২. টি এম এ-১

দ্বিতীয় পর্ব : টি এম এ-১

অধ্যায় ৭. স্পেশাল ফ্লাইট

যতবারই পৃথিবী ছেড়ে যাই না কেন, ডক্টর হেউড ফ্লয়েড আপনমনে বিড়বিড় করছে, যাবার উত্তেজনা সব সময়ই নতুন। তার মঙ্গলে যাওয়া হল একবার, চাঁদে তিনবার আর বাইরের স্পেস স্টেশনগুলোতে যে কতবার তার ইয়ত্তা নেই। অথচ আজো টেক অফের মুহূর্তটা এগিয়ে এলেই একটা বাড়ন্ত টেনশন টের পায়। বিস্ময় আর ভয়ের এক অনুভব-এবং, হ্যাঁ, সাথে একটু নার্ভাসনেস–সাথে সাথে সেই পুরনো পাগলামি, ঘরকুনো কুয়োর ব্যাঙের মতো পৃথিবীর প্রতি টান। যে কোনো কূপমণ্ডুক পৃথিবীপ্রেমী প্রথমবার গ্রহ ছেড়ে যাবার সময় যেমন অনুভব করে, ঠিক তেমনি।

মাঝরাতে প্রেসিডেন্টের সাথে ব্রিফিং ছিল। ব্রিফিংয়ের পর যে জেটটা তাকে ওয়াশিংটন থেকে উড়িয়ে এনেছে সেটা হারিয়ে যাচ্ছে অতি পরিচিত এক পরিবেশের ওপাশে। আজো তার কাছে চারপাশের দৃশ্যটা অপার্থিব মনে হয়। এখানেই স্পেস এজ বা নাক্ষত্রিক কালের প্রথম দু প্রজন্মের উত্থান; ফ্লোরিডার সাগর তীরের বিশ কিলোমিটার এলাকা জুড়ে। দক্ষিণটা মিশে গেছে মিটমিটে লাল ওয়ার্নিং লাইটের আলোয়; শেষ মাথা উদ্ভাসিত হয়ে আছে স্যাটার্ন আর নেপচুনের পথের গ্যানট্রিতে। দূরতম প্রান্তে দেখা যায় আলোর বন্যায় ভেসে যাওয়া রূপালী বিশাল জাতীয় মিনারটা। এটা সর্বশেষ স্যাটার্ন ভি’ স্মৃতিস্তম্ভ। পাদদেশে নিয়মিত সম্মেলন আর মেলা বসে।

কাছাকাছিই, আকাশের বিপরীতে দেদীপ্যমান এক বিশাল ভবন। ঠিক যেন মানুষের গড়া পর্বত। ‘দ্য ভেহিকল অ্যাসেম্নি বিল্ডিং’ আজো পৃথিবীর বুকে সবচে বড় কীর্তি।

কিন্তু এসবই অতীতের সম্পদ, আর তার যাত্রা ভবিষ্যতের পথে। বালুকাবেলার দিকে যেতে যেতে ডক্টর ফ্লয়েড তার নিচে বিল্ডিংয়ের গোলকধাঁধা দেখতে পায়, এরপরই এক বিশাল এয়ারস্ট্রিপ; তার পর এক চওড়া, মরার মতো সোজা দাগ চোখে পড়ে। এটাই সেই দানবীয় লঞ্চিং ট্র্যাক, নিচের দাগগুলো সেই ট্র্যাকের রেলপথ। শেষমাথা যানবাহন আর গ্যানট্রিতে বোঝাই; আরেক কোণায় উজ্জ্বল আলোর ভুবনে বসে আছে এক ঝকঝকে স্পেসপ্লেন। যে কোনো সময় উড়াল দিতে পারবে তারার দেশে। আচমকা সে ভুলে বসেছে নিজের উচ্চতাকে, হঠাৎই তার মনে হয় নিচে বুঝি এক সুন্দর রূপালী শুয়োপোকা বসে আছে কোনো টর্চের আলোর সামনে।

এরপর ছোট ফ্লুয়িং যন্ত্রপাতিগুলোর আকার তার সামনে সেই ‘মথ’ এর প্রকৃত গড়ন ধরিয়ে দেয়। এটার ডানার সবচে চিকন ভি আকৃতির জায়গাতেও বিস্তার হবে কমপক্ষে দু’শ ফিট। আর ঐ অসম্ভব বড় যানটা-ডক্টর ফ্লয়েড অবিশ্বাসী আর গর্বিত মনে নিজেকে শোনায়-অপেক্ষা করছে শুধু আমার জন্য। যতটুকু তার মনে পড়ে, মাত্র একজনকে চাঁদে বয়ে নেয়ার জন্য এর আগে কোনো মিশন সেট করা হয়নি।

যদিও এখন ভোর দুটো, একদল সাংবাদিক আর ক্যামেরাম্যান তাকে ঘেঁকে ধরে ওরিয়ন থ্রি স্পেসক্র্যাফটের ফ্ল্যাডলাইটের আলোয়। সে ন্যাশনাল কাউন্সিল অন অ্যাস্ট্রোনটিক্সের চেয়ারম্যান হিসেবে তাদের অনেককেই আগে থেকে চিনত। আমেরিকার জাতীয় জ্যোতির্বিজ্ঞান কাউন্সিলের সভাপতি হওয়াটাতো চাট্টিখানি কথা নয়। হাজার হলেও, সাংবাদিক সম্মেলন তার জীবনের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। কিন্তু এখানে এমন কিছু আয়োজনের সময় সুযোগ বা স্থান-কোনোটাই নেই। সবচে বড় কথা, তার বলার কিস্যু নেই; তাতে কী, কম্যুনিকেশন মিডিয়ার লোকজনকে আঘাত দিয়ে কথা না বলাই সুবোধ বালকের কাজ।

‘ডক্টর ফ্লয়েড? আমি অ্যাসোসিয়েটেড নিউজের জিম ফ্রস্টার। আপনি কি এ ফ্লাইট নিয়ে দু-চার কথা বলতে পারবেন আমাদের সাথে?’

‘আই অ্যাম ভেরি স্যরি-একটা কথাও বলতে পারব না।’

‘কিন্তু আপনি ঠিকই আজ সন্ধ্যায় প্রেসিডেন্টের সাথে দেখা করেছেন। এবার এক পরিচিত স্বর কথা বলে ওঠে।

‘ওহ-হ্যালো, মাইক। তুমি বেচারা শুধু শুধু আরামের বিছানা ছেড়ে এসেছ। অবশ্যই, কোনো মন্তব্য করা যাচ্ছে না।’

‘আপনি অন্তত এটা বলুন, চাঁদে কি কোনো রোগ ছড়িয়ে পড়ছে?’ এক টিভি রিপোর্টার আশ্চর্য দক্ষতায় তার পিছু পিছু ছুটতে ছুটতে তাকে ঠিকই নিজের ছোট্ট টিভি ক্যামেরার ফ্রেমে ধরে রাখতে রাখতে বলে চলেছে।

‘স্যরি।’ মাথা নাড়তে নাড়তে ডক্টর ফ্লয়েড বলে।

‘রোগ নির্মূলের ব্যাপারে কী করছেন আপনারা?’ আরেক রিপোর্টার আবার বা হাত ঢোকায়, ‘কদ্দিন লাগবে সেরে উঠতে?’

‘এখনো, কোনো কথা নয়।

‘ডক্টর ফ্লয়েড!’ দৃষ্টি আকর্ষণ করে এক অতি খাটো আর পরিশ্রমী মহিলা প্রেসকর্মী, চাঁদের সাথে সব ধরনের যোগাযোগ বন্ধের কী ব্যাখ্যা করবেন আপনারা? এর সাথে রাজনীতির ঘোঁট পাকানোর কোনো সম্বন্ধ নেইতো?’।

‘রাজনীতির কোন ঘোঁট পাকানো?’ কাঠখোট্টা বে রহম সুরে ডক্টর ফ্লয়েড প্রশ্ন ছুঁড়ে দেয়। হাসির ছোটখাট ফোয়ারা ছুটে যায় চারদিকে। হাল না ছাড়া সাংবাদিকের দল এবার বিদায় দেয় অপ্রসন্নচিত্তে, হ্যাভ এ গুড ট্রিপ, ডক্টর।

সাংবাদিকরা যে এমনি এম্নি ছেড়ে দিয়েছে তা নয়। ফ্লয়েড আগেই ঢুকতে শুরু করেছিল গ্যানট্রির নিরাপত্তা বেষ্টনীতে।

যদ্দুর তার মনে হয়, এটা কোনো বড়সড় স্থায়ী সংকট নয়। উনিশশো সত্তরের পর থেকে পৃথিবীকে দু সমস্যা নিয়ে বিভক্ত করা হয় আর তার একটা দিয়ে অন্যটাকে কাটিয়ে দেয়া যায়।

যদিও জন্মনিয়ন্ত্রণ সহজ, স্বল্প ব্যয়ের প্রক্রিয়া, এবং সব ধর্ম অনুমোদিত-তবু অনেক দেরি হয়ে গেছে; আজ পৃথিবীর জনসংখ্যা ছ বিলিয়ন; ছ’শ কোটি। আর তার এক তৃতীয়াংশ চৈনিক সাম্রাজ্যে। দু-সন্তান নিয়ে আইন, সুযোগ-সুবিধা আর প্রচারণা করা হয়েছে বেশ। কিন্তু সেসবের প্রয়োগ হয়নি ঠিকমতো। ফলে প্রতি দেশেই খাদ্যের চরম সংকট। এমনকি যুক্তরাষ্ট্রেও মাংসহীন দিবস রয়েছে। পনের বছরের সংকটময় মঙ্গা মানুষকে সাগরের দ্বারস্থ করে, সিন্থেটিক ফুডের খোঁজে লেগে যায় সবাই।

এর আগে কখনোই আন্তর্জাতিক সহায়তা আর সুসম্পর্ক এত জরুরী ছিল না। অথচ আজকের মতো এত বেশি হবু রণাঙ্গনও ছিল না আগে কখনো। লাখো বছরে মানবজাতি তার হিংস্রতার খুব একটা খোয়াতে পারেনি। সিম্বলিক চিত্রগুলি শুধু রাজনীতিবিদদের চোখেই ধরা পড়ে; আটত্রিশ পারমাণবিক শক্তিধর দেশ একে অন্যের উপর অহর্নিশি শ্যেন দৃষ্টি রেখে চলেছে। তাদেরকে আবার অনেক অনেক মেগাটন পারমাণবিক বর্জ্য সরিয়ে দিতে হবে পৃথিবীর আহত বুক থেকে। অথচ, অবাক লাগলেও সত্যি কথা, কখনো পারমাণবিক অস্ত্র ব্যবহৃত হয়নি। অবশ্য এই অবস্থা যে কদ্দিন চলবে তা কেউ জানে না।

আর আজকাল চীন তাদের প্রয়োজনের খাতিরে নতুন ছোট দেশ এবং গোষ্ঠীর একেবারে ঘরে পৌঁছে দিয়ে আসে পঞ্চাশ ওয়্যারহেডসম্পন্ন একটা পরিপূর্ণ পারমাণবিক যুদ্ধক্ষমতা। খরচ পড়বে বিশ কোটি মার্কিন ডলারেরও কম। এ বিকিকিনি নিয়ে সরকারের সাথে যে কোনো সময় যোগাযোগ করা যায়। সেই ঢিমেতাল সরকারি লাল ফিতার দৌরাত্ম এই একটা ক্ষেত্রে নেই।

চৈনিকরা নিজেদের ভয়ানক অস্ত্রের ভান্ডারকে হার্ড মানিতে পরিণত করে ডুবন্ত অর্থনীতিকে টেনে তুলতে চাইছে-এ মতো কেউ কেউ দেন। অথবা তারা এমন ব্রহ্মাস্ত্র আবিষ্কার করেছে যার সামনে এসব খেলনার আর কোনো দাম নেই। লোকজন বলে বেড়ায় যে রেডিও হিপনোসিস বা দূর থেকে সম্মোহিত করার পদ্ধতি বের করেছে অনেকেই। দূর-সম্মোহন করা যায় সামান্য স্যাটেলাইট ব্যবহার করে। অনেকে বলে শক্তিময় ভাইরাসের কথা। এমন সব কৃত্রিম রোগের মাধ্যমে ব্ল্যাকমেইল করার জোর গুজব রটেছে বাজারে যেগুলোর ওষুধ শুধু রোগের স্রষ্টার কাছেই পাওয়া যাবে। মজার আইডিয়াগুলো হয় স্রেফ অপপ্রচার, নয়তো অলীক কল্পনা। কিন্তু এসব ধারণার কোনোটাকেই মাথা থেকে তাড়িয়ে দেবার তিলমাত্র জো নেই। প্রতিবার ফ্লয়েড পৃথিবী ছাড়ার সময় আরেক ভয় পায় ফিরে এসে গ্রহটার দেখা পাবো তো? কে জানে!

কেবিনে ঢোকার সাথে সাথে বিমানবালা তাকে স্বাগত জানাল। মুখে মাপা হাসি, ‘গুডমর্নিং, ডক্টর ফ্লয়েড, আমি মিস সিমন্স- আপনাকে এখানে আমাদের ক্যাপ্টেন টিন্স আর কো পাইলট, ফাস্ট অফিসার ব্যালার্ডের পক্ষ থেকে স্বাগত জানাচ্ছি।’

‘থ্যাঙ্ক ইউ’ বলতে বলতেই ডক্টর ফ্লয়েড ভাবে, কেন যে স্টুয়ার্ডেসগুলো সারা জীবন রোবট স্পেস গাইডের মতো কথা বলে আল্লা মালুম।

‘পাঁচ মিনিটের মধ্যেই টেক অফ হবে,’ বিশজন যাত্রীর খালি কেবিনটার দিকে হাত নাড়তে নাড়তে মেয়েটা বলছে, যে কোনো সিটে বসতে পারেন। কিন্তু ক্যাপ্টেন টিন্স মনে করেন আপনি ডকিং অপারেশন দেখতে চাইলে প্রথম জানালার বামপাশের আসনটায় বসলে ভাল হয়।

‘তাই করব আমি।’

মাথার উপর দিয়ে বিদ্যুৎবেগে মহাকাশবালা বেরিয়ে যায়। কারণ তার কিউবিকলটা পেছনদিকে।

জায়গামতো বসে ফ্লয়েড সেফটি হার্নেস জড়িয়ে নেয়; বেঁধে নেয় কাঁধ। তারপর ব্রিফকেসটা রাখে সামনে। মুহূর্তখানেক পরেই লাউডস্পিকার মৃদু বাড়তি শব্দ করে সরব হয়ে উঠল, ‘শুভ সকাল,’ বলছে মিস সিমন্সের গলা, ‘এটা স্পেশাল ফ্লাইট থ্রি, কেনেডি থেকে স্পেস স্টেশন ওয়ানের দিকে যাত্রা করব আমরা।’

ব্যাপারস্যাপার দেখে মনে হয় এই মেয়ে পুরো পোশাকী রীতি মেনে চলতে একেবারে যাকে বলে বদ্ধপরিকর। এবার আর ডক্টর ফ্লয়েড হাসি ঠেকিয়ে রাখতে পারে না, কারণ ঠিক সেভাবেই হোস্টেসের কথা এগিয়ে যাচ্ছে।

‘আমাদের ট্রান্সমিট টাইম হবে পঞ্চান্ন মিনিট। সর্বোচ্চ ত্বরণ হবে টু জি২, আর ওজনশূন্য থাকব ত্রিশ মিনিটের জন্য। নিরাপত্তা বাতি জ্বলার আগ পর্যন্ত সিট ছাড়বেন না, প্লিজ।

ঘাড় ঘুরিয়ে পেছনে তাকালো ফ্লয়েড, বলল, ‘থ্যাঙ্ক ইউ।’

জবাবে তার পাওনা হয় একটা হালকা, মিষ্টি, সুন্দর, মনোহর কিন্তু চরম পেশাদার হাসি।

নিজের আসনে হেলান দিয়ে এবার সে একটু আরাম করে নেয়। এ ট্রিপের জন্য করদাতাদের ঘাড়ে এক মিলিয়ন ডলারের কিছু বেশি বোঝা চাপবে। কিন্তু সে জানে, তার কাজে সে ঠিকই পারঙ্গম। বিশ্ববিদ্যালয়ের নিস্তরঙ্গ জীবনে ফিরে গেলেই কি বেশ হয় না? একটা গ্রহ-জগৎ তথা প্ল্যানেটারি সিস্টেমের গঠন নিয়ে করতে থাকা গবেষণার বাড়তি কাজটা আর শেষ হলো না। কিন্তু আজ আর বয়েস নেই। কাজটাতো অন্যভাবেও করা যায়।

‘স্বয়ংক্রিয় কাউন্টডাউন শুরু হয়ে যাচ্ছে এখন,’ ক্যাপ্টেনের স্বর ভেসে আসে স্পিকারের ভিতর দিয়ে। টি চ্যাটের মাধ্যমে হালকা কোমল গানও ভেসে আসছে।

‘উপরে উঠছি এক মিনিটের মধ্যেই।’

আর সব সময়ের মতো আজো এ মুহূর্তটুকুকে একটা ঘণ্টার মতো লম্বা মনে হয়। তার চারপাশ পেচিয়ে যে দানবীয় শক্তি কাজ করছে সে সম্পর্কে মুহূর্তেই সচেতন হয়ে ওঠে সে। এ থেকে মুক্তির উপায় খুঁজতে থাকে। দুটো স্পেসক্রাফটের জ্বালানী ট্যাঙ্ক আর লঞ্চিং ট্র্যাকের শক্তি সংগ্রহ সিস্টেমে প্রায় একটা পারমাণবিক বোমার সমান শক্তির যোগান দেয়া হয়েছে। এর সবটুকু ব্যয় হয় শুধু তাকে পৃথিবী থেকে মাত্র দু’শ মাইল উপরে উঠিয়ে নিতে।

আজকাল কাউন্ট ডাউনে আর মান্ধাতা আমলের ফাইভ-ফোর-থ্রি-টু-ওয়ান জিরোর কারবার নেই। সেগুলো মানুষের স্নায়ুতে বেশ ভালো চাপ ফেলে।

‘পনের সেকেন্ডের মধ্যে উড্ডয়ন। ভালো লাগবে যদি গভীর করে শ্বাসপ্রশ্বাস নেন।’

এটা দারুণ মনস্তত্ত্ব আর শরীরতত্ত্বের সংমিশ্রণ। ফ্লয়েড নিজেকে অক্সিজেনে যথাসম্ভব টইটম্বুর করে নেয়। প্রস্তুত করে নেয় যে কোনো কিছুর জন্য। এই বিশাল যানটা তার হাজার টনী শরীর নিয়ে আটলান্টিকের উপর উড়ছে বর্তমানে।

কখন তারা ট্রাক ছেড়ে আকাশের সন্তান হয়েছে তা কেউ ঠিক ঠিক বলতে পারবে না কিন্তু রকেটের তর্জনগর্জন দ্বিগুণ হয়ে যাবার সাথে সাথে সিট কুশনের আরো আরো গভীরে ডুবে যায় ফ্লয়েড। ফার্স্ট স্টেজ ইঞ্জিন ছেড়ে দেয়া হয়েছে। খুব ইচ্ছা হয় একবার বাইরে চেয়ে জিনিসটার পৃথিবীতে ফিরে যাওয়া দেখতে, কিন্তু নিজের ঘাড়টা ফেরানোও এখন নিতান্তই কষ্টকল্পনা। অবাক হলেও সত্যি, এখনো আরামের একবিন্দু কমতি নেই। বরং গতিবৃদ্ধির দুর্দান্ত চাপ আর মোটরগুলোর দারুণ গর্জন এক আধিভৌতিক চরম শিহরন এনে দেয়। কান ঝাঁঝ করছে, রক্তপ্রবাহ শিরা উপশিরায় দেবে দেবে যাচ্ছে, এবার আবারো ফ্লয়েড বাকী জীবন থেকে বেশি ‘জীবন্ত’ হয়ে উঠছে। আবার ফিরে এসেছে দুর্দান্ত তারুণ্য, আবার তার গলা ফাটিয়ে গাইতে ইচ্ছা করছে। গাওয়ার কাজটা এক্কেবারে নিরাপদ, কোনো ব্যাটার শোনার ক্ষমতা নেই ইঞ্জিনের এই গগনবিদারী তারস্বরের সামনে।

স্ফূর্তির ভাবটা কেটে গেল জলদি জলদিই। মনে পড়ে গেছে যে সে পৃথিবী ছেড়ে যাচ্ছে, ছেড়ে যাচ্ছে সারা জীবনের সবটুকু ভালবাসা। নিচে তার তিন সন্তানের বাস, তিন এতিম সন্তান! দশ বছর আগে তাদের মা ইউরোপের সেই মরণ প্লেনে ওঠার পর…(দশ বছর? অসম্ভব! এখনো মনে হয় যেন…) তাদের জন্য হলেও তার বিয়ে করা উচিত ছিল আবার…

যখন চাপ আর শব্দ আস্তে আস্তে কমে আসে আর কেবিনের লাউড স্পিকার চেঁচিয়ে ওঠে, এবার লোয়ার স্টেজ ছেড়ে দেয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছি, শুরু হল…’ তখনো সে ঠিক বুঝে উঠতে পারে না কতটা সময় পেরিয়েছে এতক্ষণে।

একটা ছোট ঝুঁকির সাথে সাথে আবার মনে পড়ে যায় লিওনার্দো দ্য ভিঞ্চির সেই প্রদর্শনীর কথা। সেটা দেখেছিল নাসা অফিসে:

মহাপাখির পিঠে আরেক মহাপাখির উড্ডয়ন হবে, যে কুটিরে এর জন্ম সেটা গর্বে হবে উজ্জ্বলতর।

আচ্ছা, আজ সেই দ্য গ্রেট বার্ড উড়ছে, দ্য ভিঞ্চির সবটুকু স্বপ্নকে পুঁজি করে উড়ছে। এর ছেড়ে দেয়া সাথী ফিরে চলেছে পৃথিবীতে। দশ হাজার কিলোমিটারের ধনুক তৈরি করে খালি পোয়ার স্টেজটা পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলে ফিরে যাবে। এর কাজ বাড়তি গতি দেয়া। মূল যানকে একটু উঠিয়ে দিয়ে পরের বার একই কাজ করার জন্য ফিরে যাবে নিজের বাড়িতে, কেনেডিতে। কয়েক ঘণ্টায় জ্বালানী ভরে নিয়ে, ঘষামাজা শেষ হলে আবার নতুন কোনো সঙ্গীকে উপরের জ্বলজ্বলে নিরবতায় উঠিয়ে দিতে প্রস্তুত হবে। সব সঙ্গীকে সেই উচ্চতায় পৌঁছে দেবে যেখানে সে নিজে যেতে পারবে না কোনোদিন।

এতক্ষণে-ভাবছে ফ্লয়েড-আমরা অর্বিটের বেশিরভাগ পৰ্থ পেরিয়ে এসেছি। আপার স্টেজের রকেট জ্বলে উঠল; আবার ফিরে এল ত্বরণ। এবারের গ্র্যাভিটিটা অনেক বেশি ভদ্রগোছের। আসল কথা, স্বাভাবিক মাধ্যাকর্ষণের চেয়ে এক বিন্দু বেশি অনুভূত হয় না। কিন্তু হাঁটার চিন্তা নিতান্তই অবান্তর, কারণ আকর্ষণ ফিরে এসেছে ঠিকই, উল্টো দিকে। তার মাথার পিছন দিকটাই এখন নিচ। সে যদি সিটবেল্ট ছেড়ে দেয়ার মতো বোকা হয়, তাহলে সোজা গিয়ে পড়বে কেবিনের পেছনে, দেয়ালে।

এই কিম্ভুত মনোভাব কেটে যাবে যদি ভাবা যায় যে শিপ দাঁড়িয়ে আছে লেজের উপর, আরাম করে। ফ্লয়েড দেখে বাকী সব সিট তার কাছে নিচের দিকের মই বা সিঁড়ির ধাপের মতো লাগছে, কারণ সে সবচে সামনের আসনে বসা। সূর্যালোকে তরীর বাইরের দিকটা উদ্ভাসিত হয়ে উঠল। ডক্টর ফ্লয়েড এই সম্মোহন কাটানোর চেষ্টা করে প্রাণপণে।

কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই তারা লালচে বেগুনী, গোলাপী, সোনালী আর নীল পর্দার ভিতর দিয়ে প্রবেশ করে চোখ ধাঁধানো সাদায়। জানালাগুলো আলোর তীব্রতা প্রতিরোধের জন্য ভালমতো রঙচঙা করা হয়েছে। তার পরও সূর্যের অত্যুৎসাহী সর্বগ্রাসী আলো ফ্লয়েডের চোখে সামান্য সময়ের জন্য একটা রশ্মি বুলিয়ে দিয়ে বেচারাকে কয়েক মিনিটের জন্য একদম অন্ধ করে দিয়ে গেল। সে আসলেই মহাকাশ ভ্রমণ করছে, কিন্তু হায়, নক্ষত্র দেখার কোনো প্রশ্নই ওঠে না।

চোখগুলোকে হাতে ঢেকে নিয়ে সে বাইরে উঁকি দেয়ার চেষ্টা চালায় একটু। সেখানে দিনের আলোয় বাড়তি ডানাটা তপ্ত ধাতুর মতো চকচক করছে। চারপাশে অসীম আঁধার, সে অন্ধকারটা নিশ্চয়ই তারায় তারায় ভরা! দেখাই যায় না সেগুলোকে।

ধীরেসুস্থে ফিরে আসছে ওজন। শিপ নিজেকে অর্বিটে বসিয়ে নেয়ার সাথে সাথে নিভে গেছে রকেটের জ্বালামুখ। ইঞ্জিনের বজ্রপাতগুলো মিইয়ে আসে, তারপর চাপা একটু হিসহিসানি, সবশেষে পথ খুঁজে নেয় নিরবতার ভিতরে। পুনঃশক্তি সংগ্রহ স্ট্রাপ না থাকলে ফ্লয়েড ঠিকই সিট ছেড়ে বেরিয়ে পড়ত; কারণ তার পাকস্থলি বিপদসংকেত জানান দিচ্ছে। তার প্রাণান্ত ভাবনা, আধঘণ্টা আগে দশ হাজার কিলোমিটার দূরে যে পিলগুলো দেয়া হয়েছে সেগুলো আশানুরূপ কাজ দেবে। অবশ্য জীবনে মাত্র একবারই স্পেসসিক হয়েছিল। সী সিকনেস, স্পেস সিকনেস…যত্তসব! এ অবস্থাটা সহজে আসেও না।

কেবিনের স্পিকারে ভেসে আসা পাইলটের স্বর স্থির আর অবিচল, অনুগ্রহ করে জিরো জি’র সব নিয়মকানুন দেখে নিন। আমরা স্পেস স্টেশন ওয়ান এর সাথে পঁয়তাল্লিশ মিনিটের মধ্যে মিলিত হব।’

স্টুয়ার্ডেস সিটগুলোর মাঝের সরু জায়গা পেরিয়ে এগিয়ে আসছে। তার পদক্ষেপে কিছুটা অস্বাভাবিকতা। যেন পা প্রতিবার মেঝেতে পড়ে যাবার পরই আঠায় আটকে যাচ্ছে। সে পা রাখছে ফ্লোরে বিছানো ভেলক্রো কার্পেটে। এ কার্পেট আছে ছাদের গায়েও। কার্পেট আর তার স্যান্ডেলের সুখতলি অতি সূক্ষ্ম হুক দিয়ে ঢাকা। হুকগুলো একে অপরকে জড়িয়ে ধরতে পারে ঠিকমতো। চলাচলের এই কৌশল এলোমেলোভাবে ছড়িয়ে থাকা অনভ্যস্ত যাত্রীদের এক কাতারে দাঁড় করায়, বাঁচায় অস্বস্তির হাত থেকে।

‘আপনি কি একটু চা বা কফি পান করবেন, ডক্টর ফ্লয়েড?

‘না। ধন্যবাদ তোমাকে।’ একটু হেসে জবাব দেয় সে। ঐসব টিউবওয়ালা জিনিসে করে কিছু খেলে নিজেকে সব সময় একেবারে বাচ্চা বাচ্চা মনে হয়।

যখন সে ব্রিফকেস খুলে কাগজপত্র ঢোকাচ্ছে তখনো মেয়েটা আগের মতোই ঘুরঘুর করছে আশপাশে।

‘ডক্টর ফ্লয়েড, একটা প্রশ্ন করতে পারি আপনাকে?’

‘অবশ্যই।’ চশমা পরে তাকাতে তাকাতে উত্তর দেয় সে।

‘আমার… হবু বর ক্ল্যাভিয়াসের একজন ভূতত্ত্ববিদ।’ স্পষ্ট করে নিজের প্রতিটা শব্দ উচ্চারণ করছে সে, ‘এক সপ্তাহেরও বেশি সময় ধরে ওর সাথে কথা হয় না।’

‘দুঃখ পেলাম শুনে। হয়তো সে কাজের জন্য বাইরে গেছে। চাঁদে দিন সাতেক বেসের বাইরে থাকা বিচিত্র কিছু নয়।’

সাথে সাথেই মাথা নাড়ে মেয়েটা, এমন হয়, কিন্তু আগে আগেই ও আমাকে বলে রাখে। সব সময়। বুঝতেই পারছেন এ পরিস্থিতিতে আমি কীরকম ভেঙে পড়েছি চারপাশের গুজব শুনে। আসলেই কি চাঁদে মহামারী ছড়িয়ে পড়েছে?

‘এমন হয়ে থাকলে যোগাযোগ বন্ধ হবে কোনো দুঃখে? আর হলে সতর্ক হওয়ারও কিছু নেই। দারুণ প্রতিরোধ ব্যবস্থা সেখানে। আটানব্বইয়ের কথা মনে আছেতো? ফ্লু ভাইরাস বিবর্তিত হয়ে অ্যাটাক করেছিল। অনেক লোক অসুস্থ হলেও কেউ মারা যায়নি। আসলে এটুকুই আমি বলতে পারি। এরচে বেশি এক কণাও না। ভদ্রভাবে শেষ করে সে কথাটা।

মিষ্টি করে হেসেই সুদর্শনা মিস সিমন্স সোজা উপরদিকে চলে যায়।

‘আচ্ছা, ধন্যবাদ, ডক্টর, আপনাকে বিরক্ত করায় আমি আন্তরিকভাবে দুঃখিত।’

‘একটুও বিরক্ত করোনি।’ সে উষ্ণভাবে বললেও কথাটা পুরোপুরি ঠিক নয়। এরপরই নিজেকে ডুবিয়ে দেয় টেকনিক্যাল রিপোর্টের অথৈ সাগরে। শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত ব্যয় করে পেছনের দিনগুলোর কাজের তালিকায় মগ্ন হয়ে।

একবার চাঁদে পৌঁছে গেলে আর পড়ার সুযোগ পাওয়া যাবে না।

অধ্যায় ৮. কক্ষপথে দেখা

আধঘণ্টা পরে পাইলট ঘোষণা করল, ‘আর দশমিনিটের মধ্যেই যোগাযোগ স্থাপন করছি। প্লিজ সিট হার্নেসটা দেখে নিন।’

বাধ্য ছেলের মতো ফ্লয়েড কথাটা পালন করে নিজের কাগজপত্র গোছাতে গোছাতে। শেষদিকের অর্বিটের ঝাঁকিতে পড়াশোনা করা খুব একটা ভালো না–এমন কথা বলা হয়। এ অবস্থা চলছে গত তিনশো মাইল জুড়ে আসার সময়। এ সময়টায় বরং চোখ বন্ধ করে রাখাই শ্রেয়। কারণ রকেটের হঠাৎ প্রজ্বলন বেশ ঝাঁকাঝাঁকি শুরু করে।

কয়েক মিনিট পরেই সে চোখের সামনে কয়েক মাইল দূরে আবছায়ার মতো হালকাভাবে স্পেস স্টেশন ওয়ানকে দেখতে পেল। মানুষ কোথায় চলে গেছে! সে চাঁদ থেকে পৃথিবীতে যায়, পৃথিবী থেকে যায় চাঁদে; মধ্যিখানে শূন্যের স্টেশনেও একটু জিরিয়ে নেয়। স্টেশনের পালিশ করা ধাতব গায়ে সূর্যালোক যেন পিছলে যাচ্ছে সারাক্ষণ। প্রায় দু’শ আশি মিটার ব্যাসের চাকতিটা খুব বেশি দূরে নয়। একটা টিটভ ফাইভ শ্রেণীর স্পেসপ্লেন ধীরে ভেসে বেরিয়ে আসছে একই অর্বিট ধরে। দেখতে প্রায় একটা এ্যারেস ওয়ান বি ওয়ার্ক হর্সের মতোই। এর পা-গুলোও চাঁদে অবতরণের উপযোগী করে তৈরি করা। চার পা-ই শক অ্যাবজর্ভিং।

ওরিয়ন থ্রি স্পেসক্র্যাফট একটা উচ্চ শক্তির অর্কিট থেকে বেরিয়ে আসছিল বলে পৃথিবীকে স্টেশনের পেছনে অবাক করা রূপে দেখা যায়। দু’শ মাইল উচ্চতা থেকে ফ্লয়েড স্পষ্ট দেখতে পায় আফ্রিকার বেশিরভাগ অঞ্চল আর সুবিশাল অতলান্তিককে। যথেষ্ট মেঘ আছে। তবু গোল্ড কোস্টের[১৪] সবুজ সীমারেখা স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে।

ডকিং আর্ম সহ স্পেস স্টেশনের কেন্দ্রীয় অক্ষ বেরিয়ে আসছে। যেন সতরে আসছে মহাকাশের মহানদী বেয়ে। কেন্দ্রীয় অক্ষের ধারক অংশ, অক্ষ, ডকিং আর্ম একেবারেই ঘুরছে না। আরেকভাবে বলতে গেলে উল্টো হয়ে যায়, এগুলো ঘুরছে এবং বেশ ভালোভাবেই ঘুরছে। স্পেস স্টেশনের বাকী অংশের বিপরীত গতিতে ঘোরায় স্থির মনে হয়। এ অক্ষ স্থির না থাকলে আসতে থাকা কোনো স্পেসক্রাফট এর সাথে যুক্ত হতে পারবে না। তাই সেই আগুয়ান খানের সাপেক্ষে স্থির থাকতে হচ্ছে। মানুষ আর জিনিসপাতির দঙ্গলকে নামানোর ক্ষেত্রে দারুণ অসুবিধা হতো যদি স্পেস স্টেশনের মতো এটাও ঘুরে চলত ভয়ংকরভাবে।

একেবারে হাল্কা আওয়াজ তুলে, ক্ষীণ ধাক্কা দিয়ে স্টেশনের সাথে মহাকাশযান মিলিত হল। বাইরে থেকে ধাতব ঘষটানোর শব্দ আসে। বাতাস আর বায়ুচাপের সমন্বয় আর সমতার জন্য হালকা হিসহিস শব্দও ওঠে। কয়েক সেকেন্ড পরেই স্পেস স্টেশনের হালকা ইউনিফর্ম পরা এক লোক ভিতরে এল।

‘আপনার দেখা পেয়ে খুশি হলাম, ডক্টর ফ্লয়েড। আমি নিক মিলার, স্টেশন সিকিউরিটি; শাটল ছেড়ে যাওয়া পর্যন্ত আপনার দেখভালের দায়িত্বটা আমার কাঁধেই পড়েছে।’

তারা হ্যান্ডশেক করার পর ফ্লয়েড বিমানবালার দিকে তাকিয়ে একটু হাসি দেয়, ‘প্লিজ, আমার পক্ষ থেকে ক্যাপ্টেন টিন্স আর কো পাইলটকে ধন্যবাদ দিও। আশা করি যাবার পথে তোমাদের সাথে দেখা হবে।’

খুব সতর্কভাবে সে নড়াচড়া করছে, কারণ প্রায় বছরখানেক হতে চলল সে ওজনশূন্যতায় পড়েনি। ওজনহীনতায় চলাফেরার অভ্যাসটা ফিরে আসতে একটু সময় নেবে; লোকে অভ্যাসটাকে বলে স্পেসলেগ অর্থাৎ কিনা মহাকাশের অদৃশ্য পা। নিজেকে ঠিক রাখতে এয়ারলকের ভিতর দিয়ে স্পেস স্টেশনের গোলাকার ঘরটায় যেতে যেতে সে হাত ঠেকায় উপরের দেয়ালে। এই ঘরে ভালোমতো প্যাড লাগানো হয়েছে, তার উপর চারদিকে গিজগিজ করছে হ্যান্ডহোন্ড। পুরো চেম্বারটা ঘুরতে শুরু করেছে। এবার ফ্লয়েড একটা হ্যান্ডহোল্ড ধরে বসে ঠিকমতো। এই ঘুর্ণণ এক সময় স্পেস স্টেশনের ঘোরার দিকে একইভাবে চলতে থাকবে।

গতি বাড়তে শুরু করলেই অভিকর্ষের ভৌতিক আঙুল এসে তাকে খোঁচাতে থাকে আর সে ধীরে ভেসে যায় দেয়ালের দিকে। এবার সে এর উপরে সামনে পেছনে দৌড়ে দাঁড়িয়ে থাকছে যেভাবে কোনো সমুদ্রের বিশেষ স্রোত প্রবাহে প্রবাল গড়িয়ে চলে। নিচের মেঝেটাকে কুঁকড়ে যেতে দেখা কী ভয়াবহ ব্যাপার! অবশেষে স্টেশনের কেন্দ্রমুখী বল তার দখল নিয়ে নিল। কেন্দ্রের দিকে বলটা বেশ দুর্বল হলেও পরিধির দিকে যেতে থাকলে ক্রমান্বয়ে বাড়বে।

সেন্ট্রাল ট্রানজিট চেম্বার থেকে ফ্লয়েড মিলারকে অনুসরণ করে একটা বাঁকানো সিঁড়ি বেয়ে নেমে গেল। প্রথমদিকে বল এত কম ছিল যে নিচে নামতে হলে জোর দিয়ে নামতে হয়েছে। সে এই বিশাল ঘুরন্ত চাকতির একেবারে বাইরের দিকে চলে এল। এবার একটু একটু স্বতঃস্ফূর্তভাবে কাজ করা যাচ্ছে।

গত এক বছরে লাউঞ্জটাকে নানা সুবিধা দিয়ে নতুন করে সাজানো হয়েছে। আগের ছোট চেয়ার, নিচু টেবিল, রেস্তরা আর পোস্ট অফিস ছাড়াও এবার এতে একটা করে চুল কাটার দোকান, স্যুভেনির শপ, ওষুধের দোকান আর আস্ত থিয়েটার বসানো হয়েছে। স্যুভেনির শপটায় পৃথিবী আর চাঁদের চমৎকার সব প্রাকৃতিক দৃশ্য, গ্যারান্টি দেয়া চাঁদের পাথর, সব বড় অভিযাত্রী আর বড় বড় মানুষের মূর্তি পাওয়া যায় প্লাস্টিকে, শুধু দামটাই অবিশ্বাস্য চড়া।

‘অপেক্ষা করার সময় কিছু খাবেন? হাতে আরো ত্রিশ মিনিট সময় আছে।’

‘দু-টুকরো চিনির সাথে এককাপ ব্ল্যাক কফি। আর কল করতে চাই পৃথিবীতে।’

‘ঠিক আছে, ডক্টর। আমি কফি আনছি, ফোনগুলো ঐদিকে।’

ফোনবুথের সামনে দুটো বাঁধা, একটায় লেখা ‘সোভিয়েত সেকশনে স্বাগতম’ আর অন্যটায় আছে, ‘ইউ এস সেকশনে’ স্বাগতম। নিচেই স্প্যানিশ, রাশিয়ান, ইংলিশ, চাইনিজ, ফ্রেঞ্চ আর জার্মান ভাষায় লেখা:

দয়া করে প্রস্তুত করুন আপনার:
পাসপোর্ট
ভিসা
মেডিক্যাল সার্টিফিকেট
যাতায়াতের অনুমতিপত্র
ওজনের ঘোষণা

এক্ষেত্রে ব্যাপারটা সুবিধাজনক বলতে হয়। কারণ একাধিক বুথ থাকছে। এই বুধগুলো থেকে বেরুতে পারলেই যাত্রীরা মিলেমিশে আবার এক হয়ে যায়। তখন কোনো সোভিয়েত–মার্কিন ঘেঁষাঘেঁষি নেই। এ বিভক্তি শুধুই প্রশাসনিক।

ফ্লয়েড আবারো দেখে নেয়। না, ইউ এস এরিয়া কোড আজো একাশিই রয়ে গেছে। তারপর নিজের বাসার বারো সংখ্যার নম্বরটায় ডায়াল করে। সকল কাজের কাজি প্লাস্টিক ক্রেডিট কার্ডটা পরিশোধ স্লটে প্রবেশ করিয়ে আধ মিনিট অপেক্ষা করেই বাসায় লাইন পেয়ে গেল।

ওয়াশিংটন এখনো ঘুমের রাজ্য, কারণ ভোর হতে কয়েক ঘণ্টা বাকী, কিন্তু সে কাউকে বিরক্ত করবে না। জেগে ওঠার সাথে সাথেই হাউসকিপার কল পেয়ে যাবে।

‘মিস ফ্লেমিং- ফ্লয়েড বলছি। স্যরি, তাড়াহুড়ো করে পৃথিবী ছাড়তে হল। আমার অফিসে কল করে গাড়িটা ডালাস এয়ারপোর্ট থেকে যোগাড় করে নিতে বলবে। চাবিটা সিনিয়র ফ্লাইট কন্ট্রোল অফিসার মিস্টার বেইলির কাছে রেখে এসেছি। এরপরই একটু কষ্ট করে চেভি চেস কান্ট্রি ক্লাবে কল করে সেক্রেটারির কাছে একটা খবর পাঠাবে। আগামী হপ্তায় টেনিস টুর্নামেন্টে কিছুতেই অংশ নিতে পারছি না। আমার পক্ষ থেকে ক্ষমা চেয়ে নিও-মনে হয় আমাকে ধরেই হিসাব করবে ওরা। তারপর ডাউন টাউন ইলেক্ট্রনিক্সে ফোন করে বলবে তারা যদি আমার স্টাডি রুমের ভিডিওটা আগামী হপ্তার…হ্যাঁ, বুধবারের মধ্যে ঠিকঠাক না করে তো আমি অর্ডার বাতিল করে ঐ নষ্ট জিনিসটা ফিরিয়ে আনব।’ একটু পজ বাটন চেপে সে মনে করার চেষ্টা করে আর কী কী সমস্যা হতে পারে সে এ কদিন পৃথিবীতে না থাকলে। সাথে সাথে দমও নিয়ে নেয়ু একটু।

‘টাকা পয়সায় টানাটানি পড়লেই অফিসে কল করো। তারা আমাকে জরুরী কল করতেও পারে, আমার জবাব দেবার মতো সময় থাকবে না। বাচ্চাদের আমার ভালবাসা জানিয়ে বলো যত তাড়াতাড়ি পারি ফিরে আসছি। ওহ! ধ্যাৎ-আশপাশে এমন একজন আছে যার সাথে আমি কথা বলতে চাই না-পারলে চাঁদ থেকে কল করব-গুড বাই।’

ফ্লয়েড কোনোমতে নিজেকে বুখ থেকে টেনে বের করার চেষ্টা করলো, কিন্তু ততক্ষণে দেরি হয়ে গেছে। এরই মধ্যে থামিয়ে দেয়া হয়েছে তাকে। সোভিয়েত বুথ থেকে মূর্তিমান আতঙ্কের মতো উদিত হয়েছে ইউ এস এস আর একাডেমি অব সায়েন্সের ডক্টর দিমিত্রি ময়শেভিচ।

দিমিত্রি ফ্রয়েডের বেস্ট ফ্রেন্ডদের একজন; আর সেই বিশেষ কারণেই দিমিত্রি শুধু তার জন্যে অপেক্ষা করছিল। তার খা বলতে হবে। এখন, এখানে।

অধ্যায় ৯. চান্দ্র যান

বিশালদেহী, পাতলা রাশিয়ান এ বিজ্ঞানী হালকা চুলের অধিকারী। তার রেখাহীন মুখমণ্ডল দেখে কেউ বলবে না বয়সে সে পঞ্চান্ন বছর পেরিয়েছে।

তার মধ্যে শেষ দশটা বছর কাটলো চাঁদের অপর পিঠে দৈত্যাকার রেডিও অবজার্ভেটরিং তৈরির কাজে। সেখানে দু-হাজার মাইল বিস্তৃত পাথর অবজার্ভেটরিটাকে পৃথিবীর শব্দ-আবর্জনা থেকে রক্ষা করবে।

‘তাইতো সব সময় বলি, ফ্লয়েড’, উষ্ণভাবে হাত আঁকাতে ঝাঁকাতে বলে গেল সে, বিশ্বব্রহ্মাণ্ডটা একদম ছোট। তা কেমন আছ তুমি? আর তোমার মিষ্টি বাচ্চাকাচ্চার খবর কী?

‘আমরা ভালই আছি। যথাসম্ভব উষ্ণভাবে জবাব দেয় ফ্লয়েড, গত গ্রীষ্মে তুমি আমাদের দারুণ সঙ্গ দিয়েছিলে। সেসব নিয়ে আজো কথা হয়। সে অপ্রস্তুত ভাব ঢাকার চেষ্টা করছে। গত গ্রীষ্মে আসলেই দিমিত্রির সাথে তাদের একটা উইক এন্ড কেটেছিল ভালোভাবে। রাশিয়ান বিজ্ঞানীরা তখন ছুটিতে এসেছিল পৃথিবীর বুকে।

দিমিত্রি খোঁজখবর নেয়, আর যতটুকু মনে হচ্ছে, তুমি উপরের পথে, ঠিক?

‘ধ্যাৎ…হ্যাঁ-আধঘণ্টার মধ্যেই আমার ফ্লাইট ছেড়ে যাবে।’ জবাব দেয় ফ্লয়েড আমতা আমতা করে, তুমি কি মিস্টার মিলারকে চেন?

এরমধ্যেই সিকিউরিটি অফিসার এসে গেছে, একটু সম্মানসূচক দূরত্ব বজায় রেখেছে সসম্ভ্রমে। হাতে একটা কফির প্লাস্টিক কাপ।

‘অবশ্যই চিনি। কিন্তু প্লিজ কফির কাপটা নামিয়ে রাখুন। এটাই ডক্টর ফ্লয়েডের সভ্য ড্রিঙ্ক নেয়ার শেষ সুযোগ-নষ্ট না করাই ভালো সুযোগটা। চল ফ্লয়েড, একটা ড্রিঙ্ক… না-আমি অনুরোধ করছি…’।

অগত্যা তারা দুজনেই দিমিত্রির পিছু নেয় অবজার্ভেশন সেকশনের দিকে একটু পরেই তারা বসে ছিল এক মনোহর হাল্কা আলোর নিচে; দেখছিল দিগন্তজোড়া নক্ষত্রলোক। স্পেস স্টেশন ওয়ান প্রতি মিনিটে একবার গোত্তা খায় আর কেন্দ্রমুখী বলটা এই ঘূর্ণনেরই ফসল। বলের মান চাঁদের আকর্ষণের মানের কাছাকাছি। পার্থিব অভিকর্ষ একেবারেই না থাকার চেয়ে এটুকু থাকা ভালো। বরং লোকজনকে চাঁদে যাওয়ার আগে এক-আধটু চান্দ্রসুখ দেয়া যায়।

বাইরের একদম অদৃশ্য জানালা দিয়ে পৃথিবী আর তারকারাজির নিরব মহামিছিল দেখা যায়। এ মুহূর্তে সেকশনটা সূর্যের ঠিক উল্টোমুখো হয়ে থাকায় বাইরে দৃষ্টিক্ষেপের স্পর্ধা দেখানো যাচ্ছে, নইলে আলোর তোড়ে কোথায় ভেসে যেত জায়গাটা! এমনকি এখনো পৃথিবী-গোলকটা ভরে রেখেছে অর্ধাকাশ। সব ডুবে আছে অমানিশায়, শুধু মিটমিট করে উপস্থিতি জানিয়ে যায় তারার দল।

আসলে পৃথিবী প্রতীক্ষারত, এ অংশে এইমাত্র প্রবেশ করল স্টেশন ওয়ান। আরেকটু পরে রাতের দিকে গেলেই দেখতে পাবে মহানগরীর আলোকমালা। আর তখন পুরো আকাশই যেন চলে যাবে রাতের তারার দখলে।

‘তো, দ্রুত প্রথম দফা গলায় চালান করে দিয়ে দ্বিতীয়টার সাথে ক্রীড়ারত দিমিত্রি খেই ধরতে চাচ্ছে, চাঁদের ইউ এস সেক্টরে কীসের প্রাদুর্ভাব নিয়ে হৈচৈ চলছে? এবারের ট্রিপে যেতে চেয়েছিলাম, ‘নো, প্রফেসর।‘’ জবাব মিলল? ‘উই আর ভেরি স্যরি, কিন্তু পরের নোটিশ না আসা পর্যন্ত কড়া নিরাপত্তা বহাল রয়েছে।’ ক্ষেপে গিয়ে তার ধরে টানাটানি করেছিলাম, কারণ সেটা কোনো কাজেই লাগতো না। তো, তুমিই বল, হচ্ছেটা কী?’

ভিতরে ভিতরে গড়গড় করে কী যেন বলল ফ্লয়েড। আবারও এসব কথা! যত জলদি মুন শাটলে সেঁধিয়ে যেতে পারি, ততই বাঁচোয়া।

‘এই-এহ্‌-কোয়ারেন্টাইন একদমই নিরাপত্তার পদক্ষেপ।’ অতি সাবধানে বেচারা বলে চলে, আমরা ঠিক শিওর না এর দরকার আছে, নাকি নেই। কিন্তু ঝুঁকি নিতে নারাজ। এই আর কী!’

‘কিন্তু রোগটা কী? এর লক্ষণটক্ষণ? অপার্থিব নয়তো? আমাদের মেডিক্যাল সার্ভিসের একবিন্দু দরকার থাকলেও বলতে পার।’

‘আই এ্যাম স্যরি, দিমিত্রি-এ মুহূর্তে টু শব্দটাও করতে পারব না আমরা। অফারের জন্য ধন্যবাদ, কিন্তু নিজেরাই পরিস্থিতি মানিয়ে নিতে পারব।’

‘হুমম্’ একেবারে অপ্রস্তুত হয়ে বলল ময়শেভিচ, ‘আমার চোখে একদম বেমানান ঠেকে যে তুমি, একজন অ্যাস্ট্রোনমার হয়েও চাঁদে চলে যাচ্ছ একটা মহামারীর দেখভাল করতে।’

‘আমি শুধুই একজন প্রাক্তন জ্যোতির্বিদ, বা মহাকাশবিজ্ঞানী, যাই বলনা কেন। অনেক বছর ধরে কোনো রিসার্চ করি না। এখন শুধুই একজন সায়েন্টিফিক এক্সপার্ট, তার মানে হচ্ছে, আমি কোনোকিছুরই পুরোপুরি সবটুকু জানি না।’

‘তার মানে, তুমি হয়তো টি এম এ-১ নিয়েও তেমন কিছু জান না, জান কী?’

মনে হচ্ছে যেন মিলার নিজের ড্রিঙ্কে এক্কেবারে চুর হয়ে গেছে, জগতের কোনো কথাতেই তার কান নেই। কিন্তু ফ্লয়েড নিতান্তই কঠিন চিজ। সে নিজের পুরনো দোস্তের দিকে চোখে চোখে তাকায়, বরফশীতল নির্লিপ্ত কণ্ঠে প্রশ্ন ছুঁড়ে দেয়, ‘টি এম এ-১? কী অদ্ভুত নামরে বাবা! কোথায় শুনলে এসব?

‘নেভার মাইন্ড।’ জবাব ছেড়ে রাশিয়ান, ‘আমাকে বোকা বানাতে পারবে না তুমি। কিন্তু তোমরা যদি এমন কিছু নিয়ে মেতে থাক যা আর সামলে উঠতে পারছ না, আশা করি সেটা সামলেসুমলে উঠতে গিয়ে এত দেরি করে বসবে না যাতে হল্লা করে মরতে হয় ‘হেল্প! হেল্প!’ বলে।’

মিলার অর্থপূর্ণভাবে নিজের ঘড়ির দিকে তাকায়।

‘আর পাঁচ মিনিটের মধ্যেই ছাড়ছে ডক্টর ফ্লয়েড। মনে হয় এখনি যাওয়া ভালো।’

যদিও সে জানে হাতে জলজ্যান্ত বিশটা মিনিট পড়ে আছে, তবু তোণ্ডতি করে উঠে পড়ে। এত বেশি ব্যস্ত দেখায় যে গ্র্যাভিটির ছ’ভাগের একভাগের কথাটা মনেই পড়ে না। উড়ে যাওয়া ঠেকাতে সময়মতো টেবিলটা খপ করে ধরে নিয়ে নিজেকে সামলায়।

‘তোমার সাথে দেখা হওয়ায় দারুণ লাগল, দিমিত্রি।’ কথাটা পুরোপুরি সত্যি নয়, ‘আশা করি পৃথিবীতে দারুণ এক ভ্রমণ শেষে ফিরবে-ফিরে এলেই একটা কল দেব তোমাকে।’

লাউঞ্জ ছেড়ে ইউ এস ট্রানজিট ব্যারিয়ারে গিয়েই ফ্লয়েড স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে, ‘ফুহ-কানের পাশ দিয়ে গুলি গেল। আমাকে সময়মতো উদ্ধার করার জন্য অনেক ধন্যবাদ।

‘জানেন, ডক্টর,’ সিকিউরিটি অফিসার হালকা লয়ে বলে, ‘আশা করি তার কথাটা ঠিক না।’

‘কোন্ কথাটা?’

‘সামলে উঠতে পারি না এমন কিছুতে হাত দেয়া না কী যেন বললেন তিনি…’

‘ঠিক’ বলে ওঠে ফ্লয়েড, এই ব্যাপারটা দেখতেই আমি যাচ্ছি।’

পঁয়তাল্লিশ মিনিট বাদে এ্যারেস ওয়ান বি লুনার ক্যারিয়ার স্টেশন থেকে ভেসে ওঠে। পৃথিবী থেকে টেক অফের মতো ঝক্কি ঝামেলার কোনোটাই এখানে নেই-শুধু লো ব্রাস্টের একটা প্রায় শ্রবণসীমার নিচের দূরাগত শব্দ। লো থ্রাস্ট প্লাজমা জেটগুলো মহাকাশে তাদের তড়িত্বন্যা বইয়ে দিলেই এমন শব্দ ওঠে। হালকা ধাক্কা চলে মিনিট পনের ধরে, তারপরের মৃদু গতিবৃদ্ধি কাউকেই নিজের ভেসে বেড়ানো থেকে বিরত করেনি। এবার আর যানটা বাঁধা পড়ে নেই পৃথিবীর মায়াজালে। এটা আর স্পেস স্টেশন বা চাঁদের মতো কোনো উপগ্রহ নয়। এ্যারেস ওয়ান বি’র উপর পার্থিব কোনো বল কাজ করছে না বলেই এখন এ এক মুক্ত গ্রহ।

ফ্লয়েড একা যে কেবিন জুড়ে বসেছে সেটা আসলে ত্রিশজনের জন্য বানানো। চারদিকের খালি খালি সিট দেখতে অদ্ভুত লাগে, ভর করে একাকিত্ব। বেশি বিরক্তিকর ব্যাপার হল, ত্রিশজন অতি দামী, অতি সম্মানিত এবং কিছু ক্ষেত্রে অতি খরুচে যাত্রীর জন্য যথেষ্ট যে স্টুয়ার্ড আর স্টুয়ার্ডেস, তাদের সবার কাজের এবং মনোযোগের কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়েছে সে। পাইলট, কো পাইলট আর দুই ইঞ্জিনিয়ারের কথা বলতে হয় না। বড়ই সন্দেহ তার, ইতিহাসে আর কোনো মানবসন্তান এত বেশি এক্সক্লসিভ সার্ভিস পেয়েছে কিনা; আর ভবিষ্যতে কারো পাওয়ার আশা তো আরো কষ্টকল্পনা। তার অকস্মাৎ মনে পড়ে যায় কোনো এক অনুল্লেখ্য ধর্মগুরুর কথা, এবার যখন পোপত্ব পেয়েই গেলাম, চলো, উপভোগ করি ব্যাপারটা। যাক, সেও এ ট্রিপ আর ওজনহীনতার চরম আনন্দ উপভোগ করতে পারে। ওজনহীনতা মুহূর্তের জন্যে হলেও তার সচেতনতাকে ঢেকে ফেলে। কে যেন একবার বলেছিল, আপনি স্পেসে আতঙ্কে অস্থির হতে পারেন, কিন্তু একবিন্দু দুঃখও পেতে পারেন না। একদম খাঁটি কথা।

দেখেশুনে মনে হচ্ছে স্টুয়ার্ড বেচারা ট্রিপের পুরো পঁচিশ ঘন্টা জুড়েই তাকে খাইয়ে যাবার পণ করেছে। ফ্লয়েড ক্রমাগত ফিরিয়ে দিচ্ছে একের পর এক খাবার। এখন আর জিরো গ্র্যাভিটিতে খাওয়াদাওয়াটা কোনো সমস্যাই নয়, আঁধারে হারিয়ে যাওয়া সাবেক অ্যাস্ট্রোনটদের কথা অবশ্য পুরো বিপরীত। সে একটা সাদামাটা টেবিলের সামনে বসেছে, সেটায় সেঁটে দেয়া হয় খাবারের প্লেটগুলো-যেন সে বসে রয়েছে উত্তাল সাগরের টালমাটাল কোনো জাহাজের ডেকে। প্রতিটা জিনিসই সেঁটে থাকে, যাতে কেবিনজুড়ে বিশ্রী ওড়াউড়ি ঠেকানো যায়। যেমন, একটা চপ আটকে থাকে আঠালো সসের সাথে, বা কোনো সালাদের প্রিপারেশনের সাথে থাকবে থকথকে কোনো না কোনো তরল। আসলে একটু সতর্ক থাকলে সবই নিয়ন্ত্রণ করা যায়। নিষিদ্ধ খাবারের মধ্যে আছে গরম গরম স্যুপ আর একদম ভঙ্গুর পেস্ট্রি। ড্রিঙ্কের ব্যাপারে পরিস্থিতি একটু ভিন্ন, সব তরলই খেতে হয় প্লাস্টিকের স্কুইজ বোতলে করে।

ওয়াশরুমের ডিজাইনের পেছনে পুরো একটা প্রজন্মের ‘মহান’ স্বেচ্ছাশ্রম ব্যয় হয়েছে। কিন্তু কেউ এ মহত্ত্ব নিয়ে তেমন উচ্চবাচ্য করে না। আজ এ রুমটা কমবেশি ‘পরিণত’ হিসেবে বিবেচিত। মুক্ত পতন শুরুর পরপরই এর খোঁজখবর নেয় ফ্লয়েড। নিজেকে আবিষ্কার করে একটা সাধারণ বিমান-ওয়াশরুমের মতো দেখতে একটা কিউবিকলে। শুধু একটা জিনিসই নিষ্ঠুরভাবে জুলজুল করছে চোখের উপর। লাল আলোতে বড় বড় অক্ষরে লেখা, ‘সবচে গুরুত্বপূর্ণ! আপনার নিজের আরামের জন্য এই ইট্রাকশনগুলো পড়ে নিন প্লিজ!’

ফ্লয়েড বসে নেয় (ওজনহীনতায়ও মানুষ ভুলে বসে পরে) তারপর পড়ে নেয় কয়েকবার। আগের ট্রিপের পর কোনো পরিবর্তন আসেনি বুঝতে পেরেই চেপে দেয় স্টার্ট বাটন।

হাতের কাছাকাছি একটা ইলেক্ট্রিক মোটর বনবনিয়ে ঘুরছে। ফ্লয়েড নিজেকে আবিষ্কার করে ঘুরন্ত অবস্থায়। নোটিশের উপদেশ মতো সে চোখ বন্ধ করে রাখে কিছুক্ষণ। মিনিটখানেক পরেই একটা বেল বেজে উঠলে চারপাশে তাকায় সে।

এবার আলো নিখাদ গোলাপি-সাদায় বদলে গেছে। তারচেও গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার-সে গ্র্যাভিটি ফিরে পেয়েছে। একদম মৃদু কাপনেই শুধু বোঝা যায় যে অভিকর্ষটা কৃত্রিম। পুরো টয়লেট কম্পার্টমেন্ট করোসেলের মতো ঘুরছে। এক টুকরো সাবান তুলে নেয় ফ্লয়েড, তারপর ধীরে এটার পড়ে যাওয়া দেখতে পায়। সে নিশ্চিত হয়ে নিল যে সেন্ট্রিফিউগাল ফোর্স সাধারণ গ্র্যাভিটির অন্তত চারভাগের একভাগ হয়েছে। এই যথেষ্ট। বোঝা যাচ্ছে অন্তত যেখানে ঠিকমতো চলাটা জরুরী সেখানে সব চলছে ঠিকঠাক।

সে ‘স্টপ ফর এক্সিট’ বাটনটা চেপে ধরেই আবার বন্ধ করে চোখ। ঘুর্ণন কমার সাথে সাথে ওজন আবার পালিয়ে যাচ্ছে। বেলটা দুবার বেজে উঠতেই লাল ওয়ার্নিং বাতি জ্বলে ওঠে। দরজাটা ঠিক জায়গামতো লক হয়ে যায়। এবার ঠিকমতো ভেসে বেরুনো যাবে। কেবিনে ঢুকেই সে নিজেকে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব আটকে নেয় কার্পেটের সাথে। বহুকাল আগেই সে ওজনহীনতার মহত্ত্ব থেকে মুক্তি পেয়েছে। আজ আর অভিকর্ষহীনতা মজার কোনো অভিজ্ঞতা নয়, বরং তার কাছে ভেলক্রো চপ্পল এক প্রকার আশীর্বাদ।

সময় কাটানোর অনেক ব্যবস্থাই আছে। এমনকি বসে বসে পড়লেও সময় কেটে যেতে পারে। অফিসিয়াল রিপোর্ট আর মেমোরেন্ডার দঙ্গল দেখে দেখে বিরক্ত হয়ে পড়লেই সে নিজের ফুলস্কেপ কাগজ গড়নের নিউজপ্যাডটাকে শিপের ইনফরমেশন সার্কিটের সাথে যুক্ত করে নেয়। চোখ বুলিয়ে নেয় পৃথিবীর সর্বশেষ খবরগুলোয়। একের পর এক পৃথিবীর তাবৎ বড় পত্রিকা তুলে আনে। গুরুত্বপূর্ণ ইলেক্ট্রিক নিউজপেপারগুলোর কোডও আর মুখস্ত। প্যাডের পেছন থেকে দেখে নিতে হয় না। ডিসপ্লে ইউনিটের শর্ট টার্ম মেমোরিতে সুইচ করেই প্রথম পাতাটা পাওয়া যায়। সাথে সাথেই কৌতূহলোদ্দীপক হেডলাইনগুলো নোট করে নিচ্ছে। প্রতিটির আছে দু’ডিজিটের ভিন্ন রেফারেন্স নাম্বার। ডিজিট চাপলেই পোস্টেজ-স্ট্যাম্প আকারের ছোট্ট চতুষ্কোণ খবরটা প্রসারিত হতে হতে প্রায় পুরো নিউজপ্যাড ভরে তোলে, যাতে আয়েশ করে পড়া যায়। পড়া শেষ হতেই চলে যাওয়া যায় পুরো পাতায়, তারপর বাকী থাকে প্রয়োজনমাফিক অন্য কোনো বিষয় বেছে নেয়া।

মাঝে মধ্যেই ফ্লয়েড বেশ ধাঁধায় পড়ে যায়, কে জানে-নিউজপ্যাড আর এর পেছনের টেকনোলজিই মানব সভ্যতার যোগাযোগের শেষ ও পরিপূর্ণ পরিণতি কিনা! এইতো, সে বেরিয়ে পড়েছে অসীম স্পেসের বুকে; মৃত্তিকা থেকে সরে যাচ্ছে প্রতি ঘন্টায় কত সহস্র মাইল দূরে-এখনো চাওয়ামাত্র যে কোনো খবরের কাগজের হেডলাইন দেখতে পায় কয়েক মিলি সেকেন্ডের মধ্যে। (‘খবরের কাগজ’ শব্দটা নিশ্চয়ই আধুনিক ইলেক্ট্রনিক যুগের ঘাড়ে চাপিয়ে দেয়া সিন্দাবাদের ভূত! এ নামের অস্তিত্ব শুধু অতীতেই ছিল, ব্যবহার বর্তমানে।) প্রতি ঘন্টায় স্বয়ংক্রিয়ভাবে তথ্য নবায়ন করা হয়। কেউ যদি শুধু ইংরেজি খবরগুলোই পড়তে থাকে, তবু নিউজ স্যাটেলাইটগুলো থেকে আসতে থাকা চির পরিবর্তনশীল সংবাদ প্রবাহে গা ভাসিয়ে দিয়ে একটা পূর্ণ জীবন পার করে দিতে পারে সহজেই।

কী করে যে পুরো সিস্টেমটা অটোম্যাটিক আপগ্রেড হয় তা ভেবেই কুল কিনারা পায় না সে। কিন্তু আজ হোক আর কাল, ফ্লয়েড জানে, এটাও ভেসে যাবে প্রযুক্তির বাধাহীন তোড়ে। এমন অকল্পনীয় কিছু সিন্দাবাদের ভূতের দায়িত্ব নেবে, যা ভাবতেও বিষম খেতে হয়। সেদিনও হয়তো এর নাম থাকবে ‘নিউজপেপার’! কক্সটন বা গুটেনবার্গ কোনোদিন কি নিউজপ্যাড স্বপ্নেও দেখেছিলেন?

আরো একটা ব্যাপার যেন ধরা দেয় ঐ ছোট্ট নিউজগুলোয়। দিনকে দিন যোগাযোগ মাধ্যম যতই চমৎকার হচ্ছে, ততই যেন সাধারণ, সস্তা আর হতাশাজনক হয়ে পড়ছে এর উপাদানগুলো। অ্যাক্সিডেন্ট, অপরাধ, প্রাকৃতিক আর মানবসৃষ্ট বিপর্যয়, যুদ্ধের হুমকি-ধামকি, নীরস সম্পাদকীয়-এসবই যেন ইথারের মধ্য দিয়ে পৃথিবীময় ছড়ানো লাখো শব্দের মূল লক্ষ্য। অবশ্য আজো ফ্লয়েড নিশ্চিত হতে পারেনি ব্যাপারটা খুব খারাপ হল কিনা। ইউটোপিয়ার সংবাদপত্রগুলো অসম্ভব মলিন আর বিরক্তিকর দেখাবে নিশ্চয়ই।

কিছুক্ষণ পরপরই কেবিন ক্রু আর ক্যাপ্টেন কেবিনে একটু ঢু মেরে যায়। কথাও হয় দু-চারটি। তারা অতি আগ্রহের সাথে তাদের বিশিষ্ট যাত্রীর সাথে কথা বলে। তবে মজার ব্যাপার হল, কথা বলায় শিষ্টতা রক্ষার চেয়ে তাদের গোপন মিশনের ব্যাপারে ব্যাকুলতাই বেশি ধরা পড়ছে। তবে বাঁচোয়া, তারা যথেষ্ট ভদ্র, একটা কথা তো দূরে থাক, এ বিষয়ে এক বিন্দু ইশারাও করে না।

একমাত্র কমবয়েসী মিষ্টি স্টুয়ার্ডেসকেই তার উপস্থিতিতে একদম স্বচ্ছন্দ মনে হয়। হঠাৎ ফ্লয়েড আবিষ্কার করে বসে, মেয়েটা এসেছে বালি[১৯] থেকে। বোঝা যায়, সে আজো বহন করে চলেছে সেই পরিবেশের মধুর রহস্যময়তা। আজো বিশাল এ দ্বীপ নষ্ট হয়ে যায়নি, হারায়নি তার দারুণ সৌন্দর্য। তার অবাক লাগে, এই পুরো ট্রিপের মধ্যে সবচে ভালো লেগেছে জিরো গ্র্যাভিটির কিছু অনিন্দ্যসুন্দর ব্যালে নৃতের মহড়া। মেয়েটা নিশ্চয়ই নাচছে না, কিন্তু দেখে তেমন মনে হয়। পেছনে নীলচে পৃথিবীর যবনিকা।

নিভে গেছে কেবিন লাইট। ঘুমানোর সময় ইলাস্টিক স্ট্র্যাপে নিজের হাত-পা আটকে নেয় ফ্লয়েড। ঘুমের মধ্যে এদিকসেদিক ভাসতে হবে না আর। একটু বেখাপ্পা দেখালেও এটাই রীতি। ফ্লয়েডের কাউচটা পৃথিবীর যে কোনো ম্যাট্রেসের চেয়ে অনেক বেশি আরামদায়ক।

নিজের ভিতর ডুবে যাবার পর অর্ধসচেতনভাবে জেগে উঠে সে বেশ বিপাকে পড়ে যায়। আশপাশটা দেখে চিনতে পারেনি প্রথমে। একপলের জন্য মনে হয় সে শুয়ে আছে কোনো টিমটিমে চাইনিজ লণ্ঠনের ভিতরে। আশপাশের কিউবিকল থেকে আসা ক্ষীণ আলোকমালায় এমনটা মনে হতেই পারে। এরপর নিজেকে শুনিয়ে বলে চলে, ‘ঘুমাও, ছেলে। এ এক সাধারণ মুন শাটল।’

জেগে উঠে সে আধ আকাশের অধীশ্বর চাঁদকে দেখতে পায়। ব্রেকিং প্রকৌশল শুরু হবে এখুনি। প্যাসেঞ্জার সেকশনের বাঁকানো দেয়ালে বিশাল জানালার এক বৃত্তচাপ আছে। সেটা দিয়ে এবার আর এগুতে থাকা গ্লোবের দেখা পাওয়া যাবে না। দেখা যাবে আকাশ। তাতে কী, রিয়ারভিউ টিভিতে ভালোভাবেই চূড়ান্ত পর্যায় দেখা যায়। টিভি স্ক্রিনটা কন্ট্রোল কেবিনে, অগত্যা তার সেদিকে যাওয়া ছাড়া উপায় নেই।

আসতে থাকা চান্দ্র পাহাড়গুলো পৃথিবীর পাহাড় থেকে অনেক অনেক ব্যতিক্রমী। তাদের নেই পার্থিব পর্বতের তুষারশুভ্র টুপি, নেই সবুজের ছড়াছড়ি। উদ্ভিদজগতের অনিন্দ্যসুন্দর আটসাট পোশাক নেই তাদের, নেই মেঘরূপী সদাচলন্ত কিরিটী। মেঘ-মুকুট ছাড়া কোনো পাহাড়কে কি সম্রাট মনে হয়?

তাতে কী? তাদের অবাক করা আলো আঁধারের সৌন্দর্যটাতো একান্তই নিজস্ব। দুনিয়াব্যাপী সৌন্দর্যের সংজ্ঞাগুলো এখানে অসহায়। এ ভুবন গড়ে উঠেছে আরেক শক্তিতে। সময়ের অনন্ততার উপর এর ভিত, কোনো অর্বাচীন একে বুঝে উঠতে পারবে না এক লহমায়। প্রতিনিয়ত নতুন রূপ নেয়া শ্যামল পৃথিবী তার ভেসে চলা বরফ যুগ, তার সদাচঞ্চল সাগর আর সূর্যোদয়ের আগের ধোঁয়াশার মতো পাহাড় নিয়ে এই অসীমের স্পর্শ পেতে পারবে না। এখানে একটাই যুগ, অসীম, অস্পৃশ্য, অনন্ত। একে মৃত্যু বলা যায় না, কারণ শশী কখনোই জীবিত ছিল না। অন্তত আজ পর্যন্ত এটাই সত্যি।

দিন আর রাতের স্থির রেখার ভিতর নেমে আসছে শিপটা। নিচে আলো আঁধারীর মিশেল, অতি ধীর চান্দ্র সূর্যোদয়ের প্রথম কিরণের স্পর্শ পায় নিঃসঙ্গ চূড়াগুলো। সবচে আধুনিক যন্ত্রপাতি নিয়েও এখানে ল্যান্ড করাটা ভয়ংকর হওয়ার কথা। ধীরে সরে গেল এলাকাটা, এগিয়ে আসছে রাতের পাশ।

একেবারে ক্ষীণতম আলোর সাথে চোখ সয়ে এলে ফ্লয়েড দেখতে পায় ফ্লাইটের ল্যান্ডিং এলাকা একেবারে আলোকহীন নয়। এক ভৌতিক বিচ্ছুরণে আলোকিত হয়ে আছে আশপাশটা। চূড়া, পাথর আর সমতল দেখা যাচ্ছিল একেবারে স্পষ্ট। চাঁদের আকাশেও আছে এক দানবাকার চাঁদ। পৃথিবীর আলো এসে ভাসিয়ে দিচ্ছে চতুর্দিক।

পাইলট প্যানেলের রাডার স্ক্রিনে আলো খেলে খেলে যায়। কম্পিউটার ডিসপ্লেতে সংখ্যা ওঠে অনেক, হারিয়েও যায় আবার। প্রতি পলে চাঁদের সাথে দূরত্ব মেপে চলছে যন্ত্রপাতি। প্রথম ওজন ফিরে আসার সময় চাঁদের ভূমি হাজার কিলোমিটার নিচে ছিল। আলতো একটু ঝাঁকি এল, তারপর নিচের দিকে সম্মোহন। যুগযুগ ধরে চেষ্টা করে যেন চাঁদটা পুরো আকাশ দখল করে নিল। কবেই ডুবে গেছে সূর্য, শেষে এক দানো শৃঙ্গ অধিকার করে নেয় বাকী আকাশটা।

শাটল যাচ্ছিল কেন্দ্রীয় চুড়ার দিকে। একেবারে অকস্মাৎ ফ্লয়েড আবিষ্কার করে বসে, সবচে কাছের শৃঙ্গটা থেকে আলো আসছে নিয়মিত ছন্দে। পৃথিবীর হিসাবে এ এক এয়ারপোর্ট বীকন। দম আটকানো দৃষ্টিতে চেয়ে আছে ফ্লয়েড, মানুষ যে চাঁদে তার সর্বজয়ী পা রেখেছে তার জ্বলন্ত প্রমাণ এ আলো।

এবার উঁচুভূমি এত বেশি এগিয়ে এসেছে যে দেখে মনে হতে পারে এর গিরিজ্বালামুখটা হাঁ করা; ছোটগুলো যেন সাজপোশাক, তীক্ষ্ণ পাথুরে অগ্রভাগগুলো উপরের দিকে চেয়ে আছে ব্যাকুলভাবে। এরা সবাই যেন নিজেদের আসল রূপ ফুটিয়ে তুলতে আগ্রহী। কোনো কোনোটা পুরো এক নগরীকে বুকে ধরার মতো মাইলের পর মাইল প্রান্তর জুড়ে আছে।

নক্ষত্রালোকে আলোকিত আকাশ থেকে পিছলে নামছে মুন শাটল। নিজের কাজের উপর এ যান পুরো কর্তৃত্ব রেখেছে। কেবিনের ভিতর ছুটতে থাকা ইলেক্ট্রনিক বীপিং আর জেটগুলোর তর্জন-গর্জন ছাপিয়ে কোত্থেকে যেন একটা কণ্ঠস্বর ভেসে এল। ফ্লয়েড শুনতে পায় কণ্ঠের গুঞ্জন।

‘ক্ল্যাভিয়াস কন্ট্রোল থেকে স্পেশাল ফোর্টিনকে বলছি, এগিয়ে আসছেন দারুণভাবে। হাইড্রোলিক প্রেশার, শক প্যাড ইনফ্লেশন আর ল্যান্ডিং গিয়ার লকের উপর হাতেনাতে চেকিংটা সেরে ফেলুন প্লিজ।’

পাইলট সানড্রাই সুইচ চেপে ধরার পরই সবুজ বাতি জ্বলে ওঠে, সাথে সাথেই কলব্যাক পাঠায় দক্ষ নাবিক, ‘সব ম্যানুয়াল পরীক্ষণ শেষ। হাইড্রোলিক প্রেশার, শক প্যাড ইনফ্লেশন আর ল্যান্ডিং গিয়ার লক ঠিক আছে পুরোপুরি।’

‘কনফার্মড।’ বলল চাঁদ। বাকী কথা হারিয়ে গেল যেন। হ্যাঁ, আরো শত কথা বাকী, সেটা চলছে যন্ত্রপাতির সাথে। যন্ত্রগুলো ধীর মালিকদের চিন্তার চেয়ে সহস্রগুণ দ্রুতিতে বাইনারি সংকেত পাঠিয়ে চলছে অবিরত।

এর মাঝেই বেশকিছু মাউন্টেন পিক চান্দ্রযানের মাথার উপর থেকে উঁকি মারা শুরু করেছে। ভূমি আর মাত্র কয়েক হাজার ফুট নিচে। কয়েকটা নিচু বিল্ডিং আর কিম্ভুতকিমাকার যানবাহনের ভিড় ঠেলে দেখা দিচ্ছে বিশাল নক্ষত্রের মতো বিকন লাইটেরআলো। শেষ পর্যায়ে জেটগুলো যেন কোনো জটিল আর সূক্ষ্ম সুর তোলার চেষ্টায় রত। এমন সুরেই সেগুলো দিয়ে বেরুচ্ছে জ্বালানী। থ্রাস্টের সাথে শেষ মুহূর্তের কাজ চালানোর জন্যই এ কাজ।

এলোমেলোভাবে ধূলির এক ঝড় আশপাশটাকে ভরিয়ে তুলতে চাচ্ছে। জেটগুলো অন্তিম এক গর্জন দিয়ে শাটলকে আলতো হাতে চাঁদের বুকে নামিয়ে দিল। এত হালকাভাবে চান্দ্রযান নামল যেভাবে কোনো রাবারের নৌকা ছোট্ট ঢেউয়ের মুখে আন্দোলিত হয়। কয়েক মিনিট আগে হলেও এখনকার এ নিরবতাকে ফ্লয়েড মেনে নিতে পারত না, কিন্তু তার সাথে এবার হাল্কা অস্বস্তিকর গ্র্যাভিটিও মেনে নিতে হচ্ছে।

নিতান্তই আটপৌরে রুটিন ফ্লাইটের পর ডক্টর ফ্লয়েড পদার্পণ করে চির আকাক্ষিত চাঁদের বুকে। একেবারে নিরাপদে একদিনের একটু বেশি সময় নিয়ে শেষ করেছে সেই বুক কাঁপানো যাত্রা-যেটার আশায় সহস্র কোটি মানুষ দু-হাজার বছর ধরে ব্যাকুল ছিল। আসলেই কি মাত্র দু-হাজার বছর?

অধ্যায় ১০. ক্ল্যাভিয়াস বেস

ব্যাসে দেড়শো মাইল, ক্ল্যাভিয়াস, চাঁদের দেখা যাওয়া অর্ধাংশের দ্বিতীয় বড় জ্বালামুখ। অবস্থান দক্ষিণ চাঁদের উচ্চভূমিতে। খুবই পুরনো, শত বছর ধরে লাভার উদ্গীরণ হয়েছে, হাজার হাজার বছর ধরে এর শুকনো বুকে ক্ষতের সৃষ্টি করেছে মহাকাশের আগন্তুকেরা। উল্কা, পাথর, কণা।

কিন্তু শিলাসৃষ্টির শেষ যুগ থেকেই এটা শান্ত। আজো অ্যাস্টেরয়েড বেল্টের ছোট্ট গ্রহাণুরা আঘাত হানে ভিতরের দিকের গ্রহগুলোয়, কিন্তু চাঁদের এ অংশ গত পঞ্চাশ কোটি বছর ধরে ঘুমিয়ে আছে একদম।

আর আজ, এর ভিতরে বাইরে কী অদ্ভুত আলোড়ন! চাঁদের বুকে মানুষের প্রথম স্থায়ী ফোস্কা পড়েছে ঠিক এখানটাতেই। বিশেষ প্রয়োজনে ক্ল্যাভিয়াস বেস স্বয়ং একটি পরিপূর্ণ দুনিয়া হয়ে উঠতে পারে। স্থানীয় পাথর থেকেই জীবনধারণের সবকিছু গড়ে ওঠে। শুধু দরকার ভাঙা, তাপ দেয়া, রাসায়নিক বিশ্লেষণ-সংশ্লেষণ। হাইড্রোজেন, অক্সিজেন, কার্বন, নাইট্রোজেন, ফসফরাস থাকলে আর কী চাই! উপরি পাওনা হিসেবে জুটবে বাকী মৌলের বেশিরভাগ, শুধু জানা চাই কোথায় খুঁজতে হবে।

বেসটা এক ক্লোজড সিস্টেম; অভ্যন্তরীণ পরিবেশ-ব্যবস্থা। বসুন্ধরার এক ছোট্ট কর্মচঞ্চল মডেল যেন। এখানে জীবনের সবকিছুকেই রিসাইক্লিং করে নেয়া হয়। কোনো কিছুই ফেলা হয় না, সবকিছু থেকেই পুনরুৎপাদন। তারপর আবার, বারবার। বায়ুমণ্ডলটা পরিষ্কার করা হয় এক বিশাল ‘হটহাউস’-এ। এ এক বিরাট গোলাকার ঘর; অবস্থান চান্দ্র ভূমির নিচে। রাতে আশীর্বাদধন্য কৃত্রিম আলোকমালা আর দিনে ছেকে শুদ্ধ করা সূর্যালোক একরের পর একর এলাকাজুড়ে খাটো আর ঝাকড়া গাছের জীবন দিয়ে চলে। পরিবেশটা একদম উষ্ণ। সেগুলোর আছে অন্যরকম ক্ষমতা, আরো বেশি অক্সিজেন দেয়, পার্শ্ব ফলন হিসেবে খাদ্যতো আছেই।

বেশি খাদ্যোৎপাদনের জন্য কেমিক্যাল প্রসেসিং সিস্টেম আর অ্যালগি[২০] কালচারের উপর পুরোপুরি নির্ভর করা হয়। বেসের চারদিকে স্বচ্ছ প্লাস্টিক : টিউবগুলোর বিস্তৃত এলাকার ভিতরে গজিয়ে ওঠা অজস্র আগাছা একেবারে হেলায় ফেলে রাখা হচ্ছে, কারণ খাদ্য সংকট নেই। প্রয়োজন পড়লেই একজন বায়োকেমিস্ট এ থেকে এমন চপ আর সুস্বাদু সজি গড়ে তুলতে পারে যার সাথে আসল খাবারের পার্থক্য নিতান্ত অভিজ্ঞজন ছাড়া কেউ আদৌ বুঝবে না।

বেসের এগারোশ পুরুষ আর ছ’শ মহিলার সবাই সর্বোচ্চ ট্রেনিংপ্রাপ্ত বিজ্ঞানী নয়তো টেকনিশিয়ান। পৃথিবী ছাড়ার আগে তাদেরকে হাজার সতর্কতার সাথে পরীক্ষা করা হয়েছে। আজ লুনার বেস বলতে গেলে একদম সহজ পরিশ্রমের স্থান। আজ আর প্রাথমিক সময়ের মতো অসুবিধা, দুর্ঘটনা কিংবা অঘটন ঘটে না। কিন্তু ভয় রয়েই গেছে, সামান্যতম ক্ল্যাস্ট্রোফোবিয়ায় ভোগা মানুষও এখানে কাজে আসার অনুমতি পায় না। একেবারে নিরেট পাথর আর লাভা কেটে কেটে চাঁদের বুকে ঘাটি পাতা নিতান্তই খরুচে ব্যাপার ছিল, সময়ও লেগেছে খুব বেশি। তাই এখানে একটা ভালো ‘ওয়ান-ম্যান’ রুম মাত্র ছ’ফুট চওড়া, দশফুট লম্বা আর উচ্চতায় আট।

প্রতিটিই আকর্ষণীয়ভাবে সাজানো, দেখতে যে কোনো ভালো মোটেল স্যুটের মতোই। কনভার্টেবল সোফা, টিভি, ছোট্ট হাই-ফাই সেট আর ভিশন ফোন এর অংশ। একটু কৌশল করে একেবারে চোখের সামনে সেঁটে থাকা দেয়ালটাও কাজে লাগিয়ে ফেলা হয়েছে, পার্থিব বিশাল আটটি ছবি চারদেয়ালে ফুটিয়ে তোলা যায়। এত বিলাস খুবই প্রয়োজন বেসের জন্য, কিন্তু তারপরও পৃথিবীতে ব্যাখ্যা পাঠাতে হয় প্রতিনিয়ত। ক্ল্যাভিয়াসের প্রত্যেক নারী-পুরুষের পেছনেই ট্রেনিং, যাতায়াত আর বাসার জন্য শতসহস্র ডলার খরচ হয়; তাই তাদের মনের শান্তি আর ভারসাম্য রক্ষার পেছনে একটু ব্যয় করাই যায়। এ শিল্পের খাতিরে শিল্প নয়, সুস্থতার খাতিরে শিল্প।

বেস-বিশেষ করে সমগ্র চাঁদে বাসের জন্যই এক বিশাল সুবিধা পাওয়া যায়, কম মধ্যাকর্ষণ। এর ফলে এক অদ্ভুত ভালো থাকার অনুভূতি ছড়িয়ে পড়ে মানুষের মধ্যে। এর নিষ্ঠুর দিকও আছে, চাঁদের একজন ইমিগ্র্যান্টের জন্য পৃথিবীতে থাকা অভ্যাস করে নিতে বেশ কয়েক হপ্তা লেগে যায়। চাঁদের বুকে মানবদেহ পুরো নতুন এক নির্ভরশীলতা নিয়ে গড়ে ওঠে। প্রথমবারের মতো মানুষের শরীরকে ভর আর ওজনের সামঞ্জস্য ঠিক করে নিতে হচ্ছে।

যে লোক পৃথিবীতে একশো আশি পাউন্ড শরীর বয়ে বেড়াত সে চাঁদে ত্রিশ পাউন্ডের ফুরফুরে স্বাস্থ্য নিয়ে চলতে শান্তি পাবে অবশ্যই। যখনি বরাবর চলবে, তখনি আনন্দে আত্মহারা হয়ে যাবে। বিপদ দেখা দেয় পাশ ফিরতে নিলেই। হঠাৎই বেচারার আবিষ্কার করতে হবে নিজের একশো আশি পাউন্ডের সবটুকুই বল আকারে ফিরে এসেছে। কারণ এ একটা ব্যাপার সব, স-ব জায়গায় একই, তা, সেটা হোক পৃথিবী, চাঁদ বা স্পেস। একটা ব্যাপারের সাথে অভ্যস্ত হতেই হবে, তাদের ওজনের জন্য যেটুকু প্রয়োজন তার তুলনায় সবকিছু ছ’ভাগের একভাগ ধীর হয়ে গেছে। ভরবেগই এর কারণ। এ সমস্যায় পড়তেই হয়। কারো ঘাড়ে গিয়ে পড়া, কারো সাথে রামধাক্কা খাওয়া ইত্যাদি ইত্যাদি নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপার।

নিজের জটিল ও একাধিক ওয়ার্কশপ, অফিস, স্টোররুম, কম্পিউটার সেন্টার, জেনারেটর, গ্যারেজ, রান্নাঘর, ল্যাবরেটরি, ফুড প্রসেসিং প্ল্যান্ট নিয়ে ক্ল্যাভিয়াস একাই এক বিশ্ব। আর, সত্যি বলতে গেলে, এই আন্ডারগ্রাউন্ড সাম্রাজ্য গড়তে যে দক্ষতার প্রয়োজন পড়েছে তার অনেকগুলোই অর্জিত হয়েছে স্নায়ুযুদ্ধের পঞ্চাশ বছরে।

মিসাইল সাইটে কাজ করা যে কেউ ক্ল্যাভিয়াসে স্বস্তি বোধ করবে। এখানে, এই চাঁদের বুকের ভিতরও কাছাকাছি দৃশ্য দেখা যায়, একই কায়দার যন্ত্রপাতি, একই ছাঁচের জীবন পদ্ধতি, একইভাবে বিরূপ পরিবেশের মোকাবেলা, মাটির নিচের ছোট্ট পরিবেশে বসবাস। পার্থক্য একটাই, এটাই টেনে দেয় যবনিকা, এ স্থান শান্তির জন্যে বানানো। দশ হাজার বছর পর মানুষ যুদ্ধের মতো উত্তেজক অন্য কোনো কাজ পেল।

আফসোস, আজো বাকী বিশ্বের সবগুলো দেশ এ সত্য অনুধাবন করতে পারল না।

.

ল্যান্ডিংয়ের একটু আগেও যেসব দানব-দানব পাহাড় দেখা যাচ্ছিল চারদিক থেকে সেগুলো ভোজবাজির মতো উবে গেছে, তাদের নামগন্ধও নেই। চান্দ্র দিগন্ত খুব দ্রুত আকাশের সাথে মিশে যায় বলে দেখা যাচ্ছে না। স্পেসক্রাফটের চারপাশে একটা সমতল, ধূসর এবং আলোকোজ্জ্বল এলাকা। আকাশটা অবশ্যই পুরোপুরি কালো। শুধু উজ্জ্বল তারা আর কিছু গ্রহ চোখে পড়ে। আকাশের দিকে বেশিক্ষণ তাকানো যায় না, চোখ ঝলসে ওঠে চান্দ্রভূমির আলোয়।

অ্যারেস ওয়ান-বি স্পেসশিপের আশপাশে বেশকিছু কিম্ভুত যানবাহন ভিড় করেছে। কয়েকটা স্বয়ংক্রিয় আর বাকীগুলো চালায় ছোট্ট প্রেশার কেবিনে বসে থাকা অপারেটর। ভেহিকলগুলোর বেশিরভাগই চলে বেলুন-চাকায়, কারণ এভাবেই উঁচুনিচু ভূমিতে কেবিনের ভারসাম্য রক্ষা হয়। এখানটা সমতল হলেও বাকী চাঁদতে তেমন নয়।

যানগুলোয় সমতল বেশ কিছু প্লেট চারদিকে বৃত্তাকারে থাকে। প্রতিটি আলাদাভাবে বসানো, নিখুঁতভাবে সাজানো। আর আছে ফ্লেক্স হুইল, এতে ক্যাটারপিলার ট্রাকের প্রায়

সব গুণই ধরা দেয়, তবে আরেকটু উন্নত হয়ে। আসলে ক্যাটারপিলার থেকেই এসব– ধারণার উদ্ভব। যেদিক দিয়েই যাক না কেন, বন্ধুরতার সাথে মানিয়ে নিতে পারে পুরোপুরি। যানগুলোর কিছু অংশ খোয়া গেলেও চলতে পারবে।

বেঁটে হাতির মতো একটা বাস ইয়া বড় শুড় নিয়ে চান্দ্রযানের গায় সেঁটে যাচ্ছে, এ ঔড়ই শিপ থেকে বাসে ওঠার পথ। কয়েক সেকেন্ড পরেই বাইরে ধাতব শব্দ আর বাতাসের হিসহিসানি শোনা গেল। বাতাসের সংযোগ হবার সাথে-সাথেই এয়ার প্রেশার ঠিক হয়ে গেছে। এয়ারলকের ইনার ডোর খুলে যাবার পর স্বাগত জানানোর মেজবানরা প্রবেশ করল সম্মানিত মেহমানকে বেসে নিয়ে যেতে।

এগিয়ে ছিল র‍্যালফ হ্যাভোরসেন, সে সাউদার্ন প্রভিন্সের প্রশাসক-এর মানে হল, সে শুধু বেসের শাসনকর্তা নয়, বরং দক্ষিণ চাঁদের সব অভিযানের নিয়ন্তা। সাথে চিফ সায়েন্টিস্ট ডক্টর রয় মাইকেলস। এই ছোট্ট অবয়বের জিওফিজিসিস্টকে ফ্লয়েড আগের চন্দ্রভ্রমণগুলোর সময় থেকেই চিনত। আর আছে আধ ডজন সিনিয়র বিজ্ঞানী, প্রশাসক। তাকে সম্মানের সাথে তারা রিসিভ করল। কোনো এক গোপন গুরুভার যে তাদের উপর থেকে নেমে গেল ফ্লয়েড আসার পর সেটা তাদের দেখেই বোঝা যায়। নিজেদের দুঃখ কারো ঘাড়ে চাপিয়ে দিতে তারা যে উন্মুখ ছিল এতটা অন্তত স্পষ্ট।

‘আপনাকে আমাদের মাঝে পেয়ে অত্যন্ত আনন্দিত, ডক্টর ফ্লয়েড,’ অফিসিয়াল মনোভাব নিয়ে বলল হ্যাভোরসেন, ‘ট্রিপটা ভালো কেটেছে তো?’

‘চমৎকার,’ জবাবে ফ্লয়েড জানায়, এরচে ভাল হতেই পারে না। কুরাতো সারাক্ষণ যত্নআত্তি করেই কাটাল।

এরপর সেই পুরনো বিরক্তিধরানো শুভেচ্ছাবাণী বাকীদের সাথেও কপচিয়ে নিয়ে চড়তে হল বাসে। না বলা কোনো চুক্তির বলেই যেন তারা কেউ তার হঠাৎ এই ভিজিটের ব্যাপারে কোনো কথাই বলল না। হাজারখানেক ফুট পেরিয়ে বাস এলো একটা বড় লেখার সামনে

ক্যাভিয়াস বেসে স্বাগতম
ইউ এস অ্যাস্ট্রোনটিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং কোর[২২]
১৯৯৪

ফ্লয়েড এবার দেখতে পায় লেখাটা দুভাগে বিভক্ত হয়ে মাটির তলার পথ দেখাচ্ছে। এক বিশাল দরজা খুলে গিয়ে তাদের বেসের পেটে প্রবেশাধিকার দেয়। তারপর যায় বন্ধ হয়ে। পরপর তিনটি দরজা পেরিয়ে তারা বাতাসের গর্জন শুনতে পেল। আবার এসেছে বায়ুমণ্ডল।

পাইপ আর ক্যাবলে ভর্তি এক টানেল ধরে পায়ের শব্দের প্রতিধ্বনি তুলতে তুলতে তারা এক্সিকিউটিভ এরিয়াতে হাজির হয়। চির পরিচিত অফিসিয়াল সেই টাইপরাইটার, অফিস কম্পিউটার, মহিলা এসিস্ট্যান্ট, ওয়ালচার্ট আর গোঙাতে থাকা টেলিফোন দেখে বেশ স্বস্তি বোধ হচ্ছে ডক্টর ফ্লয়েডের। অ্যাডমিনিস্ট্রেটর লেখা দরজার সামনে আসতেই আবার ফিরে আসে অ্যাডমিনিস্ট্রেটর হ্যাভোরসেনের সেই অফিসিয়াল ভাব, ‘ডক্টর ফ্লয়েড আর আমি দু মিনিটের মধ্যেই ব্রিফিং রুমে হাজির হচ্ছি।’

বাকীদের কেউ নড করল, কেউবা সম্মতিসূচক শব্দ তুলে করিডোর ধরে নেমে গেল। কিন্তু হ্যাভোরসেন ফ্লয়েডকে নিজের অফিসে নিয়ে যাবার আগে ছোট্ট এক সমস্যায় পড়ে। দরজা খুলে যাবার সাথে-সাথেই এক খুদে অবয়ব ঝাঁপিয়ে পড়ে হ্যাভোরসেনের উপর।

‘ড্যাডি!’ তুমি উপরে গিয়েছিলে! আমাকে নেয়ার প্রমিজ ছিল তোমার!

‘ডায়না, আমি বারবার বলেছি, সম্ভব হলে নিয়ে যাব। এখন ডক্টর ফ্লয়েডের সাথে খুব ব্যস্ত আছি-হ্যান্ডশেক করো। ইনি এইমাত্র পৃথিবী থেকে এলেন।’

ফ্লয়েডের মনে হল ছোট্ট মেয়েটার বয়স আটের মতো হবে। হাতগুলো সরু সরু। মেয়েটার চেহারা পরিচিত লাগছে খুব। এবং হঠাৎ করেই ফ্লয়েড বুঝতে পারে অ্যাডমিনিস্ট্রেটর কেন মিটিমিটি হাসছে।

‘অবিশ্বাস্য! শেষ যেবার এখানে এলাম তখন ও-তে একদম ছোট ছিল!’

‘গত হপ্তায় ওর চতুর্থ জন্মদিন গেল। এই লো গ্র্যাভিটিতে বাচ্চাকাচ্চা দ্রুত বাড়ে। কিন্তু বয়সটা অত দ্রুত বাড়ে না। ওদের শরীরের কলকজা নষ্ট হবে না সহজে। বাঁচবে আমাদের চেয়ে অনেক অনেক বেশি।’

বিভ্রান্ত লোকের দৃষ্টি নিয়ে তাকিয়ে আছে ফ্লয়েড, এ-মেয়েতো উচ্চতায় প্রায় লেডি হয়ে গেছে এরিমধ্যে! মনে হচ্ছে ওর হাড়ের গঠন খুবই ভালো।

‘নাইস টু মিট ইউ এগেইন, ডায়না,’ এরপরই-কোনো এক প্রবণতায়, কোনো এক কৌতূহলে এক যুগজিজ্ঞাসা বেরিয়ে পড়ে আপনাআপনি মুখ থেকে, পৃথিবীতে যেতে চাও তুমি?

চোখদুটো দ্যুতি ছড়ালো একটু, হাত ঝাঁকিয়ে নিল মেয়েটা।

‘সেটাতো বাজে জায়গা। পড়ে গিয়ে তোমরা নিজেরাই নিজেদের ব্যথা দাও। আর তোমাদের চারিদিকে মানুষ ভর্তি।

এইতো, স্পেসবর্নদের ফার্স্ট জেনারেশন! নিজেকে শোনায় ফ্লয়েড। সামনের বছরে ওরাই বেড়ে চলবে। চিন্তার কোথায় যেন দুঃখের সাথে আশা মিলেমিশে একাকার হয়ে গেছে। আজ আমাদের পৃথিবী কত্তো পুরনো, কত বেশি প্রকাশিত! এখানে নতুন পাবার কিস্যু নেই। কিন্তু অভিযাত্রীদের মৃত্যুশীতল অভিযানের অন্যদুয়ার খোলা, অভিযান চলবেই। আজ তাদের যন্ত্রপাতির মধ্যে কুঠার আর বন্দুক থাকবে না, তাদের যানবাহন হবে না ওয়াগন কিংবা ক্যানো। থাকবে নিউক্লিয়ার পাওয়ার প্ল্যান্ট, পরমাণুর শক্তি চালাবে সবকিছুকে, প্লাজমা ড্রাইভের শক্তি খুঁড়ে দেবে আকাশকে, ফার্মগুলো হয়ে পড়বে হাইড্রোপোনিক। আসছে এগিয়ে সময়টা, আর সব মায়ের মতো বসুমতাঁকেও তার সন্তানের প্রতি বিদায়বাণী উচ্চারণ করতে হবে উদাত্ত কণ্ঠে।

মেয়ের কাছে একগাদা নতুন প্রমিজ করে, বেশ বকাবকি করে হ্যাভোরসেন ফ্লয়েডের সাথে একা কথা বলার সুযোগ পেয়ে যায়। প্রশাসকের অফিস স্যুটটা বড়জোর পনের স্কয়ার ফুট। কিন্তু এ ছোট্ট ঘরে বাৎসরিক পঞ্চাশ হাজার ডলার পাওয়া অফিসারের মাননুযায়ী সব সরঞ্জামই বহাল তবিয়তে দাঁত কেলিয়ে হাসতে পারছে। বিশ্বের সব বড় বড় রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বের অটোগ্রাফসহ ছবি ঝুলছে দেয়ালে। আমেরিকার প্রেসিডেন্ট বা জাতিসংঘের মহাসচিবও বাদ যাননি। অপর দেয়ালের দখলদার বিশ্বের তাবৎ বড় অ্যাস্ট্রোনটের ছবি। সেগুলোও স্বাক্ষরসহ।

এক তথাকথিত ‘লেদার’ সোফার ভিতর ডুবে গিয়ে একগ্লাস ‘শেরি’ হাতে পায় ফ্লয়েড। আতিথেয়তার এই পুরনো মদটি আসলে চান্দ্র জৈব-রসায়নবিদদের অবদান। প্রথমে একটু সাবধানে চুমুক দেয় সে, তারপর আরামে।

‘তা, চলছে কেমন, র‍্যালফ?’

‘খুব একটা খারাপ না,’ হ্যাভোরসেন জবাব দেয় চিন্তিতমুখে, বরং সেখানে যাবার আগে একটা ব্যাপার তোমার মাথায় থাকা ভালো।

‘কী?’

‘আসলে, আমার মনে হয় ব্যাপারটাকে তুমি নৈতিক সমস্যা বলতে পার…’

দীর্ঘশ্বাস ফেলে দক্ষ প্রশাসক।

‘তাই!’

‘এখনো ব্যাপারটা সিরিয়াস নয়, কিন্তু হতে কতক্ষণ?’

সরল মনে বলে বসে ফ্লয়েড, ‘নিউজ ব্ল্যাকআউট? খবর দেয়া বন্ধ করেছ সেটা?’

‘হু। আমার লোকজন গরম হয়ে উঠছে এ ব্যাপারটা নিয়ে। হাজার হলেও, প্রায় সবাই পৃথিবীতে পরিবার ফেলে এসেছে। সেসব মানুষ প্রায় বিশ্বাস করে বসে আছে যে আমরা সবাই মুনপ্লেগের শিকার।’

‘আ’ম স্যরি অ্যাবাউট দ্যাট,’ বলল ফ্লয়েড, কিন্তু কোনো পত্রিকাই এরচে ভালো কভার স্টোরির আইডিয়া পায়নি। হাজার হলেও, গুজবটা কাজে লেগেছে। ও, ময়শেভিচের সাথে স্পেস স্টেশনে দেখা হয়েছিল। এমনকি সেও একই কথা বলছে।’

‘এতেই সিকিউরিটি সন্তুষ্ট হবে।’

‘খুব বেশি তুষ্ট হবার কিছু নেই, সে টি এম এ-১ এর কথাও বলেছে। কথাগুলো কোনো ফাঁকফোকড় ধরে যে বেরিয়ে পড়বে তার নেই ঠিক। এখন আমাদের কিছুই করার নেই। আগে জানতেই হবে, মরার জিনিসটা কী, তারপর জানতে হবে পেছনে চাইনিজ বন্ধুরা আছে কিনা, সবশেষে স্টেটমেন্ট। তার আগে সেটার অস্তিত্ব ঘোষণা করলে আমাদেরই বারোটা বাজার সম্ভাবনা।’

‘ডক্টর মাইকেলস মনে করে সে সঠিক জবাবটা জানে। তোমাকে বলার জন্য নিশ্চয়ই ওর পেট ফেটে যাচ্ছে।’

ফ্লয়েড নামিয়ে রাখে নিজের গ্লাসটা। ‘আর আমার মন ওর কথা শোনার কৌতূহলে ফেটে পড়ছে।’

অধ্যায় ১১. বিশৃঙ্খলা

মিটিং রুমটায় শত মানুষ সহজেই ধরে যাবে। এখানে আছে সর্বাধুনিক অপটিক্যাল আর ইলেক্ট্রনিক ডিসপ্লের ব্যবস্থা। দেখতে একেবারে আদর্শ কনফারেন্স রুমেরই মতো; এর সাথে পোস্টার, পিন পেপার আর নবীস আঁকিয়ের চিত্র দেখা যাচ্ছে দেয়ালজুড়ে। এর মানে জায়গাটা স্থানীয় সংস্কৃতিরও আজ্ঞা। ফ্লয়েড প্রায় ধাক্কা খেয়ে বসেছিল একটা ছবির কালেকশনের সাথে। সেখানেও ফটোগ্রাফারের স্বাক্ষর জ্বলজ্বল করছে। পৃথিবী থেকে এগুলো আনতেই সবচে কম কষ্ট আর খরচ হয়, বোঝা যায়। সবগুলোর নামই চমৎকার, দয়া করে ঘাস থেকে দূরে থাকুন… দিনের বেলায়ও পার্কিং নিষিদ্ধ… ডিফেন্স ডিফিউমার… সামনে সৈকত… গবাদিপশু পার হওয়ার পথ… নরোম কাঁধ আর পশুকে কোনো খাবার দেবেন না।

এত রুদ্র পরিবেশেও মানুষ তার ফেলে আসা ভুবন নিয়ে স্মৃতি রোমন্থনে মাতে, ঠাট্টা করে, কিন্তু তাদের পরের প্রজন্ম সেই দুনিয়া আর তার এসব ফালতু ব্যাপারকে মোটেও পাত্তা দেবে না।

ফ্লয়েডের আসার অপেক্ষায় বসে আছে জনাপঞ্চাশেক লোক। এ্যাডমিনিস্ট্রেটরের পেছন পেছন ঢোকার পর সবাই সম্মানের সাথে উঠে দাঁড়ায়।

পরিচিত কয়েকটা মুখের দিকে তাকিয়ে একটু নড় করেই ফ্লয়েড বলে ওঠে, ‘বিফ্রিংয়ের আগে কয়েকটা কথা বলে নিতে চাই।’

অ্যাডমিনিস্ট্রেটর মঞ্চে উঠে গিয়ে উপস্থিত সবাইকে সম্বোধন করছে এমন সময় ফ্লয়েড সামনের সারিতে বসে পড়ল।

‘লেডিস অ্যান্ড জেন্টলমেন,’ শুরু করে হ্যাভোরসেন, ‘আমার আবার বলে নেয়া উচিত, এ এক জরুরী মুহূর্ত। নিজেদের মধ্যে ডক্টর হেউড ফ্লয়েডকে পেয়ে আমরা আনন্দিত। আমরা সবাই তাঁর কাজের দ্বারা পরিচিত, আমি ও কেউ কেউ ব্যক্তিগতভাবেও তাকে চিনি। তিনি এইমাত্র পৃথিবী থেকে একটা স্পেশাল ফ্লাইটে এসেছেন। ব্রিফিংয়ের আগে আগে তাঁর কিছু কথা বলার আছে। ডক্টর ফ্লয়েড।’

ছোট্ট একটু হাসি দিয়ে এগিয়ে গেল ফ্লয়েড, ‘থ্যাঙ্ক ইউ, এটুকুই শুধু বলতে চাই আমি। প্রেসিডেন্ট আমাকে বিশেষভাবে বলে দিয়েছেন যেন আপনাদের অসাধারণ কাজের জন্য শুভেচ্ছাবাণী পৌঁছে দিই। আশা রাখি আমরা কী পেয়েছি তা অতি শীঘ্ন বুঝতে পারব। আমি একটা ব্যাপারে পুরোপুরি সচেতন যে, এখানটায় একটু স্পষ্ট করে কথাগুলো বেরিয়ে আসে মুখ থেকে, আপনাদের কেউ কেউ কিংবা সবাই চান রহস্য আর গোপনীয়তার চোর পুলিশ খেলাটা তুলে দিতে। আসলে এটা না ভাবলে আপনাদের পক্ষে বিজ্ঞানী হওয়া সম্ভব হতো না।’

চোখ পড়ল ডক্টর মাইকেলসের উপর। নিজের গালে বিশাল একটা ক্ষত-চিহ্ন দিয়ে মাথা উঁচু করে মনোযোগের সাথে ফ্লয়েডের কথা শুনছে বিজ্ঞানী। বোঝাই যায় স্পেসে কোনো দুর্ঘটনা হয়েছিল বেচারার। শক্ত চোখমুখের কারণে আরো বোঝ যায় যে সে ফ্লয়েডের পরের বাক্যে, ‘চোর-পুলিশ খেলা’ কথাটা পছন্দ করেনি।

‘কিন্তু আমার বলা উচিত, যে, এ এক বিশেষ পরিস্থিতি। আমাদের নিজেদেরকে আগে এ নিয়ে নিশ্চিত হতে হবে। একবার, মাত্র একবার যদি ভুল করে বসি, তাহলে কোনো দ্বিতীয় সুযোগ মিলতে নাও পারে, তাই কষ্ট করে আর একটু ধৈর্য ধরুন। প্রেসিডেন্টেরও একই অভিমত।

‘এটুকুই আমার বলার ছিল। এবার আপনারা রিপোর্ট পেশ করতে পারেন।’

নিজের সিটে ফিরে গেলে প্রশাসক বলল, ‘থ্যাঙ্ক ইউ ভেরি মাচ, ডক্টর ফ্লয়েড।’ আর তারপরই তার সিনিয়র বিজ্ঞানবিদদের দিকে ঘাড় কাৎ করল। সাথে সাথে উঠে এল মাইকেলস। এবার চারদিকের আলো একটু ফিকে হয়ে আসে। এতে করে শ্ৰোতাকুলের মনোযোগ বক্তার দিকে আকৃষ্ট হবে।

চাঁদের একটা ছবি স্ক্রিনের উপর ভেসে উঠতেই দক্ষিণ-মধ্য চাঁদের এক জ্বালামুখের দিকে সবার দৃষ্টি যায়। তীব্র এক আলো উঠে এসেছে সেখান থেকে। যেন কেউ চাঁদের মুখে একগুচ্ছ ফুল গুঁজে দিয়েছে, আর সেটা ছড়িয়ে পড়ছে চারদিকে।

‘এ হল টাইকো,’ বলছে মাইকেলস, একে বরাবর উপর থেকে দেখলে এত অস্পষ্ট দেখা যায় যতটা পৃথিবী থেকেও দেখা না যায়। কিন্তু এই বিশেষ দৃষ্টিকোণ থেকে যদি দেখেন তো আপনারা বুঝতে পারবেন কী করে চাঁদের এই জ্বালামুখটা গোলার্ধ দখল করে রেখেছে।

সে ফ্লয়েডকে এই অতি পরিচিত জিনিসের অতি অপরিচিত চিত্র হজম করার মতো সময় দিয়ে বলতে লাগল, গত বছর থেকে এ এলাকায় আমরা একটা ম্যাগনেটিক সার্ভে করছি। চৌম্বকীয় নিরীক্ষণটা চালানো হয় নিচু স্যাটেলাইট থেকে। সার্ভে শেষ হয় মাত্র গতমাসে আর এ হল তার ফল-এই ম্যাপটাই পুরো সমস্যার সূত্রপাত করে।

আরেক ছবি ভেসে উঠল যেটা শুধু বস্তুর ত্রিমাত্রিকতা দেখায়, আউটলাইন দেখায়। ম্যাপটায় দেখা যাচ্ছে চৌম্বকীয় অবস্থা। বেশিরভাগ স্থানেই রেখাগুলো সমান্তরাল আর সমান। কিন্তু একটা জায়গায় গিয়ে সেসব রেখা জট পাকিয়ে যায়। যেন একটা নির্দিষ্ট কেন্দ্রের দিকে শৈল্পিক বৃত্ত বানানো হয়েছে।

একেবারে গোবেচারা চোখেও এটুকু ধরা পড়বে যে, চাঁদের এ অংশের চৌম্বকক্ষেত্রে কোনো একটা গণ্ডগোল চলছে। সেই মানচিত্রের একেবারে নিচে বড় অক্ষরে লেখা: টাইকো চৌম্বকীয় বিশৃঙ্খলা–এক (টি এম এ-১)। এর একেবারে কোণায় স্পষ্ট করে লিখে দেয়া আছে, ‘অত্যন্ত গোপনীয়।

‘প্রথমে আমরা ধরে নিলাম এটা কোনো বহির্জাগতিক শিলার কাণ্ড। কিন্তু সব তথ্যপ্রমাণ এর বিপরীতে যাচ্ছে। অগত্যা একটু চোখ বুলাতেই হলো।’

‘প্রথম দল কিস্য আবিষ্কার করতে পারেনি। এটুকু বুঝতে পেরেছে যে, স্বাভাবিক লেভেলটা চাঁদের মাটির একটু ভিতরের দিকে দেবে যায়। ওরা একটা ড্রিল দিয়ে ঠিক মধ্যখানে খোঁড়া শুরু করেছিল স্যাম্পলের আশায়। বিশ ফুট নিচে ড্রিলটা থেমে গেল। তারপরই সার্ভে পার্টি খননকাজ শুরু করে, স্পেসস্যুটের ভিতরে থেকে কাজটা বেশি সুবিধার না, আপনাদের এটুকু বলতে পারি।

‘যা পেল তা নিয়েই তড়িঘড়ি করে ফিরে এল বেসে। ভালো ইকুপমেন্টসহ একটা বড় দল পাঠালাম এবার। এবারের যুদ্ধ চলল দু হপ্তা ধরে। ফলাফল আপনারা জানেন।’

স্ক্রিনের ছবি বদলের সাথে সাথে অন্ধকার কনফারেন্স রুমের পরিবেশও বদলে গেল। প্রত্যেকেই বহুবার দেখেছে দৃশ্যটা, তবু নতুন কিছু পাবার আশায় সবার চোখ স্থির হয়ে রইল ছবির উপর। গোটা পৃথিবী আর চাঁদের মধ্যে একশোজনও এ ছবির উপর চোখ ফেলার অনুমতি পায়নি।

উজ্জ্বল লাল আর হলুদ স্পেসস্যুট পরা এক অভিযানকারী কোনো এক খননকৃত এলাকায় দাঁড়িয়ে আছে। দৃশ্যটা অবশ্যই রাতের। চাঁদ বা মঙ্গলের যে কোনো স্থানে এমন দৃশ্য দেখা যেতে পারে। কিন্তু তারপরও কোনো গ্রহে কোনোদিন এমন একটা দৃশ্যের অবতারণা হয়নি।

যে বস্তুর সামনে স্যুট পরা লোকটা দাঁড়িয়ে আছে সেটা এক মিষমিষে কালো স্ল্যাব। উচ্চতায় মোটামুটি দশফুট আর প্রস্থে পাঁচ। এক পলক দেখেই সুবিশাল কবরফলকের কথা মনে পড়ে যায় ফ্লয়েডের। একেবারে নিখুঁত পালিশ করা। মনে হয় সবটুকু আলো শুষে নিচ্ছে। কোনো খুঁত নেই উপরিতলের। কী দিয়ে তৈরি তা বলারও যো নেই। হতে পারে পাথর, প্লাস্টিক, অথবা ধাতু…অথবা মানুষের অজানা কোনো উপাদানও হতে পারে।

‘টি এম এ-১,’ ডক্টর মাইকেলস দরাজ গলায় ঘোষণা করে, ‘এটাকে দেখে ব্র্যান্ড নিউ মনে হয়, তাই না? আসলে তাদের খুব একটা দোষ দেয়া যায় না যারা বলবে এ জিনিস বড়জোর বছর কয়েকের পুরনো। কেউ আবার এটাকে আটানব্বইয়ের তৃতীয় চৈনিক অভিযানের সাথে গুলিয়ে ফেলার পাঁয়তারা ভাজছে। কিন্তু আমি কশিনকালেও সেসব কথায় কান দিইনি-আর এবার আমরা এর বয়স নিয়ে একটু মাতামাতি করতে পারি। তথ্যসূত্র? স্থানীয় ভূতাত্ত্বিক প্রমাণগুলো।

‘ডক্টর ফ্লয়েড, আমার কলিগরা আর আমি আমাদের সারা জীবনের সব সুনাম এর উপর বাজী লাগাতে রাজী। টি এম এ-১ এর সাথে চাইনিজদের কোনোকালে কোনো সম্বন্ধ ছিল না। বলতে গেলে, এর সাথে মানবজাতির আদৌ কোনো সম্বন্ধ নেই। কারণ, যখন এটাকে কবর দেয়া হয় তখন মানুষ বলতে কিছু ছিল না।

‘দেখতেই পাচ্ছেন, এটা তিন মিলিয়ন বছরের পুরনো। ত্রিশ লাখ সাল পেরিয়ে গেছে। এখন, দ্রমহোদয়গণ, আপনারা যেটার দিকে তাকিয়ে আছেন তা হল পৃথিবীর বাইরে বুদ্ধিমত্তার প্রথম প্রমাণ।’

অধ্যায় ১২. ধরণী-জোছনায় যাত্রী

ম্যাক্রো ক্র্যাটার প্রভিন্স: এস এর মতো একটা অংশ বেরিয়ে আছে সবচে সামনের জ্বালামুখ থেকে। চাঁদের দৃশ্যমান অংশে অবস্থিত। ই এর মতো বেরিয়ে থাকে সেন্ট্রাল ক্র্যাটার প্রভিন্স থেকে। এখানে-সেখানে হাজারো জ্বালামুখ। এখানেই চাঁদের সবচে বড়টা সহ অনেক বড় বড় অগ্নিগিরিমুখ রয়েছে। এন এর মতো দেখতে অংশটায় কিছু প্রভাবশালী জিনিসপত্র চোখে পড়ে। বেশিরভাগ মুখই একটু খাড়া। কোনো কোনোটা দশ ডিগ্রি থেকে বারো ডিগ্রি। কোনো কোনোটার তলদেশ একেবারে সমতল।

নামা ও নড়াচড়া এবড়োথেবড়ো ভূমির কারণে ল্যান্ড করাটা কষ্টকর হবে। বরং সমতল জ্বালামুখের কোনোটায় নামলে সবচে বেশি সুবিধা হতে পারে। যে কোনো ধরনের মুভমেন্ট সহজ হবে, কিন্তু আগে থেকেই পথ নির্দিষ্ট করে রাখা দরকার। এক্ষেত্রেও সমতল জ্বালামুখের তলদেশে নড়াচড়া সুবিধাজনক।

গঠন: এখানে গঠন করা খুব কঠিন হয়ে দাঁড়াবে। কারণ প্রচুর আলগা পাথর ও পাথরের চাই পড়ে থাকে। এক্ষেত্রেও সমতল জ্বালামুখের তলদেশ সুবিধাজনক।

টাইকো: পোস্ট-মারিয়া জ্বালামুখ। ব্যাসে চুয়ান্ন মিটার। পরিধি সাত হাজার ন’ শ ফুট, তলা বারো হাজার ফুট নিচে। চাঁদের মধ্যে টাইকো রে সিস্টেম সবচেয়ে ভাল। এ থেকে পাঁচশো মাইলেরও বেশি দূরে আলোকরশ্মি ছড়িয়ে দেয়া যায়।

(চাঁদের উপরিতলে বিশেষ ইঞ্জিনিয়ারিং সমীক্ষা’ অফিস, চিফ অফ ইঞ্জিনিয়ার্স, ডিপার্টমেন্ট অফ দ্য আর্মি-ইউ এস, ভূতাত্ত্বিক জরিপ, ওয়াশিংটন, উনিশশো একষট্টি-থেকে নেয়া।)

এখন ঘণ্টায় পঞ্চাশ মাইল এলাকা চষে ফেলছে মোবাইল ল্যাব। জ্বালামুখের দিকে তোলাপাড় করে এগুচ্ছে আট চাকার বিশালদেহী ল্যাবরেটরিটা। দেখতে ছোটখাট একটা বেসের মতো। এর ভিতর বিশজন মানুষ হপ্তার পর হপ্তা আয়েশে কাটিয়ে দিতে পারে। বলা যায়, এ হল এক ভূমিতে চলা পরিপূর্ণ স্পেসশিপ। প্রয়োজনে উড়তেও জানে এ বিশেষ যানটি। কারণ নিচে আছে শক্তিশালী চারটি আন্ডারজেট।

বাইরে তাকিয়েই ফ্লয়েড দেখতে পায় সার ধরে পড়ে আছে কত ঝকমারি যানবাহন। প্রতিটিতেই একটা করে ফ্ল্যাশলাইট আছে, আছে ট্রেইল, সেই পথেও ফ্ল্যাশলাইট বসানো। দূরত্বটা দু’শ কিলোমিটার হলেও এই রাতে কেউ ক্ল্যাভিয়াস বেস থেকে টি এম এ-১ এর পথে যেতে চায় তাহলে হারিয়ে যাবে না।

মাথার উপরকার তারার দল একটু উজ্জ্বল হয়ে জ্বলছে। নিউ মেক্সিকো বা কলোরাডোর ঝকঝকে আকাশ থেকেও নক্ষত্রলোক এত সুন্দর দেখা যাবে না। কিন্তু ঐ কয়লাকালো আকাশে এমন দুটি জিনিস আছে যা পৃথিবী-পৃথিবী ভাবকে পুরোপুরি উবিয়ে দেয়।

প্রথমটি ধরিত্রী স্বয়ং-উত্তর প্রান্তে আলোকবর্ষী এক গোলক সে। পূর্ণ চন্দ্র যত আলো বর্ষাতে পারে তারচে অর্ধশতগুণ আলো ঝরাচ্ছে আধ-পৃথিবী। পুরো ভূমিই যেন কিম্ভুত নীলচে সবুজ আলোর জোয়ারে ভেসে যাচ্ছে। প্রতিনিয়ত।

দ্বিতীয়টি হচ্ছে পুব আকাশে কৌণিকভাবে জ্বলতে থাকা ক্ষীণ আলোকমালা। এটা আস্তে আস্তে উপরে উঠে আসছে। এই হল সেই অদ্ভুতুড়ে মহিমা যা কোনো মানুষ পৃথিবীতে বসে দেখার কথা কল্পনাও করতে পারে না। এই হলো করোনা, চান্দ্র সূর্যোদয়ের পূর্বসূরী। এ বহুক্ষণ ধরে বলে যায় যে মহান সূর্য একটু পরে চন্দ্রদেবের ঘুম ভাঙাবেন।

যাত্রীদের অবজার্ভেশন লাউঞ্জটা পাইলটের সিটের ঠিক পেছনে। হ্যাভোরসেন আর মাইকেলসের সাথে অবজার্ভেশন লাউঞ্জে বসেই সে দেখল তার ভাবনার জগৎ বারবার দোল খেয়ে যাচ্ছে। তিন মিলিয়ন বছরের পুরনো উপসাগরটা এই মাত্র তার সামনে নিজের পুরো বিস্তৃতি নিয়ে হাজির হল। আর সব অভিজ্ঞ বিজ্ঞানীর মতো ফ্লয়েডের চিন্তাও ঘুরেফেরে আরো বেশি বছরের আশপাশে। ত্রিশ লাখ বছর ইউনিভার্সের তুলনায় কিছুই নয়। তবু সেসময়ে কিছু তৈরি হয়নি। মন না, ভাবনা না, তৈরি হয়নি কোনো পরিণত মস্তিষ্ক।

ত্রিশ লাখ বছর! অসীম যেন তার বিস্তৃত ছবিকে তুলে আনল সামনে। লিখিত ইতিহাস, ইতিহাস কাঁপানো সেসব যুদ্ধবাজ নৃপতি, বিশ্বের প্রগতি আনন্দ-বেদনা, এই বিশাল সময় সাগরের হাজার ভাগের একভাগকেও ভরিয়ে তুলতে পারছে না। মানুষতে মানুষই, আজকের পৃথিবীর বেশিরভাগ প্রাণীই সেদিন ছিল না যেদিন চাঁদের বুকে বড্ড যত্ন করে এই কালো কিংবদন্তীকে কবর দেয়া হয়। কবর দেয়ার জায়গাটাও খুব হিসেব করে বের করা, চাঁদের সবচে উজ্জ্বল আর সবচে অদ্ভুত জ্বালামুখ!

এটাকে যে পুঁতে দেয়া হয়েছে সে বিষয়ে ডক্টর মাইকেলস একেবারে নিশ্চিত।

‘প্রথমে,’ মাইকেলস ব্যাখ্যা করে, ‘আমি ধরে নিই যে এটা কোনো লুকায়িত জিনিস নির্দেশ করছে। কিন্তু আমাদের সর্বশেষ অভিযানে এর উল্টো ফল বেরোয়। জিনিসটা বসে আছে একই বস্তুতে তৈরি প্ল্যাটফর্মের উপর। তার নিচে নিরেট পাথর। এর… স্রষ্টারা… জানত যে একে টিকে থাকতে হবে চাঁদের সব ভূকম্পন সয়ে গিয়ে। তারা জিনিসটাকে বসিয়েছিল অসীম সময়ের জন্য।’

মাইকেলস এখনো হতাশা আর আশার মিশ্রিত সুরে বলে যায়, ফ্লয়েড দু অনুভূতিকেই প্রবাহিত করে নিজের ভিতর। শেষ পর্যন্ত মানুষের প্রাচীনতম প্রশ্নের মধ্যে একটার জবাব মিলেছে। এই একমাত্র সভ্যতা নয়; ইউনিভার্স আরো বুদ্ধিমত্তার জন্মদাতা। একই সাথে সময়ের ব্যাপারটা ভাবিয়ে তোলে সবাইকে। যাই এখান দিয়ে গিয়ে থাক না কেন, সেটা মানব সভ্যতাকে হাজায়ো প্রজন্মের ব্যবধানে না দেখেই চলে গেছে। আর আমরা তাদের সম্পর্কে আজ হঠাৎ করে কীই বা জানব, যারা আকাশ ভেদ করে চলে গেছে সেই যুগে যে যুগ আমাদের পূর্ব পুরুষদের বাস করাতো গাছের ডালে ডালে।

চাঁদের অতি ছোট দিগন্তের কাছাকাছি একটা সাইনবোর্ড দেখা যাচ্ছে। ঝকঝকে সিলভার ফয়েলে মোড়া একটা তাঁবুর মতো জিনিস সেদিকে। অবশ্যই সেই ফয়েলটা দিনের অসভ্য আলোর বিরুদ্ধে কাজে দেয়। বাস চলা শুরু করলে ফ্লয়েড শক্তিশালী দিনের আলোয় পড়তে পারে:

ইমার্জেন্সি ডিপো নং-৩
বিশ কিলো লক্স[২৩]
দশ কিলো পানি
বিশ ফুডপ্যাক এম কে ফোর
এক টুলকিট (টাইপ বি)
এক সট রিপেয়ার আউটফিট
টেলিফোন!

‘এ নিয়ে ভেবেছিলে কিছু?’ প্রশ্ন করে ফ্লয়েড, জানালার বাইরে তার হাত নির্দেশিত, ‘ধরো জিনিসটার সাপ্লাই ফুরিয়ে গেল, তখন?’

‘এমন সম্ভাবনা আছে,’ স্বীকার করে মাইকেলস, ‘সেই ম্যাগনেটিক ফোর্সটি হঠাৎ করেই আবার ঠিক হয়ে যায়। ফলে গোলযোগের সামান্য এলাকাটা পাওয়া কোনো নাভিশ্বাস তোলার মতো কষ্টের ব্যাপার না। আর ম্যাগনেটিক বিশৃঙ্খলার এলাকাটা নিতান্তই ঘোঁট। বেশি সাপ্লাইয়ের দরকার পড়ে না।’

নাক গলায় হ্যাভোরসেন, কেন নয়? কে জানে তারা কত বড় ছিল? হয়তো তারা ছিল ছয়ইঞ্চির লিলিপুট, এটা তাদের কাছে ত্রিশতলার বিল্ডিংয়ের সমান হবে।

মাইকেলস উত্তেজনায় নিজের হাত নাড়ে, ‘আউট অব কোশ্চেন। বুদ্ধিমান প্রাণীর জন্য ন্যনতম একটা মস্তিষ্ক আকুতি প্রয়োজন।’

মাইকেলস, হ্যাভোরসেন আর ফ্লয়েড-তিনজনেই বলে যায় নিজের নিজের কথা, গুরুত্ব দিয়ে শোনে অন্যের মতামত। কিন্তু একটু ব্যক্তিত্বের দ্বন্দ্বও যেন ধরা দিচ্ছে তাদের কথায়।

একটা ব্যাপারে তাদের মতভেদ নেই, তা হল টি এম এ-১ বা টাইকো মনোলিথ। সব রহস্য এর ভিতর লুকিয়ে আছে। চাঁদে নামার পর গত ছ’ঘণ্টায় ফ্লয়েড অন্তত বারোটা থিওরী শুনেছে। কিন্তু তার নিজের কোনো তত্ত্ব নেই। ধর্মমন্দির, প্রাচীন সমাধি, রত্নভাণ্ডার, সার্ভে মার্কার, জিওফিজিক্যাল ইন্সট্রুমেন্ট-আরো কত কী! কোনো কোনো মৌলবাদী’ একরোখা বিজ্ঞানীর কথাবার্তা আরো ভয়াল। অনেক বাজী ধরা হয়েছে এরি মধ্যে, আর সত্যিটা বেরিয়ে পড়লে হাতবদল হবে বেশ বড়মাপের কারেন্সি। অবশ্য একটা কথা থেকে যায়, আদৌ সত্য উদ্ঘাটন হবে তো!

একটু স্যাম্পল তুলে আনার জন্য মাইকেলস আর তার সঙ্গীসাথীদের করা সব ভদ্ৰ চেষ্টাকেই বিফল করে দিয়েছে সেই অভদ্র কালো স্তম্ভটা। তাদের কোনো সন্দেহই নেই যে একটা লেজার বিম চালালে সহজেই জিনিসটাকে কাটা যায়, কিন্তু বাস্তবে কিছুই ঐ ভয় ধরানো জিনিসের গা থেকে একটা চুল সরিয়ে আনতে পারেনি। এবার লেজার চালানোর মতো বড় সিদ্ধান্ত নির্ভর করে ফ্লয়েডের উপর।

এক্স রে, সনিক প্রোব[২৪], নিউট্রন বীম[২৫] এবং আর সব নিরাপদ পদ্ধতি আগে চেখে দেখা হবে। লেজারের ভারি গোলাবারুদ যুদ্ধক্ষেত্রে নামানো হবে তার পর। এ হল বর্বরের কাজ। তুমি কোনো জিনিসকে চিনতে পারছ না, সমস্যা কোথায়, ভেঙে দেখ! কিন্তু মানুষ সম্ভবত বর্বর জাতির সদস্য, গত শতাব্দীগুলোয় তারা সব সময় এ পথই অনুসরণ করেছে।

আর কোত্থেকে তারা এসে থাকতে পারে? স্বয়ং চাঁদের বুকে? না, এ একেবারে অসম্ভব। যদি এর বুকে একটাও প্রাণী থাকত তাও গত জ্বালামুখ-গঠন যুগে বিলীন হয়ে যাওয়ার কথা। তখন চান্দ্র-উপরিতলের বেশিরভাগই ছিল আগুন-তপ্ত।

পৃথিবী থেকে সেই সভ্যতার শুরু নয়তো? খুবই বেখাপ্পা। কিন্তু হতেওতো পারে। কোনো অতি অগ্রসর পার্থিব প্রাণী-হয়তো তারা মানুষ নয়-প্লেইস্টোসিন এরার নিষ্ঠুর দিনগুলোতে…নাহ্! আরো হাজার প্রমাণ তারা রেখে যেত পৃথিবীর বুকে। চাঁদে আসার বহুদিন আগে থেকেই আমরা সে বিষয়ে সব জেনে ফেলতাম, ভাবে ফ্লয়েড।

আর মাত্র দুটি বিকল্প সামনে-গ্রহকুল আর নক্ষত্রলোক। এরি মধ্যে সৌর জগতের আর কোথাও সভ্যতার ছিটেফোঁটা থাকার সম্ভাবনা নাকচ করে দেয়া হয়েছে। এমনকি কোনো ধরনের জীবন থাকার সম্ভাবনাও নেই পৃথিবী আর মঙ্গল ছাড়া। ভিতরের গ্রহগুলো একদম গরম আর বাইরেরগুলো বরফশীতল। কোনো কোনোটার ভূমিতে আবার প্রতি স্কয়ার ইঞ্চিতে বায়ুচাপ শত শত টন, সেখানে জীবন গড়া অসম্ভব।

সুতরাং, এই পরিদর্শকদল হয়তো এসেছে অনন্ত নক্ষত্রবীথি থেকে। এবার এটাতো আরো অসম্ভব মনে হচ্ছে। চাঁদের নগ্ন আকাশের দিকে খোলা চোখে সে তাকায়। কিছু একটা খোঁজে। তার মনে আছে কীভাবে মাঝেমধ্যেই তার বন্ধু বিজ্ঞানীরা ‘প্রমাণ’ দেখিয়েছে যে আন্তঃনাক্ষত্রিক ভ্রমণ অসম্ভব। আজো পৃথিবী থেকে চাঁদের দিকে যাত্রাটা দেখতে শুনতে বেশ লাগে। কিন্তু সবচে কাছের তারকা হাজার লাখ গুণ দূরত্বে ঘুরপাক খাচ্ছে… আকাশকুসুম ভাবনাচিন্তায় ডুবে থাকা এখন সময়ের অপচয় ছাড়া আর কিছুই নয়। আরো প্রমাণের জন্য অপেক্ষা করতে হবে।

‘দয়া করে আপনার সিটবেল্ট বেঁধে নিন এবং সব আলগা জিনিসপত্র গুছিয়ে নিন,’ হঠাৎ করেই কেবিন স্পিকার বলে উঠল, ‘সামনে চল্লিশ ডিগ্রি অবনমন।’

একেবারে দূরপ্রান্তে দুটি মার্কারপোস্ট দেখা যাচ্ছে। ফ্লয়েড কোনোমতে নিজেকে সামলে নিতেই বাসটা প্রবেশ করে খাড়া খাঁজের ভিতর। যেন কোনো ঘরের ঢালু ছাদ বেয়ে নেমে চলছে অনেকক্ষণ ধরে। এখন আর পৃথিবীর মিনমিনে আলো তেমন দেখা যাচ্ছে না। কারণ এই ঢাল। বাসের নিজস্ব ফ্লাডলাইট জ্বালতে হল। বহুবছর আগে ফ্লয়েড ভিসুভিয়াসের ঠোঁটের কাছে দাঁড়িয়েছিল। একেবারে জ্বালামুখের ভিতর। আজো সেই মুহূর্তের কথা মনে পড়ে গেল। তবে অনুভূতিটা খুব ঝেশ সুখদায়ক নয়।

ওরা টাইকোর ভিতরের কোনো এক সমভূমিতে নেমে যাচ্ছে। আরো কয়েক হাজার ফুট নিচে নেমে খাজ আবার উঠতে শুরু করবে। সামনের দিকে ঝুঁকে থেকে মাইকেলস মহোৎসাহে সমভূমি দেখাচ্ছে।

‘এইতো, সামনে।’ যেন নতুন কোনো বিস্ময়ের কথা শোনাচ্ছে সে। মাথা ঝাঁকায় ফ্লয়েড, কয়েক মাইল দূরের সবুজ আর লাল বাতিগুলো তার চোখে পড়েছে আরো আগেই। যদিও এই দানো-যানটা ভালোভাবেই নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করছিল, তবু স্বভাব অনুযায়ী ফ্লয়েড সমভূমিতে নেমে যাবার আগ পর্যন্ত স্বস্তিতে শ্বাস নিতে পারেনি।

এবার পৃথিবীর আলোয় রূপালী বুদবুদের মতো চকচক করতে থাকা দুটি প্রেশার ডোম তার চোখে পড়ে। সাইটে কাজ করার মানুষের জন্য এগুলো তাঁবুর কাজে দেয়। কাছাকাছিই একটা রেডিও টাওয়ার, একটা ড্রিলিং রিগ, প্যাকেট করা বেশ কয়েকটা যানবাহন, আর বেশ বড় একটা খণ্ড পাথরের স্তূপ। একাকিত্বের মাঝে এই ছোট্ট ক্যাম্পটা দেখে বেশ দুঃখী মনে হয়। চারপাশে প্রকৃতির জমকালো নিষ্ঠুরতা। সেখানে নেই জীবনের কোনো চিহ্ন। বাইরে থেকে দেখে কেন যে মানুষ এখানে এসেছে তা বোঝাই যাবে না।

মাইকেলস বলছে, ‘যদি পাহাড়ের উপর যাও, ঐ রেডিও অ্যান্টেনার দিকে শ’খানেক গজ গেলে শুধু জ্বালামুখই দেখতে পাবে।’

তো, এই হল সেই আতঙ্ক! ভাবল ফ্লয়েড। এখন বাসটা প্রেশার ঢোমকে পাশ কাটিয়ে যাচ্ছে। সামনেই জ্বালামুখের ঠোঁট। একটু ভালোভাবে দেখার জন্য সে এগিয়ে গেল সামনে, সাথে সাথেই বেড়ে যাচ্ছে হৃদস্পন্দন। এখন বাহনটা এক বিশাল আধভাঙা পাথরে ওঠার পাঁয়তাড়া করছে। পাথরটা অগ্নিজ্বালামুখের ভিতরে। এবং সাথে সাথেই ঠিক সেসব ছবির মতো চোখের সামনে ভেসে উঠল টি এম এ-১।

ফ্লয়েড একদৃষ্টিতে চেয়ে থাকে, মিটমিট করে চোখদুটো, একটু নাড়ে নিজের মাথা, আবার তাকায় অপলক নেত্রে। এই তীব্র ধরণী জোছনাতেও জিনিসটাকে দেখা বেশ কষ্টসাধ্য ব্যাপার। প্রথমে মনে হয় যেন কার্বন পেপার থেকে কেটে তোলা এক সমতল চতুষ্কোণ ঠায় দাঁড়িয়ে আছে। যেন এর কোনো ঘনতুই নেই। অবশ্যই, এ এক দৃষ্টি বিভ্রম। এটা কঠিন বস্তু হলেও এর আলোক-প্রতিফলন এতই কম যে জিনিসটাকে না দেখে বরং এর আশপাশের আলোয় ভেসে যাওয়া এলাকা দেখে এর উপস্থিতি বুঝতে হচ্ছে।

জ্বালামুখে প্রবেশের সাথে সাথে সব যাত্রী একদম নিশুপ হয়ে গেল। আনন্দ আছে, আছে নিখাদ বিস্ময়, চাঁদ-মৃত চাঁদ তার বুকে এতবড় বিস্ময় লুকিয়ে রেখেছিল যুগ-যুগান্ত ধরে!

কালো স্ল্যাবের বিশ ফুটের মধ্যে এসেই বাস থেমে গেল। জিনিসটার আকৃতি একেবারে নিখুঁত জ্যামিতিক, সেটাতো জানা তথ্য, আরো কিছু দেখার বাকী রয়ে গেছে। এর অপ্রতিরোধ্য মসৃণ দেহের কোথাও কোনোরকম প্রতীক নেই, নেই চিহ্ন, কোনো প্রমাণ-কিছু নেই। এ যেন রাতের কঠিনীকৃত রূপ। আরো একটা তত্ত্ব কপচানোর চেষ্টা করে ফ্লয়েড, এটা চাঁদের জন্মের সময় গঠিত কোনো বিশেষ অস্বাভাবিক প্রাকৃতিকতার ফল নয়তো! তাইবা কী করে হয়, প্রকৃতি এমন নিখুঁত জ্যামিতিক হার হিসাব করবে কোনো দুঃখে? সবচে বড় কথা, এসব সম্ভাবনা আগেই ভেবে বাতিল করা হয়েছে।

জ্বালামুখের চারধারের ফ্লাডলাইটগুলো জ্বলে উঠতেই পরিবেশ পাটে গেল। চান্দ্র বায়ুশূন্য পরিবেশে আলোর কোনো রেখা দেখা যায় না। যদি বাতাস থাকত, ধূলিকণা যত্রতত্র ভেসে বেড়াতে পারত তাহলে অন্য কথা। চান্দ্র বায়ুমণ্ডল না থাকায় আলোর রেখাটা দেখা যায় না, শুধু দেখা যায় আলোর পতন।

আলোতে ভেসে গেছে চারদিক। দুধসাদা আলোয় চোখ ধাঁধিয়ে যাচ্ছে সবার। সেই কালো গায়ে এবারো আলো পড়েছে, কিন্তু ফল সেই একই। যেন সবটুকু আলো শুষে নিচ্ছে অপার আগ্রহে।

প্যানডোরার বাক্স[২৬] নাকি এটা? ভাবে ফয়েড। চির আগ্রহী মানুষের মতোই সে ভিতরটা দেখতে চায়, কিন্তু কী লুকিয়ে আছে এর ভেতর? কে জানে?

অধ্যায় ১৩. ধীর সূর্যোদয়

টি এম এ-১ সাইটের মূল প্রেশার ডোম এপাশ-সেপাশে মাত্র বিশ ফুট হলেও লোকে লোকারণ্য। ভিতরটায় একদম গাদাগাদি করে বিজ্ঞানীরা বসবাস করে। দুটি এয়ারলক আছে এ ডোমে। প্রথমটির সাথে যুক্ত একটা বাস। বাসটা দারুণ কাজে লাগছে। সেটাই এক স্বর্গীয় শোবার ঘর এখন। অন্য এয়ারলক দিয়ে বাকীরা যাতায়াত করে।

গোলার্ধের মতো দেখতে এ প্রেশারডোম-বুদ্বুদগুলো। দেয়াল থাকে দুটি। ভিতরের ছয় বিজ্ঞানী প্রত্যক্ষভাবে প্রজেক্টের সাথে জড়িত। বুদ্বুদের ভিতরেই তাদের বেশিরভাগ যন্ত্রকে স্থান দিতে হয়েছে। রান্নাবান্না, ধোয়ামোছা বা টয়লেটের আসবাবপত্রও ডোমের বিশাল অংশ জুড়ে থাকে। গোদের উপর বিষফোঁড়ার মতো তাদের সাথে ঘুমাতে দিতে হয় জিওলজিক্যাল সার্ভের সব গুরুত্বপূর্ণ যন্ত্রকে, যেগুলোর ভ্যাকুয়ামে নষ্ট হবার সম্ভাবনা প্রকট। সব সময় এখান থেকেই চোখ রাখা যায় টি এম এ-১ এর উপর। তবু, ভিতরে ছোট টিভি স্ক্রিন রাখতেই হয়েছে।

হ্যাভোরসেন ডোমের ভিতর থাকার সিদ্ধান্ত নিলে ফ্লয়েড একটুও অবাক হয়নি। সে নিতান্ত ভদ্রভাবেই নিজের কথা জানায়।

‘আমি স্পেসস্যুটকে একটা প্রয়োজনীয় শয়তান মনে করি।’ অ্যাডমিনিস্ট্রেটর সাফ-সুতরো নিজের কথা জানিয়ে দেয়, ‘বছরে চারবার এই গন্ধমাদন পর্বত নিজের ঘাড়ে চাপাই। প্রতিবারই চেক-আউটে খোলা চাঁদে বেরুতে হয় আমাকে। ব্যস। তোমরা কিছু মনে না করলে আমি এখানে থেকেই টিভিতে সব দেখব।’

আজো কয়েকটা কুসংস্কারকে টেনে তোলা যায়নি। এখন আর স্পেসস্যুট কোনো গন্ধমাদন পর্বত নয়। কিন্তু সেসব বিজ্ঞানীর কেউ ব্যাপারটাকে বুঝতে পারবে না। প্রথম চান্দ্র অভিযানে যে জবরজঙ স্পেসস্যুট পরতে হয়েছিল তার তুলনায় আজকেরটা নস্যি। এগুলো গায়ে চাপাতে এক মিনিটও লাগে না। প্রয়োজন পড়ে না কারো সাহায্যের, এমনকি কোনো স্যুটতো অটোম্যাটিক। যে এম কে ফোরের ভিতর ফ্লয়েড নিজেকে এইমাত্র সিলগালা করে নিল সেটা চাঁদের চরম বৈরী পরিবেশ থেকেও তাকে বাঁচাবে নির্দ্বিধায়।

ডক্টর মাইকেলসের সাথে সে ঢুকে পড়ল এয়ারলকের ভিতরে। এবার, ছোট্ট বেসের শব্দ মিলিয়ে যেতেই নিজেকে সে আবিষ্কার করে চান্দ্র-শূন্যতার এক অসীম জগতে।

এই নীরবতায় চিড় ধরেছে তার স্যুট রেডিওর নাক-গলানো কথাবার্তায়।

‘প্রেশার ঠিক আছে তো, ডক্টর ফ্লয়েড? শ্বাস নিতে পারছেন ঠিকমতো?’

‘হ্যাঁ-একেবারে ঠিকমতো চলছে সবকিছু।’

অন্যদিকে মাইকেলস বাইরে থেকে সবকিছু দেখে নিয়ে বলে উঠল, ‘এবার যাওয়া যাক।’

আউটার ডোরটা খুলে যেতেই রুক্ষ প্রান্তর পৃথিবীর আলোয় উদ্ভাসিত হয়ে ওঠে। সামনে খোলা পথ।

লকের ভিতর দিয়ে বেশ কসরৎ করে ফ্লয়েড অনুসরণ করে মাইকেলসকে। কিন্তু আদৌ কসরতের কোনো প্রয়োজন নেই। হাঁটা একদম সহজ। কিন্তু এ স্যুট তাকে শুধু বাড়ি থেকে যোজন যোজন দূরত্বের কথাই মনে করিয়ে দেয়নি, বরং সময় থেকেও যেন এগিয়ে দিয়েছে অনেকটা। এর বাড়তি ওজনটা একটু হলেও পৃথিবীর বুকে ওজনের কথা মনে করিয়ে দেয়।

এক ঘণ্টার মধ্যেই আশপাশের দৃশ্য অনেক বদলে গেছে। চোদ্দদিনের চান্দ্র রজনী ফুরিয়ে গেছে প্রায়। করোনার দ্যুতি যেন মিথ্যা কোনো দৃশ্য। সবাইকে চমকে দিয়ে মাথার উপর শত ফুট উঁচু রেডিও মাস্টটা জ্বলতে শুরু করল লুকানো সূর্যের প্রথম আলোয়।

প্রজেক্ট সুপারভাইজার আর তার দুই চ্যালা এয়ারলকের ভিতর থেকে বেরুনোর আগ পর্যন্ত ফ্লয়েড আর তার সহকর্মীদের অপেক্ষায় ছিল। জ্বালামুখে পৌঁছতে পৌঁছতে এক অসীম ক্ষমতাধর সূর্য উঁকি দিল পুব দিগন্তের পেছন থেকে। ধীরে ঘোরা চাঁদের এপাশটায় সূর্যের উঠে আসতে আরো ঘন্টাখানেক লাগবে, এরি মধ্যে আকাশের তারারা হাপিস হয়ে গেছে।

জ্বালামুখ এখনো দিনের আলোর ছোঁয়া পায়নি, অভাবটা পুষিয়ে দিচ্ছে। চারপাশের ফ্লাডলাইটগুলো। ঢাল বেয়ে কৃষ্ণমূর্তির দিকে এগুতে এগুতে ফ্লয়েড শুধু অসহায় বোধ করেনি, একটু ভয়ও পাচ্ছে। হাস্যকর ব্যাপার। কিন্তু তার ভাবনা অন্য। এই রহস্যের সমা কোনোদিন মানুষ করতে পারবে? তিন মিলিয়ন বছর আগে কিছু একটা এখান দিয়ে গিয়েছিল। আর সে রহস্য এখনো স্থির, অবিচল। কীসের প্রতিক্ষায় আছে এটা?

চিন্তায় বাঁধা দিল স্যুট রেডিও, ‘প্রজেক্ট সুপারভাইজার বলছি, ডক্টর ফ্লয়েড, কয়েকটা ছবি তুলতে চাচ্ছি। একটু লাইন করে দাঁড়াবেন, প্লিজ? আপনি এই এখানটায়, মাঝখানে আসুন, ডক্টর মাইকেলস আসুন এদিকে…’

কেউ আশা করেনি ফ্লয়েড এখানেও মজার কিছু পাবে। কিন্তু যে ক্যামেরা এনেছে তার উপর সে মহাতুষ্ট। এ ছবি নিশ্চয়ই ঐতিহাসিক হবে। সে তাই দাঁত কেলিয়ে হাসি দিয়েই ক্ষান্ত থাকেনি, বরং ছবির কয়েকটা কপিও দাবী করেছে। আল্লা আল্লা করে হেলমেটের কাঁচের ভিতর দিয়ে চেহারা স্পষ্ট দেখা গেলেই হল।

‘থ্যাঙ্কস, জেন্টলমেন, বেসকে বলে দিব, সবাই কপি পাবেন।’

এবার ফ্লয়েড তার পুরো মনোযোগ দেয় নিরেট জিনিসটার উপর। পাক খায় চারধারে। তার মন কেন বোঝে না যে এরমধ্যে নতুন কিসসু পাওয়ার নেই। এ জিনিসের প্রতি বর্গ ইঞ্চি চষে ফেলা হয়েছে ইলেক্ট্রন মাইক্রোস্কোপ দিয়ে।

এবার শম্বুক গতির সূর্য দেখা দিল জ্বালামুখের উপরে। এর অকৃপণ কিরণধারার প্রথম ছোঁয়া বর্ষিত হচ্ছে কৃষ্ণগাত্রে। এখনো পুরো আলোটা যেন টেনে নিচ্ছে আলো খাদক জিনিসটা।

একটা ছেলেমানুষি পরীক্ষা করার জন্য ফ্লয়েড দাঁড়িয়ে যায় সূর্য আর টি এম এ ১ এর মাঝামাঝি। তার ছায়া কি পড়বে জিনিসটার গায়? এটা যেন সূর্যের দিকেই তাক করা। না, ছায়ার নামগন্ধও নেই। কমপক্ষে দশ কিলোওয়াট নগ্ন আলো পড়ছে স্ল্যাবের উপর। ভিতরে কিছু থেকে থাকলে সেটার কিছুক্ষণের মধ্যে একেবারে সেদ্ধ হয়ে যাবার কথা।

কী অবাক ব্যাপার, আজ ফ্লয়েড এখানে দাঁড়িয়ে আছে, আর ত্রিশ লাখ বছরের মধ্যে এ জিনিস সূর্যালোকে নেয়ে উঠেছে আজই প্রথমবারের মতো। পৃথিবীতে বরফ যুগ আসারও আগে এ জিনিস শায়িত ছিল ভূগর্ভে। কালো রঙটা একদম আদর্শ। আর সূর্যের আলো শুষে নেবার জন্যও উৎকৃষ্ট পথ। সাথে সাথেই নিজের চিন্তাটা বাতিল করে দিল ফ্লয়েড। এই ধারণা দিয়ে লোকহাসানোর কোনো মানেই নেই। কোনো ব্যাটা এত পাগল হয়েছে যে সৌর শক্তিতে চলা কোনো বস্তুকে বিশ ফুট মাটির নিচে দাবিয়ে রাখবে!

সে মুখ তুলে তাকায় পৃথিবীর দিকে। উপভোগ করে দিনের কিরণধারা। ছ বিলিয়ন মানুষের মধ্যে মাত্র মুষ্টিমেয় কয়েকজন এই অসাধারণ আবিষ্কারের খবর জানে। চূড়ান্ত খবরটা বেরুনোর পর পৃথিবীতে কী প্রতিক্রিয়া দেখা দেবে?

চিরকালীন সব ভাবনা কেমন দুলে উঠবে! মানুষ, তার রাজনীতি, তার সমাজনীতি, তার সবকিছু হয়ে উঠবে দোদুল্যমান। প্রত্যেকে, প্রত্যেক বুদ্ধিমান লোক, যে নিজের আশপাশে একটু হলেও তাকায় সে তার নিজের জীবন, মূল্যবোধ, দর্শন- সবই গোড়া থেকে কেঁপে উঠতে দেখবে প্রকটভাবে। এমনকি যদি তেমন কিছুই না পাওয়া যায় টি এম এ-১ থেকে, তবু এ এক অসীম রহস্য হয়ে টিকে থাকবে। মানুষ অন্তত এটুকু জানবে যে সেই একক বুদ্ধিমত্তা নয়। এ জিনিস চিরকাল মানুষের অসাধারণত্বের অহংবোধে খোঁচা দিয়ে যাবে। তারা সহস্র প্রজন্ম আগের হলে কী হবে, ফিরে আসতেও পারে। বিলুপ্ত হয়ে গেছে? ভালো, অন্য কেউ অবশ্যই থাকতে পারে অপার সৃষ্টিজগতের কোনো না কোনো কোণে। সারাটা ভবিষ্যৎ এই এক সম্ভাবনা বুকে নিয়ে বয়ে চলবে মানব সভ্যতাকে।

এসব ভাবনায় বেশ ডুবে ছিল ফ্লয়েড, কিন্তু এবারও বাগড়া দিল তার হেলমেট স্পিকার। অকল্পনীয় শক্তিশালী আর অপার্থিব শব্দ আসছে স্যুট হেলমেট থেকে। যেন চোখের সামনে কেউ চিরে দিল জগটাকে। শব্দটা অনেকটা ঘড়ির অ্যালার্মের মতো। সাথে সাথেই নিজের অজান্তে হেলমেটের উপর দিয়েই নিজের কানদুটো ঢেকে দেয়ার জন্য স্পেসস্যুট পরা হাত চেপে ধরে মাথার দুপাশে। এবার শব্দ কমানোর চেষ্টায় পাগলের মতো কোনো একটা সুইচ খুঁজছে ফ্লয়েড। দুলছে মাতালের মতো। একটু পরেই ক্ষমাসুন্দর নীরবতা নেমে এল চারদিকে। চারদিকের সবকিছু যেন স্তব্ধ হয়ে গেছে। রাক্ষসরাজ সোনার রথে চড়ে যাবার সময় পাথর করে দিয়ে গেছে আর সবাইকেও। তার মানে, আমার স্পেসস্যুটে কোনো সমস্যা হয়নিভাবে ফ্লয়েড। সবাই শব্দটা শুনেছে।

আর, ত্রিশ লক্ষ বছরের অমানিশা পার করে টি এম এ-১ স্বাগত জানালো।

স্বাগত জানালো চান্দ্র সূর্যোদয়কে।

অধ্যায় ১৪. শুনেছে যারা

শনির দশ কোটি মাইল পেছনের শীতল একাকিত্বে, যেখানে কোনো মানুষ কোনোদিন যায়নি, সেখানে ডিপ স্পেস মনিটর সেভেন্টি নাইন ধীর লয়ে ঘুরে চলেছে অস্টেরয়েড গ্রহাণুপুঞ্জের বেল্টের এবড়োখেবড়ো অবিটে। আপন মনে। তিন বছর ধরে এটা বেশ দক্ষতার সাথে আমেরিকান ডিজাইনার উদ্ভাবকদল, ব্রিটিশ নির্মাতা দল আর রাশিয়ান উৎক্ষেপণ বিজ্ঞানীদের সাফল্য ঘোষণা করছে। অ্যান্টেনার নাদুস-নুদুস জাল ছড়িয়ে থাকে এর চারপাশে। এগুলো সর্বক্ষণ চারদিকের সব বেতার তরঙ্গ, ভাঙনের শব্দ আর হিসহিসানি গলাধকরুণ করে। এই হিসহিসানিকেই অনেক বছর আগে প্যাস্কেল[২৭] বলেছিলেন ‘অসীম মহাকাশের নীরবতা’। গ্যালাক্সি বা আরো দূর থেকে আসা কসমিক রশিকে রেডিয়েশন ডিটেক্টরগুলো সব সময় রিসিভ ও অ্যানালাইজ করে। নিউট্রন আর এক্স রে টেলিস্কোপের দঙ্গল সব সময় এমন সব তারার উপর নজরদারি করে যেগুলো মানুষের চোখ দেখতে পায়নি কোনোকালে। ম্যাগনেটোমিটারগুলো সৌর বাতাসে হ্যারিকেনগুলোর ঘণ্টায় হাজার মাইল গতির বিশাল বিস্ফোরণ ঘটনা প্রত্যক্ষ করে। দেখে নেয় সে সময়ে ঝড়ের মাঝখানে প্লাজমার ভয়াল খেলা। এই সব সহ আর যা ঘটে, তার সবকিছুর দিকেই ডিপ স্পেস মনিটর সেভেন্টি নাইন তার অক্লান্ত চোখ রেখেছে। সবটুকুই ক্রিস্টালাইন মেমোরিতে স্থান পায়।

এরই এক অ্যান্টেনা সর্বক্ষণ খেয়াল রাখে দূরপ্রান্তে, সূর্যের কাছাকাছি। পৃথিবীর বুকে প্রতি চব্বিশ ঘণ্টা অন্তর একটা করে পাঁচ মিনিটের রেডিও পালস সম্প্রচারিত হয়। ইলেক্ট্রিক মনিটর সারাক্ষণ যা দেখে তাই সংক্ষিপ্ত আকারে পাঠিয়ে দেয়। আলোর গতিতে পনের মিনিট চলে তরঙ্গটা, পৌঁছে যায় ঠিকানামতো। সেখানকার মেশিন আর মেশিনম্যানরা তীর্থের কাকের মতো অপেক্ষায় থাকে। তারপরই এমপ্লিফাই করে নেয় তথ্যটুকু। রেকর্ড হয়ে যায় হাজার হাজার মাইল লম্বা ম্যাগনেটিক টেপের গায়। টেপগুলো আছে ওয়ার্ল্ড স্পেস সেন্টার (ডব্লিউ এস সি) এর ওয়াশিংটন, মস্কো আর ক্যানবেরার শাখাগুলোয়। আর মানুষের দুনিয়াবী যন্ত্র এ সব ব্যাপার নিয়ে চর্বিতচর্বণ চালাতে থাকে।

প্রথম স্যাটেলাইট বসানো হয় প্রায় পঞ্চাশ বছর আগে। ট্রিলিয়ন ট্রিলিয়ন, কোয়াড্রিলিয়ন কোয়াড্রিলিয়ন ইনফরমেশন পালস স্পেস থেকে অঝোর ধারায় ঝরছে সে সময় থেকেই। একটাই উদ্দেশ্য, মানুষের জ্ঞানটাকে আরেকটু এগিয়ে দেয়া। এসব বস্তাবন্দি জ্ঞান নিখুঁতভাবে দেখা হয়, তা না। এক মুহূর্তের কোনো বিশেষত্ব স্যাটেলাইটের চোখে পড়লেই যে তা মানুষের চোখে পড়বে, এমন নিশ্চয়তাও দেয়া যায় না। কিন্তু দশ, পঞ্চাশ বা শত বছর পর এ ডাটা কী কাজে লাগবে তা হয়তো এখন কল্পনা করাও অসম্ভব। সুবিশাল, প্রান্তহীন এয়ার কন্ডিশন্ড গ্যালারিতে তাই সারি সারি করে সব তথ্য জমা রাখা হয় পরম যত্নে। প্রতিটি তথ্যকে তিন কপি করে দেয়া হয় তিন সেন্টারে, নষ্ট হবার সম্ভাবনাকে পিছিয়ে দেয়া হয় আর একটু। এ হল পৃথিবীর সবচে দামী রত্ন, সমস্ত ব্যাংকের অযুত-নিযুত ভল্টে পড়ে থাকা অকর্মা সোনার তৃপের চেয়ে এর মূল্য অনেক বেশি।

আর এখন, ডিপ স্পেস মনিটর সেভেন্টি নাইন কোনো এক অদ্ভুতুড়ে ব্যাপার লক্ষ্য করে ঘাবড়ে দিল সবাইকে। এক ক্ষীণ কিন্তু স্পষ্ট বিশৃঙ্খলা সৌর জগতের এ প্রান্ত থেকে সে প্রান্তে ছুটে যাচ্ছে। অতীতে কখনোই এমন অদ্ভুত ব্যাপার দেখা যায়নি। স্বয়ংক্রিয়ভাবে এটার দিক, সময়, প্রবণতা-সবকিছুই রেকর্ড করে নিয়েছে। আর কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই খবরটা পৃথিবীতে পৌঁছে যাবে।

অরবিটার এম ফিফটিন দিনে দুবার মঙ্গলকে চক্কর দেয়। সূর্যের পথে ঘুরে চলছে হাই ইনক্লাইনেশন প্রোব টুয়েন্টি ওয়ান। ওদিকে পুটোরও পেছনে শীতল আবর্জনার মাঝে বিচরণরত কৃত্রিম উপগ্রহের নাম আর্টিফিশিয়াল কমেট ফাইড। এটা এত বিশাল অর্বিট ধরে ঘুরছে যেটা একবার ঘুরে শেষ করতে তার হাজার বছরেরও বেশি সময় প্রয়োজন। সবাই এই অতি কিম্ভুত শক্তি-বিস্ফোরণ দেখতে পেয়েছে। এ শক্তিধারা সেসব মহাকাশ দানোর কারো কারো কলকজায় নাকও গলিয়েছে। সব্বাই নিজ নিজ খবর সময়মতো স্টোর করে রাখবে পৃথিবীর বুকে, তিনটি সেন্টারে।

কম্পিউটারগুলো হয়তো কখনোই চার দূরবর্তী স্পেস-প্রোবের ব্যতিক্রমী তথ্য পাচারকে আলাদা হিসেবে ধরতে পারবে না। কিন্তু সকালে চিরাচরিত রুটিনে চোখ বুলাতে গিয়েই গদারের রেডিয়েশন ফোর্সকাস্টার বুঝতে পারল গত চব্বিশ ঘণ্টার কোনো এক সময় সৌর জগতের মাঝে কিম্ভুত কিছু একটা ঘটে গেছে।

সে শুধু এর পথনির্দেশের সামান্য অংশ বুঝতে পেরেছে। কম্পিউটার এ পথকে প্ল্যানেট সিচুয়েশন বোর্ডের উপর স্থাপন করতেই দেখা গেল মেঘহীন আকাশে স্পষ্ট একটা চিকণ মেঘরেখা। কিংবা বলা যায় কোনো কুমারী বরফভূমিতে একদল অবাঞ্ছিত মানুষের পায়ের চিহ্ন পড়েছে। এনার্জির কোনো এক অবস্তুগত আকৃতি। যেন কোনো গতিময় স্পিডবোট থেকে ছলকে উঠছে রেডিয়েশন। এর শুরু চাঁদের মুখে।

শেষ তারার দেশে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *