দ্য সোর্ড অভ ইসলাম — রাফায়েল সাবাতিনি / অনুবাদ : সাইফুল আরেফিন অপু
[পনেরো শতকের জেনোয়া। ক্ষমতা দখলের আন্তর্জাতিক রাজনীতি চলছে সেখানে। অস্থির রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের বলি হলো প্রসপেরোর বাবা অ্যাণ্টোনিওট্রো। এজন্য দায়ী অ্যাডমিরাল আন্দ্রে ডোরিয়া। পিতৃহত্যার প্রতিশোধের শপথ নিল পুত্র… এদিকে স্প্যানিশ সম্রাটের মাথাব্যথার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে তুর্কি নৌবাহিনীর কমাণ্ডার দ্রাগুজ রেইজ। ডোরিয়ার উপরে দায়িত্ব: যে কোনও মূল্যে দমন করতে হবে দ্রাগুজকে। পাকেচক্রে প্রেমিকা জিয়ান্না সহ দ্রাগুজের হাতে বন্দি হলো প্রসপেরো। এ অবস্থায় কি সে পারবে শপথ রক্ষা করতে?]
০১. লিগুরিয়াদ–এর লেখক
সমুদ্রের বুক থেকে ধাপে ধাপে উঠে আসা পাহাড়ঘেরা দেশ জেনোঁয়া, যার আরেক নাম সাগরের মুক্তো। জেনোয়ার সন্তানদের ঘিরেই রচিত হয়েছে এই কাহিনির পটভূমি।
আগস্টের বাতাসহীন খরতপ্ত এক দুপুর। বন্দর থেকে একটু দূরে পান্না-সবুজ রঙ হারিয়ে নীল হয়ে গেছে সাগরের পানি। ওখানে ভেসে আছে এক সারি গ্যালি (কাঠের তৈরি বিশাল জাহাজ)। খুব সুন্দরভাবে সোনা দিয়ে গিলটি করা ওগুলোর স্টার্ন আর স্টেম। মাস্তুলের চূড়ায় উড়ছে পোপের চিহ্ন সম্বলিত পতাকা। পতাকার এক পিঠে সেইন্ট পিটারের চাবি আর অপর পিঠে মেডিসির স্বর্ণপ্রতীক। জাহাজগুলোর দুপাশে তিরিশটা করে মোট ষাটটা ছত্রিশ ফুট লম্বা দাঁড়। দাঁড়গুলো সামান্য ওপরে তোলা পানি থেকে। এসব জাহাজের অত্যন্ত বিলাসবহুল কামরা হচ্ছে পুপ কেবিন (যেখান থেকে জাহাজ নিয়ন্ত্রণ করা হয়)। এই কেবিনকে বলা হয় টিবারনাকল। ক্যাপ্টেন প্রসপেরো অ্যাডর্নোর কেবিনের মেঝে জুড়ে পাতা হয়েছে প্রাচ্য দেশীয় উৎকৃষ্টতম সিল্ক বুনে বানানো কার্পেট।
একাধারে কাজপাগল লোক, আবার স্বপ্নবিলাসী মানুষ প্রসপেরো। একইসঙ্গে সে একজন কবি এবং দক্ষ সৈনিক। মাত্রতিরিশ বছর বয়সেই ন্যাভাল কমাণ্ডার হয়ে গেছে। সামরিক বাহিনীর আর কেউ প্রসপেরোর মত এতটা জনপ্রিয় হয়ে উঠতে পারেনি।
বছর চারেক আগের কথা। গোইয়ালাতায় তুর্কি অটোমান সাম্রাজ্যের মুসলিম বাহিনীর সুসজ্জিত এক ন্যাভাল ফ্লিটের সঙ্গে ভয়াবহ লড়াই বেঁধে গিয়েছিল আন্দ্রে ডোরিয়ার অধীন জেনোয়ার নৌবাহিনীর। পুরোপুরি কোণঠাসা হয়ে গিয়েছিল ডোরিয়া। সেদিন কেবল প্রসপেরোর চতুর রণকৌশল আর সাহসী পদক্ষেপের ফলেই দ্রাগুত রেইজের হাত থেকে রক্ষা পেয়েছিল আন্দ্রে (অসম সাহসিকতা ও নৌযুদ্ধের কলাকৌশলে দারুণ দক্ষতার কারণে দ্য ড্রন সোর্ড অভ ইসলাম নামে ব্যাপক খ্যাতি পেয়েছে দ্রাগুত)।
হারতে বসা খ্রিস্টান বাহিনীকে জিতিয়ে দেয়ায় পুরো ভূমধ্যসাগর জুড়ে ছড়িয়ে পড়ে অ্যাডর্নোর সুনাম। এর কিছুদিন পরই ফ্রান্সের রাজার সেবায় যোগ দিয়ে ফ্রেঞ্চ নৌবাহিনীর দায়িত্ব গ্রহণ করে ডোরিয়া। স্বাভাবিকভাবেই তখন জেনোয়ার নৌবাহিনীর ভার এসে পড়ে প্রসপেরোর হাতে।
১৫২৭ খ্রিস্টাব্দ। ফ্রান্স ও ভেনিসের সঙ্গে মিলে স্পেন সম্রাটের বিরুদ্ধে যৌথবাহিনী গঠন করেছে হিজ হোলিনেস (পোপ)। তখন স্পেন সম্রাটের লোকজনও চারদিকে গুজব ছড়াতে থাকে যে, যৌথবাহিনী গঠন করা হয়েছে পুরো পৃথিবী দখল করে নেয়ার জন্য। এ খবর ছড়িয়ে যাওয়ার পর একই সালের মে মাসে সম্রাটকে শিক্ষা দিতে ফ্রেঞ্চ নেভির নেতৃত্বে রওনা হয় যৌথবাহিনীর সম্মিলিত নৌশক্তি। ফ্রান্সের রাজা ফ্রান্সিস
তখন ডোরিয়াকে নিশ্চয়তা দেন, মিত্রশক্তি নৌবাহিনীর দায়িত্ব। নিলে তাঁর দেশ জেনোয়াকে স্বাধীন বলে ঘোষণা করা হবে। এতে আশ্বস্ত হয়ে প্রসপেরোকেও মিত্র বাহিনীতে যোগ দিতে উদ্বুদ্ধ করে ডোরিয়া। জেনোয়া স্বাধীন হবে ভেবে প্রস্তাবে সম্মত হয়প্রসপেরো।
এদিকে স্পেন সম্রাটের ছত্রচ্ছায়ায় জেনোয়া শাসন করে প্রসপেরোর বাবা ডজ অ্যান্টোনিওট্টো অ্যাডর্নো। ফলে বিপাকে পড়ে গেছে প্রসপেরো। ওকে এখন জন্মভূমির বিরুদ্ধে অভিযানে নামতে হবে।
অবশ্য ফ্রেঞ্চদের তরফ থেকে প্রচারণা চালানো হচ্ছে, এ অভিযান মহৎ এক উদ্দেশ্য পূরণের লক্ষ্যে-জেনোয়াকে স্বাধীন করে এর মূল শাসনভার বর্তমান শাসকের হাতে তুলে দেয়া।
যা হোক, বর্তমানে চলে আসি। আধবোজা চোখে গ্যালির টিবারনাকলে বসে আছে প্রসপেরো। এখান থেকেই জাহাজ নিয়ন্ত্রণ করে ও। প্রসপেরোর দৃষ্টি দেখে মনে হচ্ছে না, আদৌ কোন কিছু খেয়াল করছে। কিন্তু ধনুক আকৃতির খিলানের নিচ দিয়ে যা কিছু দেখা যাচ্ছে, কিছুই ওর দৃষ্টি এড়াচ্ছে না। টিবারনাকল থেকে একেবারে র্যামবেড পর্যন্ত জাহাজের পুরোটা দেখতে পাচ্ছে প্রসপেরো।
কোমরে শেকল বাঁধা অবস্থায় জাহাজের দুপাশে, বেঞ্চে বসে ঢুলতে থাকা থাকা দাসদের ভিতর দিয়ে ধীর কদমে হেঁটে বেড়াচ্ছে দুজন দাস নিয়ন্ত্রক ওয়ার্ডেন। দুজনেরই কোমরে ঝুলছে চামড়ার তৈরি চাবুক। এই দাসেরাই জাহাজটার দাঁড়ি। ডেকের একটু নিচে ওদের প্রথম সারি। আর নিচের ডেকে রয়েছে দ্বিতীয় সারি। প্রতিটা বৈঠা বাইবার জন্য রয়েছে পাঁচজন করে দাঁড়ি। নানান জাতির লোক আছে ওই দলে। মুর, শক্ত-পোক্ত আরব, শক্তিশালী মুসলিম তুর্কি, আফ্রিকা থেকে ধরে আনা নিগ্রো, এমনকী ভিনদেশ থেকে আসা কিছু খ্রিস্টানও রয়েছে দাঁড়িদের এই দলে। ওভারশিয়ারের নির্মম চাবুক, অবিশ্রান্ত কঠোর পরিশ্রম আর পর্যাপ্ত খাবারের অভাবে ক্লিষ্ট তাদের শরীর। সিন্দাবাদের ভূতের মত ওদের কাঁধেও সওয়ার হয়ে আছে দুর্ভাগ্যের পাহাড়সমবোঝা। ক্যাপ্টেনের কেবিন থেকে এই হতভাগাদের রোদে পোড়া, বৃষ্টিতে ভেজা গাঢ় বাদামি রঙের নগ্ন কাঁধ আর মাথাটাই কেবল দেখা যায়।
হঠাৎ বেজে উঠল ট্রাম্পেট। প্রসপেরোর চোখ থেকে উধাও হয়ে গেল ঢুলুঢুলু ভাব। কম্প্যানিয়ন ওয়ে দিয়ে ছুটে এল এক অফিসার। টিবারনাকলের প্রবেশপথে দাঁড়িয়ে বলল সে, স্যর ক্যাপ্টেন, ক্যাপ্টেন জেনারেলের বার্জ এসে ভিড়েছে আমাদের পাশে।
উঠে দাঁড়াল প্রসপেরো। ওর অ্যাথলেটিক কাঠামো, চওড়া কাঁধ আর শক্তিশালী হাত-পা স্পষ্ট বুঝিয়ে দেয় সত্যিকারের কাজের মানুষ ও। এরকম এক জাহাজের ক্যাপ্টেন হওয়া সত্ত্বেও ভারী ছোরা বহন করার জন্য স্বর্ণখচিত একটা বেল্ট ছাড়া গহনার কোন বাহুল্য নেই ওর।
পুপ কেবিনের গোল জানালার পাশে দাঁড়িয়ে ক্যাপ্টেন জেনারেলের উঠে আসার অপেক্ষায় রইল প্রসপেরো। দেখতে পেল, ওদের জাহাজের পাশে দাঁড়ানো বার্জটার কাপড়ের সামিয়ানা সরে গেল, উদয় হলো তিনজন লোক। জাহাজের কয়েক ধাপবিশিষ্ট ছোট মই বেয়ে ডেকে উঠে এল ওরা। এদের মধ্যে দুজন রীতিমত বিশালদেহী। তাদের একজনের উচ্চতা ছয় ফুটেরও বেশি। অপরজনের চেয়ে সে প্রায় এক মাথা উঁচু। তবে তৃতীয়জন ওদের মত নয়। মাঝারি উচ্চতা ও মাঝারি গড়নের লোক সে। তবে দৈহিক গড়ন যেমনই হোক, তার ব্যক্তিত্বের ছটা অন্য দুজনকে রীতিমত ম্লান করে রেখেছে। এই তৃতীয় ব্যক্তিটিই ডোরিয়া। আর অস্থিরদর্শন বাকি দুজন লোকটার দুই ভাতিজা জিয়ানেট্টিনো ও ফিলিপ্পিনো।
শান্ত থাকার অভ্যাস ডোরিয়া পরিবারের পুরুষদের চরিত্রে কখনোই ছিল না। তবে ওই দুজন আপাতত শান্তই রয়েছে। কারণ, ওদের সঙ্গে রয়েছে ডোরিয়া স্বয়ং। তার লালচে রঙের ভয়ানকদর্শন ভ্র, চওড়া নাসারন্ধ্র আর হাতপাখার মত দেখতে দাড়িতে ভীতি জাগানিয়া কিছু একটা আছে। দৃঢ় চোয়ালে শক্তির আভাস স্পষ্ট, আর চোখের তারায় ফুটে আছে তীক্ষ্ণ বুদ্ধিমত্তার ছাপ। বহু অভিজ্ঞতালব্ধ ষাট বছরের কর্মময় জীবন একটুও দুর্বল করতে পারেনি তাকে। উল্টো চল্লিশ বছরের একজন লোকের মতই কর্মঠ ও শক্তিশালী সে।
ডোরিয়ার ঠিক পিছনের লোকটি জিয়ানেটিনো। আক্ষরিক অর্থেই বিশাল তার শরীর। নাকটা লম্বা, আর চোয়াল খাটো। কামানো, প্রায় গোলাকার মুখটাকে মেয়েলি বলে উপায় নেই। ছোট-ছোট চোখ দুটোয় নীচ স্বভাব যেন জ্বলজ্বল করছে। সেইসঙ্গে পুরো মুখাবয়ব থেকে অদৃশ্য আভার মত ঠিকরে বেরোচ্ছে উগ্রতা। এতদিন ডোরিয়ার সঙ্গে থেকেও তার শীতল ব্যক্তিত্বের কেবল হিংস্রতাই সে অর্জন করতে পেরেছে, আর কিছুই নয়। পোশাক-আশাকও অদ্ভুত ওর। পায়ে চকচকে কালো রঙের মোজা, ঊর্ধ্বাঙ্গের পোশাকের হাতা কটকটে হলুদ রঙের। বাকিটা সাদা। সব মিলিয়ে রীতিমত দৃষ্টিকটু রুচির বহিঃপ্রকাশ।
চারদিকে হিংস্র দৃষ্টিতে তাকাচ্ছে জিয়ানেট্টিনো। ওর হাঁটা দেখে মনে হচ্ছে, হেঁটে নয়, যেন গড়িয়ে-গড়িয়ে আসছে সে! লোকে জানে, ডোরিয়ার আপন ভাতিজা জিয়ানেট্রিনো। কিন্তু ও আসলে ডোরিয়ার অনেক দূর সম্পর্কের এক ভাইয়ের ছেলে।
ডোরিয়ার দুই ভাতিজার বয়সই তিরিশের ঘরে। দুজনেরই মাথার চুল কালো আর গাত্রবর্ণ বাদামি। কিন্তু এর বাইরে আর কোন বিষয়ে মিল নেই তাদের।
তুলনায় ফিলিপ্পিনো যথেষ্ট সংযত। ভাইয়ের মত লোক দেখানো কিছু তার পোশাকে নেই। লোকটার ব্যক্তিত্বের বহিঃপ্রকাশও ভিন্ন। চলাফেরায় প্রকাশ পাচ্ছে ক্ষিপ্রতার আভাস।কোথাও মুহূর্তের বেশি থামছে না সে। ঈগলের ঠোঁটের মত নাক, কাদামাটির মত ঘোলা তার চোখের রং। সেইসঙ্গে সরু চিবুকটাকে আড়াল করেছে খাটো দাড়ি। এই মুহূর্তে ওর আচরণ একইসঙ্গে প্রকাশ পাচ্ছে গাম্ভীর্য আর কেমন একটা বিচলিত ভাব। চকচকে সিল্কের কাপড়ের একটা পোটলা হাতে নিয়ে আসছে ফিলিপ্পিনো।
প্রায় একসঙ্গেই কেবিনে ঢুকল ওরা তিনজন। কিন্তু ডোরিয়াকে কথা শুরু করার সুযোগ না দিয়ে সাপের মত বিষাক্ত হিসহিসে গলায় বলল ফিলিপ্পিনো, তোমার বাবার উপর আমরা বিশ্বাস রেখেছিলাম, প্রসপেরো, গতরাতে তার মাশুল গুনতে হয়েছে। প্রায় চারশ লোক হারিয়েছি আমরা। সত্তরজন অকুস্থলেই মারা গেছে। আহত বাকিরা মরেছে পরে। আমাদের কাজিন এট্টোরি-ও মারাত্মক আহত হয়েছিল লড়াইয়ে। মারা গেছে সে-ও। ওর স্মৃতি হিসেবে নিয়ে এসেছি এটা। পোঁটলায় রাখা ব্যাণ্ডেজ বাধা কাটা হাতটা দেখাল।
ফিলিপ্পিনো বলে চলল, কীভাবে তাদের উপর হঠাৎ করে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল বিপক্ষের সেনারা। সত্যি কথা হচ্ছে, তোমার বাবার উপর আমাদের যে বিশ্বাস ছিল, সেটাকেই ব্যবহার করা হয়েছে আমাদের বিরুদ্ধে। টেনে নিয়ে আমাদেরকে ফেলা হয়েছে। একটা অ্যাম্বুশের মধ্যে। এই প্রতারণার জন্য পুরোপুরি দায়ী ডজ (১৫০০ শতকে ইউরোপে প্রচলিত ডিউকের সমমর্যাদার শাসকের পদবি ডজ। তবে পরবর্তীতে এ উপাধি আর ব্যবহৃত হয়নি।) অ্যাডর্নো।
নিরুৎসুক দৃষ্টিতে ডোরিয়ার দুই ভাতিজাকে দেখল প্রসপেরো। ওদের হম্বিতম্বির জবাবে বলল, বলছ, তোমরা জোর করে সৈন্য নামাতে চেয়েছিলে, তখন রুখে দাঁড়িয়েছে ওরা। আর লড়াইয়ে হেরে যাওয়ার দোষ চাপাচ্ছ আমার বাবার উপর, তাইতো?
জোর করে সৈন্য নামিয়েছি? হায়, খোদা! ফিলিপ্পিনোর বিস্ময়োক্তি।
তোমরা হয়তো যথেষ্ট সাবধান ছিলে না, বলল প্রসপেরো। নয়তো এমনটা ঘটার কোন কারণ দেখছি না। তাছাড়া সামরিক দৃষ্টিভঙ্গি থেকে এমন গুরুত্বপূর্ণ একটা জায়গা সম্বন্ধে স্প্যানিশরা নিশ্চয়ই উদাসীন থাকবে না?
ঠিক। কিন্তু কথা হচ্ছে আমাদের উপর হামলাকারীরা স্প্যানিশ ছিল না। গতরাতের ঘটনার সঙ্গে ওদের কোন সম্পর্কও নেই।
কেন? গতরাতে তোমরাই তো জানালে স্পেনের ইম্পিরিয়াল বাহিনীর সঙ্গে তোমাদের লড়াই হয়েছে, আর সংখ্যায় ওরা ছিল অনেক!
এতক্ষণে মুখ খুলল ডোরিয়া। তার শান্ত, গম্ভীর ও দৃঢ় কণ্ঠ দুই ভাতিজার সম্পূর্ণ বিপরীত। কিন্তু তারপরও স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে, রেগে আছে সে। ভীষণ রেগে আছে। বলল, কিন্তু আজ আমরা জানি, ঘটনা আসলে তেমন ছিল না। আমরা কিছু লোককে বন্দি করেছি। তাদের কাছ থেকেই জেনেছি, স্প্যানিশরা না, আমাদের উপর আক্রমণ করেছে জেনোয়ার সৈন্যরা। আর তাদের নেতৃত্ব দিয়েছেন স্বয়ং ডজ।
বিস্মিত দৃষ্টিতে একবার এর, আরেক বার ওর দিকে তাকাল প্রসপেরো। তারপর হাসতে-হাসতে বলল, আমার বাবা আপনাদের বিরুদ্ধে সেনাবাহিনীর নেতৃত্ব দিয়েছে, এটা বিশ্বাসযোগ্য নয়। কারণ, আমাদের উদ্দেশ্য সম্বন্ধে ভালভাবেই জানা আছে তার।
তিনি কি আমাদের লক্ষ্যের সঙ্গে একমত? জানতে চাইল জিয়ানেট্টিনো। আমার তো মনে হয়…
মৃদু কণ্ঠে বাধা দিল তাকে প্রসপেরেরা। …এরকম সন্দেহ করার অর্থ তাকে অপমান করা।
শান্ত হও, সমঝোতার সুরে বলল ডোরিয়া। এট্টোরির মৃত্যু আমাদের সবাইকে গভীরভাবে ব্যথিত করেছে। আমাদের মনে রাখা উচিত বা আগেই ভাবা দরকার ছিল যে, ডজ অ্যাডর্নো এখানকার শাসক। এই উপাধিটা তিনি পেয়েছেন স্পেন সম্রাটের কাছ থেকে। তিনি হয়তো ভেবে থাকবেন, জেনোয়ার পতনের সঙ্গে ডিউকের মর্যাদা ও শাসন ক্ষমতাও চলে যাবে তাঁর হাত থেকে।
আমার তা মনে হয় না, স্যর। জেনোয়াবাসীদের সক্রিয় সমর্থন ছাড়া কাউকে জেনোয়ার শাসন ক্ষমতায় বসিয়ে রাখা সম্ভব নয়। একইভাবে, জনসমর্থন থাকলে ক্ষমতাচ্যুত করাও সম্ভব নয় তাকে। কাজেই বলতেই হচ্ছে, স্যর, আপনাদের তথ্য আর অনুমান-দুটোই ভুল।
আমাদের তথ্যে ভুল নেই, বলল ফিলিপ্পিনো। কিন্তু তোমার বাবার জানা থাকার কথা, তাঁর এলাকায় পদাতিক সৈন্যের কমাণ্ডে আছে সিজার ফ্রেগোসো। তিনি নিশ্চয়ই ভুলে যাননি যে, সিজার ফ্রেগোসোকে হটিয়েই ডজশিপ দেয়া হয়েছিল তাঁকে।
প্রসপেরো কিছু বলার আগেই থমথমে কণ্ঠে জিয়ানেট্টিনো বলল, আমাদের অবিশ্বাসের মূল কারণ হচ্ছে দলাদলি। অ্যাডর্নো, ফ্রেগোসো, স্পিনোলি, ফিয়েসি আর অন্যান্য বংশের মধ্যে বহু আগে থেকে চলে আসা এই দলাদলিই যত নষ্টের মূল। বহু শতক ধরে রিপাবলিকের জন্য একটা দুঃস্বপ্ন হয়ে আছে এই পারিবারিক কোন্দল। প্রতিটা পরিবারই ক্ষমতায় যাওয়ার জন্য মুখিয়ে আছে। একসময় জেনোয়া ছিল ভেনিসের চেয়েও শক্তিশালী। কিন্তু আজ এই অভ্যন্তরীণ কোন্দলের কারণে শক্তি থাকা সত্ত্বেও তারা দুর্বল। বাইরের একটা দেশের অঙ্গুলি-হেলনেচলতে হয় তাদের। আমরা এখানে এসেছি এই অভ্যন্তরীণ দলাদলি আর বাইরের কর্তাদের কর্তৃত্বের ইতি ঘটাতে। এসেছি জেনোয়িসদেরকে তাদের প্রকৃত স্বাধীনতা ফিরিয়ে দিতে…।
ধৈর্যের বাঁধ ভেঙে গেল প্রসপোেের। হয়েছে, হয়েছে, আর বলার দরকার নেই। বাজারে বক্তৃতা দেয়ার জন্য বাকিটুকু তুলে রাখো। আমি জানি, জেনোয়াকে হেঁকে” বিশুদ্ধ করতেই এসেছ তোমরা। সেজন্যই তোমাদের সঙ্গে এসেছি আমি। নইলে আমিও এখানে থাকতাম না।
আবার কথা বলল ডোরিয়া। কথাটা তোমার বাবারও বোঝা উচিত। আশা করি, তিনি ভুলে যাননি, আমিও এ দেশেরই সন্তান। আমার হাড়ে-মজ্জায় মিশে আছে জেনোয়ার মাটির ঘ্রাণ। দেশের ভাল ছাড়া খারাপ কখনো চাই না আমি।
বাবাকে আগেই চিঠি পাঠিয়েছিলাম যে, যৌথবাহিনীতে আমি যোগ দিয়েছি কেবল জেনোয়ার উন্নতির জন্য, বলল প্রসপেরো। ফ্রান্সের রাজার তরফ থেকে দায়িত্ব পেয়ে আপনি আসছেন, সেটাও চিঠিতে জানিয়েছি। আমরা যে জেনোয়াকে স্বাধীন করতে চাই, বলেছি তাও। সম্ভবত চিঠিটা বাবার হাতে পৌঁছেনি।
একথা আমিও ভেবেছি, বলল ডোরিয়া। প্রতিবাদমুখর হয়ে উঠতে যাচ্ছিল তার ভাতিজারা। শান্ত কণ্ঠে তাদের বাধা দিল লোকটা। সম্ভবত এত দুর্ভোগ আর রক্তপাতের একমাত্র কারণ এটাই। মিলানের রাস্তাঘাটে গিজগিজ করছে ডি লেইভার স্প্যানিশরা। হয়তো তোমার পত্রবাহক ওদের হাতেই ধরা পড়ে গেছে। এখন করণীয় একটাই। তাঁকে আবার চিঠি লিখে বলো, জেনোয়ার দ্বার যেন আমাদের জন্য উন্মুক্ত করে দেয়া হয়। অযথা যেন আমাদেরকে আর রক্তপাতের শিকার হতে না হয়।
কিন্তু এখানে বসে থেকে বাবার কাছে চিঠি পাঠাব কীভাবে?
ডোরিয়া বসে পড়ল। চিন্তিত ভঙ্গিতে দাড়ি হাতাতে হাতাতে বলল, সাময়িক যুদ্ধবিরতির প্রস্তাবের সঙ্গে খোলা চিঠি হিসেবে ব্যাপারটা জানাতে পারো তাঁকে।
এক কোনায় সরে গেল প্রসপেরো। বলল, এ চিঠিটাও তো স্প্যানিশদের হাতে পড়ে যেতে পারে। তাহলে মহাবিপদে পড়ে যাবে বাবা।
ঠিক তখন উপস্থিত হলো প্রসপেরোর এক লেফটেন্যান্ট। মাফ করবেন, ক্যাপ্টেন, বলল সে। একটা জেলে-নৌকা আমাদের পাশে এসে ভিড়েছে। বলছে, ডজের কাছ থেকে একটা চিঠি এনেছে সে। কিন্তু সেটা আপনাকে ছাড়া আর কারো হাতে দেবে না।
মুহূর্তের জন্য সবিস্ময়ে থমকে গেল সবাই। তারপরই হম্বিতম্বি শুরু করল জিয়ানেট্টিনো। প্রসপেরোর চারপাশে ঘুরতে ঘুরতে বলতে লাগল সে, তলে তলে ডজের সঙ্গে ঠিকই যোগাযোগ আছে আর জিজ্ঞেস করছ, কীভাবে তার কাছে চিঠি পাঠাবে?
ওর চাচা ওকে থামাল। বলল, যোগাযোগ আছে কিনা, এখনই জানা যাবে।
জিয়ানেট্রিনোর দিকে একবার তাকিয়ে লেফটেন্যান্টকে বলল প্রসপেরো, লোকটাকে ভিতরে নিয়ে এসো।
সে না আসা পর্যন্ত আর কোন কথা বলল না কেউ। লোকটা ঘরে এলে পরে দেখা গেল, অল্পবয়স্ক এক জেলে সে। কালো চোখে একে একে ঘরের চারজনকেই দেখল, তারপর জানতে চাইল, প্রসপেরো কে?
এক কদম সামনে বেড়ে বলল প্রসপেরো, আমি।
কাপড়ের ভাজ থেকে একটা সিল করা খাম বের করে তার দিকে বাড়িয়ে ধরল ছেলেটা। প্রসপেরো একবার খামটার দিকেতাকাল। সিল ভাঙতে গিয়ে রীতিমত হাত কাঁপতে লাগল ওর।
মুখ কালো করে চিঠিটা পড়ল প্রসপেরো। তারপর চোখ তুলে কাগজটা বাড়িয়ে ধরল ডোরিয়ার দিকে। লেফটেন্যান্টকে বলল, নিয়ে যাও ওকে। নিচে অপেক্ষা করুক।
চিঠিটা পড়ে ডোরিয়ার চোখে ফুটে উঠল স্বস্তির দৃষ্টি। বলল, বোঝা যাচ্ছে, প্রসপেরোর কথাই ঠিক। তারপর দুই ভাতিজার দিকে ফিরে বলল, তোমরা দুজন বিচার-বিবেচনা না করেইঅভিযোগ করছিলে।
চিঠিটা ওদের দিন, বলল প্রসপেরো। ওরাও পড়ে দেখুক।
জিয়ানেটিনোর হাতে চিঠিটা দিল ডোরিয়া। দুজনকেই সতর্ক করছি, না জেনে-বুঝে আর কখনো উল্টোপাল্টা কথা বলবে না। ডজ যা করেছেন, আমাদের উদ্দেশ্য না জেনে করেছেন। তারপর প্রসপেরোকে বলল, খবর পাঠানোর উপায় তো পেয়েই গেছ। এবার সব জানানোর ব্যবস্থা করো ওঁকে। আশা করি, আবার আমাদের জেনোয়ার রোষের মুখে পড়তে হবে না।
অ্যাডমিরাল ডোরিয়ার দুই ভাতিজা নীরবে চিঠিটা পড়ছে। ওতে লেখা:
পোর্টোফিনোতে কয়েকজনকে বন্দি করেছি। ওদের কাছ থেকে জানতে পারলাম, আমাদের উপর আক্রমণকারী পোপের এই বাহিনীর নেতৃত্বে আছ তুমি! বিশ্বাস করতে পারছি না, তুমি তোমার নিজ দেশের বিরুদ্ধে অস্ত্রধারণ করেছ। তার চেয়ে বড় কথা, নিজের বাবার বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে এসেছ তুমি! এর কোন একটা গ্রহণযোগ্য ব্যাখ্যা অবশ্যই আছে। তোমার স্বভাব যদি পুরোপুরি বদলে গিয়ে না থাকে, তাহলে আশা করি, এর একটা সন্তোষজনক ব্যাখ্যা দেবে। এক জেলেকে দিয়ে তোমার কাছে পত্র পাঠাচ্ছি। উত্তরও ওর হাতেই পাঠাবে। অবশ্য যদি তোমার কোন উত্তর থাকে। যেন থাকে, তা-ই প্রার্থনা করি ঈশ্বরের কাছে।
পড়া শেষ করে মুখ কালো করে ফিলিপ্পিনো তাকাল চাচার দিকে। বলল, চাচা, আমার কাছে চিঠিটার ভাষা আক্রমণাত্মক লাগছে।
একমত হলো জিয়ানেট্টিনোও। প্রসপেরোর দিকে ফিরে বলল, একদম পরিষ্কার ভাষায় ডজকে জানিয়ে দাও যে, আমাদেরকে বাধা দেয়ার অর্থ হবে, নিজের পায়ে কুড়াল মারা। নিজের এর চেয়ে বড় ক্ষতি আর করা সম্ভব না। কারণ, শেষ পর্যন্ত ফ্রান্স জিতবেই। তখন অকারণ রক্তপাতের জন্য এককভাবে দায়ী করাহবে কেবলমাত্র ডজকে।
শীতল চোখে দুই ভাইয়ের দিকে তাকাল প্রসপেরো। দৈহিক দিক থেকে বিশাল কিছু নয় ও। কিন্তু ওর দৃষ্টি অত্যন্ত স্পষ্টভাবে নিজের মনোভাব প্রকাশ করছে। মুখে শুধু বলল ও, এটাই যদি তোমাদের বক্তব্য হয়, তো তোমরা নিজেরাই সেটা পৌঁছে দিতে পার। আরেকটা ব্যাপার, জিয়ানেট্টিনো, কেউ যদি তোমাকে বলে থাকে যে, আমার ধৈর্যের সীমা নেই, আমি বলব, সে মিথ্যা বলেছে।
চমৎকার একটা ঝগড়ায় রূপ নিতে পারত কথাবার্তা। কিন্তু অ্যাডমিরালের হস্তক্ষেপে তা আর হলো না। তুমি যথেষ্ট ধৈর্য ধরেছ, প্রসপেরো, বলল সে। যেহেতু সবকিছু পরিষ্কার হয়ে গেছে, তাই আর ধৈর্য ধরার দরকার নেই। আমরা থাকলে চিঠিটা লিখতে তোমার কেবল দেরিই হবে।
দুই ভাতিজাকে প্রায় ঠেলতে ঠেলতেই বের করে নিয়ে চলে গেল সে।
.
০২.
দ্য ডজ
আগস্টের কড়া রোদে জ্বলজ্বল করছে জেনোয়ার শান বাঁধানো পথঘাট। প্রকৃতপক্ষেই মুক্তোর মত লাগছে দেখতে। ওদিকে মার্শাল ডি লট্রেসের অধীনে ফ্রান্সের পদাতিক বাহিনী আসছে জেনোয়া আক্রমণ করতে। তবে জেনোয়াকে প্রায় চারদিক থেকেই ঘিরে আছে সাগর থেকে উঠে আসা পাহাড়শ্রেণী। ফলে অ্যাম্ফিথিয়েটারের মত একটা প্রাকৃতিক নিরাপত্তা বলয়ের ভিতর গড়ে উঠেছে জেনোয়া। কেবলমাত্র সরু উপকূল ছাড়া আর কোনদিক থেকে সরাসরি এখানে আক্রমণ করা মোটেও সহজ নয়। তবে হ্যাঁ, কেউ যদি অমানুষিক পরিশ্রম করে পাহাড় বেয়ে এপারে আসে, তারা হয়তো আক্রমণে আসতে পারবে। কিন্তু বলার চেয়ে বাস্তবে কাজটা করা অনেক বেশি কঠিন।
ফ্রেঞ্চরাও জানে, এই দুঃসাধ্য প্রচেষ্টা তাদের দ্বারা সম্ভব না। তাই সবচেয়ে সহজ পথটাই বেছে নিয়েছে তারা। জেনোয়াকে চারদিক থেকে ঘিরে রেখে বাইরে থেকে রসদ আসার পথ রুদ্ধ করে দিয়েছে। ডোরিয়া আসার আগেই অবরুদ্ধ অবস্থায় এভাবে কেটে গেছে দশটি দিন।
অবরোধের কাজটা খুব ভালভাবে সম্পাদন করেছে মার্সেই থেকে আসা সাতটা ওঅর গ্যালি (যুদ্ধজাহাজ)। ওদিকে খিদের যন্ত্রণায় জেনোয়াবাসীদের অবস্থা কাহিল। জানা কথা, ক্ষুধা অদম্য সাহসী লোকেরও মনোবল নষ্ট করে দেয়। কাজেই, শাসকের দিকে আসতে লাগল অভিযোগের তীর। কারণ, খাবারের সংস্থান করতে পারছেন না তিনি।
ওদিকে স্পেন সম্রাটের বিরুদ্ধে শোর তোলার সুযোগ পেয়ে গেছে সুযোগ সন্ধানী ফ্রেগোসিরা। খুব ভালভাবে সুযোগটা কাজে লাগাল তারা। স্পেন সম্রাটের বলা উন্নতির ফাঁপা বুলি মেনে নেয়ায় তীব্র সমালোচনা করতে থাকল ডজের। কারণ, স্পেন সম্রাটের প্রতিনিধি হিসেবে জেনোয়া শাসন করছেন ডজ। সবৃদিক থেকে শোর উঠতে শুরু করল যে: ফ্রান্সের রাজার বশ্যতা স্বীকার করে তার ঘোষিত স্বর্ণযুগ শুরুর সুযোগ গ্রহণ করা হোক। সমাজের উঁচু-নিচু নির্বিশেষে সবাই একই রব তুলতে লাগল। দাবি উঠল, ডজ যেন মিত্রশক্তির কাছে আত্মসমর্পণ করেন। ছাত্র, দিনমজুর, নানান পেশার মানুষ-সবাই সোচ্চার হয়ে উঠল একই দাবিতে। সবাই-ই ভাবছে, স্পেনের শয়তান সম্রাটের জন্যই চূড়ান্ত বোকা ডজ তখনও জেনোয়া ধরে রেখেছেন।
মিলানে স্পেন সম্রাটের নিয়োজিত ইম্পিরিয়াল গভর্নর ডন অ্যান্টোনিও ডি লেইভার কাছ থেকে সংবাদ এল যে, ডজ চাইলেস্প্যানিশ সেনাদের ব্যবহার করতে পারেন। তাঁর সামনে এখন দুটো পথ খোলা আছে। এক, বিদ্রোহ দমন করার কাজেস্প্যানিশ সেনাদের ব্যবহার করা। আর দুই, ফ্রেঞ্চ রাজার প্রতিনিধির কাছে শহর সমর্পণ করা।
ঘনিষ্ঠ পারিষদবর্গ নিয়ে এই বিষয়েই আকাশ-পাতাল ভাবছেন ডজ, ঠিক তখনই তাঁর হাতে এল ছেলে প্রসপেরোর পাঠানো চিঠি।
চিঠিটা হাতে নিয়ে নিজ দুর্গ ক্যাস্টেলেট্টোয় বসে আছেন অ্যাডর্নো। তাঁর ঘরটা বেশ ছোট। তবে এই ঘরের জানালা দিয়েপ্রায় পুরো শহর, হার্বার আর তার সামনের সাগরটাও চোখে পড়ে। নীল রঙের মখমলে ঢাকা বড় একটা চেয়ারে বসে আছেন তিনি। বাঁ হাতটা ব্যাণ্ডেজে ঢাকা। গতরাতে পোর্টোফিনোর লড়াইয়ে একটা বর্শা বিধেছিল হাতে।
তীব্র এই গরমেও ডজের গায়ে জড়ানো একটা চাদর। ক্ষত থেকে অনেক বেশি রক্তপাতের কারণে জ্বর উঠে গেছে। তার পাশের টেবিলটার পিছনে দাঁড়িয়ে আছে স্ত্রী ডজারেসা (ডজারেসা নাম নয়, উপাধি। ডজের স্ত্রীলিঙ্গ।)। এই মাঝবয়সেও মহিলার সৌন্দর্য দেখে স্পষ্ট বোঝা যায়, সময়কালে তার সৌন্দর্য ছিল রীতিমত কবিদের কবিতা আর চিত্রকরদের ছবির বিষয়বস্তু।
ডজারেসার সঙ্গেই দাঁড়িয়ে আছে মাঝবয়সী ক্যাপ্টেন অগাস্টিননা স্পিনোলা ও লাভাগনা-র কাউন্টের ছোট ভাই স্কিপিওনি ডি ফিয়েসি।
প্রসপেরোর চিঠিটা পড়ে লম্বা সময়ের জন্য আত্মমগ্ন হয়ে রইলেন অ্যাডর্নো। এমনকী তার স্ত্রীও ধ্যান ভাঙাতে সাহস করছে না। কোন মন্তব্য করার আগে আবার চিঠিটা পড়লেন লর্ড।
…জেনোয়ার উপকার না হলে আমি যৌথ বাহিনীর সঙ্গে কখনোই হাত মেলাতাম না। আমি ফ্রেঞ্চদের সমর্থন দেয়ার জন্য আসিনি, বরং ফ্রেঞ্চরাই আমাদের সমর্থন করতে এসেছে। ওদের স্বার্থ দেখতে নয়, বরং জেনোয়াকে স্বাধীন করতে এসেছে এই নৌ-সেনাদল। এজন্যই যৌথ নৌবাহিনীর একটা অংশের দায়িত্ব গ্রহণ করতে কুণ্ঠিত হইনি আমি। আমার দৃঢ় বিশ্বাস, আমাদের উদ্দেশ্য জানার পর তুমিও আর বাধা দেবে না। বরং বাড়িয়ে দেবে সহযোগিতার হাত।
চোখ তুলে তাকালেন ডজ। চোখে বিভ্রান্ত দৃষ্টি। একে-একে তাকালেন তাঁকে ঘিরে দাঁড়িয়ে থাকা সবার দিকে। ততক্ষণে ডজারেসার ধৈর্য শেষ। কী লিখেছে প্রসপেরো? জানতে চাইল মহিলা।
চিঠিটা তার দিকে ঠেলে দিয়ে বললেন ডজ, নিজেই পড়ো। পড়ে শোনাও সবাইকে।
থাবা দিয়ে চিঠিটা তুলে নিল ডজারেসা। জোরে-জোরে পড়ে শোনাল সবাইকে। পড়া শেষ হতেই বলল, ঈশ্বরকে ধন্যবাদ। এখন তো তোমার সন্দেহ দূর হয়েছে?
