২১. ব্যাখ্যা
ফসোলু প্রাসাদে এসেছে প্রসপেরো। ডাচেসের চেম্বারে প্রসপেরোর আগমনের খবর নিয়ে গেছে তার চেম্বারলিন (খাস ভৃত্য)। অত্যন্ত চমৎকার কারুকাজ করা দর্শনীয় পিলার দিয়ে ঘেরা এক চত্বরে বসে অন্দরমহলের ডাকের জন্য অপেক্ষা করছে। ও। একসময় ডাক এল প্রসপেরোর।
গ্রেট গ্যালারি অভ হিরোজ নামে বিশাল একটা কক্ষ পার হলো ওরা। এখানেই প্রসপেরোর বাগদান হয়েছিল। হল ঘরটায় প্রবেশ করা মাত্রই সেদিনের ঘটনা মনে পড়ে গেল ওর।
ডাচেসের চেম্বারে প্রবেশ করল প্রসপেরো। আজ ওকে দেখে আগের মত উষ্ণ অভ্যর্থনায় আসন ছাড়ল না ডাচেস। ডাচেসকে হালকা বাউ করল প্রসপেরো। দুঃখী দৃষ্টিতে প্রসপেরোকে জরিপ করল ডাচেসের চোখ জোড়া।
প্রসপেরো বলল, মনে হয় মৃত ব্যক্তির হঠাৎ জীবিত হওয়া খুব একটা সুবিধার ব্যাপার নয়। কারণ জীবিতরা ততক্ষণে তার মৃত্যুর ফায়দা লুটতে শুরু করে দিয়েছে।
উত্তরে ডাচেস বলল, হয়তো ঠিক বলেছ। তবে, মৃত ব্যক্তির অন্যায় ক্ষমা করা সহজ।
প্রসপেরো বলল, আমি ক্ষমা চাইতে আসিনি।
তাহলে কেন এসেছ? প্রশ্ন করল ডাচেস।
আমার গল্প আমার দৃষ্টিকোণ থেকে বলতে এসেছি। যাতে আমার কাজ যেটাকে আপাত দৃষ্টিতে মনে হচ্ছে খুবই জঘন্য, সেই বিষয়টা পরিষ্কার করতে এসেছি।
গম্ভীরভাবে মাথা নেড়ে ডাচেস বলল, আমার মনে হয় না, আমার ভাতিজি তোমার কথা শুনবে। আর আমিও চাই না ওর ইচ্ছার বিরুদ্ধে ওর সঙ্গে তুমি দেখা করো। তোমার কার্যকলাপের কারণে, ইতিমধ্যেই যথেষ্ট ভুগছে সে। ওই ক্ষতের উপর আরেকটা নতুন ক্ষত দরকার নেই।
খানিকটা অবাক হয়েই প্রসপেরো বলল, বলতে চাইছেন, আপনি চান, জিয়ান্না জানুক যে আমি বেঁচে নেই!
অবাক হচ্ছ? মৃত প্রসপেরোকে খানিকটা দয়া ও করবে। তোমার কীর্তিময় মৃত্যু হয়েছে ভেবেই না হয় শান্তিতে থাকুক ও।
আমার কাজ যদি মহান হিসেবে বিবেচিত হয়, তাহলে আমার ফিরে আসাতে নিশ্চয়ই সেই মহত্ত্ব মিলিয়ে যাবে না। এখন, প্যারেট্টা, দয়া করে আপনার ভাতিজির সঙ্গে দেখা করার সুযোগ দিন।
জবাবে ডাচেস বলল, বললামই তো, তোমার সঙ্গে দেখা হলে জিয়ান্না আরো বেশি কষ্ট পাবে। তারপরও ওর সঙ্গে দেখা করতে চাইছ কেন?
আমিও যদি মনে করতাম, আমার কথা শুনলে ও কষ্ট পাবে তাহলে এই অনুরোধই করতাম না। বলে একমুহূর্ত থেমে বলল, জিয়ান্নাকে আমার প্রাণ, সম্মান বা এই দুনিয়ায় যা কিছু আছে তার সবকিছুর চেয়েও বেশি ভালবাসি।
তোমার বক্তব্যের দারুণ প্রমাণ আমরা ইতিমধ্যেই পেয়েছি।
কথা দিতে পারি, সবকিছু শুনলে আমার প্রতি আপনাদের ধারণা অবশ্যই বদলাবে, বলল প্রসপেরো।
কয়েক মুহূর্ত প্রসপেরোর দিকে তাকিয়ে রইল সে। একটু দয়ার ভাব জাগল ডাচেসের চেহারায়। ডাচেস আসলেই খুব দয়ার্দ্র ও দ্র একজন মহিলা। যে-কোন অপকর্মের পিছনে মানুষের হাত খোঁজার চেয়ে শয়তানের প্ররোচনাতে বিশ্বাস করতেই সে বেশি অভ্যস্ত। আর প্রসপেরোর ব্যাপারে বলা যায়, ও শুধু জিয়ান্নার সঙ্গে দেখা করতেই চায়নি, মৃতাবস্থা থেকে জীবিত হয়ে সশরীরে ফিরে এসেছে। প্রসপেরোর অটুট গাম্ভীর্য, অটল ব্যক্তিত্ব, গর্বিত সমুন্নত মস্তকে সটান দাঁড়িয়ে থাকা দেখলে কেউই বলবে না যে প্রসপেরো প্রতারক।
ডাচেস জিজ্ঞেস করল, আমার উপস্থিতিতে ওর সঙ্গে কথা বলতে তোমার আপত্তি আছে?
না, আমিও বরং সেটাই চাই, জবাব দিল প্রসপেরো।
অন্দরে গায়েব হয়ে গেল ডাচেস। এবং কিছুক্ষণের মধ্যে জিয়ান্নাকে পাশে করে নিয়ে এল সে। জিয়ান্নার পরনে আপাদমস্তক কালো পোশাক। কালোর পটভূমিতে জিয়ান্নার ফর্সা চেহারা আর কণ্ঠদেশ যেন চকচক করছে। প্রসপেরোকে দেখেই জিয়ান্নার দৃষ্টিতে বিস্ময় ফুটে উঠল। নিজের অজান্তেই উঠে এল তার হাত দুটো। পরমুহূর্তেই হাত দুটো আবার শরীরের পাশে পড়ে গেল। কাতর কণ্ঠে জিয়ান্না প্রশ্ন করল, তুমি এখানে কেন? তারপর যেন মনের ভাব প্রকাশ করতে পারেনি এমন ভঙ্গিতে আবার প্রশ্ন করল, তুমি বেঁচে আছ কেন?
বেঁচে আছি কারণ একজন খ্রিস্টান ঐন্দ্রলোক-এর চেয়ে আমাদের ভাষায় একজন বর্বর কোর্সেয়ার আমার প্রতি বেশি দয়া দেখিয়েছে, তাই। প্রথমবার আমাকে বাঁচিয়েছে, যখন খ্রিস্টান সৈন্যরা আর আমাদের কমাণ্ডার আমাকে শক্ৰবেষ্টিত এলাকায় মরার জন্য ফেলে পালিয়ে এসেছে, তখন। দ্বিতীয়বার, আমার মুক্তিপণের জন্য পাঠানো দূতকে বন্দি করা হয়েছে। কিন্তু ওই বর্বর কোর্সেয়ার আমাকে তখন শেকলে বাঁধার বদলে বিশ্বাস করে মুক্তি দিয়েছে। স্রেফ এই শর্তে যে প্রথম সুযোগেই মুক্তিপণের টাকাটা আমি পাঠিয়ে দেব। সম্ভব হলে ওই দূতকে দিয়েই।
কার বিরুদ্ধে অভিযোগ করছ? তীক্ষ্ণ কণ্ঠে প্রশ্ন করল ডাচেস।
ডোরিয়া ঘরের দুয়েকজন ভদ্রলোকের বিরুদ্ধে।
ডাচেসের চেহারা রাগে লাল হয়ে উঠেছে। বলল, একটু আগে আমাকে ভুল বুঝিয়েছ তুমি। বলেছিলে নিজের গল্প শোনাতে এসেছ। কিন্তু এখন অভিযোগের আঙুল তুলছ আমাদের পরের উপর।
একটু ধৈর্য ধরুন, প্যারো। অভিযোগ করছি না। আমি শুধু এলছি, আমি যখন দুই পরিবারের মধ্যে শত্রুতার সম্পর্ককে চিরতরে কবর দিতে যাচ্ছিলাম তখনই আবার নতুন করে আমার সঙ্গে শত্রুতা করা হয়েছে, বলল প্রসপেরো।
আরেকটু বুঝতে দাও। বলতে চাইছ, তোমার বেঁচে থাকার ব্যাপারটা আন্দ্রে বা ডোরিয়া ঘরের আরো কোন সদস্যের জানা ছিল? এবং ওই দূতকে বন্দি করার সঙ্গে তারা কেউ জড়িত?
আপনি বললে আমি ওই দূতকেও এখানে নিয়ে আসতে পারি। ওর নাম ইয়াকুব। আজ সকালেই ওকে ব্যাগনিয়োতে বন্দি অবস্থায় পেয়েছি, জবাব দিল প্রসপেরো।
তোমার পক্ষে বিশজন মুরও যদি সাফাই গায়, তবুও আমি বিশ্বাস করব না, বলল প্যারেট্টা।
তাহলে তো বলতে হয়, আমার সুবিচার পাওয়ার কোন আশাই নেই। আমার সাক্ষীই যদি আপনার কাছে বিশ্বাসের অযোগ্য হয় তাহলে আমার কথার আর গ্রহণযোগ্যতা থাকে কোথায়?
হঠাৎ কথা বলল জিয়ান্না, কোন্ কথার কথা বলছ? ব্যাখ্যা করতে পারবে, কীভাবে তুমি আমাকে নিয়ে…আমি আর পারছি না। অযথা কথা বলার কোন অর্থ নেই। দাঁড়িয়ে থেকে সময় নষ্ট করছ কেন, প্রসপেরো?
আমার কাছে সময়ের কোন মূল্য নেই। তবে আপনাদের কয়েকটা মূল্যবান মুহূর্ত ভিক্ষা চাইছি আমি। পুরো ঘটনা জানাতে চাইছি আমি।
ভাবছ, এখনো আমাদের কিছু অজানা আছে?
জবাবে প্রসপেরো বলল, ভাবছি না, আমি জানি। চোখে যা দেখা যায় ঘটনা সবসময় তেমনই হয় না। কিছুদিন আগের কথা। নানা লোকের নানা অপকৌশলে পড়ে মানসিকভাবে ভীষণ পর্যদস্ত হয়ে গিয়েছিলাম। তখন গিয়েছিলাম আমার কার্ডিনাল চাচার কাছে সাহায্য চাইতে। সে-ই তখন আমাকে মনে করিয়ে দেয় যে সবকিছুকে ডোরিয়া আর অ্যাডর্নোর শত্রুতার চশমা দিয়ে দেখলে চলবে না। অন্য কোন দৃষ্টিকোণ থেকেও তা দেখা যেতে পারে।
তীক্ষ কণ্ঠে ডাচেস প্রশ্ন করল, একথাও আমাকে শুনতে হবে যে তোমার উপর কৌশল খাটানো হয়েছিল?
দয়া করে শেষ পর্যন্ত শুনুন, আকুতি জানাল প্রসপেরো।
জিয়ান্নাকে পার্শিয়ান কাউচের দিকে টেনে নিয়ে গেল ডাচেস। ততক্ষণে নিজের কাহিনির আদ্যোপান্ত বলা শুরু করেছে প্রসপেরো। শুরু করল ডোরিয়া ঘরের শান্তি প্রস্তাবটাকে সে কীভাবে ষড়যন্ত্র ভেবে এগিয়েছিল, তা থেকে। বলল, ডোরিয়ার শান্তি প্রস্তাব সে মেনে নিয়েছিল তাদের আরো কাছাকাছি আসার জন্য, যাতে নীরবে নির্বিঘ্নে বাবার মৃত্যুর প্রতিশোধ নিতে পারে। কিন্তু বাগদানের জন্য এখানে এসে বিস্ময় আর আতঙ্কের সঙ্গে আবিষ্কার করে জিয়োভান্নাই হচ্ছে ওর জিয়ান্না। তারপর আলজিয়ার্সের দিকে জাহাজ ভাসানোর আগে কার্ডিনাল চাচার সঙ্গে কথোপকথন ও তার ফলে ওর মনোভাবের কেমন পরিবর্তন হয়েছিল, সেই কথা। বলল, কীভাবে অনেক বিষয়ে ওকে অবহিত করেছে সে, সাহায্য করেছে ভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে সবকিছু দেখতে। আর প্রতিশোধ নেয়ার ইচ্ছা কবর দিতেও যে সে-ই সাহায্য করেছে, সেকথা বলতেও ভুলল না প্রসপেরেরা।
এরপরই এল শার্শেলে ঘটে যাওয়া বিভিন্ন ঘটনা। সেইসঙ্গে আজ পর্যন্ত ওর সঙ্গে ঘটা কোন দুর্ঘটনার কথাই বাদ দিল না। আশা, এসব থেকে জিয়ান্না বুঝতে পারবে যে ওর মনের ভিতর কতটা উথাল-পাথাল হয়েছে, কতটা ঝঞ্ঝা সহ্য করে এই পর্যন্ত। এসেছে ও। এটা বলতেও ভুলল না যে ওদের বাগদান ভাঙার আগে নিজেকে ভেঙে টুকরা করে ফেলাটাও ওর কাছে অনেক সহজ। দ্বিধা নিয়ে, থামল ও। যেন আর কী বলবে বুঝতে পারছে না।
ডাচেসকে ভীষণ নাড়া দিয়ে গেছে প্রসপেরোর গল্প। তার চোখের কোণে জমে ওঠা অশ্রুবিন্দুই তা স্পষ্ট করে দিচ্ছে। ডাচেস অবশ্য তার মনোভাব লুকানোর চেষ্টা করেনি। কিন্তু জিয়ান্নার মনের ভিতর কী চলছে তার বিন্দুমাত্র.আভাসও প্রকাশ পাচ্ছে না। মাথা নিচু করে কোলের উপর হাত রেখে একদম নিশ্চল বসে আছে সে।
নীরবতা ঘনীভূত হতে লাগল। যেন লেডিরা আশা করছে প্রসপেরো আরো কিছু বলবে। ওদিকে প্রসপেরোও অপেক্ষায় আছে যে ওরাই না হয় দুয়েকটা মন্তব্য করুক। কিন্তু তারা কিছুই বলল না। শেষ পর্যন্ত মুহূর্তখানেক অপেক্ষার পর, প্রসপেরোই নীরবতা ভাঙল আবার। মৃদু কণ্ঠে খুবই নরম সুরে বলল, এটুকুই আমার বলার ছিল। ধৈর্য ধরে আমার কথা শোনার জন্য আপনাদের কাছে আমি কৃতজ্ঞ। বিদায়, বলে গাম্ভীর্যের সঙ্গে ওদের বাউ করে রওনা হওয়ার জন্য উঠল প্রসপেরো।
ঠিক তখনি কথা বলল জিয়ান্না। ঠাণ্ডা গলায় বলল, স্বীকারোক্তি দিলে, কিন্তু মার্জনার আর্জি তো করলে না?
জবাব দিল প্রসপেরো, ক্ষমা চাইনি। কারণ, প্যারেট্টার কাছে আগেই স্বীকার করেছি, যা করেছি তা ক্ষমার যোগ্য নয়। তবে পরিস্থিতি আর নিয়তি আমাকে দিয়ে সব করিয়ে নিয়েছে। আমি নিজেও জানি, অনুতাপ করার পক্ষেও অনেক দেরি করে ফেলেছি আমি। তাই শুধু আমার অপরাধের স্বীকারোক্তি দিতে এসেছি।
জিয়ান্নার মনে পড়ে গেল যে নেপলস থেকে ফেরার পর প্রসপেরো কেমন দ্বিধাগ্রস্ত ছিল। প্রসপেরোর ভিতর সেই কাব্যিক মানুষটাকে যেন খুঁজেই পাচ্ছিল না জিয়ান্না। তারপর হঠাৎ একদিন প্রসপেরোকে আবার আগের মানুষ হয়ে যেতে দেখেছে ও। বুঝতে পারল সেটা হয়েছে কার্ডিনালের সঙ্গে প্রসপেরো কথা বলার পরই। প্রসপেরো নিজের দোষের স্বীকারোক্তি দিয়ে যা-যা বলেছে তা সত্যিই বাস্তবতার সঙ্গে মিলে যাচ্ছে। বুঝতে পারল সত্যি কথাই বলেছে প্রসপেরো। তখন কথা বলল জিয়ান্না। কিন্তু অদ্ভুত শোনালেও আগের মতই শীতল জিয়ান্নার কণ্ঠ। বলল, আমার স্মৃতি তোমার ব্যাখ্যার পক্ষে কথা বলছে। বলে উঠে দুড়াল জিয়ান্না। হঠাৎ ওর চেহারায় ফুটে উঠল অনাবিল আনন্দ মাখা মিষ্টি একটা হাসি। বলল, বেচারা প্রসপেরো, তোমাকে মুখে ক্ষমা চাইতে হবে না, ক্ষমা পেয়ে গেছ। অঞ চলে এসেছে জিয়ান্নার চোখে। বলল, সব জানার পরও কীভাবে তোমাকে ফিরিয়ে দিই। আমার সুখ-শান্তি সব ধ্বংস হয়ে গিয়েছিল। ভেবেছিলাম মৃত্যুই আমার একমাত্র গতি। কিন্তু আজ তুমি আমার শান্তি ফিরিয়ে দিয়েছ।
জিয়ান্না, প্রসপেরোর মুখ দিয়ে কেবল এই একটা কথাই বের হলো। কিন্তু তাতে এমন এক হৃদয়বিদারী আকুতি ফুটে উঠল, যা ওর এতদিন ধরে লেখা সনেটগুলোর একটাতেও ফোটাতে পারেনি।
জিয়ান্নার মুখে হাসি, কিন্তু চোখে অশ্রু, আনন্দাশ্রু। অদ্ভুত দৃশ্যই বটে। ডাচেসের দিকে ফিরে ও বলল, কয়েকটা মুহূর্ত আমাদেরকে একলা থাকতে দেবেন?
কিন্তু ডাচেস তার দায়িত্ববোধ থেকে বলল, কেন? ওর মিষ্টি কথার প্রলোভনে পড়ে আবার ভুল করতে? প্রসপেরোর দিকে ফিরে কঠিন কণ্ঠে সে জিজ্ঞেস করল, মুর বন্দির কথা বলেছিলে। তার কী হলো?
জবাবে প্রসপেরো বলল, কেবল সেই মুর নয়, বরং যে ওয়ার্ডেন তাকে ছয় মাস ধরে বন্দি করে রেখেছে, সে-ও এসেছে সাক্ষ্য দিতে।
তীক্ষ কণ্ঠে ডাচেস জিজ্ঞেস করল, ছয় মাস? ঠিক কবেকার ঘটনা, ঠিক করে বলো।
গত নভেম্বরের প্রথম দিকে ওকে বন্দি করা হয়।
স্বস্তির দৃষ্টি ফুটে উঠল ডাচেসের চেহারায়। বলল, তাহলে এই কাজে ডোরিয়া কোনভাবেই সম্পৃক্ত নয়। কারণ তখন সে আমার সঙ্গে আকুইয়ে অবকাশ যাপন করছিল।
প্রসপেরোর মনে পড়ল যে ইয়াকুব বলেছিল, মুক্তিপণের চিঠিটা সে দিয়েছিল জিয়ানেট্রিনোর হাতে। তাই ডাচেসের কথা স্বীকার করল প্রসপেরো। তবে এটা মনে করিয়ে দিতে ভুলল না যে, আন্দ্রের ভাতিজারা তার ডেপুটি। ওরা আন্দ্রের হয়েই কাজ করছিল।
কিন্তু মাথা নেড়ে ডাচেস বলল, কিন্তু সবকিছুই তার হয়ে করেছে, এমনটা ভাবা ঠিক না।
বিনীত কণ্ঠে প্রতিবাদ করে প্রসপেরো বলল, কিন্তু তাদের মনোভাবে সবসময়ই মিল দেখেছি আমি।
জবাবে এবারেও মাথা নাড়ল ডাচেস। তারপর এক হাতে জিয়ান্নার কোমর পেঁচিয়ে ধরে ওকে কাছে টানল। তারপর বলল, এই বিষয়ে তর্ক করব না। বিষয়টি তর্কের দাবি রাখে না। তারপর একমুহূর্ত ইতস্তত করে বলল, আন্দ্রে, ফিলিপ্পিনো বা জিয়ানেট্টিনো, যে-ই কাজটা করুক, করেছে জিয়ান্নার কথা ভেবে। কারণ তারা জেনেছে ডোরিয়া পরিবারের সঙ্গে তোমার শান্তিচুক্তি ছিল স্রেফ লোক দেখানো হঠকারিতা। তবে আমি কাজটার পক্ষে সাফাই গাইছি না বা কাউকে দুয়োও দিচ্ছি না। তবে ভুলেও আশা কোরো না, এতসব ঘটনা ঘটার পরও জিয়ান্নাকে তুমি বিয়ে করতে পারবে। ডোরিয়ারা আর কখনোই তোমাকে বিশ্বাস করতে পারবে না। আর এজন্য তাদের দোষ। দেয়াটা অন্তত তোমার সাজে না।
প্রসপেরো বলল, আমি তা দিচ্ছিও না। অশান্তির নদীটা হঠাৎ অনেক বেশি চওড়া হয়ে গেছে। তীর বহুদূর। তবে জিয়ান্না যদি সম্মতি দেয়, তাহলে আবার বাগদান হতে পারে।
এই বাগদান হবে ডোরিয়া আর অ্যাডর্নো উভয় পরিবারের মধ্যে নতুন করে শত্রুতার দ্বার উন্মোচন।
পৃথিবীটা কেবল ডোরিয়া আর অ্যাডর্নোদের জন্য নয়। পৃথিবী আরো অনেক বড়। জিয়ান্না যা চাইবে তা-ই হবে।
জিয়ান্নার চোখে-মুখে একইসঙ্গে ফুটে উঠল হতাশা আর ভয়। ও বলল, চাচির কথা পুরোপুরি সত্যি। আমাদের বাগদান হলে তা তোমার আর আমার উভয়ের পরিবারের জন্যই ধ্বংসাত্মক একটা ব্যাপার হবে। মুখোমুখি দাঁড়িয়ে যাবে দুই পরিবার ও তাদের সমর্থকেরা। আর তুমি পড়ে যাবে এই দুই দলের মাঝে।
প্রসপেরো বলল, ওসব আমি সামলাতে পারি।
কিন্তু জিয়ান্না পারবে না, বলল ডাচেস। বাগদান বা বিয়ে হলে তোমার বিপদের বোঝা ওকেও বইতে হবে।
জিয়ান্না তখন বলল, আমি সেই ভয় পাচ্ছি না। কিন্তু পুরো ব্যাপারটা আমাকে ভীত করে তুলছে। প্রসপেরোরও ভয় পাওয়া উচিত।
ঠিক তখনই আরেকটা জরুরি খবর নিয়ে এল ডাচেসের চেম্বারলিন। বলল, তার সঙ্গে দেখা করার জন্য অপেক্ষা করছে ডোরিয়ার কাজিন লাম্বা ডোরিয়া। শান্ত কণ্ঠে তাকে ডাচেস বলল, অতিথিকে লং গ্যালারিতে নিয়ে যেতে। ওখানেই তার সঙ্গে দেখা করবে ডাচেস।
চেম্বারলিন চলে যেতেই এক দমে প্রসপেরোকে সে বলল, ওর সঙ্গে কোনমতেই তোমার দেখা হওয়া চলবে না। এমনকী সে যেন ঘুণাক্ষরেও এখানে তোমার উপস্থিতির ব্যাপারে সন্দেহ করতে না পারে।
প্রসপেরো প্রতিবাদ করতে যাচ্ছিল। কিন্তু ডাচেস ওকে থামিয়ে মনে করিয়ে দিল লাম্বার হিংস্র বদরাগী স্বভাবের কথা। বলল জিয়ান্নার আর ডাচেসের নিরাপত্তার স্বার্থে হলেও প্রসপেরো যেন এই মুহূর্তে প্রাসাদ ত্যাগ করে। এভাবেই সন্দেহ-সংশয়ের শেষ হলো সুন্দর একটা সমঝোতার মধ্য দিয়ে।
.
২২.
পলায়ন
লাম্বা ডোরিয়ার চেহারাতেই স্পষ্ট ফুটে আছে হিংস্রতার ছাপ। তার চুল আর দাড়ি দুটোই শেয়ালের মত লাল। দেখলে মনে হয় বুঝি আগুন ধরে আছে তার চুল-দাড়িতে। এতই চিকন আর পাতলা যে রীতিমত খুঁজে বের করতে হয়। ঘষা কাঁচের মত দুচোখ ঝকঝক করতে থাকে সবসময়। ছিটস্তের মত জ্বলজ্বলে দৃষ্টি ফুটে থাকে তাতে। লাম্বার বয়স এখনও চল্লিশ ছাড়ায়নি। মাঝারি উচ্চতা আর পেশিবহুল শরীরের অধিকারী সে। সৈনিকের পোশাক গায়ে চড়িয়ে এসেছে লাম্বা ডোরিয়া। তাতে স্টিল আর চামড়ার ছড়াছড়ি। স্বভাবজাত রাগ নিয়েই ডাচেসের সঙ্গে দেখা করতে এসেছে আজ।
প্রসপেরো চলে যাওয়ার পর গ্যালারি অভ হিরোজ-এ গেল ডাচেস। ওদিকে ডাচেসের দেরি দেখে রাগে ফুটন্ত তেলের মত টগবগ করছে সে। ওয়ার্ডেনের মুখ থেকে কথা ছড়িয়ে পড়েছে যে মৃত প্রসপেরো জীবিত হয়ে ফিরে এসেছে। খবরটা ডাচেসকে জানাতে এসেছে সে। সেইসঙ্গে তাকে হুকুম করতে এসেছে যে, উন্মাদ প্রসপেরো ভুলেও যদি ফসোলু প্রাসাদের দ্বার মাড়ায়, যে কোনভাবেই হোক, ওকে যেন আটকে ফেলা হয়। বাকি কাজ সারার জন্য ওরা তো আছেই। শুনেই ভীষণ রেগে গেল জিয়ান্না। রাগল ডাচেসও। শীতল বাষ্পের মত ভাপ ছড়াতে লাগল তার চেহারা। তবে এত সূক্ষ্ম ব্যাপার বোঝা লাম্বার মত শক্তিমদমত্ত স্থূল ব্যক্তিত্বের লোকের ক্ষমতার অনেক বাইরে।
ডাচেস জিজ্ঞেস করল, কতক্ষণ ওকে আটকে রাখব আমি?
কতক্ষণ? লর্ড গড! তুমি এই কথা বলছ, প্যারেট্টা? রাগে গনগন করতে করতে প্রশ্ন করল লাম্বা। বদমাশটাকে খোঁজা শুরু হয়ে গেছে। আমাদের বন্ধু আর আত্মীয়দের সবাই ওকে খুঁজে বেড়াচ্ছে। যতক্ষণ না ওকে কাফনের কাপড়ে পেঁচিয়ে ফেরত পাঠাতে পারি, এই শিকার অভিযান শেষ হবে না। ওকে খুঁজতে ওর বাড়ি পর্যন্ত গিয়েছিলাম। কিন্তু ওখানে বদমাশটা নেই। তবে যেখানেই ও নাক জাগাবে সেখান থেকেই ওকে ধরব, চিন্তা নেই। আমাদের পয়সায় ওর মৌজ করে বেড়ানোর দিন শেষ। জিয়ান্না, তোমার হয়েও আমরা প্রতিশোধ নেব, দেখে নিয়ে।
জিয়ান্না বলল, খুন করে শোধ নেবেন?
না, খুন নয়, মৃত্যুদণ্ড। সঙ্গে দর্শনীয় অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া? জবাব দিল লাম্বা ডোরিয়া।
ডাচেস হিংসাত্মক ব্যাপার দেখে অভ্যস্ত নয়। ফলে স্বভাবতই তার অন্তরাত্মা কেঁপে গেল। বলল, আমার মনে হয় না আন্দ্রে এসবের অনুমতি দেবে।
নেকড়ের মত হিংস্র হাসি ফুটে উঠল লাম্বা ডোরিয়ার মুখে। খুশিতে রীতিমত দাঁত বোরয়ে গেছে। বলল, তার অসম্মতি তো আগে থেকেই মৃত প্রসপেরোকে জীবিত করবে না।
ভুল বলোনি। কিন্তু তখন যারা জীবিত থাকবে তাদের উপর বিশাল ঝামেলা নেমে আসবে তা বুঝতে পারছ? আমি এই দলে শামিল থাকতে চাই না। কাজেই আমার কাছ থেকে কোন সাহায্য আশা কোরো না, বলল ডাচেস অভ মেলফি।
ভীষণ রেগে গিয়ে হাউমাউ জুড়ে দিল লাম্বা ডোরিয়া। ডাচেসের সঙ্গে কিছুক্ষণ হম্বিতম্বি করে বেরিয়ে গেল প্রসপেরোকে খুঁজতে।
ভীষণ বদরাগী হলেও নির্বোধ নয় লাম্বা ডোরিয়া। ফ্লাভিও ডোরিয়া নামের ডোরিয়া বংশের আরেকজন ও তার চার অমুসারীকে দলে ভিড়িয়ে নিয়েছে সে। শিকার করার জন্য ওরা বেছে নিয়েছে রাতের সময়টাকে। পরপর দুই রাত ধরে অ্যাডর্নো প্রাসাদের সামনে লুকিয়ে পাহারা দিল ওদের বসানো দুই গার্ড। দ্বিতীয় রাতে বিড়ালের ভাগ্যে শিকে ছিঁড়ল। ফাঁদ সম্বন্ধে অসচেতন প্রসপেরো তার নেভিগেটর ও বিশ্বস্ত ভূত্য ফেরুচ্চিয়োকে নিয়ে সোজা গিয়ে পড়ল লাম্বা ডোরিয়ার ফাঁদের ভিতর।
লাম্বার দলে লোকসংখ্যা ছয়। কিন্তু প্রসপেরোরা কেবল দুইজন। ফলে আক্রমণের হুকুম দিতে একমুহূর্তও দেরি করল না অতি আত্মবিশ্বাসী লাম্বা। ওদিকে অন্ধকার থেকে হঠাৎ হুঙ্কার ভেসে আসা আর ছুটন্ত দলটার হাতের নাঙ্গা তলোয়ার দেখেই যা বোঝার বুঝে নিল প্রসপেরো। প্রসপেরো আর ওর ভৃত্য দুজনেই অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত হয়ে বেরিয়েছে। ফলে ওরাও তলোয়ার খাপমুক্ত করতে দেরি করল না। দুজনেই দ্রুত দেয়ালের দিকে পিঠ ফিরিয়ে দাঁড়াল। তাতে অন্তত একদিক থেকে হামলার ভয় থাকল না।
প্রসপেরোর ভৃত্য ফেরুচ্চিয়ো কেবল একজন নেভিগেটর নয়। সময়কালে সে ছিল তুখোড় জলদস্যু। স্রেফ তলোয়ারবাজি করেই নিজের চামড়া আস্ত রেখেছিল তখন। কাজেই বলার অপেক্ষা রাখে না যে তুখোড় তলোয়ারবাজ এই লোক। এর বাইরেও আরেকটা অত্যন্ত দুর্লভ গুণ আছে তার। সেটা হচ্ছে বিপদ যত বড় হয়, ফেরুচ্চিয়োও ততটাই দৃঢ়তার সঙ্গে সেই বিপদের মুখোমুখি হয়।
লড়াইয়ের শুরুতেই তলোয়ারবাজিতে নিজের দক্ষতার নিদর্শন দেখাল ফেরুচ্চিয়ো। দেয়ালের দিকে পাশ ফিরে মালিকের সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে রক্ষণাত্মক পজিশন নিয়েছে ফেরুচ্চিয়ো। আক্রমণকারীর মুখোমুখি হয়ে প্রথম কোপেই কাঁধ থেকে এক আক্রমণকারীর হাত বিচ্ছিন্ন করে ফেলল ফেরুচ্চিয়ো। বিদ্রুপাত্মক কণ্ঠে অভিযোগ করল, মা মেরি, আর এই কয়জন মাত্র বাকি।
আহত লোকটি মাটিতে আছড়ে পড়ে তীব্র যন্ত্রণায় কাতরাচ্ছে। অন্য পাঁচজন আহত লোকটির আহাজারি শুনতে পেয়ে খানিকটা দ্বিধাগ্রস্ত হয়ে পড়ল। তখনই ওদের পেছন থেকে ভেসে এল আক্রমণ শানানোর কঠিন কমাণ্ড।
শোনা মাত্রই লাম্বার কণ্ঠ চিনে ফেলেছে প্রসপেরো। নিজের লোকদের চিৎকার করে এগিয়ে যেতে বলছে লাম্বা। তখনই হঠাৎ বিদ্যুৎবেগে নড়ে উঠল প্রসপেরো। ঠেকিয়ে দিল ফেরুচ্চিয়োর দিকে এগিয়ে আসা হামলার একটা ধাক্কা। ফেরুচ্চিয়োর উপর একযোগে আসা হামলাকারীদের দুই ভাগ করে দিল প্রসপেরো। মাটিতে পড়ে থাকা লোকটার গায়ের উপর দিয়েই প্রসপেরোর দিকে হামলা করল লাম্বা ডোরিয়ার লোকজন।
দৃঢ়তার সঙ্গে লড়াই চালিয়ে গেল প্রসপেরোরা। সেইসঙ্গে নজর রাখল, যেন হঠাৎ কেউ ঝাঁপিয়ে পড়ার সুযোগ না পায়। তলোয়ারে তলোয়ারে আর ড্যাগারে ড্যাগারে ঠোকাঠুকির তীক্ষ্ণ ধাতব শব্দে ভরে উঠেছে রাস্তা।
একসময় হামলার তীব্রতা একটু কমল। তবে পুরো থামল না। নীরবে সুযোগ মত কঠিন ধাক্কা দেয়ার চেষ্টা চালিয়ে যেতে লাগল আক্রমণকারীরা। কিন্তু এখনও দুই বদমাশকে নিকেশ করা যাচ্ছে না দেখে রাগ চড়তে শুরু করেছে লাম্বা ডোরিয়ার। এমন কিছু হতে পারে আশাই করেনি সে। তার পরিকল্পনা ছিল আচমকা ঝাঁপিয়ে পড়ে কিছু বোঝার আগেই ইহধাম থেকে বিদায় করে দেবে প্রসপেরোকে। কিন্তু ইতিমধ্যেই তার লোকজন অনেক বেশি সময় নিয়ে ফেলেছে। ঘরবাড়ির দরজার পাল্লা খোলা শুরু হয়ে গেছে। লোকজনও ডাকাডাকি শুরু করেছে। অন্ধকার রাস্তায় এসে পড়ছে বাড়িঘরের আলো। এবং কয়েক মুহূর্তেই আক্রমণকারীরাও বুঝল আরো দেরি করলে লোকজনের ঘেরের ভিতর পড়ে যাবে।
বাধ্য হয়ে নিজের লোকদের ফিরে আসার নির্দেশ দিল লাম্বা ডোরিয়া। সেইসঙ্গে শপথ করল, পরের বার এমন কিছু হবে না। নিজের কাজ সে ঠিকই শেষ করবে। ফেরুচ্চিয়ো যে লোকটার হাত কেটে ফেলেছিল তাকেও ওরা তুলে নিয়ে গেছে। কিন্তু যাকে প্রসপেরো আক্রমণ করেছিল, ফেলে গেছে তাকে। আলো আসতেই দেখা গেল রক্তের পুকুরে পড়ে রয়েছে লোকটা। যে কোন সময় মারা যাবে। আলো আরেকটু কাছে আসতেই দেখা গেল পড়ে থাকা লোকটি ফ্লাভিও ডোরিয়া। তবে তার এই দুরবস্থায় সমাগত জনতার কারো কাছ থেকেই সহানুভূতি পেল না সে। ভিড় থেকে রাগত এক বয়স্ক লোক বরং চিৎকার করে বলল, আততায়ীর উপযুক্ত শাস্তি হয়েছে। এই লোকটার মুখে যেন প্রকাশ পেল পুরো জনতার মনের কথা।
দম ফিরে পেতে যতক্ষণ লাগে ততক্ষণই ওখানে অপেক্ষা করল প্রসপেরো ও ফেরুচ্চিয়ো। তারপর সময়মত ওদের প্রাণ রক্ষার্থে এগিয়ে আসা জনতাকে ধন্যবাদ জানিয়ে রওনা হয়ে গেল ওরা। ফেচ্চিয়োর পরামর্শে বন্দরে নোঙর করে রাখা ফেলুকা গাটা-তে গিয়ে উঠল দুজনে।
ফেরুচিয়ে বলল, আমরা দুজনেই আজ প্রায় মরতে বসেছিলাম, লর্ড। স্যর লাম্বাকে আরেকটা সুযোগ দিলে ভাগ্যদেবী আজকের মত সদয় না-ও হতে পারে। তার শপথ তো নিজের। কানেই শুনলেন। লোকটা বড় রক্তপিপাসু। ফ্লাভিওর মৃত্যুতে দমে যাওয়ার পাত্র সে নয়। মাই লর্ড, যখন-তখন যেখানে-সেখানে এভাবে বের হবেন না।
রাতটা ফেলুকাতেই কাটাল প্রসপেরো। সকালে বেরিয়ে বন্দরে নামতেই দেখা হলো ওর নিজের এক লোকের সঙ্গে। সে ওকে জানাল, গতরাতে প্রসপেরোকে খুঁজতে অস্ত্রসজ্জিত একদল লোক নিয়ে ওর বাড়িতে গিয়েছিল লাম্বা ডোরিয়া। ওখানে ওকে খুঁজে না পেয়ে সে হামলা করেছে কার্ডিনালের ওখানে। কিন্তু ওখানে হালে পানি পায়নি সে। উল্টো জোর করে বাড়িতে ঢুকে পড়ার দায়ে লাম্বার বিরুদ্ধে কঠিন ব্যবস্থা নেয়ার হুমকি দেয় কার্ডিনাল। তখন তার ওখান থেকে ফিরে আসে লাম্বা ডোরিয়া। কিন্তু শপথ করে বলে আসে, যেখানেই প্রসপেরো লুকিয়ে থাকুক, সে ওকে খুঁজে বের করবেই। কারণ কীভাবে ওকে খুঁজে বের করতে হবে সেটা তার খুব ভালভাবে জানা আছে।
চিন্তা করতে বসল প্রসপেরো। ভেবে দেখল, এই মুহূর্তে জেনোয়ায় জরুরি কোন কাজ নেই ওর। কাজেই এখানে বসে থেকে প্রাণের ঝুঁকি নেয়ার কোন দরকারও নেই। যাত্রার জন্য সাপ্লাই জোগাড় করা ছাড়া আর দেরি করার কোন অর্থ হয় না। আরেকটা ব্যাপারও ভাবল যে, লাম্বা ডোরিয়াকে সামনাসামনি মোকাবেলার আহ্বান করে লাভ নেই। কারণ সামনাসামনি ওর মোকাবেলা লাম্বা কখনো করবে না। কিন্তু আরেকদল আততায়ীর সামনে পড়ার ইচ্ছাও প্রসপেরোর নেই।
এদিকে আবার তীরেও যেতেই হবে। কারণ যাত্রার জন্য সাপ্লাই কিনতে হলে টাকা চাই। তাছাড়া ওর মুক্তিপণের টাকাও মেটাতে হবে। এজন্য অবশ্য ফেরুচ্চিয়োকে রেখে যাওয়া ছাড়া উপায় নেই। একমাত্র ও-ই পারবে টাকাটা জায়গামত পৌঁছে দিতে। কাজেই বন্দরে ওকে পা রাখতেই হলো।
ভর দুপুর। মাথার উপর উদার হস্তে তাপ বিলাচ্ছে দুপুরের গনগনে সূর্য। এখন সিয়েস্তার সময় (সিয়েস্তা: ভাতঘুম। স্প্যানিশ ও ইটালিয়ানরা লাঞ্চের পর একটু ঘুমিয়ে নেয়। একেই সিয়েস্তা বলে।)। রাস্তাঘাটে লোকজন নেই বললেই চলে। যারা আছে তাদের আর কোথাও যাওয়ার জায়গা নেই। রাস্তাই তাদের বাড়ি। কাজেই রাস্তার উপরই ঘুমিয়ে আছে তারা। মাথায় চওড়া কার্নিশের একটা হ্যাট আর গায়ে ক্লেক চাপিয়ে ব্যাঙ্ক অভ সেইন্ট জর্জের উদ্দেশে রওনা হয়েছে প্রসপেরো। সঙ্গে নিয়েছে দুই ছোকরা ভৃত্যকে। কিন্তু ছদ্মবেশ থাকা সত্ত্বেও কিছু লোকের চোখে ঠিকই ধরা পড়ে গেল ও। কারণ এদিকে আসতে পারে ভেবে দুজন বস্তিবাসীকে আগেই বসিয়ে রেখেছে লাম্বা। ওদেরকে কথা দিয়েছে, যে আগে প্রসপেরোর খবর আনতে পারবে তাকে বিশ ডাকাট পুরস্কার দেবে সে। বলার অপেক্ষা রাখে না, গরীব লোকগুলোর কাছে বিশ ডাকাট বিশাল বড় একটা অঙ্ক।
প্রসপেরোকে যে প্রথমে দেখল বিনা দ্বিধায় ছুট দিল লাম্বাকে খবরটা দেবে বলে। লোকটা লাম্বা ডোরিয়ার বাড়ি পৌঁছে জানতে পারল সে বাড়ি নেই। শিকার মিশনে বাইরে গেছে। খবরটা শুনে পুরস্কার হারানোর ভয়ে বিচলিত হয়ে গেল সংবাদ বাহক। প্রসপেরোর অবস্থান ফাঁস না করে সে বরং জানতে চাইল কোথায় পাওয়া যাবে লাম্বা ডোরিয়াকে। তাকে জানানো হলো হয়তো ক্যারিগনানোর দিকে গিয়ে থাকতে পারে লাম্বা। কারণ সবাই ধারণা করেছ হয়তো ওদিকেই গেছে প্রসপেরো। হন্যে হয়ে প্রসপেরোকে খুঁজতে থাকা লাম্বা ডোরিয়া তখন চোখ বন্ধ করে ওদিকে ছুটে গেছে।
এদিকে সূর্য ডোবার আগেই শহরের এক-চতুর্থাংশ মানুষ জেনে গেছে যে, গতরাতে আততায়ীর হামলার পর ফেলুকাতেই রাত কাটিয়েছে প্রসপেরো। কিন্তু যে খবরটা ওরা জানতে পারেনি তা হচ্ছে, সাগরে ভাসার জন্য ফেলুকার প্রস্তুতি নেয়া শেষ।
সন্ধ্যা নাগাদ খবরটা লাম্বা ডোরিয়ার কানেও পৌঁছেছে। অর্থহীন খোঁজাখুঁজিতে ক্লান্ত, বিরক্ত ও হতাশ লাম্বা বসেছে ডিনার সারতে।
প্রায় একই সময়ে প্রসপেরোর ফেলুকায় রাত কাটানোর খবর ফসোলু প্রাসাদেও পৌঁছুল। খবর শুনেই উদ্বিগ্ন হয়ে উঠল ডাচেস। তৎক্ষণাৎ প্রসপেরোর কাছে খবর পাঠানোর জন্য দূতকে তৈরি হতে বলল সে।
ওদিকে প্রসপেরোকে খোঁজার জন্য হান্টিং পার্টি বের হবার খবর জিয়ান্নার কানেও পৌঁছেছে। তখন থেকেই ডাচেসের চেয়ে অনেক বেশি উতলা হয়ে আছে সে। দূত পাঠানোর খবর শুনে চাচির কাছে গিয়ে পড়ল সে। কিন্তু ডাচেস নিষেধ করতেই জিয়ান্না বলল, আর কাউকে আমি বিশ্বাস করতে পারছি না। স্রেফ এই বক্তপিপাসু লোকগুলোর ব্যাপারে সতর্ক করা ছাড়াও আরো কিছু কাজ আছে আমার। প্রসপেরোকে বোঝাতে হবে, এখানে ও মোটেও নিরাপদ না। এই মুহূর্তে জেনোয়া ত্যাগ করা উচিত ওর।
চিন্তিত দৃষ্টিতে জিয়ান্নার দিকে তাকাল প্যারেট্টা। বলল, বুঝতে পেরেছি। ঠিক আছে, যাও। ওকে বোঝাও, ও যেন অন্য কোথাও চলে যায়। অন্তত যতদিন আন্দ্রে ফিরে না আসে ততদিন যেন প্রসপেরো জেনোয়ায়, না ফেরে। আশা করি, আন্দ্রে ফিরলে শান্তিও ফিরে আসবে।
সূর্য ডোবার এক ঘণ্টা আগে ফসোলু প্রাসাদের পিছনের দরজা দিয়ে বের হলো একটা গাধাটানা গাড়ি। গাড়ির দরজা ভিতর থেকে বন্ধ করা। এটায়, করেই প্রসপেরোকে সাবধান করতে চলেছে জিয়ান্না। কিছুক্ষণের মধ্যে বন্দরে চলে এল গাড়িটা। দ্রুত পার হয়ে গেল নোঙর করে রাখা জনশূন্য ট্রাইরেম (তিন সারি দৗড়বিশিষ্ট দ্রুতগামী ছোট রণতরী) আর একটা মাছধরা নৌকা। নৌকাটায় গান গাইতে গাইতে জাল পরিষ্কার করছে কয়েকজন লোক। কিছুক্ষণের মধ্যেই জিয়ান্নার গাড়ি চলে এল বড়সড় একটা ফেলুকার সামনে।
পশ্চিম আকাশে লালিমা এখনও আছে। কিন্তু মাথার ওপরে আকাশ অন্ধকার হয়ে গেছে। গাড়ি থেকে নামল জিয়ান্না। তখনই দূর আকাশ থেকে ভেসে এল গর্জে ওঠা মেঘের গম্ভীর গুরু-গুরু ডাক। প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই নামল বড়-বড় বৃষ্টির ফোঁটা। পাথরের উপর পড়ে যেন বিস্ফোরিত হলো ডাকাটের সমান আকৃতির ফোঁটাগুলো। গ্যাংওয়ে ধরে প্রায় ছুটে ফেলুকায় উঠে এল জিয়ান্না।
ক্লোকে আবৃত অচেনা মানুষ দেখে তাকে চ্যালেঞ্জ করতে এল জাহাজের একজন নাবিক। তাড়াহুড়া করে কিছু একটা বলল জিয়ান্না।
জিয়ান্নার কণ্ঠ প্রসপেরোর কানেও গেছে। তখন জিয়ান্নার কথার জবাবে নাবিক লোকটা কিছু বলার আগেই টিবারনাকল থেকে বেরিয়ে এল প্রসপেরো। বৃষ্টির ছিটা থেকে বাঁচাতে জিয়ান্নাকে দ্রুত কেবিনে টেনে নিল সে। জিয়ান্না একটু ধাতস্থ হতেই ওকে স্টার্নে নিজের কেবিনে নিয়ে গেল প্রসপেরো।
জিয়ান্নাকে হঠাৎ এভাবে উপস্থিত হতে দেখে বেশ অবাক হয়েছে প্রসপেরো। মোটামুটি হতবুদ্ধি অবস্থা জিয়ান্নারও। কোনরকমে প্রসপেরো জিজ্ঞেস করল, কী এমন হলো যে তুমি নিজেই চলে এসেছ?
