১৬. সিদ্ধান্ত
চাচা কার্ডিনাল জিয়োজ্জিনের সঙ্গে কার্ডিনালস গার্ডেনে শতাব্দী-প্রাচীন বক্সউড হেজের পাশ দিয়ে হাঁটছে প্রসপেরো। গতদিন তার কথা শোনার পর থেকে ভীষণ উথালপাথাল করছে প্রসপেরোর মন। ও স্পষ্ট বুঝতে পারছে মন শান্ত করতে হলে কার্ডিনালের সঙ্গে মন খুলে কথা বলা ছাড়া উপায় নেই। তাই দ্বিধা না করে চলে এসেছে তার কাছে। এবং তার কাছে কনফেস করেছে (কনফেস: খ্রিস্ট ধর্মমতে কারো কাছে পাপের স্বীকারোক্তি দেয়া। সাধারণত ধর্মীয় ব্যক্তিত্ব, যেমন ফাদার বা প্রিস্ট বা কার্ডিনাল-এদের কাছেই স্বীকারোক্তি দেয়া হয়।)।
কনফেস দেয়া হয়ে গেলেও কথা হচ্ছে কনফেসের বিষয়বস্তু নিয়েই। কার্ডিনাল বলল, বাছা, প্রতিশোধের ইচ্ছা মানেই পাপচিন্তা। এই চিন্তা মন থেকে বাদ দেয়ার আগে তোমার জন্য ক্ষমার নিশ্চয়তা কেউ দিতে পারবে না।
জবাবে প্রসপেরো বলল, কিন্তু কোনভাবেই প্রতিশোধের চিন্তা বাদ দিতে পারছি না। কারণ তাতে যে অসম্মানের বোঝা মাথায় চাপছে।
প্রসপেরো আশা করছে ব্যাপারটা নিয়ে আরেকটু আলাপ করবে। কিন্তু ওর আশার গুড়ে বালি ঢেলে কার্ডিনাল বলল, তোমার চিন্তা পুরোপুরি মানবিক। কিন্তু আমার কাজ ঈশ্বরকে নিয়ে। যতদিন তুমি প্রতিশোধের ইচ্ছা বাদ না দিচ্ছ ততদিন তোমার জন্য আর কোন আশার বাণী আমি শোনাতে পারছি না।
কার্ডিনাল হিসেবে সত্যিই এর বেশি কিছু করার ছিল না তার। কিন্তু সাধারণ একজন মানুষ হিসেবে হয়তো একটু সাহায্য সে করতে পারে। তাই ওরা দুজন বাগানে পায়চারী করতে করতে কথা বলছে। কার্ডিনাল প্রসপেরোক্টে বলল, যে জালে তুমি ফেঁসেছ, প্রসপেরো, তার থেকে মুক্তির সহজ কোন উপায় আমি দেখতে পাচ্ছি না। তবে হ্যাঁ, যদি ঈশ্বরের ইচ্ছার কাছে নিজেকে সমর্পণ করো তাহলে সহজ একটা রাস্তা আছে বটে। মানুষ তোমাকে যা-ই বলুক, ঈশ্বরের দৃষ্টিতে তুমি নিরপরাধী হতে পারবে। সেটা যদি তোমার ভালবাসা পাওয়ার জন্যও হয়, সম্ভবত তবুও। কিন্তু আসল কথা হচ্ছে সিদ্ধান্ত তোমার হাতে। মনে রেখো, পাপকে ঘৃণা করবে। কিন্তু সেটা ঘৃণ্য, সেজন্য নয়। বরং সেটা তোমার মুক্তির পথে দাঁড়িয়ে আছে সেজন্য।
প্রসপেরো বলল, কিন্তু সমস্যা হচ্ছে, আমি এমন একটা জায়গায় দাঁড়িয়ে আছি যেখান থেকে ক্ষমার পথ আর প্রতিশোধের পথ বিপরীত দিকে চলে গেছে। ওদেরকে ক্ষমা করে দিলে সেটা আসলে প্রতিশোধের ইচ্ছায় ক্ষান্ত দেয়া হবে না। সেটা হবে আমার বাবাকে ন্যায্য বিচার থেকে বঞ্চিত করা। আমার শান্তিও নষ্ট হয়ে যাবে চিরতরে। এখন এই দুটো থেকে কোন্ পথ বেছে নেব, সেটাই আসল সমস্যা।
কার্ডিনাল তখন বলল, সেই তো আমার কথাই বললে। শুধু একটু ঘুরিয়ে বললে। প্রতিশোধের চিন্তা বাদ দিলে তবেই না বিকল্প একটা পথ তোমার সামনে খুলবে, তাই না?
ইয়োর এমিনেন্স একইসঙ্গে একজন প্রিস্ট ও একজন অ্যাডর্নো। একজন অ্যাডর্নো হিসেবে বলুন আমার ইচ্ছাটা কি স্রেফ প্রতিশোধ? আর কিছু কি দেখতে পাচ্ছেন না?
পবিত্র বইয়ে লেখা আছে: ঈশ্বর বলছেন, আমার জন্য প্রতিশোধের ইচ্ছা বাদ দাও।
এটা তো প্রিস্টের বক্তব্য। আমি জানতে চেয়েছি আপনার ভিতরের অ্যাডর্নো ঘরের মানুষটার বিচারের কথা।
না, ঈশ্বরেরবিধিই শেষ কথা, বাছা।
আমাকে বিশ্বাস করতে বলছেন যে প্রিস্ট না হলে, এমন একটা কাজ করার পরও ডোরিয়াদের আপনি ক্ষমা করে দিতেন?
অমায়িক একটা হাসি ফুটে উঠল কার্ডিনালের মুখে। হাসিমুখেই সে বলল, তা হয়তো দিতাম না। কিন্তু কোন সন্দেহ নেই যে, সেটা অবশ্যই ভুল হত। কিন্তু, প্রিস্ট হই বা না হই, আমি একজন অ্যাডর্নো। তোমার বাবার আপন ভাই, তোমার চাচা আমি। তারপরও শপথ করে বলতে পারি, আমার ভিতর প্রতিশোধ নেয়ার বিন্দুমাত্র ইচ্ছাও নেই। ডোরিয়াদের রক্ত আমি দেখতে চাই না। আমরা মানুষরা আসলে খুব দুর্বল আর জিঘাংসা নামের প্রবৃত্তির দাস। কিন্তু তারপরও বলব সবল বা দুর্বল যা-ই হই না কেন, যার হাতে রক্ত লাগল সে নিজেই সেজন্য দায়ী। এর জন্য অবশ্যই তাকে মূল্য চুকাতে হবে। সেই জন্যই বলছি, প্রতিশোধ নিয়ে রক্ত দিয়ে হাত রাঙানোর তৃষ্ণা আমার নেই।
কার্ডিনালের কথা শুনে থমকে দাঁড়াল প্রসপেরো। বলল, কিন্তু রক্তের দায়ও কি নেই?
প্রসপেরোর সঙ্গে দাঁড়িয়ে পড়ল কার্ডিনালও। দুই কদম সামনে বেড়ে পাশের ফুল গাছ থেকে একটা ফুল ছিঁড়ে নিল সে। ওটার উপর জমে থাকা শিশিরবিন্দুটা তখনও একটা হীরের মত চমকাচ্ছে। শিশিরের ফোঁটাটা ঝেড়ে ফেলে ফুলটার ঘ্রাণ নিল সে। তারপর বলল, আমার মতে তোমার উপর রক্তের দায়ও নেই। আর ডোরিয়ারা তোমার বাবার পিছনে আততায়ী লেলিয়ে দিয়েছিল এটা গুজব, অতিকথন। আমার মতে অ্যান্টোনিওট্টোর মৃত্যুর কারণ হচ্ছে, ডোরিয়াদের পদক্ষেপের অতি-প্রতিক্রিয়া। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, ডোরিয়াদের পদক্ষেপগুলোর টার্গেট ও ছিল কিনা বা ওকে মেরে ফেলার ইচ্ছা ওদের ছিল কিনা। আমার মনে হয় না ওকে ক্ষমতা থেকে সরানোর ইচ্ছা ডোরিয়ার ছিল। আমার জানামতে, ডোরিয়ার ইচ্ছা ছিল ওকে বাঁচানো। তোমরা পালিয়ে যাওয়ার পরই ডোরিয়া তার বাহিনীকে বন্দরে নিয়ে আসে।
বাবাকে বাঁচাতে? হতভম্ব হয়ে প্রশ্ন করল প্রসপেরো।
নয়তো কী? ওকে মারতে চাইলে তখনই আন্দ্রে পদক্ষেপ নিতে পারত।
চাইলেও কথাটা মানতে বাধ্য হলো প্রসপেরো। ওর মনে পড়ে গেল যে, ডোরিয়া ওদেরকে এসকর্ট করে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার প্রস্তাবও দিয়েছিল। সেটাও কার্ডিনালকে বলল ও। আরো বলল, কেউ একবারও আমাকে বলেনি যে, আন্দ্রে কথা দিয়ে কথা রাখে। কিন্তু কেন?
কার্ডিনাল একবার হাসল শুধু। তারপর বলল, ডোরিয়ার প্রতি তোমার ঘৃণা বাড়িয়ে দিয়েছে ডোরিয়ার শত্রুরা। তোমার ভিতরের প্রতিশোধের আগুন জ্বালিয়ে দিয়েছে তারাই।
কিন্তু ফ্রেগোসিদের সঙ্গে তার মিত্রতা কী করে ভুলি? আর বাবা মৃত্যুশয্যায় যা বলে গেছে সেটাই বা অগ্রাহ্য করি কীভাবে?
যুক্তি দিয়ে। আমরা আসলেই বিশ্বাস করতে পারি যে, জেনোয়াকে মুক্ত করার ইচ্ছা ডোরিয়ার ছিল। এবং সে বিশ্বাস করেছিল যে, ফ্রেঞ্চ রাজা ফ্রান্সিস এ কাজে তাকে সাহায্য করবে। কিন্তু পরে সাহায্য করার বদলে বেইমানি করে ফ্রান্সিস।
তখন প্রসপেরো বলল, এটা তো নিজের চামড়া বাঁচাতে ডোরিয়ার সাফাই। আপনি কথাটা বিশ্বাস করেন?
আমার বিশ্বাস এটাই সত্য। নিশ্চিত হওয়ার জন্য আমিও দুয়েকটা সুতোয় টান দিয়েছি, বলে একটু শুষ্ক হাসি হাসল সে। কারণ, শেষ পর্যন্ত আমিও একজন অ্যাডর্নো। তাই সত্য জানাটাকে আমিও নিজের কর্তব্য বলে মনে করেছি। আমার নিজস্ব উৎস থেকে তথ্যটা জেনেছি। প্রার্থনা করি এটা যেন তোমারও কাজে লাগে।
আমি স্পষ্ট প্রমাণ চাই।
ইতিবাচকভাবে মাথা নাড়ল হিজ এমিনেন্স। বলল, খোঁজ করো। ঈশ্বর নিশ্চয়ই তোমাকে সাহায্য করবেন। তখন মন থেকে হিংসাত্মক চিন্তা দূর হবে আর তুমি যা চাইছ, তা পাবে। ঈশ্বরও তখন তোমাকে শান্তি দেবেন ও ক্ষমা করবেন।
তবে, শান্তির দেখা পাওয়া অত সহজ না। কারণ ওর আর ডোরিয়ার মধ্যে দাঁড়িয়ে আছে জিয়ান্না। ডোরিয়ার সঙ্গে ও একরকম খেলা খেলছে আর জিয়ান্নার সঙ্গে আরেক রকম। জিয়ান্নাকে ও কথা দিয়েছে বটে, কিন্তু অভিযানে নেমে গেলে কী হবে তার নিশ্চয়তা দেবার ক্ষমতা কারোরই নেই। কারণ ভবিষ্যতে কী হবে তা ভবিষ্যতের গর্ভেই লুকানো আছে।
প্রসপেরো ভাবছে কার্ডিনালের বক্তব্য নিয়ে। তার মতে, ওর উপর রক্তের শোধ গ্রহণের দায় নেই। কিন্তু কিছু ব্যাপার সামনে নিয়ে এলে একথায় বিশ্বাস রাখাটা কঠিন হয়ে যায়। যেমন ওর, প্রতি ফিলিপ্পিনোর অতি প্রতিহিংসাসুলভ মনোভাব, ওকে শেকলে বেঁধে সাধারণ মাল্লাদের সঙ্গে দাঁড় টানতে বাধ্য করা, ইত্যাদি। তবে ব্যাপারটাকে আরেকভাবে দেখা যেতে পারে। যেমন ফিলিপ্পিনো হয়তো ভেবে থাকতে পারে, প্রসপেরো মুক্তি পেলে ওর উপর প্রতিশোধ নেবে, তাই আগে থেকেই যতটা সম্ভব দমিয়ে রাখার বেপরোয়া চেষ্টা করেছে সে।
পরদিন সকালের কথা। সম্রাটের জাহাজ-বহরকে স্বাগত জানিয়ে এগিয়ে নিয়ে এল চমৎকারভাবে সুসজ্জিত গ্যালি আর স্টিমারের বহর। মুহুর্মুহুঃ তোপধ্বনি, জনতার হর্ষধ্বনি ও করতালির মধ্য দিয়ে জেনোয়ার মাটিতে গা ঠেকাল স্পেনের সম্রাট পঞ্চম চার্লসের জাহাজ-বহর।
সম্রাটকে স্বাগত জানানোর জন্য রিপা-র পুরো রাস্তা ধরে দাঁড়িয়ে গেছে জেনোয়াবাসীদের লম্বা লাইন। তাদের সবার গায়ে চকচক করছে স্বর্ণ আর রূপার তৈরি নানারকম গহনা। বেশিরভাগের হাতেই সম্রাটকে স্বাগত জানিয়ে লেখা ব্যানার বা পতাকা।
গালিচা বিছানো কয়েক ধাপ সিঁড়ি বেয়ে নিচে নেমে এলেন তরুণ সম্রাট। তাঁকে স্বাগত জানাতে বেজে উঠল বিশেষ ট্রাম্পেট। সম্রাটের অপেক্ষায় সেনসরদের সঙ্গে নিয়ে সিঁড়ির ধাপের পাশে দাঁড়িয়ে আছে ডোরিয়া। নবনিযুক্ত ডজও আছে তার সঙ্গে। তার গায়ের স্বর্ণসুতোয় কারুকার্যখচিত পোশাক রীতিমত চকচক করছে। যা হোক, সম্রাট পা বাড়াতেই একতালে বেজে উঠল অনেকগুলো ট্রাম্পেট।
গম্ভীর সম্রাটের পরনের পোশাক আপাদমস্তক কালো। অলঙ্কার বলতে একটা মাত্র ফ্লিস (Fleece)। বুকের উপর নিষ্প্রভ নীল রঙের একটা রিবন আর উঁচু কলারে মুক্তোর বোতাম। চমৎকার শারীরিক কাঠামোর অধিকারী স্পেন সম্রাট। তার ইউরোপিয়ান-সুলভ লম্বা পা রীতিমত গর্বের বিষয়। লম্বাটে মুখখানা অসুস্থকর বিবর্ণ। জোড়া লুকানো চওড়া ভেলভেট হ্যাঁটের আড়ালে। চোখের দৃষ্টিতে ফুটে আছে অমার্জিত ঔদ্ধত্য। সম্রাটের চোখ দুটো খুব কম সময়ই পুরোপুরি প্রকাশ পায়। যখন প্রকাশ পায় তখন দেখা যায় উজ্জ্বল দুই চোখে ফুটে আছে দাপুটে একটা ভাব। তার চেহারার আরেকটা লক্ষণীয় বৈশিষ্ট্য তার নাক। হুকের মত বাঁকা নাকটা পাশেও খানিকটা বেঁকে আছে বলে মনে হয়। থুতনিতে চোখা করে হেঁটে রাখা দাড়ি আর অসামঞ্জস্যপূর্ণ পাতলা ঠোঁট-সব মিলিয়ে তার চেহারায় ফুটে থাকে নিরুদ্দীপ্ত, আবেগহীন একটা ভাব।
যা হোক, মাটিতে পা রাখলেন সম্রাট। তারপর ডোরিয়াকে ইশারা করলেন হাঁটু গেড়ে বসে থাকা অবস্থা থেকে উঠে দাঁড়াতে। জেনোয়ার আর্চ বিশপ ল্যাটিন ভাষায় স্বাগত জানাল সম্রাটকে। পাল্টা বক্তব্য দেয়ার জন্য তার দুই পাশে দাঁড়িয়ে থাকা দুই সভাসদের চেয়ে একটু এগিয়ে এলেন সম্রাট। ওই দুজনের একজন কার্ডিনাল গার্সিয়া ডি লয়াসা। সাধারণত এর কাছেই নিজের যাবতীয় কাজের কনফেস করেন সম্রাট। আর অপরজন কেতাদুরস্ত ডেল ভাস্টো। একটু এদিক-ওদিক তাকাতেই ডেল ভাস্টোর চোখ পড়ল প্রসপেরোর উপর। সামান্য একটু হেসে প্রসপেরোকে ছোট্ট করে সম্ভাষণ করল সে। ওদিকে নাকী স্বরে খানিকটা অসামঞ্জস্যপূর্ণ ও এলোমেলো বক্তব্য দিলেন সম্রাট।
নিজের লোকদের সঙ্গে সংক্ষেপে সম্রাটকে পরিচয় করিয়ে দিল ডোরিয়া। প্রথমে তার দুই ভাতিজা জিয়ানেট্রিনো আর ফিলিপ্পিনো, তারপর প্রসপেরোকে। বলতে ভুলল না যে সম্রাটের সেবায় সদাপ্রস্তুত নিয়াপলিটান স্কোয়াড্রনের কমাণ্ডার হচ্ছে প্রসপেরো। বলল, প্রসপেরো ইতিমধ্যেই সম্রাটের সুনজরে আছে।
জবাবে সম্রাট বললেন, ঈশ্বরের কৃপায় আমার সেবায় নিয়োজিত কেউ তার প্রাপ্য পাওনা থেকে বঞ্চিত হবে না, বলে সামনে এগিয়ে গেলেন সম্রাট। তখন এক কদম সামনে বেড়ে সম্রাটকে উদ্দেশ্য করে আলফোন্সে অভ অ্যাভালস বলল, সায়া (Sire), এ সেই অ্যাডর্নো যে প্রসিডায় মহান এক বিজয় অর্জন করে স্বয়ং সম্রাটের প্রশংসা অর্জন করেছিল।
আরেকবার প্রসপেরোর দিকে ফিরে তাকালেন সম্রাট। পূর্ণ দৃষ্টিতে তাকালেন ওর দিকে। বললেন, তাই তো, তাই তো, মনে করিয়ে দেয়ার জন্য ধন্যবাদ, মারকুইস। আপনাকে আমার অফিসারদের মধ্যে পেয়ে খুবই খুশি আমি, স্যর। আপনার আরো কিছু ভাল কাজের আশায় রইলাম আমরা।
তারপর ডজের সঙ্গে পরিচিত হয়ে তার সালাম নিলেন সম্রাট। তারপর তুলনামূলক নিম্ন পদাধিকারী গনফেলোনিয়ারদের কাছ থেকে সালাম নিতে এগিয়ে গেলেন তিনি। ওদিকে জেনোয়াবাসীরা ততক্ষণে গগনবিদারী শব্দে সম্রাটকে অভিবাদন জানাতে শুরু করেছে। জেনোয়িসদের চোখে স্পেন সম্রাট হচ্ছেন। তাদের উদ্ধারকর্তা, তাদের স্বাধীনতা আনয়নকারী মহান সম্রাট। যদিও সম্রাটের কানে ওদের স্বাগত চিৎকারটাকে শোনাচ্ছে কামান-বন্দুকের হুঙ্কারের মত। হালকা বেগুনি রঙের মখমলে কারুকার্যখচিত স্যাডল চাপানো হয়েছে একটা সাদা ঘোড়ার পিঠে। সেটায় চেপেই ক্যাথেড্রালের পথে রওনা হলেন সম্রাট। পুরো পথ জুড়ে মাথার উপর ঝুলতে দেখা গেল সম্রাটকে স্বাগত জানানো ব্যানার আর ফেস্টুন। জেনোয়ার মাটিতে সম্রাটের পদার্পণের জন্য তাকে আনুষ্ঠানিক স্বাগত ও ধন্যবাদ জানানো হলো। নিরাপদে এখানে পৌঁছতে পারায় ঈশ্বরকে ধন্যবাদ জানালেন সম্রাট। এরপরে ডিউকাল প্যালেসে জমকালো অনুষ্ঠানে গেলেন তিনি। সবশেষে রওনা হলেন ফসোলু প্রাসাদের দিকে।
সারা জেনোয়া উৎসব করেছে সেই রাতে। ওদিকে সম্রাটের সম্মানে ফলসালু প্রাসাদে বিশেষ ভোজের আয়োজন করা হয়েছে। ডিনারের পর পরিবেশিত হলো পুব দেশীয় একদল নাচিয়ের মনোমুগ্ধকর নাচ।
ডিনার টেবিলে জিয়ান্নাকে নিজের ডানপাশে নিয়ে বসল প্রসপেরো। আর অপর পাশে জায়গা করে নিয়েছে গুইস্টিনিয়ানি ঘরের এক সম্ভ্রান্ত মহিলা। তবে দুই মহিলাই আবিষ্কার করল ডিনার টেবিলে ভাল সঙ্গী নয় প্রসপেরো। এতে লেডি লিওনোরা ডি গুইস্টিনিয়ানির তেমন কোন সমস্যা হয়নি। কিন্তু রীতিমত বিপদেই পড়ে গেল জিয়ান্না।
জিয়ান্না বলল, জিয়ানেট্রিনোর কাছে শুনলাম, তীরে পা রেখেই নাকি তোমার খুব প্রশংসা করেছেন সম্রাট।
একটু যেন ব্যঙ্গ করেই প্রসপেরো বলল, জিয়ানেট্টিনো তাতে খুশি হয়েছে আশা করি।
কেন, তুমি নিজে খুশি হওনি? প্রশ্ন করল জিয়ান্না।
হ্যাঁ, অবশ্যই খুশি হয়েছি, বলল প্রসপেরো।
জিয়ানেটিনোর উপর তুমি নাখোশ হয়ে আছ যে?
জবাবে প্রসপেরো বলল, তোমার এই হাওয়া থেকে পাওয়া কাজিনরা সবসময়ই আমার প্রতি বিরূপ ধারণা পোষণ করে। তাহলে ওদের উপর আমার অসন্তুষ্টিকে দোষের বলে ভাবছ কেন?
কিন্তু তোমার প্রতি ওদের এই মনোভাব বাড়তে দিচ্ছ কেন? অতীতকে অতীতেই কবর দিয়ে দাও। সেটাই তো সবার জন্য মঙ্গলজনক।
অতীতকে কবর দিতে হলে বিরাট বড় একটা কবর লাগবে, বলল প্রসপেরো।
ওরাই তো তোমার হয়ে কবরের গর্ত করে রেখেছে। তোমার কাজ এখন সেখানে শুধু নামফলক লাগানো।
হয়তো নামফলকের ওই পাথরটা আমার জন্য একটু বেশিই ভারী, বলল প্রসপেরো।
জবাবে জিয়ান্না বলল, আমি তোমাকে সাহায্য করব। তারপর প্রসঙ্গ পরিবর্তন করল সে। প্রসপেরোকে সম্রাট প্রশংসা করেছেন, সেই প্রসঙ্গ তুলে বলল, সম্রাট তোমার প্রশংসা করেছেন শুনে আমার খুব গর্ব হয়েছে। তোমার হয়নি, প্রসপেরো?
হবে না কেন? অবশ্যই হয়েছে।
তাহলে, এমন মুখ গোমড়া করে বসে আছ কেন?
প্রসপেরো মনে মনে নিজেকেই ঘৃণা করতে লাগল। কারণ ওকে এখন ওর প্রিয় মানুষটার কাছে মিথ্যা কথা বলতে হবে। তবে যখন জিয়ান্নার দিকে চাইল তখন ওর চেহারায় তিক্ততার বিন্দুমাত্র আভাসও নেই। সফলভাবে অনুভূতিটা লুকিয়ে ফেলেছে ও। একগাল হাসি দিয়ে ও বলল, আগামী এক সপ্তাহের ভিতরই তোমাকে ছেড়ে সাগরে জাহাজ ভাসাতে হবে। তুমিই বলো এবার, কীভাবে খুশি থাকব?
শুনে জিয়ান্নার গালে একটু রক্তিম আভা ফুটল। তবে গম্ভীর গলায় সে বলল, এ-ই কারণ?
আমার মন খারাপ থাকার জন্য এটাই কি যথেষ্ট নয়?
ছোট্ট একটা দীর্ঘশ্বাস লুকাতে লুকাতে জিয়ান্না বলল, যদি তুমি বলো… কথাটায় মন্তব্যের চেয়ে আশ্বস্ত হওয়ার ইচ্ছা প্রকাশ পেল বেশি। পরে অনুষ্ঠানে একসঙ্গে নাচল ওরা। জিয়ান্নার পদক্ষেপে দুয়েকবার ভুল হলেও নিস্পৃহতার সঙ্গে সেটা শুধরে দিল প্রসপেরো। কিন্তু ওর মনের অবস্থা মোটেও ভাল হলো না। এমনকী ওর প্রতি সম্রাটের স্পষ্ট সমর্থনও ওর প্রফুল্লতা ফিরিয়ে আনতে ব্যর্থ হলো।
ওদিকে জেনোয়িসদের বেশিরভাগের দৃষ্টি ছিল ডেল স্টোর উপর। এর কারণ মূলত তার ভিন্ন ধরনের ব্যক্তিত্ব, সভাসদ হিসেবে তার সুনাম, আর সম্রাট পঞ্চম চার্লসের সঙ্গে তার ঘনিষ্ঠতা। যা হোক, প্রসপেরোকে সম্রাটের কাছে ডেকে নিয়ে গেল সে।
বিভিন্ন বিষয়ে প্রসপেরোর মন্তব্য জানতে চাইলেন সম্রাট। তিনি এমনকী প্রসিডার লড়াইয়ের কথাও তুললেন আবার। ওই লড়াই সম্বন্ধে আরো বিস্তারিত জানতে চাইলেন।
ফ্রেঞ্চ রাজের নাটুকে সৌজন্যের চেয়ে এই তরুণ স্প্যানিশ সম্রাটের আচার-আচরণ একদমই ভিন্ন। তিনি সাহসিকতার পূজারী। শক্তি আর সাহস দিয়েই এই তরুণ বয়সে এত বড় সাম্রাজ্য করেছেন। বলা হয়, পঞ্চম চার্লসের সাম্রাজ্যে কখনো সূর্য ডোবে না। সম্রাট নিজে সাহসিকতা পছন্দ করেন বলেই প্রসপেরোর সাহসিকতা আর ঝুঁকি নেয়ার সামর্থকে প্রশংসার চোখে দেখেন। আর এই ক্ষমতা আছে বলেই অত্যন্ত কুশলী জেনোয়িস নৌ-কমাণ্ডার ডোরিয়াকেও যে-কোন মূল্যে নিজের পক্ষে নিতে চেয়েছিলেন তিনি।
যা হোক, প্রসপেরোকে নিয়াপলিটান ফ্লিটের কমাণ্ডার হিসেবে নিয়োগ দেয়ার পর থেকে এখন পর্যন্ত ফ্লিটের লোকবল, জাহাজ সংখ্যা, সেগুলোর সক্ষমতা, রণসজ্জা, সাজ-সরঞ্জাম ইত্যাদি সম্বন্ধে জানতে চাইলেন সম্রাট। জানাল প্রসপেরো। এবং দেখতে পেল সম্রাটের বিস্মিত চেহারা। কারণ এত কম সময়ে এত কিছু করা মোটেও সহজ কথা নয়। এবং তার চেয়েও অবাক হলেন এই ভেবে যে, এই সাজ-সরঞ্জাম তার নিয়াপলিটান নাগরিকেরাই সরবরাহ করেছে।
এবার প্রসপেরো হাসল। বলল, না, মহামান্য। নিয়াপলিটান নাগরিকদের উপর অতিরিক্ত ব্যয় বা করের বোঝা আমি চাপাইনি। স্কোয়াড্রনের বারোটা গ্যালির মধ্যে সাতটাই আমার নিজের। এবং আমার নিজ খরচে লোকবল ও সাজ-সরঞ্জাম দ্বারা সজ্জিত।
শুনে কপালে উঠে গেল সম্রাটের ভ্র। তার চোখে তখন খেলে যাওয়া ছায়াটাকে ঠিক বন্ধুসুলভ বলা যাবে না। এবং ঠিক তখনই তাদের মাঝে নাক গলাল ডেল ভাস্টো। বলল, ডিউক অভ মেলফির মত আমাদের বন্ধু ক্যাপ্টেন প্রসপেরোও ইটালিয়ান রীতি-রেওয়াজ মেনে চলতে পছন্দ করে, সায়া।
সম্রাটের অসন্তুষ্টি প্রকাশ পাওয়ার আগেই তাকে সাবধান করতে কথাটা বলল অ্যাভালস। তখন–অনিচ্ছুক কণ্ঠে সম্রাট বললেন, ডিউক অভ মেলফির সঙ্গে তো তার গ্যালি আর সেরা সংক্রান্ত একটা চুক্তি আমাদের আছে। কিন্তু আপনার সঙ্গে তেমন কোন চুক্তি তো আমাদের নেই। আপনি কেবল একজন সাধারণ তালিকাভুক্ত নৌ-কমাণ্ডার।
জবাবে প্রসপেরো বলল, মাফ করবেন, সায়া। আপনার নামে আমার সঙ্গে চুক্তি করেছে হিজ হাইনেস, প্রিন্স অভ অরেঞ্জ। তাতে বলা আছে, আমার গ্যালি সহ আপনার সেবায় পাঁচ বছরের জন্য চুক্তিভুক্ত হয়েছি আমি। তবে আমার ইচ্ছা, যতদিন আমার পায়ের নিচে একটাও ডেক আছে ততদিন আপনার সেবা করে যাব আমি।
একটু নরম হলো সম্রাটের সুর। বললেন, যেভাবে শুরু করেছেন সেভাবে চললে আমিও তা-ই আশা করব।
আবারও তাদের মাঝে কথা বলল অ্যাভালস। বলল, আমালফির যুদ্ধে যদি প্রসপেরোর পরামর্শ শোনা হত, তাহলে আজ অবশ্যই ইতিহাস ভিন্নভাবে লেখা হত। এমনকী দুই ক্যাপ্টেন যদি কাপুরুষের মত পালিয়ে না গিয়ে ওর কথা শুনত তাহলেও ঘটনা ভিন্ন হত, আমি নিজে তার স্বাক্ষী।
কথাটা শুনে আমালফির যুদ্ধের ব্যাপারে আরো বিস্তারিত শুনতে চাইলেন সম্রাট। সব শুনে ভীষণ অবাক হলেন তিনি। বললেন, আজ সকালেই মাত্র আপনার কথা আমার কানে এসেছে। তবে ভাবিনি আমি এত সৌভাগ্যবান যে আমার ভাণ্ডারে এমন একটা রত্ন আছে। আমি জানতাম জেনোয়ার সেরা নৌ কমাণ্ডার আমার হাতে আছে। কিন্তু ধারণা ছিল না দ্বিতীয় সেরাও আমারই হাতে।
তখন হাসতে হাসতে অ্যাভালস বলল, সব শেষ হওয়ার আগেই এই দুজনের অবস্থানের পরিবর্তনও হতে পারে, সায়া।
কথাটা বেশ একটা খোঁচা মারল সম্রাটের ডোরিয়া প্রীতি-র গায়ে। তিনি মন্তব্য করলেন, অতিরিক্ত আশা করা বোকামি। যাক, আপাতত বর্তমান নিয়েই চিন্তা করি। তারপর প্রায় নির্বিকার কণ্ঠে বললেন, আপনি এখন যেতে পারেন, মাস্টার অ্যাডর্নো। প্রসপেরো তাকে বাউ করতেই বললেন, আমি আপনার কাছে ঋণী, মাস্টার অ্যাডর্নো। আপনার বাবার কাছেও ঋণী ছিলাম। ডিউক অভ মেলফি আমাকে মনে করিয়ে দিয়েছে যে আমার প্রতি তার আনুগত্যের কারণেই তাকে যন্ত্রণা সইতে হয়েছে। এসব আমি ভুলে যাইনি। এর প্রতিদান অবশ্যই দেয়া হবে।
সম্রাটের সঙ্গে এমন সপ্রশংস একটা মোলাকাতের পর দৃঢ় মনোবল নিয়ে প্রসপেরোর বের হওয়ার কথা। কিন্তু সত্যি বলতে, প্রসপেরোর ভিতর তেমন কিছুই হয়নি। আরেকটা ব্যাপার হচ্ছে, সম্রাট প্রসপেরোর বাবা অ্যান্টোনিওট্টো অ্যাডর্নোর আত্মদান সম্বন্ধে জেনেছেন ডোরিয়ার কাছ থেকে। এটাও প্রসপেরোর মনে আছে। প্রসপেরোর কার্ডিনাল চাচার বলা কথাগুলো মনে পড়ে গেল ওর। তিনি বলেছিলেন, ডোরিয়া যা করেছে পরিস্থিতির শিকার হয়ে করেছে। ফ্রান্সের রাজা ফ্রান্সিস যদি তার সঙ্গে বেইমানি না করত তাহলে এমন কিছু না-ও হতে পারত। আরেকটা চিন্তা প্রসপেরোর মাথায় খেলে গেল যে, অ্যাডর্নোদের সঙ্গে ডোরিয়াদের শত্রুতার শোধ তুলতে আর নিজের উচ্চাকাঙ্ক্ষা বাস্তবায়ন করতে সুপরিকল্পিত কোন খেলা খেলেছে কিনা ডোরিয়া। কিন্তু কোন স্থির সিদ্ধান্তে আসতে পারল না প্রসপেরো।
ওদিকে সম্রাট যতদিন জেনোয়ায় রইলেন, প্রতিদিনই প্রসপেরোর সম্মান বেড়েই চলল। ক্রমাগত চলতে থাকা আনন্দ উৎসবের মাঝেই বিশ্বস্ত লোকদের নিয়ে কয়েকটা জরুরি মিটিং করলেন সম্রাট। তেমনই এক মিটিং-এ ডাক পেল প্রসপেরো। মিটিংটা এতই জরুরি যে ডোরিয়া ছাড়া সেখানে উপস্থিত হওয়ার অনুমতি পেয়েছে আর মাত্র ছয়জন মানুষ। তাদের মধ্যে অবশ্য জিয়ানেট্টিনোও আছে। তবে ফিলিপ্পিনো এই মিটিং-এ ডাক পায়নি। এই আলোচনাটা মূলত সামনের অভিযান নিয়ে। যথারীতি তাতে সপ্রতিভভাবে নিজের ধারণা উপস্থাপন করল প্রসপেরো। এবং অবাক হয়ে ও লক্ষ করল যে ওর কথাকে ভদ্রতার সঙ্গে সমর্থন জানিয়ে যাচ্ছে স্বয়ং ডোরিয়া। স্বভাবসুলভ তির্যক মন্তব্য থেকে বিরত রইল জিয়ানেট্টিনো। প্রসপেরোর বক্তব্যে বেশ বোঝা যাচ্ছে যে ভবিষ্যতে আন্দ্রের জায়গা কেউ দখল করতে পারলে নিঃসন্দেহে সে হবে প্রসপেরো। প্রসপেরোর কথায় ডোরিয়ার মনে একটু হিংসার ভাব জাগলেও সেটাকে সে সুন্দরভাবে লুকিয়ে রেখেছে।
দুয়েক দিন পরের কথা। রাস্তায় একা পেয়ে প্রসপেরেরাকে ধরে বসল ওর কাজিন তার্দিও। ঝগড়ার ইচ্ছা নিয়ে ওর পথরোধ করেছে সে। বলল, ডোরিয়ার এত কাছের মানুষ হওয়ার ফল তোমাকে ভুগতেই হবে। পানির উপর লড়াই করে তুমি সম্মান নামের হাওয়াই মিঠাই আনছ, সেই পানিই একদিন তোমাকে সম্মানসুদ্ধ গিলে খাবে।
মৃদু হাসির আড়ালে নিজের রাগকে চাপা দিয়ে প্রসপেরেরা জবাব দিল, ওই পানি খেয়েই তো তোমরা টিকে আছ, তার্দিও। প্রার্থনা করি আরো ভাল থাকো, বলে চলে এল ও।
দিন কয়েক পরের কথা। রাস্তায় ওকে পাকড়াও করল ওর আরেক কাজিন। এ অবশ্য একটু দূর সম্পর্কের কাজিন। সে উপহাসের ভঙ্গিতে মাথার হ্যাট নামিয়ে বলল, সম্রাটের ছত্রচ্ছায়া আর ডোরিয়ার চাটুকারিতা করে নিজেকে অনেক ওপরের মানুষ ভাবছ, প্রসপেরো। ইকারাস-এর পরিণতির কথা মনে রেখো। ইকারাসের মত তুমিও সূর্যের খুব কাছাকাছি উড়তে শুরু করেছ।
এক কথায় জবাব দিল প্রসপেরো, বেশি ওপরে আছি তো, তাই তোমাকে দেখতে পাচ্ছি না। যা হোক, ধন্যবাদ।
উপহাসের বদলে উপহাস ফিরিয়ে দিলেও ক্রমাগত খোঁচা আর কটুক্তিগুলো ওর মন বিষিয়ে দিচ্ছে। তবে সৌভাগ্যবশত অভিযানের খুব একটা সময় বাকি ছিল না। ফলে প্রস্তুতিমূলক নানা কাজে ভীষণ ব্যস্ত থাকতে হচ্ছে প্রসপেরোকে। হয়তো সব ভুলে থাকার জন্য একটু বেশিই ব্যস্ত ও। এতে অবশ্য ওর উপকারই হয়েছে। উৎসবে ওর অনুপস্থিতি নিয়ে সম্ভাব্য কিছু বাজে পরিস্থিতি এড়িয়ে যেতে পারছে ও। হয়তো সেখানে ডোরিয়ার সঙ্গে সন্ধি করার কারণে ওর নিজের বংশের লোকেরা অপমানকর অবস্থা তৈরি করত। অথবা হয়তো জিয়ান্নার সামনে অভিনয় করতে হত। কে জানে। তবে ওর এই অনুপস্থিতির সময়ে সম্রাটের সামনে ওর ভাবমূর্তি আরো উন্নত হয়েছে, যদিও সে সম্বন্ধে প্রসপেরো মোটেও অবগত ছিল না। জনসমক্ষে এসে সেটা অনুধাবন করেছে ও।
যা হোক, সম্রাট আর ডেল স্টোর কথোপকথন চলছে। ডেল ভাস্টোকে বলছেন সম্রাট, আমি সবার সেবা পেতে চাই।
জবাবে বন্ধুর প্রতি অনুগত ডেল ভাস্টো প্রসপেরোর হয়ে বলল, প্রসপেরোর কাছে যা কিছু মূল্যবান তার সমস্ত কিছু দিয়েই সে আপনার সেবা করবে, সায়া।
সম্রাট বললেন, দুর্ভাগ্যবশত ওর খুব সামান্য কিছুই আছে। আমার হয়ে প্রসপেরোকে বলল আজ রাতে ছুটি নিতে। অ্যাডমিরালের উৎসব আয়োজনে আজ ওকে দেখতে চাই আমি।
সম্রাটের সম্মানে আয়োজিত উৎসবের মধ্য দিয়ে জেনোয়ার হৃত গৌরব পুনরুদ্ধারের আশায় মহা আড়ম্বরের আয়োজন করেছে ডোরিয়া। ফসোলু প্রাসাদকে উজ্জ্বল আলোয় আলোকিত করে রেখেছে হাজারো প্রদীপ। সন্ধ্যালগ্নে প্রাসাদের বাগানে বহু গণ্যমান্য ব্যক্তিকে দাওয়াত দেয়া হয়েছে সম্রাটের সঙ্গে পান করতে। আমন্ত্রিত অতিথিদের থেকে একটু দূরে এক জায়গায় দাঁড়িয়ে কথা বলছে ডাচেস অভ মেলফি, জিয়ান্না ও স্বয়ং প্রসপেরো। একটু দূরেই পুরো বাগান ঘিরে থাকা হাঁটা পথ। সম্রাটের সম্মানে পুরো পথজুড়ে বিছানো হয়েছে পুব দেশীয় কার্পেট। আর তার পাশেই বসানো হয়েছে তাজা ফুলসজ্জিত ফুলের টব আর পরিবেশের সঙ্গে মানানসই মৃদু আলোয় সজ্জিত বিশাল এক টেবিল। ডিনারের জন্য পঞ্চাশজন অতিথি একত্রে বর্সার বন্দোবস্ত করা হয়েছে তাতে। টেবিলের উপর বিছানো হয়েছে: ভেনেশিয়ান লেসওয়ার্ক সমৃদ্ধ ধবধবে সাদা ন্যাপারি। প্লেট-বাটিগুলো সব স্বর্ণ আর রূপায় তৈরি। টেবিলে বসানো বহু শাখা-প্রশাখা সমৃদ্ধ মোমদানিগুলোও স্বর্ণ আর রূপায় বানানো। ফ্লোরেন্সের নামী কারিগরদের কারখানা থেকে আনানো হয়েছে মোমদানিগুলো। স্পেন থেকে আমদানি করা গরুর মাংসের ডিশ পরিবেশন করা হয়েছে বিশাল সব স্বর্ণনির্মিত তশতরিতে। ফলফলাদিও আনা হয়েছে বিভিন্ন দেশের সুদূর প্রান্ত থেকে।
টেবিলে বসে থাকা অতিথিদের পায়ের নিচ থেকে হঠাৎ ভেসে এল সঙ্গীতের সুর-লহরী। সবাই তাতে কমবেশি অবাক হয়েছে। সিল্কের পোশাক আর পাগড়ি মাথায় মুরিশ সাজে সজ্জিত একদল ভৃত্য শুরু করল অতি উপাদেয় মাংস পরিবেশন। সঙ্গে সম্রাটের সৌজন্যে পরিবেশন করা হলো অত্যন্ত ব্যয়বহুল রেইনিশ ওয়াইন। আর ঠিক তখনই উপবিষ্ট অতিথিদের নিয়ে নড়তে শুরু করল পুরো বোওয়ার (বাগানের ভিতরে লতাপাতা ও বিভিন্ন সাজসজ্জার উপকরণে সজ্জিত অতিথিদের বসার জায়গা)। সেটা ধীরে ধীরে চলতে শুরু করল অন্ধকার সাগরের দিকে। ওখানে মৃদুমন্দ বাতাসে গ্রীষ্ম রাতের উত্তাপ অনেকটাই কম।
বোওয়ার নড়তে শুরু করার পরই অভ্যাগত অতিথিরা বুঝতে পারল যে তারা আসলে বসে আছে একটা গ্যালির ডেকের উপর। ডেকটাকে এতটা নিখুঁতভাবে সাজানো হয়েছে যে ওটা নড়ে ওঠার আগ মুহূর্ত পর্যন্ত কেউ ধারণাই করতে পারেনি যে তারা কোন জাহাজের ডেকের উপর বসে আছে। উৎফুল্ল হয়ে উঠল বিস্ময়ে অভিভূত অতিথিরা। হাতে হাতে ঘুরতে শুরু করল ওয়াইনের পেয়ালা। উঁচু থেকে উচ্চতর হতে থাকল হাসি-আনন্দের আওয়াজ! সম্রাটের গলাও শোনা গেল বেশ। অতি ক্ষুধার্তের মত হাপুস-হুপুস করে খাওয়া শুরু করলেন তিনি, সেইসঙ্গে চলল। অবারিত মদ্যপান। ফলাফল যা হওয়ার তা-ই হলো। কিছুক্ষণের মধ্যেই সম্রাটের উগরে দেয়া বমনে ভেসে ধন্য হলো জাহাজের ডেক!
সেরাতের বিলাসী আয়োজন নিয়ে জনমনে নানারকম রটনা তৈরি হয়েছে। কিছু গল্পে ডোরিয়ার উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করা হয়েছে। আবার কোন-কোনটায় তাকে সম্রাটের চাটুকার বলা হয়েছে। আবার কিছু গল্পে লোকে রটিয়েছে যে, সেরাতে ব্যবহৃত স্বর্ণের প্লেট-বাটিগুলো চুরি করেছে ভৃত্যরা। তারা ওগুলো সাগরে ফেলে দিয়েছে যেন পরে তুলে নিতে পারে। কিছু সুরসিক আবার এর সঙ্গে যোগ করেছে যে জাহাজ ঘিরে জাল বিছানো ছিল। ফলে ভোর হওয়ার আগেই স্বর্ণের বাটি-প্লেটগুলো আবার উদ্ধার হয়ে গেছে।
প্রসপেরো তার লিগুরিয়াদ নামের কাব্যগ্রন্থে এই বিলাসী আয়োজনের বিস্তারিত বর্ণনা দিয়ে কবিতা সঙ্কলন করেছে। কবিতাটাকে ঐতিহাসিকগণ পরিপূর্ণ সত্য বলে গ্রহণ না করলেও ওই রাতের আয়োজন সম্বন্ধে বেশ একটা ধারণা দেয় কবিতাটি।
.
যা হোক, আমাদের গল্পে ফিরে আসি। এমন চমৎকার আয়োজনে এমনকী প্রসপেরোরও মন ভাল হয়ে গেছে। জিয়ান্নার সঙ্গে বসে আছে ও। অনুষ্ঠানে প্রসপেরোর মায়ের ক্রমাগত অনুপস্থিতি নিয়ে দুঃখ প্রকাশ করল জিয়ান্না। কারণ এখন পর্যন্ত নিজের হবু পুত্রবধূকে চোখের দেখাও দেখেনি প্রসপেরোর মা।
জিয়ান্না বলছে, হয়তো স্বাস্থ্যহানির কারণে তিনি অনুষ্ঠানে আসতে পারছেন না। তার হবু পুত্রবধূ হিসেবে আমার দায়িত্ব তাঁর সঙ্গে দেখা করা। কিন্তু সেই অনুমতিও তো তিনি আমাকে দিচ্ছেন না। খুলে বলো তো, প্রসপেরো, আসল কারণ কী?
ওয়াইনের গ্লাস তুলে নিয়ে তাতে ছোট্ট চুমুক দিয়ে প্রসপেরো বলল, আমি আর কী বলব, তুমি নিজেই তো অনুমান করতে পারছ।
জিয়ান্না বলল, হ্যাঁ, পারছি। ডোরিয়াদের সঙ্গে তোমার সন্ধি তিনি অনুমোদন করতে পারছেন না। তাঁর মনে এখনও ডোরিয়াদের প্রতি তীব্র ঘৃণা রয়ে গেছে।
সাফাই দিয়ে প্রসপেরো বলল, ওদের কারণে তাকে অনেক ভুগতে হয়েছে।
সে তো তুমিও ভুগেছ।
ভুগেছি। কিন্তু আমার মন-মানসিকতা তাতে দুর্বল হয়নি।
সত্যি সত্যি তুমি সবাইকে ক্ষমা করে দিয়েছ? সত্যিই তোমার ভিতরে আর কোন প্রতিশোধের ইচ্ছা অবশিষ্ট নেই?
জিয়ান্নার চোখে চোখ রেখে প্রসপেরো বলল, শোধ নেয়ার ইচ্ছা থাকলে আমি কি এখানে বসে থাকতাম?
সত্যিই কি তুমি আমার সঙ্গে আছ, প্রসপেরো?
হেসে প্রসপেরো বলল, সশরীরে ও মূর্ত অবস্থায় তোমার পাশেই বসে আছি। বিশ্বাস না হলে ছুঁয়ে দেখো।
হ্যাঁ, সশরীরে দৃশ্যমান অবস্থায় আছ। কিন্তু মানুষের অদৃশ্য অংশ হচ্ছে তার মন। আমি তোমার মনের কথাই জিজ্ঞেস করেছি। তোমার মনটা যেন অন্য কোথাও ঘুরে ফিরছে। কী এক অস্পষ্ট কল্পনার মেঘের ভিতর ডুবে আছে তোমার মন। তোমার এই অবস্থা আমাকে আমাদের এই সুখের সময়েও দুঃখী করে দিচ্ছে। বিশ্বাস করো, এই পর্যন্ত আসতে অনেক কাঠখড় পোড়াতে হয়েছে আমাকে।
জিয়ান্নার কথাগুলো একটা তলোয়ারের মত প্রসপেরোর বুকে গিয়ে বিঁধল। ঠিক তখনি যেন অন্তরচক্ষু খুলে গেল প্রসপেয়োর। ও স্পষ্ট বুঝতে পারল ওর সামনে স্রেফ দুটো পথ খোলা আছে। প্রথমটা হচ্ছে সরাসরি শান্তিচুক্তি মেনে নেয়া। দ্বিতীয় পথ হচ্ছে, প্রতারকের মত অভিনয় চালিয়ে যাওয়ার বদলে সরাসরি খোলাখুলি সবার সামনে ঘোষণা দেয়া যে ডোরিয়াদের শত্রু ও। এখন সমস্যা হচ্ছে, এর যে-কোন একটা বেছে নিতে হবে। আর বাছতে হবে ওর নিজেকেই।
হাত থেকে ওয়াইনের গ্লাস নামিয়ে রাখল প্রসপেরো। ঘুরে জিয়ান্নার মুখোমুখি বসে ও বলল, কী হলে তুমি খুশি হবে, বলো, জিয়ান্না?
স্থির দৃষ্টিতে একমুহূর্ত প্রসপেরোকে জরিপ করল জিয়ান্নার দুই চোখ। তারপর বলল, সম্ভবত আমার প্রশ্নের উত্তরগুলো পেলে খুশি হব। প্রশ্নের উত্তর পাওয়ার আগে কিছু বলতে পারছি না। তারপর সে প্রশ্ন করল, সত্যি তোমার প্রতিশোধ নেয়ার ইচ্ছা নেই, প্রসপেরো? সত্যিই কি অতীতকে কবর দিতে পেরেছ তুমি?
জিয়ান্নার প্রশ্নের জবাবে স্থির দৃষ্টিতে সরাসরি তার চোখের দিকে তাকিয়ে মৃদু একটু হাসল প্রসপেরো। ওর চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেয়া হয়ে গেছে। তাই জিয়ান্নাকে ও নিশ্চিত করল এই বলে যে, হ্যাঁ, অতীতকে কবর দিয়ে ফেলেছি।
সঙ্গে সঙ্গেই প্রসপেরোর মনে হলো ওর মাথা থেকে বিরাট একটা বোঝা নেমে গেছে। ক্ষণিক আগেও ওর মনে হচ্ছিল যেন লোহার শেকলে বাঁধা পড়ে আছে ও। বাগানে জিয়ান্নার সঙ্গে দেখা হওয়া প্রেমিক মনের মানুষ হয়ে উঠল প্রসপেরো। প্রসপেরোর খুশি দেখে সত্যিই নিজের হারানো খুশি ফিরে পেল জিয়ান্না। তখনই প্রথমবারের মত মন থেকে ওদের বিয়ের কথা বলল প্রসপেরো। বলল, তুর্কিদের বিরুদ্ধে অভিযান থেকে ফিরেই বিয়ের পিঁড়িতে বসবে ওরা। তবে সতর্ক রইল যেন বিয়ে নিয়ে ওর এত দেরি করার বিষয়ে কোন কথা উঠে আনন্দটা মাটি না হয়।
ওদিকে ওদেরকে এমন ঘনিষ্ঠভাবে বসে থাকতে দেখে উজ্জ্বল হাসিতে উদ্ভাসিত হলো ডোরিয়ার চেহারা। দূর থেকেই রেইনিশের গ্লাস তুলে ইঙ্গিতে ওদের অভিনন্দন জানাল সে। ইশারায় বুঝিয়ে দিল ওদের শুভকামনা করে পান করছে সে।
অনেক রাতের কথা। অতিথিরা সবাই বিদায় নিয়েছে। ডোরিয়াকেও বিদায় জানাচ্ছে জিয়ান্না। ডোরিয়া বলল, তোমার চোখে খুশির ঝিলিক দেখতে পাচ্ছি, জিয়ান্না। আশা করি আমার কথা-কাজে তুমি সন্তুষ্ট।
কম্পিত কণ্ঠে তার কথার মৃদু প্রতিবাদ করল জিয়ান্না।
জবাবে একবার হালকা নড করে ডোরিয়া বলল, তুমি খুশি হলে আমিও খুশি। তোমার জন্য সবচেয়ে যোগ্য মানুষ প্রসপেরো। কথা দিলাম, ওকে নিরাপদে তোমার কাছে ফিরিয়ে আনব আমি। আর ওকে যদি ঠিকঠাক চিনে থাকি, তাহলে বলব, আরো বেশি সম্মান নিয়ে ফিরবে ও।
.
১৭.
শার্শেল
একটু পিছনে ফিরে যাই।
কার্ডিনাল চাচার কাছে কনফেস করা ও কথা বলার পর সম্পূর্ণ ভিন্ন মানুষ হয়ে গেছে প্রসপেরো। তার আশীর্বাদ আর ঈশ্বরের ক্ষমার আশা নিয়ে ফিরেছে প্রসপেরো। তখন থেকেই নিজের বিবেক আর জিয়ান্নার ইচ্ছার মধ্যে শান্তি রক্ষা করতে পেরেছে ও। জিয়ান্নাকে নিশ্চয়তা দিয়েছে যে অভিযান থেকে ফিরেই বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হবে ওরা। তখনই বিয়ে করেনি, কারণ মায়ের অভিশাপ ঘাড়ে নিয়ে অভিযান শুরু করতে চায়নি ও। প্রসপেরোর মাও আর কোন সন্দেহ করেনি। লিগুরিয়াদের কাব্যময়তায় ফিরে গেছে প্রসপেরোর মন। সম্রাটের জেনোয়ায় আগমন, তাঁর জৌলুস ও আনুষ্ঠানিকতা, তারপর ওদের ফ্লিটের সাগরে ভাসা আর ট্রিপোলিতানিয়ার দিকে রওনা হওয়া নিয়ে একের পর এক কবিতা লিখে গেছে প্রসপেরো।
ওই কবিতাগুলোর ছন্দে আশু যুদ্ধে সম্ভাব্য জয় নিয়ে বেশ উচ্ছ্বাস প্রকাশ করা হয়েছে, যদিও পরবর্তীতে নিয়তির হস্তক্ষেপে সেই উচ্ছ্বাস আর থাকেনি।
যা হোক, পোপের হাত থেকে শার্লেমেনের মুকুট গ্রহণ করার জন্য ফসোলু প্রাসাদে ঐতিহাসিক সেই ভোজের পরদিনই বলগনার উদ্দেশে রওনা হয়ে গেলেন সম্রাট। বলার অপেক্ষা রাখে না, এই মুকুট পাওয়ার জন্য সম্রাটকে কিছু খরচ করতে হয়েছে। মুকুট হাতে পেয়ে তারপর জার্মানি যাবে সে। ওখানে তার উপস্থিতি জরুরি হয়ে দেখা দিয়েছে।
সম্রাট রওনা হওয়ার পরের দিন বিদায়ী তোপধ্বনির মধ্য দিয়ে আলজিয়ার্সের উদ্দেশে জেনোয়ার বন্দর ছাড়ল ডোরিয়ার ফ্লিট। সাপ্লাই বহনকারী জাহাজগুলো ছাড়াও ফ্লিটে আছে তিনটা ব্রিগেন্টাইন আর ছয়টা ফেলুকা। এছাড়াও আছে ত্রিশ গ্যালির বিশাল বহর। প্রত্যেকটা গ্যালিই যুদ্ধের জন্য যথেষ্ট অস্ত্র আর লোকবলে সম্পূর্ণ সুসজ্জিত। এই ত্রিশটার মধ্যে পনেরোটি গ্যালি নিয়ে ডোরিয়ার নিজের কন্টিনজেন্ট। বারোটি গ্যালি নিয়ে প্রসপেরোর নিয়াপলিটান স্কোয়াড্রন আর অবশিষ্ট তিনটি গ্যালির কমাণ্ডে আছে সম্রাটের অত্যন্ত বিশ্বস্ত ডন আলভারো ডি কারবাজাল।
যেহেতু একটা সুসংগঠিত ফ্লিট হাতে আছে, তাই ডোরিয়া চাইছে আলজিয়ার্সের উপর সর্বশক্তিতে ঝাঁপিয়ে পড়তে। তার ইচ্ছা, আলজিয়ার্সে এমন মারাত্মক আঘাত হানবে যেন এক আঘাতেই খায়ের-আদ-দীনের রাজধানী তার দখলে চলে আসে। বারবারোসার রাজত্বকে এক লহমায় পঙ্গু করে দিতে চায় ডোরিয়া।
সৌভাগ্যবশত পথে একটা ফ্রেঞ্চ জাহাজের সঙ্গে তার দেখা হয়ে যায়। ফ্রেঞ্চ জাহাজটা থেকে খবর পাওয়া গেল যে, স্প্যানিশ ফ্লিটের আগমনের খবর বারবারোসার কানে পৌঁছে গেছে। অর্থাৎ ওদেরকে চমকে দিয়ে কাজ হাসিলের সুবিধা এখন আর নেই। একইসঙ্গে এটাও পরিষ্কার যে, কোর্সেয়ারদের হাতে একটা শক্তিশালী ও দক্ষ গুপ্তচর বাহিনী রয়েছে। ডোরিয়াদের অগ্রসরের খবর পেয়ে তাদেরকে উপযুক্ত অভ্যর্থনা জানাতে আলজিয়ার্সে সম্রাটের নৌবাহিনীর সমান বা বেশি শক্তির নৌবহর জড়ো করেছে বারবারোসা।
আলজিয়ার্স থেকে একশ মাইল দূরে থাকতে এই খবরটা পেল ডোরিয়া। ফলে রণকৌশল নিয়ে কমাণ্ডারদের সঙ্গে আরেকবার আলোচনা করতে বাধ্য হলো সে। নিজের গ্যালি গ্রিফোন-এর টিবারনাকলে ছয় চিফ ক্যাপ্টেনকে তলব করল ডোরিয়া। তলবকৃতদের মধ্যে নেপলসের ক্যাপ্টেন জেনারেল হিসেবে সর্বোচ্চ মর্যাদাধারী ক্যাপ্টেন হচ্ছে প্রসপেরো। অন্যরা হচ্ছে জিয়ানেট্রিনো আর ফিলিপ্পিনো ডোরিয়া, লর্ড অভ মোনাকোর কাজিন গ্রিমাল্ডি, প্রসপেরোর পুরানো বন্ধু লোমেলিনো ও ডন আলভারো ডি কারবাজাল।
ওদেরকে ডোরিয়া জানাল যে, তাদের অগ্রসর হওয়ার খবর পেয়ে গেছে কোর্সেয়াররা। তাই সরাসরি আক্রমণ করে সম্রাটের এই ফ্লিটকে আলজিয়ার্সদের তোপের মুখে ফেলতে চায় না সে।
স্পষ্টতই ডোরিয়ার দুই ভাতিজা তার বিপক্ষে কথা বলবে না। এমনকী লোমেলিনোও না। গ্রিমাল্টির ইচ্ছা অবশ্য ভিন্ন। কিন্তু ডোরিয়ার দল ইতিমধ্যেই ভারী হয়ে গেছে। কাজেই মনের কথা মনে রেখে দিয়ে ডোরিয়াকেই সমর্থন দিল সে। কিন্তু বিরুদ্ধ মত প্রকাশ করতে প্রসপেয়োর একমুহূর্তও দেরি হলো না। ও বলল, এই ফ্লিটকৈ লড়াইয়ে নামানোর ইচ্ছা না থাকলে সম্রাট আমাদেরকে এই অভিযানে পাঠাতেনই না।
সঙ্গে সঙ্গে প্রসপেরোকে সমর্থন জানাল ডন আলভারো। মুর জাতির লোকদের মত কৃষ্ণ গাত্রবর্ণবিশিষ্ট লোক ডন আলভারো। বয়স প্রায় চল্লিশ। এ বয়সেই মাথায় টাকের আভাস দেখা দিয়েছে। উঁচু ভর কল্যাণে মনে হয় সবসময়ই তার চোখে প্রচ্ছন্ন রসিকতা খেলা করছে। এ-ই হচ্ছে ডন আলভারোর বাহ্যিক বৈশিষ্ট্য। আর ভিতরে আমুদে, দিলখোেলা লোক ডন।
যা হোক, প্রসপেরোকে ডন আলভারো সমর্থন দিলেও ডোরিয়ার দুই ভাতিজা আর লোমেলিনোর চেহারায় স্পষ্ট প্রকাশ পাচ্ছে বিপরীত মত। এবং নিরপেক্ষ অবস্থানে গ্রিমাল্ডি। তাদের সবাইকেই এক পলকে দেখে নিল ডন আলভারো। অবস্থা দেখে তার মুখে ফুটে উঠল বিদ্রুপের হাসি।
তবে অ্যাডমিরাল ডোরিয়া ধৈর্যহারা হলো না। সে বলল, লড়াইয়ের বিভিন্ন ধরন আছে। কখনো লড়াই এড়ানো কাপুরুষতা। আবার কখনো চোখ বুজে লড়াইয়ে ঝাঁপিয়ে পড়তে হয়। যেহেতু তোমরা সবাই লড়াকু সেনা, তাই তোমাদেরকে বলে দেয়ার দরকার নেই যে কখন কোনটা করতে হয়।
তখন প্রসপেরো বলল, আমি বলছি না যে চোখ বন্ধ করে যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়তে হবে।
তাহলে বলতে চাইছ, তুমি কাপুরুষের মত পালাবে? ফোড়ন কাটল জিয়ানেট্টিনো।
লম্বা একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে প্রসপেরো মনে মনে ভাবল, ডোরিয়াদের এই বাচ্চা-কাচ্চাদের সঙ্গে শান্তি বজায় রেখে চলা প্রায় অসম্ভবের কাছাকাছি একটা কাজ। তবে মুখে শুধু বলল, অমন কিছু করলে সবাই জানতে পারবে।
ডোরিয়া বলল, সে খবর পেয়েছে, কোর্সেয়ার ক্যাপ্টেনদের ডেকে পাঠিয়েছে বারবারোসা। তাদের মধ্যে শার্শেল থেকে ডাকা হয়েছে ডোরিয়ার পুরানো বন্ধু দ্রাগুতকে, জার্বি থেকে ডাকা হয়েছে খ্রিস্টানদের পরম শত্রু সিনান রেইজকে। একে অনেকেই জাদুকর বলে সন্দেহ করে। কারণ ক্রসবো নিয়ে অসম্ভব সব অ্যাঙ্গেল থেকে অসাধারণ সব শট নিতে পারে সে। আর ডাকা হয়েছে আয়াদিন-কে। তাকে স্প্যানিশরা চাচা ডায়াবলো নামে ডাকে।
প্রসপেরো বলল, তাহলে, এই রিইনফোর্সমেন্ট বারবারোসার নাগালে পৌঁছার আগেই আমাদের ওদিকে যেতে হবে।
মাথা নেড়ে ডোরিয়া বলল, আমার উৎস বলছে, ইতিমধ্যেই যথেষ্ট শক্তি সঞ্চয় করে ফেলেছে বারবারোসা।
তখন তর্কে যোগ দিল ডন আলভারো। বলল, কিন্তু ওদের শক্তি আমাদের চেয়ে বেশি, এমন কোন খবর কিন্তু আমরা পাইনি।
ঠিক। কিন্তু ওই জাহাজগুলোকে পেছন থেকে সাহায্য করবে দুর্গের কামান।
জবাবে প্রসপেরো বলল, আমাদের অস্ত্রভাণ্ডারের সক্ষমতা ওদের থেকে বেশি। তারপর সুর পরিবর্তন করে বলল, খ্রিস্টান মূল্যবোধ নিয়ে বাজি ধরা হয়েছে। মাঠে নেমে লড়াই থেকে পিছিয়ে যাওয়া মানে অপমান মাথা পেতে নেয়া। এবং স্বীকার করে নেয়া যে, কোর্সেয়াররাই এই সাগরের রাজা।
তখন কথা বলতে চাইল ফিলিপ্পিনো। শুনুন সবাই…
কিন্তু তার কথা সম্পূর্ণ করতে দিল না প্রসপেরো। ও বলে চলল, আন্দালুসিয়ান মুররা বারবারোসাকে তাদের ত্রাতা বলে ভাবে। কিন্তু কোন ক্যাস্টিলিয়ান (অর্থাৎ স্প্যানিশ) জাহাজ ওদেরকে চ্যালেঞ্জ করে দেখেনি যে কীভাবে চ্যালেঞ্জের জবাব দেয় বারবারোসা। ওর হাতে প্রায় সত্তর হাজার স্প্যানিশ নাগরিক প্রাণ হারিয়েছে। এমনকী এখনও ওর হাতে বন্দি দাস হিসেবে মানবেতর জীবন যাপন করছে প্রায় সাত হাজার খ্রিস্টান। কাজেই এখন পিছিয়ে যাওয়ার অর্থ হচ্ছে বারবারোসার বিদ্রুপের পাত্র হওয়া আর ওর ঔদ্ধত্য আরো বাড়িয়ে দেয়া।
খোদার কসম, দারুণ বলেছ। প্রসপেরেরার উচ্চারিত প্রতিটা শব্দ সত্য, ডন অ্যাডমিরাল। মাই লর্ড, আমাদের পিছানোর কোন উপায় নেই, বলল ডন আলভারো।
গম্ভীর কণ্ঠে অ্যাডমিরাল ডোরিয়া বলল, পিছিয়ে যাওয়ার চিন্তা আমিও করছি না। ভাবছি আগে ওই রিইনফোর্সমেন্টের একটা ব্যবস্থা করা দরকার। কারণ মূলত এদের উপরই নির্ভর করে বারবারোসা। কাজেই ওদের প্রত্যাশা মত, আলজিয়ার্সের উপর আক্রমণ না করে আমরা শার্শেলে দ্রাগুতের উপর মরণ আঘাত হানতে পারি। আপনাদের কী মত?
প্রশ্নটা সবাইকে করা হলেও ডোরিয়া তাকিয়ে রইল প্রসপেরোর চোখের দিকে। কাজেই জবাবও দিল প্রসপেরো। বলল, প্রাথমিকভাবে এই চিন্তার বিপক্ষে আমি নই।
অশেষ মেহেরবানি তোমার, মহান ঈশ্বর, বিদ্রূপ করল ফিলিপ্লিনো।
স্বস্তির হাসি হেসে ডন, আলভারোও বলল, আমিও ঈশ্বরকে ধন্যবাদ জানাচ্ছি। ডন প্রসপেরোর সঙ্গে আমিও একমত। আক্রমণ করলে চরম আক্রমণ করা দরকার, যাতে এই কুকুরগুলো চিরতরে বুঝে নেয় এই সাগরের আসল প্রভু কে। কে এখানে রাজত্ব করে?
সেজন্যই বলছি, আমি কোন ঝুঁকি নেব না। এবং তোমরা কেউ এ ব্যাপারটাকে হালকাভাবে নাও, তাও আমি আশা করি না। যাক, তাহলে সিদ্ধান্ত হচ্ছে আমরা শার্শেলেই আক্রমণ করব।
সিদ্ধান্ত হয়ে গেল। কাজেই আলজিয়ার্সের চিন্তা বাদ দিয়ে শার্শেলের দিকে ঘুরিয়ে নেয়া হলো বহরের মুখ। কিন্তু ওখানে দ্রাগুতকে খুঁজতে গিয়ে বিফল হলো ওরা। কারণ আগেই আলজিয়ার্সের পথে রওনা হয়ে গেছে সে। উপকূল ঘেঁষে দলবল নিয়ে এগুচ্ছে দ্রাগুত। ফলে অপেক্ষাকৃত গভীর সমুদ্র ধরে এগিয়ে চলা ডোরিয়া বাহিনী মিস করল তাকে।
আবার ওয়ার কাউন্সিলের মিটিং ডাকা হয়েছে। কাউন্সিলে দাঁড়িয়ে দৃঢ়ভাবে প্রসপেরো বলল, অতি সতর্কতার কারণেই আমরা গভীর সাগর দিয়ে চলেছি। তাতে হারিয়েছি দ্রাগুতকে। নিশ্চিতভাবেই বলা যায়, এতক্ষণে নিজের বাহিনী নিয়ে বারবারোসার সঙ্গে যোগ দিয়ে ফেলেছে দ্রাগুত। আমাদের পক্ষে আগে যা সম্ভব ছিল এখন আর তাও সম্ভব হবে না।
ডন আলভারো তখন বলল, অতি সতর্কতা অযৌক্তিক না। কিন্তু এবারের ফলাফল আমাদের পক্ষে যায়নি। ওই কোর্সেয়ার কুত্তাগুলোর সামান্য ঘেউ-ঘেউ শুনেই আমরা নিশ্চয়ই লেজ গুটিয়ে পালাব না। আমি হাসি-ঠাট্টা করতে পছন্দ করি, কিন্তু কারো উপহাসের পাত্রে পরিণত হতে পছন্দ করি না। এখন ফিরে গেলে সম্রাট আপনাকে মোটেও ধন্যবাদ জানাবে না, মাই লর্ড ডিউক।
ডন আলভারোর কথা শুনে একদম ঠাণ্ডা মেরে গেল ডোরিয়া। দুই ভাগ্নেকে পিছনে নিয়ে নির্বাক দাঁড়িয়ে রইল সে। জানালার কাছে গিয়ে মাইলখানেক দূরের রুক্ষ উপকূলের দিকে তাকিয়ে রইল সে। ওখানেই দাঁড়িয়ে আছে তাদের ফ্লিট। পিছনে দেখা যাচ্ছে দিজাবেল সৌমা আর বনী মানাসার পাহাড়ে জন্মে থাকা খেজুর, জলপাই আর কমলা গাছ। আর দেখা যাচ্ছে গাছের ছায়ায় দাঁড়িয়ে থাকা সাদা রং করা বর্গাকৃতির বাড়িগুলোকে।
বেশ কিছুক্ষণ ওদিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থেকে মুখ খুলল ডোরিয়া। বলল, ডন আলভারো, ওই যে শার্শেল দেখা যাচ্ছে। কোর্সেয়ার ডাকাতদের সাপ্লাই পাঠানোর গুরুত্বপূর্ণ একটা বন্দর। ওদের এই আস্তানা আর বাড়তে দেয়া হবে না। এই শহর ধ্বংস করাটা হবে একটা সত্যিকারের কাজের কাজ।
তখন প্রসপেরোর মুখে ফুটে উঠল মৃদু বিদ্রুপের হাসি। ওকে হাসতে দেখে বিস্ময় ফুটে উঠল জিয়ানেট্টিনোর মুখে। একবার প্রসপেরোর দিকে, তারপর ডন আলভারোর দিকে বোকা-বোকা দৃষ্টিতে তাকাল সে। বেকুবের মত মুখ করে সে প্রশ্ন করল, হাসছ কেন?
প্রসপেরোর হাসি আরো চওড়া হলো। ও বলল, সিংহ শিকার করতে বেরিয়ে ইঁদুর শিকার করতে চলেছি আমরা, তাই।
এই এক খোঁচাই ছিল যথেষ্ট। কিন্তু সেটাকে আরো তীক্ষ্ণ করে দিল নিজের উরুর উপর ডন আলভারোর চটাশ করে মারা একটা চাপড়। বলা হয়নি, প্রসপেরো আর ডন আলভারের মধ্যে নীরবেই একটা সহানুভূতি আর বন্ধুত্বের সম্পর্ক গড়ে উঠেছে।
ওদের বক্তব্যকে বুদ্ধিহীন দুই উন্মাদের কথা ধরে নিয়ে মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলল জিয়ানেট্টিনো। এবং নিজে খাঁটি গর্দভের মত ধরে নিল, পুরো ব্যাপারটাই ওই দুজনের চিন্তার ক্ষমতার বাইরে।
অতীতের নানা ঘটনা সত্ত্বেও ডোরিয়ার প্রতি স্পষ্ট একটা শ্রদ্ধা ও সমীহ কাজ করত প্রসপেরোর ভিতর। কারণ ডোরিয়া সত্যিই একজন অত্যন্ত সাহসী ও কুশলী মানুষ। শক্তি, নিয়ন্ত্রণ আর তীক্ষ্ণ বুদ্ধিমত্তার দারুণ মিশেল আছে তার ভিতর। তবে তার দুই ভাতিজার কাছে প্রসপেরো সবসময়ই স্রেফ একজন শত্ৰু, যাকে যে-কোন মূল্যে দমন করতে হবে। যা হোক, নিজেকে সংযত করল প্রসপেরো। তারপর শার্শেলে আক্রমণের ব্যাপারে গাম্ভীর্যের সঙ্গে নিজের মত দিল ও। শীতল কণ্ঠে বলল, এটা সভ্য মানুষের আচরণ হবে না।
জবাবে ডোরিয়ার বদলে জিয়ানেট্টিনো বলল, আমরা এখানে সভ্য হতে আসিনি। নিজেকে তুমি খুব গুরুত্বপূর্ণ মানুষ ভাবো, মেসার প্রসপেরো। তাই নিজের মত অন্যদের উপর চাপিয়ে দিতে চাও। কিন্তু এবারে আমার চাচার সিদ্ধান্তটাই ঠিক। ভেবে দেখো।
ডোরিয়ার দিকে ফিরে প্রসপেরো তখন বলল, কোর্সেয়ার ডাকাতগুলোর সঙ্গে লড়তে এখানে এসেছি আমরা। নিজেদের ভিতর রেষারেষি করতে নয়। আমি আমার ফ্ল্যাগশিপে ফিরে যাচ্ছি। ওখানেই অ্যাডমিরালের হুকুমের জন্য অপেক্ষা করব।
প্রসপেরোর সিংহ আর ইঁদুরের কৌতুক বেশ ভালই আঘাত দিয়েছে ডোরিয়াকে। সম্ভবত সে কারণেই জিয়ানেটিনোকে বাধা দিল না সে। এবং যখন সে মুখ খুলল, তখনও তার কর্কশ কণ্ঠে প্রকাশ পেল গাম্ভীর্য। প্রসপেরোকে বলল, তুমি এখানেই অপেক্ষা করবে। তোমাকে স্মরণ করিয়ে দিচ্ছি আর আপনাকেও, ডন আলভারো, এই অভিযানের দায়িত্ব ও কমাণ্ড দুটোই আমার উপর ন্যস্ত।
ডন আলভারো একবার বাউ করে সকৌতুকে চোখ টিপে বলল, ক্ষমা করবেন, অ্যাডমিরাল, আমি ভেবেছিলাম আপনি বুঝি আমাদের মতামত জানতে চাইছিলেন।
হ্যাঁ, মতামত জানতে চেয়েছি, সিদ্ধান্ত নয়। কীভাবে কী করতে হবে সেই বিষয়ে আপনাদের কিছু বলার থাকলে কৃতজ্ঞতার সঙ্গেই আমি শুনব, বলে প্রসপেরেরা, আর ডন আলভারোর মুখের দিকে প্রশ্নবোধক দৃষ্টিতে চাইল ডোরিয়া।
মাথা নেড়ে ডন আলভারো বলল, লড়াইয়ের কৌশল ঠিক করার ব্যাপারে অ্যাডমিরালের সিদ্ধান্তকেই আমি প্রাধান্য দেব।
আর প্রসপেরো বলল, যেমনটা মনে করিয়ে দিলেন, অ্যাডমিরাল, দায়-দায়িত্ব সব আপনার।
একটু হেসে ডোরিয়া বলল, কাজ করার চেয়ে বিচার বিশ্লেষণ করা অনেক সহজ। চলো, কাজ শুরু করা যাক।
এরপর খুব দ্রুত আক্রমণের ছক কেটে ফেলল ডোরিয়া। ডন। আলভারো আর প্রসপেরোকে যার-যার দায়িত্বও বুঝিয়ে দিল। তারপর কাউকে আর কোন প্রশ্ন তোলার সুযোগ না দিয়ে যার-যার জাহাজে চলে যাওয়ার হুকুম করল ডোরিয়া।
জাহাজে যাওয়ার জন্য একসঙ্গে নৌকায় উঠল দুই ক্যাপ্টেন। নিজের বিরক্তি স্পষ্টভাবে প্রকাশ করল ডন আলভারো। প্রসপেরোকে সে বলল যে, নিজের মান মর্যাদা নিয়ে ডোরিয়ার অতি সচেতনতাই তার পতনের কারণ হবে।
প্রসপেরো বলল, শার্শেলে হামলা করার পরই তা হবে বলে আমার মনে হচ্ছে।
আলভারো স্বলল, তাহলে তো বলতে হয় সর্বনাশের ষোলোকলা পূর্ণ হতে চলেছে।
গম্ভীরভাবে আলভারোর কথায় সায় দিল প্রসপেরো। ব্যাপারটায় একটা কৌতুক খুঁজে পেল প্রসপেরো। আজ ডোরিয়ার যে তিরস্কারে ওর মন খারাপ হয়েছে, কয়েকদিন আগে হলে এই তিরস্কারেই মহা আনন্দ পেত সে। কারণ, শার্শেলে আক্রমণটা হবে বোকামির চূড়ান্ত। অথচ সেটাই করতে যাচ্ছে ডোরিয়া। আগের সময় হলে ডোরিয়াকে ও উৎসাহই দিত। কারণ তাতে ওর প্রতিশোধ নেয়ার ইচ্ছা পূর্ণ হত। আরেকটা ব্যাপার হচ্ছে, শার্শেলে আক্রমণ করে ওরা সফল হতে পারলেও তাতে কোন সম্মান থাকছে না। অপরপক্ষে ওদের আক্রমণ যদি ব্যর্থ হয় তা যে অসম্মান বয়ে আনবে সেটা কখনোই পূরণ হওয়ার নয়। খায়ের-আদ-দীনের আক্রমণে ডোরিয়া ধ্বংস হওয়ার আগেই।ধ্বংস হবে তার মান-সম্মান।
তপ্ত আগস্টের প্রায় দুপুর। মাথার উপর উদার হাতে তাপ বিলিয়ে যাচ্ছে আফ্রিকার সূর্য। ক্রমেই চড়ছে তাপমাত্রার পারদ। শার্শেল বন্দরের মুখে দাঁড়িয়ে আছে স্প্যানিশ ফ্লিট। গভীর পানি কেটে অনায়াসেই বন্দর পর্যন্ত পৌঁছতে পারবে যে-কোন জাহাজ। এমনকী আক্রমণকারী জাহাজকে বাধা দেয়ার জন্য ওখানে পর্যাপ্ত জাহাজ বা সেনাদলও নেই। দুয়েকটা জাহাজ যা-ও বা ছিল স্প্যানিশ ফ্লিটের দেখা পাওয়া মাত্রই সব লেজ তুলে ভেগেছে। হয়তো বন্দি হওয়ার হাত থেকে নিজেদের জাহাজ বাঁচাতে অথবা সাহায্য আনতে গেছে ওগুলো। জাহাজে বসে থেকেই ওরা শুনতে পাচ্ছে, বন্দর থেকে ভেসে আসা ট্রাম্পেট আর ড্রামের শব্দ। শব্দগুলো সাহায্যকারীদের ডাকছে। আর আশ্রয়প্রার্থীদের ডাকছে। আশ্রয় নেয়ার জন্য। দেখা যাচ্ছে, লোকজন তাদের ছাগল, গাধা, আবার কেউ তাদের উট নিয়ে ছুটে যাচ্ছে দুর্গের দেয়ালের ভিতর নিরাপত্তা খুঁজতে। যেহেতু শহরে নিরাপত্তা প্রাচীর তেমন একটা নেই তাই বেশিরভাগ লোকই ছুটছে দুর্গের দিকে।
শহরকে কামানের পাল্লায় পাওয়ার পর ওদিকে গোলাবর্ষণ শুরু করার হুকুম করল ডোরিয়া। শার্শেলের পিছনে পাহাড়ে পাহাড়ে ধ্বনিত-প্রতিধ্বনিত হয়ে ফিরে এল তার কামানের হুঙ্কারের আওয়াজ। একইসঙ্গে দুর্গ থেকেও শুরু হলো প্রতিপক্ষের ফিরতি গোলাবর্ষণ। ওরা গোলাবর্ষণে একটু বিরতি দিতেই তীরে বারোশ সৈন্য নামাল অ্যাডমিরাল ডোরিয়া, যাদের মধ্যে পাঁচশ জেনোয়িস সেনা, চারশ স্প্যানিশ আর বাকি তিনশ সেনা নামানো হলো প্রসপেরোর নিয়াপলিটান ফ্লিট থেকে। ওদেরকে দুই ডিভিশনে ভাগ করে পাঠানো হয়েছে। জেনোয়িস আর স্প্যানিশদেরকে পাঠানো হয়েছে জিয়ানেট্টিনোর অধীনে। আর নিয়াপলিটান সেনাদেরকে পাঠানো হয়েছে প্রসপেরোর অধীনে।
স্থল সেনা মোতায়েন করতে দেখে একদম হতভম্ব হয়ে যায় শার্শেলের দায়িত্বে থাকা তুর্কি অফিসার আলিট কারামানলি। এমন কিছু সে আশাই করেনি। তাই নিজের প্রায় সমস্ত টুপ আর সাধারণ মানুষকে দুর্গের ভিতর আশ্রয় দিয়েছে। ফলাফল, স্থলপথে বন্দরে আক্রমণ হলে তা ঠেকানোর মত ব্যবস্থা নেই। অবশ্য তার একজন অফিসারের অধীনে চারশর মত জানিসারি সেনা নিয়োজিত করে রেখেছে শহরের নিচের দিকে নিরাপত্তার জন্য (জানিসারি: তুর্কি অটোমান সাম্রাজ্যের এলিট সেনাদল। শিশু বয়সে খ্রিস্টান পরিবার থেকে সংগৃহীত শিশুদেরকে মুসলিম রীতিনীতি শিক্ষা দিয়ে মুসলিম হিসেবেই বড় করা হত। পরে যোগ্যতা অনুসারে তাদেরকে প্রশাসনিক কাজে বা সম্রাটের বিশেষ বডিগার্ড বা এলিট সেনা হিসেবে প্রশিক্ষিত করা হত।)। কারণ সে এতটুকু আন্দাজ করেছিল যে, সৈন্য-সামন্ত নিয়ে দুর্গের পুরু দেয়ালের আড়ালে লুকিয়ে থাকলে পরে শত্রুর দয়ার উপর তাদের বেঁচে থাকা নির্ভর করবে। শত্রুপক্ষকে খানিকক্ষণ ব্যস্ত রাখাও ছিল নিচে সামান্য কিছু সৈন্য পাঠানোর অন্যতম একটা কারণ। তবে কারণ যা-ই হোক, এই সামান্য সেনা নিয়ে বিরাট কিছু করে ফেলার আশা কেউই করেনি।
ওদিকে জেনোয়িস আর স্প্যানিশদের নিয়ে প্রথমে তীরে নেমেছে জিয়ানেট্টিনো। সে-ই জানিসারিদের প্রথম ধাক্কা সামলাচ্ছে। তবে ওদের সঙ্গে যোগ দেয়নি প্রসপেরো। সে তার সেনাদের নিয়ে স্বাধীনভাবে কাজ শুরু করে। আরাকুইবাসিয়ারদের নিয়ে ও ঝাঁপিয়ে পড়েছে তুর্কিদের আরেকটা সেনাদলের উপর। এই ধাক্কায় তুর্কিদের অর্ধেক সেনা মারা পড়ে আর নিহত হয় দলটার কমাণ্ডার। ভগ্ন মনোবল নিয়ে অনিয়ন্ত্রিত ও বিশৃঙ্খলভাবে দুর্গের দিকে পালাতে শুরু করে তারা।
তীরে প্রায় শতখানেক জেনোয়িস সেনা হারিয়েছে জিয়ানেনিনা। তাই পলায়নরত তুর্কিদের ধাওয়া করে প্রতিশোধ নেয়ার জন্য সারমিয়েণ্টো নামে একজন অফিসারের অধীনে স্প্যানিশ কনটিনজেন্টকে পাঠাল সে।
এদিকে খবরাখবর আনা-নেয়ার জন্য দুয়েকটা গ্যালি থেকে গেলেও দুর্গের উপর গোলাবর্ষণের উদ্দেশ্যে গভীর সাগরের দিকে চলে গেছে মূল স্প্যানিশ কনটিনজেন্ট। আর রয়ে যাওয়া গ্যালিগুলোতে আহতদেরকে পাঠানোর কাজ তদারক করতে পিছনে রয়ে গেছে জিয়ানেটিনো।
যা হোক, জল-স্থল উভয় দিক থেকে দ্বিমুখী আক্রমণ করে ডোরিয়া আশা করছে খুব দ্রুতই একটা ইতিবাচক ফল অর্জন করতে পারবে সে। বলার অপেক্ষা রাখে না, জাহাজ থেকে গোলাবর্ষণ শুরু করার পর দুর্গ থেকেও পাল্টা গোলাবর্ষণ শুরু হয়। কামানের শব্দে প্রকম্পিত হয়ে ওঠে শার্শেলের আকাশ বাতাস। তবে, যেহেতু দুর্গের দেয়ালগুলো ভীষণ মজবুত তাই ওদের তেমন একটা ক্ষয়ক্ষতি হয়নি।
অপরদিকে তুর্কি বাহিনী পাল্টা গোলাবর্ষণ শুরু করলেও ওদের হাতে গোলাবারুদের মজুত সামান্য। ফলে ওরাও ডোরিয়াদের তেমন একটা ধাক্কা দিতে পারল না। কিন্তু, যেহেতু স্থলভাগে একদল সেনা পাঠানো হয়েছে, তাই একটা ফলাফল আশা করা যেতেই পারে।
এই যখন অবস্থা তখন স্থলভাগে অবস্থানকারী দুই কমাণ্ডার জিয়ানেট্টিনো আর প্রসপেরোর সামনে নতুন এক পরিস্থিতির উদ্ভব হয়েছে। শহরের প্রান্তের দিকের ছোট একটা দুর্গের পরিখার পাশে পৌঁছেছে জিয়ানেনিনা আর প্রসপেরোর সেনাদল।
ঠিক তখনই দুর্গের উঁচু দেয়ালের ভিতর থেকে ভেসে এল একদল মানুষের সম্মিলিত আর্তনাদ, যিশুর কসম, আমাদের বাঁচাও।
জিয়ানেট্টিনোর কানেও পৌঁছেছে ওই আর্তনাদ। ও জিজ্ঞেস করল, চিৎকার করে কে?
ওর এক অফিসার বলল, সম্ভবত বন্দি খ্রিস্টান দাসেরা। হয়তো ক্রুসেডের সময় ওদের বন্দি করা হয়েছে।
কিন্তু এত সহজে কিছু বিশ্বাস করা জিয়ানেট্টিনোর প্রকৃতিতেই নেই। ও বলল, কিন্তু এটা যে বদমাশ: তুর্কিগুলোর পাতা ফাঁদ নয়, তা কীভাবে বুঝব? ওরা হচ্ছে খোদ শয়তানের দোসর।
ওদিকে ওই বেচারারা আর্তনাদ করেই চলেছে। সেই আর্তনাদ জিয়ানেট্টিনোর কান ভেদ করে অন্তর পর্যন্ত না পৌঁছলেও ওই তরুণ অফিসারের হৃদয়ে গিয়ে বিঁধেছে। সে বলল, পরিখায় পানি নেই। আর ওই দেয়ালও সহজেই টপকানো সম্ভব।
জবাবে জিয়ানেটিনো বলল, দাঁড়াও। গার্ডরা বন্দিদের ফেলে এভাবে পালাবে তা আমার বিশ্বাস হচ্ছে না। আর যদি ভিতরে গার্ড থাকেই তাহলে আমরা ওই দেয়াল টপকালে কী অবস্থা হবে ভেবেছ? কোন তুর্কি ফাঁদে পা দেয়ার ইচ্ছা আমার নেই।
ঠিক তখনই এসে পৌঁছল প্রসপেরো। জিজ্ঞেস করল, কী হয়েছে? ওর কানেও গেছে ওই লোকগুলোর আর্তনাদ। জবাবে ওদের ধারণা আর অন্ধের মত দুর্গের ভিতরে নামার পরিণতি কী হতে পারে সেই সম্বন্ধে নিজের অভিমতটাও জানিয়ে দিল জিয়ানেট্টিনো।
প্রসপেরো তখন বলল, মনে হচ্ছে, আমাদের উপর আক্রমণ করতে বন্দিদের ফেলে চলে গেছে দুর্গের গার্ডরা। আমি ভিতরে যাচ্ছি।
তাহলে ওপরের দুর্গে আক্রমণের কী হবে?
এখানে আমাদের খ্রিস্টান ভাইয়েরা বন্দি আছে। আগে ওদের মুক্ত করে নিই।
রুক্ষ কণ্ঠে প্রসপেরোকে জিয়ানেট্টিনো মনে করিয়ে দিল,অ্যাডমিরালের স্পষ্ট হুকুম অমান্য করছ তুমি।
জবাবে প্রসপেরো বলল, অ্যাডমিরাল নিজে এখানে থাকলে তিনিও তাঁর হুকুমে এই পরিবর্তনই করতেন।
একমুহূর্ত চিন্তা করে জিয়ানেট্রিনো ভবিষ্যদ্বাণী করল, হুকুম অমান্য করার এই প্রবণতার কারণে একদিন ভয়াবহ বিপদে পড়বে তুমি। সেটা এমনকী আজকেও হতে পারে।
প্রসপেরো বলল, না-ও হতে পারে। তবে যা হবে বলে নির্ধারিত হয়ে গেছে, তা হবেই।
ব্যঙ্গাত্মক বাউ করে জিয়ানেট্টিনো বলল, শুভ কামনা রইল। তারপর নিজের দলকে নিয়ে ওপরের দুর্গের পথে রওনা হয়ে গেল সে।
নিজের সেনাদেরকে সামনের দুর্গের দিকে নিয়ে গেল প্রসপেরো। তারপর সেখানে একডজন গানপাউডারের ফ্লাস্ক উপুড় করে সেটায় আগুন ধরিয়ে দিতেই বিস্ফোরণ, বুম। তারপরও পাল্লার কিছুটা অবশিষ্ট রয়েই গেল। তখন কিছু বর্শা একত্র করে একটা ব্যাটারিং র্যাম বানিয়ে তা দিয়ে ধাক্কা মেরে গুঁড়িয়ে ফেলা হলো বাকিটা।
দুর্গের ভিতর কোন ফাঁদ পাতা নেই। প্রসপেরো যা আশা করেছিল তা-ই পেল। দুর্গের উঠানে পৌঁছে দেখল বোল্ট আর প্যাডলকের সাহায্যে আটকানো আছে হালকা একটা দরজা। তবে হালকা-পলকা ওই দরজা ভেঙে ফেলা কোন ব্যাপারই না।
উঠানের সার্বিক অবস্থাকে এক কথায় বলা উচিত ভয়াবহ। ভর দুপুরের খাড়া সূর্যালোক অকৃপণ হাতে উত্তাপ বিলিয়ে যাচ্ছে। সূর্যের তাপে মনে হচ্ছে মগজ গলে বেরিয়ে আসবে। বাইরে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষরাই ওই তাপ সইতে পারছে না, চার দেয়ালের ভিতর গুমট পরিবেশে বন্দিদের অবস্থা সহজেই অনুমেয়। বন্দিদের গায়ে পোশাক যা আছে তা না থাকারই নামান্তর। ওদের ঘাম ও নানা ময়লা মিলে যে ভয়াবহ দুর্গন্ধ ওখানে তৈরি হয়েছে তা এক কথায় অসহ্য। তার উপর সূর্যের উত্তাপে তা আরো ছড়িয়ে পড়ছে। দুর্গন্ধে উদ্ধারকারীদের অবস্থাও শোচনীয়।
ওদিকে বন্দিদশা থেকে উদ্ধারের আশা পেয়ে খুশিতে আত্মহারা হয়ে গেছে বন্দিরা। আনন্দে কেউ হাসছে, কারো আবার চোখে পানি। উদ্ধারকারীদের যারা হাতের নাগালে পাচ্ছে, কেউ পিঠ চাপড়ে দিচ্ছে, কেউ আবার তাদের ঘাড়ে হাত দিয়ে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করছে। বন্দিদের প্রত্যেকেই পুরুষ। সবার মুখ মাথা ভর্তি নোংরা ও এলোমেলো চুল-দাড়ি। তাদের অনেকেই আহত। এমন কাউকে খুঁজে পাওয়া মুশকিল যার পিঠে লাঠি, চাবুকের আঘাতের দাগ নেই।
চোখের সামনে ওদের এই করুণ হাল দেখে স্তম্ভিত ও বাকরুদ্ধ হয়ে গেছে প্রসপেরো। রাগে ওর সারা গা কাঁপছে। কারণ এই বন্দিদের বেশিরভাগই ভদ্র ঘরের লোক। যারা ওদের জানোয়ারের হাল করেছে তাদের বিরুদ্ধে তীব্র ক্ষোভ দানা বাঁধল ওর ভিতর। প্রায় নয়শ জনকে এই কয়েদখানায় বন্দি করে রাখা হয়েছে। প্রায় সব বয়সের, সব শ্রেণীর ও বিভিন্ন দেশের লোকজন আছে এখানে। স্পেন সম্রাটের হুকুমে আগের বার যারা এখানে অভিযান চালাতে এসেছিল, ওই দলের জীবিত প্রায় সবাইকেই পাওয়া গেল এখানে। এমন অপ্রত্যাশিতভাবে মুক্তি পাওয়ায় খুশিতে আত্মহারা হয়ে প্রসপেরোদের চারপাশে নেচেকুঁদে একাকার হয়ে গেল লোকগুলো। ওরা একটু শান্ত হলে পরে ওদের ভিতর শৃঙ্খলা আনার কাজে মন দিল প্রসপেরো। ওদেরকে দুই দলে ভাগ করে নিল ও। একদলকে রাখল ওর সেনাদলের সামনে। আর অপর দলটাকে জায়গা দিল সেনাদলের পিছনে। তারপর ওদেরকে নিয়ে গেল বন্দরে অপেক্ষারত গ্যালিগুলোর কাছে।
ওদের বেশিরভাগই গ্যালিতে আশ্রয় নিতে পেরে স্বস্তি পেয়েছে। কিন্তু অনেকে আবার এই সিদ্ধান্তের বিরোধিতাও করল। তারা সদ্যপ্রাপ্ত স্বাধীনতা উদ্যাপন করতে চাইল তুর্কিদের উপর প্রতিশোধ নিয়ে। কিন্তু ওদের দাবি প্রসপেরোর কাছে গ্রহণযোগ্য বলে মনে হলো না। ফলে বাধ্য হয়ে ওদের উপর জোর খাটাতে হলো। তখন অকৃতজ্ঞ দলটার ভিতর থেকে তীব্র অসন্তোষের গর্জন উঠল যে, ওরা এক বন্দিকর্তার হাত থেকে আরেক বন্দিকর্তার হাতে এসে পড়েছে। ওদের বন্দিদশার কোন পরিবর্তন হয়নি। এরপর দল থেকে আলাদা হয়ে গেল প্রায় একশ জনের মত সাবেক বন্দি। উদ্দেশ্য দুর্গে আক্রমণকারী স্প্যানিশ সেনাদের সঙ্গে ওরাও লড়াইয়ে যোগ দেবে। হাতিয়ারের প্রশ্ন উঠলে তারা জবাব দিল, লড়াইয়ের ময়দানে অনেক অস্ত্র পড়ে আছে। যারা পারবে সেগুলো নেবে। আর বাকিরা নিজেদের পায়ে বাঁধা শেকল দেখিয়ে বলল সেগুলোকেই ওরা অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করবে।
তুর্কিদের জন্য প্রসপেরোর আফসোস হতে লাগল। কারণ যারাই এই দলটার হাতে পড়বে তাদের অবস্থা আক্ষরিক অর্থেই শোচনীয় হয়ে যাবে। সেইসঙ্গে ও ভাবল, ভালই হয়েছে। জিয়ানেট্টিনোর শক্তি আরেকটু বাড়ল। কিছু নতুন সেনা হাতে পেলে খুশিই হবে সে।
ওদিকে জিয়ানেট্টিনোর সেনাদল অরক্ষিত শহরটাকে পেয়ে নিজেদেরকে শার্শেলের হর্তাকর্তা-বিধাতা ভেবে নিয়েছে। সেনাবাহিনীর সাধারণ শৃঙ্খলা ভুলে মত্ত উল্লাসে লুটপাটে লেগে পড়েছে তারা। এমনকী জিয়ানেট্টিনোও এদেরকে থামানোর প্রয়োজন বোধ করেনি। ওর মতে যত বেশিক্ষণ ধরে দুর্গের উপর গোলাবর্ষণ চলে ততই ভাল। এতে দুর্গবাসীরা আরো দুর্বল হয়ে পড়বে।
ওদিকে সাবেক বন্দিরা শহরে এসে জিয়ানেট্টিনোর লোকদের এভাবে লুটপাট করতে দেখল। ফলে ওরাও নিজেদের লক্ষ্য ভুলে গেল। সবাই মিলে লেগে পড়ল লুটপাটে। নিজেদের ওরা এই বলে বুঝ দিল যে, চরম নিষ্ঠুর বন্দিজীবন যাপনের পর স্বয়ং স্রষ্টা ওদের সামনে এই উপহার তুলে ধরেছে। তাই শয়তানের চ্যালা তুর্কিদের জীবন নেয়ার চেয়ে শহরের ধনী লোকগুলোর ধনসম্পদ লুটপাট করাটাই বেশি বুদ্ধিমানের কাজ। আর অনেকদিন ধরে এখানে বন্দি থাকার কারণে শহরের কোথায় কোথায় দামি সব সম্পদের মজুত আছে সে সম্বন্ধে ওদের ধারণা ছিল। ফলে লুটপাটকারী সেনাদের গাইড হয়ে গেল সাবেক বন্দিরা। স্রেফ লুটেরায় পরিণত হয়ে রাস্তা থেকে হাওয়া হয়ে গেল জিয়ানেট্টিনোর সেনাবাহিনী। এমনকী শহর ছাড়িয়েও এগিয়ে গেল অনেকে। কারণ ওদিকে অতি ধনীদের কিছু বসত আছে। ওই মুসলিম ঘরগুলোতে মদ নেই বটে, কিন্তু স্বর্ণ, রত্ন আর মূল্যবান সিল্কের অভাব নেই। আর আছে সুন্দরী নারী। এসব দেখে সৈন্যদের মন থেকে হাওয়ায় উবে গেল শৃঙ্খলা আর নৈতিকতার শেষ বিন্দুটাও।
বাজারের পাশে পঞ্চাশ-ষাটজনের একটা দল নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে জিয়ানেট্টিনো। এই কজন ওর পাশে আছে, কারণ তারা যতটুকু বইতে পারবে ততটুকু লুটপাট সেরে নিয়েছে। আর তুর্কিদের ফেলে যাওয়া রাস্তার পাড়ের খোলা দোকান থেকে অদ্ভুত ধরনের মিষ্টি জাতীয় খাবার খেয়ে একটু অসুস্থ বোধ করছে।
ওদিকে উদ্ধার করা আটশ খ্রিস্টান সাবেক বন্দিদের ছয়টা গ্যালিতে তুলে দিল প্রসপেরো। তারপর একটা লং বোট নিয়ে অ্যাডমিরাল ডোরিয়ার জাহাজ গ্রিফোনে রিপোর্ট করতে গেল ও।
গ্রিফোনে পৌঁছে প্রসপেরো দেখল আন্দ্রের ফ্ল্যাগশিপে দাঁড়িয়ে আছে কারবাজাল। চেহারা দেখেই বুঝল যে, ডোরিয়া আর ডন কারবাজালের ভিতর কিছু একটা নিয়ে মতানৈক্য তৈরি হয়েছে। জাহাজের বিভিন্ন জায়গায় পড়ে আছে আহত লোকজন ও মৃত সৈন্যদের নিথর দেহ। একটা মাস্তুল ভেঙে পড়ে এই ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। জাহাজের দাঁড় থেকে বেশ কিছু দাসকে সরিয়ে আনা হয়েছে। তাদেরকে লাগানো হয়েছে ওই ভেঙে পড়া মাস্তুল কাটার কাজে। আর গ্যালিটাকেও দুর্গের কামানের পাল্লার বাইরে এনে খোলা সাগরে নোঙর করা হয়েছে।
রেলিঙের পাশে আলভারোর সঙ্গে দাঁড়িয়ে আছে ডোরিয়া। মাথায় কোন শিরস্ত্রাণ বা হ্যাট নেই, ফলে চকচক করছে টাক। তবে অন্যদিকে সে ঠিকই ফিটবাবু। মাথায় হেলমেট না থাকলেও গায়ে ব্রেস্টপ্লেট ঠিকই আছে। প্রসপেরোকে দেখা মাত্রই খেঁকিয়ে উঠল সে, এখানে কী চাই? তোমার উপর স্পষ্ট হুকুম ছিল তীরে থাকা। এতটুকু বলে সে তিক্ত ও রীতিমত উত্তেজিত কণ্ঠে বলল, আবার আমার কর্তৃত্ব নিয়ে প্রশ্ন করতে এসেছ? কিছু বলার আগে ভালভাবে জেনে নাও কে এই অভিযানের দায়িত্বে আছে।
ডোরিয়াকে রাগিয়ে ভোলা মোটেও সহজ কথা নয়। প্রসপেরো ভাবছে কীভাবে তাকে এতটা রাগাল আলভারো। অবশ্য ভেঙে পড়া মাস্তুলটার কারণেও ডোরিয়ার রাগ সপ্তমে উঠে থাকতে পারে।
যা হোক, মুখের উপর এমন ধমক খেয়েও জবাবে স্মিত হাসি ফিরিয়ে দিল প্রসপেরো। তারপর বলল, আমি রিপোর্ট করতে এসেছি, মাই লর্ড। আজ আমার ভাগ্য ভীষণ সহায় ছিল। তীরের একটা, দুর্গের বন্দিশালা থেকে হাজারের কাছাকাছি খ্রিস্টান বন্দি উদ্ধার করেছি। তারপর অ্যাডমিরালকে অবহিত করল যে, তার হুকুম ছাড়া ওই উদ্ধার করা লোকদের জন্য ভাল বন্দোবস্ত করা যাচ্ছে না। এ-ও জানাল যে আপাতত তাদেরকে ওর নিজের গ্যালিতে আশ্রয় দিয়েছে।
ডোরিয়াকে লজ্জা দিতে প্রসপেরোর আনা দারুণ সুসংবাদই ছিল যথেষ্ট। ওদিকে কারবাজালের সঙ্গে যা নিয়েই তার তর্ক চলতে থাকুক তাতে যে সে-ই জিতেছে তাও স্পষ্ট বোঝা গেল। ডোরিয়া বলল, শুনলেন তো, কারবাজাল, আমাদের এই অভিযানের ফলে নারকীয় বন্দিদশা থেকে মুক্তি পেয়েছে আমাদের হাজারখানেক খ্রিস্টান ভাই। এখনও কি বলবেন যে এখানে অযথা আমার গানপাউডার নষ্ট হয়েছে?
কামানের গর্জনের পিছনে হারিয়ে গেল ডন কারবাজালের উত্তর। আবারো গর্জে উঠল গ্যালির কামানগুলো। তবে এবার আর দুর্গ থেকে কোন উত্তর এল না। ব্যাপারটা খেয়াল করল অ্যাডমিরাল। ভেবে নিল দুর্গের গোলাবারুদের মজুত শেষ হয়ে গেছে অথবা এমন করা হচ্ছে ডোরিয়াকে লোভ দেখানোর জন্য, যাতে সে মনে করে দুর্গের বারুদ শেষ। তাহলেই মুখোমুখি লড়াইয়ে নামবে তারা।
প্রসপেরোকে ডোরিয়া বলল আরো কিছুক্ষণ অপেক্ষা করতে। ততক্ষণে অবস্থা বুঝে পরবর্তী নির্দেশনা দিতে পারবে ডোরিয়া। বাতাসে ভাসতে থাকা ধোঁয়া একটু কমেছে। দেখা গেল কামানের গোলার আঘাতে ডোরিয়ার একটা জাহাজের অবস্থা একেবারেই নাজুক। দ্রুতু ওটা থেকে লোকজনকে সরিয়ে আনা হলো। তখনি ভেসে এল দখিনা বাতাসের একটা ঝলক। কয়েক মুহূর্তেই পরিষ্কার হয়ে গেল বাতাস। গোলাগুলি শুরু করার আগে যেমন পরিষ্কার ছিল আবার তেমন পরিষ্কার হয়ে গেল বাতাস। দেখা গেল, নীরবে তীরে দাঁড়িয়ে থাকা গম্ভীরদর্শন দুৰ্গটাকে। এত গোলাবর্ষণ করা হলো, তবুও দুর্গের গায়ে সামান্য আঁচড় লেগেছে কেবল।
তখনই মূল ভূখণ্ড থেকে একটা বাহুর মত বেরিয়ে থাকা জমির আড়াল থেকে বেরিয়ে এল একটা ডিঙ্গি। দ্রুতগতিতে ওদের দিকে এগিয়ে এল ওটা। জাহাজের কাছে পৌঁছে লাফিয়ে ওটা থেকে জাহাজে উঠে এল একটা লোক। এক স্প্যানিশ সার্জেন্ট সে। আদর-লেহাজের বালাই তো নেই-ই, এসেই হাঁকডাক শুরু করল যে, কমাণ্ডার ডোরিয়ার সঙ্গে দেখা করতে চায়। ডোরিয়ার সামনে তাকে হাজির করার পর যে গল্প সে বলল সেটাকে এক কথায় বলা যায় ভয়াবহ।
কারামানলি বোকার স্বর্গে বাস করে না। দুর্গ থেকেই সে দেখতে পেয়েছে, জিয়ানেট্টিনোর লোকজন বিশৃঙ্খল হয়ে গিয়ে যথেচ্ছ লুটপাট চালাচ্ছে। সঙ্গে সঙ্গেই নিজের সুযোগটা দেখতে পায় সে। দুর্গে আশ্রয় নেয়া লোকজন আর তার অধীনস্থ জানিসারিদের নিয়ে পাঁচশ লোকের একটা দল বানিয়ে রাস্তায় নেমে আসে। জিয়ানেট্টিনোর বিশৃঙ্খল লোকদেরকে স্রেফ কচুকাটা করে ফেলে। সার্জেন্টের গল্প এই পর্যন্ত আসতে আসতেই পাত্র হয়ে গেছে ডোরিয়ার চেহারা।
কিন্তু নাটক এখনও শেষ হয়নি। তীর থেকে ঠিক তখনি ভেসে এল হইহল্লা, তলোয়ারে-তলোয়ারে ঠোকাঠুকি আর আহতদের আর্তচিল্কারের আওয়াজ। আক্রমণকারীদের গম্বুজ সদৃশ চকচকে রূপালী শিরস্ত্রাণ দেখেই বোঝা গেল ওরা মুসলিম সেনা। কোণঠাসা অবস্থা খ্রিস্টানদের। ঠেলে ওদেরকে সাগরের দিকে নিয়ে আসছে মুসলিমরা। যে-কোন সময় পতল্প শুরু হবে ওদের।
ঠিক যে মুহূর্তে সাগরে ওদের পতন শুরু হবে, দেখা গেল অদম্য সাহসের.. এক দুরন্ত প্রদর্শনী। দুর্গের কামানের গোলাবর্ষণের আতঙ্ক মাথায় নিয়েও নিজের গ্যালি নিয়ে যথাসম্ভব দ্রুত সামনে বাড়ছে লোমেলিনো। আর একটু হলেই গভীর সাগরে পতন শুরু হত স্প্যানিশ সৈন্যবাহিনীর। কিন্তু লোমেলিনোর জাহাজের প্রতিটা মাস্তুলের পিছনে লুকিয়ে আছে ক্রসবোধারী সৈন্য। কাছাকাছি হতেই মুসলিম সৈন্যদের উপর তীরের বন্যা বইয়ে দিল ওরা। বিভ্রান্ত হয়ে পড়ল মুসলিম সৈন্যদল। ওদের আচানক বিভ্রান্তির সুযোগে নিজেদের গ্যালির দিকে আছড়ে পাছড়ে ছুটতে শুরু করল খ্রিস্টান সৈন্যরা। দাঁড় আর গ্যাংওয়ে; যে যেটা পারল খামচে ধরে উঠে পড়ল জাহাজের ডেকে। লোমেলিনোর গ্যালিতে আশ্রয় পেল জিয়ানেটিনোর তিন থেকে চারশ সৈন্য। এই কজনই তখন পর্যন্ত জিয়ানেট্টিনোর সঙ্গে রয়ে গেছে। বাকিদের কোন হদিস নেই। সন্দেহ নেই, তুর্কিদের তলোয়ারের আঘাতে ধরাধামের মোহ ত্যাগ করেছে তারা।
ওদিকে মুসলিম তুর্কি সৈন্যরাও ততক্ষণে সামলে নিয়েছে। ওরাও শুরু করল বৃষ্টির মত তীরবর্ষণ। তীরের মুখে একটু অপেক্ষা করল লোমেলিনো। তারপর জাহাজ ঘুরিয়ে নিল সে। ইচ্ছা, এক জায়গায় জড়ো হয়ে থাকা মুসলিম সৈন্যদের উপর জাহাজের কামান থেকে গোলাবর্ষণ করবে। ওদিকে ভারী বর্মের ভিতর ঘর্মাক্ত, ক্লান্ত ও কয়েক জায়গায় কেটে যাওয়ায় আহত জিয়ানেট্টিনো কাতরাতে কাতরাতে আর রাগে কিড়মিড় করতে করতে শুরু করল লোমেলিনের উপর হুকুমদারি। বলল, একমুহূর্তও সময় নষ্ট না করে অ্যাডমিরালের জাহাজ-বহরের কাছে ওদেরকে নিয়ে যেতে।
মাথায় রাগ নিয়েই অ্যাডমিরালের সামনে এল জিয়ানেট্রিনো। যদিও ওর ভালই জানা আছে যে এমন মানসিক অবস্থায় অ্যাডমিরালের সামনে যাওয়া ওর উচিত না। তবে আলভারো আর প্রসপেরোকে ওখানে ডোরিয়ার সামনে উপস্থিত দেখে লড়াইয়ে ওর শোচনীয় অবস্থা সম্বন্ধে আর মুখ খরচ করল না জিয়ানেটিনো। ভাবল, পাছে তারা না আবার ওর কথার সাক্ষী রয়ে যায়। কিন্তু জিয়ানেট্টিনো নিজে তেমন কিছু না বললেও ডোরিয়ার তাকে বেশ কিছু বলার আছে।
ডোরিয়া বলল, তীরে দুর্গে আক্রমণ করে এক হাজার খ্রিস্টান সৈন্যকে মুক্ত করে এবং নিজের একজন সৈন্যও না খুইয়ে ফিরে এসেছে প্রসপেরো। আর তুমি; কিছু তো করতে পারোইনি, উল্টো নিজের অর্ধেক সৈন্য শেষ করে এসেছ। মুখরোচক একটা গল্প তৈরি হবে তোমাকে নিয়ে। তোমার আর সব লোক কোথায়? সবাই কি মারা পড়েছে?
জবাবে রাগত তীক্ষ্ণ স্বরে জিয়ানেট্টিনো বলল, আমি কেমন করে বলব? বেইমান চোরের দল লুটপাট করতে গেছে।
ওদেরকে সামলানোর কোন ক্ষমতা কি তোমার ছিল না?
দুইটা মাত্র হাত দিয়ে উন্মত্ত বদমাশের দলকে সামলাব কীভাবে?
আলভারো বলল, দুই হাত দিয়ে অবশ্যই সম্ভব নয়। কিন্তু ওদের উপর তোমার কি কোন কর্তৃত্ব ছিল না?
এই জায়গায় কথা বলে উঠল প্রসপেরো। বলল, আমরা এখানে বাক-বিতণ্ডা করতে থাকলে যে দুয়েকজন এখনও বেঁচে আছে তারাও মারা পড়বে। আপনি অনুমতি দিলে, মাই লর্ড, ওদেরকে ফিরিয়ে আনার একটা চেষ্টা আমি করতে পারি। তীরে ছোট দুর্গের কাছে আমার নিয়াপলিটান ফ্লিটের সেনারা বসে আছে। ওরা লড়ার জন্য প্রস্তুত। আপনি বললেই…
প্রসপেরোকে বাধা দিল জিয়ানেট্টিনো। ওসবের সময় নেই। আমরা ফাঁদে পড়তে যাচ্ছি। এখানে আর একমুহূর্ত থাকলেও আমাদের পুরো ফ্লিট মহা বিপদে পড়বে। তুর্কিদের একজনকে বন্দি করেছিলাম। বদমাশটা আমাদের নিয়ে উপহাস করছিল। বলছিল আমাদের এখানে আসার খবর ছড়িয়ে গেছে। উপকূল ধরে এদিকে ধেয়ে আসছে বারবারোসা, ডায়াবলো, দ্রাগুত আর সিনান রেইজ। ওরা পৌঁছুল বলে। এমনকী কোর্সেয়ারদের পুরো ফ্লিটও এদিকে রওনা হয়ে গেছে। দুর্গে খবর পৌঁছেছে, কারামানলি যেন দুর্গের দখল ধরে রাখতে যথাসম্ভব চেষ্টা করে। দ্রুতই সাহায্য পৌঁছুবে।
নির্বিকার চেহারায় ডোরিয়া প্রশ্ন করল, পুরো কোর্সেয়ার ফ্লিট?
ফ্লিটে জাহাজের সংখ্যা পঞ্চাশ থেকে একশর ভিতরে, জবাব দিল জিয়ানেট্টিনো।
ওদের দিকে তাকিয়ে বিদ্রুপাত্মক তিক্ত হাসি হাসল আলভারো। বলল, এই হলো আপনার পলিসির সুমিষ্ট ফল, লর্ড। ওরা আসার আগেই দ্রুত সর্বশক্তিতে খায়ের-আদ-দীনের উপর ঝাঁপিয়ে পড়লে ওকে হয়তো আমরা হারিয়ে দিতে পারব।
জবাবে শীতল কণ্ঠে ডোরিয়া বলল, উল্টো ফলও হতে পারে। আমরা নিজেরাও নিশ্চিহ্ন হয়ে যেতে পারি। বলে আলভারোর দিকে পেছন ফিরে দাঁড়াল সে। কিছু একটা বলার জন্য প্রসপেরোর মুখোমুখি হলো সে। আর তখন প্রসপেরো দেখল চকিতে নড়ে উঠল ডোরিয়ার প্রু জোড়া। সেখানে ফুটে আছে হতাশা। দুহাতে চোখ ঢাকল সে। রীতিমত কান্না জড়ানো কণ্ঠে বলে উঠল, হা, ঈশ্বর, ওরা চলে এসেছে!
দ্রুত ঘুরে দাঁড়াল অন্যরা। টিপাসাকে আড়াল করে রাখা পাথুরে পাহাড়ের পাশ ঘেঁষে নীল দিগন্তে তৈরি হয়েছে ফেননিভ একটা লাইন। তার উপর উড়ছে কতগুলো পাখপাখালি। তাকিয়ে থাকতে থাকতেই আকৃতি পেতে শুরু করল লাইনটা। কোর্সেয়ারদের জাহাজ তখনও দিগন্তের পিছনে। কিন্তু দিগন্তের উপর ভেসে উঠতে শুরু করেছে জাহাজের মাস্তুল। উপকূলের দিকে মুখ করে এগুচ্ছে সেটা। জাহাজটা. ওদের থেকে ছয় মাইল দূরেও হবে না। পালে এ মুখো বাতাস নিয়ে তরতর করে এগিয়ে আসছে সেটা। কয়েক মুহূর্তেই পূর্ণাঙ্গ আকৃতি পেয়ে গেল জাহাজটা।
সবার আগে নড়ে উঠল প্রসপেরো। বলল, যতক্ষণ করণীয় নিয়ে কথা বলব ততক্ষণই সময় নষ্ট হবে। অনুমতি দিন, আমাদের লোকগুলোকে তীর থেকে তুলে নিয়ে আসি, বলে কারো জবাবের অপেক্ষা না করেই পা বাড়াল ও।
কঠিন গলায় ডোরিয়া বলল, না, অনেক দেরি হয়ে গেছে। তোমার ক্যাপিটানায় ফিরে যাও। তৈরি হও, গভীর সাগরের দিকে রওনা হব আমরা।
ওদেরকে ফিরিয়ে আনার কোন চেষ্টাই করব না?
আঁতকে উঠল আলভারোও, মরার জন্য ফেলে যাব ওদের?
শীতল দৃষ্টিতে প্রথমে প্রসপেরো, তারপর আলভারোর দিকে তাকাল ডোরিয়া। তারপর শীতল গলায় বলল, ফ্লিটের নিরাপত্তা নিয়ে চিন্তা করতে হবে আগে। তীরের স্প্যানিশ বদমাশগুলো নিজেদের মাত্রাতিরিক্ত লোভের ফল ভোগ করুক। নোঙর তোলার সঙ্কেত দিচ্ছি। ওরাও সেটা শুনতে পাবে। পারলে সাগরের দিকে এগিয়ে আসুক। তখন দেখব উদ্ধার করা যায় কিনা, বলে মাস্টার গানারকে গ্যাংডেকে আসতে হুকুম দিল সে।
মুখ শক্ত হয়ে গেল প্রসপেরোর। বলল, কিন্তু ওরা এদিকে আসতে না পারলে কী হবে? বা কিনারায় পৌঁছে দেখল আমরা কেউ নেই, তখন?
জবাবে ডোরিয়া বলল, ওদের ভাগ্যে যা আছে তা-ই হবে।
এটা অমানবিক, মাই লর্ড।
আলভারোও বলল, অবশ্যই এটা অমানবিক, অ্যাডমিরাল।
গর্জে উঠল ডোরিয়া। অমানবিক? মানবিকতা দিয়ে আমি কী করব? রণনেতৃত্ব দেয়া আমার কাজ। আরো জোরে গর্জে সে বলল, নিজের জাহাজে ফিরে যাও।
সেকথা বলতে বলতেই জাহাজ ছেড়ে যাওয়ার সার্বজনীন সঙ্কেত হিসেবে পরপর তিনবার কামান দাগা হলো। প্রত্যুত্তরে তীর থেকে ভেসে এল মুসলিম সৈন্যদল আর শহরের সাধারণ লোকজনের টিটকারির মৃদু আওয়াজ।
প্রসপেরোর দিকে ফিরল অ্যাডমিরাল। আবার বলল, নিজের জাহাজে ফিরে যাও।
কিন্তু জায়গা থেকে নড়ল না প্রসপেরো। বলল, ক্ষমা করবেন, মাই লর্ড, কিন্তু ওদের ফেলে আমি এখান থেকে যেতে পারব না।
জিয়ানেটিনো বলল, ওরা বেঁচে আছে না মরে গেছে তা কীভাবে জানছ?
সবাই মরে গেছে তাও তো বলছ না। যদি নিশ্চয়তা দিতে পারো যে কেউ জীবিত নেই, তাহলে তীরে যাব না।
তীক্ষ স্বরে প্রসপেরোকে অ্যাডমিরাল মনে করিয়ে দিল, তুমি জাহাজে ফিরে যাওয়ার হুকুম পেয়েছ। তুমি তোমার ক্যাপিটানায় ফিরে যাবে আর বহর নিয়ে রওনা হবে আমার সঙ্গে।
এই কাপুরুষোচিত হুকুম মানলে আজীবন নিজের বিবেকের কাছে আসামী হয়ে থাকতে হবে আমাকে। হুকুমটা দেয়ার জন্য আপনাকেও–ই থাকতে হবে, মাই লর্ড, বলল প্রসপেরো।
বিবেকের কাছে দায়ী? হাহ, এসব মুখতা আমাকে স্পর্শ করে না। বলে নিজের পক্ষে সাফাই দিতে গিয়ে বলল, ভাবো একবার, আমাদের জাহাজগুলোয় দশ হাজার লোক আছে। চারশ জনকে বাঁচাতে গিয়ে তাদের সবার প্রাণ আমি বিপন্ন করব কেন? যারা ইতিমধ্যে মরে গিয়ে থাকতে পারে তাদের জন্য ফ্লিটকে কেন বিপদে ফেলতে যাব? এই কি তোমার ক্যাপ্টেনশিপের নমুনা? যুক্তি কী বলে? শত্রুভাবাপন্ন তীর আর কোর্সেয়ার ফ্লিটের মাঝে আটকা পড়া কি বুদ্ধিমানের কাজ? ঈশ্বর, আমাকে ধৈর্য দাও। যোদ্ধা হিসেবে কিছু নাম কামিয়েছ তুমি, কিন্তু আজ ভাবতে বাধ্য করবেন স্প্যানিশ লা গেল দতপ্রসপেলে না হচ্ছি কীভাবে কী করেছ তুমি, প্রসপেরো?
খোঁচার জবাব খোঁচা দিয়েই দিল প্রসপেরো। বলল, বিপদ থেকে পালিয়ে গিয়ে নাম কামাইনি, যেমনটা আপনি পালিয়েছিলেন গোইয়ালাতার লড়াইয়ের সময়, বলে আর দেরি করল না ও। লাফিয়ে নেমে গেল অপেক্ষারত একটা নৌকায়।
চেঁচিয়ে উঠল ডোরিয়া, থামাও ওকে।
প্রসপেরেরার নৌকা সরতে শুরু করতেই লাফিয়ে সামনে বাড়ল আলভারো। বলল, যাবেন না, মেসার প্রসপেরো। গেলে ভুল করবেন।
এই স্প্যানিশ লোকটার দৃষ্টিতেও প্রসপেরো ভুল করছে। কিছুক্ষণের মধ্যেই দেখা গেল দলত্যাগ করে তীরের দিকে এগুতে শুরু করেছে একটা গ্যালি। সেটা প্রসপেরোর নিজের গ্যালি। অ্যাডমিরালের সামনে আর কোন পথ খোলা রইল না।
ওদিকে চেঁচাতে শুরু করেছে জিয়ানেট্টিনো, উদ্ধত, অবাধ্য কুত্তা! ওখানেই পচে মর তুই। আমাদের আগেই যোঝা উচিত ছিল, শান্তি বজায় রাখার মত মানুষ ওই উদ্ধত শয়তানটা কোনকালেই ছিল, না। মরুক ও, যেতে দিন।
রাগে কাঁপতে কাঁপতে নোঙর তোলার হুকুম দিল অ্যাডমিরাল। মনে পড়ে গেল জিয়ান্নাকে দিয়ে আসা তার ওয়াদার কথা, ওকে নিরাপদে তোমার কাছে ফিরিয়ে আনব। তারপর ফিরল তার ভাতিজার দিকে। স্পষ্ট ভাষায় তাকে বলল, মনে রেখো, তোমার নির্বোধ আচরণের জন্য আজ এই পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে। একটা স্টারফিশের সমান বুদ্ধিও যদি তোমার থাকত আর নিজের সৈন্যদের ঠিকভাবে চালাতে পারতে তাহলে এসবের কিছুই হত না। যাও, ওর পিছনে যাও। দরকার হলে শক্তি প্রয়োগ করবে। কিন্তু ওকে ফিরিয়ে আনে।
দিগন্তে দিক নির্দেশ করে জিয়ানেট্রিনো বলল, দেখুন।
কোর্সেয়ারদের জাহাজ ইতিমধ্যেই মাইলের এক-চতুর্থাংশ পাড়ি দিয়ে ফেলেছে। স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে অনুকূল বাতাসে ফুলে থাকা ওদের জাহাজের ত্রিকোনাকার পাল। স্প্যানিশদের প্রায় তিনগুণ সংখ্যক জাহাজের বহর নিয়ে ধেয়ে আসছে কোর্সেয়ার ফ্লিট।
এখনও থাকতে চান? প্রশ্ন করল জিয়ানেটিনো।
প্রচণ্ড রাগে দাড়িতে আঙুল চালাল ডোরিয়া।
.
১৮.
দ্রাগুতের বন্দি
শার্শেলে অভিযান নিয়ে বিভিন্ন ঐতিহাসিক বিভিন্ন কথা বলেছেন। ইতিহাসের ধারাই এমন। একেক দৃষ্টিকোণ থেকে একেক জন একেক কথা বলে। তবে ডোরিয়াকে নিয়ে লরেঞ্জো ক্যাপেলোর লেখা বই লাইফ অভ প্রিন্স ডোরিয়া-কে ঠিক ঐতিহাসিক বলে বিবেচনা করা যায় না। কারণ এতে কেবল ডোরিয়ার নিজের সাপ্লাই করা কাহিনির মাধ্যমে তার সাফল্য আর বীরত্বের গানই গাওয়া হয়েছে। তবে বাস্তবতার নিরীখে ইতিহাস লিপিবদ্ধ করার চেষ্টাকারী ঐতিহাসিকদের মতামত ভিন্ন। আর একটু আগে বলা ঘটনার বাস্তবতা হচ্ছে শার্শেল থেকে ব্যালেয়ারিকস-এর দিকে সর্বোচ্চ গতিতে পলায়ন করছিল ডোরিয়া। তখন তার ঘাড়ে নিঃশ্বাস ফেলছিল বারবারোসার ফ্লিট। সে ঘটনাই বলছি এখন।
বারবারোসার পুরো ফ্লিট অবশ্য ডোরিয়ার পিছনে ধাওয়া করছে না। নিজের দশটা গ্যালি নিয়ে মূল দল থেকে আলাদা হয়ে গেছে দ্রাগুত। শার্শেলের দিকে রওনা হয়েছে সে। উদ্দেশ্য, শার্শেলের প্রকৃত অবস্থা জানা ও সেই অনুযায়ী ব্যবস্থা নেয়া।
বন্দরে পৌঁছে দ্রাগুত দেখল একটা মাত্র ইম্পিরিয়াল গ্যালি ছাড়া পুরো বন্দর খাঁ-খাঁ করছে। শহরের ওলট-পালট অবস্থার কথা নতুন করে বলার কিছু নেই। বন্দরে বসে থাকা ইম্পিরিয়াল গ্যালির দাঁড়ে বসে আছে বন্দি তুর্কি দাসেরা। কিন্তু সেটাকে আর কোন গ্যালি বা যুদ্ধজাহাজ পাহারা দিচ্ছে না।
এটা প্রসপেরোর নিজের গ্যালি। অন্য গ্যালিগুলোতে করে ডোরিয়ার সঙ্গে পাঠিয়ে দিয়েছে শার্শেল থেকে উদ্ধার করা খ্রিস্টান বন্দিদের। স্প্যানিশ সৈন্যদের উদ্ধার করার আশায় দুইশ লোক নিয়ে বন্দরে নেমেছে প্রসপেরো।
পাহারা না থাকায় বিনা কষ্টে প্রসপেরোর জাহাজটা দখল করে নিল দ্রাগুত। তারপর কোর্সেয়ারদের বিরাট এক দল নিয়ে শহরের দিকে অগ্রসর হতে শুরু করল সে। শহরের পথে খণ্ড-খণ্ড লড়াইয়ের চিত্র তাকে টেনে নিয়ে গেল শহরের পূর্ব দিকে প্রাচীন রোমান অ্যাম্ফিথিয়েটারের দিকে। ওখানে পৌঁছে দেখল প্রায় একশ স্প্যানিশকে উদ্ধার করেছে প্রসপেরো। কিন্তু সবাইকে নিয়ে নিজেই ফাঁদে পড়ে গেছে সে। ওকে চারদিক থেকে ঘিরে রেখেছে আলিকটের বাহিনী। ষাঁড় টানা গাড়ি দিয়ে দুর্গ থেকে অনেকগুলো বন্দুক আনা হয়েছে। উদ্দেশ্য, ঘেরে আটকা পড়া প্রসপেরোর দলকে ওখানেই কতল করা হবে।
এখানে জোরাল ভূমিকা নিল দ্রাগুত। ওদেরকে মেরে ফেলার বদলে বন্দি করার সিদ্ধান্ত নিল সে। যদিও ওদেরকে আটকেছে আলিকট। তার উপর দ্রাগুতের থেকে বয়সেও সে বড় আর স্বভাবেও রুক্ষতর। কিন্তু তারপরও সহজেই পরিস্থিতির নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নিল দ্রাগুত। কারণ ইসলামের উন্মুক্ত তরবারি সে। প্রসপেরোদের উপর গোলাগুলি করার বদলে আত্মসমর্পণের প্রস্তাব দিয়ে সাদা পতাকাসহ একজন ট্রাস্পেটধারীকে অ্যাম্ফিথিয়েটারের ভিতর পাঠাল সে।
আত্মসমর্পণের প্রস্তাব পেয়ে সিদ্ধান্ত নেয়ার দায়িত্ব নিজের অনুসারীদের উপর ছেড়ে দিল প্রসপেরো। কিছুক্ষণ আগে ওরাও দেখেছে দুর্গ থেকে বন্দুক এসেছে। সবাই ধরেই নিয়েছে যমদূত হাজির। কিছুক্ষণের ভিতরই ওদের ভবলীলা সাঙ্গ হবে। কাজেই শেষবারের মত ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা শুরু করেছিল সবাই। ঠিক ওই মুহূর্তে ঈশ্বরের কৃপা হিসেবে ওদের সামনে এসেছে প্রাণ বাঁচানোর সুযোগ। সঙ্গে সঙ্গে সুযোগটা লুফে নিল তারা। যদিও আত্মসমর্পণ মানে শৃঙ্খলে বন্দি দাসত্বের জীবন। কিন্তু তারপরও, প্রাণ তো বাঁচল। নীরবে যার-যার হাতিয়ার ফেলে দিল সৈন্যরা। তখন হৈ হৈ করতে করতে ওদের ঘিরে ধরল মুসলিম সৈন্যরা। ওদেরকে নিয়ে গেল অস্থায়ী কয়েদখানার দিকে।
সবার শেষে গেল প্রসপেরো। অত্যন্ত তিক্ততার সঙ্গে ও ভাবছে, জিয়ানেট্টিনোর সৈন্যদের শৃঙ্খলাহীন আচরণের কারণে আজ সৈন্যসহ ফাঁসতে হয়েছে ওকে। মনে মনে তীব্র ঘৃণাভরে গাল দিচ্ছে ডোরিয়াকে। কারণ ওদেরকে সাহায্য করার বদলে এখানে নিরুপায় অবস্থায় ফেলে পালিয়ে গেছে সে-ও।
প্রসপেরো তীরে নেমেছিল স্প্যানিশ সৈন্যদের উদ্ধার করতে, যা কমাণ্ডার হিসেবে ওর নৈতিক দায়িত্ব। এখানে একজন খ্রিস্টান নাইট হিসেবে ডোরিয়ার উচিত ছিল অন্তত প্রসপেরোর ফেরার জন্য শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত অপেক্ষা করা। কিন্তু প্রসপেরোকে বন্দরে একা ফেলে গভীর সাগরে পালিয়ে গেছে সে। ফলে প্রসপেরোর, মনে কোন সন্দেহই রইল না যে, যতই ওরা সন্ধি করুক না কেন, ওদের শত্রুতা আসলেই কখনো শেষ হবার নয়। ভাবছে, এতদিন ও বোকার স্বর্গে বসবাস করেছে, কারণ ও সত্যিই ভেবে নিয়েছিল, সন্ধির মাধ্যমে ডোরিয়াদের সঙ্গে অ্যাডর্নো পরিবারের গোলযোগের অবসান হয়েছে। কিন্তু এখন ও স্পষ্ট বুঝতে পারছে, এই গণ্ডগোল কখনোই শেষ হবার নয়; হবেও না। বুঝতে পারছে, স্রেফ ওকে মৃত্যুমুখে ফেলার জন্যই এভাবে পালিয়েছে ডোরিয়া।
বন্দিদশায় কেমন দুরবস্থা হতে পারে সেই চিন্তা প্রসপেরোর মনে দাগ কাটছে না। বরং ডোরিয়াকে নিয়ে এসব চিন্তাই জগদ্দল পাথরের মত চে েবসে আছে প্রসপেরোর মাথায়। চারদিক থেকে ঘিরে থাকা মুসলিম সৈন্যদের কটুক্তি আর অপমানজনক বাক্যবাণে ধীরে ধীরে হুঁশ ফিরল প্রসপেরোর। তখনই ও খেয়াল করল যে ওর সামনে দাঁড়িয়ে আছে প্রিন্স-সুলভ চেহারার এক লোক। তার মাথায় সুচাল, চকচকে রূপালী শিরস্ত্রাণের উপর সিল্কের সবুজ পাগড়ি বাঁধা। আর কোমরে বাঁধা আছে লম্বা ঝুলের মূল্যবান রত্নখচিত চামড়ার বেল্ট। বেল্টে ঝুলছে হাতির দাঁতের হাতল আর স্বর্ণে বাঁধানো সিমিটার (ভারী তুর্কি তলোয়ার)। প্রসপেরোর সামনে দাঁড়িয়ে আছে দ্রাগুত।
একহারা গড়নের, লম্বা শক্তিশালী শরীরের অধিকারী দ্রাগুত। তীক্ষ্ণ চোখে প্রসপেরোকে জরিপ করছে সে। হঠাৎ তার শ্মশ্রুমণ্ডিত মুখে ফুটে উঠল এক চিলতে রহস্যময় হাসি। প্রসপেরোর দিকে এগিয়ে গেল সে। ওদের মাঝে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষগুলোর উদ্দেশে স্রেফ একবার ধমকে উঠে বলল, বালাক। প্রসপেরোর একদম সামনে চলে এল সে। তারপর ওর দিকে তাকিয়ে সসম্ভ্রমে সালাম দিল দ্রাগুত। হেসে খানিকটা বিকৃত ফ্রেঞ্চে বলল, যুদ্ধ-ভাগ্য, স্যর প্রসপেরো।
দ্রাগুতকে দেখে একটু অবাক হলেও সামলে নিয়ে প্রসপেরো বলল, ঠিক বলেছেন, যুদ্ধ-ভাগ্য। তবে আপনার হাতে বন্দি হতে হওয়ায় বলব, আমি সৌভাগ্যবান।
আত্মসমর্পণের উদ্দেশ্যে তলোয়ারের বেল্ট খুলতে শুরু করল প্রসপেরো। কিন্তু তাকে বাধা দিল স্বয়ং দ্রাগুত। প্রসপেরোর হাত চেপে ধরে বলল, রাখুন, রাখুন, ডন প্রসপেরো। তলোয়ারটাকে জায়গামত থাকতে দিন। দুজন ভদ্রলোকের মাঝে মুখের কথাই যথেষ্ট বলে আমি মনে করি।
খ্রিস্টানদের দৃষ্টিতে দ্রাগুত স্রেফ একজন জলদস্যু। কিন্তু আজ প্রমাণ করল অন্যদের থেকে অনেক আলাদা ও উন্নত মানসিকতার অধিকারী, সে।
জবাবে একবার বাউ করে প্রসপেরো বলল, আপনি আসলেই মহৎ লোক, সিনর দ্রাগুত।
দ্রাগুত বলল, যে আমার সঙ্গে যেমন আচরণ করে, আমিও তার সঙ্গে তেমনই করি। যখন আপনার বন্দি ছিলাম আপনার কাছ থেকে সৌজন্যমূলক আচরণ পেয়েছি। আজ ভাগ্যের ফেরে আপনি আমার হাতে বন্দি হয়েছেন। আপনিও আমার কাছ থেকে একইরকম সৌজন্য পাবেন। তবে কিনা, বুড়ো:বদমাশ আন্দ্রের পিছু ধাওয়া করে আপনাকে পেয়ে যাব সেটা আমি ভাবিনি।
ওই যে বললেন, যুদ্ধ-ভাগ্য; জানেনই তো, একজন যোদ্ধার জীবন সবসময়ই নিয়ন্ত্রিত হয় নানান ঘটনা-দুর্ঘটনার দ্বারা।
প্রসপেরোর বক্তব্য শুধরে দিতে দ্রাগুত বলল, সবকিছু নিয়ন্ত্রিত হয় আল্লাহতায়ালার ইচ্ছা অনুযায়ী। হয়তো তাঁরই ইচ্ছা যে আমার মুক্তিপণের তিন হাজার ডাকাট আবার আমি ফিরে পাব। তবে চিন্তা করবেন না। আপনার আতিথেয়তার ত্রুটি হবে na। আপনি বন্দি নন, আমার অতিথি।
শার্শেলে দ্রাগুতের আতিথেয়তায় রইল প্রসপেরো। অনেক চিন্তাভাবনার পর এবং দ্রাগুতের পরামর্শে দূত পাঠানো হলো ডোরিয়ার কাছে, যদিও প্রসপেরোর তখনও মনে হচ্ছিল ডোরিয়া ওর সঙ্গে আবারও অন্যায় আচরণ করবে। দূতের জেনোয়ায় গিয়ে ফিরে আসা পর্যন্ত যে সময় দরকার, ততদিন ধৈর্য ধারণ করতে বাধ্য হলো ও।
কয়েকদিন পরের কথা। প্রসপেরোকে নিয়ে আলজিয়ার্সের দিকে রওনা হয়েছে, দ্রাগুত। সে প্রসপেরোকে জানাল যে, বারবারোসার ফ্লিটের চোখে ধুলো দিয়ে পালিয়ে গেছে ডোরিয়া।
প্রসপেরো তখন বলল, পালাতে না পারলেই আমি বেশি খুশি হতাম।
তাই? কিন্তু স্পেন সম্রাট কি খুশি হতেন? বা ধরুন, তার সঙ্গী নাবিকরা, তারা কি খুশি হত? সব প্রশংসা আল্লাহর। তার হাতেই সবার ভাগ্যের নিয়ন্ত্রণ। আমি কাপুরুষ নই। কিন্তু তাই বলে এমন জায়গায় আমি আক্রমণ করব না, যেখানে আমার ধ্বংস হওয়ার ঝুঁকি প্রবল। এটা কুশলী রণনেতৃত্ব নয়। কোন সুনাম নিয়ে বাড়ি ফিরতে পারছে না মেসার ডোরিয়া। তবে অন্যভাবে অবশ্য বলা যায় তিনি সফল। কারণ জীবিতাবস্থায় তার বাড়ি ফেরারই কথা না।
ওদিকে মেজরকা-তে পৌঁছেছে ডোরিয়া। কিন্তু তার অবস্থাও ভাল না। জাহাজের সংখ্যা আগের চেয়ে দুটো কম। কারণ দুটো গ্যালি মাঝসাগরে সমস্যায় পড়েছিল। ফলে ওগুলো দখল করতে একটুও দেরি করেনি বারবারোসা। সেইসঙ্গে বন্দি হয়েছে তার সাতশ সৈন্য। আটশ খ্রিস্টান সৈন্য মুক্ত করার বদলে সাতশ সৈন্যকে বন্দি হয়েছে। এই অপমানের বোঝা মাথায় নিয়ে বাড়ি ফেরা ডোরিয়ার পক্ষে সম্ভব না। ফলে নিজের পক্ষে সাফাই গাওয়ার জন্য আগে ভাল একটা গল্প পেতে হবে তাকে। সেটারই অপেক্ষা করছে সে। তাই পরের দিনই সে পাল খাটাল গালফ অভ আলজিয়ার্সের উদ্দেশে পথে মুসলিমদের মিশরগামী চারটা গ্যালি পেল সে। নির্দ্বিধায় সেগুলোর উপর ঝাঁপিয়ে পড়ল ডোরিয়া। প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই দখল করে নিল একটা জাহাজ। বাকিগুলো লেজ তুলে উপকূলের দিকে ভাগল। দখলকৃত জাহাজের দাঁড় থেকে বন্দি খ্রিস্টান দাসদের মুক্ত করল ডোরিয়া। প্রসপেরোর মুক্ত করা অন্যান্য সাবেক বন্দিদের দলে ভিড়িয়ে দেয়া হলো তাদের।
ডোরিয়ার হিসেবে এ-ই যথেষ্ট। বারোশ খ্রিস্টান দাসকে উদ্ধার করা আর শস্য বোঝাই একটা গ্যালি দখল করাই সাগরে তার প্রতিপত্তি বোঝাতে যথেষ্ট। তারপর এই মহান বিজয়গাথা এমনভাবে সম্রাটের সামনে সে তুলে ধরল যে, সামান্য কিছু সৈন্য খোয়াতে হওয়াটাকে আর কোন গুরুত্বই দিলেন না সম্রাট। ওদিকে সবাই ধরে নিয়েছে, মহান এক লড়াইয়ে প্রাণ খুইয়েছে প্রসপেরো। বীরত্বপূর্ণ লড়াই করে প্রসপেরো শহীদ হওয়া নিয়ে ডোরিয়ার চাপে ও হুকুমে কাব্যিক প্রতিবেদন দাখিল করল কারবাজাল।
ওর বীরত্বের কথা ডোরিয়াও তার প্রতিবেদনে তুলে ধরল। কিন্তু সঙ্গে মন্তব্য করতে ভুল করল না যে, অবাধ্য সৈন্যদের উদ্ধারের ওই লড়াইয়ে প্রসপেরো জিতলেও আখেরে তাদের লাভ কিছুই হত না।
প্রসপেরোর মৃত্যুসংবাদ শুনে সত্যিকারের বন্ধুর মতই শোক করল ডেল ভাস্টো। প্রসপেরোর কথা এমনিতেও সম্রাটের মনে। ছিল। তার উপর ডেল ভাস্টোও সম্রাটকে মনে করিয়ে দিল যে একজন প্রকৃত যোদ্ধা ও কুশলী নৌ-কমাণ্ডার হারিয়ে সম্রাটের অনেক বড় ক্ষতি হয়ে গেছে। শুনে কেবল বড় একটা দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেললেন স্পেন সম্রাট।
ডোরিয়ার প্রতিবেদনে লড়াইয়ের বর্ণনার পাশাপাশি অন্যান্য বিষয়ের উপরও আলোকপাত করা হয়েছে। যেমন, সে লিখেছে, সমুদ্রপথে সম্রাটের পাঠানো সামরিক অভিযানের ফলে সাগরে কোর্সেয়ারদের শক্তি বৃদ্ধি বা শক্তি প্রদর্শনের খুব বেশি সম্ভাবনা আর নেই, ইত্যাদি-ইত্যাদি।
শার্শেল থেকে লোক-লস্করসহ ওভাবে পালিয়ে আসা নিয়ে ডোরিয়ার মনে এতটুকুও খেদ নেই। মাথা উঁচু করে জেনোয়ায় ফিরে এল সে। সেইসঙ্গে ভান করল সঙ্গী সৈন্যদের হারাতে হওয়ায় বেদনা ভারাক্রান্ত হয়ে আছে তার হৃদয়। তবে সাফল্যমণ্ডিত অভিযান শেষে সমুন্নত মস্তকে ফিরে আসা অ্যাডমিরালের খোলস ঝেড়ে ফেললে বলতেই হবে, ভিতরে ভিতরে সে খুবই উদ্বিগ্ন।
যুদ্ধফেরত এই মহান বীর-কে সংবর্ধনা দিতে সাধারণ মানুষের সঙ্গে জেনোয়ার বড় পরিবারগুলোর দায়িত্বশীল ও গুরুত্বপূর্ণ লোকরাও ফুল, ব্যানার আর ট্রাম্পেট হাতে হাজির হয়েছে বন্দরে।
এত লোকের ভিড়েও প্রথমেই অ্যাডমিরালের চোখ পড়ল তার স্ত্রী প্যারেট্টার উপর। তারপরই দৃষ্টি গেল গম্ভীর, শোকস্তব্ধ ও নিথর হয়ে দাঁড়িয়ে থাকা জিয়ান্নার উপর। তার চোখের ঔজ্জ্বল্য হারিয়ে গেছে। সেখানে জায়গা নিয়েছে রাজ্যের বিষাদ। স্থাণুর মত ওর নিথর নিস্তব্ধতা বলে দিচ্ছে যে আবেগের উপর আগের মত আর নিয়ন্ত্রণ নেই ওর।
অ্যাডমিরালের প্রতিবেদন মোতাবেক-সবাই ইতিমধ্যেই জেনে গেছে যে প্রসপেরো আর বেঁচে নেই। জিয়ান্নার কাছে ডোরিয়া ওয়াদা করে গিয়েছিল, প্রসপেরোকে নিরাপদে ফিরিয়ে এনে তার হাতে তুলে দেবে। কিন্তু তার নিজেরই প্রতিবেদন বলছে ওয়াদা পূরণে চরমভাবে ব্যর্থ হয়েছে সে।
ডোরিয়াকে স্বাগত জানাতে বন্দরে আসার জন্য ধন্যবাদ জানিয়ে জিয়ান্নার গালে চুমু খেল ডোরিয়া। কিন্তু নির্বিকারভাবে দাঁড়িয়ে রইল জিয়ান্না। ডোরিয়ার সবচেয়ে অদ্ভুত লাগল যে, তাকে কোন প্রশ্নই করছে না জিয়ান্না। ফলে দুঃসংবাদ শোনানোর কাজটা ডোরিয়ার জন্য অনেক বেশি কঠিন হয়ে গেল।
বন্দরের আনুষ্ঠানিকতা সেরে ফসোলু প্রাসাদে পৌঁছে প্যারেট্টা আর জিয়ান্নাকে একান্তে পেয়েই দুঃসংবাদটা শোনাল ডোরিয়া। এমন এক সুরে সেকথা বলা শুরু করল যে, কথার ধরনেই জিয়ান্নার বোঝা উচিত কী হয়েছে। ডোরিয়া বলল, তোমার জন্য একটা খারাপ খবর আছে, জিয়ান্না।
কিন্তু অবাক কাণ্ড, জিয়ান্নার তরফ থেকে কোন প্রতিক্রিয়াই এল না। এমন কিছু ভুলেও ডোরিয়া আশা করেনি। অদ্ভুত, অস্বাভাবিকভাবে বসে আছে জিয়ান্না। ডোরিয়ার গম্ভীর অনুসন্ধিৎসু দৃষ্টির জবাবে সে ফিরিয়ে দিল আহত দৃষ্টি। পার্শিয়ান ডিভানে জিয়ান্নার পাশে বসে গভীর সমবেদনার সঙ্গে ওর হাত ধরে রেখেছে প্যারেট্টা।
পুরো ব্যাপারটাই ভীষণ রহস্যময় বলে মনে হচ্ছে ডোরিয়ার। কিন্তু কোন ব্যাখ্যা সে চাইল না। বরং বলে গেল তার নিজের বানানো গল্প। প্রসপেরোর বীরত্বের গল্প। তবে বলা হলো এমন ঢঙে যে, মনে হলো ওই লড়াইয়ে প্রসপেরোর বাঁচার কোন সম্ভাবনাই ছিল না। তাই ওর শেষ পরিণতি নিজের চোখে না। দেখলেও ডোরিয়া নিশ্চিত যে, মৃত্যুর আলিঙ্গনে বাঁধা পড়েছে প্রসপেরো।
ডোরিয়া আশা করেছিল গল্প শুনে শোকে ভেঙে পড়বে জিয়ান্না। এমনকী প্রসপেরোকে উদ্ধার করা বাদ দিয়ে নিজের ফ্লিট নিয়ে পালিয়ে আসার পক্ষে সাফাই গাইতেও প্রস্তুত ছিল সে। কিন্তু কোন সাফাই চাইল না জিয়ান্না। কেবল বিষণ্ণ দৃষ্টি ফুটে রইল তার চোখে।
ডোরিয়া বলে চলেছে, প্রসপেরোর তরফ থেকে স্রষ্টাকে ধন্যবাদ দিচ্ছি যে, ওর অন্তিম মুহূর্তটাকে অমন অবিস্মরণীয় করে দিয়েছেন তিনি।
কিন্তু তখন জিয়ান্নার মুখ দিয়ে যে ঘটনার বয়ান বের হলো তার জন্য মোটেও প্রস্তুত ছিল না ডোরিয়া।
.
১৯.
অরেলিয়ার নির্বুদ্ধিতা
স্ত্রীর কাছ থেকে জিয়ান্নার এই নির্লিপ্ততার কারণ জানতে পারল ডোরিয়া। খবরটা শুনে একইসঙ্গে বিস্ময়ে হতভম্ব, শঙ্কায় উদ্বিগ্ন ও শোকে প্রায় নিথর হয়ে গেল সে।
কয়েকদিন পিছনে ফিরে যাই। আলজিয়ার্সের পথে প্রসপেরোদের, স্প্যানিশ ফ্লিট রওনা হয়েছে কি হয়নি, ডোরিয়া ও অ্যাডর্নো পরিবারের সমর্থকরা মুখোমুখি দাঁড়িয়ে গেছে। প্রকাশ্যে যে যা-ই বলুক, অ্যাডর্নো বংশের মাথা ডোরিয়া পরিবারে বিয়ে করবে এটা তারা মানতে পারছে না।
অ্যাডর্নোরা ভাবছে তাদের সঙ্গে বেইমানি করেছে প্রসপেরো। ওদের এই মনোভাবের স্পষ্ট বহিঃপ্রকাশও করতে শুরু করল তারা। যখন-তখন, কারণে-অকারণে এক পক্ষের লোকজন আরেক পক্ষের সঙ্গে ঝগড়ায় লিপ্ত হতে শুরু করল। শেষ পর্যন্ত তাদ্দিওকে জনসমক্ষে অপমান করল ফাবিও স্পিনোলি। ঘটনা ডুয়েল পর্যন্ত গড়াল। ডুয়েলে স্পিনোলিকে হত্যা করল তান্দিও। এবং সেই রাতেই স্পিনোলিদের লোক-লস্কর পথে নামল ফাবিওর মৃত্যুর বদলা নিতে।
এদিকে এই ঘটনার জন্য প্রসপেরো আর ওর মা অরেলিয়াকে সম্পূর্ণ দায়ী বলে ভাবে তাদ্দিওর বাবা। রাগ ঝাড়তে সরাসরি অরেলিয়ার কাছে চলে এল সে।
বলল, আমাদের পরিবারের সঙ্গে আপনার ছেলের প্রতারণার সুমিষ্ট ফল ফলতে শুরু করেছে, দেখতে পাচ্ছেন? প্রসপেরোর স্বার্থপর চিন্তার কারণে আজ আমার ছেলে বিছানায় পড়ে কাতরাচ্ছে, পাঞ্জা লড়ছে মৃত্যুর সঙ্গে। যে-কোন সময় মারা যাবে ও। সেইন্ট লরেন্সের শপথ, ও মারা গেলে প্রসপেরোকেও অবশ্যই তার মূল্য চুকাতে হবে। ওর রক্ত দিয়ে রাস্তা রাঙিয়ে দেব আমি।
রাগে লাল হয়ে গেল অরেলিয়ার মুখ। বলল, হুমকি দিচ্ছ?
নয়তো কী? ছেলের হত্যাকারীকে এমনি-এমনিই ছেড়ে দেব?
অরেলিয়া বলল, বেশ তো, যারা ওকে হত্যা করেছে তাদের উপর শোধ নাও গিয়ে। স্পিনোলিদের উপর রাগ দেখা গিয়ে, এখানে হম্বিতম্বি করছ কেন?
ওদের ব্যবস্থাও করব। কিন্তু তার আগে, আজকের পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে যার জন্য, ওই শয়তানকেও ছাড়ব না। আমাদের বংশের উপর প্রসপেরোর আনা লজ্জার বোঝাও পরিষ্কার করব। আর কারো পরিহাসের পাত্র আমরা হতে চাই না। এতটুকু বলে ঝোঁকের বশে ঘোষণা দিল, এখনই প্রসপেরোকে ধরতে রওনা হচ্ছি আমি।
তুমি আর তোমার ছেলে তাদ্দিও, দুজনেই পাগল? বলল অরেলিয়া।
অরেলিয়াকে তাদ্দিওর বাবা বলল, পাগলামির দেখেছ কী, এখন টের পাবে পাগলামি কাকে বলে! তোমার কুলাঙ্গার ছেলের গলা যখন কাটব, বুঝবে, পাগলামি কাকে বলে।
চোখে তীব্র ঘৃণা নিয়ে পরস্পরের দিকে তাকিয়ে রইল প্রসপেরোর মা আর তাদ্দিওর বাবা রেইনাল্ডো। একসময় অরেলিয়া বলে উঠল, কী বলছ, তুমি নিজেও জানো না, রক্তপিপাসু গর্দভ।
জবাবে তীব্র স্বরে রেইনাল্ডো বলল, প্রসপেরোর অন্তিম মুহূর্ত কেমন কাটল, অবশ্যই তুমি জানতে পারবে, বলে বের হওয়ার জন্য ঘুরল সে।
আতঙ্ক গ্রাস করল অরেলিয়াকে। রেইনাল্ডোকে থামানোর জন্য থাবা দিয়ে তার হাত ধরে রীতিমত ঝুলে পড়ল অরেলিয়া। বলল, ঘৃণায়, অন্ধ হয়ে গেছ তুমি। তুমি যা ভাবছ তেমন কিছুই হয়নি। আমার কথা অবিশ্বাস করলে আজীবন পস্তাতে হবে তোমাকে। বুঝতে পারছ না কেন, ডোরিয়াদের সঙ্গে আপাত সন্ধি করা ছাড়া প্রসপেরেরার আর কোন উপায় ছিল না।
তীব্র রোষের সঙ্গে রেইনাল্ডো বলল, যেমন মা, তেমন ছেলে। আর কোন উপায় ছিল না, না? আঁকি দিয়ে অরেলিয়ার হাত ছুটিয়ে নিতে চাইল রেইনাল্ডো। ধমকে উঠে বলল, ছাড়ো আমাকে, ছেড়ে দাও।
কিন্তু তাকে ছাড়ল না অরেলিয়া। তার কাছে এখন কেবল একটা ব্যাপারই মূল্যবান। সেটা হচ্ছে এই রক্তপিপাসু নির্বোধদের রাগ থেকে ছেলের প্রাণ বাঁচানো। যেহেতু প্রসপেরোকে সাবধান করে দেয়া তার ক্ষমতার বাইরে, তাই একমাত্র দৃশ্যমান উপায় হচ্ছে, যে-কোন মূল্যে রেইনাল্ডোকে তার অন্ধ প্রতিহিংসা চরিতার্থ করা থেকে বিরত করা। এবং সেটা করতে হলে, অরেলিয়ার মতে, বিপজ্জনক ও অতি গোপনীয় সত্যটি রেইনাল্ডোর কাছে প্রকাশ করতেই হবে।
উষ্মা ঝরে পড়ল অরেলিয়ার উচ্চারিত প্রতিটি শব্দে। সে বলল, অন্ধ, নির্বোধ কোথাকার, অ্যাডর্নোরা ধ্বংস হয়ে গেলে ডোবিয়া ছাড়া কার লাভ হত? ডোরিয়াদের সঙ্গে আমাদের হিসাব বরাবর করার আগে অ্যাডর্নোদেরকে জেনোয়ার মাটিতে পা রাখতে দেয়াটা ছিল বেশি জরুরি। আমাদের হাত থেকে ডোরিয়ারা নিরাপদ, সেটা বোঝানো ছাড়া অ্যাডর্নোদের এখানে আনা কি সম্ভব হত?
একটু থমকাল রেইনাল্ডো। বলল, কী বলতে চাইছ? কিছু বলার থাকলে পরিষ্কার করে বলো।
বুদ্ধু ছাড়া সবার জন্যই তো ব্যাপারটা পানির মত পরিষ্কার। প্রসপেরো ওদের সঙ্গে তোক দেখানো সন্ধি করেছে যাতে গোপনে ডোরিয়াদের ধ্বংসের কাজ গুছিয়ে আনতে পারে।
কোমরে হাত রেখে ঘুরে দাঁড়াল রেইনাল্ডো। বলল, তাহলে জিয়োভান্নার সঙ্গে ও বাগদান করল কেন? মনে হচ্ছে ওই কথাটা তুমি ভুলে গেছ। তোমার আবোল-তাবোল গল্পে বিভ্রান্ত হচ্ছি না আমি।
আবোল-তাবোল নয়, গসপেলের কসম, সত্যি বলছি। সত্যি বলছ!
তাহলে প্রসপেরোর বাগদত্তার কী হবে?
কুটিল হাসি ফুটল অরেলিয়ার মুখে। বলল, ওর আবার কী? ডোরিয়াদের নাম ও নিতে গেছে কেন? প্রসপেরো ওকে ত্যাগ করবে। তখন ওই মেয়ে পরিণত হবে সবার হাসি-তামাশার পাত্রে।
আঁতকে উঠল রেইনাল্ডো। বলল, একথা সত্যি হলে প্রসপেরোর সম্মান ধুলোয় তো লুটাবেই, সঙ্গে ভীষণ অসম্মানিত হবে অ্যাডর্নোরাও। আর মিথ্যা হলে নতুন করে বলার কিছু নেই।
অরেলিয়া বলল, যেটাই ঘটুক তুমি খুশি হবে, তাই না, রেইনাল্ডো?
না, খুশি হব না।
অরেলিয়া বলল, তোমাকে খুশি করা দেখছি খুবই কঠিন।
না, অরেলিয়া। আমার মধ্যে এখনও কিছুটা ভদ্রতা আছে।
নতুন কথা শোনালে, রেইনাল্ডো।
ঝগড়া মেটাতে আমি কোন মহিলার আঁচলের নিচে গিয়ে লুকাই না। শত্রুর সঙ্গে মুখোমুখি মোকাবেলা করি আমি।
শুনে হেসে উঠল অরেলিয়া। বলল, আরেকটা নতুন কথা শোনালে। আগে তো দেখেছি, নিজের শত্রুর উপর অন্যদের লেলিয়ে দিতে তুমি। তা তুমি যদি এতই সাহসী হও, তাহলে ডোরিয়া যখন এখানে ছিল তখন তুমি নিজেই ওর দাড়ি টেনে ধরলে না কেন? আর আন্দ্রে ছাড়াও জেনোয়ায় আরো যে ডোরিয়ারা আছে, তাদেরই বা ধরছ না কেন? এখানে আমার সঙ্গে চেঁচামেচি না করে ওদের কারো সঙ্গে লড়লে তোমার জেদ মিটবে। বেশি। তো ওদের কাছেই যাচ্ছ না কেন?
ঈশ্বরের কসম, অরেলিয়া, তুমি পুরুষ হলে…
…তুমি আরো সভ্য আচরণ করতে। প্রসপেরো ফিরে এলে তখন ওর সঙ্গে কথা বোলো। সামনাসামনি যখন কথা বলবে তখন দেখব, এখনকার মত দৃপ্ত থাকতে পারো কিনা।
ঘৃণা পুষে রেখেই চলে গেল রেইনাল্ডো।
চিন্তা করতে বসল অরেলিয়া। এবং ঠাণ্ডা মাথায় একটু ভাবতেই বুঝল, প্রসপেরোর পরিকল্পনা যে উদ্দেশ্যে সে প্রকাশ করেছে তা তো পূরণ হয়ইনি, উল্টো বিপরীত ফল হবে এখন। অরেলিয়া চেয়েছিল প্রসপেরোর পরিকল্পনা ফাঁস করে রেইনাল্ডোকে ঠাণ্ডা করতে, যাতে মাথা গরম লোকটার কারণে প্রসপেরোর পরিকল্পনায় পানি না পড়ে। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে অরেলিয়া ভুলে গিয়েছিল, রেইনাল্ডোকে বিশ্বাস করার কোন উপায় নেই। ভীষণ ভয় পেয়ে গেল অরেলিয়া। কারণ রেইনাল্ডো অবশ্যই মুখ খুলবে। এবং সেটা চারদিকে ছড়িয়ে পড়বে। তার অবশ্যম্ভাবী ফল, কথা যাবে ডোরিয়াদের কানে। ধ্বংস হয়ে যাবে প্রসপেরোর প্রতিশোধ নেয়ার ইচ্ছা।
সত্যিই প্রসপেরোর প্রতি ঘৃণার কারণে ওসব বলে বেড়াল মাথা গরম রেইনাল্ডো। কিন্তু যখন ওর মাথা ঠাণ্ডা হলো তখন সে-ও বুঝতে পারল যে কী করে বসেছে সে, আর এর ফল কী হবে। জানা কথা, অশুভ কথা বাতাসের আগে যায়। গেছেও তাই।
রেইনাল্ডোর সঙ্গে দেখা হবার তিন-চার দিন পরের কথা। অরেলিয়ার চেম্বারলিন এসে বলল, তার সঙ্গে দেখা করতে এসেছে। ডাচেস অভ মেলফি, মানে ডোরিয়ার স্ত্রী ও তার অতিজি। বলা বাহুল্য, ভাতিজি হচ্ছে জিয়ান্না।
শুনেই আতঙ্কিত হয়ে গেল অরেলিয়া। প্রথমে ভাবল এই অনাকাঙ্ক্ষিত অতিথিদের সঙ্গে দেখাই করবে না। কিন্তু তারপরই তার ভিতর মাথা চাড়া দিল স্ট্রোজ্জিসুলভ গর্ব। কার্বেলে বাঁধানো সিড়ি দিয়ে নিচে নেমে এল অরেলিয়া। নিজের অবস্থান ও মর্যাদা সম্বন্ধে পূর্ণ সচেতন সে। যে কক্ষটায় তারা দেখা করল সেটার, ছাদ ধরে রেখেছে জটিল নকশাঙ্কিত অনেকগুলো কলাম, পুরো ফ্লোর মূল্যবান মোজাইকে ঢাকা। ওখানেই প্রথমবারের মত পরস্পরকে দেখল প্রসপেরোর মা আর ওর বাগদত্তা স্ত্রী।
অরেলিয়ার চেহারায় ফুটে আছে বিদ্রূপ মাখা আত্মম্ভরিতা। আর জিয়ান্নার চেহারায় ফুটে আছে অস্পষ্ট একটা দুঃখী ভাব ও খানিকটা যেন রহস্যময়তা। মনে মনে জিয়ান্নার অভিব্যক্তির প্রশংসা করল অরেলিয়া, কিন্তু তাতে ওর প্রতি ঘৃণা একটুও কমল না।
সবার অভিব্যক্তিই মুখোশাবৃত। জিয়ান্নার ভিতরটা ছিঁড়েখুঁড়ে যাচ্ছে কিন্তু মোটামুটি নির্লিপ্ততার মুখোশ পড়ে আছে সে। এমনকী প্যারেট্টার মুখের ভদ্রতাসূচক স্মিত হাসিটিও অভিনয়।
সিঁড়ির গোড়ায় এসে পুরোপুরি আনুষ্ঠানিক ভঙ্গিতে ডাচেস আর তার ভাতিজিকে অভ্যর্থনা জানাল অরেলিয়া। বলল, আমার বাড়িতে আপনাদের পর্দাপণে সম্মানিত বোধ করছি।
হাসিমুখে অরেলিয়ার সম্ভাষণের জবাব দিল ডাচেস। বলল, আপনার শরীর-স্বাস্থ্য খারাপ থাকায় আমাদের ঘরে পা রেখে সেটাকে সম্মানিত হবার সুযোগ দিতে অপারগ ছিলেন। তাই আমার মনে হলো, আমার ভাতিজিরই দায়িত্ব হবু শাশুড়িকে দেখতে আসা।
জবাবে অরেলিয়া বলল, দায়িত্বটা পালনে একটু দেরি হয়ে গেল না? কথার উত্তরে ফিরিয়ে দিল কথার আঘাত। যেন কথা দিয়ে তলোয়ার যুদ্ধ করছে দুজন। অতিথিদেরকে জানালার সামনে মুখোমুখি আসনে বসতে দিল অরেলিয়া। আর নিজে বসল জানালার দিকে পিঠ দিয়ে।
জিয়ান্না বলল, আপনার সঙ্গে দেখা করাটা আর পিছানো সম্ভব হলো না। একটা জরুরি বিষয় নিয়ে কথা বলা দরকার ছিল, এখন সেটা প্রকট রূপ ধারণ করেছে। তাই আপনাকে বিরক্ত করতে আসা। এমনকী শত্রুভাবাপন্ন প্রসপেরোর মারও পছন্দ হয়ে গেল জিয়ান্নার মধুমাখা কণ্ঠের শান্ত অনুরণন।
ভাবছি, কী এমন হলো যে তুমি এতটা উদ্বিগ্ন হয়ে উঠেছ।
সন্তুষ্ট কণ্ঠে প্রশ্ন করল ডাচেস, সত্যিই তা-ই ভাবছেন? বলতে বলতে ময়ূরের পেখম দিয়ে বানানো হাতপাখা দিয়ে। নিজেকে বাতাস করতে থাকল সে। তারপর আবার বলল, নাকি, আমরা কেন এসেছি সেটা আন্দাজ করে নিয়েছেন?
কোন ব্যাপারে সত্য জানার সুযোগ থাকলে কখনোই অনুমান করে সময় নষ্ট করি না আমি।
মনে বেশ দ্বিধা চলে এলেও বন্ধুত্বের ভাব বজায় রেখে কথা বলল প্যারেট্টা। বলল, স্বীকার করছি, আমি একটু সন্দেহই করেছিলাম যে, শুধু স্বাস্থ্যগত কারণেই কি আপনি আমাদের বাড়ি আসেননি? সন্দেহটা আরো বেড়েছে আপনার হবু পুত্রবধূকে নির্লিপ্ত আবেগহীনভাবে স্বাগত জানাতে দেখে।
অরেলিয়ার মুখে হাসি আছে বটে, তাতে মোটেও আন্তরিকতা নেই। সে বলল; উষ্ণ সম্ভাষণ সে পেত, যদি আমার মতামতকে গুরুত্ব দিয়ে আমার ছেলে তার স্ত্রী পছন্দ করত। তাছাড়া ওর এই কাণ্ডটা আমি কখনো আশা করিনি। সরাসরি যদি বলি, এটাই মূল কারণ।
এটাই কি একমাত্র কারণ? সত্যি বলছেন? নিরুত্তাপ কণ্ঠে বলল জিয়ান্না।
মিথ্যাটা বললাম কোথায়? বলল অরেলিয়া।
ডাচেস বলল, আসলে সেটা জানতেই আমরা এসেছি।
অধৈর্য হয়ে উঠল জিয়ান্না। তলোয়ার খেলার মত বাক্যে বাক্যে ঠোকাঠুকি বাদ দিয়ে সরাসরি মূল প্রসঙ্গ উত্থাপন করল সে। বলল, বাজারে গুজব রটছে। খুবই অস্বস্তিকর, লজ্জাজনক আর কুৎসিত গুজব। এতটাই লজ্জাস্কর আর নোংরা যে কথাটা সত্য কিনা তা সরাসরি জিজ্ঞেস করতে আমার আন্টি দ্বিধা করছে। কারণ তিনি ভাবছেন এতে আপনি অপমানিত বোধ করতে পারেন। প্যারেট্টার দ্ৰতা আমার ভিতর না দেখলে ক্ষমা করবেন। নিশ্চয়ই বুঝতে পারছেন, গুজবের সত্যতা সম্বন্ধে জানা আমার জন্য খুবই জরুরি। গুজবটা হচ্ছে…।
এ পর্যন্ত বলতেই জিয়ান্নাকে বাধা দিল অরেলিয়া। জিয়ান্নার উচ্চারিত প্রতিটা শব্দ অরেলিয়াকে অধিক থেকে অধিকতর লাগিয়ে তুলছে, বাড়িয়ে দিচ্ছে জিয়ান্নার প্রতি তার ঘৃণার মাত্রা। জিয়ান্নার কথা শেষ হবার আগেই রাগে প্রায় উন্মাদ হয়ে গেল সে। মাত্ৰাজ্ঞান হারিয়ে ফেলল, বিস্ফোরণের মত তার মুখ দিয়ে বেরিয়ে এল, বলার দরকার নেই, আমি জানি বাজারে কী রটছে। তুমি লজ্জা আর অপমানের কথা বলছ, মেয়ে? বলতে পারো, একজন অ্যাডনোর জন্য তার বাবার হত্যাকারীদের সঙ্গে হাত মেলাবার চেয়ে বেশি অপমানের আর কী আছে?
অরেলিয়ার কথা শুনেই দম বন্ধ করে ফেলেছে ডাচেস। কিন্তু জিয়ান্নার মুখের হাসি অমলিন। ও বলল, প্রসপেরো এই জঘন্য কাজ করলে সেই অপমান হবে তার চেয়েও অনেক বড়।
জবাবে অরেলিয়া বলল, এই ব্যাপারে আমাদের দৃষ্টিভঙ্গি ভিন্ন হওয়াই স্বাভাবিক। তবে সেই অপমানও আমরা সহ্য করতে পারব।
রীতিমত আঁতকে উঠে ডাচেস বলল, আপনি বলতে চাইছেন গুজবটা গুজব নয়, সত্যি? রীতিমত বিকৃত হয়ে উঠেছে তার চেহারা। একমুহূর্ত সময় নিল সে নিজেকে সামলে নিতে। তারপর অরেলিয়াকে উদ্দেশ্য করে বলল, বললেন, আমাদের দৃষ্টিভঙ্গি ভিন্ন। মেনে নিচ্ছি। কথাটা স্পষ্টভাবে বলার জন্য ধন্যবাদ। তারপর জিয়ান্নাকে বলল, চলো, ওঠো। আমরা জবাব পেয়ে গেছি।
কিন্তু জিয়ান্নার মুখে তখনও ফুটে আছে সেই অদ্ভুত হাসি। আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে ও বলল, আমরা মিথ্যা কথা শুনছি। অত্যন্ত লজ্জাজনক মিথ্যা। কথাটা ছড়ানো হয়েছে স্রেফ আমাদের আহত ও হেয় করার জন্য। আর কিছু নয়। বলতে বলতে ধীরে ধীরে উঠল সে। বলল, আপনি কি ভুলে গেছেন, আপনার ছেলে এখনও লড়াই নিয়ে ব্যস্ত? একবারও ভেবেছেন, লড়াই থেকে সে না-ও ফিরতে পারে? তখন এই গুজব সত্য বলে প্রমাণ করার কেউ থাকবে না। বরং যারা এসব বলে বেড়িয়েছে লোকে তাদের গর্দভ বলবে। আমার ধারণা, কথাটা একবারও আপনার মাথায় খেলেনি। এখন এটা নিয়ে ভাবুন, আর দয়া করে এমন কিছু বলবেন না যাতে প্রসপেরোর আর আপনাদের নিজেদের অসম্মান হয়। আরেকটা কথা, আপনি যদি ভেবে থাকেন এসব কথা বলে আমাকে আহত করবেন, আঘাত দেবেন; তা পারেননি। এসব অপলাপ বিশ্বাস করে প্রসপেরোর অসম্মান আমি করব না।
আত্মম্ভর অরেলিয়া অনেকবারই অনেককে কটুকথা বলেছে। কিন্তু নিজে কখনো কারো কাছ থেকে এভাবে বাক্যবাণে আক্রান্ত হয়নি। খানিকটা হলেও বেসামাল হয়ে গেছে সে। রুক্ষভাবে হেসে উঠে সে বলল, তাহলে, বোকার স্বর্গে বাস করাই তোমার পছন্দ, না? আর অপলাপ, মিথ্যা বলেছি? হাহ, বলো, প্রসপেরো জেনোয়ায় আছে কতদিন? কিন্তু বিয়ের সময় ও পায়নি কেন? কোন ইঙ্গিত পাচ্ছ, মেয়ে? তুমিই জানো কীভাবে এর ব্যাখ্যা সে দিয়েছে। এখন নিজেই বিবেচনা করো গিয়ে।
জিয়ান্নার বুকে কথাগুলো গিয়ে শেলের মত বিঁধেছে। স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে পুরো শরীর কাঁপছে ওর।
হঠাৎ জিয়ান্নার এই পরিবর্তন অরেলিয়ার চোখ এড়ায়নি। কুটিল ঘৃণাপূর্ণ হাসি হাসল সে। বলল, এখন আর মনে হচ্ছে না যে আমি মিথ্যা বলেছি, তাই না?
এক কদম এগিয়ে আন্টির হাত ধরে নিজেকে স্থির করল জিয়ান্না। তাকে বলল, জবাব পেয়েছি, চলো।
জিয়ান্নাকে জড়িয়ে ধরল প্যারেট্টা। এগুতে এগুতে দরজার চৌকাঠে দাঁড়িয়ে অরেলিয়াকে বিদায় জানাল সে। বলল, আপনার সন্তান আপনার ফ্লোরেন্টাইন রক্তের সত্যিকার উত্তরসুরি। খোদা তাকে সুমতি দিক। এই হীন কাজটায় গর্ববোধ করছেন আপনি, তবুও প্রার্থনা করি ঈশ্বর আপনাকেও সুমতি দিক।
জবাব দেয়া থেকে বিরত রইল অরেলিয়া। বিদায় নিল তার দুই অনাকাক্ষিত অতিথি। যাওয়ার সময় ভীষণ রেগে ছিল ডাচেস, কিন্তু একদমই শান্ত রইল জিয়ান্না। কিন্তু ওর ভিতর আর আগের মত আত্মনিয়ন্ত্রণ নেই। সেদিনের পর ডাচেসের কাছ থেকে নানা মন্তব্য শোনার পরও একদম মুখ খোলেনি ও। এমনকী ডোরিয়া জেনোয়ায় ফিরে প্রসপেরোর বিয়োগ সংবাদ দেয়ার আগ পর্যন্ত একবারও কথা বলেনি।
এতসব নাটকের ব্যাপারে অ্যাডমিরাল প্রথম জানতে পারে তার স্ত্রীর কাছ থেকে। শুনে প্রথমে সে কিছুই বিশ্বাস করেনি। কিন্তু যখন লেডি তাকে মনে করিয়ে দিল যে বিয়ে নিয়ে প্রসপেরো কতটা টালবাহানা করেছে, বিশ্বাস টলে গেল তার। তারপরও সে প্রসপেরোকে পুরোপুরি অবিশ্বাস করেনি। কিন্তু যখন তার ভাতিজারা তাকে মনে করিয়ে দিল যে শার্শেলে থাকতে প্রসপেরো কীভাবে তার হুকুম এড়িয়ে যেতে চেয়েছে, তখন আর নিজেকে নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারল না সে। প্রচণ্ড রাগ বিস্ফোরণের মত বেরিয়ে এল। সে এতটাই রেগে গেল যে তার খুব কাছের লোকও মনে করতে পারছিল না যে ডোরিয়া শেষবার কবে এভাবে রেগেছে।
প্রসপেরোর উপর এভাবে তাকে খেপিয়ে দিতে পেরে অত্যন্ত আনন্দ পেল ফিলিপ্পিনো। বলল, কুত্তাটাকে যখন শেকলে বেঁধে দাঁড়ে বসিয়েছিলাম, ভাল করেই জানতাম কী করছি। এই বেইমানের সঙ্গে সন্ধি করার সময়ই আপনাকে বারণ করেছিলাম। কিন্তু আমার কথা শোনেননি আপনি।
ডিউক এখনও ফিলিপ্পিনোর কথা শুনল না। প্রায় খেঁকিয়ে উঠে বলল, হ্যাঁ, মনে আছে। এখন বলবে আমি একটা ঘাড়ত্যাড়া বুড়ো ভাম আর তোমরা দুজনে খুব বুদ্ধিমান, তাই না? কিন্তু ভুলে যাচ্ছ, সন্ধি তোমাদের পক্ষেই গেছে। বিশেষ করে, ফিলিপ্পিনো, তোমার গর্দান বাঁচিয়েছে এই সন্ধি চুক্তি।
বিরক্ত হয়ে ফিলিপ্পিনো বলল, এখনও আপনি ওর হয়ে সাফাই গাইছেন, মাই লর্ড।
গর্জে উঠল ডোরিয়া, সাফাই? সাফাই গাইছি না, আহাম্মক কোথাকার। ঈশ্বরকে ধন্যবাদ দাও যে, শার্শেলে ও আমার হুকুম অমান্য করেছে। তাতেই আজ ওখানে পচে মরছে ও।
ডিউকের বক্তব্যের সমর্থনে ডাচেস প্যারেট্টার ঠোঁট জোড়া পরস্পরের উপর আরো শক্ত হয়ে চেপে বসল। কিন্তু কেঁপে উঠল জিয়ান্না।
জিয়ানেট্টিনো বলল, কিন্তু আমি এত অল্পে সন্তুষ্ট নই। নরকের কীট তুর্কিরা আমাদের হয়ে শোধ নেবে, তা আমার পছন্দ নয়। নিজের শোধ আমি নিজের হাতে তুলতে চাই।
একই সুর তুলল ফিলিপ্পিনোও। বলল তার তলোয়ারের ফলার নিচে দেখতে চায় প্রসপেরোর গলা।
আন্দ্রে, ফিলিপ্পিনো-আর জিয়ানেট্টিনোর বক্তব্যে স্পষ্ট যে প্রসপেরোর এখনও বেঁচে থাকার সম্ভাবনা আছে। কিন্তু ব্যাপারটা জিয়ান্নার নজরেই পড়ল না।
ক্যাপ্টেনের চিঠি নিয়ে এই ডোরিনা। কাজেনেডিনোর উনে।
.
কয়েক সপ্তাহ পরের কথা। শীত আসি-আসি করছে। সাগর আর আবহাওয়া, দুটোই যেন মাতাল হয়ে আছে। কিন্তু তা সত্ত্বেও জেনোয়ার বন্দরে ভিড়ল একটা সিসিলিয়ান জাহাজ। জাহাজটার ক্যাপ্টেনের নাম ইয়াকুব বেন ইসার। সে ডিউক অভ মেলফির জন্য একটা চিঠি নিয়ে এসেছে।
কিন্তু জেনোয়ায় নেই ডোরিয়া। তার অবর্তমানে ডেপুটি হিসেবে কাজ করছে জিয়ানেট্টিনো। কাজেই বন্দরের এক অফিসার ইয়াকুবকে নিয়ে গেল প্রাসাদে জিয়ানেট্রিনোর কাছে। কার কাছ থেকে চিঠিটা এসেছে জিজ্ঞেস করল জিয়ানেটিনো। জবাবে সে জানাল, তার মালিক দ্রাগুতের হাতে বন্দি হয়ে আছে। মেসার প্রসপেরো। এটা তার মুক্তিপণ দাবি করে লেখা চিঠি। আর কিছু জানার দরকার নেই। সিল ভেঙে ফেলল জিয়ানেট্টিনো।
ইটালিয়ানে দ্রাগুত লিখেছে:
মাই লর্ড ডিউক,
অভিবাদন নিন। জেনে খুশি হবেন যে দয়াময় আল্লাহতায়ালার অশেষ কৃপায় মহান ক্যাপ্টেন মেসার প্রসপেরোর প্রাণ রক্ষা করতে সমর্থ হয়েছি আমি। কিন্তু বর্তমানে তিনি আমার বন্দি। তার মুক্তির জন্য মুক্তিপণ হিসেবে তিন হাজার ডাকাট দাবি করছি। আমার মুক্তির জন্য মুক্তিপণ হিসেবেও এই একই পরিমাণ অর্থ আপনি পেয়েছিলেন আমার লর্ড খায়ের-আদ-দীনের কাছ থেকে। মুক্তিপণের অর্থ পরিশোধ করা মাত্রই মেসার প্রসপেরো মুক্তি পাবে। এবং সঙ্গে সঙ্গেই তাকে নিরাপদে জেনোয়ায় পৌঁছার ব্যবস্থা করে দেব। তবে ততদিন সে আমার দূত ইয়াকুবের নিরাপত্তার স্বার্থে আমার কাছে বন্দি হিসেবে থাকবে। প্রার্থনা করি আল্লাহর দয়ায় লর্ড দীর্ঘজীবী হোন।
.
সঙ্গে সঙ্গে ভাইয়ের খোঁজে লোক পাঠাল জিয়ানেট্টিনো। তারপর দুজনে মিলে আলোচনায় বসল, কী করা যায়। জিয়ানেট্টিনোর ইচ্ছে তিন হাজার ডাকাট গেলে যাক। কিন্তু প্রসপেরোকে এখানে এনে শৃঙ্খলাভঙ্গের দায়ে ওকে প্রকাশ্যে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করতে হবে।
কিন্তু কাজিনের জ্ঞানের বহরে বিরক্ত হয়ে নাক ঝাড়ল ফিলিপ্পিনো। বলল, হ্যাঁ, তারপর প্রসপেরোর বন্ধু ডেল ভাস্টো আমাদেরকে ফাঁসিতে তোলার জোগাড় করুক। আর ওর আরেক চামচা কারবাজাল বলে বেড়াক যে ভাল কাজের কারণে প্রসপেরোকে প্রাণ খোয়াতে হয়েছে।
ওকে নাক সিটকাতে দেখে বিরক্ত হলো জিয়ানেট্টিনো। বলল, আমার মনে পড়ে, তুমিই একসময় বলেছিলে শার্শেলে ওকে পচে মরতে দেয়ার চেয়ে ওর গলায় তলোয়ার চালিয়ে তুমি প্রতিশোধ নিতে চাও।
হ্যাঁ। কিন্তু পরে বুঝেছি, স্প্যানিশ সম্রাটের কাছে আততায়ীর হাতে ওর মৃত্যু আর এখানে ফাঁসিতে ঝুলে মৃত্যু একইরকম লাগবে।
আততায়ীর প্রসঙ্গ আসছে কেন? সামনাসামনি লড়াই আর পেছন থেকে খুন হওয়া এক হলো নাকি? ডুয়েলে লড়ে ওকে যদি হারাতে পারি তাহলে কে আমাকে ধরতে পারবে?
হয়তো। যদি তুমি ওকে মারতে পার তাহলে। কিন্তু যদি ও তোমাকে মেরে ফেলে? .
তাহলে তুমি ওর মোকাবেলা করবে। আর তুমিও যদি মারা পড়ো তাহলে আরো জনা বারো লোক ওর দিকে ছুটে যাবে। ওদের একজনও বেঁচে থাকা অবধি লড়বে বদমাশটার সঙ্গে।
বীরত্ব বটে! ফিলিপ্পিনো বলছে, কিন্তু তার দরকার পড়বে না। কারণ আমরা যেহেতু প্রসপেরোকে ফাঁসিতে ঝোলাতে পারছি না, তাই সবচেয়ে ভাল হয়, ও ব্যাটা শিকলে বাঁধা অবস্থায়, পচে মরলে।
কিন্তু কতদিন? বাস্তবতা হচ্ছে, কেউ না কেউ ওকে মুক্ত করবেই।
একটা বিষয় তোমার চোখ এড়িয়ে যাচ্ছে। ভাবো, দ্রাগুতের দূত ইয়াকুবের নিরাপত্তার জন্য প্রসপেরোকে আটকে রাখা হয়েছে। এখন, ইয়াকুব যদি খালি হাতে ফিরে যায় বা আদৌ না যায়, তাহলে? কুটিল হাসি ফুটে উঠল ফিলিপ্পিনের মুখে। ইয়াকুবকে বন্দি করে দাস হিসেবে গ্যালিতে পাঠিয়ে দেব। ফলে প্রসপেরোকেও একই শাস্তি পেতে হবে। আমার ধারণা, এরপর আর কোনদিন প্রসপেরোর নাম কোথাও উচ্চারিত হবে না।
ঠোঁট উল্টে জিয়ানেট্রিনো বলল, এ নিয়ে আমাদেরকে না আবার লর্ড আন্দ্রের মুখোমুখি হতে হয়। সে কখনোই এমন কিছুতে সম্মতি দেবে না।
লর্ড জানতেই পারবে না। আমরা একদম মুখ বন্ধ করে রাখব। আমি চিঠিটার কথা ভুলে যাচ্ছি, তুমিও ভুলে যাও।
.
২০.
প্রসপেনোর ফিরে আসা
শক্তিশালী ফ্লিট দাঁড় করানোর জন্য পুরো শীতকাল জুড়ে ব্যস্ত মৌমাছির মত ছুটোছুটি করেছে ডোরিয়া। উদ্দেশ্য বসন্তের প্রথম নমুনা দেখা মাত্রই যেন কোর্সেয়ার মুসলিম বাহিনীর একেবারে হৃৎপিণ্ডে আঘাত হানা যায়। এরই মধ্যে তার কাছে এসে পৌঁছেছে সম্রাটের পাঠানো খোঁচা মারা এক চিঠি, যার মূল বক্তব্য কোর্সেয়ারদের বিরুদ্ধে অত্যন্ত দ্রুত ও খুব শক্তিশালী আঘাত হানতে হবে।–
চিঠি পেয়ে ডোরিয়ার অন্তরাত্মা কেঁপে গৈছে। অনুমান করেছে, শার্শেলের ঘটনার আসল সত্য সম্বন্ধে কোন না কোনভাবে আভাস পেয়ে গেছে সম্রাট পঞ্চম চার্লস। এদিকে দক্ষিণের উপকূলে রেজ্ঞিয়ো থেকে নেপলস পর্যন্ত দ্রাগুতের, রেইড অনেক বেড়ে গেছে। ওদিকে ফনডি-তে আক্রমণ করেছিল স্বয়ং খায়ের-আদ-দীন। ওখান থেকে সুন্দরী গুইলিয়া গনজাগাকে তুলে নিয়ে সুলায়মানের হারেমে তুলে দিয়েছিল সে।
কিন্তু তাকে হারেমে ধরে রাখা যায়নি। একজন মাত্র সহকারী নিয়ে রাতের অন্ধকারে ঘোড়ায় চড়ে পালিয়েছে মহিলাটি। ঘটনাটি অনেকেরই জানা। পরে ওই সহকারীকেও সে মেরে ফেলে। কারণ, হঠাৎ চোখের সামনে অপরূপ সৌন্দর্য উন্মোচিত হতে দেখে তারও মাথা খারাপ হয়ে গিয়েছিল। লালসা পেয়ে বসেছিল লোকটাকে।
তবে রেইডের শিকার অন্য নারীরা তার মত এতটা সৌভাগ্যবতী না। এই রেইডগুলোর কারণে নিয়াপলিটান স্কোয়াড্রনের অভাব খুব বেশি বোধ করতে থাকে ডোরিয়া। একই শঙ্কায় শঙ্কিত হয়ে রেইডের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে ডোরিয়াকে নেপলসে ডেকে পাঠায় প্রিন্স অভ অরেঞ্জ।
নিয়াপলিটান স্কোয়াড্রনে এখনও প্রসপেরোর ছয়টা গ্যালি আছে। সপ্তম গ্যালিটি শার্শেল অভিযানের সময় চলে গেছে দ্রাগুতের দখলে। প্রসপেরোর আইনগত ওয়ারিশ হওয়ায় ওই ছয়টি গ্যালি দাবি করেছে রেইনাল্ডো। কিন্তু সেই আবেদনে রাজদরবার সাড়া দেয়নি। কারণ তারা ভাল করেই জানে এই অবস্থায় ছয়টা গ্যালি হারালে ইম্পিরিয়াল ফ্লিট কতটা দুর্বল হয়ে পড়বে। এদিকে প্রসপেরোর মৃত্যুর পর কারবাজালকে নেপলসের নিয়াপলিটান ফ্লিটের ক্যাপ্টেন জেনারেল হিসেবে নিয়োগ করা হয়েছে। এবং নেপলসে তার কাছেই পাঠিয়ে দেয়া হয়েছে প্রসপেরোর ছয়টা গ্যালি।
ওদিকে আরেক ভয়ানক খবর এসেছে। স্প্যানিশ রাজত্বের আফ্রিকা অংশের আউটপোেস্ট সুসা, ফ্যাক্স ও মোনাস্টির দখল করে নিয়েছে দ্রাগুত। ওই পোস্টগুলোর সেনা গ্যারিসনের বেশ কিছু সৈন্যকে মৃত্যুদণ্ড দিয়েছে সে। আর বাকিদের দাস হিসেবে বন্দি করেছে। এই দুঃসংবাদ আর সম্রাটের অতি জরুরি সমন; দুটো একসঙ্গে এসে পৌঁছুল ডোবিয়ার হাতে। সমনে বলা হয়েছে এই মুহূর্তে বার্সেলোনায় সম্রাটের সঙ্গে ডোরিয়াকে দেখা করতে হবে।
সংবাদটা ডোরিয়াকে ভীষণ অস্বস্তিতে ফেলে দিল। কারণ সাধারণত এই সুরে সম্রাটের হুকুম তার কাছে কখনো আসেনি। আবার এটাও ডোরিয়া ভাবছে যে, তাকেই যদি আবার কোর্সেয়ার ফ্লিটের পিছু ধাওয়া করতে পাঠানো হয়, তাহলে বুঝতে হবে, সম্রাটের কাছে তার সমুদ্র-সমরে জাদুকরের ইমেজ এখনও নষ্ট হয়নি। বার্সেলোনায় পৌঁছে ডোরিয়া জানতে পারল, সম্রাটের কানে খায়ের-আদ-দীনের চেয়েও দ্রাওতের নামটা অনেক বেশি ভয়ানক হয়ে বাজছে।
ডোরিয়ার বুঝতে অসুবিধা হলো না যে, তার প্রতি সম্রাটের আনুকূল্য নির্ভর করছে এই তথাকথিত ইসলামের উন্মুক্ত তরবারি নামটাকে সমূলে উৎপাটন করার মধ্যে। অবশ্য রাজদরবারে উপস্থিত হওয়ার পর ওখান থেকেও তাকে একই ইঙ্গিত দেয়া হয়েছে।
স্প্যানিশ রাজদরবার থেকে এই ধারণা নিয়ে ডোরিয়া বেরিয়ে এল যে, এটাই হচ্ছে তার আসল পরীক্ষা। তবে একটুও ভয় পেল না সে। কারণ তার হাতে এখন আছে অত্যন্ত শক্তিশালী এক নৌবহর। নিজের পনেরোটা গ্যালি আগেই প্রস্তুত করেছে। তার এক স্বজাতির কাছ থেকে পেয়েছে আরো পাঁচটা ওয়ার গ্যালি। জেনোয়ার নৌবাহিনী থেকে নিয়েছে বারোটা, পোপের কাছ থেকে পেয়েছে তিনটা গ্যালি আর নাইট অভ মাল্টার কাছ থেকে পেয়েছে বিশাল এক গ্যালিসে। সব মিলিয়ে ছত্রিশটা ওয়ার গ্যালির বিশাল এক বহর। এগুলোর সঙ্গে আরো যুক্ত হয়েছে চারটা পরিবহন গ্যালিয়ন, অনেকগুলো সুপ, ফেলুকা আর স্কাউটিঙের কাজে লাগে এমন অনেকগুলো হালকা-পলকা ও দ্রুতগামী ট্রাইরেম।
ডোরিয়াকে চারটা পরিবহন গ্যালিয়ন দিয়েছে স্পেন নৌবাহিনী। কিন্তু তার বেশি আর একটা ডিঙ্গি দিতেও অস্বীকার করেছে তারা। কারণ হিসেবে বলেছে, ডোরিয়ার হাতে ইতিমধ্যেই যা আছে তা যে-কোন অভিযানের জন্য যথেষ্টর চাইতেও বেশি। তার উপর উপকূল রক্ষার কাজে বহরের সবগুলো গ্যালিই লাগবে তাদের। ওরা আশঙ্কা করছে, যে-কোন মুহূর্তে স্পেন উপকূলে হামলে পড়তে পারে দ্রাগুত। ফলে কোন যুদ্ধজাহাজ হাতছাড়া করার উপায় তাদের নেই।
একই কারণে জেনোয়া বা নেপলসের তহবিল ব্যবহার করে আর কোন গ্যালি বা লোক-লস্কর নেয়ার উপরও নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়েছে। এমনকী ডোরিয়া যদি অনুভবও করে যে, তার আরো লোকজন দরকার, তবুও কিছু চাইবার উপায় নেই। কারণ তাতে তার বিপক্ষে যারা আছে তারা ডোরিয়ার বিরুদ্ধে সম্রাটের কান ভারী করার সুযোগ পেয়ে যাবে।
গ্রীষ্ম শুরু হওয়ার আগে-আগে বিশাল ফ্লিট নিয়ে বার্সেলোনার বন্দর ছাড়ল ডোরিয়া। মেহেদিয়ার বন্দরে আগুন দিয়ে দক্ষিণমুখী কোর্স ধরল সে। মেহেদিয়াকে ধ্বংস করতে পারলেও দ্রাগুতকে ধরতে পারল না ডোরিয়া! ওকে ধরার জন্য পাঁচ মাইল চওড়া জাহাজের এক জাল (নেটওয়ার্ক তৈরি করে আফ্রিকার উপকূল চষে বেড়াতে থাকল সে। স্কাউট হিসেবে দলের অগ্রভাগে রাখল দ্রুতগামী ট্রাইরেমগুলোকে।
দ্রাগুতের খোঁজে ডোরিয়া যখন আফ্রিকার উপকূল চষে বেড়াচ্ছে তখন জেনোয়ার বন্দরে এসে ভিড়ল দ্রুতগামী একটা ফেলুকা। এর আরোহী হচ্ছে চারজন নিয়াপলিটান সহ স্বয়ং প্রসপেরো। ফেরুচ্চিয়ো নামের একজন নেভিগেটর নিয়ে জেনোয়ায় এসেছে সে।
আগেই বলেছি, গোইয়ালাতার লড়াইয়ে দ্রাগুতকে বন্দি করেছিল প্রসপেরো। তখন প্রসপেরোর কাছে খুব ভাল ব্যবহার পেয়েছিল দ্রাগুত। তারই প্রতিদান হিসেবে প্রসপেরোকে প্যারোল দিয়েছে সে। আরেকটা ব্যাপারও ওদের মধ্যে কাজ করে থাকতে পারে, তা হচ্ছে ফিলিপ্পিনো যখন দ্রাত আর প্রসপেরোকে একইসঙ্গে শেকলে বেঁধে রেখেছিল, তখনই ওদের মধ্যে এক ধরনের বন্ধুত্ব ও সহমর্মিতার মনোভাব গড়ে ওঠে। হয়তো তারই প্রতিফল প্রসপেরোর মুক্তি। তবে কারণ যা-ই হোক মূল কথা হচ্ছে ব্যাকফায়ার করেছে ফিলিপ্পিনো ডোরিয়ার পরিকল্পনা।
প্রসপেরোর মুক্তিপণ আদায়ের জন্য পাঠানো দূত ইয়াকুবের না ফেরার একটাই অর্থ। হয় তাকে বন্দি করা হয়েছে, নতুবা হত্যা করা হয়েছে। কিন্তু এই অবস্থায় একজন খ্রিস্টান নেতা যে আচরণ করত, তার ধারে-কাছেও গেল না দ্রাগুত। এমনকী প্রসপেরোর সঙ্গে একবারও উঁচু গলায় কথা বলেনি সে। উল্টো শীত আসি-আসি করছে, এমন সময় প্রসপেরোর মুক্তির প্রস্তাব নিয়ে হাজির হলো স্বয়ং দ্রাগুত। প্রসপেরোকে সে ছেড়ে দিয়েছে স্রেফ মুখের এক কথার ভিত্তিতে যে, ফিরে গিয়ে প্রথম সুযোগেই মুক্তিপণের তিন হাজার ডাকাট পাঠানোর ব্যবস্থা করবে প্রসপেরো। এবং সম্ভব হলে সেটা ইয়াকুবের হাত দিয়েই পাঠাবে। প্রস্তাবটা ওদের দুজনকেই পরস্পরের চোখে সম্মানিত করেছে। আর শুধু সম্মানিতই করেনি, দুজনের মধ্যে একটা বন্ধুত্বের বন্ধনও সৃষ্টি করেছে।
যা হোক, জেনোয়ায় অবতরণ করে প্রসপেরো দেখল আত্মীয় শুভানুধ্যায়ীরা ওর মৃত্যুর খবর জেনে শোক পালন করছে। ওদিকে হঠাৎ মৃত প্রসপেরোকে চোখের সামনে জীবিত দেখে মূৰ্ছা গেল ওর মা। খানিক সেবা-শুশ্রূষার পর জ্ঞান ফিরল তার। এরপর প্রসপেরোকে জিয়ান্নার গল্পটা বলল সে। এবার জ্ঞান হারানোর দশা হলো প্রসপেরোর।
সংজ্ঞাহীনতা আর খুশির কান্না দিয়ে শুরু হওয়া মাতা-পুত্রের মিলন শেষ হলো রাগ-বিদ্বেষ দিয়ে। সবকিছু শিকেয় তুলে জিয়ান্নার খোঁজে ফসোলু প্রাসাদের দিকে রওনা হলো প্রসপেরো। পথে হঠাৎ ওর মনে একটা সন্দেহ জাগল।তখন রিপায় অবস্থিত বন্দিশালা ব্যাগনিয়য়া থেকে ঘুরে আসার সিদ্ধান্ত নিল ও।
প্রসপেরোকে খুব ভালভাবেই চেনে ব্যাগনিয়োর জেলার। প্রসপেরোকে জীবিত দেখে যারপরনাই বিস্মিত ও খুশি হলো সে। প্রসপেরোকে যথাযোগ্য সম্মান দেখাতেও ভুলল না। ওর অনুরোধে তার বন্দিশালার বন্দিদের তালিকাও দেখাল। ওখানে ইয়াকুবের নাম দেখেই যা বোঝার বুঝে নিল প্রসপেরো। ওর মনের কোণে লুকিয়ে থাকা সন্দেহের বীজটা মহীরুহ হয়ে আত্মপ্রকাশ করল।
প্রসপেরেরার হুকুমে ইয়াকুবকে তখনই ওর সামনে হাজির করল জেলার।
প্রসপেরোকে দেখেই উজ্জ্বল হাসি ফুটে উঠল ইয়াকুবের মুখে। ধরে নিল মুক্তি আসন্ন। বিনা দ্বিধায় প্রসপেরোর প্রশ্নের জবাব দিল সে জানাল, জিয়ানেট্টিনোর হাতে মুক্তিপণের চিঠি দিয়েছিল সে। ফলস্বরূপ গলায় উঠেছে দাসত্বের শেকল। এতটুকুই সে জানে। বাকিটা অবশ্য প্রসপেরে নিজেই জানে। যে-কোন সময়ের চেয়ে বেশি দুঃখিত, রাগান্বিত ও ভারাক্রান্ত মনে ফসসালু প্রাসাদের দিকে এগুতে থাকল সে।