ঐ দিন সন্ধ্যায় গ্রামের প্রত্যেক লোকই প্রার্থনার জন্য গুরুদুয়ারায় এসে উপস্থিত হলো। একমাত্র গুরুর জন্মদিন বা নববর্ষের দিন ছাড়া গুরুদুয়ারায় এমন উপস্থিতি আগে কখনও দেখা যায়নি। গুরুদুয়ারায় সাধারণত নিয়মিত যাতায়াত করে বৃদ্ধ লোক ও মহিলারা। অন্যরা সাধারণত আসে তাদের ছেলেমেয়ের নাম রাখতে, দীক্ষা নেয়ার জন্য, বিয়ের সময় বা অস্তুেষ্টিক্রিয়ার সময়। গ্রামের মহাজনের খুন {য়ার পর থেকে প্রার্থনার সময় লোকের উপস্থিতি ক্রমেই বাড়তে থাকে। তারা যেন উ আর একা একা থাকতে চায় না। মুসলমানরা চলে যাওয়ার পর তাদের শূন্য বাড়ির সামনে দিয়ে যাওয়ার সময় গ্রামের লোকেরা দ্রুত এগিয়ে যায়, ভায় ঘাড় ফিরিয়ে ঘরের দিকে তাকায় না। তাদের আশ্রয় নেয়ার একমাত্র স্থান গুরুদুয়ারা। এখানে আসার জন্য তাদের কারও কাছে কৈফিয়ত দিতে হয় না। ওরা এখানে এসে এমন ভান করে যেন এখানে ওদের প্রয়োজন হতে পারে। মহিলারা আসে তাদের সাথে। আর মহিলারা সাথে করে নিয়ে আসে তাদের ছেলেমেয়েদের। যে ঘরে পবিত্র গ্ৰন্থখানি রাখা আছে, সেই হল ঘর ও পাশের দুটি ঘর উদ্বাস্তু ও গ্রামের লোক দিয়ে ভরা। আঙ্গিনার বাইরে ওদের জুতা সারি দিয়ে রাখা আছে পরিচ্ছন্নভাবে।
হারিকেনের আলোয় মিত সিং সান্ধ্য প্রার্থনার শ্লোক পড়লেন। একজন লোক তাঁর পিছনে দাঁড়িয়ে পশমের ফুলঝড় আন্দােলিত করল মৃদুভাবে। প্রার্থনা শেষে উপস্থিত স্তবগান করল। মিত সিং রুচিহীন, অথচ জাঁকালো সিন্ধা কাপড়ে পবিত্র গ্ৰন্থখানি ভাঁজ করে। সারা রাতের মতো তুলে রাখলেন। প্রার্থনাকারীরা উঠে দাঁড়াল, দু’হাত এক সাথে করে নীরব রইল। মিত সিং তাঁর জন্য নির্ধারিত স্থানে এসে সবার সামনে দাঁড়ালেন। তিনি দশ জন শুরু, শিখ শহীদ ও শিখদের মন্দিরের নাম বার বার উচ্চারণ করে তাঁদের আশীৰ্বাদ কামনা করলেন। উপস্থিত সবাই হে গুরু বলে মিত সিং-এর প্রতিটি কথার মাঝে মাঝে আমেন বলল। হাঁটু গেড়ে বসে তারা মাটিতে মাথা ঠেকাল। এভাবেই শেষ হলো সন্ধ্যার অনুষ্ঠান। মিত সিং নিজের স্থান ছেড়ে বাইরে লোকদের সাথে মিলিত হলেন।
এটা ছিল একটা পবিত্র অনুষ্ঠান। শিশুরাই কেবল খেলায় মত্ত ছিল। ঘরের মধ্যে তারা একে অপরকে ছোয়াছুয়ি করে খেললো। হাসোহাসি করলো, কোন বিষয় নিয়ে কথা কাটাকাটি করলো। বয়স্করা শিশুদের তিরস্কারও করলো। পরে তারা . একে একে তাদের মায়ের কোলে গিয়ে ঘুমিয়ে পড়ল। পুরুষ ও মহিলারা ঘরের মেঝেয় যে যেখানে পারল হাত-পা ছেড়ে বসে-গুয়ে সময় কাটাল।
সারা দিনের ঘটনার কথা ঘুমের মধ্যে কারও বিস্মৃত হওয়ার কথা নয়। অনেকে ঘুমাতে পারল না। অনেকে আধা ঘুমে রইল। পাশের কারও পা বা হাত দেহে লাগার সাথে সাথে তাদের কেউ কেউ চিৎকার করে উঠল। এমন কি যারা নাক ডেকে নিশ্চিন্ত মনে ঘুমাচ্ছিল বলে মনে হলো, তারও স্বপ্ন দেখল, দিনের ভয়াবহ দৃশ্য ওদের তাড়িয়ে ফিরল। তারা শুনল মোটর গাড়ির শব্দ, গরুর হাস্থা রব। শুনল মানুষের কান্না। ঘুমের মধ্যে তারা নিজেরাই কাঁদল। চোখের পানিতে তাদের দাড়ি ভিজে গেল।
আরও একবার যখন তারা মোটর গাড়ির হর্ন শুনতে পেল, তখন যারা আধাঘুমে ছিল তাদের মনে হলো তারা স্বপ্ন দেখছে। যারা ঘুমের মধ্যে স্বপ্ন দেখছিল, তাদের মনে হলো স্বপ্নের মধ্যেই তারা ঐ শব্দ শুনছে। তোমরা সবাই কি মারা গেছ? এমন জিজ্ঞাসার জবাবে তারা ঘুমের মধ্যেই হ্যাঁ হ্যাঁ করে উঠল।
শেষ রাতে এলো একটা জীপ। জীপের যাত্রীরা চলার পথের ঐ গ্রাম সম্পর্কে কিছু জানতে চায়, এক ঘর থেকে অন্য ঘরের দরজার কাছে গিয়ে তারা জিজ্ঞাসা করল, ঘরে কেউ আছে? উত্তরে কুকুর শুধু ঘেউ ঘেউ করল। এরপর ঐ জীপ এলো মন্দিরের কাছে। আঙিনায় উঠে জিজ্ঞাসা করল, এখানে কেউ আছে? নাকি সবাই মারা গেছে?
সবাই সচকিত হলো। শিশুরা কান্না শুরু করল। মিত সিং তাঁর হারিকেনের সলতে বাড়িয়ে দিলেন। তিনি ও গ্রামের সর্দার আগন্তুকদের সাথে কথা বলতে বাইরে গেলেন। আগন্তুক দুজন প্রত্যক্ষ করল, তারা কি ধরনের ভীতি সৃষ্টি করেছে। তারা মিত সিং ও সর্দারের উপস্থিতি উপেক্ষা করে হল ঘরের দরজার কাছে এলো। ভীতবিহব্বল ঐ লোকদের দিকে তাকিয়ে একজন বলল :
তোমরা কি সবাই মরে গেছ?
তোমাদের মধ্যে কি কেউ বেঁচে নেই? অপর লোকটি যোগ করল।
ক্রুদ্ধভাবে জবাব দিলেন সর্দার, এ গ্রামের কেউ মারা যায়নি। আপনার কি চান? তারা কিছু জবাব দেয়ার আগেই খাকী পোশাক পরা আরও দুজন শিখ তাদের সাথে যোগ দিল। তাদের ঘাড়ে রাইফেল ঝুলানো।
গ্রামটিকে মৃত বলেই মনে হয়, তাদের একজন অন্যজনকে বলল।
গুরু এই গ্রামের প্রতি দয়াবান। এখানে কেউ নিহত হয়নি। আস্থার সাথে মিত সিং এর শান্ত জবাব।
ঠিক আছে, এখানে কেউ মারা না গেলে সবার মরে যাওয়া উচিত। তাল গাছ সমান পানি ঢেলে গ্রামটিকে ডুবিয়ে দেয়া উচিত। এ গ্রামে সব হিজড়াদের বাস, হাত উঁচু করে বেশ দৃঢ়তার সাথে বলল একজন।
আগন্তুকেরা তাদের জুতা খুলি হল ঘরের মধ্যে ঢুকাল। সর্দার ও মিত সিং তাঁদের অনুসরণ করলেন। লোকগুলো দাঁড়িয়ে তাদের পাগড়ি দুহাতে চেপে ধরল। মহিলারা তাদের কোলের শিশুকে জাপটিয়ে ধরে তাদের ঘুম পাড়াবার চেষ্টা করল।
দলের মধ্য থেকে একজনকে নেতার মতো মনে হলো। সে ইশারায় সবাইকে বসতে বলল। আচরণে আক্রমণাত্মক ভাব লক্ষ্য করা গেল। তার বয়স খুব বেশি নম্ন। তার চিবুকে দাড়ির চিহ্ন বেশ উজ্জ্বলভাবেই দেখা যাচ্ছে। বেঁটে ও চিকন তার গড়ন। সব মিলিয়ে তাকে হীনবল মনে হয়। নীল পাগড়ি পরা নেতার কপালের ওপর (পাগড়ির অংশ) উজ্জ্বল লাল রঙের ফিতা। তার গোলাকার ঘাড়ের ওপর চিলে-ঢালা খাকী রঙের সামরিক শার্ট ঝুলে আছে। পায়ে কালে চামড়ার জুতা। তার বুকের ওপর দিয়ে পাঁচানো বেল্টের ফাঁকে ফাঁকে বুলেট সাজানো। কোমরে কালো চওড়া বেল্ট বাঁধা, তার কোমর যে চিকন তা সহ ই অনুমান করা যায়। বেল্টের এক পাশে থাপের মধ্যে রিভলবারের বাঁট, অপরদিকে একটা ছোরা ঝুলানো। তার চেহারা দেখতে এমন, যেন তার মা তাকে মার্কিন কাউবয়ের মতো করে সাজিয়েছে।
ছেলেটি ছেলেটি রিভলবারের খাপের ওপর হাত বুলিয়ে গুলির অগ্রভাগে আঙ্গুল দিয়ে নাড়াচাড়া করল। তারপর পূর্ণ আস্থার সাথে চারদিকে একবার তাকিয়ে দেখল।
এটা কি শিখ অধ্যুষিত গ্রাম? ঔদ্ধত্যের সঙ্গে সে জিজ্ঞাসা করল।
গ্রামের লোকদের কাছে স্পষ্টভাবে প্রতীয়মান হয়েছিল যে, লোকটি লেখাপড়া জানা শহুরে লোক। কৃষকদের সাথে এসব লোক যখন কথা বলে তখন একটা ফাঁপা আভিজাত্যের ভাব তাদের আচরণে লক্ষ্য করা যায়। বয়স বা মর্যাদার প্রতি তাদের কোন শ্ৰদ্ধা নেই।
হ্যাঁ স্যার, সর্দার জবাব দিলেন। এ গ্রামটায় আগে থেকেই শিখরা বাস করে। আমাদের কিছু মুসলমান প্রজা ছিল, ওরা চলে গেছে।
তোমরা কি ধরনের শিখ? ছেলেটি জিজ্ঞাসা করল। তার অঙ্গভঙ্গিতে একটা তাচ্ছিল্যের ভাব প্রকাশ পেল। সে তার প্রশ্নের বিশদ ব্যাখ্যা দিয়ে বলল, তোমরা মরদ না হিজড়া শিখ?
এ তোমরা এ প্রশ্নের জবাব কি, তা কেউ বলতে পারল না। গুরুদুয়ারায় দাঁড়িয়ে মহিলা ও শিশুদের সামনে এ ধরনের অশ্লীল কথারও কেউ প্রতিবাদ করল না।
তোমরা কি জান, কয়টা ট্রেন ভর্তি হিন্দু ও শিখের মৃতদেহ এসেছে? রাওয়ালপিন্ডি, মুলতান, গুজরানওয়ালা ও শেখুপুরায় যে গণহত্যা হয়েছে তার খবর তোমরা রাখো? এ ব্যাপারে তোমরা কি করেছ? তোমরা শুধু খাচ্ছ, ঘুমাচ্ছ আর নিজেদের শিখ বলে দাবি করছ? হায়রে সাহসী শিখ! বীরের জাতি! সে আগের কথার সূত্র ধরে বলল, আর তাচ্ছিলের সঙ্গে হাত নাড়াল। তার কথার প্রতিবাদ করতে কেউ সাহস পায় কি না, সে তার তীক্ষ্ম চোখ দিয়ে চারদিকে তাকিয়ে নিরীক্ষণ করল। লোকগুলো লজ্জায় মাথা হেট করে রইল।
কিন্তু আমরা কি করতে পারি সর্দারাজী? সর্দার প্রশ্ন করলেন। আমাদের সরকার পাকিস্তানের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করলে আমরা যুদ্ধ করব। মানো মাজরায় বসে বসে আম্নরা কি করব?
সরকার! অবজ্ঞা ভরে ছেলেটি বলল, তোমরা আশা কর সরকার সব কিছু করে আগে পাকিস্তানের মুসলমানরা কি সরকারের কাছে অনুমোদনের জন্য দরখাস্ত করেছিল। ট্রেন থামিয়ে যুবক, বৃদ্ধ, মহিলা ও শিশুদের হত্যু করার আগে ওরা কি সরকারের কাছে দরখাস্ত দিয়েছিল? তোমরা চাও সরকার সব কিছু করে দিক বাহ! সাবাস ব্ৰেভো! ছেলেটি রিভলবারের খাপটি দৃঢ়তার সাথে চেপে ধরল।
কিন্তু সর্দার সাহেব, আমতা আমতা করে সর্দার বললেন, আমরা কি করব বলে দিন।
ভাল কথা, ছেলেটি বলল, আমরা আলোচনা করতে পারি এ বিষয়ে। শোন, মন দিয়ে শোন আমার কথা। ছেলেটি থামল। চারদিকে একবার তাকিয়ে দেখল। প্রতিটি বাক্যই সে হাতের বুড়ো আঙ্গুল দুলিয়ে স্পষ্ট করে বলল দৃঢ়তার সাথে, ওরা একজন হিন্দু বা একজন শিখকে মারলে তোমরা অপহরণ করবে। দুজনকে। প্রতিটি ঘর লুঠ করার বদলে তোমরা দু’টো লুঠ করবে। একটা ট্রেন ভর্তি মৃতদেহের পরিবর্তে তোমরা পাঠাবে দু’টো ট্রেন ভর্তি মৃতদেহ। রাস্তায় একটা গাড়ি আক্রমণের শিকার হলে তোমরা আক্রমণ করবে। দু’টো গাড়ি। এ কাজ করলে সীমান্তের ওপারে। হত্যা বন্ধ হবে। ওরা বুঝতে পারবে যে, আমরাও হত্যা ও লুঠের খেলায় মেতেছি।
তার কথায় কি ফল হলো তা অনুধাবনের জন্য সে থামল। তার কথা লোকগুলো অতি আগ্রহভরে শুনেছে। একমাত্র মিত সিং-ই তার কথায় প্রভাবিত হয়নি বলে মনে হলো। গলা পরিষ্কার করে তিনি কিছু বলতে গিয়ে থেমে গেলেন।
হ্যাঁ ভাই, চুপ করে রইলেন কেন? ছেলেটি যেন তাঁকে চ্যালেঞ্জ করে বলল।
আমি বলতে চাই, থেমে থেমে মিত সিং বললেন। আমি বলতে চাই, একই কথা তিনি আবার বললেন। এখানকার মুসলমানরা আমাদের ওপর কি করেছে যে পাকিস্তানের মুসলমানদের জন্য তাদের ওপর আমরা প্রতিশোধ নেব? তাদের আমরা খুন করব? যারা দোষ করেছে তাদেরই কেবল শাস্তি পাওয়া উচিত।
ছেলেটি ক্রুদ্ধভাবে মুক্ত সিং-এর দিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ করল। পাকিস্তানে হিন্দু ও শিখরা কি অপরাধ করেছিল যে, তাদের হত্যা করা হয়েছে? তারা কি নির্দোষ ছিল না। মহিলারা কি কোন অন্যায় কাজ করেছিল যে, তার জন্য তাদের ইজ্জত দিতে হয়েছে? শিশুরা কি কাউকে খুন করেছিল যে, তাদের পিতা-মাতার সামনে নির্বিচারে খুন করা হলো?
মিত সিং বিচলিত হলেন। ছেলেটি তাঁকে আরও বিচলিত করতে চাইল। কেন। ভাই? কথা বলুন। কি করতে চান এখন তা-ও বলুন।
আমি একজন বৃদ্ধ ভাই। কারও ওপর আমি হাত তুলতে চাই না। যুদ্ধেই হোক আছে কি? মহিলাদের ব্যাপারে আমাদের শেষ গুরু গোবিন্দ সিং কি বলেছিলেন তা তো আপনি জানেন। সবাইকে তিনি প্রতিজ্ঞা করিয়েছিলেন যে, কোন শিখ কোন মুসলমান মহিলাকে স্পর্শ করবে না। অথচ খোদা জানেন, মুসলমানদের হাতে তিনি কীভাবে নির্যাতিত হয়েছিলেন! ওরা তাঁর চার ছেলেকেই খুন করেছিল।
এ ধরনের শিখবাদ অন্য কাউকে শেখাবেন, ঔদ্ধত্যের সাথে ছেলেটি বলল, তোমাদের মতো লোকই দেশের জন্য অভিশাপ। মহিলাদের সম্পর্কে গুরুর বাণী তুমি আমাদের শোনালে। মুসলমানদের সম্পর্কে তিনি কি বলেছিলেন তা তো বললে দু:স্ব সম্প্রদায়ের লোক মারা গেলে তুর্কদের সাথে বন্ধুত্ব করবে। একথা কি হাঁ। মৃদু স্বরে জবাব দিলেন মিত সিং। কিন্তু কেউ তো আপনাকে তাদের সাথে বন্ধুত্বের কথা বলছে না। তাছাড়া গুরুর সামরিক বাহিনীতে মুসলমানরাও ছিল….।
গুরু যখন ঘুমিয়ে ছিলেন তখন তাদেরই একজন তাঁকে ছুরিকাঘাত করে।
মিত সিং অস্বস্তি বোধ করলেন।
গুরু যখন ঘুমিয়ে ছিলেন তখন তাদেরই একজন তাঁকে ছুরিকাঘাত করে, একই কথা আবার বলল ছেলেটি।
হাঁ… খারাপ লোক সব জায়গাতেই আছে…।
একজন ভাল লোকের উদাহরণ আমাকে বলুন।
ছেলেটির সরস আলোচনায় মিত সিং পরাজয় বরণ করলেন। তিনি মাথা নিচু করে পায়ের দিকে তাকিয়ে রইলেন। তাঁর নীরবতায় প্রমাণিত হলো যে, তিনি পরাজিত হয়েছেন।
উনি নিজের মতে থাকুন। উনি একজন প্রবীণ ভাই। উনি প্রার্থনা নিয়েই থাকুন, উপস্থিত লোকদের মধ্যে অনেকেই একথা বলল।
ছেলেটি খুশি হলো। সে সবাইকে উদ্দেশ্য করে আনন্দের সাথে বলল, সাবধান। আমি আবার বলছি সাবধান। মুসলমানরা তরবারি ছাড়া কোন যুক্তি জানে না। একথা কখনও ভুলবে না।
উপস্থিত লোকদের মধ্যে মৃদু গুঞ্জন শোনা গেল। ঐ গুঞ্জন ধ্বনির মধ্য দিয়ে তারা ছেলেটির কথায় সমর্থন জানাল।
গুরুর প্রিয় এমন কেউ কি এখানে আছে? শিখ সম্প্রদায়ের জন্য কেউ কি নিজেকে উৎসর্গ করতে প্রস্তুত আছে? সাহসী কেউ আছে কি? প্রতিটি বাক্যই সে চ্যালেঞ্জের মতো ছুড়ে দিল।
গ্রামবাসীরা ভীষণ অস্বন্তি বোধ করল। ছেলেটি তার বক্তব্যের মাধ্যমে সবাইকে উত্তেজিত করতে পেরেছে এবং তারা তাদের বীরত্ব প্রমাণ করতে চায়। একই সাথে তারা মিত সিং-এর উপস্থিতির কারণে অস্বস্তি বোধ করল। তারা মনে করল, মিত সিং-এর সাথে তারা বেইমানী করছে।
আমাদের কি করা উচিত? সর্দার জিজ্ঞাসা করলেন।, নিজের দিকে অঙ্গুলি নির্দেশ করে ছেলেটি বলল, আমাদের কি করতে হবে তা আমি বলে দেব। সে কাজ করতে তোমাদের অবশ্যই সাহসী হতে হবে। একটু থেমে ছেলেটি আবার বলল, আগামীকাল একটা ট্রেন মুসলমানদের নিয়ে ব্রিজ অতিক্রম করে পাকিস্তান যাবে। তোমরা যদি সত্যি সাহসী হও তাহলে তোমরা যত মৃতদেহ ট্রেন থেকে নামিয়েছিলে, ততু মৃতদেহ ট্রেনে করে ওপারে পাঠিয়ে দেবে।
শীতল নীরবতার অনুভূতি উপস্থিত সবার মনেই ছড়িয়ে পড়ল। ওরা যেন কিংকৰ্তব্যবিমূঢ় হয়ে পড়ল!
ঐ ট্রেনেই থাকছে মানো মাজরার মুসলমানরা, মাথা উঁচু না করেই মিত সিং বললেন।
ভাই, আপনি বোধ হয় সব কুছুই জুনেন, তাই না? উত্তেজিত হয়ে যুবকটি বলল। আপনি কি ওদের ট্রেনের টিকিট দিয়েছন-না আপনার ছেলে রেলের বাবু? ট্রেনে যারা যাবে তারা কোথাকার মুসলমান আমি জানি না। আমি জানতেও চাই না। তারা মুসলমান, একথা জনাই আমার জন্য যথেষ্ট। জীবিত অবস্থায় তারা এ নদী পার হবে না। তোমরা যদি আমার সাথে একমত হও, তাহলে আলোচনা হতে পারে। যদি তোমরা ভয় পাও, তাহলে সে কথা এখনই বল। তোমাদের শুভ বিদায় জানিয়ে আমরা অন্য লোক খুঁজব, যারা সত্যি সাহসী।
সবাই চুপ করে রইল। দীর্ঘ নীরবতা। ছেলেটি তার রিভলবারের খাপে একটা চাপড় দিয়ে ধীরে ধীরে তার চারপাশের উদ্বিগ্ন মুখগুলো নিরীক্ষণ করল।
ব্রিজে সৈন্যরা পাহারা দিচ্ছে। মাল্লি বলল। সবার পিছনে অন্ধকারের মধ্যে সে দাঁড়িয়ে ছিল। মানো মাজরা গ্রামে এক আসার সাহস তার ছিল না। তবু সে এসেছে। সাহসের সাথে সে গুরুদুয়ারায় পা রেখেছে। দরজার কাছে তার দলের কয়েকজনকে দেখা গেল।
সৈন্য বা পুলিশ নিয়ে তোমাদের চিন্তা করতে হবে না। কেউ তোমাদের কাজে বাধা দেবে না। এ ব্যাপারটা আমরা দেখব, ছেলেটি বলল। পিছন দিক তাকিয়ে সে আবার বলল, স্বেচ্ছাসেবক কেউ আছে। এখানে?
আমার জীবন আপ্পনার হাতে, মাল্লি বীরের মতো বলল। জুগ্গা তাকে মেরেছে, এ খবর গ্রামের সবাই জানে। তার নিজের মর্যাদা পুনঃপ্রতিষ্ঠা করা দরকার।
সাবাশ, ছেলেটি বলল। শেষে একজন লোক পাওয়া গেল। শিখ ধর্ম প্রবর্তনের সময় গুরু পাঁচজনের জীবন প্রার্থনা করেছি। তাঁরা মানুষ নন, মহামানব। আমাদের প্রয়োজন পাঁচজনের চেয়ে অনেক বেশি। আর কে তার জীবন বিসর্জন দিতে আগ্রহী?
মাল্লির চারজন সঙ্গী বারান্দায় উঠে এলো। তাদের অনুসরণ করল আরও অনেকে। এদের অনেকেই উদ্বাস্তু। গ্রামবাসীদের মধ্যে অনেকেই যারা গ্রামের মুসলমানদের চলে যাওয়ার কারণে চোখের পানি ফেলেছিল, তারাও স্বেচ্ছাসেবী হওয়ার জন্য উঠে দাঁড়াল। স্বেচ্ছাসেবী হওয়ার জন্য যারাই হাত উঁচু করছিল,। ছেলেটি তাদের সাবাশ ধ্বনি দিয়ে উল্লসিত করে এক পাশে বসার আহবান জানাচ্ছিল। উদ্ধৃঙ্খল ঐ অভিযানে পঞ্চাশ জনেরও বেশী যোগ দিতে সম্মত হলো।
যথেষ্ট হয়েছে, ছেলেটি বলল। আরও স্বেচ্ছাসেবীর প্রয়োজন হলে আমি তোমাদের বলব। আমাদের অভিযান সফল হওয়ার জন্য এসো আ৷ প্রার্থনা করি।
সবাই দাঁড়াল। যে স্থানটিতে পবিত্র গ্ৰন্থখানি রাখা আছে, সেই স্থানের দিকে সবাই মুখ করে দু’হাত এক করে প্রার্থনা করল।
ছেলেটি মিত সিং-এর দিকে ফিরে কটাক্ষ করে বলল, ভাইজি, আপনি কি প্রার্থনা পরিচালনা করবেন?
এটা আপনার অভিযান সর্দার সাহেব, বিনয়ের সাথে মিত সিং বললেন, আপনিই প্রার্থনা পরিচালনা করুন।
ছেলেটি গলা পরিষ্কার করে চোখ বন্ধ করল এবং তারপর গুরুদের নাম উচ্চারণ করল। এই অভিযানে গুরুর আশীৰ্বাদ কামনা করে সে প্রার্থনা শেষ করল। সমবেত লোকেরা নতজানু হয়ে বসে মাটিতে মাথা ঠেকিয়ে উচ্চ স্বরে ঘোষণা করল:
গুরু নানকের নামে
সবার মনে বিশ্বাস প্রতিষ্ঠিত হোক
এই আশায়
দয়াময়ের রহমতে
এই বিশ্বে আমরা প্রতিষ্ঠিত করি
শুধু শুভ কামনা।
সমবেত সবাই দাঁড়িয়ে ঘোষণা করল:
শিখ জাতি শাসন করবে
তাদের শক্ররা ছিন্ন-বিচ্ছিন্ন হবে
কেবল তারাই রক্ষা পাবে
যারা আশ্ৰয় প্রার্থনা করবে!
ছোট এই অনুষ্ঠানটি শেষ হলো শুভ সকাল ধ্বনির মধ্য দিয়ে। ছেলেটি ছাড়া আর সবাই আবার বসল মেঝের ওপর। এই প্রার্থনা ছেলেটিকে বিনম্রর ছদ্মবেশ পরিয়ে দিয়েছে। সে হাত জোড় করে সমবেত লোকদের কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করে বলল :
ভাই ও বোনেরা গভীর রাতে আপনাদের বিরক্ত করার জন্য আমাকে ক্ষমা করবেন। ভাইজি ও সর্দার সাহেব, আপনারও ক্ষমা করবেন। এই অসুবিধার জন্য এবং আমি কোন কটু কথা বলে থাকলে আপনারা দয়া করে মাফ করবেন। সব কিছু করা হচ্ছে গুরুর সেবায়। স্বেচ্ছাসেবীরা, তোমরা পাশের কামরায় যাও। আপনারা বিশ্রাম গ্ৰহণ করুন। শুভ বিদায়।
শুভ বিদায়, উপস্থিত লোকদের মধ্য থেকে কেউ কেউ বলল।