৬. পৌষ ফুরিয়ে মাঘ

২৬.

পৌষ ফুরিয়ে মাঘ এসে পড়েছিল। মধ্যে কদিন মেঘলা মেঘলা, অল্পস্বল্প বৃষ্টিও গিয়েছে, শীত চাপা পড়েছিল সামান্য; তারপর আবার আকাশ পরিষ্কার হয়ে রোদ উঠলে মাঘের প্রখর শীত সব কিছু যেন কামড়ে ধরল। পৌষের শীতে কোথাও কিছু চঞ্চলতা ছিল, মাঘে সবই অচঞ্চল, পরিণত। উত্তরের বাতাসে আর তেমন এলোমেলো দমকা নেই, একটানা একই মুখে বইছে; গাছের পাতা ঝরতে শুরু হয়েছিল; রোদের তাতেও শীতের গুঁড়ো যেন জড়ানো; সকালে ঘাস ডোবানো শিশির, রাতে হিম আর কুয়াশা। সব যেন অবশ করে দিচ্ছিল।

গগন ফিরে গেছে; তার যাবার পর সপ্তাহ দুই কেটে গেল। যাবার সময় গগন কিছুটা উদ্বেগ নিয়ে গেছে। সে থাকতে থাকতেই মনোহর মারা গেল। মনোহরের কী হয়েছিল বোঝা যায়নি, ধরা যায়নি। সকলেই বলছিল মেলা থেকে আনা রোগ। আরও কয়েকটা মৃত্যুসংবাদের কথা কানে আসছিল। কেউ বলছিল চাপা বসন্ত, কেউ বলছিল প্লেগ। এর কোনওটাই ঠিক নয়। অসুখটা অদ্ভুত। যাবার আগে গগন হৈমন্তীকে বলেছিল, তোদের এখানে এ কী অসুখ-বিসুখ শুরু হল! সাবধানে থাকবি। আমরা খুব দুর্ভাবনায় থাকব। তেমন কিছু বুঝলে কলকাতায় চলে আসবি। এমনিতেও তো তোর আর এখানে থাকার কোনও মানে হয় না।

কলকাতায় ফেরার দিন গগন অবনীর সঙ্গে দেখা করতে অবনীর বাড়ি গিয়েছিল, সঙ্গে হৈমন্তী। অবনী তখন প্রায় শয্যাশায়ী; তার সেই গলা-ঘাড়ের কাছাকাছি লাল ছোট ছোট ফুস্কুড়িগুলো শেষ পর্যন্ত হার্পিস-এ দাঁড়িয়ে ছিল, পিঠ বেয়ে নেমে এসেছিল অনেকটা। হৈমন্তী অনেকটা এই রকম সন্দেহ করেছিল প্রথমে। যে কদিন গগন ছিল, স্টেশনে যেত আসত, অবনীর অসুখের খবরটা সেই নিয়ে আসে। হৈমন্তীও গেল একদিন, ওষুধপত্র লিখে দিয়ে এল। বাকিটা করছিল স্টেশনের কালা ডাক্তার।

গগন যাবার আগে অবনীকে বলে গিয়েছিল : দিদিকে একটু দেখবেন, যে রকম শুনছি তাতে তো ভয় করছে। অবস্থা খারাপ বুঝলে ওকে আর আশ্রমে থাকতে দেবেন না, সোজা কলকাতায় পাঠিয়ে দেবেন। ও বড় জেদি। আর হঠাৎ তেমন কিছু দেখলে অন্তত এখানে নিয়ে আসবেন। হৈমন্তী গগনের পাশেই দাঁড়িয়ে ছিল; সবই শুনল, কিছু বলল না।

গগন যাবার পর পরই অন্ধ আশ্রমের বুড়ো তিলুয়া অসুখে পড়ল। অনেকটা একই ধরনের অসুখ বলে মনে হচ্ছিল। মনোহর জোয়ান গোছের বলে এই অদ্ভুত ব্যাধির সঙ্গে কদিন লড়েছিল, তিলুয়া পারল না, তার বয়েস হয়েছিল, প্রথম ধাক্কাতেই শরীরের কলকবজা বিগড়ে জটিলতা সৃষ্টি হল, মারা গেল নিউমোনিয়া হয়ে।

আপাতত আর-একজন বিছানায় পড়ে আছে–সে যাবে না থাকবে কিছু বোঝা যাচ্ছে না। এসব চিকিৎসা হৈমন্তীর করার কথা নয়, সে চোখের ডাক্তার, তবু বাধ্য হয়ে তাকে এই অদ্ভুত রোগের চিকিৎসাও করতে হচ্ছে; যথাসাধ্য করছে বটে কিন্তু বুঝতে পারছে না, ভাল করছে না মন্দ করছে। চোখের ছোট্ট একটা হাসপাতাল, সাধারণ চিকিৎসার ব্যবস্থা প্রায় নেই, ওষুধপত্রও না। তবু চিকিৎসা।

সুরেশ্বর একদিন বলল, হেম, অসুখটা কি সত্যিই ছোঁয়াচে বলে মনে হচ্ছে তোমার?

ঘাড় নাড়ল হৈমন্তী, তাই তো মনে হয়। বুড়ো তিলুয়া যেভাবে মনোহরের রোগশয্যায় আসা-যাওয়া করত তাতেও এরকম সন্দেহ হয়।

অসুখটা কী?

কী জানি! বুঝতে পারছি না।

তবু… তোমার কী মনে হয়?

আন্দাজে রোগ বলা যায় না। আমি চোখের ডাক্তার, এসবের তেমন কিছু বুঝি না।

অতদিন লেখাপড়া করলে—সুরেশ্বর যেন হতাশ হল। সে কিছু জানতে চাইছিল। তার এই ব্যগ্রতা স্বাভাবিক। তার মনে হত, হৈমন্তী অন্তত একটা কিছু অনুমান করতে পারবে। এ-রকম কেন মনে হত সে জানে না। হয়তো এই জন্যে যে, অন্য কোথাও থেকে কিছু জানার উপায় ছিল না; বা সুরেশ্বর ভাবত, হেম কলকাতার ডাক্তারি কলেজে অতদিন ধরে পড়েছে, তার পক্ষে এই অসুখ জানা সম্ভব। হয়তো এ-সবও কিছু না; অন্ধ আশ্রমের মধ্যে রোগটা ঢুকে পড়ায় সে উদ্বেগ বোধ করছিল; যদি এমনই হয়–লোকে যা বলাবলি করছে–এটা একটা নতুন উপদ্রব, এ তল্লাটে দেখা দিয়েছে, তবে কী করে কেমন করে আশ্রমের মানুষগুলোকে নিরাপদে রাখা যায় সুরেশ্বরের সেই দুশ্চিন্তা দেখা দিয়েছিল। তা ছাড়া এখানে এমন কিছু নেই যাতে অন্য কোনও ব্যাধির চিকিৎসা হতে পারে। সাধারণ জ্বর-জালা, এমনকী এ-সময়ে এখানে যেটা হয়–জল বসন্ত–এসবে কোনও ভয়-ভাবনা ছিল না। কিন্তু এখন যা শোনা যাচ্ছে তাতে উদ্বেগ বোধ না করে উপায় নেই।

হৈমন্তীর ওপর সুরেশ্বরকে ভরসা করতে হচ্ছিল। রোগটা কী? রোগটা কি ছোঁয়াচে? সত্যিই এপিডেমিক দেখা দিল? যদি তাই হয় তা হলে কী করা যায় বলতে পার? কি করে এখানের লোকগুলোকে নিরাপদে রাখি? কেমন করে বাঁচাই? অসুখের চিকিৎসারই বা কী হবে? ওষুধপত্র কোথায়? এটা কী ধরনের ছোঁয়াচে রোগ? –এই ধরনের প্রশ্ন, উদ্বেগ তাকে চিন্তিত করছিল, এবং পরামর্শের জন্যে হৈমন্তীর মুখের দিকে তাকিয়ে থাকতে হচ্ছিল।

প্লেগ বলে মনে হয় তোমার? সুরেশ্বর জিজ্ঞেস করল আর একদিন।

 না–না। হৈমন্তী মাথা নেড়ে বলল।

 তবে! কী এমন রোগ?

জানি না! কত রকমের রোগ আছে। সব সময় সব রোগ বোঝাও যায় না। মাঝে মাঝে এক-আধটা অদ্ভুত রোগও আসে…।

সুরেশ্বর আর কিছু বলল না।

 হৈমন্তী তার সাধ্যমতো ভেবেছে, ভেবে দেখেছে এই বিচিত্র রোগ তার জ্ঞানের বাইরে। রেটিনাইটিস, কেরাটাইটিস, গ্লুকোমা–এসব হলে সে বলতে পারত, কিন্তু এ রোগের সে কী জানে, কী বা বলতে পারে। যদি কেতাবি বিদ্যেতে সন্দেহ করতে হয়, তবে হৈমন্তী সন্দেহ করবে মনোনিউক্লোসিস; অথচ পুরোপুরি তা নয়; স্কারলেটিনারও লক্ষণ পাওয়া যায়। এই দুই রোগ সম্পর্কে তার কোনও অভিজ্ঞতা নেই। থাকার কথাও নয়। দ্বিতীয় রোগ এক-আধটা তবু দেখেছে

প্রথমটা আদপেই নয়। মনোহরের বেলায় কিছুই বোঝা যায়নি, বুড়ো তিলুয়ার বেলায় কিছু একটা ঠাওর করার আগেই সে নিউমোনিয়া হয়ে মারা গেল, আপাতত যে পড়ে আছে, গির্জা, তাকে দেখেই হৈমন্তীর এই রকম মনে হচ্ছে। তবে তার এই অনুমান ভুল হতে পারে, হওয়াই স্বাভাবিক। এসব রোগে মানুষ ভোগে কিন্তু কদাচিৎ মারা যায়। প্রথমটা তো সাধারণত কমবয়েসীদের। …এ সবই তার নিছক একটা অনুমান, নিজেরই শত সন্দেহ। তা ছাড়া এখন পর্যন্ত যা শোনা যাচ্ছে তার কতটা গুজব, কতটা সত্যি তা কেউ জানে না। হতে পারে এদিকের এ-মেলা সে-মেলায় দশ বিশ জন মারা গেছে, কিন্তু তারা কোন রোগে মারা গেছে কে বলবে! শীতে দু-চারটে বুড়োবুড়ি অনায়াসেই মরতে পারে : যে রকম ঠাণ্ডা তাতে মেলার ফাঁকা মাঠে প্রায় নির্বস্ত্র কটা গরিব রাত্রের হিমঠাণ্ডায় যে নিউমোনিয়া বাঁধায়নি তাই বা কে জানছে। যে সব খাদ্য মেলায় খাচ্ছে তাতেও দু-পাঁচটা মরতে পারে, বিচিত্র কী! তার ওপর শোনা যাচ্ছে কোথাও কোথাও বসন্ত শুরু হয়ে গেছে, যদি তাই হয় তবে এমনও হতে পারে মেলায় গিয়ে কারও জ্বর হয়েছে, বাড়িতে ফিরেছে বসন্ত নিয়ে, বাড়ি এসে পরে মরেছে। কে জানতে যাচ্ছে কী হয়েছিল? এ তো শহর নয়, ডাক্তারবদ্যিও নেই, চিকিৎসাও হয় না। বিক্ষিপ্ত লোকালয়, ছোট ছোট গ্রাম, কোথাও দশ বিশ ঘর, কোথাও কিছু বেশি বাসিন্দে; এক গাঁয়ের খবর অন্য গাঁয়ে পৌঁছতে একটা বেলা কেটে যায়, এমন অবস্থায় ঠিকঠাক কিছু জানার উপায় নেই। বেচারি অজ্ঞমূৰ্থে কী বলছে সেটা কোনও কাজের কথা নয়। রোগটা মেলা থেকে ছড়াচ্ছে, রোগটা মহামারী হয়ে দেখা দিয়েছে–এসব অজ্ঞেই বলছে। তারা বলছে বলেই মেনে নিতে হবে!

মনোহর এমনভাবে মারা গেল যে কিছুই ধরা গেল না। হৈমন্তী স্তম্ভিত ও বিস্মিত হলেও কোনও কিছু স্থির করে নেয়নি। তারপর গেল বুড়ো তিলুয়া। তিলুয়ার সময়েও রোগ ধরা গেল না কিন্তু কয়েকটা প্রাথমিক লক্ষণ মনোহরের মতন দেখাল, যদিও তিলুয়া শেষাবধি নিউমোনিয়া হয়ে মরল। এবারও কিছু বুঝল না হৈমন্তী। নিজেকে বড় অসহায় মনে হল।

মেলায় অসুখ দেখা দিয়েছে এই গুজবটা তো কানে এসেছিল অন্ধ আশ্রমের কারও কারও, সে গুজবে কেউ কান দেয়নি। মনোহর মারা যাবার পর গুজবের হাওয়াটা আরও জোরে এসে লাগল। তিলুয়া বুড়ো মারা যাবার পর সকলেই ভয় পেয়েছিল। তারপর গিজা। অন্ধ আশ্রমে এখন একটা চাপা আতঙ্ক দেখা দিয়েছে। সুরেশ্বরও বেশ বিচলিত, শিবনন্দনজিও। এই আতঙ্ক স্বাভাবিক : অন্ধ আশ্রমের মধ্যে দু দুটো লোক পনেরো বিশ দিনের মধ্যে হুট করে মারা গেল, আর-একটা বিছানায় পড়ে আছে–এ কি উদ্বেগ আতঙ্কের পক্ষে কম হল!

সুরেশ্বর রীতিমতো উদ্বেগের মধ্যে একদিন শিবনন্দনজিকে সঙ্গে করে টাউনে গেল। সেখানে সরকারি হাসপাতাল আছে, ডাক্তার আছে, হেলথ-ডিপার্টমেন্ট আছে। ঘুরে এসে বলল, রোগের খবরটা হেলথ-ডিপার্টমেন্টেরও কানে গেছে, তারা খোঁজখবর শুরু করেছে। সরকারি হাসপাতালে এধরনের রোগী গোটা চারেক এসেছিল। দুটো মারা গেছে, একটা বেঁচেছে; একটা ভুগছে এখনও। রোগটা অদ্ভুত, কী রোগ কেউ বলতে পারছে না। কেউ বলছে, টাইফাস, কেউ বলছে অন্য কিছু।

আরও দশ পনেরোটা দিন এই ভাবেই কাটল। গির্জা কেমন করে যেন বেঁচে গেল।

তারপর বেশ বোঝা গেল, রোগ যাই হোক–মহামারীর চেহারা নিয়েই সেটা এ তল্লাটে দেখা দিয়েছে। প্রথমে যদি বা সন্দেহ ছিল, এখন অন্তত মনে হয় রোগটা যতই বিচিত্র হোক সংক্রামক রোগের মতনই সেটা ছড়িয়েছে। এই সময়টা এদিকে মেলা-টেলার সময়, নানা জায়গা থেকে ব্যাপারি আসে, কেনাবেচার জন্যে লোকে এ-মেলা থেকে ও-মেলা যায়, কিছু ধুনিঅলা সাধুবাবা থেকে ছেঁড়া তাঁবুতে ম্যাজিক দেখানো ম্যাজিসিয়ান পর্যন্ত মেলায় মেলায় টহল দিয়ে বেড়ায়, রামলীলার দল আসে, নাওটাঙ্গির নাচ–তাও থাকে। মেলাতেই প্রথমে রোগটা কেউ বয়ে এনেছিল, তারপর এ-মেলা ও মেলা হয়ে সেটা ছড়িয়েছে, এখন মেলা-ফেরত মানুষের সঙ্গে ক্রমশই গাঁ-গ্রাম গিয়ে ঢুকেছে। শহরটহর হলে, ঘন বসতি থাকলে হয়তো রাতারাতি রোগটা মারাত্মক হয়ে ছড়িয়ে পড়ত, দূরদূরান্তে বিচ্ছিন্ন বিক্ষিপ্তভাবে ছড়ানো গাঁ-গ্রামের বসতি, হয়তো তাই ব্যাধিটা ছড়াতে বিলম্ব হচ্ছিল। এক পক্ষে এটা ভাল, অন্য পক্ষে মন্দ। মন্দ এই জন্যে যে, শহরে-নগরে হলে একটা রইরই বাঁধত, মিউনিসিপ্যালিটির টনক নড়ত, ডাক্তার বদ্যি ছোটাছুটি করত, সরকারি নজর পড়ত। তাতে দশটা মরত বাকি নব্বইটাকে বাঁচাবার চেষ্টা হত। এ-জায়গাটা শহর নয়, না মিউনিসিপ্যালিটি না ইউনিয়ন বোর্ড, কোথাও কোথাও নামে নাকি পঞ্চায়েত আছে, ডাক্তার বদ্যির বালাই নেই, কাজেই কোথায় কোন দেহাতে কে মরছে, কী রোগ হচ্ছে–কে তার খবর রাখে। সরকারি নজরটাও এতদিনে পড়েনি। গা এলিয়ে কে কী দেখছে কিছুই বোঝা যায় না। শোনা যাচ্ছে, হাকিম নাকি মেলা-টেলা বন্ধ করার হুকুম দেবেন। হেলথ-ডিপার্টমেন্টের লোক কতক মুদ্দোফরাশ জোগাড় করে কিছু ব্লিচিং পাউডার আর মশা মারা তেল দিয়ে কয়েকটা গাঁ-গ্রামে পাঠিয়ে দিয়েছে। সেই সঙ্গে কয়েকজন টিকাদার বেরিয়েছে। বসন্তের টিকে দিতে। বসন্তের টিকে এরা বড় কেউ নেয় না, টিকাদার দেখলে ঘর ছেড়ে ক্ষেতিতে পালায়, মেয়ে বউরা কান্নাকাটি শুরু করে, বাচ্চাগুলো চুহার মতন লুকোয়।

শিবনন্দনজির কাছ থেকে এই সব খবর পাওয়া যাচ্ছিল। একদিন তিনি বললেন, এ অঞ্চলে কলেরা বসন্তের মহামারী হতে আগে তিনি দেখেছেন, মহামারীটা আসে যেন পঙ্গপাল আসছে : প্রথমে ফড়িংয়ের মতন পাঁচ দশটা কোথা থেকে ছিটকে আসে, কেউ খেয়াল করে না, বোঝেও না, তারপর দেখতে দেখতে হঠাৎ বড় বড় ফোঁটায় বৃষ্টি আসার মতন এক ঝাঁক পঙ্গপাল এসে পড়ে; তখন খেয়াল হয়, সামাল দেবার জন্যে ছুটোছুটি শুরু হয়, কিন্তু ততক্ষণে আকাশ কালো করে অন্তহীন এক মেঘের মতন তারা এসে গেছে। সেই ভয়ংকর দৃশ্যের দিকে তাকিয়ে আর কিছু করার সাধ্য মানুষের থাকে না।

কথাটা শিবনন্দনজি বোধহয় ঠিকই বলেছিলেন, মহামারীটা আকাশ কালো করা পঙ্গপালের মেঘের মতনই এসে পড়ল। গাঁ-গ্রাম থেকে চোখ দেখাতে অন্ধ আশ্রমে রোগী আসার সংখ্যাও ক্রমশই কমে গেছে। এখন দু-একজন যদি বা আসে। ততদিনে মাঘ ফুরিয়ে আসছে।

.

সেদিন বিকেলের শেষ দিকটায় সুরেশ্বর এল। হৈমন্তী বাড়ির সামনে মাঠে পায়চারি করছিল, মালিনী ছিল এতক্ষণ, কাছাকাছি, এইমাত্র ঘরে গেছে।

সুরেশ্বর এসে বলল, তোমার কাছেই এলাম।

হৈমন্তী দাঁড়িয়ে পড়েছিল। সে বুঝতে পারল না দাঁড়িয়ে থাকবে, হাঁটবে, নাকি ঘরে যাবে। সুরেশ্বর কেন এসেছে তা জানতে তার তেমন কোনও আগ্রহ ছিল না। আজকাল মাঝেমাঝেই সুরেশ্বরকে তার কাছে আসতে হচ্ছে, তাগিদ হোক প্রয়োজন হোক–এ সবই সুরেশ্বরের; অসুখটা আশ্রমে ঢুকে না পড়লে সুরেশ্বরের হৈমন্তীকে প্রয়োজন হত না; সুরেশ্বর বিপাকে পড়েছে, হৈমন্তীও আজ হঠাৎ প্রয়োজনীয় মানুষ হয়ে উঠেছে। হৈমন্তী মনে করে না, এর কোনও মূল্য আছে, তার ভালও লাগে না। বরং কখনও-সখনও সে কৌতুক অনুভব করে, উপহাসের ইচ্ছে জাগে, বিতৃষ্ণা আসে।

সুরেশ্বর বলল, এখনও সন্ধে হয়নি, চলো একটু হাঁটি। বলে পা বাড়াল সুরেশ্বর।

 হৈমন্তীও বাধ্য হয়ে হাঁটতে লাগল।

হাঁটতে হাঁটতে সুরেশ্বর বলল, একটা খবর শুনেছ?

এখনকার সব খবরই রোগ-মহামারীর মৃত্যুর। হৈমন্তী কোনও উৎসাহ বোধ করল না। বরং তার বিরক্তি হচ্ছিল। কেন যেন আজ দুপুর থেকে সে অবনীর প্রত্যাশা করছিল। ছ সাত দিনের মধ্যে অবনী আর আসেনি। আজ সে আসবে এই রকম মনে হচ্ছিল।

সুরেশ্বর বলল, পাটনা থেকে কিছু ডাক্তার-টাক্তার আসছে শুনলাম, ভলেন্টিয়ারও আসতে পারে। তাঁবু ফেলে থাকবে। …তা তাড়াতাড়ি এসে পড়লেই ভাল, কি বল? এদের তো সব কিছুতেই গড়িমসি।

হৈমন্তী নীরবে হাঁটতে লাগল। কারা আসবে, কখন আসবে, কোথায় কোথায় তাঁবু পাতবে এর কোনও কিছু জানার জন্যে সে ব্যগ্র নয়। যদি ডাক্তার নার্স ভলেন্টিয়ার ওষুধপত্র আসে–ভালই হবে; আসা উচিত–এই পর্যন্ত সে ভাবতে পারে, তার বেশি আর কিছু নয়। সুরেশ্বরের মতন, সে কি চাতকের মতন পাটনার ডাক্তারদের জন্যে দিন গুনবে নাকি?

শিবনন্দনজি বলছিলেন– সুরেশ্বর বলল, এখন আর কোথাও মেলা বসতে দিচ্ছে না, পুলিশ গিয়ে দোকানপসার তুলে দিচ্ছে। কোথায় যেন মেঠাইমণ্ডা সব ফেলে দিয়েছে টান মেরে, চাটাই ছাউনির ঢাকা-টাকা পুড়িয়ে দিয়েছে।

মনে মনে হৈমন্তী বলল : ভালই করেছে। হতভাগার দল যত! মরছে, তবু মেলায় যাবে, গিয়ে ওই মেঠাইমণ্ডা খাবে। কিন্তু সুরেশ্বর কি এইসব কথা বলার জন্যে তার কাছে এসেছে? হৈমন্তীর মনে হল না, পাটনা থেকে ডাক্তার আসছে, পুলিশ মেলা বন্ধ করে দিচ্ছে–এসব তুচ্ছ কথা শোনাবার জন্যে বা তা নিয়ে গল্প করার জন্যে সুরেশ্বর এসেছে।

অন্ধ আশ্রমের ফটক পেরিয়ে তারা জামতলার সামনে এসে দাঁড়াল। গোধূলি নামছে। হৈমন্তী লাটুঠার দিকের কাঁচা রাস্তা ধরে হাঁটতে লাগল। শীত মরে আসছে, তবু বেশ ঠাণ্ডা আছে এখনও। ধুলোয় মাঠঘাট ধূসর, আলোর অভাবে এবং ছায়ার জন্যে ছোট ছোট ঝোপঝাড়গুলো কালচে দেখাচ্ছিল।

হাঁটতে হাঁটতে সুরেশ্বর এবার বলল, কলকাতা থেকে কোনও চিঠি পেয়েছ হেম?

হৈমন্তী মুখ তুলে ঘাড় ফিরিয়ে তাকাল। এতক্ষণে যেন সুরেশ্বরের আসার কারণটা সে বুঝতে পারল।

কদিন আগে পেয়েছি, হৈমন্তী বলল।

সামান্য অপেক্ষা করে সুরেশ্বর বলল, আমি আজ গগনের একটা চিঠি পেলাম।

হৈমন্তী মুখ তুলে সুরেশ্বরকে দেখল না; না দেখেও অনুমান করতে পারল গগন কী লিখেছে। অন্যমনস্কভাবে আকাশে গোধূলির মেঘ দেখতে দেখতে হাঁটতে লাগল।

সুরেশ্বর অল্প সময় নীরব থাকল, পরে বলল, গগনকে তুমি কিছু লিখেছিলে?

 হৈমন্তী ঘাড় ফিরিয়ে সুরেশ্বরকে বলল, কীসের কী লিখব।

এখানের অসুখ-বিসুখের কথা?

 গগন নিজেই দেখে গেছে।

তখন এতটা বাড়াবাড়ি এদিকে হয়নি। সুরেশ্বর যে প্রতিবাদ করল তা নয়, তবু মনে হল সে বলতে চাইছে, গগন যখন গেছে তখন এমন কিছু হয়নি যাতে খুব একটা ভয় পাবার মতন অবস্থা হয়েছিল। হৈমন্তী বুঝতে পারল গগন বেশ ভয় পেয়ে কিছু লিখেছে।

সুরেশ্বর মাঠঘাট দেখতে দেখতে বলল, গগন তোমায় কলকাতায় পাঠিয়ে দেবার কথা লিখেছে।

হৈমন্তী প্রথমটায় মুখ ফেরাল না, যেমন হাঁটছিল সেই রকম আস্তে আস্তে হাঁটতে লাগল, পরে মুখ তুলে সুরেশ্বরকে দেখল। গগন যে কিছু অন্যায় করেনি সে সম্পর্কে হৈমন্তীর সন্দেহ ছিল না। সে বেচারির দুশ্চিন্তা দুর্ভাবনা হতেই পারে; তার ওপর যদি মা আর মামা সব শোনে তবে কলকাতার বাড়িতে খুব একটা উৎকণ্ঠা যাচ্ছে যে তাতে সন্দেহ নেই।

গগনের চিঠি পড়ে আমার মনে হল– সুরেশ্বর বলল, তুমি কিছু লিখেছ। … এখানের অবস্থা যা হয়ে দাঁড়িয়েছে–দেখলাম সে প্রায় সবই জানে।

হৈমন্তী কেন যেন বিরক্তি বোধ করল। সুরেশ্বরের কথার ধরন থেকে তার মনে হচ্ছিল, হৈমন্তী যেন লুকিয়ে লুকিয়ে গগনকে ভয় পাইয়ে দেবার মতন কিছু লিখেছে। বিতৃষ্ণা অনুভব করল হৈমন্তী, সুরেশ্বরের দিকে কয়েক পলকের জন্যে তাকাল, মনে মনে বিরক্তির সঙ্গে বলল : তোমার বুঝি মনে হচ্ছে আমি এখান থেকে পালাবার মতলব করে গগনকে সব লিখেছি? গগন আমার কথা মতন তোমায় লিখেছে?

গায়ের গরম চাদরটা ঘন করে জড়িয়ে নিতে নিতে হৈমন্তী বিরক্ত গলায় বলল,তোমার মনে হলে আমার আর কী করার আছে। আমি তেমন কিছু লিখিনি। বলে একটু থামল হৈমন্তী, আবার বলল, সাধারণ একটা বুদ্ধি আমার আছে :কলকাতায় ওদের উদ্বন্ত করে তুলে কী লাভ।

হৈমন্তীর গলার স্বরে বিরক্তি ও অপ্রসন্নতা অনুভব করে সুরেশ্বর হৈমন্তীর দিকে তাকাল। ঈষৎ যেন অপ্রস্তুত হয়েছে, বলল, তা ঠিক; আমিও তাই ভাবছিলাম–দুরে যারা রয়েছে তারা কিছু জানছে না দেখছে না, অযথা ওদের ব্যস্ত করে ভয় পাইয়ে কী লাভ! … গগন বেশ ভয় পেয়েছে, মাসিমাকেও কিছু কি আর জানায়নি। … গগনটা এত কথা জানল কী করে।

হৈমন্তীর এতক্ষণে সন্দেহ হল, অবনী নিশ্চয় গগনকে লিখেছে।

সুরেশ্বর বলল, গগন তোমায় কিছু লেখেনি?

কথাটা তেমন খেয়াল করে শুনল না হৈমন্তী। সে অবনীর কথা ভাবছিল : ভাবছিল, গগনকে সবিস্তারে কেউ কিছু লিখে থাকলে অবনীই লিখেছে। তার পক্ষে লেখা সম্ভব। হৈমন্তী ভাবল, কথাটা সুরেশ্বরকে বলবে নাকি? পরে মনে হল, থাক বলবে না। অথচ হৈমন্তীর খারাপ লাগছিল; সুরেশ্বর হয়তো মনে মনে ভেবে রাখল, হৈমন্তী কিছু গোপন রাখছে।

সামান্য অপেক্ষা করে সুরেশ্বর আবার বলল, গগন তোমায় কিছু লেখেনি, হেম?

কলকাতায় যাওয়ার কথা?

 হ্যাঁ। সুরেশ্বর মাথা নাড়ল।

 লিখেছে।

সুরেশ্বর চুপ করে থাকল, যেন অপেক্ষা করছে হৈমন্তী আরও কিছু বলবে বলে। হৈমন্তী কিছু বলছিল না। আকাশে গোধূলি ফুরিয়ে এল; পশ্চিমের আকাশে অন্ধকারের জোয়ার আসছে, অবশিষ্ট একটু লালের আভার ওপর কালোর ছায়া। মাথার ওপর দিয়ে নিঃসঙ্গ কোনও পাখি ভীত হয়ে উড়ে যাচ্ছিল।

হৈমন্তী এই নিঃশব্দতায় কেমন আড়ষ্ট বোধ করল। আসন্ন সন্ধ্যার মতন কোনও কিছুর বিষণ্ণ ভার তাকে আচ্ছন্ন করে আনছিল। হৈমন্তী বলল, সন্ধে হয়ে গেল; ফিরি। শীত করছে।

অন্যমনস্কভাবে সুরেশ্বর বলল, চলো-ফেরা যাক।

ফেরার পথে হৈমন্তী বলল, গগন যখন যায়, তখনই তার বেশ ভাবনা হয়েছিল।

জানি। আমায় বলেছিল।

এখনকার অবস্থা আরও খারাপ! …আমি তাকে ব্যস্ত করার মতন কিছু লিখিনি; তবে চারপাশে খুব অসুখ-বিসুখ চলছে এখন–এরকম কিছু লিখেছিলাম। হয়তো তাতেই আরও ব্যস্ত হয়ে পড়েছে। বিশেষ করে মা…

সুরেশ্বর কথাগুলো মনোযোগ দিয়ে শুনছিল কিনা বোঝা গেল না। কিছু বলছিল না। নীরবে দুজনে আরও একটু হেঁটে এল। দেখতে দেখতে কেমন অন্ধকার হয়ে এল। দূরে নদীর দিকে শূন্যতায় ধুলোর গায়ে বুঝি কুয়াশা জমতে শুরু করেছে।

সুরেশ্বর বলল, তুমি যাবার ব্যাপারে কিছু ঠিক করেছ?

হৈমন্তীর পা থমকে স্থির হয়ে গেল, বাঁ পা বাড়িয়ে সে দাঁড়াল, ডান পা আর তুলতে পারল না। সুরেশ্বরের দিকে তাকাল, সুরেশ্বর দুপা এগিয়ে দাঁড়িয়ে পড়েছে। হঠাৎ যেন কেমন একটা আক্রোশ ও ঘৃণা হৈমন্তীকে কিছুক্ষণের জন্যে কিছু দেখতে দিল না, ভাবতে দিল না। জীবনে বোধহয় আর কখনও এমন তিক্ততা সে অনুভব করেনি। সুরেশ্বরকে অত্যন্ত ইতর,কপট ও স্বার্থপর মনে হচ্ছিল। কী ভাবছে সুরেশ্বর? সে কি ভেবে নিয়েছে, হৈমন্তী পালিয়ে যাবার জন্যে পা বাড়িয়ে রেখেছে?

সুরেশ্বর দাঁড়িয়ে পড়েছিল। হৈমন্তী আসছে না দেখে অপেক্ষা করছিল।

 শেষ পর্যন্ত হৈমন্তী পা বাড়াল।

সুরেশ্বর বলল, হেম, আমি কিছুদিন ধরেই ভাবছিলাম, তোমার সঙ্গে কটা কথা বলব। ..গগন থাকতে থাকতেই ভেবেছি কথাটা বলি। বলা হয়নি। তারপর এই রকম একটা অবস্থা দাঁড়াল।

হৈমন্তী সামান্য দ্রুত পায়ে হাঁটার চেষ্টা করছিল, যেন সুরেশ্বরের সঙ্গ তার আর পছন্দ হচ্ছিল না, সহ্য হচ্ছিল না। দ্রুত হাঁটার চেষ্টা করতে গিয়ে উত্তেজনার মাথায় হৈমন্তীর শরীর কাঁপছিল, পা এলোমেলো হয়ে পড়ছিল।

হৈমন্তী ঝোঁকের মাথায় তিক্ত গলায় বলল, যাবার দিন আমি এখনও ঠিক করিনি কিছু কাল পরশুর মধ্যে করব।

সুরেশ্বর হৈমন্তীর ক্রোধ এবং তিক্ততা অনুভব করতে পারছিল। অল্প সময় কথা বলল না। পরে বলল, তুমি আরও কয়েকটা দিন থাকলে ভাল হয়।

হৈমন্তীর ইচ্ছে হল দাঁড়ায়, সুরেশ্বরের নির্লজ্জ মুখের চেহারাটা একবার দেখে, বলে : কেন? তোমার এই আশ্রমের আবার কে অসুখে পড়বে তার চিকিৎসা করতে নাকি?

সুরেশ্বর যেন আগেই কিছু ভেবে রেখেছিল, এখন তা বোঝাবার চেষ্টা করছে–এমনভাবে বলছিল, আমি একজন ডাক্তারের খোঁজ করছি, হেম। পাটনায় উমেশবাবুকে লিখেছি, রাঁচিতে শিবনন্দনজির এক ভাই থাকেন ডাক্তার, তাঁকেও বলা হয়েছে। ভেবেছিলাম, কাগজে একটা বিজ্ঞাপন দেব–পাটনার কাগজে। কলকাতা থেকে ডাক্তার এনে লাভ হবে না, তারা এ জায়গায় থাকতে পারবে না। গগন থাকতে থাকতেই এসব ভেবেছিলাম। হয়তো এ ব্যাপারটায় এতদিনে মন দিতে পারতাম, একটা কিছু ব্যবস্থাও হত, কিন্তু হঠাৎ এই অসুখটা এসে সব গোলমাল হয়ে গেল। …আমার আর কদিন সময় দরকার।

সুরেশ্বরের কথার মধ্যে কোনও লুকোচুরি নেই, আবেগ নেই, রহস্য নেই, একেবারে সাদামাটা, সরল কাজের কথা। নিজের অসুবিধে, সমস্যা এমনকী প্রয়োজন সম্পর্কেও সে সচেতন; নিজের স্বার্থটুকু প্রকাশ করতে তার কোনও রকম সঙ্কোচ হল না।

হৈমন্তীর পক্ষে এই নির্লজ্জতা অসহ্য হল যেন। বলল, তুমি আমায় কী মনে করো?

সুরেশ্বর কোনও জবাব দিল না। হাঁটতে লাগল।

 হৈমন্তীও হাঁটছিল। বলল, তোমার সুবিধে অসুবিধে বুঝে আমায় চলতে হবে?

সুরেশ্বর কী যেন বলার চেষ্টা করল; হৈমন্তী বলতে দিল না। বিতৃষ্ণায় এবং ক্রোধে প্রায় ক্ষিপ্ত হয়ে হৈমন্তী বলল, এখানে এই এপিডেমিকের মধ্যে আমি কেন থাকব? কী লাভ আমার থেকে? যদি আজ আমার অসুখ হয়, কে দেখবে? তুমি?

সুরেশ্বর হৈমন্তীর গলার স্বরে অস্বস্তি বোধ করছিল, বলল, হেম, তুমি মাথা গরম করছ। একটু শান্ত হয়ে ভাবো। বলে সুরেশ্বর যেন হৈমন্তীকে মাথা ঠাণ্ডা হবার সময় দিল সামান্য, বলল, এই অসুখ তোমার আমার মালিনীর–এখানের যে-কোনও লোকের হতে পারে। আবার না-ও হতে পারে। আমরা কিছু জানি না। যদি আমাদের হয় তুমি দেখবে যদি তোমার হয় আমরা কি তোমায় দেখব না?

তোমরা! হৈমন্তী যেন উপহাস করে হাসবার চেষ্টা করল।

 সুরেশ্বর অপ্রতিভ হল না; বলল, আমরা ডাক্তার নই; কিন্তু চিকিৎসার ব্যবস্থা তোমার বেলায় হবে না বলেই কি তোমার মনে হয়!

অন্ধ আশ্রমের ফটকের সামনে এসে পড়েছিল ওরা।

সুরেশ্বর বলল, মনোহর, তিলুয়া, গির্জার বেলায় তুমি যথাসাধ্য করেছ। একজনকে তুমি বাঁচিয়ে তুলেছ…

তার জন্যে কি আমি তোমাদের কাছে বাঁধা পড়ে গেছি?  

না না; তা কেন! …এখন এ অবস্থায় তুমি এতগুলো মানুষের ভরসা।

তোমার অন্ধ আশ্রমের মানুষদের, তোমার।

হ্যাঁ; আমাদের।

তাতে আমার কোনও গরজ নেই। তোমার অন্ধ আশ্রমের কার কী হল, তাতে আমার কী যায় আসে?

হেম… সুরেশ্বর যেন কোনও ছেলেমানুষের মুখে বোকার মতন কোনও কথা শুনে শুধরে দেবার মতন করে হাসল, বলল, হেম, এ তোমার রাগের কথা। মানুষের জন্যে মানুষেই করে, একের রোগে শোকে অন্যে ভাবে।

আমি ভাবিনি। আমি তোমার এখানের কারও কথা ভাবি না।

তুমি তাদের জন্যে অসুখের সময় ভেবেছ।

 ওকে ভাবা বলে না। আমার কর্তব্য করেছি। উপায় ছিল না বলে করেছি।

 এভাবে কি সংসারে বাঁচা যায়?

 বাঁচার কথা উঠছে কেন! তোমার এই আশ্রম আমার সংসার নয়। হৈমন্তী রূঢ় গলায় বলল, নেহাতই আমি ডাক্তার, এখানে আর কোনও ডাক্তারবদ্যি নেই, তাই বাধ্য হয়ে আমায় আমার কর্তব্য করতে হয়েছে।

এদের জন্যে তোমার মমতা হয়নি?

না।

না?

জানি না; দুঃখ হলেও হতে পারে, কিংবা কষ্ট…।

তুমি শুধু ডাক্তারি নীতি মেনেছ?

তা ছাড়া কী! …এইসব আশ্রম-টাশ্রমে অন্ধ-টন্ধদের মধ্যে তোমার কোনও আদর্শ থাকতে পারে, বিশ্বাস থাকতে পারে। আমার নেই।

জানি, সুরেশ্বর ছোট্ট করে বলল।

হৈমন্তী মুহূর্তের জন্যে চুপ করে থাকলেও ঝোঁকের মাথায় বলল, তা হলে কি! এবার আমায় যেতে দাও।

সুরেশ্বর কোনও জবাব দিল না। কথা বলতে বলতে তারা অন্ধকারে হৈমন্তীর ঘরের কাছে এসে দাঁড়িয়েছিল। অন্ধকার হয়ে গেছে। মালিনী বাতি জ্বেলে রেখেছে বলে মনে হল, তার ঘরে বাতি জ্বলছিল, হৈমন্তীর ঘরের দরজা ভেজানো।

ঘরের সামনে এসে হৈমন্তী দাঁড়াল না, তবু মুহূর্তের জন্য তার পা থেমেছিল, যেন তার মনে হয়েছিল, সুরেশ্বর এখান থেকেই বিদায় নেবে। সুরেশ্বর গেল না, হৈমন্তীর পাশে পাশে হাঁটতে লাগল। বারান্দায় উঠে মালিনীকে দেখতে পেল না হৈমন্তী; ঘরে এসে ভেজানো দরজা খুলল। ভেতরে বাতি জ্বলছে।

সুরেশ্বর ঘরে এসে চৌকাঠের কাছে সামান্য দাঁড়াল। হৈমন্তী এগিয়ে গিয়ে টেবিলের কাছে দাঁড়িয়ে থাকল, তারপর বোধহয় খেয়াল পড়ায় বাতিটার শিস বাড়িয়ে দিল।

এপাশ ওপাশ তাকিয়ে সুরেশ্বর জানলার দিকে চেয়ারের কাছে এসে বলল, হেম, তুমি বড় উত্তেজিত হয়ে পড়েছ। শান্ত হয়ে বসো একটু। এভাবে তো কোনো কথা বলা যাবে না।

সুরেশ্বরের দিকে পিঠ আড়াল করে ছিল। তার যে উত্তেজনা রয়েছে তাতে সন্দেহ নেই, কিন্তু সুরেশ্বরকে তার ভাল লাগছিল না। মানুষটার সমস্ত ব্যবহারের মধ্যে আজ এমন এক হিসেবি, চালাক, প্রভুত্বপরায়ণ, সুবিধেবাদীর চেহারা ফুটে উঠেছে যে, হৈমন্তীর অসহ্য ঘৃণা হচ্ছিল। আশ্চর্য, এই মানুষ ভেতরে ভেতরে এত ভেবেছে : ভেবেছে হৈমন্তীকে সরিয়ে নতুন ডাক্তার আনবে, ডাক্তারের জন্যে চিঠি লিখেছে, বিজ্ঞাপন দেবার কথা ভেবেছে, সবই ঠিকঠাক প্রায়–অথচ ঘুণাক্ষরেও হৈমন্তীকে কিছু জানায়নি। নেহাত একটা রোগ বেধে গিয়ে সব গোলমাল করে দিল, নয়তো এতদিনে হয়তো সুরেশ্বরের নতুন ডাক্তার জুটে যেত। তখন বিনয় করে বলত : হেম, আমি ভেবে দেখলাম, তোমার এখানে অসুবিধে হচ্ছে, তুমি বরং কলকাতায় ফিরেই যাও।

চেয়ারে বসতে বসতে সুরেশ্বর বলল, বোসো, দুটো কথা বলি।

হৈমন্তী বসল না, বলল, আমি ঠিক আছি।

তুমি না বসলে আমার খারাপ লাগছে। বোসো।

 হৈমন্তী বাধ্য হয়ে বসল।

সুরেশ্বর অল্প সময় কিছু বলল না, পরে বলল, তুমি যখন এসেছিলে, তখন আমি তোমায় জিজ্ঞেস করেছিলাম, থাকতে পারবে? তুমি বলেছিলে, পারবে। পরে আমার মনে হয়েছিল, তুমি হয়তো শেষ পর্যন্ত থাকতে পারবে না। আমি তোমায় আগেও বলেছি, এখানে তোমার মন যদি না টানে, আমি জোর করে ধরে রাখব না। …তুমি যাবে, আমি তো তোমায় আটকাচ্ছি না। কদিন আরও থেকে যেতে বলেছিলাম। যদি না পার, থেকো না। এতে তুমি রাগ করছ কেন? অসহিষ্ণু হবার তো কোনও কারণ নেই।

হৈমন্তী চোখ তুলে না তাকিয়ে পারল না। সুরেশ্বর এমনভাবে কথা বলছে যেন হৈমন্তীর এখানে আসা, থাকা, যাওয়া–এর কোনওটাই তেমন করে গায়ে মাখার মতন নয়; সহজ একটা অঙ্ক যদি যোগে না-হয় বিয়োগ করলেই হল। কী করে, কেমন নির্বিকারভাবে একটা মানুষ এসব কথা বলতে পারে, হৈমন্তী ভেবে পাচ্ছিল না। কপালের শিরা এবং মাথায় কেমন একটা দপদপে কষ্ট হচ্ছিল।

তোমার কাছে– হৈমন্তী কী বলতে গিয়ে কথা হারিয়ে ফেলল; তার চোখের দৃষ্টি তীব্র ও সমস্ত মুখ কালশিরে পড়ার মতন কালচে হয়ে এসেছিল। নিষ্পলক কয়েক মুহূর্ত তাকিয়ে থাকার পর হৈমন্তী বলল, তোমার কাছে জীবনটা যত হাওয়া বাতাসের, আমার কাছে তা নয়।

হাওয়া বাতাসের? সুরেশ্বর আপনমনে বলার মতন করে বলল, বলে জিজ্ঞাসুর মতন তাকিয়ে থাকল। কথাটা আমি ভাল বুঝলাম না, হেম।

হৈমন্তীর গলার স্বর সামান্য খসখসে এবং তীক্ষ্ণ হয়ে এসেছিল, গলার নীচে একটি শিরা ফুলে আছে। হৈমন্তী বলল, না বুঝলে বুঝো না; আমিও তো অনেক কিছু বুঝতে পারলাম না। হৈমন্তী চোখ সরিয়ে অন্য দিকে তাকাল।

সুরেশ্বর স্থির হয়ে বসে থাকল, ভাবছিল। হৈমন্তীর শেষ কথার অর্থ সে বুঝতে পারছে। অথচ বলার মতন কিছুই যেন খুঁজে পাচ্ছে না। মাথা ধরে যাচ্ছিল। আজ সারাটা দিন কেমন ভাল লাগছেনা,শরীরটা ম্যাজম্যাজ করছে।

হৈমন্তী বলল, তোমার অন্ধ-সেবা তোমার সুখ, আমার কিছু নয়। তুমি আমায় কেন তোমার ছকের খুঁটি করেছিলে আমি জানি না।

সুরেশ্বর আহত হল। তার চোখে ক্ষণিকের জন্য আঘাত এবং বেদনার, মুখে বিষণ্ণতার ময়লা দাগ ফুটল। এই অভিযোগ সত্য হোক না হোক, তার বলার কিছু নেই। কিন্তু হেম যেভাবে কথাটা বলছে, সেভাবে ভাবতে সুরেশ্বরের কষ্ট হচ্ছিল। সুরেশ্বর অনুচ্চ, দুঃখিত স্বরে বলল, আমার ভুল আমি মেনে নিয়েছি, হেম। তবে তুমি যে কেন ও কথাটা বললে, আমি বুঝতে পারলাম না। আমি কি তোমায় সত্যিই ছকের খুঁটি করেছিলাম?

আর কী! হৈমন্তী বাঁ পাশের গলা টান করে বলল, ভঙ্গিটা দুঃখের অথচ উপহাসের।

দুজনেই নীরব হয়ে গেল তারপর। ঘরের মধ্যে কেমন জনহীনতার নিস্তব্ধতা সৃষ্টি হচ্ছিল, বাতির আলো ফ্যাকাশে সাদা, শীত ক্রমশ ঘন হয়ে উঠছে, কখনও হৈমন্তীর, কখনও সুরেশ্বরের দীর্ঘ নিঃশ্বাস শোনা যাচ্ছিল। নিঃসম্পর্কের মতন, অপরিচিতের মতন দুজনে বসে থাকল।

অবশেষে সুরেশ্বর বলল, হেম, আমি তোমায় ছকের খুঁটি করব, একথা আমি ভাবিনি কখনও। আমার মনে হত, তুমি অল্প বয়সে মানুষের দুঃখের দিক দেখেছ, নিজেও সেই অসহায়তার স্পর্শ পেয়েছ, হয়তো তুমি সাধারণ সংসারের বেড়ার বাইরে আসতে আপত্তি করবে না।

হৈমন্তী কোনও জবাব দিল না। মনে হল বলে, তুমি কী ভেবেছিলে সেটা তোমার ব্যাপার, আমার নয়। আমি কখনও তোমায় বলিনি, আমি সাধারণ সংসারের বাইরে যেতে চাই। আমি বলিনি, আমি তোমায় তেমন কিছু অনুমান করতেও দিইনি। অথচ তুমি আমায় এমন স্পষ্ট করে কোনওদিন বুঝতে দাওনি যে, আমায় তোমার শুধুমাত্র অন্ধ হাসপাতালের ডাক্তার হয়ে থাকার জন্য দরকার। কবে আমি অসুখে ভুগেছি, দুঃখে পড়েছি–তার জন্য আমার সমস্ত জীবন তোমার এই আশ্রমের অন্ধ-আতুরের সেবায় ব্যয় করতে হবে। কেন? কী করে তোমার মনে হল, আমার জীবন তোমার শখ মেটাবার সামগ্রী? বেশ, শখ না বললুম, তোমার অভিমানে লাগবে, বরং তোমার আদর্শই বলি, তোমার আদর্শের জন্য আমার জীবনটাকে তুমি লাগাম পরিয়ে তুলি এঁটে ছুটিয়ে দিতে পার না। আমি আলাদা, আমার মন আলাদা, আমি তোমার মতন অন্ধ কোলে করে জীবন কাটাতে চাই না। …তুমি তো আমার সঙ্গে প্রবঞ্চনা করেছ, তুমি কোনওদিন আমায় স্পষ্ট করে বলোনি, আমায় আর ভালবাস না, এ-ভালবাসায় তোমার সুখ নেই। আমাদের মতন সাধারণ মানুষের ভালবাসাবাসিতে তোমার সুখ না থাকতে পারে, কিন্তু কেন তুমি স্পষ্ট করে আগে বললে না? কী হিসেবে তুমি ধরে নিলে, তোমার সুখ আমার সুখ হবে? তোমার ইচ্ছে আমার ইচ্ছে হবে? তোমার সাধ মেটাবার জন্যে আমার জীবনটা নষ্ট করতে হবে কেন? আসল কথা কী জানো, সেই যে কথায় বলে–যে রাঁধে সে কি চুল বাঁধে না, তেমনি যে অন্ধ হাসপাতাল করে, গরিব দুঃখীদের আশ্রয় দেয় সে কী আর নিজের জন্যে ছোট একটু ঘর বাঁধতে পারে না? পারে। দয়া ধর্ম সংসারে অনেক লোক করেছে, হাসপাতাল করতে বাড়ি ঘর টাকা অনেকেই দিয়েছে, যদি বলো জীবন উৎসর্গ তাও অনেকে করেছে, কিন্তু তার জন্যে তাদের নিজের একটু ঘর রাখতে আটকায়নি। …আমার বয়েস হয়েছে, বেশ বুঝতে পারি, আমায় তুমি তোমার আশ্রমের জন্য প্রত্যাখ্যান করোনি, অন্য কোনও কারণ আছে, গগন যা বলছিল। কিন্তু সেটা কী, আমি জানি না, তুমি গোপন রেখেছ।

.

হৈমন্তী অন্য দিকে মুখ ফিরিয়ে স্থির অথচ শূন্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে এত কথা ভাবছিল। সুরেশ্বরও অনেকক্ষণ অন্য চিন্তা করছিল। শেষে হৈমন্তীর দিকে তাকাল, তাকিয়ে থাকল কিছু সময়, শেষে কোমল করে ডাকল, হেম।

হৈমন্তী শুনেও শুনতে পেল না।

সুরেশ্বর অপেক্ষা করল : পরে বলল, আমি তোমায় আমার স্বার্থের জন্যে চেয়েছিলাম কি না– জানি না; তবে একটা কথা ঠিক, আমি ভাবতাম তুমি আমার বড় সহায় হবে।

হৈমন্তী সামান্য মুখ ফেরাল, তুমি অনেক কিছুই ভেবেছ; যখন যা ভেবেছ নিজের দিকে তাকিয়ে ভেবেছ। …যাক, এসব কথা আমার আর ভাল লাগছে না। ছেড়ে দাও।

সুরেশ্বরের মনে হল উত্তেজনার শেষে হৈমন্তী ক্লান্ত হয়ে পড়েছে। তার মুখে চোখে কেমন অবসন্ন ভাব ফুটে উঠেছিল। হয়তো আরও কিছু বলার ছিল সুরেশ্বরের, অন্তত বলতে পারলে ভাল হত, অথচ বলতে ইচ্ছে হচ্ছিল না। চুপচাপ বসে থাকল সুরেশ্বর, অশান্তির মতন লাগছে, কোথাও যেন কোনও গভীর কষ্ট থেকে গেল, বলা গেল না, বলা হল না; সম্ভব হল না।

হৈমন্তী হঠাৎ বলল, তুমি যা চাও এখানে সব পেয়েছ, আমি কিছুই পাইনি। … কিন্তু এ বয়সে তা নিয়ে ঝগড়া করে লাভ কী!

আমি কি চেয়েছি, হেম? ।

সুরেশ্বরের গলার স্বরে যে কাতরতা ছিল, অর্থ ছিল হৈমন্তী তা শুনল, কিন্তু অনুভব করল না। বরং বিরক্ত হল। অনেক দিন থেকে তার মনে হয়েছে কথাটা সুরেশ্বরকে বলবে; বলবে কারণ নিজের সম্পর্কে সুরেশ্বরের বড় বেশি মোহ। হৈমন্তীর ইচ্ছে হল বলে: তুমি প্রতিষ্ঠা, সম্মান চেয়েছ; তুমি কর্তৃত্ব চেয়েছ; তোমার মধ্যে ক্ষমতা পাবার কাঙালপনা আছে; এই আশ্রমে তোমার আধিপত্য আমি দেখেছি। …সাধারণ মানুষের জগতে তোমার এ সব আশা মিটত না, তুমি ব্যর্থ হতে। সেই ভয়ে তুমি পালিয়ে এসেছ, পালিয়ে এসে এইবুনো জংলি দেশে নিজের জগৎ গড়েছ, সাধ আশা মেটাচ্ছ। তোমার সাধ্য ছিল না, খোলা সংসারের মাঠে ময়দানে দাঁড়িয়ে এত কিছু পাও। তুমি ভীরু, নিজের সঙ্গে নিজেকে ঠকিয়ে আজ সান্ত্বনা পেয়ে বেঁচে আছ।

এত কথার কিছুই হৈমন্তী বলল না। বরং শত দুঃখের মধ্যেও কেমন ম্লান হেসে, ঈষৎ বিদ্রুপের গলায় বলল, কেন, তোমার সেই বড় সুখ।

সুরেশ্বর স্থির শান্ত হয়ে বসে থাকল। বিদ্রুপে সে আহত হয়েছে কি না বোঝা গেল না।

কিছুক্ষণ আর কোনও কথা হল না।

সুরেশ্বর অবশেষে উঠে দাঁড়াল। গগনকে একটা জবাব দিতে হবে চিঠির।

আমি দিয়ে দেব।

 আমারও একটা চিঠি দেওয়া উচিত।

দিও।

 কী লিখব?

 তোমার যা খুশি হয় লিখো।

সুরেশ্বর আস্তে আস্তে ঘরের বাইরে এল। বাইরে এসে অনুভব করল তার খুব শীত করছে। শীতে সর্বাঙ্গ কাঁটা দিয়ে উঠেছে, গা কাঁপছে, ঠোঁট থরথর করছিল। দাঁতে দাঁত চাপল সুরেশ্বর। মাথাটা ধরে গেছে বেশ।

সুরেশ্বর দ্রুত পায়ে নিজের ঘরে যাবার চেষ্টা করছিল।

.

২৭.

পরের দিন সকালে মালিনী ছুটতে ছুটতে এল, মুখে থমথম করছে উদ্বেগ, দু চোখে ব্যাকুলতা; এমন উদভ্রান্তের মতন এসেছে যে তার কাঁধের ওপর কাপড় নেই, বুকের পাশ থেকেও শাড়ি পড়ে গিয়েছিল, আঁচলটা কোনও রকমে দুহাতে জড়ো করে ধরে আছে।

হেমদি, দাদার খুব জ্বর, ছুটতে ছুটতে এসে মালিনী বলল।

জ্বর! হৈমন্তীর বুকের কোথায় যেন ভয়ংকর একটা ভয়ের ঘা লেগে হৃৎপিণ্ড ধক করে উঠল, উঠে দোলকের মতন ভয়ে দুলতে লাগল। বিমুঢ় দৃষ্টিতে কয়েক পলক তাকিয়ে থেকে হৈমন্তী ভীত গলায় বলল, জ্বর! কখন জ্বর এল?

রাত্তির থেকে, মালিনী বলল।

হৈমন্তীর হাত-পা যেন কাঁপছিল সামান্য। মালিনীর বিহ্বলতা তাকে ভীত করেছিল। কিছু খেয়াল না করেই বলল, কত জ্বর?

কত জ্বর মালিনী জানে না। বলল, গা বেশ গরম।

তুমি দেখেছ?

মাথা নাড়ল মালিনী, দেখেছে। তার ধারণা, গা পুড়ে যাচ্ছে।

হৈমন্তী হাসপাতালে যাবার জন্যে ধীরে-সুস্থে তৈরি হচ্ছিল। আজকাল তাড়াতাড়ি হাসপাতাল যাবার দরকার হয় না, রোগীই আসেনা প্রায়। কয়েক মুহূর্ত কেমন যেন বিমূঢ়তার মধ্যে কাটল; তারপর স্টেথস্কোপটা খুঁজে নিয়ে হৈমন্তী বলল, চলো দেখি।

বারান্দায় এসে হৈমন্তী শুধোল, কী করছে? শুয়ে আছে?

বিছানায় বালিশ হেলান দিয়ে বসেছিলেন, মালিনী বলল। এতক্ষণে যেন খেয়াল হওয়ায় কাপড়ের অগুছোলো ভাবটা সামলে নেবার চেষ্টা করল মালিনী।

হৈমন্তীর মনে হল, জ্বরটা হয়তো তা হলে তেমন বেশি নয়; বেশি হলে কি বসে থাকতে পারত। কী হল হঠাৎ? মনোহর, বুড়ো তিলুয়ার মতন কিছু যদি হয়–অশুভ চিন্তাটা শিখার মতন যেন দপ করে জ্বলে উঠে তখন থেকে কাঁপছে। কথাটা ভাবতে সর্বাঙ্গ অসাড় হয়ে আসছিল।

মাঠে নেমে দ্রুত পায়ে হাঁটতে হাঁটতে হৈমন্তী বলল, গায়ে মুখে কিছু দেখলে?

না।

কিছু বলল? কোনও কষ্টটষ্ট?

মাথায় যন্ত্রণা, গায়ে হাতে ব্যথা।

হৈমন্তী আর কিছু জিজ্ঞেস করল না। তার কপালে কি শেষ পর্যন্ত এখানে আটকে যাওয়া আছে? কাল রাত্রে সে স্থির করে ফেলেছিল, সপ্তাহ দুয়েকের বেশি আর সে থাকবে না। আর নয়। এই পনেরো বিশ দিনের মধ্যে সুরেশ্বর যদি পারে অন্য ব্যবস্থা করে নিক। আজ গগনকে চিঠি লিখবে বলেও ঠিক করেছিল, অথচ এ কী বাধা এসে জুটল!

মালিনী পাশে পাশে যাচ্ছিল; যেতে যেতে কিছু ভাবছিল, কাঁদো কাঁদো গলায় বলল, আমার মাথা খুঁড়তে ইচ্ছে করছে। এত লোক থাকতে দাদারই শেষ পর্যন্ত অসুখটা হল, হেমদি? কী হবে এখন কে জানে!

মালিনীর ছেলেমানুষি আকুলতায় কান দেওয়া উচিত নয়, তবু হৈমন্তী ভাবল : ভাবল সুরেশ্বরের যদি কিছু হয় তবে এই আশ্রমের কী হবে? কী আর থাকবে? সুরেশ্বরকে বাদ দিয়ে মালিনীদের কল্পনা করা যায় না। একটা মাত্র মানুষ অথচ তার অস্তিত্বই যেন সব। হৈমন্তীর কেমন যেন বেদনা বোধ হচ্ছিল। মন থেকে এই চিন্তাটা সরিয়ে দেবার জন্যে এবং হতাশা দমনের চেষ্টায় হৈমন্তী বলল, অত ব্যস্ত হবার কী আছে, চলো আগে দেখি। জ্বর হলেই কি খারাপ ভাবতে হবে!

মালিনী বিড়বিড় করে কিছু বলল, তার কথা ভাল করে শোনা গেল না, মনে হল সে ভগবানের শরণাপন্ন হচ্ছে। ডান হাতের আলগা মুঠো বার বার কপালে ঠেকাতে লাগল, ঠোঁট নড়ছিল।

সুরেশ্বরের ঘরের বারান্দায় পা দেবার সময় হৈমন্তীর সর্বাঙ্গ কেঁপে উঠল, হঠাৎ কেমন হাতে পায়ে অসাড় ভাব এল, বুকের মধ্যে ধক ধক করছিল। ভরতু বোকার মতন দাঁড়িয়ে আছে দরজায়।

সুরেশ্বর বিছানায় শুয়ে; গায়ের কম্বলটা গলা পর্যন্ত ঢাকা। পায়ের শব্দে চোখ খুলে তাকাল।

 হৈমন্তী সুরেশ্বরকে লক্ষ করল। লক্ষ করার সময় তার দুরকম মনোভাব হল। প্রথম তার মনে হল, সে যে-সুরেশ্বরকে দেখছে, সেই সুরেশ্বর তার অতি অন্তরঙ্গ ও প্রিয় ছিল, যার সঙ্গে তার সম্পর্ক ভেঙে যাবার পরও কোথাও যেন একটা বন্ধন আছে, দায়িত্ব। এই সুরেশ্বর তাকে ব্যাকুল, বিচলিত ও ভাবপ্রবণ করে তুলেছিল। পরে, সামান্য পরে, বিছানার মাথার কাছে এসে পিঠ নুইয়ে সুরেশ্বরের মুখের দিকে তাকিয়ে থাকার সময় তার চোখের ওপর থেকে কয়েক মুহূর্তের আগেকার সুরেশ্বর যেন কোথায় অদৃশ্য হল, পরিবর্তে সে অসুস্থ এক রোগীকে দেখতে পাচ্ছিল। মিলিয়ে আসা ধোঁয়ার মতন পূর্বের আবেগ হয়তো ছিল সামান্য, কিন্তু এখন তা হৈমন্তীকে অত কাতর অথবা বিহ্বল করছিল না। সুরেশ্বরের মুখ লক্ষ করতে করতে হৈমন্তী হাত বাড়াল, কখন জ্বর এল?

মাঝরাতে– সুরেশ্বর বলল, বলে কম্বলের তলা থেকে হাত বের করে দিল।

 হৈমন্তী সযত্নে, একটু বেশি সময় নিয়ে নাড়ি দেখল। হঠাৎ এল?

কাল সারাটা দিনই শরীরটা ভাল লাগছিল না। সন্ধের দিকে খুব শীত করছিল।

 সুরেশ্বরের কপালে একবার হাত দিল হৈমন্তী, দেখল। থার্মোমিটার আছে এখানে?

না, সুরেশ্বর হাসবার মতন মুখ করল, ছিল একটা, ভেঙে গেছে।

হৈমন্তী মালিনীকে থার্মোমিটার আনতে পাঠাল। তার ঘরে থার্মোমিটার আছে, হাসপাতালে যেতে হবে না।

দেখি, বুকটা.. জড়ানো স্টেথস্কোপ খুলতে খুলতে হৈমন্তী বলল।

বুক পিঠ দেখল হৈমন্তী, জিব দেখল সুরেশ্বরের। এখনও শীত করছে?

কখনও-সখনও।

মাথার খুব যন্ত্রণা?

মাথাটা বড় ধরে আছে।

আর কী কষ্ট–?

গায়ে হাতে ব্যথা, কোমর পিঠে৷

হৈমন্তী কিছু ভাবছিল, বলল, দেখি, তোমার গা পিঠ দেখি আর-একবার।

সুরেশ্বর সকালে গায়ে জামা দিয়েছিল, জামাটা তুলল; হৈমন্তী নিজের হাতে সুরেশ্বরের গেঞ্জি তুলে গা পিঠ খুঁটিয়ে দেখল। দেখার সময় অকস্মাৎ তার মনে হল, সুরেশ্বরের গায়ের চামড়ায় যেন বয়সের নিষ্প্রভ এসেছে, অনেক ময়লা হয়ে গেছে রং।

সুরেশ্বর আবার গুছিয়ে গায়ে ঢাকা নিয়ে বসল।

হৈমন্তী বলল, দেখো, আবার চিকেন পক্স না হয়!

 চিকেন পক্স!

দু তিনটে দিন না গেলে বোঝা মুশকিল। নয়তো, আর কিছু না; সর্দি-জ্বরের মতন মনে হচ্ছে।

সুরেশ্বর কয়েক মুহূর্ত হৈমন্তীর চোখের দিকে তাকিয়ে থাকল। পরে বলল, এখানে আমার জ্বর জ্বালা আগে কখনও হয়নি। গত বছরে একবার হাঁপানির মতন হয়েছিল। কাল থেকেই কী রকম হাঁপ ধরছে, হাঁপানিটা আবার হবে না তো?

হৈমন্তী হ্যাঁ-না কিছু বলল না। মুখ দেখে মনে হচ্ছিল, এখন সে অনেকটা নিশ্চিন্ত। মালিনী যে রকমভাবে গিয়ে খবর দিয়েছিল তাতে ভয় পাবারই কথা।

সুরেশ্বর জানলার দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে নিশ্বাস ফেলে মুখ ফেরাল সামান্য; বলল, হেম, আমার সত্যি লজ্জাই করছে; জ্বরটা আসার পর কেমন মনে হয়েছিল তোমায় আবার বুঝি বিব্রত করতে হল…। কিছুই তো বলা যায় না; জ্বর এসেছে দেখে দুশ্চিন্তাই হয়েছিল। এখন ভালই লাগছে; সর্দিজ্বর এমন-কিছু নয়।

হৈমন্তী কথাগুলো শুনল। তার মনে হল, সুরেশ্বর এখন বিব্রত হবার কথাও ভাবছে। কেন? সে কি ভেবেছিল, তেমন কিছু হলে হৈমন্তী আটকা পড়বে? হৈমন্তীকে তবে আর আটকে না রাখার ইচ্ছেই হয়েছে সুরেশ্বরের।

হৈমন্তী কী স্থির করেছিল সে কথা এখানে তোলার প্রয়োজন মনে করল না। সুরেশ্বরের এই জ্বর, এখন পর্যন্ত যা মনে হচ্ছে, সাধারণ; এই জ্বরের জন্য তার আটকে পড়ার কোনও কারণ নেই। গগনকে অনায়াসেই হৈমন্তী কাল-পরশু নাগাদ চিঠি লিখতে পারবে।

সুরেশ্বর বলল, আমি আজই গগনকে চিঠি লিখব ভেবেছিলাম। …তুমি শীঘ্র যাচ্ছ–ওকে জানিয়ে দিতাম।

হৈমন্তী মুখ ফিরিয়ে সুরেশ্বরকে দেখল। তা হলে তুমিও ভেবে নিয়েছ শেষ পর্যন্ত! যাক্, ভাল; ভালই হল। এখানে কৌতুক বা পরিহাস করা শোভা পায় না নয়তো হৈমন্তী হয়তো শুধোত, তোমার ডাক্তারের ব্যবস্থা তা হলে হয়ে গেছে!

কাল সুরেশ্বর বলল, আমি তোমায় আরও কয়েকটা দিন থাকার কথা বলছিলাম। পরে ঘরে ফিরে এসে আমার মনে হল, সত্যিই তোমাকে আর থাকতে বলা উচিত না।

হৈমন্তী অন্য দিকে তাকিয়ে ছিল, সরাসরি মুখ ফিরিয়ে সুরেশ্বরকে দেখল না–আড়চোখে চকিতের জন্য একবার দেখে নিল। সুরেশ্বর কি অভিনয় করতেও শিখেছে! বরং কাল, সুরেশ্বরের স্বার্থচিন্তাও এমন কটু লাগছিল না হৈমন্তীর; এখন লাগছে। এখন মনে হচ্ছে, সুরেশ্বর বিনীত হবার এবং উদার হবার চেষ্টা করছে। এই উদারতার মধ্যে কৃত্রিমতা, বিনয়ের মধ্যে অক্ষমতা আছে। কী প্রয়োজন ছিল তোমার এসব কথা বলার! তোমার কী মনে হল, না হল, তাতে আমার যাওয়া আটকাচ্ছে না। আমি ফিরে যাচ্ছি। নিতান্ত তোমার মুখরক্ষা করার জন্য আরও দশ-পনেরোটা দিন আছি। তারপর আর নয়।

সুরেশ্বর বালিশে ভর দিয়ে আধশোয়া হল। বলল, কাল তুমি ঠিকই বলেছ, হেম। এখানে থাকলে তোমার অসুখ-বিসুখ হতে পারে; হলে সে দায়িত্ব আমার ঘাড়ে এসে পড়বে। যদি কিছু হয়। এ-অসুখের কিছুই যখন ঠিক নেই তখন তোমার জীবনের দায়িত্ব আমার নেওয়া উচিত নয়। …আমি যা দিতে পারব না, তা আর নেব না।

জানলার কাঠ ছুঁয়ে রোদের পা সামান্য এগিয়েছে, দু-তিনটে চড়ুই একে অন্যের গা ঠুকরোতে ঠুকরোতে এবং কিচমিচ শব্দ করতে করতে ঘরের মধ্যে ঢুকে পাক খেয়ে আবার ফরফর করে উড়ে গেল। যাবার সময় কার একটা পালক খসে গেল, পালকটা বাতাসে ভাসতে ভাসতে সুরেশ্বরের বিছানার ওপর এসে পড়ল।

সুরেশ্বরের শেষ কথাগুলো হৈমন্তীর কানে লাগল, যেন অনেক কিছু লেখার পর রাবার দিয়ে আর সব মুছে শেষের কয়েকটা কথা রেখে দেওয়া আছে, আর ক্রমাগত কেউ তার উপর পেনসিল বুলিয়ে সেটা মোটা করছে। সুরেশ্বর কী বলতে চাইল? জীবনের দায়িত্বের কথাটা তুলে সে কি খুব সাবধানে এবং লুকিয়ে একটা খোঁচা দিল হৈমন্তীকে? সে কী বোঝাতে চাইল : সুরেশ্বর শুধু জীবন নয়, আরও কিছু–যেমন ভালবাসা দিতে পারবে না বলে ভালবাসা নেবে না!

নিজের ওপর হঠাৎ কেমন বিরক্ত হল হৈমন্তী। মনে হল, সে ছেলেমানুষের মতন যা-তা ভাবছে। ভালবাসার কথা আর ওঠে না। কীসের ভালবাসা! সুরেশ্বরকেই কি আর ভালবাসে হৈমন্তী? না। দেওয়া-নেওয়ার কথা অবান্তর।

হৈমন্তী বিরক্তির মধ্যেই বলল, আমি যাবার মোটামুটি সময় ঠিক করে ফেলেছি।

 সুরেশ্বর যেন কথাটা শুনেও গা করল না। বলল, হেম, আমি কাল তোমায় বলেছিলাম–তোমায় আমি ছকের খুঁটি করিনি। রাত্রে আমি ভেবে দেখেছি, তুমি অন্যায় কথা বলোনি, ঠিকই বলেছ। সত্যিই ততা, আমার স্বার্থ ছাড়া তোমায় আমি আনব কেন? সামান্য চুপ করল সুরেশ্বর, পরে বলল, কাল তোমার অনেক কথাই আমার বড় লেগেছিল, হেম। কী জানি তুমি বলেছিলে বলেই লেগেছিল। মনটা বড় খারাপ হয়ে গিয়েছিল। …যাকগে–ভালই হয়েছে। নিজেকে মাঝে মাঝে অন্যের চোখ দিয়েও দেখতে হয়। সুরেশ্বর এবার হাসবার চেষ্টা করল। সে ক্লান্ত হয়ে পড়ছিল, কথার শেষে বারকয়েক হাঁপাল, সর্দিতে গলা ভারী হয়ে আছে।

হৈমন্তী অস্বস্তি বোধ করে উঠে দাঁড়াল। মালিনী থার্মোমিটার আনতে গিয়ে হারিয়ে গেল নাকি! থার্মোমিটার খুঁজে পাচ্ছে না? কি মুশকিল, হৈমন্তী তো বলেই দিয়েছে টেবিলের ওপর সেলাই করার বাক্সের মধ্যে থার্মোমিটারটা আছে। তবু পাচ্ছে না! কথাটা কানে শুনেছে কি না মালিনী কে জানে! ওই রকমই ওর স্বভাব। বা, কে জানে থার্মোমিটার আনার ফাঁকে আরও সাত জায়গায় সুরেশ্বরের অসুখের খবরটা পৌঁছে দিয়ে আসছে কি না! হৈমন্তী অস্থির হয়ে জানলার দিকে গেল।

হৈমন্তীর চাঞ্চল্য লক্ষ করছিল সুরেশ্বর। বলল, তোমার দেরি হয়ে যাচ্ছে, না?

হাসপাতালে যাচ্ছিলাম। জানলার কাছ থেকে হৈমন্তী বলল, গলার স্বর অনুচ্চ এবং বিরক্তি সত্ত্বেও কেমন উদাসীন।

তা হলে তুমি যাও। মালিনী এলে আমি জ্বর দেখে তোমায় খবর পাঠাব।

দেখি আর-একটু। …রুগি-টুগিও তো আসে না বড় একটা আজকাল.. হৈমন্তী মাঠে মালিনীতে দেখতে পেল। ছুটে ছুটে আসছে। ওই তো আসছে হৈমন্তী বলল।

অল্প পরেই মালিনী এল। তার মুখ দেখে মনে হল, কী একটা অপরাধ করে ফেলেছে। হৈমন্তী হাত বাড়িয়ে থার্মোমিটার নিল, এত দেরি? বলার সময় হাতের থার্মোমিটারের খাপ দেখেই বুঝতে পারল, এই থার্মোমিটার তার নয়।

মালিনী মুখ নিচু করে অপরাধীর মতন বলল, আপনারটা হাত থেকে পড়ে ভেঙে গেল।

হৈমন্তীর রাগ করা উচিত ছিল না; তবু তার কেমন রাগ হল। হুড়োহুড়ি করে আনতে গিয়ে যে মালিনী হাত থেকে থার্মোমিটার ফেলেছে তাতে সন্দেহ নেই। এত ছটফট করার কী আছে! সুরেশ্বরের জ্বর হয়েছে তার জন্য তুমি যে একেবারে দিশেহারা হয়ে যাচ্ছ, যেন তোমার আর হাতে-পায়ে জোর নেই।

হাসপাতালের থার্মোমিটার ব্যবহার করার আগে হৈমন্তীর মন খুঁত খুঁত করল কিনা কে জানে, ধুয়ে মুছে সুরেশ্বরের দিকে বাড়িয়ে দিল।

জ্বর উঠল একশো এক। ছিটেফোঁটা বেশি; সেটা কিছু নয়।

হৈমন্তী সুরেশ্বরের দিকে আধা-আধি তাকিয়ে বলল, মালিনীর হাতে দু-একটা ওষুধ দিয়ে দিই। অল্পতেই সাবধান হওয়া ভাল। বলে মালিনীকে আসতে বলে চলে গেল। যাবার সময় সাবধান করে দিয়ে গেল, ঠাণ্ডা যেন না-লাগানো হয়।

বাইরে এসে মাঠ দিয়ে রোদে হেঁটে যেতে যেতে হৈমন্তীর এখন আর তেমন দুর্ভাবনা হচ্ছিল না। বরং কিছুক্ষণ আগে যে ভীষণ আতঙ্কের ভাবটা এসেছিল তা কেটে যাওয়ায় যেন মনস্থির করে ভাবতে পারছিল, চোখে দেখতে পাচ্ছিল। মাঠে অফুরন্ত রোদ, ঘাসের শিশির প্রায় শুকিয়ে এল, আকাশ নীল, আশ্রমের দু একজন সুরেশ্বরের ঘরের দিকে যাচ্ছে, তাদের কানে খবরটা যে ছড়িয়ে পড়েছে তাতে সন্দেহ নেই, তাঁত-ঘরের দিকে কটা অন্ধ রোদ পোয়াচ্ছে, সবজি ক্ষেতে বুঝি জল দিচ্ছে কারা, কোণাকুণি বাতাসে গন্ধ ভেসে আসছে, কয়েকটা শুকনো পাতা উড়ে আসছে, দূরে শিমূল গাছটার পাতা হয়তো।

একটা কথা ভেবে হৈমন্তীর খুব অবাক লাগছিল। সুরেশ্বর আজ আগাগোড়া কীভাবে অম্লান বদনে সব স্বীকার করে গেল। কাল তার অন্য রকম কথাবার্তা ছিল, অন্য ধরনের যুক্তি, প্রতিবাদ; এমনকী কাল সে ক্ষুব্ধও হয়েছিল, আজ সকালে একেবারে আলাদা কথাবার্তা : মনে হল, রাতারাতি পালটে গেছে। সুরেশ্বর যে রাতারাতি অন্য মানুষ হয়ে যায়নি তা ঠিকই, বা তার কথাবার্তায় এতটা পালটে যাওয়া যে স্বাভাবিক তাও নয়, তবু-হৈমন্তীর মনে হল সুরেশ্বর যতই চাপা দেবার চেষ্টা করুক খানিকটা ঘা সে খেয়েছে। আজ সকালে যা করল, তা হল অনেকটা ভদ্রভাবে বিদায়-পর্ব সারা :বচসা, তর্কাতর্কি না করে, মনোমালিন্য আরও না বাড়িয়ে কাউকে বিদায় দেবার সময় আমরা যেমন বিনয় করে আচ্ছা আচ্ছা করি সে রকম। সুরেশ্বরের এটা স্বভাব; সে বিরোধের শেষ পর্যন্ত যেতে চায় না, তার আগেই প্রতিপক্ষকে এড়িয়ে যায়। এক্ষেত্রে, হৈমন্তীর ধারণা, সুরেশ্বর তার স্বভাব মতন কাজ করেছে। তা ছাড়া সে বুঝতে পেরেছে জোর করে বলার মতন তার কিছু নেই, এমন একটাও যথার্থ কারণ সে দেখাতে পারবে না যা তার আচরণকে সমর্থন করবে।

হৈমন্তীর কেমন অদ্ভুত এক সুখ এবং দুঃখ হচ্ছিল। সুখ হচ্ছিল এই ভেবে যে, সুরেশ-মহারাজকে সে আহত ও ক্ষুণ্ণ করতে পেরেছে; শিক্ষা না হোক অন্তত বিব্রত ও কুণ্ঠিত করতে পেরেছে। তবু তো সব কথা-হৈমন্তীর মনে যা ছিল, যা ভাবে হৈমন্তী বলতে পারল না; নোকটার মনে যে আত্মমোহ, ভীরুতা, অহংকার, আধিপত্যের ভাব ছিল তা তাকে চিনিয়ে দেওয়া গেল না। দিলে ভাল হত। সে যে সঙ্গে সঙ্গে চিনে নিত তা নয়, তবু কাঁটার মতন বিধত। সেই জ্বালা সে ভোগ করত।

আবার হৈমন্তীর দুঃখ হচ্ছিল এই ভেবে যে, মানুষটা তার নিরাসক্ত, দৃঢ়, আত্মম্ভর চরিত্রবা চরিত্রের সেই ভান নষ্ট করে হঠাৎ যেন নিজেকে নুইয়ে দিল। বলতে গেলে, হৈমন্তী বেশ বুঝতে পারছিল, তার ঘায়ে সুরেশ্বর নুয়ে পড়েনি, ইচ্ছে করে নিজেকে অনেকটা নুইয়ে দিয়ে হৈমন্তীর সন্তোষ বিধান করল যেন। এরকম না করলেই সুখী হত হৈমন্তী। এক এক সময় এত সহজে নুয়ে পড়া দেখে মনে হয়, সুরেশ্বর যেন প্রতিপক্ষকে অযোগ্য মনে করে লড়ল না, মাথা অবনত করে উপহাস করল।

হৈমন্তী হাসপাতালের সামনে এসে দাঁড়িয়ে ছিল। রোগী দেখতে পেল না বারান্দায়। ফাঁকা পড়ে আছে সব। এই দৃশ্যও তার কেন যেন মনঃপূত হল না।

যুগলবাবুও বাইরে চিন্তিত মুখে দাঁড়িয়ে। হৈমন্তী বুঝল, সুরেশ্বরের সংবাদের জন্য অপেক্ষা করছে।

 বিকেলের পর অবনী এল।

 হৈমন্তী বলল, আসুন। এ কদিন কী হল। কাজ?

না অবনী মাথা নাড়ল হেসে, কাজের জন্যে অতটা নয়, গাড়িটা বিগড়ে গিয়েছিল।

ও গাড়ি আবার খারাপ হয় নাকি? হৈমন্তী হেসে বলল।

ঘরে এসে বসতে বসতে অবনী বলল, সব গাড়িই বিগড়োয়।

নিজের হাতেই বাতি জ্বালিয়ে নিল হৈমন্তী। সন্ধে হয়ে আসছে।

 তারপর, কী খবর বলুন? অবনী শুধোল।

আপনাদের সুরেশ মহারাজের জ্বর, হৈমন্তী বলল।

জ্বর। অবনী চমকে উঠতে গিয়েও তেমন চমকাল না। হয়তো হৈমন্তীর গলার স্বরে কোনও গুরুত্ব না থাকায় এবং হালকা করে কথাটা বলায় অবনী অতটা আতঙ্কিত হল না। তবু সে উদ্বেগের দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকল।

হৈমন্তী বলল, ভয়ের কিছু নয়; সর্দিজ্বর বলেই মনে হচ্ছে।

 অবনীর চমকিত ভাবটা কাটল; চোখের পলক ফেলে দৃষ্টি হৈমন্তীর চোখের তলা থেকে নামাল।

 সর্দিজ্বর।

তবে বলা যায় না, চিকেন পক্সও হতে পারে… এখনও কিছু বোঝা যাচ্ছে না।

কেমন আছেন এখন?

ভাল। দুপুরে জ্বর সামান্য বেড়েছিল, এখন বিকেলে দেখলাম, কমেছে।

কত?

 একশো।

 অবনী চুপ করে থাকল।

আপনি আমায় যা অপদস্থ করেছেন- হৈমন্তী সামান্য হেসে বলল, তিরস্কারও যেন রয়েছে।

 অপদস্থ! কেন?

গগনকে আপনি চিঠি লিখেছেন?

 লিখেছি। অবনী অবাক হচ্ছিল।

 গগন আবার ওকে লিখেছে। … ও ভাবল, আমি গগনকে লিখেছি।

না, আমি লিখেছিলাম। …এখানে খুব প্যানিক। রোজই দু-চারটে করে মারা যাচ্ছে শুনি। অবনী চিন্তিত মুখে বলল।

আপনি কী যে লিখলেন, ও ভাবল–আমি এখান থেকে পালিয়ে যাবার জন্যে ব্যস্ত হয়ে গগনকে লিখেছি। হৈমন্তী যেন এখনও এই বিষয়ে তার ক্ষুব্ধ ভাবটা সম্পূর্ণ ভুলতে পারেনি।

অবনী হৈমন্তীকে দেখতে দেখতে এবার পকেট থেকে সিগারেট বের করল। সিগারেট ধরিয়ে নিয়ে বলল, গগন আপনাকে কলকাতায় পাঠিয়ে দিতে লিখেছে?

হ্যাঁ।

আমি তাই লিখেছিলাম।

হৈমন্তী এবার কৌতুক করেই বলল, গগন আবার আপনাকে আমার গার্জেন করে দিয়ে গেছে, কিছু তো আর বলা যাবে না।

অবনী কৌতুকটা উপভোগ করল হয়তো, গার্জেনের রেসপনসিবিলিটি বড় বেশি। …কিন্তু তা নয়। আপনি কি অবস্থাটা সব জানেন?

কী?

অবনী এবার আর হাসল না, বলল, এখান থেকে মাইল চার দূরে একটা গ্রাম আছে, মোটামুটি বড়ই, সেই গ্রামে দিন তিনেকের মধ্যে পাঁচজন মারাই গেছে, ভুগছে যে কত কে জানে! …ব্যাপারটা উড়িয়ে দেবার নয়। বিজলীবাবুর কাছে আমি খবরাখবর পাই, তাঁর বাসের ড্রাইভার কন্ডাক্টররা তো সারাটা তল্লাটে রোজ ঘুরছে, তাদের খবরে রিলাই করা যায়। …আপনি জানেন না কোনও কোনও গ্রাম থেকে তোক পালাচ্ছে।

হৈমন্তী শুনল। অবনীর উদ্বেগ অকারণ নয় হয়তো, কিন্তু গগনকে কি এইসব কথাও লিখেছে নাকি! সর্বনাশ, তা হলে বলা যায় না–কোনও রকমে মার কানে কথাটা উঠলে, হয় পত্রপাঠ ফিরে যাবার টেলিগ্রাম না হয় গগনকেই মা পাঠিয়ে দেবে তাকে নিয়ে যেতে। হৈমন্তী চোখ তুলে বলল, সর্বনাশ, আপনি কি গগনকে একথা লিখেছেন?

খানিকটা লিখেছি, অবনী হেসে ফেলে জবাব দিল।

দুপলক অবনীর মুখের দিকে তাকিয়ে থেকে হৈমন্তী বলল, তা-ই। …এখন বুঝতে পারছি, গগন কেন অত তাড়া দিয়েছে।

অবনী কথা বলল না, ধোঁয়া গিলে আস্তে আস্তে নাক মুখ দিয়ে বের করতে লাগল।

 খানিকটা চুপচাপ থাকার পর হৈমন্তী বলল, আমি তো যাচ্ছি।

অবনী তাকিয়ে থাকল, খুব একটা বিস্মিত হবার মতন কিছু যেন নয়, অথচ বিশ্বাস-অবিশ্বাসের দ্বিধা রয়েছে দৃষ্টিতে। যাচ্ছেন?

হ্যাঁ মাথা নাড়ল হৈমন্তী।

কখন?

দিন পনেরোর মধ্যেই। বলে হৈমন্তী আরও কিছু বলার জন্যে ঠোঁট ভেঙে তাকিয়ে থাকল; পরে কী মনে করে কিছু বলল না।

সুরেশ্বরবাবু জানেন?

হ্যাঁ–জানেন।

কিছু বললেন না?

প্রথমে আরও কিছু দিন থাকার কথা বলেছিল, পরে আর বলেনি। হৈমন্তী সামান্য বাঁকা হয়ে টেবিলের দিকে ঝুঁকে বাতির শিষ ঠিক করতে লাগল। আলো তার মুখে, চোখ নাক চিবুক আলোময় হয়েছিল, চুলের খোঁপা, ঘাড় পিঠ ছায়ায়। সোজা হয়ে বসতে বসতে এবার বলল, আগে যাবার কথা আমি কিছু ঠিক করিনি, বলিওনি; কিন্তু পরে ওর ভাবসাব দেখে আমার খারাপ লাগল। আরও আগে চলে যাওয়া উচিত ছিল, নেহাত– হৈমন্তী থেমে গেল, খানিকটা ঝোঁকের মাথায়, খানিকটা উন্মাবশে সে কথাটা বলে ফেলেছে। কাল থেকেই কথাটা সে ভুলতে পারছে না : সুরেশ্বর কী করে ধরে নিল হৈমন্তী প্রাণভয়ে ভীত হয়ে পালাতে চাইছে, কেনই বা সুরেশ্বর ঘুণাক্ষরেও হৈমন্তীকে নতুন ডাক্তার খোঁজার কথা জানায়নি! নিজেকে অন্তত এ ব্যাপারে এত অপমানিত ও আহত বোধ করেছে হৈমন্তী যে রাগ, অভিমান, অসম্মানের জ্বালা যেন কিছুতেই ভোলা যাচ্ছিল না। অন্য কাউকে কথাটা শোনানোর জন্যে তার ভেতর থেকে একটা উত্তেজনা ছিল। অবনীর কাছে নিজের ব্যক্তিগত বিষয় হৈমন্তী আগে কখনও আলোচনা করত না, পরে কখনও কখনও নিজের বিরূপতা জানিয়েছে যদিও তবু সেই বিরূপতায় সুরেশ-মহারাজ ছিল, আশ্রম ছিল সুরেশ্বর ছিল না। তারপর ভাসাভাসাভাবে সুরেশ্বরও হয়তো এসেছে–তবু স্পষ্ট করে ধরাছোঁয়ার কিছু থাকত না। ইদানীং, বিশেষ করে সেদিন, মাদাউআলের সেই ইনসপেকশান বাংলোয় অবনী যেন আর কোনও অস্পষ্টতা না রেখেই সুরেশ্বরের কথা তুলেছিল, হৈমন্তী বাধা দেয়নি, দিতে পারেনি। সেদিনের পর ব্যক্তিগত কথাটা আর চাপা রাখার চেষ্টা অকারণ; বিসদৃশ বলেই যা উচ্চকণ্ঠে ওরা–অবনী বা হৈমন্তী কথাটা তোলে না, নয়তো মনে মনে আজ আর কোনও বাধা অনুভব করে না।

আজ, এখন হৈমন্তী সুরেশ্বরের ব্যবহারের প্রসঙ্গটা উম্মাবশে হঠাৎ তুলে ফেলার পর অনুভব করল, অবনীর কাছে কথাটা পুরোপুরি বলতেও তার দ্বিধা বা সঙ্কোচ হচ্ছে না। বরং বলার বাসনা জাগছে, ভাল লাগছে। হৈমন্তী বলল, আমি তাড়াতাড়ি চলে যাই এটা ওর ইচ্ছে ছিল না। আরও কিছুদিন থাকতে বলেছিল। …আশ্রমে আবার যদি কারও অসুখ-বিসুখ করে তাই রাখতে চেয়েছিল। …যে যার নিজের দিকটাই দেখে।

অবনী হৈমন্তীর আচরণের মধ্যে উত্তেজনা এবং বিরূপতা অনুভব করতে পারছিল। কিছু বলল না।

হৈমন্তী হঠাৎ বলল, আপনাদের সুরেশ-মহারাজ নতুন ডাক্তার আনছেন।

 বললেন? অবনী যেন কথার কথা বলল।

কাল বললেন। …অনেক দিন থেকেই নাকি খোঁজাখুঁজি করছেন… হৈমন্তীর ঠোঁটের প্রান্ত কুঁচকে এল, চোখে কেমন উপহাস উপচে উঠছিল। আমাকে কেউ আর জানাননি অবশ্য, কিন্তু তলায় তলায় চিঠি লেখালেখি, বিজ্ঞাপন দেবার কথাও ভেবে রাখা হয়েছিল। নেহাত নাকি এই অসুখটা এসে পড়ায় সব গোলমাল হয়ে গেল। নয়তো, এতদিনে আমায় তাড়াতেন। কথার শেষে হৈমন্তী বিদ্রূপ করে হাসবার চেষ্টা করল, হাসল, অথচ সে হাসি করুণ দেখাল।

অবনী কী বলবে ভেবে পেল না। হৈমন্তীর কোথায় লেগেছে তা অনুমান করার চেষ্টা করে বুঝতে পারছিল : সম্মানে লেগেছে। লাগা অসম্ভব নয়। সে অক্ষম এই অপরাধে সুরেশ্বর নিশ্চয় নতুন ডাক্তারের খোঁজ করছে না, হৈমন্তীকে রাখা যাবে না বা হৈমন্তী থাকবে না বুঝেই হয়তো নতুন ডাক্তারের খোঁজ করছিল; কিন্তু হৈমন্তীকে কথাটা না জানিয়ে সুরেশ্বর ভাল করেনি। অবশ্য অবনী ভাবল, জানালেই কি হৈমন্তী প্রসন্ন হত?

হৈমন্তীকে শান্ত ও সুস্থির করার আশায় অবনী সামান্য হেসে হালকা গলায় বলল, না, আপনাকে তাড়াতেন না। ভদ্রলোক এতটা কাণ্ডজ্ঞানহীন নন। আপনি থাকবেন না বুঝেই একটা ব্যবস্থা করছিলেন আর কী!

হৈমন্তী তাচ্ছিল্যের সঙ্গে হাসার মুখ করল।

 সামান্য সময় চুপচাপ আবার। অবনী শেষে বলল, সুরেশ্বরবাবুকে একবার দেখে আসা দরকার। …চলুন, যাবেন নাকি?

চা খেয়ে যাবেন না? বসুন একটু চা করে আনছি–মালিনী বোধ হয় এদিকে নেই। হৈমন্তী বলল : সামান্য অন্যমনস্ক, বোধ হয় এতক্ষণে তার খেয়াল হয়েছে সে খুব অসন্তুষ্ট হয়ে পড়েছিল, নিজেকে সংযত করার চেষ্টা করছিল এবার।

হৈমন্তী উঠছিল, অবনী বাধা দিল, বলল, এখন থাক, দেখাটা করে আসি, এসে চা খাব। আপনি যাবেন?

মাথা নাড়ল হৈমন্তী, না। আমি বিকেলেও গিয়েছি। আপনি ঘুরে আসুন।

অবনী কয়েক মুহূর্ত অপেক্ষা করল, যেন শেষ পর্যন্ত হৈমন্তী মত বদলাতে পারে। পরে উঠে দাঁড়িয়ে বলল, আমি তা হলে ঘুরে আসি।

.

সুরেশ্বরের ঘরের বারান্দায় ছোটখাটো ভিড় ভেঙে গিয়েছে, তারা কেউ সিঁড়িতে, কেউ বাগানে, কেউ বারান্দায় অবনী এসে পৌঁছল। শিবনন্দনজি তখনও বারান্দায় দাঁড়িয়ে। অবনীর সঙ্গে চোখের পরিচয়, সরে দাঁড়িয়ে পথ দিলেন এবং নমস্কার জানালেন। অবনী মাথা সামান্য নিচু করে প্রতিনমস্কার জানাল, হাত তুলল না। কেমন আছেন সুরেশ্বরবাবু?

ভাল, শিবনন্দনজি জবাব দিলেন।

ঘরের দিকে পা বাড়াতে বাড়াতে অবনী শুনল শিবনন্দনজি বারান্দা দিয়ে নামতে নামতে কী যেন বলছেন অন্যদের : মনে হল তিনি কোনও বিষয়ে কিছু ব্যস্ত এবং ভেঙে যাওয়া ভিড়ের কাউকে কিছু বোঝাবার চেষ্টা করছেন। কাউকে কোথাও থেকে আনা না-আনার কথা বলেই মনে হল।

মাঝের ঘরে লণ্ঠন জ্বলছিল। অবনী কয়েক পা এগিয়ে এসে ডাকল, সুরেশ্বরবাবু।

পাশের ঘর থেকে সুরেশ্বর সাড়া দিল, এবং প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই মালিনী ভেতরের বারান্দা থেকে ঘরে এল। মালিনী এবাড়িতেই আছে তা হলে।

মালিনী কিছু বলল না, কিন্তু এমন ভাব করল যেন অবনীকে পথ দেখিয়ে সুরেশ্বরের ঘরে পৌঁছে দিচ্ছে।

সুরেশ্বর বিছানার ওপর উঠে বসতে বসতে বলল, আসুন।

অবনী ঘরের মাঝামাঝি এসে বলল, কী হল মশাই, আপনি আবার জ্বর বাঁধিয়ে বসলেন কেন? ..কেমন আছেন?

ভাল। জ্বর বাঁধিয়ে সুরেশ্বর যেন অপ্রস্তুতে পড়েছে, সেই রকম হাসল একটু, বলল, বসুন। মালিনী, ওই চেয়ারটা… সুরেশ্বর মালিনীকে চেয়ার এগিয়ে দিতে বলছিল, তার আগেই অবনী নিজে চেয়ার টেনে নিল।

ঠাণ্ডা-টাণ্ডা লাগিয়েছেন খুব… অবনী বসতে বসতে বলল, কোল্ড ফিভার।

 মালিনী ঘর ছেড়ে চলে গেল।

সুরেশ্বর বিছানার পাশ থেকে মোটা গরম চাদর টেনে নিয়ে গায়ে জড়াল, পায়ের দিকে কম্বল। বোধ হয় শুয়ে ছিল, অবনীর গলা পেয়ে উঠে বসেছে। বলল, হেম তো তাই বলছে, সর্দিজ্বর। আমার মনে হচ্ছে বেতোজ্বর–বলে সুরেশ্বর তার অসুখের প্রসঙ্গটা আরও লঘু করার চেষ্টা করল, বয়েস হচ্ছে, বাত ধরেছে। হাড়ে হাড়ে ব্যথা… হাসল। আপনাদের খবর কী? বিজলীবাবু কেমন আছেন?

ভাল, অবনী বলল, তার মনে হল সুরেশ্বরের চোখমুখ বেশ ফুলে আছে।

 আপনাদের দিকে এখনও অসুখ-বিসুখটা ছড়ায়নি।

এক-আধটা দেখা দিয়েছে, শুরু বলতে পারেন।

সুরেশ্বর এমনভাবে তাকিয়ে থাকল, মনে হচ্ছিল যেন সে ভেবেছিল কোনও সুসংবাদ শুনবে, অথচ দুঃসংবাদ শুনল।

অবনী বলল–এই এরিয়ায় এরই মধ্যে কম করে আশি নব্বইটা এই রোগে মারা গেছে। কিন্তু দেখছেন না, কারও কোনও গা নেই। …এইভাবেই অসুখটা চলবে–আরও একশো দেড়শো মারা যাবে–তারপর নিজের থেকে থামবে। ততদিনে একটা ন্যাচারাল ইমিউনিটি গ্লো হয়ে যাবে মানুষের।

শুনেছি পাটনা থেকে কিছু ডাক্তার-টাক্তার আসছেন—

আসছেন…! আসুন আগে… অবনী যেন কথাটার কোনও গুরুত্ব দিল না।

সুরেশ্বর সামান্য সময় চুপ করে থেকে বলল, শিবনন্দনজি খবরটবর রাখেন, তিনি বলছিলেন আসবে, শীঘ্রিই আসবে। …হয়তো এই সপ্তার মধ্যেই।

আপনি বিশ্বাস করেন আসবে?

বিশ্বাস তো করতেই হয়।

আপনি একটু বেশি রকম বিশ্বাসী।

 বিশ্বাস ছাড়া চলে কই। …হয় কাউকে না হয় কিছুকে তো বিশ্বাস করতেই হয়।

ঠকতেও হয়। হয় না? অবনী সুরেশ্বরের দিকে অর্থপূর্ণ দৃষ্টিতে তাকাল।

 সুরেশ্বর অবনীর দৃষ্টি থেকে কথাটার অর্থ হয়তো বুঝতে পারল। বলল, অনেকে তাই মনে করে।

আপনি করেন না?

সুরেশ্বর আস্তে মাথা নাড়ল, না–সে মনে করে না। বলল, আপনি যে ধরনের ঠকার কথা বলছেন, আমি তেমন কিছু ভাবছি না।

অবনীর ইচ্ছে হল বলে, আপনার হয়তো এমনও মনে হতে পারে আপনি কাউকে ঠকাচ্ছেন না!

অবনী সুরেশ্বরের অসুস্থ অথচ সংযত ধীরস্থির মুখভাব লক্ষ করতে করতে বলল, আমার মাঝে মাঝে মনে হয়, আপনি আমাদের জীবনের খুব কমই দেখেছেন। …কখনও কিছু হারাননি, কিছু পাননি।

কিছু হারাইনি?

না; তেমন কিছু হারাননি; যে জিনিস হারালে মানুষ তার ক্ষতির মূল্য বোঝে অন্তত তেমন কিছু হারাননি।

সুরেশ্বর অপলকে অবনীর মুখের দিকে তাকিয়ে থাকল। তার চোখের তারা মুহূর্তের জন্যে উজ্জ্বল হয়ে উঠেছিল, যেন ফুলিঙ্গের স্পর্শ পেয়েছিল, পরে সেই উজ্জ্বলতা মরে গেল, দৃষ্টিতে অন্যমনস্কতা এবং বেদনার ভাব এল। চোখের পলক ফেলে সুরেশ্বর অন্যদিকে তাকাল। তারপর শান্ত গলায় মৃদুস্বরে বলল, আপনি ঠিকই বলেছেন, বড় কিছুনা হারালে মানুষ নিজেকে বুঝতে পারে না। তার দুঃখ যন্ত্রণার বোধ থাকে না… সামান্য সময় নীরব থাকল; তারপর হঠাৎ বলল, আপনি কি কিছু হারিয়েছেন…

আমার কথা আলাদা– অবনী বলল, জন্ম থেকেই আমি হারের খেলা খেলছি। …ধাতে সয়ে গেছে। বলার পর সে কৌতুক অনুভবের ভান করে হাসার চেষ্টা করল।

সুরেশ্বর মুখ ফিরিয়ে তাকাল। আপনি তা হলে খারাপ খেলোয়াড়। সুরেশ্বরও হাসবার চেষ্টা করল।

একেবারে রদ্দি। …এ ব্যাড প্লেয়ার উইথ এ ব্যাড লাক, স্যার। অবনী এবার সামান্য জোরেই হেসে উঠল।

সুরেশ্বর যেন না হেসে পারল না। হাসি থামলে বলল, মাঝে মাঝে আপনার সঙ্গে কথা বলতে খুব ইচ্ছে করে। …আজ শরীরটায় তেমন জুত নেই। আর একদিন যদি… বলতে বলতে সুরেশ্বর থামল, ভাবল, তারপর বলল, অবনীবাবু, আপনার সঙ্গে কয়েকটা কথা বলতে পারলে ভাল হত। অন্য আর একদিন..

সুরেশ্বরের কথা শেষ হবার আগেই শিবনন্দনজি এলেন। সুরেশ্বরের দিকে তাকিয়ে থাকলেন। চিন্তিত। কিছু বলার আছে। প্রয়োজনীয় কথা। অবনীর জন্যে যেন বলতে পারছেন না।

অবনী উঠে পড়ল।

.

২৮.

দিন দুয়েক পরের কথা।

অবনী গুরুডিয়ায় আসছিল, সঙ্গে বিজলীবাবু। সুরেশ্বরের অসুখ শুনে বিজলীবাবু আসতে চেয়েছিলেন। আজ আসার পথে বাস-অফিস থেকে অবনী তাঁকে তুলে নিয়েছে।

বিকেল পড়ে গিয়েছিল, শীতের বাতাস বুঝি আজ সারাটা দিনই থেকে থেকে দিগভুল করে দক্ষিণ দিয়ে আসছিল, কয়েক ঝলক আসে আবার থেমে যায়, বাতাসে শিহরণ আছে, শীতের ধার নেই, ঈষৎ যেন উষ্ণ। ফাল্গনের মুখোমুখি এসে বাতাস বুঝি দোনা-মোনা করে কখনও মাঘ কখনও ফাল্গুনের মন রেখে বইছিল। রাস্তাটা শুকনো পাতায় ভরা, দুপাশে অজস্র ঝরা পাতা, গরগল গাছগুলোর মাথা প্রায় নিষ্পত্র হয়ে এল, মাঠেঘাটে ধুলো উঠছে, ঝোপঝাড়গুলো ধূসর, বিজলীবাবু কখন যেন ঝোপ থেকে বুনো কুলের গন্ধ পেয়ে নাক টেনে গন্ধ নিলেন।

যাই যাই করেও বিকেলটা কিছুক্ষণ ছিল, তারপর অপরাহ্ন ফুরোল।

বিজলীবাবু বললেন, শীতটা এবার গেল মিত্তিরসাহেব; আর কটা দিন।

অবনী মুখে কিছু বলল না, বার দুই ঘাড় নাড়ল আস্তে, অর্থাৎ, হ্যাঁ, শীত যাচ্ছে।

বিজলীবাবু দেশলাই কাঠি দিয়ে দাঁত খুঁচিয়ে কাঠিটা ফেলে দিলেন। ইদানীং পানের সঙ্গে তিনি যে নতুন জরদাটা খাচ্ছেন সেটা নেশার পক্ষে জুতের নয়, কিন্তু গন্ধটা ভাল। নিজের মুখের গন্ধ যেন নিজেকেই মাঝে মাঝে অন্যমনস্ক করে দেয়। বিজলীবাবু বোধহয় মুহূর্ত কয় মুখ হাঁ করে সেই গন্ধ নিচ্ছিলেন, তারপর নিজের ছেলেমানুষিতে নিজেই মুখ বন্ধ করে হেসে ফেললেন। বললেন, মিত্তিরসাহেব, একটু পান-টান অভ্যেস করুন। … জীবনটা একেবারে বিধবার ঠোঁট করে রাখলেন…!

অবনী হেসে জবাব দিল, পানের অভ্যেস তো আমার আছে, বিজলীবাবু।

বিজলীবাবু নিজের ভুলটুকু যেন সঙ্গে সঙ্গে বুঝতে পেরে হেসে উঠলেন। বললেন, আরে না, সে হল কি না জলপান, আর এ হল স্থল পান। বলে বিজলীবাবু হাসতেই থাকলেন; পরে আবার বললেন, পানের কত রকমফের আছে জানেন?

অবনী মাথা নাড়ল; জানে না।

বিজলীবাবু একটা ছড়া কাটলেন, তার খানিকটা হিন্দি হিন্দি শোনাল, বাকিটা উর্দু-টুর্দু হবে। বললেন, আয়ুর্বেদের অনুপানের মতন নানা অনুপান আছে পানের; অনুপান মেশালে কোনও পানে মন-সুখ কোনও পানে রতিসুখ। বলে হাসতে লাগলেন।

বিজলীবাবুর যাবতীয় বিষয়ে জ্ঞান মাঝে মাঝে অবনীকে চমৎকৃত করে। আপাতত সে তেমন চমৎকৃত হল না, পানশাস্ত্রে আপনি বরাবরই পণ্ডিত।

শাস্ত্র-টাস্ত্র না, এ হল নিজের মুখে ঝাল খাওয়া। সমঝদার হলে বুঝতেন।

পরিহাসটা অবনী উপভোগ করল কি না বোঝা গেল না।

 বিজলীবাবু অল্পসময় যেন অবনীর জবাবের অপেক্ষায় থাকলেন, তারপর সহাস্যমুখে বললেন, কথাটা আপনার মনে ধরল না মিত্তিরসাহেব; কিন্তু যা বললাম–এ হল খাঁটি কথা।

অবনী হাসল না; সামনাসামনি একটা গাড়ি এসে পড়েছে, স্টেশন ওয়াগন; রাস্তার দিকে চোখ রাখল।

বিজলীবাবু পকেট থেকে তাঁর সিগারেট কেস বের করছিলেন।

মুখোমুখি গাড়িটা পাশ কাটাল : অবনীর মনে হল গাড়িটা সে টাউনে অনেকবার দেখেছে, সরকারি গাড়ি, গাড়ির মধ্যে বেশ কয়েকজন যেন ছিল।

নিজের হাতে পাকানো সিগারেটের একটা নেড়েচেড়ে বেছে নিয়ে বিজলীবাবু দেশলাই জ্বাললেন। সিগারেটের অল্প একটু ধোঁয়া গলায় টেনে নিয়ে সামান্য পরে বললেন, আপনি যতই কেননা বলুন মিত্তিরসাহেব, এক হাতে সংসারের খেলাটা ঠিক জমে না। …যদি জমত তবে ভগবানের এই বাড়তি খরচটা হত না।

অবনী ঘাড় ফিরিয়ে তাকাল, হাসল সামান্য, বাড়তি খরচ?

অবনীর নির্বুদ্ধিতায় যেন কত হতাশ হয়েছেন বিজলীবাবু সেইভাবে মাথা নেড়ে জিবের শব্দ করলেন; বললেন, বাড়তি খরচটা বুঝলেন না–! হায় হায়, মিত্তিরসাহেব, বিধাতা পুরুষের এমন সৃষ্টি যার সব দিকেই বাড়তি–সেই ফেমিনাইন জেন্ডার চিনলেন না।

অবনী হেসে উঠল।

হাসির কিছু নয়, বিজলীবাবু বললেন, জগতে এই বাড়তি খরচটা না থাকলে বাঁচার কোনও সুখ ছিল না।

অবনী বলল, তা ঠিক, আপনাকে দেখেই বেশ বুঝতে পারি।

ওই তো, শুধু দেখেনই : শিক্ষা-টিক্ষা নেন না। বিজলীবাবু বেশ জোরে জোরে হাসলেন। হাসি থামলে বললেন, একটা কথা বলব, মিত্তিরসাহেব?

বলুন।

আপনি তো আর সুরেশ-মহারাজ নন যে ব্রহ্মচারী হয়ে হরতুকি খেয়ে পড়ে থাকবেন আজীবন। বয়েস-টয়েসও বেশ হল, অর্ধেক বেলা তো কবে শেষ, এখন একটু….মানে ধরুন গৃহসুখ বলেও তো একটা কথা আছে।

গৃহসুখ…! অবনী কৌতুকের স্বরে বলল।

হাসবেন না, মিত্তিরসাহেব, সংসারে এসেছেনসুখ-অসুখ শোক-দুঃখ, আরাম-বিরাম এ সবই প্রয়োজন; আপনি না চাইলেও এরা ছাড়বে না। তা ছাড়া স্নেহ-মমতা!

অবনী চুপচাপ থাকল। বিজলীবাবু যে আর রঙ্গরসিকতা করছেন না–বেশ বোঝা যাচ্ছিল। দিনে দিনে বিজলীবাবুর সঙ্গে এমন একটা সম্পর্ক হয়ে গেছে যে তিনি ঘনিষ্ঠ বন্ধুজনের মতন এখন অনেক কিছুই অক্লেশে বলতে পারেন, বলতে সঙ্কুচিত হন না।

বিজলীবাবু বললেন, আমি মাঝে মাঝে ভাবি মিত্তিরসাহেব, আপনি বড় বিচিত্র লোক।

অবনী ঘাড় ফিরিয়ে তাকাল, বিচিত্র লোক! কেন?

 বিচিত্র বই কি! দেখছি তো! ..ইচ্ছে করলে আপনি, সাধারণ লোক যা চায়, যাতে সুখ শান্তি পায় সবই প্রায় পেতে পারতেন, অথচ এমন বাউণ্ডুলে হয়ে থাকলেন যেন আপনার কিছুই জোটেনি। এটা কি আপনার শখ! তাও তো নয়।

অবনী সঙ্গে সঙ্গে কথার জবাব দিল না, পরে বলল, আপনি খানিকটা বেশি বেশি ভাবছেন, বিজলীবাবু।

বিজলীবাবু নিবে যাওয়া সিগারেটটা আবার ধরাতে লাগলেন, গাড়ি প্রায় লাঠটার মোড়ে এসে পৌঁছল।

সিগারেট ধরিয়ে বিজলীবাবু বললেন, মিত্তিরসাহেব, আমি কোনওদিন আপনার ফ্যামিলির ব্যাপারে কথা তুলিনি। ..দু-একটা কথা জিজ্ঞেস করব, অপরাধ নেবেন না।

অবনী চুপচাপ থাকল। বিজলীবাবু যে প্রসঙ্গটা কোনওদিন তোলেননি তা নয়, কিন্তু স্পষ্ট করে কোনওদিন বলেননি, প্রকারান্তরে এক-আধবার তিনি বিষয়টার উল্লেখ করেছেন।

বিজলীবাবু বললেন, স্ত্রীকে কি আপনি আদপেই পছন্দ করেন না?

না। আমার স্ত্রী নেই–এক সময়ে ছিল; এখন সে অন্য কারও স্ত্রী…

 মিত্তিরসাহেব!

রাগের কথা নয়, বিজলীবাবু; সত্যিই তাই। …কলকাতায় আমার দু-একজন বন্ধু আছে; তার মধ্যে একজনের সঙ্গে আমার চিঠিপত্রে যোগাযোগ রয়েছে। আমি না জেনে কথাটা বলিনি।

বিজলীবাবু কিছুক্ষণ নির্বাক হয়ে থাকলেন, পরে বললেন, আপনি বর্তমানে তিনি কী করে অন্য লোকের স্ত্রী হতে পারেন?

পারেন–, অবনী এবার যেন ইচ্ছে করেই সামান্য পরিহাসের চেষ্টা করল, বেআইনি স্ত্রী হতে বাধা থাকে না। …কথাটা তা নয়, আমাদের মধ্যে আর কোনও সম্পর্ক নেই, হবে না; কাজেই তার পক্ষে অন্য কারও স্ত্রী হতে বাধা নেই।

হাতের সিগারেটটা ঠোঁটে তুলেও বিজলীবাবু ধোঁয়া টানতে পারলেন না; আবার নিবে গেছে। মুখের কাছ থেকে হাত নামিয়ে বললেন, আপনি যে কী বলেছিলেন সেবার, ডাইভোর্স…তাই নাকি?

অবনী মাথা নাড়ল। না। হয়নি। হবে। আমি কলকাতায় আমার বন্ধুকে ডিভোর্সের ব্যবস্থা করতে লিখেছি।

বিজলীবাবুর কাছে যেন প্রসঙ্গটি বেদনাদায়ক হয়ে উঠেছিল। অল্প সময় কী যেন ভাবলেন, বললেন, মিত্তিরসাহেব, আপনাকে আমি অনেকটা চিনি, এই ব্যাপারটায় চিনতে পারলাম না। স্ত্রীকে আপনি ভালবাসেননি?

না।

সম্বন্ধ করে বিয়ে?

না, না। সম্বন্ধ কে করবে, আমার সঙ্গে কারও সম্বন্ধ ছিল না। …নিজেই করেছিলাম।

পছন্দ করে, ভালবেসে?

পছন্দ করে বই কি!

ভালবেসে নয়?

না।

অবনী গাড়িটা ধীরে করে আনল, রাস্তার মাঝমধ্যিখান থেকে একটা মোষ সরে যাচ্ছে; মাত্র শ দেড়েক গজ দূরে লাঠটার মোড়।

বিজলীবাবু যেন কোনও ধাঁধার মধ্যে পড়ে গিয়েছিলেন। মিত্তিরসাহেব যে কী বলছেন! এই বলেন পছন্দ করে বিয়ে করেছি, এই বলেন ভালবেসে নয়। পছন্দ করার সময় কি ভালবাসাটা ছিল না! না-ভালবেসে পছন্দ! সেটা তবে কী?

মিত্তিরসাহেব–, বিজলীবাবু গলার স্বর নামিয়ে ধীরে ধীরে বললেন, আপনি বোধ হয় কোথাও ভুল করেছিলেন। ভালবাসা ছাড়া কি পছন্দ হয়!

অবনী কথার কোনও জবাব দিল না। ললিতাকে তার কেন পছন্দ হয়েছিল, কোথায় ললিতার আকর্ষণ ছিল বিস্তৃত করে তা বলার আগ্রহও অবনীর হল না। অথচ একটা জবাবেরও বুঝি প্রয়োজন ছিল। অবনী বলল, হ্যাঁ, ভুল করেছিলাম, যৌবনের ভুল…।

বিজলীবাবু কান পেতে কথাটা শুনলেন, হয়তো ভাবছিলেন। ছায়া গাঢ় হয়ে অন্ধকার হল, লাঠটার মোড় ছাড়িয়ে গুরুডিয়ার পথে চলেছে গাড়িটা, কিছুটা দূরে–বোধহয় পঞ্চাশ-ষাট গজ তফাতে কোনও শবযাত্রা চলেছে। রামনাম সত হ্যায়. রামনাম সত হ্যায়…ধ্বনিটা শোনা যাচ্ছিল, প্রায় ঝিল্লিস্বরের মতন ভেসে আসছে। ক্রমশ সেটা নিকট হতে লাগল, ধ্বনিটা জোর হচ্ছে; অবনী গাড়ির গতি ধীর করল, শবযাত্রা আরও কাছে, রাস্তা ছেড়ে মাঠে নামছে, রামনাম সত হ্যায়..গাড়ি পাশ কাটিয়ে হেডলাইটের আলোয় ভিজিয়ে চলে গেল। বিজলীবাবু মাথা নত করে মৃতের উদ্দেশে নমস্কার জানিয়ে শ্রদ্ধা দেখালেন, এটা তাঁর অভ্যেস। নিশ্বাস ফেলে আপনমনে কথা বলার মতন করে বললেন, আর একটা গেল।

গাড়িটা আরও সামান্য পথ এগিয়ে আসতে রামনাম আর শোনা গেল না। লণ্ঠনের আলো দুলছে পেছনে; মাঠ ভেঙে ওরা নদীর দিকে চলেছে।

বিজলীবাবু এবার বললেন, মিত্তিরসাহেব, স্ত্রী না হয় আপনার পছন্দ-অপছন্দর ব্যাপার ছিল, কিন্তু মেয়েটা? সে তো আর আপনার পছন্দের মুখ চেয়ে জগতে আসেনি, কপালে পেয়েছিলেন। তাকে ফেলে এলেন কেন?

অবনী এই প্রশ্নটার প্রত্যাশা করছিল। বিজলীবাবু যেদিন প্রথম কুমকুমের কথা জানতে পারেন সেইদিন থেকেই তাঁর মনের কোথাও যেন একটা প্রবল আপত্তি ছিল, এবং দু-চারবার তিনি যে প্রকারান্তরে অবনীকে অভিযোগ না করেছেন এমন নয়। নিজে সন্তানহীন, সন্তানের প্রতি এই অবহেলা যেন তাঁকে খুব বেশি আঘাত দিয়েছে, মর্মাহত করেছে।

অবনী বলল, কুমকুমকে তার মা তখন ছাড়েনি।

 জোর করে নিয়ে এলেন না কেন?

বিজলীবাবুর আন্তরিকতা ও উষ্ণতা অবনী অনুভব করতে পারল; উনি যে আবেগপ্রবণ হয়ে উঠেছেন তাতেও সন্দেহ নেই। কিন্তু অবনী কী বলবে! কী করে বিজলীবাবুকে বোঝাবে-কুমকুমকে কেন আনতে পারেনি! বিজলীবাবুকে বোঝাতে হলে প্রসঙ্গটা দুকথায় বোঝানো যাবে না। অবনীর তেমন কোনও ইচ্ছেও হল না। অল্প সময় চুপচাপ থেকে শেষে অবনী বলল, তা হয় না, বিজলীবাবু। অসুবিধে ছিল। বলে থামল, পরে আবার বলল, কুমকুমকে আমার আনার ইচ্ছে আছে। ..

বিজলীবাবু তাকিয়ে থাকলেন। যেন অপেক্ষা করছিলেন।

অবনী কিছু ভাবছিল, ভাবতে ভাবতে বলল, ডিভোর্সের মামলায় কী দাঁড়াবে আমি জানি না। মানে, কোর্ট থেকে কাকে মেয়ে দেবে কে জানে। জেনারেলি মাদের কাছেই দেয়। …এখানে অবশ্য আমার একটা অবজেকশান আছে–থাকবে…। দেখি..কী হয়!

বিজলীবাবু আর কিছু বললেন না। অবনীর মুখ দেখে তাঁর মনে হল, মেয়ের সম্পর্কে কিছু ভাবছেন হয়তো।

দেখতে দেখতে বেশ অন্ধকার হয়ে এল। পাতলা কুয়াশা ধোঁয়ার মতন দুলছে, গাড়ির আলোয় কখনও কখনও ইলশেগুঁড়ি বৃষ্টির মতন দেখাচ্ছিল; সন্ধ্যার মাঠে গন্ধ উঠেছে, তারা ফুটেছে আকাশে, বাতাস বড় শুকনো। এই স্তব্ধতার মধ্যে যেন অতিদূরের বাতাস রামনাম সত হ্যায়-এর গুঞ্জন আনল।

অবনী গাড়ি থামিয়ে একটা সিগারেট ধরাল। বিজলীবাবুও নরম সিগারেট নিলেন অবনীর।

আবার গাড়ি চলতে শুরু করলে বিজলীবাবু ইতস্তত করে বললেন, মিত্তিরসাহেব, আমার মন একটা কথা বলে। বলব?

অবনী ধোঁয়া টেনে নিয়ে সিগারেটটা বাঁ হাতের আঙুলে রাখল। বিজলীবাবু এবার কী বলতে পারেন অবনী যেন তা অনুমান করতে পারছিল। হৈমন্তীর কথা বলবেন কি! বিজলীবাবুকে প্রসঙ্গটা তুলতে দিল না, তার ভয় হল, সরাসরি তিনি কী বলবেন, কী জিজ্ঞেস করবেন কে জানে!

অবনী বলল, সুরেশ-মহারাজের আশ্রমে নতুন ডাক্তার আসছে জানেন নাকি?

 নতুন ডাক্তার! বিজলীবাবু অবাক হলেন।

 হৈমন্তী চলে যাচ্ছেন– অবনী বলল। বিজলীবাবুকে এ-যাবৎ সে কথাটা বলেনি।

বিজলীবাবু অবাক হলেন না। বললেন, উনি যে থাকবেন না তা বুঝেছিলাম, মিত্তিরসাহেব। কিন্তু নতুন ডাক্তার আসছেন জানতাম না। কে আসছেন?

জানি না। শুনছিলাম নতুন ডাক্তারের খোঁজ হচ্ছে।

 ভাল। বিজলীবাবু বললেন, বলে নিশ্বাস ফেললেন দীর্ঘ করে।

 নিবিড় নীরবতা; গাড়ি চলছে।

গগনের সঙ্গে আমার নানা গল্প হত– বিজলীবাবু কিছু পরে বললেন, আমি খানিকটা জেনেছি শুনেছি, মিত্তিরসাহেব। …মানুষের মতি এই রকমই। না না, আমি ওঁর দোষ দিচ্ছি না। তবে, এও তো কেমন একরকম ভালবাসা। আমরা বলতাম প্রণয়, আপনারা বলেন ভালবাসা। কে জানে আপনাদের আজকালকার ভালবাসা কী রকম! সেই গানটার মতন: সুধার কলসি অলসে ভাসালি…

অবনীর কী মনে হল, হেসে বলল, আপনার বাড়িতে এবার একদিন ফেয়ারওয়েলের ব্যবস্থা করুন।

ধীরে ধীরে মাথা নাড়লেন বিজলীবাবু, যেন বোঝাতে চাইলেন–তা তো ঠিকই, যাবার আগে ওঁকে একদিন বাড়িতে আনতেই হয়। ঠোঁটে সিগারেট রেখে পর পর কয়েকটা টান দিলেন; শেষে সিগারেট সরিয়ে মৃদু হেসে বললেন, সে না হয় হবে একদিন মিত্তিরসাহেব, কিন্তু আপনি? আপনিও কি ফেয়ারওয়েল দিচ্ছেন নাকি?

অবনী নীরব; বিজলীবাবুর দিকে তাকাল না, একটু বেশি রকম মনোযোগ দিয়ে সামনের রাস্তা দেখতে লাগল যেন। তারপর অকারণে হর্ন দিল বার দুই।

বিজলীবাবু কিছুক্ষণ অপেক্ষা করে শেষে বললেন, আপনার স্বভাবে তেমন জোর নেই, মিত্তিরসাহেব। পুরুষ মানুষের কবজি হবে জোরালো, মুঠো করে ধরবেন যখন তখন আর ছাড়বেন না। আলগা মুঠোতে কিছু হয় না।

অবনী কিছু বলল না। বিজলীবাবু পুরুষমানুষের কবজির কথাটাই জানেন, তার বেশি জানেন না। ললিতাকে ধরার সময় তার কবজি জোরালো ছিল, কিন্তু কী হল, ললিতাকে রাখা গেল, নাকি রাখতে ইচ্ছে হল! …তবু, অবনী ভাবল, তার চরিত্রে বরাবর এই জিনিসটা আছে–দুর্বলতা; সে পারে না ধরে রাখতে পারে না; তার মুঠো–এক ললিতার বেলায় কিছুটা শক্ত হয়েছিলনয়তো সব সময় আলগা, দুর্বল। কেন?

অন্ধ আশ্রমের মধ্যে গাড়ি ঢুকে পড়ল।

হৈমন্তীর ঘরের কাছাকাছি গাড়ি থামাল অবনী। বলল, আমি একটু পরে যাচ্ছি, বিজলীবাবু। আপনি কি আসবেন না সুরেশ-মহারাজের কাছে যাবেন?

আপনি আসুন, আমি যাই, বিজলীবাবু বললেন; বলে গাড়ি থেকে নামতে লাগলেন।

অবনীও নেমে পড়ল। বিজলীবাবু গায়ের চাদরটা ঝেড়েঝুড়ে গুছিয়ে আবার গায়ে দিলেন, দিয়ে এগিয়ে গেলেন। অবনী দুমুহূর্ত দাঁড়িয়ে থেকে হৈমন্তীর ঘরের দিকে পা বাড়াল।

সামনের মাঠটুকু পেরিয়ে বারান্দার কাছে আসতেই ঘরের মধ্যে আলো দেখা গেল। দরজা খোলা, পরদা ঝুলছে। হৈমন্তী ঘরেই আছে।

বারান্দায় উঠে আসতেই হৈমন্তীকে দেখা গেল, গাড়ির শব্দে দরজার পরদা সরিয়ে এসে দাঁড়িয়েছে।

অবনী কাছাকাছি এসে বলল, বিজলীবাবু এসেছেন; সুরেশ্বরকে দেখতে গেলেন।

হৈমন্তী পরদা সরিয়ে নিল, অবনী ঘরে পা বাড়াল।

হৈমন্তী ঘরে বসে বসে কী করছিল বোঝা যায় না। রেডিয়ো বন্ধ; বইপত্রও কোথাও খোলা নেই; মাঝে মাঝে উল নিয়ে বুনতে বসে–উলের গোলা, বোনার কাঁটাও কোথাও দেখা যাচ্ছিল না। বিছানা পরিষ্কার, কোথাও কোনও ভাঁজ নেই, শুয়েছিল বলেও মনে হল না।

অবনী বলল, কী করছিলেন? বলে হৈমন্তীর মুখের দিকে তাকাল। কেমন আছেন সুরেশ্বরবাবু?

ভাল।

জ্বর ছেড়েছে?

 হ্যাঁ; কাল থেকেই আর জ্বর নেই।

যাক, আপনার একটা বড় রকম দুশ্চিন্তা কাটল।

হৈমন্তী তাকাল। অবনী কি তাকে পরিহাস করল? মুখ দেখে মনে হল না, অবনী পরিহাস করে কিছু বলেছে। হৈমন্তী বলল, আমার খুব একটা দুশ্চিন্তা ছিল না।

হৈমন্তীর গলার স্বরে ঠিক রূঢ়তা নয় কিন্তু কেমন একটা কাঠিন্য ছিল, যেন কথাটা তার পছন্দ হয়নি। অবনী বসল। বসে হৈমন্তীকে লক্ষ করল: কেমন শুকনো ও ক্লান্ত দেখাচ্ছে, অসন্তুষ্ট ভাব।

আর কী খবর? অবনী বলল। হৈমন্তী কি সাধারণ একটা কথায় অসন্তুষ্ট হল? তেমন কিছু ভেবে কথাটা অবনী বলেনি।

খবর ভাল না, হৈমন্তী জবাব দিল।

অবনী বুঝতে পারল না। কেন? খারাপের কী হল?

হৈমন্তী সঙ্গে সঙ্গে কথার জবাব দিল না; বিছানার কাছে গিয়ে বসল, আলোর দিকে তাকিয়ে থাকল কয়েক মুহূর্ত, তারপ অবনীর দিকে। বলল, এখানে আবার একটা রোগী এসেছে–অবস্থা ভাল না।

অবনী বিস্মিত; কেমন যেন বিমূঢ় হল। এই আশ্রমে সেই রোগ ঢুকল নাকি!

হৈমন্তী বলল, মানুষের সাধারণ একটা কাণ্ডজ্ঞান থাকে, এখানকার লোকের তা নেই।

সেই এপিডেমিক–?

হ্যাঁ।

কার হল?

এখানকার কেউ না! তাঁত-ঘরে হরিকিষণ বলে আছে একজন তার ভাই। নদীর ওপারে গাঁয়ে থাকত। তাকে নিয়ে এসেছে।

এখানে?

আর কোথায় যাবে! এটাই তো যত জঞ্জাল ফেলার জায়গা।

কবে? বলেই অবনীর মনে পড়ল, সেদিন সে যখন সুরেশ্বরের সঙ্গে দেখা করতে গেল তখন বাইরের ভেঙে যাওয়া জটলার মধ্যে বোধহয় এই রোগী আনা নেওয়ার কথাটা হচ্ছিল। শিবনন্দনজি সম্ভবত তাই অত ব্যস্ত ছিলেন। হয়তো সেদিন অবনী যখন চলে আসে শিবনন্দনজি ওই বিষয়েই কিছু বলতে এসেছিলেন। অবনী বলল, সেদিন আমি যখন সুরেশ্বরবাবুকে দেখতে গেলাম বোধ হয় এরকম একটা কথাবার্তা চলছিল।

মাথা নাড়ল হৈমন্তী। পরের দিন বেলায় গোরুর গাড়িতে নদী পার করে নিয়ে এসেছে।

অবনী বুঝতে পারল না কী বলবে।

 হৈমন্তী বিরক্ত গলায় বলল, এদের মাথায় যে কী আছে আমি ভেবে পাই না। কাণ্ডজ্ঞান থাকলে কেউ এভাবে ওই রোগী এখানে আনে!

এ-রকম একটা রিস্ক উনি নিলেন কেন?

দয়া।

 কিন্তু এখানে…! এটা তো জেনারেল হাসপাতাল নয়…

এটা কিছুই নয়।

আপনি কিছু বললেন না?

আমার বলার অপেক্ষায় ওরা ছিল না। হৈমন্তী রাগে বিরক্তিতে অসহিষ্ণু হয়ে উঠেছিল। মানুষের সাধ্য অসাধ্যের জ্ঞান থাকা দরকার, সুরেশ্বরের সে জ্ঞান নেই। সে জানে না তার ক্ষমতা কতটুকু অক্ষমতা কত বেশি।

অবনী বলল, রোগটাকে আবার আপনারা আশ্রমে ছড়াবেন।

আমি না, উনি–ওঁরা।

আমি কিছু বুঝতে পারছি না। এতে কী লাভ হল?

 কিছু না। …দয়ায় গলে মহত্ত্ব দেখানো হল।

বরং টাউনে নিয়ে গিয়ে সরকারি হাসপাতালে দিতে পারতেন।

হৈমন্তী কোনও জবাব দিল না। মানুষ যদি নির্বোধ হয়, না বোঝে তাকে কে বোঝাবে! এখানে যার চিকিৎসা হবে না, হওয়া সম্ভব না–তাকে রেখে কী লাভ? এমনিতেও যে মরত তাকে এখানে এনেও সেই মারছ। চোখের সামনে মনোহর মরল, বুড়ো তিলুয়া মরল–তোমরা দেখনি? তবে? গিরজা তো বেঁচেছে, হেম…। হ্যাঁ বেঁচেছে; কিন্তু সে কপাল জোরে, হৈমন্তীর হাতযশে নয়। সুরেশ্বর এসব বুঝেও বুঝবে না। কী করব হেম, ওরা বড় ধরেছে।

সুরেশ্বরের এই হঠকারিতা অবনীরও পছন্দ হচ্ছিল না। কী করে একজন বোধবুদ্ধিসম্পন্ন মানুষ এমন নির্বোধের মতন কাজ করে কে জানে! নিতান্ত দায়িত্বহীন না হলে এভাবে মরণাপন্ন, সংক্রামক রোগীকে আনত না। হৈমন্তীর তিক্তবিরক্ত হবার সঙ্গত কারণ রয়েছে: সে চোখের ডাক্তার, এই হাসপাতালটাও চোখ দেখবার, এখানে চিকিৎসার ব্যবস্থা কিছু নেই, তবু কেন তুমি রোগী আনলে?

অসন্তুষ্ট হয়ে অবনী বলল, ভদ্রলোক নিজের মর্জিতে কাজ করেন। ..উচিত অনুচিত বোধটাও বোধহয় তাঁর সবসময় থাকে না।

হৈমন্তী বলল, দয়া দেখানো খুব সহজ; ও শুধু দয়া দেখাতে শিখেছে, দায় নিতে নয়। …আমি হাজার বার করে বলেছি, এসব আমি পারি না, বুঝি না, আমি যা জানি না তার দায় আমি ঘাড়ে করতে পারব না। তবু…। মানুষের জীবন নিয়ে এই ছেলেখেলা আমার ভাল লাগে না।

অবনী তাকিয়ে থাকল। হৈমন্তীর চোখে এমন একটা অসহায়, অক্ষম ভাব ফুটে উঠেছিল যে মনে হচ্ছিল সে যেন কোনও অপরাধে অপরাধী হবার ভয়ে শঙ্কিত হয়ে আছে। সম্ভবত এই দায়িত্ব তার পক্ষে দুঃসহ ভারের মতন মনে হচ্ছে। নিজের অক্ষমতায় সে পীড়িত, বিব্রত।

অবনী কিছু ভাবল; লোকটার অবস্থা এখন কেমন?

 ভাল না।

বয়স কত?

বছর পঁচিশ।

 কোনও রকমে টাউনের হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া যেত না?

নিতে পারলে ভাল ছিল। চল্লিশ মাইল টানা হেঁচড়া। কেই বা নিয়ে যায়?

কাল সকালে একটা ব্যবস্থা করতে পারি।

কী ব্যবস্থা? আপনি পৌঁছে দিয়ে আসবেন?

অবনী অন্যমনস্কভাবে বলল, ভাবছি।

হৈমন্তী কয়েক পলক তাকিয়ে থাকল, পরে বলল, না। …যে এনেছে এ দায়িত্ব তার। রাস্তার মধ্যে রোগী মরলে সে দোষ হবে আমার, আপনার।

অবনী ভাবল; বলল, এখানে এভাবে রোগী পড়ে থাকলেই কি সে বাঁচবে। তা ছাড়া আমার ভয় হচ্ছে যদি আপনার কিছু হয়…! রোগটা এখানেও ছড়িয়ে পড়তে পারে।

অবনীর গলার স্বরে এমন কিছু ছিল যা হৈমন্তীকে অকস্মাৎ কেমন দুর্বল ও অভিভূত করল। সুরেশ্বর কোনওদিন এ চিন্তা করেনিঃ ভাবেনি যে হৈমন্তীরও আপদ-বিপদ হতে পারে। মুখে সে অনেক ভাল ভাল কথা বলেছে, কাজে হৈমন্তীর জীবনের মূল্য বড় দেয়নি।

অবনী সিগারেট ধরাচ্ছিল। হৈমন্তী লাইটারের আলোর শিখা দেখল, সিগারেটের ধোঁয়ার গন্ধ পেল। কেমন যেন বেহুশে ছিল কিছুক্ষণ, হুঁশ হলে বলল, আমার কিছু হবে না। ডাক্তারদের রোগ হয় না। বলে হাসবার চেষ্টা করল। তারপর আলোর দিকে তাকাল, তাকিয়ে থাকল, যেন কিছু দেখছে; শেষ বলল, যে কয়েকটা দিন আর আছি–অশান্তি করে লাভ নেই। …

এভাবে থেকেও তো আপনার শান্তি হচ্ছে না।

 না। তবে..দু-চারদিনের মধ্যেই আমার দায়িত্ব ফুরোবে।

অবনী বুঝতে পারল না, তাকিয়ে থাকল।

 হৈমন্তী বলল, কী বলে যে–মেডিকেল রিলিফ–তাই আসছে। দু-একজন ডাক্তার, নার্স, ওষুধপত্র। আপনাদের সুরেশ-মহারাজ এখানে তাদের হাসপাতাল খুলতে ঘর দিয়েছে। তারা আসবে, থাকবে, চিকিৎসা করবে। আমার কোনও দায়িত্ব থাকবে না।

অবনী বিশ্বাস করতে পারছিল না, গুজব, নাকি সত্যি?

হৈমন্তী মাথা নাড়ল, না, গুজব নয়। …আজ বিকেলেই টাউন থেকে সরকারি লোকজন এসেছিল গাড়ি করে। কথাবার্তার সময় আমি কিছুক্ষণ ছিলাম।

অবনীর হঠাৎ সেই স্টেশন ওয়াগনের কথা মনে পড়ল, আসবার সময় পথে যেটা দেখেছে। অবনী বলল, আসবার সময় একটা সরকারি স্টেশন ওয়াগন দেখেছিলাম। সেটা নাকি?

হৈমন্তী ঘাড় নাড়ল। হ্যাঁ, সেটাই।

 দুজনেই তারপর নীরব হয়ে গেল।

 কিছুক্ষণ পরে অবনী বলল, আপনাদের চোখের হাসপাতালটা তা হলে এপিডেমিকের হাসপাতাল হচ্ছে?

এখন কিছুদিনের জন্যে। ..আগে প্রাণ, পরে না চোখ.. হৈমন্তী ম্লান হাসল।

অবনী সিগারেটের টুকরোটা ফেলে দেবার আগে এক মুখ ধোঁয়া গলায় নিল; বলল, এবার বোধহয় আপনি ফিরতে পারেন।

পারি।

কবে?

 ইস…আপনি আমায় তাড়াবার জন্যে বড্ড যে ব্যস্ত।

অবনী কী যেন বলতে গিয়েও পারল না। বরং কেমন বিব্রত ও আড়ষ্ট বোধ করল। শেষে সামলে নিয়ে হেসে বলল, না, কবে যাচ্ছেন জানা দরকার, আমরা আপনাকে একটা ফেয়ারওয়েল দেব।

হৈমন্তী হাসল না; অন্যমনস্কভাবে তাকিয়ে থাকল।

.

২৯.

দিন কয়েকের মধ্যে ওরা এসে পড়ল: অল্পবয়সী দুই ডাক্তার, দুজন মেলনার্স, গুটি দুয়েক সিস্টার, আধবুড়ো গোছের এক কম্পাউন্ডার, একজন জমাদার। আর এসেছিল প্যাকিং বাক্সের পেটি করে ওষুধপত্র; সেই সঙ্গে কয়েক টিন ফিনাইল, ব্লিচিং পাউডার, কয়েকটা নতুন লণ্ঠন, একটা পেট্রম্যাক্স বাতি, মাঠে খাটাবার জন্যে তাঁবু–এইসব। সদর থেকে হাকিম এসেছিলেন, সঙ্গে বুঝি সিভিল সার্জন; তদারক করে গেলেন। সরকারি একটা ভ্যানও প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র ওষুধটষুধ নিয়ে ঘুরে গেল।

সবজিবাগানের দিকে, কিছুটা ফাঁকায় খাপরা-ছাওয়া বড় বড় ঘর ছিল দুটো; এক সময় বেত-তে থাকত, বেতের আর দড়ির কাজকর্ম করত অন্ধরা, এখন বেতের কাজ হয় অন্য ঘরে, ঘর দুটো পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন করিয়ে, কোনও কোনও জায়গায় খাপরা বদল করে সেখানে হল হাসপাতাল; দড়ির খাঁটিয়া পড়ল গোটা দশেক। কাছাকাছি আর কোনও ঘর ছিল না; পুরনো তাঁত-ঘরের একপাশে বসল ডিসপেনসারি। আগে যে-দালানে চোখের রোগীরা দু-চার দিন থাকত–সেই রোগী-ঘর ফাঁকা পড়েছিল এখন; ডাক্তার, মেল নার্স আর কম্পাউন্ডারের থাকার জায়গা হল সেখানে। সিস্টার দুজনের একজন এসেছে মিশনারি থেকে, আদিবাসী-টাসী হবে, কালো বেঁটেখাটো চেহারা, অন্যজন বেহারি মেয়েনাম পারবতী, বছর পঁচিশ বয়েস বড়জোর, লম্বা ছিপছিপে তামাটে চেহারা, মুখে বসন্তের দাগ। সিস্টার দুজনকে হৈমন্তীদের পাশাপাশি, গগন যে-ঘরে ছিল, সেই ঘরটা ছেড়ে দেওয়া হয়েছিল।

অন্ধ আশ্রমে চোখের রোগী আর আসছিল না। চোখের হাসপাতাল বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে আপাতত। যুগলবাবু হাসপাতাল-ঘরে তালাচাবি দিয়ে অন্য কাজে মন দিয়েছেন। তাঁত-ঘরে অন্ধদের কাজকর্ম খুব সামান্যই হয়; বেত বোনা-টোনা, দড়ির কাজ এখন আর হচ্ছে না।

গুরুডিয়ার অন্ধ আশ্রমের জীবন যে আর স্বাভাবিকভাবে বইছে না–এটা বোঝা কষ্টকর ছিল না। সকাল দুপুরে বাসগুলো নিয়মিত আর আসে না, যাত্রী নেই; রোগীও আসছে না; জামতলায় ভিড় হয় না দুপুরে, অন্ধ আশ্রম যেন পরিত্যক্ত হয়ে পড়ে আছে।

নতুন হাসপাতাল খোলার সঙ্গে সঙ্গেই গোরুর গাড়িতে চাপিয়ে শিবনন্দনজি দুই মরণাপন্ন রোগী এনে হাজির করলেন কোনও গাঁ গ্রাম থেকে। পরের দিন আর-একটা এল। তাঁত-ঘরের হরিকিষণের ভাই ইতিমধ্যে মারা গেল। বহু চেষ্টাতেও বেচারিকে বাঁচানো গেল না। একেবারে মাঝদুপুরে–যখন বাতাস আর ধুলো মিশে একটা আঁধি আঁধি ভাব হয়েছে–দেহাতের লোকজন হরিকিষণের ভাইয়ের মৃতদেহটা কাঁধে নিয়ে জামতলা দিয়ে রামনাম সত হ্যায় করতে করতে চলে গেল।

আশ্রমের মধ্যে কেমন একটা থমথমে ভাব জমে আসছিল। মনোহর আর বুড়ো তিলুয়া মারা যাবার পর এই রকম একটা ভাব হয়েছিল, তারপর সেটা কাটছিল আস্তে আস্তে এখন আবার সেই থমথমে ভাবটা এল। কারও কারও চোখে আতঙ্ক, কেউ বা কেমন সন্ত্রস্ত। এক সময় এই জায়গাটা আশ্ৰম বলেই মনে হত, নিরিবিলি নিরুদ্বেগ শান্ত সহজ একটা জীবন ছিল; এখন মনে হয় সত্যিই কোনও হাসপাতাল: ভীতি, সন্ত্রাস, উদ্বেগ, দুর্ভাবনা। সবজি বাগানের গন্ধের বদলে ফিনাইল আর ব্লিচিং পাউডারের উগ্র গন্ধ; বাতাসে থেকে থেকে সাদা গুঁড়ো উড়ছিল পাউডারের।

.

যেদিন অবেলার ঘুম ঘুমিয়ে পড়েছিল হৈমন্তী, ঘুম ভেঙে চোখ চেয়ে দেখল বিকেল পড়ে যাচ্ছে, ঘরের মধ্যে আলো কমে ছায়া জমতে শুরু করেছে। বাইরে মালিনীর গলার আওয়াজ পাওয়া যাচ্ছিল। অবেলায় ঘুমিয়ে আলস্য জমেছিল, শুয়ে শুয়ে হাই তুলল হৈমন্তী বার কয়েক, চোখ জড়ানো, একটু যেন জল এসেছে, ছলছলে ভাব। বিছানায় উঠে বসার আগে বালিশে ছড়ানো চুলের গুচ্ছ আলগা মুঠোয় গলার কাছে এনে দুদণ্ড শুয়ে থাকল হৈমন্তী। ঘুমের মধ্যে সে গগনের স্বপ্ন দেখেছে গগন তাকে ডাকছে–এই, এই…এই যে; আর ট্রেনের কামরার জানলা দিয়ে মুখ বাড়িয়ে রয়েছে হৈমন্তী; প্ল্যাটফর্মে মালপত্র নামছে, কুলি উঠছে। হৈমন্তী উঠি উঠি করছিল, অথচ ভিড়ের মধ্যে উঠতে পারছিল না।

স্বপ্নটার কথা মনে করতে করতে হৈমন্তী উঠে বসল। পায়ের কাপড় গুছিয়ে নামল, জল খেল। জল খেয়ে জানলার কাছে এসে দাঁড়াতে চোখে পড়ল, রোদ প্রায় গাছের মাথায় গিয়ে উঠেছে; শুকনো সামান্য উষ্ণ হাওয়া; গতকাল কিংবা আজই বুঝি ফাল্গুন মাস পড়েছে, বাতাসের সর সর শব্দ উঠছিল মাঝে মাঝে, সামনের করবী ঝোপটার পাতা ধুলোয় লাল হয়ে গেছে, জানলার পরদায় একটা শুকনো বটপাতা এসে আটকে রয়েছে।

জানলার সামনে সামান্য দাঁড়িয়ে, আলস্যভরে আঙুল দিয়ে চুলের জট ছাড়াল যেন হৈমন্তী, আর একবার হাই তুলল। স্বপ্নের কথাটা আবার মনে এল। আর কয়েকটা দিন, তারপর সত্যি সত্যি হাওড়া স্টেশনে গগনকে দেখতে পাবে হৈমন্তী।

দরজা খুলে বাইরে আসতেই চোখে পড়ল, বারান্দার নীচে মাঠে দাঁড়িয়ে মালিনী আর পারবতী গল্প করছে। পারবতী হাসছিল, মালিনী গালে হাত দিয়ে কী যেন বলছে। হৈমন্তী কলঘরে চলে গেল।

কলঘর থেকে ফেরার সময়ও হৈমন্তী দেখল, ওরা গল্প করছে। তার দিকে মালিনীর চোখ পড়েছিল। ঠিক বোঝা যায় না, তবু আজ কিছুদিন ধরেই যেন হৈমন্তীর মনে হচ্ছে, মালিনী আর আগের মতন হেমদি হেমদি করে না। আগে মালিনী যেন খুব অনুগত ছিল হৈমন্তীর; এখন ততটা নয়। হয়তো মালিনী ভেবে দেখেছে, যে-লোক চলে যাবে তার দিকে অতটা টলে লাভ নেই। বা মালিনী বেশ বুঝতে পেরেছে–তার দাদার সঙ্গে হেমদির বনিবনা না হওয়ায় হেমদি চলে যাচ্ছে; মনে মনে হয়তো সে-জন্যে খানিকটা রাগ, খানিকটা বা অসন্তোষ রয়েছে।

ঘরে আসার সময় কী ভেবে হৈমন্তী দাঁড়াল। মালিনীকে ডাকল।

মালিনী পারবতীর সঙ্গে কথাটুকু শেষ করে কাছে এসে দাঁড়াল।

 হৈমন্তী বলল, আজ আর চা-টা খাওয়াবে না নাকি?

আপনি ঘুমোচ্ছিলেন বলে ডাকিনি, মালিনী বলল, করে আনছি।

ঘুমিয়ে পড়েছিলাম– হৈমন্তী বলল, ডাকলে পারতে।

 মালিনী কোনও জবাব দিল না। চা করে আনতে গেল। পারবতী তখনও মাঠে দাঁড়িয়ে।

ঘরে এল হৈমন্তী। চোখ মুখে ঠাণ্ডা জলের স্পর্শ ভাল লাগছিল, কদিনের মধ্যেই যেন আবহাওয়া কেমন বদলে গেছে, বেশ শুকনো ভাব এসেছে একটা। এভাবে চললে দেখতে দেখতে গরম পড়ে যাবে। হয়তো গরম পড়ে এলে এই অসুখটাও থাকবে না। বা ততদিনে অসুখটা চলে যাবে।

মুখ মুছে হৈমন্তী চুল বাঁধার জন্যে চিরুনিটা হাতে নিয়ে জানলার সামনে গিয়ে দাঁড়াল। বাতাসে টুপটাপ টুপটাপ অনবরত পাতা ঝরে যাচ্ছে গাছের; এখন তো গাছপালা বেশ নেড়া নেড়া দেখায়, বেলা বেড়ে গেছে, মাঠের ঘাস কোথাও কোথাও হলুদ হয়ে আসছে।

জানলা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে হৈমন্তী অন্যমনস্কভাবে চুল আঁচড়াতে লাগল। রোদ দ্রুত পালাচ্ছে, একেবারে গাছের মাথায় রোদের একটা পাতলা ঢেউ এখনও আছে, মাটিতে আর রোদ দেখা যাচ্ছে না। আজ কয়েকটা দিন হৈমন্তী একেবারে চুপচাপ, কোনও কাজকর্ম নেই, সারাটা দিন আর রাত হাত পা গুটিয়ে বসে থাকে। কেমন আলস্য লাগছে, কুঁড়েমি ধরে যাচ্ছে, মাঝে মাঝে খুব খারাপ লাগে। কাজের মধ্যে নিজের জিনিসপত্র একটু আধটু করে গোছগাছ করে নেওয়া। এমন কিছু জিনিসপত্র নেই যে গোছগাছ করতে করতে সময় কেটে যাবে, তবু ধীরেসুস্থে গা এলিয়ে যেটুকু সময় কাটানো যায় সেইভাবে গোছগাছ করছে। এখন যা অবস্থা তাতে হৈমন্তী ইচ্ছে করলে কাল পরশুও চলে যেতে পারে, তার করার কিছু নেই, থাকাও অর্থহীন, অকারণ। তবু যে আরও পাঁচ সাতটা দিন থাকতে হচ্ছে এটা যেন নিতান্ত সঙ্কোচবশে। গগনকে চিঠি লিখে দেওয়া হয়ে গিয়েছিল আগেই, সেই মতনই সে যাচ্ছে। তা ছাড়া, এখানে এমন অবস্থায়, ওরা সব এল আর সঙ্গে সঙ্গে হৈমন্তী চলে গেল–এটা খুবই দৃষ্টিকটু দেখাত, মনে হত সে পালিয়ে গিয়ে বাঁচল। ..ওরা যেন ভেবে নিয়েছে এই বিপদের দিনে হৈমন্তীও তাদের বড় রকম সাহায্য। কিছু সাহায্য, কোনও না কোনও রকম সাহায্য হৈমন্তীর কাছ থেকে পাওয়া যাবে। কিছুই বলা যায় না, যদি হাসপাতালের দুটো ঘরই রোগীতে ভরে যায়, বা আরও একটা ঘর রোগীর জন্যে দরকার হয়ে পড়ে তবে অতগুলো রোগী সামলাতে হৈমন্তীও কিছুটা সাহায্য করতে পারবে। এসব কথা ওরাই বলেছে। …ভদ্রতা এবং সঙ্কোচবশে হৈমন্তী ওদের স্পষ্ট করে বলেনি যে সে এসবের মধ্যে নেই, সে কলকাতা চলে যাচ্ছে; অস্পষ্টভাবে অবশ্য জানিয়ে ছিল। এ বিষয়ে তার নিজের জানানোর কিছু নেই, সুরেশ্বরই জানাবে, এ দায়িত্ব তার।

মালিনী চা নিয়ে এল। ততক্ষণে হৈমন্তী এলো করে খোঁপা বেঁধে নিয়েছে।

মালিনী বলল, আজ উনি আসবেন নাকি, হেমদি?

উনি অর্থে অবনী, হৈমন্তী বুঝতে পারল; বলল, কেন?

না–তা হলে… মালিনী বোধহয় দ্বিধায় অথবা লজ্জায় সামান্য ইতস্তত করল। শেষে বলল, বাড়িতে মা বড় ভাবে, হেমদি; এখানে তো অসুখ-বিসুখ। যদি উনি আসেন–একটু বলে দেবেন, আমি ভাল আছি। আমার ভাইকে উনি অফিসে একটিবার বলে দিলেই হবে।

হৈমন্তী ঘাড় নাড়ল, বলল, যদি আসেন, বলে দেব।

মালিনী চলে গেল।

চা খেতে খেতে হৈমন্তী অবনীর কথা ভাবল। অবনী কি আজ আসবে? সেদিনের পর আর আসেনি। বলেছিল, কোন ওপরঅলা নাকি আসবে, সঙ্গে আরও সব লোক–খানিকটা ঘোরঘুরি করতে হবে। আজ প্রায় ছ-সাত দিন হয়ে গেল, অবনীর কাজ যে ফুরোয়নি এমন তো মনে হয় না। তবু কেন আসছে না কে না জানে! কোথাও গিয়েছে, নাকি কোনও কাজে আটকে পড়েছে বোঝা যাচ্ছে না। চা খেতে খেতে অন্যমনস্কভাবে হৈমন্তী অবনীর কথা ভাবছিল, তারপর কী মনে পড়ায় হেসে ফেলল। ভদ্রলোক এলে কথাটা বলতে হবে: কী, আপনি আমার ফেয়ারওয়েলের ব্যবস্থা করছিলেন নাকি? কী দিচ্ছেন-টিচ্ছেন বলুন, আগে ভাগে শুনেনি। এই হালকা চিন্তাটা কয়েক মুহূর্ত মন বেশ সকৌতুক করে রাখল, পরে কেমন যেন বিষণ্ণ হয়ে আসতে লাগল।

ভাল লাগছিল না। ঘরের মধ্যে ছায়ার রং পেনসিলের সিসের মতন কালো ও গম্ভীর হয়ে আসার আগেই হৈমন্তী বাইরে চলে এল, গায়ে পাতলা একটা চাদর, দুপুরের সাদা শাড়িটাই পরনে। মাঠে নামতে আকাশে চোখ পড়ল, আলো প্রায় নেই, মেঘের গা কালচে হয়ে এসেছে, দক্ষিণের এলোমেলো বাতাস, কুয়ায় জল উঠলে–লাটা খাম্বার ওঠানামার শব্দ, এপাশে কয়েকটা গাঁদাফুল, কিচমিচ কিচমিচ শব্দ, নিমগাছের দিকে এক ঝাঁক চড়ুই উড়ে গেল।

হাঁটতে হাঁটতে প্রায় জামতলা, আগে এসময় অন্ধকার হয়ে যেত, হিম পড়ত; এখন হিম পড়ছে না, ঠাণ্ডা নেই, পথ-ঘাটও দেখা যাচ্ছে। মিশনারি থেকে আসা সেই সিস্টার আর পারবতাঁকে দেখা গেল, নদীর দিকটার পথ দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে ফিরছে।

হৈমন্তী উলটো পথেলাঠটার দিকের পথ ধরে হাঁটতে লাগল। আকাশে কোথাও আর নীলের ভাব নেই, পশ্চিমে সামান্য লালচে ভাব আছে এখনও, সূর্য ডুবে যাবার পর যেন মেঘের গা গড়ানো অবশিষ্ট আলো, এখুনি মুছে যাবে। দৃশ্যটা কেমন বেদনা দিল। সেই বিষণ্ণতা যেন কাটছে না। মাঝে মাঝে মনে হচ্ছে, এখান থেকে চলে যাবার সময় হৈমন্তীকে কী যেন ফেলে যাচ্ছে। কিছু খেয়াল না করে হৈমন্তী হাঁটতে লাগল, হাঁটতে হাঁটতে হঠাৎ গুনগুন করে কী যেন গাইবার চেষ্টা করল, অথচ পারল না।

এ-রকম কেন মনে হয়! সে তত বাস্তবিকই কিছু ফেলে যাচ্ছে না। ব্যর্থ, হতাশ, তিক্ত বিরক্ত হয়েই সে চলে যাচ্ছে, তবু এমন কেন মনে হচ্ছে।

আলো ফুরিয়ে অন্ধকার হয়ে আসার সময় হৈমন্তী ফিরছিল, তখন সে গাড়ির শব্দ শুনতে পেল, দূরে। আলো পড়ছিল রাস্তায়।

অবনী আসছে। অবনী আসছে এই চিন্তাটা হঠাৎ যেন এতক্ষণের নৈরাশ্য দূর করল। মাঝরাস্তা থেকে সরে গেল হৈমন্তী, আর সহসা তার খেয়াল হল সে যদি আরও খানিকটা মাঠের দিকে সরে যায় অবনী তাকে দেখতে পাবে না। গাড়ির আলোর বাইরে লুকোবার জন্যে যেন ছেলেমানুষের মতন হৈমন্তী মাঠে নামল, মাঠে নেমে তাড়াতাড়ি সরে যেতে লাগল।

গাড়িটা কাছে এল, একেবারে কাছাকাছি। চলেই যাচ্ছিল যেন, যেতে যেতে দাঁড়িয়ে পড়ল। দেখতে পেয়ে গেছে অবনী।

হৈমন্তী হঠাৎ কেমন লজ্জিত হল। নিজের ছেলেমানুষির জন্যে সঙ্কুচিত হয়ে আস্তে আস্তে কাছে এল।

ওদিকে কোথায়? অবনী শুধোল।

জবাব দেবার তেমন একটা আগ্রহ দেখাল না হৈমন্তী; গাড়ির পাশ ঘেঁষে দাঁড়াল।

আসুন– অবনী গাড়িতে উঠতে বলল।

সামান্য পথ, হেঁটেও যেতে পারত হৈমন্তী; তবু গাড়িতে উঠল।

মাঠের মধ্যে নেমে গিয়েছিলেন কেন? অবনী আবার শুধোল।

এমনি; মাঠে একটু বেড়াচ্ছিলাম।

ডাকলেন না তোত আমায়? অবনী বলল।

হৈমন্তী ভেবেচিন্তে বলল, ডাকার আর কী ছিল, আমিও তো ফিরছিলাম। …

গাড়ি আবার চলতে শুরু করল।

আপনি কি আমার ফেয়ারওয়েলের ব্যবস্থা করছিলেন নাকি এ কদিন? হৈমন্তী বলল, গলায় খানিকটা পরিহাস, খানিকটা বা গাম্ভীর্য।

অবনী প্রথমটায় বুঝতে পারেনি, পরে বুঝতে পেরে হাসল। বলল, না, এখনও করিনি। …ভাবছি ওটা বিজলীবাবুর কাঁধে চাপিয়ে দেব।

নিজের কাঁধ পরিষ্কার রেখে পরের কাঁধে বোঝা চাপানো! খুব চালাক লোক আপনি। হৈমন্তী বলল, বলে হাসল। অবনীও হাসতে লাগল।

দেখতে দেখতে অন্ধ আশ্রমের ফটকের কাছে গাড়ি এসে পড়ল। হৈমন্তী বলল, আপনার সেই ওপরঅলারা এসেছিল?

এসেছিল।

 খুব ব্যস্ত ছিলেন কাজেকর্মে?

না; ওপরঅলারা একদিন থেকেই পালাল। …এপিডেমিকের ভয় দেখিয়ে তাড়ালাম। অবনী হাসল।

তবে?

আমার এক বন্ধু এসেছিল, অবনী বলল, কলকাতা থেকে।

হৈমন্তী তাকাল, কিছু বলল না।

গাড়িটা হৈমন্তীর ঘরের কাছে থামাল অবনী, থামিয়ে স্টার্ট বন্ধ করল। বাতি নেবাল।

হৈমন্তী নামল, অবনীও নেমে পড়ল।

এখানে নতুন হাসপাতাল হয়েছে, জানেন? হৈমন্তী বলল।

 নতুন হাসপাতাল। …ও সেই.যা বলছিলেন। ..কোথায়?

হৈমন্তী আঙুল দিয়ে সবজি বাগানের দিকটা দেখাল। এখান থেকে কিছু দেখা যায় না। পেট্রম্যাক্স বাতিটা আজ ওদিকে জ্বলছে।

ডাক্তার-টাক্তার এসেছে?

হ্যাঁ; ডাক্তার, নার্স, সিস্টার, ওষুধপত্র…। ব্যবস্থা ভালই হয়েছে।

রোগী?

আসছে। এখন চারজন রয়েছে। দশটা বেড।

 তার কী হল? সেই যে–যে-ছোকরা এসেছিল?

হরিকিষণের ভাই! …বেচারি মারা গেছে।

অবনী মুখ ফিরিয়ে তাকাল, আহত ও ব্যথিত হয়েছে। চুপচাপ। হৈমন্তীর পাশাপাশি বারান্দায় এল। মালিনীর গলা শোনা যাচ্ছে, তার ঘরে কেউ আছে, কথা বলছে জোরে জোরে।

হৈমন্তী নিজের ঘরের সামনে এসে দরজার শেকল খুলল। মালিনী ঘরে বাতি জ্বেলে রেখে গেছে। বাতির শিষ নামানো, আলোর একটু ভাব হয়ে আছে ঘরে; হৈমন্তী এগিয়ে এসে বাতির শিষ বাড়িয়ে দিল, জানলা খোলা, বাতাস আসছিল।

অবনী বলল, আমাদেরও একটা কুলি মারা গেছে শুনলাম। কুলি ক্যাম্পে ছিল, শরীর খারাপ হওয়ায় বাড়ি গিয়েছিল, সেখানেই মারা গেছে।

হৈমন্তী কিছু বলল না; বলার কিছু নেই। অবনী দাঁড়িয়ে আছে।

সামান্য পরে হৈমন্তী বলল, আমার কেমন মনে হচ্ছে, রোগটা এইবার আস্তে আস্তে যাবে।

যাবে!

আবার কী! মাস দুয়েক হতে চলল। …এতদিন কেউ গা করেনি, নয়তো এতটা বাড়াবাড়ি হত না। এখন গা লেগেছে। …ওমা, আপনি দাঁড়িয়ে থাকলেন যে, বসুন… বলে মাঝপথে যে কথাটা ছেড়ে এসেছিল আবার সেটা ধরল, এতদিনে বেশ চাড় হয়েছে। তা ছাড়া, এই রোগটা একেবারে আচমকা, অদ্ভুত ভাইরাস থেকেই হচ্ছে বোধহয়। গোড়ায় গোড়ায় ধরা পড়লে মরার তেমন ভয়ও নেই। কমপ্লিকেশান হয়ে গেলেই মুশকিল।

অবনী বসল। বলল, আপনি কি মত পালটাচ্ছেন নাকি?

না। কেন?  

কথা শুনে মনে হচ্ছে, অবনী হাসল, হঠাৎ এতটা অভয় দিচ্ছেন—

না, না। হৈমন্তী মাথা নাড়ল। আমি তো এমনিতেই যাচ্ছি।

অবনী এবার কিছু বলল না। অল্প সময় চুপচাপ। হৈমন্তী বিছানার একপাশে বসেছে।

শেষে অবনী বলল, সুরেশ্বরবাবু এখন কী করছেন? তাঁর ক্রিয়াকর্ম আপাতত কী?

এখন তো খুবই ব্যস্ত। এই এখানে নতুন হাসাপাতালের ব্যবস্থা করা…থাকা-টাকার ব্যাপার ঠিক করে দেওয়া। তা ছাড়া শুনছি, শিবনন্দনজিকে এদিক ওদিক পাঠাচ্ছেন, যেন গাঁ গ্রামে কারও অসুখ করলে সঙ্গে সঙ্গে এখানে চলে আসে৷

অবনী শুনল। শুনতে শুনতে পকেট থেকে সিগারেটের প্যাকেট বের করল। সেদিন–আপনার এখান থেকে ওঁর কাছে গেলাম, বিজলীবাবু ছিলেন, মেজাজটা কেন যেন ভাল ছিল না, খানিকটা তর্কাতর্কি হয়ে গেল!

হৈমন্তী অবনীর চোখ মুখ লক্ষ করল। মনে হল অবনী সেদিনের কোনও বিরূপতা অথবা তিক্ততা আজ আর মনে রাখেনি।

কী নিয়ে তর্ক? হৈমন্তী জানতে চাইল।

অবনী সে-কথার জবাব দিল না। বলল, ভদ্রলোক সংসারের কিছু দেখেননি। একেবারে অন্ধ।

হৈমন্তী কিছু বলল না, বরং সকৌতুক চোখে তাকিয়ে থাকল, যেন সংসার সম্পর্কে অবনীর কতটা অভিজ্ঞতা আছে জানার কৌতূহল সে অনুভব করছিল।

অবনী সিগারেট ধরাল; সামান্য হেসে বলল, ভদ্রলোক বোধহয় মনে মনে ক্ষুণ্ণই হয়েছেন। আমি পরে একটু লজ্জাই পাচ্ছিলাম।

ওই একটা তুচ্ছ কথাতেই ক্ষুণ্ণ হবে…

না, একটা নয়; আরও কী যেন সব বলেছিলাম। বলে অবনী যেন নিজের সেদিনের ব্যবহারে লজ্জিত হয়ে হাসল। পরে বলল, আমায় একবার সুরেশ-মহারাজের কাছে যেতে হবে…..

মাপ চাইতে–? হৈমন্তী পরিহাস করে বলল।

 না অবনী সরল গলায় হাসল, মাপ চাইতে নয়। ওঁকে কিছু টাকা দেবার আছে।

টাকা? হৈমন্তী বিস্মিত হল।

আমার মনে হয় উনি কিছু টাকার টানাটানিতে পড়েছেন; বিজলীবাবুকে বলেছিলেন। টাকাটা এনেছি।

আপনি কি আশ্রমে দান করছেন নাকি?

আমি! না, আমি দান করব কেন? আমার টাকা কোথায়! বিজলীবাবু দিয়েছেন। …উনি নিজে এসে দিলেই ভাল হত। আসতে পারলেন না।

ও! হৈমন্তী অন্য দিকে চোখ ফিরিয়ে নিলে।

অবনী সিগারেটের ছাই ফেলতে গিয়ে ট্রাউজার্সে ফেলল, হাত দিয়ে ঝেড়ে নিল। বলল, একবার, এই আশ্রম করার সময় সুরেশ্বরবাবু কিছু চাঁদার জন্যে আমায় বলেছিলেন, আমি দিইনি। ..তখন এসব আমার পছন্দ হত না। ……চাঁদা-টাঁদার জন্যে আর কখনও আমায় কিছু বলেননি উনি। …এই টাকাটা বোধ হয় ধারকর্জ করলেন। আমাদের স্টেশনের দিকে ওঁর কিছু মাড়োয়ারি ভক্ত আছে।

হৈমন্তী নীরব থাকল।

অবনী কিছু সময় অপেক্ষা করে বলল, টাকাটা বিজলীবাবু নিজেও দিতে পারেন, জানি না। আমায় তো তা বললেন না। লজ্জায় বোধহয়।

কী জানি। হৈমন্তী পরিহাস করে বলল, আপনিও দিতে পারেন; লজ্জায় বলছেন না।  

না না, অবনী মাথা নাড়ল জোরে, আমি নয়।

অত না না-র কিছু নেই। দিলেই বা– হৈমন্তী হেসে উঠল, সৎ কাজে দিচ্ছেন তো৷

অবনীও হাসল। তখন দিইনি ঠিক, কিন্তু এখন যদি সুরেশ-মহারাজ আমায় বলতেন, হয়তো যথাসাধ্য সাহায্য করতাম।

করতেন! ..তবে তো আপনিও দেখছি ওঁর ভক্ত।

ভক্ত নয়। তবু ভদ্রলোককে কোনও কোনও ব্যাপারে আমার ভাল লাগে।

আগে লাগত না

আগে এতটা পরিচয় ছিল না। জানতাম না তেমন। এখন মোটামুটি একটা ধারণা করতে পারি। অবনী ধীরস্থির গলায় বলল, সামান্য অন্যমনস্ক। দোষ যে নেই তা বলব না, দোষ আছে ভদ্রলোকের, অন্তত আমার চোখে। তবু, মানুষটি ভাল।

হৈমন্তী শেষবারের মতন যেন পরিহাস করার চেষ্টা করল, এত প্রশংসা–।

সুরেশ-মহারাজের নিন্দেও কম করিনি, একটু আধটু প্রশংসা করলে ক্ষতি কী! অবনী হেসে জবাব দিল।

আর কোনও কথা হল না। দুজনেই চুপ করে থাকল। হৈমন্তী বসে থাকতে থাকতে উঠল, বসুন, মালিনী আছে কি না দেখি, চা খেয়ে যান।

হৈমন্তী চলে গেল। অবনী বসে থাকল। জানলা দিয়ে সন্ধের ঠাণ্ডা হাওয়া আসছে, বাইরে কোথাও চিপ চিপ করে একটা পোকা ডাকছে, গাছপাতার মৃদু খসখসে শব্দ, অবনী অন্যমনস্ক, শূন্যদৃষ্টি, হৈমন্তীর বিছানার দিকে তাকিয়ে কিছু যেন ভাবছিল।

হৈমন্তী ফিরে এল।

মালিনী বলছিল– হৈমন্তী বলল, অফিসে ওর ভাইকে একটা খবর দিয়ে দিতে: ও ভাল আছে। ওর মা খুব চিন্তা করেন, এখানে অসুখ-বিসুখ…

অবনী তাকাল, হৈমন্তীকে দেখল। ও বাড়ি যায় না?

যায়; তবে এখন আর যেতে পারছে না।

কেন? ও কী করে?

কী আর, এই কাজকর্ম। ওর দাদাকে দেখাশোনা করে… হৈমন্তী যেন একটু ব্যঙ্গ করল।

অবনী বুঝতে পারল। কিছু বলল না।

হৈমন্তী বসল। দু-এক মুহূর্ত চুপচাপ। তারপর বলল, আমি আগামী রবিবার যাচ্ছি। গগনকে চিঠি লিখে দিয়েছি।

আগামী রবিবার ..কত তারিখ পড়ছে?

 উনিশ কুড়ি হবে– হৈমন্তী হিসেব করল, করে শুধরে নিয়ে বলল, উনিশ তারিখ।

অবনী যেন মনে মনে দিন-ক্ষণ ভেবে নিল। বলল, যাবার আগে আমাদের ওদিকে আসুন একদিন।

ফেয়ারওয়েল নিতে? হৈমন্তী হাসল।

 অবনীও হাসির মুখ করল। এক রকম তাই।

যাব। বিজলীবাবুর বাড়িতে দেখা করে না গেলে খারাপ দেখাবে।

কবে যাবেন?

পরশু দিনও যেতে পারি।

 পারি কেন, আসুন। পরশুই আসুন।

আজকাল খেয়াল মতন বাস আসে। প্যাসেঞ্জার না থাকলে দুপুরে আসেই না।

যে কোনও বাসে চলে আসুন। সকালে হলেই ভাল। …আমরা ফেয়ারওয়েলের জন্যে ফুলের তোড়া মালা-টালা ঠিক করে রাখব। অবনী ঠাট্টা করে হাসতে হাসতে বলল।

হৈমন্তী ভ্রূ-ভঙ্গি করে তাকাল। হেসে বলল, কলকাতায় যেতে যেতে ফুল সব শুকিয়ে ঝরে যাবে। গগনকে আমি বিশ্বাস করাতে পারব না, আমার ফেয়ারওয়েল হয়েছিল।

অবনী জোরে জোরে হাসতে লাগল। পরে বলল, আমিও কলকাতা যাচ্ছি। এমনভাবে বলল যেন প্রয়োজন হলে সে গগনের কাছে সাক্ষী দিতে পারে।

আপনিও যাচ্ছেন! কবে?

একটু দেরি আছে। আসছে মাসে।

অফিসের কাজে?

অফিস…! না; কলকাতায় আমাদের অফিসের কিছু নেই, আমাদের সব পাটনায়। বলতে বলতে অবনী থামল, প্রথমে মাটির দিকে তাকাল, পরে ছাদের দিকে। মনে হল সে প্রসঙ্গান্তরে এসে খানিকটা অস্বস্তিতে পড়ছে।

মালিনীর পায়ের শব্দ উঠছিল বারান্দায়; চা নিয়ে ঘরে এল।

হৈমন্তী উঠে মালিনীর হাত থেকে চায়ের পেয়ালা নিল, নিয়ে অবনীর দিকে বাড়িয়ে দিল।

 মালিনী চলে গেলে হৈমন্তী নিজের জায়গায় এসে বসল। অবনী চায়ে চুমুক দিয়েছে মাত্র। তার মুখ এখন কেমন গম্ভীর, অন্যমনস্ক দেখাচ্ছিল।

হৈমন্তী বলল, তবে কলকাতায় কেন? বেড়াতে?

অবনী কিছু বলল না, মাথা নাড়ল আস্তে; না বেড়াতে নয়।

হৈমন্তী সপ্রশ্ন চোখে তাকিকে থাকল।

অবনী মুখ ফিরিয়ে দরজায় দিকে তাকিয়ে ছিল। কলকাতা থেকে কমলেশ এসেছিল। চিঠিতে সব হয় না, কথাবার্তা ছিল অনেক। ললিতা এখন পুরোপুরিভাবে অন্যের কাছে থাকছে। কুমকুমকে বাপের বাড়িতে রেখে দিয়েছে, মাসি মামার কাছে। আসে কখনও কখনও। তার নামের টাকাটা নেয়। ললিতা বুঝে ফেলেছে, কুমকুম হঠাৎ বাপের সোহাগী হয়ে গেছে: শয়তানের মেয়ে তো, ওই এক রত্তি হলে কি হবে পেটে পেটে শয়তানি। কমলেশকে ললিতা আরও অনেক কিছু বলেছে: রাখো, রাখো, ন্যাকামি করো না। আমি জানি ওই হারামজাদি তার পেয়ারের বাপকে চিঠি লেখে। … তুমি তো তোমার বন্ধুর স্পাইগিরি করছ। আমি বারে গিয়ে মদ গিলি এসব তুমি বলেছ। মেয়ে জেনেছে তো আমার বয়েই গেছে। পেটে ধরেছি তা কী হয়েছে, আমার অত মা-মা আদুরেপনা নেই। আমি না হলে অন্য কেউ তোমার ওই গুণধর বন্ধুর মেয়ে পেটে ধরত না। আমি কেয়ার করি না, যাও যাও তোমার বন্ধুকে লিখে দিয়ো…ডিভোর্সের ব্যবস্থা করুক..আমি অ্যাডালট্রেস…হ্যাঁ–বেশ করি আমি অন্য লোকের সঙ্গে থাকি। থাকব, থাকব। নিয়ে যাক তার বাপ মেয়েকে। মেয়ে একবার চিনুক কেমন বাপ। কুত্তা, বংশের ঠিক নেই, যার মা থিয়েটারের মাগী ছিল, বাপ…

ঠননন করে শব্দ হল। চমকে উঠল অবনী। তার হাত থেকে চায়ের কাপটা মাটিতে পড়ে ভেঙে ছড়িয়ে গেছে।

হৈমন্তী চমকে উঠেছিল। ভাঙা পেয়ালা, ছড়ানো চা, অবনীর সচকিত বিহ্বল ভাব–দেখতে দেখতে হৈমন্তী অবাক হয়ে বলল, কী হল?

অবনীর কপালে ঘাম ফুটে উঠেছিল। গলার কাছটাও জল। তাড়াতাড়ি দাঁড়িয়ে উঠে ট্রাউজাসের ওপর থেকে চা ঝেড়ে ফেলতে লাগল; পকেট থেকে রুমাল বের করল। বিব্রত, আড়ষ্ট। না হঠাৎ কেমন হাতটা… বড্ড গরম…। অবনী কপাল মুখ মুছে ফেলল। অতিরিক্ত বিহ্বল যেন।

শরীর খারাপ লাগছে?

না, না। মুখ মুছে অবনী নিজেকে সামলে নেবার চেষ্টা করল, বুঝতে পারলাম না হঠাৎ কেমন…

মাথা ঘুরে গেল?

না।

অন্য দিকে তাকিয়ে কি অত ভাবছিলেন?

কিছু না। তেমন কিছু নয়।

বাঃ ভাবছিলেন–

সেরকম সিরিয়াস কিছু নয়। …হঠাৎ পুরনো একটা কথা মনে পড়ল..অবনী যথাসাধ্য সংযত ও সুস্থ হবার চেষ্টা করল। ছি ছি, কাপ-টাপ ভেঙে একটা কেলেঙ্কারি কাণ্ড করে ফেললাম। অবনী লজ্জিত।

জামা-টামায় যে একরাশ চা ফেললেন– হৈমন্তী উঠে জল গড়িয়ে দিতে গেল।

উঠে যাবে। অবনী বলল।

গেলে ভাল। তবে এমন দাগ যায় না।

অবনী তাকাল, হৈমন্তীর দৃষ্টি লক্ষ করল। মনে হল, হৈমন্তীর বিস্ময় ও কৌতূহল যেন আরও গভীর হয়েছে।

জল দিয়ে চায়ের দাগ মুছতে মুছতে অবনী বলল, আমি সুরেশ্বরবাবুর ওখান থেকে ঘুরে আসি। টাকাটা না দেওয়া পর্যন্ত স্বস্তি পাচ্ছি না।

হৈমন্তী ঘাড় হেলিয়ে বলল, আসুন।

অবনী চলে গেল।

.

৩০.

নিঃশব্দে বারান্দা পেরিয়ে মাঠে নেমে এল অবনী। মালিনী সিঁড়ির কাছাকাছি অন্ধকারে দাঁড়িয়ে ছিল, অবনী তাকে লক্ষ করল না। মাঠে নেমে কয়েক পা সামান্য দ্রুত হেঁটে আসার পর নিজের চাঞ্চল্য সম্পর্কে যেন সচেতন হয়ে যথাসাধ্য সংযত হবার চেষ্টা করল। চারপাশ তাকিয়ে দেখল, মনে হল যেন চাঁদ উঠেছে কিংবা উঠছে, ঈষৎ জ্যোৎস্না দেখা দিচ্ছে, গাছ এবং ঝোপঝাড়ের ছায়া, অন্ধকুটিরের দিক থেকে একেবারে দেহাতি গলায় গানের মতন একটা সুর ভেসে আসছে। নিজের মনে পায়চারি করার মতন আস্তে আস্তে হাঁটতে লাগল, হাঁটতে হাঁটতে একটা সিগারেট ধরাল।

চায়ের কাপটা যে কী করে হাত থেকে পড়ে গেল, অবনী বুঝতে পারছিল না। এখনও এই সামান্য ঘটনার জন্যে তার অস্বস্তি এবং লজ্জা হচ্ছিল। অবনীর মনে হল, সম্ভবত সে খুব বেশি অন্যমনস্ক হয়ে পড়েছিল, চায়ের কাপ কাত হয়ে গিয়েছিল একেবারে, তারপর কোনও রকমে গরম চা চলকে তার হাতে পড়তে সে হাত থেকে কাপটা ছেড়ে দিয়েছিল। কাপটা মাটিতে পড়ে ভেঙে যাওয়ায় সে এত লজ্জিত ও বিব্রত হয়ে পড়েছিল যে তার মনে হল, এতটা অন্যমনস্ক হবার কোনও কৈফিয়ত সে হৈমন্তীকে দিতে পারবে না। তার আশঙ্কা হচ্ছিল, হৈমন্তী অত্যন্ত বিস্মিত হয়ে, কৌতূহল অনুভব করে, বা কোনও কিছু সন্দেহ করে তাকে লক্ষ করছে। অনেকটা যেন উঁকি দেবার মতন করে অবনীকে আড়ালে দেখছে–এ রকম মনে হল। লজ্জায় এবং অস্বস্তিতে, খানিকটা বা গোপনতা প্রকাশ হতে পারে এই উদ্বেগে সে ঘামতে শুরু করেছিল। অবশ্য, অবনীর এখন মনে হল, ললিতা কমলেশকে যেসব কথা বলেছে তা মনে পড়ায় সে ওই মুহূর্তে কিছুটা উত্তেজিত এবং ক্রুদ্ধও হয়েছিল। ললিতা একটা পাঞ্জাবি না সিন্ধি সেলস ম্যানেজারের সঙ্গে বার-এ বার-এ ঘুরে মদ গিলে কাপড়-চোপড় খুলে লুটোপুটি খাচ্ছে কি না, বা সেই সেলস ম্যানেজারের গলা আঁকড়ে পায়ে পা জড়িয়ে বিছানায় ঘুমোচ্ছ কি না– এসব ব্যাপারে অবনীর কোনও আগ্রহ নেই, রাগও নেই। কিন্তু ললিতা অন্য যেসব কথা কুমকুম সম্পর্কে কমলেশকে বলেছে, কিংবা অবনী সম্পর্কে, তাতে অবনী ক্ষিপ্ত হতে পারে, এবং হয়েছে। নিজেকে অপমানিত বোধ করলে মানুষ ক্ষিপ্ত হয়। কুমকুমের কাছে যদি ললিতা চেঁচিয়ে কুৎসিত ভাবে এসব কথা বলে-তোর ঠাকুমা তো থিয়েটারের মাগী ছিল; তোর বাপের জাত-জন্মের ঠিক নেই…তবে তবে কী হতে পারে! মেয়েটাকে ললিতা এখনও তার বাবার সম্পর্কে বিষিয়ে রাখতে চায়। এতটা বিতৃষ্ণা, বিদ্বেষ এখনও ললিতার থাকা উচিত না। যা হবার হয়ে গেছে; তারপর ললিতা নিজের মর্জি মতন, খেয়াল খুশি মতন দিন কাটাচ্ছে; তার সুখে সম্ভোগে কেউ বাধা দিচ্ছে না; সে তার পছন্দ মতন জীবনের দিকে সরে গেছে; তবু–অকারণ কেন ললিতা মেয়েটাকে তার মতন কুৎসিত কদর্য নোংরা করতে চায়–অবনী বুঝতে পারে না। মানুষের মনে ঘৃণা কত তীব্র হতে পারে, কী ভীষণ ভাবে ভর করতে পারে প্রেত-টেতের মতন, এবং তার ফলে মানুষ কতটা উন্মাদ হতে পারে ললিতা তার উদাহরণ।

অবনী থমকে দাঁড়াল। তাকিয়ে দেখল সে হাঁটতে হাঁটতে সবজিবাগানের দিকে চলে এসেছে। সামনে একটা পেট্রম্যান্স বাতি জলছে। অবনী বুঝতে পারল, নতুন হাসপাতাল-ঘরের সামনে সে এসে পড়েছে। দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কয়েক মুহূর্ত দেখল: সরু ফালি বারান্দার মাঝামাঝি ঢালু চালের কাঠকুটোর সঙ্গে বাতিটা ঝুলিয়ে রাখা হয়েছে; আলোটা তেমন জোরালো নয়, বারান্দা এবং সামনের মাঠের খানিকটা আলো পাচ্ছে, নীলচে আলো। বারান্দায় কাউকে দেখা যাচ্ছে না; ঘরের জানলা বন্ধ, দরজা এখনও খোলা; কোনও সাড়া শব্দ আসছিল না। অবনীর মনে হল, বাতিটা সম্ভবত আসা-যাওয়ার সুবিধের জন্যে রাখা হয়েছে। বাতাসে মাঝে মাঝে একটা উগ্র গন্ধ আসছিল, ফিনাইল বা লায়জলের হতে পারে। গন্ধটা অবনীর ভাল লাগল না। এত শান্ত, নিঃশব্দ, অসাড় হয়ে আছে ঘর দুটো যে অবনীর মনে হল, কয়েকটা মানুষ যেন বাতি জ্বালিয়ে কোনও কিছুর ভয়ে নিঃশব্দে বসে আছে।

সিগারেটের টুকরোটা ফেলে দিয়ে অবনী এবার ফিরল। পেছন থেকে পেট্রম্যাক্সের আলোর সামান্য আভা আসছিল; অল্প এগিয়ে আসতেই আবার অন্ধকার, অন্ধকারে খুব পাতলা জ্যোৎস্না ধরেছে। অবনী আবার তার বিহ্বলতার কথা ভাবতে লাগল: আজকাল মাঝে মাঝেই মনে হয় নিজের জীবনের গোপনীয়তা সম্পর্কে সে বেশ উদ্বেগ বোধ করে এবং সতর্ক হয়ে পড়ছে। আগে এসব ছিল। , এটা তো কোনওমতেই নয়। আত্মসম্মান বোধটাও এখন যেন অভিমানের মতন হয়ে উঠেছে। ললিতার সঙ্গে যখন তাকে থাকতে হত তখন ললিতা এমন বহু কথা বলেছে যাতে আত্মসম্মান থাকে না; অথচ অবনী সে সময় বড় একটা ক্ষেপে উঠত না, বরং উপেক্ষা করত, পালটা একটা জবাব দিত– রুক্ষ, তিক্ত, পালটা জবাব। হয়তো তখন জবাব দেবার সুযোগ ছিল বলেই এতটা লাগত না; আজকাল লাগে। মনে হয় তাকে কেউ দেওয়ালে পিঠ লাগিয়ে দাঁড় করিয়ে দিয়ে যেন নির্বিচারে আঁচড়ে কামড়ে খিমচে মুখে থুতু ছিটিয়ে চলে যাচ্ছে–সে পালটা কিছু করতে পারছে না। ফলে রাগটা আরও বাড়ে, আক্রোশ হয়।

না, এসব কিছু না–অবনী মাথা নাড়ল: আক্রোশ, রাগ-টাগ সব বাজে। আসলে সে এখন নিজের জীবনের এইসব গোপনীয়তা নিয়ে কখনও কাতর, কখনও শঙ্কিত, কখনও বা বিব্রত হয়ে পড়েছে। এক এক সময় মনে হয়, যেন কেউ তার দু-হাতে হাতকড়া দিয়ে কোথাও নিয়ে যাচ্ছে, রাস্তায় দাঁড়িয়ে হৈমন্তী, গগন, সুরেশ্বর তাকে দেখছে; নিজের মুখ দুহাতে সে ঢেকে ফেলেছে অবশ্য, তবু হাতকড়ার আলগা শেকল গালে অনবরত ঘষে যাচ্ছে। নিজের মুখ ঢাকলেও সে যে নিজেকে লুকোতে পারছেনা তা নয়, তবু চোখাচোখি হয়ে যাবার ভয়ে বা ওদের বিস্মিত ধিক্কার-দৃষ্টি সহ্য করার গ্লানি সে এড়াতে চাইছে বলে মুখ ঢেকেছে।

ঠিক কেন যে, অবনী জানে না, কিন্তু হৈমন্তীর কাছে নিজের এই গোপনীয়তা প্রকাশ করার ইচ্ছে। তার হয়। মা কী ছিল, বাবা কে ছিল, কী ভাবে সে মানুষ–এসব কথা এবং ললিতা ও কুমকুমের কথা হৈমন্তীকে জানাতে পারলে ভাল হত। তার সম্পূর্ণ পরিচয় হৈমন্তী জানে না। এখন পর্যন্ত একটা লুকোচুরি থেকে গেছে। হৈমন্তীর তরফ থেকে এরকম কিছু নেই, যেটা ছিল সুরেশ্বরের সঙ্গে তার সম্পর্ক–সেটা অবনীর জানা হয়ে গেছে।

তুমি এসব কথা বলার জন্যে এত ব্যস্ত কেন? অবনী যেন বিড়বিড় করে নিজেকে কথাটা শুধোল। এবং সঙ্গে সঙ্গে একটা সহজ জবাব পেল। জবাবটা সহজ হলেও তা তার মনঃপূত হল না। কয়েক পা হেঁটে এসে সে অন্য কিছু বলতে যাচ্ছিল, কাছাকাছি গলার শব্দ পেল, কে যেন ডাকল: অবনী দাঁড়াল, তাকিয়ে দেখল সুরেশ্বর।

খোলামেলা মাঠের মধ্যে দিয়ে সুরেশ্বর এল, সামান্য তফাতে ছিল বোধহয়। অবনী খেয়াল করে দেখল তারা আশ্রমের মাঠে মাঝামাঝি জায়গায় দাঁড়িয়ে আছে।

কাছে এসে সুরেশ্বর বলল, এদিকে কোথায়…?

এই একটু পায়চারি করছিলাম–অবনী বলল, বলে কী ভেবে আবার বলল, আপনাদের নতুন হাসপাতাল দেখে এলাম।

সুরেশ্বর পা বাড়াল, পাশাপাশি অবনীও হাঁটতে লাগল। সুরেশ্বর বলল, কোনও রকমে তাড়াতাড়ি একটা ব্যবস্থা করা…।

হাঁটতে হাঁটতে অবনী খানিকটা যেন ঠাট্টা করেই বলল, আমার তো আগে বিশ্বাস হয়নি ডাক্তার-টাক্তার আসবে। যাক, শেষ পর্যন্ত এসেছে। আপনার কথাই ঠিক হল।

সুরেশ্বর কিছু বলল না।

মাঠে হালকা জ্যোৎস্না ফুটে উঠেছে, বাতাসে উগ্র গন্ধটা আর আসছিল না। কয়েকটা গাঁদা ফুলের গোল মতন একটা ঝোপ; ঝোঁপের পাশ দিয়ে সরাসরি মাঠ ভেঙে ওরা সুরেশ্বরের ঘরের দিকে এগুতে লাগল।

আপনার কাছেই যেতাম, অবনী বলল, বিজলীবাবু কিছু টাকা পাঠিয়েছে।

সুরেশ্বর ঘাড় ফিরিয়ে অবনীকে দেখল। যেন বলতে চাইল, টাকাটা আপনি বয়ে আনলেন, বিজলীবাবু কই?

অবনী বলল, উনি একটা কাজেকর্মে আটকা পড়েছেন, নয়তো আসতেন।

ওঁর বাড়ির খবর সব ভাল।

খারাপ কিছু শুনিনি।

দুজনেই তারপর হঠাৎ কেমন নীরব হয়ে গেল। দমকা বাতাস এল, ঈষৎ ঠাণ্ডা–মরা শীতের বাতাস, অথচ শুকনো; দুরের গাছপালায় শব্দ হল সামান্য। মাঠেঘাটে কোথাও কুয়াশা নেই, হিমের ঝাপসা ভাবও চোখে পড়ছে না, আকাশ পরিষ্কার।

কাল এখানে একজনের একটু বাড়াবাড়ি গিয়েছে সুরেশ্বর বলল, আজ দুপুর থেকে অবশ্য বেশ ভাল। আমি তারই খোঁজ নিতে গিয়েছিলাম ডাক্তারের কাছে।

অবনী শুনল। সুরেশ্বরের নতুন হাসপাতাল বা রোগীর কথা সে আর চিন্তা করছিল না। এমনকী বিজলীবাবু তার হাত দিয়ে টাকা পাঠানোয় সুরেশ্বর অসন্তুষ্ট বা ক্ষুণ্ণ হয়েছে কিনা–অবনী তাও ভাবছিল না। সে অন্যমনস্কভাবে হাঁটছিল এবং হৈমন্তীর কথা ভাবছিল। সুরেশ্বরের সঙ্গে হৈমন্তী সম্পর্কে কথাবার্তা বড় কখনও হয়নি। বা যা হয়েছে তা হৈমন্তীর ডাক্তারি হাতযশের। এখন অবনীর জানতে কৌতূহল হচ্ছিল, সুরেশ্বর হৈমন্তী সম্পর্কে আপাতত কী ভাবে! তার কোনও অনুযোগ আছে কি না! থাকা স্বাভাবিক। অথবা সুরেশ্বর নিজের ভুল সম্পর্কে কতটা সচেতন, এমনকী অনুতপ্ত কি না!

যথাসম্ভব স্বাভাবিক গলায় অবনী বলল, উনি তো চলে যাচ্ছেন।

সুরেশ্বর কথাটা শুনল, কোনও জবাব দিল না।

অবনী সামান্য অপেক্ষা করল, বলল, আপনার মুশকিলই হল…

সুরেশ্বর এবারও নীরব থাকল। অবনী বুঝতে পারল, সুরেশ্বর প্রসঙ্গটা আলোচনা করতে চায় না। বোধ হয়, অবনীর এবার মনে হল, সে ভুল করেছে; হয় সুরেশ্বর এই ব্যক্তিগত প্রসঙ্গ উত্থাপন করতে আগ্রহী নয়, না হয় সে পরাজিত পক্ষ বলে প্রসঙ্গটায় লজ্জা অনুভব করছে।

অবনী কেমন অস্বস্তি বোধ করল। বোকার মতন এই প্রসঙ্গটা সে কেন তুলল। চুপচাপ, যেন কিছুটা বিব্রত এবং কুণ্ঠিত হয়ে অবনী হাঁটছিল।

সুরেশ্বরের ঘরের কাছাকাছি ওরা পৌঁছে গিয়েছিল। আজ কোথাও কাউকে দেখা যাচ্ছে না, কলাঝোঁপের দিকে কয়েকটা জোনাকি উড়ছিল, টিমটিমে একটা লণ্ঠনের আলোও যেন সুরেশ্বরের বারান্দায় রাখা হয়েছে।

বাড়ির কাছাকাছি পৌঁছে সুরেশ্বর হঠাৎ বলল, হেম, অনেকদিন থেকেই যাব যাব করছিল, আমিই তাকে আটকে রেখেছিলাম।

অবনী তাকাল, সুরেশ্বরের গলায় স্বর পরীক্ষা করার চেষ্টা করল। কিছু বোঝা গেল না, বোঝা গেল, সুরেশ্বর মনে মনে বিরক্ত কি না অথবা তার কোনও অনুযোগ আছে কি না।

বাগানের মাঝ দিয়ে তারা ঘরের সিঁড়িতে এসে পা দিল।

অবনী বলল, আপনাকে আবার দেখছি একজন ডাক্তার খুঁজতে হবে…।

খুঁজছি। সুরেশ্বর অন্যমনস্কভাবে জবাব দিল।

 ঘরে আসার আগে সুরেশ্বর চৌকাঠের কাছ থেকে লণ্ঠনটা তুলে নিয়েছিল; ঘরে এসে টেবিলের ওপর রাখল। শিষ সামান্য বাড়িয়ে দিল। বলল, বসুন। …আমি আসছি। বলে পাশের ঘরে চলে গেল। অবনী চেয়ার টেনে নিয়ে বসল।

পাশের ঘরে সুরেশ্বরের হাঁটাচলার শব্দ পাওয়া যাচ্ছিল। মনে হল না, এ বাড়িতে আর কেউ আছে। ভরতুও বোধ হয় নেই। অবনী বসে বসে অন্যমনস্কভাবে একটা সিগারেট ধরাল। হৈমন্তীর প্রসঙ্গটা তুলে সে বোকামি করেছে বলে আগে মনে হয়েছিল, এখন মনে হল–বোকামির কিছু হয়নি। বরং কথাটা না বললে সুরেশ্বর ভাবতে পারত, সব জেনেশুনেও সে কিছু না-জানার ভান করছে। হৈমন্তীর কাছে যার এত আসা-যাওয়া সে কি জানে না হৈমন্তী কলকাতায় চলে যাচ্ছে! জানে নিশ্চয়, জেনেও কথাটা তুলল না। সৌজন্যবশে কিংবা কথার মধ্যেও এ কথাটা একবার বলা স্বাভাবিক ছিল। তবু অবনী কেন বলল না?

এমনও হতে পারে, অবনী ভাবল: সুরেশ্বর হয়তো মনে মনে এধারণাও করতে পারে হৈমন্তীকে কলকাতায় ফেরত পাঠানোর মধ্যে অবনীর কিছুটা হাত আছে। হয়তো, অবনী এবং হৈমন্তীর মধ্যে যেরকম ঘনিষ্ঠতা হয়েছে তাতে অবনীর কিছু স্বার্থ থাকতে পারে; স্বার্থের জন্যে এবং সুরেশ্বর ও তার অন্ধ আশ্রমের প্রতি অবনীর বিতৃষ্ণা থাকার দরুন হৈমন্তীকে সে আরও বিরূপ করে তুলেছে। এরকম একটা সন্দেহ অবনীর আগেও হয়েছে, কিন্তু সে গ্রাহ্য করেনি। গ্রাহ্য করলেও বা কী হত, তার করার কিছু ছিল না। আজ, এখন অবনীর মনে হল, সুরেশ্বর যেন তাকে এ ব্যাপারে কোথাও দায়ী করে রেখেছে। চিন্তাটা অবনীর খারাপ লাগছিল। সে এতদিন গোপনে সুরেশ্বরের বিরুদ্ধে কোনও শঠতা বা ষড়যন্ত্র করেছে–এ ধরনের চিন্তা অসহ্য। …অবনী কিছু করেনি, কিছুনা; তবু যদি সুরেশ্বর এরকম কিছু ভেবে নিয়ে থাকে তবে সেটা অন্যায়। অবনী কেমন ক্ষুব্ধ হল।

সুরেশ্বর এল; বলল, ভরতু নেই; একটু চায়ের জল চাপিয়ে দিয়ে এলাম।

অবনী বেশ অন্যমনস্ক হয়ে পড়েছিল, হঠাৎ যেন হুঁশ হল, সুরেশ্বরকে বসতে দেখল।

সুরেশ্বর বলল, হেম বোধ হয় দু-চার দিনের মধ্যেই যাবে।

আগামী রবিবার, অবনী বলল, বলে তাকিয়ে থাকল।

হ্যাঁ, ওই রকমই হবে।

অবনী বুঝতে পারল না সুরেশ্বর ইচ্ছাকৃত ঔদাসীন্য দেখাচ্ছে কি না। নয়তো তার জানা উচিত ছিল হৈমন্তী কবে যাচ্ছে।

সুরেশ্বর যেন কী বলতে যাচ্ছিল, অবনী বাধা দিল, বাধা দিয়ে বলল, উনি চলে যাওয়ায় আপনার ক্ষতি হবে না?

হবে প্রথম প্রথম।

না, সেরকম নয়– অবনী কোনও রকমে যেন প্রসঙ্গের মধ্যে আসতে চাইছিল, আপনি বোধ হয় অনেক আশা করে ওঁকে এনেছিলেন। এমনি একটা ডাক্তার জুটিয়ে আনা বলে আমার মনে হয়নি।

সুরেশ্বর সঙ্গে সঙ্গে কোনও জবাব দিল না, তার মুখভাবেরও তেমন কোনও পরিবর্তন চোখে পড়ল না অবনীর। পরে সুরেশ্বর বলল, হ্যাঁ, আশা ছিল। কিন্তু কী করা যাবে, হেম থাকতে পারল না। বলে সুরেশ্বর অল্প থেমে যেন হৈমন্তীর অপরাধের ভার কিছু লাঘব করার জন্যে বলল, কলকাতায় হেমের বাড়ির লোকরাও ওকে ছেড়ে থাকতে পারছে না।

অবনী মনোযোগ দিয়ে লক্ষ করছিল, সুরেশ্বর কীভাবে প্রসঙ্গটা এড়িয়ে যাবার চেষ্টা করছে। সরাসরি সে কিছু বলতে চায় না। সুরেশ্বরের চোখমুখ লক্ষ করতে করতে অবনী সিগারেটের বাকিটুকু শেষ করল, করে টুকরোটা জানলা দিয়ে ফেলে দিল।

অবনী বলল, আমি শুনেছি, আপনার ইচ্ছেতেই নাকি ওঁর ডাক্তারি পড়া…

কে বলল? হেম?

গগন।

হ্যাঁ, খানিকটা সেই রকমই। আমার আগ্রহ ছিল, ওরও অনিচ্ছে ছিল না। হেম বেশ বুদ্ধিমতী, পরিশ্রমী। ধীরে সুস্থে বিবেচনা করে দেখতেও পারে। ডাক্তার হিসেবে ভালই। তা ছাড়া ওর অভিজ্ঞতা অল্প; এই তো সবে পাশ করে বেরিয়েছে। দু-পাঁচ বছর পরে আরও ভাল হবে…

অবনী নিরাশ হল; সুরেশ্বরকে হৈমন্তীর বিষয়ে কিছু বলানো যাবে না। বললেও সুরেশ্বর যা বলবে তা অনেকটা মামুলি, যেন হৈমন্তীর চরিত্র এবং ডাক্তারি সম্পর্কে সার্টিফিকেট দিচ্ছে। অবনীর পক্ষেও আর কিছু বলা সম্ভব নয়। তবু শেষবারের মতন, খানিকটা যেন ঝোঁকের মাথায় অবনী বলল, আপনি বোধহয় কোথাও খানিকটা ভুল করে ফেলেছিলেন।

সুরেশ্বর তাকাল।

অবনী বলল, আমার ধারণা, আপনি ঠিক একজন চোখের ডাক্তার চাননি এখানে। আরও কিছু আশা করেছিলেন।

সুরেশ্বর কোনও জবাব দিল না। তার মুখ দেখে মনে হল না, সে অসন্তুষ্ট।

অবনী বলল, আপনার এই আশ্রমের জন্যে আপনার যত মায়া, ওঁর তা ছিল না। আমার মনে হয়েছে, আপনি ডেডিকেটেড, উনি তা নন।

হেম খুব কর্তব্যপরায়ণ… সুরেশ্বর আস্তে করে বলল।

 হ্যাঁ, কিন্তু আপনার মতন এই সেবা-টেবায় নিজেকে উৎসর্গ করেননি।

 না, সুরেশ্বর মাথা নাড়ল; তার মাথা নাড়ার মধ্যে হৈমন্তী সম্পর্কে বিরক্তি বা অভিমান ফুটল না। বলল, সকলের স্বভাব এক হয় না; হেমের স্বভাব আলাদা…

আপনি বোধহয় আপনার স্বভাবের মতন কাউকে চেয়েছিলেন।

কী জানি! সুরেশ্বরকে এবার সামান্য বিব্রত দেখাল।

জগতে এই একটা মজা দেখি, অবনী বলল, অনেকে নিজের গরজটা অন্যের গরজ মনে করে নেয়। …

সুরেশ্বর হয়তো কিছু বলত, কিন্তু শেষ পর্যন্ত নিজেকে সংযত করল। তারপর যেন কথাটা হালকা করার জন্যে হেসে বলল, গরজ বড় বালাই। …বসুন, চায়ের জল বোধ হয় ফুটে গেছে। চা নিয়ে আসি৷ আস্তে করে উঠে দাঁড়াল সুরেশ্বর, চেয়ার সরিয়ে চলে গেল।

অবনী বুঝতে পারল না, সুরেশ্বরকে আজ এত নিস্পৃহ এবং উদাসীন দেখাচ্ছে কেন? সাধারণভাবে সুরেশ্বর অনেকটা নিস্পৃহ, কিন্তু কোনও কোনও সময়ে, বিশেষত সাধারণ কথাবার্তায় সে বড় নিস্পৃহ থাকে না। হৈমন্তীর প্রসঙ্গ বলেই কি সুরেশ্বর এত উদাসীন? বা, হৈমন্তী চলে যাচ্ছে–এতে সুরেশ-মহারাজের আত্ম অভিমানে যথেষ্ট ঘা লেগেছে বলেই নিজের ব্যর্থতা এবং আঘাতকে সামলাবার জন্যে ভদ্রলোক এই ধরনের উদাসীনতার আশ্রয় নিচ্ছে।

অবনীর ইচ্ছে হয়েছিল, হৈমন্তীর ফিরে যাওয়ার ব্যাপারে সুরেশ্বরের মনোভাব কী তার একটা আন্দাজ নেবে। নানাভাবে সুরেশ্বরকে বাজিয়েও দেখা গেল সে প্রায় বোবা হয়ে রয়েছে; কিছু বলছে না বলবে না। সুরেশ্বরের যথার্থ মনোভাব বোঝা যাবে বলেও মনে হচ্ছে না। অথচ, অবনী সুরেশ্বরের প্রতি এখন সহানুভূতিও বোধ করছিল। শত হলেও এটা ঠিক, সুরেশ্বর অনেক আশা ভরসা করেই হৈমন্তীকে এনেছিল। শুধু ভেবে দেখেনি, তার বৈরাগ্য হৈমন্তীর চরিত্রে নেই।

পাশের ঘরে সুরেশ্বর চা তৈরি করতে করতে হঠাৎ গুনগুন করে উঠল। অবনী কান পেতে শোনার চেষ্টা করল, এবং কৌতুক ও কৌতূহল অনুভব করল। সুরেশ্বর গান গাইতে জানে নাকি? সুরেশ্বর যে গান গাইছে তাও ঠিক নয়, একটা সুর গুনগুন করছে।

অবনী ঘড়ি দেখল: সাড়ে সাত। টাকার কথাটা তার খেয়াল হল। পকেট থেকে খামে মোড়া টাকাটা বের করল। ইনসিওরের পুরনো খামে টাকাটা ভরে দিয়েছেন বিজলীবাবু, ওপরে তাঁরই নাম লেখা, পোস্টঅফিসের শিলমোহন। পাঁচশো টাকা সুরেশ্বর ধার করল, বিজলীবাবু অন্তত তাই বললেন। টাকাটা বিজলীবাবু ধার করে এনেছেন, নাকি নিজেই দিয়েছেন–এ-বিষয়ে অবনীর সন্দেহ আছে। সুরেশ্বর যে কিভাবে এই সব টাকা ধার করে, কেমন করেই বা শোধ দেয়, কে জানে। আশ্রমের পেছনে এত খরচ মাসের পর মাস টেনে যাওয়াও কি সহজ কথা!

সুরেশ্বর দুহাতে দুকাপ চা নিয়ে ঘরে ঢুকল, ডান হাতটা অবনীর দিকে বাড়ানো।

অবনী উঠে এগিয়ে গিয়ে চা নিল, নেবার সময় মনে পড়ল, খানিকটা আগে সে হৈমন্তীর ঘরে চায়ের কাপ ভেঙে এসেছে। অকারণে এবার যেন কিছুটা সতর্ক হল।

বসতে বসতে অবনী হেসে বলল, আপনি মশাই গান-টানও গান নাকি?

না, গাই না; কখনও-সখনও ওই একটু সাধ জাগে,সুরেশ্বরও হাসি মুখে জবাব দিল।

এখন কি সাধ জেগেছিল?

সুরেশ্বর হাসল সামান্য, বলল, একটা দোঁহা মনে পড়ে গেল। বলে সামান্য থেমে কেমন আবেশভরা গলায় বলল, গাছের পাতা, মানুষের মতি, আকাশের মেঘ তোমার হাতে ধরা নেই; তোমার হাতে তুমিই শুধু ধরা আছ।

অবনী চায়ে চুমুক দিল; দিয়ে তৃপ্তির শব্দ করল। বাঃ, চা-টি তো দিব্যি করেছেন।

আপনার বাড়িতে আরও ভাল চা খেয়েছি।

অবনীর মনে হল সুরেশ্বরের কথার মধ্যে প্রচ্ছন্ন একটা ইঙ্গিত রয়েছে, যেন সে বলতে চাইছে– অবনীর বাড়িতে দামি চা আছে, এখানে নেই। হাত বাড়িয়ে টেবিলের ওপর থেকে টাকার খামটা তুলে নিল অবনী, নিয়ে সুরেশ্বরের দিকে এগিয়ে দিল, টাকাটা..পাঁচশো আছে।

সুরেশ্বর খামটা নিল, নিয়ে পাশ রাখল।

অবনী হঠাৎ বলল, এই আশ্রমের পেছনে আপনি মোটমাট কত টাকা ঢাললেন, মশাই?

 সুরেশ্বর তাকিয়ে তাকিয়ে অবনীর মুখ দেখল, তারপর সহজ করে মুখে হাসল, হিসেব করিনি।

 কেন, আপনাদের আশ্রমের তো হিসেবের খাতা আছে।

আছে। সে হিসেবের মধ্যে অন্য পাঁচজনের টাকাও আছে।

 তা হলে পুণ্যটাও আপনার একার নয়, পাঁচজনের। অবনী হেসে বলল।

সুরেশ্বরও মৃদু হাসল, চা খেতে লাগল।

অবনী একটু পিঠ এলিয়ে বসল, বসে সিগারেট ধরাল। কী যেন ভাবছিল, অন্যমনস্ক। ভাবতে ভাবতে সহসা বলল, শুনেছি, আপনি বেশ ধনী বাড়ির ছেলে।

এ কথা আবার কে বলল? গগন? হালকা করে জবাব দিল সুরেশ্বর।

গগন কেন, বিজলীবাবু বলেছেন, হৈমন্তীও বলেছেন…

কথাটা বাড়িয়ে বলা; আমরা ছিলাম গ্রামের মানুষ, বাবার কিছু জমি-জায়গা সম্পত্তি ছিল।

জমিদারি?

 না, তেমন কিছু নয়।

 কোথায় বাড়ি ছিল আপনাদের?

সুরেশ্বর নাম বলল দেশের।

অবনী চায়ের কাপে বড় একটা চুমুক দিয়ে কাপটা নামিয়ে রাখল, এক মুখ ধোঁয়া নিল গলায়; তারপর বলল, আপনার মা বাবা খুব ধার্মিক-টার্মিক ছিলেন নাকি?

ধার্মিক! সুরেশ্বর কেমন বিস্মিত হয়েছিল। বাবার কথা, মার কথা মনে পড়ল। বলল, কেন, ধার্মিক কেন?

না, ছেলেবেলা থেকে সে রকম ক্লাইমেটে মানুষ হলে অনেকের এসব বাতিক হয়। অবনী হালকা ভাবে হেসে হেসে বলল।

সুরেশ্বরও হাসল। কী ভেবে বলল, আমার ছেলেবেলাটা একা একাই কেটেছে বেশি। মার নানারকম ভয়ের বাতিক ছিল। নজরে নজরে থাকতে হত।

ছেলেবেলা থেকেই আপনি তা হলে সুবোধ বালক! অবনী হাসল, ঘরের মধ্যেই বড় হয়ে উঠলেন, জগৎসংসার দেখলেন না।

সুরেশ্বর অবনীর চোখে চোখে তাকাল। যেন সত্যিই ভেবে নিয়েছে সে জগৎ-সংসার দেখেনি।

জীবনটাই চিনলেন না, মশাই। অবনী আবার বলল, নিশ্বাস ফেলল।

সুরেশ্বর বুঝতে পারল না, অবনীর এরকম একটা ধারণা কী করে হয়েছে যে সংসারের কিছুই সে দেখেনি। সংসারে কাকে দেখা বলে? কী চোখে দেখলে দেখা হয়? জীবনের কোন দিকটায় তাকালে তাকে দেখা যায়?

সুরেশ্বর বলল, আপনার এই কথাটা আমি ভাল বুঝতে পারি না। জীবনকে কী চোখে দেখতে হবে?

অবনী প্রশ্নটার কোনও গুরুত্ব দিল না, হালকা করে বলল, মানুষের চোখে।

আমি গাছ নই।

আমাদের মতনও নন।

 তফাত খানিকটা থাকে, থাকে না? আপনি আর বিজলীবাবু কি এক?

আমরা সংসারের মানুষ, সাধারণ মানুষের দোষগুণ, অমিল আমাদের আছে। আপনি আমাদের দলে পড়েন না। অবনী এবারও খানিকটা পরিহাস করে বলল।

সুরেশ্বর চায়ের পেয়ালার বাকি চাটুকু শেষ করল। তারপর শান্ত চোখে মৃদু হেসে বলল, অবনীবাবু, আপনাদের চোখে জীবনটা কেমন?

অবনী অনেকটা আলস্যের চোখে তাকিয়ে ছিল, সিগারেটের ধোঁয়ায় মুখ ভরা। ধোঁয়া গিলে নিল অবনী, জিবের সামান্য ধাক্কায় খানিকটা ধোঁয়া বাইরের বাতাসে ছুঁড়ে দিল। সামান্য সময় কোনও জবাব দিল না। পরে ঠাট্টা করে বলল, ফরাসপাতা বিছানা নয়…। বলে সুরেশ্বরের দিকে কয়েক পলক তাকিয়ে থাকল, যেন সময় দিল সুরেশ্বরকে, শেষে বলল, আপনি ভাগ্যবান, আমার ভাগ্যটা আপনার মতন হলে কী হত বলা যায় না, তবে আপনার মতন মহারাজ হলে আফশোস থাকত। আমাদের মতন মানুষকে সংসারের পাপতাপে পুড়তে হয় মশাই, সংসারটাকে খুব একটা সুখের জায়গা বলে মনে হয় না।

সুরেশ্বর শুনল। বলল, সংসার কি সুখের?

আমি তো জানি অ-সুখের।

আমিও তাই জানি। দুঃখের সংসার।

 জেনেও আপনি সুখী।

না; আমি সুখী নই– সুরেশ্বর আস্তে আস্তে বলল।

আপনি কি দুঃখী।

মানুষ মাত্রেই দুঃখী।

এসব হল তত্ত্বকথা। মিনিংলেস ওয়ার্ডস… অবনী বলল। তার হালকা এবং হাসি-ঠাট্টার ভাবটা নষ্ট হয়ে আসছিল।

সুরেশ্বর বলল, মানুষের নিয়তির কথা যদি ভাবেন তা হলে কি মনে হয় না, দুঃখ বিনা তার পরিণতি নেই? এই বিশ্ব অনেক প্রবল, তার তুলনায় আমাদের কতটুকু সাধ্য! আমরা কত অসহায়!

অবনী যেন সহসা কোনও আবেগ অনুভব করতে শুরু করেছিল, এবং বেদনার মতন লাগছিল তার। বলল, আপনি দুঃখের কিছু জানেন না। বই পড়ে, হাত জোড় করে দুঃখ চেনা যায় না। …আপনি যদি এখন তত্ত্বের বুলি আওড়ান, সংসার দুঃখময় মোহময়-টয় বলেন তবে সেটা অন্য কথা। ওটা ধার্মিক দুঃখ। আমি তো আপনার কোথাও কোনও দুঃখ-টুঃখ আছে বলে দেখি না।

সুরেশ্বর বিরক্ত বা ক্ষুব্ধ হল না। বলল, আপনি দুঃখকে কোথায় চিনেছেন?

কেন, নিজের জীবনেই।

আমিও তো আমার জীবনে সেটা চিনে থাকতে পারি।

না– অবনী মাথা নাড়ল, তার বিশ্বাস হয় না। বলল, ভদ্র সংসারে, সুখ-সাচ্ছল্যের মধ্যে জন্মেছেন মশাই, তরতর করে জীবন কাটিয়েছেন, গায়ে কাঁটা ফোটেনি। আপনি ভাগ্যবান ব্যক্তি…

সুরেশ্বর চোখ তুলে তাকিয়েছিল। অবনীর মুখের ভাব কেমন উত্তেজিত, তিক্ত, এমনকী বিদ্রূপভরা। সুরেশ্বর বলল, সাচ্ছল্যের মধ্যে আমি জন্মেছি, কিন্তু আমাদের সংসারে কোনও কাঁটা ছিল না–এ আপনি কেমন করে জানলেন?

বোঝা যায়। আমার মতন আপনার আঁতুরঘরটা নোংরা ছিল না।

সুরেশ্বর অপলকে দেখল অনীকে। বলল, আমার মা আত্মহত্যা করেছিলেন। সুখের সংসারে কেউ আত্মহত্যা করে?

অবনী কেমন যেন চমকে উঠল। চোখের পাতা পড়ল না। নিস্পন্দ হয়ে তাকিয়ে থাকতে থাকতে শেষে অস্ফুট স্বরে বলল, আত্মহত্যা!

সুরেশ্বর স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকল।

সামান্য পরে কেমন যেন আত্মসংবরণহীন হয়ে অবনী বলল, আত্মহত্যা তবু ভাল। কিন্তু আমার মা থিয়েটারের নামকরা মেয়ে ছিল। আমার বাবার শ্রাদ্ধের সময় আমি মাথা কামিয়ে নেড়া হয়েছিলাম। যদিও লোকটা আমার বাবা নয়।

সুরেশ্বর হঠাৎ কেমন নিষ্ঠুরের মতন বলল, আমার পিতৃ পরিচয়ও গৌরবের নয়। তাঁর উপপত্নী ছিল, অন্য সন্তান ছিল।

অবনী স্তব্ধ, নির্বাক; নিষ্পলকে সুরেশ্বরকে দেখছিল। মনে হল সুরেশ্বর যেন তাকে বলছে, আপনার আর কী বলার আছে? আরও কোনও দুঃখ দুর্ভাগ্যের কথা?

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *