সুনন্দা দোতলায় উঠে ঘুমন্ত ছেলেটাকে নিয়ে তাড়াতাড়ি ঘরে ঢুকে গেছে। নীলাক্ষ ট্যাক্সিভাড়া মিটিয়ে ধীরে ধীরে অসমান পায়ে দোতলায় উঠে এসে জড়িত গলায় প্রশ্ন করে, কী ব্যাপার! ডাক্তারকে বেরিয়ে যেতে দেখলাম মনে হল।
প্রশ্নটা শূন্য দালানকে, তাই উত্তর মিলল না।
নীলাক্ষ অতএব বাবার ঘরের পরদা সরিয়ে আর একবার উচ্চারণ করল প্রশ্নটা।
মীনাক্ষী বিছানার ধারে একটা চেয়ারে বসে ছিল, খাটের উপর সরোজাক্ষ শুয়ে। চোখ বোজা। জেগে আছেন কি ঘুমিয়ে আছেন বোঝা যাচ্ছে না।
মীনাক্ষীও শূন্য দালানের ভূমিকাতেই স্থির থাকল। শুধু একবার চোখটা তুলে তাকাল। সে চোখে ঘৃণার ছায়া।
একটা নেশায় টলমল মানুষকে দেখে ঘৃণা ছাড়া আর কোন ভাবেরই বা উদয় হবে!
ওঃ অসুখটা তা হলে বাবার!
নীলাক্ষ তেমনি জড়িত গলাতেই বলে, হওয়াই স্বাভাবিক! কলেজে তো আজ বেশ একখানি নাটক হয়ে গেছে। ঘেরাও নাটক! আরে বাবা, কলেজটা বাড়ি নয় যে, যাকে যা খুশি বলে পার পাবে! ও হল গিয়ে কেউটের বাচ্চার আচ্ছা। সেখানে তুমি গিয়েছ তাদের ল্যাজে পা দিতে।
মীনাক্ষী এই রোগীর ঘরে বাঁচালতার বিরুদ্ধে হয়তো রুক্ষভঙ্গি নিত, কিন্তু নীলার মন্তব্যটা অভাবিত বিস্ময়কর, তাই নিষেধ করতে ভুলে গিয়ে তাকিয়ে থাকে।
নীলাক্ষ স্ফুর্তির সঙ্গে বলে চলে, হঁ বাবা, এ হচ্ছে ঘেরাওয়ের যুগ, কথাটি কয়েছ কি ঘেরাও। নাও এখন বুঝলে তো ঠ্যালা। হাতজোড় করে ক্ষমা চেয়ে তবে
সরোজাক্ষকে ঘুমের ওষুধ দেওয়া হয়েছে, সেই ওষুধের ক্রিয়ায় এখনও আচ্ছন্নই আছেন হয়তো, তবু যেন মনে হল মীনাক্ষীর, শয্যাগতের কপালটা একটু কুঁচকে উঠল। হয়তো সত্যি নয়। হয়তো তার মনের ভ্ৰম, তবু সে নিচু অথচ দৃঢ়গলায় বলে, ও ঘরে গিয়ে কথা বলল।
ও ঘরে গিয়ে? ওঃ! অসুখটা কী?…মনোভঙ্গ? ব্লাডপ্রেসার? স্ট্রোক?
অসমান পায়ে চলে যায় নিজের ঘরে।
মীনাক্ষী সেই দিকে তাকিয়ে থাকে। মীনাক্ষীর চোখের সেই ছায়াটা আরও নিবিড় হয়।
সে ঘৃণা গিয়ে পড়ে আর এক অন্তরালবর্তিনীর উপর।
বউ এসে গটগটিয়ে ঘরে গিয়ে ঢুকলেন। খোঁজও করলেন না ডাক্তার এসেছিল কোন প্রয়োজনে। বোধ করি তাঁরও পায়ের ঠিক নেই, আর সেটা ঢাকতেই তাড়াতাড়ি
অথচ ওই বউ আগে কী ভিজে বেড়ালটিই ছিল!
মীনাক্ষীর চিন্তা বর্তমানের সব কিছু থেকে সরে গিয়ে দাঁড়িয়ে পড়ল নীলাক্ষর বউ সুনন্দার সদ্যবধূজীবনের অধ্যায়খানার সামনে।…ভিজে বেড়াল, স্রেফ ভিজে বেড়াল, আস্তে আস্তে কথা, কথায় কথায় মাথায় ঘোমটা টানা, শাশুড়ি ননদের মনোরঞ্জনের চেষ্টায় তাদের পায়ে পায়ে ঘোরা! কত ভেক্!…আর মেয়েই বা কী ঘরের! মীনাক্ষী অজ্ঞাতসারেই নাকটা কোঁচকায়, সেই তো নেহাত গরিব গেরস্ত ঘর, মা এখনও কয়লাগুঁড়োয় গুল দেয়, ক্ষার কাঁচে। বাবারই বা কী ছিরি! গাঁইয়া বুড়ো, চটের থলি হাতে ঝুলিয়ে বাজার যাচ্ছেন, রেশন আনছেন। মায়ের অঙ্গে শেমিজ ব্লাউজ কদাচ ওঠে (মীনাক্ষীর মায়ের অঙ্গে যে সেই কদাচটিও ওঠে না, তা মনে পড়ে না মীনাক্ষীর। সুনন্দার মার চেহারাই মনে পড়ে তার)। রাতদিন লক্ষ্মী-ষষ্ঠী-ইতু-মনসা-ঘেঁটু-ভাদু নিয়ে পড়ে আছেন!..বউদিই বা কী? মীনাক্ষী ভাবে, সেও তো যখন এল, তখন কত কী ব্রতট্রত করত। বলেছিল, ধরা ব্রত চার বছর করতেই হয়, আর উদ্যাপনও করতে হয়, নইলে পতিত হয়।
সুনন্দার ওই বোকা বোকা সেকেলে সেকেলে কথা শুনে মীনাক্ষীরা দুই বোন হেসে কুটিকুটি হত। আর বলত, একটু বর্তমান হও বাবা, একেবারে অতীত যুগ হয়ে থেকো না।
তবু সুনন্দা এক বছর ধরে এয়ো সংক্রান্তি করেছিল। মাস শেষ হলেই যত এয়ো ধরে ধরে তাদের পা পুজো করতে বসত। কী সাজ তখন মহিলার! সোজাসুজি বাঙালি করে শাড়ি পরা, সিঁথি ভর্তি সিঁদুর, তেল জবজবে চুলে ইয়া এক খোঁপা বাঁধা, গলায় আবার বড় বড় মটর দানার মালা! এককথায় যেন গাঁইয়া নম্বর ওয়ান! দাদা যদি কোথাও বেড়াতে নিয়ে যেতে চাইত, কি সিনেমা যেতে চাইত, ভয়ে লজ্জায় একেবারে দিশেহারা। বলা হত, একলা যাব কি? ঠাকুরঝিরাও চলুক না।
ঠাকুরঝি!ননদদের ঠাকুরঝি বলত সুনন্দা। মীনাক্ষীরাই হেসে ঠাট্টা করে সে ডাক ছাড়িয়েছে। দিদি বলেছে, দাদার সঙ্গে একা যেতে তোমার ভয়? কেন? পরপুরুষ নাকি? সেই মেয়ের পেটে পেটে এত ছিল। উঃ!
দিদিই তো বলতে গেলে ওকে সাজসজ্জায় মানুষ নামের যোগ্য করে তুলেছিল। আর এখন? এখন বেহেড দিদিটাও ওর সজ্জা দেখলে লজ্জা পায়। নেহাত পুলিশে ধরবার ভয়েই বোধ হয় বিবসনা হয়ে বেড়ায় না, সে ভয় না থাকলে তাও বেড়াত! আর কথাবার্তাই বা কী এখন! ইংরিজি বুকনি, মিহি গলা, বেপরোয়া বোলচাল!..আগে দাদা বউকে একটু ফ্যাসানি করবার জন্যে মাথা খুঁড়েছে, এখন বোধহয় বউয়ের কায়দাকানুন দেখে মাথা খুঁড়ছে। এঁয়োপোকা থেকে যে প্রজাপতি হতে পারে, বউদিই তার একটি জ্বলন্ত উদাহরণ! তার মানে ভিতরে ভিতরে ছিল সব, ওপরে দেখাত ওই ধড়িবাজি। শুনতে পাই দাদার ব্যবসার উন্নতির কারণই নাকি সুন্দরী স্ত্রী। কে জানে স্বভাব চরিত্রই বা—
এখানে থামে মীনাক্ষী। অর্থাৎ ভাবনাটাকে থামায়। ভাবে, যাকগে আমার কি? দাদাই বুঝবে। তবে ভোলটা ফিরিয়েছে বটে এ বাড়ির বউ। এত যে তটস্থ থাকত বাবা বাবা করে, এখন তো সে বাবার ছায়াও মাড়ায় না। আর শাশুড়ি-ননদদের সঙ্গে যদি কথা কইল তো ব্যঙ্গের সুরে ভিন্ন নয়। এ সংসারের সবাই যেন উপহাসের পাত্র।
মানুষ কত বদলাতেই পারে। বিশেষ করে মেয়েমানুষ! মীনাক্ষী নড়েচড়ে বসে। ভাবে, অবশ্য সব মেয়েমানুষ নয়। যাদের মধ্যে বস্তু নেই তারাই পারে দেবী থেকে দানবী হতে, শুয়োপোকা থেকে প্রজাপতি হতে। এটা ঠিক, দাদাই দিয়েছে আশকারা। দাদাই করেছে এটি, কিন্তু করলেই তাই করবি তুই?
নিজের একটা সত্তা নেই? এবাড়ির প্রজাপতি হয়ে ওঠা বউয়ের বিরুদ্ধে চিন্তা করতে করতে নিজের কথা ভুলে যায় মীনাক্ষী। ভুলে যায় দিবাকর নামের একটা দাঁতাল প্রাণী তার সত্তাকে কীভাবে নিঃশেষে গ্রাস করতে বসেছে।
.
বাইরের সাজসজ্জা খুলে ফেলে, শুধু একটা টাইটবডি আর পেটিকোট পরে ঘরের মধ্যে ঘুরে বেড়াচ্ছিল সুনন্দা। চুলটাকে রাতের উপযুক্ত করে টেনেটুনে একটা বেণী বাঁধছিল, ঘষে ঘষে ক্রিম মাখছিল সর্বাঙ্গে। নীলাক্ষ ভোম্বলের মতো পড়ে ছিল বিছানায়।
দরজার বাইরে একটা মৃদুকণ্ঠের আওয়াজ শোনা গেল, সুনন্দা গালে ক্রিম ঘষতে ঘষতেই পরদাটা সরিয়ে বলল,আমরা আজ আর খাব না, খেয়ে এসেছি।
বলে ফিরে এল আবার। ক্রিমের শিশিটার গহ্বর প্রায় শূন্য করে বাহুমূলে লাগাল মোটা আঙুলের পোঁচড়ায়, শিশির ঢাকনি বন্ধ করল, আবার ডলবে ভাল করে।
নীলাক্ষ উঠে বসে ভুরু কুঁচকে বলল,কে কথা বলল?
সুনন্দা তাচ্ছিল্যের গলায় বলল,নিতাই জিজ্ঞেস করতে এসেছিল, এখন খাব কি না। বলে দিলাম খাব না।
নীলাক্ষ বিরক্তির গলায় বলে ওঠে, তুমি এভাবে বেরোলে তার সামনে?
সুনন্দা অবিচলিত ভঙ্গিতে বলে, ইস তাই তো! ভারী অন্যায় হয়ে গিয়েছে তো। ঘোমটা দেওয়া উচিত ছিল।
ঘোমটার কথা হচ্ছে না–নীলাক্ষ বিরক্তির গলায় বলে, চাকরবাকরদের সামনে একটা প্রেস্টিজ রাখা উচিত।
উচিত বুঝি? সুনন্দা ঘাড়ে গলায় মুঠো মুঠো পাউডার মাখতে মাখতে বলে, তোমার পা দুটোর গতিবিধি যেমনই হোক ব্রেনটা কিন্তু ঠিক জায়গায় আছে বলতে হবে। একেবারে কারেক্ট চলছে।
তার মানে?
মানে অতি প্রাঞ্জল। একটু ভেবে দেখলেই বুঝতে পারবে।
নীলাক্ষর বিরক্ত গলায় বলে, সভ্যতা শালীনতা বলে একটা জিনিস আছে।
সভ্যতা! শালীনতা! ওরে বাবা, এ যে ভাল ভাল বাংলা সাহিত্য-টাহিত্য করছ নাকি আজকাল?
আমাকে ডাউন করতে পেলে তো আর কিছু চাও না। কিন্তু আমার শালীনতার মাপকাঠিতে তোমার ব্যাপারটা মাপা চলে না?
সুনন্দা পাউডার ঘষা স্থগিত রেখে রাজহংসীর মতো ঘাড় বাঁকিয়ে বলে, চলে না কেন।
চলে না বলেই চলে না। নীলাক্ষ দুর্বল গলায় বলে, আমি যদি মদ খেয়ে খানায় পড়ে গড়াগড়ি দিই, লোকে বড়জোর হাসবে, কিন্তু
আমার ব্যাপারেও ওই একই কথা। সুনন্দা তার একটা পা খাটের উপর তুলে সুগঠিত সুন্দর গোছটায় ক্রিম ঘষতে ঘষতে বলে, তা ছাড়া আর কিছুনয়। লোক হাসবে, আর কি? কিন্তু হাসার কথাই বা উঠছে কেন? সুনন্দা পা বদলায়, তেমন দৃশ্য দেখলে লোকে বরং ধন্যি ধন্যি করবে।…বলবে, কী চমৎকার কুসংস্কারমুক্ত। কী প্রগতিশীল।
এতক্ষণে আলনা থেকে একটা শাড়ি টেনে নিয়ে জড়ায় সুনন্দা।
নীলাক্ষ বিরস গলায় বলে, তোমার কথাবার্তাগুলো ক্রমশই এত কটু হয়ে উঠছে
সুনন্দা হেসে ওঠে খিলখিলিয়ে। যে হাসিটা ও কিছুকাল ধরে রপ্ত করে করে শিখেছে। আর সেই হাসির গলাতেই বলে, তাইনাকি? কবে থেকে গো?কবে থেকে আমার কথা কটু লাগতে শুরু করল? মিসেস সিনহার সঙ্গে আলাপ হয়ে পর্যন্ত বুঝি?
মিসেস সিনহা। মিসেস সিনহা মানে? নীলা ঘোঁৎ ঘোঁৎ করে বলে, এর মধ্যে আবার থার্ড পার্টির কথা আসছে কোথা থেকে?
তৃতীয় ব্যক্তির আবির্ভাবেই তো দুজনের মাঝখানে কটু তিক্ত লবণাক্ত স্বাদের সৃষ্টি হয়।
পাখার রেগুলেটারটা শেষ পয়েন্ট অবধি ঠেলে দিয়ে সুনন্দা এবার বিছানার পাশে রাখা সোফাটায় হাত পা ছড়িয়ে বসে।
নীলাক্ষ আবার উঠে বসে, ক্রুদ্ধ গলায় বলে, তা বললে তো অনেক আগেই সেটা সৃষ্টি হতে পারত। মিস্টার মেহেরার সঙ্গে যেভাবে গা গড়িয়ে মেলামেশা করো তুমি, তাতে
কথা শেষ করতে পারে না নীলা, একখানা শার্সি ভেঙে পড়ে যেন। হ্যাঁ, সুনন্দা ওই কাভাঙা সুরের হাসিটা রীতিমত রপ্ত করেছে। সেই হাসির ঝাঁপটায় কথার শেষটা আর এগোয় না। হাসিটাই কথা হয়ে এগোয়, তাতে যে-কোনও স্বামীরই রক্ত টগবগিয়ে ফুটে উঠত, তাই না? তবে নেহাত না কি এক্ষেত্রে রক্তের বদলে বরফ জল, তাই আর ফুটে ওঠে না।
এই কটু তিক্ত লবণাক্তর উত্তরে কী বলত নীলাক্ষ কে জানে, কিন্তু উত্তর দেওয়া হল না। পরদার ওপিঠে বিজয়ার চাঁচা-ছোলা ধারালো গলাটি বেজে উঠল, ছ ঘণ্টা বউ নিয়ে বেড়িয়ে এসেও আবার ঘরে বসে বউয়ের সঙ্গে হাসি-মশকরা করছিস নীলে? গায়ে কি মানুষের চামড়া নেই তোর? এদিকে বাপ মরতে পড়েছে।
সুনন্দা সাড়া দেয় না, সুনন্দা শুধু উঠে বসে। সুনন্দার কপালটা একটু কুঁচকে যায়।
নীলাক্ষ দরজার কাছে এসে দাঁড়ায়। নীলাক্ষর বোধ করি নেশা ছুটে এসেছিল, তাই ঈষৎ অপ্রস্তুত গলায় বলে, এসেই তো বললাম ডাক্তার এসেছিল কেন? তা কা কস্য পরিবেদনা! কেউ জবাবই দিল না।
বাপ অজ্ঞান হয়ে পড়ে রয়েছে দেখতে পাসনি বুঝি? বিজয়ার কণ্ঠে জগতের ধিক্কার।
আড়ালে নীলাক্ষ অনেক কিছুই করে, এই সনাতন বাড়ির ছেলে হয়েও নীলাক্ষ মদ ধরেছে, বউকে নিয়ে বাইরে নাচাচ্ছে, তবু মায়ের তীব্রতার সামনে মুখোমুখি দাঁড়ালেই নীলাক্ষ যেন কেমন অসহায়তা বোধ করে।
আর তীব্র তো বিজয়া সব সময়।
আত্মসম্মান বোধের মাপকাঠি বিজয়ার সরোজাক্ষর থেকে সম্পূর্ণ আলাদা। তাঁর মতে এ-যুগ ভালমানুষীর যুগ নয়, ভদ্রতার যুগ নয়। তোমার ভদ্রতায় অন্যে ভদ্র হবে, এ আশা বাতুলের আশা। বরং সেই ভদ্রতার সুযোগটা নেবে সে আঠারো আনা। তবে ভদ্রতায় লাভ?
লাভের জন্যে ভদ্রতা নয়, ভদ্রতার জন্যেই ভদ্রতা–সরোজাক্ষর এ মতবাদে বিশ্বাসী নন বিজয়া। তিনি বলেন, আর কিছু না হোক, দুকথা শুনিয়ে নেবার সুখটাই বা ছাড়ি কেন? যাচ্ছেতাই করে শুনিয়ে আমি দেবই সবাইকে। মেয়ে জামাই ছেলে বউ আত্মীয় বন্ধু কাউকে ছেড়ে কথা কইব না। হক কথা কইব, ভয়টা কাকে?
বিজয়ার শুনিয়ে দেবার বদলে অপর পক্ষও শুনিয়ে দিলে, আরও গলা তুলবেন তিনি, আর শেষ অবধি বিজয়িনীর গৌরব নিয়েই ফিরবেন।
নীলাক্ষ বলে, দেখতে পাব না কেন? তা তোমার ছোট কন্যে তো কথাই কইল না, বুঝব কেমন করে কী হয়েছে?
হয়েছে ব্লাডপ্রেসার বৃদ্ধি। বিজয়া কেমন নিষ্ঠুর গলায় বলেন, স্ট্রোক হতে হতে হয়নি এই আর কি! তবে ধরনটা তাই।
নীলাক্ষর কণ্ঠস্বরে নেশার আভাস বিদ্যমান, তবে কথার মধ্যে যুক্তির অভাব নেই। মার কথার উত্তরে বলে, হলেও আশ্চর্য হবার কিছু ছিল না। কলেজেই স্ট্রোক হতে পারত। বাবার মতন লোককে দিয়ে অ্যাপো-ইয়ে, ক্ষমা চাইয়ে নিয়েছে, সোজা কথা!
বিজয়া ভুরু কুঁচকে তাকান, কী চাইয়ে নিয়েছে?
ক্ষমা! স্রেফ হাতজোড় করিয়ে
কে? বিজয়া অবাক হন, কে চাইয়ে নিয়েছে?
কেন, বাবার সাধের ছাত্ররা। ঘেরাও করে ধরেছিল। ক্ষমাটি না চাইলে ওইখানেই গুম করে রেখে দিত।
বিজয়া এবার স্থির গলায় বলেন, এসব কথা কখন হল, কই উনি তো
আরে বাবা, নিজে মুখে কি আর বলবেন উনি?না, বলেন কিছু কখনও?–শুনলাম আমার শালার মুখে। তার শালীর ছেলে পড়ে ওখানে, সে এসে গল্প করে গেছে। করবেই তো, এমন একটা মজাদার গল্প! তবে কী আশ্চর্য যে সুমতি হয়েছিল, ক্ষমা চেয়েছিলেন, জেদ করলে ব্যাপার গুরুতর হয়ে উঠত।
বিজয়া ক্রুদ্ধগলায় বলেন, তা কারণটা কী ঘটল? খামোকা
কারণ আর কি!নীলাক্ষ অলস গলায় বলে, মধ্যযুগীয় জমিদারের মনোভাব। মনে করছেন ছাত্ররা সবাই ওঁর প্রজা, তাই মেজাজ দেখিয়ে বসেছেন। আরে বাবা, মেজাজ দেখাবার যুগ যে আর নেই, সেটা খেয়াল করবে তো?
যুগ থাকবেনা কেন, খুব আছে। বিজয়া ঝংকার দিয়ে বলে ওঠেন, যুগ-মাহাত্ম্যে মেজাজ দেখাবার অধিকারটা রাজা থেকে প্রজায় বর্তেছে এই যা! তা নইলে ঘরের বউ সন্ধে না হতেই ধেই ধেই করে বেরিয়ে যাচ্ছেন, রাত দুপুরে বাড়ি ফিরছেন, ফিরে এসে পালঙ্কে অঙ্গ ঢেলে দাস-দাসীকে হুকুম করছেন, আর বুড়ো শাশুড়ি সংসার নিয়ে মরছে? যুগমাহাত্ম্যর গুণেই তরে যাচ্ছে এসব। বলতে গেলেই। মেজাজ
এবার দরজার কাছে আর একটি মূর্তির ছায়া পড়ে, এবং খুব শান্তগলার একটু কথা শোনা যায়। সংসারের জ্বালা কি সিঁড়ি ভেঙে তিনতলা পর্যন্ত পৌঁছতে পারে মা?
বিজয়া ছটফটিয়ে ওঠেন এই শান্তকণ্ঠের দাহে। যদি গলা তুলে ঝগড়া করতে আসত তাঁর সঙ্গে, তা হলে যেন মর্যাদা বজায় থাকত তাঁর, তিনিও তার উপর গলা তুলে বিজয়িনী হতে পারতেন। কিন্তু এই শান্তভাষার যুদ্ধ যেন হাতিয়ার কেড়ে নেওয়া যুদ্ধ।
তাই যুদ্ধের অন্য পথ ধরলেন তিনি, কড়াগলায় বলে উঠলেন, হচ্ছিল মায়ে-ছেলেয় কথা। তুমি তার মধ্যে নাক গলাতে এলে কেন শুনি?
শুধু মায়ে-ছেলেয় কথা হলে অবশ্যই আসতাম না। ঘরের বউয়ের আচরণের কথা উঠল কি না—
বিজয়া হইচই করে তেড়ে ওঠেন, উঠবেই তো, একশোবার উঠবে। পাঁচঘণ্টা বেড়িয়ে এসে ঘরে ঢুকে অঙ্গ ঢাললে, শ্বশুর যে মরতে পড়েছে তা একবার তাকিয়েও দেখলে না। মুখ নেড়ে কথা বলতে লজ্জা করছে না তোমার?
শ্বশুরকে সুনন্দা ভালবাসে, শ্রদ্ধা করে, অসুস্থতার সংবাদে উদ্বিগ্ন হয়নি তা নয়। কিন্তু উদ্বেগ · প্রকাশের ধৃষ্টতা তার নেই, ধৃষ্টতা নেই শ্বশুরের শিয়রে গিয়ে বসবার। সরোজাক্ষর সামনে সাধ্যপক্ষে বেরোয় না আর সে। অর্থাৎ যতদিন থেকে মূর্তি বদলেছে তার।
কিন্তু এই মহিলাটিকে বরদাস্ত করা কঠিন। মানুষের মধ্যেকার কোমল বৃত্তিটুকুকে টেনে বার করে পায়ে দলে পিষে শেষ করে দেওয়াতেই আনন্দ ওঁর।
অতএব ওঁকে সুনন্দা ছেড়ে কথা কয় না। শুধু ভঙ্গিটা শান্ত আত্মস্থ। বাবার অসুখটা যে এত গুরুতর তা কী করে বোঝা যাবে বলুন? ভাবলাম তেমন হলে আপনি নিশ্চয় পুজো পাঠ ফেলে এসে কাছে বসতেন।
পুজো পাঠ ফেলে? কাছে এসে বসতাম? বিজয়া চেঁচিয়ে ওঠেন,তোমাদের কালের মতন শিক্ষা আমরা পাইনি বউমা! চব্বিশ ঘণ্টা স্বামীর অঙ্গে গা ঘেঁষাঘেঁষিরও অভ্যেস নেই, রোগ হলে ডাক্তার ডাকতে হয় তাই জানি, ঠাকুর-দেবতার কাছে কেঁদে পড়তে হয় তাই জানি, শিয়রে গিয়ে না বসলে যে কর্তব্য হয় না তা জানি না। তবে তুমি ছেলের বউ হয়ে—
ও-ঘর থেকে উঠে আসে মীনাক্ষী, চাপা রাগের গলায় বলে, মা, তোমরা ভেবেছ কী? চিৎকারের চোটে যে ঘুমের ওষুধ খাওয়া ঘুমও ভেঙে যাচ্ছে। আশ্চর্য!
চলে যায় মীনাক্ষী বিরক্তি ছড়িয়ে।
বিজয়াও তিরতিরিয়ে সরে যান। সরোজাক্ষর জন্যে তিনি এই ফাঁকে অনেক মানত-টানত করে নিয়েছেন, আর ভয় নেই।
আর ভয়টা তো কমেও গেল নীলাক্ষর কথায়। রোগটা আকস্মিক আর অকারণ নয়। কারণ আছে। মানী মানুষ, অপমানটা বুকে বেজেছে। তাই বে-এক্তার হয়ে গেছেন হঠাৎ।
কিন্তু বিজয়া এতে যেন রীতিমত একটা উল্লাস অনুভব করছেন। অদৃশ্য প্রতিপক্ষকে দাঁড় করিয়ে বলে চলেছেন তিনি। দেখে বোঝো, অপমান জিনিসটার জ্বালা কত! জীবনভর এই একটা মেয়েমানুষকে অপমানই করে গেলে, তাকিয়ে দেখলে না তার কতটা লাগে।
তার শান্তি একটু পেতে হবে বইকী, ভগবান কি নেই?
খুব যে বলা হত, মানটা বজায় রাখা নিজের হাতে, রাখতে জানলে কারও সাধ্য নেই সেটা কেড়ে নেয়। এখন?
এখন বোঝো? অদৃশ্য সেই প্রতিপক্ষ উত্তর করে না। তবু বলেই চলেন বিজয়া মনে মনে।
মীনাক্ষী আবার বাবার ঘরে গিয়ে বসে। ৪০
আর ভাবতে থাকে বাবার এই অসুস্থ হয়ে পড়ার কারণ কি শুধুই বাবার ছাত্রদের ঔদ্ধত্য, অসভ্যতা, দুর্বিনয়?
বাবার সন্তানদের ব্যবহার একেবারে নম্র সভ্য বিনীত? এবং বাবা স্ত্রীরও তাই?
মীনাক্ষীর চিন্তা যেন একটা ঘড়ির পেণ্ডুলামে বাঁধা পড়েছে, তাই সে একবার দক্ষিণে হেলে, একবার বামে। দক্ষিণের দাক্ষিণ্য নিয়ে ভাবে বাবার মতো চরিত্রের লোকের পক্ষে এ চাপটা বাস্তবিকই দুঃসহ। ঘরে বাইরে এই অসভ্য অস্ত্র উদ্ধত ব্যবহারের ভার বহন করতে করতে বাবার স্নায়ুরা সহনক্ষমতা হারিয়ে বসেছে।
আবার ক্ষণপরেই বাপের বিরূপতা নিয়ে ভাবতে বসে। কিন্তু ওঁরা কেন এই যুগকে স্পষ্ট প্রত্যক্ষ দৃষ্টিতে দেখবেন না? কেন এখনও বালির গাদায় মুখ গুঁজে বসে অতীত যুগের স্বপ্ন দেখবেন? কেন ওঁদের এখনও এত প্রত্যাশা, এত ভাবপ্রবণতা?
ভাবে, তবু মাথার মধ্যে একটা আর্তস্বর অনবরত ধাক্কা দিতে থাকে, বাইরে আজ হাতজোড় করে ক্ষমা চেয়ে এসেছি, এবার তোমাদের কাছেও তাই চাইছি, দয়া করে তুমি এ-ঘর থেকে যাও।
অর্থাৎ ঘর থেকে বেরিয়ে যাও।
ধাক্কাটা তখন অনুভবে আসেনি।
তখন মীনাক্ষীর মনের সঙ্গে শরীরটাও শক্ত হয়ে গিয়েছিল। সেই শক্ত হয়ে যাওয়া শরীরটায় একটা। মোচড় দিয়ে বেরিয়ে আসছিল মীনাক্ষী, কিন্তু বেরিয়ে আসা হয়নি।
তার আগেই সরোজাক্ষর মাথাটা অসহায়ভাবে বুকের উপর ঝুঁকে পড়েছিল।
আর ঠিক সেই মুহূর্তে ভেবেছিল মীনাক্ষী,–অথচ আমি দিবাকরের কথা তুলিনি। কিন্তু তুলব বলেই ঘরে ঢুকেছিলাম।
সারদার বয়েসটা যে নেহাত কম তা নয়, কিন্তু আকৃতি এবং প্রকৃতি দুজনেই যেন ওকে মাঝপথে কোনও একখানে বসিয়ে রেখে কোথায় সরে পড়েছে।
সারদাকে দেখলে তাই মনে হয় যেন একটি চটপটে ছটফটে খটখটে যুবক, আর সারদার কথা শুনলে মনে হয়, কৈশোর এখনও অতিক্রম করেনি।
ওষুধ নিয়ে যখন ফিরছিল সারদা, তখন তার হাঁটার ভঙ্গি দেখে মনে হতে পারত দৌড়ের রেস দিচ্ছে। কিন্তু বাড়িতে ঢোকার সঙ্গে সঙ্গে ভয়ানক শান্ত হয়ে গেল। সন্তর্পণে সিঁড়িতে উঠতে লাগল জুতো খুলে পা টিপে টিপে।
নিতাই খাবার কথা জিজ্ঞেস করে ধমক খেয়েছে। বাড়ির কর্তা মুখের খাবার ফেলে বিছানা নিয়েছে, আর বাড়ির অন্য সদস্যরা খাবে, এর চাইতে নির্লজ্জতা আর কী হতে পারে জানা নেই সারদার। সেই নির্লজ্জতার প্রশ্ন নিয়ে সামনে দাঁড়িয়ে ছিল নিতাই। অতএব ধমক খাবে, এটা স্বাভাবিক।
তবে ধমকটা উচ্চারিত হল খুব চাপা গলায়। খাওয়া? খাওয়ার কথা জিজ্ঞেস করছ? লজ্জা করল না? সব রান্না টান মেরে ফেলে দাও গে–।
এই বলে আবার উঠে যায় নিঃশব্দে, হাতের ওষুধগুলো নামিয়ে রাখে টেবিলে। যার সামনে বসে মীনাক্ষী নিদ্রায় গভীর, আর যেন অপরিচিত একটা মুখের দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে ভাবছিল, অথচ আমি দিবাকরের কথা তুলিনি।…
ভেবেছিলাম আজ একটা হেস্তনেস্ত করে ফেলব। হল না। সরোজাক্ষ হঠাৎ শরীরের ভারসাম্য হারিয়ে ফেললেন বলেই কি বলা হল না?
সরোজাক্ষ সুস্থ সবল হয়ে বসে শুনলেই কি বলা হত?
হত না।
অনুভব করল মীনাক্ষী। আর মনে মনে বলল, দিবাকর ঠিকই বলে, আমি ভীরু আমি ভীরু। কিন্তু আমাকে সাহসী হতে হবে।
.
কমনরুমে জোর আড্ডা চলছিল।
নাঃ ঠিক আড্ডা নয়, বরং বললে ঠিক হবে বিতর্ক। বিষয়বস্তু প্রফেসর মৈত্র।
গতকালকার ঘেরাও ঘটনা নিয়ে আলোচনা-সমালোচনা এবং উত্তেজনার ঝড় বইছে। ঘটনাটার প্রস্তুতিপর্বেই ছাত্রদের মধ্যে দুটো দল হয়ে গিয়েছিল, কাজেই এখন চলছে দুই শিবিরের বাকযুদ্ধ।
অবশ্য ছাত্রদের এই দলবিভেদটা যে কেবলমাত্র তাদের অধ্যাপকের লাঞ্ছনাকে ঘিরেই ঘটেছে তা নয়, এমনিতেই রাজনৈতিক মতবাদের পার্থক্যে তারা বহু শিবিরে বিভক্ত।
বামপন্থী, দক্ষিণপন্থী, বাম-দক্ষিণ পন্থী, দক্ষিণ বাম পন্থী এবং বাম-উগ্র বাম, দক্ষিণ-উগ্র দক্ষিণ, বামেতর দক্ষিণ বা দক্ষিণেতর বাম ইত্যাদি নানা সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম শাখায় বিচরণ তাদের।
তারা কেউ কারও সঙ্গে পানভোজন করে না, কেউ কারও সঙ্গে খেলাধুলা করে না এবং একে অপরের শুধু অস্পৃশ্যই নয়, ব্যঙ্গের পাত্র, করুণার পাত্র, অবজ্ঞার পাত্র।
আবার ওরই মধ্যে যারা বেশি বলবান গোষ্ঠী, তারা দুর্বল পক্ষকে ভয় দেখিয়ে দলভুক্ত করবার চেষ্টাতেও দ্বিধা করে না।
স্বাভাবিকই।
আমার মতবাদে যে আস্থাশীল নয়, সে আবার মানুষ নামের যোগ্য নাকি? এই তো মনোভাব মানুষের। অতএব হয় তাকে স্বমতে এনে মনুষ্য পদবাচ্য করে তুলব,নয় তাকে ঘৃণা করব, অবজ্ঞা করব, করুণা করব।
বন্ধুত্ব?
কদাচ না।
আমার দলে না ভিড়লে আবার বন্ধুত্ব কীসের? বন্ধুত্ব করব তুমি একটি সুন্দর হৃদয় ঐশ্বর্যের ঐশ্বর্যবান বলে? ধুত্তোরি রাবিশ! হৃদয় আবার একটা বস্তু নাকি? হৃদয়ে হৃদয়ে বন্ধুত্ব, ওসব হেঁদো কথায় আর বিশ্বাস করে না এ যুগ।
এ যুগ জানে বন্ধুত্ব সম্ভব কেবলমাত্র মতবাদে মতবাদে। বন্ধুত্ব সম্ভব শুধু একই শিবিরের ছায়ায়। সেখানে হৃদয় বস্তুটা হাস্যকর।
তা এরা সেই এক শিবিরেরই লোক–অসিত, দিলীপ, অনিল, কুমারেশ, বিমল, শিবেন্দু, অবনীশ, ইন্দ্রজিৎ, পরাশর এবং আরও অনেকে। সম্প্রতি প্রফেসর মৈত্রকে কেন্দ্র করে ওদের মধ্যেও দলবিভেদ ঘটে গেছে। আবার আর একটি শিবির বেড়ে গেছে।
এদের এক পক্ষ গতকালকার ঘটনায় লজ্জিত দুঃখিত মর্মাহত, অপর পক্ষ উল্লসিত, উচ্ছ্বসিত, বীরত্বে গর্বিত।
ছেলেবেলায় স্কুলে থাকাকালীন অবস্থাতে এ পদ্ধতি ছিল তাদের। কোনও এক ছেলের সঙ্গে কোনও এক ছেলের ঝগড়া হলেই চটপট দুটো দল গড়ে উঠত, যার নাম গ্যাঙ। একটা গ্যাঙ একটা ছেলেকে সমর্থন করত, অপর গ্যাঙ অপর ছেলেকে। বলা বাহুল্য কলহ অনলকে অতএব জইয়ে রাখত তারা নিজ নিজ দুষ্টুমির ইন্ধনে। যাদের মধ্যে বিবাদ, তারা পরস্পরে অনুতপ্ত হলেও, ঝগড়া মিটিয়ে নেবার উপায়টি আর থাকত না তাদের নিজের হাতে।
এখন এরা নিজেদেরকে আর গ্যাঙ নামে অভিহিত করে না বটে, তবে মনোভাবটার পরিবর্তন ঘটেনি।
পরিবেশ অন্য, সহপাঠীরা অন্য, কারণও অন্য, কিন্তু মনোভাব অপরিবর্তিত। তাই এক পক্ষ যখন বলে, কালকের কাজটা ভাল হয়নি, অপর পক্ষ তখন বলে, আরে রেখে দিন মশাই আপনাদের মেয়েলিপনা। ঠিক কাজ হয়েছে। মুখের মতো জুতো হয়েছে, কুকুরের উপযুক্ত মুগুর।… শা-কে যা টাইট দেওয়া হয়েছে, ভবিষ্যতে আর ট্যাঁ-ফোঁকরতে হবেনা। শা–ঘুঘু দেখেছে ফাঁদ দেখেনি। এবার বুঝবেন বাছাধন, সাপের ল্যাজে পা দেওয়ার ফলটা কী!
অতঃপর তর্ক উদ্দাম।
এভাবে কথা বলা নিজেদেরই সভ্যতা নষ্ট করা।
ও হো হো তাই নাকি? চুক চুক। এটা বাইবেলের কোন অধ্যায় ব্রাদার?
সে আপনারা যাই বলুন, আমি বলব, প্রফেসর মৈত্র সত্যিকার ভাল লোক।
ভাল লোক!ভাল শব্দটার ধাতুরূপ কী মাইরি? লোকটা একটা পেঁতি বুর্জোয়া, বুঝলেন? স্রেফ একটা পেঁতি বুর্জোয়া। আবার গাড়ি চড়ে কলেজে আসা হয়। মাইনে তো টুটু কোম্পানি, তাতে সংসার চালিয়ে গাড়ি চালানো যায়? হুঁ! অন্য আয় আছে বুঝলেন?
সেটা ওঁর ব্যক্তিগত ব্যাপার। কিন্তু নিশ্চয় বলব পড়ানোর ব্যাপারে ওঁর তুল্য আর একজনও নেই। সবাই তো ফাঁকিবাজের রাজা। তাদের মুখ্য বিজনেস খাতা দেখা আর টিউশানি করা। ক্লাস নেওয়াটা গৌণ। সাইড বিজনেস।
কিন্তু প্রফেসর মৈত্রের
আরে বাবা ক্যাপাসিটি থাকলে তো? ওই পড়ানোটুকু পর্যন্তই ক্ষমতার সীমা।
তা আমাদের সেটাই দরকার।
হতে পারে। তবে একটু ভাল পড়ায় বলে ধরাকে সরা দেখবে? হাতে মাথা কাটবে? গেট আউট বলবে? অত কীসের? ব্যস, দিয়ে দেওয়া গেল একটু টাইট। আর বলতে হবে না কিছু। মাথাটি হেঁট করে এসো, মাথাটি হেঁট করে চলে যাও, ব্যস! ওসব মধ্যযুগীয় জমিদারের মনোভাব নিয়ে বাঘের বাচ্চা চরাতে আসা চলবে না বাছাধন। স্টুডেন্টরা তোমার খাস তালুকের প্রজা নয়।
অপর পক্ষে প্রতিবাদ ওঠে, এটা আপনাদের বাড়াবাড়ি হচ্ছে। উনি মোটেই ও ধরনের নন।
কী হল মশাই? মৈত্র কি আপনাদের উকিল রেখেছে? উনি কী ধরনের, আপনার থেকে আমি ভাল জানি। একদিন ও এই শিবেন্দুর হাত থেকে একটা বই নিয়ে ছিঁড়ে ফেলেছিল তা জানেন?
ছিড়ে ফেলেছিলেন? বই? কী বই?
নামটা ঘোড়ার ডিমের মনে নেই। একটু ইয়ের ব্যাপার আর কি সাদা বাংলায় বলি মশাই একখানি কড়া সেক্সের বই। বহু চেষ্টায় জোগাড় করেছিল বেচারা
তা সেখানি ক্লাসে এনে প্রফেসরের নাকের সামনে না পড়লে চলত না?
হঠাৎ ও পক্ষ থেকে সমবেত একটি হাস্যধ্বনি ওঠে। হাস্যরোলই।
সদাচার সমিতিতে নাম লেখান গে মশাই, সেটাই আপনাদের উপযুক্ত জায়গা
ঠাট্টা করুন। তবু বলব এভাবে শিক্ষককে অপমান করার মধ্যে নিজেদেরও কোনও মর্যাদা নেই। আমরা যদি আমাদের মা বাপকে অপমান করতে বসি, সেটা আমাদেরই অসম্মানকর।
কথাটা সম্পূর্ণ শেষ হয় না-হয়, একটা হুক্কাহুয়া ধ্বনিতে চাপা পড়ে যায়। এরা তুলছে ওই শেয়ালডাক। এরা হেসে টেবিল চাপড়ে বলছে-আহা হা চুকচুক, দেশে কোথাও ধর্মযাজকের পোস্ট খালি নেই? চলে যান, চলে যান। সেটাই উপযুক্ত ক্ষেত্র আপনাদের।
তারপর নিজেদের বাহাদুরিতে উল্লসিত দল নানা জানোয়ারের ডাক ডাকতে শুরু করে, প্রতিপক্ষ ঘর থেকে বেরিয়ে যায়। তা ছাড়া আর কী করতে পারে? চিরদিনই বর্বরতার দাপটে সভ্যতা চাপা পড়ে যায়, চিৎকারের নীচে মৃদুতা।
ওদের চলে যাওয়া দেখে এরা আরও খানিক হইহই করে উঠল, তারপর আবার শুরু করল, আজ আর কলেজে আসেনি! হ্যাঁ, হ্যাঁ বোধহয় অপমানের জ্বালায় বাসায় গিয়ে মরে আছে। কদিন না এসে থাকবে জাদু? এখানেই যে ভাত জল।…বলে কিনা কাজটা ভাল হয়নি। ইঃ, খাশা হয়েছে। বেশ হয়েছে। উত্তম হয়েছে। ওই একজনের টাইটে আরও সবাই সায়েস্তা হয়ে যাবে।…হুঁ হুঁ, এ হচ্ছে বাবা সায়েস্তা খাঁর আমল।
আরও কিছু অর্থহীন অভব্য উক্তির প্রতিযোগিতা চালাতে থাকে ওরা। যেন যে যত নোংরা আর অমার্জিত কথা বলতে পারবে সে তত বাহাদুর। তার সঙ্গে অনুপান অশ্লীল হাসি।
অথচ এরা একটি বিশিষ্ট কলেজের ছাত্র, লেখাপড়ায় খারাপও নয় হয়তো, যখন শিল্প, সাহিত্য, সমাজনীতি বা রাজনীতি নিয়ে কথা বলে, মনে করা যেতে পারে বুদ্ধিমান চিন্তাশীল সর্বজ্ঞ।
কিন্তু কোনও একটা উপলক্ষে যদি একবার খুলে পড়ে উপরের খোলস, ভিতর থেকে বেরিয়ে আসে আদিম বর্বরতা। যে বর্বরতা শ্রদ্ধা সম্ভ্রম স্নেহ ভালবাসা রুচি আচরণ, সব কিছুকে নস্যাৎ করে দিয়ে একটা বন্য সুখে উল্লসিত হয়।
কে জানে, সত্যিই এদের ভিতরটা এইরকম অশালীন অপালিশ,না এটা শুধু যুগের ফ্যাশান। কোনও কিছুকে মূল্য দেব না এই ফ্যাশান নিয়ে এরা নিজেদেরকে নিরাবরণ করে উন্মত্ত নৃত্য করে।
ওরা ভাবছে ওরা খুব বাহাদুর, জানে না যুগ একথায় হাসে। জানে না ওরাই এ যুগের প্রধান বলি। যুগ ওদের নিয়ে ছিনিমিনি খেলছে, ওদের মধ্যে যা কিছু সুন্দর, যা কিছু শুভ তা নিঃশেষে নিষ্কাশিত করে দিয়ে ওদের সেই শুকনো চামড়াখানায় জয়ঢাক বাজাতে চাইছে।
যুগ ওদের দিয়ে নোংরা কথা বলাচ্ছে, নোংরা চিন্তা করাচ্ছে, ওদের চোখ থেকে সব রং কেড়ে নিচ্ছে, মন থেকে সব রস।
তাই ওরা নম্রতা, ভদ্রতা, শালীনতা, এইসব শব্দগুলোকে ওল্ড মডেল বলে হেসে ওঠে। প্রেম ভালবাসা এই শব্দগুলোকে ধিক্কার দেয়। গুরু এবং গুরুজনকে টাইট দিতে পারাটাকেই ওরা চরম আধুনিকতা ভাবে। ভাবে মানুষ নামের জীবটার যুগ-যুগান্তরের রুচির সভ্যতার আর সংস্কৃতির সাধনাকে মুছে ফেলে, তার কেবলমাত্র জৈবিক সত্তাটাকেই শেষকথা বলে ফতোয়া জারি করাটাই হচ্ছে আধুনিকতা।
চিরাচরিতকে উড়িয়ে দেবার চেষ্টায় এরা চিরন্তন আচার আচারণকে উড়িয়ে নিশ্চিহ্ন করতে চায়, আর ভাবে সেটাই আধুনিকতা। ওদের কাছে আধুনিকতার সংজ্ঞা এই। সাহস আর উদ্ধৃঙ্খলতা যে এক জিনিস নয়, সেটা ভেবে দেখে না।
অধ্যাপক প্রসঙ্গ স্তিমিত হয়ে গেলে ওরা হয়তো মডার্ন কবিতা বা মডার্ন আর্ট নিয়ে বিতর্ক সভা বসাবে এবং বোলচাল শুনে মনে হবে প্রত্যেকেই এরা এই মডার্ন রহস্যে ওয়াকিবহাল। ওদের চলনে বলনে সেই মাতব্বরি, ওদের ভাষার ছটায় সেই তীব্রতা।
কিন্তু এরাই কি সব?
নাঃ, এরাই সর নয়।
হয়তো এরা নিতান্তই সংখ্যালঘু।
তবু এরাই যেন আজ যুবসমাজের প্রতিনিধির ভূমিকা নিয়ে আসরে নেমেছে, এদের কণ্ঠ সোচ্চার। সেই উচ্চ চিৎকারে সংস্কৃতির ক্ষীণকণ্ঠ চাপা পড়ে যাচ্ছে। আশঙ্কা হচ্ছে ক্রমশ এরাই বুঝি সংখ্যাগরিষ্ঠ হয়ে উঠবে।
কারণ তীব্রতার একটা আকর্ষণ আছে, বলমত্ততার একটা প্রভাব আছে। আর–ভাল ছেলে নামের ধিক্কার বাণীটা বড় ভয়ংকর। তাতে ভাল ছেলেদের লজ্জায় দিশেহারা করে কোথায় না কোথায় নিয়ে যেতে পারে।
.
দিবাকর ভাল ছেলে নয়, দিবাকর বরং বন্যতার প্রতিমূর্তি। তাই দিবাকরের প্রেম, ভালবাসা, আসক্তি উগ্ৰ অসহিষ্ণু। তার মধ্যে স্নেহের স্বাদ নেই। তাই মীনাক্ষী নিজের বাড়ির দরজার মধ্যে ঢুকে গেলে। দিবাকর খানিকক্ষণ হিংস্র দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে। যেন মীনাক্ষীর ওই নিশ্চিন্ত আশ্রয়টুকু, ওই আরাম-আয়েস সুখ-স্বস্তিভরা গৃহকোণের অধিকারটুকু ছিঁড়েকুটে তছনছ করে দিতে পারলে ওর জ্বালা মেটে।
কারণ দিবাকরের ওসব নেই।
দিবাকর জানে এখান থেকে মোচড় খেয়ে ঠিকরে গিয়ে একটা বাসে চেপে পড়ে গন্তব্যস্থলে পৌঁছে যে দরজায় গিয়ে দাঁড়াবে ও, সেখানে ওর ভূমিকা দরজায় দাঁড়ানোরই। যে ঘরে গিয়ে ঢুকবে সেখানে দিবাকরের কোনও অধিকার নেই।
নিতান্তই গ্রাম-সম্পর্কের এক মামার অবহেলার আশ্রয়ে বাস দিবাকরের। দিবাকর জানে এখন গিয়ে সেই প্রাসাদতুল্য বাড়িটার নীচতলায় একখানা অন্ধকার-অন্ধকার ছোট্ট ঘরে গিয়ে ঢুকতে হবে তাকে। যে ঘরটার অর্ধাংশ দখল করে থাকে বাড়ির ঝাড়মোছকরা চাকর নবীন।
ঘরটা রান্নাঘর ভাঁড়ারঘর আর খুঁটে কয়লার ঘরের মাঝামাঝি কোনও একখানে। বাইরের আলো-হাওয়ার প্রবেশপথ বলতে একটিমাত্র সংকীর্ণ জানলা আছে গলিপথের দিকে। নবীনের শোয়ার চৌকিটা সেই জানলার নীচে। অতএব দিবাকরের ঠাঁই গুমোট দেয়ালের দিকে।
দিবাকরের সেই চৌকির গা ঘেঁষেই দেয়ালের গায়ে টানা লম্বা একটা দড়ি টাঙানো, যেমন ও দেয়ালে নবীনের। নবীনের দড়িতে নবীনের জামা পায়জামা ধুতি শার্ট গেঞ্জি গামছা, দিবাকরের দড়িতে দিবাকরের প্যান্ট বুশশার্ট লুঙ্গি তোয়ালে গেঞ্জি।
নবীনের মাথার কাছের দেয়াল-আলমারিতে নবীনের গোলাপ ফুল আঁকা টিনের সুটকেস, ক্যালেন্ডার থেকে সংগৃহীত নানা দেবদেবী ও সিনেমা স্টারের ছবি, বড় সাইজের একখানি আরশি, প্লাস্টিকের চিরুনি, কুন্তল বাহার তেলের শিশি, মলয় সাবান, রেণু পাউডার, আর গোছভর্তি দাঁতন কাঠি।
দিবাকরের মাথার কাছের দেয়াল-আলমারিতে দিবাকরের সস্তা ধরনের ঢাউশমার্কা নকল চামড়ার সুটকেসটা ধরে না বলে, সুটকেসটা ওর চৌকির নীচে ঢোকানো আছে। দিবাকর সেটাকে সর্বদা তালা দিয়ে বন্ধ করে রাখে এবং যখন-তখন তালা খুলে উলটেপালটে সন্দিগ্ধদৃষ্টিতে হিসেব মিলোতে বসে সব ঠিক আছে না চুরি গেছে।
আলমারির তাকে দিবাকরের নবীনের থেকেও সস্তামাকা আরশি চিরুনি তেল সাবান মাজন শেভিংসেট। আর আছে পাঠ্যপুস্তক ও খাতা কলম, পার্থক্য শুধু এই।
দিবাকর এখন গিয়ে পরনের শার্ট ট্রাউজার সাবধানে ভাঁজ করে দড়ির আলনায় তুলে রেখে লুঙ্গিটা জড়িয়ে বেজার মুখে নিজের চিরশ্যা পাতা চৌকিটায় গিয়ে বসে কিছুক্ষণ হাতপাখা চালিয়ে গায়ের ঘাম শুকিয়ে নিয়ে তারপর উঠোনের ধারের চৌবাচ্চাটার কাছে গিয়ে উঁকি মারবে। যদি দেখে কিছু কিঞ্চিৎ জল আছে, মুখের পেশিগুলো তার একটু ছড়িয়ে পড়বে। উলটোটা হলে সেই পেশিগুলো আরও গুটিয়ে যাবে, মুখটা ঝামা ইটের চেহারা নেবে–মগ ঠুকে ঠুকে কোনওরকমে একটু স্নান সেরে যখন ঘরে এসে কুচি কুচি করে ছাঁটা চুলগুলো ঝেড়ে আঁচড়াবে দিবাকর, তখনও সেই চেহারাটাই বজায় থেকে যাবে। ঝামা ইটের চেহারা।
বরং আরও বেড়েই যাবে মুখের সেই ঝামাত্ব, দোতলা তিনতলার আলো-ঝলমলে ঘর-বারান্দাগুলোর চেহারা স্মরণ করে।
ওই ওপরতলাগুলোকে চোখে দেখবার সুযোগ তার মাঝে মাঝে হয়, মামি কখনও কখনও কোনও কূট ফরমাশে ডাকেন। বলেন, নবীনের দ্বারা এসব তো হবে না, বিষ্ণুটাও তেমনি বুন্ধু। তুমি এটা করো দিকি।
কদাচ তুমি ছাড়া তুই বলেন না মামি, নিকটতম স্নেহ সম্বোধনে আত্মীয় সম্পর্কটাকে প্রতিষ্ঠিত করবার ইচ্ছে তাঁর নেই বলেই মনে হয়।
দিবাকর মামির ঘরে গিয়ে দরজার কাছে দাঁড়িয়ে থাকে, মামি হয়তো কিছু কেনবার জন্যে টাকা দেন, হয়তো কোনও একটা ঠিকানা আর বাসভাড়া। কোনও খবর আনতে হবে, কি কোনও খবর পৌঁছতে হবে।
হয়তো তেমন আদেশ দিবাকরের পরীক্ষার দিনও আসতে পারে। দিবাকরের সাহস হয় না সে কথা উল্লেখ করবার। কারণ এখানেই ওই নবীনের ঘরের অর্ধাংশের আশ্রয়টুকু ও দুবেলার নিশ্চিত অন্নের নিশ্চিন্ততাটুকু এই মামিরই বদান্যতায়।
প্রথম যখন দিবাকর দেশ থেকে এসে দূরতম মামা সম্পর্কের ভরসাটুকু সম্বল করে এই বড় বাড়ির দরজায় দাঁড়িয়েছিল, মামা প্রকাশ মণ্ডল তো প্রায় সেই দরজা থেকেই বিতাড়িত করেছিলেন, এখানে জায়গা কোথায় বলে।
মামিই দয়ার গলায় বলেছিলেন, তা ও তো তোমার, ওপরতলায় ওঠবার বায়না করছে না গো, নবীনের ঘরের একপাশে একখানা চৌকি পেতে পড়ে থাকবে। থাকার অভাবে গরিবের ছেলের নেকাপড়াটা হবে না!
প্রকাশ মণ্ডল বেজার গলায় বলেছিলেন,আত্মীয় সম্পর্কটা হচ্ছে বিষধর সর্পের মতো বুঝলে? দুধকলা দিয়ে পুষেছ কি মরেছ।
মামি আরও দয়ার গলায় বলেছিলেন,দুধকলার বায়না আবার কে করছে গো? সাপ্টা হেঁসেলের দুটো ডালভাত গুড়-রুটি খাবে, নিজের দিন কিনে নেবে, হয়ে গেল ব্যস। না না, তুমি অমত কোরো না, তোমার ঘরে মা-লক্ষ্মী হেলাফেলা। একটা পেট বই তো নয়।
সেদিন সেই বহু আড়ম্বরপূর্ণ ঘরে পালঙ্কোপবিষ্টা অষ্টালঙ্কারভূষিতা এই মহিলাটিকে দেবীসদৃশ মনে হয়েছিল দিবাকরের, কারণ দিবাকর তখন ভয়ংকর একটা উচ্চাশা নিয়ে দেশ থেকে চলে এসেছিল সদ্য স্কুল ফাইনাল পাশ করে। হোস্টেলে থেকে পড়বে এমন সামর্থ্য নেই। দাদারা বিরক্তচিত্তে মাত্র পড়ার খরচাটা পাঠাবার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল।
তা মামির করুণায় বাকিটা হয়ে গেল, কোথা থেকে যেন একটা পায়া নড়বড়ে চৌকি এসে গেল নবীনের ঘরে, মামির খাস ঝি অবলা এসে দাঁড়িয়ে ব্যবস্থা করে দিয়ে গেল কোন দিকে নবীনের জিনিসপত্র থাকবে, কোন দিকে দিবাকরের।
উনি নেকাপড়া করবে, জাঁল্লার দিকটা ওনার থাক- এ বিবেচনা প্রকাশ করেছিল অবলা। কিন্তু নবীনের কাঠকবুল প্রতিজ্ঞা জানলার ধারের অধিকার ছাড়বে না। কাজেই দেয়ালের দিকেই দিবাকর কায়েম হল।
বরাদ্দ হল সাপ্টা হেঁসেলের ডালভাত গুড়টি। যে হেঁসেলটার অধীনস্থ প্রজা হচ্ছে প্রকাশ মণ্ডলের দোকানের কর্মচারীকুলনবীন, বিষ্ণু প্রমুখ। অবলা খাস ঝি। অবলা এদের দলে নয়। কর্তা-গিন্নির হেঁসেলের তলানিতেই তার ভাল ব্যবস্থা হয়ে যায়।
তখন মামার একটা বছর চোদ্দর মেয়ে ছিল, যার নাম ব্রজবালা। মেয়েটা সম্পর্ক সূত্র শুনে দিবাকরকে দাদা বলতে শুরু করেছিল এবং বিশেষ একটু নেজরের বশে লুকিয়ে চুরিয়ে দিবাকরকে দুধটা মিষ্টিটা মাছটা ডিমটা সাপ্লাই করতে শুরু করেছিল, কিন্তু নবীনের বিশ্বাসঘাতকতায় লুকোচুরিটা প্রকাশ পেয়ে গেল। ঘরের ভাগ দিতে বাধ্য হওয়া পর্যন্ত নবীন দিবাকরের দিকে আক্রোশের দৃষ্টি ব্যতীত কদাচ সমীহর দৃষ্টিতে তাকায় না, এহেন সুবর্ণ সুযোগটা ছাড়ল না।
ফলস্বরূপ ব্রজবালার নীচে নামা বন্ধ হল, দিবাকরের সঙ্গে কথা বলা বন্ধ হল। মরুভূমির ওয়েসিসটুকু শুকোল।
তারপর তো ব্রজবালার বিয়েই হয়ে গেল।
এখন ব্রজবালা শ্বশুরবাড়ি থেকে আসে যায় সোনার ঝলক দিয়ে, কারণ তার শ্বশুর গুড়ের কারবারে অনেক লক্ষপতি। সেই সোনার ঝলসানিতে ব্রজবালারও বোধ করি মনে থাকে না দিবাকর নামে কেউ একটা থাকে এ বাড়িতে। দিবাকর রাগে ফোঁসে।
তবু মাথার উপর ছাদ।
কোলের গোড়ায় বাড়া ভাতের থালা।
তাই দিবাকর এখানেই পড়ে আছে।
পড়ে থাকার আর একটা সুবিধে, বাইরে থেকে এসে ঢোকে তো মস্ত দেউড়িটা ঠেলে। সাবান কেচে ইস্ত্রি করে বহু কষ্টে ফিটফাট করা পোশাকটি পরে যখন বেরোয় কলেজের বই খাতা নিয়ে, তখন তো বেরোয় সেই দেউড়িটা খুলে।
লোককে তো বলা যায় বিরাট মামার আদুরে ভাগ্নে। সেটাই কি কম পাওয়া। সেই আদরের চেহারাটা তো বন্ধুসমাজ দেখতে আসে না।
বাড়িতে কাউকে ডাকতে পারে না দিবাকর, কারণ মামা ছাত্রজীবনে আড্ডা দেওয়া পছন্দ করেন না।
এই বালির দুর্গে বাস দিবাকরের।
তাই ভিতরে তার এত দাহ।
তাই তার প্রেয়সী যখন নিজের পাথরের দুর্গে গিয়ে ঢোকে, আক্রোশের দৃষ্টিতে তাকিয়ে দেখে সে।
সকালবেলা ছেড়ে রেখে যাওয়া লুঙ্গিটা পরে হাতপাখা নাড়তে নাড়তে আর এক আক্রোশের মনোভাব নিয়ে দোতলার বারান্দার দিকে তাকিয়ে দেখছিল দিবাকর।
চকমিলানো ছাঁচের বাড়ি, নীচতলা থেকে ওপরতলার দিকে হাঁ করে তাকিয়ে থাকা যায়। থাকলে দেখতে পাওয়া যায় চড়া পাওয়ারের আলো জ্বালা, দেয়ালে রং করা, কেমন শনশন করে বিদ্যুৎ পাখা ঘুরে ঘুরে বাতাসের দাক্ষিণ্য বিতরণ করছে।
দোতলায়, তিনতলায়।
দোতলাটা মামা-মামির মন্দির, তিনতলাটা মামির ভাই-ভাজের। সমান রাজকীয়। অথচ ওরাও আশ্রিত–ভাবল দিবাকর। অনেক বাড়তি জায়গা আছে উপরতলায়। ওদের ঘরের একাংশে গিয়ে বসলে আলাদা করে বিদ্যুৎ খরচ হবে এমন নয়।
তবু দিবাকরকে চাকরের ঘরের কোণে বসে ভাঙা হাতপাখায় বাতাস খেতে হয়!
দিবাকর তবে অন্নদাতা আর আশ্রয়দাতা বলে কী করে কৃতজ্ঞতায় বিগলিত হবে ওই প্রকাশ মণ্ডলের প্রতি?
দিবাকর কেন সর্বদা চিন্তা করবে না কী করে লোকটার অনিষ্ট সাধন করা যায়?
চিন্তা করে, কিন্তু সুযোগ নেই।
নির্বোধ ব্রজবালাটার ওপর দিয়ে সে আক্রোশ মিটিয়ে নেবার বাসনা ছিল, কিন্তু হয়ে ওঠেনি। ওই শয়তান নবীন, সর্বদা শ্যেনদৃষ্টি মেলে বসে থেকেছে, সুযোগের সুযোগ আসেনি।
তারপর তো ব্রজবালা ব্রজধামে গিয়ে প্রতিষ্ঠিত হল।
আজ নাকি এসেছে বরের সঙ্গে। প্রকাণ্ড গাড়ি চড়ে।
গাড়িটাই গেট থেকে সংবাদ বহন করছে। দেখলে বিষ ওঠে।
জামাইটা নাকি একটা পাশ করা। সেই গৌরবে গরবিনী মামি এমন ভাব করেন যেন জামাতা না দেবতা!
এই পৃথিবীতে থাকতে হয় দিবাকরকে।
বামুন ঠাকুর একটা পিতলের রেকাবি করে জলখাবার রেখে গেল। রুটি, একটুকরো বেগুন ভাজা, খানিকটা গুড়।
নবীনের সঙ্গে এইটুকু পার্থক্য দিবাকরের, নবীনের থেকে এইটুকু খাতির, জলখাবারটা ঘরে দিয়ে যায়। রান্নাঘরের দরজায় গিয়ে আবেদন করতে হয় না।
তবু ওই থালাটা দেখলেই যেন গা জ্বালা করে। কিন্তু ফেলে দেওয়ার সামর্থ্যও নেই। খিদের সময় অযাচিত পেয়ে যাওয়া গরম রুটির মূল্যই কি কম?
দেশের বাড়িতে এই বস্তুটাও তো দুর্লভ ছিল। খাবে খাও, মুড়ি চিড়ে খাও।
এখন আর দেশের বাড়িতে গিয়েও ভাল লাগে না দিবাকরের! এই কলকাতার মোহমদ নেশাচ্ছন্ন করে রেখেছে তাকে। থাক দৈন্য, হোক অপমানের ভাত, তবু তো জুটছে এই মদ।
কলকাতার আকাশে বাতাসে, প্রতিটি ধূলিকণায় মদিরাস্বাদ।
তাই যারা বছরের পর বছর ফুটপাথে পড়ে থাকে, স্টেশনের প্লাটফর্মে জন্ম মৃত্যু বিয়ের লীলায় লীলায়িত হয়ে জীবনযাত্রা নির্বাহ করে, যারা মানুষের চেহারা নিয়ে জানোয়ারের জীবনে নিমজ্জিত থাকতে বাধ্য হয়, তারাও পারে না কলকাতাকে ছেড়ে যেতে।
কলকাতা তার অক্টোপাশের বাহুতে বেঁধে রেখেছে সবাইকে।
দিবাকরও সেই বন্ধনে বাঁধা পড়ে গেছে।
দিবাকরের দাদারা বলেছিল, একটা পাশ করেছ, আর দুটো পাশ করে এসে গাঁয়ের ইস্কুলে মাস্টারি করো, নিজেরও ভাল গাঁয়েরও ভাল।
কিন্তু দিবাকর জানে গ্রামের জীবনে ফিরে যাওয়া আর সম্ভব নয় তার।
দিবাকর এই চার বছরেই কলকাতার রসে জারিত হয়ে গেছে। দিবাকর কলকাত্তাইদের সঙ্গে তাল দেবার চেষ্টায় এত জোরে দৌড় দিয়েছে যে, তাদের ছাড়িয়ে গেছে।
দিবাকর তাই তার নিগ্রো নিগ্রো চেহারা নিয়েও অধ্যাপকের মেয়ের চোখে হিরো।
.
চেহারাটার ওই বিশেষণ স্পষ্ট করে কানে এল।
খাওয়ার শেষে বেগুন ভাজার খোসাটাও মুখে পুরে তাড়াতাড়ি উঠোনের কলে জল খেতে যাচ্ছিল দিবাকর, (না, জলের গ্লাস দিয়ে যায় না ঠাকুর) দেখল সিঁড়ি দিয়ে জামাই নামছে। পিছু পিছু ব্রজবালা।
ব্রজবালার ধরন দেখে মনে হচ্ছে না সেও চলে যাবে। মনে হচ্ছে এবার থাকতে এসেছে। অতএব বরকে দরজা পর্যন্ত পৌঁছে দেবে। বিদুষী নয় বলে কি আপ-টু-ডেট হতে পারে না?
গদগদ হাসিতে বিগলিত হয়ে নামছে সিঁড়ি দিয়ে।
জল খাওয়া হল না, চট করে গলির দিকের প্যাসেজে ঢুকে পড়ল দিবাকর। আর সেই সময় পিছনে পটকা ফাটল।
কাফ্রি কাফ্রি দেখতে ওই ছোকরাটি তোমাদের কে বলল তো?
কাফ্রি কাফ্রি? ব্রজবালা ভুরু কুঁচকে বলে, দিবুদার কথা বলছ নাকি? ও মাগো, জানো তোমার ডবল বিদ্বান উনি।
তাই নাকি? আহা!
গুড়ের কারবারের ভবিষ্যৎ মালিক কণ্ঠে গুড়ের প্রলেপ বুলিয়ে বলে, তবে তো তোমার বাবার উচিত নয় ওঁকে চাকরের ঘরে থাকতে দেওয়া! যথাযোগ্য সম্মানে–
বাকি কথা শোনা গেল না। উঠোন পার হয়ে বাইরের দরজা দিয়ে বেরিয়ে গেল কম্পাউন্ডে। যেখানে গুড়ের কারবারির প্রকাণ্ড গাড়িখানা অপেক্ষা করছে।
জ্বলতে জ্বলতে ঘরে ফিরে এল দিবাকর জল খেতে ভুলে। আর সেই মুহূর্তে তার আগুনের ঢেলার মতো চোখ দুটোয় জ্বলে উঠল একটা রূঢ় সংকল্পের শিখা।
একটা নির্বোধ মেয়েকে নষ্ট করতে কত কাঠখড় পোড়াতে হয়?
কিছু না কিছু না।
বিবাহিতা?
পতিব্রতা সতী?
ফোঃ
ওসব কথাগুলোর কোনও মূল্য আছে নাকি?
বরং বিবাহিতাদের সাহস বেশি। দিবাকরের সে অভিজ্ঞতা আছে। স্কুলের পড়া সাঙ্গ করে আসবার আগেই সে অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করে এসেছে দিবাকর। রাঙাপিসির মেয়ে চামেলিদির কাছ থেকে। অবশ্য বয়েসটা তার তখন নিতান্ত স্কুল-জনোচিত ছিল না।
চামেলিদির শ্বশুরবাড়িতে জ্বালা, তাই চামেলিদি বাপের বাড়িতে বসে থাকে। বর আসে সপ্তাহে সপ্তাহে।
কিন্তু চামেলিদির ওই মুষ্টিভিক্ষায় পেট ভরে না। তাই চামেলিদি উঞ্ছবৃত্তি করে বেড়ায়। আর হেসে হেসে বলে, বিধবা নই, আইবুড়ো নই, ভয়টা কী?
অতএব বুঝতে বাকি থাকেনি দিবাকরের, ভয়ের বাসাটা আসলে কোথায়?
দিবাকর অভিজ্ঞতা অর্জন করেছে।
দিবাকর তার সেই চামেলিদিকে দিয়ে সব মেয়েকে বিচার করছে।
দিবাকর ফিরতি মুখে পথ আগলায়, বড়লোকের বাড়ি বিয়ে হয়ে ব্রজবালা যে আর গরিবদের দেখতেই পাও না!
ব্রজবালা হঠাৎ এই আক্রমণে থতমত খায়, অপ্রস্তুত গলায় বলে, বাঃ, দেখতে পাব না কেন?
কই আর পাও? আসো যাও, তাকিয়ে তাকিয়ে দেখি, তুমি তো ফিরেও চাও না।
আমি তো বেড়িয়েই চলে যাই, এসে থাকতে পাই না। এবারেই কিছুদিন
ব্রজবালা একটু রহস্যময় কটাক্ষ করে।
অর্থাৎ এবারে ব্যাপার আলাদা। এবারে কিছুদিন থাকবার অধিকার নিয়ে এসেছে।
দিবাকর এদিক ওদিক তাকিয়ে দেখে, নবীন নেই ধারেকাছে, কেউই নেই। চট করে ব্রজবালার গালটায় একটা টোকা দিয়ে নিচু গলায় বলে ওঠে,তাই নাকি? নতুন খবর?
ব্রজবালা রেগে ওঠে না।
ব্রজবালা লাল লাল মুখে বলে, আঃ অসভ্য!
দিবাকর একটা বেপরোয়া হাসি হেসে বলে, এইটুকুতেই অসভ্য? উঃ কী শুচিবাই! ক্লাসের মেয়েদের সঙ্গে যা চালাই দেখলে কী যে বলতে তুমি!
ব্রজবালা মাটির সঙ্গে আটকে যায়। ব্রজবালা বিস্ফারিত চোখে বলে, তোমাদের কেলাসে মেয়েমানুষও আছে নাকি?
তা নেই?
তাদের সঙ্গে তুমি এইসব ইয়ার্কি করো?
এইসব? দিবাকর তাচ্ছিল্যের গলায় বলে,আরও কত সব।
ধ্যেৎ।
ধ্যেৎ তো ধ্যেৎ।
এই দিবুদা সত্যি?
সত্যি না তো কি মিথ্যে বলছি? বিশ্বাস করো না করো তোমার ইচ্ছে। ব্র
জবালা হঠাৎ সতেজে বলে, ওইজন্যেই ও বলে লেখাপড়া শিখলে মেয়েমানুষ জাহান্নমে যায়।
ও মানে তোমার বর?
তবে না তো কী।
বলবেই তো৷ নিজে তো সে আস্বাদ পেল না কখনও।
আহা, ও কক্ষনও ওরকম নয়।
ভাল। না হলেই ভাল। তুমি যখন অত শুচিবাই। তবে আমি তো কিছু দোষ দেখি না।
দোষ দেখো না?
ব্রজবালা যেন হঠাৎ ভয় পায়, বলে ওঠে, যতসব বাজে কথা। শুনতে চাই না। বলে দুড়দুড় করে পালায়।
দিবাকর একটা পরিতৃপ্তির দৃষ্টিতে তাকিয়ে দেখে।
ভয় পেয়েছে।
পাক। সেটাই দরকার।
ভয়ের কাছেই আকর্ষণ।
দিবাকর অপমানের শোধ নেবে।
দিবাকর নিশ্চিত জানে ব্রজবালা ওই ভয়-ভয় করা ভয়ংকর কথার লোভে সুযোগ সৃষ্টি করবে। নবীনকে ছুতো করে ভাগাবে।
গা ছমছমে নির্জনতায় এসে বসে বলবে, বলো তো শুনি তোমার কেলাসের মেয়েদের কথা। আমার তো বাপু বিশ্বাস হয় না, তোমার নিশ্চয় সব বানানো।
দিবাকর অবশ্যই বানাবে।
ব্রজবালা সেই বানানো গল্প গোগ্রাসে গিলবে, গোগ্রাসে বিশ্বাস করবে, আর আস্তে আস্তে জালে পড়বে। মাকড়সার জালে বন্দিনী পোকার মতো ছটফট করবে। কিন্তু বেরোতে পারবেনা। আস্তে আস্তে নিস্তেজ হয়ে আত্মসমর্পণ করবে।
আর হয়তো ভাববে, আমার আবার ভয়টা কী? বিধবা নই, কুমারী নই–
.
কিন্তু মীনাক্ষী?
তাকে কবে সম্পূর্ণ কবলিত করে ফেলতে পারবে দিবাকর?
সেটার প্রয়োজন আছে।
দিবাকর তার নিজ গণ্ডি থেকে উর্ধ্বে উঠতে চায়। প্রফেসর মৈত্রের মেয়েকে বিয়ে করতে পারলে সেই চাওয়াটা রূপ পেতে পারে। আর ওই বিয়েটার জন্যেই কবলিত করার দরকার।
মেয়েগুলো ভারী বোকা হয়।
একটু এদিক ওদিকেই ভাবে আমার সব গেল, গেল আমার শুচিতা, আমার পবিত্রতা, আমার সততা।
অতএব বিয়ে ভিন্ন আর গতি নেই আমার। বিশেষ করে মীনাক্ষীর মতো ভীরু মেয়ে। ও যেই ভাববে আমার সব গেছে, তখনই ও ওর সেই আদর্শবাদী অধ্যাপক বাবার কাছে গিয়ে আছড়ে পড়ে বিয়ের জন্যে আর্জি করবে। দিবাকরকে কিছু করতে হবে না।
দিবাকর সেই ভরসাতেই আছে।
দিবাকর তাই কড়া কড়া বিদেশি নভেল পড়ে বোলচাল মুখস্থ করে রাখে যাতে মীনাক্ষীকে বিধ্বস্ত করে ফেলা যায়।
ঘরে এসে দিবাকর আবার চৌকিতে বসল, দেখল বালিশের তলায় একটা পোস্টকার্ড গোঁজা।
তার মানে এসেছে কোনও সময়, নবীনবাবু অনুগ্রহ করে রেখে দিয়েছেন।
দিবাকরের তো মাঝে মাঝে সন্দেহ হয়, হয়তো তার অনুপস্থিতিতে আসা চিঠিগুলো ফেলে দেয় নবীন। অবশ্য চিঠি কোথা থেকে আসবে সেটা জানা নেই দিবাকরের।
ভাল চিঠি। প্রত্যাশার চিঠি!
মাঝে মাঝে যা আসে সে তো ওই কদর্য অক্ষরে রচিত পোস্টকার্ড মাত্র। ওটাকে যত্ন করে রেখে না দিলেও ক্ষতি ছিল না। ওতে যে কী লেখা আছে দিবাকরের জানাই আছে। চিঠি দিবাকরের দাদার লেখা–
কল্যাণবরেষু
দিবাকর, পরে সবিশেষ জানাই বাটিস্থ সব কুশল। তবে মাতাঠাকুরাণী বাতের বেদনায় বিশেষ কাতর এবং মধু ও গোপাল পেটের রোগে ভুগিতেছে, তৎসহ জ্বর। প্রভাকরও কয়েকদিন যাবৎ আমাশায় কষ্ট পাইতেছে। তা ছাড়া তোমার বড় বউঠাকরুণও কার্বঞ্চল হইয়া প্রায় শয্যাগত। এইসব কারণে আমারও শরীর ভাল যাইতেছে না।
বাটিস্থ সব কুশল-এর পর এতগুলি ফিরিস্তি দাখিল করে দাদা অতঃপর শুরু করবে ঝড়ে একটি আমগাছ পড়িয়া গিয়াছে। বুধির একটি বকনা বাছুর নষ্ট হইয়া গিয়াছে। বাঁশবাগান হইতে কে বা কাহারা বাঁশ কাটিয়া লইয়াছে ইত্যাদি ইত্যাদি।
তাপর শেষ কথা তোমার কবে একজামিন শেষ হইবে? তোমার আসার আশায় দিন গুনিতেছি, তুমি আসিয়া পড়িলেই সব সুসার হইবে শ্রীভগবানের নিকট এই প্রার্থনা। ইতি–
নিত্য আঃ—-
তোমার বড়দাদা
এই চিঠি।
পর পর সাতখানা চিঠি সাজিয়ে রাখলে মনে হবে একই চিঠির কার্বন কপি। শুধুমাত্র কখনও আমগাছের বদলে জামগাছ, কখনও বুধির বদলে মঙ্গলা, অথবা বকনার বদলে এঁড়ে।
তা ছাড়া সব এক।
প্রবৃত্তি হয় না হাত বাড়িয়ে হাতে নিতে। প্রবৃত্তি হয় না পড়তে। তাই দিবাকর ঘৃণায় মুখ বাঁকিয়ে একবার তাকিয়ে দেখে মাত্র।
আশ্চর্য, দিবাকর সম্বন্ধে কী ধারণা ওদের! দিবাকর লেখাপড়া শেষ করে বাড়ি গিয়ে দাঁড়ালেই ওদের ছেলের পেটের অসুখ, মায়ের বাত, ভাজের ফোঁড়া ইত্যাদি সব সেরে যাবে, আর হবে না। পড়শিরা বাঁশ কেটে নেবে না। ঝড়ে আর গাছ পড়বে না। ইত্যাদি ইত্যাদি।
থাকো ভুয়ো এই আশা নিয়ে।
দিবাকর আর যাচ্ছে না। দিবাকর তোমাদের আত্মীয় বলতে লজ্জা পায়।
.
সরোজাক্ষ তাঁর সংসারের মাথায় এক ঘা লাঠি বসিয়ে দিলেন। সরোজাক্ষ তাঁর চাকরিতে ইস্তফা দিলেন।
প্রথম জীবনে যখন সরোজাক্ষ তাঁর জীবিকা বেছে নিয়েছিলেন, তখন কেন যেন তাঁর মনে হয়েছিল এটা ঠিক চাকরি নয়। এই অবাস্তব ভুল ধারণাটি অবশ্যই সরোজাক্ষর নিজস্ব মানসিক গঠনের ফসল, তবে সেই ভুল ধারণাটি সমূলে উৎপাটিত হবার তেমন কোনও কারণ ঘটেনি। অতএব সেই ভুলের রসটাই কোন অলক্ষ্যে থেকে সরোজাক্ষকে সঞ্জীবিত রেখেছিল।
কিন্তু সরোজাক্ষর এই বিপ্লবাত্মক কর্মই ভুলটা সমূলে উৎপাটন করল। সরোজাক্ষর কানের কাছে এখন অবিরত এই ধ্বনি, চাকরি ছেড়ে দিলে?চাকরিটা ছেড়ে দিলেন?–আজকালকার দিনে যদি এত তুচ্ছ ব্যাপারে চাকরি ছাড়তে হয়, তা হলে তো
যারা হিতৈষী, তারা এ প্রশ্নও করল–এই বয়েসে কোথায় তুমি কমপিটিশনে নামতে যাবে, ইয়ং গ্রুপের সঙ্গে? কথায় কথায় এখন মেয়েছেলেরা ডি ফিল, ডি এসপি, পি-আর এস হচ্ছে।
বিস্ময় বিরক্তি, লাঞ্ছনা গঞ্জনা, উপদেশ আক্ষেপ বহুবিধ আক্রমণের মুখে পড়তে হচ্ছে সরোজাকে। সব আক্রমণের সার কথা–চাকরিটা ছাড়া উচিত হয়নি। অতএব এখন সরোজাক্ষর মনের মধ্যে আর সেই পুরনো ভুলটা বসে নেই। সরোজা জেনে নিয়েছেন তিনি চাকরি করছিলেন, চাকরি ছেড়ে দিয়েছেন।
কেন?
মেজাজের দোষে।
মেজাজ দেখিয়েছিলেন সেখানে, অতএব শিক্ষা দিয়ে দিয়েছে তারা, সরোজাক্ষ সে জায়গায় সমঝে না গিয়ে আরও মেজাজ দেখিয়ে চাকরিটাই ছেড়ে দিলেন।
কলেজ কর্তৃপক্ষ অবশ্য এককথায় সরোজাক্ষর পদত্যাগপত্র গ্রহণ করেননি, সরোজাক্ষকে ভাবতে সময় দিতে চেয়েছিলেন, কিন্তু সরোজাক্ষ সে সময় নেননি। সবিনয়ে বলে এসেছেন, নতুন করে আর কী ভাবব? ভেবেই তো দিয়েছি
তার মানে সরোজাক্ষ কেবলমাত্র নিজের মান-অপমানের কথাই ভেবেছেন, আর কিছু ভাবেননি। ভাবেননি–তাঁর স্ত্রী আছে, নাবালক পুত্র আছে, অবিবাহিতা কন্যা আছে এবং সারদাপ্রসাদ নামে একটা অর্থহীন অবান্তর পোষ্য আছে। ভাবেননি, তাঁর উপার্জনশীল সাবালক ছেলেটা একটা অমানুষ এবং নিজে তিনি এ যাবৎকাল ভবিষ্যৎ সম্পর্কে উদাসীন ছিলেন।
তবে?
তবে তোমায় কে সহানুভূতির চক্ষে দেখবে?
সংসারী মানুষ তুমি, একটা সংসারের (কর্তা বলে কেউ না মানলেও দায়িত্বের আইনে) কর্তা, তুমি অমনি কোথায় একটু মানের কানা খসে গেল বলে দুম করে চাকরিটা ছেড়ে দিলে? কর্তব্য নেই তোমার? দায়িত্ব নেই? মায়া মমতা বিবেচনা কিছু নেই।
তা এ সবই যদি না থাকে, শুনতেই হবে কটুকথা। যাদের সঙ্গে তোমার এই ব্যাপারের কোনও লাভ লোকসানের প্রশ্ন নেই, তারাও শুনিয়ে যাবে দুটো ধিক্কারের কথা। আর যাদের সঙ্গে ঘোরর সম্পর্ক, তারা তো
হ্যাঁ, একা বিজয়াই নয়, বাড়ির লোকে জনে জনে লাঞ্ছিত করেছে সরোজাক্ষকে (যদি সেই লাঞ্ছনায় মতি ফেরে), তবে বিজয়াই অগ্রণী। বিজয়া তাঁর কাঁচা কাপড়ের দুর্লঙ্ঘ্য প্রাচীর ভেঙে এ-ঘরে বিছানার ধারে এসে বসে পড়ে বলেছেন, ব্যাঙ্কে তোমার কত টাকা আছে?
সরোজাক্ষ চোখ তুলে তাকিয়েছেন বোধ হয় একটু অবাক-অবাক দৃষ্টিতে। কারণ তখনও সরোজাক্ষ ভেবেছিলেন, বিজয়া খামোক একটা বোকার মতো প্রশ্ন করল কেন।
কিন্তু বিজয়া সব ক্ষেত্রে বোকা নয়।
বিজয়া সেই সদ্য-বিবাহের কাল থেকেই ক্ষেত্রবিশেষে চালাক। বিজয়া যখন নেহাত নতুন বউ, তখনই সরোজাক্ষর অনুপস্থিতিতে সরোজাক্ষর আলমারি দেরাজ বুকশেলফ এমনকী মোটা মোেটা বইয়ের পাতাগুলি পর্যন্ত উলটে উলটে চতুর দৃষ্টিনিক্ষেপ করে দেখত। কোনওখান থেকে কোনও দলিল সংগ্রহ করে ফেলতে পারে কি না সরোজাক্ষর, কোনও দুর্বলতার সাক্ষ্য জোগাড় করে ফেলতে পারে কিনা।
আছে অপরাধ, আছে দুর্বলতা, এ বিষয়ে সেই সদ্য কৈশোরপার তরুণীটি নিঃসন্দেহ ছিল। নইলে বিজয়ার মতো অমন একটা লোভনীয় বস্তুকে হাতের মুঠোয় পেয়েও লোকটা দিনে রাত্রে সকালে সন্ধ্যায় তার সদ্ব্যবহার করে না? তাকে কী নিধি পেলাম বলে সর্বদা গলায় ঝুলিয়ে রাখে না?
করে না। রাখে না।
অতএব নির্ঘাত অন্য ব্যাপার।
অন্য ব্যাপার না থাকলে, এক্ষেত্রে রক্তমাংসের শরীরওলা যুবক বর স্রেফ হ্যাংলা বনে যেত।
সেই প্রত্যাশিত হ্যাংলামি তো করেই না বিজয়ার বর, বরং নেহাতই রক্তমাংসের দাবি মেটাতে একটু দুর্বলতা প্রকাশ করে ফেললেই যেন মরমে মরে যায়। যেন ঘৃণায় লজ্জায় মুষড়ে পড়ে। তাকিয়ে দেখে না, তার সেই রূপবতী এবং স্বাস্থ্যবতী যুবতী বউ তাতে কী পরিমাণ অপমান বোধ করে।
করত অপমান বোধ বিজয়া।
আর সেই অপমান বোধ থেকেই আক্রোশ উঠত ধুইয়ে। সেই আক্রোশে অধিকতর আকর্ষণময়ী হবার জন্যে লজ্জা শরমের বালাই রাখত না এবং সরোজাক্ষকে একদিন কাঠগড়াতে দাঁড় করাবার জন্যে খুঁজে খুঁজে বেড়াত তার অপরাধের দলিল।
হয়তো ঠিক এ পথে চিন্তাকে প্রবাহিত না করলে বিজয়া সরোজাক্ষর চিত্তজগতে স্থান করে নিতে পারত। দেহকে সম্বল করেও মনের দরজায় টোকা দিতে পারত। কিন্তু বিজয়া নিজের ভুল চিন্তাতেই নিমজ্জিত থেকেছিল, বিজয়া তার স্বামীর মনটাকে হাত ফসকে পালিয়ে যেতে দিয়েছিল। ভালবাসার বদলে ঘৃণা সংগ্রহ করেছিল।
সেই ঘৃণাটা প্রথম উপচে উঠেছিল সেই একদিন দুপুরে। যে দুপুরে সরোজাক্ষ হঠাৎ জ্বর হয়ে বাড়ি ফিরে এসেছিলেন।
এসে দেখলেন সরোজাক্ষর তিনতলার ঘরটা একেবারে তছনছ। দেরাজ খোলা, ট্রাঙ্ক খোলা, আলমারি খোলা, বিছানা ওলটানো, র্যাকের বইগুলো ছড়ানো, যেন পুলিশে খানাতল্লাশি করে গেছে। আর দেখলেন কাকার দেওয়া সেই চন্দনকাঠের বাক্সটাকে নিয়ে বিজয়া
হ্যাঁ, সারা ঘর তছনছ করেও বিজয়া সেই পাতলা গড়নের ছোট চন্দনকাঠের বাক্সটার চাবি সংগ্রহ করতে পারেনি। বিজয়া স্থিরনিশ্চিত ছিল, ওই চাবিটা খুলে ফেলতে পারলেই সরোজাক্ষর সেই গোপন ঘরটা খুলে পড়বে, যে ঘরে লুকোনো আছে সরোজাক্ষর অপরাধের প্রমাণপত্র অবৈধ প্রেমপত্র। প্রেম বস্তুটাকে অবৈধই ভাবত বিজয়া।
ওই বাক্সটাকে দেখেছে বিজয়া ইতিপূর্বে, নেড়েছে চেড়েছে, আর ভেবেছে অবসরমতো এটাকে নিয়ে পড়তে হবে। আজকে পড়েছিল তাই। ভেবেছিল চিঠি তো পাবই, ফটো-টটোও কোনও না পাব। কিন্তু নেই, কোথাও নেই চাবি।
তার মানে এমন কোনও গোপন জায়গায় রেখে দেয়, যা বিজয়ার চোখকেও ফাঁকি দিতে পারে। তার মানে দেখতে যেমন আলাভোলা বরটি তার, ভিতরে তেমন নয়। কে জানে ঘরের সিলিঙে কড়ি-বরগার মধ্যেই কোথাও খাঁজ কেটে রেখেছে কিনা।
সে বাড়িটা বিজয়া যে বাড়িটায় বিয়ে হয়ে এসেছিল, সেটা ছিল ভাড়াটে বাড়ি। পুরনো ধরনের বাড়িটা, তিনতলাটা পুরো ছাদ। ঘর মাত্র একখানাই।
বিয়ের আগে থেকেই ঘরটার অধীশ্বর ছিল সরোজা নামের সেই পড়ুয়া ছেলেটা। বিজয়া এল তারপর। অধীশ্বরী হয়ে বসল।
কিন্তু শুধু ঘরের অধীশ্বরী হয়ে কী লাভ বিজয়ার?
চাবি সংগ্রহে হতাশ হয়ে নিজের চাবির রিংটা নিয়ে যে কটা চাবি দিয়ে চেষ্টা করা সম্ভব, তা করে বিফল হয়ে মরিয়া বিজয়া করে বসল–এক কাণ্ড। বাক্সটার ডালার খাঁজে একটা ছুরি ঢুকিয়ে চাড় দিতে বসল। আর ঠিক সেই মুহূর্তে সরোজা এসে ঢুকলেন জ্বরে টলতে টলতে।
ঢুকে থমকে দাঁড়ালেন এবং দেখতে পেলেন, সুন্দর কারুকাজ করা সেই মহীশূরী চন্দনকাঠের বাক্সর ডালার খানিকটা অংশ উপড়ে বেরিয়ে এল ছুরির সঙ্গে, ডালাটা খুলে গেল চাবির কজা আলগা হয়ে।
সরোজাক্ষ খাটের উপর বসে পড়ে ঘরটাকে দেখে নিলেন, দেখে নিলেন বিজয়াকে। রুক্ষ গলায় বললেন, এসব কী?
এতখানি ভয়ংকর মুহূর্তে ঔদ্ধত্য প্রকাশ করতে সাহস করল না বিজয়া, তাই খুব তাড়াতাড়ি বলে উঠল,ও মা তুমি এমন অসময়ে যে? ঘরটর সব এলোমেলো করে ঝাড়াঝুড়ি করছিলাম—
সরোজাক্ষর মাথা ছিঁড়ে পড়ছিল, সরোজাক্ষ তবু শুয়ে পড়েননি, আরও রুক্ষ গলায় বলেছিলেন, ওই বাক্সটার ভিতরের ঝুল ঝাড়ছিলে?
বাক্সটা!
এর কী জবাব দেওয়া যায় ভেবে না পেয়ে বিজয়া চুপ করে গিয়েছিল। আর বোধ করি মনে মনে শক্তি সংগ্রহ করছিল। সরোজাক্ষ খাট থেকে নেমে বাক্সটাকে হাতে নিয়ে তার দুর্দশা দেখলেন, তারপর তার ভিতর থেকে একগোছা কাগজপত্র বার করে বাড়িয়ে ধরে ঘৃণা আর ব্যঙ্গে তিক্ত গলায় বলে উঠলেন, প্রেমপত্র খুঁজছিলে? নাও! পড়ে দেখো। যদি অবশ্য পড়বার ক্ষমতা থাকে।
কাগজপত্রগুলো সরোজাক্ষর ইউনিভার্সিটির সার্টিফিকেট, চশমার প্রেসক্রিপশন, ক্যামেরার গ্যারান্টিপত্র ইত্যাদি। হয়তো উপহার পাওয়া শৌখিন আধারটায় ওই সার্টিফিকেটগুলোই রাখতে ইচ্ছে হয়েছিল সরোজাক্ষর, তারপর এটা ওটা ঢুকে পড়েছে। চাবিটা পাছে হারিয়ে যায় বলে মায়ের কাছে রেখে দিয়েছিলেন সরোজাক্ষ।
বিজয়ার হৃতশক্তি ফিরে আসছিল, যে শক্তিটা নাকি ধৃষ্টতার গর্ভজাত। ধৃষ্টের গলাতেই বলে উঠেছিল বিজয়া, বাব্বা। এইসব জিনিস আবার মানুষে এত বাহারি করে রাখে তা কী করে জানব?
সরোজাক্ষ আর কথা বলেননি।
শুধু সরোজাক্ষর চোখমুখ দিয়ে ঘৃণা উপচে উঠেছিল। ঘৃণার সেই প্রথম প্রকাশ। তারপর সারাজীবনই প্রতিনিয়ত ধরা পড়ে যায় সেই ঘৃণা, সেই ব্যঙ্গ।
সরোজাক্ষর বাবা মারা যেতে বিজয়া যখন ডুকরে-ডুকরে কেঁদেছিল, ওগো আমার রাজা শ্বশুর ছিল যে গো! ওগো–আমি যে রাজকন্যের আদরে ছিলাম গো–ইত্যাদি আখর দিয়ে দিয়ে, সরোজাক্ষ মৃতের বিছানা থেকে উঠে এসে বলেছিলেন, তোমার এই শোকটা যদি চালাতেই হয়, তো তিনতলায় নিজের ঘরে যাও।
সরোজাক্ষর মা মারা গিয়েছিলেন তার আগে। বিজয়া তখন সধবা শাশুড়ির হাতের লোহা আর পায়ের আলতার প্রসাদ নেবার জন্যে কাড়াকাড়ি করেছিল। সরোজাক্ষ তীব্র গলায় বলেছিলেন, তোমার এই ভক্তি নাটকটা বড় বেশি ওভার অ্যাকটিং হয়ে যাচ্ছে বিজয়া, অসহ্য লাগছে।
এমন অনেক উদাহরণ আছে বিজয়ার দাম্পত্যজীবনে, যা নাকি অপরের চোখেও ধরিয়ে দিয়েছে সেই জীবনের ফাঁকি। সেই আক্রোশ বিজয়াকে উগ্র করেছে, নির্লজ্জ করেছে। এবং শেষ পর্যন্ত বিজয়াই বিজয়িনী হয়েছে।
বিজয়িনী তো হবেই।
মোক্ষম হাতিয়ার যে এসে গেছে তখন তার হাতে। ঝুপঝাঁপ করে চার চারটে ছেলেমেয়ে এসে গেছে।
হয়তো সবগুলোই সরোজাক্ষর দুর্বলতার সাক্ষী নয়, বিজয়ার বেহায়ামির কারণ, কিন্তু সে ইতিহাসের তো সাক্ষী নেই। সরোজাক্ষ তো বিজয়ার মতো অপরের কান বাঁচাবার চেষ্টামাত্র না করে সরবে প্রশ্ন করবেন না, তখন মনে পড়েনি? সরোজাক্ষ তো ঘোষণা করবেন না, বড় যে ঘেন্না আমার ওপর, বলি এগুলো এল কোথা থেকে? রাস্তা থেকে কুড়িয়ে এনেছি? সরোজাক্ষ তো হেসে হেসে বলবেন না, এদিকে তো তেজে মটমট, বলি সে তেজ থাকে? তেজ ভেঙে মাথা মুড়োতে আসতে হয় না? মনে ভাবো সাক্ষী থাকে না, কেমন? বলি আগুন কি ছাইচাপা থাকে?
হ্যাঁ, বিজয়া এসব কথা অনায়াসে উচ্চারণ করতে পারত, আর সরোজাক্ষর নিরুপায়তায় মনে মনে হাসত। আবার সেই বিজয়াই কোনও এক সাক্ষীহীন শান্ত অন্ধকারকে নখে আঁচড়ে আঁচড়ে কেঁদে কেঁদে বলত, না হয় রাগের মাথায় একটা অন্যায় কথা বলেই ফেলেছি, তাই বলে তুমি আমায় ত্যাগ করবে? তা হলে খানিকটা বিষ এনে দাও আমায়, খেয়ে মরি। বেহায়া উদ্ধত, আর আত্মসম্মানজ্ঞানহীন স্ত্রীর কাছে স্বামী নামক জীবটা যে কত অহায় সেকথা হয়তো কেবলমাত্র তার সৃষ্টিকর্তাই জানেন।
.
অবশ্য এখন নাটক অন্য দৃশ্যে পৌঁছেছে। এখন বিজয়া আত্মস্থ গলায় বলতে পারছেন, ব্যাঙ্কে তোমার কত টাকা আছে?
হঠাৎ কথাটা সরোজাক্ষর অবান্তর বলে মনে হয়েছিল।
তারপর ভাবলেন, বিজয়া কোনও মোটা খরচের ধাক্কায় ফেলতে চাইছেন তাঁকে। হয়তো কোনও ব্যয়সাপেক্ষ ব্রত, হয়তো কোনও সুদূর তীর্থযাত্রার সংকল্প।
কিন্তু সে মুহূর্তের জন্যেই।
বিজয়ার বিদ্রূপ কুঞ্চিত মুখে বিজয়ার প্রশ্নের আসল মানেটি লেখা ছিল। অতএব সরোজাক্ষ উত্তর দিলেন না, অন্যদিকে তাকিয়ে থাকলেন।
বিজয়া আবার চিমটিকাটা স্বর ব্যবহার করলেন, কই, জবাব দিলে না?
সরোজাক্ষ গম্ভীর গলায় বললেন, অনেক টাকা।
বিজয়া সহজের রাস্তা ধরলেন।
বললেন, হ্যাঁ, সেকথা তো আমার অবিদিত নেই। তবে বলি ভাঁড়ে যখন মা ভবানী, তখন এত তেজ দেখাবার কী দরকার ছিল?
সরোজাক্ষর উত্তর দিতে ইচ্ছে হয় না, তবু সরোজা জানেন, কোনও একটা উত্তর না নিয়ে ছাড়বেন না বিজয়া। তাই তেমনি গম্ভীর কণ্ঠেই বলেন, যদি বলি ছিল দরকার?
বিজয়া তাঁর সেই কাঠ কাঠ হলুদরঙা মুখটা বাঁকিয়ে কুদর্শন করে বলে ওঠেন, তা তুমি আর বলবে না কেন? নিজের কাজকে কি আর অদরকারি বলবে? তা সেই দরকারটা বোধ হয় স্ত্রী-পুত্রের পেটের ভাতের থেকেও বড়?
সরোজাক্ষ অন্যদিকে তাকিয়ে ছিলেন। সরোজাক্ষ অন্যমনস্কর মতো বলে ফেললেন, হয়তো বড়।
কিন্তু বিজয়া কি রাগ করে উঠে যাবেন? বিজয়া বলে উঠবেন না, তা তোমার কাছে তাই হতে পারে, কিন্তু মুশকিল হচ্ছে ত্রিজগৎ তা বলবে না। আমি বলছি ওসব তেজ-মান রেখে আবার জয়েন করতে হবে তোমায়।
তা হয় না।
হয় না তো, যেমন করে পারো রোজগার করে আনন। আর নয়তো আমায় অনুমতি দাও, ঝুলি হাতে করে ভিক্ষেয় বেরোই।
সরোজাক্ষ হঠাৎ হাতজোড় করে বলে ওঠেন, তুমি একটু এ ঘর থেকে যাবে?
এই, এইটিই অস্ত্র সরোজাক্ষর।
এরপর আর থাকেন না বিজয়া।
চোখে আগুন ঝরিয়ে চলে যান। কিন্তু সেদিন চলে যাননি। সেদিন তীক্ষ্ণ ধারালো গলায় চিৎকার করে করে বলেছিলেন, তাড়িয়ে দিয়ে পার পাবে ভেবেছ? সে আর এখন হয় না। মাস মাস যতটি টাকা সংসারে লাগে, তা যে করে থোক আমায় এনে দেবে, এ দিব্যি গালো, তবে আমি নড়ছি।
সে চিৎকারে সারদাপ্রসাদ ছুটে এসেছিলেন, বলেছিলেন, কী হচ্ছে কি বউদি? মানুষটা এই সেদিন মরণ বাঁচন রোগ থেকে উঠেছে, আবার এইসবে যদি একটা স্ট্রোক-টো হয়ে যায়? যান, যান, আপনার পুজোর ঘরে চলে যান।
বিজয়া এ সুযোগ ছাড়েননি।
বিজয়া হাত-মুখ নেড়ে বলে উঠেছিলেন, মুখে হিতৈষী হতে সবাই পারে গো ঠাকুরজামাই। বলি এতগুলি লোকের পেট তাতে মানবে?
সেদিন একটা অদ্ভুত ঘটনা ঘটেছিল। যে সারদাপ্রসাদ ব্যঙ্গবিক্রপ কাকে বলে জীবনে জানে না, সে হঠাৎ সেই গলায় বলে উঠেছিল, কেন, আপনার ঠাকুর কী করছেন? শুধু নিজে বসে বসে ছানা-মাখনের ভোগ লাগাবেন? তিনি পারবেন না এই পেটগুলোর ভার নিতে?
বিজয়া সহসা একথার উত্তর দিয়ে উঠতে পারেননি। তাই ন্যাকামি বলে ঘর থেকে বেরিয়ে গিয়েছিলেন। সিঁড়িতেই উঠে গিয়েছিলেন।
সারদাপ্রসাদ সুউচ্চ কণ্ঠে বলেছিল, হ্যাঁ, তাই যান। তাঁকেই জ্বালাতন করুন গে। চিরটাকাল তাঁকে নিয়েই পড়ে থাকলেন, এখন বিপদকালে মানুষের ভরসা কেন?
এত ঝামেলার মধ্যেও হঠাৎ সরোজাক্ষর মুখে একটু কৌতুকের হাসি ফুটে উঠেছিল যেন। বলেছিলেন,তোমার তো আজকাল খুব সাহস বেড়েছে দেখছি।
সারদাপ্রসাদ লজ্জিত গলায় বলেছিল, কী করব দাদা, হঠাৎ রাগটা কেমন চড়ে গেল! বুনো গোঁয়ার তো।
তারপর নিজেই বলেছিল, তারপর? এখন কী ঠিক করছেন? কিছু তো একটা করতেই হবে?
তা তো হবে।
সারদা ক্ষুণ্ণ গলায় বলেছিল, আমার বইটা শেষ হয়ে গেলে, এত ভাবতাম না। কী করব, হয়ে তো ওঠেনি। তবে গোটা কয়েক দিন চালিয়ে নিন, ও বই ছাপা হলে–একেবারে হট কেক হবে। অথচ এদিকে দামটা ভাল হবে। টাকা কুড়ির কম তো নয়ই। ধরুন যদি ফার্স্ট এডিশানে দু হাজারও ছাপায়–এসব গবেষণার বইটই অবশ্য তা ছাপে না। একেবারে চার-পাঁচ হাজার ছাপে। যাক আমি না হয় দুহাজারই ধরছি। তা হলেও–আপনার গিয়ে চল্লিশটি হাজার ঘরে আসছে। পরের পার্টটাও তো লেখা হতে থাকবে ততদিনে।
সারদাপ্রসাদের মুখটা আহ্লাদে ভরে ওঠে। সারদাপ্রসাদ সেই ভাবনাশূন্য দিনটির কল্পনায় বিভোর হয়ে তাড়াতাড়ি শেষ করতে যায় তার লেখা।
সরোজাক্ষ সেদিকে তাকিয়ে থাকেন। একটি শ্রদ্ধামিশ্রিত স্নেহের সঙ্গে।
তা সরোজাক্ষর অনেক কিছুই উলটোপালটা বইকী! নইলে সারদাপ্রসাদের জন্যে শ্রদ্ধা! স্নেহ করুণা কৃপা দয়া মায়া এগুলো না হয় ক্ষ্যামাঘেন্নার ব্যাপার। কিন্তু শ্ৰদ্ধা? সরোজাক্ষর ছেলেমেয়েরা শুনলে হেসে কুটিকুটি হত।
এখন অবশ্য সরোজাক্ষর ছেলেমেয়েদের হাসবার মুড ছিল না। বাবার ওই চাকরি ছাড়ার গোঁয়ার্তুমিতে সকলেই আহত।
বড় ছেলে বলে গেছে, যা করেছেন নিজের দায়িত্বেই করেছেন, আমার কিছু বলার নেই। তবে আমার কাছে সংসার যেন কিছু প্রত্যাশা না করে, এই হচ্ছে আমার সাফ কথা। তবে হ্যাঁ। বলতে পারেন, আমার ফ্যামিলির দায়িত্বটা আমারই। বেশ বলে দিন স্পষ্ট করে, চলে যাব নিজের ফ্যামিলি নিয়ে।
এমনভাবে দাঁড়িয়ে থাকল একটুক্ষণ, যেন অর্ডারটা পেলেই চলে যায়। নেহাত যখন কোনও শব্দ উঠল না ঘরে, নীলাক্ষ শরীরে একটা মোচড় খেয়ে বলে চলে গেল,ঠিক আছে। যখনই অসুবিধে বোধ করবেন, বলে দেবেন।
ময়ূরাক্ষী এল বিকেলে।
বউদিকে টেক্কা দেওয়া সাজ সেজে। এসেই পাখার স্পিডটা বাড়াল। তারপর বলল, আপনি হঠাৎ এমন একটা তিলকে তাল করা কাণ্ড করবেন বাবা, এটা আমাদের ধারণার বাইরে ছিল। আশ্চর্য! ঘেরাও আজকাল কে না হচ্ছে? প্রাইম মিনিস্টার থেকে হাইকোর্টের জজ পর্যন্ত বাকি আছে কেউ? সবাই কাজকর্ম ছেড়ে দিচ্ছে?
সরোজাক্ষ একটু হেসে বললেন, তুমি আমায় হিতোপদেশ দিতে এসেছ, না কৈফিয়ত তলব করতে এসেছ?
হিতোপদেশ! বরের সামনে এহেন অপমানে লাল হয়ে গিয়ে ময়ুরাক্ষী বলল, আপনাকে হিতোপদেশ দিতে আসব, এমন মুখ আমি নই বাবা। আর–কৈফিয়তই বা কীসের? আপনার চাকরি ছাড়ায় তো আমার সংসার অচল হয়ে যাবে না। এমনি কথার কথাই বলছিলাম। আপনি আমাদের সন্তানের মর্যাদা না দিলেও আমরা তো সম্পর্কটা ভুলতে পারি না।
বড় মেয়ের বাক্যের হুলে সরোজাক্ষ বিব্রত হয়েছিলেন। বিপন্ন গলায় বলেছিলেন, এ সব কথা বলছ কেন? চাকরি ছাড়াটা হয়তো সংসারের পক্ষে অসুবিধেকর, কিন্তু আমার বিবেকে বাধছে। মনে হচ্ছে এতকাল ওদের ঠকিয়ে মাইনে নিয়ে এসেছি। ওদের শিক্ষা দেবার ভান করেছি, অথচ দিইনি শিক্ষা। পিটুলি গোলা খাইয়ে দুধ খাওয়াচ্ছি বলে মিথ্যে আত্মপ্রসাদ লাভ করেছি। তারপর–মেজাজের ওজন হারিয়ে বসেছি ওরা শিক্ষিতহয়নি দেখে। এতদিন খেয়ালে আসেনি বলেই চালিয়ে আসছিলাম। এখন আর
সরোজাক্ষর জামাই শ্বশুরের সামনে মুখ খোলে কম। যা কিছু মন্তব্য করে, আড়ালেই করে। আজ কিন্তু মুখ খুলল। একটু চোরা-হাসি হেসে বলল, ছাত্ররাই তা হলে আপনার জ্ঞানচক্ষু খুলে দিয়েছে বলুন?
সরোজাক্ষ একবার ওই আহ্লাদে আহ্লাদে মুখটার দিকে তাকিয়ে স্পষ্ট গলায় বলেন, তাই দিয়েছে বলতে হবে।
ময়ূরাক্ষীর নিজের মতবাদ যাই হোক, বরের কথার প্রতিবাদ করবেই। ওই প্রতিবাদটাই হয়তো ওর আসল মতবাদ।
ও তাই নিজের কথাই খণ্ডন করে বলে, তুমি থামো তো! এ যুগের ছেলেগুলো হচ্ছে পাজি নম্বর ওয়ান! সভ্যতা নেই ভব্যতা নেই, কোনও কিছুতেই শ্রদ্ধা নেই
হয়তো ওদের সামনে–সরোজাক্ষ একটু থেমে বলেন,ওদের শ্রদ্ধার যোগ্য কিছু নেই।
ঠিক বলেছেন। সরোজাক্ষর জামাই উৎসাহিত গলায় বলে, নেই কিছু। দেখছে তো চারদিক তাকিয়ে। বুদ্ধি তো হয়েছে। দেখছে–যেমন অপদার্থ দেশের সরকার, তেমনি অপদার্থ কর্পোরেশন, তেমনি অপদার্থ ইউনিভার্সিটিগুলো, আর–
থাক জয়ন্ত, বৃথা কষ্ট কোরো না, সরোজাক্ষ আস্তে বলেন, এ দেশের অপদার্থতার লিস্ট করতে বসলে কাগজে কুলোবে না। তোমরা বরং চা-টা খাও গে…
খাও গে!
অর্থাৎ অন্যত্র সরে পড়ো গে।
জয়ন্ত মুচকি হেসে বলে, তাই ভাল। কী বলো মক্ষী? বাবাকে অনর্থক ডিস্টার্ব করার কোনও মানে হয় না।
না না– ডিস্টার্ব কেন? সরোজাক্ষ কুণ্ঠিত গলায় বলেন, অনেকক্ষণ এসেছ, চা-টা খাবে তো একটু?
ময়ূরাক্ষীর বাবাকে হিতকথা শোনানোর প্রচেষ্টা ওই চা খাওয়াতেই ইতি হল। তার ভাগ্যক্রমে সেদিন তখনও নীলাক্ষ বাড়ি ছিল, ছিল সুনন্দা।
সুনন্দাই নিজের ঘরের শৌখিন সরঞ্জাম বার করে চা খাওয়াল, খুব প্রশংসার গলায় বলল, মক্ষী তো খুব চমৎকার সেজেছ? শাড়িটা নতুন কিনেছ তাই না?
ওই নিরীহ প্রশ্নটার মধ্যে ময়ূরাক্ষী যে অপমানের কী পেল! ক্রুদ্ধ হল সে। আজেবাজে করে বলতে লাগল, নতুন শাড়ি দেখাবার জন্যেই সে এসেছে, এমন নিচু কথা সুনন্দা ভাবতে পারল কী করে। নেহাত নাকি বাবার মাথাটা খারাপ হয়ে গেছে কিনা দেখতে-বলল, হয় এরকম। হঠাৎ হঠাৎ অপমানে মানী লোকেদের ব্রেনের মধ্যে এদিক ওদিক হয়ে যায়।
সুনন্দা এতক্ষণ এদের কথায় যোগ দেয়নি। সুনন্দা লীলায়িত ভঙ্গিতে চা বিস্কুট কাজু সরবরাহ করছিল, এখন একটু হেসে বলল, হঠাৎ বুঝি?
ময়ূরাক্ষী ভুরু কোঁচকাল, কী বলছ?
কিছু না। অপমানটা হঠাৎ হলে, একটা এদিক ওদিক হয়ে যায় বলছিলে কিনা, তাই জিজ্ঞেস করছিলাম হঠাৎ কি না।
ময়ূরাক্ষী লাল লাল মুখে বলে, তা সে অপমান তোমরাই করে চলেছ। মেয়েদের থেকে বাবা কোনও আঘাতই পাননি।
কোথা থেকে কী সে কথা তো বলিনি ভাই মক্ষী, চটে উঠছ কেন?সুনন্দা হাতের প্লেটটা বাড়িয়ে ধরে বলে,আর দুটো কাজু খাও।
নীলাক্ষ বলে ওঠে, এটা হচ্ছে আমার প্রতি শ্লেষ, বুঝলি মক্ষী? শ্রীমতী সুনন্দার ধারণা আমার বাবাকে উনি আমার থেকে বেশি ভালবাসেন।
ভালবাসা!
সুনন্দা হঠাৎ বেয়াড়া ভঙ্গিতে হেসে ওঠে, সে আবার কী বস্তু? ভালবাসা! হি হি হি! তোমাদের দাদা বেশ মজার মজার কথা বলেন মক্ষী! কী জয়ন্তবাবু, শুনে আপনার মজা লাগছে না?
মীনাক্ষী বাবাকে দোষারোপ করেনি, শুধু বলেছিল, কলেজটা ছাড়া যখন আপনার পক্ষে অনিবার্যই হল বাবা, তখন আমায় একটু কিছু করবার অনুমতি দিন, যাতে নিজের দরকারটাও অন্তত
সরোজাক্ষ একটা অপ্রত্যাশিত কথা বললেন। বললেন,আমি তো তোমাকে কোনও কিছু করতে কোনওদিন নিষেধ করিনি, হঠাৎ এখন অনুমতির কথা কেন?
মীনাক্ষী একথা আশা করেনি। মীনাক্ষী ভেবেছিল বাবা আহত হবেন, ক্ষুব্ধ হবেন। তাই ঈষৎ বিচলিত হল মীনাক্ষী। বলল,এতদিন এদিকটা ভেবে দেখিনি। বেশ, আপনার যখন অমত নেই–
মীনাক্ষীকে থামতে হল।
মীনাক্ষীর বাবা তাঁর চোখের থেকে চশমাটা খুলে মুছতে মুছতে সেই চশমাহীন গভীর ছাপপড়া। চোখ দুটো মেয়ের চোখে ফেলে বললেন, আমার অমত, আমার অনুমতি, এগুলোর সত্যিই কোনও প্রয়োজন আছে তোমাদের জীবনে?
মীনাক্ষী চমকে উঠল।
মীনাক্ষী কেঁপে উঠল।
মীনাক্ষীর মনে হল, সব প্রকাশ হয়ে পড়েছে। বাবার কাছে আর কিছুই অবিদিত নেই। তবু মীনাক্ষী ভাবল–এই সুযোগ। এখনই তার নিজের কথা বলে ফেললে ভাল হত।
কিন্তু মীনাক্ষীর স্বরযন্ত্রটাকে কে যেন আটকে ধরল।
মীনাক্ষী আজও অন্যদিনের মতোই ব্যর্থ হল।
মীনাক্ষীর মাথা নিচু করে বলল, এ কথা কেন বলছেন?
বলছি–একটা উত্তর পেতে চাই বলে। এটা আমার জিজ্ঞাসা।
মীনাক্ষী ঘাড় নিচু করে বসে রইল।
সরোজাক্ষ মৃদু হেসে বললেন, প্রশ্নপত্রটা বড় শক্ত হয়ে গেছে, তাই না? এত তাড়াতাড়ি উত্তরপত্র তৈরি করা সম্ভব নয়। আচ্ছা থাক।
মীনাক্ষী বোকার মতো একটুক্ষণ বসে থেকে উঠে গেল। মীনাক্ষী তারপর নিজের ঘরে এসে চিঠি লিখতে বসল।
.
আজই দেখা হয়েছে।
তাতে কী?
আবার এখুনই তো কত কথা জমে উঠেছে। প্রেমের কথা না হোক, প্রয়োজনের কথা।
দিবাকর আজ বলেছিল, তোমার বাবার যা মতবাদ দেখছি, তাতে ওঁর প্রতি আর আস্থা নেই। এখনও এ যুগেও তিনি এতটুকু মান-অপমানে বিচলিত হন। এখনও আশা করেন ছেলেগুলি সুশীল সুবোধ হবে। এরপর আর কী করে তবে ভাবা যেতে পারে তিনি তাঁর মেয়ের এই স্বয়ংবরা হওয়াটা সুচক্ষে দেখবেন! নাঃ, আশা নেই।
আশা তো করছি না।
তবে আর আমায় ঝুলিয়ে রাখা কেন বাবা? ছেড়ে দাও, বাবার বাধ্য কন্যা হয়ে পিড়িতে বসো গে৷
মীনাক্ষী আজ ক্ষুব্ধ ছিল।
মীনাক্ষী উদ্ধত গলায় বলেছিল, বেশ, দরকার নেই বাবার প্রসন্ন অনুমতির, তোমাকেও আর ঝুলিয়ে রাখতে চাই নে। কালই চলো নোটিশ দিতে। এখন বলো, বিয়ে করে আমায় কোথায় নিয়ে গিয়ে তুলবে।
দিবাকর হো হো করে হেসে উঠল। একেই বলে মেয়ে! যে-কোনও বয়েসেই তোমরা ঘোরতর বিষয়ী!
বিষয়ী না হতে পারলে, কোনও বিষয়েই এগোনো যায় না দিবা! ডাঙার মাটি না দেখেই নৌকো থেকে পা তুলে নেওয়া নির্বুদ্ধিতা মাত্র।
উঃ, একেবারে টাকা-আনা-পাইয়ের হিসেব।
মীনাক্ষী বিরক্ত মুখে বসে ছিল, উত্তর দেয়নি।
দিবাকর তখন এক গল্প ফেঁদেছিল। বলেছিল, মেয়েরা যে কত হিসেবি হয় তা হলে বলি
তারপর দিবাকর তার মামার মেয়ে ব্রজবালার নাম দিয়ে সেই তার দেশের দিদির গল্পটা শুনিয়ে দিয়েছিল।
মীনাক্ষী রুদ্ধকণ্ঠে বলেছিল, এই কথা বলল সে তোমায়?
বলল তো! দিব্যি স্বচ্ছন্দেই বলল।
দিবাকর দিব্যি বানিয়ে বানিয়ে বলেছিল, দোতলায় ঠিক ওর ঘরের পাশেই হচ্ছে আমার ঘর, এ ঘরে চলে এসে হাসতে হাসতে বলল, তোমাদের ভগ্নীপতি আজ দশদিন হল আসছে না। তাই আজ্ঞা দিতে এলাম তোমার ঘরে।
আমি তো বিব্রত বিপন্ন।
বললাম, কিন্তু এত রাত্রে?
ও অনায়াসে ধূর্ত হাসি হেসে বলল,তাতে কী? বিধবা নই, কুমারী নই, ভয়টা কী? বাবা মা থিয়েটার দেখতে গেছে কিন্তু সাবধান করে দিচ্ছি দিবুদা, আমার সেই হতভাগা বরটা যখন আসবে, যেন দেখে না তোমার সঙ্গে আমার চেনা আছে। তুমি বাবার ভাগ্নে, এই পর্যন্ত।
বোঝো তা হলে? সাধে বলছি মেয়েরা হচ্ছে এক নম্বর হিসেবি। তারা সব সময় দু নৌকোয় পা রাখে, যাতে দুটোই দখলে থাকে। তারা মাটিতে পা না রাখা পর্যন্ত নৌকো ছাড়ে না। যেমন তুমি।
মীনাক্ষী রুদ্ধ গলায় বলেছিল, ছেলেরা আর আমাদের অবস্থা কী বুঝবে!
হুঁ, সেই চিরকেলে মেয়েলি প্যানপ্যানানি। এ দেশের আর উন্নতি হয়েছে।
মেয়েরা খুব বেপরোয়া হলেই বুঝি দেশের খুব উন্নতির চান্স?
বেপরোয়া মানেই সাহসী! দিবাকর বলেছিল, সাহসের অভাবই আমাদের দেশকে শেষ করেছে।
দিবাকরের সেই ঘোর কালো রঙের আঁটি সাঁটি ধরনের মুখটা যেন ঘৃণায় বেঁকে গিয়েছিল, এ দেশের সাহসের অভাবের কথা স্মরণ করে।
মীনাক্ষীর মুখে আর কথা জোগায়নি। কিন্তু বলবার কথা অনেক ছিল।
— সেই কথা লিখতেই কাগজ কলম নিয়ে বসল মীনাক্ষী। লিখল, তুমি কেবল আমার সাহসের অভাবই দেখছ, নিজের অভাবটা তোকই দেখছনা? এতবার বলছি তোমার মামার কাছে, তোমার মার কাছে আমাকে একবার নিয়ে চলো, কই যাচ্ছ না তো? তার মানে সাহস হচ্ছে না। ঠিক আছে, আমি একলাই যাব। দেখব কী তাঁরা বলেন আমায়।
.
মীনাক্ষী যখন তার হাতের কলমটা থামিয়ে ভাবনার গভীরে ডুবে গিয়ে ভাবছিল, আচ্ছা আমাদের দেশের সেই প্রথাটাই কি তবে ভাল ছিল? সুখের ছিল? বালিকা বয়েসেই বাপ-মা ধরে একজনের সঙ্গে বিয়ে দিয়ে দিত, ব্যস নিজের দায়িত্ব বলে কিছু থাকত না।–আর জ্ঞান হওয়া ইস্তক যাকে একমাত্র অবলম্বন বলে জানত, তাকেই ভালবেসে ফেলত–মীনাক্ষী ভাবনা থামিয়ে হাসল। ভাবল, আমার মা বাপের দাম্পত্য জীবনই তো আমার প্রশ্নের উত্তর।
মীনাক্ষীর তার নিতান্ত শৈশবের কথা অস্পষ্ট মনে পড়ল। মনে পড়ল তার মায়ের সেই একটা ভয়ংকর হিংস্র মূর্তি। তার বাবার সেই নিবিড় ঘৃণা আর অবজ্ঞার মূর্তি।
অথছ ওঁরা একসঙ্গে কাটিয়েও এলেন এই দীর্ঘ জীবনটা। ওঁরা কোনওদিন বিবাহ-বিচ্ছেদের কথা চিন্তা করেননি, কোনওদিন পালিয়ে যাবার, আত্মহত্যা করবার, সমস্ত সংসারের কাছে নিজেদের এই ফাঁকির ঝুলিটা খুলে ধরবার সাহসও অর্জন করতে পারেননি।
মীনাক্ষীর বাবাও ঠিক সেই সময় সেই কথাই ভাবছিলেন।
অথচ এই জীবনের মধ্যে কাটিয়ে এলাম এতখানি বয়েস পর্যন্ত। কোনওদিন ভাবিনি, এই ফাঁকির জীবনটাকে ছিঁড়ে ছড়িয়ে ধুলোয় ফেলে দিয়ে, সত্যের মুখোমুখি দাঁড়াই।
সরোজাক্ষ ভাবছিলেন–
আসলে আমি আমার এই পারিবারিক সত্তাটাকে গৌণ ভাবতে অভ্যস্ত হয়েছিলাম, আমার কাছে মুখ্য ছিল আমার কর্মময় সত্তাটি। তার উপরেই আমার আমিটাকে প্রতিষ্ঠিত রেখে চালিয়ে যাচ্ছিলাম। সেখানেই ছিল আমার ভালবাসা, আমার আশ্রয়।
এখন সহসা ধরা পড়ে গেছে, সেই আমার একান্ত ভালবাসার, একান্ত আশ্রয়ের জায়গাটা আরও বিরাট একটা ফাঁকির শূন্যতা সৃষ্টি করে রেখে বাতাসে মিলিয়ে গেছে।
মনে হচ্ছে জীবনে বোধহয় আর কোনওদিন আমার এই অভ্যস্ত কাজে ফিরে যেতে পারব না। আমি বোধহয় পড়াতে ভুলে গেছি। ভুলে গেছি আমার অধীত বিদ্যাকে।
না, আমি এখন আর আমার ছাত্রদের ঔদ্ধত্যে মর্মাহত হচ্ছি না, বুঝতে পারছি এ ছাড়া আর কিছু করবার ক্ষমতা ছিল না তাদের। তাদের আমরা শুধু বিদ্যাই দিয়ে এসেছি, শিক্ষা দিতে পারিনি।
বিদ্যাটা তো একটা হাতিয়ার মাত্র। যেটা তাদের জীবনযাত্রার কাজে লাগবে, জীবন সাধনায় নয়।
ওদের সামনে অনেক আশার ছবি তুলে ধরছে জগৎ, তুলে ধরতে পারছেনা কোনও আদর্শের ছবি। চরিত্র বস্তুটা দেখতে পাচ্ছে না ওরা, চরিত্রবান হবে কোথা থেকে তবে? ওদের কাছে প্রত্যাশার পাত্র খালি পেতে ধরলে বিফল তো হবই।
না, আমার ছাত্রদের দোষ দিতে পারছি না আমি। আমার সন্তানদেরও নয়।
আমার অক্ষমতাই আমার সন্তানদের অসার করেছে, অবিনয়ী করেছে, অসভ্য করেছে। আমাদের প্রেমহীন বিকৃত দাম্পত্য জীবনের অসহায় বলি ওরা। ওদের জন্যে বেদনাবোধ করবার আছে। ওদের কাছে ক্ষমা চাইবার আছে।