২৬. পলায়নের পরিকল্পনা
সুবহে সাদিক। মুয়াজ্জিনের সুমিষ্ট কণ্ঠের আজানধ্বনিতে ভরে উঠেছে আকাশ-বাতাস। শুরু হয়েছে আরেকটি নতুন দিন। আজানের শব্দে প্রাণচাঞ্চল্য জেগে উঠল নোঙরে দাঁড়িয়ে থাকা গ্যালিগুলোতে। মুসল্লিরা নামাজের জন্য কাতারবন্দি হয়ে দাঁড়িয়ে গেল জাহাজের ডেকের উপর। ইমামের কিরাতের শব্দে ঘুম ভাঙল সিগাল ও অন্যান্য সামুদ্রিক পাখিরও। জাহাজ ঘিরে চক্কর দিতে দিতে কর্কশ ডাকাডাকি করতে লাগল পাখিগুলো। পাখির ডাকের শব্দেই ঘুম ভেঙেছে প্রসপেরোর। এই মুহূর্তে শেকলবন্দি করে ডেকের উপর ফেলে রাখা হয়েছে প্রসপেরোকে। কীভাবে ও বন্দি হলো সেকথা যথাসময়েই জানা যাবে। এখন একটু পিছনে ফিরে যাই।
গতকাল নিজের ভয়াবহ পরিকল্পনার কথা প্রসপেরোকে জানিয়ে চুলে গিয়েছিল দ্রাগুত। জিয়ান্নার কী হবে এই আতঙ্কে তখন মৃতবৎ হয়ে গিয়েছিল প্রসপেরো। সময় পেলে অনেক কিছুই হতে পারে ভেবে ক্ষীণ যে আশা ছিল প্রসপেরোর, দ্রাগুতের ইচ্ছা জানার পর সেই আশাও আর রইল না। কারণ সুলতানের জন্য জিয়ান্নাকে যদি রাখা না হয়, তাহলে আর ওকে সেভাবে রক্ষা করা হবে না। উপরন্তু, দ্রাগুতের লোলুপ দৃষ্টি পড়েছে ওর উপর। কেবল ঈশ্বরের দৈব সাহায্য ছাড়া ওকে রক্ষার আর কোন উপায়ও দেখছে না প্রসপেরো।
আতঙ্কে প্রসপেরোর ভিতর থেকে সব উল্টে আসতে চাইছে। সমস্ত যুক্তি-বুদ্ধি দিয়ে ও চেষ্টা করছে এই অবস্থা থেকে অন্তত জিয়ান্নার মুক্তির একটা ব্যবস্থা করতে। কিন্তু কিছুই ওর মাথায় আসছে না। মাথায় হাত দিয়ে বসে আছে প্রসপেরো। মরিয়া হয়ে চিন্তা করছে কিছু একটা উপায় বের করতে। ঠিক তখনই হঠাৎ আলোর ঝলকের মত একটা আইডিয়া খেলে গেল প্রসপেরোর মাথায়। ভাবল ব্যাপারটা যাচাই করবে। কিন্তু কাজটা বিপজ্জনক। শুধু বিপজ্জনক না, ভীষণ বিপজ্জনক। তবে প্রসপেরো সিদ্ধান্ত নিল ঝুঁকিট ও নেবে।
সিদ্ধান্ত নিয়ে আর দেরি করল না। তাড়াহুড়া করে বেরিয়ে এল প্রসপেরো। গ্যালির পাশেই ভেড়ানো আছে একটা লংবোট। সাধারণত জরুরি কারণে কেউ তীরে যেতে চাইলে সেজন্য এটা স্ট্যাণ্ডবাই হিসেবে রাখা হয়। সেটাই দখল করল প্রসপেরো। তীরে পৌঁছে ক্যাম্পে গেল ও। সেখান থেকে দ্রাগুতের জন্য জরুরি কাজে লাগবে এমন কথা বলে সামান্য তর্ক-বিতর্কের পর আদায় করল একটা ঘোড়া। চড়া রোদ থেকে মাথা বাঁচাবার জন্য একটা সাদা বড় রুমাল মাথায় বেঁধে নিল প্রসপেরো। পায়ে আছে। নরম চামড়ার ধূসর রঙের লেসওয়ালা জুতো। এই সাজেই গোপন অভিযানে রওনা হলো ও।
কয়েক ঘণ্টা পর ফিরে এল প্রসপেরো। এবং এসেই দেখল প্রচণ্ড রাগে রুদ্র-তাণ্ডব রূপ ধারণ করে আছে দ্রাগুত। প্রসপেরোর কী সাফাই দেয়ার আছে সেদিকে বিন্দুমাত্রও কর্ণপাত না করে সঙ্গে সঙ্গেই হুকুম করল প্রসপেরোকে শেকলে বেঁধে ডেকের উপর ফেলে রাখতে।
নিজেকে গুটিয়ে নিল প্রসপেরো। ওদিকে যে বিষয় যাচাই করতে প্রসপেরো বেরিয়েছিল তা পুরোপুরি সফল। আর ডেকের উপর শেকলে বাঁধা অবস্থায় পড়ে থাকার সময়টায় মাথা খাঁটিয়ে ওর মতলবটাকে আরো শানিয়ে প্রায় নিখুঁত বানিয়ে ফেলেছে। প্রসপেরো। ও ভাবল রাতে দ্রাগুতের রাগ ঠাণ্ডা হয়ে যাবে। প্রসপেরো নিশ্চিত ওর পরিকল্পনা সম্বন্ধে খানিকটা আভাস দিতে পারলেই ওর কথা শুনবে কোর্সেয়ার কমাণ্ডার দ্রাগুত। এসব ভাবতে ভাবতেই ঘুমিয়ে পড়েছিল ও। তারপর মুয়াজ্জিনের আজানের শব্দ আর পাখির কাকলিতে সকালে ঘুম ভেঙেছে ওর। খাঁচায় শুয়ে শুয়ে বাতাসের মর্মর শুনছে আর দেখছে ঢেউয়ের মাথায় রূপালী ফেনার ভাঙন।
ধর্মকর্ম দিয়ে দিনের শুরু করার পর শুরু হলো অন্য সব কাজ। শুরু হলো জাহাজ থেকে মালামাল নামানোর প্রস্তুতি। কিন্তু দ্রাগুতের গ্যালিসে কেমন যেন থম মেরে আছে। সন্দেহ নেই অন্য গ্যালিগুলোর অবস্থাও একইরকম। ক্রুরা মাল হাতাহাতি করছে বটে কিন্তু কাজ এগুচ্ছে না। এর কারণ অনুমান করাও কঠিন কিছু না। এভাবে সব ফেলে পালানোকে ক্রু ও নাবিকরা নিজেদের লজ্জাস্কর পরাজয় ছাড়া আর কিছু ভাবতে পারছে না। আরেকটা। ব্যাপারেও ওদের মাথাব্যথা আছে। সেটা হচ্ছে, আলজিয়ার্স পর্যন্ত পথটা কম-বেশি তিনশ লিগ লম্বা। বলার অপেক্ষা রাখে না, মরুর উপর দিয়ে চলে যাওয়া এই পথটা প্রায় নরকের মত উত্তপ্ত। এই চরম উত্তপ্ত পথের প্রায় পুরোটাই ওদেরকে পায়ে হেঁটে পাড়ি দিতে হবে। ঘোড়া বা উট যে কয়টা আছে তার সবই ব্যবহৃত হবে জাহাজের অফিসার ও মালামাল পরিবহনের জন্য। কাজেই এত লম্বা পথ পায়ে হাঁটা ছাড়া ওদের আর কোন উপায় নেই।
পুপ কেবিনে বসে একের পর এক হুকুম জারি করে যাচ্ছে দ্রাগুত। তখনই একটা সুপ এসে ভিড়ল দ্রাগুতের জাহাজের গায়ে। ওটায় করে এসেছে বিশাল বপু সিনান। গড়ানোর মত করে হেঁটে দ্রাগুতের চেম্বারের দিকে এগিয়ে গেল সে। প্রায় হিংস্র কণ্ঠে তার সঙ্গে কথা বলল দ্রাগুত। জিজ্ঞেস করল, কেন এসেছ, সিনান? তোমাকে তো ডাকিনি, তোমার গ্যালিতে ফিরে যাও। নোঙর তোলার প্রস্তুতি নাও গিয়ে। আর ওই বন্দি মেয়েটাকে আমার গ্যালিতে পাঠাও। এই মুহূর্তে পাঠাবে, শুনেছ কি বলেছি? এই মুহূর্তে পাঠাবে।
রাগ উঠে গেছে সিনানেরও। সে-ও বলল, শুনেছি, দ্রাগুত, শুনেছি। তবে, আপনার কথায় আমার আপত্তি আছে। আমার অভিযান থেকে প্রাপ্য অংশ হিসেবে মেয়েটিকে দাবি করেছি। আমি। রাসূল (সাঃ)-এর কসম, আমাকে এভাবে ডাকাতি করতে দেব না।
এভাবেই কোর্সেয়ারদের নেতা আর তার অধীনস্থের মধ্যে আরবি আর ফ্রেঞ্চ ভাষার মিশ্রণে শুরু হলো বাকযুদ্ধ। ওদের বক্তব্যের সারমর্ম বুঝতে প্রসপেরোর অসুবিধা হচ্ছে না। ওদিকে ওদের দুজনের তর্ক-বিতর্কে পুরো জাহাজ জুড়ে নেমে এল নীরবতা।
দ্রাগুতের কথা হচ্ছে, বর্তমান অবস্থার প্রেক্ষিতে সুলতানের কাছে যাওয়া তো দূরের কথা, জান বাঁচানোই দায়। কেবল আল্লাহ জানে ইস্তাম্বুলের দিকে কবে ওরা রওনা হতে পারবে। তাহলে মেয়েটাকে নিয়ে সিনানের আর দরকার কী। কারণ সিনানের নিজের জন্য কোন নারীসঙ্গের দরকার নেই। কিন্তু সিনান ওদিকে কোন যুক্তির তোয়াক্কা না করে নিজের দাবিতেই অটল হয়ে রইল।
শেষে আর সহ্য করতে না পেরে দ্রাগুত হুমকি দিয়ে বসল যে ওর কথা না শুনলে সিনানকে সাগরে ছুঁড়ে ফেলে দেবে। অবশ্য তারপরই বলল, তোমাকে ঠকানোর কোন ইচ্ছা আমার নেই, সিনান। মেয়েটার জন্য একটা ন্যায্য মূল্য বলো। আলজিয়ার্সের সৌক-এ বাজারে তুললে ওর দাম যা উঠত তা-ই বলো। সেই দাম দিতেও আমি রাজি। আমার প্রস্তাব তো শুনেছ, এবার তোমার কাইয়া-কে নিয়ে ভাগো, কাজ করো গিয়ে।
দ্রাগুতের ইচ্ছা নিয়ে প্রসপেরোর মনে আর কোন সন্দেহই নেই। জিয়ান্নার আগুনের মত রূপ দেখেই প্রলুব্ধ হয়েছে দ্রাগুত। তার উপর ও হচ্ছে ডোরিয়ার ভাতিজি। ওর উপর কামলিঙ্গা চরিতার্থ করলে ডোরিয়ার উপর প্রতিশোধ নেয়া হবে ভেবেছে দ্রাগুত। প্রতিশোধ আর লিপ্স-এ দুইয়ের তাড়নায় সমস্ত মূল্যবোধ সিন্দুকে ভরে সাগরে ফেলে দিয়েছে সে। এদিকে জিয়ান্নার জন্য ডোরিয়ার ভাতিজি পরিচয়টাই এখন অভিশাপ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
রাগ উঠে গেছে প্রসপেরোরও। চিৎকার করে ডাকল, দ্রাগুত!
টিবারনাকলে ঢুকতে যাচ্ছিল দ্রাগুত। ফিরে বন্দির দিকে তাকিয়ে শয়তানি হাসি দিল সে। বলল, ডাকছেন নাকি, মেসার প্রসপেরো?
রাগ নিয়ন্ত্রণে আনল প্রসপেরো। বলল, কিছু কথা বলার আছে আমার। শেকল টেনে কষ্টসাপেক্ষ পদক্ষেপ ফেলে এগুতে থাকল প্রসপেরো।
ঘুরে দাঁড়িয়েছে দ্রাগুত। তখন প্রসপেরো আবার দ্রাগুতকে ডেকে বলল, আমার কথাটা এখনই না শুনলে বাকি জিন্দেগী আফসোস করতে হবে আপনার। আপনার নিশ্চিত মুক্তির উপায় আছে আমার কাছে।
কম্প্যানিয়ন ওয়ের গোড়ায় পৌঁছে গেছে প্রসপেরো। ওর দিকে ফিরে কুটিল হেসে দ্রাগুত বলল, আপনার জাতির কাছ থেকে অনেক স্বাধীনতা ইতিমধ্যেই আমি পেয়েছি। আমার মুক্তির পথ আমি নিজেই খুঁজে নেব।
প্রসপেরো বলল, হ্যাঁ, দেখেছি আপনার মুক্তির পথ। সেটা ধ্বংসেরই নামান্তর। কিন্তু আমার কথা শুনলে বেঁচে যাবে আপনার ফ্লিট।
লম্বা একটা সময় ধরে তীব্র দৃষ্টিতে প্রসপেরোর দিকে তাকিয়ে রইল দ্রাগুত। তবে কিনা দ্রাগুতের অবস্থাটাই এখন এমন যে খড় কুটো ধরে হলেও বাঁচার চেষ্টা করবে সে। আমার ফ্লিট বাঁচবে বললেন? সব প্রশংসা মহান আল্লাহতায়ালার। আল্লাহর শপথ, প্রতারণা করলে আপনার এমন ব্যবস্থা করব, দুনিয়ার আর কারো সঙ্গে কখনোই আর প্রতারণা করতে পারবেন না।
জবাবে প্রসপেরো বলল, আপনি জানেন, আমি প্রতারক নই, বলতে বলতে অতি কষ্টে টিবারনাকলে পৌঁছে গেল প্রসপেরো। একটু ছায়ায় দাঁড়িয়ে দ্রাগুতকে ইশারা করল ওকে অনুসরণ করতে। যেতে যেতে দ্রাগুত আবার আগে বলা সতর্কবার্তাটা প্রসপেরোকে মনে করিয়ে দিল।
প্রাণের উপর বাজি ধরেছে প্রসপেরো। তাই দ্রাগুতের রাগ উপেক্ষা করে নিজের মত করে খেলা চালানো শুরু করল ও। বলল, গতকাল জাহাজ থেকে নেমেছিলাম একটা সুযোগ পরখ করতে। নিশ্চিত হয়েই ফিরেছি। এখান থেকে পালানোর একটা সুযোগ এখনও আছে। আপনাকে তখন সেটা বলতেও চেয়েছিলাম। কিন্তু আপনি শোনেননি। উপকার করতে চাওয়ার প্রতিফল হিসেবে আমার কপালে জুটেছে লোহার শিকল। এখন আপনার কপালেও ধ্বংস নেমে আসছে।
রাগত গলায় দ্রাগুত বলল, এখন তো আমি শুনছি, বলুন। আল্লাহর দয়ায় যদি কোন রাস্তা আপনার নজরে আসে তো বলুন।
উপায় বলব, যখন আমার শর্তে আপনি রাজি হবেন, তখন, বলল প্রসপেরো।
শর্ত? ইয়া, আল্লাহ, আপনি কি ভাবছেন আমার সঙ্গে শর্তে আসার মত অবস্থায় আছেন আপনি? বিস্মিত দ্রাগুত প্রশ্ন করল।
জবাবে প্রসপেরো বলল, আপনি নিজে হলে কী করতেন? এমন সার্ভিস দিলে তার দাম নিতেন না? রিক্ত হাতে আলজিয়ার্সে ফিরে যাওয়ার বদলে পুরো ফ্লিট আর গর্ব নিয়ে ফাঁদ থেকে বের হবার রাস্তা দেখাব আমি, বিনিময়ে কি কিছুই আপনার দেবার নেই?
হেসে ফেলল দ্রাগুত। লৌহকঠিন হাতে প্রসপেরোর কাঁধ ধরল সে। বলল, শুনি, কী পরিকল্পনা করেছেন?
আমার প্রস্তাবের উত্তর কিন্তু দেননি।
কী ভাবছেন তা না জানালে হা-না বলব কীভাবে? বলল দ্রাগুত।
আমার চাহিদা পূরণের শপথ না করলে পরিকল্পনাটাই বা ফাস করি কী করে?
জাহান্নামে জায়গা হোক আপনার। আমার ফ্লিট উদ্ধার করতে পারবেন তা নিশ্চিতভাবে না জেনেই শপথ করব, বোকা ভেবেছেন?
শর্তসাপেক্ষে শপথ করবেন। আপনার কাজ শেষ হবার আগে অর্থাৎ ডোরিয়াকে কাঁচকলা দেখিয়ে সাগরে নামার আগে আমাকে কিছু দেবেন না, এভাবে শপথ করতে পারেন, বলল প্রসপেরো।
আবারো হেসে ফেলল দ্রাগুত। তখন তাকে প্রসপেরো মনে করিয়ে দিল, আমি তো আপনার হাতেই আছি। আমার পরিকল্পনা ব্যর্থ হলে আমাকে নিয়ে যা ইচ্ছা করার ক্ষমতা তো আপনার হাতেই রইল।
কথাটা মনে ধরল দ্রাগুতের। বলল, হ্যাঁ, তা ঠিক। বলুন তাহলে, কী চান আপনি।
খুব বেশি কিছু চেয়ে আপনাকে বিপদে ফেলব না। আপনার যা আছে তার অর্ধেকও চাইতে পারতাম, কিন্তু তাও চাইছি না। শার্শেলের ঘটনায় আমি আপনার কাছে আমার মুক্তিপণের টাকা দেনা আছি। প্রথমেই ওটা থেকে মুক্তি চাই।
দিলাম। আর?
এবার আমার আর আমার স্ত্রীর জন্য দাবিকৃত মুক্তিপণ থেকে মুক্তি চাই।
তীব্র দৃষ্টিতে প্রসপেরোর দিকে তাকিয়ে দ্রাগুত বলল, ওই মহিলার মুক্তি নেই।
প্রসপেরোর মন চাইছিল ঝাঁপিয়ে পড়ে কোর্সেয়ারের টুটি চেপে ধরে ওর প্রাণ-প্রদীপ নিভিয়ে দেয়। তবে নিজের মনোভাব প্রকাশ করল না ও। হেসে ফেলল প্রসপেরো। বলল, সেক্ষেত্রে আমারও আর কিছু বলার নেই।
লৌহকঠিন হাতে প্রসপেরোর কাধ ধরল দ্রাগুত। ঝাঁকুনি দিয়ে বলল, কথা বলানোর উপায় আমার খুব ভালই জানা আছে।
এবার প্রসপেরো হেসে ফেলল! বলল, বোকামি করতে চাইলে কে আপনাকে বাধা দেবে। তবে কিনা, আপনাকে ভদ্র তো বটেই, জ্ঞানীও ভেবেছিলাম। এখন দেখছি আপনি কোনটাই নন। হতাশ করলেন। আমার স্ত্রীর দিকে কুনজর দিয়েছেন আপনি। পরস্ত্রীর দিকে কুনজর দেয়া নিয়ে কি আপনাদের নবী কোন বিধান দিয়ে যাননি? আর নবী যদি বিধান না-ও দিয়ে থাকেন, তারপরও বলছি, আপনার কাছে একটা অবিশ্বাসী মহিলার দাম কি আপনার পুরো ফ্লিটের চেয়েও বেশি?
প্রসপেরোর কাঁধ ছেড়ে দিয়ে ঘুরে দাঁড়াল দ্রাগুত। হাত কচলাতে কচলাতে হাঁটা শুরু করল কেবিনের এমাথা থেকে ওমাথা পর্যন্ত। আপনার বুদ্ধিটার বিনিময়ে আর কী চান বলুন।
আমার লোক, যাদের সিনান ধরেছে, তাদের সবার মুক্তি চাই।
পাবেন। যথেষ্ট চেয়েছেন, এবার বলুন আপনার পরিকল্পনা কী, দ্রাগুত বলল।
দাঁড়ান, দাঁড়ান, আমার কথা শেষ হয়নি এখনও। আমার ডাকাটগুলো আপনার কাছে আছে, ওগুলোও ফেরত দেবেন। ওগুলো আপনার কাছে আছে, আপনার কাছেই চাইছি, কিন্তু ওর প্রত্যেকটা আমার সম্পদ। প্রয়োজনীয় লোক ও সাপ্লাই সহ আমাকে একটা নৌযান দেবেন, যাতে আমি আমার আগের গন্তব্যে রওনা হতে পারি। ছাব্বিশ দাঁড়ের একটা গ্যালি হলেই চলবে।
আল্লাহ করুক, আপনাকেও যেন কেউ এভাবে শোষণ করে। নেয়। শেষ হয়েছে?
আমি আপনাকে এই লেগুন থেকে বের করে দিতে পারব তা নিশ্চিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই এই গ্যালিটা আমার হাতে ন্যস্ত করবেন। এবং সেটা আজই হতে হবে। আমার লোক, ডাকাট আর স্ত্রীকে নিয়ে আজই আমি ওটায় উঠে পড়ব। তারপর দ্রাগুতের সন্দেহ নিরসন করতে ও বলল, অবশ্য, প্রতারণার ভয় পেলে আমার আশপাশে আপনার যত ইচ্ছা প্রহরী নিযুক্ত করতে পারেন। এই আমি চাই।
ধমকে উঠে দ্রাগুত বলল, পরিকল্পনাটা বলুন।
পরিকল্পনা হচ্ছে, আপনার জন্য খোলা সাগরের দিকে একটা পথ উন্মুক্ত করে দেব আমি।
হ্যাঁ, হ্যাঁ, বুঝেছি। আমাকে পাগল বানিয়ে ফেলবেন নাকি, কী করে বের করবেন সেটা বলুন।
বলব, কিন্তু আপনি এখনও বলেননি, আমার শর্তগুলো আপনি মেনে নিয়েছেন কিনা।
হ্যাঁ, মেনে নিয়েছি। আপনি শপথ নিতে চান? এই ফাঁদ থেকে বের হবার রাস্তা দেখান যাতে ইসলামের শত্রুদের গলায় আবার আমি সিমিটার ঠেকাতে পারি। আর পারি নবীর আইন প্রতিষ্ঠা করতে। নবী (সাঃ) ও আল কোরানের নামে আপনার কাছে শপথ করছি, এখান থেকে আপনি আমাকে বের করতে পারলে আপনার দেয়া সবগুলো শর্ত আমি অবশ্যই পালন করব। হয়েছে?
হ্যাঁ, হয়েছে, বলল প্রসপেরো। সবাই জানে, কথা দিলে তা প্রাণ দিয়ে রক্ষা করে দ্রাগুত।
সব প্রশংসা আল্লাহর। এবার বলুন, কীভাবে কী করতে চান।
জেবরা যে সরু পথটা দিয়ে মূল ভূখণ্ডের সঙ্গে মিলেছে সেই জায়গায় চলুন। স্বচক্ষেই সব দেখবেন।
দ্রাগুতের চোখ থেকে ভরসার ছাপ মিলিয়ে গেল। বলল, ওদিকে কিছু করার চিন্তা করাও বোকার স্বপ্ন।
আমি বোকা নই। জায়গাটা আমি খুব ভালভাবে পর্যবেক্ষণ করেছি। আমার সঙ্গে চলুন, দেখাচ্ছি রাস্তা কোথায় আছে।
সন্দেহের দৃষ্টিতে কিছুক্ষণ প্রসপেরোর দিকে তাকিয়ে রইল সে। ভাবল নিয়তি আবার তাকে নিয়ে কৌতুক করছে কিনা। শেষে বলল, আল্লাহর দ্বারা সবকিছুই সম্ভব। অবশ্য কণ্ঠে ফুটে থাকা সন্দেহ লুকানো থাকেনি তাতে। চলুন, দেখা যাক কী ভেবেছেন।
শেকল থেকে মুক্ত হয়ে গতদিনের পোশাকেই রওনা হলো প্রসপেরো। পাশে দ্রাগুত আর পিছনে চলেছে ছয়জন অশ্বারোহী প্রহরী। জলপাই গাছের বনের ভিতর দিয়ে এগিয়ে গেল ওরা। গাছগুলো এই এলাকায় সর্বপ্রথম রোপণ করেছিল রোমানরা। পরে সেটা ছড়িয়ে পড়েছে।
গ্রামের ভিতর দিয়ে যাবার সময় বাচ্চারা ভয়ে ঘরে গিয়ে শুকালো আর উৎসুক নয়নে তাকিয়ে রইল গ্রামের মহিলারা। গ্রামের প্রায় সর্বত্রই ছড়িয়ে আছে পাথরের উপর খোদাই করা রোমার্ন নকশা। স্পষ্টই বোঝা যাচ্ছে, এককালে রোমানদের আউটপোস্ট ছিল এখানে।
যা হোক, দ্বীপের প্রান্তে জলাভূমির পাশে গিয়ে পৌঁছুল ওরা। জায়গাটা ফ্লেমিঙ্গোদের আস্তানা। দেখা যাচ্ছে সাগর আর লেগুনের মাঝে দাঁড়িয়ে আছে দুই মাইল লম্বা একটা ভূখণ্ড। সাগরের ঢেউ এসে আছড়ে পড়ছে এর গায়ে। প্রতিটা ঢেউয়ের খানিকটা পানি উঠে আসছে মাটির এই বাঁধের উপর। ডজনখানেক ঘোড়া আর উট নিয়ে ওই জায়গাটা পার হবার চেষ্টা করছে একদল বেদুইন।
স্টিরাপে সোজা হয়ে বসে লম্বা ভূমিখণ্ডটা দেখিয়ে প্রসপেরো বলল, ওই যে আপনার মুক্তির রাস্তা।
রেগে গেল কোর্সেয়ার। বলল, ওখানে কোন পথ নেই, দেখতে পাচ্ছেন না? ওদিকে কোন চ্যানেল থাকলে এখনও আমি বসে থাকি নাকি? এমাথা থেকে ওমাথা পর্যন্ত উট চলার অভগ্ন পথ দেখতে পাচ্ছেন না?
অভগ্ন দেখছি, কিন্তু ভাঙা যাবে না এমন তো নয়। আমরাই ওটা ভাঙব, বলল প্রসপেরো।
ধরলাম ভাঙলেন। কিন্তু জাহাজগুলোকে পিছনের জলাভূমি পার করব কী করে? হাওয়ায় ভাসিয়ে?
সামনে চলুন, বলে দলবল নিয়ে রোমান আউটপোস্টের ধ্বংসাবশেষের দিকে এগিয়ে গেল প্রসপেরো। জলার শেষ প্রান্তে পৌঁছে গেছে ওরা। ঘোড়ার রাশ টেনে ধরল সবাই। ওদের সামনে এখন খোলা সাগর। সোনালি তটের উপর আছড়ে পড়ছে সাগরের ঢেউ। বামদিকে উপসাগর আর পিছনে জেবরার উঁচু ভূমি। উপসাগর দেখিয়ে প্রসপেরো বলল, ওই পথে যাবেন আপনি।
যতটা উচ্ছল প্রসপেরোর কণ্ঠ ততটাই নিরুত্তাপ দ্রাগুতের কণ্ঠ। সে বলল, একই কথা বারবার বলছেন কেন? কৌতুক করছেন আমার সঙ্গে? তা-ই যদি করেন তাহলে এটাই হবে আপনার জীবনের শেষ কৌতুক। আমরা কি ফ্লেমিঙ্গো নাকি, যে উড়ে পিছনের ওই জলাভূমি পাড়ি দেব?
না, তা নন, কিন্তু বলতে বাধ্য হচ্ছি আপনারা ক্ষীণ চিন্তাশক্তিসম্পন্ন, জবাব দিল প্রসপেরো।
হাহ, তাই নাকি? তা বলুন আপনি কোথায় পথ দেখছেন? আল্লাহ সাক্ষী, পথ দেখাতে পারলে আপনার পায়ের নিচে ধুলো হয়ে আজীবন পড়ে রইব আমি। কিন্তু ব্যর্থ হলে…
প্রসপেরো বলল, আমার হাত মুক্ত করে ছয় দিন সময় দিন। এই সময়ের ভিতরই আপনার ফ্লিট এই উপসাগরের পানিতে ভাসাব আমি। তারপর রাতের আঁধারে এখান থেকে রওনা হবেন, পরদিন সূর্য ওঠার আগেই চলে যাবেন দিগন্তের ওপাশে। কেউ জানবে না আপনি এখান থেকে চলে গেছেন। বসে বসে তখন শূন্য ফাঁদের মুখ পাহারা দেবে ডোরিয়া।
দ্রাগুতের সঙ্গের সবাই রীতিমত চমকে উঠল। তবে দ্রাগুত এত সহজে ভুলবার বান্দা নয়। বলল, স্বপ্ন দেখছেন আপনি, মাতাল স্বপ্ন।
স্বপ্ন সত্যি হবে। আর কাজ তো শুরুই হয় স্বপ্ন দেখে। আমিও আমার স্বপ্ন বাস্তব করব। সেজন্য আপনার জাহাজের প্রতিটা দাস, প্রতিটা সৈন্য আর প্রতিটা নাবিকের সামর্থ্যের শেষ বিন্দু কাজে লাগাতে হবে। জেবরার প্রতিটা কর্মক্ষম লোককেও কাজে লাগাতে হবে, সেটা যেভাবেই হোক। আমার হিসাব মতে জেবরায় পাঁচ হাজার কর্মক্ষম লোক আছে। সর্দারের আস্থা জিতে নিন আর আপনার সৈন্যদের দিয়ে ওদের থেকে কাজ আদায় করিয়ে নিন। দরকার হলে তলোয়ারের ভয় দেখিয়ে ওদের দিয়ে কাজ করান। ওদের যত বেলচা, কোদাল, ঝুড়ি আছে সব আনিয়ে দিন। তারপর বাকিটা আমার হাতে ছাড়ন। দেখুন, কী ভেল্কি দেখিয়ে দিই।
এতক্ষণে দ্রাগুতের সামনে ভাসতে শুরু করেছে প্রসপেরোর প্রজেক্ট। এর বিশালতা ভেবে রীতিমত শিউরে উঠল সে। গম্ভীর গলায় প্রশ্ন করল, ওদের দিয়ে আপনি এক লিগ (প্রায় দুই মাইল) লম্বা খাল খুঁড়বেন নাকি?
সাত হাজার হাত দিয়ে ওই চমৎকারিত্বই করা হবে। তবে খালটাকে গভীর করব না। গ্যালির সমস্ত মালামাল নামিয়ে ফেলব। শুধু খোলটা অবশিষ্ট থাকবে। তখন খালি গ্যালিগুলো অগভীর পানিতেই ভাসবে। তখন এই খাল দিয়ে গ্যালিগুলো ভাসিয়ে গভীর সাগরে এনে আবার সব মাল ভরে ফেললেই হবে।
ধীরে ধীরে দ্রাগুতের বিশ্বাস জন্মাতে শুরু করল যে প্রসপেরোর চিন্তাটা বাস্তবায়ন করা আসলেই সম্ভব। সে আরো বিশ্বাস করল, দ্রাগুতের মুক্তির জন্যই স্বয়ং সর্বজ্ঞানী, সর্বশক্তিমান আল্লাহ প্রসপেরোকে পাঠিয়েছেন এখানে। যেন ইসলামের ঝাণ্ডা সমুন্নত রাখতে লড়াই চালিয়ে যেতে পারে ইসলামের খোলা তলোয়ার দ্রাগুত রেইজ।
.
২৭.
পুনর্মিলন
ইতিবাচক সিদ্ধান্ত নেয়ার পর একমুহূর্ত সময়ও নষ্ট করল না দ্রাগুত। সঙ্গে সঙ্গেই রওনা হলো রৌমট আস সাওমের সর্দারের কাছে।
সর্দার লোকটা বয়স্ক। বহু আগেই ধূসর হয়ে গেছে তার সব দাড়ি। তার কাছে গিয়ে নিজের চাহিদার কথা জানাল দ্রাগুত। বলল দ্বীপের প্রত্যেকটা কর্মক্ষম পুরুষ চাই তার। তবে কেন তাদের দরকার তা সর্দারকে জানানো হলো না। প্রথমে সর্দার বেশ গাঁইগুই করল। তখন খানিকটা ঘুষ দিয়ে আর খানিকটা মুসলিম ভ্রাতৃত্বের দোহাই দিয়ে তাকে মানাল কৌশলী দ্রাগুত। সেইসঙ্গে লোক না দিলে কী হতে পারে সেই বিষয়ে আভাসে একটুখানি হুমকিও দিল সে।
দ্রাগুতের কাছ থেকে প্রতিশ্রুতি মোতাবেক ঘুষের সমস্ত ডাকাট আদায় করে নিল সর্দার। তারপর ডাকল দ্বীপের সমস্ত পুরুষদের। সঙ্গে সব কর্মক্ষম মহিলা, এমনকী সাহায্য করতে পারবে এমন শিশুদেরও ডাকল সে। প্রত্যেকটা গ্রামে সর্দারের সমন নিয়ে গেল তার দূত। ওদের সঙ্গে দ্রাগুতের লোকও গেল কিছু। যাতে তারা বুঝতে পারে ডাকে সাড়া দিতে শৈথিল্য দেখালে কপালে কী মুসিবত আসবে।
ওদিকে কোর্সেয়ার ফ্লিট লেগুন পাড়ি দেয়ার জন্য প্রস্তুত হয়ে গিয়েছিল। তাদেরকে জানানো হলো হুকুম প্রত্যাহার করা হয়েছে।
ওই দিন বিকেল হতে হতেই প্রায় দুই হাজার গ্রামবাসী জড়ো হয়ে গেল। বিকেলেই তাদেরকে নিয়ে যাওয়া হলো আসল কাজের জায়গায়। রাতে ওখানেই তাদেরকে থাকার হুকুম দেয়া হলো। যাতে পরদিন ভোরের আলো ফোঁটার সঙ্গে সঙ্গেই ওদেরকে কাজে লাগানো যায়। তারপর জলাভূমির পাড়ে কিছু ওয়ার্ডেনকে পাঠানো হলো ওদের ওভারশিয়ার হিসেবে, যেন কোথাও বিশৃঙ্খলা তৈরি হতে না পারে।
ঠিক কোথা থেকে খাল কাটার কাজ শুরু করতে হবে সেই বিষয়ে আগেই যথাযথ নির্দেশনা দিয়ে দিয়েছিল প্রসপেরো। এর আগেই অবশ্য কিছু অফিসারদের নিয়ে প্রসপেরোর সঙ্গে পাথুরে বাঁধটা সার্ভে করে এসেছে দ্রাগুত।
যা হোক, প্রসপেরোর কথায় দ্রাগুতের দুর্গ থেকে স্প্যানিশ গ্যালির দিকে কামানের একটা গোলা ছোঁড়া হলো। গ্যালিটা ওদের দিকে খানিকটা এগিয়ে এসেছিল। সেটাকে বুঝিয়ে দেয়া হলো দ্রাগুতরা সতর্ক অবস্থায় আছে। তাই এদিকে এর বেশি আর এগুনো নিরাপদ নয়। যদিও কামানের গোলাটা গ্যালিটার কোন ক্ষতি করেনি।
যা হোক, বিকেল নাগাদ কাজ বেশ এগিয়ে গেছে বলা চলে। ওদিকে জাহাজ থেকে দাসদের নামিয়ে দক্ষিণে রওনা করিয়ে দেয়ার পর থেকেই নাবিক-সৈনিকদের মধ্যে ব্যাপক উত্তেজনা, বিরাজ করছে। গুজব তাদের কানেও এসেছে যে দাসদেরকে এমন একটা কাজে নেয়া হচ্ছে যার ফলে ওরা এই ফাঁদ থেকে বের হতে পারবে। ফলে সবাই উৎসুক হয়ে আছে যে, আসলে হচ্ছেটা কী! কিছু সময় পরেই দ্রাগুত আর অফিসারদের তরফ থেকে নিশ্চিত করা হলো গুজবটা আসলে গুজব নয়, সত্য।
নাবিকদের প্রশ্নের জবাবে দ্রাগুত তাদের বলল, সব প্রশংসা মহান সেই সত্তার, যার কোন অংশীদার নেই। তোমরা যা শুনেছ, সত্য। নাসারা কুকুরদের ঘোল খাওয়ানোর ব্যবস্থা করা হচ্ছে। ওরা এসে এখানে দেখবে খাঁচা শূন্য, পালিয়ে গেছে তাদের শিকার।
হাসতে হাসতে নাবিক আর সৈন্যদের খবরটা জানাল দ্রাগুত। এখন তার মুড খুব ভাল। প্রসপেরো ভেবে দেখল এটাই ওর সুযোগ। ওর শর্তগুলো পূরণের জন্য এখনই দ্রাগুতকে তাগাদা দেয়া যেতে পারে।
দ্রাগুত তার কথার কোন হেরফের করল না। কেবলমাত্র কথা রাখার জন্যই দ্রাগুত জাহাজ দেয়ার হুকুম করেনি। সে ভেবে দেখেছে, যদিও কী করা হবে তা প্রসপেরো বলে দিয়েছে কিন্তু তারপরও পরিকল্পনাটা বাস্তবায়নে নানারকম সমস্যা উদ্ভব হতে পারে। ওই সমস্যাগুলো সমাধানে প্রসপেরোর চতুর মাথাটাকে খাটতে দেয়াই সবচেয়ে ভাল। ফ্রান্সের রাজা চতুর্থ হেনরি যেমন ভেবেছিল, যে-কোন মূল্যে প্যারিস ধরে রাখতে হবে, তেমন দ্রাগুতও ভেবেছে একটা মেয়ের চেয়ে তার ফ্লিটের মূল্য অনেক বেশি। কাজেই বাদ দিয়েছে জিয়ান্নাকে ধরে রাখার অপচিন্তা। তাকে প্রসপেরোর হাতে তুলে দিতেই মনস্থ করেছে সে।
সেইসঙ্গে হুকুম করেছে তার ছাব্বিশ পঁাঁড়ের কালো গ্যালি আসাদকে প্রসপেরোর জন্য প্রস্তুত করে রাখতে। ওতে কয়েকজন লোক নিয়ে কেবল জাহাজটার তুর্কি কমাণ্ডার ইউসুফ বিন হামিদকে থাকতে বলেছে। তবে সেই অর্থে প্রহরী রাখা হয়নি। ওদিকে গ্যালিটা প্রস্তুত করা হতে হতে প্রসপেরোকে নিজের গ্যালিসেতে নিয়ে গেল দ্রাগুত। জিয়ান্নাকে ওখানে আগেই আনিয়ে রাখা হয়েছে। সে অবশ্য জানে না যে, কী হচ্ছে বা হতে যাচ্ছে। তবে ক্ষীণ একটু আশা, হয়তো ওখানে তার প্রিয়তমের সঙ্গে দেখ হতে পারে।
গ্যালিসেতে সিনানও আছে। দ্রাগুতকে পেয়েই সে জিয়ান্নাকে হাতছাড়া করার ব্যাপারে তার অমতের কথা বেশ জোরের সঙ্গে উচ্চারণ করল। কিন্তু তাকে পাত্তাই দিল না দ্রাগুত। বিশটা মাত্র শব্দ ব্যবহার করে তাকে জানিয়ে দিল কোথায় কীভাবে কী পরিবর্তন আসছে। ফলে উবে গেল সিনানের আপত্তি। খাঁটি বিশ্বাসীদের প্রতি আল্লাহর রহমতের প্রশংসা করতে করতে বিদায় নিল সে। সেইসঙ্গে বুঝল তার দাসদের কেন সরিয়ে নেয়া হয়েছে।
ওদিকে দ্রাগুত যখন সিনানের কাছে সব ব্যাখ্যা করছে তখন জিয়ান্নার কাছে প্রসপেরোও সংক্ষেপে সব খোলাসা করল। স্বস্তির সাগরে ডুব দিয়ে উঠল জিয়ান্না। অবশ্য ও জিজ্ঞেস করল না যে এই বুদ্ধি কীভাবে পেল প্রসপেরো। একসঙ্গে রাতের খাবার খাওয়ার জন্য ওদেরকে ধরে রাখল দ্রাগুত।
দ্রাগুতের টিবারনাকলে সাপার করতে বসেছে ওরা। খুশিতে দ্রাগুত ডগমগ করছে যে, কী ঘোলটাই না খাবে ডোরিয়া। এবং এই অবিশ্বাস্য পরিকল্পনা দেয়ায় প্রসপেরোর উপযুক্ত প্রশংসা করতেও ভুলল না সে। সেইসঙ্গে ইসলামে বিশ্বাসীদের সুলতানের অধীনে এলে প্রসপেরো কতটা সম্মানিত হতে পারবে সেই কথাও বলল। সুলতানের সেবায় আসার পর অচিয়ালি পাশা ও অন্যান্য রেনিগেডরা কতটা সম্মান আর সম্পদের অধিকারী হয়েছে সেকথাও বলল। সেইসঙ্গে মনে করিয়ে দিতে ভুলল না যে, এখানে যা করেছে, তারপর স্পেনের সম্রাটের দরবারে কোনভাবেই আর আগের অবস্থান ফিরে পাবে না প্রসপেরো।
প্রসপেরোও বুঝল কী করতে গিয়ে কী করে ফেলেছে ও। কিন্তু এমন কিছু যে হতে পারে তা ওর মাথায় একবারও আসেনি। কিন্তু তারপরও ব্যাপারটাকে এক পাশে রাখল প্রসপেরো। বলল, ওদেরকে হারানো বা আপনাকে জিতিয়ে দেয়ার জন্য এই কাজটা আমি করছি না।
বিস্মিত দ্রাগুত প্রশ্ন করল, তাহলে কীসের জন্য করছেন?
কাজটার জন্য আপনি আমাকে যা মূল্য দিচ্ছেন (জিয়ান্নার মুক্তি) তার জন্যই করছি, বলল প্রসপেরো।
দুঃখিত দৃষ্টি ফুটে উঠল দ্রাগুতের চোখে। বলল, তারপরও ফলাফল আপনার জন্য একই হবে। যাক, কী আর করা। সবারই নিয়তি নির্ধারিত হয়ে আছে।
প্রসঙ্গটা বাদ দেয়া হলো। খাবারে মনোযোগ দিল সবাই। ওদের সামনে সার্ভ করা হয়েছে রূপার তশতরিতে জলপাই আর ডিম দিয়ে সাজানো মুরগির একটা সুস্বাদু ডিশ। এটা কোর্সেয়ারদের প্রিয় ও নিয়মিত পরিবেশিত খাবার। খাওয়া শেষে গোলাপজল মেশানো পানি দিয়ে হাত ধুয়ে নিল সবাই। শেষে প্রসপেরো আর জিয়ান্নাকে আসাদ পর্যন্ত এগিয়ে দিতে এল স্বয়ং দ্রাগুত।
এতক্ষণে একান্তে বসার সুযোগ পেল প্রসপেরো আর জিয়ান্না। তারপর ডাইনিঙে বসে দ্রাগুতের বলা কথাগুলোর প্রকৃত অর্থ জিয়ান্নাকে বুঝিয়ে বলল প্রসপেরো। তখনই পরিস্থিতি সম্বন্ধে স্পষ্ট ধারণা পেল জিয়ান্না। বুঝতে পারল ওকে মুক্ত করতে গিয়ে প্রসপেরোকে কী করতে হয়েছে এবং তার জন্য কী মূল্য ওকে চুকাতে হতে পারে।
সব বুঝতে পেরে একদম নিশ্চুপ হয়ে গেল জিয়ান্না। অন্ধকারে নিষ্পলক তাকিয়ে রইল সে। ভারী হয়ে উঠেছে বাতাস। জিয়ান্নার না বলা কথাগুলো স্পষ্ট বুঝতে পারছে প্রসপেরো। ঝুঁকে ওর হাতটা তুলে নিল প্রসপেরো। বলল, তুমি কিছু বলছ না যে?
মা মেরি! কী বলব, কী বলার আছে আমার? গম্ভীর উদ্বেগাকুল কণ্ঠে কথাগুলো বলল জিয়ান্না। কী করছ তা একবারও আমাকে জানানোর প্রয়োজন বোধ করলে না তুমি? এ যে খ্রিস্টান জাতিসত্তার সঙ্গে বেইমানি করা হলো।
বেইমানি? অস্বস্তিভরে মাথা নাড়ল প্রসপেরো। বলে চলল, যেখানে কোন আনুগত্য অবশিষ্ট নেই সেখানে বেইমানির প্রশ্ন আসতে পারে না। ঈশ্বর জানে, ডোরিয়ার প্রতি আমার কোন আনুগত্য নেই। অন্তত শার্শেলে আমাকে ওভাবে ওর ফেলে পালিয়ে আসার পর তো আর কিছুই বাকি নেই।
জিয়ান্না বলল, আমি ডোরিয়ার কথা ভাবছি না। আমি চিন্তা করছি সম্রাটের রোষ নিয়ে। স্পেন সম্রাটের সেবক তুমি। এবং ক্রিশ্চিয়ানিটিরও। কিন্তু তোমার সাহায্যে দ্রাগুত এই ফাঁদ থেকে বেরিয়ে গেলে মনে করা হবে সম্রাট আর ক্রিশ্চিয়ানিজমের সঙ্গে বেইমানি করেছ তুমি। এরপরও তুমি ক্ষমা পাবে তা আশা করা বৃথা। সেজন্যই দ্রাগুত তোমাকে প্রস্তাব দিয়েছে যে অচিয়ালির মত তুমিও তুর্কি সুলতানের কাছে আশ্রয় নাও। এছাড়া আর কী-ই বা করার আছে? জিয়ান্না আফসোস করে বলল, এ তুমি কী করলে, প্রসপেরো…
কিন্তু বিতর্ক চালিয়ে গেল প্রসপেরো। বলল, আমাকে ছাড়াও দ্রাগুত পালাতে পারত। সে আগেই পরিকল্পনা করেছিল, নিজের গ্যালিগুলো নষ্ট করে বুখারা হয়ে স্থলপথ দিয়ে আলজিয়ার্সে পালিয়ে যাবে। আমি শুধু ওর ফ্লিট বাঁচিয়ে দিয়েছি।
কিন্তু ওই ফ্লিটটাই তো আসল ব্যাপার। দ্রাগুতের ক্ষমতাই তো তার ফ্লিট। আর সবার মত তুমিও এটা জানো, জিয়ান্না বলল।
আমরা ভয়াবহ বিপদে ছিলাম, এখনও তা-ই আছি। এই বিপদ থেকে উদ্ধারের আর কোন উপায় আমি দেখিনি। তাই বাধ্য হয়েছি দ্রুত ও বেপরোয়া সিদ্ধান্ত নিতে। এতসব ঘটতে পারে তা ভাবিনি তখন। এখন বুঝতে পারছি। তবে, আগে বুঝতে পারলেও একই কাজ আমি করতাম আমি।
তীক্ষ কণ্ঠে জিয়ান্না বলল, জীবন কি এতই মূল্যবান যে আত্মসম্মান বলি দিয়ে হলেও জীবিত থাকতে হবে? এরপর কী বেঁচে থাকতে আর ভাল লাগবে?
প্রতিধ্বনি তুলে প্রসপেটরা বলল, জীবন! আহ, যদি জীবনই সব হত! বলতে পারবে কবে আমি আমার প্রাণের মায়া করেছি? গোইয়ালা, মেলফি, প্রসিডা বা শার্শেল-বলতে পারবে কোথায় আমার প্রাণের মূল্য দিয়েছি আমি?
জবাবে জিয়ান্না বলল, জানি। কিন্তু আমি তোমার প্রাণের কথা বলছিলাম না। বলছিলাম আমার কথা।
শুধু যদি তোমার বেঁচে থাকার কথা বলো…এখনো তুমি জানো না কীসের জন্য এসব করেছি আমি। জানো না, বিনিময়ে কী পাচ্ছি… এরপরই খুলে বলল যে, জিয়ান্নাকে নিয়ে প্রথমে কী করবে বলে ভেবেছিল সিনান। পরে পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে জিয়ান্নার সম্ভ্রমহানি করে ডোরিয়ার উপর দ্রাগুতের প্রতিশোধ নেয়ার পরিকল্পনার কথাও বলল। শেষে বলল, স্বর্গ থেকে ঈশ্বর নিজ হাতে ওদের বাঁচিয়ে দিয়েছেন।
লজ্জায় মাথা হেঁট হয়ে গেল জিয়ান্নার।
প্রসপেরো বলল, এসব জেনেও কীভাবে চিন্তা করি, ক্রিশ্চিয়ানিটি আর সম্রাটের প্রতি আমার দায়িত্ব কী? যে-কোন মূল্যে : তোমার মুক্তির উপায় খুঁজতে থাকি আমি.। তারই ফলশ্রুতিতে মুক্তির উপায় দেখাতে হচ্ছে দ্রাগুতকে। এখন যদি ক্রিশ্চিয়ানিটি আর সম্রাটের প্রতি বিশ্বাসভঙ্গের জন্য আমাকে মৃত্যুদণ্ডও দেয়া হয়, তবুও ঈশ্বরকে ধন্যবাদ জানাব যে, সময়মত তিনি ঠিক পথটি দেখিয়েছেন।
দুহাতে মুখ ঢেকে বসে রইল জিয়ান্না। পাশে হাঁটু গেড়ে বসে আন্তরিক সুরে প্রসপেরো বলল, বলতে পারো, ওই সময়ে। তোমার উদ্ধার ছাড়া আর কিছু কীভাবে আমি ভাবতাম?
মুখ থেকে হাত সরিয়ে নিল জিয়ান্না। কান্নাভেজা ওর চোখ। অন্ধকার চেহারায় যেন দূরাগত এক ফোঁটা আলোর আভাস। প্রসপেরোর মাথাটা নিজের দুহাতে তুলে নিল জিয়ান্না। কাঁদতে কাঁদতেই বলল, যা বলেছি, না বুঝে বলেছি, ক্ষমা করে দিয়ো, প্রিয়। আমি ভেবেছিলাম, ডোরিয়ার উপর প্রতিশোধ নিতেই বুঝি অমন পদক্ষেপ নিয়েছ তুমি। ভুলেও ভাবিনি, এরা এমন জঘন্য কিছু… থেমে গেল জিয়ান্না। তিক্ত কণ্ঠে ও বলল, কিন্তু পরে কী হবে, প্রসপেরো? দ্রাগুত যখন এখান থেকে চলে যাবে তখন কী হবে? ওকে সাহায্য করার জন্য দায়ী করা হবে তোমাকে। কী করবে তখন?
আরে, রোসো, একবারে একটা করে ঝামেলা সামলাই। ভবিষ্যতের ঝামেলা নিয়ে এখনই মাথা ঘামালে বর্তমানের সমস্যা মেটাতে পারব না। এখন আমার প্রথম দায়িত্ব, হাতের কাজটা শেষ করা। মনে রেখো, কোন ঝামেলাই চিরস্থায়ী না। সবকিছুরই শেষ আছে। এই কাজের ফল যত যন্ত্রণাদায়কই হোক, সেটাও একসময় মিটবে। কাজেই ওসব আমাকে বিরক্ত করছে না। তোমার মনেও যেন কোন দ্বিধা না আসে। ঈশ্বরকে ধন্যবাদ, তোমাকে ইস্তাম্বুল বা আলজিয়ার্সের নরক দেখতে হবে না। মুসলিমরা বলে, যা ঈশ্বর লিখে রেখেছে তা-ই চূড়ান্তভাবে নির্ধারিত। এটা ঘটবেই। কেউ ফেরাতে পারবে না, বলে জিয়ান্নাকে জড়িয়ে ধরল প্রসপেরো। ওর গাল ভিজিয়ে দিল জিয়ান্নার অশ্রু, কৃতজ্ঞতার অশ্রু।
প্রসপেরো বলল, ভেবে দেখো, এখন আমরা একসঙ্গে আছি, ব্যাপারটা অবিশ্বাস্য নয়? নিশ্চয়ই ঈশ্বর আছেন আমাদের সঙ্গে। নইলে এর কিছুই হত না। কাজেই ভবিষ্যতে যা-ই ঘটুক, তাঁর উপর ভরসা রেখো। তাঁর সাহায্যে ভবিষ্যতেও একসঙ্গেই থাকব আমরা।
.
২৮.
নতুন যাত্রা
আগে বেঁচে থাকা বা মারা যাওয়া আমার কাছে তেমন গুরুত্বপূর্ণ কিছু ছিল না। কিন্তু এখন বেঁচে থাকাটা বড় লোভনীয় মনে হয়। বিশেষ করে সময়টা যখন তোমার সঙ্গে কাটে। তাই এখন আর ডোরিয়ার স্বেচ্ছাচারিতার বলি হতে চাই না। ওর হাতে পড়লে নির্ঘাত তোমার কপালে জুটবে কনভেন্টের নান হওয়া। আর আমার ভাগ্যে জুটবে জেলখানার কয়েক গজের সেল বা হয়তো তার চেয়েও খারাপ কিছু। কিন্তু অমন কিছু হোক তা কখনোই চাই না, বলল প্রসপেরো।
ওর কথাগুলো গভীরভাবে নাড়া দিয়ে গেছে জিয়ান্নাকে।
শ্রমিকদের সঙ্গে উদয়াস্ত খেটে চলেছে প্রসপেরো। ওদিকে এই সময়টা একাকী জাহাজে বসে কাটাচ্ছে জিয়ান্না। ওর সঙ্গী হিসেবে আছে কেবল প্রসপেরোর ফেলুকার পাঁচ নাবিক। ওদেরকে জিয়ান্নার দেহরক্ষী হিসেবে নিয়োগ দিয়েছে প্রসপেরো।
জাহাজের দাস আর গ্রাম থেকে আনা শ্রমিকদের কয়েকটা দলে ভাগ করে কাজ করাচ্ছে প্রসপেরো। শ্রমিকদের দলে গ্রামের নারীদেরও ভিড়িয়ে দিয়েছে সর্দার। ফলে চাহিদার চেয়েও বেশি শ্রমিক পাওয়া গেছে। এদের দিয়েই জলাভূমিতে খাল কাটানো হচ্ছে। জলা থেকে সাগরের দিকে খাল কাটতে কাটতে এগুচ্ছে। ওরা। গ্যালি ভাসাবার জন্য ঠিক যতটুকু দরকার, খালটাকে তার চেয়ে একটুও বেশি গভীর বা বেশি চওড়া করা হয়নি।
প্রত্যেকটা জায়গায় নিজে দাঁড়িয়ে থেকে তদারক করছে। প্রসপেরো। কোন সমস্যাই ওর নজর এড়াচ্ছে না। এবং সব সমস্যারই বুদ্ধিদীপ্ত সমাধান দিয়ে চলেছে ও। এত দ্রুত কাজ এগিয়েছে যে, শুরুর দুদিনের মাথায়ই জলাভূমিতে খাল কাটার কাজ শেষ হয়ে গেছে। খালে পানিও চলে এসেছে। ওদিকে বাঁধটা কাটতে লাগিয়ে দেয়া হয়েছে আরেকটা দল। কিন্তু মাটি খুঁড়তে গিয়ে দেখা গেল এই কাজটা খুবই কঠিন। কারণ বাঁধের মাটিতে প্রচুর পাথর। আর মাটিও যেন পাথরের মত শক্ত। ফলে এটা একটা অত্যন্ত শ্রমসাধ্য ও সময়সাপেক্ষ কাজ।
জায়গাটা ভাল করে জরিপ করে প্রসপেরো বুঝল এটা কাটার জন্য যদি অপেক্ষা করতে হয় তাহলে সময়ের মধ্যে কাজ কোনভাবেই শেষ করা সম্ভব হবে না। কাজেই অন্য বুদ্ধি বের করল ও। বাদ দিল বাঁধ কাটার চিন্তা। রোলারের উপর দিয়ে গড়িয়ে গড়িয়ে গ্যালিগুলোকে জায়গাটুকু পার করার পরিকল্পনা করল ও। এবং প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই গাছের গুঁড়ি কেটে বাকল, ছিলে অল্প সময়ের মধ্যেই সেগুলোকে রোলার হিসেবে প্রস্তুত করে ফেলা হলো।
এই কাজটা হয়ে যাওয়ার পরই বাঁধের অপর দিক থেকে সাগর পর্যন্ত খাল খনন করার কাজে দাস আর শ্রমিকদের লাগিয়ে দিল প্রসপেরো। কারণ সাগরের ঢেউ বাঁধ পর্যন্ত চলে এলেও বালুকাবেলা এতটা গভীর নয় যে গ্যালিগুলো ওখানে ভাসতে পারবে। তাই ওখানেও খাল কাটতে লোক লাগাতে হলো।
ওদিকে একদল যখন খাল কাটার কাজ করছে আরেক দলকে ও লাগিয়ে দিয়েছে গ্যালিগুলো থেকে মালামাল নামানোর কাজে। শুধু কামান-বন্দুক আর ব্যালাস্ট নয়। সহজে নড়ানো যায় এমন সবকিছু নামাতে বলে দিয়েছে ও। ঠিক কী করতে হবে বুঝিয়ে দেয়ার পর দ্রাগুত নিজেই মালামাল নামানোর কাজ তদারক করছে। গ্যালিগুলো থেকে এমনকী দাঁড়গুলোও নামিয়ে ফেলা হয়েছে। ফলে অনেকটা উঁচু হয়ে ভাসছে গ্যালিগুলো। ওগুলো এখন বাঁধ পার হওয়ার জন্য প্রস্তুত। সমস্ত মালামাল নামিয়ে ফেলার পর গ্যালিগুলো এখন মাত্র পাঁচ ফুট গভীর পানিতেই ভাসছে।
গ্যালিগুলোর সঙ্গে আগেই রশি বাঁধা হয়েছে। তীর থেকে গুণ টানার মত করে রশি ধরে টেনে গ্যালিগুলোকে খাল পার করা হবে। রাত নামার আগেই আসাদ সহ দ্রাগুতের সবগুলো গ্যালিকে জলার খালে নিয়ে আসা হলো। তারপর সেদিনের মত বিশ্রাম দেয়া হলো সবাইকে।
পরের দিনের কথা। সবচেয়ে কঠিন আর পরিশ্রমসাধ্য কাজটা করতে হবে আজ। বাঁধের উপর দিয়ে রোলারে চাপিয়ে পার করতে হবে গ্যালিগুলো। তারপর গ্যালিগুলো নামানো হবে বাঁধের পরের খালের পানিতে। সন্ধ্যা নাগাদ শেষ করা হলো এই কাজটাও। সূর্য ডোবার একটু আগে তেরোটা গ্যালির সবগুলোই শেষপর্যন্ত, বাঁধ পার করিয়ে খালের পানিতে ভাসানো গেল।
তবে উদ্দেশ্যমূলকভাবে পিছনে ফেলে আসা হয়েছে দুটো ব্রিগেন্টাইন। দ্রাগুতের দুর্গের কিছুটা দূরে দুই পাশে রাখা হয়েছে ওই দুটোকে। যেন ডোরিয়াদের টহল গ্যালি থেকে অনায়াসে ওগুলো দেখা যায়। ব্রিগেন্টাইন দুটো দেখে ডোরিয়ার লোকেরা বুঝে নেবে দ্রাগুত এখনও তার লোক-লস্কর নিয়ে অসহায় হয়ে ওখানেই বসে আছে। স্বভাবতই ব্রিগেন্টাইন দুটো দেখলেই ডোরিয়ার লোকেরা পরামর্শ দেবে প্রণালীতে ঢোকার আগে যতটা সম্ভব লোক-লস্কর নিয়ে তারপর যেন ঢোকা হয়।
ব্রিগেন্টাইন দুটো এখানে নোঙর করার আগেই ও-দুটো থেকে সমস্ত মালামাল নামিয়ে নিয়েছে প্রসপেরো। অন্ধকার নামতেই ব্রিগেন্টাইন দুটো থেকে লোকজনও সব সরে এল। পরদিন সকালে ডোরিয়ার জন্য আরেকটু ভেল্কি দেখানোর ব্যবস্থা করল প্রসপেরো। দ্রাগুতের দুর্গ থেকে ভারী ব্যাসিলিস্কো কামানগুলো সরিয়ে ফেলার আগে ওগুলো থেকে ডোরিয়ার ফ্লিটের দিকে ছয়টা গোলা ছুঁড়ল প্রসপেরো। জেরায় এটাই ওদের শেষ কাজ। উদ্দেশ্য, ডোরিয়াকে নিশ্চিত করা যে, আমরা এখনও এখানে আছি। এরপরে কামানগুলোকে ষাড় দিয়ে টানিয়ে এনে খোলা সাগরে ভাসতে থাকা গ্যালিতে তুলে ফেলা হলো।
শেষ হয়েছে প্রসপেরোর জাদু দেখানো। সময়ের আগেই জেবরার প্রণালী থেকে সবগুলো গ্যালি বের করে এনেছে ও। মালামাল, লোক-লস্করে সুসজ্জিত হয়ে দ্রাগুতের ফ্লিট অপেক্ষা করছে রাত নামার জন্য। অন্ধকার হলেই চুপিসারে সাগরে নেমে পড়বে ওরা। দারুণ মুডে আছে দ্রাগুত। আগামী এক সপ্তাহ ধরে ডোরিয়া কীভাবে বোকার মত শূন্য ফাঁদ পাহারা দেবে তা নিয়ে অধীনস্থদের সঙ্গে হাসাহাসি করছে সে।
এদিকে সন্ধ্যা হয়ে এসেছে। দ্রাগুতের কাছ থেকে বিদায় নেয়ার জন্য পুপ কেবিনে দাঁড়িয়ে আছে প্রসপেরো।
আন্তরিকতার সঙ্গেই প্রসপেরোকে বিদায় জানাল দ্রাগুত। বলল, আপনাকে বিদায় জানাতে কষ্টই হচ্ছে আমার। তবে চুক্তি চুক্তিই। আপনি আপনার কথা রেখেছেন। এখন আমাকেও আমার কথা রাখতে হবে। আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করি, যদি কখনো ডোরিয়া আজকের ঘটনা জানতে পারে, তখন যেন আল্লাহ আপনাকে রক্ষা করেন।
হাত বাড়িয়ে দিল প্রসপেরো। বলল, একবার আপনি আমার বন্দি ছিলেন আর দুবার আমি আপনার বন্দি হয়েছি। এই যথেষ্ট। শত্রু হিসেবে আর কখনো আপনাকে দেখতে চাই না।
আমীন। আল্লাহ আপনার যাত্রা শুভ করুক, বলল দ্রাগুত। বিদায় নিয়ে চলে এল প্রসপেরো।
আসাদ বা অন্য গ্যালিগুলোর একটাতেও আলো জ্বালানো হলো না। ফলে অন্ধকারের ভিতর ভূতের মত কতগুলো কালো কাঠামোর নড়াচড়া চোখে পড়ল কেবল। এর বেশি কিছু বোঝার উপায় রইল না। প্রসপেরো আসাদে ওঠার আধ ঘণ্টার মধ্যেই খোলা সাগরে চলে এল সবগুলো গ্যালি।
গ্যালি আসাদকে চালাবার জন্য যথেষ্ট সংখ্যক লোক-লস্কর সঙ্গে এনেছে প্রসপেরো। তাদের সবাই খ্রিস্টান। তবে ওরা কেউই এখন আর দাস নয়, সবাইকে মুক্ত করে দিয়েছে প্রসপেরো। বাড়ি যাওয়ার জন্য স্বেচ্ছাশ্রমে জাহাজের দাঁড় বাইছে ওরা। এবং জাহাজের নিরাপত্তার জন্য যে-কোন সময় হাতে আরাকুইর্বাস বা ক্রসবো তুলে নিতেও প্রস্তুত সবাই।
পুব দিকে মুখ করে খোলা সাগরের দিকে রওনা হয়েছে আসাদ সহ দ্রাগুতের পুরো ফ্লিট। মধ্যরাত পর্যন্ত একই কোর্স ধরে রাখল ওরা। ততক্ষণে জেবরা থেকে বিশ মাইলের বেশি সাগর পাড়ি দিয়ে ফেলেছে পুরো ফ্লিট। এখানেই দ্রাগুতের ফ্লিট থেকে আলাদা হয়ে গেল প্রসপেরোর আসাদ। উত্তর দিকে জাহাজের মুখ ঘুরিয়ে নিল প্রসপেরো।
পরদিন সকাল। রেইলিঙের কাছে এসে দাঁড়িয়েছে প্রসপেরো। পালে শান্ত দক্ষিণা হাওয়া নিয়ে ধীর গতিতে এগিয়ে চলেছে আসাদ। আশপাশে আর কোন নৌযান দেখা যাচ্ছে না। শান্ত সাগরের ঢেউয়ের চূড়ায় সূর্যালোকের প্রতিফলন রীতিমত উপভোগ করছে প্রসপেরো। দাঁড়িরা সবাই তখনও ঘুমাচ্ছে। আসাদের জন্য মাত্র বারোজন নাবিক এনেছে প্রসপেরো। এদের মধ্যে পাঁচজনই ওর নিজের লোক। সিনানের হাতে বন্দি হয়েছিল এই লোকগুলো। ওরা সবাই জেনোয়া থেকে প্রসপেরোর সঙ্গে ফেলুকায় উঠেছিল। বর্তমানে আসাদের মাস্টার-এর দায়িত্ব দেয়া হয়েছে ফেরুচ্চিয়োকে (জাহাজের অত্যন্ত গুরুদায়িত্বসম্পন্ন একটি পদ মাস্টার)।
প্রসপেরোকে কেবিন থেকে বের হতে দেখে নাবিকদের ছোট্ট জটলা থেকে আলাদা হয়ে গেল ফেরুচ্চিয়ো। কিচেন হয়ে প্রসপেরোর কাছে এগিয়ে এল সে।
অদ্ভুত পোশাক গায়ে চড়িয়েছে ফেরুচ্চিয়ো। ঊর্ধ্বাঙ্গে কেবল লিনিনের লাল-সাদা স্ট্রাইপের ঢোলা একটা কোর্তা। কোমরের উপর সেটা আবার বেল্ট দিয়ে বাঁধা। মাথায় আস্ত একটা ব্যাগের মত দেখতে লাল রঙের টুপি লাগিয়েছে। এই জিনিসটা দাসদের মধ্যে ব্যাপক জনপ্রিয়। প্যান্ট, পাজামা কিছুই সে পরেনি। ফলে সব মিলিয়ে ওকে দেখতে লাগছে ভারী অদ্ভুত. তবে পোশাক যেমনই হোক, দায়িত্ব পালনে বিন্দুমাত্র গাফিলতি করছে না ও।
প্রসপেরোর সঙ্গে কথা বলছে ফেরুচ্চিয়ো, বাতাসের এই গতি বজায় থাকলে আশা করি আগামীকাল সকাল নাগাদ মাল্টায় পৌঁছে যাব। আর বাতাস যদি পড়েও যায় তবুও রাতের মধ্যেই পৌঁছতে পারব সম্ভবত।
দ্রাগুত কোন্ দিকে গেছে জানতে চাইল প্রসপেরো। জবাবে ফেরুচ্চিয়ো বলল, সূর্য ওঠার দুই ঘণ্টা আগে পশ্চিমে রওনা হয়েছে দ্রাগুতের ফ্লিট।
বিষয়টা প্রসপেরোকে বেশ অবাক করল। কারণ ওর জানামতে বারবারোসার সঙ্গে মিলিত হবার জন্য অনতিবিলম্বে গোল্ডেন হর্নের দিকে যাবার কথা দ্রাগুতের। বেশ বোঝা যাচ্ছে অন্য কোন পরিকল্পনা করেছে সে। প্রসপেরো অনুমান করল হয়তো আলজিয়ার্সের দিকে যাবে দ্রাগুত। ওখান থেকেই ওর কাইয়ার মাধ্যমে কেনা গ্যালিগুলো ফ্লিটে যুক্ত করবে সে।
কিন্তু প্রসপেরোর অনুমান পুরোপুরি ঠিক নয়। দ্রাগুত কেবল একটা গ্যালি পাঠিয়েছে আলজিয়ার্সে। সেটায় করেই হুকুম পাঠাতে যাচ্ছিল যে, নতুন কেনা গ্যালিগুলোকে ইস্তাম্বুলের দিকে রওনা করিয়ে দিতে হবে। ওখানেই দ্রাগুতের ফ্লিটে যুক্ত হবে ওরা। কিন্তু তখন ওকে বাধা দেয় সিনান। অন্য একটা পরামর্শ দেয় সে। বলে, এখন খ্রিস্টানদের উপকূল পাহারা দেবার কেউ নেই। এমন সময় আপনি সমুদ্র ছেড়ে চলে যাবেন ভাবছেন?
সিনানের বক্তব্য প্রথমে দ্রাগুত বুঝতে পারেনি। তখন নিজের চিন্তা খুলে বলল কূটকৌশলী সিনান। ডোরিয়া গাধাটা ওর পুরো শক্তি নিয়ে জেরার মুখে বসে বসে ডিমে তা দিচ্ছে। তার মানে ওদের বন্দরগুলোর পাহারায় এখন কেউ নেই। তাহলে আমরা অবিশ্বাসীদের বন্দরে হামলা করছি না কেন? বিশাল সম্পদ নিয়ে সুলতানের সামনে যাওয়ার সুযোগ থাকা সত্ত্বেও খালি হাতে যাবেন কেন? স্বয়ং আল্লাহ আমাদের সামনে এই সুযোগ এনে দিয়েছেন, ভেবে দেখুন।
বুঝতে পেরেছে দ্রাগুত। কিন্তু বুদ্ধিটা ওর নিজের মাথায় না আসায় নিজের উপরই ভীষণ রাগান্বিত আর লজ্জিত হয়েছে ও। তবে পরামর্শটা মেনে নিয়েছে। ফলে পশ্চিমে ঘুরিয়ে নিয়েছে তার ফ্লিটের গতিপথ। আলজিয়ার্স থেকে রিইনফোর্সমেন্ট আনবে বটে, তবে পথে যতগুলো সম্ভব অবিশ্বাসীদের নগর-বন্দরে হামলে পড়ে যতটা সম্ভব সম্পদ জড়ো করবে তার ফ্লিট।
এতকিছু অবশ্য প্রসপেরো অনুমান করতে পারেনি। কারণ মাত্রই একটা মারাত্মক ফাঁদ থেকে বেরিয়েছে দ্রাগুত। বলা চলে বর্শাটা কান ঘেঁষে বেরিয়ে গেছে ওর। এখন স্বভাবতই নিরাপত্তা খোঁজ করার কথা তার। এবং সেজন্য বারবারোসার ফ্লিটের সঙ্গে যোগ দেয়াটাই যুক্তিগ্রাহ্য। কিন্তু তা না করে সে যে এত দ্রুত খ্রিস্টান বন্দরে হামলা করার সিদ্ধান্ত নেবে তা ভাবাটা যে কারো পক্ষেই একটু কঠিন। এবং আগেই বলেছি, প্রসপেরোও তা ভাবতে পারেনি।
এদিকে প্রসপেরো যখন দ্রাগুতকে নিয়ে ভাবছে তখন টিবারাকল থেকে বেরিয়ে এল জিয়ান্না। পরনে সবুজাভ ধূসররঙা একটা গাউন। রংটা অনেকটা ডাহুকের মত। আসাদের আগের মালিকের অব্যবহৃত পোশাক। জিনিসটা কোনভাবে তার চোখ এড়িয়ে এখানে রয়ে গেছে। তবে গাউনটায় জিয়ান্নাকে দেখতে একটুও খারাপ লাগছে না। পুপ কেবিনের রেইল ধরে নিচে নামতে নামতে প্রসপেরো আর ফেরুচ্চিয়োকে সুপ্রভাত জানাল জিয়ান্না।
জিয়ান্নাকে নিচে নামতে দেখে আবার কিচেনের দিকে রওনা হয়ে গেছে ফেরুচ্চিয়ো। সিঁড়ি বেয়ে খানিকটা উঠে জিয়ান্নার কাছে চলে এল প্রসপেরো। বলল এই গতিতে চললে আগামীকাল মাল্টায় পৌঁছে যাবে ওরা। তখনই প্রসপেরোর অনুক্ত শঙ্কার কথা মুখ ফুটে বলল জিয়ান্না। বলল, পৌঁছানোর পর কী হবে, প্রসপেরো?
জবাবে অস্বস্তি লুকিয়ে প্রসপেরো বলল, কী আবার হবে, স্পেনের দিকে রওনা হব আমরা। এ তো আগে থেকেই ঠিক করা আছে। বার্সেলোনায় চলে যাব।
পরিকল্পনা ছিল বার্সেলোনায় পৌঁছেই একজন প্রিস্টকে ধরে বিয়ের আনুষ্ঠানিকতাটা সেরে নেবে ওরা। ডেল ভাস্টোর উপর ভরসা করে আছে প্রসপেরো। ধরে নিয়েছে ডেল স্টোর সহায়তায় সম্রাটের পরিষদে একটা জায়গা ঠিকই পেয়ে যাবে ও।
কিন্তু জিয়ান্নায় মুখ থেকে ওর শঙ্কাটাই আবার প্রকাশিত হলো। তা কি আদৌ সম্ভব? জেবরায় তুমি যা করেছ সেটা জানার পর ওরা কীভাবে তোমাকে নেবে ভেবে দেখেছ?
শুধু কী করেছি তা-ই কি ওরা জানবে? কেন কাজটা করতে বাধ্য হয়েছি তা জানবে না? সব যখন জানবে তখন…
প্রসপেরোর মুখের কথা কেড়ে নিয়ে জিয়ান্না বলল, …ওরা জানবে তুমি কেবল দুজনকে রক্ষা করেছ; তোমাকে আর আমাকে। কিন্তু কীসের বিনিময়ে? আন্দ্রে জিতলে মুসলিমদের জাহাজ থেকে অন্তত দুই হাজার খ্রিস্টান দাস মুক্তি পেত। এখন দ্রাগুত মুক্তি পেয়ে উল্টো খ্রিস্টানদের শহর-বন্দরে হামলে পড়বে। কেবল ঈশ্বরই জানেন আরো কত লোক ওর হাতে বন্দি হবে আর মারা পড়বে। না জানি কত লোককে আমাদের মুক্তির মূল্য চুকাতে হবে!
একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল প্রসপেরো। বলল, কোন কুশলী বীর যোদ্ধা হয়তো এই ব্যাপারটা অনুমান করতে পারত। কিন্তু আমি অতটা কুশলী লোক নই, দেখতেই পাচ্ছ, দুঃখমাখা একটুখানি বিদ্রুপের হাসি ফুটল প্রসপেরোর ঠোঁটে।
প্রসপেরোর হাতটা নিজের হাতে তুলে নিল জিয়ান্না। বলল, আমি তোমার কাজের বিচার করছি না। শুধু মনে করিয়ে দিচ্ছি অন্যরা কীভাবে কাজটাকে মূল্যায়ন করবে। দ্রাগুতের উপর সম্রাট কতটা রেগে আছে তা তুমি ভাল করেই জানো। আর ওর ধ্বংস দেখতে সে কতটা উদগ্রীব তাও তোমার অজানা নেই। কিন্তু তুমিই তাকে ফাঁদ কেটে বের হতে সহায়তা করেছ জানার পরও তারা কি তোমাকে সহানুভূতি জানাবে? এ কি আদৌ সম্ভব?
মরিয়া হয়ে প্রসপেরো প্রশ্ন তুলল, কিন্তু ওদের জানাতে যাচ্ছে কে?
এতকিছু গোপন রাখতে পারবে? পাল্টা প্রশ্ন করল জিয়ান্না।
এটা গোপন রাখায় কোন অসম্মান তো আমি দেখছি না।
কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে ব্যাপারটা আদৌ গোপন থাকবে কিনা? তোমার দিকে আঙুল তোলার মত কেউই কি নেই?
নিশ্চিন্ত থাকো, দ্রাগুত কখনো স্বীকারই করবে না যে একটা নাসারার সহায়তায় জেবরা থেকে পালিয়েছে সে।
এই জাহাজের মাল্লারা, যাদের তুমি দাসত্ব থেকে মুক্তি দিয়েছ তাদের বেশিরভাগই স্প্যানিশ। ওদের দিয়েও খাল কাটিয়েছ তুমি। ওরা কি মুখ বন্ধ রাখবে?
কৃতজ্ঞতাবোধ থাকলে মুখ বন্ধ রাখবে। ডোরিয়ার ফ্লিট হামলা করলে ওদের কয়জন বাঁচত, বলতে পারো?
আমি তোমাকে দোষ দিচ্ছি না, প্রসপেরো? ঈশ্বর জানেন, কখনো তোমাকে দোষী ভাবিনি আমি।
কোমর জড়িয়ে ধরে জিয়ান্নাকে কাছে টানল প্রসপেরো। বলল, যা হবার হয়েছে। এসো, আমাদের মুক্তি দেয়ার জন্য ঈশ্বরকে কৃতজ্ঞতা জানাই। তার উপর বিশ্বাস রাখো। নিশ্চয়ই তিনি আমাদেরকে অসহায় অবস্থায় ফেলবেন না।
ভাগ্যে বিশ্বাস রাখার চেষ্টা আমি করছি। কিন্তু দেখো, ভাগ্য, আজ আমাদের কোথায় এনে ফেলেছে। আরেকটু হলেই তো এমন একটা দুর্ঘটনা ঘটে যেত যার কোন ক্ষতিপূরণ নেই। সেজন্যই সতর্ক করছি, যেন ভবিষ্যতের জন্য আগে থেকেই প্রস্তুত থাকতে পারো, বলল জিয়ান্না।
তবুও বলব, ভাগ্যই পথ দেখিয়ে দেবে, বলল প্রসপেরো।
আগস্টের মৃদুমন্দ হাওয়ায় ধীরগতিতে ওরা এগিয়ে চলল উত্তরদিকে। দুই দিন হয় ওরা মাল্টা পার হয়ে এসেছে। তবে ওখানে থামেনি। কারণ সেইন্ট জনের নাইটের হাজারটা প্রশ্নের উত্তর দেয়ার ইচ্ছা বা মানসিকতা কোনটাই এই মুহূর্তে প্রসপেরোর নেই। এর পরের দুই দিন সিসিলি উপকূল ডানে রেখে চলল ওরা।
জেবরা ছেড়ে আসার ছয়দিনের মাথায় স্ট্রেইটস অভ মেসিনায় পৌঁছুল প্রসপেরোর গ্যালি আসাদ। ওখানে হঠাৎ উদয় হলো দক্ষিণগামী একটা ফ্রিট। আরেকটু হলে ফ্লিটের গায়ের উপর উঠে পড়ত প্রসপেরোরা। ফ্লিট আর ওদের মাঝে দূরত্ব আধ মাইলও হবে না। ফ্লিটে সবার সামনে থাকা তিন মাস্তুলের বিশাল গ্যালিটাকে চিনতে পেরে প্রায় দম বন্ধ হয়ে গেল প্রসপেরোর। স্পেনের রাজকীয় পতাকা বহনকারী গ্যালিটা ওর নিজের গ্যালি প্রসপেরা। ফ্লিটে আছে ছাপ্পান্ন দাঁড়ের আরো নয়টা শক্তিশালী গ্যালি। ওগুলোকে অনুসরণ করে আসছে চারটা গ্যালিয়ট আর সাপ্লাই বহনকারী তিনটা রাউণ্ডশিপ।
নিয়াপলিটান স্কোয়াড্রনের মুখোমুখি হয়েছে প্রসপেরো। ওদের গন্তব্য অনুমান করাও ওর জন্য কঠিন কিছু না। নির্ঘাত ডোরিয়াকে সাহায্য করার জন্য রিইনফোর্সমেন্ট নিয়ে জেবরার দিকে রওনা হয়েছে এই স্কোয়াড্রন। স্থলপথে হামলা চালানোর জন্য রাউণ্ডশিপে করে সৈন্য নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। প্রসপেরো বুঝতে পারছে না, হাসবে নাকি কাঁদবে।
জিয়ান্নাকে ও বলল, ভাগ্যের কী খেলা, আমার নিজের ফ্লিটের সামনে পৌঁছে গেছি আমি। এখনও নিয়াপলিটান স্কোয়াড্রনের ক্যাপ্টেন জেনারেল আমি। এই ফ্লিটের অর্ধেক গ্যালিও আমার নিজের সম্পদ।
ফেরুচ্চিয়োও দেখেছে ওই ফ্লিটটাকে। তাই পরবর্তী হুকুম জানার জন্য ডেকে উঠে এসেছে সে।
প্রসপেরো তাকে হুকুম দিল, পাল নামাও। দাঁড় বাইবার জন্য দাঁড়িদের প্রস্তুত হতে বলো।
হুকুম তামিল করা হলো। প্রস্তুত হলো দাঁড়।
তখনি আসাদের দিকে এগুতে শুরু করল নিয়াপলিটান ফ্লিটের ক্যাপিটানা। আরাকুইবাসিয়াররা প্রস্তুত হয়ে দাঁড়িয়ে আছে ওটার ডেকের উপর। অবশ্য এটাই স্বাভাবিক। কারণ আসাদ নিয়ে যেভাবে হঠাৎ প্রসপেরো হাজির হয়েছে তাতে স্বভাবতই কেউ তাকে বিশ্বাস করবে না। তার উপর আসাদে কোন পতাকা তোলা নেই, ফলে বোঝার উপায় নেই এটা কাদের গ্যালি।
যা হোক, ক্যাপিটানার টিবারনাকল থেকে বেরিয়ে এল হলুদ পোশাক পরা মোটাসোটা এক লোক। প্রসপেরো চিনতে পারল তাকে। লোকটি হচ্ছে কারবাজাল। চিৎকার করে করে হাত নেড়ে তার পাশ থেকে একজন জানতে চাইল, আহোয়, কারা আপনারা?
অভাবনীয় জবাব পেল সে। তখন কারবাজালকে সে বলল, ও, ঈশ্বর! স্যর, উনি নিয়াপলিটান ফ্লিটের আগের ক্যাপ্টেন, মেসার প্রসপেরো।
.
২৯.
ফিরে আসা
লং বোটে করে প্রসপেরোর তুর্কি গ্যালি আসাদে উঠে এল কারবাজাল। এসেই বিস্মিত কণ্ঠে ডন প্রশ্ন করল, আসলেই আপনি এসেছেন, ডন প্রসপেরো? রক্তমাংসের মানুষ! বলতে বলতে প্রসপেরোকে বুকে টেনে নিল সে। বলল, আপনি ফিরেছেন, অনেক শোকার্ত মানুষ এখন শান্তি ফিরে পাবে।
আলভারোকে দেখে প্রসপেরো নিজেও খুব খুশি হয়েছে। মানুষটাকে সত্যিই ও পছন্দ করে। তাকে দেখে আন্তরিক হাসি হাসল ও। বলল, সত্যি বলছেন? কিন্তু আমার অভিজ্ঞতা বলে, মৃত মানুষ হঠাৎ জীবিত হয়ে উঠলে অনেক জীবিত লোকই তখন আর খুশি থাকে না।
হয়তো, কিন্তু আপনার বেলায় একথা সত্যি হতে পারে না। আমাদেরকে বলা হয়েছিল আপনি মারা গেছেন। ভীষণ লড়াই করে সম্মানের সঙ্গে মারা গেছেন আপনি। আপনার মৃত্যুর সংবাদে স্বয়ং সম্রাটও শোক করেছেন। চিঠি লিখে কথাটা আমাকে জানিয়েছে ডেল ভাস্টো। মৃত্যু-সংবাদের মধ্য দিয়ে যে সম্মান আপনি অর্জন করেছেন এখন বাস্তবে সেটা পাবেন। চলুন, বলল আলভারো।
শুষ্ক কণ্ঠে প্রসপেরো প্রশ্ন করল, আমাদের ইম্পিরিয়াল অ্যাডমিরাল, সে কি আমার ফিরে আসায় খুশি হবে? সে-ও তো আমার মৃত্যু-সংবাদে শোক করেছিল, নাকি?
প্রসপেরোর সন্দেহকে অব্যক্তভাবে সত্যি বলছে আলভারোর চোখের দৃষ্টি। তবে মুখে সে বলল, আপনাকে হারানোয় তার চোখ দিয়ে অশ্রু নয়, রক্ত ঝরা উচিত ছিল। আপনি ফিরে এসেছেন, এবার হয়তো বাস্তবেই তা ঝরবে। এখন আসল ঘটনা বলুন, কী ঘটেছিল সেদিন? আমার আর তর সইছে না।
হাত ধরে কম্প্যানিয়ন ওয়ে দিয়ে আলভারোকে পুপ কেবিনে নিয়ে গেল প্রসপেরো। কিন্তু টিবারনাকলে ঢোকার মুখেই থমকে দাঁড়িয়ে গেল আলভারো। জিয়ান্নাকে দেখে ভীষণ বিস্মিত হয়েছে সে। বিস্ময়ে খানিকক্ষণ নিশ্চল দাঁড়িয়ে থেকে তারপর বাউ করল। চরম অবাক হওয়া কণ্ঠে বলল, বারবার আমাকে বিস্মিত করছেন আপনি।
জবাবে প্রসপেরো বলল, ব্যাখ্যা করলেই সব সহজ হয়ে যাবে। তাকে বসতে বলল প্রসপেরো। জিয়ান্নাও বসল। তবে দাঁড়িয়ে রইল প্রসপেরো শুরু করল গল্প বলা।
শার্শেলে সেদিন আপনারা চলে আসার পর দ্রাগুতের হাতে বন্দি হই আমি। আপনি জানেন, সে-ও একবার আমার হাতে বন্দি হয়েছিল। তখন আমার কাছ থেকে ভাল ব্যবহার পেয়েছিল সে। সেই ঋণই সে শোধ করেছে। আমার স্বাধীনতার জন্য মুক্তিপণ নিতে রাজি হয় সে। এবং জেনোয়ায় গিয়ে আমাকে সেই টাকা জোগাড়ের অনুমতিও দেয়। কিন্তু আমি পৌঁছানোর আগেই স্প্যানিশ ইম্পিরিয়াল নৌবাহিনীর অভিযান শুরু হয়ে যায়। ফলে ডোরিয়ার মুখোমুখি হতে পারিনি আমি। ওদিকে আমাকে ফেলে শার্শেল থেকে ডোরিয়ার চলে আসা ও তারপর আমার প্রতি অন্য ডোরিয়াদের আচরণের কারণে আমার বিশ্বাস দাঁড়িয়ে যায় যে আমাদের আগের শত্রুতা নতুন করে জন্ম হয়েছে। এমনকী জিয়োভান্নার সঙ্গে আমি বাগদান করেছি বলে আমার নিজ বংশের লোকেরাও আমার থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয়। তখন সিদ্ধান্ত নিই স্পেনেই আবার ফিরে আসব আমি। আমার ফেলুকায় আস্তানা নিই। ওই ফেলুকাটা নিয়েই দ্রাগুতের কাছ থেকে জেনোয়ায় এসেছিলাম। এরপর ও বলল কীভাবে ওকে সাবধান করতে ফেলুকায় এসে উঠল জিয়ান্না, তারপর সদলবলে লাম্বা ডোরিয়ার আকস্মিক আক্রমণ আর ফেরুচ্চিয়োর সাহসী পদক্ষেপে আক্রমণকারীদেরকে পিছনে ফেলে সাগরে চলে আসা ইত্যাদি।
প্রসপেরো বলে চলেছে, যে ঝড়টা শুরুতে আমাদের বাঁচিয়ে দিয়েছিল, সেটাই পরে আমাদের মারতে বসেছিল। এবং ওটাই আবার আমাদেরকে নিয়ে ফেলল দ্রাগুতের মুঠোর ভিতর। দ্রাগুতের সঙ্গে আমাদের মুক্তির শর্ত নিয়ে আলোচনা করি, ওর শর্ত পূরণ করি। তারপর তো দেখতেই পাচ্ছেন, আপনার সামনে বসে আছি আমরা। সংক্ষেপে এটাই আমার গল্প।
গভীর উদ্বেগ নিয়ে আলভারোর চেহারা জরিপ করছে জিয়ান্না। একইসঙ্গে শুনছে প্রসপেরোর গল্পের রাখা-ঢাকা সার সংক্ষেপ।
ওদিকে আশ্চর্য হয়ে প্রসপেরোর গল্প শুনল আলভারো। বিস্ময়ে রসগোল্লার মত বড় বড় হয়ে উঠেছে তার চোখজোড়া। সে বলল, আমার বিশ্বাস, স্বয়ং ঈশ্বর চান আপনাদের দুজনের মিলন ঘটুক। ডোরিয়ারা যত বাধাই দিক, কিছু আসে-যায় না। আমার আরো ধারণা, আপনাদেরকে বিবাহিত অবস্থায় দেখতে চায় স্বয়ং অ্যাডমিরাল ডোরিয়া। আরেকটা ভাল খবর আছে। ওই মাথা খারাপ মুসলিম দ্রাগুত সম্ভবত আর কখনো আমাদের কোনভাবে বিরক্ত করতে পারবে না।
তা, কীভাবে সে সম্ভবত বিরক্ত করতে পারবে না? প্রশ্ন করল প্রসপেরো।
সগর্বে আলভারো জানাল, ভূমধ্যসাগরের সবগুলো খ্রিস্টান বন্দরে খবর চাউর হয়ে গেছে, দ্রাগুতকে জেবরা উপসাগরে অবরুদ্ধ করে রেখেছে আন্দ্রে। স্থলপথে দ্রাগুতকে আক্রমণ করার জন্য প্রয়োজনীয় লোক-লস্কর আর অস্ত্রপাতি নিয়ে ওদিকেই রওনা হয়েছে নিয়াপলিটান ফ্লিট।
আলভারো আশা করেছিল খবরটা শুনে অবাক হবে প্রসপেরো। কিন্তু প্রসপেরোর কথা শুনে উল্টো সে-ই হতভম্ব হয়ে পড়ল।
প্রসপেরো বলল, এটাই আপনার মিশন হলে উল্টো ঘুরে বাড়ির পথ ধরুন। নিশ্চিত হয়েই বলছি, দ্রাগুতের ফ্লিট অবরুদ্ধ তো নয়ই, এমনকী জেবরার উপসাগরেও সে নেই। সপ্তাহখানেক আগে তিউনিশিয়ান উপকূলের আশপাশে কোথাও থেকে আমাকে ছেড়েছে সে। তখনই পশ্চিমমুখী একটা কোর্সে রওনা হয়ে গেছে।
প্রথমে হতভম্ব হয়ে গেল আলভারো, তারপর রীতিমত বিস্ফোরিত হলো সে। ঈশ্বরের শপথ, আপনার নিশ্চয়ই কোথাও ভুল হচ্ছে, ডন প্রসপেরো।
না, জেবরার উপসাগরে আমিও দ্রাগুতের সঙ্গেই ছিলাম। ওখান থেকে একসঙ্গেই বেরিয়েছি আমরা। দ্বীপের দক্ষিণ প্রান্ত দিয়ে বেরিয়ে গেছে তার ফ্লিট।
অধৈর্য হয়ে উঠল আলভারো। বলল, ওই দ্বীপটা আমি চিনি। দক্ষিণ দিক দিয়ে সাগরে বের হবার জন্য কোন পথ নেই।
-হ্যাঁ, পথ ছিল না, কিন্তু এখন পথ তৈরি করা হয়েছে। যা দেখেছি তা-ই বলছি। জলাভূমির উপর দিয়ে একটা খাল তৈরি করে দ্বীপ থেকে বেরিয়ে গেছে দ্রাগুত। আর বোকার মত শূন্য ফাঁদের মুখ পাহারা দিচ্ছে ডোরিয়া।
চরম বিস্ময়ে আলভারোর মুখ দিয়ে বেরিয়ে এল, ও, ভার্জিন মেরি! তারপর ব্যাপারটার কৌতুককর দিকটা দেখতে পেয়ে হঠাৎ হাসিতে ফেটে পড়ল সে। এবং তখনই ব্যাপারটার গভীরতাও তার গোচরীভূত হলো। গম্ভীর হয়ে গিয়ে বলল, আপনার কথা সত্যি হলে, ডোরিয়া শুধু বোকাই বনেনি, ধ্বংস হয়ে গেছে। সম্রাটের ধৈর্যের বাঁধ ভাঙার পর্যায়ে চলে গেছে। এই ব্যাপারটা এখন তাকে বিস্ফোরণোন্মুখ করে তুলবে। বললেন, জলার ভিতর দিয়ে খাল কেটে বেরিয়ে গেছে দ্রাগুত? এই বুদ্ধি ডোরিয়ার মাথায়ই আসবে না। অবশ্য কে-ই বা একথা ভাববে!
আমি ভাবতাম, জিয়ান্নার দিকে এক পলক তাকিয়ে কথাটা বলল প্রসপেরো। দেখল ভয়ে ফ্যাকাসে হয়ে গেছে জিয়ান্নার মুখ।
ডন বলল, হয়তো আপনি ভাবতেন, কিন্তু কথা সেটা না। এখন কী করা যায় সেটাই প্রশ্ন। ভাইসরয় আমাকে নির্দেশ দিয়েছে জেবরায় গিয়ে ডোরিয়ার সঙ্গে যোগ দিতে। কিন্তু এখন আর তার কোন অর্থ নেই।
প্রসপেরো বলল, প্রকৃত অবস্থা আরো খারাপ। দ্রাগুতকে পশ্চিমমুখী একটা কোর্স ধরতে দেখেছি আমি। কাজেই ধরে নেয়া যায় রিইনফোর্সমেন্টের জন্য আলজিয়ার্সের দিকে যাবে সে। আরেকটা ব্যাপারও বিবেচনা করতে হবে, যেহেতু ডোরিয়া এক জায়গায় গাট হয়ে বসে আছে, তার মানে আমাদের উপকূলবর্তী বন্দরগুলো এখন অরক্ষিত। মানে, দ্রাগুতের জন্য এগুলো এখন মোক্ষম টার্গেট। সুতরাং আপনার উচিত, এখনি নেপলসে ফিরে গিয়ে বন্দরগুলো পাহারা দেয়ার ব্যবস্থা নেয়া।
পরিস্থিতির গভীরতা ও গুরুত্ব খুব ভালভাবে অনুধাবন করতে পারল আলভারো। বলল, জেবরার মুখে অযথা বসে থেকে খালি জায়গা পাহারা দিচ্ছে ডোরিয়া। অথচ বোকা লোকটা আত্মপ্রশংসা করে লম্বা লম্বা চিঠি লিখছে সম্রাটের কাছে। ভাল। তার আত্মম্ভরিতার ভাল একটা শিক্ষা হতে যাচ্ছে। আর যেমনটা বললেন, আসলেই ইটালির মাটি অরক্ষিত রেখে আমার কোথাও যাওয়া উচিত হবে না।
প্রসপেরায় ফিরে গেল আলভারো। হুকুম জারি করল, নেপলস ফিরে যেতে হবে। দক্ষিণা বাতাসের আনুকূল্য পাওয়ায় পাল তুলে দেয়া হলো। বিশ্রাম পেল দাঁড় টানা দাসেরা। উত্তরমুখী কোর্স ধরে নেপলসের দিকে রওনা হলো নিয়াপলিটান ফ্লিট। সেদিন বিকেলে ট্রামণ্টায় পৌঁছুতেই বাতাস পড়ে গেল। দাঁড় তুলে নিল মাল্লারা। কমে এল এগুনোর গতি। উপকূলের পাশ ঘেঁষে ধীরগতিতে দিনের বেলা এগিয়ে চলল তারা। রাতে নোঙর করে বিশ্রাম দেয়া হলো মাল্লাদের।
প্রসপেরোর বক্তব্য বিনা প্রশ্নে মেনে নিয়েছে আলভারো। ফলে আপাতত দূর হয়েছে জিয়ান্নার উদ্বেগ। আর সৌভাগ্য সঙ্গে আছে এই বিশ্বাস নিয়ে নিজের ফ্লিটে ফিরেছে প্রসপেরো। ওর ছয়টা গ্যালির সবগুলোই ঘুরে দেখেছে ও। প্রতিটা গ্যালির ক্যাপ্টেন ও ক্রুরা উষ্ণ ও আন্তরিক অভ্যর্থনা জানিয়েছে ওকে। ফ্লিটের ক্রু ও ক্যাপ্টেনরা সবাই ওর নিজের নিয়োগ করা। জানতে পারল, ওর মৃত্যুর খবর প্রচার হভেই ওর চাচা বেইনাল্ডো এই ছয়টা গ্যালির মালিকানা দাবি করেছে। কিন্তু তাতে অস্বীকৃতি জানিয়েছে সম্রাট। সম্রাটের অস্বীকৃতিতে সন্তুষ্ট হলো প্রসপেরো। উগ্র মেজাজী ও স্বার্থান্ধ চাচা রেইনাল্ডোর হতাশা অনুভব করে হেসে ফেলল ও। ওই সময়টায় কাজ তেমন কিছু না থাকায় আবার লিগুরিয়াদের কলেবর বাড়ানোয় মন দিল প্রসপেরো। প্রায় পঞ্চাশ স্তবক লিখে ফেলল ও। কবিতার ওই লাইনগুলোয় মেহেদিয়ায় ডোরিয়া কী করেছে, কাব্যের ভাষায় তাও বলল প্রসপেরো।
প্রসপেরোর বর্তমান উদ্দেশ্য জানতে চাইল জিয়ান্না। কারণ নিয়াপলিটান ফ্লিট এখন সহজেই ওর ইচ্ছাপূরণে ব্যবহার করা যেতে পারে। জবাবে হেসে প্রসপেরো বলল, এখন ওর আপ্ত বাক্য, ঈশ্বরের উপর ভরসা রাখো।
প্রসপেরো বলছে, দ্রাগুত সবসময় বলত, প্রত্যেকটা মানুষের ভাগ্য লিখে সেটা আল্লাহতায়ালা তার সঙ্গে বেঁধেও দিয়েছেন। তাহলে অযথা কেন অন্য কিছু করার চেষ্টা করতে যাব? আমি শুধু নিয়তি অনুসরণ করে চলি। আমার বিশ্বাস জন্মে গেছে যে স্বয়ং ঈশ্বর দয়া করে আমাদেরকে রক্ষা করেছেন, একত্র করেছেন। কাজেই, প্রিয় জিয়ান্না, আমি যেমন তাঁর উপর ভরসা করছি, তুমিও তার উপর বিশ্বাস রাখো।
একটা দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে জিয়ান্না বলল, আমি তোমার উপর ভরসা রেখেছি।
আগস্টের কোন এক রবিবার। ভিসুভিয়াসের চূড়া থেকে গড়িয়ে নামছে কমলা রঙের লাভা স্রোত। আগ্নেয়গিরির রাস্তবতা যতই কঠোর হোক, দূর থেকে সন্ধ্যার প্রায় অন্ধকার আকাশের পটভূমিতে পাহাড়ের গা বেয়ে কমলা রঙের লাভা স্রোত নামতে দেখা আসলেই দৃষ্টিসুখকর একটা দৃশ্য।
ওরা বন্দরে আসতেই সন্ধ্যার নীরবতা খানখান হয়ে গেল। ভেসে এল ট্রাম্পেট আর ড্রাম পেটানোর আওয়াজ। প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই ভেসে এল সতর্কর্ঘণ্টি বাজার শব্দ। এর কয়েক মুহূর্তের মধ্যেই দেখা গেল আগুন জ্বলে উঠেছে দুর্গ নওভো-তে। ভেসে এল কামানের গোলা ছোঁড়ার গর্জন। গোলাটাও এল সঙ্গে সঙ্গেই। সেটা পিছনে বাঁধিয়ে এনেছে ঝাঁটার মত ফুলকির বিচ্ছুরণ। একদম সামনের গ্যালিটার শখানেক গজ সামনে পানিতে পড়ল গোলাটা। একই সময় ক্যাপিটানা থেকে ট্রাম্পেটের মাধ্যমে ভেসে এল দাসদের আবার বেঞ্চে ফিরিয়ে আনার কমাণ্ড।
ক্যাপিটানায় আলভারোর সাথে আছে জিয়ান্না আর প্রসপেরো। তাদেরকে ডিনারের দাওয়াত দিয়েছিল আলভারো। তাই বিকেল থেকেই ওখানে আছে ওরা। ডিনারে মাংসের একটা ডিশের সঙ্গে ডেজার্ট হিসেবে আছে রসালো মালাগা। বাইরের দেশ থেকে আনানো কিছু অপরিচিত ফলও আছে সঙ্গে। আলভারো নিজের জন্য ডিনারে সাধারণত খুব বেশি কিছুর আয়োজন করায় না। তবে সেদিন মিউজিশিয়ানদের একটা দলকে ডিনার টেবিলের পাশে হাজির করিয়েছে সে। ডিনারের সময় ও তারপরেও মিষ্টি সুর বাজিয়ে শুনিয়েছে ওদের। কাজেই এমন একটা সুন্দর আনন্দদায়ক সন্ধ্যায় মেজবানকে ছেড়ে মেহমানরা আর যায়নি।
আর ঠিক ওই সময়ই শুরু হয়েছে দুর্গ থেকে গোলাবর্ষণ। প্রথমে একটু হতভম্ব হয়ে গেলেও পরমুহূর্তে হুঙ্কার দিয়ে উঠল আলভারো, কেউ কি বলবে, হচ্ছেটা কী? নওভো দুর্গের সবাই কি পাগল হয়ে গেল? ওই গোলাটা আর একশ গজ এদিকে পড়লেই তো একটা গ্যালি হারাতাম এখন।
প্রসপেরো বলল, ডন, আপনাকে এখানে কেউ আশা করছে না। সবাই ধরে নিয়েছে এতদিনে জেবরায় ডোরিয়ার সঙ্গে আছেন আপনি।
কিন্তু তাই বলে গোলা ছুঁড়বে?
ওরা মনে হয় খুব আতঙ্কিত হয়ে আছে, বলল প্রসপেরো।
আতঙ্কিত! কিন্তু আতঙ্কিত কেন হবে? বিস্মিত কণ্ঠে প্রশ্ন করল আলভারো।
নওভোর উদ্দেশে সঙ্গে সঙ্গেই একটা সুপ পাঠানো হলো। এর প্রায় ঘণ্টাখানেক পর প্রসপেরার পাশে এসে ভিড়ল বাররা দাঁড়ের একটা বার্জ। কালো ক্লোকে আপাদমস্তক ঢাকা লম্বা এক লোক উঠে এল মই বেয়ে। হাতে লণ্ঠন। মাথা থেকে আবরণ সরানোর পর দেখা গেল লোকটি স্বয়ং ভাইসরয়, প্রিন্স অভ অরেঞ্জ। সংক্ষিপ্ত অভিবাদন সেরে আলভারোকে সরাসরি প্রশ্ন করল সে, আপনি এখন এখানে যে আলভারো?
জানতে পেরেছি, ইয়োর হাইনেস, জেবরায় আমার উপস্থিতির আর প্রয়োজন নেই। ডোরিয়াকে কল দেখিয়ে ফাঁদ কেটে বেরিয়ে গেছে দ্রাগুত, জবাব দিল আলভারো।
ডন ভেবেছিল খবরটা শুনে বিস্মিত হবে প্রিন্স। কিন্তু সে বলল, ব্যাপারটা দ্রুতই আপনি জানতে পেরেছেন তাহলে। ঈশ্বরকে ধন্যবাদ, সময়মত এসে পৌঁছেছেন। আমরাও খবর পেয়েছি, দ্রাগুত বড়সড় ফ্লিট নিয়ে এদিকেই আসছে। তিন দিন আগেই সে কর্সিকায় রেইড করেছিল। টারিগনানো থেকে সান নিকোলো পর্যন্ত এলাকায় ছয়টা শহর লুট করেছে সে। গুঁড়িয়ে দিয়েছে চার্চগুলো, লুট করেছে ঘরবাড়ি, হাজারের বেশি লোক বন্দি করে নিয়ে গেছে।
আঁতকে উঠল আলভারো, হা, ঈশ্বর!
আরো তিক্ত স্বরে প্রিন্স বলে চলল, ওই সময় ঈশ্বরে বিশ্বাস রাখো গানটা গাইতে গাইতে লুটপাট করেছে ওরা। তখনই আমরাও বুঝেছি, ডোরিয়ার দ্রাগুতকে আটকে রাখার দাবি ফাঁকা বুলি ছাড়া আর কিছু না। আর সম্রাট তার উপর এমন রেগে গেছে যে, এখন আস্ত একটা রাজত্ব দিয়ে দিলেও আমি ডোরিয়ার হয়ে কথা বলব না। সন্ধ্যার আধো আলোতে আপনার ফ্লিটকে এখানে ভিড়তে দেখে আমরা ভেবেছি বুঝি দ্রাগুতই চলে এল! আপনি ফিরে আসতে পারেন এমন কথা আমরা ভাবতেও পারিনি। এই গুরুতর পরিস্থিতিতে যে কয়টা পেরেছি জাহাজ জোগাড় করেছি আমি। ওস্টাসিয়া থেকে তিনটা গ্যালি পাঠিয়েছেন হোলি ফাদার (পোপ)। কিন্তু দ্রাগুত যদি এখানে নাক জাগায় তো ওকে সামলাবার মত অবস্থায় আমি ছিলাম না।
অতবড় বোকামি তার করা উচিত না।
ওই লোকটার ঔদ্ধত্যের কোন সীমা আছে নাকি? যাক, কথা বলে সময় নষ্ট না করে আপনার ফ্লিটকে নির্দেশ দিন বন্দরের মুখে টহল বসাতে।
কাজেই নড়তে শুরু করল গ্যালিগুলো।
ঘুরে দাঁড়াল ভাইসরয়। এবং তখনই সে খেয়াল করল তারা ছাড়াও আরো দুজন উপস্থিত আছে সেখানে। মূল মাস্তুলে ঝোলানো আলো গিয়ে পড়েছে প্রসপেরোর মুখে। রীতিমত আঁতকে উঠল ভাইসরয়। ডনকে বলল, ঈশ্বর! গ্যালিতে ভূত নিয়ে ঘুরে বেড়ান নাকি, আলভারো?
হাসিতে উদ্ভাসিত হয়ে উঠল আলভারোর মুখ। কিন্তু সে কিছু বলার আগেই লাফিয়ে সামনে বেড়েছে ভাইসরয়। বিস্মিত কণ্ঠে প্রসপেরোর নাম ধরে ডাকল সে, প্রসপেরো? জীবিত! কিন্তু কোন্ অলৌকিক ক্ষমতাবলে বেঁচে ফিরে এলেন?
.
৩০.
ক্ষতিপূরণ
নেপলসে আসার পরের দিনের কথা। নওভো দুর্গের বেভারেল্লো টাওয়ারে চেম্বার অভ এঞ্জেলসে ভাইসরয় আর আলভারোর সঙ্গে বসে আছে প্রসপেরো। এক বছর আগে এখানে বসেই নির্ধারণ করা হয়েছিল আমালফিতে অবরোধকারীদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ শুরু করা হবে। সেই যুদ্ধের ঘটনাক্রম আগেই বর্ণনা করা হয়েছে। এখন এখানে বসে ভাইসরয় আর আলভারোর কাছে প্রসপেরো খুলে বলছে ঠিক কী হয়েছিল জেবরায়।
গতরাতের প্রায় পুরোটা সময় ধরে প্রসপেরো ভেবেছে। ভেবে সিদ্ধান্ত নিয়েছে ফলাফল যা-ই হোক, জেবরার ঘটনা সম্বন্ধে সবিস্তারে ভাইসরয়কে জানাবে ও। ভয়ে ভয়ে সায় দিয়েছে জিয়ান্না। সে-ও বলেছে, এখন কথাগুলো গোপন করে গেলেও পরে কখনো যদি তা ফাঁস হয় তখন সম্মান বলে প্রসপেরোর আর কিছুই থাকবে না। কাজেই এখনই সব স্বীকার করে নেয়া ভাল।
যা হোক, প্রসপেরোর গল্প শুনে সম্পূর্ণ ভিন্ন চিন্তা এল দুই শ্রোতার মনে। আলভারো রসিক মনের মানুষ। জেবরা থেকে কীভাবে ডোরিয়াকে বোকা বানিয়ে দ্রাগুত পালিয়েছে তার কৌতুককর দিকটা স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছে সে। ফলে প্রসপেরোর গল্প শুনে যারপরনাই আনন্দিত সে। তবে ডোরিয়ার প্রতি কোন সহানুভূতি সে দেখাল না।
কিন্তু প্রিন্সের প্রতিক্রিয়া সম্পূর্ণ ভিন্ন। কর্তৃত্বপূর্ণ কণ্ঠে সে বলল, আপনি নিজে কথাগুলো বলার পরও আমার বিশ্বাস হচ্ছে না। ওই বদমাশটাকে ফাঁদ থেকে বের হবার রাস্তা দেখিয়ে দিয়ে খ্রিস্টানদের নিশ্চিত ধ্বংসের উপায় করে দিয়েছেন আপনি। এখন ও আমাদের শহরের পর শহর ধ্বংস করে যাচ্ছে। কিন্তু গল্পটা এখনও আমার বিশ্বাস হচ্ছে না।
জবাবে প্রসপেরো বলল, কারণ ভাবতে পারছেন না যে, এই কাজটা না করলে আমি নিজেও ধ্বংস হয়ে যেতাম।
এটা কাপুরুষের কথা, আপনার মুখে মোটেও মানানসই নয়।
মাথা নেড়ে প্রসপেরো বলল, ঘটনাটা সম্রাটের নজরে আনা উচিত।
ভাইসরয় বলল, কিন্তু এই গল্পে আপনার প্রসপেরো সুলভ সাফাই নেই। আমি জানি আপনি কাপুরুষ নন যে, মারা যাওয়ার ভয়ে বদমাশটাকে পালাতে সাহায্য করবেন।
প্রিন্সকে সমর্থন দিয়ে আলভারো বলল, গোইয়ালাতায় আপনার অসম সাহসিক লড়াইয়ের কথা সারা দুনিয়া জানে। সেদিন ডোরিয়াকে উদ্ধার করেছিলেন আপনি। আর প্রসিডার কথা যদি বাদও দিই তবুও শার্শেলে আপনাকে নিজ চোখে সামনে থেকে দেখেছি। আমি জানি, জানের পরোয়া করার বান্দা আপনি নন। কাজেই, ডন প্রসপেরো, হিজ হাইনেসকে সব খুলে বলুন। ঠিক কী কারণে দ্রাগুতকে ফাঁদ কাটার পথ দেখালেন? ডোরিয়ার উপর প্রতিশোধ নিতে চেয়েছিলেন?
ডনের কথাটাকে খপ করে ধরে ফেলল প্রিন্স। বলে ফেলল, তাই তো! ঠিক বলেছেন, ডন। এবার বুঝেছি। ডোরিয়ার সঙ্গে আপনার বংশের পূর্বশত্রুতার জের ধরে এই কাজ করেছেন আপনি। কিন্তু একবারও কি ভাবেননি যে, ওকে মুক্ত করে দিলে কত প্রাণ দিয়ে তার মূল্য চুকাতে হতে পারে? আমি আপনার ঘাড়ে দোষ চাপাচ্ছি না। কিন্তু এই কাজটার ফলে ক্রিশ্চিয়ানিটির সঙ্গে বেইমানি করা হয়েছে আর ভঙ্গ করা হয়েছে সম্রাটের বিশ্বাস। তার আশাভঙ্গের কথা না হয় বাদই দিলাম। এটাই কি আসল ঘটনা নয় মেসার প্রসপেরো?
মাথা নেড়ে প্রিন্সের অভিযোগ অস্বীকার করল প্রসপেরো। বলল, না, ইয়োর হাইনেস, ঘটনা তেমন কিছু নয়। স্বীকার করছি, ডোরিয়াদের সঙ্গে আমার বংশের শত্রুতা অনেক আগে থেকেই ছিল। আমিও এর সঙ্গে ভীষণভাবে জড়িয়ে ছিলাম। কিন্তু তারপরের ঘটনা ভিন্ন। আপনিও জানেন, সুযোগ পেয়েও আমি শোধ নিইনি। আর শার্শেলের কথা বললেন, আলভারো। আপনি যা-যা জানেন তারপরও অনেক কিছু ঘটেছে। আমার বেঁচে থাকার খবর জানিয়ে ও আমার মুক্তির জন্য মুক্তিপণ সংগ্রহ করে নিয়ে যাওয়ার জন্য লোক পাঠানো হয়েছিল। কিন্তু সেই খবর আর লোক, দুটোকেই ইচ্ছাকৃতভাবে গায়েব করে ফেলা হয়। যেন আমার বেঁচে থাকার খবর কেউ জানতে না পারে। ফলে মুসলিমদের গ্যালিতে শেকলে বাঁধা দাসের মত মৃত্যু হত আমার বা শত্রুর তলোয়ারের নিচে মাথা পেতে দিতে বাধ্য হই আমি। কিন্তু এখানেই শেষ নয়। দ্রাগুতের হাত থেকে জিয়ান্নাকেও রক্ষা করতেই হত। কারণ ডোরিয়ার উপর মহাখাপ্পা দ্রাগুত। তাই চাইছিল ডোরিয়ার ভাতিজি আর আমার বাগদত্তা স্ত্রী জিয়ান্নার শ্লীলতাহানি করে ডোরিয়ার উপর প্রতিশোধ নিতে। ডোরিয়ার ভাতিজি হওয়ার অপরাধে দ্রাগুতের প্রতিশোধপরায়ণ ও লোভী চোখে জিয়ান্নার একমাত্র স্থান ওর হেরেমের সবচেয়ে নিম্ন কক্ষ। জেবরার ফাঁদ থেকে দ্রাগুতকে বের হবার পথ দেখানোই ছিল ওর মুক্তিপণ। শেষের কথাটা একইসঙ্গে পরিতাপ ও কষ্ট মাখা কণ্ঠে বলল প্রসপেরো। জিয়ান্নাকে দ্রাগুতের হাতে ছেড়ে দেয়ার মত সাহস বা মনোবল আমার ছিল না। ওই কাজ করতে হলে আমাকে মানুষ না বরং শয়তানের কাছাকাছি কিছু একটা হতে হত। তা আমার দ্বারা সম্ভব ছিল না।
প্রসপেরোর বক্তব্য ভীষণ নাড়া দিয়ে গেছে আলভারোকে। সে বলল, আপনি করেছেন তার কারণ হিসেবে এতটুকুই যথেষ্ট।
তবে প্রিন্সের চেহারায় কোন পরিবর্তন এল না। একটা দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলল কেবল সে। বলল, অবশ্যই আপনি ডোরিয়ার সঙ্গে শত্রুতাকে সামনে রেখে কাজ করেছেন। বলা চলে ধ্বংস হয়ে গেছে ডোরিয়া। আজ যে অবস্থানে তাকে আপনি নামিয়েছেন ওখান থেকে আর কখনোই উঠে দাঁড়াতে পারবে না সে। লড়াইয়ে না নেমেই ডোরিয়ার যুদ্ধ জিতে যাওয়ার দাবি আর কর্সিকায় দ্রাগুতের চালানো ধ্বংসলীলা, দুটো খবরই সম্রাটকে একসঙ্গে দেব আমি। খবরটা শুনে অবশ্যই ডোরিয়াকে মাটিতে আছড়ে ফেলবে সম্রাট। তারপর তিক্ত কণ্ঠে সে বলল, ডোরিয়াদের সঙ্গে আপনার লম্বা ও তিক্ত লড়াইয়ে শেষ পর্যন্ত জয় আপনারই হয়েছে।
জবাবে প্রসপেরো বলল, কী হয়েছে আমি দেখতে পাচ্ছি। কিন্তু হিজ হাইনেস দেখতে পাচ্ছেন না যে, যা হয়েছে তা আমার ইচ্ছাকৃত বা কোন কূট পরিকল্পনার ফসল নয়। স্রেফ ঘটনাচক্রে হয়ে গেছে। আমি ওখান থেকে বের হবার সময় চিন্তা করিনি ডোরিয়ার কী হতে পারে।
নিশ্চয়ই বলছেন না যে, যা হতে যাচ্ছে তার কিছুই আপনি আঁচ করেননি? প্রশ্ন করল প্রিন্স।
অনিশ্চিতভাবে কাঁধ ঝাঁকাল প্রসপেরো। অত কিছু ভাবতে হলে আমার মত সাধারণ মানুষ দিয়ে কাজ হবে না, একজন সন্ন্যাসীকে আমার জায়গায় বসিয়ে দিতে হবে। যা হয়েছে, আমি বলব আমার সর্বনাশ করতে চাওয়ায় ডোরিয়ার উপর নিয়তির প্রতিশোধ। নিয়তি ওর উপর কাব্যিক প্রতিশোধ নিয়েছে।
ধুম করে টেবিলের উপর কিল বসিয়ে দিল প্রিন্স অভ অরেঞ্জ। রীতিমত ধমকে উঠে বলল, শয়তানে নিয়ে যাক আপনার লড়াই আর শত্রুতা! তাকিয়ে দেখুন, আপনাদের দুজনের লড়াই কোথায় এনে ফেলেছে আমাদেরকে। ঘরবাড়ি হারিয়েছে শতাধিক কর্সিকান, খুন হয়েছে অনেক লোক, ধর্ষণের শিকার হয়েছে বহু নারী, আর কতজনের ভাগ্যে যে আজীবন দাসত্বের শেকল জুটেছে। ঈশ্বর ছাড়া কেউ জানে না। ধূলিসাৎ হয়ে গেছে সম্রাটের সমস্ত আশা। যিশুর ক্রস এখন গড়াগড়ি খাচ্ছে লুটেরাদের পায়ের নিচে। আর আপনি কিনা বলছেন কাব্যিক প্রতিশোধ নিয়েছে নিয়তি। এত সব ক্ষয়ক্ষতির একমাত্র কারণ আপনাদের দুজনের শত্রুতা, বুঝতে পারছেন?
কারো প্রতি শত্রুতার বশবর্তী হয়ে আমি কিছু করিনি। যা করেছি, কেন করেছি, তা আপনিও জানেন। ওখানে শত্রুতার লেশমাত্র ছিল না। আমার দৃষ্টিতে আমি সঠিক কাজটিই করেছি। অবশ্য হিজ হাইনেসের দৃষ্টিতে আমার কাজটা সঠিক মনে না-ও হতে পারে। তবে এখন আপনার হাতে আছি আমি, বলে থামল প্রসপেরো।
জবাবে গম্ভীর কণ্ঠে প্রিন্স বলল, আমাকে গভীরভাবে ভাবতে হবে, বলে চলে গেল সে।
এই ঘটনার এক ঘণ্টা পার হবারও আগে আবার ডাক পড়ল পসপেরোর। এবার অবশ্য আরেকজন অপরিচিত লোকও আছে। ওদের জানানো হলো ওই লোকটি একজন ফ্রেঞ্চ শিপমাস্টার। এই মাত্র নেপলসে ল্যাণ্ড করেছে সে। লোকটা খবর নিয়ে এসেছে, দুই দিন আগে সার্ডিনিয়ার পশ্চিম উপকূলের শখানেক মাইল দূরে অনেকগুলো গ্যালির শক্তিশালী একটা ফ্লিট দেখে এসেছে সে। তার বিশ্বাস ওগুলো কোর্সেয়ার ফ্লিটের গ্যালি।
খবরটা মুষড়ে দিল ভাইসরয়কে। তার ধারণা স্পেনের উপকূলের দিকে এগিয়ে আসছে দ্রাগুতের ফ্লিট। তখন বাস্তবমুখী একটা প্রস্তাব নিয়ে এগিয়ে এল প্রসপেরো। বলল, দ্রাগুতের গন্তব্য যা-ই হোক, আফ্রিকার উপকূলে সে পৌঁছনোর আগেই তার উপর আমাদের আক্রমণ করা উচিত।
ওদিকে প্রসপেরোর কথা শুনে ভাইসরয় প্রায় হুঙ্কার দিয়ে বলল, আমাদের হাতে আক্রমণ করার মত অস্ত্রশস্ত্র আছেটা কী? সব নিয়ে জেরার মুখে বা তার আশপাশে বসে আছে ডোরিয়া। এক সপ্তাহ লাগবে তার কাছে খবর পাঠাতে। আরো এক সপ্তাহ লাগবে ডোরিয়ার ফিরে আসতে। আর এই বিষয়টা দ্রাগুত আমাদের চেয়ে ভালভাবেই বুঝতে পেরেছে বলেই একের পর এক শহর আক্রমণ করে চলেছে সে। এবার তো বুঝতে পেরেছেন কত বড় সর্বনাশ করেছেন আপনি? প্রসপেরোকে বলল সে।
জবাবে নির্লিপ্ত ভঙ্গিতে প্রসপেরো বলল, আমি ভাবছিলাম, কী করতে হবে সে ব্যাপারে বুঝি আমার কিছু দায়িত্ব আছে।
কী করার আছে? জিজ্ঞেস করল ভাইসরয়।
অবশ্য আমাকে যদি বিশ্বাসই করা না হয়, তাহলে কী-ই বা বলার থাকে…
আমাদের হাতে এই মুহূর্তে যা আছে তা দিয়েই বা কী করা সম্ভব? হতাশাভরে কথাগুলো বলে ফ্রেঞ্চ শিপমাস্টারের দিকে ফিরে দাঁড়াল প্রিন্স অভ অরেঞ্জ। জিজ্ঞেস করল, কোর্সেয়ার ফ্লিটের শক্তি কেমন দেখেছেন?
গ্যালি আর গ্যালিয়ট মিলিয়ে সাতাশটা জাহাজ গুনেছি। সেগুলোর বাইশটাই ছিল বিশালাকার ওয়ার গ্যালি।
প্রসপেরোর দিকে ঘুরে দাঁড়াল প্রিন্স। হা, ঈশ্বর! শুনেছেন, প্রসপেরো? আর আপনি যেন কী প্রস্তাব করেছিলেন? হাহ্, আমাদের হাতে মোট গ্যালিই আছে এখন তেরোটা। এই নগণ্য শক্তি নিয়ে কী করবেন বলে ভাবছেন? এই দিয়ে লড়তে গেলে নিজেরা ধ্বংস হওয়া ছাড়া আর কিছুই হবে না।
জবাবে শীতল কণ্ঠে প্রসপেরো বলল, এই শক্তি দিয়েও দ্রাগুতকে একটা শক্ত কামড় দিতে পারি আমরা। তখন নিজের ধ্বংস না চাইলে এদিকে আবার আসার আগে কয়েকবার ভেবে দেখতে বাধ্য হবে সে। এটাকে কি কম পাওয়া বলে মনে হচ্ছে আপনার?
সশব্দে একবার শ্বাস ফেলল আলভারো। তার দিকে বিরক্ত দৃষ্টিতে তাকিয়ে প্রসপেরোকে প্রিন্স প্রশ্ন করল, নিয়াপলিটান ফ্লিট কুরবানি দিতে চাইছেন আপনি?
পরিস্থিতি যেহেতু তেমনই গম্ভীর, তাহলে চাইব না কেন? এতে লাভ যে হবে না, তা তো নয়। জরুরি মুহূর্তে এটাও একটা জরুরি রণকৌশল, বলল প্রসপেরো।
কথাটা প্রিন্সের মাথায় ঢুকেছে। ধীরে ধীরে সে-ও স্বীকার করল, হ্যাঁ, এটা করা যেতে পারে। তারপর শিপমাস্টারকে বিদায় করে দিল সে। অস্বস্তিভরে বলল, কিন্তু…এমন একটা কৌশল ব্যবহারের অনুমতি যদি আমি দিই, তারপরেও কথা থেকে যায়। কথা হচ্ছে, ফ্লিটের কমাণ্ড কার হাতে দেব? নিশ্চিত মৃত্যুর মুখে গিয়ে পড়তে কাকে হুকুম করব আমি?
প্রসপেরো তখন বলল, মৃত্যু যে-কোন সময়ই আসতে পারে। একে এড়ানো কারো পক্ষেই সম্ভব না।
ওর কথায় সায় দিয়ে মাথা ঝকাল আলভারো। বলল, যুদ্ধে নামলে অনেক ঘটনাই ঘটতে পারে। আগে থেকে কিছু বলা সম্ভব না।
উঠে দাঁড়াল প্রসপেরো। গাম্ভীর্যের সঙ্গে বলল, কমাণ্ড আমার হাতে তুলে দিন। এতে অন্তত আপনার দৃষ্টিতে আমার কৃত অপকর্মের কিছুটা হলেও প্রায়শ্চিত্ত হবে।
তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল প্রিন্স। বলল, আপনাকে খুব আত্মবিশ্বাসী মনে হচ্ছে, স্যর প্রসপেরো।
আমার কাজের দায় থেকে দায়িত্বটা নিতে চাইছি। হিজ হাইনেস বলছেন, এদিকে দ্রাগুতের আসতে পারাটা আমার কৃতকর্মের ফল। তাহলে ওই ক্ষতি যতটা সম্ভব পূরণ করার চেষ্টা করাও আমার দায়িত্ব, বলল প্রসপেরো।
চেয়ারে বসে হাতে মাথা রাখল প্রিন্স। কিছুক্ষণ চিন্তা করার পর আলভারোর দিকে তাকাল সে। বলল, আপনি কী বলেন, আলভারো? সর্বোপরি, নিয়াপলিটান ফ্লিটের কমাণ্ডার এখন আপনি।
অত্যন্ত ভদ্ৰতাভরে ডন বলল, যেহেতু ডন প্রসপেরো ফিরে এসেছে, তাই আমি আর এই ফ্লিটের কমাণ্ডার নই। ফ্লিটের অর্ধেক গ্যালিই মেসার প্রসপেরোর নিজের সম্পত্তি। ওগুলো ধ্বংস হবার ঝুঁকিও সে নিচ্ছে। তবে হিজ হাইনেস অনুমতি দিলে এই অভিযানে গর্বের সঙ্গে ডন প্রসপেরোর সঙ্গী হব আমি।
আপনিও একই কথা বলছেন? বিশ্বাস করতে পারছে না যেন প্রিন্স অভ অরেঞ্জ।
অনেক, অনেক সম্মান নিয়ে ফিরব আমরা। আপনার সঙ্গে কাজ করার সুযোগ পেয়ে গর্বিত বোধ করছি, মেসার প্রসপেরো, বলল আলভারো।
জবাবে আলভারোকে প্রসপেরো বলল, আমার চেয়ে বেশি গর্বিত আপনি নন। কারণ আপনার সঙ্গে কাজ করা আর আপনার পরামর্শ পাবার সৌভাগ্য পেয়েছি আমি।
ওদেরকে এমন আত্মবিশ্বাসী দেখে দ্বিধাগ্রস্ত প্রিন্সের তিক্ত হয়ে থাকা মেজাজ আরো তেতো হয়ে গেল। দুজনেই একমত? বাহ, খুব ভাল! কিন্তু আমাকে আরো ভাবতে হবে। কারণ আপনাদের বাজির পরিমাণ বিশাল।
নষ্ট করার মত একমুহূর্তও সময় নেই, হাইনেস। কারণ একমুহূর্ত সময় নষ্ট করা মানে আত্মসমর্পণের দিকে এক কদম এগিয়ে যাওয়া। আজকের মত আর কখনো এত দ্রুত সিদ্ধান্ত দেয়ার মত পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়নি, মাই লর্ড। এদিকে আমরা ভেবে সময় নষ্ট করব আর ওদিকে প্রতিমুহূর্তে আমাদের দিকে এগিয়ে আসতে থাকবে দ্রাগুত। আজই জাহাজ ভাসাতে হবে, এতে ভাবাভাবির কিছু নেই।
আলভারোর বক্তব্যে প্রসপেরো এমন জোরালো সমর্থন দিল যে, ভাইসরয়ের কথা আর হালে পানি পেল না। এরপরই ওরা বেরিয়ে গেল যথাযথ প্রস্তুতি নেয়ার কাজে। জাহাজে লোক-লস্কর, পর্যাপ্ত সাপ্লাই ও গোলা-বারুদের মজুত তোলা হলো অত্যন্ত দ্রুততার সঙ্গে। ঠিক হলো সেদিন বিকেলেই স্ট্রেইট অভ বোনিফেসের উদ্দেশে উত্তর-পশ্চিমমুখী কোর্সে রওনা হবে নিয়াপলিটান ফ্লিট।
প্রিন্স অভ অরেঞ্জ ও তার বোন কাউন্টেস অভ নাসাউ-এর জিম্মায় আছে জিয়ান্না। কাউন্টেসের সঙ্গে একটা রাজকীয় অ্যাপার্টমেন্ট দেয়া হয়েছে ওকে। এই অ্যাপার্টমেন্টে আগে বাস করত ডেল ভাস্টো।
বিদায় নেয়ার জন্য জিয়ান্নার সঙ্গে দেখা করতে ওখানেই গেল প্রসপেরো। কথাবার্তার এক পর্যায়ে জিয়ান্না বলল, অনেক বড় বিপদের মুখে যাচ্ছ তুমি।
হ্যাঁ, তবে বিপদের মুখোমুখি হওয়া আমার জন্য নতুন কিছু নয়, বলল প্রসপেরো।
কাতরে উঠল জিয়ান্না। বলল, কিন্তু আগে কখনো এমন ভয়াবহ ঝুঁকি মাথায় নিয়ে কাজে নামোনি তুমি। দ্রাগুতের নতুন ফ্লিটের শক্তির কথা আমিও শুনেছি। সম্ভব হলে তোমাকে যেতে দিতাম না। কিন্তু আমিও মেনে নিয়েছি, তা সম্ভব নয়। পরিস্থিতির কারণে আমাদের দুজনকেই মেনে নিতে হচ্ছে সব। জিয়ান্নার চেহারা থেকে নির্লিপ্ততার মুখোশটা একটু আলগা হয়ে গেল। তোমার প্রতিশোধের আগুন, আজ আমাদের কোথায় নিয়ে এসেছে দেখতে পাচ্ছ? আন্দ্রের ধ্বংস দেখার শপথ করেছিলে তুমি। কিন্তু তার প্রতিক্রিয়া আজ আমাদেরও সইতে হচ্ছে।
প্রিন্সকে যা বলেছিল জিয়ান্নাকেও তা-ই বলল প্রসপেরো। ডোরিয়া পরিস্থিতির শিকার। আমি পরিকল্পনা করে তার বিরুদ্ধে কিছুই করিনি।
কিন্তু যা হয়েছে তা কি তুমি ফেরাতে পারবে, প্রসপেরো?
যা হয়ে গেছে তা কারো পক্ষেই ফেরানো সম্ভব নয়। তবে সুযোগ পেলে ডোরিয়ার সঙ্গে আবার সন্ধি করার চেষ্টা করব আমি।
অনেক দেরি হয়ে গেছে, প্রিয়। এখন যা করতে যাচ্ছ সেটাই করার মত একমাত্র কাজ। যদিও খুব ভয় হচ্ছে যে হয়তো তোমাকে চিরতরে হারাব, তবুও এই অভিযানে আপত্তি করব না। কারণ এই অভিযানের মাধ্যমেই হয়তো আগের কাজটার দায়মুক্তি পাবে তুমি।
একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে প্রসপেরেরা বলল, দায়মুক্তি পাব কিনা তা ভবিষ্যতেই জানা যাবে। এটা আমার ইচ্ছার উপর নির্ভর করছে না। যা করতে যাচ্ছি তাতে হয়তো আমার হৃত সম্মান খানিকটা ফিরে পাব। নইলে তার চেয়েও বড় কিছু হারাতে হতে পারে।
এখন হারানোর মত আর আছেটা কী?
তুমি, জিয়ান্না। তোমাকে হারাতে হতে পারে।
একটু হাসল জিয়ান্না। বলল, তোমার কি ধারণা যে, অন্যরা তোমাকে নিয়ে কী বলল আমি তার পরোয়া করি? আমার চোখে কখনোই তুমি অসম্মানের পাত্র না। যা-ই ঘটুক, যতদিন পরেই তুমি আসো না কেন, আমি তোমার অপেক্ষায় থাকব।
ওকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরল প্রসপেরো। বলল, সাহসী মেয়ে। খুব শীঘ্রিই ফিরব আমি। বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে, তোমার উপর আমার দাবি প্রতিষ্ঠা করতে আসব। আমার সবকিছু বাজি ধরেছি। এখন আমাকে জেতার জন্যই খেলতে হবে। এই খেলায় আমার হারার সুযোগ নেই।
কিন্তু তুমি যদি… আর বলতে পারল না জিয়ান্না। কারণ প্রসপেরো ওর মুখের কথা কেড়ে নিয়েছে। ও বলল, যদি আমি ফিরে না…নাহ্ এই বিষয়টা নিয়ে আমরা ভাবব না। আমি জিততে না পারলে ধরে নেব আমি তোমার উপযুক্ত নই।
কিন্তু এসব মন ভোলানো কথায় ভুলবার পাত্রী জিয়ান্না নয়। প্রসপেরো যখন বলেছিল যে ও সবকিছু বাজির পাল্লায় তুলে দিয়েছে, তখনই জিয়ান্না বুঝেছিল যে, ফিরতে না পারার কথাই বুঝিয়েছে প্রসপেরো।
জিয়ান্না জানে, আজই হয়তো শেষবারের মত দেখছে ওর খুব প্রিয় এই মানুষটাকে। জোর করে কান্না ঠেকিয়ে রেখেছে জিয়ান্না। গম্ভীর হয়ে আছে ওর চেহারা। বলল, তোমাকে নিয়ে আজকের চেয়ে বেশি গর্বিত আর কখনো হইনি, প্রসপেরো। তুমি ফিরে না আসা পর্যন্ত আমি প্রার্থনা থেকে উঠব না।
প্রার্থনার চেয়ে শক্তিশালী আর কোন ঢাল নেই। আমি তোমার প্রার্থনায় বিশ্বাস রাখছি। তুমিও আমার জন্য সৌভাগ্য প্রার্থনা কোরো, বলল প্রসপেরো। তারপর শেষবারের মত জিয়ান্নাকে জড়িয়ে ধরল প্রসপেরো। পরমুহূর্তেই এমনভাবে নিজেকে ছাড়িয়ে নিল যেন মামুলি একটা কাজে বাইরে যাচ্ছে। একটু পরই আবার ফিরে আসবে ও।
সূর্য অস্ত যাচ্ছে। মাল্লাদের দাঁড়ের টানে পসিলিপোর হেডল্যাণ্ডের পাশ ঘেঁষে এগিয়ে যাচ্ছে ছোট্ট নিয়াপলিটান ফ্লিট। অত্যন্ত বিষণ্ণ মনে ক্যাপিটানার টিবারনাকলে বসে আছে প্রসপেরো। জিয়ান্নার সঙ্গে দেখা করার সময় যে আত্মবিশ্বাস ও দেখিয়েছিল তার কিছুই এখন আর ওর ভিতর অবশিষ্ট নেই। ওখানে জায়গা নিয়েছে বিষণ্ণতা আর তিক্ততা।
জিয়ান্নার কাছ থেকে বিদায় নেয়ার সময়টার কথা ভাবছে প্রসপেরো। ও খুব ভালভাবেই জানে বিরাট কোন অলৌকিক ঘটনা না ঘটলে জীবিত ফিরে আসার বা জিয়ান্নাকে আবার দেখতে পাবার কোন সম্ভাবনা ওর নেই।
ভারী পদক্ষেপের শব্দ কানে এল প্রসপেরোর। পরক্ষণেই টিবারনাকলের প্রবেশমুখে দেখা দিল আলভারোর বিশাল শরীর। একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে আলভারোকে ও বলল, সৈনিকের জীবনে প্রেম থাকা উচিত নয়। কারণ তখন জীবনটাকে খুব কাঙ্ক্ষিত মনে হয়। তখন আর সহজে ঝুঁকি নিয়ে কাজ করা যায় না, বলল প্রসপেরো।
জবাবে আলভারো বলল, কিন্তু প্রেম একজন সৈনিকের মন এমন শক্তিশালী করে তোলে যে ফিরে আসার জন্য সবকিছুর বিরুদ্ধে লড়তে পারে সে। পথ চলতে গিয়ে এই শিক্ষাই পেয়েছি আমি। আর আমার মনে হয়, এই শিক্ষাটাই মেসার দ্রাগুতকে দিতে যাচ্ছেন আপনি। প্রিন্স হয়তো ভাবছেন আমাদেরকে আত্মহত্যার অনুমতি দিয়েছেন তিনি। কিন্তু আমি জানি, ডন প্রসপেরো, সফলতার পথে চলেছি আমরা।