প্রসপেরোর ক্ষতি হবার ভয় এমনভাবে জিয়ান্নার ভিতর কাজ করেছে যে আগুপিছু না ভেবেই প্রসপেরোকে সাবধান করতে চলে এসেছে ও।
নতুন খবরগুলো প্রসপেরোকে জানাল জিয়ান্না। বলল, এই মুহূর্তে ও যেন সাগরে ভেসে পড়ে। অন্তত জেনোয়া ছেড়ে যেন চলে যায়। জিয়ান্নার ভীত ফ্যাকাসে মুখের দিকে চেয়ে স্মিত হাসল প্রসপেরো। হাসিমুখেই বলল, এই মুহূর্তটা সত্যিই আমার দারুণ লাগছে। মেসার লাম্বাকে ধন্যবাদ দিতেই হচ্ছে। তার জন্যই এভাবে তোমাকে দেখতে পেলাম।
জিয়ান্না ডিভানে বসেছে। আবেগঘন দৃষ্টিতে ওর দিকে তাকিয়ে আছে প্রসপেরো। প্রসপেরোর চোখের দৃষ্টিতেই বোঝা যাচ্ছে ভয়-ভীতি নিয়ে কোন চিন্তাই এখন ওর মাথায় নেই। ওর মাথায় এখন একটাই চিন্তা যে, লেডি অভ দ্য গার্ডেনকে সামনে পেয়েছে ও। জিয়ান্নার হাত ধরে প্রসপেরো বলল, বসো, বসে আগে একটু শান্ত হও, তারপর কথা বলল।
জবাবে জিয়ান্না বলল, তোমার উপর ডানা মেলে ঘুরছে। মৃত্যুর কালো ছায়া। এমন অবস্থায় কীভাবে আমি শান্ত হব? তোমার নিজেকে নিয়ে যদি চিন্তা না-ও হয়, অন্তত আমার কথা ভেবে সাবধান হও, আকুতি ফুটে উঠল জিয়ান্নার গলায়।
জিয়ান্নার পাশে বসে পড়ল প্রসপেরো।
জিয়ান্না আবার প্রশ্ন করল, বললে না, যাবে কিনা? আমাকে যদি একটুও ভালবাসো তাহলে এমন কিছু করো যাতে তোমাকে নিয়ে আর দুশ্চিন্তা করতে না হয়।
দ্বিধা ফুটে উঠল প্রসপেরোর চেহারায়। গভীর দৃষ্টিতে জিয়ান্নার চোখের দিকে তাকাল ও। স্পষ্ট পড়তে পারল মেয়েটার চোখে ফুটে থাকা আকুতি।
প্রসপেরো স্বীকার করল, হ্যাঁ, ব্যাপারটা নিয়ে আগেই আমি ভেবেছি। শুনে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল জিয়ান্না। প্রসপেরো বলে চলেছে, বের হওয়ার প্রস্তুতি আমি ইতিমধ্যে নিয়েও রেখেছি। ভাবছি স্পেনে চলে যাব। ওখানে আমার আশ্রয়দাতার অভাব হবে না। ডিভানের পাশে লোহা দিয়ে বাঁধানো একটা বাক্স দেখিয়ে জিয়ান্নাকে ও বলল, যথেষ্ট সোনাও জোগাড় করেছি…
প্রসপেরোর মুখের কথা কেড়ে নিয়ে জিয়ান্না বলল, তাহলে অপেক্ষা করছ কীসের জন্য?
কিছুক্ষণ আগেই রওনা হতাম। কিন্তু শেষ মুহূর্তে একটা কথা মনে হতেই থেমে গেছি। এখনো অনুমান করতে পারনি সেটা? বেশ বলছি। এত কিছু হওয়ার পর এখন তোমাকে ছেড়ে আমি চলে যেতে পারছি না।
খুন হওয়ার জন্য রয়ে গেছ। তুমি মারা গেলে কি আমার কোন উপকার হবে? লর্ড আন্দ্রে ফিরে না আসা পর্যন্ত অন্য কোথাও লুকিয়ে থাকো। উনি ফিরলেই আবার শান্তি আনার চেষ্টা করব। দেখো, তখন সব আবার ঠিক হয়ে যাবে।
মাথা নাড়ল প্রসপেরো। আন্দ্রে আর অন্যান্য ডোরিয়াদের খুব ভাল করেই চেনে ও। তাই ও বলল, ডোরিয়ারা আর কখনোই ওদের বিয়েতে সম্মতি দেবে না।
জবাবে জিয়ান্না বলল, ওদের সম্মতি আমার দরকার নেই। আমি ডোরিয়া ঘরে জন্মানো কেউ নই, কেবল একজন আশ্রিতা। আন্টি পেরেট্টার চাপে ডোরিয়া নাম নিয়েছি। এখন মনে হচ্ছে কাজটা না করলেই ভাল হত। এটাই সব সমস্যার মূল। কিন্তু আমি এখনও জিয়োভান্না মারিয়া মোনাল্ডি। আমার নিজের আর আমার স্বর্গীয় বাবা আমার জন্য যৎসামান্য যা কিছু রেখে গেছে তার মালিক আমি। তুমি যদি আর কখনো জেনোয়ায় ফিরতে না-ও পারো, তাহলেও কোন অসুবিধা নেই। আমিই তোমার কাছে চলে যাব, যেখানেই তুমি থাকো না কেন। কেউ আমাকে ধরে রাখতে পারবে না।
জিয়ান্নার বক্তব্য প্রসপেরোর মনের কথাটাকেই বলার পথ করে দিল। ও বলল, তাহলে এখনই আমার সঙ্গে চলো। এখনও কেউ তোমাকে বাধা দিতে পারবে না।
দম আটকে গেল জিয়ান্নার। চোখ বড়-বড় করে বিস্মিত ও জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল প্রসপেরোর দিকে।
জিয়ান্নার অবাক দৃষ্টির জবাবে প্রসপেরো বলল, আমি তোমাকে নিয়ে এখান থেকে চলে যাওয়ার স্বপ্ন দেখেছি। হঠাৎ তোমার চলে আসাটা আমার কাছে ছিল স্বপ্নপূরণের মত। সুযোগ থাকতেও আবার বিচ্ছিন্ন হওয়ার যন্ত্রণা আমরা কেন সইব? একমুহূর্ত থেমে তারপর ও আবার বলল, না, সইব না। সবই এখন তোমার হাতে। তুমিই বলো, আমি থাকব, না রওনা হব। তবে কিছু বলার আগে জেনে রাখো, তোমাকে ছাড়া কোথাও যাচ্ছি না আমি।
পাগল হলে, প্রসপেরো? বুঝতে পারছ কী বলছ তুমি?
বুঝেই বলছি। এই মুহূর্তে আমাকে বিয়ে করো তুমি। কার্ডিনাল চাচা আমাদের বিয়ে পড়াবে। সে যথেষ্ট সমঝদার মানুষ। আমাকে ভালবাসে। ডোরিয়াদের সে বিভ্রান্ত করতে পারবে। পরে তুমি লর্ডের সঙ্গে কথা বলে নিয়ো। না বললেও অবশ্য ক্ষতি নেই। বাকিটা এখন তোমার ইচ্ছা।
ঝুমঝুমিয়ে বৃষ্টি নেমেছে। জোরালভাবে কানে আসছে কেবিনের ছাদে বৃষ্টির বেসুরো ড্রাম পেটানোর আওয়াজ। দূর আকাশে কোথাও গুরুগম্ভীর শব্দে গর্জে উঠল বজ্রনির্ঘোষ। টিবারনাকলের ভিতরটা এত অন্ধকার হয়ে গেছে যে, কোনরকমে পরস্পরের চেহারা দেখতে পাচ্ছে দুজনে। প্রসপেরোর হাতে ধরা জিয়ান্নার দুই হাত। ও স্পষ্ট টের পাচ্ছে কেমন করে কাঁপছে জিয়ান্নার হাত দুখানা। ঠিক তখনই বাইরে থেকে আসা একটা কণ্ঠ শুনে চমকে উঠল দুজনেই। কণ্ঠটা বলছে, আলসের দল, গা নাড়া! সামনে যা, পাল ওঠা তাড়াতাড়ি।
সঙ্গে সঙ্গেই ওরা টের পেল পায়ের নিচে মেঝে নড়তে শুরু করেছে। অর্থাৎ বন্দর ত্যাগ করছে ওদের ফেলুকা। ছুটে বাইরে গেল প্রসপেরো। দেখল জেটি থেকে খুলে ফেলা হয়েছে মুরিং লাইন।
মালিকের অনুমতি না নিয়েই জাহাজ ছাড়ার হুকুম দিয়েছে ফেরুচ্চিয়ো। প্রসপেরো বাইরে আসতেই হঠাৎ তাড়াহুড়ো করে রওনা হওয়ার সাফাই দিল বিশালদেহী লোকটা। বলল, রিপায় ঈশ্বরের অশেষ কৃপায় একটা ওয়াইন শেল্টারে আশ্রয় পাই আমি। একদল গলাকাটা ডাকাত সঙ্গে নিয়ে ওখানে ঢোকে মেসাব লাম্বা। ওখানে সে ঢুকেছিল গাটা নামের ফেলুকা কোথায় ভেড়ানো আছে সেই খবর বের করতে। কে কী জবাব দিয়েছে তা শোনার জন্য আর অপেক্ষা করিনি। কোনরকমে ওখান থেকে বেরিয়ে সর্বশক্তিতে দৌড়ে এসেছি। তবে এত কিছুর পরও শেষ রক্ষা বোধহয় হলো না। লাম্বার গলাকাটা খুনির দল চলেই এসেছে।
ওর বাড়ানো হাত অনুসরণ করে বৃষ্টির ভিতরই প্রসপেরো দেখল দ্রুত এদিকে ছুটে আসছে জনা বারো লোক। দাঁড়াও, হুকুম করল প্রসপেরো। বলল, ওই কুত্তাগুলোর ভয়ে আমরা পালাব?
নয়তো কি ওদের হাতে মারা পড়ার জন্য দাঁড়িয়ে থাকব? বিশ্বাস করুন, ওদের ব্যাপারে ইতিমধ্যেই আমার বেশ জানা হয়ে গেছে। ওরা সংখ্যায় অনেক। মেসার লাম্বা ডোরিয়া কখনো ছোট দলে আসে না। বলেই খপ করে একটা কুঠার তুলে নিল ফেরুচ্চিয়ো। স্টার্নের দিকের মুরিং লাইন কাটার জন্য টিবারনাকল ঘিরে ছুট দিল ও। ছুটতে ছুটতেই বলল, কখনো জায়গায় দাঁড়িয়ে লড়াই করতে হয়, আবার কখনো পালাতে হয়। বিশ্বাস করুন, লড়াই ফেলে পালাবার বান্দা আমি না। ঠিক তেমনই পালাবার সময় যখন এসেই পড়ে তখন অযথা বীরত্ব দেখাতে গিয়ে প্রাণ খোয়াবার ঝুঁকিও আমি নিই না।
মুরিং লাইন কেটে যেতেই দুলে উঠে সামনে বাড়ল ফেলুকা। আর ঠিক তখনই ওখানে এসে পৌঁছুল লাম্বা ডোরিয়া। একবার মনে হলো জাহাজে ওঠার জন্য লাফ দেবে বুঝি সে। কিন্তু তীর আর জাহাজের ক্রমবর্ধমান দূরত্ব দেখে নিজেকে সামলাল। তারপর গালাগাল করতে করতে বলল, মনে করিস না যে পালাতে পেরেছিস, অ্যাডর্নো কুত্তা। তোকে খুঁজতে নরক পর্যন্ত যেতে হলে তাও আমি যাব। ওদিকে ওর গলাকাটার দল ততক্ষণে একটা মাছধরা নৌকার দড়িদড়া কেটে ফেলেছে। বলাই বাহুল্য, প্রসপেরোর ফেলুকাকে ধাওয়া করা ওদের উদ্দেশ্য।
ওদিকে ফেরুচ্চিয়োকে প্রসপেরো বলছে, দাঁড়াও, দাঁড়াও, জাহাজ ঘাটে ভেড়াতে হবে। এখানে একজন ভদ্রমহিলা আছেন। তাকে নামিয়ে দিতেই হবে।
ভদ্রমহিলা? শয়তানের নজর পড়ল নাকি? আগে ওই খুনে বদমাশগুলোকে খসাই, তার দেখা যাবে। তখন তাকে পোর্টোফিনোয় সান পিয়েরে ডি এরিনায় নামিয়ে দেব। অথবা যেখানে আপনি বলেন সেখানেই নামাব। তবে সে পর্যন্ত তাকে জাহাজেই থাকতে হবে।
গর্জে উঠে প্রসপেরো বলল, জাহাজ থামাও বলছি।
তখন ফেরুচ্চিয়োর সমর্থনে জিয়ান্না বলল, তোমার লোক ঠিকই বলেছে। ওই দেখো! প্রসপেরোকে পিছনে তাকাতে বাধ্য করল জিয়ান্না। বলল, লাম্বার বোট তোমাকে অনুসরণ করবে। এখন আর থামার উপায় নেই।
আমি পালাতে চাইছি না, বলল প্রসপেরো। মেজাজ তেতে আছে ওর।
তাহলে, ঈশ্বরকে ধন্যবাদ, অন্তত এখন তোমার নাবিক তোমার চেয়ে বুদ্ধির কাজ করেছে।
পাল খাটানো হয়ে গেছে। পালে বাতাস পেয়ে তরতর করে বাড়ছে ফেলুকার গতি। পিছনে মাছ ধরা নৌকার ওরা এখনও বোটের ট্যাকল খসানো নিয়েই ব্যস্ত। তবে যত তাড়াহুড়োই করুক, পাল খাটানো একটা ফেলুকার সঙ্গে ওই দাঁড়টানা নৌকা দিয়ে গতির দৌড়ে পেরে ওঠার প্রশ্নই আসে না।
অসন্তুষ্টি ঝেড়ে ফেলল প্রসপেরো। মুখে মৃদু হাসি নিয়ে জিয়ান্নাকে টেনে নিয়ে গেল ক্রমেই বাড়তে থাকা বৃষ্টির ছাঁটের বাইরে, অর্থাৎ টিবারনাকলের ভিতর। বলল, তেড়ে আসা কাউকেই আমি পরোয়া করি না। তবে যা হওয়ার হয়ে গেছে। তোমাকে সান পিয়েরে ডি এরিনায় নামিয়ে দেবখন। ওখান থেকেই ফলসালুতে তোমার পৌঁছার ব্যবস্থা করে দেয়া যাবে।
কিন্তু মানুষ ভাবে এক আর হয় আরেক। কোন ইঙ্গিত ছাড়াই এল তীব্র বাতাসের ঝাপ্টা। প্রথম ধাক্কাতেই বেসামাল করে দিল ওদের। সতর্ক হবার কোন সুযোগই ওরা পেল না। বাতাসের ঝাপ্টায় আস্ত একটা চক্কর কেটে ফেলল ফেলুকা। ফেরুচ্চিয়োর তড়িৎ পদক্ষেপে সেই যাত্রা বেঁচে গেল ওরা। নামিয়ে নেয়া হলো পাল। ফেলুকাটা নিয়ে খোলামকুচির মত খেলতে লাগল বিশাল ঢেউ আর তীব্র বাতাস।
ফেলুকার আগা থেকে গোঁড়া পর্যন্ত কড়কড়, মড়মড়, কাঁচকেঁচ করতে শুরু করল। ওদিকে বাতাসের চাপে একটা পাল খুলে গেছে। ভোলা পালে প্রচণ্ড বাতাস পেয়ে পাগলের মত ভোলা সাগরের দিকে ছুটল ফেলুকা। এত বড় বুকের পাটা কারোই নেই যে, এই প্রবল উত্তাল সাগরে হ্যারিকেনের মুখে ফেলুকার পিছু নেবে।
প্রসপেরোর ফেলুকাটা যথেষ্ট শক্তপোক্ত করে বানানো। কাজেই বাতাস আর ঢেউ সামনে থেকে এলে এটার কিছুই হবে না। তবে কিনা, এক ঈশ্বর ছাড়া আর কারো ইচ্ছাতেই বাতাস চলে না। তাই শেষ পর্যন্ত কোথায় গিয়ে ওরা থামবে সেটাই এখন প্রশ্ন। প্রসপেরোর দুঃখ হতে লাগল যে, এভাবে সাগরে বের না হয়ে লাম্বার ডাকাত দলের মোকাবেলা করলেই হয়তো ভাল হত।
.
২৩.
বন্দি
মেহেদিয়ায় নিজের শক্ত ঘাঁটি তৈরি করেছে দ্রাগুত। ওখানে বসেই সে খবর পেল বার্সেলোনা থেকে বিশাল এক নৌবহর রওনা হয়েছে। উদ্দেশ্য, ঈশ্বর আর মানুষের কাছে ঘৃণ্য জলদস্যু দ্রাগুতের ইহজীবনের অবসান ঘটানো। শুনে সুচালো দাড়িতে হাত বুলাতে বুলাতে হা-হা করে হেসে ফেলল সে। তার মনে পড়ে গেল শার্শেলে ওদের বিরুদ্ধে অভিযান চালিয়ে কীভাবে নাস্তানাবুদ হয়েছিল ফ্রাঙ্কিশরা (ডোরিয়ার বাহিনী)। মনে মনে সে বলল, এবার নিশ্চয়ই স্পেন সম্রাটের বিখ্যাত জেনারেল ডোরিয়া আরো বড় বাহিনী নিয়ে আসবে। আল্লাহ সর্বশক্তিমান। তিনি চাইলে আবারও পরাজিত হবে ডোরিয়া।
দ্রাগুতের পিঠটা হঠাৎ শক্ত হয়ে গেল। যেন তখনও সে ডোরিয়ার গ্যালিতে বাঁধা অবস্থায় ওয়ার্ডেনের চাবুকের আঘাত অনুভব করছে। এর শোধ নিতেই হবে। একবার সে ভাবল, ষাট সত্তর বছরের একজন লোককে শেকলে বেঁধে দাঁড় টানার জন্য বসিয়ে দেয়ার অর্থ তাকে মৃত্যুমুখে ফেলে দেয়া। তারপর ভাবল, আন্দ্রে একা দাঁড়ে বসবে না। সঙ্গে তার দুয়েকটা সাহায্যকারীকেও বসানো হবে। তার ভাতিজা নামের কলঙ্ক ওই দুই বদমাশকেও বসানো যেতে পারে। মুক্তিপণ হিসেবে যা-ই ওরা প্রস্তাব করুক, শাস্তি ওদের ভোগ করতেই হবে। ভেবে আনমনেই হেসে উঠল দ্রাগুত। তারপর বসল রণকৌশল ঠিক করতে। আল্লাহ চাইলে এবারই ওই অবিশ্বাসীদের কঠিন সাজা দিতে পারবে। কৌশল ঠিক করে সেটা বাস্তবায়নের রসদ জোগাড় করতে আলজিয়ার্সের উদ্দেশে সাগরে নামল রেইজ। উদ্দেশ্য বারবারোসাকে দলে ভিড়িয়ে নেবে।
কিন্তু আলজিয়ার্সে পৌঁছে সে জানতে পারল খায়ের-আদ দীনকে ইস্তাম্বুলে ডেকে পাঠিয়েছে স্বয়ং তুর্কি সুলতান সুলায়মান দ্য গ্রেট। কোনভাবে সুলায়মান জেনেছে বা ধরে নিয়েছে তার অ্যাডমিরালরা অতটা শক্তিশালী নয়। তাই বহরের শক্তি বৃদ্ধি করতে ডেকে পাঠিয়েছে খায়ের-আদ-দীনকে। তার প্রতি সুলতানের হুকুম, অনতিবিলম্বে গোল্ডেন হর্নে নিজের পুরো ফ্লিট নিয়ে হাজির হতে হবে। কারণ বিশাল ব্যাপ্তির এক নৌ অভিযান শুরু করতে যাচ্ছে সুলতান।
সুতরাং দ্রাগুতকে দেয়ার মত বাড়তি শক্তি এখন আর খায়ের আদ-দীনের হাতে নেই। দ্রাগুতকে এখন নিজেরটা নিজেকেই সামলাতে হবে। বারবারোসার মনে এতটুকুও সন্দেহ নেই যে, এমনকী কেবল নিজের শক্তি ব্যবহার করে হলেও ডোরিয়ার বিরুদ্ধে অনায়াসে জিতে যাবে দ্রাগুত।
যেহেতু স্বয়ং সুলতানের কাছ থেকে হুকুম এসেছে, তাই আর এ বিষয়ে কথা বলা অর্থহীন। আল্লাহর ইচ্ছার কাছে নিজেকে সমর্পণ করল দ্রাগুত। নিজেকে এই বলে সান্ত্বনা দিল যে মেহেদিয়ায় তার ঘাঁটি ভীষণ শক্তিশালী। সহজেই একে ধ্বংস করা যাবে না।
এই ধারণাই দ্রাগুত ধরে রাখত, কিন্তু মেহেদিয়া থেকে আসা একটা খবর তার প্রশান্তি নষ্ট করে দিল। সংবাদ বাহক জানাল মেহেদিয়ায় আক্রমণ করেছে ডোরিয়া। ওখানে দ্রাগুতকে খুঁজে না পেয়ে দুর্গে আগুন ধরিয়ে দিয়ে লোকজনের গলায় তলোয়ার বসিয়েছে সে।
খবরটা দ্রাগুতের মনে শেলের মত বিঁধল। ওর জন্য এটা ভয়াবহ একটা আঘাত। দ্রাগুতের উচ্চাকাঙ্ক্ষা, বারবারোসার মত স্বাধীন একটা রাজত্ব গড়বে সে। মেহেদিয়াই তার স্বপ্ন। বাস্তবায়নের কেন্দ্রবিন্দু। কিন্তু ডোরিয়ার আক্রমণে মেহেদিয়ার পতন ওর স্বপ্নটাকে স্রেফ ধসিয়ে দিয়েছে। ধোঁয়ার মত মিলিয়ে গেছে ওর নিজের স্বাধীন এলাকার স্বপ্ন।
খায়ের-আদ-দীন রওনা হওয়ার আগে দ্রাগুতকে বলে গিয়েছিল সতর্ক থাকতে। কিন্তু রাগের মাথায় সতর্কতা ভুলে গেল সে। মধ্য জুলাইয়ের কাঠ ফাটা গরম উপেক্ষা করে পুরো ফ্লিট সাগরে ভাসাল সে। দ্রাগুতের এই ফ্লিটে আছে তিনটা গ্যালিসে, বারোটা গ্যালি, আর পাঁচটা ব্রিগেন্টাইন। এমন না যে, ডোরিয়ার বিশাল বহরের বিরুদ্ধে বিরাট কিছু করে ফেলবে বলে মনে করছে দ্রাগুত। তবে সে আশা করছে অন্তত এমন কিছু সে করতে পারবে যাতে নিজেকে অন্তত সান্ত্বনা দিতে পারে। আর মেহেদিয়াকে ঝলসানোর শোধ অন্য কোথাও নেবে সে।
সুতরাং ডোরিয়া যখন দ্রাগুতের খোঁজে আফ্রিকার উপকূল চুষছে, তখন সিসিলিতে মাথা জাগাল দ্রাগুত। জিগেনেট্টি থেকে শুরু করল স্পেন-বিরোধী অভিযান। তা চালিয়ে গেল আরো উত্তরে একেবারে মার্শালা পর্যন্ত। পিছনে ফেলে গেল কেবল ধ্বংসের চিহ্ন।
এক সপ্তাহের মধ্যে দ্রাগুতের তাণ্ডবে ধ্বংস হলো ছয়টা নগর। আর ওর হাতে বন্দি হলো প্রায় তিন হাজার নারী ও পুরুষ। পুরুষদেরকে অবধারিতভাবে দাঁড়টানা দাস হিসেবে শেকলবন্দি জীবন মেনে নিতে হলো। নারীদের মধ্যে সুন্দরীদের ভাগ্যে নির্ধারিত হলো সুলতানের হারেম। আর বাকিদের ভাগ্যে রইল ব্রথেলের পঙ্কিল জীবন।
দ্রাগুত মনে মনে ভাবল ওকে জেনোয়িস কুত্তারা ডাকে ঈশ্বর আর মানুষের ঘৃণার পাত্র জলদস্যু দ্রাগুত নামে। এবার ওরা বুঝবে ওকে এই কুৎসিত নামে ডাকার ফল কী হতে পারে।
দুই ব্রিগেন্টাইন ভরে এই বন্দিদের আলজিয়ার্সের পথে পাঠিয়ে দিল সে। ওই জাহাজগুলোর দায়িত্ব দিল ইয়ারিন সাবাহ নামে তার এক ক্যাপ্টেনের হাতে। সে জাহাজ দুটোকে সৌক আল আবিদে নিয়ে যাবে। ওখানেই বিক্রি করবে ব্লন্দি করা দাসদেরকে। দাস বেচা পয়সায় কেনা হবে নতুন গ্যালি। সেগুলোর কীল (ঢেউয়ের মুখে জাহাজের ভারসাম্য বজায় রাখার জন্য ব্যবহৃত ওজন বিশেষ) নিচু করার পর গ্যালিগুলো যাবে জেবরা প্রণালীতে। সেখানেই ওর বহরের সঙ্গে মিলিত হবে নতুন এই গ্যালিগুলো। চিন্তাভাবনা করে দ্রাগুত সিদ্ধান্ত নিল, বহরে নতুন গ্যালিগুলো যুক্ত হওয়ার আগ পর্যন্ত সাবধানে থাকবে সে। তখন ওই এলাকায় আসা একটা গ্রিক জাহাজ থেকে খবর পেল, সিসিলিয়ান উপকূলে পাগলের মত ওকে খুঁজে চলেছে ডোরিয়া। খবরটা জানতে পেরে উত্তর-পশ্চিমে বোনিফেসের দিকে রওনা হলো দ্রাগুত। ওর ইচ্ছা আরেকটু সামনে গিয়ে আবার দক্ষিণে ফিরবে। ফলে বিশাল একটা এলাকা খুঁজতে হবে ডোরিয়াকে। বিস্তর সময় নষ্ট হবে তাতে। ওদিকে সিসিলিতে ডোরিয়ার কাজকর্মের রিপোের্ট অবশ্যই স্পেন সম্রাটের কাছে যাবে। মেহেদিয়াকে ধ্বংসের পর সে কী করেছে সেই প্রশ্ন তখন অবশ্যই উঠবে। সম্রাটই তখন প্রশ্ন করবে যে তার দামি এই অ্যাডমিরাল এই লম্বা সময়ে কাজের কাজ কী করল।
জুলাই মাসের সন্ধ্যা। ভাপসা গরম। গরমে মনে হচ্ছে জাহাজের গা থেকেও ঘাম ঝরছে। আকাশের রং কেমন যেন ঘোলা তামাটে হয়ে আছে। সাগরের শান্ত পানিতে আকাশের প্রতিফলনে মনে হচ্ছে সাগর আর আকাশ দুটোই যেন মিলেমিশে একাকার হয়ে গেছে। অন্ধকার হয়ে আসছে, ঘনিয়ে আসছে আঁধার কালো রাত। সাগর এতক্ষণ শান্ত থাকলেও এখন উত্তর পশ্চিম দিক থেকে ভেসে আসছে বাতাসের ঝাপ্টা।
নিজের ক্যাপিটানার টিবারনাকলে দাঁড়িয়ে আছে দ্রাগুত। তার এই জাহাজটা ভীষণ মজবুত ও সুসজ্জিত। পুপ হোলের পাশে দাঁড়িয়ে নাক উঁচু করে বাতাসের গন্ধ শুকল দ্রাগুত। হুকুম করল ক্যাপিটানার পালগুলো টাঙিয়ে দিতে। প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই একই কাজ করল তার অন্যান্য জাহাজগুলোও। কারণ ক্যাপিটানায় যা করা হয় সেটা অন্যান্য জাহাজের জন্যও হুকুম বলেই ধরে নেয়া হয়। আকাশের দিকে তাকিয়ে রইল দ্রাগুত। দেখতে লাগল তাম্র বর্ণের আকাশের প্রান্তে থাকা মেঘগুলো দ্রুত আরো ঘন হচ্ছে আর যেন এদিকেই ধেয়ে আসছে।
দেখতে দেখতে শুরু হলো প্রচণ্ড বজ্রপাত। মেঘের গায়ে যেন আগুন ধরে গেল। যমদূতের মত ধেয়ে এল ঝড়ো বাতাসের উন্মাতাল ধাক্কা। নিরেট একটা পর্দার মত অঝোর ধারায় পড়তে লাগল বৃষ্টি। বাতাসটা যেন দেখাতে চাইছে কতটা ধ্বংসাত্মক শক্তি আছে তার।
বাতাসের তীব্র ধাক্কা সইতে না পেরে কামানের গোলা ফাটার মত আওয়াজ করে ভেঙে পড়ল দ্রাগুতের জাহাজগুলোর একটার প্রধান মাস্তুল। সঙ্গে নিয়ে গেল ওই জাহাজের জনা বারো দাসের, প্রাণ। ঝড়ের তোড়ে দাসের ওয়ার্ডেনরা নিজেরাও ভাল করে দাঁড়াতে পারছে না। কিন্তু তবুও চাবুকের আঘাতে জর্জরিত করে দাসদেরকে দাঁড় বাইতে বাধ্য করছে তারা। আসলে ওরাও নিরুপায়। দাড়িরা একবার হাল ছেড়ে দিলে জাহাজের মুখ ঘুরে যাবে। আর ঝড়ের দিক থেকে একবার মুখ ঘুরে গেলেই জাহাজের উল্টানো অবশ্যম্ভাবী।
ওদিকে সাগর ক্রমে উত্তাল থেকে আরো বেশি উত্তাল হতে লাগল। শেষে ডেকের উপর উঠে আসতে লাগল বিশাল সব ঢেউ। দাঁড়িদের বসার নিচু জায়গাগুলো ভরাট হয়ে যেতে লাগল সেই পানি দিয়ে। এরমধ্যেই বিষম খেতে খেতে যন্ত্রের মত দাঁড় বেয়ে চলল ওরা। সাগরের বুকে ঝাবিক্ষুব্ধ রাত্রি। তীব্র বাতাসের হুঙ্কার, গম্ভীর গর্জনে আত্মা কাঁপিয়ে দেয়া বজ্রনিনাদ আর উন্মত্ত সাগর, সব মিলে বর্ণনাতীত ও প্রলয়ঙ্কর এক রাত। কালো একটা চাদরের মত ওদের ঘিরে রেখেছে অন্ধকার। এর মাঝে হঠাৎ হঠাৎ বজ্রঝলকে কোনরকমে দেখা যাচ্ছে ঝড়ের বিরুদ্ধে ধুকতে ধুকতে চলছে অন্য গ্যালিগুলো।
ক্যাপিটানার পুপ হোলে তিনটা লণ্ঠন জ্বালিয়ে রাখা হয়েছে। ঢেউয়ের দোলায় জাহাজের সঙ্গে ওগুলোও সমান তালে দুলছে। লণ্ঠন ঝোলানোর উদ্দেশ্য অন্য জাহাজগুলোকে দিক প্রদর্শন করা। সেইসঙ্গে দ্রাগুতের ক্যাপিটানা থেকে নিয়মিত বিরতিতে কামানও দাগা হচ্ছে, যাতে এই ঝাবিক্ষুব্ধ সাগরে গ্যালিগুলো তাকে অনুসরণ করতে পারে।
কিন্তু এত কিছুর পরও দেখা গেল দলছুট হয়ে গেছে একটা গ্যালি। সেটা অবশ্য সঙ্কেত দেখতে না পারার কারণে না। ওই গ্যালির ক্যাপ্টেন ইচ্ছাকৃতভাবে ক্যাপিটানার হুকুম লঙ্ন করেছে।
ঝড়ের প্রথম ধাক্কায় এই গ্যালিটাই তার মূল মাস্তুল হারিয়েছে। এর কমাণ্ডে রয়েছে খোঁজা সিনান আল শানিম। দ্রাগুত তার সমস্ত ক্যাপ্টেনের চেয়ে একেই মূল্য দেয় বেশি। কারণ এখন পর্যন্ত তার অসফল হবার কোন রেকর্ড নেই। এবং সুযোগ চিনতে তার কখনো ভুল হয় না বললেই চলে। ঝুঁকি এড়িয়ে কাজ সারতেও সে ভীষণ পটু। আর বিপদ যদি একান্তই না এড়ানো যায় তাহলে ওর মত দৃঢ়চিত্ত হয়ে বিপদের মুখে বুক চিতিয়ে আর কেউ দাঁড়ায় না।
অবশ্য এমনও হতে পারে যে, মূল মাস্তুল না থাকায় জাহাজের নিয়ন্ত্রণ হারিয়েছে সিনান। আর ওই কালিগোলা অন্ধকারে অন্য জাহাজ দেখতে না পারাটা খুব যে অস্বাভাবিক তাও বলা যাবে না। কাজেই ঝড়ের ধাক্কায় একটা জাহাজ দলছুট হয়ে যেতেই পারে। তবে কারণ যা-ই হোক, মূল কথা হচ্ছে দলছুট হয়ে গেছে সিনান।
সিনানের দৃষ্টিতে দুয়েকটা ব্যাপার দ্রাগুতের নজর এড়িয়ে গেছে বা সে ইচ্ছা করেই ব্যাপারটা এড়িয়ে গেছে। তার মধ্যে একটা হচ্ছে, বাতাসের আগে আগে থাকছে ওরা। ফলে একসময় ওরা ঝড়ের নিচে চলে যাবে। তখন অবশ্যম্ভাবীভাবে ওদেরকে ক্যারিবিয়ানের দিকে ঠেলে নেবে ঝড়টা। সম্ভবত ওখানেই আছে ওদের পিছু ধাওয়াকারী ডোরিয়ার নৌবহর। কাজেই ঝড় আর ধাওয়াকারী এই দুই মহাবিপদের হাত থেকে বাঁচতে হলে সিনানের মতে ওদের উচিত আগের কোর্সে ফিরে যাওয়া। দাঁড়িদের যে মূল্যই চুকাতে হোক, ওদের উচিত বাতাসের দিকে মুখ করে যাওয়া। বাতাসের দিকে পেছন ফিরে নয়। আর বাতাসের বাধা কেটে এগিয়ে যেতে পারলেই সার্ডিনিয়ান উপকূল ছুঁতে পারবে ওরা। ওদিকে ডোরিয়া নেই। অন্তত যে-কোন মূল্যে ওদের উচিত ডোরিয়ার সঙ্গে মুখোমুখি হওয়ার ঝুঁকি এড়ানো।
সিনানের মতে যেহেতু এই পথটাই সবচেয়ে উপযুক্ত তাই জাহাজের সর্বার প্রতিবাদ সত্ত্বেও এই কোর্সেই রওনা হলো সে।
জাহাজের সবাই মৃত্যুর চেহারা খুব কাছ থেকে দেখল। জাহাজ ঘোরানোর সময় পাশ থেকে আঘাত করল পাহাড়ের মত উঁচু আর কালির মত অন্ধকার বিশাল এক ঢেউ। প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই একই আকৃতির আরেকটা ঢেউ আছড়ে পড়ল জাহাজের উপর। পানির আঘাতে মাস্তুলের উপর আছড়ে পড়ে চিড়ে-চ্যাপ্টা হয়ে গেল এক লোক। তাৎক্ষণিক মৃত্যু হলো তার। আরো দুজনকে ভাসিয়ে নিয়ে গেল ডেকের উপর দিয়ে চলে যাওয়া ঢেউয়ের স্রোত। ডেকের উপর থেকে পানি সরতেই দেখা গেল গায়েব হয়ে গেছে একজন ওয়ার্ডেন। আর দাসদের সারিতে অজ্ঞান হয়ে বসে আছে একজন দাঁড়টানা দাস। দাঁড়ের ধাক্কায় পাঁজরের হাড় ভেঙে গেছে লোকটার। তবে জাহাজের গঠন ভীষণ মজবুত। আর হোল্ডেও পানি ঢোকেনি। ফলে উত্তাল ঢেউয়ের নিচে তলিয়ে গেলেও সঙ্গে সঙ্গেই আবার ককের মত লাফিয়ে ভেসে উঠল জাহাজটা। পরমুহূর্তেই জাহাজকে নিয়ে খোলামকুচির মত খেলতে লাগল বিক্ষুব্ধ সাগর। পুরোপুরি ঘোরার আগে এমন আরো একটা ঢেউয়ের ধাক্কা সহ্য করতে হলো সিনানের জাহাজকে।
ওদিকে ততক্ষণে দক্ষিণ-পূর্বে এক মাইলের বেশি দূরে চলে গেছে দ্রাগুতের জাহাজ-বহর। নিজেকে একা বলে মেনে নিল সিনান। তীব্র উত্তেজনা, ভয় আর প্রবল অ্যাড্রিনালিনের চাপে কাঁপতে থাকা সিনানের শরীরটাও যেন এতক্ষণে একটু স্থির হবার সুযোগ পেয়েছে। বাকি সবাই ভয় পেয়েছে অবশ্যই, কিন্তু সিনানের মত ভয় আর কেউ পায়নি। কারণ কমাণ্ডারের হুকুম ভঙ্গ করার দায় এককভাবে তার উপরই গিয়ে পড়বে।
ঝঞ্ঝাবিক্ষুব্ধ সেই রাত পার হবার আগে হাজারবার যেন নিজের মৃত্যু দেখল সিনান। বর্তমান কোর্সে চলার আইডিয়া বের করায় নিজেকেই নিজে অভিশাপ দিয়ে চলেছে সে। এতদিন ধরে সাগরে থাকার পরও সাগরের ঢেউয়ের সঙ্গে নিজের পাকস্থলিটাকে মানাতে পারেনি সিনান। জাহাজ যতক্ষণ চলেছে, আরেকজনকে হেলমের দায়িত্ব দিয়ে নিজে টিবারনাকলে গিয়ে শুয়ে থেকেছে ডিভানের উপর। জাহাজ যখন ঢেউয়ের চূড়ায় গিয়ে উঠেছে পেটের ভিতর কাঁপুনি ধরে গেছে তার। আবার যখন ঢেউয়ের চূড়া থেকে খাদের মত গভীর ঢেউয়ের ভিতর পতন শুরু হয়েছে তখন শরীরের শিরশিরানিতে চিংড়ির মত বাঁকা হয়ে পড়ে গেছে সে। কাঁপুনির চোটে এমন ঘাম ছুটেছে যে, কেউ দেখলেই ভাবরে মাত্রই বুঝি গোসল করে উঠল। ওর কাঁপুনির মাত্রা আরো বাড়িয়ে দিয়েছে তীব্র বাতাসের গোঙানি, ঢেউয়ের ধাক্কার প্রতিবাদে জাহাজের কাঠের জোড়াগুলোর কাঁচকোচ শব্দ, ডেকের উপর বারবার আছড়ে পড়া বজ্রনির্ঘোষের মত ঢেউয়ের গর্জন, একঘেয়ে একটানা দাঁড়ের শব্দ আর সবকিছু ছাপিয়ে চাবুকের আঘাতে জর্জরিত ও ঢেউয়ের অত্যাচারে কাতর দাসদের আর্তনাদ। বলা যায়, সব মিলে সিনানের অবস্থা খুবই খারাপ।
যা হোক, সারা রাত এত পরিশ্রমের পরও ওরা খুব একটা এগুতে পারেনি। বরং বলা ভাল, কোনমতে নিজেদেরকে এক জায়গায় ধরে রাখতে পেরেছে শুধু। সকালে ঝড় কেটে যাওয়ার পর সার্ডিনিয়ার মন্টি সেভেরোর চূড়া দেখতে পেল সিনান। ভাল করে আলো ফোঁটার পর আরো একটা জিনিস দেখতে পেল ওরা। এক মাইলেরও কম দূরে সাগরে অসহায়ভাবে ভেসে চলেছে। সবুজ-সাদা রঙ করা একটা ফেলুকা। বলার অপেক্ষা রাখে না, ওটার বর্তমান দুরবস্থা ও অসহায়ত্বের কারণ গতরাতের ঝড়।
খবর পাওয়ার কোন সুযোগই কখনো হাত ফসকে যেতে দেয় না সিনান। এবারও তার ব্যতিক্রম হলো না। সাগরে ঢেউগুলো এখনও যথেষ্ট বড়, তবে বাতাস পড়ে গেছে। ঝড়ো বাতাসের বদলে বইছে মৃদুমন্দ সমীরণ। কাজেই বাতাসের সাহায্য যা পাওয়া যায় তা পালে নিয়ে আর বাকি শক্তিটুকু চাবুকের জোরে দাড়িদের কাছ থেকে আদায় করে চলছে সিনানের গ্যালি। সিনানের নির্দেশে গ্যালির মুখ এক পয়েন্ট সরিয়ে সোজা ফেলুকাটার দিকে মুখ ঘোরাল হেলমসম্যান।
একটা জাহাজকে এগিয়ে আসতে দেখে ফেলুকায় যেন একটু প্রাণচাঞ্চল্য দেখা দিল। নড়েচড়ে উঠল দুয়েকজন। ফেলুকার অগভীর কাঠামো থেকে মাথা জাগাল একজুন। স্টার্নে কেবিন থেকে আরেকজন মাথা বের করল। দেখতে তাকে লাগছে ঠিক খোয়াড় থেকে মাথা বের করে থাকা কৌতূহলী একটা মুরগীর মত। আর বললাম বটে যে, ফেলুকায় চাঞ্চল্য এসেছে, তবে বাস্তবে খুবই মন্থরভাবে কোনমতে নড়ছে তারা। যেন ঝড়ের রেশ এখনও ওই লোকগুলোর মাথা থেকে কাটেনি।
ফেলুকা থেকে সিনানের গ্যালি আর মাত্র দশ-বারো গজ দূরে। এমন সময় ফ্রেঞ্চ ভাষায় ফেলুকাকে গ্যালির পাশে ভেড়াতে হুকুম করল সিনানের বিশালদেহী কাইয়া হিসার। ভেড়ানো ছাড়া ফেলুকার আর কোন উপায় নেই।
দুজন লোক নিয়ে লাফিয়ে ফেলুকায় নামল হিসার। ওদের রুখতে ফেলুকা থেকে উঠে দাঁড়াল পাঁচজন লোক। তবে ওই লোকগুলোর অবস্থাও করুণ। দেখেই মনে হচ্ছে স্রেফ ভয় তাড়াতে পারছে না বলেই জেগে আছে এরা। নয়তো বহু আগেই বেহুঁশ হয়ে যেত। লোকগুলোর উপর দিয়ে ঘুরে এল হিসারের তীক্ষ্ণ দৃষ্টি। দেখল কেবিনের সামনে দাঁড়িয়ে থাকা মলিন চেহারার মহিলাটিকেও। হিসার মনে মনে আল্লাহকে ধন্যবাদ দিল যে, খ্রিস্টান নারীদের মধ্যে চেহারা ঢেকে রাখার নিয়ম প্রচলিত নয়। নইলে এই সৌন্দর্য দেখার সুযোগ কখনোই হত না।
সামনে দাঁড়িয়ে থাকা লোকটিকে হিসার জিজ্ঞেস করল, কে আপনি?
উত্তরদাতার সাজ-পোশাক আর ব্যক্তিত্ব দেখে হিসার ধারণা করে নিল সে অবশ্যই গুরুত্বপূর্ণ কোন লোক। তরে অন্য নাবিকদের মত এই লোকটির চেহারাতেও তীব্র ক্লান্তির ছাপ। লোকটি হিসারকে উত্তর দিল, আমি জেনোয়ার প্রসপেরো।
দ্রাগুতের এমন কোন অফিসার নেই যার কাছে এই নাম অপরিচিত। চোখ কপালে তুলে সে প্রশ্ন করল, এমন দুর্গত অবস্থায় যাচ্ছেন কোথায়, মেসার প্রসপেরো?
প্রসপেরো বলল, সত্যি বলতে, জানি না কোথায় যাচ্ছি।
তাহলে আমাদের সঙ্গে চলে আসুন। আমরা আপনাকে আপনার কোর্সে পৌঁছে দেব, একগাল হেসে বলল হিসার।
আপনি দয়ালু, কিন্তু আপনার সহৃদয়তার দুরোপযোগ করতে চাই না। বাতাস বইতে শুরু করেছে। আমরাই আমাদের কোর্সে চলতে শুরু করতে পারব।
আমাদের সঙ্গে আপনি কিন্তু নিরাপদ থাকতে পারতেন, বলল হিসার।
এতসব কথোপকথনের পরিণতি কী হবে সে সম্বন্ধে প্রসপেরোর মনে বিন্দুমাত্রও দ্বিধা নেই। মুসলিমদের হাতে বন্দি হতে ওর নিজের অসুবিধা নেই। কারণ দ্রাগুতের হাতে আগেও ওর বন্দি হওয়ার অভিজ্ঞতা আছে। কিন্তু জিয়ান্নাও ওদের হাতে বন্দি হবে এই চিন্তাটা ওকে কাঁপিয়ে দিচ্ছে। লাম্বার হাত থেকে বাঁচাতে গিয়ে ওদেরকে হিসারের হাতে এনে ফেলেছে ফেরুচ্চিয়োর হুট করে সাগরে ভাসার সিদ্ধান্ত। লাম্বার ডাকাত দলের সঙ্গে একশবার মোকাবেলা করাও জিয়ান্নাকে নিয়ে এই পরিস্থিতিতে পড়ার চেয়ে অনেক ভাল। এসব ভাবতে ভাবতে আনমনেই তলোয়ারের বাটে হাত দিয়ে ফেলল প্রসপেরো।
হিসারের হিসেবে যথেষ্ট ভদ্রতা করা হয়ে গেছে। ওদিকে প্রসপেরো খাপ থেকে ওর তলোয়ার এক ইঞ্চিও বের করার আগেই গলায় ঝোলানো বাঁশি তুলে তাতে ফুঁ দিয়ে দিল হিসার। সঙ্গে সঙ্গেই স্রোতের মত লাফিয়ে ফেলুকায় নামল সিনানের এক ঝাঁক নগ্নপদ নাবিক রা সৈন্য। মানুষ ওখানে এত বেশি হয়ে গেল যে লড়াই করা দূরে থাক, নড়ারই আর উপায় রইল না। শেষে লোক-লস্করসহ গ্যালিতে তুলে নেয়া হলো প্রসপেরোকে।
জিয়ান্নার সঙ্গে ভদ্র আচরণই করল কোর্সেয়ার। ভয় পেয়ে থাকলেও সেটা ভালভাবেই আড়াল করে গেল জিয়ান্না। কোর্সেয়ার হিসারের প্রতি যতই বিরূপ মনোভাব পোষণ করুক, সেটাও নির্লিপ্ততার আড়ালে লুকিয়ে গেল ও। জিয়ান্নাকেও গ্যালিতে তুলে নেয়া হলো এবং স্থান দেয়া হলো টিবারনাকলে। পায়ের উপর পা তুলে বসে আছে ও। আর ওর সামনে বসা লোকটাকে দেখে মনে হচ্ছে স্বর্ণের সুতোয় এমব্রয়ডারি করা স্কারলেট আর কোর্তা পরিহিত গোলাকার একদলা মাংসপিণ্ড। এই লোকটিই সিনান আল শানিম ওরফে সিনান রেইজ।
সিনানের মাথার পাগড়িটার রং কোন একসময় সাদা ছিল। কিন্তু এখন সেটা বিবর্ণ হতে হতে অসুস্থরকম ময়লা হলদেটে হয়ে গেছে। লোকটার চেহারা চর্বিসর্বস্ব ও ফ্যাকাসে। বেমানান কুতকুঁতে ছোট চোখ দুটো তার চেহারায় এনে দিয়েছে কেমন একটা শূকরসুলভ আবহ।
সিনানের দুচোখ যেন গিলে খাচ্ছে জিয়ান্নার ফর্সা তনুশ্রী। হঠাৎ সে জিয়ান্নার দিক থেকে ফিরে তাকাল নাবিকদের বয়ে আনা ভীষণ ভারী একটা সিন্দুকের দিকে। সিন্দুকের ডালা খুলল হিসার। দেখা গেল চকচকে সোনালি ডাকাট দিয়ে ভরা সিন্দুকটা। সিন্দুকের ভিতর হাত ঢুকিয়ে দিল সিনান। তুলে আনল মুঠো ভরা সোনালি ডাকাট। শরীরের তুলনায় অদ্ভুতরকম চিকন কণ্ঠস্বর তার। চিকন গলায় আরবিতে কিছু একটা হুকুম করল সে। প্রসপেরোর ধনভাণ্ডার স্থান পেল সিনানের টিবারুনাকলের এক কোণে। লাগিয়ে রাখা হলো সিন্দুকের ডালা।
এরপরে লেডির গলায় ঝোলানো মহামূল্য মুক্তোর মালার দিকে সিনানের দৃষ্টি আকর্ষণ করল হিসার। ওটা এতই মূল্যবান যে, কোন প্রিন্সের মুক্তিপণও ওটা দিয়ে পরিশোধ করা সম্ভব।
হিসারের অনুরোধ অনুমোদন করল সিনান। সঙ্গে সঙ্গে দাঁত কেলিয়ে মেকি ক্ষমা প্রার্থনার হাসি দিল হিসার। এবং উপহাসের হাসি হাসতে হাসতেই জিয়ান্নার গলা থেকে মুক্তোর মালাটা খুলে নিল সে।
মালাটার জন্য কষ্টে জিয়ান্নার বুক ফেটে যাচ্ছে। তবে কোন শব্দ ওর মুখ থেকে বের হলো না। যদিও ওটা খুলে নেয়ার সময় ওর ধৈর্য আর সংযমের বাঁধ ভেঙেই যাচ্ছিল প্রায়। এই মালার সঙ্গে জিয়ান্নার বহু স্মৃতি জড়িত। প্রসপেরো যেদিন জিয়ান্নার বাগানে আশ্রয় পেয়েছিল সেদিন ওর গলায় ছিল এই মালা। সেই দিনের স্মৃতির সম্মানে প্রসপেরোর সঙ্গে বাগদানের দিনও এই মুক্তোর মালাটা পরেছিল জিয়ান্না। আজ এত, মূল্যবান স্মৃতিবিজড়িত হার খোয়াতে হওয়ায় ভীষণ কষ্ট পাচ্ছে ও।
ইটালিয়ান ভাষায় কথা বলে উঠল সিনান। বলল, এত্তো মূল্যবান মুক্তোর হার যার কণ্ঠে ঝোলে সে সাধারণ কেউ হতেই পারে না। কার পদধূলি পড়ে তার গ্যালি সম্মানিত হলো তা জানতে চায় সে।
উত্তর দিতে মোটেও দ্বিধা করল না জিয়ান্না। কারণ ও ভেবেছে পরিচয় পেলৈ ওর গুরুত্ব বুঝতে পারবে এই লোক। দৃপ্ত কণ্ঠে জিয়ান্না বলল, আমি লর্ড ডোরিয়ার ভাতিজি। আমাদের সঙ্গে দুর্ব্যবহার করার আগে অবশ্যই কথাটা মাথায় রাখবেন।
শুনেই চিন্তাশূন্য হয়ে গেল সিনানের মাথা। পরমুহূর্তেই নিজেকে সামলে নিল সে। কুটিল হাসি ফুটে উঠল তার মুখে। হাসির চোটে তার মাংসল গালের ভাঁজে চোখ দুটো আড়াল হয়ে গেল।
বলল, আল্লাহর লীলা কেবল আল্লাহই জানে। হিসারকে ডেকে আরবিতে আবার কী যেন বলতে লাগল সে। একইসঙ্গে জিয়ান্নার পা থেকে মাথা চোখ বুলাতে লাগল। তার দৃষ্টিতে ফুটে উঠল ঘৃণা আর মুখে রইল কুটিল হাসি।
সিনান থামার পর হিসৗর গিয়ে ডেকের ওপরের একটা ঢাকনি খুলল। স্পষ্ট বোঝা গেল সেটা ডেকের নিচের বদ্ধ একটা কেবিন। উপহাসমূলক, অতি-সৌজন্য সহকারে লেডিকে ওই কেবিনে ঢুকতে ডাকল হিসার। আঁতকে উঠল জিয়ান্না। অজান্তেই এক কদম পিছিয়ে গিয়ে শক্ত হয়ে জায়গায় দাঁড়িয়ে পড়ল। মুহূর্তখানেক পর মেনে নিল, এদের সঙ্গে লড়ে ক্ষতি ছাড়া লাভ নেই। নিজের সম্মান বজায় রেখে গাম্ভীর্যের সঙ্গে ধীর কদমে হেঁটে গিয়ে ঢুকে পড়ল ওই কুঠুরির ভিতর। মাথার উপর বন্ধ হয়ে গেল সিন্দুকের মত কেবিনের ডালা। মেনে নিল জিয়ান্না, ভাগ্যে যা আছে, তা-ই হবে।
.
২৪.
সুলায়মানের জন্য উপহার
যেখানে প্রসপেরোকে ফেলে রাখা হয়েছে ওখানেই পড়ে আছে ও। মুসলিম নামের কলঙ্ক, বদমাশগুলোর হাতে জিয়ান্নার কী অবস্থা হবে ভেবে হতবিহ্বল হয়ে পড়েছে ও। আর সিনানের লোকদের মিষ্টি ব্যবহারে স্থাণুর মত হয়ে গেছে প্রসপেরেরা।
গরুর চামড়া পাকিয়ে বানানো রশি দিয়ে পিছমোড়া করে বাঁধা প্রসপেরোর হাত। ওর পাঁচ সহযোগীরও একই অবস্থা। পড়ে আছে ওর পাশে। ওদের ভিতর ফেরুচ্চিয়েও আছে। সে-ই কেবল আধা সচেতন। মারের চোটে ওর মাথা ফেটে গেছে। মোটামুটি চেতনা আসার পর থেকে মাথার যন্ত্রণায় থেকে থেকে গোঙাচ্ছে ও। ফেলুকায় যখন সিনানের নাবিকরা হামলে পড়ে, গাধাটা তখন গিয়েছিল ওদের সঙ্গে লড়তে। তখনই বেদম মার খেয়েছে ও। বাকি চারজনের মধ্যে তিনজন প্রবল ক্লান্তিতে ঘুমিয়ে পড়েছে।
পাগড়ি পরা একদল কালো কোর্সেয়ার ওদের ঘিরে দাঁড়িয়ে নানা উপহাস আর কটুক্তি করতে লাগল। পিচ্ছিল সিঁড়িতে কারো আসার ভারী পদশব্দ শোনা গেল। হাস্য-উপহাসরত কালো লোকদের বৃত্ত খুলে গেল। এবং প্রসপেরোর দৃষ্টিতে এল কারুকার্যখচিত জুতোয় ঢাকা পদযুগল। পুরোপুরি সচেতন হয়ে গেল ও। অতি স্থূল দৈহিক আকৃতি দেখেই প্রসপেরো বুঝতে পেরেছে এটা আর কেউ না, এসেছে সিনান রেইজ।
উপহাস করে প্রসপেরোকে সে বলল, বাহ, মেসার প্রসপেরো ফিরেছেন দেখি। এত জলদি আপনাকে আমরা আশা করিনি। দ্রাগুত খুব খুশি হবে। আপনার মুক্তিপণের ব্যাপারে জানতে চাইবে সে। আর ইয়াকুবের খবরও শুনতে চাইবে। তবে তার আগে আমার নিজের কিছু খবর দরকার। ডোরিয়ার খবর জানতে চাই আমি। বলুন কী জানেন তার সম্বন্ধে।
আমি কিছুই জানি না, বলল প্রসপেরো।
তাহলে বলব আপনি মিথ্যা বলছেন। তবে আমি অবাক হইনি। কারণ মিথ্যা বলা আপনাদের কাছ থেকেই শিখেছি। তবে তার ভাতিজিকে আপনি নিশ্চয়ই চেনেন, তাই না?
দুয়েকবার চোখ পিটপিট করল প্রসপেরে। বলল, হ্যাঁ, ওকে অবশ্যই চিনি, ডোরিয়ার পরিবারের আরো কিছু মানুষকেও চিনি আমি। আন্দ্রের গতিবিধি সম্বন্ধে জানতে চাইছেন? তার সম্বন্ধে আমি কেবল এতটুকুই বলতে পারি, আপনাদেরকে হন্যে হয়ে খুঁজে বেড়াচ্ছে ডোরিয়া। অর্থাৎ এই ব্যাপারে আমি আপনার চেয়ে বেশি জানি না।
হাসল সিনান। হাসিতে তার চেহারা বিকৃত হয়ে উঠল। বাঁশির মত চিকন কণ্ঠে ভদ্র স্বরে হুমকি দিল সে।
জবাবে প্রসপেরো বলল, অযথাই আপনার সময় নষ্ট করছেন। আমি কিছুই বলতে পারব না। তবে একটা উপদেশ দিতে পারি-মানে যদি শোনেন আরকী তাহলেই।
উপদেশ! যেমন?
ডোরিয়া আপনাকে যখন ধরবে, কীভাবে তার রোষানল থেকে বাঁচবেন তা বলছি। আর হ্যাঁ, নিশ্চিত থাকতে পারেন, আপনারা ধরা পড়বেনই।
তাহলে, দিন আপনার উপদেশ, বলল সিনান।
প্রসপেরো বলছে, আপনার জন্য অমূল্য এক সম্পদ অ্যাডমিরালের ভাতিজি। তার সঙ্গে কেমন আচরণ করছেন তার উপর নির্ভর করবে আপনার ভাগ্য। যদি বলেন যে, ভগ্নপ্রায় নৌযান থেকে আপনি ওকে উদ্ধার করেছেন তাহলে ডোরিয়ার কৃতজ্ঞতা ও সবিনয় আচরণ পাবেন। কিন্তু ওর সঙ্গে কোন দুর্ব্যবহার করা হলে সেটাকে ডোরিয়া খুবই খারাপভাবে নেবে। বলা বাহুল্য, আপনার জন্য তা কোনভাবেই ভাল হবে না। ডোরিয়াও আপনাদের বর্বর কায়দাকানুন জানে। শুধু জানেই না, ব্যবহারও করে। হয়তো শুনে থাকবে, আপনাদের তুর্কি জ্ঞাতিভাইরা ভেনেশিয়ান ব্রাগাদিনের গা থেকে জীবন্ত চামড়া তুলে নিয়েছিল। ডোরিয়ার ভাতিজির সঙ্গে দুর্ব্যবহার করলে হয়তো অমন কিছু আপনার ভাগ্যেও লেখা হয়ে থাকতে পারে। আমি ভাবছি, চামড়া তুলে নিলে আপনাকে কেমন দেখাবে, জনাব সিনান।
সিনানের কুতকুঁতে চোখ দুটোয় একবার রাগের একটা ঝলক ফুটে উঠল। ঘৃণাপূর্ণ কণ্ঠে সে বলল, আপনার বুঝি ধারণা ডোরিয়ার নাম শুনে ভয়ে কাঁপব আমি? আমার কিছু করতে হলে আগে তো আমাকে ধরতে হবে। কই, এত বছরে একবারও তো সে আমাকে ধরতে পারল না।
প্রসপেরো বলল, হ্যাঁ, এতদিন ভাগ্য তার প্রতি সদয় হয়নি বটে। কিন্তু এখনকার কথা ভিন্ন। এদিকে আপনি একা। যে-কোন মুহূর্তে দিগন্তে দেখা দিতে পারে ডোরিয়ার জাহাজের পাল।
প্রসপেরোর পাঁজরের নিচে নিজের মণখানেক ওজনের একটা পা তুলে দিল খোঁজা সিনান। দাঁত কিড়মিড় করে বলল, আসুক আগে, তখন দেখব।
আমারও একই কথা, আসুক। কিন্তু ডোরিয়ার ভাতিজি হিসেবে তার প্রাপ্য সম্মান তাকে দিন।
কুটিল হেসে সিনান বলল, ডোরিয়া কীভাবে জানবে তার ভাতিজি এখানে বন্দি হয়ে আছে? আর সে যদি না-ই জানে তাহলে আমার উপর শোধ নেয়ার প্রশ্ন আসছে কোথা থেকে? আল্লাহ জানে, এমনকী সে যদি আমার উপর শোধ নিতেও আসে তবুও আমি ভয় পাই না।
প্রসপেরো জানে এই লোক অপ্রয়োজনীয় ঝুঁকি কখনোই নেয় না। কিন্তু এখন তার কণ্ঠে লুকিয়ে থাকা অস্বস্তিটা প্রসপেরোর কানে ঠিকই ধরা পড়ে গেছে। হেসে উঠে বসল প্রসপেরো। হেলান দিল ভাঙা মাস্তুলের অবশিষ্টাংশের গায়ে। বলল আপনার বিশাল শরীরটা কি বাতাস দিয়ে ভরা? এই হাতির মত শরীরটায় খাটাবার মত মগজ কি একটুও নেই? আমি বলিনি, যে আপনার দরকারের সময় জিয়োভান্না ডোরিয়া আপনার হাতের তুরুপের তাস হয়ে উঠবে? অর্থাৎ আপনি নিজেই তখন তাকে জানাবেন। তবে আপনার করণীয় হচ্ছে তাকে তার প্রাপ্য সম্মান দেয়া ও কোনরকম দুর্ব্যবহারের শিকার যেন সে না হয় সেদিকে খেয়াল রাখা।
প্রসপেরোর বুকে ধুম করে লাথি বসিয়ে দিল সিনান। বলল, খোদার গজব পড়ক তোর অভিশপ্ত জিভে। অমন দুঃসময় এখনও আসেনি।
ঠিক, কিন্তু কেউ জানে না কখন শুরু হবে দুঃসময়।
আবার লাথি বসিয়ে দিল সিনান। বিড়বিড় করে আরবিতে কী যেন বলে উঠল সে। তারপর চলে গেল। একটু হলেও চিন্তার ছাপ ফুটেছে সিনানের চেহারায়। ওকে চিন্তায় ফেলতে পেরে খানিকটা স্বস্তি পেল প্রসপেরো। অন্তত এখনকার মত হলেও স্বস্তিতে থাকতে পারবে জিয়ান্না। কেউ ওকে বিরক্ত করবে না।
প্রসপেরো জানে ডোরিয়ার ফ্লিটের সঙ্গে ওদের দেখা হওয়ার সম্ভাবনা অনেক। বলা যায় ধরা এরা পড়বেই। ওরা ধরা পড়লে প্রসপেরোর কী অবস্থা হতে পারে তা খুব ভাল করেই জানে ও। কিন্তু তারপরও জিয়ান্নার স্বার্থে ও মন থেকে প্রার্থনা করল যেন। ডোরিয়ার ফ্লিটের মুখোমুখি এরা হয়।
এসব ভাবতে ভাবতেই প্রসপেরো হঠাৎ খেয়াল করল গ্যালির মুখ ঘুরে যাচ্ছে। অর্থাৎ প্রসপেনোর বক্তব্য সিনানের মনে ভালই দাগ কেটেছে। সে ভেবে নিয়েছে এই এলাকা তার জন্য আর নিরাপদ নয়। কিছুক্ষণের মধ্যেই হিসার এসে ঘোষণা করে গেল ওরা স্ট্রেইট অভ বোনিফেস-এর দিকে রওনা হয়েছে। তবে আগে সার্ডিনিয়ান উপকূল ঘেঁষে দক্ষিণ দিকে যাবে। উত্তর-পশ্চিমা ঝড়ো বাতাসের মুখ খানিকটা ঘুরে গেছে। সাগরের ঢেউও দ্রুত শান্ত হয়ে যাচ্ছে। তুলে দেয়া হয়েছে বাদামি রঙের বিশাল তিনকোনা পাল। সাগরের পানি দুভাগ করে দিয়ে ছুটে চলেছে গ্যালি। একই সময় তুলে ফেলা হলো দাঁড়গুলো। প্রায় সঙ্গে সঙ্গে বেঞ্চের উপরই মড়ার মত ঘুমিয়ে পড়ল পরিশ্রান্ত দাসেরা।
সকাল। মাথার উপর চড়তে শুরু করেছে সূর্য। সেইসঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে উত্তাপ। উফুল্ল মনে বন্দিদের দেখতে এল হিসার। হিসারের সঙ্গে এসেছে তিন শ্বেতাঙ্গ নাবিক ও এক নিগ্রো দাস। নিগ্রো লোকটি সাসের বাসিন্দা। তার গায়ে একটা সুতাও নেই। তার হাতে এক বালতি পানি আর একটা কাঠের প্লেটে কয়েকটা খেজুর ও বিস্কিট। বন্দিদের হাতের বাঁধন খুলে দেয়া হলো। হিসার তাদের সুসংবাদ দিল যে গ্যালির সামনের অর্ধেক অংশে তারা ঘোরাফেরা করতে পারে। তবে এই স্বাধীনতার বিন্দুমাত্র যেন অপব্যবহার করা না হয়। তাহলে ওদেরকে সাগরে ছুঁড়ে ফেলা হবে।
পালে উত্তুরে হাওয়া পেয়ে তরতর করে এগিয়ে চলেছে। সিনানের গ্যালি। গতি ঘণ্টায় প্রায় তিন লিগ। সামনের মাস্তুলে আর পাল খাটানোর জায়গা নেই। থাকলে আরো দুটো পাল বেশি ঝোলাত সিনান।
পরদিন বিকেলের কথা। ক্রোজ নেস্টে বসা পাহারাদার মাটির দেখা পেয়েছে। এর কিছুক্ষণের মধ্যেই চিৎকার করে সে জানাল দক্ষিণ দিগন্তে নোঙর করে থাকা জাহাজের দেখা পেয়েছে সে। চোখে দূরবীন তুলে সিনান নিশ্চিত হলো ওটা দ্রাগুতেরই ফ্লিট। কাজেই নিশ্চিন্তে এগিয়ে গেল সিনান রেইজ।
কেপ বোনার উপকূলে রাতের মত নোঙর করল সিনান। ভোরে মুয়াজ্জিন আযান দিলে নামাজ পড়ে রওনা হবার নির্দেশ দিল সে। বাতাস পড়ে গেছে। বিশ্রাম পেয়ে একদম তরতাজা হয়ে উঠেছে দাসেরা। কাজেই দ্রুত পানি কাটতে লাগল দাঁড়। কিন্তু সিনানের যেন তর সইছে না।
মাথার উপর সূর্য আসতে তখনও দুই ঘণ্টা বাকি। দাসদের, প্রাণান্ত চেষ্টার পরও ওরা খুব একটা এগুতে পারেনি। এই মুহূর্তে পেন্টালারিয়া আর তিউনিশিয়ান উপকূলের মাঝখান অতিক্রম করছে ওরা। তখনই ওদের সঙ্গে দেখা করতে বা মোকাবেলা করতে সবুজ দ্বীপটার দক্ষিণ দিক থেকে এগিয়ে এল লাল রং করা একটা গ্যালিসে। ওটার মূল মাস্তুলে পতপত করে উড়ছে সাদা আর লাল রঙের পতাকা, মাঝে বাঁকা চাঁদ। পতাকাটা ঘোষণা করছে এটা দ্রাগুতের নিজের জাহাজ।
মোটামুটি আধ মাইল দূর থেকে সিনানের জাহাজটাকে নিজের বহর থেকে হারানো–জাহাজগুলোর একটা বলে চিনতে পারল দ্রাগুত। ঝড়ে আরো দুটো জাহাজ হারিয়ে গেছে। দ্রাগুতের গ্যালিসে থেকে সিনানের গ্যালির প্রতি সঙ্কেতের মাধ্যমে হুকুম করা হলো বামে ভিড়তে।
ওদিকে র্যামবেডের ধাপে দাঁড়িয়ে এসব দেখছে প্রসপেরোও। বোঝার চেষ্টা করছে কোন কিছু ওর উপকারে আসবে কিনা।
পেন্টালারিয়া হারবারে নোঙর করা মাত্রই সিনানের গ্যালিতে নেমে এল দ্রাগুত। এসেই সে ঢুকে পড়ল পুপ কেবিনে। ওখানেই তার জন্য অপেক্ষা করছে সিনান রেইজ।
দ্রাগুতের পরনে হাঁটু পর্যন্ত লম্বা সবুজ রঙের সাটিনের কোর্তা। সেটায় সোনালি সুতায় লতাপাতার নকশা তোলা। তার হাঁটু ঢাকা লাল রঙের বুট জোড়া সর্বোকৃষ্ট কর্ডোভান কারুকার্যের নমুনা। দুই পাটিই স্বর্ণনির্মিত টার্সেল দিয়ে সজ্জিত। সাদা পাগড়ির কপালে ঝকমক করছে অত্যন্ত মূল্যবান রুবি। পাথরটা তার বাজপাখি সদৃশ চেহারার দীপ্তি আর দৃষ্টির তীক্ষ্ণতা দুটোই যেন বাড়িয়ে দিয়েছে।
দলছুট হওয়ায় সিনানকে আচ্ছামত ঝাড়ার মানসিকতা নিয়ে তার গ্যালিতে পা রেখেছিল দ্রাগুত। কিন্তু সিনানের রিপোর্ট শুনে রাগ দমন করল সে। তার সামনে প্রসপেরোর টাকশাল আর জিয়ান্নার গলা থেকে কেড়ে নেয়া মুক্তোর মালাখানা বের করল। সিনান। বলল, এই জিনিসগুলো আর যে লোকটাকে বন্দি করেছি তাকে আপনি নিন। আর আমার নিজের জন্য দাবি করছি বন্দি করা মেয়েটিকে।
দ্রাগুতের চোখ দুটো বিস্ময়ে একটু বড় হলো। সেখানে কৌতুক খেলা করছে। সে জানে সিনানের মেয়েদের প্রতি কোন আগ্রহ নেই। কারণ সে খোঁজা।
দ্রাগুত বলল, প্রশংসা সব আল্লাহতায়ালার। মেয়ে! মেয়ে দিয়ে তুমি কী করবে? তা মেয়েটা কি সত্যিই এমন মহাসুন্দরী যে, তোমার পুরুষত্ব জাগিয়ে তোলার মত অত্যাশ্চর্য ঘটনা ঘটিয়ে ফেলল, সিনান?
ঠোঁট উল্টে বিরক্তি প্রকাশ করল সিনান। নিজের দুর্বলতা নিয়ে কারো কৌতুক তার পছন্দ হবার কোন কারণ নেই। এবারও করল না। তবে কমাণ্ডার ও সবার শ্রদ্ধার পাত্র হওয়ায় দ্রাগুতকে কিছু বলল না সে। শান্ত কণ্ঠে শুধু বলল, মেয়েটা ভীষণ সুন্দরী। এতই সুন্দরী যে তার উপযুক্ত জায়গা কেবল বিশ্বাসীদের কমাণ্ডারের হারেম। আমি নিজে মেয়েটাকে মহান সুলায়মানের জন্য উপহার হিসেবে নিয়ে যেতে চাই।
হাসির চোটে দাঁত বেরিয়ে গেল দ্রাগুতের। বলল, দারুণ কুশলী লোক হে তুমি, সিনান।
মহান সুলায়মানের সামনে খালি হাতে যেতে চাই না। সৌভাগ্যবশত এই চমৎকার উপহার আমি পেয়ে গেছি। লোকটাকে সহ স্বর্ণমুদ্রা সব আপনি রাখুন। আমাকে শুধু মেয়েটাকে দিন।
দাঁড়াও, দাঁড়াও। মেয়েটা যদি এতই সুন্দরী হয়ে থাকে তাহলে তুমি কেন ওকে সুলতানের সামনে নেবে, আমিই তো নিতে পারি!
ঠোঁট বাঁকা করে হেসে সিনান বলল, আপনি মেয়েটাকে উপহার হিসেবে নিয়ে গেলে তাকে কি সুলতান আর অতটা মূল্যবান বলে ভাববে? তার ইঙ্গিত স্পষ্ট।
বুঝতে পেরে হাসল দ্রাগুত। বলল, ঠিকই বলেছ। আচ্ছা, ঠিক আছে, তোমার ইচ্ছাই পূরণ হোক। তার আগে কেবল সুলতানের জন্য উপযুক্ত মেয়েটাকে এক নজর দেখতে দাও।
সিনান একবার চিন্তা করল, সুলতানের জন্য নির্ধারিত কোন মেয়েকে অন্য কোন পুরুষের দেখার অনুমতি নেই। তবে. দ্রাগুত যেহেতু এই ফ্লিটের কমাণ্ডার, তাই মেয়েটাকে হাজির করার নির্দেশ দিল সিনান। জিয়ান্নাকে দেখে দ্রাগুতের মোহাবিষ্ট চোখ কপালে উঠে গেল। দ্রাগুতকে এভাবে মুগ্ধ হতে দেখে ভীষণ ইতস্তত বোধ করতে লাগল সিনান। কারণ এই আনাতোলিয়ানের লোলুপতা সম্বন্ধে খুব ভালভাবে জানা আছে সিনানের।
দ্রাগুতের সামনে মাথা উঁচু করে দাঁড়াল জিয়ান্না। তারপর মুখ খুলল দ্রাগুত। আমার ক্যাপ্টেন বলল আপনার সেবায় আসার সুযোগ পেয়ে নিজেকে ধন্য ভাবছে সে।
তেমন কোন সেবার আমার দরকার ছিল না। তবে আমি, লর্ড ডোরিয়ার ভাতিজি কথা দিচ্ছি, সে যা করেছে তার মূল্য অবশ্যই তাকে পরিশোধ করা হবে।
জিয়ান্না ভেবেছে কথাগুলো বলে ওদেরকে খানিকটা চাপে ফেলবে সে। কিন্তু দেখল ওর দিকে চোখ গরম করে তাকিয়ে আছে দ্রাগুত। কিন্তু পরমুহূর্তেই নিজেকে সামলে নিল সে। মৃদু হেসে ফেলল। তারপর সিনানের দিকে ফিরে বলল, ঠিকই বলেছ, মোটা ভাম, মেয়েটা আসলেই সুলতানের হেরেমেরই উপযুক্ত। কিন্তু এর সঙ্গে লোকগুলো কোথায়? কারা তারা?
প্রসপেরোর নাম বলা মাত্রই উজ্জ্বল হয়ে উঠল দ্রাগুতের চেহারা। এবং স্বস্তির সঙ্গে সিনান লক্ষ করল দ্রাগুতের মন থেকে পুরোপুরি দূর হয়ে গেছে জিয়ান্নাকে নিয়ে কৌতূহল। মুহূর্তেই ওদের সামনে থেকে চলে গেল দ্রাগুত। লাফিয়ে লাফিয়ে সিঁড়ি বেয়ে নামছে সে।
দ্রাগুত এসে দাঁড়াল প্রসপেরোর সামনে। সমস্ত প্রশংসা কেবল আল্লাহতায়ালার, আপনাকে রা কোত্থেকে পেল, মেসার প্রসপেরো? আমরা আপনার মুক্তিপণ নির্ধারণ করেছিলাম, আর একজন বন্দির মুক্তির কথাও ছিল, তাই না?
জবাবে প্রসপেরো বলল, আপনি নিশ্চয়ই ধারণা করছেন না যে, আমি ইচ্ছাকৃতভাবে বিশ্বাস ভঙ্গ করছি? আমি পরিস্থিতির শিকার। তবে মুক্তিপণের টাকাটা আপনি এখনি, এখান থেকেই পেতে পারেন। আমার সিন্দুকে টাকাটা রাখা আছে। সিনান নিয়ে গেছে টাকাটা।
হা-হা করে হেসে উঠল দ্রাগুত। বলল, আল্লাহ আপনার বুদ্ধিশুদ্ধি ফিরিয়ে দিন। আপনি বলতে চাইছেন লড়াই থেকে প্রাপ্ত গণিমতের মাল আপনার মুক্তিপণ? একটু পর হয়তো বলে বসবেন, মুক্তিপণ রেখে বাকিটা ফিরিয়ে দিতে, বলে আবার হেসে উঠল দ্রাগুত।
প্রসপেরো বলল, সিন্দুকটা পুরোই আপনি রেখে দিন, শুধু আমার লোকদেরকে ফেলুকা সহ চলে যেতে দিন।
আবার হেসে উঠল দ্রাগুত। দাড়ি হাতাতে হাতাতে বলল, একটা মেয়েও আছে আপনার দলে। তাকেও নিশ্চয়ই চাইবেন না?
হ্যাঁ, তাকেও চাইছি, এটা বোঝার জন্য মহাজ্ঞানী হতে হয় না।
আমি শুধু বুঝতে পারছি, সিনান খুব সৌভাগ্যবান। লেডি গুইলিয়াকে সুলতানের হেরেমে নিয়ে গিয়েছিল খায়ের-আদ-দীন। আহ, সুলতানের চোখ আর মন তাকে দেখে জুড়িয়ে গিয়েছিল। তবে ওই মহিলাও আমাদের হাতের এই লেডির মত সুন্দরী ছিল না। সিনান সৌভাগ্যবান, কারণ ও-ই এই লেডিকে বিশ্বাসীদের কমাণ্ডারের পদতলে সমর্পণ করবে।
আতঙ্কে প্রসপেরোর মুখ থেকে রক্ত সরে গেল। কিন্তু, দ্রাগুত, ও… বলতে গিয়েও একবার ভাবল বলবে কিনা। তারপর বলেই ফেলল, ও আমার স্ত্রী, দ্রাগুত, আমার বিবাহিতা স্ত্রী।
তাই? আহ, দুঃখজনক, খুবই দুঃখজনক। সে কুমারী হলে গ্র্যাণ্ড সিনরের (সুলতানকে বলা হয় গ্র্যাণ্ড সিনর) সুনজর কাড়ত তাড়াতাড়ি। তারপরও মেয়েটা খুব সুন্দরী।
প্রসপেরোকে প্রায় অবশ করে দিল তীব্র আতঙ্কের ঢেউ। আরো নিচু স্বরে প্রসপেরো বলল, দ্রাগুত, আপনি যখন আমার বন্দি ছিলেন, আমার কাছ থেকে ভুদ্র ব্যবহার পেয়েছিলেন।
হ্যাঁ। আপনি যখন আমার বন্দি ছিলেন তখন আমিও ভদ্র ব্যবহারই ফিরিয়ে দিয়েছি। এখন আমরা সমান সমান, বলল দ্রাগুত।
আমরা দুজনে একইসঙ্গে পাশাপাশি বসে দাঁড় টেনেছি। তা কি আমাদের মধ্যে কোন বন্ধন তৈরি করেনি? আপনি নিজেই বলেছেন আমাদের মধ্যে ভ্রাতৃত্বের বন্ধন তৈরি হয়েছে।
যেদিন আপনি আমার বিশ্বাস ভেঙেছেন সেদিনই ভেঙে গেছে ওই বন্ধন।
আমি বিশ্বাস ভাঙিনি। আপনি অবশ্যই আমার কাছ থেকে মুক্তিপণের টাকা পেতেন, এখনও পাবেন। আমাদের দুজনের মুক্তির জন্য আপনি কত টাকা পণ চান বলুন। আমি দেব, কথা দিচ্ছি, বলল প্রসপেরো।
জবাবে দ্রাগুত বলল, আপনাকে আবারও বিশ্বাস করব ভাবছেন?
বিশ্বাস করার দরকার নেই। টাকা আপনার হাতে পৌঁছনোর আগ পর্যন্ত আমরা আপনার হাতে বন্দি হয়ে থাকব।
দাঁত বের করে হাসল দ্রাগুত। বলল, যদি বলি দশ হাজার ডাকাট?
রাজি, সঙ্গে সঙ্গেই বলল প্রসপেরো। রক্ত ফিরতে শুরু করেছে ওর চেহারায়। আমার লোকেরা আমার হাতে লেখা চিঠি নিয়ে জেনোয়ার ব্যাঙ্ক অভ সেইন্ট জর্জে যাবে। ওখান থেকেই টাকা নিয়ে ফিরবে ওরা।
আরো চওড়া হলো দ্রাগুতের হাসি। বলল, দাঁড়ান, দাঁড়ান, এখনও বলিনি, দশ হাজার বা বিশ হাজার ডাকাট। ভেবেছেন, লক্ষ ডাকাট দিলেও ডোরিয়ার ভাতিজিকে আমি হাতছাড়া করব? ভুলে গেছেন ওই বুড়ো শয়তানটা কথা দিয়ে কতবার আমার সঙ্গে কথা ভেঙেছে? আল্লাহর শপথ, কুত্তাটা এবার নিশ্চয়ই ওই কথাগুলো মনে করবে। কাঁদবে, যখন শুনবে তার ঘরের মেয়ে সুলায়মানের হেরেমে বন্দি। আমাকে শিকলে বেঁধে দাঁড়ে বসিয়েছিল বলে তখন দুঃখ করবে সে। এভাবেই ওকে ফিরিয়ে দেব আমার পিঠের চাবুকের আঘাতের যন্ত্রণাগুলো।
আকুতিঝরা কণ্ঠে প্রসপেরো বলল, কিন্তু, আমি তো আপনার ক্ষতি করিনি। ডোরিয়ার ভাতিজি আমার বিবাহিতা স্ত্রী তাও তো আপনাকে জানালাম।
কাঁধ ঝাঁকিয়ে দ্রাগুত বলল, এমন কড়া প্রতিশোধ নেয়ার সুযোগ আপনার জন্য আমি কোনমতেই ছাড়তে পারব না। আপনার কাছে আমি ঋণীও নই। আর ঋণ যদি থাকতও, তবুও সর্বজ্ঞানী, সর্বদর্শী মহান আল্লাহতায়ালার সিদ্ধান্ত কে খণ্ডাতে পারে? যদি তার সিদ্ধান্ত হয় অপরাধীর সঙ্গে নিরপরাধও শাস্তি পাবে, তাহলে সেটা ঠেকাবার সাধ্য কারো নেই। আপনার জন্য আমার সহানুভূতি আছে, স্যর প্রসপেরো। কিন্তু তাই বলে এতটা সহানুভূতি নেই যে প্রতিশোধের মিষ্টি পেয়ালায় চুমুক দেয়া থেকে নিজেকে বা সুলতানকে বঞ্চিত করব। সিনানের সিদ্ধান্তকে আমি পূর্ণ সমর্থন করি।
আত্মনিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলল প্রসপেরো। যা মন চাইল, বকাবকি, গালাগালি করল সে দ্রাগুতকে। হাসিমুখে প্রসপেরোর সামনে দাঁড়িয়ে রইল দ্রাগুত। এমনকী সবচেয়ে জঘন্য গালি শুনেও রাগ করল না। একসময় কমে এল প্রসপেরোর উন্মাদনা। উচ্চারিত গালিগুলোর জন্য নিজেই লজ্জিত নতমস্তক হয়ে গেল প্রসপেরো।
তারপর মুখ খুলল দ্রাগুত। বলল, অনেক কিছু বললেন। সৌভাগ্যবশত মুখের কথায় রক্তপাত হয় না। তবে সাবধান, এমন আর একটা শব্দও যেন আপনার মুখ থেকে বের না হয়। হলে শেকলে বেঁধে দাসদের সঙ্গে দাঁড় টানতে বসাব আপনাকে। আপাতত আপনি আর আপনার লোকেরা আমার গ্যালিসেতে আসবেন। যতক্ষণ সাবধান থাকবেন ততক্ষণ আপনাদের কোন ক্ষতি হবে না। আল্লাহর কসম, সাবধান থাকবেন, নইলে…
.
২৫.
ফাঁদ
খুব ছোট্ট হলেও একটু যেন আশার আলো দেখতে পেল প্রসপেরো। জিয়ান্নাকে সুলতানের কাছে পাঠানোর কথা ভাবলে ওকে তেমনভাবেই পাহারা দিয়ে রাখা হবে। আপাতত ওর ক্ষতি করার চিন্তাও করবে না কেউ। তাহলেই সময় পাওয়া যাবে। আর সময়ের স্রোতে নানা ঘটনা ঘটতেই পারে। কাজেই ওরা যা চাইছে তা-ই হবে এমন কথা নিশ্চিতভাবে বলা যায় না।
এদিকে আন্দ্রের ধাওয়ার ঠেলায় দ্রাগুতের লেজে আগুন-ধরার অবস্থা। দ্রাগুত আগে ভেবেছিল খায়ের-আদ-দীনের সঙ্গে ইস্তাম্বুলে গেলে নিশ্চিত নিরাপত্তা পাওয়া যাবে। কিন্তু তা হলো না। কাজেই এখন জেবরায় গিয়ে রিইনফোর্সমেন্ট আসার জন্য অপেক্ষা করার সিদ্ধান্ত নিল সে। কারণ, ইয়ারিন সাবাহ-র যে বহর আনার কথা সেটা না পেলে দ্রাগুতের লড়াইয়ের শক্তি বাড়ছে না।
পেন্টালারিয়ায় পৌঁছে অতি ধীরগতিতে চলতে লাগল দ্রাগুত। দক্ষিণমুখী একটা কোর্সে চলে মেহেদিয়ার কাছে চলে এল ওরা। তার সাধের শহরের এত কাছ দিয়ে যাওয়ার সময় নিজেকে পুরোপুরি সংবরণ করতে পারল না দ্রাগুত। ক্ষয়ক্ষতি দেখতে বন্দরের আধ মাইলের ভিতর চলে গেল। দেখতে পেল বিধর্মী শয়তানের দুল ওর সাধের শহর গুঁড়িয়ে দিয়েছে। দেখে বন্দরে জাহাজ ভিড়িয়ে দিল দ্রাগুত।
বন্দরে যাওয়া নিয়ে দ্রাগুতের মনে কোন দ্বিধা নেই। তবে এদিকে যেহেতু এখনও দুয়েকটা স্প্যানিশ স্কাউটশিপ ঘোরাঘুরি করছে, তাই দ্রাগুত ওখানে থেমে থাকল না। চুপিসারে এগিয়ে চলল, যেন স্প্যনিশ স্কাউট জাহাজগুলোর চোখ ফাঁকি দিয়ে সবার অগোচরে জেবরা প্রণালীতে ঢুকে পড়তে পারে। অভিজ্ঞতা থেকে দ্রাগুত জানে আগামী কয়েক সপ্তাহের আগে ওর রিইনফোর্সমেন্ট এসে পৌঁছনোর সম্ভাবনা নেই।
বাইরে প্রচণ্ড গরম। এতটুকু বাতাস নেই কোথাও। একদম কাঁচের মত শান্ত, নিস্তরঙ্গ হয়ে আছে সাগরের পানি। গ্যালিগুলোকে গুণ টানার মত করে টেনে নিয়ে চলেছে ব্রিগেন্টাইনগুলো। একে একে ওরা পার হয়ে গেল স্ক্যাক্স, কারকেনাহ দ্বীপ ও গালফ অভ গেস্। এসব পার হয়ে শেষ পর্যন্ত এসে পৌঁছুল হোমারের লটোফাগি দ্বীপের কাছে, জেবার অগভীর পানিতে।
এখানে অত্যন্ত সতর্কতার সঙ্গে জাহাজ চালাতে হয়। কারণ বিশ মাইল লম্বা আর প্রায় পনেরো মাইল চওড়া এই লেগুনে পানি খুবই অগভীর। ভরা জোয়ারের সময় পানি যখন সর্বোচ্চ উচ্চতায় পৌঁছে কেবল সেই সময়টা ছাড়া লেগুন থেকে বের হওয়া সম্ভব না। প্রায় বৃত্তাকারে জেবরাকে ঘিরে আছে এই লেগুন। ফলে লোকে একে দ্বীপ বলেই মনে করে। এই এলাকার একটা জায়গা তারিক আল জামিল নামে পরিচিত। সেখানে একটা পাথুরে পায়ে হাঁটা রাস্তা আছে। সেটা দ্বীপ থেকে মূল ভূখণ্ড পর্যন্ত চলে গেছে। কাজেই এটা আসলে দ্বীপ নয়, পেনিনসুলা।
বিশাল এই লেগুনে প্রবেশ করে তীর ঘেঁষে এগিয়ে চলল দ্রাগুতের ফ্লিট। আরেকটু এগিয়ে ওরা গিয়ে পৌঁছুল হাউমট আজিম নামের গ্রামের কাছে। গ্রামের ঘরবাড়িগুলো গড়ে উঠেছে। সাদা গম্বুজওয়ালা একটা মসজিদ ঘিরে। গ্রামের কিছু বাড়ি পাথর দিয়ে তৈরি আর কিছু বাড়ির দেয়াল কাদা লেপে বানানো। তবে উভয়েরই ছাদ দেয়া হয়েছে নলখাগড়া দিয়ে। এই গ্রামের পাশে উপকূলে নোঙর করল দ্রাগুতের ফ্লিট। পুরো সৈকত জুড়ে দাঁড়িয়ে আছে অসংখ্য খেজুর গাছ। সৈকতের একটু ওপরে ধূসর-সবুজ জলপাই গাছে ছেয়ে আছে বিস্তীর্ণ জমি। স্পষ্টই বোঝা যাচ্ছে এই এলাকার মাটি খুবই উর্বর।
গ্রামের লোকজনের কাছে নৌ-সেনাদের অবতরণ মানে ব্যবসার অনন্য সুযোগ। ফলে নোঙর ফেলতেই সৈকতে লোকজনের ছুটোছুটি শুরু হয়ে গেল। গ্রামের মহিলারা ছুটে এল সবার আগে। পোশাক-আশাক দেখে ওদেরকে অসভ্য বলে মনে হলো নাবিকদের। মহিলাদের গায়ের রঙ হালকা শ্যামলা, অনাবৃত চেহারা। নৌকায় করে এল ওই মহিলারা। নৌকা চালিয়ে আনল তাদের পুরুষরা, কিন্তু কথা বলল মহিলাদের দলগুলোই।
মাথার ঝুড়িতে করে তারা নিয়ে এসেছে রসালো লোকাস্ট বীন, খেজুর, পাকা তরমুজ, সিরিয়াল, ডিম, মুরগি ও আরো নানা হাবিজাবি। জাহাজের কাছে এসে ওরা চিৎকার-চেঁচামেচি জুড়ে দিল যে এসব জাহাজীদের না দিয়ে যাবে না (পড়ুন, বিক্রি না করে)।
পদ্মের ফল কোর্সেয়ারদের পছন্দের খাবার। এই জিনিসও ওদের কাছে দেদার পাওয়া গেল। খুশি হয়েই ওসব নিল নাবিকরা। এমনকী শুকনো বিস্কুট আর দিনে এক মুঠো বীন ভাগ্যে জোটে যেই দাসদের, তারাও গ্রামবাসীদের কল্যাণে দুটো ভালমন্দ মুখে তোলার সুযোগ পেল আজ।
রিইনফোর্সমেন্ট আসার আগ পর্যন্ত নিরাপদে লুকিয়ে থাকতে পারবে বুঝেই এখানে থেমেছে দ্রাগুত। থেমেই সে কাজে লেগে গেছে। ঝড়ে ওর গ্যালিগুলোর প্রায় সবই কম-বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। তীরে একটা অস্থায়ী কামারশালা বানিয়ে দাসদের কাজে লাগিয়ে দিয়েছে ওর লোকেরা। প্রতিবারে পাঁচটা গ্যালি তীরে তুলে মেরামতের কাজ শুরু হলো। পাঁচদিন পর্যন্ত ধীরগতিতে কাজ চলল। পঞ্চম দিনে উটে চড়ে হাউট আস সাওম নামের গ্রাম থেকে এল এক সংবাদবাহক। সে সংবাদ নিয়ে এসেছে, গালফ অভ গেবসে বিশাল এক নৌবহরের দেখা পাওয়া গেছে।
ব্যাপারটা দ্রাগুতের জন্য ভীষণ অস্বস্তিকর। ঘোড়ায় করে কয়েকজন অফিসার সহ নিজেই রওনা হলো প্রকৃত পরিস্থিতি জানার জন্য। উপকূলের এক মাইলের কাছাকাছি পৌঁছে ঘোড়সওয়ারদের থামিয়ে দিল সে। দুশ্চিন্তাগ্রস্ত হয়ে দেখল জেবরার অগভীর পানিতে নোঙর করেছে ছত্রিশটা গ্যালি ও গ্যালিসে, সঙ্গে সাপ্লাই বহনকারী অসংখ্য নৌযান। ওগুলোর কোন-কোনটায় উড়ছে স্পেনের লাল-সোনালি পতাকা আর বাকিগুলোয় উড়ছে জেনোয়ার লাল-সাদা পতাকা।
দ্রাগুতকে বলে দিতে হলো না কে নোঙর করেছে। সে ভাবছে আলজিয়ার্স থেকে রিইনফোর্সমেন্ট হিসেবে ওর জন্য যে গ্যালিগুলো ইয়ারিন আনবে তা দিয়েও এত বড় ফ্লিটের মোকাবেলা করা সম্ভব নয়। খোদা মালুম, শয়তানের আছর পড়েছে কিনা। নাকি ব্যাপারটা নাসারাদের জাদু-কে জানে। নয়তো ওই তীব্র ঝড় পাড়ি দিয়ে ডোরিয়া কীভাবে এই পর্যন্ত এসে পৌঁছুল? তখন তার মনে পড়ল যে, মেহেদিয়া পাড়ি দেয়ার সময় উপকূলে চলে গিয়েছিল সে। এবং ওখানে কিছু স্কাউটশিপ দেখে দ্রুত ওই এলাকা ছেড়ে চলে এসেছিল।
শত্রুর দেখা পেয়ে এই প্রথমবারের মত তার মন কু-ডাক দিল। দুশ্চিন্তা জেঁকে বসল তার মনে, ফ্যাকাসে হয়ে গেল রোদে পোড়া গাঢ় রঙের মুখ। বিধর্মী বেইমানটার দয়ার উপর এখন নির্ভর করতে হবে ওকে। যে লেগুনটাকে সে ভেবেছিল তার জন্য নিরাপদ অভয়াশ্রম, সেটাই এখন মৃত্যুফাঁদ হয়ে দেখা দিয়েছে। কারণ, ফ্লিট নিয়ে এখান থেকে বের হওয়ার আর কোন উপায়ই নেই। হঠাৎ হাজির হওয়া বিধর্মী শয়তানগুলোও যেন ব্যাপারটা আগে থেকেই জানত। নইলে লেগুনে ঢোকার মুখটাতেই ওরা নোঙর করতে যাবে কোন্ দুঃখে? রাগের চোটে অফিসারদের সামনেই পাগলের মত শাপশাপান্ত করতে লাগল ডোরিয়া, জেবরার অগভীর লেগুন, আর নিজের অদূরদর্শিতাকে।
কিছুক্ষণ পর দ্রাগুতের উন্মাদনা কেটে গেল। রাগও কমে আসতে শুরু করল। অফিসারদের নিয়ে দশ মাইল দূরে নিজের হাইড-আউটের দিকে রওনা হলো সে।
ডোরিয়ার আগমন দিবালোকসম সত্যি নিশ্চিত হয়ে বেশ ভাল একটা ঝাঁকি খেয়েছে পুরো কোর্সেয়ার ফ্লিট। কারণ সবাই জানে। এই লেগুন থেকে বের হবার উপায় নেই। হতবুদ্ধি হয়ে গেছে। অফিসাররা।
অপরদিকে দ্রাগুতের হাতে দাঁড়টানা দাস হিসেবে বন্দি প্রায় দুই হাজার খ্রিস্টানের মধ্যে বয়ে গেল প্রশান্তির একটা চোরা স্রোত। আশুমুক্তির প্রত্যাশায় রইল সবাই।
তবে খবরটা প্রসপেরোর কাছে যতটা প্রশান্তির সুবাতাস বয়ে আনল অতটা শান্তি আর কেউই পায়নি। ওর দিন কাটছিল বিভিন্ন সময়ে ঘটে যাওয়া দুঃসহ স্মৃতি রোমন্থন করে। ওর কয়েকজন লোকও এখন দ্রাগুতের দাসদের সঙ্গে দাঁড় বাইছে। ওকে দাঁড় থেকে মুক্ত রাখা হয়েছে বটে, তবে সেটাও বন্দিত্ব বই কিছু নয়। প্রসপেরোকে একটা কেবিন দেয়া হয়েছে। সেইসঙ্গে টিবারনাকলে যাওয়ার অনুমতিও দেয়া হয়েছে। দ্রাগুতের সঙ্গে এক টেবিলে বসে খাওয়ার ব্যবস্থাও করা হয়েছে ওর জন্য। নিজের সম মর্যাদার একজন ক্যাপ্টেন হিসেবে এ পর্যন্ত ওর সঙ্গে আচরণ করেছে দ্রাগুত। তবে টিবারনাকল এড়িয়ে চলেছে প্রসপেরো, যাতে দ্রাগুতের সৌজন্য ও সাহচর্য পেতে না হয়। বলার অপেক্ষা রাখে না, বর্তমান পরিস্থিতির বিচারে তার লোক দেখানো সৌজন্য একরকম পরিহাস ছাড়া আর কিছু নয়। অবশ্য এক টেবিলে বসে খেতে হওয়ায় দ্রাগুতকে পুরোপুরি এড়িয়েও যেতে পারছে না প্রসপেরো। নইলে না খেয়ে থাকতে হবে। তবে প্রসপেরোকে কোনরকম বিরক্ত সে করছে না। গম্ভীরভাবে চুপচাপ খেয়ে নেয় দুজনে। ওদিকে জিয়ান্নাকে সুলতানের হাতে তুলে দেবে বলে সিনান যে প্রস্তাব করেছে তা মাথায় রাখলেও চূড়ান্ত অনুমোদন এখনও দেয়নি দ্রাগুত। সেজন্য অবশ্য তার প্রতি প্রসপেরোর কৃতজ্ঞতাবোধ রয়েছে। হাউট আস সাওম থেকে ফিরলে পরে তার সঙ্গে কথা বলতে গেল প্রসপেরো। সেই ব্যাপারটাই এখন ক্রমানুসারে সামনে আসছে।
আত্মরক্ষার চিন্তায় মশগুল হয়ে আছে দ্রাগুত। তাই ক্যাম্পের লোকজনের পরিবর্তন তার চোখেই পড়ল না। লড়াই শুরু হলে কীভাবে কী করবে চিন্তা করে সেই অনুযায়ী কাজকর্মের নির্দেশনা দেয়া শুরু করল সে। ভাবছে, মরি তো মরব, কিন্তু ওদের একটা মরণকামড় না দিয়ে ছাড়ব না।
সবচেয়ে শক্তিশালী বারোটা কামান মাটিতে নামাতে বলল দ্রাগুত। সে নিজেই ওগুলোর আনলোডিং তদারক করল। তারপর ডেকে পাঠালজেবরার গ্রামপ্রধান, বৃদ্ধ শেখ খাবাবকে। লোকটা এলে তাকে বলল, দ্রাগুতের দাস বাহিনীকে সাহায্য করতে খাবাব যেন দুই হাজার লোক দেয়। তারা আর দ্রাগুতের দাসেরা দ্রুত একটা দুর্গ গড়ে তুলবে। দ্রাগুতের পরিকল্পনা হচ্ছে ওখানেই স্থাপন করবে তার গোলন্দাজ ইউনিট। রাতের খাবারের জন্য অপেক্ষা করল না দ্রাগুত। খাবাবের লোকেরা আসার সঙ্গে সঙ্গেই দাসদের সঙ্গে তাদেরকেও কাজে লাগিয়ে দেয়া হলো।
ওয়ার্ডেনদের কঠোর তদারকিতে দ্রুত কাজ এগিয়ে চলল। দ্রাগুতের অফিসাররাও অক্লান্ত পরিশ্রম করে গেল। কাজে তদারক করল, কর্মীদলকে প্রয়োজনানুযায়ী এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় নিয়ে কাজে লাগাল। আর দ্রাগুত যেন সব জায়গায় আছে। ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র ব্যাপারও ওর চোখ এড়াচ্ছে না। দ্রুত ভুল সংশোধন করছে বা আরো কার্যকর করে তুলছে সবকিছু। একদল ব্যস্ত-সমস্ত পিঁপড়ের মত সুশৃঙ্খলভাবে কাজ করে চলেছে সবাই। দেখতে দেখতেই মাটি কাটার কাজ শেষ করে ফেলল ওরা। প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা হিসেবে দাঁড় করানো হলো ষাট ফুট লম্বা, পাঁচ ফুট চওড়া দেয়াল। এর মূল কাঠামো হিসেবে ব্যবহার করা হলো ঝাউ গাছের শক্ত গুঁড়ি গুঁড়িগুলোকে জায়গায় ধরে রাখতে ব্যবহার করা হলো খেজুর গাছের পাতার রশি। মূল কাঠামোকে সুরক্ষিত ও নিরাপদ করতে প্রয়োজন মাফিক মাটিও ফেলা হলো। বন্দুকধারীদের সুবিধার জন্য বুক পর্যন্ত উঁচু আরেকটা সুরক্ষা প্রাচীর তৈরি করা হলো। ভোর হওয়ার অনেক আগেই শেষ করা হলো প্রতিরক্ষা প্রাচীর নির্মাণের যাবতীয় কাজ। তারপর ক্লান্ত, পরিশ্রান্ত দাসদের দিয়ে টানিয়ে আনা হলো গুলি-বন্দুক, কামান ও ওগুলোর জন্য প্রয়োজনীয় গোলাবারুদ।
শেষ হলো প্রাচীরের কাজ। শেষ মুহূর্তের পরিদর্শন সেরে চওড়া দেয়ালটার উপর থেকে নেমে এল দ্রাগুত। মনে মনে সন্তুষ্টি অনুভব করছে সে। যদিও পরমুহূর্তেই আবার মনে হলো প্রয়োজনের তুলনায় কতটা অপ্রতুল এই নামমাত্র প্রতিরক্ষা। কথাটা ভেবে হাওয়ায় মিলিয়ে গেল তার সন্তুষ্টি। ঠিক তখন তার পেছন থেকে যেন তার চিন্তাটাকেই মুখে আনল কেউ।
এত হুলস্থুল, এত কাণ্ড-কারখানা করলেন, কিন্তু ফল পাবেন খুব সামান্যই।
পাঁই করে ঘুরে দাঁড়াল সে। দেখল কথাটা বলেছে প্রসপেরো। বিস্মিত ও রাগান্বিত দ্রাগুত বলল, আপনি এখানে? কার হুকুমে এসেছেন? এখানে আপনার কী কাজ?
কাজ নয়, কৌতূহল। আমাকে আসতে কেউ বাধা দেয়নি, বাধ্যও করেনি, হাসিমুখে শান্তভাবে কথাগুলো বলল প্রসপেরো। ওদিকে ওকে এখানে দেখে রেগে গেছে দ্রাগুত। রাগে তার নাকের পাটা ফুলে গেছে, দ্রুত নিঃশ্বাস ফেলছে সে। প্রসপেরো বলে চলল, অযথা আপনার পরিশ্রম দেখছিলাম। না বলে পারছি না, কিন্তু যা করলেন তাতে আসলে আপনার বন্দিশালার দরজা আরো মজবুত হওয়া ছাড়া আর কিছু হয়নি, মেসার দ্রাগুত।
ভীষণ রেগে গেছে দ্রাগুত। ধরেই নিল তাকে উপহাস করতে এসেছে প্রসপেরো। রাগের চোটে বলে বসল, আল্লাহ আপনার আত্মাকে জাহান্নামে নিয়ে ফেলুক।
প্রসপেরো চলে যেত, কিন্তু যে সুরে দ্রাগুত বলেছে তাতেই আবার জবাব দিল প্রসপেরো। বলল, কোথায় আসল নিরাপত্তা আল্লাহ রেখেছেন তা দেখার মত দৃষ্টি যেন তিনি আপনাকে দেন।
বিস্মিত হলো দ্রাগুত। তবে নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করল সে। প্রশ্ন করল, নিরাপত্তার কথা বললেন, আপনি জানেন কোথায় তা পাব?
জানতাম, যদি আপনাকে ধ্বংস হতে না দিলে আমার কোন উপকার হত, তাহলে, বলল প্রসপেরো।
ধ্বংস? কে ধ্বংস হচ্ছে? আবার রেগে গেছে দ্রাগুত। শয়তানের অনুসারী জেনোয়িসরা লেগুনে ঢোকার চেষ্টা করেই দেখুক, কী হাল করি ওদের। তখনই দেখবেন কার ধ্বংস ঘনিয়ে এসেছে।
আচ্ছা! বেশ। দেখতেই পাচ্ছি আপনি প্রতিরক্ষার জন্য বেশ ভাল প্রস্তুতি নিয়েছেন। কিন্তু বলুন তো, আন্দ্রে এখানে ঢুকবে কেন? বাইরে প্রবেশপথ অবরোধ করে বসে থাকলে একসময় না একসময় আপনাকেই তার কাছে যেতে হবে। শকুনের মত ধৈর্য ধরতে জানে ডোরিয়া।
রেগে গেলেও যুক্তি-বুদ্ধি হারায়নি দ্রাগুত। চিন্তিতভাবে যেন নিজেকেই প্রশ্ন করল, আমি কেন ওর কাছে যাব?
খোঁচা মেরে প্রসপেরো বলল, ওকে জানাতে যাবেন, জেরার মাটি ছেড়ে আপনি কোথাও যাবেন না, এখানেই কৃষিকাজ করে বাকি জীবন কাটাবেন।
প্রসপেরোর উপহাস উপেক্ষা করল দ্রাগুত। বলল, আমি যেমন এখানে চিরকাল থাকতে পারব না আন্দ্রেও পারবে না। কিন্তু আমার আশ্রয় আছে। তাই শীতের ঝড়ো আবহাওয়া ওকে প্রণালীর মুখ থেকে সরিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য আমিই বরং অপেক্ষা করতে পারি।
হা-হা করে দ্রাগুতের মুখের উপরই হেসে উঠল প্রসপেরো। দ্রাগুতের সঙ্গে আরো কজন ক্যাপ্টেন দাঁড়িয়ে আছে তাদের। পাত্তাই দিল না ও। বলল; হ্যাঁ, ঠিকই বলেছেন, আন্দ্রে একটা গবেট বই কিছু নয়। এ ব্যাপারে সে মোটেও চিন্তাভাবনা করবে না।–
চিন্তা করলেই বা কী, চিন্তাভাবনা ওর উপকারে আসবে না।
আন্দ্রের জায়গায় আমি থাকলে কী করতাম বলতে পারি। আমি জেবরার প্রবেশমুখে একদল সৈন্য নামিয়ে দিতাম। তাদের বলে দিতাম যে-কোন মূল্যে আপনার এই দুর্গ দখল করতে। তারপর পুরো বহর নিয়ে সামনে বাড়তাম। আপনার ধারণা ডোরিয়া এমন কিছু ভাববে না?
শুনে এবার দ্রাগুতই হেসে ফেলল। বলল, আল্লাহ ডোরিয়াকে এই কাজ করার জন্য প্ররোচনা দিন। তাহলে ওকে দ্রুত ধ্বংস করতে পারব। এই কাজে ওর অন্তত আধা শক্তি ব্যবহার করতে হবে। ও এদিকের দখল নিতে লড়বে, আমি আরেক দিকে বাইরে থাকা ওর দলের অন্য অংশকে নিশ্চিন্তে ধ্বংস করতে থাকব। সেজন্যই এই দুর্গ বানিয়েছি। এবার হয়তো এই দুৰ্গটা আপনার কাছে কার্যকর কিছু বলে মনে হবে।
এই পর্যন্ত বলেই দ্রাগুত চলে যেত। কিন্তু প্রসপেরোর হাস্যোজ্জ্বল মুখ দেখে থেমে গেল। প্রসপেরো তখন বলল, ভাবছেন, আপনার পরিকল্পনা ডোরিয়া বুঝতে পারছে না? এখানে নামানোর মত লোক আসা পর্যন্ত আপনাকে এখানে অবরুদ্ধ করে রাখতে পারলেই হবে ওর। তাছাড়া নিজের লোক নামাবে না সে। বরং রিইনফোর্সমেন্ট আনাবে নেপলস থেকে। এখান থেকে খুব একটা দূরে নয় নেপলস। বাজি ধরে বলতে পারি, ইতিমধ্যেই ওঁাদকে খবর পাঠিয়ে দিয়েছে সে। শীত আসা পর্যন্ত সময়টা অনেক বেশি লম্বা, মেসার দ্রাগুত। আর যেমনটা বলেছি, ডোরিয়া ধৈর্য ধরতে জানে। ঠিক একটা শকুনের মত।
দ্রাগুতের চেহারায় ইতস্তত ভাব ফুটে উঠলেও কপট হাসির আড়ালে সেটাকে ভালমতই চাপা দিল সে। বলল, বোকার মত বাজি ধরেছেন। ডোরিয়ার হাতে আপনার মুক্তির আশায় বসে থাকুন। নিজের ক্যাপ্টেনদের মনোভাব পড়তে পারছে দ্রাগুত। তাই এবার ধমকে উঠল সে। বলল, গ্যালিতে যান। আমার কাজে নাক গলাবেন না। বিনা অনুমতিতে আবার গ্যালি থেকে নামলে বন্দি করা হবে আপনাকে। যান, দ্রুত চলে যান। বলে ঘুরে দাঁড়াল দ্রাগুত। দুজন কোর্সেয়ার অফিসারের এসকর্টে গ্যালিতে ফিরে গেল প্রসপেরো। তবে ও ভালভাবেই বুঝেছে, প্রসঙ্গটা, আবার উঠবে। তখনই জিয়ান্নার নিরাপত্তা নয়তো মুক্তি নিশ্চিত করবে ও।
পরবর্তী তিন দিনে প্রসপেরোর সামনে আর এল না দ্রাগুত। আসবেই বা কীভাবে, কেবল ঘুমানোর সময় হলে গ্যালিতে আসে সে। আর জেগে থাকাকালীন পুরো সময় কাটাচ্ছে দুর্গের দেখাশোনা করে।
ডোরিয়ার অবস্থান দ্বীপের একদম দক্ষিণে ঠিক দ্রাগুতের কামানের পাল্লার বাইরে। ওখানে আসলেই শকুনের মত পরম ধৈর্যে বসে আছে জেনোয়িস ফ্লিট। জুলাই মাসের মাথা খারাপ করে দেয়া গরমে ওরা অপেক্ষায় আছে যে হতাশ দ্রাগুত বাহিনী কখন লেগুনের বাইরে আসার জন্য মরিয়া হয়ে আক্রমণ শুরু করবে।
ওদিকে লেগুনের ভিতর বসে দ্রাগুত দেখছে নিজের অভিশপ্ত অবরুদ্ধ অবস্থা। আর দেখছে প্রসপেরো যেমন বলেছে, ডোরিয়া আসলেই তা-ই। ব্যাটা আসলেই শকুনের মত ধৈর্য ধরতে জানে। দিনকে দিন মেজাজ বিগড়াতে শুরু করেছে দ্রাগুতের। তুঙ্গে উঠে থাকছে রাগ, চরম ঘৃণাপূর্ণ হয়ে উঠছে তার দৃষ্টি। গোইয়ালাতার সেই লড়াইয়ের পর আবার কখনো জেনোয়িসদের হাতে তাকে বন্দি হতে হবে, তা দুঃস্বপ্নেও ভাবেনি সে। কিন্তু যেভাবেই ভাবুক না কেন, বন্দিত্ব এড়াবার কোন পথ তার চোখে পড়ছে না। গোইয়ালাতায় তাও লড়ার সুযোগ ছিল, কিন্তু এখানে তো দাঁড়াবার সুযোগই দেখছে না সে।
এদিকে লেগুনে সারাইখানায় জাহাজের কীলের মেরামতি প্রায় বন্ধ হয়ে আছে। কারণ যে-কোন মুহূর্তে সবগুলো জাহাজ ভাসানোর সিদ্ধান্ত নিতে পারে দ্রাগুত। কু-নাবিকরা সবাই অলস বসে থেকে সময় কাটাচ্ছে। দ্রাগুতের হুকুমের অপেক্ষায় বসে আছে ওরা আর এই পরিস্থিতিতে ফেলার জন্য মনে মনে দুষছে খোদাকে।
প্রসপেরোর সঙ্গে কথা বলার তৃতীয় দিনের কথা। অস্তিত্ব রক্ষার স্বার্থে নিজের অহংবোধ ত্যাগ করার সিদ্ধান্ত নিল দ্রাগুত। ফিরে এল গ্যালিতে। এসেই প্রসপেরোকে ডেকে পাঠাল।
টিবারনাকলে ডিভানে বসে, প্রসপেরোর জন্য অপেক্ষা করছে দ্রাগুত। তার পরনে পা থেকে মাথা পর্যন্ত ধবধবে সাদা পোশাক। কেবল ধূসর দাড়িটা একটু অন্যরকম লাগছে।
প্রসপেরো এলে পরে কথা বলা শুরু করল দ্রাগুত। বলল, সেদিন কিছু একটা ব্যাপারে আপনি একটু ইঙ্গিত দিয়েছিলেন। আসলে কী বলতে চাইছিলেন সেদিন, বলুন তো? হয়তো আপনার মাধ্যমে বাঁচার একটা রাস্তা আল্লাহ দেখিয়ে দিতেও পারেন।
নরম কণ্ঠে প্রসপেরো বলল, ডোরিয়ার জাল থেকে আপনি উদ্ধার পান সেটা আপনার একজন বন্ধু ও শুভানুধ্যায়ী হিসেবে আমিও চাই।
নিশ্চয়ই, নিশ্চয়ই। প্রার্থনা করি, আল্লাহ আপনাকে উন্নতি করার সুযোগ দিন। আমাকে সাহায্য করার ইচ্ছা আপনার জন্যও বৃথা যাবে না। আপনিও উপকৃত হবেন আশা করি।
পাশেই আইভরি আর মহামূল্য মুক্তো দিয়ে বানানো একটা নিচু টার্কিশ টুল দেখে ওটায় বসে পড়ল প্রসপেরো। বলল, আপনার এই মহা দুর্যোগের সময় সৌভাগ্যবশত আপনার উদ্ধারের উপায় আপনার হাতেই মজুত আছে। মনে হয় ব্যাপারটা আপনার চোখে পড়েনি। ডোরিয়ার কাছে দূত পাঠান যে তার ভাতিজি আর প্রসপেরো আপনার হাতে বন্দি। কেবলমাত্র আপনাকে নিরাপদে সাগরে বের হবার পথ করে দিলেই তাদের মুক্তি দেবেন আপনি।
ভিতরের উদ্বেগ ভিতরে রেখে স্বাভাবিক কণ্ঠেই কথাগুলো বলল প্রসপেরো। জুয়াড়ির মত সর্বস্ব টেবিলে তুলে দিয়ে ফলাফলের জন্য নিঃশ্বাস বন্ধ করে অপেক্ষা করছে প্রসপেরো।
দ্রাগুতের চোখের পাতাগুলো বেশ খানিকটা প্রসারিত হলো। নীরব হয়ে রইল সে বেশ কিছুক্ষণ। ওদিকে উদ্বেগে প্রসপেরোর দম বন্ধ হওয়ার দশা। মুখ খুলল দ্রাগুত। কিন্তু তার কণ্ঠে ফুটে উঠল খানিকটা উপহাস। বলল, আমি জানি, আপনারা আপনাদের মেয়েদের অনেক মূল্য দিয়ে থাকেন। কিন্তু তাই বলে একটা মেয়ের জন্য দ্রাগুত ও তার পুরো ফ্লিটকে ডোরিয়া ছেড়ে দেবে সেটা বিশ্বাসযোগ্য হতে পারে না।
বিশ্বাস করার দরকার কী, পরখ করেই দেখুন।
শুধু শুধু সময়ের অপচয়, বলল দ্রাগুত।
জবাবে প্রসপেরো বলল, আচ্ছা, বলুন তো এখন আপনার সময়ের ব্যবহার করবেন কোথায়? আমার পরামর্শটা যাচাই করে দেখুন। তাতে যদি ফল না-ও আসে ক্ষতি কী? আপনাকে তো কিছু হারাতে হচ্ছে না।
হারাতে হবে না বটে, তবে ওই জেনোয়িস কুত্তাটা আমাকে নিয়ে সবার সামনে হাসাহাসি করবে, বলল দ্রাগুত।
কিন্তু লোকে তার চেয়েও বেশি হাসবে যখন জানবে সুযোগ হাতে থাকা সত্ত্বেও তা ব্যবহার করেননি।
পচুক আপনার জিভ, রেগে গিয়ে বলল দ্রাগুত। তবে বলল, ব্যাপারটা নিয়ে আমি ভাবব।
প্রসপেরোর প্রস্তাব নিয়ে দ্রাগুত চিন্তাভাবনা করেছে। কিন্তু তার মনে কোন ভরসা জাগেনি। তারপরও পরদিন সিনানের গ্যালিতে চলে গেল সে। কোন সুযোগ, সেটা যত ছোটই হোক ছাড়তে রাজি নয় দ্রাগুত। সিনানের সালামের প্রত্যুত্তরে তখনই জিয়ান্নাকে তার সামনে হাজির করতে হুকুম করল দ্রাগুত।
ঔদাসীন্য ঝেড়ে উঠে দাঁড়াল সিনান। এ কয়দিন এভাবে বসে থেকেই সময় কাটিয়েছে সে। কমাণ্ডারের ইচ্ছা কী বুঝতে না পেরে তার ছোট ছোট চোখে ফুটে উঠল সন্দেহ। ধীরে ধীরে মাথা নেড়ে সন্দেহযুক্ত কণ্ঠে সে কমাণ্ডারকে প্রশ্ন করল, মেয়েটার সঙ্গে কী কাজ, দ্রাগুত? সে আপনার জন্য নয়। ওর ভাগ্য নির্ধারিত হয়ে গেছে। সুলতানের হেরেম ওর গন্তব্য।
চাঁছাছোলা কণ্ঠে দ্রাগুত জবাব দিল, আমি তার জন্য অন্য কোন গন্তব্যও চিন্তা করতে পারি।
সিনানের রাগ ওঠানোর জন্য এতটুকুই যথেষ্ট। ওর চর্বিসর্বস্ব কাঠামো রাগে কাঁপতে শুরু করল। চিকন কণ্ঠে চিৎকার করে বুলল, ওই মেয়ে আমার, সে আমার পুরস্কার। আপনি তাতে সম্মতিও দিয়েছেন। এখন কথা আপনাকে রাখতেই হবে।
আল্লাহ তোমাকে বুঝ দান করুন। বুঝতে পারছ না কেন, সুলতানের হেরেমে একে নিতে হলে আগে জেবরা থেকে আমাদের জীবিত বের হতে হবে। বলে প্রণালী থেকে বের হবার জন্য জিয়ান্নাকে কীভাবে কাজে লাগাবে সংক্ষেপে সিনানকে তা বলল দ্রাগুত। তখন খানিকটা অপ্রস্তুত হয়ে, খানিকটা নিমরাজি হয়ে জিয়ান্নাকে দ্রাগুতের সামনে হাজির করতে সম্মত হলো সিনান।
এল জিয়ান্না। ওর দৃপ্ত গাম্ভীর্য যেন দ্রাগুত আর সিনানের বুঝের বাইরে। যখন জিয়ান্নাদেরকে বন্দি করা হয় তখন ধূসর রঙের একটা স্যামাইট পরনে ছিল ওর, এখনও তা-ই আছে। জিয়ান্নার চোখের কোণে অবসাদু আর খানিকটা দুশ্চিন্তার ছাপ পড়েছে। তবে ওদের সামনে এসে জিয়ান্না যখন দাঁড়াল ওর দাঁড়ানোর ভঙ্গিতেই ফুটে উঠল দৃপ্ত-গম্ভীর, নির্লিপ্ততা। কোন অভিযোগ তো করলই না, উল্টো ওর নিলিপ্ততাই যেন চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দিল দ্রাগুতের দিকে।
দ্রাগুত বসে ছিল সিনানের কয়েক গজ দূরে একটা ডিভানের উপর। বসে বসে ছুরি দিয়ে পেন্সিল চোখা করছে সে। জিয়ান্নার নির্লিপ্ত ভাব দেখে বিস্ময়ে বাক্যহারা হয়ে গেল সে। পেন্সিল রেখে উঠে দাঁড়াল। সরাসরি চাইল জিয়ান্নার চোখের দিকে।
ওদিকে দ্রাগুতের চোখে রহস্যময় দৃষ্টি ফুটে উঠতে দেখে বিস্মিত হয়েছে সিনানও। রীতিমত অস্বস্তি বোধ করছে সে। একটু বাঁকা হয়ে বসে অস্বস্তিভরে কোর্তার হাতা খুঁটতে লাগল আর আনমনে বিড়বিড় করে আরবিতে কী যেন বলতে থাকল সিনান।
দ্রাগুত ওকে জানাল, জেবরার বাইরে অবস্থান নিয়েছে ডোরিয়া। এখন, দ্রাগুতকে ফ্লিটসহ এখান থেকে নিরাপদে বের হতে না দিলে জিয়ান্নার পরবর্তী দুরবস্থার জন্য দায়ী থাকবে কেবল ডোরিয়া। এসব এবং আরো কিছু শর্ত দিয়ে জিয়ান্নাকে বলল ডোরিয়ার কাছে চিঠি লিখতে। চিঠিটা জিয়ান্নার হাত দিয়ে লেখানো দ্রাগুতের জন্য খুবই জরুরি। কারণ মুসলিম ফ্লিটে তার অবস্থানের এটাই একমাত্র প্রমাণ।
জিয়ান্নার মাথায় প্রথমেই চিন্তা খেলল যে ডোরিয়া খুব কাছেই আছে। চিন্তাটা ওর ভিতর অন্যরকম একটা শক্তি এনে দিল। ওর চেহারা থেকে খসে পড়ল শান্ত ভাব। আশা আর খুশিটাকে কোনভাবেই চাপা দিয়ে রাখতে পারল না জিয়ান্না। ওর চোখ দুটো একটু প্রসারিত হলো আর চেহারায় ভেসে উঠল রঙের খেলা। উজ্জ্বল হয়ে উঠল মুখ। কিন্তু মুহূর্তের চিন্তা ওর পা মাটিতে এনে দিল। ডোরিয়ার কঠোর দায়িত্বপরায়ণতার কথা মনে পড়ল জিয়ান্নার। ব্যাপারটা সে দ্রাগুতকেও বলল। বলল যে, ওকে জিম্মি হিসেবে ব্যবহার করে কতটুকু ফল দ্রাগুত পাবে, সে ব্যাপারে ওর নিজেরই সন্দেহ আছে।
মুখ কালো হয়ে গেল দ্রাগুতের। বলল, আমিও তা-ই বলেছিলাম। কিন্তু মেসার প্রসপেরো বলছে এতেই নাকি কাজ হবে।
জিয়ান্না বুঝতে পারল প্রসপেরো এই প্রস্তাবটা আসলে দিয়েছে জিয়ান্নার নিরাপত্তার জন্য। আর ওর নিরাপত্তা নিয়ে সিনানকে উদ্বিগ্ন হতে দেখে সিনানের আগের আচরণও ক্ষমা করে দিল জিয়ান্না।
সেদিন বিকেলের কথা। দ্রাগুতের পাঠানো চিঠির জবাব এসেছে। জিয়ান্না যা ভেবেছিল তা-ই হয়েছে। ভীষণ অপমানজনক চিঠি পাঠিয়েছে ডোরিয়া। দ্রাগুতের মনে হলো প্রসপেরোর উস্কানিতে রাজি হয়েই এমন লজ্জিত হতে হয়েছে। ওকে। তাই রাগে কাঁপতে কাঁপতে ভাবছে ওকেও কোন শাস্তি দেবে কিনা।
তবে কোর্সেয়ার ফ্লিটে জিয়ান্নার উপস্থিতি বিশ্বাস করেছে ডোরিয়া। একইসঙ্গে উপহাস করে লিখেছে কয়েক দিনের মধ্যে ভাতিজিকে সে এমনিতেই পাবে। তাহলে অকারণে আর শুধু শুধু বন্দি বিনিময় করে তার লাভ কী। এবং দ্রাগুতকে সে সাবধান করে দিয়েছে যে, জিয়ান্নার যদি একটুও ক্ষতি হয় তাহলে সাধারণ একজন কোর্সেয়ার ধরা পড়লে যতটুকু সম্মান পায় দ্রাগুত তাও পাবে না। একটা বদমাশ জলদস্যুর সঙ্গে সবাই যেমন আচরণ করে দ্রাগুতের সঙ্গেও সেরকম আচরণই করা হবে। ড্রাগুত তখন টের পাবে হুকের সঙ্গে বেঁধে মাস্তুলে ঝুলিয়ে রাখলে কেমন লাগে। সবশেষে দ্রাগুতকে সে প্রস্তাব দিয়েছে সময় নষ্ট না করে ইম্পিরিয়াল কমাণ্ডার অর্থাৎ ডোরিয়ার কাছে আত্মসমর্পণ করতে। অথবা দ্রাগুত অপেক্ষা করতে পারে, ততদিনে ডোরিয়ার প্রস্তুতি নেয়াও শেষ হবে। তখন নিজেই আক্রমণে নামবে সে।
চিঠিটা দ্রাগুতকে পড়ে শোনাচ্ছিল একজন খ্রিস্টান দাস। থাবা দিয়ে তার হাত থেকে চিঠিটা কেড়ে নিল দ্রাগুত। টানের চোটে ছিঁড়ে গেল চিঠির নিচের অংশটা। দাঁতে দাঁত ঘষে কাগজটা দুমড়ে মুচড়ে ফেলল সে। সামনে পেলে হয়তো ডোরিয়াকেও একইভাবে মোচড়াত ও। একজন ওয়ার্ডেনকে নির্দেশ দিল প্রসপেরোকে টিবারনাকলে নিয়ে আসতে। প্রসপেরো টিবারনাকলে ঢুকতে ঢুকতে শুনতে পেল ডোরিয়াকে শাপশাপান্ত করছে দ্রাগুত। তারপর ঘোষণা করল ওদের ঘরের সব মেয়েই অভিশপ্ত। ভবিষ্যদ্বাণী করল কুকুর দিয়ে তুলে খাওয়াবে কবরে শায়িত ডোরিয়ার মৃতদেহ। আর আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করল ডোরিয়ার বংশ যেন তিনি নির্বংশ করে দেন ও ডোরিয়াকে যেন পাঠিয়ে দেন জাহান্নামের অতল গহ্বরে।
একসময় ঠাণ্ডা হলো দ্রাগুতের মেজাজ। মেঝেতে বসে পড়ল সে। প্রসপেরোকে বলল, দেখুন, শয়তানের ঔরসজাত ডোরিয়া কী জবাব পাঠিয়েছে। আপনার উপদেশ আমার জন্য কী অপমান কিনে এনেছে দেখুন। আপনার পরামর্শের কল্যাণে আমার অবস্থা এখন আগের চেয়েও নাজুক। নিন, নিজেই পড়ন।
পড়তে শুরু করল প্রসপেরো। আর ওকে ঘিরে শেকলবন্দি চিতার মত পায়চারী করতে থাকল দ্রাগুত।
পড়া শেষ করে শান্ত স্বরে প্রসপেরো বলল, যাক, অন্তত এটা জানা গেছে যে, জিয়ান্নার সঙ্গে খারাপ ব্যবহারের ফল কী হবে।
জায়গায় দাঁড়িয়ে পড়ল দ্রাগুত। এমনভাবে প্রসপেরোর দিকে তেড়ে এল যেন ঝাঁপিয়ে পড়বে ওর উপর। রাগে দ্রাগুতের চোখ দুটো বড় হয়ে গেছে, দাঁতে দাঁত ঘষছে সে। বলল, আমাকে চিঠিটা লিখতে উস্কে দিয়েছেন, কারণ এই জবাব আসবে সেটা আপনি জানতেন। আমার অবস্থার কথা ফাঁস করাই ছিল আপনার লক্ষ্য।
না, আমি আশা করেছিলাম ডোরিয়া আপনার সঙ্গে যথাযথ আচরণ করবে। ভেবেছিলাম, জিয়ান্না আপনার হাতে আছে জানলে আপনাকে একটা সুযোগ দেবে সে, বলতে বলতে চিঠিটা এগিয়ে দিল প্রসপেরো।
প্রসপেরোর হাত থেকে থাবা দিয়ে চিঠিটা নিল দ্রাগুত। দুমড়ে এক কোণে ছুঁড়ে ফেলে বলল, আপনার ষড়যন্ত্র সফল হয়েছে মনে করেছেন? ভাবছেন ইটালিয়ান কূটকৌশল দিয়ে আমাকে বোকা বানাতে পেরেছেন? মোহাম্মদ (সাঃ)-এর দাড়ির শপথ, আপনি এ থেকে কোন উপকার পাবেন না। আর যদি দেখি কোন সুবিধা পেয়ে গেছেন, তাহলে আপনাকে আমার নিজের হাতে ফাঁসিতে ঝোলাব। রাগে দ্রাগুতের গলা আবার চড়ে গেছে। রীতিমত চিৎকার করে কথা বলছে সে। ডোরিয়ার মত ভাবছেন, আমি লেগুনের বাইরে যাই বা এখানে বসে অপেক্ষা করি, আমার ধ্বংস নিশ্চিত? ভাবছেন এখন আমার করার কিছুই নেই? কিন্তু আল্লাহর কাছে হাজার শুকরিয়া, এখনও আমার হাতে দুয়েকটা কৌশল আছে, বলে পাগলের মত হেসে উঠল সে। এখান থেকে বেরুবার আরো একটা পথ আছে, যেটার ব্যাপারে আপনারা জানেন না। কাল সেই পথেই এখান থেকে বেরিয়ে যাব আমি। যদিও সেজন্য খুব চড়া মূল্য দিতে হবে। কিন্তু তাতে আপনার বা ডোরিয়ার কোন লাভ হবে না। আমার একটা লোক বা একটা জাহাজও ওই অবিশ্বাসী বদমাশ ডোরিয়ার হাতে পড়তে দেব না। বলে চলেছে, আগামী কাল আমরা লেগুন অতিক্রম করে বুখারায় ল্যাণ্ড করব। তারপর পায়ে হেঁটে আলজিয়ার্সের পথে রওনা হয়ে যাব। তবে তার আগে ধ্বংস করে দিয়ে যাব আমার ফ্লিটের জাহাজগুলো।
ডোরিয়া যখন দেখবে একটা শূন্য দ্বীপ পাহারা দিচ্ছে সে আর খাঁচা ছেড়ে পালিয়ে গেছে তার সাধের পাখি, তখন তার কেমন লাগবে বলুন দেখি? তখন, আমার শর্তে রাজি না হওয়ায় বসে বসে হাত কামড়ানো ছাড়া ওর আর কোন উপায় থাকবে না। আর যখন শুনবে সুলতানের হেরেমে নয় বরং আমার ভোগের সামগ্রী হয়েছে তার ভাতিজি জিয়ান্না, তখনই বা তার কেমন লাগবে? দুঃখ রাখার জায়গা থাকবে না তার। বুক চাপড়ে সে বলবে, আমার প্রস্তাবে রাজি হলেই ভাল করত।
প্রসপেরোর মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ার অবস্থা। কোনভাবে নিজেকে সামলাল ও। তারপর প্রায় যান্ত্রিক কণ্ঠে বলল, হয়তো। কিন্তু ফ্লিট হারিয়ে আপনাকে যে পরিমাণ কষ্ট সইতে হবে তার অর্ধেকও ডোরিয়া পাবে না।
দ্রাগুতের ফ্লিট তার কাছে যে-কোন কিছুর চেয়েও বেশি প্রিয়। ফলে প্রসপেরোর কথাটা শেলের মত গিয়ে বিধল তার বুকে। প্রসপেরোর মনে হলো, দ্রাগুতের চোখে পানি বুঝি চলেই এল। তিক্ত কণ্ঠে দ্রাগুত বলল, আগেই তো স্বীকার করেছি, এর জন্য আমাকে চরম মূল্য দিতে হবে। বহু কষ্টে নিজেকে শান্ত করল সে। শান্ত কণ্ঠেই বলল, তবে যেহেতু এটাই আল্লাহর ইচ্ছা, তাই কষ্ট হলেও পরোয়া নেই। এই কাজটাই করব আমি।
দ্রাগুতের মন-মানসিকতা এখন ভীষণ বিপজ্জনক। তবুও প্রসপেরো বলল, সত্যি বলতে, আপনার এখান থেকে পালিয়ে যাওয়ার মধ্যে ডোরিয়ার জন্য বিজয় ছাড়া আর কিছু আমি দেখছি না। আপনার ফ্লিট ডুবে যাবে, লোক-লস্কর নিয়ে ফেরারির মত ঘুরে বেড়াবেন মরুভূমিতে। আবার কবে সাগরে ফিরতে পারবেন কেবল ঈশ্বর জানে। এর চেয়ে বেশি ডোরিয়া আর কী চাইতে পারে। তবে, আপনার জায়গায় আমি থাকলে সর্বশক্তি নিয়ে যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়তাম আমি। তাতেও একই ফল হত, কিন্তু অন্তত নিজের সম্মান বাঁচত। তাছাড়া এখন আপনার আর হারানোর আছেই বা কী?
পরামর্শ দিচ্ছেন না পরিহাস করছেন? একবার তো আপনার পরামর্শ শুনে মান-সম্মানের ভরাডুবি করিয়েছি। উপহাস করার আগেই সাবধান হোন। কারণ আজীবন আমার ধৈর্য থাকবে না। কাজেই সাবধান, বলে ঝড়ের মত প্রসপেরোকে পাশ কাটিয়ে চলে গেল সে। গেল তীরে হাউট আস সাওম-এ তার বানানো দুর্গে। ওখান থেকেই তার চোখে পড়ল এক মাইল দূরে কয়েকটা ইম্পিরিয়াল গ্যালি নড়তে-চড়তে শুরু করেছে। স্পষ্টতই ওগুলো স্কাউটশিপ। সঙ্গে সঙ্গেই হুকুম করল, ওই গ্যালিগুলোর উপর যেন সবগুলো কামান থেকে গোলাবর্ষণ করা হয়। যদিও সবারই জানা আছে, অতদূরে গোলাবর্ষণ করলেও কোন লাভ হবে না। কারণ জাহাজগুলো কামানের আওতার বাইরে।
কামানের গোলার আওয়াজে কেঁপে উঠল পুরো দ্বীপের আকাশ-বাতাস। সিগাল আর অন্যান্য সামুদ্রিক পাখির আতঙ্কিত কাকলিতে মুখরিত হয়ে উঠল দ্বীপের বাতাস। দ্বীপের বাসিন্দারাও বেরিয়ে এল ঘটনা কী জানার জন্য। লাভের মধ্যে লাভ হলো, ডোরিয়ার জানা হয়ে গেল দ্রাগুতের কামান কয়টা। এমনকী দ্রাগুত যে একটা দুর্গও বানিয়েছে সেটাও জেনে গেল সে।
ডোরিয়া অবশ্য এমন কিছু আশা করেনি। প্রসপেরো যেমনটা ধারণা করেছিল ঠিক সেভাবেই এগুনোর প্রস্তুতি নিচ্ছে সে। ইতিমধ্যেই পদাতিক সৈন্য চেয়ে তার সবচেয়ে দ্রুতগামী ট্রাইরেমটা নেপলসের দিকে পাঠিয়ে দিয়েছে। আশা করছে সৈন্য আসার আগ পর্যন্ত দ্রাগুতকে লেগুনেই আটকে রাখতে পারবে। আর এরমধ্যেই তার জাহাজগুলোর মেরামতির কাজও সেরে ফেলবে। কারণ ইম্পিরিয়াল বাহিনী এলে তাদের সামনে ফ্লিটের পর্যদস্ত চেহারা দেখাতে চায় না সে। ওদিকে সম্রাটের কাছে এরই মধ্যে খবর পাঠিয়ে দিয়েছে যে, সম্রাট ধরে নিতে পারে, দ্রাগুতকে ধরে ফেলেছে ডোরিয়া। এমনকী এটাও ধরে নিতে পারে যে পুরো ফ্লিট সহ ধ্বংস হয়ে গেছে দ্রাগুত। সঙ্গে যুক্ত করেছে মেহেদিয়ায় আক্রমণ করে ওই শহরটাকে গুঁড়িয়ে দেয়ার কথা। অনেকের কাছেই এটা ডোরিয়ার খ্যাতির মুকুটে আরেকটি উজ্জ্বল পালক বলে পরিগণিত হয়েছে।
দ্রাগুতের গোলাবর্ষণ দেখে হাসি পেয়ে গেল ডোরিয়ার। দ্রাগুতের শিশুসুলভ বোকামি দেখে খানিকটা মজাও পেয়েছে সে। তবে নিজের গ্যালিগুলোকে তীর থেকে নিরাপদ দূরত্ব বজায় রাখার নির্দেশ দিতে ভুলল না ডোরিয়া।