১. কত বিচিত্র ঘটনা

এক

কত বিচিত্র ঘটনাই না জগতে ঘটে যায়। তারাপদর জীবনে যেমন ঘটল আজ।

সকালে খুব বিরস মুখে তারাপদ ঘুম থেকে উঠেছিল। ঘুম ভাঙার মুখে মুখে যদি মনে পড়ে যায়, মেসের বটুকবাবুকে গোটা তিরিশেক টাকা অন্তত দিতেই হবে আজ, নিচের জগন্নাথ চা-অলাকেও পাঁচ-সাত টাকা, তা হলে কারই বা ভাল লাগে! লোকের কাছে ধার-দেনার কথা, নিজের অভাবের কথা মনে হলে ভাবনা-চিন্তা বেড়েই যায়, আরও কত রকম ধারটারের কথা মনে পড়ে, কত রকম অভাব এসে দেখা দেয়। তারাপদরও সেই রকম হল মনে পড়ল–আজ লন্ড্রি থেকে জামাটামা আনতে হবে, তা তাতেও দেড় দু টাকা; নীলুর মনিহারী দোকান থেকে একটা সাবান, নিদেন পক্ষে একটা কি দুটো ব্লেড আনতে গেলে সেও বাকি সতেরো টাকার জন্যে হাত পেতে বসবে। এই রকম আরও কত টুকটাক। না, এ আর ভাল লাগে না! এইভাবে কি বাঁচা যায়, দিনের পর দিন! মাঝে মাঝে তারাপদর মনে হয়, এ জীবন রেখে লাভ নেই; তার চেয়ে একদিন ‘জয় মা বলে ডবল ডেকারের তলায় ঝাঁপ দেওয়াই ভাল।

বিরক্ত বিরস মুখ করে তারাপদ উঠে পড়ল বিছানা ছেড়ে। তার ঘরের জানলা বন্ধ, দরজা খোলা। শীতের দিন বলেই যে জানলা বন্ধ তা নয়, এখন অনেকটা বেলা হয়ে গেছে, রোদ উঠেছে, জানলা খুলে দেওয়া যেত। কিন্তু তার রুমমেট বঙ্কিমদা কখনো সকালে জানলা খুলবেন না। কেননা, জানলাটা খোলা এবং বন্ধ করার মধ্যে কলা-কৌশল আছে। জানলার দুটো পাটই আলগা, প্রায় কৰ্জাবিহীন, হিসেব করে না খুললেই একটা পাট সোজা নিচে বটুকবাবুর মাথায় গিয়ে পড়তে পারে, আর-একটা হয়ত মাঝপথে কোথাও ঝুলতে থাকবে। নারকোল দড়ি, লোহার ছোট শিক–এইসব মালমশলা দিয়ে তারাপদ কোনো রকমে ঘরের জানলা দুটোকে ধরে রেখেছে, যদি না রাখত–এই ঘরে জানলা বলে কিছু থাকত না। তারাপদ খুব বিবেচক। বাড়ির দোষ সে দেয় না। একশো সোওয়াশো বছরের পুরনো বাড়ির হাল এর চেয়ে আর কি ভাল হতে পারে! গলির গলি তার মধ্যে বাড়িটা নড়বড়ে চেহারা নিয়ে, কপোরেশনের ময়লাফেলা গাড়ির মতন ইটকাঠের আবর্জনা হয়ে যে এখনো দাঁড়িয়ে আছে তাই যথেষ্ট। যদি গঙ্গাচরণ মিত্তির লেনের ওই বাড়ি না থাকত-কোথায় যেত তারাপদ? আজকের দিনে মাথা গোঁজার জন্যে তার মাত্র ন’ টাকা খরচ হয় মাসে মাসে। বটুকবাবু এবাড়ির জন্যে সিট রেন্ট বাবদ মাথা পিছু ন টাকা নেন। তাতেও তাঁর লাভ থাকে। আটান্ন টাকা মাসিক ভাড়ার বাড়ি। অবশ্য পুরনো ভাড়াই চলছে। জনা দশেক মেম্বারের মেসের।

তারাপদ ঘরের এক কোণ থেকে তার টুথব্রাশ তুলে নিয়ে আবার বিরক্ত হল। পেস্ট নেই। পরশুই ফুরিয়ে গিয়েছিল। গতকাল কোনো রকমে পেস্টের মুণ্ডু টিপে একটু পাওয়া গিয়েছিল, দাঁত মাজার কাজটা তাতেই সেরেছে। কাল। সারাদিন আর টুথপেস্টের কথা মনে হয়নি।

এক চিলতে সাবানের ওপর ব্রাশ ঘষে নিয়ে মুখ ধুতে যাবার সময় তারাপদর মনে পড়ল, আজ শনিবার। একুশ তারিখ। শনিবার দিনটা এমনিতেই ভাল যায় না তারাপদর, তার ওপর একুশ তারিখ। একুশ তারিখটা তার পক্ষে ভাল নয়। তিন সংখ্যাটাই তার ভাগ্যে সয় না। একুশ, মানে দুই আর এক–সংখ্যা দুটো পাশাপশি রাখলে তাই হয়। দুই আর এক যোগ করো, তিন। খারাপ। ওদিকে আবার একুশকে শুধু তিন আর সাত দিয়ে ভাগ করা যায়, করলে মিলে যায়। তিন দিয়ে মেলানো অশুভ। আবার সাত দিয়ে ভাগ করলে সেই তিন। মানে, যোগ আর ভাগ দু দিকেই একুশ সংখ্যাটা এত খারাপ তারাপদর পক্ষে যে তাকে ডবল খারাপ বলা যায়।

দিনটা যে আজ খুবই খারাপ যাবে সকাল থেকে তারাপদ তার লক্ষণ দেখতে পাচ্ছে । ঘুম থেকে উঠেই টাকার চিন্তা, কোথায় বটুকবাবু, কোথায় নীলু, কোথায় লন্ড্রি। মুখ ধোবার গেস্ট পর্যন্ত জুটল না।

.

মাত্র ক’ঘণ্টা পরেই কিন্তু সব কেমন ওলোট-পালোট হয়ে গেল ।

বেলা সাড়ে বারোটা বাজেনি। তারাপদ হন্তদন্ত হয়ে চন্দনের মেডিক্যাল হোস্টেলে গিয়ে হাজির। চন্দন ঘরেই ছিল। দাবা খেলছিল বন্ধুর সঙ্গে। সবে এম-বি পাশ করেছে চন্দন, পাশ করে পি আর সি-তে আছে।

তারাপদকে এমন অসময়ে আসতে দেখে চন্দন, “কী রে? হঠাৎ?” বলতে বলতে সে তারাপদর খানিকটা উত্তেজিত, খানিকটা বা বিমূ মুখ দেখতে লাগল ।

তারাপদ হাঁপাচ্ছিল। শীতের দিন হলেও তার মুখে যেন সামান্য ঘাম ফুটেছে। চুলটুল রুক্ষ শুকনো শুকনো চেহারা।

তারাপদ দম টেনে বলল, “চাঁদু, তোর সঙ্গে সিরিয়াস কথা আছে।”

“বল”, বলে চন্দন তার দাবার বন্ধুর মুখের দিকে তাকাল।

তারাপদ বলব কি বলব না মুখ করে বসে থাকল। তৃতীয়জনের সামনে তার কথা বলতে ইচ্ছে করছিল না।

চন্দন তার দাবা খেলার বন্ধুকে চোখের ইশারায় আপাতত উঠে যেতে বলল। বন্ধুটি স্নান করতে যাচ্ছিল, তার কাঁধে তোয়ালে ঝোলানো, সে চলে গেল।

বিছানার মাথার দিক থেকে সিগারেটের প্যাকেট দেশলাই উঠিয়ে নিয়ে সিগারেট ধরাল চন্দন; বলল, “কী তোর সিরিআস কথা, বল?”

তারাপদ নিজের উত্তেজনা সামান্য সামলে নিয়ে বলল, “চাঁদু, সাঙ্ঘাতিক একটা কাণ্ড হয়ে গিয়েছে। আমি একটা চিঠি পেয়েছি, আজ, খানিকটা আগে; রেজিস্ট্রি করে এসেছে।“

“কিসের চিঠি? চাকরির?”

“আরে না না–চাকরির নয়,” বলতে বলতে তারাপদ পকেট থেকে খামে মোড়া একটা চিঠি বের করল। “চিঠিটা পড়ে আমার মাথা ঘুরে গেছে। কিছু বুঝতে পারছি না…।” বলে তারাপদ খামসমেত চিঠিটা চন্দনের হাতে দিল।

চিঠি নিল চন্দন। রেজিস্ট্রি করা চিঠি, উইথ এ ডি। খামের মুখ ছেঁড়া। চন্দন চিঠিটা বের করে নিল। ছাপানো প্যাডে ইংরেজিতে লেখা চিঠি। যেন খানিকটা পোশকি ব্যাপার।

প্রথমটায় চন্দন তেমন মন দিতে পারেনি। চিঠির মাঝামাঝি এসে তার কেমন চমক লাগল। তারাপদর দিকে তাকাল একবার। তারপর আবার মন। দিয়ে প্রথম থেকে চিঠিটা পড়তে লাগল।

চিঠি পড়া শেষ করে চন্দন অবাক হয়ে বলল, “এ তো কোনো সলিসিটারের চিঠি বলে মনে হচ্ছে রে।”

তারাপদ মাথা নেড়ে বলল, “মনে হবার কী আছে, লেটার প্যাডের মাথায় তো লেখাই আছে, ভদ্রলোক সলিসিটার।”

“কিন্তু সলিসিটাররা অফিস থেকে চিঠি দেয় বলে শুনেছি। এটাতে বাড়ির ঠিকানা দেওয়া আছে। “

“চিঠিটা খানিকটা পাসসান্যাল বলে বোধ হয়।”

চন্দন আরও একবার চিঠিটা পড়তে পড়তে সিগারেট খেতে লাগল।

তারাপদ বলল, “কিচ্ছু বুঝলি?”

চন্দন বলল, “খানিকটা বুঝলাম। ভদ্রলোক তোকে পত্রপাঠ দেখা করতে বলেছেন। বিষয়সম্পত্তির একটা বড় ব্যাপার জড়িয়ে আছে। কিন্তু এই সলিসিটার ভদ্রলোক যাঁর কথা লিখেছেন, ওই ভুজঙ্গভূষণ হাজরা; উনি কে?”

তারাপদ কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলল, “আমি ভাই এরকম নাম কখনো শুনিনি। অনেক চেষ্টা করেও মনে করতে পারছি না। তবে মা বেঁচে থাকতে শুনেছিলুম–সাঁওতাল পরগনার দিকে আমার এক পিসিমা থাকতেন, তাঁরা হাজরা ছিলেন। পিসিমার নাম বোধ হয় ছিল সুবর্ণলতা। পিসেমশাই নাকি অদ্ভুত মানুষ ছিলেন। আমার মনে হচ্ছে, ভুজঙ্গভূষণ আমার সেই পিসেমশাই। চিঠিতে তো আর কিছু লেখা নেই তেমন।”

চন্দন চিঠিটা মুড়ে খামের মধ্যে ঢোকাল। অন্যমনস্ক। পরে বলল, “বোধ হয় ভুজঙ্গভূষণ তোকে বিরাট কোনো সম্পত্তিটম্পত্তি দিয়ে গেছেন…” বলে হাসল চন্দন, “দেখ, রাজত্বটাজত্ব পেয়ে যেতে পারিস।”

তারাপদ বলল, “আমার তিন কুলে কেউ নেই। টিউশানি করে আর বটুকবাবুর মেসে ডাল ভাত খেয়ে বেঁচে আছি। একটা চাকরি পর্যন্ত জোটাতে পারলাম না। যাও বা একটা জুটেছিল হাতাহাতি করে ছেড়ে এলাম। আমার কপালে ভাই রাজত্ব বর্তাবে ।”

চন্দন হেসে বলল, “বর্তে যাবে রে, তার হিন্টস্ রয়েছে চিঠিতে। তুই বড়লোক হয়ে যাবি। নে লেগে পড়।”

তারাপদ মাথা নাড়ল। তারপর বলল, “কতকগুলো অদ্ভুত অদ্ভুত ব্যাপার রয়েছে এর মধ্যে, তুই লক্ষ করেছিস?”

“কী?”

“প্রথমত ধর, আমার ঠিকানা এরা পেল কেমন করে? যদি ধরেই নি ভুজঙ্গভূষণের বিষয়সম্পত্তি আমার জন্যে বসে বসে কাঁদছে, তবু ব্যাপারটা হেঁয়ালির মতন নয় কি? আমার ঠিকানা সলিসিটার মশাই জানলেন কী করে? কেমন করে বুঝলেন আমি ভুজঙ্গভূষণের আত্মীয়? যদি আমার ঠিকানা জানাই থাকবে তবে সেই ভুজঙ্গভূষণ কেন আমায় নিজে চিঠি লিখলেন না?

চন্দন আচমকা বলল, “ভুজঙ্গভূষণ হয়ত মারা গিয়েছেন।”

“মারা গিয়েছেন?”

“মারা গেলেই এ-সব বিষয়সম্পত্তির ওয়ারিশানের কথা ওঠে।“

“তা আমায় কেন?”

“তুই-ই বোধ হয় একমাত্র মানুষ যে কিনা ভুজঙ্গভূষণের জীবিত আত্মীয়।”

তারাপদ চুপ করে থাকল, অন্যমনস্কভাবে লক্ষ করতে লাগল, ঘরের দেওয়ালে ঝোলানো ক্যালেন্ডারটা দমকা বাতাসে নড়ে নড়ে যাচ্ছে ।

চন্দন বলল, “তুই এত ঘাবড়ে যাচ্ছিস কেন?”

“ব্যাপারটা আমার কাছে খুব গোলমেলে লাগছে।”

“গোলমালের কী আছে, তুই আজ সোজা ওই সলিসিটার ভদ্রলোক কী যেন নাম–মৃণালকান্তি দত্ত, তাই না–, তাঁর কাছে চলে যা। গিয়ে দেখা কর।”

“তারপর?”

“দেখা করে দেখ, কী বলেন ভদ্রলোক। কেন তোকে যেতে বলেছেন।”

“কিন্তু আমি যে ভুজঙ্গভূষণের আত্মীয়, তার প্রমাণ কী? নামে মিললেই মানুষ এক হয় না। আমি তো জাল হতে পারি।”

মাথা নেড়ে চন্দন বলল, “জাল ভেজাল প্রমাণ হয়ে যাবে । ভদ্রলোকের। কাছে নিশ্চয়ই কোনো প্রমাণ আছে। তা ছাড়া যদি তোর সম্পর্কে কোনো খোঁজখবর ও-পক্ষ না রাখত তবে তোর ঠিকানায় চিঠি আসত না।”

তারাপদ চুপ করে থাকল। চন্দন যা বলছে এসব চিন্তা যে তার মাথায়। আসেনি এমন নয়। চিঠি পাবার পর থেকে সে অনবরত ভেবেই যাচ্ছে, ভেবে কোনো কূলকিনারা পাচ্ছে না। সমস্ত ব্যাপারটাই অবিশ্বাস্য। তারাপদ ভাবতেই পারছে না, যে ভুজঙ্গভূষণকে সে জীবনে চোখে দেখেনি, যার নাম শোনেনি, সেই লোক সত্যি সত্যি তারাপদর জন্যে বড়সড় কোনো বিষয়সম্পত্তি রেখে যেতে পারে! বরং এ-সব ব্যাপারে এমন একটা রহস্য রয়েছে যে, না জেনে না বুঝে এগুতে পেলে বিপদে পড়ে যাবে । গোলমেলে ব্যাপারের মধ্যে গেলেই বিপদ।

খানিকক্ষণ চুপচাপ থেকে তারাপদ বলল, “তুই যেতে বলছিস?”

“আলবত্ যাবি।”

“আমার কেমন নার্ভাস লাগছে।”

“কিসের নার্ভাস! তোকে কি সলিসিটার খেয়ে ফেলবে? তুই কি নিজে যাচ্ছিস? তোকে দয়া করে যেতে বলেছে বলে তুই যাচ্ছিস।”

“তুই আমার সঙ্গে যাবি?”

“আমি?”

“উকিল অ্যাটর্নি শুনলেই আমার ভয় করে। তা ছাড়া ওই যে কী ঠিকানা–কত নম্বর ওল্ড আলিপুর–ও সব ভাই আমি চিনি না। চল তুই…।”

‘বিকেলে আমার যে অন্য দরকার ছিল রে!”

“ক্যানসেল করে দে।…তোর এমন কোনো কাজ নেই। হাসপাতালের চাকরিরও যা বাহার।”

একটু কি ভাবল চন্দন, তারপর বলল, “বেশ, তা হলে বিকেল বিকেল চল । শীতের দিন। পাঁচটা বাজতেই সন্ধে হয়ে যাবে।”

তারাপদ যেন আশ্বস্ত হল খানিকটা। হঠাৎ আবার চোখে পড়ে গেল ক্যালেন্ডারটা। তারাপদ বলল, “চাঁদু, আজ কিন্তু আমার দিনটা ভাল নয়।”

“মানে?”

“একে শনিবার তায় একুশ তারিখ। তিন হল আমার আনলাকি নাম্বার। চন্দন হেসে উঠল। গালাগাল দিয়ে বলল, “তোর যত কুসংস্কার। এসব মাথায় কে ঢোকায় রে? আমি তো দেখছি আজ তোর সাঙ্ঘাতিকু দিন, এ ডে। অফ ফরচুন।”

তারাপদ তখনো খুঁতখুঁত করতে লাগল।

শেষে চন্দন বলল, “আমার এখনো নাওয়া-খাওয়া হয়নি। তুই মেসে যা। ঠিক চারটের সময় ওয়েলিংটনের মোড়ে থাকবে। আমি আসব ।”

তারাপদ উঠল । অনেক বেলা হয়ে যাচ্ছে।

.

আলিপুরে পৌঁছতে পৌঁছতে অন্ধকার হয়ে গেল। ডিসেম্বর মাসের এই সময়টা এই রকমই, বিকেল ফুরোবার আগেই সব ঝাপসা, ঝপ করে যেন অন্ধকার নেমে আসে আকাশ থেকে। জায়গাটাও কেমন নিরিবিলি। পুরনো আলিপুরের সেই প্রাচীন, বনেদি বাড়ি-ঘর এদিকে রাজারাজড়ার এলাকা যেন, উঁচু উঁচু দেওয়াল ঘেরা বাড়ি, মস্ত মস্ত গাছ, ফটকে দরোয়ান, ভেতরে অ্যালসেশিয়ান কুকুরের গর্জন, ঝকঝকে গাড়ি বেরুচ্ছে, ঢুকছে, রাস্তাটাস্তা বেশ ফাঁকা-ফাঁকা। তারাপদর কেমন গা ছমছম করছিল। সে বেচারি বউবাজারের দিকে থাকে, গঙ্গাচরণ মিত্তির লেনে, যেখানে আলো-বাতাসও ঢুকতে ভয় পায়, গাছটাছ তো দূরের কথা, কোথাও একটা সবুজ পাতা পর্যন্ত দেখা যায় না–সেই তারাপদ এরকম একটা জায়গায় এসে ঘাবড়ে যাবে না তো কী হবে!

তারাপদ বলল, “চাঁদু, এ-দিকে এলে মনেই হয় না এটা কলকাতা, কী বল?”

চন্দন দু পাশের বাড়ি, বাগান, গাছপালা দেখতে দেখতে হাঁটছিল ধীরে ধীরে সলিসিটার দত্ত-র বাড়ির নম্বর খুঁজছিল। ততক্ষণে রাস্তার বাতি জ্বলে উঠেছে, মাথার ওপর আকাশে তারা দেখা যাচ্ছিল।

বাড়িটা পাওয়া গেল। আশেপাশের বাড়ির তুলনায় ছোট। পুরনো আমলের বাড়ি। সামনে বাগান ছোটমতন।

ফটকের সামনে কেউ ছিল না। তারাপদ ঢুকতে চাইছিল না, যদি অ্যালসেশিয়ান তেড়ে আসে।

চন্দন বলল, “কুকুর নেই, থাকলে বাঁধা আছে; চলে আয়–।”

ফটক খুলে দুজনে ভেতরে ঢুকল। তারাপদর ভয় করছিল। তার ওপর শীতটাও যেন বেচারিকে জাপটে ধরেছে, কাঁপতে লাগল তারাপদ।

অল্প এগিয়ে গাড়ি বারান্দা।

গাড়ি বারান্দার সিঁড়িতে উঠে একজনকে দেখতে পাওয়া গেল। বুড়ো মতন একটি লোক। পরনে খাটো ধুতি, গায়ে মোটা চাদর।

তারাপদদের দেখতে পেয়ে লোকটি কেমন অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকল। তারপর কাছে এল। তার চোখে দেখে বোঝা যাচ্ছিল সে জিজ্ঞেস করছে, কাকে চাই আপনাদের?

চন্দন বলল, “আমরা বউবাজার থেকে আসছি। মিস্টার দত্ত আমাদের দেখা করতে বলেছেন।” বলে চন্দন তারাপদকে দেখিয়ে দিল। “বাবু এঁকে চিঠি লিখেছেন দেখা করার জন্যে। এঁর নামটা বলে গিয়ে বাবুকে।” চন্দন তারাপদর নাম ঠিকানা বলল।

তারাপদদের অপেক্ষা করতে বলে লোকটি চলে গেল। দুই বন্ধু দাঁড়িয়ে থাকল চুপ করে। দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে চারপাশ দেখতে লাগল। এক সময় নিশ্চয় বিস্তর পয়সা ছিল বাড়ির মালিকের, সাজিয়ে গুছিয়ে বাড়ি করেছিল, এখনো তার প্রমাণ চোখে পড়ে। মাথার ওপর শেকল দিয়ে ঝোলানো সাদা শেড় পরানো বড় বাতি জ্বলছে, আলোর রঙ বাদামী; এই ঢাকা জায়গা–অনেকটা যেন লবির মতন, দু পাশেই বড় বড় সেটি পাতা রয়েছে বসার জন্যে, এক কোণে হ্যাট স্ট্যান্ড, আয়না, দেওয়ালে গোটা দুয়েক বিশাল বিশাল ছবি ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির আমলের, একটা চমৎকার হরিণের মাথা।

সমস্ত বাড়ি কিন্তু কী চুপচাপ। দোতলা থেকে পাতলা স্বর ভেসে আসছিল সামান্য।

লোকটি ফিরে এল। এসে বলল, “আসুন আপনারা।”

খুবই আশ্চর্য, ডান বা বাঁ দিকের মুখোমুখি দুটো বাইরের ঘরের কোনোটাতেই ওদের নিয়ে গিয়ে বসাল না লোকটি। একটু ভেতর দিকের একটা ঘরে নিয়ে গিয়ে বসাল। তারাপদদের আর-একবার ভাল করে দেখে চলে গেল। .

সেকেলে কাঠের গদি-আঁটা চেয়ারে বসল তারাপদরা। এই ঘরটা সামান্য ছোট। ঘরের বারোআনা শুধু বইয়ে ভরতি। মোটা মোটা বই। বোধ হয় আইনের বই। একদিকে দেওয়ালে-গাঁথা সিন্দুক। লোহার একটা আলমারি অন্যদিকে। জানলা বরাবর বোধহয় দত্ত-মশাইয়ের বসার জায়গা, সিংহাসনের মতন চেয়ার, সামনে সেক্রেটারিয়েট টেবিল।

এই ঘরের গন্ধই যেন কেমন আলাদা। বইপত্রের জন্যেই বোধ হয় ধুলোধুলো গন্ধ লাগে নাকে। পায়ের তলায় জুট কার্পেট। দেওয়ালের দু-এক জায়গায় ছোপ লেগেছে। ঘরে মস্ত বড় একটা পোর্ট্রেট ঝোলানো, কোনো বৃদ্ধের, দত্ত-মশাইয়ের বাবা কিংবা ঠাকুরদার। এক দিকে নিচু টেবিলের ওপর একটা বেড়াল। জ্যান্ত নয়, মরা। কেমন করে তৈরি করেছে কে জানে! একেবারে জ্যান্ত বলে মনে হয়। গায়ের লোেম, চোখের মণি, কান, পায়ের থাবা সব যেন জীবন্ত। বেড়ালের গায়ের রঙ কুচকুচে কালো। চোখে খুব যে ভাল লাগে তা কিন্তু নয়।

তারাপদ আর চন্দন নিচু গলায় কথা বলছিল, পায়ের শব্দ শুনে চুপ করে গেল।

ছিপছিপে চেহারার এক ভদ্রলোক ঘরে এলেন। টকটকে গায়ের রঙ, মাথায় বেশ লম্বা, পরিষ্কার করে কামানো মুখ, মাথার চুল একেবারে সাদা ধবধবে, পরনে ধুতি, গায়ে পুরো হাতা পশমী গেঞ্জির ওপর দামি শাল। চোখে চশমা।

তারাপদরা উঠে দাঁড়াল। দাঁড়িয়ে জড়সড়ভাবে নমস্কার করত হাত তুলে।

ভদ্রলোক প্রতিনমস্কার করলেন। চশমার আড়াল থেকে দুজনকে লক্ষ করতে করতে নিজের জায়গায় গিয়ে বসলেন শেষে ।

চন্দন ইশারায় তারাপদকে চিঠিটা বের করতে বলল।

তারাপদ চিঠি বের করল।

চিঠি বের করে তারাপদ দু পা এগিয়ে সেক্রেটারিয়েট টেবিলের সামনে গিয়ে দাঁড়াল। “আজ সকালে আমি এই চিঠিটা পেয়েছি । আপনিই কি আমায় দেখা করতে বলেছিলেন?”

ভদ্রলোক চিঠির জন্যে হাত বাড়ালেন। দেখলেন। বললেন, “হ্যাঁ, আমারই নাম মৃণালকান্তি দত্ত। বসুন আপনি।”

তারাপদ আবার দু পা পিছিয়ে এসে চন্দনের পাশে বসল।

মৃণাল দত্ত কিছুক্ষণ সরাসরি তারাপদদের দিকে তাকিয়ে থাকলেন। তারপর হঠাৎ বললেন, “আপনার নামই তারাপদ?”

তারাপদ একটু কেমন ধাঁধায় পড়ে গেল। এ আবার কেমন প্রশ্ন? সামান্য যেন রাগই হল। ভাবল, বলে–আজ্ঞে আমি তো তাই জানি।…

কিন্তু মৃণাল দত্তের সামনে দাঁড়িয়ে সে-কথা বলতে তার সাহস হল না। ভদ্রলোকের চেহারায় শুধু ব্যক্তিত্বই নেই, দেখলেই বোঝা যায়, অসম্ভব সাবধানী, চালাক এবং বুদ্ধিমান উনি।

তারাপদ নিজের নাম বলল, আবার, পদবী সমেত। বটুকবাবুর মেসের ঠিকানাও।

“আপনার পিতার নাম?”

তারাপদ তার বাবার নাম বলল। তাতেও রেহাই নেই, মার নামও বলতে হল। বাবার নাম, মার নামের পর তাদের পৈতৃক দেশবাড়ি ভিটেমাটির কথাও।

তারাপদ বলল, “আমি এ-সব চোখে দেখিনি। ছেলেবেলায় একবার দেশের বাড়িতে গিয়েছিলাম, তখন আমার চার-পাঁচ বছর বয়েস, আমার কিচ্ছু মনে নেই। শুধু একটা তেঁতুল গাছের কথা মনে আছে, খুব বড় তেঁতুল গাছ, গাছটায় নাকি ভূত থাকত…..” তারাপদ একটু হাসল।

এমন সময় বাহারি ট্রের ওপর সুন্দর কাপে করে চা আনল সেই বুড়ো লোকটি। তারাপদদের দিল।

মৃণাল দত্ত বললেন, “চা খাও–”, বলেই তাঁর কী খেয়াল হল, সামান্য হালকা গলায় বললেন, “তোমাদের তুমি বলছি, কিছু মনে করো না, বয়েস তোমাদের অনেক কম।”

চা পেয়ে তারাপদরা বেঁচে গেল । একে এই বিশ্রী অবস্থা, তার ওপর শীত, হাত-পা রীতিমত ঠাণ্ডা হয়ে আসার জোগাড়।

“ওই ছেলেটি তোমার বন্ধু?” মৃণাল দত্ত চন্দনকে দেখিয়ে তারাপদকে জিজ্ঞেস করলেন।

“আমার পুরনো বন্ধু । ওর নাম চন্দন। ডাক্তারি পাশ করেছে সবে।”

মৃণাল দত্ত চন্দনকে দু চারটে কথা জিজ্ঞেস করলেন, পুরো নাম কী চন্দনের, কোথায় থাকে, বাড়ি কোথায়, বাবা কী করেন, কোথায় থাকেন–এই সব ।

শেষে মৃণাল দত্ত তারাপদর দিকে তাকিয়ে বললেন, “তোমায় এবার কটা কথা জিজ্ঞেস করব। ঠিকঠিক জবাব দিও। তোমার বন্ধু এখন এখানে থাকতে পারে–পরে তাকে একটু উঠে যেতে হবে।”

তারাপদ একবার চন্দনের মুখের দিকে তাকাল। তারপর মৃণালবাবুর দিকে চোখ ফিরিয়ে বলল, “চাঁদু আমার পুরনো বন্ধু। ওর কাছে আমার কিছু গোপন করার নেই। ও আমার সবই জানে।”

“আচ্ছা, সে আমি পরে ভেবে দেখব। এখন তোমার বন্ধু থাকুক।” বলে মৃণাল দত্ত যেন সামান্য কি ভেবে নিলেন।

খুবই আচমকা মৃণাল দত্ত বললেন, “তুমি ভুজঙ্গবাবুকে কখনো দেখেছ?”

“আজ্ঞে, না।”

“তাঁর নাম শুনেছ?”

“আমার মনে পড়ছে না।“ মার কাছে আমার এক পিসিমার কথা শুনেছি। পিসিমার শ্বশুরবাড়ির পদবী ছিল হাজরা। সাঁওতাল পরগনার কোথায় যেন থাকতেন জায়গাটার নাম আমি জানি না । মা যদি বলেও থাকে–আমি ভুলে গিয়েছি।”

মৃণাল দত্ত খুব শান্তভাবে বসে, তারাপদর দিকে তাকিয়ে আছেন। একটু চুপ করে থেকে বললেন, “তোমার বাবা কবে মারা যান?”

“বাবা–! বাবা মারা গেছেন অনেক দিন। আমি তখন স্কুলে পড়ি। ক্লাস এইট-এ।”

“অসুখ করেছিল? কী অসুখ?”

“কী অসুখ আমি বলতে পারব না।…বাবা কলকাতার বাইরে কোথায় যেন গিয়েছিলেন। অসুস্থ হয়ে ফিরে আসেন। কয়েক দিনের মধ্যে মারা যান।”

“কোথায় গিয়েছিলেন জানো না?”

“না।”

“মা-র কাছে কিছু শুনেছ?”

“না।…বাবা যখন ফিরে আসেন তিনি কেমন যেন হয়ে গিয়েছিলেন, অনেকটা পাগলের মতন। অথচ একটা কথাও বলতেন না। বলতে পারতেন না। একেবারে বোবা। মাথায়ও কিছু হয়েছিল, মনে হত আমাদের চিনতেও পারছেন না।” বলতে বলতে তারাপদ দীর্ঘনিশ্বাস ফেলল। এতকাল পূরে বাবার কথা মনে হওয়ায় হঠাৎ যেন সেই পুরনো স্মৃতি তাকে কেমন বিষণ্ণ করে তুলল।

মৃণাল দত্ত নীরব। চন্দন আড় চোখে একবার কালো বেড়ালটার দিকে তাকাল। তার চোখের মণিতে আলো পড়েছে যেন।

“তোমার মা কবে মারা যান?” মৃণাল শুধোলেন।

“আমি কলেজ থেকে বেরুবার পর মা মারা যায়। বাবা মারা যাবার পর মা অনেক কষ্টে স্কুলে একটা চাকরি জুটিয়ে নেয়। আমরা বরাবরই খুব গরিবভাবে থেকেছি। কোনো রকমে চলত দুজনের। মার বুকের অসুখ করেছিল। তাতেই মারা যায়।”

মৃণাল দত্ত সেক্রেটারিয়েট টেবিলের ওপর রাখা চুরুটের বাক্স থেকে একটা চুরুট বেছে নিলেন। “তোমরা আগে কোথায় থাকতে, ঠিকানা কী?”

তারাপদ মদন দত্ত লেনের ঠিকানা বলল।

“তারপর?”

তারাপদ বটুকবাবুর মেসে এসে ওঠার আগে যেখানে যেখানে ছিল তার কথা বলল ।

চুরুট ধরিয়ে নিয়ে মৃণাল দত্ত এবার বললেন, “তোমার পিসেমশাই ভুজঙ্গভূষণ তোমায় তাঁর সমস্ত বিষয়সম্পত্তি স্থাবর অস্থাবর-সবই দিয়ে যেতে চান। ভূজঙ্গবাবুর প্রপার্টি যা যা আছে তার সঠিক ভ্যালুয়েশান আমি এখনই দিতে পারব না। ধরো মোটামুটি দেড় থেকে পৌনে দুই লাখ টাকার। এ-সমস্তই তোমার হবে। কিন্তু…”

তারাপদর মাথা প্রায় ঘুরে উঠল। দেড় লাখ টাকার সম্পত্তি! আজ সকালে দাঁত মাজার স্টে পর্যন্ত যার ছিল না, বটুকবাবুর তিরিশটা টাকার জন্যে যারা আত্মহত্যা করার ইচ্ছে করছিল, সেই লোক সন্ধেবেলায় দেড় লাখ টাকার সম্পত্তি পাচ্ছে। তারাপদর ইচ্ছে করছিল থিয়েটারের লোকদের মতন হাহা করে হেসে ওঠে।

মৃণাল দত্ত বললেন, “কিন্তু এই সম্পত্তি পাবার আগে তোমায় দুটো শর্ত পালন করতে হবে।”

তারাপদ ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকল।

মৃণাল দত্ত বললেন, “তুমিই যে ভুজঙ্গবাবুর আত্মীয় তারাপদ তা প্রমাণ করতে হবে।”

“কী করে করব?”।

“তোমার যা করার করেছ, বাকিটা আমি করব। আমার কাছে প্রমাণ আছে। আমি মিলিয়ে দেখব। তার আগে তোমার বন্ধুকে এ-ঘর থেকে কিছুক্ষণের জন্যে উঠে যেতে হবে।”

তারাপদ কিছু বলার আগেই চন্দন উঠে দাঁড়াল। সেও রীতিমত উত্তেজনা বোধ করছিল।

তারাপদ বলল, “আর-একটা শর্ত কী?”

মৃণাল দত্ত শান্ত গলায়, “প্রথমটা যদি মেলে তবে না দ্বিতীয়টা!” চন্দন আর-একবার বেড়ালটার দিকে তাকিয়ে আস্তে আস্তে ঘর ছেড়ে চলে গেল।