৫. শনির শশীর দেশে

পঞ্চম পর্ব : শনির শশীর দেশে

অধ্যায় ৩১. বাঁচা

কাজই যে-কোনো মানসিক আঘাতের জন্য সবচে বড় প্রতিষেধক। এখন বোম্যানের হাতে অনেক অনেক কাজ। তাকে সবার আগে ডিসকভারির জীবন ফিরিয়ে আনতে হবে।

সবার আগে লাইফ সাপোর্টের ঝক্কি। অনেক অনেক অক্সিজেন হারিয়ে গেছে, তাতে কী? রিজার্ভেশনে একজনের জন্য যথেষ্ট পরিমাণ জীবন-বাষ্প মজুদ আছে। প্রেশার আর টেম্পারেচার রেগুলেশন ইউনিট যথেষ্ট শক্তিমান। এগুলোর সাথে হালের নাক গলাবার কোনো প্রয়োজন পড়ে না, পড়লেও খুব কম। পৃথিবীর কম্পিউটার বেশিরভাগ কাজই করতে পারে, শুধু বিশাল সময়-পার্থক্যটা ভোগাবে। শিপের গায়ে কোনো সমস্যা থাকলে বা ছিদ্র হয়ে গেলেও সে খবর পেতে পেতেই তিন ঘণ্টা কেটে যাবে।

শিপের পাওয়ার, নেভিগেশন, প্রপেল্যান্ট সিস্টেমগুলো এখনো অক্ষত আছে। বড় কথা হল, আগামী কয়েক মাসের মধ্যে এর শেষ দুটির প্রয়োজন পড়বে না। শিপের কোনো পরিপূর্ণ কম্পিউটার না থাকায় পৃথিবী এই মিশনের উপর ছড়ি চালাবে।

একটা কথা ভেবে নিজেকে সান্ত্বনা দেয় বোম্যান, ভাগ্যিস, হাইবারনেশনের তিনজন তার সহকর্মী ছিল, তেমন ঘনিষ্ঠ বন্ধু নয়। তাহলে পাগল না হয়ে আর উপায় থাকত না। তারা মাত্র কয়েক সপ্তাহের জন্য ট্রেনিংয়ের সময় একত্রে ছিল।

শেষবারের মতো হাইবারনেকুলাম বন্ধ করার সময় তার অনুভূতি হল এক মিশরীয় মমি চোরের মতো। সেই তিনজনই তার আগে শনিতে পৌঁছবে, কিন্তু পোলের আগে নয়। কী এক অদ্ভুত কারণে যেন সে এই ভাবনায় তৃপ্তি পায়।

পাঁচজনের খাবার আছে সাপ্লাই সেকশনে। এমনও হতে পারে-উদ্ধার পর্যন্ত সে হাইবারনেশনে না গিয়েই শনির বুকে কাজ চালিয়ে যেতে পারবে।

সে এত লম্বা লম্বা চিন্তা বাদ দিয়ে সাম্প্রতিক ভাবনায় মশগুল হতে চাচ্ছে। সময় নিয়ে শিপের জঞ্জাল পরিষ্কার করে, সব যন্ত্রকে ঠিকমতো কাজ করতে দেখে অবাক হয়, পৃথিবীর সাথে টেকনিক্যাল ব্যাপারগুলো নিয়ে মাথা ঘামায়, ঘুমায় আরো কম। সে প্রথম সপ্তাহগুলোয় আসতে থাকা রহস্য নিয়ে মাথা ঘামাতো-তাও অবসর সময়ে। মহাকাশ অভিযানের জন্য বাছাইকৃত সেরা জ্যোতির্বিদদের নেয়া হয়, এবারও কথাটার প্রমাণ মিলছে।

অবশেষে শিপের সমস্যা একটু একটু করে কমে এলে বোম্যান শিপকে অটোম্যাটিক রুটিনে দিয়ে পৃথিবী থেকে পাঠানো খবর আর কাগজ ঘাঁটার সময় বের করে নিল। টি এম এ-১ এর সেই চিৎকারের সময় তোেলা ভিডিওটা বারবার দেখা শুরু করেছে।

সেই একবারই। তারপর কালো কঠিন জিনিসটা আর কোনো উচ্চবাচ্য করেনি। এরপর আর তাকে কেটে ফেলার কোনো চেষ্টাই করা হয়নি, এর পেছনে যেমন বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিকোণ কাজ করেছে তেমনি কাজ করেছে ভয়।

চিৎকারের পরপরই চৌম্বকক্ষেত্রটা বিলীন হয়ে যায়। কেউ বলে এটা মাটি থেকে শক্তি সঞ্চয় করে, আবার কেউ বলে অভ্যন্তরীণ শক্তিকেন্দ্রের কথা।

একটা অবাক করা ব্যাপার সবাইকে ভাবায়। ব্যবহারিক বিজ্ঞানীরা সেটাকে তেমন পাত্তা না দিলেও অন্যেরা ছেড়ে কথা বলছে না। এর উচ্চতা এগারো ফুট। দৈর্ঘ্য-প্রস্থ-উচচতার মাপ নিতে গিয়ে একটা বিষম খেতে হয়, মাপ দাঁড়ায় ১:৪:৯–প্রথম তিন অবিভাজিত সংখ্যার বর্গমূল। এটা কাকতালীয় ব্যাপার হতেই পারে না। কারণ এর সঠিকত্ব অসীম। এত সুন্দর কিন্তু সরল আকারে এমন একটা জিনিস পুরো পৃথিবীর তাবৎ বিজ্ঞানকে এক করলেও বানানো সম্ভব নয়।

পৃথিবী থেকে এখন কেমন যেন গা বাঁচিয়ে চলা খবর আসছে। মিশন কন্ট্রোল পুরো ব্যাপারটা গোড়া থেকে খতিয়ে দেখতে চায়। ওরা একটু আত্মরক্ষামূলক কাজে বেশি আগ্রহী। তবে পাঠানো নজিরগুলো মজার, প্রতিরক্ষা বিভাগ কোনো এক গোপন কার্যক্রম চালিয়েছিল যার নাম প্রজেক্ট বারসুম। হার্ভার্ড স্কুল অব সাইকোলজির সেরা সেরা মনোবিজ্ঞানীরা ঊনআশিতে মানুষের উপর পরীক্ষা চালিয়ে নিশ্চিত হয়েছে, অন্য সভ্য প্রাণী আছে এবং তারা মানুষের সাথে যোগাযোগ করে। এ কাজ মামুলী জিজ্ঞাসাবাদ বা অনুরোধে থেমে থাকেনি; সম্মোহন, ড্রাগ আর ভিজুয়াল ইফেক্টও ব্যবহার করা হয়েছে যত্রতত্র। এ তিন ক্ষেত্রে কোনো অবস্থাতেই মানুষের পক্ষে মিথ্যা বলা সম্ভব নয়।

গবেষণা কাজের সময় বেশিরভাগ স্বীকারকারীই মানসিক রোগীতে পরিণত হয়, কোনো কোনো সময় অদ্ভুত বাধা আসে আবার কখনো নানা ধরনের হুমকির সম্মুখীন হতে হয় গবেষকদের। এমনকি এর ফলাফলও শেষ পর্যন্ত প্রকাশ করা সম্ভব হয়নি। এইচ জি ওয়েলসের[৪২] ওয়্যার অব দ্য ওয়ার্ল্ডস বইয়ের কল্যাণে যে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে[৪৩] তার কারণেও ফলাফল বাধা পায়।

আরো একটা ব্যাপারে তার সন্দেহ দানা বাঁধে। গোপনীয়তার কারণ হিসেবে সাংস্কৃতিক আঘাতকে আসল সমস্যা দেখানো হলেও ঘাপলাটা অন্য কোথাও। আমেরিকা-রাশিয়া আঁতাত হয়তো অন্য বুদ্ধিমত্তার সাথে সবার আগে যোগাযোগ করার সুবিধা নিতে চাচ্ছে। এমনকি এর ফলে পৃথিবী থেকে ‘দেশ’ প্রথাটাও তুলে দিতে হতে পারে। তখনো নিয়ন্ত্রক থাকার ইচ্ছা স্বভাবতই জাগবে ক্ষমতাবান দেশগুলোর মনে। এতদূর থেকে ছোট্ট নক্ষত্রের মতো দেখতে সেই গ্রহটা। তাই মহাকাশের অসীম শূন্যতায় ব্যাপারটাকে চরম স্বার্থপরতা বলে মনে হয়।

সে এখন হালের এই অদ্ভুত আচরণের সাথে ব্যাপারটাকে মিলিয়ে দেখার তালে আছে। এখন আর সত্যিটা জানার উপায় নেই, কিন্তু একই সাথে তিন তিনটি নাইন থাউজ্যান্ড কম্পিউটার কী করে মানসিকভাবে অকেজো বা পাগলাটে হয়ে যায় সে ব্যাখ্যা উদ্ধার করা নিতান্ত কষ্টসাধ্য। হালের স্রষ্টারাই যদি তার এই হঠাৎ আচরণকে ব্যাখ্যা করতে না পারে তো কী করে দূর পৃথিবীর বাসিন্দাদের সাথে মানিয়ে নিবে?

বোম্যান ডক্টর সিমনসনের ব্যাখ্যাটা পুরোপুরি বিশ্বাস করেছিল। হাল তার অপরাধবোধ আর প্রোগ্রাম বৈপরীত্যের কারণে গাড্ডায় গেছে, কিন্তু সে পোলকে কেন খুন করবে? আর সব আতঙ্কিত অপরাধীর মতো সেও আস্তে আস্তে অপরাধের জালে জড়িয়ে গেছে।

আর আতঙ্ক যে কী জিনিস তা বোম্যান জানে। কারণ এর সর্বোকৃষ্ট উদাহরণ সে এক জীবনে দুবার দেখেছে। ছেলেবেলায় আগাছায় পা জড়িয়ে যাবার সময় যখন ডুবছিল তখন একবার, আরেকবার জ্যোতির্বিদের ট্রেনিংয়ের সময়। নষ্ট একটা গজের রিডিং দেখিয়েছিল যে সে নিরাপদ আশ্রয়ে যাবার আগে অক্সিজেন ফুরিয়ে যাবে।

সেই মুহূর্তগুলোয় সে তার সমস্ত যৌক্তিকতা খুইয়ে বসে। কিন্তু অন্য যে কেউ হলে সব বিচারবুদ্ধির ধার না ধেরে পাগলামি শুরু করত।

এ ব্যাপারটা মানুষের ক্ষেত্রে হলে হালের বেলায়ও হতে পারে।

এসবই এখন অতীত, ডেভিড বোম্যানের চিন্তা-চেতনা ঘুরপাক খায় ভবিষ্যৎ নিয়ে।

অধ্যায় ৩২. অবাক করা অপার্থিব

খাবার ভালই পাওয়া যায়, মূল ফুড ডিস্পোরগুলো যে নষ্ট হয়নি তাও সৌভাগ্য বলতে হবে। এখন বোম্যান মূলত বাস করে কন্ট্রোল ডেকে। নিজের সিটটাও এখানে এনে নিয়েছে। খাবারের জায়গা কাছে, কাজের জায়গাতো এটাই।

মিশন কন্ট্রোলের কথামতো সে ডিসকভারির মোটামুটি ঠিকমতো চলতে থাকা লাইফ সাপোর্ট সিস্টেমও বন্ধ করে দিয়েছে। কারণ, বোঝাই যায় সে শনি পর্যন্ত যেতে যেতে বেঁচে থাকবে। ডিসকভারি সেখানে যাবেই, জীবিত বা মৃত ডেভ বোম্যানকে সঙ্গী করে।

তার হাতে দৃশ্য দেখার মতো তেমন বাড়তি সময় নেই, মহাকাশের দৃশ্যও তেমন মনোহর নয়, তার উপর সে কাজের চাপে নিজের খাবার কথাই ভুলে যায়-আর দৃশ্য দেখা! তারপরও মিল্কি ওয়েস্ট দেখে তার চোখ যেন বিভোর হয়ে পড়ে; এর নক্ষত্রের মেঘ বিবশ করে দেয় চোখকে। সেখানে স্যাগেটাসের সেই চিরকালীন রহস্য ঘুমিয়ে আছে, অজস্র নক্ষত্র চিরকাল নীহারিকাটার কেন্দ্রবিন্দু ঢেকে রাখে সযত্নে, সেখানে মুখ ঘুরিয়ে আপন আপন সৌরজগৎ নিয়ে পাক খায়। সেখানেই সেই চির অমানিশার দেশ-সেখানে কোনো তারকা আপন দীপ্তি নিয়ে জ্বলে। আর এইতো আলফা সেন্টোরি-সবচে কাছের নক্ষত্র, নক্ষত্রলোকের দরজা।

সিরেয়াস ও ক্যানোপাসের চেয়েও আলফা সোন্টোরির আবেদন তার কাছে অনেক অনেক বেশি। এর আলোকমালা কয়েক বছর সময় নেয় এই জগতে পৌঁছতে, পৃথিবী সবসময় এক ধরনের যন্ত্রণায় সময় কাটায়-সবচে কাছের নক্ষত্রেও না যেতে পারার যন্ত্রণা।

শনি-জগৎ আর টি এম এ-ওয়ানের সাথে যে কোনো না কোনো সম্পর্ক আছে তা নিয়ে এখন আর কারো কোনোরকম সন্দেহ নেই। কিন্তু বিজ্ঞানীরা বিশ্বাস করতে চান না যে সেখান থেকেই টি এম এ-ওয়ানের স্রষ্টাদের আবির্ভাব ঘটেছিল। জীবনদায়িনী হিসাবে শনি বৃহস্পতির চেয়েও ব্যর্থ, তার বেশিরভাগ উপগ্রহই কোটি বছরের কুম্ভকর্ণ-নিদ্রায় শুয়ে আছে, ঘুমটা সহজে ভাঙাও সম্ভব নয়-শূন্য থেকে তিন হাজার ডিগ্রি নিচে সেখানকার উত্তাপ। বায়ুমণ্ডলের মালিক শুধু টাইটান-তাও টেনেটুনে দূষিত মিথেনের একটা চাদর বলা চলে সেটাকে।

সুতরাং যে প্রাণীরা ত্রিশলাখ বছর আগে ঘুরে গেছে তারা শুধু অপার্থিব নয়, অসৌরজাগতিক। তারার দেশের পরিব্রাজকদল যেখানে সুবিধা সেখানেই একটা ঘাঁটি গেড়ে নিয়েছে-এমনি মনে হয়। কিন্তু জ্বালা ওঠানো সমস্যাটা অন্য কোথাও। পৃথিবী থেকে শনিতে সূর্যের আলো যেতে লাগে কমবেশি দেড়-দু ঘন্টা, সূর্য থেকে পৃথিবীতে আলো আসতে প্রয়োজন প্রায় আট মিনিট; অর্থাৎ পৃথিবী-শনির দূরত্ব দুই আলোক ঘণ্টার কাছাকাছি। সেখানে যেতেই দু-বছর লাগলে কয়েক আলোকবছরের পথ যেতে মানুষের কত প্রজন্ম কেটে যাবে? এজন্য কতটুকু উন্নত প্রযুক্তির কাছে ধর্ণা দিতে হবে?…এবং আদৌ কোনো প্রাণীর পক্ষে তা করা কি সম্ভব?

অনেক বিজ্ঞানী সোজা মাখা নাড়েন। না। তারা দেখিয়েছেন যে মানুষের দ্রুততম যান ডিসকভারির আলফা সেন্টোরিতে পৌঁছতে মাত্র বিশ হাজার বছর সময়ের দরকার। আর নীহারিকা ওরফে গ্যালাক্সির হিসাবের কাছে এ-তো নস্যিরও অধম। এমনকি আগামী শতাব্দীগুলোতে প্রপালশন সিস্টেম বা মহাকাশযান জ্বালানী-ব্যবস্থা অকল্পনীয় উন্নয়ন করলেও তাদের সামনে একটা বাধার অটল হিমালয় দাঁড়িয়ে যাবে। তা হল আলোর গতি। আলোর গতিকে পেছনে ফেলা কোনো বস্তুর কম্ম নয়, বরং তার ফলে বস্তু শক্তিতে রূপান্তরিত হবে-এমন কথাও আইনস্টাইনীয় গবেষকরা বলে বেড়ান। সেই আলোই যদি সবচে কাছের নক্ষত্র থেকে আসতে প্রায় আধযুগ লাগিয়ে দেয় তো দু-চারটি নক্ষত্রের ওপার থেকে ভিনগ্রহীদের আসতে কীরকম ভোগান্তি পোহাতে হবে তা বলাই বাহুল্য। এমন অনেক নক্ষত্র আবিস্কৃত হয়েছে যেখান থেকে আলো আসতেই কোটি কোটি বছর লেগে যাবে।

সুতরাং, টি এম এ-ওয়ানের নির্মাতারা অবশ্যই একই সূর্যের আলো পোহাতো-আর যেহেতু ঐতিহাসিক কালের মধ্যে তাদের কোনো দেখাই মেলেনি, তারা হয়তো কালের গর্ভে হারিয়ে গেছে।

আবার কয়েকজন একথা মানতে রাজী নন। শত-শত বছর লাগলেও নক্ষত্রান্তরের পথচারীরা যে আসেনি তারইবা নিশ্চয়তা কোথায়? হাইবারনেশনের প্রযুক্তি এখনি মানুষ ব্যবহার করতে পারলে তারা কেন অত উন্নত অবস্থায় পারবে না? তার উপর, তাদের জীবনকাল আমাদের সাথে তুলনা করার মানে কী? কোনো ব্যাক্টেরিয়া বাঁচে তিন ঘণ্টা (যদি ভাগ হওয়াকে মৃত্যু ধরা হয়) আবার কচ্ছপ বাঁচে সাড়ে তিনশো বছর, আবার কোনো কোনো গাছ কয়েক হাজার বছর বাঁচে-এমন কথাও বলা হয়। এ-তো পৃথিবীর পরিবেশের হিসাব। তাদের পরিবেশ হবে আলাদা, জীবনের মূল অণুও ভিন্ন হতে পারে, সুতরাং হাজার হাজার বছর বেঁচে মহাকাশ অভিযান করা কোনো ধর্তব্য বিষয় নয়।

তার উপর, স্ববাহিত কৃত্রিম জগতের কথাও মাথায় রাখতে হবে। একটি স্পেসশিপে যদি নিজেদের জগতের সবকিছু নিয়ে একটা ছোট্ট পরিবেশ গড়ে তোলা যায়, সেটাই তাদের জগতে পরিণত হবে এবং প্রজন্মের পর প্রজন্ম পেরিয়ে যাবার পর লক্ষ্যে পৌঁছতে পারলেও চলবে।

টি এম এ-ওয়ান যে নিজেই খবরটা নক্ষত্রজগতে পাঠিয়ে দিয়েছে তা না ভাবলেও চলে। কারণ তার এই তরঙ্গ পৌঁছতেও অনেক সময় প্রয়োজন। কারণ এ গতিতে সংবাদ গেলে সাথে সাথে ঐ পক্ষ থেকে সাড়া আসলেও তা এখানে হাজির হতে হতে শতাব্দীর পর শতাব্দী পেরিয়ে যাওয়া বিচিত্র কিছু নয়। অনেকের কাছেই এ এক স্বস্তির খবর।

স্বস্তিটা উবে যায় একথা শুনলে, শনি থেকে আসল খবর প্রচারিত হয়ে থাকতে পারে, অন্য গতিতে। কিন্তু স্বস্তি উবানোর মতো আরো কথাবার্তা বলে কিছু তাত্ত্বিক পদার্থবিজ্ঞানবিদ্বেষী বিজ্ঞানী, আমরা কি শিওর যে আলোর গতি একটা অসম্ভব বাধা, একে ভাঙা যাবে না?

এ কথা সত্যি যে আপেক্ষিকতার বিশেষ তত্ত্বকে নির্ভরযোগ্য ধরা হয়। কিন্তু এ তো সত্যি যে শত বছর পেরুনোর আগেই এর গায়ে কিছু ভাঙন দেখা দিয়েছে।

যারা এসব চিন্তাকে প্রশ্রয় দেয় তাদের আরেক তত্ত্ব হল আন্ত:মাত্রিক তথা ইন্টার ডাইমেনশনাল ভ্রমণ। স্থানকে একইভাবে রেখে একপাশ থেকে আরেকপাশে চলে যাওয়া-যেমন করে সুই দিয়ে কাঁথা সেলাই করা হয়, সুই কাঁথার নিচ দিয়ে কথাকে একটু মুড়ে নেয়, ফলে যায় অল্প একটু, কিন্তু কাঁথার হিসাবে তা কয়েকগুণ বেশি, কুঁড়ে ওঠে অন্যপাশে। হাইপারস্পেসিয়াল কানেক্টিভিটিও বলা হয় একে। প্রিন্সটনের গণিতজ্ঞরা একে বলতেন মহাকাশে পোকার গর্ত।

যারা এসব কথাকে মেনে নিতে পারে, আবার ভোগে দ্বন্দ্বে, তাদের জন্য আছে নিলস বোরের[৪৬] সেই হৃদয়ছোঁয়া কথা, যে কথা হাজারো পাগলাটে বিজ্ঞানীকে তাদের থিওরিতে অটল থাকার পেছনে পূর্ণ সমর্থন জানিয়েছে, ‘তোমার থিওরি পাগলাটে, বড়ই পাগলাটে, কিন্তু বাস্তব যতটা পাগলাটে তত্ত্বটা ততো পাগলাটে নয়।’

কিন্তু পদার্থবিদরা কথা গুছিয়ে আনতে আনতেই জীববিজ্ঞানীদের কচকচি শুরু হয়ে যায়, ‘অপার্থিব প্রাণীরা দেখতে কেমন হবে?’

সাথে সাথেই তারা নিজেদের দুই বিপরীত দলে ভাগ করে ফেলে, একদল চিৎকার করে বলতে থাকে যে তারা অবশ্যই মানুষের মতো দেখতে-আরেকদল সমস্বরে উত্তর দেয়, ‘না। কক্ষনোই নয়।’

প্রথম দলের একটা ভাল দিক আছে, দ্বিপ্রতিসম প্রাণী আমরা। অর্থাৎ শরীরের ঠিক মাঝখান দিয়ে লম্বালম্বি ভাগ করলে দু-পাশে প্রায় সমস্ত অঙ্গই সমপরিমাণে এবং বিপরীতমুখীভাবে আছে। ফলে সব কাজেরই উন্নয়ন ঘটানো সম্ভব হয়েছে প্রায় প্রতিটি অংশের বিকল্প থাকাতে, বেড়েছে গতি, যে কোনো একাংশ নষ্ট হয়ে গেলেও কাজ থামেনি, এসেছে উন্নয়ন। লম্বা দ্বিপ্রতিসমতার পা, পায়ের উপর হাত, হাতের কাছে হৃদপিণ্ড, ফুসফুস, দেহের সবচে উপরে নার্ভাস সিস্টেম ও ব্রেন থাকাতে এবং সীমিত বিশালত্বের কারণে যে সুবিধা পাওয়া যায়, তাকে তারা সর্বোৎকৃষ্ট প্রাণীজ দেহ গঠন হিসেবে আখ্যায়িত করেন। অবশ্যই, এক আধটু পার্থক্য থাকবে-পাঁচের বদলে দু আঙুল, কিম্ভূতরঙা চামড়া আর চুল-এমনকি চেহারার সংগঠন ভিন্ন হওয়াতেও কিছু এসে যায় না। কিন্তু অপার্থিব বা এক্সট্রাটেরিস্ট্রিয়াল বা ই. টি. রা মানুষের সাথে এত বেশি সাদৃশ্যপূর্ণ হবে যে তারাও কম আলোয় দেখতে পারবে না বা খুব বেশি দূরত্ব থেকে স্পষ্ট দেখবে না।

এই যুক্তির স্রোত আরেক নতুন বানে ভেসে যায়। এ জীববিদেরা নিজেদেরকে স্পেস এজ বা মহাকাশ যুগের সন্তান এবং সর্বকুসংস্কারমুক্ত বলে মনে করেন। তারা দেখিয়েছেন যে মানবদেহ লক্ষ লক্ষ বিবর্তনিক পরিবর্তন আর বেছে নেয়ার ফল, সময়ের অপার সমুদ্রে এই পরিবর্তন একটু একটু করে এসেছে-এককোষী এ্যামিবা থেকেই এর শুরু। তার লক্ষ যুগ পর একটু বড় জীবাণু, এরপর অযুত সমুদ্র পেরিয়ে তন্ত্র গঠন, আরো লাখ লাখ বছর পর অঙ্গ তৈরি হওয়া, আরো পরে কর্ডেটে পরিণত হওয়া এবং সবশেষে মাম্মালিয়ার পর্যায়ে এসে বানর থেকে মানুষ’-এ পরিণত হতে আরো আধ কোটি বছর সময় লেগেছে। এই লাখো পরিবর্তনের যে কোনো এক মুহূর্তে মানুষের কোটি জিনের জেনেটিক ছাঁচ একটু এদিকসেদিক পড়ে যেতেই পারে; এর ফলে যদি ভালও হয়ে থাকে-নিশ্চয়ই আদর্শ শরীর থেকে একটু হলেও সরে এসেছে মানুষ। তাহলে, মানুষের গঠন যদি মিলিয়ন মিলিয়ন বছরে একটু একটু নড়েচড়ে বসতে বসতে আদর্শ দেহ থেকে অনেকটা দূরে চলে যেতে পারে তাহলে ঐ প্রাণীরা কোনো দোষটা করল? তাদের গড়নও তো আদর্শ হতে পারে, তাহলেও ভিন্ন হবে। আবার আদর্শ থেকে সরে এলেও ভিন্ন হবে।

আর এ গঠনই যে আদর্শ তাই বা বিজ্ঞানীরা ঠিক করে বলেন কী করে? এরচে ভাল গঠনতো তারা দেখেননি। আর যাদের প্রযুক্তি এত ভাল তাদের গঠনও ভাল হবে। আবার মানুষের গড়ন পার্থিব হিসেবে সবচে ভাল, কিন্তু সেই প্রাণীদের গ্রহের জীবন অণু যদি অক্সিজেন কেন্দ্রিক না হয়, তাদের মাধ্যাকর্ষণ যদি অনেক বেশি হয়, খাদ্য যদি সৌরশক্তির হয়…। মানুষের দেহের বিভিন্ন প্রত্যঙ্গ বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন কাজ করতে করতে এগিয়ে এসেছে-তারা তাদের কাজ বদলে নিয়েছে খেয়াল মাফিক, এমনকি অ্যাপেন্ডিক্সের মতো একেবারে অকেজো অদরকারী অংশও মানুষ বহন করছে তার দেহে। সেটা আগে কাজে লাগলে লাগতেও পারত, এখন লাগে না। তাহলে মানবদেহ কী করে সবচেয়ে উপযোগী হয়? আর দেহ কেন্দ্রিক উন্নয়ন ভেবে মস্তিষ্ক কেন্দ্রিক উন্নয়ন হয়ে থাকলেও ঘাপলা বাধবে। বিবর্তন যদি চলে, তাহলে আরো ভাল গড়ন এগিয়ে আসবে। যেমন, হাতের প্রয়োজন ফুরিয়ে গেলে হাত হয়ে যাবে কাঠির মতো সরু। সেটা খারাপও হতে পারে। সেসব বিজ্ঞানীর শেষ অস্ত্রটাই ভয়ানক, আরে, কে বলল যে মানুষের বিবর্তন ফুরিয়ে গেছে?

আরো ভাবুক আছে, বোম্যান দেখতে পায়, তাদের দৃষ্টি আরো পাগলাটে। তারা বিশ্বাস করে না যে সত্যিকার অগ্রসর সভ্যতা ঠুনকো জৈবিক দেহ টেনে চলবে। প্রযুক্তি এগিয়ে চলতে থাকলে আজ অথবা কাল, তারা অবশ্যই তাদের প্রকৃতি প্রদত্ত ভঙ্গুর, জরা-দুর্দশা-ক্লেশগ্ৰস্ত আবাস ছেড়ে সবদিক দিয়ে নিরাপদ একটা আশ্রয় খুঁজে নেবে। কেন তারা প্রকৃতির আদেশে বিশ্রী এই বাড়িতে সারা জীবন ঝড় ঝা

পোহাবে? তারচে সেখানে না থাকাই কি ভাল না? হ্যাঁ, এই পাগলাটে তত্ত্ববিদেরা মনে করে সেসব প্রাণী অমর হতেই পারে, শতভাগ যান্ত্রিক হতেই পারে, আবার সামান্য জৈবিক অংশ রেখে বাকীটা বাদ দিতেই পারে। শুধু ব্রেনটা রাখলেই প্রথম পর্যায়ে সব চুকে বুকে যায়, তারপর তারা কেন মরণশীল ব্রেনটাকেও উপড়ে ফেলবে না? তারা সৃষ্টিজগতকে দেখবে তাড়িতিক চোখে, চাখবে ধাতব জিহ্বায়।

তাদের অনুভূতি হবে বৈদ্যুতিক, একটা-মাত্র একটা ইলেক্ট্রন এদিক থেকে ওদিকে গেলে তারা আবেশিত হবে, অনুভব করবে। উন্নত প্রাণী কোনো দুঃখে কোটি কোটি বছরের অন্ধ বিবর্তনের অর্জিত ভোঁতা নীরস জৈবিক নিউরনিক অনুভূতিকে প্রশ্রয় দিয়ে যাবে? অনুভূতির এই অসীমতা কোনোদিন এনে দিতে পারবে না বোকাটে বিবর্তনবিদ্যা।

এ কাজ করলে প্রকৃতিকে অমান্য করা হয়? বুদ্ধিমান প্রাণী যেদিন গাছ থেকে ফল না পেড়ে নিজে গাছ পুঁতেছে সেদিনই প্রকৃতিকে অমান্য করেছে। হ্যাঁ, বুদ্ধিমান প্রাণীর রোপিত গাছের ধারকও প্রকৃতিই, কিন্তু সভ্য প্রাণী সার দেয় বলে ফলন বেশি-সে হিসাবে তাদের যান্ত্রিক দেহওতো প্রকৃতি থেকেই নেয়া, তারা একটু প্রযুক্তি দেয় বলে সুবিধা বেশি।

আমরা এমন কিছু দেখিনি বলে জগতে এমন কিছু হতে পারে না- এ ভাবনাতো প্রাচীন আর মধ্যযুগের মানুষের ভাবনা। মহাকাশ যুগের মানুষ অনেক বেশি ভাবতে জানে।

এমনকি পৃথিবীতেও এমন পদক্ষেপ নেয়া হয়ে গেছে। কত শত কোটি মানুষ আগে ধ্বংস হয়ে যেত, তাদেরই মতো অন্যেরা আজ বেঁচে আছে বহাল তবিয়তে। ধন্যবাদ কৃত্রিম কিডনি, হৃদপিণ্ড, যান্ত্রিক হাত-পা কে।

এ প্রক্রিয়া এক সুনির্দিষ্ট জায়গায় গিয়েই থামবে, তা লক্ষ্যটা যত দূরেই হোক।

এমনকি এ প্রক্রিয়ায় মস্তিষ্কও হাওয়ায় মিলিয়ে যেতে পারে। ঘটনাপরম্পরায় এর প্রয়োজন এক সময় না এক সময় ফুরাবে, ইলেক্ট্রনিক ইন্টেলিজেন্সের উন্নয়ন সে কথারই প্রমাণবাহী। মন আর মেশিনের দ্বন্দ্ব ফুরাবে সেই শেষ সত্যিতে গিয়ে, যেখানে সিমবায়োসিস[৪৭] হবে পূর্ণ…

কিন্তু এই কি শেষ? এখনো দুর্ধর্ষ জীববিজ্ঞানীরা কল্পরথে চড়ে আরো আরো আরো দূরে যেতে যায়। তারা অনেক ধর্মের সারকথা বলে। বলে, মন সরিয়ে দেবে বস্তুকে। কথাটা কতটুকু ধর্মকথা আর তাতে কতটা বিজ্ঞান জড়িত? রোবট বডিতেও থাকবে লাখো সমস্যা। তারা সব করতে পারবে না ইচ্ছামতো। অসীম গতি পাবে না। সব ভেদ করতে পারবে না। অগ্রসর বিজ্ঞান কি তা-ও মেনে নিবে? নাকি তারপরই শুরু হবে নতুন যুগ…আত্মার যুগ?

সেই আত্মার পরও লাভটা কোথায়? তাদের হাতে তো কোটি কোটি বছর থাকে উন্নয়নের জন্য। আরো উন্নত তারা হতেই চাইবে। আরো কিছু বাকি থেকে যায়, আর একটা জিনিস হওয়া বাকী থেকে যায়-তা প্রাণিকুল এখনো হয়নি।

ঈশ্বর।

অধ্যায় ৩৩. রাজদূত

গত তিন মাসে ডেভ বোম্যান এত বেশি একা পড়ে গেছে যে জগতে আর কোনো প্রাণীর অস্তিত্বটাই এখন তার কাছে তাত্ত্বিক সত্যি, বাস্তব নয়।

‘এ্যালোন, এ্যালোন, অল অল এ্যালোন…
এ্যালোন অন এ ওয়াইড ওয়াইড সী…’

কোলরিজের সেই একলা নাবিকের মতো সে এত বেশি একাকী আর হতাশ হয়ে পড়েছে যে বিরাট একটা রুটিনের আড়ালে নিজেকে ঢেকে রাখার প্রাণপণ চেষ্টা করে সারাক্ষণ। বাড়তি ভ্যাজাল হিসেবে মেশিন আর সিস্টেমে গণ্ডগোলতো আছেই। তার যোগ্যতা, পরিশ্রম আত্মবিশ্বাস আর সাহস কোনোটা নিয়েই প্রশ্নের অবকাশ নেই কারণ সে মানুষের সর্বকালের সবচে বড় অভিযানের অধিনায়ক। আজো তার কৌতূহল শেষ হয়ে যায়নি।

তার আসন্ন লক্ষ্য যোগায় অমিত আশা, কানে কানে নূতন দিনের গান শোনায়।

সে শুধু মহান মানবজাতির প্রথম আর একমাত্র প্রতিনিধিই নয়, তার পরবর্তী যে কোনো পদক্ষেপের কারণেই মানুষের পুরো ভবিষ্যৎ আর ভাগ্য বদলে যেতে পারে। সে নিজেকে বোঝায়, থামলে চলবে না, ভাঙলে চলবে না। পুরো ইতিহাসে কখনো এমন সময় আসেনি। ডেভ, তুমি ডেভ নও, রাজদূত, মানব সাম্রাজ্যের রাজদূত।

সেই প্রজ্ঞা তাকে বহু সংকীর্ণ পথে আলো দেখায়। সে নিজেকে পরিচ্ছন্ন, ধীমান করে রাখে। যত সমস্যাই হোক, কোনোদিন সে শেভ করাটাও বাদ দেয় না। তাকে দেখে কেউ মানবজাতিকে ভুল বুঝবে নাতো?

মিশন কন্ট্রোল যে তাকে প্রতি পল অনুপলে দেখছে তা সে ভালমতোই জানে। সে প্রতিজ্ঞা করেছে, কোনো অসুস্থতাকে নিজের ভিতর বাসা বাঁধতে দেবে না। কিছুতেই না। মানুষ অসুস্থ নয় সেটা তাকেই বোঝাতে হবে।

কিন্তু বোম্যান টের পায় তার ব্যবহারে পালা বদলের হাওয়া লাগছে। সে আর নিরবতাকে মেনে নিতে পারে না একপলের জন্যও। ঘুম আর কথা বলার সময় ছাড়া সারাক্ষণ সে ভীষণ জোরে শব্দ করায় শিপের স্পিকারে।

মানুষের শব্দ আর সঙ্গের জন্য প্রথম প্রথম সে শ’[৪৮], ইবসেন[৪৯] আর শেক্সপিয়রের ক্লাসিক নাটক নিয়ে মেতে থাকত। নয়তো ডিসকভারি লাইব্রেরির অসীম কবিতা সংগ্রহের মধ্যে একের পর এক বেজে চলে।

বেশিদিন এ নিয়ে চলা গেল না। সে এবার ঝুঁকে পড়ে অপেরার দিকে। দু-হপ্তা পর সে বোঝে এই অত্যন্ত সাবধানে বাছাই করা শব্দগুলো তার একাকিত্বকে বাড়িয়ে তুলছে। এবার ভার্দির[৫০] রিকুইম মাস এ এসে ঠেকেছে তার তরী। এ জিনিস পৃথিবীতে থাকতে বোম্যান কস্মিনকালেও শোনেনি। মাসের বেহেস্ত থেকে কেয়ামতের ধ্বনি শিপের প্রান্তে প্রান্তে বাজতে থাকলে সে আর সহ্য করতে পারে না।

তারপর শুধু বাজনা। রোমান্টিক ধ্বনি তার মনকে আরো অন্ধকারে ঠেলে দেয়, সঙ্গহীনতার অন্ধকারে। সিবেলিয়াস, শেইকোভস্কি, আর বার্লিওস কয়েক হপ্তা টিকে থাকে। বিথোফেন[৫১] চলে আরো বেশিদিন। সে আরো অনেকেরই মতো সবশেষে থিতু হয় বাঁচে[৫২], মাঝে মধ্যে নাক গলায় মোজার্ট[৫৩]।

এবং ডিসকভারি তার প্রায় অনন্ত যাত্রা শেষ করে শনির কবলে পড়ে।

.

এক কোটি মাইল দূর থেকেই শনি পৃথিবীর আকাশে চাঁদের চেয়ে বড় হয়ে উঁকি দিচ্ছে। খোলা চোখে এ এক মহাকীর্তি, টেলিস্কোপে অবিশ্বাস্য।

প্রথমে বৃহস্পতি বলে ভুল হতেই পারে। প্রায় একই আকারে গ্রহটায় একটু ফ্যাকাসে মেঘের দল একইভাবে উড়ে চলছে-তাদের ঘনত্বটা একটু কম। আকাশে তেমনি মহাদেশীয় ঘূর্ণিঝড়। একটা দিক দিয়ে দুজনের বিস্তর তফাৎ, চোখ রেখেই বোঝা যায়, দুর্বিপাকের প্রতিভূ শনি একেবারে গোলাকার নয়।

কিন্তু শনির বলয় তার চোখকে বারবার টেনে নেয়। তাদের বিশালত্ব, তাদের ব্যাপকতাই এক ভিন্ন সৃষ্টি জগৎ গড়ে দিয়েছে। বাইরের দিকের আর ভিতরের দিকের বলয়গুলোর মধ্যে যে বিশাল ফাঁকা-সেখানেও দেখার মতো অনেক কিছুই আছে। সেখানে নিদেনপক্ষে অর্ধশত উপদৃশ্য দেখা যায়। ঐ স্থানে গ্রহের দানবীয় উজ্জ্বলতা পলে পলে রূপ বদলায়। যেন শনি নানা রকমের এককেন্দ্রিক ফিনফিনে চাকতি গায় দিয়েছে। সবাই ছুঁয়ে যাচ্ছে সবাইকে। সবাই এত পাতলা, যেন সবচে পল্কা কাগজ কেটে তাদের গড়া হয়েছে। এই আঙটি-জগৎটা যেন কোনো অসম্ভব সুন্দর জটিল শিল্পকর্ম। যেন কোনো ভঙ্গুর খেলনা, একে শুধু দেখা যাবে, ছোঁয়া যাবে না। এই বিশালত্ব উপলব্ধির, অনুভবের নয়। বোম্যানের মনে হল পৃথিবীকে এর যে কোনো বলয়ে বসিয়ে দিলে একটা মুক্তার মতো সেটা ঘুরতে থাকবে।

কোনো তারা যদি বলয়গুলোর পেছনে পড়ে যায় তবে সেটার উজ্বলতা সামান্যই ম্লান হবে, এত সূক্ষ্ম এর বুনন। আবার এক আধবার হারিয়েও যেতে পারে ঘূর্ণায়মান ছোট্ট কোনো টুকরার আড়ালে।

মানুষ আদ্যিকাল থেকেই জানে রিংগুলো কঠিন নয়। কারণ যান্ত্রিকভাবে ব্যাপারটা অসম্ভব। এগুলো অতি ছোট টুকরো আর ধূলিকণা। কে জানে কোকালে কোন উপগ্রহ শনির টানে ভেসে এসেছিল, এসে আর তা সইতে পারেনি।

তাদের উৎস যাই হোক না কেন, মানবজাতি এ জিনিস দেখার সৌভাগ্য অর্জন করেছে। এটা সৌর জগতের সময়ের মানে একপল টিকে থাকতে পারত। কিংবা আসলেই হয়তো এই বলয়গুলোর টিকে থাকার সময় সৌরজাগতিক হিসেবে সামান্য একটা মুহূর্ত ছাড়া কিছু নয়।

উনিশশো পঁয়তাল্লিশে এক ব্রিটিশ জ্যোতির্বিদ বলেছিল, রিংগুলো অস্থায়ী; গ্র্যাভিটিশনাল ফোর্স অচিরেই এই ক্ষণিকের দৃশ্যপটকে বদলে দেবে। অতীত দেখলেও বোঝা যায় যে তারা এই সেদিন জন্ম নিয়েছে। টেনেটুনে দুই বা তিন মিলিয়ন বছর হবে।

কিন্তু কেউ এই দু-ব্যাপারকে এক করে দেখেনি। এখানেও ত্রিশ লাখ বছর।

অধ্যায় ৩৪. ঘুরতে থাকা বরফ

ডিসকভারি গ্রহটার সুবিস্তৃত উপগ্রহরাজ্যের সীমানা পেরিয়ে চলে এসেছে। শনি এখন একদিনের পথ। কেন্দ্র থেকে আশি লাখ মাইল দূরে ঘুরন্ত উপগ্রহ ফোব শনির পেছনে।

সামনে এখন জ্যাপেটাস, হাইপেরিয়ন, টাইটান, রিয়া, ডিওন, টেথিস, এনক্লিয়াডাস, মিমাস, জ্যানাস। তারপর হাজারো বলয়ের অবাক চিত্র। প্রতিটি উপগ্রহই নিজস্বতা ঠিক রেখেছে পুরোদমে, আর সেসব উপরিতলের হাজারটা চিত্র পাঠাচ্ছে বোম্যান পৃথিবীর দিকে। টাইটান একাই তিন হাজার মাইল ব্যাসের স্যাটেলাইট। মাসের পর মাস ব্যয় করলেও এখানটা দেখে পোষাবে না।

বাকী সব উপগ্রহের শরীর ধূমকেতু আর উল্কার আঘাতে ক্ষতবিক্ষত। সাথে আছে হাজারো জ্বালামুখ। তবে এক্ষেত্রে এগিয়ে থাকবে মঙ্গল। উপগ্রহগুলোয় আলো আধারীর বড় নকশাদার খেলা দেখা যায়; একটু পর পর চোখে পড়ে প্রচণ্ড প্রতিফলক এলাকা-সম্ভবত জমাট গ্যাস। অন্যদিকে জ্যাপেটাসের ভূ-প্রকৃতি অনেক বেশি অদ্ভুত।

এর এক গোলার্ধ শনির চিরসাথী, ফিরে থাকে শনির দিকেই কিন্তু ঝুঁকে থাকে বাইরে; এটা একেবারে অন্ধকারের দেশ। আলোর মুখে একটা নিখুঁত ডিম্বাকার সাদা এলাকা আছে, প্রস্থে দুশ আর দৈর্ঘ্যে চারশো মাইল। জায়গাটা পৃথিবী থেকেই টেলিস্কোপে দেখা যায় কারণ এ পিঠ সোজাসুজি সূর্যের দিকে তাক করা।

এখন দেখে মনে হচ্ছে উপগ্রহের মুখে খুব চিন্তাভাবনা করে কেউ সমতল জিনিসটা বানিয়েছে; এটা জমাট কোনো তরল নয়তো? এমন কৃত্রিম আকৃতি দেখে এ ধারণাও উবে যায়।

কিন্তু তার দেখার সময় নেই- কারণ ডিসকভারি এখন গতিহ্রাসের জন্য শনি জগতের কেন্দ্রের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। এবার শনির একটা উপগ্রহ হয়ে বিশ লাখ মাইলের একটা সরু কক্ষপথে ঘুরবে, এ পথ ধরেই স্বাভাবিক নিয়মে জ্যাপেটাসের কাছে যাওয়া সম্ভব।

পৃথিবীর কম্পিউটারের সাথে এখন তিন ঘণ্টার সময় পার্থক্য থাকলেও সেটা জানিয়ে দিল যে সব ঠিকমতো চলছে।

শনি বলয়ের মাত্র দশ হাজার মাইল উপর দিয়ে উড়তে উড়তে বোম্যান নতুন দৃষ্টিকোণের সন্ধান পায়। সে জানত এখানে বরফ আছে আর সেগুলো আলো প্রতিফলন করে। কিন্তু এখান থেকে নিচে শুধু তুষারের পাতলা মহাসমুদ্র চোখে পড়ে। নিচে, যেখানে মাটি থাকার কথা, সেখানে খাবি খাচ্ছে কালো আকাশ আর নক্ষত্রের দঙ্গল।

কাছে যেতে যেতে এক সময় পুরো আকাশ জুড়ে শুধু বলয় আর বলয় দেখা গেল, এরমধ্যেই শনির পেছনে যাওয়া শুরু করেছে স্পেসশিপ। সূর্যের সবটুকু আলো বীরত্বের সাথে ফিরিয়ে দিচ্ছে চকচকে বলয়গুলো। এবার শনি-বলয়ের পেছনের সূর্যাস্ত দেখার মতো এক দৃশ্য হয়ে সামনে এলো, আকাশে ছড়িয়ে আছে লক্ষ সূর্য; এটাই বরফের কৃতিত্ব। আলোর এ অপার্থিব খেলা ফুরিয়ে যায় একটু পরেই, শনির পেছনে চলে এসেছে ডিসকভারি।

উপরে নক্ষত্রদের আকাশ, নিচে হাল্কা শনি-মেঘ। শনির মেঘমালা বৃহস্পতির মতো আলোর দ্যুতি ছড়াতে জানে না, কিন্তু ঘুরন্ত হিমবাহ সূর্যকে তাড়িয়ে দেয়ার পরও তার আলো নিয়ে খেলা করে অভাবটা পুষিয়ে দিচ্ছে।

যথারীতি রেডিও যোগাযোগ বন্ধ হয়ে গেছে। বোম্যানের একাকিত্ব উপভোগের সময় নেই। শনির ওপাশে গেলেই আবার সূর্যালোক আর রেডিও যোগাযোগ দুইই ফিরে আসবে। এখন তার প্রতিটি সেকেন্ড কড়ায়গণ্ডায় মিটিয়ে নেবে ডিসকভারি; হাতে অসীম কাজ।

বহু মাসের আড়মোড়া ভেঙে ডিসকভারির মূল গ্লাস্টার কয়েক মাইল লম্বা আগুনে-লেজ দিয়ে জ্বলন্ত প্লাজমা ছুঁড়ে দিচ্ছে। শনির আকাশ এর আগে কখনো পেছনদিকে একটা সূর্যকে দেখতে পায়নি।

অবশেষে রাতের সমাপ্তির সাথে সাথে ডিসকভারির গতিও অনেক কমে এসেছে। এখন আর সৌরজগৎ ছেড়ে যাবার ভয় নেই, কিন্তু শনির অর্বিট ছাড়ার ঝুঁকি থাকে।

চৌদ্দদিন লাগবে জ্যাপেটাসের অর্বিটে স্থান করে নিতে। বাকী উপগ্রহগুলোর কক্ষপথ একে একে ফেলে সেখানে যেতে হচ্ছে। তারপর মিলতেই হবে জ্যাপেটাসের সাথে। না পারলে ফিরে যাবে শনিতে, আটাশ দিনের কাজ শেষ করে আবার উঠে আসবে। এমনি কথা ছিল।

কিন্তু দ্বিতীয় সুযোগ পাওয়া যাচ্ছে না, পরের বার গ্রহটা থাকবে শনির পেছনে।

ডিসকভারি ঠিকই তার সাথে দেখা করবে, কিন্তু সাক্ষী হিসেবে বোম্যান নাও থাকতে পারে, কারণ এ অবস্থা ফিরে আসতে কয়েক বছর সময়ের দরকার।

অধ্যায় ৩৫. জ্যাপেটাসের নয়ন

প্রথমবার জ্যাপেটাসকে দেখার সময় সে আধো আলো-ছায়াতে ছিল। এবার ভালমতো দেখা যায়, কারণ সে তার উনআশি দিনের কক্ষপথে এখন সবচে ঝলমলে দিন পোহাচ্ছে।

বোম্যান একটা কথা বলেনি মিশন কন্ট্রোলকে, কিন্তু নিজেকে নিয়ে বেশ চিন্তায় পড়ে গেছে। অবশ্যই, একটু হলেও ডিশনে ভুগছে, মিথ্যা দৃশ্য-মিথ্যা স্মৃতি দেখছে।

যেমন এখন তার মনে হয় পুরো জ্যাপেটাসের পিছনদিকটাই তার দিকে চেয়ে থাকা পাঁপড়িবিহীন এক রাক্ষুসে চোখ। যেন সে গভীর আগ্রহে ছোট্ট ডেভ বোম্যানকে দেখছে। পনের হাজার মাইল দূর থেকে সে চোখের মনিটাও খুঁজে বের করে ফেলে। ছোট্ট, কালো সেই জিনিস এটা।

শেষবারের মতো ডিসকভারির জেটগুলো শনির বুকে পোড়া অণু-পরমাণুর হক্কা বইয়ে দিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে নিজের চিরকালীন আবাসে। কেমন একটু গর্ববোধ করে বোম্যান-সাথে একটু কষ্টও পায়। এই অসাধারণ ইঞ্জিনগুলো অসম্ভব কাজ করেছে। ডিসকভারিকে পৃথিবী থেকে চাঁদ, চাঁদ থেকে বৃহস্পতি, বৃহস্পতি থেকে নিয়ে এসেছে শনিতে; এই তাদের শেষ কাজ। নিজের প্রপেল্যান্ট ট্যাঙ্কগুলো খালি করলে আর সব মহাজাগতিক বস্তুর মতোই সে এক সামান্য উল্কা হয়ে মহাকাশে অভিকর্ষের দাসানুদাস বনে যাবে। উদ্ধারশিপটা তার জন্য কোনো বাড়তি জ্বালানিও আনতে পারবে না।

উপগ্রহ এগিয়ে আসার সাথে সাথে ফুয়েল গজও দ্রুত শূন্যের দিকে দৌড়ে যাচ্ছে, বোম্যানের চোখ নেচে যাচ্ছে এসব ডিসপ্লের উপর। সে যদি কয়েক পাউন্ড ফুয়েলের অভাবে কাজ না সারতে পারে তো আর দেখতে হবে না…

ফুয়েলের গর্জন পড়ে যায়, ডিসকভারিও নিজেকে অর্বিটে সামলে নেয়। আরো জ্বালানী বাকী আছে। সারাক্ষণ সে জ্যাপেটাসকে পিচ্চি এক উপগ্রহ ভেবে এসেছে, এবার সামনে থেকে তাকে মোটেও পিচ্চি মনে হচ্ছে না। যেন যে কোনো মুহূর্তে ডিসকভারিকে গুড়ো করে ফেলতে উদ্যত এক মহাজাগতিক হাতুড়ি এই উপগ্রহটা।

এত ধীরে সে এগিয়ে আসে যে ব্যাপারটা বোঝা যায় না। তারপর কখন যেন বোম্যান মাত্র অর্ধশত মাইল নিচে এক অনন্য সৃষ্টিকে দেখতে পায়।

বিশ্বস্ত ছোট জেটগুলো তাদের শেষ শব্দ করেই ডিসকভারিকে পৌঁছে দেয় ঠিক ঠিক অর্বিটে। সে এখন ঘন্টায় আটশো মাইল গতিতে প্রতি তিন ঘণ্টায় চক্কর দিয়ে বেড়াচ্ছে জ্যাপেটাসকে।

ডিসকভারি এখন আর কোনো স্পেসশিপের নাম নয়, এক স্যাটেলাইটের নাম।

অধ্যায় ৩৬. বিগ ব্রাদার

‘আমি আবারো দিনের পাশে প্রবেশ করতে যাচ্ছি। সেই আগের রিপোর্ট করতে হবে আবারও। উপরিতলে মাত্র দু-ধরনের জিনিস চোখে পড়ে, একটা সেই কালো এলাকা-একদম কয়লা… রাতের দিক…অন্যটা নিচের ডিম্বাকার এলাকা…

‘চওড়া এলাকার ব্যাপারে এখনো কিছু বুঝে উঠতে পারিনি। চারপাশ একেবারে মসৃণ, কোনো দাগটাগ বা আর কিছু চোখে পড়ে না। একেবারে সমতল আর…তরলও হতে পারে। তোমরা ছবি দেখে কী মাথামুণ্ডু বুঝবে তা বলতে পারি না, তবে আমার চোখে এ এক জমাট দুধসাগর।

‘এ জিনিসটা কোনো ভারি গ্যাসও হতে পারে…না, অসম্ভব মনে হচ্ছে। মাঝে মাঝে ধাঁধায় পড়ে যাই। এক আধটু জায়গা বদলায় মনে হয়। কিন্তু শিওর হয়ে কিছুই বলতে পারছি না…

‘…নিজের তৃতীয় অর্বিটে আবার আমি সেই সাদা জায়গার উপর এসে পড়েছি। গতবার ঠিক কেন্দ্রে যে মাপটা নিয়েছিলাম সেটা এবার পরীক্ষা করব। আমার আন্দাজ ঠিক হলে এর পঞ্চাশ মাইলের মধ্যে আমি যাচ্ছিই…এটা যাই হোক না কেন।

‘…ইয়েস! সামনে একটা কিছু দেখা যাচ্ছে। ঠিক যেখানে আমি আন্দাজ করেছিলাম সেখানে। উঠে আসছে! এক মিনিট, টেলিস্কোপটা সরিয়ে নিই…

‘হ্যাল্লো! কোনো ধরনের বিল্ডিং হবে বোধহয়। এক্কেবারে কালো, দেখাই যায় না। কোনো দরজা-জানালা নেই। খালি একটা বিরাট উঁচু স্ল্যাব-এখান থেকে দেখে মনে হচ্ছে কমসে কম এক মাইল উঁচু হবে। এটা দেখেই আমার মনে পড়ে গেল… অবশ্যই, কেন নয়? এ তো দেখতে ঠিক তোমাদের চাঁদের জিনিসের মতোই! এটা হল টি এম এ-ওয়ানের বিগ ব্রাদার!’

অধ্যায় ৩৭. অজি শ্রাবণের আমন্ত্রণে দুয়ার কাঁপে

একে নক্ষত্র দুয়ার বলা যায়।

ও ত্রিশ লাখ বছর ধরে আজকের দিনের প্রতীক্ষায় ছিল। এ কাজে একটা উপগ্রহ ধ্বংস করা হয়েছে, তার চিহ্ন আজো ভেসে বেড়ায় শনির চারপাশে।

সেই দীর্ঘ প্রহরের যবনিকা এবার পড়ে গেছে। আরো এক গ্রহে উন্নত জীবনের উন্মেষ ঘটেছে, এর প্রাণীরা নাড়ির বাঁধন ছিঁড়ে চলে এসেছে এতদূর।

এক পুরনো, অতি পুরনো পরীক্ষা এবার নিজের ফলাফল দেখতে পাবে।

অনেক অনেক আগে যারা এ পরীক্ষণ শুরু করেছিল তারা মানুষ ছিল না, তাদের আকৃতি মানুষ থেকে অনেক অনেক দূরে। নিজেদের রক্তমাংসের শরীর নিয়ে বিহ্বল চোখে দূর দিগন্তে তাকালে তারা একাকী বোধ করে, ভর করে কীসের যেন হতাশা, কোত্থেকে যেন দুঃখ এসে জাপটে নেয়। শক্তি অর্জনের সাথে সাথে তারা অনন্ত নক্ষত্রবীথির দিকে ছুটতে শুরু করে অমিত তেজে।

তাদের অভিযানে কত ধরনের জীবন যে চোখে পড়ল! কত অযুত গ্রহের নিযুত প্রাণীর অগুণতি বিবর্তন-পদ্ধতি যে তারা দেখল তার কোনো লেখাজোকা নেই। অন্ত বিহীন নক্ষত্ৰধুলার আলোয় একটু ফিকে হয়ে আসা অসীম মহাজাগতিক রাতে কত বিচিত্র বুদ্ধিমত্তার বিকাশ যে তারা দেখল একমুহূর্তের তারার মতো জ্বলে উঠতে, কত তারাকে দেখল নিভতে!

এবং, যেহেতু সব গ্যালাক্সি চষে ফেলেও মনের চেয়ে দামী কোনো কিছুর সন্ধান তারা পায়নি তাই এর অরুণোদয়কেই তারা সবখানে সবচে বেশি মূল্য দিল। তারা তারার জগতের চাষী, তারা চাষ করে, বোনে, মাঝে মাঝে ফসলও তোলে।

কখনো কখনো হতাশ হয়ে উপড়ে ফেলতে হয় আগাছা।

হাজার হাজার বছরের মহাকাশ অভিযান শেষে তারা যখন পৃথিবীর বুকে পা রাখে তখন ডাইনোসররা বিলুপ্ত এক প্রাণী। জমে থাকা বাইরের গ্রহগুলোর পাশ দিয়ে উড়ে এসে মঙ্গলের মৃতপ্রায় মরুভূমির উপর একটু থামে, তারপর অপার আগ্রহ নিয়ে তাকায় পৃথিবীর দিকে।

নিচে ছড়িয়ে পড়েই অভিযাত্রীরা এক জীবন সাগর দেখতে পায়। বছরের পর বছর ধরে তারা পর্যবেক্ষণ করে, সংগ্রহ করে, শ্রেণীবদ্ধ করে সবকিছুর নাম। জানার মতো সব তথ্য পাবার পর পরিবর্তনে হাত দেয়। বহু প্রাণীর জীবন নিয়ে একটু চেষ্টা করে-তা ভূমিতে হোক আর সাগরে। কিন্তু পরীক্ষা সফল হল কি হল না তা জানতে আরো দশ লক্ষ বছরেরও বেশি সময় পেরিয়ে যাবে।

তাদের ধৈর্য ছিল, কিন্তু তারা তখনো অমর নয়। ইউনিভার্সের দশ হাজার কোটি নক্ষত্রের দশ হাজার কোটি সৌরজগতে করার মতো অনেক অনেক অনেক কাজ বাকী। অন্য দুনিয়া ডাকছে। সুতরাং আবার শূন্যতায় ভেসে পড়া তারা জানে-আর কোনোদিন পায়ের চিহ্ন এ পথে পড়বে না।

তার আর প্রয়োজন নেই। যে দাসদের ফেলে গেল তারাই বাকীটা সেরে ফেলবে।

পৃথিবীর যুগে বরফযুগ হাজারটা হিমবাহ নিয়ে এল, আবার ফিরে গেল; শুধু উপরের চাঁদে কোনো পরিবর্তন নেই। তার বুকে লুকানো আছে সবটুকু রহস্য। মেরুতে বরফ জন্মানোর চেয়েও ধীর গতিতে গ্যালাক্সি জুড়ে সভ্যতার জোয়ার উঠে এল, ভরে ভাসিয়ে দিল চারপাশ।

কত শত শত সাম্রাজ্য যে উঠে এল, কত সাম্রাজ্যের হল পতন তার ইয়ত্তা নেই। তারা শুধু বংশধরের জন্য জ্ঞানের সঞ্চয়টুকু রেখে হারিয়ে যায়। কখনোই পৃথিবীর কথা ভুলে যাওয়া হয়নি-কিন্তু তাতে কী, ফিরে আসা প্রশ্নাতীত। আরো লক্ষ লক্ষ নিরব দুনিয়ার মধ্যে এও এক। এদের মধ্যে কারো মুখে বুলি ফুটবে, কেউ কেউ স্তব্ধ থেকে যাবে চিরদিনের জন্য।

এবং এখন, আর সব নক্ষত্রলোকে বিবর্তনের এক নতুন জোয়ার শুরু হয়েছে। সেই অভিযাত্রীরা তাদের রূপ বদলে ফেলেছে মেশিনগুলো শরীরের চেয়ে বেশি কার্যকর হওয়ার সাথে সাথে। প্রথম প্রথম শুধু শরীর সেখানে জায়গা করে নিত, তারপর মস্তিষ্ক, তারপর শুধু চিন্তা। এবার তারা নক্ষত্রলোকে ঠিকমতো ঘুরে বেড়াতে পারল। তারা আর স্পেসশিপ বানায় না। তারা নিজেরাই স্পেসশিপ।

কিন্তু মেশিন-প্রাণীদের যুগ খুব দ্রুত ফুরিয়ে গেল। ক্রমবর্ধমান জ্ঞানের সাথে লাখো বছরের অভিজ্ঞতা দিয়ে তারা স্বয়ং স্পেসের গায়ে জ্ঞানকে বন্দী করে রাখতে শিখল। জ্ঞানকে তারা অসীম ভবিষ্যৎ পর্যন্ত আলোর জমাট ফটিকে লুকিয়ে রাখতে জানে। এবার তারা রেডিয়েশনের সৃষ্টি, অবশেষে বস্তুর নাগপাশ থেকে অনমুক্তি পাওয়া গেল।

কিন্তু রেডিয়েশন তথা তেজস্ক্রিয়তায়ও নাক সিঁটকানো থামে না। এরও একটু সীমাবদ্ধতা আছে। কণা নির্ভর ও পরীক্ষারত বস্তুর জন্য ক্ষতিকর এ পথ ছেড়ে সেই মুক্তিটাকে সত্যিকারের বাস্তবতা দেয়ার আশায় এবার তারা বিশুদ্ধ শক্তিতে রূপান্তরিত হয়। তাদের ছেড়ে আসা খোলসগুলো মৃত্যুশীতলতা নিয়ে নেচে বেড়ায় হাজার হাজার বিশ্বে।

এখন তারা নিহারীকার ভাগ্যবিধাতা, সময় আর তাদের ছুঁতে পারে না। তারা এখন সব নক্ষত্রের মধ্য দিয়ে চলতে জানে, মহাশূন্যের যে কোনো অতল সমুদ্রে শক্তির গাঢ় কুয়াশা হয়ে মিশে যেতে পারে।

কিন্তু আজো তারা তাদের পূর্বপুরুষদের শুরু করা পরীক্ষণের পথ ছেড়ে দেয়নি।

মহাশূন্যের চাষীরা এখনো রোপণ করা চারার পরিণতি দেখে।

অধ্যায় ৩৮. প্রহরী

‘শিপের পরিবেশ একেবারে বদলে যাচ্ছে। বেশিরভাগ সময় আমাকে একটা মাথাব্যথা নিয়ে থাকতে হয়। সব সময় অক্সিজেন পরিশোধন কাজ চললেও দৃষিতটা একেবারে সরিয়ে দেয়া যায় না। মাঝেমধ্যেই আমাকে পোড থেকে অক্সিজেন নিয়ে আসতে হচ্ছে…

‘আমি কোনো সাড়াই পাচ্ছি না টি এম এ-টু থেকে। তোমরা যে নাম দিয়েছ তার মর্মও সে রাখছে না। কোনো চৌম্বক ক্ষেত্র নেই।

‘ডিসকভারি ষাট মাইলের চেয়ে বেশি কাছে যায় না। আমি ত্রিশ দিনের মধ্যে অভিযান চালাতে চাচ্ছি, কিন্তু তখন জিনিসটা অন্ধকারে চলে যাবে।

‘এমনকি এ মুহূর্তেও জিনিসটা আলো আর আঁধারের মাঝখানে। খুব বিরক্তিকর এর অবস্থা। আমি আর সহ্য করতে পারছি না। কদ্দিন এমন সাড়া ছাড়া থাকা যায়?

‘সুতরাং, আমি তোমাদের অনুমতি চাই। পোডটার যথেষ্ট ক্ষমতা আছে। জিনিসটাকে একেবারে কাছ থেকে দেখে আসব। দেখেশুনে ভাল মনে হলে পাশে কিংবা উপরে ল্যান্ড করতে পারি।

‘শিপ আমার উপরেই থাকবে নামার সময়, তাই নব্বই মিনিটের বেশি বাইরে থাকছি না।

‘তোমরা যাই বলনা কেন, আমি জানি এছাড়া আর কিছু করার নেই। শত কোটি মাইল এসেছি-ষাট মাইলের জন্য থেমে থাকতে পারি না।

.

সপ্তাহের পর সপ্তাহ ধরে নক্ষত্রলোকের প্রবেশদ্বার সেই শিপটাকে দেখছে। এর স্রষ্টারা একে হাজারো কাজের জন্য বানিয়েছে-এটি সেসব কাজের মধ্যে অন্যতম। এটা বুঝতে পারে সৌর জগতের উষ্ণতা ছেড়ে এদুর আসার মানে।

এটা জীবিত হলে রোমাঞ্চ অনুভব করত। কিন্তু তার সে অনুভূতির প্রশ্নও ওঠে না। সে অপেক্ষা করছে ত্রিশ লাখ বছর ধরে, তার অপেক্ষার দৈর্ঘ্য অসীম পর্যন্ত বিস্তৃত।

তাই শুধু দেখে, কোনো সাড়া দেয় না। একটু তেজস্ক্রিয়তার ছোঁয়া পেয়ে বোঝার চেষ্টা করে উৎসকে।

শিপ নিচে নেমে এসেছে। বারবার নিজের রেডিও বিস্ফোরণের সুরে কথা বলছে। এক থেকে এগারো পর্যন্ত মৌলিক সংখ্যাগুলো আউড়ে যাচ্ছে ইচ্ছামতো।

এবার আরো হাজারো পথে লাখো ইশারা আসে। এক্স-রে, অতিবেগুনী রশ্মি, অবলোহিত…

নক্ষত্রদ্বার কোনো শব্দ করে না। এর বলার কিছুই নেই।

একটা বিশাল বস্তুকে নেমে পড়তে দেখে এটা সাথে সাথে সব হিসাব কষে ফেলে। লজিক ইউনিট তল্লাশী চালিয়ে জানতে পারে করণীয়। অনেক অনেক আগেই এ সম্পর্কে তথ্য দেয়া হয়েছিল।

শনির ঠাণ্ডা আলোয় তারকা জগতের প্রবেশমুখ তার ক্ষমতাকে জাগিয়ে তোলে।

ধীরে, অতি ধীরে, ত্রিশ লাখ বছর পর।

অধ্যায় ৩৯. চোখের ভেতর

ডিসকভারি শিপটাকে সে শেষবার আধ আকাশ জুড়ে থাকতে দেখল। তার চোখে সামান্য পরিবর্তন ধরা পড়ছে। মহাকাশযানটার বিভিন্ন হ্যাঁচ, সংযোগ, বিভিন্ন ধরনের প্লাগ আর যন্ত্রাংশকে সে চিনতে চেষ্টা করে। সূর্যালোকে স্নাত হয়ে এত লম্বা পথ পরিক্রমা শেষে এখানে আসায় শিপটা বোধহয় ম্লান হয়ে গেছে।

সূর্য এখন আর সব নক্ষত্র থেকে একটু বেশি উজ্জ্বল, এই যা। যে কেউ এর দিকে খোলা চোখে তাকাতে পারে। বোম্যান জানালার সামনে হাত পেতে দিয়েও সূর্যের উত্তাপ পায় না।

সে এবার বেরিয়ে যাচ্ছে, হয়তো শেষবারের মতোই। তার এই ধাতব বাড়িটা নিজের কাজ করতেই থাকবে, বোম্যান ফিরে আসুক আর না আসুক।

আর সে যদি ফিরে আসে তাহলে আরো বেশ কয়েক মাস বেঁচে থাকবে সজ্ঞানে। হাইবারনেশনের দেখভালের জন্য কোনো কম্পিউটার না থাকায় তার বাঁচার আশা ফুরিয়ে যাচ্ছে। ডিসকভারি টু আসবে চার পাঁচ বছর পর।

সে এসব ভাবনাকে প্রশ্রয় দেয় না। সামনে শনির উজ্জ্বল সোনালী গোলার্ধ ভেসে আছে। পুরো ইতিহাসে সেই এ দৃশ্য দেখার সৌভাগ্য অর্জনকারী একমাত্র মানুষ।

সেই শনি রিংগুলোর প্রান্তে টাইটানকে এক উজ্জ্বল তারার মতো দেখাচ্ছে, বাকী উপগ্রহগুলো ম্লান। এই শতাব্দীর অর্ধেকটা কেটে যাবার আগেই মানুষ হয়তো এই সবগুলোতেই পা ফেলবে, কোন্ রহস্যের চাদর উঠে গেল তা জানার জন্য শুধু সে-ই বেঁচে থাকবে না।

অন্ধ সাদা চোখের তীক্ষ্ণ প্রান্ত ওর দিকে এগিয়ে আসছে। তার একটাই আশা, কথাগুলো যেন সব সময় দেড় আলোকঘণ্টা দূরের পৃথিবীতে চলে যায়। একবার নিরবতায় হারিয়ে গেলে মানুষ কোনোদিনই তার পরিণতির কথা জানবে না।

বহু উপরের কালো আকাশে ডিসকভারি এখন এক তারা হয়ে জ্বলছে। ত্বরণ কমানোর জন্য পোডের ঘোঁট জেটগুলো কাজ শুরু করবে, এগিয়ে আসবে, চির রহস্যের দেশ, শুধু চোখের সামনে থেকে উবে যাবে ডিসকভারি; এতদিনের সাথীকে সে আর খালি চোখে দেখতে পাবে না।

ত্বরণ বেশি হয়ে গেলে আবার অনেক বেশি ফুয়েল খরচ হবে গতিটা কমিয়ে আনতে। কিন্তু এখানে পুরো পোডের ওজন হবে মাত্র কয়েক পাউন্ড; তাই সে সহজেই মানিয়ে নেবে। আর না হলেও কিছু যায় আসে না। এখানে, পোডের ভিতর বা উপগ্রহের উপরে দু-একমাস আগে মৃত্যুবরণ করা আর সেখানে বেশি বাঁচায় তেমন কোনো ফারাক নেই…

নিচের সাদা সমতলের উপর স্থির দাঁড়িয়ে আছে কালো স্তম্ভটা কী এক অজানা অহংকার বুকে নিয়ে। সে মাত্র পাঁচ মাইল দূরে আছে এখন। দেখেশুনে মনে হচ্ছে এর উচ্চতা কমবেশি দু-হাজার ফুট হবে। গায়ের অনুপাতও সেই ১:৪:৯।

‘আমি এখন মাত্র তিন মাইল দূরে। চার হাজার ফুট উপরে অ্যাটিচ্যুড কন্ট্রোল জেট চেপে ধরব। এখনো বিন্দুমাত্র বৈচিত্র্য নেই। নেই কোনো সাড়া। এত বছর পর তোমরা এক-আধটু উল্কাটুল্কার ক্ষয়ক্ষতিও আশা করতে পার, তাও নেই। একেবারে মসৃণ!

‘ছাদের উপর কোনো টুকরো পড়ে নেই। কোনো খোলা-বন্ধের ব্যাপারও চোখে পড়ছে না। আশা করছি সেখানে ঢোকার কোনো…

‘এখন আমি ঠিক পাঁচশ ফুট উপরে ভাসছি। ডিসকভারি সরে যাবার আগেই আমাকে ফিরতে হবে। উপরেই ল্যান্ড করব। আশা করি সাথে সাথে আমাকে বোমা মেরে উড়িয়ে দেবে না।

‘এক মিনিট… ব্যাপারটা বেখাপ্পা…’

আর কোনো শব্দ নেই। সে কী দেখল তার বর্ণনা দেয়ার সময়ই পায়নি। জিনিসটাকে অন্যরকম লাগছিল কিন্তু সেটা সে বুঝতেও পারেনি। চোখের ভুল হতে পারে…যেন ওটা সামনে থেকে সরে যাচ্ছে। যেন ভিতরের দিকটা বাইরে আর বাইরের দিক ভিতরে চলে আসছে…কিংবা উপর থেকে চোরাবালি চলে যাচ্ছে নিচের দিকে…।

ঠিক এ ব্যাপারটাই ঘটছিল সেখানে। এটা আরো বিশাল, স্থির কোনো স্তম্ভ নেই। অসম্ভব, অবাস্তব, অবিশ্বাস্য ব্যাপারটাই চোখের সামনে ঘটে গেল। যাকে ছাদ মনে হচ্ছিল সেই চলে গেছে কোন্ অতল গর্ভে। তার শেষ নেই। যেন কোনো অন্ত বিহীন পথে প্রবেশ করছে সে…

জ্যাপেটাসের নয়ন এবার জীবন পেয়েছে, পলক ফেলেছে অনেক অনেক বছর পর।

ডেভিড বোম্যান একটা মাত্র ভাঙা বাক্য বলার সুযোগ পেল নয়শো মিলিয়ন মাইল দূরের মিশন কন্ট্রোলের মানুষদের কাছে যেটা যুগ-যুগান্ত ধরে স্মরণীয় হয়ে থাকবে:

‘জিনিসটা ফাঁপা-এর কোনো অন্ত নেই-আর-ওহ মাই গড! এটা তারায় তারায় ভরা!…

অধ্যায় ৪০. তোমার দেখা পাব বলে …

নক্ষত্ৰদ্বার খুলে গেল।

বন্ধ হলো নক্ষত্ৰদ্বার।

এক অতি ক্ষুদ্র সময়ের মধ্যে আবার স্থানটা ঠিক হয়ে গেল; আগের মতো।

আরো একবার জ্যাপেটাস বিরাণভূমিতে পরিণত হয়েছে। ত্রিশ লাখ বছর পর প্রাণের ছোঁয়া পেয়ে আবার উপগ্রহটা একাকিত্বের যন্ত্রণা ভোগ করবে।

কিন্তু উপরে এক সাথী আছে তার। ডিসকভারি এখনো ঠিক পরিত্যক্ত হয়ে পড়েনি। সে তার প্রভুর খবর পৌঁছে দিচ্ছিল বিজন প্রান্তর ভেদ করে আরেক কোণে।

এ সংবাদ না করবে কেউ বিশ্বাস, না পারবে বুঝতে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *