৪. অভিজ্ঞতার বাড়া শিক্ষা নেই

অভিজ্ঞতার বাড়া শিক্ষা নেই। দিনে দিনে হাসিমের অভিজ্ঞতার ভাণ্ড সমৃদ্ধতরো হচ্ছে। বিগত পঁচিশ বছরের জীবনখানা অনুজ্জ্বল মিনারের মতো ঠেকে। এতোদিন পেছনের দিকে তাকিয়ে দেখতে অভ্যস্ত ছিলো না। হঠাৎ অনেকগুলো ঘটনার আকস্মিক আলোকসম্পাতে তার দৃষ্টিশক্তিতে অনেক তীক্ষ্ণতা এসে গেছে। জীবনের একটা অর্থ ধীরে ধীরে রূপময় হয়ে তার চোখে জেগে উঠেছে। সমাজের প্রত্যেকটি মানুষের আচার-আচরণের অন্তরালে যে মহাসত্য সক্রিয় হাসিমের চেতনায় তা দৃশ্যমান হয়ে ওঠে দিনে দিনে। হাসিম অহরহ দগ্ধ হয়। বুকের চিন্তার আগ্নেয় রশ্মি মাঝে মাঝে বিদ্যুতের মতো ঝলসে ওঠে। সে আলোকে জগত জীবনের সমস্ত রহস্যকে বিচার করা যায়, বিশ্লেষণ করা যায়। মানুষ তাকে অবজ্ঞা করে কেন? কেন ঘৃণা করে? হাসিমের ধারণা তার কেন্দ্রবিন্দুটিতে হাত দিতে পেরেছে সে। সে এক নিষ্ঠুর সর্বভূক অনল। রাতদিন দগ্ধ হয়, মুখ ফুটে রা করার উপায় নেই। হাসিমের বাপ গ্রামের মধ্যে একমাত্র মানুষ যার কাছে এ মহাসত্য উলঙ্গভাবে উদ্ঘাটিত হয়েছিলো। মুখ ফুটে একবার উঁহু শব্দটিও উচ্চারণ করে নি। নীরবে নীরবে হৃদয়ের সে কি বেদনার্ত রক্তক্ষরণ! অনুমান করতে কষ্ট হয় না হাসিমের, যার বুকে যত বেশি বৎসব বেদনার সে ততো বেশি চিত্তাকর্ষক গল্প-কাহিনী রচনা করতে পারে। সামাজিক সত্যের আগুন পলে পলে দগ্ধ করেছিলো বলে তার বাপ হামেশা বেহেস্তের দোহাই দিতো। কল্পনাকে স্বর্গরাজ্যে তুলে দিয়ে কেমন আত্মপ্রবঞ্চনা করতো। রহমত কাজীর মেয়ে জরীনার আকর্ষণে বাপের ধর্ম ছেড়ে মুসলমান হয়েছিলো। মুসলমান হলেও জরীনাকে পায় নি। সেখানেই তার বাপের সবচেয়ে বেশি দুঃখ, চিত্তক্ষোভ, ব্যর্থতা। নিজের ব্যর্থতা চাপা দেবার জন্যে বুড়ো যখন তখন বেহেস্তের কথা বলতো। ধর্ম কি? এ সকল প্রশ্ন জাগে হাসিমের মনে। তার বাপ ভুল করেছিলো, বিরাট ভুল। জীবনের চাইতে প্রেম বড়ো নয়। প্রেমকে দেখেছিলো, জীবনকে নয়। জানতো না তার বাপ। জীবনের চাইতে প্রেম বড়ো নয়। প্রবল প্রেমের আকর্ষণে পরিচিত সমাজের গণ্ডী পেরিয়ে আরেকটা অনাত্মীয় সমাজের পরিবেশে এসে দেখলো ঘাসের ডগায় সূর্যালোক ঝলমল করা শিশির বিন্দুটি যার নাম প্রেম, কখন শুকিয়ে গেছে। রইলো শুধু আগুনভরা আকাশ। সে আগুনের শিখাহীন নির্দয় দহনে সারাটি জীবন জ্বলে পুড়ে মরলো। হাসিমের চেতনার আকাশে এ সকল প্রশ্ন বিজুলীর ফুলের মতো জেগে ওঠে। উল্কার মতো ভস্ম হয়ে যায়। অন্তরের অন্বিষ্ট চেতনার আলোকে চারপাশের কঠিন বাস্তবকে আরো নিখুঁতভাবে দেখতে পায়। একনিষ্ঠ স্রোতের মতো একমুখী জীবন হাসিমের। বাইরে জগতের কোনো সংঘাত লাগলে এসকল চিন্তা মনের অন্ধকার নিশুতির রাজ্যে নক্ষত্রমালার মতো জ্বলে ওঠে। চিন্তার আলোকে অনেক ডুবো পাহাড়কে দেখে–যে সকল পাহাড়ের সঙ্গে ধাক্কা লেগে সমস্ত জীবন স্থবির নিশ্চল হয়ে যায়।

গেলো অসুখের সময় সুফিয়া কানের ফুল দুটো অধর বাবুর কাছে বন্ধক দিয়ে চিকিৎসা আর ওষুধ-পথ্য যুগিয়েছিলো। ও দুটো সুফিয়ার মা’র। মরবার সময় তাকে দিয়ে গিয়েছিলো। মার হাতের সোনার জিনিস ভয়ঙ্কর মায়া। একাধিকবার আকারে ইঙ্গিতে সে কথা হাসিমকে জানিয়েছে। হাসিম সুফিয়ার কথা বুঝতে পেরেও না বোঝার ভান করেছে। কেন না, খালাস করে আনতে গেলে পয়সার দরকার। সাফ কথা, পয়সা এখন হাসিমের নেই। সুদ-আসল এক সমান হয়ে দাঁড়ালেও হাসিমের কিছু করার নেই। সুফিয়া হাসিমের মনোগত অভিপ্রায় হৃদয়ঙ্গম করে ফেলেছে। তাই গতকাল বৰ্গা পাওয়া গরুর বাচ্চাটাকে যুগীপাড়ার চন্দ্রকান্তকে দিয়ে বাজারে বেচে এক কুড়ি মোল টাকা আট আনা পয়সা যোগাড় করেছে। দাম হয়েছিলো এককুড়ি সতের টাকা। আট আনা গেছে রসিদের খরচ। হাসিম কিছুই বলে নি। তার বলবার কিছু নেই। পরের দিন সকালে চন্দ্রকান্তকে একেবারে ঘরে ডেকে নিয়ে এসেছে। গতকালের রাখা পান্তাভাতগুলো বড়ো বড়ো গেরাসে গিলছিলো পোড়া মরিচ দিয়ে। চন্দ্রকান্তকে তামাক জ্বেলে দিয়ে তেরছা করে কাটা একটি বাঁশের চোঙ্গা বের করে দু’খানা দশ টাকার আর একখানা পাঁচ টাকার নোট বের করে দিয়ে বললো সুফিয়াঃ

“চন্দ্রকান্ত চাচা, কিছু কম দিবার চেষ্টা গরি চাইও।” (চন্দ্রকান্ত চাচা, কিছু কম দেবার চেষ্টা করে দেখবে।)।

হাসিম মাটির সোরাহীটার পানি ঢক ঢক করে গিলে খেয়ে হাথিনায় চন্দ্রকান্তের পাশে একখানা সিঁড়ি টেনে নিয়ে বসলো। চন্দ্রকান্ত অট্টহাস্যে ফেটে পড়ে। হাসবার সময় বাবড়িটা তার দুলে দুলে ওঠে। মুখ দিয়ে গান বেরিয়ে আসে। সুখের সময়, দুঃখের সময় চন্দ্ৰকান্তের গলা দিয়ে গান ঝরেঃ।

“পাগলা মনরে কি করি রাখিমু তোরে ভুলাইয়া
শিশুরে ভুলাইয়া রাখি বুকের তন দিয়া,
যুবারে ভুলাইয়া রাখি বিবাহ করাইয়া।
ও পাগলা মনরে…।”

“ভাতিঝি, অধরবাবুরে ভোলান যাইত নয়। হাতের ফাঁক দি পানি ন গলে যার, তার নাম অধরবাবু। বুঝিলি ভাতিঝি।” (ভাইঝি অধরবাবুকে ভোলানো যাবে না। যার হাতের ফাঁক দিয়ে জল গলে না, তারই নাম অধরবাবু। বুঝলে ভাইঝি।)।

“চেষ্টা গরি চাইও না চাচা, দুই চার আনা পৈসা নি কম দিবার পার।” (তবু চেষ্টা করে দেখবে, দু-চার আনা পয়সা কম দেয়া যায় কিনা।)

“না রে মা, আঁই পারতাম নয়। হাসিমেরে ক’ তার চাচাত ভাই, ভাইয়ের থুন ভাইয়ে পৈসা একেবারে না লইতও পারে।” (না মা, আমি পারবো না। হাসিমকে বলো, তার খুড়তুত ভাই, ভাই থেকে ভাই পয়সা একেবারে নাও নিতে পারে।)

হাসিমের মুখে একটা কালো ছায়া নামে। চন্দ্রকান্ত নিজের অজ্ঞাতে হাসিমের বড়ো দুঃখের বড়ো বেদনার স্থানটিতে আঘাত দিয়ে ফেলেছে। মুখ দেখে সুফিয়া স্পষ্ট বুঝতে পারে, কষ্ট পেয়েছে হাসিম। আবহাওয়াকে তরল করবার জন্যে হঠাৎ কোনো কথা খুঁজে পায় না। তাদের মুখ দেখে থতোমতো খেয়ে যায় চন্দ্রকান্ত। বড় আফশোস হয় তার। সুফিয়া হাসিমের জামাটা নিয়ে অসে। পিঠের কাছটিতে ছিঁড়ে গেছে। সময় মতো সেলাই করে না রাখার জন্যে দুঃখ হয়। সুফিয়া বললোঃ

“ঠিক আছে চাচা, কম ন লইলে ন লউক। টেঁয়া পৈসা মইরলে ত আর লগে যইত নয়। অধর বও রাজত্বি গরুক। তুই আঁর কানফুল দুয়া আনি দেও।” (ঠিক আছে চাচা, কম না নিলে না নেবে। টাকা-পয়সা তো আর কেউ মরবার সময় সঙ্গে নিয়ে যেতে পারবে না। অধরবাবু রাজত্ব করুক। তুমি আমার নাকফুল দুটো এনে দাও।)।

হাসিমের দিকে চেয়ে সুফিয়া করুণ মিনতি মেখে বললোঃ

“চন্দ্রকান্ত চাচার লগে তুই অ যও না।” (চন্দ্রকান্ত চাচার সঙ্গে তুমিও যাও না।) নিজের বউটির দিকে চেয়ে বড় মায়া হয়। পরনের একটা কাপড় দিতে পারে না, দু’বেলা ভাত দিতে পারে না পেট পুরে। তবু বউটা কেমন জননীর মতো মেহে তাকে সমস্ত বিপদ-আপদ দুর্ভোগ থেকে রক্ষা করে আসছে। টুললাটুলো স্ফীত তলপেটের দিকে চেয়ে করুণার প্রস্রবণ বয়ে যায় মনের ভেতর। সুফিয়ার আপাদ মস্তক দেখতে থাকে। মা হতে চলেছে সুফিয়া। সেদিনের সুফিয়া পাঁচ বছর আগেও ডুরে কাপড় পরে রাস্তায় ধুলো খেলা করে বেড়াতো। তার সারা শরীরে মাতৃত্বের লক্ষণ পরিস্ফুট। হাসিমের কাছে এ বড়ো আনন্দের কথা। যাবে না বললে সুফিয়া ব্যথা পাবে। জামাটা কাঁধে ফেলে চন্দ্রকান্তকে ডেকে বললোঃ

“ল চাচা যাই।” (চল চাচা যাই।)

কাজী পুকুরের ধার ঘেঁষে, বরগুইনির পাড় বেয়ে, ঢেউ খেলানো আউশ ধানের সবুজ মাঠের কিনারা দিয়ে হেঁটে হেঁটে হাসিম আর চন্দ্রকান্ত খাঁর হাটের অধরবাবুর দোকানে এসে পৌঁছলো। দু’জনের মনের ভেতর লুকিয়েছিলো অনেক কথা। কিন্তু কোনো বৈচিত্র্য নেই বলে সাহস করে কেউ কথা বললো না। বরগুইনির পাড়ে মানুষ মহাজন বাড়ি যাওয়ার সময় একে অপরের হৃৎপিণ্ডের আওয়াজ শুনতে পায়।

মানুষে অধরবাবুর ঘর ভরে গেছে। গদীতে বসেছে অধরবাবু। দু’ভাই চোতা লিখছে একযোগে। কৃশ কাঠির মতো শরীরে কেমন একটা মেদ মেদ আভা

বেরিয়েছে অধরবাবুর। নীচে আগুন জ্বালিয়ে কারিগরেরা হাতুরি ঠক ঠক করে সোনার কাজ করছে। সোনাকে এ্যাসিডে গলাচ্ছে। কষ্টি পাথরে ঘষে দেখছে। লোহার আলমারীর ভারী পাল্লা দুটো হাট করে খোলা। কাঁচের আবরণীর ভেতর দিয়ে ঝিলিক দিচ্ছে নানা রকম সোনার অলঙ্কারের প্রতিভাময় রূপ। এ আলমারীর তালা ভেঙে তার বাপ হরিমোহন আধসের পাকা সোনা আর পাঁচ হাজার রূপোর টাকা চুরি করে রাতের অন্ধকারে কানা আফজলের সাক্ষাতে কাজী রহমতের হাতে তুলে দিয়েছিলো। রাতের অন্ধকারে সে আদান-প্রদানের কথা নিজের বিবরে লুকিয়ে রাখতে পারে নি। এখনো বেঁচে আছে মানুষের স্মৃতিতে। তার মনেও আছে তরুণ বেদনার মতো। পুরনো হয় না, পুরনো হতে জানে না।

কানা আফজল, জাহেদ বকসু আরো অনেকে এসেছে দোকানে। জাহেদ বকসুর ছেলেমেয়ে দুজনের বিয়ে এক সঙ্গে। সোনা কিনতে এসেছে। তাদের সঙ্গে খোশগল্প করছে অধরবাবু। আর নীরবে চায়ের পেয়ালায় চুমুক দিচ্ছে।

জাহেদের সারা মুখে ছড়িয়ে পড়েছে সুতীক্ষ্ণ বিষয়বুদ্ধির ছটা। কানা আফজল কথা বলছে হরদম। কথার ফাঁকে ফাঁকে হেসে উঠছে। ছোটো করে ছাটা দাঁড়িতে এক ধরনের ভাব বিকীরিত হয়ে যাচ্ছে। গ্রামে নতুন ধনী জাহেদ বকসু। ছেলেমেয়ের বিয়েতে অলঙ্কার কেনার জন্য আরো দশজন ভদ্রলোককে নিয়ে এসেছে। পছন্দ করার চাইতে মেয়েকে কতো খরচ করে বিয়ে দিচ্ছে আর ছেলের বৌকে কতো টাকার অলঙ্কার দিয়ে ঘরে এনেছে, সেকথা জানানোই তার মুখ্য উদ্দেশ্য।

অধরবাবু রুমালে সমস্ত আলঙ্কার একটা পুটুলি বেঁধে হাতে নিয়ে আফজলকে ডাকলোঃ

“হাজী সাব… অ হাজী সাব”

কানা আফজল পাশের লোকটির সঙ্গে আসন্ন ইলেকশন সম্বন্ধে আলাপ করছিলো। অধরবাবু আবার ডাকলোঃ

“অ চেয়ারম্যান সাব?”

এবার শুনতে পেলো। তার দিকে চেয়ে জিজ্ঞেস করলোঃ

“কি অধরবাবু?”

“আল্লাহর নাম লৈ গছি লন অলঙ্কার।” (আল্লাহর নামে অলঙ্কার বুঝে নিন।)

মনে মনে বিড় বিড় করে সশব্দে বললো, “দেও, কই?”

“বিসমিল্লাহির রাহমানির রহীম।” (পরম করুণাময় আল্লাহর নামে আরম্ভ করছি।)।

জাহেদ বকসুর সে দিকে খেয়াল নেই। আড়চোখে অলঙ্কারের পুঁটুলির দিকে চেয়ে জিজ্ঞেস করলোঃ

“দাম কতো চেঁয়া অইল?” (মূল্য কতত টাকা হলো?)

“কডে টেঁয়া, অনেরার লায় মুতের ফেনা। মোডে ষোলো শ পঞ্চাশ টেঁয়া।” (কোথায় টাকা, এই টাকা তো আপনাদের জন্য প্রস্রাবের ফেনা। মোটে ষোলশ পঞ্চাশ টাকা।)।

জাহেদ বকসু মানিব্যাগ থেকে দশখানা জিন্নাহ মার্কা একশো টাকার নোট গুণে দিয়ে বললোঃ

“বাকী টেঁয়া পরে দিলে অসুবিধা অইবো?” (বাকী টাকা পরে দিলে কি কোনো অসুবিধা হবে?)।

“আরে, ছি, কি কন, এই টেঁয়াও পরে দিয়ন?” (আরে ছি, কি যে বলেন, এই টাকাও পরে দেবেন?)

“না, জামাই আবার বি. এ. পাশ’ত। ঘড়ি আর খাট-পালং কিনিবার লায় শহরত যন পড়ের। বেশি টেঁয়া ন আনি লগে।” (জামাই আবার বি. এ. পাশ কিনা। ঘড়ি আর খাট-পালং কিনতে শহরে যেতে হচ্ছে, সঙ্গে করে বেশি টাকা আনি নি।)

আরো কিছুক্ষণ বসে চা খায়, গল্প করে। চন্দ্রকান্ত চোতাটা এগিয়ে দেয় অধরবাবুর দিকে। অধরবাবু চশমার ফাঁক দিয়ে হাসিম আর চক্রান্তের দিকে তাকায়। তার কপালে কুঞ্চিত রেখা। সে তীব্র ঘৃণার। অধরবাবু লোহার আলমারীর গভীর থেকে কালো মোটা মহাজনী খাতাটা হাত দিয়ে টেনে বের করে পাতা খুলে হিসেব করে বললোঃ

“বাইশ টেঁয়া আসল আর সুদ দুই চেঁয়া সাড়ে দশ আনা। নয়া পৈসা অইলে পঁষট্টি পৈসা দে।” (বাইশ টাকা আসল আর সুদ দু’টাকা সাড়ে দশ আনা, যদি নয়া পয়সা হয় তাহলে দেবে পঁয়ষট্টি পয়সা।)

“বাবু ভাংতি পৈসাগুন কম দিতাম।” (বাবু, খুচরো পয়সাগুলো কম দেই।) অনুরোধ করে চন্দ্রকান্ত।

“না, না, এক পৈসাও কম অইত নয়, আঁর হক।” (না, না, এক পয়সাও কম হবে না, আমার হক।)

পঁচিশটি টাকা দিয়ে কানের ফুল জোড়া ও বাকী সাড়ে পাঁচ আনা পয়সা ফেরত নেয়।

জাহেদ বকসু, কানা আফজল এবং অন্যান্য সকলে অলঙ্কারের পুঁটুলিসহ বেরিয়ে যাচ্ছিলো। কোণের বেঞ্চিতে হাসিমকে দেখতে পেয়ে সিগারেট টানতে টানতে থেমে বললো জাহেদ বকসুঃ।

“এ্যাই বানিয়ার পুত, সোমবারের বৈরাতির লগে বেয়াই বাড়িতে যাবি। হাত ধোয়ান পড়িব। আইজকাল দাস-গোলামের এতো অভাব দেশত।” (এই বেনের ছেলে, সোমবার বরযাত্রীর সঙ্গে বেয়াই বাড়িতে যাবি। হাত ধোয়ানো লাগবে। আজকাল দেশে দাস-গোলামের এতো অভাব।)

অধরবাবু জাহেদ বকসুর দিকে চেয়ে ম্লান হেসে বললোঃ

“জাহেদ সা’ব গরীবের মিক্যা খেয়াল রাখিবান।” (জাহেদ সাহেব, গরীবের দিকে দৃষ্টি রাখবেন।)

ঘড়েল হাসি হেসে জাহেদ বকসু জবাব দিলোঃ

“আইচ্ছা।”

হাসিম অভিশপ্ত লোহার আলমারীটার দিকে একবার, আরেকবার অধরবাবুর দিকে, আবার অপসৃয়মাণ জাহেদ বকসুর দিকে চেয়ে একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো। সে নিশ্বাসে চন্দ্রকান্ত চকিত হয়ে উঠলো। কতত বেদনাসিক্ত, ব্যথাদীর্ণ এ দীর্ঘশ্বাস। চন্দ্ৰকান্তের বুক ছুঁয়ে গেলো। চঞ্চল হয়ে উঠলো চন্দ্রকান্ত।

“চল চল হাসিম। বেলা অই গেল।” (চল চল হাসিম, বেলা হয়ে গেলো।) তারা দু’জনে পথ দিলো।

আজকের মহাজনের সোনার দোকানে সুফিয়ার কানফুল জোড়া খালাস করতে গিয়ে যে শিক্ষা হাসিমের হয়েছে তার জুড়ি নেই। জাহেদ বকসুর কথাগুলো সুঁচের মতো তার চেতনায় বিধে আছে। কেমন অবলীলাক্রমে উচ্চারণ করে গেলো কথাগুলো। দুপুরে খাওয়ার পর ঘরের দাওয়ায় বসে ভাবছে, সে লোহার আলমারীটার কথা। যে আলমারী থেকে তার বাপ সোনা আর টাকা এনে কাজী রহমতের হাতে দিয়ে চিরতরে দাস হয়ে গেলো। তাকেও দাস করে গেলো। আজ সে আলমারী থেকে জ্বলন্ত সোনা কিনে নিলো জাহেদ বকসু। তারা কাজীদের দাস নাকি ছিলো দুপুরুষ আগে। সে জাহেদ বকসু তাকে দাস করতে চায়। দাস বিয়ে শাদীতে হাত ধুয়ে দিলে টাকা পায়, বাতাসার হাঁড়ি বয়ে নিলে টাকা পায়। সপের একপাশে বসে কুকুর বেড়ালের মতো খেতে পায়। তার বাপ কাজী বাড়ির দাস ছিলো এখন তার বাপ বেঁচে নেই। কাজীদের এখন দাস রাখার ক্ষমতা নেই। এককালের কাজী পরিবারের দাস জাহেদ বকসুর টাকা হয়েছে। জাহেদ বকসু তাকে দাস করতে চায়। কেন সে দাস হতে যাবে?

জাহেদ বকসু কিসের বলে দাসের খাতায় তাকে দিয়ে দাসখত লিখাতে চায়? টাকার বলে? আর ভাবতে পারে না। গলা দিয়ে রক্ত আসতে চায়। অগ্নিময়ী চিন্তা তার বুকের ভেতর।

সুফিয়ার শরীর দিনে দিনে ভারী হয়ে উঠেছে। তার অস্বস্তি বাড়ছে দিন দিন। উদরের দেয়ালের মাংসল আবেষ্টনীতে অন্তরালবর্তী সন্তান আঘাত করছে। হাসিমের রক্ত-মাংস-বীর্যের প্রভাবে সুফিয়ার মধ্যে আরো একটা প্রাণের সঞ্চার হয়েছে।

আরেকটা বাড়তি প্রাণের ভার সুফিয়া কিছুতেই ধরতে পারছে না। অনাগত শিশুর দায় মেটাতে গিয়ে সুফিয়া নড়তে পারছে না, চড়তে পারছে না। সারা শরীর কাঁচা হয়ে উঠেছে। কাঁচা শরীর নিয়ে শুয়ে আছে। স্ফীত উদরের কাছটিতে পরনের বসন খসে পড়েছে। জ্বলজ্বলে মসৃণ তৈলাক্ত তলপেটের দিকে চেয়ে ফলবান সবুজ কোনো শষ্যক্ষেতের কথা চিন্তা করে। একদৃষ্টে চেয়ে থাকে। চেয়ে চেয়ে আশ মেটে না। পিড়ি থেকে উঠে সুফিয়ার বিস্রস্ত বসন ঠিক করে দেয়। এ উথলানো সৌন্দর্য চোখ দিয়ে দেখার অধিকার যেনো অন্য কারো নেই।

এক ছিলিম তামাক কল্কিটাতে ভরে আগুনের জন্য বাইরের মালসাটার খোঁজ করতে গিয়ে দেখলো জোহরা কাঁঠাল গাছের পাশ দিয়ে হাসিমকে দেখে লুকিয়ে লুকিয়ে চলে যাচ্ছে। হাসিম ডাক দিলো। জোহরার মুখখানা বিবর্ণ হয়ে গেলো। সে রাতের পর জোহরা আর কোনোদিন হাসিমের সামনে আসে নি। সুফিয়াকে দেখতে এসেছিলো। অন্যান্য দিন, এ সময়ে হাসিম ঘরে থাকে না। হাসিমকে দেখে তার ডাক শুনে ভয়ে বুকটা চুরচুর করে। যন্ত্রচালিত পুতুলের মতো হাসিমের সামনে এসে দাঁড়ালো। কাঁপছে। বুকের ভেতর বাসা বেঁধেছে কাঁপুনি, জীবনে কোনোদিন থামবে না।

“কি, আইয়্যারে চলি যর ক্যা জোহরা?” (কি জোহরা, এসে চলে যাচ্ছো কেন?)।

হাসিম জিজ্ঞেস করে। জোহরা জবাব দেয় না।

“কি, কথা ন কস ক্যা? (কি, কথা কও না কেন?)

“হাসিম বাই, কি কথা কইতাম?” (হাসিম ভাই, কি কথা বলবো?)

জোহরা জবাব দেয়। জোহরার চোখের কোল বেয়ে জলের ধারা নামে। ফোঁটা ফোঁটা পানি টস টস করে গণ্ডদেশে ঝরে পড়ে। হ্যাঁ জোহরার বলার কোনো কথা নেই। সকল কথা সে রাতে– তার বুকের ফুলের স্তবকের মতো গোপন গভীর সকল কথা, তার চাচা খলু আর দারোগা মিলে থেঁতলে দিয়ে গেছে। হাসিম পৃথিবীতে তার একমাত্র সাক্ষী।

গা ঘোয় নি জোহরা। চুল বাঁধে নি। পরনে কাপড়খানা মলিন। এলোমেলো রুক্ষ চুল বাতাসে উড়ছে। দু’চোখে একটু আগে পানি ঝরেছে। টলটলে চোখের মণি আর ফর্সা সুগৌর মুখোনিতে কী এক থমথমে বিষণ্ণতা। কী অপরিসীম ক্লান্তি। ক্লান্তির ভারে লুটিয়ে পড়েছে জোহরা। পৃথিবীতে কেউ আর তার ভার ধরতে পারবে না। ভারসাম্য চিরদিনের মতো সে হারিয়ে ফেলেছে। পুরোনো কক্ষপথে সে ফিরে আসবে না, আসতে পারবে না। হাসিমের মুখোমুখী দাঁড়াবার কোনো সাহস জোহরার নেই। টলতে টলতে পালিয়ে গেলো। হাসিমের দৃষ্টি থেকে নয়, সমগ্র পৃথিবীর দৃষ্টি থেকে পালিয়ে যেতে পারলে সে যেন বাঁচে।

হাসিম কল্কিটা মেটে হুঁকোর ‘গাপ্টায় বসিয়ে ক’টা মরা টান মারে। ধোঁয়া বেরোয়। আরো ক’টা টান মারে। প্রবৃত্তি হয় না। চিন্তার অতন্দ্র প্রহরীরা তাকে ঘিরে ধরেছে। একপাশে কোটা রেখে দেয়। মাথাটা ঝিম ঝিম করে। বাইরে সূর্যের ঝলমলানো রোদে হাসিম তেলীপাড়ার তেজেনের ছুরির ফলার মতো বাগিয়ে ধরা দু’চোখের দৃষ্টিকে দেখতে পায়। লক্ষ লক্ষ কোটি কোটি ভগ্নাংশ হয়ে ছড়িয়ে পড়েছে।

গ্রামে ওলাউঠা নেমেছে। জিনিসপত্রের দাম ভয়ঙ্করভাবে বাড়ছে। হাজেরার ছোটো আট বছরের ছেলেটা বিনা চিকিৎসায় মারা গেলো। মরে গিয়ে বেঁচেছে। কানা আফজল, জাহেদ বকসু, অধরবাবু আর খলু মাতব্বরদের জগতে হাজেরার ছেলেদের বাঁচবার ঠাই কই?

চন্দ্রকান্ত এসে খবর দিয়ে গেছে। লোকটার মায়া-মমতা যদি কোনো মন্ত্রবলে টাকা-পয়সা অথবা ধান-চাল হয়ে যেতো তাহলে বরগুইনির দু’পাড়ের কারো অভাব-দুঃখ থাকতো না। জাহেদ বকসু, কানা আফজল, খলু মাতব্বর সকলে যদি চন্দ্ৰকান্তের মতো হয়ে যেতো, তাহলে? তাহলে কেমন হতো? কিন্তু তা হবে না, কোনও দিন না। জাহেদ বকসু আর খলু, জাহেদ বকসু খলু হয়েই জন্মগ্রহণ করেছে, আর চন্দ্রকান্ত, চন্দ্রকান্ত হয়েই জন্মগ্রহণ করেছে। অভাবে জ্বলবে, কষ্ট পাবে, দুঃখ পাবে, বুক ঠেলে পরের উপকার করতে চাইবে, দোতরা বাজিয়ে রাধা কানুর পীরিতির গান গাইবে। ওরা জোর করবে, জুলুম করবে, লাঠির জোরে পরের জমি দখল করবে, চেয়ারম্যান হবে, মেম্বার হবে। এজন্যেই তারা জন্মগ্রহণ করেছে।

দাম-ঘেরা পুকুরটার পুব পাড় পেরিয়ে আচার্য পাড়ার রাস্তায় উঠে এলো হাসিম। হাজেরার ঘর আর দূরে নয়। চেকন রাস্তার দু’ধারে বেতঝাড় আর মেহেদী কাটার বন। বেত-ঝোঁপের বাঁ দিকে ছোট্ট আধ-ভাঙা ঘরটি থেকে একটি শিশু-কণ্ঠের আওয়াজ তার কানের পর্দায় আঘাত করে। মনোমোহন আচার্যের ছোটো ছেলেটি তার মাকে জিজ্ঞেস করেঃ।

“আইচ্ছা মা, হাজেরা পিসীর পুত আবুল মরি গেইয়ে না, আজিয়া? (আচ্ছা মা, আজ হাজেরা পিসীর ছেলে আবুল মারা গেছে, না?)

“অয় পুত, অয়।” (হাঁ বাবা, মারা গেছে) মনোমোহনের বউ একটি দীর্ঘশ্বাস ফেলে জবাব দেয়।

“মা, আঁই একবার আবুলরে চাইবাললাই যাইতাম, তুঁই যাইবানি আঁর লগে?” (মা আমি একবার আবুলকে দেখতে যাবো, তুমি আমার সঙ্গে যাবে?)

“না রে পুত, আঁরা যাইতে পাইত্যাম নয়।” (নারে বাবা, আমরা দেখতে পারবো না।) ছেলের মাথায় সস্নেহে হাত বুলিয়ে জবাব দেয় মনোমোহনের বউ।

“ক্যা মা? (কেন মা?) মনোমোহনের ছেলে শশাভন আশ্চর্য হয়ে গেলো।

“তোর হাজেরা পিসী মুসলমান, মুসলমান মইলে চাই ন পারে, নিষেধ আছে।” (তোর হাজেরা পিসী মুসলমান, মুসলমান মরলে অন্যে দেখতে পারে না, নিষেধ আছে।)

“কার নিষেধ মা?”

“ধর্মের।”

“মুসলমান মইলে চাই ন পারে? (মুসলমান মরলে অন্যে দেখতে পারে না?)

“না।”

“আঁরা মইলেও চাইত ন পারিব হাজেরা পিসীরা?” (আমরা মরলেও হাজেরা পিসীরা দেখত পারবে না?)

“না, পাইরত নয়।” (না, দেখতে পারবে না।)

“আরা কি?” (আমরা কি?)

“আরা হিন্দু।” (আমরা হিন্দু)

“মুসলমান মানুষ নয় মা?”

“মুসলমানও মানুষ, তবে মুসলমান মানুষ–”

“আর আঁরা হিন্দু মানুষ না?” (আমরা হিন্দু মানুষ না মা?)

“অয়।” (হাঁ।)

“সব মানুষ এক মানুষ নয় ক্যা মা? আঁই যে আবদুলের লগে মার্বেল খেইলতাম মা, কিছু দোষ অইব না?” (সব মানুষ এক মানুষ নয় কেন মা? আমি যে আবদুলের সঙ্গে মার্বেল খেলতাম, সেজন্য কিছু দোষ হবে?)

মনোমোহনের বউ জানায় যে, এক সঙ্গে মার্বেল খেলতে কোনো দোষ নেই।

শোভন আবার বলেঃ

“আঁর পরাণ পোড়ের মা, আঁই একবার চাইতাম যাইয়ম।” (মা, আমার প্রাণ পুড়ছে, একবার আমি দেখতে যাবো।)

“না,” দৃঢ় কণ্ঠে বলে এবার মনোমোহনের বউ।

“আইচ্ছা মা, সব মানুষ এক মানুষ নয় ক্যা?” (আচ্ছা মা, সব মানুষ এক নয় কেন?)

“ধর্ম দুই রকম, হিথার লায়।” (ধর্ম দু’রকম, তাই।)

“ধর্ম দু’রকম ক্যা?” (ধর্ম দু’রকম কেন?)

মনোমোহনের বউ সে প্রশ্নের উত্তর দিতে পারে না। অবোধ শিশুর অবুঝ প্রশ্ন। অধরবাবুর সোনা-রূপোয় ভর্তি আলমারী, জাহেদ বকসুর দ্রোন দ্রোন সম্পত্তি, ফয়েজ মস্তানের কেতাব কবচ, রামাই পণ্ডিতের প্রমাণ-পঞ্জি সংহিতাতে এ প্রশ্নের কোনো সদুত্তর নেই। তেজেনের ঝুলন্ত মৃত্যুতে এ প্রশ্নই ঝলকিত হয়ে উঠেছিলো, চোখের ভাষায়। কিন্তু হাতির মতো বলশালী তেজেনদাও অবোধ শিশুর মতো এমন সরলভাবে প্রশ্নটি তুলে ধরতে পারে নি।

হাজেরার মরা ছেলেকে দাফন করতে পাড়ার কেউ আসেনি। সেই সকালবেলা মরেছে। মরা ছেলের শিয়রে বোবা হয়ে বসে আছে হাজেরা। তার চোখের পানির ধারা শুকিয়ে গেছে। পাতার নীচে চোখের পানির মরা খালটি এখনো জেগে আছে। শোকের চেয়ে আতঙ্কটাই এখন হাজেরার বেশি। ওলাউঠার রোগী যদি কবর দিতে না পারে? খলুর দাঙ্গায় জান দিতে মানুষের অভাব হয় না। জাহেদ বকসুর ছেলের বিয়েতে বেগার খাটতে মানুষের অভাব হয় না। অভাব কেবল হাজেরার ছেলেকে কবর দেওয়ার বেলা। একা কি করতে পারে হাসিম?

কিছুক্ষণ পরে মনির আহমদ এলো, সঙ্গে কৃষক সমিতির ক’জন কর্মী। এসেই মনির আহমদ হাজেরার সামনে হাতজোড় করে বললোঃ

“আগে খবর ন পাই। হেয় কথার লায় দেরী অইয়েদে বইন। কি গইরগম, পাড়ার মানুষ ন আগায় ডরে। যুগী পাড়াত একজনেরে পোড়ন পড়িল। আরেকজনের কবর দিলাম।” (আগে খবর পাইনি তাই দেরী হয়ে গেলো বোন। কি করবো, পাড়ার মানুষ ডরে এগিয়ে আসে না। যুগী পাড়ার একজনকে পুড়তে হলো, আরেক জনকে কবর দিলাম।)

তারা কাজে লেগে গেলো। কবর খুঁড়ে ফেললো দু’জনে। আরেকজন আবুলকে গোসল দিয়ে দিলো। সে নিদারুণ অভাবের দিনে কোথায় পাবে কাফনের শাদা কাপড়। স্বামীহারা হাজেরার একমাত্র সন্তান আবুল ছেঁড়া কাপড়েই কবরে নামলো। জননী ডুকরে কেঁদে ওঠলো। আকাশ-বাতাস ছাপিয়ে প্রতিধ্বনি জাগলো।

সেদিনই মনির আহমদ এবং কৃষক সমিতির অন্যান্য কর্মীদের সঙ্গে হাসিমের পয়লা পরিচয়। মোহিত হয়ে গেলো হাসিম। মানুষের অন্তরে এতো দয়ামায়া থাকতে পারে? কলেরার সময় গা ছেড়ে পালাচ্ছে মানুষ। এক বাড়িতে কারো কলেরা লাগলে বাড়ির মানুষ উধাও। আর এরা সারাটা ইউনিয়ন ঘুরে ঘুরে দেখছে, কোথায় মানুষ মরে আছে, কোথায় মৃতের সকার হচ্ছে না। তারা হিন্দু? তারা মুসলমান? তারা কোন্ জাত? হাসিম অবাক হয়ে মনির আহমদের মুখের দিকে চেয়ে থাকে। বেঁটে-খাটো মানুষটি। রোদের ছ্যাকা লেগে লাল হয়ে উঠেছে গাল। চুলগুলো ফ্যাড়ফ্যাড়ে। এলোমেলো বাতাসে উড়ছে। ক’দিন গোসল করে নি, ক’দিন ঠিকমতো খায় নি তার হিসাব নেই। গায়ে একটা চেক চেক-হাফশার্ট। তাতে বিস্তর ময়লা। তবু কাজে এতোটুকু বিরক্তি নেই। স্বভাবে একটুও অহঙ্কার নেই। পরোপকারে কোনও দ্বিধা নেই। কণ্ঠস্বরটা মোলায়েম ভেজা ভেজা বাঁশির সুরের মতো। হিমাংশু বাবুটাও তেমন। ভালো বললে এদের ছোটো করা হয়। এদের মনোবলকে অনুভব করতে হয়, উপলব্ধি করতে হয় এদের মনোভাব। সকলে দল বেঁধে তেজেনদার বাগিয়ে ধরা সে মৃত্যুকালীন প্রশ্ন আর মনোমোহন আচার্যের অবোধ ছেলের অবুঝ কৌতূহলের জবাব দেবার জন্যে কঠিন শপথ নিয়ে পথে বেরিয়েছে যেন। চেয়ে দেখে হাসিম। তাদের কারো মুখের আদল খলু অধরবাবু কিংবা জাহেদ বকসুর মতো নয়। তাদের অনেক কথা জিজ্ঞেস করতে ইচ্ছে হলো; কিন্তু পারলো না; কথা সরলো না জিভ দিয়ে। সে ছেটোলোকের চাইতে ছোটোলোক।

এদের সম্পর্কে ছধর বাপ তসবীহ টিপতে টিপতে নবীর দোকানে বসে কতো খারাপ কথা বলেছে। ফয়েজ মস্তান এদেরকে কাফের বলেছে। রামাই পণ্ডিত কাঁধের পৈতা দুলিয়ে বলেছে, সব ব্যাটা গাঁজাখোঁর পাড় মাতাল। কাফের কাকে বলে হাসিম জানে না। কাফেরদের কেমন চোখ? কেমন মুখ? কেমন নাক? তারা কি মানুষের মতো? কেমন করে জানবে হাসিম। সেতো আবার কোরান কেতাব পড়ে নি অতো। বলতে গেলে সে শুদ্ধভাবে আরবী ভাষায় বিসৃমিল্লাহও উচ্চারণ করতে পারবে না। গান সে গায় বটে, কিন্তু গান তার শিখতে হয় নি। বরগুইনির পাড়ে মানুষদের কারো শিখতে হয় না গান । বরগুইনির পাড়ে গান ভেসে ভেসে বেড়ায়। ইচ্ছে করে গলার ভেতর ধরে রাখলে গলা দিয়ে আপনা-আপনিই বেরিয়ে আসে।

.

মনির আহমদ, হিমাংশু বাবুদের সঙ্গে পরিচিত হয়ে বুকের অর্ধেক বোঝা নেমে গেলো হাসিমের। এখনও পৃথিবীতে মানুষ আছে। যারা মানুষের বিত্তসম্পদের পানে তাকায় না। মানুষকে মানুষ বলেই গ্রহণ করতে পারে। কোনো রকমের বাধা বিপত্তির তোঁয়াক্কা না করে মানুষের বিপদে বুক পেতে দেবার হিম্মত রাখে। মনির আহমদ তাকে জিজ্ঞেস করলো, বাড়ি কোথায় ভাই?

জবাব দিতে গিয়ে তোতলাতে লাগলো হাসিম। তার কি বাড়ি আছে? তার কি পরিচয় আছে? এখনো কাজী বাড়ির মানুষ কণ্ঠে শ্লেষ মিশিয়ে তাকে বাঁদীর বাইচ্চা আর বান্যার পুত বলে নিন্দা করে। সুতরাং হাসিম কি বলবে? বলবে নাকি, আমি একজন ঘরহারা, সমাজহারা মানুষ। মানুষ আমাকে ঘৃণা করে, অবজ্ঞা করে– আমার জন্মের জন্য।

“খলু মিয়ার বাড়ির কাছে নাকি তোঁয়ার বাড়ি?” (খলু মিয়ার বাড়ির কাছে নাকি তোমার বাড়ি?) জিজ্ঞেস করে মনির আহমদ।

“জ্বী, একটু পুব সাইডে, পইরের উতর পাড়ে।” (হ, একটু পুব পাশে, পুকুরটার উত্তর পাড়ে।)

“কি নাম তোঁয়ার ভাই?” (কি নাম তোমার ভাই?)

“আবুল হাসিম, মাইনসে হাসিম ডাকে।” (আবুল হাসিম, মানুষে ডাকে হাসিম।)।

তা ছাড়া, মানুষ আরো নামে তাকে ডাকে। সে কথা মনির আহমদকে জানাতে বড় সাধ হলো। কিন্তু পারলো না। জিহ্বাটা আটকে রইলো।

“ঠিক আছে, আঁরা তোঁয়ারের হাসিম বুলি ডাইকাম।” (ঠিক আছে, আমরা তোমাকে হাসিম বলে ডাকবো।) বললো হিমাংশু বাবু।

হাসিমের মনে হলো এতোদিনে পৃথিবীতে তার আসল পরিচয় দিতে পেরেছে। সে এখন অনেক সুখী। মনির আহমদের কণ্ঠস্বর তার বুকের অর্ধেক জ্বালা শুষে নিয়েছে। হিমাংশুবাবু তাকে বললোঃ

“হাসিম বাই, তোঁয়ার যদি কাজ কাম কম থাহে আঁরার লগে কদিন আইও না। চৌকেত দেখর কি রকমের কি রকমের বিপদ।” (হাসিম ভাই, তোমার যদি কাজ কর্ম কম থাকে আমাদের সঙ্গে এসো না। দেখতে তো পাচ্ছো চোখে কি ধরনের বিপদ।)

এমনি একটা আমন্ত্রণের জন্য হাসিম যেন সারাজীবন অপেক্ষা করেছিলো। তবু ঝটপট কিছু বলতে পারলো না। সুফিয়ার কথা মনে হলো। সে যদি সমিতির লোকদের সঙ্গে ঘুরে বেড়ায়, কি খাবে? কি ভাবে চলবে তার দিন? হাসিম ভাবতে থাকে। ভেবে কোনো কুল-কিনারা করতে পারে না। অধোমুখে দাঁড়িয়ে থাকে।

মনির আহমদ আবার সস্নেহে জিজ্ঞেস করেঃ

“কি ভাবদে?” (কি ভাবছো?)

“জ্বী,” হাসিম পেঁচার মতো চোখ গোল গোল করে চেয়ে থাকে।

“বাড়িতে কন আছে তোঁয়ার হাসিম ভাই?” (বাড়িতে কে আছে তোমার হাসিম ভাই?)।

হাসিম বড় ফাঁপরে পড়লো। কেমন করে বলবে তার একটা বৌ আছে। বৌয়ের পেটে আবার বাচ্চা আছে। তাকে ভাত খেতে হয়। এতো বড়ো লজ্জার কথাটা সে কেমন করে নিজের মুখে উচ্চারণ করবে?

“আগে কি কাম গইরতা হাসিম বাই?” (আগে কি কাজ করতে তুমি হাসিম ভাই?) শুধায় মনির আহমদ।

“জ্বী, পাহাড়ত যাইতাম।” (পাহাড়ে যেতাম।)

“বাড়িঘরের কথা এই কদিন তোঁয়ার ভাবন ন পড়িব, সমিতির থুন চাঁদা গরি চালাইয়াম।” (বাড়িঘরের কথা ক’দিন তোমাকে ভাবতে হবে না। সমিতি থেকে চাঁদা করে চালাবো।)

অবাক হয়ে যায় হাসিম। জগতে এমন মানুষও কি আছে! তার মতো মানুষকেও বুকে টেনে নিতে দ্বিধা করে না! তার বুকে খুশি উপচে পড়তে চায়। হাজেরা চিৎকার করে কাঁদছে। সে কান্না হাসিমের কানে ঢুকছে না। অপরাহ্নের মিঠে মিঠে সোনালী রোদের দিকে চেয়ে একটা বিচিত্র সুর শুনতে পায়। মনির আহমদ বললোঃ

“বড়ো স্কুলের মাডত আগামী রবিবারে আঁয়ারার সমিতির মিটিং অইবো। অনেক নেতা আইব। তুইও আইবা তোঁয়ার চেনা-জানা মইনসরে লই।” (বড় স্কুলের মাঠে আমাদের সমিতির সভা হবে। অনেক নেতা আসবে। তুমিও তোমার চেনা-জানা মানুষদের নিয়ে আসবে।) হাসিম ঘার নেড়ে সায় দিলো।

অনেক নেতা এসেছে। আগে মিটিংও করেছে। বড় স্কুলের মাঠও গরম করেছে। তার মতো ছোটলোকের তো ডাক পরে নি। তৎক্ষণাৎ ঠিক করে ফেললো চন্দ্রকান্ত চাচাকে নিয়ে যাবেই যাবে।

রোববার সকালবেলা হাসিম হাইস্কুলের মাঠে গেলো। যাবার সময় চন্দ্রকান্তকেও সঙ্গে করে নিয়ে গেলো। সমিতির লোকেরা বক্তৃতার প্যাণ্ডেল তৈরি করছে। মাঠের মধ্যে নানারকম প্ল্যাকার্ড পুঁতে রেখেছে। বড় বড় কি যেন লেখা লাল কালিতে। ওখানে নাকি কলেরা মহামারীর প্রতিকারের দাবী, খাবার জিনিসের দাম কমাবার দাবী লেখা আছে। কেউ কারো ওপর খবরদারী করছে না। কেমন নীরবে সুশৃঙ্খলভাবে কাজ করছে। মনির আহমদের ফুরসত নেই। এমন সকালবেলাতেও ঘেমে নেয়ে উঠেছে। কণা কণা ঘামের ওপর সূর্যালোক চিক চিক করে জ্বলছে। মনির আহমদকে আজ আশ্চর্য তেজোব্যঞ্জক দেখাচ্ছে। বেঁটেখাটো মানুষটা। সারা শরীরে অসাধারণ কিছু নেই। কিন্তু চোখ দুটোর দিকে চাওয়া যায় না। বাজপাখির কথা মনে পড়লো হাসিমের। মুখের দিকে চেয়ে বুকের কথা বলে দিতে পারে। তেমনি অন্তর্ভেদী তীক্ষ্ণ গভীর চাউনি।

চারদিকে নতুন পরিবেশ। দেখেশুনে চন্দ্ৰকান্তের চোখ তো চড়কগাছ। চাড়া দিয়ে ওঠে কৌতুকবোধঃ

“জয় রাধামাধব, কড়ে আনলি ভাইপুত?” (জয় রাধামাধব, কোথায় নিয়ে এলি ভাইপো?) রাধামাধবের উদ্দেশ্যে দু’হাত জোড় করে প্রণাম করে হাসতে থাকে। বিরাট কোদাল কোদাল দাঁতগুলো হাসির তোড়ে বেড়িয়ে পড়ে।

মনির আহমদ নীরবে এসে হাসিমের মাথায় হাত রাখে।

“হাসিম বাই কত্তে আইস্যোদে?” (হাসিম ভাই কখন এসেছো?)

“এককেনা আগে, চন্দ্রকান্ত চাচাও আইস্যে।” (একটু আগে, চন্দ্রকান্ত চাচাও এসেছে।)

“কই?”

“চাচা কাজর তাড়াতাড়ি। বেশি কথা কইত ন পাইরলাম, এহন আইয়ো চিনা পরিচয় গরাই দি।” (চাচা কাজের খুব তাড়াতাড়ি। বেশি কথা বলতে পারছি না, এসো চেনা জানা করিয়ে দিই।)

মনির আহমদ দু’জনকে নিয়ে সকলের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিলো। দু’জনকে খুব আনন্দের সঙ্গে গ্রহণ করলো সকলে। আন্তরিকতার স্পর্শে অল্পক্ষণের মধ্যে তাদের সঙ্কোচ কেটে যায়। খুবই সহজভাবে সকলের সঙ্গে মিলেমিশে কাজ করতে থাকে। চন্দ্ৰকান্তের উৎসাহ হাসিমের চেয়ে বেশি। এটা কি, ওটা কি, জেনে নিয়ে প্রত্যেকটা কাজ বেশ আগ্রহ সহকারে করে যাচ্ছে।

এগারোটার গাড়িতে নেতারা এলে অন্যান্যদের সঙ্গে তারাও অভ্যর্থনা করে আনতে গেলো। দশ গ্রামের কৃষক এসে জমায়েত হয়েছে। তাদের সঙ্গে এক মিছিলে দাঁড়িয়ে আওয়াজ তুললো। আওয়াজ তুললো চন্দ্রকান্ত। প্রথমে হাসিমের গলাটা কেঁপে উঠলো। জিহ্বায় কেমন যেন জড়তা, কিসের যেন আওয়াজ একসঙ্গে সমুদ্রের মতো ফেটে পড়েছে। কোত্থেকে হাসিমের বুকেও এলো সাহস। গলা ফাটিয়ে ঘোষণা করলোঃ

জালেম গোষ্ঠী     ধ্বংস অউক

চাষী-মজুর     ভাই ভাই

অন্ন চাই     বস্ত্র চাই

লাঙ্গল যার     জমি তার

বাঁচার দাবীকে উর্ধ্বে তুলে ধরার চাইতে রোমাঞ্চকর উত্তেজনা কি কিছু আছে জগতে? নেতারা এলে হাসিম আর চন্দ্রকান্ত চলে আসতে চাইলো। কিন্তু কৃষক সমিতির কর্মীরা আসতে দিলো না। নেতাদেরসহ ডালে-চালে খিচুড়ী পাক করে সকলে একসঙ্গে খেলো। এসব অভিজ্ঞতা হাসিমের নতুন। খাওয়ার ব্যাপারে চন্দ্ৰকান্তের বরাবর একটা খুঁতখুঁতে স্বভাব ছিলো। আশ্চর্য, চন্দ্রকান্ত চাচাও বিন্দুমাত্র আপত্তি করলো না।

সভার নেতারা বক্তৃতা করলেন। মনে হলো না যেন তারা দূরের মানুষ। যেন তাদেরই একান্ত আপনজন– কাছের মানুষ। দুঃখ-দুর্দশাকে সোজা ভাষায় সহজভাবে চোখের সামনে তুলে ধরলো না শুধু, কারণগুলোও বর্ণনা করলো। শ্যামল চেকন তলোয়ারের ফলার মতো আন্দোলিত শরীরের মানুষটার কথাগুলো তার চেতনায় সঙ্গীতের মতো বাজতে থাকলো।

এক সময় নাকি সমাজের সকলে সমান ছিলো। সকলে সমানভাবে স্বাধীন ছিলো। দাস ছিলো না কেউ কারো। সকলে সমানভাবে পরিশ্রম করতো, সমানভাবে ফলভোগ করতো। কেউ বড় কেউ ছোট ছিলো না। মানুষ মানুষের মেহনত চুরি করে মানুষকে দাস বানিয়ে রেখেছে। কৃষক-শ্রমিকের বুকের খুন-ঝরা মেহনত চুরি করে ধনী হয়েছে মানুষ। মেহনতী মানুষের বুকের তাজা রক্ত তাদের বাগানে লাল লাল গোলাপ হয়ে ফোটে। সহস্র রকম পদ্ধতিতে বুকের রক্ত শুষে নিচ্ছে। হাসিম যেন চোখের সামনে শোষণের নলগুলো দেখতে পেলো। সর্বশক্তি প্রয়োগ করে এ শোষণের পথ বন্ধ করতে হবে। সেজন্য দরকার সমিতি। ঘরে ফেরার সময় বক্তৃতার কথাগুলো হাসিমের চেতনায় বারংবার আবর্তিত হয়ে ঘোরে। পৃথিবীর সমস্ত শ্রমিকের শ্রম চুরি করে ধনীরা বালাখানা গড়েছে। হাসিম তো শ্রমিক, তারও শ্রম চুরি করেছে। এতোক্ষণে ধরতে পেরেছে অধরবাবু, কানা আফজল আর খলুদের সঙ্গে তার মতো মানুষদের তফাৎটা কোথায়। বক্তৃতার আলোকে চেনা মানুষদের নতুন করে খুঁটিয়ে দেখে। তাদের শরীর থেকে যেনো লাল লাল তাজা রক্ত ঝরছে। আর অধরবাবুদের মুখে রক্তের ছোপ। প্রবল উত্তেজনায় দু’হাত মুষ্ঠিবদ্ধ হয়ে এলো।

“জয় রাধামাধব,” একেক জনের কথার জোর কি রকম। চন্দ্রকান্ত ফিক করে হেসে ফেললো।

“চাচা, রাখি দাও তোঁয়ার রাধামাধব। বেবাক দুনিয়া ভরা শোষণ, শোষণে রক্ত নাই, হাড্ডিত ঠেহাইয়ে আনি। এতো শোষণ তবুও মাইনষের ঘুম ন ভাঙ্গে ক্যা?” (চাচা রেখে দাও তোমার রাধামাধব। সমস্ত দুনিয়া জুড়ে চলছে শোষণ। রক্ত শুষে এখন হাড়ে এসে ঠেকেছে। এতো শোষণ তবু মানুষের ঘুম ভাঙ্গে না কেন? উত্তেজনার বশে কঠিন মাটিতে দুম করে একটা পদাঘাত করলো।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *