৬. কথা গোপন থাকে না

কথা গোপন থাকে না। জোহরার সে কথাও পাড়ায় জানাজানি হয়ে গেছে। শামুকের পেটে ভাত বেঁধে খেলেও আড়াই দিনে প্রচার হয়ে যায়। জগতের সকলে এখন বাঁকা চোখে জোহরার দিকে তাকিয়ে আছে। ঘাটে পানি আনতে গেছে। অন্যান্য মেয়েরা কথা বলছে, তাকে দেখে সকলে চুপ করে গেলো। চমকে উঠলো, যেন দিনের বেলাতে ভূত দেখেছে। নীরবে পানি ভরে নিয়ে যায়। ভরা কলসীর পানিতে শব্দিত হয় তার বুকভরা দুঃখের ধ্বনি। পাড়ার লোক জোহরাকে দেখে বাঁকা হাসি হাসে, মন্তব্য করে, কথার ধারে চিরে যায় বুক। তবু জোহরা বাইরে শান্ত, অত্যন্ত শান্ত। কোনো ভাবান্তর নেই। নীরবে করে যায় সব কাজ।

সকালে ঘুম থেকে উঠে গোয়াল সাফ করে। ঝুড়ি ভরে ছটা গরুর গোবর গাদায় ফেলে দিয়ে আসে। তারপরে চাচাত ভাইয়ের ছেলেটিকে নিয়ে আদর করে, ঘুম পাড়ায়, কচি শিশুকে বুকের সঙ্গে চেপে ধরে দুঃখজ্বালা জুড়োতে চায়। রান্নাবান্নার কাজে, চাচাত ভায়ের বৌ দুটিকে সাহায্য করে। মাতব্বরের দু’বৌয়ের ফাইফরমাশ খাটে। একান্নবতী পরিবার। প্রত্যেকদিন ঝগড়া-ঝাটি লেগেই আছে। ছোট বিবি মাঝে মাঝে না খেয়ে রাগ করে ঘুমিয়ে পড়ে। ঘুম থেকে জাগিয়ে সেধে সেধে খাওয়াতে হয়। মেজ বৌ বাপের বাড়ি চলে যাবার ডর দেখায়। বড়ো ভাইয়ের বৌ অনুযোগ করেঃ

“এই এজিদার সংসারত পড়ি হাড্ডি-মাংস কালি অই গেল।” (এই এজিদের সংসারে পড়ে হাড়-মাংস কালি হয়ে গেলো।)

জোহরার শরীরে হাড়-মাংস নেই। আগুনও লাগে না, কালিও হয় না। কারণ তার যাওয়ার জায়গা নেই। যাবে সে কার কাছে? চাচার বিরাট সংসারে সকলের মন যুগিয়ে চলতে হয়। সকলে ব্যথা দেয়, আঘাত করে; কাউকে ফিরিয়ে সে আঘাত দিতে পারে না। আঘাতের মাত্রাটা ইদানীং তীব্রতরো হয়ে উঠেছে। আঘাত, নিরাশা আর দ্বন্দ্বের তাড়নায় তার হৃদয়টা ভেঙে শত টুকরো হয়ে গেছে। আর সইতে পারছে না সে। উষ্ণ নিঃশ্বাস বুকের ভেতরে জমে জমে উত্তপ্ত বাষ্পের সৃষ্টি হয়েছে। আগে মানিয়ে নিতে সকলের সঙ্গে। সকলের খুশির অনুপাতে নিজেকে ছোট করে নেয়ার শিক্ষা তার আজন্মের। দারোগার কাছে সর্বস্ব বিলিয়ে দেয়ার পর সে উৎসাহ তার মরে গেছে। কাজকর্মে প্রেরণা পায় না। চাচীরা খুব কষে গালাগাল দিলে ড্যাবড্যাবে কালো দু’চোখ মেলে চেয়ে থাকে। কি জবাব দেবে ভেবে পায় না।

মাতব্বরেরা মামলা নিষ্পত্তি করার জন্যে শহরে গেছে। পুরুষ মানুষ কেউ ঘরে নেই, তাই জোহরা সকালবেলা ঘুম থেকে ওঠে মুখ-হাতে পানি না দিয়ে ঘরের বারান্দায় মূর্তির মতো ধুম ধরে বসে রইলো। মেজ বৌ তাকে জিজ্ঞেস করলোঃ

“গোয়াইল সাফ গইরগস নি?” (গোয়াল পরিষ্কার করেছ?)

“না,” নিস্পৃহ জবাব জোহরার।

“আইজো না?” (এখনো না?) ঝংকার দিয়ে ওঠে।

কোনো জবাব না দিয়ে হামাগুড়ি দিয়ে এগিয়ে আসা মেজ বৌয়ের ছেলেটার দিকে হাত বাড়ালো। জোহরার প্রসারিত হাত থেকে ছেলেটাকে একরকম জোর করেই ছিনিয়ে নিয়ে গেলো বৌঃ।

“অইয়ে অইয়ে, আঁর পোয়ারে আর সোয়াগ দেখান লাইগত নয়। তোর প্রত্যেক নিয়াশত বিষ।” (হয়েছে, হয়েছে, আমার ছেলেকে আর সোহাগ দেখাতে হবে না। তোর প্রত্যেক নিশ্বাসে বিষ।)

ঘৃণা ভরা চোখ দুটো জোহরার দিকে মেলে ধরে। মেজ বৌ জোহরাকে ঘৃণা করে। তার প্রতি নিশ্বাসে বিষ। এ বিষে তার কচি ছেলের নরম শরীর জর্জরিত হতে পারে। সেজন্যে আপন ছেলেকে ডাকিনীর হাত থেকে কেড়ে নিলো। বড়ো ভাইয়ের বৌ বিশ্রী হাসে। সকলের আচরণ জোহরার চোখে গভীর ইঙ্গিতময় ঠেকে। সে গোবর ফেলার ঝুড়িটা নিয়ে গোয়ালে চলে যায়। তার বাপের আমলের বুড়ো বলদটার গলা জড়িয়ে কাঁদে। শিং দুটোতে হাত বুলোয়।

খাওয়া-দাওয়ার পর সুফিয়ার ওখানে যায়। আকাশে চড়চড়ে রোদ। দক্ষিণের সাগর থেকে শীতল শীতল হাওয়া আসছে। কিন্তু জোহরার শরীরে-মনে দাহ, প্রবল দাহ। মুক্তি পেতে চায় সে। কোথায় সোনার রোদ চলকানো সে মুক্তির মনোরম দিগন্ত?

আজকাল সুফিয়া বিশেষ কথা কয় না। সে ভারী হয়ে গেছে। তার শরীরের ভেতর শিশু সন্তান দিনে দিনে জীবনী-রস সংগ্রহ করে বেড়ে উঠছে। সুফিয়ার মনেও বেদনা। সৃষ্টির সে আদিম বেদনা। জন্ম দেয়ার, জন্ম নেয়ার বেদনা। জোহরার বেদনা সে আরেক রকম। দুজনের চোখের দৃষ্টিতে তা উদ্ঘাটিত। সেজন্য চিন্তার গতি দু’জনের দু’দিকে। সুফিয়ার পরিতৃপ্ত মুখমণ্ডলের দিকে চেয়ে জোহরার মনে বুঝি একটা বেদনার তীর্যক রেখা জাগে। তার যৌবন বারবার হাত বদলের মধ্যে থেঁতলে গেছে। হৃদয়ের পানকৌড়ি তৃষ্ণার সুকোমল কোরক সকল ঝরে গেছে। আপনার বলতে যা ছিলো, সে রাতে দলিত মথিত করে দিয়ে গেছে। সুফিয়া পেটে সন্তান ধারণ করেছে। সন্তান ধারিণীর কেমন লাগে, কেমন হয় অনুভূতি, জোহরার জানতে ইচ্ছে করে। সুফিয়ার কি খুব বেশি ভয় লাগে? তার চোখের ভেতরে জীবন্ত অতৃপ্তিকেই দেখতে পায় সুফিয়া। জোহরার চোখের দৃষ্টিতে অনেক অফলন্ত আশা, অনেক নিহত কামনাকেই ঝিলিক মারতে দেখলো। কেমন জানি সুফিয়ার ভয়।

কাঞ্চন মিয়ার বৌ সুফিয়াকে ডাকতে ডাকতে ঘরে ঢুকে জোহরাকে দেখে থমকে দাঁড়ালো। কাঞ্চনের বৌয়ের চোখ দিয়ে অস্বচ্ছ একটা নীলাভ জিজ্ঞাসা ধূমায়িত হয়। পান-খাওয়া গ্যাটগাটে লাল দাঁতগুলো দেখা যায়। ঘরের নীরবতাকে ফালি ফালি করে কাটে কাঞ্চনের বৌয়ের কণ্ঠস্বরঃ।

“জোহরা, তুই আইস্যছ, ভালা অইয়ে, একখান কথা জানি লইয়ম।” (জোহরা তুই এসেছিস, ভালো হয়েছে, একটা কথা জেনে নেবো।)

“কি কথা ভাবী?” শুধোয় জোহরা।

“কি কথা ন জান না? কানত কি দিয়স? মাইনষে ছি ছি গরের। আইচ্ছা, কথাখান কি হাঁছা?” (কি কথা জানিস না? কানে কি দিয়েছিস? মানুষ ছি ছি করছে। আচ্ছা, কথাটা কি সত্যি?)।

“ওমা! গালে হাত দিয়ে কাঞ্চনের বৌ অবাক হয়ে যায়! হেই যে দারোগা আর তোর নামে যে কথা বাইর অইয়ে, ন হুনস আইজো?” (সেই দারোগা আর তোর নামে যে-কথা বের হয়েছে আজো শুনিস নি?)।

জোহরা জবাব দেয় না। জবাবের ভাষা তার জানা নেই। সে কাঁদতে থাকে। তার চোখের পানির ফোঁটা দীর্ঘ হতে দীর্ঘতরো হয়। রোদে পুড়ে ঘামে ভিজে ঘরে ঢোকে হাসিম। যেখানে বাঘের ভয় সেখানেই সন্ধ্যা হয়। জোহরা আঁচলে দু’চোখ মোছে। দু’চোখে ঝাপসা কুয়াশা।

“কি জোহরা কদর ক্যা?” (কি জোহরা, কাঁদছো কেন?) জিজ্ঞেস করে হাসিম।

জোহরা জবাব না দিয়ে চোখের রেখা দুটোকে বাইরের দিকে প্রসারিত করে দেয়। কাঞ্চনের ঠোঁট কাটা বৌটি আরো জোরালো গলায় বললোঃ

“চৌকের পানি ফেলাইলে কি অইব। কথাখান হাঁছা কি না হাসিমের সামনে ক।” (চোখের পানি ফেলে কি হবে। কথাটা সত্য কি না হাসিমের সামনে বলো।)

“কন্ কথা ভাবী?”।

“যেই কথাখান মাইনষে কই কই বেড়ার। জোহরার লগে দারোগার…।” (যে কথাটি লোকে বলে বেড়চ্ছ। দারোগার সঙ্গে জোহরার…।)

“অ যউকদে, অইসব কতা কইয়া লাভ নাই। এনে গল্প গরো।” (থাকগে, ওসব কথা বলে লাভ নেই। এমনিতে গল্প করো।)

কাঞ্চনের বৌ আর গল্প খুঁজে পায় না। পুরোনো প্রসঙ্গে একই কথা বারবার তার মুখ দিয়ে উচ্চারিত হয়। এ নির্লজ্জতায় হাসিম বেজায় বিরক্ত হয়। সে চায় না, তার চোখের সামনে জোহরা অতো বিশ্রীভাবে নাজেহাল হোক। কাঞ্চনের বৌ মুখ খুললে থামতে চায় না। ওটি তার দীর্ঘদিনের স্বভাব। পাড়ায় কাঞ্চনের বৌয়ের টাইটেল ব্যারিস্টার। পারতপক্ষে কেউ তাকে বিশেষ ঘটায় না। সুতরাং কণ্ঠস্বরও শোনালো বেশ তিরিক্ষি। ঝঙ্কার দিয়ে বললোঃ

“তোর ঘরত খাইবার লায়, পিন্দিবার লায় ত ন আই। আস্যি একখান কথা জানিবার লায়। কথাখান হাছান অইলে মাইনষে কই ক্যা বেড়ার? হলে বড় মাইনষের পিছ ধরে। হাসিম মিয়াও ধইরগে। কথা ত চাপান ন থাহে। ধর্মের ঢোল বাতাসে বাজে।” (তোর ঘরে খেতে-পরতে আসি নি। এসেছি একটা কথা জানতে। কথাটা সত্য না হলে লোকে বলে বেড়াচ্ছে কেন? সবাই বড় মানুষের পাশ ধরে। হাসিম মিয়াও বড় মানুষের পাশ ধরেছে। কথা তো চাপা থাকে না। ধর্মের ঢোল বাতাসে বাজে।)

কাঞ্চনের বৌ শক্ত মাটিতে পায়ের মুড়ি আছড়ে আছড়ে চলে গেলো। পায়ের রূপোর জলতরঙ্গ খাড়ু জোড়া ঝমঝম শব্দ করে। কোনো কিছু এখন গভীরভাবে চিন্তা করার সময় হাসিমের নয়। শহর থেকে কেরামত ভাইকে মনির আহমদ খবর দিয়ে আনিয়েছে। মিটিংয়ের পর মিটিং চলছে। আরো নানা রকম আলোচনা চলছে। হদিশ করতে পাছে না কোনো কিছুর। কিছুতেই গ্রামের মানুষদেরকে এক করা যাচ্ছে না। ওপরে দরখাস্ত করার নামে তারা ভয় পায়। একজন এগিয়ে এল তিনজন নানা অজুহাত দেখিয়ে পেছনে সরে যায়। ম্যাও ধরবে কে? সিগারেট কোম্পানী ধানি জমি একেবারে বিনি পয়সায় নিয়ে নিক। সারা বছর বৌ-ছেলে নিয়ে উপোস করতে রাজি। কিন্তু এ জমিটুকু গেলে অনেকের যে বাঁচবার উপায় থাকবে না। সুতরাং কিছুতেই তিন হাজার টাকা কানির জমি আটশো টাকায় ছেড়ে দেবে না। এমন কথা যে দরখাস্তে লেখা হয়েছে, তাতে টিপসই দিতে তাদের বড় আপত্তি। যদি দাবোগা, পুলিশ এসে ধরে নিয়ে যায়, যদি হাজতে বছরের পর বছর বদ্ধ করে রাখে। জেলেও যেতে হবে না, একথা কেমন করে বলে? হাসিমের মাথায় সে-সব ভাবনা ঘুরপাক খেতে থাকে। দুটো মুখে দিয়ে কাঁধে জামাটা ফেলে লম্বা কদমে চলে যায়। সুফিয়া প্রস্থানরত হাসিমকে উদ্দেশ্য করে স্বগতোক্তি করেঃ

“সমিতিতে রাজা-উজির বানাইব। রাইত নাই, দিন নাই আঁর দিন যে কেনে কাডে।” (সমিতিতে রাজা-উজির বানাবে। রাত নেই, দিন নেই, আমার যে কেমনে দিন কাটে।)

হাসিমের ওষ্ঠাধরে একটা শুষ্ক হাসি খেলে যায়। পাহাড়ে বাঁশ কেটে, কাঠ কেটে যে-লোক জীবন চালায় তার বৌয়ের দিন অন্য দশ কাঠুরের বৌয়ের মতোই কাটে। সমিতিতে সে রাজা-উজির বনার জন্য যায় নি। লোকগুলো সরল– তাকে গ্রহণ করেছে। তাদের মধ্যে সহানুভূতি এবং সমবেদনামাখা প্রাণখানা দেখতে পেয়েছে। হাসিমের মতো অবজ্ঞেয় এবং উপেক্ষিত মানুষকেও তারা ভাই বলে গ্রহণ করেছে। তাই হাসিম যায়- হাসিমের মনখানা টানে। টাকা-পয়সা বিত্ত-বৈভবে মানুষের সত্যিকার পরিচয় ফোটে না। মানুষের পরিচয় অন্য কোনো কিছুতেই প্রকাশ পায়। লেখাপড়া তো কানা আফজলের বড় ছেলেটাও করেছে। অনেকগুলো পরীক্ষায় পাশ করেছে। অনেক টাকা মাইনে পায়। আমেরিকা না কোথাও ছিলো ক’বছর। ছুটিছাটার সময় বাড়িতে এলে মোটা চুরুটজ্বলা মুখখানা দেখে অমন ভয় পায় কেন হাসিম! অমন শিক্ষিত লেখাপড়া জানা মানুষেরও মানুষখেকো বাঘের চোখ কেন? দূর থেকে দেখলেও বুকের ভেতরটা কেন ভয়ে গুড়গুড় করে! সমাজের বিয়ে-শাদি, ঈদে-জামাতে, কোথাও সে সহজ অনুভব করে না কেন? সমিতিতে গেলে মনখানা ছাঁৎ করে কেন আসমানের মতো প্রসারিত হয়ে যায়। এর কারণ কি, অনেকবার ভেবে দেখেছে মনে মনে। সমিতির কোনো লোক ছোট চিন্তা করে না, স্বার্থের নামগন্ধও কারো কথায় নেই। সেজন্য বোধ হয় জীবনের সমস্যাগুলোকে অমন নিখুঁতভাবে তলিয়ে দেখতে পারে। তাদের ঐকান্তিক আগ্রহের মধ্যে, চিন্তার মধ্যে–এমনকি অক্ষমতার মধ্যেও এমন কিছু আছে যা অনেককে এক করে। সে জিনিসটা কি? আর কিছু নয়– সরলতা আর নিষ্ঠা। যা বলা তা বিশ্বাস করা, যা বিশ্বাস করা তা করা। কর্মীদের চোখে-মুখে সে বিশ্বাসকে অনেকবার জ্বলতে দেখেছে। তারও অমন জ্বলে নাকি? কেরামত ভাই সেটাকেই কি বলেন আদর্শ? নানা কথা চিন্তা করতে করতে সে পুব পাড়ার আহমদ মিয়ার বাড়িতে কখন এসে গেছে। পশ্চিম দিকে চেয়ে দেখে সূর্য অনেক ঢলেছে।

অনেক মানুষ এসেছে। বলতে গেলে সকলেই পরিচিত। ভোরে উঠে এদের মুখ দেখে। তার মুখ এরা দেখে। এদের মুখ সে দেখে। সকলেই হাসিমের মতো খেটে খাওয়া মানুষ। কর্মীদের সকলেই গরীব। কারো এক-আধ কানি জমি আছে–কেউ ভাগচাষী। আবার অনেকে অপরের জমিতে মজুর খাটে। একসঙ্গে অতগুলো মানুষকে দেখে তার ভারী অনন্দ হয়। প্রত্যেকটা পরিচিত মুখকে সে বার বার খুঁটিয়ে দেখে। নিরাশ হলো হাসিম। সমবেত মানুষের চোখে-মুখে যে জিনিসটিকে দেখতে চেয়েছিলো তা কই? অভাব দুঃখ সয়েও জয় করতে হবে। জান যায় যাক। মৃত্যুর তেমন সরল প্রস্তুতি এদের কই? হাসিম অবাক হয়ে ভাবে, মানুষ মরতে ভয় পায় কেন? আদর্শের আগুন রক্তের ভেতর, বুকের ভেতর না থাকলে মানুষ মৃত্যুর মুখোমুখি দাঁড়িয়ে বলতে পারে না, মৃত্যু, আমি তোমার চেয়ে অনেক অনেক বড়ো!

মনির আহমদ উঠে গুছিয়ে গুছিয়ে দাঁড়ানো লোকগুলোকে উদ্দেশ্য করে বলছে। লোকগুলো মোটেও কথা শুনছে না। শোরগোল করছে। চেঁচামেচি চেল্লাচেল্লি করছে। হাসিমের ভারী দুঃখ হয় মানুষটার জন্য। চোখে ঘুম নেই। পেটে ঠিকমতো ভাত পড়ে না। অথচ লোকটা তাদেরই কথা বলছে। হাসিম দেখলো, রীতিমতো তাজ্জব হয়ে গেলো। ধীরে ধীরে কথা বন্ধ হয়ে গেলো। সমস্ত উঠোনে কারো মুখে রা নেই। এমনিভাবে আরেক দিন মানুষ স্তব্ধ হয়ে জাহেদ বকসুর বাড়ীতে তার গান শুনেছিলো। আজ মানুষ কানের দু’দরজা খুলে দিয়ে শুনছে। মনির আহমদ বেশ বলতে পারে গুছিয়ে গুছিয়ে। বেঁটেখাটো মানুষটা মন্ত্র জানে নাকি? গান নয়, বাজনা নয়, শুধু মুখের কথাতেই স্তব্ধ হয়ে গেলো অতোগুলো মানুষ। কি কথা বলছে মনির আহমদ? পুঁথির কথা? কেচ্ছা-কাহিনীরে কথা? মুসা-নবীর কেরামতির কথা? শ্রীকৃষ্ণের প্রেমের কথা? সে-সব কিছু নয়। ধীরে ধীরে গুছিয়ে গুছিয়ে বলছেঃ

“এ গ্রামে অধিকাংশ মানুষের জমি দক্ষিণ বিলে। দক্ষিণ বিলের জমি চাষ করে তারা সারা বছর বেঁচে থাকে। বৌয়ের বায়না মিটায়। মসজিদে শিরনী দেয়। পীর মুর্শিদকে দাওয়াত করে খাওয়ায়। এক কথায় দক্ষিণ বিলে যদি চাষ না চলে তা হলে গ্রামের অধিকাংশ মানুষের উপবাসে কাটাতে হবে। এখন সে দক্ষিণ বিলের জমিতে কোম্পানীর নজর পড়েছে। বিলের তাবৎ জমিন কোম্পানী একোয়ার করে নিয়েছে। সকলের ওপর নোটিশ এসেছে। আগামী মাসের বাইশ তারিখে চেয়ারম্যানের বাড়িতে গিয়ে যার যার দলিল-পত্র দেখিয়ে কানি প্রতি আটশো টাকা করে দাম বুঝে আনতে হবে। কারো দলিল-পত্রে ভেজাল থাকলে এক পয়সাও পাবে না।”

একটু থামলো মনির আহমদ। সমবেত মানুষ তার প্রত্যেকটা কথা অত্যন্ত মনোযোগ সহকারে শুনছে। তারপরে শুরু করলোঃ

“এ জমি এক কানির দাম তিন হাজার টাকারও বেশি। কোম্পানী দিতে চায় মাত্র আটশো টাকা। কোম্পানী ফ্যাক্টরি করে সিগারেট বানাবে। বেচে ডবল ডবল মুনাফা করবে। কিন্তু একশোটি পরিবার যে না খেয়ে মরবে তার কি হবে? আপনারা ছেলেমেয়েদেরকে কি খাইয়ে বাঁচিয়ে রাখবেন? নিজেরাও কি খেয়ে বাঁচবেন? বৌয়ের পিঠে কিভাবে কাপড় যোগাবেন? আজ টাকা পাবেন কাল খরচা হয়ে যাবে। নিজেদের দখল থেকে জমিটা চিরদিনের জন্য চলে গেলে কি করে বাঁচবেন?”

হাসিম দেখলো সমবেত মানুষের মুখ রক্তিম হয়ে উঠেছে। চকমকির মতো প্রত্যেক কথার আঘাতে জনতার মুখ তেতে আগুন হয়ে যাচ্ছে। জাদু জানে নাকি মানুষটা?

মনির আহমদের কথা থামে না। বিনা উত্তেজনায় খুবই সহজভাবে তরতরিয়ে বলে যাচ্ছেঃ

“সিগারেট কোম্পানী ফ্যাক্টরি বানাতে চায় বানাক। পাহাড়ের দিকে বিস্তর খালি জমি পড়ে আছে। কোম্পানীর টাকা আছে ট্রাক্টর আনুক। পাহাড় ভেঙে ময়দান করে একটা কেন, একশোটা ফ্যাক্টরি করা যায়। আমাদের আপত্তি নেই। কিন্তু এ বিলের জমি না হলে আমাদের চলবে না। বাঁচবো না আমরা। আট হাজার টাকাতেও এ জমি ছাড়বেন না। কেননা, এ জমি ছাড়া আমাদের অন্য কোনো নির্ভর নেই। কারো ব্যবসা নেই, চাকুরি নেই, অন্য কোথাও বাড়তি জমি নেই। যাদের এ বিলে কোনো স্বত্ব নেই, তাদের অনেকেও এ বিলের জমি ভাগে চাষ করে, মজুর খাটে। চাকুরি নওকরির টানে তারা কখনো বিদেশে যায় নি। বরগুইনির উর্বরা পলিতে কোম্পানীর নজর পড়েছে। সুতরাং গ্রামের মানুষ কি নির্বিবাদে সে জমি ছেড়ে দেবে? না, না। কিছুতেই তা হতে পারে না।”

“না, না,” কখনো না। এটা অত্যাচার। গরীবের ওপর অত্যাচার। এ অত্যাচারে কোম্পানীর সঙ্গে ইউনিয়নের মেম্বার-চেয়ারম্যান যোগ দিয়েছে। তাদের চোখের রাঙ্গা পুতুলীকে ভয় করে কি আমরা চুপ থাকবো? খলু মাতব্বরের দাঙ্গায় নিহত ছদুর মাকে মাতব্বর দুকানি সম্পত্তি দিয়ে আবার কেড়ে নিয়েছে। কাল আবার সে জমিতে হাল জুতেছে। দু’পক্ষের দাঙ্গায় অনেকেই আহত হয়ে হাসপাতালে পড়ে আছে। তাদের বৌ-ছেলেকে দেখছে কে? খলু মাতব্বর, জাহেদ বকসু, অধরবাবু, চেয়ারম্যান আফজল মিয়ার মতো মানুষ, যারা আপনাদের বারবার কেনা-বেচা করছে, তাদের বিশ্বাস করতে পারেন কি? এবারও তারা আপনাদের বিরুদ্ধে গিয়েছে। কোম্পানী তাদের টাকা দেবে। অনেক বেশি টাকা। অত টাকা জীবনে আপনারা কোনোদিন দেখেন নি। তাদের বিরুদ্ধে নিজেদের দাবীর ওপর বুক ফুলিয়ে দাঁড়াতে পারবেন কি? আপনাদের একতার বল যদি অটুট থাকে কেউ জমিতে হাত বাড়াতে পারবে না। পারবেন কি আপনারা?”

“আঁরা এক থাইক্কম। ক্যারে জমিনে দাগ লাগাইতম দিতাম নয়।” (আমরা এক থাকব, কাউকে জমিতে দাগ লাগাতে দেব না।) একসঙ্গে সমবেত জনতা সায় দিলো।

.

মনির আহমদ বসে পড়লো। সমবেত মানুষের মধ্যে ছড়িয়ে পড়েছে প্রচণ্ড উত্তেজনা। আশ্চর্য! হাসিমের আশ্চর্য লাগে। ধৈর্য ধরে পাথরে আঘাত করতে করতে কোত্থেকে আগুন টেনে নিয়ে এলো যেন মানুষটা। তার শরীর ঘামছে। গায়ের খয়েরী রঙের হাফ শার্টটা গায়ের সঙ্গে লেগে গেছে। হাসিম একখানা হাত পাখা হাতে এগিয়ে এসে মনির আহমদকে বাতাস দিতে থাকে।

উত্তেজনার জের একটু কমে এলে ভির ঠেলে ময়মুনার বাপ মনির আহমদ আর কেরামত আলীর সামনে বসে অসঙ্কোচে বলেঃ

“বা’জান, একখানা কথা পুছ গইরতাম চাইরদে, কন, রাগ গরিবানি বাজান?” (বাপজান একটা কথা জিজ্ঞেস করতে চাচ্ছি, শুনে কি রাগ করবে বাপ?)।

“না, না, রাগ কীয়র চাচা, পুছ গরন না। মনে যা চায়।” (না, না রাগ কিসের, জিজ্ঞেস করুন, যা আপনার মন চায়।) ময়মুনার বাপকে অভয় দেয়। জায়গা করে বসতে দেয়।

“বাজান, আঁরা যুদি বাধা দি, তইলে দারোগা-পুলিশ আই ধরি নিলে কি গইরগম বাজান? বউ-বেটারে বাঁচাইবার লায় আল্লাহ গতর ছাড়া আর কিছু ন দে। তোঁয়ার কথা হাঁছা কিন্তু বাজান ডর লাগে।” (বাপজান, আমরা যদি বাধা দেই, তা হলে তো পুলিশ-দারোগা এসে ধরে নিয়ে যাবে। তখন কি করবো বাপ? বউ-ছেলেকে বাঁচিয়ে রাখার জন্য তো আল্লা গতর ছাড়া আর কিছু দেয় নি। তোমার কথা সত্য কিন্তু বড় ভয় লাগে।)

একমাত্র গতর যাদের সম্বল তারা দারোগা-পুলিশকে ভয় করবে তাতে বিচিত্র কি? দারোগা-পুলিশ এসে তাদের সে গতরটা নিয়ে টানাটানি করলে তাদের বৌ ছেলে নিয়ে কি করে বাঁচবে? সমস্যার কথা, মস্ত সমস্যার কথা। মনির আহমদ শান্তভাবে জবাব দিলোঃ

“চাচা, আঁরা থাকতে তোঁয়ার মতো বুড়ো মাইনষেরে পুলিশে কিয়রলায় ধরিব?” (চাচা, আমরা থাকতে আপনার মতো বুড়ো মানুষকে পুলিশ কি জন্য ধরবে?)

বুড়ো আশ্বস্ত হয়। তার ঠোঁটে হাসির একটা ক্ষীণ রেখা জেগে ধীরে ধীরে সারা মুখে ছড়িয়ে পড়ে।

“কি যে ক’ বাজান। আঁর হাতপুতের জীবন থাকতে তোঁয়ারে কিয়লায় পুলিশে ধরিব? খাঁটি মানুষ চিনি বাজান, মাথার চুল বাতাসে ন পাকে। তুই আঁরার সোনা, আঁরার মানিক।” (কি যে বলো বাপ, আমার সাত ছেলের জীবন থাকতে পুলিশ তোমারে ধরবে কেন? খাঁটি মানুষ চিনি, মাথার চুল বাতাসে পাকে নি। তুমি আমাদের সোনা, আমাদের মানিক।)

আরো নানা পরামর্শ হয়। হাসিম দেখতে পায় সমবেত মানুষের মনোবলের ওপর নির্ভর করে একটা কর্মসূচী দাঁড় করাতে পেরেছে। আজ তার শিক্ষা হলো, নির্ভেজাল মন নিয়ে এগুতে পারলে জীবনে পরাজয় নেই। উদ্দেশ্য মহৎ থাকলে মানুষ একদিন না একদিন সাড়া দেবেই। তার মনে হলো অন্তর থেকে নীচতা, ক্ষুদ্রতা, দুর্বলতা হেমন্তের ঝরা পাতার মতো ঝরে যাচ্ছে। নিজের দুর্বলতার ভারে সব মানুষ পীড়িত। দুর্বলতাকে ঝেড়ে দিয়ে সবলে সজারুর মতো মাথা তুলে দাঁড়াতে পারে ক’জন? লক্ষ কোটি ভীরু নর-নারীর মধ্যে অমন বলিষ্ঠ মন ক’জনের?

মিটিং থেকে ফিরে এসে দেখে প্রসব-বেদনা উঠেছে সুফিয়ার। একটা প্রাণকে পৃথিবীতে আনার জন্য আরেকটা প্রাণের সে কি আকুলি-বিকুলি। সে কি বুকভাঙ্গা বেদনা। সৃষ্টি, হায় রে সৃষ্টি! এতই বেদনা সৃষ্টির। হাসিম কাকে ডাকে! সে কি জানে? তার ভয় করে। কি কঠিন পরীক্ষার ভেতর দিয়ে মানুষ পৃথিবীতে আসে! ভয় করে তার। থরথর করে কাঁপে। এখন কি করবে সে? কি করার আছে তার? কে আসবে নিদারুণ এ বিপদের সময়। সমিতির মানুষদেরকে ইচ্ছে করলে ডাকতে পারে। কিন্তু দরকার তার একজন মাত্র মানুষের, যে সুফিয়ার উদরস্থ সন্তানকে মুক্তি দিতে পারে। তেমন একজন কুশলী মানুষ তার চাই। সামনে প্রিয়তমা পত্নী নিজের চুল ছিঁড়ছে। পেটটা সমুদ্রের ঢেউয়ের মতো ফুলে ফুলে উঠছে। শরীরখানা বার বার ধনুকের মতো বেঁকে যাচ্ছে। শরীরের অণু-পরমাণুতে ভূমিকম্পের কাঁপুনি, শরীরের অভ্যন্তরে কি হচ্ছে? কি হচ্ছে সে জানে না। বোধ হয় নাড়িভূড়ি তার ছিঁড়ে যাচ্ছে? অথচ হাসিম অসহায়! কতো অসহায় সে? কতত অসহায় মানুষ? নিজেকে বড় নিষ্ঠুর মনে হয়। সে-ই তো সুফিয়ার এ দুর্দশা ঘটিয়েছে। রাস্তায় ধুলোখেলা করতো মেয়েটি। চঞ্চল হরিণের মতো হেসে-খেলে বেড়াত। কালের জোয়ারে তার দেহে যৌবন নামলো। ফাঁপানো যৌবনের সমস্ত সম্ভারসহ তৃষ্ণার তাপে বন্দী হলো। সর্বগ্রাসী তৃষ্ণা, সর্বভূক ক্ষুধার উত্তাপে শরীরের ভেতর শরীর, মাংসের ভেতর মাংস, প্রাণের ভেতর প্রাণ জেগে উঠলো। সে প্রাণ এখন বন্দী কারার ভেতরে প্রচণ্ড বিক্ষোভ শুরু করে দিয়েছে। উদরের দেয়ালে ঘোষণা করে জানিয়ে দিচ্ছে, আমার বন্দীদশার মেয়াদ ফুরিয়েছে। আমি মুক্তি পেতে চাই, মুক্তি পেতে চাই আমি। কে কোথায় আছো, তোমরা আমাকে মুক্ত করে নাও।

সুফিয়ার সারা শরীর ধনুষ্টঙ্কারের রোগীর মতো বেঁকে যাচ্ছে। তার শরীরে তরঙ্গের পর তরঙ্গ ভাঙছে। মুখে ফেনা ফুটছে। কাকে ডাকবে? কে পারে টেনে আনতে প্রাণের ভেতর থেকে প্রাণ? কে পারে গর্ভস্থ সন্তানকে মুক্ত করে উদার আলোকে টেনে আনতে? কে? কে?

সুফিয়া এখন নিষ্ঠুর। তার মুখ দিয়ে গালাগালি ছুটছে। সে কাকুতি-মিনতি করছে, সজল তার চোখ। বুকে রক্তিম বেদনা। বেদনার ক্ষিপ্র আকর্ষণে হৃদপিণ্ড ছিঁড়ে পড়তে চাচ্ছে। সে কিছু বোঝে না, এমনি বড় অবুঝ সে। তার বুকে বেদনা। মুক্তি চায়, ডেকে বলছে, না না, মুখ দিয়ে তার কথা বেরুচ্ছে না। কথা বলছে, সুফিয়ার হাত এখন মানুষের শিশু, মানুষের সংসারে এখন তার আসার সময়। কে কোথায় আছ, টেনে নিয়ে এসো। উদরের মাংসল আবেষ্টনীর অন্তরাল থেকে রক্ত মাংসের সন্তান বের করে নিয়ে এসো। জরায়ুর দ্বারে সবেগে আঘাত করছে। অন্ধ শিশু পথ খুঁজে পাচ্ছে না, নতুন অভিযাত্রী পথ চিনে না। তাকে তোমরা দক্ষ হাতে কপাট খুলে বরণ করে নাও।

কেঁদে ফেলে হাসিম। অতো স্নেহ, অতো প্রেম, অতো ভালোবাসা কোনো কাজে আসবে না তার। তারই তৃষ্ণার আগুনে সুফিয়ার উদরের ভেতর রক্ত হতে রক্ত, প্রাণ হতে প্রাণ টেনে নিয়ে যে শিশু বেড়েছে দিনে দিনে, সে অনাগত শিশুর কাছে হাসিম আজ শুধু অবাঞ্ছিত জনক। দুঃখে হাউমাউ করে কেঁদে ফেলে। কেন, জানে না। এ বিপদের সময়ে জোহরার কথাই তার মনে এলো। সুফিয়া জোহরাকে সাহায্য করতে পারে। একদৌড়ে ছুটলো। বেশি দূর যেতে হলো না। পুকুরের পাড়ে দেখা পেলো। হাসিমের বুক টলছে। জোরে জোরে নিঃশ্বাস পড়ছে। রা সরছে না আতঙ্কে।

“অ জোহরা।”

জোহরা হাসিমকে কোনো দিন অমনভাবে ডাকতে শোনে নি। চমকে ওঠে। গভীর জঙ্গলের অন্তরালে বাঘের থাবায় বিক্ষত মানুষের কণ্ঠ চিরে যে স্বর বেরোয়, তেমনি স্বর হাসিমের।

“কি হাসিম বাই?”

“বইন বাঁচা, সুফিয়ার ব্যথা উইঠ্যে।” (বোন বাঁচাও, সুফিয়ার ব্যথা উঠেছে।) ঝর ঝর করে কেঁদে ফেলে হাসিম শিশুর মতো। কলসীটা ঘাটে ডুবিয়ে তড়িঘড়ি এসে গেলো জোহরা। কিছু ভেবেও দেখলো না। তাড়াতাড়ি একখানা দড়ি টাঙিয়ে সুফিয়ার পা দুটো দড়ির ওপর তুলে দিলো। বেদনা একটু কম লাগবে। কেননা, পা দুটো ওপরে থাকলে অন্ধকারেও নবজাতকের পথ চিনতে অসুবিধা হবে না।

“বাই, তুঁই তাড়াতাড়ি করিম বকসুর মারে ডাকি লই আইয়ো মুন্সী পাড়া যাই। আর ধাই নাই এই দেশত।” (ভাই, তুমি তাড়াতাড়ি মুন্সীপাড়া গিয়ে করিম বকসুর মাকে ডেকে নিয়ে এসো। এই দেশে আর ধাত্রী নেই।)

.

ঘুটঘুটে অন্ধকারের ভেতর হাসিম ছুটলো। একটা ঢোঁড়া সাপের মাথা পায়ের তলায় পড়ে ঘেঁচে গেলো। গলে একটা ব্যাঙ চ্যাপ্টা হয়ে গেলো। করিম বকসুর মা’র দুয়ারে করাঘাত করে। ওদিকে অনাগত শিশুও তেমনি প্রচণ্ড জোড়ে সুফিয়ার জরায়ুর দ্বারে আঘাত হানছে। সে শিশু আরো নিষ্ঠুর, আরো হৃদয়হীন। কখনো পৃথিবীর আলো দেখে নি প্রবল আলোর পিপাসা, বায়ুর পিপাসা, জলের পিপাসায় কাতর শিশু বার বার রুদ্ধ আবেগে লাথি মারছে। অন্ধকারে সুফিয়ার হৃদপণ্ডের ধ্বনি জেগে থাকে। তার অমন আদরের বৌ সুফিয়ার কাঁচা তাজা জানখানা আঁচলের গিঠে বেঁধে দুষ্ট বুড়ী যেন ঘুমিয়ে আছে। হাজার ডাকেও রা করে না। বেড়ায় দুম দুম লাথি মারতে থাকে।

“কন পোড়া কোয়াল্যা এত রাইতত আবার মরিবার লায় আইল। মাইনষের আর কন কাম নাই, পোয়া বিয়ান ছাড়া।” (পোড়া কপাল কার, এতো রাতে আবার মরতে এলো। ছেলে বিয়ানো ছাড়া মানুষের আর কোনো কাজ নেই।)

কাঁচা ঘুম থেকে উঠে বুড়ী গালাগাল করে। একে তো বুড়ো শরীর। তাতে বাতের ব্যথা নেমেছে। বাম হাত, বাম পা একেবারে অবশ হয়ে এসেছে। নড়তে চড়তে পারে না। তুষের মালসায় ফুঁ দিয়ে পাটকাঠিতে আগুন জ্বালিয়ে খনখনে গলায় জিজ্ঞেস করেঃ

“হেইভা কন?” (ওটা কে?)

“আঁই দাদী।” (আমি দাদী।) হাসিমের কণ্ঠে সেই অসহায় ব্যাকুলতা।

“অ বান্যিয়ার পুত, খাড়া। কি খবর?” (ও বেনের ছেলে, দাঁড়া। কি খবর?)

‘দাদী, দাদী, এককেনা আইয়ো। সুফিয়া বাঁইচত নয়। কইছালি গরেরদে। [দাদী, দাদী, একটু এসো। সুফিয়া বাঁচবে না। কইছালি (কই মাছে ছাই মাখালে যেমন করে) করছে।

“অলক্ষণ্যা কথা ক্যা কলি গোলাম্যার পুত, তোবা গর, তোবা গর। বাঁইচত ন ক্যা?” [গোলামের ছেলে (গালি অর্থে), অলক্ষুণে কথা বললি কেন? তোবা কর অর্থাৎ আর কোনদিন বলবি না বল।]

বুড়ী হাসিমের সঙ্গে বেরিয়ে আসে। তালাটা এঁটে দিতেও ভুলে যায়। অন্ধকারে দেখতে পায় না। ব্যথায় পা ঝিমঝিম করে। মা রে, বাপ রে চীকার করে। অসহ্য হাসিমের অসহ্য লাগে। পিঠের মাঝ বরাবর একটা কিল মেরে কুঁজো বুড়ীকে সোজা করে দিতে ইচ্ছে করে। কতদূর এসে বুড়ীকে হেঁচকা টানে কাঁধের ওপর তুলে নিয়ে বিলের মধ্যে দিয়ে চলতে থাকে। উঁচু-নীচু জমি। আলে ঠোক্কর লাগে। পানিতে ঝপাঝপ শব্দ হয়। করিম বকসুর মা’র ডর করে। চীকার করে উচ্চস্বরেঃ

“গোলাম্যার পুত আস্তে যা, আস্তে–মারি ফেলালি।” (গোলামের ছেলে, আস্তে আস্তে চল; মেরে ফেললি।)

ঘরে এসে নামিয়ে দেয় করিম বকসুর মাকে। পা দুটোকে মুখের থুথু দিয়ে মালিশ করলো। তারপর এগিয়ে গেলোলা প্রসূতির শয্যার দিকে। হাসিম দরজার কাছে দাঁড়িয়ে থাকে। জোহরা আর করিম বকসুর মা কাজে লেগে যায়। সুফিয়ার চীৎকারে পাড়াপড়শীর ঘুম ভেঙে গেছে। নারীর প্রসব বেদনার কান্না শুনে কোনো নারী কি বিছানায় শুয়ে থাকতে পারে? একজন একজন করে তারা সুফিয়ার বিছানার পাশে এসে দাঁড়িয়েছে। বাক্য নেই। এ সেই মহা পরীক্ষা, যাতে উত্তীর্ণ হয়ে নারীজন্ম সার্থক করতে হয়। এর জন্য দশটি মাস অতন্দ্র প্রহর গুণতে হয়। কে একজন হাসিমকে খালাসী পানি পড়ার জন্য জহির মৌলবীর বাড়ীতে পাঠিয়ে দিলো। গেলাস হাতে ছুটলো। কোরআনের আয়াত পড়া পানি প্রসূতির দুরান আর জরায়ুতে ছড়িয়ে দেওয়া হলো। কষ্ট কমছে না একটুও। আবার তাবিজ আনতে ফয়েজ মস্তানের বাড়িতে গেলো হাসিম। প্রসূতির রানে আল্লাহর কালাম লেখা তাবিজ বেঁধে দিলো। কষ্ট কমছে না। যে ভূমিকম্পে পাষাণ ফেটে যায়, ভূ-পৃষ্ঠের পর্বত তলিয়ে যায়, তেমনই ভূমিকম্প সুফিয়ার শরীরে। কে একজন আক্ষেপ করে বললোঃ

“আহা, আজি যদি মা, ভইন থাইকতো।” (আহা, আজ যদি মা, বোন থাকতো।)

“কি অইত থাহিলে?” (থাকলে কি হতো?) অসহিষ্ণু কণ্ঠে জিজ্ঞেস করে হাসিম।

“খালাস ন অন পর্যন্ত মাথার চুল পানিতে ভিজাই রাইখতো। তাহলে ব্যথা কম লাগতো।” (খালাস না হওয়া পর্যন্ত মাথার চুল জলে ভিজিয়ে রাখতো, তাহলে ব্যাথাটা কম লাগতো।)

জোহরা ধীরে ধীরে বেরিয়ে এসে একটা বড় থালার মধ্যে পানি ঢেলে মাথার চুলগুলো পানির ভেতর ডুবিয়ে, মাথা নীচু করে রইলো। প্রত্যেক নিশ্বাসে কণ্ঠ চিরে ঝরছে, আল্লাহু, আল্লাহু।

ঘরের ভেতরে চলছে যমে আর মানুষে টানাটানি। সুফিয়ার জরায়ু ফেটে চির চির করে টাটকা তাজা রক্ত নির্গত হচ্ছে। এ রক্ত ছদুর রক্তের মতো নয়, আরো লাল, আরো গাঢ়, আরো তাজা। মনের ভেতর প্রবল আবেগের তোড়ে হঠাৎ যখন উষ্ণ কিছু, তরল কিছু ঝরে পড়ে আর হৃৎপিণ্ডটা দুলে ওঠে, চোখে দেখা যায় না, অনুভব করা যায় রক্তিম কিছু ঝরে গেলো, তেমনি লাল জরায়ুর রক্ত। নতুনের সৃষ্টির এমনি রক্তরাঙা পথ। আতঙ্কিত প্রাণে বিচিত্র ভাবনায় ঝলকে ঝলকে জেগে ওঠে। এ রক্ত আরো এক স্মরণাতীত রক্তঝরা দিনের কথা তার স্মরণে টেনে আনে। সেও কি অতীতের এমনি এক রাতে রক্তস্নানে শুভ্র হয়ে পৃথিবীর আলোতে পরম বিস্ময়ে চোখ মেলেছিলো?

প্রহরে প্রহরে গড়িয়ে যাচ্ছে রাত। রাতের নদী ছুটছে… ছুটছে। ঘরের চালে ডাকছে দুটো কানাকুয়ো পাখি। বাদুড়ের ঝটপট পক্ষবিধুননের আওয়াজ শুনা যাচ্ছে। আকাশের বোবা তারার চোখ বেয়ে সুফিয়ার উদ্দেশ্যে নীরব সহানুভূতি শিশির হয়ে ঘাসে ঘাসে ঝরে পড়ছে নীরবে। নারকেল গাছ থেকে ভূতুমটা বিরাট পাখনা মেলে দিয়ে ঘরের খড়ড়া চালে এসে বসলো। অশুভ ডাক ডাকছে ভূতুম। বড় গম্ভীর স্বর। আতঙ্কে অন্ধকারও চমকে ওঠে। হৃৎপিণ্ডের চঞ্চল প্রবাহে জমাট আস্তরণের মতো জমে থাকে। কেঁপে ওঠে বুকের ভেতরটা। অন্ধকারে ভূতুম… অন্ধকারের শব্দ ছড়ায়।

ঘরের ভেতর কেরোসিনের মিটিমিটি শিখা অস্তিত্ব রক্ষা করে টিকে আছে কোনো মতে। বাইরে চাপ চাপ অন্ধকারের মসীকৃষ্ণ যবনিকা। ঘরে কেঁদে যাচ্ছে প্রসব বেদনাকাতরা এক নারী। পেটের ভেতরের সন্তান তাকে হত্যা করার নেশায় পাগল হয়ে উঠছে। যে সন্তান রক্তের ভেতর, মাংসের ভেতর, কল্পনার ভেতর, স্বপ্নের ভেতর অণু অণু রেণু রেণু হয়ে মিশেছিলো আজ বাইরে বেরোবার সোজা রাস্তা না পেয়ে জননীকেই হত্যা করতে চাচ্ছে প্রবল আক্রোশে। মানুষের কল্পনা– ভাবনাও মানুষকে ক্ষমা করে না। প্রকাশের পথ চায়, না পেলে জল্লাদের বেশে প্রাণ নিয়ে টানাটানি করে। উদরস্থ সন্তান উদরের ভেতরেই বিদ্রোহ করেছে। তার সারা শরীরে ভূমিকম্প জেগেছে। ভয়াবহ নীরবতা। ক’জন মানুষের সম্মিলিত কণ্ঠ প্রাণপণ প্রচেষ্টায় ভয়াবহ নীরবতাকে তাড়িয়ে দিতে চেষ্টা করছে। কিন্তু সহস্র লোমশ থাবা মেলে দিয়ে ভয়ঙ্করের বেশে এগিয়ে আসছে। বিশ্ব-চরাচরের সবকিছু গ্রাস করে ফেলবে বুঝি।

সমুদ্রের জোয়ারের মতো বার বার সুফিয়ার তলপেট তরঙ্গায়িত হয়ে উঠছে। উদরের অভ্যন্তরে সে রক্তখেকো তিমি মাছটি ঘাই মারছে। ঘাই মারছে প্রচন্ড বেগে। অনেক শক্তি তার। নিজের ছোট্ট পৃথিবীতে অসম্ভব বলতে কিছু নেই। সব করতে পারে সে। তাকে বাইরে টেনে আনতে হবে। মুক্তি না পাওয়া পর্যন্ত কিছুতেই থামবে না। সুফিয়ার জরায়ুতে রক্ত ভাঙছে। এতো রক্ত সুফিয়ার! খলু মাতব্বরের দাঙ্গায়ও অতো রক্ত ঝরে নি! অতো রক্ত ছদুর শরীর থেকেও ক্ষরণ হয় নি! ছদু মারা গেছে। আশ্চর্য সুফিয়া এখনো জ্ঞান হারায় নি। জ্ঞান হারাতে পারে না সে। অন্তরের ছোট দেবতাটি আগে শরীর চিরে, জরায়ু ভেদ করে বেরিয়ে আসুক। পৃথিবীর আলোতে সন্তান চোখ মেলুক- এই-ই তো সে চায়। বুড়ো বয়সে হাসিমের বাপ যেমন মুসলমান হয়েও কালীবাড়ীর পাশ দিয়ে যাবার সময় অভ্যেসবশে মাকালীকে ভক্তি জানাতে চুপিচুপি; সেও তেমনিভাবে অন্ধকারকে সাক্ষী রেখে সালাম করলো সুফিয়াকে। সুফিয়া কাঁদছে। তার শরীরে আর সইছে না।

“ঝি রে, শান্ত অই আল্লাকে ডাক। তিন ভূবনের মালিক আল্লাহ্। আল্লায় আসান গরিব।” (ঝি, শান্ত হয়ে আল্লাহকে ডাক। তিন ভূবনের মালিক আল্লাহ্। আল্লাহ্ আসান করবে।)

ফুলের পাপড়ির মতো ঝরে পড়ছে করিম বকসুর মা’র কথা, নরম ঘুমপাড়ানি গানের মতো মেদুর।

রাতের আকাশে তারাগুলো সব মরে গেছে। সমগ্র পৃথিবীকে আঁধার ভালুকের মতো চেপে ধরেছে… ভূতুমের স্বর আরো গম্ভীর হয়ে উঠেছে। বাদুড়ের আওয়াজ মরে গেছে। সুফিয়ার আর্ত-চীকারে সহসা জমাট অন্ধকার কেঁপে উঠলো।

ওঁয়া ওঁয়া ডাক ছেড়ে নতুন শিশু কেঁদে উঠলো।

পৃথিবীতে আসার প্রথম আনন্দ, প্রথম বেদনা। সুফিয়ার ক্লান্ত ম্লান মুখমণ্ডলে একটা পরিতৃপ্ত হাসির ছটা বিকিরিত হয়ে ছড়িয়ে পড়ে। বড় দুঃখের, বড় আনন্দের; কিন্তু বিজয়ের সে হাসি। মাটির অধিকারের জন্য হাত-পা ছুঁড়ছে নবজাতক। রক্তের লাল বসনে আবৃত সারা শরীর। আঁধার কেটে গেছে। পুবে ধল পহর দেখা দিয়েছে। সিঁদুর রেখার মতো বিনম্র আলোর একটা ঈষৎ রেখা জাগলো। তারপরে লাল হয়ে উঠলো আকাশ। নবজাতকের রক্তাক্ত বসনের মতো লাল।

থালা হতে মাথা তুলে নিলো জোহরা। ঘাড়টা ব্যথা করছে। চুল থেকে ফোঁটায় ফোঁটায় পানি ঝরছে। বিস্ময়ে অভিভূত হয়ে নবজাতকের দিকে চেয়ে রইলো। একটি রক্ত-মাংসের পিণ্ড… তার ভেতরে প্রাণ। সে প্রাণ নড়ে উঠছে। পাতলা ছোট্ট দু’খানি ঠোঁট। স্লান একখণ্ড মেঘ মনে জেগে ছেয়ে ফেলে মনের আকাশ। দু’ফোঁটা পানি ঝরে পড়ে। করিম বকসুর মা মন্তব্য করেঃ

“মা, তুই বউত গরলি। পরের লায় পরে এতো ন গরে আইজ-কাইল। (মা, অনেক করলি, পরের জন্য পরে এতে করে না আজকাল।)

“পরে কন?” (পর কে?) জিজ্ঞেস করে জোহরা।

জবাব দিতে পারে না বুড়ী। ধারালো বাঁশের ফালি দিয়ে কচ কচ করে কেটে দেয় নাড়ী। চিরকি দিয়ে, ফিনকি দিয়ে রক্ত ছোটে। ক্ষরণ! ক্ষরণ! কিছুতেই বন্ধ হয় না। ওঃ সে কি রক্তক্ষরণ সুফিয়ার। হাসিম আর দেখতে পারে না চোখ দিয়ে। সংজ্ঞা তার লোপ পেয়ে যাচ্ছে। দু’হাতে মাথার যন্ত্রণারত শিরা দুটো চেপে ধরে বসে পড়ে। সুফিয়া ক্ষীণ কণ্ঠে বলেঃ

“এককেনা পানি।” (একটু পানি।)

জোহরা মাটির সোরাহীর নলটা এগিয়ে ধরে। এক চুমুকে নিঃশেষ করে ফেলে সবটা। আরো চায়, আরো। তার বুকের ভেতর প্রচণ্ড তৃষ্ণা। দু’চারটা সমুদ্র শুষে নিতে পারে। ইশারায় হাসিমকে কাছে ডাকে। হাসিম বিছানার ধারে এগিয়ে যায়। তার দু’চোখে পানি। সুফিয়া নবজাতকের নরম চুলে হাত বুলোয়। তারপর খুবই ক্ষীণ কণ্ঠে বলেঃ

“তোঁয়ার হাতখান দেও। আঁই আর বাঁইচতাম নয়।” (তোমার হাতখানা দাও। আমি আর বাঁচবো না।)

হাসিম সুফিয়ার হাতখানা তুলে নিয়ে অঝোরে কাঁদতে থাকে। সুফিয়া হাসিমকে শেষবারের মতো আবদার করেঃ।

“আঁরে কবর দিও মার পাশে।” (আমাকে মায়ের পাশে কবর দিও।)

সুফিয়ার জীবনীশক্তি ফুরিয়ে এসেছে। কণ্ঠস্বর ক্ষীণ হতে ক্ষীণতররা। এক সময় খুব করুণ কণ্ঠে জিজ্ঞেস করেঃ

“আসমান লাল অইয়ে না? কুড়ায় বাঙ দিয়ে না?” (আকাশ কি লাল হয়েছে? মোরগ কি ডাক দিয়েছে?)।

নবজাতকের রক্ত আবরণের মতো লাল হয়েছে আকাশ। সুফিয়া বোধ হয় শুনলো, বোধ হয় শুনলো না। লাল আসমানের দিকে চেয়ে চুপ হয়ে গেলো চিরদিনের মতো। একখানা হাত নবজাতকের শিয়রে পড়ে রইলো। নিপ্রাণ সুফিয়ার দু’চোখে কিসের জিজ্ঞাসা? কিন্তু চিবুক দুটি কি আশ্চর্য রকমের দৃঢ়, প্রতিজ্ঞায় পাষাণ।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *