১. দূর বিহার

দূর বিহারের একটি অঞ্চল, যেখান থেকে শহর বা রেলওয়ে স্টেশনের দূরত্ব বেশ কয়েক মাইল। নবযুগ উন্মাদ-আশ্রম ও মানসিক চিকিৎসালয় এখানে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল প্রায় কুড়ি বছর আগে। দিগন্তবিস্তৃত উন্মুক্ত প্রান্তর, অদূরেই পাহাড় ও অরণ্য মেশামেশি করে আছে। টাঙ্গা এবং আদ্যিকালের দুটি পুরনো মোটরগাড়ি শহরে যাত্রী বহন করে। দু-একজন ফরেস্ট ঠিকাদারের নিজস্ব গাড়িও আছে। বৈদ্যুতিক আলো এখানে এসে এখনও পৌঁছয়নি। একটি হিন্দি মাইনর স্কুল আছে। ছাত্র পাওয়া যদিও দুরূহ, তবু কোনও রকমে চলে।

মানসিক হাসপাতালের বাড়িটি নাকি কোনকালে কোন এক রাজা তৈরি করিয়েছিলেন। মস্ত বড় বাড়ি, প্রাসাদতুল্য। সিং-দরজাওয়ালা বড় গেট। খোলা গেটের ভিতর দিয়ে সামনে সুদীর্ঘ বাগান। দেখা যায়। তেমন যত্নকৃত বাগান বলতে যা বোঝায়, রংবেরঙের ফুল, সে সব কিছুই নেই। বড় বড় গাছের সংখ্যাই বেশি। ইউকালিপটাস, মেহগিনি, অশোক, জয়ন্তী বা গুলমোহর, এমনি বড় বড় গাছের ছায়ানিবিড়তার মধ্যে ক্যাসলের মতো বাড়িটি দেখা যায়। মাঝখান দিয়ে লাল রাস্তা বাড়ির সামনের বারান্দার সিঁড়ি অবধি চলে গেছে। হয়তো একদা মোরাম বিছানো ছিল। এখন আর বিলাসের সে প্রাচুর্য নেই।

সিংদরজার থামের একপাশে ছোট একটি ট্যাবলেট, তাতে একপাশে বাংলায় ও আর একপাশে ইংরেজিতে লেখা রয়েছে, নবযুগ উন্মাদ-আশ্রম ও মানসিক চিকিৎসালয়। চারপাশে অরণ্যের বিস্তৃতি জায়গাটিকে আরও মনোরম করেছে।

মনে হয়, বাড়িটিতে লোকজনের বাস নেই, এমনই স্তব্ধ নিবিড় শান্ত। কিন্তু একটি ঘরে দুজন বসে ছিলেন। যিনি বয়স্ক, তাঁর উশকো-খুশকো পাতলা চুল, অল্প দাড়ি, চোখে মোটা লেন্সের চশমা। তিনি যেন স্বপ্নের ঘোরে আবেগ-মন্থিত স্বরে কথা বলে চলেছিলেন। তাঁর সামনের সেক্রেটারিয়েট টেবিলটি তেমন গোছানো নয়। টেবিলে একটি টোবাকো পান করবার পাইপ রয়েছে। ভদ্রলোকের গায়ে কোঁচকানো সার্ট, অসংবৃত টাই, প্যান্টটা মোটামুটি ধরনের।

শ্রোতা একজন যুবক, সে অদূরেই একটি বেঞ্চিতে বসে আছে। কোলের ওপর হাত দুটি নিরীহভাবে ন্যস্ত। তার চুলগুলো আঁচড়ানো নেই। কোঁকড়ানো চুল কপালের অনেকখানি ঢেকে রেখেছে। মুখটি মিষ্টি, অনেকটা ছেলেমানুষের মতো। তার মুখের মুগ্ধ হাসি, আয়ত স্বপ্নিল চোখের দৃষ্টি, সবকিছুর মধ্যেই একটি শিশুর সারল্য মাখানো। গায়ে একটি প্রিন্স কোট। দেখলেই বোঝা যায় কোটটি পুরনো। বোতাম আছে, তবু প্রায় সবই ভোলা। স্বভাবতই ভিতরের শার্টটি দেখা যাচ্ছে। শার্টের চেহারাও তথৈবচ। হাতে কাঁচা, কোঁচকানো। প্রিন্স কোটের কলারের পাশ দিয়ে শার্টের এক পাশের কলার এমনভাবে খোঁচা হয়ে বেরিয়ে আছে, যেন একটি গাধার বড় কান। যুবক একটু নড়লে বা ঢোঁক গিললেই কলারটি এমনভাবে নড়ে উঠছে, যেন ঠিক গাধায় কান নাড়ছে। দৃশ্যটা হাসির উদ্রেক করে। শার্টের বোতামগুলোও তার ভাল করে লাগানো নেই। কোটের মতোই কালো রঙের একটি ভাঁজহীন প্যান্ট তার পরনে। একটু বেশি ঢলঢলেই মনে হয়। কিন্তু পায়ে মোজা নেই, অথচ পায়ে দুটি ভেলভেটের পুরনো নাগরা। এত পুরনো হয়েছে যে, অনেকটা ধূলিধূসর দেখাচ্ছে এবং ধারে-ধারে জরি উঠে গেছে, তার ফুপড়ি পর্যন্ত দেখা যায়। ডান পা-টি এমনভাবে বাঁ দিকের প্যান্টের খোলর মধ্যে ঢুকিয়ে দিয়েছে, মনে হয়, মোজা নেই বলে শীত করছে। কিন্তু দেখলেই হাসি পেয়ে যায়।

ডক্টর ঘোষের আবেগ-মন্থিত কথা শেষ হয়ে আসার শেষেই, এ সব বিশেষ করে লক্ষে পড়ে। ডক্টর ঘোষই এই আশ্রমের একমাত্র ডাক্তার, আশ্রমটি তাঁর নিজের প্রতিষ্ঠিত। ঘরটি প্রায় আসবাবপত্রহীন। দেয়ালে একটি ক্যালেন্ডার ছাড়া বড় একটি বুদ্ধের শুধু মুখচ্ছবি। সেই মুখে করুণ মধুর হাসি, নিমীলিত চক্ষু, তবু চোখের তারা দুটি ঈষৎ দেখা যায়।

তিনি বলে চলেছিলেন, …তাই, আমার সব আবেদন তাই মানুষের কাছে। বুঝলে সুজিতনাথ, মানুষ, মানুষ, মানুষকে মানুষই সব দিতে পারে, বিশ্বসংসারে এই যে এত উন্মাদ, মানসিক ব্যাধিগ্রস্ত লোক দেখছ, এ সব কিছুই ঘটতে পারে না, যদি মানুষ আর একটু কম নিষ্ঠুর হত, কম স্বার্থপর হত। একটু…কী বলব, আর একটু সহজ, আর একটু স্নেহ-ভালবাসা প্রেম-প্রীতির সম্পর্ক, আর একটু গভীর, নিবিড় করে নিয়ে দেখা, সেটাই সবথেকে বড় মহৌষধ। আমি আমার সারাটা জীবন ভরে এই অভিজ্ঞতাই সঞ্চয় করেছি। আধুনিক বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি কী বলে আমি জানি না, জানতেও চাই না। জীবনে যে আমার প্রথম রুগি, যাকে দেখে আমি প্রতিজ্ঞা করেছিলাম…।

এই পর্যন্ত বলে, টেবিলের একপাশে একটি ফটোগ্রাফের দিকে তাকান। দু পাশের ঘন চুলের মাঝখানে ফুলের মতো নিষ্পাপ একটি পবিত্র মেয়ের মুখ। কথা বলতে বলতে সহসা ডক্টর ঘোষের গলা করুণ আর স্বপ্নাচ্ছন্ন শোনায়, কণ্ঠস্বর নেমে যায়। আবার বলেন, প্রতিজ্ঞা করেছিলাম, মানুষের মনের অসুখ সারানোই হবে আমার জীবনের ব্রত। দেখেছিলাম, সংসারের কী ভয়াবহ নিষ্ঠুর পীড়ন তাকে একেবারে উন্মাদ করে দিয়েছে। আঃ, তার অপরাধ, সে শুধু ভালবেসেছিল…। তার মনকে আমি সুস্থও করে তুলেছিলাম, কিন্তু তার মৃত্যুকে আমি ঠেকাতে পারিনি… ।

ডক্টর ঘোষের কণ্ঠস্বর ডুবে গেল। যুবকটির করুণ মুগ্ধ দৃষ্টি টেবিলের ছবির দিকে। কোন গহ্বর থেকে যেন ডক্টর ঘোষের গলা আবার ভেসে উঠল, এই আমার প্রথম রুগি, আর তুমি, সুজিত, তুমি আজ আমার শেষ রুগি।

সুজিত ফিরে তাকায় ডক্টরের দিকে। ডক্টর বলেন, তোমাকে ছ বছর ধরে চিকিৎসা করছি আমি, তোমার বেলাতেও আমি দেখলাম, ছেলেবেলা থেকে তুমি কী নিষ্ঠুর নির্দয় স্নেহ-ভালবাসাহীন অবস্থায় কাটিয়েছ, যা তোমার মস্তিষ্কের মনের সমস্ত ভারসাম্য পর্যন্ত নষ্ট করে দিয়েছিল। আমার সৌভাগ্য, তোমারও সৌভাগ্য এখন তুমি ভাল হয়ে গেছ। এবার তোমার সংসারের পথে যাত্রা শুরু।

হঠাৎ ঢং ঢং করে ঘড়িতে চারটে বেজে উঠল। ঘণ্টার শব্দের মধ্যেই ডক্টর যেন সংবিৎ ফিরে পেয়ে বললেন, চারটে? তোমার তো আর দেরি করার উপায় নেই সুজিত। সব গুছিয়ে নিয়েছ তোমার?

সুজিতও যেন খুবই ব্যস্ত হয়ে উঠল। বেঞ্চির একপাশ থেকে সামান্য একটি পুঁটলি সে হাতে তুলে নিল। ডক্টর ঘোষ তাকে দেখলেন। পায়ের দিকে, প্যান্টের খোলের মধ্যে নাগরাসুদ্ধ একটা পা ঢোকানো দেখে, স্নেহ-করুণ সুরে বললেন, শীত করছে, না?

সুজিত সম্মতিসূচক ঘাড় নাড়ল।

 ডাক্তার আবার তার পুঁটলি ও পোশাক দেখলেন। বললেন, এ আশ্রমে এমন একটা বিছানা বা সুটকেসও নেই যে তোমাকে দিই। আশ্রমের ঋণ অনেক, তাই সবাই…।

সুজিতের শার্টের কলার নড়ে উঠল, তার সহজ হাসিটা একটু যেন বোকাটে দেখায়। বলল, এই তো বেশ আছে।

ডাক্তারের দৃষ্টি করুণ ও চিন্তান্বিত। বললেন, বেশ ছাড়া উপায়ই বা কী। তোমাকে যিনি আমার হাতে তুলে দিয়ে গেছিলেন, সেই প্রতাপনারায়ণ সিংহ মশায়ের এক বছর ধরে কোনও চিঠি পাইনি, তোমার চিকিৎসার জন্যে কোনও টাকাও এক বছর পাঠাননি। ওঁর কোনও ঠিকানাও জানি না। আট-ন বছর তিনি নানান জায়গা থেকে টাকা আর চিঠি পাঠাতেন। তিনি যে তোমার কে, তুমিও জান না, আমিও জানি না। শুধু এইটুকু জানি, তুমি নাকি পিতৃমাতৃহীন, ওঁর আশ্রিত ছিলে। তোমাকে চোদ্দো-পনেরো বছর বয়সে বর্ধমানের এক গ্রাম থেকে নিয়ে উনি প্রথম পাটনায় যান। তখন থেকেই তোমার মধ্যে অদ্ভুত সব পাগলামির লক্ষ্মণ দেখা দেয়, হয় হাস, নয় মনমরা হয়ে বসে থাক। লেখাপড়া মাথায় কিছুই ঢোকে না। তোমার ষোলো বছর বয়সে আমার কাছে দিয়ে যান। কিন্তু আশ্চর্য। তোমার মধ্যে আমি প্রথমেই আবিষ্কার করলাম একটি অসহায় দুঃখী, কিন্তু বুদ্ধিমান সহৃদয় ছেলে।

সুজিত লজ্জিত হয়ে এমনভাবে হাসে, মনে হয় সে একটু যেন বিকৃত মস্তিষ্কের লোক। সে মাথা চুলকোয় এবং বুকের কাছে আঙুল দিয়ে খসখসিয়ে দেয়। আসলে এটাই তার লজ্জা ও কৃতজ্ঞতা প্রকাশের ভঙ্গি। ওইভাবে হাসি হাসি মুখ নিয়েই পকেট থেকে সে হঠাৎ একটি ফটো বের করে ডাক্তারের সামনে মেলে ধরে। এবং তার মুখ কৌতূহলিত ও চোখ দুটি বড় বড় হয়ে ওঠে।

ডাক্তার বলে ওঠেন, ও হ্যাঁ, এই তো প্রতাপনারায়ণবাবুর ফটো। এটা তোমাকে দিয়ে গিয়েছিলেন বুঝি?

সুজিত ঘাড় নাড়ে। ডাক্তার আবার বলেন, দেখো তো, এটার পিছনেই কলকাতার একটা ঠিকানা আছে। সেটা আমার কাছেও লেখা রয়েছে বলে আমি তোমাকে আপাতত কলকাতা যাবার টিকিটই কেটে দিয়েছি। হয়তো এ ঠিকানায় গেলে তুমি আপনার লোকজনের বা বাড়ি-ঘরের একটা সন্ধান পাবে।

সুজিত ফটোটা উলটে ধরে। পিছনে লেখা আছে, শ্ৰীবীরেন্দ্রনারায়ণ রায়চৌধুরী, ১৯, অলিভ রোড, কলিকাতা। ঠিকানাটা দেখতে দেখতে ডাক্তার বলেন, হ্যাঁ, হ্যাঁ, এই ঠিকানা। আচ্ছা, তোমার বাবার নামটাও তো আমার পেশেন্ট বুকে–

তাঁর কথা শেষ হবার আগেই সুজিত বলে ওঠে, ঈশ্বর অতীন্দ্রনারায়ণ মিত্র।

–ইয়েস ইয়েস, দ্যাটস্ অলরাইট। দেখ এখন কলকাতায় গিয়ে কী হয়। আমিও কাল সকালেই এ আশ্রম ছেড়ে যাব।

সুজিত করুণ সহজ শিশুর মতো জিজ্ঞেস করে, কোথায় যাবেন?

ডাক্তার হঠাৎ সুজিতের কাঁধে হাত দেন। দূরের দিকে তাকিয়ে বলেন, তা তো জানি না সুজিত। অনেক ছেলেমেয়ের চিকিৎসা করেছি, এখন ক্লান্তি বোধ করছি। এবার আমার ছুটি। দেখি, কোথায় ভাগ্য টেনে নিয়ে যায়।

একটু স্তব্ধতা। একটি লোক ঘরে প্রবেশ করে জানায়, টাঙ্গা আগ্যয়া বাবুজি।

 ডাক্তারই প্রথম চমকে ওঠেন, বলেন, এসে গেছে? চলো চলো সুজিত, আর দেরি নয়, ছটায় তোমার গাড়ি, রাস্তা অনেকখানি। কিন্তু তোমার টিকেট ঠিক আছে তো? দেখো, পকেটে রেখেছ কি না।

সুজিত পকেটে হাত দিয়ে, বার্থ রিজার্ভেশন স্লিপসহ টিকেটটা দেখায়। ডাক্তার বলেন, ঠিক আছে, তোমার ফার্স্ট ক্লাস বার্থ রিজার্ভ আছে। তোমাকে সারাটা পথ হয়তো দাঁড়িয়ে যেতে হবে, তাই ফার্স্ট ক্লাসের টিকেটই কাটতে দিয়েছিলাম। এইটুকুনি আমার শেষ অবদান। আর টাকাটা কোথায় রেখেছ?

সুজিত পকেট থেকে দশ টাকার একটি নোট বের করে। ডাক্তার বলেন, ঠিক আছে, ওই টাকা দিয়েই টাঙ্গা-ভাড়া আর পথের খরচ চালিয়ে নিয়ো। আর ভবিষ্যতে যদি তোমার কোনও চিঠিপত্র আসে, সে-সব অলিভ রোডের ঠিকানাতেই পাঠানো হবে। এখানে আমি সে ঠিকানা রেখে দিয়েছি, এখন চলো।

সুজিত ঘাড় নেড়ে ডাক্তার ঘোষকে অনুসরণ করে। হাতে সেই পুঁটলি। বাইরে এসে, টাঙ্গায় ওঠবার আগে সুজিত থমকে দাঁড়ায়। সহসা এক পা পেছিয়ে এসে, নির্বাক শিশুর করুণ চোখে ডাক্তারের মুখের দিকে তাকায়, এবং নিচু হয়ে ডাক্তারকে প্রণাম করে। ডাক্তার তাকে তাড়াতাড়ি বুকে জড়িয়ে ধরেন। ডাক্তারও আবেগ-কম্পিত হয়ে ওঠেন, থাক থাক।

ডাক্তারের মুখ উজ্জ্বল কিন্তু করুণ। সুজিত ডাক্তারের কাছ থেকে সরে, অবাঙালি চাকরটির হাত চেপে ধরে নাড়া দিল একবার। চাকরটি এই আশাতীত প্রীতিতে সুজিতের হাত মুঠো করে ধরে…

.

টাঙ্গা ছুটেছে বিহারের উঁচু-নিচু রুক্ষ অঞ্চলের ওপর দিয়ে। টাঙ্গা বেশ দ্রুতগামী। প্রায় এক ঘণ্টা ছুটে টাঙ্গা রেলস্টেশনে এসে দাঁড়াল। সুজিত পকেটে হাত দিয়ে দশ টাকার নোটটি বের করে। কিন্তু টাঙ্গাওয়ালা জানাল, তার ভাড়া মিটে গিয়েছে আগেই।

সুজিতের দিকে অ্যাটেনড্যান্ট টিকেট-কলেক্টর অবাক হয়ে তাকায়। ফার্স্ট ক্লাস কম্পার্টমেন্ট সামনেই। গাড়ির গায়ে, কার্ডে প্রথম নামটা লেখা রয়েছে, মিঃ সুজিতনাথ মিত্র। লোয়ার বার্থ, টিকেট নং…। কার্ডে আরও দুটি নাম লেখা ছিল। সুজিত পড়ে নিয়েছে, মিঃ পি. দাশ ও মিস সুনীতা নাগ। অ্যাটেনড্যান্ট টিকেট-কলেক্টর সুজিতের টিকেটটা আবার দেখে, সুজিতকে আপাদমস্তক এক বার দেখল। সুজিতের শার্টের কলার নড়ে উঠল। পুঁটলিটা এক হাত থেকে আর এক হাতে গেল, এবং একটু হাসল।

অ্যাটেনড্যান্ট বলল, আপনিই মিঃ মিত্র?

সুজিত ঘাড় নাড়ল। অ্যাটেনড্যান্ট চাবি দিয়ে ফার্স্ট ক্লাসের দরজা খুলে ধরল। সুজিত ভিতরে ঢুকে গেল। অ্যাটেনড্যান্ট অদ্ভুতভাবে ঘাড় বাঁকিয়ে তাকাল। সে অবাক হয়েছে।

উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশ থেকে যে এক্সপ্রেস গাড়িটা আসবে এই বগিগুলো তার সঙ্গেই জুড়ে দেওয়া হবে।

সুজিত সুন্দর কামরাটি দেখল। ওপরে নীচে চারটি বার্থ। আয়নায় মুখটাও দেখল। তার সঙ্গে গোটা কামরাটা বেমানান। সে এক বার নিজের দিকে তাকাল এবং অসহায়ভাবে একটু ঘাড় নাড়ল।

গাড়ি চলেছে। সুজিতকে দেখা গেল সে চিত হয়ে নীচের বার্থে শুয়ে আছে। পুঁটলিটি মাথায়। সে তাকিয়ে আছে। সে ভাবছিল বাকি দুজন যাত্রী উঠল না কেন!

.

গাড়ি একটা বড় স্টেশনে ঢুকল। ঘড়িতে রাত্রি নটা দেখা গেল। সুজিত শুয়েই আছে। কাঁচের জানালা দিয়ে সে বাইরের দিকে দেখছে। ওয়ার্নিং ঘণ্টা বেজে গেল। একটু পরেই দরজায় দমাদম ঘা পড়তে লাগল। সুজিত দরজা খুলে দিতেই হুড়মুড় করে আগে একটি মেয়ে ঢুকল। পিছনে পিছনে একজন পুরুষ। তাদের পিছনে বেডিংসহ সুদৃশ্য সুটকেস নিয়ে কুলি। আরও একজন কুলি আরও ট্রাঙ্ক-সুটকেস নিয়ে ধড়াধড় ঢেলে দিল। তার আড়ালে প্রায় জবুথবু সুজিত চাপা পড়ে যাবার মতো। সে প্রায় হাঁ করে যাত্রী ও যাত্রিণীকে দেখছে।

যাত্রিণীটি অপূর্ব সুন্দরী শুধু নয়, রূপের একটি ধারালো ঝিলিক বলা যায়। বয়স অনুমান বাইশ-চব্বিশ। পোপাশাকের দিক থেকে অত্যাধুনিকাই বলতে হবে। কান ঢাকা চুল বাঁধার ভঙ্গিটা অপূর্ব, তবু এক গুচ্ছ চুল ভুরুর ওপর দিয়ে গালের ওপর এসে পড়েছে। লাল রং-এর একটি লেডিজ কোট গায়ের ওপর শুধু ফেলা রয়েছে। হাতে ব্যাগ। আপাতদৃষ্টিতে বেশেবাসে চেহারায় একটি রুক্ষতা আছে। তাকে মনে হচ্ছে চঞ্চল অস্থির। তার আয়ত চোখ দুটিতেও একটি অদ্ভুত তীব্রতা। তবু ভাল করে লক্ষ করলেই বোঝা যায়, কোথায় যেন একটি অসহায় বিষণ্ণতাও রয়েছে। হয়তো তার ক্লান্ত হয়ে বসে পড়া, চুলের গুছিটি সরিয়ে দিয়ে এক মুহূর্ত বাইরের দিকে তাকিয়ে থাকার মধ্যে সেটা সুজিতের মনে হয়। তারপরেই মেয়েটি জিনিসপত্রের দিকে এক বার তাকায়।

সঙ্গী ভদ্রলোকটির বয়স নিশ্চয় চল্লিশোধেঁ। গোঁফ আছে, জুলফির কাছে বেশ পাক ধরেছে চুলে। ভারী গম্ভীর আর অভিজাত বলেই মনে হয়। একেবারে পুরোপুরি বিদেশি কায়দায় বিলাতি স্যুট অঙ্গে। মাথায় ফেল্ট-এর টুপি। টুপিটা তিনি খুললেন। এরা ঢুকতেই কামরার মধ্যে এক ঝলক সুগন্ধও ছড়িয়ে পড়ল।

ভদ্রলোক ব্যস্ত হয়ে পকেটে হাত দিলেন কুলিদের পয়সা দেবার জন্যে। তার আগেই মেয়েটি তার ব্যাগ থেকে একটি টাকা বের করে কুলির হাতে দিয়ে দিল। ঘণ্টা বাজল, হুইও শোনা গেল। ভদ্রলোকটি বলে উঠলেন, আমিই তো দিচ্ছিলাম।

মেয়েটি কোনও জবাব না দিয়ে যেন জিনিসপত্রগুলো দেখতেই ব্যস্ত হল। এমন সময়ে একজন টি টি আই ঢুকে বিগলিত হেসে বলল, সব ঠিক আছে তো স্যার?

ভদ্রলোক–হ্যাঁ, সব, সব।

টি টি আই–্যাক, গাড়িটা যে ধরতে পেরেছেন—

বলতে বলতেই টি টি-র নজরে পড়ল সুজিতকে, মালপত্রের আড়ালে যাকে অর্ধেক দেখা যাচ্ছে। তার বোতাম-খোলা কোট, কোঁচকানো শার্ট, উশকো-খুশকো চুল, এবং কোনও মালপত্র না দেখে হঠাৎ টি টি হুমকে উঠল, আপনি কে? এখানে কী করছেন? আপনি কি এ কম্পার্টমেন্টের প্যাসেঞ্জার?

যেন এ কথা শুনে, এই প্রথম যাত্রী ও যাত্রিণীর নজর পড়ল সুজিতের ওপর। সুজিত ঘাড় নেড়ে নীরবে জানাল, হ্যাঁ?

–দেখি, আপনার টিকেটটা দেখান।

টি টি-র গলায় রীতিমতো সন্দেহ। বাকি দুজনের চোখেও তাই। সুজিত টিকেট দেখাল। টি টি অবাক হয়ে বলল, আপনার মালপত্র কোথায়?

সুজিত পুঁটলিটা হাতে তুলে দেখাল। সকলেই আরও অবাক।

 টি টি-ব্যস! কলকাতা অবধি যাবেন, আর এই আপনার?

সুজিত ঘাড় নাড়ল, একটু হাসল। কিন্তু গাড়ি তখন চলতে আরম্ভ করেছে। টি টি তাড়াতাড়ি নামতে নামতে বলল, স্ট্রেঞ্জ!…

সুজিত দেখল, যাত্রী যাত্রিণী দুজনেই তখনও তার দিকে তাকিয়ে। সে মনে মনে ভাবল, ট্রেনের গায়ে কার্ডে লেখা নাম-পরিচয়ের, একজন নিশ্চয় মিঃ, দাশ। আর একজন মিস্ সুনীতা নাগ।

যেন হঠাৎ খেয়াল হতে মিঃ দাশ তাড়াতাড়ি গাড়ির দরজা বন্ধ করলেন। এবং আবার সুজিতের দিকেই ফিরে তাকালেন। তারপরে চোখ ফেরালেন সুনীতার দিকে। কিন্তু সুনীতা দাশকে দেখছিল না। সে সুজিতকেই অবাক হয়ে দেখছিল। তার সুন্দর চঞ্চল অস্থির এবং ধূলিরুক্ষ অপ্রসন্ন মুখে যেন বিদ্যুৎচকিতে একটু হাসি খেলে গেল। সেটা বিদ্রূপ না করুণা কিংবা আর কিছু বোঝা গেল না। হাসিটা এত চকিত মুহূর্তের জন্যে দেখা গেল, যেন কারুর নজরে পর্যন্ত পড়ে না।

কিন্তু সুজিত বোধ হয় দেখতে পেল, তাই একটা ঢোঁক গিলল বিব্রতভাবে। তার অবস্থাটা করুণ। সে বলল, আপনাদের এই ট্রাঙ্কটা একটু সরাবেন? আমার দুটো পায়ের ওপর পড়েছে কিনা।

মিঃ দাশ–আই সি।

 মস্ত বড় ট্রাঙ্ক, তার ওপর বেডিং। মিঃ দাশ যদিও বা কোনও রকমে বেডিংটা ঠেলে একদিকে ফেললেন, ট্রাঙ্কটা তাঁর পক্ষে সরানো সম্ভব হল না। এবং মুখ লাল করে বলে উঠলেন, এটা আপনার পায়ের ওপর পড়ল কী করে?

সুনীতা বলে উঠল, সেটা পরে ভেবে দেখা যাবে মিঃ দাশ, এখন নিন, ধরুন। বলে সুনীতা হাত দিয়ে ট্রাঙ্ক ধরল। দুজনে কোনও রকমে সরাল। তলায় দেখা গেল সেই নাগরা। হেঁড়েনি, তবে আকৃতি বদলে গেছে। সুজিত তাড়াতাড়ি নিচু হয়ে পা দুটো একটু টিপল। টিপে সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে চোখ তুলতেই সুনীতার সঙ্গে চোখাচোখি হয়ে গেল। সুনীতার চোখে হয়তো একটা জিজ্ঞাসা ছিল। সুজিত তার সেই সরল শিশুর মতো হেসে বলল, লাগেনি।

সুনীতা ঠিক শব্দ করল না, কিন্তু যেন আশ্বস্ত হয়ে ঠোঁট নাড়ল। মিঃ দাশ এ সব দেখছিলেন। তিনি হঠাৎ ব্যস্ত হয়ে বলে উঠলেন, আচ্ছা, জিনিসপত্রগুলো একটু সাজিয়ে ফেলা যাক, কী বলো সুনীতা?

সুনীতা ফিরতেই তাড়াতাড়ি বললেন, না না, তুমি বসো। আমি বরং বিছানাটা তোমাকে খুলে পেতে দিচ্ছি।

বলে তিনি বিছানাটা খুলতে গেলেন। তাঁর হাতের হিরের আংটি ঝলকে উঠল। কিন্তু বেডিং-এর বেল্ট কিছুতেই খুলতে পারছিলেন না। তাতে উনি বিরক্ত ও লজ্জিত হচ্ছিলেন।

সুজিত বলে উঠল, আমি যদি ওটা খুলে দিই, আপনি কি বিরক্ত হবেন?

মিঃ দাশ সন্দেহজনক দৃষ্টিতে তাকালেন। লোকটা তাঁকে বিদ্রূপ করছে কি না বোঝবার জন্যে। বিরক্ত ও বিস্মিত হয়ে তাকিয়ে বললেন, তুমি–আই মিন, আপনি খুলে দেবেন?

সুজিত তার কোনও জবাব না দিয়ে বেল্টটা খুলে, একেবারে বিছানা বের করে ফেলল। এবং কিছু বিছানা হাত ভরে তুলে সিটের ওপর রাখল। আর এক বার চোখাচোখি হল সুনীতার সঙ্গে। সুজিত চোখ ফিরিয়ে বললে, এই মালপত্রগুলো কি একটু তুলে দেব?

মিঃ দাশ তাকালেন সুনীতার দিকে। সুনীতার চোখে বিস্ময়-কৌতুক। সুজিতের বড় বড় চোখের দিকে তাকিয়ে কৌতুকোচ্ছলে প্রায় হেসেই উঠল সে। বলে উঠল, না না, আর কিছু সরাতে হবে না। একটা তো রাত। আপনি বসুন।

সুজিত ওর জায়গায় গিয়ে বসল। হাত দুটো এক বার দেখল। কিন্তু দুজনেই যে দু রকম ভাবে তার দিকে তাকিয়ে আছে, এটা অনুভব করে সে দুজনের মুখের দিকেই এক বার তাকাল, একটু হাসল। সুনীতা তাড়াতাড়ি মুখটা ফিরিয়ে, মোটামুটি বিছানাটা ঠিক করে, বসে পড়ল। বাইরের অন্ধকারের দিকে তাকাল। ওর মুখে আবার গাম্ভীর্য দেখা দিল, একটা বিশেষ উত্তেজনার ছায়াও ফুটে উঠল। ও হঠাৎ দাঁত দিয়ে ঠোঁট দংশন করল।

সুজিত সুনীতার দিকেই তাকিয়ে ছিল। সুজিতের কী মনে হল, কে জানে। ও বহু দিন বাইরের জগতের মানুষের সঙ্গে বিশেষ মেলামেশা করেনি। আজকের জীবনটা সেজন্য ওর কাছে অনেকখানি নতুন। ওর চোখে সেই জন্যেই যেন প্রথম ঘুম ভাঙার বিস্ময়। এবং সেই বিস্ময় নিয়েই, সুনীতার দিকে তাকিয়ে, সে যেমন মুগ্ধ হচ্ছে, তেমনি একটা বিষণ্ণতাও তাকে ঘিরে ধরেছে। কেন, তা সে জানে না। অথচ এই প্রথম সে এই মেয়েটিকে দেখছে। পরিচয় একমাত্র সহযাত্রিণী। ওর মনে হতে থাকে, ও যেন এই রূপসী মেয়েটির ভিতর পর্যন্ত দেখতে পাচ্ছে। মেয়েটির ভিতরে যেন একটা বিক্ষোভের ঝড় বইতে দেখছে। অথচ এই ঝড়ের ভিতর দিয়ে আসলে একটি অসহায় বেদনাই যেন মাথা কুটছে। কেন যে এ রকম মনে হচ্ছে, সুজিত নিজের কাছে ব্যাখ্যা করতে পারছে না।

সুনীতা সহসা সচেতন হল, সুজিতের দৃষ্টিটা যেন সে অনুভব করল। সে মুখ ফেরাল না তখুনি, কিন্তু মুখভাব শান্ত হয়ে উঠল, এবং কয়েক মুহূর্ত পরে হঠাৎ মুখ তুলে সুজিতের দিকে তাকাল। এই তাকানোর মধ্যে দিয়ে দেখা গেল, সুনীতার চোখেও যেন একটি মুগ্ধ বিস্ময়।

সুজিত সচেতন হল, সুনীতা তাকে দেখছে।

এরকম ক্ষেত্রে সুজিতের ওর সেই স্বভাবহাসি হেসে ওঠবার কথা। কিন্তু ওর দৃষ্টি বিষণ্ণ ও গভীর, আস্তে আস্তে চোখ সরিয়ে ও দৃষ্টি নত করল। তারপর যেন খানিকটা অসহায় অস্বস্তিতেই কী করবে ভেবে পেল না। এবং যেন কিছু ভেবে না পেয়েই পুঁটলিটা মাথার দিকে রেখে শুতে গেল।

মিঃ দাশ হাতের সামনে একটা বিলিতি জার্নাল নিয়ে সুজিতকেই লক্ষ করছিলেন। তাকে শোবার উদ্যোগ করতে দেখে বলে উঠলেন, আপনি কি নীচেই শোবেন নাকি?

সুজিত বিদ্যুৎস্পৃষ্টের মতো উঠে বসল। মুখখানি বিস্মিত বিব্রত। মিঃ দাশের দিকে তাকিয়ে আপার বার্থের দিকে দেখল। আবার মিঃ দাশের দিকে তাকিয়ে বলল, আমি ওপরে যাব?

মিঃ দাশ বললেন, আপনার অবিশ্যি লোয়ার বার্থ-ই রিজার্ভ করা আছে। সু

জিত বলল, তাতে কী? আমি ওপরেই যাচ্ছি।

সুনীতা তাকিয়ে ছিল সুজিতের দিকেই। সুজিত ওর পুঁটলিটা একবার আপার বার্থের ডাইনে রাখল, আর একবার বাঁয়ে, আবার ডাইনে। পায়ের নাগরাজোড়া খুলল। আপার বার্থে ওঠার শেকল ধরে আবার বার্থের দিকে তাকাল, শার্টের কলার নড়ে উঠল, এবং লাফ দিয়ে উঠতে গিয়ে, একটা পা বার্থের ওপর তুলে, গোটা শরীরটা নীচের দিকে এমনভাবে ঝুলে পড়ল, সেটা বিপজ্জনকও বটে।

সুনীতার চোখে একই সঙ্গে ভয় ও কৌতুক। মিঃ দাশ বিস্ময় অস্বস্তিতে কী করবেন ঠিক যেন ভেবে পাচ্ছেন না। কিন্তু সুজিত সমগ্র শরীরকে একটা ধাক্কা দিয়ে বার্থের ওপর উঠে গেল। কলার দুটো নড়ে উঠল। সুনীতার একটা নিশ্বাস পড়ল, সুজিতের মুখের দিকে তাকিয়ে ওর চোখ দুটি কৌতুকে উজ্জ্বল হয়ে উঠল। সমস্ত মুখে একটা বিস্ময় কৌতুক ও খুশির আভাস। মিঃ দাশের বিস্মিত মুখে গাম্ভীর্য নেমে এল, ম্যাগাজিনটা আবার তুলে নিলেন মুখের সামনে।