়গায়, এবং সেটা অদ্ভুত। মা হঠাৎ এমন কিছু করে বসত যা সচরাচর লোকে করে না। একথা ঠিক, মার স্বভাব খেয়ালি ছিল এবং মা ঠিক প্রকৃতিস্থ থাকত না সব সময়; তবু মা সংসারের মধ্যে এমন কোনও কোনও আশ্চর্য কাণ্ড করে বসত যা কল্পনা করা যায় না। নিজের জীবনেও মা এরকম করেছে। বিনুমাসি যখন খুব একটা খারাপ অসুখে পড়ল মা তাকে নিজের ঘরে এনে তুলল, নিজের বিছানায়। মাসখানেক ধরে বিনুমাসির রোগের সঙ্গে মার যেন দুবেলা লড়াই চলল। বিনুমাসি সেরে উঠলে মা নিজের ভারী ভারী দুটো গহনা তার হাতে তুলে দিয়ে বলল, এবার ধর্মকর্ম করগে যা, পরের বাড়িতে অনেক দিন কাটালি। তুই যা আমি তোকে মাসে মাসে বিশ পঁচিশটা টাকা দেব। কারও বাড়িতে ঝিগিরি করবি না, হারামজাদি; আমার দিব্যি রইল। যা। .বিনুমাসি যাবে না, মা তাকে জোর করে যাওয়াল। লোকে বলেছিল: একটা ঝিয়ের জন্যে এত আদিখ্যেতা দেখানো কেন? …বিনুমাসি যদিও ঠিক ঝি ছিল না, তবু মার নিজের দাসী তো বটেই। বিনুমাসিকে পুরী পাঠিয়ে মা প্রায়ই বলত: বিনু পেপাড়ারমুখী যতদিন বাঁচবে ততদিন আমার কথা ভাববে, বুঝলি। এই রকম অনেক করেছে মা, কাউকে মেয়ের বিয়েতে নিজের গয়না দিয়ে দিয়েছে, কাউকে আশ্রয় দিয়েছে বারবাড়িতে বরাবরের মতন, কাউকে আবার সামান্য কারণে দূর দূর করে তাড়িয়ে দিয়েছে। বলতে কী, নিজের জীবনে মা এই অদ্ভুত অহঙ্কারের জন্যে স্বামীকে পর্যন্ত অন্য রমণীর সঙ্গে বসবাস করতে ছেড়ে দিয়েছে। …এই অহঙ্কারের মধ্যে মার এক আশ্চর্য আত্মতৃপ্তি ছিল। মা ভাবত, এইসব করে মার মর্যাদা বাড়বে, লোকে মার গুণগান গাইবে। এই রকম গুণগান কিন্তু বিনুমাসি ছাড়া আর কেউ গায়নি। বিনুমাসি এখনও বেঁচে আছে, বুড়ো হয়ে গেছে, পুরীতেই থাকে, সুরেশ্বরকে অন্তত বছরে দু-একবার চিঠিও লেখে। বিজয়ার পর বিনুমাসির চিঠি আসে; বাবা সুরেশ, আমার বিজয়াদশমীর আশীর্বাদ নেবে…….বিনুমাসি এখানে আসতে চায়, সুরেশ্বর আনে না। এতকাল যার পুরীতে কাটল, তাকে এখানে এনে কষ্ট দেওয়া।

মার এই অহঙ্কারের মূল্য বাবাও দেননি৷ এমন কী তিনি কোনওদিন অনুভবও করেননি, তাঁর অপ্রকৃতিস্থ স্ত্রী তাঁকে ভোগবাসনা নিবৃত্তির জন্যে যে অফুরন্ত স্বাধীনতা দিয়েছিল তার জন্যে তাঁর কৃতজ্ঞ থাকা উচিত ছিল। বাবা কখনও মার প্রতি কৃতজ্ঞ ছিলেন না। শুধু মা মারা যাবার পর বাবা একদিন মার ঘরে বসে অশ্রু বিসর্জন করেছিলেন।

এই অহঙ্কার-বোধ সুরেশ্বরকেও বাল্যকাল থেকে অধিকার করে বসেছিল। চাপা বেদনার মতন চাপা এই অহঙ্কার তার ছিল। পরে বয়েস হলে সুরেশ্বরের মনে হয়েছে, এই অহঙ্কার তার জীবনেও আত্মতৃপ্তির কারণ, এবং এই বোধই তার অভিমান। বাবার উপপত্নী ও তার সন্তানকে যখন সুরেশ্বর সম্পত্তির অংশ হিসেবে অর্থাদি দেয় তখনও সুরেশ্বর এই অহঙ্কার ও অভিমান বোধ করেছিল। সে যে দিতে পারে, দিতে তার কষ্ট নেই–এই কথাটা যেন সে বোঝাতে চেয়েছিল। যেমন মা বাবাকে অন্য রমণীর হাতে তুলে দিয়ে নিজের অহঙ্কারে আত্মপরিতৃপ্তি লাভ করেছিল, সেই রকম সুরেশ্বর নিজের সঙ্গত দাবির খানিকটা অনায়াসে ছেড়ে দিয়ে অভিমানকে রক্ষা করেছিল ও আত্মতুষ্টি লাভ করেছিল।

হৈমন্তীর অসুস্থতার সময়ও কী সুরেশ্বর যা করেছিল তা অহঙ্কারবশে?

সুরেশ্বর আপাতত যে কোনও কারণেই হোক কথাটা আর ভাবতে চাইছিল না। সম্ভবত বিষয়টা আরও জটিল এবং জটিল বলেই নিঃসংশয়ে কিছু বলা যায় না,ভাবাও উচিত না। অনেক সময় কর্তব্য পালন করে মানুষ আত্মতৃপ্তি পায়, সাহায্য করেও সুখ বা আনন্দ পায়। সেভাবে দেখলে, সেই অদ্ভুত যুক্তি মানতে হয়, মানুষ এক ধরনের সুখান্বেষী যন্ত্র বই কিছু না, তার প্রত্যেকটি কাজই যান্ত্রিক। ঘড়ির কাঁটার মতন সে শুধু ঘুরতে পারে, দম যতক্ষণ আছে, যতক্ষণ কলকবজা না বিগড়োচ্ছ। আর এই কলকবজাও বাঁধা ধরা, মাপামাপি করে বসানো। এই ধরনের যুক্তিতে সুরেশ্বরের কোনও আস্থা কোনও কালেই নেই। শীতার্ত, গরিব, নিরাশ্রয় ভিক্ষুককে আশ্রয় দিলে, বা তাকে একটা টাকা সাহায্য করলে আত্মতৃপ্তি ঘটে, আর আত্মতৃপ্তি ঘটে বলেই আমার দয়া-বোধ জাগে এমন নির্মম যুক্তি স্বীকার করা যায় না। সেভাবে বিচার করলে মানুষের কিছু থাকে না, সবই একটা আত্মতৃপ্তির হেতু হয়ে দাঁড়ায়; দয়া, ধর্ম, প্রেম, করুণা, মমতাকী বা নয়। ..হেমকে বা হেমদের পরিবারকে সাহায্য করার পিছনে সুরেশ্বরের কিছু গোপন ক্রয়বিক্রয় ছিল–এমন তার মনে হয় না। তার মনে হয়েছিল সাহায্য করাটা তার কর্তব্য; তার মনে হয়েছিল, হেমকে সে ভালবাসে, তার মনে হয়েছিল তার কাছে হেমের জীবনের মূল্য আছে। এবং একথাও ঠিক, সাহায্য করে, ভালবেসে, হেমের জীবনের জন্যে মূল্য আরোপ করে সে সুখ পেয়েছিল। যদি কেউ মনে করে, সুরেশ্বরের এ-সবই অহঙ্কারবোধ থেকে এসেছে তবে হৈমন্তীর আজকের কথাটা সুরেশ্বর এখন আর খুঁটিয়ে না ভেবে হৈমন্তীর আজকের ব্যবহার থেকে যা বোঝা গেছে তার কথা ভাবতে লাগল।

হেম তার প্রতি সন্তুষ্ট নয়, আশ্রমের প্রতিও না। এই অসন্তোষ এবং বিরক্তিবশে সে বিরূপ হয়ে উঠেছে। সে ক্ষুব্ধ, অপ্রসন্ন। আজকাল সুরেশ্বরের সঙ্গে তার সম্পর্ক কেমন একটা রেষারেষির মধ্যে গিয়ে দাঁড়াচ্ছে যেন। অন্তত আজকের আচরণ থেকে মনে হয়, হেম যা করেছে তা সুরেশ্বরকে অবজ্ঞা করার জন্যে, তাকে আহত করার জন্যে। এই রেষারেষির কোনও দরকার ছিল না। কিন্তু হেম ক্রমশই কেমন তিতিবিরক্ত হয়ে উঠছে, এবং ইচ্ছাকৃত ভাবে সে সুরেশ্বর ও এই আশ্রমকে এড়িয়ে থেকে তার অবজ্ঞা বোঝাতে চাইছে।

হেম কেন অকারণে এই অশান্তি সৃষ্টি করছে সুরেশ্বর বুঝতে পারল না। ভাল না লাগলে সে চলে যেতে পারে, জোর করে তাকে কেউ ধরে রাখবে না।

.

১৭.

বারান্দায় দাঁড়িয়ে মালিনীকে ডাকল হৈমন্তী।

শীতের গাঢ় দুপুরের নিবিড়তা এবার যেন কেটে যাবার সময় এসেছে, রোদ নিষ্প্রভ ও হলুদ হয়ে এল। মালিনীর ঘরের দিকে পশ্চিম হেলে বারান্দায় রোদ পড়ে আছে একটু।

মালিনীর সাড়াশব্দ নেই। হৈমন্তী আবার ডাকল।

উত্তরের বাতাসে আজ বেশ ধার। আজকাল দুপুর ফুরোবার আগে থেকেই উত্তর থেকে বাতাস আসতে শুরু করে। ঝাঁপটা দিয়ে বাতাস আসছে। ঝাঁক বেঁধে ফড়িং আর প্রজাপতি নেমেছে মাঠে; মাঠের রোদে, ঘাসের ডগায়, ফুলগাছের ঝোপেঝাড়ে ফড়িং, আর প্রজাপতি উড়ছিল। টিয়া ডাকছিল।

বার দুই ডাকার পর মালিনী বাইরে এল। শীতের দুপুরে ঘুমোচ্ছিল, চোখ ফুলে গেছে: ঘুম থেকে উঠে আসায় হাই তুলছিল বড় বড়।

হৈমন্তী বলল, স্টেশনে যাবে?

 মালিনী প্রথমটায় যেন বুঝল না, পরে বুঝল। আপনি যাচ্ছেন?

যাবে তো তাড়াতাড়ি নাও। তিনটে প্রায় বাজে।

স্টেশনে যাবার কথা বললে মালিনী সব সময় পা তুলে থাকে। তবে যাবার আগে সুরেশ্বরকে জিজ্ঞেস করা তার অভ্যেস। অন্যদিন হেমদি আগেভাগেই বলে রাখে, মালিনীও অনুমতি নিয়ে রাখে সুরেশ্বরের, হাতের কাজকর্মও সেরে রাখে। আজ একেবারে হুট করে বলা, হাতেও সময় নেই, দাদা হয়তো এখন বিশ্রাম করছেন, কাজকর্মও কিছু সেরে রাখেনি সে। মালিনী দোনামোনা করল, সে যেতে চায় কিন্তু হ্যাঁ বলতে পারছে না।

মালিনীর মুখের দিকে তাকিয়ে হৈমন্তী বলল, কী ভাবছ?

না, ভাবিনি মালিনী মাথা নাড়ল। দাদাকে যে কিছু বলিনি, হেমদি। কাজ সারাও হয়নি।

ও! তবে থাক; তোমায় যেতে হবে না। হৈমন্তী আর অপেক্ষা করল না; তার হাতে তোয়ালে, কলঘরের দিকে চলে গেল।

মালিনী বেশ দ্বিধায় পড়ল। হেমদি একা একা যাবে, সেটা কি ভাল দেখাবে? দাদা হয়তো রাগ করবেন। হেমদি যে একলা কখনও স্টেশনে যায়নি তা নয়, সেবার গিয়েছিল। দাদা একটু অখুশি হয়েছিলেন। একগাদা বই, কিছু জিনিসপত্র নিয়ে হেমদি ফিরে এলে দাদার নজরে পড়েছিল। অত জিনিসপত্র হেমদি একলা বয়ে আনায় দাদা আড়ালে মালিনীকে বলেছিলেন, তুমি সঙ্গে গেলে পারতে।

সে তো পারতই মালিনী। কিন্তু সেদিন অনেকগুলো কাজ ছিল হাতে, হেমদিও হঠাৎ যাওয়া স্থির করে ফেলেছিল। আজও সেই রকম। দুপুরে শুয়ে শুয়ে হয়তো হঠাৎ মাথায় পোকা ঢুকেছে, স্টেশনে যাব, অমনি সঙ্গে সঙ্গে তৈরি। কিংবা পড়ার বই ফুরিয়ে গেছে, জিনিসপত্রও কিছু কেনাকাটা করতে হবে, স্টেশন যাচ্ছে। …তা যাক এখন কী করা যায়? চলে যাবে মালিনী? ছুটে এক দৌড়ে গিয়ে দাদাকে বলে আসবে? হাতের কাজগুলো আর কাউকে সেরে দিতে বলবে?

অত তাড়াতাড়ি সব হয় না। হাতের কাজ অবশ্য এমন কিছু নয় যার দু-একটা চটপট সেরে, বাকিটা পারবতিয়ার হাতে দিয়ে সে চলে যেতে না পারে। কিন্তু দাদা? দাদাকে না বলে সে যায় কী করে?

হৈমন্তী কলঘর থেকে ফিরল, চোখমুখ ভিজে, কপাল আর কানের কাছের এলোমেলো চুলগুলিতে জলবিন্দু, গলার তলায় সাবানের একটু ফেনা।

হৈমন্তী কাছে এলে মালিনী বলল, হেমদি, আপনি তৈরি হতে থাকুন, আমি একছুটে দাদাকে একবার বলে আসি।

হৈমন্তী যেতে যেতেই জবাব দিল, থাক।

 মালিনীর পাশ দিয়ে চলে গেল হৈমন্তী। মালিনী এবার বলল, চা খেয়ে যাবেন না?

সময় নেই—

 জল বসিয়ে দিচ্ছি, আপনার কাপড় বদলাতে বদলাতে হয়ে যাবে।

 হৈমন্তী কোনও জবাব দিল না, ঘরে ঢুকে গেল।

এ এক জ্বালা হল মালিনীর। হেমদি হয়তো রাগ করল। সত্যি, রাগ করার কথাই। হেমদি কী তার মতন, যে এখন লাঠা পর্যন্ত একা একা টংটং করে হাঁটবে, হাতে হয়তো একগাদা বই থাকবে, তারপর লাঠার মোড়ে গিয়ে হাঁ করে বাসের জন্যে দাঁড়িয়ে থাকা, দেহাতিগুলো আবার হেমদিকে চিনে গেছে, উঁকিঝুঁকি দেবে, খাতির দেখাবে, পানের দোকান থেকে ভাঙা টিনের চেয়ার এনে রাস্তার সামনে পেতে দেবে বসতে।

মালিনী ঘরে এসে তাড়াতাড়ি চায়ের জল বসিয়ে দিল স্টোভে। দিয়ে চোখমুখ ধুয়ে আসতে গেল।

.

হৈমন্তী প্রায় তৈরি হয়ে নিয়েছে। মালিনী চা নিয়ে এল।

অবনীর কাছ থেকে আনা খান ছয়েক বই চামড়ার কালো বড় ব্যাগটায় পুরে নিচ্ছে হৈমন্তী। মালিনী দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখল দুমুহূর্ত, তারপর বলল, আপনি চা টুকু খান হেমদি, আমি তৈরি হয়ে নিচ্ছি।

হৈমন্তী পিছন ফিরে মালিনীর দিকে তাকাল না, জবাবও দিল না।

মালিনী কী করবে বুঝতে পারল না; তার মনে হল হেমদি রাগ করেছে। ইতস্তত করে মালিনী আবার বলল, আপনার হতে হতে আমারও হয়ে যাবে। আপনি বরং ব্যাগটা আমায় দিয়ে এগুতে থাকুন আমি রাস্তায় আপনাকে ধরে নেব।

থাক, তোমায় যেতে হবে না, হৈমন্তী এবার জবাব দিল।

মালিনী চুপচাপ। তারপর আস্তে করে বলল, আপনি একলা যাবেন?

