১. চেতনার প্রারম্ভ

আর এক ঝড় উপন্যাসআশাপূর্ণা দেবী

কোথায়? সেটা কোথায়?

চেতনার প্রারম্ভ থেকে অনবরত এই একই প্রশ্ন ক্ষতবিক্ষত করে চলেছে সীতুকে। কোথায়, সেটা কোথায়?

এ প্রশ্ন তাকে মা বাপের কাছে স্বস্তিতে তিষ্ঠোতে দেয় না, দেয় না সুস্থ থাকতে। থেকে থেকে মন একেবারে বিকল করে দেয়। তখন আর খেলাধুলো ভাল লাগে না সীতুর, ভাল লাগে না কারুর সঙ্গ। খাওয়ার জন্যে মায়ের পীড়াপীড়ি আর বাপের বকুনি অসহ্য লাগে।

এ প্রশ্নকে মন থেকে তাড়াতে অনেক চেষ্টা করেছে সীতু, যত বড় হচ্ছে তত চেষ্টা করছে, কিন্তু কিছুতেই কিছু হচ্ছে না। কিছুতেই এই অদ্ভুত প্রশ্নের জটিল জালকে ছিঁড়েখুঁড়ে উচ্ছেদ করতে পারছে না।

সব কিছুর মাঝখানে একটা অদেখা জায়গার ছবি চোখের উপর ভেসে উঠে মনটাকে উন্মনা করে দেয়, আশেপাশের কোন কিছু ভাল লাগে না।

সীতুর এই সাড়ে আট বছরের জীবনে কত কত বারই তো মাকে এ প্রশ্ন করেছে সীতু, আর প্রত্যেক বারই তো একই উত্তর পেয়েছে, তবু কেন সংশয় ঘোচে না, তবু কেন আবার ও বলে বসে-অনেক দিন আগে আমরা কোথায় ছিলাম মা?

 অতসী কখনো স্নেহে, কখনো বিরক্তিতে, কখনো শান্ত মুখে, কখনো ক্রুদ্ধ মূর্তিতে একই উত্তর দেয়, কোথাও নয়, কোথাও নয়। কখনো কোনদিন আর কোথাও ছিলে না তুমি। এখানেই জন্মেছ, এখানেই আছ। কেন অনবরত ওই এক বিশ্রী চিন্তা নিয়ে মাথা ঘুলোও?

কেন! সে কথা কি সীতু নিজেই জানে? সীতু কি ইচ্ছে করে এ চিন্তা মাথায় আনে? এ ছবি কি সীতু নিজে এঁকেছে?

.

…একটুকরো রোয়াক, কি রকম যেন একটা নল দিয়ে জলপড়া চৌবাচ্চা, ছোট ছোট জানলা বসানো কটা যেন ঘর, ঘরের দেওয়াল ভর্তি ছবি টাঙানো, আর পাশের কোনদিকে যেন একটা গলি। সরু গলি, মাঝে মাঝে জঞ্জাল জড় করা।

আর একটা ছোট ছেলে কোন একটা জানলায় বসে বসে দেখছে সেই গলিতে লোকের আনাগোনা।…

পথচলতি লোক চলে যায়, ফেরিওলা সুর করে করে ঢোকে আবার বেরিয়ে আসে, রাস্তার ঝাড়দার এসে সেই জমানো জঞ্জালগুলো তুলে নিয়ে যায়, ছেলেটা বসে বসে দেখে।

সে ছেলেটা কে?

সে বাড়িটা কোথায়? ঝাপসা ঝাপসা এই ছবিটা আবছা একটা রহস্যলোকের সৃষ্টি করে অনবরত যেন সীতুকে এখান থেকে ছিনিয়ে নিয়ে যেতে চায়, সীতুদের এই চকচকে ঝকঝকে সাজানো গোছানো প্রকাণ্ড সুন্দর বাড়িটা থেকে। এ বাড়িটাকে কিছুতেই যেন নিজেদের বাড়ি বলে মনে হয় না সীতুর, কিছুতেই এর সঙ্গে শিকড়ের বন্ধন অনুভব করতে পারে না।

সীতুদের বাড়ির বেঁটে নেপালী চাকরটা একটুকরো ন্যাকড়া নিয়ে যেমন করে শার্সির কাঁচগুলো ঘষে ঘষে চকচকে করে, চকচকে করে, আলমারির গায়ে লাগানো আর মার চুলবাঁধার লম্বা আয়নাগুলোকে, তেমনি একটা কিছু দিয়ে ঘষে ঘষে চকচকে করে ফেলতে ইচ্ছে করে সীতুর এই ভুলে ভুলে যাওয়া ঝাপসা ঝাপসা ছবিটা। পরিষ্কার আয়নায় মুখ দেখার মত করে দেখতে ইচ্ছে করে সেই ছেলেটাকে। দেখতে ইচ্ছে করে সেই জানলা থেকে টেনে সরিয়ে নিয়ে যেত যে মানুষটা সে কে?

কী ঠাণ্ডা স্যাঁতসেঁতে হাতটা তার!

বাড়ির সমস্ত কোলাহল আর সকলের সঙ্গ থেকে সরে এসে আপ্রাণ চেষ্টায় তলিয়ে যায় সীতু, বসে থাকে মস্ত জানলাটার ধারে, যে জানলাটা এ পাশের ছোট্ট একটা ঘরের, যাতে অন্য অন্য জানলার মত লেসের পর্দা ঝোলানো নেই।

জলখাবার খাবার সময় যে উত্তীর্ণ হয়ে যাচ্ছে, চাকরটা যে দুবার ডেকে গেছে, এইবার যে হাল ধরতে মা আসবেন, এ সবের কোন কিছু খেয়াল নেই সীতুর।

অবশেষে তাই হল।

অতসী নিজেই উঠে এল বিরক্ত হয়ে। হয়তো বই পড়তে পড়তে পড়া ছেড়ে, হয়তো বা আরামের দুপুর-ঘুমটুকু ছেড়ে। বিরক্ত মুখে বলে উঠল, সীতু, ফের তুমি গোঁজ হয়ে বসে আছ, খাওয়ার সময় খাচ্ছ না? তোমার জন্যে কী করব আমি? বল কি করব, বাড়ি থেকে চলে যাব?

মা! সীতু অসহায় মুখে বলে, সেই বাড়িটা কাদের একবারটি বল না!

অতসী খুব চীৎকার করে বকে উঠতে গিয়ে হঠাৎ স্তব্ধ হয়ে গেল। বসে পড়ল জানলার ধাপটায় সীতুর পাশে, তারপর আস্তে আস্তে বলল, সে বাড়িটা নিশ্চয় তোর পূর্বজন্মের বাড়ি সীতু! আগের জন্মের স্মৃতি তোর মনে পড়ে নিশ্চয়। ও সব কথা আর ভাবিসনে বাবা!

আমি তো ইচ্ছে করে ভাবি না মা? সীতু ম্লানমুখে বলে, আমার যে খালি খালি মনে হয়–

কি মনে হয়, সে কথা আর নতুন করে তো বলতে হয় না, অতসী জানে। তাই কোমলতার সঙ্গে ঈষৎ কঠোরতা মিশিয়ে বলে, কেন মনে হয়? বাড়ির ছেলেমেয়ে বাড়িতেই জন্মায়, বাড়িতেই থাকে, এই তো জানা কথা। এই যে খুকু, ও কি আগে আর কোথাও ছিল? এ বাড়িতেই জন্মেছে, এ বাড়িতেই আছে। বল, খুকু কি তোমার বোন নয়? দাদা নও তুমি ওর?

সীতুর চোখ ছলছলিয়ে জল ভরে আসে, তবু বলে চলে অতসী, বাড়ির ছেলেমেয়ে বাড়িতেই জন্মায়, বাড়িতেই থাকে, বুঝলে? আর কোনও দিন ও কথা ভাববে না। আমি তো বলেছি অদ্ভুত কোনও একটা বাড়ির স্বপ্ন তুমি দেখেছ বোধ হয় কোনদিন, তাই বারেবারে মনে পড়ে। স্বপ্নের কথা মনে রাখতে নেই। চল খাবে চল।

ছেলের হাত ধরে নিয়ে যায় অতসী বিষণ্ণ মুখে। মুখে যতই বকাবকি করুক, বুকটা কি দমে যায় না তার? কেন সীতুর পূর্বজন্মের কথা মনে পড়ে? কিছুতেই কেন ভুলিয়ে দেওয়া যায় না তাকে তার সে স্মৃতি?

.

আপেলের টুকরোগুলো মুখে পুরে কথাটা ভাবতে শুরু করে সীতু।

 স্বপ্ন! তাই হয়তো! স্বপ্ন তো ঝাপসা ঝাপসাই হয়।

 কিন্তু স্বপ্ন কি সব সময় এমন করে টানে?

দাদদা দাদদা! টলতে টলতে খুকু এল মোটা মোটা গোল গোল পা ফেলে। ওর ওই পা ফেলাটা ঠিক যেন ছানা হাতীর মত। দেখলেই মনটা আহ্লাদে ভরে যায়। ওর পা ফেলা, ওর খ্যাঁদা খ্যাঁদা লাল লাল মুখটা, উড় উড় সোনালী চুলগুলো, আর ওর ওই সম্প্রতি নতুন শেখা দাদদা ডাক, এটা যেন সব মনখারাপ মুছে দেয়। ওর সঙ্গে খেলায় মেতে উঠতে ইচ্ছে করে।

দাদদা দাদদা! দাদার পিঠের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে খুকু।

 ওরে সোনা মেয়ে, ওরে সোনা মেয়ে! একটা হাত বাড়িয়ে খুকুকে ধরে নেয় সীতু, বলে, আপেল খাবে? আপেল? ফল ফল?

খুকু অদ্ভুত উচ্চারণে দাদার কথার পুনরাবৃত্তি করতে চেষ্টা করে পঃ পঃ! তারপর বিনা বাক্যব্যয়ে দাদার হাতের খাদ্যটা খপ করে কেড়ে নিয়ে মুখে পুরে ফেলে।

সীতু বিগলিত স্নেহে মাথা নেড়ে নেড়ে বলে, ডাকাত মেয়ে, ডাকাত মেয়ে, থতে খাবে? থতে? খুব মিট্টি!

খুকু বলে, মিত্তি।

 দুই ভাই বোনের কণ্ঠনিঃসৃত হাসির শব্দে ঝলসে ওঠে বারান্দাটা। আর সঙ্গে সঙ্গে সেই হাসির উপর কে যেন বড় একটা থাপ্পড় বসিয়ে দেয়।

ঘর থেকে বেরিয়ে এলেন বাবা। লোকে যাকে মৃগাঙ্ক ডাক্তার বলে। কোঁচকানো ভুরু, বিরক্ত গম্ভীর কণ্ঠ।

সীতু!

সীতু মুখটা নীচু করল।

কতদিন বারণ করেছি!

 মুখটা আরও নীচু করল সীতু।

হ্যাঁ, অনেকদিনই বারণ করেছেন বটে। বাচ্চারা বড়দের এঁটো খায়, এ তিনি দুচক্ষে দেখতে পারেন না। খুকুকে সীতু নিজের পাত থেকে কিছু খাওয়াচ্ছে দেখলেই এমনি রেগে জ্বলে যান। আজও তাই আস্তে আস্তে স্বর চড়াতে থাকেন, একটা ব্যাপারেও কি সভ্য হতে নেই? সবসময় অসভ্যতা অবাধ্যতা?

সীতুর মুখটা বুকের কাছে ঝুলে পড়েছে। বাবার মুখের ওপর কথা বলতে পারে না সে, বাবার সঙ্গেই পারে না। বাবাকে দেখলেই ওর শুধু ভয় নয়, কেমন একটা রাগ আসে, ভয়ানক একটা রাগ।

আর তিনিও।

তিনিও যেন প্রতিজ্ঞাবদ্ধ, সীতুর সঙ্গে সহজ হয়ে, সহজ গলায় কথা বলবেন না। তাই যখনই কথা বলেন কপাল কুঁচকে বিরক্ত-বিরক্ত গলায়। ছেলেকে শুধু শাসনই করতে হয় এইটাই বোধ করি জানেন সীতুর বাবা। তাই তার সীতুর প্রতি সর্ববিধ ব্যবহার তো বটেই, চোখের চাউনিতে পর্যন্ত শাসন শাসন ভাব।

আর কোনদিন খাওয়াবে? বল–জবাব দাও! কিন্তু জবাবটা দেবে কে?

সীতুর মাথাটা তো একভাবে নীচু থাকতে থাকতে আড়ষ্ট হয়ে যাচ্ছে।

 তাই বোধ করি জবাব দিতে ছুটে এল অতসী। কিন্তু জবাব না দিয়ে প্রশ্নই করল, কি হল? এখুনি উঠলে যে? বলছিলে যে খুব টায়ার্ড ফিল করছ–।

টায়ার্ড ফিল আমি তোমাদের ব্যবহারে যতটা করি অতসী, ততটা দৈনিক পঁচিশঘণ্টা কাজ করলেও নয়-মৃগাঙ্ক ডাক্তারের গলার স্বরটা থমথমে শোনায়। খুব বেশি চাহিদা আমার নয় সে তুমি জানো। সম্পূর্ণ স্বাধীনতা আছে তোমার, ছেলেমেয়েকে নিয়ে যা খুশী করবার। শুধু হাত জোড় করে অনুরোধ করি, তোমার আদরের ছেলেটি যেন ওকে ওর পাত থেকে কিছু খাওয়ায় না। সে অনুরোধ রক্ষিত হবে এটুকু কি আমি আশা করতে পারি না?

সীতুর চোখটা মাটির দিকে, তবু সীতু বুঝতে পারছে বাবার সেই রুক্ষ মুখটা আরও শক্ত হয়ে পাথুরে পাথুরে হয়ে গেছে, আর মায়ের মুখটা বেচারী বেচারী! মায়ের জন্য এখন কষ্ট হচ্ছে সীতুর, মনে হচ্ছে বেশির ভাগ সময় তার দোষেই মাকে এই পাথুরে মুখের আগুনঝরা চোখের সামনে দাঁড়াতে হয়।

কিন্তু সীতু কি করবে? খুকুটা যে দাদা বলে ছুটে এসে ওর কাছ থেকে কেড়ে খায়।

কিন্তু শুধুই কি খাওয়া?

সীতু খুকুর গায়ে একটু হাত ঠেকালেই কি অমনি রুক্ষ হয়ে ওঠেন না বাবা? বলেন না বড়দের হাত লোনা, ছোটদের গায়ে দিলে তাদের স্বাস্থ্য খারাপ হয়ে যায়?

সীতু কত বড়? মার চাইতে? বাবার চাইতে? নেবাহাদুরের চাইতে?

অনেকবার ইচ্ছে করে সীতুর, বাবাকে জিগ্যেস করবে তার ডাক্তারি বইতে ঠিক পষ্ট কি লেখা আছে? লেখা আছে কি শুধু সাত আট বছরের ছেলেদের হাতই লোনা হয়?

ইচ্ছে করে, কিন্তু পারে না জিগ্যেস করতে, অদ্ভুত একটা আক্রোশে। বাপের উপর ভয়ানক একটা আক্রোশ আছে সীতুর। সর্বদা শাসনের ফল, না আরও কোন কারণ আছে? কে জানে কি, তবে এইটুকুই দেখা যায়, বাপের সঙ্গে পারতপক্ষে কথা বলে না সে। নিজে থেকে ডেকে তো নয়ই, প্রশ্ন করলে উত্তরও দেয় না। অতসীর ভাষাতে গোঁজ হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে।

যেমন আজও।

কথা কয়ে তো উত্তর পাওয়া যাবে না ওনার সঙ্গে, কাজেই বোঝা যাবে না বারণ করলে ও কেন শোনে না মৃগাঙ্ক ডাক্তার বিদ্রূপকঠিন কণ্ঠে বলেন, তোমাকেই হাত জোড় করে অনুরোধ করছি, দয়া করে ছেলের এই বদভ্যাসটি ছাড়াও।

অত আদরের খুকু সোনা, তবু তার উপর রাগ এসে যায় সীতুর, মনে মনে তাই বাপের কথার উত্তর দেয়, ছেলের বদভ্যাসটি তো ছাড়াবেন মা, আর মেয়ের বদভ্যাসটি? সামনে, খাবার জিনিস দেখলেই খপ করে মুখে পুরে দেবার অভ্যাসটি? নেপবাহাদুরের কাছ থেকে ভুট্টা খায় না সে? বামুন ঠাকুরের কাছ থেকে আলুভাজা, বড়াভাজা?

মনে মনে বলা, উত্তর শোনা যায় না।

অতসীকে তাই আলাদা উত্তর দিতে হয়, বারণ কি করি না? শুনছে কে? খুকুটাও তো হচ্ছে। তেমনি।

বাজে ওজর কোর না, মৃগাঙ্ক ডাক্তার বলে ওঠেন, বাজে ওজরের মত বিরক্তিকর জিনিস পৃথিবীতে অল্পই আছে, বুঝলে? কাল থেকে যখন ওকে খেতে দেবে খুকুকে আটকে রাখবার ব্যবস্থা করবে। এই হচ্ছে আমার শেষকথা। এটুকু যদি তোমার পক্ষে সম্ভব না হয়, তাহলে আইন আমাকে নিজের হাতেই নিতে হবে।

শেষ রায় দিয়ে ফের ঘরের মধ্যে ঢুকে যান মৃগাঙ্ক।

কিন্তু ইত্যবসরে আপ্রাণ চেষ্টায় মার কোল থেকে নেমে পড়েছে খুকু। আর আবার গিয়ে থাবা বসিয়েছে দাদা প্রস্তাবিত সেই ওর থন্দেতে।

 ঠাস করে মেয়েকে একটা চড় কসিয়ে আবার তাকে কোলে তুলে নিল অতসী, চাপা কড়া গলায় বলে উঠল, তোর শরীরে কি লজ্জা নেই হতভাগা ছেলে? তোর জন্যে যে গলায় দড়ি দিয়ে মরতে ইচ্ছে করে আমার। কেন তুই খাবার দিস ওকে? জানিস উনি বাচ্চাদের কারুর এঁটো খাওয়া ভালবাসেন না, তবু কেন? বল কেন?

কেন?

মার এই প্রশ্নের উত্তর দেবে না সীতু, ইচ্ছে করেই দেবে না। উত্তর এর পরে দেবে কাজের মধ্য দিয়ে। যেই না খুকু পাজীটা সীতুর খাবারের উপর হাত বসাবে, মার চাইতেও বেশি জোরে ঠাস করে চড় বসিয়ে দেবে ওকে।

 হ্যাঁ দেবেই তো! নিশ্চয় দেবে। সীতুকে যদি কেউ মায়া না করে, সীতুই বা করতে যাবে কেন?

মায়া করতে যাবে কেন, ভাবতে গিয়েও মাটির উপর ঝরঝরিয়ে কয়েক ফোঁটা জল ঝরে পড়ে, মাটির দিকে তাকানো চোখ দুটো থেকে।

 খুকুর খ্যাঁদা নাকওলা লাল লাল মুখটা আপাতত দেখতে না পেলেও তার মার খাওয়া মুখটা কল্পনা করে চোখের জল আটকাতে পারে না সীতু।

অতসী একটা নিঃশ্বাস ফেলে বলে, কিছুই তো খাওয়া হল না। আমারই অন্যায়, ঠিক কথাই বটে, আমার অন্যায়। কিন্তু তুই বা এমন করিস কেন? কেন আগে আগে খেয়ে নিতে পারিস না ঠাকুরের কাছে, মাধবের কাছে? সেই আমাকে তুলে তবে ছাড়বি? আমি উঠে পড়লেই খুকু উঠে পড়ে দেখতে পাস না?

না, পাই না। আমি কিছু দেখতে পাই না। বলে ছুটে পালিয়ে যায় সীতু। অতসী হতাশ দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে সেই দিকে। হতাশ–তাই কি? আরও অন্য কেমন একরকম না?

কিন্তু কেমন করে তাকিয়ে রইল অতসী?

 কি ছিল তার চোখের দৃষ্টিতে? ছেলের উপর রাগ? স্বামীর উপর বিরক্তি? না নিজের উপর ধিক্কার? স্বামীকে হাতের মুঠোয় পুরতে পারে নি, পারে নি তার সমস্ত তীক্ষ্ণতা ক্ষইয়ে ভোতা করে ফেলতে, এই ধিক্কারেই কি মরমে মরে যাচ্ছে অতসী?

কিন্তু তা কেন?

সংসারের রাশভারী কর্তারা তো এমন অনেক বাড়াবাড়ি শাসন করেই থাকে, গৃহিণীরা হয়। সেটা সভয়ে মেনে নিয়ে সাবধান হয়, নয়তো বিদ্রোহ করে চোট-পাট প্রতিবাদ জানায়। অতসীর মত এমন মর্মাহত কে হয়?

ছেলেও তেমনি অদ্ভুত!

বাপের দিক মাড়ায় না। বাপের দিকে তাকায় যেন শত্রুর দৃষ্টিতে। বয়স্ক ছেলে নয়, মাত্র একটা আট বছরের ছেলে, তাকে নিয়ে অতসীর একি দুঃসহ সমস্যা!

সংসারে ভোগ্যবস্তু বলতে যা কিছু বোঝায়, তার কোন কিছুরই অভাব নেই অতসীর। না, তা বললেও বুঝি ঠিক হয় না। অভাব তো নেই-ই, বরং আছে অগাধ প্রাচুর্য।

 বাড়ি গাড়ি চাকরবাকর আসবাব উপকরণ সব কিছুই প্রয়োজনের অতিরিক্ত। স্বাস্থ্যবান সুপুরুষ স্বামী, সুকান্তি পুত্র, সোনার পুতুলের মত মেয়ে।

স্বামী মদ্যপ নয়, চরিত্রহীন নয়, অন্যাসক্ত নয়, স্ত্রীর প্রতি স্নেহহীন নয়। অর্থনৈতিক স্বাধীনতার তো সীমা নেই অতসীর। অগুনতি উপার্জন করেন মৃগাঙ্ক, অনায়াসে অবহেলায় এনে ফেলে দেন স্ত্রীর হাতে। কোনদিন প্রশ্ন করেন না, টাকাটা কোন খাতে খরচ করলে?

আর কি চাইবার থাকে মেয়েমানুষের?

স্বামীর স্বভাব রুক্ষ কঠোর এ কথাই বা কি করে বলবে অতসী? কত কোমল মন ছিল মৃগাঙ্কর! মৃগাঙ্কর মন কোমল না হলে অতসী কোন টিকিটের জোরে এই ঐশ্বর্যের সিংহাসনে এসে বসতো?

কি আছে অতসীর?

 অগাধ রূপ? অনেক বিদ্যা? অসাধারণ বংশমর্যাদা?

কিছু না, কিছু না।

অতসী অতি তুচ্ছ অতি সাধারণ। মৃগাঙ্কর প্রেমই অতসীকে মূল্যবান করেছে।

 আশ্চর্য, তবু অতসী দুঃখী।

অতসীর আপন আত্মজ নষ্ট করে দিচ্ছে অতসীর সমস্ত সুখ শান্তি।

কেন সীতুর পূর্বজন্মের স্মৃতি বিলুপ্ত হল না? ডাক্তার মৃগাঙ্ক এত রোগের চিকিৎসা করতে পারে, পারে না এ রোগের চিকিৎসা করতে?

কতদিন ভাবে অতসী, জিজ্ঞেস করবে মৃগাঙ্ককে। এমন কোন একটা ওষুধ-টষুধ খাইয়ে দেওয়া যায় না ওকে, যাতে ওর ওই ঝাপসা ঝাপসা স্মৃতির ছায়াটা একেবারে মুছে যায়?

বলতে পারে না। মৃগাঙ্ক কি ভাববে? যদি এই অদ্ভুত প্রস্তাবে ব্যঙ্গের হাসি হেসে বলে, কিন্তু অতসী তোমার? তোমার ব্যাপারটার কি হবে?

তখন অতসী কি বলবে?

.

ছেলে আর ছেলের মাকে শাসন করে মৃগাঙ্ক ডাক্তার ফের ঘরে গিয়ে শুয়ে পড়লেন। সত্যি আজ তিনি বড় বেশি ক্লান্ত।

কিন্তু এও ঠিক–শুধু পরিশ্রমেই ক্লান্ত হচ্ছেন না ডাক্তার। সাংসারিক জীবনটাই দিনের দিন ক্লান্ত করে তুলছে তাকে।

বেশ বেশী খানিকটা বয়স পর্যন্ত অবিবাহিতই ছিলেন মৃগাঙ্ক। প্রচুর উপার্জন করেছেন, প্রচুর খরচ করেছেন, বন্ধু পোষণ করেছেন, আত্মীয়-কুটুম্বকে সাহায্য করেছেন, আর করেছেন বাড়ি, গাড়ি, আসবাবপত্র!

তারপর কোথা দিয়ে কি হল, অতসী এল জীবনে। পালা বদলালো। তা বিয়ের পর প্রথম দুএকটা বছর তো এক অপূর্ব সুখের ঘোরে কেটেছে, কিন্তু সেই ঘোরের সুর কেটে দিল সীতু। মা আর বাপের মধ্যে একটা ব্যবধানের প্রাচীর হয়ে উঠল সে, দুজনের মনের সহজ আদান প্রদানের দরজা বুঝি রুদ্ধ হয়ে গেল।

মৃগাঙ্কর মধ্যে বাড়তে লাগল বিদ্বেষ, বিরক্তি, অশান্তি। অতসীর মধ্যে কাজ করতে লাগল হতাশা, অভিমান আর অপরাধ-বোধ।

তারপর এল খুকু।

আর খুকু আসার সঙ্গে সঙ্গেই মৃগাঙ্ক সীতুকে একেবারে দূরে ঠেললেন।

সীতুর প্রতি বিদ্বেষ আর বিরক্তি তার বেড়েই চলতে লাগল, কারণে অকারণে তার প্রকাশ্য অভিব্যক্তি অতসীকে মরমে মারতে লাগল।

.

খানিকক্ষণ শুয়ে থেকে উঠে পড়লেন মৃগাঙ্ক। ভাবলেন এ অবস্থার একটা প্রতিকার হওয়া দরকার। নেপবাহাদুরকে ডেকে বললেন, খোকাবাবুকো বোলাও।

প্রমাদ গনলো নেপবাহাদুর।

ডাক্তার সাহাব বোলিয়েছে বললেই তো খোকাবাবু বেঁকে বসবে। তবু সেকথা তো আর ডাক্তার সাহাবের মুখের উপর বলা যায় না। অগত্যাই ভারাক্রান্তচিত্তে গিয়ে খোকাবাবুর কাছে বক্তব্য পেশ করল।

আর সঙ্গে সঙ্গে তারর আশঙ্কা অনুযায়ী উত্তর মিলল–যাব না।

 তারপর চলল দুজনের বাকযুদ্ধ।

 নেপবাহাদুরের বহু যুক্তিপূর্ণ বাছাই বাছাই বাণ, আর সীতুর সংক্ষিপ্ত এক একটি তীক্ষ্ণ বাণ।

শেষ পর্যন্ত নেপবাহাদুরেরই জয় হল, অবশ্য গায়ের জোরের জয়। যতই হোক আট বছরের ছেলে তো। ওর সঙ্গে পারবে কেন? পাঁজাকোলা করে নিয়ে এল সে।

শোনো, গম্ভীরভাবে বললেন মৃগাঙ্ক ডাক্তার, আমার প্রথম কথা হচ্ছে, কথার উত্তর দেবে। যা বলব শুধু আমিই বলে যাব, আর তুমি বুনো ঘোড়ার মত ঘাড় গুঁজে বসে থাকবে তা চলবে না। শুনবে একথা?

বলা বাহুল্য সীতু বুনো ঘোড়ার নীতিই অনুসরণ করে।

মৃগাঙ্ক একটু অপেক্ষা করে আরও গম্ভীরভাবে বলেন, খুকুকে এঁটো জিনিস খেতে দিতে বারণ করি, দাও কেন?

 হঠাৎ সীতুর নিজেকে আলাদা একটা লোক আর খুকুটাকে বাবার মেয়ে মনে হয়। তাই বুনো ঘাড়টা ঝট করে তুলে রুক্ষভাবে বলে, আমি সেধে সেধে দিতে যাই না, ওই হ্যাংলার মতন চাইতে আসে।

মৃগাঙ্ক বিদ্রুপে মুখ কুঁচকে বলেন, ওর অনেক বুদ্ধি, ও একটা মাতব্বর, তাই ওর কথা ধরতে হবে, কেমন? হাজার বার বলিনি তোমায় বড়দের এঁটো খেলে অসুখ করে ছোটদের?

আর যখন নেপবাহাদুরের খাওয়া ভুট্টার দানা খায়? তার বেলায় দোষ হয় না? যত দোষ নন্দ ঘোষ।

মাথাটা ঝাঁকিয়ে অন্যদিকে তাকায় সীতু। বাপের ভয়ে নয়, বাপের দিকে তাকাবে না বলে।

মৃগাঙ্ক অসহ্য ক্রোধে মিনিট খানেক চুপ করে থেকে তিক্তস্বরে বলেন, ই, অনেক কথা শেখা হয়েছে যে দেখছি। কেন, নেবাহাদুরের কাছেই বা খায় কেন? তুমি যদি দেখতে পাও তো তুমি বারণ কর না কেন?

বলা বাহুল্য সীতু নীরব।

 মৃগাঙ্ক বুঝি ভুলে যান তার সম্মুখবর্তী প্রতিপক্ষ একটা বালকমাত্র, ভুলে যান ওর সঙ্গে সমান সমান হয়ে কথা কইলে তারই মর্যাদার হানি হবে, ওর কিছুই না। তাই সেই সমান সমান ভাবেই কথা বলেন, না, তুমি বারণ কর না। তার মানে হচ্ছে, তুমি চাও খুকুর ওই সব নোংরা খেয়ে অসুখ করুক। বল তাই চাও কিনা?

হ্যাঁ চাই-ই তো, খুব চাই।

সহসা বিদ্যুতের বেগে উত্তর দেয় সীতু, বোধ করি কথার মানে না বুঝেই। বোধ করি শুধু বাবার মুখের উপর কথা বলার সুখে।

তাই চাও? তাই চাও তুমি? মৃগাঙ্কর গলা পর্দায় পর্দায় চড়ে, তা বলবে বইকি। তোমার উপযুক্ত কথাই বলেছ। আমড়াগাছে আমড়া না ফলে কি আর ন্যাংড়া ফলবে? কিন্তু মনে রেখো, তোমার এইসব বদমাইসী সহ্য করব না আমি। ফের যদি ওরকম দেখি, উচিত শাস্তি দেবো।

বেশ, খুকুও যেন আমার দিকে না আসে।

কষ্টে চোখের জল চেপে উচ্চারণ করে সীতু এই ভয়ঙ্কর শর্তের বাক্য।

 ও বটে নাকি? মৃগাঙ্ক সেই রকম ব্যঙ্গের হাসি হেসে ওঠেন, সে হাসিটা যেন সীতুর কানের পর্দাটা পুড়িয়ে দিয়ে, গায়ের চামড়াটা জুলিয়ে দিতে দিতে বাতাসে বিলীন হয়। বটে! এই সমস্ত বাড়িটা তাহলে একা তোমারই? তোমার এলাকায় ওর প্রবেশ নিষেধ?

হ্যাঁ তো। হ্যাংলা বেহায়াটা তো কাছে এলেই খেতে চাইবে।

কী, কী বললি?

মৃগাঙ্ক গর্জন করে ওঠেন, বেয়াদপ অসভ্য ছেলে! দিন দিন গুণ প্রকাশ হচ্ছে। আর যদি কোনদিন এভাবে মুখে মুখে জবাব দিতে দেখি, চাবকে লাল করব তোমায় আমি।

এ গর্জন অতসীর কাছে পর্যন্ত পৌঁছয়।

উঠে এ ঘরে ছুটে আসতে যায়। আবার কি ভেবে থেমে পড়ে। দাঁতে ঠোঁট চেপে বসে থাকে নিজের ঘরে।

কিন্তু একটা বলবান স্বাস্থ্যবান কর্তা পুরুষের ক্রোধের গর্জন কি দেওয়ালে ধাক্কা খেয়ে বিলীন হয়ে যায়? দেওয়াল ভেদ করে ফেলে না?

ক্ষীণকণ্ঠ একটা শিশুর বুকের পাটাটা যতই বেশি হোক, আর তার বিদ্বেষের তীব্রতাটা যতই প্রখর হোক, কণ্ঠস্বরটা ক্ষীণই থাকে। পর্দায় চড়ে শুধু একটা স্বরই, দুটো দেওয়াল ভেদ করে এ  ঘরে এসে আছড়ে আছড়ে পড়তে থাকে সে স্বর।

এই জন্যেই বলে, কুকুরকে লাই দিতে নেই। তোমার এই আসপদ্দার ওষুধ কি জানো? জল বিছুটি। আর এবার থেকে সেই ব্যবস্থাই করতে হবে। ছোঁবে না তুমি ওকে, বুঝলে? আঙুল দিয়ে ছোঁবে না। কী হল! আবার মুখের ওপর চোপা? হ্যাঁ তাই, শুধু তোমার হাতই লোনা। তোমার হাত গায়ে পড়লেই রোগা হয়ে যাবে খুকু। তাই ঠিক। উঃ এক ফোঁটা ছেলে, আমার জীবন বিষ করে ফেলেছ একেবারে। এই জন্যেই শাস্ত্রে বলে বটে–আগুনের শেষ, ঋণের শেষ, আর শত্রুর শেষ

না, ঘরে বসে থাকতে পারে না অতসী। ধীরে ধীরে ওঘরে গিয়ে মৃদু অথচ দৃঢ়কণ্ঠে বলে, শাস্ত্রে কী বলে, সেটা আর পাড়া জানিয়ে নাই বা বললে?

মৃগাঙ্ক চট করে উত্তর দিতে পারেন না, কেমন যেন শূন্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকেন অতসীর দিকে। বুঝি এতক্ষণ যা কিছু বলছিলেন, উগ্র এক নেশার ঘোরে। এখন অতসীর এই মৃদু কণ্ঠের দৃঢ়তায় ফিরে পেলেন চৈতন্য। নিজের ব্যবহারের কদর্যতার দিকে তাকিয়ে অশ্রদ্ধা এল নিজের উপর, আর আরও রাগ বাড়লো ওই হতভাগা ছেলেটার উপর, যে নাকি এই সব কিছুর হেতু।

 কিন্তু কটুকথা বলারও বুঝি একটা নেশা আছে। তাই মৃগাঙ্ক মনে মনে অপ্রতিভ হলেও মুখে বলে ওঠেন, ছেলের হয়ে ওকালতি করতে আসা হল?

না, তোমার জন্যে এলাম। তোমাকে বাঁচাতে। এমন করে নিজেকে আর মেরো না তুমি। সীতুর দিকে তাকিয়ে আরও দৃঢ়কণ্ঠে বলে অতসী, যা তুই ও ঘরে যা। পড়গে যা।

সীতু অবশ্য নড়ে না, তেমনি ঘাড় গুঁজে দাঁড়িয়ে থাকে।

যা। তীব্র চীৎকার করে অতসী।

তথাপি সীতু অনড়।

যা বলছি। শুনতে পাচ্ছিস না?

সাতু যথাপূর্বং।

 নিজে থেকে নড়বি না তা হলে?

আর ধৈর্য থাকে না। একটা কান ধরে টেনে ঘরের বার করে দেয় অতসী। দিয়ে এসে রাগে হাঁপাতে থাকে।

মৃগাঙ্ক একটুক্ষণ চেয়ে থেকে গম্ভীর হাস্যে বলেন, বলতে পারতাম, তোমাকে কে বাঁচাতে আসবে অতসী, কিন্তু বললাম না।

অতসীর চোখ দুটো জ্বালা করে আসে, তবু কষ্টে কঠিন হয়ে বলে, তুমি মহানুভব, তাই বললে না।

মৃগাঙ্করও কি চোখ জ্বালা করছে? তাই অন্য দিকে, খোলা জানলার দিকে তাকাচ্ছেন খোলা হাওয়ার আশায়?

সেই দিকে তাকিয়েই বলেন মৃগাঙ্ক, আমাদের পরস্পরের সম্পর্ক ক্রমশ এতেই দাঁড়াচ্ছে, না অতসী–আঘাত আর প্রতিঘাত!

অতসী উত্তর দেয় না।

হয়তো দেবার ক্ষমতা থাকে না বলেই দেয় না। মৃগাঙ্কই আবার কথা বলেন, যদি আমার উপর এখনো একটু বিশ্বাস তোমার থাকে অতসী তো বলছি বিশ্বাস কর, ওকে ধমক দেবার জন্যে ডাকিনি আমি, মিষ্টি কথায় বোঝাবার জন্যেই ডেকেছিলাম। কিন্তু

আবেগে কণ্ঠস্বর রুদ্ধ হয়ে আসে মৃগাঙ্কর।

 কিন্তু কি, তা কি আর জানে না অতসী? সীতুর ঔদ্ধত্য, সীতুর একগুয়েমি বরফকেও তাতিয়ে তুলতে পারে, সে তো অতসীর হাড়ে হাড়ে জানা। তবু মৃগাঙ্ক যখন বিষতিক্ত স্বরে কটুকাটব্য করে সীতুকে, সীতুর দিকে তাকিয়ে যখন মৃগাঙ্কর চোখ দিয়ে শুধু ঘৃণা আর আগুন ঝরে, তখন আর মেজাজের ঠিক রাখতে পারে না অতসী। তখন তুচ্ছ সীতুর একগুয়েমি, ঔদ্ধত্য, অবাধ্যতাগুলো তুচ্ছতার কোঠায় গিয়ে পড়ে, প্রকট হয়ে ওঠে মৃগাঙ্কর অভিব্যক্তিটাই।

আমাদের ভালোবাসার মধ্যে ও যে এতবড় একটা ভীষণ প্রাচীর হয়ে উঠবে, এ তো আমরা কখনো ভাবিনি অতসী!

ভাবলে কি করতে? অতসী তীক্ষ্ণ স্বরে বলে ওঠে, ওকে মুছে ফেলতে?

অতসী!

বজ্রগম্ভীর দৃষ্টিতে অতসীর দিকে তাকান মৃগাঙ্ক, ওই দুর্মতি ছেলেটা তোমার মতিবুদ্ধি সব নষ্ট করে দিচ্ছে। কিন্তু আশ্চর্য হচ্ছি, তোমার প্রভাব ওকে সুস্থ করে তুলল না, ওর প্রভাব তোমাকে নষ্ট করে ফেলতে বসল।

আমি যা ছিলাম তাই-ই আছি, সহসা ঝর ঝর করে ঝরে পড়ে এতক্ষণকার রুদ্ধ আবেগ, তুমিই বদলাচ্ছ। দিন দিন বদলে যাচ্ছ।

মৃগাঙ্ক আস্তে ওর কাঁধে উপর একটা হাত রাখেন, আমিও বদলাইনি অতসী। শুধু মাঝে মাঝে কেমন ধৈর্য হারিয়ে ফেলি। হয়ত বেশি পরিশ্রমের ফল এটা, হয়তো বা বয়সের দোষ।

অতসী মুখটা চেপে ধরে সেই বলিষ্ঠ হাতখানার আশ্রয়ের মধ্যে।

 তখনকার মত সমস্যা মেটে। কিন্তু সে মীমাংসা তো সাময়িক।

.

বড় একটা আলুর মত ফুলে উঠল ছোট্ট কপালের কোলটুকু। পড়ে গিয়ে ককিয়ে উঠে সেই যে থেমে গিয়েছিল খুকু, আবার স্বর ফুটল অনেক কাণ্ড করে। ঠাণ্ডাজল, গরমজল, বাতাষ, ধরে ঝকানি, যত রকম প্রক্রিয়া আছে, সবগুলো করে দেখার পর আবার কেঁদে উঠল সে।

 কিন্তু এমন করে পড়ল কি করে খুকু? এতগুলো চাকর-বাকরের চোখ এড়িয়ে?

না, চোখ এড়িয়ে কে বলল? চোখের সামনে দিয়েই তো।

খুকুর নিজের দাদা যদি খুকুকে ধাক্কা দিয়ে ঠেলে ফেলে দেয়, ওরা কি করবে? মাইনে-খেগো চাকররা? সেই কথাই বলে ওঠে বামুন মেয়ে। স্পষ্টবাদিতার গুণে যে সকলের চক্ষুশূল আবার ভীতিস্থল।

সারা সংসার মাথায় করে রাখে বলেই অতসীকেও বাধ্য হয়ে হজম করতে হয় বামুন মেয়ের এই স্পষ্টবাদিতা। কাজেই বামুন মেয়ে যখন খরখর করে বলে, তা ওরা কি করবে? ওদের না হক বকুনি দিচ্ছ কেন মা, ওরা মাইনে-খেগো চাকর শুধু এই অপরাধে? তোমার নিজের ছেলেটি যে একটি খুনে, সে হিসেব তো শুনতে চাইছ না? এই তো আমার চোখের সামনেই তো–কচি বাচ্চাটা দাদদা দা্দদা করে গিয়ে যেই না হাঁটুটা জড়িয়ে ধরে দাঁড়িয়েছে, ওমা ধরে–তুমি আমায় জেলেই দাও আর ফাঁসিই দাও, সত্যি কথাই কইব, বললে বিশ্বাস করবে না, ঝনাৎ করে হাঁটু আছড়ে ফেলে দিল বোনটাকে। আর লাগবি তো লাগ ধাক্কা খেলো একেবারে টেবিলের পায়ার কোণে। ওমা না বুঝে ঠেলেছিস তাই নয় তুলে ধর! তা নয়, যেই না মেয়ে মুখ থুবড়ে পড়ল, সেই তোমার ছেলে উধ্বশ্বাসে দৌড়ে হাওয়া! যাই বল মা, ছেলে তোমার হয় পাগল, নয় সর্বনেশে ডাকাত!

এ মন্তব্যের বিরুদ্ধে কি বলবে অতসী? কি বলবার মুখ আছে?

 খুকুটা যে মরে যায়নি এই ভগবানের অশেষ দয়া। ভাবতে গিয়ে প্রাণটা আনচান করে চোখে জল এসে পড়ে। মেয়েকে বুকে চেপে ধরে মনে মনে বলে, কত দয়া তোমার ঠাকুর, কত দয়া!

খুকুর কোন বিপদ হলে অতসীর প্রাণটা যে ফেটে শতখান হয়ে যেত, একথা তত মনে পড়ছে না অতসীর, যতটা মনে পড়ছে–তাহলে অতসী মুখ দেখাত কি করে?

হে ভগবান! অতসীকে উদ্ধার করো, দয়া করো।

কিন্তু অপরাধীর আর পাত্তা নেই কেন? এদিক ওদিক খুঁজে এসে শেষ পর্যন্ত সেই চাকরবাকরদেরই প্রশ্ন করতে হয়, খোকাবাবু কাঁহা হ্যায়?

খোকাবাবু!

না, খোকাবাবুর খবর কেউ জানে না। খুকুর পড়ে যাওয়ার মত ভয়ঙ্কর মারাত্মক দৃশ্যটা থেকে চোখ ফিরিয়ে নিয়ে কে আর খোকাবাবুর গতিবিধি দেখতে গেছে?

পাথরের মত মুখ করে মেয়ের কপালের পরিচর্যা করলেন মৃগাঙ্ক, নিঃশব্দে হাত ধুতে চলে গেলেন। অতসীও দাঁড়িয়ে রইল তেমনি নিঃশব্দে। বোঝা যাচ্ছে না, তার মুখে যে অন্ধকার ছায়াটা জমাট হয়ে আছে, সেটা অপরাধ-বোধের, না অভিমানের।

মৃগাঙ্ক ঘরে এসে বসতেই অতসী কাছে এসে দাঁড়াল। বলল, তুমি ওকে যা খুশী শাসন কর, আমি কিছু বলব না।

শাসন করে কি হবে? একদিন শাসন করে কি হবে?

 অতসী বলে, এমন ভয়ঙ্কর একটা কিছু কর, যাতে চিরদিনের মত ভয় জন্মে যায়।

 আমি তো পাগল নই! মৃগাঙ্ক থমথমে গলায় বলেন।

 কিন্তু আমার ভয় হচ্ছে, ও পাগল হয়ে যাচ্ছে কিনা।

ওই ভেবেই মনকে সান্ত্বনা দাও।

তবে আমি কি করব বলে দাও।

 করবার কিছু নেই। ধরে নিতে হবে এই আমাদের জীবন।

অতসী কি একটা বলতে যায়, ঠোঁটটা কেঁপে ওঠে, বলা হয় না। আর ঠিক সেই মুহূর্তে সীতুর্কে পাঁজাকোলা করে চেপে ধরে নিয়ে ঘরের দরজায় দাঁড়ায় বাড়ির দারোয়ান শিউশরণ।

সীতু অবশ্য যথোপযুক্ত হাত পা ছুঁড়ছে, কিন্তু শিউরণের সঙ্গে পারবে কেন? তাছাড়া তার একখানা হাত তত জোড়া আছে নিজের ভাঙা কপাল সংক্রান্ত ব্যাপারে।

হ্যাঁ, বাঁ হাতের চেটোটা কপালে চেপে ধরে বাকি তিনখানা হাত পা এলোপাথাড়ি চালাচ্ছে সীতু। সীতুর কপালে আবার কি হল?

শিউশরণের বহুবিধ কথার মধ্যে থেকে আবিষ্কার করা যায় কি হল।

নীচের তলায় নেমে গিয়ে বাড়ির পিছনের দেওয়ালের গায়ে ঠাই ঠাই করে নিজের কপালটা ইকছিল সীতু। নেহাৎ নাকি জমাদারটা এসে শিউশরণকে এই অস্বাভাবিক কাণ্ডের খবরটা দেয়, তাই কোন প্রকারে এই ক্ষ্যাপাকে ধরে আনতে সক্ষম হয়েছে সে।

 শিউশরণ নামিয়ে দিতেই একেবারে স্থির হয়ে গেল সীতু। হাত পা ছোঁড়া বন্ধ করে দাঁড়াল দুখানা হাত দুদিকে ঝুলিয়ে, মুখ নীচু করে। তবু দেখা যাচ্ছে, সীতুর কপালটাও ফুলে উঠেছে বড় একটা আলুর মত। বাড়তি আরও কিছু হয়েছে, সমস্ত কপালটা হাচা ছাচা কালশিরে কালশিরে।

.

হ্যাঁ সীতুর কপালের পরিচর্যাও মৃগাঙ্ককেই করতে হল বইকি!

অতসী মাটির সঙ্গে মিশিয়ে গেলেও, এছাড়া আর কি সম্ভব?

কিন্তু মৃগাঙ্কর পাথুরে মুখটা একটু যেন শিথিল হয়ে গেছে, মুখের রেখাগুলো একটু যেন ঝুলে পড়েছে। বড় বেশি চিন্তিত দেখাচ্ছে যেন সে মুখ।

এ রকম করলে কেন?

 সীতু যথারীতি গোঁজ হয়েই রইল।

মৃগাঙ্কর স্বরটা কোমল কোমল শোনায়, তোমার কপাল ফুলে উঠল বলে কি খুকুর কষ্টটা কমল?

সেজন্যে নয়। হঠাৎ একটা দৃপ্তস্বর ঝিলিক দিয়ে উঠল।

সেজন্যে নয়? কোঁচকানো ভুরুর নীচে চোখ দুটো তীক্ষ্ণ হয়ে ওঠে মৃগাঙ্কর, তবে কি জন্যে?

ঠুকলে কি রকম লাগে তাই দেখতে।

তা ভাল। বেশ ভালই লাগল, কেমন? ক্ষুব্ধ একটু হেসে চলে গেলেন মৃগাঙ্ক।

সীতুকে কখনো তুমি ছাড়া তুই বলেন না মৃগাঙ্ক। এ এক আশ্চর্য রহস্য! অন্তত চাকর মহলের কাছে।

দুদুটো এত বড় অপরাধ করেও এমনি বা কি শাস্তি পেল সীতু? রহস্য এখানেও।

.

শিউশরণের কাছে নেবাহাদুর গিয়ে গল্প করে কপালে ব্যাণ্ডেজ বাঁধা ছেলে একা শুয়ে আছে, কাছে না মা, না বাপ। ওকে কেউ দেখতে পারে না।

শিউশরণ মন্তব্য করে, ওরকম ছেলেকে যে আছড়ে মেরে ফেলেন না সাহেব এই ঢের! তাদের দেশে হলে ও ছেলেকে বাপ আস্ত রাখত না। সমালোচনা চলতেই থাকে নীচের তলায়। রোজই চলে।

অমন মা বাপের ওই ছেলে! মামাদের মতন হয়েছে বোধ হয়!

কিন্তু মামাই বা কোথা? এই চার পাঁচ বছর রয়েছে তারা, কোনদিন দেখে নি সীতুর মামা বা মাতুলালয় বলে কিছু আছে।

হ্যাঁ, সাহেবের আত্মীয়স্বজন এক আধটা বরং কালেকস্মিনে দেখেছে, কিন্তু মাইজীর? না।

অবশেষে একটা সিদ্ধান্তে পৌঁছয় ওরা–খুব গরীবের মেয়ে বোধ হয় অতসী। তিনকুলে কেউ নেই ওর।

ওদের অনুমান ভুলও নয়। সত্যিই কেউ কোথাও নেই অতসীর। শুধু মানুষের জোর নয়, ভিতরের জোরও বুঝি তেমন করে কোথাও কিছু নেই। তাই সে গৃহিণী হয়েও যেন আশ্রিতা। নিজের ক্ষেত্রটাকে যতদূর সম্ভব সঙ্কুচিত করে নিঃশব্দে থাকতে চায় সে এখানে। সংসারে বামুন মেয়ের একাধিপত্য মেনে নেয় নীরবে। চাকরবাকরকে বকতে পারে না।

মৃগাঙ্ক যতই তাকে অধিকারের সিংহাসনে বসাতে চান, সে অধিকার খাটাবার সাহস হয় না অতসীর।

কিন্তু সীতু যদি এমন না হত? তাহলে কি সহজ হতে পারত অতসী? সহজ অধিকারে গৃহিণীপনা আর স্বামী সন্তানের সেবায় সম্পূর্ণ করে তুলতে পারত নিজেকে?

সীতু যেমন অহরহ নিজেকে প্রশ্ন করে, সেটা কোথায়? সেটা কোথায়? অতসীও তেমনি সহস্রবার নিজেকে ওই প্রশ্ন করেছে, তাহলে কি সহজ হতে পারতাম? তাহলে কি স্বচ্ছন্দ হতে পারতাম? পারতাম স্বামীকে সুখী করতে, আর নিজে সুখী হতে? শুধু সীতু যদি অমন না হত?

ঝাপসা ঝাপসা ছায়া ছায়া যে ছবিটা সীতুকে যখন তখন উদভ্রান্ত করে তোলে, সে ছবিটা কি সত্যিই সীতুর পূর্বজন্মের? সীতু কি জাতিস্মর?

কিন্তু সীতু জাতিস্মর হলে অতসীকেও তো তাই-ই বলতে হয়। অতসীর মনের মধ্যেও যে সেই একটা পূর্বজন্মের ছবি আঁকা আছে। ঝাপসা হয়ে নয়, স্পষ্ট প্রখর হয়ে। সীতুর সেই পূর্বজন্মেও অতসীর ভূমিকা ছিল সীতুর মায়ের।

সংসারের অসংখ্য কাজের চাপে ছেলে সামলাবার সময় ছিল না অতসীর, তাই তাকে একটা উঁচু জানলার ধাপে বসিয়ে রেখে যেত, হয়তো বা হাতে একখানা বিস্কুট দিয়ে, কি কাছে চারটি মুড়কি ছড়িয়ে দিয়ে।

জানলা থেকে নামতে পারত না সীতু, বসে থাকত গলির পথটার দিকে চেয়ে, হয়তো বা এক সময় ঘুমে ঢুলত। খাটতে খাটতে এক একবার উঁকি মেরে দেখতে আসত অতসী, ছেলেটা কোন অবস্থায় আছে। ঢুলছে দেখে ভিজে স্যাৎসেঁতে হাতে টেনে নামিয়ে চৌকিতে শুইয়ে দিত।

মমতায় মন ভরে গেলেই বা ছেলে নিয়ে দুদণ্ড বসে থাকবার সময় কোথা? পাশের ঘরে আর একটা লোক পড়ে আছে আরও অসহায় শিশুর মত। সীতু তবু দাঁড়াতে পারে, হাঁটি হাঁটি পা পা করতেও শিখছে। আর সে লোকটা পৃথিবীর মাটিতে পা ফেলে হাঁটার পালা চুকিয়ে পৃথিবী থেকে বিদায় নেবার দিন গুনছে।

কিন্তু শিশুর মত অসহায় বলে তো আর সে শিশুর মত নিরুপায় নয়? তার মেজাজ আছে, গলার জোর আছে, অধিকারের তেজ আছে, আর কাছে কটুক্তির অক্ষয় তৃণ। তাই তার কাছেই বসে থাকতে হয় অতসীকে অবসরকালটুকু, তার জন্যেই খাটতে হয় উদয়াস্ত। কিন্তু সে খাটুনির শেষ হল কেমন করে?

সীতুর আর অতসীর সেই পূর্বজন্মটা কবে শেষ হল? কোন অনন্ত পথ পার হয়ে আর এক জন্মে এসে পৌঁছল তারা?

জন্মান্তরের মাঝখানে একটা মৃত্যুর ব্যবধান থাকে না? থাকতেই হয় যে! তা ছিলও তো!

যাদের জন্মান্তর ঘটল তাদের? না আর একটা মানুষের মৃত্যুর মূল্যে নতুন জীবনটাকে কিনল তারা?

জন্মান্তর! তা সত্যিই বৈকি। নতুন জীবন! গলিত কীটদষ্ট জীর্ণ একটা জীবনের খোলস ছেড়ে হৃদয় উত্তাপের তাপে ভরা তাজা একটা জীবন!

তবু কেন সীতু জাতিস্মর হল? কেন সে পূর্বজন্মের স্মৃতির ধূসর ছায়াখানাকে টেনে এনে এনে এই নতুন জীবনটাকে ছায়াচ্ছন্ন করে তুলল?

কেন সে ছায়ায় তিনটে মানুষের জীবনের সমস্ত আলো ঢেকে দিতে সুরু করল?

আচ্ছা, ওদের সেই পূর্বজীবনে মৃগাঙ্ক ডাক্তারও ছিলেন না? কী তার ভূমিকা ছিল? শুধু ডাক্তারের?

ভাবতে গিয়ে ভাবতে ভুলে যায় অতসী। মনে পড়ে না, ডাক্তারের ভূমিকাটা গৌণ হয়ে গিয়ে হৃদয়বান বন্ধুর ভূমিকাটায় কবে উত্তীর্ণ হল মৃগাঙ্ক?

তবু!

সর্বাঙ্গে কাটা দিয়ে ওঠে অতসীর, ওই তবুটা ভাবতে গেলেই। কিছুতেই শেষ পর্যন্ত ভাবতে পারে না। ভেবে ঠিক করতে পারে না, যে লোকটা মারা গেল, সে বিনা পয়সার চিকিৎসা উপভোগ করতে করতে শুধু পরমায়ু ফুরোলো বলেই মারা গেল, না পরমায়ু থাকতেও বিনা চিকিৎসায় মারা গেল?

অদ্ভুত এই চিন্তাটার জন্যে নিজের কাছেই নিজে লজ্জায় মাথা হেঁট করে অতসী। বারবার বলতে থাকে, আমি মহাপাপী, আমি মহাপাপী। তবু চিন্তাটা থেকে যায়।

কিন্তু শুধু আত্মনিন্দা করলেই কি জগতের সব সমস্যার মীমাংসা হয়? সমগ্র মানবসমাজ কি আত্মনিন্দায় পশ্চাৎপদ? সভ্যতার বিকাশের সঙ্গে সঙ্গেই তো মানুষ আত্মনিন্দায় পঞ্চমুখ হতে শিখেছে।

তবু মীমাংসা হয়নি। তবু সংশোধন হয়নি মানুষের।

সংশোধনের হাতই বা কোথায়? নিজেই তো মানুষ নিজের কাছে বেহাত। জন্মের আগে নাকি তার বুদ্ধি আর চিন্তার ভাণ্ডারে সঞ্চিত হয়ে থাকে পূর্বজীবনের সংস্কার। আর জন্মের সূচনার সঙ্গে সঙ্গে দেহের ভাণ্ডারে সঞ্চিত হতে থাকে নতুন জীবনের পূর্বপুরুষদের সংস্কার। অস্থিতে মজ্জাতে শিরায় শোণিতে, স্তরে স্তরে সঞ্চিত হতে থাকে শুধু মা বাপের নয়, তিন কুলের দোষ গুণ, মেজাজ, প্রবৃত্তি।

আকৃতি প্রকৃতি দুটোই মানুষের হাতের বাইরে। কেউ যদি ভাবে আপন প্রকৃতিকে আপনি গড়া যায়, সে সেটা ভুল ভাবে। ইচ্ছে থাকলেও গড়া যায় না। বড় জোর কুশ্রীতাকে কিঞ্চিৎ চাপা দেওয়া যায়, রুক্ষতাকে কিঞ্চিৎ মসৃণ করা যায়, এর বেশী কিছু না।

 শিক্ষাদীক্ষা সবই এখানে পরাজিত। শিক্ষাদীক্ষা বড় জোর একটু পালিশ লাগাতে পারে। মানুষের আদিমতার উপর। যার জোরে চালিয়ে যায় মানুষ।

শিশুরা সদ্য, শিশুরা অশিক্ষিত অদীক্ষিত। তাই শিশুরা বন্য, বর্বর আদিম।

.

কিন্তু সীতুর কি এখনো সে শৈশব কাটেনি? সামান্যতম পালিশ পড়বার বয়স কি তার হয়নি? সে কেন এমন বর্বরতা করে?

অতসী যদি তাকে সুশিক্ষা দিতে যায়, অতসীর চোখের সামনে দুই কানে আঙুল ঢুকিয়ে খাড়া দাঁড়িয়ে থাকে সীতু নির্ভয়ে বুকটান করে।

অতসী যদি গায়ের জোরে শাসন করতে যায়, সীতু তাকে আঁচড়ে কামড়ে মেরে বিধ্বস্ত করে দেয়। অতসী যদি অভিমান করে কথা বন্ধ করে, সীতু অক্লেশে সাতদিন মার সঙ্গে কথা না কয়ে থাকে, নিতান্ত প্রয়োজনেও মা বলে ডাকে না।

.

কোন উপায়ে তবে ছেলেকে শোধরাবে অতসী?

অথচ নিরুপায়ের ভূমিকা নিয়ে নিশ্চেষ্ট হয়ে যেতেও তো পারে না। মৃগাঙ্কর যন্ত্রণাটা কি উপেক্ষা করবার?

তাই আবারও ছেলের কাছে গিয়ে বসে। আবারও সহজ সহজ সুরে বলতে চেষ্টা করে, আচ্ছা সীতু, মাঝে মাঝে তোকে কিসে পায় বল তো? ভূতে না ব্রহ্মদৈত্যে?

খুকুকে কেন ফেলে দিয়েছিলি?

জিগ্যেস করেছিল অতসী খুকুর ফুলো কপাল সমতল হয়ে যাবার পর। সীতুর তখনো প্রখর হয়ে রয়েছে ললাট লেখা।

 একবারে উত্তর দেওয়া সীতুর কোষ্ঠীতে নেই, তাই আবারও ওই একই প্রশ্ন করে অতসী। বলে, বকব না মারব না, কিছু শাসন করব না, শুধু বল ফেলে দিলি কেন? তুই তো ওকে কত ভালবাসিস?

খুকু প্রসঙ্গে চোখে জল এসে গেল সীতুর, তবু জোর করে বলল, পাজীটা আমার কাছে আসে কেন? আমার গায়ে হাত দেয় কেন?

ওমা, তা দিলেই বা- অবোধ অজ্ঞান অকপট সরল অতসী, বিস্ময়ের গুড়ো মুখে চোখে মেখে বলে, তুই দাদা হোস, তোকে ভালবাসবে না?

না, বাসবে না। আমার হাত তো লোনা! আমি গায়ে হাত দিলেই তো রোগা হয়ে যাবে ও, অসুখ করবে!

ছি ছি সীতু, এই তুই ভেবে বসে আছিস? ওমা, কি বোকা রে তুই! সব বড়দেরই হাত ওই রকম। বাচ্চারা তো ফুলের মতন, একটুতেই ওদের অসুখ করে, তাই তো সাবধান হন তোর বাবা।

আমিও তো সাবধান হয়েছি। ঠেলে দিয়েছি।

আর তারপর নিজের কপাল দেওয়ালে ঠুকে ঠুকে ঘেঁচেছিস! তোকে নিয়ে যে আমি কি করব! ওঁকে তুই অমন করিস কেন? উনি কি অন্যায় কিছু বলেন? অতসী দম নেয়, কত বাড়ির কর্তারা কত রাগী হয়, কত চেঁচামেচি বকাবকি করে, দেখিস নি তো তুই, তাই একটুতেই অমন করিস। তুই যদি ওঁকে একটু মেনে চলিস, তাহলে তো কিছুই হয় না। বল এবার থেকে ওঁর কথা শুনবি? যা বলবেন তাতেই বিশ্রীপনা করবি না? উনি তোর কি করেছেন? এই যে খুকুকে নিয়ে কাণ্ডটা করলি, কিচ্ছু বকলেন উনি তোকে? বল, বল সত্যি কথাটা?

সীতু মাথা ঝাঁকিয়ে সত্যি কথাটাই বলে, না বকলেও ওঁকে আমার ছাই লাগে।

বেশ, তাহলে এবার থেকে খুব কসে বকতেই বলব!

আট বছরের একটা ছেলের কাছে নীচুর চরম হয় অতসী, হেসে ওঠে কথার সঙ্গে। হেসে হেসে বলে, বলব সীতুবাবু বকুনি খেতেই ভালবাসে, ওকে খুব বকো এবার থেকে।

আর সীতু? সীতু কঠিন গলায় বলে ওঠে, তোমার কথা আমার বিচ্ছিরি লাগছে।

তবু হাল ছাড়ে না অতসী। তবু বলে, সীতু রে, তোর কি উপায় হবে? নরকেও যে জায়গা হবে না তোর! যে ছেলে মা বাপকে এরকম করে, তাকে কি বলে জানিস? মহাপাপী! শেষটায় কিনা মহাপাপী হতে ইচ্ছে তোর?

একটু বুঝি সঙ্কুচিত হয় ছেলে পাপের ভয়ে, নরকের ভয়ে। অতসী সুযোগ বুঝে বলে, দেখছিস তো ওঁর চব্বিশ ঘণ্টা কত খাটুনি! দিনরাত খাটছেন। কেন? টাকা রোজগারের জন্যেই তো? কিন্তু সে টাকা কাদের জন্যে খরচ করছেন উনি? এই আমাদের জন্যে কিনা? সেই মানুষকে যদি তুমি কষ্ট দাও, গুরুজন বলে একটুও না মানো, তাহলে মহাপাপী ছাড়া আর কি বলবে তোমাকে লোকে?

না, সঙ্কুচিত হবার ছেলে নয় সীতু। কথাগুলো যেন বেনা বনে মুক্তো ছড়ানোর মতই হয়। যার উদ্দেশে এত কথা, সে কথাটি পর্যন্ত কয় না, মুখখানা কাঠ করে দাঁড়িয়ে থাকে।

তথাপি অতসী ভাবে একটু বোধ হয় নরম হচ্ছে। যে মনটা মাত্র সাড়ে আটটা বছর পৃথিবীর বোদ জল আলো অন্ধকারের উপসত্ত্ব ভোগ করে সবে শক্ত হতে সুরু করেছে, তাকে আর এতগুলো শক্ত কথায় নরম করতে পারা যাবে না। অতএব আরও এক চাল চালে সে। বলে, ভেবে দেখ দিকিন, তোর জন্যে আমি সুষ্ঠু কত বকুনি খাই! এবার প্রতিজ্ঞা কর, আর কখনো ওঁর অবাধ্য হবি না। উনি যা বলবেন

না, প্রতিজ্ঞা করব না।

না, প্রতিজ্ঞা করবি না? এত বড় সাহস তোর? অতসী ক্ষেপে ওঠে হঠাৎ। ক্ষেপে গিয়ে কোনদিন যা না করে, তাই করে বসে ঠাস করে একটা চড় বসিয়ে দেয় ছেলের গালে।

দাঁতে দাঁত চেপে বলে, অসভ্য জানোয়ার বেইমান!

সমস্ত মুখটা লাল হয়ে ওঠে সীতুর, এ গালের রক্তিমাভা ও গালে ছড়িয়ে পড়ে। তবু উত্তর দেয় না সে। গালে হাতটাও বুলোয় না। এক ঝটকায় মার কাছ থেকে সরে গিয়ে বুনন জানোয়ারের মতই ঘাড় গুঁজে গোঁ গোঁ করে চলে যায়। অতসী চুপ করে চেয়ে থাকে।

মনের মধ্যে মৃগাঙ্কর একদিনের একটা কথা বাজে, একটা বাচ্চা ছেলের কাছে আমরা হেরে গেলাম! আক্ষেপ করে বলেছিলেন মৃগাঙ্ক ডাক্তার।

হার মানবে না প্রতিজ্ঞা করেছিল অতসী, ভেবেছিল সমস্ত চেষ্টা দিয়ে, সমস্ত বুদ্ধি প্রয়োগ করে সীতুকে নরম করবে। মানুষের আদিম কৌশল পাপের ভয় দেখানো, তাও করে দেখবে। ছোট ছেলের মন, নিশ্চয়ই বিচলিত হবে মানুষের চিরকালীন নিয়ন্তা নরকের ভয়ের কাছে।

কিন্তু প্রথম চেষ্টাতেই ব্যর্থতা ক্ষেপিয়ে তুলল অতসীকে। তাই মেরে বসল সীতুকে।

এবার কি তবে মারের পথই ধরতে হবে? নইলে মৃগাঙ্ককে কি করে মুখ দেখাবে অতসী?

.

মৃগাঙ্ক ডাক্তারের বাড়িতে ফালতু কোনও আত্মীয় নেই, সবই মাইনে করা লোক। বামুন মেয়েকে তো অতসীই এসে রেখেছে। তবু অতসীর উপর টেক্কা মারে ওরা কাজে, কথায়।

বিশেষ করে বামুন মেয়ে।

সে ছুটে আসে অতসীর এই নীরবতার মাঝখানে। বলে, ঠিক করেছেন বৌমা, মারধোর করে কি আর ছেলে মানুষ করা যায়? যে দেবতার যে মন্তর! আমি তো কেবলই ভাবি এমন এক বগা জেদি গোঁয়ার ছেলেকে কি করে বৌমা না মেরে থাকে? আপনি রাগই করুন আর ঝালই করুন মা, পষ্ট কথা বলব, এমন ছেলে আমি জন্মে দেখি নি। বাপ বলে কথা, জন্মদাতা পিতা, তাকে কি অগ্যেরাহ্যি! সেদিনকে দেখি বারান্দায় টবে একটা গাছ পুঁতছে ছেলে, কে জানে কি এতটুকু গাছ! বাবু এসে বললেন, কি হচ্ছে? বাগান? বকে নয়, ধমকে নয়, বরং একটু হেসে, ওমা বলব কি, বাপের কথার সঙ্গে সঙ্গে ছেলে গাছটাকে উপড়ে তুলে ছুঁড়ে রাস্তায় ফেলে দিল। আমি তো অবাক। ধন্যি বলি বাবুর সহ্যশক্তি, একটি কথা বললেন না, চলে গেলেন। আমাদের ঘরে হলে বাপ অমন ছেলেকে ধরে আছাড় মারত। শুধু কি ওই একটা? উঠতে বসতে তো বাপকে তুচ্ছতাচ্ছিল্য। শান্তরে বলেছে, পিতা সগগো পিতা ধমমো, সেই পিতাকে এত অমান্যি?

বামুন মেয়ে, তুমি তোমার কাজে যাও। গম্ভীর কণ্ঠে আদেশ দেয় অতসী। অসহ্য লাগছে ওর স্পর্ধা।

বামুন মেয়ে হঠাৎ আদেশে থতমত খেয়ে চলে যায়। কিন্তু অতসী নড়তে পারে না, স্তব্ধ হয়ে চেয়ে থাকে ওর চলে যাওয়া পথের দিকে।

ওর এসব কথার অর্থ কি? এত কথা কেন? এ কি শুধুই বেশি কথা বলার অভ্যাস? না আর কিছু?

.

গালটা জ্বালা করলেও গালে হাত দেবে না সীতু, কাঠ হয়ে বসে থাকবে সেই ওর জানলার ধারে, সংসারের দিকে পিঠ ফিরিয়ে।

এ তো শুধু একটা চড়া নয়, এ বুঝি সীতুর ভবিষ্যতের চেহারার আভাস।

তাহলে অতসীও এবার শাসনের পথ ধরবে। মৃগাঙ্ক ডাক্তারের মন রাখতে তার অনুসরণ করবে। বাপের উপর রাগ ছিল, মায়ের উপর আসছে ঘৃণা। ঘৃণা আসছে ওই বিশ্রী লোকটাকে মা ভয় করে বলে, ভালবাসে বলে।

 সীতুর বয়েস কি মাত্র সাড়ে আট?

এত কথা তবে শিখল কি করে সীতু? কে শেখালো এত প্রখর পাকামি? এই প্যাচালোপাকা বুদ্ধিটা কি তা হলে সীতুর পূর্বজন্মার্জিত?

কে জানে কি!

 সীতু তার ছোট্ট দেহের মধ্যে একটা পরিণত মনকে পুষতে যন্ত্রণাও তো কম পায় না?

আচ্ছা, তবে কি এবার থেকে বাবাকে ভয় করবে সীতু? করবে ভক্তি? মার মত ভালও বাসবে? ভাববে বাবা কত কষ্ট করছেন তাদের জন্যে?

চিন্তার মধ্যেই মন বিদ্রোহ করে ওঠে। বাবাকে সীতু কিছুতেই ভালবাসতে পারবে না, কখনো না। তার জন্যে মায়ের কাছে মার খেতে হলেও না।

অনেকক্ষণ বসে থাকার পর বোধকরি জলতেষ্টা পাওয়ায় উঠল সীতু। উঠে দেখল, সামনেই বারান্দার রেলিঙের তারে বাবার রুমাল দুটো শুকোচ্ছে ক্লীপ আঁটা। বোধহয় মাধব তাড়াতাড়ির দরকারে এখানে শুকোতে গিয়ে গেছে, এইখানটায় একটু বোদ এসে পড়েছে বলে।

রুমাল দুটো ঝুলছে, বাতাসে উড়ছে ফরফর করে, সীতু সেদিকে একটু তাকিয়েই দ্রুত পায়ে এগিয়ে গিয়ে পা উঁচু করে হাত বাড়িয়ে আটকানো ক্লীণ্টা টেনে খুলে নেয়, আর মুহূর্তের মধ্যেই রুমাল দুটো কোথায় ছুটে চলে যায় রাস্তার ওপর দিয়ে উড়তে উড়তে।

ওটা সম্পূর্ণ চোখ ছাড়া হয়ে গেলে সীতুর মুখে ফুটে ওঠে একটা ক্রুর হাসি। দরকারের সময় রুমাল না পেলে বাবা কি রকম রাগ করে সীতুর জানা। লোকানটা যতই তুচ্ছ হোক, বাবার অসুবিধে তো হবে!

অতসী দূর থেকে তাকিয়ে দেখে আড়ষ্ট হয়ে চেয়ে থাকে, ছুটে এসে বকবে এমন সামর্থ্য খুঁজে পায় না মনের মধ্যে।

অনেকক্ষণ পরে আস্তে আস্তে গিয়ে আলমারি থেকে দুখানা ফরসা রুমাল বার করে রেখে : দেয় মৃগাঙ্কর দরকারী জায়গায়।

.

গালের জ্বালাটা যেন একটুখানি জুড়োল। আবার যেন চারিদিকে তাকাতে ইচ্ছে করছে সীতুর। ঠিক হয়েছে, এই একটা উপায় আবিষ্কার করতে পেরেছে সীতু বাবাকে জব্দ করবার। সব সময় সীতুর দিকে কড়া কড়া করে তাকানো, আর ভারী ভারী গলায় বকার শোধ তুলবে সে এবার বাবাকে উৎখাত করে।

আর খুকুটাকে কেবল পাতের খাওয়াবে।

 বাবা জব্দ হচ্ছেন এটা ভেবে ভারি মজা লাগে সীতুর। উপায় উদ্ভাবন করতে হবে জব্দ করার।

.

মোজার তলাটা রক্তে ভেসে গেল।

মোজা ভেদ করে কাঁচের কুচিটা পায়ের চামড়ায় বিধে বসেছে। হীরের মত ঝকঝকে ছোট্ট কোণাচে একটা কুচি।

বাড়িতে কী হচ্ছে কি আজকাল? মৃগাঙ্ক ডাক্তার চেঁচিয়ে ওঠেন, রুগী দেখতে বেরবার মুখে নিজেই রুগী হয়ে। মাধে! নেবাহাদুর!

ছুটে এল ওরা, আর সাহেবের দুরবস্থা দেখে স্তম্ভিত হয়ে গেল। পা থেকে কাঁচের কুচিটা টেনে বার করছেন মৃগাঙ্ক মোজা খুলে, রক্তে ছড়াছড়ি হয়ে যাচ্ছে জায়গাটা।

এইমাত্র জুতো পালিশ করে ঠিক জায়গায় রেখে গেছে মাধব, এর মধ্যে জুতোর মধ্যে কাঁচের টুকরো এল কি করে?

অতসীও এসে অবাক হয়ে যায়–কি করে? কি করে?

কি করে আর! মৃগাঙ্ক তীব্র চীৎকার করে ওঠেন, জুতোর পালিশের বাহার করা হয়েছে, ঠুকে একটু ঝাড়া হয় নি। তুমি শীগগির একটু বোরিক কটন আর ডেটল দাও দিকি! আর এই মেধোটার এ মাসে কদিন কাজ হয়েছে হিসেব করে মিটিয়ে বিদেয় করে দাও।

মেধো অবশ্য কাঁচুমাচু মুখে প্রতিবাদ করে ওঠে, তারস্বরে বোঝাতে থাকে, অন্তত চারবার সে জুতো ঠুকে ঠুকে ঝেড়েছে, কাঁচের কুচি তো দূরের কথা, একদানা বালিও থাকার কথা নয়। কিন্তু মেধোর প্রতিবাদে কে কান দেয়?

মৃগাঙ্ক ডাক্তারের সহ্যশক্তি অগাধ হলেও, এত অগাধ নয় যে চাকরের এতটা অসাবধানতার উপর এতখানি ধৃষ্টতা সহ্য করবেন। তার শেষ কথা আমার সামনে থেকে দূর হয়ে যাক ও!

ডাক্তারের নিজের চিকিৎসা করার সময় নেই। তখুনি উপযুক্ত ব্যবস্থা করে ফের জুতোয় পা গলাতে হয় তাঁকে, মেধো সিঁড়ির কোণে বসে কাঁদছে দেখেও মন নরম হয় না তার।

ফিরে এসে যেন তোমাকে দেখি না বলে চলে যান।

বলনে যতটা জোর ফুটল মৃগাঙ্কর, চলনে ততটা নয়, পা-টা রীতিমত জখম হয়েছে।

কিন্তু কোথা থেকে এল এই তীক্ষ্ণ কোণাচে কাঁচকুচি? মাধবের চোখে অন্নওঠার অশ্রুধারা, অন্যান্যদের চোখে বিস্ময়ের ভীতি, অতসীর চোখে শঙ্কার ধূসর মেঘ।

শুধু অন্তরাল থেকে ছোট একজোড়া চোখ সাফল্যের আনন্দে জ্বলজ্বল করে। ছোট চোখ, ছোট বুদ্ধি, সামান্য অভিজ্ঞতা, তবু ডাক্তারের বাড়ির বাতাসে বুঝি এসব অভিজ্ঞতার বীজ ছড়ানো থাকে।

কাঁচের কুচি ফুটে থাকলে যে বিষাক্ত হয়ে পা ফুলে উঠে বিপদ ডেকে আনতে পারে, একথা এ বাড়ির বাচ্চা ছেলেটাও জানে।

.

টেবিলের ওপর একখানা জার্নাল ছিল, কোথায় গেল অতসী?

রাত্রে অনেক রাত অবধি পড়াশোনা করেন ডাক্তার, করেন শোবার ঘরেই, টেবিল ল্যাম্পের আলোয়। আগে নীচতলায় লাইব্রেরী ঘরে পড়তেন, খুকুটা হওয়ার পর থেকে উঠে আসেন উপরে। খুকুর জন্যে নয়, খুকুর মার জন্যেই।

মেয়ে জন্মাবার পর অনেকদিন ধরে নানা জটিল অসুখের মধ্যে কাটাতে হয়েছে অতসীকে। তখন মৃগাঙ্ক অনেকটা সময় কাছে না থাকলে চলত না।

সেই থেকে রয়ে গেছে অভ্যাসটা। শুতে এসে তাই এই প্রশ্ন।

অতসী বিমূঢ়ের মত এদিক ওদিক তাকায়, ঘরের টেবিল থেকে কোন কিছুই তো নড়ানো হয় নি।

কি হল সেটা? তাতে যে ভীষণ দরকারী একটা আর্টিকেল রয়েছে, আজ রাত্রেই পড়ে রাখব ঠিক করেছি। খোঁজ খোঁজ!

কিন্তু কোথায় খুঁজবে অতসী? অতসীর ঘরটা তো খুঁটে কয়লার ঘর নয়। চাল ডাল মশলার ভাড়ার নয় যে, কিসের তলায় ঢুকে গেছে, হারিয়ে গেছে। ছিমছাম ফিটফাট ঘর, সুতোটি এদিক ওদিক হয় না।

খুঁজে পাওয়া গেল না। কোথাও না।

স্বামীর বিশেষ বিরক্ত হয়ে শুয়ে পড়ার পরও খুঁজতে থাকে অতসী। কিছু পড়াশোনা না করে মৃগাঙ্কর এরকম শুয়ে পড়াটা অস্বাভাবিক।

অবশেষে মৃগাঙ্করই মমতা হল। কাছে ডাকলেন অতসীকে। কোমল স্বরে বললেন, আর বৃথা কষ্ট কোর না, এসো শুয়ে পড়ো। এখুনি তো আবার খুকু জেগে উঠে জ্বালাতন করবে!

মা বাপে বিয়ে দেওয়া, অবলীলায় পাওয়া স্বামী নয়, মৃগাঙ্ক অতসীর ভালবেসে পাওয়া স্বামী। বয়সে অনেকটা তফাৎ সত্ত্বেও প্রাণ ঢেলে ভালবেসেছিল অতসী মৃগাঙ্ককে, শ্রদ্ধা করেছিল ত্রাণকর্তার মত, ভক্তি করেছিল দেবতার মত।

আর মৃগাঙ্ক?

 মৃগাঙ্কও তো কম ভালবাসেন নি, কম করুণা করেন নি, কম স্নেহ সমাদর করেন নি।

তবু কেন ভয় ঘোচ না অতসীর? তবু কেন মৃগাঙ্ক একটু কাছে টেনে কোমল স্বরে কথা বললেই চোখে জল আসে তার?

মা বাপে বিয়ে দেওয়া, অবলীলায় পাওয়া স্বামীর জন্যে বুঝি মনের মধ্যে এমন দায় থাকে না, থাকে না এমন হারাই হারাই ভাব। সেখানে অনেক পেলেও পাওয়ার মধ্যে কৃতজ্ঞতা বোধ রাখতে হয় না, মনকে দিয়ে বলাতে হয় না, তুমি কত দিচ্ছ! তুমি কত মহৎ।

প্রাপ্য পাওনায় আবার কৃতজ্ঞতা বোধ কিসের? অনায়াসলব্ধকে জমার খাতায় টিকিয়ে রাখবার জন্যে আবার আয়াস কিসের? যেখানে আমিই দাতা, আমি দান করছি আমাকে, সমর্পণ করছি আমাকে, উপহার দিচ্ছি আমার আমিটাকে–সেখানে অনন্ত দায়!

যে আমিকে উপহার দিচ্ছি, সমর্পণ করছি, দান করছি, সে আমিকে তো উপহারের যোগ্য সুন্দর করে তুলতে হবে? সমর্পণের যোগ্য নিখুঁত করে সম্পূর্ণতা দিতে হবে? দানের উপযুক্ত মূল্যবান করে গড়তে হবে?

তাই বুঝি সদাই ভয়! তাই বুঝি সব সময় কৃতজ্ঞতা।

 কি হল? কাঁদছ নাকি? কি আশ্চর্য!

অতসী তাড়াতাড়ি চোখ মুছে বলে, তোমার কত অসুবিধে হল! আমার অসাবধানেই তো

আমার অসাবধানেও হতে পারে। আমিই হয়তো আর কোথাও রেখেছি। মিছে নিজেকে দোষী ভাবছ কেন? এটা তোমার একটা মানসিক রোগের মত হয়ে দাঁড়িয়েছে দেখছি।

অতসী কি উত্তর দেবে?

ঘুমিয়ে পড়, মন খারাপ কোর না। তোমার মুখে হাসি দেখবার জন্যেই আমি কিন্তু রাহমুক্ত পূর্ণশশী কদিনই বা দেখতে পেলাম।

নিঃশ্বাস ফেলেন ডাক্তার।

অতসীও নিঃশ্বাস ফেলে ভাবে, সত্যি কদিনই বা? প্রথমটায় তো অদ্ভুত একটা ভয়, অপরিসীম একটা লজ্জা, আর অনেকখানি আড়ষ্টতা।

মৃগাঙ্কর আত্মীয় সমাজ আছে, নিজের পরিত্যক্ত জীবনেতিহাসের গ্লানিকর স্মৃতি আছে, চির অসন্তুষ্টচিত্ত বেয়াড়া আবদেরে সীতু আছে। এ আড়ষ্টতা ঘুচতে সময় লেগেছে। তারপর এল খুকুর সম্ভাবনা। এল আনন্দের জোয়ার, নতুন করে নব মাতৃত্বের সূচনায় উজ্জ্বল হয়ে উঠল অতসী, উঠল উচ্ছল হয়ে। কৃতজ্ঞতা বোধের দৈন্যটাও বুঝি গিয়েছিল, মূল্যবোধ এসেছিল নিজের উপর।

তাই বুঝি নারী মাতৃত্বে মনোহর! সেই গৌরবে রমণী আর শুধু রমণী নয়, রমণীয়। তার প্রতি অণুপরমাণুতে ফুটে ওঠে সেই গৌরবের দীপ্তি। সে দীপ্তি বলে, শুধু তুমিই আমায় অন্ন আর আশ্রয় দাও নি, আমিও তোমায় দিলাম সন্তান আর সার্থকতা।

.

হয়তো সেই গৌরবের আনন্দে ক্রমশ সহজ হয়ে উঠতে পারত অতসী। কিন্তু সীতু বুঝি পণ করেছে অতসীকে সহজ হতে দেবে না, সুখী হতে দেবে না। ওদের বংশধারাতেই বুঝি আছে এই হিংসুটেমি।

হ্যাঁ আছেই তো। তিন পুরুষ ধরে এই হিংসুটেপনা করে ওরা জ্বালাচ্ছে অতসীকে।

সেবার তো অতসীর নিজের ভূমিকা ছিল না কোথাও কোনখানে। সে তো অনায়াসলব্ধ। মা বাপের ঘটিয়ে দেওয়া বিয়ে। ছাঁদনাতলায় প্রথম শুভদৃষ্টি।

শুভদৃষ্টি!

তা তখন তো তাই ভেবেছিল অতসী। সেই দৃষ্টির সময় সমস্তখানি মন একটি শুভলগ্নের আশায় কম্পিত আবেগে থরথর করে উঠেছিল।

কিন্তু সে শুভলগ্ন তেমন করে প্রত্যাশার মুহূর্তে এসে দেখা দিল না। দিতে দিলেন না শশুর। স্বার্থপর বৃদ্ধ, আপন সন্তানের আনন্দ আহ্লাদ সহ্য করবার ক্ষমতাও নেই তার।

নইলে সত্যিই কি সে রাতে হার্টের যন্ত্রণায় মরমর হয়ে পড়েছিলেন তিনি, যে রাতে অতসীর জন্যে এঘরে ফুলের বিছানা পাতা হয়েছিল?

অতসী বিশ্বাস করেনি। করেনি বাড়ির আর সকলের মুখের চেহারা দেখে। বিয়েবাড়িতে ছিল তো কতজনা। সকলের মুখে যেন অবিশ্বাসের ছাপ।

 তবু সকলেই লোক দেখানো আহা উঁহু হায় হায় করেছিল। সকলেই হুমড়ে পড়ে তার ঘরে গিয়ে বসেছিল। তার সঙ্গে বসেছিল নতুন বিয়ের বরও। সমস্ত রাত ঠায় বসেছিল।

হাতে তার তখনও হলুদ মাখানো সুতো বাঁধা, রূপোর জাতিখানা সঙ্গে সঙ্গে ফিরছে তখনও। যেমন ফিরছিল অতসীর হাতে কাজললতা!

স্বামীর মনের ভাব সেদিন বুঝতে পারে নি অতসী। বুঝতে পারে নি সেও তার বাপকে অবিশ্বাস করেছে কিনা।

কিন্তু শুধু সেদিন কেন?

কোনদিনই কি? কোনদিনই কি বুঝতে পেরেছে তাকে অতসী? শুধু তাকে দেখেছে ভেবেছে মানুষ কেন অকারণে রুক্ষ হয়, কেন নিষ্ঠুরতায় আমোদ পায়?

সবাই ওঘরে। শুধু একা অতসী ব্যর্থ ফুলশয্যার ঘরে খালি মাটিতে পড়ে থেকে কাটিয়ে দিয়েছিল।

একবার কি কাজে যেন সে ঘরে এসেছিল বিয়ের বরটা। এসেছিল কি একটা ওষুধ নিতে ব্যস্তভঙ্গীতে। স্তু থমকে দাঁড়িয়েছিল। বলেছিল, এভাবে মাটিতে কেন? বিছানায় উঠে শুলে ভাল হত।

বিছানা মানে সেই বিছানা। যার উপর শিশিখানেক এসেন্স ঢেলে দিয়েছিল কে বা কারা, আর ফুল ছিল অনেক।

তারা হয়তো পাড়ার লোক, নিষ্পর।

ভয়ানক একটা বিস্ময় এসেছিল সেদিন অতসীর।

ভেবেছিল ও কি সত্যিই মনে করেছিল অতসী মাটি থেকে উঠে একা ওই সুরভিসিক্ত রাজকীয় শয্যায় গিয়ে শোবে? এত নীরেট ও, এত ভাবলেশশূন্য?

 আর তা যদি না হয়, শুধু মৌখিক একটু ভদ্রতা মাত্র করতে এল ফুলশয্যার রাতে নব পরিণীতার সঙ্গে? হৃদয়াবেগশূন্য এই সম্ভাষণে?

তবু তখনি মনকে সামলে নিল অতসী। ছি ছি, এ কী ভাবছে সে? বাপের বাড়াবাড়ি অসুখ, এখন কি ও আসবে প্রিয়া সম্ভাষণে? তাহলেই তো বরং ঘৃণা আসত অতসীর।

অতএব ধড়মড় করে উঠে বসে খুব আস্তে বলল, আমি ওঘরে যাব?

তুমি? না, তুমি আর গিয়ে কি করবে? তোমার যাবার কি দরকার? তুমি ঘুমোতে পারো। বলে নিজের প্রয়োজনীয় বস্তু সংগ্রহ করে চলে গেল সে।

কী নীরস সংক্ষিপ্ত নির্দেশ! একটু মিষ্টি করে বলা যেত না?

 তাড়াতাড়ি ভাবল অতসী, ছি ছি, ওর বাবার অসুখ! যায় যায় অবস্থা!

আবার ভাবল, আচ্ছা, হঠাৎ যদি তার কিছু হয়ে যায়! শিউরে উঠল ভাবতে গিয়ে।

তাহলে কী বলবে লোকে অতসীকে? কত অপয়া!

কিন্তু বেশিক্ষণ ভাবতে হল না, ঝি এসে ডাকল, নতুন বৌদিদি, পিসিমা বলছে ওঘরে গিয়ে বসতে। যাও শশুরের পায়ে হাত বুলোও গে যাও। এখন কি হয় কে জানে! ছেলে-অন্ত-প্রাণ তো! যত আবদার ছেলের ওপর। সেই ছেলে হাতছাড়া হয়ে গেল, শোকটা সামলাতে পারছে না মানুষটা।

হাতছাড়া!

অতসীর মনে হল, জীবনে এত দিন যে ভাষায় কথা কয়ে এসেছে সে, শুনেছে যে ভাষায় কথা, শুধু সেইটুকু মাত্রই বাংলা ভাষার পরিধি নয়। এ ভাষা তার কাছে ভয়ঙ্কর রকমের নতুন।

তবু উঠে গেল সেবায় তৎপর হতে। আর গিয়েই প্রথম ধরা পড়ল সেই সন্দেহটা।

না, কিছু হয়নি ভদ্রলোকের। অকারণ কাতরতা দেখিয়ে জড়িয়ে ধরে শুয়ে আছেন বড় ছেলের হাত দুখানা। স্বাভাবিক মুখ, স্বাভাবিক নিঃশ্বাস। যেটা অস্বাভাবিক সেটা চেষ্টাকৃত।

কিন্তু শুধুই কি সেই একদিন? দিনের পর দিন নয়?

মিথ্যা সন্দেহ নয়। সত্যিই রোগের ভান করে রাতের পর রাত ছেলেকে আঁকড়ে বসে রইলেন বৃদ্ধ। ছেলে চোখের আড়াল হলেই নাকি মারা যাবেন তিনি।

যতবারই পিসশাশুড়ি বলেছেন, করাত জাগছে ছেলেটা, এইবার একটু শুতে যাক দাদা? ততবারই বৃদ্ধ ঠিক তন্মুহূর্তেই চেহারায় নাভিশ্বাসের প্রাক্-চেহারা ফুটিয়ে তুলে মুখে ফেনা তুলে মাথা চেলে গোঁ গোঁ করে একাকার করেছেন। গেল গেল রব উঠে গেছে, মুখে গঙ্গাজল, কানে তারকব্রহ্ম নাম! কতক্ষণে একটু সামলানো।

বিয়ের অষ্টাহ এই ভাবেই কেটেছিল।

তা অষ্টাহই বা কেন, যতদিন বেঁচেছিলেন সেই অভিনেতা বৃদ্ধ, ততদিনই প্রায় একই অবস্থায় কেটেছে অতসীর। অনবরত হার্টফেলের ভয় দেখিয়ে দেখিয়ে দীর্ঘ চারটি বছর কাটিয়ে অবশেষে সত্যই একদিন হার্টফেল করলেন তিনি। কিন্তু ততদিনে জীবনের রঙ বিবর্ণ হয়ে এসেছে অতসীর, দিনরাত্রির আবর্তন যেন একটা যন্ত্রের মত হয়ে উঠেছে।

তারপর সীতু কোলে এল। নিষ্প্রাণ যান্ত্রিক জীবনের মাঝখানে নিরুত্তাপ অভ্যর্থনা-হীন সেই অবির্ভাব। দোষও দেওয়া যায় না কাউকে। অভ্যর্থনার পরিবেশও নেই তখন। আচমকা ওপরওলার সঙ্গে খিটিমিটি করে চাকরি ছেড়ে দিয়েছে তখন সেই কাঠগোবিন্দ ধরনের মানুষটা। ছেলের জন্মসংবাদে শুধু মুখটা একটু কুঁচকে বলল, মেয়ে হয়ে এলে নুন খেয়ে খুন হতে হত, সেই ভয়েই বোধকরি ছেলের মূর্তিতে এসেছে।

পিসি সেই সেবার বিয়েতে এসেছিলেন, আবার এসেছেন এই উপলক্ষে। তিনি বললেন, দেখো–ছেলের দিকে ভাল করে তাকিয়ে দেখো যেন সদ্য দাদার মুখ! দাদাই আবার ফিরে এসেছেন রে, বড় আকর্ষণ ছিল তো তোর ওপর!

ঘরের মধ্যে থেকে ভয়ে বুকটা ধড়াস করে উঠেছিল অতসীর। এ কী ভয়ঙ্কর কথা! এ কী সর্বনেশে কথা! যে মানুষটা তার জীবনের রাহু ছিল আবার সে ফিরে এল।

অতসীর ধারণা হয়েছিল প্রথম মিলনের পরম শুভলগ্নটা ব্যর্থ হতেই জীবনটা এমন অভিশপ্ত হয়ে গেছে তার। মন্ত্রের ধ্বনি বাতাসে মিশিয়ে গেছে শক্তিহারা হয়ে, প্রেমের দেবতা প্রতীক্ষা করে হতাশ হয়েই বোধ করি ক্ষিপ্ত হয়ে উঠে যে শর ছুঁড়ে চলে গিয়েছেন, সে শর পঞ্চশরের একটা নয়। আলাদা কিছু!

আলাদা কোন বিষবাণ!

আর এ সমস্তর কারণ একজন নিষ্ঠুর লোকের স্বার্থপরতা!

জীবনের দল ধীরে ধীরে প্রস্ফুটিত হবার সুযোগ পেল না, অবকাশ হল না পরস্পরের মধ্যে কোমল লাবণ্যমণ্ডিত একখানি পরিচয় গড়ে ওঠবার।

তার আগেই বেঁধেবেড়ে স্বামীকে ভাত বেড়ে দিতে হল অতসীকে, কাঁচতে হল তার ছাড়া ধূতি, জুতোয় কালি লাগাতে হল, হল ভাঁড়ারে কি ফুরিয়েছে তার হিসাব জানাতে।

 কিন্তু সুযোগ আর অবকাশ পেলেই কি সেই নিতান্ত বাস্তববুদ্ধিসম্পন্ন নীরস আর বিরস ধরনের মনটা কোমল লাবণ্যে মণ্ডিত হয়ে উঠতে পারত?

 কে জানে পারতো কিনা। কিন্তু এটা দেখা গেল স্বার্থপরতায় আর ফিচলেমিতে সে তার বাপের ওপরে যায়। নিজের ছেলের প্রতিই হিংসেয় কুটিল হয়ে উঠছে সে মুহুর্মুহু। ছেলে কাঁদলেই রুক্ষ গলায় ঘোষণা করবে সে দাও দাও গলাটা টিপে শেষ করে দাও, জন্মের শোধ চীৎকার বন্ধ হোক। ছেলে রাতে জেগে উঠে জ্বালাতন করলে বলতো ভালো এক জ্বালা হয়েছে, সারাদিন খাটব খুটব আর রাতে তোমার সোহগের ছেলের সানাই বাঁশি শুনব। বেরিয়ে যাও বেরিয়ে যাও আপদটাকে নিয়ে। দেব, এবার ঢাকীসুন্ধুই বিসর্জন দেব।

ছেলে নিয়ে ছাতে চলে যেত অতসী, শীতের দিনে হয়তো বা ভাঁড়ারের কোণে।

তা সারাদিনের খাটা খোটার গৌরব বেশিদিন ব্যাখ্যান করতে হল না সেই লোকটাকে, এক দুরারোগ্য ব্যাধি এসে বিছানায় পেড়ে ফেলল তাকে। আর তার এই দুর্ভাগ্যের জন্যে দায়ী করল সে শিশুটাকে। অপয়া লক্ষ্মীছাড়া শিশুটাকে।

ছেলের সঙ্গে রেষারেষি।

অতসীর সাধ্য সামর্থ্য সময় সব নিয়োজিত হোক তার নিজের জন্যে। ওই লক্ষ্মীছাড়াটার কিসের দাবী? বাসনমাজা ঝিটার কাছে পড়ে থাক না ওটা। নয়তো বিলিয়েই দিকগে না ওকে অতসী।

এরপর তো ওই ছেলের হাত ধরে ভিক্ষে করে বেড়াতে হবে! তা আগে থেকেই ভারমুক্ত হওয়া বুদ্ধিমানের কাজ।

নিজে মৃত্যুশয্যায় শুয়ে ছেলের মরণকামনা করেছে লোকটা।

মরে না! আপদটা সরেও না! দেখছি কাঠবেড়ালীর প্রাণ!

রোগবিকৃত মুখটা কুটিল হিংসেয় আরও বিকৃত হয়ে উঠত।

দুরারোগ্য রোগ, এ ঘরে ছেলে নিয়ে শোওয়া চলে না, আর সেই নিতান্ত শিশুটাকে সত্যিই রাতে একা ঘরে ফেলে রেখে দেওয়া যায় না। কিন্তু যে মন কোনদিনই যুক্তিসহ নয়, সে মন ভাগ্যের এই মার খেয়ে কি যুক্তিসহ হবে? বরং আরও অবুঝ গোঁয়ার হয়ে ওঠে। ভাবে, ওই ছেলেটার ছুতো করে অতসী তার হাত থেকে পিছলে পালিয়ে যাচ্ছে।

 জীবন তোগোনাদিনে পড়েছে, ফুরিয়ে আসছে জীবনের ভোগ, হাহাকার করা বুভুক্ষু চিত্ত নিংড়ে নিতে চায় শেষ ভোগরস। যে মানুষগুলো আস্ত দেহ নিয়ে স্বচ্ছন্দে ঘুরে বেড়াচ্ছে, তাদের ছিঁড়ে কুটে ফেলতে পারলে যেন তার আক্রোশ মেটে।

সেই হতভাগা লোকটার মনস্তত্ত্ব তবু বুঝতে পারত অতসী, কিন্তু সীতু কেন এমন? কোন কিছু না বুঝেই, ও কেন এমন হিংস্র?

অন্যকে সুখী আর স্বচ্ছন্দ দেখলেই কি ওদের ভিতরের রক্তধারা শয়তানীর বিষবাষ্পে নীল হয়ে ওঠে?

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *