চেক নয়, একশো টাকার নোটও নয়, স্রেফ দশ টাকার নোটের তাড়া। হয়তো হৈমবতী ওটাই সুবিধে বুঝেছিলেন।
সরোজাক্ষ সেই তিন তাড়া নোটের দিকে তাকিয়ে অবাক গলায় বলেন, কী এ?
সারদাপ্রসাদ যেন শেষ মুহূর্তে ট্রেন ধরতে যাচ্ছে।
সারদাপ্রসাদের ভঙ্গিতে অন্তত সেই ব্যস্ততা। নোটের তাড়া তিনটে সরোজাক্ষর সামনে ফেলে দিয়ে প্রায় দৌড়ে পালিয়ে যেতে যেতে বলে যায়, কিছু না, কিছু না। একজন পাবলিশার প্রথম খণ্ডটা নিয়ে হাজার তিনেক টাকা অ্যাডভান্স দিল, তাই
সারদাপ্রসাদের কণ্ঠে অনায়াস তাচ্ছিল্যের সুর। যেন হাজার তিনেক টাকাটা কিছুই না, যেন সেটা খোলামকুচির সমগোত্র, তাকে পকেট থেকে বার করে যেখানে-সেখানে ফেলে দেবার মধ্যে আশ্চর্যের কিছু নেই।
পালিয়ে গিয়ে অবশ্য পরিষ্কার করে কিছু ভাবতেও সময় লাগে বেচারার।
বুকের ধড়ফড়ানি কমলে তবে ভাবে, নাঃ মিথ্যে কথাটা আর কী? পাবলিশার বলতে দোষ কোথায়? বাংলায় তবু প্রকাশিকা বলে একটা শব্দ আবিষ্কার করা হয়েছে, কিন্তু ইংরেজি ভাষায় ওই পাবলিশার শব্দটার নারী সংস্করণ কী হওয়া উচিত তা যখন সারদাপ্রসাদের জানা নেই, তখন পাবলিশার ছাড়া আর কী বলবে সে?
তবে হ্যাঁ, মনে মনে মাথাটা নাড়ে সারদাপ্রসাদ, ওই দিয়েছে শব্দটা উচ্চারণ করা গর্হিত হয়েছে। দিয়েছেন বলা উচিত ছিল। কিন্তু কেমন গোলমাল হয়ে গেল। যাক গে, ভবিষ্যতে যাতে না জিভটা অমন অসতর্ক হয়ে বসে, হুশ রাখতে হবে।
তা সারদাপ্রসাদ যাই ভাবুক, সরোজাক্ষ সেই নোটের তাড়াগুলোর দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে ভাবেন, সারদা কি শেষটায় চুরি-ডাকাতি ধরল নাকি?
সারদার সঙ্গে ওই চুরি-ডাকাতি শব্দটা খাপ খাওয়ানো সহজ নয়, কিন্তু এটাই কি বিশ্বাস করা সহজ, সত্যি সত্যিই কোনও প্রকাশক ওকে তিন-তিন হাজার টাকা অগ্রিম দিয়ে বসেছে। কথায় ভুলে টাকা খসাবে, ব্যবসাদাররা এমন কাঁচা ছেলে নয়।
তবে আর কী?
ইদানীং যে সারদা উপার্জনের চেষ্টায় ঘুরছে সেটা সরোজাক্ষ বিজয়ার সুতীব্র এবং সশব্দ স্বগতোক্তির কল্যাণে নিজের এই আত্ম-নির্বাসন কক্ষে অবরুদ্ধ থেকেও টের পেয়েছেন, কিন্তু সেই চেষ্টার গাছে যে সহসা এতখানি ফল ধরে, সে ফল একেবারে পেকে উঠেছে, তাই বা বিশ্বাস করা যায় কী করে?
টাকাটা যে সারদাপ্রসাদ কোনও অলৌকিক পথে পেয়েছেন, তাতে সন্দেহ নাস্তি, কিন্তু অবোধ লোকটা কার খপ্পরে পড়ল সেইটাই তো চিন্তা।
তা ছাড়া সারদাপ্রসাদের এই আচরণটাও চিন্তার। এনে ফেলে দিয়েই ছুটে পালাবার হেতুটা কী?
লজ্জা?
হতে পারে।
কতকগুলো ব্যাপারে অহেতুক লজ্জা ওর আছে। কারও প্রতি মায়া-মমতা প্রকাশ করতে পারে না সে, ওটা খুব লজ্জার বিষয় ওর কাছে। তাই যে-কোনও ভাবে পাওয়া ওই টাকাটা অমন করে
কিন্তু সরোজাক্ষ?
সরোজাক্ষর কি লজ্জা নেই?
সরোজাক্ষ ওর সেই অব্যক্ত মায়া-মমতার শিকার হবেন?
না, তা হয় না।
সরোজাক্ষকে আপন নির্বাসন কক্ষ থেকে বেরোতে হল।
সরোজাকে ওই পলায়মান লোকটাকে ডেকে বলতে হয়, তা হয় না।
সারদাপ্রসাদ সেই তার অবোধ মুখটা নিয়ে বলে, হয় না? তার মানে?
মানে বুঝিয়ে দিতে হবে, এমন শক্ত কথা তো এটা নয় সারদা? ধরে নিচ্ছি তোমাকে তোমার কোনও পাবলিশার দিয়েছে টাকাটা। কিন্তু আমি সে টাকা নিতে যাব কেন? আর আমাকেই বা দিতে যাবে কেন তুমি?
আপনি নিতে যাবেন কেন? আপনাকে দিতে যাব কেন? সারদা হতভম্ব মুখে তাকিয়ে থেকে বলে, তবে কাকে দেব?
সরোজাক্ষ বলেন, দেবার কথা আসছে কোথা থেকে? তোমার টাকা তোমার নিজের কাছে রেখে দেবে। ব্যাঙ্কে জমা দেবে।
সারদাপ্রসাদের মুখটা আস্তে আস্তে লাল হয়ে ওঠে। তবু সারদাপ্রসাদ উত্তেজিত হয় না। শান্ত গলায় বলে, আমার টাকা আমি ব্যাঙ্কে জমা করে রাখব।
সদা উত্তেজিত সারদাপ্রসাদের মুখে এই শান্ত ভাবটা অদ্ভুত দেখতে লাগে। কিন্তু সরোজাক্ষর চোখে বোধহয় সেটা ধরা পড়ে না। কারণ সরোজাক্ষর চোখ দুটোই অন্যদিকে। সরোজাক্ষ আকাশে চোখ রেখে কথা বলছেন।
তাই সরোজাক্ষ আগের মতো সুরেই বলেন, হ্যাঁ, তাই তো রাখবে। সেটাই তো স্বাভাবিক। ভবিষ্যতে ওই টাকা থেকে তুমি অন্য খণ্ডগুলো ছাপাতে পারবে। সব সময় এ রকম পাবলিশার নাও পেতে পারো!
সারদাপ্রসাদও এবার অন্যদিকে মুখ ফিরিয়ে কথা বলে,ওই টাকা দিয়ে ভবিষ্যতের সুবিধের কথা ভাবব? সেই ভবিষ্যতের জন্যে আমি দোরে দোরে ঘুরে
থেমে যায়।
হয়তো শেষটা আর বলা সঙ্গত নয় বলে বলে না। অথবা হয়তো শেষটা আর বলতে পারে না বলেই বলে না।
কিন্তু যতটুকু বলেছে, বোঝবার পক্ষে সেটাই যথেষ্ট।
সরোজাক্ষর মুখটা লালচে হয়ে ওঠে।
সরোজাক্ষ গম্ভীর মুখে বলেন, আমার জন্যে তুমি দোরে দোরে ঘুরে টাকার সন্ধান করে বেড়িয়েছ?
আহা হা! কী আশ্চর্য! ইয়ে মানে আমি কি তাই বলছি? মানে আমি বলতে চাইছি, আমি বাউণ্ডুলে মানুষ, টাকা-ফাঁকা নিয়ে করবটা কী? হয়তো কোথায় রাখতে কোথায় রেখে হারিয়েই ফেলব। এ বরং নিরাপদ থাকল।
তা হয় না।
জজের রায় দেবার ভঙ্গিতে ওই ছোট্ট কথাটুকু উচ্চারণ করেন সরোজাক্ষ।
কিন্তু ওইটুকুই তো যথেষ্ট।
সারদাপ্রসাদের কানদুটো ঝাঁ ঝাঁ করে ওঠে। ওই টাকাটাকে ঘিরে ও মিষ্টি একটি স্বপ্ন দেখতে দেখতে আসছিল। আর কিছুই নয়। মিষ্টি একটু প্রসন্নতা, বইটা সম্পর্কে একজনও আগ্রহী হয়েছে শুনে এতটুকু আনন্দ। কিছুটা রিহার্সালও দিতে দিতে এসেছিল সারদাপ্রসাদ, প্রকাশকের নামধাম জিজ্ঞেস করলে কী বলবে।
সরোজাক্ষ সারদাপ্রসাদের সেই রঙিন কাঁচের ফুলদানিটা আছড়ে ভেঙে দিলেন!
তবু সারদাপ্রসাদ, হ্যাঁ, সেই গরম জলে ফেটে পড়া চোখটাকে কষ্টে সামলে সারদাপ্রসাদ ভাবল, আমারই ভুল হয়েছিল। আমার ভাবা উচিত ছিল দাদা এইরকমই একটা কিছু বলবেন। দাদাকে তো আমি জানি, এ টাকা বউদির হাতে দিলেই ঠিক হত। আমি দাদার একটু প্রসন্নতার আশায় এই বোকামিটা করে বসলাম।
তাই সারদাপ্রসাদ কষ্টে গলা পরিষ্কার করে বলে,ঠিক আছে। আপনাকে নিতে হবে না।
বলে ফের ঘরে ঢুকে নোটের তাড়া তিনটে কুড়িয়ে নিয়ে ছাদের সিঁড়ির দিকে এগোয়।
সরোজাক্ষ অবোধ নন।
সরোজাক্ষ বুঝতে অক্ষম হন না, সারদাপ্রসাদের লক্ষ্যটা কী।
তাই সরোজা গম্ভীর গলায় ডাকেন, সারদা।
শুধু সারদা।
তার বেশি কিছু নয়।
তবু সেই কেবলমাত্র ওই ডাকটির মধ্যেই ভয়ংকর একটি প্রতিবাদ। যেন পায়ে লোহার শিকল পড়ল সারদাপ্রসাদের।
অগত্যা দাঁড়িয়ে পড়তে হল তাকে।
সেই দাঁড়িয়ে পড়ার মধ্যেও শক্তি সংগ্রহ করতে লাগল সে। বেশ তো, উনি না নিলেন তো বয়েই গেল, বউদি কখনওই
মনে করল শক্তি সঞ্চয় হয়ে গেছে।
তাই শান্ত গলায় বলল, কী বলছেন?
বলছি টাকাগুলো নিয়ে তুমি ছাতে যাচ্ছ কেন?
যাচ্ছি এমনি।
এমনি বলে কোনও কথা হয় না সারদা!
এমনি আবার কী। আমি বাড়ির গিন্নিকে দেব।
তা হয় না সারদা!
তাও হয় না?
সারদাপ্রসাদ ঘাড় ফিরিয়ে বলে, বাড়ির লোকেরা, বাড়ির ছেলেরা রোজগার করে এনে বাড়ির হেডের হাতে দেয় না?
সরোজাক্ষ একটু থেমে যান।
কিন্তু সরোজাক্ষ থেমে থাকেন না, আবার কথা বলে ওঠেন।
হয়তো সরোজাক্ষর শত্ৰুগ্রহই কথা বলায়। নইলে সরোজাক্ষ তত বাদ-প্রতিবাদের মানুষ নন। সরোজাক্ষ তো একটা বিষয় নিয়ে দুটো কথা বলতে ভালবাসেন না।
তবু আজ বললেন।
বললেন, ওটা তোমার রোজগারের টাকা হলে হয়তো আপত্তির ছিল না সারদা, কিন্তু তা তো নয়।
তা নয়?
সারদাপ্রসাদ কায়দা করে জামার কাঁধে মুখ নামিয়ে চোখটাকে কিঞ্চিৎ ভদ্রমতো করে নিয়ে বলে, তবে কি আমি চুরি করে এনেছি?
কী করেছ তা অবশ্য তুমিই জানো, কিন্তু হঠাৎ তুমি—
তা জানি৷ সারদা ক্ষুব্ধ আহত গলায় বলে, হঠাৎ আমাকে কেউ একটা অফিসারের চেয়ারে বসিয়ে দিয়েছে সে কথা বলছিও না। পাবলিশার দিলে সেটাও রোজগারই।
পাবলিশার?
সরোজাক্ষর মুখে একটা সূক্ষ্ম হাসি ফুটে ওঠে।
সে হাসি সারদাপ্রসাদের চোখ এড়ায় না। সারদাপ্রসাদের মনে হয় সিঁড়িটা দুলছে। সারদাপ্রসাদের মনে হয় চিরদিন যে মাটিটার উপর সে মাটি ভেবে নিশ্চিন্তে দাঁড়িয়ে ছিল, হঠাৎ দেখা যাচ্ছে সেটা চোরাবালি।
সারদাপ্রসাদের মাথা থেকে পা পর্যন্ত একটা তরল আগুন ছুটোছুটি করে ওঠে। সারদাপ্রসাদ ধৈর্য হারায়, জীবনে কখনও যা না করেছে তাই করে, সরোজাক্ষর সামনে তীব্র গলায় চেঁচিয়ে ওঠে, হাসলেন যে? হাসলেন কেন?
সরোজাক্ষ চমকে ওঠেন।
সরোজাক্ষর হঠাৎ মনে হয়, সারদাপ্রসাদের গলার স্বর জীবনে এই প্রথম শুনলেন।
এই অপরিচিত স্বরকে আর শুনতে সাহস হল না সরোজাক্ষর, বললেন, হাসব কেন?
বলে ঘরে ঢুকে এলেন।
হাসলেন তো–বলে সারদাপ্রসাদও পিছু পিছু আসে।
কিন্তু ততক্ষণে অন্য ঘটনা ঘটে গেছে। সারদাপ্রসাদের ওই বিকৃত কণ্ঠের চিৎকার সুনন্দাকে ঘর থেকে বার করেছে, বার করেছে মীনাক্ষীকেও, আর নামিয়ে এনেছে বিজয়াকেও।
ওরা সাহস করল না।
বিজয়া সাহস করলেন।
বিজয়া ঘরে ঢুকে এসে বলে উঠলেন, ব্যাপার কি ঠাকুরজামাই? হঠাৎ হাল্লা তুলেছ যে?
হাল্লা?
সারদাপ্রসাদের ভিতরের গুহার হঠাৎ-জেগে-ওঠা ঘুমন্ত বাঘটা আবার গর্জে ওঠে, আপনারা ভেবেছেন কী? আমি একটা মানুষ নই? আমার রোজগারের টাকা দাদা পা দিয়ে ছুঁলেন না, অবিশ্বাসের হাসি হাসলেন, আর আপনি
তোমার রোজগারের টাকা
বিজয়ার এতক্ষণে সারদাপ্রসাদের হাতের উপর চোখ পড়ে, বিজয়ার চোখে লোভের আগুন জ্বলে ওঠে। টাকা হচ্ছে টাকা, তার ইতিহাসটা যাই হোক।
আর মোটামুটি ইতিহাসটা বিজয়া অনুমান করেই নেন। যেভাবেই হোক ওই টাকাটা সারদাপ্রসাদ এনেছে এবং সরোজাক্ষকেই দিতে এসেছে, কিন্তু মহাপুরুষটি নিতে অস্বীকৃত হচ্ছেন।
বিজয়া বলে ওঠেন, তুমিও আচ্ছা বটে ঠাকুরজামাই, টাকা দিতে এসেছ পরমহংস ঠাকুরের কাছে? যাঁর কাছে টাকা মাটি, মাটি টাকা! আমরা বাবা সংসারী মানুষ, আমাদের কাছে টাকা টাকা! আমায় দাও
বিজয়া আপন পরিধেয়র শুচিতা ভুলে প্রায় ছোঁ মেরে টাকাটা নিয়ে নিতে যান।
কিন্তু সরোজাক্ষকে বুঝি আজ সর্বনাশের নেশায় পেয়েছে। তাই সরোজাক্ষ কঠিন গলায় বলেন, না। নেবে না। ও টাকা সারদা নিজের জমি-জমা বেচে নিয়ে এসেছে–
জমি-জমা!
আকাশ থেকে পড়ে সারদা।
আপনি সেই কথা ভাবছেন?
তবে কি সত্যিই ভাবব সারদা, তোমার ওই বই নিয়ে পাবলিশার—
ওই! আবার আপনি হাসছেন। সারদাপ্রসাদের মাথায় আগুন জ্বলে ওঠে, সারদাপ্রসাদ আবার চেঁচিয়ে ওঠে,নেহাত নাম বলা বারণ আছে তাই, নইলে আমি এক্ষুনিই আপনাকে নিয়ে গিয়ে ভজিয়ে দিতাম। দেখাতাম সত্যিই কেউ দিয়েছে কিনা।
নাম বলা বারণ! তবে আর কী করা–সরোজাক্ষ খাটের উপর বসে পড়ে বলেন, কিন্তু ওই অনামা অজানা টাকা তো তোমার বউদিকে নিতে দিতে পারি না সারদা।
নিতে দিতে পারেন না?
সারদাপ্রসাদও বুঝি বসে পড়ে।
তার মানে এ-সংসারের উপর আমার কোনও দাবি নেই! আমার টাকা আপনারা পা দিয়েও ছোঁবেন না? অথচ আমি চিরকাল নিজের বাড়ি ভেবে-সারদাপ্রসাদ ছটফটিয়ে পায়চারি করতে করতে বলে, বিনা দ্বিধায় খেয়েছি পরেছি, আবদার করেছি। তার মানে সেটা দয়ার ভাত খেয়েছি। তার মানে আপনি আমাকে বাড়ির একটা পোষা কুকুর-বেড়াল ছাড়া আর কিছু ভাবেননি।
আঃ। সরোজাক্ষ প্রায় ধমকে ওঠেন, কী বাজে বাজে কথা বলছ?
বাজে নয়, বাজে নয়, ঠিকই বলছি–সারদা সরোজাক্ষর সামনে এসে দাঁড়ায়, লাল লাল চোখে বলে, বুঝতে পারছি চিরদিনই আপনি আমার লেখাকে ব্যঙ্গের দৃষ্টিতে দেখেছেন। আজ সেই হাসি প্রকাশ পেয়ে গেছে। আমি মুখ, আমি গাধা, তাই বিশ্বাস করে এসেছি–সারদাপ্রসাদের চোখের জল এবার সমস্ত চেষ্টা ব্যর্থ করে দিয়ে পরম শত্রুতা করে বসে। সারদা ভাঙা ভাঙা গলায় বলে ওঠে, কিন্তু জগতে একজনও খাঁটি লোক আছে–জিজ্ঞেস করুন গে আপনার খুড়িমাকে, টাকা সারদা কোথায় পেয়েছে–
আবেগে উত্তেজনায় নাম প্রকাশের নিষেধবাণী রক্ষা করা সম্ভব হয় না সারদাপ্রসাদের। বলে ফেলে জামার হাতাটা তুলে তুলে ঘন ঘন চোখের জলটা মুছতে থাকে সারদা।
পুরুষমানুষের চোখের জল একটা মর্মান্তিক দৃশ্য বইকী! বোধ করি জগতের প্রধানতম মর্মান্তিকের অন্যতম। সরোজাক্ষ অপ্রতিভ হচ্ছিলেন, কিন্তু খুড়িমা শব্দটা যেন সরোজাক্ষর মাথার মধ্যে হাতুড়ির ঘা বসিয়ে দিল। সেই আঘাতে সরোজাক্ষর সামনের অন্ধকারের পরদাটা ছিঁড়ে উড়ে গেল। সরোজাক্ষ আর ওই মর্মান্তিক দৃশ্যটার জন্যে অপ্রতিভ হতে পারলেন না।
সরোজাক্ষ কপালটা টিপে ধরে ধিক্কারের গলায় বলে উঠলেন, সারদা, সত্যিই তুমি মুখ অবোধ। তাই খুড়িমা তোমাকে মাধ্যম করে তোমার পাবলিশার সেজে খুড়িমা ও টাকা আমার সংসারকে ভিক্ষে দিয়েছেন সারদা! জানেন–তুমি সেটা বুঝতে পারবে না। তুমি সত্যিই বিশ্বাস করবে তোমার ওই ছেঁড়া কাগজের বোঝাগুলো
কথার মাঝখানে থেমে যান সরোজা। বোধ করি হঠাৎ হুঁশ হয়। কোথায় গিয়ে পড়ছিলেন।
কিন্তু এ হুঁশে কি আর কোনও উপকার হয়? যেখানে পৌঁছতে যাচ্ছি ভেবে থমকালেন, সেখানে তো পৌঁছে গেছেনই।
ওই আধখানা কথায় শান্ত হয়ে গেছে সারদাপ্রসাদ। তার চোখের জল শুকিয়ে গেছে।
সারদাপ্রসাদ সেই শুকনো চোখ আর শান্ত গলায় বলে, এখন বুঝতে পারছি সেটা! মূর্খের শতেক দোষ, একথাটা শাস্ত্রেই আছে, তবে অন্ধেরও চোখ ফোটে।
বলে টাকাগুলো আবার পকেটে পুরে ধীরে ধীরে ঘর থেকে বেরিয়ে যায়, সিঁড়ি দিয়ে নেমে যায়।
সুনন্দা দেখে, মীনাক্ষী দেখে, ঘটনাটা কী ঠিক না বুঝলেও ওরা ভীত হয়। ওদের সাহস হয় না, ওই চিরসহজ মানুষটার কাছে এগিয়ে গিয়ে প্রশ্ন করতে, যাচ্ছ কোথায়?
এমনকী বিজয়াও মূক হয়ে দাঁড়িয়ে থাকেন।
আর সরোজাক্ষ?
তিনি তো চির মূক।
তিনি যেন অনুভব করেন, তাঁর হৃদপিণ্ডের একটুকরো অংশ তিনি নিজেই খামচে ছিঁড়ে বার করে ফেলে দিলেন। সেই খামচানো জায়গাটায় হয়তো চিরদিনই ক্ষত থেকে যাবে।
সরোজাক্ষ আর কোনওদিন ওই মূর্খ অবোধ লোকটার মুখের দিকে তাকাতে পারবেন না।
কিন্তু এ ছাড়া আর কী করতে পারতেন সরোজাক্ষ?
বিজয়ার মতো টাকাকে কেবলমাত্র টাকা ভাবতে পারার ক্ষমতা তাঁর কোথায়? তবে এবার সরোজাক্ষকে স্বীকার করতেই হবে, মানুষ পরিবেশের দাস! পরিবেশকে অস্বীকার করে নিজের ছাঁচে নিজেকে গড়ব বলে পণ করে বসে থাকলে সেটা ব্যর্থতার বোঝা হয়ে ওঠে মাত্র।
সরোজাক্ষ কালই আবার কলেজের দরজায় গিয়ে দাঁড়াবেন। ঘাড় হেঁট করে বলবেন, আমি ভুল করেছিলাম।
আমি ভুল করেছিলাম!
মনে-প্রাণে স্বীকার না করলেও, বলতেই হয় মানুষকে একথা।
আমি ভুল করেছিলাম।
না বললে এই সমাজের মধ্যে তোমার ঠাঁই হবে না। তুমি যদি তোমার কর্মস্থলে গিয়ে সাধু হয়ে থাকতে চাও, যদি ঘুষ নিতে না চাও, দুর্নীতির প্রশ্রয় দিতে না চাও, যদি দুর্নীতিকে উদঘাটিত করতে চাও, তোমার ভাগ্যে জুটবে উৎপীড়ন, অসুবিধে, লাঞ্ছনা, অপমান, জুটবে দারিদ্র, অসহায়তা, অনিশ্চয়তা।
তুমি দরজায় দরজায় ঘুরে পৃথিবীর চেহারাটা দেখতে পাবে, তখন তুমি ফিরে গিয়ে বলতে বাধ্য হবে, আমি ভুল করেছিলাম, সাধু থাকার পণ করে মস্ত একটা ভুল করেছিলাম।
তুমি পৃথিবীর মন্ত্রে দীক্ষা নেবে তখন।
পৃথিবীই দেবে সে দীক্ষা।
সরোজাকে কেউ দীক্ষা দিতে আসেনি, কিন্তু ভিক্ষা দিতে এসেছে। তার থেকে অসহায়তাই বা আর কী আছে?
সরোজাক্ষকে অতএব পুরনো দরজায় ফিরে গিয়ে বলতেই হবে, আমি ভুল করেছিলাম।
আর সেটা যদি বলতে না পারো, ভীরু কাপুরুষের মতো পৃথিবী থেকে বিদায় নাও।
সরোজাক্ষ কি সেই পথই বেছে নেবেন?
ছি ছি!
তার মধ্যেই বা সম্মান কোথায়? গৌরব কোথায়? নিজের মতো করে বাঁচা কোথায়? নিজের মতো করে মরাটাকে পৃথিবী ক্ষমা করে না।
বলে, ছি ছি! লোকটা যুদ্ধক্ষেত্র থেকে পালাল!
অথচ অতর্কিতে সহজ আর স্বাভাবিক মৃত্যু আসবে সেইসব মানুষের, যারা দীর্ঘদিন পৃথিবীটাকে আঁকড়ে ধরে থেকে অনেক শ্বাস-প্রশ্বাসের সংখ্যা গুনতে চায়।
সরোজাক্ষর দরজায় নাকি একদিন মৃত্যুর পদধ্বনি শোনা গিয়েছিল, দরজা থেকে ফিরে গেছে, ঘরে এসে ঢোকেনি। অতএব সরোজাক্ষকে জীবনের দরজায় গিয়ে হাত পাততে হবে।
কারণ পৃথিবী যদি কাউকে দীক্ষা দিতে না পারে, তোভিক্ষা দিতে আসে।
.
আচ্ছা তুমি আমার সঙ্গে এরকম শত্রুতা করছ কেন বলো তো?
নীলাক্ষ পরম আদরে স্ত্রীকে নিবিড় বাহুবন্ধনে বেঁধে বলে, সেই সেদিনের রাগটা বুঝি আর ভুলতে পারছ না?
সুনন্দা সুকৌশলে নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়ে অবাক গলায় বলে, রাগই বা কীসের, শত্রুতাই বা কীসের?
নীলাক্ষ মনে মনে দাঁতে দাঁত চেপে বলে, হারামজাদি শয়তানি! ভদ্রঘরের বউ হতে এসেছিলে কেন তুমি? স্টেজে যাওনি কেন? পাবলিক থিয়েটারের স্টেজে? পয়লা নম্বরের একটি অভিনেত্রী হতে পারতে! অথচ আমার উপকারের জন্যে একটু প্রেমের অভিনয় করতে ক্ষয়ে যাও তুমি! তুতিয়ে পাতিয়ে খোশামোদ করে পাঠালে, তুমি শয়তানি আমাকে জব্দ করবার জন্যে এমন বাড়াবাড়ি করে বসো যে, পা থেকে মাথা অবধি জ্বলে যায়। বুঝতে পারি না সেটা সত্যি, না অভিনয়। যেমন মেহেরাটার সঙ্গে করছিলে। ব্যস, যেই সে একটু বেশি এগোতে গেল, অমনি তুমি পতিব্রতা হিন্দু কুলবধূ হয়ে ছিটকে পালিয়ে এসে ঘরের কোণে আশ্রয় নিলে! আর আমার অবস্থাটা কী হল? ভাবলে সেটা? ভাবছ একবারও? ব্যাটা বদমাশ যে এখন আমাকে জুতোর ঠোক্কর দিয়ে সরিয়ে দিচ্ছে, তার কি? তাকে আমি দোষ দিই না। এতখানি অপমানে পুরুষ বাচ্চা খেপে যাবে না? কিন্তু আমাকে যে সেই খ্যাপা কুকুরের কামড় খেতে হচ্ছে। পতিব্রতা! তাই যদি, পতির একটু উপকার করতে পারো না–এত অহংকার! আরে বাবা, তুই একটা বিবাহিতা মেয়ে, তোর আস্ত সুস্থ একটা স্বামী রয়েছে, তোর আবার এত ভয়টা কী?
কিন্তু মনের দাঁত মনের বাইরে মুখে আসে না। মুখের মধ্যেকার সাজানো দাঁতের পাটিটাই মুখের বাইরে উঁকি মারে।
তা রাগ ছাড়া আর কী! আমার সঙ্গে বেরোতেই চাও না। মেহেরা সাহেব কত দুঃখ করছিলেন। বলছিলেন, মদের ঝোঁকে কখন কী আবোল-তাবোল বলে ফেলেছিলাম, তার জন্যে মিসেস এত রেগে গেলেন যে–
বলেছেন বুঝি সাহেব? সুনন্দা মৃদু হেসে বলে, কোনটা কোন ঝোঁকে বলেছেন, সেটাই অবশ্য গোলমেলে রয়ে গেল। কিন্তু তোমার আজ ব্যাপার কী?চাঁচাছোলা কণ্ঠস্বর, পদক্ষেপ সঠিক, আজ বুঝি ড্রাই ডে?
নীলাক্ষ আর একবার মনের দাঁতটা কড়মড়িয়ে, মুখের দাঁতে হেসে ওঠে, তুমি কেবলই আমাকে মাতাল হতে দেখো। অথচ ক্লাবে আমায় সবাই বলে, এই মিস্টার মৈত্র হচ্ছেন একটি লোক, যাকে কোনওদিন টেনে তুলে নিয়ে যেতে হয় না, নিজের পায়ে বাড়ি ফেরেন।
সত্যি? সুনন্দা চোখে হাসির ঝিলিক মেরে বলে ওঠে, এ যে দেখছি দারুণ সার্টিফিকেট। বেশ! বেশ।
নীলাক্ষ ওই ঝিলিকের দিকে তাকিয়ে মনে মনে বলে, আমার জন্যে ওইটুকুর বাজে খরচা কেন? আমি কি ওতে কাত হব?
কিন্তু মুখে নীলাক্ষকে অভিমানী স্বামীর ভূমিকায় অভিনয় করতে হয়, ভাবছি–আর বেশ থাকব না। বেহেড হব! রাস্তায় পড়ে গড়াগড়ি খাব–
বাঃ বাঃ, চমৎকার! সাধু সংকল্প! সুনন্দা হাততালি দিয়ে ওঠে,উঃ দি আইডিয়া!
তা তুমি যদি আমার সঙ্গ ত্যাগ করো, উচ্ছন্ন যাওয়া ছাড়া গতি কি আমার?
সুনন্দা মনের দৃষ্টিটাকে শ্যেন করে। ওর শেষ চাল! নিজে উচ্ছন্ন যাবার ভয় দেখিয়ে স্ত্রীকে সেই পথে ঠেলে দেবার সাধু চেষ্টা। কিন্তু প্রভু, তোমার ইচ্ছের পুতুল হয়ে আমার স্বর্গে নরকে কোথাও যাবার ইচ্ছে নেই। যাই যদি তো নিজের ইচ্ছেতেই যাব। নরকে হলে নরকেও।
কিন্তু সুনন্দাও মনের ছায়া বাইরে ফেলে না। সুনন্দা কৌতুকের গলায় বলে, তা সেটাই বা কম কী? উচ্ছন্ন নামক জায়গাটা তো পৃথিবীর সেরা জায়গা। যদি আমার কল্যাণে তুমি সেই সেরা জায়গার টিকিটটা সংগ্রহ করে ফেলতে পারো, নিজেকে আমি ক্রেডিট দেব।
আচ্ছা সেটা না হয় পরে দিও। আজ চলো না একটু আমার সঙ্গে।
(সুনন্দা মনে মনে) হুঁ বুঝেছি, নতুন কোনও রুই কাতলার সন্ধান পেয়েছ, খেলিয়ে তুলতে ভাল টোপ-এর দরকার। কিন্তু আমি আর তোমার টোপ হচ্ছি না। না, সতীধর্মের পরাকাষ্ঠা দেখাতে নয়, পবিত্রতার বিশুদ্ধতা রক্ষা করতেও নয়, স্রেফ তোমার উদ্দেশ্য-সিদ্ধির হাতিয়ার না হবার জন্যে। তুমি যে হরদম তোমার সুন্দরী স্ত্রীটিকে ভাঙিয়ে খাবে, তা আর হতে দিচ্ছি না। ভেবো না তোমার থেকে আমি বোকা।
মুখে—
আজ তো হতেই পারে না। আজ আমার বিশেষ একটু কাজ আছে।
কাজ! তোমার আবার কাজ কী?
কেন, আমার কোনও কাজ থাকতে পারে না?
আঃ পারবে না কেন? তবে আমি জানি না, অথচ বিশেষ কাজ–
তাতে চোখ কপালে তোলবার কী আছে? আমি জানি না, অথচ তোমার বিশেষ, এমন কাজ তো ঝাঁকে ঝাঁকে আছে তোমার।
তা অবশ্য আছে—
নীলাক্ষ গৌরবের গলায় বলে, পুরুষের একটা আলাদা কর্মজীবন থাকে—
মেয়েদেরও সেটা থাকতে পারে।
কী ব্যাপার, তলে তলে কিছু আয় উপায় করা হচ্ছে নাকি?
সুনন্দা এবার মুখের সেই ব্যঙ্গহাসির খোলসটা খুলে ফেলে বলে, যদি হয়, সেটা কি ভুল করা হবে? সংসারের অবস্থা তুমি জানো তো?
সংসারের?
নীলাক্ষ সহসা উদ্দীপ্ত গলায় বলে ওঠে, আমি সংসারের অবস্থা জানতে যাব কী জন্যে? সংসার আমার অবস্থা জানতে চেয়েছে কোনওদিন? আজই আমি দুপয়সা করে খাচ্ছি, কিন্তু এমন দিনও গেছে আমার যে, একটা সিগারেট কেনবার পয়সা জোটেনি, বন্ধুদের কাছে ধার করে করে বন্ধু হারিয়েছি। একটা ভিন্ন দুটো গরম স্যুট ছিল না। দেখেছে সেদিকে তাকিয়ে সংসার? না না, সংসার যেন আমার কাছে কিছু আশা করে না।
করছেও না।
সুনন্দা জানলার কাছে সরে গিয়ে বলে, করছেও না সে আশা।
কিন্তু তুমি? তুমি আমার স্ত্রী, তুমিই বা সে আশা দেখাতে যাবে কেন? বহুবার তোমায় বলেছি– আমরা এখান থেকে সরে পড়ি ।
অথচ আগে যখন আমি বলেছি ওকথা, তুমিই বলেছ, চলে গেলে বাড়ির ভাগ পাব না।
বলেছিলাম! মানছি সেকথা! কিন্তু কর্তার যা মতিগতি দেখা যাচ্ছে, তাতে আর এ বাড়ির একখানা ইটও উত্তরপুরুষদের জন্যে থাকবে বলে মনে হয় না। স্রেফ তো জরদগব হয়ে বসে আছেন। কোনওদিন শুনব বাড়ি মর্টগেজ আছে। হ্যাঁ, হঠাৎ কোনওদিন এ কথা শুনলে আশ্চর্য হব না। তারপর? বাড়ির কর্তাটির যদি হঠাৎ এদিক-ওদিক হয়ে যায়, তখন? ভেবেছ তখন গলায় কী কী পড়বে? বিধবা মা, আইবুড়ো বোন, অপোগণ্ড ভাই, ওই এক আগাছা, আর নিজের স্ত্রী-পুত্র তো আছেই। বুঝছ অবস্থা?
বুঝেছি বইকী! সুনন্দা বলে,আহা, ভেবে এখন থেকেই তোমার জন্যে করুণা হচ্ছে। এই বঙ্গভূমিতে কার কার ভাগ্যে এহেন গন্ধমাদন চেপেছে!
নীলাক্ষ ট্রাউজার ছেড়ে পায়ে একটা পায়জামা গলাতে গলাতে বলে, জানি তুমি ব্যঙ্গ করবে। জানি আমার জন্যে সহানুভূতির কানাকড়িও নেই। কেন যে এখনও ও আমার দু চক্ষের বিষ– বলে ডিভোর্স স্যুট আনছ না তাই ভাবি। আনছ না বোধ হয় তোমার এই সাধের শ্বশুরবাড়ি, পরম পূজনীয় শ্বশুরঠাকুর, আদরের ঠাকুরপো ঠাকুরঝিদের হারাতে হবে ভেবে।
সুনন্দা খিলখিল করে হেসে উঠে বলে, এই সেরেছে, কারণটা ধরে ফেলেছ? সত্যি তুমি কী চালাক।
নীলাক্ষ একথার উত্তর দেয় না।
নীলাক্ষ হঠাৎ বলে ওঠে, আচ্ছা, মীনার কী হয়েছে বলতে পারো?
মীনার!
হ্যাঁ। রাতদিন দেখি ঘরে শুয়ে আছে, কলেজেফলেজেও যাচ্ছে না নাকি?
রাতদিন?
সুনন্দা আবার হি হি করে হাসতে থাকে। তুমি এত দেখার সময় পেলে কোথায় গো! তুমি যে আমায় চমকে দিলে! অ্যাাঁ, রাতদিন বাড়ির কে কী করছে, তার খবর রাখছ তুমি?
.
হৈমবতীও সরোজাক্ষর মতোই অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললেন, কী এ?
সারদাপ্রসাদ অনুত্তেজিত শান্ত গলায় বলল,আপনার সেই টাকাটা।
আমার টাকা! হৈমবতী প্রমাদ গোনেন। পাগলা খ্যাপা মানুষটা কী বুঝতে কী বুঝেছে। তাই আকাশ থেকে পড়া গলায় বলেন, কোন টাকা?
সারদাপ্রসাদ দেয়ালের দিকে তাকিয়ে দেয়ালের মতোই ভাবশূন্য গলায় বলে, বইয়ের ছুতো করে যেটা ভিক্ষে দিয়েছিলেন আমায়।
সদা-উত্তেজিত সারদাপ্রসাদের এই শান্ত মূর্তি আর ঠাণ্ডা স্বর হৈমবতাঁকে রীতিমত ভীত করে।
তা ছাড়া শুধুই কি কণ্ঠস্বর?
ভাষা নয়?
এই কি সারদাপ্রসাদের ভাষা?
চির সরল, চির শিশু সারদাপ্রসাদের?
হৈমবতী ভীত গলাতেই বলেন,আমি তো তোমার কথা ঠিক বুঝতে পারছি না সারদাপ্রসাদ!
সারদাপ্রসাদের ঘাড়টা আরও মোচড় খায়।
সারদাপ্রসাদ যেন সাদা দেয়ালের গায়ে অদৃশ্য কালিতে লেখা কোনও লিউপর পাঠোদ্ধার করছে।
হৈমবতী একটু অপেক্ষা করে আবার বলেন, কী হয়েছে বলে তো ঠিক করে। আমি তো সত্যিই বুঝতে পারছি না ।
সারদাপ্রসাদ তবু ঘাড় ফেরায় না।
সারদাপ্রসাদের সেই শান্ত স্বর আরও শান্ত, আরও দৃঢ় শোনায়, আমি বোকা–মুখ, নির্বোধ অন্ধ, আমার পক্ষে অনেক কিছুই বোঝা শক্ত, কিন্তু আপনার তো বুঝতে না পারার কিছু নেই খুড়িমা! তবে আপনাকে আমি বিশ্বাস করতাম। নির্বোধ পেয়ে আপনিও আমায় ঠকাবেন, এ ধারণা ছিল না। মূর্খের শিক্ষা বোধ হয় এইভাবেই আসে। যাক, কী বলতে কী বলছি, অপরাধ নেবেন না। আপনার টাকাটা কোনও কাজে লাগল না, তাই রেখে গেলাম। যে ছেঁড়া কাগজের টুকরোগুলোর ছুতো করে ওটা দিয়েছিলেন, সেগুলো রান্নার উনুনে ফেলে দেবেন।
চেয়ার ছেড়ে উঠে পড়ে সারদাপ্রসাদ, কোনওদিকে না তাকিয়েই আস্তে আস্তে নেমে যায়।
হৈমবতী পাথরের পুতুলের মতো তাকিয়ে থাকেন সেই চলে যাবার দিকে।
ওই চলে যাবার দিকে তাকিয়ে সন্দেহ থাকে না তাঁর, এ যাওয়া চিরদিনের জন্যে যাওয়া। ওই দীর্ঘ মাপের শিশু-মানুষটা আর কোনওদিন ফিরে আসবে না।
কিন্তু হৈমবতী ওকে আটকাবেন কোন উপায়ে?
হৈমবতী কি ছুটে গিয়ে ওর হাত ধরে বলবেন, পাগল ছেলে, চলে অমনি গেলেই হল? সব কথা না বলে কেমন তুমি চলে যাও দেখি?
না কি এখনও আবার পুরনো ভঙ্গিতে উৎসাহভরে বলবেন, কী আশ্চর্য! কী বলছ তুমি? আমি বলে আমার নতুন ব্যবসার প্রতিষ্ঠা নিয়ে কত স্বপ্ন দেখছি।
নাঃ এত নিষ্ঠুর হতে পারবেন না হৈমবতী, হতে পারবেন না অত খেলো।
তীক্ষ্ণবুদ্ধি হৈমবতীর পক্ষে অবস্থাটা অনুমান করা কঠিন হয় না, আর হঠাৎ নিজেকে ভারী ক্লেদাক্ত মনে হয় তাঁর।
মাথার মধ্যে সমস্ত কোষে কোষে একটা আহত কণ্ঠের তীব্র অভিযোগ যেন অবিরাম ধাক্কা দিয়ে চলে, নির্বোধ পেয়ে আপনিও আমায় ঠকাবেন, এ ধারণা ছিল না।
হ্যাঁ, অপরাধ করেছেন হৈমবতী।
নির্বোধ পেয়ে ঠকাতেই চেষ্টা করেছেন ওকে। একটা সরল বিশ্বাসী হৃদয়কে দুপায়ে মাড়িয়ে দিয়েছেন। অথচ ভেবেছেন ওর ভাল করছি।
তার মানে ওকেই অন্ধ ভেবে নিশ্চিন্ত থেকেছি আমি, ভাবলেন হৈমবতী–নিজে যে কতটা অন্ধ সে খেয়াল করিনি। ও আমার দৃষ্টি খুলে দিয়ে গেল।
কিন্তু ওর দৃষ্টি খুলে দিল কে?
বিজয়া?
সরোজাক্ষ?
হায়, হৈমবতী কেন নিমিত্ত হলেন?
হৈমবতী টেবিলে পড়ে-থাকা টাকাগুলোর দিকে নিষ্পলকে তাকিয়ে বসে রইলেন।
.
অন্ধ যদি রুদ্র আলোর প্রহারে সহসা দৃষ্টিলাভ করে বসে, সে বুঝি চক্ষুষ্মনদের থেকেও সচেতন হয়ে ওঠে। তাই সারদাপ্রসাদ যাত্রাকালে বিদায় গ্রহণের পালা অভিনয় করে না। নিঃশব্দে কখন যেন চলে যায় চিরদিনের জন্যে।
তার এতদিনের অধিকৃত ঘরটায়, যে অধিকারটা সরোজা বাদে বাড়ির সকলেরই দৃষ্টিশূল ছিল, সেই ঘরটায় যেখানে যা ছিল সবই পড়ে থাকল অবিকল, অবিকৃত। শুধু তার বাকি ছেঁড়া কাগজের বস্তাগুলো, যেগুলো দ্বিতীয় খণ্ড, তৃতীয় খণ্ড রূপে প্রকাশিত হবার অপেক্ষায় দড়িবাঁধা পড়ে ছিল, সেইগুলোর জায়গাটাই শূন্য হয়ে গেল।
আর গেল সারদাপ্রসাদের জায়গাটা।
কিন্তু এ বাড়িতে তার কি কোথাও জায়গা ছিল, একমাত্র সরোজাক্ষর হৃদয়ে ছাড়া?
অথচ আশ্চর্য, সরোজাক্ষর নির্মমতাতেই বিদায় হয়ে গেল সে।
হয়তো এমনিই হয়।
সবচেয়ে প্রিয়জনের কাছ থেকেই সবথেকে বড় আঘাত আসে। তার ইচ্ছায়, অনিচ্ছায়, অসতর্কতায়।
.
সারদাপ্রসাদ যে তার সমস্ত পদচিহ্ন মুছে নিয়ে চিরদিনের মতো চলে গেছে, এ সত্য ধরা পড়তে সময় লেগেছিল। কারণ ওটা কারও আশঙ্কার মধ্যে ছিল না। সারদাপ্রসাদ কখন বেরোয়, কখন ঢোকে, কতক্ষণ বাড়ি বসে থেকে জ্ঞানচর্চা করে, কে তার হিসেব রাখে? খোঁজ ছিল শুধু সরোজাক্ষর, কিন্তু সেটা ইদানীং নয়। ইদানীং তো দুজনেরই জীবন ছন্নছাড়া হয়ে গিয়েছিল। যখন সরোজাক্ষর জীবনটা ছিল আঁটসাঁট একটা কর্মের ছন্দে গাঁথা, আর সারদাপ্রসাদ ছিল ঘরকুনো, তখন সরোজাক্ষ প্রতিদিন সাড়া নিতেন কী খবর সারদা? নতুন কী আবিষ্কার করলে?
কিন্তু সে প্রশ্নের মধ্যে কি ব্যঙ্গ থাকত?
না, তা থাকত না, থাকত স্নেহ, সদয়তা।
অথচ সে কথা আর এখন বলা যাবে না। সারদাপ্রসাদও আর সেই মধুর মিথ্যার স্মৃতিকে মধুর ভাবতে পারবে না। সারাজীবনের সমস্ত স্নেহ প্রশ্নগুলোই ব্যঙ্গের শর হয়ে শরশয্যায় রেখে দেবে সারদাপ্রসাদকে।
চক্ষুষ্মান সারদাপ্রসাদ এখন প্রতিক্ষণ অনুভব করবে, কী অনধিকারের ভূমিতে দাবির অহংকারে স্ফীত হয়ে নিশ্চিন্তে কাটিয়ে এসেছে সে।
এখন সারদাপ্রসাদ বুঝতে পারছে নীলাক্ষ নামের ঔদ্ধত্যটার চোখে কোন ছবি ছিল৷ ময়ূরাক্ষী নামের অসহিষ্ণুতাটার চোখে কোন বিষ। বিজয়া নামের অহমিকাটির চোখে কী অবজ্ঞা।
অনেক দূরে চলে না গেলে বুঝি ক্যামেরার লেন্সে এত স্পষ্ট মূর্তি ধরা পড়ে না।
একদা সরোজাক্ষই সারদার খবর নিতেন। এখন সরোজাক্ষ স্তব্ধ হয়ে গেছেন। তাই সারদার চলে যাবার খবরটা প্রথম টের সরোজা পাননি, পেলেন বিজয়া, সারদাপ্রসাদ সম্পর্কে যাঁর অবজ্ঞা এবং ঔদাসীন্য ছাড়া আর কিছু ছিল না।
কিন্তু কৌতূহল আর আগ্রহ সৃষ্টি করেছিল সারদা সেই টাকাটা দিয়ে।
উদগ্র একটা কৌতূহল আর তীব্র একটা হায় হায় নিয়ে বিজয়া বারবার পুজোর ঘর থেকে নেমে এসে খোঁজ করেছেন ওই হতভাগ্য মানুষটার, কিন্তু দেখেছেন সে সবসময়ই অনুপস্থিত।
তা ছাড়া–যে দরজার পরদাটা সর্বদাই দরজার মাথার কাছে ডেলা পাকিয়ে গোটানো থাকত সেটা সর্বদাই ঝুলে রয়েছে যেন একটা বোবা নিষেধের ভঙ্গিতে।
বিজয়া না বুঝে শূন্য ঘরের বাইরে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়েই হাঁক পেড়েছেন, কী গো ঠাকুরজামাই, তোমার আবার তোমার শালার মতন পরদা বাই হল কেন? ওলটাও দিকি। একটা কথা আছে।
পরদা তিনি নিজে সরাতে পারেন না, কারণ পুজো করতে করতে শুচিবস্ত্রে নীচে নেমেছেন।
অতএব কণ্ঠস্বরকেই পরদায় পরদায় তুলেছেন, কী ব্যাপার, এই ভরসন্ধেতেই ঘুমিয়ে কাদা হলে না কি গো? বলি ও মান্যমান মশাই, একটা অধম মানুষ যে এত ডাকছে, গ্রাহ্যি নেই?
একবার দুবার তিনবার।
অতঃপর বুঝেছেন, ঘরে নেই লোকটা।
কিন্তু সেই নোটের গোছর দৃশ্যটা যে মর্মে বিধে আছে। লোকটাকে না পেলে তার রহস্য উদ্ধার হবে কী করে? বারবার এসে এসে দেখেছেন বিজয়া, ঘরে আছে কিনা সারদাপ্রসাদ নামের মূর্খটা।
কিন্তু কোথায়? কোনও সময়ই নেই।
অবশেষে দিন তিন-চার পরে সন্দেহ হল। একতলায় নেমে গিয়ে প্রশ্ন করলেন, ঠাকুর, পিসেমশাই খেয়ে বেরিয়ে গেছে?
ঠাকুর চোখ কপালে তুলে প্রতি-প্রশ্ন করল, পিসেমশাই?
হ্যাঁ হ্যাঁ, আকাশ থেকে পড়লে যে! বলছি এতখানি বেলা হয়ে গেল, এখনও ফেরেনি মানুষটা, জিজ্ঞেস করছি খেয়ে বেরিয়েছে তো?
ঠাকুর এবার কপাল থেকে চোখ নামিয়ে যা বলে, তার সারমর্ম হচ্ছে, পিসেমশাইয়ের কথা আজ নতুন করে হঠাৎ কেন? তিনি তো আজ চারদিন হল হাওয়া। কেন, মা সেকথা জানেন না? ঠাকুরকে তো বলে গেছেন তিনি, ঠাকুর, তুমি আর আমার জন্যে চাল নিও না, আমি চলে যাচ্ছি। ঠাকুর সৌজন্য করে বলেছিল, কবে ফিরবেন? বলে গেছেন, জানি না, ঠিক নেই।মা এসবের কিছু জানেন না?
বিজয়ার গৃহিণীগর্বে আঘাত লাগে।
বিজয়া ক্রুদ্ধ গলায় বলেন, জানব না কেন। ঢং করে যাই বলে যাক, কাল তো তার ফেরার কথা ছিল। ফেরেনি মানে?
ঠাকুর মনে মনে একটু মুচকি হাসে।
এই কালকে ফেরার কথাটা যে সম্পূর্ণ বাজে কথা তা বুঝতে দেরি হয় না তার। শুধু বুঝতে পারে না পিসেমশাই সম্পর্কে হঠাৎ মার এত দরদ উথলে ওঠবার হেতু কী! সে লোকটার খাওয়া সম্পর্কে মাকে তত বেজারই দেখেছে ঠাকুর বরাবর। বাবুই খোঁজ করেছেন, লক্ষ্য করেছেন, ভাল জিনিস আনিয়েছেন।
ইদানীং বাবুরও ছাড়া-ছাড়া ভাব, রান্নাঘরেও সমারোহ নেই, পিসেমশাইয়েরও আগের মতো সেই আরাম আয়েসে ভোজনপর্বটি নেই। কখন হঠাৎ বেরিয়ে যায়, কখন হঠাৎ ফেরে, কখনও ব্যস্ত হয়ে নেমে এসে নিজেই জল আর আসন নিয়ে রান্নাঘরেরই একপাশে বসে পড়ে বলে,ঠাকুর, ভাত হয়ে থাকে তো আমায় দুটি দিয়ে দাও তো। থাক, থাক, মাছ-তরকারি না হোক, ডাল হয়েছে তো? ওতেই হবে।
কোনওদিন বা বেলা দুটো-তিনটের সময় অস্নাত অভুক্ত পরিশ্রান্ত চেহারা নিয়ে এসে বলেছে, ঠাকুর, বড্ড বেলা হয়ে গেল! তুমি বেচারি এখনও বসে আছ কেন? ঢাকা দিয়ে রেখে চলে গেলেই পারতে।
অপ্রতিভ ভাবে মাথায় দুবালতি জল ঢেলে জলঝরা গায়েই এসে খেতে বসেছে।
লোকটার উপর ঠাকুরের কেমন একটা মমতা ছিল বলেই বসে থাকত হাঁড়ি নিয়ে। মা সে খবর রাখতেন না বলেই, রাখলে, নির্ঘাত হুকুম দিতেন, বসে থাকবার দরকার নেই, ভাত ঢেকে রেখে দাও।
সেই মা আজ হঠাৎ পিসেমশাইয়ের সম্বন্ধে এত ব্যস্ত! লোকটা যে আজ চারদিন আগে চলে গেছে, সে খবরও রাখেন না গিন্নি!
ঠাকুর তার কর্মদশায় সারদাপ্রসাদকে কোনওদিন চলে যেতে দেখেনি। তাই তারও যেন মনে হয়েছিল এই চলে যাওয়াটা একেবারেই চলে যাওয়া। ওই চাল নিতে বারণ করার সময় ভয়ানক একটা যন্ত্রণার মুখ দেখেছিল ঠাকুর।
কিন্তু সে রাঁধুনি মানুষ, কাকে কী জিজ্ঞেস করবে?
তা ছাড়া বাড়িটা কি আর আগের মতো আছে? যেন ভুতুড়ে বাড়ি হয়ে গেছে। মা অবশ্য চিরদিন উপরতলাবাসিনী, কিন্তু বউদি, দাদাবাবুরা, দিদিমণিরা, পিসেমশাই, এরা তো মাতিয়ে রাখত বাড়িটা। কিন্তু ক্রমে ক্রমে কী হয়েই গেল। বড়দিদির বিয়ে হয়ে গেল, ছোড়দা বিদেশে চলে গেল। বড়দাদাবাবু মদ ধরল, বউদি তার সঙ্গে সুর ধরল, ছোড়দিও কেমন কেমন হয়ে গেল। তারপর তো চলছেই ভাঙন। বাবু কাজ ছেড়ে দিয়ে ডোম্বল হয়ে বসে আছে, ছোড়দি ঘর থেকে বেরোয় না, খায় না দায় না, বড়দা বেহেড় হয়ে বাড়ি ফেরে, আবার তো ছোট্ট ছেলেটাকে বোর্ডিঙে না কোথায় রেখে এসেছে। ছেলেটা সেইখানেই থাকে, ছুটি হলে মামার বাড়ি যায়।
শেষমেশ পিসেমশাইটা ছিল, তাও বাড়ি ছেড়ে চলে গেল। তবে আর বাড়িটাকে ভুতুড়ে ছাড়া কী বলবে ঠাকুর? পুরনো লোক, সব কিছুই দেখছে বসে বসে। পুরনো মানুষ!
বিজয়ার কুদ্ধ গলায় ভয় পায় না। অবজ্ঞার গলায় বলে, ফেরেননি তা তো দেখতেই পাচ্ছেন। মানে আর আমি কী জানব? আমার তো মনে হল বরাবরের জন্যেই চলে গেলেন।
কেন কে জানে হঠাৎ বিজয়ার ভারী ভয় হয়। মাথা থেকে পা পর্যন্ত একটা বিদ্যুৎ শিহরণ অনুভব করেন বিজয়া। তবু ক্রুদ্ধ কণ্ঠটা বজায় রাখেন,ওঃ, তাই মনে হল তোমার? তা তাই যদি মনে হল, আমায় একবার বলতে পারলে না?
ঠাকুর সমান অবজ্ঞার গলায় বলে, আমি মাইনে করা লোক, আমি আপনাদের কী বলতে যাব? আর জানবই বা কেমন করে আপনারা জানেন না?
লোকটা বীরভূমের লোক, তেজী। রেখে-ঢেকে কথা বলে না।
.
বিজয়া উপরে এসে সরোজাকে ধরেন, ঠাকুরজামাই যে চলে গেল, সেটা আমায় একবার জানানো দরকার মনে হল না?
সরোজাক্ষ বিজয়ার কথায় কমই কর্ণপাত করেন, কিন্তু ওই চলে গেল শব্দটায় চমকে তাকালেন। তারপর প্রশ্ন করলেন, কোথায় চলে গেল?
সরোজাক্ষ আজ তিনদিন ধরে মনকে সংকল্পে স্থির করছেন, আবার ফিরে যাব কলেজে। মাথা হেঁট করে বলব, আমি ভুল করেছিলাম।
কিন্তু সংকল্পে স্থির হলে কী হবে, কোথায় গিয়ে বলবেন? কাকে বলবেন? কলেজে তো অনির্দিষ্ট কালের জন্যে ছাত্র-ধর্মঘট চলছে। সরোজাক্ষ সঠিক জানেন না কী তাদের দাবি। হয়তো পরীক্ষা পিছিয়ে দেবার দাবি, হয়তো প্রশ্নপত্র সহজ করার দাবি, হয়তো বা কোনও প্রফেসর বা স্বয়ং অধ্যক্ষকেই বরখাস্ত করা হোক দাবি। মোট কথা, কোনও একটা দাবিরই লড়াই এটা। এই লড়াইয়ের প্রথম সোপানস্বরূপ অধ্যক্ষকেও একদিন ঘেরাও করেছিল তারা, কিন্তু তাতে তেমন লাভ হয়নি। অতএব ধর্মঘট!
সরোজাক্ষ কোথায় গিয়ে পেশ করবেন তাঁর আবেদন?
সরোজাক্ষ কি তবে কলকাতার বাইরের কোনও শিক্ষায়তনে আবেদন করতে যাবেন? যেখানে বিজয়া যাবে না, যাবে না সরোজাক্ষর বাকি সংসার। সরোজাক্ষ একা থাকবেন ছোট একটি কোয়ার্টার্সে। হয়তো তেমনভাবে থাকতে পেলে, এখনও নিজেকে খুঁজে পাবেন সরোজাক্ষ। নিজেকে বুঝতে পারবেন।
সংসারের জন্যেও অবশ্য কর্তব্য আছে। সে কর্তব্য পালনের উপকরণ তো টাকা? সরোজাক্ষ নিতান্ত কৃচ্ছসাধন করে থেকে পাঠিয়ে দেবেন সেটা।
এই ধরনের একটা স্বপ্নজগতে বাস করছিলেন সরোজাক্ষ, সেখানে বিজয়ার প্রশ্নটা যেন পাথরের টুকরোর মতো এসে লাগল।
সারদাপ্রসাদের সেদিনের সেই মর্মাহত মুখটার ছবিটাকে সরোজাক্ষ যেন সভয় আতঙ্কে অনুভূতির ঘর থেকে সরিয়ে রেখেছিলেন, সাহস করে একবারও খোঁজ করে দেখেননি সারদার সাড়া পাওয়া যাচ্ছে না কেন?
যখনই ঘর থেকে বেরোচ্ছিলেন, একটা অপরিচিত দৃশ্য যেন সরোজাকে পাথর করে দিচ্ছিল। সারদাপ্রসাদের দরজায় পরিপাটি করে পরদা ঝোলানো। সারদাপ্রসাদ কি ওর লেখাগুলো সব নষ্ট করছে বসে বসে ওর অন্তরালে?
হাসলেন যে? হাসলেন কেন?
এ প্রশ্নটা কার?
কার এই রুক্ষ কঠিন কণ্ঠস্বর? যে-স্বর সরোজাক্ষকে অবিরত কাঁটার চাবুক মারছে? যে-স্বরের আওতা থেকে পালাতে চাইছেন সরোজাক্ষ?
কিন্তু একথা কি ভেবেছিলেন সরোজাক্ষ, সেই স্বরটাই তাঁর থেকে অনেক দূরে চলে যাবে? সরোজাক্ষকে মুক্তি দিয়ে যাবে?
সরোজাক্ষ তাই চমকে উঠে বললেন, কোথায় চলে গেছে?
ন্যাকা সাজছ কেন? তুমি জানো না?
না।
সেদিনের সেই টাকার ঘটনাটাই বা কী শুনি?
জানি না।
তোমাকেও কিছু বলে যায়নি, একথা বিশ্বাস করব আমি?
সরোজাক্ষ নীরব।
বিজয়া আবার বলেন, যাবার সময় তোমাকেও কিছু বলে যায়নি?
সরোজাক্ষ নিরুত্তর।
বিজয়া রুষ্ট ক্ষুব্ধ গলায় বলেন, যদি সত্যিই চলে গিয়ে থাকে, তো আমার দুর্ব্যবহারে যায়নি। গেলে তোমার দুর্ব্যবহারেই গেছে, সেটা মনে রেখো।
সরোজাক্ষ চোখ তুলে আস্তে বলেন, মনে রাখব। সারাজীবন মনে রাখব।
খোঁজ করবে না?
না।
বিজয়া ঘর থেকে বেরিয়ে আসেন।
সামনের দিকে তাকিয়ে থমকে দাঁড়ান।
নাট্য-শেষের যবনিকার মতো সম্ভাবনাহীন ওই পরদাটা যেন বিজয়ার দিকে ব্যঙ্গদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। যেন এখুনি বলে উঠবে, কেন? এখন মনটা এমন হু হু করে উঠছে কেন? এই তো চেয়েছিলে চিরকাল।
চেয়েছিলেন।
কিন্তু চাওয়াটা পাওয়ার চেহারা নিয়ে এসে ধরা দিলে যে এমন বীভৎস লাগে তা তো জানা ছিল না বিজয়ার।
সরোজাক্ষও আস্তে বেরিয়ে এলেন, চুপ করে তাকিয়ে রইলেন সামনের দিকে, যেখানে সারদাপ্রসাদের মতো একটা অবোধ অজ্ঞান মানুষ হঠাৎ বোধের ধাক্কায় ছিটকে চলে যাবার সময় চিরদিনের মতো একটা যবনিকা টেনে দিয়ে গেছে।
হ্যাঁ, সরোজাক্ষও টের পাচ্ছেন চিরদিনের মতো। কারণ সরোজাক্ষ বিষবাণ খাওয়া একটা হৃদয় দেখতে পাচ্ছেন, সরোজাক্ষ রুক্ষ বিদীর্ণ একটা কণ্ঠস্বর শুনতে পাচ্ছেন হাসলেন যে? হাসলেন কেন?
.
খবরটা নীলাক্ষ তার স্ত্রীর কাছে পায়নি, সংসারের যাবতীয় গুঢ় আর গোপন খবর যার কাছে পাবার কথা। স্ত্রী তো তাকে ব্যঙ্গ করেই উড়িয়ে দিল।
খবর দিল ময়ূরাক্ষী।
দেশ ভ্রমণ সেরে কলকাতায় ফিরেই মায়ের সঙ্গে দেখা করতে এসেছিল ময়ূরাক্ষী আহ্লাদে ভাসতে ভাসতে, গৌরবে ঝলসাতে ঝলসাতে। বিজয়া সেই গৌরব আহ্লাদের দিকে দৃষ্টিপাতমাত্র না করে নিভৃতে ডেকে নিয়ে গিয়ে তাকে মুহূর্তে পাথর করে দিলেন।
ধৈর্য ধরবার ক্ষমতা বিজয়ার নেই, সবুরে মেওয়া ফলে এ বিশ্বাসও নেই। তাই মেয়েটার উপর নিজের চিন্তাভারের খানিকটা চাপিয়ে দিয়ে যেন কিঞ্চিৎ হালকা হলেন।
ময়ূরাক্ষীও আবার হালকা হতে চাইল দাদার উপর চাপিয়ে।
নীলাক্ষ অবশ্য ওর মতো প্রত্যেকটি খবরকেই গুরুত্ব দিল না। বাবা কলকাতার কাজ ছেড়ে হুগলি কলেজের দ্বারস্থ হয়েছেন।
এটা কী আর এমন মন্দ?
বাড়ি বসে বসে ফসিল হচ্ছিলেন, যান না বাইরে।
সারদাপ্রসাদের চলে যাওয়া?
সেটাতেও আপাতত নিজের কাছে নিজেকে ঈষৎ অপ্রতিভ অপ্রতিভ লাগলেও, খবরটা সুখবরই, কিন্তু মীনাক্ষী?
সংসার সম্পর্কে দায়িত্ব এবং মমত্বলেশহীন নীলাক্ষও শুনে হঠাৎ আঘাত খেয়ে জেগে ওঠা বাঘের মতো গর্জে উঠে বলেছিল, অসম্ভব।
কিন্তু অসম্ভববলে হুঙ্কার দিলেই তো হল না? ময়ূরাক্ষী তো নিজের ঘর থেকে গল্পটা বানিয়ে এনে দাদাকে শোনাতে বসেনি? বিশ্বাস না হয় মাকে জিজ্ঞেস করুক সে।
মাকে জিজ্ঞেস না করে স্ত্রীকেই জিজ্ঞেস করল,জানতে তুমি?
সুনন্দা গম্ভীরভাবে উত্তর দিল, হ্যাঁ।
আমায় বলোনি যে?
বললে কী করতে?
কী করতাম?
নীলাক্ষ গজরাতে গজরাতে বলে, সেই হতভাগা রাস্কেলটাকে ধরে এনে বিয়ে করতে বাধ্য করতাম।
ওঃ বাধ্য করতে? কিন্তু বাধ্য করে বিয়েয় যদি তোমার বোনের মন না থাকে?
মন না থাকে? মন না থাকে? ইয়ার্কি নাকি? মন কী করে করাতে হয় দেখাচ্ছি গিয়ে।
সুনন্দা দৃঢ়স্বরে বলে, পাগলামি কোরো না। তোমাদের হিসেবনিকেশের ধারায় চলবার মেয়ে ও নয়।
নীলাক্ষ ক্রুদ্ধ গলায় বলে, শুধু ও কেন, জগতের কোন মেয়েমানুষটাই বা সহজে ন্যায্য হিসেবনিকেশের ধারায় চলতে চায়? এক নম্বরের পাজি জাত।
সুনন্দা উত্তর দেয় না, শুধু স্থির দৃষ্টিতে তাকায়। নীলাক্ষ তাড়াতাড়ি অন্যদিকে চোখ ফিরিয়ে বলে ওঠে, বেশ তো, বিয়ে করতে রাজি না হয়, তার নাম-ঠিকানাটা বলুক, চাবকে ছাল ছাড়িয়ে দিয়ে আসি রাস্কেলটার।
তা হলে তো খুবই ভাল হয়–সুনন্দা ভালমানুষের গলায় বলে, ছুরিটা শানিয়ে ফেলো ততক্ষণ।
নীলাক্ষ ওর দিকে জ্বলন্ত দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলে ওঠে, রাবিশ! তারপর মীনাক্ষীর ঘরে গটগটিয়ে ঢুকে এসে বিনা ভূমিকায় বলে ওঠে, এই মীনা, সেই রাস্কেলটার নাম-ঠিকানা কী?
.
মীনাক্ষী অনেকদিন পরে তার দাদাকে মুখোমুখি দেখল। মীনাক্ষী অনেকদিন পরে তার দাদার দিকে তাকাল। তারপর বলল, নাম-ঠিকানা জেনে তোমার কোনও লাভ হবে না দাদা!
লাভ-লোকসান আমি বুঝব,নীলাক্ষ ক্রুদ্ধ গলায় বলে, নাম-ঠিকানাটা আমার জানা দরকার।
দরকার নেই দাদা!
দরকার নেই মানে? আমি তাকে ধরে এনে বিয়ে করতে বাধ্য করতে চাই।
মীনাক্ষী ওর দিকে স্পষ্ট চোখে তাকিয়ে বলে, তোমার সঙ্গে এভাবে এমন স্পষ্ট করে কথা বলতে হবে ভাবিনি দাদা! ভয় ছিল হয়তো বাবার দরবারে-যা বলছিই যখন, তখন বলি, বাধ্য করানো বিয়েতে তোমার আস্থা আছে?
আস্থা? আস্থা মানে? কীসের আস্থা?
মানে সেটা সুখের হবে বলে তোমার ধারণা?
সুখের।
নীলার মুখে হঠাৎ একটা উদাস দার্শনিক হাসি ফুটে ওঠে, বাধ্য করে ছাড়া অন্য সব বিয়েই সুখের হয়, এই তোর ধারণা?
মীনাক্ষী স্থির গলায় বলে, তবু তার মধ্যে অন্তত সম্ভ্রম আছে।
সম্ভ্রম! ওঃ!
নীলাক্ষ আরও সূক্ষ্ম একটু হাসে, সম্ভ্রম কথাটার মানে তো দূরে থাক, বানানই জানা নেই মীনা! জানি না কাদের জানা আছে।
এটা তুমি কী বলছ দাদা।
ঠিকই বলছি মীনা। নীলাক্ষ অস্থিরভাবে পায়চারি করতে করতে বলে, সম্ভ্রম আমাদের কোথায়? সমবোধই বা কোথায়? সমাজের উঁচু চুড়োয় ওঠবার জন্যে আমরা নীচতার পাতালে নামতেও প্রস্তুত, সম্ভ্রমের সিংহাসনে বসবার টিকিট সংগ্রহ করতে অসম্ভ্রমের নরকে যেতেও পিছপা নই। সবাই সবাইয়ের আসল মুখের চেহারা জানে, তবু আমরা মুখোশ পরে ঘুরে বেড়াই, আর ভাবি আমি কী সম্ভ্রান্ত! এবং যদি কেউ সে মুখোশ খুলে নিজের সত্যি মুখ দেখাতে চায়, তাকে সবাই ছি ছি করে উঠি। কোনও ক্ষেত্রেই তো কেউ কাউকে সম্ভ্রমের চোখে দেখি না। তবে আর ও শব্দটা নিয়ে মাথা ঘামিয়ে লাভ?
মীনাক্ষী মৃদুগলায় বলে,অন্যের চোখে সম্ভ্রান্ত হওয়ার কথা বলিনি আমি দাদা, প্রশ্নটা আত্মসম্ভ্রমের।
নীলাক্ষ ওর ছোট বোনের মুখের দিকে তাকিয়ে দেখে। নীলাক্ষ যেন অবাক হয়ে যায়। ওর হঠাৎ মনে হয়, ছোটরা কোন ফাঁকে সহসা বড় হয়ে ওঠে। আমি ভাবছিলাম আমি ওর ভার নেব। ও নির্বোধ, ও অসহায়, ও আমার ছোট বোন, আমি ওর সহায় হব। দেখছি কখন ও বড় হয়ে গেছে। ওর আর কারও সাহায্যের দরকার নেই। ও নিজের ভুল নিজেই শোধরাতে চায়। এখানে তবে আমার আর কী করার আছে?
তবু নিজের পূর্ব চিন্তার জের টেনে বলল নীলাক্ষ, বেশ,–বিয়েতে তোর আপত্তি থাকে, ঠিকানা পেলে তাকে চাবকে আসতেও পারি।
তাতেই বা সম্মান কোথায় দাদা?
বেশ! চমৎকার! তুমি তোমার ওই এক ফস্ সম্মান আর সমবোধ নিয়ে ধুয়ে জল খাও, আর একটা বদমাইশ যা ইচ্ছে অন্যায় করে পার পেয়ে যাক, কেমন?
মীনার চোখটা এবার নেমে এসেছিল, মীনা আর দাদার মুখোমুখি তাকাতে পারছিল না, তবু আস্তে বলল, সব অন্যায়ের দায় অন্যের ঘাড়ে চাপানোর মধ্যে স্বস্তি থাকতে পারে দাদা, সত্য নেই। অন্যায় কি আমারই নেই? আমি দুঃসাহস করেছি, আমি যাকে বিশ্বাসের অযোগ্য বলে মনে করেছি, তাকেই বিশ্বাসের ভান করেছি, আমি মার অবাধ্য হয়েছি, আর–আর আমি আমার পারিবারিক মর্যাদার কথা না ভেবে লুকিয়ে একটা বাজে ছেলের সঙ্গে মিশেছি। প্রতিনিয়ত মনে হয়েছে আমি ভুল করছি–তবু মোহগ্রস্ত হয়ে ভেবেছি ওই মনে হওয়াটা কুসংস্কার, ওর প্রভাবমুক্ত হতে পারাটাই আধুনিকতা। তার একটা মাশুল দিতে হবে বইকী!
মীনাক্ষী যে তার দাদার সঙ্গে এমন খোলাখুলি কথা বলতে পারবে, একথা কবে ভেবেছিল মীনাক্ষী? অথচ পারল। মানুষ যখন কোনও একটা সংকল্পে স্থির হয়, তখন বোধ করি তার এমনি করেই সাহস আসে। আর তখন তার সেই সাহসকে অপরের সমীহ না করে উপায় থাকে না।
নীলাক্ষও করল সমীহ।
পায়চারি করতে করতে হঠাৎ দাঁড়িয়ে পড়ে বলল, তা হলে তুমি কী করবে ঠিক করছ?
অহরহ সেটাই ভাবছি।
নীলাক্ষ একটু ইতস্তত করে বলে ওঠে, ময়ূর বলছিল অথচ অতি সহজেই সমস্যার সমাধান হতে পারে।
মীনাক্ষী তার দাদার মুখের দিকে চেয়ে দেখে। সেখানে হিতৈষী বড়ভাইয়ের ব্যাকুলতা ছাড়া আর কিছু দেখতে পায় না। মীনাক্ষী অবাক হয়। দাদাকে মীনাক্ষী হৃদয়হীন বলেই জেনে এসেছে এতদিন। ভেবে এসেছে দাদা পারিবারিক বন্ধনহীন। অথচ দাদা তার ছোট বোনের জন্যে ভাবছে, ব্যাকুল হচ্ছে। তবে হয়তো ওর ওই বন্ধনহীনতার জন্যে এই পরিবারের পরিবেশই দায়ী। চিরদিন মা আছেন তাঁর কল্পিত স্বর্গের সিংহাসনে, বাবা তাঁর অহংকারের গজদন্তমিনারে, আমরা অবাঞ্ছিত, আমরা অবান্তর। তাই আমরাও স্বার্থপর হয়ে গড়ে উঠেছি। আমরা ভাইবোনে পরস্পরকে ভাল না বেসে সমালোচনা করতে শিখেছি। তবু তার মধ্যে থেকেও দাদা আমার জন্যে উদ্বিগ্ন হচ্ছে, ব্যথিত হচ্ছে।
মীনাক্ষীর চোখের কোণটা ভিজে এল, মীনাক্ষী মাথা নামিয়ে বলল,শুধু দিদি কেন, মা-ও সে সমাধানের নির্দেশ দিতে এসেছিলেন দাদা, কিন্তু একজনের কাছে যা সহজ, অন্যের কাছে তা সহজ নাও হতে পারে। অপরাধ করে তার দণ্ড ফাঁকি দেব, এ আমি ভাবতে পারছি না। তবু তোমাদের আর বেশিদিন বিপদে ফেলে রাখব না—
বিপদে ফেলে রাখবি না! নীলাক্ষ ভয় পাওয়া গলায় বলে ওঠে, কী করবি তবে? কী তোর মতলব? সুইসাইড করতে চাস বুঝি?
মীনাক্ষী মুখ তোলে।
মীনাক্ষী মৃদু হাসে।
বলে, না দাদা! সেও তো দণ্ড এড়িয়ে পালিয়ে যাওয়াই। আর তেমন মতি হলে এতদিন ধরে এত ভেবে মরবই বা কেন?
নীলাক্ষ আর একবার পায়চারি করে ঘরটা ঘুরে নেয়। তারপর মীনাক্ষীর খুব কাছে এসে তাড়াতাড়ি বলে,জানি না কী তুই ভেবে ঠিক করছিস। আমি তো ফরনাথিং এত কষ্ট পাবার কোনও মানেই খুঁজে পাচ্ছি না। তুচ্ছ একটা সেন্টিমেন্টের জন্যে জীবনটাকে জটিল করে তোলার মধ্যে কী যুক্তি আছে তোদের ভগবানই জানে। যাক–যাই ভাবিস, আর যাই ঠিক করিস, টাকা-ফাঁকার দরকার হলে বলতে লজ্জা পাস নে।
ঘর থেকে বেরিয়ে যায়।
মীনাক্ষী ওর চলে যাবার পথের দিকে স্তব্ধ হয়ে তাকিয়ে থাকে। দাদার হৃদয়ে যে তার জন্যে এতটা স্নেহ ছিল তা কবে জেনেছে মীনাক্ষী?
কিন্তু ছিল সেকথা কি নীলাক্ষ নিজেই জানত? নীলাক্ষ সর্বদাই মনকেঠিক দিত, এ সংসারের কেউ আমার নয়, আমি কারও নই, ব্যস।
অথচ ও ওর ছোটবোনের জন্যে খুব একটা কষ্ট বোধ করছে। ও ওর ছোটবোনের হাতে নিজের চেক বই তুলে দিতে চাইছে।
.
হয়তো এমনিই হয়।
তাই বিজয়া সিঁড়ি দিয়ে ওঠানামা করতে পরদা ঝোলানোনা একটা দরজার দিকে তাকাতে পারেন না। বিজয়ার অহরহ মনে পড়তে থাকে–একটা শিশুর মতো মানুষ শুধু খেতে থাকতে বলে বিজয়া তাকে বিষদৃষ্টিতে দেখতেন, বিজয়া তার উচ্ছেদ কামনায় পুজো মানত করতেন। ওই একটা ঘর বরবাদ হয়ে আছে বলে রাগের শেষ ছিল না তাঁর। কিন্তু কই, ঘরটায় ঢুকে পড়ে পুরনো চিহ্ন ধুয়ে মুছে ফেলে কাজে লাগাবার কথা ভাবতেও পারা যাচ্ছে না কেন?
.
সরোজাক্ষর ছেড়ে আসা কলেজ থেকে সহকর্মী ডক্টর মজুমদার এলেন একদিন সরোজাক্ষর বাড়ি খুঁজে।
তা বাড়ি খুঁজেই।
সরোজাক্ষ আর কবে তাঁর সহকর্মী বন্ধুদের বাড়িতে ডেকে বাড়ি চিনিয়েছেন?
কদাচ না।
ছেলেমেয়ের বিয়েতেও না।
নিজের পারিবারিক জীবন সম্পর্কে কর্মজগতে তিনি একেবারে নীরব ছিলেন। কেউ কোনও প্রশ্ন করলেও যতটা সম্ভব সংক্ষেপে উত্তর দিয়ে সারতেন।
অতএব সুজন মজুমদারকে বাড়ি খোঁজার কাজটাই করতে হল।
এলেন তিনি কলেজ কর্তৃপক্ষের দূত হয়ে। তাঁরা আবার ডাকছেন।
সরোজাক্ষ যখন পুনর্বার কাজে যোগ দিতে চেয়েছিলেন, বলেছিলেন, পদত্যাগ করে আমি ভুল করেছি ঠিক সেই মুহূর্তেই তাঁকে কেন নেওয়া সম্ভব হয়নি তার কারণ দর্শে এবং অনুতাপ প্রকাশ করে অনুরোধ জানিয়েছেন কর্তৃপক্ষ, সরোজাক্ষ যেন আবার নিজ জায়গায় ফিরে আসেন।
সরোজাক্ষ এ সংবাদে উৎফুল্ল হলেন কি বিব্রত হলেন, কিছুই বোঝা গেল না। নির্লিপ্ত গলায় বললেন, রয়েছেন তো একজন?
মজুমদার হেসে বলেন, রয়েছেন, কিন্তু না থাকাতে কতক্ষণ? একযোগে সবাই মিলে একবার অনাস্থা প্রস্তাব তুললেই
সরোজাক্ষ প্রায় অবাক গলায় বলেন, কিন্তু কেন?
কেন আর? মজুমদার অনিবার্যের গলায় বলেন, ওঁর পড়ানো ছেলেদের ভাল লাগছে না।
আমার পড়ানো ভাল লাগত?
কী আশ্চর্য! এটা কি আর নতুন করে জিজ্ঞেস করবার কথা?
কিন্তু এটা বোধহয় আপনার ভুল ধারণা সুজনবাবু, সরোজাক্ষ বলেন, তা হলে একজন ছাত্রও কোনওদিন আমার কাছে এসে আক্ষেপ প্রকাশ করত।
এসে আক্ষেপ প্রকাশ করবে! মনের ভাব গোপনে অপটু সুজন মজুমদার ব্যঙ্গ হাসি হেসে ওঠেন, তা হলেই হয়েছে। ওদের কাছে আমাদের অত আশা করবার কিছু নেই সরোজবাবু! দয়া করে যার ক্লাসে শেয়াল ডাক ডাকবে না, ধরে নিতে হবে তাকে কিঞ্চিৎ পছন্দ করছে। কিছু ছেলে অবশ্য আছে যারা সভ্য ভদ্র বিনয়ী, কিন্তু ব্যঙ্গ বিদ্রুপের ভয়ে তারাও ক্রমশ মস্তান হয়ে ওঠে। আপনি বরাবরই সাতে-পাঁচে কম থাকেন তাই অতটা লক্ষ করেন না। ভদ্রঘরের ছেলেদের মুখের ভাষা কী হয়েছে যদি শোনেন! বন্ধুতে বন্ধুতে আড্ডা দিচ্ছে, আদরের সম্বোধন হল, শালা মাইরি! কানে এলে কান গরম হয়ে ওঠে। আমরা বরাবর জানতাম মশাই, ওসব হল ইতরের ভাষা। এখন শুনছি ওটাই নাকি বাহাদুরি। একটামাত্র তুচ্ছ নমুনাই শোনালাম আপনাকে, সব কথা আপনার নার্ভ বরদাস্ত করতে পারবে না, তাই বলছি না। মজুমদার একবার দম নিয়ে বলেন, বলা হয়–শিক্ষাই সুরুচির বাহন, তা দেশে শিক্ষার প্রসার যত বাড়ছে, রুচির বালাই তো ততই দুরে সরে যাচ্ছে। উচ্চশিক্ষার আশ্রয় কলেজগুলোকেই তো মাপকাঠি বলে ধরতে হবে? তা দেখুন তাকিয়ে। সর্বত্রই দেখুন। স্টুডেন্ট মহলে এখন মদ না খাওয়াটা গাঁইয়ামি, মার্জিত ভাষায় কথা বলাটা বুড়োমি, আর দু-পাঁচটা করে গার্ল ফ্রেন্ড না থাকাটা বুষ্টুমি। এইসব ছেলেরাই ওই উচ্চশিক্ষার জোরে দেশের দপ্তরে দপ্তরে ছড়িয়ে পড়বে, উঁচু পোস্টে গিয়ে বসবে। আর আমরা নির্বোধের মতো ভাবতে বসব দেশের সমস্যা দূর হবে কোন পথে?
সরোজাক্ষ একটু সোজা হয়ে বসেন। বলেন, না, শুধু তাই ভাবতে বসব না, ভাবতে বসব কোন পদ্ধতিতে অর্থপুস্তক লিখতে পারলে অধিক অর্থ উপার্জন করতে পারব। আর ক্লাসের সময় ফাঁকি দিয়ে কীভাবে প্রাইভেট টিউশানির জন্যে সময় বার করব।
মজুমদার অবশ্যই এ আক্রমণের জন্যে প্রস্তুত ছিলেন না, তাই উত্তেজিত গলায় বলেন, আপনি তা হলে ওদেরই সমর্থন করছেন?
ভুল করছেন সুজনবাবু, আমি কাউকেই সমর্থন করছি না, আমি শুধু যা ঘটে তাই বলছি।
সুজন মজুমদার কিছু অর্থপুস্তক লিখেছেন, এবং প্রাইভেট টিউশানিও করে থাকেন তিনি, তাই আক্রমণটা তাঁর গায়ে বাজে। বাড়ি খুঁজে বাড়ি বয়ে যার হিত করতে এসেছেন, তার এই ব্যবহার!
সুজন মজুমদার উত্তেজিত গলায় বলেন, শুধু যা ঘটে তাই বলবেন কেন, উদ্দেশ্য নিয়েই বলছেন। তবে ভুলবেন না আমি আপনার হিত চেষ্টাতেই এসেছিলাম।
সরোজাক্ষ আস্তে বলেন, আপনি উত্তেজিত হচ্ছেন সুজনবাবু! কিন্তু ভাল করে ভেবে দেখুন, আমাদের কি আজ আত্মসমীক্ষার প্রয়োজন আসেনি? শুধু ছেলেদের ওপর সব দোষ চাপিয়ে নিশ্চিন্ত চিত্তে বসে তাদের সমালোচনা করাতেই কর্তব্য শেষ হবে আমাদের?
কথাগুলো শুনতে বেশ ভাল, বুঝলেন? সুজন মজুমদার উষ্ণভাবেই বলেন, সিনেমা থিয়েটারে কি গল্পে উপন্যাসে চেঁচিয়ে বলতে পারলে বাহবা পাওয়া যায়। কিন্তু চোখ খুলে দেখলেই বুঝতে পারবেন কী অবতারই হয়ে উঠেছে আমাদের ছেলেরা! কিছু না হোক, শুধু বারোয়ারি পুজোগুলোর দিকে তাকিয়ে দেখুন। পুজোর স্রোত বইছে দেশে। সবাই একযোগে ভক্ত হনুমান হয়ে উঠেছেন, পুজো না করে প্রাণ বাঁচবে না। এর মধ্যেকার তত্ত্বটা কী আর তথ্যটা কী? ভেবে দেখেছেন? এই হাজার হাজার বারোয়ারি পুজোর রসদ আসছে কোথা থেকে? আসছে জুলুমবাজির মাধ্যমে। চোখ রাঙিয়ে চাঁদা আদায় করে পুজোর নামে বেপরোয়া ফুর্তি করব, এই হচ্ছে লক্ষ্য। এক-একটি পুজোর সময় দেশের চেহারা দেখলে বোঝা যাবে এ-দেশে দুঃখ আছে? দৈন্য আছে? অভাব আছে? সমস্যা আছে?
মজুমদারকে বোধ করি সম্প্রতি মোটা চাঁদার হাড়িকাঠে গলা দিতে হয়েছে, তাই এই প্রসঙ্গে আরও উদ্দীপ্ত হন। আবেগতপ্ত কণ্ঠে চালিয়েই যান, শুধু স্ফুর্তি, শুধু উল্লাস! হৃদয় বলে কিছু নেই, চিন্তা বলে কিছু নেই, মানবিকতা বলে কিছু নেই! নইলে বাংলাদেশের এক প্রান্ত যখন ক্ষয়ক্ষতি আর মৃত্যুতে শ্মশান হয়ে পড়ে আছে, অপর প্রান্তে তখন উল্লাসের উদ্দাম রোশনাই জ্বলছে।–এইসব ইয়ংদের মধ্যে সহানুভূতি থাকবে না? সমবেদনা থাকবে না? সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেবার প্রেরণা থাকবে না? প্রেরণা আসে কীসে? না লরি চড়ে তরুণ-তরুণী মিলে সমবেতকণ্ঠে গান গাইতে গাইতে শহর প্রদক্ষিণ করে সাহায্য সংগ্রহে। তারপর সেইসব জিনিসের গতিটা কী হল–হিসেব পাবেন না আপনি!
সরোজাক্ষ মৃদু হেসে বলেন, সেটাও বলতে পারা যায়, যা দেখছে তাই শিখছে।
সুজন বলেন, ওঃ বুঝেছি, ঘেরাও হয়ে পর্যন্ত আপনি এখন ওদের ভয় করে চলতে শিখছেন। আমি সে দলে নই। আমি যদি শতবার ঘেরাও হই তো দুশতবার বলব আমাদের পরবর্তী জেনারেশান স্রেফ অপদার্থ হয়ে গেছে। ওদের হয়ে বলছেন বলেই বলছি–আপনি ভাবতে পারেন আপনার ছেলেবেলায় আপনার বাবা গুরুতর পীড়িত, অথচ আপনি বারোয়ারি তলায় বসে হল্লা করছেন? আমি অন্তত ভাবতেই পারি না। আমরা ছেলেবেলায় বাড়িতে কারও শক্ত অসুখ করলে কখনও জোরে হেসে উঠতে পারতাম না। আর এখন? প্রত্যক্ষ দেখা, ছেলেরা তো বটেই, মেয়েগুলো সুষ্ঠু-এই তো আমারই বাড়ির সামনে–এক ভদ্রলোকের সিরিয়াস অসুখ, ডাক্তারে বাড়ি ভর্তি, আর তাঁর এক চোদ্দ-পনেরো বছরের ধিঙ্গি মেয়ে পুজোপ্যাণ্ডেলে রাজ্যের মেয়ে-ছেলের সঙ্গে হি হি করছে।–জিজ্ঞেস করলাম, বাবা কেমন আছেন আজ?সঙ্গে সঙ্গে মুখের চেহারা করুণ করে ফেলে ন্যাকা ন্যাকা গলায় উত্তর দিল, আজ তো বাবার খুব বেশি বাড়াবাড়ি।বুঝুন এ জ্ঞান আছে খুব-বেশি-বাড়াবাড়ি। অথচ মনে এতটুকু মমতা নেই, ভয় নেই, এমনকী চক্ষুলজ্জার বালাই পর্যন্ত নেই। এই হচ্ছে এযুগের ছেলেমেয়ে, বুঝলেন? পারিবারিক বন্ধনের ধারই ধারে না।
সরোজাক্ষ যেন মনশ্চক্ষে কী দেখেন।
সে কি নিজেরই বাড়ির পারিবারিক ছবি?
কে জানে কী!
তবে উত্তর দেন, সেও আমাদেরই ত্রুটি সুজনবাবু! এই অবসরের ক মাস আমি কেবল বসে বসে ভেবেছি। অনেক ভেবেছি। আর ভেবে ভেবে দেখতে পাচ্ছি আমরা নিমের চাষ করে, আমের আশা করছি। যে কর্তব্যবুদ্ধি, যে মমতা, যে সমবেদনা ওদের কাছে আশা করছি, আমরা নিজেরা সে আদর্শ দেখাতে পারছি কই ওদের? আমরা ছেলেবেলায় কী ছিলাম ওরা সেটা দেখতে যাবে না। আমরা এখন কী হয়েছি? আমরা প্রতিবেশীর প্রতি সহানুভূতিশীল? আমরা একে অন্যের কথা ভাবি? বেশি কথা কী, একই বাড়িতে একজন আর একজনকে বুঝি না, একজন অপরজনকে নিষ্ঠুর আঘাত হেনে বসি। তবে?
তবে আর কী? হাত পা ছেড়ে দিয়ে ভাসাই শ্রেয় হবে। বিদ্রুপের গলায় কথাটা বলে সুজন মজুমদার দাঁড়িয়ে উঠে বলেন,আচ্ছা, আপনার মতামত জানাবেন পরে।
পরে জানাবার কিছু নেই সুজনবাবু, সরোজা বলেন, আমি মনঃস্থির করে ফেলেছি হুগলি কলেজেই জয়েন করব। আপনার সহানুভূতির জন্যে ধন্যবাদ!
সুজন মজুমদার নমস্কার করে বেরিয়ে যেতে যেতে ভাবেন, চিন্তা করছ। হরদম চিন্তা করছ। তার মানে, তোমার হেড কোম্পানিতে গণ্ডগোল বেধেছে।
তাই তো ভাবে লোকে।
কাউকে তলিয়ে চিন্তা করতে দেখলে আর বিচার করতে বসতে দেখলে বলে, লোকটার মাথাখারাপ হয়ে গেছে। চিন্তাহীন বিচারহীন–শুধু অভ্যাসের স্রোতে ভেসে যাওয়াই স্বাভাবিকতা, সুস্থতা।
.
একবস্তা কাগজ তো হৈমবতীর কাছে পড়ে রইল, বাকি বস্তাটা ভেবেছিল গঙ্গায় ফেলে দেবে, দিতে গিয়ে দিতে পারল না। গঙ্গার ঘাটে কত লোক, হাওড়া ব্রিজে কত লোক। লোকের চোখকে বড় ভয় সারদাপ্রসাদের।
হয়তো সেইটা ভেবেই মনকে চোখ ঠারছে সে। হয়তো নিজের হাতে করে জলে ফেলে দিতে বুকে বেজেছে। তাই ভাবছে, কলকাতার গঙ্গায় নয়, অন্য কোথাও। নির্জন কোনও ঘাট থেকে। আস্তে আস্তে নেমে নামিয়ে দিয়ে বলব, গঙ্গা, সারাজীবনের বৃথা স্বপ্ন আর বৃথা পরিশ্রমের ভার তোমার কাছেই নামিয়ে রেখে গেলাম।
নামিয়ে রেখে গেলাম!
নামিয়ে রেখে গেলাম।
কিন্তু কোথায় গেলাম?
সারদাপ্রসাদ যেন অবাক হয়ে ভাবে, তারপর আমি কোথায় যাব? সেই আমার প্রায় অচেনা ভাইপোদের কাছে?
তারপর যে কথাটা জীবনে কখনও মনে পড়েনি সারদাপ্রসাদের, সেই কথাটা মনে পড়ল। হয়তো পড়ত না, যদি না সরোজাক্ষ সেদিন সেই অদ্ভুত সন্দেহের কথাটা উচ্চারণ করতেন। সরোজাক্ষ সেই নোটের তাড়াটা দেখে সন্দেহ করেছিলেন সারদাপ্রসাদ তার দেশের জমিজমা বিক্রি করেছে।
সারদাপ্রসাদের তাই হঠাৎ মনে পড়ল দেশে তার জমিজমা আছে। মনে পড়ল সে জমিজমা বেচা যায়। আর বেচলে তা থেকে টাকা পাওয়া যায়। কিন্তু কত সেই টাকা? সে টাকায় সারদাপ্রসাদ কোনও একটা জায়গায় নিজের মতো করে থাকতে পারে?
কিন্তু নিজের মতোটাই বা কেমন?
স্পষ্ট কোনও ধারণা করতে পারল না সারদাপ্রসাদ সেই নিজের মতোটা সম্পর্কে। সারদাপ্রসাদ আছে, অথচ তার লেখার খাতা নেই। কেমন সেই জীবন? সকাল থেকে রাত অবধি কী তবে করবে সারদা?
সারদা তো ভেবেছিল চাকরি করবে।
সাধারণ মানুষে যা করে তাই করবে। চাকরি খুঁজে খুঁজেই তো বেড়াচ্ছিল। তবে আবার সেই খোঁজার চাকরিটাই ধরুক। তারপর যখন সত্যি চাকরি জুটবে
কিন্তু জুটলেই বা কী?
কী জন্যে সেটা করবে সারদাপ্রসাদ?
শুধু নিজে কোনও একটা জায়গায় থাকবে, আর কোনওরকমে দুবেলা খাবে, এই জন্যে? সেই থাকাটা আর খাওয়াটার জন্যে সারদাপ্রসাদকে বাঁধা নিয়মে ঘুম ভেঙে উঠতে হবে, সারদাপ্রসাদকে হয়তো বাজার করতে হবে। তারপর দাড়ি কামাতে হবে, চান করতে হবে, ফরসা কাপড় জামা পরে সেজেগুজে জনতার ভিড় ঠেলে কর্মস্থলে পৌঁছতে হবে, সারাদিন খাটতে হবে?
তারপর?
তারপর আবার কী?
বাড়ি ফিরে হয়তো আবারও দোকান বাজার যেতে হবে, যার উপর রান্নার ভার, সে রান্না ফেলে। সারদাপ্রসাদের টাকার ব্যাগটা নিয়ে সরে পড়েছে কিনা খোঁজ করতে হবে, আর সেটা না করে বেঁধে সামনে খাবার সাজিয়ে দিয়েছে দেখলে কৃতজ্ঞচিত্তে ভগবানকে সাতসেলাম ঠুকে খেয়েদেয়ে সকালবেলা যাতে সহজে উঠতে পারা যায়, তাই সকাল সকাল ঘুমিয়ে পড়তে হবে।
কিন্তু এসব কেন করতে হবে।
তার বিনিময়ে কী পাবে সারদাপ্রসাদ?
কী পায় লোকে?
কী আবার? ওই থাকা আর খাওয়া! ঘুরে ফিরে তো সেই একই জায়গায় এসে পৌঁছচ্ছে।
অথচ ভেবে খুব একটা হাসি পাচ্ছে সারদাপ্রসাদের। শুধু ওইটুকু পাবার জন্যে ঘুরে বেড়াচ্ছে মানুষ? কী আশ্চর্য! কী অদ্ভুত!
হয়তো নিজের কাছে নিজেকে ওই রকম আশ্চর্য আর অদ্ভুত লাগে বলেই মানুষ লোভ নামক রথের চাকায় বেঁধে ফেলে নিজেকে। অর্থলোভ, ক্ষমতার লোভ, নারীলোভ, উদ্দেশ্য সিদ্ধির লোভ, আত্মপ্রচারের লোভ। এই লোভের চাকায় নিজেকে বেঁধে ফেলে কাঁটাবনে ঘষটাতে ঘষটাতে যেতে যেতে তবে মানুষ আপন অকিঞ্চিৎকরতাটাকে ভুলে থাকতে পারে। অথবা ভুলে থাকতে চায়। নচেৎ শুধু খাওয়া শোয়ার জন্যে বেঁচে থাকাটা ভারী অর্থহীন লাগবে যে!
ওই অর্থহীন কাজটার উপর একটা ইতি টেনে দিলেই বা ক্ষতি কী?
ভাবল সারদাপ্রসাদ, গঙ্গায় তো জলের অপ্রাচুর্য নেই। আবার ভেবে লজ্জিত হল। ভাবল, ছি ছি! এ কী ভাবছি আমি! ভগবানের এই রাজ্যে মহৎ কাজের কোনও অভাব আছে?
.
মীনাক্ষী ভাবেনি, ভগবানের এই রাজ্যটা
মীনাক্ষী ভাবছিল, এত বড় পৃথিবীটায় এমন এতটুকু জায়গা নেই যে মীনাক্ষী সেখানে একটু বিশ্রাম নেয়। নিশ্চিত বিশ্রাম। যেখানে মাথা নিচু করে থাকতে হবে না। যেখানে মীনাক্ষী ভাবতে পারবে, এখানে আমি আমার মতো করে থাকব।
পৃথিবীর সেই দুর্লভ কোণটুকু ভেবে পায় না মীনাক্ষী। মীনাক্ষীর সব গোলমাল হয়ে যায়।
আমি কি তবে কাকি-ঠাকুমার আশ্রয়ে গিয়ে উঠব?
ভাবে মীনাক্ষী, অন্তত কিছুটা দিনের জন্যে?
উনি সংস্কারমুক্ত, উনি সংসারে একা, উনি লোকলজ্জার ধার ধারেন না।
কিন্তু উনি আর আসেন না।
পিসেমশাই থাকলে–তাঁকে দিয়ে বলে পাঠাতে পারতাম।
ভাবতে গেলেই চোখটা জ্বালা করে আসে মীনাক্ষীর। ভাবে পিসেমশাইকে যে আমি এত ভালবাসতাম তা তো কই কখনও বুঝতে পারিনি। পিসেমশাই দুঃখ পেয়ে চলে গেছেন ভাবলে কী ভয়ানক একটা যন্ত্রণা হয়। পিসেমশাইকে ইচ্ছে করে কত দুঃখ দিয়েছি, আঘাত করেছি, অবজ্ঞা করেছি, খুব একটা কৌতুকের জায়গা ভেবে মজা করেছি।
অথচ এখন ভেবে মাটিতে মিশিয়ে যেতে ইচ্ছে করছে। কত ছোট হয়েছি তাঁর কাছে। কাউকে ছোট করতে গেলে নিজেই যে কত ছোট হয়ে যেতে হয়, সেটা বোঝা যায় সেই মানুষটা যদি বিদায় নেয়।
.
মেয়ে যখন আসত, তখন রোজ আসত, রোজ থাকত। আবার এখন আসে না তো আসেই না।
সুনন্দার মা উদ্বিগ্ন হন।
মেজাজি জামাই কোনও কারণে রেগে-টেগে যায়নি তো? অথবা মেয়ে?
মহিলাটি নেহাতই সাদাসিধে গেরস্তালি ধরনের। ক্ষুদ্র একটি পরিধির মধ্যে সারা জীবন কাটিয়ে এলেন, কিন্তু নিজেকে কোনওদিন ক্ষুদ্র ভেবে মরমে মরেননি, বিধাতাকে অভিশাপ দেননি। তিনি জানেন, তাঁর হাতে যেটুকু আছে সেইটুকুতেই সন্তুষ্ট থাকতে হয়, সেইটুকু দিয়েই স্বর্গের সাধনা করতে
মেয়েটিকে ভাল ঘরে বিয়ে দিয়ে নিশ্চিন্ত ছিলেন, কিন্তু হঠাৎ কেমন করেই যে বদলে গেল সেই মেয়ে!
সেই বদলের চেহারাটা সুনন্দার মার কল্পনার বাইরে ছিল।
সুনন্দার মা মেয়ের সেই বদলে যাওয়ার রূপ দেখে ভীত হতেন, লজ্জিত হতেন, ব্যথিত হতেন, কখনও কখনও ঘৃণায় স্তব্ধ হয়ে যেতেন, তবু সাহস করে তার ব্যবহারের সমালোচনা করতে পারতেন না। পারতেন না, পাছে সেই সমালোচনার ফলে সে আর না আসে।
মাতৃহৃদয় যে সেইখানেই অসহায়।
পাছে আমার কাছে আর না আসে। পাছে আমাকে আর মা বলে না ডাকে।
এই এক ভয়ংকর ভয়ে মাতৃহৃদয় জেনেবুঝেও অন্যায়ের প্রশ্রয় দিয়ে দোষীর কাছে দোষী সাজে।
সেই দোষী মূর্তিতেই সুনন্দরা মা স্বামীর কাছে প্রায় কেঁদে পড়লেন। কতদিন আসেনি ওরা, তুমি একবার আসতে বলবে না?
সুনন্দার বাবা গম্ভীরভাবে বলেন, যখন ওদের আসার ইচ্ছে হত, আসত। বরং অতিরিক্তই আসত। এখন ইচ্ছে হয় না আসে না, আসতে বলতে যাবার দরকারটা কী?
পিতৃহৃদয় মাতৃহৃদয় থেকে অনেক বেশি যুক্তিবাদী এবং বাস্তববাদী।
সুনন্দার বাবা মেয়ে-জামাইয়ের তখনকার সেই বেয়াড়া আবদারের বোঝা মুখ বুজে সহ্য করে। গেলেও মনে মনে রীতিমত অসহিষ্ণু হয়ে উঠেছিলেন, এখন যে আর তাদের সেই প্রত্যহ আসার হুল্লোড়টা নেই, তাতে যেন খুশিই আছেন ভদ্রলোক।
মেয়ে-জামাইয়ের নিত্য আগমনে তিনি তো প্রায় সংসারে অবান্তর হয়ে পড়েছিলেন। খাওয়ার অনিয়ম, শোয়ার অনিয়ম, বিশ্রামের অনিয়ম। তারপর দুরন্ত একটা বাচ্চা ছেড়ে রেখে দিয়ে নিত্যই তাদের কেটে পড়া। গৃহিণী অতএব কর্তাকে গৃহকর্তার বদলে, গৃহভৃত্যের পোস্টটা দিয়ে রেখেছিলেন।
জামাইয়ের জন্যে খাবার আনতে ছোটো, মাংস আনতে ছোটো, নাতি কাঁদলে তাকে সামলাতে পাতালে নামো, আকাশে ওঠো। আর পকেটে পয়সা না থাকলে পয়সা বার করো।
মহিলারা যদি সবদিকেও বুঝমান হন, দু-একটা দিকে ভীষণ অবুঝ। বাপের বাড়ি, আর জামাইবাড়ি।
সুনন্দার বাবা ভেবে নিশ্চিন্ত ছিলেন, সংসারটা একটু সমে এসেছে। হঠাৎ গৃহিণীর কণ্ঠস্বরে সেই অবুঝের আভাস পেলেন। অতএব তিনি চকিত হলেন। শক্ত হলেন।
আর সেই শক্তপোক্ত গলাতেই বললেন,আমি তো কোনওদিন তাদের যেতে বলিনি যে তাই আসতে বলতে যাব?
বাঃ তা যাবে না? রোজ আসত হঠাৎ আর একেবারেই কেন?
সুনন্দার বাবা বেজার গলায় বলেন, পকেটে টাকার ঘাটতি হয়েছে বোধহয় ফুর্তিটা কম হচ্ছে। তা ছাড়া ছেলেকে বোর্ডিঙে রেখে দিয়েছে, আর তোমায় দরকার কী?
তুমি তো চিরদিনই ওই রকম নির্মায়িকের মতো কথা কয়ে এলে। বলি–কোনও কারণে রাগ অভিমানও হতে পারে!
রাগ অভিমান? সুনন্দার বাবা তপ্ত গলায় বলেন, রাগ অভিমান কীসের? তুমি তো ফুল চন্দন হাতে করে বসে থাকো, আর আমিও কোনওদিন বলতে যাইনি এ বাড়ির মেয়ে হয়ে তুই মদ খেয়ে টলছিস? কোন লজ্জায় মুখ দেখাচ্ছিস? বলিনি, একদিনের জন্যেও বলিনি। জামাইকে যখন ঠাস করে একটা চড় বসিয়ে দিতে ইচ্ছে হয়েছে, তখন তার জন্যে রাবড়ি রাজভোগ আনতে দোকানে ছুটেছি। তবুও যদি তাঁদের রাগ অভিমান হয়, নাচার।
সুনন্দার মা অভিমানের গলায় বলেন, তুমি যে জামাইকে বিষদৃষ্টিতে দেখো তা আর আমার জানতে বাকি নেই।
বাকি নেই? তবু আমাকে দিয়ে তাকে নেমন্তন্ন করতে পাঠাতে চাইছ? বাঃ।
সুনন্দার মা ক্ষুব্ধ স্বরে বলেন, তবে কি আমি যাব?
যেতেই হবে কেন, সেটাই আমার প্রশ্ন।
সে প্রশ্ন তুমি করতে পারো, তোমার কাঠ প্রাণ। সুনন্দার মা কেঁদে ফেলেন, তারা যদি আর না আসে, তোমার তো মনেও পড়বে না কোনও দিন।
ওই তো ওইটিতেই চিরদিন জিতে এলে।
সুনন্দার মধ্যবিত্ত বাপ, তাঁর মধ্যচিত্ততারও নমুনা হন। তাড়াতাড়ি বলে ওঠেন, বলো তো যাই, তাঁদের পায়ে ধরে নেমন্তন্ন করে আসি। মেয়ে কি আর তোমার সেই মেয়ে আছে? পেটকাটা জামা পরে পার্টিতে যাচ্ছে, মদ খেয়ে টলছে, শাশুড়ির ওপর আক্রোশ দেখাতে আর টেক্কা দিতে তোমাকে মা বলে ডেকে এসেছে। এখন হয়তো দরকার ফুরিয়েছে।
সুনন্দরা মা কাঁদো কাঁদো গলায় বলেন, তা হলে তুমি ওদের আসতে বলবে না?
না, সে কথা আর বলতে পারছি কই? তবে বেয়াইবাড়ি ভাবলেই মেজাজ খারাপ হয়ে যায়। বেয়াই একটার বেশি দুটো কথা কন না, বেয়ান উৰ্ব্বলোক থেকে নামেনই না,কথা যা কই তো সেই পিসেমশাই, তা সেও তো শুনছি বিদায় নিয়েছে।
সুনন্দা তো আছে? না কি সেও গেলে কথা কইবে না?
কইতেও পারে, না কইতেও পারে। তবে যেতে যখন বলছ যেতেই হবে।
এই হচ্ছে সুনন্দার মা বাপ।
অতি সাধারণ।
তারা পরস্পরের মধ্যে কোনও দিন প্রেমের কথার আমদানি করেনি, তারা জীবনের ব্যর্থতা সার্থকতা নিয়ে মাথা ঘামায়নি, তারা তাদের জীবনকে কখনও বোঝাস্বরূপ মনে করেনি।
তারা বাজার করে রান্না করে, তুচ্ছ বিষয়বস্তু নিয়ে গল্প করে রাগ করে ঝগড়া করে, আবার বলে, বলেছ যখন, তখন না করে উপায় কী?
দাম্পত্য জীবনের এই ছবিই দেখেছে সুনন্দা তার কুমারী জীবনে।
দেখেছে কখনও মা বাবাকে ভয় করে, কখনও বাবা মাকে ভয় করে। কখনও মা কোনও কাজ করে মেয়ের কাছে চুপিচুপি বলেছে, এই, দেখিস যেন তোর বাপ না জানতে পারে। যা রাগী মানুষ, টের পেলে আর রক্ষে রাখবে না।
কখনও বাবা কোনও কাজ করে মেয়েকে বলেছে, দেখিস বাবা তোর মা যেন না টের পায়, পেলে কেঁদে-কেটে অনর্থ করবে। যা ছিচকাঁদুনে মানুষ!
সুনন্দা বড় মেয়ে, তাই সুনন্দার সঙ্গেই পরামর্শ।
কিন্তু কীই বা সেই কাজগুলো? ভাবলে এখন হাসি পায় সুনন্দার। হয়তো মা একটি ছিট কাপড়-ফেরিওয়ালা ডেকে দুগজ ছিট কিনেছে, নয়তো বা একটা বাসনওলা ডেকে পুরনো বাসন বদলে দুটো বাটি কিনেছে। আর বাবা হয়তো সুনন্দার জন্যে জুতো কিনতে এসে পাঁচ টাকার জুতো কিনে নিয়ে গিয়ে অম্লান বদনে বলেছে, এইটুকুন জুতো আট টাকা দাম নিল, বাজার দেখেছ? হয়তো সুনন্দার মার ফরমাশি কিছু কিনতে এসে দাম দেখে পিছিয়ে গিয়ে দরাজ গলায়ে বলেছে, কোথাও পেলাম না বুঝলে? পাঁচ সাতটা দোকান ঘুরলাম, বলে ওটা আজকাল আর পাওয়া যায় না।
ষড়যন্ত্রের অংশীদার সুনন্দা দোকান বাজারে বাপের সঙ্গে থেকেছে, তাই সেও সোৎসাহে বলেছে, উঃ হেঁটে হেঁটে পা ব্যথা হয়ে গেছে।
আর বাবা যদি কখনও প্রশ্ন করেছে, এই তোর মা দুপুরবেলা ফেরিওলাটোলা ডাকে না তো?
সুনন্দা অপার্থিব মুখ করেছে, না তো বাবা!
এই! এমনিই সব ঘটনা নিয়ে তাদের মান অভিমান, ভয়, লুকোচুরি! প্রায় ছেলেমানুষের মতো। এই জানত সুনন্দা।
আক্রোশ নয়, হিংস্রতা নয়, একজন অপরজনকে হেয় করবার চেষ্টায় উন্মুখ হয়ে থাকা নয়, হৃদয়ের বন্ধনহীন একটা প্রতিপক্ষের ভাব নিয়ে এক ছাদের তলায় থাকার নির্লজ্জতা নয়।
এরা কি তুচ্ছ? ক্ষুদ্র? অসম্ভ্রান্ত?
এ বাড়িতে এসে সুনন্দা দাম্পত্য জীবনের তার সেই পরিচিত ছবি দেখতে পায়নি। তারপর নিজের জীবনে ।
সুনন্দা জানে নীলাক্ষ তার অতি সাধারণ শ্বশুর-শাশুড়িকে কৃপার চক্ষে দেখে। প্রয়োজনের খাতিরে তাদের বাড়িতে যাওয়া-আসা করলেও কখনও সমীহের দৃষ্টিতে তাকায় না।
অভাবের মধ্যে থেকেও যারা সুখে থাকতে পারে, তাদের প্রতি বড় অবজ্ঞা নীলাক্ষর।
নীলাক্ষ টাকার অভাবটাকেই একমাত্র অভাব বলে জানে। সেই অভাবটাই উঠেপড়ে লেগে ঘোচাতে চেষ্টা করেছিল নীলাক্ষ সুখ পাবার আশায়।
আর সেই চেষ্টায় মূলধন করেছিল সুনন্দাকে। তাই যখন সুনন্দা হাসিতে কটাক্ষে নাচে গানে তার ডিলারদের মুগ্ধ করে বড় বড় একটা কাজ গুছিয়ে দিয়েছে, তখন নীলাক্ষ সুনন্দাকে আদরে ডুবিয়ে বলেছে, তুমি আমার একটি সোনার খনি!
সুনন্দা বলত,আমাকে ভাঙিয়ে তুমি বড়লোক হতে চাইছ?
নীলাক্ষ অম্লানবদনে বলত, তা ভাঙাবার মতো আর কী সম্পত্তি আমার আছে বলো?
এ বাড়িতে এসে নিজের জীবনে এই দাম্পত্য সম্পর্ক দেখতে পেল সুনন্দা। তবু সুনন্দা এবাড়িতেই রয়ে গেছে।
আশ্চর্য!
তবে কি ওই লোকটার জন্যেও ভালবাসা রয়েছে সুনন্দার? সুনন্দা তাই ভাবতে চেষ্টা করেছে, আর কিছু নয় ও নির্বোধ, বড় বেশি নির্বোধ, তাই বুঝতে পারছে না কীসের বদলে কী কিনছে।
কিন্তু ভালই যদি বাসে, ওকে তবে সব সময় বিধতে ইচ্ছে করে কেন সুনন্দার?
ব্যঙ্গ হাসির ছুরি দিয়ে, ধারালো কথার তীর দিয়ে দিয়ে?
জানে না, কেন।
তবু নীলাক্ষ যখন তার বোনের কাছ থেকে ফিরে এসে হতাশ গলায় বলে, রাস্কেলটার ঠিকানা দিলে না? তখন সুনন্দা সেই তীর মারে। বলে, অত বিচলিতই বা হচ্ছ কেন গো? তুমি তো এমন কুসংস্কারাচ্ছন্ন ছিলে না? মেয়েদের জীবনে এ তো একটা অ্যাকসিডেন্ট মাত্র। পবিত্রতা সতীত্ব এসব তো তোমার কাছে স্রেফ কুসংস্কার।
নীলাক্ষ ক্রুদ্ধ গলায় বলে, সতীত্ব মানে? ওর কি বিয়ে হয়েছে?
ও হো হো তাই তো বটে! সুনন্দা হি হি করে হাসে, কী বোকা আমি। হি হি হি। পতি না হলে আর সতী? সত্যি, আমি এমন বোকা কেন বলো তো?
আচ্ছা, অস্বাভাবিকের ভান করতে করতে সুনন্দা কি শেষ পর্যন্ত অস্বাভাবিক হয়ে যাবে?
.
গ্যারেজের চাবি খুলে ঢুকে গাড়িটার গায়ে হাত বুলিয়ে দেখলেন সরোজাক্ষ। ধুলো জমেছে বিস্তর, সরোজাক্ষর সেই অসুখ হয়ে পড়ার পর থেকেই তো চাবিবন্ধ পড়ে আছে।
নীলাক্ষ গ্যারেজের সামনে দাঁড়িয়ে তীব্রদৃষ্টিতে দেখে দেখে ফুটপাথে নেমে ট্যাক্সি ডাকে।
কমলাক্ষ যখন এসেছিল কদিনের জন্যে, সেও বলেছিল, বসে থেকে থেকে তো জং ধরে গেল ওটায়, চাবিটা বাগিয়ে আনো না মা, একবার নিয়ে বেরিয়ে পড়ি।
বিজয়া প্রথমে বলেছিলেন, হ্যাঁ, মারামারি করে মাথা ফাটিয়ে এসেছ, এবার গাড়ি অ্যাকসিডেন্ট করে হাত-পা ভাঙো। চালাতে শিখলি কবে যে গ্যারেজের চাবিটা পেলেই চালাবি?
তারপর বলেছিলেন, চাবি উনি দিলে তো? ওই গাড়িটা তো তোদের বাপের কাছে গাড়ি নয়, ওঁর মরে যাওয়া কাকা!
সরোজাক্ষ অবশ্য শুনতে পাননি সে কথা। শুনলে হয়তো অবাক হয়ে ভাবতেন, বিজয়া কবে আমায় এমন নিষ্ঠার সঙ্গে পড়ে ফেলল?
বাস্তবিকই বুঝি সরোজাক্ষর হৃদয়ে গাড়িটা সম্পর্কে ওই রকমই একটি ভাবপ্রবণতা আছে। ওর গায়ে হাত বুলিয়ে বুলিয়ে যেন কোনও প্রিয় স্মৃতির গা থেকে বিস্মৃতির ধুলো ঝাড়লেন।
কিন্তু একে এখন চালিয়ে নিয়ে যাওয়া যাবে না, এতদিনের অবহেলার মাশুল দিতে হবে। আবার চাবিবন্ধ করলেন গ্যারেজের, রাস্তায় নামলেন, বাসস্টপের দিকে এগোলেন।
রোদে বেরোনো ডাক্তারের নিষেধ ছিল সরোজাক্ষর, ভিড়ের মধ্যে ট্রামে বাসে চড়া নিষেধ ছিল, সে নিষেধ এতদিন মেনেছিলেন সরোজাক্ষ। ডাক্তারের আদেশের প্রতি নিষ্ঠাবশতই যে মেনেছিলেন তা নয়, যেন নিষ্ক্রিয়তার একটা কফিনের মধ্যে নিজেকে পুরে ফেলে এই একখানা ঘরের মধ্যে কবরিত করে ফেলেছিলেন নিজেকে।
কেন?
সে কথা সরোজাক্ষ নিজেও বোধ করি জানেন না। হয়তো সহসা একটা বড় আঘাতে অসাড় হয়ে গিয়ে স্তব্ধ হয়ে গিয়েছিলেন, হয়তো বা অসাড় চিত্ত সহসা একটা বড় আঘাত পেয়ে বহু চিন্তায় সচেতন হয়ে উঠেছিল বলে চিন্তার দুর্গে বন্দি করে ফেলেছিলেন নিজেকে।
আজ আবার সহসাই যেন সব নিষ্ক্রিয়তার খোলস খুলে বার করে আনলেন নিজেকে সমর্পণ করলেন জনারণ্যের মধ্যে।
কিন্তু কেন?
কেন হঠাৎ আবার আজ আপন সৃষ্ট দুর্গ থেকে বেরিয়ে পড়তে ইচ্ছে হল সরোজাক্ষর? আর বাড়ির কাউকে না জানিয়েই বেরিয়ে পড়লেন কেন?
সরোজাক্ষ কি তবে হঠাৎ তাঁর সংসারের ক্লেদাক্ত ঘটনা শুনে ফেলেছেন, তাই বিচলিত হয়ে বেরিয়ে পড়েছেন সেই সংসারের গণ্ডি থেকে?
কিন্তু কই? তা তো নয়।
বিজয়া তো সেই কলঙ্কিত কথা এ পর্যন্ত সযত্নে স্বামীর কাছ থেকে গোপন করেই আসছে। জানেন কেউ কাছে গিয়ে না বললে, টের পাবার ক্ষমতা নেই সরোজাক্ষর। বিজয়া এখনও পর্যন্ত আশা করছিলেন, হয়তো শেষ অবধি মীনাক্ষীর সুমতি হবে, হয়তো গোপনটা গোপনই থেকে যাবে।
স্বামীকে বিজয়া কোনও ব্যাপারেই ভয় করেন না, স্বামীর পছন্দ-অপছন্দকে তোয়াক্কাই করেন না। কিন্তু এবারে একটু বে-পোটে পড়ে গেছেন। এবারে ভয় জন্মেছে।
অথচ এ ভয় করবার কথা ছিল না।
অন্তত বিজয়ার প্রকৃতিতে ছিল না।
বিজয়ার প্রকৃতিতে তো স্বাভাবিক ছিল স্বামীর কাছে এসে ফেটে পড়ে মেয়েকে যথেচ্ছ বিচরণের সুযোগ দেওয়ার অপরাধে তাঁকেই বাক্যবাণে বিদ্ধ করে জর্জরিত করা এবং মেয়েকে বিজয়ার ইচ্ছে অনুযায়ী মানুষ করতে দিলে যে আজ এমন কেলেঙ্কারি ঘটতে পারত না, সেটাও সগৌরবে ঘোষণায় বুঝিয়ে ছাড়া।
কিন্তু বিজয়া তা করেননি।
বিজয়া ভয় পেয়েছেন, ওই ধিক্কারটা তাঁর নিজের উপরই আসবে ওই আশঙ্কায়। বিজয়া ভেবেছিলেন, সরোজাক্ষ নিঃশব্দে শুধু তাকিয়ে থেকেই বিজয়াকে ধুলোয় মিশিয়ে দিতে পারেন। সরোজাক্ষ একটিমাত্র ঘৃণার বাণী উচ্চারণ করে মা আর মেয়েকে বিদীর্ণ করে ফেলতে পারেন।
বিজয়া বুঝতে পেরেছিলেন, সেই নিঃশব্দ ধিক্কারের, সেই একটি ঘৃণার বাক্যের সামনে বিজয়া মুখ খুলতে পারবেন না। মর্যাদাজ্ঞানহীন বিজয়া স্বামীর হৃদয়-দুর্গে প্রবেশের পথ না পেয়ে চিরকাল সেই দুর্গদ্বারে দাঁড়িয়ে চিৎকার করেছেন, আর ভেবেছেন, এটাই বুঝি বিজয়, কিন্তু হঠাৎ যেন সেই পদ্ধতির মধ্যে কোনও ভরসা খুঁজে পাচ্ছেন না। মীনাক্ষী নামের ওই মেয়েটা যেন বিজয়াকে শক্তিহীন করে ফেলেছে। বিজয়া অনুভব করছেন মিথ্যা মর্যাদার প্রাসাদটাকে আর বুঝি রক্ষা করা যাবে না।
নিজের স্বপক্ষে যুক্তি খাড়া করতে অনেক চেষ্টা করেছেন বিজয়া, ভেবেছেন–মেয়েদের যথেচ্ছাচার করবার সুযোগ দেবে তোমরা এ যুগে, দেবে যথেচ্ছ বিচরণের স্বাধীনতা, অথচ সেই মেয়েরা যদি নির্বোধের মতো আগুনে পা ফেলে তখন দোষ হবে মায়ের? সকলে সকলরবে বলবে, মায়ের শিক্ষা শাসন থাকলে এমন হতে পারে না, মায়ের দায়িত্বজ্ঞান ঠিক থাকলে মেয়ের সাধ্য কী? মা বেহুঁশ, তাই এমন বেয়াড়া কাণ্ড ঘটে বসেছে।
হ্যাঁ, এই কথাই বলবে লোকে।
বিজয়া যেন সেই লোক-মুখগুলোকে দেখতে পাচ্ছেন, তাই বিজয়া ক্রমশই সাহস হারাচ্ছেন। আর তাই বিজয়া মেয়েকে তিরস্কার করার পালা শেষ করে এখন তাকে তোয়াজের পালা ধরেছেন। মীনাক্ষী যদি এতটুকু সদয় হয় মায়ের উপর। মীনাক্ষী যদি একবার মায়ের মুখের দিকে তাকায়, তা হলেই সব সমস্যা মিটে যায়। মীনাক্ষী কঠিন হয়ে বসে আছে, তবু বিজয়া সেই কাঠিন্য গলাবার চেষ্টা করে চলেছেন।
তাই বিজয়া এখনও স্বামীর আছে উদঘাটিত করে বসেননি তাঁর এই চারখানা দেয়ালের মধ্যে কোন দুরপনেয় কলঙ্কের ইতিহাস রচিত হচ্ছে।
অতএব সরোজাক্ষর এই হঠাৎ কাউকে না বলেকয়ে বেরিয়ে পড়ার মধ্যে বিজয়া-ঘটিত কোনও ঘটনা নেই। সরোজাক্ষ এমনিই বেরিয়েছেন। হয়তো বাইরের পৃথিবীটাকে ভুলে যাচ্ছি ভেবে বিচলিত হয়েছেন।
ডাক্তারের নিষেধ, তবু সরোজাক্ষ একটা ভিড়ের বাসেই উঠে পড়লেন। কিন্তু ভিড়ের ছাড়া হালকা বাস পাচ্ছেন কোথায়? এই ভরা দুপুরেও তো রড ধরে ঝুলছে লোকে।
আশ্চর্য, কত লোক পৃথিবীতে! কত লোক এই শহরটায়!
মাটির নীচেই যে অন্ন জল লুকোনো আছে, শুধু খুঁড়ে বার করার ওয়াস্তা, এ কথা যেন ভুলেই যাচ্ছে। মানুষ। দিগ্বিদিক জ্ঞানশূন্য হয়ে সবাই শুধু লোহালক্কড়ের কাছে ছুটে আসছে। আসছে পাথরের প্রাসাদের দরজায়। যেন সব অন্ন শুধু সেখানেই জমা আছে।
অথচ এখনও মাথার উপরের আকাশ ফুরিয়ে যায়নি। ফুরিয়ে যায়নি মাটির রস।
শুধু আমরাই ফুরিয়ে যাচ্ছি।
লোভের তাড়নায় একটা শূন্যতার গহুর লক্ষ্য করে ছুটতে ছুটতে, হারিয়ে ফেলছি আমাদের সত্তাকে। অতএব লক্ষ্যে পৌঁছবার পরিতৃপ্তি নেই, সাফল্যের আনন্দ নেই, আছে শুধু শেষ অবধি হুমড়ি খেয়ে সেই শূন্যতায় আছড়ে পড়া।
মানুষ যদি সভ্যতার শৃঙ্খলে বাঁধা না পড়ত? মানুষ যদি অনেক না চাইত? সরোজাক্ষ যেন নিজের প্রশ্নে নিজেই কৌতুক অনুভব করে নিজেকে একটি সরস উত্তর দিলেন।
তা হলে বাসে এত ভিড় হত না।
দাদু কি দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে স্বপ্ন দেখছেন নাকি?
থমকে তাকালেন সরোজাক্ষ।
কে কাকে বলল কথাটা! এমন ভোলা ধারালো গলায়! আমাকেই নয় তো? অবহিত হয়ে তাকালেন, ওই প্রশ্নের লক্ষ্যের প্রতি লক্ষ করবার চেষ্টা করলেন।
প্রশ্নকর্তাকে দেখতে পেলেন না।
অতএব লক্ষ্যটা সরোজাক্ষ নয়।
সরোজাক্ষ এবার উত্তর শুনতে পেলেন, তাই দেখতে পেলেন লক্ষ্যটিকে। শীর্ণকায় এক বৃদ্ধ, পরনে অর্ধমলিন ধুতি এবং হাওয়াই নয়, পুরনো আমলের একটা জিনের কোট। কোটের উপর আবার গলায় পাক দিয়ে একখানা র্যাপার জড়ানো। র্যাপার গায়ে দেবার মতো শীত আর অবশিষ্ট নেই, তা ছাড়া দুপুর রোদ। অথচ রোদটা যে প্রখরতা লাভ করেছে সে খেয়াল ভদ্রলোকের নেই তা নয়, দেখা যাচ্ছে রোদের প্রতিষেধক ছাতাটি রয়েছে বগলে।
সরোজাক্ষর মনে হয়, এ এবং এদের মতো লোকেরা হয়তো এই শহরের বাসিন্দা নয়, হয়তো মাথার উপর যে আকাশ আছে, সেটা এরা সন্ধ্যাতারার স্নিগ্ধ আলোকে টের পায়, তবু এই দুপুরের রোদে ঠেলাঠেলি করতে এই শহরে আসে ভিড় বাড়াতে।
আসে, কারণ এরা ভুলে গেছে এদের পিতামহ প্রপিতামহ জানত মাটির নীচে অন্নজল সঞ্চিত থাকে।
বুড়ো ভদ্রলোক উত্তর দিলেন,আমায় বলছ?
একটা রোগা সিঁড়িঙ্গে ছেলে, যে ধরনের চেহারা এবং সাজসজ্জা রকের আড্ডায়, রাস্তায় ইট পেতে ক্রিকেট খেলায়, সর্বজনীন প্রতিমা ভাসানোর লরিতে টুইস্ট নাচে অথবা দুপুর রোদে সিনেমার টিকিট কাটার লাইনে সর্বদা দেখতে পাওয়া যায়, তেমনি ছেলে, মুখে একপোঁচ ব্যঙ্গের প্রলেপ মেখে উত্তর দেয়,আজ্ঞে হ্যাঁ দাদু, অনেকক্ষণ থেকে আপনার ছাতার খোঁচায় হৃদয় বিদীর্ণ হচ্ছে কি না!
হয়তো ভদ্রলোকের মস্তিষ্কে ওই ভাষাটা চট করে প্রবেশ করল না, তাই তিনি অবাক অবাক গলায় বলেন, কী বলছ?
দাদু বুঝি কানে একটু কম শোনেন?
বাসের মধ্যে একটু মৃদু হাসির গুঞ্জন উঠল। সন্দেহ নেই ছোকরার ওই ব্যঙ্গোক্তি সবাই বেশ উপভোগ করছে।
বেচারি বুড়ো ভদ্রলোকের শীর্ণমুখে একটা দীর্ণ হাসি ফুটে ওঠে, আমাদের মতো হতভাগ্যের কানে কম শোনাই ভাল ভাই।
তা অবিশ্যি–ছোকরা খুক খুক করে হেসে বলে,অন্যের পাঁজর বিদীর্ণ করে অকুতোভয়ে এগিয়ে যাবেন, সরুন মশাই বললে শুনতে পাবেন না। তা ছাতাটা দয়া করে একটু নামান দাদু!
ভদ্রলোক ছাতাটাকে টেনে হিঁচড়ে একটু নামিয়ে কাতর গলায় বলেন, আমাদের মতো শক্তিহীন লোকের আর এই বাসে-ট্রামে চড়া চলে না।
আহা আমিও তো তাই বলছি দাদু–ছোকরা জিভে একটু চুকচুক শব্দ করে বলে,কেন কষ্ট করে রোদে বেরিয়েছেন? দিব্যি শীতলপাটি বিছিয়ে, ঘরে বসে দিদিমার হাতের বেলের পানা খাবেন, আর তালপাখার হাওয়া খাবেন, তা নয়, এই আমাদের পাঁজরে ছাতার খোঁচা দিতে
এবার আর মৃদু গুঞ্জন নয়, সারা বাসে একটা স্পষ্ট হাসির ঢেউ খেলে যায়।
স্বাভাবিক।
কৌতুকের কথায় কৌতুক-হাসি হাসবে না লোকে?
বিশেষ করে যখন অনেকে একত্রে রয়েছে। অনেকজন যখন একত্র হয়, তখন তো আর তারা ব্যক্তি থাকে না, হয়ে যায় জনতা।
জনতা একটা আলাদা জাত।
যে জাতের সংক্রামতা প্রতিরোধের ক্ষমতা নেই।
যে কোনও ব্যাধিই তাকে মুহূর্তে গ্রাস করতে পারে।
যে কোনও ঘটনাই তাকে মুহূর্তে অনুপ্রাণিত করতে পারে। যে কোনও সবল কণ্ঠই তাকে অনুবর্তী করে ফেলতে পারে।
তাই জনতার মধ্যে একজন যদি হঠাৎ সভ্যতার বেড়া ডিঙোয়, সঙ্গে সঙ্গে সবাই অসভ্য হয়ে ওঠে। একজন যদি গালাগালি করে তো, সবাই গালাগালি শুরু করে দেয়–কেন, কাকে, কী জন্যে, সে চিন্তা না করেই।
তা হাসিও একটা সংক্রামক ব্যাধি, যদি সেটা ব্যঙ্গ হাসি হয়। অতএব এ ব্যাধি জনতার মধ্যে সংক্রামিত হতে দেরি হয় না। আর হয় না বলেই, যারা তার পথিকৃৎ, তারা চেষ্টা করে করে আরও কৌতুক কথার আমদানি করে, যাতে লোকে আরও হাসে।
অনেক লোকেরই এ-প্রবণতা দেখা যায়, তোক হাসানো। এমনিতে হয়তো তারা সুরসিক বলে খ্যাত নয়, কিন্তু বিশজন লোককে একত্রে দেখলেই তাদের রসনা আপনিই সরস হয়ে ওঠে। ট্রামে বাসে রেলগাড়িতে উঠলেই এরা কথায় ফুলঝুরি ঝরাতে আরম্ভ করে, ও দাদা, দয়া করে শ্রীচরণটি একটু গোটান। নইলে–এ-অভাগা যে মারা যায়। না-না, মাদুর গোটানো করে গোটাতে বলছিনা, জাস্ট একটু মুড়ে বসা।
ও দাদু, কৃপা করে যদি বিছানাটা একটু তোলেন।–আহা, ইস্ ইস্ দাদুর বুঝি দিবানিদ্রার অভ্যাস, তাই দিনদুপুরেই বিছানা বিছিয়ে–..
মাসিমা বুঝি ট্রান্সফার হয়ে অন্য কোথাও সংসার পাতাতে যাচ্ছেন? মাল মোটের বহর দেখছি কি না
এক একটি কথার সঙ্গে সঙ্গেই সারা কামরায় হাসির ঢেউ ওঠে, তা সে কথা যতই পচা পুরনো সস্তা স্থূল হোক। এতএব রসিক ব্যক্তিটি উদ্বেলিত হয়ে উঠে নব নব রসে পরিবেশন শুরু করে দেন। জুড়োতে দিতে চান না। একে ঠাণ্ডা করতে পারে একমাত্র রাজনীতি। সেটাও–ভয়ংকর রকমের সংক্রামক ব্যাধি তো! আর–সেটা যে-কোনও রসের পিছনেই গুঁড়ি মেরে বসে থাকে, এবং সহসা উঁকি মেরে মুখটি বাড়িয়ে দেয়।
এই জীর্ণ বৃদ্ধকে নিয়ে হাস্যরস সৃষ্টি হতে হতে হয়তো শেষ পর্যন্ত ব্যাপারটা রাজনীতিতে পৌঁছবে, কিন্তু সরোজাক্ষ তার আগেই নেমে পড়লেন।
সরোজাক্ষ বড় বেশি পীড়াবোধ করলেন, যখন দেখলেন, ওই শীতলপাটি আর বেলের পানাশব্দ দুটি একখানা শীর্ণ মুখের রেখায় রেখায় যেন অসহায়তার আর অপমানের গভীর বেদনা ফুটিয়ে তুলল, আর সারা গাড়িতে তুলল কৌতুকের হাসির ঢেউ।
যখন দেখলেন, ওই ঢেউ থেকে নব প্রেরণা লাভ করে নতুন উদ্যমে গলায় রঙিন রুমালবাঁধা ছোকরা আবার বলে উঠল, সত্যি, কেন ঝুটমুট আসেন দাদু? আমাদের দিদিমা বুঝি মানা করেন না? এবং জনতার হাসি আরও উদ্দাম হয়ে উঠল।
আশ্চর্য। এর মধ্যেকার নির্মমতা কি কারও চোখেই পড়ছে না? সরোজাক্ষ যেন অবাকই হলেন। সরোজাক্ষ চঞ্চল হলেন, সরোজা জানলার বাইরে মুখ রাখলেন।
বৃদ্ধ ভদ্রলোক এই হাস্যমুখর কামরার মধ্যে বোধ করি সহানুভূতির মুখ দেখতে না পেয়েই ক্ষুব্ধ গলায় বলে উঠলেন, এখুনি নেমে যাব ভাই, বেশিক্ষণ তোমাদের অসুবিধে ঘটাব না।
আহাহা, অসুবিধে কী? চুকচুক ছোকরা হাঁটুদুটোকে একবার টুইস্ট নাচের ভঙ্গিতে মোড় খাইয়ে বলে ওঠে, বরং বলুন উপকার। মাঝে মাঝে খোঁচাটা বিশেষ দরকার দাদু, তাতে বেচাল হবার ভয় থাকে না। এই তিন ভুবনে এত যে বেচাল দেখছেন, সবই তো ওই যথাসময়ে আর যথাস্থানে খোঁচাটুকুর অভাবে।
এবার হাসির বাঁধ ভাঙল।
সরোজাক্ষ সেদিকে একবার তাকিয়ে দেখে নেমে পড়লেন বাস থেকে।
আশ্চর্য, মানুষ জাতটা কী নির্লজ্জ! কী নির্মম!
অথবা মানুষ জাতটা নয়, ওই জনতা নামক জাতটা।