১.৫ মূল পোর্টের গা ঘেঁষে

মূল পোর্টের গা ঘেঁষে কয়েকটা গাড়ি দাঁড়িয়ে ছিল। সেগুলোর পাশে কালীপদ জিপটা পার্ক করতেই বিশ্বজিৎ বিনয়কে নিয়ে নেমে পড়লেন। কালীপদকে বললেন, ‘বিনয়বাবুর লাগেজ জেটিতে নিয়ে এসো।’

পার্কিং এরিয়া থেকে খানিকটা এগলে মস্ত গেট। গেটের পর ডাইনে বাঁয়ে দু তিনটে বিল্ডিং। মাঝখান দিয়ে সোজা রাস্তা চলে গেছে। বিল্ডিংগুলোতে জাহাজ কোম্পানির অফিস। কোম্পানির ক’জন কর্মচারী এধারে ওধারে দাঁড়িয়ে গল্প করছিল। অলস আড্ডার মেজাজে। নগন্য পোর্ট, বিনয়ের মনে হল, খুব সম্ভব এই বন্দরে সবসময় তেমন ব্যস্ততা থাকে না। বিশ্বজিৎকে দেখে ওরা শশব্যস্তে এগিয়ে আসে।–’নমস্কার স্যার, রিফিউজিদের নিয়ে বিভাসবাবুরা এসে গেছেন। চলুন স্যার—’

বিশ্বজিৎ যে পোর্টব্লেয়ারের একজন জবরদস্ত অফিসার সেটা টের পাচ্ছিল বিনয়। বিশ্বজিৎ ফার্স্ট ক্লাস ম্যাজিস্ট্রেট এবং রিফিউজি ডিপার্টমেন্টের একজন হর্তাকর্তা, জাহাজি ব্যাপারটা তার এক্তিয়ারের মধ্যে পড়ে না, তবু কখন কী ঝঞ্ঝাটে ফেঁসে যাবে তা তো বলা যায় না, তাই এখানকার ব্রহ্মা বিষ্ণু মহেশ্বরদের তুষ্ট রাখতে হয়। সেই কারণেই খাতিরের এমন বহর।

কর্মচারীরা যে বিভাসদেরও চেনে তাও জানা গেল। এ ধরনের ছোট শহরে সবাই সবার পরিচিত।

বিশ্বজিৎ প্রতিনমস্কার জানিয়ে বললেন, ‘আপনাদের খবর সব ভালো তো?’

‘হ্যাঁ স্যার–’

বিশ্বজিৎরা হাঁটছিলেন। পাশাপাশি কর্মচারীরা চলেছে। বিশ্বজিৎ বললেন, ‘আপনাদের আর কষ্ট করে আসতে হবে না।’

কিন্তু কে কার কথা শোনে! কর্মচারীরা চলতেই থাকে। নাছোড়বান্দাদের কীভাবেই বা ঠেকানো যায়। বিশ্বজিৎ আর কিছু বললেন না।

লম্বা প্যাসেজ পেরিয়ে বিনয়রা মস্ত এক জেটিতে চলে এল। বিশ্বজিৎ বললেন, ‘এর নাম চ্যাথাম—’

চ্যাথামের কথা অনেক আগেই বিভাসদের মুখে শুনেছে বিনয়। এই প্রথম দেখল।

জেটির পশ্চিম কোনায় স্টিমশিপ ‘মহারাজা’ নোঙর ফেলে দাঁড়িয়ে আছে। কাল ‘রস’ আইল্যান্ডে উদ্বাস্তুদের নামিয়ে বিশাল জলযান এদিকেই এসেছিল। পাহাড়ের আড়াল থাকায় চ্যাথাম জেটিটা তখন চোখে পড়েনি।

জেটির মাঝখানে উদ্বাস্তুরা ঘেঁষাঘেঁষি করে বসে আছে। সঙ্গে তাদের লটবহর। সবাই চুপচাপ। কেমন যেন উদাসীন। সরকারি বাবুরা যেখানে নিয়ে যাবেন সেখানেই তো যেতে হবে। এমন একটা নিরুপায় ভাব তাদের চোখেমুখে। চার দিন সমুদ্র আর এক রাত এবারডিন মার্কেটে কাটিয়ে দুশ্চিন্তা করার মতো শক্তিটুকুও বুঝিবা আর নেই। ভাঙাচোরা, ছিন্নমূল মানুষগুলো নিয়তির হাতে

.

নিজেদের সঁপে দিয়ে উপসাগরের দিকে তাকিয়ে রয়েছে।

বিভাস, নিরঞ্জন এবং পুনর্বাসন দপ্তরের ক’জন কর্মচারী উদ্বাস্তুদের কাছাকাছি পঁড়িয়ে কথা বলছিল। খানিক দূরে তিরিশ-চল্লিশজনের এক পাঁচমেশালি জটলা। মুখ-চোখ এবং দাড়ি পাগড়ি দেখে বর্মি এবং শিখদের চেনা যাচ্ছে। বাকিরা খুব। সম্ভব তামিল, মালাবারি মোপলা এবং ভারতের নানা এলাকার লোক। দু’চারজন বাঙালিও থাকতে পারে। সবাই বেশ বয়স্ক। পঞ্চাশ-পঞ্চান্ন থেকে ষাট-পঁয়ষট্টির ভেতর বয়স।

জেটির গায়ে এক পাশে নোঙর ফেলে আছে ‘স্টিমশিপ ‘মহারাজা’। অন্যদিকে কালকের সেই দুটো স্টিমলঞ্চ ‘সি-গাল’ আর ‘নটিলাস’ লোহার শিকল দিয়ে জেটির সঙ্গে বাঁধা রয়েছে।

বিশ্বজিৎ বিনয়কে নিয়ে উদ্বাস্তুদের দিকে এগিয়ে গেলেন। শিপিং কোম্পানির কর্মচারীরা অবশ্য থেমে গেল। আন্দামান-নিকোবর আইল্যান্ডসের ম্যাজিস্ট্রেটকে খানিকক্ষণ সঙ্গ দিয়ে যথেষ্ট সম্মান দেখানো হয়েছে। তারা ধীরে ধীরে ফিরে যেতে লাগল।

হলধর সূত্রধর, মাখন রুদ্রপাল এবং আরও কয়েকজন বিনয়কে দেখতে পেয়েছিল। উদ্বাস্তুদের দঙ্গল থেকে তারা প্রায় দৌড়েই চলে আসে।

হলধর এক নিঃশ্বাসে তত্বড় করে বলে যায়, ‘ছুটোবাবু আইজ বিহানে উইঠা আপনের লেইগা পথের দিকে তাকাইয়াআছিলাম। কিন্তুক আপনে আইলেন না। হেরপর সরকারি বাবুরা যহন এই জাহাজঘাটায় লইয়া আইল, জবর ডরাইয়া গ্যাছিলাম। হগলে (সকলে) কওয়াকওয়ি করতে আছিল আপনে ভাটকি (ফাঁকি) দিয়া কইলকাতায় ফিরা যাইবেন। অহন কী ভালা যে লাগতে আছে!’ তার ষাটবাষট্টি বছরের শুষ্ক চোখ বাষ্পে ভরে যেতে লাগল। আনন্দে। ক্ষণিক উচ্ছ্বাসে।

মাখন অপরাধী অপরাধী মুখ করে বলল, ‘সকাল তরি (পর্যন্ত) আপনেরে না দেইখা ভাবছিলাম সমুন্দুরের মধ্যিখানে আমাগো বিসজ্জন দিয়া বুঝিন চইলাই যাইবেন। আমারে মাপকইরা দ্যান।‘ সে হাতজোড় করল।

বাকি সবাই একই সুরে বলে যেতে লাগল। বিনয় হেসে হেসে বলে, ‘দেখলেন তো আমি আপনাদের ফাঁকি দিই নি। ঠিক এসে গেছি। আপনারা যে যার জায়গায় ফিরে যান। আমি ওঁদের কাছে যাচ্ছি।’ একটু দূরে বিশ্বজিৎ নিরঞ্জন আর বিভাসের সঙ্গে কথা বলছেন। সে সেদিকে চলে গেল।

বিশ্বজিৎ জিগ্যেস করছিলেন, ‘নতুন সেটলমেন্টে রিফিউজিদের থাকার মতো সব ব্যবস্থা করা হয়েছে?’

নিরঞ্জন বলল, ‘হয়েছে।‘

‘চেনম্যান আর জরিপদাররা ওখানে আছে তো?’

‘নিশ্চয়ই।‘

চেনম্যান এবং জরিপদারদের ব্যাপারটা মাথায় ঢুকল না বিনয়ের। এ নিয়ে সে কোনও প্রশ্ন করল না। সেটলমেন্টে গেলেই সব জানা যাবে।

বিশ্বজিৎ বললেন, ‘আর দেরি করে কী হবে? যাওয়ার ব্যবস্থা করো।’

হাঁকাহাঁকি করে উদ্বাস্তুদের দুই মিলঞ্চ ‘সি-গাল আর ‘নটিলাস’-এ তুলে ফেলল নিরঞ্জনরা। তারপর সেই বর্মি শিখ টিমেরা উঠল। সবার শেষে বিশ্বজিৎ আর বিনয়।

বিনয় উঠেছিল ‘নটিলাস’-এ। নিচের ডেকটা উদ্বাস্তুতে বোঝাই। সেখানে জায়গা না পেয়ে অনেকে আপার ডেকেও চলে গেছে। তাদের দেখাশোনা করছিল নিরঞ্জন। বিভাস বাকি উদ্বাস্তুদের নিয়ে ‘সি-গাল’-এ উঠেছে।

বিশ্বজিৎ বিনয়কে নিয়ে সিঁড়ি ভেঙে ‘নটিলাস’-এর দোতলায় চলে এল। এখানে ডেকের একদিকে কিছু উদ্বাস্তু বসে আছে। অন্য ধারে বর্মি, শিখ এবং নানা জাতের লোকের জটলা। বিশ্বজিতের কাছে এসে বর্মিরা সসম্ভ্রমে কপালে হাত ঠেকিয়ে কেউ বলছে নমস্তে’, কেউ বা আদাব’।

বিশ্বজিৎ প্রতি-নমস্কার জানিয়ে তাদের খোঁজখবর নিচ্ছিলেন–কে কেমন আছে, কাজকর্ম কেমন চলছে, ছেলেমেয়েরা কে কী করছে ইত্যাদি ইত্যাদি।

চ্যাথাম জেটিতে বিনয় লোকগুলোকে দেখেছিল ঠিকই, তবে খানিকটা অন্যমনস্কর মতো এবার ভালো করে লক্ষ করল। সবার গায়ের চামড়া কর্কশ, তামাটে। গালে গলায় কপালে সরু সরু অগুনতি রেখা; সেখানে পুঞ্জীভূত রুক্ষতা জমাট বেঁধে আছে। আন্দাজ করল, এরা হয়তো দীর্ঘকাল এই দ্বীপে রয়েছে। আন্দামানের অজস্র তীব্র রোদ, বছরে দু’বার প্রবল বৃষ্টিপাত আর নোনা হাওয়া তাদের চেহারায় শুষ্ক কাঠিন্য এনে দিয়েছে। বোঝ যাচ্ছিল বিশ্বজিৎকে ওরা যেমন চেনে, তিনিও তাদের সবাইকে চেনেন।

একটা লম্বা-চওড়া লোক, মুখে কাঁচা-পাকা অজস্র দাড়ি–খুব সম্ভব সে পাঠান–জিগ্যেস করল, সাহাব, পাকিস্তানসে আর কত আদমি আন্দামানে আসবে?’

বিশ্বজিৎ হাসলেন, ‘অনেক। এই তো সবে শুরু।‘

লোকগুলো আর দাঁড়াল না; যেখানে ছিল সেখানে ফিরে গেল।

বিশ্বজিৎ বিনয়ের দিকে তাকান। –‘এঁরা কারা জানেন?’

আস্তে মাথা নাড়ে বিনয়। -–‘না।‘

‘এক সময়ের দুর্ধর্ষ সব কয়েদি। যাবজ্জীবন জেল খাটতে আন্দামান পাঠানো হয়েছিল। এদের লাইফ হিস্ট্রি শুনলে বুকের রক্ত হিম হয়ে যাবে। মুক্তি পাবার পর বিয়ে-শাদি করে শান্তশিষ্ট গৃহপালিত প্রাণী হয়ে গেছে।‘

বিনয় যা ভেবেছিল- লোকগুলো অনেককাল আন্দামানে আছে–সেটা মিলে গেছে। কিন্তু নানা দুষ্কর্মের জন্য তাদের যে কালাপানি পাঠানো হয়েছিল তা বোঝা যায়নি। সে রীতিমতো অবাক হল অন্য একটা কারণে। জিগ্যেস করল, ‘এই ক্রিমিনালদের বিয়ে হল কী করে? মেয়ে পেল কোথায়?’

‘আন্দামানে তাদের জন্যে সুটেবল ব্রাইড মানে যোগ্য পাত্রী ছিল। বিয়ে আটকায় কে?’

‘এই তো সবে দেশ স্বাধীন হল। তার আগে আসামীদের জন্যে এখানে কনে মজুত ছিল?’

‘ছিল, ছিল’- হাসতে হাসতে বিশ্বজিৎ বললেন, ‘এইসব প্রাতঃস্মরণীয়া মেয়েমানুষও পুরুষদের মতো এখানে জেল খাটতে এসেছিল।’

পুরুষদের ‘কালাপানি’তে পাঠাবার কথা বিনয়ের জানা আছে। কিন্তু মেয়েদের কথা এই প্রথম শুনল। খানিকক্ষণ চুপকরে থাকে। তারপর জিগ্যেস করে, ‘এদের বিয়ে হল কী করে?’

বিশ্বজিৎ বললেন, ‘এত তাড়া কীসের? এখানে যখন এসেই পড়েছেন সব জানতে পারবেন।’

ওদিকে দু’টো লঞ্চই ছেড়ে দিয়েছিল। উপসাগরের নীল জল উথালপাথাল করে তারা কোনাকুনি ছুটে যাচ্ছে।

সূর্য এতক্ষণে আরও খানিকটা ওপরে উঠে এসেছে। এখন আর সমুদ্রের দিকে তাকিয়ে থাকা যায় না। নোনা জলে তীব্র রোদ যেন ঝলকে যাচ্ছে।

আধ ঘণ্টাও লাগল না, উপসাগর পাড়ি দিয়ে ওপারে পৌঁছে গেল ‘সি-গাল’ আর ‘নটিলাস’।

বিশ্বজিৎ বললেন, এই জায়গাটার নাম ‘বাম্বুফ্ল্যাট’।

এখানেও দু’টো কাজ চলার মতো ছোট জেটি রয়েছে। জলও গভীর নয়। তাই বড় জাহাজ ভিড়তে পারে না। কিন্তু লঞ্চের পক্ষে অসুবিধে নেই।

লঞ্চ বাঁধাহ্যাঁদা হলে উদ্বাস্তুদের নামানো হল। প্রাক্তন কয়েদিদের সঙ্গে বিনয়রাও নেমে পড়ল। তারা বিশ্বজিৎকে ‘আদাব’ এবং ‘নমস্তে’ জানিয়ে চলে গেল।

জেটির মাথায় অ্যাসবেস্টসের অল্প একটু ছাউনি। সেটার তলা দিয়ে সবাই ওধারে চলে গেল। বাইরে পাহাড় কেটে রাস্তা বানানো হয়েছে। সেখানে বারো চোদ্দোটা মাঝারি আকারের লরি লাইন দিয়ে দাঁড় করানো রয়েছে। সেগুলোর মাথা খোলা। সামনে ড্রাইভারের কেবিন। পেছন দিকে কাঠের মজবুত পাটাতন। ড্রাইভার এবং খালাসিরা যে যার লরির পাশে দাঁড়িয়ে রয়েছে।

লরির সারির ওধারে একটা জিপ চোখে পড়ে। কালীপদ বিনয়ের মালপত্র নিয়ে সেদিকে চলে গেল।

বিনয় বুঝতে পারছিল, গাড়িগুলো পুনর্বাসন দপ্তরের। উদ্বাস্তুদের নিয়ে যাবার জন্য অপেক্ষা করছে।

বিশ্বজিৎ নিরঞ্জন আর বিভাসকে বললেন, ‘তোমরা ডি.পি ফ্যামিলিগুলোকে লরিতে ভোলো৷ বিনয়বাবু আর আমি জিপে গিয়ে বসছি। সবাই উঠলে একসঙ্গে রওনা হব।’

লরির ড্রাইভার খালাসিদের মতো জিপের চালক তার গাড়ির গায়ে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে ছিল। বিশ্বজিৎকে দেখে তার শরীর টানটান হয়ে গেল। ছফিটের মতো হাইট। লম্বাটে মুখ, চওড়া বুক, ছড়ানো মজবুত কঁধ, মাথায় প্রচুর চুল, মুখটা পরিষ্কার করে কামানো, তবে থুতনিতে তেকোনা দাড়ি। পরনে ঢোলা ফুলপ্যান্ট আর শার্ট। বয়স সাতাশ-আটাশের মতো। কপালে হাত ঠেকিয়ে সে বলল, ‘আদাব–’

আদাবের জবাবে মাথা সামান্য হেলিয়ে বিশ্বজিৎ বলেন, ‘ক্যায়সা হ্যায় নাসিম?’

‘আপহিকা মেহেরবানিসে সব কুছ ঠিক হ্যায়।’

এবার বিশ্বজিৎ কালীপদকে বললেন, ‘সুটকেস টুটকেস জিপে তুলে দিয়ে তুমি ফিরে যাও। স্টিমার ব্যাম্বুফ্ল্যাটে বেশিক্ষণ দাঁড়াবে না। আমি কাল, না হলে পরশু ফিরব।‘

জিপের পেছন দিকে লটবহর রেখে ব্যস্তভাবে জেটির দিকে চলে গেল।

ওদিকে নিরঞ্জনরা যে প্রক্রিয়ায় উদ্বাস্তুদের খিদিরপুর ডকে ‘মহারাজা’ জাহাজে কিংবা ‘রস’ আইল্যান্ডে, আর চ্যাথাম জেটিতে স্টিমারে তুলেছিল, ঠিক সেইভাবেই লরিতেও তুলে ফেলল। তারপর চেঁচিয়ে চেঁচিয়ে বলল, ‘রাহাদা, আমরা রেডি—’

নাসিম জানে, এখন কী করতে হবে। সে ব্যস্তভাবে ঘুরে গিয়ে জিপে উঠে পড়ল। ফ্রন্ট সিটে বিশ্বজিৎ বিনয়কে নিয়ে উঠে তার পাশে বসে পড়লেন।

বারোটি লরি এবং একটি জিপ, মোট তেরোটি গাড়ি দৌড় শুরু করল।

সুর্য এখন প্রায় মাথার ওপর উঠে এসেছে। রোদের তেজ অনেক বেড়ে গেছে। মাত্র কয়েক মিনিট উপসাগর আর মাউন্ট হ্যারিয়েটের চুড়োটা দেখা যাচ্ছিল। তারপর চোখের সামনে থেকে একেবারে উধাও।

উঁচু উঁচু পাহাড় আর ছোট বড় অগুনতি টিলার কোমরে পাক খেতে খেতে পথ কখনও ওপরে উঠে যাচ্ছে, কখনও নেমে আসছে নিচে। একবার খাড়াই, তারপরেই উৎরাই। এক পাশে পাথরের নিরেট দেওয়াল, অন্যদিকে খাদ। খাদ কোথাও গভীর, কোথাও ততটা নয়। দু’ধারেই নিবিড় জঙ্গল। ছোটখাট গাছ যে কত তার লেখাজোখা নেই। রয়েছে বিশাল বিশাল সব মহাবৃক্ষ, মোটা মোটা বেত আর বুনো লতা সেগুলো আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে। রেখেছে। আর মাঝে মাঝেই অনেকটা করে জায়গা জুড়ে পঁচিশ-তিরিশ ফিট উঁচু বুনো ঘাসের বন। জঙ্গল কোথাও কোথাও এমন দুর্ভেদ্য যে এই দুপুরবেলাতেও সূর্যালোক ঢোকে না।

গাড়িগুলো চলছে খুব জোরেও নয়, আবার ধীর গতিতেও নয়। মাঝামাঝি স্পিডে। কেননা পাহাড়ি রাস্তা তেমন চওড়া নয়। বেশি স্পিড় তুললে বাঁকের মুখে স্কিড় করে খাদে গিয়ে পড়ার ভয়।

মাথার ওপর অনেকটা উঁচু দিয়ে অজস্র পাখি উড়ে যাচ্ছে। বক আর সি-গাল ছাড়া অন্যদের চিনতে পারল না বিনয়।

পনেরো কুড়ি মিনিট পর পর বসতি চোখে পড়ছে। খুব বড় নয়। তিরিশ-চল্লিশটা কাঠের বাড়ি, মাথায় আসবেস্টস টিনের ছাউনি। গা ঘেঁষাঘেঁষি করে নয়, ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে। বাড়িগুলো অনেককালের পুরনো। কিছু কিছু লোকজনও চোখে পড়ছিল। তাদের কারওকে দেখে উদ্বাস্তু মনে হয় না। সর্ব খোয়ানো শরণার্থীদের চেহারায় একটা মার্কামারা ছাপ থাকে।

হাজার বছরের প্রাচীন অরণ্যের খাঁজে খাঁজে লোকালয় দেখা যাবে, ভাবতে পারেনি বিনয়। অবাক হয়ে গিয়েছিল সে। জিগ্যেস করল, এগুলো তো রিফিউজি সেটলমেন্ট নয়। তিরিশ-চল্লিশ বছর আগের সব বাড়িঘরা এখানে কারা থাকে?

বিশ্বজিৎ বললেন, যেসব কয়েদি ব্রিটিশ আমলে আন্দামানে লাইফ-টাইম জেল খাটতে এসেছিল, এগুলো তাদের ভিলেজ।

বিনয় আর কোনও প্রশ্ন করল না।

.

দেখতে দেখতে সূর্যটা পশ্চিম আকাশের ঢালু গা বেয়ে নামতে নামতে উঁচু উঁচু পাহাড়ের আড়ালে উধাও হল। বেলা হেলে পড়েছে। তবু এখনও চারদিকে অঢেল রোদ।

একটা উতরাই বেয়ে গাড়িগুলো যেখানে নেমে এল সেখানে পাথুরে রাস্তা নেই। এবড়ো-খেবড়ো হলেও, মাইল দেড় দুই জুড়ে মোটামুটি সমতল জমি। সেটার তিন দিকে জঙ্গল, পাহাড়, অন্যদিকটায় সমুদ্র।

যতদূর চোখ যায় বিশাল বিশাল গাছের গুঁড়ি আর সেসবের মোটা মোটা ডালপালা তূপাকার হয়ে পড়ে আছে। এক লহমায় বোঝা যায়, বন কেটে অনেকটা জমি বার করা হয়েছে। তবে বড় বড় প্রাচীন সব গাছ কাটা হলেও অজস্র ছোট এবং মাঝারি গাছ, আর মাঝে মাঝে বুনো ঘাসের ঝোঁপঝাড়। এসব নির্মূল করতে না পারলে পুরো জমি পাওয়া যাবে না।

বেশ খানিকটা দূরে সমুদ্রের কাছাকাছি তক্তার বেড়া আর টিনের চালের অনেকগুলো লম্বা লম্বা ব্যারাকজাতীয় বাড়ি। বোঝাই যায় এগুলো নতুন তৈরি হয়েছে। সেখানে পনেরো বিশজন লোক দাঁড়িয়ে আছে।

তেরোটা গাড়ি সোজা ব্যারাকগুলোর সামনে এসে দাঁড়িয়ে পড়ল।

‘এই হল আমাদের নিউ সেটলমেন্টের জায়গা। এখানে উদ্বাস্তুদের জমি দেওয়া হবে। আসুন–’ বলে জিপ থেকে নেমে পড়লেন বিশ্বজিৎ।

ছিন্নমূল মানুষগুলোকে সমুদ্র আর জঙ্গলে ঘেরা বহু দূরের এই এলাকাটিতেই যে বসতি গড়ে তুলতে হবে, সেটা আন্দাজ করতে পেরেছিল বিনয়। সেও নেমে এল।

যে লোকগুলো সারি সারি ব্যারাকের সামনে দাঁড়িয়ে ছিল তারা বিশ্বজিতের দিকে প্রায় দৌড়ে চলে এল। এদের মধ্যে নানা জাতের মানুষ রয়েছে। রয়েছে দু’তিনজন কর্মীও। তবে সবচেয়ে বেশি করে যে নজরে পড়ে তার বয়স পঞ্চাশের আশপাশে। নিরেট চেহারা, পাথরের পাটার মতো চওড়া বুক, কাঁধ অবধি এলো মেলো কাঁচা-পাকা রুক্ষ চুল, মুখে আট-দশ দিনের জমানো দাড়ি। ছড়ানো চোয়াল, পুরু ঠোঁট। পরনে দোমড়ানো মোচড়ানো খাকি প্যান্ট আর কালচে রঙের জামা, যেটার একটাও বোতাম নেই। দেখামাত্র টের পাওয়া যায়, লোকটার গায়ে দানবের শক্তি। তার ঠিক পাশেই রয়েছে তেইশ-চবিশ বছরের একটি বাঙালি যুবক। পাতলা, একহারা চেহারা, তরতরে মুখ। পরনে ঢোলা প্যান্ট আর শার্ট। বাকি সবাই তাদের পেছনে।

বাঙালি যুবকটি হাতজোড় করে বিশ্বজিৎকে বলল, নমস্কার স্যার। আমরা দুফার থিকা আপনেগো সেইগা পথের দিকে তাকাইয়া রইছি।’ কথা শুনেই টের পাওয়া যায় তার আদি বাড়ি পূর্ববাংলায়।

বিশ্বজিৎ বললেন, হ্যাঁ। আমাদের আসতে দেরি হয়ে গেল।

লম্বাচওড়া শক্তিমান লোকটি এবং বাকি সকলে মাথা ঝুঁকিয়ে বলল, নমস্তে সাহাব–’বোঝা গেল তারা অবাঙালি।

ঘাড় সামান্য কাত করে প্রতি-নমস্কার জানালেন বিশ্বজিৎ। তারপর বাঙালি যুবকটিকে বললেন, ‘সেই সকালবেলা রিফিউজিরা খেয়ে বেরিয়েছিল। এখন সূর্য ডুবতে চলেছে। খিদেয় তাদের পেটে আগুন জ্বলছে। খাবার-টাবার সব রেডি তো?’

যুবকটি বলল, হ স্যার। দুফারের আগেই পাক (রান্না) হইয়া গ্যাছে।’

‘ভেরি গুড।’

বিশ্বজিৎ এবার বিনয়ের সঙ্গে তার পরিচয় করিয়ে দিলেন। যুবকটির নাম পরিতোষ বণিক। দেশভাগের পরে পরেই ফরিদপুরের পালং থেকে চলে এসেছিল। আইএ পাশ। আন্দামানের এই নতুন সেটলমেন্টের কলোনাইজেশন অ্যাসিস্টান্ট, সংক্ষেপে সি.এ। শরণার্থীদের এই উপনিবেশ গড়ে তোলার অনেকখানি দায়িত্ব। তার এখানে থেকেই পুনর্বাসন প্রক্রিয়ার তদারক করবে সে।

বিশ্বজিৎ বললেন, ‘বিনয়বাবুর কথা তোমাকে বলেছি। উনি আপাতত এখানে থাকবেন। আন্দামানের রিহ্যাবিলিটেশন সম্পর্কে ওঁদের কাগজে লিখবেন। ওঁকে সবরকম সাহায্য করবে।‘

‘নিশ্চয়ই স্যার। আপনে কি এইবার কয়েকদিন থাইকা যাইবেন?’

‘বড়জোর কালকের দিনটা আছি। পরশু আমাকে ফিরতেই হবে। কোর্টে অনেকগুলো কেস রয়েছে। কোনওটার হিয়ারিং আছে, কোনওটার জাজমেন্ট দিতে হবে।‘

বিশ্বজিৎ শুধু রিহ্যাবিলিটেশন অফিসারই নন, আন্দামানের ফার্স্ট ক্লাস ম্যাজিষ্ট্রেটও। তাকে নানারকম ঝক্কি সামলাতে হয়। তিনি বলতে লাগলেন, ‘তিন দিন আগে কাহালিবাবু মাল নিয়ে এসেছিলেন। তাতে কতদিন চলবে?’

ঘাড় চুলকতে চুলকতে চোখ নামিয়ে পরিতোষ বলল, ‘স্যার, রিফিউজিগো যা লিস্ট পাইছি হেয়াতে (তাতে) মনে লয় (হয়) তিনশো জন আইছে। হেরা তারা ছাড়া রিহ্যাবিলিটেশন ডিপার্টমেন্টের বিশ বাইশজন এমপ্লয়ি আছে। যা মাল আইছে, কতদিন চলব হিসাবটা বুঝতে পারছি না। এই ধরনের কাম তো আগে করি নাই। তাই—’

ধমকের সুরে বিশ্বজিৎ বললেন, ‘এটা একটা এক্সকিউজ হল? কলোনি চালাবে তুমি। হিসেবটা বুঝবে অন্য লোক? এভাবে চাকরি রাখতে পারবে না।‘

সচকিত বিনয় বিশ্বজিতের দিকে তাকায়। কাল সকাল থেকে আজ বিকেল অবধি, মোটামুটি দেড় দিনের মতো তাকে দেখছে সে। অমায়িক, সহানুভূতিশীল নরম স্বভাবের মানুষ বলেই মনে হয়েছে। কিন্তু কাজকর্মের ব্যাপারে তিনি যে অত্যন্ত কঠোর, কারও কোনওরকম গাফিলতি বা অজুহাত যে বরদাস্ত করেন না সেটা টের পাওয়া গেল।

মুখটা ফ্যাকাসে হয়ে গেল পরিতোষের। কী জবাব দেবে, ভেবে পাচ্ছে না।

নীরস গলায় বিশ্বজিৎ বললেন, ‘যেসব মাল এসেছে, সেগুলোর কত ওজন, তার ফর্দ আছে তো? না হারিয়ে ফেলেছ?’

পরিতোষের মনে হল, ফঁড়াটা খুব সম্ভব এ যাত্রায় কেটেই গেল। জোরে শ্বাস টেনে সে বলল, ‘আছে স্যার, আছে। অহনই লইয়া আসুম?’

‘এখন আনতে হবে না। পরে দেখব।’ বলেই সেই বলবান লোকটার দিকে তাকালেন বিশ্বজিৎ।–‘তোমার খবর কী ধনপত সিং?’

ধনপত বিনীত ভঙ্গিতে বলল, ‘আপকো কিরপাসে (কৃপায়) ঠিক হি হ্যায় সাহাব।’

‘কাল থেকে জমি জরিপের কাজ শুরু হবে। তোমরা রেডি তো?’

‘রিডি (রেডি) সাহাব।’ ধনপত তার সঙ্গী দু’জন বর্মি এবং অন্যদের দেখিয়ে বলল, হিন্দুস্থানিতে যা বলল তার বাংলা মোটামুটি এরকম। কাল রাতকো এই চেইনম্যানরা এসে গেছে।

জরিপের ব্যাপারটা ভাসা ভাসা ভাবে আন্দাজ করে নিল বিনয়, তবে চেনম্যানদের কী কাজ সেটা ধোঁয়াটে হয়ে রইল। এ নিয়ে কোনও প্রশ্ন করল না সে। পোর্টক্লেয়ার থেকে বহু দূরে নিবিড় বনভূমির এই খাঁজের ভেতর যখন এসেই পড়েছে কাল হোক, পরশু হোক, চেনম্যানদের সম্পর্কে অবশ্যই জানা যাবে।

ওধারে লরি থেকে রিফিউজিদের নামিয়ে ফেলেছে বিভাস আর নিরঞ্জন। সেদিক থেকে শোরগোল ভেসে আসছে। অতগুলো মানুষ একসঙ্গে কথা বলছে, তারই আওয়াজ।

বিশ্বজিৎ বিনয়কে বললেন, ‘চলুন, ওখানে যাওয়া যাক। দুজনে পেছন ফিরে হাঁটতে শুরু করল। পরিতোষও ভিজে বেড়ালের মতো তাদের সঙ্গে সঙ্গে চলেছে। ধনপতরা এল না, তারা দাঁড়িয়েই রইল।

বিশ্বজিৎ বললেন, ‘ধনপত আর বর্মিটর্মিদের দেখলেন তো। এরা কারা জানেন?’

বিনয় বলল, কী করে জানব? এই তো সবে এলাম। তবে আপনাদের কথা শুনে মনে হল জরিপ-টরিপ কিছু করবে।‘

‘হ্যাঁ। এরা সব ব্রিটিশ আমলে সাজা খাটতে ‘কালাপানি’ এসেছিল। তারপর এখানেই থেকে গেছে।’ বিশ্বজিৎ বলতে লাগলেন, ‘তখনকার জেল অ্যাডমিনিস্ট্রেশন ওদের ‘পি.ডব্লু.ডি’তে কাজ দিয়েছিল। স্বাধীনতার পর আন্দামানে যখন রিফিউজিদের পাঠানো হল তখন ওদের রিহ্যাবিলিটেশন ডিপার্টমেন্টে ট্রান্সফার করা হয়।’

বেলা চড়লে চ্যাথাম জেটি থেকে যখন ব্যাম্বু ফ্ল্যাটে আসছিল সেই সময় স্টিম লঞ্চে ইংরেজ রাজত্বের কয়েদিদের দেখেছিল বিনয়। তাদের সঙ্গে কথা বলার সুযোগ হয়নি। নতুন সেটলমেন্টে ধনপতদের সারাক্ষণই পাওয়া যাবে। ভাবতেই শিহরন অনুভব করে সে।

নতুন জায়গায় এসে উদ্বাস্তুরা খুবই উত্তেজিত। তারা এত হইচই বাধিয়েছে যে কারও কথাই স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছেনা।

ভিড়ের ভেতর থেকে হলধররা কয়েকজন বিনয়ের কাছে চলে এল। সবারই চোখেমুখে দুশ্চিন্তা এবং শঙ্কার ছাপ। হলধর ভয়ে ভয়ে বলল, ‘তিন দিকে জঙ্গল, পাহাড়, আরেক দিকে সমুদ্র। এই আমাগো কুনহানে লইয়া আইল! আর তো ফিরনের উপায় নাই।

বিনয় অবাক। বলল, ‘দেশ তো গেছে। কোথায় আর ফিরবেন? ফিরলে তো কলকাতার সেই ক্যাম্পেই যেতে হবে। কিন্তু ক্যাম্প কি কঁকা পড়ে আছে? এত দিনে অন্য রিফিউজি এনে নিশ্চয়ই সেখানে তোলা হয়েছে। একটু থেমে বলল, ক্যাম্পে কী সুখে ছিলেন, একবার ভেবে দেখুন।‘

মুখের কথা শুনে আন্দামানে এসেছে হলধর। কিন্তু স্বচক্ষে যখন দেখল বিজন, গহন অরণ্যে বাকি জীবন কাটাতে হবে, এটা ভেবে ভীষণ উতলা হয়ে উঠেছে। সে চুপ করে থাকে। হয়তো খেয়াল হয়, এই দ্বীপ ছাড়া বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের অন্য কোথাও তাদের জন্য ছ’আঙুল জমি পড়ে নেই। অনেকক্ষণ পর দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলে বিমর্ষ মুখে বলে, ‘হ, কই আর যামু! যাওনের জাগা নাই।’

বিনয় বুঝিয়ে বলে, ‘দুঃখ করবেন না। এখন থেকে এটাই আপনাদের দেশ। এখানেই জমি পাবেন, টাকা-পয়সা পাবেন, ছেলেমেয়েদের পড়াশোনার জন্যে স্কুল বসবে। আস্তে আস্তে দেখবেন, সব কষ্ট ঘুচে গেছে।‘

বিভাস ওধার থেকে রিফিউজিদের তাড়া লাগাচ্ছিল, ‘যার যার মাল লইয়া ব্যারাকে রাখেন। হের পর সমুদ্র থিকা হাত-পা ও ধুইয়া আসেন। অহনই খাওনেরটা (খাবার) দেওয়া অইব।

বিনয় হলধরদের বলল, ‘যান যান, চলে যান।‘

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *