২০.
মানুষের চেহারা জাগ্রত অবস্থায় একরকম, ঘুমন্ত অবস্থায় অন্যরকম। শহরের বেলাতেও তাই। জাগ্রত অবস্থায় কোনও মানুষকে বেশ চালাকচতুর বলে মনে হয়, কিন্তু ঘুমন্ত অবস্থায় তাকেই দেখায় আস্ত হাবা গঙ্গারামের মতো। দুপুরবেলা লালদিঘি গমগম করে রাত্রে সেখানে গা ছমছম করে। আমাদের পাড়া পার্ক সার্কাসের ট্রামডিপো অঞ্চল দুপুরবেলা ঘুমিয়ে পড়ে। সন্ধ্যায় হোটেলগুলো যেন কোরাসগান গেয়ে উঠে।
রসের ক্ষেত্রে আমি ছেলে-বুড়োতে তফাত করিনে। আট বছরের ছেলে মহাভারত পড়ে সুখ পায়, আশি বছরের বুড়োও আনন্দ পায়। আবার আট বছরের ছেলে দিব্য কীর্তন গেয়ে শুনিয়ে দিল, ষাট বছরের সুরকানা পণ্ডিত ধরতে পারল না, সেটা কীর্তন না বাউল অর্থাৎ রসবোধের ক্ষমতা বয়সের ওপর নির্ভর করে না।
কিন্তু কোনও কোনও ছোটখাটো রস বয়সের ওপর নির্ভর করে। আট বছরে সিগারেট খেয়ে কোনও লাভ নেই, আঠারোতেই রাস্তায় মার্বেল খেলার রস শুকিয়ে যায়। ঠিক তেমনি রাতের শহর ছোটদের জন্য নয়। তুলনা দিয়ে বলি, সকাল আটটায় আট বছরের ছেলেকে আটখানা ট্যাক্সি ডাকতে পাঠাতে পারি, কিন্তু রাত দশটায় দশ বছরের ছেলেকে দশ জায়গায় পাঠাতে পারিনে।
কিন্তু যেসব দুঁদে ছেলেরা যেমন পল-পার্সি– রাত দুটোর সময় জেগে আছে, তাদের নিয়ে কী করা যায়? আবুল আসফিয়া অভয় জানিয়ে বললেন, কাইরোতে এমন সব নাচের জায়গা আছে, যেখানে বাপ-মা আপন ছেলেমেয়েকে সঙ্গে নিয়ে আনন্দ করতে যান।
তারই একটা ক্যাবারেতে যাওয়া হল।
খোলাতে। উপরে মুক্ত আকাশ। চতুর্দিকে জাপানি ফানুসে ঢাকা রঙ-বেরঙের আলোর জ্যোতি ক্ষীণ বলে উপরের দিকে খানিকক্ষণ তাকালে গম্ভীর আকাশের গায়ে চটুল তারার মিটমিট নাচ দেখা যায়।
শ খানেক ছোট ছোট টেবিল। এক প্রান্তে স্টেজ। ডাইনে-বাঁয়ে উইঙ নেই, পিছনে শুধু, হুবহু শুক্তির এক পাটির মতো কিংবা বলতে পার, সাপের ফণার মতো উঁচু হয়ে ডগার কাছে নিচের থেকে বেঁকে আছে স্টেজের বিরাট ব্যাকগ্রাউন্ড। শুক্তিতে আবার ঢেউ খেলানো– এরকম ছোট্ট সাইজের ঝিনুক সমুদ্রপাড়ে কুড়িয়ে পাওয়া যায় দেখতে ভারি চমৎকার। ব্যাকগ্রাউন্ডের পিছনে এরই আড়ালে গ্রিনরুম নাকি, না মাটির নিচে সুড়ঙ্গ করে?
হঠাৎ সবকিছু অন্ধকার হয়ে গেল। ভাবছি ব্যাপার কী। পল-পার্সিকে কানে কানে বললুম, মানিব্যাগ চেপে ধরো!! বলা তো যায় না বিদেশ-বিভুই জায়গা।
নাহ্, আলো জ্বলতে দেখি, শুক্তির সামনে এক স্ফিনকস। পিরামিডের পাশে আমরা এই স্ফিনকসের পাথরের মূর্তি দেখেছি–অবশ্য এর চাইতে পাঁচশো শুণে বড়। কিন্স মিশরের সম্রাট ফারাওয়ের প্রতিমূর্তি। মুখটা রাজারই মতো, শুধু শক্তি আর প্রতাপ বোঝানোর জন্য শরীরটা সিংহের।
পিছন থেকে বেরিয়ে এল ছটি মেয়ে। গলা থেকে পা অবধি ধবধবে সাদা শেমিজের মতো লম্বা জামা পরা। রাস্তায় মিশরি মেয়েদের এরকম জামা পরতে দেখেছি। তবে অন্য রঙের।
আস্তে আস্তে তারা ফিসের চারদিকে ঘুরে ঘুরে নাচতে আরম্ভ করল। বড় মৃদু পদক্ষেপ। পায়রা যেরকম নিঃশব্দ পদসঞ্চারণে হাঁটে। চাঁদ যেরকম আকাশের উপর দিয়ে তারার ফুলকে না মাড়িয়ে আকাশের এপার-ওপার হয়।
পায়ে ঘুঙুর নেই, হাতে কাকন নেই। শুধু থেকে থেকে সমের একটু আগে তেহাইয়ের সময় থেকে বাঁশি, খঞ্জনি আর ঢোলের সামান্য একটুখানি সঙ্গীত। বড় করুণ, অতি বিষাদে ভরা। নীলনদের এপার থেকে মা যেন ওপারের ছেলেকে সন্ধ্যার সময় বাড়ি ফেরার জন্য ডাকছে। এ ডাক আমি জীবনে বহুবার শুনেছি। যে মা-ই ডাকুক না কেন, আমি যেন সে ডাকে আমার মায়ের গলা শুনতে পাই।
সে ডাক বদলে গেল। এবারে শুনতে পাচ্ছি অন্য স্বর। এ যেন মা ছেলেকে ঘুম থেকে জাগাবার চেষ্টা করছে। এ গলায় গোড়ার দিকে ছিল অনুনয়-বিনয়। তার পর আরম্ভ হল আশা-উদ্দীপনার বাণী। সঙ্গীত জোরালো হয়ে আসছে। পদক্ষেপ দ্রুততর হয়েছে। ছটি নয়, এখন মনে হচ্ছে যেন ষাটটি মেয়ে দ্রুত হতে দ্রুততর লয়ে নৃত্যাঙ্গন অপূর্ব আলিম্পনে পরিপূর্ণ করে দিয়েছে! আর পদক্ষেপের কণামাত্র স্থান নেই।
স্বপ্নে অজানা লিপি, অচেনা বাণী মানুষ যেমন হঠাৎ কোন এক ইন্দ্রজালের প্রভাবে বুঝে ফেলে, আমি ঠিক তেমনি হঠাৎ বুঝে গেলুম নাচের অর্থটা কী। এ শুধু অর্থবিহীন পদক্ষেপ নয়, ব্যঞ্জনাহীন হস্তবিন্যাস নয়। নর্তকীরা নব মিশরের প্রতীক। এরা প্রাচীন মিশরের প্রতীক ফিনসকে তার যুগ-যুগান্তব্যাপী ন্দ্রিা থেকে জাগরিত করতে চাইছে। সে তার লুপ্ত গৌরব নিয়ে সুপ্তিজাল ছিন্নভিন্ন করে আবার মিশরে সুপ্রতিষ্ঠিত হোক, বিদেশি স্বৈরতন্ত্রের কুহেলিকা উদ্ঘাটন করে সেই প্রাচীন সবিতার নবীন মূর্তি দুলোক ভূলোক উদ্ভাসিত করুক।
তবে কি আমারই মনের ভুল? দেখি, ফিক্স মূর্তির মুখে যেন হাসি ফুটে উঠেছে। এ কি জাদুকরদের ভানুমতী, না সৃষ্টিকর্তার অলৌকিক আশীর্বাদ?
আবার অন্ধকার হয়ে গেল।
নিদ্রিতের চোখে যে রকম পড়ে, আমার চোখে ঠিক তেমনি এসে পড়ল পশ্চিমাকাশ থেকে চন্দ্রান্তের রক্তছটা আর পূর্বাকাশ থেকে নব অরুণোদয়ের পূর্বাভাস।
জয় মিশরভূমির জয়।
.
২১.
ইংরেজিতে কী যেন একটা প্রবাদ আছে, —
Early to bed and early to rise.
তার পর কী যেন সব হয়? হ্যাঁ, বাঙলাটা মনে পড়েছে–
সকাল সকাল শুতে যাওয়া সকাল বেলা ওঠা,
স্বাস্থ্য পাবে বিদ্যে হবে, টাকাও হয় মোটা।
গ্রামের তুলনায় শহরে টাকা বেশি, রাস্তায় রাস্তায় বিদ্যের ভাণ্ডার ইস্কুল-কলেজ আর শহরবাসীকে অজর অমর করে রাখবার জন্য কত ডাক্তার কবিরাজ হেকিম না খেয়ে মরছে তার হিসাব রাখে কে? তাই বোধহয় শহরের লোক সকাল সকাল শুতে যাওয়ার আর সকালবেলা ওঠার প্রয়োজন বোধ করে না। গ্রামের লোক তাই এখনও ভোরবেলা ওঠে। কাইরো শহর তাই এখনও ঘুমুচ্ছে– অবশ্য নাক ডাকিয়ে নয়।
আবুল আসফিয়া বললেন তা ঠিক, কিন্তু মুসলমানদের প্রথম নামাজ পড়তে হয় কাক-কোকিল ডাকার পয়লা। এদেশে তাদের বড় বড় মসজিদ মাদ্রাসা আজহর পাড়ায়। সেখানেই যাওয়া যাক। তারা নিশ্চয়ই ঘুম থেকে উঠেছে।
উত্তম প্রস্তাব। কিন্তু মসজিদের নামাজিদের দেখবার জন্য এ সুদূর কাইরো শহরে আসা কেন? আপন কলকাতায় জাকারিয়া স্ট্রিটে গেলেই হয়!
উঁহু, সেইটেই নাকি কাইরোর প্রবীণ অঞ্চল। অবশ্য পিরামিডের তুলনায় অতিকায় নবীন বয়স মাত্র এক হাজার বৎসর। কিঞ্চিৎ এদিক-ওদিক। প্রাচ্যের রোমান্টিক নগরী কাইরো বলতে জগজ্জনের মনে আরবিস্থানের যে রঙিন তসবির ফুটে ওঠে সে বস্তু নাকি এখনও ওই অঞ্চলেই পাওয়া যায়।
ট্রাম কিন্তু তখনই চলতে আরম্ভ করেছে। কলকাতার ট্রামের তুলনায় অতিশয় লজঝড় এবং ছুটির দিনে ইস্কুল-কলেজের মতো ফাঁকা।
পয়লা ট্রাম দেখামাত্রই আবুল আসফিয়া তড়িঘড়ি ট্যাসিওলাদের পাওনা পয়সা বুঝিয়ে দিয়ে বিদেয় করে দিয়েছেন। পয়সা বাঁচাবার এ ফিকির সবাই জানে কিন্তু বিদেশে-বিভুইয়ে কে জানে কোন ট্রাম কোথায় যায়? আপন কলকাতাতেই যখন ট্রামের গুবলেটে নিত্যি নিত্যি কালীঘাট যেতে গিয়ে পৌঁছে যাই মৌলা আলী, কিংবা বলতে পার মর মর অবস্থায় মেডিকেল কলেজ না পৌঁছে ট্রাম ভিড়ল নিমতলায়। বল্ হরি, হরি বল!
আবুল আসফিয়া বললেন, আল্লা আছেন, ভাবনা কী!
তব সাথী হয়ে দগ্ধ মরুতে
পথ ভুলে তবু মরি
তোমারে ত্যজিয়া মসজিদে গিয়া
কী হবে মন্ত্র স্মরি!
তবু খুব ভরসা পেলুম না। হরিই বল আর আল্লাই বল, তারা সব-কজনা এই কটা বাউণ্ডুলের জন্য অন্য সবকিছু ছেড়ে দিয়ে এই অবেলায় ঠিক ট্রাম ঠিক সময়ে ঠিক জায়গায় পাঠাবার তদারকিতে বসে আছেন– এ ভরসা করতে হলে যতখানি বিশ্বাসী হতে হয় আমি ঠিক ততখানি নই। তা হই আর না হই, আর পাঁচ জনের সঙ্গে সঙ্গে ট্রামেই উঠতে হল।
রাস্তা ক্রমেই সরু হয়ে আসছে। পৃথিবীর সর্বত্র যা হয়– খোলা-মেলার নতুন শহর থেকে নোংরা ঘিঞ্জি পুরনো শহরে শহরে ঢুকবার সময়।
রাস্তার দু দিকে দোকানপাট এখনও বন্ধ। দু-একটা কফির দোকান খুলি খুলি করছে। ফুটপাথের উপর লোহার চেয়ারের উপর পদ্মাসনে বসে দু চারটি সুদানি দারোয়ান তসবি টপকাচ্ছে, খবরের কাগজওলার দোকানের সামনে অল্প একটু ভিড়, চাকর-বাকররা হনহন করে চলেছে বড় সায়েবদের বাড়ি পৌঁছতে দেরি হয়ে গিয়েছে বলে।
তরল অন্ধকার সরল আলোর জন্যে ক্রমেই জায়গা করে দিচ্ছে। কালো চুলের মাঝখানে সাদা সিঁথি ফুটে উঠেছে। তার উপর দেখা যাচ্ছে লাল সিঁদুরের পোঁচ। আকাশ-বাতাসের এই লীলা-খেলাতে সবকিছু যে পাপষ্টি দেখা গেল তা নয়, কিন্তু ট্রামের জানালার উপর মাথা রেখে আধো ঘুমে আধো জাগরণে জড়ানো জড়ানো হয়ে সবকিছুই যেন কিছু কিছু দেখা হল। স্বপ্নে ঘুমে জাগরণে মেশানো অভিজ্ঞতা ভাষাতে প্রকাশ করা কঠিন। ছবিতে এ জিনিস ফোঁটানো যায় অনেক অক্লেশে। তাই বোধহয় চিত্রকরদের সূর্যোদয়ের ছবি সাহিত্যের সূর্যোদয়কে প্রায়ই হার মানায়।
সবচেয়ে সুন্দর দেখাচ্ছিল মসজিদের চুড়ো (মিনার)গুলোকে। কুতুবমিনার যারা দেখেছে তারাই জানে তার সৌন্দর্য কী। মনে হয় সে যেন পৃথিবীর ধুলো-মাটির প্রাণী নয়। সে যেন কোনও রাজাধিরাজের উষ্ণীষ দেশের আপামর জনসাধারণের বহু ঊর্ধ্বে দাঁড়িয়ে ভগবানের আপন হাতের অভিষেক আশীর্বাদের পরশ পাচ্ছে।
তবু কুতুবের পা মাটিতে ঠেকেছে। এদের বহু মিনার দাঁড়িয়ে আছে আল্লার নামাজের ঘর মসজিদের উপর। কিন্তু এরা জানে উপরের দিকে আল্লার কাছে যাওয়ার অর্থ কী। সুস্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি যতই উপরের দিকে যাচ্ছে ততই ভয়ে জড়সড় হয়ে সরু হয়ে যাচ্ছে–ক্লাসের গাব্দা-গোলা ছেলেও যেরকম হেডমাস্টারের সামনে শরকাঠিটি হয়ে যায়। কিন্তু দ্যুলোক আর সবিতা যেন ওদের অভয় দিচ্ছেন আকাশ যেন তার আপন নীলাম্বরী তাদের পরিয়ে দিতে এসেছেন— পিছনের দিকটা পরা হয়ে গিয়েছে, আর সবিতা যেন অরুণালোকের লম্বা লম্বা দড়ির ফাঁস লাগিয়ে তাদের খাড়া রাখবার চেষ্টা করছেন। তাই দেখে ওমর খৈয়াম বললেন,
And lo! the Hunter of the East has caught
The Sultans turret in a noose of light. —(Fitzerald)
কান্তি ঘোষের ইংরেজি অনুবাদ সচরাচর উত্তম কিন্তু এ স্থলে আমি একটু আপত্তি জানাই। তাঁর অনুবাদে আছে–
পুব-গগনের দেব শিকারির স্বর্ণ-উজল কিরণ তীর
পড়ল এসে রাজপ্রাসাদের মিনার যেথা উচ্চ শির। (কান্তি ঘোষ)*
[*স্বর্গীয় কান্তি ঘোষ আমার অন্তরঙ্গ বন্ধু ছিলেন। আর বহু গুণীজনের সঙ্গে কণ্ঠ মিলিয়ে এ অধমও তার অনুবাদে উচ্ছ্বসিত।]
আসলে কিন্তু সূর্যালোক তীরের মতো মিনারের উপর আঘাত দিতে পারে। আবার নূস–ফাঁসের মতোও তাকে জড়িয়ে ধরতে পারে। তফাত বিশেষ কিছু নেই আর পাগলা কবিরা কত যে উদ্ভট উপমা দেয় তার কি ইয়ত্তা আছে। তবে কি না অনুবাদের বেলা মূলের যত কাছে থাকা যায় ততই মঙ্গল।
প্রকৃতির গড়া নীল, আর মানুষের গড়া পিরামিডের পরেই মিশরের মসজিদ ভুবন বিখ্যাত এবং সৌন্দর্যে অতুলনীয়। পৃথিবীর বহু সমঝদার শুধুমাত্র এই মসজিদগুলোকেই প্রাণভরে দেখবার জন্য সাত সমুদ্র তের নদী পেরিয়ে কাইরোতে আসেন। পিরামিড যারা বানিয়েছিল তাদের বংশধররাই এসব মসজিদ তৈরি করেছে কিন্তু এদের গায়ে ইতোমধ্যে কিঞ্চিৎ ইরানি গ্রিক রোমান এবং পরবর্তী যুগে বিস্তর আরব রক্ত ঢুকে পড়েছিল বলে এরা বানিয়েছে ভিন্ন। শৈলীতে। বিশেষত পূর্বেই বলেছি– পিরামিড তার লক্ষ লক্ষ মণ ওজন নিয়ে মাটির উপর ভারিক্তি চালে বসে আছে, তার রাজা যেভাবে প্রজাদের বুকের উপর জগদ্দল পাথরের মতো বসতেন তারই অনুকরণ করে। পরবর্তী যুগের মসজিদ যারা বানিয়েছিল তারা মুসলমান। তারা রাজার রাজা সৃষ্টিকর্তাকে দেয় সর্বোচ্চ স্থান। তাই তাদের মসজিদের মিনারগুলো উপরের দিকে ধেয়ে চলেছে, দুলোকেশ্বরের সন্ধানে। কিংবা বলতে পার তারা দাঁড়িয়ে আছে, মুসলমান নামাজ পড়ার সময় যেরকম প্রতিদিন পাঁচ বার সোজা হয়ে আল্লার সামনে দাঁড়ায়। তাই পিরামিডে ভীতিরস, মসজিদে গীতিরস।
পল-পার্সি দেখলুম এ রসে ঈষৎ বঞ্চিত। আমরা পুরনো কাইরোর মাঝখানে পৌঁছাতেই ট্রাম ছেড়ে একটা মসজিদের অদৃষ্টপূর্ব সৌন্দর্য দেখতে আরম্ভ করেছি; ওরা দেখি, মা-মাসির তম্বিতে গিয়ে শীতের গঙ্গাস্নানের সময় আমরা যা করি তাই করছে। গঙ্গা যে সুন্দর সেটা স্বীকার করছে কিন্তু তাতে নিমজ্জিত হওয়ার আনন্দ সম্বন্ধে সন্দিহান।
পার্সি একটু ঠোঁটকাটা। হক্ কথা–অর্থাৎ যেটাকে সে হক ভাবে, সেটা টক হলেও ক্যাট ক্যাট করে বলতে পারে। পলের ভাবটা একটু আলাদা। অশ্বত্থামা যদি পিটুলি গোলা খেয়ে সানন্দে তাণ্ডব নৃত্য জোড়ে তবে পার্সি তাকে তনুহূর্তে বলে দেবে যে দুধের বদলে তাকে ঘোল দিয়ে ফাঁকি দেওয়া হয়েছে, আর পল ভাববে, কী হবে ওর ভুল ভাঙিয়ে তার আনন্দটি নষ্ট করতে, ও যে আনন্দ পাচ্ছে তাতে তো কারও কোনও লোকসান হচ্ছে না!
পার্সি বললে, হুঁহ! যত সব! পিরামিড? হ্যাঁ বুঝি। মোক্ষম ব্যাপার। চারটিখানি কথা নয়। পারি ওরকম একটা বানাতে? মানলুম, এ মসজিদটা সুন্দর কিন্তু এটা বানানো আর তেমন কী?
পার্সিও মসজিদ দেখে বে-এক্তেয়ার হয়নি! সেকথা পূর্বেই বলেছি। কিন্তু এ যুক্তিটি তারও মনঃপূত হল না। শুধাল, পার তুমি বানাতে?
আলবৎ।
আমি বললুম, সন্দেহের কিঞ্চিৎ অবকাশ আছে। আজকের দিনে যেসব কলকজা দিয়ে নানারকম অদ্ভুত অদ্ভুত জিনিস তৈরি করা যায় তাই দিয়ে পিরামিড তৈরি করা অসম্ভব নয়। কিন্তু এ মসজিদে যে নিপুণ মোলায়েম কারুকার্য আছে সেরকম করবার মতো হাত আজকের দিনে আর কারও নেই। আর থাকলেই-বা কী? সেটা তো হবে নকল। তুমি যদি একটি বিরাট দিঘি খোঁড়ো তবে একথা কেউ বলবে না, এটা অমুক দিঘির নকল। তুমি যদি একটা পিরামিড বানাও তবে বলবে না এটা পিরামিডের নকল, কারণ সব পিরামিডই হুবহু একই প্রকারের, কোনওটা বেশি বড় কোনওটা কম বড়। কিন্তু তুমি যদি হ্যামলেট-খানা নকল করে মাসিক পত্রিকায় পাঠাও তবে তারা ছাপবে না, বলবে নকল। তুলনাটা মনঃপূত হল না? তবে বলি, তুমি যদি মোনালিজার ছবি পর্যন্ত হুবহু একে ফেল তবে সবাই বলবে, নকল, তবে ওস্তাদের হাত বটে, বাহ্! কেউ বলবে না, আহ্!
পল শুধাল, বাহু আর আহ্-এর মধ্যে তফাতটা কী?
আমি বললুম, যেখানে শুধুমাত্র হাতের ওস্তাদি কিংবা ওইজাতীয় কিছু একটা, যেমন মনে কর মাটির থেকে একশো হাত উপরে একটা দড়ির উপর হেঁটে চলে যাওয়া, কিংবা মনে কর সিঙ্গিটার মুখের ভিতর আপন মুণ্ডুটা ঢুকিয়ে দেওয়া, এক কথায় সার্কাসের তাবৎ কসরত দেখে আমরা বিস্ময়ে অভিভূত হয়ে বলি, বাহ্! পিরামিডের বেলাও তাই বলি বাহ! কিন্তু অমিতাভের উত্তম প্রতিকৃতিতে তার শান্ত-প্রশান্ত মুখচ্ছবি কিংবা মান্নার মুখে বিগলিত মাতৃরস দেখে আমরা রসের সায়রে ডুবতে ডুবতে বলি, আহ্! কী আরাম! কী সৌন্দর্য! বাহু-এর কেরানি যতই কঠিন, যতই রোমাঞ্চকর হোক না কেন, তার শেষ মূল্য আহ-এর জিনিসের চেয়ে কম। এভারেস্টের চুড়োয় ওঠা যত কঠিনই হোক না, তার মূল্য তিয়াসী পথিককে একপাত্র জল দেওয়ার চেয়ে অনেক কম। এই যে পার্সি বললে, সে পিরামিড বানানোর মতো কঠিন কর্ম করতে পারে না, সেইটেই সবকিছু যাচাই করার শেষ পরশপাথর নয়। শেক্সপিয়র খুব সম্ভব দড়ির উপরে ধেই ধেই করে নৃত্য করতে পারতেন না। তাই বলে ওই কর্ম তার হ্যামলেটের চেয়ে মূল্যবান এ রায় কে দেবে? আসলে দুটো আলাদা জিনিস। তুলনা করাই ভুল। পিরামিডে আছে ইঞ্জিনিয়ারিং হুনোর হেকমত (স্কিল) আর মসজিদে আছে রসসৃষ্টি (আর্টিস্টিক ক্রিয়েশন)।
ইতোমধ্যে দেখি একটি মিশরীয় জাব্বা-জোব্বা পরা ছাত্র আজহর বিশ্ববিদ্যালয়ের মসজিদ থেকে বেরিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে এগিয়ে আসছে। চেহারা দেখে ভারতীয় বলেই মনে হল।
.
২২.
আজহর বিশ্ববিদ্যালয়ের বয়স পুরো-পাক্কা এক হাজার বৎসর। অক্সফোর্ড, কেজি, প্যারিস, বার্লিন এর চেয়ে কয়েকশো বছরের ছোট। তবু আজ যেসব গুণীজ্ঞানীর নাম পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়ে এঁরা ওইসব ইয়োরোপীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র। আজহর থেকে যারা বেরোন তাঁদের নাম তো শুনতে পাইনে। হ্যাঁ, মনে পড়ল, মিশরের গাঁধী বলতে যাকে বোঝায় সাদ জগলুল পাশা ছিলেন আজহরের ছাত্র। কিন্তু আর কারও নাম শুনতে পাইনে কেন?
আশ্চর্য! মুসলমানরা যখন স্পেন দখল করল তখন তারা সেখানে আজহরের অনুকরণে বিশ্ববিদ্যালয় গড়ল। প্যারিস ইউনিভার্সিটির গোড়াপত্তন যারা করেন তাদের অনেকেই লেখাপড়া শিখেছিলেন স্পেনের মুসলমান বিশ্ববিদ্যালয়ে। এবং প্রথম দিককার পাঠ্যপুস্তকগুলো পর্যন্ত আরবি বই থেকে লাতিনে অনুবাদ করা। আজ আর আজহরের নাম কেউ করে না, করে প্যারিস বিশ্ববিদ্যালয়ের।
কিন্তু আশ্চর্য হই কেন? একদা এই ভারতবর্ষের জ্ঞান-বিজ্ঞান ভারতবর্ষের বাইরে ছড়িয়ে পড়েছিল। গ্রিকরা আমাদের কাছ থেকে অনেক কিছু শিখেছিল। পরবর্তী যুগে ইয়োরোপীয়রা আমাদের কাছ থেকে শূন্যের ব্যবহার শিখল (লক্ষ করেছ বোধহয় রোমান হরফে যখন I, I, X, X, C. M. লেখ তখন শূন্যের ব্যবহার আদপেই হয় না।) এবং তারই ফলে তাদের গণিত শাস্ত্র কী অসাধারণ দ্রুতগতিতে এগিয়ে চলল। আরবরা চরক সুশ্রুতের অনুবাদ করল, আরও কত কী। একাদশ শতকে ভারত আক্রমণকারী সুলতান মাহমুদের সভাপণ্ডিত অল-বিরুনি সংস্কৃত শিখে ভারতবর্ষের জ্ঞান-বিজ্ঞান সম্বন্ধে যে বই লেখেন তা পড়ে সে যুগের মুসলিম জগৎ অবাক হয়ে ভারতবর্ষের গুণগান করেছিল। তারও পরবর্তী যুগে সম্রাট আওরঙ্গজেবের বড় ভাই দারা শিকুর উপনিষদ সম্বন্ধে ফারসি বই লাতিনে তর্জমা হয়ে যখন ইয়োরোপে বেরুল তখন সে বই নিয়ে ইয়োরোপে কী তোলপাড়ই না হয়েছিল। সে যুগের সেরা দার্শনিক শোপেন হাওয়ার তখন বলেছিলেন, এ বই আমার জীবনের শেষ কটা দিন শান্তিতে ভরে দেবে। ওই সময়েই বিশ্বকবি গ্যোটে শকুন্তলার অনুবাদ পড়ে ঘন ঘন সাধু সাধু বলেছিলেন।
এখনও ভারতবর্ষের, আজহরের পুরনো সম্পদের সম্মান ইয়োরোপীয়রা করে কিন্তু আজকের দিনে যারা শুধু সংস্কৃত কিংবা মিশরের আরবির চর্চা নিয়ে পড়ে থাকেন তাদের নাম কেউ করে না। তাঁরা এমনকিছু সৃষ্টি করতে পারেন না কেন যা পড়ে বিশ্বজন বিমোহিত হয়ে পুনরায় সাধু, সাধু রবে হুঙ্কার তোলে?
হায়, এঁদের সৃজনীশক্তি ফুরিয়ে গিয়েছে। কেন ফুরল? তার একমাত্র কারণ, এক বিশেষ যুগে এসে এরা ভাবলেন, এঁদের সবকিছু করা হয়ে গিয়েছে, নতুন আর কিছু করবার নেই, পুরনো পুঁজি ভাঙিয়ে খেলেই চলবে।
এবং তার চেয়েও মারাত্মক কথা– এঁরা অন্যের কাছ থেকে আর কিছু শিখতে চান না। এঁদের দম্ভ দেখে তাই স্তম্ভিত হতে হয়।
আজহরের ছেলেটিকে জিগ্যেস করলুম, তোমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ে ফিজিক্স কেমেস্ট্রি বটুনি পড়ানো হয়?
সে শুধাল, এসব কী?
অনেক কষ্টে বোঝালুম।
সে বললে, ধর্মশাস্ত্রে যা নেই, তা জেনে আমার কী হবে?
আমি বললুম, অতিশয় হক কথা। ধর্ম ছাড়া অন্য কোনও গতি নেই কিন্তু ভ্রাতঃ, তোমার পা যদি আজ আছাড় খেয়ে ভেঙে যায় আর ডাক্তার বলে, এক্সরে করে দেখতে হবে কোন্ জায়গায় ভেঙেছে, তখন কি ধর্মশাস্ত্রে এক্সরে-র কল বানাবার সন্ধান পাবে?
উত্তরে কী বলেছিল মনে নেই। ধর্ম রক্ষা করবেন এইজাতীয় কিছু একটা। কিন্তু ইতোমধ্যে দেখি পল-পার্সি অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছে। তত্ত্বালোচনা পার্সিকে বিকল করে সে কথা পূর্বেই বলেছি, কিন্তু এস্থলে পল পর্যন্ত বিচল হয়ে পড়ল। আমি যখন একটু থেমেছি তখন দেখি তারা এক দোকানির সঙ্গে দরদস্তুর করছে।
কী ব্যাপার? মিশরের পিরামিডের ভিতর যেসব টুকিটাকি জিনিস পাওয়া গিয়েছে তারই কিছু কিছু এখানে বিক্রি হচ্ছে। আমি বললুম, এসব তো মহামূল্যবান জিনিস গুলো কেনার কড়ি আমাদের কাছে আসবে কোত্থেকে, আর মিশরি সরকার সেগুলো জাদুঘরে সাজিয়ে না রেখে বাজারে বিক্রি করবার জন্য ছাড়বেই বা কেন?
দোকানি বললে, একই জিনিস এত অসংখ্য পিরামিডে এত বেশি পাওয়া গিয়েছে যে সেগুলো সরকার বাজারে ছেড়েছে–ভালগুলো অবশ্য জাদুঘরে সাজানো আছে এবং দামও তাই বেশি নয়।
আমি কিনি-কিনছি কিনি-কিনছি করছি, এমন সময় সেই আজহরের ছেলেটি আমার কানে কানে বললে, তাই যদি হবে তবে ওর দোকানের পিছনের কারখানাতে কী সব তৈরি হচ্ছে। চলুন না, কারখানাটা দেখে আসবেন।
আমি বললুম, কী আর হবে দেখে? জর্মনিতে তৈরি কাশ্মিরি শাল, জাপানে তৈরি খাঁটি অতিশয় খাঁটি ভারতীয় খদ্দর, কলকাতায় তৈরি জর্মন ওষুধ এসব তো বহু বার দেখা হয়ে গিয়েছে। ওর থেকে নতুন আর কী তত্ত্বলাভ হবে?
পল-পার্সিকে বললুম, পাশের ছেলের পাতা থেকে টুকলি করা আর এই জাল মাল তৈরি করাতে তফাত নেই।
পল বললে, মাস্টার ধরতে পারলে কান মলে দেন।
আমি বললুম, সরকারও মাঝে মাঝে এদের কান মলে দেয়।
তখন হঠাৎ খেয়াল হল, আজহরি ছেলেটি যে ফিসফিস করে কানে কানে কথা বলেছিল, সেটা বাঙলায়। তৎক্ষণাৎ তাকে শুধালুম, আপনি কি বাঙালি?
সে বললে, হ্যাঁ।
তার পর শুনলুম, বর্ধমানে বাড়ি, দশ বছর বয়সে এখানে সে এসেছে। বাঙলা প্রায় ভুলে গিয়েছে। আরও চার বছর অর্থাৎ সবসুদ্ধ বারো বছর এদেশে কাটিয়ে ফের বর্ধমানে ফিরে যাবে।
সেখানে ফিরে গিয়ে কী করবে? এই বিদ্যের কদর তো ভারতবর্ষে নেই। তাতে আশ্চর্য হবারই বা কী? কাশী থেকে বারো বছর সংস্কৃত শিখে বর্ধমানে ফিরলে তার পাণ্ডিত্যেরই-বা মূল্য দেয় কে? তাকেও তো সেখানে উপোস করতে হয়। একেও তাই করতে হবে। আজ আর প্রাচীন শাস্ত্রের পাণ্ডিত্যের কেউ সম্মান করে না।
কিন্তু ছেলেটির দেখলুম তাই নিয়ে কোনও দুর্ভাবনা নেই। বাপ ধার্মিক লোক, ছেলেকে ধর্মশিক্ষা করতে পাঠিয়েছেন, তাই শিখে সে দেশে ফিরে যাবে– তার পর যা হবার তাই হবে।
দলের কেউ এ দোকানের সামনে দাঁড়াচ্ছে, কেউ ও দোকানের সামনে দাঁড়াচ্ছে। কেনাকাটা হচ্ছে অতি সামান্য। টুকিটাকি নাড়াচাড়াতে আনন্দ অনেক বেশি খরচাও তাতে নেই। এই করে আমরা সমস্ত দিন কাটিয়ে দিতে পারতুম কিন্তু হঠাৎ দলের একজন স্মরণ করিয়ে দিলেন, আমাদের পোর্টসঈদের ট্রেন ধরতে হবে আটটায়। আবুল আসফিয়াকে স্মরণ করিয়ে দিতে তিনি বললেন, চলুন। কিন্তু তার হাবভাবে কোনও তাড়া নেই।
অতি অনিচ্ছায় ট্রামে উঠতে হল। আজহরের ছেলেটি আমার সঙ্গে বাঙলা কথা কইতে পেয়ে আমার সঙ্গ ছাড়তে চায় না। সে-ও চলল আমাদের সঙ্গে। আরবি ভাষা এখন তার জীবনের মূলমন্ত্র, কিন্তু তাই বলে কি মাতৃভাষা বাংলার মায়া এত সহজে কাটানো যায়?
খ্যাচাঙ করে ট্রাম দাঁড়াল। কী ব্যাপার? আগের একটা ট্রাম মোড় নিতে গিয়ে লাইন থেকে ছিটকে পড়েছে। বাদবাকি সব ট্রাম তার পিছনে গড্ডলিকায় দাঁড়িয়ে। লোহার ডাণ্ডা দিয়ে জনকয়েক লোক ছিটকে পড়া ট্রামটাকে লাইনে ফেরত নিয়ে যাবার চেষ্টা করছে। চেষ্টার চেয়ে চিৎকার-চেঁচামেচি হচ্ছে বেশি। লম্বা লম্বা আলখাল্লা উড়িয়ে রাস্তার ছেলে-বুড়ো ট্রামটার চতুর্দিকে ছুটোছুটি লাগিয়েছে। আর কত প্রকারেরই না উপদেশ, আদেশ অনবরত ট্রামের ভিতর-বাহির দু দিক থেকেই উপচে পড়ছে। দেশের হরির লুট এর কাছে লাগে কোথায়?
দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে মজাটা রসিয়ে রসিয়ে দেখছি, এমন সময় দলের একজনের হুশ হল আটটায় যে আমাদের ট্রেন ধরতে হবে। আমাদের দেহমন কিন্তু ওই রণাঙ্গন থেকে তখন কিছুতেই সরছিল না। কারণ ইতোমধ্যে দেখি ট্রামটি কী পদ্ধতিতে ফের লাইনে তোলা যায় তাই নিয়ে দুইটি দলের সৃষ্টি হয়েছে। যারা ডিপো থেকে এতক্ষণে এসে পৌঁছেছে তারা। বাতলাচ্ছে এক প্রকারের রণকৌশল, আর সব-কটা ট্রামের ড্রাইভার, কন্ডাকটরের দল সে রণকৌশলের বিরুদ্ধে ঘোষণা করছে অন্য জিহাদ। ব্যাপারটা তখন এমনি চরমে পৌঁছেছে যে, উভয় পক্ষ তখন লোহার ডাণ্ডা হাতে করে মুখোমুখি হয়ে সদম্ভে সগর্বে সর্বপ্রকারের আস্ফালনকর্ম সুষ্ঠু পদ্ধতিতে শনৈঃ শনৈঃ এগিয়ে নিয়ে চলেছে। দুই দলের পিছনে দাঁড়িয়ে আছেন ট্রামের যাত্রী এবং রাস্তার লোক। আর রাস্তার ছোঁড়ারা আলখাল্লা উড়িয়ে তাদের চতুর্দিকে পাই পাঁই করে ঘুরছে, বোঁ করে মধ্যিখান দিয়ে ইসপার-উসপার হয়ে যাচ্ছে, ধরা পড়ে কখনও-বা দু-একটা চড়-চাপড়ও খাচ্ছে।
একটা ফাসটো কেলাস লড়াইয়ের পূর্বরাগ কিংবা পূর্বাভাস!
কিন্তু হায়, পৃথিবীর কত সকর্মই না অসম্পূর্ণ রেখে এই দুনিয়া থেকে বিদায় নিতে হয়। এই যে আমি প্রতিজ্ঞা করেছিলুম, নিধিরামকে একদিন মোকামাফিক আচ্ছাসে উত্তম-মধ্যম দেব, তার পূর্বেই তো ম্যাট্রিক পাস করে ইস্কুল ছাড়তে হল! আর নিধে রাস্কেলটা ফেল মেরে পড়ে রইল ইস্কুলে। কী অন্যায় অবিচার। নিধেটা লেখাপড়ায় একটা আস্ত বিদ্যাসাগর, সেকথা জানি, কিন্তু আরও কত খাটাশও তো ম্যাট্রিক পাস করে। ও করলেই-বা কোন মহাভারত অশুদ্ধ হয়ে যেত? আমিও তো দুটো কিল মারার সুযোগ পেতুম। এইসব অবিচার দেখে সংসারের প্রতি আমার তখন ঘেন্না ধরে গিয়েছিল।
আজও তাই হল। দলের লোকের তাড়ায়। তখন আর বেশি সময় হাতে নেই। ট্যাসি নিতে হল।
বুকিং অফিসের সামনে যাত্রার দলের হনুমানের ল্যাজের মতো প্যাঁচ পাকানো কিউ- Q। কেউ কেউ এটাকে U বলে বলে W-ও বলে থাকেন, কারণ জায়গার অভাব থাকলে কিউ সচরাচর এইরকম শেপ-ই নিয়ে থাকে। অথচ গাড়ি ধরার সময় তখন মাত্র পাঁচ মিনিট। আবুল আসফিয়া কিউ-এতে দাঁড়ালেন। আমি তাকে বললুম, ট্রেন মিস নির্ঘাত। তিনি বললেন, আপনারা স্টেশনে যান।
স্টেশনে কখন কোন প্লাটফর্ম থেকে গাড়ি ছাড়বে তার খবর নিয়ে যখন সেই প্লাটফর্মের মুখে দাঁড়ালুম, তখন গেট-চেকার ভাঙা ভাঙা ইংরেজিতে শুধাল–
আপনারা যাবেন কোথায়?
পোর্টসঈদ।(সমবেত সঙ্গীতে)
তবে ট্রেনে গিয়ে আসন নিচ্ছেন না কেন? তাই শুনে পড়ি-মরি হয়ে একদল দিল ছুট ট্রেনের দিকে, আরেক দল যাবে কি যাবে না এই ভাবে না যথৌ ন তন্থৌ হয়ে রইল দাঁড়িয়ে, নড়লুম না আমরা তিনজন, পল, পার্সি আর আমি।
পল বললে, আমাদের টিকিট এখনও কাটা হয়নি।
চেকার ছোকরা বললে, আপনারা যান।
মনে হল ছেলেটি বুদ্ধিমান। আমাদের চেহারা-ছবি দেখে বুঝেছে, আমরা ফাঁকি দিয়ে গাড়ি চড়ার তালে নই। আমরা যখন পয়সা দেবার জন্য তৈরি তখন আমাদের ঠেকিয়ে রাখার কোনও প্রয়োজন নেই।
আমার মন তখন যাব যাব করছে। তখন পলের কথাতে বুঝলুম, সে কতখানি ভদ্র ছেলে! আমাকে বললে, আবুল আসফিয়াকে ছেড়ে আমরা যাব না।
সেই উৎকট সঙ্কটের সময়ও আমার মনে পড়ল, ধর্মরাজ যুধিষ্ঠিরও বিশেষ অবস্থায় স্বর্গে যেতে রাজি হননি।
আমাদের চোখের সামনে স্টেশনের বিরাট ঘড়ি। সেটা তখন দেখাচ্ছে, ৭, ৫৯।
কলাপসিবল গেটের ভিতর দিয়ে দেখছি, আমাদের ট্রেনের গার্ড বীরোচিত ধীর পদে টহল দিচ্ছে, আর মাঝে মাঝে ট্যাকঘড়ির দিকে তাকাচ্ছে।
মিশর তো প্রাচ্য দেশ, আরামের দেশ, অপনচুলায়িটির দেশ। ওরা আবার সময়মতো গাড়ি ছাড়ার যাবনিক পদ্ধতি শিখল কোথা থেকে? সংসারের অবিচারের প্রতি আবার আমার ঘেন্না ধরল। ট্রেন তো বাবা, সর্বত্রই নিত্য নিত্য লেট যায়। এই যে সোনার মুল্লুক ইংলন্ড, যার প্রশংসায় এ পোড়ার দেশের সবাই পঞ্চমুখ দশানন, সেই দেশ সম্বন্ধেই শুনেছি, এক ডেলি প্যাসেঞ্জারের ট্রেন রোজ লেট যেত এবং বেচারী তাই নিয়ে অনেক আবেদন-ক্রন্দন করার পর একদিন সত্যি সত্যি কাঁটায় কাঁটায় ঠিক সময়ে ট্রেন স্টেশনে এল। লোকটি উল্লাসভরে স্টেশনমাস্টারকে কনগ্রাচুলেট করাতে মাস্টার বিমর্ষ বদনে বললে, এটা গতকালের ট্রেন; ঠিক চব্বিশ ঘণ্টা লেট।
সেই পরানের দ্যাশ বিলেতেই যদি এই ব্যবস্থা তবে এই খানদানি গেরেমভারী মিশরে মানুষ কি শুধুমাত্র আমাদের দলকে ভ্যাংচাবার জন্যই কণ্টকে কণ্টকে ট্রেন ছাড়তে চায়?
দেখি, গার্ড সাহেব দোদুল্যমান গতিতে আমাদের দিকে আসছে। চেকারকে কী যেন শুধাল তার পর উত্তর শুনে আমাকে বললে, আর তো সময় নেই, গাড়িতে উঠুন।
লোকটির সৌজন্যে আমি সমোহিত হয়ে গেলুম। কে আমরা, আমাদের জন্য ওর অত দরদ কিসের? স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছে, আমরা মার্কিন টুরিস্ট নই যে তাকে কড়া-কাঁড়া সোনার মোহর টিপস দেব। মিশরের ট্রেন লোহালক্কড়ের বটে, কিন্তু মিশরীয় গার্ডের দিল মহব্বতের খুনে তৈরি।
আমি পাগল-পারা খুঁজছি সৌজন্য ভদ্রতার আরবি, তুর্কি, ফারসি বাক্য, যা দিয়ে আমি তাকে আমার কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করতে পারি। ইংরেজিতে তো আছে শুধু ছাই, থ্যাঙ্কু, ফরাসিতে মেসি, মেসি, জর্মনেও নাকি ডঙ্কি না ডাঙ্কে কী যেন একটা আছে কিন্তু ওই সামান্য একটা-দুটো শব্দ দিয়ে গার্ড সায়েবের সৌজন্যসমুদ্রে আমার হাল পানি পাবে কেন?
তবুও তেরিয়া হয়ে বলে গেলুম, আনা উশকুরুকুম চোক তশকুর এদরং এফেলং খৈলি তশকুর মিদমহাতান, কুরবান আরও কত কী, উল্টা-সুন্টা। তার মোদ্দা অর্থ, মহাশয় যে সৌজন্য দেখাইলেন, তাহা ভারতবর্ষের ইতিহাসে যুগযুগান্তব্যাপী অবিস্মরণীয় হইয়া থাকিবে কিন্তু হালফিল আমরা লৌহ-বর্মশকটে আরোহণ করিতে অক্ষম যেহেতুক আমাদের পরমমিত্র চরমসখা শ্রীশ্রীমান আবুল আসফিয়া নুরুউদ্দিন মুহম্মদ আব্দুল করীম সিদ্দিকিকে পরিত্যাগ করিয়া দেশান্তর গ্রহণ করিতে সম্পূর্ণ অক্ষম।
সঙ্গে সঙ্গে আরবি, তুর্কি, ফারসি তিন ভাষাতেই বিস্তর ক্ষমা ভিক্ষা করলুম।
আর মনে মনে মোক্ষম চটছি আবুল আসফিয়ার ওপর। লোকটার কি কণামাত্র কাণ্ডজ্ঞান নেই? দলের নেতা হয়ে কোনওরকম দায়িত্ববোধ নেই? সাধে কি ভারতবর্ষ স্বরাজ্য থেকে বঞ্চিত!
হঠাৎ পল-পার্সি দিল ছুট। তারা আবুল আসফিয়াকে দেখতে পেয়েছে। এবং আশ্চর্য, লোকটা তখনও নিশ্চিন্ত মনে রেলের এক কর্মচারীকে স্টেশনের বড় ঘড়িটা দেখিয়ে কী যেন বোঝাচ্ছে। বোঝাচ্ছে কচু! নিশ্চয়ই বোঝাচ্ছে, ওদের ঘড়ি ফাস্ট যাচ্ছে। তা যাচ্ছে তো যাচ্ছে, সেকথা বুঝিয়ে কী তোমার টাকেতে চুল গজাবে– ওদিকে ট্রেন মিস করে?
কথার মাঝখানেই পল আর পার্সি পিছন থেকে তাঁকে দু হাতে ধরে দিলে হ্যাঁচকা টান। তার পর দিল ছুট গাড়ির দিকে। আমিও পড়ি-মরি হয়ে সেদিকে। দলের যারা ট্রেনের সামনে দাঁড়িয়ে ছিল তারাও জয়োল্লাসে হুঙ্কার দিয়ে উঠেছে। আবুল আসফিয়া হাত ছাড়াবার চেষ্টা করছেন। স্টেশনের আন্তর্জাতিক জনতা যে যার পথ ভুলে তাকিয়ে রয়েছে আমাদের দিকে। পুলিশ দিয়েছে হুইসল। তবে কি দিনেদুপুরে কিন্যাপিং! কিন্তু এ তো,
উল্টো বুঝলি রাম, ওরে উল্টো বুঝলি রাম,
কারে করলি ঘোড়া, আর কার মুখে লাগাম?
এখানে তো বুড়ো-ধাড়িকে পাকড়ে নিয়ে চলেছে দুটো চ্যাংড়া!
গাড়ি ঠিক সময়ে ছেড়েছিল না লেটে, আবুল আসফিয়ার ঘড়ি ঠিক না রেলের ঘড়ি ঠিক এসব সূক্ষ্ম প্রশ্নের সমাধান হল না। গার্ড সায়েব যেভাবে পিছন থেকে পাকা হাতে আমাদের ধাক্কা দিয়ে দিয়ে গাড়িতে ওঠাল তার থেকে অনুমান করলুম, এ প্রকারের কর্ম করে করে তার হাত ঝানু হয়ে গিয়েছে।
আবুল আসফিয়া তখনও পলকে বোঝাবার চেষ্টা করছেন, তাঁর ওই ঘড়িটাই সুইজারল্যান্ডের ক্রনোমিটার পরীক্ষায় পয়লা প্রাইজ পেয়েছিল। মিশরিদের সময়জ্ঞান নেই। আমরাও অতিশয় সরল। চিলে কান নিয়ে গেল শুনেই—
.
২৩.
আহা! সুন্দর দেশ!
খালে-নালায় ভর্তি। গাড়ি মিনিটে মিনিটে গম্, গড়ম, গড়ড় করে সেসব নালার উপর দিয়ে পেরুচ্ছে। তার পর গাড়ি বলে বড়ঠাকুরপো-ছোট্ঠাকুরপো, বড়ঠাকুরপো-ছোটঠাকুরপো, তার পর ফের নালার উপর গ, গড়ম গড়ড়ম। আর গাড়ির শব্দ যে এত মিষ্টি কে জানত? এ ট্রেন মিস করলে আর দেখতে হত না!
খাল-নালা তো বললুম, কিন্তু এক-এক নদ-নদী এমনই চওড়া যে বোধ করি সেগুলো নীলেরই শাখা-প্রশাখা। আর সেগুলোতে জলে-ডাঙার মাঝখানে ফাঁক প্রায় নেই। নিতান্ত বর্ষাকাল ছাড়া আমাদের নদীর জল যান তলিয়ে, আর পাড়গুলো থাকেন খাড়া হয়ে। সে জল অত নিচু থেকে উপরে তোলা যায় না বলে সে জল থেকেও নেই। চাষি তাই দিয়ে শীতকালে আরেকটা ফসল তুলতে পারে না। এদেশের লোক সৃষ্টির সেই আদিম প্রভাতে চাষবাস শেখার সঙ্গে সঙ্গেই তাদের একমাত্র নদী নীলের গা থেকে এত হাজার হাজার খাল নালা কেটে রেখেছিল যে সে নদী গম্ভীর হবার সুযোগ পায়নি এবং ফলে নীলের জল দেশটাকে বারো মাস টৈটম্বুর করে রাখে।
ক্ষেতভরা ধান গম কার্পাস! সবুজে সবুজে ছয়লাপ। মাঝে মাঝে খেজুরগাছের সারি, আর কখনও-বা এখানে একটা সেখানে একটা, দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ক্ষেতের পাহারা দিচ্ছে।
আর নদীর উপর দিয়ে চলেছে উঁচু উঁচু তেকোনা পাল তুলে দিয়ে লম্বা লম্বা নৌকো। এ দেশে বৃষ্টি প্রায় হয় না বলে নৌকোতে ছইয়ের ব্যবস্থা প্রায় নেই। জোর হাওয়ায় নৌকোগুলো চলেছে দ্রুতগতিতে। পালের দড়ি ছিঁড়ে গেলে নৌকো যে ডুবে যাবে সে ডরভয় এদের নেই। তবে বোধ করি এদেশে দমকা হাওয়া হঠাৎ এসে নৌকোকে এলোপাতাড়ি ধাক্কা লাগায় না।
সবুজ ক্ষেত, নানারঙের পাল, ঘোর ঘন নীল আকাশ, চন্চল্ ছলছল জল মনটাকে গভীর শান্তি আর পরিপূর্ণ আনন্দে ভরে দেয়। গাড়ির জানালার উপরে মুখ রেখে আধবোজা চোখে সে সৌন্দর্যরস পান করছি আর ভাবছি, এই সৌন্দর্য দেখার জন্যেই তো বহুলোক রেলগাড়ি চড়বে, আমি যদি এদেশে থাকবার সুযোগ পেতুম তবে প্রতি শনিবারে রেলে চড়ে যেদিকে খুশি চলে যেতুম। কিছু না, শুধু নৌকো, জল, ক্ষেত আর আকাশ দেখে দেখে দিনরাত কাটিয়ে দিতুম।
রাতের কথায় মনে পড়ল, চাঁদের আলোতে এ সৌন্দর্য নেবে অন্য এক ভিন্ন রূপ। সেটা দেখবার সুযোগ হল না– এখানটায়, এবারে।
মাঝে মাঝে নদী, নৌকো, খেজুরগাছ সবকিছু ছাড়িয়ে দেখতে পাই সেই তিনটে বিরাট পিরামিড। কত দূরে চলে এসেছি তবু তারা মাঝে মাঝে মুখ দেখিয়ে সঙ্গে সঙ্গে ছুটে চলেছে আবার কাছের গাছের পিছনে ঢাকা পড়ে যাচ্ছে, আবার মুখ দেখাচ্ছে। তখনই বুঝতে পারলুম, পিরামিডগুলো কত উঁচু। কাছের থেকে যেটা স্পষ্ট বুঝতে পারিনি।
কম্পার্টমেন্টের মাঝখান দিয়ে চলাফেরার পথ– কলকাতার ট্রামগাড়িতে যেরকম। সেই পথ দিয়ে যে কতরকমের ফেরিওয়ালা এল গেল তার হিসাব রাখা ভার। কমলালেবু, কলা, রুটি থেকে আরম্ভ করে নোটবুক, চিরুনি, মোজা, ঘড়ি, লটারির টিকিট হেনবস্তু নেই যা ফেরিওলা দু চার বার না দেখলে মনে হল লোহার সিন্দুক এবং আস্ত মোটরগাড়ি মাত্র এই দুই বস্তুই বোধ করি ফেরি করা হল না।
এক কোণে দেখি জাব্বা-জোব্বা-পরা এক মৌলানা সায়েব হাত-পা নেড়ে বক্তৃতা দিচ্ছেন আর তাকে ঘিরে বসেছে একপাল ছোকরা–তারাও পরেছে জাব্ব-জোব্বা, তাদের মাথায়ও লাল ফেজ টুপিতে প্যাচানো পাগড়ি। দু চারজন যাত্রীও দলে ভিড়ে বক্তৃতা শুনছে। পাশের এক ভদ্রলোককে জিগ্যেস করে জানতে পারলুম, ইনি আজহর বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক, ছুটিছাটায় যখন গ্রামের বাড়ি যান তখন তাঁর প্রিয় শিষ্যেরা তার সঙ্গেই বাড়ি যায়। সমস্তক্ষণ চলে জ্ঞানচর্চা। ট্রেনের অন্য লোকও সে শাস্ত্রচর্চা কান পেতে শোনে।
উত্তম ব্যবস্থা। প্রাচীন যুগে গুরুগৃহে বাস এবং বর্তমান যুগের কলেজে গিয়ে পড়াশুনা করা দুটোর উত্তম সমন্বয়। মাঝখানে থার্ড ক্লাস গাড়ির প্যাসেঞ্জার, চাষাভূষোরাও এদের জ্ঞানের কিছুটা পেয়ে গেল। আমাদের দেশের চাষারা তো প্রফেসরদের জ্ঞানের একরত্তিও পায় না।
সঙ্গে সঙ্গে ফেরিওলার কাছ থেকে কলামুলো কিনে নিয়ে মৌলানা সায়েব খাচ্ছেন, ছেলেদেরও খাওয়াচ্ছেন। সে-ও পরিপাটি ব্যবস্থা।
হরেকরকম ফেরিওলাই তো গেল। এখন এলেন আরেক মূর্তি। মুখে একগাল হাসি– আপন মনেই হাসছে– পরনে লজঝড় কোর্ট-পাতলুন, নোংরা শার্ট, টাইয়ের নটটা ট্যারা হয়ে কলারের ভিতর ঢুকে গিয়েছে, আর হাতে একতাড়া রঙিন ছবিতে ভর্তি হ্যান্ডবিল প্যালিট।
কেন যে আমাকেই বেছে নিল বলতে পারব না। বোধহয় আমাকেই সবচেয়ে বেশি বোকা বোকা দেখাচ্ছিল। ফেরিওলারা বোকাকেই সক্কলের পয়লা পাকড়াও করে এ তো জানা কথা। একগাল হাসির উপর আরেক পোঁচ মুচকি হাসি লেপটে দিয়ে শুধাল, কোথায় যাওয়া হচ্ছে স্যর?
ইয়োরোপীয় জাহাজ চড়ে মেজাজ খানিকটে বিলিতি রঙ ধরে ফেলেছে; বলতে যাচ্ছিলুম, তোমার তাতে কী? কিন্তু মনে পড়ল, মিশর প্রাচ্য দেশ, এ প্রশ্ন শুনে অভদ্রতা কিংবা অনধিকার প্রবেশ নয়। বললুম, পোর্টসঈদ।
তার পর?
মোগলাই মেজাজ চেপে নিয়ে বাঙালি কণ্ঠে বললুম, ইয়োরোপ।
ওহ্, তাই বলুন। কিন্তু ইয়োরোপ তো আর পালিয়ে যাচ্ছে না, তার আগে এই মিশরের পাশের দেশ প্যালেস্টাইনটা ঘুরে আসুন না। আমি তো এক্কেবারে থ। হরেকরকমের ফেরিওলা তো দেখলুম। কেউ বিক্রি করে ছপয়সার জুতোর ফিতে, কেউ বিক্রি করে পাঁচশো টাকার সোনার ঘড়ি কিন্তু একটা আস্ত দেশ বিক্রির জন্য তার আড়কাঠি ট্রেনের ভিতর ঘোরাঘুরি করবে, এ-ও কি কখনও বিশ্বাস করা যায়? তবু ব্যাপারটা ভালো করে জেনে নেবার জন্য শুধালুম, আপনি বুঝি দেশ বিক্রি করেন?
সে আমার কোনও কথার উত্তর না দিয়ে আরেক গাল হেসে তার হাতের তাড়ার ভিতর থেকে কী একটা খুঁজতে আরম্ভ করল। ইতোমধ্যে আমার পাশের ভদ্রলোক তাকে জায়গা ছেড়ে দিয়েছেন। সে ঝুপ করে বসে পড়ে তার হাতের উঁই থেকে বের করল প্যালেস্টাইনের হরেকরকম ছবিওলা একখানা রঙচঙ প্যাফ্লিট। তার উপর দেখি মোটা মোটা অক্ষরে লেখা প্যালেস্টাইন Palestine, the land of the lord প্রভুর জন্মভূমি, ইত্যাদি আরও কত কী! তার পর বললে, দেশ বিক্রি করি? হ্যাঁ তাই বটে, তবে কি না যেভাবে ধরেছেন, ঠিক সেভাবে নয়। কিন্তু সেকথা পরে হবে। উপস্থিত দেখুন তো, কী চমৎকার দেশে আপনাকে যেতে বলেছি। যে দেশে প্রভু জিসাস ক্রাইস্ট জন্মগ্রহণ করেছিলেন। আপনি নিশ্চয় প্রভুর
আমার ভারি বিরক্তি বোধ হল। এসব লোক কী ভাবে? ভারতবর্ষের লোক যিশুর নাম শোনেনি? তেড়ে বললুম, The book of the generation of Jesus Christ, the son of David, the son of Abraham. Abraham begat- ইত্যাদি ইত্যাদি, –চড়চড় করে মথি-লিখিত সুসমাচার থেকে মুখস্থ বলে যেতে লাগলুম, প্রভু যিশুর ঠিকুজি কুলজি। লোকটা কিন্তু একদম না দমে গিয়ে বললে, ঠিক, ঠিক। এই দেখুন, সেই জায়গা যেখানে প্রভু জন্ম নিলেন। একটা সরাইয়ের আস্তাবলে। মা মেরি আর তার বর যোসেফ তখন প্যালেস্টাইন থেকে এই মিশরের দিকে পালিয়ে আসছিলেন। বেলেহেম গ্রামে সন্ধ্যা হল। সরাইয়ে জায়গা না পেয়ে মা মেরি আশ্রয় নিলেন আস্তাবলে। এই দেখুন, নাজারেত গ্রামের ছবি। কত চিত্রকরই না এ ছবি এঁকেছেন। কত যুগ ধরে। তার পর দেখুন, নাজারেত গ্রামের ছবি। যোসেফ সেখানে ছুতোরের কাজ করতেন, আর মা মেরি যেতেন জল আনতে। এই দেখুন–
আমি বললুম, ব্যস, ব্যস, হয়েছে। কিন্তু আপনি আমার মুশকিলটা আদপেই বুঝতে পারেননি। আমি যদি পোর্টসঈদ থেকে প্রভুর জন্মভূমি প্যালেস্টাইনে চলে যাই তবে সেখানে ফিরে এসে ইয়োরোপে যাবার জন্য আমাকে নতুন করে জাহাজের টিকিট কাটতে হবে। তার পয়সা দেবে কে?–না হয় প্যালেস্টাইন তীর্থ-দর্শন-খর্চা আমি কোনও গতিকে, কেঁদে-ককিয়ে সামলে নিলুম। এক জাহাজের টিকিট একই জায়গা যাবার জন্য দু দুবার কাটবার মতো পয়সা কিন্তু আমার নেই।
আড়কাঠি তো হেসেই কুটিকুটি। আমি বিরক্ত। নিজেকে সামলে নিয়ে সে বলল, জাহাজের ডবল ভাড়া লাগবে কেন? আপনি যে জাহাজে করে পোর্টসঈদে এসেছেন সেই কোম্পানিরই আরেকখানা জাহাজ পনেরো দিন পর সেখানে এসে ইয়োরোপ যাবে। আপনি সে জাহাজে গেলেন কিংবা এ জাহাজে গেলেন তাতে কোম্পানির কী ক্ষতি-বৃদ্ধি? ডবল পয়সা নিতে যাবে কেন? আর ওই পনেরো দিনে আপনি দেখে নেবেন প্যালেস্টাইন।
আমি বললুম হুঁ, হুঁ উ-উ-কিন্তু সে জাহাজে যদি সিট না থাকে।
লোকটার ধৈর্যও অসীম। সমুখে বুদ্ধদেবের মতো করুণার হাসি হেসে বললে, কে বললে থাকবে না? এখন তো অফ সিজন, স্ন্যাক পিয়েরিয়েড, অর্থাৎ যাত্রীর ভিড় নেই। আপনি যে জাহাজে এলেন তার কি অর্ধেকখানা ফাঁকা ছিল না? আসছে জাহাজ গড়ের মাঠ।
আমি অনেকক্ষণ চুপ করে রইলুম। চিন্তাশীল লোক বলে নয়। আসলে সবকিছু বুঝতেই আর পাঁচজনের তুলনায় আমার একটু বেশি সময় লাগে। ব্রেন-বক্সে আল্লাতালা রিসিভিং সেটা দিয়েছেন অতিশয় নিকৃষ্ট পর্যায়ের। বাবগুলো গরম হতে লাগে মিনিট তিন। তার পরও চিত্তির। তিনটে স্টেশনে গুবলেট পাকিয়ে দেয় শুধু কড়া শিম্। কিছু বুঝতে পারিনে।
হঠাৎ মাথায় একটা প্রশ্ন এল। জানো বোধহয়, অগা বোকারা মাঝে মাঝে, অর্থাৎ বছরে দু একবার, পাকা স্যানার মতো দু-একটা প্রশ্ন ওঠাতে পারে। তাই শুধালুম, কিন্তু আমি প্যালেস্টাইন গেলে তোমার টাকে কি চুল গজাবে? তোমার তাতে কী লাভ?
লোকটা এইবারে একটু বিরক্ত হল। প্রশ্নটা মোক্ষম কঠিন বলে, না টাক টাক করলুম বলে ঠিক বুঝতে পারলুম না। আমার মগজ তখন ওই একটা কঠিন প্রশ্ন শুধাবার ধকল কাটাতে গিয়ে হাঁপাতে আরম্ভ করেছে।
বললে, আমার কী লাভ? আমার লাভ বিস্তর না হলেও অল্প। অর্থাৎ অল্প-বিস্তর। বুঝিয়ে বলি। আপনাকে নিয়ে যাব কুকের আপিসে। তাদের কাছ থেকে কাটবেন আপনার পয়লা গন্তব্যস্থল, প্যালেস্টাইনের রাজধানী জেরুজালেমের টিকিট। ন্যায্য ভাড়াই দেবেন। কিন্তু কুক্ আমাকে দেবে কমিশন
আমি শুধালুম, কুক্ তোমাকে কমিশন দিতে যাবে কেন?
আমার বুদ্ধির প্রাধর্য দেখে লোকটা প্রায় হতাশ হয়ে বললে, প্যালেস্টাইন সরকার কুকে পয়সা দেয়, তার দেশে টুরিস্ট নিয়ে যাবার জন্য তাতে করে সরকারের দু পয়সা লাভ হয়। তাই তারা কুককে দেয় কমিশন, কুক্ তার-ই খানিকটে দেয় আমাকে। তারা তো আর ট্রেনে ট্রেনে খদ্দেরের সন্ধানে টো-টো করতে পারে না। এ কর্মটি করি আমি। তাই আমার হয় কিঞ্চিৎ মুনাফা! বুঝলেন তো?
পাছে লোকটা আমাকে ফের বোকা বানিয়ে দেয়, তাই তাড়াতাড়ি বললুম, হ্যাঁ, হা, বুঝেছি, বিলক্ষণ বুঝেছি। যদিও আমি ততখানি সংসারী বুদ্ধি ধরিনে বলে ওইসব কমিশন-মিশনের মারপ্যাঁচ আদপেই ধরতে পারিনি।
কিন্তু লক্ষ করলুম, সে প্যাটপ্যাট করে আমার হ্যান্ডব্যাগটার দিকে তাকিয়ে আছে। তার উপরে মোটা মোটা হরফে লেখা ছিল– ALI, লোকটা শুধাল, ব্যাগটা আপনার?
আমি বললুম, হ্যাঁ।
বাহ্! তা হলে তো আপনি মুসলমান। আর জেরুজালেম মুসলমানদের তীর্থভূমি –মক্কার পরেই তার স্থান। আল্লাতালা মুহম্মদ সাহেবকে রাত্রে আরব থেকে জেরুজালেমে এনে সেখান থেকে স্বর্গদর্শনে নিয়ে যান। জেরুজালেমের সে জায়গাটার উপর এখন মসজিদ-উল-আসা। বিরাট সে মসজিদ, অদ্ভুত তার গঠন। এই কিছুদিন হল আপনাদের দেশেরই রাজা হাইদ্রাবাদের নিজাম সেটাকে দশ লক্ষ টাকা খরচ করে মেরামত করে দিয়েছেন। দেখতে যাবেন না সেটা?
তার পর বললে, আসলে কী জানেন? আসলে জেরুজালেম হল ধর্মের ত্রিবেণি। ইহুদি, খ্রিস্টান আর মুসলমান ধর্ম এখানে এসে মিলেছে। এক ঢিলে তিন পাখি।
তীর্থ দেখলে পুণ্য হয়, কি না হয় সেকথা আমি কখনও ভালো করে ভেবে দেখিনি। কিন্তু হিন্দুদের কাশী, বৌদ্ধদের রাজগির যখন দেখেছি, তখন এ তিনটেই-বা বাদ যাবে কেন? বিশেষ কোনও ধর্মের প্রতি পক্ষপাতিত্ব আমি আদপেই পছন্দ করিনে। তাকেই বলে কমুনালিজম। সৃষ্টিকর্তা যখন তার অসীম করুণায় এতগুলো ধর্ম বানিয়েছেন তখন নিশ্চয়ই সব-কটাতেই কিছু-না-কিছু আছে। আর বিশেষ করে মা ভারি খুশি হবে, যখন শুনবে আমি বয়ত-উল-মুদ্দস (পুণ্যভূমি অর্থাৎ জেরুজালেম) দর্শন করেছি। তার বাবাও মক্কা অবধি পৌঁছতে পেরেছিলেন–বয়ত-উল-মুদ্দস দেখেননি। সেখানে শুনেছি, অতি উত্তম তসবি (জপমালা) পাওয়া যায়। এক-গাছ কিনে দিলে মা যা খুশি হবে। সাত বক নামাজ পড়ার সময় (মুসলমানরা সচরাচার পড়ে পাঁচ বক-মা পড়ে সাত) মা তসবি গুনবে, আর আমার ওপর ভারি খুশি হবে।
পল আর পার্সি অবশ্য অত্যন্ত দুঃখিত হল। পার্সি বললে, আমাদের ফেলে আপনি চলে যাচ্ছেন প্যালেস্টাইন! আপনি না বলেছিলেন, ভূমধ্যসাগরের নানা জিনিস খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখাবেন, ইটালি আর সিসিলি, তার পর কর্সিকা আর সার্ডিনিয়ার ভিতর দিয়ে জাহাজ যাবার সময়, ভিসুভিয়স, আরও কত কী দেখাবেন?
আমি স্বার্থপর, পাষণ্ড। পূর্বপ্রতিজ্ঞা ভুলে গেলুম। তবু হাতজোড় করে মাপ চাইলুম।
পল-পার্সির দিকে তাকিয়ে বললে, ছিহ, পার্সি! স্যর ধর্মের জায়গা দেখতে ভারি ভালোবাসেন। এ সুযোগ ছাড়বেন কেন?
তবু আমার মনটা খারাপ হয়ে গেল।
একদিকে বন্ধুজন আরেক দিকে মায়ের তসবি।
সংসার কি শুধু দ্বন্দ্বেতেই ভরা?
.
পরিশিষ্ট
প্যালেস্টাইন ভ্রমণ যে এ পুস্তকের অংশ হতে পারত না তা নয়। কিন্তু পল আর পার্সি সঙ্গে না থাকলে সে বই তোমাদের বয়সী ছেলে-মেয়েদের কাছে ভালো লাগবে না বলে আমার বিশ্বাস। সে-বই হয়ে যাবে নিতান্তই বয়সীদের জন্য।
মানুষ বই লিখে বন্ধুজনকে উৎসর্গ করে। আমি প্যালেস্টাইন সম্বন্ধে না-লেখা ভ্রমণকাহিনী উৎসর্গ করলুম মিত্রদ্বয় পল এবং পার্সিকে।
.
.