৬. শিবপুরের হরসুন্দরী

শিবপুরের হরসুন্দরী দেবীর বাড়ি আর যাওয়া হয়নি। অনবরত যেতে যেতে ভয়ানক একটা কুণ্ঠা আসছিল। আর শেষদিন তো ভদ্রমহিলা প্রায় ক্ষেপেই উঠেছিলেন। বলেছিলেন, মিথ্যে আপনি খোঁজাখুঁজি করছেন। যে মেয়েমানুষ কোলের কচি বাচ্ছা ফেলে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে আসে, সে আবার ঘরে ফেরে নাকি? আপনার যে এখনো তার ওপর রুচি আছে, এই আশ্চর্য! জানি না আপনার কে হয়, তবে মুখের ওপরই বলছি-তাদের নিয়ে ঘর করা সম্ভব নয়। নইলে আমি কি কম ইয়ে করেছিলাম বাবা

ভয়ানক একটা লজ্জা হয়েছিল সেদিন মৃগাঙ্কর। আর ভেবেছিলেন সত্যিই তো ইচ্ছে করে যে হারিয়ে থাকতে চায়, তাকে খুঁজে বার করা কি সহজ? আর খুঁজে বার করে লাভই আছে নাকি কিছু?

কিন্তু এতটা করবার কি সত্যিই দরকার ছিল অতসীর? এই নিষ্ঠুরতা কি সম্পূর্ণ অর্থহীন নয়? ছেলে নিয়ে আলাদাই যদি থাকত, মৃগাঙ্কর ব্যবস্থা না নিত, তাই হত। কিন্তু একটু ঠিকানা একটু সন্ধান, বেঁচে আছে কি মরে গেছে তার একটু খবর, এটা জানাতে দোষ কি ছিল?

খবরের আশায় শ্যামলীদের বাড়ি গিয়ে গিয়েও আর বিব্রত করতে ইচ্ছে হয় না, ইচ্ছে হয় না খবরের কাগজে বিজ্ঞাপন দিতে। তবু নিজের নাম না দিয়ে একটা আবেদন করেছিলেন কয়েকটা সপ্তাহের কাগজে, অতসী, অন্তত খবর দাও কোথায় আছ। সাড়া এল না তার। অতসী যে খবরের কাগজের জগৎ থেকে অনেক দূরের গৃহে বাস করছে, সেটা ভাবেন নি মৃগাঙ্ক। ভেবেছেন ইচ্ছাকৃত।

ক্রমশই শিথিল হয়ে যাচ্ছিলেন মৃগাঙ্ক, কঠিন করে তুলতে চেষ্টা করছিলেন মনকে, কিন্তু আজ আবার এ কী আলোড়ন!

মৃগাঙ্ক কি আবার শিবপুরে যাবেন?

আবার নির্লজ্জের মত বলবেন, কোন ছলে কোন প্রয়োজনে তারা কি আবার এসেছিল?

যদি সেই প্রৌঢ়া মহিলা ধিক্কারে ছিঃ ছিঃ করে ওঠেন! সইতেই হবে সেই ধিক্কার।

তবু জানতে চেষ্টা করতে হবে মৃগাঙ্ককে, সীতু কার সঙ্গে গাড়ি চড়ে চলে গেল, অতসী কোথায় রইল।

তখন সামনে আড়াল করে দাঁড়ানো সেই লরিটাকে যদি মৃগাঙ্ক ইচ্ছাশক্তির সাহায্যে বিলুপ্ত করে দিতে পারতেন।

চলমান সেই গাড়িখানার নম্বরটা টুকে নিতে পারলে মৃগাঙ্ক কি এখন এমন করে বসে থাকতেন যন্ত্রণায় খাক হয়ে?

কিন্তু সত্যিই কি সীতু?

অস্নাত অভুক্ত মৃগাঙ্ক আবার গাড়ি বার করবার আদেশ দিলেন।

দিনের আলোয় সম্ভব নয়।

মনে হয় সমস্ত পৃথিবী ওর দিকেই তাকিয়ে আছে। পার্কের কোণের দিকে গাছের আড়ালে ঢাকা একটা বেঞ্চে বসে থাকে সীতু সন্ধ্যার অন্ধকারের অপেক্ষায়। দুঃসহ হচ্ছে প্রতীক্ষার প্রহর, অথচ দুর্দমনীয় হয়ে উঠেছে ইচ্ছে।

 সীতু এখন ভেবে পাচ্ছে না ছোট্ট সেই পুতুলটা, যে সীতুকে দেখলেই দাদদা দা্দদা বলে ছুটে আসত, তাকে এতদিন একবারও না দেখে কি করে ছিল সীতু!

খুকুটা যদি পার্কে আসে!

সেই লাল সিল্কের ফ্রকের নীচে থেকে নেমে আসা মোট্টা মোট্টা গোল গোল পা দুখানা নিয়ে থথপিয়ে হেঁটে ছুটে আসে সীতুর দিকে। সেই নরম ফুলের বস্তাটাকে জড়িয়ে ধরে কোলে তুলে নেবার দুরন্ত আকুলতাটা সীতুকে ভুলিয়ে দেয়, তার নাকি মরণবাচন অসুখ হয়েছিল, যায় যায় অবস্থা হয়েছিল!

আস্তে আস্তে দুপুরের রোদ ঢলে পড়ে। প্রায় ঢলে পড়ে সীতুও।

 পেটের মধ্যে খিদেয় পাক দিচ্ছে। সামনে দিয়ে হেঁকে যাচ্ছে অবাক জলপান, ঘুগনিদানা, ঝালমুড়ি, আইসক্রীম।

ওদিকে সীতুর তাকাতে নেই।

 কিন্তু যখন তাকাতে ছিল? তখন কি তাকাত সীতু? না, সীতু শুধু মুখ বিষ করে বসে থাকত বেঞ্চে। নেহাৎ চাকরদের সঙ্গে ঠেলে পাঠিয়ে দেওয়া হত তাকে পার্কে, তাই আসত।

 আজ পার্কের বেঞ্চে বসে থাকতে থাকতে সীতুর হঠাৎ মনে হয়, আচ্ছা সীতু সব সময় অমন বিশ্রী হয়ে থাকত কেন? থাকে কেন? জগতে এত ছেলে আহ্লাদের সাগরে ভাসছে, কেন সীতু কেন পারে না সে সাগরে ভাসতে!

পারে না মৃগাঙ্ক ডাক্তারের উপর আক্রোশে আর বিতৃষ্ণায়? কিন্তু মৃগাঙ্ক ডাক্তার কি সত্যিই অত খারাপ? যদি অত খারাপ, তাহলে কেন খুঁজে বেড়াচ্ছেন সীতুকে আর সীতুর মাকে?

সীতুরা তো তাকে অপমানের চূড়ান্ত করেছে।

 নিজের বাবা না হলে কি হয়? কি হয় তাকে বাবা বলে ডাকলে?

অনেকক্ষণ ধরে ভাবল সীতু।

যে বাড়িতে তারা থাকত, সে বাড়ির কর্তা বুড়োটা তো তার নিজের দাদু নয়, তবু তো সীতু তাদের বাড়ি থাকে, তাকে দাদু বলে। অতসী বলে বাবা। বুড়িটাকে বলে মা।

 কিন্তু কই, তাতে তো রাগ হয় না সীতুর, অপমান বোধ করে না অতসী।

তবে কেন সীতু মৃগাঙ্কর বেলাতেই–?

সীতুই খারাপ, সীতুই যত নষ্টের মূল। সীতুর জন্যেই সীতুর মাকে রাজরাণী থেকে ঘুঁটে কুড়নি হতে হয়েছে। হরসুন্দরীর বাড়ির মতন বিচ্ছিরি বাড়িতে থাকতে হয়েছে, লোকেদের বাড়িতে ঝি হতে হয়েছে।

এ বাড়িটায় বিচ্ছিরি ঘর নয়, কিন্তু ভাল করে রেখেও কী বলে ওরা সীতুর মাকে? রাঁধুনী! রাঁধুনী! বামুনদির মত ভাবে সীতুর মাকে!

নিজের মাকে ঝি করেছে সীতু, রাঁধুনী করেছে। মৃগাঙ্ক খুব খারাপ লোক নয় তবু তাকে কষ্ট দিয়েছে, অপমান করেছে।

আর খুকুকে?

খুকুকে সীতু? খুকুকে সীতু মেরে ফেলেছে। হ্যাঁ হ্যাঁ, মেরেই ফেলেছে। খুকুর মাকে কেড়ে নিয়েছে সীতু, কেড়ে নিয়েছে মায়ের কপাল জোর।

তবে মেরে ফেলা ছাড়া আর কি?

শার্টের ঝুলটা তুলে মুখে চাপা দিয়ে চেঁচিয়ে কেঁদে ওঠাটা রোধ করে সীতু। তারপর অনেকক্ষণের পর আস্তে আস্তে বেঞ্চ থেকে নামে।

খুকু পার্কে আসবে এ আশা আর নেই সীতুর। খুকু যেন একটা বিভীষিকার ছায়া নিয়ে ঝাপসা হয়ে আছে।

তবু

তবু সীতু

সন্ধ্যার অন্ধকারে জমাদারের সিঁড়ি দিয়ে উঠে সেই সরু বারান্দাটা পার হয়ে জানলার বাইরে দাঁড়িয়ে একবার দেখে নেবে খুকুর খাটটায় কেউ শুয়ে আছে কিনা–টিকটিকির মত রোগা কাঠির মত রোগা যা হোক।

আর যদি সেখানে কিছু না থাকে?

যদি দেখে খাটটা খালি, খাটের পায়ের কাছের সেই ছোট্ট নীচু আলনাটা খালি! আলনার তলায় সাজানো নেই লাল নীল সবুজ ছোট্ট ছোট্ট জুতো, আর খাটের ধারে ঝোলানো নেই রঙিন রঙিন তোয়ালে!

কী করবে সীতু?

কী করবে তখন? কী করবে তা জানে না। আর বেশি ভাবতে পারছে না। শুধু জানে সীতুকে যেতেই হবে।

খুকুর সম্পর্কে ভয়ঙ্কর একটা দাঁতখিঁচোনো অন্ধকারের ভয় নিয়ে টিকতে পারবে না সীতু।

.

হরসুন্দরী কপালে করাঘাত করে বলেন, আগে কি করে জানব বলুন এখনও এই চত্বরে আছে তারা! পাড়ার ইস্কুলেই পড়ছে। ইস্কুলের কথা আমার মাথায় আসে নি। সেদিন যেদিন শেষ এসেছিলেন, আপনিও গেলেন, আমিও ঘুরে দেখি সামনে মূর্তিমান। তা দাঁড়ায় একদণ্ড? আপনার কথা বলতে গেলাম, কানেই নিল না, ঠিকরে চলে

স্কুলটা দেখিয়ে দিতে পারেন?

ইস্কুল তো ওই–ও রাস্তার মোড়ে। জগদীশ স্মৃতি বয়েজ ইস্কুল। কিন্তু এখন তো ইস্কুল বন্ধ, পূজোর ছুটি পড়ে গেছে।

পূজোর ছুটি পড়ে গেছে।

 দারোয়ান সুদ্ধু দেশে চলে গেছে।

মাস্টারদের ঠিকানা?

সে আবার আশপাশের কে জেনে মুখস্থ করে রেখেছে?

শূন্যগাড়ি নিয়ে ফিরে আসেন মৃগাঙ্ক। ফিরে আসেন শিবনাথ গাঙ্গুলীর বাড়ির সামনে দিয়ে। যখন টেলিফোনে ওরা সীতুর অন্তর্ধান বার্তা বলাবলি করছে। যার একমিনিট পরে গাঙ্গুলীগিন্নী অতসীকে খুঁজে পান নি।

.

কিন্তু মৃগাঙ্ক কি ক্রমশ পাগল হয়ে যাচ্ছেন?

জলাতঙ্ক রোগী যেমন জলের দিকে তাকালেই লক্ষ লক্ষ কুকুরের ছায়া দেখতে পায়, মৃগাঙ্ক কি তেমনি সর্বত্র তার পরম শত্রুর ছায়া দেখতে পাচ্ছেন?

নইলে এই ঘণ্টাকয়েক আগে কতটা দূরে যে মূর্তি একখানা চলন্ত গাড়িতে দেখেছিলেন, সেই মুর্তিকে কেন বসে থাকতে দেখবেন পার্কের মধ্যেকার একটা বেঞ্চে?

এও চকিত ছায়া?

 দূর রাস্তা থেকে চলন্ত গাড়িতে বসে দেখা।

গাড়ি পিছিয়ে আনলেন মৃগাঙ্ক, নামতে উদ্যত হলেন, তারপর সহসাই সামলে নিলেন নিজেকে। ভ্রান্ত দৃষ্টির বিভ্রান্তিতে ভুলবেন না আর মৃগাঙ্ক।

মৃগাঙ্ক বুদ্ধিমান।

কিন্তু আশ্চর্য, সর্বত্র অতসীর ছায়া দেখছেন না মৃগাঙ্ক, দেখছেন কিনা সীতুর!

এই জন্যেই কি মহাপুরুষরা বলেন–ঈশ্বরকে শত্রুরূপে ভজনা কর।

কিন্তু সেই হতভাগ্য বুদ্ধিভ্রংশ ছেলেটাকে কি আর এখন নিজের প্রতিপক্ষ বলে মনে হয় মৃগাঙ্কর? মনে হয় শত্রু বলে?

হরসুন্দরী বাড়িওয়ালির ঘর দেখবার পরেও?

সেই বাড়ির ভাড়া যোগাতে পারে নি বলে চলে গেছে অতসী। কোথায় তবে গেছে? আরও কত সঙ্কীর্ণ গলিতে? আরও কত জঘন্য ঘরে?

.

রাস্তায় রাস্তায় ঘুরে অনেক পরে সন্ধ্যার অন্ধকারে বাড়ি ফিরে এলেন মৃগাঙ্ক। আস্তে আস্তে উঠে গেলেন ওপরে। ভুলে গেলেন আজ অভুক্ত আছেন।

ঘরটা এখনও অন্ধকার।

অন্ধকারেই একবার শুয়ে পড়লে হয়। শুধু তার আগে একবার স্নানের দরকার।

বাইরের পোশাক ছেড়ে বাথরুমের দিকে এগিয়েই জমাদারের সিঁড়ির দিকে চোখ পড়ল। পড়ার সঙ্গে সঙ্গেই সহসা একটা বিকৃত আর্তনাদ করে পড়ে গেলেন মৃগাঙ্ক, ঘর থেকে বাথরুমে যাবার প্যাসেজটায়।

মৃগাঙ্ক এবার বুঝতে পেরেছেন পাগল হয়ে যাচ্ছেন তিনি। সেই বুঝতে পারার মুহূর্তে এই আর্তনাদ!

তারপর চলে গেল সেই বোধশক্তিটুকুও। পড়ে গেলেন। মুখগুঁজে পড়ে রইলেন সরু প্যাসেজটায়।

.

সারাদিন শ্যামলী কাছে রাখে মেয়েটাকে।

মেয়েটারও অসুখ থেকে উঠে পর্যন্ত শ্যামলীর ওপর ভয়ঙ্কর একটা ঝোঁক হয়েছে। তার কাছে ছাড়া নাইবে না, খাবে না, ঘুমোবে না।

শ্যামলীরও এ এক পরম আনন্দ। সারাদিনের পর সন্ধ্যাবেলায় এ বাড়িতে নিয়ে আসে তাকে, তাও বেশিরভাগ দিনই ঘুম পাড়িয়ে রেখে তবে ফিরতে পায়।

আঁচল ধরে আগলায় খুকু। বলে, শ্যাম্মী যাবে না। শ্যাম্মী থাকবে। খুকুকে গপপো বলবে। নিজের ছেলেটার অযত্ন হয় তবু শ্যামলী পারে না তাকে বিমুখ করতে।

.

আজও যথারীতি সন্ধ্যার পর খুকুকে নিয়ে পথে পা দিয়েছে শ্যামলী, আর যেন ভূত দেখে ঠাণ্ডা হয়ে গেল।

কে? কে দাঁড়িয়ে? সীতু না? তুই এখানে? একা যে? মা কই?

 সীতু কাঁপছে।

দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কাঁপছে। তার বুকের ওঠাপড়া বুঝি দূর থেকেও দেখা যাচ্ছে।

মা কই, বল লক্ষ্মীছাড়া ছেলে! বল! মরে গেছে বুঝি? মাকে মেরে ফেলে

চেঁচিয়ে ওঠে শ্যামলী।

আর সীতু শার্টের ঝুলটা তুলে মুখে চেপে কেঁদে ওঠে, মা আছে, বাবা মরে গেছে।

 কে মরে গেছে? চেঁচিয়ে ওঠে শ্যামলী।

বাবা! ক্লান্ত ভাঙা গলায় বলে সীতু। খুকু যে টিকটিকির মতন হয়ে গিয়েছে কাঠের মতন হয়ে গিয়েছে এ বুঝি আর দেখতে পাচ্ছে না সীতু।

তার সমস্ত চৈতন্য আচ্ছন্ন করে রয়েছে একটা ভয়ঙ্কর দৃশ্য।

একদা অহরহ যে লোকটার মৃত্যুকামনা করেছে সীতু, তার মৃত্যু যে সীতুর কাছে এমন ভয়ানক যন্ত্রণাকর হতে পারে, এ সীতুর বোধের বাইরে, ধারণার বাইরে।

সীতুর সমস্ত শরীরটাকে চিরে ছিঁড়ে টুকরো করে ফেললে যদি সেই মুখগুজড়ে পড়ে থাকা মানুষটা উঠে বসে তো এক্ষুনি সীতু নিজেকে চিরে ফেঁড়ে শেষ করে ফেলতে পারে।

.

এ বাড়িতে তখন ভয়ঙ্কর একটা ছুটোছুটি চলছে। সারাদিনের অভুক্ত সাহেবকে এখন খানা দেওয়া হবে কিনা জিগ্যেস করতে এসে নেবাহাদুর এমন একটা আর্তনাদ করে উঠেছে যে, বাড়িতে যতগুলো লোক ছিল সবাই ছুটে এসেছে মৃগাঙ্কর শোবার ঘরে।

কিন্তু লোক মানে তো চাকরবাকর?

আর কে লোক আছে মৃগাঙ্কর বাড়িতে? হয়তো বাড়ির কাজের ব্যাপারে ওরা বুদ্ধিমান-নেবাহাদুর, মাধব, বামুনদি, কানাই, সুখদা, কিন্তু এমন একটা আকস্মিক বিপদপাতে তারা বুদ্ধিভ্রংশ হয়ে গেছে। সকলে মিলে জটলাই করছে, খেয়াল করছে না একজন ডাক্তার ডাকা প্রয়োজন।

বামুনদি আর সুখদা তারস্বরে মুখে চোখে জল দেবার নির্দেশ দিচ্ছে আর ওরা এঘর ওঘর ছুটোছুটি করছে।

.

নাটকের এই জটিল দৃশ্যের মাঝখানে সহসা এসে দাঁড়াল শ্যামলী, যথারীতি খুকুকে নিয়ে। কিন্তু তার পিছনে ও কে?

ওই ছেলেটা!

 আধময়লা নীল ডোরাকাটা সার্ট আর বিবর্ণ খাকি প্যান্ট পরা!

এতগুলো লোকের এত জোড়া চোখ যেন পাথর হয়ে গেছে। সাহেবের জ্ঞানশূন্যতার মত ভয়ঙ্কর বিপদটাও ভুলে গেছে ওরা। হাঁ করে তাকিয়ে আছে ওই ছেলেটার দিকে।

কিন্তু ছেলেটা তো শুধু শ্যামলীর পিছন পিছন নীরবে এসে দাঁড়ায়নি, বসে পড়েছে ঘরের মেজেয়। যেখানে মৃগাঙ্কর অচৈতন্য দীর্ঘ দেহখানাকে কোনরকমে টেনে এনে মাথার তলায় একটা বালিশ গুঁজে শুইয়ে রেখেছে ওরা।

খুকুকে সুখদার কোলে ছেড়ে দিয়ে শ্যামলীও বসে পড়ে রুদ্ধশ্বাসে বলে, কী হয়েছে?

সবগুলো লোক একসঙ্গে কী হয়েছে বোঝাতে চেষ্টা করে সবটাই দুর্বোধ্য করে তোলে। আর সেই গোলমাল ছাপিয়ে একটা তীব্র বেদনার্ত ভাঙা গলা গুমরে ওঠে, মরে গেছে, বাবা মরে গেছে!

আঃ সীতু থাম! ওকি বিচ্ছিরী কথা! ছি ছি! শ্যামলী বকে ওঠে, দেখতে পাচ্ছিস না অজ্ঞান হয়ে গেছেন!…এই তোমরা শুধু গোলমাল করছ কেন? একটা ডাক্তার ডাকতে পারোনি?

ডাক্তার!

তাই তো!

ডাক্তার সাহেবের বাড়ির লোক তারা, বাইরের ডাক্তারের কথা মনে পড়েনি।

কাকে ডাকবে তাহলে?

কোন ডাক্তারকে?

 সাহেবের তো চেনাজানা অনেক ডাক্তার বন্ধু আছে। কিন্তু কে তাদের নাম জেনে রেখেছে?

শ্যামলী হঠাৎ মুখগুঁজে বসে থাকা সীতুকে একটা ঠেলা দিয়ে দৃঢ়স্বরে বলে, এই সীতু শোন, তুই জানিস কাকাবাবুর কোনও ডাক্তার বন্ধুর নাম?

সীতু বিভ্রান্তের মত মুখ তুলে তাকায়। তারপর সমস্ত পরিস্থিতিটার উপর চোখ বুলোয়। এই তার সেই আশৈশবের পরিচিত জগৎ। ওই টেবলের উপর টেলিফোন যন্ত্রটা, ওই তার পাশে তার গাইডবুক।

যখন আরও ছোট ছিল, যখন সীতু ওই অসহায়ভাবে এলিয়ে পড়ে থাকা মানুষটাকে বাবা বলেই জানত, তখন একদিন অতসী বলেছিল, দাও না একে ফোন করতে শিখিয়ে। ভারী কৌতূহল বেচারার।

তখনো সম্পর্কে অত তিক্ততা আসেনি, তখনো মৃগাঙ্ক এই যে সীতুবাবু বলে ডেকে কথা বলতেন। তাই অতসীর অনুরোধ রেখেছিলেন, কাছে ডেকে বলেছিলেন, এই দেখ, এইভাবে নম্বর ঘোরাতে হয়। আর এই বই দেখে দেখে লোকেদের নাম বার করতে হয়। এখন তুমি ইংরিজি পড়তে পার না, যখন পড়তে পারবে তখন সব বুঝতে পারবে। আচ্ছা এখন দেখ–

নমুনাস্বরূপ নিজের একজন সহকারী ডাক্তারকে ডেকেছিলেন মৃগাঙ্ক। আর একটু হেসে সীতুর দিকে তাকিয়ে বলেছিলেন, দেখ, শিখলে তো? এখন ধর যদি হঠাৎ আমার কোনদিন বেশী অসুখ করে গেল, আমি আর কথা বলতে পারছি না, তুমি এইভাবে ডাকবে,–ডাক্তার মিত্র আছেন? ডাক্তার মিত্র?…হ্যাঁ, আমি ডাক্তার মৃগাঙ্ক ব্যানার্জির বাড়ি থেকে বলছি

.

মানুষ কি কোনও একটা মুহূর্তে হঠাৎ এক একটা বয়সের সীমা অতিক্রম করে? শৈশব থেকে বাল্যে, বাল্য থেকে যৌবনে, যৌবন থেকে বার্ধক্যে? সীতু সহসা এই মুহূর্তে অতিক্রম করে গেল তার শৈশবকে? তাই শ্যামলীর একবারের ডাকেই উঠে দাঁড়াল, এগিয়ে গেল টেবিলের দিকে, গাইড দেখে বার করল প্রার্থিত নাম, আর ভাঙা গলায় আস্তে আস্তে থেমে থেমে বলতে থাকল–ডাক্তার মিত্র আছেন? ডাক্তার মিত্র? আমি ডাক্তার মৃগাঙ্ক ব্যানার্জির বাড়ি থেকে বলছি…হা..বাবা হঠাৎ অজ্ঞান হয়ে গেছেন। এক্ষুনি আসতে হবে।

হ্যাঁ, হঠাৎ একদিন বেশি অসুখ করে গেছে মৃগাঙ্কর, কথা বলতে পারছেন না, তাই সীতু সীতু পারছে। সীতু এখন ইংরিজি শিখেছে।

.

কিন্তু সীতু কি শুধু ইংরিজিই শিখেছে?

আরও কিছু বুঝতে শেখে নি? বুঝতে শেখে নি নিজের হিংস্র নিষ্ঠুরতা? যে নিষ্ঠুরতায় এই রাজবাড়ির রাণীকে ভিখিরির সাজ সেজে পরের বাড়ি দাসত্ব করতে হচ্ছে, ওই চিরকঠিন শক্তিমান লোকটা জীর্ণ হতে হতে ক্ষয়ে যাচ্ছে, আর–আর খুকু—

খুকু!

এতক্ষণে বুঝি মনে পড়ে সীতুর খুকুর কথা, যখন জ্ঞান ফেরার পর ঔষধের প্রভাবে আচ্ছন্ন হয়ে ঘুমোচ্ছেন মৃগাঙ্ক। তার শান্ত শ্বাসপ্রশ্বাসের ওঠাপড়া দেখা যাচ্ছে।

শ্যামলীর কাছে এসে দাঁড়ায় সীতু।

অস্ফুট দ্বিধাগ্রস্ত স্বরে বলে, খুকু কোথায়?

খুকু!

শ্যামলী এত ঝঞ্ঝাটের মধ্যেও হঠাৎ হেসে ফেলে বলে, খুকু কোথায় কিরে? এই তো খুকু। চিনতে পাচ্ছিস না?

নিজের কোলের দিকে চোখ মেলে শ্যামলী বলে, কিছুতে ঘুমুতে চাইছে না। আসল কথা কাঁচা ঘুম থেকে উঠে পড়েছে তো? তাই দেরী হচ্ছে।

কিন্তু এত কথা কে শোনে?

সীতু অবাক বিস্ময়ে বিস্ফারিত লোচনে তাকিয়ে থাকে শ্যামলীর ক্রোড়স্থিত জীবটার দিকে। ওইটা খুকু? ওই রোগা সিরসিরে ঢ্যাঙা ন্যাড়ামাথা, সত্যিই টিকটিকির মত মেয়েটা খুকু? ওকে তো এই এতক্ষণ ধরে শ্যামলীরই মেয়ে ভাবছিল সীতু!

সেই লাল লাল খাদা খ্যাদা আর সোনালি চুলওয়ালা খুকুটা তাহলে পৃথিবী থেকে বিদায় নিয়েছে? আর তার হত্যাকারী সীতু?

ও কার খুকু?

তীক্ষ্ণ প্রশ্নে বিদীর্ণ করে ফেলতে চায় শ্যামলীকে সীতু–বল না কার খুকু?

কী মুশকিল! কার আবার, তোদেরই! সত্যি চিনতে পারছিস না?

সীতু আস্তে মাথা নাড়ে।

 তা চিনতে আর পারবি কোথা থেকে। শ্যামলী আক্ষেপ করে–চেনবার কি জো আছে? এমনিই তো কতদিন দেখা নেই, তাছাড়া যা হয়েছিল।

শ্যামলী খুকুর মাথায় একটু হাত বুলিয়ে সস্নেহে বলে–সবচেয়ে শক্ত টাইফয়েড। আর তার মধ্যে জ্বরের ঘোরে অবিরত শুধু মা মা বলে–হ্যাঁ, এইবার বল দিকি তোদের খবর? এতক্ষণ তো–তিনিই বা কোথায়? তুই বা কোথা থেকে?

.

মৃগাঙ্ক যখন চোখ মেললেন তখন সকাল হয়ে গেছে। চোখ মেলেই স্তব্ধ হয়ে গেলেন তিনি। তাহলে কি ভুল নয়? সত্যিই পাগল হয়ে গেছেন তিনি?

যদি পাগল না হন, তাহলে বিশ্বাস করতে হয় তার ঘরে তারই বিছানার কাছাকাছি অতসীর খাটটায় পড়ে যে ছেলেটা অঘোরে ঘুমোচ্ছ, সে সীতু!

আর সীতুর গা ঘেঁষে, সীতুর গায়ে হাত পা বিছিয়ে অকাতরে পড়ে ঘুমোচ্ছে যে, সেটা খুকু! চুপ করে এই দৃশ্যটার দিকে তাকিয়ে রইলেন মৃগাঙ্ক। ডাকলেন না, যেন ডাক দিলেই এই অপূর্ব পবিত্রতার ছবিখানি অপবিত্র হয়ে যাবে।

তাহলে কাল ছায়ামূর্তি দেখেন নি মৃগাঙ্ক?

কিন্তু কোথা থেকে এল ও? কে ওকে এখানে প্রতিষ্ঠিত করে গেল?

কিন্তু একা কেন? অতসী কোথায়?

তবে কি অতসী–তাই ছন্নছাড়া ছেলেটা পথে পথে ঘুরতে ঘুরতে অবশেষে–কেঁপে উঠলেন মৃগাঙ্ক। ভুলে গেলেন, এই ছবিখানি নষ্ট করতে চাইছিলেন না।

ডেকে উঠলেন।

 হয়তো আকস্মিকতায় একটু বেশি জোরালো হল সে ডাক।

চমকে চোখ মেলে চাইল সীতু। উঠে বসল। চোখ নামাল।

 মৃগাঙ্ক মিনিটখানেক তাকিয়ে থেকে গম্ভীর মৃদু স্বরে উচ্চারণ করলেন, তুমি একা এসেছ?

 সীতু চোখ তুলল, হ্যাঁ।

 তোমার মা মারা গেছেন?

 না না, ওকি! শিউরে ওঠে সীতু।

তবে?

সীতু প্রতিজ্ঞা করেছে এবার থেকে সে সভ্য হবে, ভদ্র হবে, কেউ কথা বললে উত্তর দেবে। তাই ক্ষীণস্বরে বলে, আমি এমনি একা-খুকুকে দেখতে

খুকুকে দেখতে! খুকুকে দেখতে এসেছ তুমি!

হ্যাঁ।

.

এবার আর হরসুন্দরীর বাড়ির দরজায় নয়।

শিবনাথ গাঙ্গুলীর দরজায় এসে থামে সেই মস্ত চকচকে গাড়িখানা।

 কাকে চাই?

এ বাড়ির রাঁধুনীকে!

 যেন রূপকথার গল্প! ঘুঁটেকুড়ানির জন্যে চতুর্দোলা!

কিন্তু এখানেও কপালে করাঘাত–এই দুদিন আগেও ছিল বাবা! হঠাৎ ছেলে ছেলে করে। বিভ্রাট হয়ে–গোড়া থেকেই বুঝেছি আমি, সে যেমন তেমন নয়, শাপভ্রষ্ট দেবী আমাকে ছলনা করতে এসেছিল।…কিন্তু তুই দুষ্টু ছেলে হঠাৎ অমন করে কোথায় চলে গিয়েছিলি? ছেলে হারিয়েছে শুনেই তোর মা যে পাগলের মত

কিন্তু মৃগাঙ্ক আর পাগলের মত হন না। হবেন না।

ফিরে এসে সীতুকে হাত ধরে গাড়িতে তুলে দিয়ে নিজে উঠে স্টার্ট দিতে দিতে গম্ভীর মৃদুকণ্ঠে বলেন, কাঁদিস নে সীতু, কাঁদলে চলবে না। খুঁজে তাকে আমরা বার করবই। খুঁজে না পেলে চলবে কেন আমাদের বল! কিন্তু আর আমার ভয় নেই। তখন একা ছিলাম, তাই হেরে গিয়েছিলাম, আর তো আমি একা নই। আর হারব না। দেখব আমাদের দুজনকে হারিয়ে দিয়ে, কতদিন সে হারিয়ে বসে থাকতে পারে!

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *