যখন জানা গেল যে, ট্রেন ভর্তি করে লাশ আনা হয়েছে, তখন গ্রামটিতে বিষন্ন নীরবতা নেমে এলো। গ্রামের অনেকে তাদের ঘরের দরজা বন্ধ করে রাখল, অনেকে সারা রাত জেগে চাপা স্বরে আলাপ-আলোচনা করল। সবাই প্রতিবেশীকে শক্ৰ মনে করল এবং আত্মরক্ষার জন্য বন্ধু খোঁজার ও জোটবদ্ধ হওয়ার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করল। তারা কেউ লক্ষ্য করল না, মেঘের খণ্ডে নক্ষত্ৰ হারিয়ে গেছে আকাশে। ভ্যাপসা শীতল বায়ুর গন্ধও তারা অনুভব করল না। সকাল বেলা ঘুম থেকে উঠে যখন তারা দেখল বৃষ্টি ঝরিছে, তখনও তাদের চিন্তায় দুটি বিষয় স্থান পেল। একটি ট্রেন এবং অপরটি মৃতদেহ পোড়ানো। গ্রামের প্রায় সব লোকই তাদের বাড়ির ছাদে দাঁড়িয়ে ক্টেশনের দিকে তাকিয়ে রইল।
ট্রেনটি যেমন রহস্যজনকভাবে অন্তৰ্হিত হয়েছিল। ঠিক তেমনিভাবে তা এসে উপস্থিত হয়েছে। স্টেশনে লোকজন নেই। সৈন্যদের তাঁবু বৃষ্টির পানিতে ভিজে গেছে। কোথাও কোথাও দেবে গেছে। শিখাহীন আগুন বা ধোঁয়া কিছুই দেখা যায়। না। সত্যি কথা বলতে কি, ওখানে জীবন বা মৃত্যুর কোন লক্ষণ দেখা যায় না। তবুও লোক দেখতে লাগল। সম্ভবত অনেক লাশ নিয়ে আরও একটা ট্রেনের আগমন প্রতীক্ষায়!
বিকালের দিকে মেঘ সরে গেল পশ্চিমাকাশে। বৃষ্টি শেষে চারদিক বেশ পরিস্কার হয়ে গেল। আশপাশের সব কিছু স্পষ্টভাবে দেখা যায়। গ্রামের লোকেরা তাদের বাড়ি থেকে বেরিয়ে আসার সাহস করল। উদ্দেশ্য, অন্যের সাথে আলাপ করে আরও কিছু যদি জানা যায়। পরে তারা স্ব স্ব গৃহের ছাদে উঠে চারদিক তাকিয়ে দেখতে লাগল।
বৃষ্টি থেমে গেলেও স্টেশন, প্লাটফর্ম বা যাত্রী ছাউনি বা সেনা ক্যাম্পে কাউকে দেখা গেল না। স্টেশন বিল্ডিংয়ের ছাদের কোণায় বেশ কয়েকটি শকুনি বসে আছে। ষ্টেশন চত্বরের ওপরে একাধিক চিল চক্রাকারে উড়ে বেড়াচ্ছে।
পুলিশ ও বন্দীদের নিয়ে হেড কনষ্টেবল গ্রাম থেকে বেশ দূরে একটা স্থান নির্বাচিত করল। গ্রামবাসীরা সংবাদ পেয়ে একে অপরকে বলল এবং অতি দ্রুত সারা গ্রামে ঐ খবর ছড়িয়ে পড়ল। গ্রামের সর্দারকে ডাকা হলো।
হেড কনস্টেবল তার দলবল নিয়ে উপস্থিত হলে অনেক লোক জড়ো হলো। মন্দিরের কাছে পিপল গাছের নিচে দেখতে দেখতে বহু লোকের সমাগম হলো।
গ্রামের লোকদের সামনেই হেড কনস্টেবল বন্দীদের হাতকড়া খুলে দিল। একটা সাদা কাগজে তাদের বুড়ো আঙ্গুলের ছাপ নেয়া হলো। সপ্তাহে দুবার তাদের থানায় রিপোর্ট করার কথা বলা হলো। গ্রামবাসীরা বিমর্ষ চিত্তে ঐ দৃশ্য দেখল। তারা নিশ্চিত যে, গ্রামের ঐ ডাকাতির সাথে জুগ্গা বদমায়েশ ও আগভুক ইকবালের কোন সম্পর্ক নেই। তারা আরও নিশ্চিত ছিল যে, মাল্লির লোকদের গ্রেফতার করা পুলিশের যথার্থ হয়েছিল এবং তারা সঠিক পথেই অগ্রসর হচ্ছিল। ওদের সব কজনই যে ঐ ডাকাতির সাথে জড়িত ছিল, এমন নাও হতে পারে। পাঁচজন লোককে গ্রেফতার করা হয়ত ভুল হয়েছিল। কিন্তু ওদের কেউ ঐ ঘটনার সাথে জড়িত ছিল না, এমন কথা বলা যায় না। তবু পুলিশ ওদের ছেড়ে দিচ্ছে তাদের নিজের গ্রামে নয়, যে গ্রামে তারা ডাকাতি ও খুন করেছিল সেই মানো মাজরায়। পুলিশ হয়ত ওদের নিরপরাধ ভেবেই এমন কাজ করল!
গ্রামের সর্দারকে এক পাশে ডেকে নিয়ে হেড কনস্টেবল তার সাথে বেশ কিছুক্ষণ কথা বলল। সর্দার সাহেব ফিরে এসে গ্রামবাসীদের উদ্দেশে বললেন, সুলতানা বদমায়েশ বা তার কোন লোককে এখানে তোমরা কেউ দেখেছ বা তাদের সম্পর্কে কিছু শুনেছি কিনা সেন্ট্রি সাহেব জিজ্ঞাসা করছেন।
গ্রামের কয়েকজন লোক এগিয়ে এলো। ওরা বলল, সুলতানা ও তার দলের লোকেরা পাকিস্তান চলে গেছে বলে তারা শুনেছে। ওরা সবাই মুসলমান। ঐ গ্রামের সব মুসলমানকে সরিয়ে নেয়া হয়েছে।
লালার খুন হওয়ার আগে না পরে সে চলে গেছে? সর্দার সাহেবের কাছে এসে হেড কনষ্টেবল জিজ্ঞাসা করল।
পরে, প্ৰায় এক সাথে সবাই বলল। এরপর কিছুক্ষণ নীরবতার মধ্যে কাটল। গ্রামবাসীরা একে অপরের দিকে তাকাল। তাদের কি করা উচিত কিছুই ঠিক করতে পারল না। পুলিশকে কিছু জিজ্ঞাসা করার পূর্বে হেড কনস্টেবল বলল,
মুসলিম লীগের কমী যুবক মুসলমান বাবু মোহাম্মদ ইকবালের সাথে কাউকে কথা বলতে বা এক সাথে উঠতে বসতে দেখেছ?
সর্দার সাহেব অবাক হলেন। তিনি জানতেন না, ইকবাল মুসলমান। তাঁর আবছা স্মরণ হলো, মিত সিং ও ইমাম বখশ তাকে ইকবাল সিং বলে ডাকতেন। তিনি উপস্থিত লোকের মধ্যে ইমাম বখশকে খুঁজলেন, কিন্তু পেলেন না। গ্রামের বেশ কয়েকজন বেশ উত্তেজিত হয়ে বলল, তারা ইকবালকে মাঠে এবং ব্রিজের ধারে রেল লাইনের কাছে ঘোরাফেরা করতে দেখেছে।
তার কাজে সন্দেহজনক কিছু লক্ষ্য করেছ?
সন্দেহজনক? মানে…
ঐ লোকটা সম্পর্কে সন্দেহজনক কিছু দেখতে পাওনি?
এ ব্যাপারে কেউ নিশ্চিত ছিল না। শিক্ষিত লোক সম্পর্কে কেউ কখনও কোন ব্যাপারে নিশ্চিত হতে পারে না, ওরা সবাই সন্দেহজনকভাবে ধূর্ত। বাবু সম্পর্কে কোন কিছু একমাত্র মিত সিং-ই বলতে পারে। কারণ বাবুর কিছু মালপত্র এখনও গুরুদুয়ারায় আছে।
মিত সিং ভিড়ের মধ্যে ছিলেন। তাঁকে ঠেলে সামনের দিকে পাঠিয়ে দিল উৎসাহী কেউ।
হেড কনষ্টেবল মিত সিং-এর উপস্থিতি উপেক্ষা করে তার কথার যারা জবাব দিচ্ছিল তাদের উদ্দেশে বলল, ভাইয়ের সাথে আমি পরে কথা বলব। ঐ বাবু মানো মাজরায় এসেছিল ডাকাতির আগে না পরে, এ কথা কেউ বলতে পারবে না?
গ্রামবাসী এ কথায় আবারও অবাক হলো। শহরের এক বাবুর সাথে ঐ ডাকাতির ও খুনের কি সম্পর্ক? হতে পারে, এর সাথে অর্থের কোন সম্পর্ক নেই। কেউ তো কিছু নিশ্চিত করে বলতে পারে না। তারা এখন কোন ব্যাপারেই নিশ্চিত নয়। হেড কনস্টেবল বলল, মহাজনের খুন হওয়া বা সুলতানা বা মোহাম্মদ ইকবাল সম্পর্কে কেউ নির্দিষ্ট কোন সংবাদ জানলে অবিলম্বে থানায় রিপোর্ট করবে।
এ কথা বলে সে যাওয়ার উপক্রম করল।
উপস্থিত লোকেরাও দলে দলে স্থান ত্যাগ করল। যাওয়ার পথে তারা প্রাণবন্ত আলোচনা ও অঙ্গভঙ্গি করল। মিত সিং গেলেন হেড কনষ্টেবলের কাছে। সে তখন তার দলকে মার্চ করে ফিরিয়ে নেয়ার তোড়জোড় করছিল।
সেন্ট্রি সাহেব, সেদিন যে যুবককে আপনি গ্রেফতার করেছিলেন সে মুসলমান নয়। সে একজন শিখ-ইকবাল সিং।
হেড কনষ্টেবল তার কথায় কান দিল না। একটা হলুদ কাগজে সে কিছু লেখার কাজে ব্যস্ত ছিল। মিত সিং ধৈর্যের সাথে অপেক্ষা করলেন।
হেড কনষ্টেবল কাগজ ভাঁজ করার সময় মিত সিং আবার বললেন, সেন্ট্রি সাহেব। হেড কনষ্টেবল তার দিকে ফিরেও দেখল না। সে একজন কনস্টেবলকে ইশারা করে কাগজখানা দিয়ে বলল, একটা সাইকেল বা টাঙ্গায় করে যাও। পাকিস্তান সামরিক ইউনিটের কমান্ড্যান্টকে চিঠিটা দেবে। মুখে তাকে বলবে যে, তুমি মানো মাজরা থেকে এসেছ এবং সেখানকার পরিস্থিতি মারাত্মক। ওখান থেকে মুসলমানদের নিয়ে যাওয়ার জন্য তিনি যেন অবিলম্বে ট্রাক ও সৈন্যদের পাঠান। এখনই যাও।
হ্যাঁ স্যার, কনস্টেবলটি জবাব দিল।
সেন্ট্রি সাহেব, মিত সিং অনুনয় করে বললেন।
সেন্ট্রি সাহেব, সেন্ট্রি সাহেব, সেন্ট্রি সাহেব, বেশ রেগে একই কথা বলল হেড কনস্টেবল। তোমার সেন্ট্রি সাহেব ডাকে আমার কান ঝালাপালা হয়ে গেছে। কি চাও তুমি?
ইকবাল সিং একজন শিখ।
তুমি কি ওর প্যান্ট খুলে দেখেছি ও শিখ না। মুসলমান। মন্দিরের তুমি একজন ভাই। যাও, গিয়ে প্রার্থনা কর।
দুই সারিতে দাঁড়ানো পুলিশের সামনে গিয়ে হেড কনস্টেবল দাঁড়াল।
সাবধানও হও, বাঁদিক থেকে শুরু কর, এগিয়ে চল।
মিত সিং মন্দিরে ফিরে গেলেন। উৎসুক গ্রামবাসীর কোন প্রশ্নেরই তিনি জবাব দিলেন না।