কেন, কী হয়েছে? হৈমন্তী দেওয়ালে টাঙানো আয়নার কাছে গিয়ে মুখ দেখে মাথার চুল সামান্য ঠিক করে নিল।

ফিরতে তো রাত হয়ে যাবে। ভয়ে ভয়ে মালিনী বলল।

 সে ভাবনা আমার।

মালিনী বুঝতে পারল না সে এমন কী করেছে যার জন্যে হেমদি তার ওপর এত রেগে গেল। হেমদির আজ কদিন কেমন অদ্ভুত রাগ-রাগ ভাব হয়েছে।

হৈমন্তী তাড়াতাড়ি চা খেতে লাগল। চা খেতে খেতেই গরম কোটটা টেনে নিয়ে বিছানায় রাখল।

এবার সরলভাবে মালিনী বলল, হেমদি, আপনি একলা একলা স্টেশনে গেলে দাদা রাগ করবেন।

হৈমন্তী যেন থমকে গিয়ে মালিনীর মুখের দিকে তাকাল, চোখ লক্ষ করল। মুখের গাম্ভীর্য আরও ঘন হয়ে এল; চোখের মণি উজ্জ্বল হল।

মালিনী কিছু বুঝতে পারল না, তাকিয়ে থাকল সরলভাবেই।

হৈমন্তী বিরক্তভাবে বলল, তোমার দাদা কি আমার সঙ্গে সঙ্গে তোমায় ঘুরতে বলেছে?

কথাটার জটিল অর্থ মালিনী ধরতে পারল না, সেবার আপনি একলা গিয়েছিলেন, দাদা আমায় বললেন–আমি কেন সঙ্গে যাইনি।

সুরেশ্বর কি হৈমন্তীর আসা-যাওয়ার খবরদারি করতে চায়? হৈমন্তীর মুখ লাল হয়ে উঠল রাগে, চোখমুখে হলকা লাগল আঁচের। মালিনীর সামনে নিজেকে যথাসাধ্য সংযত করে হৈমন্তী বলল, তুমি যাও, কর্তামি কোরো না।

মালিনী কেমন বিমূঢ় হয়ে দাঁড়িয়ে থাকল কয়েক মুহূর্ত, তারপর অপরাধীর মতন মুখ নিচু করে চলে গেল।

অল্প একটু সময় হৈমন্তী কেমন নিস্পন্দ হয়ে দাঁড়িয়ে থাকল, কিছু ভাবতে পারল না। চা আর খেল না। জানলা বন্ধ করে দিল, দরজার তালা খুঁজে নিল। গরম জামাটা হাতে ঝুলিয়ে নিয়ে, ব্যাগ হাতে বাইরে এল। তালা দিল দরজায়। মালিনীই সাধারণত তার ঘরদোর বন্ধ করে, দরজায় তালা দেয়, চাবি রাখে। আজ হৈমন্তী নিজের হাতেই সব করল, মালিনী খানিকটা তফাতে তার ঘরের কাছে বারান্দায় দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখল। তালার চাবিটা পর্যন্ত দিল না হৈমন্তী। সব দেখেশুনেও যেন হৈমন্তী কিছু দেখেনি, মালিনীকে উপেক্ষা করে সে মাঠে নেমে গেল, মাঠ দিয়ে অন্ধ আশ্রমের ফটকের দিকে চলে গেল, তারপর ওপারে জামতলার রাস্তায়।

.

গত কয়েকটা দিনই হৈমন্তীর খুব স্বস্তির মধ্যে কাটছে না। মনের মধ্যে যেন কিছু জমে আছে, রাগ ক্ষোভ বিরক্তি মালিন্য নাকি দুঃখ বা অনুশোচনা তা বোঝা যেত না। নিজের যথার্থ মনোভাব নিজে বেশির ভাগ সময়েই বোঝা যায় না। কখনও হৈমন্তীর মনে হত সে ক্ষুব্ধ ও আহত হয়ে আছে, কখনও মনে হয়তো সুরেশ্বরের সঙ্গে তার বোঝাপড়ার একটা দরকার ছিল, এবং এই চাপা কলহ বা রেষারেষি যেন তার শুরু। মাঝে মাঝে আবার এমনও মনে হত, সেদিন ঝোঁকের মাথায় হৈমন্তী বেশি রূঢ় হয়ে পড়েছিল। অতটা রূঢ় হওয়া তার উচিত হয়নি হয়তো। অথচ নিজের দিক থেকে হৈমন্তী তেমন একটা দোষও খুঁজে পেত না। সেদিন তার মাথা গরম হয়ে গিয়েছিল; মানুষ মাত্রেরই মাথা গরম হয়, এতে লজ্জায় মরে যাবার কী আছে! সবাই তো আর সুরেশ্বর নয়, গাছপাথরের মতন সহিষ্ণু হবে, শান্ত হবে। কিন্তু, সুরেশ্বর ওপর ওপর যতটা ধীরস্থির শান্ত ভাব দেখায় ভেতরে ততটা নয়। সুরেশ্বরের দৃষ্টিতে বিরক্তি এবং রাগ হৈমন্তী সেদিন লক্ষ করেছে। তার কথায় সুরেশ্বর অসন্তুষ্ট হয়েছিল, অপমান বোধ করেছে। হৈমন্তীর সন্দেহ নেই, সুরেশ্বর এই আশ্রমের সকলের কাছে আনুগত্য চায়, সম্মান চায়, না পেলে আত্মমর্যাদায় আঘাত পায়।

এই মর্যাদা হৈমন্তীরও না থাকার কারণ নেই। সুরেশ্বর নিজের মর্যাদার বিষয়ে যদি এত সচেতন হতে পারে, তবে অন্যের মর্যাদা সম্পর্কেও বা কেন হবে না? হৈমন্তীর যথার্থ মর্যাদা কী সে দিতে চায়!

গুরুডিয়ার কাঁচা রাস্তা ধরে লাঠার পথে হাঁটতে হাঁটতে হৈমন্তী এলোমলো ভাবে কথাগুলো ভাবছিল। শীতের এই মরা দুপুরে পথ হাঁটতে তার খারাপ লাগছিল না। আগে একলা একলা এভাবে ফাঁকায় হাঁটতে তার ভাল লাগত না, বা এতটা পথ হাঁটার অভ্যেস তার ছিল না। আজকাল হৈমন্তীর মোটামুটি অভ্যেস হয়ে গেছে। সে হাঁটতে পারে, ভালও লাগে।

সুরেশ্বর তার একা একা স্টেশনে যাওয়া পছন্দ করে না নাকি? কেন? মালিনী তার সঙ্গে সঙ্গে থাকবে এটাই কি সুরেশ্বরের ইচ্ছে? নাকি আদেশ? তাই বা হয় কেমন করে, যদি হত, মালিনী তার সঙ্গে আজ যেতে পারত। দাদার বড় অনুগত মালিনী, অনুমতি না নিয়ে আশ্রমের বাইরে পা বাড়াতে সাহস করে না। মালিনী অনুমতি নেয়নি বলে যেতে সাহস করল না। শেষ পর্যন্ত যে যেতে চেয়েছিল সেটা বোধ হয় ওই ভয়ে-যদি সুরেশ্বর রাগ করে!

চিন্তাটা কেমন জটিল হয়ে সুতোর জট পাকানোর মতন জড়িয়ে যেতে লাগল। কোনও কোনও সময় ভাবনার ঝোঁক নোংরা হয়ে ওঠার উপক্রম হচ্ছিল। সুতোর জট হাতে করে খুলতে গিয়ে খুলতে না পারলে বার বার চেষ্টায় যেমন আঙুলের ময়লা লেগে কোনও কোনও জায়গা কালচে হয়ে আসে সেই রকম নানাভাবে চিন্তাটাকে ছাড়াতে গিয়ে কোথাও কোথাও মনের ময়লা লাগছিল। হৈমন্তীকে সর্বক্ষণ ছায়ার মতন অনুসরণ করতে বলার মতন মন সুরেশ্বরের নয়। স্টেশনে সে মাঝে মাঝেই যাচ্ছে বলে সুরেশ্বর মালিনীকে হৈমন্তীর ওপর চোখ রাখতে বলবে–এ রকম কুৎসিত নোংরা সুরেশ্বর কখনও ছিল না, কখনও হবে না। তার ঈর্ষার বা সন্দেহের…

ঈর্ষা বা সন্দেহে কথাটা যেন মাথার মধ্যে ঝিলিকের মতন এল। অনেক সময় যেমন চোখ ফেরাতে গিয়ে বা অন্য কোনও দিকে তাকাতে গিয়ে সহসা রোদের কোনও ঝিলিক বা প্রতিফলিত আলোর তীর এসে চোখের মণিতে লেগে চোখটা কেমন হয়ে যায়, সেই রকম মনে এবং চিন্তার মধ্যে ঈর্ষা ও সন্দেহ কথাটা তীরের মতন এসে লাগল। হৈমন্তী কেমন অ-জ্ঞানে পথের মধ্যে দাঁড়িয়ে পড়ল, বেহুশ, কিছু দেখতে পেল না, কিছু ভাবতে পারল না, নিশ্বাস নিতেও যেন ভুলে গেল। তারপর হঠাৎ বুকে কষ্ট অনুভব করতেই চোখ তুলে পথ এবং গাছপালা দেখল, নিশ্বাস নিল। একটা গোরুর গাড়ি আসছে, অনেকটা দূরে লাঠা, শনশন বাতাস বইছে, শালের চারা-ঝোঁপের ওপর দিয়ে বুনো মুরগি ফরফর করে উড়ে গেল।

ঈর্ষা, সন্দেহ…! কার ওপর ঈর্ষা, কী বিষয়ে সন্দেহ?

মনে মনে অবনীর মুখ দেখতে পেল হৈমন্তী। ইদানীং অবনীর সঙ্গে তার মেলামেশা বেশ সহজ স্বাভাবিক হয়ে এসেছে। দেখাসাক্ষাৎ ঘটছে। হৈমন্তী স্টেশনে যায়, অবনীও আসে; তবে একেবারে হালে কাজেকর্মে অবনী তেমন আসতে পারছে না। হৈমন্তী আজও অবনীর কাছে যাচ্ছে। শুধু অবনীর কাছে নয়, তার কিছু কেনাকাটা করার আছে; রেডিয়োর ব্যাটারি, একটা ক্রিম, মাথার তেল, ওভালটিন– এই সব।

হৈমন্তী হাঁটতে লাগল। এখন তার কেমন অদ্ভুত লাগছিল। সুরেশ্বরের মধ্যে ঈর্ষা বা সন্দেহ বলে কিছু থাকতে পারে এ কথা ভাবা যায় না। কী কারণেই বা ঈর্ষা হবে? অবনীর সঙ্গে হৈমন্তীর মেলামেশায় তার কিছু আসে যায় না, যায় কি! সুরেশ্বর ন্যায়ত ও সঙ্গতভাবেই অবনীর ওপর ঈর্ষা বোধ করতে পারে না, হৈমন্তীর ওপর সন্দেহও তার থাকা উচিত নয়। বলতে কী, আজ হৈমন্তী ও সুরেশ্বরের মধ্যে যে সম্পর্ক তাতে হৈমন্তী অন্য কারও সঙ্গে কীভাবে মেলামেশা করছে, কী ধরনের ঘনিষ্ঠতা হচ্ছে ওদের, তাতে কী এল গেল তার! যদি ভালবাসার কথাও হয় হৈমন্তী অন্য কাউকে ভালবাসল কী বাসল না তা নিয়ে সুরেশ্বরের গায়ে জ্বালা ধরার কিছু নেই।

চিন্তাটা এবার যেন কৌতুকের মতন হয়ে উঠেছে। হৈমন্তী নিজের এই হাস্যকর চিন্তায় লঘু হয়ে হেসে ফেলতে গেল। অথচ হাসতে গিয়েও হাসতে পারল না, কোথাও যেন একটা বাধা এল। কীসের বাধা?

এমন তো হতে পারে–হৈমন্তী ভাবল: সুরেশ্বর অভিভাবক হিসেবে দায়িত্ব পালন করছে। এখানে হৈমন্তীর কোনও আত্মীয়স্বজন নেই, সে একা; সুরেশ্বরই তাকে এই জঙ্গলের দেশে আনিয়েছে, কাজেই হৈমন্তীর প্রতি তার দায়দায়িত্ব ও কর্তব্যবোধ আছে। সুরেশ্বর সেই দায়দায়িত্ব বোধের জন্য তার অভিভাবক, এবং সেই হিসেবে হৈমন্তীর প্রতি লক্ষ রাখে।

কিন্তু, হৈমন্তী ভেবে পেল না, এটা কী ধরনের অভিভাবকত্ব যে তার ব্যক্তিগত বিষয়ের ওপর সুরেশ্বর নজর রাখবে? হৈমন্তী ছেলেমানুষ নয়, বা সে সুরেশ্বরের আশ্রয়াধীন নয় যে, সুরেশ্বর তার হাঁটাচলা বেড়ানো অথবা কারও সঙ্গে মেলামেশার ওপর চোখ রাখবে।

মনে মনে যে কৌতুকের ভাব এসেছিল সামান্য আগে সে ভাব আর থাকল না হৈমন্তীর। বরং সে বিরূপ হয়ে উঠল আবার। মানুষটা নোংরা হতে পারে না, তার মনে নিশ্চয় সন্দেহ বা ঈর্ষা থাকতে পারে না; থাকলে হয়তো ভালই হত। আসলে হৈমন্তীর ওপর সুরেশ্বর এক ধরনের কর্তৃত্ব ও প্রভুত্ব দেখাতে চায়। বোঝাতে চায়, সে হৈমন্তীর অভিভাবক, তার ভালমন্দের মালিক। …চিন্তাটা বিশ্রী লাগল, এবং হৈমন্তী হঠাৎ সুরেশ্বরের ওপর তীব্র ঘৃণা অনুভব করল। তার ব্যক্তিগত স্বাধীনতা, ইচ্ছা, রুচি, মনের ওপর অন্ধ আশ্রমের মালিকের মালিকানা স্বত্ব থাকবে নাকি? আমায় কী তুমি তোমার আশ্রমের ঘরবাড়ি, তাঁত, ঝি চাকর পেয়েছ? নাকি তুমি ভেবেছ আমি বোকার মতন তোমায় বিশ্বাস করে এসেছিলাম বরাবর, ভালবেসেছিলাম তার জোরে তুমি আমার জীবন-মরণের প্রভু হয়ে গেছ?

মাঠের ওপর দিয়ে কিছু ধুলো উড়ে এল, কিছু শুকনো পাতা। সামনে লাটুঠার মোড়। হৈমন্তী হঠাৎ কেমন জোরে জোরে হাঁটতে লাগল, কপালের দুপাশ বেশ গরম। সূর্য একেবারে মুখোমুখি। মাথায় রোদ লাগছিল বলে হৈমন্তী এই ফাঁকায় মাথায় কাপড় টেনে হাঁটছিল, এবার কাপড়টা ফেলে দিল মাথা থেকে।

দূরে বাস আসছে। সময় মতন পৌঁছে গেছে হৈমন্তী। হঠাৎ হৈমন্তীর অদ্ভুত একটা কথা মনে এল। যদি আজ সে অবনীর বাড়ি থেকে না ফেরে কী করবে সুরেশ্বর? কী সে করতে পারে…?

.

১৮.

অবনী বলল, আসুন; আমার মনে হচ্ছিল আজ আপনি আসবেন।

অবনীর সহাস্য মুখ সরল দৃষ্টি লক্ষ করতে করতে হৈমন্তী সিঁড়ির শেষ ধাপ উঠে বারান্দায় পা দিল। কী করে মনে হল আমি আসব?

ইনট্যুশান! অবনী হেঁসে হেসেই বলল।

বারান্দায় বসা যেত, কিন্তু বেশিক্ষণ বসে থাকা যেত না। এখন বিকেল শেষ হয়ে এসেছে, এখুনি দেখতে দেখতে অন্ধকার হয়ে যাবে, শীত আর বাতাস গায়ে ফুটবে। হৈমন্তী বারান্দায় দাঁড়াল। বলল, আমি বাজারে নেমেছিলাম, ব্যাটারি-ট্যাটারি কেনার ছিল। বলে হৈমন্তী মুহূর্তের জন্যে থামল, অবনীর চোখ দেখল, তারপর হেসে বলল, সেখানে আপনার মহিন্দরকে দেখলুম, সাইকেল চেপে আসছে।

অবনী সঙ্গে সঙ্গেই মাথা নাড়ল। আরে, না না, মহিন্দর আমায় কিছু বলেনি, আমি জানিই না সে বাজার গিয়েছিল।

হৈমন্তী এবার চোখের একটু ভঙ্গি করল। তাহলে তো আপনার ইনচ্যুশানে বিশ্বাস করতেই হয়।

হাসির মুখ করল দুজনেই।

অবনী বলল, আজ আমি একবার ওদিকে যাব ভেবেছিলাম। তারপর কেমন মনে হল আপনি আসতে পারেন।

ভেবেছিলেন যখন তখন যাবেন– হৈমন্তী সুমিষ্ট করে হাসল। আমার বই ফুরিয়ে গেছে– হৈমন্তী এমনভাবে বলল যাতে মনে হয় এই ফুরিয়ে গেলে তার না এসে উপায় কী। অবশ্য এই বলাটা তেমন কৈফিয়তের মতন শোনাল না।

অবনী বলল, এত তাড়াতাড়ি পড়ে ফেলেন কেন?

 কেন?

এ-ভাবে পড়লে আমি আর বেশিদিন বই জোগাতে পারব না।

সে পরের কথা–।

আপনি আর-একটু রয়ে-সয়ে পড়বেন, অবনী হেসে বলল, কিন্তু এমনভাবে বলল, যাতে বোঝা যায় তার কথার মধ্যে একটা সকৌতুক ইঙ্গিত আছে। অর্থাৎ অবনী যেন পরিহাস করে বোঝাতে চাইল, অত তাড়াতাড়ি সব বই শেষ হয়ে গেলে হৈমন্তী আর কী এবাড়ি আসবে।

হৈমন্তী কথাটায় কান দিল কি দিল না বোঝা গেল না।

বসার ঘরে এসে বসল হৈমন্তী। বাতিটা জ্বালিয়ে দেবে কি দেবে না ভাবতে ভাবতে অবনী জানলার কাছে গিয়ে দাঁড়াল। সুরেশ্বরবাবুর খবর কী?

হৈমন্তী প্রথমে কোনও জবাব দিল না, পরে উদাসীন গলায় বলল, ভাল।

অবনী হৈমন্তীর দিকে তাকিয়েছিল। বলার ভঙ্গিটা তার কানে গেল। বাইরে তাকাল; শীতের অপরাহু গত, কোথাও রোদ নেই, আলোর সামান্য আভাস এখনও আছে, গাছপাতা প্রায় কালচে হয়ে এল, ছায়া গাঢ় হয়ে ময়লা রং ধরে যাচ্ছে। এই সময়টা অবনীর চোখে সব সময়ই বিষঃ লাগে, বিশেষ করে যখন একা একা থাকে একা একা দেখে। হৈমন্তীর কথা থেকে অবনীর মনে হল, জবাবটা খুব নিস্পৃহ; আগে এভাবে জবাব বড় দিত না হৈমন্তী, এখন দেয়; এখন সে আশ্রম সম্পর্কে বিরক্তি বা উদাসীনতা অবনীর কাছে জানাতেও দ্বিধা বোধ করে না। কিন্তু সুরেশ্বর সম্পর্কে বেশির ভাগ সময়ই হৈমন্তী নীরব থাকে, যা যা বলে তার মধ্যে উৎসাহ বা অনুৎসাহ কিছু থাকে না। এই মুহূর্তের ভাল বলাটা ঠিক নৈর্ব্যক্তিক নয়; কোথায় যেন একটা বিরক্তি ছিল বলার স্বরে ও ভঙ্গিতে।

অবনী বলল, বিজলীবাবু পরশুদিন গিয়েছিলেন না! কথাটা আগের কথার সঙ্গে সম্পর্কহীন। ইচ্ছে করেই অবনী অন্য প্রসঙ্গে কথা শুরু করল।

হ্যাঁ, ওঁর স্ত্রীকে দেখাতে।

চোখে কী হয়েছে বলছিলেন–

একটু গণ্ডগোল আছে, সেরে যাবেন। হৈমন্তী হাতের ব্যাগ খুলে অবনীর বইগুলো বের করে রাখল। তারপর হঠাৎ বলল, বিজলীবাবুর স্ত্রীর সঙ্গে আমার সামান্য আলাপ, বার দুই দেখলাম। বেশ ভাল লাগল।

ব্যাপার কী? অবনী ইচ্ছাকৃত বিস্ময় জানাল, পরিহাস করেই।

কীসের ব্যাপার, কেন?

একে অন্যের এত প্রশংসা করছেন?

উনি বুঝি আমার প্রশংসা করেছেন?

বিজলীবাবু তো তাই বললেন। ভীষণ প্রশংসা…

ও! পরের মুখে ঝাল খেয়ে বলছেন– হৈমন্তী এবার হাসল। তার হাসি থেকে বোঝা গেল সে আগের মানসিক বিরক্তিটুকু ভুলে গেছে।

নিজের মুখে ঝাল খেতে হলে চোখের একটা উপসর্গ দরকার হাসতে হাসতে বলল অবনী। কাছাকাছি একটা জায়গায় এসে বসল। বসার আগে ঘরের বাতি জ্বালিয়ে দিয়ে এল।

হৈমন্তী আচমকা বলল, বিজলীবাবুর স্ত্রীকে দেখলে আমার এক বন্ধুর কথা মনে পড়ে; অবিকল একই ছাঁচের মুখ। হাসি-টাসিগুলোও যেন এক রকম। আমার সেই বন্ধু এখন দিল্লিতে থাকে।

ডাক্তার? অবনী ভয়-ভয় গলা করে বলল।

হ্যাঁ, তবে এমনি ডাক্তারি করে না; সরকারি হেলথ ডিপার্টমেন্টে কীসের একটা চাকরি নিয়েছে। তার স্বামীও ডাক্তার।

অবনী হৈমন্তীর চোখে চোখে চাইল। হয়তো অবনী বোঝবার চেষ্টা করল হৈমন্তীর মনে কোনও রকম নৈরাশ্য আছে কি না। কিছু বোঝা গেল না। অবনী অন্য কোনও কথা খুঁজে না পেয়ে যেন বিজলীবাবুর স্ত্রীর প্রসঙ্গ আরও একটু বিস্তৃত করল, বিজলীবাবুর দ্বিতীয় স্ত্রী তাঁর প্রথম স্ত্রীর সহোদর বোন।

শুনেছি। ..বড়কেও দেখেছি, সেই যে বিজয়ার পর গিয়েছিলাম। খুব ভারিক্কী, গিন্নি গিন্নি…

ধর্মকর্ম জপতপ নিয়েই থাকেন। সুরেশ-মহারাজের খুব ভক্ত। অবনী শেষ কথাটা যেন কেমন ভেতরের কোনও লোভের বশে বলে ফেলল।

হৈমন্তী কথাটা শুনল কিছু বলল না।

অবনী বসে থেকে থেকে একটা সিগারেট ধরাবার জন্যে হাত দিয়ে প্যাকেট বা দেশলাই পেল না। শোবার ঘরে পড়ে আছে। উঠে দাঁড়াল, সিগারেট আনতে হবে, চায়ের কথা বলতে হবে মহিন্দরকে; জানলার বাইরে যেন হু হু করে একরাশ অন্ধকার এসে গেছে, বাগানের গাছে পাখিরা ঝাঁক বেঁধে ফিরে কলরব শুরু করেছে।

একটু বসুন, আসছি। অবনী চলে গেল।

হৈমন্তী বসে থাকল। অবনীর এই বসার ঘরে আজকাল তাকে মাঝে মাঝে এসে বসতে হয়, ঘরটা তাই পরিচিত ও অভ্যস্ত হয়ে এসেছে। সাদামাটা বেতের সোফাসেট, তুলোর গদি পাতা, কাঠের ছোট সেন্টার টেবল, একপাশে একটা বুক র‍্যাক, ছোট মতন এক কাঠের সেলফ, তার তলায় কয়েকটা তামা পেতলের মূর্তি-টুর্তি, ওপরে এক ফুলদানি, টেবল ল্যাম্প; দেওয়ালে একটি ক্যালেন্ডার, অবনীর যুবক বয়সের একটা ছবি। এই সজ্জার মধ্যে বাহুল্য নেই, একেবারে শূন্যতাও নয়, যেন কাজ চালিয়ে দেবার মতন করে সাজানো ঘর। ঘরটি বেশ পরিচ্ছন্ন, কোথাও বিশৃঙ্খল হয়ে কিছু নেই। একলা মানুষ, ঘরদোর এলোমেলো হবার কারণ নেই। চাকরবাকররা যেটুকু করে তাই যেন যথেষ্ট।

হৈমন্তী অবনীর বসার ঘর ছাড়া ভেতরের অন্য দুটি ঘরও একদিন দেখেছে। অবনী বাড়ি দেখাবার সময় একদিন দেখিয়েছিল। কোনও ঘরেই সে বাহুল্য বিশেষ শৌখিনতা দেখেনি। শৌখিনতা যেন অবনীর নেই তার সবই সাদামাটা, যেটুকু প্রয়োজন তার অতিরিক্ত বড় কিছু রাখে না। এই ধরনের মানুষ যা হয়–অফিস নিয়ে পড়ে আছে, কাজকর্ম শেষ হলে যেটুকু সময় সেটুকু শুয়ে বসে বিশ্রাম নিয়ে কাটানো, আলস্যে বসে বসে গোয়েন্দা কাহিনী পড়া, ইলাস্ট্রেটেড উইকলি দেখা, কী বড়জোর রেডিয়ো খুলে দিয়ে পায়চারি করা।

অবনী ফিরে এল। জামাকাপড় বদলে এসেছে, পরনে গরম ট্রাউজারস, গায়ে পুরো হাতা সোয়েটার, মুখচোখ পরিষ্কার, মাথার চুল আঁচড়ানো। হাতে কিছু বই। হৈমন্তীর কাছে হাতের বইগুলো নামিয়ে দিয়ে বলল, দেখে বেছে নিন, এর দু-একটা আগেও আপনাকে দিয়ে থাকতে পারি।

বাইরে এতক্ষণ সন্ধে হয়ে গেছে, ঘরের আলো এবার ফুটে উঠেছে। হৈমন্তী বই দেখতে লাগল, অবনী মুখোমুখি বসে ট্রাউজারসের পকেট থেকে মোজা বের করে পিঠ নুইয়ে পরে নিতে লাগল। তার আচরণের মধ্যে কোনও রকম সঙ্কোচ ছিল না।

বই দেখতে দেখতে হৈমন্তী বলল, কোথাও বেরোবেন?

 আপনার সঙ্গে…।

এ যেন হৈমন্তীর জানা ছিল। সাধারণত সে এলে অবনী তাকে গুরুডিয়ায় পৌঁছে দিয়ে আসে। আজ প্রথম থেকেই হৈমন্তীর কোনও তাড়া ছিল না। অন্যদিন সে এসে পনেরো কুড়ি মিনিট অন্তর ঘড়ি দেখে, বাসের কথা বলে, আজ একবারও ঘড়ি দেখেনি, বাসের কথা বলেনি। তার ইচ্ছে আজ সে দেরি করে ফিরবে, যতটা সম্ভব সে দেরি করতে চায়।

আজ বেশ ঠাণ্ডা– হৈমন্তী বলল, যেন এতটা ঠাণ্ডায় অবনীকে গুরুডিয়া পর্যন্ত টেনে নিয়ে যাওয়ার জন্যে সে মনে মনে প্রথমেই মার্জনা চেয়ে নিল।

এ ঠাণ্ডা আমাদের গা-সওয়া, অবনী সোজা হয়ে বসল। আর কদিন পরেই ক্রিসমাস, তখন কয়েকদিন, জানুয়ারির আধাআধি পর্যন্ত ভীষণ ঠাণ্ডা পড়বে। আমার নিজের খুব ভাল লাগে সময়টা।

ক্রিসমাসে গগন আসছে। হৈমন্তী তিনটে বই বেছে অন্য একটা বইয়ে হাত দিল।

চা নিয়ে এল মহিন্দর। চা আর ওমলেট। হৈমন্তী মহিন্দরের সঙ্গে দুটো কথা বলল, এ বাড়িতে তার পরিচয় এখন প্রায় স্বাভাবিক হয়ে এসেছে বলে চাকরবাকরের মধ্যেও কোনও কৌতূহল আর দেখা যায় না। মহিন্দরের বাবার চোখের ছানি হৈমন্তীকে দিয়ে দেখিয়ে এনেছে। ছানি কাটাতে হবে। এখনও একটু দেরি আছে। হৈমন্তী নিজে ছানি কাটবে না, বলেছে ব্যবস্থা করে দেবে।

মহিন্দর চলে গেলে হৈমন্তী চা ঢেলে অবনীর দিকে এগিয়ে দিল।

অবনী বলল, আসছে হপ্তায় আমাকে হয়তো একবার পাটনা যেতে হবে।

পাটনা! কেন?

 ওপরঅলার ডাক।

সেই ব্যাপারটা নাকি?

বুঝতে পারছি না। হতেও পারে। অবনী একটুকরো ওমলেট মুখে দিয়ে আস্তে আস্তে চিবোতে লাগল। তারপর বলল, নতুন যে কনস্ট্রাকসানের তোড়জোড় হচ্ছে সে ব্যাপারেও হতে পারে।

হৈমন্তী চায়ের পেয়ালা নামিয়ে রেখে চামচ করে ওমলেট কাটতে বলল, জীবনে উন্নতি হয় না বলে লোকে আফশোস করে, আর আপনার ঠিক উলটো; উন্নতি পায়ে ধরে সাধছে আপনিই মুখ ফেরাচ্ছেন।

অবনী হাসির মুখ করল। বিজলীবাবুও তাই বলেন।

 সকলেই বলবে; বিজলীবাবু আপনার বন্ধু.

সামান্য চুপ করে থাকল অবনী, চা খেলা শেষে বলল, এই তো বেশ আছি এখানে। উঁচু চেয়ারে বসার অনেক ঝামেলা।

ঝামেলা এড়াবার জন্যে প্রমোশান নেবেন না?

অবনী হৈমন্তীর চোখে চোখে তাকাল, পরে চোখ সরিয়ে নিল। এসব চাকরি–বিশেষ করে এখানে বাঙালি হয়ে বেশিদিন টিকিয়ে রাখা মুশকিল। অনেক রকম ক্লিক থাকে। আমার কোনও ইন্টারেস্টও নেই।

হৈমন্তী ওমলেট মুখে তোলার আগে অবনীকে দেখতে দেখতে বলল, আপনার যেন কোনও বড় অ্যামবিশানও নেই।

না, নেই। অবনী হাসিমুখে জবাব দিল।

 কেন?

কী হবে বড় অ্যামবিশনে।

 বেশি মাইনে, প্রতিপত্তি, খ্যাতি। হৈমন্তী হাসি হাসি মুখে বলছিল, এসব তো শুনেছি হয়।

এই মাইনেতে আমার কুলিয়ে যায়, খুব একটা অভাব বোধ করি না।

একলা আছেন বলে। পরে… হৈমন্তী অসতর্কভাবে বলে ফেলল।

অবনী আবার চোখ তুলে স্পষ্ট করে হৈমন্তীর চোখ মুখ দেখল। পরিহাস হয়তো, তবু মেয়েলি কৌতূহলে হৈমন্তীর একথা মনে হওয়া বিচিত্র নয় বা সে-কৌতূহল প্রকাশ করাও অন্যায় নয়। অবনী বলল, ভবিষ্যতের কথা আমি বড় একটা ভাবতে পারি না। ওটা আমার ডিফেক্ট.

প্রতিপত্তি চান না–এটাও বোধহয় তাই, হৈমন্তী যেন আগের অসতর্ক কথাটা মোছবার জন্যে বলল, বেশ জোরে জোরে হেসে।

অল্পস্বল্প প্রতিপত্তি আমার এখানেও আছে– অবনীও পরিহাসের গলায় জবাব দিল।

পুরুষমানুষ প্রতিপত্তির খুব ভক্ত। অহঙ্কার, প্রতিপত্তি, মর্যাদা–এসব তার ভূষণ… হৈমন্তী যদিও পরিহাসের মতন করে বলেছিল তবু কথাগুলো ঠিক পরিহাসের মতন শোনাল না।

অবনী অনুভব করতে পারল হৈমন্তীর বলার ভঙ্গিতে পরিহাসে থাকলেও কেমন এক তিক্ততা প্রচ্ছন্ন রয়েছে, যেন চাপা উপহাস করল হৈমন্তী। অবনী স্পষ্ট কিছু অনুমান করতে পারল না, তবে তার মনে হল, হৈমন্তীর আজকের আচরণটা কিছুটা বিসদৃশ।

এত ভূষণ গায়ে চাপালে হাঁটা যায়? লঘু স্বরে অবনী বলল।

যাবে না কেন, যায়। হৈমন্তীর ঠোঁটের কিনারা বঙ্কিম হল।

তবে তিনি পুরুষ নয়, মহাপুরুষ। অবনী ঠাট্টা করে বলল। চা শেষ করেছে অবনী, ধীরে সুস্থে সিগারেট ধরাল।

আরও একটা বই বেছে নিয়ে হৈমন্তী অন্যগুলো হাতড়াতে হাতড়াতে মুখ নিচু করে বলল, আপনার উদ্যোগ নেই, উদ্যোগ থাকলে মহাপুরুষ হওয়া যায়।

হ্যাঁ, আমি স্বভাবে খানিকটা ইন-অ্যাকটিভ অবনী হাসল।

বই থেকে চোখ তুলে হৈমন্তী বাকি চাটুকু শেষ করে অবনীর দিকে তাকাল। দুমুহূর্ত তাকিয়ে থেকে বলল, উঠবেন?

আমার তাড়া নেই; আরও কিছুক্ষণ বসতে পারেন।

আমার বই বাছা শেষ হয়ে গেছে–আর মাত্র একটা নেব… বলে হৈমন্তী সামান্য দ্রুত হাতে অন্য একটা বই বাছতে লাগল।

অবনীর একটা বইয়ের ওপর চোখ পড়েছিল। বলল, ওই–ওই বইটা নিতে পারেন, ঠিক ক্রাইম বা মিস্ত্রি নয়, তবে পড়তে মন্দ লাগবে না।

এইটে…? হৈমন্তী একটা বই তুলে দেখাল।

না, নীচেরটা, আপনার কোলের ওপর

হৈমন্তী কোল থেকে বইটা তুলে নিল: এ রুম ফর টু। নামটা দেখল হৈমন্তী, মুখে কিছু বলল না, বেছে রাখা বইয়ের মধ্যে রাখল।

সন্ধে গাঢ় হয়েছে। অবনী ঘড়ি দেখল। পৌনে সাত। হৈমন্তী সময় জিজ্ঞেস করল, সময় বলল অবনী। তারপর চুপচাপ, যেন এখানে কাজ হঠাৎ সব ফুরিয়ে গেছে। নীরবে বসে হৈমন্তী তার ব্যাগের মধ্যে বইগুলো ভরতে লাগল। অবনী চুপচাপ। ঘরের বাতিটা সামান্য মৃদু হয়ে আবার জোর হয়ে উঠল। বাইরে বাতাসের শব্দ প্রখর হলে শোনা যাচ্ছিল।

চলুন উঠি, হৈমন্তী বলল।

চলুন। একটু দাঁড়ান, জুতোটা পায়ে গলিয়ে আসি। অবনী উঠল, উঠে পাশের ঘরে চলে গেল।

হৈমন্তী ব্যাগের মুখ বন্ধ করল, মুখ মুছল রুমালে, দুহাতে কপালের চুলগুলো সামান্য ঠিক করল। বসে থাকতে ভাল লাগছিল না, উঠে দাঁড়িয়ে ঘরের মধ্যে পায়চারি করল সামান্য, দেওয়ালে টাঙানো অবনীর তরুণ বয়সের ছবিটা দেখল। খুব নিরীহ আর ভিতু ভিতু দেখায়, এখানকার চেহারার সঙ্গে বেশ তফাত। অবনী কখনও নিজের পারিবারিক কথা বলে না কেন? হৈমন্তী প্রায় সবই বলেছে, মা মামা দাদা বউদি গগনের কথা। অবনীর যেন এসব পারিবারিক কথায় আগ্রহ নেই। হৈমন্তী জানলার দিকে সরে গেল। বাইরে অন্ধকারে হিমের সঙ্গে ধোঁয়া জমেছে সামান্য, কাছে স্টেশন, ইঞ্জিনের ধোঁয়া এ-সময় একটু জমে থাকে এখানে, উত্তরের বাতাস শনশন করে বইল, এই ঠাণ্ডায় এবং বাতাসে অবনী গুরুডিয়ায় যাবে আবার আসবে ভেবে যেন হৈমন্তী কিছুটা সঙ্কোচ অনুভব করল।

আজ তার কী রকম যেন লাগছে। অবনীর বাড়িতে সে একটু দেরি করেই এল। কেন এল? একবার এমন কথাও মনে হয়েছিল আসবে না। আজ অকারণে তার কোথাও যেন কিছুটা দ্বিধা এবং সঙ্কোচ জাগছিল। সেই-তখন থেকে লাঠায় আসবার সময় থেকে বাসে ওঠা, এবং বাসে আসতে আসতে, বাজারে নেমে (বাজারে সে ইচ্ছে করেই আগে ভাগে নেমে সময় কাটাচ্ছিল এবং মন স্থির করে নিচ্ছিল) বাজার থেকে হাঁটতে হাঁটতে আসার সময় প্রায়ই তার ওই বিশ্রী চিন্তাটা কাঁটার মতন ফুটছিল; সুরেশ্বরের ঈর্ষা ও সন্দেহ, এবং অবনীর মুখ মনে ভাসছিল। এ বড় অদ্ভুত চিন্তা। যেন একের সঙ্গে অন্যটা জড়ানো। যদিও এই ঈর্ষা ও সন্দেহ অসম্ভব। হৈমন্তী বিশ্বাস করে না। তবু..তবু। অবনী সম্পর্কে তার এধরনের কোনও কোনও ভাবনা সজ্ঞানে হয়নি এযাবৎ, এখন হচ্ছে, যদিও সেটা প্রায় কিছুই নয়, তবু ভাবনাটাই কেমন অকারণে তাকে সঙ্কুচিত করছিল। শেষ পর্যন্ত হৈমন্তী চলে এল, কিন্তু অবনীর সামনে মাঝে মাঝে অস্বস্তি বোধ করেছে যে তাতে সন্দেহ নেই। এ রকম কেন হবে সে বুঝতে পারছিল না। আজ সে অবনীর সামনে হয়তো কিছু এলোমেলো কথা বলেছে, হয়তো অন্য দিনের মতন সপ্রতিভ হতে পারেনি। যদিও তার চেষ্টা করেছিল। এমনকী হৈমন্তী যেন গোপনে সুরেশ্বরের প্রতি তার মনের বিরূপতাও আজ কিছু প্রকাশ করে ফেলেছে। অবনী বোধহয় কিছু বুঝতে পারেনি। কিংবা পেরেছে হয়তো। কে জানে!

অবনী এল। চলুন, আমার হয়ে গেছে।

হৈমন্তী পিছু ফিরে তাকাল। গলার পাশ দিয়ে মোটা একটা মাফলার ঝুলছে অবনীর, হাতে টর্চ। দু পলক তাকিয়ে থাকল হৈমন্তী।

গরম আর কিছু গায়ে দেবেন না?

না, আর দরকার হবে না।

ঠাণ্ডা লেগে যাবে।

 লাগবে না।

 হৈমন্তী এগিয়ে এসে সোফার ওপর থেকে তার লম্বা গরম কোটটা তুলে নিয়ে গায়ে দিল।

 গাড়িতে এসে ওঠার সময় হৈমন্তী বলল, গাড়ি যদি ধীরে চালান তবে সামনে বসি। বসুন।

হৈমন্তী গাড়িতে উঠল। হালে জিপগাড়িটার কিছু সংস্কার সাধন করা হয়েছে। আগে মাথায় ছিল ক্যানভাস, এখন অ্যালুমিনিয়াম শিট দিয়ে মাথা ঢাকা হয়েছে, পিছনটা ঢেকে দিয়ে গায়ে নতুন ক্যানভাস জড়ানোও হয়েছে সদ্য। এসবই অবনীর সুবিধে মতন সে করিয়ে নিয়েছে, নয়তো এই সর্বদিক খোলা গাড়ি নিয়ে ছোটাছুটি করতে তার অসুবিধে হচ্ছিল; দরকারি জিনিস, কাগজপত্র নষ্ট হচ্ছিল পথে।

হৈমন্তী আজ পিছনে বসল না; পিছনে বসলে কথাবার্তা বলতে, গল্প করতে বড় অসুবিধে হয়; একজনের ঘাড়ের দিক মুখ করে সারাক্ষণ বসে থাকা বা কথা বলা বড় বিশ্রী, মুখ দেখা যায় না, জোরে জোরে চেঁচিয়ে কথা বলতে হয়। তা ছাড়া, বাইরের এই বাতাসের ঝাঁপটা পেছনে বেশি লাগে, সামনে বসলে কাচের আড়াল পাওয়া যায়, গায়ের পাশ দিয়ে বাতাস কাটিয়ে নেওয়া চলে।

গাড়িতে স্টার্ট দিয়ে বেরিয়ে রাস্তায় আসতে চোখে পড়ল, আকাশে বাঁকা চাঁদ উঠে আছে।

বাজার পর্যন্ত বড় একটা কথা হল না, সাধারণ কিছু বাক্য-বিনিময়। বাজার পেরিয়ে থানার দিকে পিচের রাস্তাটা ধরতেই আশেপাশে বাড়িঘর আলো কমে এল, তারপর থানা পেরুতেই সব যেন দপ করে নিবে গেল এবং লোকালয় অদৃশ্য হল। অবনী বেশ ধীরে গাড়ি চালাচ্ছিল।

ঘরে বসে হৈমন্তীর যদি কোনও অস্বচ্ছন্দ বোধ হয়ে থাকে বাইরে পথে এসে এবং অন্ধকারে তা হচ্ছিল না। বরং তার ভাল লাগছিল। শীত অনুভব করলেও কয়েক প্রস্তু পোশাকের দরুন সে কাঁপছিল না বা বাতাসের ঝাঁপটা গায়ে লাগতে দিচ্ছিল না। অথচ হাতের আঙুল, নাক কান ঠাণ্ডা হয়ে এসেছিল।

অবনী যেন কিছু বলতে যাচ্ছিল, হৈমন্তী তার আগেই বলল, গগন এলে একটু বেড়াবার ইচ্ছে আছে। চারদিকেই শুনি বেড়াবার নানা জায়গা। একদিন টাউনে যাব।

যাননি এখনও?

একদিন দুপুরে গিয়েছিলাম, বিকেলেই ফিরতে হল…

চলুন একদিন…

গগন আসুক।

এলে আর-একবার হবে, তবে পরশু যদি যেতে চান আপনাকে নিয়ে যেতে পারি। পরশু দিন আমায় যেতে হবে একবার, কাজ আছে।

কখন যাবেন?

বেলা দশটা নাগাদ—

 না, আমার যাওয়া হবে না।

কেন?

 হৈমন্তী কী একটু ভাবল, বলল, ওপরঅলার হুকুম নেই। বলে হাসবার চেষ্টা করল।

অবনী মুখ ঘুরিয়ে দেখল। তারা যে ভাবে যে-স্বরে ওপরঅলা শব্দটা বলে হৈমন্তী ঠিক সেইভাবে বলল। অনুকরণে ভুল হয়নি। কিন্তু এ ধরনের অনুকরণে যা থাকার কথা নয় হৈমন্তীর বলার মধ্যে তা ছিল।

অবনী হেসে বলল, আপনার আবার ওপরঅলা কোথায়? সুরেশ্বর…

হৈমন্তী হাসল না। বেলা একটা পর্যন্ত আমার হাসপাতাল; তার এদিক ওদিক করা যাবে না।

 ভীষণ কড়া নিয়ম তো।

এই নিয়মটা অবশ্য আমার। ওরা আরও বেশি সময় থাকতে বলে। দিন দুপুর সন্ধে। আমি রাজি না। তাই নিয়ে গোলমাল চলছে।

গোলমাল? অবনী মুখে হাসছিল, কিন্তু মনে মনে সে বুঝতে পারছিল কোথাও একটা মনান্তর চলছে বোধহয়।

হৈমন্তী মাথা নাড়ল, বলল, সেই রকম।

গাড়ি দেখতে দেখতে অনেকটা চলে এসেছে। স্টেশনে আসার শেষ বাসটা পাশ কাটিয়ে চলে গেছে। দুপাশ উঁচু নিচু মাঠ, আর গাছপালা; অন্ধকারে খুব ফিকে চাঁদের আলো জড়ানো, মাঠময় বাতাস ছুটছিল, শীত যেন আরও ঘন হয়ে এসেছে এখানে।

অবনী গাড়ি চালাতে চালাতেই একটা সিগারেট ধরিয়ে নিল। বলল, আপনার ওপরঅলা কিন্তু সব সময় আপনার সুখ্যাতি করেন।

করেন…

সেদিনও আমার কাছে প্রচণ্ড সুখ্যাতি করছিলেন।

 কী হিসেবে? ডাক্তার হিসেবে তো?

হ্যাঁ; আর কীসের করবেন?

 ডাক্তার হিসেবেই আমার যেটুকু দাম… হৈমন্তী হঠাৎ বলে ফেলল। বলে চুপ করে গেল।

অবনী এবার আর মুখ ফেরাল না। সে অনুভব করতে পারল হৈমন্তীর কোথাও যেন একটা ক্ষোভ জমে জমে ভারী হয়ে গেছে। আগে বোঝা যেত না, পরে অল্প অল্প বোঝা যাচ্ছিল, এখন তা আরও স্পষ্ট, প্রকাশ্য। সুরেশ্বরের সঙ্গে হৈমন্তীর ঠিক কোথায় যে মনোমালিন্য ঘটতে পারে অবনী তা অনুমান করে আজকাল। কিন্তু সে বুঝতে পারে না–স্বেচ্ছায় যে কলকাতা থেকে নির্বাসন নিয়ে এই বন-জঙ্গলের দেশে চলে এসেছে তার মধ্যে হটকারিতা বেশি, না কি অনুরাগ, অথবা আদর্শ? আদর্শ নয়। কেন না এই কমাসের পরিচয়ে অবনী নিঃসন্দেহে বুঝতে পেরেছে অন্ধ আশ্রমের আদর্শ বা আকর্ষণ হৈমন্তীর নেই। আদর্শ যখন নেই তখন অনুরাগ ভিন্ন আর কিছু থাকে না; সুরেশ্বরের প্রতি অনুরাগবশেই হৈমন্তী সব ছেড়ে এসেছে। এই অনুরাগ কী এখানে এসে ক্রমশ নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। কেন? হৈমন্তী কী আশা নিয়ে এসেছিল, কোথায় সে ব্যর্থ হল, তার আশাভঙ্গের যথার্থ কারণ কী? হৈমন্তী কি তার দিল্লির বান্ধবীর মতন হতে পারলে সুখী হত?

অবনী লাটঠার মোড় সামনে দেখতে পেল; বলল, গুরুডিয়ায় যাবেন, না বেড়াবেন একটু?

 বেড়াই…

শীত করছে না?

না, তেমন নয়।

আর একটু সরে বসুন, বাতাস লাগবে না।

হৈমন্তী আরও একটু অবনীর দিকে সরে বসল। অবনী সামনে তাকিয়ে খুব আস্তে আস্তে গাড়ি চালাতে লাগল, যেন এই পথে, নির্জনে, প্রান্তর আর অতিম্লান ঈষৎ নক্ষত্রের আলোর মধ্যে তারা দুজনে ঘনিষ্ঠ ও অন্যমনস্কভাবে পায়চারি করে বেড়াচ্ছে।

.

১৯.

 বড়দিনের ছুটির সময় সময় গগন এল। ডিসেম্বরের মাঝামাঝি থেকেই শীত প্রচণ্ড হয়ে উঠেছিল; সেই শীতের আঁচড় প্রত্যহ যেন আরও ধারালো ও তীক্ষ্ণ হচ্ছিল। গুরুডিয়ায় পা দিয়েই গগন বলল, আরে বাপস, বরফ-টরফ পড়বে নাকি রে এখানে? হৈমন্তী হেসে জবাব দিল, থাকছিস তো, পড়লে দেখতে পাবি।

গগনকে দেখলেই হৈমন্তীর সঙ্গে তার রক্তের সম্পর্কটা অনুমান করা যায়। দুজনের মুখের আদল প্রায় এক, চোখ মুখ কপালের সাদৃশ্য সহজেই চোখে পড়ে। তবু পুরুষ বলে গগনের কিছু বৈশিষ্ট্য আছে, সব যেন ছিমছাম কাটাকাটা। তার নাক হৈমন্তীর তুলনায় শক্ত এবং উঁচু, ঠোঁট কিছুটা পুরু ও বড়। চিবুকেরও সামান্য পার্থক্য আছে। গগনের গায়ের রং ফরসা, তবে মেয়ে বলে হৈমন্তীর গায়ের রঙে যে মসৃণতা এবং কোমলতা আছে গগনের তা নেই। সুশ্রী, সপ্রতিভ, হাসিখুশি মেজাজের ছেলে গগন, বয়সে হৈমন্তীর চেয়ে বছর চারেকের ছোট। দিদির সঙ্গে তার সম্পর্কটা বরাবরই সঙ্গী এবং বন্ধুর মতন। বড় ভাই, হৈমন্তীরও বড়, সেই দাদার সঙ্গে এই দুই ভাইবোনের সম্পর্ক না থাকার মতন। চা বাগানের সেই সাহেবদাদা আর তার সিকি-মেমসাহেব বউ তাদের আত্মীয় এই মৌখিক পরিচয়টুকু ছাড়া আর কিছুই নেই বলা যায়। যোগাযোগ দেখাসাক্ষাতও নেই, এমনকী মার সঙ্গে চিঠিপত্রেও দাদা যেটুকু সম্পর্ক বজায় রাখত একসময়, আজকাল তাও রাখে না। দাদার সঙ্গে তাদের দুজনের বয়সের যথেষ্ট পার্থক্য ছিল; বাবা বেঁচে থাকতেই দাদা দুরে দুরে সরে যায়, তার পর বিয়ে করে, বিয়েটা সে নিজের খেয়ালখুশিতে করেছিল, সংসারের বা মার মতামত নেয়নি, গ্রাহ্যও করেনি। তখন থেকে দুপক্ষের মধ্যে সম্পর্কে বড় রকমের ফাটল ধরে যায়। হৈমন্তীর অসুখের সময় দাদার ব্যবহার দেখে এরা বুঝে নিয়েছিল ওপক্ষ কোনওভাবেই আর এদের সঙ্গে সম্পর্ক রাখতে ইচ্ছুক নয়; দায় দায়িত্বও অস্বীকার করতে ওদের বাধছে না। তখন থেকেই যোগাযোগ ভেঙে গেছে; মা ও মামা বছরে একটি দুটি সাধারণ চিঠি লেখে মাত্র, দাদাও সেই রকম জবাব দেয়। কাজেই পারিবারিক ও সাংসারিক সম্পর্ক যা তা এই দুই ভাইবোনেই গড়ে উঠেছে বরাবর, দাদার কথা তারা ভাবে না, ভাবতেও পারে না।

গগন এসে গুরুডিয়ায় অন্ধ আশ্রমেই উঠল। সুরেশ্বরের ইচ্ছে ছিল গগন তার কাছেই থাকবে, তার বাড়িতে। হৈমন্তীর তাতে তেমন আগ্রহ ছিল না; তার ইচ্ছে ছিল গগন তার ঘরের পাশাপাশি থাকে। হৈমন্তী আর মালিনীর ঘরের গায়ে গায়ে ছোট মতন একটা ঘর ছিল, নানা রকম অকাজের জিনিসপত্র জড়ো করা ছিল। গগন আসার আগে আগে এই ঘর পরিষ্কার করাল হৈমন্তী। একটা তক্তপোশের ব্যবস্থাও হল, নিজের ঘর থেকে ক্যাম্বিসের হেলান-দেওয়া নতুন চেয়ারটা গগনের জন্যে তার ঘরে এনে রাখল, ছোট একটা বেতের টেবিল জোগাড় করে আনল মালিনী। মোটামুটি বেশ মানিয়ে গেল ঘরটা।

সুরেশ্বর ঘরের ব্যবস্থা দেখতে এসেছিল সকালে; দেখে শুনে বলল, বাঃ, বেশ হয়েছে।

 বিকেলে সুরেশ্বর আর হৈমন্তী দুজনেই স্টেশনে গেল গগনকে আনতে। শীতের সন্ধে দেখতে দেখতে ঘুটঘুঁটে হয়ে এসেছিল, সেই অন্ধকারে আর শীতে বাসে করে ওরা গুরুডিয়া এল, গগনকে তার ঘরে পৌঁছে দিয়ে সুরেশ্বর সামান্য বসে চলে গেল। ততক্ষণে রাত হয়ে আসছে, শীতও পড়ছে।

শীতের প্রকোপ দেখে গগন বলল, আরে বাপস, বরফ-টরফ পড়ে নাকি রে এখানে?

ভাইয়ের বিছানাপত্র পেতে দিতে দিতে হৈমন্তী হেসে জবাব দিল, থাকছিস তো, পড়লে দেখতে পাবি।

দু-চারটে সাধারণ ঘরোয়া কথার পর গগন বলল, সুরেশদা তখন কী যেন বলছিল রে?

কিছু না। ওর বাড়িতে থাকার কথা বলেছিল প্রথমে, আমি না করে দিয়েছিলাম।

ওর বাড়িটা কী রকম?

এই রকমই প্রায়, মাটির গাঁথনি; খান দুয়েক ঘর আছে। কাল দেখিস।

কিছু মনে করল না তো?

 মনে করার কী আছে, আমার বাড়ির লোক এসে আমার কাছে উঠবে না তার কাছে!

গগন বিছানার পাশে ক্যাম্বিসের হেলানো চেয়ারটায় বসে ছিল। গাড়িতে উঠেছে বেলা দশটা নাগাদ। একটু ভিড় ছিল আজ। ট্রেনের ধকলে সামান্য ক্লান্ত হয়তো, কিংবা কলকাতা শহরের হইহট্টগোল কলরব আলো থেকে হঠাৎ এই নির্জন নিস্তব্ধ অন্ধকার জঙ্গলের মধ্যে এসে পড়েছে বলে অনভ্যস্ত অজানা অচেনা পরিবেশে নিজেকে এখনও তেমন সইয়ে নিতে না পারার জন্যে মাঝে মাঝে অন্যমনস্ক ও ম্লান হয়ে পড়ছিল।

বিছানার ওপর একটা র‍্যাগ পেতে বিছানা ঢাকা দিয়ে দিল হৈমন্তী; অন্য র‍্যাগটা পাট করে পায়ের কাছে রাখল। বলল, তোর বিছানায় র‍্যাগ ঢাকা দিয়ে রাখলাম, বিছানা গরম থাকবে। পায়ের কাছে। আর-একটা থাকল।

গগন তাকিয়ে তাকিয়ে বিছানা দেখল, অন্যমনস্কভাবে ঘরের চারপাশ তাকাল, হাই তুলল।

হৈমন্তী বিছানার পাশে বসে। ঘরের জানলা বন্ধ, দরজা প্রায় ভেজানো।

গগন হঠাৎ বলল, এই ঠাণ্ডায় তোর কষ্ট হয় না?

এ কদিন একটু হচ্ছে, রাত্রের দিকে, দিনের বেলায় হয় না। দিনের বেলাটা খুব চমৎকার।

তোর শরীর খারাপ হবে না তো? গগনের গলায় চাপা উদ্বেগ ছিল।

 হৈমন্তী মাথা নাড়ল, না। আমি তো সাবধানেই থাকি।

গগন এবার সিগারেট বের করে ধরাল। ধোঁয়া টানল খানিক, তারপর বলল, মা আমায় অনেক কিছু বলে দিয়েছে, বুঝলি। মামাও।

কী বলেছে?

সে অনেক কথা। আমায় আবার পয়েন্ট ওয়ান টু করে সাজিয়ে মনে করে নিতে হবে– গগন হাসল, পরে বলব।

হৈমন্তী ভাইয়ের চোখের দিকে তাকিয়েছিল। সে মোটামুটি জানে মা কী বলেছে, কী বলতে পারে, কেনই বা গগন এখানে এসেছে। শুধু যে বেড়াবার উদ্দেশ্যেই গগন এসেছে তা তো নয়।

হৈমন্তী বলল, তুই আমার সঙ্গে কথা না বলে কিছু বলবি না কাউকে।

গগন কথার ধরন থেকে বুঝতে পারল দিদি কী বলতে চাইছে। তবু যেন বোঝেনি এমনভাবে অন্য দিকে তাকিয়ে থাকল।

সামান্য চুপচাপ, গগন আলোর দিকে ধোঁয়ার একটা রিং ছুঁড়ে দেবার চেষ্টা করল, পারল না। পরে বলল, সুরেশদাকে অনেক দিন পরে দেখলাম। সেই সেবারে কলকাতা গিয়েছিল আর এই বছর দু আড়াই হবে প্রায়। …শরীর স্বাস্থ্য কিন্তু বেশ ভালই আছে। মাছ মাংস খায়, না ছেড়ে দিয়েছে?

মাংস এখানে হয় না।

বলিস কী?

পয়সায় কুলোয় না। …মাছ-টাছ পাবি মাঝে মাঝে, নদীটদী থেকে ধরে আনা চুনো মাছ। স্বাদ আছে।

বলিস কী! আগে তো বলিসনি।

বলেছিলাম, ভুলে গিয়েছিল হৈমন্তী হাসল। কথাটা হৈমন্তী বাস্তবিকই বলেছিল কিনা সে বিষয়ে সন্দেহ আছে। হয়তো বলেনি। সে নিজেও মাংস খায় না, খেতে ভাল লাগে না। কলকাতায় থাকতেই ছেড়ে দিয়েছে।

ভাইকে সান্ত্বনা দেবার জন্যেই যেন হেসে হেসে হৈমন্তী বলল, তোর ঘাবড়াবার কোনও কারণ নেই গগন, মাংস খেতে চাস ব্যবস্থা করে দেব। ডিম খাবি, নদীর মাছ খাবি, শাকসবজি টাটকা সব– এখানকার বাগানের। সাত দিনে ফুলে যাবি। ..

তুই কিন্তু ফুলিসনি, গগন হাসল।

বলিস না; কলকাতার জামা এখন আমার গায়ে আঁট-আঁট লাগে।

মনে তো হয় না। তবে তোর শরীর খারাপও হয়নি। রংটা কেমন পুড়ে গেছে।

 শীতে এখানে ভীষণ টান ধরে, আর রোদ; সকাল তোক দেখবি কী তেজ রোদের।

গগন হৈমন্তীর চোখ মুখ এতক্ষণ লক্ষ করে করে একটা কিছু সন্দেহ করছিল। এবার বলল, এত ভাল জায়গা, কমাস ধরে রয়েছিস–কিন্তু যতটা ভাল দেখানো দরকার ততটা ভাল তোকে দেখাচ্ছে না…কলকাতায় পুজোর সময় যা দেখেছি তার চেয়ে ভাল না, বরং তোর মুখে.. কথা শেষ করল না গগন।

হৈমন্তী ভাইয়ের মুখের দিকে তাকিয়ে থাকল কয়েক পলক, তার মুখের ভাব হঠাৎ মলিন হয়ে এল, যেন সে এখন আর কিছু গোপন রাখতে চাইছে না বা পারছে না। চোখের দৃষ্টিতে এই ভাবটা ফুটে ওঠার পর হৈমন্তী হয়তো সচেতন হয়েছিল, হয়ে সে যথাসম্ভব নিজেকে সংযত করতে চাইল। এমন সময় বাইরে মালিনীর গলা শোনা গেল।

হৈমন্তী সাড়া দিল।

মালিনী ঘরে এল। হাতে একটা কাঠের বড় পিড়ি, তার ওপর মাটির ছোট উনুন; ছোটদের খেলাঘরের উনুনের মতন। কাঠ কয়লার আগুন করে এনেছে। উনুনটা নামিয়ে রেখে মালিনী হৈমন্তীর দিকে তাকাল, গরম জল দেব কলঘরে?

হৈমন্তী একটু অবাক হয়েছিল। ঘরে এই আগুন দেবার জন্যে বা গরম জল করার জন্যে সে মালিনীকে বলেনি। নিজে বুদ্ধি খাঁটিয়েই মালিনী করেছে। খুশি হয়ে হৈমন্তী বলল, গরম জলও করেছ! বাঃ! মালিনী বড় গুণের মেয়ে– বলে ভাইয়ের মুখের দিকে হেসে তাকাল।

মালিনী অপ্রস্তুত বোধ করল সামান্য, নিচু গলায় বলল, দাদা যাবার সময় আমায় বলে গিয়েছিলেন।

এই আতিথ্য পালনের ব্যবস্থাগুলো তবে সুরেশ্বরের নির্দেশে হচ্ছে! হৈমন্তী কিছু বলল না। মালিনী সামান্য দাঁড়িয়ে থেকে চলে গেল।

গগন বলল, তা হলে জামাকাপড় ছেড়ে ফেলি, কী বল!

হ্যাঁ; জামাকাপড় ছেড়ে তুই আয়, কলঘরে জল দিতে বলছি। হৈমন্তী কেমন অন্যমনস্ক গলায় বলল, বলে ঘর ছেড়ে চলে গেল।

রাত্রে খাওয়া-দাওয়া সেরে ভাইবোনে গল্প হচ্ছিল। গগন বিছানার ওপর একটা র‍্যাগ চাপিয়ে বসে, হৈমন্তী শাল মুড়ি দিয়ে ক্যাম্বিসের চেয়ারে বসে। পায়ে ঠাণ্ডা লাগার ভয়ে মোজা পরেছে। দুজনের সামনে কাঠের তক্তার ওপর সেই কাঠকয়লার উনুন, তার আঁচ নিবে এসেছে প্রায়।

কলকাতার বাড়ির কথা, মা আর মামার কথা, চেনাজানা কারও কারও কথার পর প্রসঙ্গটা শেষাবধি ফুরিয়ে গেলে দুজনেই থেমে গেল। অল্প সময় চুপচাপ। তারপর গগন বলল, তোদের সেই ইঞ্জিনিয়ার ভদ্রলোকের খবর কী?

কে, অবনীবাবু?

হ্যাঁ 

আছেন। পাটনায় যাবার কথা ছিল, অফিসের কাজে। গিয়েছিলেন জানি। ফিরে আসার কথা। এ কদিন আর স্টেশনে যেতে পারিনি।

তুই কি স্টেশনে যাস নাকি?

যাই; মাঝে মাঝে যাই। …এখানে মুখ বুজে থাকা, কথা বলার মতন মানুষ নেই একটা কথা বলতে হলে ওই মালিনী। কত আর পারা যায়!

সুরেশদা…

ও-সব বড় বড় মানুষ, ওদের কথা আলাদা। গল্পগুজব করে সময় নষ্ট করার অবসর নেই। হৈমন্তী প্রসঙ্গটা অন্যভাবে এড়িয়ে যাবার চেষ্টা করলেও তার কথার স্বরে নৈরাশ্য ও চাপা বিরক্তি ছিল।

গগন নির্বোধ নয়, তার কানে হৈমন্তীর মনের বিরূপতা ধরা পড়ল। হৈমন্তীর চোখ লক্ষ করল গগন, পরে বলল, তোকে তো তেমন খুশি মনে হচ্ছে না।

হৈমন্তী ভাইয়ের দিকে তাকাল না। নিচু মুখে শালের পাড় খুঁটতে লাগল। বলল,অখুশির কী বুঝলি!

গগন সঙ্গে সঙ্গে কোনও জবাব দিল না। হাত দুটো উনুনের আঁচে দেবার জন্যে ঝুঁকে বসল, তাত নেবার চেষ্টা করল, আগুন নিবে গেছে, সামান্য একটু তাত, ঠিক মতন অনুভব করাও যায় না।

আমি তো এই ব্যাপারটা সেটেল করতে এসেছি গগন ধীরে ধীরে বলল, মার পক্ষে এরকম ভাবে বসে থাকা আর সম্ভব নয়। অনেক বয়েস হয়ে গেছে, শরীর খারাপ, আজকাল সবসময় দুশ্চিন্তা করে। মামা বুড়ো মানুষ, সারাটা জীবন আমাদের নিয়ে থাকল, মামাও এখন আর শুনতে চায় না। কে কবে চোখ বুজবে সেই ভাবনায় পড়েছে আজকাল, দায়দায়িত্বটুকু সেরে ফেলতে চায়।

হৈমন্তী কোনও কথা বলল না। হেঁট মুখেই বসে থাকল।

গগন অপেক্ষা করল সামান্য, তারপর আবার বলল, দাদার ব্যাপারের পর মার নানা রকম ভয়, মামারও। দাদাকে আমরা বাদ দিয়ে দিয়েছি অনেককাল, দাদাও দিয়েছে। তুইও যদি..

কেন, তুই তো আছিস হৈমন্তী এবার মুখ খুলল, যেন সে আপ্রাণ চেষ্টা করল গগনের কথা সমস্ত গাম্ভীর্য সামান্য হালকা করে আবহাওয়াটা নরম করার।

আমার কথা ছাড়। আমি তো তোর ছোট।

ইস, তুই এখনও কচি খোকা– হৈমন্তী হাসবার চেষ্টা করল।

গগন হেসে হেসে জবাব দিল, আমার এখনও ম্যাচুরিটি হয়নি। তিরিশ একতিরিশ বছর বয়সে আজকাল ছেলেরা বিয়ে-ফিয়ে করে না। দাঁড়া–ওয়েট কর–আগে কেরিয়ারটা তৈরি করেনি তারপর কি আর বসে থাকব!

তোর সেই সাঁতার কাটা মেয়ে বন্ধুটার খবর কী? হৈমন্তী রগড় করে জানতে চাইল।

আরেব্বাস, তার তো সাংঘাতিক বিয়ে হয়ে গেছে–জানিস না। ফরেন সার্ভিসের এক ছোরার সঙ্গে। বিগ ফ্যামিলি। …বুঝলি দিদি, আমি আগে থেকেই বাইলাইনে চলে গিয়েছিলাম; ওসব বিগ ব্যাপারে থাকতে নেই। এখন একটা স্টেনোটাইপিস্ট মেয়ের সঙ্গে প্রেম চালিয়ে যাচ্ছি, নবনীর বোন, তুই দেখেছিস, নামটা বলব? গগন চোখমুখ ফুলিয়ে হাসছিল।

হৈমন্তী হাসতে হাসতে ডান হাত তুলে চড় মারার ভঙ্গি করল, তোর গালে ঠাস করে এক চড় মারব। বড্ড পেকে গিয়েছিস…! পাজি…!

পাকাপাকি কিছু নেই। প্রেম-ফ্রেম না থাকলে এই বয়সটার লাইফ থাকে না। কমলাকে আমার পাশে দেখলেই বুঝতে পারবি তার পাশে আমার লাইফ-ফোর্স কত বেড়ে যায়।

হৈমন্তী খিল খিল করে হেসে উঠল। এমন হাসি সে এখানে কোনওদিন হাসতে পারেনি, কলকাতায় হাসতে পারত। এখানে তার পারিবারিক সম্পর্ক কোথাও নেই, এমন কেউ নেই যার সঙ্গে তার এমন মেহমধুর ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক থাকতে পারে। কলকাতায় মা ছিল, মামা ছিল, গগন ছিল, দু-একজন বন্ধু ছিল। কলকাতায় সে সংসারের একজন মানুষ, পারিবারিক সম্পর্কে, আত্মীয়তায় স্নেহ-বন্ধুত্বে অন্যের সঙ্গে জড়িত; এখানে সে সকলের থেকে বিচ্ছিন্ন। আশ্রমের মানুষের কাছে সে ডাক্তার, বড়জোর মালিনীর হেমদি। কর্তব্য পালন ছাড়া আর কোনও সম্পর্ক নেই অন্যের সঙ্গে। স্বাভাবিক জীবনের এই আনন্দ ও সুখটুকু থেকে সে বঞ্চিত হবে এমন কথা আগে ভাবেনি। এখন বুঝতে পারে, হৈমন্তীর কলকাতার জীবনটা ছিল ঘরোয়া, সংসারের মানুষের সঙ্গে তার সম্পর্ক ছিল, ডাক্তারিটা তার পোশাকি জীবন ছিল; বাইরে কাজের সময়টুকু এই পোশাকি জীবনে সে কাটাতে পারত, তাতে অস্বস্তি হত না, কষ্টও থাকত না। কিন্তু এখানে যা হয়েছে তা উলটো, পোশাকি জীবনটাই তার সব হয়ে উঠেছে, পারিবারিক জীবনের স্বাদ কোথাও নেই।

হাসি থেমে গিয়েছিল হৈমন্তীর; অন্যমনস্ক হয়ে পড়েছিল। শীতের কনকনানি গায়ে লাগল, শিউরে ওঠার মতন কাঁপল একটু। অনেকটা রাত হয়ে গেছে, দশটা বাজল। বাঁ হাতে বাঁধা ঘড়ি দেখে নিয়ে হৈমন্তী এবার নড়ে চড়ে উঠল। দশটা বাজল; নে আর রাত করিস না, শুয়ে পড়। বলতে বলতে হৈমন্তী উঠে দাঁড়াল।

তুই তো কিছু বললি না? গগন শুধোল।

তোর কথা আগে শুনি। মা, মামা কী সব বলে দিয়েছে তোকে মনে করে রাখ, কাল বলিস…

 সে আমি সুরেশদাকে বলব।

না, আগে আমায় বলবি।

সুরেশদাকে বলার জন্যেই বলেছে।

বলুক। আমার ব্যাপারে যা বলার আমায় আগে না জানিয়ে তুই কাউকে বলবি না। …মা মামা তোকে এখানে কারও কাছে হাত জোড় করতে পাঠায়নি।

হাত জোড় করার ব্যাপারই নয়..।

 না হলেই ভাল। নে শুয়ে পড়, দরজাটা বন্ধ করে দে। হৈমন্তী দরজার দিকে পা বাড়াল।

বিছানা ছেড়ে উঠতে উঠতে গগন হেসে বলল, সুরেশদার কাছে তুই আমায় এই জন্যেই থাকতে দিলি না নাকি রে?

কথাটার স্পষ্ট কোনও জবাব দিল না হৈমন্তী। বলল, তোর সঙ্গে কথা বলতে গল্প করতে আমায় ও-বাড়ি ছুটতে হবে নাকি! ওবাড়িতে আমি বড় যাই না। আমার কাছে না থাকলে তোকে পাব কী করে সব সময়…নে,, দরজা বন্ধ করে দে।

অনেক রাত পর্যন্ত হৈমন্তীর ঘুম এল না। গলা পর্যন্ত লেপ টেনে শুয়ে থেকে থেকে সে কখনও চোখ খুলে নিবিড় অন্ধকার দেখছিল, কখনও চোখের পাতা বুজে ঘরের মধ্যে সঞ্চিত মাঝরাতের শীতে অস্বস্তি বোধ করছিল। তার কপাল ঠাণ্ডা, নাকের ডগাও তেমন গরম নয়, নিশ্বাসও ভারী হয়ে উঠেছে। এই শীত তাকে নিদ্রাহীন করছিল কিনা বলা যায় না, তবে শীতের প্রতি তার তেমন মনোযোগ ছিল না; সে অন্য চিন্তা করছিল, চিন্তা থেকে যখন মন সরে যাচ্ছিল শীতের স্পর্শে সামান্য অস্বস্তি বোধ করছিল। চিন্তা এবং উদ্বেগেই তার ঘুম আসছিল না।

গগন এসেছে: কী উদ্দেশ্য নিয়ে এসেছে হৈমন্তী জানে। সুরেশ্বর এবং গগনের মধ্যে কাল পরশু বা দু-একদিনের মধ্যে যে কথাবার্তা হবে হৈমন্তী তা অনুমান করে নিচ্ছিল এবং ভাবছিল। সুরেশ্বরের মনোভাব সম্পর্কে হৈমন্তীর নতুন করে আর বেশি কিছু জানার নেই, এই কমাসে ক্রমশ তা জানা হয়ে গেছে, এখন-হৈমন্তী প্রায় নিশ্চিতরূপে বলতে পারে, সুরেশ্বর গগনকে নিরাশ করবে। গগন তা জানে, কিংবা মনে মনে তার কিছুটা সন্দেহ দেখা দিলেও সে সুনিশ্চিত করে কিছু জানে না। মা আর মামাও এতটা বোঝেনি, জানতে পারেনি। হৈমন্তী কলকাতায় গিয়ে যে কদিন ছিল মাকে, মামাকে তার এই ব্যর্থতার বিষয় বুঝতে দেয়নি। কিন্তু এখন গগন এখানে আসার পর সুরেশ্বরের সঙ্গে মুখোমুখি কথার পর কারও কিছু অজানা থাকবে না।

গগনকে নিজের কাছে রাখার পিছনে হৈমন্তীর স্বার্থ ছিল। সে চায়নি গগন সর্বক্ষণ সুরেশ্বরের কাছে থাকে। সুরেশ্বরের হাতে গগনকে ছেড়ে দিলে সুরেশ্বর তাকে কী বোঝাত, কী বলত, কোন যাদুতে বশীভূত করত কিছুই বোঝা যেত না। গগন সুরেশ্বরকে যথেষ্ট মানা করে, পছন্দ করে, এমনকী শ্রদ্ধাও করে। সুরেশ্বর গগনকে বাল্যকাল থেকে দেখে আসছে, গগনের সঙ্গে তার সম্পর্ক সরল স্নেহপ্রীতির আত্মীয়তার মতনই। গগনের মতন সাধাসিধে সরল ছেলেকে অনায়াসে সুরেশ্বর গালভরা কথায় মিষ্ট ব্যবহারে ভোলাতে তার মর্জি মতন চালিয়ে নিতে পারত। তা ছাড়া, গগন বড় বোকা; দিদির প্রতি তার অনুরাগ এত বেশি যে, সে দিদির জন্যে সুরেশ্বরের কাছে যে কোনও রকম দীনতা প্রকাশ করে ফেলতে পারে। তাদের সংসারের অনেক কথা আছে যা একান্তভাবেই তাদের কথাদুর্বলতার মুহূর্তে গগন কী সে সব কথাও সুরেশ্বরের কাছে না বলে থাকতে পারত।

হৈমন্তী এ সব চায়নি। সে চায় না–তার মা, মামা বা ভাইয়ের কথাবার্তা থেকে সুরেশ্বর বুঝতে পারে তারা দীনতা প্রকাশ করছে। গগন এখানে ভিক্ষা চাইতে আসেনি, সুরেশ্বরের কাছে তারা কেউ আবেদন জানাচ্ছে না, ভিক্ষাও চাইছে না। তাদের সংসারের মর্যাদাটুকু হৈমন্তী নষ্ট হতে দিতে চায় না; সেই সঙ্গে নিজের মর্যাদা।

গগনকে নিজের কাছে রাখার বড় কারণ হৈমন্তী তাকে আগলে রাখবে। গগনকে সে এমন কিছু করতে বা বলতে দেবে না যাতে সুরেশ্বরের অহমিকা বোধ আরও স্ফীত হয়ে ওঠে। সংসারে এমন মানুষ আছে যারা এই অহমিকাকে সম্বল করে আত্মচরিতার্থতা লাভ করে, খুশি হয়। সুরেশ্বর সে-জাতের মানুষ কি না তা নিয়ে মাথা ঘামানোর প্রয়োজন হৈমন্তীর নেই, কিন্তু তার বাড়ির লোকের আচরণে যদি কাতর আবেদন ও ভিক্ষার মনোভাব প্রকাশ পায় সুরেশ্বরের অহমিকা বোধ তৃপ্ত হতে পারে। গগনকে হৈমন্তী তেমন কিছু করতে দেবে না, বরং যতটা সম্ভব গগনকে সে সুরেশ্বরের কাছ থেকে তফাত রাখার চেষ্টা করবে। প্রয়োজন হলে গগনকে সে তার পক্ষে টেনে এনে সুরেশ্বরের সঙ্গে লড়তেও রাজি, তবু ওই মানুষটার কাছে আত্মসম্মান সে নষ্ট করবে না, কাউকে করতে দেবে না।

সুরেশ্বরের সঙ্গে তার সম্পর্ক ইদানীং প্রায় এক ধরনের বিশ্রী তিক্ততার মধ্যে এসে পড়েছে। সুরেশ্বর পরে আবার চেষ্টা করেছিল হৈমন্তী যেন দুবেলা হাসপাতাল খুলে রাখে, তার সুবিধে মতন। হৈমন্তী দুবেলা হাসপাতালে আসতে রাজি হয়নি, তবে সে আজকাল বেলায় আরও এক ঘণ্টা বেশি থাকে। তাতে তার স্নান খাওয়াদাওয়া বিশ্রামের অসুবিধে ঘটছে। তা ঘটুক, তবু নিজের জেদ থেকে হৈমন্তী নড়বে না। সুরেশ্বর হৈমন্তীর এই আচরণে ক্ষুব্ধ হয়েছে, হৈমন্তীর জন্যে দুশ্চিন্তা জানিয়েছে, কিন্তু বিষয়টা নিয়ে কোনও পীড়াপীড়ি করেনি।

সেদিন অবনীর সঙ্গে একটু রাত করে ফেরার সময় আশ্রমের বাইরে রাস্তায় সুরেশ্বরকে হৈমন্তী ঘুরে বেড়াতে দেখেছিল। অবনী দেখতে পায়নি। সুরেশ্বর ঠিক কেন যে অন্ধকারে পথে ঘুরে বেড়াচ্ছিল হৈমন্তী জানে না, তবে তার সন্দেহ হয়েছিল, মালিনীর কাছে হৈমন্তীর একলা স্টেশন যাবার কথা জানতে পেরে, এবং সন্ধের পরও হৈমন্তী না ফিরে আসার জন্যে বিরক্ত বা অসন্তুষ্ট হয়ে সুরেশ্বর ওইভাবে ঘুরে বেড়াচ্ছিল। সন্ধের বাসে যখন ফেরেনি তখন যে অবনীর গাড়িতে ফিরবে একথা জেনেও সুরেশ্বর কেন অধৈর্য হচ্ছিল? হয়তো সে কিছু দেখতে চাইছিল। যদি সুরেশ্বর মনে মনে কিছু দেখার আশা নিয়ে বাইরে অপেক্ষা করে থাকে সেদিন, তবে সে দেখেৰ্ছে হৈমন্তী আর অবনী পাশাপাশি বসে রাত্রে আশ্রমে ফিরে আসছে।

পরের দিন এ প্রসঙ্গ নিয়ে কোনও কথা ওঠেনি। সুরেশ্বর আসেনি, বা হৈমন্তীকে ডেকে পাঠায়নি। মালিনীকেও কিছু জিজ্ঞেস করেনি হৈমন্তী। হতে পারে, সুরেশ্বর সেদিন রাত্রে শীতের মধ্যে এমনিই ঘুরে বেড়াচ্ছিল, তার কোনও উদ্দেশ্য ছিল না, হৈমন্তীর ফেরা না-ফেরার জন্যে তার উদ্বেগ বা ব্যস্ততাও ছিল না। তবু সেদিন যা ঘটেছে তাতে হৈমন্তী কোথায় যেন খানিকটা তৃপ্তি অনুভব করেছে।

কয়েক দিন পরে অন্য রকম এক ঘটনা ঘটল। পাটনা যাবার আগে অবনী দেখা করতে এসেছিল। তখন অন্ধকার হয়ে আসছে, হৈমন্তী বিকেলে খানিকটা বেড়িয়ে ঘরে ফিরেছে, অন্ধ আশ্রমের মাঠে গাড়ি দাঁড়াল অবনীর। হৈমন্তী অবনীকে নিয়ে নিজের ঘরে চলে এল। অনেকক্ষণ ছিল অবনী, গল্পগুজব করল, চা খেল, তারপর চলে গেল। সুরেশ্বরের সঙ্গে দেখা করার ইচ্ছে তার ছিল, কিন্তু গল্পগুজবের মধ্যে উঠি উঠি করেও আর ওঠা হয়নি। শেষ পর্যন্ত সুরেশ্বরের সঙ্গে তার দেখা হয়নি।

পরের দিন বেলায় হাসপাতালের সামনে সুরেশ্বরের সঙ্গে হৈমন্তীর দেখা।

সুরেশ্বর বলল, কাল অবনীবাবু এসেছিলেন?

হ্যাঁ, পাটনায় যাচ্ছেন…

পাটনা! …কখন এলেন কখন গেলেন জানতেই পারলাম না। পাটনা যাবেন জানলে একটা কাজের ভার দিতাম। …কখন যাবেন?

আজ রাত্তিরের গাড়িতে।

ও! …দেখি…, সুরেশ্বর যেন মনে মনে কিছু ভাবল, তারপর বলল, কাল একবার দেখা হলে ভাল হত।

হৈমন্তী পলকের জন্যে সুরেশ্বরের মুখের দিকে তাকাল, তারপর একেবারে আচমকা কেমন যেন কোনও অদ্ভুত এক ইচ্ছার তাড়নায় বলে ফেলল, সময় পাননি। কথায় কথায় দেরি হয়ে গেল।

সুরেশ্বর যে হৈমন্তীকে লক্ষ করছে হৈমন্তী না তাকিয়েও বুঝতে পারল। পরে সুরেশ্বর বলল, তাই হবে, সময় পাননি।

কথাটা হৈমন্তীর কানে খুব শ্রুতিমধুর হয়নি।

.

২০.

জায়গাটা গগনের খুব পছন্দ হয়ে গেল। এত পছন্দ যে প্রথম দিনটা সে পায়ে হেঁটে আশেপাশে সারাটা সকাল-দুপুর ঘুরে বেড়াল, শীতের লালচে ধুলো মাখল, রোদে পুড়ল, পুড়ে মাথার চুল রুক্ষ করে বিকেল নাগাদ বনের দিক থেকে বেড়িয়ে ফিরল। ফিরে এসে বলল, ব্রিলিয়ান্ট জায়গা, বুঝলি দিদি, চোখ দুটো জুড়িয়ে যায়। কলকাতায় আমরা তাকাতে পারি না, দু হাত অন্তর অবস্ট্রাকসান, এখানে ফুল ভিউ; এসব জায়গায় তাকিয়েও কী আরাম!

গগন এই রকমই, অল্পতেই উচ্ছ্বসিত, সামান্যতেই সন্তুষ্ট। সে বেড়াতে এসেছে এই ভাবটা তার প্রথম দুটো দিন পুরোপুরি বজায় থাকল। বেড়িয়ে, খেয়ে-দেয়ে, ঘুমিয়ে গল্প-গুজব করে দিব্যি কাটিয়ে দিল, গুরুডিয়ার শীত নিয়ে সুরেশ্বরের সঙ্গে হাসিতামাশা করল, অন্ধ আশ্রমের গল্প-গুজব শুনল, কপি কড়াইশুটির স্বাদ, ডিমের কুসুমের রং নিয়েও অনর্গল কথা বলে গেল। বোঝার জো ছিল না, গগনের মনে অন্য কোনও উদ্দেশ্য আছে। আসল কথাটা সে ঘুণাক্ষরেও তুলল না; সুরেশ্বরকে বুঝতে দিল না কয়েকটা দিন বেড়িয়ে যাওয়া ছাড়া তার অন্য কোনও কাজ আছে।

সুরেশ্বরের কাছে কথাটা না তুললেও গগন তার উদ্দেশ্য সম্পর্কে সচেতন ছিল। গগন হৈমন্তীকে খুব সাবধানে লক্ষ করছিল, এবং বোঝবার চেষ্টা করছিল। দিদির মনের ভাবটা ঠিক কী ধরনের। আড়ালে দুই ভাই বোনে যেসব কথাবার্তা হত তার বেশির ভাগটাই ছিল ব্যক্তিগত; সেই কথার মধ্যে সুরেশ্বরের প্রসঙ্গটা অবধারিত ছিল। গগন সেসব ক্ষেত্রে নিজে বেশি কিছু বলত না, যতটুকু বলত তাতে তার কিছু চালাকি থাকত। সে জানতে চাইত, দিদির মনের কোনও অদলবদল ঘটেছে কি না, দিদি চেষ্টা করে কোনও কথা লুকোতে চাইছে, নাকি তার এই তিক্ততা ও বিরক্তি নেহাতই অভিমান। এক এক সময় তার মনে হত, দিদির মধ্যে এখন যে রাগ, বিতৃষ্ণা, ক্ষোভ দেখা যাচ্ছে সেটা প্রকৃতপক্ষে কিছু নয়, প্রণয় কলহ হলেও হতে পারে; আবার অন্য সময় দিদির কথাবার্তা থেকে গগনের সন্দেহ হত, ব্যাপারটা ঠিক সরল নয়, দিদির মনের কোথাও এতদিনের সঞ্চিত বিশ্বাস ও প্রত্যাশা নষ্ট হয়ে গেছে।

তৃতীয় দিনে গগন গেল স্টেশনে বেড়াতে। সঙ্গে হৈমন্তী। সুরেশ্বর যেতে পারল না। অবনীর সঙ্গে আলাপ পরিচয় সেরে ফেরার পথে বিজলীবাবুর সঙ্গে দেখা। বিজলীবাবুর সঙ্গে পরিচয়টা প্রথম দিনেই ঘটেছিল, বাস স্ট্যান্ডে। বিজলীবাবু শুধোলেন, কী, কেমন লাগছে? গগন আবার হেসে বলল ওয়ান্ডারফুল। বিজলীবাবু বললেন, জায়গাটা তো ভালই, বিশেষ করে এ সময়। তা এদিকে এসে থাকুন দু-চার দিন, ঘুরে ফিরে বেড়ানো যাবে। গগন বলল সেসব ঠিক হয়ে গেছে অবনীবাবুর সঙ্গে…। বিজলীবাবু মাথা নাড়লেন সায় দিয়ে, তবে তো ব্যবস্থা হয়েই গেছে। দু-চারটে হালকা কথার পর গগনরা বিদায় নিল।

বাস স্ট্যান্ডে বাস হর্ন দিচ্ছিল, শেষ সময়ের যাত্রী ডেকে নিচ্ছে। আজ তেমন যাত্রী নেই। এই শীতের সময়টায় সন্ধের বাসে সাধারণত ভিড় থাকে না। ফার্স্ট ক্লাসে কোনও যাত্রী নেই। গগনরা উঠল। পেছনে কিছু যাত্রী বোঁচকা বুচকি নিয়ে বসে কলরব করছে।

বাস ছাড়ল সামান্য পরেই। সঙ্গে সঙ্গে কনকনে বাতাসের ঝাঁপটা এল। পাশের জানলা দুটো তুলে দিল গগন, তাদের মাথার ওপরে মিটমিটে বাতিটা আজ জ্বলছে না। বাজার ছাড়িয়ে আসতেই পৌষের শীতে গায়ে কাঁটা দিল। গগন গলায় মাফলার জড়িয়ে ধীরে সুস্থে সিগারেট ধরাল; হৈমন্তী দুহাতে কান চাপা দিয়ে আচমকা শিউরে ওঠার ভাবটা যেন সামলে নিল।

বাজার ছাড়িয়ে, থানা ছাড়িয়ে শেষ পর্যন্ত অন্ধকারের মধ্যে এসে পড়ল বাস, দুপাশে কোথাও এক ফোঁটা আলো নেই, অসাড় চরাচর, সামনে জোরালো আলোর স্রোত ফেলে বাসটা চলেছে, পেছনে যাত্রীরা কথা বলছে, কাশছে, বিড়ি ফুকছে।

গগন বলল, বেড়াবার ব্যবস্থা ভালই হল, কী বল?

 তা হল। কিন্তু আমি তোদের সঙ্গে অত হুড়তে পারব না।

 না পারলি; রাত্রে তোকে সঙ্গে নেওয়াও উচিত হবে না। দিনের বেলাটায় থাকবি।

দেখি…, দিনে তো আবার হাসপাতাল।

সে ম্যানেজ করা যাবে।

হৈমন্তী মুখ ফিরিয়ে গগনকে দেখবার চেষ্টা করল, অন্ধকারে তেমন কিছু দেখা যায় না, পেছনের আলোটুকু সম্বল। তোর সুরেশদাকে বলবি নাকি?

বললেই বা! বড়দিনের সময় একটু বেড়াবি তাতে আপত্তির কী আছে।

না, বলবি না।

গগন সিগারেটের ধোঁয়া গিলে নিয়ে হৈমন্তীর দিকে পুরোপুরি মুখ ফিরিয়ে বসল। হৈমন্তীর গলার কাছে শাড়ির ভাঁজটা ফুলে আছে, চিবুক ঢাকা পড়েছে প্রায়, গায়ের গরম কোটটা কালো, অন্ধকারে শুধুমাত্র মুখটুকু অবস্থা দেখা যায়।

গগন সামান্য অপেক্ষা করে বলল, তোর ব্যাপার-ট্যাপার আমার কাছে মিস্টিরিয়াস লাগছে।

হৈমন্তী কথার জবাব দিল না।

গগন চুপচাপ কিছু ভাবছিল। ধীরে ধীরে কয়েক মুখ সিগারেটের ধোঁয়া খেল, তারপর খুব ঘনিষ্ঠ গলায় মৃদুস্বরে বলল, তোর ইচ্ছেটা কী?

হৈমন্তী এবারও কথার কোনও জবাব দিল না। গগনের সঙ্গে একদিন নিভৃতে তার যেসব কথাবার্তা হয়েছে তাতে অন্তত একটা কথা সে স্পষ্ট করে বুঝিয়ে দিয়েছে, সুরেশ্বরের কাছে তার আর কোনও রকম প্রত্যাশা নেই। ওই মানুষটিকে সে আগে যেমন করে চিনত তার সঙ্গে আজকের সুরেশ্বরের পার্থক্য যথেষ্ট। সে দিনের সাধারণ মানুষ আজ কতখানি অসাধারণ হয়েছে তা নিয়ে মাথা ঘামানোর দরকার তার নেই। হতে পারে সুরেশ্বর মাটি ছেড়ে আকাশে উঠেছে, ছোটখাটো সুখ থেকে বড় সুখের অন্বেষণ করছে; কিন্তু তাতে হৈমন্তীর কী? হৈমন্তী কি এসব চেয়েছিল? না, সে চায়নি, চায় না।

অপেক্ষা করে করে শেষে গগন বলল, দিদি, তুই আমার কাছে স্পষ্ট করে বল। বলে গগন আগ্রহের সঙ্গে তাকিয়ে থাকল।

হৈমন্তী নীরব। তার নিশ্বাস পড়ল। বাসের পেছনের যাত্রীদের মধ্যে কে যেন দেহাতি সুরে দেহাতের গান গাইছে গুন গুন করে; একটানা প্রায় একই রকমের একটা শব্দ বাসের, কানে সয়ে গেছে, মনে হয় যেন এই শব্দটাই চিরস্থায়ী।

দিদি…

উঁ।

তোকে তো কেউ জোর করে এখানে আনেনি।

ঠকিয়ে এনেছে…

এটা তোর রাগের কথা নয় তো?

 না।

তুই তো সব জানতিস।

 না, জানতাম না। আমি এতদিন যা করেছি অন্যের মন রাখতে করেছি…

 এতদিন।

এতদিন বই কি। ডাক্তারি পড়ার, ডাক্তার হবার শখও আমার ছিল না। আমার ভাল লাগে না। তবু সাত আট বছর এই বেগার খাটলাম কেন?

গগন সিগারেটের টুকরোটা ফেলে দিল। কথাটা তাদের পরিবারে কেউ যে বুঝত না তা নয়, সকলেই বুঝত: দিদির ডাক্তারি পড়ার আগ্রহটাই ছিল সুরেশদার। মা বা মামার তেমন মত ছিল না। অথচ তখন কেউই খুব একটা বাধা দেয়নি; দেবার মতন মনের অবস্থা ছিল না। সকলেই ধরে নিয়েছিল সুরেশ্বরের আগ্রহ তার ভাবী পত্নী সম্পর্কে, হৈমন্তীকে সে মনোমতো করে গড়ে নিতে চায়। ওটা তার শখ হয়তো। তা ছাড়া তখন তাদের সংসার সুরেশ্বরের প্রতি এত কৃতজ্ঞ ও তার প্রতি সকলের অনুরাগ এত বেশি যে, সুরেশ্বরের ইচ্ছা ও সাধ অপূর্ণ রাখতে কেউ চায়নি। বলতে গেলে, গগনের এখন সন্দেহ হয়, দিদি সম্পর্কে তাদের সংসারের মনোভাবটা তখন যুক্তিযুক্ত হয়নি। এমনকী–মনে মনে সকলেই যেন সুরেশদাকে দিদির অভিভাবক জেনে নিয়ে দিদিকে সুরেশদার মনোমতন চলতে দিয়েছিল। পরে, বছর দুই তিন পরে, মার কেমন সন্দেহ হয়; সুরেশদা তখন কলকাতা ছেড়েছে, মাঝে মধ্যে আবার চলে যায়। মার মনে খটকা লাগলেও দিদি তখনও কিছু বোঝেনি। বা বুঝলেও শান্ত হয়ে থেকেছে, বিশ্বাস রেখেছে। তারপর যতই দিন গেছে মা ততই অস্থির অধৈর্য হয়ে উঠেছে। সুরেশদা যে কী করছে, কেন এই সব আশ্ৰমফাশ্রম–এতে কী হবে মা বুঝত না, মার ভালও লাগত না। মা এসব থেকেই সাবধান হতে চেয়েছিল। অথচ দিদির মন মা ভাল করে জানত বলেই কিছু করতে পারেনি। দিদি যেন তখন মাঝনদীতে এসে পড়েছে, ফিরে যাওয়া অসম্ভব, বাকিটুকু সে পার হয়েছে প্রত্যাশা নিয়েই, দ্বিধা যদি এসেও থাকে তার অন্য কোনও উপায় ছিল না। এখন আর দিদির কোনও ভরসা নেই।

দিদির জন্যে গগনের দুঃখ হল। তার খারাপ লাগছিল। সুরেশদার সঙ্গে এখন পর্যন্ত সে কোনও কথা বলেনি, আজ বলবে। দিদির পক্ষে যা বলা সম্ভব নয়, গগনের পক্ষে তা বলতে আটকাবে না।

গগন সামান্য কুঁজো হয়ে গালে হাত দিয়ে বসে থাকল কিছু সময়। ভাবছিল। কনকনে ঠাণ্ডা বাতাসে মুখ যেন অসাড় হয়ে আসছিল। মাফলারটা কানের ওপর চাপা দিল গগন। তারপর বলল, সুরেশদার সঙ্গে তোর সরাসরি একটা কথা হওয়া উচিত ছিল এত দিনে। তুই তো কমদিন আসিসনি।

হৈমন্তী চুপ করে থাকল। তার মনে হল না, যা সে বুঝেছে এর বেশি কিছু তার বোঝার ছিল। এতটা বয়সে সুরেশ্বরের সঙ্গে সে ছেলেমানুষের মতন গলা ফাটিয়ে ঝগড়া করবে নাকি?

তুই কলকাতায় গিয়ে আবার এলি কেন–তাও তো আমি বুঝি না, গগন বলল।

 সঙ্গে সঙ্গে জবাব দিল না হৈমন্তী, সামান্য পরে বলল, দেখতে

 দেখতে! কী দেখতে?

 মহাপুরুষ–, হৈমন্তীর কথার সুরে শ্লেষ ছিল।

 গগন কিছু বুঝতে পারল না। ভাবল, দিদি উপহাস করছে।

হৈমন্তী যেন বুঝতে পারল গগন কী ভাবছে; নিজের থেকেই আবার বলল, তুই ভাবছিস ঠাট্টা করছি। ঠাট্টা নয়; সত্যিই আমি মানুষটাকে দেখার জন্য থেকে গিয়েছি। হৈমন্তীর বলার মধ্যে উপহাস থাকলেও কোথাও যেন তার অতিরিক্তও কিছু ছিল, সেটা যে কী স্পষ্ট বোঝা গেল না।

গগন কথাটায় তেমন কান দিল না। বলল, অনেক দেখেছিস? এবার নিজেকে দেখ।

হৈমন্তী গাড়ির সামনের দিকে তাকিয়ে থাকল; ড্রাইভারের পিঠ, কয়েকটা শিকের ফাঁক দিয়ে অতি মৃদু একটা আলো, ইঞ্জিনের শব্দ…। তাকিয়ে থাকতে থাকতে হৈমন্তী মৃদু গলায়, যেন আপনমনেই বলল, মানুষ নিজেকে কত বড় করে দেখতে চায় তা যদি তুই জানতিস, গগন।

গগন ভাবছিল, দিদিকে এবার সে স্পষ্ট করে একটা কথা জিজ্ঞেস করবে। জিজ্ঞেস করবে, তুই ঠিক করে বল, সুরেশদাকে তুই এখনও ভালবাসিস কি না? হৈমন্তীর কথায় তার প্রশ্নটা মুহূর্তের জন্যে তেমন এলোমেলো হয়ে গেল। নিতান্ত কথার জবাব দেবার জন্যে বলল, সুরেশদার কথা বলছিস।

কী রকম?

নিজেদের আর মানুষ ভাবে না। তোর আমার মতন হলে তাদের মহত্ত্ব থাকবে না–এই ভয়ে মেকি সাজ পরে থাকে। লোকের কাছে এমন ভাব দেখায় যেন তারা ঠাকুর দেবতা।

হ্যাঁ, সেই রকম…, হৈমন্তী এবার উত্তেজিত হয়ে ওঠার মতন হয়েছিল; মিষ্টি করে কথা বললে, বিনয়-বিনয় ভাব করে থাকলেই মানুষ ভগবান হয় না। আমি মাটির ঘরে থাকি, জঙ্গলে এসে অন্ধ আশ্রম খুলেছি–তোমরা দেখো আমি কত বড়! আমি মহাপুরুষ। –এসবই লোক-দেখানো। …আসলে মানুষটা কী তা আমি দেখতে পাচ্ছি।

হৈমন্তীর গলার স্বর উঁচু হয়ে গিয়েছিল। গগন দিদির গায়ে হাত দিল, যেন খেয়াল করিয়ে দিল সামনে ড্রাইভার রয়েছে।

অল্পক্ষণ কেউ আর কথা বলল না। বাস লাঠার মোড়ে পৌঁছে এল।

গগন আবার একটা সিগারেট ধরাল। তারপর অন্যমনস্কভাবে বলল, তুই কলকাতায় ফিরে চল।

না– মাথা নাড়ল হৈমন্তী।

 কেন যাবি না?

এখন যাব না। বলে চুপ করে থাকল হৈমন্তী সামান্য, তারপর হঠাৎ বলল, আমার অসুখের সময় অনেকগুলো টাকা দিয়েছিল ও। কত টাকা আমি জানি না। মা আর মামা মোটামুটি জানে। আমায় তুই জানাস তো কলকাতায় গিয়ে।

গগন অবাক হয়ে তাকাল। কেন?

ঋণ শোধ করব, হৈমন্তী কেমন এক গলা করে বলল, আমার টাকা থাকলে আমি ওকে টাকাটা ফেরত দিয়ে দিতাম।

গগন হাসল না, অথচ কথাটার গুরুত্বও দিল না; বলল, এসব তোর ছেলেমানুষি।

তোরা যখন হাত পেতে টাকাটা নিয়েছিলি তখন তো ছেলেমানুষি মনে হয়নি।

গগন যেন অস্বস্তি বোধ করল। চুপ করে থাকল সামান্য, তারপর বলল, শুধু টাকা তো দেয়নি, আরও কিছু দিয়েছিল…।

কথাটার অর্থ বুঝতে হৈমন্তীর কোনও অসুবিধে হল না। বলল, আর যা দিয়েছিল–সেটা যদি দিয়েও থাকে–ও একলা দেয়নি; আমিও দিয়েছিলাম। হৈমন্তী থেমে গেল, কয়েক মুহূর্ত আর কথা বলল না, শেষে বলল, মনে মনে ওর যদি কোনও অহঙ্কার থাকে তবে একদিন আমার অসুখের সময় দয়া করে বাঁচিয়ে ছিল বলে, অন্য কোনও অহঙ্কার ওর থাকতে পারে না।

বাস লাটঠার মোড়ে এসে দাঁড়াল। দুজন মাত্র যাত্রী। তারা নামল। কে যেন উঠল একজন। বাস ছাড়ল। গুরুডিয়ায় যাবে।

সারা মাঠ জুড়ে পৌষের হিম হাওয়া হা হা করে ছুটে বেড়াচ্ছে যেন গায়ের হাড়ে শীত ফুটছিল, মাঠের প্রান্ত দিয়ে শেয়াল ডেকে যাচ্ছে। কাঁচা রাস্তা দিয়ে বাসটা টাল খেতে খেতে চলেছে।

গগন হৈমন্তীর গায়ের দিকে সামান্য ঘন হয়ে বসে ইতস্তত করে শেষে বলল, দিদি, সুরেশদাকে তোর আর ভাল লাগে না?

হৈমন্তী মাথা নাড়ল। না, লাগে না।

তোর মন বদলে গেছে?

 জানি না। …হয়তো গেছে।

তা হলে এখানে থেকে লাভ কী! কলকাতায় ফিরে চল।

এখন না। …

কী করবি এখানে থেকে–?

মজা দেখব। … সুরেশমহারাজ যতটা চকচক করছে তাতে লোকে তাকে সোনা ভাবে; আমি জানি, ও-মানুষ সোনা নয়, ও কত ছোট তা আমার খানিকটা জানা হয়েছে, বাকিটা দেখব। হৈমন্তী সমস্ত কথাটাই ব্যঙ্গ করে বলার চেষ্টা করল, অথচ গগন বুঝতে পারল দিদি যেন কীসের এক আক্রোশ অনুভব করছে।

আশ্রমে ফিরে এসে গগন বলল, তুই যা, আমি একটু সুরেশদার ওখান থেকে ঘুরে আসি।

হৈমন্তী বাধা দিয়ে কিছু বলল, গগন শুনল না; পিছন থেকে ডাকল হৈমন্তী, গগন সাড়া দিল না, অন্ধকারের মধ্যে হনহন করে চলে গেল। ওকে আর দেখা গেল না।

সুরেশ্বরের বাড়ির বারান্দায় এসে গগন যেন থমকে দাঁড়াল। এতক্ষণ সে কেমন যেন এক আবেগের বশে চলে এসেছে, কেন আসছে তা যেন তার খেয়াল ছিল না। বারান্দায় এসে দাঁড়িয়ে সে আলো নজর করতে পারল, সুরেশ্বরের ঘরে আলো জ্বলছে। দুমুহূর্ত নিস্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে থাকল, ঘরের মধ্যে সাড়া শব্দ নেই।

গগন ডাকল।

ঘরের মধ্যে থেকে সাড়া দিল সুরেশ্বর, গগন, এসো।

কাগজপত্র সাজিয়ে নিয়ে বসে সুরেশ্বর কাজ করছিল, টেবিলের একপাশে লণ্ঠন জ্বলছে। গগনকে দেখে চেয়ারটা সামান্য সরিয়ে নিয়ে আরাম করে বসল সুরেশ্বর, হাত মাথার ওপর তুলে ক্লান্তি নিবারণ করল। তারপর গগনবাবু, এই মাত্র ফিরলে নাকি? সুরেশ্বর সহাস্য গলায় বলল।

হ্যাঁ। গগন অন্য চেয়ারটায় বসল।

বাসের শব্দ শুনলাম। …কেমন বেড়ানো হল?

ভাল।  

কোথায় কোথায় গেলে?

অবনীবাবুর বাড়িতে। সেখানেই ছিলাম। আমরা একটু বেড়াব চার দিকে, অবনীবাবুর সঙ্গে একটা প্ল্যান করা গেল; ওঁর গাড়িটা পাওয়া যাবে।

তা হলে তো কাজ গুছিয়ে এসেছ! কোথায় কোথায় যাচ্ছ?

গগন বেড়াবার জায়গাগুলোর নাম বলল, শেষে রাত্রে তারা কোন জঙ্গলে যাবে, কোথায় কোন হাইড্রো-ইলেকট্রিক পাওয়ার স্টেশনের কাছে ইনসপেকশান বাংলোয় রাত কাটাবে, হরিণ দেখতে ছুটবে কোন নদীর কাছে ইত্যাদি সংক্ষেপে বর্ণনা করল।

সুরেশ্বর মনোযোগ দিয়ে শুনল। শেষে বলল, রাত্তিরে জঙ্গলের মধ্যে বেশি যেও না; তুমি যে জঙ্গলের কথা বলছ ওটা তেমন ভাল না। বন্দুক-টক সঙ্গে থাকবে?

না। আমরা কেউ ও-বিদ্যে জানি না।

তবে…সুরেশ্বর হাসল, খালি হাতে অ্যাডভেঞ্চার।

গগন পকেটে হাত ঢুকিয়ে সিগারেট খুঁজতে লাগল। দিদিকে আমাদের সঙ্গে নিয়ে যাব। রাত্তিরে জঙ্গলে যাবার দিন নেব না, অন্য সময় নিয়ে যাব।

হেম যাবে বলছে?

হ্যাঁ, যাবে না কেন! ও তো কোথাও যায়নি। আমি থাকতে থাকতে ঘুরে না এলে আর হবে না। গগন সিগারেট বের করে ধরাল।

সুরেশ্বর গায়ের মোটা গরম চাদরটা গুছিয়ে নিল! বেশ তো যাক।

সকাল-দুপুর ওর হাসপাতাল। গগন কী ভেবে মনে করিয়ে দিল।

 হাসপাতাল ঠিক দুপুরে নয়। যাকগে, সে ও ব্যবস্থা করে নেবে।

গগন পর পর কয়েক টান সিগারেট খেল। সে ঠিক যে জিনিসটা বলতে চায় তার ভূমিকা কীভাবে করা যায় বুঝে উঠতে পারছিল না। না পারায় মন চঞ্চল ও অস্থির হয়ে ছিল।

খুব শীত…। ঠাণ্ডা লেগে গেছে গলায় গগন গলার কাছটায় টিপতে লাগল। তোমার ভরতু একটু চা খাওয়াবে না?

ভরতুটার জ্বর হয়েছে। …আমি করে দিচ্ছি।

তুমি! ..না না…থাক…

থাক কেন, দু কাপ চা আমি করতে পারব না…সকালে আমি নিজের চা নিজে করে খাই, তা জানিস। সুরেশ্বর উঠল। গগনকে তুই-টুই করে কথা বলার অভ্যেস সুরেশ্বরের পুরনো।

গগন বলল, আমি করছি, কোথায় কী আছে বলো?

বলার চেয়ে করাটা সোজা– সুরেশ্বর সস্নেহে হেসে বলল। তা হলে ও ঘরে চল, স্পিরিট ল্যাম্পে জল গরম বসিয়ে দিয়ে গল্প করা যাক।

পাশের ঘরের বাতিটা যেন প্রদীপের মতন মিটমিট জ্বলছিল; শিখাটা বাড়িয়ে দিল সুরেশ্বর। ঘরের এক কোণে মিটসেফের পাশে ছোট টুলে স্পিরিট ল্যাম্প। স্পিরিট ল্যাম্প জ্বেলে চায়ের জল বসাল সুরেশ্বর।

শোবার ঘরে সুরেশ্বরের সাধাসিধে বিছানা, এক পাশে লোহার ছোট মতন এক আলমারি, আলনায় কয়েকটি জামাকাপড়, একদিকে কাঠের সাধারণ র‍্যাকে কিছু বই, হালকা একটা টিপয়, ক্যাম্বিসের চেয়ার একটা। দেওয়ালে মার ছবি।

গগন ও-ঘর থেকে একটা চেয়ার টেনে আনল, জুতোজোড়াও খুলে রাখল ওপাশে। সু

রেশ্বর বলল, আমার সঙ্গে এক জায়গায় বেড়াতে যাবি?

কোথায়?

মিশনারিরা একটা মেলা করে ক্রিসমাসের সময়, শহর থেকে মাইল আষ্টেক দূরে। আদিবাসী দেখবি, নাচ দেখবি, এদিককার ক্রিশ্চান দেখবি। নানারকমের মজা থাকে মেলায়। যাবি নাকি?

.

সুরেশ্বর মেলাটার নানা বিবরণ শোনাতে লাগল; গাধার পিঠে উলটো দিকে মুখ করে বসে কে কতটা ছুটতে পারে–তার রগড়, উলের বল ছুঁড়ে বেলুন ফাটানো, তাসের ম্যাজিক, লটারি খেলা ইত্যাদি। আসলে মেলাটা এ দিকের দেশি মিশনারিদের চেষ্টায় অনেক দিন থেকে চলে আসছে। শালবনের মাঠে বসে যিশু-ভজনা, দরিদ্রদের পুরনো গরম জামা কাপড় বিতরণ, শিশুদের হাতে কিছু দেওয়া-থোওয়া। ওরই মধ্যে কোনও সেবা প্রতিষ্ঠানের জন্যে কিছু চাঁদা সংগ্রহ।

গগন ঠাট্টা করে জিজ্ঞেস করল, তুমি কি চাঁদার কৌটো নিয়ে যাচ্ছ?

সুরেশ্বর চায়ের জলে চা-পাতা মেশাতে মেশাতে হেসে বলল, হ্যাঁ; ভাবছি তোর গলায় একটা চাঁদার কৌটো ঝুলিয়ে দেব।

তা হলে আমি নেই। গগন ভয়ের ভাব করে হাত মাথা নাড়ল।

সুরেশ্বর জোরে জোরে হাসতে লাগল। শেষে বলল, না, তোকে চাঁদা তুলতে হবে না। আমরা ওখানে ম্যাজিক লণ্ঠন দেখাই…

ম্যাজিক লণ্ঠন?

 স্লাইড শো। দেখিসনি? কলকাতায় সিনেমা দেখিস না..

তা তো বুঝতেই পারছি। কিন্তু কীসের ম্যাজিক লণ্ঠন দেখাও?

চোখের। কী করে চোখ ভাল রাখতে হয়, চোখের কী কী রোগ হয়–এই সব। ওদের কাছে এটা দেখানো দরকার। সুরেশ্বর বলল। বলে চায়ের কাপ গুছিয়ে চা ঢালতে লাগল।

গগন একরকম মন নিয়ে এসেছিল, অথচ কথায় কথায় তার মন অন্য দিকে ভেসে যাচ্ছে বুঝে অস্বস্তি অনুভব করতে লাগল। এই লোকটিকে গগন বরাবরই আত্মীয়ের মতো ভেবে এসেছে, ভক্তিশ্রদ্ধা করেছে বড় ভাইয়ের মতন, ভালবেসেছে বন্ধুর তুল্য, তর্ক করেছে, চেঁচামেচি করেছে, আবার সমীহ করতেও কোথাও বাধেনি। দিদির সঙ্গে সুরেশদার সম্পর্কের এই তিক্ততা তার ভাল লাগেনি। মনে মনে সে কষ্ট পাচ্ছিল। তাদের সংসারের কেউই চায় না–দিদির সঙ্গে সুরেশদার সম্পর্কটা এই অবস্থায় বরাবরের মতন ভেঙে যাক। দিদির যথেষ্ট বয়েস হয়ে গেছে, এ বয়সে দিদিকে কনে সাজিয়ে দেখিয়ে মা দিদির বিয়ে দেবে সে আশাও করে না। তা ছাড়া দিদির জীবনে এতকাল যা মূল্যবান হয়ে ছিল তা রাতারাতি তুচ্ছ হয়ে যাবে যে তাও নয়। মা, মামা সকলেই যা চায় তা এমন কিছু বেশি চাওয়া নয়। সমাজ সংসারে বাস করতে হলে তার কিছু কিছু নিয়ম তো মানতেই হবে। এভাবে দিদিকে রেখে দিতে পারে না সুরেশদা। যা সঙ্গত, যা উচিত, দৃষ্টিকটু নয়, অথচ দিদি যাতে সুখী হতে পারে–তুমি তাই করো। কেউ তোমার আশ্রম তুলে দিতে বলছে না, কলকাতায় ফিরে যেতেও বলছে না। তোমার এই সেবাধর্মে যদি মতি থাকে থাক, কিন্তু একটি মেয়েকে কোন আশ্বাসে তার আত্মীয়েরা এমনভাবে ফেলে রাখতে পারে।

সুরেশ্বর চায়ের কাপ বাড়িয়ে দিল। নাও হে গগনবাবু, খেয়ে দেখো।

গগন চায়ের পেয়ালায় ঠোঁট ছোঁয়াল। সুরেশ্বর তার ক্যাম্বিসের চেয়ারটায় বসল। বসে চা খেতে লাগল।

সুরেশদা– গগন আস্তে গলায় বলল।

 সুরেশ্বর চায়ে চুমুক দিয়ে মুখ তুলল। বলো।

 গগন বিশ্রি এক অস্বস্তি অনুভব করছিল। সুরেশ্বরের দিরে তাকাতে পারল না। সুরেশ্বর অপেক্ষা করছে।

কী হল…? সুরেশদা বলে যে বসে থাকলি? কী ব্যাপার?

গগন চকিতের জন্যে হৈমন্তীর বিষণ্ণ, ক্ষুব্ধ, তিক্ত মুখ দেখতে পেল, গলা শুনতে পেল। মুখ তুলে সুরেশ্বরকে দেখল ক পলক গগন। তোমার সঙ্গে আমার কটা কথা আছে।

কী কথা? সুরেশ্বর সহজ গলায় শুধোল।

বলছি। …তুমি নিশ্চয় আমাদের ভুল বুঝবেনা। গগন জড়ানো গলা পরিষ্কার করে নেবার জন্যে চা খেল। হয়তো একটু সময় নিল নিজেকে ঘুছিয়ে নেবার জন্যে।

সুরেশ্বর বলল, আমার বোঝার ভুল না হলে তোদের ভুল বুঝব কেন?

না, বলে নিলাম। তুমি আমার চেয়ে বয়সে বড়, তোমার সঙ্গে আমাদের রিলেশান কী তা তুমিও জান। … ব্যাপারটা যেমনই হোক আমি চাই না এ নিয়ে ভুল বোঝাবুঝি কিছু হয়।

বেশ তো, হবে না।

 মা আমায় কয়েকটা কথা জানাতে বলেছে তোমাকে। মামাও বলেছে।

 তুই তো আমায় কিছু বলিসনি–

না, বলব বলব ভাবছিলাম, সুযোগ হচ্ছিল না। গগন বিছানার দিকে তাকাল, সুরেশ্বরের সঙ্গে চোখাচুখি হবার সঙ্কোচ সে অনুভব করছে।

সুরেশ্বর শান্তভাবে অপেক্ষা করছিল।

শেষ পর্যন্ত গগন দুর্বলতা ও সঙ্কোচ কাটিয়ে বলল, দিদির ব্যাপারে তুমি কী ঠিক করলে?

সুরেশ্বর নীরব থাকল। গগনের কথার জড়তা, তার অস্বস্তি, সঙ্কোচ থেকে হয়তো সুরেশ্বর অনুমান করতে পেরেছিল গগন এই ধরনের কোনও কথা তুলবে। বিস্মিত অথবা বিভ্রান্ত হবার মতন যেন কিছু ছিল না কথাটায়।

গগন আবার বলল, মা বড় ব্যস্ত হয়ে উঠেছে। মামা বলছিল, এভাবে দিদিকে এখানে রেখে দেওয়া যায় না। ..ওদের কোনও দোষ নেই। তুমি বুঝতে পারছ–দুজনেই বুড়ো হয়ে গেছে, নানা দুর্ভাবনা নিয়ে থাকে। দিদির কথাটা তারা ভুলে থাকতে পারে না। হাজার হোক মেয়ে তো, তার একটা ব্যবস্থা না হওয়া পর্যন্ত মনে শান্তি পাবে না। গগন যেন এলোমেলোভাবে বলছিল।

সুরেশ্বর চায়ের কাপটা মাটিতে নামিয়ে রাখল। গগনের দিকে সরাসরি তাকিয়ে থাকল কয়েক মুহূর্ত; তারপর বলল, হেম কি তোমাদের কিছু বলেনি, গগন?

না…, গগন মাথা নাড়ল, কী বলবে?

আমি ভেবেছিলাম কলকাতায় গিয়ে সে হয়তত কিছু বলবে মাসিমাকে।

আমি জানি না। গগন সুরেশ্বরের দিকে তাকিয়ে থাকল। তারপর বলল, দিদির সঙ্গে আমার কথা হয়েছে। কিন্তু সেটা তার কথা, তোমার তরফের কথা নয়।

সুরেশ্বর চুপ করে থাকল কিছুক্ষণ, ভাবছিল; শেষে বলল, গগন, আমার আজকাল মনে হয়, আমি কয়েকটা বড় রকম ভুল করেছি। হেমকে এখানে টেনে আনা আমার উচিত হয়নি। সে যে-জন্যে এসেছে আমি তাকে সে-উদ্দেশ্যে আনিনি। এখানে আমার কাছে তাকে বরাবর রাখা যাবে না। তোমরা যা ভাবছ তা হয় না। তাতে আরও অশান্তি বাড়বে। আমার এমন কিছু নেই যাতে হেমকে আর আমি সুখী করতে পারি।

গগন যেন কিছু সময় কেমন দিশেহারা হয়ে বসে থাকল, ভাবতে পারছিল না, কথা বলতে পারছিল না। অদ্ভুত এক বেদনা এবং আঘাত তাকে নির্বাক করে তুলছিল। শেষ পর্যন্ত কোনও রকমে নিজেকে সামান্য সামলে নিয়ে গগন বলল, তোমার কিছু নেই?

না। সুরেশ্বর মাথা নাড়ল।

দিদিকে তুমি ভালবাসতে…

বাসতাম। কিন্তু সে-ভালবাসায় আনন্দ পাইনি…

গগন অসহিষ্ণু হয়ে উঠেছিল। রুক্ষ গলায় বলল, এতদিন পরে হঠাৎ তোমার সেই জ্ঞানটা হল নাকি?

না– সুরেশ্বর শান্ত গলায় বলল, না গগন, আগেই হয়েছিল। তুমি বিশ্বাস করবে না, তবে জীবনে হঠাৎ হঠাৎ কিছু হয়। বাইরে থেকে ওটা হঠাৎ, ভেতরে ভেতরে হয়তো হঠাৎ নয়। …একবার এক ঘটনা থেকে আমার মনে নানা সংশয়, দ্বিধা দুর্বলতা আসে। আমার মনে হয়েছিল–ওই ভালবাসায় আমার সুখ নেই, আনন্দ নেই।

তুমি শুধু নিজেকেই দেখছ।

সুরেশ্বর প্রতিবাদ করল না। সে নিজেকেই দেখছিল : যেন অতীতের কোনও ঘটনার সামনে সে দর্শক হয়ে বসে আছে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *