৩. হাওড়া ব্রিজ

হাওড়া ব্রিজ পেরিয়ে পায়ে হেঁটে বিচিত্র শহর কলকাতার মাঝখানে এসে দাঁড়াল সুজিত। রাস্তাঘাট কিছুই চেনে না সে। জনতার ভিড়, গাড়ি-ঘোড়ার চলমান প্রবাহ। তার মাথার মধ্যেটা যেন বোঁ বোঁ করতে থাকে। সে কোনও কোনও লোককে জিজ্ঞেস করবার উদ্যোগ করে, অলিভ রোড কোথায়? কিন্তু জিজ্ঞেস করবার আগেই, সবাই যেন তার পাশ কাটিয়ে চলে যায়। সে ঢোঁক গেলে, অসহায়ের মতো তাকায়। শেষ পর্যন্ত একটা রিকশা এসে তার পিছনে ঠুন ঠুন করে ঘণ্টা বাজায়। সুজিত ফিরে তাকায়।

রিকশাওয়ালা কাঁহা যায়েগা বাবু?

সুজিত–অলিভ রোড।

রিকশাওয়ালা–অলিভ রোড? কাঁহা হ্যায়?

সুজিত–তা তো জানি না!

একজন চলমান পথিক, কথাটা কানে যেতে বলে ওঠে, আলিপুরের দিকে যান, নিউ আলিপুর।

রিকশাওয়ালা বলে ওঠে, আই বাবা, বহুত দূর, বাস মে চলা যাইয়ে।

সুজিত অসহায়ের মতো তাকিয়ে থাকে। তার চোখের ওপর দিয়ে, গর্জন করে বড় বড় গাড়ি যায় আসে, কিন্তু কী করতে হবে, সে ঠিক করে উঠতে পারে না।

শেষ পর্যন্ত তিন টাকায় রফা করে, একজন রিকশাওয়ালাই সুজিতকে নিয়ে এল তার গন্তব্যে। ১৯, অলিভ রোড মস্ত বড় গেটওয়ালা বাড়ি। নেমপ্লেট রয়েছে, মিঃ বি. এন. রায়চৌধুরী। অভিজাত পাড়া। সব বাড়িগুলোই অনেকখানি করে জমি নিয়ে বিস্তৃত। বাগান ও আধুনিক ইমারতে গোটা অঞ্চলটা যেন সেজেগুজে গম্ভীর হয়ে রয়েছে।

সুজিত এসে বন্ধ গেটের সামনে দাঁড়ায়। এক পাশে প্লেটে লেখা আছে, বিওয়্যার অফ ডগ। দরোয়ানকে দেখা যাচ্ছে না। সুজিত বাড়িটার দিকে তাকিয়ে কী করবে ভেবে উঠতে পারছে না। ঠিক এ সময়েই পিছনে আচমকা মোটরের হর্ন বেজে ওঠে। সুজিত চমকে উঠে সরে যায়। দরোয়ান ছুটে এসে গেট খুলে দেয়। উর্দিপরা ড্রাইভার গাড়ির মধ্যে। একজন যুবক বসে ছিল ড্রাইভারের পাশেই। গাড়িটা গেট দিয়ে ঢুকতে যেতে যুবক ড্রাইভারকে ইশারা করে থামিয়ে সুজিতের দিকে ফিরে তাকায়। গম্ভীর গলায়, চিবিয়ে চিবিয়ে উচ্চারণ করে, কাকে চান?

সুজিত ঢোঁক গিলে বলে, বীরেন্দ্রনারায়ণ রায়চৌধুরী।

যুবক সুজিতের আপাদমস্তক এক বার দেখে, কী ভেবে যেন দরোয়ানকে হুকুম করে, ইয়ে আদমিকো ওয়েটিং-রুম মে বৈঠাও।

পরমুহূর্তেই গাড়িটা বাগানের ভিতর দিয়ে ছুটে গিয়ে গাড়িবারান্দার নীচে দাঁড়ায়।

 দারোয়ান সুজিতকে এক বার দেখে, হাত দিয়ে ইশারা করে ডাকে।

.

ওয়েটিং-রুম। একটি গোল টেবিল। কয়েকটি চেয়ার টেবিলের ওপরে ভিজিটরস নেমের স্লিপ। আর কোনও আসবাবপত্র নেই। একটি দরজা দিয়ে ভিতরের একটি ঘরের সামান্য অংশ দেখা যায়। সেখানে মানুষের কণ্ঠস্বরও শোনা যায়। এক বার সেখানে টেবিলের ওপর মুষ্ট্যাঘাত ও বাজখাঁই গলার হুংকার শোনা যায়, না ইমপসিবল!

সুজিত চমকে উঠে সোজা হয়, চোখ বড় বড় দেখায়, শার্টের কলার নড়ে ওঠে। একটু পরেই এক মাড়োয়ারি ও একটি স্যুটপরা লোকের সঙ্গে, একজন মাঝবয়সি লোককে দেখা যায়। মাড়োয়ারি ভদ্রলোক তখন মাঝবয়সি লোকটিকে বলছেন, আপনি মোশাই একটু মিঃ রায়চৌধুরীকে সমঝাইয়ে বলবেন, নেই তো এ বেওসাতে আমার চার লাখ টাকার ক্ষোতি হইয়ে যাবে।

মাঝবয়সি লোকটি চোখ টিপে, ফিসফিস করে বলল, বলব, বলব।

সুজিত হাঁ করে শুনছিল এদের কথা। লোক দুটি বেরিয়ে গেল। মাঝবয়সি লোকটি সুজিতকে বলল, আপনি মিঃ রায়চৌধুরীর সঙ্গে দেখা করবেন?

সুজিত কোনও রকমে ঘাড় নাড়ে। লোকটি ডাকে, আসুন।

.

একটা ঘরের দরজায় মোটা পরদার সামনে দাঁড়িয়ে মাঝবয়সি লোকটি বলে, আপনি যান ভিতরে। বগলের এ পুঁটলিটা কি রেখে যাবেন বাইরে?

সুজিত তাড়াতাড়ি বলে, না না।

লোকটি একটু অবাক হয়। সুজিত একটু বোকার মতো হাসে। লোকটি বলে, তবে যান।

সুজিত পরদা সরিয়ে ভিতরে দেখল। প্রথমেই দেখল, বিরাট এক পুরুষ-মূর্তি, স্যুট পরা, কিন্তু পিছন ফেরা। পিছনে তাঁর কাঁচা পাকা চুল দেখা যায়। তিনি যেন দেয়ালে ছবি দেখছেন, এমনিভাবে ছবিটার দিকে তাকিয়ে আছেন। হঠাৎ বলে উঠলেন, ডিয়ার স্যার, উই রিগ্রেট টু ইনফরম ইউ, দ্যাট, ডিউ টু হেভি কমজামশন, আওয়ার রিভার সার্ভিস ইজ কোয়াইট আনেবল টু গিভ ইউ এনি সার্ভিস…।

কথাগুলো অত্যন্ত দ্রুত বলেই তিনি একপাশে ফিরে তাকালেন। যেদিকে তাকালেন, সেখানে এক কোণে, গেটে দেখা গাড়ির সেই যুবকটিকে দেখা গেল। সে নোট নিচ্ছিল। নোট নিয়ে সে মুখ তুলে তাকাতে গিয়ে সুজিতকে দেখতে পেল। বলে উঠল, কাকাবাবু সে-ই

কথা শেষ করবার আগেই তার দৃষ্টি অনুসরণ করে মিঃ রায়চৌধুরী সুজিতের দিকে ফিরে তাকালেন। ঘরটা একটা সুসজ্জিত অফিস-ঘর হলেও বড় বড় গদিওয়ালা চেয়ার ও বিশ্রামের ব্যবস্থা আছে। দেয়ালে নানান রকমের কয়েকটি পেন্টিং। তা ছাড়া একটা বিরাট অংশ জুড়ে বাংলা-বিহার-উড়িষ্যা ও আসামের জলপথ, স্থলপথ ও আকাশপথের নকশা। মেঝেতে পুরু গালিচা পাতা রয়েছে।

বীরেন্দ্রনারায়ণের সঙ্গে চোখাচোখি হতেই সুজিত একটু হাসবার চেষ্টা করল।

বীরেন্দ্রনারায়ণ পুরোপুরি সাহেব, গম্ভীর, বছর পঞ্চান্ন থেকে ষাটের মধ্যে বয়স। তীক্ষ্ণ চোখে সুজিতকে আপাদমস্তক দেখেই বলে উঠলেন, কী চাই?

সুজিত ভদ্র নম্র হেসে বলল, আপনার সঙ্গে একটু দেখা করবার

বীরেন্দ্র বাধা দিয়ে বলে উঠলেন, কী চাই, আমি তাই জিজ্ঞেস করছি।

সুজিত–আজ্ঞে চাই না কিছুই, মানে–আমার নাম, শ্রীসুজিত মিত্র।

বীরেন্দ্র–অশেষ ধন্যবাদ। কিন্তু কী চাই?

 ওঁর গলায় অসহিষ্ণুতার আভাস।

সুজিত বলল, আমাকে…মানে…আমার বাবার নাম ঈশ্বর অতীন্দ্রনাথ মিত্র।

বীরেন্দ্রনারায়ণ ধৈর্য হারিয়ে উচ্চ গলায় বলে উঠলেন, আই ডোন্ট লাইক টু হিয়ার ইওর ডেড ফাদারস নেম। আমি জিজ্ঞেস করছি, কী চাই?

সুজিত আবার ঢোঁক গিলে এক মুহূর্ত বীরেন্দ্রবাবুর চোখের দিকে তাকায়। বলে, ঠিক কিছু চাই না। প্রতাপনারায়ণ সিংহের ফটোর পিছনে

বীরেন্দ্রবাবু যেন একটু চমকে উঠলেন। বললেন, কে? প্রতাপনারায়ণ সিংহ? তার সঙ্গে কী সম্পর্ক?

সুজিত–আজ্ঞে, তার সঙ্গে আমার কী সম্পর্ক, আমি ঠিক জানি না। তবে তাঁর ফটোর পিছনে আপনার নাম-ঠিকানাটা লেখা রয়েছে বলে, আপনার কাছেই এসেছি।

বীরেন্দ্রনারায়ণ তীক্ষ্ণদৃষ্টিতে সুজিতের দিকে এক বার লক্ষ করলেন, বললেন, প্রতাপনারায়ণ সিংহ তো আমার আত্মীয়, আমার স্ত্রীর বড় ভাই তিনি। কিন্তু আপনার, মানে, তোমার কথা তো আমি কিছুই বুঝতে পারছি না। প্রতাপবাবুর ফটো তোমার কাছে গেলই বা কী করে? তুমি কে?

সুজিত বলল, আমি ঠিক জানি না আমি কে!

বীরেন্দ্রনারায়ণ গম্ভীর বিস্ময়ে ঘরের যুবকটির সঙ্গে চোখাচোখি করেন। যুবকটিও থ হয়ে আছে। বীরেন্দ্রনারায়ণ কয়েক পা অন্য দিকে গিয়ে দাঁড়ালেন। দৃষ্টি সরালেন না সুজিতের দিক থেকে। বললেন, তুমি…অর্থাৎ তুমি জান না, তুমি কে?

সুজিত সরলভাবে ঘাড় নেড়ে বলল, হ্যাঁ, আমি সুজিত। শুনেছি, আমাদের বাড়ি বর্ধমানের কোনও এক গ্রামে। আমার বাবার নাম ঈশ্বর অতীন্দ্রনাথ মিত্র, প্রতাপবাবু আমাকে বছর দশ-বারো আগে পাটনায় নিয়ে গেছিলেন। তারপরে!

হঠাৎ যেন সংবিৎ ফিরল বীরেন্দ্রবাবুর। চমকে উঠে বললেন, কী বললে তোমার বাবার নাম, অতীন মিত্তির? হ্যাঁ হ্যাঁ, প্রতাপের বন্ধু ও বিজনেস পার্টনার ছিলেন। কিন্তু তারা দুজনেই তো মারা গেছেন। প্রতাপ তো গত বছর ডালহৌসির পাহাড়ে, হার্ট কনজামশনে…।

একটু থেমে আবার বলে উঠলেন, কিন্তু তুমি..মানে তুমি এখন এলে কোত্থেকে?

সুজিত বলল, বিহারের গুঁড়িয়াঁটাঁড়ের নবযুগ উন্মাদ-আশ্রম থেকে।

 প্রায় চিৎকার করে উঠলেন বীরেন্দ্রনারায়ণ, উন্মাদ-আশ্রম?

ঘরের কোণের যুবকটির দিকে বড় বড় চোখে ফিরে তাকালেন। সুজিত ইতিমধ্যে উচ্চারণ করল, এবং মানসিক চিকিৎসালয়।

বীরেন্দ্র ফিরে তাকালেন। সুজিত আবার বলল, কিন্তু আমি এখন ভাল আছি বলেই এখানে এলাম।

সন্দিগ্ধভাবে তাকালেন বীরেন্দ্র। সুজিত বলল, আমি এখন ভাল আছি।

বীরেন্দ্র তখনও সন্দিগ্ধভাবে প্রায় একটা হুংকার দিলেন, হুঁ।

সুজিতকে দেখতে দেখতে সরে গিয়ে একটা চেয়ারের পাশে দাঁড়ালেন। সুজিত আবার বলল, প্রতাপনারায়ণ সিংহ তা হলে মারা গেছেন?

বীরেন্দ্র সহসা ভাব বদলে বললেন, হ্যাঁ। কিন্তু, আমি তোমার জন্য কী করতে পারি? তুমি আমার কাছে কী চাও?

সুজিত–কিছু নয়। এমনি এলাম, মানে ওই ফটোর পিছনে আপনার ঠিকানাটা দেখলাম কিনা, ভাবলাম, আপনি হয়তো কিছু হদিস দিতে পারেন।

কীসের হদিস?

–প্রতাপবাবুর বিষয়, বা আমাদের বাড়ি কোথায়, আর কেউ আছে কি না আমার!

–কিছু না, কোনও খবরই দিতে পারি না।

 হাত নেড়ে বলে উঠলেন বীরেন্দ্র, তা তুমি কলকাতায় এখন কোথায় যাচ্ছ?

–কোনও হোটেল-টোটেলে যাব। শুনেছি অচেনা লোকেরা হোটেলে যায়।

 –হোটেলে যাবে? টাকা আছে?

–হ্যাঁ, টাকা সাত-আটেক আছে।

বীরেন্দ্র ক্ষুব্ধ বিস্ময়ে তাকিয়ে রইলেন, হরি! কলকাতায় এর আগে কখনও এসেছ?

সুজিত ঘাড় নেড়ে জানাল, কখনও আসেনি। বীরেন্দ্র কোণের যুবকের দিকে তাকিয়ে বললেন, শুনেছ? শুনেছ ব্যাপারটা? এর মাথা নাকি ঠিক আছে। দেখ, সত্যি করে বলল, তুমি কি আসলে আমার কাছে কোনও সাহায্য বা চাকরির জন্যে এসেছ?

সুজিত পরম আপ্যায়িতের ভঙ্গিতে সরলভাবে বলল, আপনি চাকরি দিতে পারেন? তা হলে তো খুবই ভাল হয়।

বীরেন্দ্র রাগতে গিয়ে, অসহায় বিস্ময়ে চুপ করে গেলেন। মুখটা কঠিন করে সুজিতকে দেখে বললেন, লেখাপড়া কদ্দূর করা হয়েছে?

সুজিত–কখনও স্কুলে গেছি বলে তো মনে পড়ে না।

বীরেন্দ্র– ইমপসিবল। কী করতে পার? কিছু কাজ-টাজ জানা আছে?

 সুজিত প্রথমে ঘাড় নাড়ে। তারপর হঠাৎ বলে ওঠে–হ্যাঁ, মানে, কাজ ঠিক না, আঁকতে পারি।

–কী আঁকতে পার?

–এই…এই ধরুন আপনি বসে থাকলে আপনাকে এঁকে দিতে পারি।

 বীরেন্দ্র আবার তাকালেন কোণের ছেলেটির দিকে। বললেন, শুনেছ? আচ্ছা, আমি দেখতে চাই, সত্যি তুমি তা পার কি না। কীসে আঁকবে? কাগজ পেন্সিল হলে হবে? না রং-তুলি চাই?

কাগজ-পেন্সিল হলেই হবে।

 –দ্যাটস অলরাইট। শিবেন, একে কাগজ-পেন্সিল দাও তো।

ঘরের কোণের ছেলেটিকে তিনি বললেন। শিবেনের চোখে তখন দুজনের প্রতিই বিস্মিত দৃষ্টি নিবদ্ধ। সশ্রদ্ধ নিচু স্বরে বলল, আজ্ঞে, দিচ্ছি।

সে ত্রস্ত হয়ে কাগজ আর পেন্সিল দিল সুজিতকে। বীরেন্দ্র বললেন, একটা চেয়ার দেখিয়ে, ওখানে বসো, বসে আঁকো।

বলে উনিও সামনের চেয়ারে গ্যাঁট হয়ে বসলেন। কৌতূহলে ভ্রু কুঁচকে তাকালেন সুজিতের দিকে। আর আপন মনেই যেন বললেন, হু, তুমিই তা হলে সেই, যার কথা প্রতাপ বলত, একজনকে মানুষ করে দাঁড় করিয়ে না যেতে পারলে আমার মুক্তি নেই।

সুজিত ততক্ষণ বসে গেছে কাগজ-পেনসিল নিয়ে। তার কাগজে খস খস করে রেখা আঁকা হয়ে চলেছে। বীরেন্দ্রবাবুর দিকে ঘন ঘন দৃষ্টিপাতের মধ্যে ও আঁকতে আঁকতেই সে যেন খানিকটা আত্মগত ভাবেই বলল, বলতেন বুঝি? অথচ উনি আমার বাবার বিজনেসের একজন পার্টনার মাত্র। তবু আমার জন্যে তিনি যা করেছেন…না না, উঁহু, একদম মুখ ফেরাবেন না, হ্যাঁ, এমনি করে তাকিয়ে থাকুন আমার দিকে।

কথার মাঝখানেই সে বীরেন্দ্রবাবুকে তার দিকে মনোযোগ আকর্ষণ করল। বীরেন্দ্রনারায়ণ চমকে ফিরে তাকালেন, ভ্রু কোঁচকালেন, একটা বিরক্তির ভাব ফুটিয়ে তুললেন। আর সুজিত বাঁ হাত তুলে যেন বীরেন্দ্রকে খানিকটা চাঁটি দেখাবার মতো করল, হাতটা একবার ডানদিকে নিয়ে গেল, আর একবার বাঁ দিকে। আসলে মুখের দুটো পাশ আলাদা করে দেখে নিচ্ছে, মেপে নিচ্ছে।

বীরেন্দ্র বিরক্ত হয়ে জিজ্ঞেস করলেন, ঠিক কতক্ষণ লাগবে বলো তো?

সুজিত অদ্ভুত ভঙ্গি সহকারে আঁকতে আঁকতেই বলল, এই মিনিট পনেরো। ছেলেবেলা থেকেই আমার আঁকার দিকে খুব

কথা শেষ না করেই, যেন বিশেষ পরিশ্রমের কসরত করতে গিয়ে তার জিভ খানিকটা বেরিয়ে পড়ল। বীরেন্দ্রর দিকে তাকাল, আবার খস খস করল।

বীরেন্দ্র শিবেনের দিকে চোখের কোণ দিয়ে চকিতে এক বার দেখে বলে উঠলেন, আমি কি এখন শিবেনের সঙ্গে একটু কথা বলতে পারি?

সুজিত–পারেন, না তাকিয়ে।

বলে ঘন ঘন দৃষ্টিপাত ও খস খস শব্দে এঁকে চলল। বীরেন্দ্র খুব জোরে এক বার খাঁকারি দিলেন। বললেন, তুমি ঠিক জান, ওরা আজই আসছে?

সুজিত বলে উঠল, কারা?

বীরেন্দ্র–আমি তোমাকে বলিনি। ইমপসিবল! শিবেন!

শিবেন তাড়াতাড়ি নিচু মোটা গলায় জবাব দিল, আজ্ঞে, হ্যাঁ কাকাবাবু, আসবেন, মানে এসে গেছেন?

বীরেন্দ্র কী করে জানলে?

 শিবেন একটু সংকুচিত দ্বিধায় বলল, আমি এখন চৌরঙ্গি থেকে আসবার সময় মিস নাগের ওখান হয়ে এসেছি।

সুজিত আঁকতে আঁকতেই আপন মনে উচ্চারণ করল, মিস নাগ, হু….উঁহু, চোখটা অত পিটপিট করবেন না স্যার।

বীরেন্দ্রর ভ্রু কুঁচকে উঠল, মুখে বিরক্তি। ইতিমধ্যে শিবেন ওঁর মুখোমুখি ঘরের একপাশে দাঁড়িয়েছে, যাতে কথা বলার সুবিধে হয়। উনি সুজিতের কথায় অবাক হয়ে এক বার শিবেনের সঙ্গে দৃষ্টি বিনিময় করলেন। আবার বললেন, দাশ কিছু বলল?

শিবেন–আপনার কাছে আসবেন তাড়াতাড়ি।

বীরেন্দ্র–দেখা করে আর কী হবে। ওই মেয়েটা, মিস নাগ, ওঁর জন্যে… সু

জিত আবার উচ্চারণ করল, মিস নাগ!

বীরেন্দ্রর ভ্রূ কোঁচকাল। সুজিতের দিকে তাকালেন। সুজিত তখন আঁকছে, যদিও তার চোখের সামনে সুনীতার মুখটা চকিতে চকিতে ভেসে উঠছে। সে সত্যি খেয়াল করছে না, এরা কী বলছে। কিন্তু মিস নাগ শুনলেই, সুনীতার কথা আপনা থেকেই তার মনে আসছে, তাই উচ্চারণ না করে পারছে না।

কিন্তু বীরেন্দ্র সুজিতের ওটা একটা খেয়াল ভেবেই, অবাক হলেও নিজের কথা চালিয়ে গেলেন–ওর জন্যে পঞ্চাশ হাজার টাকা আলাদা করে রেখেছে দাশ, দু-একদিনের মধ্যেই দিয়ে দেবে। কী ভয়ংকর পাজি মেয়ে, কলকাতাটাকে একেবারে জ্বালিয়ে খাচ্ছে। আর সেই মেয়েকে কিনা তুমি বিয়ের প্রস্তাব করেছ, হুঁ? ওই হবে আর কী, বউ পাবে না, তার টাকাটাই পাবে। অবিশ্যি,আমি তাতে রাজি, কেনো, তোমরা যখন বলছ, তোমরা ভালবাসা।

শিবেনের চোখ উজ্জ্বল হয়ে উঠল। তবু সে বীরেন্দ্রের দিক থেকে চোখ নামিয়ে নিল। বীরেন্দ্র আবার বললেন, তবু যা হোক, পঞ্চাশ হাজার টাকা তো। তোমার ভালই হবে।

সুজিত বলে উঠল, বউয়ের বদলে টাকা!

আঁকতে আঁকতেই হেসে উঠল। আবার বলল, মানুষ যে কী!

বীরেন্দ্র আর শিবেনের চোখাচোখি হল। সুজিত হঠাৎ উঠে দাঁড়িয়ে লাস্ট টাচ দিল। বলল, হয়ে গেছে স্যার।

বীরেন্দ্র লাফ দিয়ে উঠলেন। কৌতূহলিত হয়ে এগিয়ে গেলেন, এবং ছোঁ মেরে স্কেচটা তুলে নিয়ে দেখলেন। দেখে প্রায় উল্লাসে চিৎকার করে উঠলেন, বাঃ, বিউটিফুল! শিবেন, দেখো এ বাজে কথা বলেনি, সত্যি আঁকতে জানে, কী বলো? ঠিক আমার মুখটাই হয়েছে, না? ভেরি গুড, ভেরি গুড! তা হলে তো তোমাকে আমি একটা চাকরি দিতে পারি হে, আই মিন, দেওয়া উচিত, না কী বলল হে শিবেন?

শিবেনও সত্যি অবাক ও মুগ্ধ হয়েছিল। বলল, তাই তো মনে হয়।

বীরেন্দ্র বললেন, ঠিক আছে, আমাদের বিজ্ঞাপনের ছবি-টবি তো এর দ্বারা কিছু আঁকানো যেতে পারে অতএব, একে একটা কাজ দেওয়া যেতে পারে। এ মিথ্যে কথা বলেনি। বেশ ভাল আঁকা হয়েছে। আচ্ছা, এ স্কেচটার জন্যে, মানে এটা আমি কিনতে চাই, বুঝলে? তোমাকে আমি একশোটা টাকা দেব।

বলেই শব্দ করে হঠাৎ একটা ড্রয়ার খুললেন, এবং একটি একশো টাকার নোট বের করে সুজিতের হাতে দিলেন।

সুজিত হতচকিত বিস্ময়ে, খুশিতে টাকাটা হাতে নিয়ে এক মুহূর্ত কী করবে ভেবে পেল না। খালি বলতে পারল, এটা আঁকবার জন্যে আমাকে একশোটা টাকা দিলেন?

বীরেন্দ্র–হ্যাঁ, খুবই সামান্য, তবু

কথা শেষ না করে ছবিটা দেখতে লাগলেন। সুজিত বলল, এ তো অনেক টাকা। একশো।

 বলে খুশিতে ডগমগ হয়ে হাসতে লাগল।

বীরেন্দ্র বললেন, অনেক কোথায় হে? একটা তৃতীয় শ্রেণীর হোটেল-খরচাও ওতে হবে না। আমি দেখছি, তোমার জন্যে কী করতে পারি।

সুজিত হঠাৎ ঢোঁক গিলে বলল, আচ্ছা, আমার মানে, সেই কাল বিকেলে খেয়েছি কিনা, তাই খিদে পেয়েছে।

বীরেন্দ্র কয়েক মুহূর্ত মূঢ় বিস্ময়ে তাকিয়ে বলে উঠলেন, ইমপসিবল, ইমপসিবল। সে কথা বলবে তো! এই ছবিটা আমি এখুনি এক বার আমার স্ত্রীকে দেখাতে চাই, তুমিও চলো আমার সঙ্গে বাড়ির ভেতরে। চলো চলো…

সুজিত তাড়াতাড়ি পুঁটলিটা তুলতে যায়। বীরেন্দ্র ধমকে ওঠেন, ওটা দিয়ে কী হবে? কী ঐশ্বর্য আছে ওটাতে শুনি, যে, বগলে নিয়ে যেতে হবে। দেখি, দেখি ওতে কী আছে?

বলেই উনি দ্রুত হাতে পুঁটলিটা খুলে ফেললেন। দু-একটা পায়জামা, পাঞ্জাবি, আন্ডারওয়্যার, গেঞ্জি, একজোড়া স্লিপার, অনেক কাগজপত্র। প্রতাপ সিংহের বহু চিঠিপত্র, সুজিতের এবং ওর বাবার ফটো, একটা পারিবারিক ফটোও রয়েছে যার মধ্যে সুজিতের মা রয়েছেন, আর সুজিতের একটা পরিচয়পত্র, যেটা উন্মাদ-আশ্রমের ডাক্তারের কাছে ছিল।

বীরেন্দ্র বললেন, হু, এ কাগজপত্রগুলো পরে দরকারে লাগতে পারে। ঠিক আছে, এই ড্রয়ারে এখন বান্ডিলটা থাক।

ড্রয়ারে রেখে বললেন, এসো, আমার সঙ্গে এসো।

আবার থমকে দাঁড়ালেন, একটু ভেবে, ফিরে দাঁড়িয়ে শিবেনকে বললেন, আচ্ছা শিবেন, তুমি যে বলছিলে তোমাদের দোতলার কোণের একটা ঘর খালি আছে, সেখানেই একে রাখো না। পেয়িং-গেস্ট হিসেবে তোমাদের বাড়িতে থাকবে, কী বলে?

শিবেন বলল, আপনি যা বলবেন।

বীরেন্দ্র–দ্যাটস অলরাইট, সেটাই ঠিক হবে, এ হোটেলে থাকবার উপযুক্ত নয়। এসো এসো।

বীরেন্দ্র এগিয়ে গেলেন। সুজিত পিছনে। অফিস-ঘরের পরেই, মস্ত বড় একটা হলঘর, আয়নার মতো চকচকে মেঝে। মাঝখানে মস্ত বড় গোল টেবিল। চারপাশে গদি-আঁটা চেয়ার। দেয়ালে বড় বড় ছবি। সুজিতের মনে হল, মেঝেয় ওর পা পিছলে যাবে। তাই টিপে টিপে চলল। ছবির দিকে চোখ দিতে গিয়ে দু-একবার পিছলে যাবার অবস্থা হল।

হলঘরের একেবারে শেষে দোতলায় ওঠার সিঁড়ি। বীরেন্দ্রকে অনুসরণ করে সে উঠল। সিঁড়ির ওপরে উঠে লম্বা মোজেকের বারান্দা, যেন একটি সুন্দর গালিচা পাতা। নানান ধরনের ক্যাকটাস আর ফুলের টব। অর্কিড আর মানিপ্ল্যান্টার নানান ভঙ্গিতে দোলানো, লতানো, পুরনো বেলোয়ারি ঝাড়ের অনুকরণে বৈদ্যুতিক আলোর বিন্যাস। সিঁড়ি দিয়ে উঠে বারান্দার ডানপাশে নীচের মতোই একটি হলঘর। সুজিতের মনে হল, ছবিতে দেখা দরবারকক্ষের মতোই তার অঙ্গসজ্জা। বাঁ দিকে সারি সারি ঘর। বারান্দাটা এল প্যাটার্নে কোণ নিয়ে বেঁকেছে, সেদিকেও ঘর।

বারান্দায় পা দিয়েই বীরেন্দ্র হাঁক দিলেন, কিনু! কিনু!

একজন ভৃত্য ছুটে এসে জানাল, আজ্ঞে, মেমসাহেব তাঁর ঘরে আছেন।

 বীরেন্দ্র এগিয়ে গেলেন বারান্দার শেষপ্রান্ত পর্যন্ত, বাঁক নিলেন, এবং তারপরে আবার ডাকলেন, কিনু, এই দেখো, একজনকে নিয়ে এসেছি ।

বলে পরদা সরাতেই ভিতরে দেখা গেল, চল্লিশ থেকে পঞ্চাশের মধ্যেই, একজন মহিলা। দেখেই বোঝা যায়, মহিলা সুন্দরী, একদা বেশ রূপসীই ছিলেন। যদিও গতায়ুযৌবনা, তবু সব মিলিয়ে প্রৌঢ় বয়সের একটি স্নিগ্ধ সৌন্দর্য ও কমনীয়তা রয়েছে। তিনি বিব্রত ও বিস্মিত হয়ে তাকালেন।

বীরেন্দ্র সুজিতকে ডাকলেন, এসো।

আবার কিনু অর্থাৎ কিরণের দিকে ফিরে বললেন, তোমার দাদা প্রতাপ

 সেই মুহূর্তে কিরণের চোখ পড়ে সুজিতের ওপর। তিনি প্রায় অস্ফুটে আর্তনাদই করে ওঠেন, আমার দাদা?

বীরেন্দ্র বলে ওঠেন, ওঃ ইমপসিবল! আরে, এ তোমার দাদা হবে কেন? এর নাম সুরজিৎ।

 সুজিত তাড়াতাড়ি বলে ওঠে, আজ্ঞে না, আমার নাম সুজিত, সুজিত।

বীরেন্দ্র বললেন, ওই হল, সুজিত, দ্যাটস অলরাইট।

স্ত্রীর দিকে ফিরে বললেন, তোমার দাদা, প্রতাপ সিংহের সেই পার্টনার, কী নামটা যেন! বলো না হে তোমার বাবার নামটা–?

–স্বর্গীয়—

স্বর্গীয় দরকার নেই, নামটা বলো না কেন।

প্রায় ধমকে ওঠেন বীরেন্দ্র। সুজিত ধমক খাওয়া বিষমের মধ্যেই যেন বলে ওঠে, ও হ্যাঁ, মানে মৃত ব্যক্তিদের আবার স্বর্গীয় বলার–

–ইমপসিবল! প্রায় চাপা গলায় গর্জে ওঠেন বীরেন্দ্র।

সুজিত তাড়াতাড়ি উচ্চারণ করল, অতীন্দ্রনাথ মিত্র।

বীরেন্দ্র বলে উঠলেন, হ্যাঁ হ্যাঁ, অতীন মিত্তির, এ সেই অতীন মিত্তিরের ছেলে।

 ঘরের অন্যদিকের বারান্দা, যে দিকটায় নিবিড় গাছপালা দেখা যাচ্ছিল, সেইদিকের দরজায় একটি মেয়ের আবির্ভাব হয়েছে। তাকে কেউ লক্ষ করেনি। বয়স সম্ভবত উনিশ-কুড়ি। দীর্ঘাঙ্গী, স্বাস্থ্যবতী। চোখ-নাক আলাদা করে দেখলে কিছুটা কিরণময়ীরই ছাপ রয়েছে যেন। খোলা চুল পিঠে ছড়ানো। কপালের কাছে অবিন্যস্ত হয়ে ভুরুর ওপরে এসে পড়েছে চুলের গোছা। হঠাৎ কথা বলে উঠবে, যেন সেই ভয়েই রক্তিম ঠোঁট টিপে রয়েছে। কিন্তু ওর এক চোখে যেমন বিস্ময়, আর এক চোখে যেন একটি রুদ্ধ হাসি থমকে রয়েছে। মেয়েটি সুজিতের দিকেই তাকিয়ে রয়েছে।

কিরণ ভ্রু কুঁচকে, স্মৃতি মন্থিত করে উচ্চারণ করলেন, অতীন্দ্র মিত্র।

বীরেন্দ্র বললেন, হ্যাঁ হ্যাঁ, সেই অতীন মিত্তিরের ছেলে, যাকে তোমার দাদাই এ যাবৎ মানুষ করছিলেন। এখন এ আসছে পাগলাগারদ থেকে।

কিরণময়ী প্রায় আঁতকে উঠে বললেন, পাগলাগারদ?

বলে সুজিতের দিকে তাকালেন।

সুজিত অসহায় বিব্রতভাবে ঘাড় নেড়ে, তাড়াতাড়ি বলতে চাইল, সে পাগল নয়। তার আগেই বীরেন্দ্র বলে উঠলেন, আহা কিনু, তুমি যা ভাবছ তা নয়, হি ইজ নট ম্যাড।

বীরেন্দ্র না থামতেই সুজিত বলে উঠল, হ্যাঁ, পাগল নই, আমি, মানে, ডক্টর ঘোষ বলতেন, অপরিণত মস্তিষ্ক, অর্থাৎ ভারসাম্যহীন..কী যে ঠিক মানে—

সুজিতও যেন কথার খেই হারিয়ে ফেলল। বীরেন্দ্র বলে উঠলেন, মানে বোকা, বুদ্ধিশুদ্ধিহীন একটি বোকা ছিলে তুমি।

সুজিত যে কত সুন্দর, সেটা হাসলে বোঝা যায়। এই পঁচিশ-ছাব্বিশ বছর বয়সেও ওকে যেন কোমল শিশুর মতো দেখায়। বীরেন্দ্রর কথায় পরম স্বস্তিতে হেসে ও বলল, হ্যাঁ, বোকা!

কিরণময়ীর চোখ দুটি বিস্ময়ে বড় বড় হয়ে উঠেছিল। হাসবেন না কাঁদবেন ঠিক বুঝে উঠতে পারছিলেন না।

ঠিক সেই মুহূর্তেই একটি মিষ্টি মেয়ে-গলায় উদগত হাসির ঝংকারে সবাই ফিরে তাকালেন পিছনের দরজার দিকে। সেখানে এলায়িতকেশিনী, আয়তচোখ মেয়েটি মুখে আঁচল চেপেহেসে উঠেছে। কিরণময়ী সেই হাসি দেখে, ছোঁয়াচে ব্যাধির মতো আক্রান্ত হয়ে, হঠাৎ আঁচল মুখে দিয়ে হাসতে লাগলেন। কিংকর্তব্যবিমূঢ় বীরেন্দ্রনারায়ণ এদের হাসি দেখে জাকুটি-সপ্রশ্ন চোখে সুজিতের দিকে তাকালেন। বলতে চাইছিলেন, এদের এ রকম হাসির মানে কী? কিন্তু বারুদ্ধ বিস্ময়ে দেখলেন, সুজিতও হেঁ হেঁ করে হাসতে আরম্ভ করেছে।

বীরেন্দ্রর হাতে সেই পোর্ট্রেট। তিনি প্রায় অসহায় হয়ে তিনজনের হাসি দেখতে লাগলেন। কয়েক মুহূর্ত পরে প্রায় চিৎকার করেই উঠলেন, এর মানে কী? এই হাসির মানে কী?

হাসি স্তব্ধ হল। যদিও হাসির রুদ্ধ বেগের রক্তিমা মুখে মুখে ছড়ানো। কিরণময়ী বললেন, মানে আবার কী থাকবে, তোমার যেমন বলার ছিরি। তুমি হঠাৎ একেবারে নিয়ে এলে, তরতর করে বলতে আরম্ভ করলে, তাতে কিছু বোঝা যায় নাকি? এখন বুঝতে পারছি, দাদা যার কথা প্রায়ই বলতেন, যাকে প্রতিষ্ঠা না করে গেলে ওর মরেও শান্তি নেই, এ সে-ই! অর্থাৎ অতীনদার ছেলে।

বীরেন্দ্র বলে উঠলেন, একজ্যাক্টলি!

তার চেয়েও বেশি, এ আমাদের হিমানীর ছেলে।

বীরেন্দ্র আবার ধাক্কা খেলেন। বললেন, আমাদের হিমানী? কে হিমানী?

কিরণময়ীর বিস্ময়-অনুসন্ধিৎসু চোখ তখন সুজিতের ওপর। সুজিতও গভীর অভিনিবেশে তার বড় বড় দুটি চোখ মেলে কিরণময়ীর কথা শুনছিল। কিরণময়ীর অনুসন্ধিৎসু চোখ দুটিতে ক্রমেই একটি করুণ ছায়া নেমে আসছিল। বললেন, তুমি নাম শুনেছ, ভুলে গেছ, অতীনদার স্ত্রীর নাম ছিল হিমানী, আমাদের থেকে দু-এক বছরের বড় ছিলেন। অতীনদা আর হিমানী দুজনেই আবার আমার দাদার অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ বন্ধু ছিল। সে বন্ধুত্ব….

কিরণময়ী যেন মুহূর্তের জন্য অন্যমনস্ক হয়ে গেলেন। তাঁর গলার স্বর এক অতীতের বিস্মৃতির অন্ধকারে হারিয়ে গেল। সকলেই কিরণময়ীর দিকে তাকিয়ে রইল।

পরমুহূর্তেই কিরণ যেন সংবিৎ ফিরে পেলেন। সুজিতের দিকে তাকিয়ে বললেন, তোমাকেও আমি দেখেছি ছেলেবেলায়, তোমার পাঁচ-ছ বছর বয়সে, বর্ধমানে আমার বাপের বাড়ির গ্রামে। এসো এসো, বসো।

সুজিত বসতে ভুলে গেল। কিরণময়ীকে সে দেখতে লাগল, যেন অতীত জন্মের এক ইতিবৃত্তের লিখন পাঠ করছে মুগ্ধ বিস্ময়ে। বলল, আপনি আমাকে ছেলেবেলায় দেখেছেন? আমার মাকে আপনি চিনতেন?

কিরণময়ী বললেন, চিনতাম বইকী! আমি, তোমার মা, বাবা, আমার দাদা, আমরা যে সব এক গ্রামেরই ছেলেমেয়ে। প্রায় একসঙ্গেই সবাই বড় হয়েছি। তোমার বাবা, আমার দাদা হরিহরাত্মা ছিলেন। দুজনে একসঙ্গে বিরাট ব্যবসা ফেঁদেছিলেন। তোমার বাবা হিমানীকে বিয়ে করলেন, আমার দাদা বললেন, এক বউ থাকলেই হবে, দুই বউ হলেই বিবাদ বিসংবাদ, সংসারের শান্তি নষ্ট। এই আমাদের সুখী পরিবার। দাদার সঙ্গেও তো হিমানীর ছেলেবেলা থেকেই বন্ধুত্ব ছিল, যেমন অতীনদার সঙ্গে ছিল। কিন্তু কোথায় গেল সেই সুখী পরিবার।…

সহসা বুকের গভীর থেকে একটি দীর্ঘশ্বাস উঠে কিরণময়ীর গলার স্বর ডুবিয়ে দিল। তিনি যেন দূর শূন্যের এক অস্পষ্ট ছবির দিকে তাকিয়ে রয়েছেন।

সুজিতের মুখে একটি বিস্ময়-স্বপ্নের ঘোর। তার চোখের দৃষ্টিও যেন দুর্নিরীক্ষ ছবিটি দেখবার জন্যে ব্যাকুল হয়ে উঠল। বহু দূর থেকে যেন সে প্রায় চুপি চুপি স্বরে জিজ্ঞেস করল, কী হল সেই সংসারের?

কিরণময়ীর চোখ দুটি ভিজে উঠেছে প্রায়। বললেন, ভেঙে গেছে বাবা!

-কেন?

সুজিতের ব্যাকুল জিজ্ঞাসার মুখে কিরণময়ী আবার সচকিত হয়ে উঠলেন, বললেন, সে অনেক কথা। তুমি বসো।

সুজিতের দুই চোখে করুণ অনুসন্ধিৎসা। সে বলল, শুধু ছবিই দেখেছি, বাবা-মাকে কখনও চোখে দেখেছি বলে মনে পড়ে না।

সমস্ত আবহাওয়াটাই বিষণ্ণ আর করুণ হয়ে উঠল।

সুজিত আবার বলল, প্রতাপবাবুকেও না। তিনি যে আমার কে ছিলেন, তাও আজই ঠিক জানলাম। শুধু জানতাম, আমার খরচ উনিই চালান।

কিরণময়ী বললেন, বাবা-মাকে কী করে দেখবে? তোমার জন্মের কয়েক বছরের মধ্যেই। দুজনেই মারা গিয়েছিলেন। তারপরে গ্রামে আত্মীয়-স্বজনের কাছে অত্যন্ত অবহেলায় তুমি মানুষ হয়েছ যে কারণে

–আমার মাথাটাই খারাপ হয়ে গেছল। ডক্টর ঘোষ বলতেন, আমার বুদ্ধিশুদ্ধি সব লোপ পেয়ে গেছল।

–হ্যাঁ, বারো-তেরো বছর বয়সে দাদাই তোমাকে নিয়ে বাইরে চলে গেছলেন।

কী আশ্চর্য! মানুষের জীবনটা অদ্ভুত, না?

সে এমনভাবে হেসে বলল, বিষণ্ণতার মধ্যেও কিরণময়ীর মুখে হাসি দেখা দিল। আর দরজায় দাঁড়ানো সেই মেয়েটির আয়ত নিবিড় চোখেও আবার রুদ্ধ হাসি ফুটে উঠল। সুজিতের সরল নিষ্পাপ চেহারা। কপালে পড়া চুল, বিচিত্র বেশভূষা, কথা বলার বিচিত্র বোকাটে ভঙ্গিই ওই দুটি চোখের রুদ্ধ হাসির কারণ।

হঠাৎ সুজিত কিরণময়ীর দিকে দুপা এগিয়ে গেল। কিরণময়ী বিস্মিত হবার অবকাশ পেলেন না। সুজিত বলে উঠল, আমি আপনাকে একটা প্রণাম করি, অ্যাঁ?

বলে নিচু হয়ে প্রণাম করল। এমন অনুমতি চেয়ে যে কেউ প্রণাম করে, আর এমন অদ্ভুত ভঙ্গিতে, এটা কারুর জানা ছিল না। তাই আবার একটা হাসির তরঙ্গ ঢেউ দিয়ে উঠল, যদিও সরবে ফেটে আছড়ে পড়ল না। তবু দরজার কাছ থেকে একটু অস্পষ্ট ঝংকার ভেসে এল।

এইবার সুজিতের চোখ পড়ল দরজায়। আর হাসির দ্যুতি ছড়ানো সেই চোখে চোখ পড়তেই সুজিত যেন অসহায় লজ্জিত হয়ে পড়ল, এবং সেইভাবেই হাসল।

কিরণময়ী বলে উঠলেন, এ আমার মেয়ে, দোলা। তুমি বসো।

দোলা হাত তুলে নমস্কার করল। সেই নমস্কার দেখে যেন সুজিতের নমস্কারের কথা মনে পড়ল। তাড়াতাড়ি দোলার মতো করেই হাত তুলে নমস্কার করে বলল, ও, আচ্ছা!

দুবার তার চোখের পাতা পড়ল, এবং ঢোঁক গিলতে গিয়ে শার্টের কলার কেঁপে গেল। দোলার আবার হাসি সামলানো দায় হল।

বীরেন্দ্রনারায়ণ প্রায় হুংকার দিলেন, হুম! এখন কথা হচ্ছে প্রতাপের ফটোর পেছনে আমার ঠিকানা দেখে এ এখানে চলে এসেছে। একে নিয়ে কী করা যায় বুঝতে পারছিলাম না, বুঝলে কিনু। যাকে বলে কপর্দকহীন।

সুজিত তাড়াতাড়ি বলল, না, সাত-আট টাকা আছে বললাম যে?

 বীরেন্দ্র ধমকে উঠলেন, তুমি থামো তো হে!

 সুজিত–ও, আচ্ছা!

বীরেন্দ্র আবার বললেন, খোঁজ নিয়ে দেখেছি লেখাপড়াও কিছুই শেখেনি।

সুজিত ঘাড় নেড়ে অসহায় হেসে সম্মতি জানাল। যদিও তার সম্মতি কেউ জানতে চায়নি।

 বীরেন্দ্র প্রায় উত্তেজিত সুরে বলে উঠলেন, বাট হি ইজ এ গুড আর্টিস্ট, জান কিনু? এই দেখো পনেরো মিনিটের মধ্যে আমার পোর্ট্রেট করে দিয়েছে।

কিরণময়ী স্কেচটা হাতে নিয়ে মুগ্ধস্বরে উচ্চারণ করলেন, বাঃ!

দোলাও কাছে এসে উঁকি দিয়ে দেখল এবং বিস্মিত প্রশংসায় সুজিতের দিকে তাকাল। বীরেন্দ্র বললেন, এখন কথা হচ্ছে, আমাদের পাবলিসিটি বিভাগে একে আমি আর্টিস্ট হিসেবে নিয়োগ করা ঠিক করেছি।

–আর স্কেচটার জন্যে উনি আমাকে একশোটা টাকাও দিয়েছেন।

সুজিত বলে উঠল। বীরেন্দ্র বিরক্ত হয়ে তাকিয়ে বললেন, ইমপসিবিল।

 সেটা এখন না বললেও চলবে।

সুজিত ভেবেছিল, বীরেন্দ্র হয়তো সেটা বলতে ভুলে যাচ্ছেন। দোলার হাসির নিক্কণ আবার বেজে উঠল। দোলার দিকে তাকিয়ে একটু অসহায় হয়ে পড়ল সুজিত।

বীরেন্দ্র বললেন, আর এ ঠিক হোটেলে থাকবার যোগ্য নয়, তাই শিবেনদের বাড়িতেই এর থাকার ব্যবস্থা করেছি।

কিরণময়ী বললেন, ভালই তো।

বীরেন্দ্র যেন হঠাৎ কথার খেই হারিয়ে ফেললেন, আঙুল আর ঠোঁট নেড়ে বললেন, আরআর কী যেন?

সুজিত একটু লজ্জিত হেসে বলল, আর, মানে, আর আমার খিদে পেয়েছে। সেই কাল বিকেল থেকে খাইনি, তাই আপনি বলেছিলেন যে–

বীরেন্দ্রও লজ্জিত হয়েই যেন চিৎকার করে উঠলেন, ইমপসিবল। আরে সেটা মনে করাবে তো!

কিরণময়ী প্রায় তড়িতাহতের মতো চোখ বড় বড় করে উঠে দাঁড়ালেন, বললেন, ও মা!

কিন্তু দোলা ততক্ষণে হাসিতে প্রায় কুঁজো হয়ে পড়েছে। ও তাড়াতাড়ি কোনওরকমে বলল, তুমি কথা বলো মা, আমি দেখছি।

বলে এতক্ষণের সমস্ত রুদ্ধ হাসিকে ফেনিলোচ্ছাসের ঝরনায় মুক্তি দিয়ে সে ছুটে বেরিয়ে গেল। কিরণময়ীর অবস্থা ততোধিক না হলেও, হাসিতে তিনিও আরক্ত। যদিও একটি করুণ ছায়াও নিবিড় হয়ে আছে তাতে।

সুজিত দোলার চলে যাওয়া পথের দিকে তাকিয়ে দূরে চলে যাওয়া হাসির ঝংকার শুনল অবাক হয়ে। তারপরে ফিরে তাকাল প্রায় অপরাধীর মতো। বীরেন্দ্রনারায়ণও এবার তাঁর নাকের ডগাটা ঘষে কোনওরকমে গাম্ভীর্য রক্ষা করলেন।

কিরণময়ী আবার বললেন, বসো।

সুজিত করুণ হাসিমাখা মুখ নিয়ে ধীরে ধীরে বসল।

বীরেন্দ্র বলে উঠলেন, নাউ ইট ইজ হাই টাইম টু গো আউট। কিনু, আমি চললাম। পার তো এ বেলাটা একে এখানেই খাইয়ে দিয়ো। অফিসের লাঞ্চ পিরিয়ডে শিবেন এসে একে নিয়ে যাবে।

কিরণময়ী বললেন, একে আমি খাইয়ে দেব, সে জন্যে তুমি ভেবো না। বলতে বলতে কিরণময়ী স্বামীর কাছে এগিয়ে এলেন তাঁকে বিদায় দেবার জন্যে।

কিন্তু বীরেন্দ্রনারায়ণ ব্যস্ত উৎসুক চোখে এদিক ওদিক তাকাচ্ছেন দেখে, জিজ্ঞেস করলেন, আবার কী হল?

বীরেন্দ্রনারায়ণ বলে উঠলেন, পোর্ট্রেট, দ্যাট পোর্ট্রেট, সেটা কোথায় গেল?

কিরণ নিজের হাতেই সেটা রেখেছিলেন। বললেন, এই তো আমার হাতে।

বীরেন্দ্রনারায়ণ সেটা নিজের হাতে নিয়ে বললেন, এটা আমি অফিসে নিয়ে যাচ্ছি কিনু, আমার বন্ধুদের এটা আমি দেখাতে চাই। আমাদের পাবলিসিটির চিফ আর্টিস্টকেও দেখাব। দিজ ইজ হিজ ট্রায়াল, বুঝলে না? ওর কাজ দেখিয়েই ওর জন্যে আমি ওকালতি করব।

বলতে বলতে উনি বারান্দায় এসে পড়েছিলেন। কিরণও কাছে কাছে হাঁটছিলেন। হঠাৎ বীরেন্দ্রনারায়ণ দাঁড়িয়ে, পিছন ফিরে সন্দেহজনক চোখে এক বার তাকালেন। গলার স্বর নামিয়ে বললেন, তোমার কী মনে হয় কিনু, ছেলেটা বদ্ধ পাগল-টাগল নয় তো? তোমাদের ভয়-টয় করছে না তো?

কিরণ বললেন, না না, কী যে বলো! কী রকম দুঃখী আর শান্ত মুখখানি ওর, দেখলে না?

বীরেন্দ্রনারায়ণ সঙ্গে সঙ্গে বলে উঠলেন, দেখিনি আবার। দেখলাম বলেই তো তোমার কাছে নিয়ে এলাম। দ্যাটস অল রাইট, আমি চলি।

দুপাশের দেওয়ালে ঠক ঠক শব্দ তুলে তিনি বেরিয়ে গেলেন। কিরণ হাসি মুখে স্বামীর চলার পথের দিকে কয়েক মুহূর্ত তাকিয়ে রইলেন। যেন তিনি একটি প্রাণখোলা চঞ্চল ছেলেমানুষকে দেখছেন, এমন একটি নিবিড় স্নেহ ও প্রেমের ছায়া নেমে এল তাঁর চোখে। অথচ বাইরে থেকে বীরেন্দ্রনারায়ণের রাশভারী গম্ভীর চেহারা দেখে সকলেই তাঁকে ভয়ের চোখে দ্যাখে। মুখের সামনে কথা বলতেই অনেকে ভরসা পায় না। কিরণ ভাবেন, বাইরের লোকে ওকে কতটুকুই বা জানে, কতটুকু বা বোঝে। বাইরে একটা ভঙ্গির মুখোশ নিয়ে ওঁকে চলতে হয় বটে, কিন্তু যে মানুষ নিজের পায়ে দাঁড়িয়েছে, অতি দুর্দশা থেকে যিনি সম্মানে বিত্তে বৈভবে অনেক উঁচুতে উঠেছেন, তাঁর অনেক শত্রু থাকে বটে, কিন্তু তিনি নিজেকে কখনও ভোলেন না। অনেকে ভোলেও বটে, তাদের দেখলেই চেনা যায়, কিন্তু কিরণ বিশ্বাস করেন, তাঁর স্বামীর মধ্যে সেই সৎ কাজপাগলা পরোপকারী মানুষটি সম্পূর্ণ বর্তমান।

তিনি তাড়াতাড়ি আবার ঘরের দিকে ফিরে গেলেন।