ষষ্ঠ অধ্যায় —মিথকাহিনী
ওডিনের জ্ঞান আহরণ
ভ্যালহালায় অনেক সেনা এসেছে কিন্তু ওডিনের সর্বসময়ের আশঙ্কা যে যথেষ্ট সেনা যোগাড় করতে ভ্যালকারিদের অনেক সময় লাগবে। ততদিন কি দৈত্যরা অপেক্ষা করবে? এর উত্তর তিনি নিজেও সঠিকভাবে জানেন না। নর্নরা জানলেও তাঁকে জানাবে না। তখন তিনি ঠিক করলেন যতটা সম্ভব সব জ্ঞান জোগাড় করবেন নিজেই। তাঁর আশা যে যথেষ্ট জ্ঞান জোগাড় করতে পারলে তিনি ভবিষ্যত দেখতে পাবেন। তাই বহু অদ্ভুত উপায়ে তিনি জ্ঞান আহরণ করেছেন।
জ্ঞান সংগ্রহ করতে তিনি ছদ্মবেশে য়োটুনহাইমে গিয়েছিলেন। সেখানে বরফ দৈত্যরাজের পুত্রের থেকে তিনি দৈত্যদের জ্ঞান লাভ করেন।
এরপর তিনি মৃতদের জ্ঞান আহরণের জন্য নিজের বর্ণায় নিজের শরীরের একদিক বিদ্ধ করেন। তারপর একটি দড়ি গলায় বেঁধে বিশ্ববৃক্ষ ইগড্রাসিল থেকে ঝুলে থাকেন নয়দিন নয়রাত। সকল অ্যাসিরকে এই নয়দিন তাঁকে কোনোরকম খাদ্য বা পানীয় দিতে মানা করে দিয়েছিলেন। রক্তপাতে এবং অভুক্ত অবস্থায় ওডিন যখন মৃতপ্রায় তখন নিডহগ ড্রাগনের বাসার গভীর থেকে তাঁর কাছে মৃত্যুর রহস্য উদ্ঘাটিত হয়। তারপর নিজেকে মুক্ত করে তিনি গাছ থেকে নেমে আসেন।
তারপর তিনি যান স্প্যাতেলহাইমে। ভ্যালিন হলেন সবথেকে জ্ঞানী ডোয়ার্ফ— তাঁর কাছ থেকে তিনি শিখলেন ডোয়ার্ফদের যা বিশেষ জ্ঞান আছে।
শেষে তিনি ইগড্রাসিলের অপর একটি শিকড়ের কাছে গেলেন, এই শিকড়টি বরফ দৈত্যদের এলাকায় অবস্থিত। সেখানে তিনি মিমিরের দেখা পেলেন। মিমির হলেন একজন দৈত্য, ওডিনের মা বেসলার ভাই, সম্পর্কে ওডিনের মামা। তিনি সমস্ত জীবিত জীবের মধ্যে সবথেকে বেশি জ্ঞানী। ইগড্রাসিলের শিকড় চলে গেছে এক কূপে, সেই কুপে সারাবিশ্বের জ্ঞান সঞ্চিত করা থাকে। মিমির সেই বিরাট কূপ পাহারা দেন। আর রোজ মাত্র এক শিঙা জল পান করেন।
—”মিমির, আপনি সবার থেকে বেশি জ্ঞানী। আপনার কূপ থেকে এক শিঙা জল পান করার অনুমতি দিন দয়া করে।” ওডিন অনুরোধ করলেন।
—”না, একেবারেই অসম্ভব। আমার এই কূপের জলের জ্ঞানই আমার সম্পদ। আমি কাউকে শুধু শুধু এই সম্পদ পাওয়ার অধিকার দিতে অপারগ। যদি কারোর এই জল পান করতে হয়, তাহলে বিনিময়ে তারও একটা মহামূল্যবান সম্পদ আমাকে দিয়ে দিতে হবে।”
ওডিন তখন নিজের পরিচয় দিলেন, বললেন—”আমি ওডিন, অ্যাসগার্ডের সর্বাধিনায়ক। আমি সবকিছু দেখতে পাই। অ্যাসগার্ড আর মিডগার্ডের অধিবাসীদের রক্ষা করা আমার কর্তব্য, সেইজন্য আমি যত পারি তত জ্ঞান সংগ্রহ করছি। আমি এক শিঙা জল পান করতে চাই, তার পরিবর্তে আমি আমার একটি চোখ আপনাকে দিতে পারি।”
—”পরমপিতা ওডিনের একটি চক্ষু আমার কূপের এক শিঙা জলের উপযুক্ত মুল্যই বটে।” এই বলে মিমির এক শিঙা জল তুললেন। ওডিন তাঁর একটা চোখ মিমিরকে দিয়ে সেই কূপের জল পান করলেন। মিমির আর ওডিনের বন্ধুত্ব হল। ওডিন বুঝলেন মিমির দানব হলেও অত্যন্ত জ্ঞানী এবং তিনি অ্যাসগার্ডের ক্ষতি করতে একেবারেই চান না। তখন তিনি মিমিরকে তাঁর পরামর্শদাতার পদ নিতে অনুরোধ করলেন, মিমিরও সাগ্রহে রাজি হলেন।
কয়েকদিন পরেই মিমির ওডিনকে পরামর্শ দিলেন ওডিন যেন ভানির দেবতাদের সঙ্গে বন্ধুত্ব স্থাপন করেন। দানবেরা ক্রমাগত অ্যাসিরদের বিরুদ্ধে বিভিন্ন আক্রমণের পরিকল্পনা করছে। এমন অবস্থায় অ্যাসিরদের যত বেশি সংখ্যক বন্ধু হয় ততই ভালো । ওডিন নিজেও ভানিরদের সম্পর্কে বেশি জানতেন না। শুধু জানতেন, ভানিররা হলেন আরেক গোত্রের দেবতা। তাঁরা ইগড্রাসিলের অন্যদিকে ভ্যানাহাইমে থাকেন। আগে তাঁরা উল্যান্ডে থাকতেন। তাঁরা অ্যাসগার্ডে বা মিডগার্ডে আসেন না— বাতাসে ভেসে থাকেন, মাটিতে পা দেন না। ওডিন বাদে অন্যান্য অ্যাসিররা তাঁদের কথা আগে জানতেনই না, ভানিররাও সম্ভবত অ্যাসিরদের কথা জানতেন না।
ওডিন প্রথমে কয়েকজন দূত পাঠালেন উল্যান্ডে, কিন্তু তাঁরা পৌঁছতেই পারলেন না। তাই বাধ্য হয়ে তাঁরা বাতাসেই চেঁচিয়ে তাঁদের বার্তা শোনালেন। ওডিন এবং অ্যাসিররা ভানিরদের সঙ্গে মৈত্রীচুক্তি করতে আগ্রহী। ভানিরদের তরফে একজন যেন অ্যাসগার্ডে আসেন। কোনো উত্তর এলো না। কিছুদিন পরে গালভেগ নামে একজন নারী অ্যাসগার্ডে এলেন। তিনি অ্যাসিরদের থেকে অল্পই লম্বা, আর অত্যন্ত ফর্সা। শুধু তাঁর চোখ আর চুলই নয়, সারা শরীরও সোনার মত ঝলমলে।
অ্যাসিররা তাঁকে স্বাগত জানালেন। ইগড্রাসিলের কান্ডের চারদিকে এক সুন্দর উদ্যান ছিল, দেবতারা সেখানে বসে দাবা খেলতেন। সেই উদ্যানে গালভেগকেও আমন্ত্রণ জানানো হল আর তিনিও আনন্দের সঙ্গেই যোগদান করলেন। এভাবে বেশ কিছু দিন কেটে গেল। ওডিন লক্ষ্য করলেন, মিডগার্ডে মানবজাতি আর আগের মত আনন্দে থাকছে না। সোনার প্রতি ভালোবাসা তাদের হঠাৎ বেড়ে গেছে। তারা সেই সোনা দিয়ে মুদ্রা বানাচ্ছে—সেই মুদ্রা লুকিয়ে রাখছে। সোনার জন্য ষড়যন্ত্র করছে, প্রতারণা করছে এবং দরকারে হত্যাও করছে একে অপরকে।
এইসব দেখে ওডিন সমস্ত অ্যাসিরকে ভ্যালহালায় ডেকে পাঠালেন এবং গালভেগকে সবার মাঝে দাঁড়াতে বললেন। তারপর সবাইকে উদ্দেশ্য করে বললেন—“দেখ! যেদিন থেকে গালভেগ আমাদের মধ্যে এসেছে সেদিন থেকে মিডগার্ডে পাপ বেড়ে গেছে। দেখতে অত্যন্ত সুন্দরী হলেও এ আসলে এক ছদ্মবেশী জাদুকরী দানবী। মানবজাতির মধ্যে সোনার প্রতি এত আকর্ষণ, পরস্পরের প্রতি এত হিংসা আগে কখনও দেখা যায়নি। মানবজাতির স্বর্ণযুগের অন্ত হয়েছে, এখন তারা সোনার জন্য পরস্পরের সঙ্গে যুদ্ধ করতেও প্রস্তুত। য়োটুনহাইমে বাস করা আমাদের শত্রুরা এটাই তো চেয়েছিল। মানুষের মধ্যে হিংসা জাগিয়ে তুলে তারা নিশ্চয়ই আনন্দ করছে। এ তো তাদেরই বিজয়। তবে গালভেগের সম্পর্কে আমি যা জেনেছি তা তোমাদের জানানো আমার কর্তব্য। আমার ভ্রাতা অ্যাসিরগণ, এবার তোমাদের হাতেই সিদ্ধান্ত, এই শয়তানী জাদুকরী গালভেগ, এই পাপের জননীকে আমরা কি শাস্তি দেব?”
‘মৃত্যুই এর একমাত্র শাস্তি’ সকলে একসঙ্গে বলে উঠলেন। ওডিন একবার হ্যাঁ সূচক ভঙ্গীতে মাথা নাড়ার সঙ্গে সঙ্গে সবাই একসঙ্গে বিভিন্ন অস্ত্র নিয়ে আঘাত করলেন গালভেগকে, কিন্তু সব অস্ত্রই যেন তাকে ভেদ করে বেরিয়ে গেল। গালভেগ তাদের সামনে দাঁড়িয়ে হাসতে লাগল, একটুও আহত না হয়ে। তারপর সকলে মিলে এক বিরাট আগুন জ্বালালেন। সেখানে গালভোগকে ছুঁড়ে ফেলা হল, কিন্তু আগুন নিভে যাওয়ার পর দেখা গেল গালভেগের কিছু হয়নি, বরং সে আগের থেকেও বেশি সুন্দরী আর ফর্সা হয়ে গেছে। পরপর তিনবার আগুনে তাকে ঠেলা দেওয়া হল, কিন্তু তিনবারই সে আরো ফর্সা এবং সুন্দরী হয়ে বেরিয়ে এলো, একটুও আঘাত লাগেনি তার। সকলে হতভম্ব হয়ে গেল।
সে নিশ্চিন্তমনে ভ্যালহালার দরজার দিকে এগোতে লাগল। বেরোনোর আগে বলল—“মানছি আমি মানুষের মধ্যে বিভাজন এনেছি, কিন্তু তোমরা তো দেবতাদের মধ্যে বিভাজন এনেছ। আমি ভানিরদের সংবাদবাহিকা রূপে এসেছিলাম এবং তোমরা আমাকে হত্যা করার চেষ্টা করেছ। আমি এবার ফেরত গিয়ে জানাবো, যে অ্যাসগার্ড কাউকে বিশ্বাস করে না। এখানে একজন অতিথিকে অস্ত্র দিয়ে স্বাগত করা হয়, তার বসার জন্য আগুন দেওয়া হয়। আমার উদ্দেশ্য সাধিত হয়েছে। এবার অ্যাসির এবং ভানিরদের মধ্যে এক ভয়াবহ যুদ্ধ হবে।” একথা বলেই সে অ্যাসগার্ড থেকে মুহূর্তের মধ্যে উধাও হয়ে গেল।
অ্যাসিররা একটি আলোচনা সভা করলেন এর পর। ওডিন জানালেন যে তাঁর সন্দেহ গালভেগ তাঁদের যেমন ঠকিয়েছে, সেভাবেই ভানিরদেরও ঠকাবে, আর তারপর যখন ভানিরদের সঙ্গে তাঁদের যুদ্ধ হবে তখন দানবরা অ্যাসগার্ড জয় করার একটা পথ পাবে।
এই আলোচনা শেষ হওয়ার আগেই, ভানিরদের এক বিশাল সেনাবাহিনী অ্যাসগার্ডে এসে উপস্থিত হল। তারা অ্যাসগার্ডের দেওয়াল ভাঙতে শুরু করল। ওডিন আর তাঁর সেনাবাহিনীও প্রতিরোধের জন্য এগোলেন। ভানিরদের দলপতির দিকে ওডিন বর্শা ছুঁড়লেন, কিন্তু সেই দলপতি উড়ন্ত বর্শাটিই ধরে ফেললেন এবং খুবই বিনয়ের সঙ্গে ওডিনকে ফেরত দিলেন।
“ভানিরদের দলপতি, আপনাকে কী নামে সম্বোধন করব?”— ওডিন জিজ্ঞাসা করলেন।
“আমি নিয়র্ড, ভানাহাইমের সম্রাট।”— দলপতি উত্তর দিলেন। তিনি অত্যন্ত সুন্দর সুপুরুষ, তাঁর শরীর থেকে যেন দ্যুতি বেরোচ্ছে। তিনি বললেন—”আমি রাগ করে এখানে আসিনি, আমাদের সংবাদবাহিকার প্রতি আপনাদের ব্যবহারে খুবই দুঃখিত হয়েছি, সেইজন্যেই এসেছি।”
—“যদি আপনি জাদুকরী গালভেগের কথা বলেন, তাহলে আমি বলতে চাই যে, সে ভানিরদের এবং অ্যাসিরদের দূত হওয়ার যোগ্য নয়। সে অ্যাসির বা ভানির নয়, সে একজন দানবী। সে আসলে অ্যাসির এবং ভানিরদের মধ্যে যুদ্ধ করাতে চায়। সে আপনার এবং আমার প্রজাদের ধ্বংস করতে চায়। আর মিডগার্ডের বসবাসকারীদের মধ্যেও বিভেদ সৃষ্টি করতে চায়, যাতে দানবরা রাজত্ব করতে পারে।” তারপর ওডিন ব্যখ্যা করলেন আসলে কী ঘটনা ঘটেছে, আর নিয়র্ড সব শুনলেন। সব শুনে তিনি তাঁর ঝলমলে তরবারি ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে ওডিনের হাত চেপে ধরে বললেন, “আমাদের মধ্যে শান্তি ফিরে আসুক। ধরিত্রী এবং বায়ুর মধ্যে শান্তি ফিরে আসুক। আমরা দানবদের বিরুদ্ধে এক হয়ে যুদ্ধ করব। আমি আপনার সঙ্গে অনন্ত বন্ধুত্ব করতে চাই, বন্ধুত্বের চুক্তি করা হোক। আপনাদের কয়েকজন অ্যাসির ভানাহাইমে বসবাস করা শুরু করুক, আর কিছু ভানির অ্যাসগার্ডে বসবাস করুক, তাহলে আমাদের বন্ধুত্বের বন্ধন আরো বেশি পোক্ত হবে।”
অ্যাসিররা খুবই আনন্দ প্রকাশ করলেন এই প্রস্তাবে। ওডিনের ভাই হোনির নিজের থেকেই বললেন, তিনি ভানিরদের সঙ্গে গিয়ে থাকবেন ভানাহাইমে। আর নিয়র্ড বললেন—“আমি নিজেই অ্যাসগার্ডে থাকতে আগ্রহী।”
ওডিন মহানন্দে তাঁকে স্বাগত জানালেন। তিনি ঘোষণা করলেন —”নিয়র্ড নিজের নিজের প্রাসাদ বানিয়ে অ্যাসগার্ডে একজন অ্যাসগার্ডিয়ানের মতই থাকতে পারেন, অ্যাসিরদের একজন মন্ত্রণাদাতা হিসাবে রাজসভার আসনও তাঁকে দেওয়া হল।” তারপর মৈত্রীচুক্তি স্থাপন হল। একটি অনুষ্ঠান করা হল যেখানে সকল অ্যাসির এবং সব ভানিররা পারস্পরিক বন্ধুত্ব এবং বিশ্বাস রক্ষা করার শপথ নিলেন এবং এই বন্ধুত্বের নিদর্শন স্বরূপ একটি স্বর্ণপাত্রে সকলে থুতু ফেললেন।
সব চুক্তি হয়ে যাওয়ার পর, ওডিন ভাবলেন যে স্বর্ণপাত্রে এই থুতুগুলি মিশেছে, সেই পাত্রটি অ্যাসির এবং ভানিরদের সবার সমস্ত জ্ঞান ধারণ করে আছে। মিমিরের দেওয়া জ্ঞান ব্যবহার করে তিনি সেই থুতুভর্তি স্বর্ণপাত্র থেকে ভ্যস্যার নামে একজন দেবতার সৃষ্টি করলেন।
এইভাবেই ওডিন বিভিন্ন জায়গা থেকে যতটুকু পেরেছেন জ্ঞান আহরণ করেছেন আজীবন। জ্ঞানের সাহায্যেই সুষ্ঠুভাবে জগতকে নিয়ন্ত্রণ করা এবং ভবিষ্যতদর্শন সম্ভব বলে তিনি মনে করতেন।
কবিদের মদ্য
ওডিনের জাদুতে ভাস্যার একেবারে পুর্ণাঙ্গ পুরুষ রূপে জন্মগ্রহণ করলেন। তাঁর কোনো শিশুকাল ছিল না। ভ্যস্যার সমস্ত অ্যাসির এবং ভানিরদের জ্ঞান পেয়েছেন, তিনি সবথেকে বেশি জ্ঞানী এবং বুদ্ধিমান ছিলেন। তাঁর ব্যবহার ছিল খুবই নম্র। এবং অ্যাসগার্ডে সকলেই তাঁকে অত্যন্ত ভালোবেসে ফেললেন। শুধু তাই নয়, মিডগার্ডেও সকলে তাঁকে ভালোবাসল। কারণ তিনি মানবজাতিকে শেখালেন আদব-কায়দা, বিভিন্ন ধরনের কৌশল, যার সাহায্যে তাদের জীবনধারণ করা অনেক সোজা হয়ে গিয়েছিল। কেউ মনে মনে ডাক পাঠালেই তাঁকে সাহায্য করতে তিনি উপস্থিত হতেন। কিন্তু এইভাবে একদিন তিনি বিপদে পড়ে গেলেন। দুইজন ডোয়ার্ফ সাহায্য চেয়ে ডেকে পাঠাল ভ্যস্যারকে। তাদের নাম ফ্যালার আর গ্যালার। আসলে তাদের উদ্দেশ্য ছিল আলাদা।
তিনি তো কিছুই সন্দেহ না করে তাদের সাহায্য করতে এক অন্ধকার গুহায় উপস্থিত হলেন। সুযোগ পেয়েই তারা তাঁকে হত্যা করল এবং তাঁর সমস্ত রক্ত জমা করল দুটো গামলা আর একটা বিরাট কেটলিতে। তারপর তার সঙ্গে মধু মিশিয়ে এক আশ্চর্য মদ্য প্রস্তুত করল। এই মদ্যের গুণ হল, যে এটা পান করবে, সে কবি এবং জ্ঞানী হবে। তার সঙ্গে তার পর্যবেক্ষণ ক্ষমতাও বেড়ে যাবে কয়েকগুণ।
ডোয়ার্ফরা অবশ্য এই আশ্চর্য মদের কোনো ব্যবহার করল না। পরের দিন দেবতারা যখন ভ্যস্যারের খোঁজ নিতে এলেন, তখন তারা বলল, ভ্যস্যার যখন জানতে পারলেন যে ডোয়ার্ফরা বোকা এবং জ্ঞানহীন তখন তাঁর অত্যধিক জ্ঞানই তাঁকে শ্বাসরূদ্ধ করে দিয়েছিল, তার ফলে তাঁর মৃত্যু হয়। তারা ভ্যস্যারের রক্তহীন দেহ দেবতাদের দান করে দিল যাতে তাঁরা সৎকার করতে পারেন। কিন্তু দেবতারা সৎকার না করে দেহটি রক্ষা করলেন, তাঁদের আশা, ভ্যাসার নিশ্চয়ই একদিন আবার জীবিত হয়ে উঠবেন।
ডোয়ার্ফরা নিজেদের তৈরি এই আশ্চর্য মদ চাখানোর জন্য গিলিং নামে এক দানবকে সস্ত্রীক নিমন্ত্রণ করল। কিন্তু তাঁরা আসার পর তাদের মদ চাখানোর ইচ্ছে একদম চলে গেল। তারা ভাবতে লাগল কীভাবে গিলিং আর তার স্ত্রীকে মদ না দেওয়া যায়। সেইমত ভেবে, গিলিংকে বলল—”প্রাতঃরাশে মাছ লাগবে, চলুন সকলে মিলে মাছ ধরতে যাই।” গিলিং-এর স্ত্রী থেকে গেলেন, গিলিং ডোয়ার্ফদের সঙ্গে মাছ ধরতে গেলেন। কিন্তু ডোয়ার্ফদের মতলব ভালো ছিল না, তারা ইচ্ছে করে গভীর জলের দিকে নৌকা চালাতে থাকল। অনেক পাথর ছিল সেখানে, একটা পাথরের সঙ্গে ধাক্কা লাগে গিলিং নৌকা থেকে ছিটকে জলে পড়ে গেলেন।
—“বাঁচাও, আমি সাঁতার জানি না।” বলে সাহায্যের জন্য অনেক চিৎকার করলেন গিলিং, কিন্তু তাঁর প্রচুর আর্তিতেও ডোয়ার্ফরা কান দিল না, অবশেষে গিলিং জলে ডুবে মারা গেলেন।
ডোয়ার্ফরা নিশ্চিন্তভাবে ভাবে নৌকা নিয়ে ফিরে এলো। গিলিং এর স্ত্রীর প্রশ্নের উত্তরে তারা জানালো গিলিং জলে ডুবে মারা গেছেন। গিলিংএর স্ত্রী হাউহাউ করে উচ্চৈস্বরে বিলাপ করতে লাগলেন। খানিক্ষণ তারা কান্নাকাটি সহ্য করলেও তারপর যখন তাদের কানে তালা ধরে যাওয়ার জোগাড় হল, তখন ডোয়ার্ফরা ঠিক করল, এঁকেও পথ থেকে সরিয়ে দেওয়া হোক। সেইমত ফ্যালার ওঁকে বলল “আপনি যদি আমার সঙ্গে আমাদের গুহার প্রবেশপথে আসেন তাহলে আপনাকে ঠিক সেই জায়গাটা দেখাতে পারব, যেখানে আপনার স্বামীর মৃত্যু হয়েছে।” দানবী তার কথা শুনে গুহার সামনে গিয়ে দেখতে গেলেন, পিছন থেকে ফ্যালার বলল—”আর একটু এগিয়ে গেলেই আপনি আরো ভালো দেখতে পাবেন”, দানবী কিছু সন্দেহ না করেই আরেকটু এগিয়ে যেই গুহার দরজার বাইরে বেরিয়েছে, তখনই গ্যালার গুহার উপর থেকে একটা বড় ভারি পাথরের জাঁতা তাঁর মাথার উপরে ফেলল, সঙ্গে সঙ্গে তাঁর মাথা চূর্ণবিচূর্ণ হয়ে গিয়ে তাঁর মৃত্যু হল।
এবার ওরা বিপদে পড়ে গেল, গ্যালিং-এর স্ত্রীয়ের মৃতদেহকে লুকোনোর আগেই সেখানে হাজির হয়ে গেলেন গিলিং এর পুত্র সুতং। সুতং প্রথমে ডোয়ার্ফদের ধরে ফেললেন, তারপর দুইজনকে বললেন—“তোমরা আমার পিতা-মাতাকে হত্যা করেছ। প্রথম জনকে জল দিয়ে আর দ্বিতীয় জনকে পাথর দিয়ে। যদিও তাঁরা তাড়াতাড়িই মারা গেছেন, বেশি কষ্ট পাননি, কিন্তু আমি তোমাদের চরম শাস্তি দেব। আমিও জল আর পাথর দিয়েই হত্যা করব তোমাদের; কিন্তু সেই হত্যা খুব ধীরে ধীরে কষ্ট দিয়ে দিয়ে করব।” এই বলে তাদের নিয়ে গেলেন সেই নদীতে যেখানে তাঁর পিতার মৃত্যু হয়েছে। একটা বড় পাথরের উপরে দুজনকে শক্ত করে বেঁধে দিয়ে বললেন—”নদীর জোয়ারে এই পাথর ডোবে না, কিন্তু দুসপ্তাহ পরেই আসবে সমুদ্রের জোয়ার। তখন এই পাথর ডুবে যাবে আর তোমাদেরও সলিল সমাধি হবে। কিন্তু ততদিন তোমরা এখানেই বাঁধা থাকবে। মাত্র দুসপ্তাহের খিদে তেষ্টায় তোমরা মরবে না, তবে এই দুসপ্তাহ ধরে খাবার এবং জল ছাড়া ধীরে ধীরে মৃত্যুর এগিয়ে আসা কল্পনা করাই তোমাদের আসল শাস্তি। আমি রোজ দেখতে আসব তোমাদের সর্বনাশ কতদুর এগোল।”
এই বলে ওদের রেখে তিনি চলে গেলেন। অনেক চেষ্টা করল ডোয়ার্ফরা, কিছুতেই পালাতে পারল না। দিনের চড়া রোদে, রাতের কনকনে ঠান্ডায় তারা ওখানেই থাকতে বাধ্য হল, খাবার এবং জল কিছুই পেল না। আর যত দিন যেতে লাগল, জল তত উপরে উঠতে লাগল। এক সপ্তাহ বাদে ডোয়ার্ফরা দেখে জল তাদের হাঁটু পর্যন্ত উঠে এসেছে। এবার তারা সত্যি সত্যি খুব ভয় পেয়ে গেল।
প্রতিদিন সুতং আসতেন এবং তাদের নতুন করে ভয় দেখিয়ে, অপমান করে যেতেন। সেদিন সুতংকে দেখতে পেয়েই ডোয়ার্ফ দুজন আতঙ্কে চিৎকার করতে লাগল —
—“আমাদের বাঁচান, আমরা চিরকাল আপনার দাসত্ব করব।”
—”তোমাদের মত অকর্মার ঢেঁকি দাস আমার চাই না।” সুতং উত্তর দিলেন।
—“আমরা এক পাহাড় সোনা দেব আমাদের জীবনের বদলে”।
-–“সোনা দিয়ে কি হবে? আমার কাছে অনেক অনেক সোনা আছে, আমার আর সোনার দরকার নেই।” সুতং উত্তর দিলেন।
ডোয়ার্ফরা একটু দমে গেলেও আশা ছাড়ল না, তারা সুতংকে আবার লোভ দেখালো।
—“আমরা আপনাকে নানা যন্ত্রপাতি, অস্ত্র ইত্যাদি বানিয়ে দেব।”
সুতং বললেন—”আমার ওইসব কিচ্ছু চাই না। যন্ত্রপাতি, অস্ত্রশস্ত্র পেলেই কাজ করতে হবে। আমি কাজ করতে চাই না, দিনে ভালোমন্দ খাওয়া, মদ্যপান আর রাতে ঘুম, এটুকুই আমার দরকার, আর সেটা আমার যথেষ্ট পরিমানে আছে।”
তখন দুইজন ডোয়ার্ফের মনে একসঙ্গে একই কথা এলো। ফ্যালার চেঁচিয়ে বলল—”হে মহান দানব, আমি আপনাকে এমন এক মদ্য পান করাতে পারি এ জগতে যার জুড়ি নেই। অ্যাসিরদের কাছেও এই মদ্য অলভ্য, আমরা নিশ্চিত ওডিন নিজে এই মদ্যের জন্য অন্য চোখটাও দিয়ে দেবেন।”
—“সেটা কি বস্তু শুনি?” এই প্রথমবার সুতংকে একটু আগ্রহী হতে দেখা যায়। ফ্যালার আর গ্যালারের মনে সামান্য আশার আলো ফুটে উঠলো। তারা দানবের প্রশ্নের উত্তরে জানালো এই বিশেষ মদ্যকে অনুপ্রেরণার মদ্য বলা হয়। এর অসাধারণ স্বাদ জগতের অন্য কোনো মদ্যে নেই। ভ্যস্যারের রক্ত আর মধু মিশিয়ে এই মদ্য প্রস্তুত হয়েছে। এটা খেলে নেশা হবে, কিন্তু নেশা হয়ে কেউ অজ্ঞান হয়ে পড়ে যাবে না, বরং সুললিত ছন্দে গান গাইবে, কবিতা বানাবে। আর এত সুন্দর কথা বলবে যে কেউ সেই কথাকে অগ্রাহ্য করতে পারবে না।”
মদ্যের বর্ণনা শুনে সুতং বেশ আনন্দ পেলেন। বিশেষত অ্যাসিরদের কাছে এই মদ্য নেই, এই তথ্য তাঁকে খুবই আকৃষ্ট করল। তিনি দুই ডোয়ার্ফকে তীরে ফিরিয়ে আনলেন। গুহায় ফিরে কৃতজ্ঞ ডোয়ার্ফরা তাঁকে পুরো তিন পাত্র ভর্তি মদ্য দিয়ে দিল। তিনি সেই মদ্য লুকিয়ে রাখলেন এক পাহাড়ের মধ্যে। পাহাড়ের একদম মাঝে কিছু অংশ খালি করে সেখানে মদ্য রাখা হল, আর চারদিকে শক্ত নিশ্ছিদ্র পাথরের পাহারা থাকল।
এদিকে ওডিন কিন্তু এতসব ঘটনার কিছুই জানতেন না। মিমির তখন হোনিরের সঙ্গে ভ্যানাহাইমে মন্ত্রণাদাতা হিসাবে রয়েছেন। কিন্তু কিছুদিনের মধ্যেই ভানিরদের সঙ্গে মিমিরের অশান্তি শুরু হল। মিমির থাকলে তবেই হোনির খুব সপ্রতিভভাবে নিজের বক্তব্য বলতেন, কিন্তু মিমির সামনে থেকে সরে গেলেই তিনি নিজের বুদ্ধি খাটিয়ে কিছুই উত্তর দিতে পারতেন না, শুধুই বলতেন, “মিমির এসে উত্তর দেবেন।” কয়েকদিন পরে ভানিরদের সন্দেহ হতে লাগল, মিমির নিশ্চয়ই হোনিরের উপরে কোনো জাদু করেছেন। সন্দেহের বশে একদিন মিমিরকে হত্যা করা হল, এবং তাঁর মাথা কেটে ভানিররা ওডিনের কাছে পাঠিয়ে দিলেন।
ওডিন মিমিরের মৃত্যুতে গভীরভাবে শোকাহত হলেন। তিনি ভাবতেই পারেননি এমনটা কখনও হতে পারে। তবু তিনি ভানিরদের প্রতি কোনো প্রতিশোধ নিলেন না, কারণ তাঁর মনে হয়েছিল যে নিশ্চয়ই কিছু ভুলবোঝাবুঝির ফলে মিমিরের মৃত্যু হয়েছে।
তিনি নিজের বিভিন্ন জ্ঞান এবং জাদুবিদ্যা প্রয়োগ করে মিমিরের মাথাকে পচনের হাত থেকে রক্ষা করলেন। তারপর মিমিরের জ্ঞানের কূপের পাড়ে নিজের চোখের পাশে মিমিরের মাথা রেখে দিলেন। কিছু পরেই মিমিরের মাথা চোখ খুললেন এবং ওডিনকে বিভিন্ন বিষয়ে পরামর্শ, জ্ঞান এবং তথ্য দিতে থাকলেন।
মিমিরের এক অদ্ভুত হর্ন বা শিঙা ছিল। এর নাম জ্যালারহর্ন। মিমিরের মাথা ওডিনকে বললেন “এবার এই শিঙা উপযুক্ত কাউকে দেওয়ার সময় হয়েছে। তবে এই শিঙা একবারই বাজানো যাবে, সেদিন সমস্ত দেবতারা, যে যেখানেই থাকুক না কেন জেগে উঠবে এবং যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত হবে। র্যাগনারক বা জগতের শেষের দিন যখন সবাইকে জাগানো দরকার, তখনই, এবং কেবলমাত্র তখনই তুমি এই শিঙা বাজিও।” এই বলে ওডিন শিঙাটি ওডিনকে সমর্পন করলেন। ওডিন অনেক ভেবে শিঙাটি হিমদলকে সমর্পণ করলেন, যাতে শেষের সেদিন হিমদল শিঙাটি বাজিয়ে দেবতাদের জাগিয়ে তুলতে পারেন।
ভ্যস্যারের রক্ত দিয়ে তৈরি বিশেষ মদ্যের কথা ওডিনকে জানালেন মিমির। এছাড়াও জানালেন যে এই মদ্য অবিলম্বে অ্যাসিরদের দখল করা উচিত। সুতং-এর কাছে এই মদ্য আছে বটে, কিন্তু সে এখনো একফোঁটাও চেখে দেখেনি। এই মদ্যকে দেবতারা কিনতে বা দাবী করতে পারবে না। তাহলে সুতং এর ধারণা হবে যে অ্যাসিরদের কাছে এই মদ্য খুবই প্রয়োজনীয়। তাই এই মদ্যকে ছদ্মবেশে জয় করে বা চুরি করে আনতে হবে।
যখন অ্যাসিরদের এই কথা জানালেন ওডিন, তখন কেউই ছদ্মবেশ ধরে চুরি করে আনার জন্য খুব একটা উৎসাহ দেখালেন না। তাই ওডিন ঠিক করলেন তিনি নিজেই গোপনে এই মদ্য চুরি করে নিয়ে আসবেন।
পরের দিন সকালে ওডিন একটা বড় টুপি নিজের ক্ষতিগ্রস্ত চোখের উপর টেনে নিয়ে একজন প্রৌঢ় গরীব কৃষিশ্রমিকের ছদ্মবেশে বেরিয়ে পড়লেন। একসময় তিনি এসে পড়লেন য়োটুনহাইমের সেই জায়গায়, যেখানে সুতং এর ভাই, বাউগি থাকে।
বাউগির অনেক কৃষিজমি ছিল, সেখানে নয়জন দানব কৃষক ফসল কাটার কাজ করছিল। তিনি তাদের জিজ্ঞাসা করলেন, “বাউগির জমিতে কাজ করতে কেমন লাগছে?”
তারা উত্তর দিল—”মন্দ নয়, কিন্তু এত বড়বড় ফসল কাটতে গিয়ে আমাদের কাস্তের ধার বারবার নষ্ট হয়ে যাচ্ছে, তাই আমরা যত তাড়াতাড়ি কাজ সারবো ভেবেছিলাম, সেটা আর হয়ে উঠছে না।”
—“ওহ্! এইটুকু সমস্যা! এর সহজ সমাধান আমার কাছেই আছে।” এই বলে তিনি এক পাথর বের করলেন ট্যাঁক থেকে। সেটা যে সে পাথর নয়, অ্যাসিরদের অস্ত্র ধার করার এক বিশেষ জাদুপাথর। এই পাথরে যে কোনো অস্ত্র খুব সহজে ধারালো ভাবে শান দেওয়া যায়, আর সেই শান চট করে নষ্টও হয় না।
সেই পাথরের কথা তো আর অন্যরা জানে না, ওডিন অনায়াসে নটা কাস্তেকে শান দিয়ে চকচকে করে দিলেন। সেই কাস্তেতে কাজ করে বেশ আরাম। দেখতে দেখতে সেই জমির অর্ধেক ফসল কাটা হয়ে গেল। তখন সেই নয়জন চাষীর একজন এসে ওডিনকে বলল–-“আমি এই শান দেওয়ার পাথরটা কিনতে চাই।” ওমনি আরেকজন বলল “না আমি কিনব! আমার কাছে বেশি পয়সা আছে।” আরেকজন তখন বলল–-“না না, আমি কিনব।” তখন সবার মধ্যে ভারী একটা গোলযোগ শুরু হয়ে গেল। সবাই অন্যকে হারিয়ে পাথরটা হাতানোর জন্য ঝগড়া, ঠেলাঠেলি শুরু করে দিল।
ওডিন খানিক্ষণ মজা দেখলেন, অবশেষে বললেন—”আমি এক হাজার সোনার মুদ্রায় এই পাথর বেচব, তবে যে এটা লুফে নিতে পারবে সেই কিনতে পারবে।” এই বলে তিনি পাথরটা বাতাসে ছুঁড়ে দিলেন। আর নয়জন চাষীই সেটা লুফে নেওয়ার জন্য লাফালো, কিন্তু তারা ভুলে গেছিল সকলের হাতেই প্রচন্ড ধারালো কাস্তে রয়েছে। প্রত্যেকেই অপরের কাস্তেতে কাটা পড়ল। ক্ষেত্রের মধ্যে নয়খানা লাশ পড়ে রইল কেবল। ওডিন নির্বিকারভাবে পাথরটা আবার ট্যাঁকে গুঁজে পথ চলতে শুরু করলেন, এবারের গন্তব্য বাউগির প্রাসাদ।
বাউগির প্রাসাদে এসে, তিনি আশ্রয় চাইলেন। দ্বাররক্ষীরা তো অবাক, একজন সাধারণ মানুষ আশ্রয় চাইছে, প্রাণে কি ভয়ডর নেই? রক্ষীরা তাঁকে বলল—“আমাদের প্রভু বাউগির অনুমতি ছাড়া তোমাকে আশ্রয় দেওয়া যাবে না।” ছদ্মবেশী ওডিন বললেন—”তা বেশ তো, আমাকে তাহলে তোমাদের প্রভুর কাছে নিয়ে চলো।” অগত্যা দ্বাররক্ষকরা তাঁকে বাউগির কাছে নিয়ে গেল। তিনি বাউগিকে বললেন—“আমার নাম বোলভার্কার, আমি
একজন গরীব কৃষিশ্রমিক, অবশ্য কিছু কালাজাদু করার ক্ষমতাও রাখি। আমি আপনার কাছে আশ্রয় চাইতে এসেছি, বিনিময়ে আপনার ক্ষেতের ফসল তুলতে সাহায্য করব।”
বাউগির মেজাজ এমনিতেই খারাপ ছিল, তিনি বললেন—”সে তুমি যাই হও না কেন, একজন মানুষ আমাকে কিছুতেই সাহায্য করতে পারবে না। আমার নয়জন সেরা দানব-কৃষিশ্রমিক আজ কোনো কারণে মারপিট করতে গিয়ে হত হয়েছে। তাতেও আমার কিছু যেত আসত না, যদি তারা ফসল কাটার পরে মারা যেত। কিন্তু এখন আমি যথেষ্ট পরিমাণ লোক কোথায় পাই, আমার ফসল তোলার জন্য! শুধু শুধু আমার ফসলগুলি মাঠেই নষ্ট হবে।”
— “আমাকে নিয়ে ঠাট্টা করার আগে, আমার ক্ষমতা পরখ করে দেখা আপনার উচিত ছিল দানবরাজ। যদি আমি এই নয়জনের কাজ সময়ের আগেই শেষ করে দিতে পারি, তাহলে আমাকে কি পুরষ্কার দেবেন?” ওডিন জিজ্ঞাসা করলেন।
শুনে তো বাউগি আগে খানিক্ষণ পেট চেপে ধরে হো হো করে হাসলেন। তারপর বললেন—“বটে, নয়জন দানব-কৃষকের কাজ তুমি বুড়োমানুষ একাই সময়ের আগে করে ফেলবে? অসম্ভব কথা বলছ হে বুড়ো। তবে যদি তুমি সত্যিই করে ফেলতে পারো, তাহলে তুমি যা চাইবে আমি তোমাকে দিতে রাজী আছি।”
—“বেশ তো, আপনার সকল ফসল আমি এক রাতের মধ্যে তুলে গুদামজাত করে দেব। আপনার দাদা সুতং এর কাছে ভ্যস্যারের রক্ত নামের এক অত্যন্ত উতকৃষ্ট মদ্য আছে শুনেছি। আমার কাজের পরিবর্তে আমি সেটার এক চুমুক পেতে চাই” ওডিন জানালেন।
—“ভ্যস্যারের রক্ত? সুতং আমাকেই একফোঁটা পান করতে দেয়নি। নিজেও পান করেনি। সে আমাকেই একটুও দেবে না, তোমাকে তো দেবেই না।”
—“বটে, আচ্ছা! তাহলে আপনি প্রতিশ্রুতি দিন যে তাঁকে না জানিয়ে আমরা একটু মদ্য চুরি করে খাবো আর সেই কাজে আপনি আমাকে সাহায্য করবেন। আরে আপনার মত মহান, বিরাট, বুদ্ধিমান, শক্তিশালী দানব আর আমার মত দক্ষ জাদুকর মিলে এটুকু পারব না?”
বাউগি নিজের প্রশংসা শুনে একটু যেন গলে গেলেন। “হ্যাঁ! এইটুকু প্রতিশ্রুতি আমি দিতেই পারি”—দানব বললেন।
ব্যাস, ওডিনও আর সময় নষ্ট না করে কাজে লেগে গেলেন।
তিনি প্রথমেই পুরো গমক্ষেতের সব ফসল তুলে নিয়ে এক জায়গায় এসে ঝাড়াই করে খড়গুলি আলাদা করে গুছিয়ে রাখলেন। বড়বড় গোলাঘর বানিয়ে সেখানে গম রাখলেন। তারপর পুরো ভুট্টাখেতের ভুট্টা তুলে ঝাড়াই বাছাই করে আলাদা গোলায় তুলে রাখলেন। এই সব কাজ শেষ করলেন একরাতের মধ্যে। পরদিন সকালে বাউগি এসে ওডিনের কাজ দেখে তো খুব সন্তুষ্ট হলেন।—”আরে তুমি তো আমার প্রিয় সেই নয়জন কৃষকের থেকেও ভালো কাজ করেছ। তোমার যা কাজ তাতে ওই মদ্যের থেকেও ভালো পুরষ্কার তোমার প্রাপ্য হয়।” কিন্তু ওডিন অন্য কোনো পুরস্কার নিতে নারাজ। অগত্যা বাউগি বললেন—”তুমি আমার সঙ্গে চলো সুতং-এর প্রাসাদে, দেখি তাঁর অনুমতি জোগাড় করতে পারি কিনা।
কিন্তু সুতংকে রাজি করা কি অতই সোজা? তিনি তো অনুরোধ শোনা মাত্র নস্যাৎ করে দিলেন।
—“বাউগি তোমার জীবনে বুদ্ধিশুদ্ধি হবে না। আমার গুপ্তচরেরা কি খবর এনেছে জানো? আরে অ্যাসিররা এই মদ্য নিজেদের জন্য চাইছে, আর তুমি কিনা একটা সামান্য কৃষিশ্রমিককে নিয়ে এসেছ এর ভাগ দিতে হবে বলে? এ কী বিশাল কাজ করে ফেলেছে, অ্যাঁ? শুধু তোমার ওই নয়জন কৃষকের থেকে ভালো ফসল কেটে দিয়েছে? আরে এই মদ্য কি যে সে বস্তু? স্বয়ং ওডিন এই মদ্য পাওয়ার জন্য অন্য চোখটা দিয়ে দিতে পারেন। আমি নিজেই এখনও একফোঁটা পান করিনি। বরং একটা পাহাড়ের মধ্যে লুকিয়ে রেখেছি। শুধু তাই নয়, আমার কন্যা গানলড কে পাহারায় বসিয়ে রেখেছি। গভীর অন্ধকারে বন্ধ থেকে এত কষ্ট করছে সে, তা কি একে তাকে দিয়ে নষ্ট করার জন্য? এবার দুইজনেই মানে মানে কেটে পড় দেখি। এখুনি না গেলে আমি এবার তোমাদের রক্ত দিয়ে মদ্য বানাবো আর সেটা পান করতে একমুহূর্ত সময় নষ্ট করব না।”
বাউগি তো সুতং এর উপর রেগে গজগজ করতে করতে প্রাসাদ থেকে বেরিয়ে এলেন। ওডিনকে খেঁকিয়ে বললেন, “দেখলেই তো আমি চেষ্টা করেছিলাম, কিন্তু আমার দাদা একবার যে সিদ্ধান্ত নিয়ে নেন, সেটা থেকে তাঁকে সরানো যায় না। মাঝখান থেকে আমিও বকুনি খেলাম, না না ওই মদ্যের কথা তুমি ভুলে যাও, অন্য কোনো পুরস্কারের কথা বলো।”
—“কিন্তু আপনি আপনার প্রতিশ্রুতির বাকি অর্ধেক ভুলে যাচ্ছেন প্রভু। আপনি কথা দিয়েছিলেন যে আমাকে একচুমুক মদ্য চুরি করতে সাহায্য করবেন।” ওডিন শান্তভাবে মনে করালেন।
—“হ্যাঁ! সেটা আমার মনে আছে। আমি সাহায্য করতেও প্রস্তুত। কিন্তু শুনলেই তো, সুতং পাহাড়ের মধ্যে সব মদ্য লুকিয়ে রেখেছে। শুধু তাই নয়, তার কন্যা গানলড সেখানে পাহারায় আছে। তুমি যদি বুদ্ধি বার করতে পারো, তাহলে আমি তোমাকে সাহায্য করতে পারি।”
—“আচ্ছা, আমি কিছু একটা উপায় ভেবে বার করব। আপাতত যে পাহাড়ে মদ্য লুকোনো আছে, আমাকে সেই পাহাড়ের কাছাকাছি নিয়ে চলুন প্রভু।”
সেই মত পাহাড়ের কাছে গিয়ে বাউগি বললেন—”এই সেই পাহাড়। তবে আমি ভেবে পাচ্ছি না তুমি পাহাড়ের মাঝে পৌঁছবে কি করে?” ওডিন তখন নিজের ঝোলার মধ্যে থেকে একটা ড্রিলের মত যন্ত্র বের করলেন। তারপর বাউগিকে বললেন—“এই যে যন্ত্রটা দেখছেন, এটা দিয়ে পাথরের মধ্যে গর্ত করা যায়। এই যন্ত্রে জাদু করা আছে, যতই গভীর হবে গর্ত, ততই এটা লম্বায় বাড়তে থাকবে। আর ওপারে পৌঁছে একটা ফুটো করতে পারলে
তবেই থামবে। আমি তো সামান্য মানুষ, আমার গায়ের জোর সীমিত, তবে আপনার মত মহান, বিরাট, শক্তিশালী দানব নিশ্চয়ই এই পাহাড় ফুটো করার ক্ষমতা রাখে। এইবার আপনার কথা রাখার পালা, কার্য শুরু করে দিন প্রভু।”
বাউগি প্রথমে মহান দানব ইত্যাদি শুনে বেশ উৎসাহিত হয়ে কাজ শুরু করলেন, কিন্তু বেশ কিছুক্ষণ পরে ক্লান্ত হয়ে পড়লেন, তিনি বললেন—”এত সরু গর্ত করে কি লাভ হবে? যদিও আমার মাথায় ঢুকছে না, তবু তুমি দেখে নাও হয়ে গেছে গর্ত।”
নিশ্চিত হওয়ার জন্য ওডিন গর্ততে ফুঁ দিলেন, খানিকটা পাথরের গুঁড়ো ছিটকে এলো। তিনি বিনীতভাবে কিন্তু জোর দিয়ে বললেন—”বাউগি প্রভু, আমি আপনাকে এত সাহায্য করেছি, তারপরেও আপনি আমাকে ঠকানোর কথা ভাবতে পারছেন? এই দেওয়াল মোটেই পুরো ফুটো হয়নি।”
ঠকানোর কথায় অপমানিত হয়ে বাউগি মহা চটে গিয়ে দ্বিগুণ জোরে গর্ত করতে লাগলেন, এবার একেবারে অন্যদিকে ফুটো করে তবেই থামলেন। ওডিন এবারে ফুঁ দিয়ে দেখলেন, যে আর কোনো ধুলো ছিটকে বেরিয়ে এলো না, তারমানে ওইদিকে একটা গর্ত হয়েছে।
এবার আপনি এখানে পাহারা দিন, বলে ওডিন নিজেকে একটা সাপ বানিয়ে ফেলে সেই গর্তের মধ্যে ঢুকে পড়লেন।
বাউগি তো ওডিনকে সাপ হতে দেখে চমকে গেছেন। ভাবলেন, সুতং ঠিকই বলেছিল, এ নিশ্চয়ই অ্যাসিরদের পাঠানো কোনো চোর অথবা নিজেই একজন অ্যাসির। তিনি ওডিনকে ওই ড্রিল যন্ত্রটাই ছুঁড়ে মারলেন, কিন্তু গর্তে ঢোকার পরেই ওডিন একটি পোকার রূপ ধরেছেন, তাই যন্ত্রটা তাঁর কান ঘেঁষে বেরিয়ে গেল, কোনো ক্ষতিই করতে পারল না। তখন বাউগি দাদার কাছে কিরকম বকুনিটা খাবেন সেটা ভাবতে ভাবতে পালিয়ে গেলেন।
ইতিমধ্যে ওডিন তো সুতং এর ধনভাণ্ডারে পৌঁছে গেছেন, তিনি খুব সুদর্শন এক যুবক দানবের ছদ্মবেশ ধরলেন। সুতং এর সুন্দরী কন্যা গানলড হঠাৎ ওঁকে দেখে অবাক হয়ে গেলেন। তিনি একা একা অন্ধকারে বসে বসে বিরক্ত হয়ে গিয়েছিলেন, ওঁকে বললেন—”যুবক, আপনি নিশ্চয়ই জাদুবিদ্যার সাহায্যে এখানে আসতে পেরেছেন, কারণ এখানে আসার অন্য কোনো পথ নেই। আর আপনি নিশ্চয়ই ভ্যস্যারের রক্ত নামের মদ পান করতে এসেছেন। আমার পিতাকে জানানো উচিত আমার, কিন্তু আমি এই অন্ধকারে থাকতে থাকতে এত বিরক্ত হয়ে গেছি যে আমি কিছুই জানাবো না। আর আপনি যদি আমাকে চুম্বন করতে রাজি থাকেন, তাহলে আমি আপনাকে এক চুমুক মদ্য পান করার অনুমতিও দেব।”
ওডিন তখন গানলডকে চুম্বন করলেন। গানলড খুশি হয়ে একটি পাত্র খুলে দিলেন, এবং ওডিনকে বললেন—“এখান থেকে আপনি মদ্য সেবন করতে পারেন, কিন্তু শুধুই এক চুমুক।” ওডিন তখন তাঁর জাদুবিদ্যার সাহায্যে এক চুমুকে পুরো পাত্রের মদ শেষ করে দিলেন।
মুগ্ধ নয়নে চেয়ে গানলড বললেন—”আপনার তৃষ্ণাও আপনার মত সুবিশাল।” ওডিন আরেকবার গানলডকে চুম্বন করলেন, তারপর আরেক পাত্র মদ্য সেবন করে ফেললেন।
নিজের মুগ্ধতা সংবরণ করা আর সম্ভব হল না গানলডের পক্ষে, তিনি ওডিনকে বললেন “হে সুদর্শন যুবক, আমাকে বিবাহ করুন, তাহলে আমি আপনাকে সবথেকে ভালো মদ্যটি পান করাবো।” গানলড আর ওডিনের বিবাহ হল সেই অন্ধকারেই, তারপর কেটলির পুরো মদ্যও গলাধঃকরণ করলেন ওডিন। কিন্তু ততক্ষণে তাঁর পেট ফুলে গেছে, তিনি হাঁসফাঁস করছেন।
গানলড ব্যগ্র হয়ে জিজ্ঞাসা করলেন—“আপনার কি প্রয়োজন স্বামী?”
ওডিন বললেন—”আকাশ, একটু আকাশ দেখতে চাই।”
গানলড তখন একটা গোপন বোতাম টিপে পাহাড়ের উপরের একমাত্র প্রবেশদ্বারটি উন্মোচন করলেন, একফালি আকাশ দেখা গেল। ওডিন সঙ্গে সঙ্গে আর সময় না নষ্ট করে এক বিরাট সোনালী ঈগলের বেশ ধরে উড়ে পালালেন।
এতক্ষণে গানলড বুঝতে পারলেন, তাঁর সঙ্গে ছল করা হয়েছে। তাঁর চিৎকারে সুতং ছুটে এলেন। তারপরে তিনিও এক ঈগলের বেশ ধরে তাড়া করলেন ওডিনকে।
ওডিন অভিযানে বেরোনোর আগেই কিছু নির্দেশ দিয়ে গেছিলেন আসিরদের। সেইমত, তাঁরা তিনটে বড় সোনার পাত্র নিয়ে অপেক্ষা করছিলেন আসগার্ডের পাঁচিলের পাশেই। উল্লার তীরধনুক এবং বাকিরা খোলা তরবারি হাতে ওডিনের অপেক্ষা করছিলেন।
আচমকা দেবতারা দূরে দেখলেন এক সোনালি ঈগল যত দ্রুত সম্ভব উড়ে আসছে, আর তাকে ধাওয়া করছে এক বিশাল কালো ঈগল। আসগার্ডের মাটি স্পর্শ করল সোনালী ঈগল, পরমুহূর্তেই দেখা গেল সেখানে ওডিন দাঁড়িয়ে, আর তিনটে পাত্রে তিনি ভ্যস্যারের রক্ত দিয়ে তৈরি মদ্য উগরে দিলেন।
কিন্তু ততক্ষণে কালো ঈগলের বেশে সুতং-ও এসে পড়েছেন অ্যাসগার্ডের সীমানার কাছে। উল্লারের তীর ছুটে গেল তাঁর দিকে, সঙ্গে সঙ্গেই কালো রাত কেটে গিয়ে সুর্যের আলোর প্রথম রশ্মি স্পর্শ করল সুতং কে। একটা ভারী পাথরের মত সুতং পড়ে গেলেন। সুর্যের আলোতে দানবরা পাষাণ হয়ে যান। মিডগার্ডে পড়ে টুকরো টুকরো হয়ে গেলেন তিনি।
সকলে উল্লাসে চিৎকার করে উঠলেন, কিন্তু ওডিনের মুখ গম্ভীর। তিনি বললেন—”এই মদ্য আমি পান করেছি, কিন্তু তা সত্বেও আমি ভবিষ্যত দেখতে পাইনি। তবে এটুকু জেনেছি যে আমি এই মদ্য ফিরিয়ে আনার জন্য একাধিক পাপ করেছি। আমি মদ্য চুরি করেছি, সুন্দরী দানবকন্যা গানলডের সরল বিশ্বাসের সঙ্গে ছল করেছি, এইভাবে আসগার্ডের পুণ্য ভুমিতে পাপ প্রবেশ করেছে। এই পাপকে গালভেগের মত সহজেই আমরা বিতাড়িত করতে পারব না। এই পাপের শাস্তি হিসাবে ভবিষ্যতে কেউ আমাদের সঙ্গে চরম বিশ্বাসঘাতকতা করবে। মিমির বা আমি কেউই জানি না কে, কিন্তু কেউ একজন করবে। সে আমাদের নিজেদের মধ্যেই একজন হবে এইটুকুই কেবল আমি জানি।”
ভ্যস্যারের রক্তের মদ্য কোনো দেবতাই পান করলেন না। সেটা মিডগার্ডের মানুষদের জন্য রাখা হল। কিছু কিছু মানুষকে এই মদ্য দেওয়া হয়, যারা খুব সুন্দর কবিতা লেখেন বা গল্প রচনা করেন বা সুন্দর কথা বলেন।
ইডুনার আপেল
পরের বছর গ্রীষ্মকালে এক নৌকা এসে ভিড়ল আসগার্ডের সমুদ্রের তীরে। সেই নৌকায় বসে হার্প বাজিয়ে গান গাইছিলেন এক সুন্দর যুবক। তীরে নেমে তিনি আসগার্ডের দিকে আসতে লাগলেন। যেখানে যেখানে তাঁর পা পড়ছিল সেখানে সবুজ ঘাস গজিয়ে উঠছিল, তিনি এগিয়ে গেলে সেই ঘাসে ফুটে উঠছিল ফুল। পাখিরা গান গাইছিল, খরগোশ আর কাঠবিড়ালীরা নির্ভয়ে তার চারদিকে নেচে গেয়ে বেড়াচ্ছিল। এই অসাধারণ দৃশ্য দেখতে অনেকে জড়ো হলেন তাঁর আশেপাশে।
যখন তিনি আসগার্ডের কাছে এসে পড়লেন তখন বাকিরাও কেউ আর সেই অপুর্ব গান অগ্রাহ্য করতে পারলেন না, সকলে ছুটে ছুটে এলেন সেই গান শুনতে। এমন সময় এক আশ্চর্য ঘটনা ঘটল। এক জায়গায় গায়ক দাঁড়াতেই তার সামনের মাটি ফেটে গিয়ে সেখান থেকে এক অত্যন্ত সুন্দরী রমণী বেরিয়ে এলেন, তাঁর রূপের ছটায় যেন চারদিক আলো হয়ে গেল। সেই নারীর হাতে একটি ঢাকা দেওয়া সোনালি ঝুড়ি ছিল। গায়ক যেন তাঁরই অপেক্ষা করছিলেন। তিনি গাইতে গাইতেই হাত বাড়িয়ে দিলেন, সুন্দরী তাঁর হাত ধরে এগিয়ে গেলেন।
বাইফ্রস্টের সামনে গিয়ে গায়ক চিৎকার করে বললেন “আপনাদের সকলকে অভিননন্দন জানাই, আমার নাম ব্র্যাগি। আমি য়োটুনহাইমে জন্মগ্রহণ করেছি, কিন্তু আমি আপনাদেরই একজন। আমার মা হলেন দানবসুন্দরী গানলড, আর আমার পিতা হলেন স্বয়ং ওডিন। সুতং-এর ধনাগারে আমার পিতা আর মাতার বিবাহ হয়েছিল। আমার শরীরে ভ্যস্যারের রক্ত বইছে, আর সম্ভবত সেইজন্যেই আমি গানে এবং নাটকে পারদর্শী। য়োটুনহাইমে আমার স্থান নেই, তাই আমি আপনাদের কাছে আশ্রয়ের প্রত্যাশী।”
সকলের মত ওডিন এবং ফ্রিগও তখন অ্যাসির দর্শকদের দলে যোগ দিয়েছেন। ব্র্যাগির কথা শুনে ওডিন মৃদু হেসে বললেন—“আমি আগেই জানতে পেরেছি যে তুমি জন্মগ্রহণ করেছ, এবং তুমি শীঘ্রই এখানে আসবে। তোমার আসা যে অ্যাসিরদের পক্ষে পরম আনন্দদায়ক হবে, সেই সংবাদও আমার জানা আছে।”
—“আপনাদের কাছে আমি স্বাগত জেনে আমিও খুবই আনন্দিত।” এই বলে ব্র্যাগি তাঁর সঙ্গিনীর দিকে নির্দেশ করলেন, —”ইনি আমার বাগদত্তা, সুন্দরী ইডুনা, ইনি ইভাল্ডি নামক ভুমিডোয়ার্ফের কন্যা।”
ওডিন তাঁকেও সাদরে স্বাগতম জানালেন। তারপর জিজ্ঞাসা করলেন—–”আপনার সোনার বাক্সে কী আছে দেবী ইডুনা?”
ঝর্ণার মত রিনিঝিনি কন্ঠে ইডুনা উত্তর দিলেন—”আমার কাছে যৌবনের আপেল আছে। এই আপেল যিনি নিয়মিত খাবেন, তাঁর বয়স বাড়বে না। তিনি তাঁর যৌবন ধরে রাখতে পারবেন অনন্তকাল। তাঁর শক্তির একটুও ক্ষয় হবে না।”
ওডিন শুনে এত খুশি হলেন যে আনন্দ ধরে রাখার উপায় পাচ্ছিলেন না। তিনি বললেন—”এই আপেল আমাদের শক্তিকে সংরক্ষণ করতে সাহায্য করবে, এই আপেল খেয়ে আমাদের জরা গ্রাস করবে না, আর আমরা আমাদের সব শক্তি দিয়ে দানবদের আক্রমণ করতে পারব। আপনাকে অনেক অনেক ধন্যবাদ দেবী। এই আপেল সত্যিকারের বড় উপহার।”
তিনি ঘোষণা করলেন—“আজ থেকে ব্র্যাগি হলেন গান এবং সঙ্গীতের দেবতা আর তাঁর বাগদত্তা ইডুনা হলেন যৌবনের দেবী।” তারপর ব্র্যাগিকে বললেন—”আজ রাতেই তোমাদের বিবাহ সম্পন্ন হবে, আর এত বড় নৈশভোজ হবে যেমনটা আগে কেউ কখনো দেখেনি।”
সেদিন রাতেই তাদের বিবাহ হল এবং তারপর তাঁরা অ্যাসগার্ডেই থেকে গেলেন। নৈশভোজ শেষ হওয়ার পর ইডুনা প্রত্যেক অ্যাসির এবং ভানিরকে একটি করে আপেল দিলেন।
আশ্চর্যের ব্যাপার তারপরেও তাঁর সোনার ঝুড়িটি আপেল ভর্তিই থাকল।
যখন দানবেরা ঘটনার খবর পেল, তখন তারা অনেক চেষ্টা করল আপেল জোগাড় করার কিন্তু কিছুতেই পারল না। কারণ তারা অ্যাসগার্ডে আসতে পারত না, আর ইডুনা কখনো আপেলগুলি নিয়ে অ্যাসগার্ডের বাইরে যেতেন না।
ওডিন মাঝেমধ্যেই সাধারণ মানুষের ছদ্মবেশে মিডগার্ডে ঘুরে বেড়াতেন। মানুষের আনন্দ, দুঃখ, কাজকর্ম সবই তিনি এভাবে লক্ষ রাখতেন। এমনই একবার ওডিন মিডগার্ডে ঘুরে বেড়াচ্ছিলেন, এবার তিনি আর একা নন, ভ্যানাহাইম থেকে ভ্রাতা হোনিরও এসেছেন তাঁকে সঙ্গ দিতে।
তাঁরা যখন পদব্রজে বিশাল মাঠ পেরিয়ে এক পাইনবন পার করছেন, তখন এক যুবক এসে তাঁদের সঙ্গে দেখা করলেন। এই যুবক খুবই সুপুরুষ, তবে তাঁর সবুজ চোখদুটিতে যেন দুষ্টুমি চমকাচ্ছে।
“ওডিন এবং হোনির, অ্যাসিরদের নেতা, বোর এবং বেসলার পুত্রদ্বয়, আমার অভিবাদন গ্রহণ করুন।”
তাঁদের ছদ্মবেশ ধরা পড়ে গেছে দেখে ওডিন একটু বিরক্তই হলেন। জিজ্ঞাসা করলেন—”হে যুবক আপনি কীভাবে আমাদের পরিচয় জানলেন? এ কি দানবদের কোনো নতুন জাদু?”
“নাহ্, এতে কোনো জাদু নেই। আমার নাম লোকি, আর আমি আপনাদের আত্মীয়। আমার শিরায় দানবদের রক্ত বইছে এটা সত্যি কথা, কিন্তু সেটা তো আপনাদের শিরাতেও বইছে। বেসলার কাকা বারগেলমির হলেন আমার ঠাকুর্দা। আমার পিতার নাম ফারবৌটি, মায়ের নাম লফি। দানবদের সঙ্গে আমার খুব একটা মিল নেই। ওরা বিশাল এবং বোকা। আপনাদের কাছে আমার বিনীত অনুরোধ হল, দয়া করে আমাকেও আপনাদের সঙ্গে ঘুরে বেড়ানোর অনুমতি দিন। আমিও আপনাদের সঙ্গে ক্ষতিকর দানবদের মোকাবিলা করতে চাই।”
ওডিন এবং হোনির নিমরাজী হলেন। ভাবটা এই— দেখাই যাক এর কত ক্ষমতা। কিন্তু পথ চলতে চলতেই লোকি বহুবার প্রমাণ করলেন যে তিনি অ্যাসগার্ডের উপযুক্ত, তাঁর উপস্থিতবুদ্ধি আর চালাকি বহুবার অ্যাসিরদের সাহায্য করল যাত্রাপথে। কোনোরকম বিপদ এলেও তাঁর কাছে সবসময় কিছু একটা উপায় থাকে বিপদ থেকে বেরিয়ে যাওয়ার। আর ওডিনের মত তাঁরও নিজের আকার প্রকার ইচ্ছেমত পরিবর্তন করার ক্ষমতা ছিল।
কিছুদিন পরেই অবশ্য লোকির সঙ্গে দেখা হল তাঁর বেশী চালাক একজনের। ভ্রমণের সময় একদিন তাঁদের রাত্রের খাবার প্রায় শেষ, খিদেতে পেট জ্বলে যাচ্ছে। তাঁরা একটা জায়গায় এসে পৌঁছলেন যেখানে একদল ষাঁড় চরে বেড়াচ্ছিল। একটা ষাঁড়কে তাঁরা ধরে জবাই করলেন। লোকি সেই ষাঁড়কে রোস্ট করার জন্য আগুন জ্বাললেন—তাঁর পেটে তখন গনগন করছে খিদের আগুন। একটা আস্ত ষাঁড়ের রোস্ট তিনজনে মিলে ভোজন করলে তবেই সবার পেট ভরবে মনেহয়।
তিনি তো বেশ করে ষাঁড়ের রোস্ট বানাতে শুরু করলেন। বেশ অনেকক্ষণ রান্নার পর তিনি ভাবলেন এবার রোস্ট হয়ে গেছে। ছুরি নিয়ে একটা বড় টুকরো কাটতে গিয়ে অবাক হয়ে দেখলেন, ষাঁড়টা এখনো কাঁচা আছে। অগত্যা আবার তেড়েফুঁড়ে আগুন জ্বালিয়ে ষাঁড় রোস্ট করলেন আধঘন্টা ধরে। কিন্তু তখনো মাংস এতটাই কাঁচা যেন সদ্য আগুনে দেওয়া হয়েছে। নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে না পেরে লোকি ওডিন আর হোনিরকে পরীক্ষা করে দেখতে বললেন। তাঁরাও বললেন যে মাংস একেবারেই কাঁচা। স্বাভাবিকভাবে এমন হওয়া সম্ভব নয়। “এখানে নিশ্চয়ই কোনো কালোজাদু আছে”—ওডিন বললেন।
এমন সময়ে যে বিশাল গাছের নিচে তাঁরা বসেছিলেন, সেখান থেকে অট্টহাসির আওয়াজ ভেসে এল। সঙ্গে এক আওয়াজ “আমার সাহায্য ছাড়া জন্মেও ওই মাংস তোমরা রেঁধে উঠতে পারবে না।”
তিনজনেই একসঙ্গে উপরের দিকে চাইলেন। সেখানে এক বিরাট ঈগলপাখি বসে আছে, সে-ই এই কথা বলেছে।
তিনজনেই অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকলেন। তবে লোকি বেশিক্ষণ অবাক হয়ে থাকতে পারেন না। তাই সবার আগে স্বাভাবিক হয়ে কথা বললেন তিনিই
—“তাহলে ভাই তুমিই আমাদের সাহায্য করে দাও।”
—“আমি সাহায্য করতে পারি, যদি তোমরা কথা দাও যে রান্নার পর প্রথমে আমি যতটা খাবো সবটা নিয়ে নেব, তারপর তোমরা শুরু করবে।” ঈগল সঙ্গে সঙ্গে উত্তর দিল।
অন্য কোনো উপায় নেই, খিদেয় প্রাণ ওষ্ঠাগত, অগত্যা সকলে রাজী হলেন। ঈগল তখন ডানার হাওয়া দিয়ে আগুনকে শতগুণ জোরদার করে তুললেন, সেই আগুনে অবশেষে রান্না শেষ হল।
ঈগল বলল—”এবার আমার ভাগ আগে আমি নিয়ে নিই। বলে ষাঁড়ের বেশিরভাগ অংশই নিয়ে নিলো নিজের ভাগে।
লোকি রেগে উঠে বললেন—”আরে তুমি তো বেশিরভাগটাই নিয়ে নিয়েছ, আমাদের তিনজনের জন্য প্রায় কিছুই পড়ে নেই, যেটুকু আছে, সেটা আমি নিজেই শেষ করে দিতে পারি।”
ঈগল লোকির কথায় এক্কেবারে পাত্তা না দিয়ে ষাঁড়ের কোন ঠ্যাং আগে খাবে সেই নিয়ে হিসাব কষতে লাগল।
এবার লোকি প্রবল রেগে গেলেন। খিদের সময়ে ইয়ার্কি কারই বা ভালোলাগে? গাছের একটা ডাল কাছেই পড়ে ছিল, সেটা দিয়ে ঈগলের পিঠে লাগালেন এক ঘা। বললেন—”আমাদের কিছু মাংস ফেরত দাও, অত লোভ তোমার শরীরের পক্ষে ভালো না।”
সঙ্গে সঙ্গে ঈগল উড়তে শুরু করল। যে ডাল দিয়ে লোকি ঈগলকে পিটতে গেছিলেন, সেই ডালটা ঈগলের পালকের সঙ্গে আটকে গিয়েছিল, আর লোকি ডালের সঙ্গে আটকে গিয়েছিলেন। ফলে অনেক চেষ্টাতেও না ডাল ছাড়ল, না লোকি ছাড়াতে পারলেন নিজেকে। ঈগলের সঙ্গে লোকিও উড়ে চললেন।
ঈগল উড়ে উড়ে পার্বত্য এলাকায় এলো, খুব নিচে দিয়ে ওড়া শুরু করল। লোকি বেচারা, যত রাজ্যের পাথর, কাঁটা-ঝোপ আর পাহাড়ে ঠোকা খেতে খেতে চললেন। একটা সময় তাঁর মনে হতে লাগল যে কোনো সময় তাঁর হাতদুটো শরীর থেকে খুলে যাবে।
লোকি নিরুপায় হয়ে ঈগলের কাছে বহুবার ক্ষমা চাইলেন। গতবারের মত এবারেও ঈগল পাত্তা দিলো না। তখন তিনি মরিয়া হয়ে ঈগলের কাছে জীবন ভিক্ষা চাইলেন। শুধু তাই নয়, তিনি বললেন—”আমি কথা দিচ্ছি তুমি যা চাও তাই আমি করে দেব।”
তখন ঈগল থামল আর বলল—”যদি তুমি অ্যাসগার্ডের ইডুনা আর তাঁর কাছে যে যৌবনের আপেল ভরা সোনার ঝুড়ি আছে সেটা এনে দিতে পারো তাহলে আমি তোমাকে আবার তোমার বন্ধুদের কাছে ফেরত দেব।”
এত কষ্টেও লোকি হেসে ফেললেন। বললেন—“এই কাজটা অসম্ভব। আমি নিজেই অ্যাসগার্ডে ঢোকার অনুমতি আদায় করতে পারিনি এখনো। আমি চাইলেও এটি করতে পারব না।”
ঈগল বলল—”ভেবে দেখ আরেকবার। আমি কিন্তু এইভাবে পুরো মিডগার্ড তোমাকে নিয়ে ঘুরতে পারি। আমার নাম থিয়াসি, আমি ঝড়ের দৈত্যদের রাজা। আমি কিন্তু এখনো আমার ক্ষমতার কিছুই প্রদর্শন করিনি। একটুও ক্লান্ত হইনি।”
থিয়াসির হুমকি শুনে লোকি ঘাবড়ে গেলেন। একটু ভেবে তিনি বললেন, তিনি তাঁর সাধ্যমত চেষ্টা করবেন ইডুনাকে এনে দেওয়ার। তখন থিয়াসি লোকিকে ওডিনের কাছে ফেরত দিয়ে এলেন। শুধু তাই নয়, ষাঁড়ের দুইখানা ঠ্যাং দিলেন, যাতে সকলে পেটপুরে খেতে পারে।
লোকি কিন্তু ফিরে গিয়ে ওডিনদের জানালেন না যে কি শর্তে সম্মতি দিয়ে তিনি মুক্তিলাভ করেছেন। এটাও জানালেন না যে ঈগল আসলে একজন ঝড় দৈত্য, থিয়াসি। তিনি শুধু জানালেন ঈগলকে পেটানোর চেষ্টা করায় তাঁকে উপযুক্ত শাস্তি দিয়েছে ঈগল। তবে বারবার ক্ষমা চাওয়ায় ঈগল অবশেষে তাঁকে ক্ষমা করে দিয়েছে। আর তিনি ঈগলকে একটু মাংস ফেরত দেওয়ার জন্যও রাজী করাতে পেরেছেন।
ওডিন কিছুই সন্দেহ করেননি। তিনি লোকির উপরে বেশ সন্তুষ্টই হয়েছিলেন, তাই মিডগার্ডেই বাইফ্রস্ট ব্রিজের কাছে লোকির জন্য একটা এলাকা বরাদ্দ করে দিলেন। প্রায়ই বাইফস্ট বেয়ে নেমে আসতেন লোকির সঙ্গে পরামর্শ করতে।
লোকি নিজের প্রতিজ্ঞা ভুলে যাননি, তিনি তলে তলে চেষ্টা করতে লাগলেন ইডুনাকে অপহরণ করার। তাঁর সুন্দর ব্যবহার আর সাহায্য করার মানসিকতা দিয়ে তিনি সকল অ্যাসিরদের সঙ্গেই সুসম্পর্ক স্থাপন করলেন। এক সময় নবদম্পতি ব্র্যাগি আর ইডুনা তাঁর এলাকায় ঘুরতে এলেন।
লোকি দেখলেন এই সুযোগ, উনি ব্র্যাগিকে জিজ্ঞাসা করলেন বললেন—”আপনাদের কি এই জায়গাটা ভালো লেগেছে?”
ব্র্যাগি বললেন—“হ্যাঁ, অবশ্যই।”
“তাহলে আপনি এই স্থান সম্পর্কে একটা গান রচনা করুন দয়া করে।”— লোকি অনুরোধ করলেন।
ব্র্যাগি খুব আনন্দিত হয়ে গান বাঁধার জন্য একটু ব্যস্ত হয়ে পড়লেন। ইডুনা তখন মাঠে একা একা ঘুরে বেড়াচ্ছিলেন। লোকি অন্য একটি মানুষের ছদ্মবেশ ধরে, ইডুনার সঙ্গে দেখা করে বললেন—”আপনার ফলানো সোনার আপেলের খুব প্রশংসা শুনি, কিন্তু এখান থেকে একটু দুরেই একটা আপেল বাগান আছে, সেইখানে দুর্দান্ত আপেল ফলে, সেই আপেলগুলি আপনার আপেলের থেকেও বেশি সুন্দর দেখতে এবং অনবদ্য খেতে।”
—“ধরিত্রীদেবী জর্ডের আশীর্বাদ আমার উপরে আছে বলেই আমি এই বিশেষ আপেল ফলাতে পারি। এমন আপেল আর কোথাও হতেই পারে না। দুঃখিত, আপনার কথা আমার বিশ্বাস হচ্ছে না”— ইডুনা বললেন—”তবে যদি এই ঘটনা সত্যি হয়ে থাকে তাহলে আপনার গাছের আপেলগুলি আমাকে তুলে ফেলতে হবে, কারণ অ্যাসির ছাড়া আর কারোর এই আপেল খাওয়ার অধিকার নেই।”
খুবই দুঃখিত হয়ে ছদ্মবেশী লোকি বললেন—”আপনি আমার কথা বিশ্বাস করতে পারছেন না, তবে আমি নিশ্চিত বলতে পারি, এই আপেলগুলি আপনার সোনার ঝুড়ির আপেলের থেকেও ভালো। যদি আপনার নিজস্ব আপেলগুলি আপনার কাছে থাকত, তাহলে আপনি তুলনা করে দেখে তবে অবিশ্বাস করতেন।”
ইডুনা এই ছদ্মবেশী মানুষের উদ্দেশ্য সম্পর্কে একেবারেই সন্দেহ করেননি। তিনি বললেন—“আমার ফলানো আপেলগুলি সবই অ্যাসগার্ডে রেখে এসেছি। আমি আবার কাল আসব, তখন আমার সোনার ঝুড়ি ভরে আপেল নিয়ে আসব, তাহলে আমি তুলনা করতে পারব কোনটা বেশি ভালো খেতে। যতক্ষণ না জানছি ততক্ষণ আমার শান্তি নেই। আমার ধারণা ধরিত্রী মা আমাকেই একমাত্র বিশ্বাস করে যৌবনের আপেল ফলানোর ক্ষমতা দিয়েছেন।”
ইডুনা আর ব্র্যাগি অ্যাসগার্ডে ফিরে গেলেন। লোকি আর একটুও সময় নষ্ট না করে থিয়াসিকে খবর পাঠালেন যে পরদিন ইডুনা একা আপেল-সহ আসবেন।
পরদিন বিকেলে ইডুনা এলে লোকি আবার ছদ্মবেশে তাঁর সঙ্গে দেখা করে বনের মধ্যে নিয়ে গেলেন। সেখানে ইডুনাকে বললেন—”আপনি একটু অপেক্ষা করুন, আমি একটি ছোট্ট কাজ সেরে এখনই ফিরে আসছি।” বলে তিনি নিজের এলাকায় ফিরে এসে ছদ্মবেশ ছেড়ে মাঠে পায়চারি করা শুরু করলেন। যেন অন্যান্য দিনের থেকে আজকের দিনটির কোনো পার্থক্য নেই। তিনি ঘর এবং তার লাগোয়া মাঠ ছাড়া কোথাও যাননি। ইডুনার অপহরণে তাঁর কোনো ভুমিকাই নেই। কোনো অ্যাসির তাঁকে দেখলে এমনটাই ভাববে।
এদিকে ইডুনা একা হতেই সেই বিরাট ঈগলরূপী দৈত্য থিয়াসি, ইডুনাকে তার বিশাল নখে ধরে উড়ে মিডগার্ড ছাড়িয়ে
য়োটুনহাইমে নিয়ে চলে গেল। য়োটুনহাইমে একটা জায়গার নাম থ্রাইমহাইম, সেটি ঝড়ের দৈত্যদের রাজধানী। ইডুনাকে একেবারে সেখানে নিয়ে গিয়ে তবেই থিয়াসি থামল।
একটা ন্যাড়া পাহাড়। শুধুই পাথরে ভরা, একটাও গাছ নেই। সেই পাহাড়ের উপর দুর্গম স্থানে এক দুর্গ, সেই দুর্গে ইডুনাকে বন্দী করা হল। সেই জায়গায় কেবল ঝড়ের মত হাওয়া বয় সবসময়।
এবার থিয়াসি নিজের ঈগলের রূপ ছেড়ে বিশাল দৈত্যের রূপ ধরে ইডুনাকে বলল—“আমার নাম থিয়াসি, আমি ঝড়ের দানবদের রাজা। শুনেছি তোমার কাছে জাদুর আপেল আছে, আমাকে তোমার সেই আপেল খেতে দাও। সুন্দরী, আমি তোমাকে আমার স্ত্রী রূপে গ্রহণ করব, তুমি থ্রাইমহাইমের রানী হবে। আমার প্রস্তাবে রাজী হয়ে গেলে তোমার কোনো কষ্টই হবে না।”
দৈত্যের বিশাল চেহারা দেখে ইডুনা ঘাবড়ে গেলেও সাহস হারালেন না। তিনি বললেন—”ওই আপেল শুধুমাত্র অ্যাসিরদের জন্য, কোনোমতেই সেগুলি তোমাকে দেব না। তাছাড়া আমি বিবাহিতা, আমি অ্যাসগার্ডের প্রধান গায়ক, গানের দেবতা ব্র্যাগির স্ত্রী। আমি তাঁর সঙ্গেই খুবই আনন্দে আছি, তোমার রানী হতে চাই না।”
থিয়াসি এত রেগে গেল যে পুরো দুর্গ থরথর করে কাঁপতে লাগল। সে চেঁচিয়ে বলল, “বেশ, যতদিন তুমি রাজী না হও, ততদিন এখানে একা বন্দী থাকবে তুমি। কেউ কথা বলার থাকবে না।” ইডুনাকে সেই প্রাসাদের সবথেকে উঁচু ঘরে বন্দী করে রেখে এত রেগে চলে গেল যে এক বিশাল ঝড় এসে মিডগার্ডকে নাস্তানাবুদ করে ফেলল।
এদিকে রাত হয়ে গেছে, নৈশভোজ সম্পন্ন, কিন্তু প্রতিদিনের মত ইডুনা আর তাঁর আপেলের ঝুড়ি নিয়ে আসেন না। ব্র্যাগিকে জিজ্ঞাসা করা হল, কিন্তু তিনিও কিছু বলতে পারলেন না, শুধু তাঁর সোনার হার্পে বিরহের গান বাজাতে লাগলেন।
“সে নিশ্চয়ই আমার উপর রাগ করে চলে গেছে, কোথায় গেছে জানি না। হয়তো সে তার বাপের বাড়িতে চলে গেছে। তবে সে নিশ্চয়ই আবার ফিরে আসবে।” অবশেষে ব্র্যাগি বললেন।
এভাবে কিছু দিন কেটে গেল। ধীরে ধীরে অ্যাসিরদের মধ্যে বয়সের ছাপ পড়তে লাগল। একটা দুটো পাকা চুল দেখা দিতে লাগল, ওডিনের বাতের ব্যাথা চাগাড় দিলো।
সর্বশক্তিমান ওডিন নিজের সিংহাসনে বসেও কোনো ভাবেই দেখতে পেলেন না ইডুনা কোথায় আছে। এমনকি মিমিরের মাথাও ইডুনার ফিরে আশা সম্পর্কিত কোনো ভবিষ্যৎবাণী করতে পারলেন না। অ্যাসিররা ধীরে ধীরে আশা হারাতে শুরু করলেন।
কিন্তু ওডিনের পোষা দুই দাঁড়কাক, হুগিন আর মুনিন, বিভিন্ন জায়গায় ঘুরে ঘুরে যারা খবর এনে দেয় ওডিনকে, তারা গোপনে ইডুনার খোঁজ করতে শুরু করল। সব জায়গায় দেখে কোথাও না পেয়ে তারপর ধীরে ধীরে য়োটুনহাইমের একদম গভীরে যেতে থাকল। অবশেষে একদিন তারা ইডুনার সংবাদ এনে দিলো।
ইডুনাকে থ্রাইমহাইমের এক দুর্গে এক্কেবারে উঁচু মিনারে বন্দী করে রাখা হয়েছে। বন্দী করে রেখেছে থিয়াসি নামের এক ঝড়ের দৈত্য। জাদু দিয়ে ঢেকে রেখেছে বলে অন্য জগত থেকে দেখা যাচ্ছে না সেই দুর্গকে। ইডুনা যৌবনের আপেলকে নিজের সোনার ঝুড়িতে সাবধানে বন্ধ করে রেখেছেন। থিয়াসি এখনো তাতে হাত দিতে পারেনি। তবে ইডুনা উদ্ধার হওয়ার অপেক্ষায় ফ্যাকাশে এবং অসুস্থ হয়ে পড়েছেন। তিনি সারাদিন জানলার পাশে বসে উপরে অ্যাসগার্ডের দিকে তাকিয়ে থাকেন এবং চিৎকার করে ব্র্যাগিকে কেঁদে কেঁদে ডাকেন, যাতে তিনি এসে তাঁকে উদ্ধার করতে পারেন।
হুগিন এবং মুনিনের থেকে এই সংবাদ শুনেই, ওডিন তৎক্ষণাৎ সব অ্যাসির আর ভানিরদের নিয়ে এক আপদকালীন সভা ডাকলেন এবং ইডুনার খবর সবাইকে দিয়ে পরামর্শ চাইলেন কি করা যায়।
প্রথমেই থর বললেন—”আমার মতে এক্ষুনি আমাদের য়োটুনহাইম আক্রমণ করে সবকজন দানবকে মেরে ফেলা উচিত। আমাদের নষ্ট করার সময় নেই, এমনিতেই আমরা বুড়ো হয়ে যাচ্ছি।”
ওডিন মৃদু হেসে বললেন—“থর, চিরকালই তোমার মাথা একটুতেই গরম হয়ে যায়। তোমার অসীম শক্তির কথাও আমার অজানা নেই। যখন তুমি পুঁচকে ছিলে, তখনই তোমাকে সামলাতে তোমার মা জর্ড হিমসিম খেয়ে যেতেন। তোমাকে শান্ত করে ঘুম পাড়িয়ে রাখার জন্য দশখানা ভাল্লুকের চামড়া তোমার দোলনার উপরে চাপানো থাকতো, আর তুমি সেটাকে খেলতে খেলতে সরিয়ে ফেলতে। আমি তখনই বুঝেছি যে তুমি মহাশক্তিশালী হবে। কিন্তু এটা শক্তি প্রদর্শনের সময় নয়। দানবেরা সতর্ক আছে, তাঁরা জানে আমরা যেকোনো সময় আক্রমণ করতে পারি। আমি নিজেও ছদ্মবেশে ওই জাদুময় স্থানে ঢুকতে পারব না। ওরা নিশ্চয়ই অ্যাসিরদের জাদুর প্রভাব কমানোর জন্য কিছু একটা ব্যবস্থা রেখেছে।”
তখন হোনির বললেন—“যখন আমরা শেষবার বেড়াতে গেছিলাম, তখন এক নবীন আধা দৈত্যের সঙ্গে আলাপ হয়েছিল, নাম লোকি, তোমার মনে আছে? সে দৈত্য হলেও চেহারা এবং হাবভাবে আমাদের সঙ্গেই তার মিল বেশি। যে সমস্যাতেই আমরা পড়ি না কেন, সে সহজেই তার উপস্থিত বুদ্ধি ব্যবহার করে সমাধান করেছিল, তার সঙ্গে একবার পরামর্শ করলে হয় না?”
—“একদম ঠিক বলেছ, হোনির। লোকিকেই দরকার, ওর বুদ্ধির উপরে আমার আস্থা আছে। ও এখন মিডগার্ডে থাকে, বাইফ্রস্টের কাছেই। ওর সঙ্গে আলোচনা করা উচিত। আমি এখনই দূত পাঠাচ্ছি কথা বলার জন্য। নাহ্, বরং আমি নিজেই গিয়ে কথা বলি…”
ওডিন আর কয়েকজন অ্যাসির লোকির কাছে গিয়ে সমস্যাটা খুলে বললেন এবং জিজ্ঞাসা করলেন লোকি কোনোভাবে সাহায্য করতে পারবেন কি না?
লোকি এমন ভাব করে শুনলেন যেন ব্যাপারটা প্রথমবার শুনছেন এবং এই বিষয়ে তিনি কিচ্ছু জানেন না। শেষে বললেন,
—“আমি হয়তো ইডুনাকে উদ্ধার করতে পারব, তবে খুবই কঠিন এবং বিপদজ্জনক কাজ। আমি অ্যাসির নই বলেই হয়তো থ্রাইমহাইমে ঢুকতে পারব। তবে সমস্যা হল আমার শরীরে দৈত্যদের রক্ত থাকায় আমি অ্যাসগার্ডে ঢুকতে পারব না।”
তখন ওডিন বললেন—“তুমি যদি ইডুনাকে অক্ষতভাবে আমাদের কাছে পৌঁছে দিতে পারো, আর তাঁর সঙ্গে যদি তখনো যৌবনের আপেল থাকে, তাহলে আমি কথা দিচ্ছি আমরা তোমাকেও আমাদের একজন বলে গ্রহণ করব। তবে তোমাকে কথা দিতে হবে, দৈত্যদের সঙ্গে যুদ্ধে তুমি আমাদের পক্ষে যুদ্ধ করবে সবসময় এবং আমাদের প্রতি বিশ্বস্ত থাকবে।”
লোকি সম্মত হলেন এবং প্রতিজ্ঞা করলেন যে তিনি বিশ্বস্ত থাকবেন, এবং এটাও বললেন যে যদি তিনি বিশ্বস্ত না থাকেন তাহলে যেন তাঁকে এমন ভয়াবহ শাস্তি দেওয়া হয় যেটা কেউ কল্পনাও করতে পারবে না।
এই শপথ গ্রহণের পরে ওডিন এবং লোকি দুজনেই হাত কেটে রক্ত বার করে পরস্পরের সঙ্গে করমর্দন করলেন। ওডিন এবং লোকির রক্ত মিশে গেল, তাঁরা পরস্পরকে ব্লাড-ব্রাদার বলে সম্বোধন করলেন। তারপর লোকি তাঁর গন্তব্যের জন্য বেরিয়ে পড়লেন।
যাওয়ার আগে লোকি বললেন—“আমি থ্রাইমহাইম থেকে ইডুনাকে আনতে যাচ্ছি। তোমরা অ্যাসগার্ডের প্রত্যেকটা প্রবেশপথে পাইন গাছের টুকরো জমা করে রাখো, যাতে চাইলেই চট করে একটা বিশাল আগুন জ্বালানো যায়। কিন্তু সেই আগুন জ্বেলো না আমার ইশারা না পাওয়া অবধি। প্রস্তুত থাকো। আর একটা কথা মনে রেখো, আমি যেকোনো রূপ ধারণ করতে পারি কিন্তু ঝড়দৈত্য থিয়াসি দৈত্যাকার ঈগল ছাড়া অন্য কোনো রূপ ধারণ করতে পারে না।”
এই বলে লোকি রওনা দিলেন। একটু দূরে গিয়েই তিনি একটা বাজপাখির রূপ নিয়ে উড়ে উড়ে থ্রাইমহাইমে পৌঁছে গেলেন। সেখানে পৌঁছনোর পরে আগে দৈত্যদের চারদিকে ঘুরে ঘুরে একটু খবর সংগ্রহ করলেন। জানলেন যে থিয়াসি মাছ ধরতে গেছে। আর ইডুনা তাঁর কারাগারে একাই রয়েছেন। শুনে তিনি উড়ে গেলেন ইডুনার জানলার কাছে। গিয়ে বললেন—“লেডি ইডুনা, আমি আপনাকে উদ্ধার করে অ্যাসগার্ডে আপনার স্বামীর কাছে নিয়ে যেতে এসেছি। আপনি আপেল রাখার সোনার ঝুড়িটা নিজের কাছে নিয়ে নিন, আর যাই ঘটুক না কেন ঐ ঝুড়িটাকে হাতছাড়া করবেন না। আমার উপরে বিশ্বাস রাখবেন।”
ইডুনা দুঃখী দুঃখী মুখে বসে ছিলেন, বাজপাখির কথা শুনে তিনি লাফ দিয়ে উঠলেন। তাড়াতাড়ি নিজের আংরাখা জড়িয়ে নিলেন, সোনার ঝুড়িটা নিজের বুকের কাছে শক্ত করে ধরে বললেন —”ঈশ্বরের আশির্বাদের মত তুমি আমার কাছে এসেছ বাজপাখি, আমাকে উদ্ধার করে নিয়ে চল অ্যাসগার্ডে, আমি ওডিনকে তোমার উপকারের কথা জানাব। তোমার জাতিকে অ্যাসগার্ড এবং মানবজাতির কেউ কখনও ক্ষতি করবে না। আজ থেকে তোমরা আমাদের বন্ধু হলে।”
তখন লোকি জাদু করে ইডুনাকে একটা বাদামের মত পুঁচকে করে নিলেন, তারপর তাঁর নখের মধ্যে নিয়ে উড়তে শুরু করলেন।
কিছুক্ষণের মধ্যেই থিয়াসি ফিরে এলো। এসেই সে ইডুনার খোঁজে সবথেকে উঁচু মিনারে গেল। সেখানে সে যখন দেখল ইডুনা নেই, তখন এত জোরে চিৎকার করল যে সেই মিনারটাই ভেঙে পড়ে গেল।
—“কী করে সে পালালো? কেন তাকে কেউ আটকায়নি?” থিয়াসির প্রশ্নের উত্তরে কেউ কিছু বলতে পারে না। শেষে এক কর্মচারী আমতা আমতা করে বলল—“কেউ তো আসেনি এখানে, এমনকি কোনো পশুও না। শুধু এক বাজপাখি এদিকে সেদিকে উড়ে বেড়াচ্ছিল বটে। খানিকক্ষণ পরে সেও উড়ে চলে গেল। তার নখে কিছু একটা শিকার ছিল, সম্ভবত একটা চড়াই। আমি শুনেছি বাজপাখি চড়াই খেতে বেশ ভালোবাসে। তা সেটাও বেশিক্ষণ আগের কথা নয়। সে ওই মিডগার্ডের দিকে গেছে।”
শুনেই থিয়াসি বললো—”ওটা নিশ্চয়ই অ্যাসিরদের কেউ একজন।” বলে বিরাট বড় এক ঈগলের বেশে ঝড়ের বেগে পিছু ধাওয়া করলো বাজপাখির। এত জোরে সে ডানা ঝাপটাচ্ছিল যে বিরাট ঝড় উঠল। এমন ঝড় যে বড়বড় গাছেরাও শুয়ে পড়ছিল।
এদিকে অ্যাসগার্ডের মূল দরজায় অ্যাসিররা গভীর উৎকণ্ঠায় তাকিয়ে আছেন। হঠাৎ হিমদল চেঁচিয়ে উঠে বললেন—“আমি একটা বাজপাখিকে এইদিকে আসতে দেখতে পাচ্ছি, তার নখে একটা বাদাম রয়েছে। আর তার পিছু নিয়েছে একটা বিরাট ঈগল। অতবড় ঈগল পুরো মিডগার্ডের কোথাও নেই। ঈগলটা বাজের থেকে দ্রুতগতিতে আসছে, প্রায় ওদের ধরে ফেলবে।”
কিছুক্ষণ পরে বাকি অ্যাসিররাও ওদের দেখতে পেলেন। এটাও দেখলেন যে ঈগলের ডানার ঝাপটায় ঝড় উঠেছে এবং অরণ্য—অঞ্চলও সেই ঝড়ের প্রকোপে নুয়ে পড়ছে। এটা দেখে এঁরা নিশ্চিত হলেন যে এই ঈগলটাই হল ঝড়ের দৈত্য থিয়াসি।
ঈগল বাজপাখিকে ধরে ফেলে প্রায়, এমন সময়ে অ্যাসগার্ডের দরজা পার করে গেল বাজপাখি। সময় নষ্ট না করে সব আগুন জ্বেলে দিলেন অ্যাসিররা। থিয়াসি নিজের গতিবেগ রোধ করতে না পেরে এসে পড়ল সেই আগুনে, তার ডানা ঝলসে গেল, আর আসিররা সকলে এক যোগে আক্রমণ করলেন তরবারি, বর্শা আর যুদ্ধকুঠার নিয়ে। অচিরেই মৃত্যু ঘটল তার।
এদিকে লোকি তাঁর এবং ইডুনার পুর্বরূপ ফিরিয়ে দিয়েছেন। ইডুনা তাঁর সোনার ঝুড়িভর্তি আপেল নিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন লোকির পাশে।
ব্র্যাগিকে দেখে আর সামলাতে পারলেন না ইডুনা, আলিঙ্গন করলেন তাঁকে, ইডুনার চোখ তখন ভেসে যাচ্ছে আনন্দের অশ্রুতে।
সেই রাতে এক বিরাট বিজয় উৎসব হল— মধ্যমণি হলেন লোকি। অ্যাসির-ভানির মিলিতভাবে দারুণ নৈশভোজ হল, ভোজের শেষে সকলের মত লোকিও ইডুনার থেকে একটি যৌবনের আপেল পেলেন। ভানিরদের রাজা নিয়র্ডের মত তাঁকেও নিজেদের বলে গ্রহণ করলেন অ্যাসিররা।
তবে ঝড়ের দৈত্যদের থেকে আসা বিপদ শেষ হতে তখনো দেরী ছিল।
পরেরদিন দেখা গেল চকচকে বর্ম পরে হাতে বর্শা নিয়ে সুন্দরী কিন্তু বিরাটাকায় এক দৈত্যকন্যা মিডগার্ড থেকে ধেয়ে আসছে। সে রামধনু সেতুর সামনে এসে চিৎকার করল, “আমি থিয়াসির কন্যা স্কাডি। আমি আমার পিতার মৃত্যুর প্রতিশোধ নিতে চাই। তোমরা যুদ্ধ করতে রাজি থাকলে ভালো, না হলে আমি থিয়াসির দুই ভাই, ইডি আর গ্যাং কে নিয়ে আসছি। দুইজনেই আমার পিতার মতই শক্তিশালী। আমরা তিনজনে মিলে তোমাদের সবাইকে হারানোর ক্ষমতা রাখি।”
ওডিন ততক্ষণে বাইফ্রস্টের কাছে চলে এসেছেন। মধুর স্বরে তিনি বললেন—”স্কাডি আমরা তোমার সঙ্গে কোনো যুদ্ধই করতে চাই না। বরং তোমার এবং তোমার জাতের বাকিদের সঙ্গে বন্ধুত্বের হাত বাড়াতে আগ্রহী আমরা। এবার বল, কত সোনা পেলে এই রক্ত-ঋণ শোধ হবে।”
তখন স্কাডি বললেন—”ওভালডি নামের দৈত্যের নাম শুনেছ কি তোমরা? ওভালডি হল আমার ঠাকুর্দার নাম। ওভালডির তিন ছেলে থিয়াসি, ইডি আর গ্যাং। এঁদের সম্মিলিত সোনার পরিমাণ এত যে সারা জগতে কোনো দাঁড়িপাল্লা নেই যে সেটা মাপে। এত বেশি সোনা যে তাঁরা তাঁদের সন্তান সন্ততিদের মধ্যে ভাগ করতে বাধ্য হয়েছেন। আমার কাছে এত সোনা আছে যে পুরো অ্যাসগার্ড আমি কিনে নিতে পারি। আমার সোনা চাই না। তবে সত্যিই যদি তোমরা বন্ধুত্ব করতে চাও তাহলে আমার দুটি শর্ত রয়েছে। প্রথমত, আমার একজন অ্যাসগার্ডিয়ান স্বামী চাই। দ্বিতীয়ত, আমি জন্মের পরে কখনো হাসিনি, আমাকে হাসাতে হবে।”
অ্যাসিররা অনেক আলোচনা করলেন। তাঁরা ভেবে দেখলেন স্কাডির শর্ত মেনে নেওয়াই ভালো, কারণ ঝড়ের দৈত্যদের সঙ্গে বন্ধুত্ব করা একান্ত দরকারী, না হলে তাঁরা মিডগার্ড এবং অ্যাসগার্ডে প্রবল ঝড় নিয়ে আসতে পারেন। তাছাড়া স্কাডি খুবই সুন্দরী এবং শক্তিশালী, তাঁকে স্ত্রী হিসাবে পাওয়া লাভজনকই।
আলোচনার পরে ওডিন বললেন—”তোমার শর্ত মেনে নিতে আমরা রাজী স্কাড়ি, কিন্তু আমাদেরও একটা শর্ত আছে। তুমি শুধুমাত্র পা দেখে নিজের স্বামী পছন্দ করতে পারবে। এবং একটা স্থির সিদ্ধান্তে পৌঁছনোর পরেই কেবলমাত্র দেখা যাবে স্বামীকে।”
স্কাডি সম্মত হলে তাঁকে নিজের সভাঘরে নিয়ে এলেন ওডিন। সেখানে একটা পর্দার আড়ালে সকল অ্যাসিররা দাঁড়িয়ে ছিলেন। স্কাডি ওডিনকে বললেন—”তোমার যে পুত্র অ্যাসিরদের মধ্যে সবথেকে সুন্দর দেখতে, বল্ডার, তাকেই আমি বিবাহ করব বলে স্থির করেছি।” এই বলে সকল অ্যাসিরদের পা দেখে সবথেকে ফর্সা যে পা, তাঁকে দেখিয়ে বললেন—”এত সুন্দর পা নিশ্চয়ই বল্ডারের। আমি এই পায়ের মালিককেই বিয়ে করব।”
পর্দা উঠল, কিন্তু সেই পায়ের মালিক বল্ডার না, তিনি ভানিরদের রাজা নিয়র্ড।
বল্ডার না হওয়ায় একটু নিরাশ হলেও নিয়র্ডের দিকে তাকিয়ে স্কাডি সম্মতি দিলেন, নিয়র্ডও আনন্দের সঙ্গেই বিবাহ করতে রাজী হলেন। বিবাহ সম্পন্ন হল। বিবাহ পরবর্তী ভোজসভায় লোকি এত মজার মজার কথা বললেন, জাদু দেখালেন আর ভাঁড়ামি করলেন যে স্কাডি হাহা করে হেসে উঠলেন, শর্ত পুর্ণ হল অবশেষে।
তবে এই বিয়ে সুখের হয়নি। স্কাডি তাঁর নিজের বাড়িতে থাকতে পছন্দ করতেন, আর নিয়র্ডের পছন্দ ছিল সমুদ্রতীরের এক সুন্দর অট্টালিকা। তাই প্রথমে ঠিক হল নয়দিন সমুদ্রতীরের বাড়িতে আর নয়দিন থ্রাইমহাইমে থাকা হবে। তবুে আঠারো দিনের পরে নিয়র্ড জানালেন যে তিনি সারারাত ঘুমোতে পারেননি বন্যজন্তু আর নেকড়েদের আওয়াজে। স্কাডিও জানালেন যে তিনিও ঘুমোতে পারেননি সমুদ্রের পাখিদের কলকাকলিতে আর সমুদ্রের গর্জনে।
তাই তাঁরা আলাদা থাকতে শুরু করলেন বেশিরভাগ সময়ে। নির্দিষ্ট একটা সময়ের পর স্কাডি এবং নিয়র্ডের জমজ সন্তান হল। ছেলেটির নাম ফ্রে এবং মেয়ের নাম ফ্রেয়া। বড় হয়ে দুইজনেই অ্যাসগার্ডে নিজেদের ঘর খুঁজে নিলেন।
দুষ্টুমির দেবতা লোকি
অ্যাসিরদের আশ্চর্য সম্পদ
লোকি অ্যাসিরদের সঙ্গেই থাকতে লাগলেন। সকলে ধীরে ধীরে ভুলেই গেল যে তিনি আদতে দৈত্যদের বংশদ্ভূত। লোকিও প্রাণপণে ভুলে থাকার চেষ্টা করলেন যে ইডুনাকে অপহরণ করার এবং উদ্ধার করার পুরো ঘটনা তিনিই ঘটিয়েছেন। অ্যাসিরদের মধ্যে থরের সঙ্গে তাঁর খুবই ভালো বন্ধুত্ব হয়েছে। তবে থর কখনোই তাঁকে একশ শতাংশ বিশ্বাস করে উঠতে পারেননি। লোকি যেমন সমস্যার সমাধান করেছেন অনেক, তেমনি অনেক সমস্যার সৃষ্টিও তাঁর দ্বারাই হয়েছে। সেসব ঘটনার কথা আমরা পরে জানব।
থরের স্ত্রীয়ের নাম ছিল সিফ। তিনি অত্যন্ত সুন্দরী একজন অ্যাসির ছিলেন। তাঁর নীল রঙের চোখ, ফর্সা গাল, লাল টুকটুকে ঠোঁট সবকিছুই থরের অত্যন্ত প্রিয় ছিল। কিন্তু থর সবথেকে বেশি ভালোবাসতেন বাতাসে ওড়া তাঁর লম্বা সোনালী চুল দেখতে। একবার থরের সঙ্গে লোকির খুব মতান্তর হয়েছিল; সে অবশ্য নতুন কিছু না, প্রায়ই এমন হত। পরদিন সকালে থর উঠে দেখেন তাঁর স্ত্রী সিফের মাথায় একটিও চুল অবশিষ্ট নেই, পুরো গোড়া থেকে সেই চুল চুরি হয়ে গেছে। সিফ তো মাথার অবস্থা দেখে কান্নায় ভেঙে পড়লেন। সেটা দেখে আরো রেগে উঠলেন থর, তবে শুধুই বললেন, “হুম!” বলে মেগিংজর্ড নামে কোমরবন্ধ আঁটলেন কোমরে। এই কোমরবন্ধ যে সে বস্তু নয়, থরের শক্তিকে দ্বিগুণ করে দিতে পারে এই কোমরবন্ধ। তারপর তিনি ঝড়ের বেগে গিয়ে লোকিকে চেপে ধরলেন। হুঙ্কার দিয়ে বললেন—“আমি জানি তুমিই করেছ এই কাজ।”
লোকি প্রথমে খুব অবাক হয়ে জিজ্ঞাসা করলেন—“কী হয়েছে?” তখন থর একটা ঝাঁকুনি দিয়ে বললেন—“তুমিই সিফের মাথার সব চুল চুরি করেছ, আমি নিশ্চিত, তুমিই। এইরকম কুমতলব তোমার মাথাতেই কেবল আসতে পারে।” লোকি প্রথমে স্বীকার করতে চাইলেন না। তারপর থরের আরো দু’-তিনটে ঝাঁকুনি খেয়ে তিনি কবুল করলেন যে তিনিই করেছেন। কিন্তু কেন? থরের প্রশ্নের উত্তরে জানালেন গত রাতে বেশি মদ্যপান করে ফেলেছিলেন, থরের উপরে শোধ নেওয়ার ইচ্ছে তো তাঁর ছিলই, কিন্তু থরের শক্তির সঙ্গে তিনি পেরে উঠবেন না জানতেন, তাই একটু দুষ্টুমি করে ফেলেছেন। তিনি বললেন—“যেহেতু একদম গোড়া থেকে সব চুল নিয়ে নেওয়া হয়েছে, সিফের মাথায় আর কখনও চুল গজাবে না।”
গর্জে উঠলেন বজ্রদেবতা থর—“এরকম হতে পারে না, যেভাবেই হোক সিফের সমস্ত চুল ফেরত চাই। না হলে তোমার দেহের প্রতিটা হাড় আমি ভাঙব।”
লোকি বললেন—”আরে বুঝতে পারছ না, এটা অসম্ভব কাজ।”
থর বললেন—“কিন্তু এই অসম্ভবকে সম্ভব তোমাকেই করতে হবে লোকি! আমার সুন্দরী বৌ তোমার জন্য বাড়ি ছেড়ে বেরোতেই পারবে না, এ আমি হতে দিতে পারব না। তুমি একটা ব্যবস্থা না করলে কী করব জানো? প্রথমে তোমার সবকটা হাড় মটমট করে ভাঙব। তারপর ওষুধপত্র দিয়ে সেগুলি জুড়ব, তারপর আবার ভাঙব। ভাঙতেই থাকব, যতক্ষণ না কিছু উপায় করছ।”
লোকি খুব ভালোভাবেই জানেন, থর এককথার লোক। মাথাগরম মানুষ, কখন কী করে বসেন তার ঠিক নেই। তিনি সত্যিই অগুণতিবার তাঁর হাড় ভাঙার ক্ষমতা রাখেন। তখন তিনি প্রাণভয়ে বললেন—“শোনো, মাথাগরম করো না, ডোয়ার্ফরা সিফের চুল ঠিক করে দেওয়ার ক্ষমতা রাখে, এমন পরচুলা বানিয়ে দেবে যে একদম আসল চুলের মত কাজ করবে।”
—“তাহলে এখনই ডোয়ার্ফদের সঙ্গে কথা বলো, যেভাবেই হোক সিফের চুল ফেরত চাই।” এই বলে লোকিকে ছাড়লেন তিনি। লোকি পড়ি-কি-মরি করে পালালেন ওঁর সামনে থেকে। যে জুতোজোড়া পরে তিনি বাতাসে উড়তে পারেন, সেটা পরে তৎক্ষণাৎ রওনা দিলেন স্প্যাতেলহাইমের দিকে। স্প্যাতেলহাইম হল ডোয়ার্ফদের দুনিয়া। সেখানকার সবথেকে বুদ্ধিমান এবং নিপুণ কারিগর হলেন তিন ভাই, তাঁদের ইভালদির ছেলে নামে ডাকা হয়।
স্বভাবতই লোকি এখানেও তাঁর বুদ্ধি খাটালেন। তিনি ওই তিন ভাইয়ের কামারশালায় গিয়ে জিজ্ঞাসা করলেন—“আচ্ছা, এখানে সবাই বলছে ব্রক আর তার ভাই ইট্রি (মতান্তরে সিন্ড্রি), এই দুইজন হল ডোয়ার্ফদের মধ্যে সবথেকে নিপুণ কারিগর, তাঁরা কোথায় থাকে জানো?”
স্বাভাবিক ভাবেই তিনজনই একটু রেগে গেল—”ওরা মোটেই সেরা কারিগর না”, একজন বলল। —”আমরা হলাম সবথেকে ভালো কারিগর।”
লোকি বললেন—“প্রথমে আমিও তাই ভেবেছিলাম, তবে আমার ধারণা তোমাদের মতই দুর্দান্ত জিনিস ওরাও বানিয়ে দিতে পারবে।”
সবথেকে ছোট ভাই বলল—“ওরা যা বানাতে পারবে আমরা তার থেকে বেশি ভালো বানিয়ে দিতে পারবো।”
“তাই নাকি?”— লোকি বললেন—“আমি তো শুনেছি ওরা তোমাদের চ্যালেঞ্জ করেছে যে ওরা তিনখানা এমন ভালো জিনিস বানাবে যার তুলনা কোথাও নেই। অবশ্য আমি একটা সমাধান দিতে পারি, অ্যাসির দেবতারা পরখ করে দেখবেন কার তৈরি জিনিস সবথেকে ভালো, সবথেকে দুষ্প্রাপ্য। ও, হ্যাঁ বলতে ভুলেই গেছি, তিনটের মধ্যে একটা জিনিস অবশ্যই সোনালী চুল হতে হবে। স্বাভাবিক চুলের মতই যা বাড়বে এমন সুন্দর সোনালী চুল।” ইভালদির এক ছেলে বলল—”হ্যাঁ তেমনটাও আমরা বানাতে পারি।”
“তাহলে আর দেরী কিসের, কাজ শুরু করে দাও।”— বলে লোকি সেখান থেকে চলে গেলেন।
লোকি গেলেন পাহাড়ের অপরদিকে যেখানে ব্রক আর ইট্রি কাজ করছিল। তিনি গিয়ে বললেন—”তোমরা এখানে কী সব বানাচ্ছ, ওদিকে ইভালদির ছেলেরা দেবতাদের জন্য দারুণ সব উপহার বানাচ্ছে। ওরা আবার গর্ব করে একথাও বলল, যে তুমি আর তোমার ভাই ইট্রি সারাজীবন চেষ্টা করেও অত ভালো কিছু বানাতে পারবে না।”
এক বোকা নয়, সে বলল—“এইসব শুনে খুব সন্দেহ হচ্ছে লোকি। খামোখা ইভালদির ছেলেরা আমাদের সঙ্গে ঝামেলা করবে কেন? তোমার কোনো হাত নেই তো এতে?”
—“না না আমি ভাবলাম তোমাদের এতকিছু বলছে, তোমাদের সেটা জানা উচিত, আমার ব্যক্তিগত কোনো স্বার্থ জড়িয়ে নেই এর সঙ্গে।”
ব্রক তার ভাইয়ের দিকে একবার তাকালো, ইট্রি নিজে খুব বড় একজন কারিগর, তবে ব্রক দুইজনের মধ্যে বেশি বুদ্ধিমান। : সে বলল—”বেশ আমি ইভালদির ছেলেদের সঙ্গে প্রতিযোগিতা
করতে পারি, তবে আমার একটা শর্ত আছে।”
“কী শর্ত?”—লোকি জিজ্ঞাসা করলেন।
—“যদি আমরা প্রতিযোগিতায় জয়ী হই তাহলে তোমার মাথাটি আমার চাই। ওই মাথাটায় এত কুটবুদ্ধি গজগজ করছে, যে আমি নিশ্চিত, ইট্রি ওটা দিয়ে নিশ্চয়ই কিছু ভালো বানাতে পারবে।”
লোকি মুচকি হাসলেন—”বেশ তো। তোমাদের শর্তে রাজি।” কিন্তু মনে মনে তিনি একটু ঘাবড়েও গেলেন। নাহ, যেভাবেই হোক ইট্রি আর ব্রককে প্রতিযোগিতায় হেরে যেতেই হবে। তিনি বেশ আনন্দ পেলেন ভেবে যে শুধুই সিফের চুল না, তাঁর বুদ্ধিতে, দেবতারা আরো পাঁচটা অত্যাশ্চর্য উপহার পেতে চলেছেন। আর তিনি ব্রকদের হারানোর কোনো একটা উপায় ভেবে ফেলবেন নিশ্চয়ই।
এবার ব্রক আর ইস্ত্রি কাজ শুরু করল। বিরাট এক কামারশালায় গনগনে আগুন জ্বেলে একদম আনকোরা বিশাল এক শুয়োরের চামড়ার হাপর চড়িয়ে ইট্রি ব্রককে বলল—“তুমি হাপর টানা শুরু করো ব্রক। এক মুহূর্ত থামবে না, আমার খুব গরম আগুন চাই, আর সারাক্ষণ সেটা গরম থাকতে হবে।”
ব্রক হাপরে কাজ করতে শুরু করল। কিছুক্ষণ পরে মনমতো গরম হওয়ার পর, ইট্রি বাইরে গিয়ে কাজ করতে লাগল, আর এক একটানা হাপর টানতে লাগল। ইট্রি বাইরে বেরোনোর সময় একটা বেশ বড়ো কালো মাছি ঘরে ঢুকে এলো। সারা ঘরে উড়ে বেড়াতে লাগল। ব্রক সেদিক থেকে মনোযোগ সরানোর জন্য মন দিলেন ইট্রির হাতুড়ির আওয়াজের দিকে। এক সময় ব্রকের হাতের উল্টোদিকে সেই মাছিটা এসে বসল। তারপরেই হাতে কটাশ করে কামড়ে দিল। কিন্তু তবুও ব্লক একই ভাবে হাপর টানতে লাগল। এরপর ইট্রি এসে আগুন থেকে একটা বিরাট বড় বুনো শুয়োর টেনে বার করল, সেই শুয়োরের সোনার লোম একেবারে ঝকমক করছে। ইট্রি ব্রককে বললে—”দারুণ হয়েছে এটা, এক্কেবারে আমার মনোমত, এভাবেই কাজ করো। একটুও তাপমাত্রার এদিক ওদিক হলেই এই জিনিসটা এক্কেবারে বরবাদ হয়ে যেত।”
তারপর ইট্রি বড় এক টুকরো সোনা আগুনে সেঁধিয়ে দিয়ে বলল—”এবার আবার হাপর টানা শুরু করে দাও। আর যাই ঘটুক এক মুহূর্তের জন্যেও থামবে না, বা তাড়াহুড়োও করবে না। যে গতিতে কাজ করছ, সেই গতিতেই করবে।”
ব্রক আবার কাজ শুরু করল, আর কালো মাছিও আবার উড়তে শুরু করল। এবার উড়ে এসে বসল ব্রকের গলায়। এত জোরে কামড়ে দিল যে ঘামের সঙ্গে সঙ্গে ব্রকের রক্ত বেরোতেও শুরু হল, ঘামের সঙ্গে রক্ত মিশে জ্বালা করা শুরু হল কিন্তু তবুও এক নিজের কাজ থামাল না, একই গতিতে হাপর টানতে লাগল।
একটু পরে ইট্রি ফিরে এলো এবং আগুন থেকে একটা সোনার বাজুবন্ধ টেনে বার করলো। এর নাম ড্রপনির।
“মানে যার থেকে টুপটাপ করে ঝরে পড়ে? বাজুবন্ধটার অদ্ভুত নাম তো?” ব্লক বলল।
“এর কাজ জানলেই আর নামটা অদ্ভুত লাগবে না। তবে এখনই সেটা বলব না, আগে আরেকটা জিনিস বানাতে হবে। আমি বহুযুগ ধরেই তেমন একটা জিনিস বানাতে চাই, যেটা আমার মাস্টারপিস হবে। তুমি ততক্ষণ ঠিক আগের দুবারের মত হাপর চালাতে থাকো, একদম থেমো না।” এই বলে এক বিশাল ধাতুর চাঁই আগুনের মধ্যে ফেলে বেরিয়ে গেল। ব্রক আবার হাপর চালাতে লাগল।
ততক্ষণে সেই যে কালো মাছি, আসলে সে যে লোকি এতক্ষণে নিশ্চয়ই সবাই তা বুঝে গেছেন। সে তো প্রচন্ড চিন্তায় পড়ে গেছে, দুটো অসাধারণ জিনিস বানানো হয়ে গেছে, এভাবে চললে ব্রক আর ইট্রি জিতে যাবে, তারপরে লোকির মুন্ডু নিয়ে কী যে বানাবে কে জানে। আর আগেরদুটো যে রকম সুন্দর জিনিস হয়েছে, এটা যদি ইট্রির মাস্টারপিস হয়, তাহলে এটা আরো ভালো হবেই। এবার চুড়ান্ত আঘাত হানতেই হবে। লোকি বড় কালো মাছি হয়ে এবার ব্রকের কপালে বসল আর চোখের পাতায় কামড় দিলো। তাতেও ব্রক কাজ থামালো না, তারপর মাছি একই জায়গায় আবার কামড় দিলো। চোখের পাতা থেকে রক্তের ধারা বইতে লাগল। তবুও ব্রক কাজ থামালো না, বারবার ফুঁ দিয়ে মাছিকে উড়িয়ে দিতে থাকল। মাছি আরো কামড়াতে থাকলো চোখের পাতায়। শেষে যখন ব্রক চোখে রক্ত ছাড়া আর কিছু দেখতে পাচ্ছে না, তখন একটা মরণ কামড় বসালো পাতায়। অবশেষে ব্রকের ধৈর্য্যচ্যুতি হল। মাছি মারার জন্য সে এক হাত দিয়ে কপালে খুব দ্রুত একটা বিরাশী শিক্কার চাপড় বসালো। ওই চাপড় মাছির উপরে পড়লে লোকি তখনই অক্কা পেতেন, কিন্তু কোনোমতে তিনি পালিয়ে বাঁচলেন।
তারপরেই ইট্রি এসে ঘরে ঢুকল—“কী হয়েছিল? এক চুলের জন্য আমি যতটা ভালো ভাবছিলাম ততটা ভালো হয়নি জিনিসটা। জিনিসটা জবর হয়েছে বটে, শুধু একটু খুঁত থেকে গেল।” ব্যাস কালো মাছি এটুকু শোনারই অপেক্ষা করছিল। সে বোঁওও করে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল।
পরক্ষণেই লোকি, স্বমুর্তি ধরে ঘরে ফিরে এসে বললেন “জিনিসগুলি কি তৈরি হয়েছে? আমরা কি অ্যাসগার্ডে যাওয়ার জন্য প্রস্তুত?”
ইট্রি বলল—“আমাদের তরফ থেকে এক যাবে অ্যাসগার্ডে, সে উপহারগুলি দেবতাদের দেবে আর তোমার মুন্ডু কেটে নিয়ে আসবে, আমি এখানে থাকতেই বেশি ভালোবাসি।”
ব্রক লোকির সঙ্গে রওনা দিল।
অ্যাসগার্ডে দেবতারা সভা আলো করে বসে আছেন। প্রতিযোগিতায় বিচারক হলেন দেবরাজ একচক্ষু ওডিন, বজ্রবিদ্যুতের দেবতা মহাবীর থর আর শস্যের দেবতা সুন্দর ফ্রে। ওডিন বললেন—”আমাদের আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে বিচার করার, তবে আমরা এখনো এটাই জানি না যে আমরা কিসের বিচার করব?”
লোকি উত্তর দিলেন—”এদিকে ইভালদির তিন পুত্র আপনাদের জন্য তিনখানি উপহার বানিয়ে এনেছেন, অপরদিকে ব্রক এবং তাঁর ভাই ইট্রি বানিয়ে এনেছেন আরো তিনখানি উপহার। আপনাদের দেখে বলতে হবে কারা সবথেকে ভালো উপহার বানিয়েছে। এই দুইদল কারিগরের মধ্যে সেরা কারা?” ওডিনের সম্মতিতে লোকি তখন ইভালদি পুত্রদের উপহার দেখানো শুরু করলেন,।
প্রথমেই ওডিনের জন্য একটা বর্শা, তাঁর নাম গাংনির। খুব সুন্দর দেখতে এবং তার গায়ে জাদু রুনের অক্ষর খোদাই করা আছে। লোকি বলা শুরু করলেন—”এই বর্শার গুণ হল এটা যেকোনো জিনিসকে ভেদ করে যেতে পারে, আর যখন এটা ছোঁড়া হবে তখন যাকে মনে করে ছোঁড়া হবে এই বর্শা সবসময় সেই লক্ষ্য ভেদ করবে। আর এই বর্শার নামে যদি কোনো শপথ নেওয়া হয় তাহলে তা ভাঙা যাবে না।’
“বাহ্! খুব সুন্দর এটি।”— ওডিন এটুকুই বললেন।
এরপর লোকি থরকে বললেন—“পরবর্তী উপহার হল সোনার চুল। যার এই চুলের দরকার তাঁর মাথায় নিজের থেকেই জোড়া লাগবে এবং স্বাভাবিক চুলের মতই বাড়বে। আর একদম স্বাভাবিক চুলের মতই ব্যবহার করবে।”
থর বললেন—”এটা আমি পরীক্ষা করে দেখব। সিফ, এদিকে এসো।”
সিফ সামনে এসে তাঁর মাথা অনাবৃত করতেই সবাই আঁতকে উঠলেন, মাথায় একটুও চুল নেই, গোলাপি চামড়া দেখা যাচ্ছে কেবল। ডোয়ার্ফদের বানানো পরচুলাটা আস্তে করে মাথায় পরে একবার চুল ঝেড়ে নিতেই সবাই সবিস্ময়ে দেখলো যে পুরো মাথায় চুলগুলি আঁটকে গেল, যেন সিফের নিজেরই চুল, আর সিফকে আগের থেকেও আরো সুন্দরী লাগছিল যেন ওঁর গা থেকে জ্যোতি বার হচ্ছে।
থর অত্যন্ত আনন্দিত হলেন, কিন্তু সেই আনন্দের বহিঃপ্রকাশ না করে তিনি বললেন—“খুবই ভালো, বাহ্!”
সিফ সভাঘর থেকে মহানন্দে বেরিয়ে গেলেন তাঁর বন্ধুদের নতুন চুল দেখাতে।
এর পরের উপহারটি নিতান্তই ছোট, একটা রুমালের মত ভাঁজ করা কাপড়। লোকি সেটা ফ্রের সামনে রাখলেন।
—“এটা কি? একটা সিল্কের রুমালের মত দেখতে!” ফ্রে একেবারেই খুশি হননি দেখে।
—“হ্যাঁ সত্যিই সিল্কের রুমালের মত দেখতে, কিন্তু এটাকে খুললেই একটা জাহাজের রূপ নেবে, যার নাম স্কিডব্লাডনির। এই জাহাজ যেদিকেই যাক না কেন সবসময়ই এর পালে বাতাস থাকবে, আর যদিও এটা বিশাল, সব জাহাজের থেকেই বিশাল, যদি একে মুড়ে ফেলা হয়, তাহলে এটা একটা রুমালের মতই তোমার ট্যাঁকে থাকতে পারবে।”
ফ্রে খুবই খুশি হলেন দেখে লোকি নিশ্চিন্ত হলেন। যাক, প্রতিটা উপহারই অসাধারণ, এবং দেবতারা সেগুলি পেয়ে খুবই সন্তুষ্ট।
এবার ব্রকের উপহার দেখানোর পালা। তার উপহারগুলি এতক্ষণ একটা ঢাকার আড়ালে ছিল। সে লোকিকে বলতে না দিয়ে নিজেই সামনে এলো তাঁর উপহারগুলি বর্ণনা করার জন্য। লোকির যেন মনে হল, ব্রক খুবই চটে আছে, বিশেষত ইভালদির ছেলেদের উপহারগুলি দেখার পর থেকে।
ব্রক প্রথমে সোনার বাজুবন্ধটা নিয়ে ওডিনের সামনে রাখল। বলল—”এর নাম ড্রপনির, কারণ প্রতি নবম রাত্রে এই বাজুবন্ধ থেকে আটটা একই রকম দেখতে সোনার বাজুবন্ধ ঝরে পড়বে। সেগুলি নিয়ে আপনি কাউকে পুরস্কার দিতে পারেন, বা নিজের ধনাগারে রেখে দিতে পারেন, আপনার ধনরাশি বাড়তেই থাকবে।” ওডিন বাজুবন্ধটা গ্রহণ করলেন, ভালো করে খুঁটিয়ে দেখে নিজের বাহুতে পরলেন, খুব সুন্দর ভাবে এঁটে গেল এবং ঝকঝক করতে লাগল। উনি বললেন—”বাহ্! খুব সুন্দর এটি।” লোকির মনে পড়ল ওই বর্শাটা দেখেও তিনি একই উক্তি করেছেন।
এরপর ব্রক ফ্রে র কাছে গেল, সে একটা বাক্সের থেকে কাপড়ের আবরণ সরাতেই এক বিশাল বুনো শুয়োর দেখা গেল, যার লোমগুলি সব সোনার।
—“এই শুয়োরটি আমার ভাই বানিয়েছে আপনার জন্য, এই শুয়োর আপনার রথ টানবে। এ মাটি আকাশ বা জল সবস্থানেই চলতে পারে, সবথেকে দ্রুতগামী ঘোড়াও এর কাছে হার মেনে যাবে। এর সোনার লোমগুলি চন্দ্রহীন রাতেও আলো দেবে, আপনি দেখতে পাবেন আপনি কি করছেন, বা কোথায় চলেছেন। এই শুয়োর কখনও হারে না, কখনও ক্লান্ত হয় না। এর নাম গালেনবাস্টি, মানে সোনালী লোমওয়ালা।”
ফ্রে তো খুবই আনন্দিত হলেন। লোকি একবার না ভেবে পারলেন না যে এই অন্ধকারে জ্বলা অদ্ভুত শুয়োরটির মতই ওই সিল্কের কাপড়ের মত জাহাজও সমান আশ্চর্য। তবে এখনো শেষ উপহার বাকি, আর সেটায় কিছু একটা খুঁত তো আছেই।
তারপর আরেকটি কাপড় সরিয়ে এক একটা হাতুড়ি থরের সামনে রাখলেন। থর একবার দেখে একটু নাক সিঁটকোলেন, বললেন—”এর হাতলটা বড়ই ছোট। দুই হাতে ধরা যাবে না।”
ব্ৰক মাথা নেড়ে বলল—“হ্যাঁ এটা আমারই দোষে হয়েছে। তবে এটা বাতিল করার আগে আমার বক্তব্য একটু শুনে নিন, কেন এই হাতুড়ি অন্য সবার থেকে আলাদা। এর নাম মিয়লনির, মানে বিদ্যুৎসৃষ্টিকারী। এই হাতুড়ি কখনও ভেঙে যাবে না, যত শক্ত জিনিসকেই এই হাতুড়ি দিয়ে আঘাত করা হোক না কেন।”
থর শুনে প্রীত হলেন। নিকট অতীতেই তিনি অনেক অনেক অস্ত্র ভেঙেছেন। কিছুই তাঁর হাতে বেশিদিন টেকে না, তিনি কিছুতে না কিছুতে আঘাত করেন আর অবশেষে সেটা ভেঙে যায়।
কিন্তু ব্রক তখনো কথা বলে চলেছে, থর ওর কথায় মন দিলেন। ব্রক বলছে—”যদি এই হাতুড়িকে ছুঁড়ে মারা হয় কোনো লক্ষের দিকে তাহলে সেটা সর্বদাই সেই লক্ষে আঘাত করবে। আর যত জোরে বা যত দুরেই এই হাতুড়ি ছুঁড়ে ফেলা হোকনা কেন, সব সময়েই এই হাতুড়ি আপনার কাছে ফিরে আসবে। শুধু তাই নয়, এই হাতুড়ি আপনার ইচ্ছেয় বড় ছোট হবে। যখন লক্ষ্যবস্তু বড়, তখন আপনি ইচ্ছে করলেই এই হাতুড়ি বড় হবে, আবার যখন দরকার নেই, তখন ইচ্ছে করলেই এই হাতুড়ি ছোট হয়ে যাবে, আপনি আপনার জামাকাপড়ের মধ্যেই লুকিয়ে রাখতে পারবেন। হ্যাঁ তবে সত্যিই এর হাতলটা ছোট, আমার দোষেই হয়েছে, আমার ভাই ইট্ৰি যখন এটা বানাচ্ছিল তখন আমি হাপর টানায় গতি বজায় রাখতে পারিনি।”
—“এই হাতুড়ির যে গুণগুলো বললে, তার সামনে ওই সামান্য খুঁত কোনো ব্যাপারই না, এই হাতুড়িটা আমাদের বরফের দৈত্যদের থেকে রক্ষা করবে। আর কী চাই? এর থেকে অসাধারণ উপহার আমি আগে কখনও পাইনি।” থরের মুখ দৃশ্যতই উজ্জ্বল।
ওডিন বললেন—”এই হাতুড়ি আমাদের অ্যাসগার্ডকে অগুনতিবার রক্ষা করবে।”
ফ্রে বললেন—”আমি যদি দৈত্য হতাম তাহলে হাতুড়িসহ থরকে খুব ভয় পেতাম।”
লোকি এইসব শুনে একটু ঘাবড়ে গেলেন, থরকে বললেন “সিফের ওই সুন্দর চুলের কথা ভুলে গেলে?”
থর বললেন—”অ্যাঁ! হ্যাঁ সত্যিই তো সিফের চুল খুব সুন্দর হয়েছে, বাঃ! তবে আমাকে এই বড় ছোট করার ব্যাপারটা বুঝিয়ে দাও দেখি ভাই ব্রক। এই হাতুড়িটার কোন তুলনাই নেই।”
ওডিন এবং ফ্রেও একমত হলেন, “বাকি সবকটা উপহারের মধ্যে এটাই সবথেকে ভালো কারণ এটা অ্যাসগার্ডকে সুরক্ষিত করতে কাজে লাগবে।” সবাই ব্রকের পিঠ চাপড়ে দিলেন। ওডিন ঘোষণা করলেন—”খুঁত থাকলেও যেহেতু মিয়লনির হাতুড়িটা খুবই কাজের এবং অসাধারণ গুণযুক্ত, তাই এই প্রতিযোগিতার বিজয়ী হলেন ব্রক ও তাঁর ভাই ইট্রি। তাঁরাই কারিগরের মধ্যে সেরা।”
ব্রক বলল, “আমাদের তৈরি করা উপহার আপনাদের পছন্দ হয়েছে এবং আমরাই জিতেছি জেনে অত্যন্ত আনন্দিত হলাম।” তারপর লোকির দিকে তাকিয়ে বলল—”এবার মুন্ডু কেটে নিই? ইট্রি খুব খুশি হবে, আমরা ওটা দিয়ে অন্তত একটা দোয়াত তো বানিয়েই নেব।”
লোকি তখন তোতলাতে শুরু করেছেন—”আমি.. আমি আমার মাথাকে বাঁচাতে তুমি যত চাও তত ধনরত্ন দিতে রাজি।”
কিন্তু ব্রক বলল—”আরে আমরা তো ধনরত্ন চাইলে বানাতেই পারি, ওই বাজুবন্ধটা দেখলেন না? আমাদের কাছে যথেষ্ট ধনরত্ন আছে। না না লোকি, আমি আপনার মুন্ডুই চাই।”
লোকি এক মুহূর্ত চুপ থেকে বললেন—”যদি আমাকে ধরতে পারো, তবেই তো আমার মুন্ডু কাটবে” বলেই লোকি বাতাসে উড়ে গেলেন, আর এক মুহূর্তে হাওয়া হয়ে গেলেন।
ব্রক থরের দিকে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল—“আপনি লোকিকে ধরে আনতে পারবেন?”
থর বললেন—“সত্যি কথা বলতে আমার ওঁকে ধরে আনা এক্কেবারে উচিত নয়, তবে আমার এই হাতুড়িটা পরীক্ষা করার বেদম ইচ্ছে হচ্ছে। তাই আমি ওঁকে খুঁজতে গেলাম।”
বেশি নয়, অল্প কিছু সময় পরেই থর ফিরে এলেন, লোকিকে শক্ত করে ধরে আছেন তিনি। লোকি রাগে ফুঁসছেন কিন্তু কিছু করতে পারছেন না।
লোকিকে দেখেই ব্রক নিজের ঝোলা থেকে একটা ছুরি বার করল—”এইবার, লোকি আপনার মুন্ডু কাটব।”
লোকি বললেন—“হ্যাঁ তুমি আমার মুন্ডু কাটতেই পারো, কিন্তু তার আগে আমি ওডিনের সামনে একটা কথা বলতে চাই। ওডিন সাক্ষী, তুমি যদি আমার গলার এতটুকু অংশও কাটো, তাহলে কিন্তু শর্ত উল্লঙ্ঘন হবে, তোমাদের সঙ্গে শুধুমাত্র মাথার কথা হয়েছিল, শুধুমাত্র মাথা।”
ওডিনও সহমত জানালেন—”লোকি তো ঠিকই বলছে, গলা কাটার কোনো অধিকার তোমার নেই।”
ব্রক একটু বিরক্ত হল—”আরে একটুও গলা না কাটলে আমি মুন্ডু কি করে কাটব?”
লোকি নিজের এই উপস্থিত বুদ্ধিতে নিজের উপরেই অতিরিক্ত প্রসন্ন হয়ে পড়লেন—”দেখো ব্রক, যদি লোকেরা নিজেদের কথা এক্কেবারে সঠিক ভাবে বলতে না পারে তাহলে তাদের লোকির সঙ্গে কথা বলাই উচিত না। আরে লোকি কী যে সে নাকি? সে সবথেকে জ্ঞানী, সবচেয়ে চালাক, সবথেকে কৌশলী, সবথেকে বুদ্ধিমান, সবথেকে সুন্দর দেখতে….” লোকি বলেই যাচ্ছিলেন, হঠাত দেখলেন ব্রক ওডিনের কাছে ফিসফিস করে কি বলছে, আর ওডিন তাতে সায় দিচ্ছেন।
ব্রুক বললেন—”তুমি হেরে গেছ, তাই তোমার মুন্ডু আমার, তাই তো? বেশ তো, আমি মুন্ডুতেই সন্তুষ্ট, কাটতে না পারি, তোমার বকবক বন্ধ করতে তো পারি?” বলে তার ঝোলা থেকে একটা শক্তপোক্ত সুতো বার করলো তার সঙ্গে একটা গুণছুঁচ লাগানো, আর বার করলো একটা চামড়া। চামড়া লাগিয়ে লোকির ঠোঁটে গুণছুঁচ আর সুতো দিয়ে এফোঁড় ওফোঁড় করে শক্ত করে ঠোঁটদুটো জুড়ে দিলো। তারপর লোকিকে ছেড়ে স্প্যাতেলহাইমের ‘দিকে যাত্রা করল।
লোকি নিস্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে থাকলেন। সুঁচের ব্যাথার থেকেও বেশি আঘাত লেগেছে কথা বলতে না পারায়, আর ব্রক শেষে এমনি ভাবে জিতে যাওয়ায়। সকল দেবতারা হাসছিলেন তাঁর অবস্থা দেখে। তিনি কিছুই না করতে পেরে, থর, ওডিন এবং অন্যান্য অ্যাসিরদের উপর বেদম রেগে গেলেন এবং প্রতিশোধ নেওয়ার কথা ভাবতে লাগলেন। তিনি দেবতাদের জন্য এতকিছু করলেন, শুধু সিফের চুল নয়, আরো পাঁচটি অসাধারণ উপহার যোগাড় করলেন যা দেবতাদের বারবার সাহায্য করবে, বিশেষত থরের হাতুড়ি মিয়লনির, আর থর কিনা তাঁর উপরেই হাতুড়ি প্রয়োগ করলেন? দেবরাজ ওডিন তাঁর উপকারের কথা ভুলে গিয়ে সামান্য একজন ডোয়ার্ফের কথাকে প্রাধান্য দিলেন? তিনি সামনে কিছুই বললেন না। পরেও বলেননি, কিন্তু মনে মনে দেবতাদের থেকে একটু দূরে সরে গেলেন।
থরের হাতুড়ি মিয়লনির
লোকির সন্তান
লোকি সমস্ত দেবতাদের মধ্যে সবথেকে সুদর্শন ছিলেন, তিনি নিজেও এই কথা জানতেন। সবাই তাঁকে বিশ্বাস করতে চাইতেন, কিন্তু তাঁকে ভরসা করা যেত না। তিনি অত্যন্ত স্বার্থপরও ছিলেন। অ্যাসগার্ডে তিনি বিবাহ করেছিলেন এক সুন্দরী অ্যাসিরকে, যাঁর নাম সিজিন। লোকির ঔরসে তাঁর দুই পুত্রসন্তান, একজন নারফি আর অপরজন ভালি।
মাঝেমধ্যেই লোকি দীর্ঘদিনের জন্য অ্যাসগার্ড থেকে চলে যেতেন। সিজিন তখন তাঁর পথ চেয়ে থাকতেন। একদিন লোকি আবার ফিরে আসতেন। লোকির হাবভাব দেখে মনে হত তিনি এমন কিছু করে এসেছেন যাতে তিনি একাধারে অপরাধী এবং গর্বিত। তাঁর চলা-ফেরা কথা-বলাতেও একটা অন্য রকমের ধার দেখা যেতে লাগল। তিনি দেবতাদের ঠাট্টাচ্ছলে অপমান করা শুরু করলেন। ওডিন কিন্তু তাঁর অন্তরে ক্রমশ একটা কালো ছায়া টের পেতে লাগলেন।
এভাবে তিনবার তিনি অ্যাসগার্ড ছেড়ে গেছেন, আবার তিনবারই বহুদিন পরে আবার ফিরে এসেছেন। তৃতীয়বার যখন তিনি ফিরে এলেন তখন ওডিন তাঁকে ডেকে পাঠালেন।
—“আমি একটা স্বপ্ন দেখেছি,” ওডিন বললেন—–”সেই স্বপ্নে তোমার সন্তানরাও আছে।”
—“বাহ! সে তো খুব আনন্দের কথা। আপনি নিশ্চয়ই জানেন আমার এক সন্তানের নাম নারফি। সে খুবই ভালো ছেলে, তবে সবসময় আমার কথা শোনে না, দুষ্টুমি করে। আর অপরজনের নাম ভালি, সে খুব শান্ত আর বাধ্য ছেলে।” লোকি খুব সপ্রতিভভাবে উত্তর দিলেন।
—“ওদের কথা বলছি না আমি, তোমার আরো তিনজন সন্তান আছে লোকি। তুমি অ্যাসগার্ড ছেড়ে য়োটুনহাইমে গিয়ে বহুদিন বাস করেছ, একথা আমি জানি। অ্যাঙ্গবোদা নামে এক দানবীর সঙ্গে যে তুমি ওখানে বিবাহ করেছ, সেই তথ্যও আমি জানি। আমি এও জানি দানবী অ্যাঙ্গবোদার ঔরসে তোমার তিনটি সন্তান রয়েছে। আমি যখন ঘুমোই আমার মনের চক্ষু তখনো সবই দেখতে পায়। আমার স্বপ্ন আমাকে সাবধান করেছে যে তোমার ওই তিন সন্তান একসময়ে দেবতাদের সবথেকে বড় শত্রু হওয়ে উঠবে।”
লোকি নিরুত্তর থাকলেন, তিনি লজ্জিত হওয়ার অভিনয় করতে চাইলেন, কিন্তু তিনি যে নিজের প্রতি অতিরিক্ত সন্তুষ্ট, সেটা তাঁর ব্যবহারেই ফুটে উঠতে লাগল।
তখন ওডিন সমস্ত দেবতাদের ডেকে পাঠিয়ে পরিস্থিতি ব্যখ্যা করলেন। তারপর থর এবং যুদ্ধের দেবতা টিউকে পাঠানো হল যাতে তাঁরা অ্যাঙ্গবোদার তিন সন্তানকে অ্যাসগার্ডে নিয়ে আসতে পারেন।
য়োটুনহাইমের পথ সোজা নয়, দেবতাদের সেখান দিয়ে যেতে দিতে দৈত্যদের যথেষ্ট আপত্তি আছে। দৈত্যদের সাথে বেশ কিছু যুদ্ধ করে তবেই টিউ আর থর অবশেষে অ্যাঙ্গবোদার প্রাসাদে পৌঁছোলেন। তিনটি শিশু অ্যাঙ্গবোদার বিশাল হলঘরে খেলে বেড়াচ্ছিল। তাদের দেখে টিউ এবং থর দুইজনেই চমকে উঠলেন, কিন্তু ভয় না পেয়ে তাদের বন্দী করলেন। বড়টিকে একটা বিশাল পাইন গাছের সঙ্গে বাঁধলেন, ছোটটির মুখে পরানো হল উইলো কাঠ দিয়ে বানানো এক মুখবন্ধ, তার গলায় লাগানো হল এক লম্বা শিকল আর তৃতীয়জন নিশব্দে ওঁদের পাশে পাশে হাঁটতে থাকল, অত্যন্ত বিষাদকাতর তার মূর্তি। ডানদিক থেকে তার দিকে তাকালে দেখা যায় এক সুন্দরী অল্পবয়সী কন্যা, কিন্তু বাঁদিকে যারাই থাকত তাঁরা না তাকানোর চেষ্টা করত, কারণ বাঁদিক থেকে দেখলে দেখা যেত একজন মৃত বালিকা হেঁটে চলেছে, যার চামড়া মাংস ইত্যাদি সব মরা, পচে কালো হয়ে যাওয়া।
য়োটুনহাইম থেকে বন্দীসহ হেঁটে ফিরতে বেশ কিছুদিন সময় লেগে গেল থর এবং টিউয়ের। তৃতীয়দিনে থর টিউকে বললেন—”একটা জিনিস খেয়াল করেছ? যাওয়ার সময়ে আমাদের এতগুলো যুদ্ধ করতে হল। অথচ আমরা যে ওদের বন্দী বানিয়ে নিয়ে আসছি, কেউ আমাদের সামান্যতম বিরোধিতাও করল না। যেন সবাই ভাবছে লোকির সন্তানদের য়োটুনহাইমের বাইরে নিয়ে যাওয়াই ভালো।”
“তুমিও যেমন! এসব উলটোপালটা কথা ভাবার সময় কি এটা?” যদিও এইকথা বলে থরকে থামিয়ে দিলেন টিউ, তবুও যেন ঠান্ডা হাওয়ায় একবার কেঁপে উঠলেন তিনি, আগুন যথেষ্ট গরম থাকা সত্ত্বেও।
আরো দুদিন চলার পর অবশেষে তাঁরা অ্যাসগার্ডে ওডিনের দরবারে এসে উপস্থিত হলেন।
লোকির প্রথম সন্তানটি একটি বিশাল সর্প, তাকে পাইন গাছের সঙ্গে বেঁধে আনা হয়েছিল, কিন্তু ইতিমধ্যেই সে পাইন গাছের থেকে লম্বা হয়ে গেছে। টিউ বললেন, “যখন বাঁধা হয়েছিল, তখন এ অনেক ছোট ছিল। এই কদিনের মধ্যেই এ পাইনগাছটা ছাড়িয়ে গেছে।”
থর সবাইকে সাবধান করে দিলেন—“ও মুখ থেকে জ্বলন্ত কালো বিষ ছেটাতে পারে। আমার দিকেও ছুঁড়েছিল, তবে সেটা লক্ষভেদ করেনি, ওইজন্যেই আমরা ওর মাথা পাইন গাছের সঙ্গে অমনিভাবে বেঁধে রেখেছি।”
ওডিন বললেন—”এটি এখনও শিশু, এখনো অনেক বাড়বে। ওকে এমন জায়গায় পাঠানো উচিত যেখানে ও কারোর ক্ষতি করতে পারবে না।”
ওডিন ওই মহাসর্পকে নিয়ে গেলেন সেই সমুদ্রের ধারে যা মিডগার্ডকে ঘিরে ছিল। সেখানে গিয়ে তিনি তাকে ছেড়ে দিলেন, সে ধীরে ধীরে সমুদ্রের গভীরে চলে গেল। ওডিন তাকিয়ে রইলেন যতক্ষণ তাঁর নজর যায়। তারপর এক দীর্ঘনিশ্বাস ফেললেন, তিনি নিজেও জানেন না তিনি যা করেছেন তা ঠিক না ভুল। স্বপ্ন দেখে যা বুঝেছেন সেইমত কাজ করেছেন, কিন্তু স্বপ্নেও সম্পূর্ণটা জানা যায় না। এই মহাসর্প সমুদ্রের জলের তলায় ধীরে ধীরে বড় হয়ে উঠবে। একে সবাই জরমুঙ্গড বা মিডগার্ড সর্প বলে জানবে।
ওডিন ফিরে এলেন তাঁর সভায়। এবার লোকির কন্যাকে এগিয়ে আসতে বললেন। ডানদিক থেকে তার গাল গোলাপি, চোখ লোকির চোখের মতই সবুজ, ঠোঁট লাল। কিন্তু বাঁদিক থেকে তার চামড়া মড়া মানুষের মত পচে যাওয়া এবং ফুলে ওঠা। চোখটা পচা এবং খানিকটা ওষ্ঠবিহীন চামড়া কঙ্কালের মত খয়েরি হয়ে যাওয়া দাঁতকে কোনোক্রমে ঢেকে আছে।
“তোমার নাম কী?”—ওডিন জিজ্ঞাসা করলেন।
মেয়েটি খুবই বিনীতভাবে জানালো যে তাকে সবাই হেল বলে ডাকে।
ওডিন তার বিনয়ী উত্তরে সন্তুষ্ট হলেন। মেয়েটি যখন তাঁর দিকে তাকালো, তখন তিনি দেখলেন তার একটি মাত্র জীবিত চোখ, সবুজ বরফের মত শান্ত। অপর চোখটি মৃত। ওডিনের মতই কেবল একচক্ষুতে দেখতে পায় সে। হয়তো সেই কারণেই ওডিনের মনে হল এই মেয়েটিকে ভয় পাওয়ার মত কিছু নেই।
“তুমি জীবিত না মৃত?”—জিজ্ঞাসা করলেন ওডিন।
“আমি আমার নিজের মতই, অন্যদের থেকে একেবারেই আলাদা। আমি সবথেকে পছন্দকরি মৃতদের। তারা সহজ, তারা আমাকে সম্মান করে কথা বলে। অপরপক্ষে জীবিতরা আমাকে অপছন্দ করে, আমার দিকে ঘৃণার দৃষ্টিতে তাকায়।”
ওডিন তার দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকলেন, নিজের স্বপ্নকে মনে করলেন। তারপর ঘোষণা করলেন—”এই বালিকাকে আমি সবথেকে গভীর জগতের শাসনকর্ত্রী নিযুক্ত করলাম। এ এই নয় জগতের সকল মৃত জীবের অধিনায়িকা হবেন। সেই সকল জীব, যারা অসুখে, বৃদ্ধবয়সে, দুর্ঘটনায় বা সন্তানের জন্ম দিতে গিয়ে মারা গেছে; তারা এর প্রজা হবে। যে সকল বীর যোদ্ধা যুদ্ধে প্রাণ দেবেন তাঁরা ভ্যালহালায় আসবেন, কিন্তু যে সমস্ত মানুষ অন্য কোন কারণে মারা যাবেন, তাঁরা সকলেই এঁর প্রজা হবেন। অন্ধকার জগতে এঁকে সঙ্গ দেবেন।”
শুনে এতদিন পর প্রথমবারের জন্য হেলের অর্ধেক ঠোঁটে হাসি ভেসে উঠল।
ওডিন তাঁকে নিয়ে গেলেন অন্ধকার মৃতদের রাজ্যে। তার জন্য তৈরি হল এক সভাঘর। ঘোষণা করা হল যে এবার থেকে এই রাজ্যকে হেলহাইম বলা হবে। হলে গিয়ে ওডিনকে বললেন হেল —”আমি আমার খাওয়ার পাত্রকে ক্ষুধা বলে ডাকব, আমার ছুরির নাম হবে দুর্ভিক্ষ আর আমার শয্যার নাম হবে রোগশয্যা।”
ওডিন যখন ফিরে এলেন তখন তিনি লোকির দুইজন সন্তানের ভবিষ্যত নির্ধারণ করে ফেলেছেন। এবার তৃতীয় জনের ডাক পড়ল। তৃতীয়টি বেশ ছোট, একটি কুকুরছানার মতো ছোট, ধুসর ও কালো রঙয়ের একটি নেকড়ে শাবক। টিউ-এর সঙ্গে তার বেশ ভালো বন্ধুত্ব হয়ে গেছে। টিউ তার সঙ্গে খেলাধুলা করেন, গলার লোম চুলকে দেন, আর সেই উইলো কাঠের মুখবন্ধনীটা খুলে দেওয়া হয়েছে।
নেকড়েশাবকটি কাঁচা মাংস খেতে ভালোবাসে। সে আবার মানুষের মত কথাও বলতে পারে। লোকির মতই সে নিজেকে নিয়ে খুবই গর্বিত। তার নাম হল ফেনরির। (মতান্তরে ফেনরিস)
এরও খুব তাড়াতাড়ি বৃদ্ধি হচ্ছিল। প্রথমদিনে সে একটা পুর্ণবয়স্ক নেকড়ের সমান বড় হয়ে গেছিল। দ্বিতীয়দিনে একটা ভাল্লুকের মত বড়, আর তৃতীয় দিনে একটা মস্তবড় পুরুষ হরিণের সমান বড় হয়ে গেল।
টিউ ছাড়া বাকি দেবতারা ওর কাছে আসতে ভয় পেতেন। শুধুমাত্র টিউ ওর সঙ্গে খেলতেন, ঘুরে বেড়াতেন আর নিজের হাতে করে মাংস খাওয়াতেন। প্রতিদিন ফেনরির আগের দিনের থেকে অনেকটা বেশি করে মাংস খেতো। ক্রমশই বিশাল বড়, আরো শক্তিশালী এবং তেজী হয়ে উঠছিল সে।
ওডিন ফেনরিরের বেড়ে ওঠা লক্ষ রাখছিলেন, তাঁর মনে হচ্ছিল এটা খুবই দুর্লক্ষণ। তিনি তাঁর স্বপ্নে ভবিষ্যৎ দেখেছেন, তিনি দেখেছেন শেষের সেই ভয়ানক দিনে এই তীক্ষ্ণ সাদা দাঁত আর পোখরাজ চোখের দেখা মিলবে।
তাই দেবতারা একদিন আলোচনা সভায় বসলেন ফেনরিরের ভবিষ্যত নিয়ে। সভার শেষে, দেবতারা বানালেন বিরাট বড় বড় শক্তিশালী শিকল আর হাতকড়া। তারপর একদিন ফেনরিরকে যেন নতুন একটা খেলার কথা বলছেন, এমনভাবে বললেন “চলো ফেনরির, আজ তোমার শক্তির পরীক্ষা হয়ে যাক, আমরা খুব মোটা মোটা শিকল আর হাতকড়া এনেছি, তোমার কি মনে হয়, তুমি এগুলি ভাঙতে পারবে?”
ফেনরির শান্তভাবে বলল—”পারব, আমাকে বাঁধো।”
তখন দেবতারা তার থাবায় হাতকড়া পরিয়ে সারা গায়ে শিকল বেঁধে দিলেন। তারপর থর চিৎকার করলেন—”এবার চেষ্টা করো।”
ফেনরির নিজের মাংসপেশি ফুলিয়ে এক টান দিল, সঙ্গে সঙ্গে সব শিকল কাঠের টুকরোর মত ভেঙে পড়ল।
দেবতারা হেরে গিয়ে বিদায় নিলেন। এবার নিজেদের উপর আর ভরসা না রেখে তাঁরা এক অ্যাসির কামারের শরণাপন্ন হলেন। মাটি খুঁড়ে যে লোহা পাওয়া যায়, তার সঙ্গে মেশানো হল আকাশ থেকে পড়া লোহা। তৈরি হল এক এমন ধাতু, যার থেকে বেশি শক্ত কোনো ধাতুই ছিল না জগতে। সেই ধাতু দিয়ে কামাররা বানালেন এক নতুন শিকল, এই নতুন শিকলের প্রতিটা আংটা এত ভারী হল যে কোনো সাধারণ মানব তুলতে পারবে না, এই শিকলের নাম হল ড্রোমি, দেবতারা টেনে টেনে এই নতুন শিকলকে ফেনরিরের কাছে নিয়ে এলেন। ফেনরির ঘুমোচ্ছিল তখন।
সে চোখ খুলে বলল—”আবার?”
—“যদি তুমি এই শিকল থেকে বেরোতে পারো তাহলে তোমার মত শক্তিশালী কেউ নেই বলে আমরা সবাই মেনে নেব। তুমি সবথেকে শক্তিশালী হওয়ার শৌর্য লাভ করবে। দেবতা, এমনকি দানবদের থেকেও তোমার শক্তি বেশি বলে মেনে নেওয়া হবে।”
—-”বেশ, তবে তাই হোক।”
তখন সেই শিকল দিয়ে তাকে ভালো করে বেঁধে দেওয়া হল। সে বেশ কিছুক্ষণ চেষ্টা করল, কিছুই হল না। দেবতারা বেশ খুশি হয়ে গুহা থেকে বেরিয়ে আসছিলেন, এমন সময় এত জোরের সঙ্গে সেই শিকল ছিন্ন হল যে তাঁরা কাছে থাকলে আংটার ঘায়ে হয় মারা পড়তেন না হলে গুরুতর আহত হতেন। চারদিকে শিকলের টুকরো ছড়িয়ে গেল, গুহার ছাত ফেটে বাইরে চলে গেল। বহু দিন পরেও দেবতারা ওই শিকলের টুকরো কোনো গাছে বা পাহাড়ে আটকে থাকতে দেখেছেন।
ফেনরির নিজের সাফল্যের আনন্দে বিরাট এক হুঙ্কার ছাড়ল। তবে এবার সে লক্ষ্য করেছে, কোনো দেবতা, এমনকি টিউও তার এই সাফল্যে তেমন আনন্দিত নন।
এরপর বাধ্য হয়ে ওডিন তাঁর সব জ্ঞান কাজে লাগিয়ে এক নতুন ধরনের শিকলের কথা জানলেন, তার নাম গ্লিপনির। স্কিরনির নামে একজন এলফকে এই শিকল বানিয়ে আনার দায়িত্ব দিলেন ওডিন। তিনি আসলে ফ্রে এর সংবাদবহনকারী, তবে যেহেতু তিনি সব যায়গায় খুবই দ্রুত পৌঁছতে পারেন, তাই তাঁকেই ওডিন বোঝালেন কীভাবে এই একদম অন্যরকম শিকল জোগাড় করা যাবে। তখনই তিনি তাঁর দ্রুতগামী তাঁর ঘোড়া নিয়ে বেরিয়ে পড়লো স্প্যাতেলহাইমের উদ্দেশ্যে। সেখানকার দক্ষ কারিগর ডোয়ার্ফদের তিনি বোঝালেন ঠিক কেমন জিনিস চাই। ডোয়ার্ফরা তো মস্ত দাম হাঁকলেন, কিন্তু স্কিরনির তাতেই রাজি।
তখন ডোয়ার্ফরা খুঁজে পেতে সংগ্রহ করলেন এই শিকলের জন্য প্রয়োজনীয় সামগ্ৰী।
বেড়ালের পদশব্দ, মহিলার দাড়ি, পর্বতের শিকড়, ভাল্লুকের পায়ের মাংসপেশী, মাছের নিঃশ্বাস আর পাখির থুতু। এইসব জিনিস আর পাওয়া যায়না কারণ ডোয়ার্ফরা সব ব্যবহার করে ফেলেছে।
যখন ডোয়ার্ফরা এসব জিনিস ব্যবহার করে নিজেদের কাজ শেষ করলেন, তখন তাঁরা স্কিরনিরকে একটা বাক্স দিলেন। বাক্সের ভেতরে যে শিকল ছিল, সেটা খানিকটা সিল্কের রিবনের মত দেখতে, নরম, এত স্বচ্ছ যে প্রায় অদৃশ্য আর অত্যন্ত হালকা।
স্কিরনির বাক্স নিয়ে ফিরে এসে দেবতাদের ডাকলেন। তাঁরা এসে একদম নতুন রকমের শিকল দেখে একই সঙ্গে আনন্দিত এবং অবাক হলেন। তখন সন্ধ্যা হয়ে এসেছে, দেবতারা সবাই গেলেন সেই কালো ঝিলের ধারে যেখানে ফেনরির থাকে। ফেনরিরকে ডাকার সঙ্গে সঙ্গেই সে ছুটে ছুটে এলো। যখন ওডিন তাকে দেখালেন এই শিকল, সে বলল—”আমি যেকোনো শিকল ছিঁড়তে পারি, এটা তার কাছে কিছুই না, আমার জন্য বড় শিকল নিয়ে এসো।”
দেবতারা বললেন—”আরে এটা আমরা কেউ ছিঁড়তে পারিনি, তুমি কি ভয় পাচ্ছ?”
—“ভয়? না না, একেবারেই ভয় না, তবে এটা ছিঁড়তে পারলে আমি কী পাব? কেউ তো বলবে না যে ফেনরির খুব শক্তিশালী কারণ ও একটা সিল্কের রিবন ছিঁড়তে পেরেছে! হা হা হা! না আমি এই শিল্পনির ছেঁড়া খেলাটা খেলতে রাজি নই।”
ওডিন পরিষ্কার বললেন—“তুমি ভীতু, তুমি ভয় পাচ্ছ।”
ফেনরির বাতাসটা একটু শুঁকে বলল—”আমার কেমন যেন মনে হচ্ছে, বাতাসে বিশ্বাসঘাতকতা আর ধুর্তামির গন্ধ ভাসছে। যদি তোমাদের এই গ্লিপনির, সাধারণ সিল্কের ফিতে নাও হয়, তাহলেও আমি নিজেকে বাঁধার অনুমতি দেব না।”
থর বললেন—”আরে, তুমি এত বড়বড় শিকল ভেঙেছ তুমি, আর এই সামান্য সিল্কের শিকল ভাঙতে ভয় পাচ্ছ!”
ওডিন বললেন—”তোমাকে আমি মোটেই বোকা ভাবি না ফেনরির। এখানে কোনো বিশ্বাসঘাতকতার ব্যাপারই নেই, তবে আমি বুঝতে পারছি তোমার আপত্তির কারণ। সত্যিই তো কোনো বীর যোদ্ধা এমন শিকলে বাঁধা পড়তে চাইবেনই বা কেন, যেটা তিনি ভাঙতে পারবেন না? আমি দেবতাদের পিতা হিসাবে তোমাকে বলছি, যদি এটা তুমি ভাঙতে না পারো, তাহলে দেবতারা মেনে নেবেন যে তুমি দেবতাদের সমকক্ষ নও, শুধু শুধু তোমাকে ভয় পেয়ে লাভ নেই, তখন তোমাকে মুক্ত করে দেওয়া হবে, তুমি যেখানে ইচ্ছে যেতে পারো।”
রাগে গরগর করে ফেরির বলল—”ওডিন তুমি মিথ্যে কথা বলছ, তুমি শ্বাস-প্রশ্বাসের মতই মিথ্যে বলতে পারো। যদি তুমি একবার আমাকে এমন বাঁধনে বাঁধতে পারো যা থেকে আমি বেরোতে পারব না, তাহলে তুমি মোটেই আমাকে মুক্ত করবে না, তুমি আমাকে এখানেই ছেড়ে চলে যাবে, আমি কোনোমতেই এটা দিয়ে আমাকে বাঁধার অনুমতি দেব না।”
ওডিন বললেন—”ফেনরির, তুমি বড়ই বীরত্বের কথা বললে। আমাকে মিথ্যেবাদী বলে তুমি নিজের ভয়কে চাপা দিতে চাইছ আমি বুঝেছি। থাক, আর ব্যাখ্যা করে কাজ নেই।”
ফেনরির খানিকক্ষণ চোখ বুজে ভাবল, তারপর সে হাসল। সবাই সবিস্ময়ে তাঁর দাঁতগুলি দেখলেন, এক একটা দাঁত এখন একটা মানুষের হাতের মত বড় হয়ে গেছে। অবশেষে সে বলল—”আচ্ছা, আমার সাহস আছে কিনা সে প্রশ্ন না করে আমার শর্ত শোন। তুমি আমাকে বাঁধতে পারো, তবে তার আগে একজন তার হাত আমার মুখের মধ্যে রাখবে। আমি আস্তে দাঁত বন্ধ করব, কিন্তু কামড়াবো না। যদি কোনোরকম বিশ্বাসঘাতকতা না থাকে, তাহলে যখন আমি গ্লিপনির শিকল থেকে মুক্ত হব তখন হাত ছেড়ে দেব। হাতে কোনোরকম ক্ষতি হবে না, আমি শপথ করছি। এবার বলো কে আমার মুখে হাত রাখবে?”
সব দেবতারা মুখ চাওয়াচাওয়ি করলেন কিন্তু কেউ এগিয়ে এলেন না। অবশেষে টিউ একটা দীর্ঘনিশ্বাস ফেলে বললেন
“আমিই তোমার মুখের মধ্যে হাত রাখব।” ফেরির তখন কাত হয়ে শুয়ে পড়ল, টিউ তাঁর ডানহাত তাঁর মুখের মধ্যে ঢুকিয়ে দিলেন ঠিক সেই আগের দিনগুলির মত, যখন তাঁরা দুইজনে একসঙ্গে খেলতেন।
দেবতারা গ্লিপনির দিয়ে তাঁকে বেঁধে ফেললেন, চাঁদের আলোয় রিবন তখন চকচক করছে। ওডিন বললেন “এবার দেখি এটা ভেঙে ভেলতে পারো কিনা ফেনরির।”
ফেনরির অনেক চেষ্টা করলেন, কিন্তু প্রতিবার চেষ্টার সঙ্গে সঙ্গে যেন এই বাঁধন আরো পোক্ত হল, কিছুতেই খোলা গেল না। ধীরে ধীরে ফেনরিরের নড়ার ক্ষমতাও কমল, তখন দেবতারা হাসাহাসি শুরু করলেন। একমাত্র টিউ হাসলেন না। এক সময় ফেনরির চেষ্টা বন্ধ করল, যদি দেবতাদের তাকে মুক্ত করে দেওয়ার থাকে, তাহলে এটাই উপযুক্ত সময়। কিন্তু দেবতারা তা করলেন না, তাঁরা শুধুই হাসতে থাকলেন।
টিউ আর ফেনরির পরস্পরের দিকে তাকালেন। তারপর টিউ চোখ বন্ধ করে ঘাড় নাড়লেন—”তোমার শর্ত পূর্ণ করো।”
ফেরির এক কামড়ে টিউএর হাত বিচ্ছিন্ন করে দিলেন। টিউ কোনো শব্দ করলেন না। আস্তে আস্তে অন্য হাত দিয়ে এই হাতের রক্ত বন্ধ করার চেষ্টা করতে লাগলেন। ফেনরির এরপর দেখল গ্রিপনিরের একদিক একটা পর্বতের মত বড় পাথরের সঙ্গে বাঁধা হল। তারপর আরেকটা ততোধিক বড় পাথর দিয়ে ঠুকে ঠুকে সেই পাথরটাকে একটা গভীর গর্তে পুঁতে দেওয়া হল। গর্তটা হল গভীরতম সমুদ্রের থেকেও গভীর।
এবার ফেনরির চেঁচিয়ে উঠল—”ওডিন, তুমি বিশ্বাসঘাতক, মিথ্যেবাদী। যদি তুমি আমাকে মিথ্যা না বলতে তাহলে আমি দেবতাদের বন্ধু হয়ে থাকতাম। তোমার ভয় তোমাকে বিশ্বাসঘাতক বানিয়েছে, আমি জানি। আমি শপথ নিলাম, ভবিষ্যতে তোমায় হত্যা করব। আমি অপেক্ষা করব শেষের সেই ভয়ানক দিনের জন্য, যেদিন সবকিছু ধ্বংস হবে, সেদিন আমি সবথেকে আনন্দ পাব তোমাকে হত্যা করে।”
দেবতারা ফেনরিরের হাঁ-এর নাগালের বাইরে দাঁড়িয়ে ছিলেন। যে দেবতা তার সবথেকে কাছে দাঁড়িয়ে ছিলেন, তিনি তার তরবারিটা ফেনরিরের মুখের উপরের তালুর মধ্যে আটকে দিলেন, তাতে উপরের চোয়াল আর নিচের চোয়ালের মধ্যে একটা চিরস্থায়ী ফাঁক হল। আর কোনোভাবে চোয়াল বন্ধ করা সম্ভব হল না। ফেনরিরের লালা অবিশ্রান্তভাবে বেরিয়ে একটা নদীর সৃষ্টি করল।
এইভাবে লোকির তিন সন্তানের সঙ্গে মোকাবিলা করলেন ওডিন এবং তার সহযোগী দেবতারা। নিজেদের আতঙ্কের কাছে আত্মসমর্পণ করে তাঁরা সম্পূর্ণ অকারণে ফেনরিরকে শত্রু বানালেন। ভবিষ্যতে এই অকারণ শত্রুতার ফলও তাঁদের ভয়ানকভাবে ভোগ করতে হবে।
বল্ডারের মৃত্যু
বল্ডার হলেন ওডিন এবং ফ্রিগের দ্বিতীয় সন্তান। তিন সন্তানের মধ্যে তিনি সবথেকে সুন্দর দেখতে, সবথেকে প্রিয় এবং সূর্যের মত জ্যোতির্ময়। তিনি জ্ঞানবান, নরম স্বভাবের এবং লিখনে সবথেকে পটু। তিনি জ্ঞানী এবং ন্যায্য বিচারক। তাঁর বাড়ির নাম ব্রাইডাব্লিক। সে এক অদ্ভুত সুন্দর শান্তিময় জায়গা, সেখানে সবসময় আনন্দ, সঙ্গীত এবং জ্ঞান লাভ করা যায়।
বল্ডারের স্ত্রীয়ের নাম হল ন্যান্না। বল্ডার তাঁকে গভীরভাবে ভালোবাসেন। তাঁর সুযোগ্য সন্তান ফরসেটি তাঁরই পদাঙ্ক অনুসরণ করে ন্যায্য বিচারক হয়ে বেড়ে উঠছে। বল্ডারের জীবনে সবকিছুই একদম সঠিক, সবকিছুই আনন্দময়। শুধু একটিমাত্র ব্যাপার বাদে। বল্ডার প্রতিদিনই খুব খারাপ খারাপ দুঃস্বপ্ন দেখেন।
তিনি স্বপ্ন দেখেন জগত শেষ হতে চলেছে, এক নেকড়ে চন্দ্ৰ—সুর্যকে গিলে খাচ্ছে। তিনি অন্ধকারে আটকে পড়েছেন। ভাই ভাইকে মেরে ফেলছে। কেউ কাউকে বিশ্বাস করতে পারছে না। এক নতুন যুগ এসেছে, যেখানে কেবল অশেষ দুঃখ, মৃত্যু এবং হত্যা রয়েছে। এইসবই স্বপ্নে দেখেন তিনি। প্রতিবারেই বল্ডারের ঘুম ভেঙে যায় কাঁদতে কাঁদতে, তিনি ঘুম থেকে উঠে পড়েন। সে কষ্ট বলে বোঝানো যায় না।
অবশেষে আর সহ্য করতে না পেরে বল্ডার দেবতাদের কাছে তাঁর দুঃস্বপ্নের কথা খুলে বললেন। কোনো দেবতাই সেই স্বপ্নের সঠিক ব্যখ্যা দিতে পারল না। শুধুমাত্র লোকির মুখে একটু হাসি ফুটে উঠল।
অবশেষে ওডিন তাঁর ধুসর আলখাল্লা আর জাদুকরের টুপি মাথায় চাপিয়ে বল্ডারের স্বপ্নের রহস্য জানতে বেরিয়ে গেলেন। ভবঘুরে ভেগটাম নাম নিয়ে অনেক ঘুরলেন তিনি, কিন্তু কেউই তাঁর প্রশ্নের উত্তর দিতে পারল না। তবে কিছু মানুষ তাঁকে জানালো, একজন জ্ঞানী মহিলা ছিলেন, তাঁর নাম ভোলভা। তিনি সব দেখতে পেতেন, সব বুঝতে পারতেন, তিনিই সাহায্য করতে পারতেন। তবে এখন আর তা সম্ভব না, কারণ তিনি মারা গেছেন।
ভোলভার কবর একদম মিডগার্ডের শেষ প্রান্তে। তারপর থেকেই হেল-এর রাজত্ব শুরু হচ্ছে। মৃতদের রানী হেল হলেন লোকির কন্যা।
ওডিন পূর্বদিকে যাত্রা শুরু করলেন, তিনি কবরের কাছে পৌঁছনোর পরেই থামলেন। সেখানে তিনি তাঁর জাদুর প্রয়োগ করলেন। তাঁর জানা সমস্ত রুন, তাঁর সমস্ত পুরোনো জ্ঞান, গুপ্ত ক্ষমতা, এমনকি কালোজাদুও প্রয়োগ করলেন। কিছুক্ষণ পরে দেখা গেল তাঁর সামনে এক নারীমুর্তি দাঁড়িয়ে আছে। তাঁর মুখ ছায়ায় ঢাকা।
—“মৃতদের রাজ্য থেকে এখানে ফিরে আসতে আমাকে অনেক কঠিন পথ অতিক্রম করতে হল। বল পথিক, কেন আমাকে জাগালে? তুমি কে?”
ওডিন বললেন—”আমার নাম ভবঘুরে ভেগটাম। আমাকে বলুন, হেলের প্রাসাদে নতুন খবর কী?”
সেই মৃত নারী, ভোলভা ওডিনের দিকে তাকিয়ে বললেন “দেবরাজ ওডিনের পুত্র বল্ডার শীঘ্রই আমাদের কাছে আসবে। জীবিতের জগতকে আস্তে আস্তে হতাশা ঘিরে ধরছে এবং ধরবে। একমাত্র মৃতদের জগত আনন্দে ভরে উঠছে, বল্ডারের আসার আনন্দে আমরা বিশেষ মদ্য বানাচ্ছি। এসব সংবাদ তোমাকে জানানো আমার উচিত নয়, অত্যন্ত অনিচ্ছার সঙ্গে আমি এই সংবাদ তোমাকে জানাচ্ছি কারণ আমাকে বিভিন্ন জাদু বাধ্য করছে। তবে আমি আর কোনো কথা বলব না।”
ওডিন তাঁকে অনুনয় করে বললেন—“দয়া করে আমাকে আমার প্রশ্নের উত্তর দিন জ্ঞানী ভোলভা। কে বল্ডারকে হত্যা করবে? কে বল্ডারের হত্যার প্রতিশোধ নেবে?”
—“বল্ডারের মৃত্যু হবেই। এটুকুই আমি বলতে পারব। আর মিডগার্ডের পশ্চিমদিকে ওডিনের একটি সন্তান হবে। তার নাম হবে ভালি, সেই প্রতিশোধ নেবে বল্ডারের হত্যার। তবে আমি আর কোনো কথা বলব না।”
তবু ওডিন আবার অনুনয় করে জিজ্ঞাসা করলেন—”আর একবার কথা বলুন জ্ঞানী ভোলভা, আমার শেষ প্রশ্নটির উত্তর দিন দয়া করে। বল্ডারের মৃত্যুতে কে কে শোকগ্রস্ত হবেন? কেই বা একেবারেই দুঃখিত হবেন না?”
এই প্রশ্ন শুনে সেই মৃতনারী অনেকক্ষণ চুপ করে ওডিনের দিকে তাকিয়ে থাকলেন। তারপর বললেন—”আমি বুঝতে পেরেছি তুমি ভবঘুরে নও, তুমি ওডিন। অনেক কাল আগে নিজের কাছেই নিজেকে বলি দিয়েছিল যে, সেই ওডিন। বাড়ি ফিরে যাও ওডিন, আর আমাকে প্রশ্ন করো না। কেউ আমাকে আর দেখতে পাবে না বা ডেকে ফেরাতে পারবে না, যতদিন না লোকি তাঁর বাঁধন ছিঁড়ে অ্যাসিরদের ধ্বংসের কারণ হবেন। জগতের শেষ হবে র্যাগনারকে। সেই র্যাগনারক ঘনিয়ে আসছে।” এই কথাগুলি বলে ভোলভা ধীরে ধীরে মাটির মধ্যে মিশে গেলেন।
ওডিনের দুশ্চিন্তা বাড়লো বই কমলো না। দেবতারাও ভবিতব্যকে বদলাতে পারেন না। যদি বল্ডারকে বাঁচাতে হয় তাহলে চালাকির সাহায্য নিতে হবে, না হলে অসম্ভব। আর ভোলভার আরেকটা কথায় তাঁর খটকা লাগল, “লোকি তাঁর বাঁধন ছিঁড়ে অ্যাসিরদের ধ্বংসের কারণ হবেন”। কেন? লোকিকে তো বেঁধে রাখা হয়নি? তারপর অনেক ভেবে তিনি সিদ্ধান্তে এলেন, লোকিকে এখনো বেঁধে রাখা হয়নি। ভবিষ্যতে কী ঘটবে, কোন ঘটনার কেমন প্রতিক্রিয়া হবে সে কথা কেউ বলতে পারে না।
ওডিন ফিরে এলেন এবং কাউকে কিছু বললেন না, সব কথা নিজের মধ্যেই রাখলেন। তবে ওঁর স্ত্রী ফ্রিগকে তিনি সবকথা খুলে জানালেন। আর জানালেন বন্ডারের স্বপ্ন একেবারে সত্যি, তাঁর মৃত্যু আসন্ন।
ফ্রিগ খুবই বাস্তববাদী দেবী। তিনি একটু ভেবে বললেন—“আমি বিশ্বাস করতে পারছি না। যেমন সূর্য, সূর্যের উত্তাপ এবং জীবনকে ঘৃণা করে, এমন কেউ এই জগতে নেই। তেমনি আমার আমার সুন্দর সন্তান বল্ডারকে কেউ ঘৃণা তো দূরের কথা, অপছন্দও করে না। আমি একথা প্রমাণ করেই ছাড়ব।” এই বলে তিনি বেরিয়ে গেলেন।
তিনি অ্যাসগার্ড এবং মিডগার্ডের সমস্ত জায়গা ঘুরলেন। যে সমস্ত প্রকারের জীব বা বস্তুর সঙ্গে তাঁর দেখা হল, তিনি তাদের প্রতিজ্ঞা করালেন যে তারা যেন বন্ডারকে কখনও আঘাত না করে। আগুন কথা দিল বল্ডারকে দগ্ধ করবে না, জল প্রতিজ্ঞা করল বল্ডার কখনো ডুবে যাবেন না। লোহা এবং অন্যান্য ধাতু শপথ করল কখনও তাঁকে কাটবে না। পাথরেরা কথা দিল তারা কখনও আঘাত করবে না। এরপর ফ্রিগ সমস্ত গাছ, সমস্ত পশু, সমস্ত পাখি, সমস্ত কীট পতঙ্গের সঙ্গে কথা বললেন। সকলেই শপথ করল যে বল্ডারকে আঘাত করবে না। তারপর তিনি জাদুপ্রয়োগ করে সমস্ত রোগব্যাধিকে ডেকে পাঠালেন। তারাও কথা দিল যে কোনো ভাবেই বল্ডারকে তারা স্পর্শ করবে না। কোনো কিছুই ফ্রিগের কাছে ছোট বা সামান্য ছিল না, সবকিছুকেই তিনি শপথ করিয়ে নিলেন। বাদ পড়ল শুধু মিসেলটো। এই পরগাছা লতাটি এতই অন্যের উপর নির্ভরশীল, এতই ছোট, এতই অপ্রয়োজনীয় যে ফ্রিগ এর কথা একদম ভুলে গেলেন। পরে অ্যাসগার্ডে ফিরে এসে যখন তাঁর মনে পড়ল, তখনো তিনি অগ্রাহ্য করলেন। ভাবলেন, ওইটুকু পরগাছার জন্য কে আবার ফিরে যাবে? সবাই প্রতিজ্ঞা করার পর তিনি ঘোষণা করলেন যে বন্ডার সম্পূর্ণ সুরক্ষিত, কিছুই তাঁকে ক্ষতিগ্রস্ত করতে পারবে না। সব অ্যাসিররা তাঁর দাবীর প্রতি সন্দেহ প্রকাশ করল, এমনকি বন্ডারও। তখন তিনি একটা পাথর ছুঁড়ে বল্ডারকে মারলেন। পাথর বল্ডারের চারধারে লাফাতে লাগল, কিন্তু আঘাত করল না। সেই দেখে সবাই খুব আশ্চর্য হলেন।
অনেককাল পরে বল্ডার হেসে উঠলেন, যেন মেঘের মধ্য থেকে সুর্য বেরিয়ে এলো। দেবতারাও হাসলেন তাঁকে দেখে। তারপর যেন এক খেলা শুরু হল। সবাই মিলে বিভিন্ন অস্ত্র ছুঁড়ে মারলেন বল্ডারের দিকে, কিন্তু বল্ডারের কিছু হল না। তরবারি তাঁকে স্পর্শ করল না, বর্শা তাঁকে ভেদ করল না।
সমস্ত দেবতারা বেজায় খুশি হলেন, তাঁরা বল্ডারকে ঘিরে হইচই করে আনন্দ প্রকাশ করতে লাগলেন। শুধু দুইজনের মুখে হাসি ছিল না। একজন লোকি, আর অন্যজন বল্ডারের ভাই হোডার। তিনি অন্ধ। তিনি বারবার জিজ্ঞাসা করতে লাগলেন “কী হয়েছে, কী হয়েছে! এত আনন্দ কীসের? আমিও এই আনন্দের অংশীদার হতে চাই।” কিন্তু কেউ তাঁর কথা কানে তুললেন না।
কিছুক্ষণ পর এক সুন্দরী মহিলা ফ্রিগকে জিজ্ঞাসা করলেন “তুমি নিশ্চয়ই তোমার সন্তানকে নিয়ে অত্যন্ত গর্বিত। কিন্তু সবাই যে ওঁকে অস্ত্র দিয়ে আঘাত করছে অমনভাবে, তোমার ভয় করছে না? আমার সন্তান হলে আমি তো আতঙ্কিত হয়ে পড়তাম।”
ওই উৎসবের দিকে তাকিয়েই ফ্রিগ গর্বিত স্বরে উত্তর দিলেন —”আমি আতঙ্কিত হচ্ছি না, কারণ আমি জানি বন্ডারের কিছুই হবে না। কোনো অস্ত্র, কোনো রোগ, কোনো পাথর, কোনো পশু, এমনকি কোনো গাছও আমার পুত্রকে আঘাত করতে পারবে না। আমি সবাইকে দিয়ে প্রতিজ্ঞা করিয়েছি।”
—“বাহ, খুব ভালো করেছ! এই তো মায়ের যোগ্য কাজ।” মহিলা বললেন। ফ্রিগ ঠিক চিনে উঠতে পারছিলেন না এঁকে কোথায় দেখেছেন। তবে এত মধুর করে উনি কথা বলছেন, তাই ফ্রিগও নির্দ্বিধায় উত্তর দিচ্ছিলেন।
মহিলা বললেন—”আমি তোমার বুদ্ধি দেখে খুবই আনন্দ পেয়েছি। তবে তুমি নিশ্চিত তো যে কিচ্ছুটি বাদ যায়নি?”
ফ্রিগ বললেন—”নাহ্! কিছু না। শুধু একটা ছোট্ট লতা বাদ গেছে। মিসলটো। তবে ওটা খুবই ছোট একটা লতানে গাছ।
নিজেই বেঁচে থাকার জন্য অন্য গাছের উপর নির্ভর করে, ও কি আর আঘাত করতে পারবে? মিসলটো দিয়ে তো আর মুগুর বানাতে পারবে না?”
মহিলা বললেন—”মিসলটো? হ্যাঁ সত্যিই, বড় অকিঞ্চিৎকর গাছ। আমি তোমার জায়গায় থাকলে আমিও এটা নিয়ে মাথা ঘামাতাম না। ঠিকই বলেছ তুমি।”
ফ্রিগের এই মহিলাকে চেনা চেনা লাগছিল, কিন্তু কিছুতেই চিনতে পারছিলেন না। সবাই বল্ডারকে নিয়ে এত আনন্দ করছিল, মজা করছিল যে ফ্রিগের মনোযোগই ছিল না এদিকে। একটু পরে তিনি কথা বলার জন্য যখন ঘাড় ঘোরালেন, তখন দেখলেন যে সেই মহিলা কোথাও নেই। এই কথোপকথনটাও তাঁর মাথা থেকেও সঙ্গে সঙ্গেই দূর হয়ে গেল।
লোকি তখন মহিলার রূপ থেকে নিজের রূপে ফিরে পশ্চিমদিকে যাত্রা শুরু করেছেন। অনেকটা পথ হেঁটে এসে তিনি একটা ওক গাছের সামনে দাঁড়ালেন। এই ওকগাছকে জড়িয়ে একটা মিসলটো লতা উঠেছে। বিশাল ওক গাছের পাশে মিসলটোকে আরও বেশী অকিঞ্চিৎকর লাগছে। লোকি ভালো করে মিসলটো লতাকে পরীক্ষা করলেন। মিসলটোর ফল, পাতা, লতানে কান্ড, সবই। একবার তিনি ভাবলেন, মিসেলটো ফল থেকে বিষ বানিয়ে বল্ডারকে খাওয়ানো যায় কী না। তারপর ভাবলেন এটা খুবই সরল পন্থা, এভাবে হবে না। যদি বল্ডারকে আঘাত করতেই করতে হয়, তবে শুধু সে নয়, তার সঙ্গে যত বেশি সম্ভব অ্যাসিরকে আঘাত করতে হবে।
বেচারা অন্ধ হোড়ার একধারে দাঁড়িয়ে ছিলেন। কেউ তাঁর সঙ্গে কথা বলছে না। চারদিকে কত হইচই হচ্ছে। সকলে কত মজা করছে কিন্তু কেউ তাঁকে মজায় অংশীদার করছে না। হোডার খুবই শক্তিশালী, সবথেকে শক্তিশালী দেবতাদের মধ্যে একজন কিন্তু তিনি অন্ধ। সাধারণত বল্ডার তাঁকে সবসময় সব আনন্দের অংশীদার বানান, কিন্তু এবার বল্ডারও তাঁকে ভুলে গেছেন।
হঠাৎ তিনি শুনতে পেলেন, তাঁর পাশ থেকে কেউ একজন বললেন—”তোমাকে খুব দুঃখিত মনে হচ্ছে হোড।” চিনতে পারলেন লোকির গলা।
—“আসলে সবাই এত আনন্দ করছে! আমার প্রিয় ভাই বল্ডার, সেও এত আনন্দিত, কিন্তু কী হচ্ছে বুঝতে পারছি না। আমারও এই আনন্দে অংশগ্রহণ করার খুব ইচ্ছে হচ্ছে। এই আনন্দের মুহূর্তে, কিছুই না দেখতে পেয়ে, একা দাঁড়িয়ে থাকার জন্য আমি শুধু আমার ভাগ্যকেই দোষারোপ করতে পারি।”
—“তোমার মা ফ্রিগ, সকল বস্তু এবং জীবের থেকে শপথ নিয়েছেন যে কোনোকিছুই বল্ডারকে আঘাত করতে পারবে না। তাই সবাই বল্ডারকে বিভিন্ন জিনিস ছুঁড়ে মারছে, তাতে বল্ডারের কোনো ক্ষতি হচ্ছে না দেখে সবাই খুব আমোদ পাচ্ছেন। তুমি অংশ নিতে পারছ না বলে দুঃখ পাচ্ছ? শুধু শুধু ভাগ্যকে দোষারোপ করে দুঃখ পেয়ো না। সমস্যা থাকলে সমাধানও আছে। আচ্ছা হাত বাড়াও দেখি।”
হোডার লোকির মুখ দেখতে না পেলেও তাঁর সমব্যাথী কথাগুলি ওঁর মন ছুঁয়ে গেল। উনি হাত বাড়ালেন।
লোকি হাতে কিছু একটা দিলেন। তারপর হাত বন্ধ করে দিলেন। লোকি বললেন—“তোমাকে আমি বল্ডারের কাছে নিয়ে যাব, আর তোমাকে বল্ডারের দিকে ঘুরিয়ে দেব, তোমার সব শক্তি দিয়ে এই বাণটা ছুঁড়ে মেরো ওর দিকে। তারপর সব দেবতারা হেসে উঠবেন আর বল্ডারও দেখে আনন্দ পাবেন যে তাঁর অন্ধ ভাইও কত মজা করে নিল।”
এই বলে লোকি হোডারকে সামনের দিকে নিয়ে গেলেন। এক জায়গায় দাঁড় করিয়ে বললেন—“হ্যাঁ! এটা একটা ভালো দাঁড়াবার জায়গা। তুমি দাঁড়াও, আর যখন আমি বলব তখন বাণটা ছুঁড়ে দিও।”
হোডার বললেন—”এটা একটা ছোট বাণ, আমি যদি একটা বর্শা বা একটা পাথর ছুঁড়ে মারতে পারতাম তাহলে বেশ হত।”
“আরে এটাই যথেষ্ট” বলে লোকি হোডারের কানে কানে বললেন “এইবার ছোঁড়ো।”
তখনই থর একবার একটা লোহার কাঁটাওয়ালা বিরাট মুগুর বল্ডারের মাথায় ভেঙেছেন এবং সেটা গুঁড়ো হয়েছে দেখে সবাই অট্টহাস্য করছেন। তার মধ্যেই হোডার মিসেলটো দিয়ে বানানো বাণ ছুঁড়লেন, না জেনেই।
হঠাৎ সব হাসি থেমে গেল।
—“তোমরা কেউ হাসছ না কেন? আনন্দ করছ না কেন? আমি বড় কিছু ছুঁড়ে মারতে পারিনি বলে? বল্ডার তুমি তো অন্তত হাসো?” হোডারের আওয়াজ শোনা গেল।
এরপরেই একটা ভারী কিছু পড়ার আওয়াজ হল, আর সঙ্গে সঙ্গে ফ্রিগ হৃদয়বিদারক কণ্ঠে চেঁচিয়ে কেঁদে উঠলেন—”ওহ্ বল্ডার! ওহ্! আমার প্রিয় পুত্র…”
লোকি হোডের কানে কানে ফিসফিস করে বললেন—“ যাহ্! তুমি তোমার প্রিয় ভাইকে হত্যা করলে?” লোকির কথাগুলির মধ্যে কোনোরকম দুঃখের রেশ ছিল না।
বল্ডারের মৃতদেহ পড়ে থাকল, মিসেলটোর বাণ তাঁর হৃদয় ভেদ করেছে। দেবতারা সবাই ঘটনার আকস্মিকতায় বিভ্রান্ত। ওডিন শুধু বললেন—“হোডের উপর কোনোরকম প্রতিশোধ নেওয়া হবে না, এখনই না। আমরা একটি পবিত্রস্থানে দাঁড়িয়ে আছি। তাছাড়া হোডের উপর যে প্রতিশোধ নেবে সে এখনো এখানে উপস্থিত হয়নি।”
ফ্রিগ চেঁচিয়ে বললেন “কে আমার পক্ষ থেকে হেলের কাছে যাবে?” হয়তো সে বল্ডারকে ফিরিয়ে দেবে এই জগতে। হেলও এত নিষ্ঠুর হবেনা নিশ্চয়ই। তারপরেই তিনি ভাবলেন যে, হেল আসলে লোকির সন্তান। তিনি যোগ করলেন—”এছাড়াও আমরা বল্ডারের জীবনের বিনিময়ে হেল যা চাইবে তাই দান করব। কিন্তু কে যাবে হেলের কাছে? আমি আগে থেকেই তাকে সাবধান করছি, তুমি নাও ফিরতে পারো।”
দেবতারা যখন মুখ চাওয়াচাওয়ি করছেন, হারমোড বলে একজন হাত তুললেন। তিনি ফ্রিগ এবং ওডিনের আরেক সন্তান এবং ওডিনের নিজস্ব কর্মচারী, তিনি দেবতাদের মধ্যে সবথেকে দ্রুতগামী এবং অল্পবয়সী দেবতাদের মধ্যে সবথেকে সাহসী।
তিনি বললেন ঘোড়া দরকার।”
—“আমি যাব। তবে আমার একটি দ্রুতগামী
ওডিন বললেন—”স্লিপনিরের থেকে বেশী দ্রুতগামী ঘোড়া নেই। তুমি তাকেই নিয়ে যাও।” স্লিপনিরকে আনা হল। স্লিপনি ওডিনের ঘোড়া, তার আটটি পা আছে যার। স্লিপনিরে চড়ে হারমোড রওনা হলেন হেলের সাম্রাজ্যে।
হারমোড রওনা হওয়ার পর, দেবতারা বল্ডারের অন্ত্যেষ্টি করার প্রস্তুতি শুরু করলেন। তাঁরা বল্ডারের জাহাজ রিংহর্নে তাঁর মৃতদেহ রেখে দিলেন। এরপর খুব চেষ্টা করলেন জাহাজটাকে ভাসাতে কিন্তু পারলেন না। মহাশক্তিশালী থরও পারলেন না জাহাজটা তীর থেকে দূর করতে। আসলে এই জাহাজ কেবলমাত্র বল্ডারের আদেশই মানতো। অন্য কারোর নির্দেশ পালন করতো না। এখন বল্ডারই নেই।
অগত্যা বল্ডারের দেহকে কাঠের ছাউনি দেওয়া এক জায়গায় নিয়ে আসা হল। চারজন দেবতা তাঁকে বহন করলেন, পিছনে চললেন বাকি সকলে। সবার আগে ওডিন, তাঁর পিছনে ভ্যালকারি এবং বাকি অ্যাসিররা। বল্ডার সকলের এতই প্রিয় ছিলেন যে কিছু বরফদানব, পর্বতদানবও এসেছিল, এমনকি ডোয়ার্ফরাও এসেছিল তাঁর মৃত্যুতে শোক প্রকাশ করতে।
বল্ডারের স্ত্রী, ন্যান্না, তাঁর মৃতদেহের উপরে কেঁদে লুটিয়ে পড়লেন। এত জোরে তিনি কাঁদলেন যে তার শরীর থেকেও প্রাণ বেরিয়ে গেল, তিনি সঙ্গে সঙ্গে মারা গেলেন। তাঁর দেহকে ও বল্ডারের পাশেই রাখা হল। তারপর বল্ডারের ঘোড়াকে বলি দেওয়া হল, যাতে পরলোকেও বল্ডার নিজের প্রিয় ঘোড়া পান এরপর ওডিন বল্ডারের কানে কানে কিছু বললেন, সম্ভবত কোনো রহস্য, যেটা বল্ডার আর ওডিন ছাড়া আর কেউ জানবেন না। তিনি তাঁর হাত থেকে সেই আশ্চর্য বাজুবন্ধ, যার নাম ড্রপনির, সেটা খুলে বল্ডারের মৃতদেহের পাশে রাখলেন। বল্ডারের বাকি প্রিয় বস্তুও তাঁর মৃতদেহের সঙ্গেই রাখা হলো। তারপর কাঠের ছাউনিসহ পুরো জায়গায় আগুন জ্বালিয়ে দেওয়া হল।
এদিকে হারমোড চলেছেন তো চলেছেনই, নয়দিন নয়রাত্রি পর এক জায়গায় পৌঁছালেন যেখানে শুধুই নিশ্ছিদ্র অন্ধকার। ওই অন্ধকারে শুধু এটুকুই দেখা যাচ্ছিল, দূরে সোনালি কিছু একটা চমকাচ্ছিল। সেই সোনালি চমকটুকুকে লক্ষ্য করে ঘোড়া চালালেন হারমোড, অবশেষে পৌঁছলেন জ্যালার নদীর তীরে। জ্যালার নদী পার করলে তবেই মৃতদের রাজ্যে প্রবেশ করা যায়। উপরে একটা সেতু আছে, সেটাই চকচক করছিল। তিনি খুব ধীরে ধীরে সেতু পার করছিলেন কারণ তা বিপজ্জনক ভাবে নড়ছিল।
—“তোমার নাম কী? তুমি কী ধরণের প্রাণী? এই মৃতদের রাজ্যে কী কাজ করতে এসেছ?” এইসব প্রশ্ন ভেসে এলো এক নারীকণ্ঠ থেকে। হারমোড নিরুত্তর থাকলেন।
সেতু একেবারে পার করে তিনি দেখতে পেলেন সেখানে খুবই ফর্সা এবং সুন্দরী একজন নারী দাঁড়িয়ে আছেন। তাঁর নাম মডগুড, তিনি সেতুর পাহারাদাত্রী।
—“তুমি তো মৃত নও, তোমার চামড়ার নিচে লাল রক্ত দেখতে পাচ্ছি। এখানে কেবল মৃত মানুষরা আসে। তারা ধুসর, সাদা, সবুজ বা নীলরঙের হয়। কিন্তু তুমি জীবিত। তুমি কে? হেলের রাজত্বে কী করতে এসেছ?” হারমোডকে দেখে জিজ্ঞাসা করলেন মডগুড়।
হারমোড খুবই বিনীতভাবে উত্তর দিলেন, “আমি ওডিনের এক সন্তান, নাম হারমোড, আমি ওডিনের ঘোড়া চড়ে হেলের রাজত্বে এসেছি বল্ডারকে খুঁজতে। আপনি কি তাঁকে দেখেছেন?”
—“তাঁকে যে একবার দেখেছে, সে কখনও ভুলতে পারবে না। তিনি নয়দিন আগে এই সেতু পার করেছেন। তিনি হেলের সভায় গেছেন।”
—“অনেক ধন্যবাদ। তাহলে হেলের সভাতেই আমাকে যেতে হবে।”
মডগুড বললেন—“নিচের দিকে আর উত্তরের দিকে যেতে থাকো। নিচের দিকে নামতে থাকো আর সবসময় উত্তরে যাওয়ার চেষ্টা করো, তাহলেই একসময় হেল এর দরজা পাবে।”
হারমোড তাঁর কথা শুনে চলতে থাকলেন। চলতে চলতে শেষে এক বিরাট পাঁচিল এবং দরজার সামনে এসে পৌঁছলেন। দরজাটি বন্ধ। তিনি স্লিপনিরকে অনেকটা দূরে নিয়ে গেলেন, তারপর খুব তাড়াতাড়ি দৌড় করিয়ে এক লাফে ওই বিশাল উঁচু পাঁচিলের অন্যদিকে এসে পড়লেন। এটাই সেই হেলের রাজপ্রাসাদ, যেখানে কখনো কোনো জীবিত মানুষ আসেনি।
তিনি হেলের প্রাসাদে এসে দেখলেন এক বিরাট হলঘরে এক লম্বা টেবিল পাতা। সেই টেবিলের একদিকে বন্ডার বসে আছেন, তাঁর গায়ের রঙ মেঘলা দিনের মত ধুসর। অন্যদিকে বসে আছেন তাঁর স্ত্রী ন্যান্না। হেল এর জগতে কখনও সুর্যোদয় হয় না, তাই কখনও দিনের শুরু হয় না। হারমোড় হলঘরের অন্যদিকে তাকিয়ে দেখতে পেলেন এক নারী সিংহাসনে বসে আছেন। তাঁর ডানদিকটা একজন সুন্দরী রমনীর মতো, বাঁদিকটা একসপ্তাহের পুরোনো মৃতদেহের মত। হারমোড বুঝলেন ইনিই হেল। তিনি হেল-এর দিকে এগিয়ে গিয়ে বললেন—“আমি বল্ডারের জন্য এসেছি। ওডিন আমাকে পাঠিয়েছেন। জীবিতের জগতে সবাই তাঁর জন্য শোকাচ্ছন্ন। আপনি দয়া করে ওঁকে আমার সঙ্গে ফেরত যাওয়ার অনুমতি দিন।”
হেল এর ব্যবহারে কোনো পরিবর্তন ঘটল না। তিনি তাঁর ভালো সবুজ চোখটা দিয়ে হারমোডের দিকে তাকালেন, তারপর বললেন—”আমার নাম হেল। মৃতরা আমার কাছে আসে। তারা জীবিত জগতে ফিরে যায় না। তাহলে কেন আমি বল্ডারকে যেতে দেব?”
—“সমস্ত জীবজগত, সকলেই তাঁর মৃত্যুতে শোকাহত। দেবতারা, বরফদৈত্যরা, ডোয়ার্ফরা, এল্ফরা সকলেই তাঁর মৃত্যুতে শোকাচ্ছন। সকল জন্তু জানোয়ার, গাছপালা তাঁর মৃত্যুতে দুঃখিত। এমনকি ধাতু এবং পাথরদেরও দুঃখ হয়েছে। সকলেই আশায় আছেন যে বল্ডার ফিরে আসবেন তাঁদের মধ্যে।”
হেল কোনো উত্তর দিলেন না। খানিক্ষণ বল্ডারের দিকে তাকিয়ে থাকলেন, তারপর একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললেন “বল্ডার আমার রাজত্বের সবথেকে সুন্দর বস্তু। তবে যদি তুমি সত্যিই প্রমাণ করতে পারো যে সব জিনিসই বল্ডারের মৃত্যুতে শোকাচ্ছন্ন, সকলেই তাঁকে ভালোবাসে, তাহলে আমি বল্ডারকে ফিরিয়ে দেব।”
হারমোড আনন্দে হেলের সম্মুখে নতজানু হয়ে বললেন “এই উদারতার জন্য আপনাকে অশেষ ধন্যবাদ, আপনি সত্যিই এক মহান রানী।”
হেল হারমোডের দিকে তাকালেন। বললেন—”উঠে পড় হারমোড, আমি বলিনি যে এখনই বল্ডারকে ফেরত দিয়ে দেব। তুমি বললে যে সবাই বল্ডারের শোকে আচ্ছন্ন। যদি তাই হয়, তবে তুমি যাও, সব জীব এবং বস্তুকে জিজ্ঞাসা কর। যদি সত্যিই সকলেই শোকাচ্ছন্ন হয় তাহলে আমি বল্ডারকে ফেরত দেব। কিন্তু যদি মাত্র একজন শোকপ্রকাশ না করে। না কাঁদে অথবা বল্ডারের বিরুদ্ধে কড়া কথা বলে, তাহলে বল্ডার আমাদের কাছেই থাকবেন।”
হরমোড উঠে দাঁড়ালেন —বল্ডার তাঁকে দরজা অবধি ছাড়তে এলেন। তিনি ওডিনের বাজুবন্ধ ড্রপনিরটি বল্ডারকে ফেরত দিলেন, হরমোড এবং বল্ডারের যে সত্যিই দেখা হয়েছিল তার প্রমাণ হিসাবে। বল্ডারের স্ত্রী ন্যান্না একটি সুন্দর সুতির আলখাল্লা দিলেন ফ্রিগের জন্য, আর একটি সোনার আংটি ফ্রিগের নিজস্ব পরিচারিকা ফুল্লার জন্য দিলেন।
হারমোড স্লিপনিরে চড়ে আবার অ্যাসগার্ডের দিকে যাত্রা শুরু করলেন। জ্যালার নদীর সেতু পার করার পর আবার তিনি দিনের আলো দেখতে পেলেন।
হারমোড ফিরে এলেন অ্যাসগার্ডে। ওডিনকে ড্রপনির ফেরত দিয়ে জানালেন কী কথা হয়েছে হেলের সঙ্গে। তৎক্ষণাৎ ওডিন দিকে দিকে দূত পাঠালেন বল্ডারের মৃত্যুর প্রতিক্রিয়া জানতে। দূতরা বিভিন্ন জায়গা থেকে সুসংবাদ নিয়ে ফিরে আসছিলেন; সকলেই বল্ডারের মৃত্যুতে কাতর। দিক দিক থেকে ফিরে তাঁরা এক জায়গায় জড়ো হলেন; অ্যাসগার্ডে ফেরার আগে এখানেই তাঁরা খাদ্য বানাবেন এবং রাতে থাকবেন। কাছেই পর্বতের কোলে এক গুহা ছিল। হঠাৎ করে সেখান থেকে এক আওয়াজ ভেসে এলো—”এখানে কারা এসেছ? এত আওয়াজ হচ্ছে কেন?”—এক বয়স্কা দানবী বেরিয়ে এলেন। তবে এই দানবীর হাবভাব কেমন যেন চেনা চেনা। দূতদের প্রশ্নের উত্তরে তিনি জানালেন তাঁর নাম থক, নামের মানে কৃতজ্ঞতা। দানবী আবার জিজ্ঞাসা করলেন—”তোমরা কী জন্যে এখানে এসেছ?”
দূতরা উত্তর দিলেন—“আমরা চারদিকে খুঁজতে বেড়িয়েছি, সবাইকে জিজ্ঞাসা করছি তাঁরা বল্ডারের মৃত্যুতে দুঃখিত কী না। এখনো পর্যন্ত সকলেই বলেছে তারা বল্ডারের মৃত্যুতে দুঃখিত। আমরা সকলেই তাঁর মৃত্যুতে কেঁদেছি।”
এই শুনে দানবী খানিক নাক চুলকালেন, খানিক গলা খাঁকরি দিলেন, তারপর পাথরের উপর চিক করে থুথু ফেলে বললেন
“আমি, বুড়ি থক, ওডিনের ছেলে বল্ডারের মৃত্যুর জন্য একফোঁটাও দুঃখিত নই। ও আপদ বেঁচে থেকে আমার কোনো কাজেই লাগেনি। ভালো হয়েছে সে গেছে, হেলের ওকে রেখে দেওয়াই উচিত।”
বলেই তিনি পালিয়ে গেলেন অন্ধকার গুহার মধ্যে, দূতরা অনেক খুঁজেও তাঁকে আর দেখতে পেলেন না। দূতদের আনন্দ তখন শেষ হয়ে গেছে, তাঁরা কোনোমতে ফিরে এসে এই খারাপ সংবাদ ওডিনকে জানালেন। থকের বর্ণনা শুনে ফ্রিগ-এর খুবই চেনা চেনা লাগল, বাকি দূতরাও বললেন, তাঁর চলা-ফেরা কথা—বলা কেমন যেন চেনা চেনা। তাঁরা আস্তে আস্তে যেন বুঝতেও পারলেন কে ছদ্মবেশে বুড়ি থক সেজে এসেছিল।
মাথা নেড়ে থর বললেন—”নিঃসন্দেহে লোকি। ছদ্মবেশে লোকিই এমন করেছেন।” এই বলে তিনি তাঁর বিশাল হাতুড়ি তুলে নিলেন। কয়েকজন দেবতার সঙ্গে একটা দল গড়ে লোকিকে খুঁজতে বেরোলেন। লোকি কি তখন আর কাছেপিঠে আছেন? তিনি তখন অ্যাসগার্ডের থেকে বহুদূরে, লুকিয়ে আছেন ছদ্মবেশে। নিজের চতুরতায় খুবই আনন্দিত হয়ে অপেক্ষা করছেন কখন বল্ডারের মৃত্যু নিয়ে আলোচনা শেষ হয়।
ওডিনের সন্তান ভালি
বল্ডার মৃত, সারা অ্যাসগার্ড তাঁর মৃত্যুতে শোকাহত। সবথেকে শোকাচ্ছন্ন তাঁর ভাই হোডার, যাঁর হাতে তাঁর মৃত্যু ঘটেছে। তখনকার নিয়ম ছিল যে হত্যার প্রতিশোধ নিতেই হবে। কিন্তু কেউই হোডারের উপরে প্রতিশোধ নিতে আসছেন না। হোডার এতই শোকাভিভূত, এতই যন্ত্রণা পাচ্ছেন নিজে, যে তাঁকে কেউ হত্যা করলে তাঁর শান্তিই হবে।
ওডিনের মনে পড়ল, যে ভোলভা প্রতিশোধ সম্পর্কে কী বলেছিলেন। ওডিনের ভালি নামে কোনো সন্তানই জন্মগ্রহণ করেনি। হোডারের কষ্ট আর সহ্য করতে না পেরে একদিন রাতে ওডিন বেরিয়ে পরলেন ছদ্মবেশে, ভোলভার ভবিষ্যতবাণী সফল করার জন্য। মিডগার্ডের পশ্চিমদিকে রুথেন্স বলে দেশে বিলিং নামে এক রাজা ছিলেন। তাঁর কন্যার নাম রিন্ডা, তিনি পরমাসুন্দরী ছিলেন। রিন্ডা ধনুর্ভঙ্গ পণ করেছিলেন যে তিনি একজন ভ্যালকারিই হবেন। তাঁর কাছে বিবাহের প্রস্তাব নিয়ে যে পুরুষই আসত, সে অপমানিত হয়ে ফেরত যেত।
ওডিন প্রথমে ভাবলেন—মানুষ রূপেই রিন্ডাকে বিবাহের জন্য রাজী করবেন। তিনি যে সময়ে রাজা বিলিং এর রাজ্যে পৌঁছলেন, সেইসময়ে রাজ্যের খুব দুরবস্থা চলছে। অন্য রাজ্যের সেনারা আক্রমণ করবার জন্য চতুর্দিকে ঘিরে ধরেছে। ওডিন গিয়ে বিলিং-এর সঙ্গে দেখা করলেন।
বিলিং দুঃখ করে বললেন—“আমি বৃদ্ধ হয়েছি, আমার পক্ষে যুদ্ধ করা সম্ভব না। আমার কোনো পুত্র নেই, আমার যদি একটি জামাতা থাকত, তাহলে সে যুদ্ধে নেতৃত্ব দিতে পারত। কিন্তু আমার কন্যা জেদ ধরে আছে যে সে বিবাহ করবে না।” ছদ্মবেশী ওডিন বললেন—”যদিও আমি প্রৌঢ়, তবু একবার শত্রুদের হারানোর চেষ্টা করে দেখি, তারপর রাজকুমারী রিন্ডার সঙ্গে কথা বলব।”
বিলিং সানন্দে রাজী হলেন। ওডিন তখন প্রবল পরাক্রমে সব শত্রুদের হারিয়ে দিলেন
কৃতজ্ঞ রাজা বিলিং ওডিনকে নিজের রাজত্বই দিয়ে দিতে চাইলেন। কিন্তু ওডিন শুধুমাত্র রাজকুমারী রিন্ডাকে বিবাহ করতে চাইলেন। রাজা বিলিং বললেন—“আমার কন্যা নিজের মতে চলে, আপনি নিজেই জিজ্ঞাসা করে নিন।”
রাজকুমারী রিন্ডাকে বিবাহের কথা বলতেই তিনি একটি শব্দও খরচ না করে, ওডিনকে ঠাস করে একটা চড় মেরে অন্দরমহলে চলে গেলেন। রাজাকে সান্ত্বনা দিয়ে ওডিনও ফিরে গেলেন। ততক্ষণে তিনি সিদ্ধান্ত নিয়েছেন, তাঁর সন্তানের মা হওয়ার জন্য রিন্ডাই উপযুক্ত, তিনি এঁকেই বিয়ে করবেন।
কয়েকদিন পরই ওডিন আবার ফিরে এলেন এক স্বর্ণকারের ছদ্মবেশে। তিনি খুব সুন্দর একটি কঙ্কণ এবং কয়েকটি ততোধিক সুন্দর আংটি বানিয়ে নিয়ে গেলেন রাজার কাছে। বললেন তাঁর নাম রুসলো, তিনি রাজকন্যার জন্য উপহার এনেছেন। রাজকন্যাকে গয়নাগুলি উপহার দিয়ে তিনি আবার তাঁর প্রস্তাব রাখলেন। রাজকন্যা সবকিছু ছুঁড়ে ফেলে দিলেন। বললেন “ওডিন ছাড়া আর কেউ আমার ভালোবাসা পাওয়ার যোগ্য নয়। সোনা দিয়ে আমার ভালোবাসা কেনা যাবে না। এক্ষুণি দূর হও এখান থেকে।”
ওডিন আবার চলে গেলেন। দুদিন পরে ফিরেও এলেন, এবার একেবারে অল্পবয়সী এক সুপুরুষ যোদ্ধার ছদ্মবেশ ধরে। তারপর রাজকন্যাকে বিবাহের জন্য রাজি করার জন্য অনেক পরিশ্রম করলেন। তাঁর বীরত্ব দেখালেন, ভালো ভালো উপহার এনে দিলেন, অনেক মধুর মধুর গান শোনালেন। অবশেষে, রাজকন্যা তাঁকে ফিসফিস করে বললেন—“আজ রাতে আমার কক্ষে এসো, তারপর কথা হবে।” ওডিন ভাবলেন এইবার রাজকন্যা বিবাহে নিশ্চয়ই রাজি হবেন। কিন্তু যে মুহূর্তে তিনি রাজকন্যার কক্ষে প্রবেশ করলেন, তাঁকে দেখে রাজকন্যা “ডাকাত পড়েছে, ডাকাত পড়েছে!” বলে এমন চিৎকার শুরু করলেন যে চারদিক থেকে প্রহরীরা ছুটে আসতে লাগল। প্রথমে ওডিনের বেজায় রাগ হল, তারপরেই মনে হল, রাজকন্যা কিন্তু দেবরাজ ওডিনের প্রতি বিশ্বস্ত তাই এমন ব্যবহার করছেন। তখন তিনিও একটু চালাকির আশ্রয় নিলেন। তাঁর জাদুদণ্ড দিয়ে একবার স্পর্শ করলেন রিন্ডাকে, সঙ্গে সঙ্গে রিন্ডা মুর্ছিত হয়ে পড়লেন। সেই সুযোগে ওডিন পালিয়ে গেলেন, প্রহরীরা এসে কাউকেই দেখতে পেল না।
জ্ঞান ফেরার পরে সকলেই বুঝতে পারল, রিন্ডা বদ্ধ উন্মাদ হয়ে গেছেন। কেউ তাঁকে তাঁর ঘর থেকে সরাতে পারল না। তিনি কারোর কথা শোনেন না, কিছু খান না, দিনে দিনে আরো অসুস্থ হয়ে পড়ছেন। দুদিন পরেই রাজা বিলিংএর কাছে এক নারী এসে জানালো—”আমার নাম ভেচা, পাগলামি সারাতে আমার মত দক্ষ কেউ নেই। আমিই রোগীর দেখাশোনা করব। রাজকুমারীর অবস্থা শুনে আমি ছুটে এসেছি সাহায্য করার জন্য।”
রাজা হাঁপ ছেড়ে বাঁচলেন। তখনই তাকে রাজকন্যার দেখাশোনার দায়িত্বে রাখা হলো। ভেচাই প্রথম রাজকন্যাকে কিছু খাওয়াতে পারল। তারপর ভেচা রাজাকে জানালেন—”রাজকন্যার চিকিৎসার জন্য আমাকে রাজকন্যার সঙ্গে একেবারে একা ছেড়ে দিতে হবে। অন্য মানুষ দেখলেই রাজকন্যা আরো অসুস্থ হয়ে পড়ছেন।” রাজা সম্মত হলেন। সেদিন রাত্রে, যখন ভেচা এবং রাজকন্যা ছাড়া কেউ নেই, তখন ভেচা ছদ্মবেশ ছেড়ে বিশ্বপিতা ওডিনের রূপে ফিরে গেলেন। আবার জাদুদণ্ড স্পর্শ করে রাজকুমারীকে সুস্থ করে তুললেন। রাজকুমারী ধীরে ধীরে উঠে বসেই ওডিনকে দেখতে পেলেন। বুঝতে পারলেন তাঁর সামনে কে দাঁড়িয়ে আছেন।
ওডিন খুবই মায়াময় কন্ঠে রাজকন্যাকে বললেন—”রাজকন্যা রিন্ডা, তুমি চিরকাল আমার ভ্যালক্যারি সেনাবাহিনীর একজন হবে বলে মনস্থির করে এসেছ, এবং সেজন্যেই কাউকে স্বামী হিসাবে গ্রহণ করোনি। আমি অত্যন্ত দুঃখের সঙ্গে জানাচ্ছি তোমার সেই ইচ্ছা পূর্ণ হবে না। তবে নর্নরা তোমার জন্য অন্যরকম ভবিষ্যৎ কল্পনা করে রেখেছেন। তুমি একজন মানবী হয়েও সবথেকে ছোট অ্যাসিরের মা হবে। তোমার সন্তান ভালি, বল্ডারের মৃত্যুর প্রতিশোধ নেবে। শুধু তাই নয়, র্যাগনারকে ভালির একটি বিশেষ ভুমিকাও থাকবে।”
একথা শুনে রাজকুমারী রিন্ডা ওডিনের দিকে তাকালেন। তাঁর চোখে জল, কিন্তু মুখে হাসি। পরের দিনই ওডিনের সঙ্গে তাঁর বিবাহ হল। কিছুদিন পরে ওডিন তাঁর থেকে বিদায় নিয়ে তাঁর অ্যাসির স্ত্রী ফ্রিগের কাছে ফিরে গেলেন। ফ্রিগ সবই জানতেন, তিনি ভবিষ্যত দেখতে পেতেন, তাই ওডিনকে তিনি কোনোরকম দোষারোপ করলেন না।
এরপর দীর্ঘদিন কেটে গেল। হোডার সকলের সঙ্গে কথা বলা বন্ধ করে দিলেন, তিনি তাঁর ভাই এবং তাঁর দুর্ভাগ্যকে মনে করে সারাক্ষণ কাঁদেন। প্রতিদিন রাত্রে অন্ধকার জঙ্গলে একা ঘুরে বেড়ান কিন্তু কোনো জন্তুও তাঁর কোনো ক্ষতি করেন না।।
একদিন হিমদল দেখলেন, একটি ছোট্ট শিশু একটি ধনুক এবং তীরভর্তি তূণ নিয়ে বাইফ্রস্ট সেতুর উপরে উঠে আসছে। হিমদল চিৎকার করে জানালেন যে এই সেতুতে কোনো ছোটশিশুর ওঠার অধিকার নেই। শিশুটি ততোধিক জোরে বলল—“আমাকে ভ্যালহালায় নিয়ে যাওয়া হোক।” এতই জোরের সঙ্গে সে হিমদলকে আদেশ দিল, যে হিমদল আর কোনো কথা না বলে তাকে সোজা নিয়ে গেলেন ভ্যালহালায়। নিয়ে যেতে যেতে তিনি অবাক হয়ে দেখলেন শিশুটি যেন এই অল্প সময়েই একটি বালক হয়ে গেছে। ভ্যালহালায় ঢোকার সঙ্গে সঙ্গেই হারমোড বালকটিকে বললেন—”মিডগার্ডের কোনো মানব, যার শরীরে যুদ্ধক্ষত নেই, সে ভ্যালহালায় ঢুকতে পারবে না।” বালকটি তৎক্ষণাৎ বলল “আমি আমার পিতা ওডিনের সঙ্গে দেখা করতে চাই।” সকলে অবাক হয়ে দেখল, বালক নয়, একটি কিশোর কথা বলছে।
ইতিমধ্যে ওডিন এসেছেন ভ্যালহালায়, কিশোরটিকে দেখেই বললেন—“সুস্বাগতম ভালি।” তারপর বাকিদের বললেন—“ এঁর নাম ভালি, আমার এবং রাজকন্যা রিন্ডার পুত্র। ইনি অ্যাসগার্ডে এসেছেন বল্ডারের মৃত্যুর প্রতিশোধ নিতে।”
একজন অ্যাসির জিজ্ঞাসা করলেন—”কিন্তু হোডারের কাছে অন্ধকারের ঢাল এবং আতঙ্কের তরবারি আছে, এবং তিনি খুবই শক্তিশালী। তিনি শোকাহত হতে পারেন, কিন্তু বিনাযুদ্ধে আত্মসমর্পণ করবেন না। আমরা সকলেই জানি বিনাযুদ্ধের মৃত্যুতে শৌর্য্য নেই। এই কিশোর কীভাবে তাঁর সঙ্গে পেরে উঠবে?”
তখন ভালি নিজেই উত্তর দিলেন—“আমার এক দিনও বয়স নয়, তবু আমি কিশোর হয়েছি, আমার বেড়ে ওঠার গতি এতটাই যে রাত্রি শেষ হওয়ার আগেই আমি একজন পূর্ণবয়স্ক পুরুষ হয়ে যাব। তারপরেই আমি হোডারকে হত্যা করব।”
প্রতিদিনের মত সেদিনও হোডার একা একা বনের মধ্যে ঘুরে বেড়াচ্ছিলেন। হঠাৎ তিনি এক অচেনা পুরুষকন্ঠের আওয়াজ শুনতে পেলেন—”বল্ডারের হত্যাকারী, অবশেষে তোমার মৃত্যুর সময় এসে গেছে। আমি বল্ডারের মৃত্যুর প্রতিশোধ নিতে এসেছি, প্রস্তুত হও।”
হোডার যেদিক থেকে আওয়াজ পেলেন সেদিকে ঢাল আর তরবারি নিয়ে ফিরে দাঁড়ালেন। পরক্ষণেই পরপর তিনটে তীর তাঁকে বিদ্ধ করে ফেলল। তিনি মাটিতে পড়ে গেলেন এবং তৎক্ষণাৎ তাঁর মৃত্যু হল। অ্যাসিররা ছুটে এসে দেখলেন তাঁর মৃতদেহের পাশে এক নবীন যুবক দাঁড়িয়ে আছে।
হোডারের আত্মা তখন হেলের পথে চলেছেন। হোডার যখন জ্যালার নদী পার করলেন, তখনো তাঁর প্রাণে আনন্দের রেশমাত্রও নেই। তাঁকে দেখেই ভাই বল্ডার ছুটে এসে জড়িয়ে ধরলেন। বল্ডারের মুখে আনন্দ এবং ক্ষমার হাসি ছাড়া আর কিছুই নেই। তিনি বললেন—”হোডার, অবশেষে তুমি আসতে পারলে ভাই, এই হেলহাইমে থাকার কষ্ট আমার অর্ধেক হয়ে গেল তোমাকে দেখেই। তুমি আর কষ্ট পেও না, তোমার জন্য আমার মৃত্যু হয়নি। ওই দুষ্ট লোকি আমার মৃত্যুর জন্য দায়ী। তবে তোমার হাতে আমার মৃত্যু হয়েছে বলে আমি একদিক দিয়ে খুশিই হয়েছি, অবশেষে এখানে আমরা দুইজনেই আবার মিলিত হতে পারলাম। আমরা দুইজনে মিলে আবার আনন্দ করে সময় কাটাতে পারব।
র্যাগনারক অবধি সময় দিব্যি কেটে যাবে আমাদের। আর র্যাগনারকের পরে আমরা আবার দিনের আলো দেখতে পাবো।” দীর্ঘদিন পরে হোডারের মুখে হাসি ফুটল, তিনি জড়িয়ে ধরলেন ভাইকে।
লোকির অন্তিম শাস্তি
বল্ডারের মৃত্যুর পর অনেকদিন কেটে গেছে, তবে দেবতারা এখনো তাঁর মৃত্যুর জন্য শোকাভিভূত। মেঘের চাদর বুনতে বসলেই ফ্রিগের চোখ দিয়ে অশ্রু ঝরে পড়ে। তাঁর দুঃখে সেই মেঘ, ধূসর বৃষ্টি হয়ে মিডগার্ডের উপর ঝরে পড়তে থাকে। অ্যাসগার্ডের কোথাও আনন্দ নেই, ওডিনও এখন খুব কম হাসেন। বল্ডার এবং হোডার দুজনেই নেই, অবশ্য ভালি এসেছেন। লোকির কোনো দেখাই নেই। এভাবেই কেটে গেল অনেকদিন। তাঁর সন্ধানে কেউ এলেন না দেখে লোকি একটু নিশ্চিন্ত হলেন। তবে তখনো তিনি অ্যাসগার্ডে ফিরে আসার চেষ্টা করলেন না, কারণ তাঁর সবথেকে পুরোনো শত্রুর নাম হল হিমদল। বিভিন্ন কুকর্মের ফলে হিমদলের সঙ্গেই তাঁর সবথেকে বেশিবার অশান্তি হয়েছে। বাকিরা সকলে ভুলে গেলেও হিমদল যে তাঁকে ভুলবেন না বা ক্ষমা করবেন না এবং বাইফ্রস্ট সেতুতে পা রাখতেও দেবেন না, এই বিষয়ে লোকি নিশ্চিত।
শরৎকালে নর্সদের এক বিরাট উৎসব হয়, ফসল তোলার উৎসব। কাট্টিগাট দ্বীপে সাগরদৈত্য অ্যাগিরের প্রাসাদে সেই উৎসব চলছিল। থরের এনে দেওয়া এক বিরাট কেটলিতে অ্যাগির অসাধারণ মদ্য বানান প্রতিবছর। নৈশভোজের সঙ্গে অ্যাগিরের বানানো মদ্য, এটাই উৎসবের অঙ্গ। তাই সকল এল্ফ এবং দেবতারা জড় হয়েছিলেন সেখানে। অ্যাগির দানব হলেও দেবতাদের দলে, তিনি থরের বন্ধু। অ্যাগির এবং তাঁর স্ত্রী রেনের নয়জন তরঙ্গ কন্যা হলেন হিমদলের মা।
এই উৎসবে থর ছিলেন না, তিনি য়োটুনহাইমে কিছু দৈত্যকে উত্তমমধ্যম দিতে গিয়েছিলেন। সেখানে লোকি হাজির হলেন। দরজার কাছে অ্যাগিরের মূল রাঁধুনি এলডির দাঁড়িয়েছিলেন। আর কাউকে না পেয়ে লোকি তাঁকেই জিজ্ঞাসা করলেন—“দেবতাদের মূল টেবিলে কিসের আলোচনা চলছে হে এলডির?”
এলডির উত্তর দিলেন—”সবাই নিজস্ব অস্ত্রশস্ত্র আর যুদ্ধের গল্প করছেন। তবে আপনি ওদিকে যাবেন না। অ্যাসির, ভানির কেউই আপনার সম্পর্কে একটাও ভালো কথা বলছেন না।”
—“তাহলে তো আমার সেখানেই আগে যাওয়া উচিত। অন্তত তাঁদের মদ্যপানের আনন্দে একটু বিষ মেশানো উচিত, কী বলো?” বলে, এলডিরের উত্তরের অপেক্ষা না করে সোজা হলঘরের ভেতরে ঢুকলেন। মুহূর্তের মধ্যে সবাই চুপ করে গেলেন। কোনো ভ্রুক্ষেপ না করে তিনি সোজা চলে এলেন ওডিনের কাছে। বললেন—”হে পরমপিতা, আপনি আর আমি পরস্পরের রক্তের মিশেল করেছিলাম বহুদিন আগে, করেছিলাম কিনা?”
ওডিন মাথা নাড়লেন—”করেছিলাম।”
লোকি হেসে উঠে বললেন—”সেদিন আপনি কথা দিয়েছিলেন, যদি আপনার ভাই লোকি উপস্থিত থাকে একই টেবিলে, তবেই আপনি পান করবেন, দিয়েছিলেন কিনা?”
ওডিন খানিকক্ষণ লোকির দিকে তাকিয়ে থাকলেন, তারপরে একটা নিঃশ্বাস ছেড়ে বললেন—“ফেনরিরের পিতা আমাদের সঙ্গেই ভোজন করবেন” বলে তাঁর সন্তান ভিডারকে সরে বসতে বললেন যাতে লোকি তাঁর ঠিক পাশেই বসতে পারেন।
লোকির সবুজ চোখদুটি দু-টুকরো সবুজ আগুনের মত জ্বলে উঠল, তাঁর হাসি আরো চওড়া হল। তিনি ওডিনের পাশে বসলেন, তিন-চার গ্লাস অ্যাগিরের মদ্য এক নিঃশ্বাসে গলাধঃকরণ করলেন। তারপর কথা বলা শুরু করলেন।
মদ্যপানের ফলে তখন তাঁর ভাষার বাঁধন খুলে গেছে। তিনি প্রথমেই চিৎকার করে সবাইকে বললেন, “সকল দেবতাকে লোকির তরফ থেকে উৎসবের শুভেচ্ছা জানাই। শুধুমাত্র ব্র্যাগি বাদে, কারণ ব্র্যাগির মত ভিতু আমি আজ অবধি দেখিনি।”
ব্র্যাগি গলার আওয়াজ নীচু করে বললেন—”আমি আমার ঘোড়া, তরবারি, আংটি সবকিছু তোমাকে দিয়ে দেব লোকি। তুমি দয়া করে চুপ করো।”
লোকি আরো গলা তুলে বললেন—“ব্র্যাগি, আমি আবার বলছি, তোমার মত ভিতু আজ অবধি দেখিনি। তুমি জন্মেও যুদ্ধ করনি, শুধুই কবিতা আর গান লিখে গেছ। আমি আশা করি র্যাগনারকের সময়ও তুমি কোথাও লুকিয়ে থাকবে, সেখানেই কেউ তীর মেরে তোমাকে হত্যা করবে।”
—“এটা যদি উৎসব না হত তাহলে তোমার গলা কেটে ফেলতাম।” ব্র্যাগি রেগে গিয়ে বললেন।
—“দোহাই তোমাকে, লোকিকে আর খুঁচিও না, ওর নেশা হয়ে গেছে।” ব্র্যাগিকে নিরস্ত করার জন্য ইডুনা বললেন। যথেষ্ট চাপা গলাতেই বলেছিলেন কিন্তু লোকি শুনতে পেয়ে গেলেন…
—“এই তো সুন্দরী ইডুনা কথা বলছে। তা ইডুনা, সত্যি যদি তোমার বর বীর হত, তাহলে ঝড়দানব থিয়াসির কাছ থেকে তোমায় উদ্ধার করতে আমাকে যেতে হয়েছিল কেন? আমি তো তোমার স্বামীর ভাইয়ের হত্যাকারী, তুমি আমার সঙ্গে কথা বলছই বা কেন? নিশ্চয়ই তোমার কোনো কুমতলব আছে।”
অপমানে ইডুনা কেঁদে ফেললেন, বললেন—“আমি তো শুধুই শান্তি বজায় রাখতে চেয়েছিলাম।”
তখন ওডিন লোকিকে বললেন—”তুমি নিশ্চয়ই অতিরিক্ত নেশা করেছ, অথবা পাগল হয়ে গেছ, তাই এইরকম উল্টোপাল্টা কথা বলছ। লোকি, যদি তুমি শান্তির কথা বলতে না পারো, তাহলে চুপ করে যাওয়াই তোমার পক্ষে মঙ্গলকর।”
লোকি কি চুপ থাকার পাত্র? তিনি উলটে ওডিনকে বললেন —”বীরেরা যখন কথা বলে তখন তোমার মত কাপুরুষের সেখানে কথা বলতে লজ্জা করে না? সবাই জানে যে অনেক সময়ই তুমি ভীতুদের যুদ্ধে জিতিয়ে দাও। ভ্যালহ্যালায় যে সব বীরদের আনা হয়েছে তার অর্ধেকের বেশি তোমার থেকে বেশি বীর। সেজন্যেই তুমি তাদের অত সুযোগ সুবিধা দিয়ে পুষছ, যাতে র্যাগনারকের সময়ে ওরা তোমার হয়ে যুদ্ধ করে দিতে পারে। এই ব্র্যাগির দাদু সুতং এর থেকে মদ চুরি করার জন্য তুমি একটা পোকার রূপ ধরে গিয়েছিলে, না? ওই ভালির মা গানলডকে বিয়ে করার জন্য, তুমি পরিচারিকার রূপ ধরেছিলে, তাই না? ছ্যা ছ্যা, দেবরাজের কী ছিরি, কখনো পোকা কখনো নারীর ছদ্মবেশে কার্যসিদ্ধি করেন।”
—“ওডিন এবং তুমি যখন ব্লাড-ব্রাদার, তখন তোমার এসব কথা বলা সাজে না লোকি।” ফ্রিগ সামাল দেওয়ার জন্য বললেন। “দয়া করে চুপ করো।”
—“তুমিই চুপ করো ফ্রিগ। ওডিন যখন থাকেন না, তখন ওডিনের দুই ভাই ভিলি এবং ভে-এর সঙ্গে তুমি ফষ্টিনষ্টি কর সে খবর সবাই জানে।”
ফ্রিগ বিবাহ এবং বিবাহিত জীবনের প্রতি বিশ্বাসের দেবী। তাঁর প্রতি এইসব অভিযোগ এতই হাস্যকর যে অন্য সকল অ্যাসিররা হেসে উঠলেন। তবে শুধুমাত্র ফ্রিগ হাসলেন না, অপমানে তাঁর চোখে জল চলে এলো। তিনি কোনোক্রমে বললেন—”আজ আমার সন্তান বন্ডার থাকলে তুমি আমাকে অপমান করার সাহস পেতেনা।”
—“তাই নাকি?” লোকির গলায় ঠাট্টার সুর।—”তা জেনে রাখো ফ্রিগ, তোমার সুপুত্তুর বল্ডার আর আসবে না, কারণ তার মৃত্যু আমিই ডেকে এনেছি, শুধু তাই নয়, সে যাতে আমার কন্যা হেলের কাছেই পাকাপাকিভাবে থাকতে পারে তার ব্যাবস্থাও করেছি।”
লোকির বকবকানি আর সহ্য হল না ফ্রেয়ার, তিনি চেঁচিয়ে বললেন—”এই যে মাতাল লোকি, চুপ করো এবার, আমরা সবাই স্লিপনিরের জন্মকথা জানি। তুমি, তোমার সন্তানদের কখনো বাবা, কখনো মা। তুমি শুধু পুরুষ না, অর্ধ নারীও।”
এই কথাগুলি লোকিকে অপমানের তীরের মত আঘাত করল, তিনিও পালটা বললেন—”এই যে প্রেম আর সৌন্দর্যের দেবী, আসলে যে তুমি ডাইনি সে কথা আমার থেকে ভালো কেউ জানে না। তোমার ঘরে তোমার স্বামী থাকতেও এমন কোনো অ্যাসির নেই যে তোমার প্রেমে পড়েনি। ব্রিসিংম্যান নামে একটা হারের জন্য তুমি ডোয়ার্ফদের সঙ্গে কী করে বেরিয়েছ, আর কেউ না জানলেও আমি জানি।”
বেশিরভাগ অ্যাসিরই উঠে দাঁড়িয়ে তরোয়ালে হাত দিলেন। কিন্তু ওডিনের ইশারায় তাঁরা আবার বসে পড়লেন এবং লোকিকে সম্পূর্ণ উপেক্ষা করা শুরু করলেন। লোকি খানিকক্ষণ চুপ করে থাকলেন। কিন্তু তিনি বেশিক্ষণ উপেক্ষা সহ্য করার পাত্র নন, তাই আবার কথাবলা শুরু করলেন, এবার তাঁর লক্ষ টিউ।
—“ওহো, আমি টিউকে দেখতে পাচ্ছি। কেমন আছ হে বন্ধু? তুমি নাকি যুদ্ধের দেবতা? আহারে, বেচারা যুদ্ধের দেবতার ডান হাতটাই কবজি থেকে কাটা, যুদ্ধ করবে কী করে? হাতটা কেমন করে যেন কেটেছে তোমার? ও হো মনে পড়েছে, আমার আদরের ছোট ছেলে ফেরির এক কামড়ে তোমার হাত কেটে নিয়ে কচরমচর করে চিবিয়ে গিলে ফেলেছে।”
এবার ফ্রে বললেন—“তোমার মুখে লাগাম দাও লোকি। না হলে তোমার ছেলের পাশে তোমাকেও চেন দিয়ে বেঁধে রাখা হবে।”
হাহা করে হেসে উঠে লোকি বললেন—”আমার ছেলের নামে কে কথা বলছে দেখ! ফ্রে, এই ফ্রে একটা দানবীর প্রেমে এমন পাগল হয়ে উঠেছিল যে নিজের অত ভালো তরবারিটা সামান্য এক কর্মচারীকে দান করে দিয়েছে। র্যাগনারকের সময় যখন তোমাকে আমার ছেলে চিবিয়ে খাবে, তখন তোমার ওই তরোয়ালের কথা মনে পড়বে নিশ্চয়ই।”
এবার হিমদল শান্তস্বরে বললেন—”তুমি অত্যধিক মাতলামি করছ লোকি, তুমি শান্তভাবে বাইরে বেরিয়ে যাও। আমি বলছি, তোমার বলা কথাগুলি আমরা ভুলে যাব।”
—“ওহ্!এই সেতুর দারোয়ানটাও আজকে এখানে উৎসব পালন করতে এসেছে? তা ভাই হিমদল, তোমার কাজ তো রোদে বৃষ্টিতে সেতুতে দাঁড়িয়ে থাকা সর্বক্ষণ। তোমাকে দেখলেই মনে হয় তুমি মহাক্লান্ত। একটু ঘুমের জন্য তুমি বিদ্রোহ করতে পারো।”
নিয়র্ডের স্ত্রী, দৈত্যকন্যা স্কাডির একটা ক্ষমতা ছিল যে তিনি মাঝেমাঝে ভবিষ্যত দেখতে পেতেন। হঠাৎ তিনি বলে উঠলেন, —”এখন লোকি একটা কুকুরের মত ঘেউঘেউ করছে বটে, তবে আমি দেখতে পাচ্ছি যে ও পাথরের উপর বাঁধা, অ্যাসিররা ওকে চরম শাস্তি দিয়েছে।”
সঙ্গে সঙ্গে লোকি উত্তর দিলেন—“আর দানবকন্যা স্কাডির আমাকে নিয়ে কথা বলার দুঃসাহস দেখে আমি অবাক হয়ে যাচ্ছি, এর পিতা থিয়াসিকে আমিই হত্যা করেছিলাম না? একেও একটা পিঁপড়ের মত আমি মেরে ফেলার ক্ষমতা রাখি।”
সিফ এতক্ষণ চুপ ছিলেন, এবার তিনি শান্তস্বরে বললেন “অনেক হয়েছে লোকি, এবার তোমার গ্লাসের বাকি মদটুকু শেষ করে নিজের পথ দেখ।”
—“আরে আরে সিফ কথাও বলছে দেখছি। সিফের মাথামোটা কত্তার সামনে তো সিফের মুখ কখনো খোলেনা। এ নিজেকে খুব সুন্দরী আর সতী ভাবে। কিন্তু যখন আমি সব চুল চুরি করে আবার ডোয়ার্ফদের দিয়ে চুল বানিয়ে নিয়ে এসেছিলাম, তখন সিফ আনন্দে আমাকে জড়িয়ে ধরেছিল। আমি নিশ্চিত যে ওর স্বামীর আলিঙ্গনের থেকে আমার আলিঙ্গনে সিফ বেশি আনন্দ পেয়েছে, কী তাই না?”
এমন সময় আকাশে বজ্রবিদ্যুতের নির্ঘোষ শোনা গেল, পরক্ষণেই দেখা গেল থরকে। তাঁর মুখ গনগন করছে রাগে। থর এসে সোজা লোকিকে বললেন “মিয়লনিরের একটি ঘায়ে তোমার মুখ বন্ধ করে কন্যা হেলের কাছে পাঠিয়ে দেবো।”
লোকি কাষ্ঠহাসি হেসে বললেন—“এই তো! নোংরা ধুলোর বাচ্চাও এসে গেছে। এখন যা ইচ্ছে তাই বলে নাও, কিন্তু র্যাগনারকে যখন আমার সন্তানরা তোমার মুখোমুখি দাঁড়াবে, তখন দেখব তোমার বড়বড় বুকনি কোথায় যায়।”
থর বললেন—”ভবিষ্যতের কথা বাদ দাও। সেসব নর্নরাই জানেন। তবে এখন তুমি যদি আরেকটা কথাও বলো, তাহলে আমি এখুনি হাতুড়ি দিয়ে তোমায় মিহি গুঁড়ো করে ফেলব।”
লোকি আর কথা না বাড়িয়ে উঠে দাঁড়ালেন। সমুদ্রদানব অ্যাগিরকে বললেন—“আমার সত্যিকথাগুলি কারোর সহ্য হল না দেখলাম। যাগগে, তোমার বানানো মদ্যের স্বাদ অসাধারণ, অ্যাগির। তবে সামনের বছর থেকে এখানে আর উৎসব হবে না, কারণ এই বছরেই আগুন লেগে এই হলঘর, তুমি আর তোমার প্রিয় সমস্ত জিনিস পুড়ে ছাই হয়ে যাবে।” একথা বলেই তিনি দেবতাদের ছেড়ে হলঘর থেকে অন্ধকারে বেরিয়ে গেলেন।
পরের দিন তাঁর ঘুম ভাঙল। তাঁর মনে পড়ল গতকাল তিনি কী কী করেছেন। তবে তাঁর কোনো অনুতাপ বা লজ্জা হল না। লোকির অনুতাপ হয় না। তবে তিনি বুঝতে পারলেন, এবার তিনি দেবতাদের সহ্যের সীমা ছাড়িয়ে ফেলেছেন।
সমুদ্রের পাশে পাহাড়ের উপর লোকির একটি বাড়ি ছিল, তিনি ভাবলেন সেখানেই তিনি অপেক্ষা করবেন যতদিন দেবতারা তাঁকে ভুলে না যান। সেই বাড়িটি পাহাড়ের একদম উপরে ছিল, তার চারধারে ছিল চার দরজা, যাতে লোকি নজর রাখতে পারেন কোনো দিক থেকে কোনো বিপদ আসছে কিনা। দিনের বেলায় লোকি একটা স্যামন মাছের রূপ ধরতেন আর তারপর তিনি ফ্র্যানাঙ’স জলপ্রপাতের নিচে পুকুরে লুকিয়ে থাকতেন। একটা জলস্রোত এই পুকুরটাকে একটা ছোট্ট নদীর সঙ্গে যোগ করেছে, আর সেই ছোট্ট নদীটি সোজা গিয়ে সমুদ্রে পড়েছে।
কয়েকদিন লোকি দিব্যি খুশি ছিলেন, কিন্তু হঠাৎ তাঁর মাথায় নতুন চিন্তা এলো। সত্যিই কি স্যামন মাছ হয়ে তিনি সুরক্ষিত? যদি তাঁকেই স্যামন মাছ ধরার দায়িত্ব দেওয়া হয়, তাহলে তিনি ঠিক কী করবেন? এই ভেবে তিনি একটা দারুণ মাছ ধরার জাল বানালেন। তারপর ভাবলেন, এইরকম একটা জাল থাকলে আমি স্যামন মাছ ধরতে পারব। তারপরেও লোকির চিন্তা দূর হলো না। তিনি ভাবলেন, যদি দেবতারা এইরকম একটা জাল বানায় তাহলে আমি পালাব কী করে? স্যামন মাছ লাফাতে পারে, শ্রোতের উল্টোদিকে সাঁতার কাটতে পারে, এমনকি জলপ্রপাতের উল্টোদিকেও যেতে পারে। আমি জালের উপর দিয়ে লাফাবো।
লোকি এতকিছু ভাবার পর হঠাৎ লক্ষ্য করলেন, দেবতাদের অনেকে পাহাড়ের গা বেয়ে উঠে আসছেন; তাঁরা লোকির বাড়ির কাছে প্রায় এসে পড়েছেন।
লোকি প্রথমেই জালটা আগুনে পুড়িয়ে দিলেন, তারপর ফ্র্যানাঙ’স জলপ্রপাতের উপরে উঠলেন। পরক্ষণেই একটা রুপোলী স্যামন মাছের রূপ ধরে জলে তলিয়ে গেলেন। জলপ্রপাতে নিচে পড়ে তিনি গভীর পুকুরে লুকিয়ে পড়লেন।
ভ্যস্যার নামে দেবতার কথা আগেই বলা হয়েছিল, যিনি মারা গিয়েছিলেন! আবার তিনি জীবন্ত হয়ে উঠেছেন। লোকিকে ধরার জন্য দেবতাদের যে দল গঠিত হয়েছিল, সেই দলের প্রধান হলেন তিনি আর থর।
দেবতারা যখন লোকির বাড়িতে পৌঁছলেন, তখন তিনি নেই। তবে তাঁর গ্লাসে অর্ধেক মদ্য দেখেই ভ্যস্যার বুঝতে পারলেন যে কয়েক মুহূর্ত আগেই লোকি বাড়িতে ছিলেন। থর অধৈর্য হয়ে উঠে বললেন “লোকি যেকোনো রূপ ধারণ করতে পারে, এভাবে ওকে কখনোই ধরা যাবে না।” ভ্যস্যার বললেন—“একটু অপেক্ষা করো”, তারপর তিনি মেঝেতে পড়ে থাকা ছাই পরীক্ষা করে দেখে বললেন—”এখানে যেটা পোড়ানো হয়েছে, ছাই দেখে মনে হচ্ছে সেটা জাল বোনার দড়ির মত কিছু।”
থর অধৈর্য্য হয়ে বললেন—“তাতে আমাদের কী! সামান্য দড়ির ছাই দেখে কি জানা যাবে যে লোকি কোথায় গেছে?”
ভ্যস্যার বললেন—”এই জ্বলে যাওয়া দড়ির আকৃতি অনেকটা মাছ ধরার জালের মত, ওই আধপোড়া কাঠের টুকরোর সঙ্গে এই দড়ির বোনা একসঙ্গে করলে একটা মাছ ধরার জালই হয় বটে।”
থর বললেন—”যদি তাই হয়, তাতেই বা আমাদের কী? হয়তো লোকির খিদে পেয়েছিল, তাই সে জাল বুনেছে মাছ ধরতে। এই নতুন রকমের জাল সে আবিষ্কার করেছে হয়তো, সে বুদ্ধিমান লোক, আবোলতাবোল আবিষ্কার করতেই থাকে। তবে এটা আমাদের কী সাহায্য করবে বুঝতে পারছি না।”
ভ্যস্যার বললেন—“তুমি ঠিকই বলেছ। তবে একটা কথা আমাকে বলো তো, যদি লোকি এমন একটা জিনিস আবিষ্কার করে যা দিয়ে মাছ ধরা যায়, তাহলে সেটা আগুনে পুড়িয়ে দেবে কেন?”
“কারণ…” বলে থর আকাশপাতাল ভাবতে লাগলেন কিন্তু কোনো উত্তর পেলেন না।
“হ্যাঁ, কারণ একমাত্র এটাই হতে পারে, যে সে চায় না যে আমরা এটা খুঁজে পাই, আর এমন কিছুই না করি যার ফলে সে ধরা পড়ে যাবে।
থর যেন একটু একটু ধরতে পারছেন এবার, “হ্যাঁ, তাহলে লোকি…”
“হ্যাঁ! সে জলপ্রপাতের নিচে লুকিয়ে আছে মাছ হয়ে। জানি তুমি এক সময়ে এই সিদ্ধান্তেই পৌঁছবে, আমি শুধু সময় নষ্ট না করে উত্তরটা আগেই দিয়ে দিলাম।” এই বলে তিনি বাকি জাল বাঁধার দড়ি দিয়ে আরেকটা জাল বুনতে লাগলেন এবং বাকি সব দেবতাদেরও শেখালেন কিভাবে জাল বুনতে হয়, তাঁরাও বুনতে লাগলেন। এক সময় জালটা পুরো পুকুরের মতই বড় হল, তখন তাঁরা পুকুরের কাছে গেলেন। তাঁরা প্রথমে এমনি জাল ফেললেন, কিন্তু কিছু ধরা পড়ল না। তবে থর বললেন—”এই পুকুরের তলায় কিছু একটা আছে। সে জালকে ঠেলে দিচ্ছিল সেটা আমি টের পেয়েছি, কিন্তু সেটা আরো গভীরে জলতলের কাছে কাদার মধ্যে চলে গেছে, আর আমাদের জাল তার উপর দিয়ে গেছে।”
তখন দেবতারা কিছু পাথর খুঁজে বার করলেন আর সেগুলির মধ্যে ফুটো করে জালের নিচে সেগুলি বেঁধে দিলেন যাতে জাল জলের অনেক গভীরে নীচ অবধি যায়।
লোকি পুকুরের একদম নিচের দিকে কাদার মধ্যে দুটো পাথরের ফাঁকে নিশ্চিন্ত হয়ে বসে ছিলেন। দেবতাদের জাল উপর দিয়ে চলে যেতে দেখেছিলেন। ভাবছিলেন যে তাঁকে ধরতে না পেরে দেবতারা ক্লান্ত হয়ে চলে যাবেন। তবে এখন তিনি পড়লেন মুশকিলে। পুকুরের তলা অন্ধকার এবং ঠান্ডা, দম বন্ধ হয়ে আসছে তাঁর। তিনি ভাবলেন, দেবতারা আশা করবে যে তিনি সমুদ্রের দিকে যাওয়ার চেষ্টা করবে, তাই তিনি সেদিকে না গিয়ে জলপ্রপাতের উপরের দিকে যাবেন। দেবতারা নিশ্চয়ই সেটা আশা করবেন না।
একটু পরেই দেবতারা অবাক হয়ে দেখলেন একটা বিরাট স্যামন মাছ লেজ নেড়ে নেড়ে জলপ্রপাতের উপরের দিকে উঠছে।
এক মুহূর্ত পরেই ভ্যস্যার সব দেবতাদের দুটো দলে ভাগ হয়ে যেতে বললেন। জালের একদিক একদল ধরবে, অন্যদিক অন্য দল। তিনি চেঁচিয়ে বললেন—“ও জলপ্রপাতে বেশিক্ষণ থাকবে না, ওটা অনেক বেশি খোলা যায়গা। জালের একপ্রান্ত একদল ধরো, আর অন্যপ্রান্ত অন্যদল। থর, এদিকে এসো। পালাবার পথ না পেয়ে ও নিশ্চয়ই জালের উপর দিয়ে লাফিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করবে। তার মাঝেই তোমাকে শূন্যেই ওকে লুফে নিতে হবে, যেমন ভাবে ভাল্লুকে মাছ ধরে। ও যতই কৌশল করুক, ওকে ছেড়ে দিলে হবে না।”
তারপর দেবতারা একসঙ্গে জালটাকে ক্রমাগত উপরের দিকে ওঠাতে লাগলেন। লোকি বুঝলেন এখনই তাঁকে পালাতে হবে। তিনি জলপ্রপাত থেকে নদীর বুকে যাওয়ার জন্য ঝাঁপ দিলেন।
থরও তক্কে তক্কে ছিলেন। তিনি বাতাসে এক উড়ন্ত রুপোলি রেখা দেখেই সঙ্গে সঙ্গে খপ করে ধরলেন। স্যামন মাছ এমনিতে খুব পিছল, আর লোকি তো সম্ভবত সবথেকে পিছল স্যামন। তাই এই বিরাট মাছও পিছলে যাওয়ার জন্য খুব চেষ্টা করল, কিন্তু থরের বজ্রমুষ্টি আলগা হল না। দেবতারা জাল আনলেন আর মাছকে শক্ত করে বেঁধে নিজেদের মাঝে বয়ে নিয়ে যেতে লাগলেন। কিছুক্ষণ পরে মাছটা জলের অভাবে খাবি খেতে লাগল, আর তারও কিছুক্ষণ পরে দেখা গেল জালের মধ্যে হাঁপাচ্ছেন লোকি।
দেবতারা বিনা বাক্যব্যয়ে জালশুদ্ধু লোকিকে নিয়ে রওয়ানা দিলেন।
“আমাকে কোথায় নিয়ে যাওয়া হচ্ছে?” লোকি জিজ্ঞাসা করলেন, “আমাকে নিয়ে কী করতে চলেছ তোমরা?”
থর শুধুই মাথা নাড়লেন, কোনো উত্তর দিলেন না। শুধু একটা তাচ্ছিল্যের হুঁ বেরোলো যেন তাঁর নাক দিয়ে। লোকি একে একে সকল দেবতাকে জিজ্ঞাসা করলেন, কিন্তু কেউ কিছু উত্তর দিলেন না।
তাঁরা এক পর্বতের গভীর গুহায় ঢুকলেন। অনেকটা পথ চলতে চলতে একসময় তাঁরা মাটির নিচে পৌঁছলেন, কিন্তু তাও তাঁদের যাত্রা থামল না। আরো অনেক পথ পেরিয়ে একদম নিচে এক জায়গায় পৌঁছলেন তাঁরা। সেখানে সামান্য আগুন জ্বলছে আর তিনজন ব্যক্তি তাঁদের জন্য অপেক্ষা করছেন। লোকি তাঁদের দেখেই চিৎকার করে উঠলেন—“ এঁরা আমার স্ত্রী আর সন্তান, এঁরা কোনো দোষ করেননি। এঁদের কোনো আঘাত করো না।”
আর কোনো কথা না বলে দেবতারা কাজে লেগে গেলেন। কিছু দূরে তিনখানা বিরাট চ্যাপ্টা পাথর ছিল, দেবতারা ওগুলি পাশাপাশি রাখলেন, আর থর তাঁর হাতুড়ি দিয়ে প্রতিটা পাথরের মধ্যে একটা করে গর্ত করলেন।
লোকির বড় পুত্র নারফি বললেন—“আমাদের পিতাকে ছেড়ে দেওয়া হোক।”
অন্য ছেলে ভালি বললেন—“তোমরা প্রতিজ্ঞা করেছিলে আমাদের পিতাকে হত্যা করা হবে না। উনি ওডিনের রক্ত-ভ্রাতা। ওডিন দেবতাদের রাজা, এমন অন্যায় নিশ্চয়ই উনি সমর্থন করবেন না।”
ভ্যস্যার বললেন, “আমরা ওঁকে হত্যা করব না, তবে ভালি, বলো দেখি, তোমার মতে একজন ভাই অন্য ভাইকে সবথেকে আঘাত কি করে করতে পারে?”
বিন্দুমাত্র চিন্তা না করে ভালি উত্তর দিলেন, “যখন এক ভাই অন্য ভাইকে হত্যা করে, সেটা সবথেকে বেশি ভয়ানক কাজ। যেমন হোডারের হাতে বল্ডারের হত্যা হয়েছিল।”
ভ্যস্যার বললেন—”একথা সত্যিই যে লোকি ওডিনের রক্তভ্রাতা এবং আমরা ওঁকে খুন করতে পারব না। কিন্তু আমরা ওঁর সন্তানদের সম্পর্কে এমন কিছুই কথা দিইনি। দেখা যাক্, লোকির এই দুই সন্তান পরস্পরকে কতটা ভালোবাসে।” তারপর ভালির দিকে তাকিয়ে কিছু মন্ত্রোচ্চারণ করা মাত্র ভালির মধ্যে এক অদ্ভুত পরিবর্তন দেখা দিল।
ভালির মানুষের রূপ পরিবর্তিত হয়ে গেল, এবং পরক্ষণেই দেখা গেল সেখানে একটা নেকড়েবাঘ দাঁড়িয়ে ভালির মনুষ্যত্বের একটুও আর তার চোখে অবশিষ্ট নেই, সেখানে শুধুই লোভ, ক্ষুধা আর রাগ। সে একবার দেবতাদের দিকে তাকালো, একবার তার মা সিজিনের দিকে, তারপর নারফির দিকে তাকালো। মুহূর্তের মধ্যে সেই নেকড়ে নারফির ঘাড়ে গিয়ে পড়ল। নারফির গলা থেকে স্বরটুকু বেরোনোর আগেই, তার টুটি ছিঁড়ে নাড়িভুঁড়ি বের করে ফেলল নেকড়ে। তারপর রক্তমাখা চোয়াল নিয়ে একবার লম্বা একটা হুঙ্কার দিলো। পরক্ষণেই দেবতাদের টপকে একটা লাফ দিয়ে সেই যে গুহার অন্ধকারে মিলিয়ে গেল, আর তাকে কখনো দেখা যায়নি।
দেবতারা তিনখানা পাথরের উপরে লোকিকে চেপে ধরে শুইয়ে দিলেন। একটা পাথর তাঁর মাথার নিচে, একটা পাথর তাঁর কোমরের নিচে আর একটা পাথর তাঁর পায়ের নিচে থাকল। তারপর নারফির নাড়িভুঁড়ি দিয়ে সেই পাথরের সঙ্গে লোকির গলা, কাঁধ, কোমর, হাঁটু আর পা বেঁধে দিলেন। জাদুবলে সেই নাড়িভুঁড়ি এত শক্ত— যেন লোহার বাঁধন, এত ঠান্ডা যেন বরফের শিকল। লোকি নড়াচড়ার শক্তি হারালেন। শিকলের জাদুতে অন্য কোনো রূপ ধারণ করার ক্ষমতাও আর রইল না তাঁর।
সিজিন দেখলেন যে তাঁরই সন্তানের নাড়িভুড়ি দিয়ে তাঁর স্বামীকে বাঁধা হচ্ছে। তিনি বাধা দিলেন না, এক জায়গায় বসে চুপচাপ কাঁদতে থাকলেন। তাঁর কাছে একটি বড় পাত্র ছিল। সেই পাত্র কী কাজে লাগবে তা তিনি জানতেন না। দেবতারা শুধু বলেছিলেন তাঁর রান্নাঘরের সবথেকে বড় পাত্রটা নিয়ে আসতে।
এরপর এলেন দানবী স্কাডি। থিয়াসির কন্যা, নিয়র্ডের স্ত্রী, ফ্রেয়া এবং ফ্রে এর মা। তাঁর হাতে এক মস্ত বড় সাপ। সেই সাপটিকে গুহার মাথার পাথরটির সঙ্গে এমনভাবে বেঁধে দেওয়া হল যাতে সাপটির মাথা লোকির মাথার ঠিক উপরে থাকে। সাপের মুখ থেকে টপ টপ করে বিষ ঝরে পড়ছিল। এমনই সে বিষ যে এক ফোঁটা লোকির মুখে পড়লেই লোকির চোখ মুখ জ্বলে যাচ্ছিল।
লোকি বিষের জ্বালায় চিৎকার করতে লাগলেন, বারবার মুখ সরানোর চেষ্টা করতে লাগলেন। বাঁধন ছাড়াবার চেষ্টা করতে লাগলেন, কিন্তু কিছু করতেই পারলেন না। তাঁরই সন্তানের নাড়ীভুঁড়ির বন্ধন তাঁকে সামান্যতম নড়ার অনুমতিও দিল না।
একের পর এক দেবতারা সেই যায়গা ছেড়ে চলে যেতে লাগলেন। লোকিকে শাস্তি দিয়ে কেউই সুখী হননি, তবে স্বস্তি পেয়েছেন তাঁরা। এক সময় ভ্যস্যার ছাড়া সেখানে কেউ রইলেন না। তখন সিজিন জিজ্ঞাসা করলেন—”আমাকে নিয়ে কী করা হবে?”
ভ্যস্যার উত্তর দিলেন—”কিছুই না। আপনাকে কোনো শাস্তি দেওয়া হয়নি, আপনার যা ইচ্ছে আপনি করতে পারেন।” একথা বলে ভ্যস্যারও সেই যায়গা ছেড়ে চলে গেলেন।
সিজিন তাঁর পাত্রটি নিয়ে লোকির কাছে গেলেন। কোনো কথা বললেন না। পাত্রটি ধরে থাকলেন লোকির মুখের ওপর, টপ টপ করে বিষ ঝরতে থাকল পাত্রে।
এইসব ঘটনা বহুদিন আগে ঘটে গেছে। দেবতারা তখন মিডগার্ডে বিচরণ করতেন। তারপর বহুকাল অতিক্রান্ত হয়েছে। তখনকার পর্বত হয়তো এখন মাঠে পরিণত হয়েছে। আর জলাশয়গুলি শুকিয়ে গেছে।
তবে সিজিন এখনো লোকির পাশে বসে অপেক্ষা করেন, তাঁর হাতে ধরা পাত্রটি বিষে ভরে ওঠে ধীরে ধীরে। যখন সেই পাত্রটা একেবারে ভরে যায়, একমাত্র তখনই সিজিন অন্যদিকে ফিরে বিষভর্তি পাত্র খালি করেন, আর তখন সাপের বিষ এসে পড়ে লোকির মুখে। আর তখনই তিনি যন্ত্রণায় কুঁকড়ে যান, ছটফট করেন, ঝাঁকুনি দেন। এত তীব্র সেই ঝাঁকুনি, যে সারা মিডগার্ড কেঁপে ওঠে। তাকেই মিডগার্ডের লোকেরা বলে ভুমিকম্প।
নর্সমিথ অনুযায়ী লোকি র্যাগনারক পর্যন্ত এভাবেই থাকবেন। সিজিন তাঁর কাছেই থাকবেন, বিষ তাঁর মুখে পড়ার আগেই পাত্রে ধরবেন। র্যাগনারক হল শেষের শুরু। র্যাগনারক এলে সবকিছু অন্যরকম হবে।