কিন্তু এটা কতটুকু বিশ্বাসযোগ্য? গোমড়া মুখে বললেন ডজ।
বিশ্বাসযোগ্য না হলে ওই দলে প্রসপেরোর যোগদানকে কীভাবে ব্যাখ্যা করবেন? বলল স্কিপিওনি।
নিজের সন্তানকে অবিশ্বাস করছ তুমি? উত্তেজিত কণ্ঠে বলল ডজারেসা।
না। আমি ওর বিশ্বাস নিয়ে প্রশ্ন তুলছি না। কিন্তু যারা এর পিছনে আছে, তাদের আসল” ইচ্ছা নিয়ে প্রশ্ন তুলছি আমি।
সবাই কি নিশ্চিত যে, কোথাও কোন ষড়যন্ত্র হচ্ছে না?
ডোরিয়া রক্তের প্রতি মন, বিষিয়ে আছে স্কিপিওনির। সঙ্গে সঙ্গেই প্রশ্নটা সমর্থন করল ও। কিন্তু উজারেসা ও-কথায় কান দিল না।
ফ্রেঞ্চরা নিজেদের স্বার্থের কথা একটুও ভাববে না, এ হতেই পারে না, বললেন ডজ।
কিন্তু প্রসপেরোকে অবিশ্বাস করে লাভটা হচ্ছে কোথায়? তাছাড়া ওর কথায় এটুকু অন্তত পরিষ্কার যে, ডোরিয়ার বিরুদ্ধে দাঁড়ালে আসলে দেশের সর্বোচ্চ স্বার্থকেই ক্ষুণ্ণ করা হচ্ছে।
ভীষণ দ্বিধাগ্রস্ত হয়ে গেছি আমি। কেবল একটা ব্যাপারই পরিষ্কার দেখতে পাচ্ছি; সেটা হচ্ছে সম্রাটের দেয়া ডিউকের মুকুটধারী শাসক আমি। তাহলে তাঁর প্রতি আমার কি কোন কর্তব্য নেই?
উত্তর দিল ডজারেসা অরেলিয়া। বলল, তোমার সর্বোচ্চ দায়িত্ব ও কর্তব্য কি জেনোয়ার প্রতি নয়? জনগণ, না সম্রাট-কার প্রতি তোমার কর্তব্য বেশি, তা বিচার করতে গিয়ে তুমি আসলে ফ্রেগোসোর কাজ সহজ করে দিচ্ছ।
প্রশ্নবোধক দৃষ্টিতে তাকালেন ডজ ওঁর ক্যাপ্টেন স্পিনোলার দিকে। উত্তর দেয়ার আগে সামরিক কায়দায় কাষ্ঠবৎ শক্ত হয়ে দাঁড়াল ক্যাপ্টেন। তারপর বলল, আমার মনে হয়, ইয়োর হাইনেস, আপনার দায়িত্ব অবশ্যই সম্রাটের প্রতি। কিন্তু জেনোয়ার প্রশ্ন এলে বলতেই হবে, যে-কোন রাজা বা সম্রাটের চেয়ে জেনোয়াবাসীর প্রতি আপনার দায়িত্ব অনেক বেশি। প্রসপেরোও এ বিষয়ে একমত। আমার কাছে গোটা চিত্রটা এরকমই। তবে মহানুভব যদি অন্য কিছু চিন্তা করে থাকেন আর যৌথশক্তিকে বাধা দিতে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ হন, তাহলে আগে আপনাকে বিদ্রোহীদের দমন করতে হবে।
ম্লান মুখে কথাটা বিবেচনা করে বললেন ডজ, ভালই বলেছ, অগাস্টিননা। প্রসপেরোও এভাবেই বলত।
চোখমুখ শক্ত করে বলল স্কিপিওনি, প্রসপেরো এখানে থাকলে অবশ্যই আত্মসমর্পণের বিপক্ষে শক্তিশালী যুক্তি তুলে ধরত। ডোরিয়াকে অবিশ্বাস করতে বলত ও।
ডোরিয়াকে কেন অবিশ্বাস করব, সেটা বলো।
ওর অতি উচ্চাকাঙ্ক্ষার কারণে। জেনোয়ার প্রিন্স হওয়ার বাসনা থাকতে পারে ওর মনে।
ওই বিপদ যদি আসেই, তখন দেখা যাবে। স্রেফ সন্দেহের বশে জেনোয়াবাসীর রক্ত বইতে দিতে পারি না আমি।
তাহলে মহানুভবের সিদ্ধান্ত নিতে আর বাধা কোথায়? বলল স্পিনোলা।
টিটকারির সুরে বলল স্কিপিওনি, শুধু একটা ব্যাপার ছাড়া,সেটা হলো প্রসপেরোর বিশ্বাস আর ডোরিয়ার ফাঁপা বুলি।
.
০৩.
আত্মসমর্পণ
সেদিন বিকেলেই ডোরিয়া আর সিজার ফ্রেগোসোর কাছে আত্মসমর্পণের প্রস্তাব নিয়ে গেল ডজের দূত। তাতে একটা মাত্র শর্ত আরোপ করা হয়েছে। স্পেন সম্রাটের সৈন্যবাহিনীকে তাদের অস্ত্রসহ শহর থেকে বেরিয়ে যেতে দিতে হবে। আক্রমণাত্মক কোন পদক্ষেপ নেয়া যাবে না তাদের বিরুদ্ধে।
শর্তটি মেনে নেয়া হলো।
পরদিন সকালেই নিজের রেজিমেন্ট নিয়ে শহর ত্যাগ করল ডন সাঞ্চো লোপেজ, যদিও স্প্যানিশদের কাছ থেকে এ সিদ্ধান্তের তীব্র বিরোধিতা এসেছিল। তারা বলছিল যে, ডি লেইভার সেনাদল যে-কোন সময়ে শহরে পদার্পণ করবে। কিন্তু ডজ তার সিদ্ধান্তে অটল রইলেন। ফলে শেষ পর্যন্ত শহর ছেড়ে চলে যায়স্প্যানিশরা।
ওরা শহর ছাড়া মাত্রই তিনশ ফ্রেঞ্চ সৈন্য নিয়ে শহরে ঢুকে পড়ে ফ্রেগোসো। তবে তার সেনাবাহিনীর মূল অংশ রয়ে যায় ভেন্ট্রিতে, তাদের ক্যাম্পে। কারণ ক্ষুৎপিপাসায় কাতর একটা শহর এত সৈন্য ঠাই দিতে পারবে না। শহরের লণ্ঠন গেটে তাদের বীরোচিত সংবর্ধনা দেয় সাধারণ জনগণ। তাদের দৃষ্টিতে ওরা হচ্ছে স্বাধীনতা আনয়নকারী মহান সেনা। এর দুতিন ঘণ্টা পর যুদ্ধজাহাজগুলো বন্দরে ভিড়তে শুরু করে। ডোরিয়া তখন সঙ্গে করে নিয়ে আসে তার প্রভিন্সিয়াল ট্রপের পাঁচশ সৈন্য। একই সময় বন্দরে জাহাজ ভেড়ায় প্রসপেরোও। সঙ্গে তিনশ সৈন্য।
এত সৈন্য জড়ো করার উদ্দেশ্য হচ্ছে মূলত শক্তি প্রদর্শন। কিন্তু শেষ মুহূর্তে এমন একটা পরিস্থিতির উদ্ভব হয় যে সম্পূর্ণ ভিন্ন কাজে লাগাতে হয় ওই সেনাবাহিনীকে।
সম্ভবত সিজার ফ্রেগোসোর উর্বর মস্তিষ্কপ্রসূত আইডিয়া ছিল, জেনোয়াবাসীকে উৎপীড়ন-নিপীড়নের হাত থেকে মুক্তিদাতা হিসেবে নায়কোচিত ভূমিকা নেবে সে। কিন্তু তার মূল বাহিনীর দৃষ্টিভঙ্গি পুরোপুরি ভিন্ন। তারা মার্সেনারি, মানে ভাড়াটে সৈনিক। তাই তাদের দৃষ্টিভঙ্গিও ভিন্ন। তাদের চোখে জেনোয়া স্রেফ জিতে নেয়া একটা শহর। স্বভাবতই মার্সেনারিরা বিজিত শহরের উপর নিজেদের অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে চাইবে। এবং হলোও তাই। চেইন অভ কমাণ্ড ভেঙে তড়িৎ-গতিতে কাজে নেমে পড়ল, তারা। ফলে শহরে বেশ কিছু দুর্ঘটনা ঘটে গেল। এতদিন যারা শহর সমর্পণের জন্য ডজের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ চালিয়েছে তারাও বুঝল, ফ্রেঞ্চ সেনারা কতটা সাহায্য তাদেরকে করবে আর কতটা নিজেদের উদরপূর্তি করবে।
প্রথমদিকে ফ্রেঞ্চদের নজর ছিল খাবারের দিকে। তারা জোর করে শহরের ধনী ব্যবসায়ী ও গণ্যমান্য ব্যক্তিদের ঘর-বাড়িতে ঢুকে পড়ে। কিন্তু এক পর্যায়ে এটুকুতেই তাদের ক্ষুধা শান্ত থাকেনি। কিছুক্ষণের মধ্যেই দেখা যায় খাবার-দাবারের সরবরাহ শেষ। তখন রীতিমত হিংস্র হয়ে ওঠে তারা। নেমে পড়ে নির্বিচার লুটপাটে। ততক্ষণে আরো সৈন্য হাজির হয়ে গেছে। ওদের দেখে লুটপাটকারীদের সাহস আরো বেড়ে যায়। দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্যি যে ওই সময় ফ্রেঞ্চ মার্সেনারি ও সেনাদের পাশাপাশি লুটপাটে অংশ নেয় অর্থলোলুপ কিছু জেনোয়াবাসী।
অবস্থাটা খুব ভালভাবে অনুধাবন করতে পারল প্রসপেরো। রাগে ওর মাথা খারাপ হওয়ার অবস্থা। ওদিকে একদল অফিসারের জটলার ভিতর দাঁড়িয়ে কিছু একটা নিয়ে জরুরি ভঙ্গিতে কথা বলছে ডোরিয়া। অফিসারদের জটলা ঠেলে ডোরিয়ার সামনে পৌঁছে গেল ও। কিন্তু তখন ডোরিয়ার সামনে দাঁড়িয়ে থাকা লোকটাকে দেখে একটা অজানা শঙ্কা কাঁপিয়ে দিয়ে গেল ওকে। মুখের কথা মুখেই রয়ে গেল ওর।
ডোরিয়া বলল, এখন কোন কথা বোলো না, প্রসপেরো। এখন কথা নয়, কাজের সময়। যে-কোন মূল্যে বিশৃঙ্খলা থামাতে হবে। এবং এখনই, বলে সে তাকাল তার সামনে দাঁড়িয়ে থাকা খাট, দুবলা-পাতলা একজন মানুষের দিকে। লোকটার পরনে গাঢ় লাল রঙের ডাবলেটের (ডাবলেট: ১৪০০-১৬০০ খ্রিস্টাব্দে ইউরোপে প্রচলিত পুরুষদের আঁটো জামা বিশেষ) উপর কালো ধাতুর হালকা বর্ম। স্টিল হেলমেটের নিচে তার হাড়সর্বস্ব চেহারাটা কালো দাড়িতে ঢাকা। নাকের উপর কুৎসিতদর্শন আড়াআড়ি একটা ক্ষত বলে দিচ্ছে এই লোকই হচ্ছে সিজার ফ্রেগোসো।
রীতিমত গর্জন করে তাকে ডোরিয়া বলল, আপনার সেনাদের কেমন শৃঙ্খলা শিখিয়েছেন যে এমন ভয়াবহ একটা বিপর্যয় তৈরি হয়েছে?
কেমন শৃঙ্খলা? ওদের অপকর্মের দোষ কি আমাকে দিচ্ছেন?
তো কাকে দেব? এই দুবৃত্ত ফ্রেঞ্চদের কমাণ্ড কি আর কারো হাতে আছে?
হা, ঈশ্বর! একা একজন মানুষ কীভাবে তিনশজনকে সামলাতে পারে?
কমাণ্ড দেয়ার যোগ্যতা থাকলে তিনশ সৈন্য কোন ব্যাপারই নয়, শান্ত কণ্ঠে বলা কথাগুলো চূড়ান্ত অপমান করল তাকে।
নিজের দোষ ঢাকতে বিড়বিড় করে কিছু একটা বলল ফ্রেগোসো। কিন্তু তার কথা সবাই শোনেনি। তারপর সে বলল, দোষ যদি কাউকে দিতেই হয় তো আহাম্মক ডজকে দিন। স্পেন সম্রাটের পা চাটতে গিয়ে জনগণের জন্য সে কিছু তো করেইনি, উল্টো তাদের না খাইয়ে মারার জোগাড় করেছে।
হঠাৎ করেই নিজের বক্তব্যের পক্ষে সমর্থক পেয়ে গেল সে। ফিলিপ্পিনো দাঁড়িয়ে ছিল তার চাচার পাশে। সে বলল, আমার বিশ্বাস ঠিক কথাই বলছেন স্যর সিজার। সব দোষ অ্যান্টোনিওট্টো অ্যাডর্নোর।
রাগত স্বরে ফ্রেগোসো বলল, ঈশ্বরের শপথ, স্প্যানিশ সৈন্যরা চলে যাওয়ার পর এই ক্ষুধার্ত রাক্ষসদের সামলে রাখার কেউ ছিল না। তার উপর আগের দিন অ্যাডর্নোর তুচ্ছ প্রতিরোধ ওদেরকে আরো বেপরোয়া করে তুলেছে। ফলে ওরা জেনোয়াবাসীদের সাহায্য করার বদলে নিজেদের সাহায্য” করতে লেগে গেছে…
এ পর্যায়ে তাকে বাধা দিয়ে ডোরিয়া বলল, এটা কি বক্তৃতা দেবার সময়? এখন প্রথম কাজ হচ্ছে সৈন্যদের মধ্যে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনা। কথা পরেও বলা যাবে।
প্রসপেরো একটু সামনে ঝুঁকে ফ্রেগোসো আর ফিলিপ্পিনোর কাঁধ স্পর্শ করে বলল, তখন আমারও কিছু বলার থাকবে।
ওকে থামিয়ে দিয়ে ডোরিয়া বলল, ঝগড়া বাদ দাও। কী করতে হবে তুমি জানো, প্রসপেরো। শুরু করে দাও। তুমি পুব দিক সামলাও, আমি পশ্চিম দেখছি। আর হ্যাঁ, কঠিন পদক্ষেপ নেবে।
কাজেই কঠোর পদক্ষেপ নিতে প্রসপেরো তলব করল ওর এক নিয়াপলিটান ক্যাপ্টেনকে। তার নাম ক্যাটানিও। তাকে বলল আরো দুইশ সৈন্য মোতায়েন করতে। সব মিলিয়ে পাঁচশ সৈন্য মাঠে নামাল প্রসপেরো।
লুটপাটকারীরা ছোট ছোট দলে বিভক্ত হয়ে লুটতরাজ চালাচ্ছে। কাজেই প্রসপেরোও ওর সেনাবাহিনীকে ছোট ছোট দলে ভাগ করে নিল। প্রত্যেকটা দলে একজন করে নেতা নির্ধারণ করে দিল। যাতে স্বল্প সময়ে বেশি এলাকায় কাজ করা যায়। একটা দলের দায়িত্ব নিল ও নিজে। তারপর একমুহূর্তও সময় নষ্ট মা করে কাজে লেগে পড়ল।
এক বয়স্ক ব্যবসায়ীর ঘরে চলছে অবাধ লুটপাট। ওখানে উচ্ছঙ্খল কিছু ফ্রেঞ্চ সেনাদের সঙ্গে মিলে লুটপাটে অংশ নিয়েছে স্থানীয় কিছু লোক। ব্যবসায়ী তার স্বর্ণ কোথায় রাখে জানার জন্য তার উপর অত্যাচার করছে ওরা। ওই অবস্থায়ই বদমাশগুলোকে পাকড়াও করল প্রসপেরো। ওদের দলনেতাকে ধরে ওখানেই ফাঁসিতে লটকে দিল ও। বর্শার হাতল দিয়ে বেধড়ক পেটাতে পেটাতে বাকিদের এলাকাছাড়া করল। দোষীদেরকে কোন দয়া দেখাল না প্রসপেরো। এক ভদ্রলোকের ওয়াইনের সেলারে নেতাসহ একটা লুটপাটকারী দলকে ধরল ও। মদের নেশায় প্রায় বেহুঁশ নেতাটাকে মদের বালতিতেই চুবাতে চুবাতে মেরে ফেলার জোগাড় করল। মনে মনে বলল, খা, কত ওয়াইন খাবি একবারে খা। তবে বড় দলগুলোকে ধাওয়া করার সময় এমন কিছু করে মোটেও সময় নষ্ট করল না। যারাই ওর হাতে ধরা পড়েছে, হাত পা ভাঙা অবস্থায় রাস্তায় পড়ে কাতরাতে হয়েছে তাদেরকে। কিন্তু উদ্ধারকৃতদের কাছ থেকে ধন্যবাদ নিতে কোথাও একমুহূর্তের জন্যও থামেনি প্রসপেরো।
পুব দিক থেকে ধাওয়া শুরু করে বিকাল নাগাদ অ্যাকেইশা ঘেরা ছোট্ট একটা চার্চ প্রাঙ্গণে চলে এল প্রসপেরো। চমৎকার জায়গা সেটা। ঠিক তখন চার্চের পিছনে কোথাও থেকে ভেসে এল নারীকণ্ঠের আর্তনাদ, সঙ্গে এক পুরুষের উচ্চকণ্ঠের কুৎসিত লোলুপ হাসি। দ্রুত দল নিয়ে সামনে এগিয়ে গেল প্রসপেরো।
চার্চের সীমানা দেয়ালের ভিতর দিয়ে চলে যাওয়া পথটা গাঢ় ছায়াঘেরা। তার উপর এক পাশের দেয়াল আইভি লতায় ছাওয়া। ফলে ওখানে অন্ধকার আরো বেশি। আরো বিশ গজমত এগিয়ে যাওয়ার পর অন্ধকার কাটতে শুরু করল। পথটার শেষ মাথায় দেখা গেল একটা ভাঙা দরজা; কজার সঙ্গে কোনরকমে লটকে আছে সেটা। দরজা পেরিয়ে আর্তনাদের উৎসের দিকে ছুট দিল সবাই। দূর থেকেই দেখতে পেল মাটিতে দুমড়ে পড়ে আছে এক ভত্যের নিথর দেহ। পাশেই মুখ ঢেকে বসে আছে আরেকজন। বয়স্ক লোক সে। তার হাত থেকে দরদর করে গড়িয়ে পড়ছে রক্তের স্রোত। তারপরই প্রসপেরোর চোখ পড়ল ক্রন্দনরতা এক মহিলার দিকে। তার উর্ধাঙ্গের পোশাক ছিঁড়ে ফেলা হয়েছে। সম্ভ্রমহানি ও প্রাণনাশের ভয়ে আর্তনাদ করতে করতে ছুটছে সে। আর তার পেছন পেছন ছুটছে দুই ইবলিশ।
ওদিকে প্রসপেরোর বামপাশে বাগানের বেড়ার গা ঘেঁষে দাঁড়িয়ে আছে আরেকজন নারী। লম্বা, পাতলা ও সুশ্রী কাঠামোর অধিকারী সে। আতঙ্কে বিস্ফারিত হয়ে আছে তার চোখ।
পরে যতবারই প্রসপেরো ওই মহিলার কথা মনে করতে চেয়েছে, ওর শুধু মনে পড়েছে মহিলার পরনের সাদা পোশাক আর চুল ঢেকে রাখা অবগুণ্ঠনের জ্বলজ্বলে রত্নের কথা। এর কারণও অবশ্য রয়েছে। ওই সময় খুব দ্রুত কাজ সারার জন্য ছুটতে হয়েছে ওকে। বেশি কিছু লক্ষ করার সময় পায়নি ও। ফলে এক পলকে দেখা ওই দৃশ্যটাই কেবল স্মৃতিতে রয়ে গেছে।
লেফটেন্যান্টদের সংক্ষিপ্ত হুকুম দিল ও, দ্রুত কাজ সারো।
সঙ্গে সঙ্গেই দুই ধাওয়াকারীর উপর ঝাঁপিয়ে পড়ল ছজন সৈন্য। বর্শার হাতল দিয়ে পিটিয়ে লম্বা করে দেয়ার জোগাড় করল তাদের। অপরদিকে সাদা পোশাক পরিহিতা সম্ভ্রান্ত মহিলাটির পিছে লাগা আরেক বদমাশ পালাতে চাইল। এক কদম তুলেও ফেলল সে। কিন্তু এ পর্যন্তই, আর পারল না। ধরা পড়ে গেল সে। ছুরির কয়েক পোঁচে বদমাশটার গা থেকে খুলে নেয়া হলো বর্ম ও খাপসহ তলোয়ারের বেল্ট। তারপর বর্শার হাতল দিয়ে বেধড়ক পিটুনি দিতে শুরু করল সৈন্যরা। যন্ত্রণায় যখন প্রাণবায়ু বেরুবার জোগাড় তখন তীব্র আর্তনাদ করে উঠল সে। ওর দুই সঙ্গীও একইরকম সমাদর পাচ্ছে। এক পর্যায়ে একজনের মাথায় ডাণ্ডা পড়ল। সঙ্গে সঙ্গেই জ্ঞান হারিয়ে লুটিয়ে পড়ল সে। ওই ব্যাটাকে তখন পায়ে ধরে নির্মমভাবে হেঁচড়ে নিয়ে যাওয়া হলো পাথুরে সিঁড়ির উপর দিয়ে, সিঁড়ির ধাপে ধুম-ধাম বাড়ি খাচ্ছে তখন বদমাশটার মাথা। কিন্তু সেদিকে কেউ ফিরেও তাকাল না। অ্যাকেইশা গাছের নিচে ঘাসের চাদরের উপর ফেলে রাখা হলো ওকে। বাকিদেরও উপযুক্ত সমাদর করে এলাকাছাড়া করা হলো।
প্রসপেরোর সৈন্যরা খুবই সুশৃঙ্খল, তারা ওর নীতিতেই বিশ্বাসী। কাজেই, জেনোয়িস বা মার্সেনারি কারো প্রতিই বিশেষ কোন পক্ষপাত করল না ওরা। লুটেরাদের সবাইকে মোটামুটি একইরকমভাবে শাস্তি দিয়ে তাড়িয়ে নিয়ে গেল। যে বাড়িতেই লুটেরাদের পেল মেরে তাড়াল তাদের সবাইকে। বেশিরভাগ জায়গাতেই পিছনে ফেলে গেল লুটেরাদের রক্তাক্ত দেহ।
পড়ন্ত বিকেলে গিয়ে শেষ হলো প্রসপেরোর কাজ। বিশৃঙ্খলা সৃষ্টিকারীদের দমন করা হয়েছে। ক্লান্ত পরিশ্রান্ত দেহে সেনাদল নিয়ে ডিউকের প্রাসাদের দিকে রওনা হয়েছে প্রসপেরো। বাবার সঙ্গে দেখা করতে যাচ্ছে ও। সার্জানোর সরু খাড়া রাস্তা দিয়ে সান লরেঞ্জোর ডিউকাল প্রাসাদের দিকে এগুতে থাকল ওরা। পথে আর কোথাও লুটপাটের কোন চিহ্ন ওদের চোখে পড়ল না। কিন্তু তা সত্ত্বেও ওই পথ লোকে লোকারণ্য হয়ে আছে। বাকিরাও ওদের মতই প্রাসাদের দিকে যাচ্ছে। পথে ওর সঙ্গে যোগ দিল বিভিন্ন প্রান্ত থেকে আসা ওর অধীনস্থ সেনারাও। ওই দলগুলোর একটার নেতৃত্বে ছিল প্রসপেরোর ক্যাপ্টেন ক্যাট্টানিও। ততক্ষণে প্রসপেরোর সৈন্যসংখ্যা পুরো দেড়শ হয়ে গেছে। তারা সুশৃঙ্খলভাবে প্রসপেরোকে ঘিরে একটা ব্যুহ তৈরি করে এগুচ্ছে। যারা একটু সমঝদার তারা ওদেরকে দেখছে প্রশংসার দৃষ্টিতে। কিন্তু বাকি সাধারণ জনতা ওদেরকে দেখছে রাগত চোখে। কারণলুটেরাদের থামাতে ভীষণ বল প্রয়োগ করেছে ওরা।
ওদিকে লুটপাট থামাতে প্রসপেরোর চেয়ে অনেক নরম পদ্ধতি বেছে নিয়েছিল ডোরিয়া। প্রসপেরো ওর পাঁচশ সৈন্যকে পঁচিশটা দলে ভাগ করে মাঠে নামিয়েছিল। কিন্তু ডোরিয়া নামিয়েছিল চারশ সেনাকে চার ভাগ করে। তারা প্রায় পুরো শহর কর্ডন করে মানব-দেয়াল তৈরি করে অগ্রসর হয়। প্রতিটা দল ড্রাম পেটাতে পেটাতে আর ট্রাম্পেট বাজাতে বাজাতে এগুতে থাকে। স্পষ্টতই লুটেরাদের প্রতি এটা শেষ সাবধানবাণী যে এরপরই আসবে শক্তি প্রয়োগ। কালক্ষেপণ না করে জেনোয়িস লুটেরারা নিজেদের গর্তে গিয়ে ঢোকে। আর ফ্রেঞ্চ বদমাশের দলও চলে যায় তাদের ব্যারাকে। ফলে প্রসপেরোকে জনতার চোখ রাঙানি দেখতে হলেও ডোরিয়াকে তার কিছুই দেখতে হয়নি।
ডিউকের প্রাসাদের সামনে পৌঁছে প্রসপেরোর দল প্রচণ্ড ভিড়ের মুখে পড়ল। ভিড় এত বেশি যে এগুনো প্রায় অসম্ভব বলে মনে হলো। প্রাসাদের মূল ফটক আড়াল করে দুই সারিতে দাঁড়িয়ে আছে ডোরিয়ার বর্শাধারী প্রভিন্সিয়াল ট্রুপ। ঠিক তখন প্রাসাদের একটা বারান্দা থেকে ভেসে এল রুক্ষ ও উচ্চকিত একটা কণ্ঠ।
বারান্দায় দাঁড়ানো ধূসর দাড়িওয়ালা, বিশালদেহী বয়স্ক লোকটা স্বয়ং ওট্টাভিও ফ্রেগোসো। জেনোয়া যখন ফ্রেঞ্চদের অধীনে ছিল তখন এই ওট্টাভিওই ছিল জেনোয়ার ডজ। স্বভাবতই এখন প্রতিশোধস্পৃহায় উন্মত্ত হয়ে আছে তার মন। লোকটার কাঁধে ঝোলানো ডিউকের আলখেল্লা দেখেই স্পষ্ট বোঝা গেল-ফ্রেঞ্চদের ফিরে আসার সঙ্গে সঙ্গেই ডিউকের পদ, দায়িত্ব ও ক্ষমতা হস্তগত করেছে সে। বারান্দায় ওট্টাভিওর বামপাশে দাঁড়িয়ে আছে তার কাজিন সিজার ফ্রেগোসো। ডানপাশে ডোরিয়া।
নিঃশ্বাস বন্ধ করে লোকটার কথা শুনছে প্রসপেরো। সে বলছে, জেনোয়ার নাগরিক ও জাতির পিতা লর্ড ডোরিয়া স্বয়ং এখানে এসেছে জেনোয়ার অধিবাসীদেরকে তাদের অতি-কাক্ষিত স্বাধীনতা এনে দিতে। স্পেনের সেনাবাহিনীর খাবারের জোগান দিতে এ দেশের নাগরিকদেরকে আর ট্যাক্স দিতে হবে না। জেনোয়িসদের উপর স্প্যানিশদের ছড়ি ঘোরানোর দিন শেষ। ফ্রান্সের পরোপকারী রাজার নিরাপত্তার নিশ্চয়তায় আজ থেকে জেনোয়া পুরোপরি স্বাধীন। এবং এই জন্য একমাত্র ধন্যবাদ প্রাপ্য সাগরের সিংহ, লর্ড ডোরিয়ার।
এ পর্যন্ত বলে মঞ্চাভিনেতার মত হাততালির প্রত্যাশায় বক্তৃতায় বিরতি দিল সে। সঙ্গে সঙ্গেই গর্জে উঠল জনতা। বলতে লাগল, দীর্ঘজীবী হোক ডোরিয়া।
লর্ড ডোরিয়া তখন হাত তুলে তাদেরকে শান্ত হতে ইশারা করল। এবং আবার বক্তৃতা শুরু করল ওট্টাভিও ফ্রেগোসো। জেনোয়াবাসীদের জন্য ফ্রেঞ্চ অভিযানের আরো মূল্যবান উপকারিতার বর্ণনা শুরু করল সে।
ততক্ষণে বন্দরে শস্যবাহী জাহাজ থেকে মাল খালাস শুরু হয়ে গেছে। সবার জন্য যথেষ্ট পরিমাণে রুটির ব্যবস্থাও করা হয়েছে। মাংসের জন্য গবাদিপশুর পাল তাড়িয়ে নিয়ে যাচ্ছে সিজার ফ্রেগোসোর লোক। বাহ্যত জেনোয়ার দুর্ভিক্ষের অবসান হয়ে গেছে। সব মিলিয়ে খুব খুশি জেনোয়ার বাসিন্দারা। বজ্রধ্বনিতে তালি বাজাতে বাজাতে গর্জে উঠল জেনোয়াবাসীরা। এবার তারা রব তুলল, দীর্ঘজীবী হোক ডজ ফ্রেগোসো।
এরপর ফ্রেগোসো ঘোষণা দিল, জনতাকে যে বা যারা কষ্ট ভোগ করতে বাধ্য করেছে তাদের কাউকে ছাড় দেয়া হবে না। জবাবদিহি করতে হবে সবাইকে। বিদেশি শাসকদের প্রভুত্ব বজায় রাখতে যারা জেনোয়াবাসীদের অকারণ ভোগান্তির মুখে ফেলেছে তাদেরকে অত্যন্ত দ্রুত বিচারের সম্মুখীন করা হবে।
সব দেশের জনতাই আসলে খুব দুর্বল স্মৃতিশক্তির অধিকারী। খুব দ্রুতই তারা পিছনের কথা ভুলে যায়। এখানেও তার ব্যতিক্রম হলো না। ক্রোধে ফেটে পড়া জনতা চিৎকার করে উঠল, অ্যাডর্নো নিপাত যাক, বেইমানদের শাস্তি মৃত্যু।
বক্তৃতা শুনে একইসঙ্গে আতঙ্কে ও রাগে পাগল হওয়ার দশা হলো প্রসপেরোর। তখনই নিজের কাঁধে একটা শক্তিশালী হাতের স্পর্শ পেল ও। সেইসঙ্গে একটা ভারী কণ্ঠ কানের পাশে বলল, এতক্ষণে পেয়েছি। দুই ঘণ্টারও বেশি সময় ধরে তোমাকে খুঁজছিলাম।
কণ্ঠধারী আর কেউ নয়, স্কিপিওনি ডি ফিয়েসি, প্রসপেরোর বাবার বিশ্বস্ত মন্ত্রণাদাতা। প্রসপেরোর পাশে দাঁড়িয়ে হাঁপাতে হাঁপাতে কথাগুলো বলল সে। একটু শ্বাস নিয়ে বলল, ওর কথার পুরোটাই তো শুনেছ। না শুনলে তোমার এতক্ষণ এখানে থাকার কথা না।
প্রসপেরো বলল, প্রাসাদেই যাচ্ছিলাম, কিন্তু এই জটলায় আটকে গেছি। নড়াচড়ারও সুযোগ পাইনি।
তোমার বাবাকে প্রাসাদে পাবে না। তাকে বন্দি করে ক্যাস্টেলেট্টোতে (দুর্গে রাখা হয়েছে।
কী বলছেন?
অবাক হচ্ছ? নিজেদের অবস্থান মজবুত করতে বলির পাঁঠা হিসেবে তাকে জনতার হাতে তুলে দিতে চায় ফ্রেগোসিরা। পুরানো ডজকে সরিয়ে দেয়া মানে নতুন ডজের পথ সুগম করা। এবং তোমার বাবার সমর্থকদের একত্র হতে না দেয়ার নীতি অবলম্বন করছে এরা। অবশ্য এটাই যুক্তিসঙ্গত। অন্তত ওদের দৃষ্টিতে তো বটেই। প্রসপেরোর সৈন্যদের একবার দেখল সে। বলল, তোমার লোকেরা বিশ্বস্ত? বিশ্বস্ত হলে বাবাকে বাঁচাতে এখনই কাজে নেমে পড়ো।
হতাশ সুরে প্রশ্ন করল প্রসপেরো, আর মা? মা কোথায়?
একই কামরায় বন্দি হয়ে আছে দুজনে।
তাহলে সামনে বাড়ন। অ্যাডমিরালের সঙ্গে কথা বলব আমি। আমার লোকেরা জনতার মধ্য দিয়ে পথ বানিয়ে নেবে।
অ্যাডমিরাল? মানে ডোরিয়া? প্রায় কৌতুকের সুরে প্রশ্ন করল স্কিপিওনি। নাকি ফ্রেগোসের সঙ্গে কথা বলবে? ডোরিয়াই নিজ হাতে ডজের আসনে বসিয়েছে ফ্রেগোসোকে। কথা বলে লাভ হবে না। এখন কাজ দরকার। আর সেটা হতে হবে দ্রুত। দুর্গে পঞ্চাশজনের বেশি ফ্রেঞ্চ সৈন্য নেই। এটাই সুযোগ।
ক্যাপ্টেন ক্যাট্টানিওকে কিছু একটা ইঙ্গিত করল প্রসপেরো। সঙ্গে সঙ্গেই সেটা ছড়িয়ে গেল তার অধীনস্থ সবার মাঝে। ঘুরে ফিরতি পথ ধরল প্রসপেরোর বাহিনী। দুর্গে সোজাসুজি যাওয়ার উপায় নেই। একমাত্র রাস্তা হচ্ছে পিছিয়ে গিয়ে ঘুরপথে দুর্গে ঢোকার চেষ্টা করা।
.
০৪.
ক্যাস্টেলেট্টো
ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে বাগাড়ম্বরপূর্ণ বক্তৃতা দিয়ে যাচ্ছে নতুন ডজ। ওদিকে প্রসপেরোর টুপ ততক্ষণে ঘুরতে শুরু করেছে। ভিড়ের ভিতর জনতার জন্য ব্যাপারটা নিঃসন্দেহে ভীষণ অস্বস্তিকর। তারা ওদেরকে বাধাও দিত। কিন্তু সৈন্যদের গায়ের চকচকে বর্ম দেখে সেই সাহস আর কেউ করল না। তবে একেবারেই যে বিনা বাধায় ওরা বেরিয়েছে তাও না।
যা হোক, ক্যাথেড্রালের সামনে এসে পৌঁছুল ওরা। এখানে জনস্রোতের ভিড় ও গতি দুটোই মোটামুটি কম। ওরা উল্টো পথে আসায় জনস্রোতের অস্বস্তি অবশ্যই হয়েছে। কিন্তু বিকেলে ওদেরকে শৃঙ্খলা আনার কাজ করতে দেখায় কেউ সরাসরি ওদের সঙ্গে ঝামেলা করতে এল না। কিন্তু যারা প্রসপেরোর লোকদের হাতে অবদমিত হয়েছে, দূর থেকে ওদেরকে কটুক্তি করতে ছাড়েনি তারা।
কটুক্তি আর ব্যঙ্গের জবাব সৈন্যরাও ফিরিয়ে দিল ব্যঙ্গ, উপহাস আর বক্রোক্তি দিয়েই। সৈন্যদের পিছনের সারির সঙ্গে হাঁটছে প্রসপেরো আর স্কিপিওনি। ক্যাম্পেট্টোতে পৌঁছে প্রসপেরোর আরেক ক্যাপ্টেন ও তার অধীন ষাটজন সৈন্য পেয়ে গেল ওরা। ওই ক্যাপ্টেনও তার মূল বাহিনীকে খুঁজছিল। একত্র হতে পেরে দুই দলই খুশি। শেষ পর্যন্ত ওরা যখন ক্যাস্টেলেট্টোর লাল রঙ করা দেয়ালের কাছে গিয়ে পৌঁছুল, প্রসপেরোর সৈন্যসংখ্যা ততক্ষণে পুরো দুইশ।
সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসছে। ডুবন্ত সূর্যের লাল আলোয় অপার্থিব দেখাচ্ছে সব। ওরা পৌঁছে দেখল দুর্গের মূল ফটক হাঁ করে খোলা। সন্ধ্যার লালচে আলোয় উন্মুক্ত ফটক দিয়ে স্রোতের মত ভিতরে ঢুকে পড়া সৈন্যদের দেখে মনে হলো, দুর্গে ঢুকল বুঝি রহস্যময় অশরীরী প্রেতাত্মার দল। কালবৈশাখী ঝড়ের মুখে পড়া শুকনো পাতার মত উড়ে গেল ওদেরকে বাধা দিতে আসা দুজন প্রহরী। ভিতরে পাহারাদার সৈন্য যে কজন ছিল তারা ততক্ষণে প্রসপেরোর সেনাদের রুদ্রমূর্তি দেখে নিয়েছে। দুর্গ পাহারা দিচ্ছিল ডোরিয়ার প্রভিন্সিয়াল ফ্রেঞ্চ টুপ। ওদের এক অফিসার তখন এগিয়ে এল প্রসপেরোর সঙ্গে কথা বলতে।
ফ্রেঞ্চদের সঙ্গে প্রসপেরোর মৈত্রী সম্বন্ধে সে পুরোপুরি ওয়াকিবহাল। ফলে তার কথাও পুরোপুরি যান্ত্রিক। অন্তত শুরুটা তো অবশ্যই। সে বলল, কী সেবা করতে পারি, স্যর ক্যাপ্টেন?
প্রসপেরোর সংক্ষিপ্ত উত্তর, দুর্গের দায়িত্ব আমার হাতে সমর্পণ করুন।
লোকটার চেহারায় ফুটে উঠল নিখাদ আতঙ্ক। পরবর্তী কথাটা বলার আগে তাই তাকে মুহূর্তখানেক চুপ থেকে সাহস সঞ্চয় করে নিতে হলো। তারপর সে বলল, এটা আমার এখতিয়ারের বাইরে, স্যর ক্যাপ্টেন। আমাকে এখানকার দায়িত্ব দিয়েছেন স্যর সিজার ফ্রেগোসো। উনি অনুমতি না দেয়া পর্যন্ত আমি এই দুর্গের দায়িত্ব ছাড়তে পারি না।
প্রসপেরো বলল, হয় আপনি নিজের ইচ্ছায় চলে যাবেন, নয়তো আমি শক্তি খাটাব। একভাবে না একভারে আপনাকে আমার কথা মানতেই হবে।
অফিসারটি তখন হম্বিতম্বি শুরু করল। কিন্তু ততক্ষণে সুশৃঙ্খলভাবে প্রসপেরোর পিছনে দাঁড়িয়ে গেছে ওর বাহিনী।
অফিসারটি আবার বলল, না, এ হতে পারে না। আপনার হুকুম মানতে আমি বাধ্য নই…
কিন্তু হুকুম মানতে আপনি বাধ্য হবেন।
মুখ কালো করে অফিসার বলল, ঈশ্বর! আপনি এভাবে কথা বললে আমার আর কী করার থাকে…
যা বলেছি করুন। এতে আপনার-আমার দুজনেরই ঝামেলা কমবে।
আমার কমবে। কিন্তু আপনার ঝামেলা বাড়বে অবশ্যই।
আমারটা আমি সামলাব। ও নিয়ে আপনার মাথা ঘামানো লাগবে না।
আশা করি, ঝামেলাগুলো আপনার ভাল লাগবে, বলে অধীনস্থদের দুর্গ ত্যাগ করতে হুকুম করল অফিসার। দশ মিনিটের মধ্যেই সৈন্যরা দুর্গ ত্যাগ করল। সেই অফিসারটি বের হলো সবার শেষে। বের হওয়ার সময় উপহাসের ভঙ্গিতে প্রসপেরোকে একবার বাউ করে চলে গেল সে।
স্কিপিওনিকে সঙ্গে নিয়ে দুর্গে ঢুকল প্রসপেরো। সে-ই ওকে পথ দেখিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। কয়েক প্রস্থ সরু পাথুরে সিঁড়ি পার হওয়ার পর একটা দরজার সামনে এল ওরা। দুজন রক্ষী দরজাটা পাহারা দিচ্ছে। ওদেরকে এক কথায় ডিসমিস করে দিল প্রসপেরো। নিজেই দরজার তালা খুলে অ্যান্টিচেম্বার হয়ে ঢুকল মূল ঘরে। এই ঘরটাকেই ব্যবহার করা হচ্ছে বন্দিশালা হিসেবে। সরু একটা জানালার পাশে বসানো হয়েছে ছোট একটা খাট। জানালাটা সরু হলেও ওটা দিয়ে প্রায় পুরো শহরই চোখে পড়ে। সেইসঙ্গে চোখে পড়ে বন্দর ও সাগরের নীলাভ সবুজ পানি।
জানালার পাশে হতাশ চোখে বসে আছেন অ্যান্টোনিওট্টো অ্যাডর্নো। আগস্টের কাঠ-ফাটা-গরমেও তার গায়ে জড়ানো ভারী একটা পশমী ওভারকোট। পাশের একটা চেয়ারে বসে আছে সাবেক ডজারেসা। তার পরনে স্বর্ণের সুতোয় কারুকাজ করা হালকা বেগুনি রঙের গাউন। পাশে টেবিলের উপর রাখা আছে অতি সাধারণ কিছু খাবার। অর্ধেকটা পনির, রাই-এর রুটি, কিছু পিচ আর আঙুর সহ এক বাটি ফল, সঙ্গে একটা রূপালী জারে খানিকটা ওয়াইন আর কয়েকটা গ্লাস।
দরজার কব্জার কাঁচকোচ শব্দে রাগত দৃষ্টিতে ওদিকে তাকাল ডজারেসা অরেলিয়া। কিন্তু দরজায় প্রসপেরোকে দেখে ফ্যাকাসে হয়ে গেল তার চেহারা। চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়াল সে। আবেগের আতিশয্যে চোখে পানি চলে এসেছে। তার কান্নাভেজা কণ্ঠ শুনে। অবসাদে ভারী হয়ে থাকা চোখ তুলে তাকালেন অ্যান্টোনিওট্টো অ্যাডর্নো। প্রসপেরোকে দেখে তাঁর চোখের কোণ একটু প্রসারিত হলো কেবল। এর বেশি আর কোন অনুভূতি বা ভাবাবেগ প্রকাশ পেল না। এমনকী যখন কথা বললেন তখনও আবেগহীন হয়ে রইল তার চেহারা!, ওহ্, প্রসপেরো, এসেছ। দেখতেই পাচ্ছ, খুব খারাপ একটা সময়ে এসেছ তুমি।
জবাবে প্রসপেরো বলল, আমি যে আসতে পেরেছি, এতেই তো তোমার যথেষ্ট অবাক হওয়ার কথা।
না, তা কেন হবে? আমি জানতাম তুমি আসবেই। কারণ তোমার কিছু না কিছু বলার থাকবেই।
তিক্ত কণ্ঠে প্রসপেরো বলল, হ্যাঁ, অনেক কিছুই বলার আছে। তবে এখন কেবল এটাই বলব যে আমি তোমার সন্তান নামের কলঙ্ক, একটা আহাম্মক। কিন্তু সেটা তো আর তোমার কাছে নতুন কিছু না। আমার এই বদগুণের কারণে তোমার নামে যুক্ত হয়েছে প্রতারকের তকমা। রাস্কেল ডোরিয়ার ফাঁদে একটা আহাম্মকের মত ধরা দিয়েছি আমি।
তখন ওকে বাধা ও সান্ত্বনা দিয়ে অ্যান্টোনিওট্টো বলল, আমার বেলায়ও একই কথা। আমাকেও ধোঁকা দিয়েছে সে। যাক, যেমন পিতা তেমন পুত্র। বলে মাথা নিচু করে বসে রইলেন তিনি।
শহরে যদি কোন আক্রমণ হত, তাতে হেরে বন্দি হলে হয়তো এতটা লজ্জা পেতেন না অ্যান্টোনিওট্টো। তাঁর হাত ধরে বসে আছে অরেলিয়া। প্রসপেরো ছুটে গেল তার কাছে। মার হাত দুটো তুলে ধরে শ্রদ্ধাভরে হাতের পিঠে চুমু খেল ও।
অরেলিয়া বলল, অন্তত এই একটিবার তোমার বাবা ঠিক কথা বলেছে। তার দোষ কোন অংশে তোমার চেয়ে কম নয়। সবকিছুর জন্যই দায়ী তার একগুঁয়েমি। কথাগুলো বলার সময় কঠিন হয়ে গেল তার কণ্ঠ। তার উচিত ছিল জনসাধারণের ইচ্ছার মূল্য দেয়া। সাধারণ জনগণ যখন চেয়েছিল তখনই ডোরিয়াদের হাতে শহর সমর্পণ করলে আজ তারা তোমার বাবাকেই সমর্থন দিত। তা না করে তিনি ওদেরকে ক্ষুধার্ত রেখেছেন। শহরে নামিয়ে এনেছেন প্রায় দুর্ভিক্ষের মত একটা অবস্থা। ঠিক তখনই ফ্রেগোসোর নির্দেশে শুরু হয় বিদ্রোহ। এজন্যই বলছি, আজকের পরিস্থিতির জন্য তোমার বাবার দোষও কোন অংশে কম নয়।
প্রসপেরে নিজেকে দোষ দিতে থাকল আর ওর মা দোষ দিতে থাকল প্রসপেরোর বাবাকে। হতাশ দৃষ্টিতে ওদের দেখতে লাগলেন অ্যাডর্নো। ঠিক তখন এগিয়ে এল স্কিপিওনি। সে মনে করিয়ে দিল, কীভাবে এ পরিস্থিতির উদ্ভব হয়েছে তা বিচার করা দরকার বটে, কিন্তু তার চেয়ে বেশি জরুরি বর্তমান অবস্থা থেকে উত্তরণের পথ খোঁজা।
প্রসপেরো বলল, একটা সমাধান আমার হাতে আছে। আমার হাতে এখনো যথেষ্ট শক্তি আছে। ইচ্ছে করলেই এখান থেকে চলে যাওয়া যায়।
শুনেই রীতিমত আর্তনাদ করে উঠল ওর মা। এটা তোমার সমাধান? সব ফেলে চোরের মত পালিয়ে যাব? এতে উপকার হবে কেবল ফ্রেগোসো আর তার ক্ষমতার খুঁটি ডোরিয়ার। তাদের জয়ভেরীই বাজবে এতে।
তখন স্কিপিওনি বলল, প্রসপেরোর প্রস্তাব মন্দ নয়। অন্তত আপনাদের নিরাপদে এখান থেকে বেরিয়ে যেতে দেখলে খুশি মনে মরতে পারব। কিন্তু, প্রসপেরো, তুমি কি নিশ্চিত যে গ্যালি পর্যন্ত তোমাদেরকে নিয়ে যাওয়ার মত যথেষ্ট সৈন্য তোমার হাতে আছে? তাছাড়া জাহাজে পৌঁছলেও ডোরিয়া তোমাকে যেতে দেবে তা নিশ্চিত হচ্ছ কীভাবে?
প্রসপেরোর বাবাও তখন গলা উঁচু করলেন। অথবা ফ্রেগোসোই কি সেই অনুমতি দেবে? ওরাই এখন এই এলাকার আসল প্রভু। ওরা অবশ্যই নিশ্চিত হতে চাইবে যে, কোন অ্যাডর্নো যেন বেঁচে না থাকে, যাতে পরে ওদের অনৈতিক ক্ষমতা দখল নিয়ে কেউ প্রশ্ন তুলতে না পারে।
প্রসপেরো আরেকটা পরিকল্পনার কথা বলা শুরু করেছিল, যতক্ষণ এই দুর্গের দখল আমি ধরে রাখছি…।
ওর মুখের কথা কেড়ে নিলেন অ্যান্টোনিওট্টো। দুর্গের দখল ধরে রাখার চিন্তা মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলল। একদিনও এর দখল ধরে রাখতে পারবে না। কারণ তোমার সৈন্যদের খাওয়াতে হবে। কিন্তু আমাদের কাছে কোন রসদ নেই।
নির্মম সত্যটা প্রসপেরোঁর আশার পিঠে ছুরি বসিয়ে দিল। হতাশা ফুটে উঠল ওর চেহারায়। তাহলে উপায়? কী করা যায় এখন?
যেহেতু আমাদের পাখির মত ডানা নেই বা সেইন্ট এঞ্জেলোর টাওয়ার থেকে লাফিয়ে পড়া আহাম্মক ইকারাসের মত কোন উড়ে যাওয়ার যন্ত্রও নেই, তাই মনে হয় স্রষ্টার কাছে আত্মসমর্পণ করা ছাড়া আর কোন উপায় নেই।
অ্যান্টোনিওট্টো যখন আশা ছেড়ে দেবার কথা বলছিলেন, তখনই বুদ্ধি দিল স্কিপিওনি। শক্তি খাঁটিয়ে এখান থেকে বের হতে পারবেন না। তবে একজন দুজন করে চেষ্টা করলে সাধারণের মধ্যে মিশে অনায়াসে বেরিয়ে যেতে পারবেন।
সবার চোখে প্রশ্নবোধক দৃষ্টি দেখে ব্যাখ্যা দিল সে। দুর্গের পূর্ব দিকের প্রান্ত শহরের চেয়েও উঁচু। দুর্গের সর্বোচ্চ চূড়া থেকে নিচ পর্যন্ত দৈর্ঘ্য সত্তর ফিট। সেইন্ট পল যেভাবে দামেস্ক ত্যাগ করেছিলেন আপনিও সেভাবে জেনোয়া ত্যাগ করবেন। ওইটুকু উচ্চতা পাড়ি দেয়ার জন্য একটা দোলনা আমরা অনায়াসে বানিয়ে নিতে পারব। তারপর রশি বেঁধে নামিয়ে দিলেই হবে।
অ্যান্টোনিওট্টোর চোখ দুটো তখনও নির্বিকার। নিজের শারীরিক অবস্থার কথা সবাইকে মনে করিয়ে দিয়ে বললেন, এই অবস্থায় অমন দৌড়ঝাঁপ করতে সমর্থ নন তিনি। বর্শার আঘাতে তৈরি হওয়া ক্ষত তার সমস্ত শক্তি নিঃশেষ করে দিয়েছে। তাছাড়া সবই হারিয়েছেন তিনি। এমন অবস্থায় পালিয়ে গেলেই কী আর আর পড়ে থেকে মরলেই বা কী। তার চেয়ে বরং প্রসপেরো আর ওর মা পালানোর চেষ্টা করুক। তাহলে একজন অথর্বকে বইতে গিয়ে তাদের সময় নষ্ট হবে না।
বলাই বাহুল্য, প্রসপেরো বা ওর মা, কেউই ডন অ্যাডর্নোর কথায় কর্ণপাত করল না। সোজা জানিয়ে দিল, হয় সবাই যাবে নয়তো কেউই যাবে না। শুনেই চেঁচামেচি জুড়ে দিলেন ডন। কিন্তু কথা শেষ পর্যন্ত একখানেই গিয়ে শেষ হলো। পালাতে হবে।
ভোর নাগাদ প্রস্তুত হয়ে গেল সব। বড় একটা ঝুড়িতে করে ওদের তিনজনকেই একসঙ্গে নিচে নামিয়ে দেয়া হলো। উপর থেকে পুরো কার্যক্রম পরিচালনা করল স্কিপিওনি।
এভাবেই সবার অলক্ষে জেনোয়া থেকে শেষ হলো অ্যাডর্নো শাসন যুগ। ওদের এই লজ্জাস্কর পলায়ন ও পতনের জন্য প্রসপেরোর মা যুগ্মভাবে দায়ী করে ডোরিয়া ও ফ্রেগোসিদের। আর প্রসপেরে নিজেকে দায়ী করে বোকার মত ডোরিয়া আর ফ্রেগোসিদের পাতা ফাঁদে পা দেয়ায়।
.
০৫.
আমালফির যুদ্ধ
১৫২৭ সালের পহেলা আগস্টে ফ্রান্সের রাজার হয়ে জেনোয়া দখল করে ডোরিয়া। এবং একই দিন পোপের নেভির কমাণ্ড ত্যাগ করে প্রসপেরো। এর প্রায় এক বছর পরের কথা। ১৫২৮ এর মে মাসে আবার প্রসপেরোর দেখা মিলল নেপলসে।
শেষ পর্যন্ত আর সেরে উঠতে পারেননি অ্যান্টোনিওট্টো। বর্শার আঘাতের কারণে এমনিতেই ছিলেন শারীরিকভাবে দুর্বল। তাছাড়া জেনোয়া থেকে পালিয়ে আসায় মানসিক সম্মতিও ছিল না। তাঁর। ফলে দুইয়ের সম্মিলিত ধাক্কা তাঁর শরীর আর সহ্য করতে পারেনি। ওঁরা যখন মিলানে এসে পৌঁছন ততক্ষণে মুমূর্ষ অবস্থায় পৌঁছে গেছেন অ্যাডর্নো। মিলানে তারা আশ্রয় নেন ইম্পিরিয়াল গভর্নর অ্যান্টোনিও ডি লেইভার কাছে। এর তিন দিনের মাথায় মৃত্যু হয় ডন অ্যাডর্নোর।
সেদিন মায়ের কান্না দেখে নিজেও প্রায় ভেঙে পড়ে প্রসপেরো। সেদিনই ও বুঝতে পারে, মায়ের বাইরের শক্ত রূপটার ভিতরে নরম মনের একজন মহিলা আছে, যে তার স্বামীর কাছে বিশ্বাস ও ভরসার জায়গা আর সন্তানের জন্য ভালবাসার আধার স্নেহময়ী এক মা।
ডন অ্যান্টোনিওট্টোর মৃত্যু যেদিন হলো সেই পুরো দিন আর পুরো রাত শোকে অবসন্ন হয়ে রইল প্রসপেরোর মা। পুরো ত্রিশ ঘণ্টা পার হওয়ার পর ঘর থেকে বেরিয়ে এল সে। তখন তার পরনে মখমলের কালো রঙের পোশাক, শোকের পোশাক। সে এসে দাঁড়াল তার প্রয়াত স্বামী অ্যান্টোনিওট্টোর কফিনের সামনে। প্রসপেরোকে বলল, এখানে তোমার বাবা শুয়ে আছে, প্রসপেরো। তাকে হত্যা করা হয়েছে। কে তার খুনি তা তুমিও জানো। লোভী, বেইমান, বিশ্বাসঘাতক, বিবেকহীন ডোরিয়ারা খুন করেছে তাকে। সবসময় কথাগুলো মনে রেখো।
মনে থাকবে, মা, কখনো ভুলব না।
ওর মা তখন প্রসপেরোর হাত স্পর্শ করে বলল, বসো, হাত রাখো তোমার বাবার বুকের উপর। দেখো, বুকটা কেমন শীতল হয়ে আছে। কিন্তু একসময় এই বুকটাই তোমার জন্য স্নেহে উষ্ণ হয়ে ছিল। শপথ নাও, প্রসপেরো, অ্যান্টোনিওট্টোকে যেভাবে টেনে নিচে নামানো হয়েছে, যন্ত্রণা দিয়ে তার মৃত্যু নিশ্চিত করা হয়েছে, তার প্রতিশোধ তুমি নেবে। শপথ করো। তোমার শপথই পারবে তোমার বাবার আত্মাকে শান্তি দিতে।
হাঁটু মুড়ে বসে শপথ নিল প্রসপেরো। শপথ বাক্য উচ্চারণের সময় মনে পড়ে গেল ওর বাবাকে ধ্বংস করার হাতিয়ার হিসেবে কীভাবে ব্যবহার করা হয়েছে ওকে। ওর চোখে আর উচ্চারিত প্রতিটা শব্দে ঝরে পড়ল তীব্র ঘৃণা আর প্রতিশোধের ইচ্ছা।
সম্রাটের বাহিনীতে প্রসপেরোকে কাজের প্রস্তাব দিল ডি লেইভা। সঙ্গে সঙ্গেই প্রস্তাবটা লুফে নিল প্রসপেরো। কারণ ও স্পষ্ট বুঝেছে প্রতিশোধ নেয়ার পথে ওটাই হবে প্রথম পদক্ষেপ।
প্রসপেরো শপথ নেয়ার পর এক বছর যেন চোখের পলকে পার হয়ে গেল। তখনো চলছে স্পেনের সম্রাটের বিরুদ্ধে নেতিবাচক প্রচারণা। প্রায় দুই মাস ধরে ত্রিশ হাজার সৈন্য নিয়ে নেপলস অবরুদ্ধ করে বসে আছে মার্শাল ডি লট্রেস। ফলে দুর্ভিক্ষের দ্বারপ্রান্তে পৌঁছে গেছে নেপলস। সেইসঙ্গে শুরু হয়েছে প্লেগ। লট্রেসের হুকুমে নেপলস অবরুদ্ধ করতে পাঠানো হয়েছে। ডোরিয়ার গ্যালিগুলো। তবে ওই ফ্লিটের কমাণ্ডে ডোরিয়ার পরিবর্তে এসেছে তার ভাতিজা ফিলিপ্পিনো। জেনোয়াতেই রয়ে গেছে ডোরিয়া। কেন সে নিজে জেনোয়ায় রয়ে গেছে প্রথমে তা কেউ অনুমান করতে পারেনি। পরে জেনোয়া থেকে পরিস্থিতির সবিস্তার ব্যাখ্যা সহ স্কিপিওনির চিঠি আসে প্রসপেরোর হাতে। তখনই খোলসা হয় আসল ব্যাপার।
চিঠিতে স্কিপিওনি লিখেছে, জেনোয়াতে শাসক বিরোধী তীব্র আন্দোলন শুরু হয়েছে। কারণ রাজনীতিবিদরা কেউ তাদের দেয়া কথা রাখেনি। জেনোয়ার রাজনীতিতে ডোরিয়ার অবস্থান নড়বড়ে হয়ে গেছে। তার মাথা থেকে মুছে গেছে উদ্ধারকর্তার প্রভা। ওদিকে ফ্রেঞ্চদের আশ্রয়ে লিগুরিয়ান রিপাবলিক (রিপাবলিক অভ জেনোয়ার আরেক নাম) স্বাধীনতা ফিরে পাবে, একথাও মিথ্যা প্রতিপন্ন হয়েছে। ডোরিয়া নিজেই অবতীর্ণ হয়েছে স্বৈরশাসকের ভূমিকায়। এবং জেনোয়াকে গুডবুক থেকে বাদ দেয়ার পরিকল্পনা নিয়েছে ফ্রান্স। সাভোনাতে নতুন সমুদ্র বন্দর তৈরির চেষ্টা করছে। তারা। ফ্রান্সের এই সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন মানে তাদের কাছে জেনোয়ার আর কোন গুরুত্ব নেই। এর অর্থ যে জেনোয়ার নিশ্চিত ধ্বংস তা ওখানকার সাধারণ জনগণও এখন স্পষ্ট বুঝতে পারছে। এর জন্য সবাই এককভাবে দায়ী করছে ডোরিয়াকে। কারণ তার কথাতে উদ্বুদ্ধ হয়েই স্পেনের সম্রাটের আশ্রয় ত্যাগ করেছিল তারা। এমনকী যে ফ্রেগোসিকে হাতে ধরে ক্ষমতায় বসিয়েছিল, সেই ফ্রেগোসিও এখন সব দোষ ডোরিয়ার ঘাড়েই ঠেলে দিচ্ছে। এখন জনসমর্থন হারানোর ভয়ে আরেক কৌশলের আশ্রয় নিয়েছে ডোরিয়া। ঘোষণা দিয়েছে, ফ্রেঞ্চরাই বিশ্বাস ভঙ্গ করছে। এবং এই ভুল শোধরাতে না পারলে ফ্রান্সের রাজার সঙ্গে সম্পর্কচ্ছেদ করবে সে।
খবরগুলো স্কিপিওনি লিখেছে যথেষ্ট বিদ্বেষপূর্ণ ভাষায়। তবে খবরগুলোর বিশ্বাসযোগ্যতা নিয়ে সন্দেহ নেই।
চিঠি পাওয়ার পর প্রসপেরো ভাবল, এবার বোঝা যাচ্ছে, কেন ডোরিয়া নিজে না এসে তার ভাতিজাকে ফ্লিটের কমাণ্ড দিয়ে পাঠিয়েছে। এই সঙ্কটময় মুহূর্তে জেনোয়া ত্যাগ করা তার পক্ষে কোনমতেই সম্ভব না। তাহলে জেনোয়ার প্রতি তার দায়িত্ববোধ ও সততা নিয়ে বিশাল প্রশ্ন উঠবে। কাজেই নিজের যতটুকু সুনাম এখনও রয়েছে তা বাঁচাতে হলে জেনোয়াতেই থাকতে হবে তাকে। স্কিপিওনির মতানুসারে, নিজের সম্মান বাঁচাতে হলে ডোরিয়াকে ফ্রেঞ্চ আনুকূল্য ত্যাগ করতেই হবে। তার উপর হাওয়ায় ভেসে বেড়াচ্ছে নানারকম গুজব। যেমন ফ্রেঞ্চ রাজের কাছ থেকে আর টাকাপয়সা আসছে না। সৈন্যদের খোরপোষের জন্য যে স্বর্ণ আসার কথা ছিল সেগুলোও চলে গেছে রাজার স্ত্রীদের গহনা তৈরির পিছনে। ওদিকে ডোরিয়ার পকেটও একদমই খালি। আর যাদের কাছ থেকে সে ধারকর্য করেছে। তারাও ঋণ ফেরত দেয়ার জন্য চাপ দিচ্ছে তাকে। ওদিকে ভাড়াটে সৈন্যরাও তাদের পাওনা চাইছে।
এটাই স্বাভাবিক। কারণ নিয়মিত সৈন্যদের মত কোন দেশপ্রেম বা নীতিবোধে উদ্বুদ্ধ হয়ে মার্সেনারিরা কাজ করে না। তারা অস্ত্র ধারণ করে কেবলমাত্র পয়সার জন্য।
স্কিপিওনির মতে ডোরিয়ার জন্য সময়টা খুবই সঙ্কটপূর্ণ। কাজেই স্পেন সম্রাটের জন্য দাও মারার এটাই মোক্ষম সময়। বর্তমান করুণ অবস্থা থেকে উত্তরণের জন্য যে-কোন শর্ত পূরণে রাজি হবে ডোরিয়া।
স্কিপিওনির বক্তব্য স্পষ্টভাবে বুঝতে পেরেছে প্রসপেরো। এখন যে-কোন শর্তে ডোরিয়াকে বেঁধে ফেললে তাতে এখনকার মত সে উদ্ধার পাবে বটে, কিন্তু ভবিষ্যতে সে অবশ্যই ফেঁসে যাবে। কারণ এখন বাঁচতে হলে প্রচুর টাকা নিতে হবে তাকে। অর্থাৎ ভাঙতে হবে ফ্রান্সের রাজা ফ্রান্সিসের সঙ্গে তার চলমান চুক্তি। অর্থাৎ বর্তমানে তার রক্ষা পাওয়ার সুদূরপ্রসারী ফল হচ্ছে বিশ্ব নেতৃবৃন্দের ঘৃণা কিনে নেয়া। কারণ বাকি সব বাদ দিলেও নিজের স্বার্থের জন্য চুক্তি ভঙ্গকারীকে কেউ পছন্দ করে না। এবং কিছুদিনের মধ্যে এ খবর জেনোয়াবাসীরাও জেনে যাবে। তখন রিপাবলিকের কাউন্সিলে জবাবদিহিতার মুখে পড়তে হবে ডোরিয়াকে। ডোরিয়ার অবস্থার খবর আর এ সমস্ত বুদ্ধি-পরামর্শ সবই ছিল স্কিপিওনির চিঠিতে।
খবর নিয়ে মারকুইস ডেল ভাস্টো-কে খুঁজতে ছুটে গেল প্রসপেরো।
মারকুইস বাস করে রাজকীয় দুর্গ নওভো-তে। তরুণ মারকুইসের বয়স আটাশ। চমৎকার দেখতে মানুষটার সৌজন্যবোধও চমৎকার। প্রসপেরোকে সে আন্তরিকতার সঙ্গে স্বাগত জানাল। কোন ভূমিকা না করে সরাসরি কাজের কথায় চলে গেল প্রসপেরো। বলল, মাই লর্ড, অবরোধের বিরুদ্ধে কঠিন পদক্ষেপ নিতে ভাইসরয় অনিচ্ছুক। কিন্তু এ ব্যাপারে আমার মতামত আপনার অজানা নেই।
হেসে ডেল ভাস্টো বলল, আমিও আপনার সঙ্গে একমত।
চিঠিটা ডেল স্টোর দিকে বাড়িয়ে দিয়ে ও বলে, তাহলে এই নিন তাকে উদ্বুদ্ধ করার মন্ত্র।
মেঘলা দিনের স্বল্পালোকের কারণে চিঠিটা হাতে নিয়ে জানালার দিকে এগিয়ে গেল ডেল ভাস্টো। সময় নিয়ে চিঠিটা পড়ল সে। তারপর অনেকক্ষণ নীরব রইল। জানালার কাঁচে বৃষ্টির ফোঁটা পড়ার শব্দ শোনা যাচ্ছে। অনেকক্ষণ পর ফিরে তাকাল সে। তার চোখে-মুখে জ্বলজ্বল করছে এক অদ্ভুত দীপ্তি।
ডেল ভাস্টো প্রশ্ন করল, চিঠির লেখক কি বিশ্বস্ত? তার মতামতের উপর নির্ভর করা যায়?
শুধু যদি তার মতামতের কথা বলেন, তাহলে আপনাকে বিরক্ত করতে আসতামই না। কারণ অনুমান তো আমরা নিজেরাও করতে পারি। কিন্তু জেনোয়ায়, যা হচ্ছে বলে সে লিখেছে সেগুলো অবশ্যই সত্য। এর সঙ্গে ডোরিয়ার উচ্চাকাঙ্ক্ষার বিষয়টিও যোগ করা যায়। আমরা সবাই খুব ভাল করেই জানি সে কতটা উচ্চাকাঙ্ক্ষী মানুষ। সে এখন এমন একটা অবস্থার মধ্যে আছে যে, যে-কোন মূল্যে, তাকে এই পরিস্থিতি থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। নইলে জেনোয়ায় তার দিন শেষ।
বুঝতে পেরেছি। কিন্তু এমনটাও তো হতে পারে যে, ফ্রান্সের রাজা সত্যিই বিশ্বাসঘাতকতা করেছে। কারণ সবাই জানে, পিচ্ছিল প্রকৃতির মানুষ ফ্রেঞ্চ রাজা। কাউকে কথা দিতে কুণ্ঠা বোধ করে না সে। কিন্তু কথা দিয়ে কথা রাখার সুনাম তার কম।
একটু বিরক্ত হলো প্রসপেরো। বলল, সেটা কোন ব্যাপার নয়। মোদ্দা কথা, ডোরিয়াকে এখন আমরা কিনতে পারি। কারণ বাঁচতে হলে তার এই মুহূর্তে টাকা দরকার। এবং এই পরিস্থিতিকে ফ্রান্সের রাজার সততা বা অসততা কোনভাবে প্রভাবিত করছে বলে আমার মনে হচ্ছে না।
করছে। কারণ ডোরিয়াও যদি ফ্রেঞ্চ রাজের মত পিচ্ছিল হয়, কথা দিয়ে তার মূল্য না দেয়, তাহলে তার সঙ্গে কোন চুক্তিতে আমি যাব না।
কথাগুলো বলে একটা উত্তরের আশায় প্রসপেরোর মুখের দিকে তাকাল সে। কিন্তু নিজেকে দমিয়ে রাখল প্রসপেরো। অবশ্য স্কিপিওনির মতামতের সঙ্গে ও যে একমত হবে তাতে অবাক হওয়ার কিছু নেই। ব্যাপারটা ডেল ভাস্টোও বুঝতে পারছে। তবে কিনা, প্রসপেরোর প্রস্তাবটা আসলেই ভাল। অবশ্য প্রস্তাবটা আনুষ্ঠানিকভাবে কার্যকর বা বাতিল করা মারকুইসের একার কাজ না।
প্রসপেরোকে চুপ থাকতে দেখে আবার কথা বলল ডেল ভাস্টো। মানলাম, ডোরিয়ার উপর শোধ নেয়ার হাজারটা কারণ আপনার আছে। কিন্তু চিঠির তথ্য এখনও যাচাইকৃত নয়।
প্রসপেরে নিজেকে আর ধরে রাখতে পারল না। ও মন্তব্য করল, বাবার মৃত্যু বৃথা যেতে দেব না।
ধীর কদমে এগিয়ে এল ডেল ভাস্টো। প্রসপেরোর কাঁধে হাত রেখে সে বলল, বুঝি আমি, তবে এই চিন্তাটাকে আপনার সমস্ত সত্তা আচ্ছন্ন করতে দেবেন না। একটা কাজ করা যাক। যে লোক আপনার কাছে চিঠিটা নিয়ে এসেছে তাকে আমরা কাজে লাগাতে পারি। ডোরিয়ার কাছে সংবাদ পাঠাতে পারি। এতে আপনার স্কিপিওনি ডি ফিয়েসির প্রস্তাবের যৌক্তিকতাও বিচার করা হয়ে যাবে।
ডোরিয়াকে প্রস্তাব পাঠানোর কথা ভাবছেন, মাই লর্ড?।
দরকার পড়লে আরো বড় পদক্ষেপও নিতে পারি। ওকে নিয়ে সম্রাটের চিন্তাভাবনা আমার খুব ভালভাবে জানা আছে। ডোরিয়াকে তিনি এ সময়ের সবচেয়ে বড় ও কুশলী নৌ-কমাণ্ডার বলে মানেন। সম্রাট মনে করেন ডোরিয়া যার জন্য কাজ করবে সে-ই নিয়ন্ত্রণ করবে ভূমধ্যসাগর। যা হোক, আমার প্রস্তাবের প্রেক্ষিতে ডোরিয়ার সঙ্গে আলাপ-আলোচনাও শুরু করা সম্ভব হতে পারে। আপনার লোকের পাঠানো তথ্য যদি সঠিক হয় তাহলে ডোরিয়াকে সম্রাটের সেবায় আনার এটাই সুযোগ। এই সুযোগ হারালে সম্রাট কখনো আমাকে ক্ষমা করবে না। এখনই আমি মাদ্রিদে লোক পাঠাচ্ছি। এ খবর মাদ্রিদে পৌঁছতে পৌঁছতে ডোরিয়ার সঙ্গে আলোচনাও শুরু করে দেব। উষ্ণ কণ্ঠে সে বলল, চিঠিটা আমার নজরে আনায় আপনার কাছে আমি কৃতজ্ঞ। সম্রাটের কাছে আপনার কথা আমি অবশ্যই বলব।
আমাদের উপর থেকে অবরোধ তুলে নিতেও ওদের বাধ্য করার একটা সুযোগ পেয়ে গেছি বলা যায়।
মন্তব্যটা খুব সহজে করা গেলেও ভাইসরয়ের কাউন্সিলে যখন প্রস্তাবটা তোলা হলো, দেখা গেল ব্যাপারটা অতটা সহজ না। ভাইসরয় হিউগো ডি মনকাড়া তার ক্যাপ্টেনদের নিয়ে বসেছে বেভারেলো টাওয়ারের চেম্বার অভ এঞ্জেলসে। চেম্বারটার এই নামকরণ করার কারণ, ওখানকার দেয়ালে স্থান পেয়েছে বিখ্যাত চিত্রকর বিকাজোর আঁকা ফেরেশতাদের অনেকগুলো ছবি।
সভায় উপস্থিত ক্যাপ্টেনদের সবাই বিখ্যাত নৌ যোদ্ধা। সিজার ফিয়েরামোসা, অ্যাসকানিয় কলনা, এ্যাণ্ড মাস্টার অভ আর্টিলারি জিরোলামো ডাঁ ট্রানি, সেসময়কার অন্যতম সফল ও কুশলী নৌ-কমাণ্ডার কুঁজো গুইস্টিনিয়ানি। এছাড়াও ফিলিবার্ট অভ ক্যালনস আর আছে প্রিন্স অভ অরেঞ্জ। প্রিন্সের বয়স এখনও ত্রিশ হয়নি। কিন্তু এই বয়সেই যথেষ্ট নামডাক ও সফলতা অর্জন করেছে সে।
কাউন্সিলে এল প্রসপেরো। সবার সামনে স্কিপিওনির চিঠির বক্তব্য তুলে ধরে তা বিবেচনার প্রস্তাব রাখল ও।
প্রসপেরোর পড়া শেষ হলে চিঠিটা থেকে এক লাইন কোট করল ডেল ভাস্টো। তারপর বলল, আলাপ-আলোচনায় সময় নষ্ট না করে এই সুযোগ নিতে হবে সম্রাটকে। যে-কোন শর্তেই সে এখন ডোরিয়াকে কিনে নিতে পারবে। আপনাদের আশ্বস্ত করছি, কোন সময় নষ্ট হয়নি। এই সংবাদ হাতে আসা মাত্রই সম্রাটের নামে একটি প্রস্তাব দিয়ে ডোরিয়ার কাছে দূত পাঠানো হয়েছে।
প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই অরেঞ্জের প্রিন্স প্রতিক্রিয়া দেখাল। বলল, এত তাড়াহুড়া করা ঠিক হচ্ছে না। সম্রাটের প্রত্যক্ষ মতামত নিয়ে নিলে ভাল হত। তাছাড়া ডোরিয়াও এই চিঠিকে অত্যন্ত গুরুত্ব সহকারে নেবে।
উত্তরে ডেল ভাস্টো বলে, ঘটনা হচ্ছে ডোরিয়াকে আমাদের পক্ষে আনার সুযোগটা স্বয়ং ঈশ্বর আমাদের কোলে এনে ফেলেছেন। এটা অবশ্যই আমাদের বন্দরে আরোপিত অবরোধ তুলতে বাধ্য করার একটা বড় সুযোগ। কাজেই অন্য ব্যাপারে আরো কটা দিন আমরা অপেক্ষা করতেই পারি।
কুঁজো গুইস্টিনিয়ানি স্বস্তির সঙ্গে চেয়ারে গা এলিয়ে দিল। বলল, ঈশ্বরকে অনেক ধন্যবাদ। অবরোধটা রীতিমত আমাদের গলার কাঁটা হয়ে গেছে। যে-কোন মূল্যে অবরোধ সরানো দরকার।
সবাই লক্ষ করল, টেবিলের মাথায় বসা ভাইসরয় তখনও নির্বিকার ও নিশ্চুপ। তার চেহারায় প্রস্তাবটাকে অনুমোদন দেয়ার কোন নমুনা নেই। সে বলল, আপনাদের কি মনে আছে যে নেপলসে সবাই না খেয়ে আছে? মহামারী ছড়িয়ে পড়ছে চারদিকে? এমন সময় পত্রবাহকের আসা-যাওয়া আর প্রস্তাবের শর্ত নির্ধারণ হওয়া পর্যন্ত সবাই হাত-পা গুটিয়ে বসে থাকব? তারপর টেবিলে কয়েকবার তবলার মত তাল ঠুকে সে বলল, ডোরিয়াকে কেনা যেতে পারে, আবার না-ও পারে। ব্যাপারটা এখনও অনিশ্চিত। কিন্তু একটা বিষয় স্পষ্ট যে ডোরিয়াকে আজ কাল তো নয়ই, আগামী, এক সপ্তাহের মধ্যেও পাওয়া যাচ্ছে না। ব্যাপারটা অবশ্যই সময় সাপেক্ষ। লর্ড মারকুইসের সংবাদের জন্য আমি বসে থাকতে পারছি না। নেপলসবাসীর জন্য আমাকে খাবার আনতেই হবে। কিন্তু ফিলিপ্পিনো ডোরিয়াকে আমাদের গালফ থেকে তাড়ানোর আগ পর্যন্ত তা করা যাচ্ছে না।
তখন কথা বলল গুইস্টিনিয়ানি। সে বলল, আমি আগেই বলেছি, আমাদের হাতে এই মুহূর্তে এতটা লোকবল নেই যে ওদের সঙ্গে লড়াই করব।
কিন্তু ভাইসরয় মনকাড়া এতে দমবার পাত্র নয়। সিজার বর্জিয়া ও মহান গনসালভা ডিকর্ডোবার অধীনে লড়াই করেছে সে। ওই সময়ে এই এলাকায় তার মত লড়াকু নৌ-কমাণ্ডার আর একজনও ছিল না। মুরদের সঙ্গে লড়াইয়ের অভিজ্ঞতাও আছে তার। একসময় ইম্পিরিয়াল নেভির অ্যাডমিরালও ছিল সে। কাজেই সে দমে যাবার পাত্র নয়। ডক ইয়ার্ড আর আর্সেনাল থেকে ইতিমধ্যেই কিছু নৌযান বের করেছে সে। সেগুলোর মধ্যে ছয়টা সাধারণ যাত্রীবাহী গ্যালি, চারটা ফেলুকা (দাড়টানা বা পাল তোলা এক ধরনের ছোট নৌকা। সাধারণত ব্যবহৃত হয় নীল নদ ও আশপাশের ভূমধ্যসাগর এলাকায়), দুটি ব্রিগেণ্টাইন আর কিছু সাধারণ মাছ ধরা নৌকা। ভাইসরয় প্রস্তাব করল যে তার এই শক্তিশালী ফ্লিট নিয়ে ফিলিপ্পিনোর আটটা রণসজ্জিত শক্তিশালী যুদ্ধজাহাজের বিরুদ্ধে লড়াই শুরু করা হবে। আর বাকি অভাবটা পূরণ করা হবে এক হাজার আরাকুইবাসিয়ারকে দিয়ে (আরাকুইবাস: প্রাচীন স্প্যানিশ বন্দুকবিশেষ। আরাকুইবাসিয়ার: আরাকুইবাস বহনকারী যোদ্ধা)। অবশ্য সে স্বীকার করল যে এতে মারাত্মক ঝুঁকি রয়েছে। কিন্তু পরিস্থিতি এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে যে, এখন মরিয়া পদক্ষেপ নিতেই হবে। এবং তার ক্যাপ্টেনদের সে মনে করিয়ে দিল যে প্রায় দুর্ভিক্ষের মুখে পড়ে গেছে নেপলস।
ভাইসরয়ের এই কঠিন কিন্তু বাস্তব বক্তব্যের বিরোধিতা করার সাহস দেখাল কেবল ডেল ভাস্টো। সে এতই আত্মবিশ্বাসী যে করছি, কোন সময় নষ্ট হয়নি। এই সংবাদ হাতে আসা মাত্রই সম্রাটের নামে একটি প্রস্তাব দিয়ে ডোরিয়ার কাছে দূত পাঠানো হয়েছে।
প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই অরেঞ্জের প্রিন্স প্রতিক্রিয়া দেখাল। বলল, এত তাড়াহুড়া করা ঠিক হচ্ছে না। সম্রাটের প্রত্যক্ষ মতামত নিয়ে নিলে ভাল হত। তাছাড়া ডোরিয়াও এই চিঠিকে অত্যন্ত গুরুত্ব সহকারে নেবে।
উত্তরে ডেল ভাস্টো বলে, ঘটনা হচ্ছে ডোরিয়াকে আমাদের পক্ষে আনার সুযোগটা স্বয়ং ঈশ্বর আমাদের কোলে এনে ফেলেছেন। এটা অবশ্যই আমাদের বন্দরে আরোপিত অবরোধ তুলতে বাধ্য করার একটা বড় সুযোগ। কাজেই অন্য ব্যাপারে আরো কটা দিন আমরা অপেক্ষা করতেই পারি।
কুঁজো গুইস্টিনিয়ানি স্বস্তির সঙ্গে চেয়ারে গা এলিয়ে দিল। বলল, ঈশ্বরকে অনেক ধন্যবাদ। অবরোধটা রীতিমত আমাদের গলার কাঁটা হয়ে গেছে। যে-কোন মূল্যে অবরোধ সরানো দরকার।
সবাই লক্ষ করল, টেবিলের মাথায় বসা ভাইসরয় তখনও নির্বিকার ও নিশ্চুপ। তার চেহারায় প্রস্তাবটাকে অনুমোদন দেয়ার কোন নমুনা নেই। সে বলল, আপনাদের কি মনে আছে যে নেপলসে সবাই না খেয়ে আছে? মহামারী ছড়িয়ে পড়ছে চারদিকে? এমন সময় পত্রবাহকের আসা-যাওয়া আর প্রস্তাবের শর্ত নির্ধারণ হওয়া পর্যন্ত সবাই হাত-পা গুটিয়ে বসে থাকব? তারপর টেবিলে কয়েকবার তবলার মত তাল ঠুকে সে বলল, ডোরিয়াকে কেনা যেতে পারে, আবার না-ও পারে। ব্যাপারটা এখনও অনিশ্চিত। কিন্তু একটা বিষয় স্পষ্ট যে ডোরিয়াকে আজ কাল তো নয়ই, আগামী, এক সপ্তাহের মধ্যেও পাওয়া যাচ্ছে না। ব্যাপারটা অবশ্যই সময় সাপেক্ষ। লর্ড মারকুইসের সংবাদের জন্য আমি বসে থাকতে পারছি না। নেপলসবাসীর জন্য আমাকে খাবার আনতেই হবে। কিন্তু ফিলিপ্পিনো ডোরিয়াকে আমাদের গালফ থেকে তাড়ানোর আগ পর্যন্ত তা করা যাচ্ছে না।
তখন কথা বলল গুইস্টিনিয়ানি। সে বলল, আমি আগেই বলেছি, আমাদের হাতে এই মুহূর্তে এতটা লোকবল নেই যে ওদের সঙ্গে লড়াই করব।
কিন্তু ভাইসরয় মনকাড়া এতে দমবার পাত্র নয়। সিজার বর্জিয়া ও মহান গনসালভা ডিকর্ডোবার অধীনে লড়াই করেছে সে। ওই সময়ে এই এলাকায় তার মত লড়াকু নৌ-কমাণ্ডার আর একজনও ছিল না। মুরদের সঙ্গে লড়াইয়ের অভিজ্ঞতাও আছে। তার। একসময় ইম্পিরিয়াল নেভির অ্যাডমিরালও ছিল সে। কাজেই সে দমে যাবার পাত্র নয়। ডক ইয়ার্ড আর আর্সেনাল থেকে ইতিমধ্যেই কিছু নৌযান বের করেছে সে। সেগুলোর মধ্যে ছয়টা সাধারণ যাত্রীবাহী গ্যালি, চারটা ফেলুকা (দাঁড়টানা বা পাল তোলা এক ধরনের ছোট নৌকা। সাধারণত ব্যবহৃত হয় নীল নদ ও আশপাশের ভূমধ্যসাগর এলাকায়), দুটি ব্রিগেণ্টাইন আর কিছু সাধারণ মাছ ধরা নৌকা। ভাইসরয় প্রস্তাব করল যে তার এই শক্তিশালী ফ্লিট নিয়ে ফিলিপ্পিনোর আটটা রণসজ্জিত শক্তিশালী যুদ্ধজাহাজের বিরুদ্ধে লড়াই শুরু করা হবে। আর বাকি অভাবটা পূরণ করা হবে এক হাজার আরাকুইবাসিয়ারকে দিয়ে (আরাকুইবাস: প্রাচীন স্প্যানিশ বন্দুকবিশেষ। আরাকুইবাসিয়ার: আরাকুইবাস বহনকারী যোদ্ধা)। অবশ্য সে স্বীকার করল যে এতে মারাত্মক ঝুঁকি রয়েছে। কিন্তু পরিস্থিতি এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে। যে, এখন মরিয়া পদক্ষেপ নিতেই হবে। এবং তার ক্যাপ্টেনদের সে মনে করিয়ে দিল যে প্রায় দুর্ভিক্ষের মুখে পড়ে গেছে নেপলস।
ভাইসরয়ের এই কঠিন কিন্তু বাস্তব বক্তব্যের বিরোধিতা করার সাহস দেখাল কেবল ডেল ভাস্টো। সে এতই আত্মবিশ্বাসী যে নেপলসবাসীকে আরো দিন কয়েক ক্ষুধা আর মহামারীর সঙ্গে লড়াই করতে দিতেও তার আপত্তি নেই। সে চাইছে নিজে জেনোয়া গিয়ে সম্রাটের নামে ডোরিয়ার সঙ্গে সরাসরি কথা বলতে।
কিন্তু তার কথা শুনল না ভাইসরয়। এমনকী একটা পলকও ফেলল না সে। তার জানা আছে ফিলিপ্পিনোকে সহায়তা করতে এগিয়ে আসছে ল্যানডোর নেতৃত্বাধীন আরেকটি নৌবহর। ওই বহর পৌঁছে গেলে নেপলসের আর অবরোধ ভাঙার সামান্যতম সম্ভাবনাও থাকবে না। কাজেই দেরি করার কোন উপায় ভাইসরয়ের নেই। সুতরাং আগের সিদ্ধান্তই বহাল রইল। ক্যাপ্টেনরা বেরিয়ে গেল যার-যার মত লড়াইয়ের প্রস্তুতি নিতে।
মে মাসের শেষ দিকের একটা দিন। আর দশটা দিনের মতই রাত শেষ হয়ে ভোর হতে চলেছে। ভাইসরয়ের নেতৃত্বে রওনা হলো তারু ফ্লিট। ইচ্ছে, রাতের আঁধারে ক্যাপরি থেকে রওনা হয়ে শত্রুর অলক্ষে তাদের কাছাকাছি পৌঁছে তাদেরকে চমকে দেবে।
অথচ পরিকল্পনার বারোটা বাজিয়ে এমনভাবে ভাইসরয় রওনা হলো যেন যুদ্ধ নয় বিয়ের বরযাত্রী যাচ্ছে। সৈন্যদের জন্য বিশাল ভোজের আয়োজন করল সে। তারপর এক ফ্রায়ারকে দিয়ে সারমন শোনাল সবাইকে। ফলে আরো দেরি হয়ে গেল। এরপর যখন রওনা হলো ততক্ষণে অনেক দেরি হয়ে গেছে। ভোরের আলো ফুটে গেছে। রাতের আঁধারে প্রতিপক্ষকে চমকে দেয়ার সুযোগ হারাল তারা। ট্রাম্পেট বাজিয়ে এমনভাবে রওনা হলো যেন ভেনেশিয়ানদের জল উৎসবে অংশ নিতে যাচ্ছে মনকাড়া। এত ঢাকঢোল শোনার পরও কী হতে যাচ্ছে তা না বোঝার মত বোকা ফিলিপ্পিনো নয়। ফলে সুবিধামত অবস্থান নিয়ে ফেলল সে।
যে-কোন বড় শক্তির বিরুদ্ধে ছোট শক্তিকে জিততে হলে আচম্বিতে আক্রমণ করে তাদের হতভম্ব করে দিতে হয় ও তারা হুঁশ ফিরে পাওয়ার আগেই কাজ হাসিল করতে হয়। সুযোগটা মনকাডাও পেয়েছিল। কিন্তু সেটা নিজ হাতে ছুঁড়ে ফেলে দিল।
প্রসপেরোকে দেয়া হয়েছে সিকামা নামে একটা গ্যালির কমাণ্ড। এটা নিয়াপলিটানদের অন্যতম সেরা যুদ্ধজাহাজ। মনে তীব্র শঙ্কা নিয়ে ভাইসরয়ের কাণ্ডকারখানা খেয়াল করছে ও। ভাইসরয়ের ছয়টা গ্যালিই দক্ষিণ দিকে মুখ করে পাশাপাশি এগিয়ে চলছে। দাঁড়িদের পিঠে ওভারশিয়ারের নির্দয় চাবুকের আঘাতে প্রতি মুহূর্তেই বাড়ছে গ্যালিগুলোর গতি।
আমালফির পাশে পৌঁছে ওরা দেখল খোলা সাগরের দিকে রওনা হয়েছে ফিলিপ্পিনোর তিনটা গ্যালি। ভাইসরয় ধরে নিল রণে ভঙ্গ দিয়ে লেজ তুলে পালাচ্ছে ফিলিপ্পিনোর জাহাজ তিনটা। উৎসাহের আতিশয্যে যন্ত্রণাকাতর দাড়িদের পিঠে আরো জোরে চাবুক কষাতে থাকল ওভারশিয়াররা।
যে যা-ই ভাবুক, প্রসপেরোর অভিজ্ঞ চোখে জাহাজ তিনটির গতিপথ পরিবর্তনের আসল কারণ ঠিকই ধরা পড়ল। কথাটা সে ডেল ভাস্টোকেও জানাল। সিকামার পুপ কেবিনে প্রসপেরোর সঙ্গেই দাঁড়িয়ে আছে সে। নৌযুদ্ধে প্রসপেরোর খ্যাতির কথা মারকুইস ডেল ভাস্টোর ভালই জানা আছে। অবশ্য তার নিজের নৌযুদ্ধের কোন অভিজ্ঞতা নেই। তাই লেফটেন্যান্ট হিসেবে প্রসপেরোর সঙ্গে জাহাজে উঠেছে সে অভিজ্ঞতা অর্জন করার জন্য।
তখন ফিলিপ্পিনোর জাহাজগুলোর একটার মাথায় পতাকা টানানোর লাঠিটা মাঝখান থেকে ভাঙা অবস্থায় পড়ে থাকতে দেখল প্রসপেরেরা। সেদিকে ডেল ভাস্টোর দৃষ্টি আকর্ষণ করল ও। বলল, ওই তিনটা গ্যালি পালিয়ে যাচ্ছে না। ওরা, একটা কৌশল অবলম্বন করছে। আর যে জাহাজটা থেকে ওদেরকে সঙ্কেত দেয়া হচ্ছে সেটাই হচ্ছে ক্যাপিটানা। মানে যুদ্ধের সর্বাধিনায়কের জাহাজ। ক্যাপিটানার অবস্থান দেখেই ওদের কৌশল আন্দাজ করা যাচ্ছে। ওই তিনটা জাহাজকে পিছনে পাঠানো হয়েছে রিজার্ভ হিসেবে অপেক্ষা করার জন্য। দরকার হলে হুকুম করা মাত্রই ওরা ঝাঁপিয়ে পড়বে।
ওদিকে মনকাডা ভেবে বসে আছে যে তার ছয়টা গ্যালিকে ফিলিপ্পিনোর পাঁচটা গ্যালির মুখোমুখি হতে হবে। এই ভুল ধারণা নিয়েই পূর্ণ গতিতে শত্ৰু লাইনের দিকে এগুল সে। উদ্দেশ্য, দ্রুত সম্মুখ সমরে জড়িয়ে পড়া যাতে শত্রুপক্ষ তাদের দূর পাল্লার কামান ও অন্যান্য অস্ত্রশস্ত্র ব্যবহার করতে না পারে।
মনকাড়ার ফ্ল্যাগশিপেই আছে আরেক ক্যাপ্টেন ট্রানি। সে পরামর্শ দিল ফিলিপ্পিনোর গ্যালিগুলোর উপর গোলাবর্ষণ করতে। কিন্তু মনকাডা এতই আত্মবিশ্বাসী যে ট্রানির পরামর্শকে সে পাত্তাই দিল না। উল্টো ট্রানিকে সে বলল, আমরা গোলা ছুঁড়লে ওরাও গোলাবর্ষণ শুরু করবে। তারচেয়ে এই লড়াইটা তলোয়ার দিয়েই নিষ্পত্তি করব।
অপরদিকে অস্ত্রশস্ত্রে স্প্যানিশদের চেয়ে অনেক এগিয়ে ফিলিপ্লিনো। তাই অবধারিতভাবে গোলাবারুদের উপরই আস্থা রাখল সে। ঝলসে উঠল বারুদ আর আগুনের কুণ্ডলী। মনকাডার ক্যাপিটানার দিকে ছুটে এল দুইশ পাউণ্ড ওজনের দানবীয় এক গোলা। দানবীয়ভাবেই ধ্বংসযজ্ঞ চালাল সেটা। মনকাডার ক্যাপিটানার আগাপাশতলা চুরমার করে দিয়ে গিয়ে পড়ল ওপাশের পানিতে। পিছনে রেখে গেল মৃত আর তীব্র যন্ত্রণায় আর্তনাদুর মারাত্মক আহত সৈনিক ও দাসদের রক্তাক্ত দেহ।
গোলার আঘাতে ভেঙে গেল অনেকগুলো দাঁড়। ঘটনার আকস্মিকতায় হতচকিত দাঁড়িরা দাঁড় বাওয়া থামিয়ে দিল। আতঙ্কে চিৎকার করে উঠল তারা। উঠে দাঁড়াল দুই ওয়ার্ডেন। তারাও অর্ধ উন্মাদ হয়ে গেছে বলা চলে। অনড় জাহাজকে আবার সচল করার জন্য দাসদের পিঠে উন্মত্তের মত চাবুক কষা শুরু করে তারা। সেইসঙ্গে মৃতদেহগুলো সরাতে সাহায্য করতে ডাক দিল সৈন্যদেরকে।
গোলার আঘাতে গানাররা কে কোথায় ছিটকে পড়েছে কে জানে। সর্বাগ্রে সংবিৎ ফিরে পেল জিরোলামো ডা ট্রানি। লাফিয়ে গিয়ে সে দাঁড়াল এক গানারের জায়গায়। মৃতপ্রায় এক সৈনিকের হাতে কামানের গোলায় আগুন দেয়ার একটা অগ্নিকুণ্ড দেখে টান দিয়ে নিয়ে নিল সেটা। একমুহূর্তও দেরি না করে আগুন দিল কামানে। গর্জে উঠল কামান। কিন্তু জাহাজটা তখন আর আগের জায়গায় নেই। দাঁড় বাওয়া বন্ধ করার সঙ্গে সঙ্গে ওটার মুখ ঘোরা শুরু হয়ে গেছে। ফলে ট্রানির গোলা লক্ষ্যের অনেক দূর দিয়ে গিয়ে পানিতে আছড়ে পড়ল। বিফল হলো গোলা নিক্ষেপ। তখন একজন অফিসার কঠোর কণ্ঠে তার আরাকুইবাসিয়ারদের হুকুম করল ভাঙাচোরা র্যামবেডের পিছনে অবস্থান নিতে। আর ট্রানি খুঁজতে থাকল বেঁচে থাকা গোলন্দাজদের।
ওদিকে ফিলিপ্পিনোর জাহাজ থেকে ছুটে এল আরেকটা গোলা। সেটা মনকাডার ক্যাপিটানার প্রথম ডেককে প্রায় ধ্বংস করে দিয়ে গেল। থেমে গেল দাঁড় বাওয়া।
গোলাবর্ষণ দেখে মনকাডা অনুমান করল সম্মুখ সমর এড়াতে চাইছে ফিলিপ্পিনো। এই অনুমানের উপর ভরসা রেখে দাসদের ওয়ার্ডেনদের উপর হুঙ্কার দিয়ে অগ্রসর হওয়ার হুকুম করল মনকাডা। ইচ্ছে, দ্রুত জেনোয়ার গ্যালিতে চড়ে তলোয়ার লড়াই শুরু করা।
দুই পক্ষের দুই ফ্ল্যাগশিপের গোলাবর্ষণের পর অন্য গ্যালিগুলোও শুরু করল পরস্পরের উপর গোলাবর্ষণ। কিন্তু ব্যাপক গোলাবর্ষণ সত্ত্বেও কোন পক্ষই উল্লেখযোগ্য কোন সাফল্য অর্জন করতে পারল না। এদিকে গোলাগুলির মাঝেই জেনোয়ার নেতৃত্বদানকারী গ্যালিটি প্রায় অর্ধেক পথ এগিয়ে এসেছে। মনকাড়ার গ্যালির উপর প্রচণ্ড গোলাবর্ষণ শুরু করল ফিলিপ্পিনো। উদ্দেশ্য মনকাডার যাতে সামান্যতম প্রতিরোধ ক্ষমতাও অবশিষ্ট মা থাকে।
অবস্থা দেখে মনকাডার সহায়তায় সামনে এগুনোর সিদ্ধান্ত নিল প্রসপেরো। সিকামাকে ঘুরিয়ে নিল ও। সেইসঙ্গে পাশের জাহাজ ভিলা মেরিনাকেও ইশারা করল ওর সঙ্গে যোগ দিতে। প্রসপেরোর জাহাজের পার্শ্বদেশ উন্মুক্ত হয়ে গেছে, যে-কোন সময় গোলা ছুঁড়তে পারে বিপক্ষ। সাবধানতা হিসেবে প্রসপেরে নিজের লোকদের নির্দেশ দিল যেন মাথা নিচু রাখে তারা। তাতে অন্তত কিছু গুলি ওদের ক্ষতি না করে ডেকের উপর দিয়ে চলে যাবে। প্রসপেরোর উদ্দেশ্য বিপক্ষের নেতৃত্বদানকারী জাহাজকে থামিয়ে ও দমিয়ে দেয়া। যাতে তারা লড়াই থামানো বা চালিয়ে যাওয়া নিয়ে দ্রুত একটা সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য হয়।
ভিলা মেরিনার কমাণ্ডে আছে ক্যাপ্টেন সিজার ফিয়েরামোসা। প্রসপেরোর উদ্দেশ্য সে ধরতে পেরেছে। ফলে ওর ডাকে সঙ্গে সঙ্গেই সাড়া দিল। ওদিকে প্রসপেরোর উদ্দেশ্য ফিলিপ্পিনোও ধরতে পেরেছে। ফলে সঙ্গে সঙ্গেই তার বামপাশের দুই গ্যালিকে এগিয়ে আসার সঙ্কেত দিল সে।
ব্যাপারটা এখন সময়ের সঙ্গে পাল্লা হয়ে দাঁড়িয়েছে। স্প্যানিশরা চাইছে আগে জেনোয়ার ক্যাপিটানা দখল করতে। একইসঙ্গে জেনোয়িসরাও চাইছে স্প্যানিশ ক্যাপিটানার দখল নিতে। প্রসপেরো ওর ওয়ার্ডেনদের হুকুম করল দাঁড়িদের উপর চাবুক কষাতে। দুই জেনোয়িস গ্যালির গোলাবর্ষণের লাইন থেকে দ্রুত নিজেকে সরিয়ে নিতে চাইছে ও। কিন্তু তা আর সম্ভব হলো না। ফলে বাধ্য হয়ে ওই দুই গ্যালির উপর গোলাবর্ষণ শুরু করতে হলো ওকে। দ্রুতই চারটা গ্যালি পরস্পরের সঙ্গে কামান-যুদ্ধে মত্ত হয়ে গেল। ওদিকে মনকাডার ভগ্নপ্রায় গ্যালির উপর চড়াও হওয়ার সুযোগ পেয়ে গেছে ফিলিপ্পিনো। সুযোগের সদ্ব্যবহার করতে দেরি করল না সে।
এদিকে প্রসপেরোর তুলনামূলক দুর্বল অবস্থান স্পষ্ট বুঝতে পারছে গব্বার ক্যাপ্টেন গুইস্টিনিয়ানি। সঙ্গে সঙ্গেই ওকে সাহায্য করতে রওনা হয়ে গেল সে। আর বাকি দুই গ্যালিকে রেখে গেল ফিলিপ্পিনোর অপর দুই গ্যালি সামলানোর জন্য। ওই সময় মনকাডার আনা মাছ ধরার বড় নৌকা আর ফেলুকাগুলো গোলাবর্ষণ এলাকা থেকে সম্মানজনক দূরত্বেই দাঁড়িয়ে রইল। কারণ ওগুলোতে অস্ত্রশস্ত্র তেমন কিছুই নেই। তারচেয়ে বড় কথা, ওগুলোকে নেতৃত্ব দেয়ার মত যোগ্য লোকও ওখানে নেই।
ওদিকে গায়ে বর্ম চড়িয়ে বিরাট এক দুধারী তলোয়ার নিয়ে বিপক্ষের গ্যালি পেলিগ্রিনায় চার্জ করেছে প্রসপেরো। ফিয়েরামোসা তখন ফিলিপ্পিােের আরেক গ্যালি ডনাজেলার আক্রমণ সামলাতে ব্যস্ত। পেলিগ্রিনার প্রতিরোধকারী বাহিনী বেপরোয়াভাবে প্রসপেরোর সৈন্যদের উপর ঝাঁপিয়ে পড়েছে। একই সময় ফিয়েরামোসার সেনারা একদিকে পেলিথিনার আরাকুইবাসিয়ারদের গুলির মুখে পড়েছে, অপরদিকে সামলাতে হচ্ছে তলোয়ার হাতে অর্ধনগ্ন, বেপরোয়া ও উন্মত্ত দাস বাহিনীর হিংস্র আক্রমণ। ওই দাসদেরকে শেকলমুক্ত করে লড়াইয়ে নামিয়ে দিয়েছে ফিলিপ্পিনো। হয়তো ও শপথ করে ওদের বলেছে লড়াইয়ে দাসেরা জিততে পারলে ওদেরকে সে স্বাধীন করে দেবে। কাজেই দাসত্বের শৃঙ্খল থেকে মুক্তির আশায় ওরা এক একজন লড়ছে খোদ শয়তানের মত। বারবার ভয়াবহ আঘাত হানছে ওরা। কিন্তু শেষ পর্যন্ত দুদিক থেকে আক্রমণ চালিয়ে ওদেরকে দমিয়ে দিল স্প্যানিশরা, ওই লড়াইয়ে জয়ী হলো তারা। রক্ত, ঘাম আর নোংরায় মাখামাখি হয়ে ডনাজেলার পুপ কেবিনে উঠে এল প্রসপেরো। কিন্তু জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়েই ও বুঝতে পারল, জয় ওরা পেয়েছে বটে, কিন্তু অনেক দেরিতে।
প্রসপেরোর আশঙ্কা সত্য করে জোর গতিতে ছুটে আসছে ফিলিপ্পিনোর রিজার্ভ ফোর্স। প্রসপেরোর আশা ওর দখলে থাকা জাহাজগুলোকে মুক্ত করতে আসবে রিজার্ভ ফোর্স।
কিন্তু ওই তিন জাহাজের কমাণ্ডে আছে ক্যাপ্টেন লোমেলিনো। তার কৌশল ভিন্ন। সরাসরি মাথায় আঘাত হানতে যাচ্ছে সে। টার্গেট করেছে মনকাডার ক্যাপিটানাকে। সেটা তখন ফিলিপ্পিনের গ্যালির সঙ্গে লড়ছে। মনকাডার ক্যাপিটানার অবস্থা খারাপ হলেও সমান তালে লড়ে যাচ্ছে ওটা।
লোমেলিনোর তিন গ্যালি ছুটে এসে প্রায় একসঙ্গে হামলে পড়ল মনকাডার ক্যাপিটানার উপর। একটা আছড়ে পড়ল রাডারের উপর, একটা গিয়ে নিজের পেট দিয়ে জোর ধাক্কা মারল মনকাডার ক্যাপিটানার পেটে। মড়মড় করে ভেঙে গেল ক্যাপিটানার বিশাল দাঁড়গুলো। সেইসঙ্গে ভাঙল দাঁড় হাতে বসা দাঁড়িদের পাঁজর, হাত-পা। আহতদের আর্তনাদ-আহাজারিতে কেঁপে উঠল আকাশ-বাতাস। ওই ধাক্কায় ভেঙে পড়ল ক্যাপিটানার মূল মাস্তুল, ডেকে আছড়ে পড়ে প্রাণ নিল অনেকের, আহতও হলো অনেক। মাস্তুলের আঘাতে নিহতদের তালিকায় আছে জিরোলামো ডা ট্রানিও। সে কামানগুলোর গোলাবর্ষণ নিয়ন্ত্রণ করছিল। সবশেষে এল তৃতীয় গ্যালিটা। সেটা ক্যাপিটানার গায়ে গা ঠেকিয়ে দাঁড়াল অপর পাশে।
তিন দিক থেকে একসঙ্গে লোমেলিনের সেনারা ক্যাপিটানায় চলে আসছে। অবস্থা দেখে বিরাট একটা তলোয়ার হাতে ডেকে নেমে এল মনকাড়া। তার সৈন্যদের সাহস আর উৎসাহ জোগাতে চেঁচিয়ে উঠল সে। ঠিক তখনই আরাকুইবাসের একটা গুলি গুঁড়িয়ে দিল তার ডানকাধ। প্রায় একই সময় বামঊরুতে গভীর গর্ত করে বেরিয়ে গেল আরেকটা গুলি। ডেকের উপর আহত নিহতদের রক্তের পুকুরে পড়ে গেল সে। শত্রুপক্ষের ল্যাণ্ড করার শব্দে আরেকবার মাথা তুলতে চাইল মনকাডা। কিন্তু তার ভিতর আর কোন শক্তি অবশিষ্ট নেই। অচেতন হয়ে পড়ল সে। সেখান থেকেই চলে গেল না ফেরার দেশে।
মনকাডাকে পড়ে যেতে দেখেছে অ্যাসকানিয় কলনা। সাহায্য করতে ছুটে আসতে চাইল সে। কিন্তু সে-ও আছড়ে পড়ে গেল। লোমেলিনোর এক আরাকুইবাসিয়ারের গুলি লেগেছে তার হেলমেটে। হেলমেটের দফারফা হয়ে গেলেও তখনও অচেতন হয়ে যায়নি সে।
ওদিকে মনকাডার ক্যাপিটানার একদল আরাকুইবাসিয়ার তখনও ব্যাপক গুলিবর্ষণ করে ডেকের একটা অংশের দখল ধরে রেখেছে। কিন্তু বিপক্ষ দলের বন্দুক ও তলোয়ারধারীরা ঘেরের ভিতর ফেলে দিয়েছে ওদেরকেও। চারদিকে শোনা যাচ্ছে কেবল আরাকুইবাসের গুলি, তলোয়ারে তলোয়ারে ঠোকাঠুকির ঝনঝন শব্দ আর কাঠ ফাটার বিকট আওয়াজ। আর সৈন্যদের তীব্র আর্তনাদ।
কীভাবে যেন ওই ঘেরের ভিতর চলে এসেছে অ্যাসকানিয় কলনা। তখন ক্যাপিটানার স্টারবোর্ড সাইডে নেমে এসেছে শত্রুপক্ষের আরেকদল সেনা। ওই দলে ভিতর কলনা আবিষ্কার করল স্বয়ং ফিলিপ্পিনো ডোরিয়াকে।
সামনে এগিয়ে গিয়ে গলা চড়িয়ে ফিলিপ্পিনোকে সে বলল, চলে এসেছেন তাহলে…
ওর কণ্ঠে তিক্ততা থাকলেও তলোয়ার ধরে রাখার ভঙ্গিই বলে দিচ্ছে আত্মসমর্পণ করেছে সে। সঙ্গে সঙ্গে নিজের তলোয়ার আর কণ্ঠ উঁচু করে আগ্রাসন থামানোর হুকুম করল ফিলিপ্পিনো। আত্মসমর্পণ করল স্প্যানিশ ক্যাপিটানা।
তবে এই আত্মসমর্পণেও সত্যিকার অর্থে খুব একটা খুশি হতে পারেনি ফিলিপ্পিনো। কারণ কামানের গোলা আর আরাকুইবাসের গুলিতে ঝাঁঝরা হয়ে গেছে ওর দুটো গ্যালি। একটায় আগুন ধরে গেছে, নামে মাত্র ভেসে আছে আরেকটা। আরো দুটো গেছে প্রসপেরোর সেনাদের দখলে। ওই দুটোয় উড়ছে মনকাডার পতাকা। ফিলিপ্পিনার অনেক ক্রুকে বন্দি করে রেখেছে ওরা।
আরেকবার লড়াই শুরু করার মানসে দুই গ্যালি ভিলামেরিনা ও গব্বাকে সঙ্গে নিয়ে এগিয়ে গেল প্রসপেরোর গ্যালি সিকাম। কিন্তু জেনোয়িসদের গ্যালির সামরিক সক্ষমতা ওদের চেয়ে অনেক বেশি। নির্মম গোলাবর্ষণ করে অল্প সময়েই ওরা চূর্ণ করে ফেলল ভিলামেরিনাকে। আর আরাকুইবাসের একটা বল গুলি নিকেশ করে এটার ক্যাপ্টেন সিজার ফিয়েরামোসার প্রাণ। সময়মত ওটাকে কেউ নেতৃত্ব না দেয়ায় পিছিয়ে পড়ল গ্যালিটা।
কিন্তু গোলাগুলির পরোয়া না করে লোমেলিনোর তিন জাহাজের সঙ্গে লড়াইয়ে জড়িয়ে পড়ল সিকামা ও গব্বা। ওদের হাতে সেনাসংখ্যা কম। কারণ ফিলিপ্পিােের প্যালিগুলো থেকে বন্দি করা সেনাদের পাহারা দিতে একটা বড় সংখ্যক সেনাদল নিয়োজিত করে রাখতে হয়েছে।
ওদিকে প্রসপেরো তখনও আত্মরক্ষামূলক লড়াই করছে। কারণ স্প্যানিশদের দুই গ্যালি পারপিগানা ও ওরিয়াকে দেখতে পাচ্ছিল ও। ভাবছিল ওই দুটোর যে-কোন একটা বা দুটোই হয়তো ওর সাহায্যে এগিয়ে আসবে। এমনটা হলে সৌভাগ্যের পাল্লা অবশ্যই স্প্যানিশদের দিকেই ঝুঁকে পড়ত। খোলা সাগরের দিকে ছুট দেয়া ছাড়া ফিলিপ্পিনোর আর কিছুই করার থাকত না। নেপলসের উপর থেকে অবরোধও উঠে যেত। কিন্তু পরিতাপের বিষয় এসব কিছুই হলো না। ওদিকে জেনোয়িস সেনারা ততক্ষণে প্রসপেরোর গ্যালির বো-তে চলে এসেছে। প্রচণ্ড রাগ-ক্ষোভ নিয়ে প্রসপেরো দেখল ওর সঙ্কেতে সাড়া না দিয়ে স্প্যানিশ দুই গ্যালি যার যার জায়গায় পাথরের মত দাঁড়িয়েই রইল। আসলে মনকাডার পতাকা নেমে যেতে দেখে ওরা ভেবেছে স্প্যানিশরা হেরে গেছে। তাই নিজেদের প্রাণ বাঁচাতে তখন পালাবার তালে ছিল ওরা।
সত্যিই পালিয়ে গেল পারপিগানা। বন্দরে নোঙর করে গ্যালির ক্যাপ্টেন জবাবদিহি করতে গেল অরেঞ্জ কাউন্টির প্রিন্সের কাছে। মনকাডার অনুপস্থিতিতে ভাইসরয়ের অফিস সামলানোর দায়িত্ব এখন তার কাঁধে গিয়ে পড়েছে।
প্রিন্সকে পারপিগানার ক্যাপ্টেন বলল যে, লড়াইয়ের ওই অবস্থায় হার অনিবার্য। তাই সে মনে করে সম্রাটের এই গ্যালিটা বাঁচিয়ে রাখা তার দায়িত্ব। শুনে সঙ্গে সঙ্গে তাকে লড়াইয়ের ময়দান থেকে পালানো ও কর্তব্যে অবহেলার অপরাধে মৃত্যুদণ্ড দিল প্রিন্স। অপর গ্যালি ওরিয়ার ক্যাপ্টেন আরেকটু বেশি বুদ্ধি রাখে। বন্দরে ফিরে গেলে কী হবে সেটা সে ভালই আন্দাজ করতে পেরেছে। তাই সবচেয়ে যুক্তিগ্রাহ্য কাজটাই করল সে। আত্মসমর্পণ করল ফিলিপ্পিনো ডোরিয়ার হাতে।
যা হোক, আবার যুদ্ধে ফিরে যাই।
পারপিগানা আর ওরিয়ার ক্যাপ্টেনদের চরম কাপুরুষতায় চূর্ণ হয়ে গেল প্রসপেরোর সব আশা। ও স্পষ্ট বুঝতে পারল, এখন যা-ই ও করুক, কোনভাবেই আর পরাজয় রুখতে পারবে না। ওদিকে ফিলিপ্পিনের চতুর্থ গ্যালি ততক্ষণে এগিয়ে এসেছে লোমেলিনোর তিন গ্যালিকে সহায়তা করতে।
মারকুইস ডেল ভাস্টো বলে, লড়াই শেষ, বন্ধু। ওই দুই কাপুরুষের কারণে আজ ফিলিপ্পিনো বদমাশটা তোমার বিজয় চুরি করল। কিন্তু এখন তুমি মারা পড়লে তাতে তোমার বা সম্রাটের-কারো কোন লাভ হবে না।
প্রসপেরোও বুঝতে পারছে আত্মসমর্পণ না করে উপায় নেই। নিজেকেই যেন সান্ত্বনা দিয়ে বলল, হ্যাঁ, আজ বেঁচে থাকি। কাল হয়তো আরো বড় কিছু করার সুযোগ পাওয়া যাবে।
লট্রেসের সেনারা ততক্ষণে মূল ডেকে চলে এসেছে। ওখানেই প্রসপেরোর শেষ প্রতিরক্ষা ব্যুহ দাঁড়িয়ে ছিল। কিন্তু বিপক্ষের হাতে অযথা প্রাণ হারাবার কোন অর্থ নেই। তাই প্রসপেরো ওর পতাকা নামিয়ে নিল। আত্মসমর্পণ করল প্রসপেরো।
Thanks a lot for spreading knowledge to us.