৪.১০ কলকাতা থেকে নতুন উদ্বাস্তু

৪.১০

কলকাতা থেকে নতুন উদ্বাস্তু আসার জন্য একটা দিন বিশ্বজিৎ শেখরনাথকে পোর্টব্লেয়ারে আটকে রেখেছিলেন। তারা এসে গেছে। মোহনবাঁশি এখন সম্পূ সুস্থ। তাই শহরে আর থাকার দরকার নেই। পরদিন ভোরে শেখরনাথ মোহনবাঁশি এবং তার বউছেলেমেয়েদের নিয়ে রওনা হলেন। তাদের সঙ্গে বিনয় আর ফোটোগ্রাফার নকুল বিশ্বাসও গেল। পোর্টব্লেয়ার থেকে চল্লিশ মাইল দূরে আন্দামানের গভীর অরণ্য নির্মূল করে জেফ্রি পয়েন্টে যে উপনিবেশ বসানো হচ্ছে সেখানকার একটা ফোটোও এখন পর্যন্ত ‘নতুন ভারত’ অফিসে পাঠানো সম্ভব হয়নি। ওদিকে কলকাতা থেকে চিফ রিপোর্টার প্রসাদ লাহিড়ি প্রতিটি চিঠিতেই ফোটোর জন্য তাগাদা দিচ্ছিলেন। নকুল বিশ্বাস শাদিপুরের প্রচুর ছবি তুলেছে, এবার জেফ্রি পয়েন্ট কলোনির ছবি তুলবে। রিপোর্টের সঙ্গে ছবি ছাপা হলে তা পাঠকের কাছে অনেক বেশি বিশ্বাসযোগ্য হয়ে ওঠে। নকুলকে পাওয়ায় ফোটোর ব্যাপারটার সুরাহা হয়ে যাবে।

কালীপদ জিপে করে সবাইকে চ্যাথাম জেটিতে পৌঁছে দিল। সেখান থেকে লঞ্চে খাঁড়ি পেরিয়ে ওধারের জেটি। জেটির গায়ে একটা ট্রাক দাঁড়িয়ে থাকবে। সেটার ব্যবস্থা করে দিয়েছেন বিশ্বজিৎ। ট্রাকটা শেখরনাথদের জেফ্রি পয়েন্টে পৌঁছে দেবে।

লঞ্চ থেকে নেমে যখন সবাই ট্রাকে উঠল তখন অন্ধকার এবং কুয়াশা পুরোপুরি কাটেনি।

দু’ধারে হাজার বছরের অরণ্য। তার মধ্য দিয়ে পাহাড়ি রাস্তা চড়াই উতরাই এবং অগুনতি বাঁক ঘুরে ঘুরে এগিয়ে গেছে। সেই রাস্তা ধরে পাক খেতে খেতে ট্রাকটা যখন জেফি পয়েন্টের সেটলমেন্টে পৌঁছল, দুপুর পেরিয়ে গেছে।

এলাকাটার দুপাশে উঁচু উঁচু পাহাড়, সেই সব পাহাড়ের গায়ে এবং মাথায় প্রাচীন সব বনস্পতি–প্যাডক, দিদু, চুগলুম ইত্যাদি, সেগুলোকে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে আছে মোটা মোটা বুনো বেত এবং নাম-না-জানা আরও কত রকমের লতা।

পাহাড়গুলোর মাঝখানে বিশাল সমতল এলাকা একসময় দুর্ভেদ্য জঙ্গলে ঢাকা ছিল। কিছুদিন আগে উদ্বাস্তুদের সঙ্গে বিনয় যখন প্রথম আসে সেই জঙ্গলের অনেকটাই সরকার থেকে সাফ করে দেওয়া হয়েছিল পুনর্বাসনের জন্য। সরকারি কর্মীরা বিরাট বিরাট গাছগুলো কেটে দিয়েছে এবং এখনও পুরোদমে জঙ্গল ‘ফেলিং’ চলছে। বড় গাছগুলো কাটার পর জরিপওলারা চেনম্যানদের দিয়ে উদ্বাস্তু পরিবার পিছু পাঁচ একর অর্থাৎ পনেরো বিঘে করে জমি মেপে বাঁশের খুঁটি পুঁতে পুঁতে সীমানা ঠিক করে দিয়েছিল। সরকারি জঙ্গল কাটাইয়ের দল শুধু বড় গাছই কেটেছে, কিন্তু উদ্বাস্তুরা যে জমি পেয়েছে। সেখানকার ছোট, মাঝারি গাছ এবং ঝোঁপঝাড় কাটতে হবে তাদেরই।

এখন, এই পড়ন্ত বেলায় পুরনো উদ্বাস্তুরা যথারীতি জমিতে ঝোঁপজঙ্গল কাটছিল। সমস্ত এলাকা জুড়ে তুমুল ব্যস্ততা।

হঠাৎ ট্রাক থেকে শেখরনাথদের সঙ্গে মোহনবাঁশিদের নামতে দেখে উদ্বাস্তুরা দা কুড়ুল ফেলে শোরগোল করতে করতে ছুটে এল। এই সেটলমেন্টের সি. এ অর্থাৎ কলোনাইজেশন অ্যাসিস্ট্যান্ট পরিতোেষ বণিক, চেনম্যান ধনপত, পুনর্বাসন দফতরের বাঙালি এবং বর্মী কর্মীরা চলে এসেছে।

সুস্থ মোহনবাঁশিকে দেখে উদ্বাস্তুরা যেমন খুশি তেমনি উত্তেজিত। ফুসফুসে জারোয়াদের তির-বেঁধা যে মোনহবাঁশিকে কয়েকদিন আগে শেখরনাথ আর বিনয় পোর্টব্লেয়ারের হাসপাতালে নিয়ে গিয়েছিল সে যে কোনও দিন জীবন্ত অবস্থায় ফিরে আসবে, কেউ ভাবতে পারেনি। সবাই একসঙ্গে কথা বলছিল।

একজন বলল, ‘মোহনবাশি ভাই, যমের মুখ থিকা তুমি ফিরা আইলা। কী আনন্দ যে অইতে (হইতে) আছে, কইয়া বুঝাইতে পারুম না।‘

আরেকজন বলল, ‘তুমার লক্ষ বচ্ছর পরমায়ু হউক।‘

এইরকম চলছেই।

মোহনবাঁশি শেখরনাথকে দেখিয়ে বলল, ‘বাইচা (বেঁচে) যে গেছি, এই বড়কত্তার লেইগা। উনি মানুষ না, ভগমান।‘ জেফ্রি পয়েন্টের উদ্বাস্তুরা শেখরনাথকে কেউ বড়কর্তা বলে, কেউ বলে কাকা।

কে একজন বলল, ‘আইজ আর কাম কাইজ (কাজকর্ম করুম না। মোহনবাঁশি ভাইয়েরে কাছে পুট বিলাসে (পোর্টব্লেয়ারে) লইয়া যাওনের পর কী কী অইল (হল), ডাক্তারবাবুরা কেমনে হ্যাঁরে (তাকে) বাঁচাইল, বেবাক বিত্তান্ত হুনুম (শুনব)।‘

পরিতোষ বণিক শেখরনাথের পাশে দাঁড়িয়েছিল, নিচু গলায় জিগ্যেস করল, ‘আপনেরা তো হেই (সেই) ভুরে (ভোরে) বাইর অইয়া (হয়ে) আইছেন। দুফারে (দুপুরে) খাওন অয় (হয়) নাই।‘

শেখরনাথ উত্তর দিকে তাকিয়ে ছিলেন। অন্যমনস্কর মতো বললেন, ‘পাহাড় আর জঙ্গলের ভেতর দিয়ে এসেছি। ভাত কোথায় পাব? তোমাদের হাঁড়িতে আমাদের ক’জনের মতো কিছু আছে কি?’

আস্তে মাথা নাড়াল পরিতোষ।–’না, নাই। অহনই (এখনই) রান্ধনিগো (রাধুনেদের) আখা (উনুন) ধরাইয়া ভাত চাপাইয়া দিতে কই (বলি)।‘ সে দৌড়ে চলে গেল।

শেখরনাথ বিনয় আর নকুলকে বললেন, ‘চল তো আমার সঙ্গে।‘ বলে সোজা উত্তর দিকে হাঁটতে শুরু করলেন।

বিনয় বা নকুল কেউ কোনও প্রশ্ন করল না, তার পিছু পিছু এগিয়ে চলল।

খানিকটা যাওয়ার পর শেখরনাথ বিনয়কে বললেন, ‘একটা ব্যাপার তোমার চোখে পড়েছে কি?’

অবশ্যই পড়েছিল। বিনয়রা যে ক’দিন পোর্টব্লেয়ারে ছিল তার মধ্যে উত্তর দিকে বহু দূর পর্যন্ত জঙ্গল কেটে জমি বের করা হয়েছে। আগের সীমানা থেকে প্রায় আধ মাইল জুড়ে একটা বড় গাছও আর নেই। মাটি থেকে দু’তিন হাতের মতো রেখে ওপরের গুঁড়ি এবং ডালপালা কেটে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। গুঁড়িগুলোর নিচের দিকের যে অংশ এখনও রয়েছে, সেগুলোতে বঁড়শির আকারের লোহার বিরাট বিরাট আংটা গেঁথে দিয়ে লম্বা লম্বা ভারী শেকল লাগিয়ে দেওয়া হয়েছে। পরে ফরেস্ট ডিপার্টমেন্টের হাতি এনে শেকলের অন্য প্রান্তটা তাদের পায়ে শক্ত করে বেঁধে দেওয়া হবে। এই সব ট্রেনিং পাওয়া হাতি গুঁড়িগুলোর বাকি অংশ শিকড়-বাকড় সুদ্ধ টেনে উপড়ে ফেলবে।

জঙ্গলের ভেতর দিয়ে যে কাল্পনিক পেরিমিটার রোড এতদিন ছিল, জঙ্গল কাটার পর সেটা উত্তর দিকে অনেক দূর পিছিয়ে গেছে। এই পেরিমিটার রোড ধরে পঞ্চাশ ষাট গজ পরপর উঁচু উঁচু বাঁশের টঙ। ওগুলোতে বসে বুশ পুলিশ রাতদিন চব্বিশ ঘণ্টা পাহারা দেয়। কেননা টঙগুলোর ওধারের জঙ্গলে থাকে জারোয়ারা। যে কোনও মুহূর্তে তারা জেফ্রি পয়েন্টের উদ্বাস্তু কলোনিতে হানা দিতে পারে।

পেরিমিটার রোডের কাছাকাছি চলে এসেছিলেন শেখরনাথ আর বিনয়। শেখরনাথ বললেন, ‘রিহ্যাবিলিটেশন ডিপার্টমেন্টের বড় বড় অফিসার, এমনকি চিফ কমিশনারের কাছে আর্জি জানিয়েছিলাম উত্তর-দিকের জঙ্গল যা কাটা হয়েছে–হয়েছে। আর যেন কাটা না হয়। পূর্বদিকে জারোয়া নেই, ওখানকর ফরেস্ট বরং কাটা হোক। কিন্তু আমার কথা কেউ শুনল না। এর ফলে জারোয়াদের এরিয়াটা অনেক ছোট হয়ে গেল। যেভাবে ‘ফেলিং’ চলছে আরও অনেকটা জঙ্গল ধ্বংস হয়ে যাবে। এর প্রতিক্রিয়া কী হবে জানো?

বিনয় নিঃশব্দে তার দিকে তাকাল।

করুণ ব্যথিত দৃষ্টিতে উত্তর দিকটা দেখতে দেখতে শেখরনাথ বললেন, ‘জারোয়ারা আরও হিংস্র, আরও মরিয়া হয়ে উঠবে।’ হতাশায় মাথা নাড়তে লাগলেন, ‘না, কিছুই করা গেল না। চল, ফেরা যাক।’

.

৪.১১

নতুন ছত্রিশটা উদ্বাস্তু পরিবার আসার পর পুরনো উদ্বাস্তুরা জমির কাজ বন্ধ করে দিয়েছিল। ব্যারাকগুলোর সামনে এসে তারা নতুন ফ্যামিলিগুলোর লোকজনকে ঘিরে ধরল। তাদের অনন্ত কৌতূহল। আজ যারা এসেছে তারা প্রতিবেশী হবে। এখানে পরিবার পিছু পাঁচ একর করে জমি পেয়ে নতুন করে ঘর-সংসার গুছিয়ে বসবে। জেফ্রি পয়েন্টেরই স্থায়ী বাসিন্দা হয়ে যাবে।

পুরনোদের অনেকেই নতুনদের জিগ্যেস করছিল।

‘কতদিন অইল বডারের এইধারে আইছ?’

‘দ্যাশ আছিল কুনহানে (কুথায়)? কুন জিলায়?’

‘কলকাতায় আইয়া (এসে) কই (কোথায়) আছিলা?’

এই ধরনের হাজারটা প্রশ্ন।

দেখতে দেখতে সন্ধে নেমে গেল। পুনর্বাসনের কর্মীরা বড় বড় লণ্ঠন, গ্যাসবাতি আর বেশ ক’টা হ্যাঁজাক জ্বেলে দিয়েছে। ব্যারাকগুলোর পাশের অ্যাসবেস্টসের ছাউনির তলায় রান্না করার তোড়জোর চলছে পূর্ণোদ্যমে। সাতটা মস্ত মস্ত উনুন জ্বালিয়ে দেওয়া হয়েছে। তিন চারজন ক্ষিপ্র হাতে গোছা গোছা রুটি সেঁকছে। দু’জন প্রকাণ্ড প্রকাণ্ড কড়াইতে ডাল তরকারি বসিয়ে হাতা দিয়ে নাড়ছে। ইউরোপ-আমেরিকা যে চ্যারিটেবল অর্গানাইজেশনগুলো বাক্স বাক্স গুড়ো দুধ পাঠায়, দু’জন ঢাউস ঢাউস সিলভারের পাত্রে সেগুলো গুলে জ্বাল দিচ্ছে। ভোজ্য বস্তুগুলো তৈরি হয়ে গেলেই উদ্বাস্তুদের, বিশেষ করে আজ যারা এসেছে, তাদের খেতে বসিয়ে দেওয়া হবে। কেননা সেই কোন ভোরবেলায় এবারডিন মার্কেটের ট্রানজিট সেন্টার থেকে পাহাড় জঙ্গল ভেদ করে তাদের আনা হয়েছে। সকালে হয়তো কিছু খেয়ে এসেছে, তারপর এই সন্ধে অবধি পেটে কিছুই পড়ে নি। খিদেয় বুড়োধুড়ো বাচ্চাকাচ্চা ছাড়াও বাকি সবাই বেজায় কাহিল হয়ে পড়েছে।

বিভাস আর নিরঞ্জন পোর্টব্লেয়ারে নতুন উদ্বাস্তুদের নিয়ে এসেছিল। তাদের সঙ্গে বিভাস জেফ্রি পয়েন্টে এসেছে। গলার স্বর উঁচুতে তুলে সে হাত নাড়তে নাড়তে বলল, ‘পাহাড়ের উচানিচা (উঁচুনিচু) পথ ভাইঙ্গা অ্যাতখানি দূরে অরা আইছে (এসেছে) ওগো (ওদের) শরীলের উপুর দিয়া মেলা (অনেক) তাফাল (ধকল) গ্যাছে। আইজ (আজ) ছাইড়া দাও; অরা খাইয়া দাইয়া ঘুমাউক (ঘুমোক)। কাইল (কাল) যত ইচ্ছা কথা কইও।

পায়ে পায়ে বিনয়ও উদ্বাস্তুদের কাছে চলে এসেছিল। হঠাৎ ভিড়ের মধ্যে শীর্ণ, পাকানো চেহারার সেই লোকটাকে অর্থাৎ সনাতন দাসকে দেখতে পেল। পরশু তাকে ‘রস’ আইল্যান্ডে দেখেছিল সে। নব্বইটা পরিবারের মধ্যে তাকে আলাদা করে মনে রাখার কথা নয়। তবু বিনয়ের যে মনে আছে তার কারণ সনাতনের অদ্ভুত রোগা শীর্ণ চেহারার জন্য। তা ছাড়া, এই দ্বীপে যারাই পুনর্বাসনের জন্য এসেছে তাদের সকলেরই বউছেলেমেয়ে বা বুড়ো বাপ-মা, ভাইটাই আছে। কিন্তু বিশ্বব্রহ্মাণ্ডে সানতনের কেউ নেই। স্বজন-পরিজনহীন সনাতনের নিজেকে নিয়েই একটা ফ্যামিলি।

পরিতোষ বণিক, ধনপত এবং পুনর্বাসন ডিপার্টমেন্টের অন্য কর্মীরাও চলে এসেছিল। বিভাসের মতোই তারাও, বিশেষ করে পরিতোষ পুরনো রিফিউজিদের চলে যেতে বলে নতুনদের নিয়ে লম্বা ব্যারাকগুলোর দিকে এগিয়ে গেল। একটা ব্যারাকও ফাঁকা নেই। নতুন ছত্রিশটা পরিবারকে পুরনো উদ্বাস্তুতে বোঝাই ব্যারাকগুলোতেই থাকার ব্যবস্থা করে দিল। ব্যারাকটার পাশে আগে থেকে বিরাট বিরাট ড্রামে জল ভরে রাখা ছিল। প্রচুর আলোরও ব্যবস্থা করা আছে।

পরিতোষ নতুন উদ্বাস্তুদের বলল, ‘তোমরা হাত-মুখ ধুইয়া লও। রান্ধন অইয়া (হয়ে) আইছে। আধা ঘণ্টার মইদ্যে খাওনেরটা (খাবার) দেওয়া অইব (হবে)।‘

.

জেফ্রি পয়েন্টে উদ্বাস্তুদের ব্যারাকগুলো থেকে খানিকটা দূরে পাশাপাশি আলাদা দুটো সাজানো-গোছানো ঘর আছে। পোর্টব্লেয়ার থেকে বিশ্বজিৎ রাহা বা পুনর্বাসন বিভাগের বড় অফিসাররা জেফ্রি পয়েন্টে এসে এখানেই থাকেন। আপাতত কিছুদিন শেখরনাথ এবং বিনয়কে একটা ঘর দেওয়া হয়েছে। অন্য ঘরটা দেওয়া হল ফোটোগ্রাফার নকুল বিশ্বাসকে।

রাত্তিরে খাওয়াদাওয়ার পর জেফ্রি পয়েন্টের বাসিন্দারা শুয়ে পড়েছিল। ব্যারাকগুলো নিস্তব্ধ, সারাদিন খাটাখাটুনির পর খাওয়া চুকে গেলেই পুরনো রিফিউজিরা আর এক লহমাও জেগে থাকতে পারে না। বিছানায় গা ঢেলে দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে চোখ বুজে আসে। নতুন যারা এসেছে, তাদের ব্যারাক তো বটেই, পুনর্বাসন ডিপার্টমেন্টের কর্মীরা যে ব্যারাকটায় থাকে সেখান থেকেও এতটুকু সাড়াশব্দ পাওয়া যাচ্ছে না। পুরো কলোনিটাই ঘুমিয়ে পড়েছে।

বিনয় আর শেখরনাথও তাদের ঘরে শুয়ে পড়েছেন। খানিকটা ফাঁকা জায়গা রেখে উলটোদিকের দেওয়ালের পাশে শেখরনাথের খাট। মোহনবাঁশিকে পোর্টব্লেয়ারের হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার আগে এই ঘরে দু’জনে কয়েক দিন কাটিয়ে গেছে। রাত্তিরে কাছাকাছি শুয়ে আন্দামানের সেলুলার জেলের, দেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের কত অজানা কাহিনি শোনাতেন শেখরনাথ। সে সবই রোমাঞ্চকর, শিহরন-জাগানো।

আজ কিন্তু ব্রিটিশ আমলের প্রাচীন বিপ্লবীটি একেবারে চুপচাপ। ঘরের কোণে একটা নিবু নিবু। হ্যারিকেন জ্বলছে। সেই নিস্তেজ আলোয় দেখা গেল তার চোখ দুটো বোজা। অল্প অল্প নাক ডাকছে। ক’দিন পোর্টব্লেয়ারে প্রচণ্ড দৌড়ঝাঁপ গেছে, তারপর এতদূরের কলোনিতে আসা। হাজার হোক বয়স তো হয়েছে। যতই মনের জোর থাক, এত ধকল সামলাতে তাঁর মতো বয়স্ক লোকের পক্ষে সমস্যাই। শোওয়ার সঙ্গে সঙ্গে এমন টগবগে মানুষটিও ঘুমিয়ে পড়েছেন।

সমুদ্রগর্জন আর নাম না-জানা রাত-জাগা পাখিদের হঠাৎ হঠাৎ ডেকে ওঠা ছাড়া কোথাও কোনও শব্দ নেই, ঘরের নিবন্ত হ্যারিকেনটা ছাড়া কোথাও কোনও আলোও নেই।

পৃথিবীর এই সৃষ্টিছাড়া ভূখণ্ডটি ঘুমের আরকে ডুবে আছে। শুধু ঘুম নেই বিনয়ের। আগে ততটা খেয়াল করেনি, কিন্তু খেয়ে দেয়ে বিছানায় শরীর এলিয়ে দেওয়ার পর থেকে গা ম্যাজম্যাজ করতে শুরু করেছে। মাথা ভার। জ্বর আসবে কিনা, কে জানে।

জানলার বাইরে তাকিয়ে ছিল বিনয়। যতদূর চোখ যায়, কুয়াশা অন্ধকার। আজ কী তিথি, জানা নেই। খুব সম্ভব আকাশে চাঁদ আছে, কুয়াশা-টুয়াশা ভেদ করে তার ঘোলাটে আলো এসে পড়েছে লক্ষ লক্ষ মাইল নিচের এই পৃথিবীতে। ( এলোমেলো, অর্থহীন নানা ভাবনা হালকা মেঘের মতো ভেসে বেড়াচ্ছিল বিনয়ের মাথায়। আচমকা সে সব ঠেলে সরিয়ে ঝিনুকের চিন্তাটা ঢুকে গেল।

মনে পড়ল লা-পোয়ে সেদিন পোর্টব্লেয়ারে বলেছিল, খুব শিগগিরই তারা জেফ্রি পয়েন্টে চলে আসবে। এখানে কয়েকটা দিন কাটিয়ে তাদের বোটে বিনয়কে তুলে মিডল আন্দামানে নিয়ে যাবে। এমনকি তারা ভরসা দিয়েছে, সেখানকার রিফিউজি কলোনিগুলোতে বিনয়কে শুধু পৌঁছে দেবে না, আবার জেফ্রি পয়েন্টে ফিরিয়ে আনবে। কিন্তু কবে আসবে লা-পোয়েরা?

ভাবতে ভাবতে মাঝরাতে পার করে একসময় চোখ বুজে এল বিনয়ের।

.

খুব ভোরে ওঠা চিরকালের অভ্যাস বিনয়ের। দেশে থাকতে দাদু হেমনাথ মিত্র তাঁকে সুর্যোদয়ের আগেই জাগিয়ে দিতেন। সেটাই পরে অভ্যাসে দাঁড়িয়ে যায়। কিন্তু আজ কতক্ষণ ঘুমিয়েছিল খেয়াল নেই, হঠাৎ আবছাভাবে বাইরে কোথাও হইচই চেঁচামেচির আওয়াজে ঘুমটা ভেঙে গেল। চোখে পড়ল অনেক বেলা হয়ে গেছে। কুয়াশা-টুয়াশা উধাও, তপ্ত রোদে ভরে গেছে চারিদিক।

ঘুম ভাঙলেও তার রেশটা এখনও পুরোপুরি কাটেনি, আওয়াজটা কোত্থেকে আসছে, প্রথমটা বুঝতে পারল না। কিছুক্ষণ পরেই টের পেল, জঙ্গল কেটে যেখানে উদ্বাস্তুদের জমি দেওয়া হয়েছে সেখানে বহু লোক একসঙ্গে তুমুল শোরগোল বাধিয়েছে। কী হতে পারে?

খাট থেকে নামতে গিয়ে বিনয় লক্ষ করল ওধারের খাটটা ফাঁকা। সে টের পায়নি শেখরনাথ কখন বেরিয়ে গেছেন।

বিনয় ঘরের বাইরে এসে লম্বা লম্বা পায়ে উত্তর দিকে যেতে যেতে দেখতে পেল কলোনির প্রায় সবাই সেখানে জড়ো হয়ে উত্তেজিতভাবে একটানা চেঁচিয়ে চলেছে। নিশ্চয়ই কোনও অঘটন ঘটেছে। বিনয় চলার গতি বাড়িয়ে দিল। তার পেছন পেছন পরিতোষ, আমিন লা-ডিন, চেনম্যান ধনপত এবং রিহ্যাবিলিটেশন ডিপার্টমেন্টের আরও কয়েকজন ছুটতে ছুটতে আসতে লাগল।

বিনয় লক্ষ করল আরও উত্তরে পেরিমিটার রোডের দিক থেকে হাঁটু অবধি ধুতি তুলে হনহন করে হেঁটে আসছেন শেখরনাথ। খুব সম্ভব সকালে উঠে জঙ্গল কেটে জারোয়ারদের সীমানা আজ আরও কতটা ছোট করা হচ্ছে সেটা দেখতে গিয়েছিলেন। জারোয়ারদের ব্যাপারটা মাথা থেকে কিছুতেই বের করে দিতে পারছেন না। শোরগোল শুনে সচকিত শেখরনাথ এখন উধ্বশ্বাসে পা চালাচ্ছেন।

শেখরনাথ, বিনয় এবং পুনর্বাসনের কর্মীরা প্রায় একই সঙ্গে পৌঁছে গেল। রিফিউজিরা গোল হয়ে দাঁড়িয়ে বৃত্তের ভেতর কিছু একটা লক্ষ করতে করতে সমানে চেঁচিয়ে যাচ্ছে। শেখরনাথদের দেখে তারা সরে সরে পথ করে দিল। দৃশ্যটা এইরকম।

সেই পাকানো, ক্ষয়াটে চেহারার সনাতন দাস একটা লম্বা-চওড়া জোয়ান ছেলেকে চিত করে ফেলে তার বুকের ওপর চেপে বসে সাঁড়াশির মতো দুই হাতে গলা টিপে ধরেছে। প্রচণ্ড আক্রোশে সনাতনের মুখটা গনগন করছে, গর্তে-বসা চোখ থেকে আগুন ঠিকরোচ্ছে। মনে হয় সনাতনের ওপর কোনও দানব ভর করেছে।

যুবকটিকে বিনয় চেনে। কিছুদিন আগে তার সঙ্গে এই জেফ্রি পয়েন্টেই পরিচয় হয়েছিল। নাম বৃন্দাবন বসাক। তার বয়স কম, তরতাজা চেহারা। ইচ্ছা করলে সনাতনকে সে আছাড় মেরে হাড়গোড় চুরমার করে দিতে পারে। কিন্তু বৃন্দাবনের সেরকম কোনও ইচ্ছাই যেন নেই। তার চোখ ঠিকরে বেরিয়ে আসছে। দম বন্ধ হয়ে যাচ্ছিল, তবু সনাতনকে ঠেলে সরিয়ে দিচ্ছে না। ওদের পাশে বৃন্দাবনের ভারী সুন্দর বউটি, যার নাম মায়া, মুখে কাপড় গুঁজে অঝোরে কেঁদে চলেছে।

কয়েকজন উদ্বাস্তু সনাতনের হাত ধরে টানাটানি করে ছাড়াবার চেষ্টা করছে, কিন্তু পারছে না। সনাতন শুধু গলা টিপেই ধরে নেই, একটানা কুৎসিত গালাগালিও দিয়ে যাচ্ছে।’শুয়োরের ছাও, তরে (তোকে) আমি যমের বাড়ি না পাঠাইয়া ছাড়ুম না। তর কইলজা (কলিজা) ফাইড়া রক্ত খামু।

সনাতন তো সবে কাল জেফ্রি পয়েন্টে এসেছে। বৃন্দাবনরা এসেছে অনেক আগে। তার ওপর সনাতনের এত ক্রোধ, এত আক্রোশ কেন? মাথামুণ্ডু কিছুই বুঝতে পারছিল না বিনয়। বিমূঢ়ের মতো সে তাকিয়ে আছে।

শেখরনাথ হাত তুলে উদ্বাস্তুদের হল্লা থামিয়ে দিয়ে গম্ভীর গলায় সনাতনকে ধমকে উঠলেন, ‘এই, ওকে ছেড়ে দাও, ছাড় বলছি—’

সনাতন ছাড়ল না। শেখরনাথের ধমকানি তার কানে ঢুকেছে বলে মনে হল না।

শেখরনাথ এবার লা-ডিন আর ধনপতকে বললেন, ‘তোমরা ওদের ছাড়িয়ে দাও

লা-ডিন এবং ধনপত, দু’জনেরই ছ’ফিটের ওপর হাইট, চল্লিশ ইঞ্চির মতো বুকের ছাতি, শরীরে অসীম শক্তি। তারা সনাতনকে দুই হাত ধরে এক হ্যাঁচকা টানে বৃন্দাবনের বুকের ওপর থেকে তুলে আনল।

এদিকে পুনর্বাসনের দু’জন কর্মী কোত্থেকে দুটো চেয়ার নিয়ে এসেছিল শেখরনাথ আর বিনয়ের জন্য। তারা বসে পড়লেন।

সনাতন লা-ডিনদের হাত থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে বৃন্দাবনের ওপর ফের চড়াও হওয়ার জন্য প্রাণপণে চেষ্টা করছিল।–’আমারে ছাইড়া দ্যান, ছাইড়া দ্যান—’

শেখরনাথ বললেন, ‘ছেড়ো না। ধরে রাখো—’ সনাতনকে জিগ্যেস করলেন, কেন তুমি বৃন্দাবনের গলা টিপে ধরেছিলে?

সনাতন গলা থেকে বিষ উগরে দিল।–’উই খানকির পুত আমার বউরে ভাগাইয়া লইয়া আন্ধারমানে (আন্দামানে) পলাইয়া আইছে। ওই যে মাগি মুহে (মুখে) কাপড় গুইজা কানতে (কাঁদতে) আছে ও আমার বউ। মাগি বেবুশ্যার থিকাও খারাপ কত্তা।‘

শেখরনাথ হকচকিয়ে গিয়েছিলেন। বিনয় এবং অন্য সবাই হতভম্ব। এমন একটা সুন্দরী মেয়ে সনাতনের মতো গাল-ভাঙা, খাড়া খাড়া চুল, আধাবয়সি সনাতনের স্ত্রী হতে পারে, এটা ভাবাই যায় না।

শেখরনাথ তার গাম্ভীর্য বজায় রেখে সনাতনকে বললেন, ‘মুখ থেকে আর একটা নোংরা কথাও বের করবে না। যদি না শোন, লা-ডিনরা তোমার ছালচামড়া তুলে ফেলবে।‘

এবার ডুকরে কেঁদে উঠল সনাতন। –’কত্তা, সাধে কি আর মুহ (মুখ) থিকা গালি বাইর অয় (বেরোয়)? আমার কী সব্বনাশটা ওই শয়তানে করছে, একবার ভাইবা (ভেবে) দ্যাহেন (দেখেন)?’

শেখরনাথের দৃষ্টি এবার বৃন্দাবনের ওপর গিয়ে পড়ল।–’সনাতন যা বলছে তা কি ঠিক?’

সনাতনের হাত থেকে মুক্তি পেয়ে বৃন্দাবন উঠে বসেছিল। জোরে জোরে বেশ কিছুক্ষণ শ্বাস টেনে স্বাভাবিক হয়ে উঠতে শুরু করেছে। সে অপরাধীর মতো মুখ নামিয়ে রইল।

শেখরনাথ তীক্ষ্ণ চোখে তাকে লক্ষ করছিলেন। মায়াকে দেখিয়ে ফের জিগ্যেস করলেন, এই মেয়েটি কি সত্যিই তোমার বিয়ে-করা বউ?

বৃন্দাবনের মাথা আরও নুয়ে পড়ল। মায়া একনাগাড়ে কেঁদেই যাচ্ছিল। আর কান্নার তোড় হঠাৎ কয়েক গুণ বেড়ে গেল।

শেখরনাথ কড়া গলায় বৃন্দাবনকে বললেন, ‘চুপ করে থাকলে চলবে না। যা বললাম তার উত্তর দাও। আসল ব্যাপারটা কী, আমাকে জানাও।‘

সনাতন জ্বলন্ত চোখে বৃন্দাবনের দিকে তাকিয়ে আছে। সে বলল, ‘অর (ওর) কইলজায় (কলিজায়) কি সাচা (সত্যি) কথা কওনের (বলার) সাহস আছে? আমিই আপনেরে কই (বলি) কত্তা—’

কী ভেবে শেখরনাথ বললেন, ‘আচ্ছা, বল—’

সনাতন শুরু করল। তাদের আদি বাড়ি ছিল ফরিদপুরে। দেশভাগের পর পাকিস্তানে থাকা গেল না। সংসারে তার স্ত্রী মায়া এবং সে ছাড়া অন্য কেউ নেই। লক্ষ লক্ষ ছিন্নমূল মানুষের সঙ্গে তারাও কলকাতায় চলে আসে। ফরিদপুরে নিজেদের গ্রাম এবং আশপাশের কয়েকটা এলাকা ছাড়া জন্মের পর থেকে দূরে আর কোথাও যায়নি সনাতন। কলকাতার মতো বিশাল শহরে এসে একেবারে দিশাহারা হয়ে পড়েছিল।

শিয়ালদা স্টেশনের প্ল্যাটফর্মগুলোতে, এবং সামনের বিরাট চত্বরে সাত-আট হাত লম্বা এবং ছ’সাত হাত চওড়া চৌকো জায়গার চারপাশে ইট বসিয়ে সীমানা তৈরি করে কয়েক শ’ উদ্বাস্তু ফ্যামিলি থাকে, সরকারি-বেসরকারি লঙ্গরখানায় গিয়ে খায়।

সনাতন তার বউ মায়াকে নিয়ে এইরকম একটা ছোট জায়গায় কোনওরকমে ঘাড় গুঁজে থাকত। তাদের ঠিক পাশের খোপটায় ছিল বৃন্দাবনরা। সে থাকত তার খুড়াখুড়ি (কাকা-কাকিমা) আর দুই খুড়তুতো ভাইবোনের সঙ্গে। তার বাপ-মা রায়টে মারা গেছে। ওদের বাড়ি ঢাকা ডিস্ট্রিক্টে।

বছরখানেক শিয়ালদায় কাটানোর পর বৃন্দাবনের খুড়াখুড়িরা যাদবপুর-নাকতলার কাছে জবরদখল কলোনিতে খানিকটা জমি জোগাড় করে চলে যায়। কিন্তু বৃন্দাবন শিয়ালদা স্টেশনের মাটি কামড়ে পড়ে রইল। সে কিছুতেই জবরদখল কলোনিতে যাবে না। তখন কি সনাতন জানত তলায় তলায় মায়ার সঙ্গে বৃন্দাবনের পিরিত শুরু হয়েছে। এদিকে সরকারি কর্তারা আন্দামানে পাঠানোর জন্য রোজ শিয়ালদা স্টেশনে এসে ছিন্নমূল মানুষগুলোকে সমানে বোঝাচ্ছে। একদিন সনাতনের চোখে ধুলো ছিটিয়ে মায়াকে নিয়ে উধাও হয়ে যায় বৃন্দাবন। সনাতন উন্মাদের মতো মায়ার অনেক খোঁজ করেছে। কিন্তু তার হদিশ পায়নি। শেষ পর্যন্ত সেও আন্দামানে পুনর্বাসনের জন্য চলে এসেছে। যা কখনও ভাবতে পারেনি, জেফ্রি পয়েন্টে এসে তারই সন্ধান পেল।

সনাতন বলতে লাগল, ‘কাইল (কাল) সন্ধ্যায় আমরা এহানে (এখানে) আইছি। আইজ (আজ) সকালে ঘুম থিকা উইঠা চা-চু (চা এবং খাবার) খাইয়া ভাবলাম নয়া জাগাহান (জায়গাটা) কেমুন, এটু ঘুইরা দেহি (দেখি)। ঘুরতে ঘুরতে দ্যাখলাম উই দুই হালা হালি (শালা-শালী) খ্যাতে (জমিতে) কাম করতে আছে। মাথায় য্যান (যেন) আগুন ধইরা গেল। বিন্দাবনের উপুর ঝাপাইয়া পইড়া গলার নলি জাইতা (টিপে) ধরলাম। কথা শেষ করে হাঁপাতে লাগল সনাতন। একটু পর আবার বলল, ‘হগল (সকল) খুইলা কইলাম। অহন (এখন) বিচার করেন কত্তা।‘

শেখরনাথ সোজাসুজি মায়ার দিকে তাকালেন।’সনাতন এতক্ষণ যা বলল তা কি ঠিক?

যে মেয়েটা ভয়ে লজ্জায় আতঙ্কে কুঁকড়ে ছিল, সমানে কাঁদছিল, আচমকা সে সটান দাঁড়িয়ে পড়ল। বলল, ‘হ, ঠিকই কইছে।‘ তারপর সনাতনের দিকে আঙুল বাড়িয়ে দিল।–’অরে কয়ডা কথা জিগান (জিগ্যেস করুন) বড় কত্তা। দ্যাশে (দেশে) থাকতে নিশাভাং (নেশাভাং কইরা আমারে রোজ পিটাইত না? সোক্সার (সংসার) খরচের টাকাপয়সা দিত না। কতদিন না খাইয়া উপাস দিয়া যে থাকছি! তভু অরে (ওকে) ছাইড়া যাই নাই। কিন্তুক কইলকাতায় আইয়া যহন (যখন) বুঝলাম মাইয়ামাইনষের দালালগো কাছে আমারে বেইচা (বেচে) দেওনের (দেওয়ার) মতলব করছে করছে তহন (তখন) বিন্দাবনের লগে পলাইয়া আন্ধারমানে চইলা আইছি। নাইলে (না হলে) এতদিনে আমি বাজাইরা মাইয়ামানুষ (বেশ্যা) অইয়া (হয়ে) যাইতাম। বিন্দাবন আমারে বাঁচাইয়া দিছে। অহন আইছে সোয়ামিগিরি ফলাইতে। জিগান, অরে (ওকে), যা কইলাম সাচা না মিছা?’

বিনয় হতবাক। যে মেয়েটা লজ্জায় সংকোচে কান্নাকাটি করছিল, সে মুহূর্তে এতটা পালটে যাবে কে ভাবতে পেরেছে!

সবার চোখ এবার এসে পড়ল সনাতনের ওপর। সাপের মাথায় ধুলোপড়া ছিটিয়ে দিলে যেমন হয়, সেইভাবে মিইয়ে গেছে সে। ঘাড় ভেঙে তার মাথাটা যেন বুকের ওপর ঝুলে পড়েছে।

শেখরনাথ যা বোঝার বুঝে নিয়েছেন। মায়াকে জিগ্যেস করলেন, ‘তুমি সনাতনের ঘর কি করতে চাও না?

মায়ার স্পষ্ট, দ্বিধাহীন জবাব।–’না, বড়কত্তা। এই কথাহান (কথাটা) আমারে আর কইয়েন না। ভগমানের দয়ায় একবার অর (ওর) হাত থিকা নিষ্কিতি (নিষ্কৃতি) পাইছি। ফির (ফের) যদিন অর (ওর) ঘর করতে অয়, আমি গলায় দড়ি দিমু।‘

‘তুমি বৃন্দাবনের সঙ্গেই থাকতে চাও?’

নতচোখে মায়া বলল, ‘হ—’

শেখরনাথ লা-ডিনদের বললেন, ‘তোমরা সনাতনকে একটা ঘরে নিয়ে আটকে রাখ। ওর ব্যাপারে কী করা দরকার, দুপুরে ভেবে ঠিক করব।’

.

দুপুরে খাওয়া-দাওয়ার পর যে ঘরটায় বিনয়দের সাময়িক থাকার ব্যবস্থা করা হয়েছে সেখানে পরিতোষ বণিক এবং জেফ্রি পয়েন্ট সেটেলমেন্টের আরও দু’চারজন বাঙালি অফিসারকে ডাকিয়ে আনালেন শেখরনাথ। বিনয়ও সেখানে আছে কিন্তু সে সাংবাদিক, শুধুই শ্রোতা এবং দর্শক মাত্র।

শেখরনাথ বললেন, ‘সকালের ওই বিশ্রী ঘটনাটার পর আমি অনেক ভেবেছি। সনাতনকে এখানে রাখা ঠিক হবে না। বৃন্দাবন আর মায়ার ওপর ওর যা আক্রোশ, যে কোনও সময় খুনোখুনি কাণ্ড ঘটে যেতে পারে।‘

পরিতোষ বলল, ‘আপনে ঠিকই কইছেন কাকা। সারাক্ষণ তো সনাতনরে চৌখে চৌখে রাখন যাইব । হে (সে) ছাড়া মায়া তো পষ্ট কইয়াই দিছে হ্যায় (সে) সনাতনের ঘর করব না। অরে (ওকে) এহান (এখান) থিকা বিদায় করনই ভালা।‘

বাকি অফিসাররা তার কথায় সায় দিল।

শেখরনাথ বললেন, ‘আমি আর বিনয় যে গাড়িটায় মোহনবাঁশিদের নিয়ে এখানে এসেছি, সেটা এখনও রয়ে গেছে। বিশুকে (বিশ্বজিৎ রাহা) একটা চিঠি লিখে দেব। সে যেন সনাতনকে মিডল আন্দামানের সেটলমেন্টে রিহ্যাবিলিটেশনের বন্দোবস্ত করে দেয়। কাল সকালেই লা-ডিন আর ধনপত ওই গাড়িতে সনাতনকে পাহারা দিয়ে পোর্টব্লেয়ারে বিশুর কাছে পৌঁছে দিয়ে আসুক।‘

পরিতোষরা বলল, ‘এইর থিকা কারেক্ট ডিসিশান আর অয় না।’

.

দিন সাতেক হল সনাতনকে পোর্টব্লেয়ারে পাঠানো হয়েছে। উদ্বাস্তুদের দৈনন্দিন জীবন পুরনো ছকেই চলছে। সকালে উঠে চা-রুটি টুটি খেয়ে নিজের নিজের জমিতে গিয়ে বনতুলসীর ঝাড় কাটা, আগাছা এবং ছোট ছোট গাছগুলির শিকড় মাটি থেকে উপড়ে ফেলা, দুপুরে এসে চানটান করে খাওয়া দাওয়া চুকিয়ে কিছুক্ষণ জিরিয়ে আবার জমিতে নামা। পনেরো বিঘে করে জমি সাফ করা তো মুখের কথা নয়। সন্ধে অবধি কাজ করে ফিরে আসে তারা। কিছুক্ষণ গল্পসল্প, তারপর খেয়ে দেয়ে কোনওদিন একটু আধটু গানবাজনা, নইলে সটান বিছানায় গিয়ে শুয়ে পড়া। ( ঠিক সপ্তাহখানেক বাদে একটু বেলার দিকে টেবিলে বসে ‘নতুন ভারত’-এর জন্য একটা প্রতিবেদন লিখছিল বিনয়। শেখরনাথ ঘরে নেই। উদ্বাস্তুদের সঙ্গে খুব সম্ভব দূরের কোনও জমিতে গেছেন। পুনর্বাসন দফতরের কর্মীদেরও সাড়াশব্দ পাওয়া যাচ্ছে না। এদিকটা একেবারে নিঝুম।

হঠাৎ ভটভট আওয়াজে চমকে উঠল বিনয়। কাছেই সমুদ্র। জানলা দিয়ে বাঁ দিকে তাকাতেই চোখে পড়ল লা-পোয়েদের সেই ধবধবে মোটর বোট, যার নাম ‘সি-বার্ড’, ঢেউ কেটে কেটে এগিয়ে এসে পাড়ের কাছে নোঙর ফেলল। বিনয়ের বুকের ভেতর.শিহরন খেলে যায়। শেল কালেক্টরদের এই বোটটা আসবে, সেজন্য যেন হাজার-হাজার বছর অপেক্ষা করে আছে বিনয়।

মোটর বোটটা থেকে নেমে সেটলমেন্টের দিকে এগিয়ে এল লা-পোয়ে। বিনয় কাগজ-কলম রেখে জানলার পাশে গিয়ে দাঁড়িয়েছিল। লা-পোয়ে কাছাকাছি আসতেই সে তাকে ডাকল, ‘আসুন, আসুন—’

লা-পোয়ে কপালে হাত ঠেকিয়ে বলল, ‘নমস্তে’–তারপর ঘরের ভেতর ঢুকল। হেসে হেসে বলতে লাগল, দেখুন, আমি যা ওয়াদা করেছিলাম, সেটা রেখেছি। ঠিক চলে এলাম। চাচাজিকে (শেখরনাথকে) তো দেখছি না।‘

‘উনি উদ্বাস্তুদের সঙ্গে বোধহয় জমিতে গেছেন। তা আপনারা কবে মিডল আন্দামানে যাবেন?’

‘এখানে আট দশ রোজ সিপি (শঙ্খ কড়ি উড়ি) তুলব। তারপর যাব। আপনি আমাদের সঙ্গে যাচ্ছেন তো?

‘হ্যাঁ হ্যাঁ, নিশ্চয়ই। সেদিন পোর্টব্লেয়ারে কী বললাম আপনাকে–ভুলে গেছেন?’

‘নেহি, নেহি। ভুলে গেলে কি জেফ্রি পয়েন্টে আসতাম? আপনি তৈয়ার থাকবেন।‘

‘আমি তৈরিই আছি। যেদিন বলবেন সেদিনই আপনাদের সঙ্গে বেরিয়ে পড়ব।‘

‘ঠিক হ্যায়। আমি এখন উঠি। চাচাজির সাথ একবার মুলাকাত করে সিপি তুলতে যাব।‘ লা-পোয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে ডানদিকে শেখরনাথের সন্ধানে চলে গেল।

কিছুক্ষণ চুপচাপ বসে রইল বিনয়। অবনীমোহনের সেই চিঠি দু’টোর কথা মনে পড়ে গেল তার। কাশীর আশ্রমে শেষ শয্যায় শুয়ে অনুতপ্ত, গ্লানিবোধে জর্জরিত বাবা ব্যাকুলভাবে লিখেছেন, ঝিনুককে খুঁজে বের করে বিনয় যেন তাঁর কাছে নিয়ে যায়। মৃত্যুর আগে তিনি তার কাছে ক্ষমা চেয়ে নেবেন।

কিন্তু চিরদুঃখী ঝিনুক, অভিমানে অসম্মানে একদিন নিরুদ্দেশ হয়ে গিয়েছিল। তাকে কি অবনীমোহনের কাছে কাশীতে নিয়ে যাওয়া সম্ভব হবে? সে কি আদৌ যেতে রাজি হবে?

এই প্রশ্নটা আগেও বার বার নিজেকে করেছে বিনয়। যথেষ্ট সংশয় আছে তার। তবু বাবার চিঠিটা নিয়ে লা-পোয়েদের মোটর বোটে ষাট মাইল সমুদ্র পাড়ি দিয়ে মিডল আন্দামানের সেটলমেন্টে তাকে ঝিনুকের কাছে যেতে হবে। যেতেই হবে। এই প্রতিজ্ঞাটি মনে মনে কতবার সে করেছে সে।

.

৪.১২

মোহনবাঁশিকে মৃত্যুর হাঁ-মুখ থেকে বাঁচিয়ে পোর্টব্লেয়ার থেকে যেদিন বিনয়রা জেফ্রি পয়েন্টে নিয়ে এল তার পর পরই নতুন ছত্রিশটা ডি পি ফ্যামিলিও চলে এসেছে। শেখরনাথ লক্ষ করেছেন সেটলমেন্টের ক’টা ব্যারাকে আগে-আসা উদ্বাস্তুদের সঙ্গে ওদের রাখা হয়েছে। এতে নতুন-পুরনো সব উদ্বাস্তুরই যে ভীষণ অসুবিধে হচ্ছে, সেটা মুখ ফুটে না বললেও চলে। পরিতোষ বণিককে ডেকে আজ কঠিন গলায় তিনি জিগ্যেস করলেন, ‘ব্যারাকে কতজন পুরনো রিফিউজি ছিল?’

সংখ্যাটা ঠিকঠাক জানাল পরিতোষ।–-‘পাঁচশো সতরো জন। বুড়াধুড়া (বুড়োটুড়ো), পোলাপান, হগল (সকল) মিলাইয়া।‘

‘এতগুলো মানুষকে ঠাসাঠাসি করে পাঁচটা ব্যারাকে ঢুকিয়েছ। নতুন যে ছত্রিশটা ফ্যামিলি এসেছে। সবসুদ্ধ তাদের মেম্বার কত?’

‘একশ’ বাহাত্তর জন।

‘হিসেবে তো দেখছি কোনও গোলমাল নেই। ব্যারাকে যে পুরনো উদ্বাস্তুরা কষ্ট করে থাকে তাতে তাদের দম আটকে আসে। একটা ছুঁচ ফেলার যেখানে জায়গা নেই সেখানে আরও একশ’ বাহাত্তর জনকে ঢুকিয়েছ! রিফিউজিদের কী মনে কর তুমি আর তোমার কর্তারা–পোকামাকড়? অন্ধকূপ হত্যার মতো একটা কান্ড ঘটাতে চাও নাকি?’

পরিতোষ চুপ।

শেখরনাথ বলেই যাচ্ছিলেন, ‘এতগুলো মানুষ মেনল্যান্ড থেকে আসছে, এ খবরটা তোমাদের তো আগেই জানিয়ে দেওয়া হয়েছিল, নাকি হয় নি?’

পরিতোষ আস্তে ঘাড় কাত করেল।–’অইছে (হয়েছে)।‘

‘তা হলে তাদের থাকার জন্যে আগে থেকে কেন ব্যবস্থা করা হয়নি?’

পরিতোষের উত্তর নেই। শেখরনাথ ধমকে ধমকেই কথা বলছিলেন। এবার তার সুর আরও চড়ল।–’বিশু আর অন্য অফিসাররা তো সবই জানে। তারা তোমাদের বলে নি নতুন ফ্যামিলিগুলোর থাকার জন্যে অ্যারেঞ্জমেন্ট করে রাখতে?’

শেখরনাথ যেন একটা অতল খাদের কিনারায় তাকে ঠেলতে ঠেলতে নিয়ে এসেছেন। গলার ভেতরটা শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেছে। কোনও রকমে পরিতোষ বলল, ‘কইছিলেন। কিন্তুক—’

‘কিসের কিন্তু—’

‘মাত্র কয়দিনের মইদ্যে (মধ্যে) ব্যারাক বানান (বানানো সম্ভব আছিল না। ভাবছিলাম—’

হাত তুলে পরিতোষকে থামিয়ে দিয়ে শেখরনাথ বললেন, ‘কী ভেবেছিলে সেটা কে শুনতে চাইছে? তোমাদের ওপরওলারা উদ্বাস্তু আসার কথা জানিয়েছে। সেইমতো তাদের অ্যাকোমোডেশনের বন্দোবস্ত করে রাখবে, এটাই তো তোমার কাজ। সেইজন্যেই তো এই সেটলমেন্টের দায়িত্ব তোমাকে দেওয়া হয়েছে। এতটুকু বোধবুদ্ধি নেই? কলকারখানার যন্ত্রপাতি নিয়ে তোমাকে ডিল করতে হয় না। কতগুলো নিরাশ্রয়, ভিটেমাটি খুইয়ে-আসা মানুষকে তোমার হাতে তুলে দেওয়া হয়েছে। তাদের জন্যে সবচেয়ে আগে যা চাই তা হল হিউম্যান কনসিডারেশন, মমতা। আর তুমি কিনা নিজের ইন-এফিসিয়েন্সির জন্যে সাফাই গাইতে শুরু করলে! আমি একেবারে অবাক হয়ে যাচ্ছি।‘

অবিরল ভর্ৎসনায় সিটিয়ে গিয়েছিল পরিতোষ। কী একটা জবাব দিতে যাচ্ছিল কিন্তু গলায় স্বর ফুটল না। ঠোঁটদুটো থরথর করে কাঁপছিল।

পরিতোষের ম্রিয়মাণ মুখের দিকে তাকিয়ে হয়তো করুণাই হয়েছে শেখরনাথের। তার কাঁধে একটা হাত রেখে এবার নরম গলায় বললেন, ‘অনেক বকাবকি করেছি। রাগ কোরো না। সবসময় মনে রেখো এই মানুষগুলো সর্বস্ব হারিয়ে ইন্ডিয়ায় এসেছে। দেশ যে স্বাধীন হয়েছে তার জন্যে সবচেয়ে বেশি দাম দিতে হয়েছে এদেরই। ওরা যাতে এখানে এতটুকু কষ্টভোগ না করে সেদিকে লক্ষ্য রাখা উচিত। একটু থেমে ফের শুরু করলেন, ‘যাক ওসব। শুনেছিলাম, এখানে তাঁবুর সরঞ্জাম রয়েছে। ঠিক?’

‘হ্যাঁ–’ আস্তে মাথা নাড়ল পরিতোষ। এতক্ষণ ভয়ে, অস্বস্তিতে কুঁকড়ে ছিল। মুখচোখ দেখে মনে হয়েছিল সেই ভাবটা কেটে গেছে।

শেখরনাথ বললেন, ‘যতদিন না নতুন ব্যারাক ট্যারাক তৈরি হচ্ছে তাঁবু খাটানোর ব্যবস্থা কর। ক’টা তাঁবুর মতো মালপত্র আছে?’

‘বিশ বাইশটা হবে মনে হচ্ছে।‘

‘ঠিক আছে। আজ থেকেই কাজ শুরু করে দাও। তাঁবুগুলো খাটানো হলে নতুন ছত্রিশটা ডি পি ফ্যমিলিকে তার ভেতর রাখা হোক। অন্তত পুরনো ডি পি ফ্যামিলিগুলোর সঙ্গে ঠাসাঠাসি করে তাদের থাকতে হবে না।‘

শেখরনাথের মতো একজন মানুষের কাছ থেকে নতুন বাড়তি একটা দায়িত্ব পেয়ে পরিতোষের হাতে-পায়ে যেন বিদ্যুৎ খেলে গেল। প্রচন্ড রাগারাগির পরও তিনি যে তার ওপর আস্থা রেখেছেন এটাই পরিতোযের কাছে বিরাট এক পুরস্কার। বিভাস নতুন উদ্বাস্তুদের জেফ্রি পয়েন্টে পৌঁছে দিয়ে পরদিনই চলে গিয়েছিল। নইলে তাকেই হয়তো এই দায়িত্বটা দিতেন শেখরনাথ। এটা পরিতোষের পক্ষে বিরাট স্বস্তি। নিজের কর্মক্ষমতা সে প্রমাণ না করে ছাড়বে না।

বনবিভাগের কর্মীরা জেফ্রি পয়েন্টের উত্তর, পশ্চিম আর পুব দিকে ‘জাঙ্গল ফেলিং’, অর্থাৎ বিশাল বিশাল গাছ কেটে জমি বের করছিল। হাঁকডাক করে তাদের ডেকে আনল পরিতোষ; তা ছাড়া পুনর্বাসন দপ্তরের কর্মীরা তো ছিলই। এমনকি উদ্বাস্তুদেরও ডাক পড়ল। সবাই জড়ো হলে তাদের তাঁবু খাটানোর কাজে লাগিয়ে দেওয়া হল। পরিতোষ ছোটাছুটি করে, বিপুল উদ্যমে তদারক করতে লাগল। এদের সকলের ওপরে ছিলেন স্বয়ং শেখরনাথ।

তিন দিনের মধ্যে পুরনো উদ্বাস্তুদের ব্যারাকগুলোর গা ঘেঁষে একুশটা তাঁবু সারি দিয়ে মাথা তুলে ফেলল। আন্দামানের দুর্গম বনভূমি-ঘেরা এই ভূখন্ডে যেন ছিন্নমূল মানুষের জন্য একুশটা বল্মীক। তাবু বানানো হওয়ামাত্র ছত্রিশটি পরিবারকে সেগুলোর ভেতর নিয়ে যাওয়া হল। তাঁবুগুলো বিরাট বিরাট; ভেতরে অনেকটা করে পরিসর। কুড়িটা তাবুতে দু’টো তিনটে করে ফ্যামিলির জায়গা হয়েছে; বাকি একটায় চারটে ফ্যামিলি। বেশ হাত-পা মেলে তারা থাকতে পারল। তাবু খাটানোর পর বনবিভাগ আর পুনর্বাসন দপ্তরের কর্মীরা আবার তাদের পুরনো ডিউটিতে ফিরে গেল।

.

আপাতত বিশ্বজিৎদের জন্য নির্দিষ্ট দুটো ঘরের একটায় আছেন শেখরনাথ আর বিনয়। পাশের ঘরটায় আছে স্টিল ফোটোগ্রাফার নকুল বিশ্বাস।

দিন তিনেক পরের কথা।

এখন বেশ রাত হয়েছে। একটা ঘরে দু’পাশের দেওয়াল ঘেঁষে দু’টো তক্তপোষে বিছানা। শিয়রের দিকে খোলা জোড়া জানলার এধারে চেয়ার টেবিল।

ঘন্টাখানেক আগে রাতের খাওয়া চুকিয়ে শেখরনাথ বিনয়ের সঙ্গে কিছুক্ষণ গল্পটল্প করে একটা খাটে শুয়ে পড়েছেন। তবে এখনও ঘুমোন নি। তার খাট ঘেঁষে ছোট নিচু টেবিলের ওপর কাঁচের লণ্ঠন জ্বলছে। সেই আলোয় তিনি একটা বই পড়ছেন। রাত্তিরে ঘন্টা দেড়-দুই বই না পড়লে তাঁর ঘুম আসে না। বই পড়াটা তার দীর্ঘকালের প্রিয় অভ্যাস। অবশ্য যত কাল তিনি সেলুলার জেলে কাটিয়েছেন তখন তো বই পেতেন না। ইংরেজের কয়েদখানায় নারকেল ছোবড়া পিটে সরু সরু তার বের করতে করতে বা ঘানি ঘুরিয়ে দিনে পনেরো সের সরষের তেল বের করে মাসের পর মাস কেটে গেছে। এই রুটিনের একটু এদিক ওদিক হলে হয় ‘টিকটিকি’তে চড়িয়ে চাবুক মারা হত, নইলে ‘খানা বন্ধ’ (খাবার-দাবার না দিয়ে শাস্তি)। আহাদ করে কে আর তাকে তার পছন্দসই বই জোগাচ্ছে! তা ছাড়া বই পেলেও সমস্ত দিন হাড় ঘেঁতো-করা খাটুনির পর পড়ার মতো উদ্যম আর থাকত না। শরীর থেকে সমস্ত এনার্জি নিংড়ে নিয়ে ফের তাকে ‘সেল’-এ ঢুকিয়ে তালা বন্ধ করে দেওয়া হত। সেলুলার জেল থেকে মুক্তি পাওয়ার পর শেখরনাথ আবার তার পুরনো অভ্যাসে ফিরে গেছেন।

বিনয় অবশ্য শুয়ে পড়ে নি। শিয়রের দিকের বড় টেবিলটার ওপর আরও একটা জোরালো লণ্ঠন জ্বলছে। সেখানে বসে সে তাদের ‘নতুন ভারত’ কাগজের জন্য প্রতিবেদন তৈরি করেছিল। পোর্টব্লেয়ারে। মোহনবাঁশি কর্মকারের চিকিৎসার জন্য যে ক’টা দিন তাদের থাকতে হয়েছে, শেখরনাথ তাকে ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে সেলুলার জেলটা দেখিয়েছেন। ইংরেজ আমলের এই বিশাল কয়েদখানার প্রায় সাড়ে আটশো ন’শো সেলে সাধারণ বন্দি থেকে স্বাধীনতা-সংগ্রামী সশস্ত্র বিপ্লবীরা কী অবস্থায় দিন কাটিয়েছেন, তাঁদের। ওপর কী নিদারুণ নির্যাতন চালানো হত, তার অনুপুঙ্খ বিবরণ দিয়েছেন তিনি। শুনতে শুনতে সেই সব দিনের স্পষ্ট সব ছবি চোখের সামনে ফুটে উঠছে বিনয়ের। শুধু কি সেলুলার জেলেই, পোর্টব্লেয়ারের দক্ষিণ দিকে শাদিপুরেও তাকে নিয়ে গেছেন শেখরনাথ। সেলুলার জেলের পুরুষ-কয়েদিদের সঙ্গে সাউথ পয়েন্ট জেলের মেয়ে-কয়েদিদের বিয়ে দিয়ে তাদের শাদিপুরে পাঠানো হত। এই সব কয়েদিরা বিয়ের পর কিভাবে ছেলেমেয়ে নিয়ে ঘর-সংসার করছে নিজের চোখে দেখে এসেছে বিনয়। দাম্পত্য-জীবনের স্নিগ্ধ, মধুর আস্বাদ এই ভয়াবহ হত্যাকারীদের আমূল বদলে দিয়েছে। তাদের দুর্ধর্ষ, হিংস্র প্রবৃত্তি ধীরে ধীরে জুড়িয়ে শান্ত হয়ে গেছে। ঘর-গৃহস্থালির মধ্যে খুব সম্ভব কোনও অলৌকিক জাদু লুকনো থাকে।

সেলুলার জেল আর শাদিপুর নিয়ে শুধু একটা নয়, সাত আট কিস্তির একটা লেখা তৈরি করতে হবে। ফোটোগ্রাফার নকুল বিশ্বাস এই দুই জায়গার প্রচুর ছবি তুলেছে। লেখাটা শেষ হলে, তার সঙ্গে ছবিগুলো পোর্টব্লেয়ারে বিশ্বজিৎ রাহার কাছে নকুলের হাত দিয়ে পাঠিয়ে দেবে বিনয়। বিশ্বজিৎ পাঠাবেন কলকাতায় ‘নতুন ভারত’-এর চিফ রিপোর্টার প্রসাদ লাহিড়ির কাছে।

আজ লেখাটা শুরু করেছে সে। এখন কত রাত কে জানে। সামনের খোলা জানলার বাইরে যতদূর চোখ যায়–উঁচু উঁচু পাহাড়, সেগুলোর গায়ে হাজার বছরের আদিম অরণ্য, খানিক দূরের সমুদ্র–সমস্ত কিছুই ঝাপসা। সন্ধের পর থেকেই কুয়াশা পড়তে শুরু করেছিল। সেই কুয়াশা ক্রমশ গাঢ় হতে হতে চারিদিক ঢেকে ফেলেছে। এটা খুব সম্ভব পূর্ণিমাপক্ষ। আকাশে হয়তো চাঁদ আছে। কিন্তু কুয়াশা ভেদ করে তার মায়াবী আলো জেফ্রি পয়েন্টে পৌঁছতে পারছে না। যেদিকেই তাকানো যাক, সব ঘোলাটে, আবছা আবছা। ঘষা ঘষা কাঁচের ভেতর দিয়ে তাকালে যেমন মনে হয় অনেকটা সেইরকম।

মানুষের সাড়াশব্দ কোথাও নেই। ডানপাশের রিফিউজিদের ব্যারাক আর তাঁবুগুলো একেবারে নিঝুম। এখানকার মনুষ্যজগৎ ঘুমের আরকে ডুবে আছে। কিন্তু বিশ্বব্রহ্মান্ড আদৌ নিঃশব্দ নয়। বাঁ দিক থেকে অবিরল সমুদ্র গর্জন ভেসে আসছে। বিনয় টের পাচ্ছে বঙ্গোপসাগরের বিশাল বিশাল ঢেউ প্রবল আক্রোশে আছড়ে পড়ছে সোনালি বালির সৈকতে। সমুদ্র থেকে ঝড়ো হাওয়া উঠে এসে জঙ্গলের মহা মহাবৃক্ষগুলিকে নাস্তানাবুদ করে চলেছে। তারই মধ্যে রাত-জাগা পাখিরা থেকে থেকে ডেকে উঠছে। জেফ্রি পয়েন্টে মধ্যরাতের এই সব ছবি এবং শব্দ তার চেনা।

লিখতে লিখতে হঠাৎ অন্যমনস্ক হয়ে পড়ল বিনয়। পোর্টব্লেয়ার থেকে জেফ্রি পয়েন্টে ফেরার পর বাবার কথা একবারও ভাবে নি সে। উদ্বাস্তুদের এই সৃষ্টিছাড়া উপনিবেশে এমন সব কান্ড ঘটে গেছে যে ভাবার মতো সময়ও ছিল না। কোনও কার্যকারণ নেই, তবু মনের গোপন এক কুঠুরি থেকে অবনীমোহন এই মধ্যরাতে বেরিয়ে এলেন। মনের ভাবগতিক বোঝা ভার। কখন কোন দিকে মানুষকে ছুটিয়ে নিয়ে যাবে, অনেক সময় আগে থেকে তার সংকেত মেলে না।

অবনীমোহনের চিঠি আগেও পেয়েছে বিনয়। এবার পোর্টব্লেয়ারে থাকার সময় তাঁর আরও একটা চিঠি এসেছে। সেটা বিময়ের কাছেই আছে। কী ভেবে খাটের তলা থেকে নিজের সুটকেসটা টেনে এনে সেটার ভেতর থেকে চিঠি বের করে ধীরে ধীরে পড়ে ফেলল। এই নিয়ে বারদশেক পড়া হল।

বিনয়ের বাবা অবনীমোহন বসু চিরকালই তার কাছে মস্ত এক প্রহেলিকা। প্রথম জীবনে তিনি কয়েক বছর অধ্যাপনা করেছেন। তারপর হঠাৎই নেমে পড়লেন ব্যবসায়। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের সময় কলকাতা থেকে ঢাকা ডিস্ট্রিক্টের রাজদিয়ায় গিয়ে জমি কিনে চাষবাস শুরু করলেন। খুব বেশি হলে দেড় দু’বছর। তারপর জমিজমা আবাদ ছেড়েছুঁড়ে আসামে গিয়ে চুটিয়ে কিছুকাল কনট্রাক্টরি। মহাযুদ্ধ শেষ হলে কলকাতায় ফিরে এক গুরুর কাছে দীক্ষা নিয়ে মগ্ন হলেন ধর্মকর্মে। কলকাতায় আর ক’দিনই বা থাকতেন! মাঝেমাঝেই চলে যেতেন বেনারসে গুরুর আশ্রমে। জীবনযাপনে শৃঙ্খলা নেই, নেই ধারাবাহিক কোনও পরিকল্পনা। সম্পূর্ণ খামখেয়ালি একটি মানুষ। স্ত্রী আগেই মারা গিয়েছিলেন। কিন্তু তিনটি সন্তান তো ছিল–সুনীতি, সুধা আর বিনয়। তাদের নিয়ে গুছিয়ে গাছিয়ে বাকি দিনগুলো স্বচ্ছন্দে কাটাতে পারতেন। কিন্তু ঘর-সংসারের প্রতি আসক্তি তার ছিল না। সব পিছুটান ছিন্ন করে চিরকালের মতো চলে গেলেন গুরুর আশ্রমে, কাশীতে।

এত এত কান্ড ঘটানোর পরও বাবাকে বিনয়ের মনে হত উদার, সহানুভূতিশীল, হৃদয়বান। কিন্তু বেনারসে যাওয়ার আগে তাঁর সম্বন্ধে বিনয়ের যাবতীয় ধ্যানধারণা ভেঙে চুরমার করে দিয়ে গেছেন অবনীমোহন। দাঙ্গায় ধর্ষিতা ঝিনুককে তিনি মনে প্রাণে গ্রহণ করতে পারেননি। রক্তের মধ্যে সঞ্চরমান আজন্মের জীর্ণ সংস্কারকে বিসর্জন দেওয়া তার পক্ষে সম্ভব হয় নি। অপমানে, মানসিক আঘাতে বিপর্যস্ত ঝিনুক নিরুদ্দেশ হয়ে যায়। সেই চরম ধাক্কাটা এসে লাগে বিনয়ের ওপর। যে মেয়েটি কিশোর বয়স থেকে তার শ্বাসপ্রশ্বাসে জড়িয়ে আছে, উদ্ভ্রান্তের মতো তাকে বিশ্বব্রহ্মান্ডে খুঁজে বেড়িয়েছে সে। শেষ পর্যন্ত আন্দামানে তার সঙ্গে হঠাৎই দেখা হয়ে গেছে।

এই সময়েই এসে গেছে অবনীমোহনের চিঠি। তিনি মৃত্যুশয্যায়। পৃথিবী থেকে চিরবিদায়ের আগে তাঁর সংস্কারমুক্তি ঘটেছে। ঝিনুকের সঙ্গে অমানুষিক, নির্মম আচরণের জন্য এখন তিনি অনুতপ্ত, গ্লানিবোধে জর্জরিত।

অবনীমোহন লিখেছেন, বিনয় যেন যেভাবে পারে ঝিনুককে খুঁজে বের করে একবার তার কাছে নিয়ে যায়। পৃথিবীর বায়ুমণ্ডল থেকে ফুসফুসে শেষ শ্বাসটি নেওয়ার আগে চিরদুঃখী মেয়েটির কাছে তিনি ক্ষমা চেয়ে নেবেন।

শেল কালেক্টরদের মোটর বোটটা জেফ্রি পয়েন্টে আসবে কয়েক দিন পর। ওরা বলেছে তাকে মিডল-আন্দামানে পৌঁছে দেবে। সেখানে গিয়ে ঝিনুককে বুঝিয়ে সুঝিয়ে কলকাতায় নিয়ে যাবে বিনয়। তারপর বেনারস। এক দেড়মাসের আগে কি তা সম্ভব? ততদিন কি অবনীমোহন বেঁচে থাকবেন? তা হলে এখন কী করবে সে? দেশভাগের পর কত সংকটের মুখোমুখি হতে হয়েছে। কিন্তু এমনটা আগে আর কখনও তার জীবনে আসে নি।

হঠাৎ এই মধ্যরাতে জেফ্রি পয়েন্টের নিঝুম রিফিউজি সেটলমেন্টকে চকিত করে একটা ব্যাকুল, আর্ত, করুণ, চিৎকার কারও হৃদপিণ্ড ভেদ করে যেন একটানা উঠে আসতে লাগল।

চমকে উঠল বিনয়। ওপাশের খাটে ধড়মড় করে উঠে বসেছেন শেখরনাথ। বিভ্রান্তের মতো জিগ্যেস করলেন, ‘কেউ যেন কাঁদছে, তাই না?’

বিনয় মাথা নাড়ল।–’হ্যাঁ।‘

 ‘কোন দিক থেকে আওয়াজটা আসছে?’

‘বুঝতে পারছি না।‘

‘চল তো, দেখা যাক এই নিশুতি রাতে কে এমন করে কাঁদছে–’ শেখরনাথকে খুব চিন্তিত দেখাল।

.

৪.১৩

চকিতে অবনীমোহনের চিঠি টেবিলের দেরাজে ঢুকিয়ে দিয়ে তার সামনের লণ্ঠনটা এক হাতে ঝুলিয়ে নিল বিনয়। শেখরনাথ নিলেন একটা চার ব্যাটারির বড় টর্চ। তারপর দু’জন ঘর থেকে বেরিয়ে পড়ল। শেখরনাথের খাটের পাশে ছোট টেবিলের ওপর যে লণ্ঠনটা জ্বলছিল সেটা জ্বলতেই লাগল।

কান্নাটা আরও তীব্র, আরও করুণ হয়ে উঠেছে। ঘরের বাইরে এসে টর্চ জ্বাললেন শেখরনাথ। কিন্তু বিনয়ের হাতের লণ্ঠন বা টর্চের আলো চারপাশের কুয়াশামাখা জমাট ঘোলাটে অন্ধকার সরিয়ে বেশি দূর এগুতে পারছে না।

বিনয়ের হঠাৎ মনে পড়ল, এমন কান্না আগেও সে শুনেছে। শুধু কোনও এক জায়গায় নয়; অনেক,অনেক জায়গায়। সেই সব কান্নাতেও ছিল একই আকুলতা, বুকে শেল বিধলে যেরকম হয়। সেই একই যন্ত্রণা। কিন্তু কোথায় কোথায় শুনেছিল, কিছুতেই ভেবে পেল না বিনয়।

উদ্বাস্তুদের ব্যারাকগুলোতে কোনও রকম সাড়াশব্দ নেই। সারাদিন জমিতে প্রচন্ড খাটাখাটুনির পর খেয়ে দেয়ে এমন গভীর ঘুমে তারা তলিয়ে আছে যে মধ্যরাতের এই আর্ত রোদনও তাদের ঘুম ভাঙাতে পারে নি।

বিনয়রা যে ঘরে আছে তার পেছন দিকে রয়েছে আরও পাঁচ ছ’টা অ্যাসবেস্টসের ছাউনি দেওয়া লম্বা লম্বা ঘর। সেগুলো পুনর্বাসন দপ্তরের কর্মীদের আস্তানা। সেখানেও কেউ জেগে আছে মনে হল না।

বাইরে বেরিয়ে কয়েক পা এগিয়ে থেমে গিয়েছিল বিনয়রা। স্নায়ুগুলো টান টান করে আন্দাজ করতে চেষ্টা করলেন শেখরনাথ। বিনয়ও তা-ই করল। কয়েক লহমা বাদে শেখরনাথ দিক নির্ণয় করে ফেললেন।–’আমার কী মনে হয় জানো, কান্নার আওয়াজটা আসছে নতুন রিফিউজিদের তাঁবুগুলোর দিক থেকে।‘

বিনয়েরও তেমনটাই মনে হচ্ছে। সে আস্তে মাথা নাড়ল।–’হ্যাঁ। ওখানেই যাওয়া যাক।‘

শেখরনাথ বললেন, ‘একটু দাঁড়াও।’ বলেই হাঁকডাক করে পরিতোষদের ঘুম ভাঙালেন। পরিতোষ, ধনপত এবং রিহ্যাবিলিটেশনের অন্য সব কর্মীরা হুড়মুড় করে বেরিয়ে এল।

অবাক বিস্ময়ে পরিতোষ জিগ্যেস করল, ‘কী অইছে (হয়েছে) কাকা?’

শেখরনাথ বললেন, ‘শুনতে পাচ্ছ না?’

চোখে ঘুমের ঘোর ছিল পরিতোযের। লহমায় সেটা কেটে গেল। কান্নার শব্দটা তার কানে গেছে। কান খাড়া করে শুনতে শুনতে বলল, ‘মনে লয় (হয়), নয়া রিফিউজিগো যে তাম্বুগুলানে (তবুগুলোতে) রাখা অইছে (হয়েছে) হেইহান (সেখান) থিকা আওয়াজহান আইতে আছে (আসছে)। কিন্তুক এত রাইতে অমুন কইরা কান্দে ক্যাডা (কে কাঁদে)? ক্যানই বা কান্দে (কেনই বা কাঁদছে)?’

‘সেটা জানার জন্যেই তো চলে এসেছি। তুমি এখানকার একজন বড়কর্তা। তোমার এত ঘুম যে এই সেটলমেন্টে কত দুঃখে কে কাঁদছে, টেরই পাও না? আরও দু-চারটে লণ্ঠন জ্বালিয়ে আনতে বল তোমার লোকজনদের। তারপর দেখি কী হল।‘

বর্মীরা চটপট পাঁচ ছ’টা জ্বলন্ত হ্যারিকেন জ্বেলে নিয়ে এল। এদিকে ব্যারাকে যে উদ্বাস্তুরা রয়েছে তাদেরও ঘুম ভেঙে গেছে। অনেকেই দরজা খুলে বেরিয়ে এসেছে। কয়েকজনের হাতে কেরোসিনের কুপি বা লণ্ঠন।

ডানপাশে খানিকটা এগিয়ে যেতে দেখা গেল, একুশটা তাবুর প্রায় সবাই বেরিয়ে এসে গোল হয়ে এক জায়গায় দাঁড়িয়ে কাকে যেন ব্যগ্রভাবে কিছু বোঝাবার চেষ্টা করছে। এখানেও প্রচুর আলো। এতজন একসঙ্গে কথা বলায় গুঞ্জনের মতো শোনাচ্ছে।

পরিতোষ ভীষণ ব্যস্ত হয়ে পড়ল।–’এই, তোমরা সইরা সইরা (সরে সরে) খাড়াও (দাঁড়াও)। কাকায় আইছেন (কাকা এসেছেন)। পথ দ্যাও, (দাও)।‘

উদ্বাস্তুদের জটলাটা সসম্ভ্রমে খানিকটা দূরে সরে রাস্তা করে দিল। এবার চোখে পড়ল একটি মেয়েমানুষ, ষাটের কাছাকাছি বয়স, গাল ভাঙা, চোখ গর্তে ঢোকানো, কণ্ঠার হাড় ঠেলে বেরিয়ে এসেছে, মাথায় কাঁচাপাকা চুল, পরনে এই সেটলমেন্ট থেকে দেওয়া কালো-পাড় সাদা শাড়ি, ঘোমটা নেই–বসে আছে ঘাসের জমিতে। আর কেঁদেই চলেছে। বিরামহীন। তার চারপাশে মানুষের দঙ্গল। সেদিকে এতটুকু হুশ নেই।

শেখরনাথ নরম গলায় বললেন, ‘কেঁদো না মা। কী কষ্ট আমাকে বল—’

মেয়েমানুষটি উত্তর দিল না। তার ডাইনে-বাঁয়ে সামনে-পেছনে এত যে লোকজন, এতটুকু দৃকপাত নেই। সে কেঁদেই চলেছে, কেঁদেই চলেছে।

আরও দু’চার বার বলেও মেয়েমানুষটির কাছ থেকে কিছুই জানা গেল না। অগত্যা ভিড়ের দিকে চোখ ফিরিয়ে শেখরনাথ জানতে চাইলেন।-–’কাদের সঙ্গে এ এসেছে?’

ভিড়ের ভেতর থেকে একটি ক্ষয়াটে চেহারার আধবয়সি লোক আর বছর চল্লিশেকের এক শীর্ণ মেয়েমানুষ ক’পা এগিয়ে এল। পুরুষটি বলল, ‘আমাগো লগে (সঙ্গে) আইছে বড়কর্তা–’ শেখরনাথ যে জেফ্রি পয়েন্টের সবচেয়ে মান্যগণ্য মানুষ, অশেষ প্রতাপ তার সেটা এখানে পা দিয়েই টের পেয়েছে সে।

শেখরনাথ জিগ্যেস করলেন, ‘এ তোমার কে হয়—মা?’

অস্বস্তি ফুটল লোকটার চোখেমুখে। ভেতরে ভেতরে তার যেন দ্বিধা চলছে। একটু চুপ করে থেকে সেটা কাটিয়ে মিনমিনে গলায় বলল, ‘উই মায়ের লাখান (মত)—’

লোকটার কথা বলার ভঙ্গি, চোখমুখের চেহারা–সব মিলিয়ে কী যেন রয়েছে। ছলচাতুরি? কেমন যেন ধন্দে পড়ে গেলেন শেখরনাথ। সোজাসুজি তার চোখের দিকে স্থির দৃষ্টিতে তাকালেন।–’মায়ের মতো বলছ। তবে কি মা নয়?’

শেখরনাথের কণ্ঠস্বরে এমন এক দৃঢ়তা ছিল যে চুপসে গেল লোকটা। বারকয়েক ঢোক গিলে বলল, ‘তাইলে (তা হলে) আপনেরে হগল (সকল) কথা খুইলা কইতে অয় (হয়)।‘

‘সত্যি কথা বলবে। যদি বুঝি কোনওরকম বজ্জাতি রয়েছে, এখানকার জমিজমা তো পাবেই না, তোমাকে এখানে থাকতেও দেওয়া হবে না।

হাতজোড় করে শিরদাঁড়া ঝুঁকিয়ে লোকটা কাঁপা কাঁপা গলায় বলল, ‘মা কালীর কিরা (দিব্যি), সাচাই (সত্যিই) কমু। মিছা কইলে য্যান আমার মাথায় ঠাটা (বাজ) পড়ে।‘

ওদিকে আশ্চর্য একটা ব্যাপার ঘটে গেল। বয়স্কা মেয়েমানুষটি এতক্ষণ অনর্গল কেঁদে যাচ্ছিল। আচমকা একেবারে চুপ হয়ে গেল। তারপর হাতের ভর দিয়ে উঠে এলোমেলো পায়ে টলতে টলতে সামনের একটা তাঁবুতে ঢুকে পড়ল। বাইরে থেকে তাকে আর দেখা যাচ্ছে না।

বেশ অবাকই হলেন শেখরনাথ। আধবুড়ো সেই লোকটাকে বললেন, ‘বৃদ্ধা কি ওই তাবুতে থাকে?

লোকটা আস্তে ঘাড় কাত করল।’হ। আমরাও উই তাম্বুতে থাকি। আমাগো লগে (সঙ্গে) হ্যায়ও (সেও) থাকে।

শেখরনাথ এবার পরিতোষের দিকে তাকালেন।–’বিনয় আর আমার বসার জন্যে টুল-ফুল কিছু এনে দিতে পার?’

পরিতোষ রিহ্যাবিলিটেশনের বর্মী কর্মীদের হাত নেড়ে ইঙ্গিত করতেই চোখের পলকে কোত্থেকে তারা দুটো চেয়ার নিয়ে এল। বসতে বসতে শেখরনাথ সেই লোকটাকে জিগ্যেস করলেন, ‘তোমার নাম কী?’

লোকটা বলল, ‘নিত্যানন্দ বণিক। তয় (তবে) চিনাজানা (চেনাজানা) মাইষে (মানুষরা) নিত্যা কইয়া ডাকে।‘

‘নিত্যানন্দ, এবার ওই বৃদ্ধার কথা বল—’

যেসব উদ্বাস্তুরা কান্নার আওয়াজে ঘুম থেকে উঠে এসেছিল তারা কেউ ব্যারাক বা তাঁবুতে ফিরে যায় নি; অপার কৌতূহল নিয়ে কুয়াশা-ভেজা জমিতে শেখরনাথদের সামনে ঘেঁষাঘেঁষি করে উবু হয়ে বসে পড়েছে। তবে নিত্যানন্দ কিন্তু দাঁড়িয়েই রয়েছে। সে শুরু করল।–’আমাগো দ্যাশ আছিল ঢাকা জিলার ভাইগ্যকূলে (ভাগ্যকূল), ইস্টিমার-ঘাটা থিকা তিরিশ মাইল দূরে মুন্সিপুর গেরামে (গ্রামে)। উই দিকে বড় দাঙ্গার সোমায়ও (সময়ও) অশান্তি আয় (হয়) নাই। হিন্দু-মুসলমানের মইদ্যে (মধ্যে) মিলমিশ আছিল। কাইজা (কাজিয়া) বিবাদ কুনোদিন বাধে নাই। কিন্তুক পাকিস্থান হওনের পর মুসলিম লিগের গুন্ডা আর আনসারেরা পরথম পরথম (প্রথম প্রথম) হিন্দুগো শাসাইত, ভিটামাটি দ্যাশ ছাইড়া ইন্ডিয়ায় চইলা যাইতে অইব (হবে)। হের (তার)পর রাইতের আন্ধারে ঘরে ঘরে আগুন ধরাইয়া দিতে লাগল; যুবুতী মাইয়াগো টাইনা লইয়া যাইত, বাধা দিলে দাও (দা) দিয়া কোপাইয়া শ্যাষ কইরা দিত।‘

দেশভাগের ঠিক আগে সেই সময়ের অখণ্ড ভারত জুড়ে দাঙ্গা শুরু হয়েছিল। তখনকার মতো মুন্সিপুর রেহাই পেলেও পাকিস্তান কায়েম হওয়ার সময় থেকেই নিত্যানন্দদের গ্রাম শুধুই নয়, চারপাশের এলাকা একেবারে নরক হয়ে উঠেছিল; যেমন পূর্ব পাকিস্তানের অসংখ্য গ্রাম-গঞ্জে এমনটা হয়েছে। দেশভাগের আগে যত রক্তপাত হয়েছে, দেশভাগের পর হয়েছে তার বিশ পঞ্চাশ গুণ বেশি। পাকিস্তান হওয়ার পরও আগুন, ধর্ষণ, হত্যাকান্ড থামে নি।

যে ছিন্নমূল মানুষরা অনন্ত আতঙ্কে সীমান্তের ওপার থেকে পশ্চিমবঙ্গ হয়ে আন্দামানে চলে এসেছে এসব তাদের সকলেরই জানা। সীমা-পরিসীমাহীন ত্রাস আর উৎকণ্ঠা নিয়ে শুধু প্রাণ বাঁচাতে তাদের দেশ ছাড়তে হয়েছে। শ্রোতাদের কেউ সাড়াশব্দ করল না।

নিত্যানন্দ বলতে লাগল, ‘দ্যাশে আর থাকন গ্যাল না। একদিন নিশুত রাইতে আমার বউ উলুপী আর একমাত্র পোলা মংলারে লইয়া চোরের লাখান (মতো) চৈদ্দ পুরুষের ভিটা ছাইড়া বাইর অইয়া (হয়ে পড়লাম।

এরপর সে যা বলে গেল তা এইরকম। মুন্সিপুর থেকে তাদের যেতে হবে ভাগ্যকূল স্টিমার ঘাটায়। সেখান থেকে স্টিমার ধরে গোয়ালন্দ। গোয়ালন্দ থেকে রিফিউজিদের জন্য স্পেশাল ট্রেনে চেপে কলকাতার নিরাপদ আশ্রয়ে।

ভাগ্যকূল তো ঘরের কাছে নয়; পাক্কা তিরিশ মাইল দূরের পথ। এতটা রাস্তা পায়ে হেঁটে যে যাবে, তাতে প্রাণের ঝুঁকি আছে। আনসার আর লিগের ঘাতকবাহিনী দা কুড়াল তলোয়ার বর্শা ট্যাটা এমন সব মারণাস্ত্র নিয়ে তক্কে তক্কে থাকে। কাফের দেখলে নিস্তার নেই; ঝাঁপিয়ে পড়বে।

পূর্ব পাকিস্তানের সকলেই তো আর অমানুষ হয়ে যায় নি, দয়ামায়া আছে এমন মানুষের সংখ্যাও প্রচুর। এক পরিচিত বিশ্বাসী মাঝি ঘুরপথে খালবিল আর একটা ছোট শাখানদী পেরিয়ে নির্জন, জংলা জায়গায় এসে নৌকা থামাল। সেখান থেকে ভাগ্যকূল দু-আড়াই মাইলের বেশি হবে না। এই দিকটা তখনও হানাদারদের নজর এড়িয়ে শান্তই আছে। কোনওরকম গন্ডগোল হয়নি।

মাঝির নাম ফকিরা। সে বলেছিল, ‘নিত্যাভাই, তুমরা এহানে (এখানে) লাইমা (নেমে) যাও। যত তরাতরি পার, পাও (পা) চালাইয়া ইস্টিমারঘাটায় চইলা যাইবা। আল্লার মেহেরবানিতে তুমাগো কুনো বিপদ অইব (হবে) না; তেনিই (তিনিই) রক্ষা করবেন।

নেমে পড়েছিল নিত্যানন্দরা, ফকিরা নৌকোর মুখ ঘুরিয়ে ফিরে গিয়েছিল।

তখনও ভোরের আলো ফোটে নি। আবছা আবছা অন্ধকারে ভরে আছে চরাচর। এলাকাটায় গন্ডগোল না বাধলেও, বাধতে কতক্ষণ। পূর্ব পাকিস্তানে যে কোনও গ্রামগঞ্জে বা শহরে যখন তখন আগুন জ্বলে উঠতে পারে, বয়ে যেতে পারে রক্তের স্রোত। পৃথিবীর এই ভূখণ্ডে চিরশান্তির কোনও অঞ্চল বলে কিছু নেই।

নিত্যানন্দের মাথায় টিনের একটা বাক্স, তার বউ উলুপীর কাখে শতরঞ্চি-বাঁধা বিছানা এবং দু’চারটে কাপড়চোপড়, তাদের বারো বছরের ছেলে মংলা বা মঙ্গলের কাঁধে কাপড়ের থলিতে টুকিটাকি কিছু জিনিসপত্র। যেটুকু বওয়া সম্ভব ঠিক ততটুকু নিয়েই তারা বেরিয়ে পড়েছে। বাকি সমস্ত কিছু পেছনে পড়ে থেকেছে।

নিত্যানন্দরা শুনেছে, একবার ভাগ্যকূলে পৌঁছতে পারলে কিছুটা হলেও আতঙ্ক কাটবে। স্টিমার ঘাটায় নাকি কিছু পুলিশ-টুলিশ দেওয়া হয়েছে। দেশ ছেড়ে যারা চলে যাচ্ছে, যৎসামান্য হলেও ব্যবস্থা করা হয়েছে তাদের নিরাপত্তার।

নিত্যানন্দরা নিঃশব্দে এগিয়ে যাচ্ছিল। বুকের ভেতর অনন্ত উৎকণ্ঠা। দু-আড়াই মাইল রাস্তা কোনওরকমে পেরিয়ে যেতে পারলে মোটামুটি স্বস্তি। ( হঠাৎ চোখে পড়ল পেছন থেকে আরও অনেকে আসছে। আধো-অন্ধকারে সারি সারি ছায়ামূর্তির দঙ্গল। ঘাসের ওপর দ্রুত পা চালিয়ে হাঁটার অস্পষ্ট আওয়াজ ছাড়া মুখে কারও টু শব্দটি নেই।

প্রথমটা ভয় পেয়ে গিয়েছিল নিত্যানন্দরা। ঘাতক-বাহিনী নয় তো? পরক্ষণে চোখে পড়েছিল ছায়ামূর্তিগুলির মাথায় বা কাঁধে তাদের মতোই বাক্স বা নানা আকারের ছোটবড় পোঁটলাটলি। ওই দঙ্গলটার মধ্যে রয়েছে বুড়োধুড়ো, কাচ্চাবাচ্চা, নানা বয়সের পুরুষ এবং মেয়েমানুষ। শ্বাসপ্রশ্বাস সহজ হয়ে এসেছিল নিত্যানন্দদের। না, ভয়ের কারণ নেই। নারী-পুরুষের ওই দঙ্গলটাও তাদের মতোই এই হননপুরী পেছনে ফেলে চিরকালের মতো চলে যাচ্ছে।

জনতা কাছাকাছি চলে এসেছে। কিন্তু কেউ কারওকে কিছু জিগ্যেস করছে না। পাশাপাশি হেঁটেই চলেছে।

আচমকা ভোরের অপার নৈঃশব্দ্যকে চিরেফেঁড়ে করুণ আর্ত চিৎকার, তার সঙ্গে মেশানো অস্পষ্ট বিলাপের মত কিছু। অবিরল কাঁদতে কাঁদতে কেউ যেন কী বলে চলেছে, তার একটি বর্ণও বোঝা যাচ্ছে না। সেই কাতর আর্তি বিশ্বব্রহ্মাণ্ডে যেন অন্তহীন বিষাদ ছড়িয়ে দিচ্ছিল।

নিত্যানন্দ চমকে উঠেছিল। কে কাঁদে? এধারে ওধারে তাকাতে তাকাতে চোখে পড়ল, একটা বড় ডালপালাওলা গাছের তলায় একজন বুড়ো মেয়েমানুষ বসে আছে। সে-ই কেঁদে চলেছে। ছেদহীন, একটানা সেই কান্না।

নিত্যানন্দদের সঙ্গে যে বিশাল মানবগোষ্ঠী হাঁটছিল তারা কিন্তু বয়স্ক মেয়েমানুষটির দিকে ফিরেও তাকায় নি। এলাকাটা পেরিয়ে যত দ্রুত ভাগ্যকূলে পৌঁছনো যায়, সেটাই তাদের একমাত্র লক্ষ্য। পথের পাশে বসে কে আকুল হয়ে কাঁদছে, কতটা শোক বা যন্ত্রণায় তার বুকের ভেতরটা খান খান। হয়ে যাচ্ছে, দু-চার লহমা দাঁড়িয়ে যে সেই খবরটা নেবে তেমন সময় কারও নেই।

নিত্যানন্দর কেন যেন মনে হয়েছিল মেয়েমানুষটি অত্যন্ত বিপন্ন। অন্য সবার মতো সে তাকে এড়িয়ে যেতে পারে নি। কাছে গিয়ে তার কান্নার কারণটা জানতে চেয়েছিল। হঠাৎ কান্না থামিয়ে একেবারে চুপ বুড়ো মানুষটি। নিত্যানন্দ এবার জিগ্যেস করেছে, ‘আপনের লগে (সঙ্গে) আর কেওরে (কারওকে) তো দেখতে আছি না। আপনে কি এক্কেরে (একেবারে) একা?’ এবার আস্তে মাথা নেড়েছে মেয়েমানুষটি। অর্থাৎ তা-ই। নিত্যানন্দ বলেছে, ‘এইহানে (এখানে) বইয়া (বসে) আছেন ক্যান? আপনেগো কুন (কোন) গেরাম?’ সাড়া পাওয়া যায় নি। নিত্যানন্দ কিন্তু তাকে ছাড়ে নি।–’আপনে কি কুনোহানে (কোথাও) যাইতে চান?’ মাথা হেলিয়ে পশ্চিম দিকে আঙুল বাড়িয়ে দিয়েছিল মেয়েমানুষটি। কিছু একটা আন্দাজ করে নিত্যানন্দ বলেছে, ‘আপনে কি ইণ্ডিয়ায় যাইতে চান?’ জোরে মাথা ঝাঁকিয়েছে মেয়েমানুষটি। অর্থাৎ সে ভারতেই যেতে চাইছে। অবাক হয়ে গেছে নিত্যানন্দ ‘আপনের নিজের মানুষজন তো কেওরে (কারওকে) দেখি না। একা একা কেমনে অত দূর দ্যাশে (দেশে) যাইবেন? মেয়েমানুষটি ফের আগের মতোই আকুল কান্নায় ভেঙে পড়েছে। কান্নাজড়ানো ভাঙা ভাঙা গলায় বলেছিল, ‘পিরথিমীতে (পৃথিবীতে) আমার কেও (কেউ) নাই। হগল (সকল) শ্যাষ। নিত্যানন্দ হতবুদ্ধির মতো তাকিয়ে থেকেছে অনেকক্ষণ। নিঃসঙ্গ বয়স্ক মেয়েমানুষটিকে এভাবে ফেলে রেখে চলে যেতে তার পা সরে নি। অগুনতি সন্ত্রস্ত, ছিন্নমূল মানুষ উধ্বশ্বাসে পাশ দিয়ে চলে যাচ্ছিল, কিন্তু নিত্যানন্দ তা পারে নি। উলুপীর সঙ্গে পরামর্শ করে মেয়েমানুষটিকে সঙ্গে নিয়ে স্টিমারঘাটায় চলে এসেছিল। সীমান্তের ওপারে পৌঁছবার পর তারা কোথায় থাকবে, কী খাবে, আদৌ কোনও আশ্রয় পাবে কিনা, ঠিক নেই। নিত্যানন্দ ভেবেছে তাদের যা হবার বয়স্কা মেয়েমানুষটিরও তাই হোক। একটা বাড়তি মানুষকে সঙ্গে নিয়ে অনিশ্চিত ভবিষ্যতের দিকে ঝাঁপ দিয়েছিল সে।

ভাগ্যকূলে গিয়ে চোখে পড়েছিল অজস্র মানুষে চারিদিক ছয়লাপ। সামনে পেছনে ডাইনে বাঁয়ে সেদিকেই তাকানো যাক, ভীত সন্ত্রস্ত সারি সারি মুখ। ভীষণ দমে গিয়েছিল নিত্যানন্দ। কেননা গোয়ালন্দের স্টিমার দিনে মাত্র একটা। দিন সাতেক ভাগ্যকূলে পড়ে থাকার পর তারা স্টিমারে উঠতে পেরেছিল। গোয়ালন্দে এসে আবার তিন দিন অপেক্ষা করতে হয়েছে, কারণ সেখানেও কত দিক থেকে কত মানুষ যে জড়ো হয়েছে! শেষ পর্যন্ত রিফিউজি স্পেশাল নামে ট্রেনে উঠতে পেরেছিল তারা। স্টিমারে আর ট্রেনে আসার সময় মাঝেমাঝেই মেয়মানুষটি বুকফাটা চিৎকার করে উঠেছে। এর ভেতরেই নিত্যানন্দ তাকে অনেক বুঝিয়ে সুঝিয়ে যেটুকু জানতে পেরেছে তা হল মেয়েমানুষটির গ্রামের নাম নবীগঞ্জ। পূর্ব পাকিস্তানের অন্য সব এলাকার মতো সেখানেও শুরু হয়েছিল একতরফা হত্যা, ধর্ষণ, ঘরে ঘরে আগুন জ্বালিয়ে আদিম বর্বরতা। একদিন তার স্বামী আর দুই জোয়ান ছেলেকে তার চোখের সামনে কুপিয়ে শেষ করে দিয়েছিল জন্তুর দল। রক্তের স্রোত বয়ে গিয়েছিল তাদের উঠোনে। চাপ চাপ তাজা রক্ত। তাদের সতেরো বছরের যুবতী একটি মেয়ে ছিল–তারা। সে ভয়ে ঘরের ভেতর তক্তপোষের তলায় লুকিয়ে ছিল; ঘাতকবাহিনী হিংস্র চিতার মতো গন্ধ পেয়ে তাকে টেনে বের করে এনেছিল। উঠোনের এক কোণে দাঁড়িয়ে একেবারে পাথর হয়ে গেছে বয়স্ক মেয়েমানুষটি। চোখের সামনে এইসব হাড়হিম-করা দৃশ্য দেখতে দেখতে মাটিতে আছড়ে পড়েছিল। সঙ্গে সঙ্গে মূৰ্ছা। জ্ঞান ফেরার পর দেখেছে তাদের ঢেউ-টিনের চাল আর কাঁচা বাঁশের বেড়ার চারখানা বড় বড় ঘর নিয়ে যে বাড়ি সেটা পুড়ে ছাই হয়ে গেছে। তারা এবং সেই ঘাতকের দঙ্গলটা নেই। উঠোনের মাঝখানে জমাট-বাঁধা থকথকে রক্তের ভেতর পড়ে আছে তিনটে ক্ষতবিক্ষত মৃতদেহ। তার স্বামীর মাথাটা ধড় থেকে আলাদা হয়ে চামড়ার সঙ্গে কোনওরকমে আটকে আছে।

বিভীষিকায়-ভরা এই দৃশ্যগুলো দেখতে দেখতে হঠাৎ উন্মাদের মতো চিৎকার করে ওই হত্যাপুরী পেছনে ফেলে উধ্বশ্বাসে মেয়েমানুষটি দৌড়তে শুরু করেছিল। এক মুহূর্তও সে আর পাকিস্তানে থাকবে না। ধানখেত পাটখেতের ভেতর দিয়ে, খালবিলের ধার দিয়ে ছুটতে ছুটতে ভাগ্যকূলের স্টিমারঘাটার কাছাকাছি চলে এসেছে মেয়েমানুষটি। সে শুনেছে, বর্ডারের ওপারে ইন্ডিয়ায় পৌঁছতে পারলে প্রাণটা অন্তত বেঁচে যাবে। প্রিয়জনদের এভাবে হারিয়ে সে পাকিস্তানে একা-একা থাকবে কী করে? তার নামটা কোনওদিনই জানতে পারে নি নিত্যানন্দরা। যতবার জিগ্যেস করেছে বলেছে, সে তারার মা। নিত্যানন্দরা তাকে ডাকে খুড়িমা।

.

সব জানিয়ে নিত্যানন্দ হাতজোড় করে শেখরনাথকে বলেছে, বড়কত্তা, দুখী বুড়া মানুষরে পথে ফালাইয়া আইতে পারি নাই। কইলকাতায় আইয়া (এসে) কয়দিন শিয়ালদার ইস্টিশানে আছিলাম। হেরপর রিলিপ কেম্পে ছয়-সাত মাস। হেরপর এই আন্ধারমানে (আন্দামানে)। হারাদিনে (সারা দিনে) দুই-একটার বেশি কথা কয় না। হারাক্ষণ (সারাক্ষণ) মুখ বুইজা থাকে। শোকে মানুষ পাথর অইয়া (হয়ে) গ্যাছে। কুনো কুনো সোমায় বুক ফাটাইয়া কানতে (কাঁদতে) থাকে। একটু চুপ। তারপর ফের শুরু করল সে, ‘খুড়িমারে লইয়া আইয়া (নিয়ে এসে) কি দুষ (দোষ) করছি? কুনো অন্যায় অইচে (হয়েছে)?

শেখরনাথ চেয়ার থেকে উঠে এসে নিত্যানন্দর মাথায় হাত রাখলেন। গম্ভীর গলায় বললেন, ‘কোনও অন্যায় করো নি। বরং পুণ্যের কাজ করেছ। তোমার মঙ্গল হোক। যাও, এবার সবাই শুয়ে পড়।‘

বিনয়কে সঙ্গে করে নিজেদের ঘরে ফিরে এলেন শেখরনাথ। লণ্ঠনটা টেবিলের ওপর রাখতে রাখতে বিনয় বলল, ‘নিত্যানন্দর মতো মানুষ আমি আগে কখনও দেখি নি কাকা। বিপদ আপদ, নানারকম আশঙ্কার মধ্যেও একটি নিরাশ্রয় বৃদ্ধাকে সঙ্গে করে ওপার থেকে নিয়ে এসেছে।‘

শেখরনাথ সায় দিলেন।–’ঠিকই বলেছ। এই মহা দুঃসময়ে, চরম সংকটেও লোকটা মনুষ্যত্বকে বাঁচিয়ে রেখেছে। এটা বিরাট ব্যাপার। নিত্যানন্দ খুব সম্ভব নিরক্ষর। কিন্তু বহু মহা মহা পণ্ডিতের থেকেও ওর মহত্ত্ব অনেক বেশি।

একটু চুপচাপ।

শেখরনাথের ‘ওয়েস্ট এন্ড ওয়াচ’ কোম্পানির একটা সেকেলে গোলাকার পকেট-ঘড়ি আছে। সেটা কখনও তাকে ব্যবহার করতে দেখে নি বিনয়; যেখানে সেখানে ফেলে রাখেন। বালিশের তলা থেকে ঘড়িটা বের করে দেখতে দেখতে বললেন, ‘অনেক রাত হয়ে গেছে। দু’টো বেজে সাঁইত্রিশ। লণ্ঠন নিবিয়ে দিচ্ছি।’ তাড়া দিতে লাগলেন, ‘আজ আর তোমাকে লেখালিখি করতে হবে না। এখন ঘুমোও। জেগে থাকলে শরীর খারাপ হবে।‘

আলো নিবে গেছে। ঘর অন্ধকার।

বিনয় শুয়ে পড়েছে ঠিকই। পোর্টব্লেয়ারের পেনাল কলোনি শাদিপুর নিয়ে প্রতিবেদনটা মাত্র তিনচার পাতা লিখেছে সে। বাকিটা না হয় কাল লেখা যাবে। কিন্তু কিছুতেই ঘুম আসছে না। তারার মায়ের কান্না অনেক আগেই থেমে গেছে। কিন্তু সেটা যেন জেফ্রি পয়েন্টের সৃষ্টিছাড়া এই স্তব্ধ নিশুতি রাতে ফের শোনা যাচ্ছে। হয়তো কাল্পনিক। কিছুক্ষণ আগে কান্নাটা শুনতে শুনতে মনে হয়েছিল এমন কান্না আরও অনেক জায়গায় শুনেছে, কিন্তু কোথায় কোথায়, তখন মনে করতে পারে নি; এবার পারল। সেই কান্না সে শুনেছে ঝিনুককে আগলে নিয়ে পূর্ব পাকিস্তান থেকে আসার সময় তারপাশা স্টিমারঘাটায় হরিদাস সাহা নামে একটা আধবুড়ো সর্বস্বখোয়ানো উদ্বাস্তুর বউয়ের গলায়, শুনেছে গোয়ালন্দ থেকে কলকাতার ট্রেন রিফিউজি স্পেশালের কামরায়, শিয়ালদা স্টেশনের চত্বরে, যুগলদের মুকুন্দপুর কলোনিতে। প্রিয়জনদের হারিয়ে আসার অবিরল ক্রন্দন। কেউ হারিয়েছে যুবতী মেয়েকে, কেউ ছেলেমেয়ে স্বামী বা অন্য কারওকে। সারা উপ-মহাদেশ জুড়ে এই শোকার্ত হাহাকার হাজার বছরেও বুঝিবা থামবে না।

বুকে অব্যক্ত একটা কষ্ট হচ্ছে। মাথাটা ঝিমঝিম করছে। তার মধ্যে দু’চোখ বুজে এল বিনয়ের।

.

৪.১৪

আন্দামানে পুনর্বাসনের জন্য আসার কথা শুনলে সব উদ্বাস্তুই আতঙ্কে সিটিয়ে যায়। শিয়ালদা স্টেশনের চত্বরে কিংবা ত্রাণশিবিরের নরককুণ্ডগুলোতে তারা পচেগলে মরবে, তবু বঙ্গোপসাগরের অজানা এই দ্বীপপুঞ্জে কদাপি নয়। তাদের ভয় আন্দামানে নিয়ে যাওয়াটা একটা সরকারি চক্রান্ত। কিসের চক্রান্ত সে সম্বন্ধে তাদের পরিষ্কার কোনও ধারণা নেই, তার ওপর জাহাজে চারদিন পাড়ি দিয়ে নাকি সেখানে পৌঁছতে হয়। এই সব কারণেই একটা প্রচন্ড ভীতিতে তাদের শ্বাসপ্রশ্বাস আটকে আসতে থাকে। কিন্তু বৃন্দাবন অন্য সবার থেকে আলাদা। আন্দামানে আসার নামে সে মনে মনে প্রায় নেচে উঠেছিল। প্রথম সুযোগটি পাওয়ামাত্র মায়াকে নিয়ে পুনর্বাসন দপ্তরের কর্মীদের সঙ্গে সরকারি ট্রাকে চড়ে খিদিরপুর ডকে গিয়ে ‘এস এস মহারাজা’ জাহাজে উঠেছিল।

বৃন্দাবন এক তরতাজা, হাসিখুশি যুবক। তেইশ চব্বিশ বছরের মায়াও প্রায় তারই মতো। তার টানাটানা দীঘল চোখে, সুন্দর ভরাট মুখটিতে সর্বক্ষণ হাসি লেগেই থাকে। মনে হয় পৃথিবীতে তাদের মতো সুখী যুবক-যুবতী আর একজোড়া কোথাও খুঁজে পাওয়া যাবে না। বিশেষ করে জেফ্রি পয়েন্টে রিফিউজি কোটায় পনেরো বিঘে জমি পাওয়ার পর তাদের আনন্দ আর ধরে না। বিপুল উদ্যমে সেই সকাল থেকে সূর্যাস্ত অবধি জমির ছোট ছোট গাছ কেটে, ঝোঁপঝাঁপ, বনতুলসীর ঝাড় নির্মূল করে চলেছে তারা। তারপর হাল-লাঙল নামিয়ে আবাদের যোগ্য করে তুলবে। তাছাড়া জমিরই এক কোণে গড়ে নেবে ঘরবাড়ি। সুদূর পূর্ব পাকিস্তানের ঢাকা ডিস্ট্রিক্টের বিক্রমপুরে যা তারা ফেলে এসেছে এই দ্বীপের এক প্রান্তে অবিকল তারই আদলে সৃষ্টি করবে স্বপ্নের বাসস্থান। এমনই একটা ঝলমলে ভবিষ্যতের পরিকল্পনা চোখের সামনে রেখে ঠিকঠাক এগিয়ে যাচ্ছিল বৃন্দাবন আর মায়া।

কিন্তু এই সেদিন যে ছত্রিশটা নতুন ডি পি ফ্যামিলি জেফ্রি পয়েন্টে পুনর্বাসনের জন্য এল তাদের মধ্যে ছিল সনাতন দাস। রোগা, ক্ষয়াটে চেহারার আধাবয়সি এই লোকটা একাই এসেছে। জেফ্রি পয়েন্টে পৌঁছেই সে রীতিমতো তাণ্ডব ঘটিয়ে দিয়েছে। বৃন্দাবন আর মায়াকে এখানকার সেটলমেন্টে দেখতে পেয়ে একেবারে উন্মত্ত হয়ে উঠেছিল। প্রচণ্ড আক্রোশে গর্জন করে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল বৃন্দাবনের ওপর; শরীরের সবটুকু শক্তিতে তার গলার নলী ঠেসে ধরেছিল। ছিঁড়েই হয়তো ফেলত; শেখরনাথের জন্যই বৃন্দাবন বেঁচে যায়। সনাতনের এমন দানবিক ক্রোধের কারণটা হল, দেশভাগের পর সে তার বিবাহিত স্ত্রী মায়াকে নিয়ে ভারতে এসে শিয়ালদায় হাজার হাজার ছিন্নমূল মানুষের সঙ্গে আশ্রয় নেয়, তাদের ঠিক পাশেই থাকত বৃন্দাবনরা। মায়াকে ফুঁসলে তাকে নিয়ে গোপনে আন্দামানে চলে আসে বৃন্দাবন। সনাতন কিন্তু সরল সিধে ভালমানুষ নয়। শিয়ালদায় থাকতে থাকতে সে মায়াকে কলকাতার এক বেশ্যাপাড়ার দালালদের কাছে প্রচুর টাকায় বেচে দেবার ছক আঁটে। সেটা জানার পর মায়া উদ্ভ্রান্তের মতো বৃন্দাবনকে আঁকড়ে ধরে। স্টেশনের প্ল্যাটফর্মে পাশাপাশি থাকতে থাকতে দু’জনের মধ্যে চোরা একটা টান চলছিল, যার আরেক নাম ভালবাসা। রোজ সীমান্তের ওপার থেকে ‘রিফিউজি স্পেশাল’ নামের ট্রেনটি আগাপাশতলা বোঝাই হয়ে হাজার হাজার উদ্বাস্তু অবিরল আসছে তো আসছেই। হয়তো শতবর্ষ ধরে আসতেই থাকবে। আগে যারা এসেছিল তাদের সঙ্গে প্রতিদিন এসে মিলছে আরও অজস্র। চারিদিকে থিক থিক করছে মানুষ। শোকাতুর, নিঃস্ব, ভগ্ননীড়। কত ধ্বংস, কত বিপর্যয়, কত মৃত্যু, কত রক্তস্রোতের ভেতর দিয়ে যে তাদের আসতে হয়েছে। এইসব মানুষের সামনে কোনও আশা নেই, আলো নেই, ভবিষ্যৎ নেই। শুধুই অন্তহীন নৈরাশ্য, গাঢ় অন্ধকার আর অনিশ্চয়তা। তবু তারই মধ্যে একটি যুবক আর একটি যুবতীর মধ্যে প্রেম-ভালবাসা সঙ্গোপনে তার কাজ করে যাচ্ছিল, হোক না তা নিষিদ্ধ।

মায়া যে বৃন্দাবনের বিয়ে-করা বউ নয়, কোনওদিনই তা জানা যেত না যদি ধূমকেতুর মতো সনাতন জেফ্রি পয়েন্টে এসে না পড়ত। সনাতনের মতো হাড্ডিসার, পোকায়-কাটা, শীর্ণ চেহারার লোক যে কিনা নিজের স্ত্রীকে পয়সার জন্য বেচে দিতে চায় সে ভেতরে ভেতরে কতটা সাঘাতিক তাও অজানাই থাকত।

সেদিন বৃন্দাবনের মৃত্যু ছিল অবধারিত। তাকে সনাতনের মারমুখী হামলা থেকে রক্ষা করে একধারে দাঁড় করানো হয়েছিল, খানিকটা দূরে সনাতনকে। বৃন্দাবন কারও দিকে তাকাতে পারছিল না; অন্যের বউকে ভাগিয়ে আনা এবং তা ধরা পড়ে যাওয়ায় তার মুখে একটা তীব্র অপরাধী অপরাধী ভাব। সনাতন অবশ্য রক্তচক্ষু মেলে বৃন্দাবনকে দেখছিল আর জান্তব ক্রোধে দাঁতে দাঁত ঘষে চাপা হুঙ্কার ছাড়ছিল; পারলে সে তখন বৃন্দাবন আর মায়াকে ছিঁড়ে খায়।

তাদের ঘিরে দাঁড়িয়ে ছিল জেফ্রি পয়েন্টের সব উদ্বাস্তুরা এবং বনবিভাগ আর পুনর্বাসন দপ্তরের কর্মীরা। আর দুটো চেয়ারে বসে ছিলেন শেখরনাথ আর বিনয়। এমন একটা চমকদার ঘটনা আন্দামানের ঘোর জঙ্গল এবং পাহাড়ে-ঘেরা সৃষ্টিছাড়া, দুর্গম সেটলমেন্টে ঘটতে পারে, স্বচক্ষে দেখেও কেউ যেন বিশ্বাস করতে পারছিল না।

শেখরনাথ আন্দামান দ্বীপপুঞ্জের সবচেয়ে শ্রদ্ধেয় মানুষ। ব্রিটিশ আমলের প্রাক্তন এই বিপ্লবীর ব্যক্তিত্বও প্রবল। তার সামনে কেউ টু শব্দটিও করছিল না। বৃন্দাবন-সনাতনদের সমস্ত কাহিনী শোনার পর তিনি কী বলেন তা শোনার জন্য উদ্বাস্তুরা উদগ্রীব হয়ে ছিল। কেননা এর মধ্যেই তারা জেনে গেছে শেখরনাথ যা বলবেন, প্রশাসনের কর্তাব্যক্তিরা নিঃশব্দে তা মেনে নেবেন।

শেখরনাথ আর সনাতনকে জেফ্রি পয়েন্টের সেটলমেন্টে রাখা সঙ্গত মনে করেননি। সে এখানে থাকলে নিত্যনতুন ঝঞ্জাট বাধিয়ে বসবে। কোনও দিন রক্তারক্তি কান্ডও ঘটিয়ে ফেলতে পারে। এত বড় ঝুঁকি নেওয়া যায় না। তাই তাকে ষাট মাইল দূরের মিডল-আন্দামানে পাঠিয়ে দেবার বন্দোবন্ত করে দিয়েছেন। যে সমুদ্রে ঝাঁকে ঝাকে হিংস্র হাঙর ঘুরছে সাঁতরে সেটা পাড়ি দিয়ে এখানে এসে হামলা করার সাহস তার হবে না।

শেখরনাথের সিদ্ধান্ত মুখ বুজে জেফ্রি পয়েন্টের উদ্বাস্তুরা শুনে গেছে; সনাতনের এখান থেকে চলে যাওয়াটাও দেখেছে। কিন্তু মনে মনে এটা কেউ মেনে নিতে পারেনি। একটা জন্তুর হাত থেকে মায়াকে রক্ষা করে বৃন্দাবন যত মহত্ত্বই দেখাক, তাদের কাছে অন্যের বউকে চুরি করে আনাটা একটা অত্যন্ত গর্হিত অপরাধ। তারা বৃন্দাবনের গায়ে নারীহরণকারীর অদৃশ্য একটা তকমা লাগিয়ে দিয়েছিল। আর মায়া তাদের চোখে দুশ্চরিত্র, নোংরা মেয়েমানুষ। স্বামী যত অমানুষই হোক, তাকে ত্যাগ করে পরপুরুষের সঙ্গে পালিয়ে আসাটা মহাপাপ। সেটলমেন্টের অন্য উদ্বাস্তুরা পারতপক্ষে ওদের সঙ্গে কথা বলে না। কিন্তু একই কলোনিতে ব্যারাকবাড়িতে গাদাগাদি করে থাকতে হয়। উঠতে বসতে দেখাও হয় নিত্যদিন। চোখাচোখি হলে নাক কুঁচকে, তেরছা নজরে সবাই এমনভাবে তাকায় যেন দু’টো পচা বিষ্ঠার পোকা তাদের চারপাশে অনবরত ঘুরছে। বৃন্দাবন আর মায়ার প্রতি এই লোকগুলোর যে কী তীব্র ঘৃণা! অথচ তারা একবারও ভেবে দেখে না বৃন্দাবন মায়াকে রক্ষা না করলে কোন জাহান্নামে গিয়ে ঠেকত মেয়েটা।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *