৬. মাথার উপর চড়া রোদ

ধীরে ধীরে এগিয়ে চললেন সরোজা।

কোন দিক লক্ষ্য করে, তা বোঝা গেল না। হয়তো নিজেও তিনি জানেন না সেটা। অথচ মাথার উপর চড়া রোদ। গায়ে সেই আগুনের হলকা লাগছে।

রোদ শুরু হয়ে গেছে, আর সঙ্গে সঙ্গেই শুরু হয়ে গেছে ডাবের লীলা। যেখানে সেখানে বসে গেছে ডাবের বেসাতি। গাছতলায়, ফুটপাথে, পানের দোকানে। দোকানি ক্ষিপ্রহাতে ডাবের মুখ কেটে এগিয়ে দিচ্ছে পিপাসার্তের মুখের কাছে।

কেউ এমনিই গলায় ঢালছে, কেউ কায়দা করে কাগজের খড় ডুবিয়ে খাচ্ছে।

সরোজাক্ষ ভাবলেন, সহজ হতে পারার হয়তো আলাদা একটা সুখ আছে। আমি ভাবতেই পারি না রাস্তার মাঝখানে দাঁড়িয়ে কোনও কিছু খাচ্ছি। অথচ এরা অনায়াসেই

শুধু ডাব কেন, বহুবিধ বস্তুই।

শহরের রাস্তা অজস্র লোভনীয় খাদ্য পানীয় সাজিয়ে নিয়ে বসে আছে, হাতছানি দিয়ে ডাকছে, পথচারীর ইচ্ছের ঘরের দরজায় টোকা দিচ্ছে, খাবে না তারা? খাবেই তো।

সরোজাক্ষ পারেন না, সেটা সরোজাক্ষর ত্রুটি। সবাই যেটা করছে, সেটা করতে না পারা একটা ত্রুটিই নিশ্চয়ই। যে ত্রুটিটা অন্যের কোনও অসুবিধে ঘটায় না, অসুবিধে ঘটায় নিজের।

স্যার, আপনি এ সময় এখানে?

একটি ছেলে নিচু হয়ে প্রণাম করতে এল।

থাক থাক! দুপা পিছিয়ে সরে এসে তাকালেন সরোজাক্ষ, কে?

স্যার আমি শিখরেন্দু। আমি শিখরেন্দু বলেই নিশ্চিত হল ছেলেটা। তার মানে ধরে নিল, ওইটুকুতেই সব বলা হয়েছে। স্যার নিশ্চয় বুঝে নেবেন, একে পড়িয়েছেন, এবং কবে পড়িয়েছেন।

কথাটা ভেবেই সঙ্গে সঙ্গে লজ্জিত হলেন সরোজাক্ষ। ভাবলেন, কেন নয়? কেনই বা প্রত্যাশা থাকবে না এদের, যাঁর কাছে তিন চার বছর ধরে পড়েছি তিনি আমার মুখটি দেখে, অথবা নামটি শুনে চিনে ফেলবেন?

হয়তো এ আমার খুব প্রিয় ছাত্রই ছিল, হয়তো খুব মেধাবী ছিল, কিন্তু সেসবের কিছু মনে নেই আমার।

সরোজাক্ষ ভাবলেন, কিংবা এ হয়তো সেদিনের সেই ঘেরাওয়ের দলেই ছিল। এখন দলছাড়া। তাই এখন নিজের ভদ্রসত্তাকে ফিরে পেয়েছে। অথবা হয়তো প্রাক্তন ছাত্র।

সরোজাক্ষ তাই চেনা-অচেনার মাঝামাঝি একটুকরো সৌজন্যের হাসি হেসে বলেন, আমিও তোমায় সে প্রশ্ন করতে পারি।

যখন স্যার বলে পায়ের ধুলো নিতে এসেছে, তখন তুমি বলাই শোভন।

আমার কথা বলছেন? ছেলেটা যেন নিজেকে তাচ্ছিল্যের ধুলোয় আছড়ে ফেলে দিয়ে বলে, আমাদের কথা বাদ দিন। কাজের ধান্দায় সময় অসময় বলে কিছু নেই। সেই পঁয়ষট্টি সাল থেকে কী না করছি, কোথায় না ঘুরছি, কাকে না ধরছি, ঠিকমতো একটা কিছুই পাচ্ছি না।

পঁয়ষট্টি সাল!

তার মানে প্রাক্তন।

তার মানে ঘেরাওদের দলের নয়।

 সরোজা ঈষৎ নিশ্চিন্ত চিত্তে বলেন, আছো কোথায় এখন?

 আছি এখানেই। তালতলায় সেই পিসির বাড়িতেই আছি, একটা কিছু জোগাড় করে ফেলতে পারলেই একটু বাসাভাড়া করে মাকে দেশের বাড়ি থেকে নিয়ে আসব। একা-একা থাকেন

নিজেকে তাচ্ছিল্যের ধুলিতে নিক্ষেপ করার ভঙ্গি করলেও, নিজের কথাই সাতকাহন ছেলেটার।

শেষ বয়েসেও যদি মাকে একটু শান্তি দিতে না পারলাম, তবে আর কী হল। কিন্তু বলব কি স্যার, চাকরির বাজার যা হয়েছে–ব্যাকিং না থাকলে কার সাধ্য কিছু জোটাতে পারে।

সরোজাক্ষ এই জোলো জোলো আক্ষেপ আর জোলো জোলো মাতৃভক্তির বুলি শুনে মৃদু হাসলেন। এই ধরনের ছেলে বলেই বোধ হয় গুরু-শিষ্য সম্পর্কটা বজায় রেখেছে মনের মধ্যে। ভাবলেন, মাকে শান্তি দিতে না পারার আক্ষেপের পিছনে আর একটি আক্ষেপও কাজ করছে বইকী! মনকে চোখ ঠারা, ভাবের ঘরে চুরি, মাকে শাস্তি দেওয়া!

ওই আত্মপ্রতারণার বশে যা হোক একটা চাকরি জুটলেই একটু বাসাভাড়া করে মাকে দেশ থেকে এনে ফেলে মার সেবিকা এনে হাজির করবে, তারপর আবার কিছুদিন পরেই মাকে শাস্তি দিতে ফের দেশের বাড়িতে রেখে আসবে। তফাতের মধ্যে এখন সপ্তাহে মাকে দেখতে যাওয়া, তখন সেটা বন্ধ হয়ে যাবে। তখন শুধু মনি অর্ডারের ফরমে মাতৃ-সম্বোধনযুক্ত চিঠি।

এদের দিয়েই দেশ ছাওয়া।

সরোজাক্ষর প্রশ্ন করতে হয় তাই করেন। তোমার আর ভাই নেই?

 আছে স্যার। একটি ছোট ভাই আছে, ক্লাস টেন-এ উঠল এবার। ভাবছি ওকে আর হায়ার এডুকেশনে দেব না। কোনও টেকনিক্যাল লাইনে

সরোজাক্ষর ক্লান্তি আসছিল।

সরোজাক্ষর ভয় করছিল–এরপরই হয়তো বয়স্থা আইবুড়ো বোনের কথা তুলবে এবং বিয়ের বাজার নিয়ে দার্শনিক মন্তব্য করবে।

সরোজাক্ষ তাই বলেন, সেটাই ভাল। এখন যাচ্ছিলে কোথায়?

এই এখানে একজনের সঙ্গে দেখা করতে। পাবলিক সার্ভিস কমিশনের চেয়ারম্যানের সঙ্গে নাকি ওঁর ভাইপোর বিশেষ চেনা-জানা আছে। দেখি যদি বলে কয়ে দেশের স্কুলে একটা মাস্টারি পেয়েছিলাম, মানে তারাই ধরাধরি করছিল, বুঝলেন? মারও খুব ইচ্ছে ছিল যাতে দেশেই থাকা হয়। মাইনে-টাইনেও আজকাল আগের মতো পুওর নয়, সবই ঠিক, কিন্তু কী জানেন স্যার, লাইনটা বড় ইয়ে। মানে মানসম্ভ্রম বলে কিছু থাকে না। স্কুল মাস্টার শব্দটাই যেন হতশ্রদ্ধার। নয় কি না বলুন?

উত্তরের আশায় সরোজাক্ষর মুখের দিকে তাকায় শিখরেন্দু।

কিন্তু কী উত্তর দেবেন সরোজাক্ষ?

নয়, এ কথা বলতে পারবেন?

সরোজাক্ষ অতএব বলেন, সর্বত্র নয়।

 এবার ছেলেটি উদ্দীপ্ত হয়ে ওঠে, নয় কি বলছেন স্যার? সর্বত্র। সর্বত্রই এক অবস্থা। এখন আর গুরুমশাই-এর বেতের ভয়ে ছাত্ররা তটস্থ নয়। ছাত্ৰমশাইদের বেতের ভয়ে গুরুমশাইরাই আশঙ্কিত। সেই যে ছেলেবেলায় পড়েছিলাম সেই দেশেতে বেড়াল পালায় নেংটি ইঁদুর দেখে মনে হচ্ছে সেই মজার দেশটাতেই বাস করছি আমরা। নচেৎ আপনার মতো মানুষের–ছেলেটার করুদ্ধ হয়ে আসে, শুনেছি তো ব্যাপার! কাগজে বেরিয়েছিল! আপনার মতো মানুষকে যে এভাবে

সরোজাক্ষ মৃদু দৃঢ় গলায় বলেন, যাক ও সব কথা। অনেক পুরনো হয়ে গেছে।

 শিখরের কিন্তু এ ইশারায় চোখ ফোটে না, সে উদ্দীপ্ত গলায় বলে, আপনি স্যার মহানুভব মানুষ, অপমান গায়ে মাখেন না, কিন্তু শুনে আমাদের যা মনের অবস্থা হয়েছিল! আর কিছুই নয় স্যার, সবই পার্টি পলিটিক্স! ওই স্টুডেন্টদের মধ্যেই যা চাঁই এক-একখানি আছে স্যার! বছর বছর ইচ্ছে করে ফেল করে করে কলেজের মধ্যে জাঁকিয়ে বসে থাকে, আর অন্য সব ছেলেকে বিষাক্ত করে তোলে।

সরোজাক্ষ মৃদু হেসে বলেন, ইচ্ছে করে ফেল করে?

হাসছেন স্যার? আছো কোথায় আপনি? যা অবস্থা হয়েছে আজকাল শিক্ষা বিভাগের। রন্ধ্রে রন্ধ্রে শনি। কোথাও বাদ নেই। শুধু ক্যালকাটা ইউনিভার্সিটিই নয়, সর্বত্র! আমার এক পিসতুতো দাদা–

সরোজাক্ষর বুঝতে দেরি হয় না। শিখরেন্দু নামের এই ছেলেটির কোনও কথাটাই নিজস্ব চেতনা থেকে উদ্ভূত নয়, সবই ওই পিসতুতো দাদা আর মাসতুতো জামাইবাবুর ব্যাপার। সব উত্তেজনাই ঠাণ্ডা হয়ে যাবে ওর যদি এখনি একটা মনের মতন চাকরি পায়। যে চাকরির আয় থেকে অন্তত শহরে একটু বাসা করা যায়, এবং একটি বিয়ে করে ফেলে সোনার সংসার রচনা করা যায়।

সময়ে উপার্জনআর সময়ে বিয়ে, এটাই বোধ করি যুগ-যন্ত্রণার ওষুধ। ওইটার অভাবেই ওরা আগুন জ্বালিয়ে বেড়াচ্ছে।

পিসতুতো দাদার অভিজ্ঞতার কাহিনী শুনতে ইচ্ছে হল না সরোজাক্ষর, তাই বললেন, হ্যাঁ, চারদিকেই তো ওই পাটি-পলিটিক্স।

সেই কথাই তো বলছি স্যার শিখরেন্দু মহোৎসাহে বলে, আপনার সঙ্গে যে ব্যবহার করা হয়েছে, তার পিছনেও তাই। নইলে–

সরোজাক্ষ দৃঢ়স্বরে বলেন, না! ওর মধ্যে অন্য কিছু নেই। সম্পূর্ণ আমার নিজের দোষ। আমি ওদের প্রতি সম্মান রেখে ব্যবহার করিনি, ওরা শুধু তার পালটা জবাব দিয়েছে। আমার আরও ভদ্র হওয়া উচিত ছিল, আরও সহিষ্ণু হওয়া উচিত ছিল।

শিখরে এবার যেন একটু থতমত খায়।

আস্তে বলে, কাগজে কিন্তু

কাগজের কথা বাদ দাও। ওরা সব কিছুতেই লাগাতে ভালবাসে। আচ্ছা

সরোজাক্ষ বিদায়ের ইঙ্গিত করলেন।

 নাছোড়বান্দা ছেলেটা তবু স্রিয়মাণ গলায় বলে, কিন্তু একটা কথা শুনে বড় দুঃখ পেলাম স্যার, আপনি কলেজ ছেড়ে দিয়েছেন–

কলেজ ছাড়িনি–সরোজাক্ষ স্থির গলায় বলেন, ওই কলেজটা ছেড়েছি।

 সেই তো, সেই কথাই তো বলছি–ওখানে আপনি নেই, ভাবতেই পারা যায় না–

সরোজাক্ষ এবার হাসেন, তাতে তোমার আর আক্ষেপকীসের? তুমি তো আর আবার ওখানে ভর্তি হতে আসছ না?

শিখরেন্দুও এবার হাসে।

তা না হোক। তবু মানে এখনকার স্টুডেন্টদের জন্যেই

ওখানে ছাড়াও তো স্টুডেন্ট আছে। তাদের নিয়েই কাজ করা যাবে। কাজ করারই চেষ্টা করব এবার। এতদিনের ফাঁকির প্রায়শ্চিত্ত করতে চেষ্টা করব।

ফাঁকি! আপনি!

 শিখরেন্দু প্রায় জিভটা বার করে জিভ কাটে।

আপনি দিয়েছেন ফাঁকি! সেই কথা বিশ্বাস করব? লোকে বুঝি এই কথা রটিয়ে বেড়াচ্ছে? ছি ছি! যুগে যুগে এই হয় স্যার! মহতের পিছনেই ষড়যন্ত্র চলে।

দুঃখে ভেঙে পড়ে শিখরেন্দু।

 সরোজাক্ষ সেদিকে তাকিয়ে দেখেন না। বলেন, আচ্ছা, আশা করছি শিগগিরই কাজ পেয়ে যাবে।

চলে যান আর না তাকিয়ে।

ভাবেন, ফাঁকি দিইনি তো কী?

তুমিও তো আমার হাত দিয়েই পার হয়েছ।

.

যে খবর সযত্নে গোপন করেছিলেন বিজয়া, সেই খবর নিয়েই এসে ফেটে পড়লেন, যখন শুনলেন সরোজাক্ষ সত্যিই চলে যাচ্ছেন এবং একেবারে একাই যাচ্ছেন।

শেষ পর্যন্ত আশা ছিল তাঁর, সরোজাক্ষর দ্বারা অতখানি হয়ে উঠবেনা। একা বাক্স-বিছানা নিয়ে তিনি বাড়ি ছেড়ে অন্যত্র চলে যাবেন জীবিকার সন্ধানে, এ অসম্ভব। কিন্তু বিজয়ার আশাভঙ্গ হল, সরোজা ঘোষণা করেছেন, কাল নটার গাড়িতে বেরোতে হবে আমায়।

বিজয়া শুনলেন, বামুন ঠাকুরের মুখে।

তাঁকেই জানিয়েছেন সরোজাক্ষ, সকাল করে ভাত দেবার জন্যে।

বিজয়া এসে ঘরে ঢুকলেন।

দরজাটা ভেজিয়ে দিয়ে পিঠ ঠেকিয়ে দাঁড়ালেন।

বিজয়ার চোখে আগুনের ঝলক।

বিজয়ার মুখে পাথরের কাঠিন্য।

সরোজাক্ষ তবুও হয়তো কিছুই বলতেন না যদি না বিজয়া অমন করে দরজা বন্ধ করে আটকে দাঁড়াতেন।

সরোজাক্ষর হঠাৎ মনে হল, যেন অনেক অনেকগুলো দিন আগের বিজয়াকে দেখছেন। সরোজাক্ষ প্রায় প্রায় তাঁর পড়ার ঘরেই রাত দুটো তিনটে পর্যন্ত কাটিয়ে ফেলতেন, পড়াশোনা করতে করতে, এবং একান্তভাবে প্রার্থনা করতেন বিজয়া যেন ঘুমিয়ে পড়ে, তিনি বাকি রাতটুকু এই সোফাটাতেই কাটিয়ে দিয়ে বাঁচেন।

কিন্তু প্রার্থনা পূর্ণ হত না।

একঘুম থেকে উঠে নীচের তলায় পড়ার ঘরে নেমে আসত বিজয়া, আর এইভাবে দরজাটা বন্ধ করে পিঠ ঠেকিয়ে দাঁড়াত। বিজয়ার চোখে আগুন জ্বলত, বিজয়ার নিশ্বাসে আগুন ঝরত। বিজয়াকে যেন একখানি সুন্দরী পিশাচীর মতো দেখতে লাগত।

বিজয়া দাঁতে দাঁত চেপে চাপ রূঢ় গলায় বলত, তুমি ভেবেছ কী?

সরোজাক্ষ এই মূর্তিকে ভয় করতেন। কারণ সরোজা জানতেন ওর ওপর কথা বলতে গেলে কেলেঙ্কারি করতে পিছপা হবে না ও।

তাই সরোজাক্ষ ফিকে গলায় বলতেন,তুমি ঘুমোওনি এখনও?

ঘুম! বিজয়া কটু গলায় বলতেন, ঘুমোব, একেবারে জন্মের শোধ ঘুমোব, তোমাকে চিরশান্তি দিয়ে যাব। সেই ঘুমের ওষুধটা এনে দিয়ে আমায়। কিন্তু যতক্ষণ না দিচ্ছ–

সরোজা খাতাপত্র গুছিয়ে তুলতে তুলতে তাড়াতাড়ি বলতেন, কী যে যা-তা বলল। এই পড়তে পড়তে কীরকম অন্যমনস্ক হয়ে গিয়ে

থাক থাক, রোজ রোজ আর একই কৈফিয়ত দিতে এসো না। তোমার বলতে ঘেন্না করে না, আমার শুনতে ঘেন্না করে। আর কত চুনকালি দেবে আমার গালে! বাড়ির ঝি-চাকরটা পর্যন্ত বুঝে ফেলেছে। আমার দাম কী।

নিশ্বাসের তালে তালে বুকটা এমন ওঠাপড়া করত যে, মনে হত ফেটে পড়বে।

বিজয়ার আজকের এই চেহারায় সেই অতীতের ছবি দেখতে পেলেন সরোজা।

শুনতে পেলেন সেই কণ্ঠস্বর।

সংসারের সব দায় আমার মাথায় চাপিয়ে দিয়ে কেটে পড়তে চাও, কেমন?

সরোজাক্ষ শান্ত গলায় বলেন, সংসারের দায় তো কোনওদিনই আমি বহন করিনি।

তা জানি। চিরটাদিন গায়ে হাওয়া লাগিয়ে পালিয়ে বেড়িয়েছ। কিন্তু চিরদিন চলেছে বলেই যে চিরকাল চলবে, তার মানে নেই। ভেবেছিলাম বলব না, ভেবেছিলাম এত বড় সর্বনেশে কথাটা বলে হার্টের অসুখের রুগির হার্টটা ফেল করিয়ে বসব? কিন্তু তুমি যখন নিশ্চিন্ত হয়ে চলে যাচ্ছ, তখন তো আর না বলে পারছি না। আমি একলা মেয়েমানুষ কি আইবুড়ো মেয়ে নিয়ে নার্সিং হোমে ছুটব?

বিজয়ার বুকটা ওঠাপড়া করতে থাকে।

বিজয়ার কণ্ঠে আগুন ঝরে।

 বিজয়া যে চাপা তীব্র গলায় আরও কত কথা কয়ে যাচ্ছেন তা শুনতে পান না। সরোজা যেন হঠাৎ একটা বিরাট গহ্বর দেখতে পেয়েছেন, যে গহ্বরটা তাঁর নিজে ত্রুটির, নিজের অক্ষমতার।

বিজয়া বলে চলেছেন, আমি পারি না, আমার দ্বারা হয় না বলে তোমরা দিব্যি গা বাঁচিয়ে চলতে পারো, যত দায় এই মেয়েমানুষের। কিন্তু কেন? বলতে পারো কেন? মদ খেয়ে মাতাল হয়ে আসা ছেলেবউয়ের সঙ্গে ডেকে কথা বলতে হবে আমাকেই, আইবুড়ো মেয়ের কেলেঙ্কারি ঢেকে বেড়াতে হবে আমাকেই

সরোজাক্ষ হঠাৎ কঠিন স্বরে বললেন, চুপ করো।

চুপ করব?

হ্যাঁ, চুপ করবে। আর একটি কথা উচ্চারণ করবে না।

বিজয়া অনেক রকম কথা ভেবে এসেছিলেন, অনেক যুক্তিতর্কের ভাষা মনে মনে ঠিক করেছিলেন, কিন্তু এ পরিস্থিতির জন্যে প্রস্তুত ছিলেন না। বিজয়া হঠাৎ সমস্ত আত্মসম্মান বিজর্সন দিয়ে কেঁদে ফেলেন।

অপমানের কান্না, দুঃখের কান্না, অসহায়তার কান্না।

সেই উচ্ছ্বসিত কান্নার গলায় বলেন,বেশ, চুপ করছি। চিরকালের জন্যেই চুপ করব। শুধু বলে যাও, ওই মেয়েকে নিয়ে আমি কী করব?

আগুনের জায়গায় জল।

সরোজাক্ষ সেদিকে তাকিয়ে রইলেন কয়েক সেকেন্ড। তারপর স্পষ্ট গলায় উচ্চারণ করলেন, ওকে আমি নিয়ে যাব।

ওকে আমি নিয়ে যাব।

ওকে আমি নিয়ে যাব।

 এ কী অদ্ভুত ভাষা।

 সরোজাক্ষ কি বিজয়ার সঙ্গে ব্যঙ্গের খেলায় নামলেন?

না কি না বুঝেসুঝে কী একটা বলে বসলেন?

 অগাধ বিস্ময়ে বিজয়ার চোখের জল মুহূর্তে শুকিয়ে গেল।

বিজয়া যেন যন্ত্রের মতো উচ্চারণ করলেন,ওকে তুমি নিয়ে যাবে?

হ্যাঁ। ওকে প্রস্তুত করে রেখো।

 সরোজাক্ষ তাঁর রায় উচ্চারণ করে থেমে গেলেন। বিজয়া জানেন, আর একটি কথাও বলবেন না উনি।

কিন্তু এ কী ঘোষণা?

এ কি বিজয়াকে শাস্তি দেওয়া?

 বিজয়ার আবার কান্না উথলে ওঠে, কষ্টে কান্না থামিয়ে বলেন, তুমি ওকে নিয়ে গিয়ে করবে কী? রাখবে কোথায়? আমায় শান্তি দেবার জন্যে

বহুদিন পরে বিজয়ার নাম ধরে ডাকলেন সরোজাক্ষ।

বললেন, তোমাকে শাস্তি দেবার জন্যে নয় বিজয়া, শাস্তিই যদি বলল, তত বোধহয় নিজেকেই দেবার জন্যে।

বিজয়া কি ওই সম্বোধনে সম্মোহিত হলেন? তাই বিজয়া স্তব্ধ হয়ে গেলেন।

বিজয়া আস্তে দরজা ছেড়ে দাঁড়ালেন।

প্রকৃতিবিরুদ্ধ নম্র রুদ্ধ গলায় বললেন, কিন্তু ওকে আমি এ কথা বলব কী করে? ও ভাববে বুঝি ওর প্রতি ঘেন্নায় রাগে তুমি নিজের উপর শোধ নিচ্ছ।

সরোজা বলেন,ঠিক আছে, তোমায় বলতে হবে না, আমিই বলব।

 হ্যাঁ, সরোজাই বললেন।

.

কতকাল পরে, মনে হল যেন কত যুগ পরে মেয়ের ঘরের দরজায় এসে দাঁড়ালেন সরোজা।

কোনও ভূমিকা করলেন না, শান্তভাবে বললেন, মীনা, তুই তোর জামাকাপড় গুছিয়ে ঠিক করে রাখ, আমার সঙ্গে যাবি।

মীনাক্ষী জানত বাবা চলে যাচ্ছেন, তবু মীনাক্ষী দম আটকানো বুকে নিজের ঘরে চুপ করে বসে ছিল। মীনাক্ষীর নিশ্চিত ধারণা ছিল, বাবা সব জানেন, তাই বাবা ঘৃণায় চলে যাচ্ছেন। ধারণা ছিল বাবা তাকে একটি কথাও বলে যাবেন না।

যখন দেখল দরজায় বাবা, তখন ভাবল বাবা যে ঘৃণায় ধিক্কারে চলে যাচ্ছেন, সেই কথাটাই জানিয়ে যাবেন বলে এসে দাঁড়িয়েছেন। এস্তে উঠে পড়ে মনকে শক্ত করে বসে রইল। না, কিছুতেই ভেঙে পড়বে না সে। কিছুতেই কেঁদে ফেলবে না।

কিন্তু অচিন্তিত একটা কথা বললেন বাবা।

সহজ সাধারণ গলায়।

যেন মীনাক্ষী নামের সেই অনেকদিন আগের মেয়েটাই বেঁচে আছে। যেন অনেকদিন আগের সেই সরোজাক্ষ মেহগম্ভীর গলায় বলছেন, কাল এই পড়াটা তৈরি করে রেখো, আমি দেখব।

তবে কি বাবা জানেন না?

কিন্তু তা হলে বাবা হঠাৎ মীনাক্ষীকে নিয়ে যেতে চাইবেন কেন? মীনাক্ষী যে আর কলেজে যায় না, সে কথা কি জানেন সরোজাক্ষ?

তা নয়।

এ হচ্ছে মীনাক্ষীর প্রতি দণ্ডাদেশ।

বাবা!

সরোজাক্ষ চলে যাচ্ছিলেন, ফিরে দাঁড়িয়ে বললেন, কিছু বলবি?

বাবা! আমায় নিজের মতো করে মরতে দিন।

হ্যাঁ, এই মুহূর্তে ওই মরার কথাটাই মনে এল মীনাক্ষীর। এতদিন এত রকমের মধ্যেও যে কথাটা কোনওদিন মনে আনেনি, মুখে আসেনি।

আজ সরোজাক্ষর ওই স্বাভাবিক গলার ওই ভয়ংকর অদ্ভুত একটা নির্দেশে, যা মৃত্যুদণ্ডাদেশের মতোই লাগল মীনাক্ষীর, মীনাক্ষী মৃত্যুচিন্তা করল। মীনাক্ষী ভাবল, মরাই উচিত ছিল আমার। এখনও ফুরোয়নি সে সময়।

তাই মীনাক্ষী তার সমস্ত শক্তি প্রয়োগ করে বলে উঠল, বাবা! আমায় নিজের মতো করে মরতে দিন।

সরোজাক্ষ চলে যেতে গিয়ে ফিরে দাঁড়িয়েছিলেন, ঘরের মধ্যে ঢুকে এলেন। ঘরে এসে সামান্য হেসে বললেন, নিজের মতো করে কোনও কিছু করার অধিকার কারও নেই মীনা, বাঁচবারও না, মরবারও না।

মীনা তবু মাথা হেঁট করে কাতর গলায় বলে, আমায় যেতে আদেশ করবেন না বাবা

সরোজাক্ষ ওর ওই বিশীর্ণ পাণ্ডুর মুখের দিকে তাকিয়ে দেখেন। তারপর প্রায় অভ্যাস ছাড়া অন্তরঙ্গ গলায় বলেন, আদেশ বলছ কেন? কী মুশকিল। অনুরোধ করছি। আমি বাড়ি ছেড়ে বাইরে যাচ্ছি, আমায় কে দেখাশোনা করবে? একজনের তো গেলে ভাল হয়?

সরোজাক্ষ বলছেন,আমায় কে দেখাশোনা করবে? সরোজাক্ষ বলছেন তাঁর জন্যে একজনের গেলে ভাল হয়। সরোজাক্ষকে কি তবে কেউ ছাঁচে ঢালাই করে ফেলেছে?

মীনাক্ষী অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে বাবার চলে যাওয়ার পথের দিকে।

.

ভেবেছিলেন কোথাও কোনও বন্ধন নেই, দেখছে সহস্র বন্ধন। সবচেয়ে বড় বন্ধন বুঝি এই বইয়ের পাহাড়।

এই পাহাড় নিয়ে যাবার কথাও ভাবা যায় না, রেখে যাবার কথাও ভাবা যায় না। সরোজা তবু বিশেষ দরকারি কয়েকটি বেছে আলাদা করছিলেন, খানিকক্ষণ বাছতে বাছতে সহসা চোখে পড়ল ওই বিশেষ দরকারিতেই ছোটখাট একটি পাহাড় হয়ে গেছে। এদের গুছিয়ে তুলে সুটকেসে ভরতে হবে ভেবে ভারী একটা ক্লান্তি বোধ হল, সব সরিয়ে রেখে উঠে দাঁড়ালেন, জানলার কাছে গিয়ে দাঁড়ালেন।

কত রাত এখন?

দুটো? আড়াইটে? তিনটে?

কলকাতার রাস্তায় রাত বোঝা শক্ত, তবু গভীরত্বটা বোঝা যাচ্ছে। রাত্রিশেষের আভাসবাহী একটা হিম হিম হাওয়া আসছে জানলা দিয়ে।

সরোজাক্ষর মুখেচোখে এসে লাগছিল সেই হাওয়া।

সরোজাক্ষ ভাবছিলেন, নিয়তি বলে সত্যিই কেউ আছে কোথাও?

 আজ সকালে কি আমি ভেবেছিলাম

পিছনে কীসের একটা শব্দ হল।

ফিরে তাকালেন।

 বিজয়া এসে ঘরে ঢুকেছেন।

সরোজাক্ষ শঙ্কিত দৃষ্টিতে তাকালেন, আবার কী?

 কিন্তু বিজয়া কী বলে তাঁর শুচিতার গৌরব ভুলে বিছানার উপর এসে বসলেন?

নিজের বিশুদ্ধ শয্যা ছাড়া অন্য কারুর বিছানা তো স্পর্শও করেন না বিজয়া। এত রাতে আবার কোন দরকারে? আরও কী সাংঘাতিক গোপন তথ্য আছে বিজয়ার ভাঁড়ারে? যার জন্যে বিজয়া এতখানি উলটোপালটা কাজ করে বসতে পারেন?

সরোজাক্ষ তাকিয়ে দেখেন।

 কিন্তু এ কী গোপন তথ্য ভাঁড়ার থেকে বার করলেন বিজয়া?

অবচেতনের কোন অতলে তলিয়ে ছিল এই তথ্য? বিজয়া নিজেই কি জানতেন?

জানতেন কি, এমন করে অভিসারিকার মতো গভীর রাত্রির মৌন মহিমা বিদীর্ণ করে সরোজা নামের ওই পাষাণমূর্তিটার পায়ের কাছে আছড়ে পড়ে বলতে আসতে হবে তাঁকে, আমায় ফেলে রেখে যেও না তুমি, আমায় নিয়ে চলল।

তুমি আমায় ফেলে রেখে যেও না।

এ কী অলঙঘ্য ভাষা!

বিজয়ার ওই রূঢ় রুক্ষ স্থূল সোচ্চার মনের কোন গভীরে লুকোনো ছিল এ ভাষা?

 সরোজাক্ষ এখন কী করবেন?

সরোজাক্ষ একটা ভয়ংকর দুঃসাহসিক শপথে মীনাক্ষী নামের ওই দুরূহ বিপদকে স্বেচ্ছায় মাথায় তুলে নিচ্ছিলেন, কিন্তু সরোজাক্ষ এই আবেদনের বিপদের সামনে থতমত খেলেন। সরোজা বলতে পারলেন না, ঠিক আছে, চলো৷

সরোজাক্ষ যেন বোবা দেয়ালের কাছে উত্তরের আশ্রয় খুঁজলেন।

সরোজাক্ষ সে আশ্রয় পেলেন না।

সরোজাক্ষ ধূসর গলায় বললেন,তুমি! তুমি কেমন করে যাবে?

বিজয়া মুখ তুললেন।

নিশ্চিত গলায় বললেন, যেমন করে স্ত্রী স্বামীর সঙ্গে যায়।

তবু সরোজাক্ষর কুণ্ঠিত ধূসর গলা আর একটা কথা উচ্চারণ না করে পারল না, কিন্তু তোমার ওই সব ঠাকুর-টাকুর

সে ভাবনা আমার।

 সরোজাক্ষ দৃষ্টিকে প্রসারিত করলেন।

সরোজাক্ষ তাঁর ভবিষ্যতের ছবির দিকে তাকালেন। যেখানে বুঝি একটুকরো আলোর আয়োজন হচ্ছিল, সেখানে নিয়তির লোমশ কালো হাতের থাবা দেখতে পেলেন। যে থাবা চিরদিনের জন্যে কবলিত করে রেখেছে সরোজাক্ষকে। ওর থেকে মুক্তি নেই সরোজাক্ষর।

অতএব সরোজাক্ষকে এই চিরপরিচিত জায়গাটা ছেড়ে অজানা অপরিচিত কোনও এক পরিবেশে বিজয়াকে নিয়ে নতুন করে সংসার পাততে হবে।

বিজয়ার এই আবেগ, এই ব্যাকুলতা, এই আত্মনিবেদনের নম্রতা অবশ্যই চিরদিনের নয়, বিজয়া সেই নতুন পরিবেশে আবার সোচ্চার হবেন, বিজয়া হয়তো সেখানে মীনাক্ষীকে নিয়ে বহু মিথ্যার জাল রচনা করতে বসবেন।

সরোজাক্ষ যখন মীনাক্ষী নামের বিপদটাকে মাথায় তুলে নেবার সাহস করছিলেন, ভেবেছিলেন ডাক্তার আর টাকা এই দুটো জিনিস হাতে থাকলে পরিবেশের সঙ্গে যোগসূত্রহীন হয়েও যে কোনও অবস্থাকে আয়ত্তে আনা যায়।

কী ভাববে আশেপাশের লোক!

যা ইচ্ছে।

তবু কেউ এসে সরোজাক্ষর জীবনের জানলায় উঁকি দিতে সাহস করবে না। ভেবেছিলেন তাই। কিন্তু বিজয়া সেই নিশ্চিতার ছবিতে মোটা তুলির একটা কালির পোঁচ বসিয়ে দিলেন। বিজয়া গেলেই সে জানলার কপাট ভেঙে পড়বে, আর বিজয়া বানানো কথার জাল বুনে বুনে তাকে আবৃত করবার হাস্যকর চেষ্টা চালিয়ে যাবেন।

এই মুহূর্তে

এত স্পষ্ট আর পরিষ্কার করে কিছু ভাববার ক্ষমতা হয়তো হয়নি সরোজাক্ষর, তবু নিয়তির সেই লোমশ থাবার পিছনে এমনি অনেক ছায়াছবির মিছিল যেন সরোজাকে ব্যঙ্গ কটাক্ষ করে গেল।

তবু সরোজাক্ষ সেই থাবার মধ্যেই আত্মসমর্পণ করলেন।

 বললেন, বেশ চলো! তোমার যদি অসুবিধে না হয়—

অসুবিধে হবে কেন?

কিন্তু অসুবিধেই তো হবার কথা বিজয়ার। বিজয়া কি তাঁর ওই বিগ্রহের সংসারটিকে নিয়ে যেতে পারবেন তাঁর নতুন সংসারে?

যাঁদের গ্রীষ্ণকালে পাখার বাতাস করে ঘুম শুকিয়ে দিতে হয়, আর শীতকালে গায়ে গরম চাদর টেনে দিতে হয়, যাঁদের ভোরে ঘুম ভাঙাতে হয়, আর রাত্রে ঘুম পাড়াতে হয়, এবং ক্ষণে ক্ষণে ভোগ দিতে হয়, তাঁদের কী ব্যবস্থা হবে সেখানে?

না, সেখানে আর কী করে কী ব্যবস্থা হবে? ওই ঠাকুরের সংসারটিকে বিজয়া পুরোহিত বাড়িতে রেখে যাবেন।

বিবেকের দংশন?

না, তাতেই বা দংশিত হতে যাবেন কেন বিজয়া? উচিতমতো সেবার জন্যে মোটা প্রণামীর ব্যবস্থা করে যাবেন।

সরোজাক্ষ চলে গেলে বিজয়া ওই ছবি আর পুতুলগুলো নিয়ে করবেন কী? শত্রুপক্ষ বিদায় নিলে যুদ্ধের হাতিয়ার কোন কাজে লাগে?

.

গ্রামের নাম মৌটুংরি।

কে জানে কী তার অর্থ, অথবা সেটা কোন কথার অপভ্রংশ। কোন সূত্রে যে কোন নাম গড়ে ওঠে গ্রামের, শহরের, পল্লীর।

হয়তো বা ভাষাটা আদিবাসীর।

 কারণ গ্রামটা একটা আদিবাসী পল্লীর গা ঘেঁষা।

গ্রামের কোল দিয়ে বয়ে যাওয়া অজানা নামের ঝিরিঝিরি একটা নদী আছে, ছোট ছোট ঢিবি ঢিবি পাহাড়ের মতো আছে একেবারে গ্রামের কিনারে।

বাংলার গ্রাম হলেও, মাঠে ঘাটে গাছে পালায় যেন বিহারের রুক্ষতার আদল।

এইখানে সারদাপ্রসাদের পিতৃভিটে।

কতদিন আগে ছেড়ে যাওয়া এই গ্রামটার পথে হঠাৎ একদিন সারদাপ্রসাদকে দেখা গেল। একে ওকে জিজ্ঞেস করছে, লাহিড়ী বাড়িটা কোনদিকে।

ঠিকানা অবশ্য জানা আছে সারদাপ্রসাদের। জ্ঞাতিরা মাঝে মাঝে তার ভাগের জমিজমার উপস্বত্বস্বরূপ কিছু পাঠিয়েছে এ যাবৎ।

বিবেকের তাড়নায় পাঠাত না অবশ্যই, পাঠাত বোধ করি পাছে সারদা হঠাৎ কোনদিন এসে হাজির হয়ে নিজের ভাগ বুঝে নিয়ে বেচে-টেচে দিতে আসে। সেটা বড় ঝামেলা। তার চাইতে মুষ্টিভিক্ষা একটু দিয়ে রাখা ভাল।

তা, তার জন্যে সারদাপ্রসাদের কখনওই কিছু এসে যায়নি। নমাসে ছমাসে যদি কিছু আসত, চট করে বেশ কিছু লেখার সরঞ্জাম কিনে ফেলত। কাগজকালি ব্লটিং পেপার আলপিন, এটা ওটা।

নিজের অন্য প্রয়োজনে?

সে কথা কোনওদিন ভেবে দেখেনি লোকটা।

জামা ছিঁড়ে গেলে অম্লানবদনে ছেঁড়া জামা গায়ে দিয়ে রাস্তায় বেরিয়ে গেছে, কাপড় সেপটিপিন দিয়ে আটকে রেখে পরতেও দ্বিধা করেনি। তবে আশ্চর্য, সরোজাক্ষর মতো অন্যমনস্ক প্রকৃতির মানুষেরও কেমন করে যেন ওই ঘাড়ছেঁড়া শার্ট, কিংবা সেপটিপিন আটকানো ধুতি চোখে পড়ে যেত। তবে তেমন অবস্থাটা সহজে হত না, সরোজাক্ষর জামা কাপড় তোয়ালে গেঞ্জির সঙ্গে সারদাপ্রসাদেরও আসবে এই নিয়মটাই সরোজাক্ষর বাবার আমল থেকে বলবৎ ছিল।

যা দেখে বিজয়ার বাপের বাড়ির লোকেরা গালে হাত দিতেন, মেয়ে মরে গেছে, তবু বুড়ো জামাই পুষছে। ধন্যি বাবা!

কিন্তু সে যাক! সে জীবনে তো ইতি পড়ে গেছে।

এ এক নতুন সারদাপ্রসাদ তার পিতৃভিটেয় ফিরে এসেছে, জীবনের আর একটা নতুন অধ্যায়ের পাতা ওলটাতে।

একে ওকে তাকে জিজ্ঞেস করতে করতে পথটা স্মৃতির পটে ফুটে উঠতে থাকে।

শহরের রাস্তা নিত্য পরিবর্তনশীল।

আজ যেখানে মাঠ, কাল সেখানে বৃহৎ ইমারত, আজ যেটা নিচু ছোট একতলা বাসা, কাল সেটা বিরাট তিনতলা প্রাসাদ। আজ যেখানটা শৌখিন ব্যক্তির বাড়ির সামনের পুষ্পেদ্যান, কাল সেখানটা সারি সারি দোকানঘর।

গ্রামের চেহারা এমন দ্রুত পরিবর্তনশীল নয়। সেখানে হয়তো বড়লোকের ভেঙে যাওয়া দালান কোঠাটা দশ-বিশ বছর ধরে ভাঙতে ভাঙতে ভূমিসাৎ হয়, হয়তো গ্রামদেবতার মন্দিরের মাথার হেলে যাওয়া চুড়োটা ধীরে ধীরে আর একটু হেলে, শানবাঁধানো চকচকে নাটমন্দিরটায় অলক্ষ্যে কখন ফাটল ধরতে থাকে, কাকচক্ষু পুকুরটা তিলে তিলে পানায় মজতে থাকে।

আর কী?

বড়জোর কেউ ভিটের সংস্কার সাধন করতে ইটবারকরা দেয়ালের গায়ে ব্যঙ্গহাসির মতো একটু চুন লেপে, হয়তো বা কেউ রান্নাঘরের পড়ে যাওয়া ছাদটার কড়ি বরগা রাবিশ ফেলে দিয়ে দুখানা নতুন করোগেট টিন বসায়। বহু ইতিহাসের সাক্ষী পুরনো বৃহৎ গাছগুলো ঝড়ে পড়ে যাওয়া ছাড়া নতুনত্বের কোনও ছাপ নেই এই মৌটুংরির মতো গণ্ডগ্রামে।

রেল স্টেশনের ধারেকাছে যে সব গ্রাম, তাদের অনেক উন্নতি হয়েছে।

সেখানে ছাইকেল রিকশার দেখা মেলে, সেখানে ঘরে ঘরে বাইসাইকেল। তরুণ সমাজের পরনের ধুতি অপসারিত, সেখানে প্যান্টের একাধিপত্য রাজত্ব। সেই প্যান্টের পকেট হাতড়ালে প্রায় প্রত্যেকের পকেটেই একটা করে টর্চ পাওয়া যাবে, মাঝে-মাঝেই কোনও অবস্থাপনের ছাওয়ালের পকেটে ট্রানজিস্টার।

রেল স্টেশনের ধারেকাছের গ্রাম থেকে চট করে দু-একটা স্টেশন পার হয়ে সিনেমা দেখতে যাওয়া যায়, মনের মতো জামা জুতো শাড়ি ব্লাউজ কিনতে যাওয়া যায়, হাই-ইস্কুল এবং সরকারি হাসপাতালের সুবিধেও মেলে।

মৌটুংরি রেল স্টেশন থেকে অনেক মাইল দূরে। এখানে সাইকেল রিকশার টুংটাং সুদুর স্বপ্নের ছায়া। নিজের পা আর গোরুর পা, এইমাত্র ভরসা এখানে। তবে মাল বোঝাই গোরুর গাড়ির ঘণ্টাধ্বনির কামাই নেই। কতখানি যেন দূর দিয়ে কোন প্রাপ্তসীমার পারের পথে মহাজনদের লরি গাড়ি যায় গ্রামের অন্ন লুঠ করে নিয়ে যেতে, ওই গোরুর গাড়ি কাজে লাগে সেই লুঠের মালগুলো পৌঁছে দিতে।

তেমনি একখানা মালবওয়া গাড়ির ফিরতি খেপের সুযোগ রেল স্টেশন থেকে গ্রামের মধ্যে ঢুকে এসেছে সারদাপ্রসাদ, গাড়োয়ানের সঙ্গে ভাব জমিয়ে।

ওই গাড়োয়ানরা বেশিরভাগই দেহাতি বিহারি, লাহিড়ী বাড়ির ঐতিহ্যের খবরের ধার ধারে না, কাজেই তাদের কাছে হদিস মেলেনি। গ্রামের মধ্যে ঢুকে পড়ে, জিজ্ঞেস করে করে আর চিনে চিনে এসে দাঁড়িয়েছে লাহিড়ী বাড়ির ভিটের উঠোনে।

তা ভিটেটা না হয় চিনে বার করা গেছে, কিন্তু পাতলা লম্বা শ্যামবর্ণ, আর সুকুমার মুখ এই আধাবয়েসী মানুষটাকে চিনবে কে? কার দায় আছে তাকে চিনে ফেলে দুহাত বাড়িয়ে অভ্যর্থনা করবার?

পরিচয় দিয়ে তবে চেনাতে হবে।

কিন্তু সেই পরিচয়টাই বা কাকে দিতে বলবে সারদাপ্রসাদ? নিজেই কি সে চেনে কাউকে? তা ছাড়া ধারেকাছে আছেই বা কে?

তবু মনিঅর্ডারের কুপনের স্বাক্ষর স্মরণ করে গলা ঝেড়ে ঈষৎ উচ্চকণ্ঠে ডাক দেয়, শ্যামাপ্রসাদবাবু আছেন?

যদিও ওই উদ্দিষ্ট ব্যক্তিটি সম্পর্কে তার ভাইপো, তবু বাবুই বলে সারদাপ্রসাদ।

সারদাপ্রসাদ যদি কিছুদিন আগেও শুধু পিতৃভিটে দেখব বলে বেড়াতে আসত, সারদাপ্রসাদের কণ্ঠে অন্য সুর বাজত।

উল্লাসের সুর, প্রত্যাশার সুর, অকুণ্ঠিতের সুর।

কিন্তু সারদাপ্রসাদ একটা মারখাওয়া পশুর মতো ছুটে চলে এসেছে, আর কোনও জায়গার কথা মনে পড়েনি বলে। আর সারদা এই সামান্য কদিনেই অনেকখানি বয়েস বাড়িয়ে এসেছে। এসেছে পৃথিবী সম্পর্কে যেন অনেকখানি অভিজ্ঞতা নিয়ে।

আগে হলে সারদাপ্রসাদ নিশ্চয়ই ভাবত, এতদিন পরে এলাম আমি, আমায় দেখে আনন্দে দিশেহারা হবে এরা। ভাবত, কী জানি বাবা, ছাড়তে চাইবে কি না।

কিন্তু বয়েস বেড়ে যাওয়া সারদাপ্রসাদ তা ভাবছে না। বরং ভাবছে চিনতে চাইবে তো? জায়গা ছেড়ে দেবে তো?

ওই বাবু ডাকের মধ্যে সেই সংশয়ের দ্বিধা।

বারদুই ডাকের পর, সামনের দালানের একটা ভেজানো দরজা খুলে গেল, একটা ছিটের ইজের পরা ছোট ছেলে তীক্ষ্ণ গলায় প্রশ্ন করল, কে?

আমাকে তুমি চিনবে না–সারদাপ্রসাদ আর একটু এগিয়ে এল, তুমি শ্যামাপ্রসাদবাবুর ছেলে?

ছেলেটা সে প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে বাড়ির ভিতর দিকে মুখ ফিরিয়ে বলে উঠল, পিসি, দেখো কে এসেছে

এবার দেখা গেল এক মলিনবসনা বিধবা মহিলাকে। চেহারায় বয়েসের থেকে অনেক বেশি জীর্ণতার ছাপ। দরজাটাকে এক হাতে শক্ত করে চেপে ধরে প্রায় রূঢ় গলায় প্রশ্ন করে, কাকে চান?

সারদাপ্রসাদের বয়েস বেড়েছে, তবু সারদাপ্রসাদ বুঝতে পারে না এই অকারণ রূঢ়তার অর্থ কী?

এরা যে অপরিচিতকে দেখলেই সন্দেহ করে, আর সন্দেহ করে বলেই প্রথম থেকেই শক্ত হয়, সেটা জানা ছিল না সারদাপ্রসাদের। তাই রূঢ়তায় আরও বিষ হল সে।

আস্তে বলল, শ্যামাপ্রসাদবাবু আছেন? মানে আমি তাঁর কাকা, সারদাপ্রসাদ। কলকাতা থেকে এসেছি।

বিধবা মহিলা এবার কিঞ্চিৎ সহজ কণ্ঠে বলেন, ও, বুঝেছি। নতুন ঠাকুরদার ছেলে! আমি শ্যামার দিদি! তা আপনি এখনই এলেন বুঝি?

কণ্ঠস্বর ততটা রুক্ষ না হলেও আনন্দে অধীর নয়। বরং অপ্রসন্নতার আভাস।

 সারদাপ্রসাদ এ প্রশ্নে অবাক হয়।

এখনই এলেন, এমন একটা বাহুল্য প্রশ্নের হেতু কী? সারদাপ্রসাদের কি এখানে অন্য আস্তানা আছে যে, সেখানে নেমে ধীরে সুস্থে স্নানাহার সেরে জ্ঞাতি গোত্রের বাড়িতে দেখা করতে এসেছে?

সারদাপ্রসাদ সেই অবাক অবাক অসহিষ্ণু গলায় বলে, এখন নয় তোকখন? এই তো আসছি। বাবা, যা ধুলো, গলা শুকিয়ে গেছে। জল দেখি দিকি এক গ্লাস।

তুমি আপনি বাঁচিয়ে এই প্রার্থনা।

মহিলাটি কিন্তু ওই আবেদনেও বিশেষ ব্যস্ত হয়ে ওঠেন না, সেই ছেলেটার মতোই ভিতরের দিকে দৃষ্টিক্ষেপ করে কাকে যেন উদ্দেশ করে বলেন,এই এক গ্লাস জল আন তো।

মহিলাটির কণ্ঠে জেলার টান। সেই বিশেষ একটি টান সংবলিত ভঙ্গিতেই তিনি আবার প্রশ্ন করেন, এখনি এলেন তো সঙ্গে জিনিসপত্তর কই?

সারদাপ্রসাদ চকিত হয়।

ওঃ, তাই ওই বাহুল্য প্রশ্ন।

অন্যখান থেকে এলেই মানুষের সঙ্গে কিছু না কিছু থাকে। নিদেন একটা হাতব্যাগও।

সারদাপ্রসাদের সঙ্গে কিছু নেই।

 সারদাপ্রসাদ তার সমস্ত অন্তরটার মতোই শূন্য দুখানা হাত নিয়ে এসে দাঁড়িয়েছে।

কিন্তু কেন?

সারদাপ্রসাদের হাত একেবারে শূন্য কেন? কিছু তো থাকবার কথা। সারদাপ্রসাদ তো তার বাকি খাতার বোঝা সরিয়ে নিয়েছিল বিজয়ার ঘর খালি করে দিতে।

সারদাপ্রসাদের সেই আজীবনের ফসল সোনার ধানের বোঝর খানিক অংশ না হয় হৈমবতীর কাছে পড়ে রইল, কিন্তু বাকিগুলো সারদাপ্রসাদ করল কী?

সেগুলো তো আনবে?

না সেগুলো আনেনি।

কিন্তু সেই বোঝা নিয়ে করবেই বা কী সারদাপ্রসাদ? প্রিয়জন যতই প্রাণপ্রিয় হোক, তার মৃতদেহটা কে বয়ে নিয়ে বেড়ায়? তার শেষ সমাপ্তি তো হয় আগুনে, নয় জলে।

সারদাপ্রসাদের ওই প্রাণপ্রিয় খাতাগুলোর তো এখন মৃত্যু ঘটেছে, অতএব তাদের ওই দুটোর কোনও একটায় ঠেলে দেওয়া ছাড়া আর কী করবে?

তারপর এই চির অবহেলিত পিতৃভিটেয় এসে দাঁড়িয়েছে একান্ত প্রিয়জনকে পুড়িয়ে আসা শ্মশানপ্রত্যাগতের মূর্তি নিয়ে।

কিন্তু তেমন মূর্তি কে পছন্দ করে?

ঝকঝকে সুটকেস হাতে মটমটে চেহারার শহুরে আত্মীয় হঠাৎ গ্রামে এসে দাঁড়ালে, জ্ঞাতিরা তাকে সমীহর দৃষ্টিতে দেখে, এমন সর্বস্বান্তের মূর্তিকে আদৌ নয়।

তাই শ্যামাপ্রসাদের দিদি জলের আদেশ দিলেও পিপাসার্তের জন্যে তটস্থ হলেন না। খাতির করে বসতেও বলেন না, বরং উত্তর না পেয়েও আবার প্রশ্নের গামছা ছাঁকা দিয়ে খবরের চুনোপুঁটি সংগ্রহের চেষ্টা করেন।

কখনও তো আসতে দেখি না, এতদিনে বুঝি দেশকে মনে পড়ল?

এই আর কি, আসা হয়ে ওঠেনা–সারদাপ্রসাদ অন্যমনস্কের মতো এদিক ওদিক তাকায় কোনও একটা বসবার আসনের প্রত্যাশায়। কোথাও কিছু নেই, শুধু ওই উঁচু দাওয়ায় ওঠবার ইটের কোণ ভাঙা বহু ব্যবহারে ক্ষয়ে যাওয়া সিঁড়িগুলো ছাড়া।

তা সেও তো ধূলিধূসরিত।

 সারদাপ্রসাদ ক্লান্ত গলায় বলে, শ্যামাপ্রসাদ কখন আসবে?

তার আসতে দেরি আছে। কই রে অটল জল আনলি নে?

এতক্ষণে অটল নামধারী একটা একটু বড় ছেলে ঝকঝকে করে মাজা একটা ঘটিতে একঘটি জল নিয়ে আসে, তার সঙ্গে অপর হাতে ঝুলিয়ে আনে একটা জলচৌকি।

শ্যামাপ্রসাদের দিদি অপ্রসন্ন দৃষ্টিতে সেদিকে তাকিয়ে বলেন,তুই এই ভারীটা বয়ে আনলি? রাখাল কী করছে?

সে তো গোরু ছাড়তে গেছে।

দিনভর গোরু ছাড়ছে? মহিলা বেজার গলায় যেন অনুপস্থিত রাখালের ফাঁকি দেওয়ার সমস্ত দোষটা সারদাপ্রসাদের ঘাড়েই চাপিয়ে বলেন, নিন বসুন কাকা,শ্যামা বাড়িতে থাকতে এলে আপনাকে এত অসুবিধেয় পড়তে হত না।

না না, অসুবিধে কী?

সারদাপ্রসাদ দাওয়ায় উঠে জলচৌকিতে বসে ঘটির সব জলটুকু খেয়ে শেষ করে একটা নিশ্বাস ফেলে গলায় বুকে ছিটিয়ে পড়া জলের ধারা মুছতে থাকে কোঁচার কাপড় তুলে তুলে। ঘটিতে জল খাওয়ার অভ্যাস তো নেই।

শ্যামাপ্রসাদের দিদি মনে মনে বলেন, শহুরে ভূত! চুমুক দিয়ে ঘটিতে জল খাচ্ছে।

 মুখে বলেন,তা আপনি হাতমুখ ধোবেন তো?

সারদাপ্রসাদ বোকার মতো গলায় বলে, হাতমুখ? কেন স্নানের সুবিধে হবে না?

ওমা শোনো কথা। চানের আবার অসুবিধে কী? পুকুরে কি জল নেই? তবে আপনার কাপড় গামছা তো দেখছি নে–

শ্যামাপ্রসাদের দিদি বেজারই থাকেন। অনেক মালপত্র নিয়ে এসে-পড়া আত্মীয়ও যেমন ভীতিকর বইকী! হয়তো তদপেক্ষাও। চান করতে উদ্যত হয়েই তো ও প্রথমে চাইবে তেল গামছা, তারপর চাইবে কাপড়।

এ আবার কী মুশকিল! সেই মুশকিলের চিহ্ন ফুটে ওঠে তার মুখে। সারদাপ্রসাদ চকিত হয়।

 সারদাপ্রসাদ যেন তার কোনও এক প্রগতির গতির ভরসায় এসেছে।

তাই সারদাপ্রসাদ তাড়াতাড়ি বলে, তবে থাক, তবে থাক, শ্যামাপ্রসাদ এলেই হবে এখন। জিনিসপত্তর আনা হয়নি–মানে হঠাৎ চলে এলাম কিনা–

শ্যামাপ্রসাদের দিদি এই হঠাৎ-এর কারণ নির্ণয় করতে পারেন না। সেই একই ভাবে বলেন, তবে বসুন। শ্যামা আসুক। তবে এভাবে একবস্ত্রে আসা আপনার উচিত হয়নি কাকা!

ভাইঝি আর একবার কাকাকে উপদেশ অমৃত দান করে বলেন, একটা বেলা থাকলেও, মানুষের একখানা ধুতি গামছা লাগে।

ভিতরে ঢুকে যান তিনি, দরজাটি বন্ধ করতে ভোলেন না।

সারদাপ্রসাদ একা বসে থাকেন সেই অদেখা, বা ভুলে যাওয়া ভাইপোর আশাপথ চেয়ে। যেন সেই শ্যামাপ্রসাদই বুঝবে তাকে।

হয়তো বুঝত শ্যামাপ্রসাদ।

যতই হোক রক্তের সম্পর্ক।

 কিন্তু শ্যামাপ্রসাদ তার থেকে অনেক বেশি বোঝে টাকা-পয়সা। সেটা নাকি গায়ের রক্তেরও অধিক।

তাই শ্যামাপ্রসাদ এসেও আহ্লাদে অধীর হয় না কাকাকে দেখে।

কী করেই বা হবে?

সারদাপ্রসাদের বাপের দিকের ভিটের অংশটা শ্যামাপ্রসাদের খামার বাড়ি হয়নি কী? নিজের রান্নাঘরটা পড়ে যাওয়া ইস্তক-সারদাপ্রসাদের দিকের ভাঁড়ার ঘরটায় রান্নার কাজ চালাচ্ছে না? আর শ্যামাপ্রসাদের নিজের পাতকুয়োয় বালি ওঠা ইস্তক, সারদাপ্রসাদের দিকের পাতকুয়োটাই ব্যবহার করছে না কি? তা ছাড়া বাগান পুকুর সবই তো। তবে?

এই মানসিক উদ্বেগের অবস্থায় কে পারে কাকা কাকা করে গড়িয়ে পড়তে? অন্তত শ্যামাপ্রসাদ পারবে না। এই রুক্ষ মাটির বক্ষ থেকে ক্ষুধার অন্ন আহরণ করতে হয় তাকে।

শ্যামাপ্রসাদ যদি একবার তার জ্ঞাতিকাকাকে তার নিজস্ব অধিকারের জায়গাগুলো চিনিয়ে দেয়, রক্ষে আছে?

তাই সারদাপ্রসাদ যখন নেহাতই স্মৃতির মন্থন করে জিজ্ঞেস করে,আচ্ছা কোনদিকে যেন আমরা থাকতাম? সেই বড় একটা টানা বৈঠকখানায় বাবা বসতেন, আরও সব কারা আসত, দাবা খেলত–

তখন শ্যামাপ্রসাদ একটি উচ্চাঙ্গের হাসি হেসে বলে, সেই টানা বৈঠকখানা? হায় অদৃষ্ট! সে তো কবে ভূমিসাৎ হয়ে গেছে। ভিটেবাড়ি না দেখলে যা হয়। তুমি তো শুনতে পাই এখেনে ইস্কুলের পড়া সাঙ্গ করেই কলকাতায় মামার বাড়িতে থেকে কলেজে পড়েছ, তারপর বড়লোকের বাড়ি বে করে ঘরজামাই থেকেছ, এযাবৎ আর এ মুখো হওনি। মানুষকে যেমন ভাত জল দিতে হয়, ভিটেবাড়িকেও তেমনি ভাত-জল দিতে হয়। তা সে কথা আর মানলে কবে? এখনও যে তোমার সেই বাড়ি-ঘরের চেহারা মনে আছে, এইটাই অবাক কথা!

সারদাপ্রসাদ তার প্রায় সমবয়েসী ভাইপোর এই অবাকে নিজের সেই মনে থাকার লজ্জায় মরমে মরে। বাস্তবিক তো, মনে থাকাটা উচিত হয়নি তার। প্রশ্ন করাটা আরও গর্হিত হয়েছে।

ব্যস্ত হয়ে বলে, না না, এমনি হঠাৎ স্মরণে এল। সত্যিই তো, থাকবে কেন? যাবেই তো পড়ে।

 শ্যামাপ্রসাদের বুক থেকে পাহাড় নামে।

 তারপর ভাবে, ভাগ্যিস খামারবাড়িটা পাঁচিল দিয়ে ঘিরে নিয়েছি। নচেৎ চোখে পড়ে যেত।

তবে পাড়ায় নয় নয় করেও কুটিল বুড়ো দু-চারটে আছে তো? তারা একা পেলেই ঠিক ওর কানে তুলবে। কে জানে কতদিন থাকবার মতলবে এসেছে? জিনিসপত্তর যখন কিছু আনেনি, বেশিদিন থাকবে না বলেই মনে হয়। কিন্তু একেবারে এত শূন্য হয়ে কি লোকে একবেলার জন্যেও আসে?

ভগবান জানে রাস্তায় বাক্স সুটকেস খোয়া গিয়েছে কিনা–মুখের চেহারা দেখে তো মনে হচ্ছে সর্বস্বান্ত হয়ে গেছে। যাই হোক, চোখে চোখে রাখতে হবে।

পাড়ার লোকের সঙ্গে একবারও একা মিশতে দেওয়া হবে না। যে কদিন থাকে, একটু ইয়ে হয়ে থাকলেই তবে আদরযত্ন নয়। আদরযত্ন পেলে আর রক্ষে থাকবে না। এসো লক্ষ্মী, যাও বালাই। আমি তো বাবা এই সার বুঝি।

তা ক-অক্ষর গোমাংস গাঁইয়াটি এবং তার সংসার যা বুঝল তাই করল।

বাড়ির ভিতরের যে মহিলাটি ছেলের হাত দিয়ে জলের সঙ্গে জলচৌকি পাঠিয়ে দিয়েছিল, ভিতরে গিয়ে শ্যামাপ্রসাদ তাকে চাপা তর্জনে শাসিয়ে আসে, তোমায় অত সর্দারি করতে কে বলেছিল, অ্যাঁ, কে বলেছিল? খবরদার! বেশি লাই দিতে যেতে হবে না। মানে মানে বিদেয় করবার চেষ্টা করতে হবে।

তা সেই চেষ্টাটা কি করতে হয়েছিল সারদাপ্রসাদের জন্যে?

নাঃ।

সারদাপ্রসাদ নিজেই বিদায় নিয়েছে।

সারদাপ্রসাদ তার ভাইপোর উদ্বিগ্ন মুখের দিকে তাকিয়ে মৃদু হেসে বলেছে, এসেছি যখন, তখন দুদিন থেকে যেতে বলছ? তা থাকতে পারলে তো আমারও ভাল লাগত, কিন্তু থাকার উপায় কোথা?

শ্যামাপ্রসাদের মুখ থেকে উদ্বেগের পাথর সরে গিয়েছিল। শ্যামাপ্রসাদ এরপর তার কাকার এতদিন পরে দেশে এসে দুটো দিন থাকতে না পারার জন্যে অনেকখানি বড় একটা নিশ্বাস ফেলে আক্ষেপ করেছিল।

সারদাপ্রসাদ চুপ করে তাকিয়ে থেকেছিল সামনের তেঁতুল গাছটার দিকে।

 যেখানে ঝিরিঝিরি পাতার এক পরম সৌন্দর্যের খেলা চলেছে অবিরাম ভাবে।

প্রকৃতির ঘরে এমন কত ঐশ্বর্য, কত সৌন্দর্যের সঞ্চয়! যাদের দিকে ঘণ্টার পর ঘণ্টা শুধু চুপ করে তাকিয়ে কাটিয়ে দেওয়া যায়।

অথচ সারদাপ্রসাদ কোনওদিন এই বিনামূল্যে বিকোনো অফুরন্ত ঐশ্বর্যের দিকে ফিরে তাকায়নি। সারদাপ্রসাদ দশ ফুট বাই বারো ফুট একখানা ঘরের মধ্যে নিজেকে কবরিত করে ফেলে–একটা মুর্শের স্বর্গের স্বপ্ন দেখেছে বসে বসে।

প্রকৃতির এই অফুরন্ত ঐশ্বর্যের রাজ্যে কোথাও একটুকরো জায়গা কি জুটবে না সারদাপ্রসাদের? শ্যামাপ্রসাদের উদ্বেগ হয়ে এই মৌটুংরি গ্রামে পড়ে থাকবে সে? নাঃ, থাকবার ইচ্ছে নেই সারদাপ্রসাদের।

আরও তো হাজার হাজার গ্রাম আছে বাংলাদেশে। সবই তো সারদাপ্রসাদের মাতৃভূমি।

তা সেদিন কি সারদাপ্রসাদ স্নান আহার কিছুই না করে বিদায় নিয়েছিল তার সাত পুরুষের ভিটে থেকে?

না না, তাই কি হয়?

শ্যামাপ্রসাদ তাই ছাড়ে কখনও?

স্নান না হোক, আহারটা হয়েছিল বইকী!

স্নানের জন্যেও প্রস্তাব দিয়েছিল শ্যামাপ্রসাদ। বলেছিল, তোমার কাপড়জামাগুলো পরে স্নান করে এসে ওগুলো মেলে দিয়ে ততক্ষণ না হয় আমার একখানা ধুতিটুতি পরে খাওয়া দাওয়া করো, শুকিয়ে গেলে নিজেরটা পরে নিও। দেরি হবে না, রোদের জোর আছে।

রোদের জোর আছে!

রোদের যে জোর আছে, সে খবর টের পাচ্ছিল বইকী সারদাপ্রসাদ, শরীরে প্রত্যেকটি অণুপরমাণু থেকে টের পাচ্ছিল। দুদিন স্নান হয়নি। স্নানটাই একমাত্র বিলাস ছিল সারদাপ্রসাদের।

যার জন্যে বিজয়া রেগে রেগে বলতেন, জামাই নবাব চৌবাচ্চার সবটুকু জল নিজের গায়ে ঢালছেন, আর যেন কারুর কাজ নেই।

তা বিজয়ার কথা বাড়ির কেউই গায়ে মাখত না, সারদাপ্রসাদও না। কথা গায়ে মাখার অভ্যাসই ছিল না তার।

হঠাৎ কেমন করেই যেন তার অভ্যাসের জগৎটা আমূল পালটে গেল।

তাই সে ওই জোরালো রোদের দিক থেকে চোখ ফিরিয়ে নিয়ে বলল, না থাক, এত বেলায় আর স্নান টান করব না।

অতএব হাতে মুখে জল দিয়েই খেতে বসেছিল সারদাপ্রসাদ। আর সেই সাজিয়ে দেওয়া অন্নব্যঞ্জনে কোনও এক অন্তরালবর্তিনীর শ্রদ্ধা-ভক্তির স্পর্শ পেয়েছিল যেন।

থাকবে না, চলে যাবে।

এতে এত প্রীত হয়েছিল শ্যামাপ্রসাদ যে, ভিতরে গিয়ে বলেছিল, পোস্তর বড়া-টড়া দুখানা করে দাও না। আর যদি ওবেলার জন্যে মাছ থাকে তো না হয় তার থেকে

শ্যামাপ্রসাদের বউ বলেছিল,থাক তোমার আর বুদ্ধি দিতে আসতে হবে না। বাড়ির মানুষ বাড়িতে এসেছেন, দুটো যত্নের ভাত পাবেন না? শ্বশুর যে কেমন বস্তু তা তো চক্ষে দেখিনি, কাকাকে দেখে ইচ্ছে হচ্ছে গিয়ে পায়ের ধুলো নিই।

থাক, ইচ্ছেময়ীর আর অত ইচ্ছেয় কাজ নেই। শ্যামাপ্রসাদ সন্দেহের গলায় বলেছিল,দেখলে কখন?

বাঃ, সামনেই তো বসে ছিলেন দালানে। এই জানলা থেকে দেখতে পাওয়া যায় না?

 থাকবে না।

 চলে যাবে।

এই মন্ত্রের জোরে এত সব প্রতিকূলতার সঙ্গে লড়তে পেরেছিল শ্যামাপ্রসাদ। নচেৎ ওই জানলা দিয়ে দেখা নিয়েই লেগে যেত ধুন্ধুমার।

পড়ন্তবেলাতেই বিদায় নিল সারদাপ্রসাদ।

শ্যামাপ্রসাদের দিদি আঁচলে চোখ মুছতে মুছতে কাকাকে বিদায় দিতে গিয়ে অভিযোগ করল, এক বেলার জন্যে শুধু মায়া বাড়াতে এলে কাকা! এতকাল পরে সেই যখন এলেই, দুটো দিন অন্তত থাকলে হত। আত্মজন একটু খবরই পেল না। কারুর সঙ্গে দেখা হল না।

সারদাপ্রসাদ সেই তেঁতুলপাতার ঝিরিঝিরিনির দিকে চোখ রেখেই মৃদু হেসে বলল,দেখা হলেও যা, না হলেও তা। আমায় আর কে চেনে?

নাই বা চিনল। নতুন ঠাকুরদার নামেই চিনত।

 সেকালের কেউ তো আর বেঁচে নেই।

আছে, কেউ কেউ আছে– শ্যামাপ্রসাদ সাবধানে বলে, নাম করলে চিনতে পারবার লোকও আছে কিছু কিছু।

সাবধানে না বললে?

আগ্রহের অভিনয়টা যদি বেশি জোরালো হয়ে যায় তো লোকটার মন ঘুরে যেতে পারে। তার থেকে ওই সাবধানতাটুকু ভাল।

আমি জানি না আমি কোথায় যাচ্ছি। সারদাপ্রসাদ মনে মনে বলে, তবু যেতে হবে। এইটাই হচ্ছে। আসল কথা।

এবেলা আর গোরুর গাড়ির সুবিধে নেই, দ্রুতপায়ে হেঁটেই যাচ্ছিল সারদাপ্রসাদ। যাচ্ছিল আদিবাসীদের গ্রামের দিকে। ওই ছোট ছোট মাটির কুটিরগুলি দূর থেকে বড় সুন্দর লাগছে।

ওখানে যেতে হবে।

হয়তো এখনও সরলতা নামের বস্তুটা ওখানেই পাওয়া যেতে পারে। হয়তো ওখানেই বাকি জীবনটা কেটে যেতে পারে, শুধু গাছের পাতার ঝিরঝিরির দিকে তাকিয়ে।

প্রকৃতির ওই সবুজের ভাণ্ডার বিষে নীল হয়ে যায়নি, সে তার চির সম্ভার নিয়ে চিরকাল অপেক্ষা করে আছে, থাকবে! বিষে নীল হয়ে যাওয়া মানুষ যদি কখনও আবার ফিরে তাকিয়ে দেখে।

অনেকটা পথ পার হয়ে আসার পর হঠাৎ পিছনে একটা শব্দ পেয়ে ফিরে তাকাল সারদাপ্রসাদ। দাদু! দাদু! বলে কে কাকে ডাকছে?

সকালের সেই জল এনে দেওয়া ছেলেটা। হাতে তার একটা কাঁচা শালপাতায় মোড়া খাবারের পুঁটলি। সাধ্যের অতিরিক্ত ছুটে ছুটে এসেছে বেচারা। তাই কথা বলতে দেরি লাগে। হাঁপাতে থাকে।

সারদাপ্রসাদ সস্নেহে বলে, কী রে?

ছেলেটা কথা বলার ক্ষমতা পেয়ে বলে, দাদু, মা বলল, তুমি তো রাত্তিরে থাকলে না, তোমার রাত্তিরের খাবার।

সারদাপ্রসাদ মুহূর্তখানেক স্তব্ধ হয়ে তাকিয়ে থাকে। তারপর আস্তে বলে, আমি যে তো দাদু হই, এ কথা কে বললে রে?

মা! মা বলল, তোমার বাড়িঘর সব নিজে নিয়ে বাবা তোমায় তাড়িয়ে দিল, থাকতে দিল না।

সারদা মৃদু ভর্ৎসনার গলায় বলে,ছিঃ ও কথা বলতে নেই। আমি পাগলাছাগলা মানুষ, কোনওখানে কি স্থির হয়ে বসতে পারব? ঘুরে ঘুরে বেড়াব। ইস, কত ছুটে এসেছিস তুই।

আসব না, হি! মা বলল না? মা গুরুজন না?

তাই তো, সত্যিই তো।

সারদাপ্রসাদ আস্তে ওর মাথায় একটা হাত রাখে। বলে, বেঁচে থাকো দাদু, সুখে থাকো। কিন্তু এ কত খাবার ভাই, বিরাট ভারী মনে হচ্ছে। তুমি কিছু খাও।

ধ্যেৎ ছেলেটা হেসে ওঠে, তোমার জন্যে আনলাম।নাভু পরোটা আর ভোলাচচ্চড়ি আছে, খেয়ে কিন্তু। আর শোনো, মা বলেছে তোমায় পেন্নাম জানিয়েছে।

সারদাপ্রসাদ সহসা অন্যদিকে তাকায়। সারদাপ্রসাদের কোনওখানে একটু বসে পড়তে ইচ্ছে করে। সারদাপ্রসাদ একটুক্ষণ পরে রুদ্ধ কণ্ঠে বলে, তোমার মাকে আমার আশীর্বাদ দিলাম ভাই, বোলো। আর বোলো খাবারটা পেয়ে বেঁচে গেলাম। এতক্ষণ মনে হচ্ছিল রাত্তিরটা উপোসেই কাটাতে হবে।

দ্রুতপায়ে হাঁটতে থাকে সারদাপ্রসাদ। পিছন দিকে আর তাকায় না। তবু অনুভব করে, ছেলেটা পিছনে দাঁড়িয়ে আছে।

সারদপ্রসাদ অনুভব করে, একটি আধময়লা শাড়িপরা নেহাত সাধারণ গ্রামের মেয়ে ওর পিছনে কোথাও যেন খোলা দরজার কপাট ধরে দাঁড়িয়ে আছে। যার কোনও অন্যায়ের প্রতিকারের ক্ষমতা নেই, তবু সে ন্যায়-অন্যায় সত্য-অসত্যের অঙ্ক কষে বেদনা অনুভব করে।

সামনের দিকে এগিয়ে যেতে থাকে সারদাপ্রসাদ।

.

যাত্রার আয়োজন সম্পূর্ণ ছিল। অমোঘ অলঙ্ঘ্য অনিবার্যকে স্বীকার করে নিয়ে সমস্ত ভবিষ্যৎ চিন্তাকে দূরে সরিয়ে রেখে, গভীর একটি ত্যাগের জন্য মনকে প্রস্তুত করে যাত্রার জন্য প্রস্তুত হয়েছিলেন সরোজাক্ষ, কিন্তু সেই অমোঘ অনিবার্যই যেন নতুন এক নির্লজ্জ খেলায় ব্যঙ্গের হাসি হেসে সবকিছু ভূমিসাৎ করে দিয়ে গেল, মূল্যহীন করে দিয়ে গেল সরোজাক্ষর ত্যাগের গভীরতাকে, দুঃসাহসের শক্তিকে।

সেই নির্লজ্জ খেলাটা এল মৃত্যুর বেশে।

এল সেই রাত্রি শেষ হবার আগেই। যে সকালে যাবার কথা সরোজাক্ষর। কিন্তু সে মৃত্যু রাজার মতো পরম সমারোহে এল না, এল চোরের মতো চুপিচুপি-মৃত্যুর এই তস্করের রূপটা ঘৃণ্য কুৎসিত অশুচি। এই অশুচির সামনে শোকের পবিত্রতা মাথা হেঁট করে দাঁড়ায়, শোকের স্তব্ধতা আতঙ্কে বিদীর্ণ হয়।

এই তস্কর এসে উঁকি মারল সরোজাক্ষর সংসারে। চুরি করে নিয়ে গেল সংসারের এক পরম মূল্যবানকে, আর যেন সেই নিয়ে যাওয়ার সুত্রে ক্রুর হাসি হেসে বলে গেল, শুধু নিজেকে নিয়ে থাকলেই হয় না সরোজা, শুধু শান্তিপ্রিয় হলেই হয় না। সে শান্তিরক্ষার দায়িত্বও গ্রহণ করতে হয়। না হলে এই রকমই হয়। তোমার সংসারের সব সৌন্দর্যের সবুজ কোন ফাঁকে বিষে নীল হয়ে আছে, তুমি তাকিয়েও দেখোনি, তুমি শুধু নিজেকে ভদ্র আর সুন্দর করে রাখবার সাধনায় নিজেকে ঘিরে দুর্গ রচনা করে তার মধ্যে নিজেকে সুরক্ষিত রেখেছ।

তবে এখন দ্যাখো।

দ্যাখো তোমার দুর্গপ্রাচীরের ওপারে কত বিষ জমছিল। হয়তো তুমি ওই যন্ত্রণাকাতর আত্মাটাকে তোমার স্নেহের স্পর্শ দিয়ে কিছুটা স্নিগ্ধ করতে পারতে, হয়তো ওই নিরুপায় অভিমানকে তোমার ছত্রতলে আশ্রয় দিয়ে, তাকে একটু সুস্থ রাখতে পারতে। হয়তো তোমার আশ্বাস তাকে পায়ের তলায় মাটি দিতে পারত, কারণ সে তোমাকে শ্রদ্ধা করত, ভালবাসত, ভক্তি করত। কিন্তু তুমি মহিমায় উদাসীনতায় কোনও কিছুর দিকে তাকিয়ে দেখোনি।

দেখো এখন কী দুর্নিবার লজ্জা তোমার, কী দুঃসহ পরাজয়।

আর কেউ বলে যায়নি

 ওই মৃত্যুনীল মুখটার দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে এ ভাবনাটা নিজেই ভাবছিলেন সরোজাক্ষ।

আমি ওকে এ বাড়িতে নিয়ে এসেছিলাম, স্নেহের সঙ্গে, সমাদরের সঙ্গে, তারপর আমি ওকে ভুলে গিয়েছিলাম। অন্তত ও তাই ভেবে গেল। ধিক্কার দিয়ে গেল আমার নির্মমতাকে, আমার নির্লিপ্ততাকে।

অথচ চিরদিন আত্মহত্যার সংকল্প ঘোষণা করে এসেছেন বিজয়া। যে কোনও ইচ্ছা-অনিচ্ছার ঠাণ্ডা লড়াইয়ে স্বামীকে ঠাণ্ডা করে দিয়েছেন গলায় দড়ি দেব বলে।

সেই ঘোষণায় অদ্ভুত এক নিরুপায়তার রজ্জুতে সরোজাক্ষরই দমবন্ধ হয়ে এসেছে, সরোজাক্ষ পরাভূত হয়েছেন।

কিন্তু সেই বিজয়া দীনভাবেই না পরাভব স্বীকার করে বসলেন!

বিজয়া সরোজাক্ষর কাছে আছড়ে এসে পড়ে বললেন, আমায় তোমার সঙ্গে নিয়ে চলো।

সেই ভয়ানক মুহূর্তে বিজয়ার তো তাঁর সেই হাতের মুঠোর অস্ত্রটার কথা মনে পড়ল না। সেটাকে কাজে লাগালেই তো জিতে যেতে পারতেন বিজয়া, জব্দ করে ফেলতে পারতেন তাঁর চিরদিনের প্রতিপক্ষকে।

কিন্তু তা করেননি বিজয়া।

বিজয়া হার মেনেছেন।

বিজয়া বলেছেন, আমায় ফেলে চলে যেও না।

 মরবার বদলে হারলেন বিজয়া।

তা মরার কথা তো এ বাড়ির ছোট মেয়েটারও ছিল। মরাটাই তো ছিল ওর কাছে সবচেয়ে সহজ সমাধান। কিন্তু ও সেই সহজের পথে যায়নি।

ও সমস্যার জটিলতার জালে নিজেকে জড়িয়েছে, অপর সবাইকে জড়িয়েছে।

অথচ যার মরবার কোনও কথা ছিল না, যার নামের কাছাকাছি মৃত্যু শব্দটাকে কেউ কোনওদিন ভাবতেই পারেনি, সেই মানুষটা অম্লান বদনে একমুঠো ঘুমের বড়ি খেয়ে মরে গেল।

বিগত সন্ধ্যাতেও সুনন্দা জরির শাড়ি গায়ে জড়িয়ে মুখে তুলির কারুকার্য করে, ওর বরের সঙ্গে কার যেন একটা দামি মোটরগাড়ি চেপে বেড়িয়ে এসেছে।

বেশ কিছুদিন অবশ্য যাচ্ছিল না ওই প্রমোদ ভ্রমণে, জরির শাড়ি গায়ে জড়াচ্ছিল না, খুব সাদাসিধে সাজ করে ঘরের মধ্যে পড়ে থেকে বই পড়ছিল, ছবি আঁকছিল।

কোনও কোনও দিন হয়তো একা চলে যাচ্ছিল মায়ের কাছে।

 মায়ের রান্নাঘরের দরজায় ধুলোয় বসে পড়ে বলছিল,আচ্ছা মা, তোমার কখনও মনে হয় না এখান থেকে পালিয়ে যাই অনেক অনেক দূরে?

বলছিল,আচ্ছা মা, তোমার কখনও মনে হয় না বেঁচে থাকার মানেটা কী?

মা বলেছে, হয় না আবার? রাতদিনই তো মনে হচ্ছে কোথাও ছুটে পালাই–অহরহই মনে হচ্ছে। এমন দুর্গতি করে বেঁচে থাকার থেকে মরণ ভাল।

বলেছে আর সঙ্গে সঙ্গে খসখস করে বড়ির ডাল বেটেছে, মিহি মিহি করে মোচা কুটেছে, আমতেলে মশলার গুঁড়ো মেখেছে তরিবৎ করে।

সুনন্দা মৃদু হেসে উঠে এসেছে।

একদিন মা বলেছিল, একটা মাত্তর সন্তান, সেটাকে দিয়ে দিলি বোর্ডিঙে, মন হু হু করবে এ আর আশ্চয্যি কী?

সুনন্দা বলেছিল,তুমি ওকে নাও তো বোর্ডিং থেকে নিয়ে আসি, তোমায় দিয়ে যাই।

মা বলেছিল, বালাই ষাট! নিতে যাব কেন? তোর জিনিস তোর বুকভরা হয়ে থাক। তবে যদি আমার কাছে রাখতে চাস

সুনন্দা নিশ্বাস ফেলে বলেছিল, নাঃ যেমন আছে থাক।

কিন্তু কাল সুনন্দা ওর মার বাড়ি যায়নি।

কাল জরির শাড়ি গায়ে জড়িয়ে বরের সঙ্গে পার্টিতে নাচতে গিয়েছিল। যে নাচের দৌলতে ওর বরের দৌলত বেড়ে যাওয়ার কথা।

সেই মিনতিই করেছিল ওর বর, পায়ে হাতে ধরে বলেছিল, টাকা না থাকলে বেঁচে থাকবার কোনও মানেই নেই সুনন্দা!

নাচের পর সুনন্দা কোথায় যেন হারিয়ে গিয়েছিল, আর নীলাক্ষ একখানে বসে বসে গ্লাসের পর গ্লাস খালি করেছিল। দাঁড়াতে পারছিল না, টলছিল।

তারপর সুনন্দাও ফিরে এল প্রায় টলতে টলতে, আর খুব হাসতে হাসতে। কেমন করে যে এক রাঘববোয়ালকে ঘায়েল করে নীলাক্ষর বেঁচে থাকার মানে জোগাড় করবার প্রতিশ্রুতি আদায় করে ফেলেছে, রসিয়ে রসিয়ে তার গল্প করেছিল সারাক্ষণ গাড়িতে।

নীলাক্ষ মাতাল হলেও ইশারায় ড্রাইভারকে দেখিয়ে দিয়েছিল, সুনন্দা সে ইশারা গায়েই মাখেনি। হি হি করে হেসে উঠে বলেছিল, দূর দূর, ওরা কি শুনতে পায়? ওরা কালা বোবা অন্ধ।

নীলাক্ষ আর কিছু বলেনি, কারণ তখন নীলাক্ষ চটাতে চায়নি তার স্ত্রীকে।

 বাড়ি ফিরেও তোয়াজই করেছে তাকে।

 অথচ কোন ফাঁকে সুনন্দা একমুঠো ঘুমের বড়ি খেয়ে বসে থাকল।

নিঃশঙ্ক নীলাক্ষ লম্বা একটা ঘুমের পর জেগে উঠে হঠাৎ কী ভেবে অভিমানীকে একটু কাছে টানতে গিয়েছিল, সঙ্গে সঙ্গে ছিটকে উঠেছিল, লাফিয়ে পড়েছিল বিছানা থেকে। দরজা খুলে বেরিয়ে গিয়ে মায়ের ঘরের দরজায় ধাক্কা দিয়েছিল, মা মা, শিগগির একবার এসো এ ঘরে।

হয়তো সরোজাক্ষর আর কোনওদিনই এ বাড়ি ছেড়ে যাওয়া হবে না, হয়তো এই শহরেই কোনও একখানে কর্মক্ষেত্র নির্বাচন করে নিয়ে আস্তে আস্তে ট্রাম ধরবেন, বাস ধরবেন, ছাতাটা সব সময় হাতে রাখবেন। আর বারেবারে পকেট থেকে রুমাল বার করে কপালের ঘাম মুছবেন।

শৈশব থেকে সরোজা শুধু একটি জিনিসই চেয়েছিলেন, কিন্তু সেটা তিনি পাননি। সুন্দরের বদলে অসুন্দরকেই পেয়ে এসেছেন সরোজা, কারণ সরোজাক্ষর মা বাপ জীবনের মানে খুঁজছিলেন রাঢ়ী বারেন্দ্র কুলশীল গোত্র পর্যায়ের মধ্যে। সরোজাক্ষর স্ত্রী জীবনের মানে খুঁজেছিল দেহগত প্রাপ্তির মধ্যে, আর সরোজাক্ষর পুত্র সেই মানেটা খুঁজতে গিয়েছিল ব্যাঙ্কের খাতার মধ্যে।

হয়তো একা সরোজাক্ষরই নয়, সকলেরই এমনি হয়। হয়তো সুন্দরকে চাওয়াটা খুব একটা অসম্ভব চাওয়া, কারণ মানুষরা বড় বেশি নির্বোধ। ওই সুন্দরটাকে তারা নিজে হাতে ধ্বংস করে।

মনে হয় ওরা বুঝি শয়তান, কিন্তু তা নয়। আসলে শুধু ওরা বোধহীন। তাই নিজের হাতে গড়া সভ্যতা নিজের হাতে ধ্বংস করে উল্লাসের হাসি হেসে চিৎকার করে, জিতেছি, জিতেছি!

সরোজাক্ষর ছাত্রদলও তাদের গুরুকে অবমাননা করে মহোল্লাসে ভেবেছিল, জিতেছি, জিতেছি।

দিবাকর নামের সেই মহামূর্খটাও তার স্বর্ণহংসীকে হত্যা করে উল্লাস করেছিল জিতেছি, জিতেছি।

হয়তো বিজয়া একদা যদি একটা হৃতসর্বস্ব রোগজীর্ণ মানুষের দেহটার সেবার অধিকার পায়, সেই দাবিতেই পুলকিত হয়ে ভাববে, জিতেছি, জিতেছি।

বিজয়ার বড় মেয়ে তার স্বামীর কালোবাজারি পয়সায় দামি শাড়ি পরে মোটরগাড়ি চড়ে বেড়াবে আর ভাববে, কী জেতাই জিতেছি।

হয়তো বিজয়ার ছোট ছেলে তার বিপক্ষ পার্টির নেতার মাথা ফাটিয়ে দিয়ে ভাববে, জিতেছি।

শুধু হয়তো বিজয়ার বড় ছেলে কিছু ভাববে না, শুধু বসে বসে মদ খাবে, আর নেশার ঝোঁকে নিজের সঙ্গে নিজে কথা বলবে।আর বিজয়ার ছোট মেয়ে একটা সস্তা স্কুলের মাস্টারি, আর একটা অবাঞ্ছিত শিশুর বোঝা টানতে টানতে ভাববে, জিতলাম না হারলাম?

রুক্ষ শুষ্ক সেই মানুষটা হয়তো ক্রমশ একটা তিক্ততার পুতুল হয়ে ঘুরে বেড়াবে। কারণ এরা জানত না কোনটা সুন্দর।

আর একদল বোধহীন আছে জগতে। জীবনেও যাদের জ্ঞানচক্ষু খোলে না। জীবনেও যারা লাভ-লোকসানের হিসেব বুঝে উঠতে পারে না। সারদাপ্রসাদ চিরদিনই তাদের দলে। তাই সারদাপ্রসাদ মৌটুংরি গ্রামের দোরে দোরে ঘুরে সহায় সংগ্রহ করে অন্যায় দখলকারী জ্ঞাতি ভাইপোর কবল থেকে নিজের পিতৃভিটে আর সাতপুরুষের বিষয়-আশয় উদ্ধার করবার চেষ্টা না করে চলেই গেল মৌটুংরি ছেড়ে।

অথচ সহায় খুঁজলে পেত।

নির্ঘাত পেত।

কিছু কমিশনের আশা থাকলে ন্যায়ের পক্ষ অবলম্বন করতে প্রাণপণ করবার মতো লোকের অভাব ছিল না মৌটুংরি গ্রামে।

সারদাপ্রসাদ সেই সহায়ের পথ না ধরে সামনের পথ ধরল।

কিন্তু সারদাপ্রসাদের সেই পথ কি শেষ হয়েছে? খুঁজে পেয়েছে সে তেমন জায়গা, আজও যেখানে সারল্য আছে, সততা আছে, বিশ্বাস আছে?

তা কে জানে পেয়েছে কিনা খুঁজে, তবে পথচলা থামিয়ে বসে থাকতে দেখা যাচ্ছে বটে তাকে একটা জায়গায়। যার সামনে দিয়ে ঝিরিঝিরি একটা নাম-না-জানা নদী বয়ে যাচ্ছে, আর চোখ তুললে আকাশের কোলে কোলে ছোট্ট ছোট্ট টিবি টিবি পাহাড় দেখা যাচ্ছে।

সারদাপ্রসাদের বসবার জায়গাটা অবশ্য খুব একটা আদর্শ নয়। গাছতলাকে কে আর কবে আদর্শ আশ্রয় বলে? কিন্তু সারদাপ্রসাদই বা কবে লোকে কাকে কী বলে তার ধার ধেরেছে?

ওই গাছতলাটাই তো রাজসিংহাসন লাগছে তার। অন্তত তার মুখ দেখে সেইরকমই মনে হচ্ছে। চোখে তার উৎসাহের উদ্দীপনা, মুখে তার আনন্দের দ্যুতি। তার মসৃণ ললাটে নির্মল সুখের ছাপ। ওর সিংহাসনটা যে নিতান্তই ধূলি-ধূসরিত একটা গাছতলা, ওর পৃষ্ঠপটে যে নিতান্তই একটা মাটির কুটির, সেটা ওর মনেও পড়ছে না।

ওই মাটির ঘরটার গায়ে যে অদ্ভুত সুন্দর করে আলপনা আঁকা আছে, ওই গাছের গোড়াটা যে কাঁকর কাঁকর লালচে মাটির প্রলেপে অভিনব হয়ে উঠেছে, আর ওই কুঁড়েটার পাশ দিয়ে যে পায়েচলা পথটা ঘন চুলের মধ্যেকার সরু সিঁথির মতো যেতে যেতে কোনও একটা জঙ্গলে যেন হারিয়ে গিয়েছে, এইটাই ওর কাছে পরম সম্পদ।

কিন্তু মৌটুংরি গ্রামের ধারেকাছেই তো এ সব ছিল। দেহাতি প্রতিবেশিনীদের দেখাদেখি রান্নাঘরের মেটে দেয়ালে আলপনা আঁকত শ্যামাপ্রসাদের বউ। যা দেখে শ্যামাপ্রসাদের বিধবা দিদি বলত, সাঁওতাল হয়ে গেলি নাকি বউ? তোর ধরনধারণ পছন্দ-অপছন্দ সবই যেন সাঁওতালদের মতো।

তার মানে মৌটুংরি গ্রাম থেকে অধিক দূর যায়নি সারদাপ্রসাদ।

তার মানে যে জিনিসগুলোর সন্ধান করছিল সারদাপ্রসাদ, সেগুলো খুব তাড়াতাড়িই পেয়ে গেছে। অনেক পথ হাঁটতে হয়নি।

অথবা হয়তো ওই সারল্য, সততা, বিশ্বাস ইত্যাদি দুষ্প্রাপ্য দুষ্প্রাপ্য জিনিসগুলো নিজের কাছেই ছিল সারদাপ্রসাদের, ও মনে করল খুঁজে পেয়েছি।

যদিও একটা বড় হাতুড়ির ঘায়ে ওর ওই দুষ্প্রাপ্য জিনিসের সিন্দুকটা ভেঙে টুকরো টুকরো হয়ে গিয়েছিল, কিন্তু কে জানে কখন যেন সেই ভাঙা টুকরোগুলোই জোড়া লেগে লেগে আবার আস্ত হয়ে উঠেছে।

হয়তো তেঁতুল পাতার ঝিরিঝিরি, হয়তো ওই নাম-না-জানা নদীটায় বালি চিকচিকে ঝিরিঝিরি জল, হয়তো ওই শাল জঙ্গলের সোঁদা সোঁদা গন্ধ–এরা ভাঙা-জোড়ার কারিগর।

বারেবারে খালি হয়ে যাওয়া ভাঁড়ার বারেবারে পূর্ণ করে তোলার অনাহত লীলায় যে চিররহস্যময়ী, তার একান্ত সন্নিকটে এসে বসতে পারলে ফুরিয়ে যাওয়া মানুষ আবার কোন ফাঁকে ভরাট হয়ে ওঠে।

অথবা সবাই হয়ে ওঠে না, শুধু সারদাপ্রসাদের মতো বোধহীন মানুষগুলোই। নিজে বোধহীন বলেই হয়তো সারদাপ্রসাদের সঙ্গীগুলোও ততোধিক বোধহীন।

ওরা তাই সারদাপ্রসাদের সঙ্গ ছাড়তে চায় না। সারদাপ্রসাদকে দেখলেই মহোল্লাসে চেঁচিয়ে ওঠে, পাগলা মাস্টারমশাই আসছে, পাগলা মাস্টারমশাই।

মাস্টারমশাই আখ্যা পেল কেন সারদাপ্রসাদ, তা সে নিজে জানে না।

ওই মালকোঁচা মেরে ছোট ছোট ধুতির টুকরো পরা খালি গা ছেলেগুলোকে তোত কোনওদিনই বই শেলেট নিয়ে পড়াতে বসায়নি সারদাপ্রসাদ। ওদের সঙ্গে যোগসূত্র শুধু গল্পবলায় আর শোনায়। সেটা অবশ্য শোনায় সারদা খুব সমাদরে।

যদিও ছেলেগুলো নিতান্তই বালক বলে শুধু খেয়ে খেলিয়ে বেড়াবার ছাড়পত্র পায় না, এদের মধ্যে অনেককেই ছোট ছোট টোকা মাথায় দিয়ে গোরু চরাতে হয়। বাপ-ঠাকুরদার সঙ্গে খেতবাড়িতে গিয়ে উঞ্ছবৃত্তির কাজগুলো করতে হয়, অথবা মজুরানী মায়েদের সঙ্গে সঙ্গে জোগাড়ের কাজে হাত পাকাতে হয়। তবু ফাঁকে ফাঁকে ছুটে আসে ওরা এই শাখা-প্রশাখা ছড়ানো প্রকাণ্ড ছাতিম গাছটার ছাতার মতো ছায়ার নীচে।

নতুন জগতের স্বাদ পাওয়া কৌতূহলী চোখ মেলে মহোৎসাহে বলে, তারপর?

ডাকতে অবশ্য পাগলা মাস্টার বলে না, ওটা উচ্ছ্বাসের ডাক।

সারদা মাঝে মাঝে সচেতন করিয়ে দেয়, মা বাপের কাছে বকুনি খাবি নে তো বাপ? যা বাবা যা, একবার গিয়ে দেখে আয় গোরুগুলো পালিয়ে গেল কিনা। যা বাবা দেখ গে, মা ডাকছে কিনা।

কেউ হয়তো অনিচ্ছা মন্থর গতিতে গুটি গুটি উঠে যায়, কেউ বা হয়তো অগ্রাহ্যভরে বলে, না, ডাকতেছে না, তুমি বলো।

সারদাপ্রসাদ বলতে শুরু করে।

অফুরন্ত গল্পের সঞ্চয় আছে সারদার ভাঁড়ারে, সারদা এইসব চির-পতিত জমিতে তার বীজ ছড়ায়।

গল্প বলে আর তারপর মহোৎসাহে বলে, তা হলে বুঝছিস, সাহেবরা কোনও কিছুই নতুন আনেনি। এই যে নলকূপ দেখতে পাস জঙ্গলে বাংলোর মাঠে, কী যেন বলিস তোরা ওকে? টিপকল তাই না? ওটা সেই হাজার হাজার বছর আগেও ছিল। ভীষ্ম ঠাকুর যখন শরশয্যায় শুয়ে ঠাণ্ডা জল চাইল, অর্জুন তীর মেরে মেরে মাটির ভিতর থেকে জল বার করল মানে কী? কিছু না। ওই টিপল।

আর উড়োজাহাজের গল্প তো বলেইছি সেদিন। এখন যে এতসব অস্তর-শস্তরের বড়াই করে, সব তো মানুষ মারবার কল। মরামানুষ বাঁচাতে পারে কেউ? পারে না। তবে চেষ্টা করছে। আর সেই তখন? হাজার হাজার বছর আগে? হাসতে হাসতে মরামানুষ বাঁচাতে পারত।

বলতে বলতে উদ্দীপ্ত হয়ে ওঠে সারদাপ্রসাদ, শ্রোতাদের গ্রহণের পাত্রটার মাপের হিসেব ভুলে যায়, জোরালো গলায় বলে, লক্ষটা মানুষ মেরে ফেলার থেকে একটা মানুষ বাঁচানো যে অনেক শক্ত তা ভাবে না। শুধু মারামারি। পৃথিবী জুড়ে শুধু মারামারি। ১৪৬

হয়তো এই উত্তেজনার উর্ধলোক থেকে তার শ্রোতাদেরই কেউ তাকে নামিয়ে এনে বলে, সেই অবধি আমরা আর মারামারি করেছি মাস্টারমশাই?

সারদাপ্রসাদ ঊর্ধ্বলোক থেকে নেমে আসে। বলে, না না, তোরা যে সব সোনার চাঁদ ছেলে।

সোনার চাঁদদের দু-একজন হয়তো পাশের ছেলেদের সঙ্গে চিমটি কাটাকাটি চালাচ্ছিল। তারা হাত ঝেড়ে সামনে এনে অলৌকিক শান্তমুখে বলে, সেই আঙুলকাটার গপপোটা আজ আবার বলো না মাস্টার মশা, ধনু শোনে নাই। ধনুর বাপ সেদিন ওকে হাটে নে গেছিল।

আঙুলকাটার গপপো! অর্থাৎ একলব্যের কাহিনী, উতঙ্কের কাহিনী, বরাক্ষসের কাহিনী, জতুগৃহদাহের কাহিনী, এগুলো ওদেরও প্রায় মুখস্থ হয়ে গেছে। অর্থাৎ সারদা ওদের মগজে ঢুকিয়ে তবে ছেড়েছে।

বাড়িতে সন্ধ্যাবেলা ওরা ওদের মায়ের কাছে গল্প করে সেইসব কাহিনী হয়তো কতক ভুলে গিয়ে, কতক উদোর বোঝা বুধোর ঘাড়ে চাপিয়ে, তবু ওদের মা বাপেরা সারদাপ্রসাদকে ভক্তিশ্রদ্ধার চোখে দেখে।কথক ঠাকুরদের মতন সুর করে না হোক, সেইসব ঠাকুর দেবতাদের কথাই বলছে মাস্টারমশাই।

.

সারদাপ্রসাদের গল্পের আসরে মেয়ে শ্রোতার অভাব। মেয়েগুলো নিতান্ত শৈশব থেকেই মায়ের কাজে ভিড়ে যায়, পথেঘাটে বিশেষ ঘোরে না। তবু তারাও হঠাৎ কোনখানে টোকা মাথায় সারদাপ্রসাদকে দেখলেই চেঁচিয়ে ওঠে পাগলা মাস্টার লোমোস্কার।

সারদা হাসে, বলে, লোমোস্কার। তা তোরা কেন গপপো শুনতে আসিস না?

 ওরা হি হি করে হেসে ছুটে পালায় আর চেঁচায়, পাগলা মাস্টার, পাগলা মাস্টার!

 ব্যঙ্গ করে নয়, ভালবেসেই।

ওরা যে ওদের ভাইটারদের মতো প্রত্যক্ষ যোগাযোগ না রাখতে পেলেও মনের মধ্যে যোগসূত্র রেখেছে, সেটাই প্রকাশ করে।

পাগলা মাস্টার ভাবতে ভাবতে পথ হাঁটে আজ কোন গল্প বলবে।হনুমানের ল্যাজের আগুনে লঙ্কা পোড়ানোর গল্প অথবা গন্ধমাদন পর্বত বয়ে আনার গল্প, কাঠবেড়ালির সমুদ্র বন্ধনের গল্প এইগুলোয় ওদের মহোৎসব, হেসে কুটিকুটি হয়, ঠেলাঠেলি করে মাটির চাপড়া মাথায় তুলে হনুমান সাজে, কিন্তু সারদাপ্রসাদ যেন মহাভারতের গল্প বলতেই বেশি উৎসাহী। সারদাপ্রসাদ সেকাল আর একালের তুলনা করে একালকে নস্যাৎ করে দিয়ে ওদের জ্ঞানচক্ষু উন্মীলন করে দিতে চায়।

মেয়েরা বিশেষ আসে না, শুধু

মাঝে মাঝে একটি মহিলা শ্রোতা এসে বসে, সারদাপ্রসাদ তটস্থ হয়, সারদাপ্রসাদ কোঁচার কাপড় দিয়ে গাছতলাটা ঝেড়ে ধুলো ওড়ায়।

যে আসে সে অবশ্য গল্প শোনার উদ্দেশ্যে আসে না, আসে সারদাপ্রসাদের জন্যে খাবার নিয়ে। হয়তো নিতান্তই তুচ্ছ সেই খাবার, তবু যে আনে তার হৃদয়ের স্পর্শে সেই তুচ্ছতেই পরমের স্বাদ লাগে।

ওই মলিনবসনা গ্রাম্য বিধবার মুখে রানির মহিমা দেখতে পায় সারদাপ্রসাদ।

যে আসে সে একা আসে না, সঙ্গে তার ছেলে দুটোও আসে। বড়টা কোনও কোনওদিন বলে, জানো দাদু, তোমার বলা রামচন্দরের গপপোটা আমাদের ইস্কুলের বইয়ে আছে।

সারদাপ্রসাদ ওর মাথায় হাত বুলিয়ে বলে, সেই তিন মাইল রাস্তা ভেঙে ইস্কুল যেতে হয় ভাই, আবার কেন এই দু-কোশ রাস্তা ভেঙে এতদূর আসিস?

মায়ের সঙ্গে আসব না, হিঃ! ছেলেটা সারদার উদ্বেগ উড়িয়ে দিয়ে বলে, বেটা ছেলের বুঝি হাঁটলে কষ্ট হতে আছে? মা?

মা ঘোমটার অন্তরাল থেকে মৃদু হেসে বলে, না।

সারদাপ্রসাদ বলে, তুমিই বা কেন প্রায় প্রায় এত কষ্ট করে আমো বউমা? আমিই বরং গিয়ে খেয়ে আসব।

অটল নামের ছেলেটা হেসে উঠে বলে, মা বুঝি নল চালিয়ে তোমায় বলে পাঠাবে আজ কলাবড়া করেছি, আজ সরুচাকলি করেছি! তুমি জানবে কী করে?

সারদাপ্রসাদ বলে, তা এতসব করতেই বা বসো কেন বউমা? তোমার শরীর খারাপ—

 অটল বলে, মা বলে, সারাদিন কী করব?

হয়তো সত্যিই তাই, শ্যামাপ্রসাদের হঠাৎ মৃত্যু শ্যামাপ্রসাদের চিরবন্দিনী স্ত্রীকে ভয়ানক একটা মুক্তির শূন্যতা দিয়ে গেছে।

আর তার সঙ্গে কিঞ্চিৎ স্বাধীনতা।

তাই সে কলার বড়া তালের পিঠের উপচার দিয়ে দুক্রোশ পথ ভেঙে আসে তার চিরদিনের অদেখা খুড়শ্বশুরের কাছে।

ননদ রেগে বলে, শ্যামা মরে তোমার বড্ড পাখা উঠেছে বউ! বলি সাতজন্মের অচেনা খুড়শ্বশুরের জন্যে এত ভক্তি উথলে উঠেছে কেন? বুড়ো নয় হাবড়া নয়, জোয়ান মদ্দ, তার কাছে তোমার যাওয়ার দরকার?

বউ না-রাম না-গঙ্গা কিছুই করে না, অথচ যায়।

ননদ বলে, মুখের ঘোমটাটা ফেলে গলগল করে গপপো হয় বোধ হয় শ্বশুরের সঙ্গে?

 বউ বলে, কুচ্ছিত কথা বলে ভগবানের দেওয়া মুখটা নষ্ট কোরো না ঠাকুরঝি।

ঠাকুরঝি এই সদুপদেশ বাণীতে আরও জ্বলে ওঠে। বলে, শ্যামা মরে তোর পা-ই শুধু লম্বা হয়নি বউ, মুখও খুব লম্বা হয়েছে।…ওরে শ্যামা রে, ওপর থেকে দেখ তোর বউয়ের আসপদ্দা। সাতচড়ে যে রা কাড়ত না, সে এখন চোটপাট করছে।

চোটপাট আমি কিছুই করিনি ঠাকুরঝিবলে বউ দুটো ছেলের হাত ধরে বেরিয়ে পড়ে।

ননদের হাঁটুতে বাতের ব্যথা, তাই পিছু পিছু গিয়ে সরেজমিনে তদন্ত করতে পারে না, পিছনে দাঁড়িয়ে আঙুল মক্কায়। আর চেঁচিয়ে বলে, বলে যা, তবে তুই বলে যা, যাস কেন সেখানে? যাস কেন?

.

 কেন যায় সে কথা ননদের কাছে বলে না শ্যামার বউ, বলে আসল জায়গায়। কিন্তু মুখের কাপড় ফেলে কথা তো আর বলে না সত্যি। ছেলেদের মাধ্যমে কথা।

অটল বলে, দাদু, মা বলছে, মৌটুংরিতে তোমার রাজ্যপাট পড়ে, তুমি কেন এখানে পাঁচজনের দয়ায় পড়ে থাকবে?

সারদাপ্রসাদ হেসে হেসে বলে, তোর মাকে বল ভাই, তোর দাদুর এখানেও রাজ্যপাট। রাজা আমি হবই ভাবলে কে তার রাজ্যপাট কাড়তে পারে?

মা বলছে তুমি ওখানে গিয়ে আমাদের দেখাশোনা করবে, আমাদের মানুষ করার ভার নেবে।

দূর দূর! সারদা হেসে ওঠে, তোদের দাদু নিজে তো একটা অমনিষ্যি, সে আবার মানুষ করবে কী! তোরা যে মা পেয়েছিস তাতে তোদের মানুষ হওয়া আটকায় কে?

মা বলছে তোমার বিষয়-আশয় তোমাকে ভোগ করতে না দিয়ে নিজেরা ভোগ করছি, মহাপাপ হচ্ছে আমাদের।

সারদা এ কথায় উষ্ণ হয়েছে।

অতএব সারদা মাধ্যম ছেড়েছে।

সরাসরিই বলেছে, এ কথাটি তো তোমার মতন কথা হল না বউমা! আমার বিষয়-আশয় আমার নাতিরা ভোগ করবে না তো কে করবে শুনি? আমি তো একটা বাউণ্ডুলে পাগল ছাগল, আমি ওসবের মর্ম বুঝি? এ আমি বেশ আছি, খুব ভাল আছি। পাঁচজনের ভালবাসায় খাওয়া থাকাটা চলে যাচ্ছে, এদের নিয়ে আনন্দে আছি।

ছেলেটা আবার মাতৃশিক্ষামতো বলে, মা বলছে, তোমার তো একটা মানসম্মান আছে, বরাবর অন্য লোকে তোমায় খাওয়াবে কেন?

খাওয়াবে কেন?

সারদাপ্রসাদ হা হা করে হেসে ওঠে। বলে, বলে কিনা খাওয়াবে কেন! আরে বাবা ঘরের ঠাকুরটিকে খাওয়ায় কেন লোকে? পোষা কুকুরটাকে খাওয়ায় কেন? না খাওয়ালে আর কে খাওয়াবে, এই ভেবেই খাওয়ায়। সে খাওয়ায় ঠাকুরও লজ্জা পায় না, কুকুরও লজ্জা পায় না। তবে? তা ছাড়া এই ছেলে, বুঝলে বউমা, ভারী বুদ্ধিমান। এককথায় বুঝে ফেলে। এটা ঠিক নয়, ওটা ভুল বলছ বলে খোঁচ তোলে না। বোঝেও সব। তা তোমার অটলও খুব বোঝে। সেদিন বলছিলাম, সেকালে এই ভারতবর্ষের মুনিঋষিরা শরীরকে সবরকম সওয়াবার জন্যে গ্রীষ্মকালে আগুন জ্বেলে, শীতকালে একগলা জলে ডুবে, আর বর্ষাকালে খোলা আকাশের নীচে বসে তপস্যা করতেন–ছেলেটা ফটু করে বলে উঠল,ওইসব শুনে শুনে সাহেবরা সব বিদ্যে শিখে নিয়েছে, না দাদু? আমাদের ইস্কুলের মাস্টার মশাই বলেছেন, সায়েবরা যাদের চাঁদে পাঠিয়েছিল তাদেরও ওই রকম করে ঠাণ্ডা গরম, না খেয়ে থাকে, সবকিছু সইয়ে নিয়েছিল।

শুনে তো আমি তাজ্জব বনে গেলাম। অতটুকু বাচ্চা, তার মাথায় এলোও তো প্রকৃত ঘটনাটা! ঠিক তাই বুঝলে বউমা, অবিকল তাই। ওই ভাবেই মুনিঋষিরা আকাশে উঠতেন, পাতালে ঢুকতেন। তবু তো এ যুগে মায়ের পেটের মধ্যেকার শিশুর সাধ্যি নেই বাইরের জগতের কিছু শোনে কি দেখে। কিন্তু প্রাচীনকালে?

সারদাপ্রসাদ একটু উচ্চাঙ্গের হাসি হাসে, প্রাচীনকালে ততদূর পর্যন্তও এগিয়েছে মানুষ। তোমার গিয়ে অভিমন্যুই তার সাক্ষী। কিন্তু সাহেবদের দেশে হোক দিকি এখন ওই ঘটনা? ধন্যি ধন্যি পড়ে যাবে। সবাই বলবে-বিজ্ঞানের কী শক্তি! অথচ এমন কপাল আমাদের, কেউ একবার নিজেদের ঘরের দিকে তাকিয়ে দেখবে না। মহাভারতখানা একবার সাহেবদের নাকের সামনে তুলে ধরে বলে উঠতে পারবে না, কীসের বড়াই করছ তোমরা জাদু, এই দেখো। বিদ্যে থাকে তো পড়ে দেখো। বুঝতে পারবে কিছুই নতুন করোনি তোমার।

বলতে বলতে কণ্ঠস্বর উদাত্ত হয়ে ওঠে সারদাপ্রসাদের, চোখ ঝকঝক করে। নিজের একহাতের তালুতে অপর হাতে একটা ঘুসি মেরে বলে, আসল কথা কী জানো বউমা, আমাদের দেশের কারও কোনও বিষয় খেয়াল নেই। চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিলেও চমকে ওঠে না, উলটে আবার হাসে। তবে এই আমি বলে রাখলাম, এ হাসি আমাদের ঘুচবে একদিন। ওই সাহেবরাই যখন একদিন স্বীকার করবে–আমাদের যা কিছু বিদ্যে সবই তোমাদের ভারতবর্ষ থেকে পাওয়া বাপু, সংস্কৃত শাস্ত্রের যত কিছু প্রাচীন পুঁথি সেগুলি আমাদের হাতেই এসে গিয়েছিল, তার থেকেই আমাদের এত লপচপানি, তখন আমাদের বাছাধনরা বলবেন, তাই তো, তাই তো, সত্যিই তো! এই যে দেখছি হুবহু সব মিলে যাচ্ছে।

মধ্যাহ্ন সূর্য ধীরে ধীরে পশ্চিমের দিকে ঢলে পড়ে। পড়ন্ত বিকেলের রং সোনালি আলো সমস্ত পরিবেশটাকেই যেন সোনালি করে দিয়ে যায়।

আধাপাগল একটা প্রৌঢ় ব্যক্তিকে ঘিরে বসে থাকে কতকগুলো অবোধ বালক আর একটা সংসার-অভিজ্ঞ মলিনবসনা বিধবা।

সারদাপ্রসাদের কথাগুলো তারা ঠিকমতো বুঝতে পারে কিনা কে জানে, কিন্তু সারদাপ্রসাদকে তারা বোঝে। সেই বোঝার মধ্যে এক অপরিসীম কৌতূহল।

এতকাল ধরে তো এই দৃষ্টিরই প্রতীক্ষা করে এসেছে সারদাপ্রসাদ।

এই ভয়ংকর বিস্ময়কর তথ্যটা জেনে ফেলে আবিষ্কারককে তারা মুগ্ধদৃষ্টির প্রদীপ জ্বেলে পুজো করবে না?

সারদাপ্রসাদের কণ্ঠ ক্রমশ গম্ভীর হয়ে আসে, সারদাপ্রসাদ একটির পর একটি কাহিনী বলে চলে, আর তার ব্যাখ্যা শোনায়।

ওর সেই রাশি রাশি কাগজের ভূপ নিজে হাতে বিসর্জন দিয়েছে ও, কিন্তু তাতে ক্ষতিটা কী হয়েছে? কোন কথাটা হারিয়ে গেছে?

সারদাপ্রসাদের মনের পৃষ্ঠায় আগাগোড়াই ছাপা হয়ে মুদ্রিত নেই?

ছাপাখানায় ছাপা হয়ে সারদাপ্রসাদের এই অমূল্য গবেষণা লোকলোচনে আসতে পেল না বলে আর আক্ষেপ নেই সারদাপ্রসাদের, নেই জগতের ওপর কোনও ক্ষোভ, অভিমান। এই প্রায়-অরণ্য প্রকৃতির কোলে, এই গাছতলায় বসে নিজেকে তার প্রাচীনকালের শিষ্য পরিবেষ্টিত মুনিঋষির মতো লাগে।

সারদাপ্রসাদ অতএব মুনিঋষির দিব্য জ্ঞানটাও পায় যেন। তাই সেই গভীর গম্ভীর গলায় বলে, এত জ্ঞান-বিজ্ঞান, এত যন্ত্র-শক্তি কী করে হারিয়ে ফেলল ভারতবর্ষ তা বুঝতে পারছ? শুধু শক্তির অহংকারে নিজেরা নিজেরা কাটাকাটি করে। লঙ্কাকাণ্ডের পর ত্রেতাযুগ ধ্বংস হল, কুরুক্ষেত্রের পর দ্বাপর। তবু এই অভাগা কলিযুগের চৈতন্য নেই। নিজেকে ধ্বংস করে, সব উন্নতি সমুদ্রের জলে খতম করে আবার গুহার মানুষ হয়ে গিয়ে তবেই যেন ওর ছুটি। হবে, হচ্ছে, এই হিপিরাই তার সূচনা।

শ্রোতাদের কথা বুঝি আর মনে থাকে না সারদাপ্রসাদের, যেন নিজের সঙ্গেই নিজে কথা কয়, তবে আর তোদর বড়াই কীসের? বিধাতার নিয়মেই চলছিস তোরা। যেমন দিনের পরে রাত, তেমনি আলোর পরেই অন্ধকার, নিজেদের সৃষ্টি নিজেরাই ধ্বংস করে ফের কাঠে কাঠে ঘষে আগুন জ্বালাবে মানুষ, এও তো সেই প্রাচীনকালের মুনিঋষিরা লিখে রেখেই গেছে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *