৪.২০ পেরিমিটার রোডের এধারে

৪.২০

অনেকক্ষণ পেরিমিটার রোডের এধারে দাঁড়িয়ে রইলেন শেখরনাথ। তার ঠিক পাশে বিনয় এবং আশপাশে অসংখ্য উদ্বাস্তু আর পুনর্বাসন দপ্তরের কর্মীরা। সুভাষ মজুমদারের জঙ্গলে যাওয়ার খবর পেয়ে বন বিভাগের কর্মীরাও চলে এসেছে।

প্রবল উদ্বেগে, দুশ্চিন্তায় সবাই চুপ। নিরেট নৈঃশব্দ্যের ভেতর দু-চারজন বয়স্ক উদ্বাস্তু শুধু বিড় বিড় করে অবিরল বলে চলেছে–’মা দুৰ্গা, মা কালী, জগজ্জননী মাগো, তুমরা দয়া কর। মানুষডারে। (মানুষটাকে) ভালায় ভালায় (ভালোয় ভালোয়) ফিরাইয়া আনো। তেনার য্যান এতটুক ক্ষেতি না অয় (হয়)।‘

পেরিমিটার রোডের এধারে ঘন জঙ্গলের দিকে তাকিয়ে অনেকক্ষণ সবাই দাঁড়িয়ে রইল। তারপর একে একে ব্যারাকগুলোর কাছে ফিরে ছড়িয়ে ছিটিয়ে বসে রইল।

আজ আর কারও কাজকর্মে মন নেই। দা-কুড়াল কি শাবল টাবল নিয়ে একজন উদ্বাস্তুও জমিতে নামল না। তারা তো বটেই, জেফ্রি পয়েন্টের প্রতিটি মানুষের ওপর পাষাণভারের মতো একটাই চিন্তা চেপে বসে আছে। সুভাষ মজুমদার যদি জারোয়াদের বুঝিয়ে-সুঝিয়ে শান্ত করতে নাও পারেন, জীবন্ত যেন ফিরে আসেন।

শেখরনাথ এবং বিনয় জঙ্গলের ধার থেকে সোজা নিজেদের ঘরে চলে এসেছিলেন। দু’জনেই চুপচাপ। কিছুক্ষণ দু’হাতে মুখ ঢেকে বসে ছিলেন শেখরনাথ। তারপর জানলার বাইরে তাকিয়ে রইলেন। ভীষণ চিন্তাগ্রস্ত। বিনয়েরও অস্থির অস্থির লাগছিল। একসময় বাইরে থেকে চোখ ফিরিয়ে এনে শেখরনাথ ভারী গলায় বললেন, ‘আমারই বোধহয় ভুল হয়ে গেছে বিনয়—’

প্রাক্তন বিপ্লবীটি কোন ভুলের ইঙ্গিত দিয়েছেন, মোটামুটি তা আন্দাজ করতে পারছিল বিনয়। তবু জিগ্যেস করল, ‘কিসের ভুল কাকা?’

‘পোর্টব্লেয়ার থেকে সুভাষকে টেনে এনে জঙ্গলে পাঠানো ঠিক হয়নি। রং ডিসিশন। ভুল সিদ্ধান্ত—’ তাঁর কণ্ঠস্বরে অনুশোচনার সুরটাই যেন ফুটে উঠল।

বিনয় উত্তর দিল না।

শেখরনাথ বলতে লাগলেন, ‘সুভাষ মিডল আন্দামানের জারোয়াদের সঙ্গে যোগাযোগ করতে পেরেছে। হয়তো এজন্যে অনেকটা সময় লেগেছিল। যথেষ্ট প্রস্তুতি ছাড়া এমন একটা হিংস্র ট্রাইব্রের ত্রিসীমানায় যাওয়া অসম্ভব। সুভাষ সাউথ আন্দামানের জারোয়াদের নিয়ে কাজ করে নি; তাদের সঙ্গে মেশেও নি। এই মুহূর্তে এখানকার জারোয়ারা মারাত্মক উত্তেজিত আর ক্ষিপ্ত হয়ে আছে। উইদাউট প্রিপারেশন একটা ছেলেকে তাদের তির-ধনুকের মুখে ঠেলে দিলাম! উচিত হয়নি, উচিত হয় নি। সুভাষ যে ওদের বোঝাবে, তার আগেই ওরা যে ঝাঁকে ঝাকে তির মেরে তাকে ঝাঁঝরা করে ফেলবে না, তার তো কোনও নিশ্চয়তা নেই। একবার ছেলেটার দিকটা ভাবলাম না। কাল এল, আজই তাকে জঙ্গলে পাঠালাম। মতিভ্রম। ভয়ঙ্কর হঠকারি সিদ্ধান্ত

কী উত্তর দেবে ভেবে পেল না বিনয়। শেখরনাথের তীব্র অনুতাপ তার মধ্যেও যেন চারিয়ে যাচ্ছিল। সুভাষ মজুমদারের ব্যাপারে এরকম ভয়ঙ্কর সম্ভাবনার চিন্তা তার মাথায়ও তো আসা উচিত ছিল। সে নিজেও তো শেখরনাথকে মর্মান্তিক পরিণাম সম্পর্কে সতর্ক করে দিতে পারত। কেন যে এটা ভাবে নি! এখন তো খুবই দেরি হয়ে গেছে। আর কিছু করার নেই।

শেখরনাথ ম্লানমুখে বললেন, ‘জারোয়ারা দল বেঁধে হামলা করার পর তখন আমার মাথার ঠিক ছিল না। উদ্বাস্তুদের স্বার্থ, জেফ্রি পয়েন্টের ভবিষ্যৎ ছাড়া অন্য কিছুই ভাবতে পারছিলাম না। সুভাষের • কিছু হয়ে গেলে আমার এই শেষ জীবনে দুঃখের আর শেষ থাকবে না। তার কথাগুলো তীব্র কাতরোক্তির মতো শোনাল।

বেলা অনেকটাই চড়ে গেছে। দেখতে দেখতে সূর্য মাথার ওপর উঠে এল। জেফ্রি পয়েন্টের বাসিন্দাদের কোনও বিষয়েই চাড় নেই। কিছুটা দিশাহারা, অনেকটাই উদ্ভ্রান্ত। কেউ, বিশেষ করে উদ্বাস্তুরা বিশেষ কথাটথা বলছিল না। যেটুকুও বা বলছে সবই সুভাষ মজুমদারকে নিয়ে। এরই মধ্যে সমুদ্রে গিয়ে স্নান টান করেছে। কোনওরকমে একটু আধটু খেয়েছে। শেখরনাথ এবং বিনয়ও তাই।

বেলা যখন অনেকটাই হেলে পড়েছে, সূর্য পশ্চিম আকাশের ঢাল বেয়ে নেমে যাচ্ছে দ্রুত, পাহাড়ের মাথায় বিশাল বিশাল প্যাডক আর দিদু গাছগুলোর ছায়া দীর্ঘ হচ্ছে সেই সময় শেখরনাথ বললেন, ‘সেই কখন ছেলেটা জঙ্গলে ঢুকেছে, এখনও তো ফিরল না? মনটা ভীষণ উতলা লাগছে। ঘরে আর বসে থাকতে ইচ্ছা করছে না। এক কাজ করা যাক–

উন্মুখ হয়ে ছিল বিনয়। প্রশ্ন না করে সে তাকিয়ে থাকে।

‘চল, পেরিমিটার রোড পর্যন্ত যাই।’ বলে পায়ে চটি গলিয়ে বেরিয়ে পড়লেন শেখরনাথ। বিনয়ও তার সঙ্গে সঙ্গে চলল। বিপ্লবীদের সম্পর্কে সে শুনেছে তাদের মন লৌহকঠিন। মৃত্যু তাঁদের কাছে অতি তুচ্ছ একটি ঘটনা। কোন একটা বইয়ে সে পড়েছিল একজন বিপ্লবী হাসতে হাসতে ফাঁসির মঞ্চে গিয়ে উঠেছিলেন। বিচারক ফাঁসির রায় ঘোষণা করার পর তার শরীরের ওজন বেড়ে গিয়েছিল। দেশের মুক্তির জন্য মৃত্যুবরণ যেন বড়ই আনন্দের ব্যাপার, নইলে ওজন বাড়তে পারে? মারাত্মক অপরাধের আসামীরা ফাঁসির দড়িতে ঝুলতে হবে, আদালতে তা জানার সঙ্গে সঙ্গে ভয়ে, আতঙ্কে খাওয়া-দাওয়া বন্ধ করে দেয়, রাতে ঘুমোয় না। নির্জন সেলে বসে বসে করুণ কাতর গলায় অবিরাম কেঁদে যায়। কিন্তু বিপ্লবীরা অন্য ধাতুতে গড়া। তাঁদের মধ্যে এত অনন্ত শক্তি কোথায় যে সঙ্গোপন থাকে, কে জানে।– শেখরনাথ রাহা, যিনি ইংরেজদের বিরুদ্ধে অস্ত্র তুলে নিয়েছিলেন, যাবজ্জীবন কালাপানি’র সাজা নিয়ে আন্দামানে এসে আটাশ-উনত্রিশটা বছর সেলুলার জেলে কাটিয়ে দিয়েছেন, সেই অদম্য মানুষটি ব্রিটিশ পুলিশের কত নির্যাতনই না সয়েছেন, তিনিও তো অন্য বিপ্লবীদের চেয়ে আলাদা নন। বজ্রের মতো কঠোর কঠিন মানুষটির মনের ভেতর এমন একটা কোমল দিক যে ছিল, কে ভাবতে পেরেছিল! সুভাষ মজুমদারের জন্য সেই সকাল থেকে তিনি যে কতটা ব্যাকুল, কতটা উতলা হয়ে আছেন, বিনয় তো নিজের চোখেই দেখছে। একই মানুষের ভেতর কতরকম মানুষ যে লুকনো থাকে!

একসময় উদ্বাস্তুদের ভাগ-বাঁটোয়ারা করে দেওয়া জমিগুলোর ওপর দিয়ে পেরিমিটার রোডের কাছে চলে এলেন শেখরনাথ আর বিনয়। উদ্বাস্তুরাও ব্যারাকগুলোর কাছাকাছি থোকায় থোকায় দাঁড়িয়ে বা বসে কথা বলছিল। তারাও পেছন পেছন চলে এসেছে। উৎকণ্ঠা তো তাদেরও কিছু কম নয়।

টঙের মাথায় বুশ পুলিশের দলটা গভীর জঙ্গলের দিকে তাকিয়ে নজরদারি চালাচ্ছিল। শেখরনাথ গলার স্বর উঁচুতে তুলে ডাকলেন, ‘এই মাসুদ, এই জগপত—’

দুই বুশ পুলিশ মুখ ফিরিয়ে এদিকে তাকাল। মাসুদ সাড়া দিল।–’হাঁ, চাচাজি—’

‘সুভাষকে কি দেখা যাচ্ছে?’

নৃতাত্ত্বিক সুভাষ মজুমদারকে আন্দামান দ্বীপপুঞ্জের প্রায় প্রতিটি মানুষ চেনে। মাসুদ বলল, ‘নেহি চাচাজি। সুবেহ সুবেহ মজুমদারসাব জঙ্গল ঘুষা থা। বহোৎ দূর চলা গিয়া। কঁহা গিয়া, কুছ পতা নেহি—’

‘জারোয়াদের দেখতে পাচ্ছ?’

মাসুদ বলল, ‘নেহি। আজ আর ওরা রিফুজ সেটলমেন্টের দিকে আসে নি। ভারী চিন্তা হচ্ছে। মজুমদারসাব ইতনা আচ্ছা আদমি! রিফুজদের জন্যে জান বাজি রেখে খতরনাক জারোয়াদের কাছে চলে গেছে। উপরবালার মেহেরবানিতে তিনি ফিরে আসুন।‘

শেখরনাথ বা অন্য কেউ কিছু বলল না। সুভাষ মজুমদার অক্ষত শরীরে, নিরাপদে দ্রুত ফিরে আসুন, মনে মনে এটাই সবার প্রার্থনা।

ওধারের কাছাকাছি একটা টঙের মাথা থেকে জগপত সিং বলল, ‘ইক (এক) ঘণ্টার ভেতর আন্ধেরা নেমে যাবে। আন্ধেরামে জঙ্গল বহোৎ খতরনাক চাচাজি। রামজি, কিযুণজি মজুমদারসাবকে জলদি জলদি ফিরিয়ে আনুন—’

ঠিকই বলেছে জগপত। অন্ধকারে জঙ্গলের ভেতরটা খুবই বিপজ্জনক। দক্ষিণ আন্দামানের পশ্চিম দিকে মাইলের পর মাইল জুড়ে গভীর অরণ্য। উদ্বাস্তু পুনর্বাসনের জন্য ‘জাঙ্গল ফেলিং’ করে প্রচুর জমি বের করা হলেও এখনও বিপুল পরিসর নিয়ে বাকি অরণ্য দাঁড়িয়ে আছে। আন্দামানের এই অরণ্য এতটাই দুর্ভেদ্য যে দিনের বেলাতেই সেখানে সূর্যালোক পৌঁছয় না। না, বাঘ ভালুক সিংহের মতো হিংস্র জন্তু নেই। মারাত্মক বিষধর সাপের সংখ্যাও কম। তবে অজস্র কানখাজুরা (এক ফুট দেড় ফুটের মতো লম্বা এবং তিন ইঞ্চি চওড়া চেলা বিছে) চারিদিকে থিকথিক করছে। এই সরীসৃপগুলোও সাপের চেয়ে কম ভয়াবহ নয়। শরীরে একবার বিষ ঢাললে পাঁচ মিনিটের ভেতর একজন সবল সুস্থ মানুষের অনিবার্য মৃত্যু। তার ওপর জারায়ারা তো আছেই। জটিল, নিবিড় জঙ্গলে গাঢ় অন্ধকারে পথ চিনে জেফ্রি পয়েন্টে পৌঁছনো প্রায় দুঃসাধ্য ব্যাপার। এ সূর্য পশ্চিম দিকের আড়ালে এখন অনেকটাই নেমে গেছে, রোদের রং মরা মরা, ফ্যাকাশে। সন্ধে নামতে আর দেরি নেই। পেরিমিটার রোডের এধারে শতিনেকের মতো মানুষের উৎকণ্ঠা যখন চরম সীমায় পৌঁছেছে, সবাই যখন সুভাষ মজুমদারের ফেরার আশা ছেড়ে দিতে চলেছে, সেই সময় তিনি বাঁ দিকের বুশ পুলিশের টঙের পাশ দিয়ে ধুঁকতে ধুঁকতে জেফ্রি পয়েন্ট সেটলমেন্টে চলে এলেন। ক্লান্ত, বিধ্বস্ত। তার ওপর দিয়ে জঙ্গলের ভেতর সারাটা দিন যে প্রচণ্ড ঝড় বয়ে গেছে তার ছাপ সুভাষের সমস্ত শরীর জুড়ে। তবে এটা ঠিক তিনি সম্পূর্ণ অক্ষত। যে ব্যাগগুলো নিয়ে জঙ্গলে ঢুকেছিলেন। সেগুলো দেখা যাচ্ছে না। আশ্চর্য, মুখে কিন্তু হাসি লেগেই আছে। আন্দাজ করা যাচ্ছে, যে উদ্দেশ্য বা মিশন নিয়ে তিনি সকালবেলা জঙ্গলে ঢুকেছিলেন তা সফল হয়েছে। শরীর বিপর্যস্ত হলেও তাই মুখমণ্ডলে পরিতৃপ্তির হাসি।

বাঁ দিকের টঙের চুড়ো থেকে মাসুদ জান চেঁচিয়ে উঠল, ‘আল্লা, মেহেরবান। ডান পাশের টঙ থেকে জগপত গলার স্বর শেষ পর্দায় তুলল, ‘রামজি, কিযুণজিকা কিরপা (কৃষ্ণ)।’

বুকের ভেতর থেকে উথলে-আসা আবেগে ঠোঁট দুটো থরথর কাঁপছে শেখরনাথের। কণ্ঠমণিটা ওঠানামা করছে অবিরল। দৌড়ে গিয়ে সুভাষ মজুমদারকে বুকের ভেতর জড়িয়ে ধরলেন তিনি। কথা বলার চেষ্টা করছিলেন কিন্তু গলায় স্বর ফুটছিল না।

কিছু জিগ্যেস না করলে শেখরনাথের সামনে পারতপক্ষে মুখ খোলে না উদ্বাস্তুরা। কিন্তু এই মুহূর্তে তাদের কৌতূহল ঠিকরে ঠিকরে বেরিয়ে আসতে লাগল।

‘কত্তা, চৌপর (চারপ্রহর) দিন আপনের লেইগা আমরা রিফুজরা বেবাকটি (সবাই) চিন্তায় চিন্তায় উয়াস (শ্বাস) বন্ধ কইরা কাটাইছি। কী অইল (হল) আপনের?’

‘আমাগো লেইগা মানুষডার পরানডা কি শ্যাষ অইয়া (হয়ে) গ্যালো? জারোরা (জারোয়ারা) কি তির মাইরা আপনেরে শ্যাষ কইরা ফালাইল—’

‘মা দুর্গা, মা কালী মুখ তুইলা চাইছে—’

‘ভগমান ভালা মাইনষেরে (মানুষকে) চেরডা (চির) কাল রক্ষা করে।‘

‘কী অইল (হল) জঙ্গলে? জারোগগা লগে কি দেখা অইচে (হয়েছে)? কী কয় হ্যারা (তারা)?’

আবেগটাকে প্রাণপণে ঠেলে সরিয়ে কণ্ঠস্বরকে এতক্ষণে বের করে আনতে পারলেন শেখরনাথ। উদ্বাস্তুদের বললেন, ‘সুভাষকে এখন কেউ কিছু জিগ্যেস করো না। দেখছ না, শরীরের কী হাল হয়েছে। পরে সব জানতে পারবে। ওর এখন বিশ্রামের দরকার।‘

এরপর সবাই চুপ। আর কোনও প্রশ্ন করতে কারও সাহস হল না।

সুভাষ মজুমদার ধুঁকছিলেন। শেখরনাথ তাঁর কাধটা পরম মমতায় বেড় দিয়ে ধরে বললেন, ‘আর দাঁড়িয়ে থাকতে হবে না। আস্তে আস্তে চল।‘ পরিতোষ বণিককে বললেন, ‘সুভাষের পক্ষে সমুদ্রে যাওয়া সম্ভব হবে না। গরম জল করে আমাদের ঘরের সামনে দিয়ে যেও। ওখানেই স্নান করে নেবে। তারপর বড় এক গেলাস গরম দুধ আর কয়েকটা ভাল বিস্কুট কারওকে দিয়ে পাঠাও।‘

পরিতোষ বলল, ‘আমি নিজেই লইয়া যামু—’

‘রাতের খাওয়ার ব্যবস্থাটা আজ একটু তাড়াতাড়িই করো। সারাদিন ছেলেটা জঙ্গলে জঙ্গলে ঘুরেছে কিছুই খাওয়া হয়নি।

.

ঘরে নিয়ে যাবার পর অনেকক্ষণ জিরিয়ে নিলেন সুভাষ মজুমদার। এর মধ্যে গরম জল এসে গিয়েছিল। ভাল করে স্নান করে নিলেন তিনি। জলে আশ্চর্য এক জাদু আছে যা শরীরকে সুস্থ করে তোলে।

পোশাক-টোশাক পালটে সুভাষ যখন বিছানায় গিয়ে বসলেন, প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই দুধ-বিস্কুট এসে গেল। তার খাওয়া দেখে বোঝা গেল, সমস্ত দিন তার পেটে কিছুই পড়ে নি।

গভীর আগ্রহে শেখরনাথ সুভাষের দিকে তাকিয়ে ছিলেন। জিগ্যেস করলেন, এখন কি একটু ভাল লাগছে?

‘খুব ভাল কাকা—’ সুভাষের চোখমুখের চেহারা দেখেই বোঝা যায় ধকলটা কাটিয়ে উঠেছেন। বেশ চনমনে মনে হচ্ছে তাকে।

একটু চুপচাপ।

তারপর শেখরনাথ বললেন, ‘জারোয়াদের সঙ্গে যোগাযোগ করা গেল?’

‘হ্যাঁ, অনেক কষ্টে। সুভাষ মজুমদার বলতে লাগলেন, ‘আমাকে তো ওরা চেনে না। নেহাত ওদের ভাষাটা জানতাম তাই প্রাণে বেঁচে গেছি। আপনি তো জানেন, সো-কলড সিভিলাইজ ওয়ার্ল্ডের কারওকে ওরা বিশ্বাস করে না। ভীষ্মের মতো শরশয্যাই আমাকে নিতে হত। যাই হোক, রিফিউজি সেটলমেন্টের জন্যে যে জঙ্গল কাটা হচ্ছে সেজন্যে ওরা ভয়ঙ্কর ক্ষিপ্ত। ওরা চায় গাছ কাটা বন্ধ করে এখান থেকে বাইরের লোকজন সবাই চলে যাক। একজনও যেন এখানে না থাকে।‘

‘আমারও তাই মনে হয়েছিল। বিশুদেরও সেই কথা বলেছিলাম। নিজে চিফ কমিশনারের সঙ্গে দেখা করেছিলাম, আর যেন জঙ্গল ফেলিং না করা হয়। ওরা বলল, ফরেস্ট না কাটলে উদ্বাস্তু সেটলমেন্টের জন্যে জমি কোথায় মিলবে? ঠিকই বলছে। এটা একটা বড় সমস্যা।‘

‘হুঁ। আস্তে আস্তে মাথা নাড়লেন সুভাষ মজুমদার। এটা সত্যিই বড় সমস্যা। আমি জারোয়াদের বুঝিয়েছি তাদের কোনও ভয় নেই। যাদের জন্যে জঙ্গল কাটা হচ্ছে তারা তোমাদের ক্ষতি করবে না। তাদের ওপর তোমরা হামলা চালিও না। কতদূর কী বুঝেছে, জানি না। তবে মনে হল, আপাতত জেফ্রি পয়েন্টে চড়াও হবে না। কিন্তু কাকা—’

‘কী?’

‘ট্রাইবাল পিপলদের মতিগতি বোঝা ভার। কখন যে ওরা কী করে বসবে, আগে থেকে আঁচ করা মুশকিল। তাই সব সময় এখানকার মানুষজন যারা মেনল্যান্ড থেকে এসেছে তাদের সতর্ক থাকতে হবে।‘

চিন্তাগ্রস্তের মতো শেখরনাথ বললেন, ‘খুব মুশকিল হল। সমস্যাটার পুরোপুরি সুরাহা হল না।‘

‘আমি একটা কথা ভাবছি।‘

‘বল—’

‘কয়েকটা দিন আমি এখানে থেকে যাব। যদি তার মধ্যে ওরা সেটলমেন্টে ফের হানা না দেয় বুঝব আর গোলমাল বাধাবে না। যদি তেমনটা হয়, আবার আমাকে জঙ্গলে ঢুকতে হবে।‘

শেখরনাথের চোখমুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠল। –’তুমি জেফ্রি পয়েন্টের একটা বড় বলভরসা। যতদিন ইচ্ছে এখানে থেকে যাও। উদ্বাস্তুদের সাহস তাতে বাড়বে।‘

.

৪.২১

দিন চারেক জেফ্রি পয়েন্টে কাটিয়ে পোর্টব্লেয়ারে ফিরে গেছেন সুভাষ মজুমদার। যে জিপটি এই সেটলমেন্টের জন্য বিশ্বজিৎ রাহা স্থায়ীভাবে পাঠিয়েছেন সেটার চালক হল হরগোবিন। মাঝবয়সি এই লোকটির আদি বাড়ি ছিল বিহারের ছাপরা জেলায়। একসময় কালাপানির সাজা নিয়ে আন্দামানে এসেছিল। দু’বছর শান্তশিষ্ট হয়ে থাকার পর ম্যারেজ সার্টিফিকেট পেয়ে একটি তামিল কয়েদি মেয়েকে বিয়ে করে শাদিপুরে গিয়ে সংসার পাতে। তারপর থেকে তার গৃহপালিত সুখের জীবন। ব্রিটিশ আমলে ট্রান্সপোর্ট ডিপার্টমেন্টে চাকরি পেয়েছিল। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর ইন্ডিয়া গভর্নমেন্ট তাকে সেই একই নৌকরিতে বহাল রেখেছে। সে এখন পুনর্বাসন দপ্তরের অধীনে। লোকটি খুবই বিনয়ী, ভদ্র। কল্পনাই করা যায় না, একদিন ঠাণ্ডা মাথায় দু’দুটো খুনের মতো মারাত্মক অপরাধ করেছে। দেশের মূল ভূখণ্ড থেকে আট ন’শো মাইল দূরের এই বিচ্ছিন্ন দ্বীপপুঞ্জে স্ত্রী এবং বাসস্থান আর ঘর-সংসার তার জীবনটাই আমূল পালটে দিয়েছে।

হরগোবিন সুভাষ মজুমদারকে ব্যাম্বু ফ্ল্যাটের জটিতে পৌঁছে দিয়ে ফিরে এসেছে। সুভাষ ওখান থেকে পোর্টব্লেয়ারের লঞ্চে উঠবেন।

এই আশ্চর্য নৃতাত্ত্বিকটির কথা যখনই বিনয় ভাবে তার মন অসীম শ্রদ্ধায় ভরে যায়। দুর্জয় সাহস তো আছেই, তার চেয়ে অনেক বেশি তার মধ্যে যা রয়েছে তা হল মানুষের প্রতি অফুরান ভালবাসা। নইলে মৃত্যু প্রায় নিশ্চিত জেনেও কেউ কি ভয়াবহ জারোয়াদের এলাকায় ঢুকে পড়তে পারে!

জীবনে চারজন মানুষকে দেখল যাঁদের স্মৃতি আমৃত্যু, শেষ নিঃশ্বাসটি ফেলা পর্যন্ত সে ভুলবে না। তাদের একজন হলেন রাজদিয়ার ফাদার লারমোর, চারিদিকের গ্রামের মানুষজন যাঁকে লালমোহনবাবা কি লালমোহন সাহেব বলে ডাকত। ছেচল্লিশের রাজদিয়া অঞ্চলের দাঙ্গা থামাতে গিয়ে তার মৃত্যু হয়। হাজার হাজার মাইল দূরের ইউরোপ থেকে ঢাকা জেলার রাজদিয়ায় এসে এই দেশ এবং দেশের মানুষকে তিনি আপন করে নিয়েছিলেন। অখণ্ড বাংলা ছিল তাঁর দ্বিতীয় স্বদেশ।

দ্বিতীয় মানুষটি হলেন মামুদপুরের আফজল হোসেন। জীবনের অনন্ত ঝুঁকি নিয়ে তিনি তাকে এবং ঝিনুককে একটা নৌকোয় পদ্মা পার করে তারপাশা স্টিমারঘাটায় পৌঁছে দিয়েছিলেন। জলেস্থলে তখন ঘাতকবাহিনী কাফেরদের নিকাশ করতে রামদা, বর্শা, ট্যাটা নিয়ে দিবারাত্রি ঘুরে বেড়াচ্ছে। তাদের নজর এড়িয়ে সুকৌশলে তিনি বিনয়দের রক্ষা করেছিলেন। আবহাওয়া যখন চরম বিদ্বেষ, ঘৃণা আর বিষবাষ্পে ভরে রয়েছে, সেই সময় দুটি হিন্দু যুবক যুবতাঁকে বাঁচানো প্রায় অকল্পনীয় ছিল, কিন্তু আফজল হোসেন সেই অসাধ্য সাধনটাই করেছেন। তৃতীয় জন হচ্ছেন এই সুভাষ মজুমদার। আর চতুর্থ জন হলেন শেখরনাথ। দেশের জন্য একসময় নিজের জীবনকে সঁপে দিয়েছিলেন। সেলুলার জেল থেকে বেরিয়ে নিজের স্বার্থের, সুখস্বাচ্ছন্দ্যের, আরাম বিলাসের চিন্তাকে কখনও ত্রিসীমানায় ঘেঁষতে দেন নি। স্বাধীনতার পর থেকে হাজার হাজার যেসব উদ্বাস্তু আন্দামানে আসতে শুরু করেছে তাদের পুনর্বাসন না হওয়া অবধি তার নিঃশ্বাস ফেলার সময় নেই। শুধু কি উদ্বাস্তুরা, পেনাল কলোনির পুরনো কয়েদিরা, এমনকি আন্দামানের আদিম জনজাতিগুলোর জন্যও তার বুকের ভেতর যে কী অপার মায়া।

এই চারজনের চিন্তা চারিদিক থেকে বিনয়ের মাথায় ঢুকে যাচ্ছিল।

হঠাৎ আফজল হোসেনের কথা মনে পড়তে তীব্র অপরাধবোধে ভেতরে ভেতরে কুঁকড়ে গেল। বিনয়। তারপাশা স্টিমারঘাটায় গোয়ালন্দের স্টিমারে তাকে আর ঝিনুককে তুলে দিয়ে বার বার আফজল। বলেছিলেন, কলকাতায় পৌঁছেই যেন তাকে অবশ্যই চিঠি লেখে বিনয়। তাদের নিরাপদে পৌঁছবার খবরটা না পেলে তিনি ভীষণ দুশ্চিন্তায় থাকবেন। কেননা তারপাশায় গেলেই সব আতঙ্কের অবসান ঘটবে, এমনটা ভাবার কারণ নেই। স্টিমার তো গোয়ালন্দে নামিয়ে দেবে। সেখান থেকে ইন্ডিয়ার বর্ডার তো অনেকটা পথ। জল্লাদবাহিনী সেখানেও আছে।

সুভাষ মজুমদারের কথা ভাবতে গিয়ে একে একে আরও তিনজনের কথা মনে পড়েছে বিনয়ের। ফাঁদর লারমোর, তার স্মৃতির বৃত্তে সবসময়ই আছেন। সুভাষ মজুমদারকে আন্দামানে এসে দেখল সে। শেখরনাথ তো জেফ্রি পয়েন্টে সারাক্ষণ তার সঙ্গেই আছেন। কিন্তু কলকাতায় আসার পর তার আর ঝিনুকের রক্ষাকর্তা আফজল হোসেনকে সে ভুলে গেল কী করে? হয়তো বলা যায়, কলকাতায় আসার পর তার জীবনটা একেবারে উথালপাতাল হয়ে গেছে। ঝিনুককে নিয়ে তখন তার তুমুর অস্থিরতা। এতটাই দিশেহারা আর উভ্রান্ত যে কোনও দিকে তাকাবার মতো সময়টুকুও ছিল না। আফজল হোসেনকে বেমালুম ভুলে যাওয়ার, তাকে চিঠি না লেখার এটা কি একটা অজুহাত হল? নিজেকে হাজার বার ধিক্কার দিল বিনয়। সে অকৃতজ্ঞ, সে অমানুষ। কিন্তু যা হওয়ার তা তো হয়েই গেছে। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব, আফজল হোসেনের কাছে করজোড়ে ক্ষমা চেয়ে একটা চিঠি লিখবে। ঠিকানা তার জানাই আছে।

বেশ কয়েকদিন আগে মায়া আর বৃন্দাবনের সঙ্গে মাখন পালদের যে তুমুল ঝগড়াঝাঁটি হয়েছিল, শেখরনাথের শাসানিতে তা মিটমাট হয়ে গেছে। সেই থেকে জেফ্রি পয়েন্ট শান্তিতেই দিন কাটিয়ে চলেছে। সম্পূর্ণ নির্বিঘ্নে। আর কোনও উৎপাতের সৃষ্টি হয় নি।

কিন্তু আজ সকালে ফের তুমুল উত্তেজনা দক্ষিণ আন্দামানের এক প্রান্তে উদ্বাস্তুদের এই সৃষ্টিছাড়া উপনিবেশে ছড়িয়ে পড়ল। ঘটনাটা এইরকম।

পশ্চিম দিকের পাহাড় ঘেঁষে লক্ষ্মণ ভক্ত আর নবদ্বীপ কুণ্ডুদের জমি। জমি দু’টো পরস্পরের লাগোয়া। আজ সকালে চা রুটি-টুটি খেয়ে দু’জনেই দা কোদাল-টোদাল নিয়ে জমির আগাছা সাফ করতে এসেছিল। দু’জনের সঙ্গে তাদের বউছেলেমেয়েরা যথারীতি এসেছে। কারও একার পক্ষে পাঁচ একর অর্থাৎ পনেরো বিঘে জমির ঝোঁপঝাড় সাফ করে দু-এক মাসের ভেতর সেটাকে চাষযোগ্য করে তোলা অসম্ভব। তাই প্রতিটি ডিপি ফ্যামিলির সবাইকেই মাঠে উদয়াস্ত খাটতে হয়। জমি সাফাইয়ের পর তার একধারে নিজেদেরই ঘরবাড়ি বানাতে হবে। তারপর চাষবাস। পরিবারের সবাইকে তাই হাত না লাগালেই নয়।

উদ্বাস্তুদের যে জমি ভাগ করে দেওয়া হয়েছে, বাঁশের খুঁটি পুঁতে পুঁতে তার সীমানা ঠিক করে দিয়েছে পুনর্বাসন দপ্তরের কর্মীরা। এই সীমানা নিয়ে এতদিন কোনও অশান্তি হয়নি। আজ হল।

লক্ষ্মণ ভক্ত লোকটা মহা ধুরন্ধর, কুচুটে এবং রগচটা। লম্বা-চওড়া। আখাম্বা চেহারা। গায়ের রং পোড়ো-তামাটে। গাঁট-পাকানো আঙুল। চৌকো ধরনের মুখ, থ্যাবড়া থুতনি। ছড়ানো চোয়াল। চুলে পাক ধরতে শুরু করেছে। চোখে ধূর্ত চাউনি।

লক্ষ্মণের বউয়ের আঁটোসাটো, মজবুত গড়ন। ছিরিছাঁদহীন মুখচোখ। তার দিকে তাকালে লহমায় টের পাওয়া যায় ছুতোনাতায় ছোবল মারার জন্য সে ফণা তুলে দাঁড়াতে পারে। স্বামী-স্ত্রী একেবারে রাজযোটক। ওদের দুই ছেলে। একজনের বয়স উনিশ, আরেক জনের সতেরো। দু’টোই মা-বাপের ধাত পেয়েছে। ওদের আদি বাড়ি ছিল খুলনায়।

নবদ্বীপ কুণ্ডুর বয়স পঞ্চান্ন-ছাপ্পান্ন। মাঝারি উচ্চতার নিরেট চেহারা। রং কালো। মাথার চুল আধাআধি পাকা, মুখে খোঁচা খোঁচা দাড়িগোঁফ। মানুষটা এমনিতে শান্তশিষ্ট, তবে স্বার্থে ঘা পড়লে ছেড়ে দেবার পাত্র নয়; রুখে দাঁড়ায়। রাগ চড়লে তার হিতাহিত জ্ঞান থাকে না। তার স্ত্রী বেশ লম্বা; মাথায় নবদ্বীপের সমান সমান। বেশ ফর্সা। পঞ্চাশের মতো বয়স হলেও পাতলা, ছিপছিপে গড়ন। চুলে তেমন পাক ধরেনি। এমনিতে চুপচাপ, সোজাসাপটা মনে হয়। কিন্তু খেপে গেলে সে রণরঙ্গিণী হয়ে উঠতে পারে। ওদের একমাত্র ছেলে। তার বয়স আঠারো-উনিশ। মা-বাপের বেশি বয়সের সন্তান। সে খুব নিরীহ, ভিতু ধরনের। নবদ্বীপদের দেশ ছিল পূর্ব পাকিস্তানে। গ্রাম গাবতলি, জিলা : ফরিদপুর।

আজ দা-কোদাল টোদাল নিয়ে জমিতে আসতে একটু দেরি হয়ে গিয়েছিল নবদ্বীপদের। মাঠে নেমে ঝোঁপঝাড় সাফাই করবে কী, চক্ষু চড়কগাছ। নজরে পড়ল তাদের জমির পুব দিকের সীমানা বরাবর যে বাঁশের খুঁটিগুলো পনেরো হাত পর পর পুঁতে দিয়েছিল পুনর্বাসনের কর্মীরা, সেগুলো আর সেই জায়গায় নেই। প্রায় দশ হাতের মতো তাদের জমির ভেতর ঢুকে এসেছে অর্থাৎ পুব দিকে যতদূর অবধি নবদ্বীপদের জমি মেপে দেওয়া হয়েছিল তার দশ হাতের মতো এলাকা বেদখল হয়ে গেছে। আল না থাকায় এই হল বিপদ। এত বিরাট একটা অংশ হাত ছাড়া হয়ে যাবে, প্রাণ থাকতে কেউ কি তা মেনে নিতে পারে? আজ খুঁটি দশ হাত ঢুকেছে, কাল কি পরশু যে আরও পনেরো বিশ হাত ভেতরে ঢোকানো হবে না, জোর দিয়ে তা কি বলা যায়? শুরুতেই খোয়ানো জমি উদ্ধার করা দরকার।

কিছুক্ষণ তীক্ষ্ণদৃষ্টিতে নবদ্বীপ লক্ষ করল। জমির সীমানায় পুনর্বাসনের লোকেরা বাঁশের যে খুঁটিগুলো পুঁতে দিয়ে গিয়েছিল সেই গর্তগুলো স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। নতুন গর্ত খুঁড়ে দশ হাত এলাকা দখল করে যে জমি দখল করা হয়েছে, সেটা দুধের শিশুও এক পলক দেখেই টের পাবে।

পাশের জমির লক্ষ্মণরাই যে তার জমি থেকে চাতুরি করে এতটা অংশ দখল করেছে সেটা নবদ্বীপদের কাছে জলের মতো পরিষ্কার।

লক্ষ্মণরা আজ অনেক আগেই এসে তাদের জমির বনতুলসীর ঝোঁপঝাড় কাটতে শুরু করেছিল। নবদ্বীপরা যে এসে গেছে সেদিকে তাদের ভ্রূক্ষেপ নেই। আপন মনে খুব মগ্ন হয়ে তারা দা চালিয়ে যাচ্ছে।

নবদ্বীপ ডাকল, ‘লক্ষ্মণ, এই লক্ষ্মণ হুইনা (শুনে) যাও দেহি (দেখি)।’

যেন শুনতে পায় নি, এমন একটা ভান করে বনতুলসীর ঝোপে দা চালিয়েই যাচ্ছে লক্ষ্মণ। বেশ কয়েকবার ডাকাডাকির পর লক্ষ্মণ মুখ তুলে নবদ্বীপদের দিকে তাকাল।–’কী কতিছ (বলছ)?

‘এইহানে (এখানে) আহো (এসো)—’

‘ওখানি যেতি হবে ক্যানো? যা কওয়ার ক’তি (বলার বলতে) পার।‘

‘এই কুকম্ম (দুষ্কর্মটা) করল কেডা?’

‘কুন কুকন্মের কতা কতিছ (কথা বলছ)?’

‘আমার জমিনে কেডা খুডা হান্দাইছে (খুঁটি ঢুকিয়ে দিয়েছে)?’

চোখ পিট পিট করে লক্ষ্মণ নিপাট ভালমানুষের মতো মুখ করে বলল, ‘এই কতা (কথা) আমারে জিগুতিছ (জিগ্যেস করছ) ক্যানো?

নবদ্বীপ চিড়বিড় করে উঠল।-–’তুমি য্যান (যেন) ভাজা মাছহান (মাছখানা) উল্ডাইয়া খাইতে জান না!’

ইতিমধ্যে লক্ষ্মণের বউ এবং দুই ছেলে এগিয়ে এসেছে। লক্ষ্মণ কিন্তু চটাচটি করল না। বলল, ‘কী বড়র বড়র (বক বক) করতিছ! তুমার জমিনে কেডা খুডা হান্দাই দেবে (ঢুকিয়ে দেবে), তার হিসাব আমার রাকতি (রাখতে) হব?

নবদ্বীপের বউ আর ছেলে পাশেই দাঁড়িয়ে আছে। জনবল লক্ষ্মণের চেয়ে কিছু কম হলেও খুব কম নয়। একটা ছেলে লক্ষ্মণের বেশি। তা হোক, হক সম্পত্তির একটা বড় অংশ কৌশলে লক্ষ্মণরা হাতিয়ে নেবে, অত সহজ নয়।

নবদ্বীপের মাথায় রক্ত চড়ে গিয়েছিল। কপালের দু’পাশের রগগুলো সমানে দপ দপ করছে। রাগে চোখদুটো লাল টকটকে। সে চিৎকার করে উঠল, ‘হ। রাকতে অইব (রাখতে হবে)।

‘ক্যানে রাকতি হব?’ মেজাজ এখন পর্যন্ত নিয়ন্ত্রণে রেখেছে লক্ষ্মণ।–’তুমার জমিন নিয়ি (নিয়ে) আমার মাথা ব্যথাডা কিসির? (মাথা ব্যাথা কিসের?)’

ঠাণ্ডা গলায় এমনভাবে কথা বলল নোকটা যে মাথার ভেতরটা গনগনে ক্রোধে টগবগ করে ফুটতে লাগল নবদ্বীপের। গলার স্বর আরেক পর্দা চড়াল সে৷–’আমি হুজুত করতি চাই না, ভালা চাস তো যেখানকার খুডা (খুঁটি) হেইহানে লইয়া কুইপা (পুঁতে) রাখ—’

এবারও চটল না লক্ষ্মণ।–’কী কতিছ (বলছ)! সরকারি আমিন জমিন মাপি (মেপে) খুডা যেয়ানে যেয়ানে (যেখানে যেখানে) পুঁতি দেছে, ওয়ানেই (সেখানেই) তো আছে।‘

‘হেইহানে (সেখানে) আছে! কুত্তার ছাও, আইজ বিহানে আমাগো জমিনে আইতে দেরি অইচে, আর তরা (তোরা) গুষ্টিসুদ্ধা আগে আগে আইয়া খুডাগুলান আমার জমিনে হান্দাইয়া (ঢুকিয়ে) দিছস। হালা, হুমুন্দির পুত, আমার জমিন শয়তানি কইরা লবি (নিবি), আর আমি চৌখ বুইজা থাকুম? অহনই (এখনই) খুডি উঠা।‘

‘খানকির ছাওয়াল, আমাগেরে (আমাকে) গালি দিতিছ। অনেক সহ্যি করিচি (সহ্য করেছি)। এবারি (এবার) তোর বুক ছিড়ি (ছিড়ে) রক্ত খাব নে—’ লক্ষ্মণ ভক্ত গলার শির ছিঁড়ে হুঙ্কার ছাড়ল।

‘আমি খানকির পুত! তুই, তর (তোর) হগ্‌গল (সকল) গুষ্টিরে খানকিতে জন্ম দিছে।’

দু’পক্ষে কুৎসিত গালাগালি, খিস্তিখেউড়ের আদান প্রদান চলতে লাগল। ওদিকে লক্ষ্মণের বউ ছেলেরা এবং নবদ্বীপের বউ, এমনকি তার ভীতু ছেলেটা নীরব দর্শক হয়ে দাঁড়িয়ে থাকল না। তারাও রণাঙ্গনে নেমে পড়ল। দুই শত্রুপক্ষের তুমুল চিৎকার চেঁচামেচিতে জেফ্রি পয়েন্টের শান্ত সকালটা যেন খান খান হয়ে যেতে লাগল। কাছাকাছি গাছপালার ডালে যে অচেনা বুনো পাখিরা নিজেদের মধ্যে খুনসুটি করছিল, আচমকা ভয় পেয়ে ডানা ঝাঁপটাতে ঝাঁপটাতে দূরে, অনেক দূরে উধাও হয়ে যেতে লাগল।

নবদ্বীপের গলা ক্রমশ আরও, আরও চড়ছিল।–’খুডা (খুঁটি) উডাইয়া (উঠিয়ে) লইয়া যাবি কিনা সিধা কথাহান (কথাটা) জানতে চাই।‘

‘না। উটোবি (উঠাবো) না।‘ লক্ষ্মণ রুখে উঠল।

‘নাইলে কী করুম, দেখবি? আমরা ফরিদপুইরা (ফরিদপুরের) মানুষ। চেইতা (রেগে) গ্যালে পিরথিমি তুলফাড় (তোলপাড়) কইরা ফালাইতে (ফেলতে) পারি।’ যেন সে এতক্ষণ যথেষ্ট রেগে যায় নি, এমন একটা ভাব।

মুখটা তাচ্ছিল্যে বাঁকিয়ে চুরিয়ে শরীরের বিশেষ একটা প্রত্যঙ্গের দিকে আঙুল বাড়িয়ে কদর্য একটা ইঙ্গিত করল লক্ষ্মণ। বলল, ‘তুই আমার এগুলোন ছিড়বি। আর কিছু করতি পারবি না—’

‘পুঙ্গির ভাই–’ বলেই নিজের বউ এবং ছেলের দিকে তাকিয়ে নবদ্বীপ বলল, ‘খাড়াইয়া খাড়াইয়া (দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে) দেখস কীডা (কীটা)? খুডাগুলান তুইলা (খুঁটোগুলো তুলে) উই হালাগো (শালাদের) ওহানি (ওখানে) হান্দাইয়া দে—’

হুকুম পাওয়া মাত্র কাজে লেগে গেল নবদ্বীপের বউ এবং ছেলে। না, লক্ষ্মণদের বিশেষ অঙ্গটিতে খুঁটি প্রবেশ করিয়ে দেবার হঠকারিতা করল না তারা। হয়তো সাহসে কুলালো না। তবে বাঁশের টুকরোগুলো উপড়ে আগের জায়গায় পুঁততে গেল।

কিন্তু শুভকর্মে বাধা পড়ল। লক্ষ্মণও চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকার বান্দা নয়। সেও গলার স্বর সাত পর্দার ওপরে তুলল।–’খপরদার, হুইশার (হুঁশিয়ার) কইরে দিতিচি; কেউ খুডায় (খুঁটিতে) হাত দিবি না। দিলি জানে বাচতি (বাঁচতে) হবে না। আমরাও খুইলনে (খুলনা) জিলার লোক। রক্তগঙ্গা বইয়ি (বইয়ে) দেবা-হাঁ—’

‘আরে শয়তানের ছাও। আমাগো ফরিদপুইরাগো (আমাদের ফরিদপুরিয়াদের) রক্ত দেহাইস (দেখাস) না। তর (তোর) পুরা গুষ্টি আইজ নিপাত করুম—’

আশপাশের জমিতে অন্য উদ্বাস্তুরা দা-কুড়াল চালাচ্ছিল। তারা এতক্ষণ নিস্পৃহ মুখে নিজের কাজ করে যাচ্ছিল, এরকম ঝগড়া-ফ্যাসাদ জেফ্রি পয়েন্টে ডি পি ফ্যামিলির লোকজনদের মধ্যে প্রায়ই বাধে। কিছুক্ষণ চেঁচামেচি, উত্তেজনা, বাছা বাছা গালাগালির কিছু লেনদেন, তারপর সব মিটমাট হয়ে যায়। কিন্তু লক্ষ্মণ আর নবদ্বীপদের মধ্যে যা শুরু হয়েছে তাতে যে কোনও মুহূর্তে রক্তারক্তি কাণ্ড ঘটে যেতে পারে। তাই আর নিরাসক্ত থাকা গেল না। উত্তর, দক্ষিণ, পুব দিকের জমিগুলোতে যারা কাজ করছিল তারা হইচই করে উঠল।

‘এই, করতে আছ কীড়া (কীটা)?’

‘নিজেগো মইদ্যে (নিজেদের মধ্যে) মাইরদাঙ্গা ঠিক কাম (কাজ) না।’

‘চুপ যাও লক্ষ্মণ ভাই, চুপ যাও নবদ্বীপভাই। যা অইচে (হয়েছে), মিডাইয়া (মিটিয়ে) লও (নাও)। দ্যাশ ছাইড়্যা এত দূরে এই আন্ধারমান দ্বীপি আইয়া কাইজ্যা কুইজ্যা (ঝগড়াঝাটি) বাধাইয়া লাভহান (লাভটা) কী?’

চৈদ্দ পুরুষের দ্যাশ গ্যাছে, ভিটা গ্যাছে, মাটি গ্যাছে, আমরা রিফুজরা যদিন মিলমিশ কইরা (মিলেমিশে) না থাকি, এক্কেরে (একেবারে) শ্যাষ অইয়া যামু।‘

কিন্তু কে কার কথা শোনে! সৎ পরামর্শ কানে ভোলার মতো অবস্থায় লক্ষ্মণরা আর নবদ্বীপরা কেউ নেই।

অসহ্য ক্রোধে এবং উত্তেজনায় দাঁতে দাঁত ঘষতে ঘষতে চিকুর ছাড়ল লক্ষ্মণ।–-’আমাগেরে নিপাত করবি? দেকি, মায়ের দুদ (দুধ) কয় স্যার (সের) খাইচ! খানকির ছাওয়াল না হলি আগুয়ে (এগিয়ে) আয়; তোর পোঙায় কত রস হছে, দেকুয়ে (দেখিয়ে) দি। আয়–আয়—’

নবদ্বীপের শরীরে ফরিদপুরি রক্ত আরও তপ্ত হয়ে ওঠে। সে একেবারে উন্মাদ হয়ে যাঁড়ের মতো গর্জন ছেড়ে লক্ষ্মণের দিকে ধেয়ে যায়। এর পরিণাম কী হতে পারে তার খেয়াল থাকে না।

খুলনা জেলার রক্তের তেজ এতটুকু কম নয়। লক্ষ্মণ চকিতে একটা বাঁশের খুঁটি তুলে নিয়ে আক্রমণ হানার জন্য তৈরি হয়ে নিয়েছে। নবদ্বীপ নাগালের মধ্যে আসার সঙ্গে সঙ্গে সে খুঁটিটা তার মাথায় শরীরের সবটুকু শক্তি দিয়ে বসিয়ে দেয়। কপালের দিকটা চড়াৎ করে দু-ফালা হয়ে ফিনকি দিয়ে রক্ত বেরিয়ে আসে। ‘আঁক’ করে একটি মাত্র শব্দ বেরোয় নবদ্বীপের গলা থেকে। পরক্ষণে কাটা কলাগাছের মতো মাটিতে আছড়ে পড়ে সে। রক্তে ভেসে যেতে থাকে চারিদিক।

নবদ্বীপের বউ আর ছেলে চিৎকার করে ওঠে।–-’মাইরা ফালাইল রে, মাইরা ফালাইল (ফেলল) মানুষডারে।’

কাছে দূরে, চারপাশের জমি থেকে তুমুল শোরগোল উঠতে লাগল। দা-কুড়াল ফেলে উদ্বাস্তুরা লক্ষ্মণ আর নবদ্বীপের জমির দিকে দৌড়ে আসতে থাকে।

.

৪.২২

সুভাষ মজুমদার ভরসা দিয়ে গিয়েছিলেন আপাতত কিছুদিন জারোয়াদের দিক থেকে জেফ্রি পয়েন্টে অশান্তির ভয় নেই। তবু তিনি পোর্টব্লেয়ারে চলে যাওয়ার পর থেকে রোজই ভোরে বিনয়কে সঙ্গে করে পেরিমিটার রোডের কাছে চলে আসেন শেখরনাথ। কারণ, আশ্বাস দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে এটুকুও স্পষ্ট করে সুভাষ জানিয়ে দিয়েছিলেন, জনজাতির মানুষজনের মতিগতি সবসময় একরকম থাকে না। মেজাজ বিগড়ে গেলে কখন কী করে বসবে তার ঠিক নেই। জেফ্রি পয়েন্টের সবাইকে সতর্ক থাকতে হবে।

তাই শেখরনাথের প্রথম কাজটি হল পেরিমিটার রোডে এসে বুশ পুলিশের কাছে খোঁজখবর নেওয়া। তারপর ফিরে গিয়ে সমুদ্রে মুখটুখ ধুয়ে চা-রুটি টুটি খেয়ে ফের উদ্বাস্তুদের জমিতে জমিতে চক্কর দেওয়া। কারও কোনও অসুবিধা হচ্ছে কিনা জেনে নিয়ে তা দূর করা। শেখরনাথের একমাত্র ধ্যানজ্ঞান নির্বিঘ্নে সুষ্ঠুভাবে বঙ্গোপসাগরের এই দ্বীপের এক প্রান্তে পূর্ব পাকিস্তানের ছিন্নমূল মানুষগুলোর উপনিবেশ গড়ে উঠুক।

আজও পেরিমিটার রোডে এসে বুশ পুলিশের একটা টঙের তলায় দাঁড়িয়ে বন্দুকধারী সিপাইয়ের সঙ্গে কথা বলছিলেন শেখরনাথ।–-‘কী লায়েক আলি, কাল রাত্তিরে তুমি ডিউটিতে ছিলে?’

লায়েক আলি টঙের মাথা থেকে সসম্ভ্রমে বলল, ‘আমি নেমে এসে বলছি—’ ঘাড় তুলে কষ্ট করে শেখরনাথ কথা বলবেন, সেটা তার ভাল লাগছে না; অস্বস্তি হচ্ছে।

‘না না–’ শেখরনাথ ব্যস্তভাবে বললেন, ‘তোমাকে নামতে হবে না।‘

‘আপনার তখলিফ হবে চাচাজি—’

‘কিছু হবে না। তুমি ওখান থেকে বল–’

শেখরনাথের কথাগুলো খুব একটা মনঃপূত হল না লায়েক আলির। আন্দামানের সবচেয়ে শ্রদ্ধেয়, বয়স্ক মানুষটি দেশের আজাদির জন্য এত নির্যাতন সয়েছেন, এই দ্বীপপুঞ্জের তাবত বাসিন্দাদের হিতার্থে যিনি জীবন সঁপে দিয়েছেন, তিনি পায়ের নিচে মাটিতে দাঁড়িয়ে কথা বলবেন সেটা প্রবল অস্বস্তির কারণ বই কি। কিন্তু চাচাজির নির্দেশ তো অমান্য করা যায় না। সে বলল, ‘হাঁ, তামাম রাত আমি ডিপটি (ডিউটি) দিয়েছি। আজ আট বাজে থিরুমল আয়েগা। তব তক আমি এখানেই থাকব। দিনভর থিরুমলের ডিপটি।

‘সারারাত তো পাহারা দিয়েছ। কোনও গণ্ডগোল নজরে পড়েছে?’

গণ্ডগোল বলতে শেখরনাথ কী বোঝাতে চাইছেন এক লহমায় ধরে ফেলল লায়েক আলি। আস্তে আস্তে মাথা নেড়ে বলল, ‘নেহি চাচাজি, জারোয়ারা এদিকে আসে নি। ক’দিন ধরে তাদের দেখাও যাচ্ছে না। অব বহু দূরের জঙ্গলের ভেতর তারা কোথাও আছে।

শেখরনাথ স্বস্তি বোধ করলেন। –’ঠিক আছে, তবু খেয়াল রেখো।‘

লায়েক আলি কী জবাব দিতে যাচ্ছিল, হঠাৎ উদ্বাস্তুদের জমিগুলো থেকে প্রচণ্ড শোরগোল ভেসে এল। চমকে পেছন ফিরতেই শেখরনাথ আর বিনয়ের চোখে পড়ল, অনেকটা দূরে প্রায় শ’খানেক উদ্বাস্তু জড়ো হয়ে চিৎকার করে কী যেন বলছে! একসঙ্গে সবাই চেঁচাচ্ছে তাই তার একটা বর্ণও বোঝা যাচ্ছে না। তবে ওখানে মারাত্মক কিছু একটা যে ঘটেছে তা আন্দাজ করা যাচ্ছে।

উৎকণ্ঠিত শেখরনাথ নিজের মনেই যেন বললেন, ‘ওখানে আবার কী হল! –লায়েক, তুমি তোমার ডিউটি দাও, আমরা যাচ্ছি। চল বিনয়—’

লম্বা লম্বা পা ফেলে, প্রায় দৌড়েই লক্ষ্মণ আর নবদ্বীপের জমিতে চলে এলেন শেখরনাথরা। উদ্বাস্তুদের জটলাটা বৃত্তাকারে ঘিরে ধরে সমানে হইচই করে চলেছে। তাদের চোখেমুখে প্রবল উত্তেজনা, সেই সঙ্গে আতঙ্কও।

‘কী হয়েছে? সর সর—’

শেখরনাথের গলা শুনে উদ্বাস্তুরা সরে সরে পথ করে দিল। তাদের শোরগোলটা আরও তীব্র হয়ে উঠল।–’দ্যাহেন বড় কত্তা, নিজের চৌখেই দ্যাহেন—’

এবার চোখে পড়ল নবদ্বীপের রক্তাক্ত বেহুঁশ দেহটা মাটিতে কাত হয়ে পড়ে আছে। তার মুখ রক্তে মাখামাখি শুধু তাই নয়, চারপাশে চাপ চাপ থকথকে রক্ত। বোঝা যায় তার কপালটা দুর্ফাক হয়ে গেছে।

নবদ্বীপের বউ স্বামীর দেহের পাশে আছাড়িপিছাড়ি খেতে খেতে পাগলের মতো আকুল হয়ে কেঁদে যাচ্ছিল। আমার কী সব্বনাশ অইল (হল) রে। আমার কপালে এইডা লিখা আছিল রে–তার পাশে দাঁড়িয়ে তাদের ছেলেটাও কেঁদে চলেছে। সম্পূর্ণ দিশাহারা।

বীভৎস দৃশ্য। রুদ্ধশ্বাসে শেখরনাথ জিগ্যেস করলেন, ‘নবদ্বীপের এই অবস্থা কী করে হল?’

মাটি থেকে সটান তিরের মতো উঠে দাঁড়াল নবদ্বীপের বউ। লক্ষ্মণের দিকে আঙুল বাড়িয়ে বলল, ‘উই ড্যাকরা শুওরের ছাও, রাইক্ষসটা (রাক্ষসটা) বাঁশের খুডা (খুঁটি) দিয়া পিডাইয়া (পিটিয়ে) হ্যাঁরে (তাকে, এখানে নবদ্বীপকে) মাইরা ফালাইছে বড়কত্তা—’

শেখরনাথ স্তম্ভিত। উদ্বাস্তুরা বহুদূরের এই আন্দামানে সেটলমেন্ট গড়তে এসে এমন রক্তারক্তি কাণ্ড বাধাতে পারে, স্বচক্ষে দেখেও যেন বিশ্বাস করতে পারছিলেন না। বিহ্বলের মতো জিগ্যেস করলেন, ‘মারল কেন?’

কান্নাজড়ানো, ভাঙা ভাঙা গলায় নবদ্বীপের বউ বাঁশের খুঁটি তাদের জমিতে ঢুকিয়ে দিয়ে লক্ষ্মণরা কিভাবে অনেকটা দখল করেছে, তাই নিয়ে বচসা হওয়ায় কিভাবে খুঁটির বাড়ি মেরে নবদ্বীপের মাথা দুফাঁক করে ফেলেছে তার বিবরণ দিতে দিতে ডুকরে ডুকরে কাঁদতে লাগল।

অসহ্য ক্রোধে মুখচোখ রক্তবর্ণ হয়ে উঠল শেখরনাথের। চোয়াল শক্ত। লক্ষ্মণের দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘কেন নবদ্বীপকে মারলে তুমি? এত বড় সাহস তোমার হয় কী করে?’

লক্ষ্মণ, তার বউ এবং দুই ছেলে পাংশুমুখে দাঁড়িয়ে ছিল। ঢোক গিলে লক্ষ্মণ মিনমিনে গলায় বলল, ‘কাকা, আমারি (আমাকে) হে (সে) আগে মারিচে (মেরেছে)।’

তার কোনও কথাই শুনলেন না শেখরনাথ। সমস্ত ব্যাপারটা তাঁর কাছে পরিষ্কার হয়ে গেছে। মুহূর্তে রাগটা সামলে নিলেন। সবার আগে যেটা এখন প্রয়োজন তা হল নবদ্বীপকে বাঁচানোর চেষ্টা করা।

শোরগোল শুনে পুনর্বাসন দপ্তরের কর্মীরা দৌড়ে এসেছিল। অনেক দরবার করা সত্ত্বেও জেফ্রি পয়েন্টে ছোটখাটো হাসপাতাল বসানো তো দূরের কথা, এখন পর্যন্ত সামান্য একটা হেলথ সেন্টারের ব্যবস্থাও করা সম্ভব হয় নি।

শেখরনাথ বললেন, ‘যে জিপটা বিশ্য পাঠিয়েছে সেটায় নবদ্বীপকে তুলে এক্ষুনি আমি পোর্টব্লেয়ারের হাসপাতালে যাব। বিনয়, তুমিও চল—’

নবদ্বীপের বউ আর ছেলেও বলল, তারা নবদ্বীপকে কিছুতেই ছাড়বে না। তাদের নিয়ে যেতে হবে। এমন একটা জীবনমরণ সংকটের সময় প্রিয়জনরা কাছাকাছি থাকবে, সেটাই তো স্বাভাবিক। ফুসফুসে জারোয়াদের তির বেঁধার পর মোহনবাঁশিকে একা পোর্টব্লেয়ারে নিয়ে যাওয়া যায়নি, তার বউ-ছেলেমেয়েরাও সঙ্গে গেছে। নবদ্বীপের বউছেলেই বা ছাড়বে কেন? শেখরনাথ বললেন, ‘হ্যাঁ হ্যাঁ, তোমরাও যাবে।’ বলেই তার নজর এসে পড়ল লক্ষ্মণের ওপর। জেফ্রি পয়েন্টের আমিন লা ডিন আর চেনম্যান ধনপত, সিংকে বললেন, এই খুনিটাকে ছাড়া হবে না। দড়ি দিয়ে এটাকে বেঁধে ফরেস্ট ডিপার্টমেন্টের লরিতে তোল। ওকে পোর্টব্লেয়ারে নিয়ে আমি লক-আপে ঢোকাব।

লক্ষ্মণ হাতজোড় করে ত্রস্ত গলায় বলল, ‘বড় কত্তা, আমার ভুল হয়ি গ্যাছে। আমারে পুলিশি দিবেন না। দয়া করেন তার বউছেলেরা ডাক ছেড়ে কাঁদতে শুরু করল। বউটা কাঁদতে কাঁদতে শেখরনাথের দুই পায়ে ঝাঁপিয়ে পড়ে আঁকড়ে ধরে মাথা কুটতে লাগল।–’ছাড়ি দ্যান কত্তা, ছাড়ি দ্যান। আমাগের সব্বনাশ হয়ি যাবে।’

শেখরনাথ তার সিদ্ধান্তে অটল রইলেন। লক্ষ্মণের বউকে ঠেলে সরিয়ে দিয়ে প্রচন্ড জোরে ধমক দিলেন।–’নবদ্বীপকে যখন খুঁটির বাড়ি মেরেছিল তখন কী করছিলে তোমরা? তাকে ঠেকাতে পার নি? যদি নবদ্বীপের খারাপ কিছু হয়ে যায়, লক্ষ্মণকে আমি ফাঁসির দড়িতে চড়াবার ব্যবস্থা করব।‘

লক্ষ্মণের বউ জমিতে গড়াগড়ি দিয়ে কাঁদতে লাগল। শেখরনাথের মুখ পাথরের মতো কঠিন। তার কোনও প্রতিক্রিয়াই নেই। এই প্রাচীন বিপ্লবীটিকে কিছুদিন ধরে দেখছে বিনয়। নিবিড়ভাবে তার সঙ্গে মেশারও সুযোগ হয়েছে। কারও ভুলচুক হলে কিংবা কারও ডিউটিতে গাফিলতি দেখলে একটু আধটু রাগারাগি যে শেখরনাথ করেন না তা নয়। কিন্তু এমন ভয়ঙ্কর চেহারায় তাকে আগে কখনও দেখে নি সে। লক্ষ্মণে অপরাধটা সত্যিই মারাত্মক।

লা-ডিন আর ধনপত দৌড়ে গিয়ে সেটলমেন্টের গুদাম থেকে শুধু মোটা দড়িই নয়, বুদ্ধি করে আয়োডিন, তুলো আর ব্যান্ডেজ নিয়ে এসেছিল। ক্ষিপ্র হাতে আয়োডিন লাগিয়ে শেখরনাথই ব্যান্ডেজ বেঁধে দিলেন। কিন্তু রক্ত কি থামতে চায়! চুঁইয়ে চুঁইয়ে ব্যান্ডেজ ভিজিয়ে বেরিয়ে আসছে।

বিশ্বজিৎ রাহা জেফ্রি পয়েন্টের জরুরি কাজের জন্য যে জিপ পাঠিয়েছেন সেটা এখানকার ব্যারাকগুলোর পাশে দাঁড়িয়ে থাকে। পুনর্বাসন দপ্তরের যে কর্মীরা লক্ষ্মণ আর নবদ্বীপের জমিতে জড়ো হয়েছিল, শেখরনাথ তাদের বলামাত্র কয়েকজন ধরাধরি করে নবদ্বীপকে জিপে নিয়ে তুলল। শেখরনাথ, বিনয় আর নবদ্বীপের বউ আর ছেলেও জিপে উঠে পড়ল। পেছন দিকে দু’পাশে টানা দুটো সিট। মাঝখানে মেঝেতে শোওয়ানো হল নবদ্বীপকে। তার বউ এবং ছেলেকে বসানো হল একধারের সিটে, অন্যটায় বসলেন শেখরনাথ। বিনয়কে বললেন, ‘তুমি ফ্রন্ট সিটে ড্রাইভারের পাশে ব’সো।‘

ইতস্তত করতে থাকে বিনয়।-–’না কাকা, আপনি সামনে বসুন। আমি—’

একটু কড়া গলায় শেখরনাথ বললেন, ‘যা বলছি তাই কর। আমার পেছনে বসা দরকার—’

কারণটা বুঝতে অসুবিধে হল না বিনয়ের। নবদ্বীপের বউর কান্নার বিরাম নেই; ডুকরে ডুকরে কেঁদেই চলেছে। ছেলেটাও কাঁদছে, তবে তত জোরে নয়। ওদের সামলানোর জন্যই শেখরনাথের পেছনে বসা।

ড্রাইভার হরগোবিন কাছাকাছি কোথাও ছিল। সে দৌড়ে এসে ড্রাইভারের সিটে স্টিয়ারিং ধরে বসল। শেখরনাথ তাকে বলল, ‘যত তাড়াতাড়ি পার পোর্টব্লেয়ার চল—’

ওদিকে লা-ডিন আর ধনপত লক্ষ্মণের দুটো হাত দু’দিক থেকে ধরেছে। লা-ডিন বলল, ‘চল–বলছি—’

‘আমারে নিয়ি যেতি পারবা না। আমি যাবা না’–লক্ষ্মণ শক্ত করে মাটিতে পা চেপে দাঁড়িয়ে থাকতে চেষ্টা করে।

তার বউও গলা ছেড়ে কাঁদতে কাঁদতে একটানা বলে যাচ্ছিল, ‘ওরে নিয়ি যাবা না দাদারা, থানায় নিয়ি যাবা না—’

কিন্তু কে কার কথা শোনে! পঞ্চাশ পঞ্চান্ন বছরেও অসীম শক্তি ধনপতের। লক্ষ্মণ তার সঙ্গে পারবে কেন? হ্যাঁচকা টান মারতে মারতে তাকে পাহাড়ের দিকে নিয়ে যেতে থাকে। ওখানেই ফরেস্ট ডিপার্টমেন্টের বড় বড় ট্রাকগুলো দাঁড়িয়ে থাকে।

জেফ্রি পয়েন্টে বনবিভাগের চার্জে আছে আজীব সিং। এখানকার জঙ্গলে ফেলিংয়ের তদারক করার দায়িত্ব তার। সেখানে পৌঁছে হাঁকডাক শুরু করে দেয়।–-‘এ আজীব সিং।‘ ওখানে ক’টা তাঁবু আর একটা ছোট ব্যারাক ধরনের বাড়ি আছে। ডাকাডাকিতে একটা তাঁবু থেকে লম্বা-চওড়া শিখ বেরিয়ে এল। পাগড়ি বাঁধা নেই, তাই ঘন,ঝাঁকড়া, কাঁচা-পাকা চুলগুলো পিঠময় ছড়িয়ে আছে, দাড়িও বুক পর্যন্ত ঝুলছে। পরনে হাঁটুঝুল বেখাপ্পা ঢোলা দড়ি-বাঁধা ইজের। লোহার পাটার মতো চওড়া, রোমশ বুক তার। জিগ্যেস করল, ‘কী চাই রে?’

লা-ডিন বলল, ‘তোমাদের একটা ট্রাক দিতে হবে। আমরা ব্যাম্বু ফ্ল্যাট যাব–বহুৎ জরুরি—’

ভুরু কুঁচকে আজীব সিং বলল, ‘তুই বললেই ট্রাক মিলবে? যা, ভাগ—’

‘চাচাজি দিতে বলেছেন। জলদি—’

আন্দামান দ্বীপপুঞ্জে চাচাজি কে, সবাই জানে। আজীব সিংয়ের মুখচোখের চেহারা লহমায় পালটে গেল।–’ঠিক হায়, ঠিক হায়—’

‘একঠো ডেরাইভার (ড্রাইভার) চাই—’

বনবিভাগের ছোট ব্যারাকটার দিকে মুখ ফিরিয়ে হাঁক দিল আজীব সিং।-–’এ ভারুয়া, জলদি নিকাল আ। আভি। ব্যাম্বু ফ্ল্যাট যানে পড়েগা, টেরাক (ট্রাক) লেকে—’

ভারুয়া নামের চালকটি আধময়লা বেঢপ পাজামা আর ঢলঢলে ডোরাকাটা জামা গায়ে চড়িয়ে বেরিয়ে এল; পায়ে রং-চটা চপ্পল। সিঁড়িঙ্গে, কাঠ কাঠ চেহারা, বয়স পঁয়ত্রিশ-ছত্রিশ। তিন চারটে ট্রাক দাঁড়িয়ে ছিল একধারে। তার একটার দিকে আঙুল বাড়িয়ে আজীব বলল, ‘ওটা নিয়ে যা—’

ভারুয়ার মুখ থেকে একটি শব্দও নির্গত হল না। নিঃশব্দে ট্রাকে উঠে স্টিয়ারিং ধরে বসে পড়ল। ওদিকে খোলা পাটাতনে লক্ষ্মণকে টেনে তোলা হল, তার দু’পাশে বসল লা-ডিন আর ধনপত।

লক্ষ্মণের বউ ছেলেরা উদ্ধশ্বাসে চিৎকার করতে করতে চলে এসেছে। অন্য দিক দিয়ে শেখরনাথদের জিপটাও এসে গেল। লক্ষ্মণের বউ আকুল কান্নায় ভেঙে পড়েছিল আগেই। বলতে লাগল, ‘উনারি (ওকে) পুলিশি দিবা না, দিবা না—’

জিপের ভেতর নবদ্বীপের বউও সমানে কেঁদে চলেছে।–’আমার কী অইল রে? মানুষডারে যদিন বাঁচান না যায়, কী করুম আমি? কেডা আমারে দেখব (দেখবে)? ভগমান, আমরা যে এক্কেরে (একেবারে) ভাইসা যামু—’

দুই নারীর বিলাপ চলছে অবিরল। শেখরনাথ গলার স্বর উঁচুতে তুলে দুই গাড়ির ড্রাইভারকে বললেন, ‘গাড়ি চালিয়ে দাও—’

আগে আগে চলেছে জিপ, পেছনে লেজুড়ের মতো বনবিভাগের বিশাল ট্রাক।

কয়েক মিনিটের ভেতর পাহাড়ি রাস্তার একটা বাঁক ঘুরে দুটো গাড়ি অদৃশ্য হয়ে গেল। পেছনে লক্ষ্মণের বউয়ের বিলাপ ক্ষীণ হতে হতে মিলিয়ে যায়।

দু’টো গাড়ি পর পর ছুটছে তো ছুটছেই। একধারে খাড়া পাহাড়, অন্য দিকে খাদ। খাদ এবং পাহাড়ে আদ্যিকালের প্রাচীন সব জঙ্গল। যেদিকে যতদূর নজর যায়, মানুষজন নেই। সমস্ত কিছু নিঝুম। সেই নৈঃশব্দ্যকে চিরে চিরে নবদ্বীপের বউয়ের একটানা কান্না চলছেই।

.

৪.২৩

ব্যাম্বু ফ্ল্যাটে পৌঁছবার সঙ্গে সঙ্গে স্টিমলঞ্চ পাওয়া গেল। লক্ষ্মণকে নিয়ে নেমে পড়ল লা-ডিন আর ধনপত। কেননা অত বড় ট্রাক মাঝারি মাপের লঞ্চে তোলা যাবে না। তবে জিপের মতো ছোট গাড়ির পক্ষে অসুবিধা নেই। লঞ্চে এগুলো ওঠানোর ব্যবস্থা আছে।

জিপসুদ্ধ শেখরনাথরা লঞ্চে উঠে পড়লেন। লক্ষ্মণকে নিয়ে লা-ডিনরাও উঠল।

খানিক পরেই লঞ্চ ছেড়ে দিল। উপসাগরের এদিকটা ততটা চওড়া নয়। মিনিট পনেরোর ভেতর চ্যাথাম জেটিতে এসে স্টিমলঞ্চ ভিড়ল।

অন্য সব প্যাসেঞ্জারদের সঙ্গে শেখরনাথ বিনয়রাও নেমে পড়লেন। জিপ আছে, তাই অনেক দূরে সেলুলার জেলের কমপাউন্ড হাসপাতালে পৌঁছতে অসুবিধা হবে না। কিন্তু চ্যাথাম থেকে থানা কম দূরে নয়। লক্ষ্মণকে সেখানে নিয়ে যাওয়া হবে কিভাবে?

লা-ডিন জিগ্যেস করল, ‘চাচাজি, আমরা তো মুসকিলে পড়ে গেলাম।‘

তার ইঙ্গিতটা ধরতে পেরেছিলেন শেখরনাথ। বললেন, ‘আমি বন্দোবস্ত করে দিচ্ছি। হরগোবিনকে বলে দিচ্ছি সে আমাদের হাসপাতালে নামিয়ে দিয়ে চ্যাথামে ফিরে আসবে। তারপর তোমাদের থানায় নিয়ে যাবে। ততক্ষণ ওই বদমাশ খুনেটাকে নিয়ে তোমরা এখানে অপেক্ষা কর। হরগোবিন জিপ নিয়ে ফিরে এসে থানায় গিয়ে লক্ষ্মণের নামে কেস লিখিয়ে রাহাসাহেবের সঙ্গে দেখা করে লক্ষ্মণ আর নবদ্বীপের ব্যাপারটা জানাবে। বলবে আমরা নবদ্বীপকে নিয়ে হাসপাতালে গেছি।‘

‘ঠিক হ্যায় চাচাজি—’

.

জিপ চ্যাথাম জেটি থেকে বেরিয়ে মিনিট কুড়ির ভেতর সেলুলার জেলে পৌঁছে গেল। কয়েকদিন আগে এখানে মোহনবাঁশি কর্মকারকে নিয়ে আসা হয়েছিল। এবার নবদ্বীপকে।

শেখরনাথ জিপ থেকে নেমে বললেন, ‘বিনয়, তুমি ওদের নিয়ে ওয়েট কর। আমি ডাক্তার চট্টরাজকে গিয়ে বলি, নতুন একটা ক্রিটিকাল কেস নিয়ে এসেছি—’ তিনি চলে গেলেন।

দোতলায় ডাক্তার চট্টরাজকে তার চেম্বারে পাওয়া গেল। শেরখানকে দেখে ডাক্তার রীতিমতো অবাক।–’কাকা এখন আপনি হাসপাতালে জেফ্রি পয়েন্ট থেকে পোর্টব্লেয়ার কবে এসেছেন?’

শেখরনাথ বললেন, ‘আজই, এইমাত্র। সোজা তোমার কাছে চলে এলাম।‘

তাঁর উষ্কখুষ্ক চুল, চিন্তাগ্রস্ত মুখচোখের চেহারা দেখে ডাক্তার চট্টরাজ কিছু একটা আন্দাজ করে নিলেন।–’কী হয়েছে কাকা?’

‘একজন রিফিউজিকে নিয়ে এসেছি। হি ইজ ভেরি সিরিয়াসলি ইনজিওরড। প্রচুর রক্তপাত হয়েছে। সেন্সলেস। এক্ষুনি তাকে ভর্তি করে নেওয়া দরকার।‘

‘মোহনবাঁশি কর্মকারের মতো এটাও জারোয়াদের ব্যাপার?’

‘না না, অন্য কেস। অত কথা ডিটেলে বলার মতো সময় নেই। পরে শুনো। ইমিডিয়েটলি লোকটার ট্রিটমেন্ট শুরু করতে হবে। নইলে বাঁচানো যাবে না।‘

শেখরনাথের কণ্ঠস্বরে এমন এক ব্যগ্রতা ছিল যাতে এ নিয়ে আর কোনও প্রশ্ন করলেন না ডাক্তার চট্টরাজ। শুধু জানতে চাইলেন, ‘লোকটা কোথায়?’

‘নিচে জিপের ভেতর শোওয়ানো আছে। স্ট্রেচার ছাড়া তাকে ওপরে আনা যাবে না।‘

‘এক্ষুনি ব্যবস্থা করছি। আপনি আমার সঙ্গে আসুন—’

ক্ষিপ্র পায়ে বাইরে বেরিয়ে সোজা এমার্জেন্সি ডিপার্টমেন্টে চলে গেলেন ডাক্তার চট্টরাজ। সেখান থেকে স্ট্রেচার এবং দু’জন স্ট্রেচারবাহক নিয়ে হাসপাতালের সামনের খোলা জায়গায় নেমে এলেন। সঙ্গে শেখরনাথ।

জিপের ভেতর সবাই রুদ্ধশ্বাসে চুপচাপ বসে ছিল! নবদ্বীপের বউ এখন আর কান্নাকাটি করছে না। সকাল থেকে অবিরল আর্ত চিৎকারের পর কান্নার শক্তিটাই বুঝিবা সে হারিয়ে ফেলেছে। পরিস্থিতি এতটাই বিষাদময় যে কিছুই ভাল লাগছিল না বিনয়ের। ভেতরে ভেতরে কেমন যেন অস্বস্তি হচ্ছিল। একটা প্রশ্নই ঘুরে ফিরে নানা দিক থেকে তার মাথায় ঢুকে যাচ্ছিল–নবদ্বীপ বাঁচবে তো?

ডাক্তার চট্টরাজ দুই বাহককে বললেন, ‘যে লোকটাকে শোওয়ানো হয়েছে, খুব সাবধানে নামিয়ে এনে স্ট্রেচারে তুলে এমার্জেন্সিতে নিয়ে যাও। দেখো, ওর যেন চোট টোট না লাগে।‘

লহমায় নির্দেশ পালিত হল।

শেখরনাথ নবদ্বীপের বউছেলেকে নেমে আসতে বললেন।

ইতিমধ্যে বাহকেরা নবদ্বীপকে স্ট্রেচারে তুলে ফেলেছে। তার মাথায় পুরু করে যে ব্যান্ডেজ বেঁধে দেওয়া হয়েছিল তা রক্তে ভিজে গেছে। তবে চুঁইয়ে চুঁইয়ে আর রক্ত বেরুচ্ছে না। রক্তক্ষরণ বন্ধ হয়ে গেছে।

বিনয়রা সবাই নেমে পড়েছিল। আতঙ্কগ্রস্ত, বিহ্বল নবদ্বীপের বউ বলল, ‘হ্যারে (তাকে) কুনহানে (কোথায়) লইয়া যাইব?’

ডাক্তার চট্টরাজকে দেখিয়ে সদয় গলায় শেখরনাথ বললেন, ‘উনি এই হাসপাতালের বড় ডাক্তার; তোমার স্বামীর চিকিৎসা করবেন।

‘বড়কত্তা, আপনে ক’ন হ্যায় (সে) বাচব তো?’

মোহনবাঁশির বউ জ্যোৎস্নাও এই প্রশ্নটা তার স্বামী সম্পর্কে করেছিল। একই উত্তর দিলেন শেখরনাথ।–’বাঁচাবার জন্যেই তো এতদূরে নিয়ে এলাম।–বিনয়, তুমি ওদের নিয়ে দোতলায় টানা বারান্দায় যে বেঞ্চিগুলো পাতা আছে, সেখানে নিয়ে ব’সো। নইলে ওরা ভরসা পাবে না। আমি হরগোবিনকে চ্যাথামে পাঠিয়ে আসছি।‘

‘আসুন—’ নবদ্বীপের বউছেলেকে সঙ্গে করে বিনয় হাসপাতালের মেন বিল্ডিংয়ে ঢুকে দোতলার সিঁড়ির দিকে এগিয়ে গেল।

আর শেখরনাথ জিপের ড্রাইভার হরগোবিনের কাছে গিয়ে একশো টাকার একটা নোট নিয়ে বললেন, তুমি চ্যাথাম জেটিতে গিয়ে লা-ডিন, ধনপত আর লক্ষ্মণকে তুলে থানায় যাবে। সেখানে কী করতে হবে লা-ডিনরা জানে। ওখানকার কাজ শেষ হলে তুমি তোমাদের রাহা সাহেবের কাছে। গিয়ে বলবে আমরা হাসপাতালে আছি। তিনি যেন সেখানে একবার আসেন। আর হ্যাঁ, যে টাকাটা দিলাম তোমরা কিছু খেয়ে নিও। রিফিউজিদের জন্যে এবারডিন মার্কেটে যে বাড়িগুলো আছে রাত্তিরে সেখানে থাকবে। সুরেশ দত্ত ওখানকার অফিসার। তাকে বলবে রাহাসাহেব তোমাদের ওখানে থাকতে বলেছেন। ঠিক আছে?

‘হাঁ, চাচাজি। লেকিন—’

‘কী?’

‘কাল সুবেহ আমরা কী করব?’

এ দিকটা ভেবে দেখেন নি শেখরনাথ। তিনজন, বিশেষ করে লা-ডিন আর ধনপত পোর্টব্লেয়ারে থেকে গেলে জেফ্রি পয়েন্ট সেটলমেন্টের কাজকর্মে খুবই অসুবিধা হবে। সুভাষ মজুমদার ওখানকার জঙ্গলে ঘুরে আসার পর জারোয়ারা আপাতত চুপচাপ আছে ঠিকই, কিন্তু আবার যে খেপে গিয়ে উদ্বাস্তুদের ওপর হামলা চালাবে না, জোর দিয়ে তা বলা যায় না। জারোয়ারা ছাড়া উদ্বাস্তুদের মধ্যেও ঝগড়া ফ্যাসাদ লেগেই আছে। কালোনাইজেশন অ্যাসিস্ট্যান্ট পরিতোষ বণিক ঠান্ডা, নিরীহ ধরনের মানুষ। একটু এদিকওদিক হলেই সে ভীষণ ঘাবড়ে যায়; একেবারে দিশাহারা হয়ে পড়ে। ছোটখাটো কোনও হুজ্জত হলে ঠিক আছে কিন্তু বড় রকমের কিছু ঘটলে তার পক্ষে সামাল দেওয়া মুশকিল। লা-ডিন আর ধনপতের কড়া ধাত, কড়া জবান, প্রচন্ড সাহস। পুরনো এই দুই ‘কালাপানি’র সাজা খাটতে আসা কয়েদি এই বয়সেও যথেষ্ট বেপরোয়া। যে কোনও কঠিন সমস্যা দেখা দিলে তারা রুখে দাঁড়াতে পারে। ওদের পোর্টব্লেয়ারে বসে থাকলে চলবে না। সারাক্ষণ জেফ্রি পয়েন্টে থাকাটা খুবই জরুরি।

শেখরনাথ বললেন, ‘কাল সকালে উঠেই তোমরা জিপ নিয়ে সেটলমেন্টে ফিরে যাবে। মনে হচ্ছে, আমার ফিরতে কয়েকদিন দেরি হবে। এখন যাও—’

‘জি। নমস্তে চাচাজি–’

হরগোবিন জিপে উঠে স্টার্ট দিল আর শেখরনাথ হাসপাতালের মেন বিল্ডিংয়ে ঢুকে দোতলায় যেখানে নবদ্বীপের বউছেলেকে নিয়ে বিনয় বসে আছে সোজা সেখানে চলে এলেন। কাছাকাছি একটা ফাঁকা বেঞ্চিতে বসতে বসতে হঠাৎ তার কী’ খেয়াল হতে ভীষণ অপ্রস্তুত হয়ে পড়লেন।–’আরে, সেই সকাল থেকে যা কান্ড চলছে তাতে তোমাদের কারও পেটেই তো একফোঁটা জলও পড়ে নি। ওই যা, হরগোবিনকে ছেড়ে দিলাম। ডাক্তার চট্টরাজও নবদ্বীপকে নিয়ে ব্যস্ত হয়ে আছে। তাকে বলে যে হাসপাতালের একটা গাড়ির ব্যবস্থা করে এবারডিন মার্কেট থেকে খাবার টাবার নিয়ে আসব, তারও তো এখন উপায় নেই। কী যে করি–’

নবদ্বীপের বউছেলের কান্নাকাটি থেমে গিয়েছিল অনেক আগেই। তারা শুকনো, শীর্ণ মুখে অনন্ত দুশ্চিন্তা নিয়ে বসে আছে। নবদ্বীপের বউ ধরা ধরা গলায় বলল, ‘বড়কত্তা ক্ষুদা তিষ্টার (খিদে এবং তেষ্টার) কথা ভবি না। মানুষডার (বৃন্দাবনের) কী অয় (হয়) না জাইনা, মুখে কিছু তুলুম না। হ্যায় (সে) যদিন পিরথিমীতে আর না থাকে, জম্মের শোধ আমাগো (আমাদের) ক্ষুদা টুদা (খিদেটিদে) ঘুচল।’

গ্রাম্য, নিরক্ষর এই নারীটির তার স্বামীর জন্য কী নিদারুণ উৎকণ্ঠা তা বুঝতে পারছিলেন শেখরনাথ। তার মাথায় একখানা হাত রেখে অফুরান সহানুভূতির সুরে বললেন, ‘ঠিক আছে, এখন তোমাদের খেতে হবে না।–-‘ একটু ভেবে জিগ্যেস করলেন, ‘তোমার কী নাম মা?’

‘উলুপী—’

‘তুমি ভগবানে বিশ্বাস কর?’

অবাক চোখে কয়েক লহমা শেখরনাথের দিকে তাকিয়ে থাকে উলুপী। তারপর বলে, ‘এই আন্ধারমান দ্বীপি আপনেই আমাগো ভগমান। আপনে ক’ন (বলুন), হ্যায় (সে অর্থাৎ বৃন্দাবন) পরানে বাঁচব কিনা—’

ক’দিন আর, তাকে দেখছে এই উদ্বাস্তু রমণী। তবু তার ওপর কী অসীম আস্থা মেয়েটার, কত বিশ্বাস। শুধু উলুপীই নয়, জেফ্রি পয়েন্টের সব উদ্বাস্তুরই শেখরনাথের ওপর সীমা-পরিসীমাহীন নির্ভরতা। তিনি কিছুক্ষণ অভিভূত হয়ে চুপ করে থাকেন। তারপর বললেন, ‘আমি কেউ না, সামান্য মানুষ। দু’জন নবদ্বীপকে বাঁচাতে পারেন। আমার বিশ্বাস বাঁচাবেনও।’ আকাশের দিকে আঙুল তুলে দেখালেন।–’ওখানে যিনি আছেন তিনি আর যে ডাক্তারবাবু নবদ্বীপের চিকিৎসার দায়িত্ব নিয়েছেন।

‘তেনারা তো আছেই। উলুপী কেমন যেন জেদ ধরল, ‘আপনে একবার মুখ ফুইটা ক’ন (বলুন), তাইলেই আমার শান্তি। ক’ন কত্তা, কন—’ সে মাথা ঝাঁকাতে থাকে।

এতটা আস্থা মোহনবাঁশির বউ জ্যোৎস্নারও ছিল না। শেখরনাথ হকচকিয়ে গেলেন। নবদ্বীপের মাথায় আঘাত কতটা গুরুতর তা একমাত্র বলতে পারেন ডাক্তার চট্টরাজই। মিথ্যা আশ্বাস কখনও কারওকে দেন না শেখরনাথ। কিন্তু ব্যাকুল মেয়েটির দিকে তাকিয়ে বুকের ভেতরটা তোলপাড় হয়ে গেল তার। নিজের অজান্তেই তার মুখ থেকে বেরিয়ে এল।–’বাঁচবে, নিশ্চয়ই বাঁচবে—’

শীর্ণ, শুষ্ক মুখমন্ডলে আলো ফুটল উলুপীর।

এদিকে আশ্বাসটি দেওয়ার পরই চমকে উঠেছেন শেখরনাথ। বলে তো ফেলেছেন। এখন তো আর তা ফেরানো যাবে না। কিন্তু নবদ্বীপ যদি না বাঁচে? উলুপীর দিকে মুখ তুলে ইহজন্মে আর কখনও কি তাকাতে পারবেন? মেয়েটি তাকে ভগবান বলেছে, নিজেকে তিনি তা-ই ভেবে নিলেন? ভগবান হওয়ার এতই স্পৃহা তাঁর? মনে মনে নিজেকে হাজারবার ধিক্কার দিলেন। অন্যায়, ঘোর অন্যায় হয়ে গেছে।

ঈশ্বর আদৌ আছেন কিনা, এই নিয়ে কখনও মাথা ঘামান নি শেখরনাথ। তাঁর ঈশ্বর হল দেশ, তার ঈশ্বর সত্য, আদর্শ, শুদ্ধ জীবনযাপন। নবদ্বীপ বাঁচবে কি বাঁচবে না, তার জানা নেই। জীবন মৃত্যুর মাঝামাঝি জায়গায় তার প্রাণটা ঝুলছে। তবু কিনা একটা অর্ধসত্য উচ্চারণ করে বসেছেন! ঈশ্বর নামে কোনও অলৌকিক এতকাল শেখরনাথের ত্রিসীমানায় ছিল না। আজ মনে মনে তার কাছে প্রার্থনা জানাতে লাগলেন।–-‘আমার মুখ রেখো। উলুপীকে যা বলেছি তা যেন সত্যি হয়।‘

অনেকক্ষণ নীরবতা।

তারপর শেখরনাথ বিনয়ের দিকে তাকালেন।-–’নতুন ভারত’-এর জন্যে খবর জোগাড় করতে এসেছ। দেখ, তোমার ওপর দিয়ে বার বার কী ঝড় বয়ে যাচ্ছে। সেবার মোহনবাঁশি এবার নবদ্বীপ। সকাল থেকে তোমার পেটে এক দানা কিছুই পড়েনি। বড় খারাপ লাগছে।

বিনয় সামান্য হাসল।–’আপনিও তো কিছু খান নি কাকা।‘

শেখরনাথও হাসলেন।-–’এসবে আমার অভ্যাস আছে। তোমাকে তো বলেছি, সেলুলার জেলে কয়েদ খাটার সময় পান থেকে চুন খসলে কত দিন আমাদের ‘খানা বন্ধ’ হয়ে যেত। সারাদিন না খেয়ে থাকতাম। ঠিক আছে, বিশুকে খবর পাঠিয়েছি। সে নিশ্চয়ই এখানে চলে আসবে। ওর বাংলোয় গিয়ে একেবারে রাত্তিরেই খাওয়া যাবে।‘

এ দিনটা প্রায় ফুরিয়ে এসেছে। সূর্য পশ্চিম দিকে মাউন্ট হ্যারিয়েটের আড়ালে নেমে গেছে। দিনের যে শেষ রোদটুকু এখনও রয়েছে কিছুক্ষণের মধ্যে তা আর থাকবে না। লাটাইতে সুতো গুটনোর মতো অদৃশ্য কোনও জাদুকর এক টানে সেটা টেনে নেবে।

নবদ্বীপকে ভর্তি করার পর দু’ঘণ্টার মতো কেটে গেছে। দোতলার টানা প্যাসেজে বিনয়রা বসেই আছে। অন্যমনস্কর মতো এলোমেলো দু-চারটে কথা যে বলছে না তা নয়। আপাতত বলার তো তেমন কিছু নেইও। বেশিরভাগ সময়টাই তারা চুপচাপ। প্রায় ঘণ্টা দুই এভাবে কাটানোর পর সন্ধে যখন নামবে নামবে সেই সময় ডাক্তার চট্টরাজ তেতলা থেকে বিনয়দের কাছে এগিয়ে এলেন। চুল উস্কোখুষ্কো, সাদা ধবধবে পোশাক এলোমেলো। তবে চোখেমুখে প্রশান্তি।

তাঁকে দেখে সবাই উঠে দাঁড়িয়েছিল। শেখরনাথ জিগ্যেস করলেন, ‘কী হল?’

উত্তর না দিয়ে ডাক্তার চট্টরাজ জানতে চাইলেন, ‘কাকা, যে আন-কনসাস ইনজিওরড লোকটিকে জেফ্রি পয়েন্ট থেকে নিয়ে এসেছেন তার কী নাম?’

‘নবদ্বীপ কুণ্ডু।’

উৎকণ্ঠিত উলুপী আর তার ছেলের দিকে তাকিয়ে এবার ডাক্তার চট্টরাজের প্রশ্ন।–-‘এরা কি নবদ্বীপের স্ত্রী ছেলে?’

‘হ্যাঁ। কেন বল তো?’

‘ওদের নিয়ে আমার চেম্বারে আসুন। দরকার আছে।‘

ডাক্তারের চেম্বারে গেলে তিনি সবাইকে বসতে বলে নিজের চেয়ারটিতে বসলেন। বিনয় আর শেখরনাথও বসে পড়লেন। তবে উলুপী আর ছেলেটি রুদ্ধশ্বাসে দাঁড়িয়ে রইল। দু’জনে ঘন ঘন ঢোক গিলছে কিন্তু নবদ্বীপ এখন কী অবস্থায় আছে, জিগ্যেস করতে সাহস হচ্ছে না তাদের। শেখরনাথ এবং বিনয়ের উদ্বেগ আর দুর্ভাবনা বাড়ছিল।

ডাক্তার চট্টরাজ সবার মনোভাব বুঝতে পারছিলেন। বললেন, ‘ভয় নেই। নবদ্বীপ বেঁচে যাবে। আমার ধারণা আর দেড়-দু’ঘণ্টার মধ্যে তার জ্ঞান ফিরে আসবে। আপনাদের বিশেষ করে নবদ্বীপের কনসেন্ট নেবার প্রশ্নই ছিল না। এমার্জেন্সি অপারেশন করতে হয়েছে। অ্যান্ড দ্যাট ওয়াজ সাকসেসফুল। অনেকটা রক্ত পড়েছে। তাই ব্লাড দিতে হচ্ছে। কাকা, রক্ত আর অন্য সব মেডিসিনের দামটা কিন্তু দিতে হবে।’

শেখরনাথের মাথায় পাষাণভারের মতো যে দুর্ভাবনাটা চেপে বসেছিল সেটা লহমায় উধাও। সেই সকাল থেকে সারাদিন যে ঝড় বয়ে যাচ্ছিল তাতে মনে হয়েছে সমস্ত স্নায়ুমণ্ডলী ছিঁড়ে খুঁড়ে ছত্রখান হয়ে যাবে। কী কষ্টে যে সেগুলোকে তিনি নিয়ন্ত্রণে রেখেছেন, তিনিই জানেন। চাপ কেটে যাওয়ায় এখন রীতিমতো হালকা লাগছে। উলুপীর দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘শুনলে তো, ডাক্তারবাবু কী বললেন। আর ভয় নেই—’

ধরা ধরা, ঝাপসা গলায় উলুপী বলল, ‘বড়কত্তা, কইছিলাম না আপনে আমাগো ভগমান। আপনের আর ডাক্তারকত্তার দয়ায় মানুষডারে ফিরা পামু—‘

শেখরনাথের চোখ এবার ডাক্তার চট্টরাজের দিকে ঘুরে গেল।–-‘এই সুখবরটা তো প্যাসেজেই দিতে পারতে। সেজন্যে চেম্বারে ডেকে আনতে হল!’ তার কণ্ঠস্বর লঘু শোনাল।

‘না কাকা, এটা তো আছেই। আরও একটা জরুরি বিষয়ও রয়েছে।‘

উৎসুক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলেন শেখরনাথ।

ডাক্তার চট্টরাজ বললেন, ‘নবদ্বীপের এত বড় হেড ইনজুরি হল কী করে? জারোয়াদের কথা জিগ্যেস করেছিলাম, আপনি বললেন পরে জানাবেন। এটাও কি মোহনবাঁশির মতোই জারোয়ারা ঘটিয়েছে?’

‘না।‘

‘তবে?’

বিশদভাবে জানিয়ে দিলেন শেখরনাথ। কপালে ভাঁজ পড়ল ডক্তার চট্টরাজের।–’খুবই চিন্তার বিষয়। এটা ক্রিমিনাল কেস। পুলিশকে এক্ষুনি জানাতে হবে। মস্ত টেবিলের এক কোণে টেলিফোন রয়েছে। আঙুল ঘুরিয়ে ডায়াল করে নবদ্বীপের ব্যাপারটা জানিয়ে বললেন, ‘মিস্টার পান্ডে, একটা ডায়েরি করতে হবে। … ও, আপনি নিজেই আসছেন? খুব ভাল। …হ্যাঁ হ্যাঁ, ওরা আছে… মিনিট পনেরোর ভেতর পৌঁছে যাবেন? থ্যাঙ্ক ইউ’– কথা শেষ করে ফোনটা জায়গামতো নামিয়ে রাখলেন। ফের তার চোখ শেখরনাথের দিকে।–’নবদ্বীপের স্ত্রী এবং ছেলে সমস্ত ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী। তা ছাড়া ওদের স্বামী আর বাবাকে অমন নিষ্ঠুরভাবে মারা হয়েছে। ডায়েরিটা ওদেরই করতে হবে।‘

উলুপীরা দাঁড়িয়েই ছিল। ডাক্তার চট্টরাজ তাদের বললেন, ‘তোমাদের দুশ্চিন্তা তো কেটেছে। কতক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকবে! পায়ে ঝিঁঝি ধরে যাবে যে। বোসো, বোসো—’

অনেকবার বলা সত্ত্বেও উলুপীদের চেয়ারে বসানো গেল না; তারা মেঝেতে বসল।

হঠাৎ কিছু খেয়াল হওয়ায় শেখরনাথ বললেন, ‘ডাক্তার, নবদ্বীপকে আজ কি একবার দেখা যায়?’

‘আজকের দিনটা থাক কাকা। কাল ওদের এনে দেখে যাবেন।‘

‘ঠিক আছে। কতদিন নবদ্বীপকে হাসপাতালে থাকতে হবে?’

‘আশা করি পাঁচ ছ’দিন পরে ওকে রিলিজ করে দিতে পারব। খুব সম্ভব নতুন কোন কমপ্লিকেশন হবে না।‘

পোর্টব্লেয়ার থানার দারোগা মধুকর পান্ডে এবং একজন রাইটার জমাদার, যার নাম সুরেশ নিয়োগী, ডাক্তার চট্টরাজের চেম্বারে এসে ঢুকলেন।

মধুকর পান্ডের বয়স পঞ্চান্নের আশপাশে। ছফিটের কাছাকাছি উচ্চতা। মজবুত, পেটানো স্বাস্থ্য। চুল চামড়া ঘেঁষে ছোট ছোট করে ছাঁটা। শক্ত চোয়াল, পুরু ঠোঁট, তামাটে রং। নাকের তলায় চাড়া দেওয়া গোঁফ। গায়ে পুলিশের উর্দি। পায়ে ভারী বুট।

মধুকর খাস বেনারসের লোক, সুরেশ পশ্চিম বাংলার হুগলি জেলার। দু’জনেই পুলিশে চাকরি নিয়ে পোর্টব্লেয়ারে এসেছেন।

মধুকর বললেন, ‘নমস্তে ডাক্তার চট্টরাজ। আপনার তলব পেয়ে দেখুন ঠিক পন্দ্র মিনিটের ভেতর চলে এসেছি। পরক্ষণেই তার চোখ এসে পড়ল শেখরনাথের ওপর। সসম্ভ্রমে মাথাটা অনেকখানি ঝুঁকিয়ে দিলেন।–’নমস্তে, নমস্তে চাচাজি। আপনি হাসপাতালে আছেন ডাক্তার চট্টরাজ ফোন করার অনেক আগেই জেনেছি। রিফিউজি রিহ্যাবিলিটেশনের দু’জন এমপ্লয়ী জেফ্রি পয়েন্ট থেকে লক্ষ্মণ ভক্ত নামে একটা রিফিউজিকে নিয়ে এসেছে। বলেছে আপনিই তাদের আমার কাছে পাঠিয়েছেন। লক্ষ্মণ নবদ্বীপ কুণ্ডু নামে অন্য একটা রিফিউজিকে এমন মার মেরেছে যে হয়তো বাঁচবে না। তাকে নিয়ে আপনি হাসপাতালে এসেছেন। লক্ষ্মণকে আমি লক-আপে আপাতত ভরে রেখেছি। ডিটেলে সমস্ত ঘটনাটা আমাদের জানা দরকার।‘

মধুকর আন্দামানের হিন্দি-উর্দু মেশানো ভেজাল হিন্দিতে কথা বলেন না। তাঁর হিন্দি উত্তরপ্রদেশের খাস বিশুদ্ধ হিন্দি। আন্দামানের অন্য বাসিন্দাদের মতো তিনিও প্রাক্তন স্বাধীনতা-সংগ্রামীকে যথেষ্ট শ্রদ্ধা করেন।

নমস্কার প্রতি-নমস্কারের পর্ব শেষ হলে ডাক্তার চট্টরাজ মধুকরদের বসতে বললেন। টেবিলের এধারে ছ’টা ফাঁকা চেয়ার রয়েছে। সুরেশকে নিয়ে মধুকর বসে পড়লেন। বিনয়ের সঙ্গে তাদের পরিচয় করিয়ে দেওয়া হল।

মধুকর বললেন, ‘সমস্ত কেসটা এবার শোনা যাক। সুরেশ, তোমার কাগজপত্র কলম-টলম বের কর—’

সুরেশ নিয়োগী একটা চামড়ার ব্যাগ নিয়ে এসেছিল। সেটার ভেতর থেকে কাগজ এবং পেন বের করে টেবিলের ওপর রেখে প্রস্তুত হয়ে রইল।

মেঝেতে বসে থাকা উলুপী আর তার ছেলের দিকে আঙুল বাড়িয়ে দিলেন শেখরনাথ।–’ওরা হল নবদ্বীপের বউ আর ছেলে। ওরা তোমাকে ডিটেলে সবটা বলতে পারবে। ঘটনাটা যখন ঘটে তখন আমি আর বিনয় প্লেস অফ অকারেন্সে ছিলাম না। ছিলাম বেশ খানিকটা দূরে। হইচই শুনে ছুটে এসে সবটা শুনি। যা শুনেছি সেটা বলতে গেলে কিছু কিছু বাদ যেতে পারে, কিছু ভুল হওয়ারও সম্ভাবনা আছে। নবদ্বীপের স্ত্রী আর ছেলে তার সঙ্গেই ছিল। ওরাই ঠিক ব্যাপারটা বলতে পারবে। উলুপী, তুমি দারোগাবাবুকে সব বল। খুঁটিনাটি কিছু বাদ দেবে না—’

উলুপী গুছিয়ে বলতে পারে। সকালবেলার মর্মান্তিক ঘটনাটার অনুপুঙ্খ বিবরণ দিয়ে গেল সে। মধুকর পান্ডের চোখের ইঙ্গিতে সুরেশ লিখে যেতে লাগল।

মিনিট দশেকের ভেতর উলুপীর বলা শেষ হল, সুরেশের লেখাও। মধুকর পান্ডে সুরেশকে বললেন, ‘এবার আস্তে আস্তে বাংলায় তর্জমা করে নবদ্বীপ কুণ্ডুর বিবিকে শুনিয়ে দাও।‘

সুরেশ ইংরেজিতে উলুপীর বয়ান লিখে নিয়েছিল। সেটা বাংলা করে শুনিয়ে দিল।

মধুকর উলুপীকে জিগ্যেস করলেন, ‘কী, ঠিক আছে?’

‘হ, বড়বাবুরা—’ উলুপী আস্তে মাথা নাড়ল।

মধুকর বললেন, ‘লক্ষ্মণকে ছাড়া হবে না। দু-এক দিনের ভেতর তাকে আদালতে তোলা হবে। তুমি নিশ্চয়ই চাও, লক্ষ্মণের সাজা হোক—’

‘নিয্যস চাই। উই ড্যাকরা রাইক্ষসটারে আপনেরা ফাসিতে ঝুলাইয়া দ্যান দারোগা কত্তা।’ বলে ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠল।

‘কেঁদো না, কেঁদো না। তুমি যা বললে তা তোমাকে শোনানো হয়েছে। আবার জিগ্যেস করছি, ঠিক লেখা হয়েছে তো?’

উলুপী মাথা কাত করল।–’হ, ঠিকই আছে।‘

‘নিজের নাম সই করতে পার?

‘না বাবা, লিখাপড়া তো শিখি নাই।‘

‘তা হলে আঙুলের টিপছাপ দিতে হবে। সুরেশ, তুমি ওটা নিয়ে নাও—’

সুরেশ নিয়োগী ইংক-প্যাড নিয়ে এসেছিল। উলুপীর মুখ থেকে শুনে যে বয়ানটা লেখা হয়েছিল তার তলায় ডান হাতের বুড়ো আঙুলে কালি লাগিয়ে উলুপীর টিপছাপ নেওয়া হল। তারপর শেখরনাথ এবং বিনয়কে অনুরোধ করতে তারা সাক্ষী হিসেবে সই করলেন। একজন নিরক্ষর মেয়েমানুষকে যে জোর করে বা ভুলিয়ে ভালিয়ে বয়ানের তলায় টিপছাপ নেওয়া হয় নি তার সাক্ষী থাকা দরকার। পরে যাতে অভিযোগকারী তা অস্বীকার করতে না পারে তাই পুলিশকে আটঘাট বেঁধে পাকা কাজ করতে হয়।

মধুকর পাণ্ডে বললেন, ‘আজ আমরা উঠি। নমস্তে চাচাজি, নমস্তে ডাক্তার চট্টরাজ, নমস্তে বিনয়বাবু—’ এখানকার কাজ হয়ে গেছে। আর বসে থাকার প্রয়োজন নেই। সুরেশকে নিয়ে তিনি চলে গেলেন।

.

উলুপী আর তার ছেলেকে বাইরের প্যাসেজে নিয়ে বসতে যাচ্ছিলেন শেখরনাথ, সেই সময় বিশ্বজিৎ রাহা ব্যস্ত পায়ে ডাক্তার চট্টরাজের চেম্বারে এসে ঢুকলেন। একটা ফাঁকা চেয়ারে বসতে বসতে শেখরনাথকে বললেন, ‘জেফ্রি পয়েন্টে এসব কী হচ্ছে! সেদিন জারোয়ারা মোহনবাঁশিকে তির মেরে জখম করেছিল, সেটা না হয় বোঝা গেল। এই আদিবাসীরা চায় না বাইরের লোকজন এসে তাদের এলাকার জঙ্গলটঙ্গল কেটে সেটলমেন্ট বানিয়ে পার্মামেন্টলি থাকুক। কিন্তু তাই বলে রিফিউজিরা এখানে আসতে না-আসতেই জমি নিয়ে মারদাঙ্গা শুরু করে দিল! ড্রাইভার হরগোবিনের মুখে সব শুনেছি। জমির বাউণ্ডারিতে খুঁটি পুঁতে পুঁতে সীমানা ঠিক করে দেওয়া হয়েছে। লক্ষ্মণ ভক্ত কিনা খুঁটি তুলে নবদ্বীপের জমির অনেকখানি এলাকা দখল করতে চেয়েছে! কোথায় মিলেমিশে থাকবে, তা নয়, জমি পেয়েই বজ্জাতি। আমার কিন্তু খুব দুশ্চিন্তা হচ্ছে কাকা–’

ঠিক কোন কারণে বিশ্বজিতের দুর্ভাবনা অনুমান করতে না পেরে তার দিকে তাকালেন শেখরনাথ।

বিশ্বজিৎ তাঁর মনোভাব আঁচ করে নিয়ে বললেন, ‘এটা কিন্তু সূত্রপাত কাকা। এইরকম জমি দখলের ঘটনা কিন্তু আরও বাড়বে বলেই মনে হয়। দেশ থেকে উৎখাত হয়ে এসে কত কষ্ট পেয়েছে লোকগুলো কিন্তু জমি পেয়েই তাদের কুচুটেপনা, শয়তানি শুরু হয়ে গেছে। ইমিডিয়েটলি এসব বন্ধ করা দরকার।’

শেখরনাথ বললেন, ‘দরকার তো বটেই। নইলে জমি নিয়ে খুনোখুনি করে ওরা মরবে।‘

‘পরিতোষ বণিক লোক ভাল। কিন্তু বড় মিনমিনে, নরম ধরনের। ওর পক্ষে কড়া স্টেপ নেওয়া অসম্ভব। কাকা, আপনি তো এখন জেফ্রি পয়েন্টে থাকছেন। আপনাকে মেনলি ব্যাপারটা ট্যাকল। করতে হবে।‘

একটু চুপ করে রইলেন শেখরনাথ। কিছু ভেবে নিয়ে বললেন, ‘দ্যাখ, আমি বাইরের লোক, গভর্নমেন্টের কোনও পোস্ট হোল্ড করি না। লোকে আমাকে ভালবাসে, সম্মান দেয় তাই যা বলি সবাই মেনে নিচ্ছে। কিন্তু হঠাৎ কেউ ফস করে বলে বসতে পারে, আপনি কেন মাতব্বরি করছেন। মশাই, আপনি তো গভর্নমেন্টের কেউ নন। আপনার কথা শুনব কেন? আপনার ফোপরদালালি মানব না। তখন কী জবাব দেব?’

গলার স্বর একটু উঁচুতে তুললেন বিশ্বজিৎ।–’স্বাধীনতার পর থেকে এই আইল্যাণ্ডে কেউ কখনও আপনার মুখের ওপর কথা বলতে সাহস করেছে! রিফিউজিদের এত বড় বুকের পাটা কোনওদিন হবে না।‘

‘আমার কথাটা শোন। আমি জেফ্রি পয়েন্টে তো বেশ কিছুদিন থাকছিই। সেটলমেন্টটা যাতে ভালভাবে তৈরি হয় সেটা দেখব। লক্ষ্মণের মতো পাজি বজ্জাতদের ঢিট করতে চেষ্টা করব। কিন্তু তুই হলি রিহ্যাবিলিশনের একজন বড় কর্তা। তোর ওই সেটলমেন্টে গিয়ে শাসানি দেওয়া উচিত। কোনওরকম শয়তানি যে বরদাস্ত করা হবে না সেটা আমি বুঝিয়েছি। তুই নিজে বললে তার গুরুত্ব আরও বাড়বে।’

‘ঠিক আছে, শিগগির ওখানে গিয়ে কয়েকদিন থাকব।’ বলেই ডাক্তার চট্টরাজের দিকে তাকালেন। বিশ্বজিৎ।–’বৃন্দাবন কুণ্ডুর শরীরের হাল এখন কতটা ক্রিটিকাল?’

ডাক্তার জানালেন, ক্রাইসিস কেটে গেছে। বৃন্দাবন চোটটা সামলে নিয়েছে। আর কোনও সমস্যা নেই। ইত্যাদি ইত্যাদি।

বিশ্বজিৎ সামান্য হাসলেন।–’রিফিউজিরা আন্দামানে আসতে শুরু করেছে। নিজেদের মধ্যে এরকম ঝগড়াঝাটি, মারপিট করলে আরও অনেক ক্রিটিকাল কেস নিয়ে আপনার হাসপাতালে আসতে হবে।‘

ডাক্তার চট্টরাজও হাসলেন।

শেখরনাথ বিশ্বজিৎকে বললেন, ‘বিশু, আমরা সেই সকালবেলায় জেফ্রি পয়েন্টে থেকে বেরিয়ে এসেছি। বৃন্দাবনের বউ আর ছেলে বাসি রুটি আর গুড় খেয়ে মাঠের কাজে নেমেছিল। তারপর ওদের আর কিছু খাওয়া হয়নি। বিনয় আর আমার পেটে একফোঁটা জলও পড়ে নি। আমাদের সবার খাওয়ার ব্যবস্থা করা দরকার।

বিশ্বজিৎ ভীষণ ব্যস্ত হয়ে পড়লেন। –’ইস, আগে জানতে পারলে খাবার দাবার নিয়ে আসতাম। ডাক্তার চট্টরাজ বললেন বৃন্দাবন কুণ্ডুর ক্রাইসিস আর নেই। চলুন, আমার বাংলোয় যাওয়া যাক।

‘বিশু, একটা কথা বলছিলাম। এর আগে মোহনবাঁশিদের তোর ওখানে বেশ কয়েকদিন রেখেছিলাম। বার বার তুই কত হুজ্জত পোহাবি? এবারডিন মার্কেটের পাশে রিফিউজিদের ট্রানজিট সেন্টারে কি বৃন্দাবনের বউ আর ছেলেকে রাখার ব্যবস্থা করবি?’

এবারডিন মার্কেটের লাগোয়া লম্বা ব্যারাক টাইপের তিনটি বাড়ি পুনর্বাসন দপ্তর ভাড়া নিয়েছে। কলকাতা থেকে উদ্বাস্তুরা আন্দামানে এলে একটা রাত এখানে রেখে দক্ষিণ আন্দামানের নতুন নতুন রিফিউজি সেটলমেন্টগুলোতে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। কিংবা যেসব শরণার্থী আগেই এসে দূর দূর সেটলমেন্টগুলোতে চলে গেছে, অসুখবিসুখের চিকিৎসা বা অন্য কারণে পোর্টব্লেয়ারে আসতে হলে দু-চারদিন এখানেই কাটাতে পারে। এসব বিনয়ের জানা।

বিশ্বজিৎ হাত নাড়তে নাড়তে বললেন, ‘না না, হুজ্জত আবার কিসের। আমার বাংলোয় তিন চারটে ঘর তো খালিই পড়ে থাকে। তাছাড়া বৃন্দাবনের বউ আর ছেলের ওপর দিয়ে সারা দিন ঝড় বয়ে গেছে। ট্রানজিট সেন্টারে পাঠালে ওরা দিশেহারা হয়ে পড়বে। আমাদের কাছেই দু’জনকে রাখা দরকার। ডাক্তার চট্টরাজ, বৃন্দাবনকে কতদিন হাসপাতালে থাকতে হবে?

ডাক্তার চট্টরাজ বললেন, আপনি আসার আগে কাকাকে জানিয়েছি ম্যাক্সিমাম চার-পাঁচ দিন। তারপরেই ডিসচার্জ করে দেওয়া হবে।

‘এখন তা হলে যাওয়া যাক—’ বিশ্বজিৎ উঠে পড়েন।

‘হ্যাঁ, আসুন—’

সন্ধের একটু পরে পরেই বিশ্বজিৎ রাহার গাড়িতে সবাই তার বাংলোয় পৌঁছে গেলেন।

উলুপী আর তার ছেলে সেই সকাল থেকে কতক্ষণ যে একটানা কেঁদেছে। তারপর পেটে প্রায় কিছুই পড়ে নি। বিনয় আর শেখরনাথেরও একই হাল। সবাই প্রায় ধুঁকছিল।

বিশ্বজিৎ তাঁর তিন কাজের লোককে তাড়া দিয়ে তাড়াতাড়ি গরম জল করে দিতে বললেন। রান্নার লোক ভুবনকে বললেন, ‘এক্ষুনি রান্না বসিয়ে দাও—’

স্নান-খাওয়াদাওয়া সারতে সারতে বেশ রাত হল। এই বাংলোয় এলে শেখরনাথ আর বিনয়ের জন্য যে দুটো ঘরে থাকার ব্যবস্থা করা হয় সেখানেই বিছানা পেতে দেওয়া হল। মোহনবাঁশির বউ ছেলেমেয়েদের জন্য যে ঘরটা ছেড়ে দেওয়া হয়েছিল সেখানে বিছানা পেতে উলুপী আর তার ছেলেকে পাঠানো হল। যে ক’দিন ওরা পোর্টব্লেয়ারে আছে ওখানেই থাকবে। মা আর ছেলে সমস্ত দিন উৎকণ্ঠায়, কান্নাকাটিতে এতটাই কাহিল হয়ে পড়েছে যে বসে থাকতে পারছিল না। তারা শুয়ে পড়েছে।

কিন্তু ক্লান্তি নেই শেখরনাথের। ধকল তো তার ওপর দিয়েও কম যায় নি। কিন্তু এখন তাঁকে দেখে কে তা বলবে। ষাটের কাছাকাছি বয়স। এই বয়সেও শরীর এবং মনের জোর কী বিপুল। স্নান-খাওয়ার পর তিনি বেশ সজীব হয়ে উঠেছেন।

এখন হলঘরের মতো প্রশস্ত ড্রইংরুমে বসে তিনজনে কথা বলছিলেন। বিশ্বজিৎ, শেখরনাথ এবং বিনয়। বিনয়ের ক্লান্তি কিন্তু কাটে নি। পেটে ভাত পড়তেই তার দু’চোখ জুড়ে আসছিল। প্রায় বৃদ্ধ শেখরনাথ যখন তাঁর ধারেকাছে ঘুমকে ঘেঁষতে দিচ্ছেন না তখন তার পক্ষে ঘরে গিয়ে শুয়ে পড়াটা দৃষ্টিকটু তো বটেই, অশোভনও। বিনয় অতি কষ্টে চোখ মেলে রাখতে চাইছিল।

বিশ্বজিৎ বলছিলেন, কাকা, তখন হাসপাতালে আমাকে জেফ্রি পয়েন্টে গিয়ে কিছুদিন থেকে আসার কথা বলেছেন। আমি রাজিও হয়েছিলাম। কিন্তু ভেবে দেখলাম এখন অন্তত পনেরো কুড়ি দিন আমার পক্ষে ওখানে যাওয়া সম্ভব হবে না।

‘কেন?’ শেখরনাথ বিশ্বজিতের দিকে তাকালেন।

‘আমার কোর্টে বেশ কয়েকটা জরুরি কেস রয়েছে। পর পর ডেট দিয়েছি। তা ছাড়া, শুধুমাত্র মিডল আন্দামানের জন্যে মাসদেড়েক বাদে কলকাতা থেকে আরও শ’খানেক ডিপি ফ্যামিলি আসবে। তাদের রিহ্যাবিলিটেশনের জন্যে জঙ্গল কেটে অনেকটা জমিও বের করা হয়েছে। সেই ব্যাপারে চিফ কমিশনারের সঙ্গে আমাদের মতো কয়েকজন অফিসারের আর্জেন্ট কনফারেন্সও আছে। বারো চোদ্দ দিন আমাকে পোর্টব্লেয়ারে ভীষণ ব্যস্ত থাকতে হবে।‘

একটু নীরবতা।

তারপর বিশ্বজিৎই ফের শুরু করলেন, ‘খবর পাচ্ছি কলকাতায় বামপন্থী দলগুলোর আন্দোলন আরও মারাত্মক হয়ে উঠেছে। যদি উদ্বাস্তুরা আসতে না পারে, এখানকার অ্যাডমিনিস্ট্রেশন মোপলাদের ওখানে বসিয়ে দেবার কথা ভাবছে। সাউথ আন্দামানে মোপলাদের বসাতে হয়তো পারবে না। কিন্তু মিডল আন্দামানটা ভেতরে ভেতরে টার্গেট করা আছে। ওয়েস্ট বেঙ্গলের লেফট পার্টিগুলোর ভাবা উচিত বাঙালি উদ্বাস্তুদের জন্যে এতবড় সুযোগ হাতছাড়া করা ঠিক হবে কিনা।‘ তাকে বেশ চিন্তাগ্রস্ত দেখা গেল।

আস্তে আস্তে মাথা নাড়লেন শেখরনাথ। –’বাঙালি উদ্বাস্তুদের স্বার্থের কথা নেতাদের ভাবা উচিত। সে যাক, জেফ্রি পয়েন্টে নিত্যনতুন যে উৎপাতই আরম্ভ হয়েছে তা বন্ধ করা দরকার। তুই যেতে না পারলে—’ বাকিটা শেষ না করে তিনি থেমে গেলেন।

বিশ্বজিৎ বললেন, ‘আমি তো যাবই। আপনি এক কাজ করুন, কাল সকালেই বিনয়বাবুকে নিয়ে চলে যান। এর মধ্যে জেফ্রি পয়েন্টে অন্য কোনও ফ্যাসাদ ঘটেছে কিনা, কে জানে। আপনি ওখানে থাকলে সামলাতে পারবেন।‘

কিছুক্ষণ ভেবে শেখরনাথ বললেন, ‘ঠিক আছে, আমি যাব, তবে কাল নয় পরশু। কালকের দিনটা বৃন্দাবনকে দু’বেলা হাসপাতালে গিয়ে দেখব। আমি থাকলে ওর বউ আর ছেলে অনেকটা ভরসা পাবে।‘

‘ঠিক আছে, তাই হবে—’

‘কিন্তু—’

জিজ্ঞাসু চোখে তাকালেন বিশ্বজিৎ। শেখরনাথ বললেন, ‘আমি চলে গেলে বৃন্দাবনকে দেখাশোনার কী হবে?’

‘সে ব্যবস্থা আমি করব। কোনওরকম ত্রুটি হবে না। আপনি নিশ্চিন্ত থাকুন। পুরোপুরি সুস্থ হলে ওদের জেফ্রি পয়েন্টে পাঠাব।‘

‘তোরা যে জিপটা দিয়েছিলি সেটা নিয়ে হরগোবিনকে কাল সকালে তো চলে যেতে বলেছি। বিনয়কে নিয়ে আমি ফিরব কী করে?’

‘এটা কি একটা সমস্যা হল? রিহ্যাবিলিটেশনের কি আর কোনও গাড়ি নেই? সব অ্যারেঞ্জমেন্ট হয়ে যাবে।‘

বিনয় চুপচাপ দু’জনের কথাবার্তা শুনতে শুনতে অস্বস্তি বোধ করছিল। একটু ইতস্তত করে বলল, ‘আমার কিছু বলার আছে—’

বিশ্বজিৎ এবং শেখরনাথের নজর তার দিকে ঘুরে গেল। বিশ্বজিৎ বললেন, ‘হ্যাঁ হ্যাঁ, বলুন—’

‘আমি কাকার সঙ্গে যাচ্ছি না। বেশ কদিন হল কাগজের জন্যে রিপোর্ট পাঠাতে পারি নি। জেফ্রি পয়েন্টে গিয়ে লিখে পাঠাতে অনেকটা সময় লাগবে। এখানে বসেই ওগুলো লিখে ফেলতে চাই। আপনি সঙ্গে সঙ্গেই কলকাতায় পাঠিয়ে দিতে পারবেন।

‘ঠিক আছে, তাই হবে। আপনি থেকে যান। লেখাটেখা হয়ে গেলে জেফ্রি পয়েন্টে যাবেন। সে ব্যবস্থাও করে দেব।’ বলতে বলতে হঠাৎ কিছু মনে পড়ে যাওয়ায় বেশ বিব্রত হয়ে পড়লেন বিশ্বজিৎ।–’ওই দেখুন, কলকাতা থেকে আপনার কটা চিঠি এসেছে, একটা প্যাকেটে ভরে রেখেছি ক’দিন আগে। জেফ্রি পয়েন্টে যে পাঠাব, নানা কাজের চাপে একদম খেয়াল ছিল না। আই অ্যাম এক্সট্রিমলি স্যরি। প্যাকেটটা নিয়ে আসছি।’ ব্যস্তভাবে নিজের বেডরুম থেকে একটা বড় সাইজের মোটা প্যাকেট এনে বিনয়কে দিলেন।

কথায় কথায় অনেকটা রাত হয়ে গিয়েছিল। শেখরনাথ বললেন, ‘আর নয়, এবার শুয়ে পড়া যাক—’

.

নিজের ঘরে চলে এল বিনয়। এই ঘরে আগেও থেকে গেছে সে। বাংলোর কাজের ছেলে গোপালের সব দিকে নজর। সে পরিপাটি করে মশারি খাঁটিয়ে, খাটের শিয়রে আলো জ্বালিয়ে দিয়ে গিয়েছিল।

ডান পাশের জোড়া জানলাটা খোলা রয়েছে। সেখান দিয়ে অনেক দূর অবধি চোখে পড়ে। এটা বোধহয় পূর্ণিমাপক্ষ। আকাশে পূর্ণ চাঁদের মায়া। লক্ষ কোটি মাইল দূর থেকে চাঁদটা যেন গলানো রুপোর কলস উপুড় করে ঢেলে দিয়েছে। চাঁদ ছাড়া কত যে নক্ষত্র!

জানলার বাইরে খানিকটা দূর থেকে সমুদ্র–সেসোস্ট্রেস বে। চাঁদের আলোয় সেটাকে স্বপ্নের এক জলধারা মনে হয়। বাঁ দিকে যতদূর চোখ যায় শুধু পাহাড় মাউন্ট হ্যারিয়েট। সেটার মাথায় সাদা ক্রসটা স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। সমুদ্র বিপুল গর্জনে পাড়ে এসে অবিরল আছড়ে পড়ছে।

কোনও দিকে নজর ছিল না বিনয়ের। সাদা রংয়ের বড় প্যাকেটটার দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইল সে। তারপর ব্যগ্রভাবে সেটার মুখ খুলতেই চারটে মাঝারি এবং ছোট মুখ-আঁটা খাম বেরিয়ে পড়ল। প্রতিটির ওপর তার নাম লেখা আছে। শ্রী বিনয়কুমার বসু। C/O শ্রী বিশ্বজিৎ রাহা, ম্যাজিস্ট্রেট এবং রিহ্যাবিলিটেশন অফিসার, পোর্টব্লেয়ার, আন্দামান, মেরিন জেটির নিকটে।

একটা খাম হাতে তুলে নিল বিনয়। হাতের লেখাটি অত্যন্ত পরিচিত। ‘নতুন ভারত’ পত্রিকার চিফ রিপোর্টার প্রসাদ লাহিড়ি। খামের মুখ ছিঁড়ে ভেতর থেকে চিঠি বের করে পড়তে লাগল বিনয়।

‘প্রিয় বিনয়, তোমার প্রতিবেদনগুলো নিয়মিত পাওয়া যায় না। মাঝে মাঝে বেশ দেরি করে পাঠাও। তুমি অবশ্য জানিয়েছ, পোর্টব্লেয়ার থেকে প্রায় চল্লিশ মাইল দূরে জেফ্রি পয়েন্টে উদ্বাস্তুদের নতুন সেটলমেন্টে বর্তমানে আছ। জঙ্গল-ঘেরা দুর্গম এলাকায়। পোস্ট অফিস নেই। বাইরের জগতের সঙ্গে যোগাযোগের ব্যবস্থা না থাকায় প্রতিবেদন পাঠানোর খুবই অসুবিধা। তুমি জানিয়েছ, পুনর্বাসন বা বনদপ্তরের কোনও কর্মী জরুরি কাজে পোর্টব্লেয়ারে এলে তুমি তাদের হাত দিয়ে লেখাগুলি বিশ্বজিৎ রাহার কাছে পাঠিয়ে দাও। তিনি আমাদের কাছে পাঠান। এই প্রক্রিয়াটি খুবই সময়সাপেক্ষ ব্যাপার। মাঝে মাঝে লেখা না পাওয়ায় ধারাবাহিক প্রকাশে ছেদ পড়ে।

‘তোমাকে আগেও লিখেছি, আন্দামান সম্পর্কে পাঠকের বিপুল আগ্রহ। তোমার লেখা যত পড়ছে। ততই তাদের প্রত্যাশা বাড়ছে। বিপ্লবী শেখরনাথের সেলুলার জেলে বছরের পর বছর কাটানোর বিবরণ পাঠক একরকম গোগ্রাসে গিলেছে। আন্দামানের গভীর জঙ্গলে অত্যন্ত প্রতিকূল পরিস্থিতিতে উদ্বাস্তুরা সেভাবে সেটলমেন্ট গড়ে তুলছে তার প্রভাব কলকাতার ত্রাণশিবির এবং শিয়ালদা স্টেশনে যে পূর্ব পাকিস্তানের ছিন্নমূল মানুষেরা নরকযন্ত্রণা ভোগ করে চলেছে তাদের ওপর প্রবলভাবে পড়েছে। বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলো যদি এদের ভবিষ্যতের কথা ভেবে বাধা না দেয় তবে অনেকেই আন্দামানে চলে যেতে প্রস্তুত। সঠিক প্রতিবেদন যে মানুষকে কতটা আশা জোগাতে পারে সেটা কলকাতায় বসে আমরা বুঝতে পারছি। তোমার প্রতিবেদনগুলো আমাদের নতুন পত্রিকা ‘নতুন ভারত’কে অনেক উচ্চতায় তুলে নিয়ে গেছে। সার্কুলেশনও বাড়ছে হু হু করে। এটা তোমার মতো নতুন একজন সাংবাদিকের পক্ষে বিরাট কৃতিত্ব।

‘সম্পাদক জগদীশবাবু, তোমার ওপর অত্যন্ত খুশি। পরের চিঠিতে তোমার সম্বন্ধে হয়তো একটা সুখবর জানাতে পারব। তিনি চাইছেন এবং আমিও চাইছি, একসঙ্গে দশ বারোটা প্রতিবেদন পাঠিয়ে দাও। তা হলে প্রকাশে গ্যাপ পড়বে না।

‘কলকাতার অবস্থা যথাপূর্বং। সেই মিটিং, মিছিল, স্লোগান। রাইটার্স বিল্ডিং অভিযান। সরকার আইন পাশ করাতে চাইছে যাতে কলকাতা এবং চারপাশে যেসব ফাঁকা জলাজমিগুলোতে জবরদখল কলোনি বসানো হয়েছে সেগুলো থেকে উদ্বাস্তুদের উৎখাত করে দেওয়া হবে। জমিমালিকদের ক্রমাগত চাপে সরকারকে এই পদক্ষেপ নিতে হচ্ছে। আইনটি পাশ হয়ে গেলে হাজার হাজার ছিন্নমূল মানুষ ফের উদ্বাস্তু হয়ে যাবে। মানবিক দিক থেকে এদের কথা প্রশাসনের বিবেচনা করে দেখা উচিত। নইলে সারা কলকাতায় রক্তস্রোত বয়ে যাবে।

‘যাই হোক, সেদিন সম্পাদকের কামরায় আমাদের একটা মিটিং ডাকা হয়েছিল। জগদীশবাবু বলছিলেন, আন্দামান সম্পর্কে এখন পাঠকের যে আগ্রহ আছে চিরকাল থাকবে না। ল অফ ডিমিনিশিং রিটার্নের নিয়মে তা কমে যেতে বাধ্য। উনি ঠিকই বলেছেন।

‘জগদীশবাবু আরও বলেছেন, আসাম এবং ত্রিপুরাতেও হাজার হাজার মানুষ পূর্বপাকিস্তান থেকে চলে আসতে বাধ্য হয়েছে। তারাও কিন্তু পরম সুখে নেই। বিশেষ করে আসামের স্থানীয় মানুষ এবং রাজনৈতিক নেতারা একেবারেই চান না, বাঙালি উদ্বাস্তুরা সেখানে স্থায়ীভাবে থাকুক। তুমি কলকাতায় থাকতে থাকতেই তো দেখেছ, আসাম থেকে দ্বিতীয়বার উদ্বাস্তু হয়ে পূর্বপাকিস্তানের বাঙালিরা পশ্চিমবাংলায় চলে আসছে। সেই আসার কিন্তু বিরাম নেই। জগদীশ বাবু চাইছেন, আর পনেরো কুড়িদিন আন্দামানে থেকে তুমি কলকাতায় ফিরে আসো। আসামের পরিস্থিতি নিয়ে এখানকার অন্য পত্রপত্রিকায় তেমন কিছু রিপোর্ট টিপোর্ট বেরুচ্ছে না। সম্পাদকের ইচ্ছা, তুমি কলকাতায় এলেই আসামে পাঠিয়ে দেবেন। সেখানে মাসখানেক কাটিয়ে উদ্বাস্তুরা কী ধরনের শোচনীয় অবস্থায় রয়েছে। সে সম্বন্ধে যাবতীয় তথ্যভিত্তিক রিপোর্ট পাঠিয়ে চলে যাবে ত্রিপুরায়। ওই দুই রাজ্যেও প্রচুর বাঙালি পাঠক রয়েছে। বিশেষ করে উদ্বাস্তুদের দুঃখকষ্ট যন্ত্রণার কথা লেখা হলে তাদের মধ্যে আমাদের কাগজের প্রচার অনেক বেড়ে যাবে।

‘সাবধানে থেকো। তোমার চিঠি এবং কমপক্ষে বেশ ক’টা প্রতিবেদনের আশায় রইলাম। স্নেহ নিয়ো। চিরশুভার্থী প্রসাদদা’

চিঠিটা পড়া হলে কিছুক্ষণ চুপচাপ বসে রইল বিনয়। তার প্রতিবেদনগুলো যে পাঠককে খুশি করেছে, সেটা আগেও জানিয়েছিলেন প্রসাদ লাহিড়ি। কিন্তু সেগুলোর প্রতিক্রিয়া এমন ব্যাপকভাবে হয়েছে যাতে ত্রাণশিবির এবং শিয়ালদা স্টেশনের উদ্বাস্তুরা পর্যন্ত এখন আন্দামানে আসতে চাইছে। তার লেখা যে কলকাতায় এতটা আলোড়ন সৃষ্টি করতে পারবে, কে ভাবতে পেরেছিল। ‘নতুন ভারত’-এর মালিক এবং সম্পাদক স্বয়ং জগদীশ গুহঠাকুরতা পর্যন্ত তাঁর সম্বন্ধে উচ্ছ্বসিত। পরের চিঠিতে একটা সুসংবাদের ইঙ্গিতও দিয়েছেন প্রসাদ। শুধু তাই নয়, তার ওপর সম্পাদকের এতটাই আস্থা যে তিনি তাকে আসাম এবং ত্রিপুরাতেও পাঠাতে চাইছেন। চিঠির এই অংশটা পড়ে বিনয় অভিভূত। কিন্তু অন্য একটা দিক তাকে ভীষণ বিচলিত করে তুলেছে। কেমন যেন অস্থির অস্থির লাগছে।

জগদীশবাবু চান সে পনেরো কুড়ি দিনের মধ্যে যেন কলকাতায় ফিরে আসে। কিন্তু মধ্য আন্দামানে গিয়ে ঝিনুকের সঙ্গে এখনও দেখাই করতে পারে নি। কবে দেখা করা সম্ভব তাই বা কে জানে। লা-পোয়ে অবশ্য ভরসা দিয়েছে সে তাদের মোটর-বোটে মধ্য আন্দামানে নিয়ে গিয়ে ঝিনুকদের সেটলমেন্টে পৌঁছে দেবে। কিন্তু রক্তাক্ত, ক্ষতবিক্ষত বৃন্দাবনকে নিয়ে শেখরনাথের সঙ্গে তাকে পোর্টব্লেয়ারে আসতে হয়েছে। প্রতিবেদন এবং কয়েকটা চিঠি লেখার জন্য এখানে তাকে কয়েকদিন থাকতে হবে। তার ভেতর লা-পোয়েরা জেফ্রি পয়েন্টে এসে তাকে না পেয়ে হয়তো চলে যাবে। সমস্ত ব্যাপারটা কেমন যেন অনিশ্চিত হয়ে পড়ল।

জোড়া জানলার বাইরে ফিনিক-ফোঁটা জ্যোৎস্নায় স্বপ্নবৎ সমুদ্র এবং চারিদিকের দ্বীপ, পাহাড় এবং অরণ্যের দিকে অন্যমনস্কর মতো তাকিয়ে থাকে বিনয়। তারপর হঠাৎ মনস্থির করে ফেলে। না, ঝিনুকের সঙ্গে দেখা না করে সে আন্দামান থেকে কিছুতেই কলকাতায় ফিরবে না। এক মাস লাগুক দুমাস লাগুক, কিংবা তারও বেশি, নানা কৌশলে আন্দামানে থেকে যাবে। এতে চাকরির ক্ষতি হয়তো হবে। হলে হবে। কিন্তু মেয়েটা সেই কৈশোর থেকে তার সমস্ত অস্তিত্বকে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে রেখেছে, বিশ্বব্রহ্মাণ্ড খুঁজে বেড়াবার পর তাকে যখন বঙ্গোপসাগরের সৃষ্টিছাড়া দ্বীপে একবার দেখা গেছে, কী করে তাকে ফেলে চলে যাবে বিনয়?

এবার দ্বিতীয় চিঠিটি বের করল সে। এটা সুধার।–’স্নেহের ভাই বিনু, তোর আগের চিঠি পেয়েছি। গভীর দুঃখের সঙ্গে জানাই আমাদের পরিবারে মহাশোকের ঘটনা ঘটে গেছে। তোর হিরণদার দাদু, আমার দাদাশ্বশুর দ্বারিক দত্ত কিছুদিন ধরেই ভুগছিলেন। মাঝে মাঝে হাসপাতালে ভর্তি করেছি। সুস্থ হওয়ার পর তোর হিরণদা আর আমি তাকে বাড়ি ফিরিয়েও এনেছি। কিন্তু এবার আর সে সুযোগ পাওয়া গেল না। বাড়িতেই ঘুমের মধ্যে হৃদরোগে তিনি চিরকালের মতো আমাদের ছেড়ে চলে যান। আমাদের হাউস ফিজিসিয়ান ডাক্তার মজুমদারকে ডাকা হয়েছিল। তিনি এসে পরীক্ষা, করে বলেন হৃদ্যন্ত্রে আঘাতটা এতই গুরুতর যে কিছুই করার ছিল না; পাঁচ মিনিটের মধ্যে তাঁর মৃত্যু হয়। ডাক্তার মজুমদার ডেথ সার্টিফিকেট লিখে দিয়ে চলে যান। আমরা এতটাই দিশাহারা হয়ে পড়েছিলাম যে তোকে টেলিগ্রাম করে যে জানাব তা আমাদের মনেই আসে নি। প্রচণ্ড অন্যায় হয়ে গেছে। দুদিন আগে তার শ্রাদ্ধশান্তি হয়েছে। তোকে ভীষণ ভালবাসতেন। তুই আমাদের বাড়ি থেকে ‘শান্তিনিবাস’ মেসে চলে যাওয়ায় খুব দুঃখ পেয়েছিলেন। ঝিনুকের কথাও প্রায়ই বলতেন। মেয়েটা কোথায় যে নিরুদ্দেশ হল!

‘বিনু, আমরা একটা বটগাছের তলায় ছিলাম। বিপদে সংকটে সবসময় আমাদের আগলে আগলে রাখতেন দাদাশ্বশুর। মাথার ওপর থেকে একটা বড় আশ্রয় চিরদিনের মতো চলে গেল। আমরা একেবারে অনাথ হয়ে গেলাম রে।

‘তোকে আরও একটা দুঃসংবাদ দিই। মাস্টারমশাই মানে আশু দত্ত মারাত্মক আহত হয়ে মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি আছেন। যুগল তাদের মুকুন্দপুর কলোনিতে তাকে নিয়ে গিয়ে স্কুল খুলিয়ে ছিল। মাস্টার মশাই পাকিস্তান থেকে এসে তার মাকে নিয়ে কালীঘাটের ঈশ্বর গাঙ্গুলি স্ট্রিটে তার এক আত্মীয়ের বাড়িতে উঠেছিলেন। প্রথমটা তিনি মুকুন্দপুরে যেতে চাননি। তুই তাঁর প্রিয় ছাত্র। যুগলের সঙ্গে তুইও তাকে অনেক বুঝিয়ে সুঝিয়ে মুকুন্দপুরে পাঠাস। তাঁকে দিয়ে কলোনির ছেলেমেয়েদের পড়াশোনার জন্য একটা স্কুল খোলা হয়।

‘শুধু স্কুলে পড়ানোই নয়, মুকুন্দপুরের ভিটে মাটি খুইয়ে আসা মানুষগুলোর সুখদুঃখের সঙ্গে জড়িয়ে পড়েন মাস্টার মশাই। তুই আন্দামানে যাওয়ার আগে দেখে গেছিস জবরদখল কলোনিগুলো থেকে উদ্বাস্তুদের উৎখাত করার জন্য জমি-মালিকদের পক্ষে সরকার একটা আইন পাশ করতে চলেছে। তাই নিয়ে উদ্বাস্তুদের মধ্যে প্রচণ্ড ক্ষোভ শুরু হয়েছিল। সেটা এখন তীব্র আকার ধারণ করেছে। আশু দত্ত শুধু স্কুল নিয়েই পড়ে থাকেন নি; মুকুন্দপুর আর তার চারপাশের কলোনিগুলোর আন্দোলনে নেতৃত্ব দিয়ে দিনচারেক আগে রাজভবন অভিযানে শত শত উদ্বাস্তুকে নিয়ে আসেন। এদিকে যাদবপুর, গড়িয়া, ঢাকুরিয়া– দক্ষিণ কলকাতার উদ্বাস্তুরাও মিছিল করে রাজভবনের দিকে যায়। উত্তর এবং দক্ষিণের এত মানুষ মিলিত হওয়ায় জনসমুদ্রের সৃষ্টি হয়। তাদের ঠেকাবার জন্য পুলিশ লাঠি চার্জ করে, টিয়ার গ্যাস ছোড়ে, এমনকি গুলিও চালায়। আশু দত্ত মিছিলের সামনের দিকে ছিলেন। পুলিশের লাঠির আঘাতে তার মাথা, বাঁ হাত এবং পাঁজর ভেঙে যায়। প্রচুর রক্তপাত হয়েছে। যুগল তোর হিরণদার অফিসে এসে এই খবরটা দিয়ে গেছে। তোর হিরণদা মাস্টারমশাইকে দেখে এসেছে। অবস্থা বেশ সংকটজনক। বেঁচে হয়তো যাবেন, কিন্তু বেশ কিছুদিন তাঁকে হাসপাতালে থাকতে হবে।

‘দাদাশ্বশুরের শ্রাদ্ধের দিন আত্মীয়স্বজন অনেকেই এসেছিল। আনন্দদা, দিদি ছাড়াও ওর শ্বশুরবাড়ির সবাই। দিদি বলল, কাশী থেকে বাবা তোকে একটা চিঠি লিখেছেন। আনন্দদারা সেই চিঠি বিশ্বজিৎ রাহার ঠিকানায় পাঠিয়ে দিয়েছে। বাবার শারীরিক অবস্থা একেবারেই ভাল নয়। চিঠিটা আনন্দদারা খোলে নি। তাদের আলাদা চিঠি লিখে জানিয়ে দিয়েছে অবিলম্বে তোর চিঠি যেন তোকে পাঠিয়ে দেওয়া হয়।

‘এবার ঝুমার কথা বলি। ওরাও দাদাশ্বশুরের শ্রাদ্ধর দিন আমাদের বাড়ি এসেছিল। আমাকে আড়ালে ডেকে নিয়ে বলেছে, তোকে দু-তিনটে চিঠি লিখেছে। তুই একটারও উত্তর দিস নি। বিনু, নিরুদ্দেশ ঝিনুককে আর কোনওদিন পাওয়া যাবে না বলেই আমার বিশ্বাস। খোঁজটোজ তো কম করিসনি।

‘বিনু, ঝিনুকের মতো ঝুমা সেই কোন কম বয়স থেকে তোকে ভালবেসেছে। যতদিন ঝিনুক ছিল সে নিজেকে দূরে দূরেই সরিয়ে রেখেছে। কষ্ট পেয়েছে কিন্তু কোনওদিন তা প্রকাশ করে নি। ঝিনুক চলে যাওয়ার পর তোর জীবন যখন শূন্য হয়ে গেছে সেই সময় ঝুমা অনন্ত সহানুভূতিতে তোর পাশে দাঁড়িয়েছে। শোক, দাহ, দুঃখ, মানসিক যন্ত্রণা, এসব নিয়েই জীবন। একসময় প্রচণ্ড আঘাতে মনে হয় বেঁচে থাকাটাই দুর্বিষহ। কিন্তু সময়ের হাতে এমন জাদুকাঠি আছে যার ছোঁয়ায় সব শূন্যতা ভরে যায়।

‘ঝিনুক নিখোঁজ হওয়ার পর তোর জীবনের অনেকটা অংশ ফাঁকা হয়ে গিয়েছিল। তখন ভেতরে ভেতরে কতটা কষ্ট পেয়েছিস, কতখানি উতলা হয়েছিলি, সব বুঝতে পারতাম। একটা পাগল পাগল ভাব। কিন্তু ঝুমা তোর জীবনের কঁকা জায়গাটা কিন্তু ভরে দিয়েছে। ঝিনুকের কাছ থেকে ছিনিয়ে নিয়ে তোকে দখল করতে চায় নি। অবাঞ্ছনীয় কোনও কাজ সে করেনি। তুই আন্দামানে যাওয়ার আগে স্থিরই করেছিলি ঝুমাকে গ্রহণ করবি। তা হলে তাকে এত কষ্ট দেওয়ার কী কারণ? কেন মেয়েটাকে চিঠি লিখিস না? সবাইকে লিখিস, সে-ই শুধু বাদ! কী এমন ঘটেছে যে তাকে এড়িয়ে যাচ্ছিস? মেয়েটা এবং তার পরিবার তোর জন্য অপেক্ষা করে আছে। ওর বাবা-মা স্থির করেই ফেলেছেন, তুই ফিরে এলেই দুজনের বিয়েটা চুকিয়ে ফেলবেন, অবশ্য তোর মতামত নিয়েই।

‘বিনু, ঝুমা কিন্তু লঘু ধরনের সামান্য মেয়ে নয়। তার একটা বিরাট হৃদয় আছে, তার ভালবাসা তুচ্ছ করার জিনিস নয়। সেটা করলে একদিন না একদিন তোকে অনুশোচনা করতে হবে। ঝুমাকে অবশ্যই চিঠি লিখবি। সাবধানে থাকিস। নতুন ভারত’-এ তোর লেখাগুলো পড়ে ভীষণ দুশ্চিন্তায় আছি। পোর্টব্লেয়ার থেকে চল্লিশ মাইল দূরে ঘোর জঙ্গলে চরম বিপদের মধ্যে তোকে থাকতে হয়। যত তাড়াতাড়ি পারিস কাজ শেষ করে কলকাতায় ফিরে আয়। কতকাল যে তোকে দেখি না!

‘ও, একটা বড় খবর দিতে ভুলে গেছি। খুবই ভাল খবর। দিন পঁচিশেক আগে হেমদাদুর একটা চিঠি কাল পেয়েছি। তোর হিরণদাকে লিখেছেন। না, নিত্য দাস যে বর্ডারের এপারে ওপারে লোকজন। দিয়ে প্রচুর টাকা নিয়ে চিঠিপত্র চালাচালি করে, সেভারে নয়। এসেছে ডাক মারফত। দুই বাংলায় কচ্ছপের গতিতে হলেও ডাক-চলাচল শুরু হয়েছে। খুব সম্ভব সেটা খুব তাড়াতাড়িই স্বাভাবিক হবে। রাজদিয়া থেকে চিঠি আসতে হেমদাদুর পঁচিশ দিন লাগল। আশা করি, এরপর তিনি চিঠিপত্র লিখলে দু-তিন দিনের মধ্যে পেয়ে যাব। দালাল টাউটদের দিন একদিক থেকে শেষ।

‘হেমদাদু লিখেছেন, দেশের পরিস্থিতি এখন অনেকটিই ভাল। প্রায় স্বাভাবিকই বলা যায়। কিছুদিন আগে যে অশান্তি আর ভয়ের পরিবেশ তৈরি হয়েছিল আর তা নেই। তারা নির্বিঘ্নেই আছেন। বিহারি মুসলমানরা এপার থেকে গিয়ে যে তুমুল উৎপাত শুরু করেছিল, রাজদিয়া অঞ্চলের অনেক বাঙালি মুসলমান তাদের রুখে দিয়ে শাসিয়েছে, এতকাল যারা পাশাপাশি রয়েছে পুরুষানুক্রমে, তাদের কোনওরকম ক্ষতি করা চলবে না।

‘হেমদাদু জানতেন তুই আমাদের কাছেই আসিস। তিনি তোকে আশীর্বাদ জানিয়েছেন, চিঠি দিতেও লিখেছেন। দিদি, আনন্দদা আর ওদের বাড়ির সবাইকার খবর জানতে চেয়েছেন। পরে প্রত্যেককে আলাদা আলাদা চিঠি লিখবেন।

‘আমার চিঠি পাওয়া মাত্র উত্তর দিবি। আমাদের স্নেহ নিস।–ইতি ছোটদি।‘

.

চিঠিটা পড়া হলে কিছুক্ষণ নিঝুম বসে রইল বিনয়। এই তো সেদিন সে হাজারখানেক উদ্বাস্তুর সঙ্গে আন্দামানে এল। এর মধ্যে কত ঘটনা ঘটে গেছে কলকাতায়। দুঃখ, বিষাদ, আনন্দ–নানারকমের অনুভূতি তার ভেতর বেশ খানিকটা সময় আলোড়ন তুলে গেল।

দ্বারিক দত্ত’র মৃত্যুটা বিনয়ের কাছে খুবই কষ্টের। এটা ঠিকই তার যথেষ্ট বয়স হয়েছিল। সুধার আগের চিঠিগুলোতে জানা গেছে তিনি মাঝে মাঝেই ভুগছিলেন, আবার ভালও হয়ে উঠছিলেন। কিন্তু হঠাৎই চলে যাবেন, ভাবা যায় নি। রাজদিয়া থেকে কলকাতায় আসার পর ধর্ষিতা ঝিনুককে নিয়ে সে যখন দিশেহারা, যেখানেই তাকে নিয়ে যাচ্ছে, কেউ সুনজরে ঝিনুককে দেখছে না, অনন্ত সহানুভূতিতে তাকে কাছে টেনে তো নেয়ই নি, বরং তার ওপর যে নারকীয় নির্যাতন হয়েছে সেই অপরাধটা যেন ঝিনুকেরই–স্পষ্টভাবে তা বুঝিয়ে দিয়ে ঘৃণায় মেয়েটাকে দূরে সরিয়ে দিয়েছে নোংরা, দূষিত আবর্জনার মতো। এটা ঠিক, সেই সময় হিরণ আর সুধা তাদের পাশে দাঁড়িয়েছিল, আশ্রয় দিয়েছিল নিজেদের বাড়িতে। আতঙ্কগ্রস্ত, গ্লানিবোধে কুঁকড়ে থাকা ঝিনুককে ক্রমশ সুস্থ, স্বাভাবিক করে তুলেছিল। কিন্তু দ্বারিক দত্ত যদি আশ্রয় দিতে রাজি না হতেন সুধাদের পক্ষে তা আদৌ সম্ভব হত না। সংস্কারমুক্ত বৃদ্ধটির মৃত্যু বিনয়ের কাছে বিরাট এক ক্ষতি। = আশু দত্ত আদ্যোপান্ত একজন আদর্শবাদী শিক্ষক, মানুষ গড়ার কারিগর। আজীবন ছাত্র পড়িয়ে এসেছেন। কিন্তু জীবনের শেষ প্রান্তে উদ্বাস্তুদের সঙ্গে পড়ো জলাজমিতে তাদের জবরদখল কলোনির অধিকার বজায় রাখতে আন্দোলনে নেমে পড়বেন, কে ভাবতে পেরেছিল। পুলিশের লাঠির ঘায়ে তিনি যে রক্তাক্ত, আহত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন, তা জেনে বিনয় উৎকণ্ঠিত যত হয়েছে, তার চেয়ে অনেক বেশি শ্রদ্ধা বেড়েছে এই পরমাশ্চর্য মানুষটির ওপর। শুধু শিক্ষাদানের মতো মহৎ কাজই নয়, নিজে উদ্বাস্তু হয়ে অন্য ছিন্নমূল মানুষগুলোর মহাসংকটের সময় তাদের পাশে গিয়ে এই বয়সে যে দাঁড়াবেন তা কি ভাবা যায়! কলকাতায় ফিরে গিয়ে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব আশু দত্ত’র সঙ্গে সে দেখা করবে। তিনি দ্রুত সুস্থ হয়ে উঠুন, আপাতত এই প্রার্থনা ছাড়া আর কী-ই বা সে করতে পারে।

হেমদাদুরা যে ভাল আছেন, নিত্য দাসের দালালদের মারফত নয়, সরাসরি চিঠি লিখতে পারছেন, পশ্চিমবাংলা এবং পূর্বপাকিস্তানে ডাক-চলাচল স্বাভাবিক হতে শুরু করেছে, এটা একটা বড় খবর। তবে সবচেয়ে বিরাট স্বস্তির ব্যাপার হল রাজদিয়া এবং তার চারপাশের এলাকাগুলোতে অবাঙালি আর এক শ্রেণির বাঙালি মুসলমানের হিন্দুদের ওপর হামলা বন্ধ হয়েছে। হেমদাদুদের জন্য সারাক্ষণ কী দুশ্চিন্তার মধ্যে যে কাটাতে হয়। সুধার এই চিঠি পেয়ে বিনয় অনেকটাই চাপমুক্ত। পোর্টব্লেয়ার থেকেই সে হেমদাদুকে চিঠি লিখবে।

সুধার চিঠির সবচেয়ে অস্বস্তিকর প্রসঙ্গ হল ঝুমা। ঝিনুকের সঙ্গে আন্দামানে দেখা হওয়ার পর থেকে ওই মেয়েটাকে নিয়ে বিনয় আর ভাবতেই চায় না। সে বোঝে এটা ভয়ঙ্কর অন্যায়, বিশ্বাসভঙ্গের মতো মারাত্মক অপরাধ। সুধা ঠিকই লিখেছে, ঝুমার ভালবাসা তুচ্ছ করার মতো বিষয় নয়। আন্দামান থেকে ফেরার পর একবছর হোক, দু’বছর হোক কিংবা আরও কয়েক বছর বাদে এই মেয়েটাকে নিয়ে নতুন এক জীবন শুরু করবে তা একরকম স্থির হয়েই ছিল। কিন্তু কে জানত, কলকাতা থেকে আট, ন’শা মাইল দূরে নিরুদ্দেশ ঝিনুকের সঙ্গে ফের দেখা হয়ে যাবে। ঝুমা সুন্দরী, ঝকঝকে মেয়ে। লেখা পড়ায় ভাল; অনার্সে ফার্স্ট ক্লাস পাবেই, তার মাথার ওপর মা বাবা দাদু আছেন। ওদের প্রচুর পয়সা। বিনয়ের সঙ্গে বিয়েটা না হলে সে কষ্ট পাবে, ভীষণ ভেঙে পড়বে। কিন্তু সব কষ্ট, সব দাহ তো চিরস্থায়ী নয়। একদিন না একদিন সে নিশ্চয়ই সামলে নিতে পারবে। কিন্তু বিনয় ছাড়া ঝিনুকের পাশে দাঁড়াবার মতো কে আছে? আরও কয়েকজন ছিলেন হেমনাথ, স্নেহলতা, শিবানী। কিন্তু তারা তো সুদূর পূর্ব-পাকিস্তানে। অন্য এক দেশে। সেখান থেকে এস্ত, আতঙ্কগ্রস্ত ঝিনুক একদিন বিনয়ের সঙ্গে চলে এসেছিল। কোনওদিনই তাকে সেখানে পাঠানো যাবে না। মরে যাবে, তবু ঝিনুক সেখানে যাবে না। কিন্তু মধ্য আন্দামানে সমুদ্র-পাহাড় ঘেরা এক সৃষ্টিছাড়া সেটলমেন্টে বাকি জীবনটাকে সে ক্ষইয়ে ক্ষইয়ে শেষ করে দেবে তা তো হয় না। যেভাবেই হোক, তাকে কলকাতায় নিয়ে গিয়ে ঝুমা এবং তাদের পরিবারের সবার কাছে জোড়হাতে ক্ষমা চেয়ে নেবে। নিশ্চয়ই ওঁরা বুঝবেন। সুধার চিঠির উত্তরে ঝুমার কেমনও উল্লেখই আপাতত করবে না বিনয়। কলকাতায় ঝিনুককে নিয়ে গেলে আত্মীয়-পরিজন তো বটেই, সুধাও চমকে যাবে। বার বার সে চিঠি লেখা সত্ত্বেও কেন ঝুমা সম্পর্কে একেবারে নীরব থেকেছে বুঝতে পারবে। বিনয়ের গভীর বিশ্বাস সুধা এবং হিরণরা খুশিই হবে। সে যে তার কর্তব্য পালন থেকে এক চুলও সরে আসেনি। সেজন্য তার প্রতি ওদের শ্রদ্ধাই হবে।

ঝুমা যে একেবারে স্তব্ধ হয়ে যাবে, বিনয় সে ব্যাপারে পুরোপুরি নিশ্চিত। তার সঙ্গে বিয়ে ঠিক হয়ে আছে। হঠাৎ এত বড় একটা আঘাত সে কিভাবে সইবে, ভাবতেও শুধু অস্বস্তি নয়, ভীষণ কষ্টই হয়। তীব্র অপরাধবোধে নিজেকে হাজার বার ধিক্কার দিতে থাকে সে। ঝুমার মতো একটি নিষ্পাপ মেয়ের তার প্রতি বিশ্বাস, অগাধ আস্থাকে সে ভেঙে ধূলিসাৎ করে দিতে চলেছে। কলকাতায় গেলে তার গায়ে চেনাজানা সব মানুষ লম্পট, দুশ্চরিত্র, বিশ্বাসঘাতক– এই তকমাগুলো দেগে দেবে না? তখন কোন বিবরে মুখ লুকোবে বিনয়?

বিনয় নিশ্চিত, ঝুমার মা-বাবা এবং ওদের পরিবার তাকে একেবারেই ক্ষমা করবেন না। তাঁরা চরম অপমান করবেন। ঝুমার সঙ্গে বিয়েটা ভেঙে দিলে বিশ্বব্রহ্মাণ্ডে তাঁদের সামাজিক সম্মান কি এতটুকু থাকবে? তারাই বা কী করে মুখ দেখাবেন?

না, আর ভাবতে পারছে না বিনয়। কপালের দু’পাশের শিরাগুলো সমানে দপ দপ করছে। মনে হচ্ছে সমস্ত শিরাস্নায়ু ছিঁড়ে পড়বে।

বাইরে সমুদ্রের ঢেউগুলি আছড়ে পড়ছিল কোন আদিকাল থেকে, কে জানে। ক্লান্তিহীন। রাতচরা পাখিগুলো কখন থেমে গেছে টের পাওয়া যায়নি। তবে পূর্ণিমার চাঁদ তার অনন্ত মহিমা নিয়ে কোটি কোটি বছর ধরে যেমন আলো ঢেলে যায়, আজও তেমনি ঢেলে যাচ্ছে। সন্ধে থেকেই সেসোস্ট্রেস বে’র দিক থেকে হাওয়ার তেজ আরও বেড়েছে।

দূরমনস্কর মতো সুদূর আকাশের দিকে তাকিয়ে রইল বিনয়। ধীরে ধীরে ভেতরের অস্থিরতা, গ্লানি এবং অপরাধবোধের তীব্রতা কমে আসে।

এবার ধীরে ধীরে জানলার বাইরে থেকে চোখ ফিরিয়ে অন্য চিঠি দু’টো তুলে নিল বিনয়।

আনন্দর চিঠিটা খুব ছোট। মাত্র কয়েক লাইলের। বিনয় কেমন আছে, আর কতদিন আন্দামানে তাকে থাকতে হবে, অনিয়ম যেন না করে, শরীর-স্বাস্থ্যের দিকে যেন নজর রাখে, ইত্যাদি ইত্যাদি। শ্বশুরমশাই, মনে অবনীমোহনের একটা চিঠিও যে পাঠিয়েছে তাও লিখেছে।

চার নম্বর অর্থাৎ শেষ যে খামটা তুলে নিল বিনয় সেটার ওপর তার নাম এবং আন্দামানের ঠিকানা, ঠিক অন্য খামগুলোর মতোই। সুধা এবং আনন্দ লিখেছে এর মধ্যে একটা চিঠি অবনীমোহনেরও আছে। কিন্তু খামের ওপর হস্তাক্ষরটি সম্পূর্ণ অচেনা মনে হয়। বাবার হাতের লেখার ছাঁদ এধরনের নয়। ভুল করে কি আনন্দ অন্যের চিঠি তার কাছে পাঠিয়েছে। একটু দোনোমোনো করে শেষপর্যন্ত খামের মুখ ছিঁড়ে চিঠি বের করল বিনয়। পড়তেও শুরু করল। বয়ানটা এরকম।

 ‘স্নেহের বিনু, আমি যে চলচ্ছক্তিহীন, অথর্ব হইয়া গুরুতর পীড়িত অবস্থায় বিছানায় পড়িয়া আছি, তোমাকে ইতিপূর্বে তাহা জানাইয়াছি। আগের পত্রগুলি স্বহস্তে লিখিয়াছিলাম। বর্তমানে সেই শক্তিও নাই। তাই আমার এক গুরুভাইকে মুখে মুখে বলিয়াছি; তিনি অনুগ্রহ করিয়া লিখিয়া দিয়াছেন।

‘তুমি কি আমার পূর্বের চিঠিগুলি পাও নাই? পাইয়া থাকিলে উত্তর দাও নাই কেন? না পাইয়া থাকিলে তোমাকে জানাই, শরীরের যে হাল তাহাতে এই পৃথিবীতে আর বেশি দিন বাঁচিয়া থাকিব না। আমার অন্তিম কাল ঘনাইয়া আসিতেছে।

‘তোমাকে আগেই লিখিয়াছিলাম, ঝিনুককে অস্বীকার করিয়া আমি চরম অন্যায় করিয়াছি। আমারই জন্য সে নিরুদ্দেশ হইয়া গিয়াছে। সম্পূর্ণ নিষ্পাপ একটি মেয়ের জীবন হয়তো আমার কারণে ধ্বংস হইয়াছে। অন্ধ কুসংস্কারে আমার মতিচ্ছন্ন ঘটিয়াছিল। ঝিনুকের জন্য আমার প্রাণটি কোনও রকমে ধুকধুক করিয়া টিকিয়া আছে। তুমি যেমন করিয়া যেখান হইতে পার তাহাকে খুঁজিয়া বাহির করিয়া কাশীতে আমার কাছে লইয়া আসো। তাহার নিকটে ক্ষমাপ্রার্থনা করিতে না পারিলে মরিয়াও আমারও শান্তি নাই। আত্মগ্লানিতে জর্জরিত হইয়া আছি। ঝিনুক ক্ষমা করিলে আমার জীবনব্যাপী অনুশোচনার কিঞ্চিৎ উপশম হইবে।

‘কিছুদিন পূর্বে সুনীতিকে একটি চিঠি দিয়াছিলাম। তাহার উত্তরে সে লিখিয়াছে, তুমি, সংবাদপত্রে চাকুরি লইয়াছ এবং আন্দামানে উদ্বাস্তু পুনর্বাসনের তথ্য সংগ্রহ করিয়া তোমাদের কাগজে রিপোর্ট

পাঠাইবার দায়িত্ব লইয়া গিয়াছ। বর্তমানে তুমি কি আন্দামানে আছ, নাকি কলকাতার ফিরিয়া আসিয়াছ? আরেকবার স্মরণ করাইয়া দিতেছি ঝিনুককে সঙ্গে করিয়া কাশীতে আমাদের আশ্রমে চলিয়া আসিবে।

‘তোমাকে জানাইয়া ছিলাম আশ্রমে আসিবার পর আমার নাম পালটাইয়া গিয়াছে। গৃহী জীবনের সমস্ত কিছু ত্যাগ করিয়া এখানে থাকিতে হয়। আমিও তাই আসিয়াছিলাম। কিন্তু ঝিনুককে কোনও মতেই ভুলিতে পারিতেছি না।

‘তোমার উত্তরের আশায় রহিলাম। সংসার জীবনের নামটাই এখানে লিখিলাম। ইতি–

অবনীমোহন বসু’

চিঠিটা পড়ার পর বিচলিত হয়ে পড়ল বিনয়। খুবই উতলা। আগের চিঠিগুলো পেয়েও ঠিক এমনটাই হয়েছিল। অবনীমোহন যেভাবে সমস্ত অতীত, সন্তান সন্ততি, প্রায় পঞ্চান্ন বছরের সংসার জীবন পেছনে ফেলে গুরুর আশ্রমে চলে গিয়েছিলেন সেটা মেনে নিতে পারেনি বিনয়। বাবাকে এসপেটিস্ট অর্থাৎ পলাতক মনে হয়েছিল। মন শুদ্ধ থাকলে, সৎপথে জীবনকে চালিত করলে গুরুর প্রয়োজন কী? বিশেষ করে ঝিনুকের প্রতি তাঁর আচরণে সে অত্যন্ত আঘাত পেয়েছে। মর্মাহত হয়েছে। বাবার প্রতি তার শ্রদ্ধা নষ্ট হয়ে গিয়েছিল।

কিন্তু জীবনের শেষ পর্বে অনুতপ্ত, অপরাধবোধে বিপর্যস্ত মানুষটির জন্য সহানুভূতিই হয় বিনয়ের। বাবার আগের চিঠির জবাব সে দেয় নি। ঝিনুকের সঙ্গে আন্দামানে তার দেখা হয়েছিল ঠিকই, কিন্তু মেয়েটা সম্পূর্ণ ভাবলেশহীন মুখে এমন ভান করেছে যেন তাকে চেনেই না। তাকে পুরোপুরি অগ্রাহ্য করেছে। এমনটা ভাবতে পার নি সে। মধ্য আন্দামানে গিয়ে বাবার চিঠি দেখিয়ে বুঝিয়ে সুঝিয়ে তাকে কলকাতায় ফিরিয়ে নিয়ে যাবে, সেখান থেকে কাশী– এমনটাই ভেবে রেখেছিল। কিন্তু মধ্য আন্দামানে যাওয়া সম্ভব হয় নি। কে জানত, মাত্র ষাট মাইল দূরের দ্বীপে পৌঁছনো এত কঠিন! মনে হয় ওই দ্বীপটা অন্য কোনও অচেনা গ্রহে।

কিন্তু না, লা-পোয়েদের পাওয়া গেছে। বাবার চিঠিগুলো নিয়ে সে ঝিনুককে দেখাবে শেষ শয্যায় শায়িত বৃদ্ধ মানুষটি কাশীর এক আশ্রমে তার জন্য কতটা মানসিক যন্ত্রণা ভোগ করছেন। নিশ্চয়ই ঝিনুকের করুণা হবে।

প্রথম চিঠিটা পাওয়ার পর নিজের সংকল্পকে দৃঢ় করে নিয়েছিল, এবারও তাই করল। মধ্য আন্দামানে তাকে যেতেই হবে। যেতেই হবে।

.

একদিন পর সকালে পরটা-তরকারি এবং চা খেয়ে জেফ্রি পয়েন্টে চলে গেলেন শেখরনাথ। বেলা একটু বাড়লে ভাত টাত খাইয়ে উলুপী আর তার ছেলেকে কালীপদর সঙ্গে হাসপাতালে পাঠিয়ে দেওয়া হল। উলুপীরা আর এখানে ফিরবে না। বিকেলের ভিজিটিং আওয়ার্স শেষ হলে কালীপদ তাদের রিফিউজি ট্রানজিট সেন্টারে রেখে আসবে। প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই অন্য একটা গাড়িতে বিশ্বজিৎও বেরিয়ে পড়লেন।

উলুপীদের ট্রানজিট সেন্টারে রাখার কারণও রয়েছে। লক্ষ্মণের বিরুদ্ধে থানায় ডায়েরি করেছে সে। কেসটা উঠবে বিশ্বজিতের কোর্টে। উলুপীরা তার বাংলোয় থাকলে পক্ষপাতিত্ব নিয়ে প্রশ্ন উঠবে। তাই শেখরনাথের সঙ্গে পরামর্শ করে ওদের ট্রানজিট সেন্টারে পাঠানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছেন বিশ্বজিৎ।

বাংলোয় তিনজন কাজের লোক ছাড়া অন্য কেউ নেই। বিশ্বজিত্রা বেরিয়ে গেলে বিনয় লেখার টেবিলে গিয়ে বসে পড়ল। কাল বেশ ক’টা চিঠি লিখেছে। আজ অন্তত দুটো প্রতিবেদন শেষ করতেই হবে। কাল এবং পরশু আরও যে ক’টা সম্ভব হয় লিখে ফেলবে।

বাইরে বেরুবার তাড়া নেই। তাই বিশ্বজিৎদের সঙ্গে স্নান-খাওয়া চুকিয়ে ফেলে নি বিনয়। প্রথম প্রতিবেদনটা লেখা হলে ধীরেসুস্থে খাওয়া দাওয়া করবে।

দুপুরে সূর্য যখন সোজাসুজি মাথার ওপর উঠে এসেছে, বঙ্গোপসাগরের উত্তাল ঢেউগুলোর মাথায় তীব্র রোদ ঝলকে যাচ্ছে, সেদিকে তাকালে মনে হয় চোখে আগুনের ঝঝ এসে লাগছে, সেই সময় প্রথম লেখাটা শেষ হল। কাগজ কলম টেবিলের দেরাজে রেখে স্নান টান করে খেয়ে শুয়ে পড়ল সে। কাল জেফ্রি পয়েন্ট থেকে আসার ক্লান্তি এখনও পুরোপুরি কাটে নি। দিবানিদ্রার অভ্যাস না থাকলেও আজ ঘুমিয়ে নিল বিনয়। ঘুম যখন ভাঙল রোদের সেই তাপ আর নেই। দিনের নির্জীব আলোর রং এখন বাসি হলুদের মতো। ম্যাড়মেড়ে, কেমন যেন বিষাদ-মাখানো। ১ চা খেয়ে লেখার টেবিলে বসে কিছুক্ষণ জানলার বাইরে বেলাশেষের সমুদ্র, ছোটবড় দ্বীপ, আর পাহাড় জঙ্গলের দিকে তাকিয়ে রইল বিনয়। তারপর দ্বিতীয় প্রতিবেদনটি লিখতে শুরু করল। সেটা শেষ হতে হতে সন্ধে পেরিয়ে গেল।

গোপাল ঘরে আলো জ্বেলে দিয়ে গিয়েছিল। এবার দুটো প্রতিবেদনই খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে পড়ে দু-চারটে সেনটেন্স বদলে, কিছু শব্দ পালটে নতুন শব্দ জুড়ে ঠিকঠাক গুছিয়ে পিন দিয়ে গেঁথে দেরাজে রেখে দিল। আজ এখানেই ইতি। কাল সকাল থেকে ফের শুরু করা যাবে।

এই সময় বিশ্বজিৎ ফিরে এলেন। তাঁর গলার আওয়াজ শুনে ঘর থেকে ড্রইংরুমে বেরিয়ে এল বিনয়।

বিশ্বজিৎ হাসিমুখে বললেন, আপনি একটু বসুন বিনয়বাবু, আমি হাতমুখ ধুয়ে চেঞ্জ করে আসি। জাস্ট টেন মিনিটস।ভুবন, আমাদের জন্যে চা করে নিয়ে এস।

বিনয় একটা সোফায় বসে পড়ল। বিশ্বজিৎও চলে এলেন কিছুক্ষণের মধ্যে। বেশ তরতাজা দেখাচ্ছে তাকে। স্পষ্ট বোঝা যায় শুধু হাতেমুখে জল নয়, একেবারে স্নানই করে এসেছেন। পরনে ধবধবে পাজামা-পাঞ্জাবি। সোফায় আয়েশ করে বসে জিগ্যেস করলেন, ‘লেখা টেখা হল?

‘হ্যাঁ’–বিনয় বলল, ‘দুটো বড় লেখা শেষ করেছি।‘

‘বাহ, প্রোগ্রেস তো বেশ ভালই।‘

বিনয় হাসল।

ভুবন একটা ট্রেতে দুকাপ চা এবং সেই সঙ্গে ঘরে তৈরি নিমকি আর চমচম দিয়ে গেল।

খেতে খেতে এলোমেলো কিছু কথা। তারপর হঠাৎ যেন জরুরি কোনও বিষয় মনে পড়ে গেছে, তেমন একটা ভাব করে বিশ্বজিৎ বললেন, ‘লক্ষ্মণ ভক্তকে আজই কোর্টে প্রডিউস করা হয়েছিল।‘

উৎসুক চোখে তাকিয়ে থাকে বিনয়।

‘লোকটা অত্যন্ত ধূর্ত, ধুরন্ধর। এমন ক্যারেক্টার খুব কমই দেখা যায়।‘

‘কিরকম—’

‘লোকে কোর্টে এলে ভয়ে কুঁকড়ে যায়। এই লোকটার ভয়ডর তেমন কিছু আছে মনে হয় না। বিশ্বজিৎ বলতে লাগলেন, ‘জিগ্যেস করতে জানালে তার উকিলের দরকার নেই। নিজেকে সে নিজেই ডিফেন্ড করতে পারবে। একেবারে বিনয়ের অবতার। হী ইজ অ্যান ইন্টারেস্টিং পার্সন। ভেরি কানিং।‘

লক্ষ্মণ ভক্ত ব্যক্তিটি যে সোজাসাপটা নয়, আগেই বুঝতে পেরেছিল বিনয়। সে তাকিয়ে রইল।

বিশ্বজিৎ বললেন, ‘পরশু ফের তাকে কোর্টে তোলা হবে। কিভাবে সে নিজেকে বাঁচায়, জানার ইচ্ছে হচ্ছে। অপনার হচ্ছে না?

লইয়ার না নিয়ে একজন নিরক্ষর, শিক্ষাদীক্ষাহীন লোক আদালতে দাঁড়িয়ে আত্মপক্ষ কিভাবে সমর্থন করে, জানার তীব্র কৌতূহল হচ্ছিল, সত্যিই বিনয়ের। আস্তে মাথা হেলিয়ে দিল সে।’হচ্ছে।

‘আপনি পরশু আমার সঙ্গে কোর্টে চলুন। কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে সে কী বলে শুনবেন। হয়তো লেখার মতো মেটিরিয়াল পেয়ে যাবেন।

বিনয় বলল, ‘ঠিক আছে, যাব।‘

.

মাঝখানে একটা দিনে আরও তিনটে প্রতিবেদন লিখে ফেলল বিনয়। তারপর আজ স্নান করে খেয়ে বিশ্বজিতের সঙ্গে আদালতে চলে গেল।

দেশে থাকতে একবার হেমদাদুর সঙ্গে কম বয়সে মুন্সিগঞ্জে আদালতে গিয়েছিল বিনয়। কী কারণে দাদুকে যেতে হয়েছিল, এখন আর মনে নেই।

মুন্সিগঞ্জে কোর্টরুমের যেরকম চেহারা দেখেছিল, পোর্টব্লেয়ারেও তার ব্যতিক্রম নেই। একদিকে উঁচু প্ল্যাটফর্মের ওপর বিচারকের জন্য চেয়ার, সামনে টানা লম্বা টেবিল। নিচে পাবলিক প্রসিকিউর এবং ল’য়ারদের বসার জন্য চেয়ার। দু’ধারে আসামী এবং সাক্ষীদের জন্য উঁচু চৌকো ডেক। তারই একপাশে পেশকারের বসার বন্দোবস্ত। এসবের পর বেশ ক’টা ফাঁকা চেয়ার এবং বেঞ্চি। সেখানে বাদী আর বিবাদী পক্ষের লোকেরা বসতে পারে। আগ্রহী দর্শকরা আদালতের সওয়াল-জবাব শুনতে এলে ওখানে বসে।

দশটার একটু আগেই বিনয়রা কোর্ট চত্বরে পৌঁছে গিয়েছিল। গাড়ি থেকে নেমে বিশ্বজিৎ বললেন, ‘কোর্টরুমের ভেতরে গিয়ে লইয়ারদের পেছন দিকের ফাঁকা চেয়ারে বসুন। এখনও সময় হয় নি। এজলাসের পেছন দিকে আমার অ্যান্টি-চেম্বার আছে। আমি সেখানে চলে যাই। ঠিক দশটায় কোর্টের প্রসিডিংস শুরু হবে। আপনাকে বেশিক্ষণ ওয়েট করতে হবে না।

বিনয় সোজা আদালতে গিয়ে ঢুকল। বিশ্বজিৎ একটু ঘুরপথে কোর্টরুমের পেছন দিকে চলে গেলেন।

আদালত একরকম ফাঁকাই ছিল। কয়েক মিনিটের ভেতর পেশকার, আদালি, নিচের স্তরের কিছু কর্মী, পাবলিক প্রসিকিউটর, দু-চারজন লইয়ার চলে এলেন। পেছনের অ্যান্টি-চেম্বার থেকে কোর্ট রুমে এসে বিশ্বজিৎ রাহা বিচারকের নির্দিষ্ট চেয়ারটিতে বসলেন।

একটু পরেই পুলিশ পাহারায় লক্ষ্মণ ভক্তকে আসামীর ডকে এনে তোলা হল। কোর্টের কাজ শুরু হয়ে গেল।

পাবলিক প্রসিকিউটরটি বর্মী। তবে হিন্দি-বাংলা মিশিয়ে কাজ চালিয়ে নিতে পারেন। যথেষ্ট বয়স হয়েছে। বহুকাল তিনি পোর্টব্লেয়ারে আছেন। বিশ্বজিৎ তাকে বললেন, ‘মিস্টার পি পি (পাবলিক প্রসিকিউটর), অভিযুক্ত লক্ষ্মণ ভক্তকে জিগ্যেস করুন, পরশু সে বলেছিল নিজের মামলা নিজেই চালাবে। এখনও কি তার সেই একই সিদ্ধান্ত? সে যদি মত বদলে থাকে আদালত থেকে তাকে একজন উকিল দেওয়া হবে।

পি পি মুখ খোলার আগেই লক্ষ্মণ হাতজোড় করে বলে ওঠে।–’হুজুর, আমার উকিলের দরকার হবে না নে। নিজিই নিজির (নিজেই নিজের) কথা কতি চাই (বলতে চাই)।’

বিশ্বজিৎ বললেন, ‘বেশ। তোমার নামে যে গুরুতর অভিযোগ রয়েছে, পরশুদিনই তা জানিয়ে দেওয়া হয়েছে আদালতের তরফ থেকে। তুমি নবদ্বীপ কুণ্ডুকে খুন করার জন্যে বাঁশের খুটি দিয়ে এমন মার মেরেছ যে সে একেবারে বেহুঁশ হয়ে যায়। প্রচুর রক্তপাত হয়েছে। চিকিৎসার জন্যে তাকে পোর্ট ব্লেয়ারে নিয়ে আসতে হয়েছে। অনেক কষ্টে তাকে বাঁচাতে পারা গেছে। কতদিনে সে পুরোপুরি সুস্থ হয়ে উঠতে পারবে, এখনও ঠিক নেই। তা ছাড়া আরও একটা অভিযোগ রয়েছে তোমার বিরুদ্ধে। সরকারের তরফ থেকে বাঁশের খুঁটি পুঁতে প্রতিটি উদ্বাস্তুর জমির সীমানা ঠিক করে দেওয়া হয়েছে। তুমি খুঁটি তুলে নবদ্বীপের জমির অনেকটা দখল করার চেষ্টা করেছিলে, দু’টোই মারাত্মক অপরাধ। এ সম্বন্ধে তোমার কী বলার আছে?’

কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে চোখ পিট পিট করতে করতে শুনে গেল লক্ষ্মণ। তারপর হঠাৎ দুই হাত ওপর দিকে তুলে জোরে জোরে নাড়তে নাড়তে চিকুর ছাড়ল।–’মিছে কথা হুজুর, মিছে কথা। উপুরি দেহিচি ভগমান বাবা (ওপরে দেখেছি ভগবান বাবা), নিচি (নিচে) দেখিচি আফনিরি (আপনাকে)। আফনি (আপনি)–’

পি পি বাধা দিলেন।–’হুজুর যা জিগ্যেস করেছেন তার জবাব দাও। বাজে কথা বলতে হবে না।‘

লক্ষ্মণ হাত নেড়েই যাচ্ছিল।–’ক’তি দ্যান বাবা, কতি দ্যান (বলতে দিন, বলতে দিন)। হুজুরের সব কথার জবাব দেবা নে (দেব)। অত হড়বড়ালি (হড়বড় করলে) কি হয়? ধয্যি ধরতি (ধৈর্য ধরতে) হয়।’ বলেই বিশ্বজিতের দিকে ফিরে ধুয়ো ধরার মতো আগের গতে ফিরে গেল।–’উপুরি দেখিচি ভগমান বাবা, নিচি দেখিচি আফনিরি (আপনাকে)। আফনি রাখলি রাখতি ফারেন (পারেন) মারলি মারতি ফারেন (মারল মারতে পারেন)—’

পি পি আবর বাধা দিলেন।– ‘কেন, আজে বাজে বকে আদালতের সময় নষ্ট–’

তাঁকে থামিয়ে দিয়ে লক্ষ্মণ বলল, ‘পুরা কথাটা বুললি (বললে) বুজতি ফারবেন (বুঝতে পারবেন), বাজে বকতিছি (বকছি) না। উপুরি দেখিচি ভগমান বাবা, নিচি দেখিচি আফনিরে (আপনাকে), আফনে রাখলি রাখতি ফারেন (পারেন), মারলি মারতি ফারেন, টাস (ঠাস) করি বাড়ি মারি শ্যাষ করি দিতি ফারেন, গুলি করি হাগরের (সাগরের) জলে ভাসায়ে (ভাসিয়ে) দিতি ফারেন। উপুরি দেখিচি ভগমান বাবা—’

বিচারকের আসনে বসে থমথমে গম্ভীর মুখে বিশ্বজিৎ। জজ-ম্যাজিস্ট্রেটরা দীর্ঘ অভ্যাসে নিজেদের সংযত রাখেন। লক্ষ করলাম, বিশ্বজিতের কিঞ্চিৎ ধৈর্যচ্যুতি ঘটেছে। বললেন, ‘ওসব থাক, তুমি আসল কথার উত্তর দাও।‘

কিন্তু কার সাধ্য লক্ষ্মণকে রুখতে পারে। গলার স্বর উঠিয়ে নামিয়ে বলেই চলেছে, ‘হুজুর, বিহান বেলাতি (সকাল বেলায়) জমিনি আসি (জমিতে এসে) দ্যাখলাম, সীমানার খুটাগুলোন আমিন ঠিক করি বসায়ে দিতি ফারে নে (পারে নি)। আমি খরলাম (করলাম) কি, ঠিক করি পুতি দেলাম (ঠিক করে পুঁতে দিলাম)। তা নবদ্বীপভাই তার বউ আর ছেলিরে নিয়ি (বউ ছেলেকে নিয়ে) নিজির (নিজের) জমিনে আসি খুটাগুলোন দেখি খেপি গ্যাল (খেপে গেল)। ক’ল (বলল) হালার পুঁত হালা (শালার ছেলে শালা), আমার জমিনে খুটা (খুঁটি) হান্দায়ি (ঢুকিয়ে) দিছিস (দিয়েছিস) ক্যানো? আমি তারে ক’লাম (বললাম), হালার পুত হালা কতি (বলতে) নাই ভাই। হে (সে) আমারে ক’ল হালা পুঙ্গির পুত। আমি তারে ক’লাম, অত চেতি যাতি নাই (অতি রেগে যেতে নেই)। বয়স তো কম হল না। হে (আমার) আরও কত অশৈল্য (অশ্লীল) কথা ক’ল (বলল)। হেসব হুজুরের সামনি মুখি আনতি পারফ (পারব) না।’

বিশ্বজিৎ রাহা হাল ছেড়ে দিয়েছিলেন। তিনি আর বাধা দিলেন না।

লক্ষ্মণ একনাগাড়ে একই সুরে বলে যাচ্ছে, ‘নবদ্বীপ ক’ল (বলল) তুই বেবুশ্যার ছাওয়াল (বেশ্যার ছেলে), আমি তোর এইটা করি, হেইটা করি। কত যে অশৈল্য (অশ্লীল) কথা। গালি দিতি দিতি (দিবে দিতে) হে (সে) আমারে মাইরল চোপার (মারল চড়), গ্যালাম পড়ি (পড়ে গেলম)। উইঠে পড়লাম, আবার মাইরল (মারল) চোপার। চোপার খাতি খাতি মনে রাগ হল। জমিনে একখান সরু কইঞ্চি (কঞ্চি) পইড়ে ছিল। সে তুলি নবদ্বীপির কপালে আস্তে করি ঠেহাইচি ঠেকিয়েছি)। উপুরি দেখচি ভগমান, নিচি দেখিচি আফনিরে (আপনাকে)। সব খুইলে ক’লাম (বলাম)। এই বার আফনে (আপনি) আমারি (আমাকে) মারলি মারতে ফারেন (পারেন), কাটলে কাটতি ফারেন। গুলি করি মারতি ফারেন (মারতে পারেন)। টাস করি বাড়ি মারি হাগরের জলে ভাসায়ি (ভাসিয়ে) দিতি ফারেন (পারেন)। গুরু জানে ভগমান জানে, হুজুর আফনির সামনি (আপনার সামনে) সত্য কথাগুলোন কলাম (বললাম)।‘

এতক্ষণে লক্ষ্মণ ভক্ত থামল। বিশ্বজিৎ রাহা তাকে সাত দিন পুলিশের হেফাজতে রাখার নির্দেশ দিয়ে আজকের মতো আদালতের কাজ স্থগিত করে দিলেন।

অন্যদিন আদালত থেকে রিহ্যাবিলিটেশন ডিপার্টমেন্টের নানা দায়িত্ব সামলে বাংলোয় ফিরতে ফিরতে তার রাত সাতটা আটটা বেজে যায়। চিফ কমিশনারের সঙ্গে জরুরি মিটিং টিটিং থাকলে আরও রাত হয়।

আজ আর রিহ্যাবিলিটেশন ডিপার্টমেনেটর অফিসে গেলেন না বিশ্বজিৎ। বিনয়কে সঙ্গে নিয়ে গাড়িতে উঠে ড্রাইভারকে হাসপাতালে যেতে বললেন। নবদ্বীপের খবর নিয়ে খুব সম্ভব বাংলোয় ফিরবেন, বোঝা গেল। না চড়াই-উতরাই ভেঙে ঝকঝকে মডেলের হিন্দুস্থান এগিয়ে চলেছে। কিছুক্ষণ চুপচাপ। ব্যাকসিটে পিঠ হেলিয়ে দিয়ে বসে আছেন বিশ্বজিৎ, পাশে বিনয়। আড়চোখে তাকে একবার দেখে নিল বিনয়। আন্দামানের দোর্দন্ডপ্রতাপ ম্যাজিস্ট্রেটকে বেশ একটু বিধ্বস্ত মনে হচ্ছে। আন্দাজ করা গেল তার কারণ জেফ্রি পয়েন্টের লক্ষ্মণ ভক্ত। একটা আসামী যে একজন বিচারককে এমন কাহিল করে ফেলতে পারে চর্মচক্ষে না দেখলে বিশ্বাস হয় না।

একসময় সোজা হয়ে বসলেন বিশ্বজিৎ।–’লোকটা কত বড় শয়তান দেখলেন। নবদ্বীপ প্রায় মরতে বসেছিল আর সে কিনা বলে সরু একটা কঞ্চি তার মাথায় ঠেকিয়েছে! তার ওপর আমাকে পর্যন্ত এই কেসের সঙ্গে জড়িয়ে ফেলেছে। এত বড় বদমাশ—’

আদালতে বসে থাকতে থাকতে যে ক্রোধ, বিরক্তি, বিরূপতা–সব মিলিয়ে তীব্র উত্তাপ তাঁর মধ্যে জমা হয়েছিল, এতক্ষণে সেটা সশব্দে বেরিয়ে এল।

.

পোর্টব্লেয়ারে আর থাকতে চাইছিল না বিনয়। জেফ্রি পয়েন্ট নামে পাহাড় জঙ্গল সমুদ্রে ঘেরা ছিন্নমূল মানুষদের সেই উপনিবেশটা তার সমস্ত অস্তিত্ব ধরে যেন টানছিল। বেশ কয়েক দিন হল নতুন সেটলমেন্ট থেকে সে এত দূরে এসে আছে। এর মধ্যে লা-পোয়েরা হয়তো জেফ্রি পয়েন্টে চলে এসেছে। তাকে না পেয়ে আবার সমুদ্র থেকে শঙ্খ কড়ি টার্বো ট্রোকাস তোলার জন্য দূরে কোথাও চলে গেছে কিনা কে জানে। তারা যদি সত্যিই চলে গিয়ে থাকে মধ্য আন্দামানে যাওয়ার সম্ভাবনাটা অন্তত এবারের মতো বিলীন হয়ে যাবে। কবে মিডল আন্দামানে পৌঁছে ঝিনুকের সঙ্গে দেখা করতে পারবে, কে জানে। কিভাবে সেই সুযোগ আসবে তাও জানা নেই।

লা-পোয়েদের জন্য ভীষণ ব্যগ্র হয়ে উঠেছিল বিনয়। ওদের সঙ্গে কথা হয়ে আছে। জেফ্রি পয়েন্টে তাকে না পেলে ওরা কি চলে যাবে? নিশ্চয়ই তার জন্য দু-চারদিন অপেক্ষা করবে। এই আশার সুতোটুকু ধরে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব তাকে জেফ্রি পয়েন্টে চলে যেতে হবে।

আদালত থেকে ফেরার দু’দিন পর খামে খামে সুধাদের কাছে লেখা চিঠিগুলো আর একটা বড় প্যাকেটে ‘নতুন ভারত’-এর জন্য লেখা পাঁচটা প্রতিবেদন ভরে বিশ্বজিৎকে দিয়ে বিনয় বলল, ‘ওগুলো কাইন্ডলি কলকাতায় পাঠিয়ে দেবেন। আর আমাকে জেফ্রি পয়েন্টে ফিরে যাওয়ার ব্যবস্থা করে দিন। ওই সেটলমেন্ট আর খানিকটা দূরের পেনাল কলোনি আর উদ্বাস্তুদের আরও ক’টা সেটলমেন্ট সম্পর্কে বেশ কিছু লেখা তৈরি করতে হবে।

বিশ্বজিৎ বললেন, ‘হা হা, নিশ্চয়ই ব্যবস্থা হয়ে যাবে। আপনি শুধু নিউজ পেপারের রোভিং রিপোর্টার নন, এখানকার রিফিউজি সেটলমেন্টের একজন হয়ে উঠেছেন। নানাভাবে আমাদের সাহায্য করছেন। আপনি জেফ্রি পয়েন্টে গেলে কাকা খুশি তো হবেনই, সেটলমেন্টেরও অনেক উপকার হবে। কবে যেতে চাইছেন?

‘আজ কি অ্যারেঞ্জমেন্ট করা সম্ভব?

ওরা ড্রইংরুমে বসে সকালবেলার চা খাচ্ছিল। ঘড়ি দেখে বিশ্বজিৎ বললেন, এখন আটটা বেজে সতেরো। আজ আর হবে না। কাল ভোরে যান।

‘ঠিক আছে। আমার কিছু বলার ছিল—’

‘বেশ তো, বলুন না—’

‘কিছুদিন আগে আপনাকে জানিয়েছিলাম, শেল কালেক্টারদের নিয়ে আমি একটা লেখা লিখতে চাই। মনে আছে?’

‘আছে আছে। শেল কালেক্টরদের লাইফটা খুব ইন্টারেস্টিং আর ভীষণ বিপজ্জনকও। সমুদ্র থেকে ‘শেল’ ভোলা মুখের কথা নয়। হাঙরেরা ঝাঁকে ঝাঁকে ঘুরছে। কিন্তু ডাইভাররা খুবই সাহসী, হাঙরের সঙ্গে লড়াই করে ‘শেল’ তুলে আনে। এদের নিয়ে লেখা উচিত। মানুষ বেঁচে থাকার জন্যে কত রকম জীবিকা যে বেছে নিয়েছে!’

বিনয় বলল, ‘লা-পোয়েদের এই সময় জেফ্রি পয়েন্টে আসার কথা। আমি কিন্তু ওদের বোটে কয়েকটা দিন ঘুরে ঘুরে কী করে ‘শেল’ তোলে দেখতে চাই। নিজের চোখে না দেখলে, শুধু শুনে এসব লেখা যায় না। লা-পোয়েদের বোটে ওঠার আসল উদ্দেশ্যটা যে ঝিনুকের সঙ্গে দেখা করতে যাওয়া সেটা গোপনই রাখল।

বিশ্বজিৎ বললেন, ‘নিশ্চয়ই ওদের সঙ্গে ঘুরে ঘুরে দেখবেন। একটা দুর্দান্ত এক্সপেরিয়েন্স হবে।‘

.

পরদিন পড়ন্ত বেলায় জেফ্রি পয়েন্টে পৌঁছে গেল বিনয়।

শেখরনাথ তাদের ঘরেই ছিলেন। বিনয়কে দেখে খুবই খুশি। বললেন, ‘যাক, তুমি এসে গেছ। খুব ভাল। তোমার লেখালেখির কাজ শেষ করে এসেছ তো?

বিনয় হাসল। –’শেষ কি আর হয়। আমাদের মতো রিপোর্টারদের লিখেই যেতে হয়। আপাতত পাঁচটা লেখা তৈরি করে বিশ্বজিৎবাবুর কাছে দিয়ে এসেছি। উনি কলকাতায় আমার অফিসে পাঠিয়ে দেবেন। তা সেটলমেন্টের নতুন খবর কিছু আছে?’

শেখরনাথ হাসলেন।–’না, লক্ষ্মণ নবদ্বীপের ওপর তান্ডব চালাবার পর সব গতানুগতিক চলছে। জাবোয়রাও আর হামলা চালায় নি। আপাতত শান্তি। তবে জোর করে তো কিছু বলা যায় না। কোন দিক থেকে কখন যে আবার ঝঞ্ঝাট শুরু হবে,কে জানে। হঠাৎ কিছু মনে পড়ায় ব্যস্ত হয়ে পড়লেন।’দিন তিনকে হল লা-পোয়েরা এসে তোমার জন্যে ওয়েট করছে। তুমি নাকি ওদের সঙ্গে সমুদ্র থেকে ‘শেল’ তোলা দেখতে যাবে?’

বিনয়ের সারা শরীরে উত্তেজনা খেলে গেল। না, তাকে ফেলে চলে যায়নি লা-পোয়ে। তার প্রতি কৃতজ্ঞতায় মনে ভরে গেল। বলল, হ্যাঁ, আপনাকে বোধ হয় বলেছিলাম, ওদের নিয়ে কিছু লিখব।

‘গুড।’ বলে হাঁকাহাঁকি করে লা-পোয়েকে ডাকিয়ে আনালেন শেখরনাথ।–’এই যে তোমার পত্রকারজি চলে এসেছেন।‘

লা-পোয়ে বিনয়কে জিগ্যেস করল, ‘কবে আমাদের সঙ্গে যেতে পারবেন?’

‘আপনারা যেদিন বলবেন—’ বিনয় বলল।

‘কালই বেরিয়ে পড়তে চাই। তিন রোজ আপনার জন্যে ইন্তেজার করেছি। আর এখানে থাকা যাবে না। কাম-কাজ বন্ধ হয়ে আছে।‘

শেখরনাথ উৎসাহ দিলেন।–‘হ্যাঁ হ্যাঁ, কালই বেরিয়ে পড় বিনয়। ক’টা দিন ওদের সঙ্গে ঘুরে এসে এক্সপিরিয়েন্সটা লিখে ফেল। তোমাদের কাগজের রিডাররা নতুন অজানা একটা ওয়ার্ল্ডের সন্ধান পাবে।‘

.

পরদিন সকালে অবনীমোহনের দু’টো চিঠি আর দু-একটা জামাকাপড়, টুকিটাকি দরকারী কিছু জিনিস ব্যাগে পুরে লা-পোয়েদের মোটর বোটে উঠে পড়ল বিনয়। অবনীমোহনের চিঠি পড়লে ঝিনুকের সব ক্ষোভ, সব যাতনা এবং অভিমান দূর হয়ে যাবে কি? তাকে ক্ষমা করত পারবে ঝিনুক?

শেখরনাথ, পুনর্বাসনের কর্মীরা এবং উদ্বাস্তুরা সবাই সমুদ্রের ধারে চলে এসেছিল।

একসময় মোটর বোট শব্দ করে স্টার্ট দিল। উদ্বাস্তুরা সোনালি বালির সৈকতে দাঁড়িয়ে বলতে লাগল, ‘দুগ্‌গা, দুগ্‌গা, ভালায় ভালায় ঘুইরা আহেব (আসুন)।’

বিনয়ের চকিতে মনে পড়ল, একদিন সন্ধেয় রাজদিয়ার পুকুরঘাট থেকে অসুস্থ, অপ্রকৃতিস্থ, ধর্ষিত ঝিনুককে বাঁচাতে রাজেক মাঝির নৌকোয় উঠে অকূলে ভেসে পড়েছিল। আজ সেই ঝিনুকের জন্যই জেফ্রি পয়েন্টের বেলাভূমি থেকে লা-পোয়েদের মোটর বোটে আরও একবার অথৈ সমুদ্রে ভাসল।

.

[‘কেয়াপাতার নৌকো’, ‘শতধারায় বয়ে যায়’এর পরবর্তী তৃতীয় খণ্ড ‘উত্তাল সময়ের ইতিকথা’ সমাপ্ত]

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *