৩. বিজনেসের গল্প

দিবাকর কোনওদিন মীনাক্ষীকে তার বাসস্থান দেখায়নি, তবু মীনাক্ষী সে বাড়ির দরজায় এসে হাজির হল।

মীনাক্ষী দিবাকরের মামার বিজনেসের গল্প শুনেছিল এবং শুনেছিল তাঁর দোকানের নাম। সেই সূত্র ধরে ঠিকানাটা জোগাড় করে নিয়েছিল এবং সাহসে ভর করে এসে দাঁড়িয়েছিল।

দাঁড়িয়েছিল। তবু সেই সেকেলে প্যাটার্নের টানা লম্বা জালটাকা বারান্দাওলা প্রচণ্ড তিনতলা বাড়িখানার গেট ঠেলে চট করে ঢুকে পড়তে বাধছিল, তাকিয়ে দেখতে লাগল।

তাকিয়ে তাকিয়ে ভাবল, দিবাকর এত আধুনিক, কিন্তু ওর বাড়িটা একেবারে সেকেলে। এই নিরেট নিরেট বাড়িটার মধ্যে কি প্রগতির হাওয়া খেলে? কিন্তু ঢুকব কী করে?

এ সময় একটা ঘটনা ঘটল, মীনাক্ষীর পিছন থেকে কেউ একজন বলে উঠল, কাকে চান?

মীনাক্ষী তাকিয়ে দেখল।

দেখল বাড়ির চাকরটাকর কেউ।

হাতে মিঠে পানের খিলি।

পান কিনতে বেরিয়েছিল বোধহয়, ফিরে এসে দরজায় এমন একটি অপরিচিতা তরুণীকে দেখে একটু অবাক হচ্ছে।

এ বাড়িতে আত্মীয়স্বজন ছাড়া কারও যাতায়াত নেই। আর অনেকদিনের পুরনো চাকরের সেই আত্মীয়জনদের চিনতেও বাকি নেই।

নবীন সবাইকে চেনে।

নবীন সবাইয়ের সঙ্গেই মুরুব্বিয়ানা চালে কথা কয়ে থাকে।

কিন্তু আজকের অতিথিটি নবীনের অচেনা, তাই মুরুব্বিয়ানার সুরটা গলার মধ্যেই মজুত রেখে নবীন ঈষৎ সমীহর গলায় বলল, কাকে চান?

মীনাক্ষী জানত এ-সময় দিবাকর বাইরে, মীনাক্ষী সেটা ভাল করে জেনেই তবে এসেছিল। তবু হঠাৎ ভেবে পেল না কাকে চাই বলবে? তাই থতমত খেয়ে বলে ফেলল, দিবাকরবাবু আছেন?

দিবাকরবাবু!

নবীনের সমীহর গলা উপে গেল। বেরিয়ে এল তাচ্ছিল্যের গলা।

যে মেয়েছেলে দিবাকরকে খুঁজতে এসেছে, তাকে সমীহ করবার প্রয়োজন বোধ করল না।

তাচ্ছিল্যের সুরে বলল, না, নেই। দরকার থাকে সকালের দিকে আসবেন।

 পান নিয়ে গেট ঠেলে ঢুকে ঘুরে দাঁড়াল নবীন, যেন আগলানোর ভঙ্গিতে।

মীনাক্ষীর ওই ভঙ্গিটা দেখে একবার মনে হল, ধ্যেতারি চলে যাই। মনে হচ্ছে এ বাড়ির মধ্যে ঢুকে আমি সুবিধে করতে পারব না।

কিন্তু বিনা বাক্যব্যয়ে চলে আসবে শুধু একটু ভাল না লাগার কারণে? যে আসা কত আয়োজন করে।

মীনাক্ষী সাহসে ভর করে বলে,আমি তাঁর মার সঙ্গে দেখা করতে চাই।

মা!

নবীন আকাশ থেকে পড়ে।

 মা! দিবাকর দাদাবাবুর মা আবার এখানে কোথা?

নেই? সে কী? কোথাও গেছেন বুঝি?

নবীন ব্যঙ্গের গলায় বলে, যাবে কোথায়? কোনওকালেও ছিল না। দেশে থাকে।

কী আশ্চর্য!

দিবাকর তা হলে কী করে যখন তখন বলে, মা এই বলল, এই বোঝাল, মাকে এই শুনিয়ে দিলাম।

দিনের পর দিন তা হলে বাজে কথা বলেছে দিবাকর?

ধ্যেৎ। তাই কি সম্ভব? মাকে নিয়ে এমন অদ্ভুত বাজে কথা বলবে কেন? কোথাও একটা ভুল হচ্ছে।

মীনাক্ষী তাই সন্দিগ্ধ গলায় প্রশ্ন করে, এটা দিবাকরবাবুর মামার বাড়ি তো?

 নবীন ইত্যবসরে ট্যারা দৃষ্টিতে মীনাক্ষীকে যাকে বলে পুঙ্খানুপুঙ্খ সেইভাবে দেখে নিচ্ছিল। তার তীক্ষ্ণ প্রখর বুদ্ধিতে ধরা পড়তে দেরি হল না মেয়েটা দিবাকর দাদাবাবুর লভ-এর মেয়ে। সিনেমা দেখে দেখে লিভ-এর হাড়হ তার নখদর্পণে!

আর সিনেমাও তো দেখতে বাকি থাকে না কিছু। নিজের চাহিদায় যায়, গিন্নিমাকে সঙ্গে করে নিয়ে যেতেও যায়।

প্রকাশ মণ্ডলের এত সময় নেই যে গিন্নি নিয়ে সিনেমা যাবেন, গিন্নি কুসুমকামিনীর তাই একমাত্র গতি খাস চাকর নবীন। যান না অবশ্য একা, ব্রজবালা থাকলে ব্রজবালা যায়, ভাই বউ বীণা যায়, কিন্তু একটা বেটাছেলের ভরসা তো চাই?

দশটা মেয়েমানুষও একা, না ভ্যাকা! একটা বেটাছেলে হচ্ছে ভরসা। তা সে নাবালক হোক, অথবা গণ্ডমূর্খ চাকরই হোক।

অতএব নবীনের সিনেমা দেখাটা খুব ঘটে। সেই অভিজ্ঞতাতেই বুঝতে দেরি হয় না তার মেয়েটা কে!

তবু বুঝে ফেলেও উদাসীন গলায় বলে, হ্যাঁ, বাবুর ভাগ্নে বলেই তো জানি।

মীনাক্ষী চাকরটার কথার মধ্যে একটা স্পষ্ট অবজ্ঞা দেখতে পায়। মীনাক্ষীর রাগে হাড় জ্বলে যায়। বুঝতে বাকি থাকে না বড়লোকের আদুরে বেয়াদপ চাকর।

কিন্তু চোরের ওপর রাগ করে তো মাটিতে ভাত খেতে পারে না মীনাক্ষী? চাকরের ওপর রাগ করে দরজায় এসে ফিরে যেতে পারে না?

তবে কেমন যেন ধারণা হয়, ভিতরে ঢুকলেও অভ্যর্থনাটা সুবিধের হবে না। কিন্তু কী করা? এসেছে যখন ভিতরে ঢুকে দেখে যাবেই।

ঠিক আছে। মীনাক্ষী গম্ভীর স্বরে বলে, মামা বাড়ি আছেন?

না তো! এখন আবার তিনি কোথায়? গদিতে গেছে।

 মামি আছেন তো? না কি তিনিও গদিতে গেছেন?

মীনাক্ষীর বিরক্তি গোপন থাকে না।

কিন্তু নবীন ঘুঘু ছেলে, সে ভয় খায় না, এতক্ষণে নিজে একটু সরে মীনাক্ষীকে প্রবেশ পথ দিয়ে বলে, গিন্নিমাকে চান তো, উপরে চলুন। তবে নীচের ঘরে একটু বসতে হবে, আগে জানানো দরকার।

মীনাক্ষী আশান্বিত হয়ে ঢোকে।

ধড়িবাজ নবীন অমায়িক মোলায়েম গলায় বলে, দিবাকর দাদাবাবুর ঘরে বসবেন?

দিবাকর দাদাবাবুর ঘর!

মীনাক্ষীর মনটা পুলকে ভরে ওঠে। যে মানুষকে সর্বদা দেখি, অথচ জীবনে তার ঘর দেখিনি, তার ঘরটা দেখতে আগ্রহ হয় বইকী!

কিন্তু মীনাক্ষী তো জানে–দিবাকর দোতলায় মামার মেয়ে ব্রজবালার ঠিক পাশের ঘরে থাকে। তাই বলে,থাক, এখন নীচেই বসছি।

নবীন কী ভাবল বা বুঝল কে জানে। বলল,ঠিক আছে বসবার ঘরেই বসুন।

মীনাক্ষী ওর পিছু পিছু বাড়ির মধ্যে ঢুকে আসে, সঙ্গে সঙ্গে তার কানের পরদা ফুটো করে একটা বিষবাণ এসে মাথার মধ্যে বিধে যায়।

হ্যাঁ নবনে, গেট-এ দাঁড়িয়ে এত কথা হচ্ছিল কার সঙ্গে? ছুঁড়িটা কে?

 নবীন উপরে উঠে গিয়েছিল।

 বোধ করি ছুঁড়িটা কে, এবং এত কথাটা কীসের তাই জানাতে। মীনাক্ষী একা বসে ঘামছিল আব ভাবছিল, ভুল বাড়িতে ঢুকে পড়িনি তো!

এই বাড়ি দিবাকরের?

এই ভাষা দিবাকরের বাড়ির লোকের? যে দিবাকর মীনাক্ষীর বাড়ির সেকেলেপনা দেখে মুহূর্তে মুহূর্তে অজ্ঞান হয়ে যায়!

এটা কী সরল গ্রাম্যতা?

নাঃ! কণ্ঠস্বর কী কর্কশ!

ভঙ্গিতে কী অপরিচ্ছন্নতা!

না, না, এ বোধহয় ভুল বাড়িতে ঢুকে পড়েছে মীনাক্ষী।

উঃ! চাকরটাও যে গেল তো গেলই।

নেমে এসে তাকে বলে চলে যেতে পারে, এখন আর ওই গিন্নি-টিন্নির সঙ্গে দেখা করার উৎসাহ নেই মীনাক্ষীর।

নবীন এল অনেকক্ষণ পরে।

খুব সম্ভব সব কিছু গিন্নির কর্ণগোচর করে।

এসে সহাস্যে বেশ মাইডিয়ারি ভঙ্গিতে বলে ওঠে, হয়ে গেছে কুইন ভিক্টোরিয়ার হুকুম! আসুন উপরে।

মীনাক্ষীর আপাদমস্তক জ্বলে যায়, মীনাক্ষীর ইচ্ছে হয়, বলে,থাক এখন, হঠাৎ মনে পড়ল অন্য কাজ আছে।

কিন্তু মীনাক্ষীকে কৌতূহলে টানল।

যে কৌতূহল মেয়েমানুষের স্বভাবধর্ম। দেখাই যাক না কী ব্যাপার। কিন্তু নিশ্চিত হবার উপায়টা কী?

 যে লোকটার সঙ্গে কথা কইতে হাড় জ্বলছে, তাকেই বলে,আচ্ছা ইনি দিবাকর দাস তো?

আজ্ঞে হ্যাঁ।

মামার নাম?

আজ্ঞে, শ্রী প্রকাশচন্দ্র মণ্ডল।

নামটা যেন এইরকমই মনে হচ্ছে মীনাক্ষীর। কারণ প্রথম শুনে মণ্ডল শব্দটা যে হঠাৎ কানে একটা ধাক্কা মেরেছিল, সেই স্মৃতিটা স্মরণে এল।

অতএব উপরে ওঠা।

বসবার ঘরটাকে আর একবার তাকিয়ে দেখল মীনাক্ষী। প্রকাণ্ড একটা গোলটেবিল, তার ধার ঘিরে খানকয়েক কাঠের চেয়ার, ভারী ভারী হাতল দেওয়া। দেয়ালে নানা দেবদেবীর ছবি, তার সঙ্গে একটি মেমমার্কা ক্যালেন্ডার। ক্যালেন্ডারখানা বাদে সবই কেমন মলিন বিবর্ণ ধূসর।

পয়সা আছে, রুচি নেই।

কেমন একটা বিতৃষ্ণা মেশানো কৌতূহল নিয়ে নবীনের পিছু পিছু উপরে উঠল মীনাক্ষী। আর সেই সময় জিজ্ঞেস করল, তোমার নাম কী?

.

কুসুমকামিনীও সেই প্রশ্নই করেন, তোমার নাম কী?

কুসুমকামিনীর ঘরে বসবার জন্যে একটি সোফা আছে। ফুলপাতাসংবলিত সেকেলে গড়নের জোড়া পালঙ্কের পায়ের দিকে একধারে সেটি পাতা। সামনে ছোট টেবিল।

প্রকাণ্ড ঘর। জোড়া পালঙ্ক, সোফা টেবিল দেরাজ আলনা ইত্যাদি রেখেও জায়গা আছে।

কুসুমকামিনী অবশ্য সোফায় বসে নেই। তিনি সেই সোফা থেকে হাতখানেক উঁচু পালঙ্কে একটি তাকিয়া কোলে নিয়ে বসে আছেন। কাছে ডাবরে পান।

বয়সের তুলনায় চুল পাতলা, মুখে ভারিক্কি ছাপ। তাঁর পাশে ব্রজবালা গড়িয়ে শুয়ে ছিল, মীনাক্ষীকে দেখে কাপড়-চোপড় গুছিয়ে উঠে বসল।

মীনাক্ষী অবশ্য আন্দাজে ভাবল এই বোধহয় ব্রজবালা। কিন্তু এ মেয়ের মুখে কোনও দুদে ধরনের ছাপ দেখতে পেল না মীনাক্ষী। বরং যেন নেহাতই নিরেট নিরেট। এই মেয়ে সেইকথা বলতে পারে?

সে যাক, এদের একবার যাচাই করে যেতে হবে মীনাক্ষীকে। যাতে দিবাকর সম্পর্কে সঠিক জানতে পারে।

ভয়ানক একটা জ্বালা অনুভব করছে; প্রতারিত হবার জ্বালা, ঘৃণার জ্বালা।

কুসুমকামিনীর পরনে একখানি কল্কাপাড় মিহি শান্তিপুরে শাড়ি, গায়ে জামা-শেমিজের বালাই নেই। গায়ে জামা-শেমিজের বালাই মীনাক্ষীর নিজের মারও থাকে না। কিন্তু সে যেন আর একরকম। তার মধ্যে কতকটা যেন কৃচ্ছসাধনের পবিত্রতা। তা ছাড়া সর্বদাই তো গরদ-তসর পরে বেড়ান বিজয়া, একটু পুজো-পুজো ভাব থাকে, খালি গা এত দৃষ্টিকটু লাগে না।

কিন্তু এঁর সবটাই যেন একটা অশ্লীল স্থূলতা।

ডাবর থেকে একটা পান তুলে নিয়ে তার নীচের কোণটুকু দাঁতে কেটে থু করে ফেলে দিয়ে, সেটিকে মুখে পুরে কুসুমকামিনী রাশভারী গলায় বলেন, বোসো৷

মীনাক্ষী বসে।

গৃহকর্ত্রীর থেকে হাতখানেক নিচুতে।

কুসুমকামিনী তার আপাদমস্তক দেখে নিয়ে বলেন, নাম কী তোমার? মীনাক্ষী নাম বলে।

মীনাক্ষী? বেশ নতুন নামটা তো।কুসুমকামিনী তেমনি রাশভারী গলায় বলেন,দিবাকরকে খুঁজতে এসেছিলে?

মীনাক্ষী ইতস্তত করে বলে, খুঁজতে ঠিক নয়, মানে একটু দরকার ছিল। একটা বই দেবার কথা ছিল।

কার কাকে দেবার ছিল, তা অবশ্য বোঝা গেল না।

কুসুমকামিনী কিন্তু বুঝলেন। মুচকি হেসে বললেন, ও সে একই কথা, যার নাম ভাজা চাল তার নামই মুড়ি! খুঁজতে আসোনি, দরকার ছিল! তা ওর কলেজে পড়ো বুঝি?

হ্যাঁ।

কতদিন ভাব?

ভাব।

 কতদিনের চেনা নয়, আলাপ নয়, পরিচয় নয়, ভাব।

মীনাক্ষীর মাথা থেকে পা অবধি একটা বিদ্যুৎপ্রবাহ বয়ে যায়। কিন্তু ভাব নেই–এ কথা তো বলা চলে না। কী করতে তবে এসেছে সে?

মীনাক্ষী রুক্ষ গলায় বলে, যতদিন একসঙ্গে পড়ছি।

 অ। তা ভাল। তা কোনওদিন তো আসতে দেখিনি। আজ হঠাৎ

বললাম তো একটা বইয়ের দরকার ছিল।

 তবে যে নবনে বলছিল, মামাকে চেয়েছ, মামিকে চেয়েছ—

বিপন্ন বোধ করে মীনাক্ষী, বুঝতে পারে, ফাঁদটা নিজেই পেতেছে। অতএব সোজা হতে হবে, শক্ত হতে হবে। ফাঁদে জড়িয়ে পড়া চলে না। অতএব মাথা তুলে বলে, আমার ধারণা ছিল ওঁর মাও এখানে থাকেন, মামার বাড়ি যখন। শুনলাম থাকেন না। কোথায় থাকেন, ঠিকানাটা কী, জানতে চাই।

কুসুমকামিনী এবার শিথিল ভঙ্গি ত্যাগ করে নড়েচড়ে বসেন। তীক্ষ্ণ গলায় বলেন,কেন বলো তো? হঠাৎ ওর মাকে কী দরকার?

আছে দরকার।

কেন? ছোঁড়া কোনও বিপদে-আপদে পড়েনি তো?

না, বিপদ হবে কেন?

 তবে বুঝি বে?

 ব্রজবালা মুচকি হেসে বলে ওঠে, ও মা, বোধহয় দিবুদার বের ঘটকালি করতে এসেছেন ইনি৷

কুসুমকামিনী নকল ধমকে বলেন, তুই থাম তো বেজো।

 বেজো।

তার মানে ব্রজ।

তার মানে ব্রজবালা।

তার মানে ভুল বাড়ি নয়।

 অতএব আশার ক্ষীণ শিখাটুকুও নিভে গেল।

 মীনাক্ষী বলল, আচ্ছা আমি যাই।

ওমা সে কী! বাড়িতে এয়েছে ভদ্রলোকের মেয়ে, অমনি ছাড়ব? একটু চা-জলখাবার খেয়ে যেতে হবে।

কুসুমকামিনী যে বাস্তবিকই এত অতিথিবৎসলা তা নয়, তবে মেয়েটাকে এক্ষুনি উঠতে দিতে ইচ্ছে নেই। তাই ওই চা-জলখাবারের ফাঁদ।

মীনাক্ষী অবশ্য-এ ফাঁদে পা দেয় না।

নিজের পাতা ফাঁদ থেকে উদ্ধার পেতে পারলে বাঁচে এখন সে।

তাই বলে, না, এখন কাজ আছে। দিবাকরবাবু এলে বলবেন মীনাক্ষী মৈত্র এসেছিল।

আহা তা তো বলবই। তবে কী উদ্দেশ্য নিয়ে এসেছিলে তা তো কই বললে না?

কতবার বলব? বললাম তো একটা বইয়ের জন্যে

অ! আমার আবার ভুলো মন, ভুলে যাই। তা দিবার মার কাছেও তা হলে ওই বইয়ের জন্যেই দরকার? মাগী আবার এত বিদ্যেবতী হল কবে লো? অ বেজো।

কুসুমকামিনী হি হি করে হাসতে থাকেন।

কুসুমকামিনী যদি অন্য কোথাও মীনাক্ষীর মতো মেয়েকে দেখতেন, অবশ্যই রীতিমত সমীহর দৃষ্টিতে দেখতেন। কলেজে পড়া মেয়েদের প্রতি ভয় সমীহ সবই আছে তাঁর। তবে এক্ষেত্রে আলাদা। এ হচ্ছে দিবাকরের লভ-এর মেয়ে। অতএব এর সম্পর্কে এর চাইতে সভ্য ব্যবহার করার প্রশ্ন ওঠে না। যে মেয়ে দিবাকরকে পুজি করতে পারে, তার আবার মান-সম্মান।

তার ওপর আবার জাতে বামুন।

বামুনের মেয়ে হয়ে সদগোপের ছেলেকে! ছি! অবিশ্যি যার সঙ্গে যার মজে মন–এ হচ্ছে শাস্ত্রের কথা। কিন্তু হাতের কাছে এমন একটা মজার বস্তু পেলে কে না মজা করে ছাড়ে?

মীনাক্ষী আরক্ত মুখে উঠে দাঁড়ায়, বলে, আমার ভুল হয়েছিল। আচ্ছা—

মীনাক্ষী বেরিয়ে আসে।

কিন্তু ব্রজবালা হঠাৎ খাট থেকে নেমে ওর পিছু পিছু আসে। যদিও ওই আসাটা মোটেই দৃষ্টিসুখকর হয় না। একেই তো শরীরটা তার ভারী হয়ে গেছে, তার উপর জামাকাপড় যেন এলিয়ে পড়া। যেন দেহটাকে না ঢেকে উপায় নেই, তাই কোনওরকমে ঢেকে রেখেছে।

তবু আসে তাড়াতাড়ি।

চুপি চুপি বলে, মায়ের কথাবার্তার ধরনই অমনি৷ ছিরিছাঁদ নেই। রাগ করবেন না। আপনার সঙ্গে বুঝি দিবুদার ভালবাসা আছে?

মীনাক্ষী ফিরে দাঁড়ায়।

মীনাক্ষী তীব্র গলায় বলে, হঠাৎ আপনাদের এমন একটা অদ্ভুত ধারণার হেতু কী? ভালবাসা ছাড়া কেউ কাউকে খোঁজে না? কারুর সঙ্গে কারুর দরকার থাকতে পারে না?

ব্রজবালা এই তীব্রতায় থতমত খায়।

ব্রজবালা ভেবেছিল, এ মেয়ে দিবুদা বর্ণিত সেইসব মেয়ের একজন। যে মেয়েরা নাকি নীতিধর্ম সতীধর্ম কোনও কিছুকেই কেয়ার করে না। যারা নাকি সহজেই এমন সব ভয়ংকর কাণ্ড করে বসে, যা শুনলে ব্রজবালার হৃদকম্প হয়।

কিন্তু সেসব মেয়ের কি কেবলমাত্র একটু ভালবাসার কথায় এমন প্রচণ্ড রাগ আসে? ব্রজবালা তাই মলিন গলায় বলে, না না, এমনি ভাবলাম–

ও রকম ভাবনা আর ভাববেন না।

রেগে আগুন হয়েই নামছিল, তবু সিঁড়ির পাশের ঘরটার সামনে থমকে দাঁড়িয়ে পড়ে মীনাক্ষী। বলে, এই ঘরটা বুঝি দিবাকরবাবুর? দেখতাম বইটা যদি থাকে।

বানিয়েই বলল অবশ্য।

ঘরটা এ বাড়ির পক্ষে ছিমছাম এবং সরু খাট, ছোট টেবিল, হালকা বুক শেলফ ইত্যাদিতে একটি একক ছাত্রের উপস্থিতির ছাপ। দেখে মনটা তবু একটু নরম হল।

হয়তো এ বাড়ির এই পরিবেশটা দিবাকরকেও পীড়িত করে, তাই তার মধ্যে থেকেই নিজের মতো একটু ছিমছাম হয়ে থাকে।

কিন্তু সে নরমটা মুহূর্তেই কঠিন হয়ে উঠল।

ব্রজবালা অবাক গলায় উত্তর দিল,দিবুদার? না তো? এ ঘরে আমার মামার ছেলে থাকে। পড়ে কিনা? আট নটা ক্লাস পড়া হয়ে গেছে তার। তিনতলায় গোলমাল, তাই এখানে খুব ইয়ে ছেলে। বলে–অনেক পড়ব, বিলেত যাব।…দিবুদা ব্রজবালা একটু ঢোক গিলে বলে, দিবুদা নীচতলায় থাকে। নবীনকে দেখলেন তো? ওই ওর ঘরে। আমি বলেছিলাম, ও লেখাপড়া করে, ওর একটা ভাল জায়গা, তা মা বলে কি, ধান সম্পর্কে পোয়াল মাসি। কোন ডালপালার ভাগ্নে আমার, ওর জন্যে আমি রাজ আদর করতে বসব নাকি?… আমার ওই মা-টি না মোটেই সুবিধের নয় বুঝলেন? আর কেপ্পনের জাসু৷

কথা বলতে বলতে নেমে এসেছে দুজনেই।

মীনাক্ষী নীচের উঠোনে নেমে বলে, আচ্ছা নমস্কার! অনেক উপকার করলেন আমার, তার জন্যে ধন্যবাদ।

বেরিয়ে যায়।

 এগোতে থাকে।

সমস্ত শরীর যেন শিথিল হয়ে ধসে পড়তে চায় তার।

পৃথিবীতে যেন বাতাস নেই। আকাশে যেন আলো নেই।

আর কোথাও কোনও আশ্বাস নেই।  

দিবাকরকে খুব একটা মহৎ অবশ্য কোনওদিনই ভাবে না সে, তাই বলে এত জোচ্চোর দিবাকর?

 এ কী আপনি?

 রাস্তার মোড়ে যেন ভূত দেখল দিবাকর। এখানে মীনাক্ষী! তার মানে তাদের বাড়িতেই এসেছিল। তার মানে যা বলেছিল, তাই করে ছেড়েছে। বলেছিল,ঠিক আছে, নিয়ে না যাও, নিজেই যাব।

তা হলেও দিবাকর মীনাক্ষীর সেই সংকল্পটাকে আমল দেয়নি। ভাবেনি সত্যি আসবে।

কিন্তু এখানে ঠিক ওদের বাড়ির মোড়ে আর কোন মহৎ কাজে আসবে মীনাক্ষী?

রাগে সমস্ত শরীর জ্বালা করে ওঠে দিবাকরের। মেয়েমানুষের এত মর্দানি? উঃ! ঠিকানাই বা পেল কোথায়? আর এসে দেখলটা কী?

নির্ঘাত দিবাকরের থাকার জায়গাটা দেখিয়েছে কেউ। নির্ঘাত নবনে বদমাইশ অনেক কিছু গল্প করেছে।… নির্ঘাত মামি আর ব্রজবালা যা-তা প্রশ্ন করেছে।

তার মানে সর্বস্ব ঘুচিয়েছে দিবাকরের।

এখন কোন বালুকণায় এই সমুদ্র বাঁধবে দিবাকর? কোন ছুঁচে রিপু করবে এই প্রচণ্ড গহ্বর?

 তা ছাড়া জানাও তো নেই, কতটা কী জেনেছে মীনাক্ষী।

দিবাকরের কতখানি উদঘাটিত হয়েছে।

 তুমি এখানে?

এ প্রশ্নের মধ্যে বিস্ময়ের চেয়ে অনেক বেশি ফোটে বিপদে পড়ার সুর।

মীনাক্ষী সেই সুর ধরতে পারবে এটা আশ্চর্যের নয়। মীনাক্ষী তাই দাঁড়িয়ে পড়ে তীব্র ব্যঙ্গের গলায় বলে, বড্ড অসুবিধেয় ফেলে দিলাম, তাই না?

না না, আমার অসুবিধে কী? তোমারই

 আমার কথা থাক।মীনাক্ষী ঠিকরে ওঠে,আমার কোনও অসুবিধেই নেই। অসুবিধেটা তোমারই। এতদিন ধরে এত কৌশল করে ধাপ্পার সুতো বুনে বুনে যে মিথ্যের জালটি রচনা করেছিলে, সেটি ছিঁড়ে গেল, তোমার স্বরূপ বেরিয়ে পড়ল, অসুবিধে নয়?

দিবাকর প্রথমটা জাল দিয়ে জল ধরতে যায়, নুন দিয়ে নদী বাঁধতে যায়, দিবাকর তার মিথ্যের জালে নতুন ধাপ্পার সুতো লাগায়, কী হল কী? ব্যাপারটি কী? কার সঙ্গে দেখা হল? বেজায় পাজি একটা চাকর আছে আমাদের বাড়িতে, ইয়ারের রাজা! সে বুঝি কিছু

দিবাকর! মিথ্যের জালে আর নতুন মিথ্যে জুড়ো না। বড় ঘৃণা হচ্ছে। শুধু তোমার উপরই নয়, নিজের উপর, পৃথিবীর উপর।

মীনাক্ষী চলে যেতে উদ্যত হয়।

কিন্তু দিবাকর পথ আগলায়।

দিবাকর কোনওমতে মুখে হাসি টেনে এনে বলে, কিন্তু কী হল সেটা তো বলবে? মামির প্রকৃতিটা অবশ্য ভাল নয়, দুর্বাসার মহিলা সংস্করণ। কিন্তু গালমন্দ খেয়ে এলে বুঝি?

দিবাকর, আর কষ্ট দিও না–মীনাক্ষীর চোখে জল আসছিল, সে জলকে আগুনে পরিণত করে মীনাক্ষী বলে, খড় দিয়ে আগুন ঢাকতে যেও না দিবাকর! হিমালয় পাহাড় ফুয়ে ওড়ানো যায় না। তুমি যে কী, তা ভালই জেনে গেছি আমি।

মীনাক্ষী!

হঠাৎ দিবাকরের মুখের চেহারার অদ্ভুত একটা পরিবর্তন ঘটে। দিবাকরের সেই কাঠ কাঠ আঁট-আঁট মুখটা যেন ঝুলে পড়ে। দিবাকরের পুরু পুরু ঠোঁট দুটো যেন নেতিয়ে পড়ে, দিবাকরের ছোট ছোট করে ছাঁটা চুলগুলোও এলিয়ে যায়।

দিবাকর কাঁপা কাঁপা থরথরে গলায় বলে, জানতাম! আমার এই তাসের অট্টালিকা টিকবে না। কিন্তু কী করব মীনাক্ষী, এ ছাড়া কোনও উপায় ছিল না আমার! জানি আমি ঠগ-জোচ্চোর, মিথ্যেবাদী, কিন্তু এসব কেন জানো মীনাক্ষী? আমি বড় গরিব! রাস্তার ভিখিরিরও অধম। আমার সেই দারিদ্র্যের লজ্জা তোমার কাছে উদঘাটন করতে পারিনি। আমার মনে হয়েছে, এ দিনকে একদিন না একদিন আমি জয় করবই, একদিন আমি মানুষ নামের যোগ্য হব, সেই কদিন শুধু এই পাতার ছাউনিতে মাথা ঢেকে–

মীনাক্ষীর ওই বেদনাকাতর মুখের দিকে তাকিয়ে দেখে, মীনাক্ষীর সেই লোহা হয়ে ওঠা মনটা ঈষৎ নরম হয়, মীনাক্ষী স্থির গলায় বলে, গরিব হওয়াটা অপরাধ নয় দিবাকর!

আমি মনে করি অপরাধ–দিবাকরের ঝুলেপড়া চেহারাটা আবার যেন একটু সতেজ হয়, যেন পায়ের নীচে আবার একটু মাটি পেয়েছে দিবাকর, যে মাটিতে দাঁড়িয়ে আবার বড় বড় কথা বলতে পারবে। বলতে পারবে জোরালো গলায়, আমি মনে করি অপরাধ। কারণ অক্ষমতাই হচ্ছে সবচেয়ে বড় অপরাধ মীনাক্ষী! আর দারিদ্র্য তো অক্ষমতারই সন্তান।

মীনাক্ষী তবু প্রতিবাদ করে ওঠে, তা হোক দিবাকর, মিথ্যের মতো অপরাধ আর কিছু নেই। আমি ভাবতে পারছি না যে, তুমি দিনের পর দিন এইভাবে মিথ্যের প্রাসাদ বানিয়ে বানিয়ে আমাকে ঠকিয়েছ। মামার বাড়ির চাকর নবীনের সঙ্গে এক ঘরে থাকো তুমি। তোমার মা জীবনে কলকাতায় আসেননি। আর তোমার আত্মীয়রা–

চুপ করে যায় মীনাক্ষী।

গলাটা বন্ধ হয়ে যায় বলেই চুপ করে যায়।

 দিবাকরের চোখের তারায় অলক্ষ্যে আগুন জ্বলে। দিবাকরের মুখের পেশিতে যেন একটা মতলবের ভাঁজ পড়ে। কিন্তু দিবাকর রুদ্ধকণ্ঠে বলে, মীনাক্ষী, তুমি যদি একটা সুযোগ আমায় দাও, আমার সমস্ত কথা বলার জন্যে একটুখানি সময়

মীনাক্ষী আবার ক্রুদ্ধ ব্যঙ্গের গলায় বলে, সময়? যাতে আরও একবস্তা ধাপ্পা তৈরি করে ফেলতে পারো?

দিবাকরের মুখের চেহারা আবার দপ করে নিভে যায়। দিবাকর পাকা অভিনেতার মতো সেই নিভে যাওয়া মুখের সঙ্গে সামঞ্জস্য রাখা বিষণ্ণ গলায় বলে, আচ্ছা ঠিক আছে, থাক, জানতাম আমার দারিদ্র্য প্রকাশ হয়ে পড়লেই তুমি আমায় পরিচিতের মর্যাদা দিতে অস্বীকার করবে–

থামো। নাটক রাখো- মীনাক্ষী রূঢ় গলায় বলে, যে দারিদ্রটা প্রকাশ হয়ে পড়েছে দিবাকর, সেটা তোমার চরিত্রের। অবস্থার দারিদ্র্য লজ্জার নয়, চরিত্রের দারিদ্রই লজ্জার।

অবস্থাই চরিত্রকে মুচড়ে দুমড়ে বিকৃত করে ফেলে মীনাক্ষী! ওই যে আমি মামার বাড়িতে থাকি, প্রতিক্ষণ কি মনে হয় না এই গ্লানি থেকে মুক্ত হই, কিন্তু কী করব? যতদিন কলেজে পড়তে হবে, ততদিন এইভাবে কুকুরের মতো পড়ে থাকতে হবে।

মীনাক্ষী মলিন হয়। বলে, বুঝতে পারছি তোমার দেশের জমিদারির গল্পও আরব্য উপন্যাসের গল্প। কিন্তু এ আমি কোনও যুক্তিতেই বরদাস্ত করতে পারি না দিবাকর! এরপর আর তোমার কোন কথাটা বিশ্বাস করতে পারব আমি?

দিবাকর মাথা হেঁট করে।

দিবাকর আস্তে বলে, তোমার সঙ্গে আমার সামাজিক অবস্থার আকাশ-পাতাল তফাত, অথচ তোমার কাছে পৌঁছবার দুর্দমনীয় বাসনা, তাই মিথ্যের সিঁড়ি দিয়ে আকাশে উঠতে চেয়েছিলাম। যাক, শিক্ষা হয়ে গেল। হয়তো জীবনে আর দেখা হবে না, এই শেষ। আচ্ছা চলি।

মীনাক্ষী ক্রুদ্ধ গলায় বলে, এই শেষ, জীবনে দেখা হবে না, এসব কথার মানে কী? বিষ খাবে? না গলায় দড়ি দেবে?

ভাবছি।

ন্যাকামি রাখো। তোমার ওই অদ্ভুত মামার বাড়ি থেকে বেরিয়ে আসার চেষ্টা করো। জোচ্চুরি ধাপ্পাবাজি ছেড়ে মানুষের মতো মানুষ হবার সাধনা করো।

ততদিন কি তুমি আমার জন্যে বসে থাকবে মীনাক্ষী?

 দিবাকরের স্বর করুণ।

এ যেন আর এক দিবাকর।

মীনাক্ষীর মমতা আসে উদ্বেল হয়ে।

মীনাক্ষীর বুকের মধ্যেকার সেই চিরন্তন নারী অপরাধীকে ক্ষমা করে বসে। মীনাক্ষী ওর ওই ম্লান কণ্ঠ, বিষণ্ণ মুখ, আর অপরাধী দৃষ্টিকে বিশ্বাস করে বসে। তাই বলে,আচ্ছা, সে দেখা যাবে। তুমি ওখানটা ছাড়বার চেষ্টা করো তো।

মীনাক্ষী ভাবে ওখানটা ছাড়লেই বুঝি দিবাকর সুন্দর হয়ে উঠবে, সত্যের মর্যাদা দিতে শিখবে।

মীনাক্ষী, তা হলে একবার তোমাকে আমার মার সঙ্গে দেখা করতে হবে। আমি আমার মাকে তোমায় দেখাব।

তোমার মা? তিনি তো দেশে থাকেন শুনলাম। অথচ তুমি দিনের পর দিন

 আমি হাতজোড় করে ক্ষমা চাইছি মীনাক্ষী, আমি কান মলছি—

থাক, থাক, রাস্তার মাঝখানে আর সিন করতে হবে না। তবে তোমার সঙ্গে দেখা হল তাই। দেখা না হলে হয়তো জীবনে আর তোমায় ক্ষমা করতে পারতাম না।

দিবাকরও সেটা বুঝতে পারে।

দিবাকর কিছুক্ষণ আগে যে দেখা হওয়াটায় আড়ষ্ট হচ্ছিল, এখন সেটাকে ভাগ্যের দান মনে করে। নিজের অভিনয় ক্ষমতার উপর ওর অগাধ আস্থা। যখন যেমন দরকার, চালিয়ে নিতে পারবে। এতদিন মীনাক্ষীকে ডাউনকরে এসেছে, এখন অবস্থা বুঝে সম্পূর্ণ উলটোপথ ধরছে।

এখন দেখছে ওকে আয়ত্ত করবার অন্য পথ আবিষ্কার করতে হবে। মোটকথা, একবার জব্দ করে ফেলতে পারলেই এইসব সতী প্যাটার্নের মেয়েদের কজায় আনা যায়।

রাস্তায় দাঁড়িয়ে এতক্ষণ কথা চালিয়ে যাওয়া এ পাড়ায় দৃষ্টিকটু। এ দক্ষিণ কলকাতা নয় যে, বিকেল থেকে রাত দুপুর পর্যন্ত পথে শুধু যুগল মূর্তি দেখতে পাওয়া যায়। যাদের ভঙ্গিতে থাকে–এই দাঁড়িয়ে দুটো কথা বলছি, এখুনি ছাড়াছাড়ি হবে। কিন্তু ঘণ্টা, দু ঘণ্টা সেই অবস্থাই চলতে থাকে।

এখানে পথচারীরা বারবার তাকাচ্ছিল।

তবু দিবাকর হেস্তনেস্তটা করে নিতে চায়। তার সেই দীনহীন গ্রামে, ততোধিক দীনহীন কুটিরে তার দীনদুঃখী মা-টিকে একবার দেখাতে চায় মীনাক্ষীকে।

মীনাক্ষী শুধু তার বড়লোক আত্মীয়দেরই দেখল, যাদের মধ্যে শুধু অহংকার, শুধু নীচতা। কিন্তু দিবাকরের সেই পর্ণকুটিরবাসিনী মা?

না, নিজমুখে তার কথা আর বলবে না দিবাকর।

বলেছে, অনেক বলেছে। মায়ের গল্প কেন করত তা বলেছে

 কিন্তু কেন জানো মীনাক্ষী দিবাকর উদার উদাস স্বপ্নালু গলায় বলে, আমি যে মায়ের কাছ থেকে অনেক দূরে পড়ে আছি, আমার যে মনের কথা বলবার কেউ নেই, এটা ভাবতে ইচ্ছে করে না। তাই–দিবাকর চুপ করে যায়।

এবং শেষ পর্যন্ত মীনাক্ষীকে বাক্যদত্ত করিয়ে নেয়, কোনওমতে একটা দিনের জন্যে সুযোগ সৃষ্টি করে দিবাকরের সঙ্গে দিবাকরের গ্রামে যাবে।

বাংলাদেশের হতভাগ্য গ্রামকে একবার চোখে দেখাও দরকার মীনাক্ষী দিবাকর জোরালো গলায় বলে,দেখতে পাবে আসলে আমরা কী! আসলে আমরা কোথায় পড়ে আছি। যে শহরটাকে দেখে গর্বে পুলকিত হয়ে ভাবি আমরা কত এগিয়ে গেছি, সেই শহরটা এই বিরাট দেশের কতটুকু অংশ? বললে বিশ্বাস করবে, এখনও আমাদের গ্রাম এবং তার মতো হাজার গ্রাম মোটরগাড়ি কেমন তা চোখে দেখেনি? ইলেকট্রিক আলো তাদের কাছে রূপকথার গল্প। লক্ষ লক্ষ লোক রেলগাড়ি চড়ার স্বপ্ন দেখতে দেখতে বুড়ো হয়ে মরে যায়। স্নানের জন্যে যে আলাদা একটা দরজা বন্ধ ঘর থাকতে পারে, এ তারা কেউ জানে না। জানে না–অসুখ করলেই তখুনি ডাক্তার পাওয়া যায়।…

দিবাকর একটু দম নেয়।

কিছুদিন আগে রাস্তায় দাঁড়িয়ে শোনা কোনও এক সমাজসেবীর মেঠো বক্তৃতার খানিকটা ঝাড়া মুখস্থ বলে ফেলতে পেরে রীতিমত পুলকিত হয় দিবাকর।…এ ধরনের কথাগুলো যে তার পূর্বমতের বিরোধী তা খেয়াল করে না।

খেয়াল মীনাক্ষী করে।

 ওর দম নেওয়ার অবসরে বলে, সেকথা তো আমিও বলি। তুমিও তো কেবল আমাদের সমাজের অন্ধতা আর কুসংস্কার নিয়ে সমালোচনা করো। আর ও-দেশ দেখাও। আমিই বলি ও-দেশের সঙ্গে পাল্লা দিতে আমাদের যতকিছু পুরনো সংস্কার ভেঙে ফেলার লড়াইয়ে যদি জিতেই যাও তোমরা, তোমাদের সেই প্রগতির রাজ্যটা ভোগ করবে কাদের নিয়ে? ওই তোমার লক্ষ লক্ষ অবোধ অজ্ঞান হতদরিদ্র দেশবাসীই তো তোমার সম্বল? সংস্কারমুক্তির সংগ্রাম নিয়ে কত মাথাব্যথা হবে তাদের, যাদের পেটের ভাতের সংস্থান নেই? তুমিই লম্বা লম্বা কথা বলে আমায় ডাউন করে ফেলতে চাও। তুমিই বলো সতীত্ব, পবিত্রতা এইসব শব্দগুলো পুরুষের অধিকার রক্ষার সুবিধেয় তৈরি। আসলে একেবারে মানেহীন। মেয়ে-পুরুষের সমান অধিকার থাকা উচিত। নিজের সম্বন্ধে সম্পূর্ণ অধিকার। কিন্তু নিজেই দেখাচ্ছ দেশের এই অন্ধকার ছবি। অধিকার শুধু দিলেই হয় না। অধিকার বোধটা জন্মাবার শিক্ষাও দিতে হয়। না হলে সেটা অস্ত্রশিক্ষা না দিয়ে অস্ত্রের অধিকার দেওয়ার মতোই হবে। কিন্তু থাক, রাস্তায় দাঁড়িয়ে অনেক লেকচার দেওয়া হল। তবে একটা কথা বলে যাচ্ছি, যেটা সব কথার শেষ কথা। ব্লাফ দিয়ে শেষরক্ষা হয় না।

দিবাকরের ভিতরটা জ্বলে-পুড়ে যাচ্ছিল।

দিবাকরের ইচ্ছে হচ্ছিল ওই নাক-উঁচু মেয়েটাকে ধরে একেবারে ছিঁড়েখুঁড়ে শেষ করে দেয়। মেয়েমানুষ মেয়েমানুষের মতন থাক, তা নয়, নিজে তেড়ে এসেছেন বিয়ের ফয়সালা করতে! এতদিন ধরে এত কষ্ট করে নিজেকে লোকসমাজে চরে বেড়াবার মতো একটা পরিচয় বানিয়েছিলাম, উনি এসে তাকে তছনছ করে নিলেন। …উঃ! ভাবলে আমার জ্ঞান থাকছে না। আমার যে কী পোজিশান, তা সবাইকে বলে বেড়াবে নিশ্চয়। আমাকে বিয়ে করার বাসনাটা তো উপে গেল, বলে বেড়াতে আর আপত্তি কী?

…গরিব আমি চিরদিন থাকব না, তোদর মতো বড়লোকের নাকে ঝামা আমি ঘষব, এই আমার প্রতিজ্ঞা, তা সে যে কোনও পথেই হোক।… টাকা তো পৃথিবীর ধুলোয় পড়ে আছে, সেই ধুলো কুড়োতে পারলেই হল। শুধু একটু বিদ্যে করে নেওয়া দরকার। ভেক না হলে হয় না। তোদের ওই পণ্ডিত সমাজে, সভ্য সমাজে চরে বেড়াতে না পারলে তো প্রতিষ্ঠা নেই, তাই এমনি করে কুকুরের মতো পড়ে আছি প্রকাশ মণ্ডলের বেয়াদপ চাকরের ঘরে। গিন্নির আদুরে চাকর, তাই তার এত দাপট! সেই হতভাগাই বোধ হয় আমার নামে যা-তা বলেছে। আচ্ছা, এইসা দিন নেহি রহেঙ্গা।

মনের কথা কেউ টের পায় না, তাই মানুষের পৃথিবীটা আজও চালু আছে। নচেৎ কবেই ধ্বংস হয়ে যেত।

কিন্তু মন বস্তুটা বায়ুশূন্য কৌটোয় রক্ষিত, ওর থেকে আওয়াজ বেরিয়ে ছড়ায় না। তাই ওই কটুক্তিগুলোর মানসিক উচ্চারণের সঙ্গে সঙ্গে দিবাকর মুখে নভঙ্গিতে উচ্চারণ করে, মীনাক্ষী, আসবে তো আমাদের কুঁড়েঘরে?

মীনাক্ষী দ্বিধাগ্রস্ত হয়, কিন্তু গিয়ে কী হবে বলতে পারো?

দিবাকরের বিস্ফারিত ধরনের চোখদুটো মলিন হয়, কিছু না মীনাক্ষী, শুধু আমার মাকে একবার তোমায় দেখাব। আমার মতো হতভাগারও যে একটা ঐশ্বর্য থাকতে পারে শুধু সেইটুকুই

কিন্তু কী বলব বাড়িতে?

যা হোক। যা তোক একটা কিছু বোলো। একটা রাত, লোকে তো বন্ধু বান্ধবের বিয়েতেও বাইরে কাটাতে পারে।

রাত। মীনাক্ষীর চমকে ওঠাটা অস্পষ্ট থাকে না। রাত কেন?

তা ছাড়া তো সুবিধেমতো আর কোনও ট্রেন নেই।…মেদিনীপুর স্টেশনে নেমে তেরো মাইল গোরর গাড়িতে যেতে হয়। চলো মীনাক্ষী, শুধু আমার মাকেই নয়, এই বাংলাদেশটার সত্যিকার চেহারাও একবার দেখবে চলো।

দিবাকরের কণ্ঠে তার স্বভাববিরুদ্ধ আবেগ ফোটে।

আর সেই তার সর্বদা প্রজ্বলিত ভঙ্গির জায়গায় এই নম্র বিষণ্ণ আবেগকম্পিত ভঙ্গিটা নতুন একটা আকর্ষণ এনে দেয়।

মীনাক্ষী রাজি হয়।

মীনাক্ষী এবার এগিয়ে গিয়ে বাস-এ চড়ে। দেখতে পায় না পেছন থেকে দুটো জ্বলন্ত গোলক তাকে ভস্ম করবার ভঙ্গিতে স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে আছে।

.

যদি মীনাক্ষী আজ এই দুঃসাহসিক অভিযানে পা না বাড়াত, হয়তো মীনাক্ষীর জীবন সম্পূর্ণ অন্যরকম হত।

যদি আজ ফেরবার সময় তার জীবনের রাহুর সঙ্গে দেখা হয়ে না যেত, হয়তো মীনাক্ষীর জীবন অন্য মোড় নিত না। কিন্তু মীনাক্ষী দুঃসাহসের পথে পা বাড়িয়েছিল, মীনাক্ষী নির্বুদ্ধিতার ফাঁদে গলা দিতে রাজি হয়েছিল।

আর মীনাক্ষী চলতে চলতে পিছন ফিরে তাকাতে ভুলে গিয়েছিল।

তাকালে হয়তো ওই জ্বলন্ত গোলকদুটোই ওকে সাবধান করে দিত।

.

সরোজাক্ষর বেশি অসুখের সময় পর পর কদিন তাঁকে দেখতে এসেছিলেন কাকিমা হৈমবতী দেবী। কতদিন যেন পরে আজ আবার এলেন এবাড়িতে।

প্রায় সমবয়েসী এই ভাসুরপোটির সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক একাধারে স্নেহের, শ্রদ্ধার, বন্ধুত্বের, তথাপি এ-বাড়িতে তিনি কদাচই আসেন।

হৈমবতী সুন্দরী নন, কিন্তু সুশ্রী।

এই শ্রী তাঁর সর্বাঙ্গে দীপ্যমান।

সুষমা শব্দটির যে অর্থ, সেটা নতুন করে উপলব্ধি হয় হৈমবতাঁকে দেখলে। এই প্রৌঢ় বয়েসেও তাঁর আপাদমস্তক একটি ছন্দোময় সুষমায় মন্ডিত। দেখলে তাকিয়ে থাকতে ইচ্ছে করে, দেখলে সম্ভ্রম জাগে।

হালকা-পাতলা ছোটখাটো চেহারা, কিন্তু তাতে তারল্য নেই, আছে একটি মার্জিত গাম্ভীর্য। অথচ ব্যবহারিক অর্থে গম্ভীর তিনি আদৌ নন। কথায় ধার আছে, কৌতুক আছে, সৌন্দর্য আছে।

হৈমবতী এসে বসলে, তাঁকে ঘিরে যেন আপনিই একটি উজ্জ্বল পরিমণ্ডল গড়ে ওঠে। হৈমবতী এসে বসলে মনে হয় একটি নির্মল পরিচ্ছন্নতা প্রতীক হয়ে দেখা দিল।

হৈমবতীর প্রতি এ বাড়ির সকলেই আকৃষ্ট, বাদে বিজয়া।

বিজয়া হৈমবতীর আচার-আচরণ সব কিছুকেই নিচু চোখে দেখেন।

হৈমবতী যে বিধবা হয়েও বডিস-ব্লাউজ পরেন, হৈমবতী যে বিধবা হবার পর চুল কেটে ফেলেও সেই চুলে স্যাম্পু করে মুখে তরুণীর শ্রী ফোঁটান, হৈমবতীর চশমা চটি ভ্যানিটি ব্যাগ সব কিছুতেই যে শৌখিন রুচির ছাপ, এটা বিজয়া একেবারে বরদাস্ত করতে পারেন না। আর সেই না-পারাটা চাপতেও চেষ্টা করেন না।

হয়তো সেইটাই হৈমবতীর এবাড়িতে বেশি না আসার কারণ। নচেৎ স্বামীর সম্পর্কের আত্মীয় তো তাঁর আর বেশি নেই। দূর-সম্পর্কিত একটি বেকার ভাগ্নে আছে, সেইটিই হৈমবতীর কর্ণধার।

 কিন্তু সে যাক–আজ হৈমবতী তাঁর স্বামীর সম্পর্কিত আত্মীয়-ভবনে বেড়াতে এলেন।

সরোজাক্ষর ছেলেমেয়েরা কেউ হৈমবতাঁকে ঠাকুমা বলে না, বলে কাকি দিদা। এই অদ্ভুত ডাকটি সরোজাক্ষই তাঁর বড় ছেলের শৈশবকালে আমদানি করেছিলেন, পর পর আর নিজনও তাই শিখে গেছে।

বিজয়া এতেও ন্যাকামি দেখেন। ঠোঁট উলটে বলেন,আদিখ্যেতা!ছোট ঠাকুমা বলবে, ফুরিয়ে গেল ন্যাঠা! তা নয় সৃষ্টিছাড়া এক ডাক কাকি-দিদা! ঠাকুমা ডাকলে বুড়ি হয়ে যাবেন যে! চিরযুবতী থাকবেন উনি।

খুড়-শাশুড়ির উপর যেন তাঁর একটা জাতক্রোধ।

এখন না হয় বিধবা হয়েও বিধবার আচরণ সম্যক পালন করেন না বলে রাগ, কিন্তু যখন মহিলাটি সধবা ছিলেন? তখনও তো রাগের কমতি ছিল না।

কাকি- দিদা এসেছেন।

ঠাকুরঘরে গিয়ে জানিয়ে এল মীনাক্ষী।

বিজয়া মুখটা বাঁকিয়ে জোরে জোরে মালা ঘোরাতে লাগলেন।

 মীনাক্ষী আবার বলল, শুনতে পেলে? কাকি-দিদা এসেছেন।

এসেছেন তো কী? নাচতে হবে?

বিজয়া নিমপাতা খাওয়া মুখে মালাটা কপালে ছোঁয়ালেন।

নাচবে কি কাঁদবে, তা তুমিই জানো মীনাক্ষী বলে, খবর না দিলেও তো বলবে, নীচে কত ঘটনা ঘটে যায়, কত লোক আসে যায়, আমি টেরও পাইনা। দাসীর মতন এক পাশে পড়ে আছি, ছো করে একটু খবরও দিতে আসে না। বলে গেলাম, এখন তোমার ফুরসত হয় নেমো, না হয় নেমো না।

চলে যায় মীনাক্ষী।

বিজয়া জ্বলন্ত চোখে তাকিয়ে বিড়বিড় করে বলেন, কথা দেখো মেয়ের! যেন মিলিটারি! মার সঙ্গে কথা বলছে, না বাড়ির ঝিয়ের সঙ্গে কথা বলছে বোঝবার জো নেই। আছে, কপালে তোমার অশেষ দুর্গতি আছে। একটা দজ্জাল শাশুড়ির হাতে পড়বে তুমি, এ আমি দিব্যচক্ষে দেখতে পাচ্ছি। তখন ওই খরখরানি বেরিয়ে যাবে। উঠতে বসতে কাঁদতে হবে।

বিজয়া এখনও দুই মেয়ের দজ্জাল শাশুড়ির হাতে পড়ে উঠতে বসতে কাঁদবার স্বপ্ন দেখেন। বিজয়ার এখনও মুখস্থ আছে–

হলুদ জব্দ শিলে,
 চোর জব্দ কিলে,
দুষ্ট মেয়ে জব্দ হয়
শ্বশুরবাড়ি গেলে।

 ওই প্রবাদের ছড়াটা যে সমাজ অনেকদিন হল ভুলে গেছে এটা খেয়াল করেন না বিজয়া। আর খেয়াল করেন না এই অভিশাপ বাণীটি যার উদ্দেশ্যে বর্ষিত হল সে তাঁরই সন্তান।

তা খেয়াল বস্তুটা সংসারে দুর্লভ বইকী! কজনেরই বা যথাযথ থাকে ওটা? খাম-খেয়ালেরই

সেই খামখেয়ালের একটি নমুনাসরোজাক্ষর চাকরি ছাড়ার সংকল্প, আর তার কারণ।

অপমান সয়ে থাকতে পারলাম না–এর পিছনে তবু একটা যুক্তি আছে। একটা বলিষ্ঠ পৌরুষের প্রকাশ আছে। কিন্তু সরোজাক্ষর ভাষ্যটা যে উদ্ভট!

ওই অপমানের ধাক্কায় হঠাৎ তিনি নাকি অনুভব করলেন, এতদিন ছাত্রদের ঠকিয়ে পয়সা নিয়ে এসেছেন! অতএব অনুভব করে ফেলে আর সেটা চালিয়ে যেতে বিবেকে বাধছে।

খাম-খেয়ালের নজির ছাড়া আর কী?

প্রকৃষ্ট নজির।

আরে বাবা, এ-যুগের ছেলেগুলি যে এক-একখানি বিষ্ণুর অবতার, সেটা দেখতে পাচ্ছ না? দেখতে পাচ্ছ না শুধু তোমার পাড়াটি নয়, তোমার দেশটি নয়, দেশে-বিদেশে, সমগ্র পৃথিবীতে ওই ছেলেগুলোই আগুন জ্বালিয়ে বেড়াচ্ছে?

রাবণের অনাচারে খেপে উঠে লঙ্কা দহনের সংকল্পে ওরা ল্যাজে আগুন বেঁধেছে।

তাতে রাবণের লঙ্কা ধ্বংস হচ্ছে কিনা রাবণই জানে, তবে তাদের নিজেদের ল্যাজগুলো যে পুড়ছে তাতে সন্দেহ নেই, সেই পোড়া ল্যাজের দহনে মুখও পুড়ছে বাছাদের।

মুখ তারা নিজেদের তো পোড়াচ্ছেই, পোড়াচ্ছে আরও অনেক কিছুই। পোড়াচ্ছে সভ্যতা, সংযম, আদর্শ, চক্ষুলজ্জা, লোকলজ্জা, মায়া-মমতা, শালীনতা, সৌকুমার্য। কে জানে এই ধ্বংসস্তৃপের উপর কোন স্বর্গ রচনার স্বপ্ন দেখছে ওরা?

না কি স্বপ্ন-টপ্ন কিছু নেই ওদের। শুধু হঠাৎ হাওয়ার সুযোগ নিয়ে নিজেদের সমস্ত ক্রটি, নিজেদের সমস্ত দৈন্য ঢাকা দিতে চাইছে দাবির লড়াইয়ের ছদ্মবেশ দিয়ে।

তা নইলে ক্ষেত্ৰ-অক্ষেত্র মানছে না কেন ওরা? প্রয়োজন-অপ্রয়োজন মানছে না কেন? কারণে-অকারণে যেখানে-সেখানে আর যখন-তখন আগুন জ্বেলে তুলছে কেন? অর্থাৎ আসল লক্ষ্য ওই জ্বালাটাই।

নাঃ, লঙ্কা দহনে মন নেই বাপু ওদের, আপন আপন হৃদয়ের দাহ নিবৃত্ত করতেই ছটফটিয়ে বেড়াচ্ছে। যা-তা করছে।

তা নইলে সরোজাক্ষর মতো চিরশান্ত চিরসৌম্য অধ্যাপককে ঘেরাও করে বসে অপমান করে?

কিন্তু মহৎ প্রাণ সরোজা ওদের দোষ দেখছেন না, দোষ দেখছেন নিজের। তবে কেন বলা যাবে না জগৎ সংসারে খেয়ালের চেয়ে খাম-খেয়াল বেশি?

হৈমবতীও মৃদু হেসে বলেন, লোকে কিন্তু তোমাকে খামখেয়ালি বলে বদনাম দিচ্ছে।

হৈমবতী এ প্রসঙ্গ তুলতে আসেননি।

হৈমবতী এসেছিলেন সরোজাক্ষর কাছে কয়েকটা বই নিতে। তবু উঠে পড়ল প্রসঙ্গটা।

বলতে কী সরোজাক্ষই উঠিয়ে ফেললেন।

হৈমবতী এসে ঘরে ঢুকতেই সরোজাক্ষর মুখটা খুশিতে উদ্ভাসিত হয়ে উঠেছিল, সেই খুশি-খুশি মুখেই হেসে বলে উঠলেন, কী, তুমিও কি এক-পালা উপদেশ বর্ষণ করতে এলে? কিন্তু দোহাই তোমার, আর যে করে করুক তুমি কোরো না।

হৈমবতী প্রথমটা বিস্মিত হলেন, কারণ হৈমবতীর স্মরণে ছিল না সরোজাক্ষর উপর একহাত নেওয়ার একটি সুযোগ এসেছে।

তবু একটু থতমত খেয়েই বুঝে নিলেন ব্যাপারটা। আর সঙ্গে সঙ্গে হেসে বললেন, কেন, আমি নয় কেন? আমি তোমার গুরুজন না? উপদেশ বর্ষণের রাইট অবশ্যই আছে আমার।

সব সময় সব রাইট প্রয়োগ করতে নেই।

বাঃ সুযোগ পেলে কে ছাড়ে? লোকে তোমায় খাম-খেয়ালি বলে বদনাম দিচ্ছে তা জানো?

লোকে দিচ্ছে! তুমি তো দিচ্ছ না? মৃদু হেসে বলেন সরোজাক্ষ।

বা রে, আমিই বা নয় কেন? আমি কি তোক ছাড়া?

খুব শান্ত গলাতেই বলেন, তবু হৈমবতীর মুখে একটি সরসতার উজ্জ্বল দীপ্তি ফুটে ওঠে।

সরোজাক্ষ হেসে বলেন, আমার তো তাই ধারণা।

ভুল ধারণা! আমি ওই লোকেদেরই দলে। আমিও তো বলছি এটা তোমার খাম-খেয়াল! আমি ওদের ঠকিয়ে খাচ্ছিলাম হঠাৎ এমন একটা দৃঢ় ধারণা করে বসবার মানে হয় না। তোমরাও একদা ছাত্র ছিলে এবং তোমাদের যাঁরা শিক্ষক ছিলেন তাঁরা সকলেই কিছু মহাপুরুষ ছিলেন না, খুঁজলে তাঁদের বিরুদ্ধেও অনেক তথ্য বেরোতে পারে, তবু তোমরা এখনও তাঁদের নামে সশ্রদ্ধ হও, এখনও কারও সঙ্গে দেখা হয়ে গেলে স্যার!বলে বিগলিত চিত্তে আভূমি প্রণিপাত করো। করো না কি?

আমরা হয়তো একটা নির্বিচার পূজার মন্ত্রেই দীক্ষিত ছিলাম তাই! এ-যুগ ওই নির্বিচার পূজায় বিশ্বাসী নয়। গুরুজন বলেই তিনি শ্রদ্ধাভাজন একথা এ-যুগ মানে না।

বিচার করতে বসলে বিচারের শেষ কোথায় গিয়ে দাঁড়ায়, সেটা আমাদের মতো মুখ মানুষের চেয়ে পণ্ডিত মানুষ তোমরাই ভাল বুঝবে। আর সেটা চিরকালই আছে। ঠগ বাছতে গাঁ উজাড়–এটা নেহাত এ-যুগের কথা নয়। বুঝলাম নির্বিচারে মানবে না, কিন্তু বিচার করবারও একটা অধিকার থাকা দরকার নয় কি? বিচারবুদ্ধিটা না জন্মাতেই যদি বিচারকের ভূমিকা নিয়ে বসে

সরোজাক্ষ একটা নিশ্বাস ফেলেন।

কারণ সরোজাক্ষ নিজেও একথা বেশ কয়েকদিন ধরে ভেবেছেন। ভেবেছেন ওরা অর্বাচীন। ভেবেছেন ওরা উত্তপ্ত মস্তিষ্ক হিতাহিত জ্ঞানশূন্য। তবু বিবেক সুস্থির হতে দেয়নি। তবু মনে হয়েছে, এ সমস্তই আমাদের ত্রুটির ফল। আমাদের গলতি। আমাদের অক্ষমতার নিদর্শন।

অনেক ভেবে ভেবে তবেই না

সরোজাক্ষ নিশ্বাস ফেলে বলেন, নাঃ ছোট কাকি, তবু বলব এ-যুগের চোখ কান অনেক খোলা।

 হৈমবতী তর্ক করেন না। প্রতিবাদও না।

হৈমবতীও একটা নিশ্বাস ফেলে বলেন, কী জানি, খোলা, না অন্য এক মোহ-আবরণে ঢাকা। আমি তো দেখি মস্ত এক খেলার আড্ডায় ও বেচারিরা নেহাতই দাবার খুঁটি, রঙের তাস। ওদের নিয়ে চলছে বিরাট জুয়াখেলা। আর ওরা হতভাগারা ভাবছে–আমরাই হারছি জিতছি, দান পাচ্ছি! বেচারিরা জানেও না–নাইকো পাশার ইচ্ছা স্বাধীন যেই নিয়েছে খেলার ভার, ডাইনে বাঁয়ে ফেলছে তারে যখন যেমন ইচ্ছা তার। আর এও বোঝে না বাক্সবন্দি সব পুনরায় সাঙ্গ হলে খেলার জের। রাজা যুধিষ্ঠির খেলার নেশায় উন্মত্ত হয়ে সর্বস্ব খুইয়ে শেষে আপন স্ত্রী-পুত্রকে বাজি ধরেছিলেন, এ-নেশা এমনই সর্বনেশে!–এ-যুগের দাবায় যুধিষ্ঠিররা মানব সভ্যতার ভবিষ্যৎকে বাজি ধরছে।

সরোজাক্ষ একটু চুপ করে থেকে অন্যমনস্কের গলায় বলেন, কে জানে এ থেকে অন্য এক নতুন সভ্যতার জন্ম হবে কি না। যা নির্ভুল, যা নিখুঁত।

নির্ভুল! হৈমবতী মৃদু হাসেন। বলেন, প্রকৃতির সৃষ্টিতেই ভুলের শেষ নেই, খুঁতের শেষ নেই, আর মানুষের সৃষ্টি নির্ভুল হবে? হয়তো হবে একটা ভুলের বদলে আর একটা ভুল। হয়তো একটা খুঁতের বদলে আর একটা খুঁত!

প্রকৃতি তো অন্ধ।

মানুষই বুঝি চক্ষুম্মান?

মানুষের চিন্তাশক্তি আছে।

মানুষ তাই ভাবে বটে–হৈমবতী সহজ সুরে হেসে ওঠেন, সত্যি সে শক্তি থাকলে ভাবত না পৃথিবীতে শুধু একা আমিই থাকব, আর কেউ থাকবে না।

মানুষ সম্পর্কে অনেক ভাবো তো দেখছি

ভাবতে হবে কেন? চোখের উপর জাজ্বল্যমান তো। ওই ভাবনাতেই মানুষ প্রতিজ্ঞা করে বসে নিঃক্ষত্রিয় করিব পৃঙ্খী–ওই ভাবনাতেই যুগে যুগে কুরুক্ষেত্র কাণ্ড ঘটায়, ওই ভাবনাতেই সমস্ত কল্যাণবোধ বিসর্জন দিয়ে দাবার ছক পেতে বসে। কিন্তু থাক বাবা এসব দার্শনিক আলোচনা, এখনই তর্ক বেধে যাবে। আর পণ্ডিতেমূর্থে তর্ক বাধলে ব্যাপার সুবিধের হবে না। তার চাইতে যা বলতে এসেছি বলি–আমায় যে সেই বই দুটো দেবে বলেছিলে, কই দিলে না?

হৈমবতীর ডিগ্রী-টিগ্রীর বালাই নেই, তবু হৈমবতী সরোজাক্ষর পাঠোপযোগী শক্ত শক্ত ইংরিজি বইয়ের গাদা পার করেন। এটা একটা বিরক্তিকর ব্যাপার বইকী! অন্তত বিজয়ার কাছে তো বটেই।

বিজয়া অবশ্য ওই পার করাটায় তেমন বিশ্বাসী নয়। বলেন, পড়ে না, হাতি! তোমার কাছে কায়দা দেখায়।

সরোজাক্ষ এধরনের কথার উত্তর বড় দেন না, একদিন বলেছিলেন, তাতে ওঁর লাভ?

আহা, তুমি অবাক হবে, তুমি বাহবা দেবে, সেইটাই পরম লাভ।

সরোজাক্ষ আর কথা বলেননি! চুপ করে গিয়েছিলেন। আজও হৈমবতীর কাছে একটু চুপ করে গেলেন। তারপর আস্তে বললেন, ওটা কলেজ লাইব্রেরি থেকে এনে দেব ভেবেছিলাম। আচ্ছা আমি ব্রিটিশ কাউন্সিল থেকে এনে দেব।

আরে বাবা তাড়ার কিছু নেই– হৈমবতী লজ্জিত গলায় বলেন, বিদুষী নই যে বইয়ের জন্যে কাতর হব। বেকারের দিন,কাটতেই চায় না, তাই বই বই করে মরি। তবে আপাতত ব্যস্ততা নেই, নতুন করে আবার কালী সিংহীর মহাভারত পড়ছি—

এই সেরেছে! সরোজাক্ষ ঈষৎ কৌতুকে বলেন, সারদার কানে গেলে আর রক্ষে নেই–

হৈমবতী কী একটা বলতে যাচ্ছিলেন, হঠাৎ ঘরের বাইরে সারদাপ্রসাদের উদাত্ত স্বর শোনা গেল, সারদার কথা কী হচ্ছে দাদা? আরে ছোট কাকি যে? কতক্ষণ? খুড়ি ভাশুরপোয় মিলে সারদাবাবুর নিন্দে হচ্ছে তো খুব? বলে হা-হা করে হেসে ওঠে। খুড় শাশুড়িকে অবশ্য প্রণাম করতে আসে না। হৈমবতী হেসে ফেলে বলেন,কেন বাপু, নিন্দে কেন? তুমি কি আমাদের নিন্দের ছেলে?

ঘরে চেয়ার থাকতেও বিছানার একপ্রান্তে বসে পড়ে সারদাপ্রসাদ কোঁচার খুটটা তুলে কপালের ঘাম মুছে বলে, সে আপনারা স্নেহ করে না বললেও, লোকে তো পাগল ছাগল ছাড়া কিছু ভাবে না।

সারদাপ্রসাদ যে বাইরে কোনওখান থেকে ঘুরে এসেছে, তা তার সাজসজ্জায় মালুম হচ্ছে। পরনে ধুতি আর শার্ট হলেও, জিনিস দুটো ধোপদুরস্ত। যেটা দৈবাতের ঘটনা।

সরোজাক্ষর চোখেও ধরা পড়ে দৃশ্যটা। সরোজাক্ষ মৃদু হেসে বলেন,কে আবার ওকথা বলতে গেল তোমায়?

আপনি বাদে সবাই বলে, সারদাপ্রসাদ বেশ উদাত্ত গলায় বলে, বলবে, এখন বলবে। দেশটি যে আমাদের চিতায় মঠ দেবার। এই তো গিয়েছিলাম এক পাবলিশার মহাপ্রভুর কাছে। এমন একটা ভ্যালুয়েবল ম্যানাস্ক্রিপট নিয়ে গেছি, একবার দেখলও না। যেন দেখলেও পয়সা খরচ হয়ে যাবে। সাবজেক্ট ম্যাটার বোঝাতে গেলাম, তা এমন উপহাস্যি করে কথা বলল, যেন একটা সত্যি পাগল গেছি আমি। বলে কী জানেন? আমরা মশাই ক্ষুদ্র প্রাণী, দুটো গল্প উপন্যাস বেচে খাই, আমাদের কী সাধ্য যে এই মূল্যবান গ্রন্থ প্রকাশ করি। আপনি বরং আপনার ওই মহার্ঘ পাণ্ডুলিপিটি রাশিয়ায় পাঠিয়ে দিন, ওরা দরের জিনিসের কদর বুঝবে। শুনুন! শুনলে কী মনে হয়? যত সব ভুষিমাল এসে বইয়ের ব্যবসা ফেঁদে বসেছে, ধান চাল লোহা-লক্কড়ের থেকে অধিক মূল্য দিতে জানে না। আমি বলব, বরং যখন ছাপাখানা ছিল না, তখন ছিল ভাল। দামি জিনিসের দাম ছিল। সারদার স্বর উত্তেজিত।

কিন্তু তুমিই তো বলো সারদা, ছাপাখানা ছিল না বলেই আমাদের অনেক কিছু চিরতরে খোয়া গেছে। সরোজাক্ষ বলেন, ছাপা জিনিসের একটা আধটা কপিও কোথাও পড়ে থাকে।

সারদা উত্তেজিত থেকে উত্তেজিততর হয়। বলে, বলেছিলাম, বলেও থাকি। কিন্তু এইসব অসভ্য লোকেদের ব্যবহারে মেজাজ খাপ্পা হয়ে যায়, বুঝলেন? বলে কিনা, বুঝলাম না একদা আমাদের এই মহান ভারতবর্ষে বিজ্ঞানের চরম উৎকর্ষ হয়েছিল এবং আপনি তা প্রমাণ করেও ছেড়েছেন, কিন্তু সে প্রমাণে এখন কী ঘণ্টা হবে বলতে পারেন? এখন তো পরের দরজায় হাত পেতে বসে আছি, কতবড় মুখর মতো কথা বলুন? হাত পেতে বসে আছি বুদ্ধির দোষে আর কপাল-দোষে। তা বলে চির ভিখিরি যে ছিলাম না, সেটুকুও বোঝাতে হবে না পৃথিবীকে?

সরোজাক্ষ ওই উত্তেজিত মুখের দিকে তাকিয়ে ব্যথিত হন, তবু সে ভাব গোপন রেখে উৎসাহের গলায় বলেন, তা তোমার সেই থিসিস কি শেষ হয়ে গেছে নাকি?

শেষ!

সারদাপ্রসাদ যেন একটা অর্বাচীনের কথা শুনল, এইভাবে মুরুব্বির ভঙ্গিতে বলে ওঠে, শেষ কি দাদা? ওটা তো ফার্স্ট ভলম! এখনও ওইরকম নটা ভল্যুম হবে। অবশ্য হয়েই আছে একরকম। মানে খুচরো খুচরো কাগজে নোট করা আছে, সেগুলোই একবার গুছিয়ে

হৈমবতী সারদাপ্রসাদের গবেষণার বিষয়বস্তু জানেন। হৈমবতী এও বোঝেন, সরোজাক্ষর এখন ওই অবোধ লোকটার সঙ্গে মনের ভাব গোপন করে কথা চালাতে কষ্ট হচ্ছে, তাই হৈমবতীই হাল ধরেন, বলেন, তা একেবারে দশখণ্ডই শেষ করে ছাপালে হত না সারদাপ্রসাদ?না হলে এতে জিনিসটা সম্পর্কে ওদের ধারণা স্পষ্ট হবে না।

হ্যাঁ আমিও ভেবেছিলাম তাই সারদাপ্রসাদ হঠাৎ কেমন অন্যমনস্ক গলায় বলে, কিন্তু ভেবে দেখছি, এখন থেকেই চেষ্টা করা দরকার যাতে তখন চট করে মার্কেটটা ক্রিয়েট করা যায়। তা যাক–

সহসাই আবার সারদাপ্রসাদ নিজস্ব উত্তেজিত ভঙ্গিতে ফিরে আসে। বলে, ওর জন্যে ভাবি না। একবারেই হাল ছাড়বে এমন পাত্তর সারদাপ্রসাদ নয়। আমি বলে যেই মনে হল ঠিক লেখা হচ্ছে না, অমনি খাতাকে খাতা ছিঁড়ে কুচিকুচি করে আবার নতুন করে লিখতে বসি।সব পাবলিশারই কিছু আর গোলা লোক নয়, বিদ্বান বুদ্ধিমান কালচার্ড লোকও আছে এই লাইনে। যাব তাদের সন্ধান জেনে। তখন বুঝলেন কাকিমা, পড়তে পাবে না। বিষয়টা যে ভয়ানক দামি। মনে করুন না কেন– আজ আমরা ও-দেশে হৃদবদল-এর খবর শুনে উধ্ববাহু হয়ে নাচছি, অথচ ওটা ছিল আমাদের এই দেশে। রামায়ণ, মহাভারত, পুরাণ, উপপুরাণ দেখুন হাঁটকে, সব পাবেন। মৃতদেহে প্রাণসঞ্চার, একের দেহ থেকে অন্য দেহে প্রাণ ট্রান্সফার, ইচ্ছেমতো যে কোনও মানুষের বা যে কোনও প্রাণীর দেহ ধারণ, চির-যৌবন, অন্যের যৌবন আকর্ষণ করে নিজের শরীরে স্থাপন, কী নয়? বললে ফুরোবে না কাকিমা। এখানে এসে দুমাস থাকুন, একে একে নজির ধরে ধরে দেখিয়ে দেব।

দুমাস? হৈমবতী হেসে ফেলেন।

সারদাপ্রসাদ উদ্দীপ্ত কণ্ঠে বলে, দুমাস বলে আপনি ঘাবড়াচ্ছেন কাকিমা, ওটা তবু আমি কম করেই বললাম। দু মাসেও কুলোয় কিনা সন্দেহ। কত আছে, যা আপনার এ যুগের বিজ্ঞান এখনও স্বপ্নও দেখছে না। হৈমবতী হেসে বলেন, তা কবিকল্পনাও তো ছিল কিছু? যেমন সত্যযুগের মানুষ একুশ হাত লম্বা ছিল।

সারদাপ্রসাদ হঠাৎ যেন ধসে পড়ে! ছি ছি, আপনি এই কথা বললেন কাকিমা? অথচ আমি আপনাকে না–এটা আপনি বলবেন না। একুশ হাত মানুষ ছিল না কী বলছেন? তা হলে বলুন পৃথিবীতে অতিকায় হাতি, অতিকায় জিরাফ, অতিকায় কুমির কিছুই ছিল না? অবিশ্বাসের কী আছে বলুন। তাদের সঙ্গে খাপ খাইয়ে থাকত। প্রকৃতির কাজই তো হচ্ছে অ্যাডজাস্ট করে চলা। পৃথিবীতে যখন দেদার জায়গা ছিল, তখন বৃহৎ প্রাণী ছিল, মানুষ তাই বৃহৎ ছিল। ক্রমশ পৃথিবীতে জায়গা কমতে শুরু করল, মানুষের সংখ্যা বেড়ে যেতে শুরু করল, ব্যস, প্রকৃতি অমনি মানুষের মাপ কমাতে শুরু করল। এখন আপনাদের সংখ্যাতত্ত্ববিদরা বলছেন–এরপর আর পৃথিবীতে মানুষ ধরবে না। দেখবেন ঠিকই ধরে যাবে। তখন মানুষ লিলিপুট বা বুড়ো আঙুল হয়ে যাবে। তা এখন থেকেই তার কাজ শুরু হয়ে গেছে। প্রথমে মন নিয়ে শুরু হয় কিনা। দিনের পর দিন তাই মানুষের মন ছোট হয়ে যাচ্ছে। আরও ছোট হয়ে যাবে, তারপর দেহগুলোই ছোট হতে থাকবে। তা হলেই বলুন একুশ হাতে অবিশ্বাস কীসের?

হৈমবতী এই অভিনব মতবাদের বহরে কষ্টে হাসি গোপন করে বলেন, তা হয়তো সত্যি। তবে গুজব বলেও তো একটা জিনিস আছে? মনে করো সেই সত্য থেকে কলি, এই চার যুগ ধরে সেই গুজবের বাড় বৃদ্ধি হয়ে চলেছে

সারাদাপ্রসাদ এবার গম্ভীর হয়।

বলে,আপনিও যদি একথা বলেন তো নাচার। তবে সাহেবরা যখন গবেষণা করে ওইসব দেখিয়ে দেবে, তখন আমরা বাহবা দিয়ে বলব। কী আশ্চয্যি। কি অদ্ভুত, কী মজা! তখন আর অবিশ্বাস করব না।

হৈমবতীর অবশ্য মুখে আসছিল, চোখে দেখলে আর অবিশ্বাস করা যায় কী করে? কিন্তু বললেন না। হৈমবতী অনুপ্তের ভূমিকা নিলেন। বললেন, তা যা বলেছ। ভেবে দেখলে তাই। একসময় যে এই প্রাচ্যভূমি জ্ঞানে-বিজ্ঞানে পৃথিবীর মধ্যে শ্রেষ্ঠ ছিল, তার প্রমাণ নেই তাও নয়।

সেই তো, সেই কথাই তো বলে মরছি জীবনভর– সারদাপ্রসাদ হৃষ্টচিত্তে বলে, আপনি একটা কথাতেই বুঝলেন, স্বীকারও করলেন, কিন্তু আর কেউ কানই দিতে চায় না। অরণ্যে রোদন করে মরি বেনাবনে মুক্তো ছড়াই। অথচ তলিয়ে দেখতে পারলেই বোঝা যায়। এই যে, শ্রীকৃষ্ণ একমুঠো বেনাঘাস তুলে ছুঁড়ে মারলেন, আর সেগুলো লোহার মুষল হয়ে গিয়ে যদুবংশ ধ্বংস করল, কী এটা? আমি তো বলব স্রেফ আণবিক বোমার ব্যাপার, একবার নিক্ষেপেই বংশকে বংশ লোপাট।অথচ যেহেতু আমাদের নিজেদের দেশের ইতিহাসে রয়েছে সেই হেতুই ধরে নিতে হবে ওসব রূপক, গুজব, কবিকল্পনা।না না এটা ঠিক নয়।–এই যে সেদিন মীনাক্ষীকে বোঝাতে গেলাম, বল জিনিসটা আর কিছুই নয় বাপু, স্রেফ গাছের অংশ থেকে তৈরি আর্ট সিল্ক বা রেয়ন সিল্ক। তা শুনে মেয়ে একেবারে হেসেই অস্থির। একই জিনিসের নাম যেমন ভিন্ন ভিন্ন ভাষায় বিভিন্ন, তেমনি ভিন্ন ভিন্ন কালেও অনেক সময় বিভিন্ন হয়ে যেতে পারে, একথা মানে না। যাক গে ওর জন্যে ভাবি না। সত্য কখনও চিরদিন আবৃত থাকে না, এই সারদাপ্রসাদের গবেষণার ফল একদিন ভারতকে পৃথিবীর দরবারে শ্রেষ্ঠ আসন দেবে কিনা দেখবেন। আধুনিক বিজ্ঞান যতই অগ্রসর হোক, তাকে মাথা হেঁট করে বলতেই হবে, প্রাচীন ভারতবর্ষের যোগবলের কাছে এখনও আমরা অ আ ক খর ছাত্র, আর ওই যোগবলটিই হচ্ছে বিজ্ঞানশক্তি।

হৈমবতী ওই অবোধ মানুষটার উত্তেজনায় লাল মুখটার দিকে তাকিয়ে কোমল অথচ ব্যস্ত গলায় বলেন, এসব কথা তোমার মতো এমন করে তলিয়ে তো দেখি না বাপুকখনও, শুনলে মনটা খুব চঞ্চল হয়, কিন্তু তুমি এখন সারাদিন ঘুরে এলে, স্নান করবে, খাবে

আমার স্নানাহার? এর জন্যে কিছু ভাববেন না সারদাপ্রসাদ অধিকতর উদ্দীপ্ত হয়ে ওঠে এবং আরও বেশ কিছুক্ষণ প্রবল বিক্রমে আধুনিক বিজ্ঞান ও প্রাচীন যোগবল সম্পর্কে তুলনামূলক সমালোচনা করে হঠাৎই একসময় বলে ওঠে, নাঃ স্নানটাই সেরে আসি, মাথাটা কেমন ঝাঁ ঝাঁ করছে।

সারদাপ্রসাদ চলে গেলে হৈমবতী করুণার গলায় বলেন, সত্যি সরোজ, কোনওমতে ওর ওই লেখা ছাপিয়ে ফেলা যায় না?

সরোজাক্ষ মৃদু বিষণ্ণ হাসি হেসে বলেন, হাজার কয়েক টাকা খরচ করতে পারলে যায়।

আমার যদি অনেক টাকা থাকত, হৈমবতী বলেন, আমি একজন পাবলিশার হতাম।

সরোজা বলেন, কিন্তু তাতেই কি ওকে আঘাত থেকে বাঁচানো যেত ছোট কাকি? সে আরও বড় আঘাত। এ তো তবু বেচারা জানছে এতবড় একটা কাণ্ড আর কাজ ও কাউকে দেখাতে পাচ্ছে না। তাতে ব্যাকুলতা আছে, আকুলতা আছে, উত্তেজনা আছে, আশাও আছে। অগাধ আশা। যার জোরে ওর এত অ্যাকটিভিটি। কিন্তু তখন? তখন ওই আশাটাই যে ভেঙে চুরমার হয়ে যাবে। যখন দেখবে ওর গবেষণাগ্রন্থ পড়ে পড়ে পোকার খাদ্য হচ্ছে, তখন ওর ভিতরটাও ঘুণ ধরে ঝরে পড়বে।

সত্যি, কী অবাস্তব একটা নেশার পিছনে ছুটে মানুষটা

সরোজাক্ষ মৃদু গলায় বলেন, পৃথিবীতে কোন্ নেশাটাই বা অবাস্তব নয় বলো? ক্ষমতার নেশা, জয়ের নেশা, একচ্ছত্র নায়কত্বের নেশা, স্বর্ণের নেশা, ধর্মের নেশা, সংসারের নেশাযা কিছুই ছুটিয়ে নিয়ে বেড়াচ্ছে মানুষকে, তার কোন্টাই বা অবাস্তব আশার নয়? মানুষ থাকলেই অন্ধ নেশাও থাকবে। হয়তো ওটাই গতির শক্তি। যেদিন সে টের পায় এতদিন যা নিয়ে বিশ্বজগৎ ভুলে ছুটছিলাম, সেটা স্রেফ শূন্য, তখনই ভেঙে গুঁড়ো হয়ে যায়।

হৈমবতী প্রতিবাদের সুরে বলেন, কিন্তু কখনও কি কারুর সাকসেস হয় না?

আমার তো মনে হয়, না। শ্রীরামচন্দ্র রামরাজ্য গড়েও সুখী হননি।

 তবুও বেচারার ওই দুর্দান্ত আশা দেখে মনে হচ্ছিল, একটা বইও ওর অন্তত ছাপা হলে–

নাঃ। তার পরবর্তী যে ভয়ংকর বাস্তব, ও সেটা সহ্য করতে পারবে না।

হৈমবতী ঈষৎ অন্যমনা গলায় বলেন, কিন্তু এদের জন্যে বড্ড মায়া হয়।

 সরোজাক্ষ একটু হেসে ফেলে বলেন, সকলের হয় না। যেমন এ বাড়ির গিন্নির!

হৈমবতী সচমকে বলেন, এই সেরেছে! এতক্ষণ যে কথাটা মনেই পড়েনি। কোথায় এ বাড়ির গিন্নি? ইস এতক্ষণ এসেছি, খোঁজ করিনি।

সেটা কোন পক্ষের করণীয় তাই ভাবছি

বাঃ, আমারই। আমি এলাম, যাই দেখি গে—

হৈমবতী উঠে দাঁড়ান।

আর সেই দাঁড়ানোয় বিজয়া বিপদগ্রস্ত হন। ঘরে ঢুকতে এসেও দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে পড়েছিলেন তিনি নিজস্ব নিয়মে। আড়ি পেতে অপরের কথা শোনা তাঁর একটি প্রিয় কাজ, কিন্তু সেটা প্রকাশ হয়ে পড়াটা বাঞ্ছনীয় নয়। তাই তিনি সহসা একটুকু সরে গিয়ে সিঁড়িতে গলা বাড়িয়ে অদৃশ্য কাউকে উদ্দেশ করে বলে ওঠেন,আচ্ছা আমি যাচ্ছি, তুমি ততক্ষণ ওটা সেরে ফেলল।

তারপর সাহস করে ঘরে এসে ঢোকেন।

 আর যেন এইমাত্র জানলেন, এমন ভঙ্গিতে বলে ওঠেন,ছোট খুড়ি যে? কতক্ষণ?

বিজয়ার বাপের বাড়িতে কাকিকে খুড়ি বলা রেওয়াজ, তিনি সেটাই চালান।

 হৈমবতী অপ্রতিভ গলায় বলেন, এই তো খানিকক্ষণ। তুমি বুঝি পুজো করছিলে?

পুজো? বিজয়া একটি উচ্চাঙ্গের হাসি হেসে বলেন,পুজো আর কী, পুজো-পুজো খেলা। তবু এই জঞ্জালের জগৎ থেকে খানিকটা সরে যাওয়া।

একথার আর উত্তর কী?

হৈমবতী চুপ করে থাকেন।

বিজয়া নিজেই আবার পূর্বকথা ভুলে গিয়ে বলেন, এসেছ, তা জেনেছি অনেকক্ষণ। মীনা গিয়ে খবর দিয়ে এসেছে। তবে ভাবলাম, আমি আর সাততাড়াতাড়ি নেমে কী করব? বিদুষী খুড়ি, বিদ্বান ভাশুরপো, তাদের বড় বড় কথার মধ্যে আমি গিয়ে বসব, হংস মধ্যে বক! তার চেয়ে থাক। আগে তোমরা প্রাণভরে গপো করে নাও, তারপর যাব। বিজয়ার মুখে একটুকরো কুটিল হাসি।

হৈমবতীর কিছু অজানা নয়, বিজয়াকে তিনি যথেষ্ট চেনেন। তবু সরোজাক্ষ হৈমবতীর উপস্থিতিতে বিজয়ার স্বরূপের এই নির্লজ্জ উদঘাটনে একেবারে অবিচলিত থাকতে পারেন না।

সরোজাক্ষ বলে ওঠেন, বড় বড় কথা না জানলেই যে ছোট কথা কইতে হবে, এমন কোনও আইন আছে কি?

বিজয়া মূর্খ হলেও বোকা নয়। বিজয়া এ ধরনের কথার উত্তর জানেন, এবং তা প্রয়োগও করেন। বলেন, ছোট মনের মানুষ, ছোট কথা ছাড়া আর কোথায় কী পাব বলো? তা হলে বোবা হয়ে থাকতে হয়। তা তাই তো আছি। তোমাদের এই বড় মনের বাড়িতে বোবা হয়েই বসে আছি। ছেলে তার বউকে নিয়ে গিয়ে সভার মধ্যে বাইজি নাচ নাচাচ্ছে, বউ মদ খেয়ে বেহুঁশ হয়ে বাড়ি ফিরছে, মেয়ে একটা শূদুরের ছেলের সঙ্গে মাখামাখি করে আখের খোওয়াতে বসেছে, আর কর্তা বিজয়া গলার সব বিষটুকু নিঃশেষে ঢেলে বলেন, আর কর্তা ঘরে ভাঁড়ে মা ভবানী জেনেও, তেজ করে চাকরি ছেড়ে দিয়ে ভোলানাথ হয়ে বসে থেকে বড় বড় কথার চাষ করছেন, বড় বড় বই পড়ছেন, আর এই ছোটলোক মেয়েমানুষটা টাকার কথা বলতে এলেই তাকে ঘেন্না করছেন। তবু তো কথাটি কইছি না–বোবা হয়ে বসে আছি!

স্বভাবগত দ্রুতভঙ্গিতে প্রায় চেঁচিয়ে চেঁচিয়ে কথাগুলো বলে নেন বিজয়া, মাঝখানে বাধা দেবার অবকাশ না রেখে।

কথার শেষে আর বাধা দেবার প্রবৃত্তি থাকে না সরোজাক্ষর।

সন্দেহ নেই, ইচ্ছে করেই এই কথাগুলো হৈমবতীর সামনে উচ্চারণ করে নিলেন বিজয়া, তাতে আর সন্দেহ নেই।

কারণ হৈমবতী ভদ্র সভ্য সুরুচিসম্পন্না। কারণ হৈমবতী সরোজাক্ষর শ্রদ্ধেয় প্রিয়জন। অতএব এই কুরুচিপূর্ণ কথাগুলো বিজয়ার মুখ থেকে হৈমবতীর সামনে উচ্চারিত হলে সরোজাক্ষ মরমে মরে যাবেন। বলে নিয়ে বিজয়া যেন বিজয়গর্বের উল্লাস অনুভব করেন।

নাও, এখন কোথায় মুখ লুকোবে লুকোও?

খুব যে দুজনে মুখোমুখি হয়ে বসে উচ্চাঙ্গের কথাবার্তা হচ্ছিল, ঘরের মধ্যে তোমার কোন উচ্চবস্তুর চাষ হচ্ছে দেখে যাক শৌখিন খুড়ি!

আজ বাদে কাল বাড়ি বাঁধা দিতে হবে, গয়না বেচতে হবে। এই তো সংসারের অবস্থা। উনি পুরুষ–পরম-পুরুষ সেজে চেয়ারে হেলান দিয়ে বসে আছেন। চিরকাল নিজে মহৎ হলেন, সংসারকে তাকিয়ে দেখলেন না। তাই অমন গুণনিধি ছেলে, তাই অমন বেলেল্লা বউ। হচ্ছে–আরও একটি মুগুর তৈরি হচ্ছে তোমার জন্যে, ওই তোমার ছোট কন্যেটিই তোমার মান সম্ভ্রম চ্যাপটা করে দেবেন, দেখতে পাচ্ছি দিব্যচক্ষে। দি দি না, তাই চাই আমি। সমাজে তোমার মুখটা ভাল করে পড়ুক। উচ্চলোকে বসে নিম্নলোককে ঘেন্না করার ফল ফলুক। মেয়ে যখন হাড়ি-ডোমের গলায় মালা দেবে, তখন আমার নাম কেউ তুলতে আসবে না, তোমার নামেই টি-টি পড়বে।

চিন্তা বাতাসের চেয়েও দ্রুতগামী।

সরোজাক্ষর ওই মরমে মরে-যাওয়া মুখের দিকে তাকিয়ে হিংস্রপুলকে মুহূর্তে এতগুলো কথা ভেবে নিলেন বিজয়া।

হয়তো এমনিই হয়। যে ঘরটা ভালবাসার বাসা হবার কথা, সে ঘরটা শূন্য পড়ে থাকে না। ঘরটা দখল করে নেয় ঘৃণা, দখল করে নেয় হিংস্র আক্রোশ। তাই ভাইয়ে-ভাইয়ে পিতা-পুত্রে স্বামী-স্ত্রীতে যদি ভালবাসার ঘাটতি ঘটে, তো বহিঃশত্রুর চাইতে অনেক বেশি তীব্র হয়ে ওঠে পরস্পরের হিংসা আক্রোশ ঘৃণা।

কিন্তু কথাগুলো মনে মনে বলেছেন বিজয়া, তাই তৎক্ষণাৎ মুখে বলে উঠতে পারেন, যাক ওসব কথা। ঘরের কেলেঙ্কারি বলবার নয়, তবে তুমিও ঘরেরই লোক তাই বললাম গো খুড়ি! যাক দেখো যেন পাঁচ কান না হয়।

পাঁচ কান!

হৈমবতী হেসে বলেন, নাঃ, সে ভয়টা অন্তত কোরো না।

সরোজাক্ষ আরও মরমে মরেন।

সরোজাক্ষ অনুভব করেন বিজয়া সেজেগুজে লড়াইয়ে নেমেছে, ওকে এখন বকে দমানো যাবে না। সরোজাক্ষ কিছু বলতে গেলে বিজয়া আরও অপদস্থ করে ছাড়বেন স্বামীকে। অনেক সময় জ্বালাতুনে ছোট ছেলেমেয়েদের মধ্যে দেখতে পাওয়া যায় এই প্রবৃত্তি। বাইরের লোকের সামনে বাড়ির লোককে অপদস্থ করতে পারলে আর কিছু চায় না তারা।

কিন্তু বিজয়া কি ছোট বাচ্চা?

বিজয়ার হিংস্রতাটা কি কেবলমাত্র জ্বালাতন বলে স্নেহের কোপ দেখিয়ে উড়িয়ে দেওয়া যায়?

হৈমবতী সরোজাক্ষর মনের ভাব পাঠ করতে পারেন। তাই সহাস্য-সপ্রতিভতায় বলে ওঠেন, তা কী হল বউমা; তোমার ঠাকুরের প্রসাদ-টসাদ কই? বার করো? আর একটু চা খাওয়াও। তর্ক করে গলা শুকিয়ে গেছে।

সরোজাক্ষ কৃতজ্ঞচিত্তে এই করুণাময়ীর দিকে তাকান, সরোজাক্ষর বুঝতে বাকি থাকে না বিজয়াকে অন্য কাজে অন্যমনস্ক করার তাল হৈমবতীর।

বিজয়া কিন্তু এ ফাঁদে পা দেন না। বিজয়া অম্লান গলায় বলেন,ঠাকুরের প্রসাদ? সে আর তোমার মতন মেম-শাশুড়ির জন্যে কি আর আনতে সাহস করি? চাকরকে দোকানে পাঠিয়েছি খাবার আনতে। তোমার তো আর বামুনের ঘরের বিধবার মতন অত শুচিবাই নেই, ওদের দিকের চা-ই করে দিতে বলেছি। এই আনল বলে।

হৈমবতী স্তব্ধ হয়ে যান

হৈমবতী স্বখাত সলিলের চেহারা দেখতে পান। এরপর আর তাঁর বলার উপায় রইল না, খাব না, খিদে নেই।

এরপর বসে বসে শুনতেই হবে, বেশ আছো বাবা ছোট খুড়ি, বিচার-আচারের বালাই নেই, চাকরবাকর যা দিল খেলে। আমার মতন মরণদশা নেই বাবা তোমাদের।

শুনতেই হচ্ছে, কারণ বিজয়া যেখানে উপস্থিত, সেখানে সকলেরই শ্রোতার ভূমিকা হতে বাধ্য। বিজয়া যেন অন্য সকলের সমস্ত সূক্ষ্ম কোণ আর মিহি ধার ভোঁতা পাথরে শান দিয়ে ক্ষইয়ে দিতে চান।

সরোজাক্ষ কি প্রার্থনা করছিলেন একটা দুর্বিপাকও ঘটুক, যাতে বিজয়ার কথা থামে? আর সরোজাক্ষর বিধাতা শুনতে পান সে প্রার্থনা এবং মঞ্জুরও করেন?

তাই কথার মাঝখানে দুগ্রহের আবির্ভাব ঘটে।

 নীচতলায় কী যেন একটা হইচই ওঠে, তারপর সিঁড়িতে জুতোর শব্দ। সেই শব্দছন্দের শেষ যতিতে এসে দাঁড়ায় সরোজাক্ষর ছোট ছেলে।

হাতে ছোট সুটকেস।

কপালে চওড়া ব্যান্ডেজ।

.

গোলমাল শুনে সারদাপ্রসাদ তেল মাখতে মাখতে চলে এসেছেন। ব্যান্ডেজ দেখে সকলেই শিউরে ওঠে, তবে বিজয়ার মাতৃহৃদয়, তাই বিজয়া চেঁচিয়ে ওঠেন, এ কী কাণ্ড বাবা কমল? কোথায় কী সর্বনাশ ঘটিয়ে এলি?

কমলাক্ষ অগ্রাহ্যভরে উত্তর দেয়, কিছু না বাবা, কিছু না। এমন কিছু মহা মারাত্মক কাণ্ড ঘটেনি। গোটা চার-পাঁচ মাত্র স্টিচ দিতে হয়েছে।

স্টিচ দিতে হয়েছে! হৈমবতী কাছে এসে বলেন, তা হলে তো নেহাত কম লাগেনি। কী হল, পড়ে মাথা ফাটিয়েছ, না মারামারি করেছ?

নাতি সম্পর্কের কৌতুকের ভঙ্গিমাতেই বলেন।

 কমলাক্ষও সেই সুরে বলে, কাকি-দিদাই ঠিক ধরেছেন। ওই শেষেরটা।

মারামারি? রাস্তার ছেলেদের মতন মারামারি করে কপাল ফাটালি তুই? বিজয়া ঘৃণা ধিক্কার আর ব্যঙ্গে গঠিত একটা সুরে পুনরায় চেঁচিয়ে ওঠেন, চমৎকার! এই একটা ছেলেই বাকি ছিল, সেও বাড়ির ধারা রাখছে। মহাপুরুষ বাপের মহৎ শিক্ষার ফল। বলি কী নিয়ে কার সঙ্গে করলি এসব?

বউদি, সারদাপ্রসাদ ধমকের গলায় বলে, সেই ইতিহাস একটু পরে শুনলে মহাভারত অশুদ্ধ হবে যাবে না। এখন ছেলেটাকে দেখুন শুনুন!

বিজয়াকে ধমক দিয়ে কথা একমাত্র সারদাপ্রসাদই বলতে পারে।

 বিজয়া একটু দমে যান।

বলেন, আমি আর কী দেখব! তোমরাই দেখো। ডাক্তারকে খবর দাও।

ডাক্তার!

কমলাক্ষ হইহই করে ওঠে, দরকার নেই বাবা, দরকার নেই। হসপিটালের ডাক্তার দেখেছে, বেঁধেছে, ঠিক হয়ে গেছে। ব্যাপারটা উড়িয়ে দেবার ভঙ্গিতে বলে ওঠে কমলাক্ষ, বাড়ির আসল মানুষটাকে দেখছি না কেন? বিচ্ছুবাবু?

বিচ্ছু নামটা কমলাক্ষরই দেওয়া। এবং কাকুর সঙ্গেই তার ভাব ছিল সবচেয়ে বেশি। কিন্তু এখন রীতিনীতি পালটেছে।

কমলাক্ষ বাড়ি ছাড়া, নীলাক্ষ আর বউদি সুনন্দা ছেড়েছে তাদের পূর্ব নীতি। হয়তো বা সব কিছু নীতিই।

অথচ কীসের জন্যে কে কী ছাড়ছে বোঝা যাচ্ছে না।

বিজয়া কিন্তু এই অবকাশে সুযোগ ছাড়েন না। বিজয়া বলে ওঠেন, তোর জানা সংসারের ভোল এখন অনেক বদলে গেছে, বুঝলি? ভাইপোকে দেখতে ইচ্ছে হলে এখন হয় তার ইস্কুলে যেতে হবে, নয় তার মামার বাড়ি।

কমলাক্ষ অনেকদিন আসেনি, পর পর দুটো ছুটিতে ক্যাম্পে যেতে হয়েছিল তাদের, তাই ঈষৎ অবাক হয়ে বলে, হঠাৎ এ ব্যবস্থা?

দুদিন থাকলেই বুঝতে পারবি। তোর বউদি তো এখন ছেলেকে বাপের বাড়িতে রেখে পার্টিতে নাচতে যাচ্ছে।

বাঃ বাঃ, শুনে বড় আহ্লাদ হচ্ছে।

 সরোজাক্ষ স্থিরদৃষ্টিতে স্ত্রীর দিকে তাকান।

হৈমবতী অস্বস্তি বোধ করেন।

হৈমবতী বলেন, আমি এখন যাই সরোজ আর তারপরই বোধ করি এই হঠাৎ চলে যাওয়ার অস্বস্তি কাটাতে বলেন, কমল, তুই তো এখন আছিস? একটু ভাল হলে যাস একদিন। শুনব তোর বীরত্বের কাহিনী।

তার আগেই শুনবেন–কমলাক্ষ হেসে হেসে বলে, কাগজেই দেখতে পাবেন। এমন একখানা জোরালো ঘটনা কি আর কাগজে না বেরোবে? খড়গপুর টেলজিক্যাল স্কুলে ছাত্র-বিক্ষোভ। শিক্ষকগণ প্রহৃত, পুলিশ ও ছাত্রের মধ্যে সংঘর্ষ, উভয় পক্ষে আহতের সংখ্যা বাইশ, তিনজনের অবস্থা আশঙ্কাজনক।অবশ্য তার দুজনই পুলিশ। থান ইটের ব্যাপার তো!

দিব্য হেসে হেসে বলে কমলাক্ষ!

যেন ব্যাপারটা কিছুই নয়।

যেন হাসিরই কথা, তাই হেসে হেসে বলছে।

অতএব বলতে পারা যায়, বাড়ি থেকে অনেক দূরে থেকেও এ বাড়ির আর-এক ছেলেরও ভোল পালটেছে। মারামারি করে মাথা ফাটিয়ে এসে লজ্জা পাচ্ছে না সে। লজ্জা পাচ্ছেনা শিক্ষককে পিটিয়ে, পুলিশকে হটিয়ে।

হৈমবতী চলে গেলেন।

বিজয়া ব্যস্ত হয়ে বলতে গিয়েছিলেন, তোমার জন্যে চায়ের জল চড়িয়েছে, তোমার জন্যে খাবার আনতে গেছে

হৈমবতী হেসে কমলাক্ষর গায়ে একটু হাত বুলিয়ে বলে যান, আমার ভাগটা আমার নাতি খাবে।

বিজয়া পাশ কাটান।

হাসপাতালের ব্যান্ডেজ, অনায়াসে ছুঁয়ে চলে গেল বিধবা মানুষ।

 মার চেয়ে দরদ!

বিজয়ার কি ইচ্ছে হচ্ছিল না, ছেলের গায়ে-মাথায় হাত বুলোতে? কিন্তু ব্যান্ডেজের জাতটা দেখতে হবে না?

চমৎকার দেশটি হল আমাদের! বলে সারদাপ্রসাদও আবার মাথায় তেল ঘষতে ঘষতে চলে যায়। সারদা আর হৈমবতী চলে যেতে সরোজা আস্তে বলেন, এগুলোর কি খুব দরকার ছিল?

কমলাক্ষ মাস্টার পিটিয়ে আর মাথা ফাটিয়ে এসে, হেসে ওড়াবার চেষ্টা করলেও, বাবার মুখোমুখি একটু আড়ষ্ট হয়। তবু সহজ গলায় বলতে চেষ্টা করে, পরিস্থিতি শুনলে আপনিই বুঝবেন দরকার ছিল কিনা।

সরোজাক্ষ ঈষৎ দৃঢ় গলায় বলেন, আমার পক্ষে হয়তো বোঝা শক্ত। কারণ আমাদের আমলে দৃষ্টিভঙ্গি আলাদা ছিল। তবু জিজ্ঞেস করি কত খারাপ পরিস্থিতি হলে তুমি আমায় ধরে ঠেঙাতে পারো?

ও আবার কী কথার ছিরি! বিজয়া বিরক্ত গলায় বলেন, কমল, তুই চলে আয়। হাত-মুখ ধুবি, খাবি।

তুমি যাও, ও যাচ্ছে–সরোজা বলেন, আমার প্রশ্নের উত্তরটা তোমায় দিয়ে যেতে হবে কমল! আমি কতটা গর্হিত আচরণ করলে তুমি আমায় ধরে মারতে পারো?

কমলাক্ষর অবশ্য কথাটার অন্তর্নিহিত অর্থটি বুঝতে দেরি হয় না, তবু সে পাশ কাটাতে বলে, হঠাৎ একথাটা বলছেন কেন?

কেন বলছি, সেটা বোঝবার মতো ক্ষমতা অবশ্যই তোমার হয়েছে। চিরদিন এই শিক্ষাই তো পেয়ে এসেছ শিক্ষক পিতার তুল্য!

কমলাক্ষ এবার উদ্ধত গলায় বলে, আপনাদের আমলের ওসব আদর্শ আর চলবে না বাবা! তখন ব্যাপারটা উভয় পক্ষেই ছিল। শিক্ষক শিক্ষকের মতো ব্যবহার করতেন।

সেই কথাই তো জানতে চাইছি, কতদুর গর্হিত কাজ করেছেন তাঁরা যে, ধরে মারতে হয়?

খুব চটপট বলল না অবশ্য কমলাক্ষ, তবে জেরার মুখে বেরোলো ঘটনার ইতিহাস।

এধরনের জেরা সরোজাক্ষ জীবনে করেন না ছেলে-মেয়েদের। যখন ওরা ছোট ছিল, ছোটখাট খুঁটিনাটি নিয়ে বিজয়া জেরা করতে বসতেন, সরোজাক্ষর কানে গেলে বিরক্ত হতেন। বলতেন,ওতে ওদের অসহিষ্ণু করে দেওয়া হয়, ভীরু করে দেওয়া হয়, মিথ্যে কথা শেখানো হয়। ছেড়ে দাও।

কিন্তু আজ হঠাৎ সরোজাক্ষ নিজেই ব্যাপারটাকে ছেড়ে দিলেন না। যেন কেমন এক কৌতূহল, আর জিজ্ঞাসু চিত্ত নিয়ে জানতে চাইলেন। যেন দেখতে চান এই জগতের আর কোথায় কী ঘটছে, তার সঙ্গে মিলিয়ে দেখবেন নিজের অবস্থা।

তাই জানতে চাইছেন, কতটা গহিত আচরণ করেছিলেন কমলাক্ষদের মাস্টার।

কমলাক্ষ তার উত্তর দিয়েছে। কমলাক্ষর মতে–

তোমরা যদি বলো গর্হিত নয় তো বলো। তোমরা তোমাদের পুরনো চশমা দিয়ে নতুন পৃথিবীকে দেখতে চাও তো দেখো। পৃথিবীর তাতে কিছু এসে যাবে না। লজ্জিত হয়ে বদলাতেও বসবে না সে নিজেকে।

এ-যুগ বলবে মাস্টার হয়েছ বলে মাথা কেনোনি। তুমি টাকার বিনিময়ে তোমার অধীত বিদ্যা বিক্রি করছ, আমি আমার টাকা দিয়ে সেই বিদ্যা কিনছি। এর মধ্যে এ-সম্পর্ক আসে কীসে যে আমাকে তুমি কিনে নেবে? আমায় তুমি সদাচার শেখাতে আসবে? কোনও ছেলে যদি হোস্টেলের বাইরে তার গার্ল ফ্রেন্ড নিয়ে বেড়ায়, তাতে তোমার নিষেধ করতে আসার কী রাইট আছে?

.

ব্যাপারটা ঘটেছিল এই।

কোন মাস্টার নাকি দেখেছিলেন, হোস্টেলের একটি ছেলে রাস্তায় তার এক গার্ল ফ্রেন্ড নিয়ে হি-হি হো-হো করে বেড়াচ্ছে।

ক্লাস কামাই করে না অবশ্য, ছুটির দিনে।

 ব্যস, তিনি গেলেন নাক গলাতে। তিনি ছাত্র-জীবনের আদর্শ, হোস্টেলের ডিসিপ্লিন, এইসব নিয়ে এলেন লেকচার ঝাড়তে! তারপর তাঁকে বুঝতে হবে না, সাপের ল্যাজে পা দিলে কী হয়?

সব ছাত্র এককাট্টা হয়ে মাস্টারকে পেড়ে ফেলবে না?

তাও যদি হাতে-পায়ে পড়ত তো হত। তিনি গেলেন সুপারিন্টেন্ডেন্টকে জানাতে।

 খেপবে না ছেলেরা?

ভাঙবে না কলেজের চেয়ার টেবিল যন্ত্রপাতি? যা নিয়ে কাজ করে নিজেরা। সেইসব জিনিসই ভেঙে তছনছ করে ছাড়ল।

সুপারিন্টেন্ডেন্টও তেমনি বুন্ধু, তুই না হয় মেটাবার চেষ্টা কর? তা নয় তিনি পুলিশ ডাকলেন।

ব্যস্ তার পরিণতি এই।

 ছাত্ররাও অবশ্য আহত হয়েছে।

পুলিশের লাঠিতে হয়েছে।

কিন্তু পুলিশ আহত হয়েছে থান ইটে। আর মাস্টাররা আহত হয়েছেন চেয়ার-টেবিল থেকে।

কমলাক্ষ ছিল দল-নেতাদের একজন, তাই তার মাথায় একটা লাঠি না পড়ে যায়নি। কিন্তু তাতে সে কেয়ার করে না। সে বাবার কথায় সজোরে প্রতিবাদ করে,নিশ্চয়ই অন্যায় হয়েছে মাস্টারের। স্টুডেন্ট বলে কেউ নাবালক নয়। তাদের ব্যক্তিগত ব্যাপারে তুমি মাথা গলাতে আসো কেন?

বোকামি করলে, তার প্রতিফল তো পেতেই হবে।

সরোজাক্ষ আস্তে বলেন, হোস্টেলের ছেলেদের নৈতিক চরিত্র সম্পর্কে শিক্ষকদের কোনও দায়িত্ব নেই?

থাকবে না কেন? আছে। কোনও ছেলে যদি রাত দশটার পর হোস্টেলের বাইরে থাকে, সে সম্বন্ধে হোস্টেলের আইনের প্রশ্ন তুলে কথা বলার দায়িত্ব বা রাইট আছে। তা ছাড়া কখনওই নয়।

সম্পর্কটা কি শুধুই আইনের? ভাল-মন্দের দায়িত্ব বলে কিছু নেই? সরোজাক্ষ শিথিল গলায় বলেন, কোনও ছেলে যদি হোস্টেলের বাইরে গিয়ে মদ খায়, শিক্ষকের চোখে পড়লে কিছু বলতে পারে না?

হোস্টেলের বাইরে? কমলাক্ষর মুখে মৃদু একটু হাসির আভাস ফুটে ওঠে, কষ্ট করে বাইরে যাবে কেন? ভেতরেই তো যথেষ্ট চলছে।

সরোজাক্ষ অবোধ বইকী!

বিশুদ্ধ গলায় যাকে বলে ন্যাকা। তা নইলে সরোজাক্ষ একথায় এত মর্মাহত হন? তাই সরোজাক্ষ বিহ্বলদৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকেন ছেলের দিকে। যেন বুঝতে পারছেন না ও কী বলছে।

কমলাক্ষ বাপের এই মর্মাহত অবস্থা কি বুঝতে পারে না? তবু সে যেন বাপের মোহভঙ্গ করতেই নির্মম হয়।

তাই বেপরোয়া গলায় বলে, অবাক হচ্ছেন? আপনারা নেহাত ভাল ছেলে ছিলেন, আর চিরকাল বাড়ির মধ্যে মানুষ হয়েছেন, তাই পৃথিবীটাকে দেখবার সুযোগ পাননি। নইলে মদ জিনিসটা কবে ছিল না? কবে না খেয়েছে মানুষ? স্টুডেন্টরাও ছেড়ে কথা কয়নি। পুরনো কালের হোস্টেলের সঠিক ইতিহাস দেখুন তো!

তবে হ্যাঁ, আগে লোকে অনেস্ট কম ছিল, লুকিয়ে খেত, এখন লোক অনেস্ট হয়েছে, অত লুকোচুরি করে না। হোস্টেলের অধিকাংশ ছেলেই তো মদ খায়। এবং চাকফির মতো প্রকাশ্যেই খায়।

সরোজাক্ষ ছেলের দিকে নির্নিমেষে তাকিয়ে বলেন, তুমিও বোধ হয় সেই অধিকাংশের মধ্যেই পড়ো?

আমি?

কমলাক্ষ ব্যান্ডেজ বাঁধা মাথাটাই ঝাঁকিয়ে বলে, যদি বলি পড়ি না, হয়তো আপনি বিশ্বাস করবেন না। তবে বিশ্বাস করলে বলব, পড়ি না। কারণটা নীতিগত কিছু নয়, ও আমার ভাল লাগে না। তবে যারা খায়, তাদেরও এমন কিছু মহাপাতকী মনে করি না। ওটা আজকাল এত সাধারণ ব্যাপার হয়ে গেছে। ছেলেরা তো দূরস্থান, বলে মেয়েরাই

এবার একটু চুপ করে যায় কমলাক্ষ।

বোধ হয় মনে করে, বাবার পক্ষে একটু ওভারডোজ হয়ে যাচ্ছে।

সরোজাক্ষর মাথাটা আবার ঝুঁকে পড়ছে কেন? রক্তচাপে? না অন্য একটা চাপে? তাঁর নিজেরই বাড়িতে অধিক রাত্রে কোন নাটক অভিনয় হবে, সেটা স্মরণ করে?

কমলাক্ষ তো দেখবে সেই নাটকের অভিনয়। কমলাক্ষ তো দেখেনি ইতিপূর্বে।

কিন্তু আশ্চর্য, সরোজাক্ষ তাঁর ওই বেহেড পুত্রবধূকে ঘৃণার চক্ষে দেখেন না। সরোজাক্ষ যেন তাকে মমতার চক্ষে দেখেন, দেখেন করুণার চক্ষে।

তবু সরোজাক্ষর মাথা ঝুঁকে পড়ল, হয়তো সরোজাক্ষ ভাবলেন, এ প্রসঙ্গ আমি তুললাম কোন মুখে?

কমলাক্ষ চলে গেল ভিতরে।

ফুর্তিবাজ ছেলে, ওর মনে কোনও ভার দাঁড়াতে পায় না।

ও মীনাক্ষীকে দেখতে না পেয়ে, তার খোঁজ করতে গেল।

কিন্তু মীনাক্ষী কোথায়?

 মাকে কাকি-দিদার আগমনবার্তা জানিয়েই সে হাওয়া হয়ে গেছে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *