১. প্রচীন রাত্রি

প্রথম পর্ব – প্রচীন রাত্রি

অধ্যায় ১. ধ্বংসের পথ

এবারের অনাবৃষ্টি চলল কোটি বছর ধরে; এরও অনেক আগেই চারপেয়ে সরীসৃপ[১] সাম্রাজ্যের হয়েছে পতন। এই নিরক্ষীয় অঞ্চলটা অনেক অনেক পরে নাম পাবে আফ্রিকা। এই এখানে, অস্তিত্বের লড়াই পেয়েছে নিষ্ঠুরতার এক নতুন মাত্রা; কিন্তু আজো অস্তিত্ব-বিজয়ীর দেখা নেই। শূন্য, খটখটে মাটিতে একদম ছোট নয়তো একেবারে গতিময় নাহয় পুরোপুরি নির্দয়েরাই পারত বিবর্তনের ফুল ফোঁটাতে। বড়জোর দেখতে পেত বাঁচার ক্ষীণ আশা।

দিগন্তজোড়া তৃণভূমির বনমানুষেরা এসব বৈশিষ্ট্যের কোনোটা নিয়েই জন্মায়নি। তাই পারেনি বসুধাকে পুস্পিত করে তুলতে। এরই মধ্যে প্রজাতিগত অস্তিত্বের দৌড়ে পড়ে গেছে অনেক অনেক পেছনে। তাদের জনাপঞ্চাশেকের একটা দল একসারি গুহা দখল করে বসেছিল। গুহাটার পাশে জ্বলে পুড়ে খাক হওয়া এক উপত্যকা। ভ্যালিটাকে দুভাগ করেছে শামুক-গতির এক ছোট্ট উষ্ণ প্রসবণ। উত্তরে পাহাড়ের তুষার গলে যায়; দু’শ কিলোমিটার সর্পিল পথ পাড়ি দিয়ে নালাটা আসে এখানে। দুঃসময়ে প্রসবণটা উবে যেত একদম, গোটা জীবন টেনে চলত তৃষ্ণার ছায়ায় পিছলে গিয়ে।

এ উপজাতি চিরদিনই ক্ষুধার্ত ছিল, আজ তারা না খেয়ে মরতে বসেছে। সূর্যোদয়ের প্রথম ক্ষীণ আলোকমালা হামাগুড়ি দিয়ে ঢুকতে চাচ্ছে গুহার বুকে-এমন সময় চন্দ্র-দর্শী দেখে তার বাবা মরে পড়ে আছে রাতের আঁধারে। সে জানত না যে চির-বুড়োই তার বাবা। এসব সম্পর্ক তার উপলব্ধির অনেক অনেক ঊর্ধ্বে। তবু সেই শুকনো শরীরটা দেখে একটু স্তব্ধ হয়ে যায়; এ অনুভূতিটা পরে নাম পাবে, কষ্ট।

দু’বাচ্চা এর মধ্যেই চেঁচাতে শুরু করেছে অন্নাভাবে। কিন্তু চন্দ্র-দর্শী মুখ ব্যাদান করে তাকাতেই তারা থেমে যায়। মায়েদের একজন দুধের বাচ্চাগুলোর পক্ষ নিল। মা বনমানুষীটা তাদের খাওয়াতেও পারেনি। কিন্তু মা-তো, তাই চন্দ্র-দর্শীর ধমকের জবাবে এক রাগ-ধরানো ভেঙচি কেটে দেয়। এই দু:সাহসের জবাব দেয়ার শক্তিও নেই পুরুষ বনমানুষ চন্দ্র-দর্শীর।

এবার যাবার মতো আলো এসেছে। গুহার ছাদ নিচু, তাই মাথা হেঁট করে চন্দ্র-দর্শী কুঁকড়ে যাওয়া লাশটা তুলে নিল। টেনে চলল নিজের পেছনে পেছনে। বাইরে বেরুতে পেরেই সে কাঁধের উপর শরীরটাকে ছুঁড়ে ফেলে দু-পায়ে সোজা হয়ে দাঁড়ায়-এ ভুবনে একমাত্র প্রাণী, যে একাজটা করতে পারে।

নিজেদের মধ্যে চন্দ্র-দর্শী ছিল এক দৈত্য। লম্বায় প্রায় পাঁচ ফুট, অপুষ্টিতে জীর্ণ হলেও শত পাউন্ডের বেশি তার ওজন। ওর রোমশ পেশীবহুল শরীরটা মানুষ আর বানরের মাঝামাঝি। কিন্তু মাথাটা বনমানুষের চেয়ে মানবের দিকেই বেশি ঝুঁকে যায়। কপাল ততটা উঁচু নয়, অক্ষিকোটরের মধ্যে উঁচু ভাঁজ দেখা দিয়েছে; মানবতার বার্তা সে নির্ভুলভাবে বয়ে চলেছে নিজের জিনে। প্লেইস্টোসিন যুগের নির্দয় দুনিয়ার দিকে তাকাচ্ছে সে। তার অপলক দৃষ্টিতে এমন কিছু ধরা পড়ে যা আর কোনোদিন কোনো বনমানবের দৃকপাতে উঠে আসেনি। সেই কালো, গহীনে তলিয়ে যাওয়া চোখগুলোতে ভাসা-ভাসা একটু সচেতনতা খেলে যাচ্ছে-এটাই বুদ্ধিমত্তার প্রথম ঝলক যা হয়তো জন্ম-জন্মান্তরেও শিখার মতো জ্বলে উঠবে না; হয়তো কিছুদিনের মধ্যেই তলিয়ে যাবে বিলুপ্তির অতলে।

বিপদের কোনো চিহ্ন নেই, তাই চন্দ্র-দর্শী গুহামুখের প্রায় খাড়া ঢালটা বেয়ে হাচড়েপাঁচড়ে যেতে থাকে; বোঝাটা তেমন কোনো সমস্যা নয়। বাকীরা যেন এই সংকেতের আশায়ই বসে ছিল। সকালের জলপানের জন্য সাথে সাথে বেরিয়ে গিয়ে এগুতে থাকে সেই কাদাপানির নালাটার দিকে।

চন্দ্র-দর্শী উপত্যকার অন্যপ্রান্তে দৃষ্টি ফেলে-যদি অন্যদের দেখা যায়; কিন্তু ওদের মাথার টিকিটারও দেখা নেই। হয় এখনো নিজেদের গুহা ছাড়েনি নয়তো ছুঁড়ে বেড়াচ্ছে পাহাড়ের দূরপ্রান্তগুলো। কোথাও দেখা না যাওয়ায় চন্দ্র-দর্শী ভুলে যায় তাদের কথা; একসাথে একাধিক ব্যাপারে চিন্তা করতে সে আজো শেখেনি। তার মস্তিষ্কই অন্যরকম।

প্রথমেই তাকে চির-বুড়োর হাত থেকে রক্ষা পেয়ে হাঁফ ছেড়ে বাঁচতে হবে। কিন্তু এ সমস্যা নিয়ে ভাবতে হয় এক-আধটু। এ মরসুমে অনেক মৃত্যু এসেছে, একটা তার নিজের গুহাতেই; তার মানে তাকে লাশটা সেখানেই ফেলে আসতে হবে যেখানে ফেলে এসেছে নতুন-শিশু কে আকাশের চাঁদটার শেষভাগ বাকী থাকতে। বাকী কাজ সারবে হায়েনার দল।

এক জায়গায় এসে ছোট্ট উপত্যকাটা মিশে গেছে দিগন্তবিস্তৃত চারণক্ষেত্রের সাথে। হায়েনারা এর মধ্যেই প্রতীক্ষা শুরু করে দিয়েছে সেখানে। তার আসার কথা জানতে পেরেই ওরা অপেক্ষা করছে। চন্দ্র-দর্শী একটা ছোট্ট দেখে ঝোঁপের কাছে লাশটা ফেলে রেখে তড়িঘড়ি করে ফিরে যায় গোত্রের বাকীদের সাথে যোগ দিতে। আগের সব হাড়গোড় এর মধ্যেই হাওয়া হয়ে গেছে। আর কোনোদিন নিজের বাবার কথা চন্দ্র-দর্শীর মনে পড়বে না।

সে, তার দু সাথী, অন্য গুহাগুলোর বয়েসীরা আর সব নবীন মিলে খাবার খুঁজে ফিরছিল খরায় শুকিয়ে যাওয়া গাছগুলোর আশপাশে। জায়গাটা উপত্যকার উপরদিকে। গুটি-গুটি ফল আর টসটসে লতাপাতা তাদের আরাধ্য। শিকড়বাকড় নাহয় হঠাৎ ভাগ্যে ঘটে যাওয়া গিরগিটি-ইঁদুর জাতীয় প্রাণীও তারা খোঁজে। একদম বাচ্চা আর অচল বুড়োদেরই শুধু গুহায় রেখে আসা হয়। যদি সারাদিনের চষে বেড়ানোর পর এক-আধটু খাবার বেঁচে যায় তো গুহায় ফেলে আসা বাকীদের খাদ্য পাবার সম্ভাবনা আছে। তা নাহলে হায়েনাদের কপালে শীঘ্রই আবারো ভালো কিছু জুটবে।

আজকের দিনটা ভালই-কিন্তু চন্দ্র-দর্শীর কোনো অতীত স্মৃতি নেই; এক সময়ের সাথে অন্যটার তুলনা সে করতে জানে না। এক মরা গাছের গোড়ায় মৌচাক পেয়ে গেল। সবচে মজার স্বাদটা নিতে পারবে ওরা এবার। ওর গোত্র এরচে সুস্বাদু কিছু চেনে না। শেষ বিকেলে দলটাকে ঘরে তাড়িয়ে নিতে নিতেও নিজের আঙ্গুলগুলো সে চেটে চলে বেখেয়ালে। অবশ্যই, বেশ ভালো পরিমাণে হুলের গুতো জুটেছে ওর কপালে; কিন্তু সেসময়ে ও এগুলোকে থোড়াই পরোয়া করত। এখন তার খিদে মোটামুটি তৃপ্তির দিকে হেলে পড়েছে, এরচে বেশি ক্ষুন্নিবৃত্তি কোনোকালে হয়নি-এখনো সে ক্ষুধার্ত হলেও আর খিদেয় কাহিল হওয়ার জো নেই। এই আধপেটা খাওয়াটাই কোনো বনমানুষের সারা জীবনে হাসিল করার মতো একমাত্র উদ্দেশ্য।

নালার কাছে যাবার সাথে সাথে তৃপ্তি উধাও হয়ে যায়। ওপাশে অন্যেরা। ওরা প্রতিদিনই সেখানে থাকে, কিন্তু বিরক্তির কিছুমাত্র কমে না কোনোদিন।

দলটায় ত্রিশজন। কিন্তু চন্দ্র-দর্শীর দল থেকে খুব একটা আলাদা বলে মনে হয় না। এ গোত্রটাকে আসতে দেখেই ওপাশের ওরা উদ্বাহু নৃত্য শুরু করে। হাত ঝকায়, নিজেদের পাশের নালার মাটিতে আঘাত করে চলে। এপাশের ওরাও একই কায়দায় জবাব দেয়।

শুধু একুটুই হয়। কালেভদ্রে বনমানুষেরা একে অন্যের সাথে লড়ে, কুস্তি করে। তাদের খুনসুটিতে দুর্ঘটনা ঘটে খুব কমই। কোনো নখর নেই, নেই তীক্ষ্ণ দাঁত। তার উপর শরীর জুড়ে আছে প্রতিরক্ষার ভারি লোম। একে অন্যের তেমন কোনো ক্ষতিই করতে পারে না। যেভাবেই বলা হোক না কেন, এ ধরনের অনুৎপাদনশীল কাজে খরচ করার মতো বাড়তি শক্তি তাদের থাকে খুবই কম। তর্জনগর্জনই তাদের সার। শুধু নিষ্ফল আক্রোশ দেখানোর কাজটা নিরাপদ আর সুন্দর।

যুদ্ধংদেহী ভাব চলল পাঁচ মিনিটের মতো, তারপরই যেমন হঠাৎ শুরু হয়েছে তেমন করে শেষ হয়ে যায় প্রদর্শনী। শেষে প্রত্যেকে পেটপুরে শুষে নেয় কাদাজল। জরুরী কাজ শেষ। আত্মা শান্তি পেয়েছে, এবার যার যার পথ ধরে তারা। গুহা থেকে মাইলখানেক দূরে সবচে কাছের চারণভূমি, সেটাকে ভাগাভাগি করে নিতে হবে বিশালদেহী অ্যান্টিলোপের মতো জানোয়ারের সাথে। সেসব জন্তু পরোয়া করে ওদের থাকা-না থাকাকে। প্রাণীগুলোকে সরিয়ে দেয়া যায় না, কারণ ওরা মাথায় ভয়াবহ ভোজালী-তলোয়ার নিয়ে রণসজ্জায় সজ্জিত। এই শিংয়ের মতো প্রাকৃতিক সম্পদ বনমানুষদের নেই।

তাই চন্দ্র-দর্শী আর ওর সব সাথী মিলে চিবিয়ে বেড়ায় বেরী, শুকনো ফল আর লতাপাতা; তীব্র জ্বালার সাথে যুদ্ধ করে চলে। অথচ তাদের চারপাশের এসব প্রতিযোগীর সাথে ভাগজোখ করে তৃণ খেয়ে বেড়ানোর কথা না। সেসব প্রাণীই হতে পারত অফুরান, অকল্পনীয় খাদ্যের নিশ্চিত ভাণ্ডার। এই এখনো চারণভূমিতে চড়ে বেড়াচ্ছে হাজার হাজার টন সুস্বাদু মাংসের উৎস কিন্তু এ গোস্তের তালকে নিজের মনে করার কাজ শুধু তাদের জন্য অসম্ভবই নয়, অকল্পনীয়। প্রাচুর্যের ভেতর ডুবে থেকেও ওরা তলিয়ে যাচ্ছে মৃত্যু আর অবলুপ্তির অতল গহ্বরে।

গোধূলীর আলোয় তেমন কোনো ঘটনা ছাড়াই গোত্রটা ফিরে এল গুহার দিকে। আহত যে বুড়ো বনমানুষীটাকে ওরা ছেড়ে গিয়েছিল সেটা তৃপ্তির মৃদু শব্দ তলে। কারণ চন্দ্র-দর্শী একটা বেরীভর্তি ডাল এগিয়ে দিয়েছে। বনমানুষীটা সাথে সাথে ঝাঁপিয়ে পড়ে ওটার উপর। এখান থেকে খুব কম পুষ্টিই জুটবে কিন্তু এটুকুই ওকে বেচে থাকতে সাহায্য করবে। সহায়তা করবে চিতার আঘাত থেকে সেরে উঠতে, আবার খাদ্যের খোঁজে যেতে।

উপত্যকার ওপাশ থেকে উঠে আসে পূর্ণিমার চাঁদ, কোন্ দূরের পাহাড় থেকে নেমে এসে হিম-হিম বাতাস বয়ে যায়। আজ রাতে দারুণ ঠাণ্ডা পড়তে পারে, কিন্তু খিদের মতো শীতও তেমন কোনো বাস্তব উদ্বেগের কারণ নয়; এ হল জীবনের পেছনে চিরায়ত চিত্রপট।

নিচের দিকের কোনো গুহা থেকে হুংকার আর আর্তনাদ ভেসে আসছে দেয়ালে দেয়ালে ধাক্কা খেয়ে। চন্দ্র-দর্শী স্থির চোখে তাকিয়ে থাকে। এখন আর চিতার সেই মাঝেমধ্যে শোনা গর্জনের জন্য ওর অপেক্ষা করার দরকার নেই। ও ঠিক ঠিক জানে কী হচ্ছে সেখানে। সাদা চুলের বুড়ো আর ওর পরিবার লড়তে লড়তে মারা পড়ছে। সাহায্যের চিন্তাটা কখনোই চন্দ্র-দর্শীর মাথায় আসে না; বেঁচে থাকার নগ্ন নিয়মগুলো এতই কঠিন। পুরো পাহাড়ের কোথাও প্রতিবাদের একটা চিৎকার প্রতিধ্বনি ওঠে না। প্রত্যেক গুহাতেই মরণ-নিস্তব্ধতা, নয়তো চেঁচামেচি করলে নিজের গিরিগর্তটাও আক্রান্ত হতে পারে।

অনিশ্চয়তা কেটে গেছে। পাথরের উপর দিয়ে শরীর টেনে নেয়ার শব্দ শুনতে পায় চন্দ্র-দর্শী। মাত্র কয়েক মুহূর্ত পরেই চিতাটি নিজের শিকার উপভোগের মতো উপযুক্ত জায়গা পেয়ে গেল। এ কাজে তেমন শক্তি ব্যয় হয় না। নিরবতায় চিড় ধরে না। সহজেই বাঘটা নিজের চোয়ালে ঢুকিয়ে দিতে পারে শিকারকে।

আরো দু-চারদিন এখানে ঝুঁকি থাকবে; কিন্তু আরো শত্রু থাকতে পারে আশপাশে যারা এই শীতল, ফ্যাকাশে, নিশি-সূর্যের সুযোগ নিতে চায়। ঠিকমতো সবাই জানতে পারলে চেঁচামেচি করে ছোট শিকারীগুলোকে দূরে সরিয়ে রাখতে পারে। হামাগুড়ি দিয়ে চন্দ্র-দর্শী বেরিয়ে আসে, উঠে যায় প্রবেশ পথের একটা পাথরের উপর। সেখান থেকেই নজর রাখে উপত্যকায়।

সব যুগে, সব কালে পৃথিবীর বুকে এগিয়ে চলা সব প্রাণীর মধ্যে বনমানুষেরাই প্রথম চাঁদের দিকে আগ্রহ নিয়ে মূর্তির মতো চেয়ে থাকতে শিখেছে। তার মনে নেই, যখন ছোট ছিল তখন প্রায়ই পাহাড়ের পেছন থেকে ওঠা এই ভৌতিক অবয়বটাকে ধরার জন্য হাত বাড়াতো।

ও কখনোই সফল হয়নি। আর আজতো ব্যাপারটা বোঝার মতো যথেষ্ট বড়। রাতের সূর্যকে ধরতে হলে প্রথমে অবশ্যই ওকে বিরাট কোনো গাছ বেয়ে উঠে যেতে হবে।

সময় সময়ে সে খুঁটিয়ে দেখত ভ্যালিটাকে। দেখত আকাশের চাঁদ। কিন্তু সব সময় আর একটা কাজ করত-তা হল খেয়াল দিয়ে শোনা। দু-চারবার ছাড়া সর্বদা সে ঘুমায় টান-টান স্নায়ুকে জাগিয়ে রেখে। খরকুটো পতনের শব্দও তাকে বিরক্ত করার জন্য যথেষ্ট। পঁচিশ বছরের মতো বয়সেও সবটুকু ক্ষমতার উপর দখল ধরে রেখেছে নিজে। ওর ভাগ্য সহায় হলে, দুর্ঘটনা এড়িয়ে যেতে পারলে, রোগ-ব্যাধি শিকারী-ক্ষুধাকে ঠেলে দূরে সরিয়ে রাখতে পারলে আরো বছরদশেক বেঁচে থাকবে।

রাত নেমেছে। শীতল, স্বচ্ছ, বেপরোয়া। আর কোনো বিপদসংকেত নেই। চাঁদ উঠে এসেছে ধীরে ধীরে নিরক্ষীয় এলাকার পেছন থেকে। অপরূপ এ দৃশ্য কোনো মানুষের চোখ কোনোদিন দেখতে পায়নি। আর পর্বতের গর্তগুলোয় বাধা পাওয়া ঘুম এবং ভয় ধরানো প্রতীক্ষার মাঝেও জন্ম না নেয়া প্রজন্মের দু:স্বপ্নেরা জন্ম নেয়।

এদিকে দ্বিতীয়বারের মতো আকাশের একপাশ থেকে আরেক পাশে যাবার সময় ঠিক মাথার উপর দিয়ে পূর্ব দিকে এগিয়ে চলে একটা কিছু। জ্বলজ্বলে এক আলোর বিন্দু। যে কোনো তারার চেয়ে অনেক বেশি আলোময়।

অধ্যায় ২. নব্য প্রস্তর

রাত, ফুরনোর আগেই অকস্মাৎ সচকিত হয়ে জেগে ওঠে চন্দ্র-দর্শী। সারাদিনের ধকলের পর আজ একটু বেশিই পড়ে-পড়ে ঘুমাচ্ছিল সে। উপত্যকার পথ ধরে প্রথম মৃদু ধ্বনি ওর কানে পৌঁছে যায়।

গুহার পুতিগন্ধময় আঁধার পরিবেশে উঠে বসে সে। নিজের সবটুকু অনুভূতিকে ফিরে পেতে কসরৎ করে, তারপর আচমকা ওর মনের সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠতে থাকে আতঙ্ক। ওর বয়স এর মধ্যেই গোত্রের বাকীদের আকাঙ্ক্ষার জীবদ্দশা থেকে দ্বিগুণ। এত দীর্ঘ জীবনেও সে কক্ষনো এমন অলুক্ষনে শব্দ শোনেনি। বিড়াল গোষ্ঠীর বড় প্রাণীগুলো নিরবে উঠে আসে। ওদের ধোকা দেয়ার সাধ্য শুধু ভূমিকম্পেরই আছে। মাঝেমধ্যে ডালপালার ভেঙে পড়ার শব্দও শোনা যায়। অথচ এ আওয়াজ ক্রমাগত ভাঙনের মতো। ধীরেসুস্থে আরো প্রবল হচ্ছে। গায়-গতরে বিশাল কোনো প্রাণী যেন রাতের বেলা ঘুরে বেড়াচ্ছে নিজেকে গোপন করার কোনো চেষ্টা না করেই। বেপরোয়া। একবার চন্দ্র-দর্শী ঝোঁপঝাড় উপড়ে ফেলার শব্দ পেয়েছিল ঠিক ঠিক। এসব অকাজ হাতি আর ডায়নোথেরিয়ারা[৪] মাঝেমধ্যেই করে বসে। কিন্তু অন্য সময় তারাতো একদম বেড়ালের মতো নিঃশব্দ।

এবার এমন এক শব্দ আসে যেটা চন্দ্র-দর্শী চিনতে পারেনি। কারণ এর আগে পৃথিবীর ইতিহাসে কখনো ওঠেনি এমন আওয়াজ। পাথুরে জমির বুকে ধাতব জিনিসের আছড়ে পড়ার শব্দ এটা।

ভোরের প্রথম আলোয় নিজের উপজাতি নিয়ে নিচের তটিনীর দিকে এগিয়ে যাওয়ার সময় প্রথমবারের মতো চন্দ্র-দর্শী নতুন পাথর এর মুখোমুখি হয়। রাতের বীভৎস ভয়ের কথা এর মধ্যেই বেমালুম গায়েব হয়ে গেছে মন থেকে, কারণ সেই শব্দের পরপর কোনো কিছু হয়নি। তাই সে এই অদ্ভুতুড়ে জিনিসের সাথে বিপদ বা ভয়ের কোনো সম্বন্ধ পাতানোর চেষ্টাই করে না। হাজার হলেও, এ নিয়ে সতর্ক হবার মতো কিছু পাওয়া যায়নি।

জিনিসটি চৌকো আর নিরেট। লম্বায় চন্দ্র-দর্শীর চেয়ে কম করে হলেও তিনগুণ, তবে প্রস্থের হিসাবে দু-হাতে আটকে দেয়া যাবে। জিনিসটা একেবারেই স্বচ্ছ কোনোকিছুতে তৈরি। এর প্রান্তগুলোয় সূর্যালোক পড়ে ঠিকরে না বেরুলে অস্তিত্ব বোঝা যেত না। চন্দ্র-দর্শী জীবনেও বরফের মুখোমুখি হয়নি। দেখেনি স্ফটিক স্বচ্ছ জল। কোনো প্রাকৃতিক জিনিসের সাথেই এই ভুতুড়ে গড়নের তুলনা চলে না। হঠাৎই যেন খুব আকর্ষণীয় মনে হয় তার কাছে। ও যথেষ্ট সতর্ক। তবু এর চারপাশে ঘুরে বেড়াতে তেমন সময় নেয় না। যেন কিছুই হয়নি। হাত রাখে এর গায়। ঠাণ্ডা আর শক্ত একটা উপরিতল অনুভব করে সে।

কয়েক মিনিটের ইতস্তত ভাবনার পর এক দারুণ সমাধান মাথায় চলে এল। এটা এক পাথর, অবশ্যই পাথর। জন্মেছে রাতের মধ্যেই। অনেক গাছই এমন সব কাণ্ড করে বসে। সাদা, ফলের কাছাকাছি আকৃতির জিনিসগুলো রাতের প্রহরে প্রহরেই গজিয়ে ওঠে। কথা সত্যি, ওগুলো অনেকটাই ছোট, দেখতে গোলপানা। এদিকে এটা বিরাট আর প্রান্তগুলো ধারালো। হায়, চন্দ্র-দর্শীর অনেক পরের আরো বড় বড় দার্শনিক বিশাল বিশাল সব তত্ত্ব নিয়ে এর সামনে হাজির হলেও বোধ হয় একইভাবে বিনা সমাধানে আহত হয়ে ফিরে যাবে।

এই অসাধারণ চিন্তাই চন্দ্র-দর্শীকে পরের তিন-চার মিনিটের মধ্যে এক যুগান্তকারী কাজে প্রবৃত্ত করল। শিঘি এর স্বাদ নিয়ে নেয়া ভালো। পাথরের মতো দেখতে সেসব সাদা গোলগাল গাছ খেতে ভারি মজা (অবশ্য দু-চারটে এমনও মিলে যায় যা অসুখ দিয়ে কাবু করে তোলে); যতটুকু বোঝা যায়, এই লম্বাটাও…?

দু-চারবার চেটে নিয়ে কামড়াতে গিয়েই ও মিথ্যা আশার প্রহেলিকা থেকে মুক্তি পেল। এখানে কোনো পুষ্টির চিহ্নও নেই। সুতরাং একজন সজ্ঞান বন মানবের মতো সে নিজের দল নিয়ে নদীর দিকে এগিয়ে যায়। অন্যদের দিকে চেয়ে নর্তনকুর্দনের পবিত্র দায়িত্বটা পালনের সময় ভুলে যায় স্ফটিক স্বচ্ছ একশিলার সবটুকু কথা।

আজকের খোঁজাখুজি একদম বৃথা। কোনোমতে এক-আধটু খাবার যোগাড় করতে তাদের চষে বেড়াতে হয় গুহা থেকে দূরের বেশ কয়েক মাইল এলাকা। দুপুরের নির্দয় রোদে এক হাড্ডিসার বনমানবী ভেঙে পড়ে। যে কোনো সম্ভাব্য আশ্রয় থেকে অনেক দূরে তারা। চারদিকে জড়ো হল সাথীরা। অবোধ শোকের শব্দ করল। এটুকুই, এরচে বেশি কিছু করার নেই কারো। আর একটু কম পথশ্রান্ত হলেই নিজেদের সাথে বয়ে বেড়াতে পারত। কিন্তু এত বড় দয়া দেখাবার মতো শক্তির যোগান নেই ওদের। তাকে ফেলেই এগুতে হবে। খাদ্য পেয়ে উঠে না এলে নিজের বাকী সম্বলটুকুও খাবারে পরিণত হবে।

বাড়ি ফেরার পথে সে জায়গাটা ওরা পেরিয়ে যায়। সন্ধ্যাবেলা একটা হাড়ও খুঁজে পাওয়া যায় না।

দিবসের শেষ আলোয় দলটা আগের পানি-শিকারীদের খোঁজে ইতিউতি তাকাতে তাকাতে তড়িঘড়ি করে পানিতে গলা ভিজিয়ে নিয়ে নিজেদের গুহাপথে ফিরে যেতে শুরু করে। কিম্ভুত শব্দটা শুরুর সময় ওরা নতুন পাথর থেকে শত কদম দূরেই ছিল।

স্পষ্ট শোনা যায়। বজ্রাহতের মতো স্তব্ধ হয়ে যায় ওরা। যেন অসাড়ত্ব সারা শরীরকে দখল করে নিয়েছে। যার যার পথেই চোয়াল ঝুলিয়ে দাঁড়িয়ে পড়ে। একটা সাধারণ, উন্মাদনাময় তরঙ্গ ছড়িয়ে পড়েছে ক্রিস্টাল থেকে। এর জাদুর আওতায় পড়া সবাইকে করে তুলছে সম্মোহিত। প্রথমবারের মতো, এবং শেষবারের মতো, তিন মিলিয়ন বছরের জন্য-আফ্রিকার কালো বুকে ঢাকের মৃদুমন্দ বজ্রনিনাদ আকাশ-বাতাস কাঁপিয়ে তোলে।

কাঁপন আস্তে ধীরে বাড়তেই থাকে, আরো তালে তালে, আরো তালে তালে। এবার অরণ্য মানবেরা সামনে চলতে শুরু করেছে। যেন নিশিতে পাওয়া মানুষ। সামনে•সেই তরঙ্গায়িত শব্দের উৎস। মাঝেমধ্যে এক-আধটু নাচের মোহনীয় ধীরলয়ের ভঙ্গিমা নেয় পদক্ষেপগুলো। তাদের প্রতিটা রক্তকণা উল্লসিত হয়ে উঠেছে। সাড়া দিয়ে চলেছে বহু জনম পরের উত্তেজনার পথে। পুরোপুরি কাছে যাবার পরই সবাই ঘিরে ধরে মনোলিথটাকে। দিবসের সবটুকু ক্লান্তি ওরা ভুলে বসেছে; ভুলে বসেছে আসন্ন গোধূলীর ভয়াল চেহারা আর ক্ষুৎপিপাসার জান্তব জ্বালার কথা।

ঢাকের শব্দ আর রাতের অমানিশা আরো আরো বেড়ে যায়, হয় দ্রুততর। ছায়াগুলো দিগন্ত ছোঁয়া শুরু করলে, সবটুকু সূর্যালোক শোষিত হলে সেই স্ফটিক ছড়াতে শুরু করে আলোর ছটা।

প্রথমে স্বচ্ছতা হারায়। ধারণ করতে থাকে একটু রঙের আবেশ, দুধরঙা ঔজ্জ্বল্য উদ্ভাসিত করে চারদিক। অবোধ্য, অব্যাখ্যাত ভূতেরা দাবড়ে বেড়ায় এর উপরিতল থেকে গভীরে, গভীর থেকে উপরে। হঠাৎ করেই আলো-আঁধারীর রেখায় বিভক্ত হয়ে একদেহী হয়ে ওঠে ওগুলো। পরস্পরের সাথে যুক্ত হয়ে বৃত্তাকার ক্রমঘূর্ণায়মান আকার দেয়।

আলোক চক্র আরো আরো দ্রুত ঘুরে চলে। ঢাকের গুড়গুড় আওয়াজ এর সাথে সাথে বেড়ে চলেছে। এখন অকল্পনীয় সম্মোহিত বন মানুষেরা হাঁ করে চেয়ে থাকতে পারে শুধু এই আগুনে খেলার দিকে। নির্নিমেষ। এরমধ্যেই ভুলে বসেছে বংশগত সব অর্জনের কথা, সতর্কতার কথা। বেমালুম গায়েব হয়ে গেছে জীবনব্যাপী পাওয়া সেসব আত্মরক্ষার শিক্ষা। শুধু তাদের কোনো একজন নয়, সবাই। যেন গুহাগুলো অনেক অনেক দূরে, যেন সেই কষ্টকর বিকাল থেকে তারা বহু যোজন সরে এসেছে। আশপাশের ঝোঁপঝাড় জ্বলজ্বলে চোখের শ্বাপদে গেছে ভরে। রাতের সৃষ্টিরা অনড় বসে আছে, এর পরের ঘটনার জন্য প্রতীক্ষারত।

এবার আলোকমালা মিলেমিশে একাকার হয়ে যায়। চক্রের ভিতরের রেখাগুলো আলোয় ভাসা দাগে ভাগ হয়ে যায়। অরণ্য মানবের মতো সেগুলোও চক্রাকারে ঘুরতে থাকে। এবার দাগগুলো বিভক্ত হয়ে যায় জোড়ায় জোড়ায়। ফলে উজ্জ্বল জোড়গুলো একে অন্যকে অতিক্রম করে দোলায়িত হতে থাকে। পরস্পরকে ছেদ করার বিন্দু বদলাতে থাকে আস্তে আস্তে। যখন জ্বলজ্বলে খণ্ডগুলো একত্র হয়, আবার যখন হয় আলাদা তখন অসাধারণ ভাসন্ত জ্যামিতিক প্যাটার্নগুলো অস্তিত্বের ভিতর-বাহিরে আলোর ঝলক খেলিয়ে চলে। আর বনের মানুষেরা সেসব বন্দী আলোকোজ্জ্বল জিনিসের কান্ড কারখানা আটকে নেয় নিজের নিজের মনে।

কখনো হয়তো তারা বুঝবে না যে তাদের মনগুলোকে নিরীক্ষা করে নেয়া হয়েছে, এঁকে নেয়া হয়েছে তাদের শরীর, প্রতিক্রিয়ার পল-অনুপল পাকাপাকিভাবে তুলে নেয়া হয়েছে, মাপজোক নেয়া হয়েছে তাদের সবটুকু শক্তি, ক্ষমতা আর সম্পদের। প্রথমেই পুরো উপজাতিকে আধা নত করা হয়। তারা জমাট পাথরের মতো নিথর। এবার স্বচ্ছ স্ফটিকের সবচে কাছের বনমানুষটা অতর্কিতে জীবন ফিরে পায়।

নিজের জায়গা থেকে একটুও নড়েনি। কিন্তু শরীরটা বিমোহিত অবস্থান থেকে সরে আসে। আড়ষ্টভাবে নড়েচড়ে ওঠে, যেন কোনো এক অদৃশ্য খেলুড়ের হাতের পুতুল। অদৃশ্য সুতো যেন চারধারে বিছানো। মাথা একবার এদিক তো আরেকবার ওদিকে নড়ে উঠছে। নিঃশব্দে মুখ খুলেই বন্ধ হয়ে যায়। হাত মুঠো পাকায়, আবার যায় খুলে। এবার শরীর ভাঁজ হয়ে গেল নিচের দিকে। একটা লকলকে ঘাসের ডগা আনল তুলে। অপ্রস্তুত আঙুলগুলো একটা গিট পাকানোর চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে।

তাকে দেখে মনে হয় একটা ব্যাপারে সে লড়ে চলেছে নিরন্তর। কোনো এক অদেখা নিয়ন্তার হাত থেকে নিজের শরীরটাকে মুক্ত করার প্রাণান্ত প্রয়াস দেখা দেয় তার অভিব্যক্তিতে। বাতাসের জন্য আঁকুপাঁকু করে বেড়ায় ফুসফুস, অপার্থিব আতঙ্ক নগ্ন হয়ে ফুটে ওঠে সারা চোখমুখে। অবর্ণনীয় জান্তবতায় চেষ্টা চালিয়ে যায় আঙুলগুলোকে দিয়ে এমন জটিল কোনো কাজ করাতে যা ইহধামে আর কেউ কোনোকালে করেনি।

নিজের সর্বশক্তি দেবার পরেও পাতাটাকে শুধু দ্বিখণ্ডিত করে বসতে পারে, এর বেশি কিছু নয়। টুকরোগুলো মাটি ছুঁয়ে দেয়ার সাথে সাথেই নিয়ন্তা শক্তি তাকে ছেড়ে যায়। সে ফিরে যায় অনড় অবস্থায়।

এবার জীবিত হয় আরেক বনমানুষ। সেও একই কাজ করার চেষ্টা করে। বয়সে নবীন হওয়ায় একে দিয়ে কাজ করানো সহজ হচ্ছে। সহজেই তার হাতের ঘাসের ডগাটা বাঁক খায়, একের ভিতর অন্য প্রান্ত প্রবেশ করে। অপেক্ষাকৃত বয়েসীটার ব্যর্থতার উপরেই সে সাফল্যের ঝাণ্ডা ওড়ায়। বসুধার বুকে প্রথমবারের মতো কোনো জটিল বন্ধন সৃষ্টি হল…।

অন্যেরা আরো সব অস্বাভাবিক, আপাতত অর্থহীন কাজ করে চলে। কেউ হাত দুটোকে ছড়িয়ে দেয় যথাসম্ভব। একবার দুচোখ খুলে, আরেকবার একটা বন্ধ করে; কেউবা আঙুলের ডগাগুলোকে পরস্পরের সাথে লাগিয়ে নিতে চায়। কাউকে আবার সেসব আলোক কাঠির দিকে চেয়ে থাকতে হয় পলকহীনভাবে। কাঠিগুলো আরো বিভক্ত হয়, আরো ভাগ হয়ে যায়। ক্ষীণ থেকে ক্ষীণতর রেখায় বিলীন হয়ে যায়। আবার সবাই শুনতে পায় এক অখণ্ড শব্দের ঢেউ। সেটাও সূক্ষ্ম হয়ে হয়ে হারিয়ে যায় শব্দের[৫] তরঙ্গে।

চন্দ্র-দর্শীর পালা এলে ও ভয় পায় খুব কমই। তার সবচে বড় অনুভবটা সামান্য ব্যথার মতো। যেন আঘাত পেয়েছে কোথাও। পেশীগুলো হঠাৎ নড়েচড়ে ওঠে, হাত পা এমন কোনো আদেশে নড়ে যা ঠিক তার নয়।

কারণ না জেনেই সে উবু হয়ে তুলে নেয় একটা ছোট্ট পাথর। উপরে উঠেই দেখতে পায় স্বচ্ছ স্ফটিকের কোথাও একটা নতুন গড়ন ফুটে উঠেছে।

সেসব রেখা, নাচতে থাকা চক্র, সব উধাও। তার বদলে ছোট থেকে বড় বৃত্তের দলকে দেখা যায় একের উপর এক পড়ে থাকতে। পানিতে হাত ডোবালে যেমন ঢেউ ওঠে, তেমন। ঠিক মাঝে একটা কালো, ছোট্ট চাকতি।

মস্তিষ্কে আসতে থাকা নিরব আদেশ পালন করে চন্দ্রদর্শী পাথরটাকে মাথার উপরে তোলে, লক্ষ্য বরাবর দেয় ছুঁড়ে। পাথরটা লক্ষ্যের দিকে লক্ষ্যও করেনি।

আবার করো-সেই আদেশ এল। আরেক পাথর পাওয়ার আগ পর্যন্ত সে ছুঁড়ে বেড়ায় আশপাশটা। এবার সশব্দে সেটা আছড়ে পড়ে টার্গেটের উপর। রিনিঝিনি ঝংকার ওঠে সেদিক থেকে। এখনো অনেকদূরে সে, কিন্তু উন্নতি হচ্ছে কাজের ক্ষেত্রে।

চারবারের বেলায় সে কেন্দ্রের চোখটা থেকে কয়েক সেন্টিমিটার দূরে পাঠাতে পারে প্রস্তর খণ্ডকে। অপার্থিব বর্ণনাতীত কোনো আনন্দের ঢেউ খেলে গেল এবার তার মনে; প্রায় শারীরিক তৃপ্তির মতো একটা ব্যাপার। এবার একটু ঢিল পড়ে নিয়ন্ত্রণে। দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করা ছাড়া আর কিছুর তাগাদা অনুভব করছে না চন্দ্র-দর্শী।

একের পর এক গোত্রের সবাইকেই পরীক্ষা করে নেয়া হচ্ছে। কদাচিৎ কেউ সফল হয়, বেশিরভাগই নিজেকে দেয়া কাজটা করতে পারে না ঠিকমতো। আর সবাইকেই উপযুক্ত পুরস্কার দেয়া হচ্ছে, ব্যথা নয়তো আনন্দ।

এবার সেই নব্য প্রস্তরে দেখা দেয় একদেহী নিরাকার আলোর ছটা। যেন চারদিকের আঁধার রাজ্যে এ এক মহামহিম আলোকবর্তিকা। ঘুমের ঘোর কাটার মতো করে তাদের মোহভঙ্গ হল। এবার তারা নিরাপদ আশ্রয়ের পথে চলতে থাকে দুলকি চালে। পেছন ফিরে তাকায়নি। তাকালে অবাক চোখে দেখতে পেত, কোনো এক অদ্ভুত আলো তাদের বাড়ির পথ দেখিয়ে চলেছে- দেখিয়ে চলেছে অদেখা অচেনা ভবিষ্যতের রাজপথ।

অধ্যায় ৩. শিক্ষালয়

চন্দ্র-দর্শী আর ওর সাথীদের সেসব স্মৃতির কোনোটাই মনে পড়ে না; সেই ক্রিস্টাল, তারপরীক্ষা-নিরীক্ষা আর কাজ করানো-কিছুই না। পরের দিন খাবারের খোঁজে বেরুনোর পরে তারা পাথরের সামনে সামান্য সময়ের জন্যও থমকে দাঁড়ালো না। এখন এটা তাদের স্মৃতির ধূসর, বিবর্ণ, মুছে যাওয়া অংশের অন্তর্গত। ওরা এটাকে খেতে পারবে না, এরও কোনো ক্ষমতা নেই ওদের গলাধঃকরণ করার। সুতরাং কোনো পক্ষ থেকে ক্ষুধা জনিত-সম্পর্ক না থাকায় এর কোনো গুরুত্বই নেই।

পাতলা নদীটার ওপারে সেই অন্যেরা নিজেদের নিষ্ফল আক্রোশ ঢেলে যাচ্ছে। তাদের নেতা এক কানওয়ালা। বয়েস আর আকার প্রকারে চন্দ্র-দর্শীর মতোই। শুধু বেচারার হাল-হকিকত আরো খারাপ। নিজের এলাকায় একটু নেচেকুদে বেড়ায়, রক্তহিমকরা চেঁচামেচির চেষ্টা চালায়। নিজের সাহসকে আরেকটু শক্তি আর অন্যদলকে ভড়কে দেবার উদ্দেশ্যে ক্রমাগত ঝাঁকিয়ে যায় দুই বাহু। আজ ঝরা পানির প্রবাহ কোথাও কোথাও ফুটখানেক গভীর। কিন্তু এক কানওয়ালা টা এর মাঝেই দাবড়ে বেড়াচ্ছে। আরো বেশি রেগে উঠছে, উঠছে আরো তেতে। ধীরেসুস্থে সে প্রায় নিথর হয়ে আসে। তারপর পিছিয়ে গিয়ে সাথীদের সাথে যোগ দেয় জলপানে।

এটুকু ছাড়া প্রাত্যহিক নিয়মের কোনো পরিবর্তন নেই। সেদিনের মতো খোঁজাখুঁজি শেষ। আরো একটা দিনের চলনসই পুষ্টি জুটে গেল। কেউ মারাও পড়েনি।

সে রাতেও স্ফটিক স্বচ্ছ গড়নটা অধীর অপেক্ষায় রত। চারপাশে সেই আলো আর শব্দের ইন্দ্রজাল। এবারের কাজটা আরো নিখুঁত। ভিন্নতর।

বেশ কয়েকটা বনমানুষকে সে পুরোপুরি অবজ্ঞা করে। যেন সবচে সম্ভাবনাময় পাণিগুলো নিয়েই এর যত উদ্বেগ। চন্দ্র-দর্শী তাদেরই একজন। আবারো সে মস্তিষ্কের অব্যবহৃত অংশগুলোয় অচিন প্রবাহ অনুভব করে। এবার সে দেখতে লাগল দারুণ সব দৃশ্য।

দৃশ্যেরা হয়তো ক্রিস্টাল মনোলিথটার ভিতরেই আছে, নয়তো তার নিজের মনের গহীনে। কে জানে? আসল কথা হল, চন্দ্র-দর্শীর চোখে সেগুলো একেবারে বাস্তব। আবারো তার সহজাত সব প্রবৃত্তি দৌড়ে পালায় নিজের কাছ থেকে।

ও একটা দারুণ শান্তিতে থাকা পারিবারিক দল দেখতে পাচ্ছে। ওর চেতনার সেই চিরচেনাদের থেকে আপাতত একটা মাত্র পার্থক্য ধরা পড়ে। ভোজবাজির মতো উদয় হওয়া সেই পরিবারের একজন পুরুষ, এক নারী ও দুই শিশু আছে। তারা শান্তভাবে আয়েশী ভঙ্গিতে খেয়ে চলেছে। মোটাসোটা, চর্বিজমা, চকচকে দেহ তাদের। এটা জীবনের সেই ধারা যা চন্দ্র-দর্শীর মনশ্চক্ষুতে কোনোকালে ধরা। দেয়নি। অচেতনভাবেই নিজের শিরদাঁড়ায় ও দৃষ্টি দেয়-এই প্রাণীগুলোর মেরুদন্ড আর বুকের পাঁজর চর্বিতে ঢাকা। সারাক্ষণ তারা অলসভাবে বসে থাকে। কত সহজেই নিজের গুহার চারপাশে রাজত্ব করে চলে! সারা দুনিয়ার সবটুকু শান্তি ভর করেছে তাদের উপর। এক আধবার পুরুষ প্রাণীটা কেমন অপার তৃপ্তিতে ঢেকুর তুলছে।

আর কোনো কাজকর্ম নেই। পাঁচ মিনিট পরে সেই সচেতনতা কেটে গেল। এবার আর ক্রিস্টালটাকে অন্ধকারের একটা আকৃতি ছাড়া অন্য কিছু মনে হয় না; আবারো চন্দ্র-দর্শী নিজেকে স্বপ্নভঙ্গের পর খুঁজে পায়। হঠাৎ করেই নিজের অবস্থান বুঝতে পারে, তাড়িয়ে চলে দলকে গুহার দিকে।

যা দেখেছে তার তেমন কোনো সচেতন স্মৃতি ওর মানসপটে নেই। কিন্তু সেই রাতে নিজের গুহার উষ্ণতায় বসে থাকার সময় চারপাশের দুনিয়ার সবটুকু শব্দের সাথে নিজেকে সচেতন করে নেয় সে। চন্দ্র-দর্শী এই প্রথম কোনো নতুন ধরনের অনুভূতির খোঁজ পেয়েছে। পায়ে পায়ে অনুভূতিটার এগিয়ে আসার আওয়াজ শুনতে পায় সে। কোন্ গহীন থেকে উথলে আসে ঈর্ষার অপূর্ণ আর প্রাচীনতম আবেগ। নিজের জীবনের অসফলতার জ্বালা আসে। এর কারণ সম্পর্কে ওর কোনো ধারণাই নেই। এখনো এতে তেমন কিছু যায় আসে না। তার আত্মায় বাসা বেঁধেছে অতৃপ্তি। এভাবেই চন্দ্র-দর্শী প্রথমবারের মতো মানুষ’ এর পথে ছোট্ট কদম ফেলল।

রাতের পর রাত সেই চার তৃপ্ত অরণ্য মানবের দৃশ্য দেখানো হয় যে পর্যন্ত ভিতরে বসে না যায় দৃশ্যগুলো; যে পর্যন্ত ক্ষুধারই মতো রক্তে মিশে না যায়। শুধু নিজের চোখে দেখলে এমন প্রভাব পড়ত না তার উপর। এজন্য প্রয়োজন মনস্তাত্ত্বিক চাপ। সেটাও দেয়া হল ভালো করে। চন্দ্র-দর্শীর জীবনে এমন কিছু পরিবর্তন এসেছে যা সে কোনোকালে ধরতে পারবে না। ওর একেবারে সরল মস্তিষ্কের প্রতিটি কোষে, প্রতিটি অনুতে এসেছে নতুন মোড়, নতুন বাঁক। ও বেঁচে গেলে সেসব গঠন হয়ে উঠবে চিরঞ্জীব। কারণ তার জিনগুলো এসব বয়ে চলবে প্রজন্ম-প্রজন্মান্তরে; শতাব্দী-সহস্রাব্দান্তরে।

এ এক ধীর, জটিল প্রক্রিয়া। কিন্তু ক্রিস্টাল মনোলিথের যথেষ্ট ধৈর্য আছে। সে বা তার আর সব জমজেরা শুধু আধা পৃথিবী জুড়ে ছড়িয়ে পড়েই ক্ষান্ত হয়নি, যেখানে যত প্রাণী পাচ্ছে তার সব নিয়েই করে চলেছে নিরীক্ষা। মরিয়া হয়ে কাজ করছে সাফল্যের আশায়। শত ব্যর্থতায়ও কিছু যায় আসে না-একটা, মাত্র একটা সাফল্য উদ্ভাসিত করে তুলতে পারে চারদিক। বদলে দিতে পারে পৃথিবীর রীতি।

পরের নতুন চাঁদ আসতে আসতে তারা একটা জন্ম আর দুটো মৃত্যু দেখতে পায় চোখের সামনে। একটা মরেছে ক্ষুৎপিপাসায়, অন্যটা রাতে ফেরার সময়। দু খণ্ড পাথরকে ঠুকে দেয়ার কষ্টসাধ্য কাজটা করার সময় সেই বনমানব নিজের মাথাকেই গুঁড়িয়ে দেয়। সাথে সাথে আঁধার ঘনিয়ে আসে মনোলিথ জুড়ে আর গোত্রটাকে জাদুমুক্ত করা হয়। কিন্তু পড়ে যাওয়া বন মানুষটা আর উঠে দাঁড়ায়নি এবং অবশ্যই, সকালে সেখানে কিছুই ছিল না।

পরের রাতে আর কোনো কাজই হয়নি। ক্রিস্টাল তখনো নিজের ভুল বিশ্লেষণে মত্ত। রাত্রি নামার সাথে সাথে ধীরেসুস্থে গোত্রটা ফিরে যায় আশ্রয়ে। এখনো মনোলিথের উপস্থিতি তাদের কাছে অর্থহীন। পরের রাতে জিনিসটা আবারো তাদের জন্য তৈরি হয়ে নেয়।

সেই চার সুখী বনমানুষের সাথে এবার যুক্ত হয়েছে অসাধারণ সব কাজ। চন্দ্র-দর্শী কাঁপতে থাকে অনিয়ন্ত্রিতভাবে। যেন পুরো মাথাটা ফেটে বেরিয়ে পড়বে। প্রাণপণে চেষ্টা করে চোখদুটো খুঁজে নিতে। কিন্তু সেই নিষ্ঠুর মানসিক যাতনা তার শক্ত থাবায় একবিন্দু ঢিল দেবে না। নিজের সবটুকু চেতনা এর বিরুদ্ধে কাজ করলেও সে শিক্ষাটা শেষ পর্যন্ত এগিয়ে নিতে বাধ্য হল।

চিন্তাটা তার বংশধরদের চলার পথের পাথেয় হয়ে থাকবে। পথের চারধারে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকবে কত কত খাদ্য! সময় বদলে গেছে। অতীতের জ্ঞানের বংশানুক্রমিক পরিবহনের এই শুরু। অরণ্যচারী মানবদলকে এর সাথে অবশ্যই মানিয়ে নিতে হবে, নয়তো মিশে যেতে হবে ধূলিকণার সাথে। সেসব বিশালাকার শ্বাপদের মতো বিলুপ্ত হয়ে যাবে, যাদের হাড়গুলোই শুধু চুনাপাথুরে পাহাড়ে পাহাড়ে ফসিল হয়ে আটকে আছে।

চন্দ্র-দর্শী স্থির চোখে চেয়ে থাকে ক্রিস্টাল মনোলিথের দিকে। এদিকে তার মস্তিষ্কের সবটাই খুলে খুলে যায় এর পরীক্ষা-নিরীক্ষার সামনে। কখনো কখনো অনুভব করে অমিত তেজের বিপ্লব। কিন্তু সব সময় তার অনুভূতির প্রায় সবটা জুড়ে বসত করে ক্ষুধার দানবেরা। আর ধীরে ধীরে তার অজান্তেই হাতের মুঠোগুলো ভাজ হয়ে যায়, যায় খুলে। এক অভিনব পথে কাজটা হয়। এমন এক পথে, যেটা জীবনের বাকীটাকে তুলে ধরতে পারে আয়েশী, আলতো হাতে।

.

বুনো শূকরের পিল মাটি শুঁকে বেড়াচ্ছিল, চলছিল ট্রেইল ধরে। হঠাৎ করেই চন্দ্র-দর্শী দাঁড়িয়ে যায়। শূকর আর বনমানুষের দল সব সময়ই একে অন্যকে হেলা করে এসেছে, কারণ এদের মধ্যে মোটেও দ্বন্দ্ব নেই। ভদ্র জন্তু-জানোয়ারের মতো নিজের নিজের পথে চলে, কারণ অপরের সাথে খাবার নিয়ে টানা-হেচড়া নেই।

এখনো একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে চন্দ্র-দর্শী; ইতস্তত করছে। মন চলে যাচ্ছে সামনে পেছনে, শরীরও যাচ্ছে হেলে। যেন সে এসব ইচ্ছা করে করছে না। তারপর, যেন স্বপ্নের ঘোরেই তীক্ষ্ণ চোখে তাকায় মৃত্তিকার কঠিন বুকের দিকে। ঠিক কীসের জন্য এই খোঁজাখুঁজি সেটা সে আদৌ বলতে পারবে না-যদি জবান খুলে যায়, তাও না। পাওয়ার পরই চিনতে পারল সেই আকাঙ্ক্ষিত বস্তুকে।

ইঞ্চি ছয়েক লম্বা তীক্ষাগ্র এক ভারি পাথর সেটা। হাতে ঠিকমতো বসানো যাচ্ছে না, তবু এতেই চলবে। সে জিনিসটাসহ হাত ঘোরায় মাথার উপরে, নিচে। এর বাড়তি ওজনটাও কেমন মাদকতা এনে দেয়। প্রথমবারের মতো ক্ষমতা আর প্রাতিষ্ঠানিকতার শক্তিমান ভূত ভর করে তার উপর। সে সবচে কাছের শূকর ছানাটার দিকে চলতে শুরু করল উৎসাহের সাথে।

শূকর দলের নিচু স্তরের বুদ্ধিমত্তার হিসেবেও এ এক বোকাটে কমবয়েসি জানোয়ার। চোখের কোণা দিয়ে চন্দ্র-দর্শীর এগিয়ে আসাটা ঠিকই দেখতে পায় কিন্তু পাত্তা দেয় না মোটেও। আমলে নিয়েছে তখনি যখন আর সময় নেই। আসলেইতো, কেন ছানাটা এই নিতান্ত গোবেচারা প্রাণীগুলোকে গোনায় ধরবে? সে বেখেয়ালে ঘাসের গোড়া চিবিয়েই চলল যে পর্যন্ত চন্দ্র-দর্শীর প্রস্তরখণ্ডটা তার নিষ্প্রভ সচেতনতাকে সচকিত করে না তোলে। হত্যাকাণ্ডটা এত নীরবে, এতো দ্রুত ঘটে গেল যে বাকীরা নিজেদের সামনের ঘাস থেকে মুখও তুলল না।

দলের বাকী অরণ্য-মানবেরাও অবাক চোখে কান্ডকারখানা দেখে। জুটে যায় চন্দ্র-দর্শীর আশপাশে। আরেকজন তুলে নেয় রক্তপাতের আরেক অস্ত্র। আঘাতে আঘাতে বিক্ষত করে দিতে থাকে মরা জটাকে। এরপর বাকীরা কাঠি বা পাথর যাই পাক না কেন, যুগিয়ে নিয়ে নেমে পড়ে সোৎসাহে। থেতলে থেতলে ভর্তা করে ফেলেছে মাংসের তালটাকে।

এবার একটু বিরক্তি আসে। কী লাভ এ অকাজে! দু-চারজন আশপাশে ঘুরে বেড়াচ্ছে ইচ্ছামতো, কেউ আবার ইতস্তত করে দাঁড়িয়ে পড়েছে অবোধ্য জিনিসটার সামনে।

তারা জানেও না জগতের ভবিষ্যৎ ওদের সিদ্ধান্তের উপর ভর করে দাঁড়িয়ে আছে উদগ্রভাবে।

অনেক অনেক সময় কেটে যাবার পর কোনো এক পেটের জ্বালায় কাতর বনমানুষী নিজের পাথরের উপর লেগে থাকা সামান্য থেতলে যাওয়া মাংসের দিকে অপলক তাকায়। দু-হাতের পাতায় মেলে ধরা তার অস্ত্রটা।

একটু, সামান্য একটু চেটে দেখে সে মাংসটুকু।

আরো অনেক অনেক সময় লেগে যায় চন্দ্র-দর্শরি। অবাক, বিহ্বল, চিত্রার্পিত বিস্ময়ে সে নিজের ভিতরে উপলব্ধি করে আর কখনো ক্ষুধা তাকে অহর্নিশি জ্বালাবে না।

অধ্যায় ৪. চিতা

ওদের পরিকল্পনার অস্ত্রগুলো অনেক বেশি সরল। তবু এ দিয়েই তারা পুরো পৃথিবীর কর্তৃত্ব নিয়ে নিতে পারে, বনমানুষদের করে তুলতে পারে জগতের অধীশ্বর। পাথর ধরা হাতই সবচে পুরনো অস্ত্র। এ হাত যে কোনো ধাক্কার শক্তিকে আশ্চর্যজনকভাবে ঐশিতা দিতে পারে। অনন্তর এলো হাড়ের ব্যবহার। এগুলো যে কোনো মত্ত দাতাল আর নখরওয়ালা প্রাণীর বিরুদ্ধে চমকপ্রদ কাজ দেয়। এসব অস্ত্রের সাহায্যেই সামনের অসীম-ছোঁয়া চারণভূমির অযুত-নিযুত প্রাণী হয়ে পড়ে তাদের খাদ্য।

অথচ ওদের আরো কিছু থাকা জরুরী। কারণ ওদের দাঁত আর নখ আজো ইঁদুরের চেয়ে বড় কোনোকিছু গ্রহণে সম্মত নয়। কপাল ভালো, এতদিনে হিসেবি প্রকৃতি ঠিক ঠিক অস্ত্রে ওদের সাজিয়ে দিয়েছেন। অস্ত্রের নাম বুদ্ধিমত্তা।

প্রথম প্রথম খুবই ভোতা-টোতা ছুরি-করাতে কাজ চলত। এমন এক চেহারার যন্ত্র এগুলো যা আগামী ত্রিশ লক্ষ বছর এক-আধটু বদলে গিয়ে চালাতে থাকবে কাজ। কোনো কোনো কাজ অ্যান্টিলোপের নিচের চোয়ালের দাঁতাল হাড় দিয়েই চলে। লৌহযুগের আগে তারা আর তেমন বড়সড় ধাপ পেরুবে না। ছোট হরিণের শিং দিয়ে ছুরির কাছাকাছি সুবিধা লুটে নেয়া যায়। ছোটখাট যে কোনো জন্তুর পুরো চোয়াল দিয়ে আঁচড় কাটতো তারা।

পাথুরে লাঠি, দন্তময় করাত, শিঙের ছোরা আর হাড়ের আঁচড়ানিই তাদের প্রয়োজনীয় অসাধারণ আবিষ্কার। অস্তিত্বের জন্য এরচে বেশি কিছুর চাহিদা নেই। শিঘ্রি বনমানবেরা সেসব হাতিয়ারের সবটুকু ক্ষমতার কদর বুঝবে। কিন্তু তাদের জড়ভরত আঙুলগুলোর সেসব ব্যবহারের ক্ষমতা অর্জন করতে বা ব্যবহারের ইচ্ছা পোষণ করতেই বহু মাস যাবে পেরিয়ে।

সময় দিলে হয়তো তারা নিজে থেকেই এমন প্রায় অবাস্তব কষ্টসাধ্য ধারণা পেত। প্রাকৃতিক সব জিনিসকে হয়তো ব্যবহার করত কৃত্রিম অস্ত্র হিসেবে। কিন্তু বৈরী পরিবেশ সব সময় চতুর্দিক থেকে মুখ ব্যাদান করে থাকে। আর আজো তাদের সামনে ব্যর্থতার হাজার দুয়ার খোলা।

অরণ্য মানবকুলকে প্রথম সুযোগ দেয়া হয়েছে। দ্বিতীয়টা কখনোই আসবে না। ভবিষ্যৎটা একেবারে আক্ষরিক অর্থেই তাদের হাতে। শুধু হাতের উপর নির্ভরশীল।

.

চাঁদের কলা বদলে বদলে যায়। শিশুরা জন্মে, বেঁচে-বর্তে যায় প্রায়ই। ত্রিশ বছরের অথর্ব, দন্তহীন বুড়োরা যায় মরে।। চিতা ঠিকই রাতে রাতে নিজের খাজনাটুকু কড়ায় গণ্ডায় আদায় করে চলে। আজো নালার ওপাশ থেকে চেঁচিয়ে চলে অন্যেরা। আর উন্নয়ন এগিয়ে চলে গোত্রে। একটু একটু করে। এক বছরের ফারাকে চন্দ্র-দর্শী আর ওর উপজাতিটাকে একদম চেনাই যায় না।

নিজের শিক্ষাটুকু ঠিকই নিয়েছে তারা। আজ তারা সামনে পড়া সব টুকটাক যন্ত্র নিয়ন্ত্রণ করতে পারে। ক্ষুৎপিপাসার সেই দুঃসহ স্মৃতি বিলীয়মান। কমে আসছে শুকর জাতীয় প্রাণীগুলো। তাতে কী, ছোট হরিণ, অ্যান্টিলোপ আর. জেব্রা আছে সমভূমি জুড়ে। হাজার হাজার। এইসব প্রাণী এবং বাকীরাও পড়েছে মহা ফাঁপড়ে; তারা সবাই শিক্ষার্থী শিকারীদের লক্ষ্যে পরিণত হয়েছে সময়ের প্রবাহে।

আজ আর তারা প্রাণ-ক্ষুধার টানাপোডনে পড়ে আধমরা নয়। আলসেমির জন্য পড়ে আছে বিস্তর সময়। সময় পড়ে থাকে ভাবনার আদি সূত্রগুলোর জন্য। ভাবনা! ভাবনার জন্য প্রয়োজন শুধু এই সময়টুকুই। নতুন জীবনযাত্রা বেশ উষ্ণভাবেই বরণ করেছে তারা। এ নবজন্মের সাথে কোনোভাবেই মনোলিথের সম্পর্ক খুঁজে পায়নি। মনোলিথটা আজো ঠায় দাঁড়িয়ে আছে প্রসবণের পথে। এমনকি কখনো তারা মনোলিথের দাঁড়িয়ে থাকার ব্যাপারটা বোঝার জন্য একটু থমকে দাঁড়ালেও নিশ্চয়ই মনে করত তাদের এ উন্নতিটা পুরোপুরি নিজস্ব। কারণ এরই মধ্যে জীবনের আর সব রূছু চিত্র মুছে গেছে মন থেকে।

কিন্তু কোনো ইউটোপিয়াই[৭] নিখুঁত নয়। এ স্বর্গরাজ্যেরও দু-ত্রুটি ছিল। প্রথমটা হলো খোঁজাখুঁজিতে মত্ত চিতা। চিতাটার বনমানুষ-পিপাসা আরো বেড়েছে ওদের শরীর তাগড়া হওয়ার সাথে সাথে। অন্য ত্রুটিটা হল খালের ওপারের গোত্র। কীভাবে যেন ওরা আজো টিকে আছে ধুঁকে ধুঁকে। এখনো গোঁয়ার গোবিন্দের মতো খেয়ে মরতে নারাজ।

হঠাৎ করেই চিতা সমস্যার সমাধান হাজির হয়ে গেল। একটা বড়সড়-বলা চলে প্রাণঘাতী সিদ্ধান্ত নিয়েছিল চন্দ্র-দর্শীর দল। প্রথমবার ধারণাটা মনে আসার সাথে সাথে সে বেশ আনন্দের সাথে উদ্বাহু নৃত্য করেছিল, আর এ অবস্থায় সবদিক বিবেচনায় না নেয়ার দোষও তাকে দেয়া যায় না।

এখনো কালেভদ্রে দুর্দিনের মুখোমুখি হয় বুনোরা। কিন্তু তা আর অস্তিত্বের প্রতি হুমকি হিসেবে দেখা দেয় না। গোধূলী পর্যন্ত একটা শিকারও করতে পারেনি; এখনি চোখে পড়ে গিরিগর্তের ঘরবাড়ি। চন্দ্র-দর্শী নিজের ক্লান্ত আর হতাশ দলটাকে টেনে চলে আশ্রয়ের দিকে। ঠিক এমন সময় চোখে পড়ে যায় প্রকৃতির সবচে দুর্লভ এক উপহার।

একটা পূর্ণবয়স্ক অ্যান্টিলোপ পথের ধারে পড়েছিল। সামনের পা ভাঙা। কিন্তু লড়ার মতো যথেষ্ট শক্তি ছিল বলেই চারধার থেকে ঘিরে ধরা খেকশিয়ালের দল তার তলোয়ারের মতো শিংগুলোর প্রতি যথাবিহিত সম্মান প্রদর্শন করে চলেছে। রাতের শিকারীদের ধৈর্য ধরার মতো সময় সুযোগ আছে। তারা জানে, শুধু সময় ব্যয় করতে হবে, ব্যস।

কিন্তু শেয়ালের দল প্রতিযোগিতার কথা বেমালুম ভুলে বসেছে। বনমানুষের দল এগিয়ে এলে কড়া ভাষায় প্রতিবাদ করে। আতঙ্ক জাগানিয়া শিংগুলোকে এড়িয়ে গিয়ে বুনোরাও সাবধানে, ভয়ে ভয়ে চারদিক থেকে একটা বৃত্ত গড়ে চলে। এরপর এগিয়ে যায় পাথরখণ্ড আর লাঠিসোটা নিয়ে।

আক্রমণ খুব বেশি সমন্বিত বা ফলদায়ক হল না। তাই জটা হাল ছেড়ে দিতে দিতে পুরোপুরি রাত নেমে যায়। খেঁকশিয়ালের দল ফিরে পাচ্ছে আত্মবিশ্বাস। পেটের জ্বালা আর ভয়ে কাবু হয়ে চন্দ্র-দর্শী অকস্মাৎ উপলব্ধি করে যে এসব কষ্ট একেবারে বৃথা যেতে বসেছে। আর এখানে থাকা মোটেও নিরাপদ নয়।

চন্দ্র-দর্শী এবার নিজেকে এক তীক্ষ্ণবুদ্ধির মেধাবী হিসেবে প্রমাণ করে বসে; আগেও অনেকবার করেছে, পরেও করবে। কল্পনার কত কষ্টের সব ধাপ বেয়ে বেয়ে সে হঠাৎই সুখস্বপ্ন সুধার দেখা পায়। অ্যান্টিলোপের মরদেহটা শুয়ে আছে-তার নিজের নিরাপদতম গুহার ভিতরে! সাথে সাথে শরীরটাকে টানতে শুরু করে গুহামুখের দিকে। বাকীদের উদ্দেশ্য বুঝতে বাকী থাকে না। একটু পরে হাত লাগায় তারাও।

সে কাজটার কষ্ট সম্পর্কে জানলে কখনোই একাজে নামতে না। শুধু তার দারুণ শক্তি আর পূর্বপুরুষ থেকে পাওয়া গোঁড়ামি দিয়ে গুহার ঢাল ধরে উপরদিকে টেনে চলে মরা জিনিসটাকে। হতাশায় কেঁদে দিয়ে কতবার ছেড়েছুঁড়ে দিল পুরস্কারটাকে, কতবার মনের গভীর থেকে আসা ইচ্ছাশক্তি নিয়ে ক্ষুধার তাড়নায় ঝাঁপিয়ে পড়ল আবার কখনো বাকীরা সাহায্যের হাত বাড়ায়, কখনো হাত নেয় গুটিয়ে। অবশেষে কাজটা সমাধা হয়, গুহার ঠোঁট পেরিয়ে মরা জানোয়ারটাকে তুলে আনা হয় ভিতরে। সূর্যালোকের প্রথম ক্ষীণ রশ্মি হারিয়ে যাবার পর ভোজ শুরু হল। . কয়েক ঘণ্টা পরে একটু শব্দ শুনে ধড়মড়িয়ে ওঠে চন্দ্র-দর্শী। কেন যেন চারপাশের সাথীদের ঘুমন্ত দেহ ছাড়িয়ে তার কান পেতে দেয় আরো দূরে।

চারপাশের ভারি নিঃশ্বাসপ্রশ্বাসের শব্দ ছাড়া আর কোনো আওয়াজ নেই। সারাটা ভুবন যেন ঘুমন্ত। ঠিক মাথার উপর থেকে উপচেপড়া চন্দ্রালোকে গুহার সামনের পাথরগুলো স্পষ্ট দেখা যায়। যে কোনো বিপদের ভাবনাই অবান্তর।

এবার অনেকদূর থেকেই যেন একটা পাথর গড়িয়ে পড়ার শব্দ এগিয়ে আসে। চন্দ্র-দর্শী হামাগুড়ি দিয়ে বেরিয়ে পড়ল, উঁকিঝুঁকি দিল গুহাচত্বরে দাঁড়িয়ে।

নিজের ডানে সে এমন কিছু দেখতে পায় যা বেশ কয়েক মুহূর্ত জুড়ে একেবারে অসাড় করে রাখে তাকে। মাত্র বিশ ফুট নিচেই দুটি ভাটার মতো জ্বলন্ত চোখ তার দিকে নিষ্পলক তাকিয়ে আছে। চিতাটা ঐ গন্ধের ইন্দ্রজালে এত বেশি ফেঁসে গেছে যে পেছনে পাথরের উপর ঘুমন্ত নরম দেহগুলোর কথা ভুলেই যায় একদম। এর আগে বাঘটা কখনোই এত উপরে উঠে আসেনি। নিচের দিকের গুহাগুলোকে পুরোপুরি উপেক্ষা করেই এগিয়ে আসে, যদিও সেসব গিরিগর্তের বাসিন্দাদের ব্যাপারে সে পূর্ণ সজাগ। এবার ও অন্য ক্রীড়ায় মত্ত। রক্তের ক্ষীণধারা জোছনায় ধুয়ে ধুয়ে নেমে আসছে নিচে।

মুহূর্ত কয়েক পরেই উপরের দিকের গুহাবাসীদের চিৎকারে রাতের স্তব্ধতা বিদীর্ণ হয়ে যায়। চমক দেয়ার সুযোগ চলে যাওয়ায় চিতাটা হৃষ্টচিত্তে রক্তহিমকরা এক হুংকার দিল। কিন্তু আগপাশ ভালো করে দেখে নেয়নি-কারণ সে জানে ভয়ের কিছু নেই।

রিজের উপর উঠে এসে খোলা সরু জায়গায় এক মুহূর্তের জন্য দম নেয় সে। চারদিকে শোণিতের ঘ্রাণ মোটা মাথাটাকে উন্মত্ত করে তুলেছে। ভরিয়ে তুলেছে অতি আকাক্ষায়। একবিন্দু দ্বিধা না করে আলতো পায়ে প্রবেশ করে গুহায়।

এটাই চিতার প্রথম ভুল। জোছনা থেকে ভিতরে ঢুকেই ধাঁধায় পড়ে যায় এর রাতের অতি উপযোগী চোখদুটোও। বুনোদলটা চাঁদের আলোর চিত্রপটে বাঘটার অবয়ব দেখতে পায় স্পষ্ট। কিন্তু স্পষ্টভাবে চিতা ওদের দেখতে পায়নি। তারা ভয়ে অস্থির হলেও আজ আর অসহায় নয়।

নিজের লেজটা অতি আত্মবিশ্বাসে এদিকসেদিক নাড়াতে নাড়াতে চিতাবাঘটা নিজের লোভনীয় খাদ্যের খোঁজে একেবারে ভিতরে প্রবেশ করে বসেছে। খোলা প্রান্তরে শিকারের মুখোমুখি হলে কোনো সমস্যাই ছিল না। কিন্তু এখন একদল বনমানুষ ফাঁদে পড়ে গেছে, ধ্বংসের ভয়ই তাদের অসম্ভব কাজের পথ বাৎলে দেয়। প্রথমবারের মতো তারা অসম্ভবকে সম্ভব করে তোলার সুযোগ পেয়েছে।

প্রথমে মাথায় আঘাত পেয়ে চিতাটা বুঝতে পারে কোথাও বড় ধরনের গড়বড় আছে। সেটা যে কোথায় তা খুঁজে পায় না। নিজের নখর সামনে বাড়িয়ে দিয়ে গেঁথে ফেলে নরম মাংসে, একই সাথে আরো ব্যথা টের পায়। পেটের দিকে বেশ তীক্ষ্ণ, কেটে ফেলার মতো শক্তিশালী আঘাতের স্বাদ টের পায় একবার, দুবার, এমনকি তৃতীয়বারও। একপাক ঘুরে যায় হিংস্র জন্তুটা, চারপাশের নৃত্যরত ভয় পাওয়া প্রাণীগুলোকে প্রতিরোধ করতে চায়।

এবারো আরেক কষ্ট টের পায় সেটা। কেউ যেন নাকটা একদম কেটে ফেলেছে। ওর সাদা দাঁতগুলো ঝিকিয়ে ওঠে, বসে যায় সামনের অন্টিলোপ হাড়গোড়ের উপর। এবার অবিশ্বাস্যভাবেই কাটা পড়ে তার লেজটা।

চারদিকে পাক খাচ্ছে জটা। গুহা দেয়ালের গায়ে অন্ধভাবেই আঘাতের পর আঘাত করছে। এতক্ষণ যাই করে থাক না কেন, আঘাত বর্ষণ থেকে একটুও বিরত হয়নি বনমানুষেরা। ওদের হাতে নিষ্ঠুর সব যন্ত্র, হাত অপরিণত হলেই বা কী এসে যায়, শক্তি আছে অপরিমেয়। এদিকে চিতার নাক ব্যথা চূড়ান্তে পৌঁছেছে, আতঙ্কে পাগল হওয়ার দশা। অবিসংবাদিত শিকারীই এবার পরিণত হয়েছে অসহায় শিকারে, সব চিন্তা বাদ দিয়ে পিছু হটার ভাবনায় সে এখন দিশেহারা।

এবার বাঘ দ্বিতীয় ভুলটা করে বসে, ব্যথা-যন্ত্রণায় কাতর হয়ে কোথায় আছে তাই ভুলে বসে। নয়তো চোখদুটোও গেছে নষ্ট হয়ে। ব্যাপার যাই হোক না কেন, বজ্রের মতো ছিটকে বেরোয় গুহা থেকে। খোলা বাতাসে পড়তে পড়তে বিকট গর্জনও করে চিতাটা। অনেক যুগ পরে যেন পতনের এক ভারি আওয়াজ উঠে এলো। প্রাণীটা পাহাড়ের অর্ধেক পেরিয়ে নিচে পড়ে গেছে। পরে শুধু ছোটখাট পাথরের গড়িয়ে পড়ার শব্দই শোনা যায়। পাথরগুলো হারিয়ে যাচ্ছে আঁধার রাতের পথে।

আনন্দের আতিশয্যে অনেকক্ষণ ধরে চন্দ্র-দর্শী নেচেকুদে বেড়ায় গুহামুখে। অকস্মাৎ যেন টের পায়, আর সে শিকার নয়, নিজেই শিকারী।

গুহায় ফিরে গিয়ে জীবনে প্রথমবারের মতো বেঘোরে ঘুমায় অরণ্যচারী প্রাচীন মানব।

.

তারা সকালে পাহাড়ের পাদদেশে দেখতে পায় চিতার শরীরটাকে। সবাই জানে, এ এক মৃত শরীর-আর কিছু নয়। তবু বিকৃত দানবটার আশপাশে সহজে কেউ ঘেঁষতে চায় না। কিন্তু এবার ওরা এগিয়ে এসেছে হাড়ের ঘুরি আর আঁচড় কাটার হাতিয়ার নিয়ে।

কাজটা আসলেই কঠিন। সেদিন আর বনমানুষের দল চষে বেড়ায়নি পাহাড়ের পাদদেশ। প্রথমবারের মতো।

অধ্যায় ৫. ভোরের প্রথম মোকাবিলা

ভোরের প্রথম মৃদু আলোয় দলকে পানির দিকে ঠেলে দিয়েই চন্দ্র-দর্শী হঠাৎ করে থেমে গেল পথের উপর। কিছু একটা নেই। কী যে নেই, বোঝা যাচ্ছে না-কিন্তু কিছু একটা নেই। এ নিয়ে চিন্তা ক্ষয়ের কোনো কারণ দেখে না সে, কারণ সকাল থেকে তার মাথায় চক্কর দিচ্ছে অন্য ধান্ধা।

বিজলীর মতো, মেঘের কালো দলের মতো, চাঁদের সরু আর পেটমোটা হওয়ার মতো সেই বিশাল মনোলিথটা উধাও হয়ে গেছে। যেভাবে এসেছিল, চলে গেছে সেভাবেই। একবার আঁধার অতীতে চলে যাওয়ায় আর কখনোই চিন্তাটা জ্বালাতন করবে না চন্দ্র-দর্শীর মনকে।

সে কোনোকালেই জানবে না কী হারিয়ে গেল চিরতরে। কী করে দিয়ে গেল ওর পুরো জগৎটায়। চন্দ্র-দর্শীর সাথীরা থমকে দাঁড়ায়নি। সকালের রহস্যময় কুয়াশায় তারা শুধু ঘিরে ধরেছে দলপতিকে, কেন দাঁড়িয়ে আছে ও এখানে?

নালাটার নিজেদের দিকের প্রান্তে নিজেদের ত্রাসহীন এলাকায় দাঁড়িয়ে অন্যেরা চন্দ্র-দর্শী আর তার দলের দশ বারোজন পুরুষের দেখা পায়। যেন প্রথম আলোয় চলন্ত কোনো বহর। সাথে সাথেই নিজেদের প্রাত্যহিক চ্যালেঞ্জ শুরু করে দেয়। এই প্রথম সেপাশ থেকে কোনো জবাব আসে না।

ধীরে সুস্থে, উদ্দেশ্যমূলকভাবে সবচে বড় কথা, নিরবে-চন্দ্র-দর্শী আর ওর দল নদীর অন্যধারের নিচু টিলাটায় গিয়ে ওঠে। ওদের এসব কাণ্ডকারখানা দেখে অন্যেরা একদম নিশুপ হয়ে গেল। বাহাদুরির বদলে হঠাৎ আসা ভয় ওদের জড়সড় করে ফেলেছে। ওরা হালকা বুঝতে পারে যে কিছু একটা ঘটছে, কী যে ঘটছে সেটা বুঝতে পারে না। এবারের মুখোমুখি হওয়াটা আর সব বারের চেয়ে ভিন্নতর। চন্দ্র-দর্শীর দলের হাড়ি-লাঠি আর চাকু-ছুরি ওদের মোটেও ভয় পাওয়ায়নি, কারণ উদ্দেশ্যের এক কোণাও অন্যদের উপলব্ধিতে ঠাই পায়নি। অন্যরা শুধু বুঝতে পেরেছে যে তাদের শত্রুদলের নড়াচড়ায় ভিন্ন কিছু বোঝা যায়।

পানির প্রান্তে পার্টিটা শেষ হতেই অন্যদের আত্মবিশ্বাস ফিরে আসে। নেতৃত্ব দিচ্ছে এক কানওয়ালা, তারা আবার আধাআধি আত্নবিশ্বাস ফিরে পেতে থাকে। এই বিশ্বাসটা তুঙ্গে থাকে মাত্র কয়েক মুহূর্ত। তারপরই লা জওয়াব হয়ে যায় তারা একটা দৃশ্য দেখে।

চন্দ্র-দর্শী নিজের হাতটাকে অনেক অনেক উপরে তুলে ধরার চেষ্টা করে। দেখিয়ে দিচ্ছে দলের লম্বা লোমে আবৃত শরীরগুলোর পেছনে এতক্ষণ লুকিয়ে রাখা বিশেষ একটা গর্বের জিনিসকে। ও একটা ডাল ধরে রেখেছে, সেটার উপর চিতার রক্তাক্ত মাথা। একটা কাঠি ঢুকিয়ে মুখটাকেও হাঁ করিয়েছে ওরা। সামনের দিকের লম্বা দন্তগুলো ঝিকিয়ে উঠেছে সূর্যোদয়ের আলোর স্রোতে।

অন্যদের বেশিরভাগই এত বেশি ভয় পেয়েছে যে বাহতের মতো চেয়ে আছে মাথাটার দিকে। কোনো কোনোটা ধীরে পিছু হটছে। চন্দ্র-দর্শীর এরচেয়ে বেশি উৎসাহের দরকার নেই। মাথার উপর বিকৃত জিনিসটা ধরে রেখেই সে ক্ষীণস্রোতা খালটা পেরুতে শুরু করে। একপল দ্বিধা করে পিছু নেয় সঙ্গীরাও।

দূরপ্রান্তে পৌঁছার পরও এক কানওয়ালা নিজের জায়গায় স্থির দাঁড়িয়ে রইল। হয় সে অতি সাহসী, নয়তো নিতান্তই নির্বোধ। সম্ভবত বুঝতেই পারেনি এ অসম্ভব কী করে সম্ভব হয়! বীর হোক আর ভীতু, শেষে কোনোটাই কাজ দেয় না। কারণ এবার অপ্রতিরোধ্য মৃত্যু নেমে এসেছে তার মাথায়।

ভয়ে দিগ্বিদিক জ্ঞান হারিয়ে অন্যেরা আশপাশের ঝোপে লুকিয়ে পড়ে। কিন্তু একসময় তারা ঠিকই ফিরে আসবে, ঠিকই ভুলে যাবে গোত্রপতিকে।

কয়েক পল চন্দ্র-দর্শী তার নিজের নতুন শিকারের উপর দাঁড়িয়ে থাকে। অবাক চোখে দেখে মরা চিতাবাঘটারও হত্যার ক্ষমতা আছে।

আজ সে জগদীশ্বর হলেও ঠিক ঠিক বুঝে উঠতে পারে না কী করতে হবে এরপর।

কিন্তু সে হয়তো কিছু না কিছু করার কথা ভেবে রেখেছে।

অধ্যায় ৬. মানুষের অরুণোদয়

নতুন এক প্রাণী জন্মেছে গ্রহে। আফ্রিকার উৎসভূমি থেকে উঠে এসে ছড়িয়ে পড়ছে চারদিকে ছড়িয়ে পড়াটা এত মন্থর গতির যে সাগর আর ভূমিতে বিচরণশীল প্রাণীর উপরে একটা ভালো আদমশুমারীতে হারটাকে গোনা গুনতিতেই ধরা হবে না। এখনো তেমন জোরালো প্রমাণ পাওয়া যায় না যার উপর ভিত্তি করে বলা যায় এরা উন্নয়ন করবে। বাঁচবে যে তাই জোর দিয়ে বলা যায় না। কারণ এ বসুধার বুকে অগুনতি দানব প্রাণী ব্যর্থ হয়ে ফিরে গেছে। তাদের পাল্লা আজো একবার এদিকে, আরেকবার সেদিকে হেলে যায়।

স্ফটিকগুলো আফ্রিকায় বর্ষিত হওয়ার লাখো বছরের মধ্যে বনমানুষেরা কিছুই আবিষ্কার করতে পারেনি। কিন্তু তারা বদলে যাচ্ছে। তারা এমন কিছু দক্ষতা অর্জন করেছে যা আর কোনো প্রাণীর নেই। হাড়ের তৈরি লাঠিগুলো বাড়িয়ে তুলেছে সম্পদ, বাড়িয়ে চলেছে তাদের শক্তি। আজ আর প্রতিযোগী খাদকদের সামনে তারা অসহায় নয়। ছোটখাট মাংশাসীগুলোকে নিজেরাই তাড়িয়ে বেড়াতে পারে; বড়গুলোর উৎসাহে বরফ ঢেলে দিতে পারে, মাঝে মাঝে করে লড়াই।

তাদের বিকট দর্শন দন্তসারি ছোট হতে থাকে; আজ আর সেসব জরুরী নয়। তীক্ষ্ণ কোণার পাথর দিয়ে শিকড়বাকড় খুঁড়ে নেয়া যায়, কাটা যায় গোশত আর আঁশ। এগুলোই বড় দাঁতের জায়গা দখল করে কালক্রমে। বুনোরা আর দাঁত হারালে বা দাঁতের সমস্যায় পড়লে উপোস দেয় না। এসব সরলতম ভোতা হাতিয়ার মানিয়ে নিতেই তাদের পেরিয়ে যায় কত শতাব্দী! শক্তিশালী জান্তব চোয়াল নিচু আর ছোট হয়ে আসে। গালের হাড় আর বেরিয়ে থাকে না, তাই মুখ আরো স্পষ্ট, কোমল, জটিল আওয়াজ তুলতে পারে নির্বিঘ্নে। ভাষা আজো সুদূর পরাহত; লাখো শতাব্দী পেছনে পড়ে আছে-কিন্তু এর দিকে প্রথম কদম ফেলা হয়ে গেছে।

এবার ভুবন বদলে যেতে লাগল। দুনিয়ার সর্বত্র করাল ছোবল হেনে ফিরে গেল হিমযুগ। এর চার চারটা জোয়ার দু-লাখ বছর করে সময় নিয়ে ডুবিয়ে দিয়ে গেল পুরো বিশ্বটাকে। ভাটার সময়টুকু বাদ দিয়ে হিমবাহের বহর নির্দয়ভাবে হত্যা করল কত অপরিণত প্রাণীকে! চারদিকে সেসব প্রাণীর চিহ্ন। তারা পারেনি মানিয়ে নিতে।

কুম্ভকর্ণের তামসিক নিদ্রা শেষ হলে বনমানুষসহ গ্রহের প্রথমদিকের জীবনগুলো টিকে যায়। কেউ বংশধর ছেড়ে যায় পৃথিবীর বুকে, তারা হারিয়ে না গেলেও বদলে গেছে অনেকটা। এবার হাতিয়ারের কারিগরেরা হাতিয়ারের প্রয়োজনেই বদলে গেছে।

হাড়ি আর পাথরের ব্যবহারের জন্য তাদের হাত নিয়েছে নতুন রূপ, যেটা প্রাণীরাজ্যের কোথাও পাওয়া যাবে না। এ হাতই আবার নতুন, জটিল হাতিয়ার গড়ার উপযোগী হয়ে ওঠে, সেসব নতুনতর যন্ত্রপাতির প্রয়োজনে বদলে যায় তাদের মস্তিষ্ক, নব রূপলাভ করে বাহ্যিক অঙ্গগুলো। এ এক দ্রুতিময়, বাড়ন্ত প্রক্রিয়া; এর শেষ পরিণতিকেই ডাকা হয় মানব নামে।

প্রথম সত্যিকারের মানব যেসব হাতিয়ার ব্যবহার করত তা তার পূর্বপুরুষের ব্যবহার করা জিনিসের চেয়ে খুব একটা ব্যতিক্রমী কিছু নয়; কিন্তু সে সেগুলোকে অনেক সহজে অনেক বেশি কাজে ব্যবহার করতে শেখে। সেসব যন্ত্রপাতিও শতাব্দীর অতলে কী করে যেন হারিয়ে যায় সর্বকালের সবচে জরুরী ব্যাপারটার উদ্ভবের আগ দিয়ে। একে ধরাও যায় না, যায় না ছোঁয়া। কথা বলতে শিখতেই সে সময়ের উপর প্রথম বিজয়মাল্যটা ছিনিয়ে আনে নিষ্ঠুরতার সাথে। এবার জ্ঞানকে প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে পরিবাহিত করে চলে সহজেই। আগের প্রজন্মের অভিজ্ঞতার পুরোটাই চলে আসে পরের প্রজন্মের হাতের মুঠোয়।

জন্তু জানোয়ারের আছে শুধু বর্তমান, কিন্তু মানুষ এবার অতীতসমৃদ্ধ প্রাণী, তার আছে স্বপ্নেছাওয়া ভবিষ্যৎ।

এবার সে জোরেসোরে প্রকৃতিকে বেঁধে ফেলতে চায় অগ্নিদেবের বাহুডোরে। সে আগুনের সাথে সাথে আবিষ্কার করেছে প্রযুক্তির স্বর্ণদুয়ার, নিজের জান্তব অতীতকে ফেলে দিয়েছে যোজন যোজন পেছনে।

প্রস্তর হার মেনে যায় তাম্রযুগের কাছে, তামা মাথা নোয়ায় লৌহ শৃঙ্খলের সামনে। শিকারের শেষ পরিণতি হিসেবে জন্ম নেয় কৃষি। গোত্রগুলো একত্র হয় গ্রামে, গ্রামের শেষ পরিণতি শহর। কথা চিরস্থায়ী রূপ নেয়; অবদান রাখে লম্বা পাথর, কাদার ফলক আর প্যাপিরাস। আজকাল সে আবিষ্কার করেছে দর্শন শাস্ত্র আর ধর্ম। এবার বসত করা শুরু করেছে আকাশে, পুরোপুরি সেরে উঠতে পারেনি, আজো জয় করতে পারেনি দেবতাদের।

তার শরীর আরো প্রতিরক্ষাহীন হয়ে পড়ার সাথে সাথে শত্রুরাও বেশি বেশি ভীত হয়ে পড়ে। স্টোন আর ব্রোঞ্জ আর আয়রন আর স্টিলের কাল আসার সাথে সাথে সে প্রতিটা জিনিসকে পরখ করে দেখেছে, যা ভাঙা যায়, যা চিরে দেখা যায় এমন সব কিছুকেই। কিছুদিনের মধ্যেই শত্রুকে দূর থেকে ঘায়েল করার কূটবুদ্ধিও তার দখলে চলে আসে। তীর, ধনুক, বন্দুক আর সবশেষে গাইডেড মিসাইল” তাকে দিয়েছে অসীম পাল্লা, দিয়েছে আর সব; শুধু দেয়নি অসীম ক্ষমতা।

মাঝে মাঝে নিজেরই বিরুদ্ধে নিজের ব্যবহার করা এসব মারণাস্ত্র ছাড়া মানব কখনোই পৃথিবীর অধীশ্বর হতে পারত না। এ কাজেই সে নিজের সবটুকু দক্ষতা ঢেলে দিয়েছে। যুগ যুগ ধরে সেগুলো কাজও দিয়েছে বেশ।

কিন্তু আজ সহসাই সে সেসব রক্ষাকারীর কারণেই জীবন চালাচ্ছে ধার করা সময়ের উপর ভর করে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *