৬. নক্ষত্রের প্রবেশদ্বার

ষষ্ঠ পর্ব : নক্ষত্রের প্রবেশদ্বার

অধ্যায় ৪১. মহাকেন্দ্র

গতির কোনো অনুভূতি ছিল না কিন্তু সে সেই অসম্ভব তারার রাজ্যে পড়ে যাচ্ছিল যেগুলো উপগ্রহের কালো বুকে জ্বলছে অবিরত। না-ঠিক সেখানে ওরা ছিল না। সে বুঝতে পারে। সে হতাশভাবে ভাবে, আগেই হাইপারস্পেস আর ট্রান্সডাইমেনশনাল ডাক্ট থিওরিতে বিশ্বাস করা উচিত ছিল।

কিন্তু আর সব শতকোটি মানুষের কাছে সেটা থিওরি হলেও ডেভিড বোম্যানের কাছে নয়।

সম্ভবত ছাদটার ছাদছাদ ভাবই আসলে দৃষ্টিভ্রম, এর কোনো তল নেই। কিংবা উপরিতল আছে, সেটা মিলিয়ে গেছে তাকে ভেতরে নেয়ার জন্য। কিন্তু ঠিক কোথায় নেয়ার জন্য? এক বিরাট চৌকোণা গর্তের ভিতর সে সরাসরি পড়ছিল। গতি বাড়ছিল প্রতি মুহূর্তে। কিন্তু তলাটা কখনোই এগিয়ে আসেনি।

শুধু তারকাগুলো সরে যাচ্ছিল তাদের ধারক ফ্রেম থেকে। প্রথম প্রথম সে বুঝতেই পারেনি তাদের সরে যাওয়ার ব্যাপারটা। কিন্তু পরেই আসল দৃশ্য চোখে পড়ে। ছড়িয়ে পড়ছে নক্ষত্রলোক, ধেয়ে আসছে তার দিকে! কেন্দ্রের দিকের তারাগুলোকে তেমন নড়তে দেখা যায় না, পরিধির দিকেরগুলো গতিবৃদ্ধি করেই চলেছে। তারপর তারা আলোর রেখার মতো বিলীন হয়ে যায়। তার মানে উঠে আসছে জগৎটা। কেমন জগৎ এটা? কেমন জগৎ!

যেন অসীম কোনো উৎসের দিকে এই যাওয়া। মাঝখানটায় যাওয়ার পালা শেষ হবে কিনা বোঝা যায় না। সে কোনো সূর্যের বুকে পড়ে যাওয়ার আগ পর্যন্ত কি এই ব্যাপার হতেই থাকবে? কিন্তু তারা কেউ সামনে আসে না। সবাই একটা বিরাট দূরত্ব রেখে সরে যায় সেই অনন্ত কালো ফ্রেমের গায়ে। উঠে আসে আরো।

এখনো শেষপ্রান্ত এগিয়ে আসেনি। মনে হয় যেন দেয়ালগুলোও তার সাথে সাথে চলেছে। কিন্তু ত্বরণ অনুভব করবে না এ কেমন কথা! নাকি সে সত্যি সত্যি স্থিরই আছে, চারদিকে ছুটে চলছে মহাকালের মহাকাশ…

শুধু স্পেস নয়, এবার সে বোঝে তার সাথে কী হচ্ছে। পোডের ইট্রুমেন্ট প্যানেলের ছোট্ট ঘড়িটিও এবার পাগলামি শুরু করে দেয়।

সাধারণত সেকেন্ডের দশভাগের একভাগ দেখানো সংখ্যাগুলো দেখে বোঝ যাবার আগেই হাওয়া হয়ে যায়। এখন সে ভালভাবেই সেগুলোকে পড়তে পারছে। শেষে সময় গণক থেমে গেল সেকেন্ডের দশভাগের পাঁচ আর ছয়ের মধ্যে। ক্লান্ত সময় তার অবিরাম চলা বন্ধ করে দিয়েছে!

সে দেখতে পাচ্ছে, ঠিকমতো বুঝছে সব, এখনো চারপাশে দেয়াল। সে দেয়ালের গতি শূন্যও হতে পারে, আবার আলোর চেয়ে লাখগুণ বেশিও হতে পারে। কেন যেন সে একবিন্দুও আশ্চর্য হলো না। মনে কেন যেন একটুও ভয় নেই। উল্টো অবাক করা শান্ত ভাব ঘিরে ধরেছে তাকে। একবার তাকে স্পেস মেডিকরা হ্যালুসিলেশন ড্রাগ দিয়ে পরীক্ষা করেছিল। সে হঠাৎই বুঝছে, তার চারপাশটা অবাক করা, তাতে কী-ভয় পাওয়ার কিছু নেই।

একটা রহস্যের আশায় সে শত কোটি মাইল পাড়ি দিয়ে এসেছে, সে রহস্য এবার হাজির হবে সামনে।

সামনের চৌকোণাটা আলোময়। উজ্জ্বল তারাগুলো একটা দুধ-সাগরে মিলিয়ে যাচ্ছে। যেন স্পেস পোড কোনো অদৃশ্য সূর্যের আলোয় আলোকিত কুয়াশা-মেঘের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে প্রতিনিয়ত।

এবার সে টানেল ছেড়ে যাবে। কিন্তু দূরপ্রান্ত এখনো এগিয়ে আসেনি। তারপর একসময় এগিয়ে আসে, ছড়িয়ে পড়ে তার সামনে।

হঠাৎ মনে হল সে উপরে উঠছে। সে কি জ্যাপেটাসের অন্য প্রান্ত ধরে উঠে আসছে? মুহূর্তেই বাতিল হয়ে যায় ধারণাটা। এর সাথে জ্যাপেটাস বা মানবীয় হিসাব নিকাশ বা সৌরজগতের কোনো সম্পর্ক নেই।

কোনো বায়ুমণ্ডল না থাকায় সে অবিশ্বাস্য নিচের দৃশ্যও দেখছে পরিষ্কার। ওটা একেবারে সমতল! সে নিশ্চয়ই এক অকল্পনীয় রকমের বড় ভুবনের উপর ভাসছে। নিচে দেখতে পেল অনেক অনেক সূক্ষ্ম দাগ, সেগুলো নিশ্চয়ই মাইলের পর মাইল এলাকাজুড়ে আছে। যেন কোনো পাগলাটে মহাকাশের খেলুড়ে ত্রিকোণ, বৃত্ত, চতুর্ভুজ এসব এঁকে খুব মজা পেয়েছে কোনোদিন। বোম্যান কয়েকটা এলাকার মাঝখানে কালো কালে কী যেন দেখতে পায়। ভালমতো খেয়াল করে সবগুলোর ভিতরেই একটা করে টি এম এ’র অস্তিত্ব দেখতে পায় সে।

উপরের আকাশ আরো অদ্ভুতুড়ে আকার নিয়েছে, নিচের অসীম সমতলের চেয়েও বিস্তৃত তর হাল। সেখানে কোনো তারা নেই, মহাকাশের চিরাচরিত অন্ধকার নেই। আছে শুধু হাল্কা দ্যুতির দুধসাদা অসীম এক আকাশ।

বোম্যান একবার অ্যান্টার্কটিকের এক বর্ণনা শুনেছিল। পিংপং বলের মতো চারদিক সাদা আর সাদা। কথাটা নিশ্চয়ই সেখানে না মানিয়ে এখানে মানিয়ে যায়। এখানকার সাদার পেছনে কোনো মহাজাগতিক বস্তুগত কারণ নেই। এ হল আসল বায়ুশূন্যতা।

এবার তার সচেতনতা অন্যদিকে চলে যায়। জায়গাটা পুরোপুরি খালি নয়! উপরে, অকল্পনীয় উপরে ছোট ছোট কালো বিন্দু চোখে পড়ে। সেগুলো কী?

বোম্যান একজন জ্যোতির্বিদ। স্থানটা চিনে নিতে তার তাই তেমন সমস্যা হয় না।

সেই কালো বিন্দুগুলোই সাদা নক্ষত্র ছিল, আর দুধসাদা স্পেস ছিল কালো। সে গ্যালাক্সি মিল্কি ওয়ের ছবির উল্টা দৃশ্যটা দেখছে!

খোদার দোহাই! আমি কোথায়! নিজেকে প্রশ্ন করে বোম্যান। প্রশ্ন করেই হঠাৎ সে বুঝে ফেলে আর কোনোদিন সে উত্তরটা জানতে পারবে না। দেখে মনে হচ্ছে পুরো মহাবিশ্ব…পুরো ইউনিভার্সকে উল্টে দেয়া হয়েছে, টেনে বাইরের দিককে ভিতরে আর ভিতরের দিকে বাইরে এনে ফেলা হয়েছে। এ স্থান মানুষের জন্য নয়।

ক্যাপসুলটা যথেষ্ট গরম হলেও ডেভ বোম্যান কাঁপতে শুরু করে থরথরিয়ে। বন্ধ করতে চায় নিজের চোখ, অস্বীকার করে চারপাশের অনিশ্চয়তাকে। কিন্তু কাজটা কাপুরুষতা। সে চোখ বন্ধ করবে না। সে দেখবে। শেষ পর্যন্ত দেখবে।

জগত্তা ধীরে ধীরে তার নিচে ঘুরে উঠল। কিন্তু দৃশ্যপটে কোনো পরিবর্তন আসেনি। অনুমানে ধরে নেয় এখন সে সারফেসের দশ মাইল উপরে আছে। হাজার চেষ্টা করেও জীবনের কোনো চিহ্ন বের করতে পারেনি। বুদ্ধিমত্তা এখানে এসেছিল। নিজের ইচ্ছামতো কাজ করিয়েছে। তারপর চলে গেছে কাজ শেষে।

হঠাই প্রায় বিশ মাইল দূরে উপরে আরেকটা জিনিস ভাসতে দেখল। তাকাতে তাকাতেই সেটা চলে গেল দূরে। সিলিন্ডারের মতো লম্বাটে জিনিসটা হাজারো ধাতব কাঠামোর একটা সমন্বয়। কোনো কমলালেবুকে ছিলে ফেললে যেমন হয় তেমন করেই এর বাইরের পুরো দেয়াল আর আবরণ নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে। কত হাজার বছর ধরে শূণ্য মহাকাশযানটা ঘুরতে ঘুরতে এ অবস্থায় পড়েছে কে জানে! আর কারা সেই প্রাণী!

এমন সময় সে পরিত্যক্ত জিনিসটার কথা ভুলে গেল সামনে আরো একটা কিছু আসতে দেখে।

প্রথমে জিনিসটাকে সমতল চাকতির মতো লেগেছিল, পরে বুঝতে পারে সেটা সরাসরি তার দিকে আসাতেই এমন দেখা যায়। কাছে এসে পাশ কাটিয়ে গেলে সে বুঝতে পারে যে জিনিসটা লাটিমের মতো আর কয়েকশো ফুট লম্বা। এও বোধহয় কোনো শিপ। ঘুরতে ঘুরতে এগোয় বলে তেমন কিছু বোঝা যায়নি।

জিনিসটা অনেক দূরে চলে যাবার আগ পর্যন্ত সে চোখ ফেরাতে পারে না। তারপর বুঝতে পারে যদি তার চোখ ঠিক দেখে থাকে তো এর স্রষ্টারা মানুষের পরিচিত একটা ব্যাপারের সাথে মিল রেখেছে। তাদের জাহাজ বানানোর উপাদানটা পরিচিত হলেও সহজলভ্য নয়। স্বর্ণ।

বোম্যান আবারো তাকায় রিয়ারভিউ মিররে। সেটা তাকে পুরোপুরি উপেক্ষা করে চলে গেছে। সে তো উপেক্ষা করতে পারে না। নিচের বিরাট গ্রহের লক্ষ প্রবেশপথের কোনো একটা দিয়ে শিপটা ঢুকে গেল ভিতরে। আর কেউ নেই। এবার একাকীত্বটা বড় বেশি বাজছে বোম্যানের অন্তরে।

একটু পর নিজেও নামতে শুরু করে উপরিতলের দিকে। এখনো আরেক চতুষ্কোণী খাদক হাঁ করে আছে। খালি আকাশ বন্ধ হয়ে গেল, বিশ্রাম নেয়া শুরু করল ঘড়ি, এবং আবারো পোডটা অসীম কোনো গহ্বরের সন্ধানে নেমে পড়ল চৌকোণা পথে।

কিন্তু এবার সে নিশ্চিত যে আর ফেরা হচ্ছে না সৌরজগতে। কিন্তু এখন তার বোধ স্মৃতিকাতরতার অতীতে চলে গেছে। কারণ সে এমন কিছুর খোঁজ পেয়ে গেছে যার পর আর পাওয়ার কিছু বাকী থাকে না।

হায়, মানুষ জানতে পারল না। সে মানুষকে কথাটা জানাতে পারল না।

সৃষ্টি জগতের সব সৌরজগতেই একটা করে প্রবেশদ্বার আছে। সেই সব প্রবেশদ্বার একত্র হয়েছে এমন কোথাও যেখানে সময় থমকে দিয়ে পুরো গ্যালাক্সির প্রকৃতিকে পেছনদিকে টেনে রাখা হয়েছে। জানা থাকলে সেখান থেকে ইচ্ছামতো যেখানে খুশি যাওয়া যায়। কোটি কোটি আলোকবর্ষ পথ যেতে হলে পৃথিবী থেকে জ্যাপেটাসে আসতে হবে। জ্যাপেটাস থেকে এখানে, এখান থেকে লক্ষ্য সৌর জগতের প্রবেশদ্বারে, ব্যস। এক জগৎ থেকে আরেক জগতে যেতে হলে মহাশূন্য এমনকি নিজের সৌরজগৎ পেরুনোরও কোনো দরকার নেই।

এ ‘স্থান’ হল পুরো গ্যালাক্সির কেন্দ্রীয় স্টেশন।

অধ্যায় ৪২. অচেনী আকাশ

অনেক সামনে, পথের শেষ প্রান্ত ধীরে ধীরে দৃশ্যমান হয়ে আসে। তারপর ছোট্ট স্পেসপোড তার সামনে নতুন আকাশ দেখতে পায়।

সে আবার স্বাভাবিক স্পেসে ফিরে এসেছে। কিন্তু একটু চোখ বুলিয়েই বুঝে নিতে পারে যে এটা সে আকাশ নয়। এখান থেকে পৃথিবী কত শত আলোকবর্ষ দূরে তা কেউ বলতে পারবে না। সে তারার জগৎ ভালমতো চেনে। এই নক্ষত্রগুলোর কোনোটা কোনো মানুষ খালি চোখে দেখতে পায়নি।

বেশিরভাগ তারকাই দ্যুতিময় আলোর মালায় গাঁথা। মাঝে মাঝে মহাজাগতিক ধুলো শুধু সে পথকে অদৃশ্য করে দিয়েছে। দেখতে মিল্কি ওয়ের মতোই কিন্তু অনেক অনেক উজ্জ্বল। তার মানে সে গ্যালাক্সির সেই বিজন প্রান্তর থেকে ঘন কোনো এলাকায় চলে এসেছে। সৌরজগত গ্যালাক্সির প্রান্তসীমায় অবস্থিত। এতটাই প্রান্তে যে প্রায় পুরো গ্যালাক্সিটাকেই পৃথিবী থেকে আলাদা করে দেখা সম্ভব। সেখানে তারার দল আলাদা আলাদা আর অনেক দূরে দূরে বাস করে। সামনের আলোকমালাটা সম্ভবত গ্যালাক্সির কোনো বাহু।

সে আশা করে এটা মিল্কি ওয়ে। কারণ ঘর থেকে আরও দূরে চলে যেতে চায় না। একটু পরেই বুঝতে পারে ভাবনাটা শুধু বোকাটেই নয়, ছেলেমানুষী। সে এত দূরে চলে এসেছে যে এখানে এখন কোনো তারা বিস্ফোরিত হলে পৃথিবীর টেলিস্কোপে তা ধরা পড়বে কয়েক শতাব্দী পর। সহস্রাব্দও হতে পারে। এখানে থাকা আর অন্য কোনো গ্যালাক্সিতে চলে যাওয়ায় কোনো তফাৎ নেই।

সে পেছনে তাকায়। কোত্থেকে উদয় হল দেখতে হবে। এবার আরো একটা হোঁচট অপেক্ষা করছিল। পেছনে কোনো স্টেশন বা জ্যাপেটাসের মতো কোনো এলাকা নেই। শুধুই কালো আকাশের গায়ে তারার মেলা। তার মানে পৃথিবী থেকে অন্য জগতে যেতে হলে জ্যাপেটাসে না গেলেও চলবে। পৃথিবীর সামনেই কোনো পথ হাজির হতে পারে, আবার যেখানে যাবার কথা সেখানকার আকাশে উগড়ে দিতে পারে।

কিন্তু নতুন করে পুরোনো ভাবনা তাকে পেয়ে বসে। অচেনা আকাশে চেনা কিছুই নেই এখন। একটা নক্ষত্রদ্বার থাকলেও তাকে পরিচিত বলা যেত।

সামনে অত্যন্ত নিখুঁত একটা নক্ষত্র-গোলক। একক কোনো নক্ষত্র নয়, অসীম তারার দল। নক্ষত্রপুঞ্জ। এগিয়ে আসছে প্রতি মুহূর্তে। কেন্দ্রে আলো আর আলো, কোনো নক্ষত্রকে আলাদা করে দেখার উপায় নেই। বাইরের দিকটা হঠাৎ করে শেষ হয়ে যায়নি বরং হাল্কা হয়ে মিশে গেছে কালো আকাশের সাথে। আকৃতি এত বিশাল যে হাজারটা সৌরজগৎ এর ভিতরে ছেড়ে দিলে খুঁজে পাওয়া দুষ্কর হয়ে যাবে।

বোম্যান জানে এ মহামহিম অপার্থিব এবং অকল্পনীয় বিশাল আকৃতির চেয়েও বড় এলাকাটার নাম গ্লোবুলার ক্লাস্টার। সে আবারো এমন একটা কিছুর দিকে তাকিয়ে আছে যা আর কোনো মানুষের চোখ কোনোদিন দেখেনি। এমনকি সবচে শক্তিমান টেলিস্কোপেও এ দৃশ্য একেবারে অস্পষ্ট দেখা যাবে।

তার কোনো নক্ষত্রপুঞ্জের দূরত্ব মনে পড়ছে না, কিন্তু এটুকু মনে আছে যে পৃথিবীর সবচে কাছেরটাও কয়েক হাজার আলোকবর্ষ দূরে অবস্থিত।

কেমন করে যেন পোডটা আরো ভিতরে চলে গেল, সেখানে এক নতুন বিস্ময় ওৎ পেতে আছে। সামনে এক বিরাট লালচে নক্ষত্র। রেড জায়ান্ট স্টার। এর উজ্জ্বলতা এতই স্নান যে ভোলা চোখে তাকাতেও কোনো সমস্যা হয় না। এখান থেকে পৃথিবীর আকাশের চাঁদের চেয়েও বড় দেখাচ্ছে। এর দীপ্তিটা জ্বলন্ত কয়লার চেয়ে বেশি নয়। লালের গায়ে হলুদের চিকণ রেখা। সরু দাগগুলো যে হাজার মাইলের খরস্রোতা আগুন-নদী তা বোঝাই যায় না। ওরা মরতে বসা সূর্যের বুকে হারিয়ে যাবার আগে যথাসম্ভব চলাচল করে নিচ্ছে।

মৃতপ্রায় শব্দটা মানুষের ক্ষেত্রে ঠিক থাকলেও সূর্যের ক্ষেত্রে যেন মানায় না। এ সূর্য তার যৌবনের অনেকগুলো ধাপ পেরিয়ে এসে দ্যুতি হারিয়ে বসেছে। তার জ্যোতির্ময় বেগুনী, নীল আর সবুজ বর্ণালীর শত শত কোটি বছরের যুগ শেষ করে শান্ত সৌম্য দীপ্ত রূপ নিয়েছে আরো অনাগত ভবিষ্যতের অপেক্ষায়। এবং বিগত সময়ের তুলনায় অনাগত সময় আরো আরো বিশাল ব্যাপ্তি নিয়ে আসবে। তার দুর্দম যৌবনের চেয়ে সৌম্য-তারুণ্য চলবে হাজারগুণ বেশি সময় ধরে।

এখন আর বোম্যান কোনো নিয়ন্ত্রণ অনুভব করছে না। কিন্তু সে জানে, যে শক্তি তাকে এখানে টেনে এনেছে সেটা তার বজ্রমুষ্ঠিকে একটুও শিথিল করেনি। পৃথিবীর সমস্ত জ্ঞান-বিজ্ঞান-প্রযুক্তি যেন তার সামনে হাস্যকর ও মূল্যহীন।

সে বোঝার চেষ্টা করছে কোনো অবশ্যম্ভাবী নিয়তি এবার তাকে টানবে। সম্ভবত এই সূর্যের কোনো কক্ষপথ ধরে কোনো গ্রহ ঘুরছে, সেখানে তাকে হয়তো নিয়ে যাওয়া হবে। খুঁজতে খুঁজতে হঠাৎ সে সূর্যের প্রান্তসীমায় অবাক করা কিছু দৃশ্য দেখে স্তব্ধ হয়ে যায়।

পেছনে, একটা সাদা জ্যোতির উদয় হয়েছে, এগিয়ে আসছে দ্রুত। উঠে আসছে এ সূর্যের দিকে। সেটাই কি সময় থেকে সময়ে নক্ষত্র থেকে নক্ষত্রে ঘুরে বেড়ায়? পরে বুঝতে পারে, না। সেটাও এক নক্ষত্র, আকারে শুধু ছোট আর হাজারগুণ উজ্জ্বল।

সে নিজের ভাবনা দেখে নিজেই হেসে ওঠে। সূর্যোদয়ে সে বিমোহিত… সূর্যোদয়, একটা সূর্যের উপর!

নীলচে আলোর এক ছোট্ট গোলক সেটা। ছোট সূর্যটা খুব দ্রুত সঙ্গীর চারপাশে ঘুরে বেড়ায় মনে হচ্ছে। কিন্তু এই সূর্যের কি কোনো প্রতিক্রিয়াই হবে না? ভাবতে ভাবতেই সে দেখতে পায় প্রতিক্রিয়ার রূপ। ছোট দানবের শক্তির টানে কাবু হয়ে বড় নক্ষত্রের গা থেকে হাজার হাজার মাইল লম্বা আগুনের শিখা উঠে যাচ্ছে উপরদিকে। আগুনের জোয়ার!

সেই ছোট্টটা নিশ্চয়ই কোনো হোয়াইট ডোয়ার্ফ। এরা আকারে বড়জোর পৃথিবীর সমান, কিন্তু ভরে কোটিগুণ বড়। এমন বেখাপ্পা সৌর জুটি আসলে মোটেও বেখাপ্পা নয়। কিন্তু বোম্যান কোনোদিন এমন দৃশ্য দেখার বেখাপ্পা কল্পনা করেনি।

এরমধ্যেই সাদা বামন তার সাথীর অর্ধেকটা পার করে ফেলেছে। সম্ভবত কয়েক মিনিটে একবার পাক খায় পুরো এলাকাটা। অবশেষে বোম্যান বুঝতে পারে যে সেও ভেসে চলেছে। কারণ অন্তরালের এক ঝকঝকে নক্ষত্র এর মধ্যেই সামনে আসতে আসতে অনেকটা স্পষ্ট বস্তুতে পরিণত হয়েছে। নিশ্চয়ই এখানে সে যাচ্ছে।

কিন্তু সেটা কোনো গ্রহ বা উপগ্রহ নয়।

সেটা এক ধাতব জিনিস। কৃত্রিম উপগ্রহের মতো এর নাম দেয়া যায় কৃত্রিম গ্রহ। বিশাল তার আকৃতি, সারফেসে বসে থাকা শহরের সমান একেকটা মেশিন দেখেও সে আঁতকে ওঠে। সে যতবার আঁতকে উঠেছে গত কয়েক মাসে ততবার বোধহয় কোনো মানুষ চমকায় না এক জীবনে।

বড়গুলোর প্রতিটির চারপাশে একরের পর একর এলাকাজুড়ে ছোট মেশিনের রাজত্ব। সেগুলোও সমান নয়। কোনো কোনোটা দেখা যায় না আবার কোনোটা চোখে ধাক্কা দেয়। সে এমন কয়েকটা এলাকা পেরুনোর পর বুঝতে পারে যে ছোট মেশিনগুলোর প্রতিটি অঞ্চল একেকটি মহাকাশ নৌবহর। আর গোলাকার ধাতব জিনিসটা আর কিছু নয়, মহাজাগতিক পার্কিং লট।

যেহেতু পুরো পরিবেশ এবং এর প্রতিটি অংশই তার অচেনা সেহেতু সে কিছুতেই আন্দাজ করতে পারল না নিচের দৃশ্যটা কত বড়। সেখানে কোনো মহাকাশ নৌবহরে ডিসকভারিকে ঢুকিয়ে দিয়ে উপরে উঠে এলে বোঝা যেত। নিচের ওগুলো কত বর্ণের, গোত্রের আর আকৃতির তা বলে শেষ করা সম্ভব নয়। কোনোটা স্বচ্ছ, কোনোটা আলোকদাত্রী, কেউ লম্বা, কোনোটা পুরোপুরি চাকতির মতো, কোনোটা আকার বদলাচ্ছে স্থির থেকেই…মাথা খারাপ করা দৃশ্য।

এ নিশ্চয়ই কোনো মহাজাগতিক অর্থনৈতিক মিলনমেলা।

কিংবা মিলনমেলা ছিল কয়েক মিলিয়ন বছর আগে। কারণ জীবনের কোনো নিদর্শনই সে দেখতে পায়নি অনেকক্ষণ চেয়ে থেকেও। বরং মহাকালের হাজারো উল্কা নির্দ্বিধায় এর উপর পড়েছে বছরের পর বছর। এত বিশাল জিনিসটা কেন অকেজো পড়ে আছে তা আর সে জানে না। যা জানে তা হল সামনের ঐ ধাতব গড়নটা এখন শুধুই মহাজাগতিক আস্তাকুঁড়।

সে কত সহস্র বছরের ব্যবধানে এসেছে তাও জানে না। এই মহা সম্মেলন আর নির্মাতাদের দেখতে পেল না শুধু সময়ের ব্যবধানের জন্য। একটু আঁৎকে ওঠে সে কথাটা ভেবে। তার মন অপার্থিব বুদ্ধিমত্তার খোঁজে আঁকুপাকু করছিল এতদিন।

সে কোনো পুরনো ফাঁদে আটকা পড়ে যায়নিতো? লাখো বছর আগে স্টেশন গ্রহের যে গর্তে ও পড়ে যায় সেই পথ ধরে যারা যেত তারা হয়তো এখানেই নিজেদের নিয়ে আসতে চেষ্টা করত। সেই পথ একই কাজ করে যাচ্ছে আজো, তারাই শুধু নেই।

আর তার পর, আরো ভয়াবহ ধারণা খেলে গেল ডেভ বোম্যানের মাথায়। নাকি পথটা এখন শুধু নষ্ট স্পেসশিপ আর মহাকাশ জঞ্জাল নিয়ে আসে এখানে? আরো অনেক প্রাণীর মতো সেও কি বাতাসের অভাব পড়ার পর এই স্পেস পোডের ভিতর মারা পড়বে?

যাক, আরো আশা করাটা অবান্তর। এরই মধ্যে এমন শত ব্যাপার দেখে ফেলেছে যার যে কোনো একটা দেখার আশায় মানুষ নির্দ্বিধায় প্রাণ বিসর্জন দিতে পারে। তার মৃত বন্ধুদের কথাও মনে পড়ে। তাদের তুলনায় বোম্যানের আর কিছু চাওয়ার থাকে না।

জীবনের শেষ প্রান্ত নিয়ে ভাবার মুহূর্তেই চোখে পড়ে পোর্টটা এগিয়ে আসছে। তার দিকে, কিন্তু উপরে উঠছে না। একটু পর বিশাল ধাতব গোলক পেছনে পড়ে যায়, সামনে এগিয়ে চলে স্পেস পোড, আর তার ভিতর ডেভ বোম্যান।

যাক, তার ভাগ্যলিপি এখানে ফুরিয়ে যায়নি। বোম্যান ভাবে। এবং দেখতে পায় ভাগ্যলিপির শেষ অধ্যায়।

সেই ছোট্ট দানব সূর্য এবার এগিয়ে আসছে।

অধ্যায় ৪৩. জ্বলন্ত নরক

এখন সামনে শুধু লাল সূর্য। সেটা পুরো আকাশ জুড়ে বসে আছে। সে এত কাছে চলে এসেছে যে এদিক-ওদিক নড়তে থাকা আগুন নদী আর উন্মাতাল গ্যাসের ঝঞ্ঝা স্পষ্ট চোখে পড়ে। আর আগুনের হল্কাগুলো ধীরে উপরে উঠে আসছে। ধীরে? তার চোখে ব্যাপারটা পড়তে হলে ঘণ্টায় লক্ষ মাইলেরও বেশি গতি দরকার…

যে আগুনে নরকে সে পড়তে যাচ্ছে তার আকার নিয়ে সে চিন্তাও করে না। তার চিন্তাভাবনা এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে কেন? একটা সূর্যের বুকে কি কারো পড়া সম্ভব? লক্ষ মাইল দূর থেকেই সে স্রেফ হাওয়া হয়ে যাবে।

বৃহস্পতি আর শনির বিশালত্ব তার উপর টেক্কা মেরেছিল কোনো অজানা গিগামাইল দূরত্বের সৌর জগতে থাকাকালে। কিন্তু বৃহস্পতি এখানে থাকলে লজ্জায় মুখ লুকাতো।

আগুনের সমুদ্র পেছনে ছড়িয়ে পড়ায় তার আতঙ্কিত হওয়ার কথা, কিন্তু অবাক ব্যাপার-সে শুধু নিশ্চিন্ত মনে বসে আছে। তার ভাবনার কিছু নেই, নিরাপত্তা দেয়ার জন্য তার পেছনে কোনো অদৃষ্ট নিয়ন্তা কাজ করছে। সে এখন সূর্যের এত কাছে যে তাপ আসুক চাই না আসুক, শুধু এতক্ষণের তেজস্ক্রিয়তায় জ্বলে পুড়ে তার খাক হয়ে যাবার কথা। কিন্তু কিছু হয়নি। অদৃশ্য কোনো বর্ম যে কে ধরে রেখেছে তা মৃত্যুর আগে জানতে পারলে বেশ হতো। আর এতক্ষণ ধরে যতটুকু ত্বরণ তার শরীর সহ্য করে এসেছে এমনটা সত্যি সত্যি ঘটলে অনু-পরমাণু একেবারে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাবার কথা।

না, মরণ এত এগিয়ে আসেনি। এত কষ্ট তার জন্য করা হয়ে থাকলে সামনে আর কিছু থাক না থাক, আশা থাকে।

পোড এবার সূর্যের সারফেসের সমান্তরালে চলতে চলতে ধীরে নেমে যাচ্ছে। এবার প্রথমবারের মতো সে শব্দ শুনতে পায়। দূর থেকে কে যেন কাগজ ছিঁড়ছে-শব্দটা এমন।

পরিবেশ নিশ্চয়ই প্রচণ্ড প্রতাপে সবকিছুকে একেবারে বিশ্লিষ্ট করে ফেলার ক্ষমতা রাখে। কিন্তু তারচেও ক্ষমতাবান কেউ নিজের ক্ষমতা দিয়ে বোম্যানকে ঘিরে রেখেছে চতুর্পাশে।

অগ্নি চূড়া তার চারপাশে মাইলের পর মাইল এলাকা জুড়ে উঠছে আর নামছে, এ দৃশ্য শুধু অপার্থিব, অদৃষ্টপূর্বই নয়, সত্যি সত্যি অকল্পনীয়। যেন পোডটা অন্য কোনো মাত্রায়, ভিন্ন কোনো জগতে বাস করে; তাকে ছোঁয়ার অনুমতি দেয়া হয়নি সূর্যের শক্তিকে।

এবার সে দেখে যে এই নক্ষত্রের ভিতরটা আকৃতিহীন নয়। প্রকৃতিসৃষ্ট সব ধরনের গড়নই এখানে আছে।

প্রথমেই সে ছোট্ট ফোয়ারাগুলো দেখতে থাকে। এগুলো আকৃতিতে এশিয়া আর আফ্রিকার চেয়ে কোনো অংশে ছোট হবে না। সূর্য জুড়ে ছড়িয়ে আছে, দাপড়ে বেড়াচ্ছে পিঁপড়ার মতো। অবাক ব্যাপার, নিচে কোনো সৌরকলঙ্ক চোখে পড়ল না। এটা হয়তো পৃথিবীর সূর্যের কোন ব্যক্তিগত রোগ।

এখানে সেখানে এক আধটু মেঘও দেখা যায়। ধোঁয়াও হতে পারে, কারণ সূর্যটা এত ঠাণ্ডা যে এর বুকে আগুনের শিখা তৈরি হওয়া সম্ভব। সাধারণ সূর্যে আগুনের শিখা বহু দূর-অস্ত বিষয়। সেখানে পদার্থ তার তিন অবস্থাকে পিছনে ফেলে প্লাজমা হয়ে থাকে। এখানে রাসায়নিক যৌগ তৈরি হয়ে আবার প্রাজমায় পরিণত হওয়ার আগে দু-চার সেকেন্ড সময় পেলেও পেতে পারে।

নক্ষত্রের উপরিতল জ্যোতির্ময় হয়ে যাচ্ছে। আলোয় চোখ ধাঁধিয়ে যায় বোম্যানের। এখন সে কী করবে? চোখে তো সাদা বামন নক্ষত্র সহ্য করা সম্ভব নয়। ছোট নক্ষত্রটা উঠে আসার সময় চোখ বন্ধ করে রাখে।

সে চোখ মেলে বড় সূর্যের অন্য দিকে তাকিয়ে। আগুনের ঘূর্ণিঝড় উঠেছে নতুন অরুণোদয়ের সাথে সাথে। সে একবার ক্যারিবিয়ানের বুকে জল-ঝড় দেখেছিল। ঘূর্ণিপাকটা ছিল সচল। এই আগুনে ঘূর্ণিও হুবহু এক, শুধু এর গা আগুনের তৈরি আর আকৃতি পৃথিবীর সমান।

এরপর সে ঠিক নিচে এমন একটা কিছু দেখে যা আগে সেখানে থাকলে অবশ্যই চোখে পড়ত। নিচে গ্যাসের একটা বিরাট দল তৈরি হয়েছে এইমাত্র। তারা চারদিকের তাপ সহ্য করতে না পেরে দল বেঁধে উপরদিকে বাঁকা হয়ে সাঁতরে উঠছে-যেমন করে স্যামন মাছ ওঠে।

এমন আরো হাজারটা চোখে পড়ল একটু চেষ্টা করতেই। সেসব অঞ্চল আসলে ফিতার আকারে গ্যাস সাম্রাজ্য। সে ঠিকমতো দেখতে পায় না, তবে বোঝা যায় যে শত শত মাইল লম্বা হবে প্রত্যেকে।

তারা প্লাজমা মেঘও হতে পারে যা কোনো অজানা প্রাকৃতিক পরিবর্তনের ফল। এই হল সবচে সহজ সরল ব্যাখ্যা। কিন্তু আচরণটা ঠিক বিশ্বাস করে উঠতে পারছে না সে। সবাই দল বেঁধে সাদা মনের আগুন-স্তম্ভের উপর উঠে পড়ছে এবার।

একি কোনো জোরপূর্বক দখল, নাকি আলোর দিকে আলো কণার যাত্রা? যাই হোক, সে আন্তঃনাক্ষত্রিক অভিবাসন দেখতে পেল এইমাত্র। বড় সূর্য থেকে ছোটটার দিকে এই যে আগুনের সেতু বেয়ে অসীম পদার্থের গ্যাস হয়ে চলে যাওয়া তা আদৌ প্রাকৃতিক নাকি কোনো অদৃশ্য হাতের খেলা তা সে বুঝে উঠতে পারে না।

সে এক নতুন সৃষ্টির খেলা দেখছে, এ খেলার কথা ভাবার মতো, ফুরসৎ মিলবে না মানবজাতির। কিন্তু এর সবই সে বুঝতে পারবে এমন বোকামির আশা করাটাও বোকামি।

অধ্যায় ৪৪. অভ্যর্থনা

আগুনের সিঁড়ির দিক থেকে চোখ ফিরিয়ে ডেভ বোম্যান বুঝতে পারে তার চারপাশে একটা কিছু ঘটছে। তরল পানির মতো আগুনে দুনিয়া যেন প্রবাহিত হচ্ছে। আলো কমে আসছে। দ্বিতীয় কোনো সূর্যাস্তের সময় চলে এসেছে। এরপর হঠাৎ করেই উপলব্ধি করে যে এখানে আলোর উৎস সূর্যটা নয়, বরং নিচের পৃথিবী।

মনে হচ্ছে ধোয়ার দেয়াল গজিয়ে উঠেছে তার চারপাশে, লাল জ্যোতিকে ছিন্নভিন্ন করে দিয়ে ঢেকে দিচ্ছে অচেনা পরিবেশে নেয়ার জন্য। আস্তে আস্তে ঘন হয়, সাথে সাথে সৌর ঝড়ের মৃদু গর্জনও হারিয়ে যায় আড়ালে। এখন পোডটা একেবারে কালিগোলা অন্ধকারে ঠায় ভেসে আছে; একটু পর সামান্য ঝাঁকিতে বোঝা গেল কোনো শক্ত সারফেসে এবার স্পেস পোডটা বসার সুযোগ পেয়েছে।

কিন্তু কিসের উপর? আলো ফিরে আসার সাথে সাথে চারপাশে যা দেখল তাতে তার নিজেকে পাগল ভাবতে আর বাকী নেই।

সে যে কোনো কিছুর জন্য প্রস্তুত ছিল, প্রস্তুত ছিল না শুধু পরিচিত কিছু দেখার জন্য।

পোডটা এক চমৎকার পালিশ করা ঝকঝকে হোটেল স্যুটের মেঝেতে অবতরণ করেছে। এ অত্যন্ত দামী কামরা শুধু পৃথিবীর বিরাট বিরাট শহরের পাঁচ তারা হোটেলগুলোতেই দেখা যেতে পারে। এ হল স্যুটের থাকার ঘর। লিভিংরুমটায় একটা কফি টেবিল, ডিভান, এক ডজন চেয়ার, রাইটিং ডেস্ক, নানা ধরনের টেবিল ল্যাম্প, আধ ভর্তি বুককেস আর বেশ কিছু ম্যাগাজিন, এমনকি এক স্থানে সাজানো তাজা ফুলও চোখে পড়ে। ভ্যান গগের ব্রিজ এট আর্লস শোভা পাচ্ছে এক দেয়ালে, অন্যটায় ইয়েথের ক্রিস্টিনা’স ওয়ার্ল্ড। সে নিশ্চিত, ডেস্কের ড্রয়ার খুললেই একটা বাইবেল পাবে সেখানে…

ডেভ বোম্যান আসলেই পাগল হয়ে গিয়ে থাকলে তার ডিলুশনগুলো বেশ সুন্দরভাবেই সাজানো হয়েছে তো! সব ঠিকঠাক আছে, পেছনে ঘোরার পর কিছুই হারিয়ে যায়নি। আসলে সে যতটা চাপ সহ্য করেছে একজন মানুষের পক্ষে তার হাজার ভাগের এক ভাগও সহ্য করা সম্ভব নয়। সুতরাং মানসিক বিকৃতি আসা তেমন অস্বাভাবিক নয়। পুরো দৃশ্যে বেমানান যে অংশ চোখে পড়ে তা হল তার স্পেস পোড।

জিনিসটাকে এত বাস্তব দেখাচ্ছে যে সেটাই এক বিস্ময়কর ব্যাপার। সম্ভবত তার মনকে যাচাই করা হচ্ছে দৃষ্টিবিভ্রমের সাহায্যে। নাকি সেই ক্ষমতাবানের দল তাকে স্বর্গ-নরক দেখিয়ে এবার মর্তে নামিয়ে দিয়েছে? বলছে, যাও, গিয়ে সবাইকে বলো আমাদের কথা। আমরা আছি, তোমাদের পাশে পাশেই সর্বশক্তি নিয়ে আছি…

ভাবনাটা তাকে কাঁপিয়ে দেয়। পোডের দরজা খোলার সাথে সাথে মৃদু শব্দ ওঠে চাপ সমতাকরণের জন্য।

সে পোডের বাইরে পা রাখে। স্থানটা একেবারে কঠিন…অবশ্যই, নাহলে স্পেসপোড থাকে কী করে?

কিন্তু বাতাসের ভয়তো কেটে যায়নি। সে নিশ্চিত ঘরটা হয় ভ্যাকুয়াম, নয়তো দূষিত বায়ুর বস্তা। কেউ এতকিছুর পরে এমন নিখুঁতভাবে খুতখুতে ভাব দেখাবে না, কিন্তু সে আলাদা বলেই এ পর্যন্ত টিকে আছে। তার আগে বেঁচে থাকার নিশ্চয়তা চাই। জীবন খোয়াতে আপত্তি ছিল না, আবার বিনা চেষ্টায় কখনো জীবন দিতেও রাজি নয়। তার ব্যক্তিত্ব এমন, তার উপর ট্রেনিং তাকে আরো বেশি বাস্তববাদী করে তুলেছে। দেখেশুনে যুক্তরাষ্ট্রের কোথাও এমন হোটেল আছে বলে মনে হচ্ছে।

হাত উপরে তুলে ছেড়ে দিতেই সেটা ধপাস করে নেমে এল। তার মানে মাধ্যাকর্ষণ পৃথিবীর মতো। সব কেমন গোলমেলে লাগছে। হিসাব করে প্রতিটি সেকেন্ড চলতে হবে।

সে দেয়ালের পাশে যায়, ছুঁয়ে দেখে, যায় কফি টেবিলের পাশে। এর মধ্যে বেয়ারা ডাকার বেলও আছে। একটা ভিশন ফোন আর তার পাশে স্থানীয় ফোন ডাইরেক্টরিও পড়ে আছে। সে স্পেসস্যুট পরা হাতে তুলে নেয় বইটাকে।

জীবনে হাজারবার এমন নামের টেলিফোন বই হাতে নিয়েছে বোম্যান। ওয়াশিংটন ডি.সি.।

এবার সে ভালমতো লক্ষ্য করে বুঝতে পারে যে এ সব সত্যি হতে পারে, কিন্তু সে সম্ভবত পৃথিবীতে নেই।

এলাকার নামটার পর বাকী লেখাগুলো বোঝা যাচ্ছে না। সেগুলো দারুণ ঝাপসা। ব্যাপার বোঝার জন্য পাতা উল্টে নিয়ে দেখতে পেল সব ফাঁকা, কোনো লেখা নেই। এমনকি কাগজের জিনিসটাও ঠিক কাগজ নয়, কেমন যেন কোঁচকানো সাদা জিনিসে গড়া। দেখতে অবশ্য খুব বেশি এদিক-সেদিক নয়।

সে টেলিফোন তুলে নিয়ে ডায়াল করে; যা ভেবেছিল তাই। কোনো শব্দ নেই।

সুতরাং, এ এক নিখুঁত ভাওতাবাজী। কিন্তু এই ভাওতাবাজী নিশ্চয়ই তাকে একটু শান্ত করার জন্যে, সান্ত্বনা দেয়ার জন্য। যাই হোক, সে আর স্পেসস্যুট খুলছে না।

চেয়ারগুলো দুনিয়ার ওজন নিয়ে বসে আছে, টেবিলের কোনো ড্রয়ার খুলছে না। বইগুলো দেখেও হতাশ হতে হল। গত তিন বছরের সেরা সেরা হাজার রকমের বই এখানে। বুকসেলফ থেকে তোলারও উপায় নেই।

দুটো দরজা বেশ সাবলীলভাবে খুলে গেল। প্রথমটা দিয়ে বেডরুমে যাওয়া যায়, সেখানকার লাইটগুলো জ্বালানো-নিভানো যাচ্ছে। অন্য দরজা খুলে ভিতরে দেখতে পায় একটা ক্লোজেট। ক্লোজেটে চারটা স্যুট, ডজনখানেক শার্ট, কয়েকটা আন্ডারওয়্যার আরামে ঝুলছে।

একটা স্যুট নামিয়ে এনে চোখের সামনে ধরে সে বুঝতে পারে যে জিনিসটা ফারের নয় বরং উলের মতো কিছু দিয়ে তৈরি। পোশাকটা একটু পুরনোও বলতে হবে, পৃথিবীতে গত চার বছর ধরে কোনো মানুষ সিঙ্গেল ব্রেস্টেড কোট পরে না।

বেডরুমের পর একটা বাথরুম ছিল। সে হাজারো স্বস্তির সাথে অনুভব করে যে তার বাথরুমটা ডামি নয়, কাজ করছে ভালমতো। এর পাশেই একটা পিচ্চি রান্নাঘর। সেখানে ইলেক্ট্রিক কুকার, ফ্রিজ-এসবই আছে। সে এসব দেখা শুরু করেছে শুধু আগ্রহের কারণে নয়, পর্বতপ্রমাণ খিদের জ্বালায়ও।

ফ্রিজের ভেতর পরিচিত অনেক ধরনের ক্যান আর প্যাকেট, ঠাণ্ডার ব্যাপারটা বোঝা যাচ্ছে একটু কুয়াশা কুয়াশা ভাব দেখে। প্যাকেটগুলোর লেখা কাছ থেকে বোঝা যায় না, কিন্তু বোঝানো হচ্ছে যে লেখাটা ইংরেজি।

একটা ব্যাপার লক্ষ্য করে সে হতাশ হয়-সেখানে ডিম, দুধ, মাছ মাংস বা সজির মতো কোনো রান্নার যোগ্য খাবার নেই। সব প্যাক করা খাবার।

সে কিছু পরিচিত নাস্তার প্যাকেট তুলে নেয়। ভেবে একটু মজা পায়, এসব ফ্রিজে রাখার কথা না। প্যাকেট তোলার সাথে সাথেই বুঝতে পারে সেখানে কর্নফ্লেক্স নেই। জিনিসটা অনেক বেশি ভারি।

প্যাকেট খুলে সে হালকা নীলচে আঠালো এক ধরনের খাবার দেখতে পায়। ওজনে পুডিংয়ের মতো। রঙ-গন্ধের তোয়াক্কা না করে ক্ষুধার কাছে নত হতে হচ্ছে।

হঠাৎ করেই নিজের চুল টেনে তুলে ফেলতে ইচ্ছা করে তার। ব্যাপারটা হাস্যকর হলো না? আমি যদি কোনো বুদ্ধিমত্তার পরীক্ষায় পড়ে থাকি তো এর মধ্যেই ফেল মেরে বসেছি। এখনো স্পেসস্যুট না খোলা উচিত হয়নি।

সে সাথে সাথে বেডরুমে ফিরে গিয়ে নিজের হেলমেট খোলার কাজে মনোযোগ দেয়। একটু আলগা করেই বাতাস নিয়ে বুঝতে পারে চারপাশে তার বিশুদ্ধ বাতাসের ছড়াছড়ি।

সাথে সাথে হেলমেটটা বিছানায় রেখে ভালমতো স্যুট খুলে ফেলে। তারপর ভদ্রভাবে কয়েকবার বাতাস টেনে নিয়ে ক্লোজেটের অন্য পোশাকের সাথে ঝুলিয়ে দেয়। দেখতে একটু বেখাপ্পা লাগলেও করার কিছু নেই। মানবজাতিকে সুন্দররূপে উপস্থাপন করতে হবে তো! তার উপর তার আছে একজন জ্যোতির্বিদের নিয়মানুবর্তিতা।

বোম্যান রান্নাঘরে ফিরে গিয়ে পরের প্যাকেটগুলো দেখার কাজে মনোযোগ দিল। সেগুলোতেও একই জিনিস। অগত্যা নীলচে আঠালো তরলের গন্ধ নিয়ে খুব একটা খারাপ লাগল না। জিনিসটায় ম্যাকারনির মতো মসলা মসলা ঘ্রাণ আছে। সে সাবধানে পুডিং থেকে একটু ভেঙে হাতে নেয়, তারপর ভাবে, তাকে বিষ দেয়ার কোনো ইচ্ছা নিশ্চয়ই তাদের নেই; কিন্তু বায়োকেমিস্ট্রির মতো একটা ঘোরালো বিষয়ের জন্য একটু ভয় ভয় হচ্ছে।

মুখে দিয়ে প্রথমে সে একটু চুষে দেখেই চিবিয়ে খেয়ে ফেলে। এর স্বাদ-গন্ধ আমেজ অনন্য। চোখ বন্ধ করে খেলে জিনিসটাকে মাংসও মনে হতে পারে, নরম রুটিও মনে হতে পারে আবার শুকনো ফলও মনে হতে পারে।

এবার একটা ক্যান খুলে সেখানে বিয়ার না পেয়ে সে খানিক হতাশ হয়। একই জিনিস। সুতরাং খাবারগুলো একটু বিরক্তিকর ঠেকবে এক সময়। পানি ছাড়া তরল কিছু নেই।

সে প্রথমে দু-এক ফোঁটা পানি চেখে দেখে, স্বাদটা অপূর্ব। তারপর নিজের সন্দিহান মনের জন্য একটু লজ্জা পেয়েই যেন বাকীটা এক চুমুকে শেষ করে ফেলে।

পানিটা তবু কেমন কেমন মনে হয়। এ হল একেবারে খাঁটি পানি এবং শুধু এইচ টু ও। আর কিছু নেই এই পানির মধ্যে। আতিথেয়তাকারী তার স্বাস্থ্যের ব্যাপারে এক বিন্দু ঝুঁকি নিতে চায় না মনে হচ্ছে।

গোসলের সময় সাবান না পেয়ে মন যতটা খারাপ হয়েছিল তা পুষিয়ে গেল এয়ার ড্রায়ারে শরীর শুকিয়ে। এবার ক্লোজেট থেকে কাপড় নিয়ে পরার পালা।

শুয়ে শুয়ে দেখার জন্য যথারীতি রুমের সিলিংয়েও একটা হোটেল টাইপ সিলিং টিভি আছে, সেটাও খেলনা হবে তাতে আর সন্দেহ কী?

কিন্তু তার বিছানার পাশে কন্ট্রোল ডিস্কটা দেখে এত বাস্তব মনে হল যে সাথে সাথে সেটার অন বাটন চেপে দেয় বোম্যান।

সাথে সাথে চিত্র ভেসে ওঠে মনিটরে। এ লোক খুবই পরিচিত একজন আফ্রিকান ধারাভাষ্যকার, লোকটা সেই পরিচিত সুরে নিজের দেশের বন্যপ্রাণী বাঁচানোর আন্দোলনের কথা বলছে। সে জানতো না মানুষের কণ্ঠস্বর এত মধুর, এত প্রয়োজনীয়, এত দামী। মুহূর্তে জীবন ফিরে আসে তার মনোজগতে।

এর পর অন্য চ্যানেলে ওয়াল্টনের ভায়োলিন কনসার্তো বা বেহালা কনসার্ট দেখতে পায়। দেখতে পায় আরো কত অনুষ্ঠান কত শত চ্যানেলে তার কোনো ইয়ত্তা নেই। অনুষ্ঠানগুলো মনকে শুধু সজীব করে তোলেনি, সাথে সাথে তার একটা সন্দেহও প্রকট হয়ে উঠেছে।

এই সবকিছুই মানুষের টি এম এ-ওয়ান আবিষ্কারের পর পর রেকর্ড করা হয়। তার মানে মানুষ যেটুকু ধারণা করেছিল টি এম এ-ওয়ান তারচে অনেক বেশি কাজ করে। সব কিছু সম্প্রচার করেছে অহর্নিশি।

এরপর একটা নাটকে সে তার নিজের লিভিংরুমে বসে থাকা অতি বিখ্যাত এক চিত্রতারকার দৃশ্য দেখে বিমূঢ় হয়ে যায়। সে বেডরুমে ঢুকছে, এমন সময় বোম্যানও সেই দরজার দিকে তাকায়।

কিন্তু কেউ প্রবেশ করে না। ওদিকে ছবিতে সেই লোক এরিমধ্যে বিছানায় উঠে বসেছে।

তার মানে এই পরিবেশ সেই ছায়াচিত্রের নকল। এজন্যেই টেলিফোন বুকের বড় লেখা পড়া গেলেও ছোটগুলো পড়া যায়নি।

নিজের আঙুলগুলো মাথার পেছনে চালিয়ে দিয়ে টিভি বন্ধ করে স্থির দৃষ্টিতে সেদিকে চেয়ে থেকে এবার সে ভাবে-কী করব এখন?

শারীরিক আর মানসিক-দু-দিকদিয়েই একেবারে ক্লান্ত ডেভ বোম্যান। কিন্তু এ পরিবেশে ঘুমানোর কথা চিন্তাও করা যায় না।

কিন্তু শরীর, মন আর আরামদায়ক বিছানা তার বিপক্ষে চলে যাচ্ছে।

ক্লান্তি টের পেয়ে কোনোমতে লাইট নিভিয়েই সে অসাড় হয়ে যায়। এবার সে স্বপ্ন রাজ্যের চেয়েও দূরে কোথাও চলে গেছে।

পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ মহাকাশচারী জ্যোতির্বিদ ডেভিড বোম্যান শেষবারের মতো ঢলে পড়েছে ঘুমের কোলে।

অধ্যায় ৪৫. পরিণতি

আর কোনো প্রয়োজন না থাকায় পুরো হোটেল স্যুটটাই এর স্রষ্টার মনে বিলীন হয়ে গেল। শুধু আছে সেই খাট, খাটের বাইরে প্রতিরক্ষা শিল্ড আর খাটের উপর স্বপ্নহীন অপূর্ণ নিদ্রারত আধা-সচেতন ডেভ বোম্যান। বাইরে আগুনের হল্কা, ভিতরে নিরুদ্বিগ্ন ডেভিড, আশপাশে অবোধ্য অনুভূতি। নেই ভয়, শঙ্কা, আশা, হতাশা; কিছুই নেই।

সে যেন কোন্ অজানার দেশে ভেসে আছে, চারপাশে আদিগন্ত কালো সুতোর রেখা নানা ক্ষেত্র গড়ছে, ভাসছে অজস্র ছোট ছোট আলো-কোনটা স্থির, কোনোটা অকল্পনীয় গতিতে চলমান।

সে একবার মানুষের ব্রেনের এক ছোট্ট টুকরোকে মাইক্রোস্কোপের নিচে ধরেছিল। সেই হাজারো সুতোর গোলকধাঁধা ছিল মৃত, কিন্তু চারপাশের অজস্র বিস্তৃতির পুরোটাই যেন জীবন্ত।

সে জানে, অথবা মনে করার চেষ্টা করে যে জানে এই রহস্যের সমাধান। সে এক দুনিয়াজোড়া মাথার কাজের ধারার ভিতরে বসে আছে। জীবন্ত মস্তিষ্ক। সেখানে অকল্পনীয় বিস্তৃত সব কাজ চলছে অবিরত, কিন্তু দেখা যায় না। শুধু অনুভব করা যায় নিজের অপরিমেয় ক্ষুদ্রতা।

এই দৃশ্য, অথবা দৃষ্টিভ্রম চলে যায় এক মুহূর্ত পরেই। সেই স্ফটিকীকৃত জগৎ, সেই আলোর গোলকধাঁধা, সেই অকল্পনীয় অবস্থা কাটার পর পরই সে একটা সচেতনতার ভুবনে ভাসতে শুরু করে।

প্রথমে মনে হল স্বয়ং সময় পেছনে চলে যাচ্ছে। সে ব্যাপারটাকে মেনেও নেয় আসল সত্যি জানার আগ পর্যন্ত।

পুরনো অনুভূতি, দৃশ্য, মনোভাব, স্বাদ, তৃপ্তি-সব ফিরে আসছে, চলে যাচ্ছে। হোটেল রুম-জ্বলন্ত লাল নক্ষত্র- স্টেশন- প্রবেশদ্বার- জ্যাপেটাস- ডিসকভারি শনি- বৃহস্পতি- চাঁদ- পৃথিবী- ট্রেনিং… সব, সব ফিরে আসছে। ক্রমবর্ধমান গতিতে যেন তার স্মৃতির ফিতা পেছনে টানে কেউ একজন। কিছুই হারায়নি, কিন্তু মানুষের মন কি এত নিখুঁতভাবে সব সংরক্ষণ করে রাখে?

এগিয়ে আসছে সহজ-সরল পৃথিবী, আনন্দময় অতীত, বেদনায় নীল হয়ে যাওয়া সব মুহূর্ত। প্রিয়মুখ, প্রিয় কাজ, কৈশোর, শিশুত্বও এক সময় কেটে গেল।

এখন স্মৃতির মহা সুড়ঙ্গ শুকিয়ে আসছে। সময় বইছে অতি, অতি ধীরে। পরের চক্র শুরু হওয়ার আগ পর্যন্ত পেন্ডুলামের মতো দুলছে মহাকাল; এদিক-ওদিক।

সময়হীন মুহূর্ত কেটে গেল, পেন্ডুলামের দোলনের দিক গেল বদলে। থেমে গেল সবকিছু। সব, সবকিছুর উল্টোরথ শুরু হয়েছে আবার।

এক দ্বৈত নাক্ষত্রিক এলাকায়, পৃথিবী থেকে বিশ হাজার আলোকবর্ষ দূরে এক শিশু তার চোখ খুলে প্রথমবারের মতো কেঁদে ওঠা শুরু করবে এখন।

অধ্যায় ৪৬. এই লভিনু সঙ্গ তব, সুন্দর, হে সুন্দর

এক সময় সে নিরব হয়ে যায়, কারণ এখন আর সে একা নয়।

এক ভৌতিক ঝকঝকে চতুষ্কোণ আকাশে উদিত হয়েছে। সেটা এক ক্রিস্টাল ট্যাবলেটে পরিণত হয়ে এক সময় স্বচ্ছতা হারায়। এর ভিতর দুধসাদা আবহ।

অস্পৃশ্য, ভৌতিক কিছু শরীর ঘোরাফেরা করে তার উপরিতলে, ভেতরে। তারা জোড়ায় জোড়ায় একত্র হয়, তারপর কাঠির মতো সরু হয়ে যায় প্রত্যেকে, তারপর ঘুরতে থাকে; আলোর বৃত্ত তৈরি করে। যেন পুরো মহাকাশ জুড়ে রয়েছে তার ব্যাপ্তি।

এ আলোকসামান্য দৃশ্য যে কোনো শিশুর, যে কোনো বন মানুষের মনোযোগ আটকে রাখতে জানে। কিন্তু এ দৃশ্য ত্রিশ লাখ বছর ধরে সত্যিকার কাজের কাজ কিছুই করেনি। সে শুধুই মনোযোগ আটকে রাখে। বাকী আসল কাজটা হয় মনের গহীনে।

এবার কাজের ধারা অতি দ্রুত এগিয়ে চলে, কারণ নতুন পদ্ধতি বেরিয়েছে।

শিশু তার চোখ তুলে ক্রিস্টালের গভীরে তাকায়। এ চোখ মানুষের চোখ নয়। সে দেখতে পায় ঘুমিয়ে থাকা রহস্যলোকের দরজাকে, কিন্তু এখনো ঠিক বুঝতে পারে না। সে জানে এখন সে সবচে নিরাপদ অবস্থায় আছে, কারণ এখানে লাখো প্রাণীর জন্ম হয়েছে। কিন্তু সে এখনো জানে না সামনে সবচে অদ্ভুত জন্মটা এখনো বাকী।

এবার, স্বচ্ছ মনোলিথ তার আলোর খেলা বন্ধ করে দেয়; হারিয়ে যায় নিজের আলোরই মতো; তারপর শূন্য থেকে উঠে আসা প্রতিরক্ষা বর্ম মিলিয়ে যায় শূন্যে; এবং, এক বিশাল দানব লাল নক্ষত্র তার এলাকার অহেতুক বর্মটা মিলিয়ে যাবার সাথে সাথে সেটুকু দখল করে নেয়।

সেই স্পেস পোডের ধাতু আর প্লাস্টিক, এক সময় যে লোকটা নিজেকে ডেভিড বোম্যান বলে পরিচয় দিত তার সমস্ত পোশাক আর তার সাথে যা ছিল সব সাথে সাথে প্লাজমার অকল্পনীয় উত্তাপে লীন হয়ে যায় সূর্যের সাথে।

আরামদায়ক উষ্ণতাতেও সেই শিশু ভয় পেয়ে বুঝতে পারে যে সেসব পদার্থের তার প্রয়োজন আছে। নাহলে কিসের দিকে সে তার ক্ষমতা আর দৃষ্টিশক্তিকে তাক করবে? তার ধ্বংসাতীত শরীরটা তার নিজের মনের বর্তমান প্রতিচ্ছবি ছাড়া আর কিছু নয়। এবং এতসব থাকা সত্ত্বেও, সে জানে, সে এক শিশু, মাত্র একটা শিশু।

তাই এখনো বুঝে উঠতে পারছে না যে তার আর পদার্থের প্রয়োজন নেই, নিজের ক্ষমতা প্রয়োগের সবচে ভাল ক্ষেত্র হচ্ছে শক্তি।

এবং সময় এসেছে যাবার। অবশ্য এক অর্থে সে কখনোই জন্মস্থান ছেড়ে যাবে না, কারণ জন্মের সময় তার অস্তিত্বের একটা অংশ মিশে গেছে দ্বৈত নক্ষত্রের চির দ্বৈরথের সাথে। কোন্ এক অজানা, অকল্পনীয় উদ্দেশ্য যেন মিশে আছে সেখানে। তার লক্ষ্য এখন সে জানে। কিন্তু যাবার জন্য সেই প্রাচীন পথ ধরতে হবে না। সে ত্রিশ লাখ বছরেরও বেশি সময়ের অভিজ্ঞতায় বুঝেছে, সৃষ্টি জগতের পেছন দিয়ে যাওয়া ছাড়াও যাতায়াতের আরো সহজ সহজ রাস্তা ছড়িয়ে আছে চারপাশে। নক্ষত্র দুয়ারের মান্ধাতা প্রযুক্তি তার যথেষ্ট সেবা করেছে, কিন্তু আর কখনো সেসবের প্রয়োজন নাও পড়তে পারে।

সেই আভাময় চতুষ্কোণ, যেটাকে প্রথমে সামান্য এক স্ফটিক মনে হয়েছিল তা এখনো তার সামনে ভাসছে। এর ভিতরে সময় আর স্থানের কত অযুত নিযুত রহস্য লুকিয়ে আছে। কিন্তু এখন সে অন্তত একটা ব্যাপারে কর্তৃত্ব খাটাতে পারে। কী অপরিহার্য, কী প্রয়োজনীয় এই ১:৪:৯ অনুপাত! কী দুঃখজনক ব্যাপার, এই সিরিজ মাত্র তিন মাত্রাতেই ফুরিয়ে গেছে।

সে তার মনকে এই জ্যামিতিক সারল্যের দিকে তাক করানোর সাথে সাথে এর ভিতর মহাকাশ-রাজ্যের কালিগোলা অন্ধকার প্রবেশ করে। নিভে যায় লালচে আগুন-সমুদ্র, প্রবেশ করে কোথায় যেন…এবং অবশেষে, তার সামনে সেই চির নিশীথের রঙের উপর ফুটে ওঠে এক জ্যোতির্ময় ঘূর্ণিপাক। মিল্কি ওয়ে গ্যালাক্সি।

মনে হতে পারে প্লাস্টিকের উপর একটা মডেল, কিন্তু এই হল পুরো গ্যালাক্সির রূপ, রস, গন্ধ। এবং এই শিশুর তালুবন্দী। সে চাইলেই এই পুরোটার দশ সহস্র কোটি নক্ষত্রের যে কোনোটায় মনোনিবেশ করতে পারে। সে চাইলে এরচে বেশি কিছু করতে পারে।

এখন সে এই সৌর-নদীতে ভেসে যাচ্ছে। এখন সে গ্যালাক্টিক কোরের মাঝপথে। সেখানে ঝলমল করে অযুত নক্ষত্র, আর পেছনে, প্রান্তসীমায় একা একা পাহারা দেয় কিছু নিঃসঙ্গ তারার দল।

সে জানে, সামনের এই আকৃতিহীন এলাকায় এখনো জোয়ার আসেনি, এখনো বিবর্তনের প্রাথমিক উপাদান গড়ে ওঠেনি, এখানে সময় বলতে কিছু নেই। এই শূন্যতায় আলো নেই, আলোর সৃষ্টি উপাদানও নেই। এখানে আলো জ্বলবে, কায়া তৈরি হবে, সময় তৈরি হবে, তারপর জীবনের অপার স্রোত ভাসিয়ে দেবে দশ দিগন্ত, ঝলমলিয়ে উঠবে চারদিক। বিলিয়ন বিলিয়ন বছর পরে।

সে খেয়াল না করে এমন একটা এলাকা পেরিয়েছিল, এবার সচেতনভাবেই সেখানে প্রবেশ করে। শিউরে ওঠে একাকিত্বের প্রকৃতি দেখে।

এই গ্যালাক্টিক মহাসাগর তাকে শীতল করে দেবে সেই ভয় নেই। সৃষ্টিহীনতার বিষাদ তার মর্মে মর্মে ধ্বনিত হচ্ছে। এবার সে বুঝতে পারে কেন ত্রিশ লাখ বছর ধরে ওরা শুধু ফুল ফোঁটানোর সাধনারত। কিন্তু তার একাকিত্ব তবু একটুও ঘোচে না।

এরপর হঠাৎ করেই বুঝতে পারে যে সে কখনোই একা হবে না। সাথে সাথে সৃষ্টি জগতের স্ফটিক-স্বচ্ছ রূপ তার মুঠোয় ধরা দেয়; পুরোপুরি তার নিজের ইচ্ছায় নয়, সে বুঝতে পারে।

সে আবার অযুত, নিযুত আলোকবর্ষ উপরে উঠে যায়, যেখানে পুরো মিল্কি ওয়ে একটা বিন্দু, তারপর নামতে শুরু করে। চারপাশে ছিটকে বেরোয় তারকারাজি, নেবুলা, গ্রহ, নক্ষত্রপুঞ্জ। নক্ষত্রগুলোর ভিতর দিয়ে, সব বস্তুকে ভেদ করে সে একটা নির্দিষ্ট লক্ষ্যের দিকে এগোয়। কসমিক ধুলোবালির দিকে প্রায় চোখই পড়ে না।

নক্ষত্রগুলো ছোট হয়ে হয়ে হারিয়ে যাচ্ছিল। কালো আকাশে হারিয়ে যাচ্ছিল মিল্কি ওয়ে।

এবং অবশেষে সে হাজির হয়েছিল সেখানে, যেখানে তার যাবার ইচ্ছা, যেখানে সে আগে ছিল, যেখানটাকে মানুষ বলে-বাস্তব।

অধ্যায় ৪৭. শতদল-দল খুলে যাবে থরে থরে, লুকানো রবে না মধু চিরদিন তরে …

এখানে, ওর ঠিক সামনে এক বিশাল খেলনা ভেসে বেড়াচ্ছে, কোনো নক্ষত্র জাতক একে প্রতিহত করতে পারবে না। পৃথিবী নামক গ্রহটি তার স-ব মানুষ নিয়ে ভেসে চলেছে কোন্ অজানার উদ্দেশে!

সে ফিরেছে সময়মতো। হয়তো অনেক নিচে, জনবহুল নগরীগুলোয় রাডার স্ক্রিন জুড়ে দাপড়ে বেড়াচ্ছে অ্যালার্মের লাল আলো। আকাশ ছত্রখান করে ফেলছে দানবীয় টেলিস্কোপগুলো। এবং মানুষ যে ইতিহাস জানে হয়তো তার যবনিকাপাত হবে এ যাত্রায়।

হাজার মাইল নিচে একটা মৃত্যু-দৃত জেগে উঠেছে…সে বুঝতে পারে। সেই কার্গোটা উঠে আসছে নিজের অর্বিটে। তার কাছে এর ভিতরের অস্থির অসীম শক্তির কোনো মানেই নেই, কিন্তু সে আরো পরিষ্কার এক আকাশ আশা করেছিল। নিজের ইচ্ছাটাকে সামনে বাড়ায়, ঘুরন্ত মেগাটনের জিনিসটা এক নীরব বিস্ফোরণে কৃত্রিম সূর্যোদয় নিয়ে আসে ঘুমন্ত অর্ধ ধরিত্রী জুড়ে। আণবিক মেঘ ঝরে পড়ে কুমারী বনভূমির সবুজ-সুন্দরের বুকে।

এরপর সে প্রতীক্ষা করে, নিজের সবটুকু চিন্তার উপর আধিপত্য বিস্তার করে। বোঝার চেষ্টা করে নিজের আজো অচেনা শক্তিকে।

আজ সে জগদীশ্বর হলেও ঠিক ঠিক বুঝে উঠতে পারে না কী করতে হবে এরপর।

কিন্তু সে হয়তো কিছু না করার কথা ভেবে রেখেছে।

***

আর্থার সি ক্লার্ক

সাহিত্যচর্চার একটা পরিবেশের জন্য অনেকেই অনেক কিছু করেছেন। এক্ষেত্রে কতটা নিবেদিতপ্রাণ হলে একজন মানুষ অধুনা সভ্যতার কেন্দ্রবিন্দু ব্রিটেন ছেড়ে টগবগে যৌবন থেকে জীবনের শেষ সময় পর্যন্ত থাকেন শ্রীলংকার মতো দ্বীপদেশে-অর্ধশতাব্দীরও বেশি কাল ধরে, আসলেই তা বিবেচ্য বিষয় সেই লেখক, তাঁর লেখা, লেখনীর বৈশিষ্ট্য-সর্বোপরি লেখকের জীবন আর মানব জীবন সম্পর্কে তাঁর দৃষ্টিভঙ্গী আলোকপাত করার ক্ষেত্রে। তিনি ক্লার্ক, আর্থার চার্লস ক্লার্ক। বড় মাপের একজন লেখকই নন, লেখকের মাপকাঠি হিসেবেও বিবেচিত। তিনিই সর্বকালের সফলতম এস এফ ছায়াছবির চিত্রনাট্যকার, আজ পর্যন্ত একটা সায়েন্স ফিকশন লিখে তাঁরচে বেশি টাকা কেউ পায়নি। সোজা কথায় জীবিতদের মধ্যে তিনিই এস এফ জগতের শ্রেষ্ঠ ব্যক্তি। আর সর্বকালের হিসেবে দ্বিতীয়।

‘আর্থারকে, যিনি চাঁদে যাওয়ার স্বপ্ন দেখেছিলেন আমি পা রাখার আগেই’ কথাটা লিখেছিলেন অলড্রিন। চন্দ্রবিজয়ী। আর্থার সি ক্লার্কের ড্রয়িংরুমের দেয়ালে ঝোলানো ছিল একটা টি শার্ট। ওতে লেখা এই অসাধারণ উক্তিটি- যা দেয় ক্লার্কের কাজ আর জীবনের স্বীকৃতি।

আর্থার সি ক্লার্ক অ্যাপোলো এগারো, বারো ও পনের মিশনের ধারাভাষ্যকার ছিলেন। পৃথিবীবাসীর কানে তাঁর কণ্ঠ থেকে ভেসে আসা বিবরণেই পৌঁছে গেছে। চাঁদে গমনকারী অভিযাত্রীদের অভিযানের কথা- ধারাবাহিক কর্মকাণ্ডের চিত্র। বাস্তব জীবনে সম্পৃক্ততা ছিল বিজ্ঞানের সাথে। সায়েন্স ফিকশন জগতে শক্তিময় লেখনীর জন্য বিখ্যাত হয়ে আছেন আর্থার সি ক্লার্ক। প্রথম যেদিন ভূ-স্থির কৃত্রিম উপগ্রহ সম্পর্কে লেখেন, সেদিনও হয়তো তাঁর মতো অতি কল্পনাবিলাসী বিজ্ঞানবিদ ভাবেননি যে, জীবিতাবস্থায় তাঁরই লেখা তুলে আনবে বাস্তব সোনার ফসল। ভাবেননি, কোটি কোটি মানুষ তাঁরই কল্পনার বদৌলতে শত শত স্যাটেলাইট টেলিভিশন চ্যানেলে তথ্য প্রবাহের স্রোতে-বিনোদনের জগতে গা ভাসাবে। তিনি কি জানতেন যে, পৃথিবীর আবহাওয়া বিজ্ঞান, সমরনীতি, গোয়েন্দাগিরি, তথ্য প্রযুক্তি ও বৈজ্ঞানিক গবেষণায় অকল্পনীয় হারে ব্যবহৃত হবে তাঁরই মাথা থেকে আসা আইডিয়া? লেখাটি প্রকাশিত হয় হিরোশিমায় পারমাণবিক বোমা বিস্ফোরণের এক সপ্তাহ আগে। ‘ওয়ার্লেস ওয়ার্ল্ড’ নামক বিজ্ঞান বিষয়ক পত্রিকায়।

স্যাটেলাইট বিজ্ঞানের জনক তিনি।

সচেতন জীবনের শুরু থেকে বিজ্ঞান তাঁকে নাড়া দিয়েছিল বেশ জোরেসোরেই। ছেলেবেলায় বাসায় বানানো টেলিস্কোপে চাঁদ ছত্রখান করার চেষ্টা করতেন। মামুলি দৃষ্টি দিয়েই। উনিশশো ছত্রিশে লন্ডন এসে ব্রিটিশ ইন্টার প্ল্যানেটারি সোসাইটিতে যোগ দেন। ব্রিটেনের রয়্যাল এয়ার ফোর্সে রাডার ইস্ট্রাক্টর ছিলেন একচল্লিশ থেকে ছিচল্লিশ পর্যন্ত। এর পর লন্ডনের কিংস কলেজ থেকে পদার্থ আর অঙ্কে ফার্স্টক্লাস সহ গ্র্যাজুয়েশন শেষ করেন। তিনি ‘দ্য রয়্যাল অ্যাস্ট্রোনমিক্যাল সোসাইটি, ‘অ্যাকাডেমি অব অস্ট্রোনটিক্স’ সহ আরো বহু প্রতিষ্ঠানের অনারারি মেম্বার।

‘যা একবার পৃথিবীতে ঘটতে পারে তা লক্ষ লক্ষবার মহাবিশ্বে ঘটেছে বলে আশা করা যায়।’- এ কালান্তরী বিশ্বাসই তাঁকে দাঁড় করিয়েছে সায়েন্স ফিকশনের সামনে। তাঁর লেখার বয়সই অর্ধশতাব্দী পেরিয়েছে। শতাধিক বই লিখেছেন। গল্পের শব্দ গাঁথুনীতে বিজ্ঞানমনস্কতা ফুটিয়ে তুলতে পারদর্শী। বার্ধক্যের বানে জর্জরিত তিনি নিরন্তর বিজ্ঞান সাধনা করে যাচ্ছেন আজও। শ্রীলংকার যে জায়গাটায় ক্লার্ক থাকেন, ওখানকার নাম হয়েছে তাঁর নামে। একজন ক্যাব বা বেবিট্যাক্সি ওয়ালাকে ‘ক্লার্ক পয়েন্টে যেতে বলতে হয় না। ক্লার্ক শব্দটা উচ্চারণ করলেই হয়। এই আজো এ মানুষটা সারাটা দিন কাটান স্টাডি রুমে। তাঁর সার্বক্ষণিক সহকারী একজন শ্রীলংকান সায়েন্স ফিকশন রাইটার। তিনি মনে করেন ক্লার্কের কাছাকাছি আসতে পারাটাই তাঁর জীবনের শ্রেষ্ঠ পাওনা। শ্রীলংকার মানুষের চোখে তিনি “দ্য অনারারি রেসিডেন্ট”।

উনিশশো সতেরতে ইংল্যান্ডের মাইনহেডে জন্মগ্রহণ করেন ক্লার্ক। উনিশশো ছিচল্লিশ সালে, বেশ খানিকটা দেরিতেই লেখালেখির দরজায় পা রাখেন ‘রেসকিউ পার্টির মাধ্যমে। “প্রিয়ডিক্যাল অ্যাসফাউন্ডিং সায়েন্স’ পত্রিকাতে। তাঁর সাড়া জাগানো টেকনিক্যাল ব্যাপার ভিত্তিক উপন্যাস হচ্ছে ‘চাইল্ডহুডস এন্ড’ (১৯৫৩), ‘দ্য সিটি অব দ্য স্টার্স’ (১৯৫৬), এঁদেভু উইথ রামা’ (১৯৭৩), আর দ্য ফাউন্টেইনস অব প্যারাডাইস’ (১৯৭৯)। বিখ্যাত গ্রেট বেরিয়ার রীফ আর সিংহলের সাগরে ডুব দিয়ে কেটেছে সারাটা যৌবন। বৈজ্ঞানিক কাহিনী ভিত্তিক ছায়াছবিও করেছেন। বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন বিজ্ঞান আর বৈজ্ঞানিক কল্পকথাভিত্তিক কর্মকাণ্ডে সক্রিয়ভাবে অংশ নেন।

‘থ্রি থাউজ্যান্ড ওয়ান: দ্য ফাইনাল ওডিসি’র জন্য তিনি সাত অঙ্কের ডলার পেয়েছেন বলে মনে করা হয়। সংখ্যাটা না কি দু-এক মিলিয়ন নয়। এর মানে হল, টাকার হিসাব আঠার কোটির উপর। আর এটা শুধু ইংরেজির জন্য। আরো পঁয়ত্রিশ ভাষার কথা হিসাবে না নিলেও চলবে। তাঁর অর্ধশত বই শুধু ইংরেজিতেই দু কোটির উপর কপিতে বেরিয়েছে।

ক্লার্কের প্রভাব আর আওতা অনেক দূরে গিয়ে ঠেকে। খ্রিস্টিয় পোপ জন পল তাঁকে পোপের দেশ ভ্যাটিকান সিটিতে ডেকেছেন মহাকাশ যুগে মানুষ কেমন হতে পারে, ধর্মের সম্ভাব্য অবস্থা ও অবস্থান এবং মানুষের মনস্তত্ত্ব সংক্রান্ত আলোচনার জন্য। এ লোকটা মনেপ্রাণে একজন সায়েন্স ফিকশন রাইটার। দীর্ঘ জীবনে তিনি সায়েন্স ফিকশন ছাড়া মাত্র দুটি উপন্যাস লিখেছেন। একটা ছেলেবেলা নিয়ে আর অন্যটা নিজের দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধকালীন রাডার অফিসারের দায়িত্ব পালনের অভিজ্ঞতা নিয়ে। ওটার নাম ‘গ্লাইড পাথ’। আর যেগুলো এস এফ নয় সেগুলো প্রবন্ধ।

দ্বিতীয় মহাযুদ্ধে যখন অন্যান্য দেশের মতো তারটিও ব্যস্ত ধ্বংসলীলায়- তখনো বিশ্বের সুবিধা আর ভবিষ্যৎ নিয়ে ভেবে তিনি স্যাটেলাইট সম্পর্কে লিখেছেন। ‘মার্কনি ইন্টারন্যাশনাল ফেলোশীপ’ পান ওটার জন্য।

পেয়েছেন ফ্র্যাঙ্কলিন ইনস্টিটিউট স্বর্ণপদক, উনিশশো পঁচাশি সালে SCIENCE FICTION WRITERS OF AMERICA তাকে গ্র্যান্ড মাস্টার (Grand Master of Science Fiction) খেতাবে ভূষিত করে। উনিশশো ঊননব্বইতে নাইট উপাধিতে ভূষিত হন। বাষট্টি সালে কলিঙ্গ (ব্লদেভু উইথ রামা), উনসত্তর সালে আরেকটি পুরস্কার, র‍্যাডফোর্ড ওয়ারশার খেতাব, দু-বার হুগো, নেবুলা অ্যাওয়ার্ড, J.w. CAMPBELL খেতাব সহ আরো অনেক পুরস্কার জুটেছে তাঁর এ জীবনে। তবে কথাও থেকে যায়। এখন এমন অবস্থা দাঁড়িয়েছে যে, পুরস্কারদাতারা তাঁকে পুরস্কৃত করে নিজেরাই বিখ্যাত হয়ে যাচ্ছেন।

যে দু-বার নেবুলা পেয়েছেন:

১৯৭৩ Rendezvous with Rama

১৯৭৯ The Fountains of Paradise

আর হুগো এ্যাওয়ার্ড:

১৯৭৪ Rendezvous with Rama

১৯৮০ The Fountains of Paradise

ক্লার্ক ভবিষ্যতের বেসাতি করেন। তাই বিজ্ঞান কল্প গল্পকারদের জন্যও তাঁর একটা কথা আছে জানানোর মতো। তিনি সায়েন্স ফিকশন লেখার পেছনে সবচে বড় যে উদ্দেশ্যটা খুঁজে পেয়েছেন তা তাঁর কথায় স্পষ্ট হয়ে ওঠে, “এসবের (ধর্ম- দর্শন সংস্কার-সমাজ-মূল্যবোধ) মধ্য দিয়ে নূতনতর জীবনবোধ কেমন দাঁড়াতে পারে, তা অনুসন্ধানের দায়িত্ব সায়েন্স ফিকশন রাইটারের। শুধু বিজ্ঞানকে জাদু হিসেবে উপস্থাপিত করার জন্যে নয়- এ এক প্রচার। প্রচারের উদ্দেশ্য মানুষকে ভবিষ্যৎ সম্পর্কে প্রস্তুত করে তোলা।”

গ্রীক মহাকবি হোমারের ওরাল এপিক বা মুখে রচিত মহাকাব্য ছিল ‘ওডিসি’ (Odyssey)। চব্বিশ অধ্যায়ের মহাকাব্য। আরেক বিশ্বখ্যাত মহাকাব্য ‘ইলিয়াড’ এর পরিশিষ্ট হিসেবে পরিচিতি পেয়েছে। ইউলিসিস বা অডিসিউস ট্রয়ের যুদ্ধে অংশ নেন। তাঁর স্বদেশ যাত্রা নিয়ে রচিত এই মহাকাব্য খ্রীষ্টপূর্ব নবম শতকের। ওটাতে সম্রাট ইউলিসিস অতিমানবিক সংগ্রাম করেছে নিজ দেশ তথা লক্ষ্যে পৌঁছুতে। এর পর আরো একটা বইয়ের নামে ওডিসি এসেছে। এটার এ নামকরণের কারণ ওডিসির মতোই লক্ষ্যের দুস্তরতা আরোপ করা। টু থাউজ্যান্ড ওয়ান: এ স্পেস ওডিসি’ (2001: A Space Odyssey)। উনিশশো আটষট্টি সালে বেরুনোর পর আণবিক বোমার চেয়ে কোনো অংশে কম শক্তির বিস্ফোরণ ঘটায়নি সায়েন্স ফিকশন বোদ্ধাদের মনোজগতে। একজন পরিপূর্ণ দার্শনিকের রূপ পরিগ্রহণ করেন ক্লার্ক এতে। বলা হয় এজন্যই সবচে বেশি পরিচিত তিনি।

এটাকে অনেকে বলেন মহাকাশ বিজ্ঞান বিষয়ক সায়েন্স ফিকশনগুলোর-বিশেষ করে মহাকাশ অভিযান বিষয়ক বৈজ্ঞানিক সাহিত্যের কম্পাস হিসেবে। কারণ তিনি এতে মহাকাশ অভিযানের সব দিক তথা প্রযুক্তি আর মানবিকতা-দুইই প্রকাশ করেছেন বিজ্ঞানীর মতো। স্টার ট্রেক’ থেকে ‘মার্স অ্যাটাক’ পর্যন্ত এর প্রভাব পড়েছে। এমনকি ক্লার্কের ওডিসি পেন্টালজিকে মহাকাশভিত্তিক সায়েন্স ফিকশনের প্রথম বিস্তৃত মাইল ফলক বলা হয়। এ অসম্ভব সফল বইটির আরেক অংশ লেখেন ‘টু থাউজ্যান্ড টেন: ওডিসি টু’। এরপর ‘টু থাউজ্যান্ড সিক্সটি ওয়ান: ওডিসি থ্রি’। কোনোটি লেখার সময়ই ইচ্ছা ছিলো না আরো একটু প্রলম্বিত করার। কিন্তু পাঠকরা ছাড়েননি ক্লার্ককে। আর কালাতিক্রমী অনন্যসাধারণ ঘটনাচক্র বাধ্য করেছে আরেকটি লিখে ওডিসির পাট চুকিয়ে দিতে। সময় সমাজ আর ভাবনাকে ডিঙিয়ে গিয়ে এ মহাকাব্যের সমাপ্তি টানলেন ‘থ্রি থাউজ্যান্ড ওয়ান: দ্য ফাইনাল ওডিসি’ নামে। এর মাধ্যমেই ওডিসি রহস্যের দুদিকের ভারি দরোজা চিরদিনের জন্য বন্ধ করে দিতে চান উনিশশো সাতানব্বইতে। কিন্তু বিধি বাম, পাঠক-প্রকাশক সম্পাদকরা তাঁকে অতিষ্ঠ করে তুললে বাধ্য হন ‘ওডিসি ফাইভ’ লিখতে। ক’দিন আগে শেষ করেছেন বইটা। হয়তো বেঁচে থাকলে সব সময়ই তাকে ওডিসি লিখে যেতে হবে মানুষের চাপে পড়ে।

এর রহস্যঘেরা টোটেম, কু, হাল-ন হাজার কম্পিউটার, মানবিক দ্বন্দ্ব-কোনোটার চেয়ে কোনোটা কম যায় না। এক্সপেডিশন অফ আর্থ’ (১৯৫৩) এর বিশেষ একটা ছোটগল্প ‘দ্য সেন্টিনেল’। মজার ব্যাপার হচ্ছে, ‘দ্য সেন্টিনেল কে পরে ওডিসির সিনেমা স্ক্রিপ্টে ঢুকিয়ে দিয়েছিলেন এবং তা মানিয়েও গেছে। এ নিয়ে লেখা চিত্রনাট্য ওই বছরের সেরার মর্যাদা কেড়ে আনে। একাডেমিক অ্যাওয়ার্ড ফর স্পেশাল ভিজুয়্যাল ইফেক্টস’ এবং ব্রিটিশ ফিল্ম অ্যাকাডেমি অ্যাওয়ার্ডস ফর বেস্ট সিনেমেটোগ্রাফি, বেস্ট সাউন্ড, বেস্ট আর্ট ডিরেকশন’ পায়। অস্কার অ্যাওয়ার্ডের মনোনয়নও পেয়েছে ওটা। সবচে বড় কথা, ‘অল টাইম বেস্ট সায়েন্স ফিকশন মুভি’, ‘মোস্ট ওয়াইডলি ডিসকাসড এস এফ মুভি অব অল টাইম উপাধি পায় ওটি।

ক্লার্কের জাদুর সাথে কুবরিকের পরিচালনায় সৃষ্ট অমর গাঁথার ছবিটা মুক্তি পায় উনিশশো আটষট্টিতে। অবাক ব্যাপার, এর গ্রাফিক্যাল কাজ দেখে কেউ বলবে না এটা এত আগের। আর খারাপ দিক হচ্ছে-একেকটা দৃশ্য অনেক অনেক বেশি লম্বা এবং কাহিনীকে বেশ বদলে দেয়া হয়েছে ছবিতে। চার বছর আগে প্রয়াত বিখ্যাত চিত্র পরিচালক স্ট্যানলি কুবরিক ঘটনাটা নিয়েছিলেন। এ ছবি এত বেশি প্রভাব। ফেলেছে বাস্তব ক্ষেত্রে-যা এক কথায় অবিশ্বাস্য।

ইসরায়েলী কম্পিউটার সংস্থা বহুদিন ধরে গবেষণা চালাচ্ছে শুনে শেখা কম্পিউটার বিষয়ে। সাম্প্রতিক সময়ে তারা তাদের কম্পিউটারের নাম রেখেছে ‘হাল’! এর বয়োবৃদ্ধির সাথে সাথে আর্টিফিসিয়াল ইন্টেলিজেন্স (A.I) বিষয়ক অগ্রগতিরও দাবী করছে। মার্কিন মহাকাশ গবেষণা সংস্থা নাসা তাদের সর্বশেষ মহাকাশযানের নাম রেখেছে ‘ওডিসি’। রুশ বিজ্ঞানীরা শুনে শেখা কম্পিউটার তৈরির ব্যাপারে সফলতার দ্বারপ্রান্তে পৌঁছুবার ঘোষণা দিচ্ছেন।

বহুদেশে ‘আর্থার সি ক্লার্কের রহস্যময় জগৎ’ টিভি সিরিয়ালটি চলছে। ওটা তের পর্বের।

ছোটগল্পের মাঝে ‘দ্য সেন্টিনেল’, ‘হুজ দেয়ার হলো ক্লার্কের নিজ রীতির খাঁটি ভয়ভিত্তিক সায়েন্স ফিকশন। প্রতীক্ষা’, ‘সময় সমস্যা’, ‘অস্ত্র প্রতিযোগিতা’, ‘অন্ধকারের পথ’ তাঁর কয়েকটি অনন্য কর্ম।

তাঁর আরেক চরিত্র রামা’। লিখেছেন গার্ডেন অব রামা’, ‘রামা দ্য সেকেন্ড, ‘রামা রিভিড সায়েন্স ফিকশনের উপন্যাসগুলো। মজার ব্যাপার হলো, অনেক বোদ্ধা মনে করেন ক্লার্কের শ্রেষ্ঠ কাজ ওডিসির সিরিজ নয় বরং রামার সিরিজ। এটা পুরস্কারও পেয়েছে বড় বড়। কিন্তু প্রভাব ফেলতে পারেনি ওডিসির মতো।

‘চাইল্ডহুডস এন্ড’ বিখ্যাত বই। লিখেছেন ‘দ্য লাইট অব দ্য আদার ডে’জ’। বহু নন ফিকশনও লিখেছেন তিনি। লেখার ক্ষেত্রের বিস্তৃতি ছিল সেই মহাকাশ ভ্রমণ, সমুদ্রগর্ভের অতলে হারিয়ে যাওয়ার আলোচনার আশেপাশেই।

সায়েন্স ফিকশন ও ভবিষ্যৎ জীবনে মানুষকে যে সমস্যাটার মোকাবিলা করতে হয় তা হল ভয়। সম্ভবত মানবের আদিমতম শত্রু এবং অসহায়ত্বের প্রথম প্রতীক। তিনি তাঁর রচনায় প্রাধান্য দিয়েছেন পাঁচটা বিষয়ে যা সাহিত্যগুণকে মহিমান্বিত করেছে। এক, ভয়; দুই. মানবিকতা বিশ্লেষণ; তিন, মানসিকতা বিশ্লেষণ; চার. অনিশ্চয়তায় ভরা কাহিনীর ধারা আর গঠনগত দিকেও অনিশ্চয়তা; পাঁচ, কাহিনীর বক।

বিজ্ঞানের দিক দিয়ে কখন কী প্রাধান্য দিয়েছেন তা কোনো ছকে ফেলে দেয়া সম্ভব না; তবে সাধারণত যা উঠে আসে তা হচ্ছে, ১.স্পেস ট্রাভেল কেন্দ্র করে অনেক কাহিনীই ঘুরেছে, তিনি মূলত একজন মহাকাশবিদ্যার এস এফ লেখক; ২.সরাসরি সংযোগে না এসেও সবচে বড় প্রভাবটা ফেলে এলিয়েনই; ৩.স্বাভাবিকভাবেই নতুন গ্রহ বা উপগ্রহের উপর কাহিনী ঘুরপাক খায় প্রচণ্ড গতিতে; ৪. মহাকাশ বসত বা মহাকাশ যুগে মানব বসতি বিষয়ে অহরহ উঠে আসে ঘটনা। এক কথায়, তিনি অনন্ত নক্ষত্রবীথির কথক।

তাঁর লেখা যে মহাকাশ অভিযান, মহাকাশ টেকনোলজি নিয়ে আবর্তিত হয়, তা বেশ কয়েকবার বিভিন্ন লেখক বলেছেন। বিচারটা অনেক বেশি স্কুল হয়ে গেলেও করার কিছু নেই। তাঁর মতো লেখক বিজ্ঞানের কোনো দিক নিয়ে কাজ করছেন তা বিশ্লেষণ করাটা প্রায় অসম্ভব যেখানে বিজ্ঞানের ভোলা মাঠের পুরোটাতেই তিনি ম্যারাডোনা। তার আরেক ব্যাপার ভাল লাগে, আর সব ইংরেজ বা আমেরিকান লেখকের মতো শুধু ইংরেজ চরিত্র রাখেন না লেখাগুলোয়। বরং আফ্রিকান, ভারতীয়, চৈনিক, রাশিয়ান চরিত্র অনেক। কারণ তিনি কোনো জাতি বা দেশের প্রতিনিধি নন, প্রতিনিধি এ বিশ্বের মানুষের।

আর সাইবার পাঙ্ক হিসেবে তাঁকে কোনো শ্রেণীতে ফেলে দেয়া কঠিন। কারণ সাইবার পাঙ্ক শ্রেণীর জন্মের বহু আগ থেকেই তিনি নক্ষত্র। তবে লেখায় কাব্যধর্মীতা, উপমাশ্রয়, লম্বা বাক্য লেখার প্রবণতা, বক্র বচন, একটা বিষয় নিয়ে বেশি ঘাটানো আর বহু তুলনা করার স্টাইল থাকার কারণে অবশ্যই তাঁকে সাইবার পাঙ্ক লেখক বলা যায় না। কারণ তার সেসব বৈশিষ্ট্য ষাট-সতুর দশকে আন্তর্জাতিক সাহিত্যের। এসব বৈশিষ্ট্য অনেকটাই বিরক্ত করে পাঠককে, কিন্তু তিনি সেসময় সে স্টাইলেইতো লিখবেন, এটাই স্বাভাবিক। আর সাইবার পাঙ্ক হল আশির শেষার্ধে শুরু হওয়া একটা ধারা যা সাহিত্যকে গোয় ধরে না।

রাশিয়ায় ইউটোপিয়ান ফিকশন (utopian fiction) বা স্বপ্ন রাজ্যের গল্প নামে একটা ধারা বেশ পুরনো আমল থেকেই প্রচলিত। এর গোড়া অষ্টাদশ শতকের মাঝামাঝিতে দেবে আছে। একে অনেকে কম্যুনিস্ট ফিকশনও বলেন। এক মতে, ইউটোপিয়ার অর্থ দাঁড়ায় ভবিষ্যতের স্থানিক রূপ বা ভবিষ্যৎকে একটি সুন্দর স্থান হিসেবে কল্পনা করা। আরেক মতানুসারে, এর অর্থ ‘স্বপ্নীল জগৎ’। সত্যি বলতে গেলে, ক্লার্কের গোটা লেখার কোথাও এই স্বপ্ন রাজ্যের পেছনে দৌড়ানো দেখা যায়নি। তবে ভিতরে এমন একটা প্রবাহ দেখা যায়। আবার তাঁর শ্রেষ্ঠ অবদান ওডিসি পেন্টালজিতে এই ‘স্টার চাইল্ড’ এর পেছনে ধাওয়া করাটাই দেখানো হয়েছে যা আসলে ইউটোপিয়ান। কিন্তু ক্লার্ক কোন শ্রেণীর? আমার মনে হয় ক্লার্ককে সেমি সাইবারপাঙ্ক আর টেকনো ইউটোপিয়ান বলা যায়। কারণ প্রাযুক্তিক ইউটোপিয়া বা টেকননা ইউটোপিয়ান প্রভাবই তাঁর লেখায় বেশি।

অনেকটা স্পষ্টভাবে ঘটনা বুঝিয়ে দেন পাঠককে অত্যন্ত শক্তিময় আবেদনের সাহায্যে। তাতেই পাঠক পেয়ে যায় অসাধারণ মজা। তাঁর দারুণ একটি বৈশিষ্ট্য-পাঠককে খোলাসা করে বলেও দেন, রাখেন রহস্যও। তিনি আসিমভের মতো পাঠকের উপর সিদ্ধান্ত ঠিকই ছাড়েন, তবে আসিমভের চেয়ে আরেকটু এগিয়ে নেন কাহিনী। এতে করে পাঠককে কষ্ট করে সিদ্ধান্ত নিতে হয় না, অবশ্যম্ভাবীরূপে তা এসে যায়। আর গদ্য অন্তর্গত ধোঁয়াশার দিক দিয়ে আসিমভের চেয়ে পরিষ্কারভাবে ফুটে উঠতে দেন কাহিনীকে। তবে ক্লার্কের গদ্যশৈলী থেকে আসিমভের শৈলী অনেক সরল আর সুখপাঠ্য। থ্রিলার ভাবটা ফোঁটানোর ক্ষেত্রেও আসিমভ অগ্রগণ্য। ঠিক আসিমভের মতোই বিজ্ঞান ও সাহিত্যের উভয়ক্ষেত্রেই সমান দৃষ্টি রেখে প্রকাশিত করেন ঘটনা। জুলভার্নের বেলায় একটা বইয়ের পাতাগুলোর মতো মনে হয় এ পাতা উল্টালেই বই শেষ-অর্থাৎ আপাতত কাহিনী এক ধারায়, রহস্য এক ধারায়-পরের মুহূর্তেই ওটার একটা জট খুলে যাওয়ায় পরের আরেক রহস্য ধরা দেয় এবং বেশ কবার এমন হবার পর কাহিনী শেষ হয়। ক্লার্কও প্রায় একই প্রক্রিয়ায় এখোন। তবে পার্থক্য হচ্ছে, ভার্নের ধাপ ও কাহিনী স্বচ্ছতম, ক্লার্কেরটা এই একটু কম স্বচ্ছ। ধাপও-কাহিনীও।

বিখ্যাত আরেক থ্রি ল’জ দিয়েছেন তিনি। বলেছেন কালোত্তীর্ণ কথা ‘যখন একজন একনিষ্ঠ আর পুরনো বিজ্ঞানী ঘোষণা করেন যে, কিছু একটা সম্ভব, তিনি বলছেন একেবারে ঠিক কথা। যখন তিনি বলেন যে কিছু একটা অসম্ভব, খুব সম্ভবত তিনিই এবার ভুল করছেন।’

বয়স হয়ে গেছে। লিখেছেন একটা বড়সড় বই স্টিফেন বাক্সটারের সাথে। তবে তিনি থেমে নেই। এখনো প্রথম যৌবনের মতো সাগরে ডাইভ দিতে চান। পাঞ্জায় হারাতে চান পঁচিশ বছরের যুবককে। এজন্যই হয়তো তিনি সায়েন্স ফিকশন কাহিনীকার-চির তারুণ্যের সবুজ পাতায় আবৃত। সময় তাঁর এ দুর্বল অবস্থাকে আরো দুর্বল করে দিতে পারে। ক্লার্ক থেকেই যাবেন-যেমন থেকে গেছেন আসিমভ-জুলভার্নরা।

নির্ঘণ্ট

১. চারপেয়ে সরীসৃপ: প্রাচীন চারপেয়ে সরীসৃপ মানে ডায়নোসর জাতীয় প্রাণী।

২. জিন প্রাণীর প্রতিটি কোষের নিউক্লিয়াসে থাকে নির্দিষ্ট সংখ্যক ক্রোমোজোম, প্রতিটি ক্রোমোজোমে বংশগতির বার্তাবাহক যে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র অংশ থাকে তা জিন। চোখের রঙ, গায়ের উচ্চতা, লোমশতা-এমন প্রতিটি বিষয় প্রকাশের জন্য এক বা একাধিক জিন কাজ করে। জিনের জন্যই বাবা-মায়ের বৈশিষ্ট্য সন্তানের দিকে যায়। মজার ব্যাপার হল, দাদার লাল চুল এবং বাবার কালো চুল হলেও নাতির লাল চুল হতে পারে, অর্থাৎ মানুষের জিন হারায় না, পরের কোনো না কোনো বংশধরের কাছে প্রকাশ পেতে পারে। অর্ধ শতাব্দীরও বেশি সময় ধরে গবেষণায় বিজ্ঞানীরা মানুষের মাত্র ৪% জিনের কাজ সম্পর্কে অস্পষ্ট ধারণা পেয়েছেন। জিন গবেষণা শেষ হলে মানুষের অমর হয়ে যাওয়াও বিচিত্র নয়।

৩. প্লেইস্টোসিন: এক ভূতাত্ত্বিক, আবহাওয়া নির্ভর যুগ। চব্বিশ লক্ষ বছর আগের। এর পর বরফ যুগ। প্লায়োসিন-প্লেইস্টোসিন থেকেই মানব জাতির উদ্ভব (বিবর্তন মতবাদ অনুসারে)। ইউরোপ-আমেরিকায় বর্তমান মাটি এবং বহু বিলুপ্ত প্রজাতির ফসিল এ উষ্ণ যুগের ফসল।

৪. ডায়নোথেরিয়া: হাতি জাতীয় বিশাল স্থলজ প্রাণীর উপগোত্র। পূর্বসূরী ম্যামথ, উলি ম্যামথ।

৫. শব্দেতর: যে নিচু কম্পাঙ্কের শব্দ শোনা যায় না। মানুষ আঠারো হার্জের নিচের কম্পাঙ্কের শব্দ শোনে না। আবার আঠারো হাজার হার্জের উপরের শব্দও শোনে না। সেটা শব্দোত্তর তরঙ্গ।

৬. অ্যান্টিলোপ: দ্রুতগামী, হাল্কাপাতলা, তৃণভোজী, বিচরণশীল প্রাণীর দল। ভেড়া ও ছাগলজাতীয় প্রাচীন প্রাণী।

৭. ইউটোপিয়া: কল্পরাজ্য, কল্প-ভূস্বর্গ, পৃথিবীর সর্বসুখের স্থান। টমাস মুর তার ইউটোপিয়া গ্রন্থে প্রথম এ নাম দেন। তাঁর কল্পিত এই দ্বীপে আসলে সমাজবিজ্ঞান আলোচনা করেছেন। অনেকে মনে করেন সায়েন্স ফিকশন মানে ইউটোপিয়ার সন্ধান। তাই এস, এফ. এ ইউটোপিয়ান ও এন্টি ইউটোপিয়ান ধারা চালু হয়েছে।

৮. গাইডেড মিসাইল: নিক্ষেপের পর যে ক্ষেপণাস্ত্রের দিক বদলানো যায়। অটো গাইডেড মিসাইল আবার শক্রযানের পেছনে ধোয়া অথবা তাপ অনুসরণ করে যেতেই থাকে।

৯. গ্যানট্রি: যে বিশাল প্ল্যাটফর্ম থেকে রকেট বা অন্য মহাকাশযান ছোঁড়া হয়।

১০. ওয়্যারহেড: মিসাইলের অগ্রভাগে আসল বিস্ফোরক থাকলে সেটা। এখানে পারমাণবিক বোমা যা মিসাইলে বসানো যাবে।

১১. কেনেডি: জন ফ্রিৎজেরাল্ড। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সবচে জনপ্রিয় প্রেসিডেন্ট, কিউবা ও বার্লিন সংকটের ত্রাতা। উনিশশো তেষট্টি সালে খোলা গাড়িতে যাবার সময় আততায়ীর গুলিতে নিহত। পৃথিবীর সবচে বড় স্পেস স্টেশনটি কেনেডির নামে।

১২. জি: সপ্তদশ শতকে ইম্পার শব্দটি ব্যবহার করেন ডানে চলা বা সামনে যাওয়া বোঝাতে। পরে শব্দটি পৃথিবীর মাধ্যাকর্ষণের মানের সাথে সম্পর্কযুক্ত হয়ে পড়ে। এখানে টু জি মানে মাধ্যাকর্ষণের দ্বিগুণ।

১৩. সিস্টেম: কোনো পরিপূর্ণ ব্যবস্থাপনা। যেমন হার্ড ডিস্ক, মনিটর, স্পিকার প্রতিটি যন্ত্র হলেও কম্পিউটার একটি যন্ত্র নয়, বরং যান্ত্রিক ব্যবস্থাপনা বা সিস্টেম।

১৪. গোল্ড কোস্ট: গিনি উপসাগরের উপকূলীয় এলাকা, স্বর্ণ পাওয়া যেত, ব্রিটিশ শাসনে গোল্ড কোস্ট কলোনি নামে যে এলাকা ছিল পরে তা ঘানা নামে স্বাধীন হয়।

১৫. রেডিও অবজার্ভেটরি: প্রাকৃতিক ব্যাপার নিরীক্ষণের বিল্ডিং বা প্রতিষ্ঠান, যা দূরের ব্যাপার ও তরঙ্গ যোগাযোগ পরীক্ষা করে।

১৬. কক্সটন: উইলিয়াম। প্রথম ইংরেজ ছাপাকর্মি, প্রকাশক, অনুবাদক। গুটেনবার্গের সমসাময়িক। এক হিসাবে প্রকাশনা শিল্পের সার্থক সর্বচারী জনক।

১৭. গুটেনবার্গ: জোহান্স,। ১৪৩৬ সালে ছাপাখানার আবিষ্কারক / উন্নয়নকারী। বিয়াল্লিশ লাইন বা মাজারিন বাইবেলের অপর নাম তাঁর নামে, গুটেনবার্গ বাইবেল।

১৮. ইথার: আগে ধরা হত মহাশূন্যে ইথার একটি অতি স্থিতিস্থাপক মাধ্যম। কারণ ধরা হতো যে আলো একটি তরঙ্গ। বাস্তবে কোনো তরঙ্গই মাধ্যম ছাড়া চলতে পারে না। তাই ইথারের কল্পনা। কিন্তু কোয়ান্টাম তত্ত্ব আসার পর ধারণা পাল্টে যায়। বর্তমানে শব্দটিকে সম্মান করার জন্য এক যৌগকে এ নাম দেয়া হয়েছে।

১৯. বালি: জাভার এক মাইল দূরের ইন্দোনেশীয় পাথুরে পর্যটন দ্বীপ। সর্বোচ্চ শৃঙ্গের নামও বালি। প্রকৃতি অনিন্দ্যসুন্দর। দানবীয় সব বটগাছ, বাঘ (এর মধ্যে বালি বাঘ, রয়েল বেঙ্গলের মতো দেখতে, বিলুপ্ত), হাজারও হরিণ আর বুনো শুয়োর আছে। অবকাশ যাপন কেন্দ্র ও পর্যটন কেন্দ্র গড়ে ওঠার পর ক্লার্কের স্বপ্নের বালি দ্বীপ আসলেই কলুষিত হয়েছে,তারপর সেখানে অস্ট্রেলিয় পর্যটকদের উপর বোমাও বিস্ফোরিত হয় এবং ইমাম সমুদ্র অভিযুক্ত হন।

২০. এ্যালগিঃ এক ইঞ্চির আড়াই হাজার ভাগের একভাগ থেকে শুরু করে দু’শ ফুট পর্যন্ত দৈর্ঘের বিচিত্র সব জলজ আলো-খাদক শৈবাল-শ্যাওলার দল। এরা আমাদের অক্সিজেনের এক বিরাট অংশ দেয় এবং সব জলজ প্রাণীর প্রাথমিক খাদ্য।

২১. ক্ল্যাস্ট্রোফোবিয়া: এক ধরনের মনস্তাত্ত্বিক অসুস্থতা। আবদ্ধ স্থানে অস্বস্তি বোধ বা ভয়/ আতঙ্ক বোধ।

২২. কোর (কর্প): সৈন্যদলের সম্পূর্ণ আলাদা ও স্বয়ংসম্পূর্ণ অংশ যা সাধারণত একই কাজ করে। সাধরণত আশি হাজার সেনার ইউনিট, এর প্রধান একজন লেফটেন্যান্ট জেনারেল। যেমন: ক্যাডেট কোর, পদাতিক কোর। তবে বেসামরিক ক্ষেত্রে এক অভিন্ন ও বিশাল কাজে অংশ নেয়া লোকবলকে কোর বলা যায়।

২৩. লক্স: লিকুইড অক্সিজেন। উনিশশো তেইশ সালে এই সংক্ষিপ্ত নাম দেয়া হয়।

২৪. পোব: ছোট কিন্তু তথ্য সংগ্রহকারী বা অভিযান চালনাকারী যন্ত্র। আবার পরীক্ষা করলেও এ শব্দ ব্যবহৃত হয়। সনিক প্রোব মানে শব্দের তরঙ্গ দিয়ে চেষ্টা করা।

২৫. নিউট্রন বীম: হাইড্রোজেন ছাড়া আর সব পরমাণুর নিউক্লিয়াসে নিউট্রন আছে, ভর প্রায় প্রোটনের সমান। আবিস্কৃত হয় উনিশশো বত্রিশে। এর কোনো চার্জ নেই, তাই আকৃষ্ট বা বিকর্ষিত হয় না। বেশি ভর ও চার্জহীনতার কারণে নিউট্রনের সরল প্রবাহ বা বিম চালানো শক্তিশালী কিন্তু নিরাপদ ও নিশ্চিত।

২৬. প্যানডোরার বাক্স: গ্রিক পুরাণ অনুসারে প্রথম নারী, তাকে সব দেবতা তাদের পছন্দের রূপ দিয়ে গড়ে পৃথিবীতে পাঠান একটা বাক্স দিয়ে যেটা খোলা নিষিদ্ধ ছিল। কিন্তু অনেক পেয়ে প্যানডোরা লোভী হয়ে বাক্সটা খুলে ফেলেই সর্বনাশ ডেকে আনে। প্রাকৃতিক-অতিপ্রাকৃতিক দুর্যোগ ঘনিয়ে আসে।

২৭. প্যাস্কেল: ব্লেইজ.। প্রখ্যাত কিশোর গণিতজ্ঞ। ১৯ বছর বয়সেই ‘প্যাস্কেলের চাকা’ বানান। কম্পিউটার বিজ্ঞান ও গণিতে এর অনেক অবদান। অন্য কীর্তিও রয়েছে।

২৮. ক্যানবেরা: সিডনির দেড়শো মাইল দূরে, মলোঙ্গো নদী তীরে অস্ট্রেলিয়ার রাজধানী।

২৯. অ্যামনেসিয়া: চিকিৎসা বিজ্ঞানে স্মৃতিভ্রষ্টতা।

৩০. কম্পিউটার প্রজন্ম: ক্লার্ক তিনটি প্রজন্ম দেখিয়েছিলেন কারণ চৌষট্টি পর্যন্ত বিশ বছর অঙর কম্পিউটারের প্রজন্ম এগিয়ে আসত। কিন্তু একাত্তরে মাইক্রো প্রসেসর আবিষ্কারের পর ধারাটা পাল্টে যায়। আমরা কম্পিউটারের পঞ্চম প্রজন্মের দ্বারপ্রান্তে আছি।

৩১. এনিয়াক: ইলেক্ট্রনিক নিউমেরিক্যাল ইন্টিগ্রেটর অ্যান্ড কম্পিউটার। এটিই প্রথম প্রোগ্রাম ঢোকানোর মতো ডিজিটাল কম্পিউটার। এ থেকেই প্রজন্ম শুরু। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের তালে পড়ে যুক্তরাষ্ট্র সেনাবাহিনী একটি পুরোপুরি ইলেক্ট্রনিক কম্পিউটার নির্মাণের পরিকল্পনা নিলে আধুনিক কম্পিউটারের জনক জন ভন নিউম্যান, প্রেসপার একটি জুনিয়র এবং হারম্যান গোল্ডস্টেইনের মতো কম্পিউটার মহারথী ও মুর স্কুল অব ইলেক্ট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং এবং পেনসিলভানিয়া ইউনিভার্সিটিতে যোগ দেয়। পঞ্চাশ ফুট বাই ত্রিশ ফুটের ভূ-গর্ভস্থ কক্ষে চল্লিশজন বিজ্ঞানী তিন দেয়ালজুড়ে থাকা এ কম্পিউটার চালাতেন। অনেকেই জানেন না, মানবজাতির উপর আশীর্বাদ কম্পিউটারের শুরু এনিয়াক আসলে তৈরি করা হচ্ছিল হাইড্রোজেন বোমা বানানোর হিসাব করার জন্যে। কিন্তু সৌভাগ্যবশত তিন বছরের চেষ্টায় চার লাখ ডলার ব্যয়ে উনিশশো চল্লিশের ফেব্রুয়ারীতে যখন এ জিনিস তৈরি হয় তখন যুদ্ধই শেষ।

৩২. সলিড স্টেট মাইক্রো ইলেক্ট্রনিক্স: একেবারে আণবিক স্তরে নেমে গিয়ে কঠিন পদার্থের ইলেক্ট্রিক যন্ত্র তৈরির প্রচেষ্টার বিজ্ঞান।

৩৩. মিনস্কি: মারভিন,। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা তত্ত্বের দিকপাল। ম্যাসাচুসেটস ইন্সটিটিউট অব টেকননালজির (এম আই টি) নিউরোফিজিওলজি এবং কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ল্যাবরেটরির সাবেক শিক্ষক। শত শত কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা বিশারদের দীক্ষাগুরু এবং বাস্তব গবেষক। তিনি এজন্য প্রচুর কম্পিউটার ও অন্যান্য যন্ত্র তৈরি ও উদ্ভাবন করেন।

৩৪. নিউরাল নেটওয়ার্ক: ট্রিলিয়ন ট্রিলিয়ন নিউরন কোষ জটিলভাবে পরস্পরের সাথে যুক্ত না হয়ে মানুষের মস্তিষ্ক গঠন করে। তাই এই জটিলতার বিশালত্ব ও কাজের ব্যাপকতাকে বোঝাতে কথাটা ব্যবহৃত হয় ভবিষ্যৎ কম্পিউটারের ক্ষেত্রে। অনেকে এ দিয়ে মানবীয় গুণের কম্পিউটারের কথাও বোঝান।

৩৫. পাইথিয়াস: প্রাচীন সপ্তাশ্চর্যের অন্যতম হ্যাঁলিকারনাসাসের সমাধিমন্দির নির্মিত হয় যীশুর জন্মের সাড়ে তিনশো বছর আগে। তিনি স্থপতি।

৩৬. গ্যালিয়ন: বিশাল স্প্যানিশ শিপ। মূলত সাঁজোয়া যুদ্ধে ব্যবহার হতো পনের থেকে আঠারো শতকে।

৩৭. কুক: রবিন.। বিখ্যাত জীববিজ্ঞানী।

৩৮. রজার: গ্রহণ করা হয়েছে, শুনতে পেয়েছি। শব্দটা শুধু রেডিও যোগাযোগের ক্ষেত্রে সব দেশে ব্যবহার করা হয়।

৩৯. হাইপোকন্দ্রিয়া: স্বাস্থ্য বা রোগ নিয়ে মনে ভয় পুষে রাখার রোগ। আবার পুরো পেটের উপরদিকের অংশকেও বোঝায়।

৪০. বিস্ফোরণ: মানুষের শরীরে গ্যাসীয় অনুগুলো তরল আছে কিছুটা চাপ ও তাপের কারণে। সব সময় বায়ুমণ্ডল আমাদের উপর অত্যন্ত বেশি চাপ দেয় এবং পৃথিবী আকর্ষণ করে বলে শরীরের দ্রবীভূত অক্সিজেন, কার্বনডাইঅক্সাইডসহ আরো শত গ্যাস তরল হয়ে থাকে। কিম্বা গ্যাসীয় থাকলেও কম স্থান দখল করে। কিন্তু যেখানে এক বিন্দুও বায়ুমণ্ডলীয় চাপ নেই সেখানে সাথে সাথে সেসব তরল ও সংকুচিত বায়বীয় গ্যাস তাদের গ্যাসীয় রূপ পাবার জন্য বিস্তৃত হয়, ফলে মহাকাশে কোনো স্পেসস্যুট পরা না থাকলে প্রাণীদেহ একেবারে ফেটে যায়।

৪১. নিউরোসিস: নিউরনে গণ্ডগোল। আসলে হাল্কা মানসিক রোগকে বোঝায় যার ফলে বাহ্যিক কথাবার্তায় এবং আচরণে বোঝা যায় না। অপ্রকাশ্য পাগলামি।

৪২. এইচ জি ওয়েলস: হার্বার্ট জর্জ,। ভার্ন, আসিমভ, ক্লার্কের পর সবচে দামী এবং সাড়া জাগানো সায়েন্স ফিকশন লেখক। প্রথম জীবনে অর্থাভাবে নানা কাজ করেছেন অথচ পরে তাঁর লেখা কোটি কোটি মানুষ পড়ে। ‘দি টাইম মেশিন’, ‘দ্য ইনভিজিবল ম্যান’ তাঁর অমর কীর্তি।

৪৩. আতঙ্ক: আমেরিকার মানুষ মঙ্গল নিয়ে ফ্যান্টাসিতে ভোগার সময় এক হ্যালোইন উৎসবের রাতে (যে রাতে ছোটরা ছদ্মবেশে মানুষের বাড়ি বেড়াতে যায়) ওয়েলসের এক সায়েন্স ফিকশনের নাট্যরূপ রেডিওতে প্রচারের সময় নাটকের মধ্যে খবরে বলা হচ্ছিল যে মঙ্গলের প্রাণীরা মানুষের উপর আক্রমণ করেছে। কিন্তু অনেকে সে সময় রেডিও খোলে এবং আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। অর্থ শতাব্দী আগেও মানুষ এত বিজ্ঞান সচেতন এবং এস এফে বিশ্বাসী ছিল যে সাথে সাথে লক্ষ লক্ষ মানুষ বাঁচার তাগিদে পথে নেমে পড়ে, অস্ত্র নিয়ে প্রস্তুত হয়, লুকিয়ে পড়ে পথেঘাটে, কেননা হ্যালোইনে আসলেই ছদ্মবেশে আসা খুব সহজ কাজ। সেই রাতের মতো আতঙ্ক মানুষের মনে খুব কমই নেমেছে।

৪৪. মিল্কি ওয়ে: আমাদের গ্যালাক্সি হলেও আমরা এর প্রান্তে পড়ে আছি বলে একে দেখতে পাই। দশ হাজার কোটির উপর নক্ষত্র সর্পিল পথে পানির ঘূর্ণির মতো একত্র হয়ে এ নীহারিকা সৃষ্টি করেছে।

৪৫. আলফা সেন্টোরি: সৌরজগতের সবচে কাছের জগৎ, ত্রি-সূর্য। সবচে কাছেরটার নাম প্রক্সিমা সেন্টোরি। আলো যেতে ৪.৩ বছর সময় প্রয়োজন। সেঞ্চুরি (শতক) বলা হয় মাঝে মাঝে, সেটা ভুল। সেন্টোরি বা সেন্টাউরি অর্থ পুরনো পৃথিবীর গাছ।

৪৬. নিলস বোর: অন্যতম শ্রেষ্ঠ বিজ্ঞানী। ডেনিশ পদার্থবিদ নিলস হেনরিক ডেভিড বোর প্রথম কোয়ান্টাম তত্ত্বের প্রয়োগকারী, পরমাণুর শক্তির ব্যাখ্যাদানকারী। আসলে পরমাণু কেমন-তা নিয়েই গণ্ডগোল চলছিল, সেটার আংশিক সমাধান দিয়ে বোরের পরমাণু মডেল গড়েন একেবারে তরুণ থাকাকালে। আণবিক নিউক্লিয়াসের তরল মডেল তৈরি করেন। উনিশশো বাইশে পদার্থে নোবেল পান। তিনি নাৎসী বিরোধী আন্দোলনেও ছিলেন। পারমাণবিক বোমাবিরোধী প্রচারণার জন্য উনিশশো সাতান্নতে শান্তি পুরস্কারও পান। কিন্তু দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে অবদান ছিল।

৪৭. সিমবায়োসিস: দুই ভিন্ন সত্তা বা প্রাণীর একত্রে বসবাস। মনের স্ববিরোধিতা।

৪৮. শ’: দরিদ্র মায়ের উপর নির্ভরশীল হতে না চাওয়া এক তরুণ ব্রিটিশ মিউজিয়ামে পড়ে সময় কাটায় এবং লেখে। উপন্যাসগুলি চরমভাবে ব্যর্থ হয়, প্রকাশই করে না কেউ। পরে সে হয় সমাজবাদী একজন নাট্যকার এবং সমালোচক। তার নাটক জনপ্রিয় হতে সময় লাগে, অথচ তিনি নোবেল নেননি, জীবন্ত কিংবদন্তী হয়ে ছিলেন। বিশ্বের অন্যতম শ্রেষ্ঠ লেখক, ম্যান অ্যান্ড সুপারম্যান’ এর স্রষ্টা খুব রসিকও ছিলেন। একবার এক অনুষ্ঠানে বক্তব্য দেয়ার সময় এক মহিলা অন্যজনকে বলছিলেন যে জর্জ বার্নার্ড শয়ের মতো লোকের প্যান্ট টেনে টেনে তোলা উচিত নয়। শ’ জবাবে বলেছিলেন যে প্যান্টটাকে নেমে পড়তে দেয়াও তাঁর উচিত মনে হচ্ছে না।

৪৯. ইবসেন: হেনরিক জন.। শ্রেষ্ঠ নরওয়েজিয়ান নাট্যকার। তাঁর নাটকও এত কম চলেছিল যে তিনি নাটক ছেড়ে দেয়ার কথাও ভেবেছেন।

৫০. ভার্দি: গুইসেপো ফচুনেনো ফ্রান্সিসকো,। উনিশ শতকের ইতালীয় অপেরার শ্রেষ্ঠ স্রষ্টা।

৫১. বিথোফেন: লুডউইক ভন.। ঊনবিংশ শতাব্দীর জগৎবিখ্যাত জার্মান সুরস্রষ্টা। নটি পর্যন্ত সিম্ফনির কথা শোনা যায়। পঞ্চম সিম্ফনিটি পৃথিবীর সব মানুষ কোনো না। কোনোভাবে শুনেছে। ঘড়ি, মোবাইল ফোন, খেলনা, কলিং বেল বা মিউজিক কালেকশন-সব ক্ষেত্রে তাঁর এই অমর সৃষ্টি বেজে ওঠে। বলা হয় তিনি কোনোদিন কানে শোনেননি।

৫২. বাচ: জন ক্রিস্টোফ ফ্রেডরিক.। অষ্টাদশ শতকের সুর-নির্দেশক, সিম্ফনি-নির্মাতা বাচ প্রথমে এক জমিদারের বাদ্যবাদক ছিলেন। অর্কেস্ট্রা, পিয়ানোসহ নানা যন্ত্রে নতুন সুর তুলেছেন।

বিশেষ টিকা : ভ্যান অ্যালেন : আমেরিকান মহাকাশ বিজ্ঞানী। তরুণ বয়সে পৃথিবী ঘিরে রাখা বলয় আবিষ্কার করে পদার্থবিদ্যায় নোবেলজয়ী। এ বেল্ট খুব প্রভাবশালী। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় আমেরিকায় তাঁর সাথে ডিনারে যাবার আগে তার কোমরবন্ধনী জড়িয়ে বলেছিলেন, ‘ভ্যান অ্যালেনের বেল্ট আমার কোমরে।’

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *