অতসীর ভাগ্যলিপি রচিত হয়েছিল চিতাভস্মের কালি দিয়ে। এই ভয়ঙ্কর সত্যটা টের পেয়ে গেছে অতসী। টের পেয়ে গেছে বলেই নিজের জীবনের চিতা রচনা করল সে নিজেই। জীবনকে বিদায় দিল জীবন থেকে। জোর করে চলে এল ভালবাসার সংসার থেকে। যে সংসারে আরাম ছিল আশ্রয় ছিল, সমাজের পরিচয় ছিল, আর ছিল একান্ত ব্যাকুলতার আহ্বান।
সে সংসারকে ত্যাগ করে চলে এসেছে অতসী, সে ডাককে অবহেলা করেছে ভাগ্যের উপর প্রতিশোধ নিতে। ভাগ্য যদি তাকে সব দিয়েও সব কিছু থেকে বঞ্চিত করে কৌতুক করতে চায়, নেবে না অতসী সেই কৌতুকের দান।
তুমি কাড়ছ? তার আগেই আমি স্বেচ্ছায় ত্যাগ করছি। কি নিয়ে আত্মপ্রসাদ করবে তুমি কর।
কিন্তু অতসীর সব আক্রোশ কি শুধু ভাগ্যেরই উপর? তার প্রতিশোধের লক্ষ্য কি আর কেউ নয়? নয় আট বছরের একটা নির্বোধ বালক? তার উপরও কি একটা হিংস্র প্রতিশোধ উদগ্র হয়ে ওঠে নি অতসীর?
হ্যাঁ, সীতুর উপরও হিংস্র হয়ে উঠেছিল অতসী। তাই প্রতিশোধ নিতে উদ্যত হয়েছে।
বুঝুক হতভাগা ছেলে পৃথিবী কাকে বলে, দারিদ্র্য কাকে বলে, অভাবের যন্ত্রণা কাকে বলে। সুরেশ রায়ের পরিচয় নিয়ে এই উদাসীন নির্মম পৃথিবীতে কতদিন টিকে থাকতে পারে সে দেখুক। সে দেখা তো শুধু চোখের দেখা নয়। প্রতিটি রক্তবিন্দু দিয়ে দেখা।
অতসী সেই দিনই মরতে পারত। কিন্তু মরে নি। মরে নি সীতুর জন্যে।
না, সীতুর মায়ায় নয়। সীতুকে রক্ষা করবার জন্যেও নয়, মরে নি সীতুর পরাজয় চোখ মেলে দেখবার জন্যে।
তিলে তিলে অনুভব করুক সীতু মৃগাঙ্ক তাকে কী দিয়েছিল, অনুভব করুক মৃগাঙ্ক তার কি ছিল!
.
সেই রাত্রে অদ্ভুত জিদ করে মৃগাঙ্কর গাড়ি থেকে নেমে পড়েছিল অতসী ছেলেকে নিয়ে। সুরেশ রায়ের ভাইঝির বাড়ির দরজায়।
কী যেন ভেবে মৃগাঙ্ক বেশি বাধা দেন নি। অথবা ক্লান্ত পীড়িত বিপর্যস্ত মন তাঁর বাধা দেবার শক্তি সঞ্চয় করে উঠতেও পারে নি। হয়তো ভেবেছিলেন থাকগে খানিকক্ষণ! হয়তো ছেলের সঙ্গে একটা বোঝাঁপড়া করতে চায়। এই জায়গাটাই যদি অতসী বেশ প্রশস্ত মনে করে থাকে তো করুক।
তারপর ঘণ্টা দুই পরে একবার গাড়ি পাঠিয়ে দিয়েছিলেন মাইজীকে নিয়ে আসতে। সে গাড়ি ফিরে গিয়েছিল শূন্যহৃদয় নিয়ে।
মাইজী আসলেন না।
মৃগাঙ্ক একটা ভ্রূকুটি করে বলেছিলেন, ঠিক আছে। কাল সবেরমে ফিন যানে পড়ে গা। সাত বাজে।
কিন্তু সকালের গাড়িও ফিরে এল সেই একই বার্তা নিয়ে।
মাইজী আয়া নেই! ওহি কোঠিমে
মৃগাঙ্ক হাত নেড়ে থামিয়ে দিয়েছিলেন।
তারপর মৃগাঙ্ক ডাক্তার নিজেই গিয়েছিলেন সুরেশ রায়ের ভাইঝির বাড়ি। বসেছিলেন তার বসবার ঘরে। রুদ্ধকণ্ঠে বলেছিলেন, পাগলামী করো না অতসী, চল।
অতসীর চোখের সব জল বুঝি কালকেই নিঃশেষ হয়ে গিয়েছিল, তাই অত শুকনো গলায় উত্তর দিয়েছিল, পাগলামী নয়, এটা আমার সিদ্ধান্ত।
বৃথা অভিমান করে লাভ কি অতসী? আর কার উপরই বা করছ? আমরা সকলেই ভাগ্যের হাতের খেলনা।
অভিমান নয়। কারও ওপর আমার অভিমান নেই, শুধু যে ভাগ্য আমাদের খেলনার মত খেলতে চায়, তার হাত থেকে ছিটকে সরে যেতে চাই। দেখতে চাই সর্বনাশের রূপ কী?
সে রূপ তো তোমার একেবারে অজানা নয় অতসী! ব্যাকুল হয়ে উঠেছিলেন মৃগাঙ্ক।
অতসী বলেছিল, ভুল করছ। সুরেশ রায়ের সংসারে আমার শুধু অসুবিধে ছিল, যন্ত্রণা ছিল, জ্বালা ছিল আর কিছু ছিল না। তাই সুরেশ রায়ের রোগ আর মৃত্যু আমাকে সর্বনাশের চেহারা দেখাতে পারে নি। যা দেখিয়েছিল সে হচ্ছে চিন্তার বিভীষিকা। আর কিছু না। যেখানে কিছু নেই সেখানে সর্বনাশেরও প্রশ্ন নেই।
পরের বাড়িতে আড়ষ্ট পরিবেশের মধ্যে আরও ব্যাকুল হয়ে উঠেছিলেন মৃগাঙ্ক। বুঝি অতসীর স্থির সংকল্পের দৃষ্টির মধ্যে নিজের সর্বনাশের ছায়া দেখতে পেয়েছিলেন। তাই বলে উঠেছিলেন, ইচ্ছে করে সবাই মিলে শাস্তি ভোগ করবার এমন ভয়ঙ্কর সাধ তোমায় পেয়ে বসল কেন অতসী? সীতু কি তোমার রাগের যোগ্য?
রাগের কথা নয়।
বল তবে কিসের কথা?
সে তোমায় বোঝাতে পারব না।
বোঝাবার যে কিছু নেই অতসী, কী করে বোঝাবে? হঠাৎ একটা আঘাতে তোমার বুদ্ধিবৃত্তি অসাড় হয়ে গেছে, তাই এমন একটা আজগুবি কল্পনা পেয়ে বসেছে। চলো বাড়ি চলে। সেখানে মাথা ঠাণ্ডা করে ভেবো।
অদ্ভুত রকমের ঠাণ্ডা আছে মাথা। এই ঠাণ্ডা মাথাতেই ভেবে দেখেছি তোমার ঘরে ফিরে যাবার উপায় আমার আর নেই। সীতুর যা সত্যকার ভাগ্য, যে ভাগ্যকেই ও অহরহ চাইছে, সেই ভাগ্যের মধ্যেই সীতুকে নিয়ে বাস করতে হবে আমাকে।
আমি তোমায় কথা দিচ্ছি অতসী, সীতুর উপযুক্ত ব্যবস্থা আমি শীগগিরই করে দেব। এখন বুঝতে পারছি ভুলই করেছিলাম। অন্য কোথাও দূর বিদেশে কোনও বোর্ডিঙে ভর্তি করে দেবো ওকে, ওর যথার্থ পরিচয় দিয়ে, পিতৃহীন সীতেশ রায় নাম দিয়ে। হয়তো তাতেই ও শান্তি পাবে।
না।
না?
না। তোমার দেওয়া ব্যবস্থায় ওকে মানুষ হয়ে উঠতে দেবো না আমি।
আমার দেওয়া ব্যবস্থায় ওকে মানুষ হতে দেবে না? অতসী, আমাকে বুঝিয়ে দেবে কি, এ তোমার অহঙ্কার না অভিমান?
বলেছি তো অহঙ্কার নয় অভিমানও নয়। এ শুধু বিচার বিবেচনার সিদ্ধান্ত। তোমার দেওয়া ব্যবস্থায় মানুষ হয়ে ওঠবার সুযোগ আমি দেব না সীতুকে। দুধকলা আর কালসাপের প্রত্যক্ষ দৃষ্টান্ত দেখিয়েছে তোমায় সাপের বংশধর, এবার মুক্তি দাও আমায়। সেই একই দৃশ্য আর দেখবার শক্তি আমার নেই।
বেশ, আমি ওকে কোন দুঃস্থ ছেলেদের সংস্থায় ভর্তি করে দেব, যেখানে পয়সা লাগে না, ফ্রি সীট।
অতসী অপলকে এক সেকেন্ড তাকিয়ে নিয়ে বলেছিল, অনাথ আশ্রম?
এবার মৃগাঙ্ক ডাক্তারের মুখ লাল হয়ে উঠেছিল। ভয়ঙ্কর একটা চাপা গলায় বলে উঠেছিলেন তিনি, যদি তাই-ই হয়। আমার কোন সাহায্যই যদি নিতে না দাও তোমার ছেলেকে, অনাথ আশ্রম ছাড়া আর কোথায় আশ্রয় জুটবে ওর?
সে আশ্রয় তো জুটিয়ে দিতে হয় না। অবস্থাই ওকে সে জায়গা জুটিয়ে দিতে পারবে।
মৃগাঙ্ক এবার ক্রুদ্ধকণ্ঠে বলে ফেলেছিলেন, কুটিল বুদ্ধির মারপ্যাঁচ শুধু তোমার ছেলের মধ্যেই নেই অতসী, তোমাকেও তার ছোঁয়া লেগেছে। সহজ কথা, যুক্তির কথা, বুদ্ধির কথা, কিছুতেই বুঝবে না, এই যে প্রতিজ্ঞা করে বসে আছ। যা বলছ তা যে কিছুতেই সম্ভব নয়, এটা যেন চোখ বুজে অস্বীকার করতে চাও। মায়ে ছেলেতে মিলে সব রকমে কেবল আমার মুখ হাসাবে, এমন ভয়ানক প্রতিজ্ঞাই বা কেন তোমাদের? বুঝতে পারছ না কতটা মাথা হেঁট করে এ বাড়িতে আসতে হয়েছে আমাকে? কতটা
অতসী বাধা দিয়ে বলেছিল, বুঝতে পেরেছি বলেই তো এইখানেই তার শেষ করে দিতে চাইছি। চাইছি মাথা হেঁটের পুনরাবৃত্তি আর যাতে না হয়।
চমৎকার! তুমি এইখানে পরের বাড়িতে বাস করবে এতে আমার মুখ খুব উজ্জ্বল হবে? বলেছিলেন মৃগাঙ্ক। শুনে অতসী হেসেছিল।
হ্যাঁ, হেসেই বলেছিল অতসী, তাই কখনো ভাবতে পারি আমি? না তাই থাকতে পারি? থাকব এখানে নয়, হয়তো বা এদেশেও নয়। তোমার চোখ থেকে, তোমার জীবন থেকে নিজেকে একেবারে মুছে নিয়ে সরে যাব।
লোহাও গলে বৈকি! তেমন তাপে গলে। মৃগাঙ্ক ডাক্তারের চোখ দিয়েও জল পড়ে।
আমার জীবন থেকে নিজেকে মুছে নিয়ে সরে যাবে, এ কথাটা উচ্চারণ করতে পারলে অতসী?
পারলাম তো!
হ্যাঁ পারলে তো! তাই দেখছি। আর কত সহজেই পারলে। কিন্তু অতসী, শুধু আমার চোখ থেকেই নিজেকে নয়, নিজের মন থেকেও নিশ্চিহ্ন করে মুছে ফেলতে চাইছ যে, তুমি কেবলমাত্র মৃত সুরেশ রায়ের ছেলের মা নও, খুকুরও মা!
তার উত্তর তো কালই দিয়েছি। লোকের তো মা মরে। খুকুর মত অনেক বাচ্চারও মা থাকে না। খুকুরও মা থাকবে না। ধরে নাও খুকুর মা মরে গেছে।
চমৎকার! চমৎকার তোমার প্রবলেম সলভ করার ক্ষমতা। কিন্তু তবুও প্রশ্নের জের থেকে যায় অতসী, মৃগাঙ্ক ডাক্তার তিক্ত ব্যঙ্গের সুরে বলেন, শেষ হয় না। ভুলে যেও না তুমি আমার বিবাহিতা স্ত্রী। সুরেশ রায়ের বিধবাকে প্রলোভিত করে এমনি নিয়ে এসে আটকে রাখি নি আমি। আইনত তোমার ওপর আমার জোর আছে। যা খুশী করবার স্বাধীনতা তোমার নেই।
অতসী আবার হেসে বলে, জোর খাটাবে?
যদি খাটাই?
তবে তাই দেখো।
অতসী, এত নিষ্ঠুর তুমি হলে কি করে? তোমার এই নিষ্ঠুর নির্দয় ছেলেটা কি তোমাকে এমনি করেই আচ্ছন্ন করে ফেলেছে? এখন কি মনে হচ্ছে জানো অতসী, সুরেশ রায়ের সেই রোগা পাকাটির মত ছেলেটাকে আমি বাঁচতে দিয়েছিলাম কেন? কেন কৌশলে শয়তানের জড়কে শেষ করে দিই নি?
না, অতসী রেগে যায় নি, কেঁদেও ফেলে নি, বরং হাসির মত মুখ করেই বলেছিল, এর চাইতে আরও অনেক বেশি কঠিন কথা বললেও আমি তোমায় দোষ দেব না।
অতসী, তোমায় হাতজোড় করে বলছি, পাগলামী ছাড়ো। রাগের মাথায় যা মুখে আসছে বলছি, ক্ষমা করতে পারো কোর। না পারলে কোর না। দোহাই তোমার, এখন অন্তত বাড়ী চলল। তারপর
ও কথা তো আগেও বলেছ। কিন্তু আমায় মাপ করো।
মৃগাঙ্ক ডাক্তার উঠে দাঁড়িয়েছিলেন, ক্রুদ্ধকণ্ঠে বলেছিলেন, না। কিছুতেই আমি তোমাকে মাপ করব না। কিছুতেই তোমার পাগলামীর তালে চলব না। জোরই খাটাব। পুলিশের সাহায্যে নিয়ে যাব তোমাকে। এদের নামে চার্জ আনব, আমার স্ত্রী-পুত্রকে দুরভিসন্ধির বশে আটকে রেখেছে।
অতসী তবুও হেসেছিল।
বলেছিল তা তুমি পারবে না আমি জানি।
জানো? জানো বলে এত সাহস তোমার? তুমি আমার কতটুকু জানো অতসী? কদিন তুমি দেখেছ আমায়?
তবে ডাকো পুলিশ। বলে স্থির হয়ে বসে থেকেছিল অতসী।
তারপরেও অনেক কথা বলেছিলেন মৃগাঙ্ক, অনেক সাধ্যসাধনা করেছিলেন। এমন কি এও বলেছিলেন, অতসী যদি মৃগাঙ্কর সঙ্গে একেবারে বিচ্ছিন্ন হয়ে থাকতে চায় তো সে ব্যবস্থাও করে দেবেন মৃগাঙ্ক। চেম্বারে থাকবেন তিনি, নয়তো অন্যত্র কোথাও থাকবার ব্যবস্থা করে নেবেন। অথবা অতসীকেই দেবেন আলাদা ফ্ল্যাটে থাকার সুযোগ। তবু আজ এদের বাড়ি থেকে চলুক অতসী। সুরেশ রায়ের ভাইঝিকে একান্ত আত্মীয় বলে আঁকড়ে ধরে থেকে এমন করে মৃগাঙ্কর গালে কালি না মাখায় যেন।
কিন্তু অতসী টলে নি। শুধু কথা দিয়েছিল এ বাড়িতে ও আর বেশিক্ষণ থাকবে না। ঘণ্টা কয়েক পরেই চলে যাবে।
কোথায় যাবে? ছেলেকে গলায় বেঁধে গঙ্গায় ডুবতে? বলেছিলেন মৃগাঙ্ক। অসহিষ্ণু হয়ে অস্থির হয়ে বলেছিলেন।
অতসী এত জোর সঞ্চয় করল কখন? কোথায় পেল এত সাহস, এত মনোবল? কী করে থাকল এর পরেও অটল থাকতে?
তা আত্মহত্যাও তত করে মানুষ। ধরে নাও এও তাই।
সীতুকে একবার ডেকে দেবে আমার কাছে? আমার ভাগ্যদেবতার সেই নিষ্ঠুর পরিহাসের কাছে, আমার জীবনের সেই শনির কাছে একবার হাতজোড় করি আমি!
ছিঃ, একথা ভেবো না। তুমি কি ভাবছ শুধু সীতুর জন্যেই আমার এই সংকল্প? তা ভাবলে ভুল হবে। এ আমার নিজের জন্যেও। দেখছি ভাগ্যের কাছে আমার যা প্রাপ্য পাওনা নয়, তাই জোর করে পেতে গিয়েই ভাগ্যের সঙ্গে এত সংঘর্ষ। আমি তো তোমার জীবনে বেশিদিন আসি নি, মনে করো সেই আগের জীবনেই আছ তুমি। আমি কোনদিনই–
খুকুটাকে,গোড়া থেকেই হিসেবের বাইরে রাখছ এইটাই এক অদ্ভুত রহস্য বলে মনে হচ্ছে অতসী! আশ্চর্য! তোমার মাতৃস্নেহধারা কি শুধু ওই একটা জায়গায় এসেই জমাট হয়ে থেমে গেছে, আর এগোতে পারে নি? খুকু কি তোমার সন্তান নয়? নাকি ওকে তুমি মনের মধ্যে বৈধ সন্তান বলে গ্রহণ করতে পারোনি? অবৈধের পর্যায়ে রেখে দিয়েছ?
অতসী কি সত্যিই ওর চোখ দুটোকে আর মনটাকে পাথর দিয়ে বাঁধিয়ে ফেলেছিল, তাই একথার পরও একেবারে শুকনো খটখটে চোখে তাকিয়ে বলতে পেরেছিল, বলেছি তো যত কঠিন কথাই তুমি বল, দোষ তোমায় দেবো না আমি।
.
তারপর? তারপর চলে এসেছে অতসী এইখানে।
শিবপুর লেনের একটা জরাজীর্ণ পচাবাড়ির একতলার একখানা ঘরে। শ্যামলীর বর অনুরোধে পড়ে বাধ্য হয়ে এ জায়গা খুঁজে জোগাড় করে দিয়েছে।
সেদিন শ্যামলী অবাক বিস্ময়ে কথা খুঁজে পায়নি। বোবার মত তাকিয়েছিল ফ্যালফ্যাল করে। অতসীই আশ্বাস দিয়ে ওর সাড় এনেছিল। বলেছিল, জীবনের রহস্য অপার শ্যামলী! সে কারও কাছে আসে বন্ধুর বেশে, কারও কাছে আসে রুদ্রের বেশে! তার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা, পাথরে নিষ্ফল মাথাকোটার সামিল। জীবনের পঙ্কিল রূপ দেখেছি, সুন্দর রূপও দেখেছি, এবার দেখব ভয়াবহ রুদ্রের মূর্তিটা কেমন।
তার মধ্যে নতুনত্ব কিছুই নেই কাকীমা! হাজার হাজার মানুষ আমাদেরই আশেপাশে সেই রুদ্রের অভিশাপ মাথায় বহে বেড়াচ্ছে। রোগে ওষুধ নেই, পেটে ভাত নেই–।
একটু ভুল করছিস শ্যামলী! ওটা তো হচ্ছে কেবলমাত্র অভাবের চেহারা, দারিদ্র্যের চেহারা। আমার সমস্যা আলাদা। আমার জন্যে খোলা পড়ে আছে আশ্রয় আরাম স্বাচ্ছন্দ্য, কিন্তু ভাগ্য আমাকে তা নিতে দেবে না
হঠাৎ রেগে উঠেছিল শ্যামলী। বলে উঠেছিল, ভাগ্য না হাতী! নিজের জেদেই আপনি রাগ রাখতে পারে নি, কেঁদে ফেলে বলেছিল, নইলে আট নবছরের একটা ছেলের দুষ্টুমিকে এত বড় করে দেখার কোন মানেই হয় না। ডাক্তার কাকাবাবুর মত মানুষকে আপনি ত্যাগ করে চলে যাচ্ছেন, এ আমি ভাবতেই পারছি না
ছিঃ শ্যামলী, ভুল করিস না!
ও আপনার ভুল-ঠিক বোঝবার ক্ষমতা আমার নেই কাকীমা! কিছু নয়, এ আমারই ভাগ্য। হঠাৎ কাছাকাছির মধ্যে আপনাকে পেয়ে গিয়ে বর্তে গিয়েছিলাম কিনা, সেটা ভাগ্যে সইল না।
কিন্তু শেষ পর্যন্ত সীতুর আচরণে শ্যামলীকেও হার মানতে হয়েছিল। বোর্ডিং থেকে নেমে সেই যে সীতু শ্যামলীদের একটা বিছানায় উপুড় হয়ে শুয়ে ছিল, পুরো দুদিন তাকে সেখান থেকে মুখ ভোলানো যায় নি। অস্নাত, অভুক্ত, এমন কি জল পর্যন্ত না খেয়ে পড়ে থাকা কাঠের মত শক্ত ছেলেটাকে বারবার খোসামোদ করে ওঠানোর চেষ্টায় হার মেনে হতাশ শ্যামলী বলেছিল, এ তো দেখছি বদ্ধ পাগল! একে স্কুল বোর্ডিঙে ভর্তি করবার চেষ্টা না করে পাগলা গারদে ভর্তি করে দেওয়া উচিত ছিল আপনার!
অতসী বলেছিল, এ রকম পাগল ওর বাপ ছিল, ঠাকুর্দা ছিলেন, তারা তো জীবনের শেষ অবধি গারদের বাইরেই রয়ে গেলেন শ্যামলী! কেউ বলে নি ওদের পাগলা গারদে পাঠিয়ে দাও।
বলে নি, তাই আজ এই অবস্থা। শেষ অবধি হয়তো আপনাকেই সেখানে যেতে হবে।
তা যদি হয় শ্যামলী, সমস্ত কর্তব্যের বোঝা, সমস্ত বিচার বিবেচনার বোঝা মাথা থেকে নামিয়ে হালকা হয়ে বেঁচে যাই। কিন্তু তা হবে না। তোর কাকীমার স্নায়ু বড় বেশি জোরালো শ্যামলী!
তাই অমন ছেলে জন্মেছে। বলে আর একদফা কেঁদে ফেলেছিল শ্যামলী।
বোঝা যায় নি সীতু এসব কথা শুনতে পাচ্ছে কিনা। মনে হচ্ছিল একটা পাথরের পুতুল শুয়ে আছে। দেড়দিনের অক্লান্ত চেষ্টায় যখন শ্যামলীর বর শিবপুরের এই ঘরখানা জোগাড় করে সে খবর নিয়ে এসে দাঁড়াল, আর অতসী বলল, সীতু ওঠ, আমাদের অন্য জায়গায় যেতে হবে, তখন দেখা গেল সীতু বলে ওই ছেলেটার শ্রবণেন্দ্রিয় অবিকল বজায় আছে। ভাবলেশশূন্য মুখে উঠে মায়ের কাছাকাছি দাঁড়িয়ে থাকল।
.
শিবপুর লেনের এই ঘরখানাতেও মায়ে-ছেলের কাছাকাছি থাকা ছাড়া উপায় নেই, কারণ আটফুট বাই দশফুট এই ভাঙা ঘরখানার মধ্যেই অতসীর এই নতুন জীবনের সমগ্র সংসার। এর মধ্যেই তার খাওয়া শোওয়া থাকার সমস্ত সরঞ্জাম।
হ্যাঁ, মৃগাঙ্ক ডাক্তারের কিছু সাহায্য অতসীকে নিতে হয়েছিল। গলার হারটা আর হাতের চুড়ি কটা তো মৃগাঙ্ক ডাক্তারেরই দেওয়া। ভারী কিছু নয়, ভারী গহনার স্থূলতা অতসীর রুচিতে সইত না, তবু নেহাই হালকা ওই আভরণটুকুই অতসীর নতুন সংসারের মূলধন।
এখানে ওই নিরাভরণতার সঙ্গে সামঞ্জস্য রাখতেই বুঝি অতসী তার শাড়িখানাও সীমারেখাহীন সাদায় পরিণত করে নিয়েছে। এখানে তার পরিচয় নাবালক সীতেশ রায়ের মা বিধবা অতসী রায়।
তা সন্দেহের দৃষ্টিতে কেউ তাকায় নি।
এযুগ আগের যুগের মত শ্যেনচক্ষু নয়। এ যুগে বাংলাদেশের এমন হাজার হাজার বিধবা মেয়ে আত্মীয়ের আশ্রয় ছেড়ে নাবালক ছেলে নিয়ে জীবনযুদ্ধে নামে।
.
কিন্তু অতসীর হাতে যুদ্ধের অস্ত্র কই?
বাড়িওয়ালা গিন্নী মাঝে মাঝে দোতলা থেকে নেমে এসে ভাড়াটের দরজায় দাঁড়ান, সমবেদনা জানান, আর প্রশ্ন করেন, ছেলে তোমার স্কুলে ভর্তি হয় নি?
মানুষটা সাদাসিধে স্নেহপ্রবণ, কৌতূহলের বশে প্রশ্ন করেন না, সহৃদয়তার বশেই করেন। বলেন, ওটুকুকে মানুষ করে তুলতে পারলেই তোমার দিন কেনা হয়ে গেল মা, ওকে যাহোক করে মানুষ করে তুলতেই হবে। একদিন এই দুঃখিনী তুমিই রাজার মা হয়ে বসবে, তখন পাঁচটা কনের বাপ তোমার দোরে এসে সাধবে। ছেলের মতন জিনিস আর আছে মা? এই যে আমি, তিন-তিনটে তো বিইয়েছি, তিনটেই মাটির ঢিপি। এককড়ি খরচ করে বিয়ে দিয়েছি, যে যার আপন সংসারে রাজত্ব করতে চলে গেছে, আমার কথা কত ভাবছে? যাই এই বাড়িটুকু ছিল কর্তার, তাই ঘর ঘর ভাড়াটে রেখে দিন চলছে। তোমার মেয়ে হয় নি বাঁচোয়া।
মেয়ে হয়নি!
অতসী কি কেঁপে ওঠে? অতসীর মুখটা কি প্যাঙাস হয়ে যায়?
বয়স্থা মহিলা অত বুঝতে পারেন না। তিনি কথা চালিয়ে যান, চেষ্টা বেষ্টা করে একটা ফ্রি স্কুলে ওকে ভর্তি করে দাও বাছা, আখের ভাবো।
অতসী একদিন সাহস করে বলে ফেলে, দেবো তো মাসীমা, কিন্তু তার আগে আমাকে তো কোনও একটা কাজে ফর্মে ভর্তি হতে হবে। হাতের পুঁজি তো সবই কথা শেষ করেছিল অতসী ভাববাচ্যে। একটু হাসি দিয়ে।
ঘরে সীতেশের উপস্থিতি কি ভুলে গেছে অতসী? নাকি সীতেশের আড়ালে কোন জায়গা নেই বলেই নিরুপায় হয়ে সব কথাই তার সামনে উচ্চারণ করতে বাধ্য হচ্ছে?
ঘরকুনো সীতেশ ঘরেই আছে। ঘরেই থাকে।
হরসুন্দরী দেবীর এই পাঁচ ভাড়াটের বাড়িতে তার সমবয়সী ছেলের অভাব নেই, কিন্তু সীতেশকে বোধকরি তারা চক্ষেও দেখে নি।
হরসুন্দরী দেবী বলেন, বললে যদি তো বলি বাছা, আমিও কদিন ভাবছি, নতুন মেয়ে তো কাজকর্ম কিছু করে না, অথচ ছেলে নিয়ে একলা বাস করতে এসেছে। তো ওর চলবে কিসে? তা ভাবি, বোধহয় স্বামীর দরুণ কিছু আছে হাতে। এ যুগে তো আর ভাই-ভাজ দ্যাওর-ভাসুর বিধবাকে দেখে না মা।
অতসী শান্ত গলায় বলে, আমার ওসব কিছুই নেই মাসীমা। আর স্বামীর টাকাও নেই। তেমনি নির্লিপ্ত ভঙ্গীতে একটু হাসে অতসী। খেয়াল করে না জানালায় পিঠ ফিরিয়ে বসে থাকা ছেলেটার পিঠের চামড়াটা পুড়ে উঠছে কিনা অতসীর এই হাসিতে।
তা ভাল! তিন কুলের কেউ কোথাও নেই?
নাঃ।
হ্যাঁগা, তা ওই যে ছেলেটি ঘর খুঁজতে এসেছিল?
ওটি আমার দূর সম্পর্কের ভাসুরঝি জামাই হয় মাসীমা।
হরসুন্দরী বলেন, দূর আর নিকট! যার শরীরে মায়া মমতা আছে, সেই নিকট। ছেলেটির আকার প্রকার তো ভালই মনে হল, কিছু সাহায্য করে না?
আরক্ত মুখ কোনমতে পাশ ফিরিয়ে অতসী বলে, করলেই বা আমি জামাইয়ের সাহায্যে নেবো কেন মাসীমা?
তা বটে, তা বটে। কথাতেই আছে পরদুয়ারী জামাই ভাতি, এ দুইয়ের নেই ঊর্ধ্বগতি– তা মেয়ে, অপিসে চাকরি বাকরি করবে তাহলে?
অতসী মাথা নীচু করে বলে, অফিসে চাকরি করার মত বিদ্যে সাধ্যি নেই মাসীমা, ছেলেবেলায় বাপ ছিলেন না, মামার বাড়ি মানুষ, তাড়াতাড়ি একটা বিয়ে দিয়ে দিয়েছিলেন, পড়ালেখার তেমন সুযোগ হয় নি।
আহা! চিরটাকালই তাহলে দুঃখ! তোমায় দেখলে কিন্তু বাছা এখনকার পাশটাশ করা মেয়ের ধাঁচে লাগে।
অতসী একথার আর কি উত্তর দেবে?
হরসুন্দরী বলেন, মুখ ফুটে তুমি বললে তাই বলতে সাহস করছি বাছা, কিছু মনে না করো তো বলি কাজ একটা আছে। মানে আমাকেই একজন বলেছিল লোক দেখে দেবার জন্যে। আমি তো এ পাড়ায় আজ নেই, চল্লিশ বছর আছি, সবাই চেনে।
লোক দেখে দেবার জন্যে অস্ফুট কণ্ঠে বলে অতসী, কি চান তারা? ঝি?
আহা-হা ঝি কেন, ঝি কেন! হরসুন্দরী ব্যস্তভাবে বলেন, একটা তালমুড়ি বুড়িকে একটু দেখাশোনা করা। নার্সের হাতের সেবা নেবে না এই আর কি! বুড়ির নাকি সত্তর বছর পার হয়ে গেছে। তবে কিনা বড় মানুষের মা, তাই তারা মাসে একশোর বেশি টাকা দিয়েও লোক রাখতে প্রস্তুত। ছেলের বৌটা মহাপাজী মা, স্বামীকে মুখনাড়া দিয়ে বলবে, তোমার মার সুবিধে করতে একটা বাইরের লোক এনে প্রতিষ্ঠা করবে, আর আমি ভাবতে বসব তার কখন কি চাই, সে কী খাবে, কোথায় থাকবে, কোথায় তার জিনিসপত্র রাখবে–পারব না, রক্ষে কর। ঠিকে লোক রেখে মায়ের সেবা করাতে পারো, করাও। ব্যস!
তা বুড়ির ছেলে অশান্তির ভয়ে তাতেই রাজী, কিন্তু ঠিকে বড় কেউ থাকতে চায় না। বলে সারাদিন রুগীর ঘরে থাকব তো রাঁধব বাড়ব কখন? বুড়ির ছেলে তাই বলেছে, দিন চার-পাঁচ টাকা করেও যদি লোক পাই তো রাখব। ছেলেটা ভাল, বৌটা দজ্জাল। অবিশ্যি তার জন্যে ভাবনার কিছু নেই, সে বৌ শাশুড়ির ঘরের ছায়াও মাড়ায় না। বুড়ি কত কাঁদে। এই তো মা, পয়সা থেকেও কত কষ্ট। তবে হ্যাঁ, এই যে লোক রাখতে চায়, পয়সা আছে বলেই তো? আমার মরণকালে যে কী দুর্দশা হবে ভগবানই জানে।
অতসী সান্ত্বনাৰ্থে বলে, তখন কি আর আপনার মেয়েরা আসবেন না?
আসবে। মায়ের এই ইটকাঠটুকুর ভাগ বুঝতে আসবে। আর এসে তিন বোনে ঝগড়া করবে আমি একা কেন করব বলে। মেয়ে সন্তান পরের মাটি দিয়ে গড়া মা! তোমার মেয়ে নেই রক্ষে।
অতসী কষ্টে গলায় স্বর এনে বলে, ওদের সঙ্গে আপনি কথা বলুন মাসীমা, আমি করতে রাজি আছি।
হরসুন্দরী ইতস্তত করে বলেন, অবিশ্যি নার্সের কাজ বলতে যা বোঝায় তার সবই করতে হবে বাছা। তবে কিনা জাতে বামুন–
অতসী দৃঢ়স্বরে বলে, জানে বামুন হোন কায়েত হোন, কিছু এসে যায় না মাসীমা, কাজ করব বলে যখন প্রস্তুত হয়েছি, তখন সবই করব।
হরসুন্দরী সপুলকে বলেন, তবে তাদের তাই বলিগে?
হঠাৎ জানলার দিকে পিঠ ফিরিয়ে বসে থাকা ছোট মানুষটা ছিটকে এদিকে মুখ ফিরিয়ে চীৎকার করে ওঠে, না, বলবে না।
বলব না? হরসুন্দরী হকচকিয়ে যান।
না না! তোমার এখানে আসার এত কি দরকার?
সীতু!
তীক্ষ্ণ তীব্র গলায় একটি সম্বোধন করে অতসী। যেমন গলায় বোধকরি কোনদিনই সীতুকে ডাকে নি। মৃগাঙ্কর সংসারে সীতুকে নিয়ে অনেক যন্ত্রণা ছিল অতসীর, কিন্তু সীতুকে শাসনের বেলায় কোথায় যেন কানায় কানায় ভরা ছিল অভিমানের বাষ্প, তাই কখনো গলায় এমন নীরসতার সুর বাজে নি।
সীতু মাথা নীচু করে ফের জানলায় গিয়ে বসে। সে জানলার সঙ্গে তার অস্ফুট স্মৃতির কোথায় যেন একটা মিল আছে। জানলার ওপিঠটা একটা সরু পচা গলি, বছরে দুদিন সাফ হয় কিনা সন্দেহ, দুদিকের বাড়ির আবর্জনা পড়ে পড়ে জমা হতে থাকে।
এ বাড়িতে উঠোনের মাঝখানে চৌবাচ্চাও একটা আছে, আর কলের মুখে লাগানো নল বেয়ে জল পড়ে পড়ে সেটা ভরতে থাকে সারাদিনে। সীতুর স্মৃতির সঙ্গে অনেক কিছু মিল আছে এ বাড়ির।
কিন্তু সীতু?
সে কি তবে এতদিনে স্থির হয়েছে, সন্তুষ্ট হয়েছে? তার বিদ্রোহী মন শান্ত হয়েছে?
এসে পর্যন্ত তেমনি এক অবস্থাতেই ছিল সীতু। মা ডেকেছেন সীতু খাবে এসো, সীতু নিঃশব্দে উঠে এসে খেয়েছে। মা বলেছে সীতু বেলা হয়ে যাচ্ছে ওঠ, এর পরে আর কলতলা খালি পাবে না, সীতু উঠে গিয়ে সেই পাঁচ শরিকের কলের থেকে মুখ ধুয়ে এসেছে। কোন প্রতিবাদ কোন দিন ধ্বনিত হয়নি তার কণ্ঠ থেকে।
আজ সীতুর গলায় সেই পুরনো তীব্রতা ঝলসে উঠল।
অতসী হরসুন্দরীর দিকে চোখ টিপে ইশারায় বলে, ওর কথা ছেড়ে দিন, আপনি ব্যবস্থা করুন।
হরসুন্দরী বোঝেন–বালক ছেলে, মাকে ছেড়ে থাকার কথায় বিচলিত হয়েছে। পরম আনন্দে তিনি চক্রবর্তী গিন্নীর কাছে সুখবর দিতে ছুটলেন। বুড়ি এমনি একটি ভদ্র গৃহস্থঘরের মেয়ের জন্যেই হা-পিত্যেশ করে বসে আছে। হরসুন্দরী জোগাড় করে দেওয়ার গৌরবটা নেবেন।
.
সারাদিন নর্দমার ধারে বসে বসে স্বাস্থ্যটা নষ্ট করে কোন লাভ আছে?
অতসীর এই প্রশ্নের সঙ্গে সঙ্গেই সীতু জানলা থেকে নেমে এসে ঘরের প্রায়ান্ধকার কোণে পাতা চৌকীটায় গিয়ে বসে।
অতসী বলে, কাল তোমায় স্কুলে ভর্তি করতে নিয়ে যাব। হেডমাস্টার মশাইয়ের সঙ্গে দেখা করে এসেছি আমি, ওপরের মাসীমার তিনি চেনা লোক, কাজেই ভর্তি হতে বেশি অসুবিধে হবে না। তবে একটি কথা তোমাকে শিখিয়ে রাখছি সত্যি কথা নয়, মিথ্যা কথা। হ্যাঁ, এখন অনেক মিথ্যা কথা তোমায় শেখাতে হবে আমাকে, বলতে হবে নিজেকে। নইলে কোথাও টিকতে পাব না। তুমি বলবে, এর আগে তুমি কোন স্কুলে পড় নি, বাড়িতে মায়ের কাছে পড়েছ। মনে থাকবে? বলতে পারবে? স্কুলে পড়েছিলে জানতে পারলেই এ স্কুল তোমার পুরনো স্কুলের সার্টিফিকেট চাইবে। জিজ্ঞেস করবে, কেন ছেড়ে এসেছ? সেখানের রেজাল্ট দেখি। তা হলে কি বিপদে পড়বে বুঝতে পারছ? সে স্কুলে তোমার নাম সীতেশ রায় নয়, সীতেশ মজুমদার, তা মনে আছে বোধ হয়? কি কাজের কি ফল তোমাকে বোঝাবার বয়স নয়, কিন্তু তুমি বুঝতে পারো, বুঝতে চাও, তাই এত করে বুঝিয়ে শিখিয়ে রাখলাম। আর যা করো করো, দয়া করে নিজের ভবিষ্যৎ নষ্ট কোর না।
আমিও ভুলে যেতে চেষ্টা করব রায় ছাড়া আর কোনদিন কিছু ছিলাম আমি, ভুলেও যাব আস্তে আস্তে। যাক আরও একটা কথা শোনোপরশু থেকে আমি মাসীমার দেওয়া সেই কাজে ভর্তি হবো। তোমাকে সকালবেলা স্কুলের ভাতটা মাসীমার কাছেই খেতে হবে। সেই ব্যবস্থাই করেছি।
আমি খাব না।
সীতেশের গলায় বিদ্রোহ। কিন্তু সে বিদ্রোহে কি আর্দ্রতার ছোঁয়া?
অতসী নরম গলায় বলে, খাব না বললে তো রোজ চলবে না, একটা ব্যবস্থা তো করতে হবে।
তুমি ওপরের বুড়ির কথা শুনলে কেন? ওই বিচ্ছিরি কাজ নিলে কেন?
অতসী মৃদু হেসে বলে, বিচ্ছিরি ছাড়া সুচ্ছিরি কাজ কে আমায় দেবে বল? আমি কি বি. এ., এম. এ., পাশ করেছি? আর কাজ না করলে
না না না, তুমি কাজ করবে না। তুমি ঝি হতে পাবে না। বলে সহসা জীবনে যা না করে সীতু, তাই করে বসে। উপুড় হয়ে পড়ে উথলে উথলে কেঁদে ওঠে।
নির্নিমেষ চোখে তাকিয়ে থাকে অতসী, সান্ত্বনা দিতে ভুলে যায়। অমনি করে উপুড় হয়ে পড়ে কেঁদে ভাসাবার জন্যে তার অন্তরাত্মাও যে আকুল হয়ে উঠেছে।
খুকু খুকু! খুকুমণি! কতদিন তোকে দেখি নি আমি! কী করছিস তুই মা মরা হয়ে গিয়ে। কে তোকে খাওয়াচ্ছে খুকু, কে ঘুম পাড়াচ্ছে? মা মা করে খুঁজে বেড়ালে কী বলছে তোকে ওরা? মা নেই, মা মরে গেছে। মা চলে গেছে, আর আসবে না! শুনে কেমন করে কেঁদে উঠছিস তুই খুকু সোনা। খুকু তুই কেমন আছিস? খুকু তুই কি আছিস?
হরসুন্দরী প্রতি কথায় বলেন, তোমার মেয়ে নেই মা বাঁচোয়া। নিজের মেয়েদের প্রতি দুরন্ত অভিমানের বশেই হয়তো বলেন, কিন্তু তিনি কেমন করে বুঝবেন তার এই সান্ত্বনাবাক্যে অতসীর বুকের ভিতরটা কী তোলপাড় করে ওঠে, জননীহৃদয়ের সমস্ত ব্যাকুলতা কেমন করে ষাট ষাট করে ওঠে।
সারাদিনের বেঁধে রাখা মন রাতে বাঁধ মানে না। নিঃশব্দ ক্রন্দনে নিজেকে নিঃশেষ করে ফেলতে চায়।
আলাদা চৌকীতে সীতু।
ঘরে জায়গা কম, এ চৌকী যতটা স্বল্পপরিসর হওয়া সম্ভব ততটা স্বল্প, পাশ ফিরতে পড়ে যাবার ভয়। তবু রাত্রির অন্ধকারে অতসীর মনে হয় যেন তার কোলের কাছে একটা বিশাল শূন্যতা! সেই শূন্যতা অতসীকে গ্রাস করে ফেলতে চাইছে, অদৃশ্য দাঁত দিয়ে অতসীকে ছিন্নভিন্ন করে দিতে চাইছে।
বুকের মধ্যেটা মুচড়ে মুচড়ে ওঠে। সর্বশরীরে সেই মোচড়ানির যন্ত্রণা অনুভব করে অতসী। যেন দেহের কোথাও ভয়ঙ্কর একটা আঘাত করতে পারলে কিছুটা উপশম হবে। চীৎকার করে উঠতে ইচ্ছে করে তার। চীৎকার করে বলতে ইচ্ছে করে, খুকু খুকু, তোর মা নেই। তোর মা মরে গেছে, বুঝলি?
মৃগাঙ্ক কি খুকুকে নিজের কাছে নিয়ে শোন?
ঝাপসা করে এইটুকু শুধু ভাবতে পারে অতসী, এর বেশি নয়। মৃগাঙ্কর কথা ওর থেকে বেশি ভাববার ক্ষমতা অতসীর নেই।
ভয়ঙ্কর ক্ষতের দৃশ্যটা যেমন ঢাকা দিয়ে রাখতে চায় মানুষ, দেখতে পারে না, তেমনি সেই ভয়ঙ্কর চিন্তাটাকে সরিয়ে রাখে অতসী, ঢেকে রাখে আতঙ্ক দিয়ে।
শুধু রাত্রে যখন সীতু ঘুমিয়ে পড়ে, যখন আবছা অন্ধকারে ওর রোগা পাতলা ছোট্ট দেহটাকে একটা বালক ছাড়া আর কিছু মনে হয় না, তখন তীক্ষ্ণ অস্ত্রাঘাতের মত একটা প্রশ্ন অতসীকে কুরে কুরে খায়–আমি কি ভুল করলাম? আমার কি আরও ধৈর্য ধরা উচিত ছিল?
কিন্তু ধৈর্যের সীমা অতিক্রম করবার মত অবস্থা কি ঘটে নি?
.
সকাল হতে না হতেই সমস্ত চিন্তা আর সমস্ত প্রশ্নে যবনিকা টেনে দিয়ে তাড়াতাড়ি ছুটতে হয় মনিববাড়ি। ছটার মধ্যে গিয়ে পৌঁছতে না পারলেই অনুযোগ সুরু করে বুড়ি, আজ তোমার এত দেরি যে আতুসী? কতক্ষণে মুখ ধোওয়াতে আসবে বলে রাত থেকে দুয়োরের পানে তাকাচ্ছি। দেরি না হলেও অনুযোগটা তার উদ্যত।
অনিদ্রা রোগীর রাত বড় দীর্ঘ। সকালের আলোের আশায় পলক গোনে সে।
অতসী তর্ক করে না, প্রতিবাদ করে না, এই একটু দেরি হয়ে গেল দিদিমা। উঠুন, মুখ ধুয়ে নিন। বলে তৎপরতা দেখায়।
তারপর কাজ আর কাজ।
মুখ ধোওয়ান, বিশুদ্ধ কাপড় পরিয়ে তাকে জপ আহ্নিক করতে বসানো, নিজে স্নান করে এসে তবে তাকে খাওয়ানো, ওষুধ খাওয়ান। ঠিক রোগী নয়, বলতে গেলে রোগটা জরা, তবু ওষুধ খেতে ভালবাসেন চক্রবর্তী গিন্নী। ভালবাসেন সেবা খেতে। তাই হাত খালি হলেই তেল মালিশ করতে হয় বসে বসে। আর বসে বসে শুনতে হয় তার ছেলের প্রশংসা আর ছেলের বৌয়ের নিচ্ছে। এই শোনাটাও একটা বিশেষ কাজ।
এই কাজ আর অকাজের অবিচ্ছিন্ন ধারার মধ্যে তলিয়ে থাকে চিন্তা ভাবনা। মনে করবার অবকাশ থাকে না অতসী কে, অতসী কি, অতসী এখানে কেন। যেন এই খামখেয়ালি বড়লোক বুড়ির খাস পরিচারিকা, এইটাই অতসীর একমাত্র পরিচয়।
মানুষটা খিটখিটে নয়, এইটুকুই পরম লাভ। মিষ্টিমুখে সারাক্ষণ খাঁটিয়ে নেন। মালিশ হলেই বলেন, অ আতুসী, মালিশের তেলের হাতটা ধুয়ে দুটো পান ছাচ দিকি খাই। পান ছাচা হলেই বলবেন, আতুসী দেখ তো বিছানায় পিঁপড়ে হয়েছে না ছারপোকা? চব্বিশ ঘণ্টা কী যে কামড়ায়।
সন্ধ্যাবেলা সব মিটে গেলে, চলে যাবার সময় পর্যন্ত ডাক দেন, আতুসী, মশারীটা ভাল করে খুঁজেছ তো? কাল যেন একটা মশা ঢুকেছিল মনে হচ্ছে।
আসল কথা সারাক্ষণ একটা মানুষের স্পর্শ আর সান্নিধ্যের লোভ! সংসার যার পাওনা চুকিয়ে দিয়েছে, অবস্থা যাকে নিঃসঙ্গ করে দিয়েছে, তার হয়তো এমনিই হয়। মানুষের সঙ্গ লালসা, এমনিই চক্ষুলজ্জাহীন করে তোলে তাকে। এই কাজের জগতে বার্ধক্যকে সঙ্গ দেবে এমন দায় কার? তাই ওই সঙ্গ দেওয়াটাই যার ডিউটি, তাকে পুরো ভোগ করে নিতে চান চক্রবর্তী গিন্নী সুরেশ্বরী।
আবার ভাল কথাও বলেন বইকি!
খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে অতসীর জীবনকাহিনী শুনতে চান তিনি, চান আহা করতে। চান অতসীর আত্মপরিজনকে কটুবাক্যে তিরস্কার করতে। বলেন, এই বয়সে, এই ছবির মতন চেহারা, কোন প্রাণে তারা একলা ছেড়ে দিয়েছে। এই যাই ভাল আশ্রয়ে এসে পড়েছ তাই রক্ষে। নইলে কার খপরে যে পড়তে! আবার বলেন, ছেলেকে তো কই একদিন আনলে না আতুসী! দেখতে চাইলাম!
অতসী বলে, আসবে না দিদিমা। বড় লাজুক।
সুরেশ্বরী বলেন, আহা আসতে আসতেই লজ্জা ভাঙবে। আনলে চাইকি আমার আনন্দর নেকনজরে পড়ে যেতে পারে। তখন তোমার ওই ছেলের বই খাতা জুতো জামা কোন কিছুর অভাব হবে না। আনন্দর যে আমার বড় মায়ার শরীর, গরীবের দুঃখ একেবারে দেখতে পারে না।
অতসী কাঠের মত শক্ত হয়ে যাওয়া হাতে অভ্যস্ত ভঙ্গীতে মালিশ চালিয়ে যায়, আর সহসা এক সময় বলে ওঠেন সুরেশ্বরী, কাজ করতে করতে থেকে থেকে তোমার যে কী হয় আতুসী, যেন কোথায় আছে মন কোথায় আছে দেহ। একটু মন দাও বাছা। মাস গেলে কম গুলি করে তো গুনতে হয় না আমার আনন্দকে, এই বুড়িমার আরাম স্বস্তির জন্যে!
হ্যাঁ, এটুকু স্পষ্ট কথা তিনি বলেন। নিজের গৌরব গরিমা বাড়াতেই বলেন।
তা এটুকু না সইলে চলবে কেন?
উদয়াস্ত খিটখিট করলেই কি সইতে হত না? মনিব খিটখিটে বলে একশ পঁচিশ টাকার চাকরিটা ছেড়ে দিত? তাই কেউ দেয়? ঘরে যার ভাত নেই?
ওদিকে এদিক ওদিক থেকে সুরেশ্বরীর ছেলের বৌয়ের সঙ্গে চোখোচোখি হয়ে গেলেই তিনি হাতছানি দিয়ে ডেকে সহাস্যে বলেন, কেমন কাজ চলছে?
অতসী মৃদু হেসে বলে, ভাল।
তা ভাল না বলে আর উপায় কি। বলি এক মিনিট বসতে শুতে পাও কোনদিন? ইস তা আর নয়, ওই চীজটিকে আমার জানতে বাকী আছে কিনা। চব্বিশ ঘণ্টা খালি ফরমাস আর ফরমাস। বাবাঃ! তা বাপু আমি মুখফেঁড় মানুষ বলে ফেলি। এমন চেহারাখানি তোমার, এমন মিষ্টি মিষ্টি গলা, তুমি মরতে এই অখদ্যে কাজ করতে এলে কেন? সিনেমায় নামলে লুফে নিত।
অতসী উত্তর দেয় না, শুধু কান দুটো যে তার কত লাল হয়ে উঠেছে সেটা নিজেই অনুভব করে।
ভদ্রমহিলা আবার হেসে হেসে বলেন, একটা তো ছেলেও আছে তোমার শুনেছি। তোমার মতনই সুন্দর হবে নিশ্চয়। মায়ে ছেলেয় নেমে পড়। আজকাল ছোট ছেলের চাহিদা ও লাইনে খুব। হাড়ির হাল থেকে রাজার হাল হবে। নইলে এই দাসীবৃত্তি করে ছেলেকে আর কতই মানুষ করে তুলতে পারবে? তার চাইতে ও লাইনে অগাধ পয়সা।
অতসী মৃদুস্বরে বলে, আপনারা হিতৈষী, আপনারা অবিশ্যি যা ভাল তাই বলবেন, দেখব। ভেবে।
হিহি করে হাসেন ভদ্রমহিলা আর বলেন, তোমার মতন অবস্থা আমার হলে ওসব ভাবাভাবির ধার ধারতাম না, কবে গিয়ে হিরোইন হতাম। ভাল থেকে হবেটা কি? কেউ তোমায় ভাত দেবে, না সামাজিক মানমর্যাদা দেবে?
ভদ্রমহিলার মতবাদকে অযৌক্তিক বলা যায় না।
না, তুমি ছাড়া আপনি এবাড়িতে কেউ বলে না অতসীকে। বাসনমাজা ঝিটাও বলে, তুমি আবার এখন কলে পড়তে এলে? সরো বাপু সরো, আমায় বাসন কখানা ধুয়ে নিতে দাও আগে।
সুরেশ্বরীর চা দুধ খাওয়া পাথরের বাটি গেলাস অতসীকেই মেজে নিতে হয়, সুরেশ্বরীর নির্দেশ। সেই দুটো হাতে করে অপেক্ষা করতে হয়ে অতসীকে যুগযুগান্তর কলের আশায়।
সন্ধ্যাবেলা ঘরে ফিরে কোনদিন দেখে সীতু আধময়লা বিছানাটায় গুটিসুটি হয়ে ঘুমিয়ে পড়েছে, কোনদিন দেখে হ্যারিকেনের আলোর সামনে রক্তাভ চক্ষু মেলে পড়া করছে। বেশিক্ষণ পারে না তখুনি গুটিয়ে শুয়ে পড়ে। লাইট নেই।
বারো টাকা ভাড়া ঘরে লাইট থাকে না। ওই দামে কোঠা ঘর পাওয়া গেছে এই ঢের।
অতসী এসে কাপড় ছাড়ে, হাত পা ঘোয়, উনুনে আগুন দিয়ে রুটি তরকারি করে ডাক দেয়, সীতু ওঠ, খাবার হয়েছে।
সীতু আস্তে আস্তে উঠে খেতে বসে।
না বসে উপায়ই বা কি?
খিদেয় যে পাকযন্ত্র শুদ্ধ পরিপাক হয়ে থাকে। ইস্কুল থেকে এসে কে হাতের কাছে খাবার জুগিয়ে দেবে?
অতসী মাঝে মাঝে বিরক্ত হয়ে বলে, কৌটায় মুড়ি থাকে, নাড়ু থাকে, পাঁউরুটি আনা থাকে, কিছু খাস না কেন সীতু?
সীতু গম্ভীর ভাবে বলে, খিদে পায় না।
এমনি করে কাটে দিন আর রাত্রি।
.
কয়েকটা মাস গড়িয়ে যায়।
সুরেশ্বরী আর একটু অপটু হতে থাকেন। আর সুরেশ্বরীর ছেলের বৌ রোজ একবার করে অতসীকে প্ররোচনা দেন-ছেলেকে সিনেমায় না দিলে তোমার কাছে এখানেই নিয়ে এসে রাখো না। সারাদিন তোমার চোখে চোখে থাকবে।
অবশেষে একদিন অতসীকে সুরেশ্বরীর কাছ থেকে আড়ালে ডেকে আসল কথাটা পাড়ে সুরেশ্বরীর ছেলের বউ, কই গো, তোমার ছেলেকে একদিন আনলে না?
অতসী একবার ওই মদগর্বমণ্ডিত মুখের দিকে তাকিয়ে ঘাড় নীচু করে বলে, ছেলে লাজুক, আসতে বললে আসতে চাইবে না।
বাঃ, দিব্যি তো কথা এড়াতে পারো তুমি! বউ যেন ঝাঁজিয়ে ওঠে, আসতে বললে আসতে চাইবে কি না চাইবে, আগে থেকেই বুঝছ কি করে?
অতসী চোখ তুলে মৃদু হেসে বলে, ছেলে কি চাইবে না চাইবে মায়ে বুঝতে পারে বইকি।
হু। ভদ্রমহিলার মুখখানি থমথমে হয়ে ওঠে। বোধকরি তার সন্দেহ হয় শাশুড়ির নার্সের এটি তার সন্তানহীনতার প্রতি কটাক্ষপাত। কিন্তু এখন একটি মতলব নিয়ে কথা সুরু করেছে সে, প্রথম নম্বরেই মেজাজ দেখিয়ে কাজ পণ্ড করলে লোকসান। তাই আবার কষ্টে মুখে হাসি টেনে বলে, আহা, বেড়াতে আসার নাম করে.ভুলিয়েভালিয়ে নিয়ে আসবে একদিন। মানুষের বাড়ি মানুষ বেড়াতে আসে না?
অতসী কষ্টে মৃদু হেসে বলে, তা একদিন নিয়ে এসেই বা লাভ কি?
যাক আলোচনাটা অনুকূলে আসছে, বউ হৃষ্ট হয়ে ওঠে। মুচকি হেসে বলে, একদিন থেকেই চিরদিন হয়ে যেতে পারে, আশ্চর্য কি!
অতসী একথার অর্থ গ্রহণে অক্ষম হয়েই বোধকরি চুপ করে চেয়ে থাকে।
সুরেশ্বরীর ছেলের বৌ, যার নাম নাকি বিজলী, সে ঠোঁটের কোণে একটু বিজলীর চমক খেলিয়ে বলে ওঠে, তুমি বাবু বড় বেশি সরল, কোন কথা যদি ধরতে পারো। বলছিলাম তুমি তো ওই হরসুন্দরী বামনীর ভাড়াটে। যা বাহারের বাড়ি তার, দেখেছি তো! সেই ভাঙা ঘরেরও কোন না পাঁচ সাত টাকা ভাড়া নেয়, সেখানে ওই ভাড়া গুনে নাই বা থাকলে? এখানে আমার এতবড় বাড়ি, নীচের তলায় কত ঘরদোর পড়ে, ছেলে নিয়ে অনায়াসে এখানে এসে থাকতে পারো।
তাই কি আর হয়! বলে কথায় যবনিকা টেনে চলে যেতে উদ্যত হয় অতসী। কিন্তু বিজলী তাকে এখন ছাড়তে রাজী নয়, তাই ব্যগ্রভাবে বলে, দাঁড়াও না ছাই একটু। বুড়ি আর তোমাবিহনে এক্ষুনি গলা শুকিয়ে মরছে না। তাই কি আর হয় বলছ কেন? এতে তো তোমারই সুবিধে, আর–গলা খাটো করে বিজলী আসল কথায় আসে, দুদিক থেকেই তোমার হাতে কিছু পয়সা হয়। ঘরভাড়াটা বাঁচে, আর তোমার ছেলে যদি বাবুর ফাই-ফরমাসটা একটু খাটতে পারে তাতেও পাঁচ সাত টাকা–।
হঠাৎ যেন সমস্ত পৃথিবীটা প্রবল বেগে প্রচণ্ড একটা পাক খেয়ে অতসীকে ধরে আছাড় মারে। সেই আছাড়ের আকস্মিকতা কাটতে সময় লাগে। কথা বলবার শক্তি সংগ্রহ করতে দেরি হয়। ততক্ষণে বিজলী আর একটু বিদ্যুহাসি হেসে বলে, বাবুর যা দিলদরিয়া মেজাজ, হাতে হাতে ঘুরে মন জুগিয়ে চলতে পারলে বখশিশেই–
হ্যাঁ, এতক্ষণে শক্তি সঞ্চয় হয়েছে।
অতসী ঝাঁ ঝাঁ করা কান আর জ্বালা করা চোখ দুটো নিয়েও কথা বলতে পেরেছে। কিন্তু সে কথা শুনে মুহূর্তে বিজলী বজ্র হয়ে ওঠে। তীব্রস্বরে বলে, কী বললে? ভবিষ্যতে যেন আর কখনো এ ধরনের কথা না বলি? তেজটা তোমার একটু বেশি নার্স! বলি আমার বাড়িতে থেকে ছেলে যদি তোমার ঘরের ছেলের মত একটু কাজকর্ম করত, মানের কানা খসে যেত তার? তবু তো তুমি পাশ করা নার্স নও। মা যার দাস্যবৃত্তি করছে, তার ছেলের এত মান! বাবাঃ! কিন্তু এটি জেনো নার্স, এত মান নিয়ে পরের বাড়ি কাজ করা চলে না। মান একটু খাটো করতে হয়।
অতসী এতক্ষণে স্থির হয়ে গেছে। স্বাভাবিক রং ফিরে পেয়েছে ওর চোখ আর কান।
সেই স্থির চেহারা নিয়ে ও বলে, আপনার আর কিছু বলবার আছে? যদি থাকে তো বলে নিন।
বিজলী এবার বোধকরি একটু থতমত খায়, তবু থতমত খেয়ে চুপ হয়ে যাবার মেয়ে সে নয়। তাই ভুরু কুঁচকে বলে, আর যা বলবার আছে, সেটা বাবুকে বলব, তোমাকে নয়। কুমীরের সঙ্গে বিবাদ করে জলে বাস করা যায় না। এটা মনে রেখো।
মনে রাখব। বলে চলে এসে অতসী যথারীতি সুরেশ্বরীকে ওষুধ খাওয়ায়। মালিশ করে দেয়। তারপর সহজ শান্তভাবে বলে, বিকেল থেকে আমি আর আসব না দিদিমা!
তার মানে? আসবে না মানে? নেহাৎ অপটু তাই, নইলে বোধকরি ছিটকেই উঠতেন সুরেশ্বরী, আসবে না বললেই হল?
তা আসতে যখন পারব না, তখন বলে যাওয়াই তো ভাল।
বলি পারবে না কেন বাছা সেইটাই শুধোই। বুঝেছি বুঝেছি আমার ওই বৌটি নিশ্চয় ভাঙচি দিয়েছে। ডেকে নিয়ে গিয়ে ওই শলা-পরামর্শই দিল তাহলে এতক্ষণ? বলি তুমি তো আর হাবার বেটি নও? শুনবে কেন ওর কথা? বুঝছ না আমার ওপর হিংসে করে তোমায় ভাঙচি দিচ্ছে? এই যে তুমি আমায় যত্নআত্তি করছ, দেখে হিংসেয় বুক পুড়ছে ওর। মহা খল মেয়েমানুষ মা, মহা খল মেয়েমানুষ! কান দিও না ওর কথায়।
অতসী গম্ভীর ভাবে বলে, বৃথা ওসব কথা বলবেন না দিদিমা, উনি আমায় যেতে বলেন নি। আমার অসুবিধে হচ্ছে।
তাই বল–সুরেশ্বরী সহসা একগাল হেসে বলেন, বুঝেছি। চালাকের বেটির আরও কিছু বাড়ানোর তাল। তা বলব আমি, ছেলেকে বলব। বলে কয়ে সাড়ে চার টাকা রোজ করে দেবো তোমার। তাতে হবে তো? হবে না কেন, মাস গেলে পনেরোটা টাকা তো বেড়ে গেল। তা হা মা আতুসী, একথা মুখ ফুটে একটু বললেই হত। দেখছ যখন তোমাকে আমার মনে ধরেছে। না বাছা, ছাড়ার কথা মুখে এনো না। এই বুড়ি যে কটা দিন আছে থেকো। আমি প্রাতর্বাক্যে আশীর্বাদ করছি, তোমার ভাল হবে।
অতসী বৃদ্ধার ওই উদ্বিগ্ন আটুপাটু, আবার প্রায় নিশ্চিন্ত মুখের দিকে তাকিয়ে দেখে। মনে ভাবে, একের অপরাধে আরের দণ্ড! পৃথিবী জুড়ে তো এই লীলা! আমি আর কি করব? বুড়ির জন্যে মায়া হচ্ছে, কিন্তু উপায় কি? এখানে আর থাকা যায় কি করে?
সুরেশ্বরী তার ছানিপড়া চোখের দৃষ্টি যতটা সম্ভব তীক্ষ্ণ করে অতসীর মুখের দিকে তাকান এবং সে মুখে অনমনীয়তার ছাপ দেখে বিচলিত কণ্ঠে বলেন, তা ওতেও যদি তোমার মন না ওঠে, পাঁচ টাকা রোজই করিয়ে দেবো বাছা। আর তো মন খুঁতখুঁত করবে না? কিন্তু তাও বলি আতুসী, আমার ছেলে খুব মাতৃভক্ত, আর টাকায় দুখদরদ নেই বলেই এতটা কবুল করতে সাহস করলাম আমি। নইলে এ তল্লাটে এর অর্ধেক দিয়েও কেউ বুড়ো মায়ের সেবার জন্যে লোক রাখতে চাইবে না। বৌটি হারামজাদা হয়েই হয়েছে আমার কাল। তুই ডাণ্ডা খাণ্ডা বাঁজা মানুষ, শাশুড়ির সেবা করতে পারিস না? সোয়ামীর এতগুলো করে টাকা জলে যাচ্ছে, তাই দেখছিস বসে বসে? কী বলব আতুসী, জ্বলে পুড়ে মলাম, জ্বলে পুড়ে মলাম।
অতসী মৃদুস্বরে বলে, দুঃখ যন্ত্রণার বিষয় বেশি আলোচনা না করাই ভাল দিদিমা, ওতে কষ্ট বাড়ে ভিন্ন কমে না।
সুরেশ্বরী সহসা বিগলিত স্নেহে অতসীর হাতটা চেপে ধরেন, বলেন, এই দেখো তো মা, এই জন্যেই তোমায় ছাড়তে চাই না। কথা শুনলে বুক জুড়োয়। আর আমার বৌটি! কথা নয় তো, যেন এক একখানি চ্যালা কাঠ! যাকগে বাছা, তুমি মনকে প্রফুল্ল করো, দিন পাঁচ টাকা করেই পাবে।
অতসী দৃঢ়কণ্ঠে বলে, পাঁচ টাকা দশ টাকার কথা নয় দিদিমা, দিন কুড়ি টাকা করে হলেও আমার পক্ষে আর এখানে থাকা সম্ভব হবে না।
সুরেশ্বরী স্তম্ভিত বিস্ময়ে কিছুক্ষণ হাঁ করে থেকে বলেন, বুঝেছি, ওই হারামজাদী তোমায় কোনও অপমানের কথা বলেছে। আচ্ছা ডাকাচ্ছি ওকে আমি একবার। দেখি কী তোমায় বলেছে? যতই হোক তুমি হলে ভদ্রঘরের মেয়ে, তোমাকে একটা মান অপমানের কথা বললে .তো গায়ে লাগবেই। কে যাচ্ছিস রে ওখানে? নন্দ? তোদের বৌদিদিকে একবার ডাক তো।
অতসী ব্যাকুলভাবে বলে, মিথ্যে কেন এসব মনে করছেন দিদিমা? আমি বলছি উনি কিছু বলেন নি। আমারই থাকা সম্ভব হচ্ছে না। এমনিই হচ্ছে না। আগে বুঝতে পারি নি
সুরেশ্বরী হঠাৎ দপ করে জ্বলে উঠে বলেন, আগে বুঝতে পারো নি বলে আমায় তুমি গাছে তুলে মই কেড়ে নেবে? এই যে আমার সেবার অভ্যেসটি ধরিয়ে দিলে, তার কি?
সুরেশ্বরীর অভিযোগের ভাষা শুনে এত যন্ত্রণার মধ্যেও হাসি পেয়ে যায় অতসীর। প্রায় হেসে ফেলে বলে, ওর আর কি, যে থাকবে, সেই করবে। এত এত টাকা দিলে এক্ষুনি লোক পেয়ে যাবেন।
সুরেশ্বরী নিজের আগুনে নিজেই জল ঢালেন।
কাঁদো কাঁদো হয়ে বলেন, লোক পাব না তা বলছি না। লোক পাব। ভাত ছড়ালে কাকের অভাব নেই। কিন্তু মা আতুসী, সব কাকই যে দাঁড়কাক। যারা আসবে, তারা হয় একেবারে ঝি চাকরাণীর মতই নোংরা ইল্লুতে ছোটলোক হবে, নয় হাসপাতালের নার্সদের মত গ্যাডম্যাড ফ্যাড হবে। তোমার মতন এমন সভ্য ভব্য শান্ত ভদ্দর মেয়ে আমি আর কোথায় পাব শুনি?
অতসী চুপ করে থাকে আর ভাবে, ভেবেছিলাম মনকে পাথর করে ফেলেছি, মমতাকে জয় করেছি। কিন্তু দেখছি বড্ড বেশি ভাবা হয়ে গিয়েছিল।
সুরেশ্বরী আবার ভাবেন, মৌনং সম্মতি লক্ষণম্। অতসীর বোধ হয় মন ভিজছে। তাই আকুলতার মাত্রা আর একটু বাড়ান তিনি। আবার হাত ধরেন, চোখের জল ফেলেন, অতসীকে কাজের শেষে সকাল সকাল ছেড়ে দেবেন বলে শপথবাক্য উচ্চারণ করেন, তার ফাঁকে ফাঁকে নিজের বৌ সম্পর্কে ন ভূতো ন ভবিষ্যতি করেন। কিন্তু অতসী অনমনীয়। মমতাকে সে জয় করতে পারে নি সত্যি, কিন্তু ওইটুকুই, তার বেশি নয়। মমতায় বিগলিত হয়ে সংকল্পচ্যুত হবে, সে এমন দুর্বল নয়।
অনুরোধ, উপরোধ? তাতে টলানো যাবে অতসীকে? যদি তা যেত, অতসীর ইতিহাস অন্য হত।
অতসী চলে এল।
শেষের দিকে সুরেশ্বরী রাগ করে গুম হয়ে রইলেন। অতসী নিঃশব্দে চলে এল। বিজলী দোতলার বারান্দা থেকে দেখল। আর একই সঙ্গে বিপরীত দুই মনোভাবে কেমন বিচলিত হল।
অতসী এসে পর্যন্ত সুবিধা হয়েছিল তার অনেক, সুরেশ্বরী যতই গালমন্দ করুন এবং নিজে সে যতই বিধিয়ে বিঁধিয়ে শোনাক শাশুড়িকে, তবু শাশুড়ি সম্পর্কে একটা দায় তার ছিল, অতসী এসে পর্যন্ত সেই দায়টা ঘুচেছিল। আবার সেই দায়টা ঘাড়ে এসে পড়বে এই ভেবে মনটা বিরস হচ্ছিল, কিন্তু পরক্ষণেই একটা হিংস্র পুলকে ভাবছিল–ঠিক হয়েছে, বেশ হয়েছে, বুড়ি জব্দ হবে।
কিন্তু আশ্চর্য! ভাল বলতে গিয়ে মন্দ হওয়া!
ছেলেকে চাকর রাখায় আপত্তি। বেশ বাপু আপত্তি তো আপত্তি। তোমার ছেলে না হয় জজ ম্যাজিস্ট্রেটই হবে, তুমি লোকের বাড়ি পা টিপে আর কোমরে তেল মালিশ করে ছেলেকে রূপোর খাটে বসিয়ে মানুষ করগে, কিন্তু দুম করে চাকরিটা ছেড়ে দেবার দরকার কি ছিল? এতই যদি তেজ তো পরের বাড়ি খাটতে আসা কেন?
এইভাবে যুক্তি সাজিয়ে বিজলী নিজেকে দোষমুক্ত এবং অতসীকে দোষযুক্ত করে তুলল, কিন্তু তবু তেমন নিশ্চিন্ত হতে পারল না।
স্বামী এসে কী বলবেন?
মায়ের আবার পুনমুর্শ্বিক অবস্থা দেখে খুশী নিশ্চয় হবেন না এবং সন্দেহ নেই বিজলীকেই এ ঘটনার নায়িকা মনে করবেন।
তাই করে লোকটা। সব সময় করে। বলে না কিছু, কিন্তু নীরব থেকেও শুধু চোখ মুখের ভাবে বুঝিয়ে ছাড়ে; সব দোষ বিজলীর।
আর সুরেশ্বরী?
তিনি বিশ্বসংসারের সকলকে শাপশাপান্ত করছেন, এমন কি হরসুন্দরীকেও রেহাই দিচ্ছেন না। জেনে শুনে এরকম নিষ্ঠুরপ্রাণ মেয়েমানুষকে সে কোন হিসেবে দিয়েছিল? হরসুন্দরীকে সামনে পেলে আরও যে কী বলতেন তিনি!
অতসী অবশ্য বাড়ি এসে কিছুই বলল না।
সামনের ঘরের পড়শীনি চোখখাচোখি হতে বললেন, দিদি যে আজ এক্ষুনি?
অতসী বলল, এমনি। চলে এলাম।
সীতু তখন স্কুল থেকে আসে নি, ঘরের দরজায় একটা সস্তাদরের তালা ঝুলছে। এ ব্যবস্থা হরসুন্দরীর নিজের। ভাড়াটের ভালমন্দের দায়িত্ব তারই এই বোঝেন তিনি। কিছু যদি চুরি যায়, তার বাড়িরই বদনাম হবে।
কিন্তু অতসীর কি চুরি যাবে। কি হচ্ছে তার?
তালার চাবিটা নিতে দোতলায় উঠতেই হল। হরসুন্দরী অবাক হয়ে বললেন, এমন সময় যে?
অতসী একটু ইতস্তত করে বলল, কাজ ছেড়ে দিয়ে এলাম।
কাজ ছেড়ে দিয়ে এলে! হরসুন্দরী আঁতকে ওঠেন, কেন গো? বুড়ি হয়ে গেল নাকি?
না না, কী আশ্চর্য, তা কেন? এমনিই।
হরসুন্দরী হাঁ করে তাকিয়ে বলেন, এমনি! ঘরে তো অদ্যভক্ষ্য ধনুর্গুণ, এমনি তুমি কাজটা ছেড়ে দিলে? বুড়ি খুব খিটখিট করেছিল বুঝি?
না না, কিছুই বলেন নি তিনি।
তবে ওই বৌ ছুঁড়ি ক্যাঁটকেঁটিয়ে কিছু বলেছে নিশ্চয়! ওর কথাই অমনি। দেখ না শাশুড়ি পর্যন্ত জ্বলেপুড়ে মরে। তবু বলি, রাগের মাথায় ঝপ করে চাকরিটা ছেড়ে দিয়ে আসা তোমার উচিত হয়নি মেয়ে। এ জগৎ বড় কঠিন ঠাঁই।
অতসী আস্তে চাবিটা কুড়িয়ে নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। তর তর করে চলে আসতে পারে না।
হরসুন্দরী আবার বলেন, বুঝছি তোমার কপালে এখন অশেষ দুঃখু তোলা আছে। নইলে অমন কাজটা ছেড়ে দিলে! আর কোথাও কিছু জোগাড় করেছ নাকি?
অতসী ক্ষুব্ধ হাসি হাসে, আমি আর কোথায় কি জোগাড় করব?
তাও তো সত্যি। কিন্তু এও বলি অতসী, ঝোঁকের মাথায় কাজটা ছেড়ে না দিয়ে একবার বাড়ি এসে বিবেচনা করা উচিত ছিল। পরের দাসত্ব করতে গেলে গায়ে গণ্ডারের চামড়া পরতে হয় মা!
সেটা পরতে সময় লাগবে মাসীমা! বলে অতসী চলে আসতে চায়। হরসুন্দরী বাধা দিয়ে সন্ধিগ্ধভাবে বলেন, শাশুড়িও কিছু বলে নি বলছ, বৌও কিছু বলে নি, তবে ব্যাপারটা কী হল বল তো? বুড়ির ছেলেকে তো ভাল বলেই জানতাম, সেই কোনরকম কিছু বেচাল দেখাল নাকি?
আঃ ছি ছি, কী বলছেন মাসীমা! অতসী রুদ্ধকণ্ঠে বলে, কী করে যে এই সব আজগুবি কথা মাথায় আসে আপনাদের? বলেই চলে আসে, আর দাঁড়ায় না।
স্কুল থেকে ফিরে সীতু কোনদিন মাকে বাড়িতে দেখতে পায় না। অতসী আসে সন্ধ্যার পর। আজ ঘরের দরজা খোলা দেখে ঈষৎ বিস্ময়ে দরজায় উঁকি দিয়েই পুলকে রোমাঞ্চিত হল সে। তার সীল করা মনও এই পুলককে লুকিয়ে রাখতে পারল না।
বই রেখেই মার কাছাকাছি বসে পড়ে উজ্জ্বল মুখে বলে উঠল সীতু, মা এখন?
অতসী কী এই উজ্জ্বল মুখে কালি ঢেলে দেবে? বলবে, ঘুচিয়ে এলাম চাকরি? এবার নেমে আসতে হবে দুর্দশার চরমে?
না, এই মুহূর্তে তা পারল না অতসী। শুধু মৃদুহেসে বলল, দেখে বুঝি রাগ হচ্ছে?
ইস রাগ বইকি! রোজ তুমি থাকবে। ইস্কুল থেকে এসে তালা খুলতে বিচ্ছিরি লাগে।
অতসী তেমনিভাবেই বলে, বেশ রোজ আমি থাকব, তোকে আর দরজার তালা খুলতে হবে না। কিন্তু রোজগারের ভার তুই নিবি তো?
না, কালি ঢেলে দেওয়া রদ করা গেল না। সুর কেটে গেল।
সীতু আস্তে আস্তে উঠে গেল মুখ হাত ধুতে।
কিন্তু নিজে ছাড়লেও কমলি ছাড়ে না।
পরদিন হরসুন্দরী এসে জাঁকিয়ে বসলেন, শুনলাম বাছা তোমার কাজ ছাড়ার কারণ কাহিনী।
অতসী অনুভব করল সীতু হেঁটমুণ্ডে অঙ্ক কষতে কষতেও উৎকর্ণ হয়ে উঠেছে। তাড়াতাড়ি বলল, থাক মাসীমা ও কথা।
কিন্তু হরসুন্দরী তো এসেছেন দূত হয়ে, কাজেই এক্ষুনি থাকলে তার চলবে কেন? তাই প্রবল স্বরে বলেন, তুমি তো বলছ বাছা থাক ও কথায়। কিন্তু তারা যে আমায় আবার খোসামোদ করছে। বুড়ি তো মা আমার হাতে ধরে কেঁদে ভাসাল। শুনলাম সব। বৌটা নাকি তোমার ছেলেকে বাবুর ফাইফরমাস খাটতে চাকর রাখতে চেয়েছিল? অহঙ্কার দেখ একবার! তুমি না হয় অভাবে পড়ে দাসীবিত্তি–
মুখের কথা মুখেই থাকে হরসুন্দরীর, হঠাৎ সীতু খাতা ফেলে উঠে এসে তীব্র চীৎকারে বলে, তুমি চলে যাও।
একে তুমি তায় চলে যাও!
হরসুন্দরীর আগুন হয়ে উঠতে পলকমাত্রও দেরি হয় না।
তিনি দাঁড়িয়ে উঠে বলেন, তোমাদের মায়ে-বেটার তেজটা একটু বেশি সীতুর মা! কপালে তোমার দুঃখু আছে। আচ্ছা চলে আমি যাচ্ছি। ঠিক ঠিক সময়ে ঘরভাড়াটা যুগিও বাছা, তোমার ছায়া মাড়াতেও আসব না। আত্মজন ছেড়ে কেন যে তুমি ওই ছেলে নিয়ে অকূলে ভেসেছ, বুঝতে পারছি এবার।
হরসুন্দরী বীরদর্পে চলে যান। অতসীর অকূলের তৃণের ভেলা, অসময়ের একমাত্র হিতৈষী হরসুন্দরী বাড়িওয়ালী।
অতসী কি ছুটে গিয়ে ওই ভেলাকে আঁকড়ে ধরবে? বলবে, জানেনই তো মাসীমা, ছেলে আমার পাগলা।
না, অতসীর সে শক্তি নেই। ছুটে যাওয়ার শক্তি। স্থাণু হয়ে গেছে সে।
বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা হয়ে আসে। ঘণ্টার পর ঘণ্টা কেটে যায়, নির্বাক দুটো প্রাণী বসে থাকে সেই অন্ধকারে। এমনি করেই কি লেখাপড়া চালাবে সীতু? মানুষ হবে, বড়লোক হবে? মৃগাঙ্ক ডাক্তারের অর্থঋণ শোধ করবে?
হঠাৎ এক সময় অতসী পিঠে একটা স্পর্শ অনুভব করে। একটা চুলে ভরা মাথা আর হাড় হাড় রোগা মুখের স্পর্শ।
ও কেন ওকথা বলবে? রুদ্ধ অস্ফুট স্বর।
অতসী নির্বাক।
আর একবার সেই রুদ্ধস্বর বলে ওঠে, আমার বুঝি বিচ্ছিরি লাগে না? আপোসের স্বর, কৈফিয়তের স্বর।
অতসী স্থির স্বরে বলে, পৃথিবীর কোনটা তোমার বিচ্ছিরি লাগে না, সেটা আমার জানা নেই সীতু। নতুন করে আর কি বলবে?
চাকর বললে, দাসী বললে, চুপ করে থাকব?
হ্যাঁ থাকবে। অতসী দৃঢ় স্বরে বলে, তাই থাকতে হবে। আমারই ভুল হয়েছিল কাজ ছেড়ে আসা। ঠিকই বলেছিল ওরা। আমাদের অবস্থার উপযুক্ত কথাই বলেছিল। অহঙ্কার আমাদের শোভা পাবে কিসে? জানো, একমাস যদি এ ঘরের ভাড়া দিতে না পারি, রাস্তায় বার করে দিতে পারেন উনি! জানো, জেনে রাখো! এসব জানতে হবে তোমায়। জেনে রাখো তোমার বিচ্ছিরি লাগা আর ভাল লাগার বশে পৃথিবী চলবে না। অতসী যেন হাঁপাতে থাকে, কাল থেকে আবার আমি ওখানে কাজ করতে যাব। পায়ে ধরে বলব, আমার ভুল হয়েছিল–।
না না না! বাণ খাওয়া পশুর মত আর্তনাদ করে ওঠে বাক্যবাণবিদ্ধ ছেলেটা।
আশ্চর্য, এত নিষ্ঠুর কি করে হল অতসী?
নাকি ছেলেকে চৈতন্য করিয়ে দিতে ওর এই নিষ্ঠুরতার অভিনয়? অভিনয় কি এত তীব্র হয়? নাকি অহরহ খুকুর মুখ তার ধৈর্যের বাঁধ ভেঙে দিচ্ছে?
ওই আর্তনাদে একটু সামলায় অতসী। একটু চুপ করে থাকে। তারপর সহজ গলায় বলে, না তো চলবে কিসে তাই বল?
নাই বা চলল? সীতু তেমনি একগুঁয়ে স্বরে বলে, আমরা দুজনেই মরে যাই না?
অতসী উঠে দাঁড়ায়, যথাসম্ভব দৃঢ় স্বরে বলে, কেন? মরে যাব কেন? মরে যাওয়া মানেই হেরে যাওয়া তা জানো? হারতে চাও তুমি? যদি হেরেই যাব, তাহলে তো ও বাড়িতেই মরতে পারতাম। এ খেয়ালকে মনে আসতে দিও না সীতু। মনে রেখো তোমায় বাঁচতে হবে, জিততে হবে। দেখাতে হবে, যে অহঙ্কার করে চলে এসেছ, সে অহঙ্কার বজায় রাখবার যোগ্যতা তোমার আছে।
উঠে গিয়ে উনুন ধরাতে বসে অতসী।
কিন্তু কদিন উনুন ধরাবে? কোথা থেকে আসবে রসদ?
কী করে কি করছে ওরা?
কি করে চালাচ্ছে? কোথা থেকে আসছে ওদের রসদ?
এই কথাটাই আকাশপাতাল ভাবেন মৃগাঙ্ক ডাক্তার। ভাবেন সত্যিই কি এইভাবে ভেসে যেতে দেবেন ওদের?
না, অতসীর আস্তানা এখন আর তার অজানা নেই। অনেকদিন ভেবে ভেবে অবশেষে মাথা হেঁট করে শ্যামলীর বাড়ি গিয়ে সে খোঁজ করে এসেছেন। যদিও অতসীর সহস্র নিষেধ ছিল, তবু শ্যামলী বলতে মুহূর্ত বিলম্ব করে নি। কাঁদো কাঁদো হয়ে বলেছিল, লজ্জায় আমি আপনার কাছে মুখ দেখাতে পারি না কাকাবাবু, না হলে কবে গিয়ে বলে আসতাম! আমি বলি কি, আপনি আর ওঁদের জেদের প্রশ্রয় দেবেন না। এবার পুলিশের সাহায্য নিয়ে জোর করে ধরে এনে বাড়িতে বন্ধ করে রেখে দিন। আবদার নাকি, ওই ভাবে একটা বস্তির বাড়ির মত বাড়িতে থেকে আপনার মুখ পোড়াবে?
বোকাদের মুখরতা মৃগাঙ্কর অসহ্য, তবু সেদিন ওই বোকা মেয়েটার মুখরতা অসহ্য লাগেনি। সহসা মনে হয়েছিল, জগতে এই সরল সাদাসিধে অনেক কথা-বলা লোক কিছু আছে বলেই বুঝি পৃথিবী আজও শুকিয়ে উঠে জ্বলে পুড়ে খাক হয়ে যায় নি। ভেবেছিলেন, আশ্চর্য, মেয়েটার ওপর এত বিরূপই বা ছিলাম কেন!
তোমরা কোনদিন গিয়েছিলে? সসঙ্কোচে প্রশ্ন করেছিলেন মৃগাঙ্ক।
শ্যামলী মাথা ঝাঁকিয়ে বলেছিল, উপায় আছে? একেবারে কড়া দিব্যি! দেখা করব না, খোঁজ করব না, কোন সাহায্য করব না–
সাহায্য শব্দটা উচ্চারণ করে অপ্রতিভ হয়ে চুপ করে গিয়েছিল শ্যামলী। চলে এসেছিলেন মৃগাঙ্ক। চলে তো আসতেই হবে। নিতান্ত কাজ ব্যতীত বাইরে থাকার জো আছে কি? খুকু নামক সেই ভয়ঙ্কর মায়ার পুতুলটা আছে না বাড়িতে? সারাক্ষণ যাকে ঝি-চাকরের কাছে পড়ে থাকতে হয়। মৃগাঙ্ক এলেই যে কোথা থেকে না কোথা থেকে ছুটে এসে বাব্বা বাব্বা বলে ঝাঁপিয়ে কোলে ওঠে।
শুধু ওই বাবা ডাকেই চিরদিন সন্তুষ্ট থাকতে হবে খুকুকে! মা বলতে পাবে না! মা নেই ওর! হঠাৎ একদিন মোটর অ্যাকসিডেন্টে মা মারা গেছে ওর!
বাবাই তাই বুকের ভেতরে চেপে ধরে খুকুকে।
কিন্তু থাকে না। বেশিদিন থাকে না এই অভিমান। থাকানো যায় না।
গাড়ি নিয়ে বেরিয়ে যান মৃগাঙ্ক।
শিবপুরের এক অখ্যাত গলির ধারে কাছে ঘুরে বেড়ান। একদিন নয়, অনেকদিন। কিন্তু কী যে হয়, কিছুতেই সাহস করে গাড়ি থেকে নেমে পায়ে হেঁটে সেই বাই-লেনের ছায়াচ্ছন্ন অন্ধকারের মধ্যে এগিয়ে যেতে পারেন না। বুকটা কেমন করে ওঠে। পা কাঁপে।
যদি অতসী পরিচয় অস্বীকার করে বসে? যদি অন্য পাঁচজনের সামনে বলে ওঠে, আচ্ছা লোক তো আপনি? বলছি আপনাকে চিনি না আমি
চলে আসেন।
আবার যখন গভীর রাত্রে ঘুম থেকে জেগে ওঠা কান্নায় উদ্দাম খুকুকে কিছুতেই ভোলাতে না পেরে, কোলে নিয়ে পায়চারি করে বেড়ান, তখন মনে মনে দৃঢ় সংকল্প করেন, কাল নিশ্চয়ই। কিন্তু আবার পিছিয়ে যায় মন।
এই কাল কাল করে কেটে যায় কত বিনিদ্র রাত, আর অশান্ত দিন।
তারপর সেদিন।
যেদিন খুকু
কিন্তু এমন কি হয় না? ডাক্তার হয়েও এত বেশি নার্ভাস হলেন কি করে?
হয়তো অত বেশি নার্ভাস হয়ে উঠেছিলেন বলেই খুকু…