পঞ্চম অধ্যায় —মানুষ যেভাবে কাজ করতে শিখলো
ওডিন অ্যাসগার্ডে অবস্থিত তাঁর উচ্চ রাজসিংহাসন থেকে ইচ্ছা করলেই অন্যান্য জগতে কী চলছে সবকিছুই দেখতে পান। তিনি দেখতে পেলেন য়োটুনহাইমে দানবেরা ষড়যন্ত্র করছে তাঁকে হারাবার জন্য। এদিকে তাঁর যুদ্ধ করতে সেনার দরকার। অ্যাসিররা যথেষ্ট নয়। তিনি তাকালেন মিডগার্ডের দিকে, মানুষদের সাহায্য পাওয়ার আশায়। দেখলেন সাধারণ পশুদের মতই মানুষরা খাদ্য জোগাড়ে ব্যস্ত। সারাদিন ধরে খাদ্য সংগ্রহ করে রাত্রে তারা ঘুমিয়ে পড়ে। যুদ্ধ এবং যুদ্ধের ফলে প্রাপ্ত শৌর্য সম্পর্কে তাঁরা কিছুই জানেন না। খাদ্য অন্বেষণ করার সময় কম না হলে, তারা যুদ্ধবিদ্যা বা দেশশাসন কিছুই শেখার সময় পাবে না; আর তাদের না শেখালে র্যাগনারক অর্থাৎ শেষ যুদ্ধের জন্য ওডিনের যথেষ্ট সেনা পাওয়া মুশকিল। এই সব ভেবে তিনি তাঁর পুত্র হিমদলকে ডেকে পাঠালেন।
হিমদলকে তিনি বললেন, “বাছা, মিডগার্ডে যাও, যে ছদ্মবেশ তোমার ভালো লাগে সেটাই ধারণ করো। সাধারণ ভালো মানুষদের মধ্যে যাও। তাদের মধ্যে লোভ, হিংসা ইত্যাদি জাগানোর পরিকল্পনা করছে দানবেরা। আমি চাই তুমি তার আগে গিয়ে কিছু উপযুক্ত ব্যক্তিকে খুঁজে বের করে তাদের কিছু নতুন বিদ্যা শেখাও। তারা এখন কিছুই জানে না—তাদের এক উপযুক্ত জাতি তৈরি করো—যাতে তারা শৌর্য, বীরত্ব সম্পর্কে জানতে পারে। বিভিন্ন জিনিস বানাতে শেখাও যাতে তারা শুধুই খাদ্য জোগাড় করতে সময় নষ্ট না করে অন্য বিষয়ে ভাবনা চিন্তা করার সময় পায়। এমন নেতা তৈরি কর যে উপযুক্ত নেতৃত্ব দিতে পারে। এমন কিছু বীর আমার দরকার যারা র্যাগনারকের সময় আমার পাশে থাকবে।”
হিমদল এক পরিব্রাজকের ছদ্মবেশে বাইফ্রস্ট সেতু পার হয়ে মিডগার্ডে এলেন। তিনি পদব্রজে বন জঙ্গল পার হলেন, বিরাট মাঠ পার হলেন। সারাদিন হেঁটে সন্ধ্যাবেলায় তিনি এক কুটিরের সামনে এসে উপস্থিত হলেন।
দরজা খোলাই ছিল, তিনি ভেতরে ঢুকে এসে দেখলেন আগুন জ্বলছে আর তার উপরে একপাত্র স্যুপ ফুটছে। আর সেই আগুনের দুইপাশে বসে আছে বাড়ির কর্তা আই আর কর্ত্রী এডা। পরিবারটি গরীব হলেও পরিচ্ছন্ন।
তাঁরা এই অতিথিকে দেখে খুবই আপ্যায়ন করলেন। বিনীতভাবে বললেন যে এই বাড়িটিকে অতিথি যেন নিজের বাড়িই মনে করেন। শুধু অতিথির পরিচয় জানতে পারলে আপ্যায়নে একটু সুবিধা হত।
“আমার নাম রিগ, আমি একজন পরিব্রাজক” এই বলে হিমদল মাঝের আসনটি দখল করলেন। কর্তা আর কর্ত্রী তাঁর দুইপাশে বসলেন। রাতের খাবারের সময় তিনি সবথেকে বেশি রুটি আর স্যুপ খেলেন। তারপর রাতে তিনি খাটের ঠিক মধ্যিখানে শুলেন, যেখানটা সবথেকে নরম আর আরামদায়ক হয়ে ছিল। তাই কর্তা আর কর্ত্রী তাঁর দুইপাশে শুতে বাধ্য হলেন।
তিনদিন এইভাবে হিমদল থাকলেন। তিনদিন পর তিনি মুচকি হেসে এদের থেকে বিদায় নিয়ে নিজের পথে চলতে লাগলেন।
নয় মাস পরে আই আর এডার একটি পুত্রসন্তান হল। তার নাম থ্রল। সে সাধারণের থেকে খানিক অন্যরকম। সে স্বাভাবিকের থেকে তাড়াতাড়ি বড় হয়ে উঠল আর অসম্ভব শক্তিশালী হয়ে উঠল। গ্রামের অন্য কোনো মেয়ে তার পছন্দ হল না। পাহাড়ের অন্য পার থেকে ঘুরতে আসা একটি মেয়েকে সে বিয়ে করল। তার সন্তানরা নানা গুণের অধিকারী হল, তারা বেড়া বাঁধতে পারত, চাষ করতে পারত। পশুপালন, বিশেষত শুকর ও ছাগল পালন করতে পারত। শুধুমাত্র শিকার করেই তারা জীবন নির্বাহ করত না। তাদের সন্তানদের বিবাহ হলে এই গুণগুলি ছড়িয়ে পড়ল সবার মধ্যে।
এদিকে হিমদল আবার তার যাত্রা শুরু করেছেন। পরদিন বিকেলে তিনি আরেক বাড়ির সামনে গিয়ে দাঁড়ালেন, তারপর দরজা খুলে সোজা ঢুকে গেলেন। এই পরিবারটি একটু স্বচ্ছল, সুন্দর জামাকাপড় পরা। এই স্বামী-স্ত্রীয়ের নাম গ্যাফার আর গ্যামার।
তাঁরা বললেন, “আপনাকে স্বাগত জানাই অতিথি। এই বাড়িটিকে নিজের বাড়ির মতই মনে করুন। আপনাকে কী নামে ডাকা হবে বলুন?”
“আমার নাম রিগ, আমি একজন পরিব্রাজক।” তারপর তিনি যথারীতি মাঝখানের জায়গা দখল করলেন। রাত্রে তিনি সবথেকে বেশি স্যুপ আর সবথেকে বেশি মাংস খেলেন। যথারীতি খাটের মাঝখানে ঘুমোলেন, কর্ত্রী আর কর্তা তাঁর দুইপাশে শুতে বাধ্য হলেন। তিন রাত্রি পরে তিনি আবার নিজের পথে রওয়ানা দিলেন।
নয় মাস পরে গ্যাফার আর গ্যামারের এক পুত্রসন্তান হল, তার নাম কার্ল। ছোটবেলা থেকেই তার জিনিসপত্র বানাবার অদ্ভুত ক্ষমতা ছিল। সে-ই প্রথম ষাঁড়কে হালে জুতে ক্ষেতে চাষ করতে শুরু করল, সুন্দর বাড়ি বানাতে পারল, তারপর সে নানা রকম জিনিস বানাতে শুরু করল— গরুর গাড়ি, ঘোড়ার গাড়ি, কৃষিজমিতে কাজ করার যন্ত্রপাতি ইত্যাদি। যথাসময়ে তার বিয়ে হল। তারা নিজেদের জমি নিজেরাই চাষ করত, নিজেদের বস্ত্র নিজেরাই বানাতে পারত। আর এইভাবে তারা তাদের টাকা সঞ্চয়ও করতে পারল। তাদের পুত্ররা চাষী, কারিগর ইত্যাদি হল। তাদের কন্যারা গৃহকর্ম-নিপুণা আর গোয়ালিনী হল। এভাবে এই সব গুণগুলি মানুষের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ল।
হিমদল আবার বেরিয়ে পড়েছিলেন। এবারেও হাঁটতে হাঁটতে তিনি এসে পড়লেন এক বড় বাড়িতে। এই বাড়িতে একটি উচ্চবিত্ত পরিবারের বাস, তাঁদের নাম স্কোয়ার আর লেডি। স্কোয়ার বসে বসে তাঁর লম্বা ধনুকে গুণ পরাচ্ছিলেন।
হিমদলকে দেখে তাঁরা স্বাগত জানালেন। তাঁরাও জিজ্ঞাসা করলেন— হিমদলকে কী নামে ডাকা হবে। হিমদল জানালেন—তিনি রিগ, পরিব্রাজক। তারপর মাঝের জায়গাটি দখল করলেন। রাতের খাবার সময় তাঁকে লেডি পরিবেশন করলেন রুটি, মাংস, মুরগীর রোস্ট, জগ ভর্তি ওয়াইন। সব বাসনপত্রই রূপোর। খাওয়াদাওয়ার শেষে হিমদল যথারীতি খাটের মাঝখানে শুলেন। কর্তা আর কর্ত্রী তাঁর দুইপাশে শুলেন। তিনদিন পরে হিমদল আবার নিজের পথে রওনা দিলেন।
নয় মাস পরে স্কোয়ার এবং লেডির একটি পুত্রসন্তান হল। সেই পুত্র হল খুবই বীর। তাঁর নাম ওয়ারিয়র লর্ড। সে যতই বড় হতে লাগল, তার ধনুক বানাবার ক্ষমতা, বর্শা ছোঁড়ার ক্ষমতা, ঘোড়ায় চড়ার ক্ষমতা, তলোয়ারের লড়াই আর সাঁতার কাটার ক্ষমতা বাড়তে লাগল। তার দৃষ্টিশক্তি এবং শ্রবণশক্তি প্রখর হতে লাগল।
যখন হিমদল অ্যাসগার্ডে ফিরে এলেন, তখনো ওয়ারিয়র লর্ড জন্মাননি। হিমদল ফিরে দেখলেন একটা নতুন বিশাল হলঘর বানানো হয়েছে অ্যাসগার্ডে, ওডিনের মূল সভাগৃহের পাশেই। সেইটিই হল ওডিনের বিরাট সুবিখ্যাত হল ভ্যালহালা।
ওয়ারিয়র লর্ড যখন একজন তরুণ যুবা, তখন একদিন ঘন বন থেকে বেরিয়ে এলেন পরিব্রাজক রিগ। তিনি তাকে বললেন, “এই সমস্ত জমি, যা ল্যান্ড অফ উডাল নামে পরিচিত, তুমি আজ থেকে তার রাজা হলে। তোমার পুত্র এবং তার পুত্রেরা এই জমিতে বংশপরম্পরায় রাজত্ব করবে। আমি আসলে একজন অ্যাসির, অ্যাসগার্ডে থাকি। আমি ঘোষণা করছি যে তুমি আমার ধর্মপুত্র। আর তোমাকে আমিই এই রাজত্ব দান করছি— তুমি আজ থেকে মানুষদের নেতৃত্ব দেবে।” এই বলে রিগ ওয়ারিয়র লর্ডকে আরো গভীর বনে নিয়ে গেলেন, যেখানে ট্রলরা বাস করে। সেখানে তিনি তাকে শেখালেন অতি উত্তম তরোয়ালবাজী, ঢালের বিভিন্ন ব্যবহার আর ঘোড়াকে লাফ দেওয়ানো।
এরপর ওয়ারিয়র লর্ড নিজের এক সেনাবাহিনী বানালেন। যে সমস্ত দুষ্ট মানুষরা দৈত্যদের সঙ্গে মিলে মানবজাতির আর অ্যাসিরদের ক্ষতি করার চেষ্টায় ছিল— তাদের যুদ্ধে হারিয়ে তাদের সব জমি দখল করে নিলেন। তারপর তিনি বিবাহ করলেন এক রাজকন্যাকে। তাঁদের যে পুত্র হল, তিনি হলেন মিডগার্ডের প্রথম রাজা, ডেনমার্কের রাজা। রাজা তাঁর বীর সেনানীদের আর জমিদারদের একত্র করলেন এবং সমস্ত দেশ জয় করে শান্তিপুর্ণ রাজত্বের সুচনা করলেন।
তারপরে তিনি এক বিশাল হলঘর বানালেন, যেখানে যুদ্ধজয়ের পরে পানভোজন হয় এবং সেখানে যারা খুবই বীরত্বের সঙ্গে যুদ্ধ করেছেন— তাদের তিনি সোনার আংটি উপহার দেন।
ওয়ারিয়র লর্ডকে হিমদল অনেক কাহিনী শুনিয়েছিলেন। অ্যাসিরদের কাহিনী, দৈত্যদের কাহিনী এবং র্যাগনারকের কাহিনী। তিনি আরও বলেছিলেন— ওডিন জানিয়েছেন যে যারা বীরের মত যুদ্ধ করে মারা পড়বে সেই সকল আত্মা ওডিনের বিরাট এক হলে আশ্রয় পাবে, যার নাম ভ্যালহালা। সেখানে এক বিরাট সৈন্যদল তৈরি হবে, যারা শেষ দিনে র্যাগনারকে যুদ্ধ করবে। সেই কাহিনীই নর্সমেনদের মধ্যে ছড়িয়ে পড়েছে, তাই নর্সদের কেউ যুদ্ধ করতে এতটুকু ভয় পেতেন না।
ভাঙ্কনাট — ওডিনের অনেকগুলি প্রতীকের মধ্যে এটি অন্যতম। ভাল শব্দের অর্থ বীরের মত নিহত, আর নাট শব্দের অর্থ গিঁট। প্রসঙ্গতঃ ওডিন যুদ্ধ এবং ফাঁসিকাঠের দেবতা।