৩. গাড়ি গ্যারেজে পুরে

গাড়ি গ্যারেজে পুরে মৃগাঙ্ক বাড়ি ঢুকলেন, সঙ্গে ঢুকল অতসী–পায়ে হেঁটে।

মৃগাঙ্ককে দেখে একটু কি অস্বস্তি পেল? নাকি সপ্রতিভভাবেই ঢুকল শুধু মাথার কাপড়টা আর একটু টেনে? হয়তো বা টানলও না, শুধু একেবারে নির্লিপ্ত থাকবে, তাই টানার ওই ভঙ্গীটুকু করল মৃগাঙ্কর উপস্থিতিকে সম্মান দিতে।

মৃগাঙ্ক ঈষৎ অবাক হয়ে বললেন, পায়ে হেঁটে একা কোথায়?

 অতসী এক মুহূর্ত চুপ করে থেকে বলল, পায়ে হেঁটে, কারণ গাড়ি চড়ার মত দূর নয়, কাউকে নিয়ে যেতে চাই না বলেই একা, আর কোথায় সে কথা শুনলে হয়তো সুখী হবে না।

সমুদ্রের ঢেউ আছড়ে পড়ার মত মনের মধ্যে একটা আবেগের আলোড়ন উঠে আছড়ে পড়ল।

সুখী হতে বাধা কি? সুখী হতে কি পারে না মৃগাঙ্ক?

 হঠাৎ ভারি একটা ইচ্ছে হল মৃগাঙ্কর, সুখী হলে কেমন লাগে অনুভব করতে। সুখী হওয়াটা না নিজের হাতের মুঠোয়? শক্তিমানেরা না ইচ্ছে করলেই সুখী হতে পারে? তাই এতক্ষণ ভাবছিল না মৃগাঙ্ক গাড়ি চালিয়ে আসতে আসতে?

তবে একবার পরীক্ষা করে দেখতে দোষ কি?

তাই মৃগাঙ্ক ডাক্তারের কপালের চামড়া কুঁচকে উঠল না, কোঁচকালো গালের চামড়া, ঈষৎ হাসিতে। আমি কিসে সুখী হই আর কিসে হই না, সে খবর রাখো?

অতসী একটু অবাক হয়েছে, স্পষ্টই বোঝা যাচ্ছে সেটা। অবাকটা দেখতে বেশ মজা লাগছে।

খবর রাখবার শক্তি থাকলে তো?

অতসীও হয়তো ঈষৎ হেসেছে, অবাক হওয়া সত্ত্বেও।

শক্তি অর্জন করতে হয়!

 পারলাম আর কই?

চেষ্টা করে দেখেছ কখনো? শুধু পারলাম না বলে হারই মানলে!

ততক্ষণে বসবার ঘরের মধ্যে এসে বসে পড়েছেন মৃগাঙ্ক, অগত্যা অতসীও।

জোরালো আলোটা মুখে এসে পড়েছে, সেই দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে মৃগাঙ্কর, সহসা মনে হয় অতসী নেহাৎ ছোট। মৃগাঙ্কর চাইতে অনেক ছোট। এত দুঃখকষ্ট এত ঝড়ঝাঁপটা পার হয়ে এসেও এখনো ও তরুণী। কালের চাকার দাগ পড়ে নি ওর কপালে, মুখে, চোখের কোণায়, ঠোঁটের রেখায়। কোথাও ধরা পড়ছে না ওর জীবনের ইতিহাস।

কিন্তু নিজেকে তো মৃগাঙ্কর আরশির পটে দেখেছেন। সে বড় স্পষ্টভাষী। মৃগাঙ্কর মুখে কালের চাকা গম্ভীর হয়ে ফুটেছে।

সুখী হবার সাধ জাগলেই কি আর এখন সুখী হবার ক্ষমতা আছে?

তৎক্ষণাৎ নিজের ক্ষণপূর্বের কথাটাই কানে বেজে উঠল, ক্ষমতা অর্জন করতে হয়। তাই নির্বাক নতনয়না অতসীর দিকে তাকিয়ে গম্ভীর হাস্যে বলেন, শুনলে আমি অসুখী হব না। তবে তোমার যদি গভীর গোপনীয় কিছু থাকে–

হাসিটা গম্ভীর, কণ্ঠে ঈষৎ তরলতা।

অতসী বড় অবাক হচ্ছে মনে হচ্ছে। অতসীর অবাক হওয়াটা আরও মজার লাগছে!

অবাক হোক, তবু অতসী এবার স্পষ্ট সুর ধরেছে, আমার আর গোপনীয় কি? সব জেনেই তো এনেছ।

আহা, নতুন কিছু হতেই বা আটকায় কে? এখনো তো প্রায় কলেজ গার্ল।

তুমি কি আমাকে ব্যঙ্গ করতে চাইছ?

না, চেষ্টা ছাড়বেন না মৃগাঙ্ক, তাই হেসে উঠে বলেন, ব্যঙ্গ কেন, ঠাট্টা হতে নেই? নিজের স্ত্রীকে একটু ঠাট্টা করা চলে না?

 অসম্ভব অবাক হচ্ছে অতসী, বেশ বোঝা যাচ্ছে দিশে পাচ্ছে না ও। মন্দ নয়। এ তো বেশ মজার খেলা, নেশা লাগছে। দেখা যাক কি বলে।

অতসী বলছে, পৃথিবীতে আমি বেশি দেখিনি, জানি না কি চলে আর কি চলে না। শুধু এইমাত্র পৃথিবীর একটুকরো দেখে এলাম, দেখে ধাঁধায় পড়েছি, ওরাই অস্বাভাবিক, না ওটাই স্বাভাবিক?

দেখে এলে! ও তুমি যে কোথায় যেন গিয়েছিলে? কারুর বাড়ি নাকি?

হ্যাঁ, শ্যামলীর বাড়ি!

হায় ঈশ্বর!

 মৃগাঙ্কর সুখী হওয়ার এত আক্রোশ কেন তোমার?

 কিন্তু তবু মৃগাঙ্ক সহজে হার মানবে না, তোমার ওপর জিতবে।

শ্যামলী! ও! ওর সেই বাচ্চাটি ভাল আছে?

তা অতসীও বোধকরি সামলে নিচ্ছে নিজেকে। সহজ হচ্ছে। বাচ্চাটি ভাল আছে। মা নিজেই হঠাৎ অসুখে পড়েছে।

তাই নাকি? কি হয়েছে?

কাল একটু জ্বর হয়েছিল। এমন কিছু বেশি না, আজ সকালে ভালই ছিল। হঠাৎ বিকেলের দিকে সেন্সলেস হয়ে পড়ে। বাড়িতে শুধু ওই বাচ্চাটা আর ঝি, স্বামী বাড়ি নেই, ঝিটা ভয় পেয়ে এবাড়িতে এসেছিল ডাক্তার ডাকতে- অতসী একটু থামল।

এই অবসরে মৃগাঙ্ক বলে উঠলেন, তা ডাক্তারকে না পেয়ে বুঝি ডাক্তারগিন্নীকেই কল দিয়ে নিয়ে গেল?

অতসীর ভয় হচ্ছে। মৃগাঙ্ক কি ড্রিঙ্ক করে এসেছেন? ডাক্তারদের ক্লাবে নাকি ওটা চালু ব্যাপার।

এমন হালকা চালের কথা মৃগাঙ্ককে কবে বলতে শুনেছে অতসী?

শুনেছে হয়তো সেই প্রথম পর্বে, কিন্তু তখন তো অতসী সর্বদাই আড়ষ্ট। এখনও কি নয়? শুধু শ্যামলীর প্রসঙ্গেই সেদিন সহসা মুখর হয়ে উঠেছিল। উত্তাল হয়ে উঠেছিল।

তারপর সেই এক বাক্স সন্দেশ চাকরদের বিলিয়ে দেবার পর, শান্ত চিত্তে সংকল্প করেছিল, থাক আর প্রশ্রয় দেবে না শ্যামলীকে। অথবা স্পষ্ট করেই বলে দেবে তাকে, অতীতের জের টেনে জীবনকে বিড়ম্বিত করতে ইচ্ছে নেই অতসীর।

কিন্তু কোথায় বসে আছেন এক অদৃশ্য চক্ৰী! তাই যে বাড়িতে একদিনও যায় নি অতসী শ্যামলীর সহস্র সাধ্যসাধনায়, কেবলই এড়িয়ে গেছে নানা কথায়, সেই বাড়িতেই ছুটে চলে গেল নিজে থেকে।

নিজে থেকেই।

শ্যামলীর বাড়ির ঝি জানত না তার মনিবানির সঙ্গে এবাড়ির গিন্নীর পরিচয়ের যোগাযোগ আছে। সে শুধু হাঁউমাউ করছিল। ওগো বাড়িতে একটা বাচ্চাছেলে আর সেই জ্ঞানশূন্য রুগী! ছেলেটা যদি ভোলা দরজা পেয়ে রাস্তায় বেরিয়ে আসে! ওগো, ডাক্তারবাবু কখন ফিরবে গো? মানুষটা বেঁচে আছে না নেই তাও তো বুঝতে পারছি না, কি করব গো!

ওর চেঁচামেচিতে বাড়ির ঝি-চাকররা আকৃষ্ট হয়ে অকুস্থলে গিয়ে উপস্থিত হয়েছিল, সঙ্গে সঙ্গে বামুন মেয়েও; আর সে-ই এসে সংবাদ পরিবেশন করল। বৌদিদি, সেই যে মেয়েটা তোমায় কাকীমা কাকীমা করে, তার বাড়ির ঝি এসে হল্লা লাগিয়েছে ডাক্তার ডাক্তার করে।

প্রসঙ্গটা এমনই যে, একেবারে অগ্রাহ্য করা চলে না। বামুন মেয়েকে অগ্রাহ্য দেখাবার জন্যেও না। তাই বলতেই হয়েছিল অতসীকে তাদের বাড়ির ঝি মানে? কে বললে?

আহা বলবে আবার কে! ওই ঝিটাকে নিয়ে গিন্নী তো যখন তখন বাজার যাচ্ছে, দোকান যাচ্ছে দেখি যে পথে। ঝিমাগী হাউমাউ করছে, গিন্নী নাকি হঠাৎ অজ্ঞান হয়ে গেছে, বাড়িতে কেউ নেই। ও জানে এ বাড়িতে ডাক্তার আছে তাই ছুটে এসেছে। এখন ছেলেটা ওর পিছু পিছু পথে বেরিয়ে এসেছে কিনা কে জানে! যে রাস্তাঘাট, বেরলে আর বাঁচতে হবে না!

কথা কটি নিবেদনের সময় বামুন মেয়ের মুখে উল্লাসের যে অভিব্যক্তি ফুটে উঠেছিল, তা যদি দেখতে পেত, তাহলে হয়তো বা অতসী বিরক্ত হয়ে সেখানে যেতই না। নিস্পৃহতার ভান দেখাত, কিন্তু অতসী শোনামাত্রই মনকে প্রস্তুত করে নিয়েছিল। তাই আসতে রাত হতে পারে, সীতু যেন খেয়ে নেয় এই বলে বেরিয়ে পড়েছিল ঝিটার সঙ্গেই।

তাই বুঝি ডাক্তার গিন্নীকেই কল দিয়ে নিয়ে গেল এই সামান্যতম পরিহাসটুকু এমন করে মনকে তোলপাড় করে তুলল কেন? কেন চোখে এনে দিল জল! এ কী রোগ অতসীর!

কি হল? নাঃ, এ কঁদুনে বেবি নিয়ে তো মহা মুশকিল! আশ্চর্য, চেষ্টা করে কথা তৈরি করতে হচ্ছে না! এসে যাচ্ছে আপনা থেকে। সুন্দর করে কথা বলতে যে এত সুন্দর লাগে একথা যেন ভুলেই গিয়েছিলেন মৃগাঙ্ক ডাক্তার।

সেই বিয়ের পর প্রথম প্রথম অতসীর ভয় ভাঙাতে সুন্দর করে কথা বলেছেন, কিন্তু সীতুরূপী দেওয়ালটি যতদিন থেকে মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে, ততদিন থেকে জীবনের সব সৌন্দর্যই ধ্বংস হয়ে গেছে। আজ এই খেয়ালের খেলার ধারে কাছে সীতু নেই বলেই বুঝি আবার মনে হচ্ছে জীবনের সব সৌন্দর্য হারিয়ে যায় নি।

তোমার এই নার্ভাসনেসের জন্যেই আমি বেচারা মাঝে মাঝে কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে পড়ি। যাক, ওই কি বলে–শ্যামলীর এখনকার অবস্থা কি?

 এখন তো কথাটথা বলছে। সুনীল, মানে ওর স্বামী, এসে গেছে। ডাক্তার ডাকবার জন্যে খুব ব্যস্ত হচ্ছিল, শ্যামলীই জোর করে বারণ করল। ভাল আছে দেখে আমিও চলে এলাম।

যাক ডাক্তারগিন্নীর চিকিৎসাতেই তাহলে রোগী চাঙ্গা! কিন্তু হঠাৎ এটা হল কেন সেটা জানা দরকার। কাউকে দেখিয়ে নেওয়া ভাল।

 অতসী ভিতরে ভিতরে মনকে নাড়া দিচ্ছে–বিহ্বল হস নে, স্তব্ধ হয়ে তাকিয়ে থাকিস নে। উপভোগ কর এই হঠাৎ পাওয়া সম্পদটুকু। ভাবতে বসিস নে এ সম্পদ যাদুকরের মায়া রচনা না ভগবানের দান।

দেখিয়ে নেওয়া ভাল, সে কথা আমিও বলে এলাম। সুনীল তো—

 কি হল, কথায় ড্যাস টেনে ছেড়ে দিলে যে?

না, মানে ও বলছিল কাকে দেখালে ভাল হয়?

তা তোমার সুনীল যদি আমাকে–হেসে ওঠেন মৃগাঙ্ক–ডাক্তার বলে গণ্য করে, আমিও গিয়ে দেখে আসতে পারি।

তুমি!

হ্যাঁ। যদি গণ্য করে।

এমন অদ্ভুত ঠাট্টা করছ কেন?

কেন? কেন জানো অতসী, মৃগাঙ্ক সহসা স্ত্রীর খুব কাছে সরে এসে বলেন, কেবল গম্ভীর হয়ে হয়ে বড় ক্লান্ত হয়ে পড়েছি। জীবনটা বোঝার মত হয়ে উঠেছে। একবার দেখা যাক না হাল্কা হলে কেমন লাগে?

.

হালকা হতে কেমন লাগে সে কথা যদি কেউ জানে তো সে হচ্ছে এরা। শ্যামলী আর সুনীল। এই একটু আগে বাড়িতে প্রায় শোকের ছায়া পড়ে গিয়েছিল, অকস্মাৎ বাড়ি ফিরে শ্যামলীর ওই অবস্থা দেখে সুনীল তো নিজেই প্রায় অচৈতন্য হয় হয়, নেহাৎ অতসীর শাসনেই খাড়া হল। কিন্তু এখন দেখো!

পৃথিবীতে যে কোন ভাবনা আছে, চিন্তা আছে, দুঃখ আছে, ভার আছে, একথা ওরা যেন জানেই না। যদিও সুনীল বারে বারে বলছে, দেখো, তোমার কিন্তু বেশি কথা কওয়া ঠিক হচ্ছে না! এবার ঘুমনো দরকার। তবু কথার ধারা সমান বেগেই প্রবাহিত হচ্ছে।

আজকের আলোচ্য বিষয়ের মধ্যে অতসী প্রধান। সুনীল তো মুগ্ধ। ও নাকি এমন মহিলা ইতিপূর্বে দেখে নি। শ্যামলী যোগ দিচ্ছে দেখছ তো? সাধে কি আর সেই ছেলেবেলা থেকে প্রেমে পড়ে বসে আছি?

কিন্তু মৃগাঙ্ক ডাক্তারের সঙ্গে মানায় না। সু

নীলের এ কথাতেও শ্যামলীর সায়।

মানায় না। সত্যিই মানায় না। ওই আড়ে দীর্ঘ মস্ত, গম্ভীর রাশভারী মানুষটার সঙ্গে অতসীর অত রোগা রোগা ঝিরঝিরে স্নিগ্ধ সুকুমার মানুষটাকে মানায় না।

 কিন্তু ডাক্তার হিসেবে খুব ভাল। সুনীল বলে, শুধু স্পেশালিস্ট হিসেবে নয়, সাধারণভাবেও খুব নাম আর হাতযশ আছে ওঁর। আগে তো এমনি ডাক্তারই ছিলেন, পরে বিলেত গিয়ে স্পেশালিস্ট হয়ে আসেন।

এত কথা তুমি জানলে কি করে?

 বাঃ পাড়ায় পড়ে থাকি, আর এটুকু তথ্য রাখব না? ডাক্তার খুবই ভাল।

খোকনের ব্যাপারে দেখলামও তো। কিন্তু কাকীমার সঙ্গে রিলেশান খুব ভাল বলে মনে হয় না। অবশ্য এ ধরনের বিয়ে হওয়া শক্ত।

তা কেন? এতেই তো হবে। ইচ্ছে করে ভালবেসে যখন বিধবা জেনেও বিয়ে করেছেন

তা করেছেন সত্যি। তবু যে মেয়ের একটা অতীত ইতিহাস রয়েছে, নিজে সে সম্পূর্ণ সুখী হবে কি করে? এ জীবনের মাঝখানে সেই অতীত ছায়া ফেলবেই।

 আহা গোপন কিছু তো নয়?

নাই বা হল। তবু উচ্ছ্বসিত হয়ে একটা পুরনো দিনের গল্প করতে বাধবে, সে জীবনের সুখ দুঃখ আশা হতাশার কাহিনী বলতে বাধবে, হঠাৎ কোন ছলে প্রথম প্রেমের অনুভূতির কথা উঠে পড়লে সুর যাবে কেটে, অতএব জীবনের সেই কয়েকটা বছরকে একেবারে সীল করে সিন্দুকে তুলে রাখতে হবে। স্বচ্ছন্দতাই যদি না থাকল, সুখটা অব্যাহত রইল কোথায়?

হু। কিন্তু পৃথিবীর সর্বত্রই তো চলে আসছে এ প্রথা।

শ্যামলী মাথা ঝাঁকিয়ে বলে, প্রথা জিনিসটা হচ্ছে প্রয়োজনের বাহন, ওর সঙ্গে প্রকৃত সুখের সম্পর্ক কি? নিঃসন্তান লোকেদের তো দত্তক নেওয়ার প্রথা আছে। তাই বলে কি নিজের সন্তানের মত হয় সে?

এ তুলনাটা কি রকম হল?

যে রকমই হোক, আমি বলতে চাইছি প্রয়োজনের খাতিরে অনেক প্রথাই চলে আসছে। সমাজে, তার মধ্যে প্রাণের স্পর্শ থাকে না।

তা পুরুষেরা তো দিব্যি দ্বিতীয়পক্ষ তৃতীয়পক্ষ নিয়ে আনন্দের সাগরে ভাসে।

শ্যামলী মুখ টিপে হেসে বলে, হবে হয়তো। সে সাগরের খবর তো আমি রাখি না। তুমি ভাল করে জানতে পারবে আমার জীবনান্তের পর যখন নতুন পক্ষ মেলে উড়বে।

হেসে ওঠে দুজনে।

কেটে যায় কিছুক্ষণ খুনসুড়িতে। অকারণ হাসি অকারণ কথায়।

এক সময় আবার বলে, আচ্ছা তোমার কাকার সঙ্গে ওঁর রিলেশানটা কি রকম ছিল?

আমার কাকার কথা আর তুলো না। শ্যামলী বলে, গুরুজন মরেছেন স্বর্গে গেছেন, তবে বলে পারছি না, তিনি মানুষ নামের অযোগ্য ছিলেন। নেহাৎ তো ছোটই ছিলাম, তবু কি বলব কেবলই ইচ্ছে হত ওঁর কাছ থেকে কাকীমাকে চুরি করে নিয়ে পালাই।

সাধু ইচ্ছে! যাক, ভদ্রলোক আর যাই হোন একটা বিষয়ে অন্তত বুদ্ধির কাজ করেছিলেন, সময় থাকতে মারা গিয়েছিলেন।

শ্যামলী হেসে ফেলে বলে, মারা যাবার পর এমন একটা ব্যাপার ঘটবে জানলে খুব সম্ভব মারা যেতেন না।

আচ্ছা ধর, তোমার কাকা যদি ওরকম হৃদয়হীন প্যাটার্নের না হতেন, ধরো খুব প্রেমিক মহৎ স্নেহশীল স্বামীই হতেন, মারা গেলে তোমার কাকীমার প্রয়োজনের সমস্যাটা তত সমানই থাকত? সে ক্ষেত্রে? মানে কেবলমাত্র এদের সম্বন্ধে বলছি না, জেনারেল ভাবেই বলছি, তেমন হলে কিংকর্তব্য?

কর্তব্য নির্ধারণ করা অপরের কর্ম নয় বলে শ্যামলী, এই হচ্ছে সাদা কথা। কে যে কোন অবস্থায় কি করতে বাধ্য হয় বলা শক্ত। কারণ হৃদয়ের চাইতে পেটের দাবী বেশি প্রত্যক্ষ। তাছাড়া প্রশ্ন তো কেবল নিজেকে নিয়েই নয়, প্রধান প্রশ্ন আরও মেম্বারদের নিয়ে। নিজে না খেয়ে পড়ে থাকব বলে জোর করা যায়, ওরা না খেয়ে পড়ে থাক বলা যায় না। সে ক্ষেত্রে অপরের কর্তব্য হচ্ছে সমালোচনা না করা। আমি তো এই বুঝি।

হায় অবোধ বালিকা! জগতে যদি সমালোচনা বস্তুটাই না থাকল, তাহলে রইল কি?

 রইল মানুষ।

সমালোচনা আছে তাই মানুষ মানুষপদবাচ্য। অন্যের সমালোচনার মুখে পড়বার ভয় না থাকলে, কি দায় থাকত মানুষের শৃঙ্খলা মেনে চলবার, নিয়ম মেনে চলবার?

যাকগে বাবু এসব বাজে কথায়। তুমি একদিন চল না ওখানে।

 আমি? ক্ষেপেছ?

 কেন, এতে ক্ষ্যাপার কি হল?

বাবা, ডাক্তারকে দূরে থেকেই আমার হৃৎকম্প হয়, যা গম্ভীর মুখ! কি করে যে তোমার কাকীমা

ও একটা কথাই নয়। নারকেলের মধ্যে মজুত থাকে চিনির সরবৎ। কাকীমাও তো গম্ভীর।

তা যাই বল, এই গম্ভীর গম্ভীর মানুষগুলোর মধ্যে প্রেম ভালবাসা ইত্যাদি বস্তুগুলো যে কোন কোটরে থাকে, তাই ভাবি।

.

তা সে কথা কি শুধু অপরেই ভাবে?

অতসীও যে আজকাল ভাবতে শুরু করেছে সেই কথা। মৃগাঙ্কর হালকা হওয়ার ইচ্ছেটা টিকল আর কই? হল না। হয় না। তাই অতসী ভাবে–কোথায় ছিল মৃগাঙ্কর মধ্যে অত স্নেহ, অত স্নিগ্ধতা? আজকের এই গম্ভীর রুক্ষ ক্লিষ্ট মৌনমূর্তি মানুষটাকে দেখে কি চেনবার উপায় আছে–মানুষটা একদিন গভীরভাবে প্রেমে পড়েছিল?

 কিন্তু এত বেশী মৌনতা সহ্য করা যায় কি করে?

অতসীর যে কী হয়েছে আজকাল, যখন তখন ইচ্ছে করে মৃগাঙ্কর সঙ্গে ভয়ানক রকম একটা ঝগড়া বাধায়, রাগে ফেটে পড়ে চেঁচামেচি করে, অস্বাভাবিক একটা কিছু ঘটিয়ে অস্বাভাবিক আচরণ করে।

কেন যে এমন ইচ্ছে হয়! সুরেশ রায়ের সংসারে, সুরেশ রায়ের নিষ্ঠুরতার মধ্যেও যে মেয়ের কখনো মুখ ফোটে নি, তার এমন উগ্র উন্মাদ ইচ্ছা কেন?

.

তা সবের কারণই বুঝি সীতু। সীতুকে বাদ দিয়ে দুজনের জীবন কল্পনা করলে বোঝা যায়

কিন্তু তাও হয় না। সীতুকে বাদ দেওয়ার মত ভয়ানক অলক্ষণে চিন্তা এক ধাপের বেশি এগোতে পারে না।

খুকু আছে সত্যি।

 খুকু অতসীর চোখের আনন্দ, প্রাণের পুতুল, কিন্তু সীতু যেন বুকের ভিতরকার হাড়!

অথচ সীতুরও কী এক দুর্দান্ত নেশা, মাকেই যন্ত্রণা দেবে। নখে ছিঁড়ে ফেলবে মার সমস্ত সুখ সমস্ত শাস্তি।

তাই আবার একদিন তোলপাড় হয়ে ওঠে সংসার সীতুর হিংস্র দুর্বুদ্ধিতে।

খাওয়ার পর জল খাওয়া অভ্যাস মৃগাঙ্কর। বড় এক গ্লাস জল ঢাকা দেওয়া থাকে ঘরের টেবিলে। রূপোর গ্লাস, রূপোর রেকাবী চাপা। মৃগাঙ্কর মায়ের আমল থেকে এই ব্যবস্থা।

খাওয়ার পর কিঞ্চিৎ বিশ্রাম শেষে বেরুবার আগে এক চুমুকে জলের গ্লাসটা খালি করে তবে পোশাক পরতে সুরু করেন মৃগাঙ্ক, আজও তাই করেছিলেন, কিন্তু না, শেষ পর্যন্ত নয়।

নিয়ম পালন হয়েছিল জলটা চুমুক দেওয়া পর্যন্তই। পরক্ষণেই ভীষণ একটা আলোড়নের বেগে ছুটে যেতে হল মৃগাঙ্ককে বমি করতে।

খাবার জলটা লবণাক্ত!

সন্দেহ নেই যে খুব ধীর হাতে জলের গ্লাসের মধ্যে একটি নুনের ডেলা ছাড়া হয়েছিল, তাই প্রথমটা টের পান নি মৃগাঙ্ক। ঢকঢক করে খেয়ে নিয়েছেন। টের পেলেন গ্লাস খালি করার সময়, জলের তলাটা নুনে ভর্তি।

কোথা থেকে এল! যেমন ঢাকা দেওয়া তেমনিই রয়েছে। কোন ফাঁকে কে ওই সৈন্ধবের ডেলাটি দিয়ে রেখে ফের চাপা দিয়ে গেছে।

এ ঘটনা দৈবের হতে পারে না, কোনও সূত্র ধরেই বলা চলে না অসাবধানে কিছু একটা হয়ে গেছে। অবশ্য ভৌতিকও নয়।

তবে?

তবের আর আছে কি?

 এহেন ঘটনা তো যখন তখনই ঘটেছে, কিছুদিন একটু থামা পড়েছিল।

 হ্যাঁ, কিছুদিন একটু থামা পড়েছিল। একটু নিশ্চেষ্ট ছিল সীতু। যবে থেকে সন্দেহ ঢুকেছিল। হয়তো বা নিজের মধ্যে পরিবর্তন সাধনের সাধনাই করছিল, কিন্তু কি থেকে যে কি হয়!

.

সকালে আজ বাগানে নেমে এসেছিল সীতু। অন্তত সীতু যাকে বাগান বলে। গেটের ভিতর কম্পাউন্ডের মধ্যে কেয়ারী করা গাছের সারিতে ফুল ফোটে দৈবাৎ, পাতারই বাহার।

আজ দুএকটা গাছ আলো হয়ে উঠেছিল সীজন ফ্লাওয়ার।

জানলা দিয়ে দেখতে দেখতে নেমে এল সীতু। একগোছ ফুল নিয়ে খুকুটার ওই থোকা থোকা চুলের খাঁজে খুঁজে দেবে। গতকাল পার্কে দেখেছে একটা কোঁকড়া-চুল মেয়ের চুলে ফুলসজ্জা।

অবশ্য যা কিছু করবে সবই অপরের চোখ থেকে লুকিয়ে। কারুর সামনে কোন কিছু করতে চায় না সে।

কেন? সেই এক রহস্য।

খুকুর জন্যে প্রাণ ফেটে যায়, কিন্তু কারও সামনে তাকিয়ে দেখে না পর্যন্ত।

আজ দেখল মৃগাঙ্ক তখনও নিদ্রিত, চাকররা এদিকওদিকে। নেমে এল চুপিচুপি, চারিদিক তাকিয়ে পটপট করে ছিঁড়ে নিল কয়েক গোছ ফুল, আর আশ্চর্য, এই মাত্র যাকে ঘুমন্ত দেখে এসেছে, সেই মানুষ দোতলার বারান্দা থেকে দিব্যি খোলা গলায় বলে উঠল, বাঃ চমৎকার!

 চমকে চোখ তুলেই চোখটা নামিয়ে নিয়ে হাতের ফুলগুলো তক্ষুনি ফেলে দিয়েছিল সীতু, কিন্তু সেই বাঃ চমৎকার শব্দটিকে কোথাও ফেলে দিতে পারল না সে। সে শব্দ অনবরত কানের মধ্যে হাতুড়ির ঘা ফেলতে লাগল, বাঃ চমৎকার!

 তুচ্ছাতিতুচ্ছ ঘটনা, কিন্তু ওই ব্যঙ্গোক্তিটা তুচ্ছ করবার নয়।

দাহে ছটফট করতে করতে সিঁড়ি দিয়ে ছুটে উপরে আসতে গিয়ে ধাক্কা। মৃগাঙ্ক নামছেন। তারও যে বরাবরের অভ্যাস সকালে ওই বাগান তদারক।

যদি মৃগাঙ্ক ধমকে উঠতেন, তাহলে এতটা দাহ হত না, কিন্তু জুলিয়ে দিয়েছিল ক্ষুদ্র ওই ব্যঙ্গটুকু। বাঃ চমঙ্কার–শুধু এই কথাটুকুর মধ্যেই ছিল অনেক কথা!

পরক্ষণেই আবার সিঁড়িতে দেখা।

কিন্তু সেখানে তো ব্যঙ্গের ভাষা ব্যবহার করেন নি মৃগাঙ্ক। শুধু মৃদুগভীর একটি প্রশ্ন করেছিলেন, ফুল চাইলে কি পাও না? অমন চোরের মত চুপিচুপি নেবার দরকার কি?

আর কিছু নয়।

নেমে গিয়েছিলেন মৃগাঙ্ক, সীতুও উঠে এসেছিল। কিন্তু সেই থেকে আবার সীতুর কাঠত্ব প্রাপ্তি।

সীতু আর সীতুর পরম শত্রুটাকে থাকতেই হবে এক বাড়িতে? আর কোন উপায় নেই? মা যে বলেছিল অন্য জায়গায় পাঠিয়ে দেবার ব্যবস্থা করবে–দেখা যাচ্ছে সেটা নেহাৎই স্তোকবাক্য। সেই আশায় কত ভাল হবার চেষ্টা করেছিল সীতু, কিন্তু মাটা মিথ্যাবাদী।

মার বিশ্বাসঘাতকতায় সেদিন তো সীতু নিরুদ্দেশ হয়েই যাচ্ছিল, পার্কে বেড়াতে গিয়ে আর ফিরে আসবে না বলে চলেও গিয়েছিল অনেক দূর। কিন্তু একটু রাত্তির হয়ে যেতেই কি রকম ভয় ভয় করল। ফিরে এসে আবার বসে রইল পার্কের বেঞ্চে। অনেক রাতে বীরবাহাদুর এসে ধরে নিয়ে গেল।

তা সেদিন কেউ কিছু বলে নি সীতুকে।

 অতসীও না। শুধু কেমন এক রকম করে যেন তাকিয়ে খুব বড় করে নিঃশ্বাস ফেলেছিল। মায়ের ওই নিঃশ্বাস-ফিশ্বাসগুলো তেমন ভাল লাগে না। তাই না সীতু কদিন ধরে চেষ্টা করছিল ভাল হবার!

কিন্তু ওই, কি থেকে যে কি হয়।

.

এক বাড়িতে দুজনের থাকা চলবে না।

দৃঢ় সংকল্প করে ফেলেছিল সীতু। সীতুর মরে গেলেই হয়। মরার অনেক উপায় ঠাওরাল সীতু। কিন্তু কোনটাই তার ক্ষমতার মধ্যে নয়।

তাছাড়া

সেই কথাটা না ভেবে পারল না সীতুমা? মার সেই কেমন এক রকম করে চাওয়া আর নিঃশ্বাস ফেলা! সীতু মরে গেলে মার প্রাণে লাগবে।

তার থেকে ওই লোকটাকে সরিয়ে দিলেই সব শান্তি।

কিন্তু মরে কই? লোকটা যেন প্রহ্লাদের মতন।

 কতবার কত চেষ্টা করল সীতু, কিছুই হল না।

বামুনমেয়েরা সেদিন বলাবলি করছিল ওদের পাড়ায় কে যেন ভেদবমি হয়ে মারা গেছে। বলছিল কী দিনকাল পড়েছে। দুবার ভেদ দুবার বমি, ব্যস! জলজ্যান্ত মানুষটা মরে গেল।

ভেদ কথাটার মানে ঠিক জানে না সীতু। কিন্তু পরবর্তী কথাটার মানে জানে।

অতএব দিনকালের প্রতি পরম আস্থা নিয়ে চুপি চুপি ভাড়ার ঘরে ঢুকে প্রয়োজনীয় বস্তু সংগ্রহ করা। বেগ পেতে হল না, সহজেই হল। কাঠের একটা বড় গামলায় উঁচু করে ঢালা ছিল সৈন্ধবের টুকরো।

কিন্তু শেষ পর্যন্ত কী হল?

শুধু খুব খানিকটা হৈ চৈ চেঁচামেচি, কে করেছে, কি করে হল বলে বিস্ময় প্রকাশ, তারপর প্রত্যেকবার যা হয় তাই। মসমস করে জুতোর শব্দ তুলে চলে গেল শত্রুপক্ষ। সীতু দাঁড়িয়ে রইল অনেকগুলো জ্বলন্ত দৃষ্টির সামনে।

সাধে কি আর প্রহ্লাদের সঙ্গে ওকে তুলনা করে সীতু? মারলে মরে না, কাটলে কাটা পড়ে না, বমি করেও মরে না।

শুধু সীতুকে অপদস্থ করতে, তাকে শাস্তি না দিয়ে ক্ষমা করে চলে যায়। কেন, ও পারে না সীতুকে খুব ভয়ঙ্কর শাস্তি দিতে? তাতেও বুঝি সীতুর দাহ কিছু কমত।

কিন্তু সীতু হাল ছাড়বে না, ঠিক একদিন মেরে ফেলবে ওকে।

আচ্ছা, মোটরগাড়ির পেট্রল অনেকখানিটা নিয়ে আসা যায় না লুকিয়ে?

সেদিন বীরবাহাদুর কোথা থেকে যেন এনেছিল। প্রকাণ্ড একটা কাঁকড়াবিছে বেরিয়েছিল রান্নাঘরের পিছনে, বীরবাহাদুর ঝ করে তার গায়ে পেট্রল ঢেলে দিয়ে দেশলাই দিয়ে জ্বালিয়ে দিয়েছিল।

কেউ যখন ঘুমোয়, তখন

পেট্রল কোথায় থাকে, আদৌ বাড়িতে থাকে কিনা, এ সব তথ্য জেনে নিতে হবে।

দেশলাই? দেশলাই একটা জোগাড় করা কিছু এমন শক্ত নয়।

.

আমি বলি কি, ওকে কোন একটা বোর্ডিঙে ভর্তি করে দেওয়া হোক।

অতসী এসে প্রস্তাব করে।

মৃগাঙ্ক অতসীর জলভারাক্রান্ত চোখের দিকে তাকিয়ে মৃদু গম্ভীর স্বরে বলেন, মিথ্যে অভিমান করছ কেন অতসী? আমি কি ওর প্রতি ভয়ানক একটা কিছু দুর্ব্যবহার করছি? কেউ কি ছেলে শাসন করতে এটুকু কঠোরতা করে না?

অতসী বিষণ্ণ দৃঢ়স্বরে বলে, না, এ আমার মান অভিমানের কথা নয়। ভেবে চিন্তেই বলছি। এতদিন নেহাৎ শিশু ছিল, কিছু উপায় ছিল না। এখন বড় হয়েছে, বোর্ডিঙে রাখা শক্ত নয়। ছেলের শিক্ষার জন্যে অনেকেই তো রাখে এমন। খরচ হয়তো অনেক হবে, কিন্তু তোমার তো টাকার অভাব নেই?

টাকা!

টাকা! তা বটে! মৃগাঙ্ক ডাক্তার হাসেন, মাঝে মাঝে সন্দেহ হয় অতসী, ওটাই আমার একমাত্র কোয়ালিফিকেশন ছিল কিনা।

কী বললে?

চেঁচিয়ে উঠল অতসী। তীক্ষ্ণ গলায় চেঁচিয়ে উঠল।

সত্যি করে কিছু বলি নি অতসী, শুধু মাঝে মাঝে সন্দেহ হওয়ার কথাটা বলছি। জগতে এ রকম তো কতই হয়।

জগতে কত রকম হয়, তার একটা দৃষ্টান্ত যে আমি, এটা স্বীকার করছি। সন্দেহ করবে, এর আর আশ্চর্য কি? অতসী ম্লান হেসে বলে, ও তর্ক করে কোন লাভ নেই, আমি যা বলতে এসেছি সেই কথাটাই শেষ হোক। ওকে বোর্ডিঙে ভর্তি করে দিলে ওরও লাভ, আমারও লাভ।

 তোমার কি ধরনের লাভ সেটা তুমিই বোঝ, তবে তাতে আমার একটা মস্ত লোকসান ঘটবে সন্দেহ নেই। ওকে বাড়ি-ছাড়া করলে তোমার মনটাই কি বাড়িতে থাকবে?

অতসী এবার জোর করে হাসবার চেষ্টা করে। আদুরে আদুরে মিষ্টি হাসি। আহা, আমি যেন তেমনি অবুঝ! ছেলেমেয়ের শিক্ষাদীক্ষার জন্যে কত বাচ্চা বাচ্চা বয়সে কত দূর দূর বিদেশের বোর্ডিঙে পাঠিয়ে দিচ্ছে লোকে, দেখি নি বুঝি আমি?

মৃগাঙ্ক ডাক্তারও হাসেন। মিষ্টি হাসি নয়, ক্ষুব্ধ হাসি।

সকলের মত তো নই আমরা অতসী!

হতেই তো চাই আমি।

চাইলেই হয় না। আমিই কি চাই নি? বল অতসী, মৃগাঙ্কর গলার স্বরটা ভরাট ভারী ভারী হয়ে ওঠে, আমি কি সাধ্যমত ওকে আপনার করবার চেষ্টা করি নি? আমি ওর প্রতি পিতৃকর্তব্যের কোন ত্রুটি করেছি? ওকে নিয়ে তোমার খুব বেশি ক্ষুব্ধ হবার কোনও কারণ ঘটেছে? কিন্তু সেই এতটুকু শিশু থেকে ও আমাকে বিদ্বেষের দৃষ্টিতে দেখে, আমাকে এড়িয়ে চলতে চাওয়া ভিন্ন কাছে আসতে চায় নি কখনো।

মাথা হেঁট হয়ে যায় অতসীর।

না গিয়ে উপায় নেই বলে। মৃগাঙ্কর কথা তো মিথ্যা নয়। প্রথম প্রথম সীতুর মনোরঞ্জনের জন্যে বহু চেষ্টা করেছে মৃগাঙ্ক। হয়তো সে চেষ্টা অতসীরই মনোরঞ্জনের চেষ্টা। হয়তো মনের বিরক্তি, চোখের রুক্ষতা চাপা দিয়ে স্নেহের অভিনয় করেছে! হয়তো অনেক সাধনালব্ধ প্রেয়সীর মনে শুধু প্রেমিকেরই নয়, শুধু স্বামীরই নয়, দেবতার আসনের জন্যও একটু লোভ ছিল মৃগাঙ্কর। যে কারণেই হোক, চূড়ান্ত উদারতা দেখিয়েছিল মৃগাঙ্ক, সীতুকে চূড়ান্ত আদর করেছিল। কিন্তু সীতুর দোষেই সব গেল।

সীতুই অতসীর মাথা হেঁট করেছে।

সেই একটুখানি শিশু অত যত্ন সমাদরের কোনও মূল্য দেয় নি। মৃগাঙ্ক আহত হয়েছে, ক্ষুব্ধ হয়েছে, হয়তো বা অপমান বোধ করেছে। অতসী পারে নি তার প্রতিকার করতে, পারে নি সেই একফোঁটা ছেলেকে বাগে আনতে।

কিন্তু কেন?

ভেবে ভেবে কোনদিন কূলকিনারা পায় নি অতসী, কেন এমন? ছোট বাচ্চারা সর্বদা কাছাকাছি থাকতে থাকতে তুচ্ছ একটা ঝি-চাকরেরও কত অনুরক্ত হয়, অনুগত হয় পাড়াপড়শী মামা কাকার, অথচ যে মৃগাঙ্ক সীতুকে দুহাত ভরে দিয়েছ, দিয়েই চলেছে, রাজপুত্তুরের যত্নে রেখেছে, তাকেই সীতু দুচক্ষের বিষ দেখে আসছে বরাবর। তাও বা ছোটতে যা হোক মানিয়ে নেওয়া যেত অবোধ বলে, শিশুর খেয়াল বলে। এত মাথা কাটা যেত না তখন। কিন্তু সীতু বড় হয়ে পর্যন্ত প্রতিনিয়ত এ কী লজ্জা, এ কী অশান্তি অতসীর!

কোন দৈন্যের ঘর থেকে মৃগাঙ্ক অতসীকে তুলে এনেছে এই রাজ-ঐশ্বর্যের মধ্যে, প্রেমের সিংহাসন আর সোনার সিংহাসন দুই দিয়েছে পেতে। অতসীর সুখের জন্যে কত করেছে, কত ছেড়েছে, অথচ অতসী কিছুই পারল না। সামান্য একটা ক্ষুদে ছেলের মন ঘোরাতে পারল না মৃগাঙ্কর দিকে।

হয়তো মৃগাঙ্ক ভাবে অতসীর তেমন চেষ্টা নেই, চেষ্টা থাকলে কি আর মায়ে পারে না ছেলের মন বদলাতে? কোলের ছেলের? শিশু ছেলের?

 কতদিন ভেবেছে অতসী, মৃগাঙ্ক তো এমন সন্দেহও করতে পারে, অতসী ইচ্ছে করেই ছেলের মন ধরে রাখতে চায়, একেবারে সংরক্ষিত রাখতে চায় নিজের জন্যে। সে ছেলে অতসীর একার। সম্পূর্ণ একার!

মৃগাঙ্ক নতনয়না অতসীর দিকে তাকিয়ে কোমল স্বরে বলে, চাইলেই সব হয় না অতসী! যা হবার নয় তা হয় না! তুমি আর মন খারাপ করে কি করবে?

অতসী দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে, তা যদি না হবার হয় তো হওয়ানোর চেষ্টা করেই বা লাভ কি? যত বড় হচ্ছে ততই তো আরও একগুঁয়ে আরও অবাধ্য হচ্ছে। বোর্ডিঙে পাঁচটা ছেলের সঙ্গে থাকলে হয়তো একটু সভ্য হবে, বাধ্য হবে, ভালই হবে ওর।

তুমি থাকতে পারবে না অতসী!

কে বললে পারব না? অতসী জোর দিয়ে বলে, ঠিক পারব। এই তো খুকুর হৈ-চৈ-তে কোথা দিয়ে দিন কেটে যায়। মন-কেমনের সময়ই থাকবে না।

অত চট করে সর্বস্ব দানের দানপত্রে সই করে বোস না অতসী!

অতসীর চোখে সহসা জল এসে পড়ে। উত্তর দিতে দেরি হয়, তবু সামলে নিয়ে বলে, কিন্তু এভাবে কি করে চলবে? তুমিও তো আর ওর ওপর মেহ রাখতে পারছ না? তুমিও তো খুকু হয়ে পর্যন্ত, এবার আর সামলাতে পারে না অতসী। সব বাঁধ ভেঙে নামে বন্যা।

.

কথাটা মিথ্যা নয়।

খুকু জন্মে পর্যন্তই মেজাজটা বড় যেন বদলে গেছে মৃগাঙ্কর। আগে বিরূপতা করত সীতুই, মৃগাঙ্ক চেষ্টা করত সহজ হতে। এখন যেন দুজনের হাতেই ধারালো অস্ত্র!

কিন্তু মৃগাঙ্করই বা দোষ কি? কি করে সে নিজের ওই ফুলের মত মেয়েটিকে নিশ্চিন্ত হয়ে ছেড়ে দেবে তার সংস্পর্শে, যার রক্তে রয়েছে সংক্রামক রোগের সন্দেহ।

.

প্রথম প্রথম যখন মৃগাঙ্ক খুকু সম্পর্কে অস্বস্তি প্রকাশ করেছে, খুকুকে কেড়ে নিয়েছে সীতুর কাছ থেকে, তখন হঠাৎ একদিন ফেটে পড়েছিল অতসী, স্বভাবছাড়া তীব্রতায় বলেছিল, অত অমন কর কেন? ও কি তোমার মেয়েকে বিষ খাইয়ে মেরে ফেলবে? দেখতে পাও না কত ভালবাসে ওকে?

সেদিন প্রকাশ করেছিল মৃগাঙ্ক নিজের অসহিষ্ণুতার কারণ। বলেছিল, হাতে করে বিষ খাইয়ে মারবে, এমন কথা কেউ বলে নি অতসী, কিন্তু পরোক্ষ বলেও তো একটা কথা আছে! এমনও তো হতে পারে ওর রক্তের মধ্যে বিষ লুকিয়ে আছে। যদি থাকে, সুযোগ পেলে বিষ নিজের ডিউটি পালন করবেই। আর কুষ্ঠের বিষ–

শুনে চুপ করে গিয়েছিল অতসী।

বুঝতে পেরেছিল কোথায় মৃগাঙ্কর বাধা। তারপর একটু থেমে ম্লানস্বরে বলেছিল, ওর জন্মাবার পরে তো

 প্রত্যক্ষ দৃষ্টিতে হয়তো পরে, কিন্তু ওর জন্মের আগেই যে রোগটা জন্মায় নি, তাও জোর করে বলা যায় না অতসী! রোগ প্রকাশ হবার আগে অনেক দিন ধরে নিঃশব্দে লুকিয়ে থাকে রোগের বীজ, এ শুধু আমি ডাক্তার বলেই জানি তা নয়, সবাই জানে।

তাহলে–বলতে গলা কেঁপে গিয়েছিল অতসীর, তাহলে সীতুকে ভাল করে পরীক্ষা করছ না কেন একবার?

করেছি অতসী! তোমার মিথ্যা উৎকণ্ঠা বাড়ানোয় লাভ নেই বলে তোমাকে না জানিয়ে করেছি পরীক্ষা

পরীক্ষার ফল? আরও কেঁপে গিয়েছিল অতসীর গলা।

ফল এমন কিছু ভয়ঙ্কর নয়, কিন্তু তবুও সাবধান হবার প্রয়োজনীয়তা আছে। ছোট্ট বাচ্চারা একেবারে ফুলের মত, এতটুকুতেই ক্ষতি হতে পারে ওদের।

 শুনে আর একবার বুকটা কেঁপে উঠেছিল অতসীর, আর এক আশঙ্কায়। ছোট্ট ফুলের মতটির অনিষ্টের আশঙ্কায়। সেখানেও যে মাতৃহৃদয়! মা হওয়ার কী জ্বালা!

অতসীর ক্ষেত্রে বুঝি সে জ্বালা সৃষ্টিছাড়া রকমের বেশি, এই জ্বালাতেই সমস্ত পৃথিবীটাকে হাতের মুঠোয় পেয়েও কিছুই পেল না অতসী।

কিন্তু এমন দুঃসহ যন্ত্রণার কিছুই হত না, যদি সীতুর স্মৃতিশক্তিটা অত প্রখর না হত! যদি বা সীতু তখন আরও একটু ছোট থাকত!

 ঠিক অতসীর এই চিন্তারই প্রতিধ্বনি করেন মৃগাঙ্ক ডাক্তার, হয়তো আমরা সত্যিকার সুখী হতে পারতাম অতসী, যদি সীতু তখন আরও ছোট থাকত। বলেছি তো, একটা বাচ্চা ছেলের কাছে হেরে গেছি আমরা।

 অতসী দৃঢ়স্বরে বলে, আর হেরে থাকতে চাই না। সুখী হতেই হবে আমাদের। আমি যা বলছি সেই ব্যবস্থাই কর তুমি।

 বললাম তো–মৃগাঙ্ক হাসেন, এত চট করে দানপত্রে সই করে বসতে নেই। যাক আরও কিছুদিন। হয়তো আর একটু বড় হলে ওর এই বন্য স্বভাবটা শোধরাবে।

হয়তো অতসী আরও কিছু বলত। হয়তো বলত, শোধরাবার ভরসাই বা কি? রক্তের মধ্যে যে উত্তরাধিকারসূত্রে শুধু রোগের বিষই প্রবাহিত হয় তা তো নয়? স্বভাবের বিষ? মেজাজের বিষ? সেগুলোও তো কাজ করে? বল তো, আর শোধরাবার উপায় নেই। সব জেনে ফেলেছে সীতু।

কিন্তু বলা হয়নি, টেলিফোনটা বেজে উঠেছিল, মৃগাঙ্কর ডাক পড়েছিল।

.

থমথম করে কাটে কয়েকটা দিন।

বাড়িটাও স্তব্ধ। মৃগাঙ্ক ডাক্তার যেন নিঃশব্দ হয়ে গেছেন।

অতসী জিদ ধরেছে সীতুকে বোর্ডিঙে ভর্তি করে না দিলে অতসীই বাড়ি ছাড়বে। মৃগাঙ্ক এর অন্য অর্থ করেছেন। ভেবেছেন অভিমান।

আশ্চর্য, পৃথিবীটা কী অকৃতজ্ঞ! যাক থাকুক বোর্ডিঙে, হয় তো সেই ভাল।

ভারি গম্ভীর হয়ে গিয়েছেন মৃগাঙ্ক। সীতুর দিকে আর তাকিয়ে দেখেন না, এমন কি স্পষ্ট একদিন দেখলেন নিজের খাওয়া দুধ থেকে খুকুকে দুধ খাওয়াচ্ছে সীতু, বোধ করি ইচ্ছে করেই মৃগাঙ্ককে দেখিয়ে দেখিয়ে, তবু একটি কথা বললেন না। মিনিট খানেক তাকিয়ে দেখে সরে গেলেন। গেলেন সীতুরই জামা জুতো কিনতে। ছেলেকে অন্যত্র রাখবার প্রস্তুতি। বড়লোকের ছেলেদের জায়গায়, বড়লোকের ছেলেদের সঙ্গেই তো থাকতে হবে মৃগাঙ্ক ডাক্তারের ছেলেকে!

কিন্তু সীতু? সীতু ক্রমশই ক্ষেপে যাচ্ছে।

মাকে যেমন করে সেদিন মেরে ধরে আঁচড়ে কামড়ে যা খুশী বলেছে, তেমনি করে মেরে আঁচড়ে কামড়ে যা খুশী বলতে ইচ্ছে হয় তার মৃগাঙ্ককে। তাই চেষ্টা করে বেড়ায় কিসে ক্ষেপে যাবেন মৃগাঙ্ক।

 সেই ক্ষেপে যাবার মুহূর্তে যখন সেদিনের মত কান ঝাঁকুনি দিতে আসবেন, তখন আর চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকবে না সীতু, ঝাঁকিয়ে নিজেকে ছাড়িয়ে এলোপাথাড়ি ধাক্কা দিয়ে দিয়ে বলবে কেন, কেন তুমি আমাকে মারতে এসেছ? কে তুমি আমার? তুমি কি আমার সত্যি বাবা? তুমি কেউ নও, একেবারে কেউ নও! তুমি মিথ্যুক! আমার বাবা মরে গেছে।

কিন্তু সে সুযোগ আর আসে না।

খুকুকে এঁটো দুধ খাওয়ানোর মত ভয়ঙ্কর কারণ ঘটিয়েও না। মৃগাঙ্ক কেবল জিনিসের উপর জিনিস আনছেন।

অতসী হতাশ হয়ে বলে, কি করছ তুমি পাগলের মতন? কত এনে জড় করছ? আট বছরের একটা ছেলে আটটা সুটকেস নিয়ে বোর্ডিঙে যাবে, ক্লাস ফোরের পড়া পড়তে? এ কী অন্যায় টাকা নষ্ট!

নষ্ট করার মত অনেক টাকা যে আমার আছে অতসী! মৃগাঙ্ক ম্লান হেসে বলেন, তাই করছি।

ওকে বাড়ি থেকে সরাতে আমার চাইতে তো দেখছি তোমার অনেক বেশি মন-কেমন করছে।

কিছু না অতসী, কিছু না। টাকা আছে, টাকা ছড়াচ্ছি, এই পর্যন্ত।

ও কথা বলে আমায় ভোলাতে পারবে না। অতসী হতাশার নিঃশ্বাস ফেলে বলে, বংশের গুণ কেউ মুছে ফেলতে পারে না। ওরা অকৃতজ্ঞের বংশ। উপকারীকে লাথি মারাই ওদের স্বভাবগত গুণ। নইলে আর সীতু তোমাকে–

মৃগাঙ্ক ডাক্তার কেমন একরকম করে তাকান, তারপর আস্তে আস্তে বলেন, আমার ওপর ওর কৃতজ্ঞ থাকবার কথা নয় অতসী, কদিন ভেবে ভেবে আমি বুঝছি এইটাই আমার ঠিক পাওনা। আমার ওপর ওর ভালবাসা হবে কেন? পশু পাখী কীট পতঙ্গও শত্রু চিনতে পারে। সেটা সহজাত। তুমি জানন না, আমি তো জানি, আমি ওর বাপকে চিকিৎসা করার নামে খেলা করেছি, ইনজেকসনের সিরিঞ্জে শুধু ডিস্টিল্ড ওয়াটার ভরে নিয়ে গিয়েছি–

আমি জানি। অকম্পিত স্বরে বলে অতসী।

তুমি জানো? তুমি জানো? জানো আমার সেই ছলচাতুরি? অতসী! তবু তুমি

হ্যাঁ, তবু আমি। আমি জানতাম আমার সেই মরণান্তকর দুরবস্থা তোমার আর সহ্য হচ্ছিল না, তাই সেই দুরবস্থার মেয়াদটাকে নিজের চেষ্টায় বাড়িয়ে তোলবার মত শক্তি সঞ্চয় করতে পারো নি।

অতসী! এত দেখতে পেয়েছিলে তুমি? কি করে পেয়েছিলে?

 তোমার ভালবাসাকে দেখতে পেয়েছিলাম, তাই হয়তো অতটা দেখতে শিখেছিলাম।

অতসী, ছেলেটা কাল চলে যাবে। এখন মনে হচ্ছে, হয়তো আর একটু সদ্ব্যবহার করতে পারতাম ওর ওপর! অতটুকু শিশুকে আর একটু ক্ষমা করা যেত।

কিন্তু ও…ও তো তোমাকে,

 ও আমাকে? হ্যাঁ সত্যি, ও আমাকে সহ্য করতে পারে না। কিন্তু আমি যে ওর সঙ্গে সমান হয়ে গেলাম, ওর সঙ্গে সমান হতে গিয়েই তো ওর কাছে হেরে গেলাম অতসী! এখন ভাবছি আর একবার যদি চান্স পেতাম, চেষ্টা দেখতাম জিতবার। কিন্তু অনেকটা এগিয়ে যাওয়া হয়েছে।

তা হোক, ওতে ওর ভাল হবে।

.

এত জিনিস কেন? এত জিনিস কার? কে কাকে দিচ্ছে এসব? ভুরু কুঁচকে দেখে সীতু, কিন্তু কে দিয়েছে এই শিশুটাকে এমন নির্লোভের মন্ত্র?

সীতুর মন্ত্র শুধু চাই না। এসব চাই না আমি। কেন দিচ্ছে ও?

সীতু ভাবে, বোর্ডিঙে থাকতে থাকতে এমন হয় না, সেই স্বপ্নে দেখা ছবি থেকে কেউ এসে নিয়ে চলে যায় সীতুকে! যেখানে এত নিতে হয় না, আর শুনতে হয় না এত অকৃতজ্ঞ তুই, এত নেমকহারাম!

.

এত জিনিস কেন নেবে সীতু?

কার কাছ থেকে?

যে লোকটা সীতুর বাবা নয় তার কাছ থেকে? সমস্ত মন বিদ্রোহ করে ওঠে। কিন্তু ঠিক বুঝতে পারে না কি করা চলে। বোর্ডিঙেও যে যেতে হবে তাকে।

কে জানে বোর্ডিঙে হয়তো এত সব না থাকলে থাকতে দেয় না, কম কম জিনিস নিয়ে ঢুকতে চাইলে হয়তো বলে, চলে যাও দূর হও!

লেখাপড়া শিখে সীতু যখন বড় হবে তখন অনেক রোজগার করবে। ওই লোকটার চাইতে অনেক অনেক বেশি। আর সেই টাকাগুলো দিয়ে দেবে ওকে।

আজকাল যেন বড্ড বেশি চুপচাপ হয়ে গেছে লোকটা। সীতুর দিকে আর সেরকম করে তাকায় না।

কিন্তু চুপচাপ থাকবার কি দরকার? খুব রাগারাগিই করুক না ও, অসভ্যর মত চেঁচামেচি করুক। তাই চায় সীতু। ও যত রাগ করবে, ততই না অগ্রাহ্য করার সুখ!

.

 কেনই বা এত দমে যাচ্ছি আমি? মৃগাঙ্ক ডাক্তার অবিরতই ভাবতে থাকেন, অতসী তো ঠিক কথাই বলেছে, ছেলের শিক্ষার জন্যে ছেলেকে কাছছাড়া না করছে কে? এই যে ভাবী ভারত নাগরিক আবাস, যেখানে ভর্তি করছেন সীতুকে, সেখানে তো সীট পাওয়াই দুষ্কর হচ্ছিল, নেহাৎ তার এক ডাক্তার বন্ধু, যে নাকি আবার ওখানকার অধ্যক্ষরও বন্ধু, তার মাধ্যমেই এটা সম্ভব হয়েছে।

আবাস তো ভোলা হয়েছে শোনা গেল মাত্র দুবছর, এর মধ্যেই ছাত্র ধরে না। আর সবই রীতিমত অবস্থাপন্ন ঘরের ছেলে। তাদের কি কারও মা নেই? তারা কি সবাই সংসারের জঞ্জাল? সেই জজ্ঞাল সরাবার জন্যেই মাসে তিনশখানি করে টাকা খরচ করতে রাজি হয়েছে তাদের সংসার?

তা তো আর নয়।

.

সীতুর বোর্ডিংবাসের ব্যবস্থা একেবারে পাকা হয়ে যাওয়া পর্যন্ত একটু যেন নরম হয়েছিল সে, একটু যেন সভ্য। অতসী যখন গম্ভীর বিষণ্ণমুখে ওর জিনিসপত্র গোছায়, সীতুও গম্ভীর গম্ভীর মুখে কাছে বসে থাকে।

বোর্ডিং সম্বন্ধে কি তার আতঙ্ক নেই? যত প্রবীণ পাকাই হোক, বয়সটা তো আট-নয়।

মার ওপর একটা আক্রোশ ভাব থাকলেও মাকে ছেড়ে যেতে কি তার মন-কেমন করছে না? আর খুকু? খুকুকে আর দেখতে পাবে না বলে মনের মধ্যে কি যেন একটা তোলপাড় হচ্ছে না কি?

তাই বিষণ্ণ গম্ভীর মুখে ভাবে, কত ছেলের বাবা তো বিলেত যায়, বিদেশে চাকরি করতে যায়, অসুখ করে মরে যায়, সীতুর এই বাবাটা কেন ওসবের কিছু করে না?

বাবা নয় বলে ঘোষণা করলেও মনে মনে মৃগাঙ্কর ব্যাপারে কিছু ভাবতে গেলে, আর কি ভাবা সম্ভব বুঝে উঠতে পারে না সীতু। তাই মনে মনে বলে, এ বাড়ির বাবাটা যদি মরে যেত, কি নিরুদ্দেশ হয়ে যেত, ঠিক হত।

তাহলে হয়তো সীতু মাকে আবার ভালবাসতে পারত।

সব প্রস্তুত, বিকেলে চলে যেতে হবে, গাড়ি করেই পৌঁছে দিয়ে আসবেন মৃগাঙ্ক। কতই বা দূর? কলকাতা থেকে মাত্র তো ষোলো মাইল।

মনোরম পরিবেশ, মনোহর ভবন। অতি আধুনিক উপকরণ, আর অতি পৌরাণিক আদর্শবাদ নিয়ে কাজে নেমেছেন স্কুল কর্তৃপক্ষ। সেদিন কথাবার্তা কইতে এসে ভারি ভাল লেগেছিল মৃগাঙ্কর।

পৌঁছে দিয়ে আসবেন আনন্দের সঙ্গে। আরও আনন্দের হয়, যদি ফিরে আসবার সময় নিঃসঙ্গতার দুঃখ ভোগ না করতে হয়। কাছে এসে বললেন, অতসী, তুমিও চল না?

আমি! অবাক হয় অতসী, আমি কোথা যাব।

কেন সীতুকে পৌঁছতে। ঠিক হয়ে থেকো তাহলে, চারটের সময় বেরোব। মৃগাঙ্ক চলে গেলেন। চুকে যেত সব, যদি না চালে ভুল করে বসত অতসী।

মনের তার যখন টনটনে হয়ে বাঁধা থাকে, তখন এতটুকু আঘাতেই ঝনঝনিয়ে ওঠে। এটুকু খেয়াল করা উচিত ছিল অতসীর, ঠিক এই মুহূর্তে কথা না কওয়াই বুদ্ধির কাজ হত। কিন্তু অতসী কথা কইল। বলে ফেলল, দেখলি তো খোকা, কত ভাল লোক উনি? তোর জন্যে আমার মন কেমন করছে ভেবে বোর্ডিং পর্যন্ত পৌঁছাতে নিয়ে যেতে চাইছেন। এমন মানুষকে তুই বুঝতে পারলি না? একটু যদি তুই হয়তো ছেলের জন্যে মনের মধ্যেটায় হাহাকার হচ্ছে বলেই গলার স্বরটা অমন আবেগে থরথরিয়ে উঠল অতসীর, সেই থরথরে গলায় বলল, যদি তুই সভ্য হতিস, ভাল হতিস, এমন করে বাড়ি থেকে অন্য জায়গায় পাঠিয়ে দিতে হত না। সেখানে একা পড়ে থাকতে হবে তো? আর ওঁকেও মাসে মাসে তিনশ করে টাকা দিতে হবে।

তিনশ!

অস্ফুট বিস্ময়ে উচ্চারণ করে ফেলে সীতু। এতটা ধারণা করে নি সে কোনদিন।

 কিন্তু থাকত থাকত শিশুমনের বিস্ময়। নাই বা বুঝত সে মৃগাঙ্ক ডাক্তারের মহিমা, কি এসে যেত অতসীর? আবার কেন কথা বলল সে? কোর মত, ওজন না বোঝা কথা!

তবে না তো কি? প্রত্যেক মাসে মাসে দিতে হবে। খুব তো বাজে বাজে লোকের কাছে যা তা কি একটা শুনে চেঁচাচ্ছিলি, ও আমার বাবা নয় কেউ নয়–নিজের বাবা না হলে কে করে এত?

মুহূর্তে কোথা থেকে কি হয়ে গেল, ছিটকে উঠল সীতু। ছিটকে দাঁড়িয়ে উঠে বলল, আমি চাই না, চাই না বোর্ডিঙে যেতে, দিতে হবে না কাউকে টাকা। সবসময় মিথ্যে কথা বল তুমি। আমি জানি অন্য বাবা ছিল আমার, মরে গেছে সে। আবার বিয়ে করেছ তুমি ওকে।

না, এ কথার আর উত্তর দেওয়া হল না অতসীর, সীতু ঘর থেকে চলে গেছে।

 কিন্তু থাকলেই কি উত্তর দিতে পারত অতসী? দেবার কিছু ছিল? শুধু বার বার ধিক্কার দিল নিজেকে। কি জন্যে বলা শক্ত। হয়তো মাত্র একটাই কারণে নয়।

দুপুর গড়িয়ে বিকেল এল।

.

মৃগাঙ্ক সাড়া দিয়েছেন তাড়াতাড়ি প্রস্তুত হয়ে নিতে।

কাঁটা হয়ে আছে অতসী, কি জানি শেষ মুহূর্তে কি না কি হয়। নিজে বলতে পারে না, মাধবকে দিয়ে বলায় খোকাবাবুকে পোশাক টোশাক পরে নিতে। আসন্ন বিচ্ছেদবেদনাখানিও বুঝি শুকিয়ে গেছে আতঙ্কের আশঙ্কায়।

কিন্তু না, অতসীর আশঙ্কা অমূলক।

কোন গোলমাল করল না সীতু, প্রস্তুত হয়ে নিল নির্দেশমত।

 মায়ের পিছু পিছু গাড়িতে গিয়ে উঠল।

শহর ছাড়িয়ে শহরতলির পথে গাড়ি ছুটছে দুরন্ত বেগে। অতসীর মনও ছুটছে সেই বেগের সঙ্গে তাল দিয়ে। অন্য পরিবেশে অন্য শিক্ষায় মানুষ হয়ে উঠবে সীতু-সভ্য হবে, মার্জিত হবে, বড় হবে। তখন হয়তো মায়ের প্রতি যা কিছু অবিচার করেছে, তার জন্য লজ্জিত হবে। হয়তো মার প্রতি দয়া আসবে ওর, আসবে মমতা।

পৃথিবীর হালচাল আর দুঃখ-দুর্দশা দেখে দেখে নিশ্চয়ই বুঝবে, মা তার কত হিতাকাঙ্কিণী, মা তার কত উপকার করেছে! তখন হয়তো যাকে আজ বাপ বলে স্বীকার করতে পারছে না, তাকেই শ্রদ্ধা করবে, ভালবাসবে।

কিন্তু অতসী কি অতদিন বাঁচবে? সেই সুখের দৃশ্য দেখা পর্যন্ত?

.

এসে গেলাম। বললেন মৃগাঙ্ক।

সুন্দর কম্পাউন্ড দেওয়া আবাসিক আশ্রমের গেটের সামনে গাড়ি থামল।

নতুন করে কৃতজ্ঞতায় মন ভরে ওঠে অতসীর। কত ভাল মৃগাঙ্ক, কত মহৎ! নইলে অতসীর ছেলের জন্যে, যে ছেলে মৃগাঙ্ককে বিষ নজরে দেখে, সেই ছেলের জন্যে, নির্বাচন করেছেন এমন সুন্দর সেরা স্থান।

 অধ্যক্ষ এদের অভ্যর্থনা জানালেন। সব কিছু দেখে অতসী সন্তোষ প্রকাশ করছে জেনে ধন্যবাদ জানালেন, কোন ঘরে সীতুর থাকার ব্যবস্থা হয়েছে তা জানালেন। তারপর অফিসঘরে এসে মৃগাঙ্কর সঙ্গে এটা ওটা লেখালিখি করিয়ে একখানা ছাপানো ফরম এগিয়ে দিলেন সীতুর দিকে, আচ্ছা এবার তুমি নিজে এই ফরমটা ফি আপ করো তো মাস্টার! এইখানে তোমার নামটা লেখো ইংরেজিতে!

কলমটা টেনে নিয়ে খসখস করে লিখল সীতু নিজের নাম।

বাঃ, বেশ হাতের লেখাটি তো তোমার! অধ্যক্ষ ফরমের আর একটা জায়গায় আঙুল বসালেন, এবার এখানটায় বাবার নাম লেখ।

বাবার!

সহসা পেনের মুখটা বন্ধ করে টেবিলে রেখে দিয়ে সীতু পরিষ্কার গলায় বলে উঠল, বাবার নাম জানি না।

অধ্যক্ষ প্রথমটা একটু ধাক্কা খেলেন, তারপর কি বুঝে যেন মৃদু হেসে বললেন, ওঃ, আচ্ছা। আমি বলে যাচ্ছি, তুমি লেখো–এম আর আই

ও বানান বললে কি হবে? ও তো আমার কেউ নয়। আমার বাবা নেই। মরে গেছে।

অতসী স্তব্ধ। মৃগাঙ্ক পাথর।

আশ্চর্য! ঘরের স্তব্ধতা ভঙ্গ করেন অধ্যক্ষ, তাহলে ইনি তোমার কে হন?

বললাম তো কেউ না।

সীতু! অতসী চাপা আর্তনাদের মত তীক্ষ্ণ গলায় বলে, কী অসভ্যতা হচ্ছে? এ রকম করছ কেন? বল সব ঠিক করে, নাম লেখো।

কতবার বলব, আমার বাবার নাম আমি জানি না।

অধ্যক্ষ ভারি থমথমে মুখে বলেন, ডক্টর ব্যানাজি

ডক্টর ব্যানার্জি তাকিয়ে আছেন বাইরের আকাশে দুর্নিরীক্ষ দৃষ্টি মেলে।

অতসী উত্তর দেয় ব্যাকুলভাবে, দেখুন, কিছু মনে করবেন না, থেকে থেকে ওর এ রকম একটা খেয়াল চাপে, তখন—

থাক। অধ্যক্ষ প্রায় ভীষণ গলায় বলে ওঠেন, বুঝতে পেরেছি আপনি কি বলতে চাইছেন। কিন্তু এ ধরনের খেয়ালি ছেলেকে আমার এখানে রাখা সম্ভব নয়।

 কিন্তু আপনি বুঝছেন না, মৃগাঙ্ক নিঃশব্দ–কথা চালাচ্ছে অতসী, ব্যাপার হচ্ছে–

 দেখুন আমি হয়তো বুঝি কম। সবরকম ব্যাপার বোঝবার মত হয়তো বুদ্ধি আমার নেই, কিন্তু বললাম তো আপনাকে, কোনরকম অ্যাবনর্মাল ছেলেকে আমরা রাখতে পারি না। পরীক্ষায় রেজাল্ট ভাল করেছিল, চান্স দিয়েছিলাম। কিন্তু চোখে দেখে…না! মাপ করবেন আমাকে।

তবু হাল ছাড়তে চায় না অতসী, তবু ধরে রাখতে চায়, তাই বলে, সীতু, এ কী দুষ্টুমি করলে তুমি? দেখো তো ইনি কত বিরক্ত হচ্ছেন? কেন ঠিক ঠিক উত্তর দিলে না সব কথার?

ঠিকই তো দিয়েছি। বুক টানটান করে বলে সীতু।

অধ্যক্ষ মৃদুহাসির সঙ্গে বলেন, এরা তাহলে তোমার কে হন খোকা?

ইনি আমার মা, আর উনি কেউ না।

.

মাথা হেঁট করে ফিরে এসেছেন মৃগাঙ্ক ডাক্তার, নিঃশব্দে চোখের জল ফেলতে ফেলতে এসেছে অতসী। সীতুকে শাসন করবে, এ শক্তিও আর তার কোথাও অবশিষ্ট নেই। একটা কাতর আর্তনাদে যন্ত্রণা প্রকাশেরও শক্তি নেই বুঝি।

নিঃশব্দে আবার সেই শহরতলির পথে ফিরে আসছে তিনজনে। পাথরের মূর্তির মত।

 শুধু অতসীই বুঝি দূর আকাশের গায়ে দেখতে পেয়েছে আপন অদৃষ্টলিপি। যে আকাশ গোধূলিখেলার সব রং সমস্ত ঔজ্জ্বল্য হারিয়ে সন্ধ্যার হাতে আত্মসমর্পণ করেছে।

অতসীর ভাগ্যলিপি লেখবার সময় সেই অদৃশ্য লিপিকারের প্রাণটা কি লোহা দিয়ে বাঁধানো ছিল? আর সীতুর ভাগ্যলিপি লিখতে? শুধু হতভাগ্য নয়, শুধু দুঃখী নয়, শুধু নির্বোধ নয়–তার জন্মলগ্নস্থিত গ্রহ তাকে মাতৃহত হতে বলেছে।

 অতসী কি শুধু ভালবাসার জন্যেই অকাল বৈধব্যকে অস্বীকার করে নতুন জীবনের আলো দেখতে চেয়েছিল? চায়নি সীতুর জন্যেও অনেকখানি?

খাদ্যের অভাবে, যত্নের অভাবে, অস্থিচর্মসার হয়ে যাওয়া ছেলেটাকে বাঁচিয়ে তোলবার বাসনাটাও কি অনেকখানি সাহস জোগায় নি অতসীকে লোকলজ্জা ভুলতে?

কিন্তু আজ?

হ্যাঁ, মনের অগোচর চিন্তা নেই। আজ মনে হচ্ছে–অত দুর্দশার মধ্যেও সেই অস্থিচর্মসার দেহটুকুন টিকে থেকেছিল কি করে?

না টিকলেও তো পারত। সেটাই তো স্বাভাবিক ছিল।

 এ কি শুধু অতসীর সমস্ত জীবনটা দুঃসহ করে দেবার ষড়যন্ত্রে বিধাতার নিষ্ঠুর কৌশল নয়?

ফেরার পথে গাড়িতে এক অখণ্ড স্তব্ধতা। মৃগাঙ্কর হাতে স্টিয়ারিং, কিন্তু সে যেন একটা কলের মানুষ। যে মানুষ অন্য কিছু জানে না, জানে শুধু ওই চাকাখানা ধরে গাড়িটা এগিয়ে নিয়ে যেতে। ওর রক্ত নেই মাংস নেই। মন, মস্তিষ্ক, চিন্তা, ভাব, কোন কিছুই নেই।

অতসী জানলার দিকে মুখ ফিরিয়ে বসে আছে। তার গালের ওপর একটা অবিচ্ছিন্ন অশ্রুধারা। সেটা বাইরের বাতাসে এক একবার শুকিয়ে উঠছে, আবার চোখ উপচে ঝরঝর করে নেমে আসছে নতুন জলের ধারা।

অতসী কখনো কাঁদে না। সেই অকথ্য অত্যাচারী কুষ্ঠরোগগ্রস্ত সুরেশ রায়ের অত্যাচারে জর্জরিত হয়েও কাঁদে নি কখনো। ভয়ঙ্কর যন্ত্রণার সময় স্তব্ধ হয়ে গেছে, মৌন হয়ে গেছে, পাথর হয়ে গেছে।

ইদানীং সীতুকে নিয়ে নিরুপায়তার এক দুঃসহ জ্বালায় মাঝে মাঝে মাথার রক্ত চোখ দিয়ে নেমে এসেছে। কিন্তু হয়তো সেই শুধু এক ঝলক। তপ্ত ফুটন্ত এক ঝলক জল গালে পড়ে, গালের চামড়া পুড়িয়ে দিয়ে মুহূর্তে শুকিয়ে গেছে।

এমন অবিরল অশ্রুধারায় নিজেকে কখনো এমন উজাড় করে দেয় নি। নিঃশেষ করে দেয় নি। আজ বুঝি সংকল্প করেছে অতসী, যা তার প্রাপ্য নয়, তার জন্যে আর প্রত্যাশার পাত্র ধরে থাকবে না।

ভাগ্য তার জন্যে এককণাও বরাদ্দ করে নি। তার ললাটলিপি লেখা হয়েছে চিতাভস্মের কালি দিয়ে। অতসী বৃথাই সেখানে আশা রেখেছে, বৃথাই ভাগ্যের দরবারে আঁচল পেতে বসে থেকেছে এতদিন। আর থাকবে না।

গাড়ি এগিয়ে চলেছে। পরিচিত পথে এসে পড়েছে। এইবার বাড়ির কাছে বাঁক নেবে। হঠাৎ অতসী গাড়ির মধ্যে স্তব্ধতা ভেঙে বলে ওঠে, আমাদের একটু আগে নামিয়ে দেবে।

একটু আগে নামিয়ে দেবে! এ আবার কেমনধারা কথা!

কলের মানুষটা চমকে উঠে ঘাড় ফেরায়। ঘাড় ফেরায় জানলায় মুখ দিয়ে বসে থাকা ছোট মানুষটাও। সীতুও সেই থেকে বাইরে চোখ ফেলে বসে আছে।

তারও এবড়োখেবড়ো দীন বিদীর্ণ হৃদয়টা ভয়ঙ্কর উত্তাল এক অনুভূতিতে তোলপাড় করছে।

কী হয়ে গেল!

 এটা সে কী করে বসল!

কাল থেকেই এই সংকল্প করে রেখেছে বটে সে, কিন্তু তার পরিণামটা তো পরিষ্কার করে ভাবে নি। ওদের সামনে, অন্যলোকের সামনে, মৃগাঙ্ক যে সীতুর কেউ নয় এই সত্যটা উদঘাটন করে দিয়ে মৃগাঙ্ককে একেবারে অপদস্থর একশেষ করে দেবে সীতু, এইটুকু পর্যন্তই ভাবা ছিল। কিন্তু সেই সংকল্প সাধনের মাশুল দিতে যে অনেকদিনের আশা আর আশ্বাসের বোর্ডিং-বাসটা হারাতে হবে এটা কি করে ভাববে সে?

যতই দুর্মতি হোক তবু শিশু তো।

সীতু ভেবেছিল, ওইভাবে বাবাকে অপদস্থ করে সে স্কুলের কর্তাকে বলবে, যেহেতু ওই ডাক্তারটা তার বাবা নয়, সেই হেতু সীতেশ তার দেওয়া টাকা নেবে না। ইস্কুল কর্তারা যেন সীতুকে অমনি অমনি না পয়সা নিয়েই এখানে রাখেন। সীতু বড় হলে টাকা রোজগার করে সব শোধ করে দেবে।

কিন্তু সে সব কথা বলবার তো সুবিধেই হল না। আর সত্যি বলতে, সাহসও হল না। বোর্ডিঙের কর্তা যেন মৃগাঙ্কর চাইতেও ভয়ঙ্কর! মুখের দিকে তাকানই যায় না।

বাবা গাড়িতে উঠতে বললে, কিছুতেই তোমার সঙ্গে যাব না, এখানেই থাকব বলে মাটিতে শুয়ে পড়বার সংকল্পটাও কাজে পরিণত করা গেল না। আস্তে আস্তে গাড়িতেই উঠে বসতে হল।

গাড়ি চলছে।

চলছে সীতুর চিন্তার স্রোত।

আচ্ছা, সীতু যদি এই খুকুর বাবাটাকে অপদস্থ করতে না চাইত। যদি বাপের নাম লিখতে বললে ওর নামই লিখত! তাহলে তো আর চলে আসতে হত না।

মৃগাঙ্কর বাড়ি ছেড়ে, অন্য একটা জায়গায়, সুন্দর একটা জায়গায় থাকতে পেত সীতু। কিন্তু ওই কর্তাটা? ওটা যে বাড়ির বাবাটার চাইতেও বিচ্ছিরি। তাছাড়া সেই অতসীর সেদিনের কথা!

মাসে মাসে তিনশ টাকা করে পাঠাতে হবে মৃগাঙ্ককে। কেন নেবে সীতু সে টাকা? সীতুর জন্যে অত কিছু চাই না।

এই যে বাড়িতে?

 বেশি কিছু খায় সীতু? মোটেই না। সীতুর জন্যে যাতে মোটেই বেশি খরচা না হয় তা দেখে সীতু। অথচ বোর্ডিঙে থাকলে মা সব সময় ভাববে, ওই বাবাটা সীতুকে কিনে রেখেছে।

কিন্তু আবার সেই বাড়ি!

সেই বামুনদি, নেপবাহাদুর, কানাই, মোক্ষদা! সীতু যদি গাড়ির দরজাটা খুলে নেমে পড়ে? অনেকে তো নাকি চলন্ত গাড়ি থেকে নামে। কিন্তু গাড়ি চলতেই থাকে। পেরে ওঠা যায় না।

ঠিক এই সময় হঠাৎ অতসীর গলা কানে এল। অতসী বলছে, আমাদের আগে নামিয়ে দেবে।

ঠিক অনুরোধ নয়, যেন একটা ঠিক করে রাখা ব্যবস্থা, শুধু মনে করিয়ে দেওয়া।

আমাদের মানে কি?

কাদের?

মার কথাটা অনুধাবন করতে পারে না সীতু। কিন্তু কথাটা যেন ভয়ঙ্কর একটা আশাপ্রদ। একথা যেন বলছে সীতুকে–আর সেই বামুনদি কানাই নেপবাহাদুরের বাড়িতে ঢুকতে হবে না।

মৃগাঙ্ক কি বলেন শোনবার জন্যে কান খাড়া করে বসে থাকে সীতু। শুনতে পায়– শান্ত মার্জিত মৃদুগলায় মৃগাঙ্ক বলছেন, তোমাদের আগে নামিয়ে দেব! কোথায় নামিয়ে দেব?

যেখানে তোক। বলছে অতসী, দুঃখের মধ্যে, দৈন্যের মধ্যে, রিক্ততার মধ্যে।

একি! মৃগাঙ্ক হেসে উঠলেন যে!

 কি বলছেন?

অত ভাল ভাল জিনিসগুলো এখন চট করে কোথায় পাই বল তো?

কানকে আরও তীক্ষ্ণ করতে হচ্ছে সীতুকে, কারণ এ রাস্তাটা শহর ছাড়ানো ফাঁকা রাস্তা নয়। শব্দ হচ্ছে আশেপাশে। আর অতসীর কণ্ঠ মৃদু।

উড়িয়ে দিলে চলবে না। মৃদু তবু দৃঢ় কণ্ঠে বললে অতসী, সীতুকে নিয়ে আর আমি ও বাড়িতে ঢুকব না।

মৃগাঙ্ক বলেন, ছেলেমানুষী করে লাভ কি অতসী?

না না, ছেলেমানুষী নয়, অতসীর মৃদুকণ্ঠ তীক্ষ্ণ হয়ে ওঠে, এ আমার স্থির সংকল্প। তুমি এখন আমাদের এখানে এই শ্যামলীর বাড়িতে নামিয়ে দাও, তারপর যত শীগগির সম্ভব ছোট একখানা ঘর, যেমন করে আমার থাকা উচিত ছিল, সীতুর থাকা উচিত ছিল, তেমনি একখানা দৈন্যের ঘর জোগাড় করে নেব আমি।

তবুও মৃগাঙ্কর কণ্ঠে কি বিদ্রূপ?

সেই বিদ্রুপের কণ্ঠই উচ্চারণ করছে, তারপর?

তুমি ব্যঙ্গ কর, উড়িয়ে দিতে চেষ্টা কর, কিন্তু পারবে না। আমার ভবিষ্যৎ আমি স্থির করে নিয়েছি। তারপর বাঙলা দেশের অসংখ্য নিঃসম্বল মেয়ে যেমন করে নাবালক ছেলে নিয়ে ভাগ্যের সঙ্গে যুদ্ধ করে এগিয়ে চলে, তেমনিই করতে চেষ্টা করব।

মৃগাঙ্কর গাড়ির গতি মন্দীভূত হয়েছে, তবু মৃগাঙ্ক পিঠ ফিরিয়েই কথা বলছেন- ভাগ্যের সঙ্গে যুদ্ধ করে এগিয়ে চলে না অতসী, যুদ্ধ করে হারে, যুদ্ধ করে মরে।

সেইটাই আমার অদৃষ্টলিপি মনে করব। মৃত্যুর মত নিষ্ঠুর, মৃত্যুর মত অমোঘ ভঙ্গিতে বলে অতসী, মনে করব তাদেরই একজন আমি। আমার জীবনে কোনদিন দেবতার দর্শন হয় নি, কোনদিন স্বর্গ থেকে আলোর আশীর্বাদ ঝরে পড়ে নি। আমি কুষ্ঠব্যাধিতে গলে পচে মরে যাওয়া সুরেশ রায়ের নাবালক পুত্রের রক্ষয়িত্ৰী মাত্র।…এই যে এসে পড়েছে শ্যামলীর বাড়ি, নামতে দাও আমাদের।

মৃগাঙ্ক স্থিরভাবে বলেন, কি বলবে ওদের?

যা সত্যি তাই বলব। আর বানিয়ে বানিয়ে মিথ্যার ছলনা দিয়ে খেলার স্বর্গ গড়ব না। গাড়ি থামাও।

মৃগাঙ্ক গাড়ি থামালেন।

বললেন, তোমার হিসেবের খাতা থেকে একটা ছোট্ট হিসেব বোধহয় খসে পড়েছে অতসী! এ পৃথিবীতে খুকু বলে একটা জীব আছে সেটা বোধহয় ভুলে গেছ!

না ভুলি নি। অতসী গাড়ির জানালার ধারে মাথা রাখে, কত শিশুই তো শৈশবে মাতৃহীন হয়, খুকুর জীবনেও তাই ঘটেছে এইটাই ধরে নিতে হবে।

মৃগাঙ্ক বলেন, অর্থাৎ তাকেও ফেলে দিতে হবে দুঃখের মধ্যে, দৈন্যের মধ্যে, রিক্ততার মধ্যে! কিন্তু একা আমার অপরাধে এত জনে মিলে কষ্ট পেয়ে লাভ কি? এ মঞ্চ থেকে যদি মৃগাঙ্ক ডাক্তারের অন্তর্ধান ঘটে, তাহলেই তো সব সোজা হয়ে যায়। সুরেশ রায়ের বিধবা স্ত্রীর পরিচয় বহন না করে, না হয় সেই হতভাগ্যের স্ত্রীর পরিচয়েই তার নাবালক সন্তানদের রক্ষয়িত্রী হয়ে থাকলে। অন্তত দুটো শিশুহত্যার পাপ থেকে রক্ষা পাবে।

অতসী ততক্ষণে নেমে পড়েছে। আঁচলটা মাথায় টেনে নিয়ে বলে, সে পাপ থেকে রক্ষা পাবার ভাগ্য নিয়ে সবাই পৃথিবীতে আসে না। খুকুর কোন অভাব হবে না। খুকুর তুমি আছ।

মৃগাঙ্কও গাড়ি থেকে নেমেছিলেন, তাতে ঠেস দিয়ে দাঁড়িয়ে অতসীর চোখে চোখ রেখে বলেন, তুমি পারবে?

মানুষ কি না পারে? মেয়েমানুষ আরও বেশিই পারে।

আমার থেকে, খুকুর থেকে, একেবারে বিচ্ছিন্ন হয়েই থাকতে চাও তাহলে?

অতসী হতাশ গলায় বলে, এখন আমি হয়তো সবকিছু গুছিয়ে বলতে পারব না, তবু এইটুকুই বলছি, সীতুকে সীতুর যথার্থ অবস্থার মধ্যে রাখতে চাই। অহরহ আর বৃথা চেষ্টা, আর ব্যর্থ আশার বোঝা বইতে পারছি না আমি।…সীতু নেমে এসো।

কোথায় যাব? ক্ষীণস্বরে বলে সীতু।

সে প্রশ্ন করবার দরকার তোমার নেই সীতু, অধিকারও নেই। ও বাড়িতে ফিরে যাওয়া তোমার আর হবে না, এইটুকুই শুধু জেনে রাখ। বলে মৃগাঙ্কর দিকে পূর্ণ গভীর একটি দৃষ্টি ফেলে কয়েক মুহূর্ত চুপ করে থেকে শ্যামলীর বাড়ির দিকে এগোয়। সীতুর হাতটা চেপে ধরে।

মৃগাঙ্ক ধীর স্বরে বলেন, সীতুর জিনিসপত্রগুলো গাড়িতে থেকে যাচ্ছে।

ও জিনিস সীতুর জন্যে নয়।

মৃগাঙ্ক এবার ক্ষুব্ধস্বরে বলেন, আজ তোমার মনের অবস্থা চঞ্চল, তাই এমন সব অদ্ভুত কথা বলতে পারছ। বেশ, আজ রাতটা থাকতে ইচ্ছে হয় থাকো এখানে, খুকুকে পাঠিয়ে দিচ্ছি। রাতে তোমার কাছছাড়া হয়ে সে কখনো থাকতে পারে?

অতসী বোঝে, মৃগাঙ্ক আবার সমস্তটাই সহজ করে নিতে চাইছেন, লঘু করে নিতে চাইছেন। তাই দৃঢ় স্বরে বলে, খুকুর মা এইমাত্র মোটর অ্যাকসিডেন্টে মারা গেছে।

 তবু মৃগাঙ্ক বলেন, অতসী তোমার সিদ্ধান্ত দেখে মনে হচ্ছে, একমাত্র অপরাধী হয়তো আমিই। তাই যদি হয়, আমি হাতজোড় করে ক্ষমা চাইছি।

 অতসী বলে, ও কথা বলে আর আমায় অপরাধী কোর না। শাস্তি যার পাবার, তাকেই পেতে হবে। আর আজ থেকেই তার সুরু। সীতু চল।

বড় রাস্তা থেকে হাত কয়েক ভিতরে শ্যামলীর বাড়ি। অতসী তার মধ্যে ঢুকে সীতুকে নিয়ে। অন্ধকারে মিলিয়ে যায়।

মৃগাঙ্ক দাঁড়িয়ে থাকেন। অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকেন। তারপর গাড়িতে ওঠেন।

চিরকালের মত একটা কিছু ঘটে গেল এটা কিছুতেই ভাবা সম্ভব নয়। শুধু ভাবতে থাকেন, খুকুটাকে নিয়ে কি করবেন আজ রাত্রে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *