১০.
পল আর পার্সিকে এখন আর বড় একটা দেখতে পাইনে। ওরা আবুল আসফিয়ার কোটের উপর ডাকটিকিটের মতো সেঁটে বসেছে–চিনে-জোকের মতো লেগে গেছে বললে কমিয়ে বলা হয়, কারণ, রক্ত শোষা শেষ হলে তবু ছিনে-জোক কামড় ছাড়ে এরা খামের উপর ডাকটিকিটের মতো, যেখানেই আবুল আসফিয়া সেখানেই তারা। মুখে এক বুলি, এক প্রশ্ন–কী করে সস্তায় কাইরে গিয়ে সেখানে থেকে সস্তাতেই ফের সঈদ বন্দরে জাহাজ ধরা যায়? আবুল আসফিয়া বলেন, হবে, হবে, সময় হলে সবই হবে।
শেষটায় জাহাজ যেদিন সুয়েজ বন্দরে পৌঁছবে তার আগের দিন তিনি রহস্যটি সমাধান করলেন। অতি সরল মীমাংসা। আমাদের মাথায় খেলেনি।
আবুল আসফিয়া বললেন, কুক কোম্পানির লোক ট্যুরিস্ট সায়েব-সুবোদের নিয়ে যাবে গাড়িতে ফার্স্ট ক্লাসে করে– সুয়েজ থেকে কাইরো, এবং কাইরো থেকে সঈদ বন্দর। কাইরোতে যে রাত্রিবাস করতে হবে তার ব্যবস্থাও হবে অতিশয় খানদানি, অতএব মাগী হোটেলে। আমরা যাব থার্ডে, এবং উঠব একটা সস্তা হোটেলে। তা হলেই হল।
প্রথমটায় আমরা অবাক হয়ে গিয়েছিলুম। সংবিতে ফেরামাত্র আমার মনে আরেকটি কঠিন সমস্যার উদয় হল। যদি কোনও জায়গায় আমরা ট্রেন মিস করি কিংবা অন্য কোনও দুর্ঘটনার মুখে পড়ে যাই আর শেষটায় সঈদ বন্দরে ঠিক সময়ে পৌঁছে জাহাজ না ধরতে পারি তবে যে আমাদের চক্ষু চড়কগাছ। বরঞ্চ চা খেতে প্লাটফর্মে নেমেছি, আর গাড়ি মালপত্র নিয়ে চলে গেল সে সমস্যারও সমাধান আছে কিন্তু জাহাজ চলে গেলে কতদিন সঈদ বন্দরে পড়ে থাকতে হবে, তার কী খরচা, নতুন জাহাজে নতুন টিকিটের জন্য কী গচ্চা এসব তো কিছুই জানিনে। কুকের লোক এসব বিপদ-আপদের জন্য জিমেদার, কিন্তু আবুল আসফিয়াকে জিম্মেদার করে তো আর আমাদের চারখানা হাত গজাবে না? তাকে তো আর বলতে পারব না, মশাই, আপনার পাল্লায় পড়ে এত টাকার গচ্চা হল- আপনি সেটা ঢালুন।
শেষের কথাটা বাদ দিয়ে আমার সমস্যাটা নিবেদন করতে তিনি উঠে দাঁড়িয়ে চলে গেলেন। যাবার সময় মাত্র একটি বাক্য বললেন, নো রিসক, নো গেন–সোজা বাঙলায়, খেলেন দই রমাকান্ত আর বিকারের বেলা গোবদ্দন সে হয় না। তুমি যদি দই খেতে চাও তবে বিকারটা হবে তোমারই। মাগুরমাছ ধরতে হলে গর্তে হাত দিতে হবে তোমাকেই! কিছুটা ঝুঁকি নিতে রাজি না হলে কোনও প্রকারের লাভও হয় না।
আবুল আসফিয়ার নো রিস্ক নো গেন এই চারটি কথা– চাট্টিখানি কথা নয়– শুনে পল দুশ্চিন্তাভরা গলায় বললে, তাই তো!
পার্সি মাথা নাড়িয়ে বললে, সেই তো!
আমি বললুম, ওই তো!
পল বললে, কিংবা মনে করুন কাইরোতে পথ হারিয়ে ফেললুম। আবুল আসফিয়া কি কাইরোর ভাষা জানেন? সেখানকার লোকে কী বুলি বলে তার নামই তো জানিনে!
পার্সি বললে, দেখো পল, তুমি কী জানো না তার ফিরিস্তি বানাবার এই কি প্রশস্ততম সময়? তাতে আবার সময়ও তো লাগবে বিস্তর।
আমি পার্সিকে ফাঁকা ধমক দিয়ে বললুম, আবার! পলকে বললুম আরবি। কিন্তু কিছু কিছু লোক নিশ্চয়ই ইংরেজি-ফরাসি জানে। রাস্তা ফের খুঁজে পাওয়া যাবে নিশ্চয়ই।
পল বললে, যাবে নিশ্চয়ই। কিন্তু ততক্ষণে হয়তো জাহাজ বন্দর ছেড়ে চলে গিয়েছে।
আরও অনেক অসুবিধার কথা উঠল। তবে সোজা কথা এই দাঁড়াল, একটি দেশের ভাষার এক বর্ণ না জেনে, এতখানি কম সময় হাতে নিয়ে সে দেশে ঘোরাঘুরি করা কি সমীচীন? এতই যদি সোজা এবং সস্তা হবে তবে এতগুলো লোক কুকের ন্যাজ ধরে যাচ্ছে কেন? একা একা কিংবা আপন আপন দল পাকিয়ে গেলেই তো পারত। তাই দেখা যাচ্ছে আবুল আসফিয়ার নো রিসক, নো গেন প্রবাদে অন্তত এক্ষেত্রে রিসক ন সিকে গেন মেরে কেটে চোদ্দ পয়সা। রবিঠাকুর বলেছেন,
আমার মতে জগন্টাতে ভালোটারই প্রাধান্য
মন্দ যদি তিন-চল্লিশ, ভালোর সংখ্যা সাতান্ন।
যদি আমাদের রিসক সাতান্ন আর গেন তিন-চল্লিশ হত তা হলেও আমরা কানাইলালের মতো সোল্লাসে ইয়াল্লা বলে ঝুলে পড়তুম যাচ্ছি তো মুসলমান দেশে।
তখন স্থির হল, আবুল আসফিয়াকে পাকড়াও করে আরেক দফা সবিস্তার সওয়াল-জবাব না করে কোনওকিছু পাকাপাকি মনস্থির করা যাবে না।
ধুয়া-ভুয়া করে করে, বিস্তর খোঁজাখুঁজির পর আমরা আবুল আসফিয়াকে পেলুম উপরের ডেকের এক কোণে, আপন মনে গুনগুনিয়ে গান গাইছেন। আমাদের দেখে, আমাদের কিছু বলার পূর্বেই বেশ একটু চড়া গলায় বললেন, আমি কোনও কথাই শুনতে চাইনে। আমি কোনও উত্তর দিতে পারব না। আমি কাইরো যাব। তোমরা আসতে চাও ভালো, না আসতে চাও আরও ভালো।
সঙ্গে সঙ্গে যেন আরও একটা শব্দ শুনতে পেলুম–শব্দটা ফারসি, বুজ-দিল–অর্থাৎ বকরির কলিজা, অর্থাৎ ভীতুরা সব।
এই শান্ত প্রকৃতি সদাশিব লোকটির কাছ থেকে আমরা এ আচরণ প্রত্যাশা করিনি। এ যেন সেনাপতির আদেশ, আমি তাহলে একাকী শত্রুসৈন্য আক্রমণ করব, তোমরা আসো আর না-ই আসো। ত্রিমূর্তি লড়াহত সারমেয়বৎ নিম্নপুচ্ছ হয়ে স্ব-স্ব আসনে ফিরে এলুম। কারও মুখে কথা নেই। নিঃশব্দে আহারাদি করে যে যার কেবিনে শুয়ে পড়লুম।
সিংহের ন্যাজে মোচড় দিতে নাই; কথাটি অতি খাঁটি, কিন্তু আবুল আসফিয়া সিংহ না মর্কট সেটা তো এখনও কিছু বোঝা গেল না। তার আচরণ তেজীয়ান না লেজীয়ানের লক্ষণ তার তো কোনও হদিস পাওয়া গেল না।
.
১১.
পরদিন নিদ্রাভঙ্গে কেবিন ছেড়ে উপরে আসতেই দেখি হৈ-হৈ-রৈরৈ কাণ্ড! একদল লোক আবুল আসফিয়াকে ঘিরে নানারকমের প্রশ্ন শুধোচ্ছে। কুক কোম্পানি কাইরো দেখবার জন্য চায় একশো টাকা আর আপনি বলেন, পঞ্চাশ টাকাতেই হয়, সেটা কী প্রকারে সম্ভব? আরেক দল বলে, তারাও আসতে রাজি কিন্তু যদিস্যাৎ কোনও প্রকারের গড়বড় সড়বড় হয়ে যায় আর তারা জাহাজ না ধরতে পারে তখন যে ভয়ঙ্কর বিপদ উপস্থিত হবে তার কী সমাধান?
অর্থাৎ ইতোমধ্যে আমাদেরই মতো আমাদের গরিব সহযাত্রীরা জেনে গিয়েছে সস্তাতেও কাইরো এবং পিরামিড দেখা যায়। কাজেই এখন আর পল, পার্সি, আমি, এই ত্রিমূর্তি, এবং আবুল আসফিয়াকে নিলে চতুর্মুখ– এখন আর তা নয়, এখন সমস্যাটা সহস্রনয়না হয়ে গিয়েছে, জনগণমন সাড়া দিয়েছে।
আবুল আসফিয়া কেবল মাঝে মাঝে বলেন, হো জায়গা, সব কুছ হো জায়গা।
হিন্দুস্তানি বলছেন কেন? তিনি তো ইংরেজি জানেন। তখন লক্ষ করলুম যেসব দল তাকে ঘিরে দাঁড়িয়েছে তাদের ভিতর রয়েছে ফরাসি, জর্মন, স্পেনিশ, রুশ আরও কত কী? এরা সবাই বোঝে, এমন কোনও ভাষা ইহসংসারে নেই। তাই তিনি নিশ্চিন্ত মনে মাতৃভাষায় কথা বলে যাচ্ছেন। ইংরেজি বললে যা, হিন্দুস্তানি বললেও তা। ফল একই।
এমন সময় আমাদের দলের সবচেয়ে সুন্দরী মহিলা মধুর এবং দরদভরা গলায় বললেন, মসিয়ো আবুল, যদি কোনও কারণে আমরা জাহাজ মিস করি তখন যে আমরা মহা বিপদে পড়ব। আপনি তো আমাদের কাউকে তার অনিচ্ছায় জোর করে নিয়ে যাচ্ছেন না যে আপনাকে জিম্মাদার হতে বলব।
ক্লোদেৎ শেনিয়ের যা বললেন, তার মোটামুটি অর্থ, আপনি যে আমাদের নিয়ে যাচ্ছেন তার জিম্মাদারি আপনার নয়, কিন্তু যদি কোনওরকমের বিপর্যয় উপস্থিত হয় তবে তার গুরুত্বটা আপনি ভালো করে বিবেচনা করে দেখলে হয় না কি?
উপস্থিত সকলের মনোভাব মহিলাটি যেন অতি ললিত ভাষায় বুঝিয়ে দিলেন। সবাই চিৎকার করে সায় দিল আপন আপন ভাষায়।
ফরাসি দল– উঁই উঁই,
জর্মন দল–ইয়া ইয়া,
ইতালীয় দল– সি সি,
একটি রাশান–দা দা,
গুটিকয়েক ভারতীয়– ঠিক হৈ ঠিক হৈ,
পল-পার্সি–-ইয়েস ইয়েস,
আমি নিজে কিছু বলিনি– কিন্তু সেকথা যাক।
আবুল আসফিয়া উত্তরে ঘাড় নিচু করে বললেন, মৈ জিম্মেদার হুঁ।
তাকে যদিও কেউ জিম্মেদার হবার শর্ত চায়নি তবু তিনি জিম্মাদার, এটা সম্পূর্ণ। তাঁরই দায়িত্ব!
.
১২.
চাকরির সন্ধানে গিয়ে এক বাঙালি বড় সাহেব ইংরেজকে খুশি করার জন্য বলেছিল, হুজুর, আপনার বাঙলোতে আসবার জন্য ভয়ের চোটে পা আর ওঠে না। যদি এক পা এগোই তো তিন কদম পিছিয়ে যাই। বড় সায়েব মাত্রই যে গাধা হয় তা নয়– এ সায়েবের বুদ্ধি ছিল। বাবুর কথা শেষ হতে না হতেই শুধাল, তা হলে এখানে পৌঁছলে কী করে? সায়েব যে বাবুর বিনয় বচন এতখানি শব্দার্থে নেবেন বেচারী সেটা অনুমান করতে পারেনি। প্রথমটা হকচকিয়ে গিয়েছিল বটে কিন্তু চাকরির ফিকিরে বাঙালির কাছে কোনও কসরত কোনও কৌশল অজানা নেই। একটিমাত্র শুকনো টোক না গিলেই বললে, হুজুর, তাই আমি আপন বাড়ির দিকে মুখ করে চলতে আরম্ভ করলুম, আর এই দেখুন দিব্যি হুজুরের বাঙলোতে পৌঁছে গিয়েছি।
গল্পের বাকিটা আমার মনে নেই, তবে আবুল আসফিয়ার কাইরো ভ্রমণ প্রস্তাবে উমেদাররা যদি এক পা এগোন তবে তিন পা পিছিয়ে যান। পল, পার্সি আর আমি ছাড়া কেউই পাকাপাকি কথা দেন না, আমাদের পার্টিতে আসছেন কি না। অথচ ঘড়িঘড়ি তরো-বেতরো প্রশ্ন। গাড়ি যদি মিস্ করি, কাইরোতে হোটেলে যদি জায়গা না মেলে, যদি রাত্রিবেলা হয় আর আকাশে চাঁদ না থাকে তবে পিরামিড দেখব কী করে আরও কত কী বিদঘুঁটে সব প্রশ্ন। ওদিকে আবুল আসফিয়া আপন কেবিনে খিল দিয়ে শুয়ে আছেন। প্রশ্নের ঠেলা সামলাতে হচ্ছে আমাদেরই আমরা যেন ইংলন্ডের রাজা পঞ্চম জর্জের ভারতীয় ভাইয়! শেষটায় আমরাও গা-ঢাকা দিতে আরম্ভ করলুম।
সন্ধের ঝোঁকে জাহাজ সুয়েজ বন্দরে পৌঁছল। সুয়েজ খালের মুখে এসে জাহাজ নোঙর ফেলতেই ডাঙা থেকে একটা স্টিমলঞ্চ এসে জাহাজের গা ঘেঁষে দাঁড়াল। তখন জানা গেল আবুল আসফিয়ার দলে সবসুদ্ধ আমরা নজন যাচ্ছি। তাঁকে নিয়ে দশ জন।
কুকের গাইড স্টিমলঞ্চে করে ডাঙা থেকে জাহাজে এসেছিল। দেখলুম, তার দলে বারো জন যাত্রী। তা হলে আমাদের দশ জন এমন মন্দ কী!
গাইড চড়চড় করে সিঁড়ি বেয়ে লঞ্চে নামল– পিছনে পিছনে তার দলের বারো জন নামল পাণ্ডা– গোরুর ন্যাজ ধরে পাপী যেরকম ধারা বৈতরণী পেরোয়। আমাদের আবুল আসফিয়াও চচ্চড় করে নামলেন যেন কত যুগের ঝানু গাইড!
কুকের গাইড এরকম ব্যাপার আগে কখনও দেখেনি। তার তদ্বিরি জিমেদারি উপেক্ষা করে একপাল লোক চলেছে আপন গোঠ বেঁধে– এতখানি রিস্ক নিয়ে এ ব্যাপার তার কাছে সম্পূর্ণ অবিশ্বাস্য। আবুল আসফিয়ার দিকে যে ধরনে তাকাল তাতে সে দুর্বাসা হলে তিনি নিশ্চয়ই পুড়ে খাক হয়ে যেতেন– উনিই তো তার মক্কেল মেরেছেন।
তখন ভালো করে দেখলুম আবুল আসফিয়ার নবীন বেশভূষা। সেই ঝুলে পড়া আঠারো-পকেটি কোট, মাটি-ছোঁয়া, চোঙা-পানা পাতলুন, তিনি বর্জন করে পরেছেন একদম ফার্স্ট ক্লাস নেভি ব্লু স্যুট-কোট, পাতলুন ওয়েস্ট কোট সমেত সোনালি বেনারসি সিঙ্কের টাই, তদুপরি ডাইমন্ড টাই-পিন, পায়ে পেটেন্ট লেদারের মোলায়েম জুতো, তদুপরি ফন্ রঙের স্প্যাট, মাথায় উচ্চাঙ্গের ফেল্ট ব্যাট, গরম বলে বা হাতে ধরে রেখেছেন, নেবু রঙের কিড় গ্লাভস, ডান হাতে চামড়ার একটি পোর্টফোলিয়ে।
বিবেচনা করলুম, এই সুটে আঠারোটা পকেট নেই বলে তিনি পোর্টফোলিয়োতে টফি চকলেট, সিগার সিগারেট ভর্তি করেছেন।
সুর্যাস্তের সঙ্গে সঙ্গে ঘন নীলাকাশ কেমন যেন সূর্যের লাল আর আপন নীলে মিলে বেগুনি রঙ ধরতে আরম্ভ করলে। তারই আভাতে লাল দরিয়ার আনীল জলে ফিকে বেগুনি রঙ ধরে নিচ্ছে। ভূমধ্যসাগর থেকে একশো মাইল পেরিয়ে আসছে মন্দমধুর ঠাণ্ডা হাওয়া। সে হাওয়া লাল দরিয়ার এই শেষ প্রান্তে তুলেছে ছোট ছোট তরঙ্গ। তারই উপর দিয়ে দুলে দুলে আসছে আমাদের স্টিমলঞ্চ। তার রঙ আসলে সাদা কিন্তু এই লাল-বেগুনির পাল্লায় পড়ে তারও রঙ যেন বেগুনি হতে আরম্ভ করলে।
স্টিমলঞ্চটি শুভ্রপুচ্ছ রাজহংসবৎ। রাজহাঁস সাঁতার কেটে যাবার সময় যেরকম শুভ্র বীচিতরঙ্গ জাগিয়ে তোলে, এ তরণীটিও তেমনি প্রপেলারের তাড়নায় জাগিয়ে তুলছে। শুভ্র ফেননিত ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র অসংখ্য চক্রাবর্ত। বড় জাহাজের বিরাট প্রপেলার যখন এরকম আবর্ত জাগায় তখন সেদিকে তাকাতে ভয় করে, মনে হয় ওই দয়ে পড়লে আর রক্ষে নেই কিন্তু ক্ষুদ্র লঞ্চের ছোট্ট ছোট্ট দয়ের একটি সরল মাধুর্য আছে। ঘণ্টার পর ঘণ্টা তাকিয়ে থাকা যায়।
সূর্য অস্ত গেল মিশর মরুভূমির পিছনে। পদ্মার সূর্যাস্ত, সমুদ্রের সূর্যাস্ত যেমন আপন আপন বৈশিষ্ট্য ধরে ঠিক তেমনি মরুভূমির সূর্যাস্তও এক দর্শনীয় সৌন্দর্য। সোনালি বালিতে সূর্যরশ্মি প্রতিফলিত হয়ে সেটা আকাশের বুকে হানা দেয় এবং ক্ষণে ক্ষণে সেখানকার রঙ বদলাতে থাকে। তার একটা রঙ ঠিক চেনা কোনও জিনিসের রঙ সেটা বুঝতে না বুঝতে সে রঙ বদলে গিয়ে অন্য জিনিসের রঙ ধরে ফেলে। আমাদের কথা বাদ দাও, পাকা আর্টিস্টরা পর্যন্ত এই রঙের খেলা দেখে আপন রঙের পেলেটের দিকে তাকাতে চান না।
সুয়েজ বন্দরে ইংরেজ সৈন্যদের একটি ঘাটি আছে, তাই রবিঠাকুরের ভাষায় বড় সায়েবের বিবিগুলো নাইতে নেমেছে। কেউ কেউ আবার ছোট্ট ছোট্ট নৌকো করে এখানে-ওখানে ঘোরাঘুরি করছে। নৌকোগুলো হালফ্যাশনের ক্যাম্বিসে তৈরি। নৌকোর পাঁজর ভেনেস্তা কাঠের দড় শলা দিয়ে বানিয়ে তার উপর ক্যা এজাতীয় নৌকো কলাপসিবল-পোর্টেবল অর্থাৎ নৌভ্রমণের পর ভেনেস্তার পাঁজর আর ক্যাম্বিসের চামড়া আলাদা আলাদা করে নিয়ে, ব্যাগের ভিতর প্যাক করে বাড়ি নিয়ে যাওয়া যায়। ওজন দশ সেরের চেয়েও কম। পরিপাটি ব্যবস্থা। অবশ্য নৌকোগুলো খুব ছোট। দু জন মুখোমুখি হয়ে কায়ক্লেশে বসতে পারে। মাঝখানে সামান্য একটু ফাঁকা জায়গা। সেখানে জল বাঁচিয়ে টুকিটাকি জিনিস রাখার ব্যবস্থা আছে। একজোড়া, গুণী দেখি সেখানে একটা পোর্টেবলের উপর রেকর্ড লাগিয়েছে ব্লু ডানয়্যুবের!
ওই তো মানুষের স্বভাব, কিংবা বলব বজ্জাতি। যেখানে আছে সেখানে থাকতে চায় না। যে জোড়া র ডানয়ুব বাজাচ্ছে তাদের যদি এক্ষুণি ডানয়ুব নদীর উপর ভাসিয়ে দাও তবে তারা গাইতে শুরু করবে, মাই হার্ট ইজ ইন দি হাইল্যান্ড, মাই হার্ট ইজ নট হিয়ার।
তাকে যদি তখন তুমি স্কটল্যান্ডের হাইল্যান্ডে নিয়ে যাও তবে সে গাইতে আরম্ভ করবে, ইম, রোজেন-গানে ফন্ সাঁসুসি অর্থাৎ সাসুসির গোলাপবাগানে–সাসুসি পদামে, বার্লিনের কাছে। তখন যদি তুমি তাকে বার্লিন নিয়ে যাও তবে সে গাইতে আরম্ভ করবে ভারতবর্ষের গান। জর্মানির বড় কবি কী গেয়েছেন শোনো,
গঙ্গার পার– মধুর গন্ধ ত্রিভুবন আলো ভরা
কত না বিরাট বনস্পতিরে ধরে
পুরুষ রমণী সুন্দর আর শান্ত প্রকৃতি-ধরা
নতজানু হয়ে শতদলে পূজা করে।
আম্ গাঙ্গোস ডুফটেটস লয়েস্টট
উনট রিসেনবয়মে ব্ল্যুয়েন,
উন্ট শোনে, স্টিলে মেনশেন
ফর লটসব্লুমেন ক্লিয়েন।
এবং সেখানে যখন মন ওঠে না তখন গেয়ে ওঠেন স্বপ্নপুরীর গান, যে পুরী কেউ কখনও দেখেনি, যার সঙ্গে আমাদের মতো সাধারণ জনের কোনওই পরিচয় নেই, কবিরাই শুধু যাকে মর্ত্যলোকে নামিয়ে আনার চেষ্টা করেন–
কোথা হায় সেই আনন্দনিকেতন?
স্বপ্নেই শুধু দেখি সে ভুবন আমি,
রবির এল, কেটে গেছে হায়, যামী
ফেনার মতন মিলে গেল এ স্বপন।
আখ ইয়েনসে লান্ট ডের ভনে,
ডাস্ জে ই অফ ইম্ ট্রাউম,
ডখ কমট ডি মর্গেনজনে,
ফেরফ্লিস্টস্ ভি আইটেলশাউম্।
আমি কিন্তু যেখানে আছি সেখানেই থাকতে ভালোবাসি। নিতান্ত বিপদে না পড়লে আমি আপন গা ছেড়ে বেরুতে রাজি হইনে। দেশভ্রমণ আমার দু চোখের দুশমন। তাই যখন রবিঠাকুর আপন ভূমির গান গেয়ে ওঠেন তখন আমি উদ্ধাহু হয়ে নৃত্য আরম্ভ করি।
শোনো–
তোমরা বল, স্বর্গ ভালো
সেথায় আলো
রঙে রঙে আকাশ রাঙায়
সারা বেলা।
ফুলের খেলা
পারুল ডাঙায়!
হক না ভালো যত ইচ্ছে–
কেড়ে নিচ্ছে
কেউ বা তাকে বলল, কাকী?
যেমন আছি
তোমার কাছেই
তেমনি থাকি!
ঐ আমাদের গোলাবাড়ি
গোরুর গাড়ি
পড়ে আছে চাকা ভাঙা,
গাবের ডালে
পাতার লালে
আকাশ রাঙা।
সন্ধেবেলায় গল্প বলে
রাখো কোলে
মিটমিটিয়ে জ্বলে বাতি।
চালতা-শাখে
পেঁচা ডাকে।
বাড়ে রাতি।
স্বর্গে যাওয়া দেব ফাঁকি
বলছি, কাকী,
দেখব আমায় কে কী করে।
চিরকালই
রইব খালি
তোমার ঘরে।
এ ছেলে তার কাকিমার কোলে বসে গলা জড়িয়ে যা বলেছে সে-ই আমার প্রাণের গান, তাতে আমার সর্ব দেহ-মন সাড়া দেয়। বিস্তর দেশভ্রমণের পর আমি তাই এই ধরনের একটি কবিতা লিখেছিলুম। কত না ঝুলোঝুলি, তারও বেশি ধন্নে দেবার পরও যখন কোনও সম্পাদক সেটা ছাপাতে রাজি হননি– বসুমতীর সম্পাদকও তাঁদেরই একজন– তখন তোমাদের ঘাড়ে আজ আর সেটা চাপাই কোন অধম বুদ্ধিতে?
দুম করে ধাক্কা লাগতে সংবিতে ফিরে এলুম। লঞ্চ পাড়ে লেগেছে। কিন্তু এরকম ধাক্কা লাগায় কেন? আমাদের গোয়ালন্দ-চাঁদপুরে তো এরকম বেয়াদবি ধাক্কা দিয়ে জাহাজ পাড়ে ভিড়ে না!
আবার!
সেই পূর্ণিমা সন্ধ্যায়,
দেশ পানে মন ধায়।
.
১৩.
সুয়েজ বন্দর কিছু ফেলনা বন্দর নয়। বন্দরটার সামরিক গুরুত্ব স্ট্রাটেজিক ইম্পর্টেনস– আছে বলে ইংরেজকে তার নৌবহরের একটা অংশ এখানে রাখতে হয়। যেসব গোরাদের ক্যাম্বিসের নৌকোয় করে জলকেলি করতে দেখেছিলুম তারাই এইসব নৌবহরের তদারকি করে। ফলে তাদের জন্য এখানে দিব্য একটা কলোনি গড়ে উঠেছে।
কিন্তু কিছুই নয়, কিছুই নয়, পূর্বের তুলনায় আজ সুয়েজ বন্দরের কী আর জমক জৌলুস! কেপ অব গুড হোপের পথ না বেরুনো পর্যন্ত, এমনকি তার পরও ভারতবর্ষ, বার্মা, মালয়, যবদ্বীপ, চীন থেকে যেসব জিনিস রপ্তানি হত তার অধিকাংশই সমুদ্রপথে এসে নামত সুয়েজ বন্দরে এবং ভুললে চলবে না, তখনকার দিনে প্রাচ্যই রপ্তানি করত বেশি। এখান থেকেই ফিনিশিয়ানরা, তার পরে গ্রিক, তার পর রোমান, তার পর আরবরা ভারতের দিকে রওনা হত। ভারত থেকে মাল এনে সুয়েজে নামানো হত। সুয়েজ থেকে একটা খালে করে এসব মাল যেত কাইরোতে এবং সেখান থেকে নীল নদ বয়ে সে মাল পৌঁছত আলেকজেনড্রিয়ায় আরবিতে যাকে বলে ইসকনদরিয়া। সেখান থেকে ভেনিসের মাধ্যমে তাবৎ ইউরোপ।
এইসব মাল কেনাকাটা আমদানি-রপ্তানিতে ভারতবর্ষের প্রচুর সদাগর-শ্ৰেষ্ঠী, মাঝি-মাল্লার বিরাট অংশ ছিল। যে যুগে ভাস্কো-দা-গামা এ পথকে নাকচ করে দেবার জন্য আফ্রিকা ঘুরে ভারতে আসার পথ বের করলেন সে যুগের পূর্বে প্রাচ্যের তাবৎ ব্যবসা-বাণিজ্য ছিল ভারতীয় এবং সুয়েজ অঞ্চলের মিশরীয়দের হাতে।
একদিকে ভারতীয় এবং মিশরীয়; অন্য দিকে ভাস্কো-দা-গামার বংশধর পর্তুগিজ দল।
জাত তুলে কথা কইতে নেই, তাই ইশারা-ইঙ্গিতে কই। এই যে পর্তুগিজ গুণ্ডারা গোয়া নিয়ে আজ দাবড়াদাবড়ি করছে এ কিছু নতুন নয়। ওদের স্বভাব ওই। এক কালে তারা জলে বোম্বেটে ছিল, এখন তারা ডাঙার গুণ্ডা। বোম্বেটে শব্দের মূল আর অর্থ অনুসন্ধান করলেই কথাটা সমপ্রমাণ হবে। বোম্বেটে কিছু বাঙালিদের উর্বর মস্তিষ্ক থেকে বানানো আজগুবি কথা নয়। বোম্বেটে শব্দ এসেছে ওই পর্তুগিজদের ভাষা থেকেই (bombardeiro), অর্থাৎ যারা না-বলে না-কয়ে যত্র-তত্র bomba)– বোমা ফেলে। হয়তো বলবে, আমাদের কলকাতাতেই কেউ কেউ এরকম বোমা ফেলে থাকে, কিন্তু তাদের সংখ্যা এতই নগণ্য এবং ঘৃণ্য যে আজ তাবৎ কলকাতাবাসীকে কেউ বোম্বেটে নাম দেয়নি। কিন্তু তাবৎ পর্তুগিজরাই এই অপকর্ম করত বলে তাদের নাম হয়ে গেল বোম্বেটে।
ওদের দ্বিতীয় নাম—-আমাদের বাঙলা ভাষাতেই হারমদ সেটাও পর্তুগিজ কথা ama da থেকে এসেছে। বিখ্যাত কোষকার স্বর্গীয় জ্ঞানেন্দ্রমোহন দাস তার সুবিখ্যাত অভিধানে এ শব্দের অর্থ করতে গিয়ে বলেছেন, পর্তুগিজ জলদস্যুরা যখন বাঙলা দেশের সুন্দরবন অঞ্চলে প্রথম হানা দেয় তখন তাদের অসহ্য অত্যাচারে অতিষ্ঠ হয়ে বাঙালিরা সুন্দরবন অঞ্চল ত্যাগ করতে বাধ্য হয়। আমাদের ঘরোয়া কবি কবিকঙ্কণ মুকুন্দরামের চণ্ডীকাব্যে আছে–
ফিরিঙ্গির দেশখান বাহে কর্ণধারে।
রাত্রিতে বহিয়া যায় হারমদের ডরে ॥
অর্থাৎ এইসব হারমদ–amada বোম্বেটে bombardeiro-দের ডরে তখন দক্ষিণ বাঙলার লোক নিশ্চিত মনে ঘুমুতে পারত না।
এস্থলে যদিও অবান্তর, তবু প্রশ্ন, বাঙালিরা এত ভয় পেয়ে পালাল কেন?
উত্তরে বলি, যে কোনও বন্দরে জাহাজ থেকে নেমে, একপাল লোক সেটাকে লুটতরাজ করতে পারে। এটা আদপেই কোনও কঠিন কর্ম নয়, যদি,
এইখানেই এক বিরাট যদি–
যদি সে রাজা তার সমুদ্রকূল রক্ষার জন্য নৌবহর মোতায়েন না করেন। জনপদ রক্ষা করার জন্য যেরকম পুলিশ-সেপাই রাজাকেই রাখতে হয়, ঠিক তেমনি সমুদ্রকূলবাসীদের হেপাজতির জন্য রাজাকেই নৌবহর রাখতে হয়।
কিন্তু হায়, তখন বাঙলা দেশ হুমায়ুন, আকবর মোগল বাদশাদের হুকুমে চলে। মোগলরা এদেশে এসেছে মধ্য এশিয়ার মরুভূমি থেকে। তারা শক্ত মাটির উপরে খাড়া পদাতিক, অশ্ববাহিনী, হস্তিযূথ, স্ত্রবাহিনী চতুরঙ্গ সৈন্যসামন্তের কী প্রয়োজন সে তত্ত্ব বিলক্ষণ বোঝে, কিন্তু নৌবহর রাখার গুরুত্ব সম্বন্ধে সম্পূর্ণ অচেতন। বাঙলা, উড়িষ্যা গুজরাত থেকে তাদের কাছে অনেক করুণ আবেদন-নিবেদন গেল–হুঁজুরেরা দয়া করে একটা নৌবহরের ব্যবস্থা করুন; না হলে আমরা ধনে-প্রাণে মানে-ইজ্জতে গেলুম।
কথাগুলো একদম শব্দার্থে আঁটি। ধন গেল, কারণ পর্তুগিজ বোম্বেটেদের অত্যাচারে ব্যবসা-বাণিজ্য আমদানি-রপ্তানি বন্ধ। প্রাণ যায়, কারণ তারা বন্দরে বন্দরে লুটতরাজের সময় যেসব খুনখারাবি করে তারই ফলে বন্দরগুলো উজাড় হতে চলল। মান-ইজ্জত? ছোট ছোট ছেলে-মেয়েদের ধরে নিয়ে গিয়ে পর্তুগালের হাটবাজারে গোলাম বাদি, দাসদাসীরূপে বিক্রয় করছে।
কিন্তু কা কস্য পরিবেদনা! মোগল বাদশারা বসে আছেন পশ্চিম পানে, খাইবার পাসের দিকে তাকিয়ে। ওই দিক থেকেই তারা এসেছেন স্বয়ং, তাদের পূর্বে এসেছে পাঠান শক্-হুঁ-সিথিয়ান-এরিয়ান। তাই তাঁরা তৈরি করেছেন চতুরঙ্গ। ওদের ঠেকাবার জন্য। নৌবহর চুলোয় যাক গে। ভারতবর্ষ তো কখনও সমুদ্রপথে পরাজিত এবং অধিকৃত হয়নি। তার জন্য বৃথা দুশ্চিন্তা এবং অযথা অক্ষয় অতিশয় অপ্রয়োজনীয়।
ফলে কী হল? পর্তুগিজদের তাড়িয়ে দিয়ে ইংরেজ সমুদ্রপথেই মোগলদের মুণ্ডু কেটে এদেশে রাজ্য বিস্তার করল।
সেকথা পরের কথা। উপস্থিত আমরা আলোচনা করছি, ভারতীয় উপকূলবাসীরা পর্তুগিজদের সঙ্গে যে লড়াই দিয়েছিল তাই নিয়ে। এরা তো মোগলদের কাছ থেকে কোনও সাহায্যই পেল না, উল্টো যারা লড়ছিল, তাদের সঙ্গে আরম্ভ করলেন শক্রতা।
গুজরাতের রাজা বাহাদুর শাহ্ বাদশাহ তখন লড়ছিলেন পর্তুগিজ বোম্বেটেদের সঙ্গে। তার প্রধান কারণ, গুজরাতের সুরাট, ব্রউফ (ভৃগু, খন্বত Cambay, স্তম্ভপুরী) ভিতর দিয়ে উত্তর-ভারতের যাবতীয় পণ্যবস্তু ইয়োরোপে যেত। সে ব্যবস্থা তখন পর্তুগিজ বোম্বেটেদের অত্যাচারে মরমর। বাহাদুর শাহ্ বাদশার দুই শক্র। একদিকে সমুদ্রপথে পর্তুগিজ, অন্যদিকে স্থলপথে রাজপুত। প্রথম রাজপুতদের হারিয়ে দিয়ে পরে পর্তুগিজদের খতম করার প্ল্যান করে তিনি পর্তুগিজদের সঙ্গে করলেন– আর্মিসি-সমরকালীন সন্ধি। তার পর হানা দিলেন রাজপুতনায়।
দিল্লিতে তখন রাজত্ব করেন বাদশা হুমায়ুন। ইতিহাসে নিশ্চয়ই পড়েছ, তখন এক রাজপুতানি শাহ-ইন-শাহ দিল্লীশ্বর জগদীশ্বরকে পাঠালেন রাখী। সেই রাখীর সম্মানার্থে হুমায়ুন ছুটলেন রাজপুতনার দিকে। বুঝলেন না, বাহাদুর শাহ্ হেরে গেলে পর্তুগিজদের আর কেউ ঠেকাতে পারবে না। পূর্বেই বলেছি, নৌবহর নৌসাম্রাজ্য বলতে কী বোঝায়, মোগলরা সেকথা আদপেই বুঝত না।
হুমায়ুন রাজপুতনায় পৌঁছলেন দেরিতে। বাহাদুর শাহ বাদশাহ তখন রাজপূতনা জয় করে ফেলেছেন। রাজপুতানিরা জৌহতে প্রাণ বিসর্জন দিয়েছেন। হুমায়ুন তখন আক্রমণ করলেন বাহাদুর শাহকে। বাহাদুর তখন পালিয়ে গিয়ে আশ্রয় নিলেন চম্পানির দুর্গে। সেখানে কী করে হুমায়ুন দুর্গ জয় করলেন সে কাহিনী অবশ্য ইতিহাসে পড়েছ। ইতোমধ্যে বাহাদুর দুর্গ ত্যাগ করে পালিয়েছেন গুজরাতে আপন রাজধানী আহমেদাবাদের দিকে। হুমায়ুন সেদিকে তাড়া লাগাতে তিনি পালালেন সৌরাষ্ট্র অর্থাৎ কাঠিওয়াড়ারের দিকে। সেখানকার কোনও কোনও উপকূলে তখন পর্তুগিজরা বেশ পা জমিয়ে বসেছে।
ইতোমধ্যে হুমায়ুন খবর পেলেন, বিহারের রাজা শেরশাহ দিল্লি জয় করার উদ্দেশ্যে সেদিকে এগিয়ে যাচ্ছেন। তদ্দণ্ডেই তিনি বাহাদুরকে ছেড়ে দিয়ে ছুটে চললেন দিল্লির দিকে। সেখানে শেরশাহের কাছে মার খেয়ে তিনি পালালেন কাবুলে। তার পর শের শাহ ব্যস্ত হয়ে রইলেন, উত্তর-ভারতে আপন প্রতিষ্ঠা কায়েম করতে। বাহাদুরকে তাড়া দেবার ফুরসত তার নেই। বাহাদুর হাঁফ ছেড়ে বেঁচে বললেন, এইবার তবে পর্তুগিজ বদমায়েশদের ঠাণ্ডা করি। পর্তুগিজরা ততদিনে বুঝতে পেরেছে, বাহাদুরের পিছনে তখন আর শত্রু নেই তাই তারা আরম্ভ করল তাদের পুরনো বদমায়েশি। বাহাদুর শাহকে আমন্ত্রণ জানাল, তাদের জাহাজে এসে ব্যবসা-বাণিজ্য সন্ধি-চুক্তি সম্বন্ধে যাবতীয় আলোচনা-পরামর্শ করার জন্য।
বাহাদুর আহাম্মুখের মতো কেন গেলেন সেই নিয়ে বিস্তর ঐতিহাসিকগণ বহু আলোচনা-গবেষণা করেছেন। সে নিয়ে আজ আর আলোচনা করে কোনও লাভ নেই।
তা সে যাই হোক, একথা কিন্তু সত্য, বাহাদুর জাহাজে ওঠামাত্রই বুঝতে পারলেন, তিনি ফাঁদে পা দিয়েছেন। পর্তুগিজদের বদমতলব তাঁকে খুন করার, তাঁর সঙ্গে সন্ধি সুলেহ করার জন্য নয়। তক্ষুনি তিনি ঝাঁপিয়ে পড়লেন জলে সাঁতরে পাড়ে ওঠার জন্য। সঙ্গে সঙ্গে দশ-বিশটা পর্তুগিজও হাতে বৈঠা নিয়ে তার পিছনে জলে ঝাঁপিয়ে পড়ল। সেইসব বৈঠা দিয়ে গুজরাতের শাহ্-ই-শাহ্ বাদশাহ্ বাহাদুর শাহের মাথা ফাটিয়ে দিলে।
পর্তুগিজদের বিরুদ্ধে ভারতবর্ষের এই শেষ লড়াই।
***
কিন্তু আজ সুয়েজ বন্দরে ঢোকার সময় আমি দেশ পানে ফিরে গিয়ে এসব কথা পাড়ছি কেন?
কারণ এই সুয়েজের রাজাকেই বাহাদুর তখন ডেকেছিলেন তার নৌবাহিনী নিয়ে এসে পর্তুগিজদের বিরুদ্ধে তাঁকে নৌ-সমরে সাহায্য করতে। পূর্বে বলেছি, সুয়েজও বেশ জানত পর্তুগিজদের বোম্বেটেগিরি তাদের ব্যবসা-বাণিজ্যের জন্য কতখানি মারাত্মক। শুধু বাহাদুর নয় তাঁর পূর্বপুরুষগণও বার বার এঁদের ডেকেছেন। দুয়ে মিলে পর্তুগিজদের একাধিকবার ঝিঙে-পোস্ত চন্দন-বাটা করেছেন।
তারা তখন যেসব কামান এনেছিল সেগুলো ফেরত নিয়ে যায়নি। গুজরাতের বাদশা যখন বললেন, এগুলো রেখে যাচ্ছেন কেন? তখন তারা বলেছিল, এইসব পর্তুগিজ বদমায়েশরা আবার কখন হানা দেবে তার ঠিকঠিকানা কী? আবার তখন কামান নিয়ে আসার হাঙ্গাম হুজ্জোত ঠেলবার কী প্রয়োজন?
এ ঘটনার দশ বৎসর পর আকবর গুজরাত জয় করেন। তিনি কামানগুলো দেখে তাদের পূর্ববর্তী ইতিহাস জেনেও নৌবাহিনী নৌ-সমরের মূল্য বুঝতে পারেননি। তাই পর্তুগিজরা জিতল। তাদের হারিয়ে দিয়ে ইংরেজ জিতল। ক্রমে ক্রমে মাদ্রাজ কলকাতা হয়ে তাবৎ ভারতবর্ষে আপন রাজ্য বিস্তার করল।
***
আজ সুয়েজে ঢুকে সেই কথাই স্মরণে এল, এই সুয়েজের লোকই একদিন আমাদের সঙ্গে একজোট হয়ে পর্তুগিজ বর্বরতার বিরুদ্ধে কী লড়াই-ই দিয়েছিল।
.
১৪.
সম্বিতে ফিরে এলুম। দেখি বখেড়া লেগে গিয়েছে। বন্দরে নেমে যে দপ্তরের ভিতর দিয়ে যেতে হয় সেখানে আমাদের অর্থাৎ আবুল আসফিয়ার দলকে আটকে দিয়েছেন বন্দরের কর্তারা। কেন কী ব্যাপার? আমাদের হেলথ সার্টিফিকেট কই? সে আবার কী জ্বালা? দিব্যি তো বাবা লঞ্চ থেকে নেমে পায়ে হেঁটে এখানে এলুম, স্ট্রেচারে চেপে কিংবা মড়ার খাঁটিয়ায় শুয়ে আসিনি তবে আমাদের হেলথ সম্বন্ধে এত সন্দ কেন? উঁহু, কর্তারা বলছেন আমরা যে ভিতরে ভিতরে বসন্ত, প্লেগ, কলেরা, সেৎসেত সে জ্বর (সে আবার কী মশাই?) স্পটেড ফিভার (ততোধিক, সমস্যা আলপনা-কাটা জ্বর?) ইত্যাদি যাবতীয় মারাত্মক রোগে ভুগছি না তার সার্টিফিকেট কই। আমরা যে এসব পাপিষ্ঠ রোগ তাদের সোনার দেশ মিশরে ছড়াব না, তার কি জিম্মাদারি?
শুনে পার্সি বলছে, স্যর, এসব মারাত্মক রোগেই যদি ভুগব, তবে বাপ-মার সেবাশুশ্রূষা ছেড়ে পাদ্রিসাহেবের শেষ ধর্মবচন না শুনে এখানে আসব কেন?
দ্যাশের লোক প্রতুল সেন বলছে, মিশরের সঙ্গে এরকম ধারা দুশমনি আমরা করতে যাব কেন?
তার বউ রমা বলছে, পিরামিড তোমাদের গৌরবের বস্তু; আমাদের যেরকম তাজমহল। তার কোনটা ভালো, কোনটা মন্দ সে বিচারের সুযোগ না দিয়ে আপনারা আপন দেশের প্রতি কী অবিচার করছেন বুঝতে পারছেন কি?
আমি কানে কানে রমাকে শুধালুম, তবে কুকের সঙ্গে যে সব লোক এসেছিল তারা পেরুল কী করে?
রমা বললে, চুপ করুন, ওরা যে ওই সব হলদে হলদে কাগজ দেখালে। আমাদেরও আছে। জাহাজে ফেলে এসেছি। আমরা তো জানতুম না এখানে ওসব রাবিশের দরকার হবে। কুকের লোক জানত, ওরা তাই সার্টিফিকেট এনেছিল।
ওহ! তখন মনে পড়ল পাসপোর্ট নেবার সময় ভ্যাকসিনেশন ইনকুলেশন করিয়েছিলুম বটে এবং ফলে একখানা হলদে রঙের সার্টিফিকেটও পেয়েছিলুম বটে। সেইটে নেই বলেই এখানে এ গর্দিশ।
কিন্তু এ শিরঃপীড়া তো আমাদের নয়। আবুল আসফিয়া যখন আমাদের দলের নেতা তখন তারই তো বোঝা উচিত ছিল ওই ম্যাটমেটে হলদে রঙের কাগজটা আমাদের সঙ্গে নিয়ে আসা অতিশয় প্রয়োজনীয়। এই সামান্য কাণ্ডজ্ঞান যার নেই–
চিন্তাধারায় বাধা পড়ল। দেখি, পল আমার হাত টানছে আর কানে কানে বলছে, চলুন জাহাজে ফিরে যাই।
কিন্তু আবুল আসফিয়া কোথায়?
তিনি দেখি নিশ্চিন্ত মনে, একে সিগারেট দিচ্ছেন, ওকে টফি খাওয়াচ্ছেন, তাকে চকলেট গেলাচ্ছেন। কোলে আবার একটা বাচ্চা। খোদায় মালুম কার?
লোকটা তা হলে বদ্ধ পাগল! পাগলের সংস্পর্শ ত্যাগ করাই ধৰ্মাদেশ।
পলের হাত ধরে পোর্ট-আপিস ছেড়ে সমুদ্রের কিনারায় পৌঁছলুম। তখন দেখি আমাদের জাহাজ ভোঁ ভোঁ করে গুরুগম্ভীর নিনাদে সুয়েজ খালে ঢুকে গিয়েছে।
.