ইকবালকে গ্রেফতার করতে দুজন কনষ্টেবলকে পাঠানোর সময় দশ জন কনস্টেবলকে পাঠানো হয়েছিল জুগ্গাত্ সিংকে গ্রেফতার করতে। তারা জুগ্গাত্-এর বাড়িতে গিয়ে বাড়ির চতুর্দিক ঘিরে রইল। রাইফেলসহ কনস্টেবলরা পাশের বাড়ির ছাদের ওপর বসে জুৰ্গাত্র-এর বাড়ির দিকে তাক করে রইল। এরপর রিভলবারসহ ছয়জন কনস্টেবল বাড়ির মধ্যে গিয়ে প্রবেশ করল। জুগ্গাত্ সিং খাটিয়ার ওপর ঘুমিয়ে ছিল। তার পা থেকে মাথা পর্যন্ত একটা ময়লা চাদর দিয়ে ঢাকা। সে নাক ডাকিয়ে ঘুমাচ্ছিল। দুই রাত ও একদিন সে জঙ্গলে কাটিয়েছে খাদ্য ও আশ্রয় ছাড়াই। ঐ দিন ভোর রাতেই সে বাড়ি ফিরেছে। তার ধারণা, ঐ সময় গ্রামের সব লোক ঘুমিয়ে থাকবে এবং তাকে কেউ দেখতে পাবে না। কিন্তু গ্রামের লোক সতর্ক প্রহরায় ছিল। তার আগমনের সাথে সাথে তারা পুলিশকে খবর দেয়। তবু তারা অপেক্ষায় ছিল জুগ্গাত্-এর খাওয়া ও ঘুমিয়ে না যাওয়া পর্যন্ত। তার মা বাইরে গিয়েছিল। ঘরের দরজা বাইরে থেকে বন্ধ করে।
জুগ্গাত্ সিং-এর পায়ে বেড়ি এবং ডান হাতে হাতকড়া লাগিয়ে দেয়া হলো। তখনও সে ঘুমিয়ে। পুলিশরা তাদের রিভলভারের খাপ থেকে রিভলবার বের করে নিল। রাইফেলধারী পুলিশরাও বাড়ির আঙ্গিনায় এসে জমায়েত হলো। তারা বন্দুকের বাট দিয়ে জুগ্গাত্কে গুতা মারল।
ও জুগ্গা, উঠে পড়, সন্ধ্যা হয়ে এলো যে!
দেখ, কিভাবে সে শূকর ছানার মতো ঘুমিয়ে আছে। কি ঘটে যাচ্ছে তার কোন খেয়াল নেই।
চোখ রাগড়াতে রাগড়াতে জুগ্গা ক্লান্তভাবে উঠে বসল। দার্শনিক উদাসীনতায় সে তার হাতের কড়া ও পায়ের বেড়ি দেখল। তারপর সে তার দুবাহু প্রসারিত করে জোরে হাই তুলল। ঘুমে তার চোখ বুজে এল। সে বসেই ঝিমুতে লাগল।
জুগ্গাতু সিং-এর মা বাড়িতে এসে দেখল তার বাড়ির উঠেন অস্ত্ৰধারী পুলিশে ভর্তি। সে দেখল তার ছেলে খাটিয়ার ওপর বসে আছে। তার মাথা রয়েছে হাতকড়া বাঁধা হাতের ওপর। তার চোখ বন্ধ। সে তার কাছে ছুটে গিয়ে তাকে জড়িয়ে ধরল। তার হাতের মধ্যে নিজের মাথা রেখে সে কান্নায় ভেঙ্গে পড়ল।
জুগ্গাত্ সিং তন্দ্রাচ্ছন্নভাব থেকে জেগে উঠল। সে তার মাকে পিছনের দিকে জোর করে সরিয়ে দিল।
তুমি কাঁদছো কেন?, সে বলল। তুমি তো জানো ঐ ডাকাতিতে আমি জড়িত ছিলাম না।
কিন্তু তার কান্না থামল না। সে এ কাজ করেনি। সে কিছুই করেনি। ভগবানের নামে শপথ করে বলছি, সে কিছুই করেনি।
তা হলো খুনের রাতে সে কোথায় ছিল? হেড কনস্টেবল জিজ্ঞাসা করল। সে রাতে সে নিজের ক্ষেতে ছিল। সে ডাকাত দলের সাথে ছিল না। আমি শপথ করে বলছি, সে ছিল না।
সে একটা বদমায়েশ। সন্ধ্যার পর তার গ্রামের বাইরে যাওয়া নিষেধ। এ কারণে হলেও তাকে আমাদের গ্রেফতার করতে হবে। সে তার লোকদের দিকে তাকিয়ে বলল, ঘর ও তার চারপাশে তল্লাশি কর। হেড কনষ্টেবলের সন্দেহ ছিল যে, জুগ্গাত সিং তার নিজের গ্রামে। ঐ ডাকাতির সঙ্গে জড়িত ছিল না। কারণ এ ধরনের ঘটনা সাধারণত ঘটে না।
চারজন কনস্টেবল ঘর ও তার চারপাশে তল্লাশির কাজে লেগে গেল। তারা টিনের বাক্স খুলে সব জিনিস বের করল। খড়ের গাদা টেনে নামিয়ে ফেলল। ঘরের আঙ্গিনায় খড় ছড়িয়ে ছিটিয়ে দিল। এর মধ্য থেকে বেরিয়ে এল বর্শাটি।
আমার মনে হয় তোমার চাচা এটা এখানে রেখে দিয়েছে, জুগ্গার মাকে লক্ষ্য করে রসিকতা করে বলল হেড কনষ্টেবল। এর ধারাল অংশ কাপড় দিয়ে জড়িয়ে রাখ। এতে রক্তের দাগ লেগে থাকতে পারে।
এতে কিছুই নেই, জুগ্গার মা চিৎকার করে বলল, ক্ষেতে ফসল নষ্ট করতে আসা শুয়োর মারতে সে এটা রেখেছিল। আমি শপথ করে বলছি, সে নির্দোষ।
আমরা দেখব, আমরা অবশ্যই দেখব। হেড কনস্টেবল জুগ্গার মায়ের কথায় আমল না দিয়ে বলল, তুমি বরং ম্যাজিষ্ট্রেটের কাছে উপস্থাপনের জন্য তার নির্দেষিতার প্রমাণ তৈরি রাখ।
বৃদ্ধ মহিলাটি তার কান্না থামাল। তার কাছে প্রমাণ আছে। এক প্যাকেট ভাঙ্গা চুড়ি। সে জুয়াকে এ কথা বলেনি। এ কথা তাকে বললে রাগে ও অপমানে ক্ষিপ্ত হয়ে উঠত। এখন তার পায়ে বেড়ি, হাতে কড়া। এখন তার শুধু মেজাজ খারাপ হওয়ার কথা।
দাঁড়াও পুলিশ ভাই, আমার কাছে প্রমাণ আছে।
রংয়ের কাগজ দিয়ে মোড়া একটা প্যাকেট নিয়ে এল। সে কাগজের মোড়া খুললো। এর মধ্যে দেখা গেল নীল ও লাল রংয়ের ভাঙ্গা কাচের চুড়ি। এর মধ্যে দু’টো চুড়ি অক্ষত অবস্থায় রয়েছে। হেড কনস্টেবল এগুলো হাতে নিল।
এর থেকে কি প্রমাণ পাওয়া যায়?
খুন করার পর ডাকাতরা এগুলো ঘরের আঙ্গিনায় ছুড়ে মারে। তাদের সাথে না যাওয়ার জন্য তারা জুগ্গাকে অপমানিত করে। দেখ! বৃদ্ধা মহিলা তার হাত প্রসারিত করে বলল, আমি বৃদ্ধা। আমি কাচের চুড়ি পরি না। তাছাড়া এগুলো এতই ছোট যে, আমার হাতে পরা যাবে না।
তাহলে জুগ্গা অবশ্যই জানে ঐ ডাকাতদের। চুড়ি নিক্ষেপ করার সময় তারা কি বলেছিল? হেড কনস্টেবল জিজ্ঞাসা করল।
না, তারা কিছুই বলেনি। জ্বপ্নাকে তারা শুধু অপমানিত করেছিল…।
জুগ্গা তার মায়ের কথার মাঝে বলল, তুমি কি মুখ বন্ধ করবে? কারা ডাকাত আমি জানিনে। আমি যা জানি তা হলো, ঐ ডাকাতদের সাথে আমি ছিলাম না।
তোমার জন্য চুড়ি রেখে দিয়েছে কারা? হেড কনষ্টেবল জিজ্ঞাসা করল। তার মুখে মৃদু হাসি দেখা গেল।
জুগ্গা তার মেজাজ ঠিক রাখতে পারল না। হাতকড়া পরানো হাতটা সে উঁচু করে হেড কনষ্টেবলের হাতের মধ্যে রাখা চুড়ির দিকে নিক্ষেপ করল সজোরে। কোন মায়ের বেজন্ম ছেলে আমাকে লক্ষ্য করে চুড়ি ছুড়েছে? কোন…।
কনষ্টেবলরা জুগ্গাত্কে ঘিরে ধরল। তারা তাকে থাপ্পড় মারল এবং জুতো দিয়ে লাথি মারতে লাগল। জুগ্গা খাটিয়ার ওপর বসে তার হাত দিয়ে মাথা ঢেকে রাখল। তার মা তার কপাল চাপড়ে পুনরায় কান্না শুরু করল। সে পুলিশের কর্ডন ভেদ করে ছেলের কাছে আছড়ে পড়ল।
তাকে মেরো না। তোমাদের ওপর গুরুর অভিশাপ নেমে আসবে। সে নির্দোষ। এটা আমার অপরাধ। মারতে হয় আমাকে মার।
জুগ্গাকে মারা বন্ধ হলো। হেড কনস্টেবল তার হাতের তালুতে আটকে যাওয়া কাচের টুকরা বের করল। রক্তের দাগ মুছে ফেলল রুমাল দিয়ে।
সে জুগ্গার মাকে লক্ষ্য করে বেশ কৰ্কশভাবেই বলল, তোমার ছেলের নির্দেষিতার প্রমাণ হিসাবে এগুলো রেখে দাও। তোমার শয়তান ছেলের কাছ থেকে আমরা আমাদের পদ্ধতিতে আসল কথা জেনে নেব। পাছায় কয়েকটা বেত পড়লে সে কথা বলবে। এরপর অন্য পুলিশদের দিকে তাকিয়ে বলল, নিয়ে চল। ওকে।
জুগ্গাত্ সিংকে বাড়ির বাইরে নিয়ে যাওয়া হলো। তার হাতে হাতকড়া, পায়ে বেড়ি। তার মায়ের কান্না তখনও থামেনি। সমানে সে কপাল ও বুক চাপড়ে যাচ্ছিল। এ অবস্থাতেও জুগ্গার আচরণে আবেগের কোন লক্ষণ দেখা গেল না। তার বিদায়ী কথা ছিল এ রকম :
আমি তাড়াতাড়ি ফিরে আসব। বর্শা রাখার জন্য ও গ্রাম থেকে বাইরে যাওয়ার জন্য তারা আমাকে কয়েক মাসের বেশি আটকে রাখতে পারবে না। বিদায়।
জুগ্গা যেমন ক্ষণিকের মধ্যে তার মেজাজ খারাপ করে ফেলেছিল, ঠিক তেমনি দ্রুত তার মেজাজ ঠাণ্ডা হয়ে এলো। সে চুড়ির ঘটনা ভুলে গেল। ঘরের আঙ্গিনার বাইরে পা দিয়েই সে পুলিশ প্ৰহারের কথা ভুলে গেল। পুলিশের প্রতি তার কোন বিদ্বেষ নেই বা তাদের কোন ক্ষতি করারও ইচ্ছা নেই। অন্যান্য মানুষের মতো তারা মানুষ নয়। তাদের কোন স্নেহ-মমতা নেই। অনুরাগ নেই। নেই কোন শক্ৰতা। তারা শুধুই ইউনিফর্ম পরা মানুষ-মানুষ যাদের এড়িয়ে চলতে চায়।
জুগ্গাত্ সিং-এর মুখ ঢেকে রাখার কোন প্রয়োজন ছিল না। কারণ সারা গ্রামের লোক তাকে চেনে। সে গ্রামের পথ ধরে হাটছিল হাসতে হাসতে। কাউকে দেখতে পেলে হাতকড়া পরা হাত দিয়ে অভিবাদন জানাচ্ছিল। পায়ে বেড়ি থাকায় তাকে হাঁটতে হচ্ছিল আস্তে আস্তে। তার পদক্ষেপ ছিল ছন্দপূর্ণ। সে তার পাতলা সরু মোচে তা দিয়ে প্রকাশ করল, তার কোন চিন্তা নেই। পুলিশের দিকে তাকিয়ে সে ব্যঙ্গোক্তিও করুল অশ্লীল ভাষায়।
নদীর ধারে এসে দুজন পুলিশসহ ইকবাল জুগ্গাত্ সিং-এর দলের সাথে মিশলেন। তারা সবাই উজান মুখে ব্রিজের দিকে চলল। হেড কনস্টেবল ছিল সবার আগে। অস্ত্ৰধারী পুলিশ ছিল বন্দীর পাশে ও পিছনে। পুলিশদের খাকি ও লাল ইউনিফর্মের মাঝে ইকবালকে ভাল করে দেখা যাচ্ছিল না। কিন্তু জুগ্গাত্ সিং-এর ঘাড় ও মাথা দেখা গেল পুলিশের পাগড়ির ওপর। মনে হলো, মাঝখানে হাতিসহ ঘোড়ার একটা মিছিল। হাতিটা লম্বা চওড়া, ধীর গতিসম্পন্ন এবং তার পায়ে বেড়ি। হাঁটার সময় ঝন ঝন শব্দ হচ্ছিল। ঐ শব্দ যেন সজ্জিত অনুষ্ঠানের জন্যই সৃষ্টি করা হয়েছিল!
কেউ কথা বলার মেজাজে ছিল বলে মনে হলো না। পুলিশরাও অস্বস্তিতে ভুগছিল। তারা বুঝতে পেরেছে যে, তারা হয় একটা আর না হয় দুটা ভুল করেছে। একজন সমাজকর্মকে গ্রেফতার করা তাদের মারাত্মক ভুল হয়েছে এবং এজন্য তাদের সাংঘাতিক বিড়ম্বনা হতে পারে। তিনি যে নির্দোষ তা তার উদ্ধত আচরণে প্রকাশ পেয়েছে। তাঁর বিরুদ্ধে অবশ্য অন্য যে কোন মামলা দায়ের করা যেতে পারে। শিক্ষিত লোকের ব্যাপারে এ ধরনের চালাকির আশ্রয় প্রায়ই নিতে হয়। জুগ্গাত্ সিংকে গ্রেফতার করা অবশ্য ঠিক হয়েছে। কারণ সে রাতে গ্রামের বাইরে গিয়ে নিঃসন্দেহে আইন ভঙ্গ করেছে। কিন্তু নিজের গ্রামের এক বাড়িতে ডাকাতির কাজে সম্ভবত সে অংশ গ্ৰহণ করেনি। বিরাট দেহ নিয়ে ঐ কাজে গেলে সহজেই লোকে তাকে চিনে ফেলত। এ কথাও সত্য যে, ইকবাল ও জুগ্গাত্ সিং এই প্রথম একে অপরের সাথে মিলিত হলো।
ইকবাল নিজেকে অপমানিত বোধ করলেন। জুগ্গাত্ সিংকে দেখার পর তাঁর মনে হয়েছিল যে, রাজনৈতিক কারণেই তাঁকে গ্রেফতার করা হয়েছে। তিনি নিজে হাতকড়ি লাগাবার অনুরোধ করেছিলেন এই কারণে গ্রামবাসী তাঁকে দেখে এই ধারণা নিক যে, তিনি কতটা মৰ্যাদার অধিকারী। সামাজিক স্বাধীনতার ঐ হাল দেখে গ্রামবাসীরা নিশ্চয়ই ক্ষুব্ধ হতো। কিন্তু পুরুষরা তাঁর দিকে বিস্ময়ভরা দৃষ্টিতে তাকাল আর মেয়েরা অবগুণ্ঠনের ফাঁক দিয়ে তাকিয়ে একে অপরকে জিজ্ঞাসা করল, লোকটা কে? জুগ্গাত্ সিংকে পাহারা দিয়ে নিয়ে যাওয়া দলের সাথে তিনি যখন মিশলেন তখন তাঁর পুলিশের সেই উপদেশের (আপনি মুখ ঢেকে নিন। অন্যথায় সনাক্তকরণ প্যারেডে সবাই আপনাকে চিনে ফেলবে) কথা মনে হলো। তাঁকে গ্রেফতার করা হয়েছে রামলালের খুনের সাথে জড়িত থাকার কারণে। এমন নিবুদ্ধিতা তাঁর বিশ্বাস হয় না। প্রত্যেকেই জানে যে, রামলাল খুন হওয়ার পর তিনি মানো মাজরায় আসেন, এমনকি পুলিশের সাথে একই ট্রেনে। খুন হওয়ার সময় তিনি এখানে ছিলেন না, এ কথার সাক্ষ্য তারাও দিতে পারবে। হাস্যকর এই ঘটনা বলার ভাষা নেই। কিন্তু পাঞ্জাবী পুলিশ সেই ধরনের পুলিশ নয় যারা ভুল করে স্বীকার করে যে, ভুল করা হয়েছে। তারা যে কোন অভিযোগ দায়ের করবে: ভবঘুরে, অফিসারদের কাজে বাধা দান বা অনুরূপ অন্য কোন অভিযোগ। এর বিরুদ্ধে অবশ্যই তিনি আপ্ৰাণ লড়বেন।
ঐ দলের মধ্যে জ্বগ্নাত্ সিং-এর মনে কোন ভাবান্তর দেখা দিল না। এই ঘটনায় সে যেন কিছুই মনে করেনি। আগেও সে গ্রেফতার হয়েছে। সে বাড়িতে যত দিন কাটিয়েছে প্রায় ততদিন সে জেলে কাটিয়েছে। পুলিশের সাথে তার সম্পর্ক বলা যায় উত্তরাধিকারসূত্রে প্রাপ্ত। পুলিশের দশ নম্বর খাতায় তার পিতা আলম সিং-এর নাম ছিল। অসৎ চরিত্রের লোকদের কাজের ফিরিস্তি এই খাতায় থাকে। খুন করে ডাকাতি করার দায়ে আলম সিং দোষী সাব্যস্ত হয় এবং তার ফাঁসি হয়। উকিলের পয়সা যোগাড় করতে জুৰ্গাত্ সিং-এর মাকে সব সম্পত্তি বন্ধক দিতে হয়। সম্পত্তি ফেরত আনার জন্য জুগ্গাত সিংকে টাকার যোগাড় করতে হয় এবং ঐ বছরেই সে টাকা ফেরত দিয়ে জমি ছাড়িয়ে নিয়েছে। কিভাবে সে ঐ টাকা যোগাড় করেছে কেউ তার প্রমাণ দিতে পারবে না। বছর শেষেই পুলিশ তাকে ধরে নিয়ে যায়। তার নাম খাতার দশ নম্বরে অন্তর্ভুক্ত করা হয়। সরকারীভাবে তাকে অসৎ চরিত্রের লোক বলে ঘোষণা করা হয়। তার অগোচরে লোকে তাকে দশ নম্বর বলে ঠাট্টা করে।
জুগ্গাত্ সিং তার পাশের বন্দীর দিকে কয়েকবার তাকিয়ে দেখল। সে তার সাথে আলাপ করতে চাইল। কিন্তু ইকবালের সেদিকে খেয়াল ছিল না। তাঁর দৃষ্টি ছিল সামনের দিকে নিবদ্ধ। তিনি যেন হাঁটছিলেন ক্যামেরাসচেতন একজন নায়কের মতো করে যার দৃষ্টি ক্যামেরার লেন্সের দিকেই প্রসারিত। জুগ্গাত্ সিং আর ধৈর্য রাখতে পারল না।
শুনুন। আপনি কোন গ্রাম থেকে আসছেন? কপট হেসে জুগ্গাত্ সিং জিজ্ঞাসা করল। হাসির সময় তার সামনের দাঁতগুলো দেখা গেল। মাঝের একটা দাঁত সোনা দিয়ে বাঁধানো।
ইকবাল ফিরে তাকালেন, কিন্তু হাসির জবাব দিলেন না। আমি কোন গ্রামের বাসিন্দা নই। আমি দিল্লী থেকে এসেছি। কৃষকদের সংগঠিত করার জন্য আমাকে পাঠানো হয়েছিল। কিন্তু লোকগুলো সংগঠিত হোক সরকার এটা চায় না।
জুগ্গাত্ সিং ভদ্র হয়ে গেল। ঘনিষ্ঠ লোকের সাথে লোকে যেভাবে কথা বলে সে ধরনের কথা থেকে সে বিরত রইল। আমরা শুনেছি আমরা এখন স্বাধীন, সে বলল। দিল্লীতে এখন মহাত্মা গান্ধীর সরকার, তাই না? আমাদের গ্রামে লোকে এ রকমই বলে।
হ্যাঁ। ইংরেজরা চলে গেছে। কিন্তু তাদের স্থান দখল করেছে ধনী ভারতীয়রা। স্বাধীনতা থেকে তুমি বা তোমার গ্রামের লোক কি পেয়েছে? বেশি রুটি বা বেশি কাপড়? ইংরেজরা যে হাতকড়া ও বেড়ি পরাত তোমাদের, সেই হাতকড়া তোমার হাতে, সেই বেড়ি তোমার পায়ে। এর বিরুদ্ধে আমাদের সংগঠিত হয়ে প্রতিবাদ করতে হবে। এই শৃঙ্খল ছাড়া আমাদের আর কিছুই হারাবার নেই। ইকবাল শেষের কথাটা খুব জোর দিয়ে বললেন। তিনি তাঁর দু’হাত মুখের কাছে এনে একটা বড় রকমের বাঁকুনি দিলেন। তাঁর প্রকাশভঙ্গি এমনই যেন ঐ আন্দোলন হাতকড়া ভেঙ্গে ফেলবে!
পুলিশরা পরস্পরের দিকে তাকাল।
জুগ্গাত্ সিং তার পায়ের বেড়ির দিকে তাকাল। হাতকড়ার সাথে সংযুক্ত লোহার রডটাও সে তাকিয়ে দেখল।
আমি একটা বদমায়েশা। সব সরকারই আমাকে জেলে ঢোকায়।
কিন্তু, ইকবাল বেশ ক্রুদ্ধভাবেই তার কথায় বাধা দিয়ে বললেন, কে তোমাকে বদমায়েশ বানিয়েছে? সরকার। সরকার আইন প্রণয়ন করে এবং রেজিস্টার, জেলার ও পুলিশ রাখে ঐ আইন বলবৎ করার জন্য। কাউকে তাদের পছন্দ না হলে তাদের আইনে সে হয় অসৎ চরিত্রের লোক, অপরাধী। আমি কি করেছি …
না বাবু সাহেব, সহস্যে জুগ্গাত্ সিং বলল, এটাই আমাদের ভাগ্য। এটা আমাদের কপালে ও হাতের রেখায় লেখা আছে। আমি সব সময় কিছু করতে চেয়েছি। জমি চাষ করার সময় বা ফসল ঘরে তোলার সময় আমি ব্যস্ত থাকি। যখন কোন কাজ থাকে না তখনও আমি কাজ করতে উদ্গ্ৰীব থাকি। সুতরাং আমি কিছু কাজ করি এবং তা সব সময় হয়ে যায় অপরাধমূলক কাজ।
এ সময় তারা ব্রিজের নিচ দিয়ে পার হয়ে রেষ্ট হাউসের নিকটবর্তী হলো। জুগ্গাতু সিং-এর আত্মপ্রসাদের কথা শুনে ইকবালের মেজাজ খারাপ হয়ে গেল। একজন গ্ৰাম্য অসৎ চরিত্রের লোকের সাথে তর্ক করে তিনি সময় নষ্ট করতে চাইলেন না। তিনি ম্যাজিষ্ট্রেটের জন্য সব কথা জমা রাখতে চাইলেন। সব কথা তিনি তাঁকে ইংরেজীতে বলবেন-সে সব কথা তিনি কিভাবে বলবেন সেই চিন্তাই তাঁকে পেয়ে বসল।