০১. বন্দর থেকে জাহাজ ছাড়ার কর্মটি

জলে ডাঙায় – সৈয়দ মুজতবা আলী

০১.

বন্দর থেকে জাহাজ ছাড়ার কর্মটি সবসময়ই এক হুলস্থুল ব্যাপার, তুমুল কাণ্ড! তাতে দুটো জিনিস সকলেরই চোখে পড়ে; সে দুটো– ছুটোছুটি আর চেঁচামেচি।

তোমাদের কারও কারও হয়তো ধারণা যে সায়েব-সুবোরা যাবতীয় কাজকর্ম সারা করে যতদূর সম্ভব চুপিসারে আর আমরা চিৎকারে চিৎকারে পাড়ার লোকের প্রাণ অতিষ্ঠ না করে কিছুই করে উঠতে পারিনে। ধারণাটা যে খুব ভুল সেকথা আমি বলব না। সিনেমায় নিশ্চয়ই দেখেছ, ইংরেজরা ব্যাঙকুইট (ভোজ) খায় কীরকম কোনও প্রকারের শব্দ না করে। বাটলাররা নিঃশব্দে আসছে যাচ্ছে, ছুরিকাঁটার সামান্য একটু ঠুং-ঠাং, কথাবার্তা হচ্ছে মৃদু গুঞ্জরণে, সবকিছু অতিশয় পরিপাটি, ছিমছাম।

আর আমাদের দাওয়াতে, পাল-পরবের ভোজে, যুগ্যির নেমন্তন্নে?

তার বর্ণনা দেবার ক্ষমতা কি আমার আছে। বিশেষ করে এসব বিষয়ে আমার গুরু সুকুমার রায় যখন তার অজর অমর বর্ণনা প্ল্যাটিনামাক্ষরে রেখে দিয়ে গিয়েছেন। শোনো :

এই দিকে এসে তবে লয়ে ভোজভাণ্ড
সমুখে চাহিয়া দেখ কি ভীষণ কাণ্ড;
কেহ কহে দৈ আন্ কেহ হাঁকে লুচি
কেহ কাঁদে শূন্য মুখে পাতখানি মুছি।
হোথা দেখি দুই প্রভু পাত্র লয়ে হাতে
 হাতাহাতি গুতাগুতি ধরণে মাতে।
 কেবা শোনে কার কথা সকলেই কর্তা
অনাহারে কত ধারে হল প্রাণহত্যা।

বলে কী! ভোজের নেমন্তনে অনাহারে প্রাণহত্যা! আলবাৎ! না হলে বাঙালির নেমন্তন্ন হতে যাবে কেন পছন্দ না হলে যাও না ফাপ্পোতে। খাও না আলোনা, আধাসেদ্ধ ওয়োরের মুণ্ডু কিংবা কিসের যেন ন্যাজ!

কিন্তু জাহাজ ছাড়ার সময় সব শেয়ালের এক রা।

আমি ভেনিসে দাঁড়িয়ে ইটালির জাহাজ ছাড়তে দেখেছি– জাহাজে বন্দরে, ডাঙায় জলে উভয় পক্ষের খালাসিরা মাক্কারনি-খেকো খাঁটি ইটালিয়ান; আমি মার্সেলেসের বন্দরেও ওই কর্ম দেখেছি–উভয় পক্ষের খালাসিরাই ব্যাঙ-খেকো সরেস ফরাসিস; আমি ডোভারে দাঁড়িয়ে ওই প্রক্রিয়াই সাতিশয় মনোযোগ সহকারে নিরীক্ষণ করেছি– দু পক্ষের বাঁদরগুলোই বিফস্টেক-খেকো খাটাশ-মুখো ইংরেজ; আর গঙ্গায়, গোয়ালন্দে, চাঁদপুরে, নারায়ণগঞ্জে যে কত শত বার এই লড়াই দেখেছি তার তো লেখাজোখা নেই। উভয় পক্ষে আমারই দেশভাই জাতভাই দাড়ি-দোলানো, লুঙি-ঝোলানো, সিলট্যা, নোয়াখাল্যা।

বন্দরে বন্দরে তখন যে চিৎকার, অট্টরব ও হুঙ্কারধ্বনি ওঠে সে সর্বত্র একই প্রকারের। একই গন্ধ, একই স্বাদ। চোখ বন্ধ করে বলতে পারবে না, নারায়ণগঞ্জে দাঁড়িয়ে চাটগাইয়া শুনছ, না হামবুর্গে জর্মন শুনছ।

ডেকে রেলিঙ ধরে দাঁড়িয়ে প্রথমটায় তোমার মনে এই ধারণা হওয়া কিছুমাত্র বিচিত্র নয় যে, জাহাজ এবং ডাঙ্গার উভয় পক্ষের খালাসিরা একমত হয়ে জাহাজটাকে ডাঙ্গার দড়াদড়ির বন্ধন থেকে নিষ্কৃতি দিতে চায়। কিন্তু ওই তো মারাত্মক ভুল করলে দাদা। আসলে দু পক্ষের মতলব একটা খণ্ডযুদ্ধ লাগানো। জাহাজ ছাড়ানো-বাঁধানো নিছক একটা উপলক্ষ মাত্র। যে খালাসি জাহাজের এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্ত অবধি তুর্কি ঘোড়ার তেজে ছুটছে, সে যে মাঝে মাঝে ডাঙার খালাসির দিকে মুখ খিঁচিয়ে কী বলছে তার শব্দ সেই ধুন্ধুমারের ভিতর শোনা যাচ্ছে না সত্যি কিন্তু একটু কল্পনাশক্তি এবং ঈষৎ খালাসি মনস্তত্ত্ব তোমার রপ্ত থাকলে স্পষ্ট বুঝতে পারবে তার অতিশয় প্রাঞ্জল বক্তব্য, ওরে ও গাডুম ইস্টুপিড, দড়িটা যে বাঁ-দিকে গিট খেয়ে গিয়েছে, সেটা কি তোর চোখে মাস্তুল খুঁজে দেখিয়ে দিতে হবে। ওরে ও (পুনরায় কটুবাক্য)

এই মধুরসবাণীর জুতসই সদুত্তর যে ডাঙার কনেপক্ষ চড়াসে দিতে পারে না, সেকথা আদপেই ভেবো না। অবশ্য তারও গলা শুনতে পাবে না, শুধু দেখতে পাবে অতি রমণীয় মুখভঙ্গি কিংবা মুখ-বিকৃতি এবং বুঝতে হবে অনুমানে।

জাহাজের দিকে মুখ তুলে ফাঁচ করে খানিকটে থুথু ফেলে বলবে, ওরে মর্কটস্য মর্কট, তোর দিকটা ভালো করে জড়িয়ে নে না। জাহাজের টানে এ দিকটা তো আপনার থেকে খুলে যাবে। একটা দড়ির মনের কথা জানিসনে আর এসেছিস জাহাজের কামে। তার চেয়ে দেশে গিয়ে ঠাকুরমার উকুন বাছতে পারিসনে? ওরে ও হামানদিস্তের খাতলামুখো (পুনরায় কটু বাক্য)

একটুখানি কল্পনার সাবান হাতে থাকলে ওই অবস্থায় বিস্তর বাস্তবের বুদ্বুদ ওড়াতে পারবে।

ওদিকে এসব কলরব–মাইকেলের ভাষায় রথচক্ৰ-ঘর্ঘর-কোদণ্ড-টঙ্কার ছাপিয়ে উঠছে ঘন ঘন জাহাজের ভেপুর শব্দ ভে, ভোঁ ভোঁ, ভোঁ–

তার অর্থ, যদি সে ছোট জাহাজের প্রতি হয়, ওরে ও ছোকরা, সরু না। আমি যে এক্ষুণি ওদিকে আসছি দেখতে পাচ্ছিসনে? ধাক্কা লাগলে যে সাড়ে বত্রিশভাজা হয়ে যাবি, তখন কি টুকরোগুলো জোড়া লাগাবি গাদাপাতার রস দিয়ে? আর যদি তোমার জাহাজের চেয়ে বড় জাহাজ হয়, তবে তার অর্থ, এই যে, দাদা, নমস্কার। একটু বাঁ দিকে সরতে আজ্ঞা হয়, আমি তা হলে ডান দিকে সুড়ত করে কেটে পড়তে পারি। এবং এই ভেঁপু বাজানোর একটা তৃতীয় অর্থও আছে। প্রত্যেক জাহাজের মাঝিমাল্লারা আপন ভেঁপুর শব্দ চেনে। কেউ যদি তখনও বন্দরের কোনও কোণে আনন্দরসে মত্ত হয়ে থাকে, তবে ভেঁপুর শব্দ শুনে তৎক্ষণাৎ তার চৈতন্যোদয় হয় এবং জাহাজ ধরার জন্য উর্বশ্বাসে ছুট লাগায়।

আমি একবার একজন খালাসিকে সাঁতরে এসে জাহাজে উঠতে দেখেছি। তখন তার আর সব খালাসি ভাইয়ারা যা গালিগালাজ দিয়েছিল তা শুনে আমি কানে আঙুল দিয়ে বাপ বাপ করে সরে পড়েছিলুম। ইংরাজিতে বলে, হি ক্যান সুএ্যার লাইক এ সেলার অর্থাৎ খালাসিরা কটুবাক্য বলাতে এ দুনিয়ার সবচাইতে ওস্তাদ। ওরা যে ভাষা ব্যবহার করে সেটা বর্জন করতে পারলে দেশ-বিদেশে তুমি মিষ্টভাষীরূপে খ্যাতি অর্জন করতে পারবে।

তোমার যদি– ফারসি পড়নে-ওলা ক্লাসফ্রেন্ড থাকে তবে তাকে জিগ্যেস কর, ইস্কর-ই-রুমিরা পুরসিদ–অর্থাৎ আলেকজান্ডার দি গ্রেটকে জিগ্যেস করা হয়েছিল— দিয়ে যে গল্প আরম্ভ, তার গোটাটা কী? গল্পটা হচ্ছে, সিকন্দরশাহকে জিগ্যেস করা হয়েছিল, তা আপনি কার কাছ থেকে শিখেছেন? উত্তরে তিনি বললেন, বে-আদবদের কাছ থেকে। সে কী প্রকারে সম্ভব? তারা যা করে আমি তাই বর্জন করেছি।

খুব যে একটা দারুণ চালাক গল্প হল তা বলছিনে। তবে জাহাজের খালাসিদের বিশেষ করে ইংরেজ খালাসিদের ভাষাটা বর্জন করলেই লাভবান হওয়ার সম্ভাবনা বেশি।

জাহাজের সিঁড়ি ওঠার শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত দেখবে দু-একটা লোক এক লাফে তিন ধাপ ডিঙোতে ডিঙোতে জাহাজে উঠছে। এরা কি একটু সময় করে আগেভাগে আসতে পারে না? আসলে তা নয়। কোনও বেচারিকে কাস্টমস হাউস (যারা আমদানি-রপ্তানি মালের ওপর কড়া নজর রেখে মাশুল তোলে) আটকে রেখেছিল, শেষ মুহূর্তে খালাস পেয়েছে, কেউ-বা আধঘণ্টা আগে খবর পেয়েছে কোনও যাত্রী এ জাহাজে যাবে না বলে খালি বার্থটা সে পেয়ে গিয়েছে কিংবা কেউ শহর দেখতে গিয়ে পথ হারিয়ে ফেলেছিল, কোনও গতিকে এইমাত্র বন্দর আর জাহাজ খুঁজে পেয়েছে।

বদর বদর বলে জাহাজ বন্দরের বন্ধন থেকে মুক্তি পেল।

অজানা সমুদ্রের বুকে ভেসে যাওয়ার ঔৎসুক্য একদিকে আছে, আবার ডাঙা থেকে ছুটি নেবার সময় মানুষের মন সবসময়ই একটা অব্যক্ত বেদনায় ভরে ওঠে। অপার সমুদ্রের মাঝখানে দাঁড়িয়ে, সীমার শেষের দিথলয়ের দিকে তাকিয়ে মুক্ত মনের যত অগাধ আনন্দই পাও না কেন, ঝঞ্ঝাবাত্যার সঙ্গে দুর্বার সংগ্রাম করে করে ক্ষণে-বাচা ক্ষণে-মরার অতুলনীয় যত অভিজ্ঞতাই সঞ্চয় কর না কেন, মাটির কোলে ফিরে আসার মতো মধুময় অভিজ্ঞতা অন্য কিছুতেই পাবে না। তাই ভ্রমণকারীদের গুরু, গুরুদেব বহু নদ-নদী সাগর-সমুদ্র উত্তীর্ণ হওয়ার পর বলেছেন–

ফিরে চল, ফিরে চল মাটির টানে
যে মাটি আঁচল পেতে চেয়ে আছে মুখের পানে।

জাহাজ ছাড়তে ছাড়তে সন্ধ্যার অন্ধকার ঘনিয়ে এল।

আমি জাহাজের পিছন দিকে রেলিঙের উপর ভর করে তাকিয়ে রইলুম আলোকমালায় সুসজ্জিত মহানগরীর পৃথিবীর অন্যতম বৃহৎ বন্দরের দিকে। সেখানে রাস্তায় রাস্তায়, সমুদ্রের জাহাজে জাহাজে আর জেলেদের ডিঙিতে ডিঙিতে কোথাও-বা সারে সারে প্রদীপশ্রেণি আর কোথাও-বা এখানে একটা ওখানে দুটো, সেখানে একঝাক যেন মাটির সাত-ভাই-চম্পা।

আমরা দেয়ালি জ্বালি বছরের মাত্র এক শুভদিনে। ওখানে সম্বৎসর দেয়ালির উৎসব। এদের প্রতিদিনের প্রতি গোধূলিতে শুভ লগ্ন। আর এদের এ উৎসব আমাদের চেয়ে কত সর্বজনীন! এতে সাড়া দেয় সর্ব ধর্ম সর্ব সম্প্রদায়ের নরনারী… হিন্দু-বৌদ্ধ-শিখ-জৈন পারসিক-মুসলমান-খ্রিস্টান!

আমি জানি, বৈজ্ঞানিকেরা বলেন, কোনও কোনও ছোট্ট পাখির রঙ যে সবুজ তার কারণ সে যেন গাছের পাতার সঙ্গে নিজের রঙ মিলিয়ে দিয়ে লুকিয়ে থাকতে পারে, যাতে করে শিকারে পাখি তাকে দেখতে পেয়ে ছোঁ মেরে না নিয়ে যেতে পারে! তাই নাকি আমের রঙও কাঁচা বয়সে থাকে সবুজ– যাতে পাখি না দেখতে পায়, এবং পেকে গেলে হয়ে যায় লাল, যাতে করে পাখির দৃষ্টি আকর্ষণ করতে পারে–যাতে সে যেন ঠুকরে ঠুকরে তাকে গাছ থেকে আলাদা করে দেয়, নিচে পড়ে তার আঁটি যেন নতুন গাছ জন্মাতে পারে।

বৈজ্ঞানিকদের ব্যাখ্যা ভুল, আমি বলি কী করে? বিজ্ঞানের আমি জানি কতটুকু, বুঝি কতখানি? কিন্তু আমার সরল সৌন্দর্য-তিয়াষী মন এসব জেনে-শুনেও বলে, না, পাখি যে সবুজ, সে শুধু তার নিজের সৌন্দর্য আর আমার চোখের আনন্দ বাড়াবার জন্যে। এর ভিতর ছোট হোক, বড় হোক, কোনও স্বার্থ লুকনো নেই। সৌন্দর্য শুধু সুন্দর হওয়ার জন্যই।

ঠিক তেমনি আমি জানি, পৃথিবীর বন্দরে বন্দরে প্রতি গোধূলিতে যে আলোর বান জেগে ওঠে, তার মধ্যে স্বার্থ লুকনো আছে। ওই আলো দিয়ে মানুষ একে অন্যকে দেখতে পায়, বাপ ওই আলোতে বাড়ি ফেরে, মা তার শিশুকে খুঁজে পায়, সবাই আপন আপন গৃহস্থালির কাজ করে; কিন্তু তবু যখনই আমি দূরের থেকে এই আলোগুলোর দিকে তাকিয়ে দেখি, তখনই মনে হয় এগুলো জ্বালানো হয়েছে শুধুমাত্র দেয়ালির উৎসবকে সফল করার জন্য। তার ভিতর যেন আর কোনও স্বার্থ নেই।

অকূল সমুদ্রে পথহারা নাবিক তারার আলোয় ফের পথ খুঁজে পায়। সেই স্বার্থের সত্য উপেক্ষা করে রবীন্দ্রনাথ গেয়েছেন–

তুমি কত আলো জ্বালিয়েছ এই গগনে
কি উৎসবের লগনে।

বন্দরের আলোর দিকে তাকিয়ে যদি আমিও ভগবানের উদ্দেশে বলি–

মোরা কত আলো জ্বালিয়েছি ওই চরণে
কি আরতির গগনে।

 তবে কি বড্ড বেশি ভুল বলা হবে?

অনেক দূরে চলে এসেছি। পাড়ের আলো ক্রমেই ম্লান হয়ে আসছে। তবু এখনও দেখতে পাই হুশ করে একখানা জেলেডিঙি আমাদের পাশ দিয়ে উল্টোদিকে চলে গেল। আসলে কিন্তু সে হুশ করে চলে যায়নি। সে ছিল দাঁড়িয়েই, কারণ তার গলুই সমুদ্রের দিকে মুখ করে। আছে, আমরা তাকে পেরিয়ে গেলুম মাত্র।

আশ্চর্য, এত রাত অবধি পাড় থেকে এত দূরে তারা মাছ ধরছে।

এখন যদি ঝড় ওঠে তবে তারা করবে কী? নৌকা যদি ডুবে যায় তবে তারা তো এতখানি জল পাড়ি দিয়ে ডাঙায় পৌঁছতে পারবে না। তবে তারা এরকম বিপজ্জনক পেশা নিয়ে পড়ে থাকে কেন? লাভের আশায়? নিশ্চয় নয়। সে তত্ত্ব আমি বিলক্ষণ জানি। আমি একবার কয়েক মাসের জন্য মাদ্রাজের সমুদ্রপাড়ে আমার এক বন্ধুর বাড়িতে ছিলুম। তারই পাশে ছিল, একেবারে সমুদ্রের গা ঘেঁষে এক জেলেপাড়া। আমি পাকা ছটি মাস ওদের জীবনযাত্রা-প্রণালি দেখেছি। ওদের দৈন্য দেখে আমি স্তম্ভিত হয়েছি। আমাদের গরিব চাষিরাও এদের তুলনায় বড়লোক, এমনকি, আমাদের আদিবাসীরা, সাঁওতাল ভিলেরাও এদের চেয়ে অনেক বেশি সুখস্বাচ্ছন্দ্যে জীবনযাপন করে। তোমাদের ভিতর যারা পুরির জেলেদের দেখেছ তারাই আমার কথায় সায় দেবে।

তবে কি এরা অন্য কোনও সুযোগ পায় না বলে এই বিপদসঙ্কুল, কঠিন অথচ দুঃখের জীবন নিয়ে পড়ে থাকে? আমার সেই মাদ্রাজি বন্ধু বললে, তা নয়, এরা নাকি ভোলা সমুদ্র এত ভালোবাসে যে তাকে ছেড়ে মাঠের কাজে যেতে কিছুতেই রাজি হয় না। ঝড়ের সময় মাছ ধরা প্রায় অসম্ভব বলে তখন উপোস করে দিন কাটাবে, ক্ষুধায় প্রাণ অতিষ্ঠ হলে, ভুখা কাচ্চাবাচ্চাদের কান্না সহ্য করতে না পারলে সেই ঝড়েই বেরোয় মাছ ধরতে আর ডুবে মরে সমুদ্রের অথই জলে। তবু জল ছেড়ে ডাঙার ধান্দায় যেতে রাজি হয় না।

এবং নৌকোর মাঝি-মাল্লা, জাহাজের খালাসিদের বেলাও তাই। এদের জীবন এতখানি অভিশপ্ত নয়, জানি, কিন্তু এরাও ডাঙায় ফিরে যেতে রাজি হয় না। এমনকি, যে চাষা সাতশো পুরুষ ধরে ক্ষেতের কাজ করেছে, সে-ও যদি দুর্ভিক্ষের সময় দু পয়সা কামাবার জন্য সমুদ্রে যায় তবে কিছুদিন পরই তাকে আর ডাঙার কাজে নিয়ে যাওয়া যায় না। আর পুরনো খালাসিদের তো কথাই নেই। গোপদাড়ি পেকে গিয়েছে, সমুদ্রের নোনা জল আর নোনা হাওয়ায় চামড়ার রঙটি ব্রোনজের মতো হয়ে গিয়েছে, আর কদিন বাঁচবে তার ঠিক নেই, জাহাজে কেউ চাকরি দিতে চায় না, তবু পড়ে থাকবে খিদিরপুরের এক ঘিঞ্জি আড্ডায় আর উদয়াস্ত এ-জাহাজ ও-জাহাজ করে করে বেড়াবে চাকরির সন্ধানে। ওদিকে বেশ দু পয়সা জমিয়েছে। ইচ্ছে করলেই দেশের গাঁয়ের তেঁতুলগাছতলায় নাতি-নাতনির পাখার হাওয়া খেতে খেতে গল্প-টল্প বলতে বলতে দুটি চোখ বুজতে পারে।

সমুদ্রের প্রতি এদের কেমন যেন একটা নেশা আছে, সে সম্বন্ধে তারা একটু লজ্জিত। কেন, জানিনে। তুমি যদি বল, তা, চৌধুরীর পো–চৌধুরীর পো বলে সম্বোধন করলে ওরা বড় খুশি হয়–দু পয়সা তো কামিয়েছ, আর কেন এ-জাহাজে ও-জাহাজে ঝকমারির কাজ করা। তার চেয়ে দেশে গিয়ে আল্লা-রসুলের নাম স্মরণ কর, আখেরের কথা ভাববার সময় কি এখনও আসেনি?

বড় কাচুমাচু হয়ে বুড়ো বলবে, না, ঠাকুর, তা নয়। দাড়ি চুলকোতে চুলকোতে বলবে, আর দুটি বচ্ছর কাম করলেই সব সুরাহা হয়ে যাবে। দু পয়সা না নিয়ে নাতি-নাতনিদের ঘাড়ে চাপতে লজ্জা করে।

একদম বাজে কথা। বুড়ো জাহাজের কামে ঢোকে যখন তার বয়স আঠারো। আজ সে সত্তর। এই বাহান্ন বৎসর ধরে সে দেশে টাকা পাঠিয়েছে ভালো করে ঘর-বাড়ি বানাবার জন্য, জমি-জমা কেনার জন্য। এখন তার পরিবারের এত সচ্ছল অবস্থা যে রা জমিদারকে পর্যন্ত টাকা ধার দেয়। আর বুড়ো বলে কি না ব্যাটা-ভাইপো নাতি-নাতনি তাকে দু-মুঠো অন্ন খেতে দেবে না!

সমুদ্রের প্রতি কোনও কোনও জাহাজ-কাপ্তেনের এত মায়া যে বুড়ো বয়সে তারা বাড়ি বানায় ঠিক সমুদ্রের পাড়ে, এবং বাড়িটার ঢপও কিম্ভুতকিমাকার! দেখতে আদপেই বাড়ির মতো নয়, একদম হুবহু জাহাজের মতো অবশ্য মাটির সঙ্গে যোগ রেখে যতখানি সম্ভব। আর তারই চিলেকোঠায় সাজিয়ে রাখে, কম্পাস, দুরবিন, ম্যাপ, জাহাজের স্টিয়ারিং হুইল এবং জাহাজ চালাবার অন্যান্য যাবতীয় সরঞ্জাম। বাড়ির আর কাউকে বুড়ো সেখানে ঢুকতে দেয় না– ইউনিফর্ম পরা না থাকলে জাহাজের ও জায়গায় তো কাউকে যেতে দেওয়া হয় না– এবং সে সেখানে পাইপটা কামড়ে ধরে সমস্ত দিন বিড়বিড় করে খালাসিদের বকাঝকা করে। ঝড়বৃষ্টি হলে তো কথাই নেই। তখন সে একাই একশো। জাহাজ বাঁচাবার জন্য সে তখন ক্ষেপে গিয়ে ব্রিজময় দাবড়ে বেড়ায়, টেলিফোনে চিৎকার করে এঞ্জিন-ঘরকে হুকুম হাঁকে, আরও জলদি, পুরো স্পিডে, কখনও-বা বরষাতিটা গায়ে চাপিয়ে ব্রিজ খুলে ডেকের তদারকি করে ভিজে কাঁই হয়ে ফের ব্রিজে ঢুকবে। ঝড় না থামা পর্যন্ত তার দম ফেলার ফুরসত নেই, ঘুমুতে যাবার তো কথাই ওঠে না। ঝড় থামলে হাঁফ ছেড়ে বলবে, ওহ্, কী বাচনটাই না বেঁচে গিয়েছি। আমি না থাকলে সব ব্যাটা আজ ডুবে মরত। আজকালকার ছোঁড়ারা জাহাজ চালাবার কিস্-সু-টি জানে না। তার পর টেবিলে বসে আঁকাবাঁকা অক্ষরে জাহাজের ক্রুদের ধন্যবাদ জানাবে, তারা যে তার হুকুম তামিল করে জাহাজ বাঁচাতে পেরেছে তার জন্য। তার পর ঝড়ের ধাক্কায় জাহাজ যে কোথায় ছিটকে পড়েছে তার বেয়ারিঙ নেবে বিস্তর ল্যাটিটুড-লঙিটুড কষে এবং শেষটায় হাঁটু গেড়ে ভগবানকে ধন্যবাদ জানিয়ে পরম পরিতৃপ্তি সহকারে হাই তুলতে তুলতে আপন কেবিনে শুতে যাবে।

তিন দিন পরে গুম গুম করে জাহাজ থেকে নেমে সে পাড়ার আড্ডায় যাবে গল্প করতে– জাহাজ বন্দরে এসে ভিড়েছে কি-না! সেখানে সেই মারাত্মক ঝড়ের একটা ভয়ঙ্কর বর্ণনা দিয়ে শেষটায় পাইপ কামড়াতে কামড়াতে বলবে, আর না, এই আমার শেষ সফর। বুড়ো হাড়ে আর জলঝড় সয় না। সবাই হা-হা করে বলবে, সে কী, কাপ্তেন, আপনার আর তেমন কী বয়স হল? কাপ্তেনও হেঁ-হেঁ করে মহাখুশি হয়ে জাহাজে ফিরবে।

আমি আরও দুই শ্রেণির লোককে চিনি যারা কিছুতেই বাসা বাঁধতে চায় না।

দেশ-বিদেশে আমি বিস্তর বেদে দেখেছি। এরা আজ এখানে, কাল ওখানে, পরশু আরও দূরে, অন্য কোথাও। কখন কোন্ জায়গায় কোন্ মেলা শুরু হবে, কখন শেষ হবে, সব তাদের জানা। মেলায় মেলায় গিয়ে কেনাকাটা করবে, নাচ দেখাবে, গান শোনাবে, হাত গুনবে, কিন্তু কোথাও স্থির হয়ে বেশিদিন থাকবে না। গ্রীষ্মের খরদাহ, বর্ষার অবিরল বৃষ্টি সব মাথায় করে চলেছে তো চলেছে, কিসের নেশায় কেউ বলতে পারে না। বাচ্চাদের লেখাপড়া শেখাবার চাড় নেই, তাদের অসুখ-বিসুখ করলে ডাক্তার-বদ্যিরও তোয়াক্কা করে না। যা হবার হোক, বাসা তারা কিছুতেই বাধবে না। বাড়ির মায়া কী তারা কখনও জানেনি; কোনওদিন জানবেও না।

ইংলন্ড দুশো বছর ধরে চেষ্টা করে আসছে এদের কোনও জায়গায় পাকাপাকিভাবে বসিয়ে দিতে। টাকা-পয়সা দিয়েছে, কিন্তু না, না, না, এরা কিছুতেই কোনও জায়গায় কেনা গোলাম হয়ে থাকতে চায় না। ইংলন্ড যে এখনও তার দেশে প্রাথমিক শিক্ষার হার শতকরা পুরো একশো করতে পারেনি তার প্রধান কারণ এই বেদেরা। এরা তো আর কোনও জায়গায় বেশিদিন টিকে থাকে না যে এদের বাচ্চারা ইস্কুলে যাবে! শেষটায় ইংরেজ এদের জন্য ভ্রাম্যমাণ পাঠশালা খুলেছে, অর্থাৎ পাঠশালার মাস্টার শেলেট, পেন্সিল নিয়ে ভবঘুরে হয়ে তাদের পিছন পিছন তাড়া লাগাচ্ছে, কিন্তু কা কস্য পরিবেদনা, তারা যেমন ছিল তেমনি আছে।

খোলামেলার সন্তান এরা– গণ্ডির ভিতর বন্ধ হতে চায় না।

কিন্তু এদের সবাইকে হার মানায় কারা জানো?

 রবীন্দ্রনাথ যাদের সম্বন্ধে বলেছেন,

ইহার চেয়ে হতেম যদি আরব বেদুইন
চরণতলে বিশাল মরু দিগন্তে বিলীন।

এই যে আরবসাগর পাড়ি দিয়ে আদন বন্দরের দিকে যাচ্ছি এরা সেই দেশের লোক। সৃষ্টির আদিম প্রভাত থেকে এরা আরবের এই মরুভূমিতে ঘোরাঘুরি করছে। এরা এদিক-ওদিক যেতে যেতে কখনও ইরানের সজল উপত্যকার কাছে এসে পৌঁছেছে, কখনও লেবাননের ঘন বনমর্মরধ্বনিও শুনতে পেয়েছে কিন্তু এসব জায়গায় নিশ্চিন্ত মনে বসবাস করার কণামাত্র লোভ এদের কখনও হয়নি। বরঞ্চ মরুভূমির এক মরূদ্যান থেকে আরেক মরূদ্যানে যাবার পথে সমস্ত ক্যারাভান (দল) জলের অভাবে মারা গেল– এ বীভৎস সত্য তাদের কাছে অজানা নয়, তবু তারা ওই পথ ধরেই চলবে, কোনও জায়গায় স্থায়ী বসবাসের প্রস্তাব তাদের মাথায় বজ্রাঘাতের ন্যায়।

জানি, এককালে আরব দেশ বড় গরিব ছিল, কৃত্রিম উপায়ে জলের ব্যবস্থা করতে পারত না বলে সেখানে চাষ-আবাদের কোনও প্রশ্নই উঠত না। কিন্তু হালে নদ-হিজ্জাজের রাজা ইবনে সউদ পেট্রল বিক্রি করে মার্কিনদের কাছ থেকে এত কোটি কোটি ডলার পেয়েছেন যে সে কড়ি কী করে খরচা করবেন তার কোনও উপায়ই খুঁজে পাচ্ছেন না। শেষটায় মেলা যন্ত্রপাতি কিনে তিনি বিস্তর জায়গায় জল সেঁচে সেগুলোকে খেত-খামারের জন্য তৈরি করে বেদুইনদের বললেন, তারা যেন মরুভূমির প্রাণঘাতী যাযাবরবৃত্তি ছেড়ে দিয়ে এসব জায়গায় বাড়িঘর বাঁধে।

কার গোয়াল, কে দেয় ধুনো!

সেসব জায়গায় এখন তালগাছের মতো উঁচু আগাছা গজাচ্ছে।

বেদুইন তার উট-খচ্চর, গাধা-ঘোড়া নিয়ে আগের মতোই এখানে-ওখানে ঘুরে বেড়ায়। উটের লোমের তাবুর ভিতর রাত্রিবাস করে। তৃষ্ণায় যখন প্রাণ কণ্ঠাগত হয় তখন তার প্রিয় উটের কণ্ঠ কেটে তারই ভিতরকার জমানো জল খায়। শেষটায় জলের অভাবে গাধা-খচ্চর, বউ-বাচ্চাসহ গুষ্ঠীসুদ্ধ মারা যায়।

তবু পা-জমিয়ে কোথাও নীড় বানাবে না।

এইসব তত্ত্বচিন্তায় মশগুল হয়েছিলুম এমন সময় হুশ করে আরেকখানা জেলেনৌকা পাশ দিয়ে চলে গেল। দেখি, ক্যাম্বিসের ছইয়ের নিচে লোহার উনুন জ্বেলে বুড়ো রান্না চাপিয়েছে। কল্পনা কি না বলতে পারব না, মনে হল ফোড়নের গন্ধ যেন নাকে এসে পৌঁছল। কল্পনা হোক আর যাই হোক, তত্ত্বচিন্তা লোপ পেয়ে তদ্দণ্ডেই ক্ষুধার উদ্রেক হল।

ওদিকে কবে শেষ ব্যাচের শেষ ডিনার খাওয়া হয়ে গিয়েছে।

প্রাকৃতিক সৌন্দর্য নিরীক্ষণ, তত্ত্বচিন্তায় মনোবীক্ষণ বিলক্ষণ সুখনীয় প্রচেষ্টা কিন্তু ভক্ষণ-ভিত্তিম উপেক্ষা করা সর্বাংশে অর্বাচীনের লক্ষণ!

তবু দেখি, যদি কিছু জোটে, না হলে পেটে কিল মেরে শুয়ে পড়ব আর কি।

দশ পা যেতে না যেতেই দেখি আমার দুই তরুণ বন্ধু পল আর পার্সি রামি খেলছে। আমাকে দেখে একসঙ্গে দাঁড়িয়ে উঠে বললে, গুড ইভনিং, স্যার!

আমি বললুম, হ্যালো, অর্থাৎ এই যে।

তার পর ঈষৎ অভিমানের সুরে বললুম, আমাকে একলা ফেলে তাস খেলছ যে বড়! জানো, তাস ব্যাসন-বিশেষ, তাসে অযথা কালক্ষয় হয়, গুণীরা বলেন–

ওরা বাধা দিচ্ছে না বলে আমাকেই থামতে হল।

পার্সি বললে, যথার্থ বলেছেন, স্যার।

পল বললে, হক কথা। কিন্তু স্যার, আমরা তো এতক্ষণ আপনার ডিনার যোগাড় করে কেবিনে গুছিয়ে রাখাতে

আমি বললুম, সে কী হে?

পার্সি বললে, আজ্ঞে। যখন দেখলুম, আপনি ডিনারের ঘণ্টা শুনেও উঠলেন না, তখনই আমরা ব্যবস্থাটা করে ফেললুম।

সোনার চাঁদ ছেলেরা। ইচ্ছে হচ্ছিল দু জনকে দু-বগলে নিয়ে উল্লাসে নাগা-নৃত্য জুড়ে দিই। কিন্তু বয়সে কম হলে হবে কী, ওজনের দিক দিয়ে ওরা আমার চেয়ে ঢের বেশি ভারিক্তি মুরুব্বি। বাসনাটা তাই বিকাশ লাভ করল না। বললুম, তবে চল ব্রাদার্স, কেবিনে।

০২.

গড্ডলিকা-প্রবাহে অর্থাৎ ভিড়ের সঙ্গে মানুষ গা ভাসিয়ে দেয় কেন? তাতে সুবিধে এই; আর পাঁচজনের যা গতি, তোমারও তাই হবে। এবং সেহেতু সংসারের আর পাঁচজন হেসে-খেলে বেঁচে আছে, অতএব তুমিও দিব্য তাদেরই মতো সুখে-দুঃখে বেঁচে থাকবে।

আর যদি গড্ডলিকায় না মিশে একলা পথে চল তবে যেমন হঠাৎ গুপ্তধনের সন্ধান পেয়ে যেতে পার ঠিক তেমনি মোড় ফিরতেই আচমকা হয়তো দেখতে পাবে, ব্যাঘ্রাচার্য বৃহল্লাঙ্গুল থাবা পেতে সামনে বসে ন্যাজ আছড়াচ্ছেন!

গুপ্তধনটা একা পেয়েছিলে বলে সেটা যেমন তোমার একারই, ঠিক তেমনি বাঘের মোকাবেলা করতে হবে তোমাকে একাই।

তাই বেশিরভাগ লোক সর্বনাশা ক্ষতির ভয়ে অত্যধিক লাভের লোভ না করে গড্ডলিকার সঙ্গে মিশে যায়।

জাহাজেও তাই। তুমি যদি আর পাঁচজনের সঙ্গে ঘুম থেকে জাগো তবে সেই ভিড়ে তুমি ঝটপট তোমার বেড-টির কাপটি পাবে না। আর যদি খুব সকাল সকাল কিংবা আর সকলের চেয়ে দেরিতে ওঠ তবে চা-টি পেয়ে যাবে তনুহর্তেই, কিন্তু আবার কোনও দিন দেখবে, তখনও আগুন জ্বালা হয়নি বলে চায়ের অনেক দেরি, কিংবা এত দেরিতে উঠেছ যে, বেড-টির পাট উঠে গিয়ে তখন ব্রেক ফাস্ট আরম্ভ হয়ে গিয়েছে বলে তোমার বেড-টি হয় মাঠে, অর্থাৎ দরিয়ায় মারা গিয়েছে।

ইংরিজিতে একেই বলে, নো রিসক, নো গেন অর্থাৎ একটুখানি ঝুঁকি যদি নিতে রাজি না হও তবে লাভও হবে না। লটারি জিততে হলে অন্তত একটা টিকিট কেনার রিস্ক নিতে হয়।

সেদিন ঝুঁকিটা নিয়ে সুবিধে হল না। চা-টা মিস্ করে বিরসবদনে ডেকে এসে বসলুম।

 এক মিনিটের ভিতর পল আর পার্সির উদয়।

পল ফিসফিস করে কানে কানে বলল, নতুন সব বার্ডিদের ( অর্থাৎ চিড়িয়াদের) দেখেছেন, স্যার?

এরা সব নবাগত যাত্রী। কলম্বোয় জাহাজ ধরেছে। বেচারীরা এদিক-ওদিক ঘুরে বেড়াচ্ছে, ডেকে চেয়ার পাতবার ভালো জায়গার সন্ধানে। কিন্তু পাবে কোথায়? আমরা যে আগে-ভাগেই সব জায়গা দখল করে আসন-জমিন জমিয়ে বসে আছি– মাদ্রাজ থেকে।

এ তো দুনিয়ার সর্বত্র হামেশাই হচ্ছে। মিটিঙে, ফুটবলের মাঠে সর্বদাই আগে গিয়ে ভালো জায়গা দখল করার চেষ্টা সবাই করে থাকে। এমনকি রান্নাঘরের দাওয়ায় বসি ঠিক দরজাটির কাছে। মা রান্নাঘর থেকে খাবার নিয়ে বেরিয়েই সক্কলের পয়লা দেবে আমাকে।

ভালো জায়গায় বসতে পারাতে দুটো সুখ। একটা ভালো জায়গা পেয়েছ বলে এবং দ্বিতীয়টা তার চেয়েও বড়। বেশ আরাম করে বসে চিনেবাদাম খেতে খেতে অলস নিরাসক্তভাবে তাকিয়ে দেখতে, অন্যেরা ফ্যা ফ্যা করে কীভাবে ভালো জায়গার সন্ধানে ঘুরে মরছে। পরিচিত এবং অপ্রিয় লোক হলে তো কথাই নেই। এই যে ভড় মশাই, জায়গা পাচ্ছেন না বুঝি? বলে ফিক করে একটুখানি সদুপদেশ বিতরণ করবে, কেন, ওই দিকে তো মেলা জায়গা রয়েছে, বলে হাতখানা মাথার উপর তুলে চতুর্দিকে ঘুরিয়ে দেবে। তার থেকে কেউই বুঝতে পারবে না, কোনদিকে জায়গা খালি। লোকটা দৃষ্টি দিয়ে বিষবৃষ্টি নিক্ষেপ করে গজরাতে গজরাতে তোমার দৃষ্টির আড়াল হবে!

আহ্! এ সংসারে ভগবান তার অসীম করুণায় আমাদের জন্যে কত আনন্দই না রেখেছেন। কে বলে সংসার মায়াময় অনিত্য? সে বোধহয় ফুটবলের মাঠে কখনও ভালো সিট পায়নি।

আমি পল-পার্সিকে জিগ্যেস করলুম, অদ্যকার প্রোগ্রাম কী?

পল বললে, প্রথমত, জিমনাসটিক-হলে গমন।

 সেখানকার কর্মতালিকা কী?

একটুখানি রোইং করব।

রোইং সেখানে কি নৌকো, বৈঠে, জল আছে?

সব আছে, শুধু জল নেই।

?

বৈঠেগুলোর সঙ্গে এমনভাবে স্প্রিং লাগানো আছে যে জল থাকলে বৈঠাকে যতখানি বাধা দিত স্প্রিং ঠিক ততখানি দেয়। কাজেই শুকনোয় বসে বৈঠে চালানোর প্র্যাকটিস আর পরিশ্রম দুই-ই হয়।

আমি বললুম, উঁহু। আমার মন সাড়া দিচ্ছে না। আমাদের দেশে আমরা বৈঠা মারি দু হাত দিয়ে তুলে ধরে। তোমার কায়দাটা রপ্ত করে আমার কোনও লাভ হবে না।

পল বললে, তা হলে প্যারালেল বার, ডামবেল কিছু একটা?

 উঁহু।

পার্সি বললে, তা হলে পলে-আমাতে বকসিং লড়ব। আপনি রেফারি হবেন।

 আমি তো ওর তত্ত্ব কিছুই জানিনে।

 আমরা শিখিয়ে দেব।

উঁহু।

পল তখন ধীরে ধীরে বলল, আসলে আপনি কোনওরকম নড়াচড়া করতে চান না। একসেরসাইজের কথা না হয় রইল কিন্তু আর সবাই তো সকাল-বিকেল জাহাজটাকে কয়েকবার প্রদক্ষিণ দেয় শরীরটাকে ঠিক রাখবার জন্য। আপনি তো তা-ও করেন না। কেন বলুন তো?

আমি বললুম, আরেকদিন হবে। উপস্থিত অদ্যকার অন্য কর্মসূচি কী?

পার্সি বললে, আজ এগারোটায় লাউঞ্জে চেম্বার মুজিক। তাই না হয় শোনা যাবে।

পল আপত্তি জানাল। বললে, যে লোকটা বেহালা বাজায় তার বাজনা শুনে মনে হয়, দুটো হুলো বেড়ালে মারামারি লাগিয়েছে।

পার্সি বললে, ওই তো পলের দোষ। বড় পিটপিটে। আরে বাপু, যাচ্ছিস তো সস্তা ফরাসি মেসাজেরি মারিতি জাহাজে আর আশা করছিস, ক্রাইজ্বলার এসে তোর কেবিনের জানালার কাছে চাঁদের আলোতে বেহালা দিয়ে সেরেনেড বাজাবেন!

আমি বললুম, আমাদের দেশে এক বুড়ি কিনে আনল এক পয়সার তেল। পরে দেখে তাতে একটা মরা মাছি। দোকানিকে ফেরত দিতে গিয়ে বললে, তেলে মরা মাছি। দোকানি বললে, এক পয়সার তেলে কী তুমি একটা মরা হাতি আশা করেছিলে?

পার্সি বলল, এইবার আপনাকে বাগে পেয়েছি, স্যার! আপনি যে গল্পটি বললেন তার যে বিলিতি মুদ্রণটি আমি জানি সে এর চেয়ে সরেস।

আমি চোখ বন্ধ করে বললুম, কীর্তন কর।

পার্সি বললে, এই আমাদের পলেরই মতো এক পিটপিটে মেমসায়েব গিয়েছেন মোজা কিনতে। কোনও মোজাই তার পছন্দ হয় না। শেষটায় সবচেয়ে সস্তায় এক শিলিঙে তিনি একজোড়া মোজা কিনলেন। দোকানি যখন মোজা প্যাক করছে তখন তার চোখে পড়ল মোজাতে অতি ছোট্ট একটি ল্যাডার

আমি শুধোলুম, ল্যাডার মানে কী? ল্যাডার মানে তো মই।

আজ্ঞে, মোজার একগাছা টানার সুতো যদি ছিঁড়ে যায় তবে ওই জাগায় শুধু পড়েনগুলো একটার উপর একটা এমনভাবে থাকে যেন মনে হয় সিঁড়ি কিংবা মই। তাই ওটাকে তখন ল্যাডার বলা হয়।

আমি বললুম, থ্যাঙ্কিউ; শেখা হল। তার পর কী হল?

মেম বললেন, ও মোজা আমি নেব না, ওতে একটা ল্যাডার রয়েছে।

দোকানি বললে, এক শিলিঙের মোজাতে কি আপনি একটা মার্বেল স্টেয়ারকেস আশা করেছিলেন, ম্যাডাম?।

আমি বললুম, সাবাস, তোমার বলা গল্পটি আমার গার্হস্থ্য সংস্করণের রাজসংস্করণ বলা যেতে পারে। তদুপরি তোমরা তো রাজার জাত।

পার্সি বললে, ও কথাটা নাই-বা তুললেন, স্যার!

আমি আমার চোখ বন্ধ করে বললুম, জাহাজের দুর্বিষহ গতানুগতিক জীবনকে বৈচিত্র্যপূর্ণ করবার জন্য কোম্পানি অদ্য অন্য কী ব্যবস্থা করেছেন?

পার্সি বলল, সঙ্গীতে যখন পলের আপত্তি তখন আমি ভাবছি ওই সময়টায় আমি সেলুনে চুল কাটাতে যাব।

আমি হন্তদন্ত হয়ে বললুম, অমন কর্মটি গলা কেটে ফেললেও করতে যেয়ো না, পার্সি! তোমার চুল কেটে দেবে নিশ্চয়ই কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে তোমার হাজামও করে দেবে।

কথাটা বুঝতে পারলুম না, স্যর!

আমি বললুম, ওটা একটা উর্দু কথার আড়। এর অর্থ, তোমার চুল নিশ্চয়ই কেটে দেবে ভালো করে, কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে মাথাটিও মুড়িয়ে দেবে।

পার্সি আরও সাত হাত জলে। শুধোল, চুল যদি ভালো করে কাটে তবে মাথা মুড়োবে কী করে?

আমি বললুম, তোমার চুল কাটবে শব্দার্থে, কিন্তু মাথা মুড়োবে বার্থে, অর্থাৎ মেটাফরিকেলি। মোদ্দাকথা, তোমার সর্বস্ব লুণ্ঠন করবে। জাহাজে চুল কাটানোর দর্শনী পঞ্চ মুদ্রা।

পল বললে, সে কী স্যর? চীন দেশে তো পাঁচ টাকায় কুড়ি বার চুল কাটানো যায়।

আমি বললুম, ভারতবর্ষেও তাই। এমনকি বিশ্বফ্যাশানের রাজধানী প্যারিসেও চুল কাটাতে পাঁচ টাকা লাগে না। ব্যাপারটা হয়েছে কী, জাহাজের ফার্স্টক্লাসে যাচ্ছেন পয়সাওয়ালা বড়লোকেরা। তারা পাঁচ টাকার কমে চুল কাটান না। কাজেই রেট বেঁধে দেওয়া হয়েছে পাঁচ টাকা। আমাদের কথা বাদ দাও, এখন যদি কোনও ডেকপ্যাসেঞ্জারও চুল কাটাতে যায় তবে তাকেও দিতে হবে পাঁচ টাকা।

তা হলে উপায়? একমাথা চুল নিয়ে লন্ডনে নামলে পিসিমা কী ভাববেন? তার ওপর পিসিমাকে দেখব জীবনে এই প্রথম, পিসিমার কথা উঠলে বাবা-মা যেভাবে সমীহ করে কথা বলেন তার থেকে মনে হয় তিনি খুব সোজা মহিলা নন। তা হলে পাঁচটা টাকা দরিয়ার জলে ভেসে গেল আর কি, একদম শব্দার্থে।

আমি বললুম, আদপেই না। জিবুটি বন্দরে চুল কাটাবে। বিবেচনা করি, সেখানে চুল কাটাতে এক শিলিংয়েরও কম লাগবে।

পল বললে, আমরা যখন বন্দরে রোদ লাগাব তখন পার্সিটা একটা ঘিঞ্জি সেলুনে বসে চুল কাটাবে। তা হলে তার উপযুক্ত শিক্ষা হয়।

পার্সি আমার দিকে করুণ নয়নে তাকাল।

আমি বললুম, তা কেন? বন্দর দেখার পর তোমাতে-আমাতে যখন কাফেতে বসে কফি খাব তখন পার্সি চুল কাটাবে। চাই কি, হয়তো সেলুনের বারান্দায় বসেই কফি খেতে খেতে পার্সিকে আমাদের মহামূল্যবান সঙ্গসুখ দেব, অমূল্য উপদেশ বিতরণ করব।

পার্সি চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে আমাকে বাও করে বললে, এ যাত্রায় আপনার সঙ্গে পরিচয় না হলে, স্যর, আমাদের যে কী হত–

আমি বাধা দিয়ে বললুম, কিছুই হত না। আমার সঙ্গে বজর বজর না করে এদিক-ওদিক ঘোরাঘুরি করতে, পাঁচরকমের ছেলে-ছোকরাদের সঙ্গে আলাপচারি হত। অনেক দেখতে, অনেক শুনতে।

দু জনাই সঙ্গে সঙ্গে কেটে পড়ল!

আমি আরব সাগরের আবহাওয়া সম্বন্ধে একখানা বিরাট কেতাব নিয়ে পড়তে লেগে গেলুম।

.

০৩.

আরবের তুলনায় বাঙালি যে অতিশয় নিরীহ সে বিষয়ে কারও মনে কোনও সন্দেহ থাকার কথা নয় কিন্তু আরব সাগর, সাগর হয়েও বঙ্গোপসাগরের উপসাগরের চেয়ে অনেক বেশি শান্ত এবং ঠাণ্ডা। মাদ্রাজ থেকে কলম্বো পর্যন্ত অধিকাংশ যাত্রী সি-সিকনেসে বেশ কাবু হয়ে থাকার পর এখানে তারা বেশ চাঙা হয়ে উঠেছেন। উত্তর-পূর্ব দিকে মৃদু-মন্দ মৌসুমি হাওয়া বইছে তখনও– এই হাওয়ায় পাল তুলে দিয়েই ভাস্কো দা গামা আফ্রিকা থেকে ভারতে পৌঁছতে পেরেছিলেন। কিন্তু এই সময়ে ওই হাওয়া ভারতের দিকে বয় সে আবিষ্কার গামার নয়। আরবরা এ হাওয়ার গতিবিধি সম্বন্ধে বিলক্ষণ ওকিবহাল ছিল এবং বিশেষ ঋতুতে (মৌসুমে এ হাওয়া বয় বলে এর নাম দিয়েছিল মৌসুমি হাওয়া। ইংরেজি শব্দ মনসুন এবং বাঙলা মরশুম এই মৌসুম শব্দ থেকে এসেছে। কিন্তু মৌসুমি হাওয়ার খানিকটা সন্ধান পাওয়ার পরও গামা একা সাহস করে আরবসাগর পাড়ি দিতে পারেননি। আফ্রিকা থেকে একজন আরবকে জোর করে জাহাজে পাইলট রূপে এনেছিলেন।

রোমানরাও নিশ্চয়ই এ হাওয়ার খবর কিছুটা রাখত। না হলে আরবদের বহু পূর্বে দক্ষিণ ভারতের সঙ্গে তারা এতখানি ব্যবসা-বাণিজ্য করল কী করে? এখনও দক্ষিণ ভারতের বহু জায়গায় মাটির তলা থেকে রোমান মুদ্রা বেরোয়।

তারও পূর্বে গ্রিক, ফিনিশিয়ানরা এ হাওয়ার খবর কতখানি রাখত আমার বিদ্যে অতদূর পৌঁছয়নি। তোমরা যদি কেতাবপত্র ঘেঁটে আমাকে খবরটা জানাও তবে বড় খুশি হই।

এই হাওয়াটাকেই ট্যারচা কেটে কেটে আমাদের জাহাজ এগোচ্ছে। এ হাওয়া যতক্ষণ মোলায়েমভাবে চলে ততক্ষণ কোনও ভাবনা নেই। জাহাজ অল্প-স্বল্প দোলে বটে তবু উল্টোদিক থেকে বইছে বলে গরমে বেগুন-পোড়া হতে হয় না। কিন্তু ইনি রুদ্রমূর্তি ধরলেই জাহাজময় পরিত্রাহি চিৎকার উঠবে। এবং বছরের এ সময়টা তিনি যে মাসে অন্তত দু তিনবার জাহাজগুলোকে লণ্ডভণ্ড করে দেবার জন্য উঠে-পড়ে লেগে যান সে সুখবরটা আবহাওয়ার বইখানাতে একাধিকবার উল্লেখ করা হয়েছে।

আবহাওয়ার বিজ্ঞান ঝড় ওঠবার পূর্বাভাস খানিকটা দিতে পারে বটে কিন্তু আরব সাগরের মাঝখানে যে ঝড় উঠল সে যে তার পর কোনদিকে ধাওয়া করবে সে সম্বন্ধে আগে-ভাগে কোনওকিছু বলে দেওয়া প্রায় অসম্ভব।

তাই সে ঝড় যদি পূর্ব দিকে ধাওয়া করে তবে ভারতের বিপদ, বোম্বাই, কারওয়ার, তিরু অনন্তপুরম, (শ্রী অনন্তপুর, ট্রিভাণ্ডএম) অঞ্চল লণ্ডভণ্ড করে দেবে। যদি উত্তর দিকে যায় তবে পার্শিয়ান গালফু এবং আরব উপকূলের বিপদ আর যদি পশ্চিম পানে আক্রমণ করে তবে আদন বন্দর এবং আফ্রিকার সোমালিদের প্রাণ যায় যায়।

একবার নাকি এইরকম একটা ঝড়ের পর সোমালিদের ওবোক শহরে মাত্র একখানা বাড়ি খাড়া ছিল। সে ঝড়ে শহরের সব বাড়ি পড়ে যায়, তার সঙ্গে যদি মাঝদরিয়ায় আমাদের জাহাজের মোলাকাত হয় তবে অবস্থা কীরকম হবে খানিকটা অনুমান করা যায়।

তবে আমার ব্যক্তিগত দৃঢ় বিশ্বাস, এরকম ঝড়ের সঙ্গে মানুষের একবারের বেশি দেখা হয় না। প্রথম ধাক্কাতেই পাতালপ্রাপ্তি!

পাতালপ্রাপ্তি কথাটা কী ঠিক হল? কোথায় যেন পড়েছি, জাহাজ ডুবে গেলে পাতাল অবধি নাকি পৌঁছয় না। খানিকটে নাবার পর ভারী জল ছিন্ন করে জাহাজ নাকি আর তলার দিকে যেতে পারে না। তখন সে ত্রিশঙ্কুর মতো ওইখানেই ভাসতে থাকে।

ভাবতে কীরকম অদ্ভুত লাগে! সমুদ্রের এক বিশেষ স্তরে তা হলে যতসব জাহাজ ডোবে তারা যতদিন না জরাজীর্ণ হয়ে টুকরো টুকরো হয়ে যায় ততদিন শুধু যোরাফেরাই করবে!

জলে যা, হাওয়াতেও বোধ করি তাই। বেলুন-টেলুন জোরদার করে ছাড়তে পারলে বোধহয় উড়তে উড়তে তারা এক বিশেষ স্তরে পৌঁছলে ওইখানেই ঝুলতে থাকবে না পারবে নিচের দিকে নামতে, না পারবে উপরের দিকে যেতে। তারই অবস্থা কল্পনা করে বোধহয় মুনি-ঋষিরা ত্রিশঙ্কুর স্বর্গ-মর্তের মাঝখানে ঝুলে থাকার কথা কল্পনা করেছিলেন।

আমাকে অবশ্য কখনও কোনও জায়গায় ঝুলে থাকতে হবে না। দ্বিপ্রহরে এবং সন্ধ্যায় যা গুরুভোজন করে থাকি তার ফলে ডুবলে পাথরবাটির মতো তরতর করে একদম নাক বরাবর পাতালে পৌঁছে যাব। আহারাদির পর আমার যা ওজন হয় সে গুরুভার সমুদ্রের যে কোনও নোনাজলকে অনায়াসে ছিন্ন করতে পারে। আমার ভাবনা শুধু আমার মুণ্ডুটাকে নিয়ে। মগজ সেটাতে এক রত্তিও নেই বলে সেটা এমনি ফাপা যে, কখন যে ধড়টি ছেড়ে হুশ করে চন্দ্র-সূর্যের পানে ধাওয়া করবে তার কিছু ঠিক-ঠিকানা নেই। হাজারো লোকের ভিড়ের মধ্যে যদি আমাকে শনাক্ত করতে চাও তবে শুধু লক্ষ কোরো কোন লোকটা দু হাত দিয়ে মাথা চেপে ধরে নড়াচড়া করছে।

অনেকক্ষণ ধরে লক্ষ করছিলুম আমার সখা এবং সতীর্থ– একই তীর্থে যখন যাচ্ছি তখন সতীর্থ বলাতে কারও কোনও আপত্তি থাকার কথা নয়– শ্রীমান পল কোথা থেকে একটা টেলিস্কোপ যোগাড় করে একদৃষ্টে দক্ষিণ পানে তাকিয়ে আছে। ভাবলুম, ওই দিক দিয়ে বোধহয় কোনও জাহাজ যাচ্ছে আর সে তার নামটা পড়ার চেষ্টা করছে।

আমাকে দাঁড়াতে দেখে কাছে এসে বললে, ওই দূরে যেন ল্যান্ড দেখা যাচ্ছে।

 আমি বললুম, ল্যান্ড নয়, আইল্যান্ড। ওটা বোধহয় মালদ্বীপপুঞ্জের কোনও একটা হবে।

পল বললে, কই, ওগুলোর নাম তো কখনও শুনিনি!

আমি বললুম, শুনবে কী করে? এই জাহাজে যে এত লোক, এঁদের সব্বাইকে জিগ্যেস কর ওঁদের কেউ মালদ্বীপ গিয়েছেন কি না? অদূরেই-বা কেন? শুধু জিগ্যেস কর, মালদ্বীপবাসী কারও সঙ্গে কখনও ওঁদের দেখা হয়েছে কি না? তাই মালদ্বীপ নিয়ে এ বিশ্বভুবনের কারও কোনও কৌতূহল নেই।

আপনি জানলেন কী করে?

শুনেছি, মালদ্বীপের লোকেরা খুব ধর্মভীরু হয়। এক মালদ্বীপবাসীর তাই ইচ্ছে হয়, তার ছেলেকে মুসলিম শাস্ত্র শেখাবার। মালদ্বীপে তার কোনও ব্যবস্থা নেই বলে তিনি ছেলেকে কাইরোর আজহর বিশ্ববিদ্যালয়ে পাঠান;- ওইটেই ইসলামি শাস্ত্র শেখার জন্য পৃথিবীর সবচেয়ে সেরা বিশ্ববিদ্যালয়। ছেলেটির সঙ্গে আমার আলাপ হয় ওইখানে। বহুবার দেখা হয়েছিল বলে সে আমাকে তার দেশ সম্বন্ধে অনেককিছুই বলেছিল, তবে সে অনেক কাল হল বলে আজ আর বিশেষ কিছু মনে নেই।

ওখানে নাকি সবসুদ্ধ হাজার দুই ছোট ছোট দ্বীপ আছে এবং তার অনেকগুলোতেই খাবার জল নেই বলে কোনও প্রকারের বসতি নেই। মালদ্বীপের ছেলেটি আমায় বলেছিল, আপনি যদি এরকম দশ-বিশটা দ্বীপ নিয়ে বলেন, এগুলো আপনার, আপনি এদের রাজা, তা হলে আমরা তাতে কণামাত্র আপত্তি জানাব না। অন্যগুলোতেও বিশেষ কিছু ফলে না, সবচেয়ে বড় দ্বীপটার দৈর্ঘ্য নাকি মাত্র দু মাইল। মালদ্বীপের সুলতান সেখানে থাকেন এবং তার নাকি ছোট্ট একখানা মটরগাড়ি আছে। তবে যেখানে সবচেয়ে লম্বা রাস্তার দৈর্ঘ্য মাত্র দু মাইল সেখানে ওটা চালিয়ে তিনি কী সুখ পান তা তিনিই বলতে পারবেন।

মালদ্বীপে আছে প্রচুর নারকেলগাছ আর দ্বীপের চতুর্দিকে জাত-বেজাতের মাছ কিলবিল করছে। মাছের শুঁটকি আর নারকেলে নৌকো ভর্তি করে পাল তুলে দিয়ে তারা রওনা হয় সিংহলের দিকে মৌসুমি হাওয়া বইতে আরম্ভ করলেই। হাওয়া তখন মালদ্বীপ থেকে সিংহলের দিকে বয়। সমস্ত বর্ষাকালটা সিংহলে ওইসব বিক্রি করে এবং বদলে চাল ডাল কাপড় কেরোসিন তেল কেনে। কেনাকাটা শেষ হয়ে যাওয়ার পরও তাদের নাকি সেখানে বহুদিন কাটাতে হয়, কারণ উল্টো হাওয়া বইতে আরম্ভ করবে শীতের শুরুতে। তার আগে তো ফেরার উপায় নেই।

পার্সি বললে, কেন স্যর, এখন তো শীতকাল নয়। আমরা তো হাওয়ার উল্টো দিকেই যাচ্ছি।

আমি বললুম, ভ্রাতঃ, আমাদের জাহাজ চলে কলে, হাওয়ার তোয়াক্কা সে করে থোড়াই। মালদ্বীপে কোনও কলের জাহাজ যায় না, খরচায় পোষায় না বলে। তাই আজ পর্যন্ত কোনও টুরিস্ট মালদ্বীপ যায়নি।

তাই মালদ্বীপের ছোকরাটি আমায় বলেছিল, আমাদের ভাষাতে অতিথি শব্দটার কোনও প্রতিশব্দ নেই। তার কারণ বহুশত বৎসর ধরে আমাদের দেশে ভিনদেশি লোক আসেননি। আমরা এক দ্বীপ থেকে অন্য দ্বীপে যা অল্পস্বল্প যাওয়া-আসা করি তা এতই কাছাকাছির ব্যাপার যে কাউকে অন্যের বাড়িতে রাত্রিযাপন করতে হয় না। তার পর আমায় বলেছিল, আপনার নেমন্তন্ন রইল মালদ্বীপ ভ্রমণের কিন্তু আমি জানি, আপনি কখনও আসবেন না। যদিস্যাৎ এসে যান তাই আগের থেকেই বলে রাখছি, আপনাকে এর বাড়ি ওর বাড়ি করে করে অন্তত বছর তিনেক সেখানে কাটাতে হবে। খাবেন-দাবেন, নারকেলগাছের তলাতে চাঁদের আলোয় গাওনা-বাজনা শুনবেন, ব্যস, আর কী চাই।

যখন শুনেছিলুম তখন যে যাবার লোভ হয়নি একথা বলব না। ঝাড়া তিনটি বচ্ছর (এবং মালদ্বীপের ছেলেটি আশা দিয়েছিল যে সেখানে যাহা তিন তাহা তিরানব্বই) কিচ্ছুটি করতে হবে না, এবং শুধু তিন বৎসর না, বাকি জীবনটাই কিছু করতে হবে না। একথাটা ভাবলেই যেন চিত্তবনের উপর দিয়ে মর্মর গান তুলে মন্দমিঠে মলয় বাতাস বয়ে যায়। একজামিনের ভাবনা, কেষ্টার কাছে দু-টাকার দেনা, সবকিছু ঝেড়ে ফেলে দিয়ে এক মুহূর্তেই মুক্তি। অহহ!

কী আনন্দ, কী আনন্দ, কী আনন্দ
 দিবা-রাত্রি নাচে মুক্তি, নাচে বন্ধ
সে তরঙ্গে ছুটি রঙ্গে পাছে পাছে
তা তা থৈ থৈ তা তা থৈ থৈ তা তা থৈ থৈ ॥

এসব আত্মচিন্তার সবকিছুই যে পুল-পার্সিকে প্রকাশ করে বলেছিলুম তা নয়, তবে একটা কথা মনে আছে, ওরা যখন উৎসাহিত হয়ে মালদ্বীপে বাকি জীবনটা কাটাবে বলে আমাকে সে খবরটা দিল তখন আমি বলেছিলুম

বাকি জীবন কেন, তিনটি মাসও সেখানে কাটাতে পারবে না। তার কারণ যেখানে কোনও কাজ করার নেই, সেখানে কাজ না করাটাই হয়ে দাঁড়ায় কাজের কাজ। এবং সে ভয়াবহ কাজ। কারণ, অন্য যে কোনও কাজই নাও না কেন, যেমন মনে কর এগজামি– তারও শেষ আছে, বি-এ, এম-এ, পি-এইচ-ডি, তার পর কোনও পরীক্ষা নেই। কিংবা মনে কর উঁচু পাহাড়ে চড়া। পাঁচ হাজার, দশ হাজার, ত্রিশ হাজার ফুট, যাই হোক না কেন তারও একটা সীমা আছে। কিন্তু কাজ নেই– এ হল একটা জিনিস যা নেই, কাজেই তার আরম্ভও নেই শেষও নেই। যে জিনিসের শেষ নেই সে জিনিস শেষ পর্যন্ত সইতে পারা যায় না।

কিংবা অন্যদিক দিয়ে ব্যাপারটাকে দেখতে পার।

আমাদের কবি রবীন্দ্রনাথ বলেছেন, মনে কর একটা ঘর। ঘরে আসল জিনিস দি ইমপর্টেন্ট এলমন্ট হল তার ফাঁকাটা, আমরা তাতে আসবাবপত্র রাখি, খাই-দাই, সেখানে রৌদ্রবৃষ্টি থেকে শরীরটা বাঁচাই। ঘরের দেয়ালগুলো কিন্তু এসব কাজে লাগছে না। অর্থাৎ ইমপর্টেন্ট, হল ফাঁকাটা, নিরেট দেয়ালটা নয়। তাই বলে দেয়ালটা বাদ দিলে চলবে না। দেয়ালহীন ফাঁকা হল ময়দানের ফাঁকা, সেখানে আশ্রয় জোটে না।

তাই গুরুদেব বলেছেন, মানুষের জীবনের অবসরটা হচ্ছে ঘরের ফাঁকাটার মতো, সে-ই দেয় আমাদের প্রবেশের পথ কিন্তু কিছুটা কাজের দেয়াল দিয়ে সেই ফাঁকা অবসরটাকে যদি ঘিরে না রাখো তবে তার থেকে কোনও সুবিধে ওঠাতে পার না। কিন্তু কাজ করবে যতদূর সম্ভব কম। কারণ স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছ, ঘরের মধ্যে ফাঁকাটা দেয়ালের তুলনায় পরিমাণে অনেক বেশি।

তার পর আমি বললাম, কিন্তু ভ্রাতৃদ্বয়, আমার গুরুদেব এই তত্ত্বটি প্রকাশ করেছেন ভারি সুন্দর ভাষায় আর সুমিষ্ট ব্যঞ্জনায়, কিছুটা উস্টার সসের হাস্যকৌতুক মিশিয়ে দিয়ে। আমি তার অনুকরণ করব কী করে?

কিন্তু মূল সিদ্ধান্ত এই মালদ্বীপের একটানা কর্মহীনতার ফাঁকাটা অসহ্য হয়ে দাঁড়াবে, কারণ তার চতুর্দিকে সামান্যতম কাজের দেয়াল নেই বলে।

একটানা এতখানি কথা বলার দরুন ক্লান্ত হয়ে ডেক-চেয়ারে গা এলিয়ে দিলুম।

তখন লক্ষ করলুম, পল ঘন ঘন ঘাড় চুলকোচ্ছে। তার পর হঠাৎ ডান হাতটা মুঠো করে মাথায় ধাই করে শুত্তা মেরে বললে, পেয়েছি, পেয়েছি, এই বারে পেয়েছি।

কী পেয়েছে সেইটে আমি শুধোবার পূর্বেই পার্সি বললে, ওই হচ্ছে পলের ধরন। কোনও একটা কথা স্মরণে আনবার চেষ্টা করার সময় সে ঘন ঘন ঘাড় চুলকোয়। মনে এসে যাওয়া মাত্রই ঠাস করে মাথায় মারবে এক ঘুষি। ক্লাসেও ও তাই করে। আমরা তাই নিয়ে হাসি-ঠাট্টা করে থাকি। এবারে শুনুন, ও কী বলে।

পল বললে, কোনও নতুন কথা নয়, স্যর! তবে আপনার শুরুর তুলনাতে মনে পড়ে গেল আমার শুরু কফুসর (আমার মনে বড় আনন্দ হল যে ইংরেজ ছেলেটা ক-ফু-সকে আমাদের গুরু বলে সম্মান জানাল–ভারতবর্ষের ইংরেজ ছেলে-বুড়ো বন্ধুকে কখনও আমাদের গুরু, বলেনি)–এ বিষয়ে অন্য এক তুলনা। যদি অনুমতি দেন।

আমি বললুম, কী জ্বালা! তোমার এই চীনা লৌকিকতা-ভদ্রতা আমাকে অতিষ্ঠ করে তুললে। কন্-ফু-ৎসর তত্ত্বচিন্তা শুনতে চায় না কোন মর্কট? জানো, ঋষি কন্-ফু-ৎস আমাদের মহাপুরুষ গৌতমবুদ্ধের সমসাময়িক? ওই সময়েই পৃথিবীতে অবতীর্ণ হয়েছিলেন, ইরানে জরথুস্ত্র, গ্রিসে সোক্রাতেস-প্লাতো-আরিস্ততেলেসে, প্যালেস্টাইনে ইহুদিদের ভিতরে– তা থাক গে, তোমার কথা বল।

পল বললে, সরি, সরি। ক-ফু-ৎস বলেছেন, একটি পেয়ালার আসল (ইমপর্টেন্ট) জিনিস কী? তার ফাঁকা জায়গাটা, না তার পর্সেলেনের ভাগটা? ফাঁকা জায়গাটাতেই আমরা রাখি জল, শরবত, চা। কিন্তু পর্সেলেন না থাকলে ফাঁকাটা আদপেই কোনও উপকার করতে পারে না। অতএব কাজের পর্সেলেন দিয়ে অকাজের ফাঁকাটা ঘিরে রাখতে হয়। এবং শুধু তাই নয়, পর্সেলেন যত পাতলা হয়, পেয়ালার কদর ততই বেশি। অর্থাৎ কাজ করবে যতদূর সম্ভব সামান্যতম।

তার পর হঠাৎ দাঁড়িয়ে উঠে আমাকে বাও-টাও করে অর্থাৎ চীনা পদ্ধতিতে আমায় হাঁটু আর মাথা নিচু করে অভিবাদন জানিয়ে বললে

আমি বাধা দিয়ে বললুম, ফের তোমার চীনে সৌজন্য?

বললে, সরি সরি। কিন্তু স্যর, ওই মালদ্বীপের কথা ওঠাতে আর আপনি আপনার গুরুদেবের কথা বলতে আমার কাছে কন্-ফু-ৎসর তত্ত্বচিন্তা আজ সরল হয়ে গেল। ওঁর এ বাণী বহুবার শুনেছি, অনেকবার পড়েছি কিন্তু আজ এই প্রথম

আমি বাধা দিয়ে বললুম, চোপ্।

.

০৪.

কোনও কোনও জাহাজে কী যেন এক রাসায়নিক প্রক্রিয়ায় হাওয়াকে ঠাণ্ডা করে সেইটে জাহাজের সর্বত্র চালিয়ে দেওয়া হয়। মনে হয়, এই রৌদ্র-দগ্ধ, জ্বরতপ্ত বিরাট জাহাজরূপী লৌহদানবকে তার মা যেন ঠাণ্ডা হাত বুলিয়ে বুলিয়ে তার গায়ের জ্বালা জুড়িয়ে দিতে চান। কিন্তু পারেন কতখানি? বরঞ্চ রেলগাড়ি প্ল্যাটফর্মে প্লাটফর্মে ছায়াতে দু-দশ মিনিট ঠাণ্ডা হবার সুযোগ পায়, কিংবা উপত্যকার ভিতর দিয়ে যাওয়ার সময় তার গায়ে এসে পাহাড়ের ছায়া পড়ে, ঘন শালবনের ভিতর দিয়েও গাড়ি কখনও কখনও বনানীর স্নিগ্ধছায়া লাভ করে, এবং সুড়ঙ্গ হলে তো কথাই নেই- সেখানকার ঠাণ্ডা তো রীতিমতো বরফের বাক্সের ভিতরকারের মতো কিন্তু জাহাজের কপালে এসব কিছুই নেই। একে তো দিগ-দিগন্তব্যাপী জ্বলছে রৌদ্রের বিরাট চিতা, তার ওপর সূর্য তার প্রতাপ বাড়িয়ে দিচ্ছেন সমুদ্রের জলের উপর প্রতিফলিত হয়ে। কালো চশমা পরেও তখন সেদিকে তাকানো যায় না। রাত্রে অল্প অল্প ঠাণ্ডা হাওয়া বয় বটে, কিন্তু সে ঠাণ্ডাতে গা জুড়োবার পূর্বেই দেখা দেন পূর্বাকাশে সূয্যি-মাস্টার ফের তাঁর রোদের চাবুক হাতে নিয়ে। ভগবান তাঁকে দিয়েছেন লক্ষ লক্ষ কর, এবং সেই লক্ষ লক্ষ হাতে তিনি নিয়েছেন লক্ষ লক্ষ পাকা কঞ্চির সোনালি রঙের চাবুক। দেখামাত্রই গায়ের সবকটা লোম কাঁটা দিয়ে খাড়া হয়ে দাঁড়ায়।

আমাদের জাহাজে ঠাণ্ডা বাতাস চালানোর ব্যবস্থা ছিল না অর্থাৎ সেটা অ্যারকন্ডিশনড় নয়। কাজেই কি দিনের বেলা কি রাত্রে কখনও ভালো করে ঘুমোবার সুযোগ বঙ্গোপসাগর, আরব সমুদ্র কিংবা লাল দরিয়ায় মানুষ পায় না।

দুপুররাত থেকে হয়তো ঠাণ্ডা হাওয়া বইতে আরম্ভ করল। ডেকে বসে তুমি গা জুড়োলে। কিন্তু তখন যে কেবিনে ঢুকে বিছানা নেবে তার উপায় নেই। সেখানে ওই ঠাণ্ডা হাওয়া যেতে পারে না বলে অসহ্য গুমোট গরম। গড়ের মাঠে ঠাণ্ডা হয়ে ফিরে এসে গলিবাড়িতে ঘুমোবার চেষ্টা করার সঙ্গে এর খানিকটে তুলনা হয়।

ডেকে যে আরাম করে ঘুমোবে তারও উপায় নেই। ঘুমুলে হয়তো রাত দুটোর সময়। চারটে বাজতে না বাজতেই খালাসিরা ডেকে বালতি বালতি জল ঢেলে সেখানে যে বন্যা জাগিয়ে তোলে তার মাঝখানে মাছও ঘুমুতে পারে না। তখন যাবে কোথায়? কেবিনে ঢুকলে মনে হবে যেন রুটি বানানোর তন্দুরে-আভৃনে– তোমাকে রোস্ট করা হবে।

এই অবস্থা চলবে ভূমধ্যসাগর না পৌঁছনো পর্যন্ত।

তবে সান্ত্বনা এইটুকু যে, তোমাদের বয়সী ছেলেমেয়েরা ঠাণ্ডা-গরম সম্বন্ধে আমাদের মতো এতখানি সচেতন নয়। পল-পার্সি তাই যখন কেবিনের ভিতর নাক ফরফরাতো আমি তখন ডেকে বসে আকাশের তারার দিকে তাকিয়ে থাকতুম। তখন বই পড়তে কিংবা দেশে আত্মীয়-স্বজনকে চিঠি লিখতে পর্যন্ত ইচ্ছে করে না।

মাঝে মাঝে ডেক-চেয়ারেই ঘুমিয়ে পড়তুম।

একদিন কেন জানিনে হঠাৎ ঘুম ভাঙতেই সামনে দেখি এক অপরূপ মূর্তি।

ভদ্রলোক কোট-পাতলুন-টাই পড়েছেন ঠিকই কিন্তু সে পাতলুন ঢিলে পাজামার চেয়েও বোধ করি চৌড়া, কোট নেবে এসেছে প্রায় হাঁটু পর্যন্ত আর মান-মুনিয়া দাড়ির তলায় টাইটা আবছা আবছা দেখা যাচ্ছে মাত্র। ওঁর বেশভূষায়—ভুল করলুম, ভূষা জাতীয় কোনও বালাই ওঁর বেশে ছিল না– অনেককিছুই দেখবার মতো ছিল কিন্তু প্রথম দর্শনেই আমি সব-কটা লক্ষ করিনি, পরে ক্রমে ক্রমে লক্ষ করে অনেক কিছুই শিখেছিলুম। উপস্থিত লক্ষ করলুম, তাঁর কোর্টে ব্রেস্ট পকেট বাদ দিয়েও আরও দু সারি ফালতো পকেট। তাই বোধহয়, কোটটা দৈর্ঘ্যে হাঁটু পর্যন্ত নেমে এসেছে।

একে তো এতদিন জাহাজে দেখিনি। ইনি ছিলেন কোথায়? তবে কি ইনি কলম্বোতে উঠেছেন। তা হলেও এ দুদিন ইনি ছিলেন কোথায়?

ভদ্রলোক সোজাসুজি বললেন, গুড নাইট।

 বিলিতি কায়দা-কেতা যদিও আমি ভালো করে জানিনে তবু অন্তত এতটুকু জানি যে শুড় নাইট ওদেশে বিদায় নেবার অভিবাদন– আমরা যেরকম যে কোনও সময় বিদায় নিতে হলে বলি, তবে আসি। দেখা হওয়ামাত্রই কেউ যদি বলে, তবে এখন আসি তবে বুঝব লোকটা বাঙালি নয়। তাই তাঁর গুড নাইট থেকে অনুমান করলুম, ইনি যদিও বিলিতি বেশ ধারণ করেছেন তবু আসলে ভারতীয়।

আমি বললুম, বৈঠিয়ে।

আমার বাঁ দিকে পার্সির শূন্য ডেক-চেয়ার। তিনি তার-ই উপরে বসে পড়ে আমাকে বললেন, আমার নাম আবুল আসফিয়া নুর উদ্দিন মুহম্মদ আব্দুল করিম সিদ্দিকি।

আমার অজানাতেই আমি বলে ফেলেছিলুম, বাপস। কেন, সেকথা কি আর খুলে বলতে হবে? তবু বলি। 

আমি মুসলমান। আমার নাম সৈয়দ মুজতবা আলী, আমার পিতার নাম সৈয়দ সিকন্দর আলী। আমার ঠাকুরদাদার নাম সৈয়দ মুশররফ আলী। ভারতীয় মুসলমানের নাম সচরাচর তিন শব্দেই শেষ হয়। তাই এর আড়াইগজি নামে যে আমি হকচকিয়ে যাব তাতে আর বিচিত্র কী?

বিবেচনা করি, তিনিও বিলক্ষণ জানতেন। কারণ চেয়ারে বসেই, তিনি তাঁর অন্যতম পকেট থেকে বের করলেন একটি সুন্দর সোনার কেস্। তার থেকে একটি ভিজিটিং কার্ড বের করে আমার হাতে দিয়ে বললেন, নামটা একটু লম্বা। তাই এইটে নিন।

আমি তো আরও অবাক। ভিজিটিং কার্ডের কে হয় তা আমি জানি। কারণ, ভিজিটিং কার্ড সুন্দর সুচিকুণ। যাদের তা থাকে তাদের কেউ কেউ সেটা কেসে রাখেন। যেমন মনে কর, ইনশুওরেন্সের দালাল, খবরের কাগজের সংবাদদাতা কিংবা ভোটের ক্যানভাসার। কিন্তু ওঁদেরও তো কেস দেখেছি জর্মন সিলভারে তৈরি। ভিজিটিং কার্ডের সোনার কেস্ পূর্বে আমি কখনও দেখিনি।

সেই বিস্ময় সামলাতে না সামলাতেই তিনি আরেক পকেটে হাত চালিয়ে ডুবুরির মতো গভীর তল থেকে বের করলেন এক সোনার সিগারেট কে। ওরকম কে আমি শুধু স্বপ্নে আর সিনেমায় ফিলুস্টারদের হাতে দেখেছি, বাস্তবে এই প্রথম সাক্ষাৎ। ডেকের অপেক্ষাকৃত ক্ষীণ আলোতেও সেটা যা ঝলমল করে উঠল তার সঙ্গে তুলনা দেওয়া যায় শুধু স্যাকরা-বাড়ি থেকে সদ্য-আসা গয়নার সঙ্গে। কেসের এক কোণে আবার কী যেন এক নীল রঙের পাথর দিয়ে আল্পনা এঁকে ইংরেজি অক্ষরে ভদ্রলোকের সেই লম্বা নামের গুটি দু তিন আদ্যক্ষর। কেসটি আবার সাইজেও বিরাট। নিদেনপক্ষে ত্রিশটি সিগারেট ধরবে। আমার সামনে কেসটি খুলে ধরে আরেক পকেট থেকে বের করলেন একটি লাইটার। তার উপর জয়পুরি মিনার কাজ। হঠাৎ দেখলে মনে হয় জমিদারবাড়ির বড় গিন্নিমার কবচ কিংবা মাদুলি।

আমার মনের ভিতর দিয়ে হুড়-হুঁড় করে এক পলটন সেপাইয়ের মতো পঞ্চাশ সার প্রশ্ন চলে গেল।

তার মধ্যে সবচেয়ে বড় প্রশ্ন, এরকম লজঝড় কোট-পাতলুনের ভিতর অতসব সুন্দর সুন্দর দামি দামি জিনিস লোকটা রেখেছে কেন?

দ্বিতীয় প্রশ্ন, এমন সব দামি মাল যার পকেটে আছে, সে ফার্স্ট ক্লাসে না গিয়ে, আমার মতো গরিবের সঙ্গে টুরিস্ট ক্লাসে যাচ্ছে কেন?

তৃতীয় প্রশ্ন– তা সে যাক গে। কারণ সবকটা প্রশ্নের পুরো ফর্দ এখানে দিতে গেলে আমার বাকি দিনটা কেটে যাবে। আর তোমাদেরও বুদ্ধিসুদ্ধি আছে, ভদ্রলোকের বর্ণনা শুনে তোমাদের মনেও সেইসব প্রশ্ন জাগবে যেগুলো আমার মনে জেগেছিল। তবে আর সেগুলো সবিস্তর বলি কেন?

কিন্তু প্রশ্নগুলোর উত্তর পাই কী প্রকারে?

তিনি বয়সে আমার চেয়ে ঢেড় বড়। তিনি যদি আলাপচারী আরম্ভ না করেন তবে আমি তাঁকে প্রশ্ন শুধাই কী করে? মুরুব্বিদের আদেশ, ছেলেবেলা থেকেই শুনেছি, বড়রা প্রশ্ন জিগ্যেস করবেন– ছোটরা উত্তর দেবে। সে আদেশ লজ্জন করব কী করে? বিশেষ করে বিদেশে, যেখানকার কায়দা-কেতা জানিনে। সেখানে দেশের গুরুজনদের আদেশ স্মরণ করা ভিন্ন অন্য পুঁজি আছে কি?

আধ ঘন্টাটাক কেটে গিয়েছে। ইতোমধ্যে আমি তার দু-দুটো সিগারেট পুড়িয়েছি। ফের যখন তৃতীয়টা বাড়িয়ে দিলেন তখন আমাকে বেশ দৃঢ়ভাবে না বলতে হল। সঙ্গে সঙ্গে সাহস সঞ্চয় করে শুধালুম, আপনি যাচ্ছেন কোথায়?

যেন প্রশ্ন শুনতে পাননি। আমিও চাপ দিলুম না।

আমি খানিকক্ষণ পরে বললুম, মাফ করবেন, আমি শুতে চললুম, গুড নাইট। বললেন, গুড নাইট।

কী জানি, লোকটা কেন কথা বলে না। বোধহয় জিভে বাত হয়েছে। কিংবা হয়তো ওর দেশে কথা বলাতেও রেশনের আইন চলে। যাক গে, কী হবে ভেবে।

পরদিন সকালবেলা পল-পার্সিকে নিয়ে আমি যখন সংসারের যাবতীয় কঠিন কঠিন প্রশ্ন এবং সমস্যা নিয়ে ব্যস্ত, এমন সময় সেই ভদ্রলোক এসে আবার উপস্থিত। আমি ওদের সঙ্গে তার আলাপ করিয়ে দিতেই তিনি তার আরেকটা পকেটে হাত চালিয়ে বের করলেন একরাশ সুইস চকলেট, ইংরেজি টফি এবং মার্কিন চুইংগাম। পল-পার্সি গুটি কয়েক হাতে তুলে নিয়ে যতই বলে, আর না, আর না, তিনি কিন্তু বাড়ানো হাত গুটোন না। ওদিকে মুখে কোনও কথা নেই। শেষটায় বিষণ্ণ বদনে একটা চেয়ারে বসে পড়লেন।

আমরা খানিকটে ইতি-উতি করে পুনরায় নিজেদের গল্পে ফিরে গেলুম। তখন দেখি, ভাষণে অরুচি হলেও তিনি শ্রবণে কিছুমাত্র পশ্চাদপদ নন। আমাদের গল্পের মাঝে মাঝে তাগমাফিক হু, হা দিব্যি বলে যেতে লাগলেন। তার পর আমাদের তিনজনকে কিছুতেই লাইম স্কোয়াশ খাওয়াতে না পেরে আস্তে আস্তে উঠে চলে গেলেন।

উঠে যাওয়া মাত্রই আমি পলকে শুধালুম, এ কীরকম চিড়িয়া হে?

পল বললে, কলম্বোতে উঠেছেন। পকেটভর্তি দুনিয়ার সব টুকিটাকি, মিষ্টি-মিঠাই। যার সঙ্গে দেখা তাকেই কিছু-না কিছু একটা অফার করেন। কিন্তু এ পর্যন্ত তাকে কথা বলতে শুনিনি।

আমি বললুম, জিগ্যেস করে দেখতে হবে তো।

পল বললে, উত্তর কি পাবেন?

 বললুম, ঠিক বলেছ, কাল রাত্রে তো পাইনি।

এঁর সম্বন্ধে যে এত কথা বললুম, তার কারণ এর সঙ্গে পরে আমাদের খুব বন্ধুত্ব জমে। গিয়েছিল; সেকথা সময় এলে হবে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *