৬. গাড়িটা ছেড়ে দিতে

গাড়িটা ছেড়ে দিতেই সুজিত হঠাৎ বলে উঠল, ও হো, একটা কথা দোলাকে জিজ্ঞেস করতে ভুলে গেলাম।

এখনকার শিবেন সেই বীরেন্দ্রনারায়ণের সামনের শিবেন না। সেই বিনীত শান্তভাবের মধ্যে তার নিজস্বতা ফুটে বেরিয়েছে। সে এখন গম্ভীর, এবং আত্মসচেতন। গাড়ি ঘোরাতে বলব? জরুরি কথা নাকি!

সুজিত তাড়াতাড়ি বলল, না না, তেমন কিছু নয়। আপনাকেও বলতে পারি। মানে কথাটা হল, মিঃ রায়চৌধুরী তো আপনার কাকা হন, না?

সুজিতকে নিয়ে শিবেন পিছনের সিটে বসেছিল। সকালবেলার পোশাক এখন তার গায়ে নেই। পায়ের থেকে মাথা পর্যন্ত সে এখন পুরোপুরি সাহেব। সে সিগারেট ধরাতে গিয়ে থেমে বলল, কাকা হবেন কেন?

–আপনি যে কাকাবাবু বলে ডাকছিলেন তখন?

শিবেন বাইরের দিকে তাকিয়ে একটু চুপ করে রইল। তারপরে বলল, আমার ছেলেবেলায় মিঃ রায়চৌধুরী আমার বাবার বন্ধু ছিলেন, অর্থাৎ প্রায় বন্ধুর মতোই। আমাদের বাড়িতেও যাতায়াত ছিল। এখন উনি আমার বস, আমি ওঁর সেক্রেটারি। তবে বাড়িতে উনি আমাকে কাকাবাবু ডাকবারই পারমিশন দিয়েছেন। ছেলেবেলায় ডাকতাম তো।

সুজিত ঘাড় নেড়ে বলল, ও। তাই আমি ভাবছিলাম, খুড়তুতো বোনের দিকে আপনি ওভাবে তাকাচ্ছিলেন কেন, আর কথাই বা বলতে পারছিলেন না কেন।

–তার মানে? কী বলতে চান আপনি?

শিবেনের চোখে জাকুটি-বিস্ময় ফুটে উঠল। সুজিত হেসে বলল, আপনি কেমন করে যেন তাকাচ্ছিলেন, না? যেন…যেন…ওকে আপনার ভাল লাগছে, কথা বলতে চান, অথচ…মানে

সুজিত তার সহজ সরল হাসি-মাখানো চোখ দুটি শিবেনের দিকে তুলে ধরল। শিবেন তীক্ষ্ণ চোখে তার দিকে তাকিয়ে ছিল। তাকিয়ে থাকতে থাকতে আস্তে আস্তে কুঞ্চিত জ সরল হয়ে এল তার, মুখে সহজভাব নেমে এল। বলল, হুম! আফটার অল সি ইজ ডটার অফ মাই বস। আই রিগার্ড হার।

সুজিত বলে উঠল, ডটার মানে তো কন্যা, না?

শিবেনের চোখ আবার সন্দিগ্ধ তীক্ষ্ণ হয়ে উঠল। সুজিত বলল, আমি কয়েকটা ইংরেজি কথা শিখেছিলুম ওয়ার্ডবুক পড়ে।…এটা তো ট্রাম, না? হাওড়া থেকে আসবার সময় রিকশাওয়ালা আমাকে বলেছিল, এগুলো ট্রাম। দোতলা বাসগুলো কী ভীষণ দেখতে।

সুজিত অবাক হয়ে কলকাতাকে দেখতে লাগল। শিবেনের মুখে আস্তে আস্তে হাসি ফুটে উঠল। জিজ্ঞেস করল, কত দিন সেখানে ছিলেন?

–কোথায়?

 –ওই উন্মাদ-আশ্রমে?

অনেক দিন, আট-ন বছর হবে বোধ হয়। তবে আমি উন্মাদ ছিলাম না।

শিবেন সরস সুরে বলল, কী ছিলেন?

সুজিত যেন বাইরের থেকে তার বিস্ময়-চকিত, কৌতূহলিত চোখ ফেরাতে পারছিল না। সেইদিকে চোখ রেখেই বলল, ডক্টর ঘোষ বলতেন, আমার অপরিণত মস্তিষ্ক ছিল। তারপর মুখ ফিরিয়ে হেসে বলল, এখন ভাল হয়ে গেছি।

শিবেন ঘাড় নেড়ে হেসে বলল, ও? তা, মিঃ রায়চৌধুরীর বাড়িতে কেমন লাগল আপনার?

-খুব ভাল। মাসিমা খুব ভাল।

–মাসিমা?

–হ্যাঁ, মানে মিসেস রায়চৌধুরী, ওঁকে আমি মাসিমা বলে ডেকেছি। দোলাও খুব ভাল, সুন্দর। মুখখানি কী সুন্দর, আর হাসিটা। ও খুব সুখী আর পবিত্র মেয়ে। দুঃখ কী, কিছুই জানে না, তাই না?

শিবেনের সারা মুখ বিস্ময়ে পরিপূর্ণ। বলল, আপনি কি দোলাকে নাম ধরে ডেকেছেন নাকি?

সুজিত বলল, হ্যাঁ, মাসিমা যে বললেন, ও আমার থেকে ছোট। ওকে তুমিই বলেছি।

–আপনি কী করে বুঝলেন, ও সুখী আর পবিত্র কি না?

–মুখ দেখে। আমি মুখ দেখলেই বলতে পারি।

শিবেন আবার হাসতে লাগল। বলল, ও!

সুজিত আবার দু চোখ ভরে কলকাতাকে দেখতে লাগল আর আপন মনেই বিড়বিড় করতে লাগল। যত বিস্ময়, তত যেন তার অস্বস্তি। যেন ঠিক খুশি হতে পারছে না। সবই বড় দ্রুত, ব্যস্ত, চলন্ত। মনেই হচ্ছে না সময়টা ভর-দুপুর। এই রকম দুপুরে সবই তো একটু নিশ্ৰুপ নিঝুম থাকে। এখানে হয় ঘরের নিরালা, নয় দরজা খুললেই হাট। কোথাও একটু শব্দহীন, নিরালার নিবিড়তা নেই। কষ্ট হয় না মানুষের? কী এটা? ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল হল? ওটা মনুমেন্ট? খেলার ময়দান, চৌরঙ্গি, ওই দূরে গভর্নরের প্রাসাদ? কিন্তু কোথায় যাচ্ছে সুজিতরা। ইটালি! ও! এন্টালি, একটা রাস্তার নাম? সেখানে বুঝি শিবেনবাবুদের বাড়ি? কে কে আছেন? অসুস্থ মা, আর বুড়ো বাবা, এবং একটি ছোট ভাই?

সুরেন ব্যানার্জি রোড দিয়ে গাড়িটা চলেছে। সুজিত হঠাৎ জিজ্ঞেস করল, আচ্ছা, আপনি কত টাকা মাইনে পান?

এই আদবহীন প্রশ্নে শিবেন একটু দ্বিধান্বিত হল। তারপরে বলল, আটশো টাকা।

–আট-শো? এত টাকা কী করেন?

শিবেন হা-হা করে হেসে উঠল। বলল, আটশো টাকায় কী হয়? মাসের পনেরো দিন চলতে চায় না।

তাই নাকি? বলেন কী!

সন্দিগ্ধ চোখে সুজিত তাকাল শিবেনের দিকে। ঠাট্টা করছে কি না বুঝতে পারছে না। বলল, পনেরো দিন চলতে চায় না?

শিবেন বলল, তাই তো। আমিই তো একমাত্র আর্নিং মেম্বার।

–এই গাড়িটা তবে কার?

 –কোম্পানির। মানে মিঃ রায়চৌধুরীরই বলতে পারেন।

-আপনার বাবা কী করেন?

 –কিছুই না। এক সময়ে খুব বড়লোক ছিলেন। বড় ব্যবসা ছিল।

–ও! তারপরে আবার গরিব হলেন কী করে?

–যেভাবে সবাই হয়, বুদ্ধির দোষে। পার্টনাররা প্রচুর চুরি করেছিল, নিজেও বেহিসেবি ছিলেন আমার বাবা। মিঃ রায়চৌধুরীও বাবার বিজনেসের পার্টনার ছিলেন।

সুজিত চোখ বড় করে বলল, তার মানে উনিও চুরি করেছিলেন?

শিবেন বলল, সেটা আমরা জানি না। কে যে চুরি করেছিল আর করেনি, এটা তো হাতেনাতে ধরা যায়নি, ঋণের দায়ে যখন ব্যবসা লাটে উঠে গেল, তখন জানা গেল, পুকুরচুরি হয়ে গেছে। কিন্তু দেখবেন, এ সব কথা আবার মিঃ রায়চৌধুরীকে বলতে যাবেন না যেন।

বলব না? আচ্ছা। কিন্তু আমার খুব খারাপ লাগছে।

শিবেন বলল, বাবার সব পার্টনাররাই এখন বেশ বড়লোক, বড় ব্যবসা করে।…হ্যাঁ, আপনাকে একটা কথা বলে রাখি, আমার বাবার একটু ইয়ে আছে, মানে মাথায় একটু গোলমাল আছে। একটু আবোল-তাবোল বকেন। খুব একটা বিপজ্জনক নন, তবে, ওই আর কী, একটু দেখে-শুনে চলবেন।

সুজিত বলল, ও, তাই নাকি। বোধ হয় শোকে-দুঃখেই ওরকম হয়ে গেছেন।

শিবেন গম্ভীর ও নির্বিকার মুখে বলল, বোধ হয়। আপনি আমাদের বাড়িতে থাকবেন বলেই কথাটা বলতে হল।

বলাটা যে মনঃপূত নয়, সুজিত তা অনুমান করল শিবেনের মুখের দিকে তাকিয়ে। বলল, সেজন্যে আপনি ভাববেন না। ওরকম লোকদের আমি অনেক দেখেছি আশ্রমে।

শিবেন বিরক্ত চোখে তাকাল সুজিতের দিকে। সুজিত হাসল। শিবেনদের বাড়িটা বেশ বড় আর দোতলা, কিন্তু পুরনো এবং সেকেলে ধরনের। সামনে খানিকটা জমি আছে, তাতে বাগান বলে কিছু নেই। দেখেই বোঝা যায়, বাড়িটায় অনেক কাল চুনকাম বা রং করা হয়নি। গোটা বাড়িটা তাই শ্যাওলার রং ধরেছে। ওপরে নীচে অধিকাংশ দরজা-জানালাই বন্ধ। মনে হতে পারে, বাড়িটায় লোক নেই। কিন্তু ড্রাইভারকে তিনটের সময় আসতে বলে, শিবেন দরজার চৌকাঠে কলিং বেলের বোতাম টিপল। একটু পরেই একজন এসে দরজা খুলে দিল। দেখেই বোঝা যায়, সে বাড়ির ভৃত্য।

শিবেন জিজ্ঞেস করল, কোনও চিঠিপত্র এসেছে?

চাকর জবাব দিল, না।

চাকরটি সুজিতকেই দেখছিল। দরজা দিয়ে ঢুকে, বাঁ দিকে সিঁড়ি উঠে গিয়েছে। সামনাসামনি যে দরজাটা আছে, সেটা বন্ধ। শিবেন সুজিতকে ডেকে সিঁড়ি দিয়ে উঠতে লাগল। জিজ্ঞেস করল, দীপেন কোথায়?

চাকর জবাব দিল, ইস্কুলে।

বাবা?

বসবার ঘরে।

সিঁড়ি দিয়ে উঠতে উঠতেই টেলিফোনের ক্রিং ক্রিং শোনা যাচ্ছিল ওপরে। তারপরেই সেটা থেমে গিয়ে মোটা শ্লেষা-জড়ানো গলায় শোনা গেল, হ্যালো, ইয়েস! আপনি কে? ও ও ও, মহাশয়া শিবেন রায় মহাশয়কে চান? জাস্ট এ মিনিট প্লিজ, একটা কলিং বেলের শব্দ পাওয়া গেছে, হয়তো

ঠিক সেই সময়েই শিবেনের সঙ্গে সুজিত ওপরের বসবার ঘরের দরজায় দাঁড়াল। সুজিত দেখল, ঘরের একপাশে হাফ-হাতা পাঞ্জাবি গায়ে ময়লা কাপড় কিন্তু কোঁচা লুটানো এক ভদ্রলোক টেলিফোনের রিসিভার নিয়ে কথা বলছেন। বয়স ষাট নিশ্চয়ই। বেশিও হতে পারে। বেশ কয়েক দিনের না কামানো গোঁফ-দাড়ি। চুল উশকোখুশকো। চোখ দুটি বড় বড়, কিন্তু রক্তিম এবং গর্তে ঢোকানো। শিবেনকে দেখেই, –টেনে চোখ বড় বড় করে বলে উঠলেন, এই যে মিঃ শিবেন রায়।…হ্যালো, আপনি যাকে চাইছেন, তিনি এসেছেন।

বলে রিসিভার মুখের কাছ থেকে সরিয়ে খানিকটা যেন ঠাট্টা ও বিদ্রুপের ভঙ্গিতে বললেন, এই যে আসুন বড় রায়মহাশয়, আপনার ফোন, মনে হচ্ছে কোনও যুবতী আপনাকে ডাকছেন।

বৃদ্ধের কথা শেষ হবার আগেই শিবেন দ্রুত এগিয়ে, রিসিভারটা প্রায় কেড়ে নিল। বলল, তা অত গাঁক গাঁক করে চেঁচাবার কী আছে? যান, ওদিকে গিয়ে বসুন।

বৃদ্ধ ঘাড় নেড়ে বললেন, বসবই তো, বসবই তো, বহু দিনই তো বসে আছি। ৪৮৮

বলতে বলতে তিনি সরে এলেন। ইতিমধ্যে শিবেনের গম্ভীর স্বরে আবেগ ঝংকৃত হয়ে উঠল, ও, তুমি!–হ্যাঁ, হ্যাঁ, হ্যাঁ, না আমাকে আবার মিঃ রায়চৌধুরী নিজে একজন গেস্ট দিয়েছেন, আমাদের বাড়িতে থাকবার জন্যে, তাকে নিয়ে এইমাত্র…হ্যাঁ, না, কই আমি তো সে বিষয়ে কিছু বলিনি।…তা শুনেছি বটে, এবং ইন দি মিনটাইম কুবের কলকাতাতে ছিলও না, সেই জন্যেই বোধ হয়…না, রঞ্জনের কথা আমি কিছুই জানি না, আর আমি বিশ্বাসও করতে পারি না যে তুমি রঞ্জনের সঙ্গে বাইরে বেড়াতে যাবে। অ্যাঁ? হ্যাঁ, তা জানি বইকী, বারো হাজার টাকার নেকলেস তোমাকে রঞ্জন দিয়েছে, অ্যাঁ? না, এ বিষয়ে কোনও মন্তব্য করতে চাই না। তা হলে কলকাতার অনেক গুণ্ডা বদমায়েশ সম্পর্কেই…ও! তা বেশ…। হ্যাঁ, আজ সকালেই তো বললাম তোমাকে…।

সুজিত অবাক হয়ে টেলিফোনের কথা শুনছিল। অদ্ভুত লাগছিল তার। এবং তার স্মৃতিশক্তি দুর্বল হলেও মনে হল কুবের নামটা একাধিকবার শুনেছে সে। এক বার রাত্রে ট্রেনে, আর এক বার কিরণময়ীর মুখে। রঞ্জন নামটা নতুন শুনতে পেল সে।

অবাক হয়েই শুনছিল সে। ইতিমধ্যে বৃদ্ধ সুজিতের দিকে এগিয়ে, হাত প্রসারিত করে বললেন, আপনি নিশ্চয় বড় রায়ের সঙ্গে এসেছেন? আসুন, আসুন, আসতে আজ্ঞা হোক।

সুজিত হেসে আপ্যায়িত হয়ে ভিতরে এল। বৃদ্ধের ভাবভঙ্গির মধ্যে ঈষৎ বিদ্রুপের বক্রতা থাকলেও, গলাটা বেশ দরাজ, কিন্তু বাজখাঁই নয়। মুখে গাম্ভীর্য আছে, কিন্তু রাশভারী গোছের নন। মনে মনে ভাবল, ইনি কি শিবেনের বাবা?

বৃদ্ধ সুজিতের দিকে তাকিয়ে বললেন, লুকিং ভেরি ফ্রেশ, অ্যাঁ? চোখ দুটি তো এখনও দেখছি নির্দোষ নিষ্পাপ ভাবের, মুখখানিও ছেলেমানুষের মতন। যেন ভাজা মাছটিও উলটে খেতে জানা নেই।

সুজিত অবাক হয়ে বলল, ভাজা মাছ?

ভাজা মাছ বইকী! আর ভাজা মাছ বললে, বেশ বড় সাইজের কালবোস মাছই বলতে হবে মিষ্টি আর নরম, স্পেশাল ফর ফ্রাই। তা বলে ওই এঁদো গলির রেস্টুরেন্টের বোয়াল মাছের বারো আনা দামের ফিস ফ্রাই নয়, সত্যিকারের বাঙালির মাছভাজা যাকে বলে।…আমি অবিশ্যি আপনার পরিচয় জানি না।

সুজিত তাড়াতাড়ি উচ্চারণ করল, শ্রীসুজিতনাথ মিত্র আমার নাম।

বৃদ্ধ বললেন, হতে পারে আপনার নাম সুজিতনাথ মিত্র, আমার নাম ভুজঙ্গভূষণ রায়, এখন অনেকে অনেক কিছু নাম বলে, এক সময়ে শুধু বি-বি বললেই আমাকে চেনা যেত। কিন্তু সুজিতনাথবাবু, আপনাকে একটু গোবেচারার মতো দেখতে বলেই, ভাজা মাছের কথা বলছি আমি, অনেক সময় বেড়ালকেও তপস্বীর মতো দেখায় কিনা।

সুজিত অবাক স্বরে বলল, বেড়ালকে?

 ভুজঙ্গভূষণ বললেন, হ্যাঁ, বেড়াল, মার্জার যাকে বলে। কিন্তু মাছভাজার কথাই যখন উঠল, তখন বলে পারছি না, কিন্তু তার আগে বলুন, আপনার জন্ম কত সালে?

সুজিত ঠিক খেই ধরতে পারছে না, তাই আরও অবাক হয়ে বলল, আমার জন্ম? তা এই চব্বিশ-পঁচিশ বছর বয়স হয়েছে।

ভুজঙ্গ বললেন, ও, সে আপনার জন্মেরও আগের কথা তা হলে। তখন যিনি ছোটলাট ছিলেন, আমি আবার সাহেবদের নাম মনে রাখতে পারি না, যাই হোক ছোটলাট, কয়েক জন পশ্চিম দেশীয় রাজা, আর বিলাতি কোম্পানির কয়েক জন কর্তাকে আমি একটা পার্টি দিয়েছিলাম।

সুজিত মুগ্ধ বিস্ময়ে উচ্চারণ করল, ও!

-হ্যাঁ, আমার অনেকগুলো পুকুর ছিল। অর্ডার দিয়ে সেখান থেকে কালবোস মাছ ধরিয়েছিলাম, আধমন-তিরিশ সের ওজনের কালবোস এক-একটা। কালচে নীল রং তাদের।

কালচে নীল?

-হ্যাঁ, কালচে নীল, আর পেটের দিকটা লাল। গোয়ানিজ সূপকারকে দিয়ে সে মাছের ফ্রাই বানিয়ে যখন পরিবেশন করানো হল, সবাই হাত গুটিয়ে নিল। কেউ মাছভাজা খাবেন না, গলায় নাকি কাঁটা ফুটবে, নেটিভদের মতো তাঁরা কাঁটা বাছতে পারেন না। মানে ভাজা মাছ উলটে খেতে জানেন না। আমি লাটবাহাদুরকে কোনওরকমে বুঝিয়ে-সুঝিয়ে মুখে ভোলালাম। মুখে দিয়েই লাটবাহাদুরের মুখ রসে ভরপুর।

সুজিত দেখল, ভুজঙ্গবাবুরই মুখ দিয়ে লালা গড়িয়ে পড়ার অবস্থা। উনি ঝোল টেনে বললেন, ব্যস, আর যায় কোথায়। দেখলাম, খালি হুইস্কি আর কালবোস ফ্রাই খেল সবাই, বাকি খাবার সব পড়ে রইল। কিছু ছুঁলেই না। অতএব, বুঝতেই পারছেন, ভাজা মাছ উলটে খেতে সবাই জানে। আপনি কি জানেন না?

ভুজঙ্গভূষণ তাঁর কাঁচাপাকা লোমশ জ্বর তলা থেকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকালেন সুজিতের দিকে। সুজিত বিব্রত বিস্ময়ে বলল, মানে, ভাজা মাছ?

–হ্যাঁ, উলটে খেতে।

 সুজিত ঘাড় কাত করে হেসে বলল, আজ্ঞে হ্যাঁ, জানি তো।

ভুজঙ্গভূষণ হা হা করে হেসে উঠলেন। মনে হল, দেওয়ালগুলি সব কেঁপে উঠল সেই হাসির শব্দে। বললেন, জানি, জানি, মুখ দেখতে যেমনই হোক–

সহসা তীব্র উচ্চ গলায় ধমকে উঠল শিবেন, আস্তে আস্তে।

সুজিত দেখল, শিবেন রিসিভারের স্পিকারের মুখে হাত চেপে ক্রুদ্ধ চোখে এদিকে তাকিয়ে রয়েছে। কিন্তু ভুজঙ্গভূষণ তা ফিরে তাকিয়ে দেখলেন না। গলার স্বর একেবারে নামিয়ে ফিসফিস করে বলেই চললেন, অর্থাৎ বেড়ালের মুখ, তা সে দেখতে যেমনই হোক, সাদা কালো হলদে, সাদা চোখো, হলদে চোখখা, ভাজা মাছ উলটে খেতে সবাই জানে।

উনি থামতেই, আবার শিবেনের গলা সে শুনতে পেল, ফোনে সে তখনও বলে চলেছে, কিন্তু তুমি জান যৌতুকের কথা আমি কিছুই চিন্তা করিনি। অ্যাঁ? না..মানে…শুনেছি বটে, উনি তোমাকে…আশ্চর্য! এতে এত হাসবার কী আছে?

ভুজঙ্গভূষণ হঠাৎ সুজিতের কানের কাছে ঝুঁকে পড়ে চুপিচুপি স্বরে বললেন, বিশ্ব সংসারের সবটাই যখন হাসির, তখন উনি বললেন কিনা, হাসির কী আছে, বুঝুন এক বার ব্যাপারটা।

পরমুহূর্তেই জিজ্ঞেস করলেন, কিছু অনুমান করতে পারছেন ব্যাপারটা?

 সুজিত হেসে ঘাড় নাড়ল, সে বুঝতে পারছে না। ভুজঙ্গও ঘাড় নেড়ে বললেন, আমিও কিছুই পারছি না। তবে একটা বেকায়দার ব্যাপার কিছু হয়েছে নির্ঘাত, নইলে অতক্ষণ ধরে ফোনে বকরবকর…তা সে যাকগে, বুঝতে পারছি, এ ব্যাপারে আপনার সঙ্গে বড় রায়ের যোগাযোগ নেই, অ্যাঁ?

সুজিত বলল, আজ্ঞে না।

কিন্তু আপনি দাঁড়িয়ে কেন, বসুন না। বসুন বসুন।

 ঘরের মধ্যে সোফা এবং চেয়ার ছিল। কিন্তু সবই প্রায় পুরনো জীর্ণ হয়ে এসেছে। বোঝা যাচ্ছে এর ওপর যথেষ্ট ঝাড়ামোছা করে মোটামুটি একটু শ্ৰী বজায় রাখার চেষ্টা করা হয়েছে। টেবিলের ওপরে ফুলদানিও আছে, এবং ফুলদানিগুলি যে মাজলেও পরিষ্কার হয় না, তাও অনুমান করা যায়। ফুলগুলি প্ল্যাস্টিকের। প্রত্যহ নতুন নতুন টাটকা ফুল কিনে সাজানো নিশ্চয় সম্ভব হয় না। ঘরটা যেন কেমন অন্ধকার মতো। অধিকাংশ জানালা-দরজা বন্ধ বলেই বোধ হয়। দেয়ালে কিছু ছবি টাঙানো আছে, অধিকাংশই পুরনো।

ভুজঙ্গ প্রায় এক কোণে সুজিতকে টেনে নিয়ে গেলেন, সোফা দেখিয়ে বললেন, এখানে বসুন। না, না আপনি যা ভাবছেন তা মোটেও নয়, ওতে ধুলো নেই, সোফার কাপড়টার রংই ওরকম। অবিশ্যি পুরনো হয়েছে, কিন্তু পরিষ্কার।

–আজ্ঞে না না, আমি তা ভাবছি না।

সুজিত লজ্জিত হয়ে উঠল। তাড়াতাড়ি বসে পড়ল ধপাস করে। বড় সোফা, পাশাপাশি ভুজঙ্গ বসলেন। এক বার তাকালেন শিবেনের দিকে। সে তখন এদিকে পিছন ফিরে ফোনে কথা বলেই চলেছে, যদিও গলার স্বর আগের থেকে অনেক নিচু।

ভুজঙ্গ শুরু করলেন, কী যেন নাম বলছিলেন আপনার। সুজিত, সুজিতনাথ মিত্র! বেশ নাম। যদি কিছু মনে না করেন, ওর সঙ্গে, মানে বড় রায়, যিনি ফোনে কথা বলছেন, ওর সঙ্গে আপনি কোথা থেকে আসছেন? কী দরকার?

বলেই তাড়াতাড়ি শিবেনের দিকে এক বার দেখে নিয়ে বললেন, অবিশ্যি, এমনি জিজ্ঞেস করছি, মানে এ সময়ে তো কাউকে আসতে দেখি নে। আর আপনার মতো একজন, যদি কিছু মনে না করেন নিতান্তই চালচুলোহীন ছোকরা, বগলে কাগজের বান্ডিল..অবিশ্যি এ কথা ঠিক আপনার মুখখানি সত্যি সুন্দর, চোখ দুটিও, খুবই নিরীহ আর ভালমানুষ বলেই মনে হচ্ছে, কিন্তু কী মনে করে এসেছেন, সেটা আমি জানতে ইচ্ছুক।

ভুজঙ্গ থামলেন। ইতিমধ্যে কয়েকবারই ভুজঙ্গভূষণের জবাব দেবার চেষ্টা করেছে সুজিত, কিন্তু ওঁর প্রশ্নের স্রোতে ভেসে গিয়েছে। উনি থামতে সে বলল, আমি আসছি এখন বীরেন্দ্রনারায়ণ রায়চৌধুরীর বাড়ি থেকে।

–আচ্ছা? আপনি বীরেনের বাড়িতে থাকেন?

না না, আজই এসেছি ওখানে।

 –কোথা থেকে?

–গুড়িয়াঁটাঁড়, মানে বিহার থেকে।

–ও, সেখানে কি আপনি বীরেনদের কোম্পানির?

–আজ্ঞে না, আমি আসছি উন্মাদ-আশ্রম ও মানসিক চিকিৎসালয় থেকে। আমি ওখানকার রুগি ছিলাম, এখন ভাল আছি, আর ইতিমধ্যেই

–দাঁড়ান দাঁড়ান।

হাত তুলে সুজিতকে থামিয়ে ভুজঙ্গ জ্ব তুলে বললেন, আপনি ছিলেন?

সুজিত হেসে ঘাড় নেড়ে বলল, আজ্ঞে না, আমার মাথাটা…মানে, বুদ্ধিশুদ্ধি ছিল না আর কী। এখন ঠিক আছে। আমাকে বীরেন্দ্রনারায়ণবাবু একটা চাকরিও দেবেন বলেছেন, তবে আমার তো কোথাও থাকবার জায়গা নেই, এ বাড়িতে শুনলাম দোতলায় কোথায় একটা ঘর আছে, সেখানেই আমি থাকব পেয়িংগেস্ট হিসেবে…।

–সে তো খুবই ভাল কথা। সে কথা আমাকে বলুন, আমিই তো এ বাড়ির কর্তা। আপনি যার সঙ্গে এসেছেন, আমি সেই শিবেন রায়েরই বাবা।

ভুজঙ্গভূষণ যেন খুবই সুখী হলেন। বললেন, অবিশ্যি এসেছেন ভালই করেছেন, এ বাড়িতে পেয়িংগেস্ট একদা চিন্তা করাই যেত না। ভদ্রলোকের ছেলে মুখ ফুটে বললেই যথেষ্ট যে, আমি থাকব এবং খাব। কিন্তু এখন! এই বাড়িটার চেহারা কী ছিল আপনি ভাবতেই পারেন না।

সুজিত ফাঁক পেয়েই বলল, আমি অবিশ্যি অনুমান করেছিলাম, আপনিই শিবেনবাবুর বাবা।

–হ্যাঁ, সেটা মানতেই হবে।

আপনাদের অবস্থা এককালে যথেষ্ট ভাল ছিল, সে কথাও শুনেছি।

ভুজঙ্গ হঠাৎ একটি দীর্ঘশ্বাস ফেলে গম্ভীর ও ধীর স্বরে বললেন, সে কথা অনেকেই শুনেছে, আর এখনও অনেকে দেখছে আমাদের। আমার এখনও মনে আছে, যে বার লেডি লকফিল্ড এলেন এবাড়িতে…।

হঠাৎ থেমে গিয়ে তিনি শিবেনের দিকে তাকালেন। ওঁর ভ্র জোড়া কয়েকবার কেঁপে উঠল। উনি যেন কান পেতে শুনলেন, শিবেন তখন বলছে, হ্যাঁ, এখন তো অফিসেই বেরিয়ে যাব, এখন ছেড়ে দিচ্ছি..। অ্যাঁ? কী বললে?

হঠাৎ ভুজঙ্গভূষণ সুজিতের দিকে ফিরে বললেন, আচ্ছা, আমি একটু উঠব। আপনার কাছে কি কিছু টাকা আছে সুজিতনাথবাবু?

সুজিত অবাক হয়ে তাকিয়ে বলল, টাকা?

–হ্যাঁ হ্যাঁ, গোটা-চারেক টাকার একটু দরকার ছিল। সুজিত হেসে তাড়াতাড়ি পকেটে হাত দিয়ে বলল, আজ্ঞে হ্যাঁ, আছে। আপনার কত চাই বলুন? ভুজঙ্গ চকিতে এক বার শিবেনের দিকে তাকিয়ে নিয়ে বললেন, এই গোটা দশ-পনেরো? সুজিত তাড়াতাড়ি বীরেন্দ্রনারায়ণের দেওয়া একশো টাকার নোটটা বের করে বলল, দশ-পনেরো টাকা তো ভাঙানো নেই, তা হলে এটার থেকে…।

–হ্যাঁ হ্যাঁ, আমি ভাঙিয়ে নিয়ে আসছি, আপনি বসুন।

একশো টাকার নোটটা প্রায় ছোঁ মেরে নিয়ে যখন বেরিয়ে গেলেন, শিবেন রিসিভার রেখে ফিরে দাঁড়াল। ফিরে দাঁড়িয়েই বাবার পথের দিকে তাকিয়ে সুজিতকে জিজ্ঞেস করল, কী হল, উনি কোথায় গেলেন?

সুজিত তার সেই স্বভাবসিদ্ধ হাসি হেসে বলল, টাকা ভাঙাতে গেলেন?

–টাকা?

–হ্যাঁ, আমার কাছে দশ-পনেরো টাকা আছে কি না জিজ্ঞেস করলেন, তা আমি বীরেনবাবুর দেওয়া সেই একশো টাকার নোটটা

শিবেন বিকৃত মুখে প্রায় চিৎকার করে উঠল, একশো টাকার নোট! উনি চাইলেন, আর আপনি অমনি দিয়ে দিলেন?

কথা শেষ হবার আগেই শিবেন ছুটে গেল। ছুটতে ছুটতে এক বার চিৎকার করে ডাক দিল, বিশু।

ডেকেও সে দাঁড়াল না। বাইরে বেরিয়ে সিঁড়ি দিয়ে নীচে নেমে চলে গেল। পরমুহূর্তেই সেই চাকরটিকে দেখা গেল। ঘরের মধ্যে উঁকি দিয়েই সে-ও সিঁড়ির দিকে শিবেনকে অনুসরণ করল। সুজিত কয়েক মুহূর্ত হাঁ করে দাঁড়িয়ে রইল। পূর্বাপর ব্যাপারটা সে কিছুই বুঝতে পারল না। তাকে শিবেন ওরকম ধমকাল কেন, বা ওর বাবার পিছনে ওরকম ছুটেই বা গেল কেন? হঠাৎ তার মনে পড়ল, শিবেন বলেছিল বটে, ওর বাবার মাথাটা একটু গোলমাল আছে, আবোল-তাবোল বকে। কিন্তু সুজিতের তো সেরকম বিশেষ কিছু মনে হয়নি। একটু বেশি কথা বলছেন, এই যা। তা ছাড়া তো টাকা চেয়েছেন, নিশ্চয়ই কোনও দরকার পড়েছে। উনি চাইলেন আর সুজিত কি না বলবে? তাই কি কখনও সম্ভব? তা হলে তো মিথ্যে কথা বলা হয়। এরকম মিথ্যে কথা আবার বলে নাকি কেউ!

কিন্তু ব্যাপারটা কী? সে আস্তে আস্তে দরজার কাছে গেল। কাউকে দেখতে না পেয়ে, চারিদিকে এক বার তাকিয়ে, বারান্দায় এগিয়ে গেল। সিঁড়ির দিকে উঁকি দিল। দেখল শিবেন বিশুকে নিয়ে ওপরে উঠছে। শিবেনের মুখ লাল হয়ে উঠেছে। সে ক্রুদ্ধ এবং উত্তেজিত। বলছিল, দেখতে পেলি তো ডাকলি না?

বিশু বলল, হ্যাঁ ডেকেছিলাম, উনি লাফ দিয়ে একটা ট্যাক্সিতে উঠে পড়লেন, আমার কথাই শুনলেন না।

সুজিত মুখ বাড়িয়ে জিজ্ঞেস করল, কী হয়েছে বলুন তো? আপনারা ওরকম ছুটোছুটি করছেন কেন?

শিবেন তাকাল, কিন্তু কোনও জবাব দিল না। বিশু তার মুখের দিকে অবাক হয়ে তাকাল। শিবেন সুজিতের পাশ ঘেঁষেই ঘরের দিকে যেতে যেতে বলল, ঘরে আসুন।

সুজিত ঘরে ঢুকল শিবেনের পিছু পিছু। শিবেন বিশুকে বলল, তুই ভেতরে যা, আমি যাচ্ছি।

 বিশু ভিতরে চলে গেল। সুজিতের দিকে ফিরে বলল, আপনাকে বলেছিলাম না, বাবার মাথার একটু গোলমাল আছে?

সুজিত বলল, হ্যাঁ, কিন্তু আমি দেখলাম একটু বেশি কথা বলেন।

যাই হোক, আপনি টাকা দিতে গেলেন কেন?

উনি যে চাইলেন।

–চাইলেই দিতে হবে? আপনার কাছে টাকা আছে সে কথা বললেন কেন?

 সুজিত অবাক হয়ে বলল, একী বলছেন? আমার কাছে আছে, আমি না বলব?

শিবেন উত্তেজিত স্বরে, প্রায় ভেংচে উঠল, হ্যাঁ তাই বলবেন।

–কেন?

বিস্মিত রাগে শিবেন নির্বাক হয়ে গেল কয়েক মুহূর্ত। সুজিত আবার বলল, তার মানে, মিথ্যে কথা বলতে বলছেন?

শিবেন বলে উঠল, আপনি…আপনি একটা কী? আপনার মাথায় কী আছে বলতে পারেন?

সুজিত আবার বলল, কেন?

-কেন? আপনার কাছে যা থাকবে, সবই বলে দেবেন?

–তাতে কী হয়েছে?

শিবেন অসহায় রাগে প্রায় চেঁচিয়েই উঠল, আপনি…আপনি একটা উজবুক!

–ও!

 –হ্যাঁ, আপনি আবার চিকিৎসা করাতে যান।

সুজিত অবাক হয়ে বলল, কীসের চিকিৎসা?

 শিবেন সামনেই একটা চেয়ারে বসে পড়ল। চেয়ারের হাতলটা ভাঙবার জন্যেই যেন কয়েকবার মোচড়াল। তারপরে বলল, আপনি শুনে রাখুন, আপনার টাকা আপনি আর ফেরত পাবেন না।

সুজিত ঘাড় নেড়ে বলল, ও!

–হ্যাঁ, ওর একটি পয়সাও আর ফেরত পাবার আশা নেই।

সুজিত বলল, ও! সব টাকাটাই কি আপনার বাবার দরকারে লাগবে? কী করবেন উনি অত টাকা দিয়ে?

শিবেন বলল, মদ খাবেন।

সুজিত চোখ বড় বড় করে বলল, অত টাকার মদ খাবেন। একশো টাকার মদ কতখানি হবে?

শিবেন তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকাল সুজিতের দিকে। তার চোখে আবার সন্দেহ দেখা দিয়েছে। কিন্তু সুজিত তারপরেও জিজ্ঞেস করল, বেশি মদ খেলে তো শুনেছি লোকে মাতাল হয়ে যায়।

শিবেন বলল, শুনেছেন, দেখেননি?

সুজিত কয়েক মুহূর্ত ভেবে বলল, হ্যাঁ, গুঁড়িয়াঁটাঁড়ের রাস্তাঘাটে দেখেছি, হাটের দিনে মেয়ে-পুরুষ সবাই হাঁড়িয়া খেয়ে মাতলামি করত। কিন্তু ওরা মাঝে মাঝে বিচ্ছিরি মারামারি করত। এক বার নাকি একজনকে মেরেই ফেলেছিল। তা বলে ভুজঙ্গবাবুও কি সেরকম করবেন?

শিবেনের সন্দিগ্ধ চোখ আবার সহজ হয়ে এল। বলল, তা করতে পারেন। উনিও মাতাল। মাতালদের কোনও কিছুরই ঠিক নেই। কিন্তু আপনার টাকাটার কী হবে?

কী আবার হবে? উনি তো সব টাকার মদই খেয়ে ফেলবেন। আর আমি তো চাকরিতেই লেগে যাচ্ছি, আমার অসুবিধে কী? আমি যখন মাইনে পাব, তখন আপনাদের বাড়ির টাকাটা দেব, মানে আমার থাকার আর খাওয়ার খরচ। তাতে অসুবিধে হবে না তো?

শিবেন হঠাৎ আবার একটু গম্ভীর হয়ে উঠল। বলল, সেজন্য আপনাকে ভাবতে হবে না। এখন চলুন আপনার ঘরটা দেখিয়ে দিই।

শিবেনের সঙ্গে দোতলার বারান্দা দিয়ে, পুব দিকে গিয়ে, একটা কোণের ঘরে পৌঁছল সুজিত। মাঝারি ঘর। পুরনো কটা সিঙ্গল খাটে শুধু তোশক পাতা ছিল। পুব দক্ষিণ দুই-ই ভোলা। উত্তর দিকের একটা জানালা খুলে দিল শিবেন। সুজিত সেদিকে উঁকি দিয়ে প্রথমেই দেখল, একতলা ভাঙা পুরনো বাড়ি একটা। একটা বড় উঠোন, উঠোনের একপাশে কলের মুখ থেকে জল পড়ছে। সেখানে মেয়ে-পুরুষেরা একসঙ্গে এলোমেলো চান করছে। মোটামুটি খারাপ লাগল না। শিবেন জানাল, বিশু এসে এখুনি ঘরটা ঝাঁট দিয়ে, তোশকের ওপর চাদর পেতে দিয়ে যাবে। বাথরুম এবং আর সবই দেখিয়ে দেবে। এ ঘর থেকে সুজিত যখন খুশি বাইরে চলে যেতে পারবে। আবার আসতেও পারবে। শিবেনের কাছ থেকে আরও জানল সে, নীচে ভাড়াটেরা থাকে।