অন্য কোন মুসলমান বাড়িতে যাওয়ার আগে ইমাম বখশ মসজিদের লাগোয়া তাঁর নিজের বাড়িতেই গেলেন। নূরান তখন বিছানায় শুয়ে ছিল। একটা মাটির প্রদীপ দেয়ালের কুলঙ্গিতে জ্বলছিল।
নূরু, নূরু, তিনি ডাকলেন। তার ঘাড়ে ঝাঁকি দিয়ে বললেন, ওঠো, নূরু।।
মেয়েটি চোখ খুলল। কি হয়েছে? উঠে সব কিছু গুছিয়ে নাও। কাল সকালেই আমাদের চলে যেতে হবে, নাটকীয়ভাবে তিনি মেয়েকে কথাগুলো বললেন।
চলে যেতে হবে? কোথায়?
আমি জানি না … হয়ত পাকিস্তানে।
নূরান এক লাফে উঠে বসল। আমি পাকিস্তানে যাব না, সে অত্যন্ত দৃঢ়তার সাথে বলল।
ইমাম বখশ এমন ভান করলেন যেন তিনি কিছুই শুনতে পাননি। কাপড়চোপড় সব বাক্সে রাখ। রান্নার জিনিসপত্রগুলো চটের ছালার মধ্যে রােখ। মহিষটার জন্য কিছু নিও। ওটাকে আমরা সাথে করে নিয়ে যাব।
আরও দৃঢ়তার সাথে মেয়েটি বলল, আমি পাকিস্তানে যাব না।
তুমি যেতে চাও বা না চাও, ওরা তোমাকে তাড়িয়ে দেবে। মুসলমানরা সবাই আগামীকাল ক্যাম্পে যাচ্ছে।
কে আমাদের তাড়িয়ে দেবো? এটা আমাদের গ্রাম। পুলিশ ও সরকার, এরা কি মরে গেছে?
অবুঝ হয়ো না নূরান! তোমাকে যা বললাম। তাই কর। হাজার হাজার লোক পাকিস্তানে যাচ্ছে, হাজার হাজার লোক পাকিস্তান থেকে আসছে। যারা যাচ্ছে না, তাদের মেরে ফেলা হচ্ছে। তাড়াতাড়ি কর, সব গুছিয়ে নাও। আমি যাই অন্যদেরকে বলতে হবে, তারা যেন তৈরি হয়ে থাকে।
ইমাম বখশ ঘর থেকে বেরিয়ে পড়লেন। মেয়েটি তখনও বিছানার ওপর বসা। নিজের হাত দিয়ে নূরান তার চোখ দু’টো ব্লগড়ে নিল। দেয়ালের দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল। কিছুক্ষণ। সে কি করবে তার কিছুই ভেবে পেল না। সারা রাত সে বাইরে কাটাতে পারে ইচ্ছা করলে। তারপর সবাই চলে গেলে সে ঘরে ফিরে আসতে পারে। কিন্তু তার পক্ষে একা এ কাজ করা সম্ভব নয়। তদুপরি বৃষ্টি হচ্ছে মাঝে মাঝে। তার একমাত্র ভরসা জুগ্গা। মাল্লিকে পুলিশ ছেড়ে দিয়েছে। হয়ত জুগ্গাও ঘরে ফিরে এসেছে। সে জানত, জুগ্গা ফিরে এসেছে। এ কথা সত্য নয়। কিন্তু সে আশায় বুক বাঁধল এবং এই আশাই তাকে কিছু করার সাহস যোগাল।
বৃষ্টির মধ্যেই নূরান বাইরে বেরিয়ে পড়ল। গলি পথে সে অনেক লোককে দেখতে পেল। বৃষ্টির হাত থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য। ওরা মাথা থেকে ঘাড় পর্যন্ত চটের বস্তা পরে নিজের গন্তব্যস্থলে যাচ্ছিল। সমস্ত গ্রামটাই যেন জেগে আছে! প্রায় প্রতিটি ঘরেই সে দেখতে পেল প্রদীপের অস্বচ্ছ আলোর শিখা। কেউ জিনিসপত্র গোছগাছ করছে, কেউ কেউ তাদের কাজে সাহায্য করছে। অনেকে বন্ধুদের সাথে মামুলি কথাবার্তা বলছে। মেয়েরা মেঝেয় বসে পরস্পরকে আলিঙ্গন করে চোখের পানি ফেলছে। দেখে মনে হয় সব ঘরেই যেন কারও মৃত্যু হয়েছে!
জুগ্গার ঘরের দরজা নাড়াল নূরান। দরজার অপর পাশের শিকল নড়ে উঠল, কিন্তু কেউ কোন সাড়া দিল না। ধূসর আলোয় সে দেখতে পেল, দরজাটা বাইরে থেকে বন্ধ করা। সে লোহার রিংটা খুলে ভিতরে প্রবেশ করল।
জুগ্গার মা ঘরে ছিল না, সম্ভবত কোন মুসলমান বন্ধুর বাড়িতে বেড়াতে গেছে। কোন আলো নেই ঘরে। একটা চারপাই-এর পরে নূরান বসল। সে একাকী জুগ্গার মায়ের সামনাসামনি হতে চাইল না, আবার বাড়িতেও ফিরে যেতে চাইল না। তার আশা, কিছু একটা ঘটে যেতে পারে— হয়ত দেখা যাবে, জুগ্গা আসছে। ঘরের দিকে। সে বসে অপেক্ষা করল। আশায় বুক বাঁধল।
প্রায় ঘণ্টাখানেক ধরে নূরান লক্ষ্য করল, মেঘের ধূসর ছায়া একে অপরকে তাড়িয়ে ফিরছে। কখনও ঝিরঝরে, কখনও বা প্রবল বৃষ্টি ঝরিছে। কর্দমাক্ত গলি পথে সে সাবধানে ফেলা পায়ের শব্দ শুনতে পেল। দরজার কাছে এসে থেমে গেল এ পদশব্দ।
কে একজন দরজায় ধাক্কা দিল।
কে ওখানে? বৃদ্ধ এক মহিলা জিজ্ঞাসা করল।
নূরান ভয়ে আঁতকে উঠল। সে নিচুপ হয়ে রইল।
কে ওখানে? রেগে জিজ্ঞাসা করল ঐ মহিলা, কথা বলছ না কেন?
নূরান উঠে দাঁড়াল। বিড় বিড় করে অস্পষ্ট স্বরে সে কিছু বলতে চাইল। কিন্তু কিছু বোঝা গেল না।
বৃদ্ধা মহিলা গৃহাঙ্গণে এসে দরজা বন্ধ করে দিল।
জুগ্গা, জুগ্গা তুই? মহিলা ফিস ফিস করে বলল, ওরা তোকে ছেড়ে দিল?
না। আমি নূরান। চাচা ইমাম বখশের মেয়ে, মেয়েটি ভয়ে ভয়ে জবাব দিল।
নুরু? তোকে এ সময় এখানে কে আসতে বলেছে? ক্রুদ্ধভাবে জিজ্ঞাসা করল মহিলা।
জুগ্গা কি ঘরে ফিরে এসেছে?
জুল্পার সাথে তোর কি কাজ? নূরুর কথা শেষ না হতেই জুগ্গার মা বলল, তুই ওকে জেলে পাঠিয়েছিস। তুই ওকে বদমায়েশ বানিয়েছিস। তোর বাবা কি জানে, তুই বেশ্যার মতো মাঝ রাতে অচেনা পুরুষের বাড়িতে যাস?
নূরানের কান্না বাধা মানল না, আমরা কাল চলে যাচ্ছি।
এ কথায় বৃদ্ধা মহিলার হৃদয় মথিত হলো না।
তোর সাথে আমাদের কি সম্পর্ক যে, তুই আমাদের সাথে দেখা করতে এসেছিস? তোর যেখানে ইচ্ছা সেখানেই যা।
নূরান দৃঢ়তার সাথে বলল, আমি যেতে পারি না। জুয়া আমাকে বিয়ে করার প্রতিজ্ঞা করেছে।
দূর হ, নষ্টা মেয়ে কোথাকার, বৃদ্ধা মহিলা হুঙ্কার দিয়ে উঠল। একটা মুসলমান তাঁতীর মেয়ে তুই। বিয়ে করবি একটা শিখ চাষীর ছেলেকে। দূর হ এখান থেকে। তা না হলে আমি তোর বাপ ও সারা গ্রামের লোকদের বলব। পাকিস্তানে তুই চলে যা, আমার জুগ্গাকে একা থাকতে দে।
নূরান খুব ব্যথিত হলো। মনে হলো, তার জীবন প্ৰদীপ নিভে গেছে।
ঠিক আছে, আমি চলে যাচ্ছি। আমার ওপর রাগ করবেন না। জুগ্গা ফিরে এলে তাকে বলবেন আমি এসেছিলাম তার কাছ থেকে বিদায় নিতে। মেয়েটি হাঁটু গেড়ে বসে বৃদ্ধ মহিলার দুপা চেপে ধরে ফুঁপিয়ে কাঁদতে লাগল। আমি চলে যাচ্ছি। আর কোনদিন ফিরে আসব না। যাওয়ার সময় আপনি আমার প্রতি কঠোর হবেন না।
জুল্লার মা শক্ত হয়েই দাঁড়িয়ে রইল। তার আচরণে আবেগের কোন লক্ষণ দেখা গেল না। কিন্তু অন্তরে সে কিছুটা দুর্বল ও নরম হয়ে গেল। তোর কথা আমি জুগ্গাকে বলব।
নূরান কান্না থামাল। কিন্তু মাঝে মাঝে তার ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কান্না থামল না। সে তখনও জুল্লার মারা পা জড়িয়ে ছিল। তার মাথা ছিল নত। সে তার নত মাথা আরও ঝুঁকিয়ে জুগ্গার মায়ের পায়ের ওপর রাখল।
নূরান যেন কিছু বলতে গিয়েও পারল না।
কি বলতে চাস তুই? মেয়েটি কি যেন বলতে চায় তা সে আশঙ্কা করল।
নূরান বিড় বিড় করে কি যেন বলল!
বিড় বিড় করে কি বলছিস, স্পষ্ট করে কিছু বল না, বৃদ্ধা তাকে জিজ্ঞাসা করল। সে তাকে ঠেলে দূরে সরিয়ে দিল। কি হয়েছে তোর?
মেয়েটি মুখের থুথু গিলল।
আমার পেটে এখন জুগ্গার বাচ্চা। আমি পাকিস্তান যাওয়ার পরে ওরা যদি জানে আমি শিখের বাচ্চা পেটে ধরেছি, তাহলে ওরা ওকে মেরে ফেলবে।
নূরান বৃদ্ধ মহিলার পায়ের ওপর আবার মাথা রাখার চেষ্টা করল। এবার সে বাধা দিল না। নূরান তার পা দুটি ধরে অঝোরে কাঁদতে লাগল।
কতদিনের বাচ্চা?
মাত্র কয়েক দিন হলো আমি বুঝতে পেরেছি। এখন দুমাস।
জুগ্গার মা কোন কথা বলল না। নূরানের দিকে দু’হাত বাড়িয়ে দিল। তাকে উঠতে সাহায্য করল। তারপর দুজনেই চারপাই-এর ওপর গিয়ে বসল। নূরান কান্না থামাল।
শেষে জুগ্গার মা বলল, তোমাকে এখানে রাখা সম্ভব নয়। পুলিশের সাথে আমার নানা সমস্যা আছে। সব কিছু ঠিক হলে এবং জুগ্গা ফিরে এলে তোমাকে সে ফিরিয়ে আনবে। তুমি যেখানেই থাক না কেন, সেখানেই সে তোমাকে আনতে যাবে। তোমার বাপ কি, একথা জানে?
না। সে একথা জানলে আমাকে অন্যের সাথে বিয়ে দিয়ে দেবে, আর না হয় আমাকে মেরে ফেলবে, মেয়েটি আবার কাঁদতে শুরু করল।
আহ্, ঘেনঘেনানি বন্ধ করা, দৃঢ়তার সাথে বৃদ্ধা মহিলা আদেশ দিল। ঐ সময় তোমার একথা খেয়াল ছিল না? আমি তোমাকে বলেছি, জুগ্গা ফিরে এসেই তোমাকে নিয়ে আসবে।
নূরান তার কান্না থামাল।
সে যেন বেশি দেরি না করে।
সে তার নিজের গরজেই তাড়াতাড়ি যাবে। সে যদি তোমাকে না নিয়ে আসে, তাহলে তাকে আর একটা বিয়ে করতে হবে। কিন্তু আমাদের কাছে একটা পয়সা বা গহনা নেই। সে যদি একটা বউ চায় তাহলে তোমাকেই ঘরে আনতে হবে। ভয় করো না।
নূরানের মন একটা অস্পষ্ট আশায় ভরে উঠল। সে অনুভব করল, সে এই বাড়ির লোক এবং এই বাড়ি তার। যে চারপাই-এ সে বসে আছে, মহিষ, জুগ্গার মা-সব তার। জুগ্গা যেতে ব্যর্থ হলে সে নিজেই ফিরে আসতে পারে। সে তাদের বলতে পারবে যে, সে বিবাহিত। তার সীমাহীন আশার মাঝে তার পিতার চিন্তা এক টুকরা কালো মেঘের মতো মনে হলো। সে তার পিতাকে না বলেই চলে আসবে। তার আশা উজ্জ্বল থেকে উজ্জ্বলতর হলো।
সকালে সুযোগ পেলে আমি আবার এসে আপনার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে যাব। আমি এখন যাই, সব কিছু আবার গোছাতে হবে। বিদায়। আবেগভরা মন নিয়ে নূরান বৃদ্ধা মহিলাকে জড়িয়ে ধরল। চাপা স্বরে সে আবার বলল, বিদায়। তারপর সে চলে গেল।
চারপাই-এ বসে রইল জুগ্গার মা। ঘন অন্ধকারের দিকে সে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল কয়েক ঘণ্টা ধরে।