৩. গাড়ি ছাড়ার সময়

টাইম টেল-এ গাড়ি ছাড়ার সময় রাত প্রায় দশটা; ন’টার আগেই তারাপদরা হাওড়া স্টেশনে পৌঁছে গেল। হাতে খানিকটা সময় থাকা ভাল, টিকিট কাটা, আগেভাগে বসবার জায়গা দখল করা । সারা রাত এই শীতে তো দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে যাওয়া যাবে না, ঘুমোতে না পারুক–অন্তত ভাল করে বসার জায়গা দরকার।

তারাপদ নিজে টিকিট কাটতে গেল না। চন্দনকে পাঠিয়ে দিল। সারাটা দিন আজ তারাপদর বড় ছুটোছুটি গিয়েছে। কাল সারা রাত তেমন একটা ঘুমোতেই পারল না, মাথার মধ্যে মৃণাল দত্ত আর ভুজঙ্গভূষণ। ওরই মধ্যে সাধুমামার মুখ মাঝে মাঝে উঁকি দিয়েছে, মা বাবার কথা মনে পড়েছে, পরীর কথাও মনে পড়ল। পরীর মুখ তো মনেই ছিল না তারাপদর, ছবি দেখে মনে পড়ল। ওই একটিমাত্র বোন, আর তো কেউ ছিল না তার, আহা সে বেচারিও থাকল না। হাজার চিন্তায় ঘুম হল না। তার ওপর ওই ব্যাপারটাও তাকে বেশ অবাক করে তুলেছিল। মৃণালবাবুর বাড়ি থেকে বেরিয়েই চন্দন সেই কালো বেড়ালটার কথা বলল। বেড়ালটা নাকি ঘড়ির কাঁটার মতন ঘুরে যায়। চন্দন স্বচক্ষে দেখেছে, তারাপদরা যখন মৃণালবাবুর ঘরে গিয়ে বসে তখন তার মুখ ছিল তাদের দিকে, আর যখন চলে আসে তখন বেড়ালটার মুখ মৃণাল দত্তর দিকে। এ কি করে সম্ভব? একটা ভুয়ো, নির্জীব, পুতুল ধরনের বেড়াল কেমন করে মুখ ঘোরাবে? চন্দন নিশ্চয় ভুল দেখেছে।

চন্দন জোর দিয়ে বলল, না, সে ভুল দেখেনি। ঠিকই দেখেছে।

কেমন করে এটা হয় তারাপদ বুঝতে পারল না। ভূতের ব্যাপার নাকি? ম্যাজিক?

ভুজঙ্গভূষণের পুরো ব্যাপাটাই ভূতুড়ে মনে হচ্ছে, ভাবতে গেলে সেরকমই মনে হয় নাকি? কোথায় তারাপদ আর কোথায় ভুজঙ্গভূষণ–চেনা না জানা না–কস্মিনকালেও যারা পরস্পরের মুখ পর্যন্ত দেখল না, তারা কেমন করে। আজ একজন অন্যজনকে খুঁজে বেড়াচ্ছে! ভুজঙ্গভূষণ খুঁজছে তারাপদকে, আর তারাপদ খুঁজে বেড়াচ্ছে ভুজঙ্গভূষণের দেড় দুলাখ টাকার সম্পত্তি! সত্যিই ব্যাপারটা ভুতুড়ে।

ব্যাপার ভুতুড়ে হোক আর যাই হোক, সকালে ঘুম ভেকে উঠে তারাপদকে মৃণালবাবুর কাছে ছুটতেই হল। দেড় দু’লাখ টাকার লোভে কি? হতে পারে। আবার টাকার লোভ ছাড়াও কেমন একটা রহস্যের টানও রয়েছে। সত্যি সত্যি ওই ভুজঙ্গভূষণ কে? কেনই বা তাঁর ওই রকম কাপালিক-মাকা চেহারা? কী করতেন তিনি এতকাল? কেন কোনদিন তারাপদদের খোঁজখবর নেনি, অথচ সাধুমামাকে দিয়ে তাদের পরিবারের–মানে তারাপদর মা, বাবা, পরী সকলের ছবি জোগাড় করে নিয়েছেন! কী তাঁর উদ্দেশ্য ছিল?

হাজার রকম ‘কেন’র কোনো জবাব যেমন পাওয়া যাচ্ছে না–সেইরকম। বোঝা যাচ্ছে না ভুজঙ্গভূষণ কী করে জানতে পারলেন যে সামনের অমাবস্যা পর্যন্ত তিনি বেঁচে থাকবেন? ভদ্রলোকের কি ইচ্ছামৃত্যু? কে জানে বাবা! এত রকম অবাক হবার ব্যাপার যখন রয়েছে তখন বেড়ালটার মুখ ঘোরানোও আর এমন কি আশ্চর্যের! তবে, ওই কালো বেড়ালটা তো ছিল, মৃণাল দত্তর ঘরে। তা হলে? মৃণাল দত্তও কি ভুজঙ্গভূষণের ছোঁয়া পেয়েছেন?

সকালে মৃণাল দত্তকে একবার কালো বেড়ালটার কথা জিজ্ঞেস করলে হত। এসব কথা জিজ্ঞেস করতে লজ্জাও তত করে। কিন্তু সে সুযোগই হল না। পুরনো ঘরে মৃণাল দত্ত তারাপদকে আর বসাননি। বাইরের বৈঠকখানায় বসিয়ে রেখে তাঁর দরকারি কাগজপত্র এনে দিলেন। যেন তিনি জানতেন তারাপদ ঠিকই আসবে, রাত পোহালেই এসে হাজির হবে। সমস্ত তৈরি করে রেখেছিলেন। সিলমোহর করা একটা চিঠি, সামান্য ভারী মতন একটা প্যাকেট, রেজিস্ট্রি করা পার্শেলের মতন চেহারা সেটার চারপাশে গালা দিয়ে করা, মোহরের ছাপ।

সেইসব জিনিস নিয়ে তারাপদ এল চন্দনের মেডিক্যাল হোস্টেলে। চন্দনকে বলল, “চাঁদু তোকে সঙ্গে যেতে হবে ।”

চন্দন প্রথমটায় রাজি হচ্ছিল না; তার হাসপাতাল। আবার পুরো ব্যাপারটাই এমন গোলমেলে যে একলা তারাপদকে ছেড়ে দিতে তার ভাল লাগছিল না। তারাপদ কোনো কালেই সাহসী নয়, বরং ভিতু ধরনের; তার শরীর স্বাস্থ্য ততটা মজবুত নয়; নিরীহ ভালোমানুষ গোছের ছেলে ও, ভিড়ের ভয়ে কোনোদিন মোহনবাগান ইস্টবেঙ্গলের লিগ বা শিন্ডের খেলা পর্যন্ত দেখতে গেল না। চন্দন কতবার বলেছে, চল্ না-আমি তো রয়েছি। তারাপদ মাথা নেড়েছে আর বলেছে, থাক ভাই, আমার মাঠে গিয়ে দরকার নেই, রিলে শুনলেই আমার খেলা দেখা হয়ে যাবে।

সেই তারাপদকে একলা একলা কী করে ছেড়ে দেয় চন্দন! তারাপদর মা যখন মারা যায় চন্দন শ্মশানে গিয়েছিল, তার মনে আছে সেদিন বারবার তারাপদ শুধু চন্দনকেই আঁকড়ে ধরেছিল আর ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছিল ।

অনেক রকম গবেষণার পর ঠিক হল, চন্দন হাসপাতাল থেকে কয়েক দিনের ছুটি নেবে, বললবাবার অসুখ। কথাটা মিথ্যে হলেও করার কিছু নেই, ছুটির যখন দরকার তখন বড় কিছু একটা না বললে ছুটি দেবে কেন?

চন্দন রাজি হয়ে যাবার পর তারাপদ বটুকবাবুর মেসে ফিরল। স্নান খাওয়া সেরে বেরুলো কিছু টাকা পয়সা জোগাড়ের ধান্ধায়। বন্ধুবান্ধবের কাছ থেকে যা পায় জুটিয়ে অন্তত একশো সোয়া শো টাকা তো হাতে রাখতেই হবে।

দুপুরের পর তারাপদ মেসে ফিরল। বেশ ক্লান্ত হয়ে পড়েছে। তারপর গোছগাছ শুরু করল।

সন্ধের গোড়ায় গেল চন্দনের হোস্টেলে। চন্দন প্রায় তৈরি। তারপর দুই বন্ধু মিলে জয় মা বলে বেরিয়ে পড়েছে। দেখা যাক কপালে কী আছে!

চন্দন টিকিট কেটে ফিরে এসে বলল, “নে, চল…। ননম্বরে গাড়ি দেবে।

জিনিসপত্র তেমন কিছু নেই তাদের, দুজনের দুটো কিট ব্যাগ, চন্দন একটা কম্বল নিয়েছে হাতে ঝুলিয়ে, রাত্রে শীতের হাত থেকে বাঁচতে হবে। তারাপদর কম্বল নেই, সে একটা তুষের পুরনো চাদর আর বঙ্কিমদার হনুমান টুপিটা নিয়ে নিয়েছে সঙ্গে করে। মেসে কেউ জানে না–তারাপদ কোথায় যাচ্ছে।

তারাপদ শুধু বলেছে, একটু বাইরে যাচ্ছি এক বন্ধুর সঙ্গে, দরকার আছে।

প্লাটফর্মে ঢুকে তারাপদরা দেখল, ভিড় ভীষণ একটা কিছু নয়, মোটামুটি। প্যাসেঞ্জার ট্রেন; তায় আবার শীতকাল, হয়ত তাই ভিড়টা কমই।

একটু পরেই প্লাটফর্মে গাড়ি দিয়ে দিল। চন্দন বাহাদুর ছেলে। গাড়ি প্লাটফর্মে ঢুকতে না ঢুকতেই কী-এক বিচিত্র কায়দায় সে চলন্ত ট্রেনের হ্যাঁন্ডেল ধরে ঝুলে পড়ল ।

গাড়ি দাঁড়াবার পর তারাপদ খুঁজে খুঁজে চন্দনকে বের করে নিল। চমৎকার জায়গা জুটিয়ে কম্বল বিছিয়ে ফেলেছে।

গাড়িতে উঠে তারাপদ বলল, “তোর দৌড়বার কী ছিল? ভিড় তেমন নেই।”

চন্দন বলল, “দেখতেই পাবি। ট্রেন ছাড়ার সময় হয়ে আসুক। নে বসে পড়। এদিকে আয়-জায়গা নিয়ে বস্–চাদরটা বিছিয়ে দে; শোবার জায়গা ছাড়বি না।”

কি ব্যাগ মাথার কাছে রেখে একেবারে কোণের দিকে মুখোমুখি দুই বন্ধু কম্বল আর চাদর পেতে ফেলল। কামরায় লোক উঠছে, কুলি উঠছে, আবার নেমেও যাচ্ছে, মালপত্র রাখার হইচই।

চন্দন নিজের জায়গায় বসে সিগারেটের প্যাকেট বের করল। “তোর এই মালগাড়ি কাল নটা দশটার সময় শংকরপুর পৌঁছবে।”

গাড়িটা অবশ্য প্যাসেঞ্জার ট্রেন, মালগাড়িরই যমজ-ভাই। ঢিকির ঢিকির করে যাবে, হাজারবার দাঁড়াবে। অন্য কোনো গাড়িতে যাওয়া চলত, কিন্তু সারাদিন এত ছুটোছুটি করতে হয়েছে তারাপদকে যে সে-সুযোগ তার হয়নি। একটা এক্সপ্রেস গাড়ি ছিল, সেটা শংকরপুরে দাঁড়াত না।

ততক্ষণে দু বন্ধু মিলে সিগারেট ধরিয়ে নিয়েছে। কামরায় তোক বাড়ছে, দেখতে দেখতে বেশ ভিড় হয়ে গেল। প্লাটফর্মে আরও যাত্রী এসে পৌঁছচ্ছে। তারাপদদের কামরায় এক দঙ্গল বেহারি উঠেছে, দু পাঁচজন বাঙালিও।

এমন সময় এক অদ্ভুত ধরনের ভদ্রলোক এসে কামরায় উঠলেন। টিয়াপখির মতন নাক, তোবড়ানো গাল, গর্তে বসা চোখ। চেহারাটি রোগাসোগা, গায়ে সেই আদ্যিকালের অলেস্টার, মাথায় কাশ্মীরি টুপি ডান হাতে একটা সুটকেস ঝুলছে, বাঁ হাতে খয়েরি বালাপোশ । ভদ্রলোক এতই রোগা যে গায়ে অলেস্টার চাপিয়েও তাঁকে মোটা দেখাচ্ছে না। গলায় মোটা মাফলার জড়ানো।

চন্দন ভদ্রলোককে দেখে নিচু গলায় বলল, “ডিসপেপসিয়ার কেস রে তারা, টিপিক্যাল ডিসপেপটিক পেশেন্ট।”

ভদ্রলোক তারাপদদের দিকেই এগিয়ে এলেন। কাছে এসে এমন মুখ করে হাসলেন যেন কতই না চেনা তারাপদর, গঙ্গাচরণ মিত্তির লেনে রোজই দেখা হয়।

“কত দূর?” ভদ্রলোক জিজ্ঞেস করলেন হাসিমুখে। হাসবার সময় তাঁর। দাঁত দেখা গেল। এবড়োখেবড়ো কালচে দাঁত, পান-খাওয়া দাঁত যেন।

তারাপদ ভদ্রলোককে কোনোদিন দেখেনি। জবাবও দিল না কথার।

ভদ্রলোক কিন্তু নির্বিকার, সুটকেসটা বেঞ্চির তলায় রেখে বালাপোশটা বিছিয়ে নিলেন, তারাপদর চাদর সামান্য গুটিয়ে গেল। তাঁর চেনাচেনা হসি আর কথা : “এই ট্রেনটায় যত ছিঁচকে চোরের উপদ্রব, বুঝলেন মশাই, চোখে পাতা দু দণ্ড বুজেছেন কি পুঁটলি-পাটলা সুটকেস ব্যাগ হাওয়া। ওই দরজার দিকটায় তাই গেলাম না।…ওদিকটায় একটু পরেই দেখবেন কী হয়-ছিলিম চলবে। সে কী দৃর্গন্ধ।! গোয়ালাগুলো ব্যোম ভেলার জাত। গাঁজাই ওদের সর্বনাশ করল। দেখি স্যার, আপনার পা-টা একটু সরান–সুটকেসটাকে প্লেস করে দি আরও একটু সেফ সাইডে।“

চন্দন হেসে ফেলেছিল। সামলে নিল। ভদ্রলোক এবার গোছগাছ সেরে তারাপদর পাশে বসলেন।

গাড়ি ছাড়ার সময় হয়ে আসছিল। প্লাটফরমের কলরব কমে আসছে যেন। তারাপদদের কামরা থেকে কিছু বেহারি লোকজন নেমে গেল।

ভদ্রলোক ততক্ষণে পান-জরদা মুখে পুরেছেন। “আপনারা কদুর যাবেন স্যার?” ভদ্রলোক আবার জিজ্ঞেস করলেন। তারাপদ কিছু বলার আগেই চন্দন বলল, “মধুপুর-টধুপুরের দিকে।”

“মধুপুর? কোথায়? কোন দিকটায়?”

“আপনি মধুপুরে থাকেন?”

“না স্যার, আমি অরিজিন্যালি ভাগলপুরের, তারপর থেকেছি জামসেদপুরে, শেষে ইছাপুরেও কিছুদিন ছিলাম, এখন আর কোনো পুরে থাকি না, টুরে টুরে দিন কেটে যায়।”

তারাপদ হেসে ফেলল। চন্দনও।

“আমার স্যার কতকগুলো বদ দোষ আছে,” পান চিবোতে চিবোতে ভদ্রলোক বললেন, “আমি হাসিঠাট্টা করতে ভালবাসি। আমার আপন-পর নেই। ভেরি ফ্র্যাংক…। একটা কথা স্যার আগেই বলে নি, আমার মুখ থেকে হরদম ইংলিশ বেরোয়, নো গ্রামার, কিছু মনে করবেন না। আমার বাবাকে একজন অ্যাংলো ঘুষি মেরে নাক ভেঙে দিয়েছিল, তখন থেকেই আমার ওই ভাষাটার ওপর রাগ। অ্যাংলোরা হাফ ইংলিশ বলে, তাতেই আমার বাবার নাক চলে গেল, ফুল ইংলিশ যারা বলে তাদের ঘুষি খেলে তো আমার বাবার ফেসই পালটে যেত। বলুন ঠিক কি না! আমি তখন থেকে রিভেজ নিতে শুরু করেছি ভাষাটার ওপর, যা মুখে আসে বলব–তুই আমার কাঁচকলা করবি। তোর ভাষা কি আমার মার না বাবার ভাষা!”

তারাপদরা এবার জোরে হেসে উঠল।

গাড়ি ছাড়ল। গাড়ি ছাড়ার সময় যেমন হয়, দু-একজন নেমে পড়ল, ছুটতে ছুটতে কে এজন পা-দানিতে উঠে পড়ল, প্লাটফর্মের ওপর দাঁড়িয়ে কেউ কেউ হাত নাড়ছে, একদল দেহাতী গোছের মানুষ ‘গঙ্গা মাই কি জয়’ বলে চেঁচিয়ে উঠল।

ধীরে ধীরে গাড়িটা প্লাটফর্মের বাইরে আসতেই শীতের হাওয়া এসে ঢুকল জানলা দিয়ে।

চন্দন জানলা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে ছিল, এবার ভেতরে মুখ ফেরাল।

চন্দন বলল, “আপনার নামটা কী স্যার?”

“কিঙ্করকিশোর রায়, দেড়গজী নাম স্যার, ছোট করে লোকে বলে কিকিরা দি গ্রেট।“

জোরে হেসে উঠে চন্দন বলল, “আলেকজান্ডার দি গ্রেট-এর পর আর কোনো গ্রেট দেখিনি স্যার, আপনাকে দেখলাম।”

কিকিরা খকখক শব্দ করে হেসে উঠলেন। অদ্ভুত সে শব্দ। তারাপদও হেসে উঠল। ঠাট্টা করে চন্দনকে বলল, “তুই তা হলে আলেকজান্ডার দি গ্রেটকে দেখেছিস।”

“ছবি দেখেছি”, চন্দন রসিকতা করে বলল।

কিকিরা হাসতে হাসতে বললেন, “এবার জ্যাস্ত দেখুন, লিভিং গ্রেট।”

তারাপদ জিজ্ঞেস করলে, “আপনি কী করেন?”

কিকিরা অলেস্টারের গলার দিকে বোতাম খুলতে খুলতে বললেন, “আমার করার কিছু ঠিক নেই, স্যার। কখনো ছুরি-কাঁচির এজেন্ট, কখনো খোস পাঁচড়ার মলমের, কখনো অম্লশূলের ওষুধ বেচে আসি, কখনো আবার অন্য কিছু–যা হাতের কাছে জুটে যায়। আমার নেচারটা অস্থির গোছের। মেজাজে না বলে আমি কাউকে ছেড়ে কথা বলি না। লাস্ট মাস্থে আমি একটা নতুন কোম্পানির স্নো ক্রিম পাউডারের রিপ্রেজেনন্টেটিভ ছিলাম । মালিক বেটা ছ্যাঁচড়া, আমার সঙ্গে বনলো না, ছেড়ে দিলাম। দিয়ে এখন একটা কোম্পানির কাঁচি, খুর, ক্লিপের এজেন্ট হয়ে গিয়েছি। হাওড়ায় কারখানা খুলেছেন ভদ্রলোক বেশ ভাল খুর তৈরি করছে স্যার । আমার সুটকেসে স্যাম্পল আছে। কাল সকালে দেখাব।”

চন্দন হাত নেড়ে বলল, “থাক্ স্যার, খুব আর দেখাবেন না, খুর দেখলেই আমার ভয় করে।”

“ভয়ের কিছু নেই, স্যার। ঠিক মতন টানতে পারলে মাখনের মতন গাল নরম থাকবে। বেকায়দায় টানলে অবশ্য গলা যাবে…” বলে কিকিরা তারাপদর দিকে তাকিয়ে খখক্ শব্দ করে হাসলেন। তারপর নিজেই বললেন, “সত্যি কথা বলতে কি স্যার, আমি আসলে ম্যাজিশিয়ান ছিলাম। গণপতিবাবু আমার গুরুর গুরু। আমার সাক্ষাৎ গুরু বড় একটা কলকাতায় আসতেন না। তাঁর ফিল্ড ছিল পাটনা, মজঃফরপুর, জামালপুর; ওদিকে বেনারস, লক্ষ্ণৌ, আগ্রা–এইসব। আমার গুরু অদ্ভুত অদ্ভুত খেলা জানতেন। ইন্ডিয়ান ট্রিক বলে তাঁর একটা খেলা ছিল–তাতে তিনি স্টেজের ওপর একটা মেয়ের হাত-পা, মুখ সব আস্তে আস্তে অদৃশ্য করে দিতেন। তারপর আবার একে একে সব জোড়া লাগিয়ে দিতেন।”

চন্দন কৌতূহল বোধ করছিল, “বলেন কী!”

“মিথ্যে বলব না স্যার, গুরুর নামে কেউ মিথ্যে বলে না।” বলে কিকিরা হাত জোড় করে গুরুর উদ্দেশে প্রণাম জানালেন। উঁচুদূরের লোক ছিলেন তিনি। একবার নাইট্রিক অ্যাসিড খাবার খেলা দেখাতে গিয়ে কী একটা গণ্ডগোল হয়ে গেল। তিনি মারা গেলেন। আমি পনেরো বছর বয়েস থেকে তাঁর চেলাগিরি করেছি। সাত আট বছর লেগে ছিলাম। আরও পাঁচ সাতটা বছর সঙ্গে থাকতে পারলে দেখতেন–কিকিরা কী না করত! জাপান, আমেরিকা, লন্ডন করে বেড়াতাম । কপাল স্যার, কপাল, ব্যাড লাক…।”

তারাপদ জিজ্ঞেস করল, “আপনি নিজেও কি ম্যাজিক দেখিয়ে বেড়াতেন?”

“আমরা ম্যাজিকের বংশ স্যার। আমার ফাদারের অলটারনেট ফাদার বিরাট ম্যাজিশিয়ান ছিলেন।”

চন্দন অবাক হয়ে বলল, “ফাদারের অলটারনেট ফাদার কী জিনিস মশাই?”

কিকিরা মজার মুখ করে হেসে বললেন, “বাবার বাবাকে ছেড়ে তাঁর বাবা–-মানে প্রপিতামহ।”

তারাপদ আর চন্দন হেসে গড়িয়ে গেল।

কিকিরা বললেন, “ওটাই তো আমার অরিজিন্যাল ব্যবসা ছিল স্যার, বছর আট দশ কিকিরা ম্যাজিক মাস্টার হয়েছিল; তারপর আমার বাঁ হাতটায় কী যে হল–প্রথমে ব্যথা-ব্যথা করত, দেখতে দেখতে হাত শুকোতে লাগল, জোর একেবারে কমে গেল, সব সময় কাঁপত। হাত না থাকলে ম্যাজিশিয়ান হওয়া। যায় না। ম্যাজিশিয়ানের হাত, চোখ আর মুখ এই তিনটেই হল আসল। “

চন্দন কী যেন বলতে যাচ্ছিল, তার আগেই কিকিরা তার বাঁ হাতটা দেখালেন। সত্যিই শুকনো মতন দেখতে। আঙুলগুলো বেঁকা বেঁকা, চামড়া কেমন পোড়া পোড়া রঙের। হাতটা কাঁপছিল। কোট থাকার জন্যে কব্জির ওপর দেখা গেল না ।

চন্দন বলল, “আপনি ডাক্তার-টাক্তার দেখাননি?”

“দেখিয়েছি, কত ডাক্তার দেখিয়েছি, ওষুধ খেয়েছি, ইনজেকশান নিয়েছি, কিছু হয়নি। ডাক্তাররা ধরতে পারছে না। কেউ বলছে, নার্ভের রোগ;কেউ বলছে কোনো বিষাক্ত জিনিস থেকে হয়েছে, কেউ আবার অন্য কিছু বলছে–।”

তারাপদ চন্দনকে দেখিয়ে কিকিরাকে বলল, “ও হল ডাক্তার।“

চন্দন যেন সামান্য লজ্জা পেল। বলল, “না না, এখনো পুরো ডাক্তার হইনি, সবে পাশ করেছি।”

তারাপদ রগড় করে বলল, “চন্দন এখনও দশ বিশটা কেন, একটাও মানুষ মারেনি। কাঁচা হাত। দু-চার বছর আরও যাক তারপর ডাক্তার হবে।”

তিনজনেই হেসে উঠল।

হাসি-ঠাট্টার কথা বলতে বলতে রাত বাড়তে লাগল। গাড়ি মাঝে মাঝে থামছে, আবার চলছে। শীতের জন্যে জানলা সব বন্ধ। কামরার লোকজন কথাবার্তা বলতে বলতে ক্রমশই নিস্তেজ হয়ে আসছে। দু-একজন ঘুমিয়েও পড়েছে। কিকিরা ততক্ষণে তারাপদদের নামধাম জেনে গিয়েছেন। শুধু জানতে পারেননি তারাপদরা ঠিক কোথায় যাচ্ছে। ওরা সেই যে বলেছিল মধুপুর-ধুপুর, তার বেশি আর কিছু বলেনি।

বর্ধমানের পর গোটা কামরাটাই যেন ঘুমিয়ে পড়ল।

তারাপদর ঘুম পাচ্ছিল। হাই উঠছিল তার।

হাই তুলতে তুলতে চন্দন হঠাৎ কিকিরাকে বলল, “আপনি তো একজন এক্স-ম্যাজিশিয়ান আচ্ছা এই যে লোকে মন্ত্রটন্ত্রর কথা বলে, আপনি ওসব বিশ্বাস করেন?

মাথা নাড়লেন কিকিরা, “না, ম্যাজিক হল খেলা, তার সঙ্গে মন্ত্রটন্ত্রর কোনো সম্পর্ক নেই। তবে আমি হিপ্নোটিজম, মেসম্যারিজম্ এ-সব বিশ্বাস করি । নিজে করেছি একসময়। আমাদের দেশে অনেকে যোগ অভ্যাস করে অনেকে কিছু করতে পারেন। আমার গুরু মাটির তলায় চাপা দেওয়া অবস্থায় দু-তিন ঘণ্টা থাকতে পারতেন।”

তারাপদ আর বসে থাকতে পারছিল না, বড় ঘুম পাচ্ছে। শুয়ে পড়ার জন্যে তৈরি হতে হতে বলল, “আপনার দু-চারটে ম্যাজিক কাল সকালে উঠে দেখব।”

কিকিরা তারাপদকে দেখতে দেখতে হেসে বললেন, “কাল পর্যন্ত অপেক্ষা করবেন, না এখনই দেখবেন?”

“এখন?”

কিকিরা যেন মজা করছেন এমন চোখমুখ করে বললেন, “একটা স্যাম্পল দেখিয়ে দিই, কী বলেন?” বলে কয়েক পলকের জন্যে চোখ বুজলেন, তারপর বললেন, “আপনি আপনারা মধুপুর যাচ্ছেন না। কোথায় যাচ্ছেন জানি না–তবে মধুপুর নয়, এমন কোনো জায়গায় যাচ্ছেন যার নামের প্রথমে ‘এস্‌’ অক্ষর আছে। রাইট? যার কাছে যাচ্ছেন তার নামের প্রথমে ‘বি’ অক্ষর থাকবে। রাইট?”

তারাপদ যেন চমকে উঠল। চন্দনও। দুজনেই হতভম্ব; অপলকে কিকিরার দিকে তাকিয়ে থাকল, নিশ্বাস নিতেই যেন ভুলে গেছে ।

শেষে তারাপদ বলল, “আপনি–আপনি কে?”

কিকিরা খক খক্ করে বিচিত্র হাসি হেসে বললেন, “আমি কিকিরা দি গ্রেট, কিকিরা দি ম্যাজিশিয়ান।”

তারাপদ মাথায় পাশে তার কিট ব্যাগের দিকে তাকাল। ওই ব্যাগের মধ্যে ভুজঙ্গভূষণকে দেবার জন্যে সিলমোহর করা চিঠি আর প্যাকেট আছে একটা। খুব দরকারি জিনিস। মৃণাল দত্ত বার বার সাবধান করে দিয়েছেন। ও দুটো যদি খোয়া যায় সর্বনাশ হবে। তারাপদ যেজন্য শংকরপুর যাচ্ছে তা ব্যর্থ হবে। এই কিকিরা লোকটা কি সেটা জানে? সে কি সমস্ত জেনেশুনে তারাপদদের পিছু ধরেছে? লোকটার উদ্দেশ্য কী? কোন মতলব নিয়ে সে তাদের সঙ্গী হয়েছে?

তারাপদ ভীষণ ভয় পেয়ে গেল। চন্দনও বিচলিত, বিমূঢ়।