২. ললিতার স্বপ্ন

০৬.

ললিতার স্বপ্ন দেখছিল অবনী।

দেখছিল: ওরা বিছানায় শুয়ে আছে; ললিতা ছাদের দিকে মুখ তুলে সোজা হয়ে শুয়ে; ললিতার দিকে পাশ ফিরে তার বালিশে কনুই রেখে সামান্য উঁচু হয়ে অবনী। ললিতার চোখ খোলা, ঠোঁট ফাঁক, দুটি সাদা চকচকে দাঁত বেরিয়ে রয়েছে, গলায় তুলসীমঞ্জরীর মতন হার। অবনী ডান হাত আস্তে করে ললিতার মুখের কাছে আনল, গালে ঠোঁটে আঙুলের ডগা বুলোলো, তারপর চোখের পাতা শেষে ডান হাতের পাঁচটি আঙুল ও তালু দিয়ে ললিতার মুখ ঢেকে দিয়ে অবনী ললিতার বুকের ওপর মুখ নামাল। ললিতার হাত অবনীর মাথার চুলে এসে পড়েছে। নিরাচ্ছাদিত বুক ললিতার; অবনী পরিপূর্ণ যুবতীদেহে চুম্বন ও দংশন করল। ললিতা তাকে উৎফুল্ল করছিল, পীড়ন করছিল। তারপর সহসা সে অবনীর আলিঙ্গন থেকে মুক্তির জন্যে বসল। পরমুহূর্তে ললিতাকে আর বিছানায় দেখা গেল না; অবনী অতি দ্রুত তাকে অন্বেষণ করতে ঘরের বাইরে এল। ঘর থেকে অন্য ঘর, বাদুড়বাগানের বাড়ির শোবার ঘরে, ললিতা যেন এইমাত্র এই ঘর থেকে চলে গেছে–তার খোলা জামা কাপড় বিছানায় ও মেঝেতে লুটোচ্ছিল; অবনী চকিতে অন্য ঘরে চলে গেল। স্নানের ঘরে অবিরল জল পড়ছে, পড়ছে… জানলায় জালের পরদা, দরজায় জালের পরদা, দেওয়ালে কোথাও একটু আলো। ললিতা মাথার ওপর শাওয়ার খুলে দাঁড়িয়ে আছে, নগ্ন, পালকের মতন বঙ্কিম নরম পিঠ, কোমর সামান্য ভারী, সদ্যসিক্ত কুম্ভের মতন পিছন, জলের ধারায় জঘা, পায়ের ডিম অস্পষ্ট হয়ে আছে। অবনী এগিয়ে গেল, ললিতার পিছনে; কাঁধ ধরে ঘুরিয়ে নিজের মুখোমুখি করল। এবং সহসা অনুভব করল সেও নগ্ন। মাথার ওপর কলঘরের ফোয়ারা; জলধারার মধ্যে দাঁড়িয়ে সে দেখল, জলজ প্রাণীর মতন তাদের গায়ে শ্যাওলা ধরে যাচ্ছে, পানা জমে গিয়ে সবুজ কালো হয়ে গেল সব। ললিতা ধাক্কা মেরে তাকে ঠেলে ফেলে দিতে গেল, পারল না; অবনী হাত বাড়িয়ে ললিতাকে সরিয়ে দিতে গেল, পারল না। অবশেষে মাথার ওপরকার ফোয়ারার জলের ধারা হঠাৎ কেমন সুতোর মতন হয়ে মস্ত একটা জাল বোনা হয়ে গেল। শক্ত কালো জাল। কোনও জেলে বিশাল এক জাল ফেলে তাদের যেন ধরে ফেলেছে; সেই জালের মধ্যে শ্যাওলাধরা পানামাখা দুই জলজ প্রাণীর মতন তারা বন্দি। অবনী পাগলের মতন এই জাল কেটে পালিয়ে যাবার চেষ্টা করতে গিয়ে দেখল, ললিতাও দাঁত দিয়ে জাল কাটার চেষ্টা করছে। তারপর দুজনের আপ্রাণ জাল ছিঁড়ে পালিয়ে যাবার চেষ্টা…

ঘুম ভেঙে গেল অবনীর। ভেঙে যাবার পরই তার মনে হল সে জাল ছিঁড়ে পালিয়ে আসতে পেরেছে, স্বস্তির নিশ্বাস ফেলে চোখের পাতা খুলল, পাতা খুলতেই বিছানার মশারির জাল দেখল, বাতাসে কাঁপছিল সামান্য; অবনী ভীত ও ত্রস্ত হয়ে ছুটে পালাবার জন্যে উঠে বসে টান মেরে মুখের সামনে থেকে মশারি সরিয়ে ফেলল। এত জোরে সে হাত দিয়ে মশারি টেনে সরাল যে মশারির খানিকটা ছিঁড়ে গেল। ততক্ষণে তার ঘুমের আচ্ছন্ন ভাব এবং ভ্রম ভেঙে গেছে। তবু একবার অবনী বিছানার মধ্যে তাকাল, না–কেউ নেই।

মুখের সামনে থেকে মশারি সরিয়ে অবনী কিছুক্ষণ বসে থাকল, তার শরীরের খানিকটা মশারির মধ্যে, বাকিটা বাইরে। গলায় মুখে ঘাম জমে গেছে। দুঃস্বপ্ন দেখার পর যেভাবে মানুষ তার ভীত, বিমর্ষ ভাবটা ক্রমশ সইয়ে নেয়, অবনী সেইভাবে তার আতঙ্ক ও বিহ্বলতা কাটিয়ে নিচ্ছিল।

শেষে উঠল, বিছানা ছেড়ে এগিয়ে গিয়ে বাতি জ্বালল। তৃষ্ণায় ঠোঁট গলা শুকিয়ে আছে। অবনী জল খেল, খেয়ে বাথরুমে গেল। ফিরে এসে ঘড়ি দেখল, শেষরাত, চারটে বেজে গেছে। সিগারেট ধরাল। কী মনে করে বাতি নিবিয়ে জানলার কাছে গিয়ে দাঁড়াল।

এখন সমস্তই নিঃসাড়। বাইরে অন্ধকার। ঠাণ্ডা বাতাস আসছে দমকে দমকে। অন্ধকারে বাগানের গাছপালা ঘন ছায়ার মতন দেখায়, আকাশ কালো, কয়েকটি তারা এখনও চোখে পড়ে।

সিগারেটের ধোঁয়া অবনীর স্নায়ুকে শান্ত ও স্বাভাবিক করছিল। স্বপ্নের উত্তেজনা অবসিত। অথচ তার অন্যমনস্কতা ও বিমর্ষতা বাড়ছিল।

কিছুক্ষণ জানলার সামনে দাঁড়িয়ে থাকল অবনী, সিগারেট শেষ করল, তারপর বিছানায় ফিরে এসে শুয়ে পড়ল।

এই রকম স্বপ্ন সে আর দেখেনি। ললিতাকে কখনও কখনও সে এখনও স্বপ্ন দেখে, কিন্তু কোনওদিন এভাবে দেখেনি। এই স্বপ্ন, অবনীর মনে হল, অদ্ভুত, ভীতিকর। স্বপ্নে ললিতাকে সাহচর্য সুখ অথবা রমণক্রিয়া হেতু যে হর্ষোৎফুল্লভাব তা সে অনুভব করেছিল কিনা সে বিষয়ে সন্দেহ হয়। নির্দিষ্ট ও স্থায়ী ছবির মতন অবনী শুধু সেই বীভৎস জালটি দেখতে পাচ্ছিল: কালো, শক্ত, কঠিন; সেই জালের মধ্যে আদিম কোনও জলজ জীবের মতন নগ্ন দুটি নরনারীর সর্বাঙ্গে শ্যাওলা ও পানা। কেন যেন এই স্বপ্নের কোথাও অবনী তার অতীতকে খুঁজছিল।

ললিতার বিষয়ে অবনী আজকাল সাধারণত কিছু ভাবতে চায় না, ভাল লাগে না ভাবতে। তার মনে। হয় না, এখন আর ও-বিষয়ে কিছু ভাববার থাকতে পারে। অকারণে মনে মনে পুরনো বিরক্তিকর একটি স্মৃতিকে ফাঁপিয়ে ফুলিয়ে দেখে লাভ কী! এখনও যে অবনী ললিতার কথা ভাবতে চাইছিল তা নয়, অথচ এই অদ্ভুত স্বপ্নটির রহস্যে ও বিচিত্রতায় সে এতই বিহ্বল ও তন্ময় হয়েছিল যে ললিতার কথা না

ললিতার সঙ্গে আলাপ সাধারণ ভাবেই। কমলেশ আলাপ করিয়ে দিয়েছিল রাস্তায়। একসময় কমলেশ অবনীর সহপাঠী বন্ধু ছিল। মাঝে মাঝে অবনীর কাছে আড্ডা মারতে গল্প-সল্প করতে আসত। কমলেশ হাসিখুশি মেজাজের ছেলে, চাকরি করত মোটামুটি ভাল জায়গায়, চৌরঙ্গি পাড়ায় কোনও কোনওদিন বিয়ার-টিয়ার খেতে আসত। একদিন অবনীর সঙ্গে লিন্ডসে স্ট্রিটের কাছে দেখা কমলেশের, সঙ্গে ললিতা। পরিচয় করিয়ে দিল কমলেশ।

অবনী প্রথম দর্শনেই আকৃষ্ট হয়েছিল। ললিতার প্রতি আকর্ষণ অনুভব করা যে-কোনও পুরুষের পক্ষেই স্বাভাবিক ছিল। দেহজ সৌন্দর্য প্রথমেই পুরুষের চোখকে নিষ্পলক ও কাতর করে– ললিতার শরীরে সে সৌন্দর্য অতিমাত্রায় ছিল। প্রখর ও প্রলুব্ধক সেই রূপে অনী আকৃষ্ট হল। ললিতার মুখ ছিল ভাসন্ত, সামান্য হোট:কপাল চওড়া, গালের চামড়া পাতলা, ফোলানাক একটু মোটা, ঠোঁট পুরু। ঠোঁটের ডগায় ডিমের কুসুমের মতন টলটলে, আঠালো ভাব ছিল। ললিতার চোখ ছিল বড় বড়; ঘন, মোটা ভুরু, পাতা মোটা। দৃষ্টিতে কটাক্ষ ও কামভাব ছিল। ওর মুখ চোখের মধ্যে কোথাও এক ধরনের মাদকতা থাকায় ললিতা চোখ জড়িয়ে বিলোল করে কথাবার্তা বলত, বাদামের দানার মতন দাঁত দেখিয়ে হাসত। ওর কাঁধ, গলা সুন্দর ছিল; পিঠ ভরা; স্তন পরিপূর্ণ ও দৃঢ়; গুরু নিতম্ব, সুডৌল জঙ্ঘা।

অবনী প্রথম দর্শনেই ললিতাকে তার চিত্ত চঞ্চলতা বুঝতে দিয়েছিল। ললিতাও বুঝেছিল।

পরিচয় খুব সামান্য সময়ের মধ্যেই ঘনিষ্ঠতায় দাঁড়াল। অনী সেসময় যেরকম ব্যবহার করেছিল তাতে মনে হবে, তার মন ও দৃষ্টিকে সে একই জায়গায় নিবদ্ধ রেখেছিল। একটি মাত্র বস্তু কামনা করলে যেভাবে মানুষ অন্য আর সব কিছু ভুলে যায়–অবনী সেই ভাবে অন্য কোনও বিষয়ে বিন্দুমাত্র আগ্রহ প্রকাশ না করে একমাত্র ললিতাতেই তার মনঃসংযোগ করেছিল।

কমলেশ একদিন বলল: কীরে, তুই যে একেবারে জ্ঞান হারিয়ে ফেলেছিস।

জ্ঞান হারাবার মতনই দেখাচ্ছিল তখন। অবনীকে একমাত্র অফিসে ছাড়া কোথাও কখনও বড় একা দেখা যেত না। সে সর্বদাই ললিতাকে সঙ্গে রাখত, বা ললিতাকে সঙ্গদান করত। কমলেশ ঠাট্টা করে যাই বলুক, অবনী দিশেহারা অথবা উন্মাদ হয়নি, সে ললিতাকে একটি কলয়ের মতন চতুর্দিক থেকে আস্তে আস্তে ঘিরে ফেলেছিল। চতুরের মতন সে এ কাজ করেনি, আবেগ ও বাসনার দ্বারা করেছিল। ললিতার প্রতি তার আকর্ষণ অতি তীব্র ও আন্তরিক হওয়ায় সে সতর্ক, সংযত হয়নি, হবার চেষ্টাও করেনি। প্রয়োজন ছিল না। কমলেশ পরে আবার একদিন বলল:

একটু সাবধান হ

কেন?

আমি যতদূর জানি, ওর আরও কিছু বন্ধুবান্ধব আছে।

তাতে আমার কী?

 অনেক সন্ন্যাসীতে গাজন নষ্ট।

এক সন্ন্যাসীর গাজনটাই তুই দেখ, বাদবাকির কথা ভাবিস না।

তুই ভীষণ সিরিয়াস। প্রেমে পড়েছিস নাকি!

ওসব প্রেমটেম বুঝি না, ভাই; ভাল লাগে, দ্যাটস অল।

 বিয়ে করবি?

লোকে তো তাই করে।

ললিতার সঙ্গে পরিচয়ের বছর দেড়েকের মধ্যেই অবনী তাকে বিয়ে করে ফেলল। ললিতা ভাল করে কিছু হুঁশ করতে পেরেছিল কি না কে জানে। অবনী সে সুযোগ সম্ভবত দেয়নি। যদি এমন ধরে নেওয়া হয় যে, ললিতা অবনীর মৃগয়ার বস্তু ছিল তবে অবনী তার শিকারকে দ্বিধা করতে, সরে যেতে অথবা পালিয়ে যেতে দেয়নি; নিশানার বিন্দুমাত্র ভুলচুক না করে স্থির দৃষ্টি রেখে সে লক্ষ্যভেদ করেছিল। অবনীর এই সাফল্যের মূলে তার বাসনার তীব্রতা ছিল সবচেয়ে বেশি, তার অনমনীয় দৃঢ় পৌরুষ, তার দ্বিধাহীন আকাঙ্ক্ষা এবং স্পর্ধিত আক্রমণের সামনে ললিতা অসহায় হয়ে পড়েছিল।

ললিতা বোকা বা অনভিজ্ঞ ছিল এমন মনে করার কোনও কারণ নেই। নিজের দাম সে জানত। সাংসারিক লাভ লোকসানের হিসেবটা সে মনে মনে ভালভাবেই কষে রেখেছিল। ভবিষ্যৎ সম্পর্কেও তার মোটামুটি একটা ধারণা ছিল। কিন্তু ললিতা কোনও কোনও জায়গায় তার হিসেবের ভুল করে ফেলেছিল। অবনীকে সে যথার্থভাবে বোঝেনি। ভেবেছিল তার লাভ বই লোকসান হবে না। অবশ্য অবনীকে আপাতদৃষ্টিতে অপছন্দ করার কিছু ছিল না–এমন কোনও স্থূল কারণ ললিতা খুঁজে পায়নি যাতে অবনীকে প্রত্যাখ্যান করতে পারে। অন্য কোনওদিকে, যা স্থূল নয়যা সূক্ষ্ম এবং ভিতরের দিক-সেদিকে তাকাবে এমন সুযোগ ললিতা পায়নি, অবনী তাকে সে অবসর দেয়নি। সম্ভবত, ললিতা তার শারীরিক লক্ষণগুলির জন্যে মনে মনে যে দাম স্থির করে রেখেছিল অবনী প্রথম থেকেই তার বেশি ললিতাকে দিয়েছে; অনন্য এতটা দেবে কি দেবে না ললিতা জানত না; প্রাপ্তির আধিক্যে সে সন্তুষ্ট ও লোভী হয়ে পড়েছিল। তা ছাড়া, ললিতা অবনীর প্রবল আকাঙ্ক্ষার কাছে আত্মরক্ষা করতে পারেনি, তার প্রয়োজনও সে অনুভব করেনি তখন। এসব সত্ত্বেও ললিতা অবনীকে সঙ্গী হিসেবে, পুরুষ হিসেবে পছন্দই করেছিল।

বিয়ের পর বাদুড়বাগনের বাড়িতে ওরা কয়েক মাস যেন হাওয়ায় ভেসে ছিল। চার-পাশে তখন খুশি ঠিকরে উঠছে; সুখ, সুখ আর সুখ। ভোরবেলায় ঘুম থেকে উঠে মনে হত ওদের হাতে কেউ যেন সুখের একটা বড়সড় নোট ধরিয়ে দিয়েছে, দিয়ে বলেছে: যাও, খরচ করো। ওরা দুজনে সারা দিন ভরে সেই নোটের ভাঙানি খরচ করে রাত্রে বিছানায় শুয়ে দেখেছে তখনও অনেক অবশিষ্ট থেকে গেছে। অবশিষ্ট যা থেকে যেত তা খরচ করার জন্যে ওরা কৃপণতা করেনি; কারণ সকালে ঘুম থেকে চোখ মেলেই আবার একটি সুখের নোট পাওয়া যাবে। এত সুখ-শুতে, বসতে, কথা বলতে, বেড়াতে কোথায় যে ছিল তা যেন তারা জানত না। অবনীরও মনে হত, সে আশাতীত তৃপ্তির মধ্যে রয়েছে; হয়তো এতটা সে প্রত্যাশাও করেনি।

বিবাহ ও দাম্পত্য জীবনের প্রথম কয়েকটা মাস তারা যেন এক ঘূর্ণির মধ্যে ছিল, কোথাও স্থিরতা বা শান্তভাব ছিল না। কিছু বিচার করেনি, ধীরে-সুস্থে পরস্পরকে দেখেনি। ঘূর্ণির মধ্যে পড়ে পাক খেয়েছে। হয়ত এটা স্বাভাবিক। সদ্যপ্রাপ্ত নতুন খেলনা হাতে পেয়ে ছেলেমানুষে যেমন সব কিছু ভুলে গিয়ে খেলায় মন দেয়–এও অনেকটা সেই রকম। এমনকী নতুন খেলনা পেলে শিশুরাও যেমন অনেক সময় মনে মনে বোঝাপড়া করে পরস্পরকে খেলনাটা নিয়ে খেলতে সুযোগ দেয়, অবনী ও ললিতাও সেই রকম পরস্পরকে সুযোগ দিত।

বছর খানেক পরেই দেখা গেল সুখের স্বাদ ফিকে হয়ে আসছে। ভোরবেলায় ঘুম থেকে উঠে বসলেই আর হাতের মুঠোয় সুখের নোট কেউ গুঁজে দিয়ে যায় না। দুঃখেরও নয় অবশ্য।

কুমকুম তখনও হয়নি, কিন্তু ভেতরে ভেতরে হচ্ছে। কুমকুমের ভারে ললিতা ভারাক্রান্ত। ওর ইচ্ছে ছিল না–এত তাড়াতাড়ি ছেলেমেয়ে হোক। অবনীর মনে হয়েছিল, যদি হয়ে থাকে তবে তা নিয়ে ললিতার এই অশান্তি মনে মনে পুষে রাখা অনুচিত। প্রথম সন্তানের জন্যে অবনীর কেমন ঔৎসুক্য ও কৌতূহল ছিল। ললিতার তেমন কিছু ছিল না। তবে এ নিয়ে সামান্য কথাকাটাকাটি হলেও বড় রকমের কোনও ঝগড়াঝাটি হয়নি। যেটুকু অশান্তি তা ভুলে যাওয়া যায়।

কুমকুম হল। কুমকুমের জন্মের পর ললিতার সেই ক্ষুব্ধভাবটা কমল। কেমন করে যেন সে নিজেকে খাপ খাইয়ে নিল। বরং অবনী ও ললিতার মধ্যে সম্পর্কের যেটুকু চিড় ধরেছিল তা সাময়িকভাবে মেরামত হয়ে গেল।

তারপর ক্রমশ, বাদুড়বাগানের বাড়িতে অশান্তি দেখা দিতে লাগল। স্পষ্ট করে কিছু বোঝা যেত না প্রথমে, ধার পড়ত না; কিন্তু ধোঁয়া ধুলো নোংরা উড়ে এসে এসে যেভাবে ঘরের কোণে, দেওয়ালে ময়লা জড়ো হয়, ঝুল জমে–সেইভাবে সংসারে মালিন্য জমতে লাগল। হঠাৎ হঠাৎ চোখে পড়ত।

অবনী চেষ্টা করত ওই সব মালিন্য থেকে চোখ ফিরিয়ে নেবার। চোখ ফিরিয়ে সে ললিতার দিকে তাকাত। ললিতার দেহের প্রতি তার তখনও প্রবল আসক্তি। কুমকুম হওয়ার পর ললিতার শরীর ভেঙে যায়নি, যৎসামান্য যা পরিবর্তন তাতে ললিতার প্রতি বিতৃষ্ণা জাগার কোনও কারণ ছিল না। বরং অবনীর চোখে এই পরিবর্তন ভালই লাগত।

স্ত্রীর সঙ্গে তার সম্পর্ককে সে আর কোথাও যখন তেমন করে ধরে রাখতে পারছিল না, তখনও শয্যায় সে এই সম্পর্ক ধরে রাখার চেষ্টা করছিল। ললিতা এক্ষেত্রে কেমন উৎসাহহীন, নিশ্চেষ্ট হয়ে আসতে লাগল। তারপর এক সময় সে অবনীর কাছ থেকে যেন সরে গেল।

এক সময় যে বাড়িতে দিবারাত্র দুরন্ত শিশুর সাড়ার মতন সুখকে অনুভব করা যেত এখন সেখানে সুখ মৃত, তার সাড়াশব্দ পাওয়া যায় না, সে চলে গেছে এটা বোঝা যায়, বোঝা যায় বলেই মনে হয় সব যেন ফাঁকা। দুঃখ, এখন দুঃখকেই শুধু অনুভব করা যায়।

চোখ সরিয়ে রেখে রেখে অবনী যা দেখেনি, দেখতে চায়নি–এখন তা দেখতে সে বাধ্য হতে লাগল। দেওয়ালে, কোণে, ছাদে, ফাঁকে ফোকরে এত মালিন্য জমে গেছে যে এখন সব অস্বাভাবিক বিবর্ণ দেখায়। পুরু ধুলো, ময়লা ন্যাকড়ার মতন ঝুল, মরা কীটপতঙ্গ জমে গিয়ে যেমন দেখায় অনেকটা সেই রকম। ললিতাও এই নোংরামি দেখতে পাচ্ছিল।

সাংসারিক কলহ, অশান্তি, বিতৃষ্ণা তখন থেকেই ওদের চারপাশে ফেটে পড়ল।

ললিতার শরীরের মতন তার চরিত্রেরও কিছু স্থূলতা ছিল। অবনী যথার্থভাবে সেই স্থূলতার সঙ্গে আগে পরিচিত হতে পারেনি; এখন হচ্ছিল। নিজের চরিত্রেও অবনীর যে রুক্ষতা ও অসহিষ্ণুতা ছিল তাও প্রকাশ পেতে লাগল।

ললিতা বলত: অবনী তাকে মাংসের দরে কিনেছে।

অবনী জবাব দিত: ফুলের বাজারে বিকোবার মতন ললিতার কিছুই নেই।

ওরা পরস্পরকে বিরক্তি বিতৃষ্ণার মধ্যে নতুন করে চিনতে পারল। অবনী বুঝতে পারল, ললিতার স্বভাব অত্যন্ত নোংরা, সে হীন, স্বার্থপর, হিসেবি, দায়িত্বহীন, বিলাসী। ললিতাও বুঝতে পারল, অবনী হৃদয়হীন, অহংকারী, রুক্ষ, কামুক, উদ্ধত। উভয়ে উভয়ের সহস্র রকম ত্রুটি আবিষ্কার করতে পেরে যেন সুখী হচ্ছিল; অথবা নিজেদের সান্ত্বনা দিতে পারছিল।

পরস্পরকে নোখ দিয়ে আঁচড়াবার প্রবৃত্তি এবং হিংসা তাদের বেড়েই যাচ্ছিল। সকালে ঘুম থেকে উঠেই কোনওনা-কোনও তুচ্ছতম বিষয় নিয়ে কথা কাটাকাটি শুরু হত। তারপর সেই ধোঁয়া থেকে আগুন দেখা দিত।

হয়তো সকালে ঘুম থেকে উঠে অবনী চায়ের পেয়ালায় মুখ দিয়ে দেখল চায়ের স্বাদ অত্যন্ত তেতো জুড়িয়ে জলের মতন হয়ে গেছে। বিরক্ত মুখে অবনী বলল, কী হয়েছে এটা? চা না চেরতার জল?

ললিতা জবাব দিল, যা হয়েছে তাইওর বেশি হবে না।

 হবে না মানে– এক পেয়ালা চা দিয়ে আমার মাথা কিনে রেখেছ নাকি?

 তুমি কি আমায় দুবেলা দুটো ভাত দিয়ে কিনে রেখেছ নাকি?

দুবেলা দুমুঠো ভাত দিয়ে যাদের কেনা যায় তুমি তাদের দলে নও। তাদের মতন হলে তবু লজ্জা থাকত।

তোমারই কত লজ্জা! …গলা ভর্তি মদ খেয়ে রাত বারোটায় বাড়ি ফিরে কুকুরের মতন গা চাটতে আস, আর ভোরবেলায় ঘুম ভাঙলে চোখ রাঙাও।

অবনী রাগের মাথায় চায়ের পেয়ালাটা প্রাণপণে ছুঁড়ে মারল দরজার দিকে, ভেঙে চুরমার হয়ে গেল কাপ। কুমকুম পাশের ঘর থেকে ছুটে এসে বাবা এবং মাকে অবাক হয়ে দেখতে লাগল।

অকারণে, অল্প কারণে, কখনও বা ইচ্ছাকৃত ভাবেই ঝগড়া করত ললিতা। অবনী অন্তত তাই ভাবত। আবার ললিতা ভাবত অবনীই সব দোষে দোষী। অবনী ললিতার মধ্যে শিক্ষা রুচি শালীনতা কর্তব্যজ্ঞান সংসারের প্রতি টান খুঁজে পেত না। মেয়েটাকে ও ছোটবেলা থেকেই নষ্ট করেছে, তার স্বভাব খারাপ করে দিচ্ছে।

ললিতা ভাবত, অবনী তাকে ঠকিয়েছে; চাতুরি করে–কৌশলে ললিতাকে তার সংসারে এনে আটকে ফেলেছে। তার স্বাধীনতা, পছন্দ বলে এখন আর কিছু নেই।

ললিতার স্থির ধারণা হয়ে গিয়েছিল, অবনী তাকে প্রবঞ্চনা করেছে। কী ধরনের প্রবঞ্চনা তা সে তেমন বুঝত না; তবে মনে হত–এ-রকম জীবন সে চায়নি, আর পাঁচজন মেয়ের মতন ঘরদোর, স্বামী, মেয়ে এইসব নিয়ে তাকে দিন কাটাতে হবে, ভাবতেই তার বিশ্রী লাগত, ঘৃণা হত। অবনী তাকে সেই একঘেয়েমির মধ্যে জড়িয়ে ফেলেছে। তা ছাড়া অবনী, ললিতার মনে হত, তাকে ভালবাসে না, তার প্রতি মমতা নেই, মর্যাদাও দেয় না। শুধুমাত্র বিছানায় নিয়ে শোবার জন্যে তাকে বিয়ে করেছিল। লোকটা চতুর এবং কামুক।

তোমার টান তো শুধু এক জায়গাতেই। ফুর্তির জন্যে যখন দরকার, যেটুকু দরকার। ললিতা বলত।

তোমার কত জায়গায় টান-অবনী বিদ্রূপ করে জবাব দিত।

নেই। কেন থাকবে। আমি কি এইসব চেয়েছিলাম?

চাওনি। তুমি কী চেয়েছিলে আমি এখন তা বুঝতে পারি।

কী শুনি?

 এখানে দুদিন সেখানে দুদিন করে কাটাতে; মজা লুটতে। যার কাছে যতদিন লোটা যায়।

কত মজাই তোমার কাছে পেলাম। ললিতা উপহাস করে বলত।

আসলে অবনী ও ললিতার মধ্যে স্বভাবের পার্থক্য ছিল প্রচুর। তারা নিজেদের প্রকৃতি ও চরিত্র সম্পর্কে চিন্তা করে একে অন্যের কতটা নিকট হতে পারবে তা ভাবেনি। একমাত্র শয্যাই তাদের মিলনক্ষেত্র ছিল, অন্যত্র তারা বিচ্ছিন্ন ও স্বতন্ত্র থাকত। যে অনুভব, বোঝাপড়া, সহিষ্ণুতা এবং স্বার্থত্যাগ থাকলে তারা পরস্পরের বিপরীত স্বভাবকেও সহ্য করে নিতে পারত, সহ্য করে পরস্পরকে ক্রমশ পরিবর্তিত ও সম্পর্ক ঘনিষ্ঠ এবং একাত্ম করতে পারত–তেমন বোঝাপড়া, সহিষ্ণুতা ইত্যাদি তাদের কিছুই ছিল না।

অবনী অবসাদ বোধ করতে লাগল। ললিতাও যেন পালাতে পারলে বাঁচে। অবনী লক্ষ করত, ললিতা বাইরে বাইরে ঘুরে বেড়ায়, তার পুরনো বন্ধুবান্ধবের সঙ্গে মেলামেশা সেরে অনেক রাত করে বাড়ি ফেরে, অবনীর দিকে চোখ ফেরায় না। সংসার খরচের টাকা মুড়িমিছরির মতন খরচ করে, নষ্ট করে, আবার চায়। কুঠা নেই, লজ্জা নেই।

অবনীর একটিমাত্র দুর্বলতা ছিল। কুমকুম। কুমকুমকে তার মার হাত থেকে বাঁচাবার চেষ্টা অবনী করেছিল। ললিতা তা দিল না। বরং সে কুমকুমকে অবনীর বিপক্ষে দাঁড় করাল। বাবাকে ঘৃণা করতে, অপছন্দ করতে, অবজ্ঞা করতে কেমন করে শেখাল ললিতা কে জানে, কিন্তু কুমকুম তার মার দলে চলে গেল। ওইটুকু মেয়ের চোখে অবনী যে বিষাক্ত দৃষ্টি দেখেছে তাতে মনে হয়েছে, সংসারে তার মতন পাকা শয়তান যেন আর নেই।

ললিতা মেয়েটাকে একেবারে নষ্ট করে দিচ্ছিল। তাকে শত রকমের ইতরতা শেখাচ্ছিল। অবনীর মনে হয়েছিল, ললিতা তাকে দুর্বল স্থানে আঘাত করে আনন্দ পেতে চাইছে।

একদিন ললিতা বলল, এভাবে আমি থাকব না।

কী ভাবে?

 তোমার সঙ্গে কোনও মেয়ে থাকতে পারে না।

আর কেউ তোমায় পুষতে চাইছে নাকি?

ভদ্রলোক হবার শিক্ষা যে পাওনি তা তো আমার জানা আছে।

তোমার পরিবারের লোকজন কি ভদ্র?

তোমার চেয়ে ভদ্র।

দেখতেই পাচ্ছি। …বাপ কুকুর-ব্রিড করিয়ে পয়সা নেয়, ছেলে নাচের দলে মেয়ে সাপ্লাই করে, এক বোন তো…

তোমার মা বাবাও দেবতার অংশ নয়। ওসব কথা থাক, নিজের গায়ের গন্ধ যখন লুকোতে পারবে না তখন অন্যকে দোষ দিয়ে লাভ কী! ..আমি ঠিক করেছি–তোমার এখানে আমি থাকব না।

কার সঙ্গে থাকবে?

 দরকার হলে কারুর সঙ্গে থাকব।

আজকাল মাঝে মাঝে সেখানে গিয়ে থাকছ নাকি?

 আমি ডিভোর্স চাইব।

 চাও।

 তুমি রাজি?

আপত্তি নেই। …পরে ভেবে দেখব।

মেয়ে আমার কাছে থাকবে।

না। মেয়ে আ

মার। তোমার কাছে আমি তাকে থাকতে দেব না।

পারিবারিক জীবনে যেমন, বাইরেও অবনী সেই রকম অসুখী অসহিষ্ণু হয়ে উঠছিল। অফিসে তার সঙ্গে বন্ধুবান্ধব সহকর্মীর মনোমালিন্য ঘটছিল। ওপরঅলার সঙ্গে বিরোধ। তার আর কিছু ভাল লাগত না, সহ্য হত না। সব বিষয়েই তার অসীম ক্লান্তি জমছিল, অনাগ্রহ বাড়ছিল। মনে হত সে অসুস্থ হয়ে পড়েছে, অবসন্ন ও ক্লান্ত বোধ করছে। কেমন যেন এক একঘেয়েমি, অর্থহীনতার মধ্যে সে বেঁচে আছে, উদ্দেশ্যবিহীন জীবন, কোথাও কোনও স্বাদ নেই সুখ নেই।

একদিন মদ খেতে খেতে কমলেশ বলল, তুই খুব সিক হয়ে পড়েছিল।

শরীর দেখে বলছিস?

না, তোর চোখ মুখ দেখে, কথাবার্তা শুনে।

কিছুই ভাল লাগে না…

সাফারিং ফ্রম বোরডোম।

জানি না। … আমি মাঝে মাঝে ভাবি: আগুনটা এবার নিবে আসছে।

আগুন? কিসের আগুন?

উনুনের। …চল্লিশ বছর বয়েস হয়ে গেছে, বুঝলি। আজকের দিনে চলিশ বছর বেঁচে থাকা খুব ডিফিকাল্ট। …আমার মতন ব্যাসটার্ডের ধুনি কতকাল জ্বলবে।

বুঝতে পারছি, এই বেলা কেটে পড়।

শেষ পর্যন্ত অবনী সত্যিই চলে এল। ললিতাকেও ছেড়ে দিল, মেয়েকেও। কিন্তু অবনী বুঝতে পারছিল না, জালের বাইরে এসেও সে এ-স্বপ্ন কেন দেখল?

.

০৭.

নদীর দিকে আজ বেড়াতে বেরিয়েছিল হৈমন্তী। সঙ্গে মালিনী। নদীতে এখনও বর্ষার জল রয়েছে। এখানে ওখানে পাথর। স্রোতের কোথাও তাই সামান্য আবর্ত; জলে টান আছে, মৃদু শব্দ রয়েছে, নয়তো এই পাথর আর নুড়িভরা শীর্ণ জলধারাকে নদী বলা যায় না। মাঝে মাঝে মালিনীকে নিয়ে হৈমন্তী এদিকে বেড়াতে আসে। এই নদী যে তার ভাল লাগে তা নয়, তবু আসে। আশ্রম থেকে বেরুলে যাবার রাস্তা মাত্র দুটোই, হয় উত্তরে যাওনয় দক্ষিণে; উত্তরে কাঁচা রাস্তা ধরে গেলে সোজা বাস-রাস্তার মোড় লাটুঠা; দক্ষিণে হাঁটলে অল্প পথ এগিয়ে এই নদী,নদী পেরুলেই গুরুডিয়ার গ্রাম। আশ্রমের মধ্যে ঘুরে বেড়াতে, বা প্রত্যহ কাঁচা সড়ক ধরে উত্তরে এগুতে ভাল লাগে না বলেই নদীর দিকে আসা। নদীর দিকে আসতেও রোজ ইচ্ছে করে না। তবু, এপাশে এলে, নদীর পাড়ে পাথরে গিয়ে বসলে মনে হয়– এখানে একটু চঞ্চলতা রয়েছে, মৃদু হলেও শব্দ বলে কিছু আছে; উত্তরের দিকে কিছু যেন আর নড়ে, সেই পথ, সেই মাঠ, গাছ, আকাশসমস্তই স্থির; কাল যেমন ছিল আজও সেইরকম আছে, আগামীকালও থাকবে।

এপাশে, নদীর দিকে বেলাবেলি বেড়াতে এলে দুপাঁচজন মানুষও দেখা যায়। গ্রামের মানুষ:নদীর এপারে সবজি অথবা শস্যক্ষেত্রে কাজকর্ম সেরে নদী পেরিয়ে বাড়ি ফিরছে, সাইকেলের পেছনে শূন্য টুকরি বাঁধা ব্যাপারিও দু-একজন গ্রামে ফেরে। নদীর শীর্ণতম স্থানটি দিয়ে পাথরে পা ফেলে ফেলে বালি আর গোড়ালিডোবা জল পেরিয়ে তারা যখন চলে যায় তখন মালিনী বলে, জল আরও কমে যাক, আপনাকে একদিন গাঁয়ে বেড়াতে নিয়ে যাব, হেমদি; ওখানে একটা মেয়ে আছে, একেবারে বাচ্চা কী ফুটফুটে গোবলাগাবলা, দেখলেই আদর করতে ইচ্ছে করবে। বেচারি একেবারে অন্ধ। আমাদের এখানে আগে অনেকবার এসেছে। ওর নাকি চোখ আর সারবে না। এত কষ্ট হয়। ..মালিনী ওই গ্রামের আরও পাঁচরকম খবর রাখে: কোথায় একটা মহাদেবের মন্দির আছে, কোন সময়ে ছট পরব হয়, এমনকী একটা অদ্ভুত কুলগাছ আছে, সাদা কুল হয় শুধু–এইরকম অজস্র খবর।

মালিনী এখানে এলে সবসময় পাথরে বসবে, যতক্ষণ বসে থাকবে নদীর জলে পা ডোবাবে। বলে, ওর হাতে পায়ে নাকি খুব জ্বালা। হৈমন্তী কাছাকাছি একটা বড় পাথর বেছে বসে অবশ্য; কিন্তু জলে কখনও পা ডোবায় না, হাতও দেয় না। ইচ্ছে হয় হয়তো, কিন্তু মালিনীর সামনে চাঞ্চল্য প্রকাশ করতে তার সঙ্কোচ হয়, যেন তার বয়সে এবং মর্যাদায় এই ধরনের ছেলেমানুষি করতে বাধে।

সাধাসিধে সরল বলেই মালিনী কথা একটু বেশি বলে। তার কথাবার্তা কখনও কখনও একেবারে বোকার মতন শোনায়, কখনও কখনও মনে হয় সে হৈমন্তীর বন্ধুর মতন হয়ে উঠছে, কী তার বলা উচিত কিবা উচিত নয় তা বুঝতে পারে না। হৈমন্তীর পরিবার সম্পর্কে সে নানান কথা জিজ্ঞেস করে, এই আগ্রহ মেয়েলি কৌতূহল; কলকাতার গল্প, হৈমন্তীর ডাক্তারি লেখাপড়ার গল্প শুনতেও তার ছেলেমানুষের মতন আগ্রহ রয়েছে। ইদানীং হৈমন্তী লক্ষ করছিল, মালিনীর আরও একটি বিষয়ে অস্বাভাবিক কৌতূহল দেখা দিয়েছে, স্পষ্ট করে বা সাহস সঞ্চয় করে কখনও কথাটা জিজ্ঞেস করতে পারে না, কিন্তু অনেক সময় তার সেই কৌতূহল চাপা ভাবে প্রকাশ হয়ে পড়ে, ওর দৃষ্টি বহু সময়ে তা ব্যক্ত করে। সুরেশ্বরের সঙ্গে হৈমন্তীর সম্পর্কের মধ্যে একটি রহস্যের গন্ধ মালিনী পেয়েছে।

মেয়েটিকে হৈমন্তী পছন্দই করে; তবু মালিনীকে সে সমমর্যাদার মানুষ বলে মনে করতে পারে না। বরং মালিনীর বয়স ও অন্যান্য বিষয়ের কথা ভাবলে মনে হয়, ওকে এতটা মেলামেশা করার সুযোগ দেওয়া হয়তো প্রশ্রয় দেওয়া হচ্ছে। আবার, হৈমন্তী কখনও কখনও ভাবে, মালিনীর সঙ্গে তার এমন কিছু তফাত নেই; সে লেখাপড়া শিখেছে, ডাক্তার হয়েছে, মালিনী লেখাপড়া বিশেষ কিছু শেখেনি, বয়সে সে বড়, মালিনী কিছুটা ছোট, হৈমন্তীর শহুরে শিক্ষাদীক্ষা, মালিনীর তা নয়; এ আর কী এমন তফাত। মালিনী তার দাসী নয়, সে ভদ্র পরিবারের মেয়ে, আর্থিক সঙ্গতি আজ তাদের নেই; হৈমন্তীদের কি এক সময়ে খুব একটা আর্থিক সঙ্গতি ছিল! হৈমন্তীর অসুখের সময় সুরেশ্বরের অর্থ সাহায্য কি তাদের প্রয়োজন হয়নি? তবে! ..দরিদ্র বলে মালিনীকে অবহেলার চোখে বা ছোট চোখে দেখতে হৈমন্তী কুণ্ঠিত হত। তার মতন ডাক্তার নয় বলে, বা মালিনী শহুরে নয় বলেও তাকে নিচু করে ভাবতে তার খারাপ লাগত। তবু পুরোপুরি মালিনীকে নিজের সমান সে মনে করতে পারত না।

সঙ্গী হিসেবে, আর অনেকটা যেন দূর আত্মীয়ের মতন হৈমন্তী মালিনীকে গ্রহণ করেছিল। দুটো কথা বলতে, গল্প করতে, মন হালকা করে হাসতে মালিনী ছাড়া তার সঙ্গী নেই। তা ছাড়া, মেয়ে বলেই হয়তো, স্বভাববশে তারা পরস্পরের ঘনিষ্ঠ হয়ে উঠেছিল, হৈমন্তী তেমন স্বতন্ত্র ও পৃথক থাকতে পারছিল না। হৈমন্তীর এই ধরনের মনোভাবকেই মাঝে মাঝে তার প্রশ্রয় দেওয়া বলে মনে হত। মনে হলেই সে বিরক্ত হত। আবার সময়ে সময়ে তার বিরক্তি নষ্ট হয়ে কেমন কুণ্ঠা জাগত।

নদীর পাড়ে পাথরে বসে কথা বলতে বলতে বিকেল পড়ে গেল। বর্ষা বিগত, শরৎকাল এসে পড়েছে। হৈমন্তী তেমন করে কখনও শরৎকাল কলকাতায় দেখতে পায়নি কিন্তু অসুখের সময় সে বীরভূমের মাঠেঘাটে শরৎকাল দেখেছে, স্মৃতি হয়ে এখনও তা বেঁচে আছে। এখানে সেই শরৎ নেই; কাশফুল চোখে পড়ে না-ধানের ক্ষেতে বাতাসের লুটোপুটি খাওয়া নেই, হাসিকান্নার মতন রোদ বৃষ্টিতে ভেজা তরুলতা কোথায়! তবু এখানেও শরৎকাল এসেছে। আকাশে, মেঘে, রোদে, বন্য প্রান্তরে এমনকী শস্যক্ষেত্রেও তা চোখে পড়ে। এই শরৎ সজল স্নিগ্ধ নয়, শুষ্ক স্নিগ্ধ। বড় তাড়াতাড়ি এখানে সব শুকিয়ে যায়। দীর্ঘ বর্ষার সমস্ত চিহ্ন এখানে অতি দ্রুত শুকিয়ে যাচ্ছিল, যেন নতুন পালা শুরু হওয়ার আগে কেউ দক্ষ হাতে তাড়াতাড়ি পুরনো পালার সব কিছু মুছে নতুনের জন্যে রঙ্গমঞ্চ সাজিয়ে দিচ্ছিল।

বেলা পড়ে আসছিল। এক ঝাঁক পাখি নদী পেরিয়ে ওপারে চলে গেল। গোধূলির মতন আকাশ কোথাও কোথাও রক্তাভ।

হৈমন্তী উঠল। মালিনীর ইচ্ছে ছিল আরও একটু বসে। আজ সে হৈমন্তীর কাছে নানারকম মজার গল্প শুনছিল। গল্পে গল্পে হৈমন্তীর ডাক্তারি পড়ার গল্প উঠেছিল: প্রথম প্রথম মড়ার গন্ধ কেমন লাগত হৈমন্তীর, কী কী করতে হত।

জল থেকে পা উঠিয়ে নিয়েছিল মালিনী অনেক আগেই, ওঠার সময় নদীর জলে মুখ ধুলো, কুলকুচো করল, তারপর আঁচলে হাত মুছে উঠে পড়ল।

হাঁটতে হাঁটতে মালিনী বলল, মানুষ মরে যাবার পর তার আত্মা কী করে স্বর্গে যায়, হেমদি?

হৈমন্তীর পঠিত বিদ্যার মধ্যে আত্মার স্বর্গগমনের কোনও সংবাদ ছিল না, হৈমন্তী সকৌতুক চোখে এই সরল মেয়েটির মুখের দিকে তাকাল, হাসির মুখ করল। তা তো জানি না।

মালিনী বোধ হয় জবাবটায় খুশি হল না; তার মনঃপূত জবাব এটা নয়। বলল, এখানে স্টেশনের কাছে একবার একটা বায়স্কোপ এসেছিল, সাবিত্রী সত্যবান পালা আমি দেখেছি। হিন্দি। সত্যবান মারা যাবার পর যমরাজ তার আত্মা নিল জানেন হেমদি। ইস্..কী কষ্ট যে হচ্ছিল, কিন্তু খুব ভাল দেখিয়ে ছিল। যমরাজ তার গদার মতো জিনিসটা কাঁধ থেকে নামিয়ে সত্যবানের বুকের কাছে ধরল আর সঙ্গে সঙ্গে সত্যবানের শরীর থেকে আর-একটা ছায়ার মতন সত্যবান বেরিয়ে এল; যমরাজ যত তার দণ্ডটা তুলছে, সেই ছায়ার মতন সত্যবানের শরীরটা ছোট হয়ে হয়ে জ্যোতির মতন হয়ে গেল, অবিকল একটা বলের মতন। যমরাজ তার দণ্ড কাঁধে তোলর পর জ্যোতিটা মিলিয়ে গেল, দেখা গেল না। ..

হৈমন্তী বুঝতে পারল না কী বলবে। চুপ করে থাকল।

 মালিনী বলল, আত্মা ওই রকম ভাবে চলে যায়। না?

সিনেমায় ওই ভাবে দেখায়।

না হেমদি– মালিনী মাথা নেড়ে প্রতিবাদ জানাল। আমার বাবা যখন মারা গেল আমি বাবার মাথার দিকে দেওয়ালে গোল মতন আলো দেখেছিলাম, ঠিক যেন কেউ আলো ফেলেছে দেওয়ালে। তারপর কান্নাকাটি করছিলাম তো, আর কিছু দেখিনি।

হৈমন্তীর ইচ্ছে হল, বলে, ওটা তোমার চোখের ভুল, মনের ভুল; কিন্তু বলতে কষ্ট হল। মালিনী যদি তার বাবার আত্মাকে আলোর মতন হয়ে মিলিয়ে যেতে দেখে থাকে তবে দেখুক–এখন এই মুহূর্তে তার ভ্রম ভাঙানোর চেষ্টা করলে সে ব্যথিত হবে।

হৈমন্তী চুপচাপ হাঁটতে লাগল। পাশে মালিনী।

মালিনী বেশিক্ষণ চুপচাপ থাকতে পারে না। আবার বলল, আমাদের আত্মাটা কোথায় থাকে, হেমদি? বুকের মাঝখানে?

হৈমন্তী মুখ ফিরিয়ে মালিনীকে দেখল। বলল, আমি জানি না। বলেই কী যেন ভেবে আবার বলল, এসব কথা তোমাদের দাদাকে জিজ্ঞেস কোরো।

সুরেশ্বরকে আত্মার কথা জিজ্ঞেস করার মতন সাহস মালিনীর নেই। মালিনী বলল, না বাবা, দাদাকে কে জিজ্ঞেস করবে।

ভয় করে?

ভয় করবে না…উনি কত রকম জানেন, আমি কোথাকার কী একটা, এসব কথা জিজ্ঞেস করতে পারি নাকি!

করেই দেখোনা, খেয়ে ফেলবে না তো আর।

মালিনী বিন্দুমাত্র উৎসাহ পেল না। আপনিই করবেন, করে আমায় বলবেন।

হৈমন্তী হাসল। আচ্ছা, করব।

সামান্য সময় চুপচাপ। মালিনী আবার বলল, হেমদি, অনেকে বলে–দাদা পুজোআচা করে না, দাদা হিন্দু নয়, খেস্টান-হিন্দু।

হৈমন্তী যত অবাক হল তত মজা পেল। খেস্টান-হিন্দু আবার কী?

 কে জানে! আমি ওসব বুঝি না। তবে আছে।

 কোথায়?

মালিনীর তাও জানা নেই। আমি দেখিনি। তা দাদা হিন্দু না হবে কেন বলুন, হেমদি। দাদা গীতা পড়েন, কী সুন্দর পড়েন–আমি শুনেছি। দাদার ঘরের বাইরে ওই যে বেদিটা আছে ওখানে বসে তিনি ধ্যান করেন, আমি দেখেছি। …দাদার ঘরে রামায়ণ মহাভারত-টারতও আছে।

হৈমন্তীর হাসি পাচ্ছিল, হাসলে মালিনী অপ্রস্তুত হবে, হাসছিল না তাই। তবে সুরেশ্বর তার ঘরের সামনে বেদিতে বসে ধ্যান করে এটা জানা ছিল না। বলল, তোমাদের দাদা কখন ধ্যান করেন? খুব সকালে?

কাক-ভোরেও আমি ওঁকে দেখেছি, সন্ধেতেও।

মন্ত্র পড়েন?

না, চুপচাপ থাকেন। ..আমি কোনওদিন কাছে যাইনি, যাওয়া উচিত না।

হৈমন্তী হঠাৎ বলল, তবে হয়তো চুপচাপ বসেই থাকেন।

 না–না, মালিনী জোরে জোরে মাথা নাড়ল, ওভাবে কেউ বসে থাকে না।

 হৈমন্তী আর কিছু বলল না।

 কথা বলতে বলতে আশ্রমের কাছাকাছি পৌঁছে মালিনী হঠাৎ শুধোল, আপনি যেন কিছু বিশ্বাস করেন না, হেমদি। ঠাকুর দেবতা মানেন না?

হৈমন্তী জবাব দিতে গিয়ে কেমন দ্বিধায় পড়ল। বলতে পারত, না করি না। কিন্তু সেটা মিথ্যে হত। যদি বলে হ্যাঁ, সেটাও সত্য হয় না। ঠাকুর দেবতায় বিশ্বাস করে সে পুজোপাঠ, উপোস করে না; আবার দুর্গাপুজোয় সে প্রতিমা দর্শন করে, প্রণাম করে, মন্দিরে গেলেও মাথা নোয়ায়, প্রসাদ খায়। বিপদে ও দুঃখে ভগবানকে স্মরণ করে। কলেজে পড়ার সময়ে কত বন্ধুবান্ধবকেই দেখেছে ঠিক এই রকম, দেবমন্দির দেখে প্রণাম করতে, অঞ্জলি দিতে। এমনকী তাদের কলেজের দুজন বাঘা সার্জনকেও সে ছুরি ধরার আগে একবার নীরবে পলকের জন্যে চোখ বন্ধ করে ঈশ্বর স্মরণ করতে দেখেছে। হয়তো এটা সংস্কার; ছেলেবেলা থেকে দেখে দেখে শুনে শুনে এরকম হয়েছে। আচার পালন বা সংস্কার মানা ছাড়া আর কিছুই নয়। তবু হৈমন্তী অন্তত বলতে পারে না, আমি মানি না। তার জীবনের চরম বিপদের সময় সে কি ভগবানের কথা ভাবত না? প্রার্থনা করত না? অসুখের সময় তার কাছে সর্বক্ষণ আর তো ভগবানের কেউ ছিল না; যা বলার ভগবানের কাছেই বলত।

হৈমন্তীর কেন যেন মনে হল, সে বেশির ভাগ মানুষের মতন আচার ও সংস্কারের বশে ঠাকুর দেবতা মানে, আবার অনেকের মতন সে জানে এর সবই মিথ্যে। নিজের সমাজ, পরিবার, আত্মীয়স্বজন তাকে কিছু কিছু জিনিস বিশ্বাস করতে, ভক্তি করতে শিখিয়েছে; বুদ্ধি ও অভিজ্ঞতা তাকে অনেক বিষয়ে অবিশ্বাসী হতে শিক্ষা দিয়েছে। মালিনী যখন তাকে আত্মার কথা বলল, দেহ থেকে জ্যোতির মতন আত্মা বেরিয়ে যায়, তখন হৈমন্তী অনায়াসে হাসতে পারল। কেন না সে জানে, এরকম হয় না, হওয়া অসম্ভব। অথচ সে কেন হেসে বলতে পারছে না ঠাকুর দেবতা আবার কী! ও-সব লোকে দেখায়, বোঝায়। আমি মানি না। কোথায় যেন একটা দুর্বোধ্য বিশ্বাস তার থেকে গেছে।

নিজের দুর্বলতা এবং দ্বিধা হৈমন্তী লুকোতে চাইল না। বলল, আমরা হিন্দু, মালিনী; আমাদের ধর্মে ঠাকুর দেবতা লোকে বিশ্বাস করে। আমিও করি! .. তা ছাড়া এসব নিয়ে আমি কখনও ভাবিনি। সত্যি মিথ্যে জানি না।

মালিনী কেন যেন খুশি হল। বলল, হেমদি, আমার বাবা বলত: ঘুমন্ত মানুষের ঘরেই চোরে সিদ দেয়, ভাবন্ত মানুষের ঘরেই ভগবান দেখা দেয়। বলে মালিনী কেমন ভাবের ঘোরে গুনগুন করে হিন্দি ভজনের একটা কলি গাইল।

.

আশ্রমের কাছে আসতেই চোখে পড়ল সামান্য দূরে একটা জিপগাড়ি দাঁড় করানো। আশেপাশে কেউ নেই।

হৈমন্তী কিছু অনুমান করার আগেই মালিনী বলল, কে এল?

অনেকটা দূর থেকেও হৈমন্তীর মনে হল সে গাড়িটা চিনতে পেয়েছে। অনুমান করল, অবনীবাবু এসেছেন।

মালিনী তাড়াতাড়ি হাঁটতে লাগল, কে এসেছে জানতে সে ছেলেমানুষের মতন ব্যগ্র। হৈমন্তী পিছিয়ে পড়ল।

অবনীর কথা মনে আসতেই মালিনীর সেই কথাগুলো মনে পড়ল: খুব মদটদ খায়, একলা থাকে। মালিনী একেবারে একটি গেজেট। হৈমন্তীর হাসি পেল! ..তা হঠাৎ ভদ্রলোক আজ এখানে এলেন? বেড়াতে? সুরেশ্বর ওঁকে আসতে বলেছিল, তাই নাকি? হৈমন্তীও তো আমন্ত্রণ করেছিল।

জিপগাড়ি দেখে মালিনী ফিরে আসছিল। রোগীদের ঘরের দিকে বারান্দায় এক চোখে ব্যান্ডেজ বেঁধে একটা বাচ্চা দাঁড়িয়ে, পাশে পিছন ফিরে আর একজন কে দাঁড়িয়ে। অন্ধকুটিরের দিকে কয়েকজন মাঠে গোল হয়ে হয়ে বসে। চাকরবাকরও দেখা যাচ্ছিল। ফিরে আসার সময় মালিনী চেঁচিয়ে কাকে কী জিজ্ঞেস করল। ফিরে এসে বলল, কে এক বাবু এসেছে।

অবনীবাবু বোধহয়– হৈমন্তী বলল।

মালিনী চোখ তুলে হৈমন্তীর মুখ দেখল, দুপলক, তারপর নিজের বোকামির জন্যে যেন আফসোস করে বলল, ওমা তাই তো! ঠিক ধরেছেন হেমদি, এ গাড়ি আমি দেখেছি আমাদের ওখানে।

নিজেদের ঘরের দিকে পা বাড়াল হৈমন্তী; মালিনীও হাঁটতে লাগল।

হেমদি–

একটা কথা বলব, রাগ করবেন না?

কী কথা? হৈমন্তীর সন্দেহ হল মালিনী আরও কোনও নতুন খবর শোনাতে চায়।

মালিনী বলল, আপনার সঙ্গে তো চেনা আছে– ওঁকে একটু আমার ভাইয়ের কথা বলবেন। আমার ভাইটা একেবারে গোবাগাবলা; কিছু মুরোদ নেই। ধরলে করলে চাকরিটা আর একটু ভাল হতে পারত, মাইনেও বাড়ত।

হৈমন্তী কোনও জবাব দিল না। মালিনীর কথায় এমন এক কাতর অনুরোধ ছিল যে, হৈমন্তীর দুঃখই হল। সেদিন মালিনীর কথা শুনে শুনে মনে হয়েছিল–যে মদ খায়, অত বড় বাড়িতে একলা থাকে তার সম্পর্কে মালিনীর যেমন ভয় তেমনি বিতৃষ্ণা, হয়তো ঘেন্নাও। এখন মালিনীর কথা শুনে মনে হবে, ভদ্রলোক মদই খান আর একলাই থাকুন মালিনীর তাতে আসে যায় না; তার যত বিতৃষ্ণা, ভয়, ঘৃণাই থাকুক তবু সে জানে ওই ভদ্রলোক ইচ্ছে করলেই মালিনীর ভাইকে তরিয়ে দিতে পারেন। এই বিশ্বাসও, হৈমন্তীর হঠাৎ যেন মনে হল অদ্ভুত, প্রয়োজনে বিশ্বাস।

মালিনী অপেক্ষা করছে দেখে হৈমন্তী বলল, আমার সঙ্গে আর কতটুকু চেনা? হুট করে কি ও-সব কথা বলা যায়। বরং তুমি ওঁকে বলতে বলো।

কাকে?

তোমাদের দাদাকে। ..ওঁর সঙ্গেই বেশি চেনা।

 মালিনী মাথা নাড়ল, নানা, দাদাকে এসব কথা বলা যায় নাকি! আপনি যেন কী হেমদি!

 মালিনীর জন্যে কেমন সহানুভূতি বোধ করল হৈমন্তী, বলল, আচ্ছা দেখি।

 দরজার মাথায় শেকল খুলে হৈমন্তী নিজের ঘরে ঢুকল, মালিনী গেল তার ঘরে।

অন্ধকারে কয়েক দণ্ড দাঁড়িয়ে থাকল হৈমন্তী। মালিনী হাত মুখ ধোবে, সন্ধে দেবে, লণ্ঠন জ্বালবে; ততক্ষণ অপেক্ষা করতে হবে হৈমন্তীকে।

অবনীবাবু এসে সুরেশ্বরের কাছে বসে রয়েছেন নিশ্চয়, গল্পগুজব করছেন। সেখানে যাওয়া কি তার উচিত? ভদ্রতা রক্ষা করতে হলে একবার যাওয়া দরকার। সেদিন এই অবস্থায় পৌঁছে দিলেন, আবার পথে যেদিন দেখা হল দাঁড়িয়ে কথাবার্তা বললেন, এগিয়ে দিলেন খানিকটা, হৈমন্তী ওঁকে আশ্রমে আসতে অনুরোধ করল। এর পর, ভদ্রলোক আজ যখন আশ্রমে এসেছেন তখন তাঁর সঙ্গে দেখা না করাটা কি ভাল দেখাবে! না দেখা করাটা সৌজন্য হয় না। আবার সুরেশ্বরের ওখানে গিয়ে দেখা করাটাও কেমন যেন!

সুরেশ্বরের সঙ্গে ভদ্রলোক কী গল্প করছেন তাও জানার কৌতূহল হল হৈমন্তীর; প্রথম দিনই, জিপগাড়িতে আসার সময় পরস্পরের কথাবার্তা শুনে হৈমন্তী বুঝতে পেরেছিল, দুটি মানুষই দুরকম, কোথাও কোনও মিল আছে বলে মনে হয় না। এই আশ্রম সম্পর্কে যে অবনীর কোনও আস্থা নেই, বরং সুরেশ্বর ও এই আশ্রম সম্পর্কে তার মনোভাব উপহাসের তা বোঝা যায়। হৈমন্তীর কানে অবনীর সেই বিদ্রূপ ধরা পড়েছে। ..দুই বিপরীত প্রকৃতির মানুষ মুখোমুখি বসে কী গল্প যে করছে তা শোনার কেমন এক অদ্ভুত বাসনা হল হৈমন্তীর।

 মালিনী বাতি দিয়ে গেল।

হৈমন্তী কলঘরে যাবার জন্যে পা বাড়িয়ে বলল, আমায় একটু জল খাওয়াও মালিনী, আমি আসছি।

মুখ হাত ধুয়ে ফিরে এসে হৈমন্তী শাড়িটা একটু গোছগাছ করে নিল, মুখ মুছল পরিষ্কার করে, হালকা করে পাউডার বুলিয়ে নিল, চুলে একটু চিরুনি ছোঁয়াল, জল খেল। তারপর ঘরের বাইরে এসে শেকল তুলে দিল।

মালিনী বাইরে এসেছিল, শুধোল, কোথায় যাচ্ছেন, হেমদি?

ওবাড়িতে যাই, একবার দেখা করে আসি।

হৈমন্তী মাঠে নামল। ততক্ষণে অন্ধকার হয়েছে। অন্ধকারের মধ্যেই বোঝা গেল চাঁদ উঠছে।

.

০৮.

সুরেশ্বরের বাড়ির বারান্দায় ওরা বসে, লণ্ঠন জ্বলছে, ছোট মতন জলচৌকির ওপর চায়ের কাপ। হৈমন্তীকে দেখে অবনী সৌজন্য প্রকাশ করে তার চেয়ার ঠেলে সামান্য উঠে দাঁড়াল, বলল, আসুন।

হৈমন্তী ঠিক নমস্কার করল না, মাথা নিচু করে যেন তার তরফ থেকে ভদ্রতা প্রকাশ করল; পরিচয়ের স্নিগ্ধ হাসি হেসে বলল, আপনি বসুন।

সুরেশ্বর আশেপাশে তাকিয়ে হৈমন্তীর বসার জায়গা খুঁজছিল, হৈমন্তী একটা কাঠের চেয়ার টেনে নিল। বসল। অবনীও বসেছে।

সুরেশ্বর বলল, কোন দিকে বেড়াতে গিয়েছিলে?

নদীর দিকে, হৈমন্তী মৃদু গলায় জবাব দিল।

চুপচাপ। সুরেশ্বর অবনী কোনও বিষয়ে কথা বলছিল, হৈমন্তী ওদের গলার শব্দ শুনেছে, এখন হৈমন্তী আসায় ওরা থেমে গেছে। অবনীর দিকে তাকাল হৈমন্তী, কতক্ষণ এসেছেন?

অনেকক্ষণ। ঘন্টা খানেকেরও বেশি।

দেখলেন সব… হৈমন্তী মুখে হাসি মাখিয়ে বলল।

মোটামুটি।

কেমন লাগল?

অবনী কেমন অপ্রস্তুত বোধ করে সুরেশ্বরের দিকে তাকাল। সুরেশ্বর যেন হাসছিল।

সুরেশ্বর বলল, উনি তেমন করে কিছু দেখেননি, হেম। আমার সঙ্গে দাঁড়িয়ে গল্প করার সময় একটু পায়চারি করলেন।

অবনী সঙ্কোচ অনুভব করে বলল, না, ঠিক তা নয়; এখন আর কী দেখব! পরে আবার একদিন আসা যাবে।

হৈমন্তীর মনে হল, আশ্রম দেখার উৎসাহ অবনীর নেই। কী বা দেখবে সে? কটা বাড়ি, কয়েকজন অন্ধ, আর হাসপাতাল? এসব দেখার আগ্রহ কারই বা থাকে।

নিজের কুণ্ঠা ও অপ্রস্তুত ভাব কাটবার জন্যে অবনী ঠাট্টার গলায় এবার বলল, আমরা মিস্ত্রি-মজুর মানুষ, এসব বুঝি না। …কথাটা হৈমন্তীর দিকে তাকিয়েই প্রায় বলল অবনী, তারপর সুরেশ্বরের দিকে তাকাল, তবে আপনি মশাই, কাজের লোক। আমাদের বিজলীবাবু বলেন, কর্মযোগী ব্যক্তি। বলে জোরে জোরে হাসল।

সুরেশ্বরের নীরবে হাসল। হৈমন্তীর ঠোঁটেও হাসি খেলে গেল।

অবনী পকেট থেকে প্যাকেট বের করে সিগারেট ধরাল। এক গলা ধোঁয়া টেনে নিয়ে ঢোঁক গিলল। পরে সুরেশ্বরকে লক্ষ করে বলল, আপনি বেশ সুখে-শান্তিতে আছেন দেখছি। …আজকাল সুখটুখ পাওয়া একটা ভাগ্য।

অবনী ঠাট্টা করল নাকি বাস্তবিকই কোনও ক্ষোভ জানাল বোঝা গেল না। হৈমন্তী আড়চোখে অবনীর মুখ দেখল। সুরেশ্বরকে যদি অবনী ঠাট্টাই করে থাকে তবে ভালই করেছে। হৈমন্তী কোথায় যেন তৃপ্তি বোধ করল। ইচ্ছে হল অবনীকে বলে–ওঁর মতন হয়ে যেতে পারলে কোনও আঁচই গায়ে লাগে না, লাগলেও ফোঁসকা পড়ে না–নিশ্চিন্ত থাকা যায়।

সুরেশ্বর শান্ত গলায় হাসিহাসি মুখেই বলল, তা একরকম আছি; সুখের চেষ্টায়… সুখের চেষ্টা কথাটায় ঝোঁক ছিল।

কথাটা অবনী খেয়াল করে না শুনলেও তার কানে গিয়েছিল। হৈমন্তীও শুনেছে। অবনী কোনও কিছু না ভেবেই ঠাট্টাচ্ছলে বলল, বেশ তো রয়েছেন, আবার চেষ্টায় আছি বলছেন কেন!

সুরেশ্বর বলল, আপনি বোধহয় সেই পাখির গল্পটা শোনেননি?

পাখির গল্প শোনার মতন ছেলেমানুষ অবনী নয়। অনাগ্রহের গলায় বলল, না।

এ সংসারে একটা গাছ আছে, তাতে দুটো পাখি থাকে… সুরেশ্বর বলল, একটা পাখি থাকে গাছের মাথায়, অন্যটা নীচে-গাছের ডালে বসে ফল খায়। …আমার যতটুকু সুখ তা নীচের ডালে বসে, ওপরে উঠতে পারি না।

অবনী সুরেশ্বরকে দেখল। হৈমন্তীও লক্ষ করছিল। সুরেশ্বর হেঁয়ালি করলেও করতে পারে, কিন্তু অবনীর মনে হল সে কিছু বোঝাবার চেষ্টা করছে।

এ যে মশাই তত্ত্বকথা, অবনী হেসে বলল, আমার মোটা মাথায় ঢুকবে না।

সুরেশ্বর সঙ্গে সঙ্গে কোনও জবাব দিল না। হঠাৎ যেন সে অন্যমনস্ক হয়ে গেছে। সামান্য পরে হৈমন্তীর দিকে তাকাল একবার, তারপর অবনীকে বলল, হেম সেদিন বলছিল সংসারে সবাই সুখ চায়। মিথ্যে বলেনি। আমরা সবাই সুখ চাই, দুঃখ পাবার জন্যে কে আর জগতে বাঁচতে চায়। তবু দুঃখের জগতে দুঃখ আছে। সুখও আছে। কিন্তু সুখের কথা ভাবলে কোথায় যেন সন্দেহ থাকে। আমি দেখি সুখ ওই রকম: একই গাছে দুই পাখি, একটা ওপরে, অন্যটা নীচে। আমাদের বেশির ভাগ মানুষের সুখ নীচের ডালে…

নীচে যে কিছু পাওয়া যায়, ওপরে কিছু না। অবনী অক্লেশে বলল।

আমার তা মনে হয় না, সুরেশ্বর জবাব দিল, ওপরে উঠলে হয়তো আরও বড় কিছু পাওয়া যায়।

কী পাওয়া যায়? ভগবান?

আনন্দ।

 কেমন আনন্দ? অবনী শ্লেষের মতন করে হাসল।

তা তো জানি না। যাঁরা পেয়েছেন তাঁরা বলছেন সমস্ত সংকীর্ণ বেদনা থেকে মুক্ত এ-আনন্দ।

কারা কী বলেছে তাতে কী আসে যায়। তারা মিথ্যে বলতে পারে, ধাপ্পা মারতে পারে। অবনী উপহাস করে বলল। কী পাচ্ছি তার হিসেব না করে কী পাব তার হিসেব করা মূর্খতা। ওসব সুন্দর সুন্দর কথা আমি বিশ্বাস করি না।

সুরেশ্বর উত্তেজিত হল না। স্বাভাবিক গলায় বলল, আপনি কি মনে করেন আজকের হিসেবটাই সব?

না মনে করার কারণ নেই।

সুরেশ্বর আর কিছু বলল না। যেন এ বিষয় নিয়ে তর্ক করার অভিরুচি বা ইচ্ছা তার নেই, প্রয়োজনও নয়। সামনের দিকে তাকিয়ে বসে থাকল।

হৈমন্তীও বাগানের দিকে তাকিয়ে বসে ছিল। জ্যোৎস্না আরও পরিষ্কার হয়ে ফুটে উঠেছে, লতায়পাতায় চাঁদের আলো মাখানো। অথচ হৈমন্তী তেমন সুখ পাচ্ছিল না। কোথায় যেন এক অদ্ভুত বিষণ্ণতা রয়েছে।

অবনী হাতের সিগারেট ফেলে দিল। সুরেশ্বরের সঙ্গে কথা কাটাকাটি করার পরই সহসা তার ললিতার কথা মনে পড়ল। কেন? ললিতার কাছে সে যা পেয়েছিল তা স্থায়ী হয়নি বলে, নাকি সেদিন তার হিসেবে গোলমাল হয়েছিল, ভুল হয়েছিল।

ভাল লাগল না অবনীর। এসব চিন্তা তার ভাল লাগে না। তেমন করে দেখলে মানুষ, এই মুহূর্তে যা পায় তার অনেক কিছুর হিসেবই তবে করতে পারবে না। সুখেরও নয়, দুঃখেরও নয়। হীরালাল মারা যাচ্ছে এই সংবাদে সে সেদিন যতটা বিচলিত হয়েছিল আজ আর ততটা নয়। তা হলে তার দুঃখ ক্ষোভ কি জলের হিসেবে মাপা হবে।

সুরেশ্বর প্রসঙ্গ পরিবর্তন করে বলল, আপনাদের কাজ কতদূর এগুল?

চলছে, অবনী অন্যমনস্কভাবে জবাব দিল।

কে যেন সেদিন বলেছিল, এ দিককার কাজ প্রায় শেষ।

কোথায় শেষ, এখনও অনেক বাকি। অবনী বলল, তারপর কী মনে পড়ায় হেসে বলল, যে কাজ এরা হাতে নিয়েছে তা অশেষ।

সুরেশ্বর হাসল। হৈমন্তী হাসল না, মুখ ফেরাল।

অবনী পরিহাস করে বলল, কাজ শেষ হয়ে গেলে আমায় বেকার হতে হবে। তখন আপনাদের শরণাপন্ন হব। বলে হৈমন্তীর দিকে তাকাল।

হৈমন্তী সহাস্য সকৌতুক মুখ দেখল অবনীর। যে-কোনও কারণেই হোক সামান্য আগে আবহাওয়া কেমন গম্ভীর হয়ে এসেছিল, এখন বেশ হালকা হয়ে আসছে। হাসির মুখ করল হৈমন্তী।

সুরেশ্বর হেসে বলল, আমাদের এখানে অন্ধরা আসে, আপনি তো অন্ধ নন।

 না; তবে হতে কতক্ষণ?

কথাটা বলার পর অবনী কোথাও যেন কিঞ্চিৎ সন্দেহ অনুভব করল। সুরেশ্বরের দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে হৈমন্তীর দিকে তাকাল। কয়েক পলক যেন তার কেমন এক রহস্যময় অনুভূতির মধ্যে কাটল।

এদিকে কি অন্ধটন্ধ বেশি? অবনী হঠাৎ জিজ্ঞেস করল।

পুরোপুরি যাকে অন্ধ বলে তা হয়তো তেমন নেই, তবে চোখের রোগটা বেশি।

কেন?

 অযত্ন, দারিদ্র্য, অবহেলা…। আপনি এদের গাঁয়েটায়ে গেছেন কখনও?

না।

যে ভাবে থাকে সেটা স্বাস্থ্যকর নয়। …

সুরেশ্বর অস্বাস্থ্যকর আবহাওয়ার সাধারণ এক উদাহরণ বোঝাতে গিয়ে জানাল, এদিকের সকলেই জ্বালানির জন্যে কাঠকুটো ব্যবহার করে। কাঠের বিশ্রি ধোঁয়া পাখির খোপের মতন খাপরার ছোট্ট ঘরে কত ঢুকছে তা ওরা দেখে না। চার ছ মাসের বাচ্চা থেকে ছেলেমেয়ে বউ সবাই সেই ধোঁয়া খাচ্ছে রোজ। চোখের পক্ষে এটা খারাপ। …এদের বাচ্চাকাচ্চাগুলো সকালে ঘুম থেকে উঠে চোখে জল পর্যন্ত দেয় না। …এ সবই কিছুটা সাধারণ স্বাস্থ্যরক্ষার ব্যাপার। ওরা জানে না, গা করে না। চোখে সামান্য কিছু হলে সেটাকে হাতুড়ে-বিদ্যে করে আরও বাড়িয়ে ফেলে। …

অবনী অন্যমনস্কভাবে শুনল খানিকটা; কোনও উৎসাহ বোধ করল না।

সামান্য সময় নীরবতার মধ্যে কাটাল। অবনী সিগারেটের টুকরোটা নিবিয়ে ছুঁড়ে ফেলে দিল। দেখতে দেখতে জ্যোৎস্না এ পাশে বারান্দার গায়ে এসে পড়েছে।

সুরেশ্বর বলল, একটু বসুন, আমি আসছি।

 সুরেশ্বর ঘরে গেল। হৈমন্তী জ্যোৎস্নার দিকে তাকিয়ে বসে, অবনীও সামনের দিকে তাকিয়ে থাকল।

 কিছু সময় কেউ কোনও কথা বলল না। শেষে অবনীই কথা বলল। সহাস্য গলায় শুধোল, আপনার আবাস কোনটা?

ভেতরে ঢুকেই ডান দিকে; ছোট মতন বাড়িটা।

যাবার সময় দেখব। ..ও, আচ্ছা…আপনাকে একটা কথা জিজ্ঞেস করি–ডকটরস ওপিনিয়ান আমার আজকাল মাঝে মাঝেই মাথা ধরে। চোখ খারাপ হচ্ছে নাকি?

হৈমন্তী অবনীর চোখে চোখে তাকাল। মুখ দেখে বোঝা যায় না ঠাট্টা-তামাশা করছে না সত্যি সত্যিই কিছু জানতে চাইছে। হৈমন্তী প্রায় পেশাদারি গলায় বলল, আপনার চোখ কি খারাপ?

না; দেখতে কোনও অসুবিধা হয় না।

পড়তে? পড়াশোনার কাজকর্ম করতে?

না।

তা হলে কিছুনয়, হৈমন্তী বলল। বলেই ভাবল: বেশি মদটদ খাওয়ার জন্যেও হতে পারে হয়তো। অবনী সম্পর্কে সে কেন যেন সামান্য বিরক্তি বোধ করল এখন।

না হলেই ভাল অবনী হাসল, চারদিকে এত রকমের অন্ধ দেখে ভয় হয়।

কথাটা শুনতে সাদামাটা; কিন্তু অবনী এমনভাবে বলল যে হৈমন্তীর সন্দেহ হল কথাটার মধ্যে দ্বিতীয় অর্থ আছে, খোঁচা আছে। ঠিক কী বোঝাতে চায় অবনী হৈমন্তী জানতে চাইল, এবং জানার আশায় অবনীকে লক্ষ করল।

অবনী নিষ্পলকে হৈমন্তীকে দেখছিল। দৃষ্টি অস্বাভাবিক মনে হচ্ছিল অবনী যেন হৈমন্তীর মধ্যে কিছু খুঁজছে, কিছু বা বলছে। হৈমন্তী চোখ সরিয়ে নিল।

অবনী গলার স্বর নামিয়ে বলল, আপনারা দুজনেই খুব ডিভোটেড?

হৈমন্তীর মনে হল, অবনী দুজনে শব্দটা ইচ্ছাকৃত জোর দিয়ে বলল, বিশেষার্থে যেন। কী বোঝাতে চাইল? সুরেশ্বরের সঙ্গে হৈমন্তীর একটা যুগ্মসম্পর্ক কী সে গড়ে নিয়েছে। কেন যেন অবনীর এই ধারণা তার ভাল লাগল না।

হৈমন্তী বলল, আমি নয়; উনি।

 আপনি?

..ভেবে দেখিনি।

সুরেশ্বর ফিরে এল।

সুরেশ্বর ফিরে এসে বসতে না বসতে যুগলবাবুকে দেখা গেল। বাগানের মধ্য দিয়ে এলেন। হাতে কিছু খাতাপত্র। সিঁড়িতে পা দিলেন।

হৈমন্তী অবাক। যুগলবাবু কি আজ বাড়ি ফেরেননি। বলেছিলেন অবশ্য, আজ অনেক কাজ আছে, আশ্রমের অফিসের কাজ, হিসেবপত্রের ঝঞ্জাট। হৈমন্তী বুঝতে পারল, কাজের চাপে আজ ওঁর বাড়ি ফেরা হয়ে ওঠেনি, এখানেই থেকে গেছেন।

যুগলবাবু বারান্দায় উঠে অবনীকে দু পলক দেখলেন। সুরেশ্বরের সঙ্গে তাঁর কাজ, অথচ এখন খাতাপত্র খুলে বসা যাবে কি না সে বিষয়ে তাঁর সন্দেহ হল যেন।

সুরেশ্বরও সামান্য বিব্রত বোধ করে অবনীর দিকে তাকাল।

যুগলবাবু বললেন, তিনি কি আর একটু পরে ঘুরে আসবেন?

সুরেশ্বর কিছু বলার আগেই অবনী বলল, আপনারা বোধহয় কাজে বসবেন?

 সুরেশ্বর মাথা নাড়ল, হ্যাঁ কিছু অফিস সংক্রান্ত জরুরি কাজ। …আপনি…

আমার জন্যে ব্যস্ত হবেন না। কাজের মানুষকে অকাজে আটকে রাখব না। আমি আজ উঠি। উঠবেন!

 এখনও তেমন রাত হয়নি। সন্ধে…

আপনাদের আশ্রমে একটু বেড়াই। …উনি তো রয়েছেন। হৈমন্তীকে ইঙ্গিতে দেখিয়ে দিল অবনী।

সুরেশ্বর হৈমন্তীর দিকে তাকাল। হেম, তোমার তো সন্ধে কাটে না। ওঁর সঙ্গে গল্পটল্প করো, আমি কাজটা শেষ করে ফেলি।

অবনী উঠে পড়ল।

সুরেশ্বরও উঠে দাঁড়াল। বলল, আমি দু-একদিনের মধ্যেই আপনাদের দিকে যাব, দেখা করব। আপনি আর-একদিন আসুন। এখানেই দুটো খাবেন… আসবেন। আপনার সঙ্গে অনেক গল্প করা যাবে। …তত্ত্বকথা ছাড়াও গল্প হয়। আমি নিজেও খুব একটা তত্ত্বের ভক্ত নয়। সুরেশ্বর সুন্দর করে হাসল।

অবনীও হাসল, বলল, আসব।

সুরেশ্বর হৈমন্তীর দিকে তাকাল, হৈমন্তী উঠে দাঁড়িয়েছে। বলল, হেম, অবনীবাবুকে আর-একবার চা-টা খাইয়ো। আমার এখানে অনেকক্ষণ আগে খেয়েছেন।

অবনী সিঁড়ি নামতে লাগল পেছনে সুরেশ্বর, শেষে হৈমন্তী।

সিঁড়ি নেমে অবনী বলল, আপনার এই বাড়ি বেশিদিন টিকবে না।

 কেন?

 ড্যাম্প…।

 সবে বর্ষা গেল।

মাটির সঙ্গে কিছু মিশিয়ে নিতে পারতেন।

 কয়েকটা বছর যাক তারপর দেখব।

সুরেশ্বর খানিকটা পথ এগিয়ে দিয়ে বিদায় নিল।

জ্যোৎস্নাভরা মাঠ দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে অবনী বলল, ভদ্রলোক এখানে নিজেকে বেশ মানিয়ে নিয়েছেন।

হৈমন্তী কোনও জবাব দিল না। নীরবে নতমুখে হাঁটতে লাগল।

অবনী আবার বলল, আমার কয়েকটা জিনিস জানতে কৌতূহল হয়। যদি কিছু মনে না করেন জিজ্ঞেস করি।

হৈমন্তী মুখ তুলে তাকাল। কী বিষয়ে কৌতূহল অবনীর? সুরেশ্বর সম্পর্কে কিছু জানতে চান, না তার বিষয়ে?

অবনী বলল, আমি ওঁর মুখে শুনেছি, এক সময়ে উনি কলকাতায় থাকতেন।

হৈমন্তী আস্তে করে মাথা নাড়ল। হ্যাঁ, থাকতেন।

 কী করতেন? অবনী শুধোল।

তেমন কিছু না। হৈমন্তী বলল।

 পয়সাকড়ি ছিল বোধহয়।

কিছু ছিল।

 আত্মীয়স্বজন নেই?

না। মা মারা যান আগে, পরে বাবা।

আমার সঙ্গে এ ব্যাপারে ভদ্রলোকের মিল হল না। আমার মা পরে মারা যায়। কথাটা অবনী কেমন অকরুণ ভাবে বলল। হৈমন্তী কিছু বুঝতে পারল না।

অল্প কয়েক পা হেঁটে অবনী এবার বলল, উনি কি আপনাদের আত্মীয়?

 চোখ তুলে পলকের জন্যে দেখল হৈমন্তী, চোখ নামাল। আমাদের পারিবারিক বন্ধু। আমার মার সঙ্গে ওঁর মার দূর সম্পর্কের একটা আত্মীয়তা ছিল।

অবনী ঘাড় ফিরিয়ে হৈমন্তীকে দেখছিল। আপনার মা…

আছেন। বাবা মারা গেছেন আমার ছেলেবেলায়। দাদা আছেন, চা বাগানে চাকরি করেন, ছোট ভাই আছে, চাকরি-বাকরি করে। এক মামা আছেন। হৈমন্তীর কেন যেন এই পারিবারিক কথা বলতে ভাল লাগছিল।

অবনী কিছু বলতে যাচ্ছিল, তার আগেই হৈমন্তী বলল, এ-পাশে হাঁটুন–ওই যে–ওই বাড়িটা আমার।

বাড়ির কাছাকাছি এসে দ্বিধা বোধ করল হৈমন্তী। তার একটিমাত্র ঘর, বিছানা কাপড়-চোপড় বইপত্র থেকে শুরু করে যাবতীয় যা কিছু ওই ঘরে, ওই স্থানটুকুর মধ্যেই তার শোওয়া বসা বিশ্রাম-বিলাস। নিজের নিভৃতি এবং গোপনীয়তা বলতে যা কিছু সবই ওখানে। সামান্য পরিচিত এই পুরুষমানুষটিকে তার ঘরে নিয়ে গিয়ে বসাতে হৈমন্তীর সঙ্কোচ এবং কুণ্ঠা জাগল। তা ছাড়া এই আশ্রমের স্বাভাবিক দীনতার স্পর্শ তার ঘরেও রয়েছে। অবনী নিজের চোখে তার নিভৃত জীবনযাপনটুকু দেখে যাবে হৈমন্তীর তাতে আপত্তি আছে। অথচ ভদ্রলোককে বসাবে কোথায়? বাইরে? সরু বারান্দাটুকুতে? অবনী যদি কিছু মনে করে? যদি ভাবে, এ কেমন ভদ্রতা? বাইরে বসিয়ে রাখা? সুরেশ্বরের ওপর রাগ হল। যুগলবাবুকে একটু ঘুরে আসতে বললে ক্ষতি ছিল না, কিংবা সুরেশ্বর যুগলবাবুকে নিয়ে ঘরে গিয়ে কাজ করতে পারত। তোমার তো ঘরের অভাব নেই, দুটো ঘর, আমার মাত্র একটাই।

মালিনী নিত্যকার মতন বারান্দায় বসে। চাঁদের আলোয় বারান্দা ভরে আছে। হৈমন্তীদের আসতে দেখে মালিনী তাড়াতাড়ি উঠে দাঁড়াল।

কাছাকাছি এসে হৈমন্তী বলল, বারান্দায় বসি, চমৎকার জ্যোৎস্না..বাতাসও রয়েছে। বারান্দায় উঠে মালিনীকে বসার জন্যে কিছু আনতে বলল, তারপর নিজেও শেকল খুলে কিছু আনতে ঘরে ঢুকল।

হৈমন্তী বেতের একটা চেয়ার পেল নিজের ঘরে, মালিনী একটা মোড়া এনে দিল। অবনীকে বেতের চেয়ারটা এগিয়ে দিয়ে হৈমন্তী বলল, বসুন। …মালিনী, একটু চা করো ভাল করে।

অবনী বসতে বসতে হেসে বলল, এই মেয়েটি আপনার অ্যাসিসটেন্ট নাকি?

না; এখানে ও বছর খানেকের বেশি আছে। এমনি কিছু কাজকর্ম করে, আর রুগিদের দেখাশোনা করে খানিক।

নার্স?

 না, নার্স নয়; তবে হাতে হাতে খানিকটা শিখেছে। হৈমন্তী বেতের মোড়ায় বসল। ওর ভাই আপনার অফিসে চাকরি করে।

শুনেছি। বিজলীবাবু সেদিন বলছিলেন।

হৈমন্তী ভাবল, মালিনীর আবেদনটা এখন জানাবে কি না। উচিত হবে কি? বরং মালিনী চা নিয়ে আসুক, মালিনীকে দিয়েই বলবে।

কয়েক মুহূর্তে কেউ আর কথা বলল না। অবনী একটা সিগারেট ধরাল।

হৈমন্তী নীরবে জ্যোৎস্নার দিকে তাকিয়ে বসে থাকল।

অবনী শেষে বলল, এখানে আপনার সময় কাটে কী করে?

 হৈমন্তী সামান্য সময় কোনও জবাব দিল না, যেন তার অজস্র সময় যে কী বিশ্রী, নিরিবিলি ও শূন্যতার মধ্যে কাটে তা আবার মনে মনে অনুভব করে চাপা নিশ্বাস ফেলল, তারপর বলল, সময় কাটানোই মুশকিল। …সকালে রুগি, বেলা বারোটা পর্যন্ত বড়জোর; তারপর আর করার কিছু নেই। একলা। ওই মালিনীই আমার কথা বলার সঙ্গী।

অবনীর ইচ্ছে হল বলে, কেন-সুরেশ্বর? সুরেশ্বর আপনার সঙ্গী নয়? মুখে বলল, সুরেশ্বরবাবু তো রয়েছেন। ..

হৈমন্তী চোখের পাশ দিয়ে অবনীকে দেখল। বলল, উনি কাজকর্মে ব্যস্ত থাকেন– বলে থামল কয়েক মুহূর্ত, তারপর হাসির মুখ করে বলল, ওঁর কাছে বসে থাকলে আশ্রমের কথা বড় বেশি শুনতে হয়।

অবনী মুখ ফিরিয়ে হৈমন্তীকে লক্ষ করল, বলল, এই আশ্রমের ওপর আপনার অচলা ভক্তি দেখছি না তো। বলে হাসল অবনী।

কেন! আছে তো৷

না। তেমন টান কই!

হৈমন্তী চুপ। মনে হল বলে, না–আমার বিন্দুমাত্র টান নেই, আমি এসব গ্রাহ্য করি না, আমার ভাল লাগে না। এ আশ্রম আমার নয়।

আশ্রমের প্রসঙ্গে হৈমন্তীর আর ভালও লাগে না। এর বাইরে কি কিছু নেই। সাধারণ মানুষ আমি, সাধারণ কথাই আমার কাছে ভাল। অন্য গল্প, আর পাঁচটা অন্য কথা বলতে পারলে সে খুশি হবে।

হৈমন্তী বলল, আপনাকে এখানে কী করতে হয়? কাজের কথা বলছি।

কিছুই না, অবনী হেসে জবাব দিল। তারপর সে তাদের কাজকর্মের কথা বুঝিয়ে বলল।

 মালিনী চা নিয়ে এল।

অবনীর হাতে চায়ের কাপ তুলে দিতে দিতে হৈমন্তী বলল, আপনি মালিনীকে চেনেন না? …মালিনী বড় ভাল মেয়ে। …ওর কী একটা কাজ ছিল আপনার কাছে। বলো না মালিনী।

মালিনী বোকা ও বোবা হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। হেমদি তাকে অপ্রস্তুতের একশেষ করল। মুখ তুলতে পারল না।

হৈমন্তী নিজের চায়ের পেয়ালা নিয়েছে। মালিনীর অবস্থা দেখে হেসে ফেলল, দুঃখও হল। অবনীও দেখছিল মালিনীকে।

শেষ পর্যন্ত হৈমন্তীই মালিনীর আবেদনটুকু জানাল। মালিনী আর দাঁড়াতে পারল না, পালিয়ে গেল।

 অবনী সংক্ষেপে বলল, দেখি কী করা যায়।

চা খেতে খেতে টুকরো আরও কিছু কথা হল, সাধারণ আলাপ। হৈমন্তী হালকা মনে পারিবারিক কথা, কলকাতার গল্প করছিল। তার ভাল লাগছিল। তারপর কী কথায় যেন তার এখানে আসার প্রথম দিনটির কথা উঠল। বলল, সেদিন যখন এই জঙ্গলে এসে রাস্তায় বাস খারাপ হয়ে গেল, আমি তো ভয় পেয়ে গিয়েছিলুম। কপাল ভাল, আপনার সঙ্গে দেখা হল।

অবনী বলল, তার খানিকটা আগে আমিও ভয় পেয়েছিলাম।

 আপনি…! কেন?

কী জানি। …হয়তো মৃত্যুভয়; হয়তো অন্য কিছু…

আমার মনে হয়েছিল আপনি খুব বিচলিত হয়ে পড়েছেন।

হয়েছিলাম। …হীরালাল বড় ভাল ছিল, চমৎকার ছেলে। ..সে বিয়ে করেছিল, বাচ্চা আছে। অথচ বেচারির জীবনটা কীভাবে নষ্ট হল। …মিনিংলেস।

হৈমন্তী তার পাশের মানুষটির মুখ দেখল। সংসারের সাধারণ বেদনায় এ মানুষ ব্যথা পায়, দুঃখ বোধ করে, চঞ্চল হয়। এর মধ্যে রক্তমাংস অনুভব করা যায়। সুরেশ্বর এরকম নয়; তার চঞ্চলতা নেই। নিরুত্তাপ। সমস্তই যেন বাইরের।

কী মনে হওয়ায় হৈমন্তী হঠাৎ বলল, আপনার স্বভাব দেখছি খুব নরম।

অবনী নীরব থাকল।

সামান্য পরে হৈমন্তী আবার বলল, আমি চোখের ডাক্তার, তবু ডাক্তার তো, একটা ডাক্তারি উপদেশ দি। মৃত্যুভয় বড় খারাপ, ওসব ভাববেন না, মন দুর্বল হয়। আন্তরিকভাবে গাঢ় সুন্দর গলায় হৈমন্তী বলল, মুখে সামান্য হাসি।

অবনী অল্প সময় চুপ করে থেকে বলল, সুরেশ্বরবাবু হলে অন্য কথা বলতেন..চন্দ্র সূর্য তারা..কত কথা। বড় বড় কথা শুনতে বেশ। আমার ভাল লাগে না। সমস্ত ব্যাপারে এত তত্ত্বের কী আছে!

উনি খানিকটা অন্যরকম। হৈমন্তী বলল।

কী জানি লোকে বলে। ..আগে তো দেখিনি।

 উনি অন্ধ আশ্রম করতে এলেন কেন?

 জানি না।

অবনী সবিস্ময়ে তাকিয়ে থাকল। হৈমন্তী কি তাকে কথাটা বলতে চায় না? অথচ মুখ দেখে মনে হয় না সে কিছু গোপন করছে। বরং অবনীর মনে হল, প্রশ্নটা হৈমন্তীকেও কেমন অন্যমনস্ক, বিমর্ষ করেছে।

অবনী চুপ করে থাকল, হৈমন্তীও নীরব। অবনী চোখ ফিরিয়ে নিল, মাঠে ঘাসের ওপর জ্যোৎস্নার কেমন পালিশ ধরে আছে। দুরে তার জিপগাড়ি। মানুষের গলা প্রায় শোনাই যাচ্ছে না, নিস্তব্ধ।

কিছুক্ষণ মাঠের দিকে তাকিয়ে পরে অবনী চোখ ফেরাল, হৈমন্তীর দিকে তাকাল। হৈমন্তী কখন যেন একটু পাশ ফিরে বসে অন্য দিকে তাকিয়ে আছে। জ্যোৎস্নার মধ্যে ডুবে আছে হৈমন্তী। হঠাৎ দেখলে মূর্তির মতো মনে হয়। স্থির, নিঃসম্পর্ক, যেন মায়া অথবা ভ্রম। অবনী অপলকে দেখছিল: হৈমন্তীর মুখের গড়নটি ডিমের মতন, ছোট কপাল, গড়ানো মসৃণ গাল, টোল তোলা নরম থুতনি, নাক সোজা লম্বা। চোখ দুটি বড়, তবে অস্বাভাবিক নয়, টানাটানা চোখের পাতা, পাতলা ভুরু। হয়তো বয়সে, হয়তো কোনও রকম গাম্ভীর্যে ওর চোখ দুটি শান্ত। ঘাড় হাত পা কোথাও কোনও রকম বিকৃতি নেই, স্বাভাবিক, সুসমঞ্জস। হৈমন্তী সুশ্রী, লাবণ্যপূর্ণ। তার ফরসা গায়ের রং, প্রায়-সাদা শাড়ি, সাধারণ একটি এলো খোঁপা–এমন কিছু নয় যার দিকে অবনী নিষ্পলকে তাকিয়ে থাকতে পারে।

অথচ অবনী সম্মোহিতের মতন তাকিয়েছিল। সে কী যেন অনুভব করছিল। ললিতাকে দেখার পর সে এরকম কিছু অনুভব করেনি, তার শরীর চঞ্চল ও ইন্দ্রিয়গুলি ক্ষুধার্ত হয়েছিল। হৈমন্তীকে দেখে ইন্দ্রিয়ের কোথাও তড়িৎ-উত্তেজনা অথবা জ্বালা অনুভব করছে না। সে কেমন বিক্ষিপ্তমন হয়ে পড়েছে, কোনও বেদনা বোধ করছে, যে-বেদনা বুঝি অগোচরে থাকে। হঠাৎ কেমন দুঃখী ও দীন মনে হল। অবনী অস্পষ্টভাবে অনুভব করল, তার হৃদয় সহসা শিশুর মতন অভিমানী ও কাতর হয়ে উঠে কিছু চাইছে।

হৈমন্তী দীর্ঘ নিশ্বাস ফেলে মুখ ফেরাতেই অবনীর সম্মোহিত বেদনাপূর্ণ চক্ষু দুটি দেখতে পেল।

.

০৯.

আচমকা একদিন মাঝরাতে ঝড় বৃষ্টি নামল। পরের দিন সারাটা সকাল কখনও ঝড়, কখনও বৃষ্টি, আকাশ জুড়ে শুধু মেঘ ভেসে চলেছে, যেন একপাশ থেকে কেউ মেঘের ফিতে খুলে দিচ্ছে, অন্য পাশে আর-কেউ গুটিয়ে নিচ্ছে, বিকেলে শাল-গরগলের বনে আবার বুঝি নতুন করে বাদলার পালা নামল, বৃষ্টির ঝাঁপটা দেওয়া বাতাস আসছিল ক্ষণে ক্ষণে; সারা রাত ধরে মেঘ ডাকল গুরুগুরু, বিদ্যুৎ চমকাল আর বৃষ্টি পড়ল। মনে হচ্ছিল, আশ্বিনের শেষে শ্রাবণের ধারা নামল। পরের দিন সকালে আকাশ পরিষ্কার,নভোমণ্ডল নীলের সমুদ্র, কোথাও যেন মেঘের আঁশ নেই, ঝকঝক করছে রোদ, রোদের মধ্যে কোথাও একটু আমেজ পাওয়া গেল শীতের।

আশ্রমের কয়েকটা পলকা গাছ এই ঝড়ে বৃষ্টিতে ছন্নছাড়া চেহারা করে দাঁড়িয়ে থাকল, লতাপাতা ফুল দলিত মথিত, জল, জলের ওপর মাথা উঠিয়ে ঘাসের শিস বাতাসে কাঁপছিল।

কেমন করে যেন এই দুর্যোগে হাতের খানিকটা কেটে গিয়েছিল সুরেশ্বরের, শার্সির কাঁচ ভেঙে বিছানায় ছড়িয়ে পড়েছিল; তার ওপর ডান পায়ের গোড়ালি মচকে গিয়ে হাঁটাচলাও কষ্টকর করে তুলেছিল। দু-তিনটে দিন সামান্য অসুস্থ থাকল সুরেশ্বর।

সেদিন সন্ধেবেলায় ঘরে ক্যাম্বিসের চেয়ারে সুরেশ্বর শুয়ে, মালিনী অন্ধকুটিরের সামনের ডাল-ভাঙা গাছ থেকে একরাশ শিউলি ফুল এনে কাচের প্লেটে রেখে দিল, বলল: একটু চুনহলুদ গরম করে দেব, লাগাবেন?

সুরেশ্বর মাথা নাড়ল, বলল, না। তারপর কী মনে করে বলল, চুনহলুদ নয়, একটু গরম চা করে খাওয়া তো মালিনী, সর্দি সর্দি লাগছে। মালিনীকে কখনও কখনও আদর করে সুরেশ্বর তুই টুই বলে।

একটু পরেই হৈমন্তী এল। মালিনী চা দিয়ে চলে গেল।

এসো হেম, তোমার কথাই ভাবছিলাম। সুরেশ্বর বলল হালকা গলায়, চা খেতে খেতে।

হৈমন্তী সামনাসামনি বসল। মালিনী তাকেও চা দিয়ে গেছে।

 তুমি নাকি কলকাতায় যাচ্ছ? সুরেশ্বর শুধোল।

হৈমন্তী তাকাল, মুখ দেখল সুরেশ্বরের। মা কি সুরেশ্বরকেও চিঠি লিখেছে? বলল, মা যেতে লিখেছে।

আর মাত্র সাতটা দিন পরে পুজো। কলকাতা থেকে মা যেতে লিখেছে। না লিখলেও যাবার কথা ভেবেছিল হৈমন্তী। এখানে সে মন বসাতে পারছে না, ভাল লাগছে না। কলকাতাতে কটা দিন কাটিয়ে আসতে পারলে ভাল হত। নিজের পরিবার ও আত্মীয়-স্বজনের মধ্যে মনটা হালকা হত খানিক। অথচ কী করে যে যাবে বুঝে উঠতে পারছিল না। সুরেশ্বর কি হাসপাতাল বন্ধ রাখতে রাজি হবে? নিজেও যে হাত কেটে পা মচকে বসে আছে। কথাটা মনে মনেই রেখেছিল হেম, ভেবেছিল পরে বলবে। হয়তো আজও বলত। সুরেশ্বর তার বলার আগেই জেনে গেছে। মা কি সুরেশ্বরকে লিখেছে কিছু!

মা চিঠি লিখেছে? হৈমন্তী জানতে চাইল।

না, মালিনী বলছিল।

ও!

 মালিনীর ওপর ঈষৎ বিরক্তি অনুভব করল হৈমন্তী। মালিনীর বলার কী ছিল! মাতব্বরি!

ভাবছিলাম যাব, হৈমন্তী বলল।

 সুরেশ্বর কিছু ভাবছিল, বলল, কবে যাবে?

দেখি, এখনও কিছু ঠিক করিনি; ষষ্ঠীর দিন যাব ভাবছি।

চিঠি দিয়েছ মাসিমাকে?

 না, দেব।

হাসপাতাল একেবারে বন্ধ রাখবে?

সুরেশ্বর এমনভাবে বলল যেন হাসপাতালটা হৈমন্তীর। ভাল লাগল না শুনতে। কার হাসপাতাল, কে যে বন্ধ রাখছে! হৈমন্তী অপ্রসন্ন হয়ে মনে মনে বলল: তোমার হাসপাতাল, তুমিই জানো।

আর-একটু ভেবে সুরেশ্বর বলল, এ-সময় এদিকে ওরা মেলা-টেলায় যায়, দশহরা-টরা করে, হাসপাতালে বড় কেউ আসে না। তা বেশ তো, তুমি যাও।

হৈমন্তীর মনে হল, সুরেশ্বর যেন তার ছুটি মঞ্জুর করল। অবশ্য ছুটি দেবার আগে নিজের প্রয়োজনটা হিসেব করে দেখে নিল। সে কলকাতায় যেতে চাইছে এটা বিবেচনার বিষয় নয়, রুগিটুগি আসতে পারে কি না সেটাই সুরেশ্বরের বিবেচনার বিষয়।

হৈমন্তী এখানে চাকরি করতে আসেনি, তার পরিশ্রমের মূল্য সে নেয় না। স্বেচ্ছায় সে এসেছে, যা করছে তা নিঃস্বার্থে, নিতান্ত দয়াপরবশে। তার ইচ্ছেতেই সে যেতে পারে, অন্য কারও ইচ্ছার ওপর তার আসা-যাওয়া নির্ভর করে না। রোগীরা আসবে কি আসবেনা তার ওপর হৈমন্তীর কলকাতা যাওয়া স্থির হবে! আশ্চর্য!

মনে মনে ক্ষুব্ধ হলেও হৈমন্তী মুখে কিছু বলল না।

 সুরেশ্বর বলল, যাবার আগে তোমার এখানের রুগিদের ছেড়ে দিয়ে যেতে পারবে না?

আবার সেই তোমার রুগি! সুরেশ্বরের এই তোমার হাসপাতাল, তোমার রুগি কথাগুলো ভাল লাগে না হৈমন্তীর। এরা বাস্তবিকই তার কিছু নয়। সুরেশ্বর যেন ইচ্ছে করে বার বার তাকে হাসপাতাল, রোগী, আশ্রমের সঙ্গে জড়িয়ে দিতে চায়। এখানে আমার কিছু নেই, ওরা কেউ আমার নয়–হৈমন্তীর এই সরল মনোভাবটা কি সুরেশ্বর বোঝে না; অথবা বোঝে বলেই ধীরে ধীরে বুদ্ধিমানের মতন হৈমন্তীকে এই আশ্রমের সঙ্গে জড়িয়ে ফেলতে চাইছে। হয়তো সে ভাবছে, হৈমন্তীকে এই ভাবে দুর্বল করা যায়, মোহের মধ্যে জড়িয়ে ফেলা যায়। সংসারে বহু মানুষ এইভাবে মজে, এই ফাঁদে পা দেয়।

হৈমন্তী হঠাৎ এক ধরনের জেদ অনুভব করল। সুরেশ্বর তাকে যেখানে ঠেলে দিতে চাইছে সেখানে সে যাবে না, বাধা দেবে। বলল, কারা আছে আমার মনে নেই। তার সবই মনে ছিল। যারা আছে তাদের ছেড়ে দিতেও কোনও বাধা নেই। অনেক সময় এরা অনেকটা দূর থেকে খুব কষ্ট করে আসে। দু-চার দিন পরে আবার কাটাকুটি দেখাতে আসা সম্ভব নয় বলেই কয়েকদিন রেখে দেওয়া হয়, নয়তো রাখার অর্থ নেই।

সুরেশ্বর বেশ অবাক হয়ে হৈমন্তীকে দেখল। বলল, যাদের রাখো তাদের কথা তোমার মনে থাকে না!

তিরস্কার নয়, ভর্ৎসনা নয়, তবু বেশ বোঝা গেল সুরেশ্বর হৈমন্তীর দায়িত্বহীনতার জন্যে ক্ষুব্ধ ও বিস্মিত।

হৈমন্তী যতটা জেদ প্রকাশ করতে চাইছিল, পারল না; বরং সামান্য অস্বস্তি অনুভব করল।

সুরেশ্বর বলল, কবে ফিরবে?

হৈমন্তীর ইচ্ছে হল বলে, ফিরব না; কেন ফিরব? এখানে কী আছে?

হৈমন্তী নীরব। সুরেশ্বর নিজেই বলল, যাবার আগে রুগিদের যাদের পার ছেড়ে দিয়ে যেও। নতুন আর নিও না এ কদিন। ফিরে এসে…

হৈমন্তী বলল, আমি কদিন পরে ফিরব।

দেরি করবে?

না, তবে মা যদি দেরি করায়

এখানে খুব অসুবিধেয় পড়তে হবে। …আগে যিনি আসতেন তাঁকে তো এখন আর পাব না। রুগি এসে ফিরে যাবে।

রোগী এসে ফিরে গেলেই সুরেশ্বরের দুঃখ, আর কেউ ফিরে গেলে তার গায়ে লাগে না।

বিরক্তি ও বিতৃষ্ণা বোধ করে হৈমন্তী বলল, তা হলে যাব না।

সুরেশ্বর হৈমন্তীর গলার স্বর শুনে তার মুখভাব মনোযোগ দিয়ে লক্ষ করল। হেসে বলল, তুমি রাগ করছ হেম! 

হৈমন্তী কথা বলল না, ইচ্ছে হল না।

সামান্য সময় সুরেশ্বরও কথা বলল না, তারপর আস্তে করে বলল, আমি দেখছি এখানে তোমার তেমন ভাল লাগছে না। তুমি এখনও মন বসাতে পারলে না। ভেবেছিলাম, আস্তে আস্তে বসে যাবে।

যাবে হয়তো–, হৈমন্তী আচমকা বলে ফেলল, বলার মধ্যে দুঃখ ছিল, শ্লেষও ছিল।

সুরেশ্বর প্রথমে হৈমন্তী পরে জানলার দিকে মুখ করে তাকিয়ে থাকল। হৈমন্তী ঘরের অন্ধকার দেওয়ালের দিকে তাকিয়ে। সুরেশ্বরের এই ঘর ছোট, আসবাবপত্র সামান্য কিছু তার লেখাপড়া কাজকর্ম করার ঘর এটা, বইপত্র, কাগজ, দু-একটা দরকারি জিনিসে ভরা। টেবিলের ওপর কাচের প্লেটে শিউলিফুল, বাতাসে গন্ধ এল হালকা।

সুরেশ্বর বলল, হেম, তুমি কেমন হয়ে গেছ।

এই প্রথম, এখানে আসার পর সুরেশ্বর সরাসরি হৈমন্তীকে এমন কিছু বলল যা তাদের ব্যক্তিগত প্রসঙ্গ। হৈমন্তী মুখ ফিরিয়ে সুরেশ্বরের দিকে পলকের জন্য তাকাল, তাকিয়ে মুখ ফিরিয়ে নিল। বলল, বদলে গিয়েছি?

বোধহয়।

তুমিও।

গিয়েছি। আমার বদলের কথা তুমি জানতে না?

না।

না?

কী করে জানব!

আমি তো তোমায় অনেক আগেই জানিয়েছিলাম।

আমি বুঝিনি। …তোমার সব কথা বুঝব এমন বিদ্যেবুদ্ধি আমার নেই।

সুরেশ্বর অনেকক্ষণ যেন হৈমন্তীর দিকে মুখ ফিরিয়ে একদৃষ্টে কিছু দেখল। তারপর মৃদু গলায় বলল, আমি হয়তো তোমায় বোঝাতে পারিনি। থামল একটু, তারপর আবার বলল, আমি তোমায় এখানে দুঃখ দিতে আনিনি, হেম।

তোমার সুখ দুঃখ বোধ আলাদা।

কারও দুঃখে আমার সুখ নেই।

কথাটা হৈমন্তী শুনল, অর্থটাও বুঝতে পারল। সুরেশ্বরের সুখ-বোধ সে বোঝ না। প্রসঙ্গটা তর্ক করার মতন নয়, হৈমন্তীর তেমন কোনও ইচ্ছেও হল না।

সুরেশ্বর অনেকক্ষণ আর কথা বলল না। নীরব। হৈমন্তীও স্থির নিশ্চল হয়ে বসে। বাইরে কোথাও একটা পোকা ডাকছিল-চিপ চিপ। ঘরের অন্ধকার কোণে একটা জোনাকি এসেছে, জ্বলছে, নিবছে। দুজনের নীরবতার মধ্যে কেমন এক বিচ্ছিন্নতা সৃষ্টি হয়ে ক্রমশ তা এক দুস্তর ব্যবধানের মতন হয়ে উঠেছিল।

শেষে সুরেশ্বরই কথা বলল। এখানে তোমার ভাল লাগছে না।

না।

 কলকাতায় ফিরে যেতে চাও?

 ফিরে যাবার কথা বলিনি।

এখানে ভাল না লাগলে ফিরে যাওয়া ছাড়া আর কী করার আছে?

হৈমন্তী এবার মুখ ফিরিয়ে সুরেশ্বরকে দেখল। টেবিল বাতির ম্লান আলোয় যে-মুখটি হৈমন্তীর দৃষ্টিগোচর হল তার প্রতি সে আজ আর মমতা অনুভব করল না। ওই নিস্পৃহ মুখকে তার অত্যন্ত স্বার্থপর ও নিষ্ঠুর মনে হল।

ফিরে যাবার কথা এখনও ভাবিনি—

হৈমন্তী বলল, অগোছালো ভাবে।

কিন্তু তোমার যদি ভাল না লাগে—

ভাল লাগা না লাগার প্রশ্নটা অবান্তর। হৈমন্তী সংক্ষেপে বলল, রোজই তো রুগি দেখছি।

দেখছ, তবে মন পাচ্ছ না হয়তো।

আমার সাধ্যমতো যত্ন করে আমি রুগি দেখি।

ভালবেসে দেখ না?

ডাক্তারদের কাছে যত্নটা বড়, ভালবাসা নয়।

 তুমি কর্তব্যের কথা বলছ।

তার বেশি আমার প্রয়োজন নেই। …আমার কাজ আমি বুঝি।

সুরেশ্বর আর কথা বলল না। বলা নিরর্থক।

দুজনেই আবার নীরব হয়ে বসে থাকল। অন্ধকার দেওয়ালের কোণ থেকে জোনাকিটা হৈমন্তীর পায়ের দিকে উড়ে এসেছিল, কোথায় যেন হারিয়ে গেছে।

বসে থেকে থেকে হৈমন্তী উঠল। বলল, হাত কেমন আছে?

 ভাল।

কাল দেখব। …যাই। হৈমন্তী চলে যাচ্ছিল।

 সুরেশ্বর বলল, মাসিমাকে চিঠি লিখে দিয়ো৷ কবে যাচ্ছ জানিয়ো

 হৈমন্তী কোনও জবাব দিল না। চলে গেল।

.

হৈমন্তী চলে গেলে সুরেশ্বর বসে থাকল, একই ভাবে, শান্ত স্থির হয়ে। কিছু সময় এইভাবে কাটল; ভরতু ঘরে এসেছিল, তার পায়ের শব্দ শুনল সুরেশ্বর; কাজ সেরে ভরতু চলে গেল। সর্দির জন্যে চোখ এবং কপাল সামান্য ভারী লাগছিল সুরেশ্বরের।

মন খানিকটা বিক্ষিপ্ত হয়েছিল, আস্তে আস্তে তা শান্ত ও সংযত করে ফেলেছে সুরেশ্বর, এখন অনেকটা শান্ত ভাবেই ভাবার চেষ্টা করছিল, হৈমন্তীকে এখানে আনা তার উচিত হয়েছে কি না!

হেম এখানে সুখী নয়, সন্তুষ্ট নয়। আসার পর পর প্রথম দিকে ওর চোখে মুখে কিছু বিস্ময় ছিল, কলকাতা শহর থেকে হঠাৎ এই নির্জনে এসে পড়ার বিস্ময় হয়তো, হয়তো এই আশ্রমের পরিবেশ, এখানকার জীবনযাপন তার কাছে অপরিচিত ও অনভ্যস্ত বলে সাধারণভাবে সে অবাক বোধ করত। কয়েক দিনের মধ্যে সে বিস্ময় কেটে গেল। তারপর থেকে হৈমন্তী আর প্রসন্ন নয়। এখন তার কথাবার্তা থেকে বেশ বোঝা যায়, হেম অসন্তুষ্ট, ক্ষুণ্ণ, মনোভারে পীড়িত। এখানে সে নিঃসঙ্গ ও একাকী।

এরকম হতে পারে সুরেশ্বর পূর্বে যে ভাবেনি তা নয়; তবে সে এতটা ভাবেনি। সে আশা করেছিল, হৈমন্তীর পক্ষে ক্রমশ এটা মানিয়ে নেওয়া সম্ভব হবে।

আজ বেশ কয়েক বছর হৈমন্তীর সঙ্গে তার প্রত্যক্ষ যোগাযোগ ছিল না। চিঠিপত্রেই বেশি, কদাচিত কলকাতায় গেলে দেখাসাক্ষাত ঘটত। হেমদের বাড়িতেই সে উঠত অবশ্য, কিন্তু সেই সাময়িক সাক্ষাতের মধ্যে সুরেশ্বর স্পষ্ট করে কিছু বোঝেনি। বোঝেনি যে, হেমের স্বভাবও বদলে যাচ্ছে। ডাক্তারি পড়াশোনা নিয়ে হেম তখন ব্যস্ত, বয়সের একটা পরিবর্তনও সাধারণত থাকে। হেমের বয়সোচিত পরিবর্তন ঘটেছে এটা বোঝা যেত। বোঝা যেত, হেম আগের তুলনায় অনেক গম্ভীর, আত্মমগ্ন স্বল্পবাক হয়ে উঠেছ। সুরেশ্বর অন্য পরিবর্তন দেখতে পায়নি, বুঝতে পারেনি। হেম কখনও স্পষ্ট করে চিঠিপত্রেও বোঝায়নি।

এখানে আসার পর থেকে হেমকে সুরেশ্বর যেন অল্পে অল্পে নতুন করে চিনছে। যে-হেম সুরেশ্বরের খুব বেশি চেনা ছিল, সেই হেম আর আজকের হেমে অনেক তফাত। অল্প বয়সের বা তরুণী হেমকেই সুরেশ্বর নিবিড় করে চিনত। সেই আঠারো উনিশ কি কুড়ি বছর বয়সের হেমের সঙ্গে আজকের পরিণত হেমের পার্থক্য অনেক।

সুরেশ্বর এখনও সেই হেমকে স্পষ্ট করে দেখতে পায় যেন। তাকে বুঝি অনুভব করা যায়। কুঁড়ি ফেটে ফুল ফোঁটার মতন হেম তখন ফুটে উঠছে, জীবনের চতুর্দিকে চঞ্চল বাতাস, তার সবটুকু যেন দুলত, সে সতত অধীর ছিল, উজ্জ্বল, নির্মল, বিভোর ছিল। সুরেশ্বরের তখন মনে হত তার চোখের মণিতে হেমের মুখ স্থির হয়ে আছে। হেমের কথা ভেবে দিনের কতটা সময় যে কাটত তাও সুরেশ্বর হিসেব করে দেখত না। হঠাৎ ওই বয়সে হেমকে তার ভাগ্য এক গভীর দুঃখ ও নৈরাশ্যের মধ্যে ছুঁড়ে দিল। আজ বোঝা যায় না কিন্তু সেদিন সুরেশ্বর বুঝেছিল কী দুঃসহ সে যন্ত্রণা হেমের, মস্ত এক অন্ধকার কুয়োর মধ্যে কেউ যেন তাকে ফেলে দিয়েছে। সুরেশ্বরও দিশেহারা হয়ে পড়েছিল, বিষাদে দুশ্চিন্তায় দুঃখে তার অবস্থা হয়েছিল উদভ্রান্তের মতন। কিন্তু সুরেশ্বর এই উৎক্ষিপ্ত ভাবটা সামলে নিয়েছিল। দুঃখের সঙ্গে তার পরিচয় আগেই ঘটেছিল বলে হয়তো বিহ্বলতা কাটাতে তার সময় লাগেনি। হেমকে সুস্থ করার জন্যে সে ব্যাকুল।

এই সময় সুরেশ্বর নিঃসন্দেহে জেনেছিল, হেমকে সে ভালবাসে। জেনেছিল, হেমকে না বাঁচাতে পারলে তার চারপাশে যে শূন্যতার সৃষ্টি হবে তা সহ্যাতীত। স্বপ্ন দেখতো: মস্ত এক শূন্য মাঠে আটচালা ঘরে লোহার বিছানায় হেম একাকী শুয়ে আছে, তার চারপাশে ন ভন মাছি উড়ছে, মাটিতে মাছিতে হেমকে আর দেখা যায় না, বিছানার তলায় কলাইয়ের নোংরা গামলায় সুরেশ্বরের নাম লেখা ছোট ঘোট রুমাল, দোমড়ানো মোচড়ানো, যেন হেম হাতের মুঠো খুলে সেগুলো একে একে ফেলে দিয়েছে। সুরেশ্বর হেমের বিছানার সামনে গিয়ে দুহাতে মাছি তাড়াবার চেষ্টা করতে করতে অসহায় হয়ে কেঁদে ফেলত।

সুরেশ্বর এই একই স্বপ্ন কয়েক বারই দেখেছিল, কখনও সে সবটা দেখত, কখনও টুকরো করে দেখত। একবার সে স্বপ্নটার কথা পুরোপুরি না বললেও হেমকে বলেছিল সে আজেবাজে বিশ্রী স্বপ্ন দেখে।

কী স্বপ্ন? হেম জিজ্ঞেস করেছিল, হাসপাতালের বিছানায় শুয়ে।

বাজে স্বপ্ন, বিশ্রী!

 আমি মরে গিয়েছি?

যাঃ, তুমি মরে যাবে কি?

তবে।

আমি মরে গিয়েছি।

 মিথ্যে কথা।

বিশ্বাস হচ্ছে না…! সত্যি।

কথাটা অবিশ্বাস্য বলে সেদিন সুরেশ্বরের মনে হত না। হেম মরে গেলে সুরেশ্বর মৃত হয়েই থাকত। হেমকে বাঁচার আশা দেবার সময় সুরেশ্বর নিজেকেও যেন আশা দিত। হেমকে যখন ভরসা দিত, সাহস দিত–তখন নিজেও ভরসা ও সাহস পেত।

হেম ক্রমে ক্রমে রোগমুক্ত হয়ে উঠতে লাগল। এই সময় সুরেশ্বর দেখল, ওই নরম বয়সে হঠাৎ গভীর দুঃখের ও নৈরাশ্যের মধ্যে পড়ে হেম এমন কিছুর স্পর্শ পেয়েছে যা, তার বয়সে সচরাচর পাবার কথা নয়। সংসারের যেটা বিষাদের দিক–যেখানে অকারণে শোক, নির্বিচারে আঘাত পেতে হয়– হেম সেই বিষাদের জগৎ দেখেছিল। সুরেশ্বর নিজের জীবনে এই জগৎ আরও আগে দেখেছে, প্রায় বাল্যকাল থেকেই দেখে আসছিল। তার মা বাবা, মা বাবার সম্পর্ক, মার ভয়, মার মস্তিষ্ক বিকৃতি, বাবার চরিত্রহীনতা, নিষ্ঠুরতা, মার আত্মহত্যা–এসমস্তই তার সেই বিষাদের জগতের অন্তর্ভুক্ত ছিল। এমন কী, বাবার উপপত্নী ও সেই উপপত্নীর গর্ভজাত পুত্র যখন সম্পত্তির দাবি তুলে মামলার ভয় দেখিয়েছিল সুরেশ্বর তখনও এই বিষণ্ণ জগতেরই আরও একটি পরিচয় পেয়েছিল। সম্পত্তি অথবা অর্থের জন্যে সে কাতরতা অনুভব করেনি, করেছিল গ্লানি অনুভব করে, শ্রদ্ধাহীনতায়। বাবা স্ত্রীকে অশ্রদ্ধা করেছে সন্তানকেও শ্রদ্ধাহীন করে তুলেছে। অপর স্ত্রী এবং সন্তানকেও বাবা মর্যাদা দেয়নি, মালিন্য দিয়েছে শুধু। একথা কাউকে সে বলেনি যে, বাবার দ্বিতীয় পুত্রটির জন্যে সে সহানুভূতি ও বেদনা বোধ করেছিল।

কেমন করে যেন সুরেশ্বর অনুভব করল তার ব্যক্তিগত বিষাদের জগৎ আর হেমের বিষাদের জগতের মধ্যে কোথাও যেন এক ধরনের সমগোত্রীয় ভাব আছে। তারা পরস্পরকে সহানুভূতি দেখাতে পারে। সুরেশ্বর নিজের জীবনে সহিষ্ণুতা ও সহানুভূতিকে প্রসারিত করতে চাইছিল; তার মনে হয়েছিল হেমও মমতা ও ভালবাসায় পূর্ণ হতে চায়।

হেমদের হাসপাতালে হেমের চেয়ে কিছু ছোট প্রায় সমবয়সী বলা যায়–একটি মেয়ের সঙ্গে হেমের বন্ধুত্ব হয়েছিল। বিছানায় শুয়ে শুয়ে মেয়েটি নেকড়ার পুতুল তৈরি করত, তার সঙ্গে দেখা করতে গেলে সে প্রায় দীনের মতন সকলের কাছে ঘেঁড়া টুকরো টাকরা নেকড়া চাইত, উঁচ সুতো চাইত, রংটং আনতে বলত। হাসপাতালের প্রতিটি বিছানায় তার হাতের বিচিত্র নেকড়ার পুতুল দেখা যেত। ওর আত্মীয়স্বজন ছিল না বুঝি, কেউ আসত না। একদিন মাঝরাতে মেয়েটি মারা গেল, সকালবেলায় দেখে গেল তার বিছানায় মস্ত একটা নেকড়ার পুতুল, ধড় আছে, মাথা আছে হাত পা নেই।

এই মেয়েটির মৃত্যুতে হেম কেঁদে আকুল, দুঃখে মুহ্যমান। সুরেশ্বর সেবার যখন হেমের সঙ্গে হাসপাতালে দেখা করতে গেল, হেম শুধু তার বন্ধুর কথা বলেছে আর কেঁদেছে।

হেম বলেছিল: ও বলত সেরে উঠলে ও পরিষ্কার নেকড়া দিয়ে পুতুল করবে।

কেন, পরিষ্কার নেকড়া কেন?

এখানে সব রোগ-টোগের ছোঁয়া, এসব পুতুল তো বাইরে যেতে দেয় না।

ও!

পরিষ্কার নেকড়া দিয়ে পুতুল করলে সবাই নেবে।

পুতুল বেচবে?

ওর কেউ ছিল না; একমাত্র দিদি; খুব গরিব। …পুতুলের দোকান করলে বিক্রি হত।

ও!

হেম চুপ করে থেকে তারপর হঠাৎ বলল, যাদের কেউ কোথাও নেই তাদের কী কষ্ট! ভগবান যদি ওর জন্যে কাউকে রাখত…

সুরেশ্বর মাথা নিচু করে ফেলেছিল, নয়তো কেঁদে ফেলত সেদিন।

হেম হাসপাতালে থাকার সময় মমতা ও ভালবাসা জেনেছিল।

 তারপর হেম সুস্থ হয়ে ফিরে এল। সুরেশ্বর হঠাৎ কেমন এক মুক্তি অনুভব করল, আনন্দ। এ আনন্দ অবর্ণনীয়। যেন সে নিজেই পুনর্জন্ম লাভ করেছে। হেমকে নিয়ে ঘাটশিলায়, সঙ্গে মাসিমা। সারাটা সকাল, দুপুর, সন্ধে, রাত আট নটা পর্যন্ত তার পাশে হেম থাকত। বেড়াতে বেরিয়ে কোনও কোনওদিন হেম গুনগুন করে সুখের গান গেয়ে উঠত। কোনও কোনওদিন বা বলত, আমার এখন সব ভাল লাগে, ধুলো বালি রাস্তা, সকাল বিকেল…

আমাকে কেমন লাগে?

হেম আড়চোখে চোখে দেখত, তারপর বলত, লাগে না।

লাগে না! সে কী! ভালমন্দ একটা কিছু না লাগলে হয়!

কী জানি! নিজেকে আবার কেমন লাগবে মানুষের– বলে মুখ টিপে হাসত।

সুরেশ্বর অনুভব করত হেম সুরেশ্বরকে নিজের অঙ্গীভূত করে নিয়েছে, নিজের অন্তরে মিশিয়ে নিয়েছে, সে আর আলাদা কিছু নয়, হেমের মধ্যেই সে আছে।

হেমের নরম গালে গাল রেখে সুরেশ্বর একদিন বলেছিল, হেম, অসুখের পর তুমি আরও সুন্দর হয়ে গেছ। …

তারপর কলকাতায় ফিরে এসে সুরেশ্বরের হঠাৎ কেমন যেন হয়ে গেল। যা তার কাছে অবধারিত ও সত্য ছিল, ভালবাসা ছিল, সুন্দর ছিল–অকস্মাৎ যেন সেখানে দ্বিধা এল; মনে হল এই ভালবাসা বড় কষ্টদায়ক। এ-রকম কেন হল? সুরেশ্বর যেন নিজেকেই প্রশ্ন করল, কেন?

আচমকা সে গাড়ির হর্ন শুনতে পেল, এবং সঙ্গে সঙ্গে বুঝল অবনী এসেছে। অবনী এর মধ্যে আরও কয়েকবার এসেছে, কিন্তু এতটা রাত করে কখনও নয়। আজ এতটা রাত করে অবনী এল কেন? সুরেশ্বর কিছু বুঝতে বা অনুমান করতে পারল না।

.

১০.

কলকাতার গাড়ি এইমাত্র ছেড়ে গেল। হৈমন্তীকে উঠিয়ে দিতে এসেছিল সুরেশ্বর, ট্রেন ছেড়ে গেলে প্ল্যাটফর্ম দিয়ে ফিরতে লাগল। পাশে বিজলীবাবু।

বিজলীবাবুর সঙ্গে বাস-স্ট্যান্ডে দেখা হয়েছিল, গাড়ির আর সময় নেই তখন, সুরেশ্বরদের মালপত্র সমেত স্টেশনে পাঠিয়ে দিয়ে বিজলীবাবু বুকিং অফিসে ঢুকে টিকিট কেটে একেবারে গাড়ির সঙ্গে সঙ্গেই প্ল্যাটফর্মে হাজির হলেন।

ফেরার পথে রেলের দু-একজন বাবু-টাবু–প্ল্যাটফর্মে যারা ছিল তাদের সঙ্গে সুরেশ্বর দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দুটো কথা বলল; সকলেই তার চেনা-জানা, দেখা হলে দুদণ্ড দাঁড়িয়ে কথা বলতেই হয়, খোঁজখবরও করতে হয় এর ওর। সুরেশ্বর সম্পর্কে এদের সকলেরই কেমন একটা শ্রদ্ধার ভাব আছে, কৌতূহলও আছে হয়তো। বিশেষত, আজ হৈমন্তীকে তুলে দিতে এসে সুরেশ্বর সেটা অনুভব করতে পারল।

ওভারব্রিজ দিয়ে না উঠে প্ল্যাটফর্মের শেষ প্রান্ত দিয়ে নামল, লাইন পেরিয়ে ঢালু মতন জায়গাটা দিয়ে রাস্তায় উঠল সুরেশ্বর। গোড়ালির ব্যথাটা এখনও পুরোপুরি সারেনি। আসার সময় ওভারব্রিজের সিঁড়ি উঠে ব্যথাটা আবার বোঝা যাচ্ছিল; ফেরার সময় তাই আর সিঁড়ি ভাঙল না।

রাস্তায় উঠে বিজলীবাবু বললেন, দুর্গাবাড়ির দিকটা একবার ঘুরে যাবেন নাকি?

দুর্গাবাড়ি খানিকটা দূর, জোরে জোরে হাঁটলেও মিনিট কুড়ির রাস্তা। যেতে আসতে খানিকটা সময় যাবে, এতটা হাঁটাহাঁটিতে আবার গোড়ালি ব্যথা করবে কিনা তা-ও সুরেশ্বর বুঝতে পারল না। পোস্ট অফিসেও একবার যাবার দরকার। সুরেশ্বর বলল, আমায় যে একবার পোস্ট অফিসে যেতে হবে। টাকা তুলব।

ফেরার পথে যাবেন–, বিজলীবাবু বললেন, এখনও নটা বাজেনি। দশটার মধ্যে গেলেই চলে। বিজলীবাবু সময়ের ব্যাপারটা গ্রাহ্যের মধ্যেই আনলেন না।

সুরেশ্বর বলল, এতটা হাঁটব কী না ভাবছি।

বেশ ব্যথা?

না, খুব একটা নয়। ব্যথা তো ছিলই না প্রায়, সিঁড়ি উঠতে গিয়ে হয়তো ঠিক মতন পা পড়েনি কোথাও, খচখচ করছে।

হাড়-টাড় ভেঙেছেন নাকি

? না, সুরেশ্বর হাসল, হাড় ভাঙলে কি এত অল্পে রেহাই দিত। …হেম তো বলল, স্প্রেইন।

বিজলীবাবু সুরেশ্বরের মুখের দিকে তাকালেন, উনি কি এসবও বোঝেন?

সুরেশ্বর হাসল, তা অল্পস্বল্প বোঝে বইকি! ডাক্তারিটা তো পাশ করতে হয়েছে। বিজলীবাবু সঙ্গে সঙ্গে কোনও জবাব দিলেন না, পরে বললেন, তবে থাক, দুর্গাবাড়ি আর না গেলেন, পোস্ট অফিসেই যাওয়া যাক। ওখান থেকে যদি বৈজুর রিকশাটা পাওয়া যায়, তবে না-হয় দুর্গাবাড়ি যাওয়া যাবে।

বেলা এমন কিছু নয়, তবু শরতের রোদ এত ঝকঝকে যে চোখে লাগছিল, তাত ফুটে উঠেছে। গাছের ছায়া ধরে হাঁটতে হাঁটতে বিজলীবাবু সিগারেট ধরালেন।

সুরেশ্বর শুধোল, এবার লোকজন কেমন আসছে, বিজলীবাবু।

আজ বিকেল থেকে বোঝা যাবে। কাল কিছু এসেছে। তা মন্দ না।

উমেশবাবু এসেছেন?

না; কাল আসবেন বোধ হয়।

আপনাদের পুজো কেমন হচ্ছে?

নতুন আর কী হবে–যেমন হয় বরাবর বলে বিজলীবাবু একটু থেমে সুরেশ্বরের মুখের দিকে চেয়ে কিছু দেখলেন, বললেন, আপনি তো জানেন মশাই, আমি লোকটা মদ্যটদ্য খাই, উপসর্গ এক-আধটু আছে, তবে ড্যাং ড্যাং করে বাজনা বাজিয়ে, কলকাতার বড়লোক বাবুদের বাড়িতে এক থালা করে প্রসাদ, দুকাঁসি করে সরু চালের খিচুড়ি ভোগ পাঠিয়ে অর্থ অপব্যয় করতে রাজি না। বিজলীবাবু ঠোঁটে চেপে সিগারেটে টান দিলেন বার কয়েক, আবার বললেন, নবমীর দিন ভিখিরি-টিখিরি খাওয়ানো হয় এখানে নিজেই দেখেছেন–সেটা হোক, বরাবর হয়ে আসছে, আমি তাতে কথা তুলছি না। কিন্তু বড়লোক বাবুদের বাড়ি বাড়ি একরাশ করে ফল-মিষ্টি আর ভোগ পাঠানোর দরকারটা কী? …এই নিয়ে সেদিন ঝগড়া, হরিহরের সঙ্গে। বলে, কলকাতার ওই বড়লোক মশাইদের কাছ থেকে পঁচিশ, পঞ্চাশ, একশো করে চাঁদা পাই, খাতির না করলে হবে কেন? .. চুলোয় যাক তোর খাতির…

বিজলীবাবু যে কোনও কারণে অসন্তুষ্ট এবং উত্তেজিত সুরেশ্বর বুঝতে পারল। বলল, ওঁরা অবশ্য মোটা চাঁদা দেন। না এলেও বছরের চাঁদা ঠিক পাঠিয়ে দেন বলে শুনেছি।

তাতে কার কী, টাকা দাও বলে ঠাকুরের ভোগ তুমি শালা তোমার কুকুরকেও খাওয়াবে। …বিশ্বাস করুন মহারাজ, স্বচক্ষে দেখেছি। কলকাতার এক ইংলিশবাবুচারবেলা ডিম, মুর্গির ঠ্যাঙ, মাছ কলা ফল খাচ্ছে, ভোগ গেল ঠাকুরের, মেয়েরা একটু আধটু ঠোঁটে ছোঁয়াল কি ছোঁয়াল না, বাড়ির কুকুরকে খাইয়ে দিল। … রাগের চোটে বিজলীবাবু সামনাসামনি মহারাজ বলে সম্বোধন করে ফেললেন। এটা তিনি সাধারণত করেন না। সুরেশ্বর অবশ্য জানে বিজলীবাবু তাকে মহারাজ-টহারাজ বলেন।

কী বলবে সুরেশ্বর, চুপচাপ থাকল।

 বিজলীবাবু শার্টের পকেট হাতড়ে দেশলাই বের করলেন। ঠাকুরফাকুর কাঁধে করে নাচানাচি আমার নেই। হিন্দুর ঘরে জন্মেছি দুর্গা কালী লক্ষ্মী দেখলে বড় জোর একটা পেন্নাম ঠুকি, ব্যাস। কথা হল, আজ সতেরো আঠারো বছর ধরে এখানে বাঙালিরা দুর্গাপুজো করছে সেটা তো আর আমরা তুলে দেব না। আমি না হয় অষ্টমীর দিন পাঁঠার মাংস চিবিয়ে বোতল-ঠাকুর সামনে বসিয়ে অষ্টমী করলাম, কিন্তু আমার বউ দুটো তো অষ্টমীর উপোস করবে, অঞ্জলি দেবে, সন্ধিপুজো দেখবে…। বলুন আপনি, আমাদের বাড়ির বউ-টউ, ছেলেমেয়ে, বুড়ো বাপ-মা-এদের কাছে তো পুজোর একটা মূল্য আছে। ভক্তি-টক্তি তারাই করে; তাদেরই আনন্দ। তা ছাড়া আমি না হয় ঠাকুরফাকুর না মানলুম, অন্য লোক তো মানে। …আমার তাই সাফ কথা, পুজো আলবত করব, তবে বড়লোককে তোয়াজ করার জন্যে পুজো নয়।

সুরেশ্বর বলল, হরিবাবুদের সঙ্গে আপনার ঝগড়াঝাঁটি হল।

হল। ওই হরি আর বেঁটে কার্তিক–ওই দুটোই হচ্ছে হারামজাদা। দল গড়েছে, দল গড়ে কলকাতার কেষ্টবিন্ধুদের ভজিয়ে এখানে একটা আখড়া করার মতলব ফেঁদেছে, বোষ্টমদের আখড়া। খোল করতাল বাজাবে, বাতাসা খাবে। আমি বলেছি পুজো কমিটি থেকে বেরিয়ে গিয়ে ওসব করো। …আমার নাম বিজলীবরণ চক্রবর্তী, পঁয়ত্রিশ বচ্ছর এখানে আছি, তোমরা ভেবো না, দুদিনের যোগী এসে আমার ওপর টেক্কা মারবে।

ঝগড়াঝাটি করতে গেলেন কেন? সুরেশ্বর একটু হেসেই যেন বলল।

কেন করব না ঝগড়া! ওরা পুজোর টাকা চুরি করে, পাবলিক মানি নিয়ে বিজনেস করে… হরি-বেটা বাজারে একটা কাপড়ের দোকান দিয়েছে। কোথ থেকে দেয়?

সুরেশ্বর এই অপ্রিয় প্রসঙ্গটা চাপা দিতে চাইল। বলল, যেতে দিন। এসব কথা থাক।

বিজলীবাবু সিগারেট ধরিয়ে আবার টানতে শুরু করলেন। ডান দিকে রেললাইন, একটা ট্রলি চলে যাচ্ছে, সাদা ছাতার তলায় হাফ প্যান্ট আর শার্ট পরে অচিন্ত্যবাবু বসে আছেন, কুলি দুটো পায়ের কাছে, মোটরের ফটফট শব্দ হচ্ছে। দেখতে দেখতে ট্রলিটা কেবিন ছাড়িয়ে চলে গেল।

বাঁ দিকের পথ ধরল সুরেশ্বর, পোস্ট অফিস যেতে হলে এই পথটাই সুবিধের।

সামান্য এগিয়ে বিজলীবাবু বললেন, একটা কথা তা হলে স্পষ্ট করে বলেই ফেলি। মতলব ছিল, এবারে পুজো থেকে কিছু টাকা বাঁচিয়ে আপনার হাতে তুলে দেব।

সুরেশ্বর যেতে যেতে থমকে দাঁড়িয়ে বিজলীবাবুর দিকে তাকাল। আমার হাতে?

 বিজলীবাবু এমন করে চশমার আড়ালে চোখ উজ্জ্বল করে হাসলেন, মনে হবে যেন এই বিষয়ে তাঁর উদ্দেশ্যটি পূর্ব পরিকল্পিত। হাঁটতে হাঁটতে বললেন, সৎ কর্মে দু পয়সা গেলে গায়ে লাগে না। …তা ছাড়া এরা দুএকশো টাকা দেবে নাই বা কেন। এখান থেকে চোখ দেখাতে তো কম লোক যায় না।

সুরেশ্বর কেমন অস্বস্তি বোধ করল, প্রথম প্রথম এখানের সকলেই যার যা সাধ্য আমায় সাহায্য করেছে, বিজলীবাবু।

জানি, বিজলীবাবু মাথাটা কাত করে বললেন, সবই জানি। দু-একটা টাকা সবাই দিয়েছে, সে আপনার মন রাখতে মান বাঁচাতে। …যা দিয়েছে তার পাঁচ গুণ আদায়ও করে নিয়েছে।

তা হলেও!

আপনার টাকার আর দরকার নেই, মহারাজ?

সুরেশ্বর বিজলীবাবুর মুখের দিকে তাকাল, তাকিয়ে চুপ করে থাকল। শেষে বলল, আছে। কত কী করার আছে অর্থাভাবে পারছি না।

ঠিক এই মুহূর্তে সুরেশ্বর যেসব অভাব বোধ করছে বা করতে পারলে লোকের সুবিধে হয় তার কথা বলতে বলতে হাঁটতে লাগল। সবচেয়ে বড় প্রয়োজন চশমা দেবার একটা ব্যবস্থা করা। সেই শহর ছাড়া এই অঞ্চলের কোথাও চশমার দোকান নেই, শহরেও মাত্র একটি দোকান, অত্যধিক দাম নেয়, গরিব মানুষের পক্ষে শহরে আসা যাওয়া করা, চশমা কেনার টাকা জোটানো খুবই কষ্টকর। যদি সুরেশ্বর চশমাও দিতে পারত সুবিধে হত। অল্প খরচে, তেমন ক্ষেত্রে বিনা খরচেই অনেকে চশমা নিতে পারত। …অন্ধদের থাকার ঘরবাড়িও বাড়ানো দরকার, আরও কিছু অন্ধজনকে রাখার ব্যবস্থা করতে পারলে ভাল হয়। ওদের হাতে জিনিস দিলে আরও কত কাজ করতে পারে, অর্থাভাবে মালপত্র দেওয়া যায় না তেমন।

কথা বলতে বলতে পোস্ট অফিসের কাছাকাছি পৌঁছে গেল সুরেশ্বর।

বিজলীবাবু বললেন, ময়দা বেশি মাখবেন না, শেষকালে লুচি বেলারও লোক পাবেন না, ভেজে উঠতেও পারবেন না। যা করবেন–এসব জায়গায় অল্প করেই করবেন।

সুরেশ্বর হাসল। একে একে সবই হবে। আপনারা পাঁচজন তো রয়েছেন।

 বিজলীবাবু মাথা নাড়লেন, মজা করে করে বললেন, আপনার মতন বিজ্ঞ লোক কী করে এই কথাটা বললেন? পাঁচজনে একসঙ্গে বসে তাসপাশা খেলতে পারে, আফিং মদ গাঁজা পঞ্চরং চড়াতে পারে; কিন্তু পাঁচজনে কোনও সৎ কর্ম হয় না।

অসৎ কর্ম হয়…? সুরেশ্বর লঘু স্বরে, হাসিমুখে বলল।

তা তো হয়ই। ..বিদ্যেটা আপনার ঠিক জানা নেই কি না, জানা থাকলে বুঝতেন কথাটা যা বলেছি। খাঁটি কথা।

সুরেশ্বর কেমন পরিহাস করেই শুধোল, বিদ্যেটা আপনারই কি জানা আছে?

তা খানিকটা আছে, বিজলীবাবুও হাসিমুখে জবাব দিলেন; তারপর বললেন, দেখুন মহারাজ, আপনি আমার চেয়ে বয়সে ছোট–বেশ ছোট, তবে বিদ্যে বুদ্ধিতে অনেক বড়, মানুষও বড়। কিন্তু এই জগতের হালচাল আমি যত জানি, আপনি জানেন না।

কী রকম হালচাল?

বিজলীবাবু সুরেশ্বরের হাসিহাসি মুখের দিকে তাকালেন। যেন ইচ্ছে করলে অনেক কিছুই বলতে পারেন। অবশ্য কিছু বললেন না তেমন, শুধু বললেন, জগতে যখন রয়েছেন, এর হালচাল কিছুটা আপনিও বোঝেন, পরে আরও বুঝবেন।

পোস্ট অফিসের সামনে পৌঁছে গেল ওরা। সিঁড়িতে ডাক পিওন।

 বিজলীবাবু দাঁড়ালেন, কিছু আছে নাকি, রামেশ্বর?

রামেশ্বর মাথা নেড়ে না বলে চলে যেতে গিয়ে হঠাৎ দাঁড়াল, হাতে কিছু চিঠি, বাকি থলিতে। হাতের চিঠি থেকে একটা খাম বার করে নিয়ে বলল, ইয়ে দেখিয়ে তো থোড়া।

বিজলীবাবু খামটা হাতে নিয়ে দেখলেন। জল পড়ে খামের ওপরে লেখা কাঁচা হাতের ঠিকানা ধুয়ে একেবারে অস্পষ্ট হয়ে গেছে, বোঝা যায় না। লক্ষ করে দেখে বিজলীবাবু বললেন, বিজলি অফিসের সাহেবের বলেই তো মনে হচ্ছে–মিত্তিরসাহেবের।

মিত্তির সাহাব! … হামারা ভি ওইসি মালুম হোথা থা। …সাহেব কো এক রসিদ ভি হ্যায়।

কীসের রসিদ?

 মানিঅর্ডারকা।

 বিজলীবাবু রামেশ্বর-পিয়নের দিকে তাকিয়ে কি যেন ভাবলেন। চিঠিটা তার হাতে ফেরতও দিলেন। তারপর হঠাৎ বললেন, দেখি তো, হাতের লেখা যদি মেলে…।

রামেশ্বর কিছু বুঝল না, রসিদ বের করে এগিয়ে দিল। মনিঅর্ডার পৌঁছে তার রসিদটা ফিরে এসেছে। বিজলীবাবুনামসইটা দেখলেন। ললিতা মিত্র। কলকাতার স্ট্যাম্প তো বটেই। টাকার অঙ্কটাও দেখে নিলেন।

রসিদটা ফেরত দিয়ে বিজলীবাবু বললেন, না, আলাদা লেখা। ও চিঠি মিত্তির সাহেবেরই হবে। তবে সাহেবকে এখন অফিসে পাবে না, ভোরবেলায় কাজে বেরিয়ে গেছেন, বাড়িতে দিয়ে দিয়ো চিঠি।

রামেশ্বর চলে গেল। সুরেশ্বর পোস্ট অফিসের মধ্যে ঢুকে গেছে।

বিজলীবাবু ডাকঘরের বারান্দায় সামান্য সময় দাঁড়িয়ে থাকলেন। বেশ যেন চিন্তায় পড়েছেন। ললিতা মিত্র! ললিতা মিত্র কে? মিত্তিরসাহেবের মা নেই, বোন নেই; বউ আছে বলেও তো তিনি শোনেননি। বিয়ের কথায় মিত্তিরসাহেব বরাবর প্রসঙ্গটা এড়িয়ে গিয়ে হেসে বলেছেন: চেষ্টা করেছিলাম; কপাল মন্দ! এ ধরনের কথা থেকে কিছু বোঝা যায় না, যাও বা যায়–তাতে মনে হয়, বিয়ে করব ভেবেছিলেন হয়তো, কিন্তু বিয়ে করেননি।

পাকানো সিগারেট, বারে বারে নিবে যায়; বিজলীবাবু আবার সিগারেট ধরিয়ে নিলেন। খামের চিঠিটা যে মিত্তিরসাহেবের তাতে খুব বেশি সন্দেহ হচ্ছে না। অফিসের নামটা (ভুল নাম এবং বানান সত্ত্বেও) মোটামুটি বোঝা যাচ্ছিল। এই অফিসে এ এন মিত্র (মিত্র যদিও পড়া যায়নি; এ এন গিয়েছিল) আর কেউ নেই। কাঁচা হাতের ঠিকানা, একেবারে বাচ্চা ছেলেমেয়ের যেমন হয়। ললিতা মিত্রর নাম সই আর এই খামের ঠিকানা একই হাতের লেখা নয়। চিঠিটাই বা কে লিখল? মিত্তিরসাহেব তো কখনও বলেননি তাঁর আত্মীয়স্বজন কেউ আছে সংসারে। বন্ধুবান্ধবের কথা অবশ্য বলেছেন। ওই চিঠি কি তবে বন্ধুদের কারও বাড়ির কেউ লিখেছে? কিন্তু টাকাটা?

মিত্তিরসাহেব বেশ রহস্যময় পুরুষ। বিজলীবাবু আপন মনেই মাথা নাড়লেন, আচ্ছা, আজ রাত্রে দেখা যাবে।

সুরেশ্বর টাকা তোলার ফর্ম লিখে দিয়ে বসে বসে শর্মাজির সঙ্গে গল্প করছিল। বিজলীবাবু পাশে এসে দাঁড়ালেন।

.

পোস্ট অফিসের কাজ সেরে সুরেশ্বর গেল বাজারে। কাছেই বাজার। বাজারে ছেদিলালের দোকানে টাকা পয়সা মেটাল। তারপর বিজলীবাবুর সঙ্গে বাস অফিস। বাস অফিসে বিজলীবাবুর ঘরে বসে জল খেল, চা খেল। বাস ছাড়তে এখনও কিছু দেরি, মিনিট কুড়ি। দশটা বেজে গেছে।

বিজলীবাবু বললেন, পুজোর মধ্যে একদিন আসুন। কবে আসবেন?

সুরেশ্বর জানলা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে দেখছিল। ওপাশে রাস্তার ও-দিকটায়–গাছের ছায়ায় বাজার বসে গেছে, শাকসবজি, মাছ ডিম। এ সময় এখানে বাজার একটু বড় হয়েই বসে, পুজোর মুখে কলকাতা পাটনা থেকে তোকজন আসে, বাবুদের জন্যে গাঁ গ্রাম থেকে ব্যাপারিরা মাথায় সওদা নিয়ে ছুটে আসে ভোরবেলায়, দুপুর নাগাদ ফিরে যায়। আজকের বাজার তেমন বড় নয়, কাল থেকে আরও আসবে অনেকে, সকালের দিকটা বেশ ভিড় হবে। কিছু ছেলেমেয়ে, প্রবীণপ্রবীণাকে সুরেশ্বর দেখতে পেল, বাজার করছে ঘুরে ঘুরে। কারও কারও মাথায় ছাতা।

বিজলীবাবু পান চিবোতে চিবোতে বললেন, কবে আসছেন তা হলে?

সুরেশ্বর বিজলীবাবুর দিকে তাকাল, হাসল, নেমন্তন্ন করছেন?

 গরিবের ঘরে দুমুঠো খাবেন এতে আর কথা কী!

আসব একদিন।

 কবে?

সুরেশ্বর আবার জানালা দিয়ে বাইরে তাকাল। আসব।

অষ্টমীর দিন এলে-সকালে; বিকেলে বিজলীবরণ সন্ধিপুজোয় বসবে। বলে বিজলীবাবু আপন রসিকতায় জোরে জোরে হাসলেন।

সুরেশ্বর বলল, অভ্যেসটা এবার ছাড়ার চেষ্টা করুন না। বয়স হয়ে যাচ্ছে তো।

 বিজলীবাবু কৃত্রিম বিস্ময়ে সুরেশ্বরের মুখ দেখতে দেখতে বললেন, এটা আপনি কী বলছেন মহারাজ? কাকে ছাড়ব? … বিজলীবাবু এমনভাবে কাকে ছাড়ব বললেন যে সুরেশ্বর হেসে ফেলল।

বিজলীবাবু সামান্য পরেই বললেন, আমরা কি ছাড়ার লোক, মহারাজ! সে হলেন আপনারা ছাড়ার লোক। সবই ছাড়ছেন। সংসার ছাড়লেন, সুখ আহ্লাদ ছাড়লেন, ফুর্তি-টুর্তি তাও ছাড়লেন। আরও কত কী ছাড়ছেনছাড়বেন–কে বলতে পারে!

সুরেশ্বর বিজলীবাবুর চোখে এমন এক ধরনের হাসি দেখল যা কেমন ধূর্তের মতন। বিজলীবাবু যে ঠিক কী বলতে চাইলেন সুরেশ্বর বুঝল না।

আপনারা সব ছাড়েন, আমরা ধরি। ছাড়ার মজা কী জানেন, একবার ছাড়তে শুরু করলে ছাড়ার মজা ধরে যায়, নেশা ধরে যায়। আজ মদ ছাড়ব, কাল চাকরি ছাড়ব, পরশু বউ ছাড়ব… ছাড়তে ছাড়তে একেবারে বুদ্ধদেব হয়ে যাব। …ওই জন্যেই তো ওপথে যাইনি।

সুরেশ্বর হাসতে হাসতে উঠে দাঁড়াল, বলল, যাই, আর বোধহয় সময় নেই।

 বিজলীবাবু তাঁর টেবিল থেকে কিছু কাগজপত্র উঠিয়ে ড্রয়ারে রাখলেন, বললেন, চলুন, আপনাকে তুলে দিয়ে আমি একবার দুর্গাবাড়ি যাব।

বাইরে এসে বিজলীবাবু তাঁর সাইকেল নিলেন, হ্যাঁন্ডেলে একটা শোলার হ্যাট ঝুলছে। বর্ষায় ছাতা ঝোলে, রোদে তিনি শোলার হ্যাট চাপিয়ে নেন মাথায়।

রাস্তায় নেমে বিজলীবাবু বললেন, মিত্তিরসাহেবের একটা বড় প্রমোশন হচ্ছে, শুনেছেন?

না।

মিত্তিরসাহেবের ওপরঅলা চলে যাচ্ছে পাটনা, সেই জায়গায় মিত্তিরসাহেবকে কাজ করতে হবে।

এ তো সুখবর।

আমাদের কাছে সুখবর, তবে যাঁর খবর তিনি তো খাদ্ধা হয়ে উঠেছেন।

 কেন?

তা জানি না। মিত্তিরসাহেব এ জায়গা ছেড়ে যেতে রাজি না। ওপরঅলার জায়গায় কাজ করতে হলে অন্য জায়গায় যেতে হবে।

সুরেশ্বর কোনও কথা বলল না। হাঁটতে লাগল, সামনেই বাস।

 বিজলীবাবুই কথা বললেন। মিত্তিরসাহেব মানুষটি, বুঝলেন মহারাজ, অদ্ভুত! কী বলে যে, মিস্টিরিয়াস–তাই। জীবনে উন্নতি করার সুযোগ এলে মানুষ খাদ্ধা হয় এমন আর দেখেছেন?

সুরেশ্বর মাথা নাড়ল অন্যমনস্কভাবে।

বাসের কাছে এসে বিজলীবাবু ড্রাইভারকে কী যেন বললেন। তারপর সুরেশ্বরকে ফার্স্ট ক্লাসে উঠিয়ে দিলেন। আপনি রোদে লাঠটা থেকে হাঁটবেন না, বাস আপনাকে গুরুডিয়ায় পৌঁছে দেবে।

সুরেশ্বর আপত্তি করতে যাচ্ছিল, কিন্তু তার সেই আপত্তি গায়ে না মেখে বিজলীবাবু সাইকেলে উঠে চলে গেলেন। সাইকেলে ওঠার আগে শোলার হ্যাটটা মাথায় চাপিয়ে নিয়েছেন।

বাস ছাড়ল। সুরেশ্বরের পাশে জনা তিনেক শহরের প্যাসেঞ্জার। তার মধ্যে জানলার ধার ঘেঁষে বিবাহিতা একটি মেয়ে বসে আছে। অবাঙালি। স্বামী-স্ত্রীতে কথা বলছিল, তৃতীয় ব্যক্তিটি ওদেরই আত্মীয়, সেও কথা বলছে।

যেতে যেতে সুরেশ্বরের কেন যেন অবনীর কথাই মনে পড়ছিল। ভদ্রলোক যে কিছুটা অন্য ধরনের এই ধারণা সুরেশ্বরের পূর্বেই হয়েছিল। ইদানীং অবনীর সঙ্গে কথাবার্তা বলে এবং তার আচরণ দেখেও সুরেশ্বরের সে-ধারা ভাঙেনি,বরং তার মনে হচ্ছিল: অবনী ঠিক যতটা তিক্ততা ও বিতৃষ্ণা প্রকাশ করে ততটা তিক্ত ও বিতৃষ্ণ মানুষ সে নয়। ওর অনেক আচরণ এখনও অপরিণতের মন, কথাবার্তায় অনেক সময় আবেগের তাপ থাকে। সেদিন অতটা রাতে সে নিতান্ত তুচ্ছ কারণে গুরুডিয়ায় গিয়ে হাজির হয়েছিল। কারণটা যে তুচ্ছ সে নিজেও জানত, এবং তা গোপন করার চেষ্টাও তেমন করেনি। বড় একটা দুর্যোগ ঝড়বৃষ্টি গেল মাথার ওপর দিয়ে তাই নাকি খবর নিতে গিয়েছিল: খোঁজ নিতে এলাম কেমন আছেন? …আমি তো ভেবেছিলাম আপনাদের আশ্রমের চালাফালা উড়ে গেছে। কিছুই তো হয়নি দেখছি।

অবনী চতুর নয়, ঠিক যতটা বুদ্ধিমান হলে তার উদ্দেশ্য ধরা মুশকিল হয়ে পড়বে–ততটা বুদ্ধিমানও নয়। সুরেশ্বর অন্তত বেশ বুঝতে পারছে, অবনীর আকর্ষণের পাত্র হেম।

বাস থানা পেরিয়ে গেল। সুরেশ্বর অন্যমনস্ক।

চাকরিতে উন্নতি চায় না এমন মানুষ বড় চোখে পড়ে না-সুরেশ্বর ভাবছিল–অবনী সেই উন্নতি উপেক্ষা করতে চাইছে। কেন? এ জায়গা ছেড়ে সে যেতে চায় না, বিজলীবাবু বললেন। কিন্তু কেন?

হেম। হেমের জন্যেই কি অবনী এ জায়গা ছেড়ে যেতে রাজি না?

 কিন্তু আজ হেম কলকাতায় যাচ্ছে বলে সে তো স্টেশনে এল না। বিজলীবাবুর কথা মতন, দরকারি কাজে ভোরবেলাতেই বেরিয়ে গেছে অবনী। যে মানুষ এতটা কাজ বোঝে, দায়িত্ব বোঝে, সে আরও বড় দায়িত্ব নিতে অরাজি কেন?

সুরেশ্বর রোদভরা মাঠের দিকে তাকিয়ে কী ভেবে যেন মৃদু হাসল।

1 Comment
Collapse Comments
Arghadipa Chakraborty March 17, 2021 at 9:57 am

বিমল করের “খড়কুটো” আর বালিকা বধূ টা দেবেন প্লিজ।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *