১২. আত্মা-নামানোর সেই রহস্যময় ঘরে

বারো

সন্ধের পর পর তারাপদ ভুজঙ্গভূষণের আত্মা-নামানোর সেই রহস্যময় ঘরে এসে বসল। আজ সে একা, চন্দন নেই। চন্দন আসবে না।

দুপুরটা যে কেমন করে কেটেছে, তারাপদ নিজেই শুধু জানে, আর জানে চন্দন। উত্তেজনায় যেন ফেটে পড়েছিল মাঝে মাঝে; দুঃখে ঘৃণায় এক এক সময় সে খেপার মতন কাণ্ড করছিল। চন্দন তাকে অনেক কষ্টে সামলেছে। বলেছে, “ওরকম করিস না তারা, ভুজঙ্গর কোনো চেলা যদি একবার বুঝতে পারে আমরা ভুজঙ্গর সিক্রেট জানতে পেরেছি তা হলে তুইও গেলি, আমিও গেলাম। নিজেকে কন্ট্রোল কর। তোকে এখন অ্যাক্টিং করতে হবে, কিকিরা যেভাবে শিখিয়ে দিয়েছেন।”

চন্দন অনেক বুদ্ধিমান। তারাপদর ওই ছটফটে ভাবটাকে সে বুদ্ধি করে কাজে লাগাল। কম্বল মুড়ি দিয়ে বিছানায় শুয়ে থাকতে বলল বন্ধুকে। তারপর মৃত্যুঞ্জয়কে ডেকে পাঠাল। তারাপদকে বলল, “ভুজঙ্গর সঙ্গে আর একবার দেখা করতে চাস তুই; একলা। শেষবারের মতন তোর মা-বাবার কাছে দুটো কথা জানতে চাস। বুঝলি?”

তারাপদ সবই বুঝল। ভুজঙ্গর ওই ঘরে বসে আজ তাকে সত্যিই অনেক কিছু করতে হবে। কিকিরা বলে দিয়েছেন, বুঝিয়ে দিয়েছেন।

মৃত্যুঞ্জয় এল, চন্দনই কথা বলল বেশি, তারাপদ কেমন ভেঙে পড়েছে, কী ভীষণ কান্নাকাটি করছে–এই সব বুঝিয়ে বলল, আজ আর-একবার সে ভুজঙ্গভূষণের সঙ্গে দেখা করতে চায়।

তারাপদ প্রায় কিছুই বলল না, বড় বড় নিশ্বাস ফেলতে লাগল। তার চোখমুখ দেখে মৃত্যুঞ্জয় কী ভাবল কে জানে, ভুজঙ্গভূষণকে তারাপদর কথা বলতে গেল। খানিকটা পরেই আবার ফিরে এল, বলল, “হ্যাঁদেখা হবে।”

সেই দেখা করতেই তারাপদ এখন সন্ধেবেলায় ভুজঙ্গভূষণের রহস্যময় ঘরে এসে বসেছে। একলা।

তারাপদ চুপচাপ বসেই থাকল। আজ ক’দিন আসা-যাওয়া করতে করতে এই ঘর তারাপদর চেনা হয়ে গেছে। অভ্যেসও হয়ে এসেছে অনেকটা। আগের মতন অতটা গা-ছমছম করে না। তবু এই ঘরের একটা ভৌতিক পরিবেশ রয়েছে, মন যেন অন্যরকম হয়ে যায়, বুকের মধ্যে শিরশিরে ভাব হয়।

তারাপদ এপাশ ওপাশ তাকাতে লাগল। এত অস্পষ্ট, প্রায়-ঘুটঘুঁটে ঘরে কোনো কিছুই ভাল করে দেখা যায় না। এই ঘর যেমন ছিল সেই রকমই রয়েছে। সেই একই মিটমিটে আলো, সেই ধূপধুনোর গন্ধ, সেই ভুজঙ্গভূষণের সিংহাসন, সেই বেড়াল ।

ছোট টেবিলের ওপর বসানো কালো বেড়ালটাকে দেখল তারাপদ। এই বেড়াল তাদের খুব অবাক করেছিল, ভয়ও পাইয়ে দিয়েছিল। আজ তারাপদ কালো বেড়ালটাকে দেখল। তার ভয় হল না। কেনই বা হবে? এটাও তো চালাকি, কিংবা মানুষকে বোকা বানিয়ে দেবার ফন্দি। চন্দন কিকিরাকে জিজ্ঞেস করেছিল, কেমন করে বেড়ালটা ঘুরে যায়?

কিকিরা হেসে হেসে বলেছিলেন, ঘড়ির কাঁটা যেভাবে ঘোরে। ঘড়িতে দুটো কাঁটা থাকে, ছোট কাঁটা আর বড় কাঁটা, যদি একটা থাকত কী হত? একটাই ঘুরত। খুব পুরনো আমলের বড় বড় দেওয়াল-ঘড়ি কিংবা দেরাজের ওপর রাখা ঘড়ি দেখেছেন স্যার? এক একটা ঘড়ি থাকত যার মধ্যে ঘণ্টার কাঁটার ওপর ছোট্ট রঙিন পাখি বসানো থাকত মেটালের। ঘণ্টার সঙ্গে সঙ্গে সেটাও ঘুরত। এটাও সেই রকম, তফাতের মধ্যে কী জানেন, ঘড়ির যন্ত্রপাতিগুলো নিচে আছে, আর ওপরে–কাঁটার বদলে একটা ফুঁকো বেড়াল, পেপার পাল্পের কিংবা হালকা কিছুর। ঠিক যেভাবে গ্রামোফোনের রেকর্ড ঘোরে–সেইভাবে বেড়ালটা ঘুরছে, তবে খুব ধীরে ধীরে–বোঝা যায় না। যদি একটা ওয়াল-ক্লক মাটিতে শুইয়ে রাখেন চিত করে তার কাঁটাও এইভাবে ঘুরবে।

তারাপদ কালো বেড়ালটার দিক থেকে চোখ সরিয়ে নেবার আগেই স্তোত্রপাঠ শুরু হল। যেমন রোজই হয়–সেইরকম। দামি লাউডস্পিকারটা যে কোথায়, বোঝা যায় না, কিন্তু বড় নিখুঁত। এই নিঃশব্দ ঘরে চমৎকার শোনায়, মন ধীরে ধীরে কেমন যেন হয়ে যায়।

স্তোত্রপাঠ শেষ হবার সঙ্গে সঙ্গে ঘরের সেই ক্ষীণ আলো নিবে গেল। নিবে গিয়ে ভুজঙ্গভূষণের বসবার দিকটায় লাল আলো জ্বলে উঠল । ভেলভেটের পরদা সরিয়ে ভুজঙ্গভূষণ এলেন, সেই একই রক্ত-গৈরিক বসন, গলায় রুদ্রাক্ষ মালা, মুখ মুখোশে ঢাকা।

নিজের আসনে বসলেন ভুজঙ্গভূষণ। তাঁর পায়ের দিকে একপাশে ঘণ্টা।

তারাপদ এইবার ভয় পেতে শুরু করল। উত্তেজনা আর ভয়ে তার গলা শুকিয়ে আসছে। আজ যে কী হবে শেষ পর্যন্ত সে জানে না। হয়ত ভীষণ কোনো বিপদে পড়বে, তেমন কিছু ঘটলে বাঁচবে না মরবে–কে বলতে পারে । মনের এই ভয়ের ভাবটাও কাটাবার জন্যে প্রাণপণে তারাপদ বাবার কথা ভাবতে লাগল। এই লোকটা–ওই ভুজঙ্গভূষণ তার সরল, ভালোমানুষ, সাদাসিধে স্বভাবের বাবাকে কী ভীষণ প্রবঞ্চনা করেছে। শুধু প্রবঞ্চনা নয়, সেই প্রবঞ্চনার দরুন তার বাবা-বেচারি মিথ্যেকে সত্য বলে জেনেছে। বাবা-বেচারির হয় মানসিক আঘাত লেগেছিল, না হয় বাবা মেয়ের কথা ভাবতে ভাবতে পাগলের মতন হয়ে পড়েছিল। তাতেই বাবার অসুখ, আর মাত্র কয়েক দিনের মধ্যেই মৃত্যু।

এই সমস্তর জন্যে ওই ভুজঙ্গই দায়ী। বাবাকে ওই লোকটাই মেরেছে। তারাপদদের সংসার, তাদের জীবন, এত দুঃখকষ্ট, মার অত কষ্ট সওয়াসবই ওই শয়তানটার জন্যে। তারাপদ কেমন করে লোকটাকে ক্ষমা করবে?

তারাপদকে চমকে দিয়ে ভুজঙ্গভূষণই কথা বললেন, “তারাপদ, তুমি আজ আবার আমার সঙ্গে দেখা করতে চেয়েছ কেন? আমার শরীর ভাল নেই, ভাবছিলাম বিশ্রাম করব।”

প্রথমে কথা বলতে পারল না তারাপদ, গলা কাঠ হয়ে থাকল। বার দুই গলা পরিষ্কার করে শেষে কাঁপা কাঁপা গলায় তারাপদ বলল, “আপনার সঙ্গে আমার ক’টা কথা ছিল।”

“বলো।”

একটু থেমে নিজেকে সামলে নিতে নিতে তারাপদ বলল, “কাল সারারাত আমি ঘুমোত পারিনি, শুধু ভেবেছি। আজও সারাদিন ভেবেছি। আমার বন্ধুর সঙ্গে কথা বলেছি।” বলে আবার একটু থামল তারাপদ, তারপর গলায় যতটা সম্ভব আবেগ দিয়ে বলল, “পিসেমশাই, আপনি রাগ করবেন না, আপনার। কথামতন আমি চলতে রাজি। কিন্তু আর একবার, একটিবার মাত্র আমি মা-বাবার কাছে তাঁদের আদেশ জানতে চাই। মনে কোনো খুঁত রাখতে চাই না। আপনি দয়া করে আজ একবার ওঁদের ডাকুন।”

“আবার?” ভুজঙ্গভূষণ বললেন।

“শুধু আজকের মতন-” তারাপদ মিনতি জানাল।

“তোমার মনে কি এখনো সন্দেহ আছে, তারাপদ? তোমার মা বাবার যা ইচ্ছে সে তো আগেই জেনেছ।”

“আমার কোনো সন্দেহ নেই। তবু সব ছেড়েছুঁড়ে যখন আপনার এখানে চলে আসব ভাবছি–তখন আসবার আগে আর একবার মা বাবার আদেশ নিতে চাই।”

দু মুহূর্ত অপেক্ষা করে ভুজঙ্গভূষণ বললেন, “বেশ। আজই তোমায় মনঃস্থির করতে হবে, আর সময় পাবে না।”

ভুজঙ্গভূষণ ঘণ্টা বাজালেন। মৃত্যুঞ্জয় এল ।

কিছু যেন বললেন ভুজঙ্গভূষণ, তারাপদ কিছুই শুনতে পেল না, বুঝতেও পারল না। মৃত্যুঞ্জয় চলে গেল।

ভুজঙ্গভূষণ বললেন, “তোমার বন্ধু কবে ফিরবে?”

“ফিরবে। শীঘ্রি।”

তারাপদ বেশি কথা বলল না। কিছু না বলে চুপ করে থাকাই ভাল। কথা ঘুরোবার জন্যেই হোক কিংবা অন্য কোনো কারণেই হোক, তারাপদ আচমকা বলল, “পিসেমশাই, একটা কথা বলব?”

“বলো।”

“আপনার এই ঘরবাড়ি সম্পত্তি আপনি কেন আমায় দিয়ে যেতে চাইছেন?”

“কেন চাইছি তোমায় বলেছি। আমার নিজের বলতে কেউ নেই, তুমি ছাড়া। আমি যা করেছি ও রেখেছি, তা তোমার হাতে থাকলেই খুশি হব। “

মৃত্যুঞ্জয় ততক্ষণে আবার ফিরে এল। ভুজঙ্গভূষণকে কিছু বলল মুখটা নামিয়ে । ভুজঙ্গ ইশারায় ঘরের দিকে আঙুল দিয়ে কী দেখালেন। চলে গেল মৃত্যুঞ্জয়। একটু পরেই আর-একজন এল, ঘরের মধ্যে আবার ধুনো দিয়ে গেল, লুকোনো জায়গায় ধূপ বসিয়ে গেল।

ঘরটা আবার ধোঁয়ায় আরও অস্পষ্ট হল। ধুনো-গুগগুলের গন্ধে চাপা বাতাস ভারী হয়ে উঠল।

আর-একটু পরেই সেই মেয়েটি এল। কালো শাড়ি জামা পরা, মাথায় এলো চুল। এল, ভুজঙ্গর সামনে দাঁড়াল, তারপর ঘণ্টাটা তুলে নিয়ে গোল টেবিলের অন্যদিকে বসল। আজ চন্দন নেই, সে থাকলে যেমনভাবে তিনজনে গোল হয়ে বসা যায়, কানামাছি খেলার মতন হাত ছড়িয়ে-তেমনভাবে বসা গেল না। মুখোমুখি বসতে হল; সকালে কিকিরার সামনে যেমনভাবে বসেছিল তারাপদ।

নতুন করে শেখাবার কিছু নেই। তারাপদ টেবিলের ওপর হাত ছড়িয়ে দিল, পা বাড়িয়ে দিল টেবিলের তলা দিয়ে। মেয়েটিকে একবার ভাল করে দেখল। অন্য দিনের চেয়ে আজ যেন মেয়েটিকে শুকনো দেখাচ্ছে। রোগা মুখ আরও শুকনো।

এরপর রোজই যেমন হয়–সেই রকম। ঘরের বাতি নিবে গেল। ঘুটঘুঁটে অন্ধকার। টেবিলের ওপর তারাপদ হাত বাড়িয়ে মেয়েটির হাত ধরে রেখেছে। তার পায়ের আঙুলের সঙ্গে মেয়েটির পায়ের আঙুল ছোঁয়াননা। ভুজঙ্গভূষণ তাঁর গম্ভীর গলায় বললেন, “তারাপদ, তুমি তোমার মার কথা ভাব। তাকে ডাকো। মন যেন চঞ্চল না হয়!”

তারাপদ মা বাবার কথা ভাবল না। কোনো প্রয়োজন নেই।

খুব সতর্ক ছিল তারাপদ। সমস্ত কিছু অনুভব করার চেষ্টা করছিল। চোখ খুলছিল মাঝে মাঝেই। যদিও চোখ খোলার কোনো অর্থ হয় না। এই জমাট অন্ধকারে এক বিঘত দূরের জিনিসও বিন্দুমাত্র চোখে পড়ে না।

প্রথমেই একটা জিনিস অনুভব করতে পারল তারাপদ। মেয়েটির ডান পায়ের আঙুল শক্ত শক্ত লাগলেও বাঁ পায়ের আঙুল অত শক্ত লাগছে না। তার মানে, আগের কদিন মেয়েটির দুটি পায়ের একটি চন্দন ছুঁয়ে থাকত, অন্য পা ছুঁয়ে থাকত তারাপদ। একই লোকের পক্ষে এই তফাত বোঝার উপায় ছিল না, মেয়েটির এক পায়ের আঙুল কেন কাঠের মতন শক্ত, অন্য পায়ের আঙুল স্বাভাবিক? এই তফাতটুকু কেন?

তারাপদ খুব সহজেই এই ধাঁধা ধরে ফেলতে পারল। মেয়েটি তার ডান পায়ে নকল পাতা পরে। সেই পা কাঠ কিংবা শক্ত রবারের পায়ের ফাঁপা পাতা থেকে বের করে নিয়ে ঘণ্টা বাজায়। কিকিরা ঠিকই বলেছেন।

আজও মেয়েটি ঘণ্টা বাজাতে পারবে। সে সুযোগ তারাপদ তাকে দেবে।

নিস্তব্ধ ঘরের মধ্যে সত্যিই এক সময় ঘণ্টা বেজে উঠল।

ভুজঙ্গভূষণ বললেন, “কে, বেণু? তুমি এসেছ?”

ঘণ্টা বাজল।

ভুজঙ্গভূষণ বললেন, “বেণু, তোমার ছেলে তোমায় ডেকেছে। সে তোমার আদেশ চায়। তোমাদের মনের ইচ্ছে তাকে জানাও…”

তারাপদ আত্মা আবিভাব, ঘণ্টা বাজানোর দিকে মন দিল না, ভুজঙ্গর কথাতেও নয়। খুব সাবধানে নিজের বাঁ পা দিয়ে মেয়েটির ডান পায়ের ফেলে রাখা নকল ফাঁপা পাতা আস্তে আস্তে টেনে নিতে লাগল। যে কোনো সময়ে এই চালাকি মেয়েটি বুঝে ফেলতে পারে। ভয় করছিল তারাপদর, শুধু সাবধানে সে তার কাজ করে যাচ্ছিল। এর আগে চন্দনও একদিন ঘণ্টা বাজানোর রহস্য উদ্ধারের চেষ্টা করেছিল, কিকিরার কথা মতন। মাফলার থেকে ছিঁড়ে আনা সাদা উলের টুকরো ঘণ্টার পাশে ফেলে রেখেছিল। ধরবার চেষ্টা করছিল ঘন্টাটা কেউ তুলে নিয়ে বাজায় কিনা? মানুষেই হোক অথবা ভূতেই হোক, ঘণ্টা তুলে নিয়ে বাজানোর পর আবার যখন রাখবে–তখন একটুও নড়চড় হবে না, উলের টুকরোর ঠিক পাশেই থাকবে–এটা হতে পারে না। চন্দন দেখেছিল, ঘন্টা আর উলের টুকরো ঠিক জায়গাতেই আছে। তখন থেকেই চন্দনের সন্দেহ আরও বেড়ে গিয়েছিল। কিন্তু এই তুচ্ছ একটা প্রমাণ প্রমাণই নয়, আরও বড় প্রমাণ চাই।

ভুজঙ্গ আত্মা নামিয়ে যাচ্ছেন। বেণু গেল, বিষ্ণু এল। কথা বলছেন ভুজঙ্গ। তারাপদ ততক্ষণে তার কাজ সেরে ফেলেছে। বাজাক-টেবিলের তলায় গোপনে ঝুলিয়ে রাখা ঘণ্টা যত খুশি বাজাক মেয়েটি কিছু আসে যায় না তারাপদর।

আত্মারা শেষ পর্যন্ত বিদায় নিল। তারাপদ নিশ্বাস বন্ধ করে অপেক্ষা করতে লাগল, এবার মেয়েটি পা নামাবে, নামিয়ে তার নকল পায়ের পাতা খুঁজবে।

তারাপদ বুঝতে পারছিল মেয়েটি পা নামিয়েছে, পায়ের পাতা খুঁজছে। তার পা নড়ছে, শাড়িও নড়ছে। ঠিক জায়গায় নকল জিনিসটি না পেয়ে পা দিয়েই যেন চারদিক খুঁজছে, অন্ধকারে আমরা যেভাবে পায়ের চটি খুঁজি।

মেয়েটির হাতের আঙুলের ওপর সামান্য চাপ দেবার চেষ্টা করল তারাপদ, বোঝাতে চাইল-তুমি ধরা পড়ে গেছ। চলে যাও।

এইবার সেই ক্ষীণ বাতি জ্বলল। আত্মারা চলে যাবার সামান্য পরে যেমন রোজই বাতি জ্বলে ওঠে। মেয়েটি তারাপদর মুখের দিকে তাকাল। তার ফরসা মুখে ভয় ও বিস্ময়। চোখের পাতা পড়ল না মেয়েটির। কয়েক মুহূর্ত একই ভাবে তাকিয়ে থেকে মেয়েটি উঠে পড়ল। তারাপদর মনে হল, ভুজঙ্গকে বলে দেবে।

মেয়েটি কিছু বলল না। মুখ নিচু করে অন্য দিনের মতন ভুজঙ্গর পাশ দিয়ে চলে গেল।

তারাপদর এবার সত্যি সত্যিই বুক কাঁপছিল।

ভুজঙ্গ বললেন, “তোমার আর কিছু বলার আছে, তারাপদ?”

কথার জবাব দেবার আগে তারাপদ প্রাণপণে নিজেকে সামলাবার চেষ্টা করছিল। শেষে বলল, “না। আর কিছু নেই।” একটু থেমে আবার বলল, “পিসেমশাই, পরীকে আজ আর-একবার দেখতে পাব না?”

ভুজঙ্গ যেন বিরক্তই হলেন; বললেন, “তোমায় আমি বারবার বলেছি–আত্মাদের যখন-তখন খেয়াল-খুশি মতন ডাকতে নেই। তাতে তাঁদের কষ্ট হয়।”

তারাপদ মনে মনে বুঝতে পারল, ভুজঙ্গ কেন বারবার পরীকে আনতে চান না। ধরা পড়ে যাবার ভয় রয়েছে। যতই চালাকি করে শিখিয়ে পড়িয়ে, কায়দা কানুন করে পরীর নাম দেখিয়ে ওই মেয়েটিকে আনা হোক না কেন–তবু ঘণ্টা বাজানোর চেয়ে এই ব্যাপারটা কঠিন। সামান্য ভুলচুক হলেই ধরা পড়ে যাবার ভয় রয়েছে। এই ঘুটঘুঁটে অন্ধকারে যে-কোনো মানুষের পক্ষে আসা, আর ঘরের মধ্যে ঘুরে বেড়ানো মুশকিল। তার চেয়েও মুশকিল হল, একেবারে গায়ের সামনে এসে দাঁড়ানো রুমালে মাখানো সেন্টের গন্ধ নাকের কাছে ধরা, খুব আলগা করে মাথার ছড়ানো চুলের ছোঁয়া দিয়ে যাওয়া। কাল। তারাপদকে এইভাবে ঠকানো হয়েছে। যদি ওই মেয়েটি সামান্য ভুলচুক করত–তারাপদর গায়ে এসে পড়ত । হয়ত তারাপদ তখন উত্তেজনার মাথায় হাত বাড়িয়ে পরীকে ধরতে গিয়ে মেয়েটিকে ধরে ফেলত।

ভুজঙ্গ চতুর লোক। ঝুঁকি নিতে বারবার রাজি হবে না। কিন্তু তেমন একটা বড় ঝুঁকি কি ভুজঙ্গ নেয়? কিকিরা বলেছেন, এই সশরীরে আত্মা আসার ব্যাপারটা ব্ল্যাক ম্যাজিকের মতন। এখানে একটু অন্যরকম চালাকি করতে হয়। অন্ধকারে দেখা যাবার একরকম দূরবীন আছে। যুদ্ধের সময় রাত্রে ঝোঁপঝাড়ের আড়াল থেকে শত্রুরা গুলি ছুঁড়তে পারে ভেবে অন্ধকার দেখার জন্যে সৈনিকেরা এই দূরবীন ব্যবহার করে। একে বলে স্নাইপারস্কোপ। পরীর বেশে যখন মেয়েটি এসেছিল–তখন তার হাতে ওই দূরবীন ছিল, ছোট ধরনের। কাজেই এই অন্ধকারে সে সবই দেখতে পাচ্ছিল। কোনো অসুবিধে তার হয়নি।

তবু কখনো কখনো এ-সব কাজে ভুল হয়ে যায়। ভুজঙ্গ খুব সাবধানী।

তারাপদ বলল, “আমি তা হলে উঠি?”

ভুজঙ্গ বললেন, “তুমি মনঃস্থির করেছ?”

“হ্যাঁ।”

“তুমি রাজি?”

“রাজি।”

“আমার সমস্ত শর্ত মানছ?”

“মানছি।”

“খুশি হলাম, তারাপদ। তোমায় আমি আমার আশীর্বাদ জানাচ্ছি।” বলে ভুজঙ্গ একটু চুপ করে থাকলেন, তারপর বললেন, “ঘন্টাটা আমার কাছে দিয়ে যাও।”

তারাপদ ঘণ্টা তুলে নিল। তার চেয়ারের পেছন দিকে পায়ের নকল পাতা পড়ে আছে। ভুজঙ্গর দেখার কোনো সম্ভাবনা নেই।

ভুজঙ্গভূষণের পায়ের কাছে ঘণ্টাটা নামিয়ে তারাপদ দাঁড়িয়ে থাকল।

ভূজঙ্গভূষণ হাত নেড়ে ইশারায় তারাপদকে তার নিজের জায়গায় ফিরে যেতে বললেন। ফিরে এল তারাপদ ।

ঘণ্টাটা বাজালেন ভুজঙ্গ। প্রায় সঙ্গে সঙ্গে বললেন, “তারাপদ, আমাদের পালনীয় কিছু আচার আছে, নিয়ম পদ্ধতি রয়েছে। আজ তোমায় তার জন্যে ব্যস্ত হবে না। কাল সকালে মৃত্যুঞ্জয় তোমাকে যেমন-যেমন বলবে তুমি সেইভাবে কাজ করবে। আজ আর তোমায় আমি বসিয়ে রাখব না। কিন্তু একটা কথা মনে রেখো, আমার সমস্ত শর্ত মেনে কাজ করলে এই আসনের তুমি হবে একমাত্র উত্তরাধিকারী। যদি প্রবঞ্চনা করো, ছলনা করো–তবে তার। শাস্তি কত ভয়ংকর হবে তুমি জানো না।”

তারাপদকে কথা বলার কোনো সুযোগ না দিয়েই ভুজঙ্গ ঘণ্টা বাজাতে লাগলেন। আর সঙ্গে সঙ্গে ঘর অন্ধকার হয়ে গেল । নিকষ কালো অন্ধকার।

সেই অন্ধকার যেন এবার পাতালের অন্ধকার বলে মনে হচ্ছিল। থমথম করছে সব, স্তব্ধ। আচমকা ভুজঙ্গভূষণের গলা শোনা গেল, বজ্রগম্ভীর। “আমার সঙ্গে প্রবঞ্চনা করলৈ তোমার কী হবে তুমি জানো না। সামনে তাকাও। দেখো।”

ভুজঙ্গর কথা শেষ হবার আগেই ঘরের মাথার দিকে ক্ষীণ একটা আলো জ্বলে উঠল । তারাপদ মাথা তুলে আলোটা দেখবার চেষ্টা করে মুখ নামাতেই ভয়ে-আতঙ্কে চিৎকার করে উঠল।

ঘরের মাঝখানে একটা রক্তাক্ত মুণ্ডু ঝুলছে। শরীর হিম হয়ে গেল তারাপদর। মাথা ঘুরতে লাগল। দু হাতে চোখ ঢাকল।

সমস্ত ঘর কাঁপিয়ে অট্টহাস্য হেসে উঠলেন ভুজঙ্গ। সেই হাসি যেন ঘরের বাতাসে ঘূর্ণির মতন পাক খেতে লাগল। অসহ্য। একেবারেই অসহ্য। চোখ ছেড়ে দিয়ে দু হাতে কান চেপে ধরল তারাপদ। আবার তাকাল। দেখল মুণ্ড নয়, একটা মাথার খুলি, টকটকে লাল রক্তে যেন চোবানো। তার চোখের গর্ত, মুখের হাঁ–বীভৎস। মাথার খুলিটা ঘরের একপাশ থেকে অন্য পাশ পর্যন্ত শূন্যে লাফাতে লাফাতে আসা-যাওয়া করছিল।

ভুজঙ্গভূষণ তখনো হাসছেন। তারাপদ টেবিলের ওপর মাথা থেকে বেহুঁশের মতন পড়ে থাকল।

.

রাত অনেক হয়েছে। বারোটা বাজতে চলল।

তারাপদদের ঘর অন্ধকার। সমস্ত বাড়ি নিস্তব্ধ। বাইরে প্রচণ্ড শীত।

চন্দন আর-একটা সিগারেট শেষ করে নিচু গলায় বলল, “আর দেরি করে লাভ নেই।”

চন্দনের বিছানার একপাশে কিকিরা সেই অলেস্টার পরে, মাথায় টুপি এঁটে বসে আছেন। গলায় মাফলার। অন্ধকারে তিনজনে বসে আছে। কেউ কাউকে দেখতে পাচ্ছে না।

তারাপদ তার বিছানায়। শীতের সবরকম সাজ তার পরনে। কিকিরা চাপা গলায় বললেন, “আরও পনেরো বিশ মিনিট অপেক্ষা করা যাক।”

তারাপদ বলল, “সাধুমামার দায়িত্ব আপনার।”

কিকিরা বললেন, “সাধনদার দায়িত্ব আমি ঠিক লোককে দিয়েছি। আপনি স্যার নিশ্চিন্ত থাকুন।”

চন্দন বলল, “আপনি আর আমাদের সম্মান করে আজ্ঞে-আপনি করবেন না কিকিরাবাবু, বড় লজ্জা লাগে।”

কিকিরা একটু হাসলেন, “তা হলে বলব না।”

তারাপদ বলল, “ওই মেয়েটির জন্যে আমার বড় ভয় হচ্ছে।”

“ভয়ের কিছু নেই,” কিকিরা ফিসফিস করে বললেন, “সাধনদা যদি বেঁচে থাকে–ওই মেয়েটিও বেঁচে থাকবে । ও হল সাধনদার ভাইঝি। ইন্দু। ছেলেবেলায় মা বাপ হারিয়ে অনাথ হয়ে পড়েছিল ও সাধনদা ওকে নিজের কাছে নিয়ে এসেছিলেন অনাথ মেয়েকে মানুষ করবেন বলে। কিন্তু ও ভুজঙ্গর চোখে পড়ল । ভুজঙ্গ ওকে হাতে পেয়ে নিজের আত্মা নামানোর কাজে লাগাচ্ছিল।“

তারাপদ বুঝতে পারছিল, মেয়েটি আজ তাকে বাঁচিয়েছে। মেয়েটি তার নকল পায়ের পাতা খোয়া যাবার কথা ভুজঙ্গকে বলে দিতে পারত। বলেনি। বলেনি, কারণ মেয়েটি সাধুমামার কাছে সব শুনেছে।

তারাপদ বসে থাকতে থাকতে হঠাৎ কেঁপে উঠল। কেমন শব্দ করল, বিড়বিড় করে কিছু বলল।

চন্দন বলল, “কী হল তোর?” তারাপদ বলল, “মাঝে মাঝেই সেই মড়ার মাথা-খুলিটা আমার চোখে ভেসে উঠছে। হরি। এখনো বমি আসছে।”

কিকিরা বললেন, “আপনার–তোমার নার্ভ বড় দুর্বল তারাপদ। তুমি কখনো ম্যাজিকে মেয়েদের পেট কাটা, স্টেজের ওপর কংকাল নেচে বেড়ানো দেখোনি? আশ্চর্য! আমি তো তোমায় বললাম, ওটা কিছু নয়। প্রথম দিন যেভাবে তোমরা রঙিন বল নাচতে দেখেছিলে, এটাও সেইভাবে নাচানো হয়েছে। সবই চালাকি। ওই খেলাটা হবার সময় মাথার ওপরে যে বাতিটা জ্বলে ওঠে–সেটা ব্ল্যাক ল্যাম্প। আর যে বস্তুটা নাচে তার গায়ে লাগানো থাকে লুমিনাস পেন্ট। পাশের ঘর থেকে কেউ একজন ওটা নাচায়। কেমন করে নাচায় তাও বলছি। তোমরা ভাল করে কিছু লক্ষ করোনি। করার মনও তোমাদের ছিল না। ওই ঘরের মাথায় কালো রঙ করা লম্বা তার ঝোলানো আছে। এক পাশ থেকে আরেক পাশ পর্যন্ত। সেই তারের সঙ্গে আবার কালো রঙ করা অন্য তারে রঙিন বলই বলো আর মাথার খুলিই বলো ঝোলানো আছে। পুলি জানো? কিংবা গোল গোল চাকা! চাকার গায়ে তার জড়িয়ে এই খেলা দেখানো হয়। একটা স্ট্রেট লাইনে একদিক থেকে অন্যদিকে টেনে নেওয়া কিংবা ঢিলে করা কিছুই নয়। ঢিলে করলে ঝুলবে, টানলে উঠবে। নাথিং বাট পুলি সিস্টেম। পুতুল নাচের মতন ব্যাপার, তবে পুলিটাই হচ্ছে এখানে আসল। আর ওই ব্ল্যাক ল্যাম্প। দুটো পুলি দিয়ে এ কাজ করতে হয়। পাশের ঘরে বসে ভুজঙ্গর কোনো চেলা এই ভূতের নাচ দেখায়।”

তারাপদ অত বুঝল না। তবে বুঝতে পারল, ঘণ্টা বাজানোর মতন এও একটা ধাপ্পা, ধোঁকা ।

চন্দন দেশলাই জ্বেলে ঘড়ি দেখল। বারোটা বাজতে দু মিনিট। ঘড়িটা দেখাল কিকিরাকে ।

কিকিরা মাথা নাড়লেন। “ডায়নামো দশটার পর বন্ধ হয়ে গেছে। আর চলবে না?”

“না”, চন্দন বলল, “সে ব্যবস্থা আমি করেছি। খারাপ হয়ে গেছে।”

“বেশ। তা হলে তারাপদ থাকবে আস্তাবলে, গাড়িতে ঘোড়া জোতা থাকবে। রামবিলাস থাকবে। সাধনদা, ইন্দু, আর তারাপদ গাড়ি করে পালাবে।” বলতে বলতে কিকিরা তাঁর লুকোনো ছোট টর্চটা বার করে নিয়ে জ্বালালেন একবার । নিবিয়ে দিলেন আবার।

“ফটক?” তারাপদ জিজ্ঞেস করল।

“খোলা আছে,” কিকিরা মুচকি হাসলেন। “এই বাড়িতে যারা থাকে তারা সকলেই ভুজঙ্গ নয়। দায়ে পড়ে থাকে। ভয়ে। দু-চারজন ভাল লোকও আছে যারা এই পাপের রাজ্য থেকে বেরিয়ে যেতে চায়, তারাপদ সাধনদার মতনই তারা একদিন এসে পড়েছিল, হয় কিছু পাবার আশায়, না হয় পেটের দায়ে। তারপর আর ফিরে যেতে পারেনি। মৃত্যু ছাড়া তাদের মুক্তি ছিল না। ওরাই আজ আমাদের সহায় সম্বল বন্ধু। নয়ত আমি কেমন করে এখানে এলাম বলো?”

তারাপদ কিছু বলল না। কিকিরা বিচিত্র মানুষ। এই লোকটির আসল পরিচয় আজও জানা গেল না।

বারোটা বাজতেই চন্দন উঠে দাঁড়াল।

কিকিরাও ধীরে-সুস্থে উঠলেন। টর্চ জ্বালালেন। বললেন, “আমার পকেটে দু বোতল পেট্রল আছে। ভুজঙ্গ শয়তানের আত্মার ঘর তাতেই পুড়ে ছাই হয়ে যাবে।…তুমি একটা কিছু নাও চন্দন। কিছু নেই?”

চন্দন পকেট থেকে পাতলা সরু ছুরিটা বার করল। বলল, “আপনি চলুন।”

তিনজনেই দাঁড়াল। পরস্পরের মুখের দিকে তাকাল।

তারাপদ চন্দনকে বলল, “তোরা আগুন লাগিয়েই পালিয়ে আসবি। আমরা বাইরে থাকব।”

কিকিরা বললেন, “ভয় পেয়ো না, আমরা আসব। তোমরা সাবধানে থেকো।”

.

ফটকের বাইরে সামান্য তফাত থেকে তারাপদ দেখল, ভুজঙ্গভূষণের দোতলায় আগুন জ্বলে উঠেছে। শীতের বাতাসে দেখতে দেখতে দাউ দাউ করে আগুনটা যেন ছড়িয়ে যাচ্ছিল। দমকা হাওয়ায় আগুনের শিখা যেন ঝাঁপটা মারছে, আকাশের দিকে লকলক করে উঠে যাচ্ছে, তারপর ধোঁয়া হয়ে শূন্যে মিলিয়ে যাচ্ছে। চারদিকের জমাট অন্ধকার আলো হয়ে উঠল। ভীত, ত্রস্ত মানুষের কলরব। ধোঁয়ায় ভরে যাচ্ছে ভুজঙ্গভূষণের বাড়ির চারদিক।

তারাপদ হঠাৎ কেমন আনন্দ অনুভব করল। প্রতিহিংসার আনন্দ। একজন শয়তানের সর্বনাশ হবার আনন্দ। তারপরই সে ব্যাকুল হয়ে উঠল । চন্দনের জন্যে, কিকিরার জন্যে। ওরা কোথায়?

একটু পরেই চন্দনকে দেখতে পেল। বাগান দিয়ে প্রাণপণে ছুটে আসছে।

কিকিরা! কিকিরা কোথায়?

চন্দন ফটক পর্যন্ত পৌঁছে যাবার পর তারাপদ এক অদ্ভুত দৃশ্য দেখল। পরনে লাল গেরুয়ার বস্ত্র, গায়ে চাদর, গলায় রুদ্রাক্ষের মালা, মুখে ব্যান্ডেজ এক উন্মাদ ছুটে আসছে। হাতে তার খঙ্গ। চোখে বুঝি দেখতে পাচ্ছে না। তবু ছুটে আসছে । গায়ের চাদরে আগুন জ্বলছে। চাদরটা ফেলে দিল ও নগ্ন গা।

তারাপদ চিৎকার করে ডাকতে লাগল, “চাঁদু–চাঁদু–চাঁদু, আমরা এখানে।”

চন্দন মুহূর্তের জন্যে দাঁড়াল। দেখল। তারপর ছুটতে ছুটতে গাড়ির কাছে এসে পড়ল।

চন্দন হাঁপাচ্ছিল।

“কিকিরা কোথায়?” তারাপদ ব্যাকুল হয়ে জিজ্ঞেস করল।

চন্দন আগুনের দিকে তাকাল। সমস্ত বাড়িতেই আগুন ছড়িয়ে পড়েছে। কী ভীষণ কোলাহল হচ্ছে ওদিকে।

“কিকিরা কোথায়?” তারাপদ আবার বলল।

“আমরা একসঙ্গে ঘরে আগুন দিই। তারপর আর তাঁকে দেখিনি। কোথায় যে ছুটে চলে গেলেন!”

তারাপদ বিহ্বল হয়ে পড়ল। এখন কী করা যাবে? সেই উন্মাদ ততক্ষণে ফটকের কাছে এসে দাঁড়িয়েছে। হাতের খড়গ উঁচু হয়ে আছে। আগুনের আলোয় ভয়ঙ্কর দেখাচ্ছে। চারিদিকে পাগলের মতন তাকাচ্ছে। ও যে ভুজঙ্গ বুঝতে কষ্ট হয় না। তারাপদ বলল, “ভুজঙ্গ আমাদের খুঁজছে। কী করব?”

কম্বল মুড়ি দিয়ে সাধুমামা ঘোড়ার গাড়ির মধ্যে বসে ছিলেন। তাঁর পাশে ইন্দু। কালো চাদরে সর্বাঙ্গ ঢাকা। সে থরথর করে কাঁপছিল।

সাধুমামা বললেন, “গাড়িটাকে আরও একটু আড়ালে নিয়ে যেতে বলি।”

গাড়ির কোচোয়ানকে সাধুমামা কী যেন বললেন। কোচোয়ান হাতের লাগাম টেনে ঘোড়ার গাড়িটাকে আরও আড়ালে সরিয়ে নিয়ে গেল।

ভুজঙ্গর লোকেরা দু একজন প্রাণ বাঁচাতে বাগানে ছুটে বেরিয়ে এসেছে। কিন্তু কিকিরা কোথায়?

সময় বয়ে যাচ্ছে। প্রতি মুহূর্ত যেন কত দীর্ঘ! তারাপদ অস্থির হয়ে পড়ছিল, চন্দন বুঝতে পারছিল না তার কী করার আছে।

তারাপদ ব্যাকুল হয়ে বলল, “সাধুমামা, আমরা কী করব?” সাধুমামা বললেন, “ভুজঙ্গর বাড়িতে বন্দুক আছে। মৃত্যুঞ্জয় বন্দুক চালাতে পারে। সেও যদি এসে পড়ে আমরা বিপদে পড়ব।”

“কিন্তু কিকিরা?”

সাধুমামাও কিছু বলতে পারলেন না।

ভুজঙ্গ যেন কিছু অনুমান করে আরও কয়েক পা এগিয়ে এলেন। হঠাৎ চন্দন বলল, “কিকিরা!”

কিকিরাকে বাগানের কাছে দেখা গেল। প্রাণপণে ছুটে আসার চেষ্টা করছেন, পারছেন না। বাগানের লোকগুলো চিৎকার করে উঠল। কিকিরার ওভারকোটটা গায়ে নেই। হাতে। আগুন জ্বলছে কোটটায় দাউ দাউ করে। কিকিরা সেই কোটটাকেই আত্মরক্ষার অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করে লাঠি ঘোরানোর মতন চারপাশে ঘোরাচ্ছেন ।

ভুজঙ্গ কিন্তু দেখতে পেয়ে গিয়েছেন কিকিরাকে। ছুটে গেলেন । মাথার ওপর খাঁড়া তুলে।

তারাপদ ভয়ে চোখ বুজে ফেলল । চন্দন কেমন আর্তনাদ করে উঠল।

আবার যখন চোখ খুলল তারাপদ, দেখল, ভুজঙ্গর খাঁড়া কিকিরার মাথার ওপর। কিকিরা কোটটা ঘোরাচ্ছেন। আগুনের হলকায় খাঁড়া ঝকঝক করে উঠল। ভুজঙ্গর খাঁড়া পড়ল। কিকিরার মাথাতেই পড়ার কথা কিন্তু কেমন করে যেন সরে গেলেন কিকিরা, খাঁড়ার কোপ থেকে নিজেকে বাঁচালেন। ভুজঙ্গ ক্ষিপ্ত হয়ে আবার কিকিরার শরীর লক্ষ করে খাঁড়া তুললেন। তারাপদ বুঝতে পারছিল, কিকিরার হাত দুর্বল। এতক্ষণ তিনি নিজেকে ভাগ্যের জোরে, সামলেছেন–আর পারবেন না। চোখের সামনে মানুষটা মরবে।

পারলেন না কিকিরা, জ্বলন্ত কোটটা খাঁড়ায় জড়িয়ে গেল। ভুজঙ্গ প্রাণপণ চেষ্টা করতে লাগলেন কোটটা ফেলে দেবার । কিকিরাও সেই ফাঁকে ছুটতে শুরু করেছেন।

কোচোয়ান রামবিলাস বলল, “সামালকে বসুন বাবুরা। জান বাঁচান।” বলতে বলতে রামবিলাস তার ঘোড়াকে হঠাৎ ঘুরিয়ে নিল ফটকের দিকে। তারপর চাবুক কষাল।

আচমকা চাবুক খেয়ে ঘোড়া লাফ মেরে উঠল। তারপরই সামনের দিকে ছুটল।

কিকিরার কোটের আগুন ভুজঙ্গর কাপড়ে লেগে গিয়েছিল। তিনি এই অবস্থাতেই ছুটে আসছিলেন, হাতের খাঁড়া থেকে কোটটা মাটিতে পড়ে গেছে।

রামবিলাস কোনো দিকে তাকাল না, সোজা ভুজঙ্গর দিকে গাড়ি ছুটিয়ে দিল।

তারাপদ পলকের জন্যে দেখল ভুজঙ্গ খাঁড়া তুললেন, কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে ঘোড়াটা তাঁর সামনে লাফ মেরে, ভুজঙ্গকে মাটিতে ফেলে দিয়ে ফটক পর্যন্ত ছুটে গেল ।

রামবিলাস ফটকের কাছ থেকে আবার গাড়িটা ঘুরিয়ে নিল। ফেরার সময় দেখল ভুজঙ্গ মাটিতে পড়ে আছেন। উপুড় হয়ে। তার খাঁড়া একদিকে, তিনি অন্যদিকে। কাপড়ে আগুন জ্বলছে দাউদাউ করে।

কিকিরাকে গাড়িতে তুলে নিল রামবিলাস।

তারাপদ বলল, “আপনি এত দেরি করলেন কেন?”

কিকিরার কথা বলার শক্তি ছিল না। হাঁপাচ্ছিলেন। অনেকক্ষণ পরে বললেন, “মৃত্যুঞ্জয়কে খুঁজছিলাম। ভুজঙ্গর ঘরে সিন্দুক খুলে সে পাগলের মত টাকা-পয়সা সোনাদানা হাতড়াচ্ছিল। তাকে ঘরের মধ্যেই বন্ধ করে রেখে এলাম। জানলা দিয়ে লাফানো ছাড়া তার আর উপায় নেই।”

ভুজঙ্গর বাড়ি ছেড়ে গাড়িটা অনেক দূর চলে এল। এখনো দূরে তাকালে আকাশের একটা দিক লাল দেখায়। অথচ আশপাশে মাঠ আর ঝোঁপঝাড়ে অন্ধকার ঘন হয়ে আছে। শীতের বাতাস বইছে শনশন করে, ঘোড়ার গাড়ির চাকার শব্দ আর খুরের আওয়াজ উঠছে খটখট।

সাধুমামা বসে থাকতে থাকতে কেঁদে উঠলেন।

কিকিরা প্রথমে কিছু বললেন না, পরে বললেন, “সাধনদা, তুমি কাঁদছ কেন? আজ এতকাল পরে তোমার মুক্তি হল।”

ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে সাধুমামা কেঁদে উঠলেন। কাঁদতে কাঁদতেই বললেন, “আমার পাপের প্রায়শ্চিত্ত হল। তারাপদর বাবাকে আমিই এনেছিলাম।”

কিকিরা বললেন, “তারাপদকেও তুমি এনেছ। ভুজঙ্গকে শেষ করবে বলে তুমি ধীরে ধীরে ধৈর্য কতকাল ধরে জাল ছড়িয়েছে সাধনদা। সেই জালে একে একে সবাই জড়িয়ে পড়েছে।”

সাধুমামা কাঁদতে কাঁদতে বললেন “না না, আমার কিসের সাধ্য। তুমিই তো করলে সব। তোমার ও কত ক্ষতি করেছিল আমি জানি।”

চন্দন জিজ্ঞেস করল, “কিকিরাবাবু, আপনি কে? আপনার সত্যিকারের পরিচয়টা জানতে পারি?”

কিকিরা তাঁর আগুনে ঝলসানো হাত সামলাচ্ছিলেন মনের জোরে। যন্ত্রণার শব্দও করছিলেন মাঝে মাঝে। বললেন, “আমি সাধনদার বন্ধু। কিঙ্করও বলতে পার । সাধনদা আমায় কলকাতায় খবর দিয়েছিল তোমরা শংকরপুরে আসছ।” বলে একটু থেমে কিকিরা আবার বললেন, “সলিসিটার মৃণাল দত্তর বাড়িতে যে বুড়ো মতন লোকটিকে তোমরা দেখেছ, সে আমাদের লোক। আমরা তাকে মধুপুর থেকেই সলিসিটার দত্তর বাড়িতে ঢুকিয়ে দিয়েছিলাম কাজে লাগাব বলে।”

তারাপদ চুপ করে ছিল। খানিক পরে বলল, “আপনি সত্যি সত্যি কে–আমরা জানি না। কিন্তু আপনার দয়াতেই আমরা বাঁচলাম।”

কিকিরা বললেন, “অতশত জানি না বাবা, তবে এটুকু জানি–তুমি যদি একবার ভুজঙ্গর ফাঁদে পা দিতে তুমিও ভুজঙ্গ হয়ে যেতে। পাপের পথ, লোভের পথ–মানুষ যদি একবার ধরে, সে আর সহজে ছেড়ে আসতে পারে না। দেড় দু লক্ষ টাকার সম্পত্তির লোভ থেকে তুমি বেঁচেছ।”

তারাপদ মনে মনে বলল, “হ্যাঁ, সে বেঁচেছে।” বেঁচে গিয়েছে।