০৫.
পল বিজ্ঞকণ্ঠে বললে, কলম্বো থেকে আদন বন্দর ২০৮২ মাইল রাস্তা। জাহাজে ছদিন লাগে। মাঝখানে দ্বীপ-টীপ নেই, অন্তত আমার ম্যাপে নেই। তবে আদনের ঠিক আগেই সোকোত্রা দ্বীপ। সেটা হয়তো দেখতে পাব।
আমি বললুম, যদি রাত্রিবেলা ওই জায়গা দিয়ে যাই তবে দেখবে কী করে? আর দিনের বেলা হলেও অতখানি পাশ দিয়ে বোধহয় জাহাজ যাবে না। তার কারণ বড় বড় দ্বীপের আশপাশে বিস্তর ছোট ছোট দ্বীপও জলের তলায় মাথা ডুবিয়ে শুয়ে থাকে। এর কোনওটার সঙ্গে জাহাজ যদি ধাক্কা খায় তবে আর আমরা সামনের দিকে এগুব না– এগিয়ে যাব তলার দিকে।
এদিকে কথা বলে যাচ্ছি, ওদিকে আমার বার বার মনে হতে লাগল, সোকোত্রা নামটা যেন চেনা চেনা মনে হচ্ছে। হঠাৎ আমার মাথার ভিতর দিয়ে যেন বিদ্যুৎ খেলে গেল। আমার বাবার মাসি-মেসোমশাই তাঁদের দুই ছেলেকে নিয়ে গত শতকের শেষের দিকে মক্কায় হজ করতে গিয়েছিলেন এবং আমার খুব ছেলেবেলায় তাঁর কাছ থেকে সে ভ্রমণের অনেক গল্প আমি শুনেছিলুম। আমার এই দাদাটি ছিলেন গল্প বলার ভারি ওস্তাদ। রাত্রির রান্না না হওয়া পর্যন্ত তিনি আমাদের গল্প বলে দিব্যি জাগিয়ে রাখতে পারতেন এবং যেই চাচিরা খবর দিতেন, রান্না তৈরি, অমনি তিনি বেশ কায়দা করে গল্পটা শেষ করে দিতে পারতেন। আমরা টেরই পেতুম না, আমাদের সামনে তিনি একটা ন্যাজকাটা হনুমান রেখে চলে গেলেন। আমাদের মনে হত গল্পটা যেন একটা আস্ত ডানাকাটা পরী।
সেই দাদির মুখে শুনেছিলুম, সোকোত্রার কাছে এসে নাকি যাত্রীদের মুখ শুকিয়ে যেত। জলের স্রোতের তোড়ে আর পাগলা হাওয়ার থাবড়ায় জাহাজ নাকি হুড়মুড়িয়ে গিয়ে পড়ত কোনও একটা ডুবন্ত দ্বীপের ঘাড়ে আর হয়ে যেত হাজারো টুকরোয় খান খান। কেউ-বা জাহাজের তক্তা, কেউ-বা ডুবন্ত দ্বীপের শ্যাওলা মাখানো পাথর আঁকড়ে ধরে প্রাণপণ চিৎকার করত বাঁচাও, কিন্তু কে বাঁচায় কাকে, কোথায় আলো, কোথায় তীর। ক্রমে ক্রমে তাদের হাতের মুঠি শিথিল হয়ে আসত, একে একে জলের তলে লীন হয়ে যেত।
দাদি যেভাবে বর্ণনা দিয়ে যেতেন, তাতে আমি সবকিছু ভুলে দুশ্চিন্তায় আকুল হয়ে উঠতুম, দাদি বাঁচলেন না, দাদিও ডুবে গেলেন। মনেই হত না জলজ্যান্ত দাদি আমাকে কোলে বসিয়ে গল্প বলছেন। শেষটায় বলতেন, আমাদের জাহাজের কিছু হয়নি, এসব টেছিল অন্য জাহাজে। সে জাহাজে করে গিয়েছিলেন তোর বন্ধু ময়না মিয়ার ঠাকুর্দা। জানিস তো, তিনি আর ফেরেননি। খুদাতালা তাঁকে বেহেশতে নিয়ে গিয়েছেন। মক্কায় হজ্বের পথে কেউ যদি মারা যায় তবে তার আর পাপ-পুণ্যের বিচার হয় না, সে সোজা স্বর্গে চলে যায়।
দাদি এরকম গল্প বলে যেতেন অনেকক্ষণ ধরে আর একই গল্প বলতে পারতেন বহুবার। প্রতিবারেই মনে হত চেনা গল্প অচেনা রূপে দেখছি। কিংবা বলতে পার, দাদিবাড়ির রাঙা বউদিকে যেন কখনও দেখছি রাস-মণ্ডল শাড়িতে, কখনও বুলবুল-চশমে। (হায়, এসব সুন্দর সুন্দর শাড়ি আজ গেল কোথায়!)
দাদির গল্পের কথা আজ যখন ভাবি তখন মনে হয় দাদি তার বর্ণনাতে আরব্য উপন্যাসের সাহায্য বেশকিছু নিতেন। আরব্য উপন্যাসের রকম-বেরকমের গল্পের মধ্যে সমুদ্রযাত্রা, জাহাজডুবি, অচেনা দেশ, অজানা দ্বীপ সম্বন্ধে গল্প বিস্তর। সিন্দবাদ নাবিকের গল্প পড়ে মনে হয়, জলের পির বদর সাহেব যেন আইন বানিয়ে দিয়েছিলেন যে জাহাজ ডুববে সেটাতেই যেন সিন্দবাদ থাকে। বেচারি সিন্দবাদ!
আরব্য উপন্যাসে যে এত সমুদ্রযাত্রার গল্প, তার প্রধান কারণ, আরবরা এক কালে সমুদ্রের রাজা ছিল, আজ যেরকম মার্কিন-ইংরেজের জাহাজ পৃথিবীর বন্দরে বন্দরে দেখা যায়। তবে কারণ বুঝতে কিছুমাত্র বেগ পেতে হয় না। আরব দেশের সাড়ে তিন দিকে সমুদ্র, তাই আরবরা সমুদ্রকে ডরায় না, আমরা যেরকম পদ্মা-মেঘনাকে ডরাইনে, যদিও পশ্চিমারা গোয়ালন্দের পদ্মা দেখে হনুমানজির নাম স্মরণ করতে থাকে– বোধহয় লম্ফ দিয়ে পেরোবার জন্য। আরবদের পূর্বে ছিল রোমানরা বাদশা– আরবরা তাদের যুদ্ধে হারিয়ে ক্রমে ক্রমে তাদেরই মতো অবাধে অনায়াসে সমুদ্রে যাতায়াত আরম্ভ করল। ম্যাপে দেখতে পাবে, মক্কা সমুদ্র থেকে বেশি দূরে নয়। আরবরা তখন লাল দরিয়া পেরিয়ে মৌসুমি হাওয়ায় ভর করে ভারতবর্ষের সঙ্গে ব্যবসা জুড়ল।
এসব কথা ভাবছি এমন সময় হঠাৎ আবার সোকোত্রার কথা মনে পড়ে গেল। দাদিমার সোকোত্ৰা স্মরণ করিয়ে দিল গ্রিকদের দেওয়া সোকোত্রার নাম দিয়োকরিদেস, সঙ্গে সঙ্গে হুশ-হুঁশ করে মনে পড়ে গেল যে পণ্ডিতেরা বলেন এই দিয়োস্করিদে নাম এসেছে সংস্কৃত দ্বীপ-সুখাধার থেকে। আরবরা যখন এই দ্বীপে প্রথম নামল তখন ভারতীয় বোম্বেটেদের সঙ্গে এদের লাগল ঝগড়া। সে ঝগড়া কতদিন ধরে চলেছিল বলা শক্ত কারণ আমাদের সমাজপতিরা তখন সমুদ্রযাত্রার বিরুদ্ধে কড়া কড়া আইন জারি করতে আরম্ভ করেছেন। আমার মনে হয় এদেশ থেকে কোনও সাহায্য না পাওয়াতে এরা ক্রমে ক্রমে লোপ পেয়ে যায়, কিংবা ওই দেশের লোকের সঙ্গে মিলেমিশে গিয়ে এক হয়ে যায় যেরকম শ্যাম, ইন্দোচীন ইন্দোনেশিয়ার সঙ্গে বহু শতাব্দীর আদান-প্রদানের পর একদিন আমাদের যোগসূত্র ছিন্ন হয়ে যায়। খুব সম্ভব ওই সমুদ্রযাত্রা নিষেধ করারই ফলে। ভারতীয়েরা কিন্তু সোকোত্রায় তাদের একটি চিহ্ন রেখে গিয়েছে; সোকোত্রার গাই-গরু জাতে সিন্ধু দেশের। আশ্চর্য, সভ্যতার ঘাত-প্রতিঘাতে মানুষ নিশ্চিহ্ন হয়ে যায় কিন্তু তার পোষা গরু-ঘোড়া শতাব্দীর পর শতাব্দী বেঁচে থেকে তার প্রভুর কথা চক্ষুষ্মন ব্যক্তিকে স্মরণ করিয়ে দেয়। মোগল-পাঠানের রাজত্ব ভারতবর্ষ থেকে কবে লোপ পেয়ে গিয়েছে কিন্তু তাদের আনা গোলাপ ফুল আমাদের বাগানে আরও কত শত শত বৎসর রাজত্ব করবে কে জানে!
আমি চোখ বন্ধ করে আত্মচিন্তায় মগ্ন হলেই পল-পার্সি আস্তে আস্তে চেয়ার ছেড়ে অন্য কিছু একটায় লেগে যেত। আমি তাদের সন্ধানে বেরিয়ে দেখি তারা লাউঞ্জে বসে চিঠি লিখছে। আমাকে দেখে পার্সি শুধাল, জাহাজে যে ফরাসি ডাকটিকিট পাওয়া যায় তাই দিয়ে এ চিঠি চীন দেশে যাবে তো?
আমি বললুম, নিশ্চয়। এমনকি জিবুটি বন্দরের ডাকঘরেও যদি ছাড় তবু যাবে। কারণ জিবুটি বন্দর ফরাসিদের। কিন্তু যদি পোর্টসঈদ বন্দরে ছাড় তবে সে টিকিট মিশর দেশে বাতিল বলে চিঠিখানা যাবে বেয়ারিং পোস্টে।
কিন্তু যদি পোর্ট সঈদে পৌঁছে জাহাজের লেটার বকসে ছাড়ি?
তা হলে ঠিক।
তার পর বললুম, হু। তবে বন্দরে নেমে মিশরি ডাকটিকিট লাগানই ভালো।
কেন, স্যর?
আমি বললুম, বৎস, আমার বিলক্ষণ স্মরণ আছে, চীন দেশে তোমার একটি ছোট বোন রয়েছে। সে নিশ্চয়ই ডাকটিকিট জমায়। তুমি যদি বন্দরে বন্দরে ফরাসি টিকিট সাঁটো তার কী লাভ? মিশরি টিকিট পেলে কি সে খুশি হবে না? তা-ও আবার দাদার চিঠিতে!
পার্সি আবার ভ্যাচর ভ্যাচর আরম্ভ করলে চুলকাটা সমস্যার সমাধান যখন আমি করে দিয়েছিলুম ঠিক সেইরকম- আমার সঙ্গে দেখা না হলে
আমি বললুম, ব্যস, ব্যস। আর শোনো, স্ট্যাম্প লাগাবার সময়, এক পয়সা, দু পয়সা, এক আনা, দুপয়সা করে করে চৌদ্দ পয়সার টিকিট লাগাবে–দুম করে শুধু একটা চৌদ্দ পয়সার টিকিট লাগিয়ো না। বোন তা হলে এক ধাক্কাতেই অনেকগুলি টিকিট পেয়ে যাবে।
ততক্ষণে পল এসে আমার সঙ্গ নিয়েছে। আস্তে আস্তে গুধাল, সোকোত্রা দ্বীপের কথা ওঠাতে আপনি কী ভাবছিলেন?
আমি বললুম, অনেক কিছু। এবং তার খানিকটে তাকে শুনিয়ে দিলুম।
পল দেখেছি পার্সির মতো সমস্তক্ষণ এটা-ওটা নিয়ে মেতে থাকে না। মাঝে মাঝে জাহাজের এক কোণে বসে বই-টই পড়ে। তাই খানিকক্ষণ চুপ করে আমার কথাগুলো হজম করে নিয়ে বললে, বিষয়টা সত্যি ভারি ইনট্রেসটিঙ। সমুদ্রে সর্বপ্রথম কে আধিপত্য করলে, তার পর কে, তারাই-বা সেটা হারাল কেন, আজ যে মার্কিন আর ইংরেজ আধিপত্য করছে সেটাই-বা আর কতদিন থাকবে এবং তার পর আধিপত্য পাবে কে?
আমি একটু ভেবে বললুম, বোধহয়, আফ্রিকার নিগ্রোরা। ফিনিশিয়ান, গ্রিক, রোমান, ভারতীয়, চীনা, আরব, পর্তুগিজ, ওলন্দাজ ইত্যাদি যাবতীয় জাতই তো পালা করে রাজত্ব করলে একমাত্র ওরাই বাদ গেছে। এখন বোধহয় ওদের পালা। আর ম্যাপে দেখছ তো, কী বিরাট মহাদেশ, ওতে কোটি কোটি লম্বা-চওড়া স্বাস্থ্যবান স্ত্রী-পুরুষ গমগম করছে।
পল বললে, কিন্তু ওদের বুদ্ধিসুদ্ধি?
আমি বললুম, সে তো দুই পুরুষের কথা। লেগে গেলে একশো বছরের ভিতর একটা জাত অন্য সবকটা জাতকে হারিয়ে দিতে পারে। বরঞ্চ পুরনো সভ্য জাত যারা আধমরা হয়ে গিয়েছে, তাদের নতুন করে বলিষ্ঠ প্রাণবন্ত করে রাজার আসনে বসানো কঠিন। একবার ছাঁচে ঢালাই করে যে মাল তৈরি করা হয়েছে তাকে ফের পিটে-টুকে নতুন আকার দেওয়া কঠিন– সেই তো হচ্ছে আজকের দিনের চীনা, ভারতীয় এবং আরও মেলা প্রাচীন জাতের নতুন সমস্যা।
পল জিগ্যেস করলে, ভারতীয়েরাও এককালে সমুদ্রে রাজত্ব করেছে নাকি?
আমি বললুম, সেকথা আজ প্রায় সবাই ভুলে গিয়েছে। কিন্তু সে জন্য তাদের দোষ দেওয়া অনুচিত। কারণ, ভারতীয়েরা নিজেরাই সে ইতিহাসের সন্ধান রাখে না। অথচ আমার যতদূর জানা, তাতে তারা লাল দরিয়া থেকে চীনা সমুদ্র পর্যন্ত ব্যবসা-বাণিজ্য করেছে, শ্যাম, ইন্দোচীন, ইন্দোনেশিয়াতে রাজত্বও করেছে। তার পর একদিন আমাদের সমাজপতিরা সমুদ্রযাত্রা বারণ করে দিলেন খুব সম্ভব আমাদের সাম্রাজ্য বিস্তার তারা পছন্দ করেননি। তাই হয়তো তারা বলতে চেয়েছিলেন, যে দেশ জয় করছ তারই আর পাঁচজনের সঙ্গে মিলেমিশে এক হয়ে যাও, আপন দেশে ফিরে আসার কোনও প্রয়োজন নেই।
পল বললে, আমার জীবনের এই ষোল বৎসর কাটল চীনে কিন্তু ভারতের সঙ্গে চীনের কখনও কোনও যোগ হয়েছিল বলে শুনিনি। শুধু শুনেছি বৌদ্ধধর্ম ভারত থেকে এসেছিল। কিন্তু সে তো কটমটে ব্যাপার!
আমি বললুম, অতিশয়। ও-পাড়া মাড়িয়ো না। কিন্তু চীন-ভারতের মধ্যে একবার একটি ভারি চমৎকার মজাদার দোস্তি হয়েছিল। শুনবে?
পল বললে, তা আর বলতে! কিন্তু পার্সিটা গেল কোথায়? কুকুরছানার মতো যেন সমস্তক্ষণ নিজের ল্যাজ খুঁজে বেড়ায়। ওরে, ও পার্সি!
.
জিরাফ কাহিনী
দিল্লিতে যখন পাঠান-মোগল রাজত্ব করত তখন সামান্যতম সুযোগ পেলেই বাঙলা দেশ স্বাধীন হয়ে যাবার চেষ্টা করত। বাঙলার প্রধান সুবিধে এই যে, সেখানে নদী-নালা বিল-হাওর বিস্তর এবং পাঠান-মোগলের আপন পিতৃভূমি কিংবা দিল্লিতে ওসব জিনিস নেই বলেই তারা যখনই বিদ্রোহ দমন করতে এসে বাঙলার জল দেখত তখনই তাদের মুখে জল যেত শুকিয়ে। দেশটা পিছলে, অভ্যাস না থাকলে দাঁড়ানো কঠিন।
এইরকম একটা সুযোগ পেয়ে বাঙলার এক শাসনকর্তা স্বাধীন হয়ে রাজা হয়ে যান। রাজাটি একটু খামখেয়ালি ছিলেন। তা না হলে কোথায় ইরান আর কোথায় বাঙলা দেশ। তিনি সেখানে দূত পাঠালেন বিস্তর দামি দামি সওগাত সঙ্গে নিয়ে ইরানের সবচেয়ে সেরা কবি হাফিজকে বাঙলা দেশে নিমন্ত্রণ করার জন্য। চিঠিতে লিখলেন, হে কবি, তোমার সুমধুর তথা উদাত্ত কণ্ঠে তামাম ইরান দেশ ভরে গিয়েছে। ইরান ক্ষুদ্র দেশ, তোমার কণ্ঠস্কৃর্তির জন্য সেখানে আর স্থান নেই। পক্ষান্তরে ভারতবর্ষ বিরাট দেশ, এখানে এস, তোমার কণ্ঠস্বর এখানে প্রচুর জায়গা পাবে। তার সরল অর্থ, ইরানে আর কটা লোক তোমার সত্যকার কদর করতে পারবে এ-দেশের লোকসংখ্যা প্রচুর। এইখানে চলে এস।
হাফিজের তখন বয়স হয়েছে। তার বুড়ো হাড়-কখানা তখন আর দীর্ঘ ভ্রমণ আর দীর্ঘতর প্রবাসের জন্য দেশ ছাড়তে নারাজ। তাই কবি একটি সুন্দর কবিতা লিখে না আসতে পারার জন্য বিস্তর দুঃখ প্রকাশ করলেন।
বাঙলা দেশের সরকারি দলিল-দস্তাবেজে এ ঘটনার কোনও উল্লেখ নাই। এর ইতিহাস পাওয়া গিয়াছে ইরানের খাতাপত্র থেকে।(১)
তার পরের রাজার দৃষ্টি গেল সেই সুদূর চীনদেশের দিকে। কিন্তু চীনসম্রাটকে তো আর বাংলা দেশে নিমন্ত্রণ করা যায় না। কাজেই রাজদূতকে বহু উত্তম উপঢৌকন দিয়ে চীনের সম্রাটকে বাঙলার রাজার আনন্দ-অভিবাদন জানালেন।
চীনসম্রাট সুদূর বাঙলা দেশের রাজার সৌজন্য-দ্রতার পরিচয় পেয়ে পরম আপ্যায়িত হলেন। চীন বিত্তশালী দেশ। প্রতিদানে পাঠালেন আরও বেশি মূল্যবান উপঢৌকন। সে রাজা কিন্তু ততদিনে রাজার দেশে চলে গিয়েছেন।
বাংলার রাজা তখন ভাবলেন, চীনের সম্রাটকে আমি কী দিতে পারি যা তার নেই। রাজদূতকে মনের কথা খুলে তার উপদেশ চাইলেন। রাজদূতটি ছিলেন অতিশয় বিচক্ষণ লোক। তিনি যখন চীনে ছিলেন তখন চীনদেশের আচার-ব্যবহার বিশ্বাস-অবিশ্বাস পুঙ্খানুপুঙ্খরূপে অনুসন্ধান করেছিলেন। বললেন, চীনের বহু লোকের বিশ্বাস, গাছের চেয়ে উঁচু মাথাওলা যে এক পয়মন্ত প্রাণী আছে সে যদি কখনও চীনদেশে আসে তবে সে দেশের শস্য তারই মাথার মতো উঁচু হবে।
রাজা শুধালেন, কী সে প্রাণী?
রাজদূত বললেন, জিরাফ। আফ্রিকাতে পাওয়া যায়।
রাজা বললেন, আনাও আফ্রিকা থেকে।
যেন চাট্টিখানি কথা! কোথায় বাঙলা দেশ, আর কোথায় আফ্রিকা! আজ যে এই বিরাট বিরাট কলের জাহাজ দুনিয়ার সর্বত্র আনাগোনা করে তারই একটাতে জিরাফ পোরা কী সহজ! তখনকার দিনের পালের জাহাজে আফ্রিকা থেকে বাঙলা দেশ, সেখান থেকে আবার চীন–ক মাস কিংবা ক বছর লাগবে কে জানে? ততদিন তার জন্য ওই অকূল দরিয়ায় ঘাস পাতা পাবে কোথায় দেখতে পাচ্ছি এই কলের জাহাজেই আমাদের শাকশবজি স্যালাড় খেতে দেয় অল্প– তার অন্যান্য তদারকি কি সহজ?
তখনকার দিনে আরব কারবারীরা আফ্রিকা, সোকোত্রা, সিংহল হয়ে বাঙলা দেশে ব্যবসা করতে যেত। রাজা হুকুম দিলেন, জিরাফ নিয়ে এস।
জিরাফ এল। কী খেয়ে এল, কতদিনে এল, কিছুই বলতে পারব না। রাজা জিরাফ দেখে ভারি খুশি। হুকুম দিলেন, চীনসম্রাটকে ভেট দিয়ে এস।
সেই চীন! জাহাজে করে! কতদিন লাগল কে জানে!
চীনসম্রাট সংবাদ পেয়ে যে কতখানি খুশি হয়েছিলেন তার খানিকটে কল্পনা করা যায়। তিনি হুকুম দিলেন, প্রাণীর জন্য খুব উঁচু করে আস্তাবল বানাও।
বলা তো যায় না তার মুণ্ডুটা মেঘে ঠেকবে, না চাদে ঠোক্কর লাগাবে। দীর্ঘ ভ্রমণের পর জিরাফ যখন জিরিয়ে জুরিয়ে তৈরি তখন শুভদিন শুভক্ষণ দেখে, চীনসম্রাট পাত্র-অমাত্য-সভাসদসহ শোভাযাত্রা করে জিরাফ দর্শনে বেরুলেন। সঙ্গে নিলেন, বিশেষ করে, রাজচিত্রকর এবং সভাকবি।
সম্রাট জিরাফ দেখে গভীর আনন্দ লাভ করলেন। সভাসদ ধন্য ধন্য করলেন। আপামর জনসাধারণ গভীরতর সন্তোষ লাভ করল–তাদের গুরুজন বলেছিলেন যে এরকম অদ্ভুত প্রাণী পৃথিবীতে আছে, এবং সে একদিন চীনদেশে আসবে, সেটা কিছু অন্যায় বলেননি। যারা সন্দেহ করত তাদের মুণ্ডুগুলো এখন টেনে টেনে ওই জিরাফের মুণ্ডুটার মতো উঁচু করে দেওয়া উচিত।
সম্রাট চিত্রকরকে আদেশ দিলেন, এই শুভদিবস চিরস্মরণীয় করে রাখার জন্য তুমি এই জিরাফের একটি উত্তম চিত্র অঙ্কন কর।
ছবি আঁকা হল।
সম্রাট কবিকে আদেশ করলেন, তুমি এই শুভ অনুষ্ঠানের বর্ণনা ছন্দে বেঁধে ছবিতে লিখে রাখ।
তাই করা হল।
গল্প শেষ করে বললুম, সে ছবির প্রিন্ট আমি কাগজে দেখেছি। পল শুধাল, স্যর, আপনি কী চীনা ভাষা পড়তে পারেন?
আমি বললুম, আদপেই না। আমার এক বন্ধু চীনা শিখেছে সে ভাষাতে বৌদ্ধ শাস্ত্রগ্রন্থ পড়ার জন্য। জান তো, আমাদের বহু শাস্ত্র এদেশে বৌদ্ধধর্ম লোপ পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে লুপ্ত হয়ে যায়, কিন্তু চীনা অনুবাদে এখনও বেঁচে আছে। আমার বন্ধু বৌদ্ধশাস্ত্র খুঁজতে খুঁজতে এই অদ্ভুত কাহিনীর সাক্ষাৎ পায়। তারই বাঙলা অনুবাদ করে, ছবিসুদ্ধ সেটা বাঙলা কাগজে ছাপায়। তা না হলে বাঙলা দেশের লোক কখনও এ কাহিনী জানতে পারত না, কারণ বাঙলা দেশে এ সম্বন্ধে কোনও ইতিহাস বা দলিলপত্র নেই।
পার্সি বললে, কিন্তু স্যর এটা তো ইতিহাসের মতো শোনাল না! এ যে গল্পকে ছাড়িয়ে যায়।
আমি বললুম, কেন বৎস, তোমার মাতৃভাষাতেই তো রয়েছে, টুথ ইজ স্ট্রেঞ্জার দ্যান, ফিশ–সত্য ঘটনা গল্পের চেয়েও চমকপ্রদ।
এবং আমাদের ব্যক্তিগত বিশ্বাস যে ঘটনার বর্ণনা মানুষকে গল্পের চেয়েও বেশি সজাগ করে না তুলতে পারে, সে ঘটনার কোনও ঐতিহাসিক মূল্য নেই। কিংবা বলব, যে লোক ঘটনাটার বর্ণনা দিয়েছে সে সত্যকার ঐতিহাসিক নয়। আমার দেশে এরকম কাঠখোট্টা ঐতিহাসিকই বেশি।
.
০৬.
কলরব, চিৎকার, তারস্বরে আর্তনাদ! কী হল কী হয়েছে। তবে কী জাহাজে বোম্বেটে পড়েছে বায়স্কোপে যেরকম দেখি, বোম্বেটেরা দু হাতে দুই পিস্তল, দু পাটি দাতে ছোরা কামড়ে ধরে লাফিয়ে লাফিয়ে এক জাহাজ থেকে আরেক জাহাজ আক্রমণ করে। তার পর হঠাৎ কানের পর্দা ফাটিয়ে এক ভয়ঙ্কর প্রলয়ঙ্কর বিস্ফোরণ- বারুদ গুদামে আগুন লেগে সেটা ফেটে গিয়েছে। তারই আগুন জাহাজের দড়াদড়ি পাল মাস্তুলে লেগে গিয়ে সমস্ত জাহাজ দাউ দাউ করে জ্বলে উঠেছে।
নাহ! স্বপ্ন। বাঁচলুম। সর্বাঙ্গ ঘামে ভিজে গিয়েছে। চোখ মেলতে দেখি, কেবিনের সব-কটা আলো জ্বলছে। আর সামনে দাঁড়িয়ে পল আর পার্সি। পল দাঁড়িয়ে আছে সত্যি কিন্তু পার্সিটা জুলু না হটেনটট কী যেন এক বিকট আফ্রিকান নৃত্য জুড়েছে–আফ্রিকানই হবে, কারণ ওই মহাদেশেরই গা ঘেঁষে তো এখন আমরা যাচ্ছি।
তা আফ্রিকার হটেনটটীয় মার্তণ্ড-তাত্ব নৃত্যই হোক আর ইয়োরোপীয় মাসুকা কিংবা ল্যামবেথ-উয়োক্-ই হোক আমি অবশ্য এ দুটোর মধ্যে কোনও পার্থক্যই দেখতে পাইনে, সঙ্গীতে তো আদৌ না– পার্সি এ সময়ে আমার কেবিনে এসে বি-নোটিশে নাচ জুড়বে কেন?
নাহ, নাচ নয়। বেচারি উত্তেজনায় তিড়িংবিড়িং করছে আর যে কাতর রোদন জানাচ্ছে সেটার সামারি করলে দাঁড়ায়;
হায়, হায়, সবকিছু সাড়ে সর্বনাশ হয়ে গেল, স্যর! আপনি এখনও অকাতরে নাক ডাকাচ্ছেন। আমার জীবন বিফল হল, পলের জীবনও বৃথায় গেল। জাহাজ রাতারাতি ডুব সাঁতার কেটে জিবুটি বন্দরে পৌঁছে গিয়েছে। সবাই জামাকাপড় পরে, ব্রেকফাস্ট খেয়ে পারে নামবার জন্য তৈরি, আর আপনি– হায়, হায়!
(এই বইখানার যদি ফিল হয় তবে এ স্থলে অশ্রুবর্ষণ ও ঘন ঘন দীর্ঘনিশ্বাস)
আমি চোখ বন্ধ করলুম দেখে পার্সি এবার ডুকরে কেঁদে উঠল।
আমি শান্ত কণ্ঠে শুধালুম, জাহাজ যদি জিবুটি পৌঁছে গিয়ে থাকে তবে এখনও এঞ্জিনের শব্দ শুনতে পাচ্ছি কেন?
পার্সি অসহিষ্ণুতা চাপাবার চেষ্টা করে বললে, এঞ্জিন বন্ধ করা, না করা তো এক মিনিটের ব্যাপার।
আমি বললুম, নৌভ্রমণে আমার পূর্ব-অভিজ্ঞতা বলে, এঞ্জিন বন্ধ হওয়ার পরও জাহাজ থেকে নামতে নামতে ঘণ্টা দুয়েক কেটে যায়।
পল, এই প্রথম মুখ খুললে; বললে, বন্দর যে স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি।
আমি বললুম, দার্জিলিং থেকে কাঞ্চনজঙ্খর চুড়োটা স্পষ্ট দেখা যায়, তাই বলে কি সেখানে দশ মিনিটে পৌঁছানো যায়?
তার পর বললুম, কিন্তু এসব কুতর্ক। আমি হাতে-নাতে আমার বক্তব্য প্রমাণ করে দিচ্ছি।
তার পর অতি ধীরেসুস্থে দাড়ি কামাতে আরম্ভ করলুম। পল আমার কথা শুনে অনেকখানি আশ্বস্ত কিন্তু পার্সি তখনও ব্যস্তসমস্ত। আমাকে তাড়া লাগাতে গিয়ে দাড়ি কামানো বুরুশটা এগিয়ে দিতে গিয়ে তুলে ধরে দাঁতের বুরুশ ওইটে দিয়ে গাল ঘষলে মুখপোড়া হনুমান হতে কতক্ষণ টাই ভেবে সামনে ধরে ড্রেসিংগাউনের কোমর বন্ধটা। তার পর চা-রুটি, মাখন-আণ্ডাতে অপূর্ব এক ঘ্যাঁট বানিয়ে আমার সামনে ধরে চতুর্দিকে ঘুরপাক খেতে লাগল– বাড়িতে জিনিসপত্র বাঁধাই-দাই করার সময় পাপিটা যেরকম এর পা ওর পা-র ভিতর দিয়ে ঘুরপাক খায় এবং বাড়িসুদ্ধ লোককে চটিয়ে তোলে।
শেষটায় বেগতিক দেখে আমি একটু তাড়াহুড়ো করে সদলবলে ডেকে এলুম।
উপরে তখন আর সবাই অপেক্ষা করে করে ক্লান্ত হয়ে তাস, পাশা, গালগল্পে ফিরে গিয়েছে।
পল চোখে দুরবিন লাগিয়ে বললে, কই, স্যর বন্দর কোথায়? আমি তো দেখতে পাচ্ছি, ধূ-ধূ করছে মরুভূমি আর টিনের বাক্সের মতো কয়েক সার একঘেয়ে বাড়ি।
আমি বললুম, এরই নাম জিবুটি বন্দর।
ওই মরুভূমিতে দেখবার মতো আছে কী?
কিচ্ছু না। তবে কী জানো, ভিদেশে পরদেশের ভিতর দিয়ে যাবার সময় অত-শত বাছবিচার করতে নেই– বিশেষত এই অল্প বয়সে। চিড়িয়াখানায় যখন ঢুকেছ, তখন বাঘ সিঙি দেবার সঙ্গে সঙ্গে খাটাশটাও দেখে নেওয়াই ভালো। আর কে জানে, কোনও মোড় ঘুরতে কোনও এক অপ্রত্যাশিত জিনিস বা অভিজ্ঞতা সঞ্চয় হবে না? মোকামে পৌঁছানোর পর না হয় জমা-খরচ করা যাবে, কোনটা ভালো লাগল আর কোনটা লাগল না।
জাহাজ থেকে তড়তড় করে সিঁড়ি ভেঙে ডাঙায় নামা যায় পৃথিবীর ভালো ভালো বন্দরেই। এখানে তাই পারে যেতে হল মোটরলঞ্চ করে। জিবুটির চেয়েও নিকৃষ্ট বন্দর পৃথিবীতে হয়তো আছে কিন্তু আমার দেখার মধ্যে ওইটেই সবচেয়ে অপ্রিয়দর্শন ও বৈচিত্র্যহীন বন্দর। মরুভূমির প্রত্যন্ত ভূমিতে বন্দরটি গড়ে তোলা হয়েছে একমাত্র রাজ্য বিস্তারের লোভে। এবং এ মরুভূমিকে কোনও প্রকারের শ্যামলিমা দেওয়া সম্পূর্ণ অসম্ভব জেনেই কেউ কোনওদিন কণামাত্র চেষ্টা করেননি একে একটুখানি আরামদায়ক করার।
ডাঙা থেকে সোজা চলে গিয়েছে একটা ধুলোয় ভর্তি রাস্তা বন্দরের চৌক বা ঠিক মাঝখানে। তার পর সেখান থেকে এদিকে-ওদিকে দু-চারটে রাস্তা গিয়েছে বটে কিন্তু বড় রাস্তাটা দেখার পর ওসব গলিতে ঢোকার প্রবৃত্তি সুস্থ লোকের হওয়ার কথা নয়। বড় রাস্তার দু দিকে সাদা কাম করা বাড়িগুলো এমনি মুখ গুমসো করে দাঁড়িয়ে আছে যে বাড়ির বাসিন্দারাও বোধ করি এসব বাড়িতে ঢোকার সময় দোরের গোড়ায় দাঁড়িয়ে খানিকক্ষণ শুকনো ঢোক গেলে কিংবা বাঁ হাত দিয়ে ঘাড়ের ডান দিকটা চুলকে নেয়। ছোট গলির মুখে পঁড়িয়ে উঁকি মেরে দেখি, মাটির তৈরি দেয়াল-ছাদের ছোট ছোট ঘর, না, ঘর নয়, গহ্বর কিংবা গুহাও বলতে পার। বৃষ্টি এদেশে এতই ছিটেফোঁটা হয় যে, ছাত গলে গিয়ে পড়ে যাবার সম্ভাবনা নেই। আর থাকলেই-বা কী, এদেশে তো আর ঘাস-পাতা গজায় না যে তাই দিয়ে চাল বানাবে?
এরই ভিতরে মানুষ থাকে, মা ছেলেকে ভালোবাসে, ভাই ভাইকে স্নেহ করে, জন্ম-মৃত্যু-বিবাহ সবই হয়!
কিন্তু আমি এত আশ্চর্য হচ্ছি কেন? আমি কি কখনও গলির ঘিঞ্জি বস্তির ভিতর ঢুকিনি কলকাতায়। সেখানে দেখিনি কী দৈন্য, কী দুর্দশা! তবে আজ এখানে আশ্চর্য হচ্ছি কেন? বোধহয় বিদেশে এ জিনিস প্রত্যাশা করিনি বলে কিংবা দেশের দৈন্য দেখে দেখে অভ্যস্ত হয়ে গিয়েছি বলে বিদেশে তার অন্য রূপ দেখে চমকে উঠলুম।
এইখানেই মহামানব এবং হীনপ্রাণে পার্থক্য! মহাপুরুষরা দৈন্য দেখে কখনও অভ্যস্ত হন না। কখনও বলেন না, এ তো সর্বত্রই হচ্ছে, অহরহ হচ্ছে ছেলেবেলা থেকেই দেখে আসছি। দৈন্য তাদের সবসময়ই গভীর পীড়া দেয় যদিও আমরা অনেক সময় তাদের চেহারা দেখে সেটা বুঝতে পারিনে। তার পর একদিন তারা সুযোগ পান, যে সুযোগের প্রতীক্ষায় তারা বছরের পর বছর প্রহর গুনছিলেন, কিংবা যে সুযোগ তারা ক্ষণে ক্ষণে দিনে দিনে আপন হাতে গড়ে তুলছিলেন, এবং এরই বর্ণনা দিতে গিয়ে রবীন্দ্রনাথ বলেছেন,
অখ্যাত অজ্ঞাত রহি দীর্ঘকাল হে রাজবৈরাগী, গিরিদরী-তলে
বর্ষার নিঝর যথা শৈল বিদারিয়া উঠে জাগি পরিপূর্ণ বলে
সেই মত বাহিরিলে; বিশ্বলোক ভাবিল বিস্ময়ে যাহার পতাকা
অম্বর আচ্ছন্ন করে এত কাল এত ক্ষুদ্র হয়ে কোথা ছিল ঢাকা।
তাই যখন হঠাৎ একদিন এক অরবিন্দ ঘোষ, এক চিত্তরঞ্জন দাশ এসে আমাদের মাঝখানে দেখা দেন তখন আমাদের আর বিস্ময়ের অবধি থাকে না। আজন্ম, আশৈশব, অনটনমুক্ত বিলাসে জীবনযাপন করে হঠাৎ একদিন তারা সবকিছু বিসর্জন করে গিয়ে দাঁড়ান গরিব দুঃখী, আতুর অভাজনের মাঝখানে। যে দৈন্য দেখে ভিতরে ভিতরে গভীর বেদনা পেতেন, সেই দৈন্য ঘুচাতে গিয়ে তারা তখন পান গভীরতর বেদনা। কিন্তু সত্যের জয় শেষ পর্যন্ত হবেই হবে।
–তাই উঠে বাজি
জয়শঙ্খ তার? তোমার দক্ষিণ করে।
তাই কি দিলেন আজি কঠোর আদরে
দুঃখের দারুণ দীপ আলোক যাহার
জ্বলিয়াছে বিদ্ধ করি দেশের আঁধার
ধ্রুব তারকার মতো। জয় তব জয়।
কিন্তু এতসব কথা তোমাদের শোনাচ্ছি কেন? তার কারণ গত রাত্রে জাহাজে বসে আফ্রিকা মহাদেশ এবং বিশেষ করে যে সোমালি দেশের ভিতর জিবুটি বন্দর অবস্থিত তারই কথা ভাবছিলুম বলে। এবং সেই সোমালিদের দুঃখ-দৈন্য ঘোচাবার জন্য যে একটি লোক বিদেশি শক্রদের সঙ্গে প্রাণ দিয়ে লড়েছিল তার কথা বার বার মনে পড়ছিল বলে।
ইয়োরোপীয় বর্বরতার চূড়ান্ত বিকাশ দেখতে হলে পড়তে হয় আফ্রিকার ইতিহাস ইংরেজশাসিত ভারতের ইতিহাস তার তুলনায় নগণ্য।
পর্তুগিজ, ইংরেজ, জর্মন, ফরাসি, বেলজিয়াম– কত বলব। ইয়োরোপীয় বহু জাত, কমজাত, বজ্জাত এই আফ্রিকায় একদিন এসে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল সাম্রাজ্য বিস্তারের বর্বর পাশবিক ক্ষুধা নিয়ে, শকুনের পাল যেরকম মরা গরুর উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। ভুল বললুম, শকুনিদের ওপর অবিচার করা হল, কারণ তারা তো জ্যান্ত পশুর উপর কখনও ঝাঁপ দেয় না। এই ইয়োরোপীয়রা এসে ঘেঁকে ধরল সোমালি, নিগ্রো, বান্টু, হটেনটটদের। তাদের হাতে-পায়ে বেঁধে মুরগিলাদাই কঁকার মতো জাহাজভর্তি করে নিয়ে গেল আমেরিকায়। কত লক্ষ নিগ্রো দাস যে তখন অসহ্য যন্ত্রণায় মারা গেল তার নিদারুণ করুণ বর্ণনা পাবে আঙ্কল টম ক্যাবিন পুস্তকে বইখানা পড়ে দেখ। ইংরেজি ভালো বুঝতে না পারলে বাংলা অনুবাদ টম্ কাকার কুটির পড়লেই হবে– আমি ছেলেবেলায় বাংলাতেই পড়েছিলুম।
আর আফ্রিকার ভিতরে যা করল তার ইতিহাস আজও লেখা হয়নি। বিখ্যাত ফরাসি লেখক আঁদ্রে জিদ কঙ্গো সম্বন্ধে একখানা বই লিখে এমনই বিপদগ্রস্ত হয়েছিলেন যে, তার মতো দুঃসাহসী না হলে ওই সম্বন্ধে কেউ আর উচ্চবাচ্য করতে সাহস পায় না। আর লিখলেই-বা কী, প্রকাশক পাবে না। প্রকাশক পেলেই-বা কী? কাগজে কাগজে বেরুবে তার বিরুদ্ধে রূঢ় মন্তব্য, অশ্লীল সমালোচনা। তখন আর কোনও পুস্তকবিক্রেতা তোমার বই তার দোকানে রাখবে না। তবু জেনে রাখা ভালো, এমন মহাজনও আছেন যারা এসব বাধা-বিপত্তি সত্ত্বেও বই লেখেন, ছাপান, প্রকাশ করেন এবং লোকে সেসব পড়ে বলে দেশে অন্যায়-অবিচারের বিরুদ্ধে আন্দোলন সৃষ্টি হয়।
সোমালি দেশের ওপর রাজত্ব করতে এসেছিল বিস্তর জাত : তাদের মধ্যে শেষ পর্যন্ত টিকে রইল ফরাসি, ইংরেজ ও ইতালীয়।
ব্রিটিশ-সোমালি দেশে প্রথম বিদ্রোহ ঘোষণা করেন মুহম্মদ বিন আবদুল্লাহ ১৮৯৯ খ্রিস্টাব্দে। নিরস্ত্র কিংবা ভাঙাচোরা বন্দুক আর তীর-ধনুক সজ্জিত সোমালিরা তার চতুর্দিকে এসে জড় হল অসীম সাহস নিয়ে–ইয়োরোপীয় কামান মেশিনগানের বিপক্ষে। এদিকে ইতালীয় এবং ব্রিটিশে সোমালি দেশের ভাগ-বাটোয়ারা নিয়ে মারামারি, ওদিকে কিন্তু দুই দলই এক হয়ে গেলেন মোল্লা মুহম্মদের স্বাধীনতা প্রচেষ্টাকে সমূলে উৎপাটিত করার জন্য।
দুই পক্ষেরই বিস্তর হার-জিত হল, কিন্তু শেষ পর্যন্ত মোল্লাই ইয়োরোপীয়দের খেদিয়ে খেদিয়ে লাল দরিয়ার পার পর্যন্ত পৌঁছিয়ে দিলেন। ইংরেজ তখন সোমালিদের ওপর রাজত্ব করার আশা ছেড়ে দিয়ে সমুদ্রপারে দুর্গ বানিয়ে তারই ভিতর বসে রইল লাল দরিয়ার বন্দরগুলো বাঁচিয়ে রাখবার জন্য।
সারা সোমালি দেশে জয়ধ্বনি জেগে উঠল– সোমালি স্বাধীন! তখন ইংরেজ তাকে নাম দিল, ম্যাড মোল্লা অর্থাৎ পাগলা মোল্লা, আমাদের গাঁধীকে যেরকম একদিন নাম দিয়েছেন, নেকেড ফকির অর্থাৎ উলঙ্গ ফকির। হেরে যাওয়ার পর মুখ ভ্যাংচানো ছাড়া করবার কী থাকে, বল?
কিন্তু হায়, খুব বেশি বৎসর গেল না। ১৯১৪-১৮-এর প্রথম বিশ্বযুদ্ধে ইয়োরোপীয়রা অ্যারোপ্লেন থেকে বোমা মেরে মানুষকে কাবু করার কৌশল শিখে গিয়েছে। তাই দিয়ে যখন আবার তারা হানা দিলে তখন মোল্লাকে সে সময়কার মতো পরাজয় স্বীকার করে আশ্রয় গ্রহণ করতে হল ভিন্ দেশে।
মোল্লা সেই অনাদৃত অবহেলায় আবার সাধনা করতে লাগলেন স্বাধীনতা জয়ের নতুন সন্ধানে। কিন্তু হায়, দীর্ঘ বাইশ বৎসরের কঠিন যুদ্ধ, নিদারুণ কৃসাধনে তাঁর স্বাস্থ্য তখন ভেঙে গিয়েছে। শেষ পরাজয়ের এক বৎসর পর, যে ভগবানের নাম স্মরণ করে বাইশ বৎসর পূর্বে তিনি স্বাধীনতা সংগ্রামে নেমেছিলেন তাঁরই নাম স্মরণ করে সেই-লোকে চলে গেলেন যেখানে খুব সম্ভব সাদা-কালোর দ্বন্দ্ব নেই।
এই যে জিবুটি বন্দরে বসে বসে চোখের সামনে তাগড়া লম্বা জোয়ান সোমালিদের দেখছি, তারাও নাকি তখন চিৎকার করে কেঁদে উঠেছে।
বীরের কাহিনী থেকে আমরা উৎসাহ সঞ্চয় করব, তা না হলে আমি এ দুঃখের কাহিনী তুললুম কেন? তার কারণ বুঝিয়ে বলার পূর্বে একটি কথা আমি বেশ জোর দিয়ে বলতে চাই।
ফরাসিরা বড় খারাপ, ইংরেজ চোরের জাত এরকম কথার কোনও অর্থ হয় না। ভারতবর্ষে বিস্তর পকেটমার আছে, তাই বলে কেউ যদি গাল দেয় ভারতবাসীরা পকেটমার তা হলে অধর্মের কথা হয়। ইংরেজ জাত অত্যাচারী একথা বলার কোনও অর্থ হয় না।
তাই যখন অধর্ম অরাজকতা দেখি তখন সংযম বর্জন করে তদণ্ডেই অস্ত্রধারণ করা অনুচিত। বহু জাত বহু বার করে দেখেছে, কোনও ফল হয়নি; হিংসা আর রক্তপাত শুধু বেড়েই গিয়েছে।
তাই মহাত্মাজি অহিংসার বাণী প্রচার করেছেন। অহিংসা দিয়ে হিংসা জয় করতে হবে। এর চেয়ে মহৎ শিক্ষা আর কিছু নেই। ভারতবর্ষ যদি তাই দিয়ে আন্তর্জাতিক যুদ্ধ-সংগ্রাম, লুণ্ঠন-শোষণ রুদ্ধ করতে পারে তবে পৃথিবীর ইতিহাসে সে সর্বসভ্য জাতি বলে গণ্য হবে।
এবং শেষ কথা– সবচেয়ে বড় কথা
আমাদের যেন রাজ্যলোভ না হয়। এদের অন্যায় আচরণ দেখে আমরা যেন সতর্ক হই। আমরা দুশো বৎসর পরাধীন ছিলুম। পরাধীনতার বেদনা আমরা জানি। আমরা যেন কাউকে পরাধীন না করি।
.
০৭.
পল জিগ্যেস করলে, একদৃষ্টে কী দেখছেন স্যর? আমি তো তেমন কিছু নয়নাভিরাম দেখতে পারছিনে।
বললুম, আমি কিঞ্চিৎ শার্লক হোমসগিরি করছি। ওই যে লোকটা যাচ্ছে দেখতে পারছ? সে ওই পাশের দোকান থেকে বেরিয়ে এল তো? দোকানের সাইনবোর্ডে লেখা ফ্রিজোর; তাই লোকটার ঘাড়ের দিকটা দেখে অনুমান করছিলুম জিবুটি বন্দরের নাপিতদের কোন পর্যায়ে ফেলি?
পার্সি বললে, হ্যাঁ, হ্যাঁ, আপনার ঠিক মনে আছে। আমি তো চুল কাটাবার কথা বেবাক ভুলে গিয়েছিলুম। চলুন ঢুকে পড়ি।
আমি বললুম তা পার। তবে কি না, মনে হচ্ছে, এ দেশে কোদাল দিয়ে চুল কাটে।
পার্সি বললে, কোদাল দিয়েই কাটুক, আর কাস্তে দিয়েই কামাক, আমার তো গত্যন্তর নেই।
নাপিত ভায়া ফরাসি ভিন্ন অন্য কোনও ভাষা জানেন না। আমি তাকে মোটামুটি বুঝিয়ে দিলুম, পার্সির প্রয়োজনটা কী।
কিন্তু দোকানটা এতই ছোট যে, পল আর আমি সেখানে বসবার জায়গা পেলুম না। বারান্দাও নেই। পার্সিকে বললুম, তার চুল কাটা শেষ হলেই সে যেন বন্দরের চৌমাথার কাফেতে এসে আমাদের সঙ্গে যোগ দেয়।
চৌমাথায় একটি মাত্র কাফে। সবকটা দরজা খোলা বলে স্পষ্ট দেখতে পেলুম, খদ্দের গিস গিস করছে। কিন্তু এইটুকু হাতের তেলো পরিমাণ বন্দর, এখানে মেলার গরুর হাট বসল কী করে?
ভিতরে গিয়ে দেখি, এ কী; এ যে আমাদের জাহাজেরই ডাইনিং রুম! খদ্দেরের সব-কজনই আমাদের অতিশয় সুপরিচিত সহযাত্রীর দল। এ বন্দর দেখা দশ মিনিটেই শেষ হয়ে যায় বলে, সবাই এসে জড়ো হয়েছেন ওই একটিমাত্র কাফেতেই। তাই কাফে গুলজার। এবং সবাই বসেছেন আপন আপন টেবিল নিয়ে। অর্থাৎ জাহাজের ডাইনিং রুমে যে চারজন কিংবা ছ জন বসেন এক টেবিল নিয়ে, ঠিক সেইরকম এখানেও বসেছেন আপন আপন গুষ্ঠী নিয়ে।
এক কোণে বসেছে গুটিকয়েক লোক, উদাস নয়নে, শূন্যের দিকে তাকিয়ে। জাহাজে এদের কখনও দেখিনি। আন্দাজ করলুম, এরাই তবে জিবুটির বাসিন্দা। জরাজীর্ণ বেশভূষা।
কিন্তু এসব পরের কথা। কাফেতে ঢুকেই প্রথম চোখে পড়ে এ দেশের মাছি। চোখে পড়ে বাক্যটি শব্দার্ধেই বললুম, কারণ কাফেতে ঢোকার পূর্বেই একঝাক মাছি আমার চোখে থাবড়া মেরে গেল।
কাফের টেবিলের উপর মাছি বসেছে আল্পনা কেটে, বারের কাউন্টারে বসেছে ঝাঁকে ঝাকে, খদ্দেরের পিঠে, হ্যাটে– হেন স্থান নেই যেখানে মাছি বসতে ভয় পেয়েছে।
দু গেলাস নিধু-পানি টেবিলে আসামাত্রই তার উপরে, চুমুক দেবার জায়গায়, বসল গোটা আষ্টেক মাছি। পল হাত দিয়ে তাড়া দিতেই গোটা কয়েক পড়ে গেল শরবতের ভিতর। পল বললে, ওই য যা।
আমি বললুম, আরেকটা অর্ডার দিই?
সবিনয়ে বললে, না স্যর, আমার এমনিতেই ঘিন ঘিন করছে। আর পয়সা খরচা করে দরকার নেই।
তখন তাকিয়ে দেখি, অধিকাংশ খদ্দেরের গেলাসই পুরো ভর্তি।
ততক্ষণে ওয়েটার দুটি চামর দিয়ে গেছে। আমরাও চামর দুটি হাতে নিয়ে অন্য সব খদ্দেরদের সঙ্গে কোরাসে মাছি তাড়াতে শুরু করলুম।
সে এক অপরূপ দৃশ্য! জন পঞ্চাশেক খদ্দের যেন এক অদৃশ্য রাজাধিরাজের চতুর্দিকে জীবনমরণ পণ করে চামর দোলাচ্ছে। ডাইনে চামর, বাঁয়ে চামর, মাথার উপরে চামর, টেবিলের তলায় চামর। আর তারই তাড়ায় মাছিগুলো যূথভ্রষ্ট কিংবা ছন্নছাড়া হয়ে কখনও ঢোকে পলের নাকে, কখনও ঢোকে আমার মুখে। কথাবার্তা পর্যন্ত প্রায় বন্ধ। শুধু চামরের সাইসাই আর মাছির ভনৃভন! রুশ-জর্মনে লড়াই। মাত্র সেই চারটি খাস জিবুটি বাসিন্দে নিশ্চল নীরব। অনুমান করলুম, মাছি তাদের গা-সওয়া হয়ে গিয়েছে, এবং মাছিদের সঙ্গে লড়নেওলা জাহাজযাত্রীর দলও তাদের গা-সওয়া। এরকম লড়াইও তারা নিত্যি নিত্যি দেখে।
তখন লক্ষ করলুম তাদের শরবত পানের প্রক্রিয়াটা। তারা চামর তো দোলায়ই না, হাত দিয়েও গেলাসের মুখ থেকে মাছি খেদায় না। গেলাস মুখে দেবার পূর্বে সেটাতে একটু মোলায়েম ঠোনা দেয়, সঙ্গে সঙ্গে মাছিগুলো ইঞ্চি তিনেক উপরে ওঠামাত্রই গেলাসটি টুক করে টেনে এনে চুমুক লাগায়। ঘিনপিত এদের নেই।
পলও লক্ষ করে আমাকে কানে কানে শুধালে, এ লক্ষ্মীছাড়া জায়গায় এসব লোক থাকে কেন?
আমি বললুম, সে বড় দীর্ঘ কাহিনী। অর্থাৎ এদের প্রত্যেককে যদি জিগ্যেস কর তবে শুনবে, প্রত্যেকের জীবনের দীর্ঘ এবং বৈচিত্র্যময় কাহিনী।
এ সংসারের সর্বত্রই একরকম লোক আছে যারা রাতারাতি লক্ষপতি হতে চায়। খেত-খামার, ব্যবসা-বাণিজ্য, চাকরি-মোকরি, কোনও কাজেই ওদের মন যায় না। অত খাটে কে, অত লড়ে কে?– এই তাদের ভাবখানা।
সিনেমায় নিশ্চয় দেখেছ, হঠাৎ খবর রটল আফ্রিকার কোথায় যেন সোনা পাওয়া গিয়েছে; সেখানে মাটির উপর-নিচে সর্বত্র তাল তাল সোনা পড়ে আছে আর অমনি চলল দলে দলে দুনিয়ার লোক সেই সোনা যোগাড় করে রাতারাতি বড়লোক হওয়ার জন্য। সিনেমা কত রঙ-চঙেই না সে দৃশ্য দেখায়! অনাহারে তৃষ্ণায় পড়ে আছে, এখানে মড়া সেখানে মড়া। কোনও কোনও জায়গায় বাপ-মা, বেটা-বেটি চলেছে এক ভাঙা গাড়িতে করে ছেলেটার মুখ দিয়ে রক্ত উঠছে, মেয়েটা ভিরমি গেছে। বাপ টিনের ক্যানাস্তারা হাতে করে ধুঁকতে ধুঁকতে জল খুঁজতে গিয়ে এ পাথরে টক্কর খেয়ে পড়ে যাচ্ছে, ও পাথরে ঠোক্কর খেয়ে জখম হচ্ছে। মায়ের চোখে জলের কণা পর্যন্ত নেই– যেন অসাড় অবশ হয়ে গিয়েছে।
এগিয়ে চলেছে, এগিয়ে চলেছে, এরা এগিয়ে চলেছে। এ ছাড়া উপায় নেই। থামলে অবশ্যম্ভাবী মৃত্যু, এগুলে বাঁচলে বাঁচতেও পার।
কজন পৌঁছয়, কজন সোনা পায়, তার ভিতর কজন জনসমাজে ফিরে এসে সে ধন ভোগ করতে পারে, তার কোনও সরকারি কিংবা বেসরকারি সেনসাস কখনও হয়নি। আর হলেই-বা কী? যাদের এ ধরনের নেশা জন্মগত তাদের ঠেকাবে কোন্ আদমশুমারি?
কিংবা হয়তো এদেরই একজন লেগে গেল কোম্পানি বানিয়ে, শেয়ার বিক্রি করে টাকা তুলতে। কেন? কোনও এক বোম্বেটে কাপ্তান কোনও এক অজানা দ্বীপে কোটি কোটি টাকার ধন নিয়ে উধাও হয়ে যায়। যে দ্বীপ খুঁজে বের করতে হবে। সেই ধন উদ্ধার করে রাতারাতি বড়লোক হতে হবে। সেই সমুদ্রে ওই দ্বীপটায় থাকার কথা সেখানে যাত্রী-জাহাজ বা মাল-জাহাজ কিছুই যায় না। সে দ্বীপে নাকি খাবার জল পর্যন্ত নেই। ওই বোম্বেটে কাপ্তান নাকি জলতৃষ্ণায় মারা গিয়েছিল, আরও কতরকম উড়ো খবর।
যে কোম্পানি খুললে, সে বলে বেড়াচ্ছে তার কাছে ম্যাপ রয়েছে ওই দ্বীপে যাবার জন্য। সাধারণ লোক বলে, কই ম্যাপটা দেখি। লোকটা বলে, আব্দার। তার পর তুমি টাকাটা মেরে দাও আর কি? কিন্তু রাতারাতি বড়লোক হওয়ার দল অতশত শুধায় না। তারা কোম্পানির শেয়ারও কেনে না– পয়সা থাকলেও কেনে না। তারা গিয়ে কান্নাকাটি লাগায় লোকটার কাছে খালাসি করে, বাবুর্চি করে আমাদের নিয়ে চল তোমার সঙ্গে। আমরা মাইনে কিছু চাইনে। কাপ্তেনও ওইরকম লোকই খুঁজছে– শক্ত তাগড়া জোয়ান, মরতে যারা ডরায় না।
তার পর একদিন সে জাহাজ রওনা হল। কিন্তু আর ফিরে এল না।
কিংবা ফিরে এল মাত্র কয়েকজন লোক। কিছুই পাওয়া যায়নি বলে এরা তাকে খুন। করেছে। তখন লাগে পুলিশ তাদের পিছনে। মোকদ্দমা হয়, আরও কত কী?
পল কাফের সেই চারটি জিবুটিবাসীর দিকে তাকিয়ে ফিস ফিস করে আমাকে শুধাল, এরা সব ওই ধরনের লোক?
আমি বললুম, না, তবে ওদের বংশধর। বংশধর অর্থে ওদের ছেলে-নাতি নয়, কারণ ও ধরনের লোক বিয়ে-থা বড় একটা করে না। বংশধর, বলছি, এরা ওই দলেরই লোক, যারা রাতারাতি বড়লোক হতে চায়। কিন্তু আজকের দিনে তো আর সোনা পাওয়ার গুজব ভালো করে রটতে পারে না তার আগেই খবরের কাগজগুলো প্লেনভাড়া করে সবকিছু তদারক করে জানিয়ে দেয়, সমস্তটা ধাপ্পা কিংবা জাহাজভাড়া করার কথাও ওঠে না। প্লেনে করে ঝটপট সবকিছু সারা যায়। হেলিকপ্টার হওয়াতে আরও সুবিধে হয়েছে। একেবারে মাটির গা ছুঁয়ে ভালো করে সবকিছুই তদারক করা যায়।
তাই এরা সব করে আফিং চালান, কিংবা মনে কর, কোনও দেশে বিদ্রোহ হয়েছে বিদ্রোহীদের কাছে বেআইনিভাবে বন্দুক-মেশিনগান ইত্যাদি বিক্রি।
যখন কিছুতেই কিছু হয় না, কিংবা সামান্য যে টাকা করেছিল তা খুঁকে দিয়েছে, ওদিকে বয়সও হয়ে গিয়েছে, গায়ে আর জোর নেই, তখন তারা জিবুটির মতো লক্ষ্মীছাড়া বন্দরে এসে দু পয়সা কামাবার চেষ্টা করে, আর নতুন নতুন অসম্ভব অ্যাডভেঞ্চারের স্বপ্ন দেখে। জিবুটির মতো অসহ্য গরম আর মারাত্মক রোগ-ব্যাধির ভিতরে কোন সুস্থ-মস্তিষ্ক লোক কাজের সন্ধানে আসবে? কিন্তু এদের আছে কষ্ট সহ্য করার অসাধারণ ক্ষমতা। তাই এদের জন্য এখানে কিছু একটা জুটে যায়। এই যেমন মনে কর, এখান থেকে যে রেললাইন শুরু হয়ে আবিসিনিয়ার রাজধানী আদ্দিস-আবাবা অবধি গিয়েছে প্রায় পাঁচশো মাইলের ধাক্কা– সে লাইনে তো নানারকমের কাজ আছেই, তার ওপর ওরই মারফতে ব্যবসা-বাণিজ্য যা হবার তা-ও হয়। ওইসব করে, আর একে অন্যকে আপন আপন যৌবনের দুঁদেমির গল্প বলে।
পাছে পল ভুল বোঝে তাই তাড়াতাড়ি বললুম, কিন্তু এই চারটি লোক বসে আছে, ঠিক এরাই যে এ ধরনের অ্যাডভেঞ্চারার সেকথা আমার উদ্দেশ্য নয়। তবে হওয়ার সম্ভাবনা আছে– ওইটুকু যা কথা।
ইতোমধ্যে মুখে একটা মাছি ঢুকে যাওয়াতে বিষম খেয়ে কাশতে আরম্ভ করলুম। শান্ত হলে পর পল শুধাল, এদের কথা শুনে এদের প্রতি করুণা হওয়া উচিত, না অন্য কোনও প্রতিক্রিয়া হওয়া উচিত, ঠিক বুঝে উঠতে পারছিনে।
আমি অনেকক্ষণ ভেবে নিয়ে বললুম, আমার কী মনে হয় জানো? কেউ যখন করুণার সন্ধান করে তখনই প্রশ্ন জাগে, এ লোকটা করুণার পাত্র কি না? কিন্তু এরা তো কারও তোয়াক্কা করে না। জীবনের শেষদিন পর্যন্ত এরা আশা রাখে, স্বপ্ন দেখে, রাস্তার মোড় ঘুরতেই নদীর বাঁক নিতেই সামনে পাবে পরীস্থান, যেখানে গাছের পাতা রুপোর, ফল সোনার, যেখানে শিশিরের ফোঁটাতে হাত দিলেই তারা হীরের দানা হয়ে যায়, যেখানে
আরেকটুখানি কবিত্ব করার বাসনা হয়েছিল কিন্তু ইতোমধ্যে পার্সি মাছি তাড়াতে তাড়াতে এসে উপস্থিত। চেয়ারে বসে টেবিলের উপর রাখল ও-দ্য কলনের এক ঢাউস বোতল। মুখে হাসি, দুনিয়ার সবচাইতে ডাকসাইটে ও-দ্য-কলন– খাস কলন শহরের তৈরি কলনের জল– Eau de Cologne! 4711 মার্কা!
পার্সি বললে, দাঁও মেরেছি স্যর! বলুন তো এর দাম বোম্বাই কিংবা লন্ডনে কত?
আমি বললুম, শিলিং বারো-চোদ্দ হবে।
লঙ্কা জয় এবং সীতাকে উদ্ধার করেও বোধহয় রামচন্দ্রজি এতখানি পরিতৃপ্তির হাসি হাসেননি। তবু হনুমান কী করেছিলেন তার খানিকটে আভাস পেলুম, পার্সির বুক চাপড়ানো দেখে।
তিন শিলিং স্যর, তিন শিলিং! সবে মাত্র, কুললে, জ, তিন শিলিং! নট, এ পেনি মোর, নট ইভন, এ রেড ফার্দিং মোর।
এমন সময় দেখি, কাফের আরেক কোণ থেকে সেই আবুল-আসফিয়া-কী কী যেন-সিদ্দিকি সাহেব তাঁর সেই লম্বা কোট আর ঝোলা পাতলুন পরে আমাদের দিকে আসছেন। ইনি আমাদের সেই বন্ধু যিনি সবাইকে লাইমজুস, চকলেট খাওয়ান–কিন্তু যার। কসি কথা কওয়াতে।
আমরা উঠে তাকে অভ্যর্থনা জানালুম।
তিনি বসেই বোতলটা হাতে তুলে নিয়ে ডাক্তাররা যেরকম একসরের প্লেট দেখে সেইরকম ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখতে লাগলেন।
পার্সি পুনরায় মৃদু হাস্য করে বললেন, একদম খাঁটি জিনিস।
আবুল আসফিয়া মুখ বন্ধ রেখেই নাক দিয়ে বললেন, হুঁ।
তার পর অনেকক্ষণ পরে অতি অনিচ্ছায় মুখ খুলে শুধালেন, এটা কার জন্য কিনলে?
পার্সি বললে, পিসিমার জন্য।
আবুল আসফিয়া বললেন, বোতলটার ছিপি না খুললে বিলেতে নামবার সময় তোমাকে প্রচুর কাস্টমসের ট্যাক্স দিতে হবে। এমনকি এ জাহাজে ওঠার সময়ও তবে সে আমি ঠিক জানিনে।
পার্সি আমার দিকে তাকাল।
আমি বললুম, ছিপি খোলা থাকলে ওটা তোমার আপন ব্যবহারের জিনিস হয়ে গেল, তাই ট্যাক্স দিতে হয় না।
অনেকক্ষণ পর আবুল আসফিয়া বললেন, যখন খুলতেই হবে তখন এই বেলা খুলে ফেলাই ভালো।
আমরা সবাই পার্সিও–বললুম, সেই ভালো।
ওয়েটার একটা কর্ক স্ক্রু নিয়ে এল। আবুল আসফিয়া পরিপাটি হাতে বোতল খুলে প্রথম কর্কটার ভিতরের দিকে ঝুঁকলেন, তার পর বোতলের জিনিস।
একটু ভেবে নিয়ে আমাদের শোকালেন।
কোনও গন্ধ নেই!
যেন জল-প্লেন, নির্জলা জল!
পার্সি তো একেবারে হতভম্ব। অনেকক্ষণ পর সামলে নিয়ে ধীরে ধীরে বললে, কিন্তু ছিপি, সিল সবই তো ঠিক?
আবুল আসফিয়া বললেন, এসব হোট বন্দরে পুলিশের কড়াকড়ি নেই বলে নানা রকমের লোক অনেক অজানা প্রক্রিয়ায় আসল জিনিস সরিয়ে নিয়ে মেকি কিংবা প্লেন জল চালায়।
আমি পলকে কানে কানে বললুম, হয়তো আমাদেরই একজন অ্যাডভেঞ্চারার।
পাশের টেবিলের দিকে তাকিয়ে দেখি, খাস জিবুটি-বাসিন্দারা দরদভরা আঁখিতে আমাদের দিকে তাকিয়ে আছে। অনুমান করতে বেগ পেতে হল না, এরা ব্যাপারটা বুঝতে পেরেছে।
পার্সিও খানিকটে বুঝতে পেরেছে। বললে, যাত্রীরা বোকা কি না, তাই এ শয়তানিটা তাদের ওপরই করা যায়। আর প্রতি জাহাজেই আসে এক জাহাজ
পল বাধা দিয়ে বললে, পার্সি!
পার্সি চটে উঠে বললে, ওহ্, আর উনিই যেন এক মহা! কন্-ফু-ৎস!
জাহাজে ফেরার সময়, আবুল আসফিয়াকে একবার একা পেয়ে শুধালুম, ছোঁড়াটাকে বড় নিরাশ করলেন।
বললেন, উপায় কী? না হলে প্রতি বন্দরে মার খেত যে!
.
০৮.
গুণীরা বলেন, অগ্র-পশ্চাৎ বিবেচনা করে কথা বলবে।
জিবুটি ত্যাগ করার সময় পার্সি বন্দরের দিকে তাকিয়ে বললে, লক্ষ্মীছাড়া জায়গাটা। ও-দ্য কলনের খেদটা তখনও তার মন থেকে যায়নি। তাই অগ্র-পশ্চাৎ বিবেচনা না করেই কথাটা বলল।
ঘন্টাখানেকের ভিতর উঠল ঝড়। তেমন কিছু মারাত্মক নয় কিন্তু সি সিকনেস দিয়ে মানুষের প্রাণ অতিষ্ঠ করে তোলার পক্ষে যথেষ্ট। পার্সিই প্রথম বিছানা নিল। বমি করতে করতে তার মুখ তখন শর্ষে ফুলের রঙ ধরেছে। ভাঙা গালদুটো দেখে মনে হয় সত্তর বছরের বুড়ো।
আমি নিজে যে খুব সুস্থ অনুভব করেছিলুম তা নয়। তবু পার্সিকে বললুম, তবে যে, বস, জিবুটি বন্দরকে কটুকাটব্য করছিলে? এখন ওই লক্ষ্মীছাড়া বন্দরেই পা দিতে পারলে যে দু মিনিটেই চাঙা হয়ে উঠতে। মাটিকে তাচ্ছিল্য করতে নেই– অন্তত যতক্ষণ মাটির থেকে দূরে আছ– তা সে জলের তলাতে সাবমেরিনেই হোক, উপরে জাহাজেই হোক, কিংবা তারও উপরে বাতাসে ভর করে অ্যারোপ্লেনেই হোক। তা সে যাক গে। এখন বুঝতে পারলে গুণীরা কেন বলেছেন, অগ্র-পশ্চাৎ ইত্যাদি?
পার্সি কিন্তু তৈরি ছেলে। সেই ছটফটানির ভিতর থেকে কাতরাতে কাতরাতে বলল, কিন্তু এখন যদি কোনও ডুবন্ত দ্বীপের মাটিতে ধাক্কা লেগে জাহাজখানা চৌচির হয়ে যায় তখনও মাটির গুণগান করবেন নাকি?
আমি বললুম, ওই য যা! এতখানি ভেবে তো আর কথাটা বলিনি।
পল তার খাটে বসে আমাদের কথাবার্তা শুনছিল। আস্তে আস্তে বললে, জাহাজ যদি মাটিতে লেগে চৌচির হয়ে যায় তবে তো সেটা মাটির দোষ নয়। জাহাজ জোরের সঙ্গে ধাক্কা দেয় বলেই তো খান খান হয়ে যায়। আস্তে আস্তে চললে মাটির বাধা পেয়ে জাহাজ বড়জোর দাঁড়িয়ে যাবে। ভাঙবে কেন? মাকে পর্যন্ত জোরে ধাক্কা দিলে চড় খেতে হয়, আর মাটি দেবে না?
আমি উল্লসিত হয়ে বললুম, সাধু সাধু! তুলনাটি চমৎকার! তবে কি না আমার দুঃখ, বাঙলা ভাষায় এ নিয়ে যে শব্দদুটো আছে তার pun তোমরা বুঝবে না। মা হচ্ছেন মাদার আর মাটি হচ্ছেন দি মাদার কিংবা আর্থ।
পল বললে, বিলক্ষণ বুঝেছি, Good Earth!
পার্সি বিরক্ত হয়ে বললে, পলের তুলনাটা নিশ্চয়ই চোরাই মাল।
আমি বললুম, সাধুর টাকাতে দু সের দুধ, চোরের টাকাতেও দু সের দুধ। টাকার দাম একই। তুলনাটা ভালো। তা সে পলের আপন মালই হোক আর চোরাই মালই হোক। তা সেকথা থাক। তুমি কিন্তু সি সিকনেসে কাতর হয়ে ভয় পেয়ো না। এ ব্যামোতে কেউ কখনও মারা যায়নি।
পার্সি চিঁ চিঁ করে বললে, শেষ ভরসাটাও কেড়ে নিলেন, স্যরআমি তো ভরসা করেছিলুম আর বেশিক্ষণ ভুগতে হবে না, মরে গিয়ে নিষ্কৃতি পাব।
পল বললে, আগাছা সহজে মরে না।
আমি বললুম, থাক, থাক। চলো পল, উপরে যাই। আমরা তিনজন মিলে সি সিনেসকে বড্ড বেশি লাই দিচ্ছি।
পল বেরুতে বেরুতে বললে, হক কথা। পার্সির সঙ্গে একা পড়লে যে কোনও ব্যামো বাপ বাপ করে পালাবার পথ পাবে না।
উপরে এসে দেখি, আবুল আসফিয়া কোথা থেকে এক জোরদার দুরবিন যোগাড় করে কী যেন দেখবার চেষ্টা করছেন। এসব জাহাজ কখনও পাড়ের গা ঘেঁষে চলে না। তাই জোরালো দুরবিন দিয়ে বিশেষ কিছু দেখা যায় না। পল আমাকে শুধালে, কী দেখছেন উনি?
আমি বললুম, আবুল আসফিয়া মুসলমান এবং মনে হচ্ছে ধর্মে তাঁর অনুরাগও আছে। লাল দরিয়ার এক পারে সোমালি ভূমি, হাবসি মুলুক এবং মিশর, অন্য পারে আরব দেশ। মহাপুরুষ মুহম্মদ আরবদেশে জন্মেছিলেন, ওই দেশে ইসলাম প্রচার করেন। মক্কা মদীনা, সবই তো ওইখানে।
পল বললে, ইংরেজিতে যখনই কোনও জিনিসের কেন্দ্রভূমির উল্লেখ করতে হয় তখন বলা হয়, যেমন ধরুন সঙ্গীতের বেলায়, ভিয়েনা ইজ দি মেক্কা অব মিউজিক– এ তো আপনি নিশ্চয়ই জানেন। কিন্তু বিশেষ করে মক্কা বলা হয় কেন? মক্কা তো আর তেমন কিছু বড় শহর নয়।
আমি বললুম, পৃথিবীতে গোটা তিনেক বিশ্বধর্ম আছে, অর্থাৎ এ ধর্মগুলো যে দেশে জন্মগ্রহণ করেছে সেখানেই সীমাবদ্ধ হয়ে থাকেনি–দূর-দূরান্তরে ছড়িয়ে পড়েছে। যেমন মনে কর বৌদ্ধধর্ম, খ্রিস্টধর্ম এবং ইসলাম। কিন্তু পৃথিবীর বহু বৌদ্ধ কিংবা খ্রিস্টান কোনও বিশেষ পুণ্যদিবসে এক বিশেষ জায়গায় একত্র হয় না– মুসলমানরা যেরকম হজের দিনে মক্কায় একত্র হয়। কোথায় মরক্কো, কোথায় সাইবেরিয়া আর কোথায় চীন পৃথিবীর যেসব দেশে মুসলমান আছে সেসব দেশের লোককে সেদিন তুমি মক্কায় পাবে। শুনেছি, সেদিন নাকি মক্কার রাস্তায় দুনিয়ার প্রায় সব ভাষাই শুনতে পাওয়া যায়।
তাতে করে লাভ?
আমি বললুম, লাভ মক্কাবাসীদের নিশ্চয়ই হয়। তীর্থযাত্রীরা যে পয়সা খরচ করে তার সবই তো ওরা পায়। কিন্তু আসলে সে উদ্দেশ্য নিয়ে একথা সৃষ্টি হয়নি। মুহম্মদ সাহেবের ইচ্ছা ছিল যে, পৃথিবীর সব দেশের মুসলমানকে যদি একত্র করা যায় তবে তাদের ভিতর ঐক্য এবং ভ্রাতৃভাব বাড়বে। আমরা যখন বাড়িতে উপাসনা না করে গির্জায় কিংবা মসজিদে যাই তখন তারও তো অন্যতম উদ্দেশ্য আপন ধর্মের লোকের সঙ্গে এক হওয়া। মুহম্মদ সাহেব বোধহয় এই জিনিসটাই বড় করে, সমস্ত পৃথিবী নিয়ে করতে চেয়েছিলেন।
পল অনেকক্ষণ ভেবে নিয়ে বলল, আমরা তো বড়দিনের পরবে প্রভু যিশুর জন্মস্থল বেথলেহেমে জড় হইনে। হলে কি ভালো হত না? তা হলে তো খ্রিস্টানদের ভিতরও ঐক্য সখ্য বাড়ত।
আমি আরও বেশি ভেবে বললুম, তা হলে বোধহয় রোমে পোপের প্রাধান্য ক্ষুণ্ণ হত।
কিন্তু থাক এসব কথা। আমার কোনও ক্যাথলিক পাঠক কিংবা পাঠিকা যেন মনে না করেন যে, আমি পোপকে শ্রদ্ধা করিনি। পৃথিবীর শত শত লক্ষ লক্ষ লোক যাকে সম্মানের চোখে দেখে তাকে অশ্রদ্ধা করলে সঙ্গে সঙ্গে সেই শত শত লক্ষ লক্ষ লোককে অশ্রদ্ধা করা হয়। অতটা বেয়াদব আমি নই। বিশেষত আমি ভারতীয়। ছেলেবেলা থেকে শুনে আসছি, সব ধর্মকে শ্রদ্ধা জানাতে হয়।
.
০৯.
ঝড় থেমেছে। সমুদ্র শান্ত। ঝড়ের পর বাতাস বয় না বলে অসহ্য গরম আর গুমোট। এ যন্ত্রণা থেকে নিষ্কৃতি পাই কী প্রকারে।
নিষ্কৃতির জন্য মানুষ ডাঙায় যা করে, জলে অর্থাৎ জাহাজেও তা-ই। একদল লোক বুদ্ধিমান। কাজে কিংবা অকাজে এমনি ডুব মারে যে, গরমের অত্যাচার সম্বন্ধে অনেকখানি অচেতন হয়ে যায়। বোকার দল শুধু ছটফট করে। ক্ষণে এটা করে, ক্ষণে ওটা নাড়ে, ক্ষণে ঘুমাবার চেষ্টা করে, ক্ষণে জেগে থাকতে গিয়ে আরও বেশি কষ্ট পায়।
জাহাজেও তাই। একদল লোক দিবারাত্রি তাস খেলে। সকালবেলাকার আণ্ডা-রুটি খেয়ে সেই যে তারা তাসের সায়রে ডুব দেয়, তার পর রাত বারোটা-একটা-দুটো অবধি তাদের টিকি টেনেও সে সায়র থেকে ভোলা যায় না। লাঞ্চ সাপার খেতে যা দু একবার তাস ছাড়তে হয়, ব্যস্– ওই। তখন হয় বলে কী গরম, নয় ওই তাসের জেরই কানার টেবিলে টানে। চার ইস্কাপন না ডেকে তিন বে-তরুপ বললে ভালো হত, পুনরপি ডবল না বলে সে কী আহাম্মুকিই না করেছে?
জাহাজের বেসরকারি ইতিহাস বলে, একটানা ছত্রিশ ঘণ্টা তাস খেলেছে এমন ঘটনাও নাকি বিরল নয়। এরা গরমে কাতর হয় না, শীতেও বেকাবু হয় না। ভগবান এদের প্রতি সদয়।
দাবাখেলার চর্চা পৃথিবীতে ক্রমেই কমে আসছে। আসলে কিন্তু দাবাড়ুই এ ব্যাপারে দুনিয়ার আর সবাইকে মাত করতে পারে। দাবাখেলায় যে মানুষ কী রকম বাহ্যজ্ঞানশূন্য হতে পারে, সেটা না দেখলে বিশ্বাস করা যায় না। পরশুরাম লিখেছেন এক দাবাড়কে যখন চাকর এসে বললে, চা দেব কী করে?- দুধ ছিঁড়ে গেছে তখন দাবাড়ু খেলার নেশায় বললে, কী জ্বালা, সেলাই করে নে না!
আরেক দল শুধু বই পড়ে। তবে বেশিরভাগই দেখেছি, ডিটেকটিভ উপন্যাস। ভালো বই দিবা-রাত্র পড়ছে এরকম ঘটনা খুব কমই দেখেছি।
আরেক দল মারে আড্ডা। সঙ্গে সঙ্গে গুনগুন করে আড্ডার যেটা প্রধান মেনু পরনিন্দা, পরচর্চা। সেগুলো বলতে আমার আপত্তি নেই, কিন্তু পাছে কোনও পাঠক ফস করে শুধায়, এগুলো আপনি জানলেন কী করে, যদি নিজে পরনিন্দা না করে থাকেন? তাই আর বললুম না।
আরও নানা গুষ্ঠী নানা সম্প্রদায় আছে, কিন্তু আবুল আসফিয়া কোনও গোত্রেই পড়েন না। তিনি আড্ডাবাজদের সঙ্গে বসেন বটে, কিন্তু আড্ডা মারেন না– খেয়ানৌকার মাঝি যেরকম নদী পেরোয়, কিন্তু ওপারে নাবে না। একথা পূর্বেই বলেছি, কিন্তু আজ হঠাৎ তাকে দেখি অন্য রূপে। খুলে কই।
পার্সি সেরে উঠে আবার জাহাজময় লম্ফঝম্ফ লাগিয়েছে। যেখানেই যাই সেখানেই পার্সি। মাঝে মাঝে সন্দেহ জাগে, তবে কি পার্সির জন আষ্টেক যমজ ভাই আছে নাকি? একই লোক সাত জায়গায় একসঙ্গে থাকবে কী করে?
সে-ই খবরটা আনলে।
কী খবর?
জাহাজ সুয়েজ বন্দরে পৌঁছানোর পর ঢুকবে সুয়েজ খালে। খালটি একশো মাইল লম্বা। দু-পাড়ে মরুভূমির বালু বলে জাহাজকে এগুতে হয় ঘন্টায় পাঁচ মাইল বেগে। তা হলে লাগল প্রায় কুড়ি-বাইশ ঘণ্টা। খালের এ মুখে সুয়েজ বন্দর, ও মুখে সঈদ বন্দর। আমরা যদি সুয়েজ বন্দরে নেমে ট্রেন ধরে কাইরো চলে যাই এবং পিরামিড দেখে সেখান থেকে ট্রেন ধরে সঈদ বন্দর পৌঁছই, তবে আমাদের আপন জাহাজই আবার ধরতে পারব। যদিও আমরা মোটামুটি একটা ত্রিভুজের দুই বাহু পরিভ্রমণ করব– আর সুয়েজ খাল মাত্র এক বাহু তবু রেলগাড়ি তাড়াতাড়ি যাবে বলে আমরা কাইরোতে এটা-ওটা দেখবার জন্য ঘণ্টা দশেক সময় পাব।
কিন্তু যদি সুয়েজ বন্দরে নেমে সময়মতো ট্রেন না পাই, কিংবা যদি কাইরো থেকে সময়মতো সঈদ বন্দরের ট্রেন না পাই আর সেখানে জাহাজ না ধরতে পারি, তখন কী হবে উপায়?
পার্সি অসহিষ্ণু হয়ে বললে, সে তো কুক কোম্পানির জিম্মাদারি। তারাই তো এ টুর—না এক্সকাশন, কী বলব? বন্দোবস্ত করেছে। প্রতি জাহাজের জন্যই করে। বিস্তর লোক যায়। চলুন না, নোটিশবোর্ডে দেখিয়ে দিচ্ছি– কুকের বিজ্ঞাপন।
ত্রিমূর্তি সেখানে গিয়ে সাতিশয় মনোযোগ সহকারে প্রস্তাবটি অধ্যয়ন করলুম।
কিন্তু প্রস্তাবটির শেষ ছত্র পড়ে আমাদের আক্কেল গুড়ুম নয়, দড়াম করে ফেটে গেল। এই এক্সকার্শন-বন-ভোজ কিংবা শহর-ভোজ, যাই বলে, যাচ্ছি তো কাইরো শহরে– যারা করতে চান তাদের প্রত্যেককে দিতে হবে সাত পৌন্ড অর্থাৎ প্রায় একশো টাকা। পল বললে, হরি, হরি (অবশ্য ইংরেজিতে গুড হেভেন্স, মাই গুডনেস এইজাতীয় কিছু একটা) এত টাকা যদি আমার থাকবেই তবে কি আমি এই জাহাজে ফার্স্ট ক্লাসে যেতুম না?
আমি বেদনাতুর হওয়ার ভান করে বললুম, কেন ভাই, আমরা কি এতই খারাপ লোক যে আমাদের এড়াবার জন্য তুমি ফার্স্ট ক্লাসে যেতে চাও?
পল তো লজ্জায় লাল হয়ে তোতলাতে আরম্ভ করলে।
আর পার্সি? সে তো হনুমানের মতো চক্রাকারে নৃত্য করে বলতে লাগল, বেশ হয়েছে, খুব হয়েছে। কর মস্করা স্যারের সঙ্গে! বোঝ ঠ্যালা!
আমি বললুম, ব্যস্, ব্যস্! হয়েছে। হয়েছে। কিন্তু পার্সি, একশো টাকা তো চাট্টিখানি কথা নয়। আমাকেই তো টালমাটাল হয়ে টাকাটা টানতে হবে।
পার্সিকে দমানো শক্ত। বললে, অপরাধ নেবেন না, স্যর, কিন্তু আমিই-বা কোন হেনরি ফোর্ড কিংবা মিডাস রোটশিট? কিন্তু আমি মনস্থির করেছি, আমার জেবের শেষ পেনি দিয়ে আমি পিরামিড দেখবই দেখব। চীনা দেওয়াল দেখার পর পিরামিড দেখব না আমি? মুখ। দেখাব তা হলে কী করে? তার চেয়েও খারাপ, আয়নাতে নিজেরই মুখ দেখব কী করে?
অনেক আলোচনা, বিস্তর গবেষণা করা হল। শেষটায় স্থির হল, পিরামিড-দর্শন আমাদের কপালে নেই। গালে হাত দিয়ে যখন ত্রিমূর্তি আপন মনে সেই শোক ভুলবার চেষ্টা করছি এমন সময় আবুল আসফিয়া মুখ খুললেন।
তার সনাতন অভ্যাস অনুযায়ী তিনি আমাদের আলোচনা শুনে যাচ্ছিলেন। ভালো-মন্দ কিছুই বলেননি। আমরা যখন স্থির করলুম, আমরা ট্রিপটা নেব না তখন তিনি বললেন, এর চেয়ে সস্তাতেও হয়।
আমরা একসঙ্গে চেঁচিয়ে শুধালুম, কী করে? কী করে? বললেন, সেকথা পরে হবে।
তার পর আপন চেয়ার ছেড়ে খানা-কামরার দিকে চলে গেলেন।
.