২.০৪ উদ্বাস্তুদের মধ্যে তুমুল আতঙ্ক

পরশু মাঝ রাতে উত্তর দিকের গভীর জঙ্গল থেকে বেরিয়ে নয়া সেটলমেন্টে হানা দিতে এসেছিল। ফলে উদ্বাস্তুদের মধ্যে তুমুল আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছিল। তার ধাক্কা সামলাতে কাল দুপুর পেরিয়ে গেছে। উদ্বাস্তুদের বুঝিয়ে-সুঝিয়ে শান্ত করতে বিশ্বজিৎ বিভাস নিরঞ্জন ধনপত সিং থেকে শুরু করে পুনর্বাসন দপ্তরের কর্মীদের দম বেরিয়ে গিয়েছিল।

কাল রাতটা অবশ্য নির্বিঘ্নেই কেটে গেছে। বুশ পুলিশ আর সেটলমেন্টের কর্মীরা খুবই সতর্ক ছিল। পালা করে তারা রাত জেগেছে। জারোয়ারা আর এদিকে আসেনি।

আজ সকাল হতে না হতেই বিভাস নিরঞ্জনরা হাঁকডাক করে উদ্বাস্তুদের ঘুম ভাঙিয়ে দিয়েছিল। পশ্চিম দিকের পাহাড়ের ঢাল যেখানে ঝোঁপঝাড় আর অজস্র বুনো গাছ আর লতায় ঠাসা, তাড়া দিয়ে দিয়ে তাদের সেখানে পাঠিয়েছে। আবরু বাঁচানোর জন্য চারদিক ঘিরে এখানে পায়খানা-টায়খানা তৈরি করে রাখা হয়নি। বুড়ো-ধুড়ো, বাচ্চা-কাচ্চা, জোয়ান ছেলেমেয়ে প্রতিদিনের প্রাকৃত কর্মটি সারার জন্য ঝোঁপজঙ্গলের আড়ালে না গিয়ে উপায় নেই কারও। খোলা আকাশের নিচে এই মুক্ত, আদিম শৌচাগারই একমাত্র ভরসা।

জঙ্গল থেকে সমুদ্রে গিয়ে মুখটুখ ধুয়ে উদ্বাস্তুরা ফিরে আসতেই বিভাসরা হেঁকে হেঁকে বলতে লাগল, হগলে (সবাই) একহান কইরা থাল গিলাস (থালা গেলাস) লইয়া আহেন।

আগের দিনই উদ্বাস্তুদের কিছু কিছু বাসনকোসন দেওয়া হয়েছিল। একটু পর দেখা গেল, কথামতো থালা এবং গেলাস নিয়ে বিভাসদের সামনে কাতার দিয়ে দাঁড়িয়ে পড়েছে।

চারদিকের হাঁকাহাঁকিতে বিশ্বজিৎ এবং বিনয়েরও ঘুম ভেঙে গিয়েছিল। তারাও তাড়াহুড়ো করে সমুদ্র থেকে মুখটুখ ধুয়ে বিভাসদের কাছে চলে এলেন।

সকালে শুকনো খাবারের ব্যবস্থা। চিঁড়ে, আখের গুড় এবং এক গেলাস করে দুধ। আমেরিকার কটা চ্যারিটেবল অর্গানাইজেশন এবং স্ক্যান্ডিনেভিয়ার এভাঙ্গেলিস্টরা পূর্ব পাকিস্তানের উদ্বাস্তুদের জন্য ঢাউস ঢাউস সুদৃশ্য টিনের পাত্র বোঝাই করে পাউডার মিল্ক, চকলেট, চিজ, মাখন ইত্যাদি নিয়মিত কলকাতায় পাঠাচ্ছে। সর্বস্ব হারিয়ে আসা রুক্ষ, আধমরা, ছিন্নমূল মানুষগুলো যাতে অপুষ্টিতে ভুগে ভুগে শেষ না হয়ে যায় সে জন্য সাগরপারের দাঁতব্য প্রতিষ্ঠানগুলোর অনন্ত দুর্ভাবনা।

যেসব পুষ্টিকর খাদ্যবস্তু জাহাজ বা প্লেনে কলকাতায় পৌঁছয়। তার সামান্য কণিকা আন্দামানের দুর্গম অরণ্যে যেসব সেটলমেন্ট বসছে সেখানেও পাঠানো হয়। তবে শুধুই পাউডার মিল্ক। অন্য সমস্ত বাদ।

গুঁড়ো দুধ গুলে প্রকাণ্ড একটা ড্রাম বোঝাই করে রেখেছিল সেটলমেন্টের কর্মীরা।

প্রতিটি উদ্বাস্তুর থালায় চিড়ে, গুঁড় ও গেলাসে দুধ বিলি করা শুরু হয়।

বিশ্বজিৎ আগেই কড়া হুকুমনামা জারি করে রেখেছিলেন, তাঁদের জন্য আলাদা দামি দামি খাবারের ব্যবস্থা যেন না করা হয়। উদ্বাস্তুরা যা খাবে যে দরের মহামান্য অফিসারই হোন, তাকেও তাই খেতে হবে।

বিশ্বজিৎ আর বিনয় খালি হাতে চলে এসেছিল। তাদের ঘরে আগে থেকেই থালা গেলাস রাখা ছিল। পরিতোষ দৌড়ে গিয়ে নিয়ে এল। চিঁড়ে-গুড়টুড় নিয়ে উদ্বাস্তুদের কাছাকাছি দাঁড়িয়ে খেতে শুরু করলেন বিশ্বজিৎরা।

খাওয়াদাওয়া চুকতে ঢুকতে মিনিট চল্লিশেক লেগে গেল। এর। মধ্যে বেশ খানিকটা বেলা হয়েছে। সূর্য পুব দিকের পাহাড়ের চুড়োর ওপর উঠে এসেছে। তেজি রোদে ভেসে যাচ্ছে বনজঙ্গল উপত্যকা। এই সকাল বেলাতেই সমুদ্রের দিকে বেশিক্ষণ তাকিয়ে থাকা যায় না। রোদে নোনা জল থেকে এখনই আঁঝ উঠে আসছে। বেলা যত বাড়বে এই ঝঝ ততো বাড়বে। চোক আরও ধাঁধিয়ে যাবে।সসস।

বিশ্বজিৎ পরিতোষ বিভাসদের ডেকে বললেন, আর দেরি কোরো না; জমি মেপে ভাগ বাটোয়ারার বন্দোবস্ত কর।

বিভাস বলল, হ। অহনই কামটা শুরু করুম।

একদিনে কটা ফ্যামিলিকে জমি দেওয়া সম্ভব?

 লা-ডিনরে জিগাইয়া কইতে আছি।

লা-ডিন এই সেটলমেন্টের আমিন। উনিশশো তিরিশে বর্মার মৌলমিন থেকে খুনের দায়ে কালাপানির সাজা নিয়ে আন্দামানে এসেছিল। ভারত স্বাধীন হল,ব্রহ্মদেশ ইন্ডিয়া থেকে আলাদা হয়ে নতুন সার্বভৌম রাষ্ট্রের মর্যাদা পেল। কিন্তু লা-ডিন আর মৌলমিনে ফিরে যায়নি। আন্দামানেই থেকে গেছে।

এখানে আসার পর প্রথম বছরটা সেলুলার জেলেই কাটাতে হয়েছে লা-ডিনকে। তারপর তাকে জেলের বাইরে পি ডব্লু ডিতে কাজ দেওয়া হয়। জমি জরিপের খুঁটিনাটি শিখে সে তুঘোড় আমিন হয়ে ওঠে। সেই কাজটাই করে যাচ্ছিল। যখন আন্দামানে পূর্ব পাকিস্তান থেকে উৎখাত হওয়া মানুষদের পুনর্বাসনের জন্য ব্যাপক পরিকল্পনা নেওয়া হল সেই সময় তাকে পি ডরু ডি থেকে রিহ্যাবিলিটেশন ডিপার্টমেন্টে বদলি করা হয়।

বিভাস লা-ডিনের কাছে চলে গেল। তার সঙ্গে আলোলাচনা সেরে ফিরে এসে বিশ্বজিৎকে বলল, পনরোটা ফ্যামিলিরে জমিন মাইপা দ্যাওন (দেওয়া) যাইতে পারে। এইটাই ম্যাক্সিমাম।

বিশ্বজিৎ মনে মনে অঙ্ক কষে বললেন, তার মানে আড়াইশো ফ্যামিলিকে ল্যান্ড ডিষ্ট্রিবিউট করতে সতেরো-আঠারো দিন লেগে যাবে।

হেয়া (তা) তো লাগবই। জঙ্গলের মধ্যে জমি মাইপা (মেপে) সীমানা ঠিক করন তো সোজা কথা না। সোময় তো লাগেই।

কিন্তু

উৎসুক চোখে বিশ্বজিতের দিকে তাকাল বিভাস। কোনও প্রশ্ন করল না।

বিশ্বজিৎ বললেন, আমার পক্ষে এতদিন এই সেটলমেন্টে পড়ে থাকা সম্ভব না। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব পোর্ট ব্লেয়ারে ফিরে যেতে হবে।

বিনয় পাশেই দাঁড়িয়েছিল। সে আগেই শুনেছে, পোর্ট ব্লেয়ারে বিশ্বজিতের কোর্টে অনেক কেস জমে আছে। সেই সব মামলার শুনানি হবে, কম করে ছ-সাতটা রায় দিতে হবে।

বিভাস বলল, অতদিন থাকতে হইব না। আপনের সামনে কামটা খালি আরম্ভ হউক। পরে আমরা অন্য ফেমিলিগুলানরে জমিন বিলি কইরা দিতে পারুম।

জমি ডিস্ট্রিবিউশন শেষ হলেই তুমি আর নিরঞ্জন পোর্ট ব্লেয়ার চলে আসবে। সেখানে রিহ্যাবিলিটেশন ডিপার্টমেন্টের অনেক কাজ পড়ে আছে। নতুন নতুন আরও সেটলমেন্ট বসবে। কোথায় কোথায় বসবে, ঘুরে ঘুরে সেইসব জায়গা সম্পর্কে রিপোর্ট তৈরি করতে হবে।

হে (সেই) খেয়াল আমার আছে। আপনে চিন্তা কইরেন না।

যাও, এবার কাজে লেগে পড়।

এর মধ্যে পরিতোষ সেটলমেন্টের এক ধারে অ্যাসবেস্টসের ছাউনি দেওয়া যে অফিসঘর রয়েছে সেখান থেকে মোটা বাঁধানো লম্বা একটা খাতা নিয়ে এসেছে। সেটায় উদ্বাস্তু ফ্যামিলিগুলো কাল এখানে এসেছে তাদের নাম, প্রতিটি পরিবারের আলাদা আলাদা বিবরণ লেখা আছে।

ওদিকে ধনপত এবং পুনর্বাসনের কয়েকজন কর্মী মালপত্র রাখার গুদাম থেকে কোদাল, শাবল, করাত এবং লম্বা লম্বা বর্মি দা এবং গোলাকার মস্ত দুটো জার এনে একধারে জড়ো করে রেখেছে। জার বা বয়ম দুটো গাঢ় ধরনের তরল জিনিসে বোঝাই।

উদ্বাস্তুরা সামনের ফাঁকা জায়গাটায় কেউ দাঁড়িয়ে, কেউ বা বসে বসে নিজেদের মধ্যে কথা বলছিল। বিভাস পরিতোষের হাত থেকে খাতাটা নিয়ে গলার স্বর উঁচুতে তুলে উদ্বাস্তুদের দিকে তাকিয়ে বলতে লাগল, হগলে মন দিয়া আমার কথা শুনেন।

চিড়েটিড়ে খাওয়ার পর ছিন্নমূল মানুষগুলোর কেমন একটা এলানো ভাব এসে গিয়েছিল। এবার তারা চনমনে হয়ে ওঠে। যারা বসে ছিল তারা শরীরে ঝাঁকুনি দিয়ে উঠে দাঁড়ায়।

বিভাস থামেনি। বলেই চলেছে, কাইল জারোয়াগো লেইগা মেলা (অনেক) তাফাল গ্যাছে। তাই আপনেগো জমিন দেওন যায়। নাই। আইজ থিকা বিলি করন শুরু হইব। একদিনে এতগুলান ফেমিলিরে দেওন সোম্ভব না। রোজ পনরোটা ফেমিলিরে জমিন বিলি করন হইব। যারা আইজ জমিন পাইবেন হেয়াগো (তাদের) নাম পড়তে আছি। হাতের খাতাটা খুলে সে পড়তে লাগল, জলধর বারুই, মনা ব্যাপারী, সহদেব রুদ্রপাল…

পনেরো জনের নাম পড়া হলে বিভাস বলল, প্রতিটি ফেমিলিরে শাবল, কুড়াল, দাও (দা) দেওন হইব। আপনেরা আউগাইয়া (এগিয়ে) আইয়া লইতে থাকেন।

পনেরোটি পরিবারকে শাবল-টাবল দেওয়া হলে বিভাস ধনপতকে বলল, এইবার এয়াগো (এদের) হাতে লোশান দাও উদ্বাস্তুদের বলল, যারা আমাগো লগে জঙ্গলে জমিন লইতে যাইবেন হেরা (তারা) গায়ে লোশান মাইখা লন (নিন)। মাথাতেও মাখবেন।

লোশান অর্থাৎ লোশন। সেটা যে কী বস্তু আন্দাজ করতে পারছিল না উদ্বাস্তুরা। জঙ্গলে জমি বুঝে নিতে হলে সেটা গায়ে মাথায় কেনই বা মাখতে হবে কেউ ভেবে পাচ্ছিল না। তারা রীতিমতো অবাকই হয়ে যাচ্ছিল।

উদ্বাস্তুদের মনোভাব কিছুটা আঁচ করে বিভাস বলল, ক্যান লোশান মাখতে লাগব, জঙ্গলে গ্যালেই ট্যার পাইবেন। ধনপত তুমি এয়াগো (এদের) হাতে লোশান দাও—

ধনপত হতবুদ্ধি মানুষগুলোকে তাড়া দিয়ে দিয়ে তার কাছে ডেকে নিল। তারপর সেই মোটা জার থেকে পরপর তাদের দাঁড় করিয়ে হাতে গাঢ় তরল চটচটে জিনিস ঢেলে দিতে লাগল। নির্দেশমতো গায়ে মাথায় সেসব মেখে নিল উদ্বাস্তুরা।

বিনয় দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে সব দেখছিল। সেও কম অবাক হয়নি। নিচুগলায় বিশ্বজিৎকে জিগ্যেস করল, রিফিউজিদের ওই লিকুয়িডটা মাখতে বলা হল কেন?

বিশ্বজিৎ মৃদু হাসলেন। প্রশ্নের উত্তরটা না দিয়ে বললেন, আন্দামানে কীভাবে উদ্বাস্তুদের ল্যান্ড ডিস্ট্রিবিউট করা হয়, নিশ্চয়ই আপনাদের কাগজে তা লিখবেন।

হ্যাঁ, তা তো লিখতেই হবে।

তা হলে আমাদের সঙ্গে আপনাকেও জঙ্গলে যেতে হবে। আর তখন বুঝতে পারবেন লিকুয়িডটা কেন মাখা জরুরি।

আপনিও জঙ্গলে যাবেন নাকি?

অবশ্যই। বিশ্বজিৎ জানালেন, আন্দামানের যেখানে যেখানে রিফিউজি সেটলমেন্ট বসেছে সেসব জায়গায় তিনি নিজে দাঁড়িয়ে থেকে জমি বিলিবণ্টনের শুরুটা করে দিয়েছেন। এখানেও করবেন।

বিশ্বজিৎ, বিভাস, নিরঞ্জন, লা-ডিন এবং পুনর্বাসনের কর্মীরা লোশন মেখে নিল। দেখাদেখি বিনয়ও মাখল।

যে ফ্যামিলিগুলোকে আজ জমি দেওয়া হবে তাদের হেড অফ দি ফ্যামিলি অর্থাৎ কর্তারা বিভাসের কথায় শাবল এবং বর্মি দা হাতে ঝুলিয়ে নিয়েছে। পুনর্বাসনের কর্মীরা দা-শাবল তো নিয়েছেই, সেইসঙ্গে নিয়েছে লম্বা লম্বা লোহার চেন।

ব্যারাকগুলোর সামনের ফাঁকা জায়গাটায় তিন দিকে–পুবে, পশ্চিমে এবং উত্তরে ঘোর জঙ্গল। এবার সবাই উত্তর দিকে চলল। যাদের জমি দেওয়া হবে তারা তো যাচ্ছেই, বাকি উদ্বাস্তুদের অনেকেই তাদের পিছুপিছু চলেছে। জমি কীভাবে ভাগ-বাঁটোয়ারা করা হবে ওরা স্বচক্ষে তা দেখতে চায়। কৌতূহল, অপার কৌতূহল।

কালই বিনয়ের চোখে পড়েছিল ব্যারাকের পেছন দিকে বিশাল বিশাল গাছ কেটে সেগুলোর গুঁড়ি এবং মোটা মোটা ডাল মস্ত এলাকা জুড়ে ভঁই করে করে ফেলে রান্না হয়েছে। কাল নজরে পড়েনি, পাহাড়-প্রমাণ গুঁড়িগুলোর পেছন দিকে আট-দশ ফুটের মতো মাপ করে বাঁশ কেটে সেই টুকরোগুলোও টাল দিয়ে সাজানো রয়েছে।

বনবিভাগের কিছু কর্মী বিনয়দের সঙ্গে চলেছে। কিন্তু আরও কুড়ি-পঁচিশজন দশ-পনেরোটা করে বাঁশের খুঁটি দড়ি দিয়ে শক্ত করে বেঁধে মাথায় চাপিয়ে একটু ঘুরপথে উত্তরের জঙ্গলে যাচ্ছে। এদের কারও কারও হাতে রয়েছে নানা মাপের এবং ওজনের করাত। যে করাতগুলো প্রকাণ্ড এবং বেজায় ভারী সেগুলো দুজনে দুমাথায় ধরে নিয়ে চলেছে। মাঝারিগুলো তুলনায় অনেক হালকা। এগুলোর জন্য দুজন দরকার নেই। একজনই হাতে ঝুলিয়ে নিয়ে যেতে পারছে।

বাঁশের খুঁটি বা করাত কোন কাজে লাগবে, আন্দাজ করা যাচ্ছে না। তবে এ ব্যাপারে কোনও কৌতূহল প্রকাশ করল না বিনয়। জঙ্গলে ঢুকলেই তা জানা যাবে।

ফাঁকা জায়গাটা পেরিয়ে জঙ্গলে ঢোকার মুখে এসে ঘুরে দাঁড়াল বিভাস। যে উদ্বাস্তুদের আজ জমি দেওয়া হবে না তাদের দিকে তাকিয়ে বলল, আপনেরা গায়ে লোশান মাইখা আহেন নাই। এহানেই খাড়হয়া খাড়ইয়া আমাগো কাম কাইজ (কাজকর্ম) দ্যাখেন।

লোকগুলো দাঁড়িয়ে পড়ল। বিনয়রা জঙ্গলে ঢুকে বড় বড় সব গাছ যেগুলোর বেড় তিনশো চারশো ফিটের মতো সেগুলো কাটা হলেও, শিকড়বাকড় এখনও তুলে ফেলা হয়নি। কিন্তু বিরাট মহাবৃক্ষ আর কটা? চারিদিকে অগুনতি মাঝারি এবং ছোট ছোট গাছ, ঝোঁপঝাড়, বনতুলসীর উদ্দাম জঙ্গল। যে গাছগুলো অক্ষত দাঁড়িয়ে আছে সেগুলোকে আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে রয়েছে মোটা মোটা বেতের লতা।

বড় গাছগুলো কেটে ফেলায় কোথাও কোথাও জঙ্গল ততটা ঘন নয়, তাই আকাশ চোখে পড়ছে। কিন্তু যেখানে হাজার বছরের অরণ্য ডালপালা মেলে চাপ বেঁধে রয়েছে সেইসব এলাকায় আন্দামানের তেজি সূর্যালোকও ঢুকতে পারছে না। সমস্ত কিছু ছায়াচ্ছন্ন, অন্ধকার অন্ধকার। সেখানকার মাটি স্যাঁতসেঁতে, ঠান্ডা, শ্যাওলার পুরু স্তর জমে আছে। অসাবধানে পা ফেললে পিছলে পড়ার সম্ভাবনা।

জঙ্গলে ঢোকার সঙ্গে সঙ্গে ঝাঁকে ঝাকে বাড়িয়া পোকা, মাছি আর মশাদের দঙ্গল কোত্থেকে যেন বেরিয়ে এসে বিনয়দের হেঁকে ধরল। সরসর আশেপাশে অদৃশ্য সরীসৃপেরা বুকে ভর দিয়ে দূরে চলে যাচ্ছে। মাথার ওপর নাম না-জানা হাজারে হাজারে বুনো পাখি চক্কর দিয়ে কর্কশ গলায় সমানে চেঁচিয়ে চলেছে। উর্ধশ্বাসে কটা বুনো শুয়োর দৌড়তে দৌড়তে ঝোঁপঝাড় ভেদ করে আরও দূরে উধাও হয়ে গেল যেখানে জঙ্গল আরও জমাট, আরও দুর্ভেদ্য।

হঠাৎ উটকো কিছু মানুষ এসে পড়ায় এখানকার আদি বাসিন্দা জারোয়ারা খেপে গিয়ে কাল রাতে হানা দিয়েছিল। আজ দেখা যাচ্ছে পোকামাকড় সরীসৃপ পাখি থেকে জন্তুজানোয়ার, সবাই মহাবিরক্ত। উড়ে এসে যারা জুড়ে বসতে চাইছে, ভাগ বসাতে চাইছে তাদের আবহমানকালের অধিকারে তাদের ওপর ওরা আদৌ খুশি নয়। যতই চেঁচিয়ে-মেচিয়ে, চক্কর মেরে তারা হুলুস্থুল বাঁধাক, যে লক্ষ লক্ষ মানুষ সর্বস্ব খুইয়ে সীমান্তের ওপার থেকে এপারে চলে এসেছে তাদের জন্য উপনিবেশ তো গড়ে তুলতেই হবে।

কয়েক পা এগুতেই গাছের ডাল থেকে থপ করে কী যেন বিনয়দের মাথার ওপর পড়ল। খুব একটা ভারী নয়নরম, হড়হড়ে, ঠান্ডা।

বিনয় চমকে ওঠে। পরক্ষণে চোখে পড়ে অগুনতি সেঁক তারগা বেয়ে নিচে পড়ে যাচ্ছে। শুধু তারই নয়, অন্য সবারই এক হাল।

লোশনটার মহিমা এতক্ষণে বোঝা গেল। ওটা না মাখলে জেঁকগুলো তাদের গা থেকে রক্ত শুষে নিত। হাত দিয়ে কটাকে আর ছাড়ানো যেত!

বিশ্বজিৎ তাকে লক্ষ করছিলেন। চোখাচোখি হতে একটু হাসলেন। তার হাসিটা যেন বুঝিয়ে দিল কেন লোশন মাখতে হয়েছে, এবার টের পেলেন তো।

একটা সামান্য ফাঁকা মতো জায়গায় এসে সবাই দাঁড়িয়ে পড়ল। বিভাস গলার স্বর উঁচুতে তুলে হল, মোহনবাঁশি কর্মকার

একটা আধবুড়ো রোগাটে চেহারার লোক মুখে খোঁচা খোঁচা দাড়ি, খাড়া খাড়া কাঁচা-পাকা চুল–পরনে ময়লা ফতুয়া আর খাটো ধুতি-সামনে এসে বলল, আইজ্ঞা—

পরথম আপনেরে জমিন দেওন অইব। বড় গাছগুলান সরকার থিকা কাইটা দেওন অইছে। মাঝারিগুলানও কাইটা দিমু কিন্তুক ছুটো গাছ, ঝোঁপঝাঁপ আপনেগো হগল রিফুজিগো সাফ কইরা লইতে অইব।

মোহনবাঁশি হুঁশিয়ার লোক। সে ঢোক গিলে জিগ্যেস করল, বড় গাছগুলান কাটা অইছে ঠিকই কিন্তুক মাটির উপুরে হাতখানেক কইরা রইয়া গ্যাছে; মাটির তলে রইছে শিকড়বাকড়। হেগুলান (সেগুলো) উঠান (ওঠানো) তো আমাগো শক্তিতে কুলাইব না।

বিভাস বলল, বড় গাছের গোড়া আর শিকড় আপনেগো তুলতে অইব না, আমরাই তুইলা দিমু।

সহদেব রুদ্রপাল এবং জলধর বারুইয়ের বয়স অনেক কম। তিরিশের বেশি হবে না। দেশভাগের পর এপারে এসে শিয়ালদা স্টেশনে কিছুদিন কাটিয়ে তারপর ত্রাণশিবিরে গিয়ে উঠেছিল। তাদের ওপর দিয়ে ঝড়ঝাঁপটা কম যায়নি কিন্তু শরীরস্বাস্থ্য সেভাবে ভেঙে পড়েনি। মোটামুটি অটুটই আছে। দুজনেরই শক্তপোক্ত চেহারা।

সহদেব বলল, শিকড়কড় আপনেরা উঠাইবেন বাকি ঝোঁপঝাঁপ আমরা সাফ করুম। জঙ্গলের মুখ থিকা জমিন বাইর করতে যে মেলা (অনেক) সোময় লাইগা যাইব ছার (স্যার)।

বিভাস বলল, হেয়া তো লাগবই।

সংশয়ের সুরে জলধর বলল, জঙ্গলে ভরা জমিন দিয়াই কী কইবেন, এইবার নিজেগো প্যাটের চিন্তা নিজেরা কর।

তার মনোভাবটা বুঝতে পারছিল বিভাস। হেসে হেসে বলল,  ভাইবেন না। আন্দামানে আপনেগো শুকাইয়া মারণের লেইগা আনি নাই। যতদিন না চাষবাস কইরা ফসল ফলাইতে পারেন, আপনেগো প্যাটের চিন্তা সরকারের। আমাগো উপুর ভরসা রাখেন।

দূরের জঙ্গলে লম্বা লম্বা করাত নিয়ে যারা ঢুকেছিল সেখান থেকে একটানা ঘষঘষ আওয়াজ আসছে। বিনয় আন্দাজ করে নিল। বড় গাছ কাটা শুরু হয়ে গেছে। মাঝারি মাপের করাত নিয়ে যারা এসেছিল তারা গভীর জঙ্গলে যায়নি। কাছাকাছি যে পাতলা জঙ্গল রয়েছে সেখানকার মাঝারি গাছগুলো কাটছে।

গাছ কাটার কায়দাটা বিচিত্র ধরনের। দুজন করে লোক গাছে চড়ে ক্ষিপ্র হাতে করাত চালিয়ে প্রথমে ডালগুলো ছেঁটে ফেলছে, তারপর নিচে নেমে এসে কবন্ধ গাছের গুঁড়িগুলো খণ্ড খণ্ড করে টাল দিয়ে রাখছে।

বনভূমির চতুর্দিকে শুধু করাত রাত চালানোর কর্কশ আওয়াজ। জঙ্গলের মাথায় পাখিদের চেঁচামেচি আরও বেড়েছে। বেড়েছে বনচর প্রাণীদের দুদ্দাড় দৌড়ে পালানোর শব্দ। বেড়েছে মশা-মাছি নানা ধরনের পোকা আর পতঙ্গের ওড়াউড়ি।

বিনয়রা যেখানে দাঁড়িয়ে আছে তার খানিকটা দূর দিয়ে এক পাল হরিণ বিদ্যুৎ গতিতে বাঁ পাশের পাহাড়ের দিকে চলে গেল।

বিশ্বজিৎ একবার আকাশের দিকে তাকিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়লেন। ব্যস্ততার যথেষ্ট কারণ রয়েছে। বারোটি ফ্যামিলি আজ পনেরো। বিঘে করে মোট একশো আশি বিঘে জমি পাবে। এতটা জমি মাপজোখ করা কি মুখের কথা। তিনি বললেন, বেলা বেড়ে গেছে। আর দেরি করো না। এবার আসল কাজ আরম্ভ করে দাও।

আমিন লা-ডিন, চেনম্যান ধনপত এবং পুনর্বাসন দপ্তরের আরও কজন কর্মী মুহূর্তে তৎপর হয়ে ওঠে। প্রথমেই মোহনবাঁশিকে জমি দেওয়া হবে। তাকে সঙ্গে নিয়ে লা-ডিনরা জঙ্গলের ডানদিকে গেল। তাদের সঙ্গে বিভাস বিনয় এবং বিশ্বজিৎও গেলেন। বিভাস জমি মাপার কাজটা যাতে সুষ্ঠুভাবে হয় তার তদারক করবে। একবার কাজটা শুরু করে দিতে পারলে বাকিটা মসৃণভাবে চলবে। ঠিক হল, জঙ্গলের ডান পাশে জমি পাবে মোহনবাঁশি। কিন্তু নিবিড় কাঁটাঝোঁপ, ফনফনিয়ে বেড়ে ওঠা ঘণ বনতুলসীর ঝাড়, গাছ, বুক সমান উঁচু ঘাস বনের ভেতর জমি মাপা সহজ নয়। একটা দল সমানে ধারালো চালিয়ে ঝোঁপঝাড় কেটে সাত আট ফিটের মতো জায়গা সাফ করছে; সেখান দিয়ে। লোহার লম্বা চেন পেতে জমি মাপার কাজ চলল।

লা-ডিন আর ধনপত হাঁকডাক করে বলল, খুঁটি বসাতে বসাতে চল- তুরন্ত

বনবিভাগের যে কর্মীরা বাঁশের সমান মাপের টুকরোগুলো নিয়ে এসেছিল, শাবল দিয়ে মাটি খুঁড়ে দশ হাত পর পর খুঁটি পুঁততে লাগল। এই খুঁটি অবধিই মোহন বাঁশির জমির সীমানা। চৌকোনা পনেরো বিঘে জমি খুঁটি দিয়ে ঘিরতে সময় লাগল ঘন্টা দেড়েক।

মোহনবাঁশির পর সহদেবের পালা। মোহনবাঁশির জমির চারপাশে যেসব খুঁটি বসানো হয়েছে সেগুলোর পর চার ফিটের মতো বাদ দিয়ে একই প্রক্রিয়ায় জমি মেপে সহদেবকে দেওয়া হল।

কিন্তু পোকামাকড়, হরিণ, শুয়োর, তক্ষকই নয়, মাঝে মাঝে থোকায় থোকায় ঝোঁপঝাপের ভেতর থেকে বেরিয়ে আসছে। বাদামি রঙের চেলা বিছেরা। লম্বায় এক বিগধ এক ফুটের মতো, চওড়ায় ইঞ্চিখানেক।

হোঁশিয়ার-হোঁশিয়ার। কানখাজুরা (চেলা বিছে) বহোত জহরিলা। সাপের চেয়েও খতারনাক। কামড়ালে জান চলে যাবে।

মোহনবাঁশি সহদেবরা দৌড়ে বিশ হাত দূরে চলে যায়।  তাদের মুখ আতঙ্কে সাদা হয়ে তারা চিৎকার করতে আমাগো আন্ধারমানে আইনা যমের মুখে ফেইকা (ছুঁড়ে) দিছে। একদিকে জারো (জারোয়া), একদিকে কানখাজুরা, সমুন্দুরে হাঙ্গর। আমাগো নিঘঘাত মরণ।

বিভাস হুংকার ছাড়ে। চুপ। এক্কেরে চুপ। পদ্ম ম্যাঘনার দ্যাশ থিকা আইছেন। সেই হল জাগায় (জায়গায়) সাপ বাঘ কুমের (কুমির) আছিল না? বেবটাকে (সবাই) বাঘ আর কুমিরের প্যাটে গ্যাছেন? নিকি সাপের ছোবল মইরা ঝইরা গ্যাছেন?

বিভাসের তর্জন-গর্জনে মোহনবাঁশিদের চেঁচামেচি থেমে যায়। তারা চুপচাপ দূরে দাঁড়িয়ে থাকে।

বিনয় আগে লক্ষ করেনি। এবার দেখতে পেল, যারা বাঁশের খুঁটি, শাবল, কুড়ল এবং করাটরাত নিয়ে এসেছিল তারা কয়েকটা বড় বড় পেটমোটা বোতলও সঙ্গে করে এনেছে। বোতলগুলো পেট্রোল বোঝাই।

কানখাজুরা বা চেলা বিছেগুলো দলা পাকিয়ে কিলবিল করছে। ধনপত চকিতে একটা বোতল থেকে বিষাক্ত সরীসৃপগুলোর গায়ে পেট্রোল ছিটিয়ে দিয়ে দেশলাইয়ের কাঠি ধরিয়ে তাদের দিকে ছুঁড়ে দেয়। চোখের পলকে দাউদাউ আগুনে পুড়ে বিছেগুলো দলা পাকিয়ে যায়।

বিভাস মোহনবাঁশিদের দিকে ফিরে বলল, এইবার ডর কাটছে তো? আমরা আপনেগো পাশে আছি। কানখাজুরা জারোয়া কেও আপনেগো কিছু করতে পারব না। আহেন আহেন, আবার জমিন মাপামাপি শুরু হইব। নিজেগো চৌখে দেইখা হল (সব) বুইঝা লন (নিন)।

মোহনবাঁশিদের সাহস অনেকখানি ফিরে আসে। হয়তো ভাবে কাল রাতে প্রাণের ঝুঁকি নিয়ে বুশ পুলিশ এবং ধনপতরা জারোয়াদের ঠেকিয়েছে, আজ কানখাজুরা মারল। এসবই তো তাদের নিরাপত্তার জন্য। পায়ে পায়ে উদ্বাস্তুরা ফিরে আসে।

যে এলাকা দিয়ে জমি মাপামাপির জন্য লম্বা লোহার চেন বসানো হবে সেখানকার ঝোঁপঝাড় কেটে আবার নতুন উদ্যমে কাজ শুরু হয়ে যায়। তবে পুরোপুরি নির্বিঘ্নে নয়। কতকাল ধরে যে কানখাজুরা আর জেঁকেরা জঙ্গলের ভেতর চিরস্থায়ী আস্তানা গেড়ে আছে। দশ পা এগতে না এগতেই গাছের ডালপালা থেকে থোকায় থোকায় জোঁক মাথায় এসে পড়ছে। সারা গায়ে এবং মাথায় লোশন লাগানো রয়েছে তাই বাঁচোয়া। সঙ্গে সঙ্গে সেগুলো গা-মাথা থেকে খসে পড়ছে। ঝোঁপজঙ্গলে দা কিংবা কোদালের কোপ পড়লেই বুড় বুড় করে বেরিয়ে আসছে কানখাজুরা এবং অন্য সব বুনো সরীসৃপের দঙ্গল। পেট্রোল দিয়ে তাদের পোড়াতে পোড়াতে জমি মাপা এবং খুঁটি পোঁতা চলতে লাগল। মোহনবাঁশির পরিবারের জন্য পনেরো বিঘে জমি মেপে তার চরপাশে খুঁটি পুঁতে পুঁতে সীমানা ঠিক করে দিয়ে, তারপর সহদেবের পরিবারের জন্য জমি দেওয়া হল। এইভাবে সূর্য যখন পশ্চিম দিকে ঢলতে শুরু করেছে তার মধ্যে পাঁচটি ফ্যামিলিকে জমি বিলি করা সম্ভব হল।

সেই সকালবেলায় চিড়ে গুড় খেয়ে জঙ্গলে ঢুকেছিল সবাই। খিদেয় এখন পেট জ্বলে যাচ্ছে। মুখে কেউ খিদের কথা না বললেও সেটা বোঝা যাচ্ছিল। বিশ্বজিৎ বললেন, এ বেলার মতো কাজ বন্ধ থাক। খেয়েদেয়ে এসে আবার করা যাবে।

বিভাস হেঁকে হেঁকে সবাইকে বলল, অহন কেম্পে ফিরা চলেন।

.

স্নান এবং খাওয়াদাওয়া চুকিয়ে যখন সবাই আবার জঙ্গলে ঢুকল, সূর্য আরও খানিকটা হেলে গেছে।

বিশ্বজিৎ বললেন, ও বেলা মাত্র পাঁচটা ফ্যামিলিকে জমি দেওয়া হয়েছে। এভাবে কাজ হলে এতগুলো ফ্যামিলিকে জমি দিতে অনেক সময় লেগে যাবে। যে উদ্বাস্তুরা এখানে এসে পৌঁছেছে এক উইকের ভেতর তাদের ল্যান্ড ডিস্ট্রিবিউশন কমপ্লিট করতেই হবে। মাসখানেক বাদে আবার একশো ফ্যামিলি মেনল্যান্ড থেকে এসে পড়বে। এখন প্রচুর কাজ।

ঠিক করা ছিল, আজ বারোটি ফ্যামিলিকে জমি দেওয়া হবে কিন্তু উত্তর দিকে ঝোঁপ-ঝাড় অনেক বেশি ঘন। সেসব সাফ করে আর মাত্র চারটি ফ্যামিলিকে জমি দেওয়া সম্ভব হল।

আজ সব মিলিয়ে নটা উদ্বাস্তু ফ্যামিলি জমি পেল।

সূর্য পশ্চিমদিকের পাহাড়ের পেছনে অনেকখানি নেমে গেছে। সেটাকে আর দেখা যাচ্ছে না। পাহাড় আর বিশাল বিশাল মহাবৃক্ষগুলির ছায়া নেমে এসেছে উপত্যকায়। সেই ছায়া এমনই ঘন যে সন্ধে হবার আগেই চারিদিক দ্রুত অন্ধকার হয়ে যাচ্ছে। অন্ধকার ভেদ করে সহজে নজর চলে না।

বিভাস হেঁকে বলল, আইজকার মতো কাম বন্ধ। কাইল ভুরের। (ভোরের আলো ফুটলেই আবার জমিন দেওন শুরু হইব। চলেন কেম্পে যাই

জঙ্গল থেকে বেরিয়ে সবাই ব্যারাকগুলোর দিকে এগিয়ে যায়।

বিনয় আর বিশ্বজিৎ বিরাট দলটার একেবারে পেছনে ছিলেন। সারাটা দিন জঙ্গলের পুরু শ্যাওলায় ঢাকা, সঁতসেঁতে, পিছল, উৎকট সোঁদা গন্ধে-ভরা জমি, নানা ধরনের পোকামাকড়, সেঁক। আর কানখাজুরার মধ্যে কাটিয়ে ভীষণ ক্লান্তি বোধ করছিলেন। দুজনে।

পশ্চিমদিকের পাহাড় এবং বনজঙ্গল গাঢ় ছায়ায় ঢেকে গেলেও পুবদিকের পাহাড়ে বেলাশেষের একটু আলো এখনও আলগাভাবে লেগে রয়েছে। দক্ষিণ প্রান্তে পাহাড়-টাহাড় নেই; একেবারে খোলা। সেখানে অফুরান বঙ্গোপসাগর। যদিও নিভুনিভু, তবু সমুদ্রের ঢেউগুলোর মাথায় মাথায় প্রচুর আলো দোল খাচ্ছে।

চলতে চলতে হঠাৎ পুবের পাহাড়ের দিকে নজর চলে যায় বিনয়ের। এক দঙ্গল হাতিকে প্যাচানো পাহাড়ি রাস্তা দিয়ে হাঁটিয়ে হটিয়ে নামিয়ে নিয়ে আসছে কটা লোক। খুব সম্ভব তারা মাহুত। হাতিদের পেছনে দুটো বিরাট ট্রাক। ট্রাক বা হাতি, কারও কোনও তাড়া নেই। তারা ধীর চালে এধারের ঢাল দিয়ে নেমে আসছে।

অবাক বিনয় দাঁড়িয়ে পড়েছিল। জেফ্রি পয়েন্টে হাতির পাল। আর পেল্লায় পেল্লায় ট্রাক নিয়ে কেন লোকগুলো আসছে, বোঝা যাচ্ছে না।

বিশ্বজিৎও কম অবাক হননি। হাতিটাতি এসে হাজির হবে, খুব সম্ভব জানতেন না। তাই তিনি দাঁড়িয়ে পড়েছেন।

উদ্বাস্তুদের নিয়ে বিভাসরা বেশ খানিক দূর এগিয়ে গিয়েছিল। হাতি দেখে তারাও থমকে গেছে।

কয়েক মিনিটের ভেতর কটা বিপুল আকারের প্রাণী, দুটো ট্রাক আর বেশ কিছু মানুষ নিচের উপত্যকায় নেমে এল।

বিশ্বজিতের সঙ্গে বিনয়ও সেদিকে এগিয়ে গেল। ওদিকে হাতি দেখে বিভাসরা শুধু নয়, যে উদ্বাস্তুরা ক্যাম্পে ছিল তারাও ছুটে এসেছে। বাচ্চাকাচ্চা, যুবকযুবতী, বুড়োধুড়ো–কেউ বাকি নেই। সবার চোখে অপার কৌতূহল।

বিনয় গুনে গুনে দেখল সবসুদ্ধ পাঁচটি হাতি। মাহুতরা পায়ে মোটা শিকল লাগিয়ে গাছের গুঁড়িতে সেগুলোকে বেঁধে ফেলল। কাল যে ছোট লরিগুলোতে চেপে উদ্বাস্তুরা এসেছিল সেগুলো কাতার দিয়ে ক্যাম্প থেকে খানিক দূরে র্ঘড়িয়ে আছে। দুই ট্রাকের ড্রাইভার লরিগুলোর পেছনে তাদের গাড়ি দাঁড় করিয়ে নেমে পড়ল। ট্রাকে আরও কয়েকজন রয়েছে। মাহুতসুদ্ধ তারা সবাই বিশ্বজিতের কাছে দৌড়ে এল। এদের মধ্যে নানা জাতের মানুষ রয়েছে বর্মি, শিখ, সাঁওতাল, তামিল ইত্যাদি। সবার বয়স পঞ্চাশের ওপারে। বিনয় আন্দাজ করে নিল এরা একদিন বঙ্গোপসাগরের এই দ্বীপপুঞ্জে কালাপানির সাজা খাটতে এসেছিল। এখন মুক্তি পেয়ে তারা স্বাধীন ভারতের সরকারি কর্মচারী।

সবাই এসে সসম্ভ্রমে কপালে হাত ঠেকিয়ে বিশ্বজিৎকে বলে, সেলাম হুজৌর

বিশ্বজিৎ ওদের না চিনলেও, ওরা বিশ্বজিৎকে খুব ভালো। চেনে। মোটামুটি একটা আন্দাজ করে নিয়ে তিনি জিজ্ঞেস করলেন, তোমরা কি ফরেস্ট ডিপার্টমেন্টে কাজ কর?

সবার হয়ে একটা হট্টাকাট্টা চেহারার, চাড়া-দেওয়া গোঁফওয়ালা লোক, নিশ্চয়ই পুরো দলটার চালক বা সর্দার, বলল, হ, হুজৌর। লোকটা খুবই বিনয়ী, ন; গলার স্বর নরম। কে বলবে সে একদিন দুর্ধর্ষ দাগি আসামি হয়ে এখানে এসেছিল।

তোমাদের এখানে কে পাঠিয়েছে?

 তিরুরের ফরিস্টার (ফরেস্টার) সাহাব।

 তিরুর অঞ্চলের ফরেস্ট অফিসারকে ভালোই চেনেন বিশ্বজিৎ। বললেন, মণ্ডল সাহেব পাঠিয়েছেন?

হা সাহেব। এখান থেকে গাছের মোটা মোটা বল্লা নিয়ে যেতে হবে। উসি লিয়ে

তোমার নাম কী?

আজীব সিং।

 ঠিক আছে। কবে থেকে কাজ শুরু করবে?

 কাল সুবেসে।

একটু ভেবে বিশ্বজিৎ জিজ্ঞেস করলেন, তোমাদের খানাদানার কী বন্দোবস্ত? এখানকার রিফিউজিদের সঙ্গে খাবে?

আজীব সিং বলল, জি, নেহি। সে জানায়, নিজেদের রসদ চাল ডাল আটা তেল ঘি রশুন পেঁয়াজ মরিচ মশলা আর এক বস্তা আলু সঙ্গে করে নিয়ে এসেছে। হাতিগুলোর জন্যও খাবার আনা হয়েছে। বস্তা বস্তা ছোলা, কলাগাছ, কলার কাদি এবং অন্যান্য বুনো ফল। রসদ ফুরিয়ে গেলে আবার তারা ট্রাক পাঠিয়ে আনিয়ে নেবে। শুধু তা-ই নয়, তাদের থাকার ব্যবস্থাও নিজেরাই করবে। রসদের সঙ্গে অনেকগুলো তবুও এসেছে। সেটেলমেন্টের একধারে সেগুলো খাটিয়ে নিলেই হবে।

ঠিক আছে। তোমরা অনেকদূর থেকে আসছ। এবার কিছুক্ষণ আরাম করে তাবুটাবু বসিয়ে নাও। বিশ্বজিৎ আর দাঁড়ালেন না। বিনয়কে সঙ্গে করে তার ঘরের দিকে এগিয়ে গেলেন।

বিনয়ের মাথায় বল্লা শব্দটা ঘুরছিল। কথাটার মানে সে জানে না। জিজ্ঞেস করল, বল্লা কী?

বিশ্বজিৎ বুঝিয়ে দিলেন যে, বড় বড় গাছ কাটার পর বিশাল আকারের গুঁড়ি এবং মোটা মোটা ডাল চারদিকে ছড়িয়ে রয়েছে সেগুলো হল বল্লা।

হাতি ওগুলো কীভাবে সরাবে?

কাল থেকেই দেখতে পাবেন। বিশ্বজিৎ বললেন, আমাদের। এখানে ক্রেন নেই। হাতিরাই ক্রেনের কাজ করবে।

বিনয় আর কোনও প্রশ্ন করল না।

ওদিকে উদ্বাস্তুরা কিন্তু হাতিগুলোর সঙ্গ ছাড়েনি। খুব সম্ভব একসঙ্গে এত হাতি আগে আর কখনও দেখেনি। নিরাপদ দূরত্বে দাঁড়িয়ে অবাক বিস্ময়ে তারা পাহাড়প্রমাণ প্রাণীগুলোকে লক্ষ করছিল।

হাতিরা উঁচুনিচু পাহাড় ডিঙিয়ে এতটা পথ হেঁটে আসার ধকলে আর দাঁড়িয়ে থাকতে পারছিল না। তারা বসে পড়েছে। কিন্তু জঙ্গলে নিশ্চিন্তে জিরোবার কি উপায় আছে? মশা আর বাড়িয়া পোকার ঝক তাদের হেঁকে ধরেছে। অবিরাম গুঁড়ের ঝাঁপটা মারতে মারতে তারা মশাটশা তাড়িয়ে চলেছে।

বিশ্বজিৎ আজীব সিংদের কিছুক্ষণ আরাম করে নিতে বলেছিলেন। কিন্তু এখন তাদের বসে বসে জিরোবার সময় নয়।

ওদের একজন হাতিগুলোর চারপাশে মশা এবং পোকা মারার ধূপ জ্বালিয়ে দিল। দুজন পাঁচটা কাঠের বিরাট গামলা বোঝাই করে ছোলা, কলা, কলাগাছ ইত্যাদি হাতিদের সামনে এনে রাখল। হাতিপিছু একটা করে গামলা।

পোকা আর মশামারা ধূপ জ্বালাতে অনেক পোকামাকড় লহমায় মরে গেল। বাকি সবাই মহা বিপদের গন্ধ পেয়ে জঙ্গলের। দিকে উধাও। হাতিদের খিদে পেয়েছিল জবর। তারা এখন অপার স্বস্তিতে খাওয়া শুরু করল।

আজীব সিংয়ের বাহিনীর অন্য লোকগুলো বসে নেই। তারা ট্রাক থেকে তাঁবুটাবু নামিয়ে মাটিতে খুঁটি পুঁতে পর পর সেগুলো খাটিয়ে ফেলতে থাকে। কয়েকজন অন্য লটবহর নামিয়ে আনে। তাঁবুগুলোর একধারে একজন মাটি খুঁড়ে উনুন বানিয়ে ফেলে। দুজন জঙ্গলে গিয়ে শুকনো কাঠকুটো জোগাড় করে নিয়ে আসে। শুকনো কাঠই এখানে জ্বালানি।

উদ্বাস্তুদের মধ্যে যারা যুবকযুবতী বা আরও বয়স্ক হাতি দেখার সঙ্গে সঙ্গে আজীব সিংদের কার্যকলাপ খুব মন দিয়ে লক্ষ করছিল। কিন্তু বাচ্চাগুলো এতক্ষণ চুপচাপ থাকার পর হাতিগুলোকে ঘিরে চক্কর দিতে দিতে তুমুল হইচই বাধিয়ে দেয়।

আজীব সিং দুহাত তুলে নাড়তে নাড়তে বলে, বিচ্চেলোগ, চিল্লামিল্লি মত করো। হাঁথি গুসা করেগা তো বহুৎ খতরা হো যায়েগা।

সবাই মোটামুটি আন্দাজে বুঝল, এত চেঁচামেচিতে হাতিদের মেজাজ বিগড়ে যাবে। এই বিশাল প্রাণীগুলো একবার খেপে গেলে রক্ষা নেই; মহা সর্বনাশ ঘটবে।

উদ্বাস্তুদের মধ্যে যারা বয়স্ক, বিপদের গুরুত্বটা তারা বুঝতে পারছিল। তারা চেঁচিয়ে চেঁচিয়ে বাচ্চাকাচ্চাদের ঠান্ডা করে, এই পোলাপানেরা চিল্লাইস না, চিল্লাইস না। হাতি চেতলে (খেপে গেলে) অঁড়ে প্যাচাইয়া (পেঁচিয়ে) আছাড় মাইরা শ্যাষ করব।

বাচ্চাদের হল্লা থেমে যায়।

.

বিনয়কে নিয়ে বিশ্বজিৎ তার ঘরে ফিরে এলেন। বাইরে দিনশেষের ফ্যাকাশে আলো থাকলেও ঘরের ভেতরটা অন্ধকার। তবে পুনর্বাসন বিভাগের কোনও কর্মী লণ্ঠন জ্বালিয়ে তার তেজ কমিয়ে রেখে গিয়েছিল। চাবি ঘুরিয়ে সেটার শিখা বাড়িয়ে দিলেন বিশ্বজিৎ। উজ্জ্বল আলোয় ঘর ভরে গেল।

বিশ্বজিৎ এবার জুতো খুলে বিছানায় শরীর এলিয়ে দিলেন। বললেন, হোল ডে জঙ্গলে ভীষণ ধকল গেছে। একটু রেস্ট নিয়ে নিন।

বিনয়ের হাত-পা যেন আলগা আলগা হয়ে আসছিল। সেও হুড়মুড় করে শুয়ে পড়ল।

কিছুক্ষণ চুপচাপ।

তারপর বিশ্বজিৎ বললেন, কাল তো আমাকে পোর্টব্লেয়ার চলে যেতে হচ্ছে। মাসখানেক বাদে আবার একশো উদ্বাস্তু ফ্যামিলি আসবে। তার বন্দোবস্ত করতে হবে। নিরঞ্জন আর বিভাসকে দু খেপ কলকাতায় রিফিউজি আনতে পাঠিয়েছিলাম। এবার অন্য লোক যাবে। বিভাসদের পোর্টব্লেয়ারে রিহ্যাবিলিটেশন অফিসে প্রচুর কাজ জমে আছে। সেসব ওদের শেষ করতে হবে। সেগুলো আমাকে চেক করে দিল্লিতে পাঠাতে হবে। তাছাড়া আমার কোর্টে অনেকগুলো কেস জমে রয়েছে। আমি না গেলে হিয়ারিং শুরু করা যাবে না।

এসব কথা গতকালও বলেছিলেন বিশ্বজিৎ। বিনয় জিজ্ঞেস করল, কাল কখন যাবেন?

যেতে যেতে বিকেল হয়ে যাবে মনে হচ্ছে।

ওঁদের কথাবার্তার মধ্যে বনবিভাগের একজন কলাই-করা দুটো বড় কাপ বোঝাই করে চা নিয়ে এল। তার সঙ্গে প্রচুর বিস্কুট।

কর্মীটি বর্মি। চায়ের কাপটাপ টেবলে রেখে ঘরের চার কোনায় মশা এবং পোকা মারা ধূল্প জ্বালিয়ে দিল। কেননা সন্ধে নামতে না-নামতেই মশাদের দঙ্গল ঘরে ঢুকতে শুরু করেছে।

চায়ের পেয়ালা থেকে ধোঁয়া উড়ছিল। সটান উঠে বসলেন বিশ্বজিৎ। বললেন, এই বস্তুটির জন্যে মন-প্রাণ অস্থির হয়ে উঠেছিল।বর্মিটিকে দেখিয়ে বলেন, লোকটা বোধ হয় অন্তর্যামী। ঠিক সময় ঠিক জিনিসটি এনে হাজির করেছে। নিন–চা খান।

বিনয়ও এর মধ্যে উঠে পড়েছে। একটু হেসে সে চায়ের পেয়ালা তুলে নিল।

বর্মিট কাজ শেষ করে আর দাঁড়ায়নি। নিঃশব্দে চলে গেছে।

চা খেতে খেতে দুজনের কথা হচ্ছিল। বিশ্বজিৎ বললেন, যদি মনে হয়, আপনাদের কাগজের জন্যে আরও দু-একটা রিপোর্ট লিখবেন, আজই লিখে ফেলুন। কাল আমার সঙ্গে দিয়ে দেবেন।

বিনয় বলল, হ্যাঁ, লিখতে তো হবেই। তবে এক্ষুনি নয়; রাত্তিরে খাওয়া দাওয়ার পর লিখব।

ঠিক আছে।

একটু ভেবে বিনয় এবার জিগ্যেস করে, বলেছিলেন কাকা দু-চারদিনের মধ্যে এখানে এসে পড়বেন। তাকে ভীষণ দরকার। তাঁর কাছ থেকে ব্রিটিশ আমলের আন্দামানের অনেক কথা জানা যেত।

এই কাকা হলেন শেখরনাথ রাহা। বিশ্বজিতের বাবার সবচেয়ে ছোট ভাই। তার কথা আগেই বিশ্বজিতের কাছে শুনেছে বিনয়। শেখরনাথ ছিলেন সশস্ত্র বিপ্লবী। অহিংস নির্বিষ আন্দোলনে ইংরেজ সরকারকে এদেশ থেকে উৎখাত করা যাবে, তিনি বা তার মতো বিপ্লবীরা আদৌ তা বিশ্বাস করতেন না। ভারতের মতো একটা কলোনি থেকে চরকা কেটে, সত্যাগ্রহ বা অসহযোগ আন্দোলন করলে তারা চাটিবাটি গুটিয়ে দেশ থেকে সুবোধ বালকের মতো বিদায় হবে, এসব আকাশ কুসুম কল্পনা। পাগলের প্রলাপও বলা যায়। এই উপমহাদেশের মতো কামধেনু। ফেলে কেউ কি সহজে চলে যেতে চায়! এদের তাড়াতে হলে সশস্ত্র অভ্যুত্থান চাই। তার জন্য চাই বিপুল পরিমাণ অস্ত্র, বন্দুক, রাইফেল, পিস্তল। মুখের কথা খসালেই তো সেসব মুড়ি মুড়কির মতো পাওয়া যায় না। তার জন্য টাকা দরকার। ট্রেন ডাকাতি করে টাকা জোগাড় করতে গিয়ে ধরা পড়ে উনিশশো কুড়ি সালে শেখরনাথ কালাপানির সাজা নিয়ে আন্দামানে এসেছিলেন। পোর্টব্লেয়ারে সেলুলার জেল এবং বঙ্গোপসাগরের দ্বীপপুঞ্জ সম্পর্কে তাঁর বিপুল অভিজ্ঞতা।

তাদের নতুন ভারত-এর চিফ রিপোর্টার, নিউজ এডিটর থেকে শুরু করে কাগজের মালিক জগদীশ গুহঠাকুরতা পর্যন্ত সবাই চান শুধু রিফিউজি সেটেলমেন্টই নয়, সেলুলার জেল, ব্রিটিশ আমলের পেনাল কলোনি ইত্যাদি সম্পর্কেও যেন নিয়মিত প্রতিবেদন পাঠায় বিনয়। ইন্ডিয়ার মেন ল্যান্ডের মানুষজনের কাছে আন্দামান এক অচেনা দ্বীপপুঞ্জ। যেমন ভীতিকর তেমনি রহস্যময়। এই দ্বীপগুলি সম্বন্ধে সবার অপার কৌতূহল। শেখরনাথের সঙ্গে দেখা হলে তার কাছ থেকে সেকালের এবং একালের অজস্র তথ্য জোগাড় করা যাবে।

বিশ্বজিতের সঙ্গে এই নিয়েও অনেক কথা হয়েছে বিনয়ের। তিনি বললেন, জেফ্রি পয়েন্টে নতুন সেটেলমেন্ট বসছে আর। কাকা আসবেন না তাই কখনও হয়। নিশ্চিন্ত থাকুন, দু-একদিনের মধ্যে তিনি ঠিক এসে পড়বেন। এখানকার উদ্বাস্তুরা এখন তার। ধ্যানজ্ঞান।

.

রাত্তিরেও সেটেলমেন্ট অফিসের সামনের খোলা চত্বরে খাওয়া দাওয়ার ব্যবস্থা। দুদিন খিচুড়ি খাওয়ানো হয়েছে। আজ দুপুরে দেওয়া হয়েছিল ভাত ডাল আর সুবয়াই মাছের ঝোল। এবেলা অর্থাৎ রাত্তিরে চাপাটি তরকারি এবং ডাল।

খোলা চত্বরটায় অনেকগুলো গ্যাস বাতি আর হ্যাঁজাক জ্বেলে দেওয়া হয়েছে। আলোয় আলোয় ভরে গেছে সমস্ত এলাকাটা।

বড় বড় কাঠের পরাতে পাহাড় প্রমাণ চাপাটি। প্রকাণ্ড প্রকাণ্ড। ডেকচি বোঝাই ডাল, তরকারি। তরকারি বলতে আলু কুমড়োর ছক্কা। ছক্কার স্বাদ বাড়াবার জন্য প্রচুর আস্ত আস্ত ছোলা দেওয়া হয়েছে।

উদ্বাস্তুরা নিজের নিজের থালা গেলাস হাতে নিয়ে যথারীতি কাতার দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। নিরঞ্জন আর বিভাসের তদারকিতে। ধনপত এবং পুনর্বাসন বিভাগের কর্মীরা তাদের থালায় চাপাটি টাপাটি তুলে দিচ্ছে। খাবার নিয়ে তারা কঁকা জায়গায় চলে যাচ্ছে।

বিশ্বজিৎ বিনয়কে সঙ্গে করে চলে এসেছেন। খাবার নিয়ে। খেতে খেতে তারা কথা বলছিলেন।

মজার গলায় বিনয় জিগ্যেস করল, রিফিউজিদের জন্যে এই সরকারি লঙ্গরখানা কতদিন চালু থাকবে?

বিশ্বজিৎ একটু ভেবে বললেন, দ্যাট ডিপেন্ডস

কথাটা বুঝতে পারল না বিনয়; সে তাকিয়ে থাকে।

বিশ্বজিৎ বললেন, বড় বড় গাছগুলো তো আমরা কেটে দিচ্ছিই। জমি ডিস্ট্রিবিউশনের পর বাকি ঝোঁপঝাড় মাঝারি আর ছোট গাছটাছ কেটে সাফ করবে রিফিউজিরা আপনাকে আগেই তা বলেছি। তারপর যে যার জমির একধারে নিজেদের ঘর তুলে নেবে। চাষের জমির পাশেই বাড়ি। এই বাড়ির সব মেটিরিয়াল বাঁশ টিন দড়ি কাঠগভর্নমেন্ট থেকে দেওয়া হবে।

বিশ্বজিৎ আরও জানালেন, ঘর তোলা হলে অ্যাডাল্টদের মাথা পিছু পঁচিশ টাকা আর মাইনরদের মাথা পিছু কুড়ি টাকা করে। ক্যাশডোল দেওয়া হবে। সেই টাকায় উদ্বাস্তুরা নিজেদের ফ্যামিলি চালাবে। অবশ্য আইরিশ আর আমেরিকান এভাঙ্গেলিস্টরা যে। পাউডার মিল্ক পাঠাচ্ছে সেটা ওদের ফ্রি দেওয়া হবে। তখন রিহ্যাবিলিটেশন ডিপার্টমেন্ট এই কমন কিচেন বন্ধ করে দেবে। আগে যেসব সেটেলমেন্ট বসানো হয়েছে সেসব জায়গাতেও এটা করা হয়েছে।

বিনয় বেশ ধন্দে পড়ে যায়। কিন্তু

 কী?

টাকা না হয় দেওয়া হল, কিন্তু এই জঙ্গলের ভেতর মানুষগুলো চাল ডাল তেল নুন কোথায় পাবে? এখানে তো হাটবাজার কিছু নেই।

বিশ্বজিৎ জানালেন, রিহ্যাবিলিটেশন ডিপার্টমেন্টে একটা কো-অপারেটিভ সেকশন রয়েছে। সেই সেকশনের লোকজন এখানে এসে দোকান বসাবে। পোর্টক্লেয়ার থেকে নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র এনে উদ্বাস্তুদের মধ্যে বিক্রি করবে। না-লাভ, না-লোকসান, এই পদ্ধতিতে।

ওঁদের কথাবার্তার মধ্যেই মোহনবাঁশি, সহদেব, হলধর দাসরা হাতে খাবারের থালা এনে কাছাকাছি এসে দাঁড়ায়। মোহনবাঁশিদের কী একটা যেন বলার আছে কিন্তু বলতে পারছে না। ভয়ে ভয়ে শুধু বিশ্বজিতের দিকে বার বার তাকাচ্ছে।

বিশ্বজিৎ মোহনবাঁশিদের লক্ষ করেছিলেন। জিগ্যেস করলেন, কিছু বলবেন?

মোহনবাঁশি মাথা নেড়ে খুব বিনীত ভঙ্গিতে বলল, হ, স্যার

বেশ তো বলুন না।

 জমিন দেওয়া শুরু হইচ্ছে। তমস্ত (সমস্ত দিন আমাগো যার যার জমিনে কাইটা যাইব। সন্ধ্যার পর আর কুনো কাম নাই। ওই সোময়টা কিছুক্ষণ যদিন আমরা ইট্ট গানবাজনা করি, আপত্ত নাই

সহদেব বলল, দ্যাশ ছাইড়া আসনের সোময় আমি একহান দোতারা লইয়া আইছি। কেও কেও সারিন্দাও আনছে। গান বাজনা করলে মন ভাল থাকব।

চকিতে বিশ্বজিৎ একবার বিনয়ের দিকে তাকালেন। তাঁর চাউনির মধ্যে এমন কিছু রয়েছে যাতে আন্দাজ করা যায় তিনি খুশি হয়েছেন। খুশির কারণটাও মোটামুটি আঁচ করা যাচ্ছে। পরশু রাত্তিরে জারোয়ারা যখন আঁচমকা সেটেলমেন্টে হানা দিয়েছিল, উদ্বাস্তুরা ভয়ে আতঙ্কে পাগলের মতো চেঁচাচ্ছিল; তারা কিছুতেই এই দ্বীপে থাকবে না, কলকাতায় ফিরে যাবে। আজ তারাই কিনা পাহাড়ে-ঘেরা বিজন বনভূমিতে গান বাজনার আসর বসাতে চাইছে। এই সেটেলমেন্টে বাকি জীবন কাটানো যে ওদের ভবিতব্য সেটা ওরা বুঝতে পারছে। এখানে তাদের মন বসতে শুরু করেছে। ভালো লক্ষণ।

বিশ্বজিতের চোখমুখ উজ্জ্বল হয়ে ওঠে। উৎসাহ দেবার সুরে বেশ জোর দিয়েই বললেন, নিশ্চয়ই গাইবেন, বাজাবেন। গ বাজনায় মন ভালো থাকে। যদি আরও কিছু বাজনার জিনি দরকার হয়, যেমন ধরুন হারমোনিয়াম, তবলা, সব সরকার থে কিনে দেওয়া হবে।

মোহনবাঁশির চোখ দুটো উদ্দীপনায় চকচক করছে, তাদে আর্জি যে এত সহজে পূরণ হবে, ভাবতে পারেনি। বল আমাগো মইদ্যে (মধ্যে) কেঠা কেঠা (কে কে) হারমুনি অ তবলা বাজাইতে পারে, একবার খবর লই, হের পর আপনে কমু

আমি তো কালই চলে যাচ্ছি। তবে এখানকার অফিস পরিতোষ বণিক থাকবেন। তাঁকে বলবেন সব ব্যবস্থা হয়ে যাবে

সার (স্যার), ভরসা যহন দিলেন, আর দুইখান কথা কই।

 হ্যাঁ, হ্যাঁ, বলুন।

ফাঁকা চত্বরটার দিকে আঙুল বাড়িয়ে মোহনবাঁশি বলল, আম ওইহানে খুটি কুইপা (পুঁতে), বাঁশের পাটাতন বহাইয়া (বসিয়ে একহান বড় কইরা মাচান বানাইতে চাই।

বিশ্বজিৎ একটু অবাক হলেন। –মাচান দিয়ে কী হবে?

হের উপুর বইসা গীত গামু। কুলোনির মাইনষে ঘিরা বই শুনব।

গীত বাদ্যের একটা পাকাঁপোক্ত বন্দোবস্ত করতে চাই। মোহনবাঁশিরা। মঞ্চ সাজিয়ে তারা আসর বসাবে, কিন্তু শ্রা ছাড়া আসরের তো মানেই হয় না, তাই তাদের ঘিরে বস সেটেলমেন্টের নতুন বাসিন্দারা।

বিশ্বজিৎ বললেন, নিশ্চয়ই মাচান বানিয়ে নেবেন। আর যেন বলবেন?

আইজ রাইতেই খাওয়া দাওয়া সাইরা কিছু সোময় গী গাইতে চাই। বাত্তিগুলান নিভাইয়া না দিলে ভালা হয়। আন্ধা তো গাওন (গাওয়া) যায় না।

না না, আলো অবশ্যই জ্বলবে। আমি বলে দেব। যা আপনারা খেয়ে নিন।

মোহনবাঁশিরা চলে গেল।

.

খাওয়া চুকলে নিজেদের ঘরে চলে এল বিনয়রা। বিশ্বজি বললেন, এবার লেখা শুরু করে দিন।

মশা এবং পোকামাকড় মারা ধূপগুলো জ্বলছিল। কাজে জঙ্গলের দিক থেকে তারা এদিকে ঘেঁষছিল না।

খোলা জানালার ধার ঘেঁষে যে লেখার টেবলটা রয়েছে সেট ওপর একটা লণ্ঠন তুলে কাগজ কলম নিয়ে বসে পড়ল বিনয়।

ওধারের খাটে কাত হয়ে শুয়ে একটা বই খুলে পড়তে লাগলেন বিশ্বজিৎ। বিনয় যতক্ষণ লিখবে, তিনি পড়বেন।

 কয়েক লাইন লেখার পর হঠাৎ হইচই কানে এল। জানালার বাইরে তাকাতেই চোখে পড়ল, ওধারের চত্বরে তুমুল ব্যস্ততা চলছে। উদ্বাস্তুরা তো বটেই, পুনর্বাসন দপ্তরের কয়েকজন কর্মী বিপুল উদ্যমে অনেকটা জায়গা জুড়ে লম্বা লম্বা চট বিছিয়ে লোকজনের বসার ব্যবস্থা করছে। বিভাস, নিরঞ্জন বা পরিতোষরাও গা গুটিয়ে নেই। তাদেরও বিপুল উৎসাহ। কটা হ্যাঁজাক আর গ্যাসবাতি এনে চারপাশে এবং মাঝখানে বসিয়ে দিচ্ছে।

আসর সাজানো শেষ। সেটেলমেন্টের কেউ বাকি নেই; সবাই কে। মাঝখানে খানিকটা অংশ বাদ দিয়ে গোল হয়ে বসে পড়তে শুরু করেছে। বোঝাই যায়, মাঝখানের জায়গাটা বাজনদার আর গাইয়েদের জন্য ফাঁকা রাখা হয়েছে।

একটু পরেই সহদেব, হলধর, মোহনবাঁশি এবং হরিপদ দোতারা সারিন্দা টারিন্দা নিয়ে আসরের মধ্যিখানে বসে পড়ল। খুলনার আছেরপুর গাঁয়ের হরিপদ এবং তার দাদা সোমেন বিশ্বাসকে স্পষ্ট মনে আছে বিনয়ের। রস আইল্যান্ডে রিফিউজি নার কোটা পূর্ণ করার জন্য পঁয়তাল্লিশ মিনিটে যে ছ ছটা বিয়ে দেওয়া হয়েছিল তার মধ্যে হরিপদও ছিল।

যেসব ফ্যামিলি কলকাতা থেকে মহারাজা জাহাজ বোঝাই হয়ে এই খেপে আন্দামানে এসেছে তাদের দু ভাগে ভাগ হয়ে একদল গেছে মিডল আন্দামানে। আরেক দল সাউথ আন্দামানের এই জেফ্রি পয়েন্টে। এদের ভেতর যে হরিপদরা ছিল, আগে খেয়াল করেনি বিনয়। আসলে আন্দামানে পৌঁছুবার পর এত ধকল গেছে, এতসব ঘটনা ঘটেছে যে আলাদা করে হরিপদর কথা তার মাথায় আসেনি।

হরিপদ কী করবে ওখানে? গাইবে? বাজাবে?

মোহনর্বাশি দোতারা আর সহদেব সারিন্দা নিয়ে এসেছিল। একটু পর মোহনবাঁশির আঙুলের টোকায় দোতারা টুং টুং সুরে বেজে ওঠে। ধীর লয়ে সারিন্দায় ছড় টানে সহদেব। ক্রমশ লহর তুলে দুই বাদ্যযন্ত্রের সুর পর্দায় পর্দায় চড়তে থাকে।

ঠিক এই সময় একটা হাত সামনের দিকে বাড়িয়ে গাইতে শুরু করে হরিপদ।

বন্ধু আমার নিধনিয়ার ধন
তারে দেখলে জুড়ায় জীবন যৈবন,
না দেখলে হয় আমার মরণ
 যেদিন হইতে বন্ধুহারা
 আমি হইয়াছি পাগলের পারা গো
আমার দুই নয়নে বহে ধারা
কে করে আমায় বারণ…

রোগাটে গড়নের ভীরু, লাজুক, মুখচোরা, গেঁয়ো যুবকটির এমন এক আকুল করা, সতেজ কণ্ঠস্বর রয়েছে, কে তা ভাবতে পেরেছিল! পদ্মা-মেঘনা-মধুমতী পারের স্মৃতিটাকে বহুদূরের বঙ্গোপসাগরের এই দ্বীপে লহমায় তুলে এনেছে হরিপদ। তিন টার দিকের পাহাড়ে গানের সুরটা প্রতিধ্বনি তুলে চলেছে অবিরল; হাওয়ায় ভেসে যাচ্ছে সমুদ্রের দিকেও। অবাক বিস্ময়ে তাকিয়ে থাকে বিনয়।

ওধারে হাতের বইটা নামিয়ে রেখে উঠে বসেছেন বিশ্বজিৎ। গানটা তাঁকেও প্রবল নাড়া দিয়েছে। নিচু গলায় বললেন, এক্সেলেন্ট! এ একেবারে খাঁটি ইস্ট বেঙ্গলের জিনিস। শহুরে ভেজাল ভাটিয়ালি নয়। চলুন, বাইরে গিয়ে শোনা যাক।

দুজনে বেরিয়ে আসর থেকে একটু দূরে গিয়ে দাঁড়ালেন। ওঁদের দেখলে হরিপদ হয়তো ঘাবড়ে যাবে; গানের সুর তাল কেটে যাবে, তাই খুব কাছে না যাওয়াই ভালো।

হরিপদ আধবোজা চোখে বিভোর হয়ে গেয়ে চলেছে।

বনের আগুন সবাই দেখে
আমার মনের আগুন কেউ না দেখে গো।
আমি বনপোড়া হরিণের মতো
পুড়িয়া হই ছাই যখন।
শিখাইয়া দারুণ পীরিতি
আসলো না মোর প্রাণনিধি গো
সারা জীবন সার হইল।
 সার হইল, গো আমার কান্দন

একের পর এক গান গেয়ে হরিপদ যখন থামল, বেশ রাত হয়ে। গেছে। সে যতক্ষণ গাইছিল তারিফের সুরে শ্রোতারা মাঝে মাঝেই বলে উঠছিল, আহা হা, কী গীতইনা হুনলাম (শুনলাম)! বা ‘পরান খান উথালি পাথালি করে গো’

আসর ভাঙার পর বিশ্বজিৎ আর বিনয় হরিপদর কাছে এগিয়ে যায়। মুগ্ধ গলায় বিশ্বজিৎ বললেন, তুমি তো গুণী লোক হে। একজন সত্যিকারের আর্টিক্ট।

গুণী শব্দটা হরিপদর জানা। কিন্তু আর্টিস্ট কথাটার মানে জানে না। তবে বিশ্বজিৎ যে তার সুখ্যাতি করছেন সেটা বুঝতে পারছিল। সঙ্কোচে সে একেবারে এতটুকু হয়ে যায়। মুখ নামিয়ে বলে, আপনারা আমার হাবিজাবি গান শুনিছেন!

বিশ্বজিৎ বললেন, হাবিজাবি কী বলছ! চমৎকার গেয়েছ।

আরও নুয়ে পড়ল হরিপদ। কী যেন বলতে চাইল; পারল না। গলার ভেতর উত্তরটা আটকে গেল।

বিশ্বজিৎ তার কাঁধে একটা হাত রাখলেন। এতগুলো। মানুষকে আনন্দ দেওয়া, সেটা কি সোজা কথা! সাত পুরুষের ভিটেমাটি ছেড়ে চলে আসতে হয়েছে, সেখানে আর ফিরে যাওয়া যাবে না। এখন এই দ্বীপ তোমাদের দেশ। নিজে আনন্দে থাকো, সবাইকে আনন্দ দাও। মোহনর্বাশি সহদেবদের বললেন, তোমরাও গুণী মানুষ। যেমন বলেছিলে তেমনি রোজ সন্ধের পর আসর বসাবে। অনেক রাত হয়ে গেছে, এবার ব্যারাকে গিয়ে শুয়ে পড়। কাল সকাল থেকে আবার জমি দেওয়া শুরু হবে। বেশি রাত পর্যন্ত জেগে থাকলে তাড়াতাড়ি উঠতে পারবে না।

বিশ্বজিৎও আর দাঁড়ালেন না, বিনয়কে জেনে থাকলে। তাড়াতাড়ি উঠতে পারবে না।

বিশ্বজিৎ আর দাঁড়ালেন না, বিনয়কে সঙ্গে করে নিজের ঘরে চলে এলেন।

বিনয় প্রতিবেদন লিখতে লিখতে উঠে গিয়েছিল। ভেবেছিল ফিরে এসে বাকিটা শেষ করে ফেলবে। কিন্তু এখন আর টেবলে। গিয়ে বসতে ইচ্ছে করছে না। হরিপদর গান আর মোহনবাঁশিদের বাজনার রেশ জেফ্রি পয়েন্টের পাহাড়ে, বনভূমিতে এবং সমুদ্রে এখনও থেকে গেছে যেন। খুব ভালো লাগছে বিনয়ের। হরিপদরা যেন পূর্ববাংলা নামে বহুদূরের এক স্বপ্নের ভূখণ্ডে তাকে ফিরিয়ে নিয়ে গেছে। আজ আর অন্য কাজে মন বসবে না।

পুনর্বাসন দপ্তরের কোনও কর্মী কখন যেন এসে তাদের দুজনের মশারি খাটিয়ে দিয়ে গিয়েছিল। বিনয় টেবলের ওপর যে লণ্ঠনটা জ্বলছিল সেটা নিভিয়ে মশারির ভেতর ঢুকে পড়ল।

বিশ্বজিত শুয়ে পড়লেন। তাঁর খাটের পাশে নিচু টেবলে আরেকটা লণ্ঠন জ্বলছিল। চাবি ঘুরিয়ে সেটা নিভিয়ে দিতে দিতে বললেন, আজ আর লেখাটা কমপ্লিট করা গেল না–তাই তো?

বিনয় বলল, হ্যাঁ, কাল সকালে উঠে ওটা শেষ করব। আসলে হরিপদর গানটা

বিশ্বজিৎ বললেন, খুব সাধারণ চেহারা–মোস্ট আন-ইমপ্রেসিভ। পাশ দিয়ে গেলে কেউ ফিরেও তাকাবে না। কিন্তু ছেলেটার গলায় ম্যাজিক আছে; একেবারে হিপনোটিক। কার ভেতরে কী যে থাকে, মুখ দেখে বোঝা যায় না।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *