৫. হাসিম গ্রামে গ্রামে ঘুরে বেড়ায়

হাসিম গ্রামে গ্রামে ঘুরে বেড়ায়। চারদিকে ছড়িয়ে পড়েছে মহামারী। সমিতির মানুষদের কাজ অনেকগুণ বেড়ে গেছে। ফুরসত নেই কারো একদণ্ড। খাবার জিনিসের দামে আগুন লেগেছে। ডাক্তার বদ্যি পাওয়া যাচ্ছে না মোটেও। একেকজন মানবসন্তান নীরবে বিনা চিকিৎসায় বিনা পথ্যে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ছে।

এতোদিন হাসিম নিজের দুঃখকেই বাড়িয়ে দেখেছিলো। আশপাশের মানুষের হাল হকিকত নজর মেলে দেখে নি। তার পক্ষে দেখবার উপায়ও ছিলো না। বাস্তবে কাজ করতে নেমে দেখতে পেলো পৃথিবীতে সে শুধু একমাত্র দুঃখী নয়। আরো মানুষ আছে, যাদের অবস্থাও তার চাইতে কোনোক্রমে ভালো নয়। তার মতো হাজারো হাজারো মানুষের জীবনের চারপাশে ঘিরে রয়েছে কঠিন করুণ বাস্তবতা। আঘাত খেয়ে রক্ত ঝরে, হৃদয় রক্তাক্ত হয়, সামনে এগিয়ে যাবার পথ পায় না জীবনে। মানুষের জীবনের মিছিল সে আলোহীন নিশুতির গাঢ় অন্ধকারে থমকে দাঁড়িয়ে আছে। নতুন পাওয়া চেতনার আলোকে সবকিছুর মর্মমূল পর্যন্ত কেটে চিরে দেখে। এতোদিন সেও আকাশের দিকে মুখ তুলে মানুষের দুঃখ-বেদনার অবসান কামনা করতো। সমিতির কর্মীদের সঙ্গে কাজ করে, আলাপ-আলোচনা করে সে বুঝতে পেরেছে, মানুষ নিজেকেই তার ভবিষ্যৎ রচনার ভার হাতে তুলে নিতে হবে। ওপর থেকে কোনো আসমানী রহমত এসে মানুষের দুঃখ আর অভাব দূর করবে, সে অসম্ভব কথা। হাজার মানুষের দুঃখ-বেদনার সঙ্গে সে যখন তার নিজের দুঃখও মিলিয়ে দেখলো, তখন অনুভূতির আয়নাতে সুন্দর ধারণা ফুটে উঠলো–সেও মানুষ। সমিতির লোকদের সঙ্গে কাজ করে ক্রমশই ধারণা আপনার থেকেই বদ্ধমূল হয়েছে যে, সেও মানুষ। জীবন অমূল্য সম্পদ, অসম্ভবকে সম্ভব, অসুন্দরকে সুন্দর করার নিরবচ্ছিন্ন সংগ্রাম করার নামই জীবন। ক্ষয়ে ক্ষয়ে ধুকে ধুকে মরার জন্য মানুষ পৃথিবীতে আসে নি। সমস্ত পরিশ্রম, সমস্ত আকাঙ্খ, সমস্ত স্নেহ ঢেলে দিয়ে জীবনকে মাটির পৃথিবীতে দাঁড় করাতে হবে সুন্দর করে। কেউ কারো চেয়ে পৃথক নয় একই রক্তের নদী ছুটছে সমস্ত মানুষের ধমনীতে। সকলকে বাঁচাতে হলে প্রয়োজন সকলের সমবেত প্রচেষ্টা। একা থাকার মধ্যে তৃপ্তি নেই। কেননা একা থাকলে অতি সহজে নেতিয়ে পড়ে। সংগ্রাম করার অনুপ্রেরণা থাকে না। জীবনের সুখ মানেই তো জীবনের সংগ্রাম। সামনের উজ্জ্বল আশা আর পেছনের উদ্দীপনা না থাকলে মানুষ পারে না সংগ্রাম চালিয়ে যেতে। অবসর সময়ে হাসিম বসে বসে এসব কথা ভাবে। এ ক’দিন সমিতির কর্মীদের সঙ্গে কাজ করে এমন একটা আতস কাঁচ সে পেয়েছে যার ভেতর দিয়ে দেখল জাহেদ বকসু, খলু মাতব্বর, কানা আফজল সকলকেই তাদের আসল চেহারায় দেখা যায়, চেনা যায়। নিরন্ন ভুখা মহামারীর আক্রমণে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়া মানুষদেরকেও চেনা যায়। রাতে ঘুম আসে না, বিছানায় শুয়ে ছটফট করে।

সমিতির জেলা অফিস থেকে কাজ করবার জন্যে একটা মানুষ এসেছে। সারাদিন তাদের সঙ্গে ঘুরে মরা পোড়ায়, কবরস্থ করে। রোগীর সেবা করে। দুটো পেলে খেয়ে শুয়ে পড়ে যেখানে সেখানে। যেমনি সরল, তেমনি কঠিন মানুষটা। বেশ লেখাপড়া জানে। সকলের কেরামত ভাই। কতো কতো দেশ ঘুরেছে। কেরামত ভাই চাটগেয়ে ভাষায় কথা বলতে পারে না। তবু মর্মার্থ বুঝতে তাদের কারো অসুবিধে হয় না। হাসিমের মনে হয়, স্নেহ, প্রেম আর ভালোবাসার ভাষা দুনিয়ার সবদেশে এক। আরেকটা তেমন ভাষা আছে, তাও এক– সে সংগ্রামের ভাষা।

ঘরে আসতে পারে না বেশি। দলাদলা মানুষ মরছে। মাটি দিতে হচ্ছে, পোড়াতে হচ্ছে। জাত বিচারের সময় নেই। জাত বিচার করলে যে মৃতের সত্যার হয় না। এ পর্যন্ত ছেলে-বুড়ো-জোয়ান সব মিলিয়ে মরেছে একশো পঁচিশজন। মনির আহমদ শহরে গিয়ে ওপরে দরখাস্ত করে ডাক্তার আনিয়েছে, পুকুরের পানিতে ওষুধ ছড়িয়ে দিয়েছে। পানিতে রোগের পোকা বাড়ে। জীবানু মিশেল পানি খেলে রোগ সংক্রামিত হয়। টিকা দেবার ব্যবস্থা করেছে। গ্রামের মানুষ টিকা নিতে চায় না। তাতে নাকি ঈমান চলে যায়। এ কথা শুক্কুরবারের জামাতে ফয়েজ মস্তান মুসুল্লীদেরকে বলে দিয়েছে। কাজী পাড়া এবং ফকির পাড়ার সকলে একযোগে ফয়েজ মস্তান জহির মৌলভীকে নিয়োগ করেছে। ছাগল জবাই করে শিরনি দিয়েছে। কোরআনের আয়াত পড়ে পাড়া বন্ধ করেছে। মাটির সরায় সুরা লিখে গাছে গাছে ঝুলিয়ে দিয়েছে, যাতে করে ওলাউঠা পাড়ার ত্রিসীমানায় ঘেঁষতে না পারে। দিনেরাতে শোনা যায় আজানের ধ্বনি। জীবনে যারা নামাজ পড়ে নি ওলাউঠার ডরে তাদের মাথায়ও টুপি উঠেছে। রাতের বেলায় ফয়েজ মস্তান আর জহির মৌলভী জেগে থেকে সমস্ত পাড়াময় ঘুরে বেড়ায়। মাইজ ভাণ্ডারের কোন্ কামেল পীর নাকি স্বপ্নে দেখেছে মানুষের গুনাতে দুনিয়া ভরে গেছে। সে জন্য আল্লাহ্ বান্দার ওপর অসন্তুষ্ট হয়ে কলেরা, হাম, বসন্ত প্রভৃতি সাতবোন পাঠিয়ে গজব নাজেল করছে। ওরা সুন্দরী মেয়েলোকের বেশ ধরে দেশ হতে দেশান্তরে ঘুরে বেড়াবে। যে পাড়ায় আল্লাহর কালামের কোনো নিষেধের গণ্ডী থাকবে না, ভেতর দিয়ে হুড়হুড় করে ঢুকে পড়বে। হেঁটে গেলেই শুরু হবে রোগ। তারপর মৃত্যু… কান্নাকাটি ইত্যাদি। এরই নাম আসমানী মুসিবত। এই আসমানী মুসিবতেরও আসানী আছে আল্লাহর কালামে। একবার জহির মৌলভী নাকি জোয়ারা গ্রামে রাতের অন্ধকারে এক বোনের মাথার লম্বা চুল জারুল গাছের সঙ্গে পেঁচিয়ে বেঁধে খরম দিয়ে হেঁচতে হেঁচতে মুচলেকা আদায় করেছিলো। আল্লাহ্র হুকুম নেই, নয়তো ধরে রেখে দিতো। একথা জহির মৌলভী যত্রতত্র বলে বেড়ায়। আর সেজন্য কলেরার সময় জহির মৌলভীর এতো দাম।

একমাস আগে হাসিম এসবে মোটেও অবিশ্বাস করতো না। কিন্তু আজকে তার কেবল হাসিই আসে। এরকম সুন্দর সুন্দর গল্প বানাতে পারে বলে মোল্লারা খেতে পায়। ওসব কিছু নয়, ভাওতা। মুর্গীর রান খাওয়ার আর মেহনতকে ফাঁকি দেওয়ার জন্য এসব মোল্লারা বানিয়েছে।

জ্যৈষ্ঠের শেষ। আষাঢ় নেমেছে। আউশ ধানের কচি সবুজ রঙে শ্যামায়িত হয়েছে মাঠ। মাঠে মাঠে গঙ্গাফড়িং ছুটোছুটি করছে। মেদুর মেঘ সরে গিয়ে সুন্দর চড়চড়ে রোদ উঠেছে। রক্তের মতো লাল হয়ে উঠেছে। এখন সমিতির বিশেষ কাজ নেই। বলতে গেলে মড়ক থেমে গেছে। সে জন্যে হাসিমদের পেটের ভাত চোখের ঘুম বিসর্জন দিতে হয়েছে অনেকদিন। পুকুরে পুকুরে ওষুধ ছড়িয়েছে, ঘরে ঘরে ফিনাইল, ব্লিচিং পাউডার বিলিয়েছে। কেরামত ভাই এসে তাদেরকে সুন্দর সুন্দর অনেক কাজ শিখিয়ে দিয়েছে। রোগীর সেবা করা, কৃত্রিম উপায়ে শ্বাস-প্রশ্বাস করানো, মশা-মাছি ধ্বংস করার তেল ছড়ানো-সব কিছু শিখে ফেলেছে হাসিম। কৃষক সমিতিতে যোগ না দিলে এসব শিক্ষা কোথায় পেতো? মানুষের জীবন রক্ষার জন্য কতো প্রয়োজন–এসব কি কম মূল্যবান অভিজ্ঞতা!

আরো অনেক মূল্যবান মণিমুক্তো সঞ্চিত হয়েছে অভিজ্ঞতার ভাণ্ডে। ছোট ছোট টুকরো টুকরো সে সকল অভিজ্ঞতা, হাসিমের মনে হয়েছে তার গুরুত্বি অপরিসীম। অভিজ্ঞতার শুদ্ধ আলোতেই সমাজের ভাঁজে ভাঁজে জমা ক্লেদ পঙ্কিলতা স্পষ্ট দেখতে পায়। কিছুদিন আগে হাসিমেরা লাশ কবর দেওয়ার জন্য রিফুজি পাড়ায় গিয়েছিলো। পাড়াটা বসেছে দু’বছর আগে। বুড়ীর ছোট ছেলেটার ওলাউঠা হয়েছে। খবর পেয়ে মনির আহমদ হাসিম আর কেরামতকে পাঠিয়ে দিলো।

ভাঙা ঝুরঝুরে বেড়ার ঘরে ছেঁড়া মাদুরের ওপর বুড়ীর ছেলেটা নিঃসাড় হয়ে পড়ে আছে। সারা ঘরে ভন ভন উড়ছে বড় বড় মাছি। রোগী পায়খানা, প্রস্রাব করে সবকিছু একাকার করে ফেলেছে। বদবুয়ের জন্য কাছে আগানো যায় না, সে অসহনীয়। বদবুকে অগ্রাহ্য করে বুড়ী মৃত্যুকল্প সন্তানের শিয়রে বসে আছে। চোখে মুখে আতঙ্ক… ক্লান্তি… শোক একসঙ্গে বাসা বেঁধেছে। হাসিমেরা সে ময়লা পরিষ্কার করছিলো। মনির আহমদ ডাক্তার এনে চিকিৎসা করে মৃত্যুকল্প বালককে বাঁচিয়ে তুলেছিলো। তিনদিন হাসিমকে বুড়ীর সঙ্গে সঙ্গে রোগীর বিছানায় বসে কাটাতে হয়েছে। চারদিনের দিন চোখ মেলে তাকিয়ে ছিলো রোগী। সন্তানকে চোখ মেলতে দেখে বুড়ীর দু’চোখে অশ্রুর ধারা নেমেছিলো। অথচ বুড়ীর চোখ এতোদিন ছিলো আশ্চর্য রকমের শুকনো। এ ভাবান্তর দেখে হাসিম আবাক হয়ে গেলো। সন্তান ভালো হয়ে উঠেছে এতে কাঁদবার কি থাকতে পারে? বুড়ীকে জিজ্ঞেস করেছিলো কেন সে কাঁদছে। জবাবে বলেছিলোঃ

“বাপজান, কেন কাঁদছি তোমাকে বোঝাতে পারবো না।”

মানুষ কেন কাঁদে তা কি বোঝাবার? তবু হাসিমের দরদী মন বুঝতে চেয়েছিল। জবাবে বুড়ী বলেছিলো। তার অনেক কথা মনে পড়েছে। ঘর-বাড়ির কথা… আত্নীয়-স্বজনদের কথা… আরো বলতে পারা যায় না এমন অনেক কথা… গভীর কথা মনে পড়েছে। তাই বুড়ী কাঁদছে। একটি মাত্র আশার অঙ্কুর শিশুসন্তানটি, তাও ঝরে যেতে বসেছিলো। বেঁচে উঠেছে হাসিমদের কল্যাণে। জিজ্ঞেস করলোঃ

“পোয়ার বাপ কডে, খালা?” (ছেলের বাপ কোথায়, খালা?)

“আর কোথায় যাবে, সকলে সবশেষে যেখানে যায় সেখানেই গেছে।”

“কি রোগ অইয়েলদে, খালা?” (কি রোগ হয়েছিলো খালা?)

“বাপজান, রোগ-ব্যারাম কিছু নয়। জ্যান্ত মানুষটাকে মেরে ফেললো।”

“কনে?” (কে?)

“আর কে, হিন্দুরা।” উহ্ করে একটু বুকভাঙ্গা নিঃশ্বাস বেরিয়ে আসে।

হাসিম ঠিকমতো ব্যাপারটা বুঝতে পারে না। কেন হিন্দুরা মারবে তার স্বামীকে? বিশদ জানবার জন্য আবার শুধোয়ঃ

“তোঁয়ারার জাগা-জমিন ন আছিল?” (সেখানে তোমার জায়গা জমিন ছিলো?)।

“বাপজান, আট বিঘে ধানের জমি ছিলো, ভিটি ছিলো, বাগান ছিলো, ঘর ছিলো এবং মুখে বলা যায় না এমন অনেক কিছু ছিলো। জল-হাওয়া… আলো।”

কেন এ যাওয়া-আসা? হিন্দুরা পাকিস্তান থেকে হিন্দুস্তানে যায়, হিন্দুস্তান থেকে মুসলমানরাও বা আসে কেন? কেন আসে? কেন যায়?

“জাগা-জমিন ছাড়ি আইলা ক্যা?” (জায়গা-জমি ছেড়ে এলে কেন?)

“ডরে, বাপজান, ডরে।”

“এই দেশত ত ব্যারামে আর অভাবে মরণের দশা অইয়ে।” (এই দেশেও তো রোগে আর অভাবে মরণের অবস্থা হয়েছে।)

“বাপজান, মরণের কি ভয়?”

“ভয় কারে?”

“ভয় ত হিন্দুদের।”

ভয় শুধু হিন্দুকে? হিন্দুরা কি মরণের চাইতেও ভয়ঙ্কর? হিন্দুদের মধ্যে কি ভালো মানুষ নেই? মুসলমানদের মধ্যে কি খারাপ মানুষ নেই? জাহেদ বকসু, খলু মাতব্বর, কানা আফজল এরা কি ভালো মানুষ? হেডমাষ্টার গিরিজাশঙ্করবাবু যিনি মুসলমানের ছেলের প্রাণরক্ষা করতে গিয়ে প্রাণ দিলেন তিনি কি খারাপ মানুষ? হাসিমের ধারণা কানা আফজল আর অধরবাবুরা একযোগেই তো মৃত্যুর ব্যাপার করে। ওরা হিন্দু নয়, ওরা মুসলমান নয়, ওরা একজাত-অত্যাচারী। এ সত্যটা মানুষ বোঝে না কেন? কেন বোঝে না? ভয়ানক দুঃখ হয়, যে-দুঃখের কোনো রূপ নেই।

আপাততঃ সমিতির কাজ চুকিয়ে বুকিয়ে দিয়েছে। এখন ঘরে ফেরা দরকার। সুফিয়ার কথা চিন্তা করে শঙ্কিত হয়ে ওঠে হাসিম। তার দিন কি রকম করে কাটছে কে জানে। সেদিনই বাড়ির উদ্দেশ্যে পথে বেরিয়ে পড়ে। বাড়াবাড়ির বটতলার নবীর দোকানের পাশ দিয়ে যাবার সময় তাকে দেখে দোকান ভর্তি মানুষ সশব্দে হেসে ওঠে। সম্মিলিত হাসির শব্দে একটু দিশেহারা হয়। অন্যদিন হলে ভয় পেতো। আজকে তার করুণা হলো। কোথায় দাঁড়িয়ে আছে জানে না বলেই হাসছে ওরা। তাদের স্থান কোথায় যদি সঠিকভাবে জানতে পারতো, তাহলে তাদের হৃদয়েও দয়া জাগতো, উথলে উঠতো প্রেম। তাকে টিটকিরি দেয়। গায়ে মাখে না হাসিম। ছতুর বাপ তসবীহ্ রেখে দাড়ি দু’হাতে মুঠি করে শ্লোক উচ্চারণ করলোঃ

“অকুলীন কুলীন অইব কুলীন অইব হীন
অকুলীনে দুঁড়াইব ঘোড়া কুলীনে ধরিব জ্বীন।”

ধীরে ধীরে হাঁটতে হাঁটতে কথাগুলো ওজন করে দেখে হাসিম। কোনো মানুষের ভালো কামনা করার মতো মন এদের নয়। তেমন তীক্ষ্ণ নয় দৃষ্টিরেখা। গভীর নয় অনুসন্ধিৎসা। প্রবল নয় ভালোবাসা। তাই কেউ ভালো কাজ করতে গেলে সম্ভাব্য সকল উপায়ে নাজেহাল করা চাই তাদের। এটা তাদের মনের চরম দুর্বলতার অভিব্যক্তি। যার কিছু করার ক্ষমতা আছে করবে। বেহুদা কথা কয় না সে। তাদেরকে তো চিনেছে হাসিম। তাদের পরিচয় কি অনুদঘাটিত? তাদের প্রাণ আছে বটে শরীরে, তবে সে প্রাণ নিজেদের এখতিয়ারে নয়। জাহেদ বকসুর হুকুমে লাগান অথবা খলু মাতব্বরের দাঙ্গায় বিসর্জন দেবার জন্য তৈরি করে রেখেছে। মানুষের লহুর স্পন্দন তাদের শিরায় কই?

পাড়ায় ঢুকবার মুখে নারী-কান্নার তীক্ষ্ণ শব্দ তার কানে আসে। অভ্যেস অনুসারে স্বরের অনুসরণে ছোটে। তার নিজের পাড়ায়ও কি লাগলো ওলাউঠা, জহির মৌলভী কিছু করতে পারলো না নাকি? কি করতে হবে মনে মনে সে কথা চিন্তা করে। পুকুরের পশ্চিম পাড় ঘেঁষে চেকন ঘাসে ঢাকা কর্দমাক্ত পিচ্ছিল পথটা বেয়ে অতি সন্তর্পণে হাসিম হাঁটতে থাকে। যে-কোনো মুহূর্তে সাপে কাটার আশংকা। তখন সন্ধ্যা চারদিকে। জীবন্ত অন্ধকার পৃথিবীকে গ্রাস করেছে। সে আঁধার সাঁতরে ছদুর মা’র উঠোনে এসে দাঁড়ালো। ছদুর মা গলা ছেড়ে কাঁদছে। এবার তার কাঁদবার ঋতু। বৌটা একগালে একটা হাত দিয়ে স্বামীর মৃত্যুর সংবাদটা যাচাই করছে। কদিন আগেও যোয়ান মানুষটা বেঁচে ছিলো। কাঁচা বউটি, অল্প বয়েস। একটি ছেলেপুলেও জন্মায় নি। কচি পাটের চারার মতো আন্দোলিত শরীর। আজ খবর পেয়েছে, ছদু তিনদিন আগে শহরের হাসপাতালে জননী আর প্রিয়তমার মায়া কাটিয়ে চলে গেছে। এমন স্বাস্থ্যবান সুঠাম সুন্দর সবল শালকাঠের মতো যুবক ছদু–মারা গেলো? আহা রে! আহা রে! রক্তমাখা বিক্ষত চেহারাটা ভেসে ওঠে। সে প্রাণ আর নেই। আলো হয়ে, হাওয়ায় মিশে গেছে। কলজের ভেতর কে যেন সাঁড়াশী দিয়ে টানছে। বউটা পানি ফেলছে দু’চোখের। শ্রাবণের ধারার চাইতেও ঘন। এবং দীর্ঘতরো। মাটা ডানাভাঙ্গা ঘুঘুর মতো কাতরাচ্ছে। উঠোনের কাদায় গড়াগড়ি যাচ্ছে। বুকে কিলের পর কিল মারছে। বিধবার একমাত্র সন্তান ছদু। গ্রামের মান ইজ্জতের সঙ্গে যার ছিলো প্রগাঢ় সম্বন্ধ। শূন্যচারী ঈগলের মতো ছিলো যার দুঃসাহস, সে ছদু আর নেই। ওলাউঠার মৃত্যু দেখেছে। সে এরকম অণুপরমাণু নিঃসার হয়ে, হাত-পা শীতল হয়ে নীরবে নীরবে ঠাণ্ডা হয়ে ঝরে পড়া মৃত্যু। কিন্তু ছদু-তার রক্তাক্ত মৃত্যু বুকে একবুক টনটন জ্বালা দিয়ে যায়। সহজভাবে নিতে পারে না। বুদ্ধি দিয়ে বিচার করতে পারে না। আবেগেরা স্পন্দিত হয়ে কথা কয়। বজ্রাহত মানুষের মতো দাঁড়িয়ে থাকে হাসিম। আরো মানুষ দাঁড়িয়ে আছে–তারাও বজ্রাহত। পরিস্কার মেঘমুক্ত নিথর আকাশ থেকে একটা বজ্র অনেকগুলো কালো মাথায় নেমে এসেছে–ছদু নেই, বেঁচে নেই, সে কথা বরগুইনির দু’পাড়ের বাতাসে আজ বেজে উঠেছে।

তারপরে দেখলো হাসিম। চোখের পানি মুছে ফেললো বউটি। পড়নের কাপড়খানা আঁটসাট করে পড়লো। বাহ্যজ্ঞানরহিত যেন স্বপ্নের মধ্যেই করে যাচ্ছে সব কিছু। কারো মুখে কোনো কথা নেই। সকলে একদৃষ্টে ছদুর বউকে দেখছে। চুলের খোঁপাটা এলো হয়ে পিঠের ওপরে এলিয়ে পড়েছে। এলোচুলে ঘরের ভেতরে ঢুকে সাড়ে তিন হাতি কিরীচখানা নিয়ে এলো। এখনো ফলায় চাপ চাপ রক্ত জমাট বেঁধে রয়েছে। এ কিরীচ নিয়েই ছদু দাঙ্গাতে গিয়েছিলো। কাদির মিয়াকে কোপ দিয়েছিলো। গাছের ডালে না লাগলে দুফাঁক হয়ে যেতো। তারপর কিরীচ রেখে বর্শা হাতে ছুটে গিয়ে কাদির মিয়ার বড় ছেলের উরু এক ঘাইয়ে এফোঁড়-ওফোঁড় করে ফেলেছিলো। তার পরেও লড়াই দেয়া ষাঁড়ের মতো ছুটে গিয়েছিলো সাতবাড়িয়ার মানুষদের পিছু পিছু। সেই যে গিয়েছে ছদু আর ঘরে আসে নি। মর্মান্তিকভাবে আহত হয়ে থানা হাসপাতালে–থানা থেকে সদর হাসপাতালে–সদর হাসপাতাল থেকে একদম জীবনের ওপারে।

ছদুর কচি বউটির শোক কঠিন হয়ে জেগে উঠেছে। শঙ্খের চরের মেয়ে খেপা শঙ্খিনীর মতো ফনা তুলছে। ছুটছে সে ছুটছে, ছুটছে কিরীচ হাতে। শঙ্খের বানের জলের মতো গতি। খলুকে খুন করে জুড়োবে নাকি বুকের জ্বালা! বিশ্ব-সংসারের কারো এমন সাধ্য নেই যে প্রতিশোধ-পাগল এ হাল্কা পাতলা মেয়েটিকে ধরে রাখে। অন্ধ হয়ে অন্ধকারে ছুটেছে। হাতের ঝকঝকে রক্তপিপাসু তলোয়ার পথ দেখিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। তার হাতের অস্ত্র পথ চিনে। অন্ধকারে বারণ মানে না। রুদ্ধশ্বাসে তাকিয়ে আছে সকলে। অজ্ঞান হয়ে হাঁটার সময় অন্ধকারে পিটুলী গাছের সঙ্গে ধাক্কা লেগে ‘মা রে’ বলে চীকার ছেড়ে কাদা মাটিতে ধপ করে পড়ে গেলো। হাত থেকে কিরীচ খসে পড়লো। ছদুর বউ নড়ে না, চড়ে না, ছদুর বউয়ের হুঁশ নেই।

বুকে একরাশ তরতাজা জ্বালা নিয়েই হাসিম ঘরে ফিরলো। প্রায় পনেরো দিন পর সে ঘরে ফিরছে। দরজার কাছে এসে দাঁড়িয়ে রইলো। পা দুটো ছড়িয়ে বসে সুফিয়া। স্ফীত উদরের জন্য পা দুটো ভিরিয়ে বসতে পারে না। পাশে বসে আছে জোহরা। চেরাগের আলোতে তার মুখমণ্ডল দেখা যাচ্ছে। দু’চোখের কোণায় দুটো ভরভর পানির ফোঁটা টলমল করছে। অপরূপ সুন্দর লাগলো। মুছে গেলো রক্তের দাগ মন থেকে। মানুষের কান্নাও কি সুন্দর হতে পারে? কান্নাতেও কি হৃদয়ের রঙ ছায়া ফেলে? হাসিম গলা খাকারী দেয়। এস্তা হরিণীর মতো জোহরা ছুটে পালায়। কেন আসে? কেন ছুটে যায়? বাঁশের ঝাঁপটা টেনে ঢোকে। সুফিয়া হাসিমকে দেখে খুশি হয়–খুবই খুশি হয়।

সুফিয়াকে নতুন লাগে। তার গায়ের রঙে সজীবতা আসছে দিনের পর দিন। লেগে থাকে হাসিমের চোখ। ফিরিয়ে নিতে পারে না। অমনভাবে একা ফেলে যাওয়া উচিত হয় নি তার। কে আছে যে সুফিয়াকে দেখবে? প্রাণের ভেতর প্রাণের সঞ্চার হচ্ছে। গর্ভবতী মেয়ের প্রাণ কতো কিছুর জন্য ছটফট করে। কতো কিছু খেতে চায়। একটু আদর পাওয়ার জন্যে মনটা কেমন আইঢাই করে। মা নেই, বাপ নেই, কেউ নেই। আছে হাসিম। হাসিমও বাউলের মতো ঘুরে বেড়ায় দেশে দেশে।

সুফিয়া ধীরে ধীরে বসা থেকে উঠে হাসিমকে রাধা ভাত বেড়ে খেতে দেয়। নড়তে চড়তে তার কষ্ট হচ্ছে। একটা প্রাণকে পৃথিবীতে আনা সে কি সহজ কথা? শুয়ে পড়ে। শুয়ে আছালি-পিছালি করে। সুফিয়ার হাতে তৈরি আমের আচারের কাজী আর সুটকীর ভর্তা অমৃতের মতো লাগে।

খাওয়ার পর হাসিমও সুফিয়ার পাশে বাতি নিভিয়ে শুয়ে পড়ে। চুলে কপালে হাত বুলিয়ে দেয়। একেবারে বুকের কাছটিতে এগিয়ে আসে সুফিয়া। গায়ের সঙ্গে গা লাগিয়ে কাদার মতো লেপ্টে থাকে। পাঁচ বছরের মেয়ের মতো মনে হয়। হাসিম তার গায়ে আর তলপেটে হাত বুলোয়। হাতের স্পর্শে সুফিয়ার শরীরে মিহি গভীর শিরশিরানি অনুভব করে। শিরায় শিরশির ফোঁটা যে আনন্দ তার কোনো প্রকাশের ভাষা নেই। একখানা হাত হাসিমের গায়ের ওপর চড়িয়ে দেয়। হাসিম সুপুষ্ট দু’বুক চেপে চেপে নাক ডুবিয়ে ঘ্রাণ নিতে চেষ্টা করে। কিসের ঘ্রাণ সে জানে না। বাঁশের ফোকড় ফোকড় দরজার ফাঁক দিয়ে দেখা যায়, আস্তে আস্তে শিরীষ গাছের উঁচু ডালটির আড়াল দিয়ে মেঘের বুক চিরে একফালি চাঁদ উঠেছে। গভীর রাতের ভেতর বুকের যেসব অতি গভীর কথা ভাষা পায় না… সে সকল কথাই যেন গুঁড়ো গুঁড়ো হয়ে ভেঙে পড়েছে চাঁদের আলোতে।

পাশে শায়িতা সুফিয়ার মুখখানা আবার ভালো করে দেখে। মন্দিরের প্রতিমার মতো নির্বাক নিটোল সৌন্দর্যময় মুখচ্ছবি। অতি সন্তর্পণে যেন উদরস্থ সন্তানকেও ফাঁকি দিয়ে একটা চুমু খায় মুখে। সুফিয়া তার হাত দুটোতে হাত বুলিয়ে নিয়ে যায়। সারা শরীরে তার হাত ঘোরাফেরা করে। সাপের গায়ের মতো শীতল গা সুফিয়ার। স্পর্শে জানাজানির বিদ্যুৎ সারাশরীরে ছড়িয়ে যায়। কোনো তুলনা নেই তার। প্রতিটি মুহূর্ত জমে জমে শিশির হয়ে যাচ্ছে। ধরা যায়, ছোঁয়া যায়, যেন একেকটি মুহূর্ত গামছা দিয়ে বেঁধে রাখা যায়। যেন তারা অনেকদিন এমনি পাশপাশি শুয়ে আছে জন্ম জন্ম ধরে যেন শুয়ে আছে।

হাসিমের মুখের খোঁচা খোঁচা দাড়ির ওপর হাতখানা বুলিয়ে নিতে নিতে জিজ্ঞেস করেঃ।

“কি চিন্তা গরদদে?” (কি চিন্তা করছো?)

“কিচ্ছু না।” আয়েশে হাই তুলে হাসিম।

সুফিয়ার ডান হাতখানা বিশাল হাতের ভেতর পুরে আদর করে। আদরের স্রোতে সুফিয়া ভেসে যেতে চায়। আবছা একখানা স্বপ্ন আসে চোখে কেঁপে কেঁপে। সে যেন উজানী নায়ের মতো স্রোত কেটে কেটে ভেসে যাচ্ছে। দৃষ্টির অতীত হয়ে যাচ্ছে; দু’পাশের ঘরবাড়ি লোকালয়। উপরে উদার নীল আকাশ। একটু আগে সূর্য ডুবেছে। সিঁদুরের মতো বরণ ধরেছে আকাশ। একটি তারার ঝিকিমিকি। তারা আলোর দিকে চেয়ে চেয়ে দূরে বহুদূরে ভেসে যাচ্ছে। সামনে সাগর… অথৈ নীল জল নোনা পানির ঢেউ। ঢেউয়ের আঘাতে আঘাতে জ্বলে উঠছে শুভ্র শাদা চূর্ণিত ফেনার পুঞ্জ। জ্বলজ্বল করছে। একি, কোথায় যাচ্ছে সে? আতঙ্কে শিউরে ওঠে। দু’হাতে জড়িয়ে ধরে। চিৎকার ছেড়ে ওঠেঃ

“আই ভাসি গেলামগই।“ (আমি ভেসে গেলাম)।

“কি?”

“আই ভাসি যাইরদে। আঁর ডর লাগেরদে।” (আমি ভেসে যাচ্ছি। আমার ভয় লাগছে।) আতঙ্কিত কণ্ঠস্বর সুফিয়ার।

“কিয়র ডর আঁই ত আছি।” (কিসের ভয়, আমি তো আছি।)

অভয় দেয় হাসিম।

“তুই ত আছ, তারপরও ডর লাগেরদে।” (তুমি আছ তা হলেও ভয় লাগে।)

হাসিমকে জড়িয়ে ধরে কচি কলার ডগার মতো থিরথিরিয়ে কাঁপে। হাসিম তলপেটে হাত বুলিয়ে দেয়। ওখানে তার বীর্যের ব্যঞ্জনা শিল্পীর স্বপ্নের মতো ঘুমিয়ে আছে। সুফিয়া আশ্বস্ত হতে পারে না। অধিকতরো আতঙ্ক মেশানো স্বরে বললোঃ

“আই বাঁইচতাম নয় এবার।” (এবার আমি বাঁচবো না।) চোখ ফেটে পানি বেরিয়ে আসে। হাসিম তার চোখের পানি সযত্নে মুছিয়ে দেয়। এ জল চোখের নয় হৃদয়ের।

“এইবার পইলা কিনা, হিথার লায় ডর লাগেরদে। কিছু অইত নয়, ডরের কিছু নাই।” (এবার পয়লা কিনা, সেজন্য ভয় লাগছে। কিছু হবে না, ডরের কিছু নেই।)

“নয়, নয় বুইঝতা নয়। আঁই আর বাঁইচতাম নয়। এতোদিনে আঁর আয়ু শেষ অইল।” (না, না, তুমি বুঝবে না। আমি আর বাঁচবো না। এতোদিনে আমার আয়ু শেষ হলো।)

ওদিকের আম গাছে একটা ভূতুম ভূতুরে স্বরে ডাকছে। হাসিম সুফিয়ার মুখ চেপে ধরে। অলক্ষুণে কথা বলতে দেয় না। ভূতুমটা অলক্ষুণে ডাক ডাকছে। না, না মরতে দিতে পারে না সে সুফিয়াকে। মা-বাপ, ভাই-বন্ধু কেউ নেই–আছে সুফিয়া, মায়ের মতো স্নেহে তাকে আগলে আছে। সে যদি মারা যায় কার কাছে যাবে হাসিম? বিশ্বভুবনে প্রাণভরা আদর দিয়ে আপন করে নেবে অমন কেউ আছে নাকি তার? ছোটোলোকের চাইতেও ছোটলোক হাসিম। যদি সুফিয়া মরে যায়! সন্তান প্রসব করতে গিয়ে অমন অনেকেই তো মারা যায়। মনের পরিস্কার আকাশে একখণ্ড কৃষ্ণবর্ণ মেঘের সঞ্চার হয়। ধীরে ধীরে ছড়িয়ে পড়ে… ছায়া বিস্তার করে। হাসিম ভাবে সুফিয়া মৌরলা মাছের ঝোল খেতে চেয়েছিলো। আগামীকাল মৌরলা মাছ ধরার কথা চিন্তা করে। মৌরলা মাছের কথা চিন্তা করতে করতে ঘুমিয়ে পড়লো। ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে খারাপ খারাপ স্বপ্ন দেখলো। কখন দেখলো রক্ত, কখন আগুন, কখন রেলগাড়ি, মেয়েমানুষ আরো অনেক কিছু। এলোমেলো জড়ানো ছড়ানো পক্ষাঘাত জর্জর স্বপ্নরেখা মনের অবচেতনে সমুদ্রের কাঁকড়ার মতো হেঁটে গেলো।

পরদিন সকালে ছদুর মার বুকভাঙা চিৎকারে হাসিমের ঘুম ভাঙলো। এ সেই চীৎকার যার সঙ্গে জড়িয়ে আছে মৃত্যু, রক্তপাত আর সবকিছু হারানোর সুতীক্ষ্ণ হা হুতাশ। হাসিমের বুকটা চি চি করে। হাতে-মুখে পানি দিয়ে ছদুর উঠোনে এসে দাঁড়ায়। পাড়ার মেয়ে-পুরুষ সকলে এসে দাঁড়িয়েছে। ছদুর মা বুক চাপড়িয়ে কাঁদছে। সকলে তার দিকে চেয়ে আছে। কেউ কিছু বলছে না। বলবার কিইবা আছে? তার একটা ছেলে ছিলো। গ্রামের মান-ইজ্জতের প্রশ্নে যার শিরার রক্ত উজানে যেতো। তার শিরার শেষটুকু রক্ত চরের রেতী বালুতে ঢেলে দিয়ে গ্রামের মুখ রক্ষা করেছে। তাতে কার কি-ই বা বলার আছে?

এমন সময় কানা আফজল, জাহেদ বকসু আর খলু মাতব্বর উঠোনে এসে ঢুকলো। পুরুষেরা সসম্ভ্রমে উলে দাঁড়ালো। মেয়েরা এক হাতে গোমটা টেনে সরে দাঁড়ায়। সুপুরী গাছটা ধরে দাঁড়িয়ে রইলো হাসিম। একটু পরেই চন্দ্রকান্ত এসে হাসিমের পাশে দাঁড়ালো।

“ভাইপুত, দেখিস, এককান জানের দাম ক’ পয়সা দে।” কথা বললো চন্দ্রকান্ত। হাসিম জবাব দেয় না। শাদা পরিষ্কার কাপড় পরা মানুষগুলোর দিকে গভীর চোখে তাকিয়ে দেখে। কানা আফজলের দিকে তাকায়। আধকালো আধপাকা দাড়িতে জড়িয়ে আছে বীভৎসতা। বুক চাপরাচ্ছে ছদুর মা। বৌটা বসে আছে ঘরের বাইরে। গতরাতে যে মেয়েটা দলিতা ফণিনীর মতো ছুটে গিয়েছিলো আজ দিনের আলোকে তাকে বড় নিষ্প্রভ, বড় স্নান দেখাচ্ছে। রাতের অন্ধকারে জেগে ওঠা সুতীব্র প্রতিহিংসার তরঙ্গ কি রাতের অন্ধকারেই বিলীন হয়ে গেলো? অধোমুখে বসে আছে ছদুর বৌ। কলা গাছের আড়াল দিয়ে দেখা যাচ্ছে তার চুপসে যাওয়া মুখমণ্ডল। হাসিমের কেমন গলা ছেড়ে কাঁদতে ইচ্ছে করে। চন্দ্রকান্ত কাঁধের ওপর হাত রেখে উচ্চারণ করলোঃ

“জয় রাধামাধব।”

কণ্ঠস্বরে আগের সে কৌতুকবোধ নেই। একযোগে চেয়ে থাকে দু’জন। কানা আফজল, জাহেদ বকসু ও খলু মাতব্বর ঘরের বারান্দায় একটা সপের ওপর বসেছে। কানা আফজল চোখের চশমা খুলে পাশে রেখে ডাকলোঃ

“অ ছদুর মা কথা হুন। এককেনা ঠাণ্ডা অও। আল্লাহ্র হুকুমের উয়র ত বান্দার হাত নাই। যা অইবার অই গেইয়ে।” (অ ছদুর মা, কথা শোন। একটু ঠাণ্ডা হও। আল্লাহর হুকুমের উপর তো মানুষের কোনো হাত নেই। যা হবার তো হয়ে গিয়েছে।)।

ছদুর মা ধীরে ধীরে তাদের সামনে এসে দাঁড়ায়। অভ্যেসবশে মাথার ঘোমটা টেনে দেয়। তার চোখের ভেতর বিরাট শূন্যতা। কানা আফজলের মতো ধড়িবাজ মানুষও সেদিকে চেয়ে থতোমতো খেয়ে গেলো। সমগ্র পৃথিবীর সমস্ত আলো সে চোখ দুটোতে পুরে দিলেও শূন্যতা পূরণ হবে না।

“ছদুর মা, বিধির হুকুম ত কেউ খাইতে ন পারে। অহন উঁই এককেনা ঠাণ্ডা ন অইলে ত কতা কইতে ন পারি।” (ছদুর মা, বিধির হুকুম তো কেউ খণ্ডাতে পারে না, এখন তুমি একটু ঠাণ্ডা না হলে কথা তো বলতে পারবো না।)

“ভাইরে আঁর বুকত অইন।” (ভাই আমার বুকে আগুন।) ডুকরে কেঁদে ওঠে ছদুর মা। জাহেদ বকসু উঠে মুখটা মুছিয়ে দেয়। হাজার চেষ্টা করেও শান্ত করতে পারছে না। মৃগী রোগীর মতো হাত-পা ছুঁড়ছে। এবার কানা আফজল বলেঃ

“ছদুর মা, খলু তোঁয়ার ভরণ-পোষণের লায় রাস্তার পাশেই দু’কানি জমিন দিল।” (ছদুর মা, তোমার ভরণ-পোষণের জন্য খলু তোমাকে রাস্তার পাশে দু’কানি জমি দিলো।)

“জমি দি আঁই কি গইরগম রে ভাই। কনে চাষ গরিব? একবার চৌকের দেখা ন দেখিলাম পুতরে। বন্দার আশা পুরাইয়ে।” (জমিন নিয়ে আমি কি করবো ভাই। চাষ করবে কে? একবার ছেলেকে চোখের দেখা দেখলাম না। মানুষের আশা পূর্ণ হয়েছে।) “আল্লাহরে’ বলে চীৎকার ছেড়ে কেঁদে ওঠে।

কানা আফজল বিরক্ত হয়ে দু’কানের ভিতর আঙ্গুল পুরে দেয়। কান্নাকাটি শোনার মেজাজ নয় তার। গ্রামের চেয়ারম্যানের কথায় কান দেয় না, কেমন বেহায়া মেয়েমানুষ?

“ঠিক আছে, কথা অইল, দুই কানি জমি তোঁয়ারে দিল খলু। আঁরা সাক্ষী রইলাম।” (ঠিক আছে, কথা হলো, দু’কানি জমি তোমাকে খলু দিয়ে দিলো। আমরা সাক্ষী রইলাম।)

তারা উঠে পড়ে। ছদুর বউ উঠোনের এক পাশে ডালিম গাছের তলায় এসে দাঁড়ায়। জমিনের কোনো দরকার নেই। কি করবে সে জমি দিয়ে? কে একজন বললোঃ

“ছদুর বৌ–বৌয়ের কি হবে?”

“ছদুর বৌয়ের যুদি আপত্তি ন থাহে আঁর আনুর লগে শাদী দিয়ম। কেন অইব ক তোঁয়ারা দশজনে।” (ছদুর বৌয়ের যদি আপত্তি না থাকে আমার আনুর সঙ্গে বিয়ে দেবো। কেমন হবে বলো তোমরা দশজনে।) জবাব দিলো খলু। সকলে সায় দিলো।

“ভালা–খুব ভালা অইবো।” (ভালো, খুব ভালো হবে।) ওরা চলে গেলো। অনেক কাজ তাদের। এবার চন্দ্রকান্ত মুখ খোলেঃ

“কেন ভাইপুত, তোরে আগে কি কইলাম। বুঝিলি ছদুর জানের দাম মোডে দুই কানি জমিন না? আজিয়া দিব কালিয়া কাড়ি লৈব। বদমাইশ পোয়ারে আগে এত চেষ্টা গরিও বিয়া গরাইত না পারে। অহন এউগ্গা তৈয়ারী বউ পাই গেল। কেন ভাইপুত রাধামাধবের লীলা ‘তেল্যা মাথায় তেল। আতেল্যা মাথা ফুয়াই গেল। আল্লাহ্ ত খল্যা আর কানা আফজল্যার, কি কস?” (কেমন ভাইপো, আগে কি বলেছিলাম? বুঝলি ছদুর জানের দাম মোটে দু’কানি জমিন। আজ দেবে কাল কেড়ে নেবে। বদমায়েশ ছেলেটাকে আগে এতো চেষ্টা করেও বিয়ে করাতে পারে নি। এখন একটা তৈরি বৌ পেয়ে গেলো। রাধামাধবের কেমন লীলা ভাইপো দেখো। তেলা মাথায় তেল। আল্লাহ তো খলু আর কানা আফজলের, তুমি কি বল?)।

হ্যাঁ, আল্লাহ্ খলু আর কানা আফজলের। হাসিম কথা কয় না। মনে মনে আল্লাহ্র কেমন বিচার উপলব্ধি করতে চেষ্টা করে। আল্লাহ্ তাদের না হলে অন্যের সর্বনাশ করেও কেমন করে তারা লাভবান হয়! আজ দু’কানি জমি মুখে মুখে দিলো। কাল কেড়ে নিয়ে যাবে। আনুর সঙ্গে খাদিম আলীর মেয়ের বিয়ে দেয়ার চেষ্টা করেছিলো দু’বছর আগে। অনেক ভেট বেগার বয়েও কোনো ফল হয় নি। ভেট বেগারে খাদিম আলীর মন ওঠে নি। সরল মানুষ খাদিম আলী। শত অনুরোধে খলু মাতব্বরের মতো পেঁচী মানুষের সঙ্গে সম্বন্ধ পাতাতে রাজী হয় নি। খাই খাসলত ভালো দেখে ছদুকেই মেয়ে বিয়ে দিয়েছিলো। ছদু গেছে, বউটা অল্প বয়সে রাড়ী হয়েছে। এখন খলু মাতব্বরের ছেলের সঙ্গে বিয়ে হতে খাদিম আলীর তরফ থেকে কোনো আপত্তি ওঠার কথা নয়। কেমন জটিল আর ঘোরালো আল্লাহর কল। সে কলে গরীবেরাই বা কেন পিষে যায়! চন্দ্রকান্ত নয় শুধু, গ্রামের সকলের মনে এ কথা লেগেছে। কিন্তু মুখ দিয়ে বের করার সাহস নেই কারো। বুকের কথা মুখে বলতে পারে না কেন মানুষ? কেন মানুষ মুখ ফুটে অত্যাচারকে বলতে পারে না অত্যাচার? এ সকল মৌলিক প্রশ্ন হাসিমকে ভয়ানকভাবে খোঁচায়। একজন দু’জন করে মেয়ে পুরুষ চলে যেতে থাকে। তাদের দৈনন্দিন কাজ আছে। যা হবার হয়ে গেছে। চন্দ্রকান্ত আর হাসিমও চলে আসে।

কিছুদিন পর শুনতে পেলো কানা আফজল আর জাহেদ বকসু খুব ঘন ঘন সাতবাড়িয়া যাওয়া-আসা করছে। খবর শুনে চট করে আনুমান করে নিতে আসুবিধে হয় না হাসিমের। খলু এবারও কোনো নতুন চাল চেলেছে। একদিন বাগিচার হাট থেকে আসবার সময় দেখতে পেলো খাঁর দীঘির উঁচু পাড়ে মিলিটারী বটগাছ তলায় বসে কানা আফজল, খলু, জাহেদ বকসু এবং কাদির মিয়া চুপি চুপি আলাপ করছে। দেড়মাস আগে দাঙ্গা করেছে খলু আর কাদির মিয়া। দাঙ্গায় একজন মানুষ প্রাণ দিয়েছে। ছদুর মতো অমন একজন মানুষের প্রাণ। এখনো চরের মাটি সে রক্তের সবটা শুষে নিতে পারে নি। এখনো প্রতিদিন বালুচরে সূর্যালোকে ঝিলিমিলি যা জ্বলে সে কি ছদুর রক্ত নয়? ছদুর মা’র কাঁচা শোক এখনো পুরোনো হয় নি। এরি মধ্যে খলুর সঙ্গে কাদির মিয়ার আপোষ হয়ে গেলো কেমন করে? তিন বছরের শত্রুতা কোথায় গেলো? এ কেমন করে সম্ভব? কেরামত ভাইয়ের কথা মনে পড়ে হাসিমের। কেরামত ভাই বলে, পূর্ণিমায় চোরেরা যতো ঝগড়া, যতো মারামারি করুক না কেন, অমাবস্যার জোতে সকলে একজাত। মহিষের শিং হানতে সোজা। তেমনি দুনিয়ার অত্যাচারীরা একজাত।

সেদিনই সাঁঝের বেলায় কাজী পুকুর থেকে পানি ভরে নিয়ে যেতে দেখলো জোহরাকে। জোহরার চোখ-মুখ ঘিরে আছে বিষণ্ণতা-করুণ ম্লান। চেতনার গভীরে শেকড় প্রসারিত করেছে। তার চোখের কোণে কালি পড়েছে। চিন্তার কৃষ্ণ সরীসৃপেরা কুরে কুরে যাচ্ছে তার হৃদয়– সে কৃষ্ণবর্ণ হৃদয়ের ছবি সারা মুখে আভাসিত। বড় মায়া হয়, বড় দুঃখ জাগে হাসিমের। জোহরার অনেক দুঃখ, অনেক ব্যথা, অনেক ভাবনা। একপাশে কলসী কাখে সরে দাঁড়ায় তাকে দেখে। হাসিমকে কি যেন বলতে চায়। দু’চোখে কি একটা প্রশ্ন ফুটি ফুটি করেও ডুবে গেলো। বুকের ব্যথা কি চোখের দুটো মণিতে ঝিকিয়ে ওঠে? কি আবেদন জানাতে চায় জোহরা, বোব চোখের নীরব ভাষায়? হঠাৎ কেঁপে ওঠে মাটির কলসীটা হাতের বলয় থেকে খসে পড়ে ভেঙে যায়। বমি করতে চায়। কিন্তু বমিতে উগরানো যাবে না। গলার কাছে কি একটা বাধা। কিসের বাধা হাসিমের জানা। কিন্তু জোহরা কেমন করে সে কথাটি বলবে? পারে নাকি কোনো মেয়েমানুষ? যদি পারতো রক্তবমি করতো, আগুন বমি করতো সে?

জোহরা হতভাগিনী, তার হতভাগ্যের শেষ নেই। আগে দু’বার বিয়ে হয়েছিলে। চাচা খলু দু’বারই তাকে তালাক দিতে বাধ্য করেছে। কবীরের তিন কানি জমি বিরাট হাঁয়ের ভেতর পুরে দেয়ার জন্য কবীরকেও তালাক দিয়ে দিয়েছে। কবীর কি জোহরার শোকে মরেছে? জোহরার এখন কি আছে? সে জমিকে কেন্দ্র করে মারামারিতে অমন শক্ত-সবল মানুষটা প্রাণ হারালো। নারী হৃদয়ের সমস্ত কামনা সমস্ত বাসনার অংকুরটিকে চাচা খলু আর দারোগা মিলে পিষে ফেলেছে নির্মম হাতে। দু’দিন বাদে মাথায় নেমে আসবে কলঙ্কের ডালি। জোহরার থিরথিরানো কাঁপুনিতে সবকিছু হাসিমের চোখের সামনে জেগে ওঠে। মাত্র কিছুক্ষণ, যেন পেরিয়ে গেলো কয়েক যুগ। জোহরার ভবিষ্যতে কি আছে? কি করবে সে? এখন তার হৃদয় জুড়ে প্রকাণ্ড শূন্যতা। বৈশাখের ফুটিফাটা মাঠের মতো খা খা করছে। এ বিরাট শূন্যতাকে সে কি দিয়ে ভরাট করবে? কেউ কারো সঙ্গে একটি কথা না বলে চলে গেলো। কলসীর পানিতে সারা গা কাপড় ভিজে সপসপ করছে। গমনরতা জোহরার ভিজে কাপড়ে এক ধরনের শব্দ হয়। দুঃখের মুহূর্তেও অমন সুন্দর দেখায় কেন জোহরাকে?

সেদিন নবীর দোকানে শুনলে কাদির মিয়া আর খলুর মধ্যে আপোষ মীমাংসা হয়ে গেছে। মধ্যস্থতা করেছে কানা আফজল আর জাহেদ বকসু। তিন কানি জমিকে দু’জনে আধাআধি ভাগাভাগি করে ফেলেছে। এ আপোষে সকলে খুশি হয়েছে। ছদুর বাপ তো তসবীহ্ টিপতে টিপতে বললোঃ

“আপোষ বেহেস্তের নেয়ামত। রাগ চণ্ডাল। রাগ গরি এক মুসলমান আরেক মুসলমানের লগে কথা ন কইলে শুয়র অই কবরের থুন উডিব।”

কেউ কিছু বললো না। বেশির ভাগ মানুষের বুক চিরে কি একটা শব্দ বেরিয়ে নবীর দোকানের গুমোট আবহাওয়ায় মিশে গেলো। ছদুর বাপ আরো কিছু বলতে যাচ্ছিলো। দোকানের লোকগুলোর পাষাণ কঠিন নীরবতা তাকে থামাতে বাধ্য করলো। ছদুর বুকের রক্তে রাঙিয়ে যে-পথ বেঁধেছে সে পথেই তো এসেছে কাদির মিয়া আর খলুর মধ্যে সখ্য। মানুষের জীবন এতো সস্তা? হায় রে মানুষের জীবন।

দু’দিন পরে মাতব্বরের বাড়িতে বিরাটভাবে খানাপিনার আয়োজন করা হয়েছে। পাড়ার লোকজনেরা খেতে এসেছে। খলু তার মা-বাপের নামে জেয়াফত দিচ্ছে। কথা রেখেছে মাতব্বর। জমি দখল করতে মদদ করলে তিন বেলা খাওয়াবে বলেছিলো। দখল পেয়েছে, তবে পুরো নয়। আধা আধা। সেজন্য তিন বেলার বদলে এক বেলা খাওয়াচ্ছে। তিনটা গরুর গোশতের বদলে হাটের গোশত খেয়ে গাঁয়ের লোকেদের সন্তুষ্ট থাকতে হলো।

কানা আফজল, জাহেদ বকসু এবং ইউনিয়নের আরো ভদ্রলোক এসেছে। সপ-সপের ওপর পাটি, তার ওপর সতরঞ্জি পেতে সম্মানিত মেহমানদের বসতে দিয়েছে। কাদির মিয়া, তার দু’ছেলে এবং সাতবাড়িয়া ইউনিয়ন কাউন্সিলের দু’জন মেম্বার এসেছে। মিহি গলায় কিসের যেন আলাপ করছে। যেন কতো জনমের বন্ধুত্ব। হাসিম কান পেতে তাদের আলাপ শুনে হতবাক হয়। কতো সহজে খলু মাতব্বর আর কাদির মিয়ার মিল হয়ে গেলো, ছদুর বুকের রক্ত তাদের মিলনের পথ প্রশস্ত করে দিয়েছে। গলাগলি করে যেভাবে পূর্ণিমা বাসরের আলাপ করছে, তাতে মনে হয় সারাজীবন তাদের মধ্যে টু শব্দটিও হয় নি।

আর সকলে শুধু গোত আর তরকারী দিয়ে খেয়েছে। বিশিষ্ট মেহমানদের জন্য নানা রকম তরকারী পাক করা হয়েছে। সামনে চীনামাটির ফুল আঁকা পাত্রে সবকিছু থরে থরে সাজানো। পোলাও, গোশত, তরকারী আরো কত কিছু। পোলাও পাক করার জন্য খলু আলাদা বাবুর্চি এনেছে। ম ম ঘ্রাণ ছুটছে তরকারীর। তারা বিলম্বিত লয়ে আলাপ করছে। সুস্বাদু ব্যঞ্জনে চুলের মতো সরু দুধকমল চালের ভাত গেরাসে গেরাসে মুখে তুলে নিচ্ছে। ভাতের গেরাস চিবুতে চিবুতে কানা আফজল বললোঃ

“খাইলাম একবার জামির জুড়ির রফিক সওদাগরের বাড়িত তান মাইয়ার বিয়াত। যারে কয় খানা। মুখে এহনও লাগি রইয়ে।” (খেয়েছিলাম একবার জামির জুড়ির রফিক সওদাগরের বাড়ীতে, তার মেয়ের বিয়ের সময়। যারে কয় খানা। মুখে এখনো লেগে রয়েছে।)

“রফিক সওদাগর এইবার হজে গেইয়েল না?” (রফিক সওদাগর এবার হজ্জে গিয়েছিলেন?)

জানতে চাইলো কাদির মিয়া। কানা আফজল হাঁ-সূচক জবাব দেয়।

“কোয়াল্যা মানুষ।” (ভাগ্যবান মানুষ।)

“রফিক মিয়া কোয়াল্যা নইলে কোয়াল্যা কন? গাইডের টেয়া মোডেও খরচ ন অয়। সতের ভরি সোনা আন্যে মক্কাখুন। আর ঘড়ি অন্যান্য জিনিস যা আন্যে না, হাজার চেঁয়ার মতো লাভ অইয়ে।” (রফিক মিয়া ভাগ্যবান না হলে ভাগ্যবান কে? গাঁটের পয়সা মোটেই খরচ হয় নি। মক্কা থেকে সতের ভরি সোনা এনেছে। ঘড়ি আর অন্যান্য জিনিস যা এনেছে, তাতে করে হাজার টাকা লাভ হয়েছে।)

“আল্লায় যারে দেয়, আসমানখুন ঢালি দেয়।” (আল্লাহ্ যারে দেয় আসমান থেকে ঢেলে দেয়।) মন্তব্য করে জাহেদ বকসু।

সালুনের ভাত খাওয়ার পর দৈয়ের ভাত নিয়েছে পাতে মেহমানেরা। ধোপাছড়ী থেকে আগে বায়না দিয়ে মহিষের দৈ আনিয়েছে। হাঁড়ি ভাঙলেও দৈয়ের চাক ভাঙ্গে না। চাক চাক দৈ তুলে নিয়ে ভাতের সঙ্গে মাখছে। পানি দিয়ে মেঠো করে নিচ্ছে। ভাত। চিনি মাখছে ভাতে। এমন সময় রাতের বুকে তীব্র ছুরি হেনে জেগে উঠে ছদুর মা’র বুকভাঙা কান্না।

“অ-পুতরে!”

এ অভাবিত ক্রন্দনে তারা চকিত হয়। একে অন্যের মুখের দিকে তাকায়। ভাতমাখা বন্ধ হয়ে গেছে। হারিয়ে ফেলেছে গল্পের সূত্র। কিছুক্ষণ পর আবার গেরাসে গেরাসে মুখে তুলে দেয়। মনের চিন্তাকে তারা ঢোক গিলে চাপা দিতে চায়। খলু হাত জোড় করে বলেঃ।

“বেয়াদবী মাপ গরিবান, কিছু খাবাইতে ন পাইরলাম, হুধা হাডাইলাম।” (বেয়াদবী মাফ করবেন। কিছু খাওয়াতে পারলাম না। শুধু শুধু হাঁটালাম।)

খাওয়া-দাওয়ার পরে তারা পরামর্শ করে। হাসিম শুনে। আগামীকাল কোর্টে গিয়ে সোজা দাখিল করবে। দারোগাকে টাকা দিয়ে ছদুর মা’র মামলার গোড়া কেটে দিতে হবে। দারোগা ফাইন্যাল রিপোর্ট দিলে সবকিছু শেষ হয়ে যাবে। কাদির মিয়া চালাক। এতো সহজে দারোগা যে বশ হবে না বিলক্ষণ জানে। সে সন্দেহ করেঃ

“কিন্তু দারোগারে কেনে বশ গইরগম?” (কিন্তু দারোগাকে কেমন করে বশ করবে?)

“যেনে বশ অয়।” (যেমনিতে বশ হয়।) খলু জবাব দেয়।

“অনেক টেঁয়াত দেয়ন পড়িব।” (অনেক টাকা তো দিতে হবে।)

“হ টেঁয়া কিছু ন দিলে অইব কেনে?” হে কিছু টাকা না দিলে চলবে কেমন করে?)।

“সামান্য টেঁয়ায় ত কুলাইত নয়। অনেক কেঁয়া চাইবো।” (সামান্য টাকায় তো কুলোবে না। অনেক টাকা দাবী করবে।)।

“ক্যা, পাঁচশো দিত পাইরতা নয়?” (কেন পাঁচশো টাকা দিতে পারবে না?)

“না আঁর কাছে দেড় হাজার টাকা চাইয়ে।” (না, আমার কাছে দেড় হাজার টাকা দাবী করেছে।)।

“আরে না, আই পাঁচশো টেয়া দি মিটমাট গরি ফেলাইয়ম।” (আরে না, আমি পাঁচশো টাকা দিয়ে মিটমাট করে ফেলবো।)

“কেনে?” (কেমনে?)

“হেই ওষুধ জানি। চেয়ারম্যান সাবের থুন পুছ গড়ন।” (সে ঔষধ জানি। চেয়ারম্যান সাহেবের কাছ থেকে জিজ্ঞেস করুন।)।

কানা আফজল খলুর দিকে তাকায়। দুজনেরই চোখে চোখে ভাষা বিনিময় হয়। দু’জনেই হেসে ওঠে। টাকার সঙ্গে আরো একটি জিনিসের প্রতি যে গাঢ় আসক্তি দারোগার আছে, সে কথা খলু আর চোখের ঠারে জানায়। কানা আফজল তার পিঠে হাত বুলিয়ে বলেঃ

“সাবাস খলু সাবাস, লেখাপড়া গইরলে তুই মন্ত্রী অতি।”

হাসিমের চোখের সামনে নির্মমভাবে ধর্ষিতা জোহরার ছবিটিই জেগে ওঠে। দু’দিন পরে সে তিন কানি জমিতে খলু কাদির মিয়া পাশাপাশি হাল জুতে। চৌধুরী পাড়ার লড়াইয়ের খেলায় যে ষাঁড়টাকে নিয়ে দাঙ্গা লেগেছিলো সে ষাঁড়টাকে হালে জুতেছে খলু কাদির মিয়াও তা’রটাকে। কেমন টগবগিয়ে হাঁটছে ঘাড় বাঁকিয়ে বাঁকিয়ে। খলু কাদির মিয়াকে জিজ্ঞেস করেঃ

“কি ধান দিবা, মোড়া না চিয়ন?” তার মানে সরু ধান না মোটা ধান।

“চিয়ন ধান দিয়ম। মোডা ধানের ভাত কেউ ন খায়, গাউর জন ছাড়া।” (সরু ধান দেবো। মোটা ধানের ভাত কেউ খায় না, জন-মজুরেরা ছাড়া।)।

“তুই?” (খলু কি সরু না মোটা ধান দেবে জানতে চায়।)

“চিয়ন ধান দিয়ম। আঁরও একই দশা, চিয়ন ছাড়া ন খায় কেউ।” (সরু ধান দেবো। আমারও এক দশা। সরু ছাড়া কেউ খায় না।)

হাসিম সমিতির অফিস থেকে বিল কোণাকোণি পথে আসতে আসতে তাদের কথোপকথন শোনে। ছদুর রক্ত কি শুষে নিয়েছে কুলটা মাটি! হঠাৎ আলের ওদিকে কে একজন কথা কয়ে ওঠেঃ

“না না, আঁর মোড়া ধানের জমিন। চিয়ন ধান ন ফলে। চিয়ন ধান তোরা দিত পারতি নয়। আঁই চিয়ন ভাত খাইত ন পারি। খবরদার! খবরদার!” (না, না, আমার জমি মোটা ধানের। সরু ধান ফলে না। তোরা সরু ধান দিতে পারবি না। আমি সরু ভাত খেতে পারি না। খবরদার! খবরদার!)

কবীরের বাপের বুকের পাঁজরের হাড় ক’টি গোণা যায়। পিঠে বাঁকা চাঁদের মতো স্পষ্ট জেগে আছে গরুর শিংয়ের আঘাতের দাগটা। বুড়ো আসমানের দিকে চেয়ে ফরিয়াদ করেঃ

“আল্লাহ্, আঁর পুত কবীর মিয়া–আঁর বোবা পুত তিনকানি। তুই কড়ে নিলি?” (আল্লাহ্, আমার ছেলে কবীর মিয়া আর বোবা ছেলে তিনকানি–তুমি কোথায় নিয়ে গেলে?)

আসমানের আল্লাহ্ কোথায় নিয়েছে তার ছেলে কবীর এবং বোবা ছেলে জমি। ছেলের বাপ, জমির মালিক আকাশে তার অনুসন্ধান করছে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *