৫. শংকরপুর গাড়ি পৌঁছতে

পাঁচ

শংকরপুর গাড়ি পৌঁছতে পৌঁছতে সামান্য বেলা হয়ে গেল। মধুপুরে মিনিট কুড়ি দাঁড়িয়ে থাকল ট্রেন, কিসের একটা গণ্ডগোল হয়েছিল ইঞ্জিনে। শংকরপুরে পৌঁছতে হরেদরে আধ ঘণ্টা লেট।

কিটব্যাগ হাতে ঝুলিয়ে তারাপদরা প্লাটফর্মে নেমে পড়ল। ছোটখাট স্টেশন, তেমন একটা লোকজন ওঠানামা করল না। যারা নামল বা গাড়িতে উঠল, তাদের মধ্যে বেশির ভাগই দেহাতী মানুষজন।

প্লাটফর্মে নেমে তারাপদরা কিকিরার জানলার দিকে সরে এল । চন্দন বলল, “আপনিও নেমে গেলে পারতেন।”

কিকিরা মাথা নেড়ে বললেন, “না স্যার, এখন আমার নামা চলবে না। এখানে আমাকে দু-চারজন চেনে। আপনাদের সঙ্গে নামলে চোখে পড়ে যেতে পারি।”

তারাপদ বলল, “চোখে পড়লে কী হবে?”

“কী হবে তা কেমন করে বলব। সাবধানের মার নেই। আপনারা ভাববেন না; আমি যশিডির কাজকর্ম সেরে বিকেলের প্যাসেঞ্জার ট্রেনে এখানে ফিরে আসব। যা বলে দিয়েছি মনে রাখবেন, স্টেশনের পুব দিকে বালিয়াড়ির মতন জায়গাটার কাছে হরিরামের আস্তানা। ওখানে আমায় পাবেন। কাল দেখা করার চেষ্টা করবেন। যান স্যার, আর দাঁড়াবেন না। খুব সাবধানে থাকবেন, চোখ কান খোলা রেখে। ভয় পাবেন না। “

তারাপদরা দাঁড়িয়ে থাকার কোনো কারণ দেখল না আর। গাড়িও ছাড়ল ছাড়ব করছে। হুইল বেজে গেছে। ইঞ্জিনের দিকেও স্টিম ছাড়ার শব্দ উঠছে।

চন্দন হঠাৎ কিকিরাকে বলল, “আপনি আমাদের ক্ষমা করবেন আমরা ভুল বুঝেছিলাম। বুঝতেই তো পারছেন–”

কিকিরা চন্দনের কথায় বাধা দিয়ে বললেন, “কিছু না, কিচ্ছু না স্যার, ক্ষমা-টমার দরকার নেই। আমি আপনাদের পেছনে আছি। আমার যতটা সাধ্য করব।”

ট্রেন ছেড়ে দিল। কিকিরা কেমন হাসি-হাসি অথচ মায়া-মাখানো মুখ করে তারাপদর দিকে তাকিয়ে থাকলেন।

তারাপদ একটু হাত ওঠাল, যেন বিদায় জানাল কিকিরাকে ।

প্লাটফর্ম ততক্ষণে ফাঁকাই হয়ে এসেছে । দুই বন্ধু মিলে হাঁটতে লাগল।

টিকিট কালেক্টারকে টিকিট দিয়ে স্টেশনের বাইরে এসে দাঁড়াল ওরা। পাঁচ-সাতটা ছোট ছোট দোকান, এক ফালি রেল কোয়াটার, মস্ত মস্ত ক’টা শিমুলগাছ ছাড়া আশেপাশে আর কিছু চোখে পড়ে না। পানের দোকান, দেহাতী মিঠাইয়ের দোকান। একপাশে কয়েকটা বুড়বুড়ি গোছের লোক ছোট-ছোট ঝুড়ি করে বেগুন, কাঁচা টমাটো, অল্প ক’টা ফুলকপি বিক্রি করছে। খদ্দের বলতে রেলের বাবু আর খালাসি গোছের লোক। একদিকে ছোট এক হনুমান-মন্দির, বাঁশের আগায় পতাকা উড়ছে।

তারাপদ বলল, “চাঁদু, নো রিকশা? নাথিং?”

চন্দন বলল, “কিকিরা তো বলেই দিয়েছিলেন হাঁটতে হবে।“

“তা হলে নে, হাঁট।”

চারদিক তাকিয়ে চন্দন বলল, “ওদিকে একটা মারোয়াড়ি দোকান দেখছি। চল, আগে সিগারেট-ফিগারেট কিনে নিই। ভুজঙ্গভূষণের মাঠ-মোকামের কথাও জেনে নেব।”

জায়গাটা এই রকম যে, তারাপদ আর চন্দনের মতন দুটি বাঙালি ছেলে কাঁধে কিট ব্যাগ ঝুলিয়ে নেমেছে, হাতে কম্বল ঝোলানো–এই দৃশ্যটাই যেন অনেকের কাছে কৌতূহলের বিষয় হয়ে উঠেছিল। সকলেই তাদের নজর করছিল। কালো জোয়ান গোছের একটা লোক সাইকেল কোমরের কাছে হেলিয়ে দেহাতী মিষ্টির দোকানের সামনে দাঁড়িয়ে ছিল। ময়লা কাঁচের গ্লাসে চা খাচ্ছিল। লোকটার চেহারা ষণ্ডার মতন, মাথা নেড়া, পরনে নীল একটা প্যান্ট, গায়ে কালো রঙের সোয়েটার।

চন্দন এবং তারাপদ দুজনেই তাকে দেখল।

তারাপদ ইশারা করে চন্দনকে বলল, “ভুজঙ্গভূষণের লোক নাকি রে?”

চন্দন বলল, “ড্রেস থেকে রেলের লোক মনে হচ্ছে। মালগাড়ির ড্রাইভার হতে পারে।”

“বেটা আমাদের অমন করে দেখছে কেন?”

“দেখুক। তাকাস না। ইগনোর করে যা।”

সামান্য এগিয়ে চন্দনরা মারোয়াড়ির দোকানটার মধ্যে গিয়ে দাঁড়াল।

দোকানটা দেখতে বড় নয়, কিন্তু হরেক রকম জিনিস রয়েছে। মুদির দোকান খানিকটা, খানিকটা মনিহারী। কবিরাজী তেল আর ভাস্কর লবণ ধরনের করলে আরও নিশ্চিন্ত হওয়া যায়।

সস্তা সিগারেট পাওয়া গেল। কয়েক প্যাকেট কিনে নিল চন্দন।

তারাপদ মাঠ-মোকামের কথাটা দোকানদারকে জিজ্ঞেস করল । কিকিরা যদিও বলে দিয়েছিলেন রাস্তাটা, তবু তারাপদ জিজ্ঞেস করল । নতুন জায়গায় কিছু খুঁজে বের করতে হলে একজনের জায়গায় দুজন কি তিনজনকে জিজ্ঞেস করলে আরও নিশ্চিন্ত হওয়া যায়।

দোকানের ছোকরামতন লোকটি মাঠ-মোকামের যাবার রাস্তাটা বলে দিলেও দোকানের বাইরে যে বুড়োমতন লোকটি টিনের চেয়ারে বসে ছিল, সে কেমন কৌতূহলের সঙ্গে ভাঙা ভাঙা বাঙলায় হিন্দিতেই জিজ্ঞেস করল, “কাঁহা যাবেন?

তারাপদ বলল, “ভুজঙ্গবাবুর বাড়ি।“

লোকটা অবাক হলেও নিজেকে যেন সামলে নিতে নিতে বলল, “ভুজঅংগ মহারাজজি? আচ্ছা আচ্ছা । যাইয়ে…।”

দোকানের বাইরে এসে তারাপদরা একটা নিমগাছের পাশ দিয়ে পাথরফেলা রাস্তাটা ধরল। সামান্য এগিয়ে চড়াই। চড়াইয়ের কাছে পৌঁছতেই ডান দিকে গ্রাম চোখে পড়ল। ছোট গ্রাম। কয়েকটা মাত্র ঘর। হরিরামের আস্তানা দেখা গেল না, টিলাটা চোখে পড়ল গ্রামের কাছাকাছি। ঝোঁপঝাড়ের আড়ালে আস্তানাটা বোধ হয় আড়াল পড়েছে। বাঁ দিকেও দু-একটা পাকা বাড়ি, বাঁধানো কুয়ো ।

চড়াই ফুরিয়ে গেলেই বাঁ দিকের কাঁচা রাস্তা ধরতে হল।

জায়গাটা যে সুন্দর তাতে কোনো সন্দেহ নেই। খটখটে শুকনো শক্ত মাটি, বিশাল বিশাল মাঠ, ঢেউ-খেলানো; মাঝে-মাঝে বড় বড় পাথর পড়ে আছে, জংলা গাছ নানা রকমের, মাথার ওপর দিয়ে দু-চারটে বক উড়ে যাচ্ছে, রোদ টকটক করছে, শীতের বাতাস দিচ্ছে শনশন করে।

হাঁটতে হাঁটতে চন্দন বলল, “জায়গাটা কিন্তু চমৎকার, কী বলিস?”

তারাপদ বলল, “খুব ভাল। কিন্তু জায়গার কথা এখন ভাবতে পারছি না চাঁদু।”

“কেন? জেনেশুনেও চন্দন বলল।

“ভুজঙ্গ যেরকম ফণা ধরে দাঁড়িয়ে আছে–,” তারাপদ হাজার দুভাবনার মধ্যেও তামাশা করবার চেষ্টা করল।

চন্দন হেসে বলল, “যা বলেছিস। ভুজঙ্গ যে কোন্ ফণা ধরে দাঁড়িয়ে আছে কিচ্ছু বোঝা যাচ্ছে না। কিকিরা যা বললেন তাতে লোকটাকে একটা আস্ত শয়তান বলেই মনে হচ্ছে।”

তারাপদ বলল, “কিকিরা কিন্তু সত্যিই বড় ভাল লোক।”

“আমরা ভাই ওঁকেই অবিশ্বাস করছিলাম। সত্যি, মানুষ চেনা বড় কঠিন।”

“সবই কঠিন। এই সংসার চেনাই কি সহজ। ধর না ভুজঙ্গভূষণের কথা লোকটা এত শয়তান কিন্তু সেই লোক মরার আগে আমায় সম্পত্তি দেবার জন্যে ডেকে পাঠায়?”

চন্দন একটা কুলঝোঁপের পাশে বিশাল এক গিরগিটির মতন জীবন দেখে থমকে দাঁড়িয়ে পড়ল। “তারা, দেখ।“ চন্দন আঙুল দিয়ে জীবটাকে দেখাল।

তারাপদ বলল, “কী রে ওটা? তক্ষক নাকি?”

চন্দন পায়ের শব্দ করতেই জন্তুটা ঝোঁপের আড়ালে পালাল।

 তারাপদ বলল, “ডেনজারাস্ জিনিস। বিষটিষ আছে বোধ হয়।

চন্দন বলল, “তুই এক আচ্ছা জায়গায় এলি, কী বল? চারপাশেই ডেনজার।”

“সত্যি! এখন ভাবছি, টাকার লোভে মানুষ কী না করে!”

“আমার কিন্তু ভালই লাগছে।”

“ভালই লাগছে?”

“অ্যাভেঞ্চার-অ্যাডভেঞ্চার মনে হচ্ছে। সেই যকের ধনের মতন ব্যাপার। তোর পিসেমশাই ভুজঙ্গভূষণের গুপ্তধন উদ্ধারের থ্রিলটা মন্দ কী রে?”

তারাপদ দুঃখের শব্দ করে বলল, “গুপ্তধন উদ্ধার! বলেছিস বেশ। ঢাল নেই তরোয়াল নেই নিধিরাম সর্দার।”

“কেন কেন? নিধিরাম কেন?”

“কিকিরার মুখে শুনলি না ভুজঙ্গ কেমন ভয়ংকর। তার সঙ্গে লড়ব আমরা? আমাদের কী আছে রে? নাথিং। একটা লাঠি পর্যন্ত হাতে নেই।”

চন্দন এবার মুচকি হেসে বলল, “আছে, আছে।”

“কী আছে?”

“বলব?”

“বল।”

“প্রথমে আছে কিকিরার হেল্প। কিকিরা আমাদের সব রকম সাহায্য করবেন বলেছেন।”

“তুই বড় বাজে কথা বলিস, চাঁদু। কিকিরা একটা রুগ্ন লোক, তাঁর একটা হাত একরকম অসাড়। ওই মানুষ তোকে মুখের কথায় ছাড়া আর কিসে সাহায্য করতে পারেন?”

চন্দন একটা ছোট পাথর লাফ মেরে টপকে গেল। যেন তার হাত-পায়ের সাবলীল ভাবটা দেখাল। বলল, “শোন তারা, কিকিরা আমাদের কাছে চোদ্দ আনা কথাই ভাঙেননি। আমি তোকে বলছি, কিকিরা ভুজঙ্গভূষণের হাঁড়ির খবর রাখেন। কিকিরা ভুজঙ্গভূষণের শত্রু। কাজেই শত্রু যদি ভুজঙ্গভূষণের হাঁড়ির খবর দেন তা হলে আমরা সেটা জানতে পেরে যাচ্ছি। ওটা কম কাজে লাগবে না। দু নম্বর হল, কিকিরার অ্যাডভাইস। সেটা খুব কাজের হবে। আর তিন নম্বর হল, আমার দুটো অস্ত্র।”

“অস্ত্র?” তারাপদ থমকে দাঁড়িয়ে পড়ল।

চন্দন মিটমিট করে হেসে বলল, “ভাই, যখন থেকে আমি ভুজঙ্গভূষণের কথা শুনেছি তখন থেকেই আমি তাঁকে সাসপেক্ট করেছি। ভুজঙ্গভূষণের দুর্গে ঢুকব অথচ একেবারে খালি হাতে, তা কি হয়! আমি দুটো জিনিস সঙ্গে করে নিয়ে এসেছি। ইনজেকসানের সিরিঞ্জ, আর একটা পাতলা ছিপছিপে ছুরি।”

তারাপদ বন্ধুর এই ব্যাপারটাকে তামাশা মনে করে তাচ্ছিল্যের গলায় বলল, “এই তোর অস্ত্র? আমি ভেবেছিলাম রিভলবার-টিভলবার নিয়ে এসেছিস।

“ওটা আমি চালাতে জানি না। এ দুটো জানি।”

“তুই ভুজঙ্গকে ওই দিয়ে ভয় দেখাবি? সত্যি চাঁদু তোর যা বুদ্ধি!”

“ভয় দেখাব কেন? ভদ্রলোকের মতন সব যদি মিটমাট হয়ে যায়–তোর ভুজঙ্গভূষণকে ভগবানের হাতে দিয়ে আমরা কলকাতায় ফিরে যাব।”

তারাপদ যেন কি ভেবে বলল, “কিন্তু চাঁদু, যদি ভুজঙ্গ আগেই তোর চালাকি ধরতে পারে?”

চন্দন বলল, “ধরা পড়লেই বা কী হবে! আমরা কলকাতাতেই শুনেছি, ভুজঙ্গভূষণের অ্যাকসিডেন্ট হয়েছে। আমি তোর ডাক্তারবন্ধু; ইমার্জেন্সিতে কাজে লাগতে পারে ভেবে জিনিস দুটো এনেছি।”

যুক্তিটা তারাপদর পছন্দ হল। তবু বলল, “তুই স্টেথোকোপটা এনেছিস?”

“না।”

“বাঃ, তা হলে? স্টেথোস্কোপ ছাড়া ডাক্তার হয়?

“ভুলে গিয়েছি। তাড়াহুড়োর মধ্যে জরুরি জিনিস নিতে লোকে ভুল করে না? সেই রকম ভুল।”

তারাপদ কী যেন ভাবল, বলল, “শুধু ইজেকসানের সিরিঞ্জ নিয়ে কী হবে? ওষুধপত্র?”

চন্দন বলল, “মাথা ধরা, পেট ব্যথার দু-চারটে খুচরো ওষুধ ছাড়া ইনজেকসানের জন্যে মরফিয়ার দুটো অ্যাম্পুল এনেছি, আর-একটা অ্যাম্পুল আছে হার্টের গোলমালের ওষুধ। সবই ইমার্জেন্সির জন্যে।”

তারাপদ এক ফোঁটাও ডাক্তারি বোঝে না। কিন্তু চন্দনের এই উপস্থিত বুদ্ধির জন্যে ওকে বাহবা দিতে ইচ্ছে করছিল । সত্যিই তো, একজন ডাক্তার বন্ধু নিয়ে সে মুখ ঝলসানো ভুজঙ্গভূষণের কাছে আসছে, এরকম অবস্থায় একেবারে খালি হাতে কি আসা যায়?

চুপচাপ কয়েক পা এগিয়ে এসে তারাপদ বলল, “দেখ চাঁদু, ভুজঙ্গকে আমরা যতটা ভয় পাচ্ছি–এতটা ভয়ের কারণ আমাদের বেলায় নাও থাকতে পারে । কাল রাত্রেও ঠিক এতটা ভয় আমাদের ছিল না। আজ সকালে কিকিরাই আমাদের ভয় ধরিয়ে দিয়েছে। আমরা যতটা ভাবছি তা হয়ত কিছুই হবে না। তা ছাড়া আমি কি যেচে এসেছি? ভুজঙ্গভূষণই আমায় ডেকে পাঠিয়েছেন।”

তারাপদ তার কথা শেষ করেনি, চন্দন অনেকটা দূরে গাছপালার আড়ালে একটা বাড়ি দেখতে পেয়ে চেঁচিয়ে বলল, “তারা, ওই তোর মাঠ-মোকাম, ভুজঙ্গভূষণের বাড়ি।”

চন্দন তাকাল। জায়গাটা দেখার মতন। মাঠের ঢল নেমে গেছে অনেকটা, চারদিকে জঙ্গলের ঝোঁপঝাড় গাছপালা, মনে হয় জঙ্গল বুঝি এখান থেকেই শুরু হয়েছে। ওরই এক পাশে একটা বাড়ি দেখা যাচ্ছে, কিন্তু আড়ালের জন্যে বোঝা যাচ্ছে না বাড়িটা কেমন।

আরও আধ মাইলটাক হেঁটে তারাপদরা ভুজঙ্গভূষণকে বাড়ির কাছে গিয়ে দাঁড়াল। এটা বাড়ি না দুর্গ বোঝা যায় না। জেলখানার মতন উঁচু পাঁচিল দিয়ে চারদিক ঘেরা। গাছপালার অভাব নেই, আম জাম নিম কাঁঠাল থেকে শুরু। করে শিমুল পর্যন্ত। জল বৃষ্টি রোদ সয়ে সয়ে পাঁচিলের গায়ে শ্যাওলার রঙ ধরেছে। কোথাও কোথাও কালো হয়ে গেছে। পাঁচিলের এ-পাশ থেকে বাড়ির সামান্যই চোখে পড়ে। অনেকটা ভেতর দিকে বাড়িটা। দোতলাই হবে। দোতলরা রেলিং-দেওয়া বারান্দা চোখে পড়ছিল। কেমন একটা ফটফট শব্দ হচ্ছে, যেন একটা মেশিন গোছের কিছু চলছে।

তারাপদ বলল, “কিসের শব্দ রে?”

চন্দন বলল, “ডায়নামো বলে মনে হচ্ছে।”

“কী করে ডায়নামো দিয়ে?”

“বোধ হয় বাতিটাতি জ্বালায়।”

“অবাক হয়ে তারাপদ বলল, “বাব্বা! বিশাল কারবার তা হলে?”

একটা জিনিস চন্দন লক্ষ করল। তারা বাড়ির হয় পেছনে না হয় পাশে কোথাও এসে দাঁড়িয়েছে। সামনের দিকটা নজরে আসছে না।

পাঁচিলের পাশ দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে চন্দন বলল, “আয়, সামনের দিকে যাই।”

শুকনো পাতা, গাছের সরু সরু ভাঙা ডালপালা, ছড়ানো পাথরের ভূপ টপকে তারাপদরা বাড়ির সামনের দিকে এসে পড়ল। প্রথমেই চোখে পড়ল, লোহার ফটক। বিশাল ফটক। কারখানার গেটে যেমন দেখা যায়, অনেকটা সেই রকম। ফটকের একপাশে পাঁচিল জুড়ে ছোট একটা ঘর মতন। বোঝাই যায় পাহারা দেবার ব্যবস্থা রয়েছে। খুবই আশ্চর্য, ফটকের সামনে দিয়ে যে রাস্তাটা মাঠের দিকে চলে গেছে–সেটা কাঁচা হলেও গাড়ি চলার দাগ আছে। মরা ঘাস, কাঁকর-মেশানো মাটির ওপর চাকার দাগ। গরুর গাড়ি চললে যেমন দাগ ধরে যায় মাটিতে। কিন্তু দাগের গর্ত গভীর নয়।

তারাপদ ফটকের সামনে এসে বলল, “এবার?”

চন্দন আশেপাশে কাউকে দেখতে পেল না। ফটক বন্ধ। পাহারা ঘরের গায়ে একটা ছোট ফটক রয়েছে, কিন্তু তালা দেওয়া। ফটকটা টপকানো যেত, যদি না মাথায় বশার ফলার মতন শিক থাকত।

গলা ফাটিয়ে চেঁচিয়ে চেঁচিয়ে ডাকা ছাড়া চন্দন অন্য কোনো উপায় খুঁজে পেল না।

হঠাৎ তারাপদ বলল, “চাঁদু, এদিকে একবার দেখ।”

চন্দন তারাপদর কাছে গেল। বাঁ ফটকের পাশে থামের গায়ে একটা কী যেন লেখা আছে। লোকে সাদা পাথরের ওপরেই বরাবর কালো দিয়ে বাড়ির নামটাম লিখে এসেছে। এ একেবারে উলটো। কালো পাথরের ওপর সোনালি দিয়ে কিছু লেখা ছিল। সোনালি রঙ এখন প্রায় কালচে হয়ে এসেছে, অক্ষরগুলো বোঝা কষ্টকর, অর্ধেক নষ্ট হয়ে গিয়েছে, গিয়ে পাথরের খোদাইটুকু কোনো রকমে টিকে আছে। দেবনাগরী অক্ষরে কিছু লেখা। চন্দন দেবনাগরী বেমালুম ভুলে মেরে দিয়েছে, তারাপদ হয়ত বুঝতে পারত, কিন্তু ভাঙা অস্পষ্ট অক্ষর সে পড়তে পারছিল না।

খুব খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখে তারাপদ বলল, “সংস্কৃত মনে হচ্ছে। ঠিক ধরতে পারছি না, তবে আত্মাটাত্মা কিছু লেখা আছে।”

“আত্মা?”

“তাই তো দেখছি।”

চন্দন কী যেন ভাবল, “আত্মা পরে হবে। জোর খিদে পেয়ে গিয়েছে। নিজেদের আত্মা আগে বাঁচাই। আয় আগে তোর পিসেমশাইয়ের সঙ্গে মোলাকাত করি।“

তারাপদকে টেনে নিয়ে চন্দন পাহারা-ঘরটার কাছে এল। “টপকাতে পারবি?”।

“পাগল, বর্শায় গিঁথে যাব।”

“তা হলে?…আচ্ছা, দাঁড়া, আমার কম্বলটা পাট করা রয়েছে। এটা বশার মাথায় দিচ্ছি। তুই ওই সেট্রি পোস্টের গা ধরে ওঠ, উঠে টপকে যা।”

চন্দন যাকে সেট্রি পোস্টের গা বলল সেটা পাহারা-ঘরের দেওয়ালই বলা যায়।

তারাপদ ইতস্তত করল। এই ফটকটা ছোট, ফুট চারেকেরও কম উঁচু মাটি থেকে। হাই জাম্প করেও পেরিয়ে যাওয়া যেত যদি জায়গা থাকত দু পাশে । অবশ্য তারাপদ স্পোর্টসম্যান নয়, চন্দন খানিকটা লাফঝাঁপ করতে পারে।

চন্দনের তাড়া খেয়ে তারাপদ মনে-মনে ভগবানকে ডেকে গেটের ওপর চেপে পড়ল।

কপাল ভাল, কোনো অঘটন ঘটল না। দুজনেই গেট টপকে ভেতরে ঢুকে পড়ল।

ভেতরে ঢুকে তারাপদরা দেখল, বাড়িটা ফটক থেকে গজ পঞ্চাশেক দূরে হবে। গড়নটা সেকেলে জমিদারবাড়ির মতন, অবশ্য সামনের দিকে গোলাকার ভাব আছে। মজবুত বাড়ি মস্ত মস্ত থাম, পাকাঁপোক্ত বারান্দা বাইরে। দূর থেকে মনে হয়, যেন বড় বড় পাথরে গাঁথা বাড়ি। বাইরে রঙরঙ কিছু নেই, কালচে হয়ে আছে, মানে ভুজঙ্গভূষণ বাইরের দিকে আর নজর দেন না। দেখতে বাড়িটা ছোট নয়। ভুজঙ্গভূষণ একলা মানুষ, এই বাড়ি নিয়ে কী করেন কে জানে!

ফটক থেকে যে রাস্তাটা সোজা বাড়ির সদর সিঁড়িতে গিয়ে পড়েছে, তার দু পাশে বাগান। এক সময় নিশ্চয় ফুলের বাগান ছিল, এখন ফুলটুল তেমন কিছু নেই, নানা ধরনের পাতাবাহার, জবা, গাঁদা আর এলোমেলো কিছু ফুলগাছ। চোখে পড়ে। বাগানে বেদী আছে বসার । ঘাসগুলো মরে যাচ্ছে শীতে। কিছু লতাপাতা নিজের মতন বেড়ে যাচ্ছে। পাঁচিলের গা ধরে অবশ্য বড় বড় গাছ–নিম, কাঁঠাল, আম, হরীতকী ।

তারাপদ আর চন্দন ধীরে ধীরে বাড়ির দিকে এগিয়ে যাচ্ছিল। সেই ডায়নামোর শব্দ ছাড়া কোনো শব্দ নেই। মানুষের গলা পাওয়া যাচ্ছে না, কারও কোনো রকম টিকি দেখা যাচ্ছে না। ক’টা প্রজাপতি উড়ছে বাগানে। রোদ আরও গাঢ়, রীতিমত তাপ লাগছে গায়ে। শীত যেন এই রোদের কাছে। হার মেনে গেছে।

চন্দন বলল, “তারা, একটাও লোক নেই, কোনো সাড়াশব্দ নেই, তোর ভুজঙ্গভূষণ বেঁচে আছে তো?”

কথাটা শোনামাত্র তারাপদ যেন চমকে উঠল। সত্যিই তো, ভুজঙ্গভূষণ যদি মারা গিয়ে থাকে? ভুজঙ্গ নিজে অমাবস্যা পর্যন্ত বাঁচব বলেছে–কিন্তু মরা বাঁচা কি মানুষের নিজের হাতে? ওটা ভগবানের হাত । যদি ভুজঙ্গভূষণ মারা গিয়ে থাকে তবে তো হয়েই গেল! তারাপদর এই ছুটে আশা বৃথা হল । বেড়ালের ভাগ্যে শিকে ছেঁড়ার যে আশা দেখা গিয়েছিল তাও গেল।

তারাপদ বেশ বুঝতে পারল, সে ভুজঙ্গভূষণকে জীবিত দেখতে চায় টাকার লোভে, সম্পত্তির লোভে? অথচ এই ভুজঙ্গকে নিয়ে তাদের ভয় দুশ্চিন্তা কি কম!

পাথরকুচি-ছড়ানো রাস্তা দিয়ে বাড়ির একেবারে সামনের সিঁড়িতে এসে দাঁড়াল তারাপদরা। তবু কোনো শব্দ নেই, কারও সাড়া নেই। একেবারে চুপচাপ সব।

চন্দন বন্ধুর দিকে তাকাল। “কী ব্যাপার রে?”

“কী জানি, বুঝতে পারছি না।”

“চেঁচিয়ে চেঁচিয়ে ডাকব?”

“কাকে?”

“কেন, ভুজঙ্গভূষণকে?”

তারাপদ বুঝতে পারল না, কী বলবে।

পাঁচ-সাত ধাপ সিঁড়ি উঠে গেল ওরা। বারান্দায় উঠে এসে দাঁড়াল। সামনেই একটা বড়-মতন ঘর। দরজা খোলা। বারান্দার একদিকে গোটা দুই চেয়ার পাতা রয়েছে।

চন্দন ঘরের দিকে পা বাড়িয়ে উঁকি মারতে যাচ্ছিল, এমন সময় পাশের ঘর থেকে কে বাইরে এসে দাঁড়াল। চন্দন তাকাল।

তারাপদ একদৃষ্টে লোকটিকে দেখছিল। তারপর অবাক হয়ে বলল, “সাধুমামা!”

সাধুমামা যেন তারপদকে চিনতে পারছিলেন না। তাকিয়ে থাকলেন।

তারাপদ আবার বলল, “সাধুমামা, আমি তারাপদ । তোমার এ কী চেহারা হয়েছে? তুমি ওভাবে আমায় দেখছ কেন? আমায় চিনতে পারছ না?”

সাধুমামার শরীর কঙ্কালের মতন, মাথার চুল একেবরে সাদা, ঘাড় পর্যন্ত ছড়ানো, মুখের মাংস কুঁচকে বিশ্রী হয়ে গেছে। বীভৎস দেখাচ্ছে। কিছু যেন হয়েছিল মুখে। কাটাকুটি, ঘা, নাকি সাধুমামারও মুখ পুড়ে গিয়েছিল ঝোঝা যাচ্ছে না। সাধুমামা এমন অদ্ভুত চোখে তাকিয়ে থাকলেন যেন সত্যিই তারাপদকে চিনতে পারছেন না।

তারাপদ বিশ্বাস করতে পারছিল না যে, সাধুমামা তাকে চিনতেও পারছেন না। বছর দেড় দুই আগেও সাধুমামা তার কাছে গিয়েছিলেন,

এমন সময় একেবারে আচমকা ভয়ংকর গম্ভীর গলায় কে যেন বলল, “ওদের হলঘরে বসাও। বসিয়ে তুমি ওপরে আমার কাছে এসো।”

তারাপদরা চমকে উঠল।

কে যে কথাটা বলল দেখবার জন্যে তারাপদরা তাকাল। কাউকে দেখতে পেল না কোথাও। গলার স্বরটা কী গম্ভীর, কী কঠিন। গমগম করে উঠল যেন বারান্দাটা। কিন্তু কে কথা বলল? কে?

সাধুমামা ওই গলা শোনামাত্র বাড়ির চাকরবাকরের মতন হাত দেখিয়ে তারাপদদেরর মাঝের ঘরটার দিকে যেতে ইশারা করলেন। কথা বললেন না।