৩. সওদা করার জন্যে বাজারে

হাসিম সেদিন কিছু সওদা করার জন্যে বাজারে গিয়েছিলো। কবরস্থানের পাশ দিয়ে দুপুরবেলা ঘরে ফিরছিলো। পাকা ঘাটলার কাছে কাজী বাড়ীর গোলাম কাঁদেরের সঙ্গে দেখা। বহু কালের ক্ষয়ে যাওয়া ঘাটলায় বসে কা’কে সশব্দে গাল দিচ্ছিলো কাজী গোলাম কাদের। গাল দেয়ার সময় গোলাম কাঁদেরের মুখের ভাব পরিবর্তিত হয়। ঘাড়ের ঝুলে পড়া রগের মধ্যে দুটো রগের রং লাল হয়ে যায়। কবুতরের ভাঙা বাসার মতো ভগ্ন শরীরের আবেষ্টনী ছিন্ন করে বৈদ্যুতিক তারের মতো উত্তপ্ত হৃদপিণ্ডটা বেরিয়ে আসতে চায় বুঝি! শ্বেত-শুভ্র বুকের ধার অবধি লুটিয়ে পড়া দাড়ি তরঙ্গায়িত হয়ে কেঁপে ওঠে। চোখের ঘোলাটে দৃষ্টিতে অস্বাভাবিক একটা জ্বালা ফুটে বেরোয়।

হাসিমকে দেখতে পেয়ে গাল দেয়া বন্ধ করে গোলাম কাদের। এক কানে দড়ি দিয়ে আটকানো চশমার কাঁচ মুছে হাসিমের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলোঃ

“হেইভা কন?” (ওটা কে?)।

“আঁই দাদা।” (আমি দাদা।) হাসিম বাজারের ঠোঙ্গাটা বাম থেকে ডান হাত বদল করতে করতে উত্তর দিলো।

“।কানে ন হুনি, বড় গরি ক।” (কানে শুনতে পাইনে, বড় করে বলো।)

“আঁই দাদা।” ক্ষয়ে যাওয়া ঘাটলার কাছটিতে কাজী গোলাম কাঁদেরের দৃষ্টির তলায় গিয়ে জবাব দেয়।

অবশেষে চিনতে পারায় খুশি হয় বুড়ো। দাঁতহীন মাড়ি দেখিয়ে হাসতে চেষ্টা করে। বিবর্ণ গামছাটা দিয়ে পাশের জায়গাটিতে দুর্বল অশক্ত হাতে কটা বাড়ি দিয়ে বললোঃ

“অ হাসিম মিয়া, বয়।” (ও, হাসিম মিয়া, বসো।)

বাড়িতে হাসিমের অনেক কাজ। তবু বুড়ো কাজী গোলাম কাঁদেরের অনুরোধ ফেলতে পারে না। কাজী বাড়ির গোলাম কাঁদেরের সঙ্গে হাসিমের কোথায় একটা অস্পষ্ট মিল আছে। খুবই অস্পষ্ট, শাদা চোখে ধরা পড়ে না। হাসিমকে বসিয়ে বুড়ো আবার গালাগাল দিতে থাকে।

“হারামজাদা, বেল্লিক বাঁদরের বাইচ্চা, লাথি মারি মাথার ছড় উলডায়া ফেলাইয়াম। বাদীর বাইচ্চা কন ঝাড়ত কন বাঘ আছে কইত না পারে।” (হারামজাদা, বেল্লিক বাঁদরের বাচ্চা, লাথি দিয়া মাথার ছড় উলটে ফেলবো। বাদীর বাচ্চা জানে না কোন জঙ্গলে কোন বাঘ থাকে।)

হাসিমের অসোয়াস্তি লাগে। মাথার ওপরে ঝাঁ ঝাঁ রোদ তদুপরি বুড়ো গালাগালি করার সময় তিনশ বছর আগের ইউসুফ কাজীর রক্ত শিরায় চঞ্চল হয়ে ওঠে। বাইশ গ্রামের জায়গীরদারী স্বভাব মাথা চাড়া দেয়। অথচ লোকটা অসহায় চরম অসহায়। এ অসহায়তাতে আঘাত লাগলেই বুড়ো আভিজাত্যের পুরোনো গর্তের মধ্যে ঢুকে আত্মরক্ষার চেষ্টা করে। হাসিম জানে, ওটা গোলাম কাদের বুড়োর স্বভাব। তবু তার বুকের ভেতর ঝড়ের পূর্বাভাস দেখা দেয়। শরীরের রক্ত চিনচিন করে। তাকে লক্ষ করেই যেনো বুড়ো কথাগুলো বলছে।

কাজী পরিবারের বাদীর গর্ভে সে জন্মলাভ করেছে। এ কথা কেউ যেন তাকে ভুলতে দেবে না। এমন কি, যে গোলাম কাদের বুড়ো তাকে একটু খাতির করে, বানিয়ার পুত বলে না, হাসিম বলে ডাকে– সেও এ ষড়যন্ত্রে যোগ দিয়েছে। কাজী বাড়ির গৌরব, প্রভাব প্রতিপত্তি সবকিছুর বিরুদ্ধে তার মনে ধারালো বিদ্বেষ রেখায়িত হয়। বুড়ো হরদম ঘ্যানর ঘ্যানর করে। হাসিম দেখতে পায়, একটা করুণ বিষাদময় আলেখ্য, যার সঙ্গে তার জীবন ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে গেছে এবং জড়িয়ে যাবে তার উত্তর-পুরুষের জীবন। বিরক্ত হয়ে গিয়েছিলো, চোখ মেলে দেখে বুড়োর চোখে পানি। হাসিমের মনটা গলে যায়। একটু আগের বিদ্বেষ করুণার বিগলিত ধারায় বুক ছেয়ে যায়। লজ্জিত হয়ে গোলাম কাঁদেরের দিকে মনোনিবেশ করে।

“হাসিম, তুই ক’ বাই। আঁই কি কনদিন কেউর কেচা আইলত পারা দিই-না পনা (পাকা) ধানেত মই দিই? পুত নাই, পৈতা নাই, মাইনসে আঁরে এত কিল্লাই বেইজ্জত গরে?” (হাসিম ভাই, তুমি বলো দেখি। আমি কারো কাঁচা আলে পা দিয়েছি, না পাকা ধানে মই দিয়েছি? ছেলে-পুলে নেই, তবু মানুষ আমাকে এতো বেইজ্জত কেন করে?)

হাসিম স্তব্ধ হয়ে মুখের দিকে চেয়ে থাকে। বুড়ো একটু একটু করে সবকিছু বর্ণনা করে। আজ দুপুরে চন্দনাইশের একজন লোক ছাগির দড়ি ধরে পাঁঠার খোঁজ করছিলো। খলু নাকি বলেছে গোলাম কাঁদেরের একটা জাতি পাঁঠা আছে। খলুর কথা বিশ্বাস করে গোলাম কাঁদেরের কাছে গিয়ে বলেছে, আপনার কাছে নাকি একটা জাতি পাঠা আছে। আমার ছাগিটা তিনদিন ধরে ডাকছে। দূরে যেতে হলো না, ভাগ্য ভালো। দয়া করে আপনার পাঁঠাটা একটু দেবেন কি? বাচ্চা দিলে আপনাকে দুধ দিয়ে যাবো। কাজী গোলাম কাদের বেদম খেপেছিলোঃ

“আর কাছে পড়া আছে বুলি তোরে কন্ কুত্তার বাইচ্চায় কইয়েদে?” (আমার কাছে পাঠা আছে, এ কথা তোমাকে কোন্ কুত্তার বাচ্চা বলেছে?)

কিন্তু লোকটি নাছোড়বান্দা। খলু বলে দিয়েছে, পাঁঠা চাইলে বুড়ো প্রথমে দা। হাতে কাটতে আসবে। তাতে বেজার হওয়ার কিছু নেই। মুখটা খারাপ হলেও বুড়োর মনটা ভালো। এক সময় হাসি মুখে পাঁঠা দিয়ে তোর কাজ উদ্ধার করে দেবে। বুড়োকে নাজেহাল করার জন্যে খলু মাঝে মাঝে এ ধরনের ইতরামমা করে থাকে। কেউ কিছু কিনতে এলে ক্রেতাকে বুড়োর কাছে পাঠায়। এ করে খলু এক ধরনের আনন্দ পায়। এরকমভাবে লজ্জা দিয়ে কাজী বাড়ীর সাত পুরুষের ঐতিহ্যে আঁচড় কামড় কাটে।

চোখের অনেক পানি ঝরে গেলেও শান্ত হয় না বুড়ো। বুকে আগুন জ্বলছে। শরীরের বল থাকলে খলুকে রসাতল করে ফেলতো। তার অভিশাপে ফল ফলবে না, দম্ভে কোনো কাজ দেবে না, এ কথা বুড়ো জানে– হাড়ে হাড়ে জানে। তারপর হাসিমকে একেবারে কাছে ডেকে গোপন কোনো পরামর্শ করেছে, তেমনি ফিসফিসিয়ে খলুর নতুন কাণ্ড-কাহিনীর কেচ্ছা শোনায় সবিস্তারে। শুনে হাসিম চমকে ওঠে না। গোড়াতেই আঁচ করেছিলো। কেননা জোহরার তালাক দেয়া স্বামী কবীর এখন বেঁচে নেই। তিন কানি ধানি জমি নিজের চাষে নিয়ে আসার পথে মাতব্বরের কোনো বাধা নেই। বুড়ো এবার তার দিকে তাকিয়ে নিষ্প্রভ চোখের দৃষ্টিরেখা বাগিয়ে ধরে। ত্রিকালদর্শী বিচারকের মতো মন্তব্য করলোঃ

“দেখিস হাসিম, এইবার হারামির পুত মরিব। পরের হক নয়, মরণের দারু কানত বাইন্ধ্যে। পরের ধন হরণে গতি নাই মরণে।” (দেখিস হাসিম, এবার হারামির ছেলে মরবে। পরের হক নয়, কানে মরণের ওষুধ বেঁধেছে।)

সৃষ্টির পরম সত্যটির মতো বুড়ো কথা বললো। কথা বলে খুশি হলো।

সেদিন সন্ধ্যায় দোকানে গিয়েও এ আলোচনা শুনতে পেলো। এ জমি মাতব্বরের দখল করা উচিত, সে সম্পর্কে মতও দিলো অনেকে। ছতুর বাপের বড়ো ছেলে সুলতান বললোঃ

“এই জমিনত যেই ধান পাইব, হেই ধানদি মাতব্বরের বিরাট জেয়াফত দিব, তিন বেলা খাবাইব। দুইটা গরু দিব আল্লাহর নামে।” (এই জমিতে যে ধান পাওয়া যাবে, তাই দিয়ে মাতব্বর বিরাট নেমন্তন্নের আয়োজন করবে। তিন বেলা খাওয়াবে। আল্লাহ্র নামে দুটো গরু জবাই করবে।)

জেয়াফত এবং তিন বেলা খাওয়ার নামে অনেক প্রতিবাদী কণ্ঠ নীরব হয়ে গেলো। তবু কয়েকজনের মনে খুঁতখুঁতানি রয়ে গেলো। পাড়ায় পাড়ায় ঘুরে চিকিৎসা করে যোগী পাড়ার সুধীর। অনেককে সুধীরের কাছে ঠেকতে হয়, অনেক সময় চিকিৎসা করিয়ে পয়সা দিতে পারে না। পয়সা ছাড়াও চিকিৎসা করতে পারে বলে সুধীরের জিহ্বার ধারটা কিঞ্চিত বেশি। হক কথা বলতে বাপকেও ভয় করে না। সুধীর বলেঃ

“গরু জবাই গরিল ভালা কথা, জেয়াফত দিল ভালা কথা, পাড়ার মাইনসরে খাবাইল, আরও ভালা কথা। কিন্তু পরের জমিনের ধান দিয়ে রে ক্যা?” (গরু জবাই করলো ভালো কথা, নিমন্ত্রণ দিলো ভালো কথা। পাড়ার লোককে খাওয়ালো, আরো ভালো কথা, কিন্তু পরের জমির ধান দিয়ে কেন?)

“ন বুঝিলা না, বৈদ্যের পুত নিজের জমিনের ধান বেচি মাইনসে টেঁয়া কামায়। পরের জমিনের ধানদি ছোঁয়াব কামায়।” (বুঝলে না বৈদ্যের পুত, নিজের জমির ধান বেচে টাকা জমায়, পরের জমিনের ধান দিয়ে পূণ্য সঞ্চয় করে।)

সুধীরের কথার জবাব দেয় লেদু। তারপর একটু হেসে ওঠে। মাতব্বরের ছোটো ছেলে সুলতানকে বাপের নাম করে ডেকে নিয়ে যায়। তসবীহ্ টিপতে টিপতে ছতুর বাপ ঘরে ঢুকে নতুন প্রসঙ্গের অবতারণা করে।

তার পরের দিন খলু মাতব্বর তিন ছেলেসহ বরগুইনির দক্ষিণ পাড়ের বিলে হাল জোতে। সূর্য ওঠার অনেক আগেই বাপ-বেটা তিনজনে হাল জুতেছে। সাধারণত এতো রাতে কেউ হাল জোতে না। দিনের আলোতে সাহস করেনি। তাদের দেখে মানুষের চোখে যে জিজ্ঞাসার চিহ্ন জাগবে তার কোনো সঙ্গত জবাব দিতে পারবে না বলেই বোধ হয় রাতের অন্ধকারে পরের জমিতে, পরের অধিকারে হাল চালাতে এসেছে। পূবের আকাশে শুকতারাটি দপদপিয়ে জ্বলছে। মাতব্বরের তিনটি হালের ছ’টা গরু থলো থলো পানির ভেতর পাক খেয়ে হাঁটছে। পানিতে ছলাৎ ছলাৎ জাতীয় আওয়াজ ফেটে পড়ছে। রোশন আলী যাচ্ছিলো শহরে। প্রতিদিন তরকারীর টুকরী মাথায় করে সকাল সাড়ে চারটার গাড়ী ধরে। রাস্তা দিয়ে যাবার সময় পানির আওয়াজ এবং গরু ফেরাবার বোল শুনতে পেয়ে কৌতূহল জাগে রোশনের। তরকারীর টুকরীটাসহ হেঁটে হেঁটে আলের ওপর দিয়ে কবীরের বাপের তিন কানি চরের আলের কাছে এসে থামে। কাঁচা কর্দমাক্ত আলের ওপর মাথার টুকরিটা নামিয়ে রাখে। বাপ-বেটা তিনজনে নিঃশব্দে গরু ফিরিয়ে নিচ্ছে। কারো মুখে রা নেই। আচাবুয়ার মতো দেখায় একেক জনকে। রোশন আলী হাঁ করে চেয়ে থাকে। কবীর মরেছে আজো বিশদিন হয়নি। খলু তামাক পাতার একটা মোটা চুরুট টানছে। সে আগুনে তার শয়তানের মতো মুখখানা দেখা যায়। হাল নিয়ে আলের এদিকে এলে কেউটে সাপের মতো কুতকুতে চোখে রোশন আলীকে দেখে ।

আর শহরে যায় না রোশন আলী। কাঁচা আল থেকে প্যাক মাখা টুকরিটা মাথায় তুলে নিয়ে ঝপ ঝপ করে পানি ভেঙে চলে আসে। কিছুদূর এলে তার কানে খলুর কণ্ঠস্বর আঘাত করেঃ

“মেডি আর বেডি তার, জোর আছে যার।” (মেয়ে মানুষ আর মাটি তার যার জোর আছে।)।

সাতবাড়িয়ায় রোশন আলীর বাড়ী। জমিনের গোড়া থেকে প্রায় আধ মাইল দূর। গ্রামে পৌঁছে লোকজনকে খবরটা জানায়। সদ্য পুত্রশোকে কাতর কবীরের বাপকে কেউ খবরটা দিতে সাহস করে না। তাই বুড়ো সংবাদ পেতে পেতে আকাশে সূর্য ওঠে। পড়ি মরি জ্ঞান না করে ষাট বছরের বুড়ো দুর্বল শরীর নিয়ে লাঠি ভর করে হাঁটতে থাকে। ডানে বামে না চেয়ে এক নাগাড়ে কিসের ওপর দিয়ে হেঁটে এলো সে হুঁশ নেই। তিন কানির চারদিকে পথের মতো বড়ো আলের ওপর এসে বসলো। খলু আর তার ছেলেরা বুড়োর দিকে একবারও ফিরে তাকালো না পর্যন্ত। নির্বিকারভাবে গরু খেদিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। অনেক রাতে হাল জুতেছে। প্রায় এক চাষ দেয়া হয়ে গেলো। জোয়ান গরু, জোয়ান মানুষ। চন্দ্রপুলী পিঠের মতো স্তরে স্তরে পলিময় মাটি। ধারালো তিনখানা লাঙলের কতোক্ষণ লাগে।

বুড়োর ছেলে গেছে। ছেলের বউ গেছে, জমিটাও যেতে বসেছে। আলের ওপর বসে অনেক কথাই মনে পড়লো। সে বছর তিলের বেপার করতে শঙ্খ উজান গিয়েছিলো। উজানের উঁচু পাহাড়ে ওঠবার সময় গড়িয়ে নীচে পড়ে যেতে যেতে শিমুল গাছের শেকড় ধরে আত্মরক্ষা করেছিলো। বুকের কাছে চোট লেগেছিলো। পনেরো দিন বিছানা থেকে উঠতে পারে নি। সে বছরই তিল বেপারের লাভের টাকা দিয়ে এ জমি কিনেছিলো হরিদাস মহাজনের ছেলের কাছ থেকে। তারপরে আর কোনোদিন উজানে বেপারে করতে যায়নি। এ জমিতে চাষ করেছে। ফলিয়েছে ফসল। ধান বেচে টাকা জমিয়ে বিয়ে করেছে। তরমুজ বেচে সোনার নাকফুল কিনে দিয়েছে বৗকে। ছেলে হয়েছে। ছেলে বড়ো হয়েছে। গায়ে কাঁচা সোনার মতো রঙ হয়েছে। চাষী গেরোস্তের ঘরে অমন সুন্দর গায়ের রঙ সচরাচর দেখা যায় না। ছেলেকে বিয়ে করিয়েছে। ছেলের বউ এসেছে, বেঁধেবেড়ে খাইয়েছে। অজু করবার পানিভরা বদনা এগিয়ে দিয়েছে। শাশুড়ীকে প্রাণপণ সেবা করেছে। ছেলের মা মারা গেলো। সে সময়ও তরমুজ বেচা পয়সায় কেনা সোনার নাকফুলটা জ্বলজ্বল করছিলো নাকে। তারপর ছেলের বউও গেলো। তারপর… বুকে হাতুড়ি পেটার শব্দ হয়। বুকের ভেতর জলোচ্ছ্বাস জাগে, বুকের তলায় আগুন জ্বলে। ছোটো ছোটো কোটরাগত চোখ দুটোর চার পাশে বিন্দু বিন্দু শিশির জমে… জমতে থাকে। জমাট শিশিরে আকাশ পৃথিবী ছেয়ে যায়। বুড়ো কিছু দেখতে পায় না। স্থাণুর মতো কাঁচা আলের ওপর লেপ্টে বসে আছে। দুঃখ আর বয়সের ভারে পৃথিবী তখন সেঁধিয়ে যাচ্ছে বুঝি মাটির ভেতর।

“চাচা, কি ধান দিবা?” ছতুর বাপের বড়ো ছেলে সুলতান, পেছনে আরো দশ বারোজন লেঠেলসহ এসে জিজ্ঞেস করে। সকলের হাতে লাঠি। সাতবাড়িয়ার মানুষ খলুকে জমি চষতে বাধা দিতে পারে। সে আশঙ্কা করে সুলতান লাঠিসোটা আর সাঙ্গোপাঙ্গো নিয়ে একেবারে তৈরি হয়ে এসেছে। কবীরের বাপ সুলতানের কথায় জ্ঞান ফিরে পায়। কি দেখছে? কি ভাবছে? তেজী গরু সিনা আলগা করে পানির ওপর ঝপঝপিয়ে হাঁটছে। লাঠি হাতে অনেক মানুষ দাঁড়ানো। ওদের চোখে মুখে ক্রুরতা! সকালের শিশু সূর্য লাফিয়ে লাফিয়ে ওপরে ওঠছে।

“ভাইপুত চিন্নাল ধান দিয়ম। কেন অইব?” [ভাতিজা ভাবছি চিন্নাল ধান (এক রকমের ধানের নাম) দেবো। কেমন হবে? জানতে চায় সুলতানের মতামত। সুলতান মাথা নেড়ে জবাব দেয়ঃ

“ছোডো ধান খুব ভালা অইব চাচা।” (হা, সরু ধান খুব ভালো হবে চাচা!)

হঠাৎ কবীরের বাপ গোত্তা খাওয়া বাঘের মতো ফুঁসে ওঠে। চোখের চারপাশ থেকে বিন্দু বিন্দু শিশির অন্তর্হিত হয়ে যায়। গা ঝাড়া দিয়ে দাঁড়ায়। তার নিজের অধিকারের ওপর হাত দিয়েছে। যতোই দুর্বল হোক সে, সহ্য করবে না।

“না, আর জমি মোড়া ধানর। ক্যারে চিয়ন ধানর চাষ গইরতাম দিতাম নয়।” (না, আমার জমিন মোটা ধানের, কাউকে চিকন ধানের চাষ করতে দেবো না।)

চোখের পলকের মধ্যে একেবারে আগের হালের সামনে জলকাদার ওপর শুয়ে পড়লো। আগের হালের পেছনে লাঙলের গুটি ধরে আসছিলো খলু মাতব্বর। ঘটনার আকস্মিকতায় সুলতানসহ সকলে স্তম্ভিত হয়ে দাঁড়ালেন। খলুর এতে ভাবান্তর নেই। পলিমাটির বুক চিরে চিরবিরিয়ে লাঙল টেনে, দুর্ধর্ষ ষাড় জোড়া ঘার বাঁকিয়ে পলটনের ঘোড়ার মতো চলছে। গতির মুখে বুড়োকে শায়িত দেখে কালো গরুটা গলা নীচু করে বুড়োর ঘাড়ের নীচে লম্বা শিং দিয়ে একটা ঘাই দিলো। বুড়ো ‘মা রে বাপরে’ বলে উঠে দাঁড়াতে পিঠের ঝুলে পড়া চামড়ায় তীক্ষ্ণ বাঁকা দীর্ঘ শিং ঢুকিয়ে দিলো। বুড়োর শরীরের শাদাটে মাংস বেরিয়ে পড়লো। কয়েক বিন্দু রক্ত চুঁইয়ে চুঁইয়ে ঝরতে থাকে। খলু বলে সুলতানকেঃ

“ভাইপুত, এই বেকুবরে পাথারি কোলা গরি রাস্তার উয়র রাখি আয়।” (ভাতিজা, এই বেকুবকে পাঁজাকোলে করে, রাস্তার উপর রেখে এসো।)

সুলতান বুড়োকে পাঁজাকোলো করে রাস্তার ওপর রেখে আসে। বুড়োর পিঠ এবং ঘাড় থেকে সুলতানের হাতে, গেঞ্জিতে ও লুঙ্গিতে রক্ত লাগে। রক্তাক্ত হাতে মুখ মুছে। ছোপ ছোপ রক্ত লাগে মুখে। খুনীর মতো দেখায় সুলতানকে। কবীরের বাপ কঁকায়। কঁকিয়ে আল্লাহর আরশের উদ্দেশ্যে বলেঃ

“আল্লাহ্ আঁর বোবা পুত, আঁর বোবা ছাওয়াল।” (আমার বোবা ছেলে।)

বুড়োর কথা কওয়া ছেলেকে যম নিয়ে গেছে। আরেকটি বোবা ছাওয়াল ছিলো। কথা কয় না। চাহিদা মতো ধান দিতো, মরিচ দিতো। কালো হীরে মাটি তার বোবা ছাওয়াল। বুড়ো হাড়ের সর্বশক্তি দিয়ে বোবা ছাওয়ালকে আঁকড়ে ধরে রাখতে চেয়েছে। কিন্তু পারে নি। ঘাড়ের কাছে রক্ত, পিঠে রক্ত, বুকের ক্ষত চুঁইয়েও বুকের ভেতর ঝরছে রক্ত। তবু বুড়ো চীৎকার করেঃ

“আল্লাহ্, আঁর বোবা ছাঁওয়াল।”

এক চাষ দেয়া হয়ে গেলে গরুকে জোয়ালমুক্ত করে হাল লাঙল কাঁধে ফেলে লেঠেলদের নিয়ে চলে গেলো খলু।

কয়েকটা দিন পার হয়ে গেলো। ইতিমধ্যে উল্লেখযোগ্য কিছু ঘটে নি। বরগুইনির পাড়ের পাশাপাশি দুটো গ্রাম কেমন ঝিম্ মেরে আছে। অথচ এ নীরবতার মধ্যে আবর্তিত হচ্ছে কুটিল একটা চক্রান্ত। সাত বাড়িয়ার মানুষ ব্যাপারটাকে সহজভাবে নিতে পারবে না, খলু মাতব্বর আগেই সে আশঙ্কা করেছিলো। তবু পুরোপুরি ওয়াকেবহাল হবার জন্যে খলু মাতব্বর মকবুল মস্তানের ছেলে ফয়েজ মস্তানকে মাগুর মাছের মাথা আর লক্ষীবিলাস চালের গরম ভাত বেঁধে খাইয়ে আসল খবর সংগ্রহ করার জন্যে সাতবাড়িয়া পাঠিয়ে দিলো।

ফয়েজ মস্তান মানুষ। সুতরাং তার পথ অটকায় কে? এককালে অনেকেই তার বাপের মুরীদ ছিলো। পীর মুর্শীদের প্রতি টান উঠে গেলেও অনেকে ফয়েজকে এখনো সমীহ করে। অবশ্য তারা বুড়োবুড়ি। হাল জমানার চ্যাংড়ারা ফয়েজকে পরোয়া করে না।

সন্ধ্যাবেলায় ফয়েজ খবর দিয়ে গেলো। মাগুর মাছের মাথা এবং চিকন চালের ভাতে বেশ কাজ দিয়েছে। ফয়েজ এক্কেবারে পাকা খবর দিয়ে গেছে।

গেলো ফাল্গনের আগের ফাল্গনে গরুর লড়াইয়ে কাদির মিয়ার ছেলের সঙ্গে মাতব্বরের ছেলের মারামারি হয়েছিলো। কাদির মিয়ার গরুর সঙ্গে গরুর লড়াই দিয়েছিলো চৌধুরী পাড়ার খোলায়। মাতব্বরের গরু আঁটতে না পেরে হেঁটে যাচ্ছিলো। আরেকটু হলেই হটে যেতো। নিজের গরুকে পরাজিত হতে দেখে মাতব্বরের ছেলে আবদুল বেপরোয়াভাবে কাদির মিয়ারটাকে কেরেক বেত দিয়ে মারতে থাকে। কাদির মিয়ার ছেলেও রেগে তেড়ে এসে আবদুলকে মেরেছিলো। দু’দলে লাগলো দাঙ্গা। কাদির মিয়ার ছেলেরা সংখ্যায় বেশি ছিলো না। তাই একেবারে ঘেঁচে পানি করে দিয়েছিলো। গরু কেড়ে রেখেছিলো। খলুর ছেলের কাছে তার ছেলে মার খেয়েছে একথা হাকিমের কাছে স্বীকার করতে হবে, সে বড় লজ্জার কথা। সে জন্যে কাদির মিয়া মামলা করেনি। নীরবে নীরবে সুযোগের সন্ধান করছিলো। এতদিন পরে সুযোগ মিলেছে।

খলুকে উচিত শিক্ষা দেওয়ার জন্যে বিনামার তারিখের আগের স্ট্যাম্প কালোবাজার থেকে যোগাড় করে সদর রেজিস্ট্রি অফিসে গিয়ে কবীরের বাপের সে তিনকানি জমি আগের তারিখ দিয়ে কবলা করে নিয়েছে। সবকিছু ঠিকঠাক করে ওঁত পেতে বসে আছে। বাপ বেটাকে পেলে একসঙ্গে কেটে কুচি কুচি করে বরগুইনির পানিতে ভাসিয়ে দেবে।

খবর পেয়ে খলু তড়িঘড়ি কাজীদের বড় পুকুরে মাছ ধরতে জাল নামিয়ে দেয়। খলু পুকুরটা দু’বছর আগে খাসমহাল থেকে পানির দামে নীলামে খরিদ করেছে। দুটো বড় কাতলা মাছ ধরে। ঘর থেকে সরু কমল চিকন চাল, সে অনুপাতে তেল ডাল তরকারী দিয়ে একটা মাছ তহশীলদার সাহেবের বাসায় এবং অন্যটা পাঠিয়ে দেয় কানা আফজলের বাড়ি। এককালের কাজী রহমতের ভাবশিষ্য এবং দুষ্কর্মের সঙ্গী কানা আফজল বর্তমানে আফজল আহমদ চৌধুরী। ইউনিয়ন কাউন্সিলের চেয়ারম্যান।

তহশীলদার যদি খাসমহলের কাগজপত্রে সবকিছু ঠিক করে রাখে, কাদিরার বাপের কি সাধ্য তাকে বেদখল করে। তবু আসতে পারে আপদ-বিপদ। সেজন্য বুদ্ধি করে চেয়ারম্যান কানা আফজলের মুখ বন্ধ করে রাখলো। মেম্বার চেয়ারম্যান পক্ষে থাকাটা খুব ভাগ্যের কথা। বিপক্ষে গেলে রক্ষে নেই। ডালি না পেলে, জানা কথা, বিপক্ষে যাবে। শালারা গুখোরের জাত। মার কানের সোনা চুরি করতে কসুর করে না। পাঁঠাপাঠির ভেদ তাদের কমই আছে। গ্রামের মানুষদেরকেও স্ববশ করেছে। ছতুর বাপ মুসুল্লী মানুষ, তার কথা দশজনে শোনে, মান্য করে। দাওয়াত করে গলা পর্যন্ত আছুদা করে খাইয়েছে। এখন পষ্টাপষ্টি বলে ছতুর বাপ। বিনামা নেই শরীয়ত মতে… বিনামা মানেই কবলা। জোহরার কাছে সাফ-কবলা দিয়ে বেচে দিয়েছে কবীরের বাপ। জোহরার হক… সে তিনকানি সম্পত্তি। বর্তমানে মাতব্বর জোহরার গার্জিয়ান…। সুতরাং খলু মাতব্বরের ও জমিতে হাল চষতে শরীয়তের কোন বাধা নেই। কেউ বেদখল করতে চেষ্টা করলে গোটা গাঁয়েরই বেইজ্জতি। মুর্গীর রান খেয়ে ছতুর বাপের মুখ দিয়ে এখন জজবা ছুটছে। আপাতত তসবীহ টেপা বন্ধ রেখে কবীরের জমি যে খলু মাতব্বরের হক যত্র তত্র সে কথা প্রচার করে বেড়াচ্ছে। মকবুল মস্তানের ছেলে ফয়েজ মস্তান। সে তো বলতে গেলে, ঘরের কুত্তা-বিলাইর সামিল। তু তু করে ডাকলে এসে লেজ নাড়বে, হেই বললে চলে যাবে। আগে দু’বেলা আদালতে মিছা সাক্ষী দিয়েও পেটের ভাত যোগার করতে পারতো না। খলু-ই তো একক প্রচেষ্টায় মসজিদের ইমাম মুয়াজ্জিন দুই-ই করেছে। তাকে। এখন যে গায়ে লম্বা কোর্তা ঝুলায়, চেহারায় যে জৌলুস বেড়েছে, দু’দুটো বিয়ে করেছে-এর মূলে কি খলু মাতব্বর নয়? ঠোঁট বেয়ে একটা লতানো হাসি জাগে এক সময়ে। সশব্দে উচ্চারণ করেঃ

“হালার পুত কাদিরা।”–(শালার পুত কাদিরা–)।

কাঁচা ছেলে খলু নয়। লাঠিতে হলে আসো। মামলা-মোকদ্দমা করে ভদ্রলোকের পরিচয় দিতে চাও–সেও আসো। খলু পথের ভিখারী নয়। মাথায় বুদ্ধি, গাঁটে কড়ি–দুই-ই তার আছে। গোলায় এখনো চার বছরের বিন্নি চিকন ধান মজুত আছে। যে ভাবেই যুদ্ধ করতে চাও, আসো। খলু পিছু হঠার মতো মানুষ নয়। কোনো জিনিসে নজর দিয়ে পিছু হটে না খলু কোনোদিন। মরদের মতো জান বাড়িয়ে লড়তে জানে।

“তুমি খড়গ ধারিলে আমি খৰ্গধারী
তুমি যদি পুরুষ হও আমি ই নারী।”

পুঁথির মজলিসে শোনা পদ্মাবতীর কাহিনীর রাজা রত্নসেনের উক্তিটি মনে মনে কয়েকবার আওড়ালো। সবকিছু ঠিকঠাক। বিধাতার অন্তরের গোপন আকাঙ্খার মতো নিখুঁত পরিকল্পনা খলুর। তবু মনের ভেতরে একটা সংশয় দোলা দিয়ে যায়। ভবিষ্যতকে কিসের বিশ্বাস। খলুর মতো অমন ধড়িবাজ মানুষও আশঙ্কায় শঙ্কিত হয়ে ওঠে। ধীরে ধীরে পায়চারী করে। মাথার তালুতে উত্তাপ জমে।

দু’চারদিন পর দু’গ্রামে ছড়িয়ে পড়লো প্রবল সংক্রামক উত্তেজনা। ডরে এ গ্রামের মানুষ ও গ্রামের ওপর দিয়ে যায় না। মাতব্বরের ভাতিজা রমজু এসবের কিছু জানে না। সে বরকল গ্রামে শ্বশুর বাড়িতে ঘরজামাই থাকে। বাপের ভিটেতে সাতবাড়িয়ার ওপর দিয়ে বেড়াতে আসার সময়, সাতবাড়িয়ার মানুষ মেরে আধমরা করে দিয়েছে। রমজুর সঙ্গে খলুর সদ্ভাব ছিলো না। খলু ভেবেছিলো ভাতিজা নাম মাত্র দামে ভিটেটুকু কবলা করে দেবে চাচাকে। রমজু কিন্তু উচিত দামে জাহেদ বকসুর কাছেই ভিটে বেচে খাল কেটে কুমীর এনে দিলো। অন্য কেউ হলে বেদখল করে দিতে। জাহেদ বকসুরা পাঁচ ভাই আর গ্রামের নতুন ধনী। খলুর জারিজুরি চালাকী তাদের কাছে চলবে না। বাধ্য হয়েই চুপ করে রইলো। কিন্তু আজকে কাদির মিয়ার মানুষের হাতে বেদম মার খাওয়া ভাতিজার জন্য খলুর দরদ উথলে উঠলো। পাড়ার লোকে দূর ভিন গ্রামে চলে গেলেও রমজুকে ভালোবাসে। এ সুযোগেই খলু গ্রামের লোককে এক জায়গায় জড়ো করলো। গ্রামের দশজনকে ডেকে এনে ঘটনাটা সবিস্তারে বর্ণনা করলো। ছতুর বাপ, কানা আফজল, ফয়েজ মস্তান সকলে এসেছে। আর এলো গ্রামের যুবকেরা… যাদের লেঠেল রক্ত ছলকে ছলকে গরম হয়ে যায়। এ কথা সে-কথা… কাদির মিয়াকে খুব এক চোট গালাগাল দেওয়ার পর সকলে মূল কথা আলোচনা করতে লাগলো। কিভাবে এ অন্যায়ের বদলা নেয়া যায়। এ বদলা নিলে গ্রামের ইজ্জত হুরমত বজায় থাকে না। কুয়ত কি শুধু তাদের বাহুতে? হিম্মত কি শুধু তাদের বুকে? গাছবাড়িয়ার যুবকেরা কি মরে গেছে? তাদের লহু কি ঠাণ্ডা হয়ে গেছে? তারা কি শোধ নিতে জানে না? ছতুর বাপ দু’হাতে দাঁড়ি মুঠো করে একাধিক দাঙ্গার কথা বললো। সে সকল দাঙ্গায় সাতবাড়িয়ার মানুষ কি মার খেয়েছিলো, সে কথাও বললো। কানা আফজল আশ্বাস দিলো। ওসব কাজে বুকে হিম্মত আর মাথা ঠিক রেখে ঘাড়ে দায়িত্ব নিতে হয়। সে আশ্বাসে গ্রামের যুবকদের রক্ত চাড়া দিয়ে ওঠে। প্রতিশোধের নেশায় তারা পাগল হয়ে যায়। গ্রামের সব চাইতে শক্তিমান, সেরা দাঙ্গাবাজ যুবক ছদু মন্তব্য করলোঃ।

“আঁরা কাদিরা চোরার নাহান চুরি গরি মাইরতাম নয়। খবর দেও। সামনাসামনি দাঙ্গা গইরগম–তারপর খানকীর পুতের মাথা কাডি লইয়ম।” (আমরা কাদিরা চোরার মতো চুরি করে মারবো না। খবর দাও, সামনাসামনি দাঙ্গা করবো। তারপর খানকীর বাচ্চার মাথা কেটে নেবো।)

স্থির হলো সামনাসামনি দাঙ্গা করার জন্য কাদির মিয়াকে খবর দেওয়া হবে । দু’পক্ষে যথারীতি খবর চালাচালি হয়ে গেলো। আগামী সোমবার দাঙ্গার দিন ধার্য হয়েছে। দু’দিন ধরে সারা গ্রামের কারো চোখে ঘুম নেই। কিরীচ শানাচ্ছে। কামার বাড়িতে পিটিয়ে বর্শার মুখ ছুঁচলো করে আনছে। মেয়েরা রাত জেগে কেঁকিতে পাড় দিয়ে মরিচের মিহি গুঁড়ো তৈরি করছে। বাঁশ ঝাড় থেকে লাঠি কেটে জুতসই করছে। খলুর মেটে দেওয়ালের বৈঠকখানায় দিনে-রাতে মিটিং চলছে। নতুন নতুন পরামর্শ হচ্ছে। কৌশলের কথা চিন্তা করা হচ্ছে। রোববার দিন বিকালবেলা খলুর বড়ো ছেলে হাজারী হাটে গিয়ে একটা গোটা গরুর গোশত্ কিনে নিয়ে এলো। আগামীকাল দাঙ্গা করতে যাবার আগে লেঠেলদেরকে গোশত্ দিয়ে ভাত খাওয়াবে।

রাতে খলুর বৈঠকখানায় চাপা আলোচনা চলছে। মনির আহমদ, হিমাংশু ধর, মান্নান প্রভৃতি চার-পাঁচজন মাতব্বরকে ডাকতে ডাকতে বৈঠকখানায় এলো। এরা কৃষক সমিতির মানুষ। দেখে মাতব্বর স্পষ্টত বিরক্ত হয়েছে। নিশ্চয়ই কোনো উদ্দেশ্য নিয়ে তারা সদলবলে এসেছে। এই কৃষক-সমিতিই মাতব্বরের লাভজনক বহু অভিসন্ধিকে ভণ্ডুল করে দিয়েছে। মফিজার মার ভিটাটুকু বলতে গেলে খলু একরকম পানির দামেই কিনে নিয়েছিলো। কিন্তু মনির আহমদই চাঁদা তুলে মফিজার মা’র মেয়েটাকে বিয়ে দিয়ে দেয়। ফলে চৌদ্দশতক অমন ফলন্ত সুপুরির বাগান নিজ দখলে আসি আসি করেও এলো না। মাথা খাঁটিয়ে কিছু লাভের কাজ করতে চাইলে পারে না। এরা কোত্থেকে এসে বাধা দেয়। শহর-বন্দর চেনে। আইন-আদালত বোঝে। পত্রিকার কাগজে কি সব লেখালেখি করে। কিছুদিন আগে ওপরে টিপসই দিয়ে দরখাস্ত পাঠিয়ে খাসমহালের তহশীলদারকে জেলে পাঠিয়েছে। লোকটা একদম বিনামূল্যে চরের দু’পাশের জমি বন্দোবস্ত দিতে চেয়েছিলো। বাতির স্বল্প আলোকে মনির আহমদের মুখের দিকে তাকিয়ে মনের ভাবখানা জেনে নিতে চেষ্টা করে। মনির আহমদ কোনোরকম ভূমিকা না করেই বললোঃ

“হুইনলাম খলু চাচা, তোঁয়ারা দাঙ্গা গরিবার লাই তৈয়ার অইয়ো। আঁরা আস্যিদে মীমাংসার লায়। কি লাভ চাচা মারামারি কাড়াকাডি গরি? তারথুন মীমাংসা বউত ভালা। তারপরে কোর্ট-কাঁচারীতে দৌড়ন লাগিব। তিন কানির লায় দশকানির টেঁয়া খরচ গরন লাগিব।” (শুনলাম খলু চাচা, তোমরা দাঙ্গা করবার জন্য তৈরি হয়েছে। আমরা এসেছি মীমাংসার জন্য। মারামারি কাটাকাটি করে কি লাভ? তার চেয়ে মীমাংসা খুব ভালো। কোর্ট-কাঁচারীতে দৌড়াতে হবে। তিনকানির জন্য দশকানির টাকা খরচ করতে হবে।)

“তেঁরা কন মীমাংসার কথা কইবার? তোরা কি গেরামর মেম্বর-চেয়ারম্যান?” (মীমাংসার কথা বলবার তোমরা কে? তোমরা কি গ্রামের মেম্বার চেয়ারম্যান?)

“আঁরা সমিতির মানুষ চাচা।” (আমরা সমিতির মানুষ চাচা।) জবাব দিলো মনির আহমদ।

“তোরার সমিতি ভরে আঁই মুতি, দুত্তোর সমিতি। মীমাংসার কথা কইলে কইব চেয়ারম্যান সা’ব।” (তোমাদের সমিতিতে আমি প্রস্রাব করি, দুত্তোর সমিতি। মীমাংসার কথা বললে বলবে চেয়ারম্যান সাহেব।)

এরপরে আর কথা বলা যায় না। সকলে সুর সুর করে বেরিয়ে আসে। আকাশে অষ্টমীর চাঁদ জেগে আছে। পৃথিবী সুপ্তিমগ্ন, গভীর প্রশান্তিতে মৌন সমস্ত চরাচর। সমিতির কর্মীরা কানভরে গভীর পৃথিবীর পাঁচালী শুনে যেন। খলু মাতব্বরের বৈঠকখানায় চুপি চুপি নরহত্যার মন্ত্রণা চলছে।

পরের দিন বরগুইনির দু’পাড়ের দু’গ্রামের মানুষ খুব সকালে শয্যাত্যাগ করে। আজকের দিন ভয়ঙ্করের বার্তা নিয়ে এসেছে। গাছবাড়িয়ার জোয়ানেরা সকলে মাথায় লাল পাগড়ী বেঁধে মাতব্বরের উঠোনে সমবেত হয়েছে। একটু পরেই সকলে খেতে বসলো। সপের দু’ধারে সার সার মাটির সানকী। এমন সময় হাসিমের খোঁজ পড়লো। হাসিম আসেনি। এতো বড়ো বুকের পাটা বানিয়ার পুতের? পাড়ায় থাকবে অথচ দশজনের কাজে আসবে না। তড়াক করে লাফিয়ে ওঠে ছদু। গর্বিত পদক্ষেপে হাসিমের উঠোনে এসে হাঁক দেয়ঃ

“বান্যিয়ার পুত, এই বান্যিয়ার পুত।” (বেনের ছেলে, এই বেনের ছেলে।)

বারবার ছদুর অসহিষ্ণু কণ্ঠস্বর বেজে ওঠে। হাসিম কালকের রাখা পান্তাভাত খাচ্ছিলো। ডাক শুনে বাইরে এসে ছদুকে দেখে মুখের কথা মুখে আটকে থাকে। হাতে লাঠি, মাথায় লাল কাপড়ের পাগড়ী। অন্তরটা পর্যন্ত শিউরে ওঠে। কোনো রকমে জিজ্ঞেস করে, কথাগুলো জড়িয়ে যায়ঃ

“কি মামু?” (কি মামা?)

“কুত্তার বাইচ্চা যাতি নয়? (কুত্তার বাচ্চা, তুই কি যাবি না?)

“মামু আঁর শরীর ভাল না।” (মামা আমার শরীর ভালো নয়।)।

সুফিয়া ছদুর উগ্রমূর্তি দেখে ভয় পায়। তাড়াতাড়ি বেরিয়ে একখানা সিঁড়ি এগিয়ে দেয়।

“মামু বইয়ো।” (মামা বসো।)

ছদু পিঁড়িটাকে লাঠি দিয়ে উলটিয়ে ফেলে। ঠকঠক কাঁপা পা দুটো জোড় করে ছদুর ভয়ঙ্কর মূর্তির সামনে একান্ত বশংবদের মতো দাঁড়িয়ে থাকে। সুফিয়া দু’হাতে ছদুর পা দুটো জড়িয়ে ধরে।

“মামু, জ্বরতথন উইঠ্যেদে আজিয়া মোডে চারদিন। ঠ্যাংগর ফুলা ন কমে। মামু তুই ন বাঁচাইলে কেউ বাঁচাইত পাইরত নয়।” (মামা, জ্বর থেকে উঠেছে আজ মোটে চারদিন। পায়ের ফোলা কমে নি। তুমি না বাঁচালে কেউ বাঁচাতে পারবে না।)

এ অবস্থার জন্য ছদু তৈরি ছিলো না। হাসিমকে কানে ধরে হিড়হিড় করে টেনে নিয়ে যেতে এসেছিলো। পদতলে শায়িতা রোরুদ্যমানা রমণীর আকুতিতে তার ভেতর একটু করুণার সঞ্চার হলো। মনের দৃঢ় সংকল্প কেমন যেন নেতিয়ে পড়লো। ভাবে, মোটাসোটা হলে কি হবে, বান্যার জাত তো। বাপের আমলে মুসলমান হয়েছে। রক্তে হিম্মত না থাকারই কথা। খুন-খারাপীকে জব্বর ডরায়। হাতের লাঠিটা ঘুরিয়ে হাসিমকে একটা বাড়ি দিয়ে বৃথা সময় নষ্ট না করে চলে গেলো।

খলু মাতব্বরের বৈঠকখানা ঘরে আট-দশজন মৌলানা সুর করে কোরআন শরীফ তেলাওয়াত করে। দাঙ্গা শেষ না হওয়া পর্যন্ত করতে থাকবে। মেয়েরা হাতের খাড় এবং নাকের নাকফুল খুলে ফেলেছে। তারা রাড়ীর বেশ ধারণ করেছে। স্বামী-পুত্র যদি আর ফিরে না আসে। লেঠেলরা কলেমা পাঠ করে। লাল পাগড়ী পরা মানুষগুলো ‘আলী আলী’ রব তুলে লাঠি বর্ষা হাতে বরগুইনির চরে যাত্রা করলো।

ঠিক জোহরের নামাজের পরে তারা রক্তাক্ত কলেবরে ফিরে এলো। অনেকেই আহত। কারো মাথা ফেটে গেছে, হাত ভেঙ্গেছে কারো। মাতব্বরের ছেলে আবদুল চোখ খুলতে পারছে না। তারে চোখের ভেতরে কাদির মিয়ার লোকদের ছড়ানো মরিচের গুঁড়ো ঢুকেছে। স্থির হয়ে দাঁড়াতে পারছে না, অস্থির যন্ত্রণায় নাচানাচি করছে। মাতব্বরের বাহুমূল থেকে ফিনকি দিয়ে রক্ত ছুটছে। সবচেয়ে বেশি চোট লেগেছে ছদুর। বিপক্ষ দলের মানুষেরা তাকে ঠেঙিয়ে সংজ্ঞাহীন করে ফেলেছে। গ্রামের সবচেয়ে সবল যুবা, সবচেয়ে দুঃসাহসী, গ্রামের মান-ইজ্জতের সঙ্গে শিরার শোণিত-কণিকার অচ্ছেদ্য সম্বন্ধ ছিলো যার– সে ছদুকে মারতে মারতে সংজ্ঞাহীন করে ফেলেছে; সে-ই তো প্রথমে বিপক্ষ দলকে পেছনে ঘুরে আক্রমণ করেছিলে। একজনকে বর্শার ঘায়ে উরুর কাছটিতে এফোঁড় ওফোঁড় করে ফেলেছিলো। ছদুর পেছন পেছন গাছবাড়িয়ার ওরা গিয়ে বিপক্ষ দলের ওপর এলোপাতাড়ি মার শুরু করেছিলো। সহ্য করতে না পেরে তারা পালিয়ে আত্মরক্ষা করেছে। ছদু টেকে বাঁকে বর্শা হাতে তাদের পেছন দিক থেকে তাড়া করতে করতে যখন বরগুইনির পানিতে এসে নেমেছে তখনই তারা সুযোগ পেয়ে চলে গেলো। একটু পানি নাকি চেয়েছিলো। কে একজন মুতে তাকে পান করতে দিয়েছে। কে কাকে দেখে, সকলেই আহত। লেগেছে সকলের। মা-বোন স্ত্রী পুত্র লক্ষ্য করেছে। খলু মাতব্বরের উঠোনে চ্যাংদোলা করে এনে রেখেছে ছদুকে। খালের পানির মতো রক্ত ছুটছে বলকে বলকে। হাফেজ ডাক্তার প্রাণপণ চেষ্টা করেও বন্ধ করতে পারছে না।

মাতব্বর বাহুমূলে একটি পট্টি জড়িয়ে সিন্দুক খুলে টাকা নিলো। তারপর ছদুসহ অন্যান্য আহতদের নিয়ে ছুটলো৷ এজাহার করার পর অন্যান্য আহতদের থানা হাসপাতালে পাঠিয়ে দিলো।

দু’পক্ষ এজাহার করেছে। সন্ধ্যার দিকে গ্রামে পুলিশ এলো। মনে মনে মাতব্বর বেজায় খুশি হয়েছে। তার পক্ষের মানুষেরা জখম হয়েছে বেশি। কারো কারো অবস্থা সঙ্কটজনক। সুতরাং মামলা তার পক্ষে যাবে। এখন চেয়ারম্যান সাবকে খবর দিয়ে বড়ো দারোগাকে সন্তুষ্ট করতে পারলেই হলো। একটু পরেই বাঁকা লাঠিটা হাতে নিয়ে চেয়ারম্যান সাব এলো। ইজিচেয়ারে হেলান দিয়ে বসে পা নাচাচ্ছে দারোগা। পাশে একখানা টিনের চেয়ার টেনে নিয়ে চেয়ারম্যান কানা আফজল বসলো। দারোগার সঙ্গে অনেকক্ষণ ধরে ফিসফাস আলাপ করলো। খলুকে ডেকেও কানে কি বলে দিলো।

সন্ধ্যা হয়ে এলো। চেয়ারম্যান সা’ব চলে গেলো। খলু জোড়হাতে চেয়ারম্যান সা’বকে, দারোগা-পুলিশদের সঙ্গে দু’মুঠো খেয়ে যেতে অনুরোধ করলো। এর প্রতিক্রিয়া ভালো হবে না সে কথা চেয়ারম্যান সাব খুলুর কাছে ব্যাখ্যা করলো। ঘরের খাসী জবাই করে দারোগা-পুলিশকে আচ্ছা করে খাওয়ালো। রাতের বেলায় আসামী ধরার জন্য পুলিশেরা সাতবাড়িয়া চলে গেলো।

মাতব্বরকে নানা দিক দেখতে হয়। বড়ড়া সঙ্কটের সময় এখন। কামলারাও পালিয়েছে। দারোগা-পুলিশকে খুব ভয় করে কিনা। খলুরও ভয় করে প্রবলভাবে। তবু একবার যখন ফেঁসে গেছে আর রক্ষে নেই। একটু আগে চেয়ারম্যান সা’ব যে কথা বলে গেছে তার তাপে খলুর মতো মানুষের শরীরেও বিন্দু বিন্দু ঘামের কণা নির্গত হয়েছে।

দারোগা-পুলিশকে খাওয়াতে হয়, টাকা দিতে হয়, এতোদিন তা-ই জানতো খলু। রাতের শয্যার সঙ্গীনীও যে তাদেরকে দিতে হয় এ জ্ঞান খলুর ছিলো না। খলু ভাবছে আর চর্বিওয়ালা পাহাড়ের মতো সটান শুয়ে থাকা মানুষটাকে হাওয়া করেছে। ভাবছে, কি করা যায়। শহর-বন্দর নিদেন পক্ষে থানা হলেও বিশেষ অসুবিধে ছিলো না। এ যে নিতান্তই গণ্ডগ্রাম। কোথায় পাবে নষ্টা মেয়েমানুষ? টাকা দিলেও কে আসবে? প্রত্যেকটা মুহূর্ত তার স্নায়ুকেন্দ্রে হাতুড়ির ঘায়ের মতো বেজে উঠছে প্রবলভাবে। খলুর মতো অমন শক্ত-সমর্থ কূট-কৌশলী মানুষও ছিন্নভিন্ন হয়ে যাচ্ছে। দারোগার মুখোমুখী দাঁড়িয়ে কিরূপে না বলবে– বিশেষ করে এ বিপদের সময়।

দারোগা বোঁজা চোখ দুটো পাকিয়ে প্রকাণ্ড একটা কাতলা মাছের মতোই হাই তুললো। চারদিকে স্থির দৃষ্টিতে চেয়ে জিজ্ঞেস করলোঃ

“চেয়ারম্যান সা’ব তোমাকে কিছু কন নি?”

“জী হুজুর, কইয়ে।” (হ্যাঁ হুজুর, বলেছে।) কুণ্ঠিতভাবে জবাব দিলো খলু।

“যাও, তোমার পাখা করতে হবে না। অন্য কাউকে ডেকে দাও, পাখা করুক।”

“এ্যাই শোন্।” খলু নতমুখে ঘরে ঢুকলো।

“হুজুর।”

“ডাবকা জোয়ান মাংসল আর পুরুষ্ট বুক দেখে আনবে। যাও তাড়াতাড়ি।”

আর কাউকে না পেয়ে হাসিমকে ঘর থেকে গিয়ে নিয়ে আসে। হাসিম আনমনে পাখা করছে। তালের পাখার নরম হাওয়া ছুটছে। শব্দ উঠছে। বাইরে লুটিয়ে পড়ছে চাঁদের আলো। এ আলোতে কতো কথা মনে পড়ে। দারোগা সা’ব হাতির মতো মোটা ডান পা-খানা প্রসারিত করে দিয়ে বললোঃ

“এ্যাই একটু টিপে দে তো।”

ঘৃণায় কুঞ্চিত হয়ে ওঠে হাসিমের নাক-মুখ। তবু পা টিপতে হয়। না টিপে যে উপায় নেই। বৈঠকখানার জানালা দিয়ে হাসিম দেখতে পেলো মাতব্বর কাকে ধাক্কিয়ে ধাক্কিয়ে এদিকে নিয়ে আসছে। নিয়ে আসছে সেটি মেয়ে। অবাক হয়ে দেখতে লাগলো হাসিম। আপনা থেকেই পা টেপা বন্ধ হয়ে গেলো। চিনতে চেষ্টা করলো। দারোগা ঝাঁজালো গলায় বললোঃ

“এই শালার বেটা থামলি কেন?”

হাসিম ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে যায়। খলু চোরের মতো ঘরে ঢুকে হাসিমকে বললোঃ

“হাসিম, তুই এহন যা।”

হাসিম বেড়িয়ে আমগাছটার কোলভরা অন্ধকারের ভেতর আত্মগোপন করে রইলো। দেখলো, জোহরাকে জোরে ধাক্কিয়ে ধাক্কিয়ে দরজার কাছ অবধি নিয়ে যাচ্ছে খলু। কাঁদছে জোহরা। কাঁদবার পালাই তো তার এখন। খলু তাকে ঘরের ভেতর ঢুকিয়ে বাইরে থেকে শেকল তুলে দিলো। এমনও হয়? এমন ও হয়? চিন্তা করতে পারে না হাসিম। আপন চাচা নিজের ভাইয়ের মেয়েকে জোরে-জব্বরে দারোগার কাছে ঠেলে দিতে পারে? হাসিম কি দেখছে? পৃথিবীটা কাঁপছে কেন? আকাশ-বাতাস টলছে কেন? বোধশক্তি সে হারিয়ে ফেলেছে। নিশ্চল পাথরের মূর্তির মতো নিশ্চেষ্টভাবে দাঁড়িয়ে থাকলো। তার দাঁড়িয়ে থাকা অবস্থাতেই আধখানা সোনার থালার মতো সুন্দর চাঁদ ডুবে গেলো। চরাচরের জীবন্ত পীচের মতো অন্ধকার। হেঁটে আসছে কে একজন। সেদিকে এগিয়ে গেলো হাসিম। তাকে দেখে হেঁটে আসা মূর্তি থমকে দাঁড়ায়। হাসিম জিজ্ঞেস করে। কিন্তু ফ্যাসফ্যাসে গলার স্বর বেরোয় না।

“হেইভা কন?” (তুমি কে?) ছায়ামূৰ্তি কথা কয় না। এগিয়ে আসে। কেঁপে কেঁপে হাসিমের হাত ধরে। জড়িয়ে ধরে কাঁপতে থাকে। হাসিমও কাঁপে। কেন কাঁপে? জোহরা সংজ্ঞা হারিয়ে হাসিমের গায়ে ঢলে পড়ে। অন্ধকারের নির্মম চক্রান্ত চারদিকে। এ অন্ধকারেই ঢলে পড়লো নির্মমভাবে ধর্ষিতা জোহরা।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *